টাইম ক্যাপসুল চুরি করতে গিয়ে

টাইম ক্যাপসুল চুরি করতে গিয়ে

উইল লিখতে গিয়ে টের পেলাম, আমার উইলের পাঠক কে হবে সেটা না জেনে তো সেটা লেখা শুরু করা সম্ভব না।

এলাকার স্টেশনারি দোকান থেকে একটা কলম আর কাগজের প্যাড কিনে এনেছি। অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছি, কী লেখা উচিত আমার। জানালার ঠিক বাইরের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে একটা সিকাডা পোকা বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছিল। সেটা এত জোরে কিচকিচ শব্দ করছিল যে, মনে হচ্ছিল ওটা আমার ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে শব্দ করছে। হ্যাঁ, আমার কাজের অপারগতার পেছনে সিকাডাটাকে দোষ দেয়া যায়, কিন্তু ওটা উড়ে যাবার পরেও কিছুই লিখতে পারিনি।

আচ্ছা, আমার এই উইল কে পড়বে? কার আশায় আমি এটা লিখছি? শব্দ দিয়ে তথ্যের আদানপ্রদান করা হয়ে থাকে। আমার লেখা এই শব্দগুলো আমার ভেতরে থাকা অদৃশ্য জিনিসটাকে অন্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।

আমি কী বলতে চাইছি? এবং কাকে? সবার আগে যার নাম মাথায় এল, সেটা হলো আমার শৈশবের বন্ধু ‘হিমেনো’। হয়তো এই উইলের মাধ্যমে তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি তাকে গোপনে ভালোবাসার কথাটাও বলে যেতে পারব।

পরীক্ষামূলকভাবে বেশ সতর্কতার সাথে একঘণ্টা ধরে একটা চিঠি লিখলাম। মোটামুটি এরকম দাঁড়াল চিঠিটা –

এখন আমাকে তুমি কীরকম চোখে দেখো, সেটা জেনে আমার কোনো লাভ নেই। কিন্তু যখন দশ বছর বয়স ছিল আমাদের, তখন থেকেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই যে, এখন আমি বিশ বছর বয়সে পা ফেলতে পেরেছি, এটা সম্পূর্ণই তোমার রেখে যাওয়া সেই স্মৃতিগুলোর জন্য। আর বিশ বছরের বেশি আমি বাঁচবও না, কারণ আমি এমন কোনো দুনিয়ায় বাঁচতে চাই না যেখানে তুমি আমার আশপাশে থাকবে না। মৃত্যুর একদম সন্নিকটে এসে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি আমি। যেদিন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে সেদিন থেকেই আমি প্রায় মৃতের মতো জীবন কাটিয়ে এসেছি। বিদায় হিমেনো। আশা করি, আমার দশ বছর বয়সের সেই আমি’র স্মৃতিটুকু তোমার ভেতরে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকবে।

কয়েকবার পড়ার পর বুঝতে পারলাম, আমি কখনোই এই চিঠিটা পাঠাতে পারব না। কী যেন একটা বিশাল ত্রুটি ছিল এটায়। এসব তো আমি বলতে চাইনি। আর তাছাড়া আমি আসলে কী বলতে চাই, সেটা কাগজে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব না। যদি কাগজে লেখার চেষ্টা করি, তবে তাতে প্রাণ থাকবে না।

আমার মনে হয়, চিঠিটার একদম শেষ অংশটাই ছিল আমার ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ : দশ বছর বয়সের সেই আমি’র স্মৃতিটুকু হিমেনোর মধ্যে আরও কিছুকাল বাঁচিয়ে রাখা। আর আমি যদি এই চিঠিটাকে সত্যিই সে কাজে লাগাতে চাই, তবে ঐ লাইনটা না লেখাই বরং ভালো হবে। চিঠিই পাঠাতে চাচ্ছি আমি, অন্য কিছু না। যদি চিঠিতে কেবল হিমেনোর নাম আর ঠিকানায় আমার নাম দিয়ে চিঠিটা তাকে পাঠাই, তাতেও আমি খুশি। এতে চিঠিটা খুলে সে তেমন কিছুই বুঝতে পারবে না। যদি খালি চিঠি পাঠালে সেটা খারাপ দেখায়, তবে চিঠিতে ‘তোমাকে একটা চিঠি লিখতে চেয়েছিলাম’ লিখেই নাহয় পাঠিয়ে দেব। চাইলে নিছক, তুচ্ছ কিছু জিনিস ও লেখা যায়-আমার মৃত্যুর কথা মোটেও লিখব না সেটায়।

কলমটা টেবিলে ছুঁড়ে মেরে কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দিলাম, যাতে মিয়াগির চোখে না পড়ে এসব। ছাদের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লাম আমি। কবে সর্বশেষ আমি চিঠি লিখেছিলাম?

স্মৃতি ঘাঁটতে শুরু করলাম। কখনো কারো সাথে চিঠি চালাচালি করিনি আমি, আর উৎসবগুলোতে কার্ড পাঠানোর মতো কেউ ছিল না আমার। একদম শৈশব থেকেই এই অবস্থা আমার। হয়তো হাতেগোনা কিছু চিঠি লিখেছি এই ক্ষুদ্র জীবনে।

সতেরো বছর বয়সের সেই ‘ঘটনা’কে বাদ দিলে সর্বশেষ আমি বোধহয় ফোর্থ গ্রেডে পড়ার সময়ে লিখেছিলাম।

তখন গ্রীষ্মকাল চলছিল। আমাদের স্কুলের জিমনেসিয়ামের পেছনে আমরা একটা টাইম ক্যাপসুল পুঁতে রেখেছিলাম। ঐ যে, শুরুতে যে শিক্ষিকার কথা বলেছিলাম না? উনিই আমাদের এই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একটা চিঠি লিখতে বলা হয়েছিল, যাতে সেটা গোলাকৃতির একটা ক্যাপসুলে রাখতে পারে।

“আমি চাই দশ বছরের পরের, অর্থাৎ ভবিষ্যতের ‘তোমাকে একটা চিঠি লিখো তোমরা,” তিনি বলেছিলেন। “হ্যাঁ, কী লিখতে চাও সেটা বের করতে হয়তো কষ্ট হবে—কিন্তু তুমি কিন্তু চাইলে সহজ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পার চিঠিটায়। যেমন ‘তোমার স্বপ্নটা কি পূরণ হয়েছে?’ কিংবা ‘তুমি কি এখন সুখী?’ কিংবা ‘এই ঘটনার কথা তোমার মনে আছে?” অথবা ‘তুমি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?’ এছাড়া চাইলে ভবিষ্যতের ‘তোমাকে’ উৎসাহ দিয়েও কিছু লিখতে পার। যেমন, ‘প্লিজ স্বপ্নটা পূরণে লেগে থাক’ কিংবা ‘সুখ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা কর’ অথবা ‘এটার কথা প্লিজ ভুলে যেয়ো না’।’

অবশ্য তার তো জানা ছিল না : দশ বছর এই ছেলেমেয়েগুলোর অর্ধেকই তাদের স্বপ্নগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে ফেলেছে, সুখ হারিয়ে ফেলেছে, জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর কথা ভুলে গিয়েছে।

হয়তো চিঠিটা ভবিষ্যতের আমাদেরকে নয়; বরং যে মুহূর্তে আমরা চিঠিটা লিখছিলাম, সেই তখনকার আমি’র উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছিল।

তিনি আমাদের আরও বলেছিলেন, “আমি চাই চিঠির শেষে তোমরা তোমাদের এখনকার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর নামটা লিখে দেবে। ঐ মানুষটা তোমাকে কী ভাবে না ভাবে, সেটা নিয়ে তোমাকে একটুও চিন্তা করতে হবে না। এমন যদি হয় যে, যাকে তুমি পছন্দ কর সে তোমাকে ঘৃণা করে-তাতেও সমস্যা নেই। নামটা লিখে দিও। এই চিঠিগুলোকে খুব সতর্কতার সাথে রাখা হবে, যাতে কেউ এসব পড়তে না পারে-এমনকি আমিও পারব না পড়তে। তাই চিঠি নিয়ে ভেবো না।”

আমি কী লিখেছিলাম তা এখন মনে পড়ছে না।

কিন্তু কার নামটা লিখেছিলাম, তা মনে করার কোনো দরকারই বোধ করছি না আমি।

টাইম ক্যাপসুলটাকে দশ বছর পর খুঁড়ে বের করার কথা ছিল, মানে এই বছর। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো কথা কানে আসেনি। এমনও হতে পারে আমাকে ডাকা হয়নি সে অনুষ্ঠানে। কিন্তু সেটা যদি না হয়? যার ওপর দায়িত্ব ছিল সবার সাথে যোগাযোগ করে জানিয়ে দেয়া হয়তো সে-ই ভুলে গিয়েছে এর কথা? কিংবা হয়তো মনে আছে, কিন্তু এখনও কাউকে জানানো শুরু হয়নি?

মরে যাওয়ার আগে আমি ঐ চিঠিটা পড়ে যেতে চাই। কিন্তু পুরো কাজটাই একলা করার ইচ্ছে আমার। পুরোনো কোনো সহপাঠীর সাথে যোগাযোগ করতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না।

“আজ কীভাবে দিনটা কাটাবেন আপনি?” উঠে দাঁড়াতেই মিয়াগি প্ৰশ্ন করল।

“একটা টাইম ক্যাপসুল চুরি করে,” উত্তর দিলাম।

***

আমি ছোটবেলায় যেখানে বেড়ে উঠেছিলাম, প্রায় একবছর পর সেখানে ফিরলাম। ট্রেন স্টেশনটা আগের মতোই ভাঙাচোরা, ছোট্ট একটা বাংলোর মতো চেহারা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। স্টেশনটার ঠিক বাইরেই অতিপরিচিত দৃশ্যগুলোকে আবার দেখতে পেলাম।

সবুজ, টিলাময়, মফস্বল একটা শহর। আশপাশ থেকে পোকামাকড়ের তীব্র শব্দ আর গাছপালার যে প্রকট গন্ধ টের পাচ্ছিলাম, তার সাথে আমার বর্তমান অ্যাপার্টমেন্টের তুলনা করলে সেটাকে কিছুই মনে হবে না। তীব্র শব্দের মধ্যে মনোযোগ দিয়ে কান পাতলেও পাখপাখালি আর পোকামাকড়ের শব্দই কেবল কানে এল।

“এই দিনের আলোতে নিশ্চয়ই আপনি চুপিচুপি এলিমেন্টারি স্কুলের দেয়াল টপকিয়ে সেখানের মাটি খোঁড়ার কথা ভাবছেন না?” মিয়াগি আমার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল।

“অবশ্যই না। সে কাজ করার জন্য রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করব।”

এ মফস্বল এলাকায় আনন্দ করার মতো কিংবা সময় কাটানোর মতো কোনো ব্যবস্থা নেই, এমনকি রেস্তোরাঁও নেই কোনো। তাই রাত পর্যন্ত সময়টা কীভাবে কাটাব, সে নিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম। হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে এখানে এসে পড়েছি, তাই এতকিছু ভাবার সুযোগ ছিল না। কাছাকাছি পায়ে হাঁটা দূরত্বেও কোনো দোকানপাট নেই। এর থেকে বাইকে করে এখানে আসতাম, তাহলে অনেকখানি সময় নষ্ট করা যেত।

হাতে সময় থাকলেও আমি বাবা-মায়ের বাসায় যাচ্ছি না। আমাকে চেনে, এমন কোনো মানুষের সামনেও পড়তে চাচ্ছি না আমি।

“যদি সময় কাটানোর মতো কোনো কাজকর্ম মাথায় না আসে, তবে অতীতের স্মৃতিময় জায়গাগুলো ঘুরে দেখলেও কিন্তু পারেন,” মিয়াগি ঠিক আমার মনে ঘুরপাক খেতে থাকা কথাটাই বলে দিল। “ধরুন, এমন একটা জায়গা যেখানে আপনি শৈশবে গিয়েছিলেন, কিন্তু বড় হবার পর যাননি।”

“অতীতের স্মৃতিময় স্থান? এই শহরে আমার কেবল বাজে স্মৃতিই রয়েছে।”

“হিমেনোর সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো বাদে নিশ্চয়ই?”

“ওর নাম আর মুখে না আনলেই আমার জন্য ভালো হতো। আপনার মুখে ওর নামটা শুনতে চাই না আমি।”

“আচ্ছা। তাহলে সে বিষয়ে সতর্ক থাকব আমি-তবে একটা উপদেশ না দিয়ে পারছি না : চেনাজানা কারো সাথে দেখা না করাটাই আপনার জন্য ভালো হবে।”

“সেরকম কোনো পরিকল্পনাও ছিল না।”

“শুনে ভালো লাগল,” মিয়াগি জবাব দিল। আগের মতোই শীতল তার কণ্ঠস্বর।

সূর্যের তাপ এতটাই তীব্র ছিল যে, মনে হচ্ছিল সেটা আমার চামড়াকে ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটায় ভালোই গরম পড়েছে। স্টেশনের বাইরের বেঞ্চে বসে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, কী করা যায়।

একটু দূরেই মিয়াগি গায়ে একধরনের সানস্ক্রিন মাখছিল। প্রথমবার দেখা হবার সময়েই তার রক্তশূন্য, ফর্সা চেহারাটার সাথে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। তার কাজকর্ম এতটাই গম্ভীর ছিল যে, চেহারার প্রতি সে যে মনোযোগ দিতে পারে তা মনে হয়নি। এভাবে সানস্ক্রিন মাখতে দেখে তাই খানিকটা অবাকই লাগল।

“আচ্ছা, আমি বাদে আপনাকে আর কেউ তো দেখতে পারছে না, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“এটা কি সবসময়ের জন্যই সত্য?”

“হ্যাঁ, আমি যার পর্যবেক্ষণ করছি তিনি বাদে আর কেউ আমাকে দেখতে পারবেন না। তবে সবকিছুরই ব্যতিক্রম রয়েছে। আমি যখন পর্যবেক্ষকের কাজ থেকে ছুটি নিই, তখন যারা তাদের আয়ু, সময় কিংবা স্বাস্থ্য বিক্রি করতে আসে তারা কিন্তু আমাকে দেখতে পায়—হঠাৎ করে এই প্ৰশ্ন কেন?”

“কোনো কারণ নেই। আপনাকে ক্রিম মাখতে দেখে মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কেউ তো আপনাকে দেখতেই পারছে না, তবে ক্রিম মাখার পেছনের উদ্দেশ্য কী?”

আমাকে অবাক করে দিয়ে সে খানিকটা রেগে গেল।

“মাঝেমধ্যে নিজের জন্য এসব করি আমি,” কন্ঠস্বরে বোঝাই যাচ্ছে সে রেগে গিয়েছে। “আপনি নিজেও তো মাঝেমধ্যে কারো সাথে দেখাসাক্ষাৎ না করা লাগলেও গোসল করেন, তাই না?”

বুঝতে পারলাম, তার মনে কষ্ট দিয়েছি আমি। অন্য কোনো মেয়ে হলে সাথে সাথে ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু মেয়েটা ‘মিয়াগি’ হওয়ায় একটু খুশিই লাগল। মনে হচ্ছিল, আমার সাথে করা বাজে ব্যবহারের একটা বদলা নিতে পেরেছি। এরকম ফালতু একটা চিন্তা আসায় নিজেকে বাহবা দিতে মন চাইল।

আপনমনে ঘুরতে ঘুরতে টের পেলাম, রাস্তার পাশের গাছগাছালির মধ্যে আমার পা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে আমি আর হিমেনো ছোটবেলায় খেলাধুলা করতাম। খুব বিরক্ত লাগল এই ভেবে যে, মিয়াগির উপদেশ মতোই কাজ করছি আমি। আমার কাজকর্ম আর আচরণ যে খুব সহজেই যে কেউ ধরে ফেলতে পারে, সেটাই প্রমাণ করে দিলাম আবার।

আমার বাড়ির আশপাশ এড়িয়ে যাচ্ছিলাম বলে জায়গাটায় যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। যাত্রাপথে সামনে একটা দোকান পড়ল। চকলেট ও অন্যান্য মিষ্টদ্রব্যাদি বিক্রির দোকান ছিল সেটা। ছোটবেলায় এখানে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। আজ দেখি, দোকানটার সাইনবোর্ডটা আর নেই; ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে তারা।

গাছগাছালির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর রাস্তা থেকে নেমে গাছগাছালির ভেতর ঢুকে গেলাম। পাঁচমিনিট পর আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম আমি।

একটা পরিত্যক্ত বাস পড়ে ছিল সেখানে। ছোটবেলায় আমি আর হিমেনো সেটাকে আমাদের ‘গোপন দুর্গ’ হিসেবে কল্পনা করে কত আনন্দ করেছি! বাসের বাইরের দিকটা জং ধরে একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা হলেও ভেতরটা কিন্তু ভালোই পরিষ্কার ছিল। সিট আর মেঝেতে ধুলোবালির আস্তরণ পড়া বাদে ভেতরের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। বনের ভেতর যেহেতু, তাই ভেতরে পোকামাকড়ের আড্ডাখানা থাকবে সেটা ধরে নেয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, পোকামাকড় ভেতরে ছিল না বললেই চলে।

বাসটার ভেতর দিয়ে হেঁটে আমাদের অতীতের অস্তিত্বের চিহ্ন খুঁজে বেড়ালাম। নাহ, সেরকম কিছু চোখে ধরা পড়ল না। হাল ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় ড্রাইভারের সিটে আড়চোখে তাকাতেই জিনিসটা চোখে পড়ল আমার।

সিটটায় নীল রঙের পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে কী যেন লেখা ছিল। কাছাকাছি গিয়ে চোখ কুঁচকে দেখতেই বুঝতে পারলাম, একটা তীরচিহ্ন আঁকা রয়েছে সেখানে। যেদিকে ওটা নির্দেশ করছিল, সেদিকে তাকাতেই আরেকটা তীরচিহ্ন চোখে পড়ল আমার।

ছয়টা তীরচিহ্ন অনুসরণ করার পর সিটের পেছনটার দিকে তাকালাম। একটা ‘লাভ আমব্রেলা’ আঁকা রয়েছে তাতে। ছোটবেলায় এসব আঁকে বাচ্চাকাচ্চারা। এরকম ছাতার নিচে মানুষের নাম লিখলে তারা নাকি একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। ছোটবেলায় আমরা মজা করতে গিয়ে এরকম লাভ আমব্রেলা এঁকে অন্যের নাম লিখেছি কিংবা আমাদের পছন্দের মানুষটার নাম লিখেছি।

স্বাভাবিক ভাবেই এখানে লাভ আমব্রেলার নিচে আমার আর হিমেনোর নাম লেখা ছিল। আমি এটা আঁকিনি, আর এই জায়গার কথা কেবল আমার আর হিমেনোরই জানা ছিল; কাজেই এটা হিমেনোই এঁকেছে।

মুখে হাসি ফুটে উঠল আমার। এরকম মেয়েলি কাজ যে সে করতে পারে, সেটা তাকে দেখে কখনো মনে হয়নি।

অনেকক্ষণ ধরে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। মিয়াগিও আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে জিনিসটা দেখল, কিন্তু কোনো খোঁচা মারা মন্তব্য করল না।

ছবিটা স্মৃতিতে একদম খোদাই করে নিয়ে বাসটা থেকে বের হলাম। ছোটবেলায় যেভাবে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িটার ওপর ভর করে বাসটার ছাদে উঠতাম, ঠিক সেভাবেই আজকে বাসের ছাদে উঠলাম আমি। জমে থাকা পাতা আর ডালপালা সরিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়লাম।

সন্ধ্যায় যখন সিকাডারা তারস্বরে গুঞ্জন করতে শুরু করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানেই থাকলাম।

.

দাদার কবরস্থানটা অল্প সময়ের জন্য ঘুরে আসতে আসতে রাত হয়ে গেল। আমি এলিমেন্টারি স্কুলটার উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামলাম। স্কুলের টুলশেড থেকে একটা শাবল ধার করে জিমনেশিয়ামের পেছনে যে জায়গাটা সঠিক মনে হলো, সেখানের মাটি খোঁড়া শুরু করে দিলাম। স্কুলের বাইরের দিকে থাকা ইমার্জেন্সি এক্সিট এর সবুজ আলো চারপাশ এক সবুজাভ আলোয় আলোকিত করে রেখেছিল।

ভেবেছিলাম অল্প খানিকটা মাটি খোঁড়ার পর সাথে সাথেই ক্যাপসুলটা পেয়ে যাব। কিন্তু হয়তো আমার স্মৃতি আমার সাথে প্রতারণা করছে, কিংবা হয়তো ক্যাপসুলটা বহু আগেই তুলে ফেলা হয়েছে-একঘণ্টা ধরে ঘাম ঝরানোর পরেও ক্যাপসুলটা পেলাম না আমি।

গলা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গিয়েছে। গতকালকের ব্যাটিং সেন্টারে সময় কাটানোর পর থেকে হাতেও তেমন একটা জোর পাচ্ছি না আমি। মিয়াগি আমাকে মাটি খুঁড়তে দেখে কী যেন নোটবুকে লিখছিল।

সিগারেট ব্রেক নিলাম একটা। ঠিক তখনই মাথায় এল : হ্যাঁ, শুরুতে এখানে রাখার কথা ছিল ঠিকই, কিন্তু কদিন পর এখানে গাছ লাগানোর কথা শোনার পর জায়গা পরিবর্তন করা হয়েছিল।

ঐ জায়গায় গিয়ে দশমিনিট খুঁড়তেই শাবলের মাথা ধাতব কোনো কিছুর সাথে আঘাত পেল। সতর্কতার সাথে গোলাকৃতির সেই জিনিসটা বের করে এনে আলোর সামনে ধরলাম। ভেবেছিলাম লক করা থাকবে, কিন্তু না, একটু চাপ দিতেই খুলে গেল।

আমার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল শুধু আমার চিঠিটা বের করে নিয়ে ওটা আবার মাটিচাপা রেখে দেব। কিন্তু জিনিসটা বের করতে এতটা পরিশ্রম করেছি যে, বাকি চিঠিগুলোতেও চোখ বোলাতে মন চাইল। আর কয়েক মাসের মধ্যেই তো ফুড়ুৎ হয়ে যাচ্ছি এই দুনিয়া থেকে, তাই নিশ্চয়ই তারা এ কাজের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেবে।

সম্পূর্ণ আন্দাজে একটা চিঠি তুলে নিলাম। চিঠিটা খুলে নিচের দিকের ‘প্রাণের বন্ধুর নাম’টা দেখে নিলাম আমি।

শেষ করে নোটপ্যাড বের করে যে লিখেছে তার নাম, আর যার নাম লিখেছে তার নামটা চট করে লিখে ফেললাম। লিখে তাদের মাঝে একটা তীরচিহ্ন দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম ‘অমুকের প্রিয় বন্ধু হচ্ছে অমুক’। এভাবে সবগুলো চিঠি বের করে নিয়ে নাম আর তীর দিয়ে কাগজটা ভরিয়ে ফেললাম। শেষমেশ একটা ডায়াগ্রাম দাঁড়াল। কোনগুলো দ্বিমুখী বন্ধুত্ব আর কোনটা একমুখী বন্ধুত্ব?

কাজটা শুরুর সময়ে যে সন্দেহটা মনে ঘোরাফেরা করছিল, সেটাই শেষমেশ প্রমাণিত হলো। এতগুলো নামের মধ্যে তীরহীন একজনই ছিল-আর সেটা আমি। একটা মানুষও আমাকে তার ‘প্রিয় বন্ধু’র জায়গায় স্থান দেয়নি।

টাইম ক্যাপসুলটা হাজারো ঘাঁটার পর হিমেনোর চিঠিটা খুঁজে পেলাম না। বোধহয় যেদিন এই ক্যাপসুল মাটিতে রাখা হয়েছিল, সেদিনও সে স্কুলে আসেনি।

সে আসলে নিশ্চয়ই আমার নাম লিখত-আমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে। আমাদের গোপন এই ‘দুর্গ’টায় সে লাভ আমব্রেলা এঁকে আমাদের নাম সেটার নিচে লিখেছিল। হয়তো চিঠি লিখলে সে আমার নাম লেখার পাশাপাশি একটা হার্টের ছবিও এঁকে দিত।

ইশ, যদি হিমেনোর চিঠিটা এখানে থাকত!

জিন্সের পকেটে আমার চিঠিটা ঢুকিয়ে, টাইম ক্যাপসুলটা আবার মাটিতে পুঁতে ফেলে, টুলশেডে শাবলটা রেখে, ওখানকার পানির কলে হাতমুখ ধুয়ে স্কুল থেকে বের হলাম।

হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। টলমল পায়ে হাঁটতে থাকার সময় পেছন থেকে মিয়াগির গলা শুনতে পেলাম, “এতক্ষণে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন? অতীতের বন্ধনের ওপর ভরসা করে লাভ নেই। প্রথমত, এতদিন সবাইকে এড়িয়ে এসেছেন আপনি। দ্বিতীয়ত, হিমেনো স্কুল পাল্টানোর পরে আপনি কি তাকে একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলেন? হাইস্কুল পাস করার পর নারুসের সাথে একবারো যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন? ওয়াকানা কেন আপনার ওপর হাল ছেড়ে দিয়েছিল? ক্লাসের রি-ইউনিয়নে যাওয়ার ইচ্ছে করেনি আপনার। আমার এই কথাগুলো হয়তো আপনার বুকে কাঁটার মতো বিঁধছে, কিন্তু এখন কি আপনার ফেলে আসা সময়ের দিকে ফিরে তাকানোর মতো অধিকার রয়েছে?”

কথাগুলো আমাকে প্রচণ্ড ক্ষেপিয়ে তুলল, কিন্তু উত্তরে বলার মতো কিছুই ছিল না আমার

মিয়াগির কথাগুলোয় হয়তো খানিকটা হলেও সত্যতা ছিল। আমি এমন এক ধরনের নাস্তিকের মতো আচরণ করছিলাম, যে কিনা সামান্যতম সাহায্যের দরকার হলে নানা ধরনের মন্দিরে গিয়ে সেখানকার দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করে দেয়।

কিন্তু আমার ‘অতীত’ আর ‘ভবিষ্যৎ’ দুটোর দরজাই যদি বন্ধ থাকে, তবে আমি কোথায় যাব? কী করব?

স্টেশনে গিয়ে পৌঁছানোর পর টাইমটেবিলটা দেখলাম। বোধহয় এতকিছু ঘটে যাবার পর চোখে ভুলভাল দেখতে শুরু করেছি। কারণ, টাইমটেবিল অনুযায়ী সর্বশেষ ট্রেনটা দু’ঘণ্টা আগেই স্টেশন ছেড়ে চলে গিয়েছে। এখানে থাকাকালীন সময়ে আমি ট্রেন ব্যবহার করিনি বললেই চলে। তাই এত সকাল সকাল ট্রেন ব্যবস্থা বন্ধ হতে দেখে প্রচণ্ড অবাক হলাম।

চাইলেই ট্যাক্সি ডাকতে পারতাম। তার চেয়েও বড় কথা, বাড়িতে যাওয়া থেকে কেউ আমাকে আটকাচ্ছে না। কিন্তু এত সুযোগ থাকার পরেও আমি স্টেশনে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই মুহূর্তে শারীরিকভাবে নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে। শারীরিক যন্ত্রণা বেশি হলে মানসিক যন্ত্রণাটা কিছুটা হলেও কম মনে হবে। সম্পূর্ণ মনোযোগটা তখন শরীর ব্যথাতেই ব্যস্ত থাকবে।

শক্ত বেঞ্চে বসে আমি চোখ বন্ধ করলাম। স্টেশনের বাতিটার সাথে পোকাগুলো বারবার গোত্তা খাচ্ছে আর শব্দ তৈরি করছে। একটানা চলতেই থাকল এই শব্দ। শরীরটা এতটাই ক্লান্ত যে, চোখ বন্ধ করলেই ঘুম এসে যাবে আমার। কিন্তু স্টেশনের ভেতরটা এতটা আলোকিত যে, চাইলেও ঘুম আসবে না। আর পোকামাকড়গুলো আমার পা বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই ঘুম দেয়াটা যে আরামদায়ক কিছু হবে না এটা অন্তত পরিষ্কার ।

আমার পেছনের বেঞ্চ থেকে মিয়াগির কলমের খসখস শব্দ কানে এল। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, তার কাজটা অনেক কঠিন। কদিন ধরে তার সাথে থেকে যে অভিজ্ঞতাটা হলো তা থেকে মনে হচ্ছে তার ঘুমানোর সুযোগ খুব কমই মেলে, মাঝেমধ্যে হয়তো তাও মেলে না। একমিনিট ঘুমালে তাকে পাঁচমিনিট জেগে থাকতে হয়—এই হলো তার অবস্থা। একজন পর্যবেক্ষকের কাজ বোধহয় এরকমই। কিন্তু একজন যুবতির জন্য কাজটা বেশ কঠিন।

কিন্তু আমি এতটা সহানুভূতিশীল নই। বরং কাজটা যে আমাকে করতে হচ্ছে না, এতেই আমি খুশি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *