ডবল মামলার হামলা

ডবল মামলার হামলা

আজকের প্রাতরাশটা হয়েছিল পুরোদস্তুর পূর্ণভোজনের সামিল৷ চায়ের পেয়ালায় অন্তিম চুমুক দিয়ে এবং একটি আরামসূচক ‘আঃ’ শব্দ উচ্চারণ করে ফেললেন ডিটেকটিভ ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু৷

দৈনিক প্রভাতি থেকে খানাপিনার অব্যবহিত পরেই উল্লেখযোগ্য সংবাদ পরিবেশনের ভার ছিল মানিকের উপরে৷ সে সামনের টেবিলের উপর থেকে টেনে নিল খবরের কাগজখানা৷

জয়ন্ত বার করলে তার রুপোর শামুকের নস্যদানি৷ সে একটিপ নস্য নাসিকার সাহায্যে আকর্ষণ করতেই সুন্দরবাবু বিকৃত মুখে বলে উঠলেন ‘হুম! তোমার ওই নোংরা সেকেলে নেশাটা তুমি কি কস্মিনকালেও ছাড়তে পারবে না হে!’

জয়ন্ত বললে, ‘কে বলে নস্য সেকেলে নেশা? সব ব্যাপারেরই উঠতি-পড়তি আছে, নস্যেরও রেওয়াজ মাঝে কিছু কমে গিয়েছিল বটে, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে নস্যের চলন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে৷ আপনি জানেন কি, এক ইংল্যান্ডেই বৎসরে পঁয়ষট্টি লক্ষ টাকার নস্য তৈরি হয়?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম বল কী হে! খামখা আধ কোটি পনেরো লাখ টাকা নস্যাৎ! বড়োই বড়োই, বড়োই অন্যায়৷’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ নস্য নোংরা নয় মশাই, নস্য হচ্ছে রাজকীয় নেশা, তার আভিজাত্য অতুলনীয়৷ নস্যের উৎপত্তি আমেরিকায়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বার সেখানে গিয়ে কলম্বাস তার ব্যবহার দেখে এসেছিলেন৷ ষোলো শতাব্দীতে নস্যের আমদানি হয় ইউরোপে৷ তারপর সেখানকার বড়ো বড়ো রাজা-রানি, সেনাপতি, আমির-ওমরাও, রাজনৈতিক, কবি, শিল্পী, অভিনেতা-এমনকী সাধুসন্ন্যাসী পর্যন্ত নস্যের সেবাহত হয়ে পড়েন৷ আমি তো তুচ্ছাদপি তুচ্ছ৷ দিগবিজয়ী নেপোলিয়নের মতন ব্যক্তিও ছিলেন নস্যগতপ্রাণ৷ তাঁর সোনার নস্যদানি ছিল অসংখ্য, সেগুলিরও মোট দাম হবে লক্ষাধিক টাকা৷ নস্যের এত কদর কেন শুনবেন?’

সুন্দরবাবু গাত্রোত্থান করে বললেন, ‘না ভাই, এখন আমার নস্য-কাহিনি শোনবার ফুরসত নেই৷’

-‘কেন ত্বরা কীসের?’

-‘তদন্ত৷’

-‘কীসের তদন্ত?’

-‘আত্মহত্যার৷ এক ভদ্রলোক পুত্রশোকে আত্মহত্যা করেছেন৷ বিশেষ হন্তদন্ত হতে হবে না, কারণ জোর তদন্ত নয়, একান্ত সহজ মামলা৷ তবু একবার যেতে হবে৷’

-‘আপনার হাতে ওই খামখানা কীসের?’

-‘এর মধ্যে ঘটনাস্থলের আর লাশের খানকয় ফোটো আছে৷’

-‘একবার দেখি না৷’

ফোটোগুলো নিয়ে জয়ন্ত খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে যেন নিজের মনেই বললে, ‘মৃতদেহের ডান হাতে রয়েছে একটা রিভলবার৷ ওইটেই বোধ হয় আত্মহত্যার অস্ত্র৷ ডান হাতের মণিবন্ধে দেখা যাচ্ছে একটা হাতঘড়িও৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘কোনো কোনো খেয়ালি লোকের ডান হাতেই থাকে হাতঘড়ি৷’

-‘তা থাকে বটে৷ কিন্তু মৃত ব্যক্তিকে একটু বেশিরকম খেয়ালি বলেই মনে হচ্ছে!’

-‘একথা বলছ কেন?’

-‘মৃতদেহের সামনে রয়েছে দাবা-বোড়ের ছক৷ কয়েকটা ঘুঁটি এখনও ছকের উপরে সাজানো আছে৷ তাহলে কি হত্যার আগে ভদ্রলোক দু-এক চাল দাবা নিয়ে শখ মিটিয়েছিলেন?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তোমার প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না৷ কারণ মামলাটার প্রাথমিক তদন্তে গিয়েছিলেন আমার এক সহকারী৷ তবে ভদ্রলোক যে রিভলবারের গুলিতে মারা পড়েছেন তাতে আর সন্দেহ নেই৷ গুলিটা তাঁর বক্ষ ভেদ করে পিছন দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ সেই বুলেটটাও পাওয়া গিয়েছে৷’

-‘রিভলবার আর বুলেটটা দেখবার জন্যে আগ্রহ হচ্ছে৷’

-‘এখনি দেখাতে পারি, আমার গাড়ির ভিতরেই আছে৷

সুন্দরবাবুর হুকুমে একজন পাহারাওয়ালা একটা ছোটো ব্যাগ এনে দিয়ে গেল৷ তার মধ্যে ছিল ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া রিভলবার, বুলেট ও আরও কোনো কোনো জিনিস৷

জয়ন্ত খুব মন দিয়ে রিভলবার ও বুলেটটা পরীক্ষা করলে৷ তারপর গম্ভীর স্বরে বললে, ‘সুন্দরবাবু, মামলাটা মোটেই সহজ নয়৷’

সুন্দরবাবু ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন ‘তার মানে? তোমার কথায় সোজা বাঁকা হবে নাকি?’

-‘রিভলবারটার মালিক ছিলেন তো মৃত ব্যক্তিই?’

-‘তাইতো শুনেছি৷’

-‘তাহলে এটা হচ্ছে বড়োই জটিল মামলা৷ এ সম্বন্ধে আপনি আরও আরও যা জানেন, শুনতে পেলে খুশি হব৷’

অঃতপর জয়ন্তের অন্বেষণের ফলে নূতন যে রহস্যনাট্যের যবনিকা উঠে গেল, তা হচ্ছে সম্পূর্ণরূপেই অপ্রত্যাশিত৷ একটা একান্ত সাধারণ মামলা কেবল অসাধারণ হয়েই উঠল না, তার উপরে আরোপিত হল আর একটা এমন নূতন ও রোমাঞ্চকর মামলা, যা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ভাই জয়ন্ত, মামলাটা নিয়ে এখনও আমি মাথা ঘামাবার সময় পাইনি৷ আজ দু-দিন সর্দিজ্বরে পড়ে আমি বিছানা নিয়েছিলুম৷ প্রাথমিক তদন্তের পর আমার সহকারী যে রিপোর্ট পেশ করেছেন, সেটুকু ছাড়া আর কিছুই জানি না৷ শোনো-

‘যিনি আত্মহত্যা করেছেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনারায়ণ রায়৷ বয়স পঞ্চান্ন৷ তিনি দক্ষিণ বাংলার এক জমিদার৷ দেশ ছেড়ে উত্তর কলকাতায় বাস করতেন৷ বিপত্নীক৷ তাঁর একমাত্র সন্তান সত্যেন্দ্র গত মাসে কলেরা রোগে মারা গিয়েছেন৷ প্রকাশ, তারপর থেকেই রবীন্দ্রবাবু অত্যন্ত মনমরা হয়ে থাকতেন এবং তাঁর আত্মহত্যার আসল কারণও নাকি ওই পুত্রশোক৷

‘রবীন্দ্রবাবুর এক সহোদর দেশেই থাকতেন, কিন্তু তিনিও এখন পরলোকে এবং তাঁরও একমাত্র পুত্র দীনেন্দ্রনারায়ণই এখন রবীন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী৷ যতদূর জানা যায়, রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে তাঁর ভ্রাতা বা ভ্রাতুষ্পুত্রের বনিবনাও ছিল না, সম্পত্তি-সংক্রান্ত মতানৈক্যই নাকি এই মনোমালিন্যের কারণ৷

‘রবীন্দ্রবাবুর বাড়ি ত্রিতল৷ একতল ব্যবহার করে জমিদারি সেরাস্তার কর্মচারীরা এবং পাচক, দারোয়ান, দাসদাসী ও অন্যান্য লোকজন৷ দোতলায় বৈঠকখানা এবং তাঁর মৃত পুত্রও সেখানে থাকতেন৷ ত্রিতলে রবীন্দ্রবাবুর শয়নগৃহ ছাড়া আর কোনো ঘর নেই৷

‘পরশু গিয়েছে কালীপূজার রাত্রি৷ শরীর সুস্থ ছিল না বলে রবীন্দ্রবাবুর সেদিন সন্ধ্যার পরেই ত্রিতলে উঠে যান এবং পরদিন সকালেই ঘরের ভিতরে পাওয়া যায় তাঁর মৃতদেহ৷ ঘরের দরজা খোলাই ছিল-যদিও তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে, রবীন্দ্রবাবুর দরজা খুলে শয়ন করার অভ্যাস ছিল না৷

‘বাড়ির লোকজনরা বলে, রবীন্দ্রবাবুর নিষেধ ছিল বলে সন্ধ্যার পর আর কোনো লোক সেদিন ত্রিতলের ঘরে যায়নি৷ অন্যান্য দিনেও সে ঘরে একজন ছাড়া আর কোনো বাইরের লোকের প্রবেশ করবার অধিকার ছিল না৷ সেই একজন হচ্ছেন সত্যানন্দ বসু, রবীন্দ্রবাবুর প্রধান ঘনিষ্ঠ বন্ধু৷ তিনি অন্য পাড়ার বাসিন্দা, প্রায়ই রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে আসতেন৷ রবীন্দ্রবাবুর দাবা খেলার শখ ছিল অত্যন্ত প্রবল, সত্যানন্দবাবুর আবির্ভাব হলেই দু-জনে দাবার ছক পেতে বসে যেতেন৷ কিন্তু সবাই একবাক্যে বলেছে, ঘটনার দিন সত্যানন্দবাবু একবারও সেই বাড়িতে পদার্পণ করেননি৷

‘নিজের হাতে রিভলবার ছুড়ে রবীন্দ্রবাবু আত্মহত্যা করেছেন৷ কিন্তু বাড়ির কেউ রিভলবারের শব্দ শুনতে পায়নি; অন্তত শুনতে পেলেও বুঝতে পারেনি, কারণ সেদিন ছিল কালীপূজা,-বোমার ও বাজির দুমদাম শব্দে সারা শহর হয়ে উঠেছিল মুখরিত৷

‘রবীন্দ্রবাবুর ভাইপো দীনেন্দ্র খবর পেয়ে কলকাতায় এসে হাজির হয়েছেন৷ সত্যানন্দবাবুকেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে৷ আজ তদন্তে গিয়ে প্রথমেই তাঁদের এজাহার গ্রহণ করব৷’

জয়ন্ত বললে, ‘আমিও যদি সঙ্গে যাই, তাহলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?’

-‘মোটেই না, মোটেই না৷ মানিকও যেতে পারে৷ কিন্তু জয়ন্ত হঠাৎ তোমার এই আগ্রহের কারণ কী? কোনো সূত্র-টুত্র পেয়েছ নাকি?’

-‘যথাসময়েই জানতে পারবেন৷’

-‘ওই রোগেই তো ঘোড়া মরেছে? এত ঢাকঢাক-গুড়গুড় কেন বাবা?’

জয়ন্ত জবাব দিল না৷

রবীন্দ্রনারায়ণের বাড়ি৷ সদর দরজায় পুলিশ পাহারা৷

দোতলার বৈঠকখানায় উপবিষ্ট দুই ভদ্রলোক৷ একজন পৌঢ়, মাথায় কাঁচা-পাকা লম্বা চুল, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল, চোখে কালো চশমা, দোহারা চেহারা, পরনে পাঞ্জাবি ও পায়জামা৷ একান্ত বিষণ্ণ ভাবভঙ্গি৷

আর একজন যুবক, বয়স বাইশের বেশি নয়, সুশ্রী ফরসা, একহারা দেহ, জামাকাপড়ে বাবুয়ানার লক্ষণ৷ মুখ-চোখ ভাবহীন৷

যুবকের দিকে তাকিয়ে সুন্দরবাবু শুধোলেন, আপনিই বোধ হয় ধীনেন্দ্রবাবু৷’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘আর উনি?’

-‘সত্যানন্দবাবু-আমার জ্যাঠামশাইয়ের বিশেষ বন্ধু৷’

-‘উত্তম৷ বাড়ির আর সবাইকে ডাকুন৷ আমি সকলের এজাহার নেব৷’

সকলেরই আবির্ভাব৷ একে একে প্রত্যেকেই এজাহার দিল৷ বিশেষ কোনো নূতন তথ্য প্রকাশ পেল না৷

এইবারে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, ‘আচ্ছা দীনেন্দ্রবাবু, আপনার জ্যাঠা কি ন্যাটা ছিলেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তাঁর বাঁ-হাতই বেশি চলত৷’

-‘তাই তিনি ডান হাতেই কবজিঘড়ি ব্যবহার করতেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে আপনাদের মনোমালিন্যের কারণ কী?’

কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে দীনেন্দ্র বললে, ‘মনোমালিন্যের উৎপত্তি হয় তিনটি মুক্তার জন্যে৷’

-‘তিনটি মুক্তা?’

-‘হ্যাঁ, তিনটি মহামূল্যবান মুক্তা৷’

-‘ব্যাপারটা বুঝতে পারলুম না৷’

-‘বুঝিয়ে বলছি৷ আমার প্রপিতামহ সুরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জন্যেই আমাদের বংশের সমৃদ্ধি আরম্ভ হয়৷ সিপাহি বিপ্লবের সময়ে তিনি ইংরেজ ফৌজে রসদবিভাগের পদস্থ কর্মচারী হয়ে পশ্চিম ভারতে গিয়েছিলেন৷ সেই দেশব্যাপী অশান্তি আর বিশৃঙ্খলার যুগে কী উপায়ে জানি না, তিনি প্রচুর ধনদৌলতের মালিক হয়ে দেশে ফিরে আসেন৷ তাঁর সংগ্রহের মধ্যে ছিল তিনটি অপূর্ব ও অমূল্য মুক্তা-শুনেছি তিনি তা পেয়েছিলেন কোনো ভাগ্যবান নবাবের কাছ থেকে৷ মুক্তা তিনটি আমিও দেখেছি৷ দু-টির আকার পায়রার ডিমের মতো, একটি আরও বড়ো৷ তেমন বড়ো বড়ো মুক্তা আমি আগে কখনো দেখিনি, আজকের বাজারে তাদের দাম অন্তত দুই-আড়াই লক্ষ টাকাও হতে পারে৷ এই মুক্তা তিনটি আমার পিতামহের অধিকারে আসে উত্তরাধিকার সূত্রে৷ তারপর আমার জ্যাঠামশাই ও আমার পিতা দু-জনেরই দাবি ছিল তাদের উপরে৷ কিন্তু জ্যাঠামশাই আমার বাবার দাবি অগ্রাহ্য করে বলেন, তাঁর বাবা ওই মুক্তা তিনটি কেবল তাঁকেই দিয়ে গিয়েছেন৷ এই নিয়েই প্রথমে মনোমালিন্য, তারপর মুখ-দেখাদেখি বন্ধ৷’

জয়ন্ত ভাবতে ভাবতে বললে, ‘বটে, এমন ব্যাপার! সেই মুক্তা তিনটি এখন কোথায় আছে?’

-‘শুনেছি জ্যাঠামশাইয়ের শোবার ঘরে লোহার সিন্দুকে৷ কিন্তু সে ঘর তো এখন পুলিশের জিম্মায়৷’

সুন্দরবাবু করলেন একটি নিষ্ঠুর প্রশ্ন৷ ‘তাহলে রবীন্দ্রবাবুর মৃত্যুর ফলে আপনিই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন?’

দীনেন্দ্র বিরক্ত মুখে বললে, ‘লাভ-লোকসানের হিসাব এখনও আমি খতিয়ে দেখিনি মশাই!’

-‘কিন্তু পুলিশ তা দেখতে বাধ্য৷’

-‘দেখুক৷’

জয়ন্ত এইবারে সত্যানন্দের মুখের পানে তাকিয়ে বললে, ‘আপনার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রবাবুর মৃত্যুর জন্যে আপনি বড়োই কাতর হয়ে পড়েছেন৷’

সত্যানন্দ করুণস্বরে বললেন, ‘কাতর হব না? তিনি আর আমি ছিলুম হরিহর আত্মার মতো, বহু সুখ-দুঃখের দিন আমাদের একসঙ্গে কেটে গিয়েছে৷’

-‘তাহলে আপনারা ছিলেন পুরাতন বন্ধু?’

-‘না, ঠিক তা বলতে পারি না৷ তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয় বছর চারেক আগেই৷ কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা নিবিড় হয়ে উঠেছিল পুরাতন বন্ধুত্বের মতোই৷’

-‘রবীন্দ্রবাবু আপনার সঙ্গে দাবা খেলতে ভালোবাসতেন?’

-‘হ্যাঁ, আমি এলেই তিনি পাততেন দাবার ছক৷’

-‘রবীন্দ্রবাবুর মৃত্যুর দিনেও তাঁর সঙ্গে আপনি দাবা খেলেছিলেন?’

-‘আজ্ঞে না, সেদিন আমি নিজের বাড়ির বাইরে পা বাড়াতেই পারিনি৷’

-‘কেন?’

-‘অসুস্থতার জন্যে৷ উদরাময়৷’

-‘কিন্তু সেদিনও সন্ধ্যার সময়ে বা পরে রবীন্দ্রবাবু দাবা খেলেছিলেন৷’

অত্যন্ত বিস্মিতের মতো সত্যানন্দ নিজের দীর্ঘ দাড়ির ভিতরে অঙ্গুলি চালনা করতে করতে বললে, ‘কেমন করে জানলেন?’

-‘তাঁর মৃতদেহের সামনে পাতা ছিল দাবার ছক আর সেই ছকের উপরে সাজানো ছিল গোটা কয়েক ঘুঁটি৷’

-‘ও, তাই বলুন৷ তা হতে পারে! যারা দাবা খেলতে অভ্যস্ত, তারা মাঝে মাঝে নতুন চালের কৌশল আবিষ্কার করবার জন্যে একা একাই ছকে ঘুঁটি সাজিয়ে বসে৷’

-‘ঠিক৷ সেটা আমিও জানি৷ আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই৷’

সুন্দরবাবু সদলবলে প্রথমে বাড়ির একতলার সর্বত্র ঘুরে ঘুরে দেখলেন৷

তারপর দ্বিতল৷ চারখানা বাস করবার ঘর, তারপর পাইখানা ও গোসলখানা৷ বাইরের দিকে একফালি বারান্দা থেকে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি নীচের একটা শুঁড়িগলির ভিতরে নেমে গিয়েছে৷

জয়ন্ত শুধোল, ‘এই সিঁড়িটা বোধ হয় মেথরের ব্যবহারের জন্য?’

দীনেন্দ্র বললে, ‘হ্যাঁ৷’

-‘নীচের শুঁড়িগলিটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে?’

-‘বাড়ির বাইরেকার হাতায়৷’

-‘কোনো লোক যদি সদর দরজার বদলে ওই শুঁড়িগলি দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় ওঠে, তাহলে বাড়ির লোক দেখতে পাবে না-তাই নয় কি?’

-‘হ্যাঁ৷’

তারপর ত্রিতলে রবীন্দ্রবাবুর শয়নকক্ষ৷ তালাবন্ধ দরজার চাবি ছিল পুলিশের কাছে৷ দরজা খুলে সকলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলে৷

মাঝারি আকারের ঘর৷ একদিকে খাট, একদিকে ড্রেসিং টেবিল, একদিকে একটা প্রকাণ্ড আলমারি এবং একদিকে একটা ভারী সেকেলে ডালা-দেওয়া লোহার সিন্দুক৷ খান দুই চেয়ার৷ কার্পেট-মোড়া মেঝেয় ছোটো বিছানা পাতা৷ গুটি দুই তাকিয়া৷

মৃতদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে৷ কিন্তু মেঝের বিছানার একাংশে একটা তাকিয়ার উপরে রয়েছে শুকনো রক্তের ছোপ৷ বিছানার মাঝখানে দাবার ছক, তার উপরে ও আশেপাশে কতকগুলো ঘুঁটি৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘দীনেন্দ্রবাবু, এইবারে আপনি সিন্দুক খুলে মুক্তো-টুক্তো কী আছে বার করুন৷ আমরা এখনও সিন্দুক পরীক্ষা করিনি৷ এই নিন রবীন্দ্রবাবুর চাবির গোছা, এটা লাশের পাশেই পাওয়া গিয়েছে৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সাবধান দীনেন্দ্রবাবু, আপনি সিন্দুকের হাতলে হাত দেবেন না, চাবিটা আমাকে দিন, আমি সিন্দুক খুলছি৷’

সুন্দরবাবু কী প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জয়ন্তের চোখের ইশারা দেখেই তাঁর মুখ বন্ধ হয়ে গেল৷

সিন্দুকের মধ্যে তথাকথিত একটিমাত্র মুক্তাও আবিষ্কৃত হল না৷ পরিবর্তে পাওয়া গেল একতাড়া দলিল দস্তাবেজ, অন্যান্য কাগজপত্র, এক-শো টাকার বারোখানা নোট, কতকগুলো পুরাতন মোহর ও কিছু খুচরো টাকা প্রভৃতি৷

দীনেন্দ্র বললে, ‘কী আশ্চর্য মুক্তাগুলো কে নিলে?’

সত্যানন্দ বললেন, ‘কে আবার নেবে বাবা? তোমার জ্যাঠা ছেলের শোকে আত্মঘাতী হয়েছেন, বাইরের কেউ এখানে আসেনি৷ চোর এলে কি অতগুলো টাকা আর মোহর সিন্দুকের ভিতরেই ফেলে রেখে যেত?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ঠিক কথা৷ পায়রার ডিমের মতো ডাগর মুক্তো যদি রূপকথার অশ্বডিম্ব না হয়, তাহলে সেগুলো অন্য কোথাও লুকানো আছে, খুঁজে দেখতে হবে৷’

সুন্দরবাবুর গা টিপে দিয়ে জয়ন্ত বাইরে এসে দাঁড়াল৷ তাঁর পিছু পিছু গিয়ে সুন্দরবাবু বললেন, ‘আবার গা-টেপাটিপি কেন? তোমার আবার কী গুপ্তকথা?’

-‘সিন্দুকের হাতলে কারুর আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় কি না পরীক্ষা করে দেখুন৷’

-‘মানে?’

-‘পরে বুঝবেন৷’

দিন দুই পরে দূরভাষের মধ্যস্থতায় শ্রুতিগোচর হল থানায় বিরাজমান সুন্দরবাবুর উত্তেজিত কন্ঠস্বর : ‘হ্যালো! জয়ন্ত শোনো৷ তুমি যা বলেছ তাই!’

-‘আমি কী বলেছি?’

-‘রবীন্দ্রনারায়ণ রায় আত্মহত্যা করেনি৷’

-‘নবীন সহকারীর ওপর নির্ভর না করে একটু মাথা ঘামালে আপনিও এটা বুঝতে পারতেন৷’

-‘আমি কিন্তু তোমারও চেয়ে বড়ো একটা আবিষ্কার করেছি৷’

-‘আপনাকে অভিনন্দন দিচ্ছি৷’

-‘তারপর থেকে আমার অবস্থা হয়েছে কীরকম জানো? যাকে বলে একেবারে সসেমিরা!’

-‘ভাবনার কথা!’

-‘সব শুনলে তোমারও আক্কেল-গুড়ুম হয়ে যাবে৷’

-‘ভয়ের কথা!’

-‘ফোন ছেড়ে সবেগে থানায় ছুটে এসো৷’

‘যথা আজ্ঞা৷’

থানায় গিয়ে জয়ন্ত দেখলে, সুন্দরবাবু তখনও উত্তেজিতভাবে ঘরের ভিতর পদচালনা করছেন৷

-‘ভো সুন্দরবাবু, অতিথি হাজির৷ আপনার সন্দেশ পরিবেশন করুন৷’

-‘তিষ্ঠ ক্ষণকাল৷ রবীন্দ্রবাবু যে আত্মহত্যা করেননি, সেটা তুমি কেমন করে ধরতে পারলে আগে সেই কথাই বলো৷’

-‘দেখলুম মৃতের ডান হাতে রয়েছে হাতঘড়ি৷ কোনো কোনো খেয়ালি ব্যক্তি ডান হাতেও ঘড়ি ধারণ করে বটে, কিন্তু সেটা হচ্ছে ব্যতিক্রম৷ সাধারণত যারা ন্যাটা, অর্থাৎ ডান হাতের কাজ সারে বাম হাতে, তারাই হাতঘড়ি ব্যবহার করে ডান হাতে, অতএব ধরে নিলুম রবীন্দ্রবাবু ন্যাটা৷ সে ক্ষেত্রে বাম হাতে রিভলভার নিয়েই তাঁর আত্মহত্যা করবার কথা, কিন্তু রিভলভার ছিল তাঁর ডান হাতে৷ তাই দেখেই প্রথমে আমার সন্দেহ জাগ্রত হয়৷ কিন্তু তা হচ্ছে সামান্য সন্দেহ, বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয়৷’

-‘বেশ, তারপর?’

-‘তারপর দেখলুম মৃতের সামনে দাবার ছক৷ যে আত্মহত্যার জন্যে প্রস্তুত, তার মনের অবস্থা হয় ভয়ানক অস্বাভাবিক, তার দাবা খেলবার বা নতুন চাল আবিষ্কার করবার শখ কিছুতেই হতে পারে না৷ রবীন্দ্রবাবু নিশ্চয় সেদিন সহজ আর স্বাভাবিক মন নিয়েই আর কারুর সঙ্গে দাবা খেলায় নিযুক্ত হয়েছিলেন, আত্মহত্যার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না৷ সুতরাং-‘

-‘সুতরাং তোমার সন্দেহ দৃঢ়তর হল, কেমন এই তো৷’

-‘হ্যাঁ৷ তারপর রিভলবার আর বুলেট দেখেই নিঃসন্দেহে আমি বুঝতে পারলুম যে, এটা হচ্ছে আত্মহত্যার নয়, নরহত্যার মামলা৷ রবীন্দ্রবাবুর হাতের রিভলবারটা ছিল ২২-ক্যালিবারের ছোটো রিভলবার, তার ভিতর থেকে ৩৮-ক্যালিবারের বুলেট নির্গত হওয়া অসম্ভব৷ অর্থাৎ যে বুলেটটা হয়েছে রবীন্দ্রবাবুর মৃত্যুর কারণ, সেটা বেরিয়েছে কোনো ৩৮-ক্যালিবারের রিভলবার থেকে৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তাহলে হত্যার কারণ চুরি?’

-‘সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷’

-‘তবে সিন্দুকের ভিতর থেকে টাকা আর মোহরগুলো চুরি যায়নি কেন?’

-‘এই খুনে চোর হচ্ছে অতিশয় চতুর৷ সে পুলিশকে ভুল পথে চালাতে চায়৷ সে লাভ করতে চায় তিন-তিনটি মহামূল্যবান অতুলনীয় মুক্তা, তার কাছে কয়েক শত টাকা তুচ্ছ৷ সে দেখাতে চায় চুরি বা হত্যা করবার জন্যে কেউ ঘটনাস্থলে আসেনি৷ তাই রবীন্দ্রবাবুর হাতে তাঁর নিজের রিভলবার গুঁজে দিয়ে আর টাকাগুলো ফেলে রেখে গিয়েছে৷ তাড়াতাড়িতে ভেবে দেখতে পারেনি যে, ন্যাটা রবীন্দ্রবাবুর ডান হাতে রিভলবার থাকতে পারে না-বিশেষত ২২-ক্যালিবারের রিভলবার৷ তার আরও একটা মস্ত ভ্রম হয়েছে৷ দাবার ছক আর ঘুঁটি সে তুলে রেখে যায়নি৷ অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই এমনি সব ছোটোখাটো ত্রুটি থেকে যায় বলেই হত্যাকারী শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারে না৷’

-‘জয়ন্ত, অনেক কথাই তো তুমি ভেবে দেখেছ৷ কিন্তু তুমি কি বলতে পারো, হত্যাকারী কে?’

-‘বাড়ির লোকদের কথা মানলে বলতে হয়, বাহির থেকে কোনো ব্যক্তিই সেদিন বাড়ির ভিতরে আসেনি৷ অথচ সেদিন রবীন্দ্রবাবুর পরিচিত কোনো লোক তাঁর সঙ্গে দাবা খেলেছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে৷ এখন আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, সেই খেলোয়াড় ব্যক্তি কে?’

-‘আমি জানি সে কে!’

জয়ন্ত সবিস্ময়ে বললে, ‘আপনি জানেন!’

-‘নিশ্চয়! তোমার আগে আমিই তাকে আবিষ্কার করেছি!’

-‘বাহাদুর! কিন্তু কে সে?’

-‘বাড়ির কেউ নয়৷’

-‘দীনেন্দ্র?’

-‘না৷’

-‘সত্যানন্দ!’

-‘সেও নয়!’

-‘তবে?’

-‘তার নাম নফরচন্দ্র প্রামাণিক৷’

স্তব্ধ ভাবে স্থির হয়ে রইল জয়ন্ত-নির্বাতনিষ্কম্প দীপশিখার মতো৷ কিন্তু মস্তিষ্ক চালনা করতে লাগল তুরন্ত গতিতে, তারপর সে ধীরে ধীরে বললে, ‘বুঝেছি৷ আপনার এই আবিষ্কারের মূলে আছে আমারই অভিভাবন!’

-‘অভিভাবন! সে আবার কী চিজ!’

-‘Suggestion-এর বাংলা পরিভাষা হচ্ছে অভিভাবন৷’

-‘মাথায় থাক আমার বাংলা পরিভাষা, এর চেয়ে ইংরেজিই ভালো৷ কিন্তু আমার আবিষ্কারের সঙ্গে তোমার Suggestion-এর সম্পর্ক কী?’

-‘আমি কি আপনার কাছে প্রস্তাব করিনি যে, রবীন্দ্রবাবুর লোহার সিন্দুকের হাতলটা আঙুলের ছাপের জন্যে পরীক্ষা করা হোক?’

-‘তা করেছিল৷’

-‘তা করা হয়েছে কি?’

-‘হুঁ৷’

-‘আর তারই ফলে বোধকরি তথাকথিত নফরচন্দ্র প্রামাণিক নামধেয় ব্যক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে?’

সুন্দরবাবুর ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, ‘ভায়া হে, তোমার উপরে টেক্কা মারা অসম্ভব দেখছি! হ্যাঁ, ঠিক তাই! সিন্দুকের হাতলে ছিল আঙুলের ছাপ৷ পুলিশের ফাইলে সেই আঙুলের ছাপের জোড়া পাওয়া গেছে৷ সে ছাপ হচ্ছে নফরচন্দ্র প্রামাণিকের৷’

-‘ওই মহাপুরুষের পরিচয় কী?’

-‘অতিশয় চিত্তোত্তেজক৷ পুলিশের কাছে রক্ষিত অপরাধীদের ইতিহাসে দেখি, সাত বৎসর আগে নফরচন্দ্র একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ে৷ কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ অভাবে খালাস পায়৷ তার পর-বৎসরেই দু-দুটো খুন আর অর্থলুন্ঠন করে সে আবার অভিযুক্ত হয় রাহাজানির মামলায়৷ বিচারে তার প্রতি পনেরো বৎসর কারাবাসের হুকুম হয়৷ কিন্তু পাঁচ বৎসর আগে সে জেল ভেঙে পালিয়ে যায়৷ সেই থেকেই নফরচন্দ্র ফেরার৷ যে তাকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরে দিতে পারবে তাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে৷’

-‘আপনি তাকে দেখেছেন?’

-‘না, তার কোনো মামলাই আমার হাতে আসেনি৷’

-‘নফরচন্দ্র যখন দাগি আসামি, পুলিশের কাছে নিশ্চয়ই তার ফোটো আছে?’

-‘আছে বই কী! এই নাও৷’

শ্মশ্রুগুম্ফহীন এক সাধারণ চেহারার লোক-সুশ্রী বা কুশ্রী কিছুই বলা যায় না৷ কেবল জোড়া ভুরুর তলায় দুই চক্ষু দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে যেন ক্রূরতার আভাস৷ বয়স হবে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ৷

সুন্দরবাবু অভিযোগপূর্ণ স্বরে বললেন, ‘আত্মহত্যার মামলা হয়ে দাঁড়াল নরহত্যার মামলা-তার সঙ্গে এল আবার তিন-তিনটে হত্যাকাণ্ডের নায়ক ফেরারি নফরচন্দ্রের মামলা! বাপ রে, এখন এই ডবল মামলার হামলা একলা সামলাই কেমন করে? নফরের মতো ধড়িবাজের পাত্তা পাওয়া কি সোজা কথা? পুলিশের কেউ যা পারেনি, আমি তা পারব কেন?’

তীক্ষ্ণনেত্রে নফরচন্দ্রের ফোটোর দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনার বকবকানি থামান৷ এখানে স্বচ্ছ কাগজ আছে?’

-‘স্বচ্ছ কাগজ?’

-‘হ্যাঁ, ইংরেজিতে যাকে বলে ট্রেসিং পেপার৷’

-‘মরছি নিজের জ্বালায়, এখন তোমার ওই সব ছাঁকা বাংলা বুলি ভালো লাগছে না! কেন সোজাসুজি বলতে পারো না কি-ট্রেসিং পেপার চাই? তা থাকবে না কেন? কিন্তু ও জিনিস নিয়ে তোমার আবার কী হবে?’

-‘একটু অপেক্ষা করুন, দেখতে পাবেন৷’

জয়ন্তের অল্পস্বল্প ছবি আঁকার হাত ছিল৷ সুন্দরবাবুর দিকে পিছন ফিরে বসে ফাউন্টেন পেন ও ট্রেসিং পেপারের সাহায্যে সে ফটো থেকে নফরচন্দ্রের একখানা হুবহু প্রতিলিপি তুলে নিলে৷ তারপর সেই নকল-করা মুখের উপরে যথাস্থানে এঁকে ফেললে লম্বা চুল, কালো চশমা, ঘন গোঁফদাড়ি!

সুন্দরবাবু বিরক্তভাবে বললেন, ‘আরে গেল, ও আবার কী ছেলেমানুষি হচ্ছে শুনি?’

-‘সুন্দরবাবু এখন দেখুন দেখি, এই লোকটিকে কি চেনেন বলে মনে হচ্ছে?’ জয়ন্ত প্রশ্ন করলে কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে৷

সুন্দরবাবু প্রথমে নিতান্ত অবজ্ঞাভরেই ছবিখানার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন৷ তারপর দেখতে দেখতে যতদূর সম্ভব বিস্ফারিত হয়ে উঠল তাঁর দুই চক্ষু৷ তিনি চমৎকৃত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আরে আরে, এ যে রবীন্দ্রবাবুর বন্ধু সত্যানন্দ বসুর মুখ!’

জয়ন্ত রুপোর শামুকদানি থেকে একটিপ নস্য নিয়ে হাস্যমুখে বললে, ‘ছবিতে আঁকা মুখে লম্বা চুল, কালো চশমা আর গোঁফদাড়ি বসিয়ে দিতেই নফরচন্দ্রের মূর্তির ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে সত্যানন্দ স্বয়ং! এমন যে হবে আমি তা আগেই অনুমান করেছিলুম৷ আমি নফরকে চিনতুম না, তার জীবনীও জানতুম না, কিন্তু এই মামলার সমস্ত দেখে-শুনে আমি সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করেছিলুম সত্যানন্দকেই৷ চেহারার রকমফের করে নাম ভাঁড়িয়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে নফরচন্দ্র বহালতবিয়তে হতভাগ্য রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে মিতালি জমিয়ে ফেলেছিল-প্রথম থেকেই তার কুদৃষ্টি ছিল সেই মুক্তা তিনটির উপরে৷ সকলের অগোচরে শুঁড়িপথ দিয়ে ঢুকে মেথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে সে পাপকার্য সেরে আবার অদৃশ্য হয়েছিল৷ কিন্তু এইবার তাকে মুখোশ খুলতে হবেই৷ নফরচন্দ্র এখনও আমাদের নাগালের মধ্যেই আছে-কারণ এখনও সে সন্দেহ করতে পারেনি যে, আমরা তাকে সন্দেহ করেছি৷ সুতরাং উঠুন! জাগুন! ছুটুন সবাই নফরচন্দ্র ওরফে সত্যানন্দের আস্তানার দিকে!’

-‘হুম! তথাস্তু, তথাস্তু, তথাস্তু!’

নফর ওরফে সত্যানন্দের বাড়ি৷

চারিদিকে পুলিশ পাহারা বসিয়ে সদরে কড়া নাড়তে নাড়তে সুন্দরবাবু ডাকলেন, ‘সত্যানন্দবাবু, সত্যানন্দবাবু!’

বারান্দা থেকে উকি মারলে সত্যানন্দের মুখ৷ পুলিশ দেখে তার ভাবান্তর হল না৷ সহজ স্বরেই শুধোলে, ‘অধীনের গোলাম-খানায় আপনারা যে?’

-‘মামলা সংক্রান্ত একটা কথা জানতে এসেছি৷’

-‘বেশ করেছেন৷ বেয়ারা গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছে৷ সোজা উপরে চলে আসুন৷’

দোতলার ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন সুন্দরবাবু তারপর জয়ন্ত তারপর আরও দু-জন পুলিশ কর্মচারী৷

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সত্যানন্দ হাসিমুখে বললে, ‘অনুগ্রহ করে সকলে আসন গ্রহণ করুন৷’

সুন্দরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘বসবার সময় নেই৷’

-‘কিন্তু আপনারা কি জরুরি কথা জানতে চান? যা বলবার সব তো আমি বলছি৷’

-‘কিন্তু একটা কথা বলেননি৷’

-‘কী?’

-‘আপনি নফরচন্দ্র নামটা ত্যাগ করলেন কেন?’

পর মুহূর্তে সুন্দরবাবুর বক্ষের উপরে নিক্ষিপ্ত হল যেন দুর্যোধনের মহাগদা! আচম্বিতে নফরচন্দ্র অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে সুন্দরবাবুর বুকের মাঝখানে করলে প্রচণ্ড পদাঘাত এবং বপুষ্মান সুন্দরবাবুরও দেহ ঠিকরে গিয়ে পড়ল হুড়মুড় করে একেবারে জয়ন্তের উপরে এবং সঙ্গেসঙ্গে ঘর কাঁপিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন ও গুরুভার দেহপতনের শব্দ৷

মেঝের উপরে অল্প ছটফট করেই নফরচন্দ্র ওরফে সত্যানন্দের মূর্তি নিশ্চেষ্ট ও একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেল৷ তার কপাল থেকে বেরুতে লাগল ঝলকে ঝলকে রক্ত৷

সুন্দরবাবু আপশোস করে বলে উঠলেন, ‘হায় হায় হায়! নফরা আমাকে লাথি মেরেও ফাঁকি দিলে, ব্যাটাকে ফাঁসিকাঠে দোল খাওয়াতে পারলুম না! ছি জয়ন্ত, ওকে তোমার বাধা দেওয়া উচিত ছিল৷’

জয়ন্ত হেসে বললে, ‘উচিত তো ছিল, কিন্তু আপনি এমন কমলির মতন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন যে, আমার অবস্থা তখন ন যযৌ ন তস্থৌ৷ তবে আপনার এ-কূল দু-কূল নষ্ট হয়নি, নফরচন্দ্রের লাশ দাখিল করতে পারলেও আপনার ভাগ্যে লাভ হবে পুরস্কারের পঞ্চ সহস্র মুদ্রা৷’

পুরস্কারের কথা মনে হতেই সুন্দরবাবু একমুখ হাস্য করলেন৷ তারপর বুকের উপরে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘নফরা তো পটল তুলল৷ কিন্তু রবীন্দ্রবাবুর মুক্তো তিনটে কোথায় লুকিয়ে রেখে গেল?’

জয়ন্ত বললে, ‘আশা করি এখানে খানাতল্লাস করলেই মুক্তা পাওয়া যাবে৷ আর নফরের হাতের ওই রিভলবারটা দেখুন৷ আমার বিশ্বাস, রবীন্দ্রবাবু মারা পড়েছেন ওই রিভলবারের বুলেটেই৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *