টপ টেরর ২

২৫.

 হালকা নীল রঙের স্যাটার্ন এসএলওয়ান ভাড়া গাড়িতে একাই আছে রানা। তেল কম খায় বলে সুনাম আছে এই মডেলের। পিছু পিছু নিজেদের ভাড়া গাড়ি নিয়ে আসছে জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। বজায় রেখেছে দূরত্ব। ওরা রানার আস্তিনের সেরা তাস। ঠিক করেছে এখন খেলবে না।

ডালাস থেকে উত্তরদিকের সড়ক ধরে চলেছে ওরা। গন্তব্য রে রবার্ট লেক। একবার ওখানে পৌঁছুলে পুবে যাবে ছোট শহর পাইলট পয়েন্ট-এ। এরপর শাখা রাস্তা ধরে পৌঁছুবে খামার এলাকায়। ওই মাঠ গিয়ে মিশে গেছে ওকলাহোমা রাজ্যের সীমান্তে। রানার গাড়িতে আছে জিপিএস লোকেশন ফাইত্তার, কিন্তু কোনও কাজে আসবে না ওটা। চারপাশে খেত, জায়গায় জায়গায় জঙ্গল। সিনথেসাইয মহিলাকণ্ঠ বারবার বলছে: ফিরে যাও যেদিক থেকে এসেছ। আরও কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে সুইচ টিপে মহিলার কণ্ঠরোধ করল রানা। বুঝতে পারছে, কঠিনই হবে ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ খুঁজে বের করা।

মাঝে মাঝে সেল ফোনের মাধ্যমে দুই বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে রানা। একমাইল পেছনে আসছে তারা। হঠাৎ বিপদ হলে সময় লাগবে ওদের ওর কাছে পৌঁছুতে। তবে বেশিরভাগ সময় দেখা যাচ্ছে খেত গিয়ে মিশেছে দিগন্তে। নেই কোনও দালান-কোঠা বা শহর। ময়নিহানের লোক এলে তাদেরকে দেখা যাবে বহু দূর থেকে। কারও সন্দেহ হবে না একটা গাড়ি চলে গেলে। তবে পর পর দুটো গাড়ি গেলে তা দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

আর্লিংটনের বাইরে ওই মোটেলে বসে নতুন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে বাড হিগিন্স। টেক্সাসে অসংখ্য স্থাবর সম্পত্তি আছে ময়নিহানের জমি উন্নয়ন ব্যবসা সংস্থার। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বিশেষ একটি মনোযোগ কেড়েছে ওদের।

ময়নিহান র‍্যাঞ্চ।

লোকটা বেছে নিয়েছে প্রত্যন্ত এলাকায় দেশের সেরা জমি। তাকে খুঁজতে হলে প্রথমেই যাওয়া উচিত ওখানে। কাউকে বন্দি করে রাখতেও উপযুক্ত জায়গা ওটা। কেউ শুনবে না আর্তের চিৎকার। আত্মরক্ষার জন্যেও ভাল। দুমাইলের ভেতর গোপনে পৌঁছুতে পারবে না কেউ।

গুগল দেখে কোন্ দিকে যেতে হবে বের করেছে বাড। লোকেশন বুঝে নিয়েছে রানা। ম্যাপ অনুযায়ী, র‍্যাঞ্চে গেছে মাত্র একটা রাস্তা। বেরোতেও ব্যবহার করতে হবে এটাই। তবে সমস্যা হচ্ছে সঠিক পথ কোটা খুঁজে বের করা কঠিন। টুরিস্টরা যায় না ওদিকে। রাস্তায় কোনও সাইনবোর্ডও নেই। ধরে নিতে হচ্ছে, দিগন্তের ওদিকে ওই র‍্যাঞ্চ। বহু ব্যবধানে কখনও কখনও খুঁটিতে একটা-দুটো মেইলবক্স বুঝিয়ে দিচ্ছে, পাশ দিয়ে গেছে কাঁচা রাস্তা। বেশিরভাগ ট্রেইল মানেই চেপ্টে যাওয়া ঘাসের মাঝে দুটো দাগ। বহু দূরে দূরে এসব ট্রেইল।

চুপচাপ ড্রাইভ করছে রানা। শীত আসছে বলে রাস্তার দুপাশে বাদামি ঘাসের বিশাল মাঠ। দূরে পেট পূজায় ব্যস্ত গরুর পাল। একেকটার মস্ত শিং ধনুকের মতই বড়। রানার মনে পড়ল, বেণ্ডারদের ডজ র‍্যাম গাড়ির কথা। ভাবল, এখন কোথায় দানবের মত লোকটা? আত্মরক্ষা করতে গিয়ে তার ছোটভাইকে খুন করেছে ও।

নতুন করে সচেতন হয়ে উঠল রানা। ময়নিহানের কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে জুডিকে। কাজটা কঠিন, আগে খুঁজে বের করতে হবে মেয়েটা আছে কোথায়।

স্যাটার্ন থামাল রানা। মোবাইলের বাটন টিপে কল দিল জনকে। তোরা বরং আরও পিছিয়ে যা।

কোনও সমস্যা? জানতে চাইল জন।

চারপাশটা দেখতে থেমেছি, বলল রানা। গাড়ি নামিয়ে দিল বামের মাঠে। ওদিকেই কোথাও ময়নিহান র‍্যাঞ্চ। একটা কমপাস পেলে কাজ হতো।

এগোতে থাক, ওই র‍্যাঞ্চ বেশি দূরে নেই, বলল জন।

দূরের দিগন্তে আবছাভাবে সবুজের রেখা দেখল রানা। গাছ ও ঝোপ লাগিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে ওদিকে।

সোজা র‍্যাঞ্চের দিকেই চলেছি, বলল রানা। তবে দেখিনি গেট। কাছাকাছি গিয়ে আবার রাস্তায় ফিরব।

বাডের গালি শুনতে পেল রানা।

যাশশালা! বলে উঠল জন। এগোতে থাক, কিন্তু তোর দিকে যাচ্ছে একটা কপ্টার। নিচে আরও আছে দুটো গাড়ি, সন্দেহজনক।

তোদের দিকে কপ্টার থেকে বাড়তি মনোযোগ দেয়নি?

হ্যাঁ, দিয়েছে। নিচু হয়ে উড়ে আসছে। দেখতে চায় আমরা কারা। চুপ হয়ে গেল জন। বোধহয় রেখে দিয়েছে ফোন।

গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টোদিকে চলল রানা। ওকে অন্যদিকে যেতে দেখলে হয়তো সন্দেহ কমবে কপ্টার পাইলটের। বহু দূরে যান্ত্রিক ফড়িংটাকে দেখতে পেল রানা। উড়ে আসছে রাস্তার ওপর দিয়ে। কালো রঙের। কী ধরনের কপ্টার বোঝ গেল না। গতি ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল। হয়তো চলে যাবে পাশ কাটিয়ে। আগের চেয়ে গাড়ির গতি বাড়াল রানা। যে-কোনও সময়ে হয়তো রাইফেলের মাযলে ঝলসে উঠবে কমলা আগুন।

কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেলেও এল না গুলি।

উচ্চতা কমিয়ে ঘুরে রানার দিকে এল কপ্টার।

আবারও ফোনে কথা বলে উঠল জন। ভালভাবে দেখে নিয়েছে। আমাদেরকে খুঁজছে না। তোর ক্ষেত্রে তেমন না-ও হতে পারে। সোজা তোর দিকে আসছি। যে-কোনও সময়ে শুরু হতে পারে ঝামেলা।

সাধারণ গতিতে আয়, বলল রানা। এখনও চিন্তার কিছু নেই। ফোন রেখে কোমর থেকে ওয়ালথার নিল ও। রাখল পাশের সিটে। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে নিয়ে মাথায় চাপাল বেসবল ক্যাপ। কে জানে, হয়তো ওটার জন্যেই আরও বেশি সন্দেহপ্রবণ হবে লোকগুলো। এরা ময়নিহানের স্যাঙাৎ হলে তাদেরকে ওর চেহারা ও দৈহিক বর্ণনা দিয়েছে রিক বেণ্ডার, জাজ হোল্ড বা শেরিফ ম্যাকলাস্কি। আবছাভাবে ওকে দেখবে ককপিট থেকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই।

ষাট মাইল বেগে কপ্টারের দিকেই চলেছে রানা। ওর চেয়ে জোরে আসছে কপ্টার। এবার ওটাকে চিনল রানা। বেল জেট রেঞ্জার। লেজে ধূসর-লাল রঙ। কোনও চিহ্ন নেই যে ধরে নেবে ওটা ন্যাশ ময়নিহানের। ভেতরে দুজন। ষণ্ডামার্কা চেহারা। মনে হলো না সহজ লোক। ভুরু কুঁচকে দেখল রানাকে।

নিজে অভিনয় ভালই করল রানা। মিষ্টি হাসল তাদের দিকে চেয়ে। হাতও নাড়ল বারকয়েক। পেছনে রয়ে গেল কপ্টার। আয়নায় ওটাকে দেখল ও। বামে বাঁক নিয়ে আবারও পিছু নিল লোকদুজন। দেখতে না দেখতে আবার চলে এল কাছে। কড়া চোখে রানাকে দেখল কো-পাইলট। অবাক হয়েছে, এমন ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রানা। জবাবে হাতের ইশারা করল নোকটা। খোল, ব্যাটা, তোর ক্যাপ!

আদেশ মানল রানা। খুলে ফেলল ক্যাপ। খাটো করে ছাঁটা চুলে হাত বুলিয়ে নাচাল দুই ভুরু। মুখ হাঁ করে বুঝিয়ে দিল: আবার কী হলো, ভাই?

রানার চেহারা দেখে খুশিই মনে হলো কো-পাইলটকে। নাড়ল মাথা। গাড়ি পেছনে রেখে এগোল কপ্টার। ধুলোয় অন্ধকার হলো চারপাশ। কপ্টারের তলা দিয়ে চলেছে গাড়ি। ওপরে উঠছে কপ্টার। আয়নায় রানা দেখল, ওটা চলেছে। পুবের সবুজ রেখা লক্ষ্য করে। বুঝে গেল, ওখানেই ন্যাশ ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ।

কিছুটা যেতেই দেখল উল্টোদিক থেকে আসছে জন ও বাডের ফোর্ড উইণ্ডস্টার মিনিভ্যান। গতি কমিয়ে থামল রানা। একটু পর পাশাপাশি হলো দুগাড়ির জানালা।

তোর জন্যে অপেক্ষা করছে ময়নিহান, মন্তব্য করল জন।

তাই মনে হচ্ছে, বলল রানা, কিন্তু এখন আবারও ওদিকে গেলে সন্দেহ করবে কপ্টারের লোকগুলো। এর পরেরবার হয়তো এত সহজে পার পাব না।

তা হলে কী করবি? জানতে চাইল জন।

রানা, সোজা যা পাইলট পয়েন্টে, এদিকে জায়গা দেখে ফিরব আমরা,বলল বাড।

তোদেরকেও দেখেছে, বলল রানা।

কথা ঠিক, ঘুরপথে যেতে পারি উত্তরদিকে, বলল জন। পরে দেখা হবে লেক হাউসে।

কথাটা যৌক্তিক। হয়তো দূরের রাস্তায় অপেক্ষা করছে। কপ্টার। ঠিক সময়ে না পৌঁছুলে কয়েক মিনিটে পৌঁছে যাবে এখানে। অন্যদিকে গেলেও খুঁজে নেবে। সেক্ষেত্রে হয়তো শুরু হবে মুখোমুখি লড়াই। ওদের তিনজনের বিরুদ্ধে প্রাণে বাঁচবে না লোকদুটো। কিন্তু রানা চাইছে না, এখনই শত্রুপক্ষ জেনে যাক সঙ্গে আছে জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। জুডিকে সরিয়ে নেয়ার সময় কাজে আসবে ওই চমক।

রওনা হ, বলল রানা, চেষ্টা করবি যেন তোদের চিনতে না পারে।

মাথা দোলাল জন।

গাড়ি নিয়ে রওনা হলো বাড।

গাড়ি ঘুরিয়ে লেক তীরে ওদের ভাড়া নেয়া কেবিন লক্ষ্য করে চলল রানা। রেকি করতে এসেছিল, সেটা ভালভাবে না পারলেও হতাশ নয়। কপ্টার দেখে আঁচ করা যাচ্ছে, র‍্যাঞ্চ হাউসে আছে ময়নিহান। অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

দেখা হবে, ময়নিহান, বিড়বিড় করল ও। আগের চেয়ে গতি তুলে ফিরছে পাইলট পয়েন্ট-এ। সময় কাটাতে গিয়ে জুডির কথা মনে পড়ল ওর। যেন চোখের সামনে ভাসল প্রথম দেখার দৃশ্য: কিছুক্ষণ হলো দেখছে, রুপালি সাগর সৈকতের বাঁক ঘুরে হেঁটে আসছে এক যুবতী। আর সব মেয়ের তুলনায় লম্বা। সরু কোমর, চওড়া কাঁধ। হাঁটার ভঙ্গি ব্যালেরিনার মতই সাবলীল। কালো চুল। আয়ত দুই চোখের মণি কুচকুচে কালো। উঠে এল বিচ হাউসের সান-ডেকে। নিচু কণ্ঠে জানতে চাইল, তুমিই কি মাসুদ রানা?

রানার মনে পড়ল লিটল ফোর্কের মোটেলে ওর ঠোঁটে চুমু দিয়েছিল জুডি। সাড়া দিতে গিয়েও সামলে নিয়েছিল ও। লাল হয়েছিল জুডির দুগাল। বুঝেছে, সুযোগটা নেবে না রানা। তখন ম্লান হেসেছে মেয়েটা। নরম সুরে বলেছে, ধরে নাও, বন্ধু হিসেবে ধন্যবাদ দিতেই চুমু দিয়েছি।

অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল রানা। পরে বিড়বিড় করে কী যেন বলেছে জুডি। দারুণ সুন্দরী মেয়ে, ওকে পাত্তা না দেয়ায় চোখে ছিল রাগের ছাপ।

রানার মনে পড়ল, পরে কী বলেছে জন: দেখতে দারুণ, তাই না?

জবাবে রানা বলেছে: হোক, তাই বলে পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিবি?

হেসেছে জন। ওহ্, বলে দিয়েছে? যাহ্!

ভাবতে পারিনি মাইকের বোন।

আমিও ভাবতে পারিনি। সে তো ছিল মদ্দা মোষের মত। সব বাজে জিন ওর ওপর খরচ করে ফেলেছিল ওর বাপ। তারপর স্বর্গ থেকে নেমে এল ওই মেয়ে।

চুপ থেকেছে রানা।

কী, রানা, প্রেমে পড়ে গেলি? জানতে চেয়েছে জন।

এখনও না, বলেছে রানা।

ওর কথা শুনেই বুঝেছি, তোকে পছন্দ করে। ক্ষতি কী মেলামেশা করলে?

উচিত হবে না, জন। পাহাড়ে ওর বোনের বাড়িতে মুগ্ধ হয়ে চেয়েছি। তাতে আরেকটু হলে মাথা উড়ে যাচ্ছিল আমার। এক সেকেণ্ড দেরিতে গুলি পাঠিয়েছি।

আনমনে এসব ভাবতে গিয়ে ভুল করেছে রানা।

কখন যেন মাঠ পাড়ি দিয়ে ঘাড়ের কাছে পৌঁছে গেছে। দ্রুতগামী এক ল্যাণ্ড রোভার!

রানার গাড়ির জানালা ঝনঝন করে ভেঙে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে বুলেট বিধতেই চটকা ভাঙল ওর। এক সেকেণ্ড পর মেঝেতে দাবিয়ে দিল অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল। লাফ দিয়ে এগোল গাড়িটা। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড লাগল ঘণ্টায় আশি মাইল বেগে গতি তুলতে। কিন্তু এর বেশি সাধ্য নেই এ গাড়ির। ময়নিহানের লোকদের সন্দেহ থেকে দূরে থাকতে অতি সাধারণ গাড়ি ভাড়া করেছে-রানা। তখন হুঁশ ছিল না যে লাগতে পারে তুমুল গতি।

কসেকেণ্ডে ওর পেছনে পৌঁছে গেল ল্যাণ্ড রোভার। রিয়ার ভিউ মিররে ওটাকে দৈত্য মনে হলো রানার। জিপে দুজন লোক। ড্রাইভ করছে একজন, অন্যজন অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে জানালা দিয়ে। হাতে রাইফেল। মাযল আবারও তাক করছে ওর দিকেই!

ছদ্মবেশ বৃথা গেছে, ভাবল রানা। ডানদিক থেকে উড়ে আসছে সেই ধূসর-লাল কপ্টার! আরও খারাপ খবর: ওটার দরজায় এখন দাঁড়িয়ে আছে একলোক, কাঁধে অটোমেটিক রাইফেল।

ওদের আছে ভাল মেশিনারি, সংখ্যায় ওরা বেশি এবং অস্ত্রও আধুনিক। বিড়বিড় করল রানা, ওরে, গাধা, এমন ফাঁদে কীভাবে পড়লি তুই?

.

২৬.

 নিজের কথা রেখেছে হেনি। কিন্তু রিক ভাবছে, কখন দেখাবে লোকটা তার আসল রূপ? ওর ভুল না হলে, সময় লাগবে না ভদ্রতার মুখোশ খুলতে। বাররুমে ঢুকতেই দেখল, নতুন এক টেবিল এনে ওটা ঘিরে বসে আছে চার যুবক। চেহারা গম্ভীর। উঁচু মঞ্চ পেরিয়ে দরজার দিকে যেতেই কঠোর চোখে ওকে দেখল মার খাওয়া লোকটা। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তাদের উদ্দেশে মৃদু নড় করল রিক। জরাবে মাথা দোলাল তিনজন। ভুরু আরও কুঁচকাল চতুর্থর্জন।

দরজার দিকে চলেছে রিক। শুনল হাসাহাসি করছে চার যুবক। ওকে নিয়ে হাসছে না। কপা পেছনে আসছে হেনি। মনে হলো পনেরো শ ডলার পেয়ে খুশি। হয়তো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে রিকের কথা। বিদায় দিয়ে ফিরবে ভেতরে।

ডোরওয়ের ক্রোম ফিটিঙে তাকে দেখল রিক। লোকটা ঘুরে চেয়েছে বন্ধুদের দিকে। ইশারায় কথা হয়েছে নীরবে। যা বোঝার বুঝে গেল রিক। একবার স্পর্শ করল ডেসার্ট ঈগল, তারপর সরিয়ে নিল হাত। ওকে পাশ কাটিয়ে ডাবল ডোর খুলে বেরিয়ে গেল হেনি। ঠাস করে বন্ধ হলো কবাট। ওই আওয়াজে চমকে গেছে বাইরের দুজন। তিন সেকেণ্ড পর নাইট ক্লাবের পেছনের উঠানে বেরোল রিক। ততক্ষণে লড়তে তৈরি দুই যুবক। তবে দানবীয় রিককে দেখে একটু ভড়কেই গেল তারা।

ঘাড় কাত করে ইশারা দিল হেনি। হাসি-হাসি মুখে বলল, চিন্তা নেই, রুবেল, রাসেল; বিদায় নিচ্ছে আমাদের বন্ধু।

দুই যুবকের চেহারা দেখল রিক। ফুলে গেছে একজনের গলার শিরা। চোখের তারা বিস্ফারিত। লড়বে। কোনও ইঙ্গিত ছিল হেনির কথায়। আবছাভাবে রিক শুনল, ভেতরের ঘরে পায়ের আওয়াজ। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। হেনি। তাকে পাশ কাটাল রিক। তখনই ওর কনুইয়ে টোকা দিল লোকটা। তাতে ঝট করে ওর দিকে ঘুরল রিক। হাত বাড়িয়ে দিল দলনেতা। খুবই খুশি হলাম তোমার সঙ্গে ব্যবসা করতে পেরে।

হেনির হাত ধরলে দুই যুবকের দিকে পিঠ দিতে হবে, তাতে আপত্তি নেই রিকের। আমিও খুশি, হেনির হাতটা ধরল সে। কাজটা করেছে হিসাব কষেই। পেছনে থাক না দুজন, দেখতে পাবে বার থেকে চার যুবক বেরিয়ে এলে।

হেনির চোখে চোখ রেখে হাসল রিক।

পেছনে শুনল বুটের আওয়াজ।

আজ ভাল মুনাফা করলে, হেনিকে বলল রিক, আরও মুনাফা বোধহয় স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল হবে না।

হ্যাণ্ডশেক করা হাতটা প্রচণ্ড জোরে নিজের দিকে টানল রিক। মুহূর্তে হেনিকে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দুই যুবকের ওপর। মুখোমুখি সংঘর্ষে হতভম্ব হয়েছে তারা। ওই একই সময়ে প্রচণ্ড এক ঘুষিতে বামের যুবকের চোয়াল চুরমার করল রিক। ভীষণ ঝাঁকি খেল হাতে। পাশবিক শক্তি। যুবকের চোয়াল গিয়ে গুতো দিয়েছে মগজে। খুন না হলেও মাসের পর মাস খাবার খেতে পারবে না চিবিয়ে। কাটা কলাগাছের মত পড়ল যুবক। বুকটা হুমড়ি খেল হেনির কোমরে। দুজনই হুড়মুড় করে পড়ল পাকা উঠানে।

বন্ধুদের পায়ে হোঁচট খেয়ে পড়েছে দ্বিতীয় যুবক। কিন্তু সামনে বেড়েই খপ করে তার শার্টের কলার ধরল রিক। একটানে তুলল মেঝে থেকে। মাঝারি আকারের লোক সে, কিন্তু রিকের কাছে নাদান শিশু। দুহাতে তাকে তুলে দরজার পাশের দেয়ালে আছড়ে ফেলল রিক। পরক্ষণে ওর হাঁটু নামল যুবকের উরুসন্ধির ওপর। এদিকে ডানহাতে বন্ধ করেছে কাছের কবাট। বার থেকে এল কজনের হৈ-চৈ শব্দ। বাইরে কী হচ্ছে বুঝেই ছুটে আসছে তারা। মাঝারি আকারের বাউন্সরকে ছাড়েনি রিক, নিজের আর চার যুবকের মাঝে তাকে রাখল ঢালের মত। চার যুবকের দুজনের হাতে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল। অন্য দুজনের হাতে ছোরা। কিন্তু একজনও ব্যবহার করতে পারল না অস্ত্র। তাদের মুখের ওপর ধুম্ করে কবাট বন্ধ করল রিক।

অকস্মাৎ হামলায় শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে মাঝারি বাউন্সার। তাতে হাল ছাড়ল না, বোকার মত ঘুষি চুড়ল রিকের চোয়ালে। মাথা নিচু করে নেয়ায় ঘুষিটা পড়ল দানবের মাথার চাঁদিতে। হাতের হাড় ভাঙল যুবকের, কিন্তু তখনই বদ্ধ দরজার ওপর বারবার তার মাথা ঠুকতে লাগল রিক। ওদিক থেকে এল চিৎকার, ঘুষি ও ধাক্কা। শুকনো কাঠের দরজা ভরে উঠল যুবকের তাজা রক্তে। কসেকেণ্ড পর রিক ছেড়ে দেয়ায় ভিজে নেতিয়ে যাওয়া ন্যাকড়ার মত মেঝেতে পড়ল মৃত যুবক।

দরজার বাইরে পোক্ত বোল্ট ও প্যাডলক। খদ্দেরদের জন্যে সামনে দরজা খুললে বোধহয় বন্ধ রাখে এদিকেরটা। পুরু ছিটকিনি লাগিয়ে দিল রিক, পরক্ষণে ক্লিক শব্দে আটকে গেল প্যাডলক।

এবার ঘুরে হেনিকে দেখল রিক।

শেষপর্যন্ত বন্ধুর তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে দলনেতা। কিন্তু হাঁটু সোজা করে দাঁড়াবার আগেই একহাতে তার গলা চেপে ধরল রিক।

চারপাশে কী হচ্ছে বুঝে ভীষণ ভয়ে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে হেনির। সবার ভেতর সে সবচেয়ে শক্ত পেরেক। বারকয়েক ঢোক গিলে বলল, তুমি জানো, কার সঙ্গে লাগতে এসেছ?

তোকে মগ প্রেযেণ্ট করেছে যে মেয়েছেলে, মস্ত ভুল করেছে সে, আন্তরিক হাসল রিক। এবার দ্যাখ কী করি!

দুহাতে রিকের কবজি ধরে নিজেকে ছাড়াতে চাইল হেনি। কিন্তু ক্ষুধার্ত নেকড়ের চোয়াল থেকে মুক্তি নেই মোরগের। গায়ের জোরে না পেরে প্যান্টে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করল হেনি। কিন্তু ওর কবজিটা ধরল রিক। রানাকেও এভাবে ধরেছিল বলে খুন হয়েছে ছোটভাই। দ্বিতীয়বার ভুল না করে প্রচণ্ড চাপ দিল হেনির পিস্তল ধরা কবজিতে। শুনল মুড়মুড় শব্দে গুঁড়ো হচ্ছে হাড়। দাঁতে দাঁত চেপেও হেনি ঠেকাতে পারল না বিকট, কর্কশ আর্তনাদ। প্রচণ্ড ব্যথায় বিকৃত হলো চেহারা। অবশ হাত থেকে খসে পড়ল পিস্তল। অন্যহাতে হেনির গলা টিপে ধরল রিক। মুচড়ে ভাঙল গলার কার্টিলেজ। যন্ত্রণায় ছটফট করছে হেনি, দুঠোঁটের কশ বেয়ে দরদর করে পড়তে লাগল তাজা রক্ত।

তুই কঠিন গজাল না; বরং শুকনো পাটকাঠির মতই পলকা, বলল রিক। গলা কাটা মুরগির মত ছটফট করছে হেনি। তাকে বারবেল তোলার মত করে দুহাতে মাথার ওপর তুলল রিক। টেরই পেল না টান পড়ছে কাঁধের জখমে। তিন গুনে গায়ের জোরে পাকা উঠানে আছড়ে ফেলল শক্ত পেরেককে। লাশের মত পড়ে থাকল বাউন্সর। নড়ছে না। নড়বেও না। স্থির দুই চোখ চেয়ে রইল আকাশের দিকে।

লাশের পকেট হাতড়ে পনেরো শ ডলার নিজের বুক পকেটে জল রিক। নিল লোকটার পিস্তল। মেয়েদের প্রিয় গ্লক উনিশ। পরে লাগতে পারে। হেনির চাবির গোছা নিল রিক, একটা চাবি দেখে হেসে ফেলল।

দুমিনিট পর পার্কিংলট থেকে বেরোল হেনির সাধের ক্যাডিলাক। একইসময়ে নাইট ক্লাবের সামনের দরজা খুলে ছিটকে বেরোল চার যুবক। তাদের অপমান করতে মাঝের আঙুল দেখাল রিক। পিস্তল তাক করল দুই যুবক, কিন্তু গুলি করল না। ঘুরে দৌড়ে গেল হেনির পাশে।

এবার ওদের কে বাউন্সার হবে, ভাবছে রিক। হয়তো আবার ফেরার সময় তাকে একটু বাজিয়ে দেখবে ও।

ক্যাডিলাক ছুটে চলেছে পুবে। ওদিকেই ডালাস।

গাড়িটা ট্যাঙ্কের মতই ভারী, প্রচণ্ড খাটনির জন্যে তৈরি। ঝড়ের বেগে পিছনে পড়ছে মাইলের পর মাইল। আনমনে ভাবল রিক, পেয়েছি অস্ত্র। ট্যাক্সির ভাড়া আর ড্রাইভারকে দেয়া টিপস বাদ দিলে গাড়ি ও অস্ত্রের জন্যে খরচ হয়নি এক সেণ্টও। হেনি অত লোভী না হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। কিন্তু ডলার বের করেই রিক বুঝেছে, সব কেড়ে নেয়ার লোভ সামলাতে পারবে না লোকটা। ওই লোভের কারণেই হারাল সব। অস্ত্র, টাকা, গাড়ি ও নিজের জীবন।

ক্যাডিলাকের গতি বাড়াল রিক। ৩৫ই রোড ধরে চলেছে। উত্তরদিকে। ৫৫ রুটে পৌঁছে পাশ কাটিয়ে গেল লিউইসভিল লেক ও কোরিহ্। চলেছে পুবের ডেণ্টন লক্ষ্য করে। ওখানে পৌঁছুলে যাবে পাইলট পয়েন্ট ও গ্রেসন কাউন্টি। আগেও শটগান হাতে ওদিকে গেছে। সঙ্গী ছিল শেরিফ ম্যাকলাস্কি। সেসময়ে উড়ে গেছে ময়নিহানের ব্যক্তিগত জেট বিমানে চেপে। অত গতি না পেলেও ক্যাডিলাকে আপত্তি নেই রিকের। দারুণ গাড়ি। ঠিক সময়ে পৌঁছে দেবে ক্ষুরধার ময়নিহানের র‍্যাঞ্চে। ওখানে নিশ্চয়ই পাবে মাসুদ রানাকে।

.

২৭.

কাউন্টার-টেরোরিযম ট্রেনিঙের সময় আত্মরক্ষামূলক ড্রাইভিং শেখানো হয়েছে রানাকে। কিন্তু সেসময়ে ওর গাড়িটা ছিল বুলেটপ্রুফ সেডান, জিপ বা হামার। সে তুলনায় স্যাটার্ন গাড়িটা চাকাওয়ালা পনিরের মতই নরম। আততায়ী চাইলে গুলি না করে পাথর মেরেও বারোটা বাজাতে পারবে দশ বছর বয়সী পুরনো এই গাড়ির।

কপ্টারের লোকটা খুব আগ্রহী না হলেও ল্যাণ্ড রোভারের খুনি আপ্রাণ চেষ্টা করছে রানাকে গাঁথতে। ওদিকে ওর গতিরোধ করতে চাইছে কপ্টারের পাইলট। আরও নেমে এসে ভাবছে, বাধ্য করবে গাড়ি থামাতে। কিন্তু পুরো গতি তুলে কপ্টারের দিকে চলেছে রানা। ওর গো দেখে কপ্টার ওপরে তুলে নিল পাইলট। তাদেরকে বলা হয়েছে রানাকে খুন করতে, খুন হতে নয়।

রানা বুঝল, আশি মাইল বেগ আপাতত যথেষ্ট। পেছনে তেড়ে আসছে ল্যাণ্ড রোভার। সারা রাস্তাভরা গর্ত। জায়গায় জায়গায় মেরামতের চিহ্ন। তবে বড় গর্ত এড়াতে গিয়ে গতি কমিয়ে ষাট মাইলে নামাতে হচ্ছে, নইলে উল্টে পড়বে গাড়ি। খরগোসের মত লাফিয়ে ছুটছে স্যাটার্ন। পেছনে ছিটকে দিচ্ছে রাশি রাশি ধুলো ও নুড়িপাথর।

একের পর এক গুলি করছে ল্যাণ্ড রোভারের খুনি। তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুলিতে এন্তেকাল করেছে রানার গাড়ির পেছন কাঁচ। ঝাঁঝরা হয়েছে প্যাসেঞ্জার সিট। রানার উচিত পাল্টা গুলি করা। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। পাশের সিটে ওয়ালথার। একহাতে স্টিয়ারিং সামলে গুলি করা অসম্ভব। তীরের গতি তুলে পশ্চিমে চলেছে রানা। ওর চোখ খুঁজছে পছন্দমত জায়গা। এমন কোথাও যেতে হবে, যেখানে আত্মরক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ।

সামনেই পড়বে পাইলট পয়েন্ট থেকে কলিন্সভিলে যাওয়ার দক্ষিণ হাইওয়ে ৩৭৭। কিন্তু আপাতত চারপাশে মাঠ ছাড়া কিছুই দেখছে না রানা। এদিকে-ওদিকে একটা দুটো ধূসর গাছ। কপ্টার বা ল্যাণ্ড রোভারের খুনিদের কাছ থেকে কাভার দেবে না। রানার চাই আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা ও ইটের দেয়াল। চারপাশে আছে শুধু ঘাসজমি, গাছ ও গরুর পাল।

উল্টে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরাল রানা। স্পিড ডায়াল করল মোবাইল ফোনে। তিন সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে ধরতেই বলল, জলদি ফিরে আয়! জরুরি দরকার!

আসছি, জবাবে বলল জন।

বাড হিগিন্স গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়ায় চাকা ঘষার কর্কশ শব্দ শুনল রানা। স্যাটার্ন গাড়ির নিচে আলগা নুড়িপাথরের বিশ্রী কড়মড় শব্দ। গলা উঁচিয়ে বলল ও, পেছনে ল্যাণ্ড রোভারে দুজন। কপ্টারেও অন্তত আরও দুজন। সঙ্গে রাইফেল।

ফোন রেখে স্টিয়ারিং হুইল ঠিক করে নিল রানা। রওনা হয়েছে জন ও বাড। সমস্যা হচ্ছে: ওদের মাঝে ব্যবধান চার থেকে পাঁচ মাইল। রানা বুঝে গেল, বাঁচতে হলে ঠেকাতে হবে পেছনের লোকগুলোকে।

ধুলো ভরা রাস্তায় কড়া ব্রেক কষে রী-রী করা আওয়াজ তুলে থামল রানা। পিছলে গেল গাড়ির পেছনদিক। তাতে তৈরি হলো ধুলোর বিশাল মেঘ। একইসময়ে প্রচণ্ড বেগে গাড়ির পেছনে এসে তো মারল ল্যাণ্ড রোভারের গ্রিল। দুই সেকেণ্ড পর চাকা পিছলে এগোল স্যাটার্ন গাড়ি। বডির সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল চেপে ধরেছে রানা। পরের কয়েক সেকেণ্ডে তুমুল গতি তুলল গাড়িটা।

রিয়ার ভিউ মিররে রানা দেখল, ধুলোর মেঘের মাঝে রয়ে গেছে ল্যাণ্ড রোভার। তাতে খুশি হলো ও। এখনও ওকে দেখতে পায়নি লোকগুলো। আবার ব্রেক করল রানা। রাস্তা থেকে উঠছে ঘন ধুলো। ব্রেক করে গাড়ি অর্ধেক ঘুরিয়ে নিল ও। বেরিয়ে এল ওয়ালথার হাতে। পাঁচ ফুট সরার আগেই রকেট বেগে ধুলোর মেঘ থেকে এসে স্যাটার্নের ঘাড়ে চাপল ল্যাণ্ড রোভার।

আধ সেকেণ্ড রানার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল ড্রাইভার। স্যাটার্ন হালকা গাড়ি, চুরমার হলো ভারী গাড়ির ধাক্কায়। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের মত নানাদিকে ছুটল ধাতুর বড়সড় সব টুকরো। প্রাণের ভয়ে ছুটছে রানা, কিন্তু কাঁধে কী যেন ঠাস করে লাগতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে। শরীর গড়িয়ে দিয়ে উঠে বসে তাক করল ওয়ালথার। সামনের দৃশ্য দেখে বিস্ফারিত হলো ওর চোখ।

স্যাটার্ন গাড়িতে গুঁতো মেরে ওটাকে ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে আকাশে নাক তুলেছে ভারী ল্যাণ্ড রোভার। উঠছে তীরের গতি তুলে। কিন্তু তিন সেকেণ্ড পর কাত হলো শূন্যে। পুরো একপাক ঘুরে দড়াম করে পড়ল রাস্তার পাশে। থামল না ভারী গাড়ি, গড়িয়ে চলে গেল পাশের মাঠে। ওটা থেকে খসে পড়ছে ধাতুর বড় বড় সব টুকরো। মাঠের মাঝে রাইফেল ওয়ালাকে দেখল রানা। কবার অস্বাভাবিক ভাঁজ খেয়েছে তার দেহ। ড্রাইভারকে দেখতে পেল না। তবে আশা করল, ওই লোকও আস্ত নেই।

শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। আকাশের দিকে তাকাল কপ্টার দেখতে। তবে চারপাশে শুধু ধুলোর মেঘ। ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্রী কটু গন্ধ। পুড়ছে ফিউয়েল, প্লাস্টিক ও মানুষের মাংস। কপ্টারের আওয়াজ শুনলেও ওটাকে দেখল না রানা। বুঝে গেল, ওকেও দেখছে না তারা। কুঁজো হয়ে ভাঙা ল্যাণ্ড রোভারের দিকে ছুটল রানা। সামনের মাটিতে চোখ, কিন্তু কোথাও নেই রাইফেলটা। গাড়ির সিট বেল্টে ঝুলে আছে ড্রাইভার। মুখ ভেসে গেছে রক্তে। ঘোলা চোখে পাগলাটে দৃষ্টি। পেরিফেরাল ভিশনে নড়াচড়া দেখে ঘুরে তাকাল রানার দিকে। মরার দশা, তবুও পাশের সিট থেকে তুলে নিল রিভলভার।

অচেনা লোক, পেশাদার খুনি। এসেছিল খুন করতেই। বাঁচলে ভবিষ্যতে খুন করবে অন্য কাউকে। দয়া এল না রানার মনে, হাতে গুলি না করে ফুটো করল তার কপাল। ঘুরে তাকাল রাইফেলওয়ালার দিকে। পনেরো গজ দূরে পড়ে আছে সে। আধপোড়া দেহ থেকে উঠছে কালচে ধোয়া। আরও সতর্ক হলো রানা। যে-কোনও সময়ে হাজির হবে যান্ত্রিক ফড়িং।

তিন সেকেণ্ড পর ওর ভাবনা বাস্তব করতেই যেন প্রায় ওর মাথা ছুঁয়ে ছুটে এল বেল রেঞ্জার। রোটর ব্লেডের জোরালো বাতাস টলিয়ে দিল ওকে। চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে বিধ্বস্ত দুই গাড়ির ঘন ধোঁয়া। একদৌড়ে ল্যাণ্ড রোভারের আরেক দিকে গিয়ে কাভার নিল রানা। ওয়ালথারের দুটো গুলি গেঁথে দিল কপ্টারের আণ্ডারক্যারিজে। কোনও সুযোগ নেই পাইলটকে গুলি করার। তবে সে সরলে সুযোগ পাবে ও। পর পর দুই বুলেট কপ্টারে লাগতেই কাত হয়ে আরেক দিকে সরল পাইলট। থামল গিয়ে অন্তত এক শ গজ দূরে। আবারও ঘুরিয়ে নিল কপ্টার। দূরে রানাকে দেখে রাইফেল তুলে গুলি পাঠাল গানম্যান। বিধ্বস্ত ল্যাণ্ড রোভার ভেদ করে গেল বুলেট। কানের পাশে রানা টের পেল ওটার তপ্ত হাওয়ার ঝাপটা। আধবসা থেকে উঠেই গুলি পাঠাল রাইফেলওয়ালার উদ্দেশে। ঠিকভাবে তাক করা হয়নি, গুলি লক্ষ্যে লাগবে ভাবেনি রানা। তবে প্রাণের ভয়ে কপ্টারের আড়ালে লুকাল লোকটা। দৌড়ে ল্যাণ্ড রোভারের অন্যদিকে সরল রানা। দুসেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, সে জায়গা দিয়ে গেল বুলেট।

অপেক্ষায় থাকল রানা। গাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝ দিয়ে দেখছে কপ্টার। আবারও আসছে ওটা। শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে ওয়ালথার তাক করল ও। ঠিক সময়ে স্পর্শ করবে ট্রিগার।

কিন্তু হঠাৎ মাটির কাছে নেমে এল বেল রেঞ্জার। খুলে গেল দরজা। লাফিয়ে নামল দুই লোক। দৌড়ে দুদিকে গিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। হাতে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল। মাযল তাক করেছে ল্যাণ্ড রোভারের পেছনে রানার দিকে।

এরা একই জায়গায় আটকে রাখবে ওকে, বুঝে গেল রানা। সে সুযোগে আরও লোক ও অস্ত্র নিয়ে আসবে কপ্টার পাইলট। এখন জানে, ওকেই খুঁজছে তারা। ময়নিহানের এলাকায় পাহারা দিচ্ছিল ল্যাণ্ড রোভারের লোকদুজন। কিন্তু রানা এদিকে আসতেই তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে কপ্টার পাইলট। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দুজনের বদলে হামলা করবে ছয়জন মিলে। কোনও ঝুঁকি নেয়নি তারা।

জন আর বাড কোথায়, ভাবছে রানা। হয়তো এখনও ওরা কয়েক মাইল দূরে। আর কিছু ভাবার আগেই, মাঠের লোকদুজনের তরফ থেকে এল তুমুল গুলিবর্ষণ। ওর চারপাশে ছিটকে উঠছে ভাঙা ধাতুর ধারালো টুকরো। শুয়ে পড়ে শরীর গড়িয়ে সরে গেল রানা। আশা করছে ওকে গেঁথে ফেলতে পারবে না লোকদুটো। প্রচণ্ড বেগে যাওয়ার সময় বাতাসে ঝটকা তৈরি করছে বুলেট। ল্যাণ্ড রোভারের কঙ্কাল ঠেকিয়ে দিচ্ছে বেশিরভাগ গুলি, কিন্তু অন্যগুলো যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে। রানার খুব কাছে বিঁধল কিছু বুলেট। বাধ্য হয়ে সরল ও। বুঝে গেছে, পড়েছে এমনই বাজে গাড়ায়, বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।

দুই গড়ান দিয়ে রাস্তার পাশে অগভীর নালায় নেমে পড়ল রানা। দ্রুত ক্রল করে সরছে লাইন অভ ফায়ার থেকে।

ওদিকে এগোচ্ছে সতর্ক দুই গানম্যান। গুলি পাঠাচ্ছে। ল্যাণ্ড রোভারের দিকে। গুলি ঝাঁঝরা করল মৃত ড্রাইভারের লাশ। এ থেকে রানা বুঝল, খুন করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শত্রুপক্ষ। আবারও আকাশে উঠে গেছে কপ্টার। ও মরল কি না দেখতে চাইছে পাইলট। সেক্ষেত্রে দলের লোকদুজনকে বলবে নিশ্চিন্তে এগোতে।

দুই দলে ভাগ হয়েছে শত্রুপক্ষ। রানা কপ্টার বা লোকদুটোর দিকে গুলি পাঠালে সবাই বুঝবে ও কোথায়। সেই সুযোগে আসবে অন্যদল। আবার চুপচাপ পড়ে থাকলে, এসে ওকে খুঁজে নেবে পাইলট। তখন দুদিক থেকে হামলা করবে দুই রাইফেলম্যান। পরিস্থিতি যেভাবেই দেখুক রানা, ওর বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

নালা থেকে ঘাড় তুলে রাস্তা দেখল রানা। ভেবেছিল হয়তো ছুটে আসছে উইণ্ডস্টার মিনিভ্যান। কিন্তু ফাঁকা পড়ে আছে রাস্তা। অর্থাৎ, প্রাণে বাঁচতে হলে চাই নতুন কৌশল। এদিকে ফুরিয়ে এসেছে ওয়ালথারের বুলেট।

লিটল ফোর্কের রেস্টুরেন্টে মৃত লোকটার গ্লক সেভেনটিন হাতে নিল রানা। তৈরি হলো লড়াইয়ের জন্যে। নালা থেকে ঘাড় তুলে দেখে নিল চারপাশ।

ভাঙা ল্যাণ্ড রোভারের দিকে চলেছে কপ্টার। এবার গানম্যানরা জানবে ওদিকে নেই রানা। সতর্ক পায়ে আসবে তারা। তবে ধ্বংসস্তূপ থেকে ভলকে ভলকে উঠছে ধোঁয়া ও লাল-কমলা আগুনের শিখা। ওরা আপাতত রানার বন্ধু। কিন্তু চারপাশ পরিষ্কার করে দেবে কপ্টারের দমকা হাওয়া। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আরেক রাইফেলম্যান। রানার গুলি উড়িয়ে দিল তার কাঁধের একখণ্ড মাংস। হোঁচট খেয়ে কপ্টারে ঢুকল সে। তার আর্তনাদ শুনে ভয় পেয়েছে পাইলট। কন্ট্রোলে হ্যাঁচকা টান দিতেই বিপজ্জনকভাবে কাত হয়ে সরে গেল কপ্টার।

 রাইফেলওয়ালাকে খতম করলে সহজে কপ্টার নিয়ে ধারে কাছে আসবে না পাইলট, কিন্তু সেটা পারেনি রানা। ঘাড় সামান্য তুলে মাঠের লোকগুলোকে খুঁজল ও। তাদের একজন আছে ধোয়ার আড়ালে। অন্যজন ছুটে আসছে মাঠের আরেকদিক থেকে। এরা চাইছে দুদিক থেকে রানাকে কোণঠাসা করতে। রানা দুটো গুলি করতেই ভূমিশয্যা নিল লোকটা। রানার মতই শরীর গড়িয়ে সরে যাচ্ছে সে। থেমে গিয়ে গুলি পাঠাল রানার উদ্দেশে।

রানা বুঝে গেল, আর্মি থেকে ট্রেনিং পেয়েছে এ লোক। ওর পরের গুলি বিঁধল খুনির নাকের কাছের মাটিতে। ভয় পেয়ে ঝটকা দিয়ে সরে গেল সে।

ক্রল করে সরতে লাগল রানা। গলা শুকিয়ে গেছে ওর। নালার দুপ্রান্তে দুই খুনি হাজির হলে মহাবিপদ। আরও বড় বিপদ তৃতীয় কেউ কপ্টার থেকে গুলি পাঠালে। অনায়াসেই গেঁথে ফেলবে ওকে। কাছের লোকটা পুবে। নালায় ক্রল করে ওদিকেই চলল রানা। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর থেমে ঘাড় তুলে গুলি পাঠাল তার দিকে। কিন্তু ওর মতই সরে গেছে পেশাদার খুনি। এখন আছে আরও দশ গজ কাছে। পর পর কটা গুলি ছুঁড়ে গাঁথতে চাইল রানাকে। চারপাশের মাটি ও ঘাস ছিটকে উঠতেই চমকে উঠেছে বিসিআই এজেন্ট। বালি ঢুকেছে চোখে। ঝটপট শুয়ে পড়ল নালায়। নতুন করে টের পেয়েছে, ওই খুনি দক্ষ সৈনিক। আরেক গড়ান নিয়ে দেখল, সরাসরি নালার পাশ দিয়ে ছুটে আসছে দ্বিতীয় গানম্যান!

একইসময়ে পরস্পরের দিকে গুলি পাঠাল ওরা দুজন।

খুনির গুলি ঊরুর বাইরে ছ্যাকা দিলেও রানারটা বিঁধল তার পেটে। ছুটতে ছুটতে হুমড়ি খেয়ে মাঠে পড়ল সে। খুব বেশি দূরে নয়। হাত থেকে পড়ে গেছে অ্যাসল্ট রাইফেল। আহত হলেও খপ করে ধরল কোমরের পিস্তলের বাঁট। কিন্তু রানার পরের গুলি বিঁধল তার মাথায়। এক ঝটকা দিয়েই নিথর হলো নোকটা।

অ্যাসল্ট রাইফেলের দিকে ক্রল করবে ভাবছে রানা, এমনসময় মাথার ওপর দিয়ে বিকট শব্দে গেল কপ্টার। তারই মাঝে শুনল ছুটন্ত পায়ের ধুপ-ধাপ আওয়াজ। নালার পাশ দিয়ে ছুটে আসছে অন্য খুনি। এখনও চিত হয়ে পড়ে আছে রানা। আকাশ বা মাঠ থেকে ওকে গেঁথে ফেলবে দুই গানম্যানের কেউ।

রানাকে খুন করা সহজ হবে মাঠের লোকটার জন্যে। মাথার পেছনে হাত নিয়ে ওয়ালথার ও গ্লক দিয়ে একইসঙ্গে লোকটার দিকে গুলি পাঠাল রানা। তাতে ভীষণ চমকে গিয়ে লাফিয়ে নালা পেরিয়ে গেল লোকটা। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও হাজির হবে। বাঁচার উপায় নেই রানার।

ওর মাথার ওপর দিয়ে সগর্জনে গেল কপ্টার। দেরি না করে ওটার পেটে কয়েকটা গুলি গাঁথল রানা। মনোযোগ দিল মাঠের লোকটার দিকে। তাকে দেখল উঠে দাঁড়াতে। চোখে তৃপ্তি নিয়ে কাঁধে রাইফেল তুলেছে সে। এবার খুশি মনে স্পর্শ করবে ট্রিগার। কিন্তু পরক্ষণে তার চোখে-মুখে ফুটল দ্বিধা। পাশ ফিরে তাকাল সে। ঘুরিয়ে নিল অ্যাসল্ট রাইফেলের মাল।

এক সেকেণ্ডের এক শ ভাগের এক মুহূর্তে বিস্ফোরিত হলো তার গোটা মাথা। হাই ভেলোসিটির গুলি চারদিকে ছিটকে দিল রক্তের ফোয়ারা।

নিশ্চয়ই জন ও বাড পৌঁছে গেছে, ভাবল রানা।

খুন হয়েছে পেশাদার খুনি, কিন্তু তার আগে টিপে দিয়েছে ট্রিগার। এম সিক্সটিনের বুলেট বিঁধল রাস্তার পাশে। ছিটকে উঠল মাটি। পরের সেকেণ্ডে হাঁটু ভাঁজ হতেই ধুপ করে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল খুনির লাশ।

আপাতত কপ্টারের রাইফেলওয়ালা ছাড়া আর কোনও বিপদ নেই। রানার চোখের আড়ালে গেছে কপ্টার। শুনতে পেল রাইফেলের গর্জন। তার জবাবে বুম! করে উঠল ভারী ক্যালিবারের পিস্তল। প্রায় একইসময়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার ছাড়ল কেউ। তিন সেকেণ্ড পর ধুপ করে মাঠে নামল ভারী কিছু। আবারও বু! করে উঠল পিস্তল। রানার মনে হলো বজ্রপাত হয়েছে কানের কাছে। তখনই পাল্টে গেল কপ্টারের ইঞ্জিনের আওয়াজ। উঠে বসে রানা দেখল, কাত হয়ে গেছে যান্ত্রিক ফড়িং। ফিউযেলাজ থেকে ভকভক করে বেরোচ্ছে ঘন কালো ধোয়া। উড়োজাহাজ চলেছে উত্তর দিকে। প্রতি মুহূর্তে হারাচ্ছে উচ্চতা।

রানা বুঝে গেল, যে-কোনও সময়ে ভূপাতিত হবে ওটা। সত্যিই কমুহূর্ত পর দূর থেকে এল পতনের জোরালো ফাঁপা আওয়াজ। টেক্সাসের আকাশে লাফিয়ে উঠল রাশি রাশি কালো ধোঁয়া।

বিপদমুক্ত হয়ে মৃদু হাসল রানা। ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে ঘুরে তাকাল জন ও বাডের দিকে।

কিন্তু তারা আশপাশে নেই।

তাদের বদলে কোত্থেকে যেন এসে হাজির হয়েছে রিক বেণ্ডার!

.

২৮.

 মাসুদ রানার লাশ থাকবে পায়ের কাছে, এরচেয়ে বেশি কিছু চায় না রিক বেণ্ডার। খুনের আগে ভয়ঙ্কর ব্যথা দেবে মাসুদ রানাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তেমন ভাল প্ল্যান তৈরি করেনি সে এখনও। ফালতু এলাকায় মাঠের পাশে অগভীর এক নালায় বসে আছে রানা। ওকে এভাবে এক গুলিতে খুন করলে নিজেই মনের দুঃখে মারা পড়বে রিক।

গাড়িতে করে আসার সময় কোনও পরিকল্পনা আসেনি মনে। লিটল ফোর্কে ম্যাকলাস্কি আর হোল্ডকে খুন করেছে জানলে, আর যাই হোক, দুহাত বাড়িয়ে ওকে কোলে টেনে নেবে না ময়নিহান। বরং রানাকে খুন করাতে যেসব লোক ডেকেছে, তাদেরকে লেলিয়ে দেবে রিকের পেছনে। অর্থাৎ, ওর উচিত নয় ক্ষুরধারের দরজায় কড়া নাড়া।

অথচ, ময়নিহানের সঙ্গে দেখা করার যথেষ্ট কারণ আছে। রিকের। ওই র‍্যাঞ্চেই জুডিকে রেখেছে লোকটা। আর লিটল ফোর্কে রানা দেখিয়ে দিয়েছে, সহজ বান্দা সে নয়। সুতরাং রিক বুঝে নিয়েছে, ওই লোক যাবে ময়নিহানের র‍্যাঞ্চে।

কিন্তু হঠাৎ এভাবে দেখা হবে, ভাবতে পারেনি রিক।

প্রথমে দেখেছে ধোঁয়া। তারপর কেউ মরবে সে আশায় যেমন আকাশে ঘোরে শকুন, সেভাবে ঘুরছিল ওই কপ্টার। ভাঙা রাস্তার নুড়িপাথর সরে যাওয়ার শব্দের মাঝে শুনেছে গোলাগুলির আওয়াজ। কী ঘটছে, বুঝতে অনেক বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয়নি রিকের।

তুলেছে তুমুল গতি। দূরে দেখল, কপ্টার নেমে এসে পেট থেকে মাটিতে খালাস করল দুই লোককে। তাদের হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। দুদিকে সরে গেল তারা। গুলি করছে ভাঙাচোরা ল্যাণ্ড রোভারের ওপর। রাস্তার সামনে আরেকটা বিধ্বস্ত গাড়ি।

তখন পথের পাশে ক্যাডিলাক রেখেছে রিক। এমনভাবে এগিয়েছে, যাতে ওকে দেখতে না পায় কেউ। শেষ এক শ গজ দৌড়ে থেমেছে ধ্বংসস্তূপের কাছে। একসময় গাড়িটার কেমন চেহারা ছিল, বোঝার উপায় নেই। ওটাকে কাভার হিসেবে ব্যবহার করবে ভেবেছে রিক। মাঠের ওদিকে নালায় কাউকে খতম করতে অতিব্যস্ত ন্যাশ ময়নিহানের লোক। বারকয়েক রিক দেখেছে, নালা থেকে মাথা উঁচু করেছে কেউ। ক্রল করছে সে। ওর বুঝতে দেরি হয়নি, ওই লোক মাসুদ রানা না হয়েই যায় না। শক্তিশালী চুম্বকের মত ওকে টানছে নিকের খুনি শালা।

তখনই ভাঙা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে নালায় লাফ দিল এক গানম্যান। তাকে দেখেনি রানা। গুলি করছিল ওদিকের অন্যজনকে লক্ষ্য করে। আরেকটু হলে আড়াল থেকে উঠে ওই গানম্যানকে গুলি করে মারত রিক। কিন্তু সেসময় দেখল লোকটার বুক-পেট থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত। দৌড়ের মধ্যে হুমড়ি খেল কিলার। আরেকবার গর্জে উঠল পিস্তল। মাটি থেকে আর উঠল না লোকটা। কপালে চড়ল রিকের ভুরু। যা ভেবেছে, তার চেয়েও বহু গুণ বিপজ্জনক লোক মাসুদ রানা!

নিজেও এত সহজে খুন করতে পারে না রিক। তখনই দেখল, তার সাধের শিকারের দিকে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেলের মাযল তাক করছে আরেক কিলার। ওদিকে কপ্টারে চেপে রানার ওপর রাইফেল তাক করছে আরেক গানম্যান।

যে-কোনও সময়ে খতম হবে রিকের জীবনের চরম তৃপ্তির একমাত্র উৎস। সময় নষ্ট করল না সে। শালারা, ঠকাতে চাস আমাকে?

ওই, শালা! ধমক দিল রিক।

রাইফেল নিয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকাল লোকটা। চোখে ফুটল ভয়। তার দিকেই চেয়ে আছে ডোর্ট ঈগল। এক গুলিতে লোকটার মাথা উড়িয়ে দিল রিক। মনে মনে বলল, আরে, দারুণ ভাল জিনিস বানিয়েছে তো শালারা!

কপ্টার থেকে সঙ্গীর লাশ দেখেছে গানম্যান। দুসেকেণ্ড পর বুঝল, ভাঙা গাড়ির আড়ালে কুঁজো হয়ে বসে আছে শত্রুপক্ষের কেউ। আরেক গুলিতে গানম্যানের পেট ফুটো করল রিক। করুণ এক চিৎকার ছেড়ে কপ্টার থেকে হুমড়ি খেল লোকটা। সাঁই-সাঁই করে নেমে এল মাটিতে। আস্ত হাড় বলতে কিছুই থাকল না তার।

ভীত চোখে রিককে দেখল পাইলট। বুঝে গেল, পালাতে হবে তাকে। কিন্তু বাঁচলে ময়নিহানের কাছে গিয়ে সব ফাঁস করবে পাইলট। তার দিকে আবার গুলি পাঠাল রিক। আগেই কন্ট্রোল নেড়ে কপ্টার ঘুরিয়ে নিয়েছে লোকটা। তাতে দমে গেল না রিক। ডের্ট ঈগলের কটা গুলি লাগল কপ্টারের ইঞ্জিনের কেসিং-এ। এবড়োখেবড়ো গর্ত থেকে বেরোতে লাগল ঘন কালো ধোঁয়া। মাঠের ষাট ফুট ওপর দিয়ে যেতে যেতে উচ্চতা হারাতে লাগল কপ্টার। তারপর হঠাৎ দুই ডিগবাজি মেরে সোজা নামল মাঠে। পরক্ষণে ফাপা এক জোরালো আওয়াজে ভাঙা ফড়িংটাকে ঘিরে ধরল লেলিহান আগুন।

খুব খুশি হলো রিক। ময়নিহানের কান ভারী করবে না পাইলট শালা। পোড়া, ভাঙা গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে চলল নালার দিকে। মাসুদ রানা আছে ওখানে। আরও সতর্ক হতে হবে। পিস্তল আছে ব্যাটার কাছে। কুত্তীর বাচ্চার নিশানাও ভয়ঙ্কর। তবে বাড়তি সুবিধে পাবে সে। ওর জন্যে অপেক্ষা করছে না লোকটা।

কসেকেণ্ড পর সরাসরি রানার মাথায় পিস্তল তাক করল রিক। পিস্তল ফ্যাল, কুত্তার বাচ্চা!

দিনের আলোয় ভয়ানক কুৎসিত পিশাচ দেখছে, এমন চেহারা করেছে হতভম্ব রানা।

কী হলো, শুয়োরের বাচ্চা? শুনছিস না? দ্বিতীয়বার আর বলব না!

বড় করে শ্বাস নিলেও অস্ত্র নামাল না রানা। রিক নড়ে ওঠার আগেই ওর দিকে তাক করল দুই পিস্তল। সরাসরি শত্রুর দিকে চেয়ে আছে দুই কালো মাযল। উঠে বসল রানা। তুমিই বরং পিস্তলটা ফেলে দাও।

ধীরে ধীরে রিকের ঠোঁটে ফুটল হাসি। গুলি করলে মরবি, আমিও হয়তো মরব। কিন্তু তোকে এভাবে খুন করতে চাই না।

আর কোনও উপায় তো নেই, বলল রানা।

তো কী করা যায়, বল তো? পরস্পরকে গুলি করব?

 তাই তো মনে হচ্ছে, বলল রানা।

মাথা দোলাল রিক। তা ঠিক।

 গুলি করল না ওরা দুজনের কেউই।

রানার ওপর থেকে চোখ সরাল না রিক। তুই আমার ছোটভাইকে খুন করেছিস।

নইলে ও আমাকে খুন করত, বলল রানা। সুযোগ পেলে তুমিও বাঁচতে দিতে না আমাকে।

মাথা দোলাল রিক। মিথ্যা ভেবে লাভ নেই। একে খুন করতে পয়সা দিয়েছে ময়নিহান। তবে পরে ব্যাপারটা হয়ে গেছে ব্যক্তিগত। এক পা সামনে বাড়ল রিক। যে-কোনও সময়ে তোকে গুলি করতে পারি।

বদলে বুকে উপহার পাবে দুটো বুলেট।

তুই চাস এভাবে খুন হই আমরা দুজন?

খুশি হব তোমাকে শেষ করে নিজে বাঁচলে। মৃদু হাসল রানা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আপাতত সে উপায় নেই।

যা খুশি হোক, তাই চাস?

ক্ষতি কী?

তা হলে কী করবি? গুলি?

হয় গুলি করো, নইলে গ্যারেজে যেমন পালিয়েছিলে, তেমনি বিদায় হও এখান থেকে। ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল রানা। একবারের জন্যেও লক্ষ্য থেকে সরল না পিস্তলের মাযল। এক কাজ করতে পারো, আপাতত বিদায় হও। পরে কখনও লড়ব আমরা।

তাই করব ভাবছিস? আর সেই সুযোগে আমার পিঠে গুলি করবি তুই?

আমি কাপুরুষ নই, রিক। তা ছাড়া, আমি তোমার কাছে ঋণী। একটু আগে আমার প্রাণ রক্ষা করেছ।

বাঁচাতে চেয়েছি, যাতে তোর মাথা ছিঁড়ে নিতে পারি।

তা জানি। তবে আগেই তোমার মগজে বুলেট ঢুকলে খুন করার তৃপ্তি পাবে না।

কথাটা মনের ভেতর নেড়েচেড়ে দেখছে রিক। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, ঠিকই বলেছে লোকটা… মনে হয় শিক্ষিত লোক। ও হয়তো গুলি করল, কিন্তু তার আগেই ওকে গেঁথে ফেলল লোকটা। হয়তো জ্যামই হলো পিস্তল। সেক্ষেত্রে কীভাবে ব্যথা দিয়ে মারবে কুত্তাটাকে? নিজে মরতে আপত্তি নেই রিকের। বড় কথা হচ্ছে, সঙ্গে নিতে হবে হারামজাদাকে। কিন্তু সেটা পারবে, এমন কথা বলছে কে?

রাস্তার দূরে একটা কালো গাড়ি দেখল রিক।

 ঝড়ের বেগে আসছে ওটা।

রানার চোখে তাকাল রিক। তা হলে পরেই লড়ব আমরা, ঠিক?

হ্যাঁ, পরে, নিচু গলায় বলল রানা। খালি হাতে।

কথাটা খুবই পছন্দ হলো রিকের। হাসল। এক পা পিছিয়ে গেল সে, ওর দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে রানা। কাছে চলে এসেছে ইঞ্জিনের আওয়াজ। আরেকবার রানার চোখে তাকাল রিক, তারপর এক পা এক পা করে পিছাতে লাগল। গলা চড়িয়ে বলল, ময়নিহানের নোক আসছে। খবরদার, রানা! ওদের হাতে খুন হবি না! তুই কিন্তু শুধু আমার!

মনে থাকবে, মৃদু হাসল রানা। মনে পড়েছে পুরনো আমলের তুমি যে আমার বাংলা গানটির কথা।

বিধ্বস্ত ল্যাণ্ড রোভারের পাশে পৌঁছে ঘুরেই দৌড় দিল রিক। চলেছে লুঠ করা ক্যাডিলাকের দিকে। ভাবছে, এই বুঝি পিঠে বিঁধল বুলেট। আবার মনের অন্য অংশ বলছে: কাপুরুষের মত পেছন থেকে গুলি করে ওকে মারবে না মাসুদ রানা। বাউন্সার হেনির মত মিথ্যা বলার লোক নয় বাদামি কুত্তাটা। নইলে প্রথম সুযোগেই ওকে খুন করত জঙ্গলের ভেতর।

ক্যাডিলাকে চেপে বসল রিক। মুচড়ে দিল ইগনিশনের চাবি। গর্জে উঠল ভারী গাড়ি। ঘাড় কাত করে দেখল, ধুলো উড়িয়ে ঝড়ের বেগে কালো গাড়ি চলেছে রানার দিকে। বিড়বিড় করল রিক, খবরদার, খুন হবি না কিন্তু তুই!

ক্যাডিলাক নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে।

.

২৯.

 বড় দুটো ভুল করেছে রিক বেণ্ডার। যে দুই লোক গাড়ি নিয়ে আসছে রানার দিকে, তারা ন্যাশ ময়নিহানের লোক নয়। আগেই ফোর্ড গাড়িটা দেখে রানা বুঝেছে, মরিয়া হয়ে ফিরছে ওর বন্ধু জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। দ্বিতীয় ভুল করেছে রিক ওকে খুন না করে। কষ্ট দিয়ে মারবে বলে ওকে আপাতত ছেড়ে দিয়েছে উন্মাদটা।

নিজেও কম ভুল করেনি রানা। উচিত ছিল দানবটাকে খুন করা। কিন্তু কাপুরুষের মত খুন বা খামোকা মিথ্যাচার ওর ধাতে নেই। প্রয়োজনে শত্রুর মুখোমুখি হবে, কিন্তু দৌড়ে চলে যাচ্ছে এমন কাউকে গুলি করবে না পেছন থেকে।

পিস্তল নামিয়ে ক্যাডিলাকটাকে বাঁক নিতে দেখল রানা। গাড়িটা ক্লাসিক মডেলের। চাকাওয়ালা পঙ্খিরাজ বললেও চলে। ওই জিনিস কোথা থেকে জোগাড় করল রিক, কে জানে! প্রচুর ধুলো উড়িয়ে বিদায় নিল লোকটা। ঘুরে চেয়ে বন্ধুদের গাড়ির দিকে হাত নাড়ল রানা।

কসেকেণ্ড পর ওর কাছে থামল জন ও বাড। দরজা খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। জনের হাতে পিস্তল গ্রিপসহ মসবার্গ শটগান। বাডের হাতে গ্লক সতেরো। গম্ভীর ওদের চেহারা। দেরি হবে না শত্রুকে গুলি করতে।

খেল খতম, দেরি করে ফেলেছিস, বলল রানা।

কী হয়েছে, রানা? চারপাশ দেখছে জন। চুরমার হয়েছে। দুটো গাড়ি। মাঠে জ্বলছে ভাঙা কপ্টার। লাশ ছয়জন লোকের। তোকে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্যে ছেড়ে গেলাম, আর এখন এসব কী দেখছি! চালাকি পেয়েছিস? সব মজা একাই লুটে নিচ্ছিস তুই!

চোখে না দেখলেও এখনও শোনা যাচ্ছে ক্যাডিলাকের ইঞ্জিনের ভারী আওয়াজ।

পালিয়ে যাচ্ছে কেউ, বলল বাড। উচিত হবে না ছেড়ে দেয়া।

এদিকের লোক নয়, বলল রানা। ওই লোক রিক বেণ্ডার।

বেণ্ডার? বলল জন, শেষ শুনেছি সে ছিল ময়নিহানের দলেই।

এখন আর তা নয়, বলল রানা। বিশ্বাস করিস বা না করিস, একটু আগে খুন হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে ও আমাকে।

বলিস কী!

আর কেউ যাতে আমাকে খুন করে ফেলতে না পারে, গুলি চালিয়েছে ও ময়নিহানের লোকের ওপর এমন কী ফেলে দিয়েছে হেলিকপ্টার। সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে আমাকে নিজের হাতে খুন করতে চায়।

বদ্ধ উন্মাদ! চল, এবার ভাগি, বলল জন।

ঠিকই বলেছে, ভাবল রানা। উইণ্ডস্টারে চেপে বসল ওরা তিন বন্ধু। সামনের সিটে জন ও বাড, পেছনের সিটে রানা। সাবধানে স্যাটার্ন গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে রওনা হলো বাড। চলেছে সোজা পাইলট পয়েন্ট-এর দিকে।

কী হয়েছিল, প্রথম থেকে খুলে বলল রানা। শেষে যোগ করল, উপায় থাকলেও ওকে গুলি করে মারতে রাজি হয়নি রিক বেণ্ডার।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়বে? জানতে চাইল জন।

ওটা ওর প্রাপ্য, বলল রানা।

ওর ভাইকে মেরেছিস বলে? মাথা নাড়ল বাড। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল রানাকে। ব্যাটা তো বদ্ধ উন্মাদ! তুইও।

আমার প্রিয় কাউকে খুন করলে আমিও তাকে ছাড়তাম না, বলল রানা, তোরাও ছাড়বি না। একা লড়তে চাইছে। বলে ওকে দোষ দিচ্ছি না।

তুই ওর কাছে ঋণী নস, বলল জন। ওই দানবটাকে তো মানুষ বলেই গণ্য করা যায় না।

জানি, বলল রানা। হেসে ফেলল। ভাবা কঠিন, আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে রিক বেণ্ডার। তবে ওকে কথা দিতে হয়েছে আগেই কারও হাতে মরে যাব না কিছুতেই। ওর সঙ্গে লড়েই মরতে হবে আমাকে।

আসল কথাটা বল তো, রানা? ঘুরে তাকাল জন।

মৃদু হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। ঠিক আছে, মিথ্যা বলব না, আমিও চাই ওকে হারিয়ে দিতে।

ওটা তো আস্ত গরিলা একটা! আঁৎকে উঠল জন। খুন হয়ে যাবি তো!

খুন হব কি না তা দেখতেই তো লড়ব, বলল রানা।

রানাটা পাগল হয়ে গেছে, গুঙিয়ে উঠল বাড। ওই গণ্ডার একাই আমাদের তিনজনকে আলুভর্তা করে দেবে!

সায় দিয়ে মাথা দোলাল জন।

নীরব থাকল রানা।

ছাড়া-ছাড়াভাবে তৈরি বাড়িঘরের মাঝ দিয়ে চলেছে, ওদের গাড়ি। দক্ষিণের ৩৭৭ হাইওয়েতে পড়ে চলল পাইলট পয়েন্ট লক্ষ্য করে। রিক বোরের গাড়ি দেখার জন্যে চারপাশে চোখ রাখল ওরা। কিন্তু অন্য কোনও দিকে চলে গেছে দানব।

একটু পর সরু শাখা-রাস্তায় পড়ল গাড়ি। দশ মিনিটে পৌঁছে গেল রে রবার্ট লেকের পারে। ওখানে একঝাড় প্রকাণ্ড ওক গাছের পেছনে ওদের ফিশিং কেবিন। এখানে বসেই জুডিকে উদ্ধার করার প্ল্যান করবে ওরা।

টেক্সান কর্তৃপক্ষের কারও সঙ্গে তোদের যোগাযোগ আছে? কেবিনের সামনে পৌঁছে জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল জন।

তবে চিবুক উঁচু-নিচু করল বাড।

একটু আগে র‍্যাঞ্চের কাছে যা ঘটেছে, এরপর ন্যাশ ময়নিহানের নাকের ডগা থেকে জুডিকে সরিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব। অত্যন্ত সতর্ক থাকবে লোকটা। পরেরবার তার জমিতে হাজির হতে হলে, চাই নিখুঁত পরিকল্পনা। এদিকে হাতে সময় নেই। দেরি করলে দলের লোকদের গুছিয়ে নেবে টপ টেরর।

গোটা কয়েক রাইফেল দরকার, বাড, বলল রানা।

চাইলে দশটাও পেতে পারি, বলল বাড। তবে মনে হচ্ছে বিশেষ ধরনের রাইফেলের কথা ভাবছিস।

ঠিক, মনের কথা খুলে বলল রানা।

মাথা দোলাল বাড। কখন লাগবে?

 এখুনি।

তুড়ি বাজাল বাড। হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে চুকচুক শব্দ করল জিভ দিয়ে। আমি ভাল ম্যাজিশিয়ান নই! তবে দেখি কী করা যায়।

রানা, কোনও প্ল্যান করেছিস? জানতে চাইল জন।

লেকের সবজেটে জলের দিকে চেয়ে বলল রানা, বারোটা বাজাব ন্যাশ ময়নিহানের মানসিক শান্তির।

.

বিপদ এড়াতে ডেণ্টন শহর ঘুরে এগিয়ে চলেছে রিক বেণ্ডার। পাশ কাটাল সিএইচ কলিন্স ফুটবল স্টেডিয়াম। ভাবছে এরপর কী করবে।

ভীষণ ব্যথা পেয়ে খুন হবে মাসুদ রানা… পুরনো কথা। কিন্তু একই কথা বার বার ভাবতে ভাবতে চলেছে রিক। তবে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য পাল্টে যাওয়ায় বুঝল, আবার চলেছে ইউনিভার্সিটি ড্রাইভের পশ্চিমে হাইওয়ে পঁয়ত্রিশের দিকে।

ডানে পড়বে বিশাল বার্গারের দোকান। আপাতত ওখানে থামবে সে। খিদে লেগেছে বলে নয়, তার দরকার পে-ফোন।

একটু পর বার্গারের দোকানের পার্কিংলটে গাড়ি ঢোকাল রিক। আশপাশে আছে কয়েকটা ভ্যান ও গাড়ি, কিন্তু ওগুলো ক্যাডিলাকের মত জমকালো নয়। রিক ঠিক করল, প্রথম সুযোগেই পাল্টে নেবে গাড়ির নাম্বার প্লেট। তবে সেজন্যে তাড়াহুড়ো করতে হবে না। মনে হয় না মামা লিলিয-এর কেউ গাড়ি চুরির কথা জানাবে পুলিশে। তবুও গাড়িটা রাখল দূরে এক ডাস্টবিনের পাশে। ঝুলছে নো পার্কিং লেখা সাইন বোর্ড। ওটা পাত্তা না দিয়ে ক্যাডিলাক থেকে নেমে আয়েস করে আড়মোড়া ভাঙল। লিটল ফোর্ক থেকে আনা সেই ওভারকোট এখনও পরনে। উচিত নয় ওটা ফেলে দেয়া। কাজে লাগছে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে। ওটা ভালভাবে জড়িয়ে নিল শরীরে। কোণ ঘুরে চলে গেল দালানের সামনে। হু-হু বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া। যা খুঁজছে, পেয়ে গেল রিক। চারকোনা বাক্সের মত পে-ফোনের বুদ। ভেতরে ঢুকে ফোন করল সঠিক নম্বরে।

বেশ কবার রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে রিসিভ করা হলো কল। হ্যালো?

আপনি নাকি, বস্?

রিক? জানতে চাইল ময়নিহান। রিক বেণ্ডার?

হ্যাঁ। আমি।

নীরব থাকল লাইন। রিক বুঝতে পারছে, ঝড়ের বেগে ভাবছে ময়নিহান। একটু পর বোঝা যাবে ও ফোন করে ভুল করেছে কি না। হয়তো এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

বেঁচে আছ, না? গুড! কণ্ঠ শুনে রিকের মনে হলো ময়নিহান খুশি। তবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। সবসময় খোশ মেজাজে থাকে নোকটা। পরক্ষণে কী করবে কেউ জানে না। আমি তো ভেবেছিলাম ম্যাকলাস্কি আর হোল্ডের সঙ্গে তোমাকেও মেরে ফেলেছে মাসুদ রানা।

হেসে ফেলল রিক। কেটে গেছে বিপদের কালো মেঘ। ময়নিহান জানে না ওই দুজনকে নিজেই খুন করেছে সে। পাইলটের কথাও ভাবতে হবে না। যোগাযোগ করার আগেই কপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে মরেছে ওই কুত্তা। কেউ জানে না ময়নিহানের লোক মেরে সাফ করছে ও।

রেস্টুরেন্টে আমার ওপর ট্রাক চাপিয়ে দিয়েছিল হারামজাদা, জ্ঞান হারাই। যখন জেগে উঠলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে, হোল্ড বা ম্যাকলাস্কিকে বাঁচাতে পারিনি। পরে যখন সুস্থ লাগল, ততক্ষণে পালিয়ে গেছে মাসুদ রানা। তাই ভাবলাম, আমার প্রথম কাজ হওয়া উচিত তার পিছু নেয়া।

ওর পিছু নিয়ে এখানে এসেছ?

এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেছি। এরপর আটকা পড়লাম ব্লিযার্ডে। তবে জানতাম টেক্সাসেই আসছে লোকটা।

তা হলে তুমি এখন টেক্সাসে?

হ্যাঁ। কোথায় আছে বলল না রিক।

গুড, রিক। তো দেরি না করে চলে এসো। তোমাকে লাগবে আমার। আশপাশে এসে হাজির হয়েছে মাসুদ রানা।

আপনি জানেন সে কোথায় আছে?

না, তা এখনও জানি না। তবে বেশি দূরে নেই। চলে এসো, রিক। খুশি হব তোমাকে পাশে পেলে।

আপনি না আরও কয়েকজনকে ডেকে নিয়েছেন?

হ্যাঁ, ওরা পৌঁছে গেছে। ফিরেছে লিটল ফোর্ক থেকে। গম্ভীর হলো ময়নিহানের কণ্ঠ, ওদের কথা বাদ দাও, রিক। তুমি সবসময় ছিলে আমার কাছে সবার চেয়ে প্রিয়।  

কিন্তু, হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা, নিকের ব্যাপারে তোর কোনও দায় নেই, না? ভাবল রিক।

তুমি তো চাও মাসুদ রানাকে খুন করতে, ঠিক কি না?

কয়েক ঘণ্টার ভেতর র‍্যাঞ্চে পৌঁছে যাব, বস্।

 ভেরি গুড। চলে এসো।

কল কেটে দিল রিক। ভাবছে, কপালটা সত্যিই ভাল। তবে, বসের বাচ্চা জানে না, মাসুদ রানা আর ওর মাঝে পড়লে ওই শালাকেও বাঁচতে দেবে না সে!

.

৩০.

ঝকঝকে পরিষ্কার সবুজাভ জলের বিশাল লেক দেখলে মনে হয়, ওটার বয়স কোটি কোটি বছর। বাস্তবে, তৈরি করা হয়েছে উনিশ শ আশির দশকে। যে কমিশনার চেয়েছিলেন প্রেয়ারিতে পানি আসুক, তাঁর নামেই পরিচিত ওটা: রে রবার্ট লেক। আগে কখনও ভদ্রলোকের নাম শোনেনি, তবে অপূর্ব লেকটা দেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জন্মেছে রানার মনে। জল প্রায় স্থির। তার ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে আকাশের নীলে ভাসা সাদা মেঘ। যেন পৃথিবীর বুকে নেমেছে স্বর্গের ঘোট একটা টুকরো। তীরে ওক গাছের সারি। মগডালে কিচিরমিচির করছে হরেক জাতের পাখি। মৃদু শব্দে পাড়ে চুমু দিয়ে ফিরছে ছোট ঢেউ। বড় প্রশান্তিময় পরিবেশ।

জায়গাটা নিরালা প্রেমকানন হিসেবে চমৎকার। দূরে তাকাল ও। রো বোটে চেপে হৈ-চৈ করছে অল্প বয়সী দুই ছেলে। রানা ভাবল, জন বা বাডের জন্যে প্রাণের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করবে না ও। ওরাও একই কাজ করেছে আগে। কিন্তু ওই দুই ছেলের কেউ বোট থেকে পড়ে ডুবে গেলে, অন্যজন কি ডাইভ দেবে ওকে উদ্ধার করতে? আনমনে মাথা দোলাল রানা। হয়তো তাই করবে। বন্ধুর জন্যে এটা করে বন্ধুরা। কী অদ্ভুত পবিত্র বন্ধন!

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কেবিনে ফিরল রানা। এবার তৈরি করতে হবে ভাল কোনও প্ল্যান।

বিকেল গড়িয়ে গেলেও ধিকিধিকি জ্বলছে আকাশ। কেবিনের ভেতর ল্যাম্প জ্বেলেছে জন। একটু আগে ফিরেছে বাড। বিছানায় রেখেছে কাঠের দীর্ঘ ক্রেট।

ড্রাগুনভ স্নাইপার রাইফেল পেলাম না, রানাকে বলল বাড। তবে এ-দিয়েও কাজ চলবে। খুলে ফেলল ক্রেটের ডালা।

চোখ বোলাল রানা। ক্রেটে শুয়ে আছে ইউএস আর্মি এম টোয়েন্টিফোর বোল্ট অ্যাকশন স্নাইপার রাইফেল। প্রশংসার চোখে ওগুলো দেখল রানা। কেভলার ও গ্রাফাইট দিয়ে তৈরি স্টক। পিঠে ফিট করা হয়েছে লিউপোল্ড-স্টিউয়েন্স এম থ্রি আল্টা টেলিস্কোপিক সাইট। জানিয়ে দেবে বুলেটের পতন কেমন। আগেও ইউএস আর্মি ইশ্য রাইফেল ব্যবহার করেছে। বলে রানা ভাল করেই জানে, এই অস্ত্র দিয়ে একহাজার গজ দূর থেকে লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব। ইন্টারনাল ম্যাগাযিনে আঁটবে পাঁচটা .৩০৮ উইনচেস্টার রাউণ্ড। মৃদু মাথা দোলাল রানা। যে-কোনও হিসেবে এসব অস্ত্র সত্যিই দারুণ।

কাজ চলবে বললেই হলো? ক্রেট থেকে একটা এম টোয়েন্টিফোর তুলে নিয়ে কাঁধে বাঁট ঠেকাল জন। কেবিনের আরেকদিকে তাক করল অদৃশ্য টার্গেটে। স্টিলের জ্যাকেট পরা বুলেট ছুঁড়লে দেয়াল ভেদ করে পৌঁছে যাবে লেকের ওদিকে। ওখানে কেউ থাকলে খুন হবে সে। এই মালের চেয়ে অনেক ভাল রাশানদেরগুলো।

বলা যায় না, বলল রানা, বড় কথা অস্ত্রগুলো জোগাড় করতে পেরেছে বাড।

চওড়া হাসল বাড। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর হয়ে গেল গম্ভীর। ধার করেছি। কথা দিয়েছি কাজ শেষে ফেরত দেব। আমার কিছু হলে তোরা ফেরত দিবি মালিকের কাছে। ও জানাল জয়েন্ট রিযার্ভ বেস ফোর্ট ওঅর্থের এক সার্জেন্টের নাম।

জেআরবি না নেভাল এয়ার স্টেশন? জানতে চাইল জন, স্নাইপার রাইফেল কেন?

ওখান থেকে মাঝে মাঝে উড়াল দেয় সিল ফোর্স, বলল বাড।

ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ আর্মির দুর্গের মতই দুর্ভেদ্য হবে, ভাবছে রানা। বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা এক শ ভাগ। দলে ওরা মাত্র তিনজন। পাবে না অত্যাধুনিক অস্ত্র। দলের লোকের পেছনে থাকবে ময়নিহান। হামলা করলে করতে হবে দূর থেকে। ওদের লাগবে স্নাইপার রাইফেল। এই জিনিসই ওদের সেরা সম্পদ। রানা বুঝতে পারছে, যে কাজে নামছে, সেটায় সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। মনে মনে প্ল্যান গোছাতে শুরু করেছে, এমনসময় হঠাৎ করেই ওর পকেটে থরথর করে কেঁপে উঠল মোবাইল ফোন।

ওটা বের করে স্ক্রিন দেখে কল রিসিভ করল রানা, হ্যাঁ, কিছু বলবে?

ভালই দেখালে, বলল ন্যাশ ময়নিহান। খুশি হতাম ওখানে থাকলে। লড়লে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতই।

মোবাইল ফোনের স্পিকার চালু করল রানা।

ময়নিহানের কথা শুনবে বলে চুপ করে অপেক্ষা করছে। জন ও বাড।

তুমি থাকলে ভাল হতো, বলল রানা। তোমাকে শেষ করে ঝামেলা চুকিয়ে দিতাম।

তা হলে নাটকীয়তা থাকত না। খতম হয়ে যেত সব মজা। তুমি তাই চাও, রানা?

আমি তোমাদের নাটক বুঝি না, বলল রানা। স্রেফ শেষ করতে চাই নিজের কাজ।

পেয়েছ নিনা ভেঞ্চুরাকে?

জবাব দিল না রানা। ময়নিহান ভাল করেই জানে, ও আছে আঁধারে। নইলে আগেই যোগাযোগ করত।

তুমি তো এখনও সুন্দরী জুডিকে ফেরত চাও, তাই না? দারুণ লোভনীয় মেয়ে। চাপ দিয়ে জেনেছি, ওর ফোন এখন তোমার কাছে।

শুরু করল রানা, জুডির কোনও ক্ষতি হলে…

হেসে ফেলল ন্যাশ ময়নিহান। নরম সুরে বলল, যত দ্রুত নিনাকে হাজির করবে, ততই জলদি ফেরত পাবে জুডিকে। তাতে কমবে ওর বিপদ। যে-কোনও সময়ে ওর ওপর চড়াও হতে পারে রিক বেণ্ডার।

রিক বেত্তার?

হ্যাঁ, আমার দানব বন্ধু পৌঁছে গেছে। ভয়ঙ্কর ঘৃণা করে তোমাকে। সেজন্যে দোষ দেব না ওকে। খুন করেছ ওর ছোটভাইকে। অন্তর থেকে চাইছে তোমার হৃৎপিণ্ড কাঁচা চিবিয়ে খেতে।

নিক সাইকোপ্যাথ ছিল।

সহমত। পিয়োর সান অভ আ বিচ। তার ওপর আবার ট্যাড়া। তবুও তো ছিল রিকের ছোটভাই। তোমাকে বাগে না পেলে জুডির ক্ষতি করবে রিক, বুঝতেই পারছ।

নিনাকে চাইলে জুডির কাছ থেকে সরিয়ে রাখবে ওকে, বলল রানা।

কারও কথা শোনে না রিক, কাজেই বেশি দেরি কোরো না নিনাকে খুঁজে আনতে, হাসিখুশি ভাবটা বিদায় নিয়েছে ন্যাশ ময়নিহানের কণ্ঠ থেকে, আগামী কাল রাত পর্যন্ত সময় পাচ্ছ। এরপর টুকরো করে তোমার কাছে পৌঁছে দেব জুডিকে।

আগামীকাল রাতে দেখা হবে, কল কেটে দিল রানা।

চুপচাপ শুনেছে জন ও বাড। এবার একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল ওরা। ওদের মূল কথা: রানার উচিত ছিল ময়নিহানকে জানানো, লড়াইয়ে তার লোকদের খুন করেছে। রিক বেণ্ডার।

জবাবে রানা বলল, ওকে খুন করাত ময়নিহান।

সেটাই উচিত ছিল, বলল জন। কমত একটা শত্রু।

ব্যাপারটা কী, রানা? বলল বাড, তুই মেয়েটাকে সরিয়ে আনতে চাস, নাকি আগে তোর চাই রিক বেণ্ডারের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা?

চুপচাপ বন্ধুর দিকে চেয়ে আছে রানা।

লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকাল বাড।

জরুরি কারণে রিকের কথা ময়নিহানকে জানাইনি, বলল রানা। মিথ্যা বলছে লোকটা। রিক বেণ্ডার জুডির ওপর রেগে উঠবে, এমন কোনও কারণ তৈরি হয়নি। তা ছাড়া, ভুলে যাস্ নে, জুডি ময়নিহানের দামি জিম্মি। ওর জন্যে আড়াল থেকে বেরোতে বাধ্য হবে নিনা ভেঞ্চুরা।

কিন্তু রিক বেণ্ডারের ব্যাপারে চুপ থাকলি কেন? জানতে চাইল জন।

ভাল কথা বলেছে ময়নিহান, বলল রানা, নিজ মতে চলে রিক বেণ্ডার। তবে ময়নিহান জানে না, প্রয়োজনে বসের কথাও শুনবে না সে। এ-ও জানে না, তাদের পেছনে আমাদের পক্ষে কাজ করছে বিপজ্জনক দানব। এবার বের করতে হবে, কীভাবে তাকে কাজে লাগানো যায়।

তা হলে তুই ভাবছিস, নিজেকে তুই ওর হাতে তুলে দিবি জানালে, প্রয়োজনে জুডিকে আমাদের হাতে তুলে দেবে সে? জানতে চাইল বাড।

তা মনে হয় না, বলল রানা। ওকে ওভাবে কাজে লাগাতে গেলে খুন হবে মেয়েটা।

তা হলে ওকে দিয়ে কীসের লাভ হবে? বলল জন।

যখন নিনা আর জুডিকে বিনিময় করব, ওখানে থাকবে রিক। আমার ভুল না হলে, বাড়তি হুমকি হিসেবে ওকে রাখবে ময়নিহান। জুডির নিরাপত্তার দায়িত্ব পাবে সে। কিন্তু মনোযোগ থাকবে ওর আমার ওপর। তাকে রাগিয়ে দিলে পাব বাড়তি সুবিধে।

ভাবছিস, সে সুযোগে আমরা সরিয়ে ফেলব জুডিকে? বলল বাড।

অনেক বেশি যদি বা হয়তো ভরা প্ল্যান, আপত্তির সুরে রানাকে বলল জন।

আপাতত এ ছাড়া উপায় নেই, স্বীকার করল রানা। আরও কিছু বলতে গিয়ে দেখল দপদপ করছে মোবাইল ফোনের স্ক্রিন। ওটা দেখে মৃদু হাসল রানা। ওই যদি বা হয়তোছাড়া জীবনটাই অর্থহীন।

ন্যাশ ময়নিহানের পর এবার কল করেছে নিনা ভেঞ্চুরা!

.

৩১.

আর্মি কমাণ্ডের রোল কলের মত নয় ন্যাশ ময়নিহানের তলব। তবে ব্যাপারটা প্রায় তেমনই। র‍্যাঞ্চের ওপরতলায় বিশাল লাউঞ্জে জড় হয়েছে সবাই। প্রত্যেকে দক্ষ খুনি।

চুপচাপ বসে থেকে কাউকে খুন করার সুযোগ পেলে বেশি খুশি হবে।

উপস্থিত হয়েছে ন্যাশ ময়নিহান, রিক বেণ্ডার, র‍্যাঞ্চের কাজে নিয়োজিত খুনে কর্মচারীরা এবং পাঁচ আততায়ী। শেষের এই পাঁচজন জড় হওয়ায় পরিবেশে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা ও বিপদের স্ফুলিঙ্গ। যে-কোনও সময়ে ওরা সাধারণ কথায় খুন করবে একে অপরকে। প্রত্যেকের ধারণা, নিজের মাঠে সেই সেরা। নেই দল বেঁধে কাজের অভিজ্ঞতা। নিজেদের এলাকায় আছে অধীনস্থ খুনির দল। এ দলের প্রধান করা হয়নি, তাই অপমান বোধ করছে প্রত্যেকে। তাতে কিছু যায় আসে না ময়নিহানের। কাজে লাগাবে এদের মাঝের দ্বন্দ্ব। পাঁচজনই চাইবে অন্যের চেয়ে ভাল কাজ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে সেই আসলে সেরা।

সবাই দাঁড়িয়ে থাকলেও ময়নিহান বসেছে উইং-ব্যাড় চেয়ারে। হাতে জ্বলন্ত সিগার। পরনে স্যুটের বদলে সাধারণ পোশাক। উইণ্ডচিটার জ্যাকেট ও ক্যানভাস প্যান্ট। লেস দেয়া বুট। যে-কোনও দিকে সরতে পারবে বিদ্যুতের গতিতে। তা ছাড়া, ডিযাইনার স্যুট ত্যাগ করায় চারপাশের পরিবেশের মতই ধূসর ক্যামোফ্লেজুড় হয়েছে সে। মাথায় ধূসর বেসবল ক্যাপ। উরুর হোলস্টারে ঝুলছে বিখ্যাত সেমি অটোমেটিক বেরেটা পিএক্স ফোর স্টর্ম পিস্তল। ম্যাগাযিনে সতেরোটা গুলি। বাইরের খুনিরা কেউ জানে না, ময়নিহানের ডান কবজির কাছে পাউচে ঘুমাচ্ছে ওর প্রিয় ক্ষুর।

চুপচাপ বসে একে একে প্রত্যেককে দেখল ময়নিহান। এদের একজন ড্যাগেট ওয়াইল্ড। আকারে বেশ বড়সড়। পেশিবহুল শরীর। বিশেষ করে দেখার মত পুরুষ্টু বাইসেপ। হাসি চাপল ময়নিহান। রিক বেণ্ডারের তুলনায় নিতান্তই শিশু ড্যাগেট ওয়াইল্ড। বারকয়েক দানবের দিকে তাকিয়ে দেখেছে লোকটা, চোখে ঈর্ষা ও হেরে যাওয়ার কষ্ট।

এবার সময় হয়েছে সব বিভেদ ভুলে যাওয়ার, বলল ময়নিহান। মাসুদ রানাকে বলেছি আগামীকাল রাতের মধ্যে নিনা ভেঞ্চাকে এনে দিতে হবে। এর ফলে জুড়ি মেয়েটাকে উদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে উঠবে সে। হামলা করবে এ র‍্যাঞ্চে। কিন্তু হাত মিলিয়ে কাজ না করলে, ধরে নিতে পারো প্রত্যেকে মারা পড়বে তোমরা।

আমাদের সঙ্গে পারবে না, বলল ধূসর চুলের এক লোক। কোমরের খাপে ছোরা। অন্যদের বেলায় কপাল ভাল ছিল ওর।

ঘরে সবচেয়ে বয়স্ক লোক এই হ্যাঙ্ক পার্কার। বয়স পেরিয়ে গেছে পঞ্চাশ। অবশ্য শরীরটা এখনও ত্রিশ বছরের যুবকের মতই। বিড়ালের মত ক্ষিপ্র। সবুজ চোখে হিংস্রতা।

ভারী ভুরুর এক যুবক কড়া চোখে দেখল তাকে। আর যাকে পারুক না-পারুক, আমাকে হারাতে পারবে না।

তার নাম ওয়াল্টার হেইন্স। কথার উচ্চারণ থেকে বোঝ যায় এসেছে আয়ারল্যাণ্ডের উত্তর এলাকা থেকে। হ্যাঙ্ক পার্কারের দিকে মাথা ইশারা করল সে। তবে ওই বুড়োর ব্যাপারে আমি ততটা শিয়য়ার নই।

কঠোর চেহারার লোক হেইন্স। শরীরে কটা ক্ষতচিহ্ন। তার বাবা ছিল আইআরএ-র খুনি। নিজেই খুন হয়েছিল এসএএস-এর সৈনিকের হাতে। আমেরিকার নিওয়ার্ক শহরে ত্রাসের রাজ্য গড়েছে তার ছেলে। প্রচণ্ড হিংসা করে পাশের শহর জার্সি সিটির হ্যাঙ্ক পার্কারকে।

টিটকারির হাসি হাসল হ্যাঙ্ক। এ বুড়ো এখনও অনেক কিছু শেখাতে পারবে তোমাকে, বাছা।

চেষ্টা করেই দেখো! বলল হেইন্স।

তোমরা মাথা ঠাণ্ডা রাখো, সতর্ক করার সুরে বলল চার্লস গ্রেড। মিস্টার ময়নিহান ঠিকই বলেছেন। আমাদের উচিত নয় ওই লোককে আণ্ডারএস্টিমেট করা। মারা গেছে ছয়জন প্রশিক্ষিত সৈনিক। প্রত্যেকের কাছে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। এ ঝামেলা উত্রাতে হলে আমাদের থাকতে হবে একাট্টা।

সমস্যাটা কী তোমার, টেক্স? জানতে চাইল হেইন্স, আত্মবিশ্বাস নেই? আগে ভাবিনি মাত্র একজনের ভয়ে এভাবে পুতিয়ে যাবে তুমি। শুনেছি বছরখানেক আগে খালি হাতে খতম করেছ তিন ইউএস মার্শালকে। তা হলে সেসব আসলে মিথ্যা গুজব?

টেক্সাসের লোক চার্লস গ্রেড। ডালাসে নয়, তার ঘাঁটি উত্তরদিকের শহর অস্টিনে। দীর্ঘদেহী, চওড়া হাড়, মাথা ভরা এলোমেলো খড়ের স্তূপের মত কালো চুল। ওপরের পাটিতে দুটো দাঁত নেই তার। সুযোগ পেলেই ওই ফাঁক দিয়ে বের করে জিভ। অনেকে মনে করে আনমনে কী যেন ভাবছে লোকটা। কিন্তু মৃত্যুর পর আর সুযোগ থাকে না ভুল শুধরে নেয়ার।

হেইন্সের দিকে চেয়ে হাসল গ্রেড। ওরা তিনজন ছিল না, দোস্ত। ছিল চারজন। তা ছাড়া, যাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল, তাকেও নিকেশ করেছি।

টিটকারির হাসি হাসল হেইন্স। ঘুরে দেখল ড্যাগেট ওয়াইল্ডকে। তোমার কী হাল, ভয় লাগছে, ফ্রেঞ্চম্যান?

কাউকেই ভয় পাই না, বলল ড্যাগেট। তবে চট করে তার চোখ চলে গেল রিক বেণ্ডারের ওপর।

এই খুনির দলে খুব বেমানান পঞ্চম মানুষটি। সে এক যুবতী। নাম মারি কিটন। বারবার প্রমাণ করেছে, যে-কোনও মানুষকে মুহূর্তে খুন করতে পারে সে। কয়েক বছর আগে ছিল ডিইএর এজেন্ট। কিন্তু আইনের উল্টো পথের মানুষদের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক প্রমাণ হওয়ায় চলে গেছে চাকরি। হালকা শরীরের মেয়ে সে। কোমল নয় মুখটা। প্রয়োজনে প্রচণ্ড ব্যথা দিতে জানে যে-কোনও পুরুষকে। নরম সুরে বলল মারি কিটন, তোমার বোধহয় শেখা উচিত ঠিক কখন মুখ বন্ধ রাখতে হয়।

তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে, নাকি, মাগী? মারির উদ্দেশে তুড়ি বাজাল হেইন্স। তোমার তো উচিতই হয়নি এখানে আসা। ময়নিহানের দিকে তাকাল সে। জানতে একসঙ্গে কাজ করব, সেক্ষেত্রে এই বাঁজা মেয়েলোকটাকে এসবে ডাকলে কেন?

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল মারি। হাত চলে গেছে উরুর পাশে হোলস্টারের কাছে।

পারলে অস্ত্রটা বের কর, মাগী, ঠিক জায়গা দিয়ে ওটা ভরে দেব, অন্যদের দিকে চেয়ে হাসল হেইন্স। কিন্তু ওর ফালতু কথা শুনে হাসছে না কেউ। আরও রেগে গেল যুবক। যা, মর, শালারা! আমি একাই দেখিয়ে দেব কীভাবে শেষ করতে হয় লোকটাকে! আমার সামনে পড়বি না কোনও শালা! মারি কিটনের দিকে ঘুরল সে। বিশেষ করে তুই, মাগী, ঘেয়ো কুত্তী!

এত রাগ কীসের, হেইন্স? জানতে চাইল মারি। পাত্তা দিইনি বলে? আগেই তো জানি, বিছানায় এক মিনিটেই খেলা খতম হয় তোমার!

মর, মাগী!

হাসছে অন্য খুনিরা। রাগে লাল হয়ে গেল হেইন্সের দুই গাল। চুপ হয়ে গেছে চরম অপমানে। ড্যাগেট ওয়াইল্ডের মত করেই বুকে বাধল দুই হাত। কড়া চোখে দেখছে মারি কিটন ও হ্যাঙ্ক পার্কারকে। বুঝতে পারছে না, ওই দুজনের ভেতর কাকে বেশি ঘৃণা করে।

যেহেতু, শেষ হয়েছে সবার শুভেচ্ছা বিনিময়, এবার আসা যাক কাজের কথায়, বলল ময়নিহান। তোমাদের বসদের নানান ধরনের উপকার করেছি বলেই তাঁরা তোমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এখানে। যার যার সিণ্ডিকেটের ফ থেকে এসেছ তোমরা। আমাকে বলা হয়েছে, তোমরা তাদের টপ টেরর। খোঁজ নিয়েও জেনেছি, সত্যিই তোমরা সেরা। কিন্তু, জেন্টলমেন ও লেডি, বিনা পয়সায় কাজ করিয়ে নেব না। বড় অঙ্কের টাকা পাবে মাসুদ রানাকে খুন করতে পারলে। কাজটা কঠিন। তাই তোমাদের মধ্যে চাই সুশৃঙ্খল জোট, নইলে এক এক করে খুন হবে তোমরা। একবার রিক বেণ্ডারকে দেখে নিয়ে আবার শুরু করল ময়নিহান, জানতেও চাই না কে শেষ করল লোকটাকে। প্রথম এবং শেষ কথা, খতম করতে হবে মাসুদ রানাকে। কিন্তু মনে রাখবে, একটা কাজ কখনও করবে না। এক এক করে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল সে। বেশিক্ষণ দেখল হেইন্সকে। তোমরা কেউ খুন করবে না মহিলাদেরকে।

আমি তো ভেবেছি ওই নিনা ভেঞ্চুরাকে খুন করতে চান, বস্, বলল চার্লস গ্রেড।

তা ঠিক, তবে মেরে ফেলার আগে ওর পেট থেকে বের করব অনেক জরুরি তথ্য। ওর কাছে আছে আমার বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ। তা ফেরত পেতে হবে। আগেই মরে গেলে বিপদ হবে।

আপনি মনে করেন ওই মেয়েকে আপনার হাতে তুলে দেবে মাসুদ রানা? আস্তে করে মাথা নাড়ল মারি। জুডি মেয়েটার জন্যে যেভাবে লড়ছে, তা থেকে বুঝতে পারছি, কোনও মেয়েকে আপনার কাছে পৌঁছে দেবে না সে।

নিনা ভেঞ্চুরা ওর অচেনা। দাম নেই ওর কাছে। কিন্তু জুড়ি অন্য কিছু।

ওরা তো দুই বোন, তাই না?

ড্যাগেট ওয়াইল্ডের দিকে তাকাল ন্যাশ ময়নিহান। প্রথমবারের মত মুখ খুলেছে লোকটা। এতক্ষণ একটু পর পর দেখছিল বেণ্ডারের বাইসেপ। বুক থেকে হাতের বাঁধন খুলল সে। ওই লোক প্রেমিকার জন্যে প্রেমিকার বোনকে কারও হাতে তুলে দেবে না। সেক্ষেত্রে ইজ্জত থাকবে না তার। আপনার কী ধারণা?

আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

চার্লস গ্রেডের দিকে তাকাল ময়নিহান। দুই দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভ বের করেছে লোকটা। তৈরি করল ছোট একটা বুদ্বুদ। হাত বোলাল কাকের বাসার মত চুলে।

কী জানতে চাও?

নিনা ভেঞ্চুরা জীবিত থাকবে তাই যদি অত চান, তা হলে যে-লোক চেষ্টা করছে তাকে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে, সেই লোককে খুন করতে চাইছেন কেন?

কারণ, সে অনেক বিপজ্জনক। বাঁচতে দেয়া যাবে না। সত্যি নিনা ভেঞ্চুরাকে আমার হাতে তুলে দিলে, পরে আবারও চেষ্টা করবে তাকে সরিয়ে নিতে।

অথচ, একটু আগেই বলেছেন, চেনেও না সে ওই মেয়েকে, বলল মারি। তা হলে তার জন্যে এত বড় ঝুঁকি নেবে কেন?

কারণ জুডি অনুরোধ করবে।

তা হলে মেয়েটাকে মেরে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়, বলল ওয়াল্টার হেইন্স, ভয়ঙ্করভাবে খুন করা যায় কুত্তীটাকে। তাতে বুঝিয়ে দেয়া যাবে, ওর বড়বোনকে তোমার হাতে তুলে না দিলে কষ্ট দিয়ে তাকে মারবে তুমি। জুডি কুত্তীটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, বুঝে যাবে কত কষ্ট হয় মরতে।

রাগী চোখে হেইন্সকে দেখল মহিলা খুনি মারি কিটন। তুমি সত্যিই নোংরা, হেইন্স। নারীবিদ্বেষী। তবে বলে লাভ নেই, সব যাবে তোমার মাথার ওপর দিয়ে।

আমি মেয়েদের পছন্দ করি, বলল হেইন্স। কিন্তু মুখ চালালে তাদের মুখ চিরকালের জন্যে বুজে দিই।

একটা কথা জানো, হেইন্স, বলল মারি, বেশিরভাগ পুরুষ তোমার মত হলে এত দিনে লেসবিয়ান হয়ে যেতাম।

তাই? আমি তো ভাবতাম তুমি ও-ই মালই।

যথেষ্ট হয়েছে, উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতের মাঝে সিগার জল ময়নিহান। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, নিজেরা তোমরা বিবাদে মত্ত হলে কাজটা অনেক সহজ হবে মাসুদ রানার।

তা হলে এ মেয়েলোকটাকে বিদায় করো, কড়া সুরে বলল হেইন্স। ঘুরে তাকাল হ্যাঙ্ক পার্কারের দিকে। আর এই বুড়ো হাবড়াটাকেও গুলি করে মারা উচিত। বিপদের সময় আমাদেরকে ধীর করে দেবে এ।

আমার মাথায় একটা ভাল আইডিয়া এসেছে।

ন্যাশ ময়নিহানের দিকে ঘুরতে শুরু করেছে ওয়াল্টার হেইন্স। কিন্তু ঝট করে তার গলার কাছে ডানহাত নাড়ল ময়নিহান। আঙুলের মাঝে দেখা দিল রুপালি ঝিলিক। যেন স্পর্শ করা হয়েছে হেইন্সের ত্বক। কিন্তু বিস্ফারিত হলো যুবকের চোখ। একইসময়ে ফাঁক হয়ে গেল গলা। ওই ফাটল দিয়ে গলগল করে বেরোল রক্ত। ভিজে গেল বুক-পেট। ক্ষুরের আরেক টানে আরও ফাঁক হলো গলা। আর্টারির রক্ত গায়ে লাগবে বলে দুপা পিছিয়ে গেল ময়নিহান।

ওয়াল্টার হেইন্স বুঝে গেছে, মরছে সে। দুহাতে চেপে ধরল গলা। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে গেল অন্যদের কাছে, কিন্তু ধারালো ক্ষুর কেটে দিয়েছে ল্যারিংস। কণ্ঠ থেকে বেরোল বিদঘুটে গড়গড়ার আওয়াজ। ধমনি থেকে আবারও ছিটকে বেরোল রক্ত। থেমে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। উপুড় হয়ে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল যুবক।

সবার চোখ দেখে নিল ময়নিহান। যথেষ্ট সহ্য করেছি ওই বেয়াড়া গাধাটার অভদ্রতা। তোমাদের কেউ যদি ভাবো ওই সুরে আমার সঙ্গে কথা বলবে, তো চেষ্টা করে দেখতে পারো।

কাঁধ ঝাঁকাল চার্লস গ্রেড। তৃপ্তি নিয়ে হেইন্সের লাশের দিকে চেয়ে রইল মারি। শুধু বিব্রত ড্যাগেট ওয়াইল্ড। তবে তা আইরিশ ম্যানের দুঃখে নয়। মৃদু হাসছে হ্যাঙ্ক পার্কার। সে বলল, সহজ লোক নয় ওই মাসুদ রানা। বাঁচার উপায় থাকত না হেইন্সের। ওর বত্সকে জানিয়ে দেব, বীরের মত লড়তে গিয়ে মরেছে সে।

ধন্যবাদ, শীতল হাসল ন্যাশ ময়নিহান। খুশি হলাম, পার্কার। তবে কারও নির্দেশ মানতে আপত্তি থাকলে, তোমরা দেরি না করে এখনই সেটা জানিয়ে দাও।

তিন খুনিকে মনে হলো খুশি। চিন্তিত ড্যাগেট ওয়াইল্ড, আবারও দুহাত বেঁধে ফেলল বুকে।

কোনও সমস্যা, ওয়াইল্ড? এখনও ময়নিহানের হাতে ক্ষুর।

না, বস, সমস্যা নেই। হেইন্স একটা উটকো ঝামেলা ছিল। উল্টোপাল্টা করে বিপদে ফেলত অন্যদেরকে।

কথা ঠিক, ওয়াইল্ডের পেছন থেকে জানাল গম্ভীর রিক বেণ্ডার। মুখ খুলেছে প্রথমবারের মত। ওই কথা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে, বুঝল না কেউ।

সতর্ক চোখে ওকে দেখল ময়নিহান। তোমরা শিয়োর তো, এখন থেকে পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারবে? আপত্তি তুলল না কেউ। গুড। তো কাজের কথায় আসা যাক। উবু হয়ে হেইন্সের প্যান্টে রক্তাক্ত ক্ষুরের ফলা মুছল সে। কবজির ভেতরের দিকে চলে গেল অস্ত্রটা। মিটিঙের সময় নীরবে টপ টেররদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকল ময়নিহানের পেশাদার কয়েকজন খুনি। নিজের কথা শেষ হলে দলের দুজনকে ইশারা করল ক্ষুরধার। লাশটার ব্যবস্থা করো।

ওটার কী করবেন, বস? জানতে চাইল মারি কিটন। দেখছে মেঝে থেকে লাশটা তুলে নিয়েছে দুই লোক।

অন্যদের যা করি, ওরও তাই করব, বলল ময়নিহান। কসাইখানায় গরুর মাংসের মত কুচি করে ক্যান করা হবে।

.

৩২.

 যে-কারও জন্যে এক সপ্তাহ মানব-জগৎ থেকে হারিয়ে যাওয়া কঠিন নয়। কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করলেই হলো। এড়িয়ে যেতে হবে সব কাগজপত্র ও ইলেকট্রনিক সূত্র। তাতে ধরে নেয়া যায়, যে-কেউ থাকবে মানব রেইডারের নাগালের নিচে। ঝামেলা এড়াতে ঠিক তা-ই করেছে নিনা ভেঞ্চুরা।

গত সাত দিন ছিল মস্তবড় এক ক্রু শিপের সাধারণ অচেনা যাত্রী হয়ে। জাহাজ ওকে নিয়ে গেছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। ঘুরে দেখেছে পুয়ের্তো রিকো, সেন্ট থমাস ও সেন্ট মার্টেন। হোটেলে না উঠে রাত কাটিয়ে দিয়েছে জাহাজে নিজের কেবিনে। যেখানে নামতে গেলে দেখাতে হবে পাসপোর্ট বা বোর্ডিং কার্ড, সেসব জায়গায় জাহাজ থেকে নামেইনি সে। মায়ামিতে জাহাজে ওঠার সময় একবার তোলা হয়েছে ক্রেডিট কার্ডের ছবি, কিন্তু এরপর জাহাজে উঠে ব্যাংকিং সিস্টেমের সাহায্য না নিয়ে সবসময় দরকারি জিনিস কিনেছে ও নগদ টাকায়। আর যে তিন দ্বীপে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছে, সেই হিসাবের রেকর্ড নতুন করে অ্যাকাউন্টে তুলতে লাগবে অন্তত কয়েকটা দিন। ক্রুজ শিপের বুকিং দিয়েছে ক্যাশ টাকায়। হাতে সময় আছে এমন দক্ষ কেউ চেষ্টা করলে টুর অপারেটরের সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করতে পারত ওকে। কিন্তু সেই চিন্তা মাথায় ঢোকেনি ন্যাশ ময়নিহানের।

রানাও ব্যস্ততার কারণে ওসব নিয়ে ভাবেনি।

ডালাসের ফোর্ট ওঅর্থ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে রানা যেতেই টার্মিনাল সি-র লাউঞ্জে বেরিয়ে এল মহিলা। সহজেই তাকে চিনল রানা। জুডির ফোনের ছবিতে যেমন ছিল, সে চুলের স্টাইল পাল্টে ফেলেছে নিনা ভেঞ্চুরা। ছোট চুলে এখন কালো ডাই। প্রায়-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোদে ত্বক তামাটে। চোখে বড় সানগ্লাস। একটু ভারী গড়ন আর সামান্য খাটো হলেও জুডির সঙ্গে তার চেহারায় ঢের মিল। বড়বোন নয়, অনেকে ভাববে যমজ।

হাই, নিনা, বলল রানা। এলেন, তাই খুশি হয়েছি।

যা বললেন, এরপর না এসে উপায় আছে, বলুন?

নিনা অত্যন্ত নার্ভাস, বুঝে গেল রানা। স্বাভাবিক। এক সপ্তাহের বেশি হলো প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে আছে মহিলা। আর ওর নিজের বক্তব্য ছাড়া এমন কোনও প্রমাণ নেই যে ও আসলে ভয়ঙ্কর খুনি নয়।

সানগ্লাসের ওদিক থেকে রানাকে দেখছে নিনা ভেঞ্চা। একবার আমার ভাইকে গাড়িতে করে আমাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরে ওর কাছে আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। ছবিও দেখেছি। তাই মনে আছে চেহারা।

চলুন, যাওয়া যাক, বলল রানা।

নিনার হাতে ছোট ব্যাগ। ওটা হাতে রানার পাশে পার্কিংলটের দিকে চলল মেয়েটা।

ব্ল্যাকমেইলার বলে কথা, তাই ভদ্রতা করে তার ব্যাগ বইতে গেল না রানা। টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে উইণ্ডস্টারের পাশে পৌঁছুল ওরা। দুবন্ধুর কাছ থেকে গাড়িটা ধার নিয়েছে রানা। ওদিকে কেবিনে বসে প্ল্যান নিখুঁত কি না, তা নিয়ে গবেষণা করছে জন ও বাড।

নিনা গাড়িতে উঠতেই উত্তরদিকের সড়ক ধরে পাইলট পয়েন্ট লক্ষ্য করে চলল রানা। কিছুক্ষণ পেরোল, কথা হলো না ওদের মাঝে। ছোটবোন খুন হবে, তাই ভীত এবং চিন্তিত নিনা। চুপ করে আছে।

প্রথমে নীরবতা ভাঙল রানা, ন্যাশ ময়নিহানের বিরুদ্ধে কী ধরনের প্রমাণ আছে আপনার কাছে?

জেনে কী করবেন? অস্বস্তি বোধ করে সিটে সরে বসল নিনা।

রানার মনে হলো, চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে পড়বে মেয়েটা। আপনার কাছে কিছু তথ্য বা প্রমাণ আছে, যেগুলোর জন্যে ক্ষতি হতে পারে ময়নিহানের ব্যবসার। ব্যাপারটা কি এর চেয়েও বেশি কিছু?

জবাব দিল না নিনা। ভাবছে কী যেন। একটু পর উল্টো প্রশ্ন করল, আপনি কি জুডির প্রেমিক?

না, জানাল রানা। ভাবছে, প্রেমিকা না হলেও জুডির জন্যে অদ্ভুত এক আকর্ষণ জন্মেছে ওর মনে।

ভেবেছিলাম আপনি আর ও…

 জুডি অনুরোধ করায় আপনাকে খুঁজতে শুরু করি।

ভয়েসমেইল খোলার পর পেলাম ওর মেসেজ। তাতে মনে হয়েছিল… আপনি… ইয়ে…

প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল রানা, ভাল করেছেন যোগাযোগ করে, নিনা। এখন আমাদের কাছ থেকে সাহায্য খুব দরকার জুডির।

সানগ্লাসের নিচে আঙুল নিল নিনা। রানার মনে হলো মেয়েটা মুছে ফেলল অশ্রু। রাস্তার দিকে মনোযোগ দিল ও। এগোতে হচ্ছে প্রচুর গাড়ির মাঝ দিয়ে। নাম নর্থ স্টেমন্স ফ্রিওয়ে হলেও ভীষণ জ্যাম। কাছেই লিউইসভিল লেক। সামনেই সেতু। পথের পাশে সাইনবোর্ডে লেখা: হিকোরি ক্রিক ও কোরিথ টার্ন অফ। সামনেই ডেণ্টন।

কোথায় নিয়ে চলেছেন? জানতে চাইল নিনা।

পাইলট পয়েন্টে একটা কেবিনে যাব। ওখানে অপেক্ষা করছে আরও দুজন।

কারা তারা?

নাম জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। হয়তো নাম শুনেছেন আপনার ভাইয়ের কাছে।

জর্ন হার্বার্ট? ওই যে, যার মা ছিলেন জাপানি?

ঠিকই ধরেছেন।

 আমাকে খোঁজার জন্যে তাদেরকে ভাড়া করেছে জুডি?

 না। জুডিকে উদ্ধার করতে ওদের সাহায্য নিচ্ছি আমি।

আপনারা মাত্র তিনজন, হতাশ সুরে বলল নিনা, আপনি কি জানেন, একটা ফোন দিলেই অন্তত বিশজন খুনিকে জড় করতে পারবে ন্যাশ ময়নিহান?

তাদের অনেকে ঝরে গেছে, বলল রানা। খুলে জানাল লিটল ফোর্কে যাওয়ার পর কী হয়েছে।

শুনতে শুনতে ফ্যাকাসে হয়ে গেল নিনা। রানা থামার পর বলল, আপনি নিক বেণ্ডারকে খুন করেছেন?

নইলে আমাকে খুন করত।

আর রিক বোর?

পালিয়ে গিয়েছিল।

দুহাতে মুখ ঢাকল নিনা। ফুঁপিয়ে উঠল কবার। একটু পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ওরা দানব। আপনি হয়তো জানেনও না কী করেছে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির। সে ছিল লিটল ফোর্কের…

শেরিফ এবং আপনার প্রেমিক, কথাটা শেষ করল রানা।

সানগ্লাস মাথার ওপর তুলে ওকে দেখল নিনা। লালচে হয়েছে দুচোখ।হ্যাঁ। সে আমার প্রেমিক ছিল। কিন্তু ওকে পিটিয়ে মেরেছে বেণ্ডাররা। ম্যালভির কান ছিঁড়ে নিয়েছিল নিক।

এ ধরনের লোকের সঙ্গে মিশলে যে-কোনও সময়ে আসে বিপদ, শুকনো গলায় বলল রানা। ময়নিহানকে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা উচিত হয়নি ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির।

বিড়বিড় করে কী যেন বলল নিনা। মাথা থেকে সানগ্লাস নিয়ে বন্ধ করল দুই উঁটি। ওটা রেখে দিল পার্সে।

রানা দেখল, ব্যাগে মেয়েলি কিছু জিনিস ও ডিজিটাল ভিডিয়ো ক্যামেরা। জানতে চাইল, ওরা যখন খুন করছে ম্যালভিকে, সে সময়ে ওখানে ছিলেন আপনি?

হ্যাঁ। ক্যামেরাটা স্পর্শ করল নিনা। লুকিয়ে ছিলাম জঙ্গলে। ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে কথা হয়েছিল, ভিডিয়ো করব পুরো মিটিং। ওটাকে কাজে লাগাব ময়নিহানের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে।

তবে কি ধরে নেব ময়নিহানকে ব্ল্যাকমেইল করছিল না ম্যালভি?

অবশ্যই না। ময়নিহান বা জাজ হোন্ডের বিরুদ্ধে জোগাড় করছিল প্রমাণ। কথা অনুযায়ী টাকা নেবে সে, তারপর সব প্রমাণ তুলে দেবে স্টেট পুলিশের হাতে। ফ্র্যাঙ্ক জানত, এ ছাড়া উপায়ও নেই। সেজন্যে ওই লোকগুলোর মতই ভান করেছে, ও-ও ভয়ঙ্কর দুর্নীতিপরায়ণ।

আগেই কেন যোগাযোগ করেনি স্টেট পুলিশের সঙ্গে? কী দরকার ছিল আপনাকে দিয়ে ভিডিয়ো রেকর্ড করার?

আমাকে অন্তর থেকে ভালবাসত ফ্র্যাঙ্ক। বুঝছিল না, দলের কাকে বিশ্বাস করবে, আর কাকে নয়। অনেকেই জড়িয়ে যায় ময়নিহানের জালে। স্টেট পুলিশের সঙ্গে কথা বললে, ময়নিহানের কাছে সব ফাঁস করে দেয়া হবে না, এমন নিশ্চয়তা ছিল না। তারপর বেণ্ডারদের সঙ্গে যখন হাজির হলো ম্যাকলাস্কি, ফ্র্যাঙ্ক বুঝল ওর ধারণাই ঠিক।

অস্টিন ম্যাকলাস্কি বলেছে, ম্যালভি খুন হওয়ার পর আপনি নিজেই ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন। সরাসরি মহিলার চোখে তাকাল রানা। আপনার দাবি ছিল দুই মিলিয়ন ডলারের।

ওর কথা বিশ্বাস করলেন? মাথা নাড়ল নিনা।

বিশ্বাস না করার কারণ পাইনি, বলল রানা। চেপে গেল তখন লোকটার পেট থেকে তথ্য জোগাড় করছিল ও।

অসম্ভব মিথ্যুক তোক সে, মুখ ঘুরিয়ে নিল নিনা।

রানা বুঝল, ম্যাকলাস্কি একমাত্র মিথ্যুক নয়। সহজ সুরে বলল ও, সে মিথ্যুক কি না তা আর জানার উপায় নেই। তবে আপনি যেটা করেছেন, তা বেআইনী, নিনা। অবশ্য, ময়নিহান বা অন্যরা যা করছে, সে তুলনায় আপনার অপরাধ অনেক কম। খারাপ লাগছে যে আপনার লোভের জন্যে আজ জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে জুডি।

আমি কাউকে ব্ল্যাকমেইল করিনি, শুধু চেয়েছি আমার প্রাপ্য টাকা। ময়নিহানের কাছে টাকা পাই আমি।

কয়েক হাজার ডলার, বলল রানা।

সেটা বড় কথা নয়। রেস্টুরেন্টের জন্যে কাজ করেছি, অথচ আমার টাকা আটকে দিল সে। চাইনি এমনি এমনি তাকে ছেড়ে দিতে।

তার মানে, কয়েক হাজার ডলার আদায় করতে গিয়ে নিজের বোনকে ফেললেন মৃত্যুর মুখে। কাজটা কী ভাল করেছেন?

আমি জানতাম না যে এসবে জড়িয়ে যাবে জুডি।

সেটা বড় কথা নয়, নিনার একটু আগের কথাটাই ব্যবহার করল রানা। মস্তবড় বিপদে আছে জুডি।

দুহাতে মুখ ঢাকল নিনা। থরথর করে কাঁপছে আঙুল।

রানা ভাবছে, বিপজ্জনক লোকের কাছ থেকে মেয়েটা নিজের প্রাপ্য আদায় করতে গেছে, তা বিপজ্জনক; কিন্তু এর চেয়েও ঢের বড় অন্যায় আছে। সেটা নিরীহ মানুষের কাছ থেকে জোর করে ঘুষ আদায় করা। বাংলাদেশে সেটা চলছে পূর্ণমাত্রায়। আবারও নিনার দিকে মনোযোগ দিল রানা। নিনা, দেখিয়ে দিয়েছি আমার হাতের সব তাস। আপনি জানেন, আমি কে এবং কী করি। জুডিকে ছুটিয়ে নিতে ডেকেছি দুজন বন্ধুকে। তবুও আপনার বিশ্বাস না এলে আমার আর কিছু করার নেই। নিনাও বুঝে গেছে, হয়তো প্রাণে বাঁচবে না জুডি। ভাল করবেন খুলে বললে, ন্যাশ ময়নিহানের বিরুদ্ধে কী ধরনের প্রমাণ আছে আপনার হাতে।

মাথা দোলাল নিনা। ডান চোখের কোণে টিপটিপ করে লাফ দিচ্ছে একটা নার্ভ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। লিটল ফোর্কের ওই রেস্টুরেন্টের জন্যে তৈরি করি পাবলিসিটি ক্যাম্পেনের একটা ওয়েবসাইট।

ভিলাজ-ও-সঁও।

হ্যাঁ। মালিকপক্ষ চেয়েছিল নতুন করে সাজিয়ে নেবে রেস্টুরেন্ট। প্রচুর খরচ করেছিল আধুনিক আসবাবপত্রের জন্যে। চমক দিতে চেয়েছিল লিটল ফোর্কের নাগরিকদের। দেখার মত হয়ে ওঠে ওই রেস্টুরেন্ট।

এ কথায় রানার মনে পড়ল, এখন কী অবস্থা ওই বাড়িটার।

যখন শুনলাম ওটা বিক্রি করেছে মালিকপক্ষ, খুব অবাক হলাম। অথচ, কদিন আগেও খুব হৈ-চৈ করছিল তারা। এদিকে তৈরি হয়েছে আমার পাবলিসিটি ক্যাম্পেন প্রোগ্রাম। আর তখনই আমার পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নেয়া হলো পাপোশ।

ওই রেস্টুরেন্ট কিনে নিল ন্যাশ ময়নিহান, বলল রানা, জানিয়ে দিল কাজের জন্যে কিছু দেবে না।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল নিনা। এর কোনও ব্যাখ্যা দিল না কেউ। হঠাৎ করেই শহর ছেড়ে চলে গেছে মালিকপক্ষের সবাই। হাজির হলো ন্যাশ ময়নিহান। জানি, ব্যবসার সময় কখনও কখনও এমন হয়। তবুও কেমন যেন সন্দেহ হলো। বলে দেয়া হলো, যেন সরিয়ে নিই রেস্টুরেন্ট অফিস থেকে আমার ইকুইপমেন্ট। বলতে লজ্জা লাগছে, আর কারও কাছে স্বীকার করব না, তবে নিজের মালপত্রের সঙ্গে তাদের কমপিউটারের কিছু কাগজপত্র সরিয়ে ফেললাম। জানলাম, জোর খাঁটিয়ে রেস্টুরেন্ট দখল করেছে ময়নিহান। সেজন্যে আগের মালিকপক্ষকে দিয়েছে মাত্র বিশ হাজার ডলার। অথচ ওই সম্পত্তির দাম অন্তত দুই থেকে তিন লাখ ডলার।

এরপর গেলেন শেরিফের কাছে। ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভিও জেনে গেল অন্যায়ভাবে ওই সম্পত্তি দখল করেছে ন্যাশ ময়নিহান। আগ্রহী হয়ে উঠল সে।

আগেই টের পেয়েছিল, গোলমাল আছে। আমাকে জানাল, আগে থেকেই জাজ হোল্ডের বিপক্ষে তদন্ত করছে ও। ওই লোক অনেক দিন ধরেই আদালতকে কাজে লাগিয়ে জমি-জিরাত কম দামে বিক্রি করছিল ময়নিহানের কাছে। ফ্র্যাঙ্ক আরও জানাল, ওর চাই আরও শক্ত প্রমাণ। এমন কিছু, যেটার জন্যে ফসবে জাজ হোল্ড আর ন্যাশ ময়নিহান।

ডেণ্টন শহরের ভিড় ভরা রাস্তায় পৌঁছে গাড়ি চালনায় মন দিল রানা। সরে গেল উত্তরদিকে এক শাখা রাস্তায়। চলেছে রে রবার্ট লেক লক্ষ্য করে। চুপ হয়ে গেছে নিনা ভেঞ্চুরা। তবে রানার মনে হলো না, সব কথা বলেছে সে। ওসব কথায় রয়েছে বড় কিছু ফাঁক।

জাজ হোল্ড আমাকে বলেছিল, চাপের মুখে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির কথা মত তাকে পুরো টাকা দিয়েছিল ময়নিহান, বলল রানা। তবুও আরও বেশি চেয়ে বসল সে।

নড়েচড়ে বসল নিনা। চোখে অপরাধী দৃষ্টি। তা যদি করেও থাকে, সেটা আমি জানি না।

মিথ্যা না বলাই ভাল, নিনা। ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভি শেরিফ হলেও চেয়েছিল হঠাৎ বড়লোক হতে। আর আপনার মনে হলো: ভালই তো, প্রতিশোধ নেয়া যাবে ন্যাশ ময়নিহানের ওপর।

অস্বীকার করছি না। মনে হয়েছিল উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত তার। তাতে ফিরে পাব প্রাপ্য টাকা। শায়েস্তা করতে চেয়েছি তাকে। …কিন্তু আপনি ভুল ভাবছেন, সত্যিই সব টাকা তুলে দিতাম স্টেট পুলিশের হাতে।

নিজের টাকা সরিয়ে নেয়ার পর?

তা ভাবিনি। কঠোর হলো নিনার চোখ। নিয়ম মেনেই আদায় করতাম টাকা। সেজন্যে পাঠাই উকিলের নোটিস। ভেবেছি, জাজ হোল্ড আর ময়নিহান মামলায় ফেঁসে গেলে আমার জন্যে সহজ হবে টাকা পাওয়া।

কাজেই আপনারা চাপ দিলেন ময়নিহানকে, যাতে সে গোপনে দেখা করে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির সঙ্গে? টার্নপাইক পেরিয়ে উত্তরদিকের রাস্তায় পড়ল রানা। কেন ভাবলেন যে জঙ্গলে দেখা হলে তা আপনাদের জন্যে সুবিধাজনক হবে?

প্রস্তুতির সময় ছিল না। নিজে নার্ভাস ছিল ময়নিহান। এমন জায়গায় টাকা নিতে হবে, যেখানে ছবি তুলে প্রমাণ রাখতে পারব। তাই গ্রেট ওয়েলস ওঅটারফলের কাছের জঙ্গল বেছে নিলাম আমরা। ভাল করেই চিনতাম আশপাশের সব জায়গা, যেখানে লুকিয়ে পড়তে পারব। আগেই ভিডিয়ো ক্যামেরা নিয়ে ওখানে চলে যাই আমি।

কিন্তু ঠিক সময়ে এল না ন্যাশ ময়নিহান, বলল রানা। বদলে এল ম্যাকলাস্কি আর দুই বেণ্ডার। তারা খুন করল ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভিকে।

না, একটু ভুল বললেন। ময়নিহান ওখানে ছিল।

তাই কী?

হ্যাঁ, অন্যরা না জানলেও, আমি ওকে দেখেছি। উপভোগ করছিল খুনের প্রতিটি মুহূর্ত।

তার ভিডিয়ো তোলেন আপনি?

হ্যাঁ।

এখনও আছে ওই ভিডিয়ো?

 পার্সের ক্যামেরা স্পর্শ করল নিনা। এখানেই আছে।

 কপি করেছেন?

অবশ্যই।

মাথা দোলাল রানা। ম্যাকলাস্কি বলেছিল আপনি খুন হতে দেখেননি।

অসম্ভব মিথ্যুক লোক, বলল নিনা। ভিডিয়ো দেখাতে পারব কীভাবে ফ্র্যাঙ্ককে খুন করছে তারা। ভাল করেই জানে, প্রমাণ আছে আমার কাছে। তাই খুন করতে জঙ্গলে। খুঁজছিল আমাকে। লুকিয়ে ছিলাম পুরো একদিন একরাত। তারপর বহু কষ্ট করে পালিয়ে যেতে পারলাম। সরাসরি রানার চোখে তাকাল নিনা। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কী কারণে নিজেকে বাঁচাতে এত মরিয়া ন্যাশ ময়নিহান?

বুঝলাম, বলল রানা, কিন্তু সেক্ষেত্রে কেন গল্প ফাঁদল অস্টিন ম্যাকলাস্কি? আপনি ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছেন ওদেরকে?

যাতে পিছু নেয়া বাদ দেয়, তাই হুমকি দিই। স্টেট পুলিশের হাতে প্রমাণ তুলে দিলেও প্রাণে বাঁচতাম না। পেছনে খুনি লেলিয়ে দিত ময়নিহান। তখন মনে হলো তার কাছ থেকে অনেক টাকা চাইলে চমকে যাবে সে। তাতে অন্যদিকে সরাবে মনোযোগ।

উল্টো আরও জটিল করলেন সব। ভাল করতেন জুডিকে জানালে। পুলিশ অফিসার। ভাল করেই বুঝত কী করা উচিত।

দেরিতে বুঝেছি, ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল নিনা।

ওর জন্যে খারাপই লাগল রানার। বলল, বড় কয়েকটা ভুল করেছেন। ভুল আমিও করেছি। এরপর থেকে প্রতিটা পা ফেলতে হবে সতর্ক হয়ে।

আমরা কি প্রমাণ নিয়ে পুলিশের কাছে যাব?

আপাতত না। তাতে খুন হবে জুডি।

তা হলে কী করব আমরা?

শেষ করব ঝামেলা। পথের ধারে গাড়ি থামাল রানা। হাওয়ার জোর ঝাপটা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে পেছনের গাড়ি। গম্ভীর রানা বলল, জুডিকে উদ্ধার করতে কি আপনি তৈরি? হয়তো নিতে হবে মস্তবড় ঝুঁকি।

যা বলবেন, তাই করব। বোনের জন্যে জান দিতেও দ্বিধা করব না।

গুড, বলল রানা, তা হলে নিন মানসিক প্রস্তুতি।

.

৩৩.

বসো, নরম সুরেই বলল জ্যাকসন।

বাথরুমে যেতে হবে। উসখুস করল জুডি।

আবারও? একটু আগে না গেলে?

 অনেক পানি খেয়েছি, তাই না গেলেই নয়।

বিরক্ত হলো জ্যাকসন। চলে এসেছে লোগানের পালা। একটু পর যেয়ো।

খোঁচা দিল জুডি, ভয় পাচ্ছেন? আপনাকে তো সাহসী মানুষ বলেই ভাবতাম?

ওকে ধর্ষণ করতে চেয়েছে লোগান টার্সন। অনুমতিও দিয়েছে ময়নিহান। ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ওর ব্লাউস আর ব্রা খুলে স্তন মন্থন করেছে জানোয়ারটা। লোভে বেরিয়ে গিয়েছিল জিভ। তবে খোলেনি ওর জিন্সের প্যান্ট। কুকুরটা ময়নিহানের জরুরি কাজ নিয়ে ঘর থেকে চলে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়েছে জুডি।

জ্যাকসন ভাড়াটে মস্তান হলেও টার্সনের মত লোভী এবং অভদ্র নয়। সাহায্য করেছে ব্লাউস পরতে। লম্বায় সে সোয়া ছয় ফুট। ধূসর রঙের চুল খাটো করে ছাঁটা। গালে অসংখ্য লাল ফুটকি। গোল কাঁচের চশমার ওদিকে বড় দুটো নীল চোখ। অনামিকায় সোনার আঙটি। বিবাহিত তোক। তাকে এদের মাঝে দেখে অবাকই হয়েছে জুডি। তার বাচ্চা আছে কি না, কে জানে! হয়তো আছে। সেজন্যেই এখনও আছে বিবেক।

ভয় পাচ্ছি না, বলল জ্যাকসন। চেয়ারে বসো।

প্রস্রাব করতেই হবে। নইলে এখানেই… মেঝে দেখাল জুডি।

কাজটা করলে তোমাকেই পরিষ্কার করতে হবে।

তার চেয়ে ভাল হতো না বাথরুমে যেতে দিলে?

আরে বিপদ! চেয়ার ছেড়ে হলওয়ের দরজা খুলল জ্যাকসন। হোলস্টার থেকে নিল পিস্তল। নল দিয়ে ইশারা করল জুডিকে। বাথরুমে যাবে। কিন্তু দেরি করবে না, ঠিক আছে? আর সঙ্গে যাব আমিও।

মাথা দোলাল জুডি। চলল বাথরুমের দিকে। পেছনেই পিস্তল হাতে জ্যাকসন। ময়নিহান র‍্যাঞ্চে বন্দি হওয়ার পর থেকে চলছে এ নিয়ম। জুডি বাথরুমে গেলে চোখ রাখছে কেউ না কেউ। ওর গোপনাঙ্গ দেখার লোভে বেশিরভাগ সময় যাচ্ছে টার্সন। তবে জুডি আবিষ্কার করেছে, উপায় আছে পালিয়ে যাওয়ার। বাথরুমে একটা জিনিস খেয়াল করেনি জেলাররা। ওটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে,  ও। হয়তো প্রতিশোধ নিতে পারবে ওর অপমানের।

খুলে দেবেন হাতকড়া? দুহাতই ব্যবহার করতে হবে। জিন্সের প্যান্টের বোতাম দেখাল জুডি। চোখ গেল টয়লেট সিটের ওপর। অথবা আমার হয়ে করতে পারেন কাজটা।

জুডির হ্যাণ্ডকাফ খুলে বাথরুমের দরজার হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে দিল জ্যাকসন। দেখাল টয়লেটের বাউল। ঠিক আছে। কাজ ঝটপট শেষ করো।

অবশ হয়েছে আঙুল, কবজি নেড়ে রক্ত চলাচল ঠিক করতে চাইল জুডি। বন্ধ করতে গেল দরজা।

কিন্তু পা বাড়িয়ে দরজা বন্ধ হওয়া ঠেকাল জ্যাকসন। না, দরজা খোলা থাকবে।

ঠিক আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টয়লেটের দিকে ফিরল জুডি। খুলতে শুরু করেছে জিন্সের প্যান্টের বোতাম।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল জ্যাকসন। আধখোলা রেখেছে দরজা। গলা চড়াল: আমরা সবাই লোগানের মত পশু নই। ভেতরে কী করবে দেখতেও চাই না। কোনও চালাকি না করলেই হলো।

আপনি লোগানের মত নন, তা জানি, ভেতর থেকে বলল জুডি। অনেক ধন্যবাদ, জ্যাকসন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে পিঠ দিল লোকটা।

কবাটের ফাঁক দিয়ে জুডি দেখল, হোলস্টারে পিস্তল রেখেছে জ্যাকসন। মনে মনে হাসল ও। এবার সুযোগ করে পালিয়ে যেতে হবে। আগে মনে আশা ছিল, উদ্ধার করবে রানা। কিন্তু পরে বুঝেছে, তা হওয়ার নয়। নিজেরই কিছু করতে হবে। হলিউডের মেকাপ করা নায়িকাদের মত চুপ করে বসে থাকবে আর নায়ক এসে উদ্ধার করবে, তা হবে না। ভুললে চলবে না, ও এনওয়াইপিডির পুলিশ অফিসার। সুতরাং নামতে হবে কাজে।

টয়লেটের সিটে বসল জুডি। পরের কাজ কঠিন। এটা ভাবতে গিয়েই রক্তে ছড়াল অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। তৈরি হয়ে নিচ্ছে লড়তে বা পালিয়ে যেতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝাতে রোল থেকে নিল টিশ্য। কয়েক সেকেণ্ড পর করল ফ্লাশ। পরে নিল প্যান্ট। যে জিনিস দেখে মুক্তির কথা ভেবেছে, ওটা তুলে নিল কমোডের পেছন থেকে। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল জ্যাকসন। তাকে পাত্তা না দিয়ে সিঙ্কে হাত ধুতে লাগল জুডি। ভারী তোয়ালে দিয়ে শুকিয়ে নিল হাত। জিনিসটা ঠিক জায়গায় না ঝুলিয়ে চলল বাইরে জ্যাকসনের দিকে। মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে বলল, সত্যি ধন্যবাদ, জ্যাকসন। হাসছে জুডি। খুব চাপ ছিল।

ঠিক আছে, এবার ফিরতে হবে ঘরে।

আচ্ছা, হাত থেকে তোয়ালে ফেলল জুডি। আমার কাজ শেষ।

জুডিকে নিয়ে ঘরে ফিরবে জ্যাকসন। দরজার হ্যাণ্ডেল থেকে নিতে গেল হাতকড়া। হাঁ করল কী যেন বলতে। কিন্তু তখনই পোকামাকড় মারার অ্যারোসলের ক্যান ওপরে তুলল। জুডি। এতক্ষণ ওটা ছিল তোয়ালের আড়ালে। দেরি না করেই ক্যাপ খুলে জ্যাকসনের চোখে-মুখে অ্যারোসল স্প্রে করল জুডি।

ইনসেকটিসাইড খুন করবে না লোকটাকে। কিন্তু চোখে ঢুকতেই জীবনটা নরক হলো তার। মুখে বিশ্রী স্বাদ। ভীষণ জ্বলছে চোখ। যেন মুখে ছুঁড়ে দিয়েছে সালফিউরিক অ্যাসিড। সরল টলতে টলতে। দুহাতে ঢেকে ফেলেছে চোখ। স্প্রের ধক খানিকটা ঠেকিয়ে দিয়েছে চশমা, তবুও আপাতত সে অন্ধ। আরও কবার জ্যাকসনের চোখে-মুখে স্প্রে করল জুডি। পরের কাজ আরও কঠিন।

খালি পায়ে লোকটার উরুসন্ধিতে লাথি মারল জুডি। নিজেই ফুঁপিয়ে উঠল পায়ের ব্যথায়। কিন্তু জ্যাকসনের মনে হলো আগে কখনও এত ব্যথা পায়নি সে। গুঙিয়ে উঠে দুই হাতে গোপনাঙ্গ ও অণ্ডকোষ চেপে ধরল সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে মেঝেতে। হ্যাণ্ডেল থেকে হ্যাণ্ডকাফ নিয়েই ঝট করে ওদিকে ঘুরল জুডি। শেকলের নয়, এ হ্যাণ্ডকাফের মাঝে রয়েছে লোহার পুরু ডাণ্ডা। জ্যাকসনের মাথার ওপর গায়ের জোরে ওটা নামাল জুডি। মাথা বাঁচাতে হাত তুলল জ্যাকসন। হোলস্টারের পিস্তলে থাবা দিল অন্যহাত। দ্বিতীয়বারের মত তার মাথায় হ্যাণ্ডকাফের বাড়ি দিল জুডি। খুলির চামড়া ও মাংস কেটে দরদর করে নামল রক্ত।

জুডির দিকে ঘুরতে চাইছে জ্যাকসন। কিন্তু পেছনে গিয়ে হাতটা ধরে ফেলল জুডি। পরক্ষণে কবজিতে পরিয়ে দিল হাতকড়ার একটা কাফ। লোহার পুরু ডাণ্ডার কারণে ইচ্ছে হলে শক্তিশালী যে কাউকে দিতে পারবে প্রচণ্ড ব্যথা। হ্যাণ্ডকাফ মুচড়ে দিয়ে জ্যাকসনের হাত পেছনে নিল জুডি। বেকায়দাভাবে কবজি আটকা পড়েছে লোকটার। ঘাড় ধরে জোরে নিচে ঠেলে দিতেই বাধ্য হয়ে শুল সে। এ সুযোগে তার পিঠে হাঁটু রেখে অন্যহাতও হ্যাণ্ডকাফে আটকে নিতে চাইল জুডি। বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে জ্যাকসন, কিন্তু আটকা পড়া হাতটা মুচড়ে দেয়ায় গুঙিয়ে উঠল ব্যথায়। পরক্ষণে তার মুক্ত হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল জুডি।

হোলস্টার থেকে প্রায় খসে পড়েছে পিস্তল। খপ করে ওটা নিল জুডি। উপুড় হয়ে পড়ে আছে জ্যাকসন, লড়তে পারে, বা দিতে পারে চিৎকার।

মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল জুডি। গায়ের জোরে পিস্তলের বাঁট দিয়ে বাড়ি দিল শত্রুর ঘাড়ে। গাল বকে উঠল জ্যাকসন, কিন্তু আবারও তার ঘাড়ে বাঁট নামাল জুডি। বিড়বিড় করছে, অজ্ঞান হও… অজ্ঞান হও… আরে, বাপু…।

রিক বেণ্ডারের মাথার পাশে বাড়ি দিয়ে ওই পাহাড়টাকে অজ্ঞান করেছে রানা, নিজ চোখে দেখেছে জুডি। তা হলে এই বেয়াক্কেলেটা এমন করছে কেন? একের পর এক বাড়ি দিতে হবে? কিন্তু খুলি ভেঙে মগজে গেঁথে গেলে? কিন্তু উপায়ই বা কী? চিন্তা বাদ দিয়ে পিস্তলের নলের জোরালো আরেক বাড়ি দিল জ্যাকসনের চাদি বরাবর। ফুঁপিয়ে উঠে ঘুমিয়ে পড়ল লোকটা, নিচ্ছে হালকা শ্বাস।

উঠে দাঁড়াল জুডি, হাঁফিয়ে গেছে ভয়ে। ঘরে ঢুকে দেখল কোথাও নেই ওর বুটজুতো। হয়তো আনা হয়নি লিটল ফোর্ক থেকে। খালি পায়ে পালিয়ে যাওয়া কঠিন। তবে এসব ভেবে এখন দমে যাওয়া অনুচিত। হলওয়ের দরজায় পৌঁছে জ্যাকসনের গ্লক সতেরো পরখ করল জুডি। ও যেটা ব্যবহার করত, তার চেয়ে এই পিস্তল বড়।

দক্ষ হাতে খুলল ম্যাগাযিন। ওটা গুলিতে ভরা। নতুন করে পিস্তলে ম্যাগাযিন ভরে টেনে নিল স্লাইড। ফায়ারিং চেম্বারে পৌঁছে গেছে বুলেট। ট্রেনিঙে বলা হয়েছে, অফ করে রাখবে না সেফটি ক্যাচ। কিন্তু রানাকে দেখেছে উল্টো কাজ করতে। নইলে যে মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময় লাগবে, তাতে খুন হতে পারে কেউ।

রানার কথা মনে পড়তেই থেমে গেল জুডি।

 মরেই কি গেল মানুষটা?

আর কখনও দেখা হবে না?

চিন্তাটা জোর করে মন থেকে দূর করল জুডি।

না, নিশ্চয়ই বেঁচে আছে রানা!

খারাপ ভাবনা মনে আসতে দেবে না ও।

কক্ষণো না!

রানার প্রতি ওর অনুভূতি নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে ন্যাশ ময়নিহান। ডাহা মিথ্যা বলেছে ও। জানিয়ে দিয়েছে, ওদের মাঝে ব্যক্তিগত কোনও সম্পর্ক নেই।

আসলেই তো নেই!

অন্তত রানার তরফ থেকে।

 কিন্তু মানুষটার ব্যাপারে বুকে হাত রেখে এ কথা বলতে পারবে ও?

সত্যের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ময়নিহান।

 হ্যাঁ, জুডি ভালবেসে ফেলেছে রানাকে।

খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে, নিজ জীবনে কখনও কোনও মেয়েকে জড়াবে না রানা। চিরকালের মুক্ত-বিহঙ্গ।

তখনই ঠিক করেছে জুডি, সুযোগ এলেও রানাকে বাঁধতে চাইবে না ও।

না হয় হলো ওরা ভাল বন্ধু?

 তাই বা কম কী ওর জন্যে?

সত্যিকারের দেবতা না দেখলেও রানাকে দেখেছে– স্বর্গের দূত কি ওর চেয়েও নির্লোভ?

মনে হয় না!

নিজেকে কড়া ধমক দিল জুডি: এটা সময় হলো তোর এসব ভাবার?

বেরোতে হবে এই দুর্গ থেকে!

পাথরের মত শক্ত করতে হবে মন। সতর্ক করবে না কাউকে। সুয়োগ দেবে না কোনও। গুলি করবে খুন করতে। নইলে খুন হবে নিজে।

জুডি ভাবল, হ্যাঁ, এখন তুই ভুলে যা রানার কথা!

হলওয়ের ওদিকের দরজা খুলল ও। বামে কটা দরজা, ডানে সরু হল। ওদিকে ডাবল ডোর কোনও লাউঞ্জ এরিয়ার। কান পাতল জুডি, সকালে ওখানে শুনেছে অস্পষ্ট কথা। কিন্তু এখন কোনও আওয়াজ নেই ওই ঘরে। পায়ের নিচে পালিশ করা কাঠের তক্তার মেঝে। হল-এ বেরিয়ে বড় করে দম নিল জুডি। বাগিয়ে ধরেছে গ্লক। চলল লাউঞ্জ লক্ষ্য করে।

প্রথমে যখন আনা হলো, বাঁধা ছিল হাত-পা-চোখ। দেখা হয়নি কিছুই, আটকে রেখেছিল বেডরুমে। সর্বক্ষণ পাহারায় ছিল এক লোক। বোঝার উপায় ছিল না বাড়িটা কেমন বা আছে কজন লোক। পরে বুঝেছে, ও আছে বিশাল বাড়ির দোতলায়। সম্ভবত এটা টেক্সাসের দক্ষিণে কোনও র‍্যাঞ্চ হাউস।

লাউঞ্জে পা রেখে জুডি দেখল, প্রকাণ্ড ফ্রেঞ্চ ডোরের ওদিকে বারান্দা। দূর দিগন্তে গেছে প্ৰেয়ারি। কড়া রোদ ও শুকনো হাওয়ায় হলদে প্রায়-পোড়া ঘাস। জানা নেই সময়, তবে বোঝা যাচ্ছে এখন বিকেল। একটু পর আকাশ ও দিগন্ত ছেয়ে ফেলবে ধূসর রঙ।

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চাইল জুডি। চোখ খুঁজছে বেরোবার পথ। বোধহয় হলওয়ের দূরে সিঁড়ি। কিন্তু ওদিকে গেলে যখন-তখন ধরা পড়বে ময়নিহানের লোকের হাতে। পিস্তল আছে মানেই এমন নয়, ওটা দিয়ে ঠেকাতে পারবে সবাইকে। একদল খুনির বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না ও। দিবাস্বপ্ন দেখছে না জুডি।

লাউঞ্জে ঢুকে উঁচু এক উইং-ব্যাকড় চেয়ার পাশ কাটল ও। পায়ের নিচে মৃদু আপত্তি তুলল মেঝের কাঠের তক্তা। থমকে গেল জুডি। মেঝেতে কালচে দাগ। দ্বিতীয়বার দেখতেই বুঝল, মেঝেতে পড়েছে অনেক রক্ত। এখানে খুন হয়েছে কেউ। বাতাসে এখনও রক্তের আঁশটে গন্ধ।

গলা শুকিয়ে গেল জুডির।

তা হলে কি খুন হয়েছে রানা বা নিনা?

হয়তো ওদেরকে ধরে এনেছিল ময়নিহান?

 খুন করেছে এখানে।

মনে দুশ্চিন্তা আসতেই চোখ বুজল জুডি।

রক্ত যদি রানা বা নিনারই হবে, তো বাঁচিয়ে রেখেছে কেন ওকে ন্যাশ ময়নিহান? বা ওকে তুলে দিচ্ছে না কেন লোগান টার্সন বা লোভী কারও হাতে?

এতক্ষণে খুন হওয়ার কথা ওর।

না, এ রক্ত রানা বা নিনার নয়।  

কালচে দাগ এড়িয়ে দরজার দিকে চলল জুডি। পেছনে শুনল মৃদু আওয়াজ। হলওয়ে ধরে হেঁটে আসছে কেউ।

বোধহয় লোগান টার্সন!

চলেছে জুডির বন্দিশালার দিকে।

সেক্ষেত্রে সময় নেই হাতে। এ বাড়ি ছেড়ে প্রথম সুযোগে পালাতে হবে জুডিকে। প্রতিটি মুহূর্ত খুব জরুরি।

জুডি একবার ভাবল, লুকিয়ে পড়বে দরজার পাশে, তারপর লোগান পাশ কাটালেই গুলি করে মারবে তাকে।

ওকে কম অপমান করেনি লোভী জানোয়ারটা!

মরাই উচিত পাগলা কুকুরটার!

কিন্তু গুলি করলে সেই আওয়াজে ছুটে আসবে অন্যরা।

মাথা নাড়ল জুডি। এত ঝুঁকি না নিয়ে উচিত বারান্দায় চলে যাওয়া। হয়তো ওদিকে আছে কোনও পথ। তা না পেলেও ওখানে গেলে বুঝবে চারপাশ কেমন। হয়তো পেয়ে যাবে লুকিয়ে পড়ার মত জায়গা।

ডাবল ডোরের কবাট খুলে বারান্দায় পা রাখল জুডি। পুরো বাড়িটাকে ঘিরেছে এই বারান্দা। বামে সরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘরে উঁকি দিল ও।

কেউ ঢোকেনি ঘরে। দূরের দরজার ওপাশে বন্দিশালার দিকে হাঁটছে কেউ। জুডি ধারণা করল, ওই লোক লোগান টার্সন না হয়েই যায় না। কসেকেণ্ড পর করিডোরে দেখল প্যারামিলিটারি পোশাক পরনে কেউ, মাথায় কাউবয় হ্যাট।

হ্যাঁ, সে লোগান টার্সনই!

এক এক করে ক্ষণ গুনতে লাগল জুডি।

দুমিনিট পেরোবার আগেই শুনল টার্সনের চিৎকার ও গালি। দেরি না করে বারান্দার দূরের বাঁক লক্ষ্য করে দৌড় দিল জুডি। উড়ে চলেছে রকেট বেগে। কোণ ঘুরে দেখল, একপাশে নিচে যাওয়ার সরু সিঁড়ি। প্রথমতলায় রেলিং দিয়ে ঘেরা আরেকটা বারান্দা। ওর ভয় লাগছে, যে-কোনও সময়ে ছুটে আসবে টান। ঝড়ের বেগে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেও কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চাইল জুডি। একতলায় নেমে বসে পড়ল সিঁড়ির একপাশে। বামে একটু দূরে কটা আউটবিল্ডিং। পেছনে টিনের বিশাল ছাউনি। ওখান থেকে আসছে বাজে দুর্গন্ধ।

কয়েক ঘণ্টা আগে টান ছিঁড়ে দিয়েছে জুডির ব্লাউস। দেখা যাচ্ছে বুকের বড় অংশ। এখন ছুটতে হবে খালি পায়ে। ভয় লাগছে ওর। খালি পায়ে বালিতে হাঁটা এক কথা, আর পাথুরে জমিতে দৌড়ানো অন্য কথা। প্রতিটি পদক্ষেপ দেবে ব্যথা। কিন্তু এসব ভেবে লাভ নেই। রেলিং টপকে তিন ফুট নিচে উঠানে নামল জুডি। থমকে গেল ওখানে। কান পাতল। দূর থেকে এল টার্সনের চিৎকার। তারপর এল ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ।

ঘুরেই ছাউনির দিকে ছুটল জুডি। চাইছে ধারালো পাথরের খোঁচা এড়াতে। কিন্তু প্রথম আউট বিল্ডিঙের কাছে যেতে না যেতেই ফুলে গেল পায়ের পাতা। কপাল ভাল রক্তপাত হচ্ছে না।

যন্ত্রণা থাকুক, নিজেকে বলল জুডি। দৌড়াতে থাক!

কানের পাশ দিয়ে গিয়ে ছাউনির দেয়ালে বিঁধল বুলেট। ভয়ে আত্মা খাঁচা-ছাড়া হয়েছে জুডির। তবে ঘুরেই বাড়ির দিকে তাক করল পিস্তল। ওপরের বারান্দায় লোগান টার্সন। তাক করছে পিস্তল। টিপে দিল ট্রিগার। হাতে লাফিয়ে উঠল অস্ত্রটা। একপাশে সরে পাল্টা গুলি করল জুডি। ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল টার্সন, তবে গুলি লাগেনি গায়ে।

ওই যে! চিৎকার করল সে। ছাউনির দিকে যাচ্ছে!

প্রাণের ভয়ে ছুট দিল জুডি। যেভাবে হোক শত্রুদের সঙ্গে বাড়াতে হবে ব্যবধান। তৃতীয় গুলিতে ওকে গেঁথে ফেলতে পারে টার্সন। চলেছে বাড়িটার পাশ দিয়ে। বাঁক ঘুরে ওদিকে মাঝারি কাঠের বেড়া দেখে ওদিকে ঝাঁপ দিল জুডি। মাটিতে পড়ল বেকায়দাভাবে চিত হয়ে। চারপাশে ভেসে উঠল একরাশ ধুলো। ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল ও। তিন সেকেণ্ড পর তাকাল ফেলে আসা পথে। শুকিয়ে গেল গলা। বাড়ি থেকে ছুটে আসছে কজন লোক। ধুলোর মেঘের কারণে কাউকে চিনল না জুডি।

উঠে পর পর তিনবার গুলি পাঠাল লোকগুলোর দিকে। হাতে ভীষণ ঝাঁকি দিয়েছে অস্ত্রটা। বুঝে গেল, ওপর দিয়ে গেছে ওর গুলি। কেউ আহত না হলেও ছত্রভঙ্গ হয়েছে। তারা। স্বাভাবিক অবস্থায় জুডি নিয়ন্ত্রণ করত শ্বাস, তারপর অস্ত্র তাক করে গুলি করত কুকুরগুলোর দিকে। তাতে মাটিতে পড়ত দুতিনজন। কিন্তু কাজ করছে না ওর মগজ। ঘুরেই দৌড় দিল। পেছনে আবার গর্জে উঠল পিস্তল। ওর বাম কানের পাশ দিয়ে গেল বুলেট। ছাউনির দরজা পেরোতে গিয়ে ভেতরে ছায়ার মাঝে দেখল বিশাল সব মেশিন। ভাবল ওখানে কাভার নেবে কি না। না, উচিত হবে না। পেছনের ওরা এসে কোণঠাসা করবে ওকে। সংখ্যায় বেশি, প্রত্যেকের কাছে পিস্তল। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

দৌড় বন্ধ করো, জুডি। ওই গলা চিনতে পারল জুডি। নির্দেশ দিলেও কণ্ঠে রয়েছে রসিকতার ছাপ।

নরকে যাও, ময়নিহান! দৌড় না থামিয়ে পাল্টা চেঁচাল জুডি। সামনেই আরেকটা বেড়া। আগেরটার চেয়ে দক্ষতার সঙ্গে টপকে গেল ও। কিন্তু মাটিতে পা দিতেই ডান পায়ের নিচে খচ্‌ করে বিঁধল কী যেন। নরম মাংস কেটে বেরোচ্ছে রক্ত। ব্যথায় মুখ বিকৃত করলেও দৌড়ে চলল জুডি।

সামনেই গরু রাখার গোয়ালঘর ও টিনের বিশাল ছাউনি। বামে বাঁক নিয়ে ছাউনি লক্ষ্য করে ছুটল জুডি। আপাতত ওকে দেখবে না পেছনের কেউ। ছাউনির বাইরে পেল পরিত্যক্ত বড় এক ট্রাক ও পুরনো শেভ্রোলে গাড়ি।পুড়ছে টেক্সাসের রোদের আগুনে। ট্রাকের ক্যাব দখল করেছে মোরগ ও মুরগির পাল। ট্রাক বা গাড়ি এতই প্রাচীন, ওসব নিয়ে পালাতে পারবে না জুডি। আড়াল নিল ট্রাকের। চোখ রাখল ছাউনির কোণে। কসেকেণ্ড পর দেখল ছুটে আসছে কেউ। তাকে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল ও। দেখে নিল কাঁধের ওপর দিয়ে। এখান থেকে সরতে হবে, নইলে ঘিরে ফেলবে তারা। তাতে খুন হবে বা ধরা পড়বে ও।

বাড়িটার কোনা লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল জুডি। শত্রুপক্ষ পিছিয়ে যেতেই কাভার থেকে বেরিয়ে দিল ছুট। চলেছে ছাউনির জানালার দিকে। তিন সেকেণ্ড পর চৌকাঠে হাত রেখে টেনে তুলল নিজেকে। লাফ দিয়ে নামল ছাউনির ভেতর। নাক কুঁচকে গেল পোড়া ধাতু ও এভিয়েশন ফিউয়েলের কটু গন্ধে। ম্লান আলোয় দেখল, বিধ্বস্ত এক এয়ারক্রাফট ও দুটো ভাঙাচোরা গাড়ি। চুরমার হয়েছে বড়জোর দুএক দিন আগে। এখনও ইঞ্জিন থেকে টপটপ করে পড়ছে মোবিল ও অকটেন।

কীভাবে এ তাণ্ডব হলো জানে না, তবে জুডি বুঝে গেল ওকে উদ্ধার করতেই হামলা করেছিল রানা। বুকে সাহস ফিরল ওর। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল, বাঁচব কী করে? কোথায় মানুষটা? ঠিক আছে তো? যতই আশা করুক, আপাতত সাহায্য পাবে না রানার কাছ থেকে।

ছাউনির সদর দরজা বন্ধ। জুডি গেল দূরের জানালার কাছে। ওটা বন্ধ হলেও ভোলা যাকে ছিটকিনি। জানালা খুলে লাফ দিয়ে ওদিকে নামল ও। কিন্তু পা পড়েছে কাদায়। নাকে এল কাঁচা গোবরের গন্ধ। ডুবে গেছে গোড়ালি। সরতে গিয়ে সড়াৎ করে পিছলে গেল। আরেকটু হলে হাত থেকে পড়ত পিস্তল। সামলে নিল নিজেকে। গোবরের মাঝ দিয়ে চলল বাড়িটার সামনে। ময়নিহান এবং তার লোক আসবে ওদিক দিয়েই।

কোনও মেশিন চালু হওয়ায় দালানে শুরু হলো ধাতব আওয়াজ। কড়াৎ শব্দ তুলল আগ্নেয়াস্ত্র, জুডিকে পাশ কাটিয়ে ছাউনির দেয়ালে, বিঁধল বুলেট। ওর মনে হলো, ইচ্ছে করেই গুলি করছে মাথার ওপর দিয়ে। চাইছে ওকে জীবিত ধরতে। তাতে বাড়তি সুবিধা পাবে ও। ঘুরেই খুঁজল টার্গেট। বাড়িটার কোণে কে যেন! দেরি হলো না গুলি পাঠাতে। বুলেট বিঁধল লোকটার বাম বুকে। ছিটকে পিছিয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ল সে। জুডি খুশি হতো ওর গুলিতে ময়নিহান মরলে। কিন্তু কাকে গুলি করেছে বোঝার উপায় নেই। প্রত্যেকের পরনে একই কালো ড্রেস।

এ-ই শেষ সুযোগ, ধমক দিল ময়নিহান, পালাতে চেষ্টা করলে গুলি করা হবে।

পাত্তা না দিয়ে হালকা পায়ে আরেকটা বেড়া টপকে গেল জুডি, ছুটল ছাউনির কোনা ঘুরে। কিন্তু তখনই মুখোমুখি ধাক্কা লাগল একজনের সঙ্গে। এইমাত্র একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে সে।

তাল সামলে তার দিকে তাকাল জুডি। ভেবেছে গুলি করবে শত্রুপক্ষ, কিন্তু তা নয়। এ ন্যাশ ময়নিহানের কেউ নয়, মাঝারি আকৃতির এক মহিলা। পরনে সাদা ব্লাউস, ব্লেযার ও জিন্সের প্যান্ট। দেখলে মনে হয় মহিলা পুলিশ। কিন্তু তার সাদা ব্লাউস ভরা রক্তের ছিট-ছিট দাগ। দুহাত চট চট করছে রক্তে। জুডির জানার কথা নয়, ওয়াল্টার হেইন্সের লাশ টুকরো করার দায়িত্ব যেচে ময়নিহানের কাছ থেকে নিয়েছে মারি কিটন। নিজ কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, এমনসময় বুঝল কাছেই হাজির হয়েছে কেউ। জুডিনা জানলেও ময়নিহানের লোকদের ভেতর ভয়ঙ্করতম খুনি মারি কিটন।

দুজনই একইসময়ে বুঝল, ওরা আছে বিপদে। ট্রিগারে চাপ বাড়াল জুডি। কিন্তু বিদ্যুদ্বেগে নড়ল মারি। ঝট করে সরে গেছে বামে, পরক্ষণে লাথি মারল জুডির কবজির ওপর। দূর দেয়ালে বিঁধল গুলি। থাবা দিয়ে পিস্তল কেড়ে নিল মারি। পাথরের মত শক্ত বামহাতে চড় মারল জুডির গালে। চোখের সামনে কালো চাদর দেখছে ও। পেছাতে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল মাটিতে। এক সেকেণ্ড পর পিস্তলটা ঘুরিয়ে ওর দুই চোখের মাঝে তাক করল মারি কিটন।

ও, তুই সেই বেশ্যা, যাকে ফেরত চাইছে মাসুদ রানা? টিটকারির হাসি হাসল মারি। কিন্তু দুঃখের কথা, মরে গেলে তোকে দিয়ে ওর কোনও কাজ হবে না।

এত বিপদেও স্বস্তি পেল জুডি। রানা বেঁচে আছে।

 ট্রিগারে চাপ দিচ্ছে মারি কিটন।

মারি, থামো, জুডির পেছন থেকে নির্দেশ দিল ন্যাশ ময়নিহান।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গ্লক নামিয়ে নিল মহিলা।

ঘাড় ফিরিয়ে ময়নিহানের দিকে তাকাল জুডি।

লোকটার কানে মোবাইল ফোন। কথা বলছে কার সঙ্গে যেন। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। কসেকেণ্ড পর বলল, ওকে, রানা, দেখা হবে একঘণ্টা পর।

.

৩৪.

 কল কেটে মোবাইল ফোন পকেটে রাখল রানা। তিক্ত হয়ে গেছে মন। ওর পাশে উইণ্ডস্টার গাড়ির পেছন সিটে বসে আছে নিনা ভেঞ্চুরা। সামনের সিটে জন হার্বার্ট। ড্রাইভ করছে বাড হিগিন্স। জুডির মোবাইল ফোন ট্রেস করে কেবিনে হামলা করতে পারে ময়নিহানের খুনেরা, তাই পাইলট পয়েন্টের রাস্তায় ঘুরছে ওরা।

আমাদের উচিত এফবিআই-এর সাহায্য নেয়া, তৃতীয়বারের মত বলল নিনা।

আগেও মানা করেছে রানা। এবারও যুক্তি দিয়ে বোঝাল, কেন আইনী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা অনুচিত হবে।

আপনার জন্যে মানুষ খুন করেছি, নিনা, বলল রানা। এখন পুলিশ বা এফবিআইকে জড়ালে বাকি জীবন থাকব জেলে।

মরে যাওয়ার চেয়ে জেলে থাকা ভাল, নাক ফুলিয়ে বলল নিনা ভেঞ্চুরা।

সেটা সবার জন্যে নয়, বলল রানা। জুডিকে ছুটিয়ে আনার একটা পরিকল্পনা করেছে ও। কাজটা কঠিন। তবে তাতে সম্ভাবনা আছে সফল হওয়ার। সেজন্যে মৃত্যুও হতে পারে নিনার। তার কারণেই আজ এত বড় বিপদে পড়েছে। জুডি, তাই ওর উচিত ছোটবোনকে বাঁচাতে ঝুঁকি নেয়া। রওনা হ ময়নিহান র‍্যাঞ্চের দিকে, বাডকে বলল রানা।

পুব লিবার্টি স্ট্রিট ধরে শহর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। উত্তরদিকের হাইওয়েতে উঠে চলল গ্রেসন কাউন্টির দিকে। তবে একটু পর ধরল সরু এক শাখা রাস্তা। চলেছে ময়নিহান র‍্যাঞ্চের দিকে। আবারও শুরু হলো প্রত্যন্ত এলাকা। একটা-দুটো কাঠের বাড়ি, আশপাশে ছোট-বড় ঘাসজমি, এখানে-ওখানে নানান গাছ ও ঝোপঝাড়। আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর পৌঁছে গেল ওরা অ্যাম্বুশ করা সেই এলাকায়। শহরে জনাকীর্ণ জায়গায় জিম্মি বদল হলে ভাল হতো, কিন্তু সেক্ষেত্রে হয়তো শুরু হতো দুপক্ষের গোলাগুলি। এসব ভেবেই রানা ওর প্ল্যানে রেখেছে এই প্রেয়ারি। যা হবে, কোনও সাক্ষী থাকবে না তার।

ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যা, এমনসময় প্রথমবারের মত থামল ওরা। আশপাশে বাড়িঘর নেই। মাঠে চরছে এক পাল লংহর্ন গরু ও ষড়।

গাড়ি থেকে নেমে কোমর সমান উঁচু ঘাসের মাঠে হারিয়ে গেল জন ও বাড। গাড়ি নিয়ে রওনা হলো রানা। পেছনের সিটে চোখ বুজে ফ্যাকাসে মুখে বসে আছে নিনা ভেঞ্চুরা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

সব ঠিক থাকলে আগামী একঘণ্টার ভেতর ফেরত পাব জুডিকে, আশ্বস্ত করতে চাইল রানা।

যদি সব ঠিক না থাকে? গলা কেঁপে গেল মেয়েটার।

সেক্ষেত্রে মারা পড়ব আমরা। তবে সে সম্ভাবনা কম। যা করতে বলেছি, সেটা করলে ঝুঁকি অনেকটাই কমবে।

আমাকে দেখেই যদি খুন করে ময়নিহান?

মৃদু হাসল রানা। তা হলে ওকে খুন করব আমি।

সেটা তো খুব আনন্দের কথা, বিড়বিড় করল নিনা।

তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনাকে গুলি করবে না। আগে চাইবে ক্যামেরার রেকর্ড করা দৃশ্য মুছে দিতে। গুলি না করার আরেকটা কারণ, আপনার বা আমার কাছে রয়ে যেতে পারে ভিডিয়োর কপি। আগে নিশ্চিত হতে হবে তাকে।

অত্যন্ত বিপজ্জনক লোক। খুশি হয় খুনোখুনি হলে। কে জানে, হয়তো মজা পেতেই খুন করবে। তারপর দেখতে চাইবে আপনি কী করেন।

সেক্ষেত্রে নিজেও বাঁচবে না সে।

আপনি খুব আত্মবিশ্বাসী মানুষ, বলল নিনা। জানলেন কী করে আপনি তাকে মেরে ফেলার আগেই আপনাকে সে খুন করবে না?

এটা নিশ্চিত হতে পারবে না কেউই, বলল রানা। তবে আগেও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। ন্যাশ ময়নিহান শহুরে মস্তান। নিরীহ কিছু মানুষকে খুন করেছে বলে ভাবছে যা খুশি করতে পারবে। তার ধারণা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মনে হলো না রানার কথা শুনে স্বস্তি পেল নিনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার বড়ভাইও পুলিশ ছিল। পরে যোগ দেয় আপনার ডিটেকটিভ এজেন্সিতে। কিন্তু করুণভাবে মরতে হয়েছে ওকে। আমরাও হয়তো বাঁচব না।

হয়তো, বলল রানা। কেউ জানে না পরের সেকেণ্ডে বেঁচে থাকবে কি না। রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল ও।

চোখ বিস্ফারিত করে ওকে দেখছে নিনা। বুঝে গেছে, কী বলা হয়েছে ওকে।

গাড়িতে নামল নীরবতা।

একমাইল যাওয়ার পর চওড়া এক গেটের সামনে থামল রানা। আগেরবার এপর্যন্ত আসতে পারেনি। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ। গেটের ওদিকে নেই কোনও নড়াচড়া। ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার। দীর্ঘ হয়েছে প্ৰেয়ারিতে ছায়া। গেট পেরোলে দূর দিগন্তের ওদিকে কোথাও ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ হাউস।

নিনার দিকে ঘুরে তাকাল রানা।

মেয়েটার চোখে পানি। নিচু গলায় বলল, কখনও ভাবতেও পারিনি এমন বিপদে পড়বে জুডি।

মনে সাহস রাখুন, নিনার হাতে মৃদু চাপড় দিল রানা। দেখবেন, বড় কোনও বিপদ হবে না।

জুডিকে ফিরে পেলেই আর কিছু চাই না।

ঘুরে গেটের ওদিকে তাকাল রানা। আরেকবার চেক করল ওয়ালথার। মনে মনে তৈরি লড়াইয়ের জন্যে। মনে রাখবেন, যা যা বলেছি, ঠিক তাই করবেন।

তর্ক করল না নিনা। ঠিক আছে।

 উইণ্ডস্টার সামনে বাড়াল রানা। গেটের ওদিকে ন্যাশ ময়নিহানের জমি। সিকি মাইল যাওয়ার পর গাড়ি রাখল ও। নেমে পড়ে খুলে দিল পেছনের দরজা। নিনাকে সাহায্য করল বেরিয়ে আসতে। দুজনই ওরা জানে, ঘনিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর বিপদ।

সামনে থেকে এল ইঞ্জিনের আওয়াজ।

এবার চাই ভাল অভিনয়। খপ করে নিনার জ্যাকেটের কলার চেপে ধরল রানা। হিঁচড়ে নিয়ে চলল মেয়েটাকে। থামল গাড়ির সামনে। ঘাড় ধরে নিনাকে বসিয়ে দিল মাটিতে। হাঁটু গেড়ে এদিক-ওদিক দেখছে মেয়েটা। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে মাথার দিকে ওয়ালথার তাক করল রানা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে নিনা। কনভয় তৈরি করে আসছে তিনটে গাড়ি। থেমে গেল এক শ গজ দূরে। হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নামল বেশ কজন। তাদের ভেতর পাহাড়ের মত বিশাল এক লোককে দেখল রানা। মালিকের কাছে ফিরেছে তা হলে রিক বেণ্ডার।

বাড কমপিউটারে ছবি দেখালেও আগে সামনা-সামনি ন্যাশ ময়নিহানকে দেখেনি রানা। রিক সহ তারা পাঁচজন। থামল কনভয়ের প্রথম গাড়ির সামনে। প্রত্যেকের পরনে কালো মিলিটারি গিয়ার। তাদের মাঝে হালকা-পাতলা এক মেয়েকেও দেখল রানা। ভেবেছিল জুডি। কিন্তু এক সেকেণ্ড পর বুঝল ভুল ভেবেছে,। ওই মহিলা জুডির মত লম্বা নয়। নড়াচড়ার ভঙ্গি ছোবল মারতে উদ্যত কেউটের মত। অন্য তিনজনের হাতে অস্ত্র। পঞ্চমজনের দুইহাত পেটের ওপর। যেন প্রার্থনা করছে। রানা ধারণা করল, ওই লোকই ন্যাশ ময়নিহান।

নিনা ভেঞ্চুরাকে এনেছি, ময়নিহান, গলা ছাড়ল রানা, জুডিকে দেখাও। নইলে এক গুলিতে ফুটো করব এর মগজ।

দূর থেকে পাল্টা চেঁচাল লোকটা, রানা? ভাবছ, ধরে নেব যে নিনা ভেঞ্চুরাকে গুলি করবে তুমি?

এই কুত্তীর জন্যেই এত ঝামেলা। কাজেই বিশ্বাস করো বা না করো, এ মরে গেলে আমার কিছুই যায় আসে না!

কপা সামনে বাড়ল ন্যাশ ময়নিহান। দুপাশে একটু ছড়িয়ে গেল অন্যরা। দুপাশ থেকে রানার দিকে রাইফেল তাক করেছে দুই লোক।

আমার পরনে কেভলার জ্যাকেট, বলল রানা, তোমার লোক একটা গুলি করলে সঙ্গে সঙ্গে নিনা ভেঞ্চুরাকে শেষ করে দেব।

দলের সবাইকে অস্ত্র নামাতে হাতের ইশারা করল ন্যাশ ময়নিহান।

জুডি কোথায়? ওকে দেখাও!

দ্বিতীয় গাড়ির পাশে গেল রিক বেণ্ডার। দরজা খুলে বের করে আনল কাউকে। মরা আলোয় রানা দেখল, রিকের হাত থেকে ঝটকা দিয়ে ছুটতে চাইছে কেউ।

হ্যাঁ, জুডি।

ওকে কাঁধে তুলে নিল দানব। ব্যবহার করছে বর্ম হিসেবে। ফিরে এসে থামল ময়নিহানের পাশে। কাঁধের ওপর দিয়ে রানার দিকে তাকাল জুডি। এতটা দূরে হলেও রানা দেখল, বিস্ফারিত হয়েছে বেচারির দুচোখ। পাগল হয়ে উঠল রিকের কাঁধ থেকে নামার জন্যে। ছটফট করছে গলা কাটা মুরগির মত। মুখের ভেতর রুমাল, কিন্তু গলা থেকে বেরোল গোঙানি। গালি দিয়ে ভূত বিদায় করছে। রানার। স্বাভাবিক, ওর বোনের মাথায় পিস্তল ধরেছে বাঙালি যুবক!

শুয়োরের পালে ফিরেছ, তাই না, বেণ্ডার? জোর গলায় বলল রানা। অবাক হইনি!

ন্যাশ ময়নিহানের দিকে তাকাল রিক বেণ্ডার। জবাবে কিছু বলল না টপ টেরর। রানাকে বামহাতের মধ্যমা দেখাল দানব।

জিম্মি কীভাবে বদল করতে চাও, রানা? জানতে চাইল ময়নিহান।

জুডিকে পাঠাবে আমার দিকে। ও যখন মাঝপথে পৌঁছে যাবে, আমি ছেড়ে দেব নিনাকে।

না। একইসময়ে রওনা হবে দুজন।

ঠিক আছে। জুডি এগোতে থাকুক।

ওই ক্যামেরা কোথায়?

জ্যাকেটের পকেট থেকে ক্যামেরা নিয়ে দেখাল রানা। এই যে তোমার জিনিস। কথাটা শেষ করেই, ডানদিকের ঘাসভরা মাঠে ক্যামেরা চুড়ল ও। এখনই ক্রিটিকাল মুহূর্ত। এবার যে-কোনও সময়ে গুলি করবে শত্রুপক্ষ। কিন্তু রানা ভাবছে সে সম্ভাবনা কম। কারণ, আগে ময়নিহানের বুঝতে হবে, ওই ক্যামেরায় ভিডিয়োটা আছে কি না। হতে পারে, ওটা নকল জিনিস। অন্য কোথাও আছে আসল ক্যামেরা ও ভিডিয়ো।

ধরে নিচ্ছি, ভিডিয়োর কপি করেছ, বলল ময়নিহান। পরে হয়তো ওটা ব্যবহার করবে আমার বিরুদ্ধে?

জবাবে বলল রানা, ওই ক্যামেরা বা ভিডিয়ো নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার! এই কুত্তীটাকে নিয়ে কী করবে, বা কোথায় লুকাবে প্রমাণ, সেসব তোমার ব্যাপার! দেরি না করে পাঠাও জুডিকে। আমরা সরে যাওয়ার পর নিনার কী হলো, সেটা নিয়ে ভাবতেও যাব না।

নীরবে কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল ময়নিহান। তারপর মুখ তুলে তাকাল রানার দিকে। ঠোঁটে ফুটে উঠল হাঙুরে হাসি। মৃদু মাথা দোলাল রিক বেণ্ডারের উদ্দেশে। কাঁধ থেকে জুডিকে নামাল দানব। একটু ঝুঁকে কী যেন বলল মেয়েটার কানে। রানার সাধ্য নেই যে অত দূর থেকে শুনবে। ঘুরে ওর দিকে তাকাল জুডি। চোখে গনগনে আগুন ও হতাশা। আরও কী যেন ওর মুখে। চেয়ে আছে রানার চোখে।

হ্যাঁচকা টানে নিনাকে দাঁড় করাল রানা। এখনও মাথায় ঠেকিয়ে রেখেছে ওয়ালথারের নল।

পেরোতে লাগল ভীষণ অস্বস্তিকর ক্ষণ।

আধমিনিট পর জুডিকে সামনে ঠেলল ময়নিহান। একই কাজ করল রানা। এক পা এক পা করে পরস্পরের দিকে চলেছে জুডি ও নিনা।

নিনার মেরুদণ্ড লক্ষ্য করে ওয়ালথার তাক করে রেখেছে রানা। আসল ক্যামেরা পাবে কি না জানে না, তবে চুপ করে আছে ময়নিহান। আরও কপি আছে কি না সে ব্যাপারেও মন্তব্য করল না। রানা জানে, আপাতত ও নিজে আছে অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে। নিনা মরলে ময়নিহানের মহা বিপদ। হয়তো কোথাও রয়ে গেছে ভিডিয়োর কপি।

রানার উদ্যত পিস্তল দেখে জুডির পিঠে নিজেদের রাইফেলের নল তাক করল ময়নিহানের লোক। কামানের মত ডের্ট ঈগল তাক করেছে রিক বেণ্ডার। ওটা দিয়েই ফেলে দিয়েছিল কপ্টার। দেহের পাশে হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে টপ টেরর। মুখে স্থির হাসি। দেখছে। পরস্পরের দিকে হেঁটে চলেছে দুই বোন।

মনে রাখবেন কী করতে হবে, নিচু গলায় নিনাকে বলল রানা। জবাবে দুই কাধ আড়ষ্ট করল নিনা। ফুঁপিয়ে উঠল ভয়ে। এখন অভিনয় করছে না।

কাছাকাছি পৌঁছে গেছে দুই বোন। জুডির চেহারা দেখছে রানা। প্রচণ্ড রেগেছে মেয়েটা। সেইসঙ্গে চোখে ভয়। নিশ্চয়ই একই হাল নিনার। পরস্পরের দিকে তাকাল তারা।

জুডি, হাঁটতে থাকো, মনে মনে বলল রানা। নইলে মুখ থুবড়ে পড়বে আমার প্ল্যান!

নিনার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রানার দিকে তাকাল জুডি। কঠোর চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে রানা। এ ছাড়া উপায়ও নেই ওর। ধোঁকাটা ধরা পড়লে প্রাণে বাঁচবে না ওরা কেউ।

হাঁটার গতি বাড়াল জুডি ও নিনা। কমে এল দুজনের ব্যবধান। মুখে রুমাল, তবুও কথা বলতে চাইল জুডি।

পরস্পরকে জড়িয়ে না ধরলে বাঁচি, ভাবল রানা।

সোজা হেঁটে যাও, জুডি, তাড়া দিল ময়নিহান, কোনও কথা নয়। পাশ কাটিয়ে যাবে তোমরা।

ময়নিহানের কথা শুনেছ, নিনা, ধমকের সুরে বলল রানা। বোনকে বাঁচাতে হলে ওর কথা শোনো। রানার দিকে তাকাল জুডি। ফুলে গেছে নাক। এমনই ছিল ওর বড়ভাইয়ের নাকটাও। দূর থেকে শুনতে পেল রানা, মুখে রুমাল থাকলেও গোঁ-গোঁ আওয়াজ তুলে কিছু বলতে চাইছে জুডি।

দুই বোনের মাঝে এখন দশ ফুট ব্যবধান।

 বোনের দিকে সরে যেতে লাগল জুডি।

তাতে ঘন-ঘন মাথা নাড়ল নিনা। বুঝিয়ে দিতে চাইছে, উচিত হবে না কাছে আসা।

পাঁচ ফুটের ভেতর পৌঁছে যেতেই পরস্পরের চোখে তাকাল ওরা।

আর তিন ফুট…

 দুই…

 এক…

চিৎকার করে সতর্ক করতে চাইল রানা, কিন্তু সেটা করলে চমকে গিয়ে গুলি পাঠাবে ময়নিহানের লোক। ওর মনে হলো, পেরোচ্ছে জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ মুহূর্ত।

পরের সেকেণ্ডে সরেই জুডিকে জড়িয়ে ধরল নিনা। ধুপ করে পড়ল মাটিতে। ওখানে থামল না নিনা, জুডিকে নিয়ে গড়িয়ে গিয়ে পড়ল অগভীর নালায়। একইসময়ে সামনে বেড়ে দ্রুত ট্রিগার টিপতে লাগল রানা।

পুরো দেড় সেকেণ্ড পর ময়নিহানের লোক বুঝল, তাদের উচিত পাল্টা গুলি করা।

ঘুরেই রাইফেল কাঁধে তুলল দুইজন। কিন্তু এঁকেবেঁকে দৌড় দিয়েছে রানা। গুলি পাঠাল শত্রুদের উদ্দেশে। এত দূর থেকে পিস্তলের বুলেট লাগলে বলতে হবে নেহায়েত কপালের জোরে লেগেছে। অবশ্য, ভয় পেয়ে ছিটকে সরল লোকগুলো। রানার আশপাশ দিয়ে গেল গুলি। এখনও রানার থেকে ত্রিশ গজ দূরে জুডি ও নিনা। নালার ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে উইণ্ডস্টার গাড়ির দিকে। আধ সেকেণ্ড পর ওদিকে অস্ত্র তাক করল ময়নিহানের খুনিরা।

খবরদার! নিনা ভেঞ্চুরাকে খুন করবে না! ময়নিহানের চিৎকার শুনল রানা।

নতুন এই তথ্য পেয়ে থমকে গেছে সবাই।

নিজে তাদের দিকে গুলি পাঠাল রানা। ওর দুটো গুলি বিঁধল ময়নিহানের পেছনের গাড়িতে। দুই লাফে ওই গাড়ির আড়ালে সরল টপ টেরর। তাকে খুন করার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি রানার জন্যে জুডি ও নিনাকে সরিয়ে নেয়া। রাস্তা থেকে নেমে পড়ল ও। শুকনো মৌসুমে খটখট করছে নালা। ঝড়ের বৈগে সামনে বেড়ে খুনিদের উদ্দেশে গুলি করছে রানা।

ছড়িয়ে পড়েছে ময়নিহানের ভাড়াটে খুনিরা।

হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে অ্যাসল্ট রাইফেল কাঁধে তুলল লম্বা এক লোক। সাইটে পেয়ে গেছে রানাকে।

কিন্তু তখনই চুরমার হলো লোকটার মাথা। চারদিকে ছিটিয়ে গেল মগজ, খুলির টুকরো ও রুক্ত। উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল লাশ। আধ সেকেণ্ড পর প্রেয়ারি থেকে এল এম টোয়েন্টিফোর স্নাইপার রাইফেলের গর্জন।

ঠিক জায়গায় পযিশন নিয়েছে জন ও বাড, ভাবল রানা। গলা উঁচিয়ে বলল, জুডি, নিনা, জলদি এসো!

দৌড় থামিয়ে ময়নিহানের আরেক খুনির দিকে গুলি পাঠাল রানা। পেশিবহুল সে, কিন্তু পেশি ঠেকাতে পারল না প্রচণ্ড গতির বুলেট। এক পা পিছিয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ল লোকটা। গড়ান দিয়ে এড়িয়ে গেল রানার পরের গুলি। উঠে বসে অ্যাসল্ট রাইফেলের নল তাক করেই টিপে দিল ট্রিগার। আগেই মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রানা। ওর মাথার ওপর দিয়ে গেল একরাশ বুলেট। প্রাণের ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল জুডি ও নিনা। উড়ন্ত ধুলোর মাঝ দিয়ে ওদিকে তাকাল রানা। আবারও নালায় শুয়ে পড়েছে মেয়েরা।

জলদি ওঠো! নির্দেশ দিল রানা, থাকবে কাছাকাছি। ময়নিহান চায় নিনা বেঁচে থাকুক। গুলি করবে না কেউ।

কিন্তু ওর নিজের কপাল অতটা ভাল নয়। এক পশলী গুলি পাঠাল পেশিবহুল লোকটা। রানার চারপাশে বিধছে বুলেট। ছিটকে উঠছে ছেঁড়া ঘাস। মুখে ঠাস্ করে লাগল মাটির চাপড়া। চোখ বাঁচাতে পাতা বুজে ফেলল রানা। কিন্তু পরের সেকেণ্ডে শুনল প্ৰেয়ারিতে বজ্রপাতের মত আওয়াজ। গর্জে উঠেছে ইপার রাইফেল। থেমে গেল এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল। মাথা তুলে রানা দেখল, উপুড় হয়ে পড়ে আছে শক্তপোক্ত লোকটা, বুলেটের আঘাতে প্রায় উড়ে গেছে। তার ঘাড়।

সরে যেতে হবে এখান থেকে, বুঝে গেছে রানা। একটা একটা করে গুলি পাঠাচ্ছে রিক বেণ্ডার। আওয়াজটা কামানের গোলাবর্ষণের মত। পাশে টাশ-টাশ শব্দ তুলছে ময়নিহানের পিস্তল। গাড়ির ওদিক থেকে গুলি করছে দুজন। কিন্তু গাড়ি ভেদ করে জন ও বাডের উইনচেস্টারের গুলি ঢুকতেই লাফিয়ে অন্য কাভার খুঁজল ময়নিহান ও রিক।

প্রাথমিক শক কেটে যেতেই পুলিশ ট্রেনিং মনে পড়েছে জুডির। বড়বোনকে টেনে তুলে দৌড়ে এল রানার দিকে। ওদেরকে কাভার দিতে শত্রুপক্ষের দিকে গুলি পাঠাল রানা। ময়নিহানের গাড়ির কাছে রয়ে গেছে এক লোক। বেতের মত সরু। নানান দিকে সরে এড়াতে চাইছে গুলি। পাল্টা গুলি পাঠাল সে।

রানা সরে যাওয়ার আগেই একটা বুলেট ভেদ করল ট্রেপেইযিয়াস মাংসপেশি। ওর মনে হলো, খেয়েছে গর্দভের লাথি। কপাল ভাল, ও ডানহাতি। অসুবিধে হবে না গুলি পাঠাতে। কিন্তু ঘাড়ের কাছটায়, যেন দাউদাউ আগুন ধরে গেছে।

গাড়িতে উঠে মাথা নিচু রাখবে! জুডিকে বলল রানা। বড়বোনকে টেনে আনছে মেয়েটা। একটু আগের সেই ভাব আর নেই জুডির চোখে। সেখানে কৃতজ্ঞতা ও দুশ্চিন্তা। দেখছে, রানার জ্যাকেটের কলারকে পাশ কাটিয়ে কুলকুল করে নামছে রক্ত। তাড়া দিল রানা, আমি ঠিক আছি, গিয়ে গাড়িতে ওঠো!

একটা অস্ত্র দাও, বলল জুডি। পাশে লড়তে পারব।

তার চেয়ে চট করে নিনাকে তোলো গাড়িতে।

চিকন লোকটা আর যুবতী হাঁটু গেড়ে বসেছে মাটিতে। হাতের অস্ত্র সরাসরি তাক করেছে রানার বুকে। কিন্তু তাদের লাইন অভ ফায়ারে চলে এল জুডি ও নিনা। নিনার গায়ে লাগবে, সেই ভয়ে গুলি করতে পারছে না রানাকে। নির্দিষ্ট অ্যাংগেল বজায় রেখে পেছাতে শুরু করেছে রানা। শত্রুপক্ষের দুজনকে ওয়ালথারের সাইটে রেখেছে, তবে পাঠাচ্ছে না গুলি। আশপাশে দেখল না ময়নিহান বা রিক বেণ্ডারকে। জন বা বাড গুলি শুরু করতেই কাভার নিয়েছে তারা।

খেলা খতম, ময়নিহান! নীরবতা ভাঙল রানা। ভুলে যাও আমাদের কথা। থাকল ক্যামেরা। ভেবো না ক্ষতি করব। নিনাকেও আর দরকার নেই তোমার।

বোগাস কথা বলেছে, রানা নিজেই জানে। খেলা খতম নয়। ওদেরকে খুন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করবে ন্যাশ ময়নিহান।

তবে আপাতত আর চাইবে না খুন করতে।

উইণ্ডস্টারের পেছনের সিটে উঠল নিনা ও জুডি। এক সেকেণ্ড পর ড্রাইভিং সিটে চাপল রানা। অ্যাক্সেলারেটরে চাপ দিয়ে চরকির মত ঘুরিয়ে নিল গাড়ি। রওনা হলো গেটের দিকে। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল, ময়নিহানের গাড়িবহরের সামনে থেমেছে চারজন। কেউ অস্ত্র তুলল না ওদের গাড়ির দিকে।

দূর থেকে এল অমানুষিক গর্জন। রানার মনে হলো, ওটা ছেড়েছে রিক বেণ্ডার। আনমনে ভাবল: হ্যাঁ, শেষ হইয়াও হইল না শেষ!

তীরের বেগে ময়নিহান র‍্যাঞ্চের গেট পেছনে ফেলল গাড়ি। আগে প্রথমবার যেখানে থেমেছে, দুমিনিটে পৌঁছে গেল ওখানে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল রানা, তারপর দীর্ঘ ঘাসের মাঠ থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে পৌঁছে গেল জন ও বাড। এখানেই ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে গেছে রানা। দুই বন্ধুর হাতে রাইফেল। বাড উঠে পড়ল গাড়ির সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে। পেছনের সিটে নিনা ও জুডির পাশে বসল জন। পেছনের সিটের ওদিকে লাগেজ কম্পার্টমেন্টে রাখল বাডের আনা এম টোয়েন্টিফোর স্নাইপার রাইফেল। কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল। কাজটা শেষ হতেই গাড়ির তুমুল গতি তুলল রানা। ফিরে চলৈছে লেকের পাশের কেবিন লক্ষ্য করে।

হায় হায়, রানা, তোর তো গুলি লেগেছে! রানাকে বলল বাড। গাড়ি রাখ। আমি ড্রাইভ করছি।

কিছুই হয়নি… দাঁতে দাঁত চেপে বলল রানা। বলেছে ডাহা মিথ্যা। ব্যথা প্রচণ্ড। চোখের কোণে আসছে কালো সব ছায়া।

রাখ তো, রানা! ওর কানের কাছে ধমক দিল জন।

আগে সরি ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ থেকে। ওরা পিছু নিতে পারে।

তুই রওনা হওয়ার পর গাড়িতে উঠেছিল, কিন্তু তারপর ফিরে গেছে র‍্যাঞ্চে, বলল জন, যাতে তাড়াতাড়ি যায়, সেজন্যে গোটা দশেক গুলি পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। তবে কারও গায়ে লেগেছে বলে মনে হয় না।

ঘুরে পেছনে তাকাল জুডি। ফাঁকা পড়ে আছে রাস্তা। অবশ্য, এর মানে এই নয়, পিছু নিয়ে আসছে না কেউ। রানা, জন ও বাডের আকস্মিক হামলায় হতভম্ব হয়েছে ময়নিহান। বিশেষ করে কাজে এসেছে এম টোয়েন্টিফোর স্নাইপার রাইফেল। কিন্তু যখন বুঝবে আশপাশে নেই স্নাইপার, লোকটা চাইবে পিছু নিতে। দেরি হবে না দলবল নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে। তা ছাড়া, পাগল হয়ে উঠবে রিক বেণ্ডার। এরই ভেতর বুঝে গেছে, বোকা বনেছে সে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ধাওয়া করে ছুটে আসবে।

প্রথম সুযোগেই ওদেরকে ফেলে দেয়া উচিত ছিল, বলল জন।

উদ্দেশ্য ছিল আমাদের ভিন্ন, বলল রানা।

তা ঠিক। জুডি ও নিনাকে দেখছে জন।

সরি, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দিয়ে ফেললাম, জুডি ও নিনাকে বলল রানা। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল না।

যা হওয়ার হয়েছে, বড় কথা আমরা বেঁচে আছি, বলল নিনা। তাকাল ছোটবোনের দিকে।

মৃদু মাথা দোলাল জুডি। ওকে জড়িয়ে ধরল নিনা।

অবশ্য, পাঁচ সেকেণ্ড পর বড়বোনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল জুডি। সাবধানে স্পর্শ করল রানার ঘাড়ের ক্ষত। নরম ও উষ্ণ আঙুল লাগতেই শিউরে উঠল ক্লান্ত রানা। পরক্ষণে শুনল জুডির ভেজা কণ্ঠ: মাসুদ রানা, আবারও যদি দেখি এমন ঝুঁকি নিয়েছ, খোদার কসম, আমি নিজেই গুলি করে মারব তোমাকে! ফুঁপিয়ে উঠে কান্না চাপল ও।

চুপ করে আছে রানা। গত কদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রম, ঘুমের অভাব আর আহত ঘাড়ের ব্যথায় আস্তে করে বুজে গেল ওর চোখ। জোর করে খুলল পাতা।

কিছুক্ষণ হলো ওকে লক্ষ করছে বাড। নিচু গলায় বলল, এবার গাড়িটা রাখ, রানা। নইলে ময়নিহান যা পারেনি, তুই পারবি। ঝড়ের বেগে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পাঠিয়ে দিবি আমাদের সবাইকে স্বর্গের মেইন গেটে!

লজ্জা পেয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামাল রানা। নেমে পড়ল ড্রাইভিং সিট থেকে। ড্রাইভারের সিটে উঠল বাড। প্যাসেঞ্জার সিটে চাপল জন, হাতে শটগান। জুডি পেছনের সিট থেকে নামতেই মাঝের সিটে ঠাই হলো রানার।

আবারও রওনা হলো গাড়ি।

জুডি ও নিনার মাঝে সমাসীন হয়েছে রানা। দুপাশে যেন আরামদায়ক দুই গদি। ঝিমাতে শুরু করল ও। টের পেল, সাবধানে খোলা হচ্ছে ওর জ্যাকেট ও শার্ট।

সুন্দরী রাগলে নাকটা এত ফোলে কেন, ভাবতে গিয়ে আনমনে হাসল রানা। পরক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ল জুডির কাঁধে মাথা রেখে।

.

কতক্ষণ অচেতন থেকেছে, জানে না রানা। হঠাৎ করেই জেগে উঠল। চোখের পাতা সামান্য খুলে আবছা আলোয় দেখল এদিক-ওদিক। আছে লেকের তীরের সেই কেবিনে। প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ওকে খাইয়ে দেয়া হয়েছে ব্যথার ওষুধ। ঝিমঝিম করছে মাথা। শরীরের বামদিক অবশমত। ডানহাতে বামকাধ স্পর্শ করল। দক্ষতার সঙ্গে ক্ষতের ওপর ব্যাণ্ডেজ বেঁধেছে কেউ। যাতে অন্ধকারে ওকে থাকতে না হয়, তাই জ্বেলে দেয়া হয়েছে বাথরুমের বাতি। বাইরে কয়েকজনের গলার মৃদু আওয়াজ।

রানার পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। বিছানায় উঠে বসে চারপাশ দেখল ও। পাশের চেয়ার থেকে জিন্সের প্যান্ট নিয়ে নেমে পড়ল খাট থেকে। ভীষণ টলে উঠল একবার। তাল সামলে সাবধানে পরল প্যান্ট। ভদ্রস্থ হওয়ার পর ধীর পায়ে গিয়ে খুলল কেবিনের দরজা। বাইরে লেকের তীরে বসে আলাপ করছে জন, বাড, জুডি ও নিনা। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাল ওরা। চারজনের মধ্যে জ্বলছে ধিকিধিকি আগুন। ডিনারে বসেছে ওরা। বার্গারের ঘ্রাণ নাকে আসতেই বমি এল রানার। কয়েকবার ঢোক গিলে সামলে নিল নিজেকে।

নিনার আনা পোশাক পরেছে জুডি। দুবোনের চেহারায় এতই মিল, রানার কয়েক সেকেণ্ড লাগল ওদেরকে আলাদা করতে। চট করে উঠে ওর দিকে এগিয়ে এল জুডি। ওকে দেখছে জন, বাড ও নিনা। তারপর আবারও মজে গেল আলাপে।

রানার সামনে পৌঁছে নরম সুরে বলল জুডি, তোমার চাই অনেক ঘুম।

প্রায় সেরে গেছি, বলল রানা।

ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ করা হয়েছে। তবে বিশ্রাম নিতে হবে। চলো, শুয়ে পড়বে। আলতো হাতে রানাকে কেবিনের দিকে ঠেলল জুডি।

অনেক কাজ পড়ে আছে, তা ছাড়া…

হ্যাঁ, আছে, তবে সেসব পরে করলেও হবে।

রানা খেয়াল করল, ফুলে আছে জুডির চোখের পাতা। কেঁদেছে অনেক। সুস্থ কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে কেবিনের দিকে নিয়ে চলল মেয়েটা। আপত্তি করে লাভ হবে না বুঝে সুবোধ বালকের মত হাঁটছে রানা। কেবিনে ঢুকে বিছানার পাশে থামল ও।

শুয়ে পড়ো, নরম সুরে বলল জুডি। চোখে টলমল করছে অশ্রু। প্রথমে ভেবেছি আমার জন্যে নিনার ক্ষতি করবে তুমি। তখন তোমার প্রতি মনে এসেছিল ভীষণ বিরূপ ভাব। …তারপর…।

অমন না করলে…

পরে বুঝেছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েছ নিনা আর আমার জন্যে। ভাবতেও পারিনি কেউ এত নিঃস্বার্থভাবে… চুপ হয়ে গেল জুডি। একটু পর বলল, তোমার ওপর রাগ করেছি বলে এখন ঘৃণা করতে ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে।

প্রাণপণে ঘৃণা করো, কিন্তু সুন্দর নাকটা ওভাবে ফুলিয়ো না তো, বাপু, ভাবল রানা। মুখে বলল, এখন তো আর ঘৃণা নেই?

একটু আছে।

আমার এবারের অপরাধ?

আমাকে দিয়ে ঘৃণা করিয়েছ, সেজন্যে তোমাকে ঘৃণা করি। গম্ভীর চেহারা করেও নিজের বোকামি বুঝে ফিক করে হেসে ফেলল জুডি।

আমার উচিত হয়নি মোটেলে তোমাকে রেখে চলে যাওয়া, বলল রানা।

ঠিক। উচিত ছিল আমার খুব কাছে থাকা। তুমি ঠিকই জানতে কী চেয়েছি তোমার কাছে।

বোধহয় জানতাম, খুকখুক করে কাশল রানা। তবে তখন জরুরি কাজে…।

খাটে বসে পড়ে রানার কোমর জড়িয়ে ধরে টানল জুডি।

বাথরুমের হলদে আলোয় ওকে স্বর্গের অপ্সরা মনে হলো রানার। বসল ওর পাশে।

তবে তখন মোটেল থেকে তুমি চলে না গেলে, পরে কখনও হয়তো এত ভালভাবে চিনতাম না, অস্পষ্ট স্বরে বলল জুডি। এবার মাথাটা ঠেকাও বালিশে, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

বহু দূরে হুতাশ নিয়ে সঙ্গিনীকে ডাকছে পাহাড়ি সিংহ। ঘুম আসতে দেরি হলো না রানার। পাশে বসে আকাশ পাতাল ভাবছে জুডি। বুকটা হু-হু করছে কেন জানি।

.

৩৫.

 একটু আগে র‍্যাঞ্চ হাউসের লিভিংরুমে ফিরেছে ন্যাশ ময়নিহান। বসে আছে উইং-ব্যান্ড চেয়ারে। চুপ করে ভাবছে এবার কী করবে। হাতে নিনার ভিডিয়ো ক্যামেরা। ছোট্ট স্ক্রিনে দেখছে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভিকে পিটিয়ে খুন করছে রিক বেণ্ডার ও নিক বেণ্ডার। শেরিফের বুকে অস্ত্র তাক করে তাকে খুন হতে দেখছে অস্টিন ম্যাকলাস্কি। দুই বেণ্ডারের বিরুদ্ধে লড়ার সাধ্য নেই ম্যালভির। এক পর্যায়ে তার কান ছিঁড়ে নিল নিক। এমনি সময়ে শোনা গেল নিনা ভেঞ্চার ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ। চুপ থাকতে পারেনি মেয়েটা। জঙ্গলের দিকে ঘুরল ক্যামেরা। দেখা গেল নীরব এক লোক। মনোযোগ দিয়ে দেখছে হত্যাকাণ্ড। যুম করা হলো ছবি।

মুখের ভাল দিকটা তোলেনি, আপত্তির সুরে বলল ময়নিহান। তবু পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে তাকে। হাত নেড়ে নিনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সবার। এ ছবি দেখলে যে কেউ বুঝবে ময়নিহান ওখানে ছিল খুনের সময়। কোনওভাবেই মাফ পাবে না আদালত থেকে।

এবার দুলে উঠল ক্যামেরা, অস্পষ্ট হয়ে গেল ছবি। ভীষণ ভয়ে পালাতে শুরু করেছে নিনা ভেঞ্চুরা। শোনা গেল দৌড়ে যাওয়ার সময় রীতিমত ফোঁপাচ্ছে মেয়েটা। ধুপধাপ আওয়াজ তুলছে ওর বুটজুতো।

এ ধরনের ছবি চিরকালের জন্যে জেলখানায় পুরবে ময়নিহানকে। মাসুদ রানা যা-ই বলুক, নিশ্চয়ই কপি আছে এ ভিডিয়োর। অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে জুডি ব্ল্যাকউড, নিনা ভেঞ্চুরা আর মাসুদ রানাকে খতম করা। কোনওমতেই বাঁচতে দেয়া যাবে না ওই দুই বোনকে। তবে মাসুদ রানার বিষয়টি অন্যরকম। অন্য সিণ্ডিকেটের টপ টেররদের সামনে ওকে বোকা বানিয়ে অপমান করেছে লোকটা। কাজেই ভয়ঙ্কর কষ্ট দিয়ে খুন করতে হবে তাকে।

মারি কিটনের অনুরোধ শুনে ওয়াল্টার হেইন্সের মৃতদেহ টুকরো করতে দিয়েছে ময়নিহান। তবে মাসুদ রানাকে ধরে এনে কসাইখানায় খুন করবে সে নিজ হাতে। হেইন্সের মত নয়, জীবিত অবস্থায় ওই লোকটাকে কেটে নামাবে সে।

অফ করে দিল ময়নিহান ক্যামেরা। ঘরের দূরে চুপ করে বসে আছে রিক বেণ্ডার। ডুবে আছে আপন চিন্তায়। তাকে ক্যামেরা দেখাল ময়নিহান। এই ফিল্মের জন্যে আমার চেয়ে অনেক বড় বিপদে আছ তুমি। হয়তো বোঝোনি বিপদের মাত্রা। অবাক লাগছে ভাবতে যে এটা উদ্ধার করতে পুরো মনোযোগ দাওনি তোমরা।

মেয়েলোকটা বা তার ছবি নিয়ে মাথা ঘামাইনি, বলল রিক। ভেবেছি, কী করবে বেটি? ইন্টারনেটে পোস্ট দেবে? যোম্বি সিনেমা আর মানুষের কাঁচা মাংস খাওয়ার অন্তত হাজার খানেক মুভি দেখেছি ইউটিউবে। কেউ সিরিয়াসলি নেয় না এসব। একবার দেখেই ভুলে যাবে সবাই।

আইনী যে-কোনও সংস্থার হাতে যখন তুলে দেবে, তারা কিন্তু সিরিয়াসলিই নেবে। বিশেষ করে যখন জানা যাবে যে অফিসে আর ফেরেনি শেরিফ।

আমরা না ওদিক সামলে নিয়েছি? বলল রিক, প্রমাণ করা যাবে, জাজ হোন্ডের টাকা লুঠ করে প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে লোকটা।

ওই গল্প তৈরি করেছিল অস্টিন ম্যাকলাস্কি। শেরিফ অফিসের একটা কেবিনেট সরিয়ে ওটা রাখা হয় জাজের অফিসে। আবার তার একটা কেবিনেট নেয়া হয় শেরিফের অফিসে। এসব করা হয়েছিল প্রমাণ করার জন্যে। দেখিয়ে দেয়া হতো, জাজ হোল্ডের অফিসের কেবিনেটে পাওয়া গেছে ম্যালভির আঙুলের ছাপ।

এসব বলে চাপা দিত ম্যালভির কেস। কিন্তু এখন ভিডিয়োটা থাকার কারণে, যে-কেউ বুঝবে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে লোকটাকে। আর সেসময় ওখানে ছিল ময়নিহান। মস্তবড় বিপদে জড়িয়ে যাবে সে। তার কাছে এখন আছে অরিজিনাল ভিডিয়ো। ওটার কপি রেখে খুব লাভ হবে না। রিক ঠিকই বলেছে, আজকাল বেসিক কমপিউটার প্রোগ্রাম জানে এমন যে-কোনও নবিশ তৈরি করতে পারবে এমন বিশ্বাসযোগ্য ভিডিয়ো। অনায়াসেই ময়নিহানের উকিলরা প্রমাণ করবে এ ধরনের ভিডিয়ো মিথ্যা।

ভিডিয়ো সংক্রান্ত চিন্তা মন থেকে দূর করল ময়নিহান। ঠিক করেছে, পরে ভেবে দেখবে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায় প্রমাণ। রিক, এখনও মাসুদ রানাকে খুন করতে চাও?

ওকে মারতে পারলে আর কিছুই চাই না, বলল রিক।

আমিও চাই মরুক লোকটা, বলল ময়নিহান। তবে এটাও চাই, আমরা দুজন যেন তাকে খুন করতে গিয়ে প্রতিযোগিতা না করি।

সোজা হয়ে বসল রিক। কাঁচকোচ আওয়াজ তুলল চেয়ার। আমরা আবার কবে শত্রু হলাম, বস্?

যখন তুমি ফেলে দিলে আমার হেলিকপ্টার, আয়েস করে বসল ময়নিহান। হাত রেখেছে পেটের ওপর।

আপনি তা হলে জানেন, বস্? বিস্মিত রিক।

বিধ্বস্ত হওয়ার আগে কল করেছিল পাইলট, বলল ময়নিহান, বলেছিল প্রকাণ্ড এক লোক ম্যাগনাম দিয়ে গুলি করছে তার দিকে। বলো তো, রিক, কার কথা মনে পড়বে তোমার?

আপনার লোককে খুন করেছি জেনেও আমাকে বললেন ফিরতে?

হ্যাঁ, বললাম, রিক। বুঝতে পেরেছি কেন করেছ ওই কাজ। তুমি চাও নিজ হাতে মাসুদ রানাকে খুন করতে। অন্যরা যদি পথে বাধা হয়, সরিয়ে দেবে তাদেরকে।

উঠে দাঁড়াল রিক। ওর ছায়া পড়ল ঘরের মাঝে। প্রায় ছাত ছুঁই-ছুঁই করছে মাথা। আমি শুধু ওই মস্তানদের শেষ করিনি, আরও কয়েকজনকে মেরেছি।

ম্যাকলাস্কি আর হোল্ড? আমারও তাই ধারণা। ঘাড় মটকে গিয়েছিল ম্যাকলাস্কির। আর হোল্ড পড়ে তিনতলার জানালা থেকে। মনে হয়নি ওগুলো মাসুদ রানার স্টাইলের সঙ্গে মেলে।

তো? এবার কী করতে চান, বস?

আমাদের হওয়ার কথা শত্রু। কিন্তু আগেই তোমাকে বলেছি, চাই না আমাদের ভেতর শত্রুতা থাকুক।

কর্কশ হাসল রিক। বস্, আপনার খুনিরা জানেও না, তাদেরকে কলের পুতুলের মত ব্যবহার করছেন আপনি। কিন্তু আমি অত গাধা নই। এক এক করে মরছে তারা। বলুন তো, ঠিক কখন আমাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করবেন?

আমার প্ল্যানটা তেমন নয়, বলল ময়নিহান, তবে একটা কথা, আমি হাতের মুঠোয় চাই রানাকে। সবার সামনে আমাকে অপমান করেছে লোকটা।

আপনি বলছেন অপমানের কথা? আর ওই হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা খুন করেছে আমার আপন ছোটভাইকে!

আমি নিজ হাতে খুন করতে চাই ওকে।

মাথা নাড়ল রিক। না, বস, ও আমার।

অলস বেড়ালের মত আয়েস করে চেয়ার ছাড়ল ন্যাশ ময়নিহান। আড়ষ্ট হয়ে গেছে রিক। তার উদ্দেশে হাত নাড়ল টপ টেরর। ভয় পেয়ো না, রিক। আমার হাতেই খুন। হবে রানা। তবে তুমি চাইলে তোমাকেও রাখতে পারি পাশে। দুজন মিলে খুন করব ওকে। তবে সব প্রশংসা দিতে হবে আমাকে।

অন্য কেউ এ প্রস্তাব দিলে, বস, তার কলজেটা উপড়ে নিতাম; তবে আপনার কথা আলাদা। ঠোঁট বেঁকে গেল রিকের। গভীরভাবে ভাবছে টপ টেররের প্রস্তাব। জীবনের সেরা চুক্তি বলেই মনে হচ্ছে তার এটাকে। হাসতে হাসতে প্রতিশোধ নেবে, অথচ খুনের দায় চাপবে না ঘাড়ে। আপনার যুক্তি তত ভাল বলেই মনে হচ্ছে, বস।

কেউ যেন জানতে না পারে আসল সত্যি, রিক।

কাউকে বলতে যাব কোন আক্কেলে?

অর্থাৎ, মেরে ফেলতে হবে অন্যদেরকে।

হ্যাঙ্ক পার্কার আর মারি কিটন? আপনি বললে এখনই গিয়ে খতম করে দিয়ে আসি।

ভুল ভাবছ। বলেছি রানার সঙ্গীদের কথা। প্রেয়ারিতে হাজির হয়েছিল স্নাইপার রাইফেল নিয়ে। যেদিক থেকে গুলি খেয়ে মরেছে ড্যাগেট, ওয়াইল্ড আর চার্লস্ গ্রেড, তাতে বুঝতে পেরেছি, তারা ছিল কমপক্ষে দুজন। জুডি ব্ল্যাকউড আর নিনা ভেঞ্চরাকেও ছেড়ে দেয়া যাবে না কিছুতেই।

প্রথম সুযোগে খুন করব ওদের সবাইকে।

কিন্তু বাঁচিয়ে রাখবে মাসুদ রানাকে।

ঠিক আছে, মেঝের দিকে তাকাল রিক। আর আপনার অন্য লোকগুলোকে, বস? ওদেরকে মেরে ফেলব?

এক সেকেণ্ডের জন্যে কী যেন ভাবল ময়নিহান, তারপর বলল, যা করতে বলে দেব, তার বাইরে যাবে না ওরা।

ঠিক আছে, বস্।

রিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ন্যাশ ময়নিহান।

সন্দেহ নিয়ে তাকে দেখল দানব।

অত ভয় কীসের, রিক? চুক্তি না হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, হয়েছে, বলল রিক, তবে খুঁজে বের করতে চাইছি কোথায় রেখেছেন আপনার নরকের ওই ক্ষুর।

মুচকি হাসল ময়নিহান। এজন্যেই তোমাকে ভালবাসি, রিক। আগে কখনও বলেছি, তুমি আমার দলের সেরা?

জী, বস্, আগেও বলেছেন।

নতুন অংশীদারী চুক্তি, হাত মেলাল ন্যাশ ময়নিহান ও রিক বেণ্ডার।

.

৩৬.

 কুয়াশা মাখা মাঝরাত।

রওনা হয়েছে রানা, জন, বাড, জুডি ও নিনা। থমথম করছে নীরব পাইলট পয়েন্টের রাস্তা। উইণ্ডস্টারের সামনের দুসিটে বাড ও জন। পেছনের সিটে জুডি ও নিনার মাঝে রানা। চিন্তায় ডুবে গেছে মেয়েদুটো। রানার কাঁধে মাথা রেখেছে জুডি। ওর চুল থেকে রানা পাচ্ছে কী-এক ফুলের মিষ্টি সুবাস। মনে পড়ছে কয়েক ঘণ্টা আগের কথা। ভালবাসার কোনও দাবি বা বিয়ের কথা তোলেনি জুডি। বরং নিজেই বলেছে, আর কখনও দেখা না হলেও সন্তুষ্ট থাকবে শুধু বন্ধু হিসেবে রানাকে পেলে। তাতে বিরাট হাঁফ ছেড়ে স্বাভাবিক হতে পেরেছে রানা।

ডিএফডাব্লিউ এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে ওরা। ঠিক হয়েছে বিমান যোগে টাম্পা শহরে যাবে জুডি ও নিনা। ওদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উড়ে আসছে গিল্টি মিয়া ও হারাধন কই। ঠিক হয়েছে, উপযুক্ত লোক পাওয়ার আগ পর্যন্ত নতুন শাখায় জন হার্বার্টের সহযোগী হিসেবে ওখানে থাকবে ওরা দুজন।

হারাধন কই গিল্টি মিয়ার ফুপাত ভাই। বয়স বড়জোর বাইশ। গিল্টি মিয়াও জানে না ওর আসল নাম। পাঁচ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মেলা দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। একমাত্র ছেলে, প্রায় পাগল হয়ে যায় ওর বাপ-মা। কিন্তু দুদুটো নদী সাঁতরে পার হয়ে, পনেরো মাইল পায়ে হেঁটে ভোররাতে বাড়ি ফিরল সে। ওর দাদা তখনই ঘোষণা দিল: এখন থেকে ওর নাম হারাধন কই।

দুঘণ্টা পর জুডি ও নিনাকে নিয়ে ফ্লোরিডার দিকে রওনা হবে গিল্টি মিয়া আর হারাধন কই। রানা, জন ও বাড ফিরবে ময়নিহান র‍্যাঞ্চে। ওরা শত্রুর আস্তানায় হামলা করবে শুনে ভীষণ রেগে গিয়েছিল জুডি। মাথা নেড়ে বলেছে, রানা আহত ও ক্লান্ত। খুন হবে যখন-তখন, কাজেই কোনওভাবেই ওকে ছেড়ে যাবে না জুডি। কিন্তু নতুন করে তর্ক শুরু করার আগেই ওর মুখ বুজিয়ে দিয়েছে রানা চুমু দিয়ে। পুরো এক মিনিট পর ঠোঁট সরিয়ে বলেছে, কাজটা শেষ করতে হবে, জুডি। নইলে বাকি জীবন আমরা সবাই থাকব বিপদে। যে-কোনও সময়ে আসবে মৃত্যু। তুমি নিশ্চয়ই নিরন্তর হুমকি মাথায় নিয়ে বাকি জীবন চাও না?

কেঁদে ফেলেছে জুডি। ভয় লাগছে, আর কখনও দেখব না তোমাকে।

সতর্ক থাকব, কথা দিয়েছে রানা।

ওর আহত কাধ স্পর্শ করে বিড়বিড় করেছে জুডি, অনেক বেশি ঝুঁকি নাও। দুই ইঞ্চি নিচ দিয়ে বুলেট গেলে খুন হতে।

তখন নিজের দিকে খেয়াল ছিল না। তা ছাড়া, এবার কাউকে সরিয়ে আনতে হবে না, স্রেফ দুনিয়া থেকে বিদায় করব একদল হিংস্র জানোয়ারকে।

বড় বড় চোখে রানাকে দেখেছে জুডি। ওর বুকে জেগে উঠেছে পুলিশ অফিসারের বিবেক।

ওরা অশুভ মানুষ, জুডি, যুক্তি দিয়েছে রানা।

তা জানি।

ওদেরকে থামাতে হবে, নইলে বাঁচতে দেবে না আমাদের মত আরও অনেককে। এফবিআই-এর কাছে ভিডিয়োর কপি দিলেও ওদের নাগালের বাইরে থাকবে ময়নিহান। নিজ হাতে আমাদেরকে খুন করতে না পারলে ভাড়া করবে খুনি। বা কাজে লাগাবে কোনও সিণ্ডিকেটকে।

ভাবছ আপত্তি তুলব? রানাকে অবাক করে বলেছে। জুডি, না, আপত্তি বা তর্ক করব না। র‍্যাঞ্চ থেকে বেরোবার সময় ভেবেছি, ওখানে এমন কেউ নেই যে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। ওরা মারা গেলে থাকছে না ছেঁড়া কোনও সুতো।

জুডির চোখে অবাক হয়ে চেয়েছে রানা। কসেকেণ্ড পর বলেছে, জানতাম না তোমার মধ্যে বাস করে দুঃসাহসী এক মেয়ে!

তোমার মত সাহসী নই, তবে যুক্তি বুঝতে অসুবিধা হয় না, মৃদু হেসেছে জুডি। তা ছাড়া, তোমার সঙ্গে থেকে এই কদিনেই হয়ে উঠেছি দুর্ধর্ষ।

অবশ্য সামান্য ভুল ভাবছ, বলেছে রানা, লিটল ফোর্কে আমাদেরকে চেনে অস্টিন ম্যাকলাস্কি আর জাজ হোল্ড।

ওরা দুজন মারা গেছে, জানাল জুডি।

অবাক চোখে ওকে দেখেছে রানা।

কান পেতে শুনেছি ময়নিহানের কথা। তার ধারণা ওই দুই খুন তুমিই করেছ। তবে আমার তা মনে হয় না।

ম্যাকলাস্কি যখন মোটেল রেইড করল, বুঝলাম আমার নাম তাদের অজানা, বলল রানা, একই কথা খাটে বেণ্ডারদের স্যাঙাৎদের বিষয়ে। তবে ভেবেছি তোমার কাছ থেকে নামটা জেনে থাকতে পারে পুলিশ ফোর্স।

রানার মন পড়েছে জুডি। কমুহূর্ত পর বলল, আমাকে ময়নিহানের হাতে তুলে দেয়ার পর ম্যাকলাস্কি জানতে পেরেছে আমার নাম। ফোনে শেরিফ অফিসে যোগাযোগ করার সময় নিজের নাম জানাইনি। মহিলা পুলিশকে শুধু বলেছি, নিনা ভেঞ্চুরার ব্যাপারে কথা বলতে চাই শেরিফের সঙ্গে।

নিনাকে চিনবে স্থানীয় মস্তানরা, ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে গোলমালে জড়িয়ে গিয়েছিল ও।

কিন্তু মুখ খুলতে গেলেই প্রমাণ হবে লিটল ফোর্কে কী করছিল তারা, মাথা নাড়ল জুডি। কাজেই মুখ বন্ধ রাখবে সবাই।

কথা ঠিক, সায় দিল রানা। তা ছাড়া, তারা জানে না এ শহরে এসেছিল নিনা। এ থেকে আরেকটা বিষয় বেরিয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে বিপদ এড়াতে চাইলে মুখোমুখি হতে হবে ময়নিহান আর ওর দলের।

রানার যুক্তি খণ্ডন করতে গেল না জুডি। শুধু বলল, খেয়াল রেখো, লড়তে গিয়ে যেন খুন হয়ে না যাও।

মরতে কে চায়? ঠিক আছে, সতর্ক থাকব, বলল রানা।

এরপর এ বিষয়ে দ্বিতীয়বার কথা হয়নি রানা বা জুডির।

গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে ওরা। একটু পর পৌঁছে গেল এয়ারপোর্টে। লাউঞ্জে ওদের সঙ্গে দেখা করল গিল্টি মিয়া ও হারাধন কই। বসে পড়ে রানার পা ছুঁয়ে সালাম করল বাঙালি তরুণ। উঠে দাঁড়িয়ে লাজুক চোখে দেখল জুডি আর নিনাকে। গিল্টি মিয়া দুপায়ের স্যাণ্ডেল বুটের মত করে ঠুকে স্যালিউট করল রানাকে। অনেক বকা দিয়েও ওর ভক্তির আতিশয্য থামাতে পারেনি রানা। শেষে বুঝেছে: ছোট্ট সাইজের মানুষটা ওকে শুধু ভক্তিই করে না, অন্তর থেকে ভালবাসে। এ-ভালবাসার কোনও তুলনা হয় না।

কী ধরনের বিপদ, আগেই ফোনে গিল্টি মিয়াকে বলেছে রানা। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে হাজির হয়েছে বত্তিশ বচোর কয়েদ খাটা প্রাক্তন পাকা চোর। তবু ওকে সরিয়ে নিয়ে আরেক দফা ব্রিফ করল রানা।

সব মাতায় আচে, স্যর, কোনো চিন্তে করবেন না, বলল গিল্টি মিয়া, কেউ বেগড়বাই করলেই ঠক্কাস করে দোব। তাছাড়া, হারাধোন আচে না। ওর গায়ে ষাড়ের জোর। সেদিন ভোরে আমায় কাঁদে তুলে একমাইল দৌড়ে গেল। এটু হাঁপাল না! বোজেন অবস্তা, স্যর! ওকে। আপিসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দোব… তাহালে

কিন্তু কেউ এসে গুলি বা ছোরা চালালে? জানতে চাইল চিন্তিত রানা।

তা কখখোনও হবে নি, স্যর। আরও পাকা হয়েছি না? এলেই ঠক্কা। বারোটা বাজিয়ে দোব।

বাজার করবে কে? মেয়েদের একা রেখে তুমি তো কোথাও যেতে পারবে না।

ও-বাড়ি থেকে বেরোবই না। বাজার-সদাই করবে হারাধোন। তবে, স্যর, ইয়ে… ও ব্যাটা আমার চেয়েও এক কাটি সরেস হয়ে উটেছে। সেদিন বড়সড় একটা নোট গাপ করে দিলে। পেলাম না তো পেলামই না। বুজলাম ওস্তাদ মারা সাগরেত হয়ে উটেছে, স্যর। এমন করবে বুজলে, আগেই চড়িয়ে ওর বত্তিশ পাটি দাঁত ফেলে দিতুম। আবার হেসে জিজ্ঞেস করে: কিচু খুজচেন, দাদা? বলতে ইচ্চে হলো, ওরে, স্লা, তোর মতন বেয়াদপ… শ্রদ্ধেয় স্যরের সামনে গাল বকে ফেলে দাঁতে জিভ কাটল গিল্টি মিয়া।

গম্ভীর চেহারায় বলল রানা, ঠিক আছে, চলো।

আবার ওরা ফিরল অন্যদের পাশে।

এবার উঠতে হবে বিমানে, জুডিকে জানাল রানা।

মিষ্টি হেসে বিদায় নিল জুডি।

দুই বোনের দুপাশে চলল গিল্টি মিয়া ও হারাধন কই।

 একটু পর পেরিয়ে গেল ওরা ডিপারচার গেট।

ঠিক আছিস? রানার গম্ভীর মুখ দেখে নরম সুরে বলল জন। শরীর খারাপ লাগছে?

না, ঠিক আছি, বলল রানা। ঘাড়ের চামড়া ও সামান্য পেশি চেঁছে নিয়ে গেছে বুলেট। ইতিমধ্যেই কমেছে ব্যথা। লড়তে সমস্যা হবে না।

জুডির জন্যে মন খারাপ? জানতে চাইল বাড।

দূর! ভালমত পরিচয়ই হলো না! মাথা নাড়ল রানা। মাত্র কদিনের পরিচয় ওর জুডির সঙ্গে, অথচ অদ্ভুত এক আকর্ষণ বোধ করছে মেয়েটির প্রতি। অন্যদিকে মন সরাল ও, চল, যাওয়া যাক।

পাঁচ মিনিট পর পার্কিংলটে গাড়ির পাশে থামল ওরা। ভাল করেই জানে, সব ঝামেলা শেষ করতে চাইলে ময়নিহান র‍্যাঞ্চে গিয়ে লড়তে হবে। কোনও নিশ্চয়তা নেই যে বেঁচে ফিরবে ওরা।

আশা করি ময়নিহান যাবে মাটির নিচে, আর আমরা থাকব ওপরে, যেন রানার চিন্তা মুখে প্রকাশ করল জন।

উইণ্ডস্টারের ড্রাইভিং সিটে বসল বাড। পাশের সিটে জন। পেছন সিটে রানা। ঠিক করেছে ঘুমিয়ে নেবে একটু। সঞ্চয় করতে হবে শক্তি। সামনে হয়তো পড়ে আছে দীর্ঘ লড়াই। জুডির উদ্বিগ্ন, মিষ্টি মুখটা মন থেকে সরিয়ে দিল ও।

গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল দুর্ধর্ষ, বেপরোয়া তিন বন্ধু।

.

৩৭.

 মারি, জরুরি একটা কাজ দিতে চাই তোমাকে, বলল ন্যাশ ময়নিহান।

কিচেনে দাঁড়িয়ে গ্রিন টি-র কাপে চুমুক দিচ্ছে মহিলা। পাশের টেবিলে মোবাইল ফোন। ঘরে ঢুকে ওটা দেখেছে ময়নিহান। মনে হয়েছে, মালিকপক্ষের কাছে রিপোর্ট দিচ্ছিল মারি কিটন। ঘাড় ফিরিয়ে ময়নিহানের দিকে তাকাল ও, যেন মরা মাছের চোখ। কেমন যেন গা শির শির করে।

আপনি আগেই একটা কাজ দিয়েছেন, বলল মারি। খুন করতে হবে মাসুদ রানাকে।

তারও আগে আরেকটা জরুরি কাজ আছে।

পা ছড়িয়ে চেয়ারে বসল মারি। মেয়েলি ভাব নেই তার আচরণে। প্যান্টের পকেটে ডানহাতের বুড়ো আঙুল ভরে তাকাল ভুরু কুঁচকে। মাসুদ রানাকে খুনের চেয়েও জরুরি কী কাজ থাকতে পারে, বস?

আমি চাই প্রথম সুযোগেই নিনা ভেঞ্চুরাকে খুন করবে তুমি। ও এখন আমাদের জন্যে ভয়ানক বিপজ্জনক।

ও তো আছে রানার সঙ্গে। মাসুদ রানাকে খুন করার সময়েই শেষ করে দেব।

কাজটা অত সহজ হবে না, বলল ময়নিহান। অন্য কোনও কৌশলে নিনাকে সরিয়ে দেবে রানা।

ধীর হাতে মোবাইল ফোন তুলে বুক পকেটে রাখল মারি কিটন। অস্ত্র বোধহয় হাতব্যাগে। বাড়তি পোশাকও র‍্যাঞ্চে আনেনি। মুহূর্তে রওনা হতে পারবে যে-কোনও দিকে। তো, বলুন কী করতে হবে?

অল্প কথায় সারবে ঠিক করেছে ময়নিহান। একটু আগে রিক বেণ্ডারের সঙ্গে আলাপে জেনেছে জরুরি তথ্য। ফ্লোরিডার টাম্পা শহর থেকে লিটল ফোর্ক শহরে এসেছিল নিনার ছোটবোন জুডি। এ কথা মাথায় রেখে টাম্পায় পরিচিত কজন ক্রাইম বসের সঙ্গে কথা বলেছে ময়নিহান।

জানা গেছে, সহজ লোক নয় মাসুদ রানা। নামকরা এক প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির চিফ। শুধু তা-ই নয়, সম্ভবত বাংলাদেশ আর্মি ইন্টেলিজেন্সের কমাণ্ডো ছিল। আরও পরিচয় আছে: মেক্সিকো, উরুগুয়ে, পেরু এবং আরও অনেক দেশে শখের আর্কিওলজিস্ট হিসেবে কাজ করেছে নানান অভিযানে। দুহাতে লাখ লাখ ডলার সাহায্য করে দুস্থ মানুষকে। কবার হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে বের করেছে জঙ্গল-পাহাড়-মরুভূমি-সাগর ছুঁড়ে। অনেকে বলে: লোকটা সত্যিকারের দুঃসাহসী এক বেপরোয়া বাঙালি অভিযাত্রী।

কিছুদিন হলো টাম্পা শহরে খুলেছে ওর ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির শাখা। এরই মাঝে অপরাধী সমাজের চক্ষুশূল হয়েছে উঠেছে তার দুই সহযোগী। ওই শাখা অফিসের চিফের নাম জন হার্বার্ট। প্রাক্তন যোদ্ধা। রানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আপাতত কোথায় যেন গেছে সে। বুঝতে দেরি হয়নি ময়নিহানের, ওই লোকই স্নাইপারদের একজন। এ-ও আন্দাজ করেছে, এসবের শেষ না দেখে টেক্সাস ছেড়ে নড়বে না তারা।

আরেক ঝামেলা হচ্ছে ওই দুই মেয়ে। তাদেরকে দূরে কোথাও সরিয়ে দেবে মাসুদ রানা। তারপর ঠিকই ফিরবে শো-ডাউন করতে। এ ছাড়া উপায়ও নেই তার। নইলে তাড়া খেয়ে বেড়াবে আমৃত্যু। ময়নিহানের ধারণা, রানা পাঠিয়ে দেবে মেয়েদুটোকে টাম্পা শহরে। লুকিয়ে রাখবে কোথাও।

কয়েক ঘণ্টা আগে ডিএফডাব্লিউ এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে উঠেছে দুই মেয়ে। ব্যবহার করেছে নকল নাম। কিন্তু আমার লোকের বর্ণনা থেকে বুঝতে পেরেছি, ওরাই। পাহারা দিয়ে নিয়ে গেছে দুজন বাদামি চামড়ার লোক।

তো রানা বা তার রহস্যজনক বন্ধু নয়? জানতে চাইল মারি। অন্য কেউ নিয়ে গেছে ওদেরকে?

যাত্রীর লিস্ট দেখেছে আমার লোক। ওই দুই লোক এসেছিল ফ্লোরিডার টাম্পা শহর থেকে। ফিরেছে পরের ফ্লাইটে। আইআরএস ডেটাবেস থেকে জেনেছি, লোকদুটো বাংলাদেশি। চাকরি করে রানা এজেন্সিতে। টেবিলের ওপর দিয়ে মারির দিকে একটা কাগজ ঠেলল ময়নিহান। এই যে ঠিকানা। মাত্র কিছুদিন হলো ভোলা হয়েছে ওই অফিস। …পারবে তো কাজটা শেষ করতে?

দুটো লোক আর দুটো মেয়ে? ভাববেন না। সময় লাগবে না ঝামেলা শেষ করতে। কাগজটা পকেটে রাখল মারি কিটন। কিন্তু আমাকে কেন কাজটা দিলেন, বস্? পাঠাতে পারতেন হ্যাঙ্ক পার্কার আর ওই পর্বতটাকে।

কারণ, মনে হয়েছে এ কাজের জন্যে তুমি সেরা।

মৃদু হাসল মারি। ক্ষণিকের জন্যে মনে হয়েছিল, আপনি চান আমাকে সরিয়ে দিতে। যাতে বিপদ না হয় আমার। …আপনি তো লড়বেন মাসুদ রানার বিরুদ্ধে?

হ্যাঁ, শেষ করব ওকে, বলল ময়নিহান। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল। ভাল করেই জানি, অন্যদের চেয়ে দুর্বল নও তুমি। খুশি হবে জুডি ব্ল্যাকউডকে বাগে পেলে। খুন করতে যাচ্ছিলে, কিন্তু আমি বাধা দিই। এখন আর তা করব না।

আমাকে গুলি করতে চেয়েছিল কুত্তীটা, বলল মারি। কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছু করলে কোনদিন ভুলি না। কাজেই মরতে হবে তাকে।

তো কখন নামছ কাজে?

মাথা দোলাল মারি কিটন। দেরি হবে না দুই কুত্তীকে শেষ করতে।

কাজ শেষ হলে পাবে মোটা অঙ্কের বোনাস, লোভের টোপ ফেলল ময়নিহান। টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলল আরেকটা কাগজ। এটা বিমানের রির্ভেশনের নম্বর। টিকেট পাবে বিমান টিকেটের কাউন্টারে।

কীভাবে যাব এয়ারপোর্টে?

 আমার গাড়িটা নেবে, মারির দিকে চাবি বাড়িয়ে দিল ময়নিহান। এখানে আমার কাজ শেষ হলে এয়ারপোর্টের পার্কিংলট থেকে সংগ্রহ করে নেব ওটা।

হয়তো আগেই শেষ হবে আমার কাজ, বলল মারি। সেক্ষেত্রে ওটা নিয়ে নিজেই ফিরব।

কাঁধ ঝাঁকাল ন্যাশ ময়নিহান। ভাবছে, চট করে ফিরতে পারবে না মারি। এদিকে আগামী কঘণ্টার ভেতরই হামলা করবে মাসুদ রানা।

 .

৩৮.

 রাত তিনটা বা চারটায় সবচেয়ে অসচেতন থাকে মানুষ। তাই ওই সময়ে পৃথিবীর বুকে খুন হয় সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ মানুষই থাকে ঘুমের কোলে। এ সুযোগে অপ্রস্তুত অপরাধীদের ধরতে রেইড দেয় পুলিশবাহিনী। টেরোরিস্ট ধরতেও মিশনে বেছে নেয়া হয় ওই রাত তিনটে থেকে চারটা। রানার উচিত ন্যাশ ময়নিহানের র‍্যাঞ্চে সেই সময়ে হামলা করা। কিন্তু তাতে রয়েছে একটা সমস্যা। ময়নিহান ভাল করেই জানে, কোন্ সময়ে হামলা করবে রানা। তার দলে আছে কয়েকজন খুনি। সতর্ক থাকবে তারা। এসব ভেবেই রানা ঠিক করেছে, অপেক্ষায় রাখবে না টপ টেররকে।

রানা যেমন চিনেছে ময়নিহানকে, ওই লোককে চিনতে বাকি নেই জন ও বাডেরও। টপ টেররের কাছে সবই হাসির বিষয়। খুন করা যেন মজার ভিডিয়ো গেম। সবসময় মরলে মরবে অন্যরা। তার কিছুই হবে না। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করবে সে।

পাকা শয়তান বলতে পারিস, বলল জন। ওর ধারণা, পুরো দুনিয়া ঘুরছে ওকে ঘিরে।

আবার কেবিনে ফিরেছে রানা, বাড ও জন। নতুন করে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলেছে বাড। কিছুক্ষণ পর লেকের বুকে পড়বে সূর্যের প্রথম রশ্মি। রাতে বার্গারের তেলতেলে গন্ধে বমি এলেও এখন খিদেয় রানার মনে হচ্ছে খেতে পারবে গোটা দশেক।

বাবুর্চির কাজ করছে বাড, কাঁটাচামচ দিয়ে গেঁথে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল আরেকটা মস্ত বার্গার। লোকটা হয়তো ভাবছে সে দুনিয়ার সেরা খুনি, তার তুলনা নেই।

হয়তো সত্যিই তা-ই, কে জানে! বলল জন।

জানে না আমরা কারা, বা কী আমাদের ব্যাকগ্রাউণ্ড, বার্গারে কামড় বসাল রানা।

মাথা নাড়ল জন। আগের কথা বললি। এতক্ষণে তোর ব্যাপারে সব তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে।

কাঁধ ঝাঁকাতে গিয়ে চামড়ায় টান পড়তেই গাল কুঁচকে ফেলল রানা। কঠোর চোখে দেখল বার্গারটাকে। দোষ যেন ওটার। তবে আরেক কামড় দিয়ে বুঝল, দারুণ স্বাদের। মাংস চিবুনোর পর ঢোক গিলে বলল, হয়তো যথেষ্ট রিসোর্স নেই। দেড় দিন জুডির ফোন ছিল আমার কাছে। ট্রেস করতে পারেনি। কঠিন হবে তার জন্যে আমার ব্যাকগ্রাউণ্ড জানা।

শত্রুর ব্যাপারে প্রথম শর্তটা ভুলে গেলি? বলল জন।

ভুলিনি, বলল রানা। ছোট করছি না কাউকে। তবে বুঝলাম না, কেন মুখোমুখি হতে চাইছে। তাতে কী পাবে সে?

হাতের বার্গার ওর দিকে তাক করল জন। ভুলে গেলি, ক্ষতি করেছিস তার? অর্ধেক তোক মেরে সাফ করলি, ভেঙে চুরমার করলি রেস্টুরেন্ট। তোর জন্যে বন্ধ হয়েছে কেন্টাকির বড় ব্যবসা। থেকে নামিয়ে দিয়েছিস তাকে বটম টেররে- তোকে ছাড়তে চাইবে কেন?

রিক বেণ্ডারকে বুঝতে পারি, বলল রানা। আমার হাতে মরেছে ওর ছোটভাই। তাই চাইছে খুন করতে। কিন্তু ন্যাশ ময়নিহানকে ঠিক স্বাভাবিক লোক মনে হচ্ছে না।

সে কেমন তা নিয়ে ভাবছি না, বলল জন, শুধু জানি সে আমাদের শত্রু। পথ থেকে সরিয়ে দিলে নিশ্চিন্তে ফিরতে পারব ফ্লোরিডায়। তখন আর এদের কেউ আসবে না খুন করতে।

চুপচাপ বার্গার চিবুতে লাগল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর দিগন্তের ওদিক থেকে উঁকি দিল সোনালি রোদ। বার্গার শেষ করে কফি নিল রানা। ভাবছে, সামনে দীর্ঘ দিন। ওরা ফিরবে ময়নিহান র‍্যাঞ্চে। স্নাইপার রাইফেল পাবে না। নেবে এমন অস্ত্র, যেগুলো ডেটাবেস থেকে ট্রেস করতে পারবে না এফবিআই বা পুলিশ ফোর্স। আশা করা যায়, জন ও বাড উইনচেস্টার দিয়ে যেসব গুলি করেছে, সেগুলো টার্গেটে লেগে হারিয়ে গেছে প্রেয়ারিতে। সামনের লড়াইয়ে আড়াল করা যাবে না ওদের গুলি।

রাইফেলের কেস নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড। বাইরে গর্জে উঠল গাড়ির ইঞ্জিন। পুরো নব্বই মিনিট পর ফোর্ট ওঅর্থ জয়েন্ট রিযার্ভ বেস থেকে ফিরল ও। সার্জেন্টের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে অস্ত্রগুলো।

কেবিনে ওদের আঙুলের ছাপ ও রানার রক্তের ফোঁটা মুছল ওরা। পরে আইনী সংস্থা হয়তো ধরে নেবে কেবিন ভাড়া নিয়েছিল কজন মৎস্যশিকারী।

যে যার অস্ত্র পরীক্ষা করল ওরা। রানা নিয়েছে ওয়ালথার পি.পি.কে. আর একটা কে-বার নাইফ। জনের পছন্দ গ্লক সতেরো, মসবার্গ কমব্যাট শটগান আর আট ইঞ্চি ব্লেডের শ্রেড নাইফ। বাডের কাছে রাশান সেমি অটোমেটিক পিস্তল আর উরুর সঙ্গে বাঁধা কমাণ্ডো নাইফ। গাঢ় রঙের শার্টের ওপর ওরা পরল কালো জ্যাকেট, জিন্সের প্যান্ট, পায়ে বুট। আমেরিকার সবচেয়ে বাজে বারের ডোরম্যান/বাউন্সার বলে মনে হচ্ছে জনকে, তবে বরাবরের মতই চুল পরিপাটি করা নিপাট ভদ্রলোক সেজেছে বাড।

শেষবারের মত পাইলট পয়েন্ট ছাড়ার আগে একটা কাজ করবে রানা। সবাইকে নিয়ে রানা এজেন্সিতে উঠেছে গিল্টি মিয়া, তবুও লেকের তীরে গিয়ে জুডিকে ফোন দিল ও।

হাই, রানা, ওদিক থেকে এল মিষ্টি কণ্ঠ। তবে গলায় ক্লান্তি। কাঁধের কী অবস্থা?

প্রায় সেরে গেছে।

ডাহা মিথ্যুক!

 গিল্টি মিয়া কোথায়?

বাইরের ঘরে টেবিলের ওদিকে। ভেতরের ঘরে আমরা দুই বোন।

ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম? সরি!

না, তা নয়, তাড়াতাড়ি করে বলল জুডি। খুব খুশি হয়েছি ফোন করেছ বলে।

নিনাকে বোলো, রুক্ষ আচরণ করেছি, সেজন্যে আমি দুঃখিত।

ও জানে কেন এমন করতে হয়েছে।

একটু পর রওনা হচ্ছি, বলল রানা, কল করেছি তা জানাতে।

আমি গুডবাই দেব না।

 কেন?

পরে যাতে দেখা হয় আবার।

চিন্তা কোরো না, বলল রানা। আশা করি আজই কেটে যাবে সব বিপদ। অন্তত ময়নিহান আর আসবে না তোমাদের বিরক্ত করতে।

ফিসফিস করে বলল জুডি, ভাল থেকো।

কল কেটে দিয়ে পকেটে রাখল রানা মোবাইল ফোন। স্পর্শ করল ওয়ালথারের বাট। চলে এল কেবিনের কাছে। উইণ্ডস্টার গাড়ির সামনে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে জন ও বাড।

তুই রেডি তো, রানা? জিজ্ঞেস করল জন।

জবাবে রানা বলল, চল, রওনা হওয়া যাক।

ন্যাশ ময়নিহানের র‍্যাঞ্চে বাড়তি ঝুঁকি যেন নিতে না হয় বন্ধুদের, সেজন্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজটা নিয়েছে রানা। আপত্তি তুলেছিল দুই বন্ধু, কিন্তু পাত্তা দেয়নি ও।

একটু পর গাড়ি নিয়ে রওনা হলো ওরা। বরাবরের মতই কমপিউটার দিয়ে জাদু দেখাল বাড। মোবাইল ব্রডব্যাণ্ড কানেক্টর ব্যবহার করে স্ক্রিনে আনল ময়নিহান র‍্যাঞ্চ হাউস ও আশপাশের এরিয়াল ইমেজ। গুগল ব্যবহার করলে আজকাল আর শত্রু এলাকায় রেকি করতে হয় না কাউকে। পরিষ্কার দেখা গেল ওই এলাকার প্রতিটা বাড়ি। এরপর জাদুর চেয়েও বেশি কিছু করল বাড। গ্রেসন কাউন্টি ডেটাবেস থেকে সংগ্রহ করল ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ হাউস ও অন্যান্য বাড়িটা স্কেটিক্স। কীভাবে ওগুলো তৈরি করা হয়েছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ওরা।

র‍্যাঞ্চ হাউস প্রকাণ্ড। বেযমেন্ট ও অ্যাটিকসহ পুরো চারতলা। কলোনিয়াল ম্যানশনের ওপরতলায় আছে লিভিং কোয়ার্টার। নিচতলায় কিচেন, ডাইনিং ও গুদাম। একটু দূরেই বিশাল কয়েকটা বাড়ি। শেষের বাড়িটা খোয়াড়, আয়তক্ষেত্রাকার। চারপাশে মাইলের পর মাইল খোলা ঘাসজমি।

গোপনে কাছে যাওয়া অসম্ভব, বলল জন। ভাল হতো এম টোয়েন্টিফোর থাকলে। গুলি করতে পারতাম দূর থেকে।

ইউটা মরুভূমিতে সিআইএর একটা টেরোরিস্ট ট্রেনিং সেল-এর খুব কাছে ক্রল করে পৌঁছেছিল রানা ও জন হার্বার্ট। তা করতে হয়েছিল জাতিসংঘের অ্যান্টি টেরোরিস্ট টিমের হয়ে। ফিরেছিল জরুরি তথ্য নিয়ে। পরে বাগদাদ শহরে কিছুদিনের জন্যে ঠেকিয়ে দেয় ওরা অসামরিক জনসাধারণের ওপর মার্কিনীদের অন্যায়, নির্বিচার, অনৈতিক বোমাবর্ষণ। সেই জন বলছে, কঠিন হবে র‍্যাঞ্চ হাউসে হামলা করা।

ওদের কাছে এফএলআইআর টেকনোলজি না থাকলে বড় ঘাসের কারণে যেতে পারব অনেক কাছে, বলল বাড।

ওই টেকনোলজি ব্যবহার করে আর্মি। খুঁজে বের করে কোথায় আছে অ্যাম্বুশ। ইনফ্রা-রেড ডিটেক্টর জানিয়ে দেয় ডিজিটাল থারমাল ইমেজ। ক্যামোফ্লেজ পরা সৈনিকও দেখা যাবে আয়নার মত, এমন কী খরগোশ বা ইঁদুরও রক্ষা পায় ওটার চোখ থেকে।

রানার মনে হয়নি এফএলআইআর টেকনোলজি হাতে পাবে ময়নিহান। অপরাধী সঙ্ঘের লোকদের সঙ্গে তার ওঠবস, জোগাড় করেছে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে পেয়ে গেছে আর্মির গোপন সব ইকুইপমেন্ট।

দৃষ্টি সরিয়ে দিলে, চট করে বুঝবে না ঢুকেছিস তাদের এলাকায়, বলল রানা, আমি মনোযোগ আকর্ষণ করব। ন্যাশ ময়নিহান চায় প্রতিশোধ নিতে, কাজেই তার দলের চোখ থাকবে আমার ওপর। সেই সুযোগে র‍্যাঞ্চ হাউসের পেছনের দালানে পৌঁছে যাবি তোরা।

আমাদের জন্যেও তৈরি থাকবে, বলল জন, গত কালকের অ্যাম্বুশের কথা ভুলবে না। ঘাসের ভেতর ছিল দুজন স্নাইপার। গুলির অ্যাংগেল দেখে বুঝে গেছে।

জানবে না আমি একা, না তোরাও আছিস, বলল রানা, আমি হামলা করলে বাধ্য হয়ে আমার দিকেই বেশি সময় দেবে। হয়তো খেয়াল থাকবে না তোদের কথা।

আসলে কী করতে চাস তুই? জানতে চাইল জন। সংক্ষেপে ওর প্ল্যান জানাল রানা।

 সব শুনে মাথা নাড়ল জন ও বাড।

পাগল নাকি? আপত্তি তুলল জন। যে-কেউ বলবে, খুন হবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিস তুই!

রানা ভাবছে ও রুস্টার কাবার্ন, বলল বাড। ঘোড়ার রাশ দাঁতে কামড়ে ছুটবে জন ওয়েইনের মত, দুই হাতে দুই সিক্সগান!

জন ওয়েইনের ভক্ত দুই বন্ধুর পাল্লায় পড়ে সিনেমাটা দেখেছে রানা। ডায়ালোগ পাল্টে নিয়ে মনে মনে বলল, ফিল ইয়োর হ্যাণ্ড, ময়নিহান; ইউ সান অভ আ বিচ!

.

৩৯.

 মাসুদ রানার জন্যে কয়েকটা জায়গায় অপেক্ষা করতে পারত ন্যাশ ময়নিহান। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মিডওয়েস্টের কয়েকটা বড় অফিসবাড়ি। অথবা থাকতে পারত ডালাসের অফিসে। জানালা দিয়ে দেখা যাবে রিইউনিয়ন টাওয়ার। সামান্য দূরে টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোযিটরি। ওখান থেকেই জন এফ. কেনেডিকে গুলি করেছিল খুনি লি হার্ভে অসওঅল্ড। আগে স্টেডিয়াম থেকে আসত দর্শকের চিৎকার। পরে সব খেলা সরিয়ে নেয়া হয়েছে ডালাস স্টার আমেরিকান এয়ারলাইন্স সেন্টারে।

আরও কিছু জায়গায় থাকতে পারত ময়নিহান। কিন্তু সবচেয়ে নির্জন বলে র‍্যাঞ্চটাকেই বেছে নিয়েছে সে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় দুবার গোলাগুলি হলেও এখানে আসেনি পুলিশের কেউ। তৃতীয়বারও সম্ভাবনা নেই আসার। ময়নিহান চাইছে না লড়াইয়ের সময় তৃতীয় আর কেউ এসে হাজির হোক।

আসবে রানা, ভাল করেই জানে অধীর ময়নিহান। কয়েক ঘণ্টা আগেই তৈরি হয়েছে তার কজন ভাড়াটে খুনি। ঠেকিয়ে রাখবে রানাকে। এদিকে বাড়ির দোতলায় রানার জন্যে থাকবে রিক বেণ্ডার। রানাকে খুন করার অনুমতি তাকে দিয়েছে স্বয়ং ময়নিহান, নইলে আগেই গুলি শুরু করত দানব। ওর বুকে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। ময়নিহান চায়নি রানা খুন হওয়ার আগে নিভে যাক ওই অঙ্গার। তার চেয়েও বড় কথা, রানাকে নিজ হাতে খুন করার লোভে হ্যাঙ্ক পার্কার ও অন্যদেরকে মেরে ফেলতে পারে উন্মাদটা।

নিজের কাছে প্রশ্ন রেখেছে ময়নিহান: কেন রিককে বাঁচিয়ে রেখেছে সে? জানে, তাকে পছন্দ করে এটা ডাহা মিথ্যা। বাস্তব কথা হচ্ছে, অন্যদের মতই রিকও ওর হাতের সুতোয় ঝুলানো হিংস্র এক পুতুল। কিন্তু এখন নিখুঁত নয় এ পুতুল। ভ্রাতৃমৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে দলের ছয়জনকে খুন করেছে সে। রানাকে শেষ করার পথে ময়নিহান বাধা হয়ে উঠলে ওকেও খুন করবে দানব। অন্তত চেষ্টা করবে।

রিক বলেছে, রানা-হত্যার সব প্রশংসা দেবে ন্যাশ ময়নিহানকে। কিন্তু একফোঁটাও বিশ্বাস করে না সে দানবটাকে। লোকটা শপথ নিয়েছে: ছোটভাইয়ের খুনের বদলা নেবে নিজ হাতে। হাতজোড় করে মাফ চাইলেও রক্ষা নেই রানার। কিন্তু বেণ্ডারের হাতে রানা মরলে চলবে না ময়নিহানের।

হ্যাঁ, সঠিক সময়ে সে শেষ করে দেবে রিক বেণ্ডারকে।

তবে এখন নয়!

খুঁতওয়ালা পুতুলেরও দরকার আছে। ভোতা হাতুড়িও কাজে লাগে তক্তায় পেরেক গাঁথতে। রানা মরলে ওরই পথে যাবে রিক। তখন নরকে গিয়ে ট্যাড়া ভাইকে ফাঁক হয়ে যাওয়া গলা দেখিয়ে বিস্তারিতভাবে বলবে: ক্ষুরধারন্যাশ ময়নিহান সত্যিই দল-নেতা।

সড়াৎ করে ক্ষুর বের করল ময়নিহান। ডেস্ক থেকে নিল একটা কাগজ। ওটা দুআঙুলে টিপে ধরে ওপর থেকে নিচে নামাল ক্ষুরের ধারালো ফলা। কেটে দুটুকরো হয়ে টেবিলে পড়ল কাগজ।

ইস্পাতের পাতে দেখল নিজ চোখ। আনমনে জিজ্ঞেস করল, কতটা ভাল লাগবে রানার গলা নামিয়ে দিতে? …অনেক! অনেক!

.

শুয়ে থাকা দিগন্ত ছেড়ে আকাশে উঠছে সোনালি সূর্য। উইণ্ডস্টার গাড়ি নিয়ে ময়নিহান র‍্যাঞ্চের গেট পেরিয়ে গেল রানা.। এই গাড়ি গত চব্বিশ ঘণ্টায় বেশ কবার কাজে এলেও এবার বিদায় দিতে হবে এটাকে। জন যে কোম্পানি থেকে ভাড়া নিয়েছে, প্রাণে বাঁচলে পরে সেখানে ক্ষতিপূরণ পাঠিয়ে দেবে রানা।

দেখল ফিউয়েল মিটার। ফুরিয়ে এসেছে তেল। হয়তো উচিত ছিল ট্যাঙ্কে খানিকটা বাড়তি অকটেন রাখা। ওখান থেকে বের করে দুটো ক্যানে তেল ভরে পেছনের সিটে রেখেছে রানা। এখন ভয়ই লাগছে, গন্তব্যে পৌঁছুবার আগেই না বন্ধ হয় ইঞ্জিন! অবশ্য, ভুল হওয়ার কথা নয়। সামনে মাত্র একমাইল দূরেই র‍্যাঞ্চ হাউস।

অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেলে চাপ দিল রানা। দ্রুতগতি এখন ওর বন্ধু। হামলা করবে ময়নিহান র‍্যাঞ্চে। লড়াই না জিতে ফেরার পথ নেই।

রানার মনে দুশ্চিন্তা এসেছিল, র‍্যাঞ্চে হয়তো রয়ে গেছে নিরীহ কেউ। পরে বুঝেছে, ময়নিহানের পশুর দল ছাড়া কোনও মানুষ থাকবে না ওখানে। ভাল করেই জানে, আবারও হামলা করবে রানা। কাজেই ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এমন কাউকে আশপাশে রাখবে না সে। এ কথা ভেবেই নিজের প্ল্যান গুছিয়ে নিয়েছে রানা। ভাবছে, ও কামিকাযি পাইলটের মত। তবে ওর থাকবে ইজেক্টর সিট।

সগর্জনে ঝড়ের বেগে চলেছে উইণ্ডস্টার। আরও বাড়ছে গতি। যেখান থেকে জুডি ও নিনাকে সরিয়ে নিয়েছিল রানা, সে জায়গাটা পিছিয়ে গেল বিদ্যুদ্বেগে। জমির একটা ভাঁজ পেরোল গাড়ি। প্রথমবারের মত দেখা গেল দূরে বিশাল র‍্যাঞ্চ হাউস। আধুনিক নয়। ন্যাশ ময়নিহান নিজেও হয়তো এ যুগের জন্যে উপযুক্ত নয়। উচিত ছিল কয়েক শ বছর আগে জন্ম নেয়া। হয়তো হতো জলদস্যুদের নামকরা খুনে নেতা। কয়েক সেকেণ্ড পর প্রথম আধুনিকতা চোখে পড়ল রানার। রাস্তার পাশের নালা থেকে উঠল এক লোক। মুখে তুলল রেডিয়ো। তার উল্টোদিকের মাঠের কিনারায় আরেক লোক। সরাসরি রানার গাড়ির দিকে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল তাক করল সে। চোখে চশমা। আগে কখনও তাকে দেখেনি রানা। তবে জুডির কাছে শুনেছে, তার নাম রডনি জ্যাকসন। একে অজ্ঞান করে পালাতে চেয়েছিল জুডি। সবার মধ্যে সে নাকি কিছুটা বিবেকবান।

ভুল ভেবেছ, জুডি, এ রাইফেল তাক করছে অচেনা মানুষকে খুন করতে, মনে মনে বলল রানা। আরও বাড়াল ইঞ্জিনের গতি। পরমুহূর্তে এক পশলা গুলি লাগল গাড়ির সামনের দিকে। ছিঁড়েখুঁড়ে গেল ধাতব দেহ। নানাদিকে লাফ দিল কমলা স্ফুলিঙ্গ। কান ফাটানো আওয়াজ তুলছে রাইফেল। সিটে প্রায় শুয়ে পড়েছে রানা। বামহাতে হ্যাণ্ডেল টান দিয়ে খুলল দরজা। ওর জ্যাকেটে জোর টান দিল বুলেট, নাকের ডগা দিয়ে তাপের হলকা ছুটে চলে গেল।

দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপ দিল রানা। কয়েক গড়ান দিয়ে উঠেই ওয়ালথারের গুলি পাঠাল রেডিয়োওয়ালার দিকে। ওর প্রথম গুলিতে ফুটো হয়েছে লোকটার গলা। পিছিয়ে গেল সে, হাত থেকে পড়ে গেছে রেডিয়ো। চিত হয়ে পড়ল মাঠের ভেতর।

চশমাওয়ালা গুলি শুরুর পর পেরিয়ে গেছে পাঁচ সেকেণ্ড। লাফিয়ে দূরে পড়েছে রানা, দেখেনি লোকটা। মনোযোগ গাড়ির ওপর। খালি করছে ম্যাগাযিন। বুলেটের আঘাতে ফুটো হচ্ছে উইণ্ডস্টারের পাতলা খোলস।

তাকে আরও গুলি করতে দিল রানা। ওর কাজেই সহায়তা করছে সে।

দুসেকেণ্ড পর চশমাওয়ালার গুলি বিঁধল ঠিক জায়গায়। বিস্ফোরিত হলো গাড়ির পেছন সিটে রাখা ক্যানিস্টার। উইণ্ডস্টারের পেট থেকে ছিটকে উঠল আগুনের নীল ফুটবল। মাঠের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ভাঙা ধাতব খণ্ড। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শুকনো ঘাস। অকটেন নিভে যেতেই ভকভক করে বেরোল কালো ধোয়া। ইঞ্জিন বন্ধ হলেও জ্বলন্ত চাকায় ভর করে সোজা র‍্যাঞ্চ হাউস লক্ষ্য করে ছুটছে গাড়ি।

রডনি জ্যাকসনের দিকে পিস্তল তাক করল রানা। আগুনভরা গাড়ি দেখছে লোকটা। বুঝতে পারেনি কী ভুল করে বসেছে। বিজয়ের ছাপ পড়ল মুখে, কিন্তু দুসেকেণ্ড পর চোখে ফুটল অবিশ্বাস। নীল শিখা নিয়ে কাঠের বাড়ির দিকে চলেছে গাড়ি।

হায়, ঈশ্বর!

এবার বুঝেছ, বিড়বিড় করল রানা। পরক্ষণে টিপল ট্রিগার। জ্যাকসনের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে পিঠ ফুটো করে বেরিয়ে গেল গুলি।

কালো, কটুগন্ধী ধোঁয়ার পেছনে ছুটল রানা। চলেছে বাড়ি লক্ষ্য করে। রাস্তার গর্তে এখানে-ওখানে জ্বলছে অকটেন। আঁধার হয়েছে চারপাশ। স্বস্তি বোধ করছে রানা। কাউকে দেখছে না, বাড়ি থেকেও ওকে দেখবে না কেউ।

ফুটো হওয়া জ্বলন্ত চাকায় ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে গাড়ি, কমে গেছে গতি। লিটল ফোর্কের রেস্টুরেন্টের মত বাড়ি ভেঙে ঢুকবে না এই গাড়ি। তবুও ধপাক আওয়াজে লাগল বাড়ির বামদিকে। রানার মনে হলো, মুহূর্তের জন্যে দুলে উঠেছে বিশাল ম্যানসন। পরক্ষণে কালো ধোঁয়ায় আড়াল হলো সব। রানা দৌড়ে চলেছে তীরের বেগে। কসেকেণ্ড পর দেখল, শুকনো কাঠের বাড়ির গা চাটছে ধোঁয়া ও লকলকে কমলা আগুন। কাজে লেগেছে ওর চলন্ত আগুনে বোমা।

ছুটতে ছুটতে চোখের কোণে নড়াচড়া দেখল রানা। ঘাসের মাঝ দিয়ে ছুটে আসছে এক লোক। কাঁধে তুলল রাইফেল। গুলিও করল, কিন্তু লক্ষ্যভেদের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। রানার মাথার ওপর দিয়ে গেল বুলেট। এক সেকেণ্ড পর বাড়কে দেখল রানা। লোকটার পাজরে ঢুকল ওর কমাণ্ডো নাইফ। নিচ দিয়ে ঢুকে ডগা পৌঁছে গেল হৃৎপিণ্ডে। মুহূর্তে খুন হয়েছে লোকটা। লাশটা মাঠে পড়ার আগেই হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিল বাড। নিচু হয়ে দৌড়ে আবারও উধাও হলো কোথায় যেন।

মারা গেছে শত্রুপক্ষের তিনজন। আর কজন আছে, জানা নেই। দৌড়ে চলেছে রানা। এখনও বড় কোনও বিপদ হয়নি। জ্বলন্ত উইণ্ডস্টার গাড়িটা পাশ কাটিয়ে উদ্যত ওয়ালথার হাতে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল রানা।

ওপরতলায় পদশব্দ। লাথি মেরে দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকল বিসিআই এজেন্ট। ঝট করে সরে গেল কবাটের একপাশে। কাভার করেছে কিচেন। মাথার ওপরে মেঝেতে দৌড়ে যাচ্ছে কে যেন। কী যেন বলল চিৎকার করে। দূরে গুলির আওয়াজ। বাড়ির পাশে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ছে জন বা বাড।

রানার বামে কাঠের দেয়াল চাটছে কমলা আগুন। একটু পর আগুনে পুড়বে বাড়ির এদিকটা। লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়বে পুরো বাড়িতে। তার আগেই পালিয়ে যেতে পারে ন্যাশ ময়নিহান। তার খোঁজে চলল রানা। ওদিকের দরজা পেরোবার আগে দেখল প্যাসেজওয়ে।

কেউ নেই।

 টার্গেট খুঁজছে রানা।

মাথার ওপর ছুটন্ত পদশব্দ। বাড়িতে আগুন ধরতেই সিঁড়ি লক্ষ্য করে ছুটছে কেউ। প্যাসেজওয়ের একপাশে সরু সিঁড়ি গেছে দোতলায়। উঠতে হবে ওপরে, কিন্তু সিঁড়ির আগে দুপাশে ঘরের দরজা। কবাটের ওদিকে থাকতে পারে কেউ। বাইরে জন ও বাডের তুমুল গুলি। কড়কড়-পড়পড় আওয়াজে পুড়ছে কাঠ। বাইরে উইণ্ডস্টারে হলো ভোতা বিস্ফোরণ। বোধহয় ওটা দ্বিতীয় ক্যানিস্টার। আশপাশে নেই ময়নিহান বা রিক বেণ্ডার। মুহূর্তের জন্য রানার মনে হলো, বিপদ বুঝে পালিয়ে গেছে লোকদুটো। পরক্ষণে বুঝল: তা হওয়ার নয়। তারা অপেক্ষা করবে ওকে খুন করতে।

ডানের দরজা খুলে সবকিছুর ওপর দিয়ে পিস্তলের নল ঘুরিয়ে আনল রানা।

কেউ নেই।

 আছে শুধু কটা ওয়াশিং মেশিন।

বামের দরজা খুলল রানা।

খালি।

আবার মনোযোগ দিল সিঁড়ির নিচের দিকে। ওপরে কে যেন দৌড়ে যাচ্ছে বাড়ির পেছন লক্ষ্য করে। ধাওয়া করতে হবে। তবে আগে নিশ্চিত হতে হবে কেউ নেই পেছনে।

ওয়ালথার তাক করে পরের দরজা খুলল রানা। কিন্তু তখনই ওর পিস্তল ধরা কবজিতে প্রচণ্ড জোরে ঠাস্ করে নামল কী যেন! ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেল ওর মুখ। প্রায় অবশ হয়েছে হাত। প্রাণপণে ধরে রাখল ওয়ালথার। ঝন্টু করে ওপরে তুলল বামহাত। মুখ লক্ষ্য করে ঘুষি আসতেই কনুই তুলে ঠেকিয়ে দিল হাতটা। তখনই বুকে লাগল হাঁটুর প্রচণ্ড গুতো। হুড়মুড় করে পড়তে গিয়েও টলমল করে বেরোল প্যাসেজওয়েতে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পিঠ ঠেকল দেয়ালে। পরক্ষণে বামহাতে ওয়ালথার নিল ও। গুলি করল লোকটাকে লক্ষ্য করে। ছুটে আসতে গিয়েও ঝটকা খেয়ে থামল সে। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ঘোড়ার মত পিছন পায়ের লাথি দিয়েছে .৩৮ গুলি। রানা আবছাভাবে দেখল, লোকটার পরনে কেভলার ভেস্ট। আবারও সামনে বাড়ল আততায়ী, এবার তারও হাতে উঠে এসেছে পিস্তল।

ঝট করে আরেকদিকে সরল রানা। মাথার পাশে কাঠের দেয়ালে গর্ত তৈরি করল বুলেট। বুকে পিস্তল তাক করলে এতক্ষণে লাশ হতো ও। নিজে ভুল করতে চাইল না রানা, ওয়ালথার তুলেই গুলি করল লোকটার কপাল লক্ষ্য করে। ছিটকে ওদিকের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ওখান থেকে মেঝেতে পড়ল লাশ। বয়স হবে অন্তত পঞ্চাশ। রানার মনে পড়ল, জুডিকে সরিয়ে নেয়ার সময় এর গুলিতেই আহত হয়েছিল ও।

আগুনে কড়মড় আওয়াজে ফাটছে দেয়াল ও মেঝে। প্যাসেজ ভরে উঠছে ধোঁয়ায়। ক্রমেই বাড়ছে তাপ।

সিঁড়ির দিকে তাকাল রানা। উঠতে হবে ওপরে। হাতে সময় নেই। সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই ওপরতলা থেকে এল চিৎকার: পার্কার! পার্কার? শেষ করতে পেরেছ?

না, পারেনি, মনে মনে বলল রানা। ওপরের লোকটার গলা ময়নিহান বা রিক বেণ্ডারের নয়।

বাড়ির পেছন থেকে এল গুলির আওয়াজ।

জন ও বাড দুজনই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। পাগল করে দিয়েছে ময়নিহানের ভাড়াটে খুনিদেরকে। বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেবে রানা, তবে আগে রয়ে গেছে একটা কাজ। ময়নিহানের এক লোকের আছে যৌন বিকৃতি, চরম অপমান করেছে জুডিকে। লোগান টার্সন নামের ওই লোককে শেষ করবে রানা। মুখে হাত চেপে আমেরিকান সুরে বলল, কে? টান?

হ্যাঁ, জবাব দিল সে। কুত্তার বাচ্চা শেষ?

হ্যাঁ, খতম, নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে রানা।

.

৪০.

 প্রতিশোধের উপযুক্ত সময় এসেছে রিক বেণ্ডারের। পাত্তা না দিলেও চলে ন্যাশ ময়নিহানকে। র‍্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছে গেছে মাসুদ রানা। এবার মরবে এতে ভুল নেই। কিন্তু কল্পনায় যে লড়াই চেয়েছে রিক, হয়তো তেমনটা হবে না। মুখোমুখি লড়বে না বাদামি লোকটা। জ্বলন্ত বাড়ির মধ্যে কীভাবে মরবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ধোঁয়ায় শ্বাস আটকে? শুয়োরের মত পুড়ে রোস্ট হয়ে? নাকি খুন হবে বদমাসটা কারও গুলিতে?

সেক্ষেত্রে সারাজীবনেও আফসোস যাবে না রিকের।

দেরি না করে খুঁজে বের করতে হবে মাসুদ রানাকে। এতে বাধা দিলে গুলি করে ময়নিহানের মাথা উড়িয়ে দেবে রিক। কিন্তু নিজে যে সে গুলি করে রানাকে মারতে পারবে, তার নিশ্চয়তা নেই। অথচ, মগজে সর্বক্ষণ গর্জন ছাড়ছে নিক। বলে চলেছে: বড়ভাই হয়েও মিথ্যা বলেছ! তোমার না কথা ছিল মাথা ছিঁড়ে নেবে মাসুদ রানার!

যখন জীবিত ছিল, বেশি কথা বলত নিক। এখনও তাই করছে রিকের মগজের ভেতর। সর্বক্ষণ বিরক্ত করত বলে কতুবার তাকে খুন করতে চেয়েছে রিক! তবুও এখন কেন জানি, নিক মরে গেছে বলেই হয়তো, খুব কষ্ট লাগে বুকে।

হ্যাঁ, ছোটভাইকে খুশি করতে সবই করবে রিক। বিড়বিড় করল, চুপ, নিক! বলেছি না নিজ হাতে খুন করব? আগে বেরোতে দাও এখান থেকে!

শোঁ-শোঁ গর্জন ছাড়ছে আগুনের হলকা।

মড়াৎ করে ভেঙে পড়ল বেডরুমের পেছন-দেয়াল।

মৃত ভাইয়ের কথা শুনতে পেয়ে অস্বস্তি বোধ করছে রিক। ও যা বলছে, মোটেও শুনছে না নিক। জোরে উচ্চারণ করেও লাভ হচ্ছে না। কিন্তু দেয়াল ধসে পড়ায় থেমেছে নিকের অনুযোগ। এবার এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে খাপ পেতে অপেক্ষা করবে রিক রানার জন্যে।

দোতলার বেডরুমে আছে সে। জেগে ছিল দুদিনের বেশি। তাই ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল শরীর। তাই একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিল।

এখন বাজে কয়টা?

হয়তো ঘুমিয়েছে বড়জোর পাঁচ মিনিট।

 আবার হতে পারে কয়েক ঘণ্টা।

একটা গাড়ি এসে গুঁতো দেয়ায় আগুন জ্বলে উঠেছে বাড়িতে। তখনই আচমকা জেগে উঠেছে রিক। ঘরে ঢুকেছে কয়েকটা গুলি। বাইরে থেকে গুলি করে সবাইকে বাড়ির আরেকদিকে পাঠাতে চাইছে কেউ। গুলির ভয়ে নয়, জীবন্ত পুড়ে মরার ভয়ে সরে যেতে হবে ওকে এখান থেকে।

গুলির শব্দ নিচতলায়। বাইরেও গোলাগুলি। বিছানা থেকে নেমে বেডরুমের দরজা খুলে খালি প্যাসেজে উঁকি দিল রিক। হাত কোমরের হোলস্টারে। ডের্ট ঈগল পিস্তল বের করে প্যাসেজে বেরিয়ে এল সে। সামনের এক ঘর থেকে ছিটকে বেরোল এক লোক। তাকে চিনল রিক। ওই শালার নাম লোগান টার্সন। তাকে বাঁচতে দেয়া যাবে না। আগে হোক বা পরে, রানা বা রিকের হাতে মরবে সে। আগেই পথের কাঁটা নিকেশ করা ভাল ভাবলেও পিস্তল তুলল না রিক। লোগান টার্সন যোগ্য লোক না হলেও কাজে আসবে।

লোগান? ডাকল রিক। চরকির মত ঘুরে পিস্তল তাক করল লোকটা। এক সেকেণ্ড পর বুঝল রিক বেণ্ডার তাদেরই লোক। অস্ত্র নামিয়ে ফেলল সে। ময়নিহান কোথায়?

বাড়ির পেছনে। চোখ বিস্ফারিত করে রিককে দেখছে লোগান। ক্রিমির পেটের মত ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ। রিক খেয়াল করল, একটু কাঁপছে তার পিস্তল ধরা হাত।

রানা তো সামনে। পেছনে কী করছে ময়নিহান?

অন্যরা যা করছে! আগুনে পুড়ে মরার আগেই বেরোতে চাইছে বাড়ি ছেড়ে!

ক’পা সামনে বেড়ে লোগানের কলার চেপে ধরল রিক। কাজের জন্যে পয়সা দিচ্ছে তোমাকে, পালিয়ে যাওয়ার জন্যে নয়!

তা ঠিক, কিন্তু পয়সার লোভে উন্মাদটার হাতে জান দেব? পুরো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে শালা!

নিজের কাজ করো, ধমকের সুরে বলল রিক। নইলে রানার হাতে নয়, খুন হবে ময়নিহান বা আমার হাতে। লোগানের ঘাড় ধরে সিঁড়ির দিকে ঠেলে নিয়ে চলল সে। সিঁড়ি পাহারা দেবে।

নিচের ল্যাণ্ডিঙে হ্যাঙ্ক পার্কার আছে।

ওকে খতম করবে রানা, বলল রিক। দ্বিধা নেই কণ্ঠে।

ভাবছ তাকে খুন করতে পারব আমি? আপত্তির সুরে বলল টার্সন।

না, চাইছি তুই মর, শালা, ভাবল রিক। রানাকে দেরি করিয়ে দিবি, আর সে সুযোগে বাড়ি থেকে বেরোব আমি। যে ঘর থেকে এসেছে, ওই দরজা দিয়ে আসছে এখন ঘন কালো ধোঁয়া। কঠোর চোখে লোগানকে দেখল রিক। অন্তত ঠেকাতে চেষ্টা করো, কাপুরুষ!

তুমি কী করবে?

বুকে আঙুল ঠুকল রিক। আমি? অন্য সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাব। খুন করব হারামজাদাটাকে।

সিঁড়ির মুখে লোগানকে রেখে করিডোর ধরে ঝেড়ে দৌড় দিল রিক। দূরে এক ঘরের দরজার ওদিকে বারান্দা। ওটা ধরে পুরো বাড়ি ঘুরে আসতে পারবে। ছুটতে ছুটতে শুনল লোগান টার্সনের প্রশ্ন: পার্কার! পার্কার? শেষ করতে পেরেছ?

থমকে দাঁড়াল রিক। পার্কার রানাকে খুন করতে পারলে নিজের হাড়ের মত শক্ত বুট চিবিয়ে খেতেও আপত্তি তুলবে না ও! নিচতলা থেকে জবাব দিয়েছে কেউ। কিন্তু আগুনের গর্জনে রিক বুঝল না কে সে। ওপরের প্যাসেজ ভরে উঠছে কুচকুচে কালো ধোঁয়ায়। ওদিকে লোগান। কাশছে খুকখুক করে।

আগের প্ল্যান অনুযায়ী শেষ ঘরের দিকে চলল রিক। হাঁক ছাড়ল, ময়নিহান! থামল ওই ঘরের কাছে পৌঁছে। দরজা সামান্য খোলা। অনুচিত হবে অনুমতি না নিয়ে ঘরে ঢোকা। চমকে গিয়ে গুলি করতে পারে ময়নিহান।

বস, আমি, রিক বেণ্ডার। ধীরে ধীরে কবাট ঠেলে সরাল রিক। গুলি এল না। ঘরে কেউ নেই। সাবধানে কবাটের পেছনদিক দেখল। বস্ শালা ওর ক্ষুর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে খুন হবে।

না, সে নেই কবাটের আড়ালে।

বারান্দায় যাওয়ার দরজা খোলা।

ঘর পেরিয়ে বাইরে উঁকি দিল রিক। বাড়ির পেছনে যাওয়ার জন্যে ছুটছে এক লোক, পরনে মিলিটারি ফ্যাটিগ। ওই একই জিনিস সবাইকে দিয়েছে ময়নিহান। তবে এর বেসবল ক্যাপের নিচে ধূসর খাটো চুল। ওই যে ময়নিহান!

বারান্দায় বেরিয়ে পিছু নিল রিক। কিন্তু তখনই পাশের বাড়ি থেকে শটগান তাক করল এক লোক। চুল কালো। ঠোঁটে হাসি। গুলি করার আগেই একলাফে সরে গেল রিক। পাশের দেয়ালে বাস্কেট বলের সমান একটা গর্ত তৈরি করল বাকশট।

পাল্টা গুলি পাঠাল রিক। হাঁতে কামানের মত লাফিয়ে উঠেছে ডেযার্ট ঈগল। কিন্তু আগেই সরে গেছে হারামি লোকটা।

বন্দুকওয়ালাটা আবার কে! জন হার্বার্ট সম্বন্ধে মারি কিটনের কাছে যা বলেছে ময়নিহান, তার কিছুই জানে না রিক।

বাড়ির পেছনে ঠা-ঠা শব্দে গর্জে উঠল এম সিক্সটিন। খুবলে গেল বারান্দার রেলিং। পরক্ষণে গুলির তাড়া খেয়ে আবারও বাঁক ঘুরে ছুটে এল ময়নিহান। দুহাতে ঢেকেছে মাথা। যেন এভাবে বাঁচাতে পারবে ওটাকে। পেছনের দেয়ালে বিঁধল একরাশ গুলি। নানাদিকে ছিটকে গেল কাঠের কুচি। দৌড়ে সরতে গিয়ে পিছলে মেঝেতে ধুপ করে পড়ল ময়নিহান। তার দিকে ছুটল রিক। একবার দেখে নিল কাঁধের ওপর দিয়ে। শটগানওয়ালা এলে মহাবিপদ। কাছে পৌঁছে বসের হাত ধরে টেনে তুলল সে।

আমরা যেমন প্ল্যান করেছি, ঠিক তেমনটা হচ্ছে না, কী বলেন, বস্?

বাড়ির দেয়ালে হেলান দিল ময়নিহান। বিস্ফারিত দুই চোখ। এই প্রথম তাকে দুশ্চিন্তায় পড়তে দেখছে রিক। সব সময়ের হাসিটা উধাও হয়েছে শালা বসের।

বাড়ির পেছনে কুচকুচে এক বদমাস, হাতে সাবমেশিন গান, বলল ময়নিহান, আরেকটু হলেই আমাকে দুটুকরো করে ফেলত।

বুড়ো আঙুল দিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে দেখাল রিক। ওদিকে জাপানি একজন। সে-ও সুবিধার লোক না। বলুন তো, বস্, এখানে হচ্ছেটা কী?

ভুরু কুঁচকে ফেলল ময়নিহান। রানার কারণে শুরুতেই খতম হয়েছে তিন গানম্যান। একজনকে ভুল করে মেরে ফেলেছে আমাদেরই কেউ। অন্যজন মরেছে কেলে ব্যাটার হাতে। তা হলে আমরা বাকি থাকলাম কজন, রিক?

সিণ্ডিকেটের লোক বলতে লোগান টার্সন, বলল রিক। বুঝে গেছে, ওই লোকও বেশিক্ষণ নেই। ও বলল সিঁড়ির ল্যাণ্ডিঙে আছে পার্কার।

তা হলে আমরা চারজন, আর ওরা তিনজন। এখনও আমাদের জেতার সম্ভাবনাই বেশি।

আঙুলের কড়া গুনে বলল রিক, মারি কিটন কই?

অন্য কাজে পাঠিয়েছি, ময়নিহানের কন্ঠে আফসোস। মাথা থেকে বেসবল ক্যাপ খুলে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। বড় ধরনের ভুল হয়ে গেছে।

চোখ পিটপিট করল রিক। মারি গেছে কোথায়?

ওই দুই মেয়েকে শেষ করতে টাম্পা শহরে, বলল ময়নিহান। ঝট করে কুঁজো হয়ে বসে পড়ল। নিজেও একই কাজ করেছে রিক। বন্দুকের ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হলো মাথার একটু ওপরের দেয়াল।

মর, কুত্তার বাচ্চা! গলা ফাটাল রিক।

আটকা পড়েছি, বলল ময়নিহান, বেরোতে হবে এই ফাঁদ থেকে।

আমি খুন করব মাসুদ রানাকে, জেদ ভরা কণ্ঠে বলল রিক।

অন্যদের কী হবে?

ওরাও বাঁচবে না। মাথা সামান্য ওপরে তুলেও নামিয়ে নিল রিক। এইমাত্র দেয়ালে লাগল আরেক পশলা এম সিক্সটিনের গুলি। অতবড় শরীরটা নিয়ে মেঝেতে মিশে যেতে চাইল সে। কিন্তু ঠিকই বলেছেন, আগে বেরোতে হবে এই গাড়া থেকে।

পাশের বাড়িটার সঙ্গে এই বাড়ির ব্যবধান দেখল রিক। কাছের রুম থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেরোচ্ছে ঘন ধোঁয়া।

বেরোবার পথ তো দেখি না, বলল রিক। লড়াই করে বেরোতে হবে, নইলে মরব পুড়ে।

ওদের গুলিতে মরতে চাই না, বলল ময়নিহান।

এ ব্যাপারে আমিও একমত, বস, বলল রিক। ওদের চেয়ে ভাল যোদ্ধা আমরা।

ঠোঁট বাঁকা করে নকল হাসি হাসল ময়নিহান। টেনে নিল পিস্তলের স্লাইড। অস্ত্রটা চোয়ালের পাশে ধরল, যেন জেম্স্ বণ্ড মুভির নায়ক। রওনা হও, রিক। কাভার দেব।

ময়নিহানের দিকে তাকাল রিক। মনে পড়ল, এই হাঁদা শালার পা চেটেই পেট চালাত সে। এই শালাই লবস্টার থেকে মাংস খুঁটে খেত আর অপমান করত ওর লক্ষ্মী ছোটভাই নিককে। শীতের মধ্যে রাস্তায় থাকত বেচারা। হঠাৎ করেই রিক বুঝল, ময়নিহান, আসলে কী। বদ্ধউন্মাদ সাইকোপ্যাথ! কুত্তাটার ধারণা সে দুনিয়ার রাজা!

ময়নিহানের কথা ভুলে উঠে দাঁড়াল রিক। ভাবছে, শত্রু বলতে ওই তিনজন। গুলি করেও ওকে থামাতে পারবে না। লড়তে পারবে ময়নিহান আর সে। তবে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে মাসুদ রানা। ময়নিহানের দিকে তাকাল রিক। ঠিক আছে, বস, ওই দুজনকে খতম করতে যাচ্ছি।

রেলিং টপকে কার্নিশে নেমে পাশের বাড়ি লক্ষ্য করে লাফ দিল রিক। উড়ে চলেছে দানব শূন্যে। বিশ ফুট নিচে শক্ত জমিন।

.

৪১.

 ছেঁড়া ছিল জুডির ব্লাউস। স্তনে খামচির দাগ। লেক তীরে কেবিনে রানাকে বলেছে ও, কীভাবে ওকে চরম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেছে লোগান টার্সন নামের এক পশু। কখনও ভুলবে না সেই অপমান। এবং এ কারণে টার্সনের প্রাপ্য কঠিন শাস্তি। সেটা দেবে ঠিক করেছে রানা। এখন দোতলায় সিঁড়ির মুখে আছে লোকটা।

অন্য কেউ হলে গুলি করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠত, সেটা করবে না রানা। ওপরের লোকটা ধরে নিয়েছে ও মারা গেছে পার্কারের হাতে। তবুও সতর্ক হয়ে একটা একটা করে ধাপ টপকে উঠছে রানা। ধোঁয়ার ওদিকে টার্সন। একবার গুঙিয়ে উঠল রানা। যে-কেউ ভাববে পার্কার আহত। এতে অসতর্ক হওয়ার কথা টার্সনের।

শালা শেষ, কিন্তু গুলি লেগেছে, ওহ্, আমেরিকান টানে চাপা স্বরে বলল রানা।

কোথায় লাগল গুলি? ওপর থেকে জানতে চাইল টার্সন। মাত্র সাত ধাপ ওপরেই দোতলায় আছে সে।

ছয় ফুট নিচের ধাপে মাথা নিচু করে রেখেছে রানা। চট করে দেখতে পাবে না লোকটা। চারপাশে ধোয়ার জাল। কয়েকবার কেশে উঠল রানা। যে-কেউ ভাববে ও আহত।

 কুত্তাটা মরেছে তো, পার্কার?

হ্যাঁ, শেষ, কয়েক ধাপ টপকে দোতলায় উঠল রানা। ডানদিকে লোকটা, হাতে পিস্তল। যেন ধরে নিয়েছে ওটার আর দরকার নেই। টলতে টলতে হাত বাড়াল রানা, যেন ধরবে রেলিঙের মত কিছু। নিজের হাত ওপরে তুলল টার্সন। সেটা সাহায্য করতে, না ওকে বিদায় করতে, সেটা বোঝা গেল না। খপ করে তার হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিল রানা।

মুহূর্তে টার্সন বুঝে গেল, সামনে কে!

রানা ভেবেছিল লড়াই করতে চাইবে লোকটা। কিন্তু তা না করে পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকাল সে। হাত তুলে ফেলেছে মাথার ওপর। চোখে-মুখে ভয়। সত্যিকারের কাপুরুষ। শক্ত কারও সামনে পড়লে নেতিয়ে পড়ে ভেজা মুড়ির মত।

টার্সনের চোয়ালের নিচে ওয়ালথারের নল ঠেকাল রানা। পার্কার মারা গেছে।

ঘন-ঘন মাথা নাড়ল টার্সন। প্লিয! হায়, ঈশ্বর! দয়া করে আমাকে খুন করবেন না!

আমি নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে করি না, নিচু গলায় বলল রানা। চারপাশে পাক খাচ্ছে ধোঁয়া। চুলোর গনগনে আগুনের মত বাড়ছে উত্তাপ। যে-কোনও সময়ে পুড়তে শুরু করবে গায়ের পোশাক। প্রচণ্ড রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে জানতে চাইল রানা, তোমার নাম লোগান টার্সন?

ভয়ে চুপ করে থাকল লোকটা।

 পিস্তল তার কানে ঠেকাল রানা। যে-কোনও সময়ে গুলি করবে। নানা দিকে ছিটকে যাবে মগজ ও রক্ত।

হ্যাঁ… আমি টার্সন। আমি এদের কেউ না!

 তা জানি, সেজন্যেই করে দেব বাঁচার সুযোগ।

বাঁচতে দেবেন আপনি?

হ্যাঁ। কিন্তু আর কখনও অত্যাচার করতে পারবে না কোনও মেয়ের ওপর।

টার্সনের পিস্তল নিচে তাক করল রানা। মাযল চেয়ে আছে লোকটার উরুসন্ধির দিকে।

মাত্র একবার ট্রিগার টিপল রানা।

তীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়ে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল টার্সন।

যদি নিচতলার আগুন পেরিয়ে বেরোতে পারো, হয়তো বাঁচবে তুমি।

প্রচণ্ড ব্যথায় গোঙাতে গোঙাতে সিঁড়ির দিকে ক্রল শুরু করল টার্সন। আগুন, ধোঁয়া বা ছিঁড়ে পড়া গোপনাঙ্গের রক্তপাতে হয়তো মরবে, তবে নিজের কথা রেখেছে রানা। লোকটা বাচলেও আর কখনও কোনও মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারবে না।

দূরে একটা দরজার ওদিকে বেডরুম। ওপাশের দরজা দিয়ে আসছে সকালের উজ্জ্বল সোনালি আলো। ওদিকে পা বাড়াবার আগে, কাঁধের ওপর দিয়ে একবার তাকাল রানা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছে টার্সন। গর্জে উঠল জনের মসবার্গ বন্দুক। বারান্দায় চাপা কণ্ঠ। আগুনের শোঁ-শোঁ আওয়াজে চাপা পড়েছে কথাগুলো। তবে তখনই রানা চিনল রিক বেণ্ডারের ভারী গলা। জবাবে কী যেন বলল ময়নিহান।

হ্যাঁ, এখন বারান্দায় রানার দুই চরম শত্রু!

খ্যাট-খ্যাট শব্দে গর্জে উঠল এম সিক্সটিন। ঘরের ছাত ভেদ করে অ্যাটিকে বিঁধল গুলি। প্ল্যান অনুযায়ী বাড়ির পেছনে শত্রুদেরকে কোণঠাসা করেছে জন ও বাড। ওয়ালথার উঁচিয়ে ঘরে ঢুকল রানা। প্রথম সুযোগে শেষ করবে ন্যাশ ময়নিহান ও রিক বেণ্ডারকে।

তখনই শুনল তক্তায় ধুপ আওয়াজ। দরজার ওপাশে দেখল উড়ে চলেছে বিশাল ছায়া। তিন সেকেণ্ড পর এল কাঠ ফাটার মড়াৎ শব্দ ও কাঁচ ভাঙার ঝনঝন। ঝাঁপ দিয়ে বারান্দা থেকে পাশের দালানে গিয়ে ঢুকেছে দানব রিক বেণ্ডার।

আপাতত মুখোমুখি হওয়া গেল না। রিককে হয়তো বাগে পাবে জন ও বাড। অথবা ওদেরকে পাবে দানবটা। রানার উচিত প্রথমে ময়নিহানকে শেষ করা। বারান্দার দরজার দিকে পা বাড়াল ও।

বাইরে বিড়বিড় করে গাল বকে চলেছে কেউ।

ঘর থেকেই তাকে শেষ করবে কি না, ভাবল রানা। অনায়াসেই কাঠের দেয়াল ভেদ করবে .৩৮ বুলেট। কিন্তু তাতে খচখচ করবে মন। বদমাসটা ময়নিহান হলে নিজ চোখে দেখুক, কার হাতে মারা পড়ছে সে।

খুব সাবধানে দরজার পাশে পৌঁছে গেল রানা। একপাশ থেকে দেখল হাঁটু গেড়ে ওর বন্ধুদের দিকে গুলি করছে ময়নিহান। নিঃশব্দে সামনে বেড়ে তার মাথার তালুতে ওয়ালথারের মামল ঠেকাল রানা। মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও।

ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ঘুরে ওকে দেখল ময়নিহান।

.

৪২.

 দুজন মানুষের চেয়েও ভারী একজন লোকের জন্যে কঠিন লং জাম্প দেয়া। গায়ের জোরে লাফ দিয়েছে রিক বেণ্ডার। কিন্তু কফুট যেতেই কমেছে গতি ও উচ্চতা। ভেবেছে ঢুকবে ওদিকের বাড়িটার জানালা ভেঙে। তবে করেছে ভুল হিসাব। জানালার পর্যন্ত না পৌঁছলেও ওজন কাজে এল রিকের। পা দিয়ে আছড়ে পড়তেই মড়াৎ করে ভাঙল দেয়াল। ঝনঝন করে ভাঙল জানালার ফ্রেম ও কাঁচ। ওর কপাল ভাল সরাসরি সামনে ছিল না কাঠের কলাম। রকেটের মত ধুলো ভরা মেঝেতে পিছলে গেল সে।

উঠে বসে হাত দিতেই টের পেল, কপাল কেটে ঝরঝর করে পড়ছে রক্ত। পায়ের আঘাতে দেয়াল ভেঙে ঢুকলেও ক্ষত তৈরি হয়েছে মাথায়। জানা নেই জানালার নিচের চৌকাঠে লেগে এই হাল। উত্তেজনা কমলে শুরু হবে ভীষণ ব্যথা। ওর প্রথম কাজ কী তা বুঝে গেল রিক। অস্ত্র হাতে ওই দুজন আছে কাছেই কোথাও। আপাতত তাদের বিরুদ্ধে লড়বে না সে। সঠিক সময় আসুক। দুহাতে ছিঁড়ে ফেলবে ওদেরকে। একজনের হাতে এম সিক্সটিন রাইফেল, অন্যজনের কাছে শটগান। এখন এড়িয়ে যেতে হবে, নইলে ভণ্ডুল হবে ন্যাশ ময়নিহানের প্ল্যান। মরুক হারামজাদা!

এখনও মুঠোয় ডেযার্ট ঈগল পিস্তল, রানার দুই সঙ্গীকে ভয় দেখাতে তিনটে গুলি দেয়ালের ওদিকে পাঠাল রিক। হাতে সময় চাই। ভেবে বের করতে হবে এবার কী করবে। দুসেকেণ্ড পর মন বলল, আগে সরে যা এখান থেকে। তারপর একজন একজন করে ওদের দুটোকে শেষ করবি।

উঠে দৌড় শুরু করল রিক। পরিত্যক্ত কিছু খামারের যন্ত্রপাতি পাশ কাটিয়ে তীরের বেগে ছুটল বাড়িটার সদর দরজা লক্ষ্য করে। কিন্তু ওই পথে বেরোলে সামনে পড়বে বন্দুকওয়ালা। বাঁক নিয়ে বাড়িটার পাশের দরজার দিকে চলল রিক। দরজা তালাবদ্ধ কি না দেখতে গেল না, দুহাত সামনে বাড়িয়ে ওটার ওপর হামলে পড়ল যুদ্ধের ট্যাঙ্কের মত। কবজা ছুটিয়ে দড়াম করে বাইরের আছড়ে পড়ল দরজা। না থেমে বামে বাক নিয়ে পাশের বাড়ির মাঝের প্যাসেজওয়ে ধরে ছুটল রিক। ডানের ছাউনিতে রয়েছে ন্যাশ ময়নিহানের বিধ্বস্ত কপ্টার।

 প্যাসেজওয়ে শেষ হতেই থমকে দাঁড়াল রিক। উঁকি দিল বাড়িটার দিকে। এদিকেই কোথাও আছে কালো লোকটা। কিন্তু দেখা গেল না তাকে। ধুপধাপ আওয়াজে পাথুরে জমিতে দৌড় দিল রিক। একটু দূরেই হেনির ক্যাডিলাক। আগেই খুলে রেখেছে নরম চামড়ার ছাত, দরজা না খুলে প্রায় ঝাঁপিয়ে উঠল ড্রাইভিং সিটে। মুচড়ে দিল ইগনিশন চাবি। প্রথমবারেই গর্জে উঠল ক্যাডিলাকের ইঞ্জিন। রিক জানে, পালিয়ে যাচ্ছে না সে। সুযোগ বুঝে হামলা করবে রানা ও ওর বন্ধুদের ওপর। ময়নিহানের মত গাধা নয় সে, দুনিয়ার মানুষকে দেখাতে হবে- সে-ই সেরা তুলনাহীন! ময়নিহান শালা সত্যিকারের বুরবক! মরুক হারামজাদা!

অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে অর্ধবৃত্ত তৈরি করে ক্যাডিলাক নিয়ে সোজা গবাদি রাখার ছাউনির দিকে চলল রিক। ঝড়ের গতি তুলছে গাড়ি। এল না একটা গুলিও। নিশ্চয়ই বোকা বনে গেছে কেলে ভূত!

কসাইখানা পাশে রেখে ছুটছে ক্যাডিলাক। নাকে এল পচা রক্ত ও গোবরের বিশ্রী দুর্গন্ধ। তীরের বেগে বাক নিল রিক। সামনেই কোথাও আছে বন্দুকওয়ালা। ওর মাথা উড়িয়ে দেয়ার আগেই খুন করতে হবে তাকে।

সিটে গুটিয়ে বসার তুলনায় রিক প্রকাণ্ড। শুয়ে পড়লেও টার্গেট হিসেবে থাকবে বাস্কেট বলের সমান মাথাটা। কিছুই করার নেই। কপ্টারের বাড়িটার কোনা ঘুরে ছিটকে বেরোবে সে। আশা করা যায় মরবে না গুলি খেয়ে। পেছনে পড়ল আগের বাড়ি। ওখানেই দেয়াল ভেঙে ঢুকেছে সে।

বাঁক নিতেই দেখল জাপানি চেহারার লোকটাকে। বন্দুক তাক করেছে বারান্দার দিকে। বারান্দা দেখল রিক। ন্যাশ ময়নিহানের মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাসুদ রানা। পরে তার ব্যবস্থা নেবে সে, আগে শেষ করতে হবে জাপানি শালাকে। ডের্ট ঈগল তুলেই গুলি করল রিক।

চরকির মত ঘুরেই ধুপ করে মাটিতে পড়ল জন হার্বার্ট। এত জোরে ছুটছে ক্যাডিলাক, রিক বুঝল না লোকটা মরেছে কি না। ঝড়ের বেগে চলেছে ক্যাডিলাক। চারপাশে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া। বাতাসে উড়ছে জ্বলন্ত পঙ্গপালের মত ছাই ও স্ফুলিঙ্গ। এরই ভেতর ধসে পড়েছে বাড়ির সামনের দিক। তাতে কী, তীরের বেগে ছুটতে ছুটতে আবারও গাড়ি ঘুরিয়ে নেবে রিক। আবার তেড়ে যাবে বাড়ির পেছন দিয়ে।

ঘন ধোঁয়া থেকে পরিষ্কার জায়গায় বেরোল দ্রুতগামী ক্যাডিলাক। সামনেই ঢালু রাস্তা। ওখানেই অ্যাম্বুশ করেছিল রডনি জ্যাকসন। ঢালু রাস্তায় চাকা পিছলে ঘুরে গেল ক্যাডিলাক, আবার ছুটল বাড়ির দিকে। গতি প্রচণ্ড। নতুন করে ধোয়ার জালে ঢুকছে রিক। শিয়োর হতে ৩৫৭ বুলেট গেঁথে দেবে জাপানির বুকে। ক্যাডিলাকের চারপাশে হলদে লাল-কমলা স্ফুলিঙ্গ। ধোঁয়ায় ভীষণ জ্বলছে রিকের চোখ। কিছুই পাত্তা না দিয়ে গতি তুলছে ক্যাডিলাক গাড়ির। দেখল, সামনেই জ্বলন্ত বাড়ি থেকে বেরোল এক লোক। আগুন ধরে গেছে পোশাক, চুল ও সারাশরীরে। প্রাণপণে বিকট আর্তচিৎকার ছাড়ছে সে, টলতে টলতে সরাসরি চলে এল ক্যাডিলাকের চলার পথে।

চাইলেও বাঁক নিতে পারবে না রিক।

সরাসরি লোকটাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল ভারী ক্যাডিলাক। ছিটকে আকাশে উঠে উইণ্ডশিন্ডে পড়ল লোকটা। গাড়ির শক্ত ছাত থাকলে গড়িয়ে পেছনের মাটিতে গিয়ে পড়ত লাশ, কিন্তু চামড়ার টপ নামিয়ে রাখায় উইণ্ডশিল্ড ফাটিয়ে ওটার ওপর দিয়ে এসে সোজা রিকের কোলে নামল লোগান টার্সন।

লম্বা-চওড়া লাশ সে, ছুঁড়ে দেয়া ভারী গদার মত এসে লেগেছে রিকের বুক-পেটে। ওর নাকে-মুখে লাগল রক্ত ও আগুনের ফুলকি। মাথায় ঢুকছে না কী হচ্ছে। প্রাণপণে ধরে রাখল স্টিয়ারিং হুইল। সাঁই করে বামে ঘুরে বাড়ির সামনের ফুটপাথে উঠল ক্যাডিলাক। ভেঙে দিল বারান্দার কয়েকটা খুঁটি। আরেক লাফে নেমে পরক্ষণে গেল উল্টে। গাড়িটা গড়াতে শুরু করে পড়ল গিয়ে রাস্তা থেকে মাঠে। ওটা থেকে ছিটকে পাথুরে জমিতে পড়েছে রিক ও টার্সন।

কী হচ্ছে বুঝছে না রিক। চোখের সামনে ঝিলিমিলি, সারাশরীরে তীব্র ব্যথা। গড়িয়ে চলেছে পাথরের ওপর দিয়ে। চোখ-মুখে ঢুকেছে একরাশ বালি। টাশ করে একটা আওয়াজ হতেই বুঝল, ভাঙল পাঁজরের একটা হাড়। কসেকেণ্ড পর স্থির হলো দেহ। পড়ে আছে চিত হয়ে। চরকির মত ঘুরছে দুনিয়া। আঁধার চারপাশ। সব বড় বেশি থমথমে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রিক, তারপর উপুড় হলো দুই হাতে ভর করে। পিটপিট করছে চোখ। থু-থুহ করে মুখ থেকে ফেলল মাটি ও ধুলো। ওকে ঘিরে রেখেছে একরাশ ধোঁয়া। গুঙিয়ে উঠল ব্যথায়। বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে পাঁজরের ভাঙা হাড়। ওটার জন্যেই এত ব্যথা, তা নয়। সারা শরীরের নানান জায়গা জানান দিচ্ছে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে সে।

মটকে গেল মেরুদণ্ড?

বা ফেটে গেছে করোটি?

হবে বোধহয়!

হঠাৎ আবার সব শুনতে পেল রিক। কর্কশকণ্ঠে চিৎকার করছে নিক: শুয়োর কোথাকার, উঠছিস না কেন? উঠে দাঁড়া! কে খুন করবে মাসুদ রানাকে?

গড়ান দিয়ে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসল রিক। বনবন করে ঘুরছে মাথা। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো, ও আসলে হারিকেনে পড়া কোনও টাওয়ার।

 আগুনের তীব্র হলকা সরিয়ে নিচ্ছে ধোঁয়া। সামনে চেয়ে চমকে গেল রিক। ওর দিকেই চেয়ে আছে জাপানি নোকটা! বুকে রক্তের চিহ্ন নেই! গুলি করেও মিস করেছে সে। হাতের মসবার্গ বন্দুক সরাসরি ওর পেটে তাক করেছে লোকটা।

রানার শত্রু তুমি, বলল জন, সেক্ষেত্রে তোমাকে লড়তে হবে আমার সঙ্গে।

.

৪৩.

 অস্ত্রটা ফেলো, ময়নিহান, চাপা ধমক দিল রানা।

কুত্তার বাচ্চা, বিড়বিড় করল ময়নিহান। ঠোঁটে ফুটল হাসি। ওটা নকল বলে মনে হলো না রানার। তার মানে, তোমার সঙ্গে দেখা হলো। এবার মুখোমুখি লড়ব আমরা।

অস্ত্র ফেলো, নইলে খুন হবে, সহজ সুরে বলল রানা।

অস্ত্র ফেললেই বা কী, তুমি তো খুন করবেই আমাকে।

গুলিতে মরতে আপত্তি থাকলে আগুনে ঢুকতে পারো, ময়নিহানের খুলি থেকে মাযল সরাল রানা। পেছনের ঘরে দাউদাউ জ্বলছে লেলিহান আগুন। পিঠে এসে লাগছে প্রচণ্ড উত্তাপ।

তার চেয়ে আলাপ করা যাক, মিষ্টি হাসল ময়নিহান।

রাগে রানার মনে হলো ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারবে ও। আর আলাপের কিছু নেই। অস্ত্রটা হাত থেকে ফেলো!

ময়নিহান আঙুল ফাঁক করায় মুঠো থেকে পড়ল পিস্তল। লাথি মেরে ওটাকে আগুনে পাঠিয়ে দিল রানা।

কোটি কোটি ডলার পাবে, রানা। শুধু জানাও কত চাই। বাঁকা হাসল ময়নিহান। আমার ওপর খেপে আছ, কারণ ধরে এনেছি তোমার প্রেমিকাকে। কথা ঠিক। কিন্তু ওটা ব্যক্তিগত কিছু ছিল না। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। নিজের ক্ষতি করতে পারি না। বুঝতেই পারছ।

আমি তোমাকে ব্যবসায়ী মনে করি না। মানুষ বলেও মনে করি না।

হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, অনেকে মারা গেছে। কিন্তু তারা প্রত্যেকে ছিল লোভী লোক। যে যার স্বার্থে কাজ করেছে।

তুমি নিজেও তাই, ময়নিহান। এসবই ছিল তোমার কাছে সামান্য খেলা। এ খেলায় সবসময় জিততে চেয়েছ। কিন্তু এবার হারতে হবে তোমাকে।

কাঁধ ঝাঁকাল ময়নিহান।

তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, লোকটার রাজত্ব ধসে পড়েছে বলে মোটেও চিন্তিত নয় সে।

তুমি কখনও জিতবে, কখনও হারবে, ব্যবসার নিয়ম।

ইঞ্জিনের গর্জন শুনল রানা। ক্যাডিলাক নিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে চলেছে রিক বেণ্ডার। গুলি করল জনকে লক্ষ্য করে। চরকির মত ঘুরেই পড়ে গেল জন। ভঙ্গিটা দেখে রানা বুঝল, ও আহত নয়। দুজনের চোখ পরস্পরকে দেখল, তারপর আবারও ময়নিহানের দিকে মনোযোগ দিল রানা।

তোমার দোস্ত বুদ্ধিমান। ওই যে দেখো, লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

রিক বেণ্ডার আমার দোস্ত নয়, চাপা স্বরে আপত্তি তুলল ময়নিহান। তারও এসবে স্বার্থ আছে।

 জানি। তবে নিজ স্বার্থে তুমি ব্যবহার করছিলে ওকে।

ভুল নয়, চিনেছ আমাকে, হাসল ময়নিহান। জিতে গেলে তুমি। তো? কী করবে? খুন করবে?

উঠে দাঁড়াতে ইশারা দিল রানা। চোয়ালের নিচে ঠেসে ধরেছে ওয়ালথারের নল। এবার শেষ করব তোমার মজার খেলা।

তার মানে ভাবছ সমান সুযোগ দেবে না? হাসল ময়নিহান, কিন্তু আমি যদি তোমাকে খুন করি? তা হলেও গুলি খেয়ে মরব তোমার বন্ধুদের হাতে?

কে বলল তুমি আমাকে খুন করতে পারবে? নল দিয়ে ময়নিহানের চোয়ালের নিচের নার্ভে খোঁচা দিল রানা। নীরবে ব্যথাটা সহ্য করল লোকটা। এখনও মুখে হাসি, যদিও ম্লান হয়েছে ওটা।

বাঁচার উপায় না দেখলে কেউ কেউ হয় অনেক বেশি বিপজ্জনক। বিদ্যুদ্বেগে ঘুরল ময়নিহান। তার কবজির কাছে ঝিলিক দেখল রানা। বামহাতে ওর পিস্তল সরিয়ে নিয়েছে টপ টেরর। ডানহাতের ক্ষুর সাঁই করে চালাল রানার ভোলা গলা লক্ষ্য করে। এবার কাটা পড়বে কণ্ঠনালী।

বহু মানুষকে এভাবে খুন করেছে ময়নিহান। কিন্তু আগেই রানা বুঝেছে, হামলা করবে সে। ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে খুন করা কঠিন। আবার না ভুগে এক গুলিতে খুন হবে এই নরপশু, তা-ও রানার মনে হয়েছে অনুচিত। প্রতিটা পদক্ষেপে তাই থেকেছে সতর্ক। একহাতে পিস্তল সরিয়ে ক্ষুরের আঘাতে গলা কাটতে যেতেই ময়নিহানের বাহুতে কে-বার গাঁথল রানা। পড়পড় করে মাংস ভেদ করে তীক্ষ্ণধার ডগা ঢুকল লোকটার পাঁজরের ফাঁকে।

কিন্তু তখনই ভীষণ দুলে উঠল গোটা দুনিয়া।

নিচে থেকে এল বিকট আওয়াজ। মুচড়ে গেল ধাতব কিছু। পরক্ষণে বাইরের দিকে লাফ দিল বারান্দা। রানার পায়ের তলা থেকে সাঁই করে সরে গেল ওটা। চমকে গিয়ে দরজার ফ্রেম খামচে ধরেছে রানা। হাত থেকে ছুটে গেছে ছোরা। বাইরে ঢালু তক্তায় চেপে পিছলে সরে গেল ময়নিহান। ধাপ করে লাগল রেলিঙে, তারপর টপকে গেল ওটা। রানা প্রথমে ভেবেছে, অস্বাভাবিক দ্রুত আগুনে পুড়েছে বাড়ির কাঠের ভিত্তি, কিন্তু পরক্ষণে বুঝল রিকের গাড়ি গুঁতো মেরেছে বারান্দার কয়েকটা খুঁটিতে। আগেই বোঝা উচিত ছিল, হাল ছাড়বে না রিক বেণ্ডার। কী করতে চাইছে কে জানে, তবে এইমাত্র প্রাণ রক্ষা করেছে ন্যাশ ময়নিহানের!

রানার চারপাশে উড়ছে আগুনের ফুলকি। ঢালু বারান্দায় পা রেখে দাঁড়াতে চাইল ও। বামহাতে ওয়ালথার। ওটা গুজল কোমরে। ময়নিহানের সঙ্গে বিদায় নিয়েছে ওর ছোরা। লোকটাকে কোথাও দেখল না রানা। চোখে পড়ল, ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে রিক বেণ্ডারের দিকে চলেছে জন। ওর ইচ্ছে হলো বন্ধুর পাশে থাকতে, কিন্তু আগে ধরতে হবে ময়নিহানকে, নইলে প্রথম সুযোগে পালিয়ে যাবে কাপুরুষ লোকটা।

বাড়ির আগুনের তীব্র হলকায় পুড়তে শুরু করেছে রানার হাতের আঙুল। দরজা ছেড়ে দিল ও। পিছলে নেমে গেল বারান্দায়। পা তাক করেছে রেলিঙের দিকে। আটকে গেল। দেয়ালের মত জায়গাটায়। উঠে খুঁজল ময়নিহানকে। ডানদিকে গেছে, জন। বামে তাকাল রানা। পাশের বাড়ির কোণ ঘুরে ওদিকে চলে গেল টপ টেরর।

রেলিং টপকে মাটিতে পড়েই শরীর গড়িয়ে দিল রানা। উঠে দাঁড়াল মাত্র দুই সেকেণ্ডে। ছুটল ময়নিহানের পেছনে। বামে ধোয়া থেকে বেরিয়ে আসছে কেউ। বাড, হাতে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল।

ময়নিহানের খোঁজে যাচ্ছি, বাডকে বলল রানা। জন গেছে রিক বেণ্ডারের পেছনে। ওর হয়তো সাহায্য লাগবে।

দেখিস, আবার মেরে ফেলিস না।

কোনও কথা না বলে রানাকে পাশ কাটিয়ে ছুটল বাড।

.

নিজেকে কী মনে করিস, কুত্তার-বাচ্চা, সরু চোখ শালা? জানতে চাইল রিক বেণ্ডার। ওর দিকে মসবার্গ শটগান তাক করেছে জন। ওকে পাত্তা দিচ্ছে না দানব। মুখে কুৎসিত হাসি।

নামটা আমার জন হার্বার্ট।

বুক থেকে গুমগুম শব্দের হাসি বেরোল রিকের। ভুলে গেছে ভাঙা পাঁজরের ব্যথা। জন? মানে জনি? তো শালা তুই পায়খানা আর পেচ্ছাবখানা?

এ লোকই খুন করবে তোমাকে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল জন।

তো কাপুরুষের মত গুলি করবি তুই, শালা? নাকি তোর দোস্ত রানার চেয়ে সাহস বেশি তোর?

কুত্তা যেভাবে মারে তেমনি গুলি করে মারব তোমাকে।

মাথা নাড়ল রিক। তা করবি না তুই। গুলিই যদি করতি, তো সেটা করতি আগেই।

আগে গুলি করিনি মানেই এখন করব না এমন নয়।

তো কর? খামোক বিরক্ত করছিস কেন?

তার আগে লাথিয়ে তোমার পাছা ফাটিয়ে দেব, জঙ্গলের ভালুক কোথাকার, নরম সুরে বলল জন।

হাসির দমকে ঝড়ে পড়া বাঁশ পাতার মত কাঁপল রিক বেণ্ডার। বক্সিং গ্লাভসের সমান আকারের হাত তুলে মুখ থেকে সরাল ধুলোবালি। দেখছে জনকে। সামনের লোকটার মাথা বড়জোর ছুঁই-ছুঁই করবে তার কাঁধ। তোর মত পুঁচকে ছুঁচো ভাবছে আমার সঙ্গে লড়ে জিতবে?

ধোঁয়া থেকে ছুটে এল কালো লোকটা, হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। ঝট করে ওটা তাক করল রিকের বুক লক্ষ্য করে।

তোর মত আরও কয়টা তেলাপোকা আছে? জানতে চাইল রিক।

পরস্পরের দিকে তাকাল জন ও বাড।

এই নির্বোধকে নিজে শায়েস্তা করতে চায় রানা, বলল জন।

ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলল বাড। কুঁচকে গেছে ভুরু। দরকার কী, আমরাই শেষ করে দিই ঘেয়ো কুত্তাটাকে।

পিটিয়ে মারাই ভাল, মন্তব্য করল জন।

নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে তাচ্ছিল্যের আওয়াজ তুলল রিক। পারলে তোরা দুটো মিলে চেষ্টা করে দ্যাখ! চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি!

বন্দুক দিয়ে জ্বলন্ত বাড়ি দেখাল জন। ওদিকে হাঁটো।

কাপুরুষের মত পিঠে গুলি করবে, নাকি?

তা করব না, তবে যখন পিটিয়ে আধমরা করব, হাসতে চাই তোমার মুখের ওপর।

আগুনে পোড়া বাড়ির দিকে পা বাড়াল রিক।

ঠাণ্ডা মাথার খুনি নয় জন বা বাড। আত্মসম্মানটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। কিন্তু সুযোগ পেলে প্রথম সুযোগে ওদেরকে গুলি করত রিক। ভাবছে, দুই গাধা যখন গুলি করেনি, এ সুযোগে হয়তো এদেরকে শেষ করে দিতে পারবে সে।

মাত্র তিন কদম হেঁটেই হঠাৎ উবু হলো রিক। গুলি এল না তার দিকে। কাজেই ঝট করে সোজা হয়েই ঘুরে দাঁড়াল সে। আগেই দুহাতে তুলে নিয়েছে লোগান টার্সনের পোড়া লাশ। ওটা ছুঁড়ল বাডের দিকে। টার্সন যখন জীবিত ছিল, তাকে মানুষ বলেই গণ্য করত না রিক, কিন্তু সে মরে যাওয়ায় আগের চেয়ে হয়ে উঠেছে কাজের। পোড়া লাশ সরাসরি উড়ে আসছে দেখে বিস্ফারিত চোখে পিছিয়ে গেল বাড। ভুলে গেছে গুলি করতে। তার দিকে তেড়ে না গিয়ে জনের দিকে ছুটল রিক।

মুহূর্তের জন্যে দ্বিধায় পড়েছে জন। পোড়া লাশ নিয়ে মনে নেই দুশ্চিন্তা। বন্দুকের কাঠের বাট তুলে ছুটন্ত রিকের চোয়ালে বেদম জোরে গুতো দিল ও।

রিকের মনে হলো চোয়ালে বয়ে গেল হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ। কিন্তু তরুণ বয়সে এর চেয়েও বেশি ব্যথা সহ্য করেছে সে। জনের হাত থেকে ছো দিয়ে বন্দুক নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। চোখের কোণে দেখল, পোড়া লোগানের লাশ টপকে আসছে কালো লোকটা। তাক করছে রাইফেল। কিন্তু গুলি করতে পারবে না সে। নইলে এক পশলা গুলির বেশ কটা বিঁধবে বন্ধুর গায়ে। কালো লোকটাকে পাত্তা দিল না রিক, ঝড়ের বেগে ঘুষি চালাল জনের মুখে।

নিচু হয়ে পিছিয়ে হাতুড়ির মত ঘুষিটা এড়িয়ে গেল জন। দেহ ঘুরিয়ে কনুইয়ের গুঁতো লাগাল রিকের পাঁজরে।

জাপানি শালার শয়তানি কায়দা, ভাবল দানব। কপাল ভাল সুস্থ হাড়ে পড়েছে ওই মার। নইলে ভাঙা হাড় ঢুকত ফুসফুঁসে। বলতে গেলে ব্যথাই পায়নি সে। প্রচণ্ড জোরে কনুই নামাল খাটো লোকটার মাথার তালুর ওপর।

গুঙিয়ে উঠলেও রিকের কোমর জড়িয়ে ধরল জন। বন্ধুর মহাবিপদে ছুটে এল বাড। রাইফেল তুলেছে গদার মত করে।

কুঁজো হয়ে জনকে জড়িয়ে ধরে ওপরে তুলে বাডের দিকে ঘোরাল রিক। কিন্তু আগেই তার কাঁধে নেমেছে অ্যাসল্ট রাইফেলের বাঁট। যন্ত্রণা পাত্তা না দিয়ে জনকে ক্রিকেট ব্যাটের মত ব্যবহার করে বাড়কে ছিটকে ফেলল রিক। দুহাতে তুলল জনকে, পরক্ষণে গায়ের জোরে আছাড় দিল জমিতে। ভেবেছিল পাথরে লেগে চুরমার হবে জাপানির খুলি। কিন্তু দানবের মতলব বুঝে শেষ মুহূর্তে মাটির দিকে কাঁধ ঘুরিয়ে নিয়েছে জন, ফলে এড়িয়ে গেছে প্রচণ্ড পতন। সাধারণ কেউ চিরকালের জন্যে পঙ্গু হতো, কিন্তু ওর সারাশরীরে বেতের মত পেশি। জুডোর কায়দায় ফল ব্রেক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল। তবে বুঝে গেল, দানবের কাছে ও নিজে প্রায় শিশুর মতই অসহায়।

হাত থেকে জনকে পুরোপুরি ছাড়েনি রিক, দুই কদম সামনে এগিয়ে অবিশ্বাস্য শক্তি ব্যয় করে আবারও তুলে নিল মাথার ওপরে। পরের আছাড়ে শেষ করবে খেলা। মাথা নিচু, পা আকাশে, ব্যথায় প্রায় অবশ জন, পাথুরে জমিতে আছড়ে পড়লে চুরমার হবে খুলি।

জাপানির শরীরের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েও খুব দ্রুত সামলে নিয়েছে কালো লোকটা, দেখল রিক।

দানবের খপ্পর থেকে জনকে ছোটাতে চাইলে হাত থেকে ফেলতে হবে রাইফেল। তাই করল বাড। পরপর কটা ঘুষি বসিয়ে দিল রিকের নাকে-মুখে। বেশিরভাগ পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধা লজ্জা পাবে ওর হাতের দ্রুতগতি দেখে। তৃতীয় ঘুষিতে ঠাস্ করে ফাটল রিকের নিচের চোয়াল। গর্জন ছেড়েই বাডের দিকে ঘুরল দানব। ব্যথায় সরু হয়ে গেছে। চোখ।

সামনে বেড়ে জনকে রিকের দিকে ঠেলল বাড। বন্ধুকে আবারও ব্যবহার করতে দেবে না ব্যাটের মত করে। রিকের দুপায়ের মাঝে ঝুলছে জন, টেনে অণ্ডকোষ ছিঁড়তে চাইল।

কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না রিক। দুহাত থেকে ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে জনকে ফেলল বাডের ওপর। ভীষণ ঠেলা খেয়ে ভাঙা পুতুলের মত হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ল সাহসী দুই লড়াকু। বন্ধুর গা থেকে সরে গড়ান দিয়ে চিত হলো জন। পাশেই বাড। ওরা পড়ে আছে ধুলোর ভেতর।

দুযোদ্ধার পায়ের কাছে থামল রিক। পেছনে আগুনের তীব্র হলকা, দাউদাউ করে জ্বলছে বাড়ি। কর্কশ স্বরে বলল দানব, এবার লাথি মেরে ফাটিয়ে দেব তোদের পেট। নরকে যাবি তোরা!

.

পাশের বাড়িটার কোনা ঘুরে ছুটে গেছে ন্যাশ ময়নিহান। কোনও উদ্দেশ্য আছে তার। একবারও পিছু ফিরে চায়নি। ইচ্ছে করলে অনায়াসেই তাকে গুলি করতে পারত রানা। কিন্তু মাথায় জেদ চেপে গেছে, মুখোমুখি হবে। দেখবে কতবড় সে!

পিছু নিল রানা। ঘুরে চলে গেল বাড়িটার দিকে। পেরোল গবাদি পশুর খামার। বাঁক নিল টিনের ছাউনির দিকে। ময়নিহানের চেয়ে ওর গতি বেশি। দূরে দেখল ছাউনির দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল লোকটা।

খালিহাতে আবছা আলোর ওখানে ঢোকার আগে কোমর থেকে ওয়ালথার নিয়ে স্লাইড টানল রানা। ট্রিগারে আঙুল না ছুঁইয়ে তর্জনী রাখল ট্রিগার গার্ডের ওপর। গুলি করবে না বাধ্য না হলে।

জখম হয়েছে ময়নিহানের ডান বাহু। তবে গলা কাটতে পারবে ক্ষুর ব্যবহার করে। আরও সতর্ক হলো রানা। দরজা দিয়ে ঢুকেই সেঁটে গেল পাশের দেয়ালে। পিস্তল হাতে দেখছে চারপাশ।

ভেতরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। নাক কুঁচকে গেল পচা রক্তের দুর্গন্ধে। চোখ সয়ে যেতেই দেখল একটু দূরে ছাত থেকে দুলছে লোহার শেকল ও ঝাড়বাতির মত হুক। মৃদু ঠং-ঠুং আওয়াজ তুলছে ওগুলো। ওই যে ছুটন্ত পদশব্দ! তবে কোথাও দেখা গেল না ময়নিহানকে। অবশ্য বেশি দূরে নেই সে। ডানে বেশি দুলছে শেকল। ওদিক দিয়ে গেছে লোকটা। নিঃশব্দে পিছু নিল রানা। নাকে লাগল নাড়িভুড়ি ও পচে যাওয়া মাংসের ভয়ানক কুবাস। মনটা চাইল, ঘুরেই ছাউনি থেকে বেরিয়ে যাবে। তাতে বাঁচবে নাক। ডানে নড়ছে আরও কিছু শেকল। ওদিকে চলল রানা। টিনের দেয়ালের অনেকটা ওপরে সরু জানালা। আলো আসবে বলে নয়, বাতাস চলাচলের জন্যে। ওই পথে ঢুকছে রূপকথার দানবীয় সাপের মত ধূম্রজাল। তাতে পড়ছে রোদের সোনালি আলো।

সামনে কোথাও থেকে এল ধাতব আওয়াজ। খোলা হয়েছে কোনও দরজার ছিটকিনি। পালিয়ে যেতে চাইছে ন্যাশ ময়নিহান। ওদিকে ছুটল রানা।

একটু দূরেই আয়তাকার রুপালি বিশাল ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কোল্ড রুম। ওখানে গিয়ে ঢুকেছে ময়নিহান? লুকাতে চায় রানার কাছ থেকে?

ওয়ালথার হাতে দরজার কাছে পৌঁছে গেল রানা।

ছিটকিনি খোলা।

কান পাতল লোহার বাটে। ওদিকে কোনও আওয়াজ নেই। ভেতরটা বোধহয় ভ্যাকিউম করা সাউণ্ডপ্রুফ রুম। ময়নিহান ওখানে আছে কি না জানতে হলে ঢুকতে হবে রানাকে, এ ছাড়া উপায় নেই।

দরজা খুলতে গেলে ভেতরের প্রেশারের জন্যে রাবারের সিল তুলবে সু ধরনের শব্দ, কিন্তু ঠেলতেই নীরবে সামান্য খুলল কবাট। রানা বুঝে গেল, একটু আগে খোলা হয়েছে এ দরজা, অথবা বিদ্যুৎ নেই রেফ্রিজারেটেড ঘরে। ওর মনে হলো, দুটো ধারণাই ঠিক। টান দিয়ে দরজা খুলে তাকাল ভেতরের অন্ধকারে। হাতে ওয়ালথার। বিপদ এলে গুলি করবে। আবারও নাক কুঁচকে গেল তাজা রক্তের জঘন্য গন্ধে।

অন্ধকার থেকে ছুটে এল কে যেন!

ময়নিহানকে চরম শাস্তি দেবে রানা। ঝুঁকি না নিয়ে প্রায় ছুটন্ত প্রেতাত্মার মত ছায়া লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল ও। একমুহূর্ত পর বুঝল, ওটা ন্যাশ ময়নিহান নয়। হাত বা পা নেই। মস্ত হুক থেকে ঝুলছে আস্ত একটা লাশের বুক ও পেট। রানা বুঝে গেল, সম্প্রতি এখান থেকে ঘুরে গেছে ময়নিহান। ক্ষুর দিয়ে গলা ফাঁক করেছে হাত-পা কাটা লাশটার।

এসব বুঝতে মাত্র দুসেকেণ্ড ব্যয় করেছে রানা, কিন্তু গভীর ছায়া থেকে ছুটে এল ময়নিহান। ডানহাতে ওর প্রিয় ক্ষুর। কিন্তু ওদিকে মন দিল না রানা। লোকটার বামহাতে কসাইয়ের কাঠের হ্যাণ্ডেলে চকচক করছে স্টিলের তীক্ষ্ণ হুক, দৈর্ঘ্যে অন্তত একফুট। পৈতৃক প্রাণ বাঁচাতে একলাফে ঘর থেকে বেরোল রানা।

দ্যাখ কীভাবে মরবি! ওর মাথা লক্ষ্য করে সাই করে হুক চালাল ময়নিহান।

 এবার গর্দান থেকে বলের মত ছিটকে যাবে রানার মাথা। তবে শেষ সময়ে ওয়ালথারের নল দিয়ে খটাং করে হুকটাকে ঠেকিয়ে দিল ও। বুঝে গেছে, পড়েছে সত্যিকারের নরকের পিশাচের খপ্পরে। আবারও মাথা লক্ষ্য করে হুক চালাল ময়নিহান। অন্যহাতে ক্ষুরের টান দিল রানার পেট লক্ষ্য করে।

পিস্তল দিয়ে হুক ঠেকিয়ে দিলেও বিসিআই এজেন্টের জ্যাকেট বা শার্ট ঠেকাতে পারল না ক্ষুরের ফলা! পেট চিরতেই ছিটকে পিছাল রানা। বুঝল, খুব গভীর নয় জখমটা। অন্তত পায়ের কাছে ঝুলছে না নাড়িভুড়ি।

ময়নিহানকে এড়াতে অন্যদিকে সরল রানা। কাঁধে লাগল লোহার শেকল। পিঠে ধুম করে তো দিল স্টিলের স্টক-পেন। বামে এক গজ দূরে শিকের দেয়াল। কোণঠাসা করতে পেরেছে ময়নিহান, এবার খতম করবে ওকে।

বাঁদরকে হার মানিয়ে শিক টপকে হাঁটু সমান গোবরে নেমে পড়ল রানা। লোহার শিকে লেগে কমলা ফুলিঙ্গ তুলল হুক। লোকটার দিকে ওয়ালথার তাক করেও পিছাতে শুরু করেছে রানা। তাতে খেপে গিয়ে শিকের দেয়াল টপকে রানার দিকে চলে এল টপ টেরর। কমুহূর্ত আগে ওখানেই ছিল রানা।

সামনে বেড়ে রানার নাকের কাছে আবার রুপালি ঝিলিক তুলল ময়নিহান। একপাশে সরে লোকটার মাথায় পিস্তলের নল নামাতে চাইল রানা। কিন্তু পিছিয়ে গেছে টপ টেরর। গোবরে রানা পিছলে যেতেই শুনল ময়নিহানের খুশির চিৎকার। হুক তুলে লাফিয়ে এল লোকটা। গেঁথে ফেলবে রানার গলা। আত্মরক্ষা করতে ঝট করে ওয়ালথার তাক করল রানা, কিন্তু ট্রিগার গার্ডে বেধে গেল হুকের ডগা। টান খেয়ে ওর হাত থেকে ছিটকে পড়ল পিস্তলটা।

আগেই উচিত ছিল গুলি করা, হতাশ হয়ে ভাবল রানা। পড়তে গিয়েও সামলে নিয়েছে তাল। ময়নিহান মাথার ওপর তুলেছে হুক, এবার গাঁথবে ওর খুলিতে লোহার তীক্ষ্ণ ডগা। পিছিয়ে মেঝে থেকে কাঁচা গোবর তুলে শত্রুর মুখে ছুঁড়ল রানা। মার খাওয়া নেড়ি কুত্তার মত কেঁউ করে উঠল ময়নিহান। পচা গোবরের গুণে ভীষণ জ্বলে উঠেছে চোখ। সোজা হয়েই গায়ের পুরো জোর খাঁটিয়ে তার পেটে লাথি ঝাড়ল রানা। ছিটকে পিছিয়ে শিকের দেয়ালে পড়ল ময়নিহান। রাগ ও ক্ষোভে গর্জন ছাড়ল খেপা ষাঁড়ের মত। দুহাতে চরকির মত চালাল হুক ও ক্ষুর। তার বাহুর ক্ষত থেকে ছিটকে রানার মুখে পড়ল রক্ত। আবারও দুই অস্ত্র চালাল ময়নিহান। তবে এবার হুক এড়িয়ে তার কাছে পৌঁছে গেল, রানা। ওর বুটের হিল পড়ল ময়নিহানের হাঁটুর বাটিতে। পটা আওয়াজে খুলে গেল মালাইচাকি। প্রচণ্ড ব্যথায় থরথর করে কেঁপে পেছাল লোকটা। সামনে বেড়ে সরাসরি তার নাকে হাতের তালু চালাল রানা। আবছা আলোয় দেখল, প্রায় উল্টে গেছে শত্রুর চোখ। প্রায় অচেতন হলেও আবার হুক চালাল ময়নিহান। মারাত্মকভাবে আহত হবে বুঝেও ডানহাত সামনে বাড়াল রানা। কপাল ভাল, বাহুতে ঠাস্ করে হুকের তীক্ষ্ণ ডগার বদলে নামল মাঝের অংশ। ব্যথা পেলেও বাহু দিয়ে শিকের দেয়ালে হুক চেপে ধরল রানা। পরক্ষণে গায়ের জোরে হুক ঠেলল ময়নিহানের বুকে। টলমল করছে লোকটা। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে ভাঙা নাক থেকে। সামনে বেড়ে রক্তঝরা নাকে এবার ঘুষি চালাল রানা। একইসময়ে খপ করে ধরেছে ময়নিহানের ডানহাতের ক্ষুর ধরা মুঠো।

যেন যৌন মিলনে ব্যস্ত, ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে ওরা। আগে কথা বলে উঠল রানা, আর কখনও কাউকে ব্যথা দিতে পারবে না।

আমি… শালা… তোর চেয়ে…

এটা তোমার ভুল ধারণা।

 ময়নিহানের জখমি হাতে প্রায় কোনও শক্তিই নেই।

ক্ষুর ধরা হাতটা তুলে সহজেই তার গলায় পোচ বসাল রানা। দ্বিতীয় মুখের মত ফাঁক হলো কণ্ঠনালীর ক্ষত। থরথর করে কাঁপছে শিরা ও ধমনী। পরক্ষণে গলগল করে বেরোল রক্তের স্রোত। উল্টে গেল ন্যাশ ময়নিহানের অক্ষিগোলক। ধড়াস্ করে মেঝেতে পড়ল লোকটা। টান খেয়ে রানার বাহুর তলা থেকে বেরোল হুক। ছোট একটা ফুটো তৈরি হলো ওর জ্যাকেটে। হুকের ডগা চলে যাওয়ার আগে নিয়ে গেছে পেশির সামান্য মাংস। তাতে আপত্তি নেই রানার।

জবাই করা গরুর মত কবার পা ছুঁড়ে থরথর করে কাঁপল ন্যাশ ময়নিহান, তারপর থেমে গেল। ওদিকে চেয়ে নেই রানা। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। পা বাড়িয়ে দশফুট দূরে পেল গোবরমাখা ওয়ালথার। ওটা পরিষ্কার করল ন্যাশ ময়নিহানের শার্টের কাঁধে। অস্ত্র কাজ করবে, না জ্যাম হবে, বোঝার উপায় নেই। কোমরে ওয়ালথার খুঁজে অন্য কোনও অস্ত্র খুঁজতে লাগল রানা।

তখনই শুনল বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ। থরথর করে কাঁপল কসাইখানার ভিত্তি। হাজারখানেক ঘণ্টির মত জোরালো ঝনঝন আওয়াজ তুলল অসংখ্য শেকল।

কসাইখানার দরজার দিকে পা বাড়াল রানা।

দেখল, বাইরে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রিক বেণ্ডার। তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় না করলে শেষ হবে না এই লড়াই।

.

৪৪.

 র‍্যাঞ্চ হাউস ও পাশের কাঠের বাড়িটা গিলে নিয়েছে লেলিহান লাল আগুন। একটু আগে তৃতীয় বাড়িটা চাটতে শুরু করেছে আগুনের শিখা। ওখানেই আছে ময়নিহানের বিধ্বস্ত কপ্টার ও চুরমার হওয়া গাড়িদুটো। ওই আস্তানার ভেতর রয়েছে প্রচুর ফিউয়েল। মাটি থেকে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল তুলে নেবে রিক বেণ্ডার, এমনসময় পারমাণবিক বোমার মত ফাটল ওই বাড়িটা।

দানবটাকে কাঁপিয়ে দিল প্রচণ্ড উত্তাপের দমকা হাওয়া। জোর টান দিয়ে খুলতে চাইল গায়ের পোশাক। রিকের মনে হলো আগুন ধরে গেছে দেহে। প্রাথমিক বিস্ফোরণের ধাক্কা বিদায় নেয়ায় দেখল, এখনও দাঁড়িয়ে আছে সে। জায়গায় জায়গায় হাত-পায়ের ত্বক পুড়লেও বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে। চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে কালো ধোঁয়া। বেদম কাশতে লাগল রিক বেণ্ডার। আর তখনই আকাশ থেকে শিলার মত ঝরঝর করে ঝরল ভাঙাচোরা কাঠের টুকরো। পাশেই পড়ল প্রকাণ্ড কটা জ্বলন্ত খুঁটি ও বরগা। রিক ভাবল, ওপরের কেউ খুলে দিচ্ছে সামনের পথ। ওপরের লোকটা অবশ্য নিক নয়, কারণ ওর ছোটভাই আছে ভয়ঙ্কর কোনও নরকে।

ধোঁয়ায় অন্ধ হলেও দ্বিতীয়বারের মত রাইফেলের দিকে হাত বাড়াল রিক। যেখানে দেখেছে স্টক, ওখানে হাত দিতেই পেল অস্ত্রটা। অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে আগে কখনও গুলি করেনি, কিন্তু কতই বা কঠিন হবে চালানো? কাজ তো সহজ, তাক করে গুলি করে দেয়া, তাই না?

ভাল করেই মনে আছে কোথায় পড়েছে জাপানি শালা আর কেলেভূত। ওদিকে রাইফেল তাক করেই একরাশ গুলি পাঠাল রিক। কর্কশ খ্যাট-খ্যাট শব্দে হাতে লাফিয়ে উঠছে রাইফেল। কয়েক সেকেণ্ডে খালি হলো ম্যাগাযিন।

গুলির জন্যে বাতাস সরেছে বলে তৈরি হয়েছে ফট-ফট আওয়াজ। নতুন শূন্যতা পূরণ করতে ছুটে এল তপ্ত হাওয়া ও ঘন কালো ধোঁয়া। তবে নিচে দেখা গেল পরিষ্কার। যেখানে গুলি করেছে রিক, এখন ওখানে কেউ নেই!

কুত্তার বাচ্চাগুলো কই? রেগে গেল রিক। তার দশফুট ডানে দেখল জাপানিটাকে। বামে দশফুট দূরে কেলেভূত। দুজনের হাতেই এখন পিস্তল। মাযল সরাসরি তাক করেছে রিকের মাথা লক্ষ্য করে।

গুলি করবি, হারামজাদার বাচ্চারা? গলা ফাটাল রিক। কাপুরুষের বাচ্চা!

না, গুলি করব না, নরম সুরে বলল জন। রিকের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল। করলে তো এতক্ষণে নরকে পৌঁছে যেতে। আমরা শুধু তোমাকে ব্যস্ত রেখেছি, যাতে উপস্থিত হতে পারেন মাননীয় অতিথি।

ঘুরে তাকাল রিক।

ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে আপাদমস্তক রক্তে মাখা মাসুদ রানা। পাথরের মত কঠিন ওর চোখ। মণি যেন কালো বরফের টুকরো। হাতে কসাইয়ের বিশাল হুক।

যে-কেউ ওকে দেখে আতঙ্কিত হবে, কিন্তু চওড়া হাসি হাসল রিক বেণ্ডার।

ঠিক আছিস তো, রানা? জানতে চাইল জন।

 ভালই আছি, থমথমে চেহারায় বলল রানা।

এত রক্ত কার? জানতে চাইল বাড।

 ন্যাশ ময়নিহানের।

শালার এইডস্ থাকলে তুই মরেছিস, বিরস সুরে মন্তব্য করল জন।

ওই বিপদের কথাটা ভেবে ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা।

এবার কাঠের গুঁড়িটাকে গুলি করব? রিক বেণ্ডারকে দেখাল জন।

না। মাথা নাড়ল রানা। আমাদের কিছু ব্যক্তিগত বোঝাঁপড়া আছে।

বাদামি কুত্তাটা আমার ছোটভাইকে খুন করেছে। হাত থেকে গুলিশূন্য অ্যাসল্ট রাইফেল ফেলে দিল রিক। কড়া চোখে দেখল জন ও বাডকে। যেন ওরা আপত্তি তুললে গায়ে হাত তুলবে অঙ্কের কড়া স্যরের মত। ওর জন্যে প্রতিশোধ নেব।

আরেকটু হলে আমার ভাইয়ের মত দুই বন্ধুকে খুন করতে যাচ্ছিলে, বলল রানা, কাজেই এসো, আমিও নেব প্রতিশোধ।

হাতদুটো তুলে রানাকে ডাকল রিক।

মুখোমুখি হবে, কথা দিয়েছে রানা, কিন্তু এ কথা দেয়নি যে দানবের সঙ্গে লড়বে খালিহাতে। হুক উঁচু করে এগোল ও। ওটার কারণে সমান হয়েছে ওদের দুজনের হাতের দৈর্ঘ্য। ময়নিহান যেভাবে রানাকে গাঁথতে চেয়েছে, সেভাবে রিককে গাঁথার ইচ্ছে নেই ওর। কাছাকাছি পৌঁছে দানবের মাথা লক্ষ্য করে হুক ছুঁড়ল রানা।

মাথা নিচু করল রিক। তার মাথার ওপর দিয়ে গেল হুক। এ-ই চেয়েছে রানা। দানব সোজা হওয়ার আগেই লাফিয়ে উঠল ও। ওর হাঁটু সরাসরি লাগল রিকের মুখে। এমনিতে মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়ত রানা, কিন্তু এতবড় দৈত্যের বিরুদ্ধে কৌশল না খাটালে খুন হবে কয়েক মুহূর্তে। ওর শরীরের পুরো ওজন নিয়ে হাঁটু গিয়ে লেগেছে রিকের চিবুকে। খট্টাস্ শব্দে বন্ধ হয়েছে মুখ। ছিটকে পিছিয়ে গেছে দৈত্য। সে তাল সামলে নেয়ার আগেই সামনে বেড়ে গলা লক্ষ্য করে ঘুষি ছুঁড়ল রানা। দ্বিতীয় ঘুষি লাগল রিকের অণ্ডকোষের ওপর।

শরীর ঘুরিয়ে অন্ধের মত পাল্টা ঘুষি ছুঁড়ল রিক বাতাসে, তবে ওর আওতার বাইরে সরে গেছে রানা। পরক্ষণে সামনে বেড়ে আবারও ঘুষি বসাল দানবের গলায়। ওটা যেন চামড়ার ড্রাম। রিকের উল্টো হাতের চড় পড়ল রানার বুকে। তাতে ওর মনে হলো, ও সামান্য মাছি, চাপড় মেরে ওকে উড়িয়ে দিচ্ছে কিংকং। পিছিয়ে বুক ভরে বাতাস নিল রানা। গোপনাঙ্গের ব্যথায় খুঁড়িয়ে হাঁটলেও চরম খেপে গেছে রিক মার খেয়ে, রেলগাড়ির মত তেড়ে এল সে। পেয়েও গেল রানাকে নাগালে।

রিকের প্রচণ্ড ঘুষি এড়িয়ে গেল রানা। একপাশ থেকে ঘুষি মারল দানবের পাঁজরে। বুঝে গেল, দৈত্যের দেহের ভিতর আছে পুরনো ক্ষত। ব্যথা পাত্তা না দিয়ে ঘুরেই রানার পেট লক্ষ্য করে প্রচণ্ড লাথি ঝাড়ল দানব। ওটা উটের পেছন পায়ের লাথির মত, লাগলে নাড়িভুড়ি ফেটে মরত রানা। শেষমুহূর্তে সরে গেছে ঝট করে। আকাশে উঠছে রিকের বুট। একপাশ থেকে তার উরুর নার্ভ জয়েন্টে পড়ল রানার কনুইয়ের বেমক্কা গুঁতো। গভীরভাবে মাংসে গেঁথেছে চোখা হাড্ডি। টলমল করে পিছিয়ে গেল রিক। আগের চেয়ে বেশি খোঁড়াচ্ছে।

কুত্তার বাচ্চা! দাঁতমুখ খিচাল দানব। চাপড় মেরে কাটাতে চাইল ঊরুর অবশভাব।

গালি খেয়েও খেপল না রানা, সামনে বেড়েই ডানহাতি ঘুষি বসাল রিকের পেটে। পরক্ষণে আবার বামহাতি ঘুষি পাজরে। একহাতে দানবের কনুই আটকে অন্যহাতে ঘুষি মারল তার ঘাড়ে। সাধারণ কেউ ক্যারোটিড সাইনাসে চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে ধুপ করে মাটিতে পড়ত, কিন্তু ঘাড়ে রিকের চাকা চাকা মাংসের তাল। গলায় ঘুষি মারতে ডানহাত তুলল রানা। কিন্তু হাত বাড়িয়ে দেয়ায় দানবের আঙুলে বেধে গেল ওর জ্যাকেট। পরক্ষণে হ্যাঁচকা টানে ওকে কাছে নিল সে। রাগ ও পরিশ্রমে দানবের মুখ থেকে বেরোচ্ছে সাদা ফেনা।, নাক-মুখ না কামড়ে দেয় পশুটা, ভাবল রানা। প্রাণের ভয়ে পর পর তিনবার প্রচণ্ড জোরে কপাল ঠুকল তার নাক-মুখে। নিজেই দেখল চোখে অজস্র লাল-নীল নক্ষত্র। তারই ফাঁকে ডানহাতে ঘুষি মারল। রক্তাক্ত ক্ষতে ব্যথা পেয়ে গুঙিয়ে উঠেছে রিক। কিন্তু শক্তি তার ভালুকের মত। রানাকে জাপ্টে ধরে বুকে নিয়ে ভয়ঙ্কর চাপ দিল। ব্যথায় কাতরে উঠবে না ভেবেও ওর কণ্ঠ চিরে বেরোল চাপা গোঙানি। যেন কার ক্রাশারে ভাঙা হচ্ছে ওর পাঁজর! বুঝে গেল, হাড়গোড় ভেঙে ঢুকবে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুঁসে। কানের মধ্যে দপদপ করছে রক্তের স্রোত।

রানা…দূর থেকে এল জনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।

রানা জানে, ছুটে আসবে বন্ধুরা। তাই চিৎকার করে বলল, না, জন, বাড! এই লড়াইটা আমার আর ওর!

আগে এত ভয়ঙ্কর কারও বিরুদ্ধে লড়েনি রানা। মুখ গুঁজে আছে দানবের বুকে। মুক্ত ডানহাত রয়ে গেছে ওপরে। দেরি না করে মুঠো করে চেপে ধরল শত্রুর শিঙাড়ার সমান নাক। পরক্ষণে গায়ের জোরে ছিঁড়তে চাইল ওটা। ঝরঝর করে ওর হাতে পড়ল উষ্ণ রক্তের স্রোত। বিকট আর্তনাদ ছেড়ে ছিটকে রানাকে ফেলে পিছিয়ে গেল দানব। রানার মুঠোয় এখন তার অর্ধেক ছেঁড়া নাক।

মাটিতে পড়তে গিয়েও সামলে নিয়েছে রানা। কিন্তু হাঁফ ফেলার উপায় নেই।

বাদামি শুয়োরের বাচ্চা… গর্জন ছাড়ল রিক। দৌড়ে এল রকেট গতি তুলে। লাথি বসাতে গেল রানার কোমরে। কিন্তু একপাশে ঝাঁপিয়ে মাটিতে পড়ে শরীর গড়িয়ে দিল রানা। একটু দূরেই বিস্ফোরিত হলো ছাউনির জ্বলন্ত এক বরগা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওটা টপকে গেল ও। পেছন পেছন তেড়ে আসছে দানব। থমকে তুলে নিল ধোঁয়া ও আগুন ভরা বরগা। ওটার ওজন দুশ পাউণ্ডের চেয়েও বেশি। ছুঁড়ল অমানুষিক জোরে। লাফিয়ে সরে গেল রানা। বরগা মাটিতে আছড়ে পড়তেই গায়ে এসে লাগল আগুনের ফুলকি। পিছিয়ে গেল রানা। পায়ে পড়েছে এক টুকরো অঙ্গার।

চেঁচিয়ে কী যেন বলছে জন ও বাড।

পা থেকে অঙ্গার ঝেড়ে পাল্টা হাঁক ছাড়ল রানা, গুলি করবি না!

অন্য কারণে সতর্ক করছে ওরা। র‍্যাঞ্চ হাউসের আগুনের খুব কাছে পৌঁছে গেছে রানা। একই কথা খাটে রিক বেণ্ডারের ক্ষেত্রেও। ওরা দুজনই ভাসছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোতে। দানবের ছেঁড়া নাক থেকে লাল ঝর্নার মত ঝরছে রক্ত। তেড়ে গেল রানাকে লক্ষ্য করে। দুহাত তুলেছে গলা টিপে ধরবে বলে। উঁচু করা দুহাতের তলা দিয়ে তার বুকের কাছে পৌঁছে গেল রানা। পরক্ষণে গায়ের জোরে ডানহাতি ঘুষি বসাল রিকের ভাঙা পাঁজরের হাড়ের ওপর। কট্টাস্ করে আওয়াজ শুনল ও। পরমুহূর্তে একটা হাত ধরে গায়ের জোরে হিপ-থ্রো করল দৈত্যকে।

ধড়াস করে মাটিতে পড়ল পাহাড়। করুণ অথচ বিকট চিৎকার ছাড়ল ও। দুহাতে চেপে ধরল বুক। হাঁপাচ্ছে হাপরের মত। হঠাৎ ঠোঁটের কশ বেয়ে নামল রক্ত ও বুদ্বুদ। কর্কশ স্বরে বলল: নিক! নিক! আমাকে মারছে লোকটা! তুই কই! করুণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। বারকয়েক পা নেড়ে থেমে গেল নিথর হয়ে।

আগুনের শো-শো ছাড়া কোনও শব্দ নেই।

 ঘুরে তাকাল রানা।

অবিশ্বাস নিয়ে ওকে দেখছে জন ও বাড। পারলি তুই! বিস্মিত কণ্ঠে বলল জন।

এবার লাশ ফেলতে হবে আগুনে, বলল বাড। তা হলে থাকবে না কোনও প্রমাণ।

যুক্তিবাদী কাকে বলে, বলল জন।

ওরা সরে গেল আগুনের হলকা থেকে। দাউদাউ করে জ্বলছে র‍্যাঞ্চের প্রায় প্রতিটি বাড়ি। রানা দেখল, একটু দূরে আধপোড়া এক লাশ। ওটা লোগান টার্সনের। তার জন্যে কোনও করুণা এল না ওর মনে। বলেছিল খুন করবে না, করেনি। শুধু পথ দেখিয়ে দিয়েছে যেতে হবে কোন পথে।

রিক বেণ্ডারেই শেষ, নাকি আরও কেউ আছে? জানতে চাইল জন।

র‍্যাঞ্চ হাউসের পেছনে শেষ করেছি একটাকে, বলল বাড। মাঠে আরেকজন। তার রাইফেলটা নিয়েছি।

ছোরা দিয়ে খতম করেছি একজনকে, তা ছাড়া গুলি করেছি শুধু দেয়ালের দিকে, বলল জন।

চওড়া হাসল বাড। তুই দেয়ালের বদলে কাউকে গুলি করলে ভাবছিস লাগাতে পারতি?

কেন আমিই না নরম করলাম বেণ্ডারকে রানার জন্যে? প্রতিবাদ করল জন।

কথা ঠিক, কিন্তু ব্যাটার রক্ত প্রথম বের করল কে? বুক ঠকল বাড।

হালকা সুরে বললেও ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে উঠে এসেছে ওরা। মরত যে-কোনও সময়ে। এই র‍্যাঞ্চে এখন রয়েছে বেশকিছু লাশ। কারা মারা গেছে, সরজমিনে দেখল ওরা। আরও ফিউয়েল ঢেলে জড় করে লাশ ফেলল আগুনে। কাজ শেষে দূরের টিউব ওয়েল থেকে পানি তুলে হলো পরিচ্ছন্ন। ময়নিহানের এক কর্মচারীর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এল র‍্যাঞ্চ থেকে। ডালাসে যাওয়ার পথে নদীর সেতু থেকে ফেলল ওদের অস্ত্র। গাড়িটা পুড়ল নির্জন এক পার্কিংলটে। হেঁটে চলল ওরা ডিএফডাব্লিউ এয়ারপোর্টের দিকে।

ন্যাশ ময়নিহান বা তার লোকদের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক আছে, এমন কোনও প্রমাণ নেই। পাহাড়ে নিনার বাড়িতে যারা মারা গেছে, প্রত্যেকে পুড়েছে আগুনে। রেস্টুরেন্টে জাজ, শেরিফ ও সিঁড়িতে লোকটার খুনের জন্যে বোধহয় দায়ী করা হবে রিক বেণ্ডারকে। ধরে নেয়া হবে নিজের ছোটভাইকেও খুন করেছে গ্যারাজে। শুধু তা-ই নয়, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ময়নিহানের র‍্যাঞ্চের প্রতিটি বাড়ি ও ছাউনিতে। কিন্তু কেউ খুঁজে পাবে না তাকে। ময়নিহান উধাও হওয়ায় ডালাস দখল করতে পাগল হয়ে মারামারি শুরু করবে আণ্ডারওঅর্ল্ডের ক্রিমিনাল দলগুলো।

এসবই ভেবেছে রানা। ওর জানা নেই শুরুতে কজন। ছিল ময়নিহানের সঙ্গে। তবে একজন যে র‍্যাঞ্চে নেই, তা বুঝে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে ও। জন ও বাডের উদ্দেশে বলল, আমরা ন্যাশ ময়নিহানের হাত থেকে জুডি ও নিনাকে ছুটিয়ে নেয়ার সময় এক মহিলা ছিল। তোরা দেখেছিস তার লাশ?

আমি দেখিনি, বলল বাড।

কাঁধ ঝাঁকাল জন। কাউকে গুলি লাগাতে পারিনি।

পাথরের মত কঠিন হয়ে গেল রানার মুখ। তার মানে, ভুল না হয়ে থাকলে সে গেছে টাম্পায় জুডি আর নিনাকে খুন করতে।

.

৪৫.

 মাত্র কিছু দিন হলো টাম্পা শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় খোলা হয়েছে রানা ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস। জন ও বাড় ছাড়া অন্য কাউকে এখনও নিয়োগ দেয়া হয়নি এই শাখার জন্যে। পুরো গুছিয়ে নেয়া হয়নি দুই কামরার অফিস। বাইরের ঘরটায় খা-খা করছে চার সাদা দেয়াল। দরজা দিয়ে ঢুকলেই পনেরো ফুট দূরে মস্ত এক ডেস্ক ও কয়েকটা চেয়ার। বামে আরেকটা দরজা ভেতরের ঘরে যাওয়ার। ওখানেই গত একমাস ধরে বাস করেছে জন হার্বার্ট। প্রায় চৌকির মত সরু খাট, ওয়ার্লোব ছাড়া আসবাবপত্র কিছুই নেই। একপাশে অ্যাটাচড় বাথরুম।

রানার কথায় ভেতরের ওই ঘরে জুডি ও নিনাকে তুলেছে গিল্টি মিয়া ও হারাধন কই। তাতে একবারের জন্যেও আপত্তি তোলেনি মেয়েদুটো। ঘুম ও খাওয়া ছাড়া বাকি সময় গল্প করে কাটিয়ে দিচ্ছে ওরা। আলাপের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে মাসুদ রানা।  

আপাতত খাটে কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে নিনা।

রানার কথাই ভাবছে জুডি।

আর যোগাযোগ করল না মানুষটা!

এখনও কি লড়ছে ন্যাশ ময়নিহানের লোকদের বিরুদ্ধে?

হয়তো তা-ই!

অথবা হয়েছে ব্যর্থ।

আহত হয়নি তো?

যদি মরে যায়?

নাহ, তা হতে পারে না!

এ কথা মনে আসতেই দেবে না জুডি!

 ময়নিহান বা তার দলের সবাইকে হারিয়ে দেবে রানা।

নিশ্চয়ই পারবে।

ওর মত দায়িত্বশীল কাউকে আগে দেখেনি জুড়ি। এনওয়াইপিডিতে কাজ করে ও নিজে। শক্ত মনের অনেকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে, কিন্তু তাদেরও নেই রানার মত যোগ্যতা। অথচ, মানুষটাকে কঠোর মনে হলেও একটু কাছে যেতে পারলে বোঝা যায়, ফুলের মত নরম একটা মন আছে তার। বন্ধুর জন্যে জান দিতেও দ্বিধা নেই। তার চেয়েও বড় কথা, বদলে চায় না কিছুই। কোনও দিক দিয়েই রানার স্বার্থ খুঁজে পাবে না কেউ। জুডিকে বলেছিল সাহায্য করবে নিনাকে খুঁজে বের করতে। সেজন্যে ভয়ঙ্কর সব শত্রু তৈরি হয়েছে ওর, নিতে হয়েছে বিপদ ও মৃত্যুর ঝুঁকি। একবারের জন্যে বলেনি এ কাজের জন্যে ওর কিছু প্রাপ্য হয় না টাকা, না মন। রানা বলেছে, জুডির বড়ভাই ওর সহযোগী ছিল। কথাটা ঠিক নয়। মাইক ছিল রানার কর্মচারী। কিন্তু বস্ হিসেবে কখনও তাকে কোনও হুকুম দেয়নি রানা। আপন করে নিয়েছিল ভাই বা বন্ধুর মত। এ সংস্থা অন্যসব অফিসের চেয়ে অন্যরকম। সে কারণে কর্মচারীরা যেমন প্রাণ দিতে রাজি থাকে রানার জন্যে, তেমনি রানা নিজেও তাদের জন্যে মরতে প্রস্তুত। অদ্ভুত মানুষ। কখনও কঠোর, কখনও নরম। বেশিরভাগ সময় নীরব। অথচ, ওর কালো দুই চোখে কত কথা, কীসের অবাক করা এক আকর্ষণ। ওর বিলিয়ে দেয়া স্নেহ ও মায়ায় আটকা পড়ে যায় সবাই। যেমন এই গিল্টি মিয়া। রানার প্রিয় কেউ জুডি, তাই দিন রাত বাইরের ঘরে বসে পাহারা দিচ্ছে সে। একটু পর পর আধখাপচা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে কিছু লাগবে কি না। প্রাণ দিতেও রাজি নিনা আর ওর জন্যে। আর হারাধন, লজ্জায় কাতর, চোখে অঢেল শ্রদ্ধা। সে-ও বারবার জিজ্ঞেস করে চা করে দেবে কি না।

সচেতন হয়ে উঠল জুডি। বাইরের ঘরে চাপা স্বরে কথা বলছে কেউ। বিছানা ছেড়ে দরজার পাশে পৌঁছে গেল ও। সামান্য ফাঁক করল কবাট।

বাজারে গেছে বলে ওই ঘরে নেই হারাধন কই। রাজকীয় ডেস্কে বসে আছে, ছোটখাটো মানুষ গিল্টি মিয়া। যাতে জুডি ও নিনার ঘুম না ভাঙে, তাই নিচু গলায় বলল, কাউকে পাবেন না, দিদি। নেই তো কেউ! সবাই কোতায় যেন চলে গেছে!

মহিলার কাঁধে হাতব্যাগ। মুখের একপাশ দেখে কু ডেকে উঠল জুডির মন। যতই মাথায় হ্যাট থাকুক, কোথাও দেখেছে তাকে। দরজা খুলে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এল জুডি।

ওকে দেখেই খোলা ব্যাগ থেকে কী যেন বের করছে মহিলা। এবার মনে পড়ল জুডির, মাত্র দুবার ময়নিহানের র‍্যাঞ্চে দেখেছে তাকে। প্রথমবার আরেকটু হলে ওকে খুন করত সে। তখন ওর প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল ময়নিহান। পরেরবার দেখেছে জিম্মি বিনিময়ের সময়। ঘুরেই ভেতরের ঘরের দিকে ছুটতে চাইল জুডি। ওখানেই আছে ওর পিস্তল।

কিন্তু মহিলার হাতে কুচকুচে কালো অটোমেটিক পিস্তল দেখেই ধমকে উঠল গিল্টি মিয়া: খবদ্দার! নড়েচ তো মরেচ!

ঘুরেই ছোটখাটো মানুষটার দিকে অস্ত্র তাক করল মারি কিটন।

জুডি বুঝে গেল, এবার আর বাঁচবে না ওরা।

ট্রিগার টিপছে মহিলা। মুখে নিষ্প্রাণ হাসি।

সত্যিই গুলি হলো। তবে ঠকা শব্দটা কেমন যেন। মারি কিটনের কপালে উঠেছে আলুর মত বড়সড়ো একটা আব। এমনি সময়ে কোত্থেকে ছুটে এসে পিছন থেকে দড়াম করে ওর মাথায় লাঠির বাড়ি লাগিয়ে দিল হারাধন কই। পরক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল মারি কিটন।

লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে ছুটে এল গিল্টি মিয়া, হাতে জুডির দেখা সবচেয়ে বড় পিস্তল। একবার ওকে দেখে নিয়ে মহিলার দিকে মনোযোগ দিল রানার সহযোগী।

নে, হাত-পাগুনো বেঁদে ফেল্ দিকি, হারু।

সামনে বেড়ে মেঝে থেকে পিস্তল তুলে নিল জুডি। বুঝে গেল, জ্ঞান হারিয়েছে মহিলা। নাক ডাকছে ঘড়ঘড়ঘঘা শব্দে।

এ মরণ-ঘুম ভাঙতে কম করেও দুঘণ্টা, বুজলেন, বউদি? আর মাতার ব্যতায় বলবে দশটা ডিসপ্রিন দাও গো, নইলে গেলুম! রানার সঙ্গে সুন্দরী কাউকে দেখলেই সে মেয়েকে গিল্টি মিয়ার পছন্দ হয়ে যায়, ওর কাছে সে হয়ে ওঠে সম্ভাব্য বউদি। খুঁজে-পেতে মেঝে থেকে মার্বেলটা নিয়ে বুক পকেটে রেখে দিল গিল্টি মিয়া। এতক্ষণে মুখে ফুটল নিষ্পাপ সরল হাসি। বুজলেন, বউদি, স্যরকে বলেছি না, কখোনও ফস্কায় না আমার গুলি!

ভেতরের ঘরে বেজে উঠেছে মোবাইল ফোন। দৌড়ে গিয়ে বিছানা থেকে ওটা নিয়ে কল রিসিভ করল জুডি। হ্যালো, রানা?

জুডি, আছ মস্ত বিপদে, বলল গম্ভীর রানা, ময়নিহানের মহিলা-খুনি গেছে তোমাদেরকে খুন করতে। হাতের কাছে রাখো পিস্তল। …আর গিল্টি মিয়াকে দাও। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে…

গিল্টি মিয়া আর হারাধন অজ্ঞান করে ফেলে রেখেছে। ওই মহিলাকে, বলল জুডি, কিন্তু বুঝলাম না ওই মার্বেল ভরা পিস্তল পেল কোথা থেকে!

পরে বলব, দীর্ঘ কাহিনী, শ্বাস ফেলল রানা। পুলিশ ডাকতে বলল। খুনিকে তুলে দেবে তাদের হাতে।

কিন্তু, রানা, পুলিশকে এসবে জড়ালে বেরিয়ে আসবে তোমাদের কথা, আপত্তি তুলল জুডি। অন্য কোনও উপায়…

ভেবো না, বলল রানা, যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওয়ান্টেড লিস্টে ছিল মারি কিটনের ছবি। চেহারা মনে রেখেছে বাড। পরে তাকে দেখেছে র‍্যাঞ্চে। তখনই দেরি না করে খোঁজ নিয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে ওই সংস্থার এক এজেন্টকে খুন করেছে মহিলা। একটু আগে বাড যোগাযোগ করেছে তাদের সঙ্গে। পুলিশ তদন্ত করবে না, মহিলাকে মুঠোয় চায় ডিইএ। তাদের এজেন্ট খুনের ব্যাপার ছাড়াও তার পেট থেকে বের করবে আরও বহু কথা। নিজ স্বার্থেই ন্যাশ ময়নিহান বা আমাদের কথা চেপে যাবে সে, নইলে পড়বে মস্ত ঝামেলায়। তা ছাড়া, কোথায় আমাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রমাণ? পুলিশ বা ডিইএ পাচাতে চাইলে বলে দেব, ছিলাম পেনস্যাকোলার পুবে রুপালি সাগর-সৈকতে এক বিচ হাউসে। অন্য কিছু প্রমাণ করুক পারলে। …এবার ফোনটা গিল্টি মিয়ার হাতে দাও।  

জুডির কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে কানে ঠেকাল গিল্টি মিয়া। ইয়েস, স্যর, সবাই বেঁচে আছি। ভাববেন না। একোন আর ঘুম ভাঙবে না দুষ্টু মেয়েটার। তবে বুজতে পারছি না একটা কতা। কপালে ঠাস্ করে দিয়েছি বলে এটা কী কাজ করচে! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকচে আর ছ্যার ছ্যার করে মেজে ভাসিয়ে মুতে… ছিহ, এভাবে ইয়ে করে ভাল মেয়েরা? এতক্ষণে ওর খেয়াল হলো স্যরের সঙ্গে এসব বলা ঠিক হচ্ছে না। জিভ কেটে বলল, থুক্কু! কিচু মনে নেবেন না, স্যর।

হাসি চাপতে খুকখুক করে কাশল রানা। গিল্টি মিয়া, পুলিশ ডেকে তাদের হাতে ওকে তুলে দাও। কর্তৃপক্ষ বিদায় নিলে দেরি না করে সবাইকে নিয়ে চলে যাবে দুই নম্বর সেফহাউসে।

জী, স্যর, আপনি হলেন গিয়ে ফেরেস্তা মানুষ, ধরে নিন, ওভেনে পৌঁছে গেছি, আপনার কতা কি ফেলতে পারি? আপনি হলেন গিয়ে…

আবার! রানার ধমক খেয়ে জিভ কাটল ও।

সমযদার রানা বুঝে গেছে, অনেক কথা আছে গিল্টি মিয়ার পেটে, কিন্তু কাজের কথা আর একটাও নেই। সময় নষ্ট না করে কল কেটে দিল ও।

.

৪৬.

 সামনেই ফ্লোরিডার উন্মুক্ত সুনীল উপসাগর।  

জায়গাটা পেনস্যাকোলার পুবে।

রুপালি সাগর-সৈকতের অর্ধচন্দ্রের মত বাঁক ঘুরে বহু দূরে গেছে সবুজ, গভীর অরণ্য। কিছুক্ষণ হলো জ্বরের ঘোরে মাসুদ রানা দেখছে, সৈকত ধরে হেঁটে আসছে দারুণ রূপসী এক মেয়ে। সামান্য কাত হয়ে শুয়ে তৃতীয়বারের মত তাকাল রানা।

গোবি মরুভূমির মত গলা শুকিয়ে গেল ওর। ভাবছে: সত্যিই টাইম মেশিনে চেপে পিছিয়ে গেছি নাকি? আবারও সব শুরু হবে প্রথম থেকে? নাহ্, এটা বোধহয় আর কেউ। সত্যিই কি ওই অপ্সরার গন্তব্য ওর ভাড়া করা নির্জন, ছোট্ট বিচ হাউস?

আরে! সত্যিই তো মেয়েটা জুডি!

চোখ পিটপিট করে চতুর্থবারের মত তাকাল রানা।

না, এটা কোনও দৃষ্টিভ্রম নয়!

এইমাত্র বালিতে হোঁচট খেয়েছে দেবী! বিড়বিড় করে কী যেন বলল, কিন্তু সাগরের শোঁ-শোঁ আওয়াজ ও ঝিরঝিরে হাওয়ায় চাপা পড়ল ওর কথা। উঠে এল রানার সান ডেকে। বসে পড়ল পাশে। রানা কিছু বলার আগেই হাত রাখল ওর কপালে। পরক্ষণে বলল, এহূহে, জন হার্বার্ট দেখি ঠিকই বলেছেন। তুমি কেমন ধাঁচের লোক, রানা? ডাক্তার না দেখিয়ে এত জ্বর নিয়ে পড়ে আছ জঙ্গলের মধ্যে?

জ্বর কমে গেছে, আত্মরক্ষা করতে চাইল রানা।

নাক ফোলাল জুডি। কচু! ভেতরের ঘরে চলো। শুয়ে পড়বে খাটে।

তারপর কী করব? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল রানা।

জ্বর কমলে… চোখ টিপল জুডি।

যাক বাবা, প্রথম থেকে শুরু হয়নি সব। টাইম মেশিনে চেপে ফিরতে হবে না ওকে লিটল ফোর্কে! ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল রানা। ওর কোমর জড়িয়ে ধরে কেবিনে ঢুকল জুডি।

দুজনই বুঝে গেছে, রানার ফুরিয়ে আসা ছুটির শেষ এই তিনটে দিন ওরা ঘুরে আসবে স্বর্গের চেয়েও ভাল কোথাও থেকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *