কাচের কফিন

কাচের কফিন

খুনের না মানুষ চুরির মামলা

-‘বোলো না, বোলো না, আজ আমাকে চা খেতে বোলো না!’ ঘরে ঢুকেই বলে উঠলেন সুন্দরবাবু৷

মানিক সবিস্ময়ে শুধোলে, ‘এ কী কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে!’

-‘না আজ কিছুতেই আমি চা খাব না৷’

-‘একেবারে ধনুর্ভঙ্গ পণ?’

-‘হুম!’

জয়ন্ত বললে, ‘বেশ, চা না খান খাবার খাবেন তো?’

-‘কী খাবার?’

-‘টিকিয়া কাবাব৷’

-‘ও, তাই নাকি?’

-‘তার পরে আছে ভেন্ডালু৷’

-‘হংস-মাংস?’

-‘হাঁ, বনবাসী হংস৷’

সুন্দরবাবু ভাবতে লাগলেন৷

-‘খাবেন তো?’

সুন্দরবাবু ত্যাগ করলেন একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস৷ তারপর মাথা নেড়ে করুণ স্বরে বললেন, ‘উহুম! আজ আমাকে হংস-মাংস ধ্বংস করতে বোলো না৷’

মানিক বললে, ‘হালে আর পানি পাচ্ছি না৷ হংস-মাংসেও অরুচি! সুন্দরবাবু এইবার বোধ হয় পরমহংস হয়ে বৈরাগ্যব্রত গ্রহণ করবেন৷’

-‘মোটেই নয়, মোটেই নয়৷’

-‘তবে গেরস্তর ছেলে হয়েও এ-খাব না ও-খাব না বলছেন কেন?’

-‘আজ আমার উদরদেশের বড়োই দুরবস্থা৷’

-‘অমন হৃষ্টপুষ্ট উদর, তবুও-‘

-‘আমার উদরাময় হয়েছে৷’

-‘তাই বলুন৷ তবে ওষুধ খান৷ আমি হোমিওপ্যাথি জানি৷ এক ডোজ ওষুধ দেব নাকি?’

-‘থো কর তোমার হোমা পাখির কথা৷ আমি খাবার কি ওষুধ খেতে আসিনি৷ আমি এসেছি জরুরি কাজে৷’

-‘অসুস্থ দেহ, তবু কাজ থেকে ছুটি নেননি? কী টনটনে কর্তব্যজ্ঞান!’

-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই! স্বর্গবাসী ঢেঁকিও ধান ভানে৷ পুলিশের আবার ছুটি কী হে?’

জয়ন্ত শুধোলে, ‘নতুন মামলা বুঝি?’

-‘তা ছাড়া আর কী?’

-‘কীসের মামলা?’

-‘বলা শক্ত৷ খুনের মামলা কি মানুষ চুরির মামলা, ঠিক ধরতে পারছি না!’

একটু একটু করে জাগ্রত হচ্ছিল জয়ন্তের আগ্রহ৷ সে সামনের চেয়ারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললে, ‘সুন্দরবাবু, ওই চেয়ারে বসুন৷ ব্যাপারটা খুলে বলুন৷’

আসন গ্রহণ করে সুন্দরবাবু বললেন, ‘এটা আজব মামলা বলাও চলে৷ রহস্যময় হলেও অনেকটা অর্থহীন৷ নাটকের পাত্র-পাত্রী হচ্ছে তিন জন৷ এক জন নারী আর দু-জন পুরুষ৷ ওদের মধ্যে এক জন পুরুষ হচ্ছে আসামি৷ তিন জনেই অদৃশ্য হয়েছে৷’

-‘অদৃশ্য হবার কারণ?’

-‘শোনো৷ বছর দেড়েক আগে সুরেন্দ্রমোহন চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক থানায় এসে অভিযোগ করেন, তাঁর পিতামহী সুশীলা সুন্দরী দেবীর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না৷ ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই৷ সুশীলা দেবী বিধবা৷ তিনি তাঁর স্বামীর বিপুল সম্পত্তির একমাত্র অধিকারিণী৷ তাঁর বয়স পঁচাত্তর বৎসর৷ স্বাস্থ্যভঙ্গ হওয়ার দরুন ডাক্তার মনোহর মিত্রের চিকিৎসাধীন ছিলেন৷ সুশীলা দেবী হঠাৎ একদিন একখানা ট্যাক্সি ডাকিয়ে এনে মনোহর মিত্রের সঙ্গে বাড়ির বাইরে চলে যান, তারপর আর ফিরে আসেননি৷ খোঁজাখুঁজির পর প্রকাশ পায়, অদৃশ্য হবার আগে সুশীলা দেবী ব্যাঙ্ক থেকে নগদ পনেরো লক্ষ টাকা তুলে আনিয়েছিলেন৷ সে টাকাও উধাও হয়েছে৷’

-‘ডাক্তার মনোহর মিত্র নামে এক ভদ্রলোকের খ্যাতি আমি শুনেছি৷ পদার্থশাস্ত্রে তাঁর নাকি অসাধারণ পাণ্ডিত্য৷’

-‘তিনিই ইনি৷ মনোহরবাবুকে তুমি কখনো চোখে দেখেছ?’

-‘না৷’

-‘আমিও দেখিনি, তবে তাঁর চেহারার হুবহু বর্ণনা পেয়েছি৷’

-‘কীরকম?’

-‘মনোহরবাবুর দীর্ঘতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির বেশি হবে না, কিন্তু তাঁর দেহ রীতিমতো চওড়া৷ তাঁর মাথায় আছে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে-পড়া সাদা ধবধবে চুল, মুখেও লম্বা পাকা দাড়ি আর তাঁর বয়সও ষাটের কম নয়, কিন্তু তার শরীর এখনও যুবকের মতো সবল৷ রোজ সকালে সূর্য ওঠার আগে পদব্রজে অন্তত চার মাইল ভ্রমণ করে আসেন৷ তাঁর চোখ সর্বদাই ঢাকা থাকে কালো চশমায়৷ টিকালো নাক৷ শ্যামবর্ণ৷ সাদা পাঞ্জাবি, থান কাপড় আর সাদা ক্যাম্বিসের জুতো ছাড়া অন্য কিছু পরেন না৷ বর্মা চুরুটের অত্যন্ত ভক্ত৷ তাঁর মুখ সর্বক্ষণই গম্ভীর৷ ডান কপালের ওপর একটা এক ইঞ্চি লম্বা পুরোনো কাটা দাগ আছে৷ হাতে থাকে একগাছা রুপো-বাঁধানো মোটা মালাক্কা-বেতের লাঠি৷’

জয়ন্ত বললে, ‘আরে মশাই, এ বর্ণনার কাছে যে আলোকচিত্রও হার মানে! এরপর বিপুল জনতার ভিতর থেকেও মনোহরবাবুকে আবিষ্কার করতে পারব৷’

সুন্দরবাবু দুঃখিতকন্ঠে বললেন, ‘আমি কিন্তু দেড় বৎসর চেষ্টা করেও তাঁর টিকিও আবিষ্কার করতে পারলুম না৷’

-‘কেন?’

-‘তিনিও অদৃশ্য হয়েছেন৷’

-‘তাঁর বাড়ি কোথায়?’

-‘বালিগঞ্জে নিজের বাড়ি৷ সেখানে গিয়েছিলুম৷ কিন্তু বাড়ি একেবারে খালি৷’

-‘মনোহরবাবুর পরিবারবর্গ?’

-‘মাথা নেই, তার মাথাব্যাথা৷ তিনি বিবাহই করেননি৷’

-‘অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন?’

-‘কারুর পাত্তা পাইনি৷ পাড়ার লোকের মুখে শুনলুম, মনোহরবাবু জন-চারেক পুরাতন আর বিশ্বস্ত ভৃত্য নিয়ে ওই বাড়িতে বাস করতেন বটে, কিন্তু হঠাৎ একদিন সকলকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছেন৷’

জয়ন্ত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, ‘আপনি বললেন, সুশীলা দেবী ট্যাক্সিতে চড়ে মনোহরবাবুর সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ তাঁর কি নিজের মোটর নেই?’

-‘আছে বই কী! একখানা নয়, তিনখানা৷’

-‘তাহলে মেনে নিতে হয়, সুশীলা দেবীর নিজের ইচ্ছাও ছিল, তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কেউ যেন জানতে না পারে৷’

-‘হয় তোমার অনুমান সত্য, নয় তিনি ট্যাক্সি ভাড়া করেছিলেন মনোহরবাবুর পরামর্শেই৷’

-‘আপনি ট্যাক্সিখানার সন্ধান নিয়েছিলেন!’

-‘নিয়েছি বই কী! ট্যক্সিচালককেও খুঁজে বের করেছি৷ সে আরোহীদের হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে৷ আর কিছুই সে জানে না৷’

-‘তাহলে মনোহরবাবুর সঙ্গে সুশীলা দেবী বোধ হয় কলকাতার বাইরে চলে গিয়েছেন৷ কিন্তু কলকাতার বাইরে- কোথায়?’

-‘হুম, আমিও মনে মনে বার বার এই প্রশ্নই করেছি৷ কোথায় কোথায়, কোথায়?’

-‘খালি ওই প্রশ্ন নয় সুন্দরবাবু, আরও সব প্রশ্ন আছে৷ পঁচাত্তর বৎসর বয়সে পনেরো লক্ষ টাকা নিয়ে সুশীলা দেবী রুগ্ন দেহে এমন লুকিয়ে মনোহরবাবুর সঙ্গে চলে গেলেন কেন? তিনি বেঁচে আছেন কি নেই? মনোহরবাবু বিখ্যাত পদার্থবিদ হলেও মানুষ হিসাবে কি সাধু ব্যক্তি নন?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমার কথা এখনও ফুরোয়নি৷ সবটা শুনলে প্রশ্নসাগরে তোমাকে তলিয়ে যেতে হবে!’

-‘আমার আগ্রহ যে জ্বলন্ত হয়ে উঠল! বলুন সুন্দরবাবু, বলুন!’

দুই

মানুষ না দেখে প্রতিকৃতি আঁকা

সুন্দরবাবু বললেন, ‘যে মাসে সুশীলা দেবী অন্তর্হিত হন, সেই মাসেই আর একটা মানুষ নিরুদ্দেশ হওয়ার মামলা আমার হাতে আসে৷ দুটো মামলাই কতকটা একরকম৷ গোবিন্দলাল রায় একজন বড়ো জমিদার৷ বয়স সত্তরের কম নয়৷ তিনি বিপত্নীক হলেও সংসার তাঁর বৃহৎ৷ পাঁচ পুত্র, তিন কন্যা, পৌত্র-পৌত্রীও আছে৷ কিন্তু হঠাৎ একদিন গোপনে ব্যাঙ্ক থেকে নগদ বারো লক্ষ টাকা তুলে নিয়ে তিনিও গিয়েছেন অজ্ঞাতবাসে৷ তবে গোবিন্দবাবু যাবার সময়ে একখানা চিঠি রেখে গিয়েছিলেন৷ তাতে লেখা ছিল-আমি বিদেশ-ভ্রমণে যাচ্ছি৷ ফিরতে বিলম্ব হবে৷ তোমরা আমার জন্য চিন্তিত হয়ো না৷ -তারপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজখবর নেই৷ তিন মাসের মধ্যেও বৃদ্ধ পিতার কাছ থেকে একখানা পত্র পর্যন্ত না পেয়ে তাঁর পুত্ররা আমার আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেও গোবিন্দবাবুর নাগাল ধরতে পারিনি৷’

জয়ন্ত শুধোল, ‘আপনি কি মনে করেন, আগেকার মামলার সঙ্গে এ মামলাটারও কোনো সম্পর্ক আছে?’

-‘অল্পবিস্তর মিল কি নেই জয়ন্ত? একজন অতি-বৃদ্ধা নারী, আর একজন অতি-বৃদ্ধ পুরুষ; দু-জনেই গোপনে অজ্ঞাতবাসে গমন করেছেন; আর দু-জনেই যাবার ঠিক আগেই ব্যাঙ্ক থেকে বহু লক্ষ টাকা তুলে নিয়ে গেছেন; দু-জনেই আত্মগোপন করবার দিন থেকে আজ পর্যন্ত নিজেদের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণই দেননি৷’

-‘কিন্তু গোবিন্দবাবুর সঙ্গে কি মনোহরবাবুর পরিচয় ছিল?’

-‘গোবিন্দবাবুর বাড়ির কোনো লোকই মনোহরবাবুর নাম পর্যন্ত শোনেনি৷’

-‘তাহলে আপনি কী বলতে চান?’

-‘মাস খানেক আগে গোবিন্দবাবুর বড়ো ছেলে আমার হাতে একখানা পত্র দিয়ে বলে গিয়েছেন-একখানা বইয়ের ভিতর থেকে এই চিঠিখানা পেয়েছি৷ চিঠিখানা পড়বার পর বাবা নিশ্চয়ই ওই বইয়ের ভিতর গুঁজে রেখেছিলেন৷ -জয়ন্ত এই নাও চিঠিখানা পড়ে দেখো৷’

জয়ন্ত খামের ভিতর থেকে পত্র বার করে নিয়ে পাঠ করলে:

প্রিয় গোবিন্দবাবু,

এতদিন পরে আমার প্রস্তাবে আপনি সম্মত হয়েছেন শুনে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করলুম৷ বেশ, আগস্ট মাসের চার তারিখে পাঁচটার সময়ে আমার লোক হাওড়া স্টেশনে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং-রুমে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবে৷ কিন্তু মনে রাখবেন, আপনাকে সঙ্গে করে আনতে হবে অন্তত নগদ বারো লক্ষ টাকা৷ যতদিন না আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, ততদিন আমরা এইখানেই বাস করব৷ আমার উপরে বিশ্বাস রাখুন৷ আপনার কোনো আশঙ্কা নেই৷ পত্রের কথা কারুর কাছে প্রকাশ করবেন না৷

ইতি-

ভবদীয় শ্রীমনোহর মিত্র

সুন্দরবাবু বললেন, ‘পড়লে?’

জয়ন্ত উত্তর দিলে, ‘হুঁ, চিঠির কাগজে কোনো ঠিকানা নেই৷ কিন্তু খামের উপরে ডাকঘরের নাম রয়েছে, সুলতানপুর৷’

-‘সুলতানপুর হচ্ছে একটি ছোটোখাটো শহর৷ সেখানে আমি গিয়েছিলুম৷ কিন্তু ডাক্তার মনোহর মিত্রের নাম পর্যন্ত কেউ সেখানে শোনেনি৷’

-‘সুলতানপুর ডাকঘর থেকে কোন কোন গ্রামের চিঠি বিলি হয় সে খোঁজ নিয়েছিলেন তো?’

-‘তা আবার নিইনি? শুধু খোঁজ নেওয়া কীহে, সব জায়গাতেই নিজে গিয়ে ঢুঁ মারতেও ছাড়িনি৷ কিন্তু লাভ হয়েছে প্রকাণ্ড অশ্বডিম্ব৷’

জয়ন্ত ভাবতে লাগল নীরবে৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমার কী সন্দেহ হচ্ছে জানো? মনোহর নাম ভাঁড়িয়ে কিছুদিন ও অঞ্চলের কোথাও বাস করেছিল৷ তারপর সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবুকে হাতে পেয়ে হত্যা করে তাঁদের টাকাগুলো হাতিয়ে আবার সরে পড়েছে কোনো অজানা দেশে৷’

জয়ন্ত যেন নিজের মনেই বললে, ‘চিঠি পড়ে জানা গেল মনোহরবাবুর কোনো প্রস্তাবে গোবিন্দবাবু প্রথমে রাজি হননি, কিন্তু পরে রাজি হয়েছিলেন৷ খুব সম্ভব সেই প্রস্তাবটাই কার্যে পরিণত করবার জন্যে তিনি চেয়েছিলেন বারো লক্ষ টাকা৷’

-‘হুম, কে বলতে পারে সুশীলা দেবীর কাছেও মনোহর ঠিক এইরকম প্রস্তাবই করেনি?’

-‘কিন্তু কী সেই প্রস্তাব, যার জন্যে লোকে এমন লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে রাজি হয়?’

-‘কেবলই কি টাকা খরচ করতে রাজি হয়? ধাপ্পার ভুলে সংসার, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে যেতেও কুন্ঠিত হয় না!’

-‘সুন্দরবাবু, প্রস্তাবটা যে অতিশয় অসাধারণ সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘জয়ন্ত, মনোহরের প্রস্তাব নিয়ে বেশি মস্তিষ্ক চালনা করে কোনোই লাভ নেই৷’

-‘লাভ আছে বই কী! প্রস্তাবটা কী জানতে পারলে আমাদের আর অন্ধকারে হাতড়ে মরতে হয় না৷’

-‘কিন্তু যখন তা আর জানবার উপায় নেই তখন আমাদের অন্ধকারে ঢিল ছুড়তে হবে বই কী!’

-‘অন্ধকারে বহু ঢিল তো ছুড়েছেন, একটা ঢিলও লক্ষ্যে গিয়ে লাগল কি?’

-‘তুমি আমাকে আর কী করতে বল?’

-‘আপনি তো সর্বাগ্রে মনোহরবাবুকে আবিষ্কার করতে চান?’

-‘নিশ্চয়৷’

-‘তাহলে আমাদের সঙ্গে আর একবার সুলতানপুর চলুন৷’

-‘সেটা হবে ডাহা পণ্ডশ্রম৷ কারণ সে অঞ্চলের কোনো পাথরই আমি ওলটাতে বাকি রাখিনি৷’

-‘না, একখানা পাথর ওলটাতে আপনি ভুলে গিয়েছেন৷’

-‘কোনখানা, শুনি?’

-‘যথাসময়ে প্রকাশ পাবে৷’

সুন্দরবাবু একটা নিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘বেশ, তাই সই৷’

-‘মানিক, সব শুনলে?’

-‘শুনলুম তো৷’

-‘এখন তোমাকে একটা কাজ করতে হবে৷’

-‘ফরমাশ করো৷’

-‘তোমার ছবি আঁকার হাত খুব পাকা৷’

-‘তুমি ছাড়া আর কেউ ওকথা বলে না৷’

-‘কারণ আমি আর্ট বুঝি, বাংলা দেশের পনেরো আনা লোক যা বোঝে না৷’

-‘আচ্ছা, পনেরো আনা অ-রসিকদের কথা এখন থাক৷ আমায় কী করতে হবে, তাই বলো৷’

-‘মনোহরবাবুর আকৃতি-প্রকৃতির বিশেষত্বগুলি আগে তুমি সুন্দরবাবুর কাছ থেকে ভালো করে আর একবার শুনে নাও৷ তারপর এমন একটি মনুষ্যমূর্তি আঁকো, যার মধ্যে থাকবে ওই বিশেষত্বগুলি৷’

সুন্দরবাবু কৌতূহলী হয়ে বললেন, ‘ওরকম ছবি এঁকে কী লাভ হবে?’

-‘ওই ছবির সাহায্যে হয়তো আসামিকে শনাক্ত করা যাবে!’

-‘জয়ন্ত কী যে বলে তার ঠিক নেই! মনোহরকে আমিও দেখিনি, মানিকও দেখেনি৷ আমি খেয়েছি পরের মুখে ঝাল৷ সাত নকলে আসল খাস্তা! মানিক শিব গড়তে বানর গড়ে বসবে৷ ছবি দেখে মনোহরকে চেনাই যাবে না৷’

-‘ফলেন পরিচীয়তে সুন্দরবাবু, ফলেন পরিচীয়তে! অর্থাৎ ফলের দ্বারা চেনা যায় বৃক্ষকে৷ আসল তাৎপর্য হল, আকৃতির দ্বারা মানুষকে না চিনলেও তার ব্যবহারের দ্বারা চেনা যায় অনায়াসেই৷ বহু অভিজ্ঞতার ফলেই এইরকম এক-একটি প্রবাদবাক্য রচিত হয়, বুঝলেন মশাই?’

-‘হুম, কিচ্ছু বুঝলুম না৷’

-‘তাহলে শ্রবণ করুন৷ পৃথিবীতে সেই জাতীয় মানুষের সংখ্যাই বেশি, যাদের আকৃতির মধ্যে থাকে না সুস্পষ্ট কোনো বিশেষত্ব৷ হয়তো তারা দেখতে সুন্দর, তবুও তারা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না, হারিয়ে যায় জনতার গড্ডলিকা প্রবাহের মধ্যে৷ কিন্তু আপনার মুখে বর্ণনা শুনে এটুকু বেশ বোঝা গেল, মনোহরবাবু ওই শ্রেণির সাধারণ মানুষের মতন নন৷ তাঁর মধ্যে একাধারে আছে একটি দু-টি নয়, অনেকগুলো characteristics বা বিশেষত্বদ্যোতক লক্ষণ৷ যথা- উচ্চতায় সাধারণ, কিন্তু চওড়ায় অসাধারণ দেহ; মাথায় কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে-পড়া ধবধবে পাকা চুল, মুখেও লম্বা পাকা দাড়ি, বৃদ্ধ হলেও যুবকের মতো সবল শরীর; চোখে কালো চশমা; সাদা পাঞ্জাবি, থান কাপড়, সাদা ক্যাম্বিসের জুতো; মুখে বা হাতে সর্বদাই বর্মা চুরুট, গম্ভীর মুখ, ডান কপালে এক ইঞ্চি কাটা দাগ, হাতে মালাক্কা বেতের রুপো-বাঁধানো লাঠি৷ একসঙ্গে এতগুলো বিশেষত্ব যদি ছবির মূর্তিতে ফোটে, তবে তা মনোহরবাবুর ফটোগ্রাফ না হলেও, যে তাঁকে দেখেছে সেই-ই এই ছবি তাঁর বলে শনাক্ত করতে পারবে৷’

তবু সুন্দরবাবুর মন মানল না, তিনি বললেন, ‘তুমি কেবল নিজের মনগড়া কথাই বলছ, একটা প্রমাণও তো দিতে পারলে না!’

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘একটা কেন অনেক প্রমাণই দিতে পারি৷’

-‘তাই নাকি? এদেশের কোনো গোয়েন্দা যে এমন বর্ণনা শুনে প্রতিকৃতি এঁকে অপরাধী গ্রেপ্তার করেছে, আমি তো কখনো তা শুনিনি৷’

-‘এদেশের কথা শিকেয় তুলে রাখুন সুন্দরবাবু, এদেশের কথা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না৷ কিন্তু পাশ্চাত্য দেশের গোয়েন্দারা অনেকবারই এমনি বর্ণনা-শুনে-আঁকা প্রতিকৃতির সাহায্যে আসল অপরাধীকে বন্দি করতে পেরেছে৷’

সুন্দরবাবু বিস্ফারিত চক্ষে বললেন, ‘বটে, বটে, বটে! আমি তা জানতুম না৷’

মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনি অনেক কিছু আগেও জানতেন না, এখন জানেন না, আবার না জানালে ভবিষ্যতেও জানতে পারতেন না৷ তবু জানতে গেলেও এত বেশি তর্ক করেন কেন বলুন দেখি!’

সুন্দরবাবু দীপ্তনেত্রে কেবল বললেন, ‘হুম!’

জয়ন্ত বললে, ‘জানাজানি নিয়ে হানাহানি ছেড়ে দাও মানিক৷ এখন বর্ণনা শুনে মনোহরের চিত্ররূপ আঁকবার চেষ্টা করো৷ কালই আমরা সুলতান পুরে যাত্রা করব৷’

তিন

সিদ্ধেশ্বরবাবুর চিঠি

সুলতানপুর ছোটো শহর হলেও তিনটি রেলপথের সংযোগস্থলে অবস্থিত বলে লোকজনের সংখ্যা বড়ো অল্প নয়৷

শহরের ভিতর দাঁড়িয়ে দেখা যায়, সুলতানপুরের বাইরে চারিদিকেই প্রকৃতি যেন নিজের ভাণ্ডার উজাড় করে ছড়িয়ে দিয়েছে অজস্র সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য৷ সূর্যকিরণে ঝকমকে নদীর রৌপ্যবাহু লীলায়িত ভঙ্গিতে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে মরকত-সবুজ দূর্বা খেতের পর দূর্বা খেত; প্রান্তরের প্রান্তে দিকে দিকে ঘন নীল অরণ্যের জাফরি-কাটা যবনিকা আলো-ছায়ায় করছে ঝিলমিল ঝিলমিল, আর তাদের শিয়রে যক্ষপুরীর রহস্যময় অঃন্তপুরের জাগ্রত অথচ নিস্পন্দ প্রহরীর মতো মাথা তুলে আছে সারি সারি শৈলশিখর৷ বনলক্ষ্মীর ছন্দ-সুন্দর বার্তা বহন করে শহরের ভিতরে দলে দলে উড়ে আসে কলকন্ঠ বিহঙ্গ এবং চন্দন শীতল সমীরণ থেকে থেকে এসে বলে যায় সংগীতমধুর ভাষায়, কোনো অজানা বনে অচেনা ফুল-ফোটার কাহিনি৷

মানিক বললে, ‘জয়ন্ত এমনি সব জায়গাতেই জন্মলাভ করে কবির কল্পনা৷’

জয়ন্ত বললে, ‘কিন্তু আমরা কবি নই৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমরা ঠিক তার উলটো৷ আমরা এখানে কাল্পনিক মিথ্যার সঙ্গে মিতালি করতে আসিনি, আমরা এসেছি বাস্তব সত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে৷’

ফাঁক পেলে মানিক ছাড়ে না৷ বললে, ‘সত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে? সেকী সুন্দরবাবু, সত্য কি আপনার শত্রু?’

সুন্দরবাবু বদনমণ্ডলে ঘনিয়ে উঠেছিল অন্ধকার, কিন্তু জয়ন্ত তাড়াতাড়ি তার পক্ষ অবলম্বন করে বললে, ‘না মানিক, সুন্দরবাবু বোধকরি বলতে চান, উনি এসেছেন সত্যের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে৷’

সুন্দরবাবুর মুখ তৎক্ষণাৎ প্রসন্ন হয়ে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘জয়ন্ত ঠিক ধরেছে৷ আমি তো ওই কথাই বলতে চাই!’

জয়ন্ত বললে, ‘যাক ওকথা৷ সুন্দরবাবু, ওই বাড়িখানা কী?’

-‘পোস্ট অফিস? যাবে নাকি?’

-‘পরে বিবেচনা করব৷ কলকাতার বিখ্যাত চৌধুরী ব্যাঙ্কের একটা শাখা এখানে আছে না?’

-‘হ্যাঁ৷ সেটি এখানকার প্রধান ব্যাঙ্ক৷’

-‘একবার সেই ব্যাঙ্কে যেতে চাই৷’

-‘কেন বল দেখি?’

-‘সেখান গেলেই বুঝতে পারবেন৷’

চৌধুরী ব্যাঙ্ক৷ দোতলায় উঠে দেখা গেল, একটি বিলাতি পোশাকপরা যুবক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রবল বাতাসে দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না৷

তাকে দেখেই মানিক বিস্মিত স্বরে বলে উঠল, ‘একী, করুণা!’

-‘আরে, মানিক নাকি? এখানে যে?’

-‘এই ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে একটু দরকার৷’

-‘আমিই এখানকার ম্যানেজার৷’

-‘সে কী হে, কবে থেকে?’

-‘মাস ছয়েক৷ তুমি তো আমাদের পাড়া আর মাড়াও না, জানবে কেমন করে? এঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও!’

-‘ইনি হচ্ছেন সুন্দরবাবু-ডাকসাইটে পুলিশ কর্মচারী৷ ইনি হচ্ছেন আমার বন্ধু জয়ন্ত, আমার মুখে এর কথা তুমি অনেকবার শুনেছ৷ আর জয়ন্ত, এটি হচ্ছে আমার বাল্যবন্ধু করুণা ভট্টাচার্য৷ আমার মামার বাড়ির পাশেই এঁদের বাড়ি৷’

করুণা বললে, ‘আপনাদের মতো মহাবিখ্যাতরা এই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে কেন? আচ্ছা সেকথা পরে হবে, আগে আমার ঘরে এসে বসুন৷’

পাশেই ম্যানেজারের ঘর৷ সকলে আসন গ্রহণ করলে পর নিজেও টেবিলের সামনে গিয়ে বসে করুণা বললে, ‘এইবার আপনাদের জন্যে কী করতে পারি আদেশ করুন৷’

জয়ন্ত সহাস্যে বললে, ‘আদেশ-ফাদেশ কিছুই নয়৷ প্রথমেই বিনীত নিবেদন আছে৷ বলতে পারেন, সুলতানপুর ডাকঘরের এলাকার মধ্যে সবচেয়ে ধনী বাঙালি এমন কে আছেন, যিনি আপনাদেরও মক্কেল?’

করুণা বললে, ‘বিচিত্র প্রশ্ন! সুলতানপুর ডাকঘরের এলাকার কিছু কিছু বাঙালি আছেন বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর সকলেই সম্পন্ন গৃহস্থ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক৷’

-‘সেই একজন কি খুব ধনী?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তাঁকে ধনকুবের বলাও চলে হয়তো৷’

-‘তিনি কি আপনাদেরও মক্কেল?’

-‘আমাদের একজন প্রধান মক্কেল৷’

-‘তিনি কোথায় থাকেন?’

-‘এখান থেকে তিন মাইল দূরে আছে বেগমপুরা নামে একটি জায়গা৷ সেখান থেকেও মাইল দুয়েক তফাতে দস্তুরমতো গহন বনের ভিতরে আছে তাঁর বাংলোর ধরনে তৈরি মস্ত বাড়ি৷’

-‘অতবড়ো ধনী এমন নির্জন জায়গায় থাকেন কেন?’

-‘শুনতে পাই তিনি ভারি খেয়ালি লোক৷’

-‘তার নাম কি ডাক্তার মনোহর মিত্র?

-‘আজ্ঞে না, তার নাম সিদ্ধেশ্বর সেন৷’

জয়ন্ত চুপ করে রইল গম্ভীর মুখে৷

সুন্দরবাবু মুরুব্বিয়ানা চালে ঘাড় নাড়তে নাড়তে গালভরা হাসি হেসে বললেন, ‘তুমি আমার উপর টেক্কা মারবে বলে এখানে এসেছ৷ কিন্তু দেখছ তো ভায়া, আমি কোনো পাথর ওলটাতেই বাকি রাখিনি৷’

জয়ন্ত নিরুত্তর মুখে পকেট থেকে মানিকের আঁকা সেই ছবিখানা বার করে ধীরে ধীরে বললে, ‘করুণাবাবু . . . এই ছবির মানুষটিকে কোনোদিন কি আপনি স্বচক্ষে দর্শন করেছেন?’

করুণা ছবির উপরে ঝুঁকে পড়ল৷ এবং তারপরেই বিনা দ্বিধায় বলে উঠল, ‘এই ছবির সঙ্গে সিদ্ধেশ্বরবাবুর মুখ ঠিক ঠিক মিলছে না বটে, তবে এখানা যে সিদ্ধেশ্বরবাবুর প্রতিকৃতি সে বিষয়ে একটুও সন্দেহ নেই৷’

জয়ন্ত অপাঙ্গে সুন্দরবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় হেঁট করে ফেললেন সুন্দরবাবু৷

চার

কাচের কফিন

-‘করুণাবাবু, আপনাদের এই সিদ্ধেশ্বরবাবুর কথা আরও কিছু বলতে পারেন?’ জিজ্ঞাসা করলে জয়ন্ত৷

-‘একে আপনি মানিকের প্রাণের বন্ধু, তার উপরে আপনার মতো লোকের সঙ্গে বাক্যালাপ করবার সুযোগ পাওয়াও পরম সৌভাগ্য৷ আপনি কী জানতে চান বলুন?’

-‘সিদ্ধেশ্বরবাবু কবে কত দফায় আপনাদের ব্যাঙ্কে কত টাকা জমা রেখেছেন?’

করুণা স্তব্ধ হয়ে রইল অল্পক্ষণ৷ তারপর মৃদুস্বরে ধীরে ধীরে বললে, ‘দেখুন এরকম প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমাদের পক্ষে উচিত নয়, কারণ সিদ্ধেশ্বরবাবু হচ্ছেন আমাদের একজন প্রধান মক্কেল৷ কিন্তু আপনাদের কথা স্বতন্ত্র, বিশেষত সুন্দরবাবু হচ্ছেন একজন বিশিষ্ট রাজকর্মচারী৷ এক্ষেত্রে আমরা আদেশ পালন করতে বাধ্য৷ আপাতত আমার স্মৃতি থেকেই আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করব৷ দরকার হলে পরে টাকার সঠিক পরিমাণ আপনাকে জানাতে পারি৷ শুনুন৷ সিদ্ধেশ্বরবাবু তার বাংলো বাড়ি তৈরি হবার পর এ অঞ্চলে প্রথম আসেন প্রায় দুই বছর আগে৷ সেই সময়েই আমাদের ব্যাঙ্কে তিনি জমা রাখেন ছয় লক্ষ টাকা৷ দ্বিতীয় বারে প্রায় বছর দেড়েক আগে তিনি এই ব্যাঙ্কে পনেরো লক্ষ টাকা জমা দেন৷ তৃতীয় বারে সেও বোধ হয় দেড় বছরের কাছাকাছি,- সিদ্ধেশ্বরবাবুর কাছ থেকে আবার আমরা বারো লক্ষ টাকা পাই৷ অর্থাৎ মোট তেত্রিশ লক্ষ টাকা৷’

জয়ন্ত অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে সুন্দরবাবুর দিকে তাকিয়ে খুব মৃদুস্বরে বললে, ‘শুনছেন? দ্বিতীয় আর তৃতীয় বারে সিদ্ধেশ্বরবাবু এখানে জমা দিয়েছেন যথাক্রমে পনোরো আর বারো লক্ষ টাকা? সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবু কি যথাক্রমে পনেরো আর বারো লক্ষ টাকা নিয়েই নিরুদ্দেশ হননি?’

সুন্দরবাবু মৃদুস্বরে জয়ন্তের কানে কানে বললেন, ‘কিন্তু প্রথম দফায় ছয় লক্ষ টাকা কোথা থেকে এল?’

-‘জোর করে কিছু বলতে চাই না৷ খুব সম্ভব ওটা হচ্ছে সিদ্ধেশ্বরবাবুর নিজের টাকা৷’

করুণা বললে, ‘আপনারা আর কিছু জানতে চান?’

-‘সিদ্ধেশ্বরবাবুর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?’

-‘বিশেষ কিছুই জানি না৷’

মানিক শুধাল, ‘আচ্ছা করুণা, বছর দেড়েক আগে কোনো প্রাচীন মহিলা কি সিদ্ধেশ্বরবাবুর অতিথি হয়েছিলেন?’

করুণা একটু ভেবে বললে, ‘দেখো মানিক, বছর দেড়েক আগেকার কথা আমি ঠিকঠাক জানি না৷ তবে একথা শুনেছি বটে, বছর দেড়েক আগে সিদ্ধেশ্বরবাবু একটি অতিবৃদ্ধাকে নিয়ে সুলতানপুর স্টেশনে এসে নেমেছিলেন৷’

-‘তারই কিছুদিন পরে একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোকও এখানে এসেছিলেন?’

-‘এও আমার শোনা কথা মানিক৷ শুনেছি, সে ভদ্রলোকও গিয়েছিলেন সিদ্ধেশ্বরবাবুর বাড়িতে কিন্তু-‘

-‘থামলে কেন, কিন্তু কী?’

কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে করুণা বললে, ‘ভাই মানিক, সিদ্ধেশ্বরবাবুর সম্বন্ধে অনেক কানাঘুষাই শুনতে পাই৷ কিন্তু শোনা কথা পরের কাছে প্রকাশ করতে ভয় হয়৷’

করুণার পৃষ্ঠদেশে একটি সাদর চপেটাঘাত করে মানিক অভিযোগভরা কন্ঠে বললে, ‘করুণা, আমিও কি তোমার পর? কোনো ভয় নেই, তোমার শোনা কথাই প্রকাশ করো৷’

করুণা বললে, ‘শুনেছি, সিদ্ধেশ্বরবাবুর বাংলোয় একটি বৃদ্ধা নারী আর একটি বৃদ্ধ পুরুষ প্রবেশ করেছিলেন বটে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তাঁদের প্রস্থান করতে দেখেনি৷ কেবল তাই নয়, তাঁরা যে এখনও ওই বাংলোর ভিতর আছেন, এমন কোনো প্রমাণও নেই!’

-‘এ যে অসম্ভব কথা৷’

করুণা প্রায় আতঙ্কগ্রস্ত কন্ঠেই বললে, ‘তুমি আমার বাল্যবন্ধু৷ তুমি জিজ্ঞাসা করছ বলেই বলছি, সিদ্ধেশ্বরবাবুর ওই রহস্যময় বাংলো সম্বন্ধে আরও যেসব কানাকানি শুনতে পাই তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়৷’

-‘তোমার কথার অর্থ বুঝলুম না৷’

-‘লোকে বলে, ও বাংলো হচ্ছে ভূতুড়ে৷’

-‘কেন?’

-‘ওখানে নাকি কাচের দুটো কফিনের মধ্যে . . .’

-‘কাচের কফিন!’

-‘হ্যাঁ৷ ওখানে নাকি কাচের দুটো কফিনের মধ্যে আছে একটি পুরুষ আর একটি নারীর মৃতদেহ৷’

সুন্দরবাবু চমকে উঠে প্রায় গর্জন করে বললেন, ‘হুম! হুম!’

ঠিক সেই সময়ে ঘরের ভিতরে এসে ঢুকল একজন ভৃত্য৷ সে বললে, ‘সিদ্ধেশ্বরবাবু দেখা করতে এসেছেন৷’

সচমকে সকলে করলে দৃষ্টি বিনিময়!

করুণা বললে, ‘বেশ, তাঁকে এখানে নিয়ে এসো৷’

মিনিট দুয়েক পরই ঘরের দরজার কাছে সিদ্ধেশ্বরবাবুর আবির্ভাব৷ মানিকের আঁকা ছবির বারো আনাই মিলে যায় তাঁর চেহারার সঙ্গে৷ ত্রস্তভাবে সকলের মুখের উপরে একবার বিদ্যুৎবেগে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি বললেন, ‘করুণাবাবু, আপনার ঘরে আজ অনেক অতিথি দেখছি৷ আমি জানতুম না, মাপ করবেন, আর একদিন আসব৷’ বলতে বলতে সিদ্ধেশ্বরের অন্তর্ধান৷

সুন্দরবাবু তাঁর দোদুল্যমান ভুঁড়িকে রীতিমতো কাহিল করে তড়াক করে এক সুদীর্ঘ লম্ফ মেরে সচিৎকারে বললেন, ‘পাকড়াও, পাকড়াও! মনোহর মিত্তির লম্বা দিচ্ছে! ওকে গ্রেপ্তার করো! ওকে গুলি করে মারো!’

জয়ন্ত হাত বাড়িয়ে সুন্দরবাবুর কাঁধ চেপে ধরে কঠোর কন্ঠে বললে, ‘শান্ত হোন সুন্দরবাবু, শান্ত হোন! লম্ফঝম্ফ আর চিৎকার করে ভাঁড়ামি করবেন না৷ আসুন দেখা যাক মনোহরবাবু এর পরে কী করেন৷’

তারপর ব্যাঙ্কের বারান্দায় গিয়ে দেখা গেল, রাস্তায় মনোহরবাবু তাঁর মোটরবাইক চালিয়ে দিয়েছেন সবেগে৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এখন আমরা কী করব? নীচে নেমে গিয়ে মোটরে চড়ে মনোহরের পশ্চাদ্ধাবন করতে পারি বটে, কিন্তু ততক্ষণে আসামি আমাদের নাগালের বাইরে অদৃশ্য হয়ে যাবে৷’

করুণার দিকে ফিরে জয়ন্ত বললে, ‘আপনি তো মনোহরবাবুর বাংলোয় যাবার রাস্তা জানেন?’

-‘জানি৷’

-‘তাহলে কালবিলম্ব না করে আমাদের সঙ্গে আসুন৷ মনোহরবাবু তো বাংলোখানা আর কফিন দুটো কাঁধে করে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন না৷ আগে দেখা যাক তাঁর বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ আছে, তারপর তাঁকে পুনরাবিস্কার করতে আমার বেশিক্ষণ লাগবে না৷’

সকলে পুলিশ-লরির উপরে চড়ে বসল এবং সঙ্গে চলল কয়েক জন সামরিক পুলিশ৷

খানিকক্ষণ পরেই পিছনে পড়ে রইল সুলতানপুর এবং সামনে এগিয়ে এল ভুস্বর্গের বর্ণোজ্জ্বল দৃশ্য৷ আকাশ, পাহাড়, কানন সূর্যকর ও লতাপাতা-ফুল-এমনকী মৌমাছি, প্রজাপতি ও পতঙ্গ পর্যন্ত যেন চোখের সামনে ধরে রাখবার চেষ্টা করছে, রামধনুকের সাতটি বর্ণমালা৷ ঝরঝর ঝরনা ঝরছে শ্যামল শৈলের কোলে, সূর্যকিরণ তারও শিকরগুলির মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে রচনা করেছে ইন্দ্রধনুর ছন্দ৷ জীবন্ত প্রকৃতি যে বিচিত্র গীতি-কবিতা শোনাতে চায় তার মধ্যেও আছে কত বিভিন্ন সুরের মাধুরিমা-বাতাসের গুঞ্জন, তরুপল্লবের মর্মর, কোকিলের কুহু কুহু, ভ্রমরের গুনগুন, তটিনীর কুলকুল৷

বেগমপুরাও পিছনে গিয়ে পড়ল৷ সামনে এবার দুরারোহ পর্বতমালার তলায় মাথা তুলে দাঁড়াল দুর্গম অরণ্য এবং তারই বক্ষ ভেদ করে অগ্রসর হয়েছে সর্পিল গতিতে একটি নাতি-বৃহৎ পথ৷ সেই জনহীন পথে নীরবতার তন্দ্রাভঙ্গ করে ছুটে চলল মোটর-লরি৷

মানিক বললে, ‘এমন জায়াগাতেও মানুষ থাকে!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘মনোহর মানুষ নয়, সে অমানুষ! নিজের যোগ্য জায়গাই বেছে নিয়েছে৷ কিন্তু আমার খালি খালি এই কথাই মনে হচ্ছে, জয়ন্ত কেমন করে সন্দেহ করলে যে, সুলতানপুরের চৌধুরী-ব্যাঙ্কের সঙ্গে মনোহরের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে?’

জয়ন্ত হাসিমুখে বললে, ‘আন্দাজ সুন্দরবাবু, আন্দাজ! আমার বিশেষ অটুট কোনো যুক্তি নেই, আন্দাজেই ছুড়েছি অন্ধকারে ঢিল!’

-‘হুম, আন্দাজটা কী শুনতে পাই না?’

-‘গোড়া থেকেই আমার দৃঢ় ধারণা ছিল, মনোহরবাবু বাসা বেঁধেছেন সুলতানপুর ডাকঘরের এলাকার মধ্যেই৷ এও ধরে নিলুম, যথাক্রমে পনেরো লক্ষ আর বারো লক্ষ টাকা নিয়ে সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবু তাঁরই কাছে গিয়ে হয়েছেন নিরুদ্দেশ৷ সাতাশ লক্ষ টাকা হস্তগত করে নিশ্চয়ই তিনি নির্বোধের মতো বাড়ির ভিতরে রেখে দেবেন না৷ বাড়িতে চোর-ডাকাতের ভয়, ওদিকে ব্যাঙ্কে রাখলে টাকা সুদে বাড়ে৷ তারপর ও টাকার কথা নাহয় ছেড়েই দিলুম৷ মনোহরবাবুকে তিনি লিখেছিলেন-যতদিন না আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় ততদিন আমরা এইখানেই বাস করব৷ কিন্তু মানুষের খাওয়া-পরার জন্যে দরকার হয় টাকার৷ টাকা আগাছার মতন আপনাআপনি মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠে না৷ নিজের ভরণপোষণের জন্য মনোহরবাবু নিশ্চয়ই কিছু টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখবেন৷ সুতরাং কোনো-না-কোনো দিক দিয়ে তাঁর সঙ্গে যে ব্যাঙ্কের সম্পর্ক আছে, এটা আমি আগে থাকতেই আন্দাজ করতে পেরেছিলুম৷ অবশ্য আন্দাজমাত্র৷’

সুন্দরবাবু তারিফ করে বললেন, ‘বা রে আন্দাজ! বলিহারি!’

করুণা বললে, ‘ওই সিদ্ধেশ্বর-অর্থাৎ মনোহরবাবুর বাংলো দেখা যাচ্ছে৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুঁ, মনোহরহীন মনোহরের বাংলোর ভিতরে আছে হয়তো এয়ার-টাইট কাচের কফিনের মধ্যে দুটো বুড়ো-বুড়ির কতদিনের বাসি শুকনো মড়া! বাবা, এ কীরকম বাংলো! চারিদিকে ঘন জঙ্গল আর ঝোপঝাপ, উপর থেকে মাথার উপরে ঝাঁপ খাবে বলে হুমড়ি খেয়ে আছে প্রকাণ্ড কালো পাহাড়৷ এ যেন হানাবাড়ি! গা ছমছম করে ওঠে! মনোহরটা বোধ হয় এখানে বসে শবসাধনা করত! সে মন্ত্র পড়ে দিলে রাত্রে মড়া দুটো জ্যান্ত হয়ে উঠত! এত কাঠখড় পুড়িয়েও তান্ত্রিক খুনিটাকে ধরতে পারলুম না, আমার এ আফশোস রাখবার ঠাঁই নেই৷ কপাল!’

গাড়ি ফণীমনসার বেড়া দিয়ে ঘেরা একখানা সুদীর্ঘ একতলা বাড়ির সামনেকার খোলা জমির উপরে গিয়ে দাঁড়াল৷

পাঁচ

ষোড়শী ললিতা দেবী

সারি সারি ঘর৷ সামনে টানা চওড়া দালান৷ জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে আসছে ঘুঘুর কান্না-সুর, তা ছাড়া আর কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া নেই৷ এ যেন এক অপরিসীম বিজনতার রাজ্য৷ স্তব্ধতার মধ্যে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে সত্য সত্যই৷

স্বভাবত উচ্চকন্ঠে সুন্দরবাবুও সেখানে চেঁচিয়ে কথা কইতে পারলেন না-সেখানে চিৎকার করাও যেন নিয়মবিরুদ্ধ৷ চুপিচুপি বললেন, ‘মনোহরের লোকজনরাও কি আমাদের গাড়ির সাড়া পেয়ে চম্পট দিয়েছে?’

-‘অসম্ভব নয়৷ দেখা যাক৷’ এই বলে জয়ন্ত অগ্রসর হয়ে দালানে গিয়ে উঠল-তার পিছনে পিছনে চলল আর সকলে৷ নিজের পায়ের শব্দে তারা নিজেরাই উঠতে লাগল চমকে৷

দালানের উপর দাঁড়িয়ে একবার এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে দেখলে জয়ন্ত৷ তারপরে সামনের একটা ঘরের দিকে সোজা এগিয়ে গেল-

এবং সঙ্গেসঙ্গে সুগম্ভীর কন্ঠে শোনা গেল-‘ওদিকে নয়, ওদিকে নয়, এদিকে আসুন-আপনাদের বাঁ-দিকের শেষ ঘর৷’

সচকিত প্রাণে সকলে একসঙ্গে ফিরে দাঁড়াল বিদ্যুতের মতো৷

সুন্দরবাবু এতক্ষণ দেখতে পাননি-বাঁ-দিকের শেষ ঘরের পর্দা-দেওয়া দরজার দুই পাশে দাঁড় করানো রয়েছে দুটো সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ নরকঙ্কাল!

আঁতকে উঠে অস্ফুট কন্ঠে তিনি বললেন, ‘আর নয়, এইবেলা সরে পড়ি এসো! মড়ার হাড় এখানে কথা কয়!’

সেই কন্ঠস্বরে শোনা গেল, ‘ভয় নেই! ও দুটো হচ্ছে রক্তমাংসহীন কঙ্কাল মাত্র! নির্ভয়ে ঘরের ভিতরে আসুন৷’ গম্ভীর কন্ঠস্বর, কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে যেন ব্যঙ্গের আভাস৷

আকস্মিক কন্ঠস্বর শুনে জয়ন্ত কেবল বিস্মিত হয়েছিল, তার মনে কোনোদিনই ছিল না ভয়-ডরের বাসা৷ সে এগিয়ে গেল দৃঢ়পদে৷

ঘরের ভিতর থেকে কে বললে, ‘পর্দা ঠেলে প্রবেশ করুন৷’

দুই হাতে দুই দিকে পর্দা সরিয়ে জয়ন্ত ঘরের ভিতরে গিয়ে দাঁড়াল৷

সামনেই একখানা ইজিচেয়ারের উপরে অর্ধশয়ান অবস্থায় স্বয়ং মনোহর মিত্র!

এ দৃশ্য একেবারেই অপ্রত্যাশিত! হতভম্ব হয়ে গেল জয়ন্ত পর্যন্ত৷

মনোহরের গম্ভীর মুখের ওষ্ঠাধরের উপরে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল যেন একটুখানি হাসির ফিনিক! তিনি বললেন, ‘আমি পালাইনি দেখে অবাক হচ্ছেন? অবাক না হলেও চলবে৷ আপনারা শুভাগমন করবেন জেনেই আমি এখানে আপনাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে অপেক্ষা করছি৷ আপনারা দয়া করে আসন গ্রহণ করুন, এখানে আসনের অভাব হবে না৷’

পিছন দিক থেকে সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘হুম! ছদ্মনামের আড়ালে যে লোক তেত্রিশ লাখ টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছে, তার বাড়িতে আসনের অভাব হবে না, আমি তা জানি৷’

মনোহরের একটুও ভাবান্তর হল না৷ খুব সহজ, স্থির কন্ঠে তিনি বললেন, ‘নানা কারণে সময়ে আত্মগোপন করবার দরকার হয় অনেকেরই-এমনকী আপনাদেরও৷’

-‘আমরা মাঝে মাঝে আত্মগোপন অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণ করি অসাধুদের শাস্তি দেবার জন্যে৷ কিন্তু তুমি?’

কালো চশমার আড়ালে মনোহরের দুই চক্ষু ক্রোধে দীপ্ত হয়ে উঠল কিনা বোঝা গেল না৷ কিন্তু তাঁর গম্ভীর কন্ঠস্বর হয়ে উঠল অত্যন্ত কঠিন৷ ধীরে ধীরে তিনি বললেন, ‘আমি মহাশয়ের চেয়ে বয়সেও বড়ো, বিদ্যা-বুদ্ধি মানসম্ভ্রমেও বোধ হয় ছোটো নই৷ আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করে ভদ্রতার অপমান না করলেই বাধিত হব৷ আপনারা অসাধুদের দণ্ড দেবার জন্যে ছদ্মবেশ ধারণ করেন, কেমন? তাহলে জানবেন, আমি ছদ্মনাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি৷ মনুষ্য জাতির মঙ্গলের জন্যে৷’

সুন্দরবাবু টিটকিরি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ও হো হো হো! মনুষ্যজাতির মঙ্গলের জন্যে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন বিংশ শতাব্দীর অভিনব যিশুখ্রিস্ট! তাই তিনি সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবুকে হত্যা করে কাচের কফিনে পুরে রেখে দিয়েছেন৷ তাই তিনি ওই দুই হতভাগ্যের কাছ থেকে সাতাশ লক্ষ টাকা অপহরণ করে ধরা পড়বার ভয়ে ছদ্মনামের আশ্রয়ে ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছেন৷ এরপর কী করা উচিত বলুন দেখি? আপনাকে সাধুবাদ দেব, না হাতকড়ি আনবার হুকুম দেব?’

একটুও বিচলিত না হয়ে স্থির কন্ঠে মনোহর বললেন, ‘লোকে আমাকে অপবাদ দেয়-আমি নাকি হাসতে জানি না৷ কিন্তু আপনার কথা শুনে আজ আমার প্রাণপণে অট্টহাস্য করবার ইচ্ছে হচ্ছে৷ আমি সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবুকে হত্যা করেছি? কোন প্রত্যক্ষদর্শী আপনার কানে কানে এই অপূর্ব খবরটি দিয়ে গিয়েছেন?’

-‘দেখুন, ধাপ্পা দিয়ে আপনি আমাকে গুলোবার চেষ্টা করবেন না৷ বলতে পারেন সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবু আজ কোথায়?’

-‘তাঁরা এই বাড়িতেই আছেন৷’

-‘হ্যাঁ, কাচের কফিনের ভিতরে!’

-‘বারবার কাচের কফিন বলে চিৎকার করবেন না৷ আমার বাড়িতে কফিন বলে কোনো জিনিসই নেই৷’

-‘বটে, বটে,-হুম! এখানে কাচের কফিন আছে কি না আছে সেটা খানাতল্লাস করলেই জানতে পারা যাবে৷’

এতক্ষণ পরে মনোহর হঠাৎ সিধে হয়ে উঠে বসে বললেন, ‘কাচের কফিনের কথা ছেড়ে দিন৷ আপনি আগে জীবন্ত অবস্থায় কাকে দেখতে চান? সুশীলা দেবীকে, না গোবিন্দবাবুকে?’

সুন্দরবাবু প্রথমটা থতমত খেয়ে গেলেন৷ তারপর বাধো বাধো গলায় বললেন, কোথায় সুশীলা দেবী? আগে তাঁকেই দেখতে চাই৷’

-‘উত্তম! বলেই মনোহর গলা চড়িয়ে ডাকলেন,-সুশীলা! সুশীলা!’

বাড়ির ভিতর থেকে গানের মতন একটি আওয়াজ শোনা গেল-

-‘আজ্ঞে! কী বলছেন?’

-‘তুমি একবার এই ঘরে এসো তো মা৷’

ঘরের ভিতরকার একটি দরজার পর্দা ঠেলে আত্মপ্রকাশ করল যে আশ্চর্য রূপবতী ও মহিমময়ী মূর্তি, তাকে দেখবার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না৷ এ মূর্তি যে মাটির পৃথিবীর, স্বচক্ষে দেখে কেউ তা বিশ্বাস করতে পারলে না, মনে হল সে যেন কোনো অজানা স্বর্গের অবাস্তব স্বপ্ন! পৌরাণিক কাব্যে যেসব উর্বশী, রম্ভা, মেনকা ও তিলোত্তমা প্রভৃতির কাল্পনিক বর্ণনা পাঠ করা যায়, এই মূর্তির তাজা রূপমাধুরীর কাছে ম্লান হয়ে যায়, সে সব বর্ণনাও! ষোড়শী কি বালিকা, একে দেখলে ভালো করে তাও বোঝা যায় না৷

বিপুল বিস্ময়ে জয়ন্ত বলে উঠল, ‘উনিই কি সুশীলা দেবী?’

মনোহর বললেন, ‘হ্যাঁ৷ কিন্তু এখন থেকে ইনি নতুন নামে আত্মপরিচয় দেবেন৷’

-‘নতুন নাম?’

-‘হ্যাঁ, ললিতা দেবী৷’

ছয়

মাতৃভাষার দৌড়

সুন্দরবাবু দৃঢ়কন্ঠে বললেন, ‘হুম! ইনি ললিতাদেবী বা পালিতা দেবী হতে পারেন, কিন্তু ইনি সুশীলা দেবী নন!’

-‘কেন বলুন দেখি?’

-‘সুশীলা দেবীর বয়স পঁচাত্তর বৎসর৷’

-‘ঠিক৷ কিন্তু এখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর হলেও তিনি আর বৃদ্ধা নন৷’

-‘পাগলের মতন কী আবোল-তাবোল বকছেন৷’

-‘সুশীলা দেবী নবযৌবন লাভ করেছেন৷’

-‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা করবেন না মনোহরবাবু৷’

-‘কেন, প্রাচীনা কি আবার নবীনা হতে পারে না?’

-‘অসম্ভব৷ জরার পর মৃত্যু, জরার পর আর যৌবন নেই৷’

-‘বিজ্ঞানের মহিমায় সবই সম্ভবপর হয়৷ আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি, বিজ্ঞান একদিন মানুষকে অমর করবে৷’

-‘আপনার ওই নির্বোধের স্বর্গে আমাদের টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন না৷ হয় কাজের কথা বলুন নয়-‘

-‘নয়?’

-‘নয় থানায় চলুন৷’

-‘বেশ, তবে কাজের কথাই শুনুন৷ মনোহর ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, ‘মা সুশীলা৷’

-‘বাবা!’

সে কি মানুষের কন্ঠস্বর, না, বীণার ঝংকার?

-‘তুমি এখন বাড়ির ভিতরে যাও৷ এই ভদ্রলোকদের জন্যে একটু চা-টা পাঠিয়ে দাও৷’

সুন্দরবাবু ব্যস্তভাবে সভয়ে বলে উঠলেন, ‘না, না, এখানে আমরা চা-টা খেতে আসিনি৷’

-‘ভয় নেই, আপনাদের চায়ে কেউ বিষ মিশিয়ে দেবে না৷’

-‘বিষ থাক আর না থাক, এখানে চা আর টা কিছুই খাওয়া চলতে পারে না৷’

-‘আপনাদের সকলেরই কি এক মত?’

জয়ন্ত বললে, ‘আমার অন্য মত৷ আমি চা-টা সব খাব৷ কী বল মানিক?’

-‘আমিও তোমার দলে৷’

-‘করুণাবাবু কী বলেন? পরমা সুন্দরী সুশীলা-ওঁকে কি দেবী বলে ডাকব, মনোহরবাবু?’

-‘ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন৷’

আবার বাজল সেই অমৃতায়মান কন্ঠস্বরের মোহনীয় বীণাবেণু৷ ‘বাবার কাছে আমি সুশীলা৷ কিন্তু আপনারা তো সেই সুশীলাকে দেখেননি আপনারা ললিতা বলেই ডাকুন৷’

জয়ন্ত বললে, ‘বেশ! করুণাবাবু, এই পরমা সুন্দরী ললিতা দেবী যদি তাঁর সুন্দর হাত দিয়ে সুন্দর চা তৈরি করে দেন, তাহলে সুন্দরবাবুর মতো আপনিও কি তা পান করবেন না?’

-‘করব না, বলেন কী? আমি তো নির্বোধ নই৷’

-‘সুন্দরবাবু, আপনি কি এখনও মত বদলাবেন না? মনে রাখবেন চায়ের সঙ্গে আবার ‘টা’৷’

সুন্দরবাবু জুলজুল করে জয়ন্তের মুখের পানে তাকিয়ে বললেন, ‘কী আর করি বল! তোমরা সবাই যখন রাজি, তখন আমার আর এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় কেন? আমিও রাজি৷’

ললিতা দেবীর গোলাপ-পেলব ওষ্ঠাধরে ফুটল যে মিষ্টি হাসিটুকু তাও যেন নীরব সংগীতের মতো সুন্দর৷ একটি নমস্কার করে পাশের ঘরে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন জীবন্ত স্বপ্নপ্রতিমার মতো৷

মনোহর গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘শুনুন সবাই৷ জরার কারণ কী, মানুষ যে তা জানে না, একথা সত্য নয়৷ বরং এই কথাই সত্য যে, জরার কারণ তার কাছে অজ্ঞাত নয়, এইটুকুই জানে না সে৷’

সুন্দরবাবু মুখভঙ্গি করে বললেন, ‘বাবা, এ যে হেঁয়ালি৷’

-‘এসব সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক ব্যাপার আপনাদের যে কেমন করে বোঝাব বুঝতে পারছি না৷ Radioactive বস্তু কাকে বলে জানেন?’

জয়ন্ত বললে, ‘জানি৷ আমাকেও মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে হয়, যদিও তা ধর্তব্যের মধ্যেই গণ্য নয়৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘বিজ্ঞানে আমি একেবারে অজ্ঞ৷ বাংলায় বুঝিয়ে দিতে পারেন?’

-‘ইংরেজি তো পদে আছে, বাংলায় শুনলে একেবারে অজ্ঞান হয়ে যাবেন৷’

-‘তাও কখনো হয়? বাংলা আমাদের মাতৃভাষা৷’

-‘আমাদের মাতৃভাষার অভিধানে radioactive-এর অর্থ এইভাবে বোঝানো হয়েছে: আশুবিকিরণ দ্বারা বিদ্যুৎমাপক প্রভৃতির উপর ক্রিয়াকরণক্ষম, (রেডিয়াম, ইউরেনিয়াম পলানিয়াম প্রভৃতি সম্পর্কে কিরণবিকিরণক্ষম৷) কী বুঝলেন, বলুন?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ব্যাপার বুঝব কী, আরও গুলিয়ে গেল৷ মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে৷ এইজন্যেই কি কবি গান বেঁধেছেন- আ মরি বাংলা ভাষা!’

-‘বাংলা ভাষার দোষ নেই সুন্দরবাবু, তবে বাংলা ভাষায় এখনও ভালো করে বিজ্ঞানকে পরিপাক করবার চেষ্টা হয়নি, কারণ দেশ এতদিন স্বাধীন ছিল না৷ যাক ওকথা৷ যতটা সংক্ষেপে পারি কিছু কিছু বোঝাবার চেষ্টা করি৷ অনেক পরীক্ষার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছি যে, সারাজীবন ধরে আমাদের দেহের ভিতরে যে radioactive বস্তু জমে ওঠে (অর্থাৎ যাকে বলে ক্রমিক radium বিশ্বসঞ্চার), জরার কারণ হচ্ছে তাই-ই৷ সূর্যের দ্বারা পৃথিবীর উপর প্রতিদিনই radium নিক্ষিপ্ত হচ্ছে৷ আমরা তা খাচ্ছি, আমরা তা পান করছি, নিশ্বাস দিয়ে বাতাস থেকে তা আকর্ষণ করছি৷ তারই ফলে প্রত্যেক জীব আর তরুলতাও ধীরে ধীরে জরাগ্রস্ত হয়৷ সেই জরা-ব্যাধি নিবারণ করবার উপায় আমি আবিষ্কার করেছি৷’

সুন্দরবাবু দুই চোখ ছানাবড়ার মতন করে বললেন, ‘বলেন কী মশাই!’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ Calcium থেকে দেহের হাড় তৈরি হয়৷ রসায়নশাস্ত্রের দিক থেকে radium কাজ করে calcium-এর মতো৷ গঠনকার্যে যেখানে calcium-এর পরমাণুর দরকার হয়, সেখানে radium পরমাণু ব্যবহার করলে দেহের রক্তস্রোত তা না জেনেই গ্রহণ করে৷ Radium বিষের দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্ষা করবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, তাদের দেহের ভিতর থেকে এই radium পরমাণুগুলিকে বিতাড়িত করা৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সেটা কি অসম্ভব ব্যাপার নয়?’

-‘প্রথম দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয় বটে৷ কিন্তু কার্যকালে দেখা যায়, মোটেই তা নয়৷ জরাব্যধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাড়ের ভিতর থেকে বিপদজনক radium পরমাণুগুলোকে বাইরে বার করে দেওয়া অসম্ভব নয় মোটেই৷ প্রথমে রোগীকে এমন ভিনিগার ও অ্যাসিড-জাতীয় পথ্য দিতে হবে, যাতে করে তার দেহের হাড়গুলো calcium থেকে মুক্ত হয়৷ এক হপ্তার পর রোগীকে আমি আবার এক হপ্তা ধরে স্বাভাবিক পথ্য দিই বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে এদিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখি যে, খাদ্যের ভিতরে যে খাঁটি calcium থাকে তার মধ্যে কিছুমাত্র radioactivity বর্তমান নেই৷ প্রথমে যে ভিনিগার ও অন্যান্য অ্যাসিডের পথ্য দেওয়া হয় দেহের ক্ষতিসাধন করবার ক্ষমতা তাদের অপেক্ষাকৃত কম৷ ওই পথ্যের পরমাণুকগ্রহণশক্তি বা valence আছে৷ তাই ওই পথ্যের আকর্ষণে আসল calcium-এর সঙ্গে দেহের ভিতরে উড়ে এসে জুড়ে বসা radiumও ক্রমে ক্রমে বাইরে বেরিয়ে যায়৷ স্বাভাবিক পথ্যের পর দিই আবার অ্যাসিড-জাতীয় পথ্য৷ তারপর আবার স্বাভাবিক পথ্য৷ এইভাবে চিকিৎসা চলে মাসের পর মাস৷’

জয়ন্ত চমৎকৃত হয়ে বললে, ‘এই চিকিৎসার ফলেই জরাগ্রস্ত রোগী আবার ফিরে পায় তার নবযৌবন?’

-‘প্রায় তাই বললেও চলে৷ তবে উপসর্গও যে দেখা দেয় না, তা বলা চলে না৷ যেমন ওই কাচের কফিন ব্যাপারটা৷ সুন্দরবাবু কাচের কফিনের উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু সেটা যে কী পদার্থ আপনারা কেউ তা জানেন না৷ দেখতে চান তো আমার সঙ্গে আসুন৷’

সাত

মানুষ-‘গুটিপোকা’

মনোহরের সঙ্গে সকলে এসে উপস্থিত হল প্রকাণ্ড একখানা হল ঘরে৷ তার অধিকাংশ জুড়ে বিরাজ করছে নানানরকম যন্ত্রপাতি৷ যাঁরা কোনো কলেজের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার দেখেছেন, তাঁদের কাছে ওসব যন্ত্রের কয়েকটি পরিচিত বলে মনে হবে৷

কোথাও একাধিক bunsen-এর (অত্যন্ত তপ্ত উত্তাপসঞ্চারক প্রদীপবিশেষ) উপরে টগবগ করে ফুটছে still বা অধোযন্ত্রগুলো, কোথাও সারি সারি কীলক থেকে ঝুলছে condenser বা সংহিতযন্ত্র৷ কিন্তু এখানে-ওখানে-সেখানে আরও যেসব ছোটো-বড়ো বৈদ্যুতিক যন্ত্র রয়েছে, সাধারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে সেগুলোকে দেখা যায় না৷

সুন্দরবাবু আবার ‘হুম’ শব্দটি উচ্চারণ করে বললেন, ‘মনোহরবাবু, এতক্ষণ কানে যা শুনলুম তার একবর্ণও বুঝতে পারলুম না৷ এখন চোখে যা দেখছি তাও ভালো করে বুঝতে পারছি না৷ আপনি বোধ হয় আবার লেকচার শুরু করবেন? কিন্তু তার আগে আমার গোটাকয় সহজ প্রশ্নের জবাব দেবেন?’

-‘আজ্ঞা করুন৷’

-‘আপনি এইসব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা তো কলকাতায় বসেই করতে পারতেন? মিথ্যে এত লুকোচুরি কেন?’

-‘কলকাতার কৌতূহলী জনতা যদি ঘুণাক্ষরেও আমার পরীক্ষার ব্যাপার টের পেত, তাহলে আমার বাড়িটি পরিণত হত সরকারি বাগানে আর সেখানে উঁকিঝুকি মারতে আসত রাম-শ্যাম যদু-মধু সকলেই৷ তারপরেও আমি কি আর নির্বিঘ্নে পরীক্ষা চালাবার অবসর পেতুম?’

-‘সেকথা ঠিক৷ কিন্তু সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবু, কারুকে কিছু না জানিয়ে আপনার সঙ্গে অমন চোরের মতন পালিয়ে এসেছেন কেন?’

-‘তারও প্রথম কারণ হচ্ছে, মন্ত্রগুপ্তি৷ দ্বিতীয় কারণ গুরুতর!’

-‘গুরুতর মানে?’

-‘সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবু নতুন দেহ লাভ করবার পর ইহজীবনে আর নিজের বাড়িতে ফিরবেন না বোধ হয়৷’

-‘সে কী মশাই!’

-‘হ্যাঁ৷ সেইজন্যেই সুশীলা আজ ললিতা নাম ধারণ করেছে৷’

-‘কিন্তু কেন, কেন?’

-‘নূতন দেহে অতিপ্রাচীনা সুশীলাকে কেউ কি চিনতে পারত?’

-‘তা তো পারতই না-হুম!’

-‘সুশীলার কথা কেউ কি বিশ্বাস করত?’

-‘তা তো করতই না-ঠিক!’

-‘তাকে নিয়ে আরও নানারকম গণ্ডগোল-এমনকী মামলামোকদ্দমা হবারও সম্ভাবনা ছিল না কি?’

-‘তা তো ছিলই-হ্যাঁ৷’

-‘আরও কত দিক দিয়ে সুশীলার জীবন হয়ে উঠত ভয়াবহ৷ সেইজন্যে সে স্থির করেছিল আমার পরীক্ষা সফল হলে নতুন দেশে নতুন নামে নতুনভাবে জীবনযাপন করবে৷ গোবিন্দবাবুর সম্বন্ধেও ওই কথা৷’

‘সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবু অত টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কেন? আর সেসব টাকা আপনার নামেই বা জমা আছে কেন?’

-‘নতুন দেশে নতুন নামে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হলে প্রথমেই দরকার টাকা৷ সে টাকা আসবে কোথা থেকে? নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার জন্যেই সুশীলা দেবী আর গোবিন্দবাবু উচিতমতো টাকা সঙ্গে করে এখানে এসেছেন৷ ওঁদের টাকা আমার ছদ্মনামে জমা রেখেছি কেন? আমি জানতুম পুলিশ ওঁদের খোঁজ করবে৷ ওঁদের নামে টাকা জমা রাখলে পুলিশ ওঁদের সন্ধান পেত৷ আর কোনো প্রশ্ন আছে?’

-‘আর একটি প্রশ্ন৷ যদিও ললিতা দেবীই সুশীলা কি না সে খটকা আমার মন থেকে এখনও দূর হয়নি তবু ওটা আপাতত ধামা চাপাই থাক! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গোবিন্দবাবু কোথায়?’

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মনোহর ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, যে উপসর্গের কথা বলছিলুম এইবারে সেটা দেখবেন আসুন৷’

মনোহর এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একখানা খাটের পাশে৷ সেখানে শয্যার উপরে যে শায়িত মূর্তিটি ছিল তাকে দেখেই সকলের চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল পরম বিস্ময়ে৷

একটি অতিতরুণ অপূর্ব সুন্দর মূর্তি-বালক বললেও চলে৷ সুগঠিত, শুভ্র, নগ্ন, দেহ-যেন গ্রিক ভাস্করের হাতে-গড়া৷ কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, সর্বাঙ্গ তার কাচ দিয়ে মোড়া এবং সেই কাচ যেন কেউ গলিয়ে এমনভাবে মূর্তির উপরে ঢেলে দিয়েছে যে, সারা দেহের সঙ্গে তা অচ্ছেদ্য ভাবে সংযুক্ত হয়ে আছে৷

মনোহর বললেন, ‘সুন্দরবাবু, এই আপনার কাচের কফিন!’

-‘হুম কিন্তু কাচের কফিনের ভিতর ওটা কী রয়েছে? রঙিন মোমের পুতুল? না মৃতদেহ?’

-‘আরও কাছে গিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন৷’

-‘না, ওটা মোমের পুতুলও নয়, মৃতদেহও নয়৷ ও যে জীবন্ত৷ ওর সর্বাঙ্গে যে জীবনের রং, জীবনের আভাস৷ এমনকী দুই মুদিত চোখের পাতাও থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে৷’

মনোহর বললেন, ‘ও এখনও ঘুমুচ্ছে, কিন্তু ওর ঘুম ভাঙতে আর বেশি দেরি নেই৷’

জয়ন্ত শুধোল, ‘আসল ব্যাপারটা কী মনোহরবাবু?’

-‘আমি নিজেই জানি না৷ ওই কাচের আবরণী আমার সৃষ্ট নয়৷ পর্যায়ক্রমে calcium পথ্য দিয়ে, আবার তা বন্ধ করে বেশ কিছুকাল চিকিৎসা চালাবার পর রোগী হঠাৎ দীর্ঘকালব্যাপী নিদ্রাঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, আর তার সর্বাঙ্গ ব্যেপে দেখা দেয় ওই কাচের আবরণ! কিছুকাল পরে আবার রোগীর ঘুম ভাঙে, কাচের আবরণ ফেটে যায়, তারপর উঠে বসে তার জাগ্রত মূর্তি! এর অর্থ আমিও জানি না৷’

সুন্দরবাবু হতভম্বের মতো বললেন, ‘বাবা এ যে মানুষ গুটিপোকা!’

মানিক শুধোলে, ‘ও মূর্তিটি কার?’

-‘গোবিন্দবাবুর৷’

-‘তার বয়স তো সত্তর বৎসর!’

-‘সুশীলার বয়সও ছিল পঁচাত্তর বৎসর৷’

সকলে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল৷

সুশীলার প্রবেশ৷ সেই সুমধুর কন্ঠে সে বললে, ‘বাবা, ও ঘরে খাবার দেওয়া হয়েছে৷’

মনোহর এতক্ষণ পরে একটু হেসে বললেন, ‘চলুন৷ এই বিজনে বসে আপনারা খাবারের মধ্যে কোনো বিশেষত্ব পাবেন না৷’

সুশীলা বললে, ‘বাড়িতে যা ছিল তাই দিতে পেরেছি৷ স্যান্ডউইচ, শিককাবাব, রুটি-মাখন, চা আর মিষ্টান্ন৷’

মানিক বললে, ‘ললিতা দেবী, চায়ের বৈঠকে যে ভূরি-ভোজনের আসরে পরিণত হল৷ এই বিজন বনে শিককাবাব বানালেন কী দিয়ে! বাঘের মাংস দিয়ে নয় বোধ হয়!’

-‘খেলেই বুঝতে পারবেন৷’

-‘আসুন সুন্দরবাবু৷’

-‘ভায়া, আজ যা দেখলুম আর শুনলুম, আমার পিলে অত্যন্ত চমকে গিয়েছে৷ খাওয়ার চিন্তা মোটেই জাগছে না৷’

-‘আপনার পিলে নির্বোধ নয়৷ একখানা স্যান্ডউইচ উদরসাৎ করলেই সে আবার অত্যন্ত শান্ত হয়ে পড়বে৷ আপনার ধাত জানতে আমার বাকি নেই৷ চলুন, মধুরেণ সমাপয়েৎ করে আসি৷ জয় হিন্দ!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *