ঠাকুরমার গল্প-১
“বহু-বহু বছর আগে ভারতবর্ষের কোনও এক পাহাড়ি অঞ্চলে চিত্রভানু নামে এক রাজা রাজত্ব করত। রাজার জীবনে কোনও কিছুর অভাব ছিল না। তার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, জুম চাষের খেত ভর্তি ফসল, ছ’জন রানি, আঠারোটা ছেলে ছাড়াও আরও কত কী ছিল! তবু রাজার মনে আনন্দ ছিল না একটুও। সারাদিন রাজসভায় বসে রাজকার্য সামলালেও তার মন পড়ে থাকত অন্য কোথাও। গাইয়েরা তাঁকে গান শোনালে তাঁর কানে সুর পৌঁছোত না। জাদুকরেরা তাঁকে খেলা দেখালে তাঁর চোখে বিস্ময় ফুটত না। বিদূষক মজার কিস্সা শোনালেও মুখে জাগত না হাসি৷ শুধু তাঁর মনে হত, ‘আমার যদি একটা মেয়ে থাকত!’
“মন্ত্রী দেখল, এমন চললে তো ভারী বিপদ! রাজকার্য তো লাটে উঠবে!
“মন্ত্রী তাই একদিন রাজপুরোহিতের সঙ্গে এই নিয়ে পরামর্শ করল। পুরোহিত বললেন, ‘এ তো সোজা ব্যাপার। ওই দূরের বরফ পাহাড়ের গুহায় একটি হলদি গাছ আছে, তার প্রধান মূল নিয়ে এসে যদি বড় রানিকে খাওয়ানো হয়, তবেই রাজার মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবে।’
“পরের দিন, কাজের ফাঁকে রাজপুরোহিতের এই কথাটি মন্ত্রী রাজার কানে তুলল।
“সব বিস্তারিতভাবে শুনেই রাজা চিত্রভানু যারপরনাই খুশি হয়ে বলল, ‘আমি এখুনি যাব সেই হলদি গাছের সন্ধানে!’
“যেই কথা সেই কাজ। সেই দিন বিকেলবেলাতেই রাজা একাই রওনা হল উত্তরের সেই বরফ পাহাড়ের উদ্দেশে।
“পথে নানা বিপদ এল। ভয়ংকর পশু আক্রমণ করল রাজাকে! আকাশ থেকে বজ্রপাত হল রাজার সামনে! ঝঞ্ঝায় দশদিক আঁধার হয়ে এল! তবু রাজা চিত্রভানু বিশ্বাস হারাল না। সব বাধা কাটিয়ে সেই গুহায় গিয়ে ঠিক হলদি গাছটা খুঁজে বের করল সে। তারপর সেটাকে উপড়ে তার প্রধান মূল সংগ্রহ করে ফিরে এল রাজধানীতে।
“সেই প্রধান মূল রাজপুরোহিতের নির্দেশমতো খাওয়ানো হল বড় রানিকে। তারপর যথা সময়ে রানির গর্ভে সন্তান এল।
“আর তার ঠিক নয় মাস পরে পৃথিবীতে এল রাজার স্বপ্ন! তার বড় আদরের কন্যা। রাজা চিত্রভানু তার নাম রাখল, রাজিতা।
“ক্রমশ রাজিতা বড় হতে লাগল। রাজা চিত্রভানুর চোখের মণি সে। কেউ তাকে কোনও কথা বলে না। তার হাজার দোষও ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আঠারোজন দাদা সব সময় বোনের সব আবদার মেনে নেয়। মায়েরা তাকে মাথায় করে রাখে। রাজিতার যেন সুখের শেষ নেই!
“কিন্তু না চাইতেই এত কিছু পেয়ে যাওয়ায় রাজিতা ক্রমশ জেদি হয়ে উঠল! কারও কথাই সে গ্রাহ্য করে না। সকলকেই সে অবহেলা করে।
“এর পর রাজিতা যেই ষোলো বছরে পড়ল, ঠিক তখনই একটা ঘটনা ঘটল। রাজার সৈন্যবাহিনীর একজন তরুণ সৈনিক এক ভোরবেলা রাজিতাকে দেখল রাজপ্রাসাদের উদ্যানে খেলা করতে। দেখামাত্র তার প্রেমে পড়ল সেই তরুণ সৈনিকটি।
“তারপর থেকে সে রোজই নানা সময়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকত উদ্যানের গাছ-গাছালির আড়ালে। ভাবত যদি একটু দেখা পায় রাজিতার!
“এমনভাবে বেশ কিছুদিন কাটে। শেষে একদিন আর নিজেকে আটকাতে পারল না সেই তরুণটি! সব দ্বিধা আর ভয় দূরে সরিয়ে রেখে সে এসে দাঁড়াল রাজিতার সামনে।
“সরাসরি বলল, ‘আমি আপনাকে ভালবাসি রাজকুমারী। জানি আমি সামান্য একজন সৈনিক। সামাজিকভাবে আপনার সমকক্ষ নই। কিন্তু আমি যতটা আপনাকে ভালবাসব ততটা কেউ বাসবে না!’
“সেই কথা শোনামাত্রই রাজকুমারী রাজিতা প্রচণ্ড রেগে গেল। কী! সামান্য একজন সৈনিকের এতটা স্পর্ধা! তাকে ভালবাসার কথা বলে! তার সামনে এসে মুখ তুলে দাঁড়ায়!
“রাজিতা সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম করল সেই তরুণ সৈনিকটিকে যেন এখুনি চাবুক মারা হয়।
“রাজকুমারীর নির্দেশ! কে অমান্য করবে? তাই সৈনিকটিকে সেই মুহূর্তেই পাকড়াও করে চাবুক মারা হল।
“সৈনিকটি যখন মার খেয়ে মাটিতে পড়ে আছে, সেই সময় রাজিতা নিজের থেকেই গেল তার কাছে। তারপর অবজ্ঞার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি এখনও ভালবাসো আমায়?’
“সৈনিকটি ক্লান্ত কিন্তু নিশ্চিত স্বরে বলল, ‘আমি সারাজীবন আপনাকেই ভালবাসব রাজকুমারী, এ জীবন কারও জন্য নয়!’
“এতে রাজিতা আরও রেগে গেল! সে সান্ত্রিদের নির্দেশ দিল, ‘একে সাতদিন অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে রাখো। কোনও খাবার দেবে না। এমনকী, জলও দেবে না।’
“সৈনিকটিকে সঙ্গে-সঙ্গে অন্ধকার কয়েদখানায় ছুড়ে ফেলা হল।
“রাজা চিত্রভানু খুব কড়া হলেও উদার মনের মানুষ ছিলেন। তিনি রাজিতাকে বোঝালেন যে, ভালবাসা তো অন্যায় কিছু নয়। আর তা সব সময় সামাজিক নিয়ম মেনেও হয় না। তাই সৈনিক যুবকটিকে এমন শাস্তি দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। রাজিতার তাকে পছন্দ না হলে সেটা ভালভাবে জানিয়ে দেওয়াটাই প্রকৃত মানুষের মতো কাজ।
“কিন্তু রাজিতা কারও কথাতেই কর্ণপাত করার মেয়ে নয়। রাজার কথাতেও করল না। সাতদিন পরে সৈনিকটিকে অর্ধমৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হল রাজিতার সামনে।
“রাজিতা আবার তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি এখনও আমায় ভালবাসো?’
“সৈনিকটি ক্ষীণ কিন্তু আত্মবিশ্বাসী গলায় আবারও বলল, ‘আমি আজীবন শুধু আপনাকেই ভালবাসব।’
“রাজিতা শুনে থমথমে মুখে তাকিয়ে রইল সৈনিকটির দিকে। রাজা, তাঁর ছয় রানি, আঠারোজন দাদা সকলে প্রমাদ গুনল মনে-মনে। না জানি রাজিতা এবার কী করবে!
“রাজিতা সময় নিল কিছুটা। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। আমিও রাজি। তবে একটা শর্ত আছে! আমার ঘরের সামনে যে বাগানটা রয়েছে, তোমায় সেখানে হাঁটু গেড়ে ছ’মাস বসে থাকতে হবে। উঠলে চলবে না। ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। ঝড়, জল, তুষারপাত যাই হোক কোনওমতেই শর্ত ভঙ্গ করা যাবে না। ছ’মাস তুমি যদি এই অবস্থায় কাটাতে পারো, যদি এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারো, তবে আমি কথা দিচ্ছি, তোমায় বিয়ে করব।’
“সৈনিকটি বলল, ‘আমি রাজি।’
“এমন একটা খবর তো আর চাপা থাকে না। রাজ্যসুদ্ধু রটে গেল যে, রাজকুমারী রাজিতা সৈনিককে শর্ত দিয়েছে! সকলে ধীরে-ধীরে জড়ো হতে লাগল উদ্যানে আর প্রত্যক্ষ করল সেই অদ্ভুত প্রেমের পরীক্ষা!
“তরুণ সৈনিকটি ঈশ্বরকে প্রণাম করে রাজকুমারীর ঘরের সামনের সেই উদ্যানে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
“দিন জড়ো হয়ে সপ্তাহ হল। সপ্তাহ বদলে গেল মাসে৷ সৈনিকটি বসেই রইল। ক্রমশ শরৎ কেটে হেমন্ত এল। তারপর হেমন্তকে ছিঁড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল শীতের দৈত্য! চারিদিক তুষারপাতে সাদা হয়ে গেল। রাজিতা হঠাৎ একদিন তার নিজের ঘরের ভিতর থেকে পরদা সরিয়ে দেখল এখনও হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে সেই সৈনিক! তার সারা শরীর তুষার ঢাকা। সে যেন বরফের তৈরি মূর্তি এক। আচমকাই রাজিতার মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুকের ভিতর কেমন যেন কষ্টের ছোট-ছোট ফুল ফুটতে শুরু করল। নিজের ঘরের উষ্ণ আরামের ভিতরে শুয়েও সে রাতে ঘুম এল না ওর। শুধু মাঝে-মাঝেই ও উঠে গিয়ে পরদা সরিয়ে দেখতে লাগল সেই বরফ-মোড়া তরুণ সৈনিকটিকে! এমনও কেউ পারে!
“রাজিতা বুঝল ওর মনের পরিবর্তন হয়েছে। আর সৈনিকটির কষ্ট সহ্য করতে পারছে না ও। আর ও চায় না সৈনিকটিকে কষ্ট দিতে। কিন্তু অহং বাধা হয়ে দাঁড়াল এখানে৷ রাজিতা গুনে দেখল আর তো সাতটা দিন মাত্র বাকি। তারপর যখন সৈনিকটি পরীক্ষায় পাশ করবে, তখন রাজিতা গিয়ে ওকে নিজের আলিঙ্গনের উষ্ণতা দেবে। রাজার মেয়ে ও! একবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কথা তো আর এখন ফেরাতে পারে না! লোকে কী বলবে?
“তারপর ক্রমশ একটা করে দিন কাটতে শুরু করল। রাজিতাও যেন আর ধৈর্য ধরতে পারছে না। ও নিজেও যেন সেই পরীক্ষা দিচ্ছে এখন। এই ছয় মাসে ওর মনের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন রাজিতাও ভালবেসে ফেলেছে সেই সৈনিকটিকে।
“নির্দিষ্ট দিনের আগের দিন, রাজ্যের লোক আবারও ভিড় করতে শুরু করল সেই উদ্যানে। রাজা, ছয় রানি এবং সমস্ত রাজপুত্ররাও এসে দাঁড়াল নিজেদের প্রাসাদের বারান্দায়। রাজিতা, নিজের প্রাসাদ থেকে নেমে এসে দাঁড়াল সেই উদ্যানের মাঝে।
“ঘড়ির কাঁটা ক্রমশ এগোতে লাগল নির্দিষ্ট সময়ের দিকে। সকলে উৎকণ্ঠার সঙ্গে রাজমিনারের প্রধান ঘড়িটির দিকে তাকাতে লাগল। আর এক ঘণ্টা! আর আধ ঘণ্টা! আর কুড়ি মিনিট! রাজিতা নিজেও অস্থির হয়ে উঠল এবার। কিন্তু কাউকে সেটা ও বুঝতে দিল না! শুধু অপলক চোখে তাকিয়ে রইল তরুণ সৈনিকটির দিকে।
“তারপর যখন ছ’মাস হতে ঠিক দশ মিনিট বাকি তখন হঠাৎই চোখ খুলল সেই সৈনিক। তারপর সকলকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল!
“ভিড় করে দাঁড়ানো রাজ্যের প্রজারা হায়-হায় করে উঠল। আর তো মোটে দশটা মিনিট ছিল ছ’মাস পূর্ণ হতে! যুবকটি কি সেটা বুঝতে ভুল করল! নানা দিক থেকে লোকজন চিৎকার করে তাকে বলতে লাগল, ‘আর দশ মিনিট বাকি! মোটে দশটা মিনিট বাকি! তুমি এত মাস বসে রইল পাথরের মূর্তির মতো আর দশটা মিনিট বসবে না!’
“রাজিতা নিজেও স্থির হয়ে গিয়েছে। বুকের ভিতরে ওর আশঙ্কা আর বিস্ময়ের দোলাচল! কী করছে সৈনিকটি! এত কাছে এসেও এমন কেন করছে ও? ছ’মাস অমানুষিক কষ্ট সহ্য করেও এখন কেন ও নিজেকে এমন করে সরিয়ে নিচ্ছে পরীক্ষা থেকে! কেন ইচ্ছে করে অকৃতকার্য হচ্ছে?
“সৈনিক উঠে দাঁড়িয়ে সটান চোখে-চোখ রাখল রাজিতার! এক অদ্ভুত মেঘ-আলোর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত! তারপর আর কাউকে কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল!”
ঠাকুরমা কথা থামিয়ে পানের বাটা টেনে নিল কোলে। রাজিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বলল “ঠাকুরমা, এটা কী হল? এ কেমন গল্প!”
“কেন?” ঠাকুরমা পান সেজে মুখে দিয়ে বলল, “কেমন আবার! যেমন গল্প তেমনই বললাম।”
রাজিতা বলল, “আমার নামে রাজকুমারীর নাম!”
ঠাকুরমা হেসে বলল, “বাঃ এমনও তো হতে পারে যে, ওই রাজকুমারীর নামে তোর নাম!”
রাজিতা ভুরু কুঁচকে বলল, “তা না হয় হল, কিন্তু গল্পের শেষে কী হল? সৈনিকটার নাম কী? সে কেন উঠে চলে গেল? আর রাজকুমারী? সেও এমন কেন? গল্পের এমন শেষ হয় নাকি?”
ঠাকুরমা বলল, “এমন শেষ মানে!”
রাজিতা বলল, “এর পর কী হবে বললে না তো?”
ঠাকুরমা সময় নিল একটু। জড়ো করা পা দুটো টান করে বলল, “এর পর কী হবে আমি জানি না।”
“জানো না মানে!” রাজিতার রাগ হল। এ আবার কেমন ধারার গল্প!
ঠাকুরমা ক্লান্ত মুখটা তুলে তাকাল রাজিতার দিকে। তারপর বলল, “সব শেষটা তো বলা থাকে না দিদিভাই! নিজের মতো করে শেষটাকে খুঁজে নিতে হয় আমাদের! কে, কেন, কী করে, জীবনে সব উত্তর কি একবারে পাওয়া যায়! তোকে তোর মতো করে এই গল্পের উত্তর খুঁজে নিতে হবে। বুঝলি?”
এক
রাজিতা
আলো অন্ধকারে মেশানো একটা সকাল আজ। ভেজা হাওয়ায় কেমন যেন মন খারাপ করা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে! চোয়াল শক্ত করে দৌড়োনো এই শহরের চোখেও আজ যেন আনমনাভাব। একলা চড়াই হয়ে সকলে যেন বসে আছে নির্জন বারান্দায় আর আমায় বলছে, ও নেই! বলছে, এ জীবনের মতো ও চলে গিয়েছে আমায় ছেড়ে!
আমি ওড়না দিয়ে মুখটা মুছলাম। মেঘ করে থাকায় সারা কলকাতা জুড়ে আজ কেমন একটা কম্বলচাপা গরম। ছোট গলিটা থেকে বড় রাস্তায় বেরিয়ে দাঁড়ালাম একটু। মনখারাপের মাঝেও হঠাৎ হাসি পেল! কোন দিন ও আমার ছিল? জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তো ওকে দেখছি! কিন্তু তাও কোনও দিনও কি আমার ছিল ও?
আমি রাস্তার দিকে তাকালাম। সকাল ন’টার কলেজ স্ট্রিট মোড় যেন গিঁট লাগা সুতো!
আমি দেখেশুনে রাস্তা পার হলাম। তারপর সোজা আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে থাকলাম। দোকানপত্তর খোলেনি। তাই ফুটপাথে পা রাখা যাচ্ছে এখনও।
আমার বাড়ি বেনিয়াটোলা লেনের ভিতরের এক গলিতে! বাড়িটা পুরনো! বয়স দুশো বছরের বেশি। প্লাস্টার খসে গিয়েছে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই। শুধু পাতলা ইট আর চুন-সুরকির গাঁথনি দেখা যায় এখন। কেমন যেন সাতের দশকের বাংলা আর্টফিল্মের মতো লাগে বাড়িটাকে! তবে বাড়িটার একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। তিনতলা থেকে একটা লোহার ব্রিজ চলে গিয়েছে রাস্তার ওপাশের আরও-একটা বাড়িতে। মাটিতে দাঁড়ালে অদ্ভুত দেখতে লাগে। দুটো বাড়িকে যুক্ত রেখেছে একটা ব্রিজ! পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ব্রিজ কি এটাই?
ব্রিজের অন্য মাথার বাড়িটা আমাদেরই এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের। মানে আমার বৃদ্ধ প্রপিতামহের জেঠতুতো দাদাদের। সহজ করে এই সম্পর্ককে কী বলে আমি জানি না।
আমার আর ভাইয়ের ঘর তিনতলায়। আমার ঘরের সামনের ছোট্ট ঝুলবারান্দাটা থেকেই ওই ব্রিজটা শুরু হয়েছে।
ওই ব্রিজটাকে প্রায় সকলে সাঁকো বলে। তবে প্রায়! সকলে নয়। কারণ আমি শুধু সাঁকো বলি না। বলি দোয়েল-সাঁকো!
আগে সাঁকোটা ভাল ছিল। কিন্তু ভাগের মা তো, তাই গঙ্গাটা জোটেনি। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি একটুও। এখন সাঁকোর মেঝেটা জায়গায়-জায়গায় কেমন যেন ভেঙে গিয়েছে। শুধু সাপোর্ট রাখা বড় লোহার বিম দুটো দেখা যায়। আমরা কেউ আর ওতে পা দিই না। ভয় লাগে, শরীরের ভারে যদি মড়মড় করে ভেঙে পড়ে!
বড় রাস্তা থেকে কোনা করে ঢুকে গিয়েছে বেনিয়াটোলা লেন। সেখান দিয়ে কিছুটা এগিয়ে ডান দিকের গলিটায় আমাদের বাড়ি। রোদ উঠলেও এই গলিটা ছায়া-ছায়া হয়ে থাকে সবসময়। আর আজ আবার এমন মেঘলা। তাই এই মধ্য অগস্টে কেমন যেন সাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে রাস্তাটা।
আমার আজ একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। আসলে সপ্তাহে তিনদিন হাবিবুরদার বাড়িতে আমি পড়াতে যাই। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে আটটা। দু’ঘণ্টা। ইংলিশ আর ইতিহাস পড়াই হাবিবুরদার ভাই লিটনকে।
লিটন এবার মাধ্যমিক দেবে। ওর স্কুল সাড়ে ন’টা থেকে। তাই ওকে সপ্তাহে তিনদিন এমন ভোরবেলা পড়াতে যেতে হয়।
আজ আমার সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছিল একটু। তাই সাড়ে ছ’টার জায়গায় পৌনে সাতটা হয়ে গিয়েছে লিটনকে পড়াতে যেতে। ফলে বেরোতেও দেরি হয়েছে।
না, আমার তেমন কোনও রাজকার্য নেই। আসলে বাবা কারখানায় যাওয়ার জন্য বেরোয় সাড়ে ন’টা নাগাদ। যাওয়ার আগে আমায় একবার দেখতে চায়। বাবা লিলুয়ার কাছে একটা পেপার মিলে চাকরি করে, ফোরম্যান। সকাল সাড়ে নটায় বেরিয়ে ফিরতে-ফিরতে সন্ধে সাড়ে সাতটা হয়ে যায়। বাবাকে দেখলেই বোঝা যায় খুব খাটনি যায় মানুষটার। সন্ধেবেলা যখন ফেরে মুখ শুকিয়ে যায়। মনে হয়, কে যেন সমস্ত প্রাণটাই শুষে বের করে নিয়েছে!
আমাদের বাড়িটা বেশ কিছু শরিকে ভাগ করা আছে। আমাদের দিকে আমরা আর জেঠুরা থাকি। বাবারা তিন ভাই। জেঠু বড় আর বাবা মেজ৷ ছোট ভাই মানে তরুণ কাকা গত দু’বছর আগে লাং ক্যানসারে মারা গিয়েছেন। তরুণ কাকা বিয়ে করেনি। ফলে বাবা আর জেঠু দু’জনের ভাগে পড়েছে বাড়ির এই পূর্ব দিকটা। অন্য পাশে বাবার খুড়তুতো ভাইরা থাকে। তারা আমাদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না। না, কোনও ঝগড়াঝাঁটি নেই। কিন্তু তাও আমরা দু’পক্ষই দু’পক্ষকে এড়িয়ে যাই।
আমার মা বাড়িতেই থাকে। ছা-পোষা গৃহবধূ যাকে বলে। কোনওদিনও চাকরি-বাকরি করেনি। সেই যে উনিশ বছর বয়সে এই বাড়ির বউ হয়ে ঢুকেছিল এখনও তেমনই রয়ে গিয়েছে। বাবা, আমি আর ভাই-ই মায়ের বিশ্বসংসার।
মায়ের শরীরটা ভাল যায় না। ডায়বেটিস, হাঁটুর ব্যথা, হার্টের অসুখ সব আছে। মাসে হাজারদু’য়েক টাকার ওষুধ লাগে। আমাদের সংসারের পক্ষে সেটা অনেক ভারী! বাবা পায় হাজার পনেরো টাকা। আমি টিউশন করে মোট পাই সাড়ে চার হাজার। সেখান থেকে তিন দিয়ে দিই বাড়িতে। দেড় রাখি হাতখরচ হিসেবে।
আমি জানি আমার বন্ধুরা যেমন জীবনযাপন করে, আমার জীবন তেমন নয়। ছোট থেকেই জেনে এসেছি টানাটানির সংসার। শিখেছি কী করে টিপে-টিপে ইচ্ছেগুলোকে মেরে ফেলতে হয়। বছরে একবার বিরিয়ানি খেয়ে খুশি থেকেছি। সকলে যখন পাঁচ-ছ’জন টিচারের কাছে টিউশন নিয়েছে, আমি তখন একজনের কাছে পড়ে বাকিটা এর ওর থেকে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ‘মাসের শেষ’ নামে একটা সময় মাসের প্রথম থেকেই আমাদের তাড়া করে এসেছে!
তাই ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে পড়া শেষ করেই আমি চাকরির জন্য চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলাম। মাস্টার ডিগ্রি করিনি। অবশ্য সত্যি কথা বলতে কী রেজ়াল্টও ভাল হয়নি খুব একটা। তাই সুযোগও পাইনি শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।
বাবার কষ্ট হয়েছিল খুব। বাবা চেয়েছিল আমি এমএসসি-টা করি। কলকাতায় না থেকে বাইরের কোনও জায়গা থেকেও যদি করতে পারি! কিন্তু আমিই বাধা দিয়েছি। আরও একটা জায়গায় গিয়ে থাকা মানে আরও একটা বাড়তি সংসার। পড়ার খরচ তো আছেই। সঙ্গে থাকা-খাওয়ার খরচ! আমি জানি সেটা আমাদের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়।
আর আমি একটা চাকরি পেয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু কপালে টেকেনি! চিট ফান্ডের কেলেংকারিতে পড়ে আমাদের কোম্পানিটা উঠে গিয়েছে। তারপর থেকে আমি বেকার। অনেক জায়গায় আমি রেজ়িউমে দিয়ে রেখেছি, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। পাশাপাশি গানের জগতেও চেষ্টা করছি। কিন্তু সেখানেও কিছু হচ্ছে না।
ক্লাস টু থেকে গান শিখি আমি। পাড়ার জলসা থেকে দূরদর্শন সব জায়গাতেই গান করেছি। কিন্তু সেটুকুই। কতদিন ধরে চেষ্টা করছি একটা সিডি বের করার। কিন্তু কেউ সুযোগই দিচ্ছে না!
আচ্ছা, সব কিছুই খুব ‘না’, ‘না’ শোনাচ্ছে, তাই না? আসলে কী করব? একটা নেগেটিভলি বায়াস্ড জীবনে আটকে আছি যেন আমি। যেন কিট্সের পসথুমাস এগজ়িসটেন্স-এ আমাদের দিন আর রাত্রিগুলো সব মুড়ে আছে।
আমাদের দুশো বছরের পুরনো বাড়ি, আমাদের সপ্তাহে দু’দিন ছোট মাছের ঝোল, বিছানায় শুয়ে দেখা কড়িবরগার পাশে বেরিয়ে পড়া বাড়ির লোহার পাঁজর আর শেষ রাতের আচমকা হাওয়ায় ভেসে আসা ছাতিম ফুলের গন্ধ কেমন যেন এলোমেলো করে দেয় আমায়! মনে হয় বাড়ির দেওয়ালগুলো যেন চারিদিক থেকে চেপে ধরছে। যেন টুথপেস্টের টিউবের মতো আমার পেট টিপে বের করতে চাইছে, ভাল চাকরি, অনেক রোজগার, সাফল্য আর সুন্দর একটা ভবিষ্যতের রোড ম্যাপ। এই চব্বিশ বছর বয়সেই মনে হয় বছর চল্লিশের একটা পৃথিবী ঢুকে পড়েছে আমার মধ্যে!
বাড়ির সামনে এসে মোবাইলটা দেখলাম। এটা নতুন। জেঠু কিনে দিয়েছে। সাড়ে সাত হাজার টাকা দাম। আমার কাছে অনেক! খুব ভয় লাগে ব্যবহার করতে। একবার যদি হারিয়ে ফেলি তবে তো আর কিনতে পারব না!
আরে ফোন এসেছিল একটা! শুনতে পাইনি। আসলে পড়াতে বসলে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রাখি। পড়ানো হয়ে গেলে আবার রিঙ্গারটা অন করে দিই। কিন্তু আজ সবটাই যেন কেমন গুলিয়ে গিয়েছে। হবেই! কারণ, গতকাল তো ও চলে গিয়েছে। আর আমার মন বলছে সারা জীবনের মতোই ও সরে গিয়েছে আমার থেকে।
মিসকলটা দেখে আবার এই কথাটা মনে পড়ল। কাকিমা ফোন করেছিল। কেন করেছিল জানি না। আমি ভাবলাম কল করি। তারপরেই মনে পড়ল আমার মোবাইলে ব্যালেন্স নেই তেমন। আর কাউকে মিসকল দিতে আমার খারাপ লাগে। জানি কাকিমা এসবে কিছু মনে করবে না। কিন্তু কেউ কিছু মনে করবে না বলেই তো আর আমি তার অন্যায্য সুযোগ নিতে পারি না!
নকশা করা মোটা কাঠের সদর দরজাটা ঠেলে আমি বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। আমাদের একতলায় সিঁড়ির এক পাশে শ্যাওলা ধরে গিয়েছে। আমি সাবধানে পা ফেলে তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম জেঠিমা বারান্দায় বসে তরকারি কাটছে। আমায় দেখে জেঠিমা গলা তুলে বলল, “তুই কি আজ বেরোবি রাজি?”
আমি দাঁড়ালাম। বললাম, “হ্যাঁ, একবার পার্ক স্ট্রিট যাব। কেন গো?”
জেঠিমা বলল, “আমায় একটা শেকড় এনে দিবি? জ্যোতিষ ভটচাজ বলেছেন পরতে। শ্বেত বেড়েলার মূল পরলে নাকি হাঁটুর ব্যথা কমবে।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই হয়েছে জেঠিমার এক সমস্যা! সারাদিন জ্যোতিষ-টোতিষ হাবিজাবি নিয়ে পড়ে আছে। আমি জানি, বলে কোনও লাভ হবে না। তাই বলি না। কারণ, জেঠিমা কারও কথা শোনার পাত্রী নয়। উলটে আমাদের সকলকে জেঠিমার কথা শুনতে হয়!
বললাম, “এনে দেব।”
জেঠিমা বলল, “দুটো আনবি। একটা আমার আর-একটা মিঠির।”
“মা পরবে!” আমি অবাক হলাম। মা আবার এসব কবে থেকে ধরল?
“কেন পরবে না?” জেঠিমা ভুরু কোঁচকাল, “তোর মায়ের হাঁটুর কী অবস্থা জানিস? কত কষ্ট পায় দেখিস না? তবে?”
আমি বললাম, “সে তো কার্টিলেজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শেকড় পরলে সেটা গজাবে নাকি আবার?”
“তোকে যা বললাম শোন। এনে দিবি শেকড়। দুটো দশ টাকা নেবে। আমার থেকে নিয়ে যাবি। কোনও তর্ক করবি না। বুঝেছিস?”
আমি হাসলাম। জেঠিমা এমনই। কখনও পালটা কথা শুনতে চায় না। বেঁচে থাকার জন্য, জেঠিমার নিজস্ব কিছু যুক্তি আর পদ্ধতি আছে। কেউ তাকে সেখান থেকে সরাতে পারে না। যা ভাববে তা করবেই!
জেঠিমা বলল, “তুই এখনও হাসছিস কেন? আমি কি ভুল বললাম?”
আমি বললাম, “কিছুই ভুল বললানি। আসলে তোমার কনভিকশন দেখে হেসে ফেলছি!”
“কী?” জেঠিমা বলল, “খুব ইংরেজি শিখেছিস, না? যা বললাম শুনবি।”
জেঠিমা আবার তরকারি কাটায় মন দিল।
জেঠু পুলিশ ছিল। এখন রিটায়ার করেছে। তাও রোজ সকাল-সকাল বেরিয়ে যায়। আসলে নিজেই একটা বেডিং-এর ব্যাবসা শুরু করেছে বি.বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। জেঠু-জেঠিমার এক মেয়ে। জুনিদিদি। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন নাসিকে থাকে।
আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। নীচের তলার গোটাটা আর দোতলার অর্ধেক জেঠুদের। আর দোতলার বাকি অর্ধেকের সঙ্গে তিনতলাটা আমাদের। বাবা-মা থাকে দোতলায়। আমি আর ভাই তিনতলায়।
দোতলার রান্নাঘর থেকে শব্দ শুনে বুঝলাম মা কাজ করছে। স্বাভাবিক। বাবার কারখানা যাওয়ার সময় হল। বাবা ভাত খাবে তো।
আমি বাবার ঘরে গিয়ে উঁকি দিলাম। বাবা স্নান সেরে জামাকাপড় পরে তৈরি। বিছানায় বসে খবরের কাগজ দেখছিল। আমায় দেখে মুখ তুলে তাকাল, “আরে তুই এসেছিস! বউদি ফোন করেছিল। তোকে পায়নি ফোনে। রিং হয়ে যাচ্ছিল, তুলিসনি নাকি?”
আমি ঘরে ঢুকে ফ্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “সাইলেন্ট ছিল শুনতে পাইনি। কী হয়েছে?”
“কাল তো রিয়ান রাতে চলে গেল। তাই পুজো দিতে আসবে ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে। মানত ছিল বউদির। তোকে নিয়ে যেতে চায়।”
“আমায় নিয়ে!” অবাক লাগল আমার। গতকালও তো বিকেল অবধি ছিলাম ওখানে। কিছু তো বলেনি কাকিমা। অবশ্য আমিই বা শোনার মতো অবস্থায় ছিলাম কই!
“তাই তো বলল আমায়। বলল তুই যেন হুট করে বেরিয়ে না যাস,” বাবা হাসল, “আর শোন না, তোর নাকি টাকার দরকার! কী ব্যাঙ্কিং পরীক্ষার ফর্ম ফিল-আপ করবি শুনলাম।”
আমি অবাক হলাম। আমি তো মা-বাবাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি। তবে কে বলল?
বাবা যেন বুঝতে পারল। বলল, “জুড়ো বলল সকালে। ওই টেব্লের ড্রয়ারটা খোল। ওতে যে ব্রাউন খামটা রয়েছে তার থেকে দরকার মতো টাকা নিয়ে নে।”
জুডো আমার ভাই। খুব পেটপাতলা।
আমি ঠোঁট টিপে তাকালাম বাবার দিকে। মাসের বারো তারিখ আজ। এখনই চারশো টাকা বের করে নিলে মাসের শেষে মুশকিল হবে।
বাবা আবারও বুঝতে পারল, হেসে বলল, “আরে গত মাসে বেশ কিছু ওভারটাইম হয়েছে। তুই ভাবিস না। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে এই এক মুশকিল, বাবা-মায়ের সব কথাতেই প্রশ্ন করতে শুরু করে! যা বলছি শোন। নে।”
আমি হেসে বললাম, “ঠিক আছে, পরে নেব।”
“কী পরে নিবি?” পিছন থেকে মায়ের গলার স্বর পেলাম।
দেখলাম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছছে মা। চোখে জিজ্ঞাসা।
বাবা বলল, “ওই ফর্মের টাকা।”
মা কী বুঝল কে জানে! তবে আর কথা বাড়াল। বলল, “তুমি খেতে এসো। ভাত দিয়ে দিয়েছি।”
বাবা বলল, “তুমি যাও আমি আসছি।”
মা বেরিয়ে গেল আবার।
বাবা খবরের কাগজটা রোল করল। তারপর বিছানা থেকে উঠে এসে দাঁড়াল আমার সামনে। কাগজ দিয়ে আলতো করে আমার মাথায় মেরে বলল, “মনখারাপ?”
“কেন?” আমি অবাক হলাম।
বাবা হাসল, “তুই জানিস না?”
আম দীর্ঘশ্বাসটা দ্রুত গুমখুন করে দিলাম। তারপর পালটা হেসে বললাম, “না তো!”
বাবা তাকাল আমার দিকে। তারপর বলল, “কিছুই কিছু নয়, বুঝলি! সবাই মায়া-খনিজ! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়িস তো! এটা জানিস না?”
আমি বললাম, “ওপরে যাই, একটু ফ্রেশ হয়ে নিই, কাকিমা এলে হইচই শুরু করে দেবে। তখন সময় পাব না।”
বাবা বলল, “আয়। টাকাটা নিয়ে নিস। আর শোন, যে-ব্যাপারে আমাদের হাত নেই সেই ব্যাপারে মনখারাপ করে লাভ হয় না। জানি তোর বয়স কম। এসব এখন মানতে পারবি না। কিন্তু চেষ্টা কর। একসময় ঠিক পারবি! একদিনে কেউ পারে না।”
তিনতলায় আমার ঘরে এসে কাঁধের ব্যাগটাকে রাখলাম টেব্লে। তারপর বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এখানে, কোনায় একটা ছোট বেসিন রাখা আছে। মুখ ধুয়ে দড়িতে টাঙানো গামছায় মুখটা মুছে তাকালাম পাশের বাড়ির দিকে। সাঁকোর ওই দিকে বারান্দায় একটা কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছে ঠাকুরমা। পাশের অন্য একটা বাড়ির কার্নিশে এসে বসা সার-সার পায়রার দিকে চোখ।
ঠাকুরমাকে দেখলেই ভাল লাগে আমার। এককালে খুব সুন্দরী ছিল বোঝা যায়। এখনও তার টুকরো-টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে উপস্থিতিতে। একটা ঢিলে নাইটি পরে বসে রয়েছে ঠাকুরমা। মাথায় ছোট করে কাটা সাদা চুল! প্রায় চুরাশি বছর বয়স, তাও এখনও নিজেই টুকটুক করে সব কাজ করে। ছোটবেলায় কত গল্প শুনেছি ঠাকুরমার কাছে! এখনও কিছু-কিছু মনে আছে।
আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলেও ঠাকুরমার সঙ্গে আমার ছোট থেকেই খুব ভাব। এখনও যাই মাঝে-মাঝে। কুকি বলে একটা মেয়ে আছে ঠাকুমার সব কাজ করে দেওয়ার জন্য। তেমন দরকার পড়লে কুকিকে দিয়ে ঠাকুরমা আমায় ডেকে পাঠায়।
আমি দেখলাম ঠাকুরমা খুব মন দিয়ে পায়রাদের দেখছে। আমি জানি ঠাকুরমা কানে কম শোনে। তাই এখান থেকে ডেকে লাভ হবে না।
“কী রে? রেডি হোসনি?”
আচমকা পিছন থেকে গলাটা শুনলাম। সামান্য চমকে উঠলাম। ঘুরে দেখলাম কাকিমা!
“তুমি!”
“কেন রজত বলেনি আমি আসব?”
“হ্যাঁ, বাবা বলেছিল তো,” আমি হাসলাম, “আসলে পড়িয়ে এই ফিরলাম। ভেবেছিলাম তোমার আসতে আরও একটু সময় লাগবে।”
কাকিমা বলল, “আমি ট্যাক্সিতে আসতে-আসতেই ফোন করে দিয়েছিলাম। তা জুডো কই রে?”
আমি হাসলাম, “ও ঘুমোচ্ছে! জানোই তো সারারাত জাগে!”
আমার পাশের ঘরে ভাই থাকে। ঘরের দরজা বন্ধ।
কাকিমা হাঁপিয়ে গিয়েছে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বলল, “তোদের এই তিনতলাটা এখনকার বাড়ির পাঁচতলার সমান। উঠতে গেলে চারটে ফুসফুস লাগে!”
আমি বললাম, “তুমি আমার ঘরে বসো। আমি চেঞ্জ করে নিই।”
“না, চেঞ্জ করলে হবে না,” কাকিমা বলল, “স্নান করে আয়। পুজো দিতে যাব। এভাবে হয়? আর এই শাড়িটা পরে নে। নতুন। তোর জন্যই কিনেছি।”
“শাড়ি!” আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।
কাকিমা বলল, “নতুন শাড়ি পরেই পুজো দিতে যেতে হয়। আমি ফল্স পিকো সব করিয়ে রেখেছি।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।
কাকিমা ধমক দিল, “কী হল? নে।”
আমি যন্ত্রের মতো শাড়িটা নিলাম। কাকিমা কিছু বললে ‘না’ করার মতো সাহস আমার নেই।
“যা স্নানটা সেরে আয়। এমনিতে দেরি হয়ে গিয়েছে।”
আমি পিছন ঘুরলাম যাব বলে। কিন্তু তখনই কাকিমা ডাকল আবার, “শোন।”
আমি তাকালাম, “কী?”
“এইটে তুই ফেলে এসেছিলি গতকাল,” কাকিমা হাত বাড়িয়ে একটা ছোট বই দিল।
আমার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠল। এটা গতকাল রিয়ানকে দিয়েছিলাম আমি। উপহার। পার্টিং গিফ্ট। অক্সফোর্ডের মিনি ডিক্শনারি। ছোট থেকেই ও সব সময় এই মিনি ডিক্শনারিটা নিয়ে ঘোরে। হারিয়ে ফেলেছিল নিজেরটা। তাই চলে যাওয়ার আগে ওকে এটা কিনে দিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমার একটা টুকরো অন্তত সারাক্ষণ থাকবে ওর সঙ্গে! আর ও এটা নিয়েই যায়নি! আচ্ছা, ওই ব্যাপারটার জন্য কি?
“কী হল? ধর।”
আমি নিলাম ছোট্ট বইটা। আর ঠিক তখনই ওই পাশের বাড়ির কার্নিশে বসা সার-সার পায়রাগুলো ডেকে উঠল একসঙ্গে। হাওয়ার ভিতর মনখারাপের গন্ধটা ফিরে এল আচমকাই। আলো ও অন্ধকার ঠাসাঠাসি করে ঢুকে পড়ল সকালবেলার মধ্যে। আর আবার সকলে যেন একসঙ্গে বলে উঠল, ও নেই। বলে উঠল, সারাজীবনের মতো ও আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে!
দুই
রিয়ান
ইমিগ্রেশন পার করে প্রথম বিদেশের মাটিতে পা দিয়েই হাত-ঘড়িতে চোখ রাখলাম আমি। সকাল দশটা কুড়ি বাজে। সময়টা জানা খুব দরকার আমার। কারণ এই দিন আর এই সময়টা আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। আজ থেকে আমার বেঁচে থাকার একটা নতুন পথ খুলে গেল।
আমি ভাল করে চারিদিকে তাকালাম। ঝকঝক করছে সবটা। কত রকমের মানুষ হাঁটছে, দৌড়োচ্ছে। কিন্তু তার ভিতরেও কোথাও কোনও হামলে পড়া ব্যাপার নেই। অন্যকে গুঁতো মেরে এগোনোর চেষ্টা নেই! আমি এদিক-ওদিক খুঁজলাম। সামুদার আসার কথা। কিন্তু কোথাও তার টিকির দেখা পেলাম না। এবার তবে কী হবে?
নিমেষের মধ্যে আমার মুগ্ধতা নার্ভাসনেসে বদলে গেল। হাতের বড় দুটো সুটকেস টানতে-টানতে আমি একটা বসার জায়গার সামনে দাঁড়ালাম। সামুদার মনে আছে তো যে আমি আসছি!
গতকালও তো দুবাই থেকে ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। সামুদাও বলেছিল দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবে এয়ারপোর্টে। তবে? কোথায় সামুদা? ভুলে গেল নাকি! আমি তা হলে যাব কী করে? সামুদাই বলেছিল আমার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করে রেখেছে। নিজেই নিয়ে যাবে। তার কোনও ঠিকানাও আমাকে দেয়নি। চাইলে বলেছিল, “মারব শালা কানের গোড়ায়। আমি বলছি বিশ্বাস হচ্ছে না, না?”
আসলে সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না। কারণ সামুদার খুব ভুলো মন!
সামুদা মানে স্ম্যয়ন চক্রবর্তীকে আমি চিনি ছোটবেলা থেকে। ভবানীপুরে চলে যাওয়ার আগে মুদিয়ালির কাছে রজনী সেন রোডে থাকতাম আমরা। সামুদারা থাকত আমাদের দুটো বাড়ি পরে। আমার থেকে প্রায় দশ বছরের বড় সামুদা। কিন্তু মেশে বন্ধুর মতো। সামুদা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ভাল ফুটবল খেলত। হলিউডের ছবি বলতে পাগল। আমার ছোটবেলার আইডল!
সামুদাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। বিশাল বড় পরিবার। সামুদার ভাষায় রাবণের গুষ্টি!
সামুদা বলত, “শালা এই এত বড় ফ্যামিলিতে জন্মানোর যে কী জ্বালা! তিনটে পায়খানা। তাও সব সময় তিনটেই অকুপায়েড। পটি চাপলে রীতিমতো ধূপকাঠি বিক্রি করার মতো করে পায়খানার ভিতরের জনকে কনভিন্স করতে হয়। তারও উপর খাবার জায়গায় চান্স পাওয়া! যেদিন প্রথম সুযোগ পাব সেদিনই কেটে পড়ব আমেরিকা। আরে সালমা হায়েক, ড্রিউ ব্যারিমোর সব ওয়েট করছে আমার জন্য! এই দেশে আমার মতো প্রতিভার কোনও দাম নেই, বুঝলি!”
সেই সামুদা এখন ডালাসে থাকে। গত ছ’বছর আছে। তাই এখানে পড়তে আসার সময় প্রথমেই সামুদার কথা মনে পড়েছিল।
এসএমইউ, মানে সাউদার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসছি শুনে সামুদাও খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, “চলে আয় তাড়াতাড়ি। কোনও অসুবিধে হবে না। ব্যাপক লাগবে দেখবি আর আমি তো আছি।”
সামুদা আছে, এই ডালাসেরই কোথাও আছে সামুদা। কিন্তু কোথায়? সেটাই প্রশ্ন!
ঘড়ির কাঁটা প্রায় এগারোটা ছুঁতে যাবে। আমার এবার রীতিমতো ভয় লাগছে। এমন বিশাল দুটো সুটকেস আর দরকারি কাগজের সাইডব্যাগটা নিয়ে কোথায় দৌড়াদৌড়ি করব?
আমি আশপাশে তাকালাম। শুনেছি আমেরিকায় প্রচুর ভারতীয় আছে। বাঙালিও নাকি অনেক। কিন্তু এই বিপদের সময় একজনকেও চোখে দেখলাম না।
আমার খুব ভুল হয়ে গিয়েছে যে, আমি মোবাইল নিয়ে আসিনি। আসলে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং-এ প্রচুর খরচ। অতটা আমার সাধ্যের বাইরে। তা ছাড়া নেমেই তো সামুদাকে দেখার কথা। কী করে বুঝব যে, ছ’বছরেও সামুদার লেট করার বাতিক গেল না! আর শুধু লেট করলে তো কথাই ছিল না, সামুদার মনটাও যে খুব ভুলো। নিজেই বলত, “শালা কোনদিন না শ্বাস নিতে ভুলে যাই! তা হলেই কেলো!”
‘কেলো’ কে আমি জানি না। কিন্তু বাঙালিকে নানা দুর্দশায় ফেলতে এই লোকটির জুড়ি নেই! এই এখন যেমন আমায় ফেলেছে!
আমি ভাবলাম, কী করা যায়। এখানে কি কোনও ফোন বুথ নেই? আমি আশপাশে চোখ বোলালাম। না নেই! তবে যে হলিউড সিনেমায় দেখায় প্রচুর ফোন বুথ আছে! কী বিপদ রে ভাই। তারপরেই মনে পড়ল সামুদা বলেছিল, “হলিউড দেখে এখানে এলে কিন্তু কেস খাবি! জানবি ওটা সিনেমা আর এটা সত্যিকারের জীবন।”
আমি মনে-মনে ভাবলাম আশপাশে দেখে তো সকলকেই ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। একটা কাজ করি। লাগেজটা এখানেই রেখে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি। এখানে না থাকলেও সামনে নিশ্চয়ই কিছু একটা পেয়ে যাব।
আমি লাগেজটা রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম। এত বড় এয়ারপোর্ট। কত রকম সাইন ঝুলছে। আমি বুঝতেই পারছি না কী করব। দশ মিনিট উন্মাদের মতো এদিক-ওদিক ঘুরে আবার ফিরে এলাম আমার জায়গায়। বুকের ভিতর রীতিমতো দাপাদাপি চলছে। কী করব এখন? সামুদাকে ফোন করাটা জরুরি!
আমি বসার জায়গার কাছে ফিরে এসে একটু হকচকিয়ে গেলাম। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গায়ে সিকিউরিটির পোশাক। আমায় দেখেই ভুরু কুঁচকে খটমট উচ্চারণে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলেন।
আমি ঘাবড়ে গেলাম। আগাগোড়া ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছি আমি। কিন্তু তাও এদের উচ্চারণ ভঙ্গির জন্য ইংরেজিকেও প্লুটোর ভাষা মনে হচ্ছে।
আমি “সরি?” বলে আবার বুঝতে চাইলাম কী বলতে চাইছে মানুষটা!
মানুষটি বললেন, “এটা কি তোমার লাগেজ? এমন আন-অ্যাটেন্ডেড রেখে দিয়েছ কেন?”
আমি বললাম, “খুব বিপদে পড়েছি। আমি এসএমইউ-তে সুযোগ পেয়ে পড়তে এসেছি। এটা আমার প্রথমবার। কিন্তু যে নিতে আসবে বলেছিল, সে আসেনি। আমার ফোন নেই যে তাকে ফোন করব। তাই আমি গিয়েছিলাম ফোন বুথ খুঁজতে।”
কথাটা বলে আমি মানুষটার সামনে ‘আই টোয়েন্টি’ কাগজটা দেখালাম। ইউনিভার্সিটি থেকে এটা পাঠিয়েছে আমায়। এটাকেই আমার গেট পাস বলা যেতে পারে।
লোকটা ভাল করে সেটা দেখলেন। তারপর মাথা নাড়লেন আর প্লুটোর ভাষায় আবার কিছু একটা বলে পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে সামনে ধরলেন।
আমার সামান্য সময় লাগল। তারপর বুঝলাম, আরে ভদ্রলোক আমায় সাহায্য করছেন! ওঁর ফোনটা দিচ্ছেন কল করার জন্য।
আমি দ্রুত ফোনটা নিয়ে সামুদার নম্বর মিলিয়ে কল করলাম।
ছ’টা রিং হওয়ার পর সামুদা ফোনটা ধরল।
আমি ফোনের মধ্যে দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, “সামুদা, তুমি কোথায়? টেনশনে আমার হার্ট অ্যাটাক হবে এবার!”
সামুদা বলল, “কেন? তুই এসে গিয়েছিস? তোর ফ্লাইট রাত্রে আসবে না?”
“মানে?” আমি ঘাবড়ে গেলাম, “তোমায় কাল দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করলাম না? ভুলে গেলে?”
সামুদা নাক টেনে জিজ্ঞেস করল, “সেটা আজকের সকালের জন্য?”
“সামুদা কী বলছ?” আমি কী করব বুঝতে পারলাম না, “কী হবে এখন?”
সামুদা বলল, “কী আর হবে? আমি আসব। এবার ফোনটা এই তালগাছকে ফেরত দে!”
“তালগাছ!” আমি ঘাবড়ে গেলাম। সত্যি পাশে দাঁড়ানো লোকটা তালগাছের মতোই লম্বা!
আমি চট করে পিছনে ফিরলাম। আর দেখলাম আমার থেকে কুড়ি ফুট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সামুদা। মুখে হাসি।
মনে হল দু’হাজার বছর পর বৃষ্টি নামল তাকলামাকানে!
আমি ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে ধন্যবাদ জানালাম। মানুষটিও বুঝতে পেরেছেন যে আমি যাকে খুঁজছিলাম সে এসে পড়েছে! উনি হেসে চলে গেলেন।
সামুদা এসে একটা সুটকেস টানতে টানতে বলল, “শালা, পুরো কলকাতাটাকে নিয়ে এসেছিস নাকি ব্যাগে ভরে!”
আমি অন্য সুটকেসটা নিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
সামুদা বলল, “বাইরে আমার গাড়ি আছে। সরি রে অনেক লেট করেছি।”
“তুমিও পালটাওনি একটুও, না?”
সামুদা হাসল, “চুল পাতলা হয়ে গেছে। চোখে চশমা। দাড়ি পেকে গিয়েছে বেশ কিছু। পালটাইনি কে বলল রে?”
“এই যে লেট করলে!”
সামুদা তাকাল আমার দিকে। বলল, “এটা তো পারফেকশন! একে ইমপ্রুভ করা যায় নাকি?”
বাইরে এসে চারিপাশে তাকালাম। মনে হল এলইডি টিভিতে এইচডি ছবি দেখছি! এত পরিষ্কার! এত ঝকঝকে। আমি যে শহর থেকে এসেছি, আমি যেখানে বড় হয়েছি তার তুলনায় এটা তো কাপড় কাচার সাবানের বিজ্ঞাপন! সফেদি কা চমক!
আকাশের দিকে তাকালাম। কী নীল, কী নীল! আল্ট্রামেরিন! তাতে ছোট-ছোট সাদা মেঘের তুলো ভাসছে। যেন কোথাও কোনও বিশাল একটা বালিশ ছিঁড়ে গিয়েছে!
গাড়ির ডিকিতে দুটো সুটকেস রেখে সামুদা এসে দাঁড়াল আমার কাছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, “কী দেখছিস?”
আমি বললাম, “এখানে পলিউশন নেই, না?”
সামুদা বলল, “কলকাতার চেয়ে অনেক কম। তাই ভিজ়িবিলিটি এত ভাল।”
“দারুণ,” আমি চারিদিকে তাকালাম, “রাস্তাঘাটও তো খুব পরিষ্কার। ভাবা যায়!”
“গাড়িতে বস,” সামুদা আলতো করে মাথায় চাঁটি মারল একটা, “এখানে মিনিমাম পাঁচ বছর থাকতে হবে। অনেক সময় পাবি এসব দেখার। একটা সময় আর দেখতেও ভাল লাগবে না। বুঝলি!”
গাড়ির সামনের ডান দিকের দরজা খুলে উঠলাম আমি। সামুদা বাঁদিকটা খুলে উঠল। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আবার এয়ারপোর্টটাকে দেখলাম। দেখলাম লেখা আছে, ‘ডিএফডব্লিউ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।’ অর্থাৎ ডালাস ফোর্ট ওয়ার্থ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।
সামুদা গাড়িটা স্টার্ট করে বলল, “ডালাস আর ফোর্ট ওয়ার্থ টুইন সিটি। এই এয়ারপোর্ট দুটো শহরকেই কেটার করে। এখানে পড়তে এসেছিস আর এসব খবর নিসনি?”
আমি বললাম, “নিয়েছি তো।”
সামুদা হাত বাড়িয়ে গান চালাল এবার। খুব নিচু স্বরে আরডি বর্মন বাজতে লাগল।
আমি পুরো শরীরটাকে ছড়িয়ে দিলাম সিটে। ক্লান্ত লাগছে একটু। এতটা প্লেন জার্নি করিনি তো কোনওদিন। তবে একটা ব্যাপার, প্লেনে ঘুমিয়ে নিয়েছি কিছুটা। হঠাৎ মনে পড়ল, মা কী করছে এখন? ওখানে তো রাত! মা কি ঘুমিয়ে পড়েছে! একা বাড়িতে মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই! মামারা তো উপর তলায় থাকে। মা একা কাঁদছে কি? আচমকা মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। মায়ের মুখটা এমন করে মনে পড়ল যে, বুকের ভিতরে একটা গিঁট পড়ে গেল।
সামুদা আমার কানটা অল্প করে টেনে দিয়ে বলল, “কী রে ঘুম পাচ্ছে? জেট ল্যাগ?”
আমি চোখ খুলে তাকালাম। মসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। পাশে নানা ধরনের বাড়ি। মাঝে-মাঝে গাছ। কী সুন্দর! সবকিছুর মধ্যে একটা অদ্ভুত শৃঙ্খলা!
আমি বললাম, “সব এমন নিখুঁত কী করে আছে সামুদা? মনে হচ্ছে যেন কমপিউটারে প্রোগ্রাম করা! কী করে এমন হয়? আমাদের ওখানে তো এমন হয় না!”
সামুদা বলল, “আরে তুই কি এখনও সেই ক্লাস নাইনের বায়োলজিতে আটকে আছিস নাকি?”
“অ্যাঁ!” আমি অবাক হলাম।
সামুদা হাসল, “সেই যে উদ্ভিদ আর প্রাণী কোষের পার্থক্য! এর প্লাসটিড আছে ওর মাইটোকনড্রিয়া আছে। তেমন। শোন, কলকাতার সঙ্গে এর তুলনা করিস না। এখানকার পার্সপেকটিভটাই আলাদা।”
“মানে!” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সামুদা সামনের দিকে তাকিয়েই বলল, “এই দেশটার বয়স কত? পাঁচশো, সাড়ে পাঁচশো বছর। তাই তো? আমাদের দেশের সভ্যতার বয়স কত বল তো? পাঁচ হাজার বছর মিনিমাম! ভাবতে পারিস?”
আমি অবাক হলাম, “তো?”
সামুদা হেসে বলল, “সাড়ে চার হাজার বছর আগে ভারতবর্ষও এমন সাজানো-গোছানো আর সুন্দর ছিল। এমন চকচকে আর ডিসিপ্লিন্ড ছিল। আরও সাড়ে চার হাজার বছর পর দেখিস আমেরিকার কী হাল হয়!”
“মাইরি সামুদা!” আমি কী বলব ভেবে পেলাম না।
সামুদা বলল, “বাদ দে ওসব। পাড়ার সকলে কেমন আছে? কাকিমা? তুই আসাতে কষ্ট পায়নি?”
আমি বললাম, “কষ্ট তো পেয়েইছে। কিন্তু আমার সামনে খুব একটা দেখায়নি। জানোই তো কত শক্ত মানুষ!”
সামুদা এবার ড্যাশবোর্ড থেকে চিউয়িংগাম বের করে আমায় দিয়ে বলল, “আর? আর কী খবর?”
আমি জানি সামুদা কী বলতে চাইছে। কিন্তু উত্তর দিলাম না। সামুদা নিজে না জিজ্ঞেস করলে আমি কিছু বলব না।
সামুদা এবার তাকাল আমার দিকে। বলল, “জানিস তোর অ্যাপার্টমেন্টটা কোথায়? দ্য চেস, ৫৬৫৭ অ্যামেসবারি ড্রাইভ। ভাল বেশ। দোতলায়। দেখিস ভাল লাগবে। একটা সাউথ ইন্ডিয়ান ছেলের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। ও নিজেও এসএমইউ-তে আছে। কলকাতায় থাকত। কেমন বাংলা বলে দেখবি!”
আমি একটু ভয় পেলাম, “ভেজ নাকি?”
সামুদা বলল, “সে নিজেই জিজ্ঞেস করিস। আর বাইরে এসেছিস, অত ভাবিস না। সব পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে হবে। মনে রাখবি এখানে তোর কেউ নেই। সামুদাও না।”
“তুমি নেই?” আমি অবাক হলাম।
সামুদা আবার একটা ডান দিকের রাস্তায় ঢুকে বলল, “না নেই। ডোন্ট কাউন্ট মি। এটা রজনী সেন রোড নয় রিয়ান। ইউ আর ফার অ্যাওয়ে ফ্রম ইয়র কমফর্ট জ়োন। রিমেমবার দ্যাট।”
আমি ঘাবড়ে গেলাম একটু। সামুদা এমন ব্যবহার করে না তো! কী হল?
আমি বললাম, “রেগে গেলে কেন সামুদা?”
সামুদা দাঁত চেপে বলল, “যেখানে সেখানে থুতু ফেলবি না। গারবেজ ফেলবি না। যখন তখন গাছের গোড়ায় প্যান্টের চেন খুলে দাঁড়িয়ে পড়বি না। এ দেশটা মুক্ত সুলভ শৌচালয় নয়। তেমন হলে না লাথি মেরে বের করে দেবে!”
আমি বুঝতে পারলাম কী হয়েছে!
সামুদা আবার বলল, “আর কখনও এক্সপেক্ট করবি না তোকে আমি গাড়ি করে কোথাও নিয়ে যাব। তোকে বেবি সিটিং করার জন্য আমি এ দেশে আসিনি। আমার কাজ আছে। এখানে মুখে রক্ত তুলে খাটতে হয় আমায়। বুঝেছিস? আর… আর…”
সামুদার মুখটা রাগে লাল হয়ে গিয়েছে।
আমি বললাম, “জল খাও একটু। আর শোনো সামুদা মিমিদির আরও-একটা ছেলে হয়েছে। মাসদু’য়েক হল।”
সামুদা আচমকা চুপ করে গেল। আমি পাশের থেকে দেখলাম চোয়াল শক্ত করে গাড়ির স্টিয়ারিংটা ধরে রেখেছে। মুখটা আরও লাল হয়ে গিয়েছে। যে-কোনও সময়ে যেন নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে।
আমি আবার বললাম, “সামুদা তুমি ঠিক আছ?”
সামুদা এবার তাকাল আমার দিকে, “এই জন্য বললাম তোকে, আমরা সবাই একা। কেউ কারও নয়, বুঝলি? না তুই আমার, না আমি তোর। না মিমি…”
আমি জানি ঘটনাটা। সেই না বোঝার বয়স থেকেই জানি। সবাই বলত, ‘স্ম্যয়ন মিমির জন্য সব করতে পারে!’
সকলে বুঝত সেটা৷ শুধু মিমিদি বুঝত না। বা হয়তো বেশি বুঝত। তাই সারাটা জীবন স্ম্যয়নদাকে নিয়ে খেলা করে গেল! কোনও-কোনও মানুষ এমন করে কেন কে জানে! ছোটবেলায় কি তাদের খেলনা কিনে দেয় না তাদের বাবা মায়েরা, যে পরে বড় হয়ে অন্য মানুষকে নিয়ে খেলে সেই অপূর্ণ সাধ মেটাতে হয়!
মিমিদি সামুদাকে সারা জীবন নাকে দড়ি পরিয়ে ঘুরিয়ে শেষে, “তোকে আমি কোনওদিনও ভালইবাসিনি সামু!” বলে অন্য একজনকে বিয়ে করে নেয়।
আমার মাথা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। সামুদাকে কষ্ট পেতে দেখলে ছোট থেকেই আমার খারাপ লাগে। ফুটবল, টিনটিন, ফেলুদা, হলিউড সব তো এই মানুষটাই হাতে ধরে বুঝিয়েছে। আমার গুরু তো! কষ্ট হবে না!
অ্যামসবেরি ড্রাইভ রাস্তাটা মোটামুটি চওড়া। চারটে গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে। এই রাস্তার দু’দিকে ছড়ানো ‘দ্য ভিলেজ’ নামের কমিউনিটি। এই ‘দ্য ভিলেজ’টা নানা ছোট-ছোট অংশে বিভক্ত। তেমনই একটা অংশ ‘দ্য চেস’। সেখানকার একটা বাড়িতে আমার থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে।
গাড়ির ভিতর থেকেই আমি আমার বাসস্থানটি প্রথম দেখলাম। বাড়িটা দোতলা। মেরুন আর সাদা রঙের। বাংলো ধরনের। কেবল ফিল্মেই এরকম বাড়ি দেখেছি। মনে হল, এখানে আমি থাকব!
গাড়ি থেকে নেমে সুটকেস দুটো বের করে দিল সামুদা। তারপর পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে বলল, “এটা আমার আরও-একটা মোবাইল। রাখ তোর কাছে। নিজের কানেকশন নিয়ে পরে আমায় এটা ফেরত দিয়ে দিস। বুঝলি? আমি আর উপরে যাব না। অফিস থেকে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করে এসেছি। এবার তুই চলে যা। টু-সি অ্যাপার্টমেন্ট। এখানে কিন্তু একতলাকে গ্রাউন্ড ফ্লোর বলে না। ফার্স্ট ফ্লোর বলে। দোতলাকে সেকেন্ড। জানবি এরা সবকিছুর মধ্যে নিজেদের একটা আলাদা আইডেন্টিটি তৈরি করে রেখেছে। নাও, গো। আমি পরে খবর নেব। টেক রেস্ট।”
আমি বললাম, “তুমি কত দূরে থাকো?”
“এখান থেকে তিরিশ মিনিট ড্রাইভ। নিয়ে যাব তোকে। একটা স্টুডিয়ো আছে আমার। অফিস দিয়েছে। ও, বলতে ভুলে গিয়েছি,” সামুদার যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেল, “নানিয়া আসবে। বুঝলি!”
নানিয়া! আমি অবাক হয়ে গেলাম।
নানিয়া ধীলোঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ফেসবুকে। এখানেই পড়তে এসেছে। সেই জন্যই আলাপ করেছিলাম। মানে, একদম কাউকে চিনব না এমনটা যেন না হয়, তাই নানিয়ার সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
নানিয়া দিল্লির মেয়ে। কিন্তু দীর্ঘদিন নিউজ়িল্যান্ডে ছিল। আসলে ওর বাবা ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে আছেন। সেই জন্যেই পৃথিবীর বহু দেশে ঘুরেছে নানিয়া।
আমার থেকে ফেসবুকেই ও সামুদার মোবাইল নাম্বার নিয়েছিল। আমার অবাক লাগল। সামুদা আমায় এই অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা দেয়নি। কিন্তু নানিয়াকে দিয়েছে!
সামুদা গাড়িতে উঠে বলল, “কিছু দরকার হলে বলিস। আরও-একটা কথা, এখানে কারও থেকে বেশি আতিথেয়তা এক্সপেক্ট করিস না। এটা হিজ় হিজ়, হুজ় হুজ় দেশ। কেমন?”
আমি মাথা নাড়লাম।
গাড়িটা স্টার্ট করে আবার জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল সামুদা, “এই রিয়ান, গাড়িতে যা বলেছি সব ভুলে যা। ওটা এমনি বলেছি, বুঝলি?”
আমি হাসলাম। আমি কি তা জানি না? কেন রাগ করেছিল সামুদা, তা কি বুঝি না আমি!
দোতলায় উঠতে হাঁপ ধরে গেল আমার। দু’বারে দুটো সুটকেস তুললাম। আমার অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় নম্বর লেখা আছে। সামুদা আমায় চাবি দিয়েছিল। কিন্তু ওই সাউথ ইন্ডিয়ান ছেলেটা নিশ্চয়ই আছে ভিতরে। তাই হুট করে ঢুকে পড়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। আমি দ্বিধা নিয়ে ডোর নকারটা ঠুকলাম।
একটু সময় পরে দরজার ওপারে একটা শব্দ পেলাম। তারপর খুলে গেল দরজাটা। আর আমি চমকে উঠলাম! নানিয়া! এতদিন শুধু স্ক্রিনেই দেখেছিলাম মেয়েটাকে। এবার চাক্ষুষ করলাম। লম্বায় প্রায় পাঁচ দশ। সামান্য চৌকো মুখ। বড় চোখ। টানা-টানা ভুরু! গালে ব্রণ হওয়ার স্মৃতিচিহ্ন। মাখনের সঙ্গে ‘কে বেশি ফরসা’ সেই নিয়ে মোকদ্দমা চলছে ধরনের গায়ের রং!
আমি এত অবাক হয়ে গেলাম যে কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমার অ্যাপার্টমেন্টে আমি আসার আগে নানিয়া চলে এসেছে! সামুদা যে কী করে মাঝে-মাঝে।
“ওয়েলকাম,” নানিয়া সরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল।
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে সামান্য হেসে সুটকেস দুটোকে ঘরে ঢোকালাম। ভাবলাম, সেই আমার ফ্ল্যাটমেট ছেলেটি কই!
আমি দেখলাম ফ্ল্যাটটা। ছোট। সুন্দর। বসার জায়গাটায় একটা বড় সোফা পাতা৷ সেটাতেই যেন গোটা ঘর জুড়ে গিয়েছে। তার এক পাশে ফ্রিজ আর কোণের দিকে রান্না করার জায়গা। এই বসার ঘরের দু’দিকে দুটো ঘর। বুঝলাম এর একটা আমার। কিন্তু কোনটা!
নানিয়া বলল, “চলো, তোমার ঘরটা দেখিয়ে দিই। তোমার রুমি আসছে। ওই তো আমায় বসতে দিল। ভাবলাম এসে তোমায় সারপ্রাইজ় দিই। কেমন লাগল?”
আমি হাসলাম। ভালই লাগল। এমন ধারালো সুন্দরী একটা মেয়ে এসে দু’হাত ছড়িয়ে ওয়েলকাম বলছে, খারাপ লাগার মতো অসুস্থ নাকি আমি!
কিন্তু তাও যতটা ভাল লাগার ততটা লাগছে না! মনে হচ্ছে সবই তো হল, কিন্তু আমি যদি এখন ‘কিছু ভাল লাগছে না’ বলে বাড়ি যেতে চাই, যেতে পারব না। মনে হচ্ছে যার থেকে পালানোর জন্য এই দেশে এলাম সত্যিই কি সেটা থেকে পালাতে পেরেছি! সেই এগারো বছর আগের সকালটার ছায়া কি আমি এখানে এসে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি? ঝেড়ে ফেলতে পারব?
নানিয়া বলল, “কী হয়েছে?”
আমি হাসলাম, “না, জাস্ট গেটিং দ্য ফিল অফ ইট।”
নানিয়া নিজেই একটা ব্যাগ তুলে নিয়ে বাঁ দিকের দরজাটা খুলে ঢুকে গেল ঘরে। আমিও গেলাম পিছন-পিছন।
তারপর নিজের ঘরটা দেখলাম।
ছোট। একটা বিছানা রাখা দেওয়াল ঘেঁষে। মাথার কাছে দুটো জানালা। তাতে সাদা রঙের ব্লাইন্ড্স ঝোলানো। গোটা ঘরটার রং খুব আরামদায়ক!
নানিয়া আমার বিছানায় বসে হাত দিয়ে চাপড়ে ওর পাশে বসতে বলল। আমি হেসে বিছানায় বসতে যাব, এমন সময় ঘরের দরজার সামনে থেকে একটা গলা শুনলাম, “হাই গাইজ়!”
আমি ঘুরে তাকালাম। দোহারা চেহারার একটা ছেলে। মাথায় জমিয়ে তেল দেওয়া। চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা। কপালে একটা হরাইজ়ন্টাল তিলক।
ছেলেটা এসে হাত বাড়াল, “আই অ্যাম শরথ হরিহরণ আইয়ার! তুমি তো রিয়ান। গুড নেম!”
আমি ওর বাড়ানো হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললাম, “রাইট ইউ আর!”
শরথ বলল, “কিন্তু এর মানে কী? রিয়ান মানেটা কী? আমি ডিকশনারি দেখছিলাম, পেলাম না। এই দ্যাখো, এতে নেই!”
আমি দেখলাম শরথের হাতে ধরা আছে একটা ডিকশনারি! অক্সফোর্ড মিনি ডিকশনারি।
আচমকাই চোয়ালের কাছটা শিরশির করে উঠল আমার! চোখের সামনে এক ঝলক ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল একটা মুখ। মনে পড়ে গেল, ইস! ডিকশনারিটা তো ফেলে এলাম! রাজিতা জানতে পারলে কী ভাববে!
তিন
রাজিতা
সুজাতাদির বাড়িটা দেখলে আমার মনে হয় আসলে এটা বাড়ি নয়, রাক্ষসের হাঁ! সল্ট লেকের এক কোণে এমন অদ্ভুত দেখতে বাড়ি কলকাতায় আর আছে কি না সন্দেহ! সুজাতাদির হাজ়ব্যান্ড একজন নামকরা আর্কিটেক্ট। বিদেশেই থাকে বেশির ভাগ সময়। সুজাতাদি বলে, “হাবিজাবি বাড়ির ডিজ়াইন করতে-করতে পুরো মাথাটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে গগনের। দেখেছিস কী বানিয়েছে এটা! দালির সাররিয়ালিজ়ম নাকি এটা! বোঝ!”
আমি বুঝতে চাই না। কী হবে বুঝে? এসব দালি-টালির আমি খুব কিছু জানি না। বুঝতে মনও চায় না। আমার রোজকার জীবনে এসবের কোনও জায়গা নেই। আমি জানি আমার জায়গা কোথায়! জানি আমায় কী করতে হবে। যেমন এখন আমার জীবনের প্রায়োরিটি হল একটা চাকরি জোগাড় করা!
অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে আমি গেটের দিকে এগোলাম।
বড় লোহার দরজা। পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বুধন। সুজাতাদিদের দরোয়ান। আমায় দেখে হেসে গেটটা খুলে দিল। বাড়ির ভিতরে ঢুকেই একটা বড় ঘণ্টা দেখা যায়। প্রায় ছ’ফুট ব্যাসের একটা সিমেন্টের ঘণ্টা মাটিতে রাখা। এটা নাকি আর্ট! পায়ে হাঁটা রাস্তা সেই ঘণ্টাকে পাক দিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল সুজাতাদি। আমায় দেখে হাত তুলে বলল, “কী রে এত দেরি করলি আসতে! এমন তো করিস না!”
আমি হাসলাম। সুজাতাদি কী করে জানবে রাস্তার কী অবস্থা! শোভাবাজার থেকে অটো করে উলটোডাঙা, আবার সেখান থেকে আরও-একটা অটোয় সল্ট লেক। তারই মাঝে কত দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনের মতো জ্যাম, সিগনাল আর গাড়ির গিঁট! ইচ্ছে থাকলেও কী করে পৌঁছোব সময়ে?
একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা কেমন যেন নীল রঙের কাচ দিয়ে তৈরি। আমার ভয় লাগে, এই বুঝি পা পিছলে গেল।
দোতলার বারান্দায় বসে আছে সুজাতাদি। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। আজ সকালের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার রোদ। সঙ্গে ভ্যাপসা গরম! সুজাতাদিদের গোটা বাড়িটা এয়ার কন্ডিশন্ড! তবে বারান্দায় যে এসি নেই সেটা তো বলাই বাহুল্য।
বাড়িটার চারিদিকে অনেক গাছপালা। সঙ্গে মাথার উপর পাখা ঘুরছে। ফলে অতটা গরম লাগছে না।
আমি বেতের চেয়ার টেনে বসলাম।
সুজাতাদি বলল, “কী অবস্থা করেছিস চেহারার? এমন পুড়িয়ে ফেলেছিস কেন সোনার রং! সানস্ক্রিন ইউজ় করছিস না?”
আমি হাসলাম। সুজাতাদি সারাক্ষণ আমার কী-কী করা উচিত সে কথা বলে। কিন্তু বোঝে না যে, আমার এসব ভাল লাগে না।
সুজাতাদি বলল, “ভগবান ঢেলে রূপ দিয়েছে তো তাই কদর করিস না! বুঝবি!”
বুঝব? না, আমি বুঝব না। আচমকা আমার মনের ভিতরটা শক্ত হয়ে গেল! কী বুঝব! কেন বুঝব! কার জন্য সানস্ক্রিন ব্যবহার করব? চুলটা গুছিয়ে বাঁধব? ফিটিং কুর্তি পরব?
লোকে বলবে, কেন? নিজের জন্য। কিন্তু আমার নিজের জন্য কিছু করতে ভাল লাগে না। শুধু একজনের জন্য এসব কিছু করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে-ই যখন নেই, তখন আমার কী বা দিন কী বা রাত!
আমি দিইনি, কিন্তু কী করে যেন সুজাতাদি নিজেই আমার জীবনের দখল নিয়ে নিয়েছে!
ছোটবেলা থেকেই গানের দিকে ঝোঁক ছিল আমার। কিন্তু গান শেখার কথা বাড়িতে বলতে পারিনি কোনওদিন। শুধু একা-একা গান গাইতাম। সামনের বাড়ির ঠাকুরমা বলত আমার নাকি গানের গলাটা স্বাভাবিক! বলত, “তোর বাপটাকে বলিস না কেন তোকে গান শেখাতে!”
একবার ঠাকুরমা নিজেই কথাটা বলেছিল বাবাকে। আর সেই দিন রাতে আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম বাবা আর মা এই নিয়ে কথা বলছে।
বাবা বলেছিল, “রাজি গান শিখতে চায়? খুড়িমা বলছিলেন! তুমি জানো কিছু?”
মা সেলাই করছিল কিছু একটা। দাঁত দিয়ে সুতো ছিঁড়ে বলেছিল, “শিখতে চাই বললেই তো হল না! খরচ জানো? হারমোনিয়াম কিনতে হবে। মাস্টারের মাইনে আছে। এসব ভেবেছ? পারবে?”
পারবে! এই ছোট্ট প্রশ্নটা বাবাকে একদম চুপ করিয়ে দিয়েছিল। আমি দরজার আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখেছিলাম বাবা মুখ ঠোঁট টিপে বসে রয়েছে। ফরসা মুখ লাল। চোয়াল শক্ত। বাবা খুব নরম মনের মানুষ আমি জানি। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম বাবা খুব কষ্টে কান্নাটা গিলছে।
আমাদের পেট ভর্তি! এমন অনেক কিছু সারা জীবন গিলে নিতে-নিতে আমাদের পেট একদম ভর্তি এখন! তাই মাঝে-মাঝে মনে হয় আর কিছু গিলতে পারব না হয়তো!
তবে আমার মন খারাপ হয়নি। কারণ আমি তো জানতাম আমার কী-কী পাওয়া হবে না! কিন্তু ঠাকুরমা দমে যায়নি। নিজেই যোগাযোগ করেছিল এখানে ওখানে। তারপর বাবাকে ঠিকানা দিয়েছিল একটা। এই সুজাতাদির ঠিকানা।
বারো বছর হল আমি গান শিখছি সুজাতাদির কাছে। কোনওদিন সুজাতাদি এক পয়সাও নেয়নি। বরং উলটে আমাকে কত কিছু যে দিয়েছে। সুজাতাদির ছেলেমেয়ে নেই। শুধু স্বামী-স্ত্রীর সংসার। আমরা ছাত্রছাত্রীরাই সুজাতাদির কাছে সব।
সুজাতাদি বলল, “কী রে কোন দিকে মন তোর? কথা কানে যাচ্ছে না?”
আমি কাঁধের ব্যাগটা সামনের টেব্লে রেখে পাশের প্লেট থেকে একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে বললাম, “কী বলব? আমার ওসব সানস্ক্রিন- টিন ভাল লাগে না!”
সুজাতাদি বিরক্ত হয়ে বলল, “খালি চোপা! কিছুই ভাল লাগে না! এই চব্বিশেই যদি কিছু ভাল না লাগে তবে ভবিষ্যতে কী করবি? একদিন তো আমাদের মতো বয়সও হবে! এই বয়সে একটা প্রেমও করলি না এখনও! হ্যাঁ, তোর কি মেয়েদের ভাল লাগে?”
আমি হাসলাম, “সত্যি সুজাতাদি! তুমি পারো!”
সুজাতাদি বলল, “কেন? পারো বলছিস কেন? আমার তো মনে হয় ওটাই বেস্ট! ছেলেগুলো সব বদের বাসা! মেয়েদের সঙ্গেই মেয়েদের প্রেম হওয়া উচিত। তোরও কি তেমন মনে হয়?”
আমি বললাম, “না, আমার ছেলেদের সঙ্গেই প্রেম হবে, মানে কোনও দিনও যদি হয়!”
সুজাতাদি মুখ বেঁকিয়ে বলল, “তবে তুই মরেছিস আর কী!”
আমি বিস্কুটটা শেষ করে পাশের বোতলটা তুলে জল খেলাম। তারপর হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে বললাম, “কী ঠিকানা দেবে বলেছিলে! দেবে না?”
“ও, হ্যাঁ!” সুজাতাদির যেন মনে পড়ে গেল, “দাঁড়া দিচ্ছি! আসলে ও আমার দূর সম্পর্কের ভাই হয়। নাম আকাশ। আকাশ বাসু। দীর্ঘদিন ও অস্ট্রেলিয়ায় ছিল। এখন এখানে একটা মিউজ়িক চ্যানেলের হেড হয়ে এসেছে। গত পরশু এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তখন কথায়-কথায় বলেছিলাম তোর কথা।”
আমি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম। বেশ কয়েকদিন আগে সুজাতাদিকে বলেছিলাম কাজের ব্যাপারে। সুজাতাদি শুনেছিল। কিন্তু কিছু বলেনি।
সুজাতাদি টেব্লেরর উপর রাখা একটা ডায়েরি খুলে তার থেকে ছোট একটা চিরকুট বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
আমি দেখলাম ওটা আসলে একটা ভিজ়িটিং কার্ড। পিছনে হাতে লেখা একটা নম্বর। মোবাইলের।
সুজাতাদি বলল, “শোন। এটা আকাশের প্রাইভেট নাম্বার। এটাতে একটা ফোন করবি। আমি তো বলেই রেখেছি, তুই শুধু আমার রেফারেন্স দিবি।”
আমি বললাম, “এটা তো তুমি আমাকে ফোনেই বলে দিতে পারতে।”
“না পারতাম না,” সুজাতাদি হঠাৎ নিজের চেয়ারটা টেনে আমার পাশে এসে বসল। তারপর নিচু স্বরে যেন ভয়ংকর কোনও গোপন কথা বলছে তেমন গলায় বলল, “শোন আকাশ দেখতে খুব সুন্দর। ছ’ফুটের উপর লম্বা। গমের মতো গায়ের রং! অ্যাথলেটিক বডি। বয়স তিরিশ। দেখিস খুব পছন্দ হবে।”
আমি হেসে বললাম, “তুমি আমার চাকরির জন্য বলেছ, না বিয়ের জন্য?”
সুজাতাদি বলল, “দূর বোকা মেয়ে, দুটোই ইমপর্ট্যান্ট। অমন একটা ছেলেকে বিয়ে করতে পারলে কেরিয়ার প্লাস লাইফ দুটোই সেট হয়ে যাবে। তুই বুঝিস না কিছু!”
আমি হাসলাম। আসলে কিন্তু হাসলাম না একটুও। বরং আমার চোখের সামনে আবার দপ করে উঠল একটা মুখ। অভিমানী, রাগী একটা মুখ। যেন শুনতে পেলাম, ‘আমি তোর কেউ নই। তুইও আমার কেউ নোস!’
সুজাতাদি বলল, “নে, আমার সামনে ফোনটা কর।”
আমি অবাক হলাম, “এখন!”
সুজাতাদি বলল, “কেন, তোর আপত্তি আছে? কর বলছি!”
আমি সময় নিলাম একটু। তারপর মোবাইলটা বের করে কার্ডের পিছনে হাতে লেখা নাম্বারটা ডায়াল করলাম।
দু’ বার রিং হতেই ফোনটা ধরা হল ওই দিক থেকে। যে হ্যালো বলল, তার গলাটা বেশ ভারী।
আমি বললাম, “নমস্কার, আমি রাজিতা চক্রবর্তী বলছি। সুজাতাদির রেফারেন্সে…”
“ও হ্যাঁ,” আমায় কথাটা শেষ করতে দিল না ওপাশের লোকটি। বলল, “আমি আকাশ। হ্যাঁ সুজিদি তো বলেছিল আপনার কথা।”
আমি বললাম, “তো, মানে…”
আকাশ বলল, “আমরা নতুন কিছু ছেলেমেয়েকে রিক্রুট করছি। আপনি কি ইন্টারেস্টেড?”
আমি বললাম, “শিয়োর। সেই জন্যই তো ফোন করলাম।”
“গুড,” আকাশ হাসল, “আপনি আজই চলে আসুন। আমিই গোটা ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করছি। খুব ইনফরম্যালি কাজ করি আমরা। আমার কার্ডেই তো অ্যাড্রেস দেওয়া আছে।”
“ক’টা নাগাদ আসব?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এখন ক’টা বাজে? সাড়ে দশটা তো! আপনি বারোটায় আসুন।”
আমি ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা রেখে দেখলাম, সুজাতাদি এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমার থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে কি হবে না এর নিশ্চিত খবরটা পাবে।
আমি ফোনটা ব্যাগে রেখে বললাম, “আজ যেতে বলেছে। বারোটা নাগাদ।”
সুজাতাদি বাচ্চাদের মতো উৎসাহিত গলায় বলল, “লেভেল ওয়ান কমপ্লিটেড!”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। আরে আমার জীবনটা কমপিউটার গেম্স নাকি! আরে কীসের লেভেল? কতগুলো লেভেল? একটা চাকরি দরকার। আমি তো ইকোনমিক্স নিয়ে অনার্স করেছি। গানটা মোটামুটি জানি। এর উপর ভরসা করে যে যা কাজ দেবে করার চেষ্টা করব।
সুজাতাদি উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টানল, “ওঠ। মুখটা ধুয়ে নে একটু। বাথরুমে যা। ফেস ওয়াশ আছে। তারপর আসবি, আমি একটু সাজিয়ে দেব।”
“মানে?” আমি চোখ গোল করলাম, “কী বলছ তুমি?”
সুজাতাদি বলল, “শোন, সেজে যাবি সব সময়।”
আমার এবার একটু বিরক্ত লাগল। কিন্তু সেটা দেখালাম না। বরং স্বাভাবিক গলায় বললাম, “আমি তো বিয়ের সম্বন্ধে যাচ্ছি না।”
“সে তোকে ভাবতে হবে না। সেদিন তোর ছবি দেখিয়েছি ওকে। আমাদের লাস্ট ফাংশনের ছবিগুলো। আকাশ দেখে বলল, এতটা সুন্দর দেখতে!” সুজাতাদি খুশি হয়ে তাকাল আমার দিকে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এসবের যে কোনও প্রভাব আমার উপর পড়ে না সেটা সুজাতাদি জানে না?
“তবে,” সুজাতাদি একটু থমকাল এবার। তারপর বলল, “তোকে একটা কথা বলা দরকার। আকাশের পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে।”
আমি বললাম, “প্লিজ় সুজাতাদি আমি এসব জানতে চাই না। উনি আমায় আজ ডেকেছেন। ইন্টারভিউ দেব। সেটুকু সম্পর্কই থাক না!”
“আঃ, একটু এসব বলতে দে না আমায়!” সুজাতাদি বলল, “খালি বাধা দেয়! জানিস তো এসব হাঁড়ির খবর দেওয়া-নেওয়া না করলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি!”
আমি হাসলাম। কথাটা ঠিক। তবে সুজাতাদি এমন করে বলে যে রাগ হয় না।
বললাম, “বলো তবে।”
“ও না ডিভোর্সি!”
“তো?” আমি ভুরু তুললাম।
“না, কিছুই না,” সুজাতাদি বলল, “তোকে জাস্ট জানিয়ে রাখলাম। একটা অস্ট্রেলিয়ান মেয়েকে বিয়ে করেছিল সাতাশ বছর বয়সে। দু’বছরের মাথায় মেয়েটা ওকে ছেড়ে চলে যায়। হি ওয়াজ় ভেরি আপসেট। তবে এখন ঠিক আছে। সেই কারণেই এ দেশে চলে এসেছে। স্টার্টিং আফ্রেশ!”
আমি কিছু না বলে উঠলাম।
“কী রে উঠলি!” সুজাতাদি জিজ্ঞেস করল। তারপর যেন মনে পড়ে গেল ব্যাপারটা, “ও তুই তো যাবি! শোন না লক্ষ্মী মেয়ে আমার। মুখটা একটু ধুয়ে যা অন্তত। মেকআপ করতে হবে না!”
আমি বললাম, “এখান থেকে ভবানীপুরে ওই অফিসে যাব সুজাতাদি। মুখ ধুয়ে কী লাভ! বাস-মেট্রোয় আবার যেই কে সেই হয়ে যাবে তো!”
সুজাতাদি যেন এবার বুঝতে পারল ব্যাপারটা। বলল, “তাও ঠিক। শোন না তোকে শোভাবাজার মেট্রো অবধি রতনকে বলব ছেড়ে দিয়ে আসতে? এ তো বসেই আছে এখন।”
রতনদা সুজাতাদিদের গাড়ি চালায়। বয়স্ক লোক। খুব শান্ত। আমি চিনি।
বললাম, “না গো, অটোয়-অটোয় চলে যাব।”
সুজাতাদি বলল, “আসলে আমি বুঝতে পারিনি যে ও তোকে আজকেই ডেকে নেবে ইন্টারভিউতে। ভেবেছিলাম কথা বলে কাল বা পরশু ডেট দেবে। আর তুই আজ দুপুরে আমার সঙ্গে খাবি! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ডাকল! আসলে তোকে আবার সেই অত দূর ঠ্যাঙাতে হবে তো! তবে…”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
সুজাতাদি হেসে বলল, “তোর ছবি দেখেছে বলেই ও এতটা ইন্টারেস্টেড বোধহয়। মনে হচ্ছে লেভেল টু-ও কমপ্লিট!”
অটোয় উঠে বাইরের দিকে তাকালাম। আকাশে আজ রোদ খুব। ভাদ্রের প্যাচপ্যাচ গরমে সমস্ত শহরটার গায়ে কে যেন মিষ্টির চটচটে রস মাখিয়ে দিয়েছে! আমি বসে রয়েছি পিছনের সিটের কোনায়। আমার পাশে একটা মোটা লোক বসে রয়েছে। মোবাইল কানে ধরে গাঁক-গাঁক করে চেঁচিয়ে হিন্দিতে কথা বলছে কারও সঙ্গে। আর কথার সঙ্গে ছোট-ছোট মশলার কুচি উড়ছে হাওয়ায়!
আমি সিঁটিয়ে বসে রয়েছি। এমন লোকজন দেখলে ঘেন্না করে আমার।
খুব কম হলেও এক-একদিন রিয়ানের মেজাজ ভাল থাকত। সেই দিনগুলোয় ও বলত, “তুই বাতিক-বুড়ি! এত শুচি বায়ুগ্রস্ত হলে হয়!”
আমি রাগ করতাম ওর কথায়। বলতাম, “তোর মতো হতে পারব না! একটা স্যান্ডো গেঞ্জি দু’দিন পরিস! সপ্তাহে একদিন শেভ করিস! নোংরা!”
রিয়ান হাসত আর বলত, “আয় দ্যাখ আমার গায়ে কেমন গন্ধ!”
বলত আর আচমকা জড়িয়ে ধরত আমায়। আমি নিজেকে ছাড়াবার জন্য ছটফট করতাম। কিন্তু সত্যি বলতে কী ছাড়াতে চাইতাম না নিজেকে। মনে হত আরও জড়িয়ে ধরে থাকুক ও আমায়। আরও শক্ত করে ধরুক। ওর গায়ের থেকে সুইস আর্মি পারফিউমের গন্ধ যেন আমার শরীরের অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে যেত। ভাললাগায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসত! নিজের অজান্তে ওর শার্টের কোনাটা চেপে ধরতাম! রিয়ান আরও কত কী যে বলত। হাসত। চিৎকার করে অদ্ভুত শব্দ করত মুখ দিয়ে। আর আমি বিড়ালের মতো ওর সঙ্গে লেপটে ওর গায়ের গন্ধ নিতাম। মনে হত যতটা পারা যায় ওকে জমিয়ে রাখি নিজের মধ্যে!
কেন জানি না সব সময় মনে হত রিয়ান আমায় ছেড়ে চলে যাবে। মনে হত এই যে পাঁচ বছর বয়স থেকে আমরা দু’জন দু’জনকে চিনি সেটা একসময় ভেঙে যাবে। একটা সময় আসবে যখন এই পৃথিবীতে রিয়ান থাকবে, রাজিতাও থাকবে। কিন্তু ওদের আর দেখা হবে না কোনওদিন!
যখন আমার বাবা আর রিয়ানের বাবার আলাপ হয়েছিল তখন আমার বয়স পাঁচ। তারপর কীসের থেকে যে কী হল, বাবারা দু’জনেই বন্ধু হয়ে গিয়েছিল খুব। তার ফলে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়ে গিয়েছিল!
সেই পাঁচ বছর বয়স হলেও আমার আজও মনে আছে রিয়ানকে প্রথম দেখার দিনটার কথা। সেটা শীতকাল ছিল। ডিসেম্বর মাস। আমাদের বাড়িতে এসেছিল ওরা। আমি ড্রয়িং করছিলাম বাবার ঘরে খাটে বসে। বাবা-মায়ের সঙ্গে রিয়ান এসে ঢুকেছিল ঘরে। সকালবেলা ছিল সেটা। পুবের জানালা দিয়ে ওই সময়টায় রোদ আসে বাবার ঘরে।
সেদিনও রোদের একটা স্তম্ভ এসে পড়েছিল ঘরের ভিতর। আর তার ভিতর উড়ে বেড়াচ্ছিল অসংখ্য ধুলো-কুচি! আমি মুখ তুলে দেখেছিলাম লাল সোয়েটার আর কালো ফুলপ্যান্ট পরা একটা ছেলে। মাথার চুল পেতে আঁচড়ানো। থুতনিতে টোল! ছেলেটা হাত তুলে সেই ধুলো-কুচি ছোঁয়ার চেষ্টা করছে!
আমরা জানি না জীবনের কোন মুহূর্তে কীভাবে আমাদের বেঁচে থাকার গতিপথ বদলে যায়! জানি না কী থাকে কোনও এক মুহূর্তে যে সেটাই নিভৃতে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বাকিটা জীবন!
সেই ছোট বয়সে আমি কিছুই বুঝিনি। কিন্তু কেমন যেন কর্পূরের গন্ধ পেয়েছিলাম হাওয়ায়! মনে হয়েছিল, ওই আলোর ফোকাসের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা লাল সোয়েটার পরা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকি অনন্তকাল!
সেই শুরু। তারপর আমাদের মধ্যেও অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল! প্রায়ই আমাদের দেখা হত। গল্প হত। ঝগড়া হত। রাগ করত রিয়ান। অল্পতেই রেগে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকত। আর আমায় ওর রাগ ভাঙাতে হত। ওকে বোঝাতে হত।
তারপর আরও একটু বড় হওয়ার পর যখন দেখলাম যে, কোনও সপ্তাহে রিয়ানকে না দেখতে পেলে মন খারাপ করছে, কান্না পাচ্ছে। যখন সকালে উঠে দেখলাম প্রথম ওর মুখ মনে পড়ছে আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে শেষ ওর কথাই ভাবছি! যখন বৃষ্টি পড়লে ওর কাছে বসতে ইচ্ছে করত! রবি ঠাকুরের ‘তুমি রবে নীরবে’ শুনলে ওর মুখটা মনে পড়ত! শাহরুখ খান আর কাজলের সিনেমা দেখলে মনে হত ওর হাতটা একটু ধরি! তখনই বুঝেছিলাম কিছু একটা গোলমাল হয়েছে মনে!
তবে সেই ক্লাস সেভেনের বয়সে নিজের মনের অবস্থাটা তো নিজের মনেই শুধু কৌটো বন্ধ হয়ে থাকত না! বরং সেটা উপচে বাইরে পড়তে চাইত! আশপাশে ছড়িয়ে পড়তে চাইত!
এখনও মনে আছে একদিন টিফিন পিরিয়ডে পিউকে বলেছিলাম সবটা।
পিউ মানে পিউ ব্যানার্জি! আমাদের ক্লাসেই পড়ত। বরাবর ফার্স্ট হত। দারুণ গান গাইত। আর দেখতেও ছিল ভাল। তবে অহংকারী ছিল একটু। কেউই খুব একটা পছন্দ করত না পিউকে। কিন্তু আমার খুব ভাল লাগত মেয়েটাকে। আমি মনে-মনে ওকেই বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে দেখতাম। তাই পিউকে বলেছিলাম আমার মনের কথাটুকু।
পিউ আমার কথা মন দিয়ে শুনে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুই এসব সত্যি ফিল করিস? ওর কথা বারবার মনে পড়ে? ঠিক কখন-কখন মনে পড়ে?”
আমি যথাসম্ভব উত্তর দিয়েছিলাম ওর সব প্রশ্নের! আর পিউও ডাক্তারের মতো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব জেনে নিয়েছিল। তারপর মুখ গম্ভীর করে বসে পা দুলিয়ে বলেছিল, “বুঝেছি তোর কী হয়েছে!”
আমার কিছু হয়েছে। আমি নিরুপায় রোগীর মতো তাকিয়েছিলাম পিউয়ের দিকে। পিউও অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “বুঝতে পারছিস না কী হয়েছে?”
আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, “না!”
পিউ বলেছিল, “প্রেম! আমার যেটা পাড়ার বন্ডেলদাকে দেখে হয়, তেমনই তোর ওই রিয়ানকে দেখে হয়েছে! বুঝেছিস!”
প্রেম! আমার! আচমকা আমার সারা গায়ে কদম ফুটে উঠেছিল! কে যেন সারা আকাশ জুড়ে কটন ক্যান্ডি ছড়িয়ে দিয়েছিল নিমেষে! যেন হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছিলাম ‘তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম!’ গানটার গূঢ় অর্থ!
আমি বলেছিলাম, “সত্যি! প্রেম!”
পিউ জিজ্ঞেস করেছিল, “কিস করেছিস?”
“দিদি নামবেন না?” আচমকা ঘোর ভাঙল আমার। দেখলাম অটো এসে দাঁড়িয়েছে শোভাবাজার মেট্রোর সামনে। পুরনো কথা মনে পড়লেই কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে যাই আমি। উলটোডাঙায় অটো পালটে কখন যে এখানে এসে পৌঁছোলাম বুঝতেই পারিনি!
আমি ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম। সামনেই মেট্রো স্টেশন। শোভাবাজার থেকে নেতাজি ভবন পৌঁছোতে সময় লাগবে না বিশেষ। এখনও হাতে পৌনে এক ঘণ্টা মতো সময় আছে।
আমি এদিক-ওদিক দেখে রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথে উঠলাম। আমার একটা মেট্রোর কার্ড আছে। তাই ওই লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে না।
একটা পানের দোকানের সামনে বেশ ভিড়। কী নিয়ে যেন ঝগড়া হচ্ছে! আমি সেই জটলার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম শোভাবাজার-সুতানুটি মেট্রোর দরজার দিকে। আর ঠিক তখনই ব্যাগের ভিতরটা নড়ে উঠল! মোবাইল!
আমি ভাবলাম এখন কে আবার ফোন করল! অনেক জায়গায় তো রেজ়িউমে জমা দিয়ে রেখেছি। তেমনই কোনও অফিস থেকে নাকি!
ফোনটা বের করে দেখলাম বাবার মোবাইল নম্বর! বাবা তো এমন সময় কখনও ফোন করে না! তবে?
আমি ফোনটা ধরে কানে লাগালাম, “হ্যালো বাবা।”
“না, আমি আপনার বাবা, মানে রজতদা নই। আমি ওঁর সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। আপনি একবার এখুনি আসতে পারবেন?”
“আমি? কোথায়?” নিমেষে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল! মাথাটাও ঘুরে গেল যেন!
লোকটা বলল, “লিলুয়াতেই। এখুনি আসুন। স্টেশনের কাছে। ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোমে। উনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”
“কী?” আমার হাত থেকে প্রায় পড়ে গেল ফোনটা৷ বাবা অসুস্থ!
আমি কোনওমতে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবার কী হয়েছে?”
“প্লিজ় তাড়াতাড়ি আসুন। দেরি করবেন না। আসুন,” লোকটা কথা না বাড়িয়ে কেটে দিল মোবাইলটা।
আমি ফোনটা কানে ধরে দাঁড়িয়েই রইলাম। চারিদিকে ব্যস্ত শহরটা কেমন যেন নিমেষে আবছা হয়ে গেল! মনে হল, আমার পা দুটো কেউ যেন পেরেক দিয়ে পুঁতে দিয়েছে মাটির সঙ্গে! মনে হল, সারা শরীর জুড়ে ঝিঁঝি ডেকে চলেছে একটানা। ভুলে গেলাম কোন দিকে গেলে লিলুয়া বলে জায়গাটায় পৌঁছোনো যায়! বা আদৌ পৌঁছোনো যায় কি না!
চার
রিয়ান
মা কী করছে এখন? আমি দেওয়ালের ঘড়িটা দেখলাম। রাত সাড়ে আটটা বাজে। মানে দেশে তো প্রায় সকাল দশটা। মা তো এখন রান্না করে! ফোনটা রান্নাঘরেই নিয়ে যায় সঙ্গে করে। তা হলে ধরছে না কেন? তবে কি মায়ের শরীর খারাপ? নাকি আজ সেই দিনটা বলে মায়ের অন্যরকম কষ্ট হচ্ছে! খুব চিন্তা হচ্ছে আমার!
আজ কলেজ শুরু হয়েছে। তাই সকালে যাওয়ার আগেও মাকে ফোন করেছিলাম। তখনও ধরেনি। ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছি না। আজ সেই দিনটা বলেই চিন্তা বেশি হচ্ছে। এখানে আসার আগে মাকে আমি ইমেল করতে শিখিয়ে দিয়ে এসেছি। কিন্তু মায়ের থেকে কোনও ইমেলও আসেনি।
মন ঘোরাতে আমি ফোন রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। সাদা ঘরের দেওয়ালের সঙ্গে মানানসই সাদা হরাইজ়ন্টাল ব্লাইন্ডস। সকাল হলেই আমি খুলে দিই ব্লাইন্ডসটা। এখানের জানালাগুলো খোলা যায় না। মানে এই ক’দিনে একটা ব্যাপার দেখেছি যে কেউই এখানে খুব একটা জানালা খোলে না। সবার জানালাই কাচে ঢাকা।
আসলে সবক’টা বাড়িতেই এয়ার কন্ডিশনার বসানো আছে। গোটা বাড়িতেই সেই ঠান্ডা ভাব অনুভব করা যায়। শরথ আমায় দেখিয়েছে যে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের এসি-টা আমাদের বাথরুমের উপরে একটা লফ্ট ধরনের জায়গায় বসানো আছে। শীতকালে এটাকেই হিটার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু ডালাসে এখন গরমকাল। বাইরের তাপমাত্রা পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মতো থাকে সকালবেলা, আবার রাতে ধপ করে তাপমাত্রা বেশ কিছুটা কমে দাঁড়ায় কুড়ি থেকে পঁচিশের মতো।
এখানে রেসিডেনশিয়াল এলাকায় রাস্তায় লোকজন এমনিতেই খুব কম থাকে। আজ যেন আরওই নেই! রাস্তায় তেমন আলোও থাকে না এখানে।
আমি আবার বসে পড়লাম বিছানায়। আজ সামুদার বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে। আমায় আর নানিয়াকে যেতে বলেছে সামুদা। তাই নানিয়ার অপেক্ষা করছি।
এখানে এই এক বাজে জিনিস। কিছু করার থাকে না। এখনও পড়াশোনা শুরু হয়নি। তাই হয়তো এমন বেকার লাগছে নিজেকে। পড়াশোনা একবার শুরু হয়ে গেলে আমি জানি আর সময় পাব না। এখানে এসে একটা জিনিস বুঝেছি কেউই বাজে সময় নষ্ট করে না।
গতকাল প্রথম ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। কিছু ফরম্যালিটি ছিল। তার সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছে। তবে সবটাই খুব সহজভাবে হয়েছে। কোথাও কোনও ঝামেলা পোহাতে হয়নি। এমনকী, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটা খুলতেও মাত্র মিনিট দশেক লেগেছে। গোটা ফরম্যালিটিটায় নানিয়া আমার সঙ্গেই ছিল।
আমাদের বাড়ি থেকে হেঁটে ইউনিভার্সিটি যেতে মিনিট তিরিশেক সময় লাগে। গতকাল হেঁটেই গিয়েছিলাম। ফিরেওছিলাম হেঁটে। নানিয়ার বাবা বলেছিল পৌঁছে দিয়ে যাবে। কিন্তু আমি বারণ করেছিলাম। এমন ফাঁকা জায়গায় হাঁটার সুযোগ তো জীবনে পাইনি খুব একটা।
আমি আজও ভেবেছিলাম হেঁটেই যাব। শুধু একটু তাড়াতাড়ি বেরোলেই হবে। কিন্তু শরথ বাধা দিয়েছিল। বলেছিল, “তুই হেঁটে যাবি কেন? এখানে একটা বাস যায়। কাছেই স্টপ। বলে এসএমইউ শাট্ল। চল আমার সঙ্গে।”
শরথরা আসলে কেরলের লোক। কিন্তু ওর বাবা কর্মসূত্রে প্রথম থেকেই কলকাতায় আছেন। শরথের জন্মও তাই কলকাতায়। তবে টুয়েল্ভ পাশ করার পর থেকে ও কলকাতা ছাড়া। শরথ ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিল কানপুরে। সেখানে থেকে এখানে এসেছে।
ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভাল। আর সামান্য টান থাকলেও বাংলাটা ঝরঝর করে বলে। কমিক্স আর ফিল্মের পোকা। তবে প্রশ্ন করে খুব! আমি ঘুম থেকে উঠে আমার ঘরের বাইরে বেরোলেই জিজ্ঞেস করে, “কী রে ঘুম থেকে উঠলি? ঘর থেকে এই বেরোলি?”
আমি কী উত্তর দেব ভেবে পাই না। শুধু মাথা নাড়ি।
আমাদের এখান থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে একটা বাসস্ট্যান্ড। আমি আর শরথ গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ওখানে। আমার বুকের ভিতর একটু ঢিপঢিপ করছিল। কেমন হবে ইউনিভার্সিটি কে জানে? আমাদের এখানের থেকে একেবারে আলাদা সেটা তো বলাই বাহুল্য!
শরথ আমার এক বছর আগে এসেছে এখানে। ও সারাটা রাস্তা জুড়ে বকবক করে মাথা খেয়ে নিয়েছিল আমার। তবে তাতে ইনফরমেশনের চেয়ে প্রশ্নই ছিল বেশি। “কলকাতায় এখন দুর্গাপূজা কেমন হয়?” “ক’টা ফ্লাই ওভার হয়েছে?” “মেট্রো রেল কতটা এক্সটেন্ড করা হয়েছে!” “হকার কি আরও বেড়ে গিয়েছে!” “ম্যাডক্স স্কোয়্যারের পুজোর সময় গেলে কি এখনও ‘হেভি-হেভি’ মেয়ে দেখা যায়?”
আমি ভাবি ক্লাসে কী করে ও? সেখানেও কি প্রফেসরদের মাথা খারাপ করে দেয় প্রশ্ন করে-করে?
বাসটা বেশ বড়। সামনের দিকের দরজাটা ভাঁজ করে খুলে গিয়েছিল। আমি শরথের পিছনে উঠে পড়েছিলাম। এই বাসে টিকিট কাটতে হয় না।
শরথ বলেছিল, “এটাই ভাল বুঝলি। তবে হাতে সময় থাকলে হাঁটতেও পারিস।”
সস্তা ব্যাপারটা যে এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা এই দু’-তিন দিনেই বুঝে গেছি। আমি প্রতি বছর সাড়ে যোলো হাজার ডলার পাব স্কলারশিপ বাবদ। তবে নানা ট্যাক্স কেটে হাতে এসে পৌঁছোবে সাড়ে পনেরোর মতো। আর সেটাই ভাগ করে দেওয়া হবে সারা বছর ধরে। তবে বারো মাস নয়, দেওয়া হবে দশ মাসে। মানে এই সাড়ে পনেরো হাজার ডলারে আমায় কাটাতে হবে একটা বছর! অর্থাৎ মাসে প্রায় তেরোশো ডলার করে থাকবে হাতে।
আমার বাড়ির অবস্থা এমন নয় যে, মা টাকা পাঠাবে। তাই এই সবেধন নীলমণিটুকুই সম্বল! এখানে অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া সাতশো ডলার। মোবাইল আর নেট কানেকশন বাবদ একশো ডলার আর খাওয়া খরচ দুশো ডলার মতো। মানে তিনশো ডলার পড়ে থাকবে হাতে। এটাই আমার অন্ধের যষ্টি!
আমি বাড়িতে থাকাকালীন খুব একটা হিসেব করতাম না। যখন যা টাকার দরকার মা দিত। আর রাজি তো ছিলই। ও নিজেই অনেক কিছু কিনে আনত। আমার ঘরদোর গুছিয়ে দিত। কিন্তু এখানে আমার বিছানা তোলা থেকে খাবার তৈরি করা সব করতে হয়। সঙ্গে টাকার হিসেব! এই ক’টা দিনেই আমার দম বন্ধ লাগছে! পাঁচ বছর আমি কী করব এখানে?
শরথ সিটে বসেই বলেছিল, “তোকে একটা কথা বলি। আর দুটো স্টপ পরেই আমার বউ উঠবে বাসে। দেখবি শুধু।”
“বউ!” আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বলে কী ছেলেটা!
শরথ বলেছিল, “দেখ না। তবে লোভ দিবি না। আমার বউ কিন্তু। তোর বউদি।”
আমি অবাক হয়ে অপেক্ষা করেছিলাম। আর ঠিক দুটো স্টপ পরেই উঠেছিল মেয়েটা। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। সোনালি চুলের একটা মেয়ে। খুবই সুন্দর দেখতে। মেয়েটা বাসে উঠেছিল অত্যন্ত ধীরে। কারণটা বুঝেছিলাম ওকে পুরোটা দেখার পরে। মেয়েটার হাতে একটা লাঠি। মেয়েটা অন্ধ!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম মেয়েটাকে। বাসটা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। তবু মেয়েটা সামনের দিকে না বসে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে হেসে বলল, “হাই শরথ !”
শরথ আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করে মেয়েটাকে বলেছিল, “হাই টিফানি! মিট মাই ফ্রেন্ড রিয়ান। হি ইজ় নিউ ইন ডালাস।”
মেয়েটি আলগোছে হাত বাড়িয়েছিল আমার দিকে। আমি হাতটা ধরে ‘হাই’ বলেছিলাম।
মেয়েটি এবার পিছনের সিটের দিকে যাওয়ার আগে শরথের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “হ্যাভ আ নাইস ডে। সি-ইয়া।”
শরথ বলেছিল, “দেখলি!”
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।
শরথ বলেছিল, “দারুণ মেয়ে। একদিন ওকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব!”
আমি বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছিলাম, “সিরিয়াসলি!”
আমাদের ইউনিভার্সিটিটা বেশ বড়। কিন্তু কোনও পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ডিফাইন করা নেই। আমি গতকালই জেনে নিয়েছিলাম যে, আমার ক্লাস ডালাস হলের ডেডম্যান কলেজে হবে।
ডালাস হলটা খুব সুন্দর একটা বিল্ডিং। মাথার উপর বড় ডোম আর সামনে রোমান স্থাপত্যের মতো বড় পিলার দেওয়া বাড়িটা দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। ডালাস হলের সামনেই বড় লন। তাতে অনেক রাস্তা ক্রিসক্রস করে গেছে। আর রাস্তাগুলোর ইন্টারসেক্টিং পয়েন্টে একটা বড় ফোয়ারা বসানো। ফোয়ারার চারদিকে চারটে বেঞ্চও আছে।
গতকালই ওখানে গিয়েছিলাম। আজ তাই চিনতে অসুবিধে হয়নি। তিনটে ঘোড়া, বা থ্রি মাসট্যাঙের মূর্তির সামনে থেকে শরথ নিজের ক্লাসের দিকে যেতে-যেতে বলেছিল, “ফেরার সময়ও কিন্তু বাস পেয়ে যাবি। হাঁটিস না।”
ডেডম্যান কলেজের একটা বড় হলঘরে আমাদের ওরিয়েন্টেশন ছিল। আমি গিয়ে দেখেছিলাম নানিয়া এসে গিয়েছে। মুখটা গম্ভীর। আমি অতটা পাত্তা না দিয়ে চারিদিকে তাকিয়েছিলাম। ক্লাসরুমটা সুন্দর। পরিষ্কার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনা পনেরোজন বসে রয়েছে। তার মধ্যে আমিই একমাত্র বাঙালি। বাকিদের মধ্যে নানিয়া ছাড়াও বসে রয়েছে বেশ কিছু চাইনিজ় ছাত্র। দু’-তিন জন আমেরিকান আর কয়েকজন দক্ষিণ আমেরিকার ছাত্র। এর মধ্যে কয়েকজনের বয়স তো প্রায় চল্লিশ! একজন আমেরিকান ভদ্রলোকের বয়স তো নিশ্চিতভাবে পঞ্চাশ হবেই!
আমি চুপ করে বসে আমার ল্যাপটপটা খুলেছিলাম। নানিয়া নিজেই এসে বসেছিল আমার পাশে। তারপর কনুই দিয়ে ঠেলে বলেছিল, “কেয়া হুয়া দিখাই নেহি দে রাহা হ্যায় মুঝে!”
আমি বলেছিলাম, “দিখাই তো দিচ্ছে ম্যাডাম। কিন্তু টেম্পারেচার দেখে কাছে যেতে ভয় লাগছে।”
নানিয়া বলেছিল, “আরে পুছো মত।”
আমি ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখে বলেছিলাম, “নহি পুছতা।”
“আরে,” নানিয়া রেগে গিয়েছিল, “বাড়িতে বাবা, এখানে তুই। কী পেয়েছিস তোরা?”
আমি হেসে বলেছিলাম, “ব্যাপারটা কী?”
নানিয়া বলেছিল, “আমি কি বাচ্চা নাকি? এখনও বেবি সিটিং করে চলেছে। তোর বাড়ির কাছেই আমি একটা অ্যাপার্টমেন্ট দেখেছি। ওই অ্যামসবেরি ড্রাইভেই। বললাম, ওখানে শিফ্ট করি, বাবা বলে, না এখন যেখানে আছি সেখানেই থাকতে হবে। কাছেই আমার পিসির বাড়ি। পিসি নাকি আমার খেয়াল রাখবে! আবে ম্যায় বচ্চি হু কেয়া?”
আমি বলেছিলাম, “বাবা যাচ্ছে কবে?”
নানিয়া বলেছিল, “কাল।”
“পরশু শিফ্ট কর,” আমি হেসেছিলাম, “বেকার টেনশন নিচ্ছিস কেন?”
নানিয়া চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, “জানিস তো না! এরা সব বড়-বড় চাকরিই করেছে শুধু! সারা জীবন বিদেশেই ঘুরেছে। কিন্তু মনটা বড় হয়নি! আদর্শ আর সংস্কারের নামে শুধু মেয়েদের উপর জুলুম করা! বাড়ি তো নয় যেন হিন্দি সিরিয়াল চলছে!”
আমি কথা ঘোরাতে বলেছিলাম, “আমায় একটা মোবাইল নিতে হবে। কী করি বল তো?”
নানিয়া বলেছিল, “এখান থেকে বেরোবার সময় বলবি। যাব তোকে নিয়ে। সামনেই এটি অ্যান্ড টি-র স্টোর আছে। শ’দুয়েক ডলারের ভিতর হয়ে যাবে। টাকা আছে, না আমি দেব?”
আমি তাকিয়েছিলাম নানিয়ার দিকে। রাজি এমন বলত না? না, রাজি বলত না। কিনে এনেই হাজির করত। তারপর জোর করলে টাকা নিত। কোথা থেকে যে মেয়েটা টাকা পেত কে জানে! এখানে আসার পর আর কথা হয়নি রাজির সঙ্গে। কেমন আছে ও! তারপরেই মনে হয়েছিল, কেমন আর থাকবে, ভালই আছে!
ওরিয়েন্টেশন চলেছিল ঘণ্টাখানেক ধরে। তাতে এখানকার সম্বন্ধে বলা হয়েছিল আমাদের। কোর্স কেমন। কতটা পড়াশোনা করতে হবে। পরীক্ষার প্যাটার্ন কী। এসবই বলা হয়েছিল। তার সঙ্গে কী-কী ফেসিলিটি আমরা পাব! কার সঙ্গে কথা বলতে পারি। প্রফেসররা কীভাবে আমাদের হেল্প করবেন, এসবও বলা হয়েছিল। আর সব শেষে বলা হয়েছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা। এক বছরের শেষে একটা পরীক্ষা হবে। আর সেটায় পাশ না করতে পারলে একদম তলপিতলপা সমেত বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে আমাদের।
এটা শুনে আমার ভিতরটা কেঁপে গিয়েছিল একদম। বাড়ি পাঠিয়ে দেবে! আমি এখানে আসার আগে বুঝেছিলাম যে ইকোনমিক্স নিয়ে আমার দেশে আমি যা পড়েছিলাম সেটার চেয়ে এখানের কোর্স অনেক আলাদা। পড়াশোনার ধরনও আলাদা। তাই আসার আগে অঙ্ক আর স্ট্যাটিসটিক্সের উপর আমি খুব জোর দিয়েছিলাম। এখানে ওরিয়েন্টেশনে কথা শুনে বুঝেছি যে, আরও জোর দিতে হবে। কারণ আমার মতো ছাত্ররা পিছিয়ে আছে অনেক। তাই ওই পরীক্ষায় পাশ করতে গেলে আমায় খাটতে হবে খুব।
ওরিয়েন্টেশন শেষে আমাদের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত ছিল। সেখানেই টুকটাক কথা হচ্ছিল সবার সঙ্গে। দেখেছিলাম চাইনিজ় ছাত্ররা খুব একটা গল্প করতে বা কথা বলতে আগ্রহী নয়। তবে ওই বছর পঞ্চাশেকের ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হয়েছে। লোকটির নাম টম গ্রে। ভদ্রলোকের বিজ়নেস আছে। এখন উনি একটা পিএইচ ডি ডিগ্রি পেতে চান। সারা জীবন কাজের পর ব্যাবসা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, ওঁকে আর ব্যাবসা সেভাবে না দেখলেও হয়। এত বছর পরে উনি নিজের মতো পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন। তাই এসএমইউ-তে ভর্তি হয়েছেন। উনি নিজের থেকেই আমায় মোবাইল নাম্বার দিয়েছিলেন। আমি অবাক হয়েছিলাম খুব। এমন তো হয় না!
ফেরার পথে নানিয়ার সঙ্গে গিয়েছিলাম মোবাইল কানেকশন নিতে। সেখানেও বিশেষ সময় লাগেনি। আসলে এখানে এসে ন্যূনতম জিনিসগুলো জোগাড় করতেই প্রথমে কয়েকটা দিন চলে যায়।
মোবাইলটা খুব একটা দামি না হলেও বোকাও নয়। স্মার্ট ফোন। এখানে সবকিছুই ইমেল নির্ভর। আমাদের দেশে যেমন আমরা টেক্সট করি বা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ রাখি এখানে তেমনই ইমেল। তাই এমন একটা ফোন থাকা জরুরি যাতে মেলটা সহজে দেখা যাবে।
আমি নানিয়াকে থ্যাঙ্কস জানিয়ে বাড়ির পথ ধরব ভেবেছিলাম। কিন্তু নানিয়া ছাড়েনি। বলেছিল, “বাড়ি যাবি? এখনই?”
“তবে কোথায় যাব?” আমি অবাক হয়েছিলাম।
নানিয়া বলেছিল, “তেরা ও বোরিং সা ঘর মে রাক্খা কেয়া হ্যায়? এর পরে পড়াশোনার চাপ বাড়বে খুব। গান্ড ফাটনি হি হ্যায় বাদ মে! চল কিছু খাই!”
আমি বলেছিলাম, “দুপুরেই তো খেলাম। কলেজেই তো খাবার ছিল।”
“আঃ, চল না,” নানিয়া রীতিমতো আমার হাত ধরে টানছিল।
আমার ভয় লেগেছিল খুব। শুনেছি এখানে বাইরে খাওয়া খুব খরচসাপেক্ষ। এখনও ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার হয়নি। বাড়ি থেকে হাজার ডলার নিয়ে এসেছিলাম। সেটাই খুব টিপে খরচ করছি। কিন্তু তাও ন্যূনতম জিনিসগুলো কিনতে প্রায় শ’চারেক ডলার বেরিয়ে গিয়েছে! আমি ঢোক গিলে দাঁড়িয়েছিলাম।
“তু বান্দা বহত বোরিং হ্যায়। আই উইল ট্রিট ইউ নাউ! চল। বাবা আছে। আমায় ভালই টাকা দিয়ে রেখেছে!” নানিয়া নিজের ডেবিট কার্ডটা দেখিয়েছিল, “আমি তোর মতো স্কলারশিপে পড়তে আসিনি। সামঝা?”
আমি কী বলব বুঝতে পারিনি। আমার মধ্যবিত্ত বাঙালি মন একটু ধাক্কা খেয়েছিল। মেল ইগোও বোধহয় টাল খেয়েছিল একটু। একটা মেয়ে এভাবে আমার দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে! তারপর ভেবেছিলাম, এসব পনেরোশো শতাব্দীর মানসিকতা নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
নানিয়া আমাকে একটা চিপোট্ল-এ নিয়ে গিয়েছিল। ছিমছাম খাবারের জায়গা। একটা লম্বা কাউন্টার। এক পাশে টাকা নেওয়া হচ্ছে। কাউন্টারের মাথার উপরের লাল রঙের মেনু বোর্ড ঝুলছে। এক পাশে চেয়ার টেব্লও রাখা। অন্য পাশে ফাউন্টেন আছে সফ্ট ড্রিঙ্কসের জন্য।
নানিয়া বলল, “এটা মেক্সিকান গ্রিল। নাম করা রেস্টুরেন্ট চেন। ট্যাকো অর্ডার করি?”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলাম।
নানিয়াই সমস্তটা সামলে খাবার হাতে করে এনে রেখেছিল সামনে। বলেছিল, “খেয়ে নে। রাতে রান্না করবি?”
“কেন?”
“এখান থেকে কিছু প্যাক করে দেব?” নানিয়া জিজ্ঞেস করেছিল!
আমি অবাক হয়েছিলাম। তারপর বলেছিলাম, “না, না, কী বলছিস?”
নানিয়া হেসেছিল একটু। তারপর বলেছিল, “আসলে আমার একটা হেল্প লাগবে তোর।”
আচ্ছা! এবার বুঝেছিলাম নানিয়ার এমন দয়ার সাগর হওয়ার পিছনের কারণটা। আগেই খাইয়ে দাইয়ে ফিট করে নেওয়া হচ্ছে! যাতে পরে কাজটা করব না বলতে না পারি।
আমি শান্ত গলায় বলেছিলাম, “একটা সফ্টড্রিঙ্ক নে। আর বাড়ির জন্য বুরিটো প্যাক করে দিস।”
“শালে!” টেব্লের তলা দিয়ে আমার পায়ে আলতো করে লাথি মেরেছিল নানিয়া। তারপর বলেছিল, “তুই ঠিক বলেছিস, আমায় ওই পিসিদের বাড়ির কাছের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকতে হবে। কিন্তু সুরির সঙ্গে দেখা করব কী করে?”
“সুরি?” আমি খাবার ভর্তি মুখ নিয়ে অবাক হয়েছিলাম।
নানিয়া খাবারটা ছুঁয়েও দেখেনি। বরং আগ্রহভরে বলেছিল, “সুরিন্দর চাড্ডা। দিল্লির ছেলে। আমার সঙ্গে খুব ভাব। মানে উই আর ইন লাভ। তো যদি তোর ওখানে আমরা মিট করি!”
“ও এখানে থাকে?”
“ডালাস এখন বুমিং জানিস তো! এখানেই একটা সফ্টওয়্যার ফার্মে আছে সুরি। ওর জন্যেই তো এসএমইউ-তে পড়তে এসেছি। প্লিজ় ইয়ার।”
আমার ঘড়িটা দেখলাম আবার। একটু আগে ফোন করেছিলাম নানিয়াকে। ও গাড়ি নিয়ে আসছে। আমায় তুলে সামুদার বাড়িতে যাবে। এত দেরি হচ্ছে কেন কে জানে! আমি আর একবার মোবাইলটা দেখলাম। মা ফোনটা ধরল না কেন!
গতকাল খাবার দোকান থেকে বেরিয়ে আমি বাড়ি চলে এসেছিলাম। নানিয়া যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল, “থ্যাঙ্কস রিয়ান। ইউ আর আ ডার্লিং। বাবা এই ক’দিনেই তোকে খুব বিশ্বাস করে ফেলেছে। সুরি খুব খুশি হবে।”
আমি উঠে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। অন্ধকার। জনমনিষ্যি নেই। তারপর মুখ ফিরিয়ে ঘড়ি কাম ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ গেল। আর হঠাৎ কেমন একটা লাগল আমার। মনে হল এখানে যদি আমি এখন মরেও যাই কেউ তো জানতে পারবে না। আমার যদি বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে বাড়িও ফিরতে পারব না! হঠাৎ মনে হল কে যেন আমার হাত-পা সব বেঁধে দিয়েছে। মনে হল বুকের ভিতর কেমন যেন একটা খালি টিন ঢুকে বসে রয়েছে। আমি নিজেই তো আসতে চেয়েছিলাম এখানে। অনেক বড় হতে হবে আমায়। অনেক নাম করতে হবে। অনেক টাকা রোজগার করতে হবে, এসবই তো লক্ষ্য ছিল। সেই ক্লাস এইট থেকে তো এটাকেই পাখির চোখ করে নিয়েছি। তবে কেন এখন এমন লাগছে! আচ্ছা আজ ওই দিনটা বলেই কি! এতক্ষণ তো মনে করব না বলে নানা কিছু ভাবলাম! কিন্তু কেন তাও বারবার মনে পড়ছে!
আচমকা আমার কান গরম হয়ে উঠল। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল! মনে হল কে যেন গলার কাছটা চেপে ধরেছে আমার! আমি দ্রুত ঘরের লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলাম। কত চেষ্টা করি যাতে ওই কথাটা মনে না আসে, কিন্তু সময়ের একটু ফাঁক পেলেই ঠিক মনের ভিতর মাথা তুলবে কথাটা। আমি জোর করে মনটা ঘোরাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু বারবার সেই সকালটা ছোট-ছোট দৃশ্যের আকারে ছিটকে উঠছে চোখের সামনে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সব কথাগুলো! মায়ের সেই ভাঙাচোরা মুখটা যেন এত দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে খুলে যাওয়া একটা হোটেল রুমের দরজা!
আমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে তোয়ালেতে মুখটা মুছলাম। সত্যি, মানুষের মন কীরকম যেন। এই মুহূর্তে একরকম আর পরের মুহূর্তেই অন্যরকম!
“সরি, সরি, লেট হো গ্যায়া।”
আমি পিছন থেকে নানিয়ার স্বরটা পেয়ে মুখ ঘোরালাম। ও কখন এল?
“শরথ বাইরে যাচ্ছিল। দরজায় তাই নক করতে হয়নি,” কথাটা শেষ করেই নানিয়া থমকে গেল, “তোর কী হয়েছে? মুখ-চোখ এমন লাল কেন?”
আমি নিজেকে স্বাভাবিক করতে বললাম, “না কিছু নয়। এমনি।”
“ও,” নানিয়া বুঝল এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।
“চল তা হলে। তোর দাদার বাড়ি যেতে তো আধঘণ্টা সময় লাগবে। যেতে পারবি তো?”
শেষের প্রশ্নটা সাবধানে রাখল নানিয়া।
আমি চুলটা আঁচড়ে “চল,” বলে এগিয়ে গেলাম। নানিয়া ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি আলোটা নিভিয়ে দরজাটা বন্ধ করার জন্য টানলাম। তাও শেষ মুহূর্তে আবার চোখ পড়ল নীলচে আলো-জ্বলা ঘড়ি কাম ক্যালেন্ডারটা। আঠেরোই আগস্ট! বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আবার। এগারো বছর হয়ে গিয়েছে তবু আজও বাবার মৃত্যুদিনটা আমায় ভিতরে-ভিতরে একই রকমভাবে মেরে ফেলে!
পাঁচ
রাজিতা
ছোটবেলায় বাবার ঘরের পাখাটাকে ভাবতাম ভীমের গদা। অবিকল একই রকম দেখতে। যখন সুইচ অন করা হয়, একটা ঘটাং শব্দ দিয়ে পাখাটা ঘোরা শুরু করে।
আজও সেই শব্দ দিয়েই পাখাটা ঘোরা শুরু করল। এতক্ষণ ওটা বন্ধ ছিল। আমি বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম খাবার ঘরে। বাবার একা হাঁটতে কষ্ট হয় আজকাল। ভাই তো সকালে ঘুমোয়। আর মা নিজেই হাঁটু নিয়ে কাহিল। তাই আমি যতক্ষণ বাড়িতে থাকি বাবার সব কাজ করে দেওয়ার চেষ্টা করি।
বাবা কেমন যেন থতমত খেয়ে গিয়েছে। বিশেষ কথা বলে না। খেতে চায় না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর চোখের কোণ দিয়ে জল পড়ে! আমার সুস্থ-সবল বাবা এক মুহূর্তের মধ্যে কীভাবে যে এমন হয়ে গেল সেটা ভেবেই আমি অবাক হয়ে যাই!
সকালে পড়িয়ে ফিরে আমি বাবাকে ধরে ধরে খাবার জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিলাম। মা সামনে দুধ আর খই দিয়ে গিয়েছিল। আমি ভাল করে দুটো মেখে চামচ দিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম বাবাকে। বাবা খাচ্ছিল, কিন্তু জোর করে। যেন ইচ্ছে নেই এমন একটা ভাব। আর খেতে-খেতে আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল বারবার।
আমি বলেছিলাম, “বাবা কিছু বলবে?”
বাবা জড়িয়ে বলেছিল, “আমি কেমন অপদার্থ, না?”
“আবার বাজে কথা শুরু হল!” আমি সামান্য ধমক দিয়েছিলাম, “কেন এসব বলছ? মানুষের শরীর খারাপ হয় না? হয় তো!”
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গিয়েছিল।।
আমি খাবারটা খাইয়ে বাবাকে ধরে-ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম বেসিনের কাছে। মুখ ধুইয়ে, মুছিয়ে তারপর এই আবার নিয়ে এসেছি ঘরে।
বাবা বিছানায় হেলান দিয়ে ঘরে বসে বাইরের দিকে তাকাল। দোতলার এই ঘরটা থেকে পাশের বাড়ির শ্যাওলা ধরা ইটের দেওয়াল দেখা যায়। এখানে সবটাই বহু পুরনো বাড়িঘর। দেখার কিছুই নেই। শুধু ইটের দেওয়াল। কালো হয়ে যাওয়া শ্যাওলা। এদিক ওদিক থেকে বেরিয়ে আসা অশ্বথ চারা, নয়নতারার ডাল! তাও ওই দিকে তাকিয়ে বাবা কী দেখে কে জানে!
আমি বললাম, “বাবা একটু শোবে না?”
“অ্যাঁ!” বাবা তাকাল আমার দিকে।
পাঁচ বছরের বাচ্চা হয়ে গিয়েছে বাবা!
আমি বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “কাল রাতে তো ভাল করে ঘুমোওনি। একটু শোও। পারলে ঘুমিয়ে নাও।”
“ঘুমোব?” বাবা জিজ্ঞেস করল।
ওই জিজ্ঞেস করার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যে, আমার চোখে জল চলে এল। এই মানুষটা সারা জীবন তুলোর মতো করে আমায় রাখার চেষ্টা করেছে। শরীর খারাপ হলেও সারা রাত মাথার কাছে বসে থেকেছে। পরীক্ষার সময় সব সময় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছে। কখনও আমায় একা হতে দেয়নি। আজ সেই মানুষটাকে এমনভাবে দেখে আমার বুকের ভিতরটা ঝুপ ঝুপ করে ভেঙে পড়ল!
বাবা আস্তে-আস্তে শুয়ে পড়ল এবার। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। দেখলাম দু’মিনিটের মধ্যেই চোখ বন্ধ হয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম বাবার দিকে। এই দু’সপ্তাহে কেমন যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে গিয়েছে মানুষটা। আবার চোখে জল এল। বাবা এমন হয়ে যাবে আমি ভাবতেই পারিনি। আমার জীবনের সুপারম্যান আমার বাবা!
বাবার অল্প বয়সেই ঠাকুরদা মারা যান। আর মৃত্যুর সময় ঠাকুরদা এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারেননি। একসময় নাকি আমাদের অনেক টাকা-পয়সা ছিল। আমাদের এক পূর্বপুরুষ ব্রিটিশদের সঙ্গে ব্যাবসা করে অনেক টাকা করেছিলেন। সেই টাকায় কলকাতায় চারটে বাড়ি আর বর্ধমানে অনেক জমিজমা কিনেছিলেন। কালের গতিতে সেসব আর কিছুই নেই। তাঁর বংশধরেরা সেই সব কিছুই উড়িয়ে পুড়িয়ে খেয়েছে। শুধু এই দুটো বাড়ি পড়েছিল শেষমেশ। যা আমাদের হাতে এসে পড়েছে।
বাবা তাই বিশেষ কিছু পায়নি ছোট থেকে। বুড়ো কচ্ছপের মতো এই বাড়িটার অংশ ছাড়া বাবা আর জেঠুর কিছুই ছিল না।
বাবা আর জেঠু দিনের বেলা নানা কাজ করে নাইট কলেজে পড়াশোনা করেছে। আর সেইসব কাজের মধ্যে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ধূপকাঠি বিক্রি করা থেকে বাসের কন্ডাক্টরের চাকরি, সব ছিল। পরে কলেজ পাশ করে বাবা লিলুয়ার এই ফ্যাক্টরিতে কাজ পায়। জেঠু ততদিনে পুলিশে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল।
তারপর থেকে সেই সর্বগ্রাসী অভাবটা আর ভোগ করতে হয়নি, কিন্তু তাও হিসেবের বাইরেও যেতে পারেনি। সারাক্ষণ ‘মাসের শেষ’ নামক ভয় আমাদের তাড়া করেছে!
কিন্তু এবার মনে হয় সেই পুরনো দিনগুলো আবার ফিরে আসবে। আজকাল মনে হয় কালো একটা ছায়া ক্রমশ ঘিরে ধরছে আমাদের বাড়িটাকে। প্রথমে রিয়ান চলে গেল তারপর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ল৷ আমার জীবনের প্রিয় দু’জনই কেমন যেন পিছলে গেল হাতের থেকে!
পিছলে কি গেল সত্যি! আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম একটু। আজ শনিবার। ভাবছি বাড়িতেই থাকব। সুজাতাদির কাছে গানের ক্লাস নেই আজ। তা ছাড়া চাকরির জন্য এদিক ওদিক যাওয়ার কিছু নেই। যে ক’টা জায়গায় সিভি ফেলা আছে তারা হয়তো এবার আমাকে দেখলেই পুলিশে খবর দেবে!
শুধু একজন ভদ্রলোকের কাছে যাওয়ার আছে। সাগর সামন্ত নাম ভদ্রলোকের। উনি বলেছেন গানের সিডি বের করার বন্দোবস্ত করে দেবেন। এমনকী কিছু প্রোগ্রামও জোগাড় করে দেবেন।
জানি এটা শুনলে সুজাতাদি রাগ করবে। আসলে সুজাতাদি অনেক প্রোগ্রাম করে। সেখানে আমাকেও নিয়ে যায়। টুকটাক গানও করায়। কিন্তু আমি চাইছি নিজে কিছু করতে। সুজাতাদির ওই প্রোগ্রামগুলোতে এমনিই গান করি। টাকা-পয়সা কিছু পাই না। কিন্তু আমার এখন টাকার দরকার। দেখি সাগর সামন্ত যদি কিছু করে দিতে পারেন!
জুডো ঘুমাচ্ছে এখনও। ছেলেটা কেন রাত জাগে কে জানে!
আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালাম। মাথার উপর সাঁকো দেখা যাচ্ছে। জং ধরা ভাঙাচোরা ছোট্ট ব্রিজ একটা। শুনেছি একসময় আমাদের বাড়ির সঙ্গে সামনের বাড়ির খুব দহরম-মহরম ছিল। তখন খুব ব্যবহার করা হত সাঁকোটা। এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত চলত খুব। ক্রমশ সবই ছানা কেটে গিয়েছে। দু’বাড়ির যাতায়াত বন্ধ হয়েছে। রোদে-জলে-ঝড়ে একা পড়ে থাকতে-থাকতে এই সাঁকো অভিমানী আর একলা হয়ে পড়েছে। জং লেগে তার মন ভেঙে গিয়েছে।
হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। আমাদের সাঁকোটাও যদি এমন ভেঙে যায়! রিয়ান কত দিন হল গিয়েছে একবারও তো যোগাযোগ করেনি! আমি ইমেল করেছিলাম। উত্তর দেয়নি! তবে কি আর ও যোগাযোগ রাখতে চায় না? আমার নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করল! এত বছর চুপ করে রইলাম, আর কেন ও চলে যাওয়ার দিন ওই কাজটা করতে গেলাম! আমি রিয়ানকে আমার থেকে দূরে ঠেলে দিলাম!
মন এক অদ্ভুত জিনিস! যা ভাবলে আমাদের কষ্ট হবে সেগুলোই যেন বারবার আমাদের সামনে নিয়ে আসে আমাদের মন। যে স্মৃতি সবচেয়ে বেশি ক্ষত তৈরি করে সেগুলোই যেন বারবার চোখের সামনে সিনেমার মতো তুলে আনে। আমার মনে হয় আমরাই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু! আমরা যেন নিজেরাই চাই না নিজেদের ভাল রাখতে! সারাক্ষণ ফেসবুকে হাজার-হাজার ইন্সপিরেশনাল কোটেশন পড়লেও আমরা নিজেরাই নিজের অজান্তে বেঁকে যাই কষ্টের দিকে! এর থেকে কি কোনও গুপ্ত আনন্দ পাই আমরা? কষ্ট পেতে কি সত্যি আনন্দ লাগে আমাদের? নিজেদের সঙ্গে কীসের এত শত্রুতা! আমরা আমাদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি?
আমি জোর করে মনটা ঘোরাবার জন্য অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করলাম। চোখ তুলে দেখলাম সামনের বাড়ির তিনতলায় ঠাকুরমা এসে বসেছে একটা কাঠের চেয়ারে। আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল ঠাকুরমার কাছে যেতে। যেভাবে ছোটবেলায় দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরমার ওই দোতলার মতো উঁচু খাটটায় উঠে পড়তাম, সেভাবেই আবার উঠে পড়তে ইচ্ছে করছে। কোলে মাথা গুঁজে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, “সুড়সুড়ি দাও।”
ঠাকুরমা আমার দিকে তাকাচ্ছে না! আজকাল ঠাকুরমা কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণ কাচের চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে অজানা কোনও দিকে। ভাবলাম, আজ একবার ঠাকুরমার কাছে যাব। বাবার খবরটা দিয়ে আসব। জানি না ওদের বাড়ির বাকিরা খবরটা দিয়েছে কি না ঠাকুরমাকে।
আমার এখনও সেদিনের কথা মনে পড়লে বুক কেঁপে ওঠে! ওই শোভাবাজার থেকে কি বললেই হুট করে লিলুয়া পৌঁছে যাওয়া যায়! আমি বুঝতেই পারছিলাম না কী করব! আমার যেন সব দিক গুলিয়ে গিয়েছিল! আমি তো কোনও দিন যাইনি লিলুয়া। বাবার ফ্যাক্টরি যাইনি। কী করে খুঁজে পাব? ফোনে শোনা নার্সিংহোমের নামটাও যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল টেনশনে। ভাবছিলাম মাকে কি এখন জানাব, না পরে! আমি ঠিক করতে পারছিলাম না কী করব! আসলে সংসারের সব তো বাবাই সামলায়! এখন সেই লোকটার কী হয়েছে!
আমি ব্যাগ খুলে দেখেছিলাম কত টাকা আছে। বেশি নেই। ট্যাক্সি করা যাবে না। আমি বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। হাওড়া স্টেশন যেতে হবে। টাকা কী যে গুরুত্বপূর্ণ একটা বস্তু তা আমি সেদিন যেন আরও বুঝতে পারছিলাম। আমার মাথার থেকে পুরো বেরিয়ে গিয়েছিল ওই ভবানীপুরের ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারটা।
বাসে উঠে কোনওমতে পৌঁছেছিলাম হাওড়ায়। মাথাটা ঘুরছিল। টেনশনে হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল! ভাবছিলাম, আজ যদি রিয়ান থাকত তবে তো ওকেই ডাকতাম। আমার যে আর কাউকে ডাকার নেই!
হাওড়া থেকে লিলুয়া যেতে সময় লাগেনি। আমি স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা ধরেছিলাম। ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোম বলতেই রিকশাচালক বলেছিল চেনে।
আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল ভয়ে। খালি ভাবছিলাম কী দেখব গিয়ে?
ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোমটা ছোট। দেখে মনে হয়েছিল সদ্য তৈরি হয়েছে। আমি সিঁড়িতে পা দিয়েই নতুন রঙের গন্ধ পেয়েছিলাম। জানালার ফ্রেমের কোথাও-কোথাও এখনও প্লাস্টিক লেগে রয়েছে।
দরজা দিয়ে ঢুকেই রিসেপশন। আর তার এক পাশে লম্বা করে বসার জায়গা। আমায় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখে চেয়ারে বসে থাকা তিন-চারজন উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল আমার দিকে।
“আপনি রজতদার মেয়ে?” মাঝবয়সি সামান্য বেঁটে একজন জিজ্ঞেস করেছিল আমায়।
“হ্যাঁ! বাবা কেমন আছে? কী হয়েছে?”
লোকটি হাত জোড় করে নমস্কার করে বলেছিল, “নমস্কার। আমি অনিল রায়। রজতদার সঙ্গেই কাজ করি। আসলে আজ খুব সমস্যা হয়েছে। নিউজ় দেখেননি?”
আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, “কী হয়েছে বাবার?”
“রজতদার সেরেব্রাল অ্যাটাক হয়েছে। আইসিসিইউ-তে আছে। তবে আউট অফ ডেঞ্জার।”
“সে কী!” আমার মনে হয়েছিল পা দুটো নরম মাটির তৈরি। মনে হয়েছিল এবার পড়ে যাব।
অনিলবাবু বলেছিলেন, “চিন্তা করবেন না। লাইফ রিস্ক নেই। আসলে খুব শক পেয়েছেন তো!”
“কেন? কী হয়েছে?”
এবার অনিলবাবুর পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক বলেছিলেন, “আসলে আমাদের ফ্যাক্টরি লক-আউট হয়ে গেছে আজ। গত মাস দুয়েক ধরেই লেট হচ্ছিল মাইনে দিতে। আজ সকালে এসে দেখি ফ্যাক্টরি গেটে তালা ঝুলছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে ফ্যাক্টরি। মেন গেটের সামনে মালিকের পোষা কিছু গুন্ডা ছিল। আমরা অ্যাজিটেশন দেখাতেই তারা হামলা করে। খুব ঝামেলা হয়েছে। পুলিশ, প্রেস সব এসেছিল। তার মধ্যেই একটা হুলিগান এসে রজতদার কলার ধরে গালে থাপ্পড় মেরেছিল। তারপরেই রজতদা জানি কেমন হয়ে যায়! মাটিতে পড়ে যায়। ঘামতে থাকে। আমরা সঙ্গে-সঙ্গে এখানে নিয়ে এসেছি!”
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে ওই সিটে বসে পড়েছিলাম।
অনিলবাবু পাশে বসে বলেছিলেন, “আপনি শক্ত হন। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখানে দু’দিন রেখে তারপর কলকাতায় বাড়ির কাছে কোনও হাসপাতালে শিফ্ট করে নিয়ে যাবেন। এখন হাজার পাঁচেক জমা দিতে হবে।”
আমি কী বলব বুঝতে পারিনি। অত টাকা আমি পাব কোথায় এখন?
অনিলবাবু আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলেছিলেন, “আমরা জমা করিয়ে দেব আজ। জোগাড় করতে লোক পাঠিয়েছি। জাস্ট বললাম আপনাকে। আপনি কাল-পরশু মিটিয়ে দেবেন। তবেই হবে।”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “বাবাকে দেখব।”
“আসুন। আমি পারমিশন করিয়ে নিয়েছি। আইসিসিইউ-তে আছে তো। ভিতরে যেতে দেবে না। আপনি বাইরের থেকে মানে কাচের এপার থেকে দেখবেন।”
আমি অনিলবাবুর সঙ্গে গিয়েছিলাম দোতলায়। লিফ্ট আছে। কিন্তু শুধু রোগীদের জন্য। আমরা হেঁটেই উঠেছিলাম উপরে। একটা কাঠের বড় দরজা। বাইরে লেখা ‘আইসিসিইউ’। জুতো খোলার নোটিশ টাঙানো।
আমরা জুতো খুলে কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকেছিলাম ভিতরে। ভিতরটা ঠান্ডা। ওষুধের গন্ধে চোবানো। সামনে আর-একটা কাঠের পার্টিশন। আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম।
বাবা শুয়েছিল একটা পরদা দিয়ে আলাদা করা বিছানায়। চোখ বন্ধ। স্যালাইন চলছে। মাথার কাছে মনিটর। আচমকা আমার সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। বুকের ভিতর খাবার আটকে যাওয়ার মতো কষ্ট হয়েছিল একটা। মনে হয়েছিল অক্সিজেন কমে গিয়েছে চারিপাশে।
“আপনি কাঁদবেন না,” অনিলবাবু আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলেন, “এমন তো হয় জীবনে। কত মানুষের হয়েছে। তারা সামলেছে, আপনিও পারবেন।”
আমি নীচে নেমে প্রথমেই জেঠুকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম মাকে একটু বুঝিয়ে বলতে। জেঠু সঙ্গে-সঙ্গেই আসতে চেয়েছিল। আমি বারণ করেছিলাম। কারণ এখন তো কিছু করার নেই। পরের দিন টাকা নিয়ে তো আসতেই হবে। তখন আসবে!
আমি বারান্দায় থেকে সরে এলাম। মেঘ করছে এখন। এবার বর্ষায় বৃষ্টি নেই তেমন। সারাক্ষণ একটা দম চাপা ভাব হাওয়ায়! এমন দিনগুলোয় আমার কেমন যেন লাগে! আগে এমন বেকার দিনগুলোয় আমি ভবানীপুর চলে যেতাম। রিয়ান থাকুক বা না-থাকুক ওর বাড়িতে যেতাম। কাকিমার সঙ্গে গল্প করতাম। রিয়ানের ঘরে ঢুকে ওর বিছানায় শুয়ে থাকতাম। গান চালিয়ে শুনতাম। বইপত্তর গুছিয়ে দিতাম।
কাকিমা সব দেখত আর হাসত। বলত, “এখন থেকেই সব দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছিস? ও কিন্তু খুব স্বার্থপর রাজি, তোকে কষ্ট দেবে বলে দিলাম।”।
আমি ভাবতাম না ওসব। কত ছোট থেকে ওকে দেখেছি। শুধু ওকেই দেখেছি! আর কারও দিকে কোনও দিনও চোখ যায়নি। ও কেন কষ্ট দেবে আমায়? ও তো বোঝে আমি কত ভালবাসি ওকে! সব কি আর মুখে বলতে হয়!
রিয়ান বরাবর একটু চাপা স্বভাবের। একটু আনমনা। খেয়ালি ধরনের। দেখতেও খুব সুন্দর। ভাল গান করে। গিটার বাজায়। পড়াশোনাতেও খুব ভাল। ফলে একটু বড় হতেই দেখতাম মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই ওর দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। আমি নিজে ওর ব্যাগে মেয়েদের লেখা চিঠি পেয়েছি। ওর মোবাইলে প্রেমের মেসেজ দেখেছি। কিন্তু কোনও দিন আমার হিংসে হয়নি। রাগ হয়নি। কারণ রিয়ান তো এসব পাত্তাই দিত না। নিজেই আমায় দেখাত আর বলত, “এদের খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই? আর দেখ রাজি, কত বানান ভুল!”
আমার এখনও মনে আছে সেই ইলেভেনে পড়ার সময় আমি আর রিয়ান এমন মেঘলা দিনগুলোয় ওদের বাড়ির ব্যালকনিতে বসে এইসব চিঠি পড়তাম। আর হাসতাম। আর হাসতে-হাসতে হঠাৎ রিয়ান কেমন চুপ করে যেত। মনে হত এই তো ছেলেটা এক্ষুনি এখানে ছিল, আর এই নেই!
ওই সময়টা আমি কিছু বলতাম না ওকে। শুধু ওর গা ঘেঁষে বসে থাকতাম। ওকে দেখতাম। মনে পড়ত ক্লাস সেভেনের সেই পিউ ব্যানার্জির প্রশ্ন, “কিস করেছিস?”
আমার খুব ইচ্ছে করত ওই আনমনা হারিয়ে যাওয়া রিয়ানটাকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে। ওর ওই ছোট্ট দুটো ঠোঁটকে আমার ঠোঁটের মধ্যে আঁকড়ে ধরতে। ইচ্ছে করত পিউকে জানাতে যে আমি চুমু খেয়েছি রিয়ানকে! মনে-মনে লক্ষবার!
রিয়ান বেশিক্ষণ বসত না। উঠে পড়ত। তারপর গিয়ে দাঁড়াত বারান্দার কিনারায়। বলত, “একদিন জানিস, সব ছেড়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব। কেউ আমায় আর খুঁজে পাবে না!”
রিয়ান ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি আর ওকে খুঁজে পাচ্ছি না। এত দিন হয়ে গেল আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি ও। কাকিমার থেকে জেনেছি যে নতুন শহরে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে রিয়ান। খুব ব্যস্ত। শুনেছি নানিয়া ধীলোঁ নামে একটি পাঞ্জাবি মেয়ে নাকি ওকে খুব হেল্প করছে। তার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়েছে।
কথাটা শোনার পর থেকেই বুঝেছি আমার বুকের মধ্যে বেশ কিছু মৌমাছি বাসা বেঁধেছে। আর ওই কথাটা মনে পড়লেই তারা আমার বুকে কুট কুট করে হুল বিঁধিয়ে দিচ্ছে!
“রাজি, তোর বাবা ঘুমিয়েছে?” আমি মায়ের প্রশ্নে পাশে তাকালাম। মাকে কেমন যেন লাগছে। ফরসা মুখটায় একটা মেঘলা ছায়া। চোখের তলায় কালি। এই ক’দিনেই মা ভাঙা জমিদার বাড়ির মতো হয়ে গিয়েছে।
আমি সেদিন লিলুয়া থেকে বাড়িতে ফিরে দেখেছিলাম মা জবুথবু হয়ে বসে রয়েছে। পাশে জেঠিমা বসে। কাকিমাও এসে গিয়েছে ভবানীপুর থেকে!
মা আমায় দেখেই হাউমাউ করে উঠে বলেছিল, “এ কী হল রাজি? আমাদের এ কীরকম সর্বনাশ হল! এবার কী হবে? আমাদের এবার কী হবে?”
ওই অবস্থায় আমার মায়ের জন্য কষ্ট হলেও কোথায় যেন একটা খারাপ লাগাও উঁকি দিয়েছিল সামান্য! মা এটা কী বলল! বাবার শরীর খারাপ। সেটার চেয়ে আমাদের কী হবে সেটা কি বড় হল! বাবা কি আমাদের শুধু সিকিউরিটি? আর কিছু কি নয়?
মা আরও কিছু বলছিল। কাঁদছিল। বিছানায় মাথা ঠুকছিল। জেঠিমা আর কাকিমা মাকে সামলাবার চেষ্টা করছিল। আমি কিছু না বলে চুপ করে সরে এসেছি বারান্দায়। আমাদের বারান্দাটা থেকে কিছুটা আকাশ দেখা যায়। আমি সেইদিকেই তাকিয়েছিলাম। ঘোলাটে লাগছিল সবটা। উজ্জ্বল কিছু গ্রহ-নক্ষত্র ছাড়া বাকি সবটাই কেমন যেন আউট অফ ফোকাস হয়ে যাওয়া ছবি। আমি ভাবছিলাম, বাবার অসুখ সারতে সময় লাগবে অনেক। ফ্যাক্টরি বন্ধ। তার মানে আমাকে আরও জোর দিয়ে খুঁজতে হবে কাজ! আর তখনই মনে পড়েছিল সুজাতাদির কথা। সেই আকাশ বাসুর কথা। পাকা চাকরিটা রাখা ছিল আমার জন্য। কিন্তু হল না! আমার কপাল! সুজাতাদি সকালে বলেছিল লেভেল টু কমপ্লিট! আসলে আমার খেলাটাই যে শুরু হয়নি সেটা বুঝতেই পারেনি!
দু’দিন পরে আমরা বাবাকে নিয়ে এসেছিলাম এদিকে। জেঠুর জানাশোনা ছিল তাই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করতে অসুবিধে হয়নি। সেখান থেকে কয়েক দিন হল বাড়িতে এসেছে বাবা। সেরেব্রাল অ্যাটাকের ফলে ডান দিকটা একটু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওষুধ চলছে। গতকাল থেকে ফিজ়িয়োথেরাপিও শুরু হয়েছে। আমি জানি নার্স রাখতে পারলে ভাল হয়, কিন্তু সম্ভব নয়। টাকায় কুলিয়ে উঠব না। আমি আর মা মিলেই সবটা করছি!
এর পাশাপাশি আমি আরও টিউশনের চেষ্টাও করছি। হাবিবুরদাকে বলেছি। চেনাশোনা আরও কয়েকজনকেও বলেছি। একজন বলেছে ক্লাস ইলেভেনে ইকোনমিক্স পড়াতে হবে এমন দু’-চারটে ছেলেমেয়ে জোগাড় করে একটা ব্যাচ করে দেবে। তাই পড়াব। চাকরি যখন হচ্ছে না, কিছু তো একটা করতে হবে। আমি জানি এই ক’দিনেই যা খরচ হয়ে গিয়েছে তাতে পরের মাস থেকেই ব্যাঙ্কের টাকায় হাত পড়বে। তার আগে যে করেই হোক আমায় কিছু একটা করতে হবে।
“কী রে?” মা ধাক্কা দিল আমায়, “আজকাল কী হয়েছে তোর? এমন পাথর হয়ে যাস কেন মাঝে-মাঝে? উত্তর দিচ্ছিস না!”
আমি বললাম, “হ্যাঁ মা, ঘুমিয়েছে!”
মা বিরক্ত গলায় বলল, “তোরা আমায় কী পেয়েছিস বল তো? কেউ শান্তি দিবি না একটুও! তোর বাপ ওইদিকে পড়ে আছে। তোর ভাইটা অমানুষ। বাড়ির এই অবস্থা জেনেও পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছে! আর তুই! দশবার জিজ্ঞেস করলে একবার উত্তর দিস! আমায় ঝি পেয়েছিস? তোদের সবার খিদমত খাটতে এসেছি এই বাড়িতে? তেল নেই রান্নার! আটা ফুরিয়েছে! কে এনে দেবে এগুলো আমায়? ভূত? আমি নিজে যাব আনতে এই পা নিয়ে? তোদের কারও লজ্জা করে না!”
আমি ক্লান্তভাবে তাকালাম মায়ের দিকে। কান দুটো যদি আপনা থেকেই বন্ধ করে দিতে পারতাম! তেল, আটা সব আমিই আনব। যা করার আমিই করব। মা-ও সেটা জানে। কিন্তু তাও কেন এমন করে বলে কে জানে!
মা আরও কিছু বলত কিন্তু পারল না। নীচের সিঁড়ির থেকে ‘রাজি’ বলে একটা গলা শুনতে পেলাম। অবাক হয়ে গেলাম আমি। সুজাতাদি! এখন!
আমি ঠোঁট কামড়ালাম! সেদিনের পর থেকে সুজাতাদিকে আর ফোন করা হয়নি আমার। মানে বাবার ব্যাপারটা জানানোই হয়নি!
মা কথা না বলে অবাক হয়ে তাকাল সিঁড়ির দিকে। দেখলাম সুজাতাদি উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। পিছনে লম্বা মতো একটা ছেলে।
আমি এগিয়ে গেলাম, “সুজাতাদি তুমি!”
সুজাতাদি উপরে উঠে দম নিল একটু, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠাস করে তোকে একটা চড় মারব। তুই এত বড় বেয়াদপ জানতাম না তো!”
আমি চোখটা বন্ধ করে মাথা নিচু করে নিলাম। বাইরের লোকের সামনে এ কী কথা বলছে সুজাতাদি!
সুজাতাদি বলল, “এত কিছু ঘটে গেছে আমায় বলিসনি? তুই মানুষ! আমি তাই ফোন করিনি আর! নিজেই চলে এসেছি।”
আমি আর মা কী বলব বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সুজাতাদি পিছন ফিরে ছেলেটাকে বলল, “তুই ব্যাগটা রাখ, হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন?”
ছেলেটা হাসল। তারপর কোথায় রাখবে বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, “আমায় দিন।”
ছেলেটা হেসে আমার হাতে ব্যাগটা দিল।
সুজাতাদি বলল, “এতে কিছু ফল আর হেল্থ ড্রিঙ্কস আছে।”
মা আমতা-আমতা করে বলল, “এসব আবার…”
সুজাতাদি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল “বেশ করেছি! আপনিও বকুনি খাবেন এবার। আপনি তো আমায় একটা খবর দিতে পারতেন! যাই হোক আমায় নিজের লোক মনে করেন না, আমি আর কী বলি!”
“না, না সুজাতাদি…”
“তুই একটা কথাও বলবি না,” সুজাতাদি আমার হাতটা চেপে ধরল, “গতকাল খবর পেয়েছি। তারপর আজ সকালে ও এল। বললাম নিয়ে চল।”
আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম।
সুজাতাদি বলল, “ও! তোদের তো আলাপ করানো হয়নি। তোরা কে ও জানে। আর ও হল আকাশ। আকাশ বাসু।”
আমি যেন ইলেকট্রিকের শক খেলাম। এই সেই আকাশ! আমি চট করে তাকালাম সুজাতাদির দিকে। সুজাতাদিও যেন আমার এই দৃষ্টিটার জন্যেই ওয়েট করছিল। আমার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “নে, আমি আবার লেভেল ওয়ান কমপ্লিট করে দিলাম। তবে এবার যদি ঘেঁটেছিস তবে দেখিস তোকে আমি কী করি!”
ছয়
রিয়ান
শুক্রবার বিকেল চারটের গড়িয়াহাট মোড়টা কেমন হয়? কতজন লোক সেখানে চিৎকার করে একসঙ্গে? কতজন মানুষ সিগনাল-টিগনাল তুচ্ছ করে চলন্ত বাস, অটো আর গাড়ির ভিতর দিয়ে প্যাকম্যান খেলার মতো এদিক ওদিক করে রাস্তা পেরোতে চায়? ক’জন ট্রাফিক পুলিশ বালিগঞ্জ ফাঁড়ি, গোলপার্ক, রাসবিহারী আর বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে থেকে ধেয়ে আসা গাড়ির স্রোত সামলাতে হিমসিম খায়? বিকেল চারটের গড়িয়াহাটে দাঁড়ালে মনে হয় না কি যে পৃথিবীর সব রাস্তা, সব মানুষ আর সব গাড়ি এই মোড়টা ছুঁয়েই যায়! মনে হয় না কি এই জনবিস্ফোরণের প্রভাব হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও সাংঘাতিক!
আমি ঘড়ি দেখলাম। বিকেল চারটে বেজে দশ মিনিট। আকাশে কমলা রঙের ফোটন থিকথিক করছে, কিন্তু আমার আশপাশটা কী শান্ত! নির্জন! রাস্তায় এত কম লোক! এত কম গাড়ি! এখানের সব লোকজন আর গাড়ি-ঘোড়া গেল কোথায়? গড়িয়াহাট মোড়ে?
আমি রাস্তার ডানদিকে ‘ক্যাফে ব্রাজ়িল’ নামের দোকানটার দিকে তাকালাম। শরথ আমার সঙ্গেই ছিল, একটু আগে ওই দোকানে গিয়ে ঢুকল। ওর কোর্সের একটা মেয়ে নাকি আজ ট্রিট দেবে।
আজ কলেজে কনফারেন্স ছিল। কিন্তু সময়ের একটু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে পড়তে বসব। এখানে পড়া আর কলেজ যাওয়া আর আবার পড়া ছাড়া কোনও কাজ নেই।
সপ্তাহে একদিন আমি গ্রোসারিতে যাই কেনাকাটা করতে। বিশাল ট্রলি ঠেলে-ঠেলে দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি। একটি পাথরের মতো মেয়ে আমার দিকে কাচের চোখ নিয়ে তাকিয়ে বিল করে। আমি টাকা মেটাই। তারপর সেইসব মালপত্তর টানতে-টানতে বাড়ি নিয়ে আসি।
যখন কলকাতায় থাকতাম আর বিদেশ থেকে ছাত্ররা ছুটিতে বাড়ি আসত তাদের কথা শুনে যে পৃথিবীর ছবিটা দেখতে পেতাম, এখানে এসে দেখলাম সেই পৃথিবীই এটা, শুধু তাদের না বলা স্পেসবারগুলো এখানে অনেক বেশি ‘ক্লিক’ করা আছে! এখন বুঝতে পারছি আসলে লোনলিনেস বলতে কী বোঝায়।
আমার বাবা একটি বেসরকারি অফিসের সেল্স ম্যানেজার ছিল। খুব ভাল কথা বলতে পারত বাবা। দেখতেও খুব সুন্দর ছিল। লম্বা, শ্যামলা গায়ের রং। কাটা-কাটা চোখ মুখ। থুতনিতে খাঁজ। আমি ছোট থেকেই বুঝতাম বাবা যখন কথা বলত আশপাশের সবাই খুব মন দিয়ে শুনত সেই কথা। মা-ও বোধহয় তাই অমন করে বাবার প্রেমে পড়েছিল।
ছোট থেকেই বাবার ন্যাওটা আমি। বাবা খুব ট্যুর করত। সারা ভারতে ঘুরতে হত বাবাকে। বাবার কোম্পানি বিভিন্ন ল্যাব অ্যাপারেটাস বানাত। বাবা সেসবের মার্কেটিং-এর জন্যই দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেত। মায়ের সঙ্গেই আমার সময় কাটত বেশি। তবে বাবা এলেই বাবার কাছে ঘুরঘুর করতাম আমি। কত গল্প বলত বাবা! কত সুন্দর-সুন্দর জিনিস কিনে আনত!
আর ছিল রজতকাকু। বাবার বন্ধু। কী করে দু’জনের বন্ধুত্ব হয়েছিল আর মনে নেই। কিন্তু এই শান্ত ভদ্র মানুষটি আসত আমাদের বাড়িতে। নানা কাজকর্ম করে দিত। আর রজতকাকুর সঙ্গে আসত রাজিতা। মানে আমাদের রাজি।
বাবা যখন ছুটি পেত আমরা ঘুরতে যেতাম। কখনও-কখনও রজতকাকুরাও যেত আমাদের সঙ্গে। রিশপ বলে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম আমরা। এখনও মনে আছে সেখানে জীবনের প্রথম তুষারপাত দেখেছিলাম! কত বয়স তখন আমার? এই তেরো!
আমরা যে কাঠের কটেজটায় ছিলাম, সেদিন তার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম আমি আর রাজি। সামনে আকাশ থেকে ঝরে পড়েছিল নরম বরফের তুলো। রাজি হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল আমার। মনে আছে ও বলেছিল, “এমন যদি সারা জীবনটা হত!”
সে সময় আমার জীবন খুবই আনন্দের ছিল। ভাল বাবা-মা, ভাল স্কুল। মন দিয়ে পড়াশোনা। ভাল বন্ধুবান্ধব। সব যেন ঝুলনে সাজানো ছবি!
সেদিনের ওই রিশপের কটেজটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, এমন সুন্দরভাবেই হয়তো কেটে যাবে আমার বাকি জীবনটা! তখন বুঝতে পারিনি জীবনের অলিগলিতে অচেনা আততায়ী দাঁড়িয়েই থাকে তার চকচকে ছুরি হাতে। বুঝতে পারিনি ‘ভাল সময়’ আসলে একটা কনসেপ্ট মাত্র! কোনও উপন্যাসের নাম হিসেবে সবচেয়ে প্রযোজ্য!
টিংটিং করে পকেটের ফোনটা নড়ে উঠল। আমি বের করে দেখলাম সামুদা।
সামুদা বলল, “কী রে রিয়ান আজ কী করছিস সন্ধেবেলা?”
আমি বললাম, “পড়তে বসব অ্যাজ় ইউজ়ুয়াল!”
সামুদা বিরক্ত হল যেন, “শালা মাড়োয়াড়িদের ব্যাবসা আর তোর পড়াশোনা কোনওদিন পালটাল না! এত পড়িস কেন?”
আমি হাসলাম, “কী করব সামুদা! তুমি তো জানোই আমাদের ওখানে যা পড়ে এসেছি তা কম সে কম টু ডিকেড্স ব্যাকের ইকোনমিক্স। এখানে সব এত অ্যাডভান্সড! সব এত ম্যাথম্যাটিকাল আর স্ট্যাটিসটিক্যাল যে ভাবা যায় না! আমায় সত্যি খুব খাটতে হচ্ছে!”
“দূর”, সামুদা আমার কথায় পাত্তা দিল না, “আমি আসব রাত ন’টা নাগাদ। তোর ফ্ল্যাটে রাত কাটাব আজকে। রান্না করিস না আমি খাবার কিনে আনব। তবে তোর ওই শরথ মালটাকে কাছে আসতে দিবি না কিন্তু। এখন থেকেই পড়তে বসে যা। রাতে পড়া আছে বলে ঢ্যামনামো করবি না। বুঝলি?”
সামুদার কথা বুঝব না তা কি আর হয়! আমি ফোনটা কেটে হাসলাম।
আজ কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি আর বাস ধরিনি। সব সময় বাসে করে যেতে ভাল লাগে না আমার। এসএমইউ থেকে আমার বাড়ি এক মাইলের একটু বেশি। এটা আমার কাছে কোনও দূরত্বই নয়। আগে তো প্রায় নিয়ম করে আমি পার্ক স্ট্রিট থেকে ভবানীপুরে হেঁটে ফিরতাম। বোসপুকুরের কাছে আমার বন্ধু রনি আর শ্রীপর্ণার বাড়ি থেকে আমার বাড়িতে হেঁটে ফিরতাম।
ওই সেই ভিড়ের ভিতর দিয়েও হাঁটতে ভাল লাগত আমার। আর এখানে এমন সুন্দর নির্জনতা আমায় যেন আরও বেশি করে হাঁটতে বলে!
শরথ আমায় বলেছিল ওর সঙ্গে ওই ব্রাজ়িল ক্যাফেতে যেতে। কিন্তু আমি বারণ করে দিয়েছি। আরে আমি পাগল নাকি! ওদের ডিপার্টমেন্টের কাউকে আমি চিনি না। সেখানে যাব কেন?
এখানে একটা জিনিস আমি দেখেছি যে, কেউ খুব একটা কারও গায়ে পড়ে না। সবাই সবাইকে স্পেস দেয়। অন্যকে বিরক্ত করে না। এখানে ‘ইউ ফার্স্ট’ ব্যাপারটাই যেন রীতি। সবাই লাইনে দাঁড়ালেও একটা দূরত্ব রাখে। হ্যাঁ, হ্যাঁ করে অন্যের কানের কাছে হাসে না। প্যান্টের চেন খুলে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে না। সিগারেট খেতে-খেতে এমন করে হাঁটে না যেন রাস্তাঘাট সবটাই তাঁর পিতৃদত্ত সম্পত্তি!
আমাদের দেশের চেয়ে এই দেশটা অনেক পরিষ্কার। সাজানো। অনেক বেশি সচল। আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি এখানে এসে! কলকাতা আমায় কষ্ট ছাড়া কিছু দেয়নি! সেই চোদ্দো বছর থেকে এই পঁচিশ বছর বয়স অবধি শুধু মনখারাপ আর অপমান নিয়েই যেন বেঁচেছিলাম। যাকে সবচেয়ে ভালবেসেছিলাম তার জন্যই আমার জীবনটা বিষ হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম ওই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে। তাই এখন আমার হালকা লাগে খুব। এই যে একা-একা হাঁটছি মনে হয় ভেসে যাচ্ছি মেঘের ভিতর।
এখানে আরও একটা জিনিস দেখলাম সেটা হল কাজের গতি! আমি এখানে যেসব কাজ সেরেছি, সে কলেজ বা সরকারি দপ্তর যেখানেই হোক, কোথাও আমায় হ্যারাস্ড হতে হয়নি! কেউ টাকা চায়নি। নির্লজ্জভাবে ঘুষের কথা বলেনি! আমার কাছে এটা খুব অবাক লেগেছিল! আমাদের শহরটার কথা মনে পড়ছিল। যেখানে অটোচালক থেকে সবজি বিক্রেতা সবাই মেজাজ না দেখিয়ে কথা বলতে পারে না। ঘুষ ছাড়া কোথাও কোনও ফাইল নড়ে না। মরণাপন্ন রোগীকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দালালরা নিজের টাকার জন্য চাপ দেয়। নেতারা সরকারি টাকাকে নিজের উপার্জনের টাকা ভেবে ফেলে! ছোট জামা পরলে মেয়েদের উদ্দেশ্যে নোংরা কথা ও হাত ছুটে আসে! সাফল্যকে টাকা আর জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে মাপা হয়। মনে হয় গোটা দেশটাই যেন টিকিট কাউন্টার হয়ে গিয়েছে! পরিষেবা বলে কিছু নেই। সবটাই ফেলো কড়ি মাখো তেল! এমন একটা দেশে কী করে আমি ছিলাম! কী করে অন্য মানুষজন ঠান্ডা মাথায় এখনও আছে! কেন আমার দেশে প্রতি মিনিটে বিপ্লব হয় না? কী করে আমরা এতটা ধৈর্যর অধিকারী হলাম? কে আমাদের শিরদাঁড়াগুলো খুলে নিয়েছে? এত কোটি-কোটি লোকের শিরদাঁড়ার হাড় দিয়েই কি চারিদিকের নানা উৎসবের প্যান্ডেল হচ্ছে? এই উৎসব শেষ হবে কবে? আমরা কবে হাততালি দেওয়া ছাড়াও দুটো হাতের অন্য ব্যবহার করব! শুধু সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সেলফি, পণ্ডিতি আর নেশা করা নিয়ে হামবড়াই করে যাব? শুধু ফুকো, লাকা, দেরিদার কথাই শুনব? ছোটবেলায় বলা মায়ের কথা শুনব না? মা যে মানুষ হতে বলেছিল সেটা ভুলে যাব?
আমি নিজেকে শান্ত করলাম। জানি এসব ভাবনার কোনও মানে নেই! আমি নিজেই তো এই দেশে পালিয়ে এলাম। ওই দেশে থেকে তো কিছুই করলাম না, করতে পারলাম না। আমি তো সেই চোদ্দো বছর বয়স থেকেই আমার শহর ছেড়ে পালাতে চেয়েছি! সরে আসতে চেয়েছি ওই সবকিছুর থেকে। তাই আমার মুখে সমালোচনা মানায় না।
আমি হাঁটতে লাগলাম। এই পথে এলে আমায় বেশ কিছুটা ঘুরতে হয়। অ্যামসবেরি ড্রাইভে হেঁটে যেতে হলে অন্য পথও আছে। কিন্তু ওই যে শরথ বলেছিল ওর সঙ্গে যেতে, তাই এসেছি।
আমি সামনের ফনড্রেন ড্রাইভ ধরে ডানদিকে বাঁক নিলাম। এখন বাড়ি যাব তারপর পড়তে বসব। সামনে কিছু অ্যাসাইনমেন্ট আছে। সেগুলো শেষ করতে হবে। টার্মের শেষে একটা পরীক্ষা হবে, তাতে পাশ না করতে পারলেই তো দেশে ফিরে যেতে হবে। আমি কোনও মতেই আর ওইদিকে যেতে চাই না! আবার মামাদের কথার সামনে পড়তে চাই না। দেখতে চাই না রাতে বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বসে রয়েছে মা!
“হাই রিয়ান!”
গলাটা শুনে আমি একটু থমকে গেলাম। পাশে একটা দামি গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। কলকাতায় এসব গাড়ি দেখা যায় না। এই ইউনিভার্সিটিতে বহু ছাত্র আছে যারা নানা দামি-দামি গাড়ি করে পড়তে আসে!
আমি দেখলাম নীল রঙের কনভার্টিব্লটার ভিতর বসে রয়েছে ইয়ানা। একটু থমকে গেলাম। এখানে ক্লাসের বাইরে পড়া বোঝা ছাড়া আর কেউ বিশেষ কোনও টিচিং স্টাফের সঙ্গে কথা বলে না। আমি যদিও সরাসরি ওদের টিচার নই, তাও আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্তরে আমায় টিএ বা টিচিং অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে হয়। ইউনিভার্সিটি যে-টাকাটা আমায় স্টাইপেন্ড হিসেবে দেয় সেটা আমার মুখ দেখে নয়! সপ্তাহে কুড়ি ঘণ্টা আমায় তার জন্য কাজ করতে হয়।
ইয়ানা মেয়েটা আন্ডার গ্র্যাডের। আমি দেখেছি৷ মানে না দেখে উপায় নেই আর কী! এমন ফিগার দেখে যদি ছেলেরা না তাকায় তবে জানতে হবে সে নিজের জেন্ডার সম্বন্ধে এখনও সঠিক তথ্য পায়নি! তার উপর টেনিস খেলে, সাঁতার কাটে! আরও কী-কী করে কে জানে! আমার তো দেখলে মনে হয় চন্দ্র সূর্য যে-মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে তার পিছনেও ইয়ানার হাত আছে! কিন্তু মনে হ্যাংলামি থাকলেও মুখে তো আমি স্যার ওদের!
তাই গম্ভীর হয়ে বললাম, “সরি!”
ইয়ানা হাসল, থিক অ্যাকসেন্টে বলল, “স্তপ প্রিতেন্ডিং। ইউ নো মি। আমি যখন টেনিস খেলি তুমি আমায় দেখো।”
লজ্জা-লজ্জা! আমি ভাবলাম হে ধরণী দ্বিধা হতে দ্বিধা কোরো না! তাকিয়ে দেখলাম নীল চোখ, সোনালি চুল, গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট! আরে বাবা এমন মেয়েদের ছবি তো আমি শ্যাওলা ধরা বাথরুমের চল্লিশ পাওয়ারের আলোর তলায় লুকিয়ে দেখতাম! আর তেমন একজন নিজে আমার সঙ্গে কথা বলছে! আর শুধু তাই নয়, এও বলছে আমি ওকে টেনিস খেলতে দেখতাম! তার মানে খেলার ফাঁকে ও নিজেও আমায় দেখত! শিবরাম জানলে কী বলতেন এই নিয়ে!
আমি আমতা-আমতা করতে লাগলাম। খুব ধরা পড়ে গিয়েছি। ইয়ানা আমায় গাড্ডায় পড়তে দেখে খুব হাসল। ভারী মজা পেয়েছে!
“তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
আমি বললাম, “অ্যামসবেরি ড্রাইভের দ্য চেস-এ আমি থাকি। বাড়ি যাচ্ছি।”
“আমি পৌঁছে দেব?”
আমি অবাক হলাম। আরে একেই কি পুরনো দিনের লোকজন সুবর্ণ সুযোগ বলত! মানে এমন ‘এফ’ টিভি টাইপের মেয়েদের নিয়ে ফ্যান্টাসি করার বুকের দমও আমার নেই! সেখানে সে একদম আমায় লিফ্ট দিতে চাইছে!
আমি তাকিয়ে রইলাম ইয়ানার দিকে। ভগবান আমাদের মতো মানুষদের নিজের ট্রেনিদের দিয়ে বানিয়েছেন। কিন্তু ইয়ানাকে বানিয়েছেন নিজের হাতে নাকের ডগায় চশমা নামিয়ে চোখে হাই পাওয়ারের লেন্স পরে! এত সুন্দর কী করে দেখতে হয় কাউকে? অমন খাঁড়া নাক! বড়-বড় চোখ! অমন খাঁজ কাঁটা কিউপিড বো বসানো ঠোঁট! আলতো টোল পড়া থুতনি! এর গাড়ি কি সাধারণ গাড়ি হতে পারে! এর গাড়ির নাম তো পুষ্পক রথ! এমন গাড়িতে বসার ভাগ্য কি আমার হবে?
আমি জানি পৃথিবীতে বিনি পয়সায় কিছু হয় না! ফ্রি লাঞ্চ শুধু আমাদের দেশের স্কুলগুলোয় হয়। তাও তার গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট অসন্তোষ আছে। তাই এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এমন একটি মেয়ে যেচে আমায় গাড়িতে লিফ্ট দেবে সেটা তো এমনি-এমনি নয়! আমি বুঝতে পারছি বাঘ বাবাজি সামনে বাঁধা ছাগলটিকেই দেখতে পাচ্ছে শুধু, পাতার আড়ালে মাচায় লুকিয়ে থাকা বন্দুকবাজটিকে দেখতে পাচ্ছে না!
“প্লিজ় হপ ইন,” ইয়ানা গাড়ির দরজাটা খুলে দিল।
আমি ভয়ে-ভয়েই বসলাম। জানি না এবার কী প্রস্তাব আসছে।
গাড়িটা স্টার্ট করে ইয়ানা বলল, “সিত কামফারতেব্লি। আই দোন্ত বাইত।”
আমি জানি সেই ‘বাইট’ খাওয়ার ভাগ্য আমার হবে না!
ইয়ানা হাসল, “ইউ হ্যাভ আ নাইস স্মাইল। তোমার আরও বেশি হাসা উচিত।”
আমি খুশি হতে গিয়েও কেমন যেন চমকে উঠলাম। এই কথাটা আগেও শুনেছি আমি। সেই তেরো বছর বয়সে। সেই রিশপে।
সেই যে রাজি বলেছিল, “এমন যদি সারা জীবনটা হত!”
তার উত্তরে আমি হেসেছিলাম শুধু। তাতে রাজি আমার হাতটা আলতো করে ধরে বলেছিল, “তুই হাসিস না কেন? এত সুন্দর হাসি! ইউ শুড স্মাইল মোর অফন।”
“কী হল?” ইয়ানা বলল, “কী ভাবছ?”
আমি হাসলাম। মাথা নেড়ে বললাম, “কিছুই না।”
ইয়ানা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আই নিদ ইয়োর হেল্প।”
আমি হাসলাম আবার। না ওই প্রশংসা শোনার হ্যাংলামিতে নয়! হাসিটা আপনা থেকেই বেরিয়ে এল। কারণ এবার ওই বন্দুকবাজটিকে দেখতে পেলাম যে!
ইয়ানা বলল, “আমার স্ট্যাটিসটিক্সটা খুব উইক। এ ছাড়াও আরও কয়েকটা সাবজেক্ট আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
আমি সময় নিলাম একটু। তারপর বললাম, “প্রফেসররা তো আছেন তাঁরা তো হেল্প করেন।”
ইয়ানা বলল, “হ্যাঁ করেন। কিন্তু আমার আরও একটু বেসিক লেভেলে হেল্প দরকার। মানে অনেক কিছুই আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
আমি বললাম, “তোমায় কে বলল যে, আমি হেল্প করতে পারব?”
ইয়ানা হাসল, “আই কিপ মাই ইয়ার্স ওপেন। আমি শুনেছি যে, তোমার স্কোর খুব ভাল। ফুল স্কলারশিপে এসেছ!”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। এমন প্রস্তাব খারাপ নয়। কিন্তু এখানে এসে এমন টিউশন জুটবে ভাবিনি।।
ইয়ানা বলল, “আমায় বাবা এখানে পড়তে দিতে চায়নি। কিন্তু আমি এখানেই পড়তে চেয়েছি। বাবা তাই রেগে আছে। ভাল রেজ়াল্ট না হলে মুশকিল হবে। আমি তো স্কলারশিপে আসিনি। তবে টাকাটা আমাদের সমস্যা নয়। বাবার ইগোটাই সমস্যা। তাই যদি আমি রেজ়াল্ট ভাল না করতে পারি এই সেম-এ আমায় আর এখানে থাকতে দেবে না!”
এক নিশ্বাসে কথাটা বলে থামল ইয়ানা। তারপর আমার মুখের দিকে তাকাল। মানে এবার আমার ডায়ালগ!
কিন্তু কী বলব? সব ভুলে গিয়েছি তো! এত কাছে এমন করে একজন বসে থাকলে কি কিছু মাথায় ঢোকে?
রাজি বলত, “তুই সুন্দরী মেয়েদের সামনে গেলে এমন হয়ে যাস কেন রে? কথা বলতে পারিস না? শুধু…”
আমি জিজ্ঞেস করতাম, “কী শুধু?”
রাজি বলত, “শুধু আমার সামনে কথার মস্তানি! আমায় শুধু অবহেলা!”
আমি হেসে বলতাম, “তুই সুন্দরী নাকি? তাই তো তোর সামনে আমি নরমাল থাকি।”
রাজি রাগ করে বলত, “আমি সুন্দরী নই?”
আমি বলতাম, “তোর বাড়িতে আয়না নেই?”
রাজি গম্ভীর হয়ে যেত। মাথা নিচু করে নিত। বলত না কিছু। আমি হাসতাম মনে-মনে। রাজি খুবই সুন্দরী! সেটা তো সবাই জানে! না হলে কি এমনি-এমনি এত ছেলে ওর পিছনে লাইন দেয়! আমি নিজেই তো বলেছিলাম একদিন, “তোর পিছনে যা লাইন, টিকিটের বন্দোবস্ত করলে কিন্তু সারা মাসের ইলেকট্রিক বিলের খরচ উঠে যাবে!”
রাজি উত্তর দিয়েছিল, “তোর খুব ভাল লাগে, না?”
আমি হেসেছিলাম, “খুব মজা লাগে!”
রাজি কিছু বলতে গিয়েও আর বলেনি। এবারও মাথা নামিয়ে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল!
সেদিন বুঝিনি, কিন্তু পরে আর-একদিন বুঝেছিলাম রাজির গম্ভীর হয়ে যাওয়ার অর্থ!
ইয়ানা বলল, “কী হল, তুমি চুপ করে থাকছ কেন? ইউ দোন্ত লাইক মাই কম্পানি, নো?”
এই সেরেছে! এ যে উলটো বুঝলি রাম! আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “না, না আমি চিন্তা করছি আর কী!”
ইয়ানা বলল, “এই এসএমইউ-তে স্পোর্টসের প্রসপেক্ট খুব ভাল। আমি এটা হারাতে চাই না। প্লিজ় হেল্প মি৷ আই উইল পে ইউ। চল্লিশ ডলার পার আওয়ার।”
চল্লিশ ডলার! আমি থমকে গেলাম। টাকাটা আমার দরকার! খুবই দরকার। মাকে কিছু টাকা পাঠাতে পারলে ভাল হয় প্রতি মাসে। এখানে যা দেয়, তাতে নিজেরই টেনেটুনে চলে, তাই মাকে কিছু পাঠাতে পারি না। কিন্তু আমি জানি মায়ের টাকার দরকার। মামাদের থেকে টাকা নিতে আমার খুব খারাপ লাগে! বিশেষ করে বাবার সম্বন্ধে যখন ওসব কথা শুনতে হয় তখন খুবই কষ্ট হয়। এমনিতে পোস্ট অফিসের এমআইএস থেকে কিছু টাকা পায় মা। কিন্তু সেটা বেশ কম। তাই মামাদের দেওয়া টাকাই ভরসা। মামারাও কখনও কার্পণ্য করে না। কোনও কিছুতেই বাধা দেয় না। মাকে ভালবাসে খুব। তবু বাবাকে নিয়ে কথা শোনায়। হয়তো তারা বোনের প্রতি ভালবাসা থেকেই শোনায় কথাটা। কিন্তু আমি মানতে পারি না। আজও বাবার নামে কেউ কিছু বললে আমার কষ্ট হয়। সব কিছু তার মুখে ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করে!
আমি দ্রুত হিসেব করে নিলাম। সপ্তাহে তিন ঘণ্টা পড়াতে হলেও মাসে প্রায় পাঁচশো ডলার। অনেক টাকা!
আমি বললাম, “ঠিক আছে। আই উইল। তবে আমি যখন অফিস হোল্ড করি তখনও তো দেখে নিতে পারতে। তোমায় বাড়তি টাকা দিতে হত না!”
ইয়ানা বলল, “বললাম না ওইটুকু টাইমে হবে না। আমার থরো লার্নিং চাই। প্লিজ়। প্লাস তখন তো আরও অনেকে আসে।”
আমি দেখলাম গাড়িটা আমাদের ইট রঙা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বললাম, “ঠিক আছে। এখানে আমি থাকি। তুমি এখানে আসতে পারো।”
ইয়ানা বলল, “থ্যাঙ্কস। তোমার কনট্যাক্ট নাম্বারটা দেবে?”
আমি দিলাম। এখানে কেউ কারও ফোন নাম্বার চট করে চায় না। সবাই ইমেলেই যোগাযোগ করে। এমনকী, প্রফেসরদেরও দেখছি একে অন্যের মোবাইল নাম্বার জানেন না!
আমি গাড়ি থেকে নেমে হাসলাম, “কবে থেকে শুরু করবে?”
ইয়ানা বলল, “নেক্সত মানদে। থ্যাঙ্কস রিয়ান। ইত্স আ প্রিতি নেম। আমি শুনেছি ইন্দিয়া ইজ় আ প্রিতি কান্ত্রি! সোমবার সন্ধেবেলা দেখা হচ্ছে। ওকে?”
পুষ্পক রথটি চলে যাওয়ার পর মনে একটা ভাল ফিলিং হল। না, সুন্দরী মেয়ের জন্য নয়। আমি জানি এসব শোকেসের জিনিস। আমার মতো বিপিএল-এর ছেলেদের জন্য নয়। আমরা কাচের দরজার ওপার থেকে সারা জীবন শুধু সার-সার টিভিতে রংচঙে ছবিই দেখে যাব! আসলে আমার ভাল লাগছে টাকাটার কথা ভেবে! মাকে দুশো ডলার পাঠাতে পারলেও অনেক!
আমাদের এই কমিউনিটিতে একটা ছোট্ট ঘরের মতো আছে। তাতে সবার লেটার বক্স থাকে। আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম কিছু এসেছে কি না! তারপর নিজের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে এগোলাম। কিন্তু দশ পা যেতে না যেতেই থমকে দাঁড়াতে হল আমায়! এটা কী দেখছি আমি!
আমি অবাক হয়ে দেখলাম বাড়ির সিঁড়িতে বসে রয়েছে নানিয়া! চোখ-মুখ লাল। ব্যাপারটা কী!
আমার পায়ের আওয়াজে নানিয়া মুখ তুলে দেখল আমায়। তারপর দৌড়ে এল আমার দিকে। আর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমায় জড়িয়ে ধরল প্রচণ্ড জোরে। আমি কোনওমতে নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে আটকালাম। নানিয়া চেপে ধরে রেখেছে আমায়! বুঝলাম ও কাঁপছে থরথর করে! কাঁদছে! আমি বুঝতে পারলাম ও একদমই ভাল নেই। নিজের মধ্যে নেই। শুধু বুঝলাম না কেন!
সাত
রাজিতা
পুজো আসছে। কলকাতার চারিপাশ ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে বাঁশ আর ব্যানারে। বাসের জানালা দিয়ে ঝুঁকে বাইরেটা দেখলাম। শিয়ালদা ফ্লাইওভার থেকে নেমেই বাসটা আটকে গিয়েছে। চারিদিকে থিকথিক করছে গাড়ি! দু’জন ট্রাফিক পুলিশ হাতে ম্যানপ্যাক নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না বিশেষ!
আমি ঘড়িটা দেখলাম। আজ যাব একটা জায়গায়। সেই সাগর সামন্ত বলে লোকটি আমায় একটা রেফারেন্স দিয়েছে।
পবন পোদ্দার বলে একজন ভদ্রলোক বাংলা ছবি করছেন। আর সেই কারণে প্লেব্যাকের জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন! সাগরবাবু তাকে আমার কথা বলেছেন। তাই সাগর সামন্তর রেফারেন্সে গত কয়েকদিন আগে আমি পবন পোদ্দারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। উনি আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। তবে সকালে আবার ফোন করে সেটা নিশ্চিত করে নিয়েছি!
জানি না কপালে কী আছে। আমি নিজের গানের একটা স্ক্র্যাচ বানিয়েছিলাম। সুজাতাদিই বানিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। সেটাই দিয়ে আসব ভদ্রলোককে।
আমি জানি না এতেও কিছু হবে কি না! তাও চেষ্টা ছাড়লে তো হবে না।
আমি আর আকাশ বাসুর কাছে যাইনি। হ্যাঁ, জানি আমার চাকরির দরকার। যে-কোনও একটা সম্মানজনক কাজ আমায় এখুনি পেতে হবে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমায় সুজাতাদির খামখেয়ালিপনায় হাওয়া দিয়ে যেতে হবে।
সেদিন সুজাতাদি যেই আমায় ওই ‘লেভেল’-এর কথা বলেছিল সঙ্গে-সঙ্গে আমার মাথার ভিতর পোকা নড়ে উঠেছিল। মানে কেবলই মনে হচ্ছিল সুজাতাদি আমায় কী ভেবেছে? সোশ্যাল ক্লাইম্বার? এটা কি ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’-এর শহর!
সুজাতাদি সেদিন ঘণ্টাখানেক ছিল। তার মধ্যেই বারবার আমায় আর আকাশের আলাদা ঘরে পাঠিয়ে কথা বলাবার চেষ্টা করছিল। কী রাগ হচ্ছিল আমার! আকাশও যে স্পষ্ট বিব্রত হচ্ছিল সেটা যেন বুঝেও বুঝতে চাইছিল না সুজাতাদি।
শেষে আমি বলেই ফেলেছিলাম, “সুজাতাদি এমন কোরো না প্লিজ়। আমি এতটাও ডেসপারেট নই।”
সুজাতাদি রাগ করে বলেছিল, “ভালর জন্যই বলছি। পরে বুঝবি!”
আমি আর কিছু বলিনি। আর আকাশের কাছেও চাকরির জন্য যাইনি! জানি আমার চাকরির দরকার খুব কিন্তু কিছুতেই সেটা এইভাবে নয়!
“আজকাল এত চুপ করে থাকিস কেন?” পাশের থেকে জেঠিমা কনুই দিয়ে খোঁচা মারল আমায়।।
আমি কিছু না বলে হাসলাম।
জেঠিমা বলল, “এই চব্বিশ বছর বয়সেই এমন বুড়িয়ে গেলি কী করে? না বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করিস! না টিভি দেখিস! না একটু পার্লার-টার্লারে যাস! কিছুই করিস না। কী হয়েছে তোর?”
আমি বললাম, “টিভি দেখি না কেন জানো? বেশি সিরিয়াল দেখলে এই হয়! সব কিছুতেই কারণ খুঁজতে শুরু করে মানুষ!”
জেঠিমা বলল, “পাকামো করিস না! আমি যেন জানি না!”
“তাই? কী জানো?” আমি অবাক হয়ে তাকালাম, “সত্যি জেঠিমা তুমি কেন সব জেনে যাও! মানে আমি নিজের ব্যাপারে যা জানি না সেগুলোও তুমি কী করে জেনে যাও!”
জেঠিমা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,“যতই ঘুরিয়ে কথা বল আমি জানি।”
আমি জেঠিমার কথার উত্তর না দিয়ে ভিড়ের দিকে তাকালাম। আমরা লেডিস সিটে বসেছি। কিন্তু জুডো জায়গা পায়নি! সামনের ভিড়ের ভিতর কোথাও একটা আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি না। গতকালই জেঠিমা বলে রেখেছিল যে আজ জুডো আর আমায় নিয়ে বেরোবে। জামাকাপড় কিনে দেবে। আমি তীব্র আপত্তি করেছিলাম। কারণ দুটো, এক আমার নতুন জামাকাপড়ের দরকার নেই আর দুই আমায় ওই পবন পোদ্দারের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
জেঠিমা কিন্তু তাও ছাড়েনি। আমায় বলেছিল, “তোকে ক’টায় যেতে হবে?”
আমি বলেছিলাম সাড়ে বারোটায় টাইম।
জেঠিমা বলেছিল, “ঠিক আছে। আমার সঙ্গে যাবি, পছন্দ করবি। তারপর চলে যাবি। জুডো তো যাবেই, আমি জুডোর সঙ্গে ফিরে আসব!”
“আমি যাবই!” জুডো অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
“হ্যাঁ,” জেঠিমা বলেছিল, “আমরা দশটার সময় বেরোব। মনে থাকে যেন। তোদের দুই ভাইবোনকে যেন আর তেল না দিতে হয় আমায়! জানবি আমার বাবা স্কুল মাস্টার ছিলেন। আরবের শেখ ছিলেন না!”
“কী হল, পাত্তা দিচ্ছিস না আমার কথায়?” জেঠিমা ঠেলল আমায়।
আমি বললাম, “জুডোটা কোথায় গেল!”
“আছে, তুই আমার দিকে তাকা,” জেঠিমা আমার গালটা ধরে ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে, “কেন কষ্ট পাচ্ছিস ওই জানোয়ারটার জন্য!”
“কী বলছ তুমি?” আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
জেঠিমা বলল, “ওই রিয়ান! আগে ভাবতাম কত ভাল ছেলে! কিন্তু পরে দেখলাম বাজে একদম, জানোয়ার একটা!”
“জেঠিমা আস্তে,” আমি জেঠিমার হাতে চাপ দিলাম। উত্তেজিত হয়ে গেলে জেঠিমার গলার স্বর চড়ে যায়। এটা লোকজন ভর্তি বাস! বাড়ির উঠোন তো নয়!
জেঠিমা বুঝতে পারল। গলার স্বরটা নামাল। কিন্তু তাতে রাগটা কমল না। বলল, “তোকে সারা জীবন নাচিয়ে শেষে ন্যাকামো! ওর মা কত ভাল মানুষ! তার ছেলে হয়ে এমন লম্পট! বিদেশ গেছে বলে কি সাপের পাঁচ পা দেখেছে নাকি! আমাদের সময় মানুষ নেপাল গেলেই তাকে পাড়ার সবাই পরদা সরিয়ে দেখত। সেই সময় আর নেই যে আমেরিকা গেছে বলেই সবার মুখ দিয়ে জল গড়াবে! এখন সবাই বিদেশ যায়! আমি বাড়ি থেকে বেরোই না বলে কি খবর রাখি না কিছু!”
আমি জেঠিমার হাত ধরে বললাম, “এত এক্সাইটেড হচ্ছ কেন?”
জেঠিমা বলল, “তোকে তো দেখছি! কী কুক্ষণেই না ওকে তুই…”
“প্লিজ় জেঠিমা,” আমি এবার জেঠিমাকে কথাটা শেষ করতে দিলাম না।
জেঠিমা কেমন যেন চুপ করে গেল হঠাৎ। তারপর বলল, “তোকে সেই দশ দিন বয়সে তোর মা আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, এটা তোমারই দিদি। সেদিন থেকে আমি তোকে নিজেরই মনে করি। তুই না বললে কি আমি কিছু বুঝি না? তোর মা চুপচাপ, কিন্তু আমি নই। তোকে কেউ কষ্ট দেবে আর সেটা আমি মেনে নেব? পারব না।”
আমি দেখলাম জেঠিমার চোখ ছলছল করছে! জেঠিমা এমনই। খুব সেন্টিমেন্টাল। ছেলেমানুষ! সহজেই হাসে, রাগে, কাঁদে। জড়িয়ে পড়ে! তাই তো ছোট থেকে আমার মায়ের বদলে জেঠিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব! একসঙ্গে সিনেমা দেখা, ফুচকা খাওয়া থেকে শুরু করে লুকিয়ে বান্ধবীদের প্রেমপত্র লিখে দেওয়াতেও জেঠিমা আমার সঙ্গ দিয়েছে।
আমি বললাম, “আরে তুমি কাঁদছ নাকি? দূর, ছাড়ো তো!”
জেঠিমা আরও কিছু বলত কিন্তু কন্ডাক্টর জোড়া গির্জা বলে ডাক দিল। এখানে আমাদের নামতে হবে। দেখলাম, জুডো ভিড়ের ভিতর থেকে মুখ বের করে বলল, “কী রে উঠে আয়!”
বাস থেকে নেমে আমি আবার তাকালাম জেঠিমার দিকে। জেঠিমা হাসল এবার। বলল, “ঠিক আছি এখন। তোকে এমন শুকনো মুখে দেখতে ভাল লাগে না আমার। তাই রাগ হয়ে যায়। এই যে ছেলেটা গেল, মাসখানেকের বেশি হয়ে গেল তো, কিন্তু তোকে একটাও ইমেল করেছে? ফোন যে করেনি সেটা তো জানিই! এমন একটা ছেলের জন্য বিরহিনী রাধা হয়ে থাকার কী মানে?”
আমি বললাম, “ওঃ, চলো তো দোকানে। আজ কী হয়েছে তোমার? ডোপ করেছ? নাকি হাঁটুর ব্যথা কম। বোধহয় কম, না? আমি আর ওই শ্বেত বেড়ালা না কী, এনে দেব না! হাঁটুর ব্যথা কমলেই তুমি আমায় নিয়ে পড়ো!”
জেঠিমা বলল, “তুই যতই বল! ছেলেটা ভাল না! কলির কেষ্ট একদম!”
জুড়ো জেঠিমাকে ধরে রাস্তাটা পার করে দিল। আমিও গেলাম পিছন- পিছন কিন্তু সব কেমন যেন আবছা হয়ে গেল। বুকের ভিতর আবার হুল গেঁথে দিল মৌমাছি! কলির কেষ্ট! নানিয়া ধীলোঁ! একটা জিনিস ছোট থেকেই আমি দেখেছি। রিয়ানের দিকে মেয়েরা আকৃষ্ট হয়।
স্কুল জীবনেই একবার মা আমার জন্মদিন করেছিল। রিয়ানদের তো নেমন্তন্ন ছিলই, সঙ্গে আমার দু’-একজন বান্ধবীও এসেছিল। তার মধ্যে সেই পিউও ছিল।
রিয়ান তখন ষোলো বছরের। হালে হালকা দাড়ি। গম্ভীর। একা-একা থাকে।
আমাদের বাড়িতে এসে তিনতলার সাঁকোটার কাছে দাঁড়িয়েছিল। কারও সঙ্গেই বিশেষ কথা বলছিল না।
আমি জানি ওর মুড। তাই ঘাঁটাছিলাম না। কিন্তু পিউ নাছোড় ছিল।
বলেছিল, “এই তোর হিরো! ব্যাপক কিন্তু! সেক্সি! এখনও চুমু খাসনি? তুই একটা অপদার্থ !”
আমার রাগ হয়ে গিয়েছিল, “তুই ওইদিকে তাকাচ্ছিস কেন?”
পিউ চোখ টিপে বলেছিল, “কিছু তো করতে পারব না। অন্তত দেখতে দে!”
সেই থেকে দেখেছি মেয়েরা এমনিতেই পছন্দ করে রিয়ানকে। অমন চুপচাপ, ভুলো চোখের ছেলে বলেই কি! হবে হয়তো!
কিন্তু যতবার কোনও মেয়ে রিয়ানকে পছন্দ করেছে আমার কষ্ট হয়েছে। যেমন আজও হয়। কিন্তু কোনও দিনেই রিয়ান কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়েনি! ওর বাবা মারা যাওয়ার পর রিয়ানের যেন আরও জেদ বেড়ে গিয়েছিল! যেন আরও ভাল রেজ়াল্ট হচ্ছিল। আমায় শুধু বলত, এখান থেকে ওকে চলে যেতে হবে। এসব প্রেম-ট্রেমের মতো ফালতু ব্যাপার নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। এই শহরটা ছেড়ে যেতে না পারলে ওর মুক্তি নেই!
তখন মজা লাগত এটা শুনে। মনে হত, যাক ও অন্য কারও দিকে তো মন দেবে না! আমার হয়েই থাকবে। আসলে তখন বয়স কম ছিল। তাই ওর কথার পরের অংশটার গুরুত্ব বুঝিনি! ও যে সত্যি এই শহরটার থেকে মুক্তি খুঁজছে, বুঝিনি!
এখন মনে হয় পরের অংশটাই বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল! রিয়ান যে সত্যি এভাবে মুক্তি খুঁজে পাবে ভাবতে পারিনি। ও যে নিজের জন্য এমন একটা নতুন পৃথিবী তৈরি করে নেবে বুঝিনি। বুঝিনি সেখানে আমার কোনও জায়গা হবে না!
শপিং করতে আমার ঠিক দশ মিনিট লাগল। দুটো কটনের কুর্তি আর একটা লেগিংস পছন্দ করেই আমি রণে ভঙ্গ দিলাম। আসল এটাও না হলে আমার চলত। বাবার অমন শরীর খারাপ। সেখানে এসব তো বিলাসিতা। তা ছাড়া কাজও কিছু পাচ্ছি না। সঙ্গে রিয়ানের জন্য সারাক্ষণ বুকের ভিতরে একটা শূন্যতা! এসবের মধ্যে কী করে আমার শপিং ভাল লাগবে!
নেহাত জেঠিমা জেদ করেছে তাই এসেছি!
তবে এটুকু কেনাকাটায় জেঠিমা খুশি হচ্ছিল না। বলছিল জিন্স নিতে হবে। টি-শার্ট নিতে হবে। আমি ওসব নিইনি। জেঠিমা কিনতে পারলে আর কিছু চায় না। কিন্তু আমায় আর টলাতে পারেনি।
আমি আমারটুকু সেরেই বেরিয়ে এসেছি। জেঠিমা আর জুডো এখন করুক শপিং। পবন পোদ্দারের কাছে যাওয়া আমার জন্য জরুরি।
গত দু’দিন বৃষ্টি হয়নি। কলকাতায় আবার সেই গুমোট গরম আর চ্যাটচ্যাটে ঘামটা ফিরে এসেছে। আমি রাস্তায় নেমে ঘড়ি দেখলাম। প্রায় বারোটা বাজে। এখান থেকে পবন পোদ্দারের অফিস কিছুটা দূর। কিন্তু এমন দূরও নয় যে বাস ধরতে হবে।
রিয়ান চলে যাওয়ার পর আমার একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। হাঁটা বেড়ে গিয়েছে! সেদিন তো এসপ্ল্যানেড থেকে হেঁটে আমি বাড়িতে এসেছি। কেন এটা হয়েছে জানি না। কিন্তু হয়েছে!
আমার এমনিতে খুব কিছু বন্ধুবান্ধব নেই। আসলে পুরো সময় আমি রিয়ানকে দিয়ে দিয়েছিলাম। তার ফলে অন্য কিছু তৈরিই হয়নি। যারা বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল তারা সাড়া না পেয়ে সরে গিয়েছে! আর এখন রিয়ান নিজেই সরে যাওয়ায় আমি পুরো একা।
রাতে যখন ঘুম আসতে চায় না, আমার আরও একা লাগে। তখন মনে হয় তবে কি আমি রিয়ানকে সব দিয়ে ভালবেসে ভুল করেছিলাম! নিজের জন্যও কি নিজেকে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখার দরকার ছিল! প্রেমের মহান আদর্শ তো কেবল সিনেমা-উপন্যাসেই হয়! বাস্তবে সেসব যারা প্রয়োগ করতে চায় তারা তো বোকা! বোঝে না যেটাকে তারা সব ভাবছে আসলে সেটা তেমন কোনওদিনই ছিল না!
এসব ভাবতে-ভাবতে শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগে আমার! মনে হয়, এত দেশ, মহাদেশ, সাগর, মহাসাগর পেরিয়ে সেই নতুন শহরে এখন তো দিন! কী করছে রিয়ান? ওর ওই বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করছে? ঘুরছে? নাকি অন্য কিছু করছে? ‘আমি’ বলে যে কেউ ছিলাম সেটা কি ওর মনে পড়ে আর! আমি জানি ওর আর আমাকে মনে পড়ে না। নিজেকে উন্মাদ মনে হয়! মনে হয় যা ছিল না সেটাই কী করে এতগুলো বছর দেখলাম! কেন নিজেকে এমন একটা অন্ধ বাইলেনে আটকে রাখলাম!
আমি তখন বারান্দাটায় এসে দাঁড়াই। দেখি ভাঙাচোরা সাঁকো দু’ হাত দিয়ে আপ্রাণ ধরে রেখেছে দু’-দুটো পুরনো বাড়িকে! পুরনো সম্পর্ককে। কিন্তু কতদিন? এই ভেঙে পড়া সাঁকো কত দিন জুড়ে রাখবে সম্পর্ককে? কত দিন সে ধরে রাখতে পারবে দুই মহাদেশের দু’জনকে!
আমি দেখি সামনের বাড়ির তিনতলার বন্ধ জানলার পাখির পিছনে তিরতির করে কাঁপছে আলো। বুঝি সেই যে ছোটবেলায় রূপকথার গল্প বলত চাঁদের বুড়ি, বন্ধ জানালার ওপারে সেও জেগে আছে আমার মতো। একা।
পবন পোদ্দারের কোম্পানির নাম ‘মেলোডি আনলিমিটেড। একটা মাল্টিস্টোরেডের দোতলায় দেখলাম বড় করে সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে। গেটে দরোয়ান ছিল। কিন্তু আমায় আটকাল না। বললও না কিছু। একতলায় গ্যারেজের পাশ দিয়ে সোজা গেলে পাশাপাশি দুটো লিফ্ট! আমি একটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশি অপেক্ষা করতে হল না। লিফ্ট এসে গেলে নিমেষের মধ্যেই।
দোতলায় লিফ্ট থেকে বেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা। ডানদিকে একটা করিডর চলে গিয়েছে। দেখলাম দেওয়ালে লেখা আছে ‘মেলোডি আনলিমিটেড দিস ওয়ে’।
সেই নির্দেশ ধরে এগিয়ে দেখলাম একটা ঘষা কাচের দরজা। গায়ে নাম লেখা আছে কোম্পানির। নাম দেখে বুঝলাম এটাই আমার গন্তব্য!
রিসেপশানে একজন বয়স্ক মহিলা বসেছিলেন। আমায় দেখে নির্বিকার মুখে তাকালেন। তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে কমপিউটারে খুটখাট শুরু করলেন।
“এক্সকিউজ় মি,” আমি ঝুঁকে পড়লাম।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে না তাকিয়ে রোবটের মতো গলায় বললেন, “বলুন।”
“আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। মিস্টার পবন পোদ্দারের সঙ্গে। উনি আমায় আসতে বলেছিলেন,” কথাটা শেষ করে আমি নিজের নাম বললাম।
ভদ্রমহিলা একইভাবে বললেন, “দেখা হবে না। স্যার নেই।”
“নেই!” আমি অবাক হলাম, “আজ সকাল ন’টায় ওঁকে ফোন করেছিলাম। বললেন আসতে। আর নেই!”
“না নেই,” ভদ্রমহিলা এবার কৃপা করে আমার দিকে তাকালেন, “আপনি গানের জন্য এসেছেন তো? কোনও সিডি আছে? দিয়ে যান।”
আমি বললাম, “কিন্তু উনি তো বললেন নিজে শুনবেন! মানে একটা ফিল্মে…”
ভদ্রমহিলা কথা শেষ করতে দিলেন না আমায়। বললেন, “শুনুন অমন কথা উনি অনেককে বলেন। সেটা ইমপরট্যান্ট নয়। এমন কথা ওঁকে সারাদিন বলতে হয়। নিজেকে লতা মঙ্গেশকার ভাবে এমন মেয়েদের তো অভাব নেই। দিয়ে যান।”
আমার হঠাৎ মনে লাগল, “না থাক। আমি দেব না।”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, “শুনুন ভাই, আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা! ব্যাপারটা বুঝুন। উনি আর সিডি বের করেন না। খুব নামকরা গাইয়ে। হলে এক কথা। কিন্তু নতুনদের মার্কেট নেই। এমনিতেই গানের বাজার খুব খারাপ। মানুষ ইন্টারনেট থেকে গান ডাউনলোড করে করে সব শেষ করে দিয়েছে। বিনে পয়সায় গান পেয়ে গেলে কে আর গাঁটের কড়ি খরচ করে? কত বড় মিউজ়িক শপ জাস্ট উঠে গেল! এটা একটা লাল বাতি জ্বলা ইন্ডাস্ট্রি। কিছু হবে না। আপনি ভাই রিয়েলিটি শো-তে ট্রাই করুন। যদিও সেখানেও শুনেছি নানা ম্যানিপুলেশন হয়। তাও ওটাই করুন।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। কথাটা সত্যি। পাইরেসি এমন একটা জায়গায় চলে গিয়েছে, ফ্রি ডাউনলোড এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে-মানুষ এই চুরিটাকে লিগাল ভেবে ফেলেছে!
শিল্পীদের কাছে খুবই হতাশাজনক, কিন্তু কে আটকাবে! কে ব্যবস্থা নেবে! এ দেশে কিছু করার নেই। যারা এসব করে, তারা বোঝে না যে খালি পেটে কোনও শিল্পই হয় না। যদি এটাই চলতে থাকে একটা দিন আসবে যখন কেউ আর গানটান গাইবে না।
আমি বললাম, “তাও যদি ওঁর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যেত! উনি ফিল্মে গান গাওয়ার কথা বলেছিলেন।”
ভদ্রমহিলা কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেলেন, তারপর আমার পিছনের দিকে কাউকে একটা দেখে হেসে দাঁড়িয়ে উঠলেন। আর ঠিক সেই সময়ে আমি শুনলাম একটা গলা। বলছে, “আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলাম আপনি এলেন না। আর এখানে দিচ্ছে না কিন্তু আপনি ট্রাই করছেন!”
গলাটা শুনে আমার কেন জানি না গায়ে কাঁটা দিল হঠাৎ! আমি চট করে পিছনে ঘুরলাম। দেখলাম।।
“সুজাতাদি ঠিক বলেছেন। আপনি সত্যি অদ্ভুত!” কথাটা বলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল আকাশ বাসু!
আট
রিয়ান
আমাদের পাড়ায় দুর্গাপুজো হয়। খুব বড় না হলেও বেশ আন্তরিকভাবেই হয়। আমাদের বাড়ির গা ঘেঁষে প্যান্ডেল ওঠে। বিশ্বকর্মাপুজোর পর পরেই বাঁশ পড়ে যায়। তারপর শুরু হয় প্যান্ডেলের কাঠামো বাঁধার কাজ! না কোনও থিম-টিম হয় না। সাবেক মতে প্যান্ডেল করা হয়। ডাকের সাজের ঠাকুর হয়। চতুর্থীর মাঝ রাতে পাড়ার ছেলেরা হইহই করে ঠাকুর নিয়ে আসে।
তারপর ষষ্ঠীর সকালে মাইকে চণ্ডীপাঠ হয়। শুরু হয় ঢাক আর পুজোর স্তোত্র। অষ্টমীতে সবাই মিলে একসঙ্গে ভোগ খাওয়া। সন্ধিপুজো। শেষে দশমীর রাতে ভাসান।
এসব তো সবাই জানে। আমিও জানি। তবে এটুকুই জানি। কারণ পুজোর দিনগুলোয় আমি বাড়ির বাইরে বেরোতাম না একটুও। বই নিয়ে বা ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকতাম চুপ করে।
বাবা যত দিন ছিল বেরোতাম। বাবাই নিয়ে বেরোত। গাড়ি ভাড়া করে আমরা আর রাজিতাদের বাড়ির সবাই মিলে সারারাত ধরে কলকাতার ঠাকুর দেখতাম।
আমার খুব একটা ভাল লাগত না। ছোট থেকেই ভিড় আমার পছন্দ নয়।।
মা জিজ্ঞেস করত, “সবাই বেরোতে চায়, তুই চাস না কেন?”
আমি বলতাম, “জানি না। আমার ভাল লাগে না।”
মা রাগ করত, “এত ঘরকুনো কেন তুই? কেন ভাল লাগে না?”
আমি চুপ করে থাকতাম প্রথমটা। তারপর বলতাম, “তোমার তো সকালবেলার আকাশ দেখতে ভাল লাগে মা। সেটা কেন ভাল লাগে?”
মা আরও রেগে যেত, বলত “খুব মুখে-মুখে কথা বলতে শিখেছিস, না?”
তখন বাবা আসত, হাসতে হাসতে বলত, “তোর মা বুঝবে না। আমি জানি তোর ভিড় ভাল লাগে না। কিন্তু তুই না বেরোলে আমার যে কষ্ট হয়!”
বাবা নেই। আমি পুজোয় ঘুরতে না বেরোলে আর কেউ কষ্ট পাওয়ারও নেই। তাই আর পুজোয় বেরোতাম না!
আমি পুজোয় শুধু শব্দ শুনতাম। শব্দ শুনে বুঝতাম পাড়ায় কী হচ্ছে! মা ঠেলত। মামারা এসে জোর করত বেরোবার জন্য। কিন্তু আমি কোনও কথাই শুনতাম না। কারও কথাই শুনতাম না।
পুজোর দিনগুলোয় রাজি রোজ আসত। কাকিমা কিছু না-কিছু খাবার বানিয়ে পাঠাত রাজির হাত দিয়ে। আমি রাগ করতাম। বলতাম, “তুই কেন সেই নর্থ থেকে এই ভিড় ঠেলে রোজ আসিস?”
ও রাগ করত না। শান্ত গলায় বলত, “আমার কষ্ট হয় না। আমার ভাল লাগে। তা ছাড়া তুই বাড়িতে একা বসে থাকিস। আমার মনে হয় যাই গিয়ে তোর একটু মাথা খাই!”
আমি বলতাম, “শুধু-শুধু ব্যাটারি খরচ করিস না। আমাদের সময়গুলো আর আমরা নিজেরাও এক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট। যেখানে সেখানে করতে নেই।”
রাজি প্রথমে কিছু বলত না। শুধু একবার তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিত। তারপর কিছু বলত হয়তো, কিন্তু শুনতে পেতাম না। কারণ কেন জানি না ঠিক সেই সময়টাতেই প্রতিবার পাড়ার ঢাকটা বেজে উঠত জোরে। আর রাজির সব কথা ঢেকে যেত সেই শব্দে! আমি অবাক হয়ে ভাবতাম এমনটা হয় কী করে?
রাজি সকালবেলা আসত আর সন্ধেবেলা ফিরে যেত। চার দিনই এক রুটিন।
আমার বেশ মনে আছে। সেবার আমরা দু’জনেই কলেজে ভর্তি হয়েছি। ফার্স্ট ইয়ার। সপ্তমী পুজোর দিন ছিল সেটা।
দুপুরে খাওয়ার পরে রাজি এসে আমার ঘরের এটা ওটা গোছাচ্ছিল। আমি কিছু না বলে দেখছিলাম ওকে। আর সত্যি বলতে কী রাগ হচ্ছিল আমার খুব। এসব হচ্ছেটা কী! একটা এই বয়সের মেয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে না গিয়ে আমার ঘরের বইপত্তর গোছাচ্ছে কেন! এটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট বাংলা সিনেমা নাকি?
আমি বলেছিলাম, “এই রাজি, তুই কাল থেকে আসবি না।”
রাজি প্রথমে বুঝতে পারেনি আমি কী বলছি! ও নিজের মনে গুনগুন করতে-করতে কাজ করছিল। আমার বলা বাক্যটার মধ্যে ও শুধু নিজের নামটুকু শুনেছিল!
আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী বলছিস?”
আমি আরও রুক্ষভাবে বলেছিলাম, “বলছি কাল থেকে একদম আসবি না এখানে।”
“কেন?” রাজি পাথরের মতো স্থির হয়ে গিয়েছিল নিমেষে।
আমি চোয়াল শক্ত করে বলেছিলাম, “তোকে কারণ বলতে যাব কেন? যা বলছি শুনবি। আসবি না।”
রাজি বলেছিল, “কেন আসব না সেটা বলতে হবে।”
আমি আরও রেগে গিয়ে বলেছিলাম, “তোর কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?”
“ছেলে বন্ধু?”
“ন্যাকামো করিস না,” আমি খিঁচিয়ে উঠেছিলাম, “প্রেমিক আজকাল তো খুব প্রোপোজ়াল পাস! একটাকেও জোটাসনি? তার সঙ্গে ঘুরতে যেতে পারিস না?”
রাজি বলেছিল, “তোর কি খুব অসুবিধা হয় আমি এলে?”
আমি বলেছিলাম, “তোর মতো একটা অল্পবয়সি মেয়ে কেন এমন করে থাকবে? কেন বেরোবি না তুই! তোর বাবা আছে, মা আছে, ভাই আছে। সবাই আছে। তা হলে তুই কেন পড়ে থাকবি এখানে? কেন থাকবি এমন করে?”
রাজি পালটা বলেছিল, “তুই কেন থাকিস এমন করে? এমন ঘরের মধ্যে। নিজেকে বন্দি রাখিস কেন?”
আমি বলেছিলাম, “আমি যা খুশি করব। শুধু তুই এখানে আসবি না।”
“কেন?” রাজি জেদি গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।
আমি বলেছিলাম, “আমি বলছি তাই।”
“তুই এমন থাকিস কেন সেটা আগে বল। পাশ কাটাবি না।”
আমি শক্ত গলায় বলেছিলাম, “শোন রাজি, আমি এখানের কোনও কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাই না। কোনও কিছুতে নিজেকে ইনভল্ভ করতে চাই না। আমি নিজেকে তৈরি করছি। যেদিন সুযোগ পাব সব ছেড়ে চলে যাব। এই দেশ, এই শহর আমার নয়। আমি থাকব না এখানে।”
রাজি শান্ত গলায় বলেছিল, “এক কথা বারবার বলিস কেন? আর ঠিক আছে, যত দিন আছিস তত দিন আমি আসব। তারপর না হয় আসব না। কিন্তু যত দিন আছিস তত দিন আসবই। কারণ…”
কারণটা আর শোনা হয়নি। কারণ ঠিক তখনই প্রচণ্ড জোরে ঢাক বেজে উঠেছিল পাড়ায়।
গাড়ির ভিতরটা নিস্তব্ধ! সামুদা চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে মুড ভাল নেই। আমি কথা না বাড়িয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। বিকেল শেষ হচ্ছে। এখন অক্টোবরের মাঝামাঝি। ঠান্ডা পড়েনি। তবে দিন ছোট হয়ে গিয়েছে।
কলকাতায় পুজো শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখানে পুজো এখন। পুজোর কাছাকাছি শুক্র-শনিবার করে এখানের বাঙালিরা দুর্গাপুজো করে। মূলত দুটো বড় পুজো হয়। একটা হল ‘বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অফ ডালাস-ফোর্টওয়ার্থ’ আর অন্যটা হল ‘আন্তরিক’।
এসব পুজোয় স্টুডেন্টরা খুব একটা থাকে না। এখানে যেসব বাঙালিরা মূলত চাকরি করে তাদেরই উদ্যোগে পুজো হয়। আমিও যেতাম না। কিন্তু সামুদা জোর করল। অ্যাডমিশন ফি পঞ্চাশ ডলারের মতো। আমি দিতে চেয়েছিলাম। সামুদা ধমক দিয়েছে।
কাছের একটা বড় হাইস্কুল ভাড়া নিয়ে পুজো হচ্ছে। ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা। শুনলাম দশ-বারো বছর ধরে এই প্রতিমায় পুজো হচ্ছে। পুজো হয়ে গেলে ঠাকুরটিকে স্টোরেজে রেখে দেওয়া হয়।
শুক্রবার ষষ্ঠী-সপ্তমীর পুজো হয়। শনিবার দুপুর অবধি হয় অষ্টমী-নবমীর পুজো। আর শনিবার বিকেলে দশমী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। কলকাতা থেকে কয়েকজন শিল্পীকে নিয়ে আসা হয় গানবাজনা করার জন্য!
পুজোর হইচই কোনও দিনই ভাল লাগে না আমার। আর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তো আরও বাজে লাগে। বড়মামা বলে, “তোর বাপটা যতটা বারমুখো ছিল, তুই ততটা ইন্ট্রোভার্ট! কেন রে?”
আমি উত্তর দিই না। সব কিছুকেই মামার বাড়ির লোকজন বাবার রেফারেন্সে বলে। শুধু মামাবাড়ি নয়। আমার মনে হয় সবাই তাই করে। আমি বুঝতে পারি না বাবা যা করেছে তাতে আমার কী দোষ! আমার বাবার উপর রাগ হয় খুব! মনে হয়, লোকটা কোনও দিন ভালইবাসেনি আমায়। শুধু ভান করে গিয়েছে!
ছোট থেকেই এই একাচোরা মনটা বাবার মৃত্যুর পর যেন আরও একা হয়ে গিয়েছে। কোনওরকম উৎসব অনুষ্ঠান দেখলেই আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হল, “যাব না।” এবারও আমি আসতে চাইনি এই পুজোয়। কিন্তু সামুদা এমন জোর করল! সামুদার কোনও কথা আমি ফেলতে পারি না।
“কী রে কেমন লাগল পুজো?” সামুদা হালকা চালে জিজ্ঞেস করল।
আমি বললাম, “ওই আর কী! বড়লোকদের ব্যাপার। কয়েকজনকে তো দেখলাম মানি ফ্লেক্সিং করে গেল সারাক্ষণ! তবে ওভারঅল ভাল। দেশের থেকে এত দূরে এসে থাকা! সেই হিসেবে ভালই!”
সামুদা বলল, “একসঙ্গে হয় সবাই। গল্প করে। একটু খাওয়া-দাওয়া হয়। খারাপ কেন হবে! প্লাস দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালির তো চিরকালীন একটা পাগলামো আছেই!”
আমি কিছু বললাম না। বাইরের দিকে তাকালাম। বাইরে এখন অন্ধকার। এখানে পাড়ার ভিতরের রাস্তাগুলোয় আলো খুব কম। শুধু দূরে-দূরে একটু করে আলো দেওয়া। আমি একা-একা হাঁটি এখানে। ঝিঁঝি ডাকে। যেন ঠিক কোনও মফস্সল! তার উপর মানুষজন কম। এক-এক সময় তো মনে হয় ভূত-টুত বেরিয়ে আসবে চারিদিকের গাছপালার মধ্যে থেকে।
সামুদা বলল, “রাজিতার কথা বলিস না তো! কেমন আছে ও?”
আমি কিছু বললাম না। বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সামুদা হাসল, “কী রে কেসটা কী? অ্যাভয়েড করছিস?”
আমি বললাম, “দেখো সামুদা, রাজিতা খুব ভাল মেয়ে। কিন্তু ওই দেশ থেকে যখন শেকড় তুলে নিয়েছি তখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই! তবে এটা শুনলাম যে রজতকাকুর নাকি শরীর খুব খারাপ। সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে। কোম্পানিও লক আউট। মা ফোনে বলেছিল।”
সামুদা অবাক হল, “সে কী রে! সাংঘাতিক ব্যাপার তো! উনিই তো একমাত্র আর্নিং মেম্বার। তা হলে!”
আমি চুপ করে থাকলাম। কথাটা সত্যি! কিন্তু তাতে আমি কী করব! অ্যামসবেরি ড্রাইভ আর বেনিয়াটোলা লেন বাইলেনের দূরত্বটা কি ভুলে গিয়েছে সামুদা!
সামুদা বলল, “তুই খবর নিয়েছিস?”
আমি বললাম, “পাঁচ বছর এখানে থেকে ডিগ্রি নেব। তারপর এখানেই চাকরি করব। মাকে নিয়ে আসব, ব্যস! কলকাতায় আমার কেউ নেই।”
সামুদা আধো অন্ধকারে তাকাল আমার দিকে। তারপর মাথা নাড়ল নিজের মনে। বলল, “ইট্স নাইস টু বি ইমপরট্যান্ট রিয়ান। বাট রিমেমবার, ইট্স ইমপরট্যান্ট টু বি নাইস।”
বাড়ি অবধি গেল না সামুদা। বড় রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল কাল পুজোয় যাব কি না! আমি বারণ করেছি!
আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম, সামুদা উপরে আসবে কি না!
সামুদা শুধু বলেছিল, “সেই শুক্রবার তো রাতে এসেছিলাম। শালা, সারা রাত অমন হুতোম প্যাঁচার মতো মুখ করে ছিলি কেন কে জানে! আর তোর ঘরে ঢুকে ওই মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না!”
আমি কিছু উত্তর দিইনি, আসলে সব কথা নিজের আইডলকেও বলা যায় না!
বড় রাস্তা থেকে আমার বাড়িটা একটু দূরে। আমি আধো অন্ধকারে হাঁটতে লাগলাম। শীত আসতে দেরি। তবে সন্ধের পর তাপমাত্রা বেশ কমে যায়। একটু চিলচিলে ঠান্ডা যেন জড়িয়ে আছে হাওয়ায়। ‘ফল’ শুরুর সঙ্গে-সঙ্গে ম্যাপেল গাছের পাতায় মরচে ধরতে শুরু করেছে! টেক্সাস তো সাদার্ন স্টেট, শুনেছি ইস্ট কোস্ট বরাবর এই ‘ফল’ ব্যাপারটা খুব সুন্দর দেখা যায়। মনে হয় গোটা চত্বর জুড়ে আগুন লেগে গেছে!
এখানে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষা আছে আমাদের। তারপর এক মাস ছুটি। আমার এখনও অবধি পড়াশোনার অগ্রগতি ভাল। তাই আমায় প্রফেসর জোন্স বলেছেন যে, উইন্টার ব্রেকে কিছু স্পেশ্যাল ক্লাস হবে আন্ডার গ্র্যাডদের। আমি চাইলে ক্লাস নিতে পারি। দু’হাজার ডলার মতো উপরি রোজগার হতে পারে! খুবই ভাল প্রস্তাব।
এখানে যে টাকাপয়সা পাই, তাতে খুব কষ্ট করে চলে আমার। এখানে আসার আগে যে এল ডোরাডোর কথা শুনেছিলাম, এখানে এসে বুঝতে পারছি গোটাটাই আসলে হলিউডের ছবি। বাস্তবটা খুব কঠিন! খুব কষ্ট করে থাকতে হয়। টাকা-পয়সা মেপে খরচ করতে হয়। বাইরে খাওয়ার প্রশ্নই নেই! সারাক্ষণ মনের পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজ়িকের মতো বাজতে থাকে ‘পয়সা বাঁচাও, পয়সা বাঁচাও!’ সেখানে আমি দু’হাজার ডলার অতিরিক্ত কামাবার সুযোগ পাচ্ছি! চাট্টিখানি কথা নয়! আমি বলেছি ক্লাস নেব। আমার তো কিছু করার নেই। দেশে তো আর ফিরব না!
অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলেই নাকে ঝাঁঝালো সর্ষের গন্ধ পেলাম। শরথ রান্না করছে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ও ভেজেটেরিয়ান। পরে দেখি মোটেও তা নয়। বরং বলে, “গাছপালা এত কাটলে চলে! এমনিতেই গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে। তার চেয়ে প্রাণী কমা! অক্সিজেন বাড়বে পরিবেশে!”
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আরে, তুই এসব খাস বাড়িতে জানে?”
শরথ বলেছিল, “পাগল! আমরা কেরলের আইয়ার ব্রাহ্মণ। বাবা জানতে পারলে কেলিয়ে লাট করে দেবে! বাড়িতে গেলে তাই খুব চাপ হয়।”
আমি ঘরে ঢুকে বললাম, “কী রে? আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে নাইন ওয়ান ওয়ান ফোন করবে! বলবে সন্ত্রাসবাদীরা গ্যাস বোমা ছেড়েছে!”
শরথ হাসল, “কেন বলবে? তোর কি মনে হয়, ওরা বেশি প্যানিক করে?”
এই সেরেছে! শরথ আবার প্রশ্ন শুরু করেছে!
আমি বললাম, “আমি ঘরে গেলাম।”
শরথ বলল, “আমি গ্রোসারি থেকে সব নিয়ে এসেছি আজ! নেক্সট উইক তোকে যেতে হবে কিন্তু!”
আমি মাথা নেড়ে আর দাঁড়ালাম না।
আমি ঘরে এসে জামাকাপড় পালটে নিলাম। পড়তে বসব। এখানে একটুও সময় নষ্ট করতে পারি না। কিন্তু বইটা খুলেই থমকে গেলাম। প্রথম পাতায় নামটা দেখে কেমন একটা লাগল। নানিয়া ধীলোঁ। নানিয়ার বই এটা। এখনও নিয়ে যায়নি। আমিও দিয়ে উঠতে পারিনি। আসলে সেইদিনের পর নানিয়া আর আসেনি আমার ঘরে। আমিও কথা বলিনি ওর সঙ্গে!
‘রিবাউন্ড’ বলে একটা কথা আমি শুনেছিলাম আগে। কিন্তু আমল দিইনি। আমার সঙ্গে এসব তো হয়নি কখনও! আর জানতাম, হবেও না।
সেদিন ওই ভেঙে পড়া ‘লেগো’ ব্লকের মতো নানিয়াকে নিয়ে আমি আমার ঘরে বসিয়েছিলাম। খুব কাঁদছিল ও। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে। শুধু কাঁদতে থাকা নানিয়ার লাল মুখটার দিকে তাকিয়েছিলাম।
ওকে কিছুটা সময় দিয়ে এক গ্লাস জল এনে ধরিয়েছিলাম ওর হাতে। তারপর বলেছিলাম, “এবার থামো। কী হয়েছে বলো!”
নানিয়া তখনও নিজেকে জোড়া লাগাতে পারছিল না। তাও কোনওমতে জলটা খেয়ে যা ভাঙা-ভাঙা সেনটেন্স বলছিল, তাতে বুঝেছিলাম ও সুরিন্দরকে সারপ্রাইজ় দিতে ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখেছে যে সুরিন্দর অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে বিছানায় শুয়ে আছে!
আমি থতমত খেয়ে চুপ করে গিয়েছিলাম। আরে এমন তো সিনেমায় হয়!
নানিয়া বলেছিল, “ও নিজেই আমায় ওর ফ্ল্যাটের একটা চাবি দিয়ে রেখেছিল। আমি ভাবলাম আজ শুক্রবার। ওর ফ্ল্যাটে ঢুকে কিছু রান্না করে ওর জন্য ওয়েট করব। অফিস থেকে ফিরলে চমকে যাবে। কিন্তু…”
নানিয়া আবার বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করেছিল। এবার যেন কান্নার তোড় আরও বেশি! আমি কী করব বুঝতে না পেরে আলতো করে পিঠে হাত দিয়েছিলাম ওর। বলেছিলাম, “কাঁদিস না। প্লিজ় কাঁদিস না।”
নানিয়া মুখ তুলে তাকিয়েছিল আমার দিকে। তারপর কী যে হল! হঠাৎ ও সোজা বসে আমার জামার কলারটা ধরে টেনে নিয়েছিল নিজের কাছে।
আমি বুঝতে পারছিলাম নানিয়ার ঠোঁটে নোনতা চোখের জল লেগে রয়েছে।
মিনিট পনেরো পরে নানিয়া উঠে বসেছিল বিছানায়! ওর কোঁকড়া চুলগুলো ছড়িয়ে ছিল খালি শরীরের উপর। নগ্ন স্তনদুটো শ্বাসের জন্য ওঠানামা করছিল দ্রুত। আর ওই ফর্সা মুখটা গোলাপি হয়েছিল একদম! আমি খালি গায়ে একটা চাদরের ভিতর শুয়েছিলাম চুপ করে।
এটা কী হল! হঠাৎ হলই বা কেন! আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার শ্বাসের মধ্যে নানিয়ার চুইংগামের গন্ধ আটকেছিল। বুকের ভিতর পাক খাচ্ছিল নানিয়ার ডিওডরেন্টের ছোট-ছোট প্রজাপতি!
নানিয়া আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল একবার। তারপর চোখ খুলে বলেছিল, “সরি। রিবাউন্ড!”
তারপর থেকে নানিয়া আর আসেনি এখানে। ক্লাসেও এড়িয়ে গিয়েছে আমায়। আমিও কেন জানি না কথা বলতে পারিনি ওর সঙ্গে! ভিতরে কীসের যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে আমার! সনাতন চিন্তাভাবনার মানুষ আমি। যাকে ভালবাসি তার সঙ্গে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ক্যাজুয়াল সেক্স করার কথা ভাবতেও পারি না। আর সেখানে এটা কী হল! আমি জানি না আর কখনও নানিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঠিক হবে কি না! কেন যে নানিয়া সেদিন অমন করল আর আমিও কেনই বা সাড়া দিলাম কে জানে! কাম কি সত্যিই ব্যাধের মতো? শিকার না শেষ করে শান্ত হয় না?
বইটা বন্ধ করে আমি বিছানায় হেলিয়ে বসলাম একটু! ভাল লাগছে না কিছু। কাঁহাতক সারাক্ষণ পড়াশোনা করা যায়! এখানে এসে এমন অবস্থায় পড়তে হবে কে জানত! এ যেন দ্বীপান্তর!
পিং করে এবার একটা শব্দ হল। আমি মোবাইলটা তুললাম। ইমেল এসেছে!
আমি খুললাম মেলটা! আর সঙ্গে-সঙ্গে বুকে ধাক্কা লাগল আমার! রাজিতা!
আমি চোখ বন্ধ করলাম একটু। কেন জানি না বুকের ভিতর আচমকা ঘোড়া ছুটছে! এমন তো হওয়ার কথা নয়! কিন্তু কেন হচ্ছে? এসব কি একা থাকার ফল?
আমি নিজেকে সংযত করে চোখ খুললাম। রোমান হরফে বাংলায় লেখা চিঠি :
রিয়ান,
বড় এই চিঠিটা মনে-মনে লিখেছিলাম আরও আগে, কিন্তু সেটাকে কেটে-ছেঁটে এটুকুই পাঠালাম আজ। একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। দোয়েল-সাঁকোটা কি সত্যি শুধু গল্পেই হয়?
রাজি।