টপ টেরর ১

মাসুদ রানা ৪৫৫ – টপ টেরর – কাজী আনোয়ার হোসেন, সহযোগী কাজী মায়মুর হোসেন – সেবা প্রকাশনী

০১.

 এমন ভয়ানক বিপদ হবে, কখনও ভাবেনি নিনা। গভীর জঙ্গলে ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কাঁটাঝোঁপের ওপর। চোখা ডাল উলের পুরু প্যান্ট ছিঁড়তেই ছড়ে গেল ঊরু। গলা চিরে বেরোল চাপা আর্তচিৎকার। পরক্ষণে বুঝল, আওয়াজ করা চলবে না। ধাওয়া করে আসছে ওরা। ধড়মড়িয়ে উঠে আবারও ছুটল প্রাণ হাতে করে। তীব্র ভয়ে গলার কাছে উঠে এসেছে হৃৎপিণ্ড। দেখেছে এমন দৃশ্য, এখন মন চাইছে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে। বুকের ভেতর কে যেন বারবার। বলছে: পালাও! পালাও! পালাও! দূরে কোথাও! আরও দূরে!

প্রাণপণে ছুটছে নিনা। পেছনে ফেলে যাচ্ছে রক্তাক্ত, বীভৎস দৃশ্য। একটু আগে বুঝেছে, বাঁচতে চাইলে পালাতে হবে ওকে। আর… নিরাপদে রাখতে হবে হাতের জিনিসটা। পরে হয়তো কাজে আসবে ওটা।

আগে এত খারাপ কোনও বছর আসেনি নিনা ভেঞ্চার জীবনে। গত বসন্তে আঠারো বছরের এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেল ওর স্বামী। গ্রীষ্মে তালাক দিয়ে দিল। হেমন্তে নিনার মনে হলো জীবনটা অর্থহীন। ভীষণ মানসিক কষ্ট। এরপর এই কনকনে শীতে এখন তাড়া করে ওকে খুন করতে চাইছে একদল নিষ্ঠুর আততায়ী!

এরই মধ্যে খুন হয়েছে একজন। আবছা আলোয় ওই দৃশ্য ছিল দুঃস্বপ্নের মত। কিন্তু তার চেয়েও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে: জঙ্গলে রাইফেল-পিস্তল হাতে খুঁজছে ওকে খুনির দল। দেখামাত্র খুন করবে।

আগে হোক বা পরে, ধরা ওকে পড়তেই হবে। আর তখন আবারও ঝরবে রক্ত- সে রক্ত ওর নিজের!

প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটছে নিনা। লুকাতে হবে। তাজা রক্তের গন্ধ পাওয়া ব্লাডহাউণ্ডের মত তেড়ে আসছে ওরা। এ জঙ্গলেই ওর বাড়ি, অথচ ফিরতে পারবে না ওখানে। বাধ্য হয়ে পালাচ্ছে, কিন্তু কোথায় যাবে, তা জানে না। শক্তি নেই। যে লড়বে। ঠেকাতে পারবে না খুনিগুলোকে। অস্ত্র বলতে শুধু একটা ডিজিটাল ভিডিয়ো ক্যামেরা।

কদিন আগে ত্রিশ বছরে পা দিয়েছে নিনা। তিন বছর আগে হলেও পঞ্চাশ মিনিটে পেরোত পাঁচ মাইল। কিন্তু তা আজ অসম্ভব। ভারী হয়েছে শরীর। বড়জোর ছুটবে মাইল দুয়েক। সে চেষ্টাই করছে।

পেছনে চিৎকার ও পদশব্দ, এগিয়ে আসছে খুনিরা।

বিপদের মাত্রা মনে করিয়ে দিতেই যেন কানের পাশ কাটিয়ে গেল রাগী ভোমরার মত বুলেট। সামনে ডানদিকের একটা গাছ থেকে ছিটকে এল কাঠের কুচি।

আরেকটু হলে মরত বুঝে থমকে গেছে নিনা ভেঞ্চুরা। সরে গেল একপাশে। পরক্ষণে ছুটল আবার। ঢিবির মত উঁচু হয়েছে সামনের জঙ্গলের মাটি। ওখানে জন্মেছে হাজারো ঝোপঝাড় ও লতাগাছ। শৈবালে ছাওয়া উপড়ে পড়া এক গাছ টপকে ওদিকেই চলল নিনা। আবারও কানের পাশ দিয়ে গেল বুলেট। আর একটু বাড়ল দৌড়ের গতি। হাঁপাচ্ছে বেদম।

সামনে দূর থেকে এল চাপা গর্জন।

নিনা ভাবল, খুনির দল এনেছে আর্মার্ড ভেহিকেল। কিন্তু পরক্ষণে বুঝল, প্রকাণ্ড কোনও কামানের গোলাবর্ষণের মত শোনালেও ওই আওয়াজ আসলে গ্রেট ওয়েলস্ জলপ্রপাতের। আগেও কবার ওদিকে গেছে নিনা। তখন টিলা বেয়ে নেমে গিয়েছিল নদীর তীরে।

ছুটতে ছুটতে ভাবল, কেমন হয় সোজা গিয়ে জলপ্রপাত থেকে ঝাঁপ দিলে?

খাড়া টিলা থেকে বহু নিচে উন্মত্ত নদীর তুমুল বেগে ছুটে চলা সাদা জলরাশি। কিন্তু ওখানে নামতে হলে চাই অনেক সময়। তা ছাড়া, পা পিছলে গেলে সোজা পড়বে দেড় শ ফুট নিচের জলমগ্ন পাথরের ওপর। মরবে নির্ঘাত।

না, অনুচিত হবে জলপ্রপাতের দিকে যাওয়া।

 ইলেকট্রিফায়েড বেড়ার চেয়ে কম বিপজ্জনক নয় ওটা।

ওদিকটা বাদ।

দৌড় না থামিয়ে সরু জঙ্গুলে পথ থেকে সরে গেল নিনা। এক লাফে টপকে গেল ভাঙা, মোটা এক পাইন গাছের ডাল। ঘন হয়ে জন্মানো ঝোপঝাড় এড়িয়ে ছুটছে ও। ঠিক করেছে লুকিয়ে পড়বে অচেনা জঙ্গল ও টিলার গোলকধাঁধায়। কেউ যায় না, কিন্তু উপায় নেই ওর ওদিকে না গিয়ে। পালাতে হবে। কিছুক্ষণ পর হয়তো হাল ছেড়ে দেবে খুনিরা। তবে তা যদি না করে, মরতেই হবে ওকে। ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে শরীরের শক্তি।

.

০২.

 সামনেই ফ্লোরিডার উন্মুক্ত সুনীল উপসাগর।

জায়গাটা পেনস্যাকোলার পুবে।

রুপালি সাগর-সৈকতের অর্ধচন্দ্রের মত বাঁক ঘুরে বহু দূরে গেছে সবুজ, গভীর অরণ্য। কিছুক্ষণ হলো রানা খেয়াল করছে, ডানের সৈকত ধরে হেঁটে আসছে এক যুবতী। সামান্য কাত হয়ে শুয়ে তৃতীয়বারের মত তাকাল রানা। গলা শুকিয়ে গেল সাহারা মরুভূমির মত। ভাবছে: এ কি সত্যিই মানবী, না স্বর্গচ্যুত, দিগ্ভ্রান্ত কোনও অপ্সরা?

ওর ভাড়া করা নির্জন, ছোট্ট বিচ হাউস বোধহয় তার গন্তব্য। চোখ পিটপিট করে চতুর্থবারের মত তাকাল রানা।

না। দৃষ্টিভ্রম নয়।

এইমাত্র বালিতে হোঁচট খেয়েছে গ্রিক দেবী!

বিড়বিড় করে কী যেন বলল, কিন্তু সাগরের শোঁ-শো আওয়াজ ও ঝিরঝিরে হাওয়ায় চাপা পড়ল তার কথা।

ওই মেয়ে ছাড়া আশপাশে কেউ নেই, তবুও সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা। পাশে রাখা ভোয়ালের নিচে স্পর্শ করল কড় .৩৮ ক্যালিবারের ওয়ালথার পি.পি.কে. পিস্তলটা।

সুন্দরী হয়তো টুরিস্ট। সাধারণ মেয়ের চেয়ে লম্বা। সরু কোমর, চওড়া কাঁধ। নিয়মিত বোধহয় সাঁতার কাটে। হাঁটার ভঙ্গি ব্যালেরিনার মতই সাবলীল। কালো চুল। বড় দুই চোখের মণি কুচকুচে কালো। এইমাত্র উঠে এল রানার বিচ হাউসের সান-ডেকে।

এত কাছ থেকে ওকে দেখে হঠাৎ আরেকজনের চেহারার ছদ মনে পড়ল। কিন্তু সে তো আজ আর পৃথিবীতে নেই।

মিষ্টি কণ্ঠে জানতে চাইল রূপসী, তুমি কি মাসুদ রানা?

উদোম রানার পরনে শুধু নীল হাফপ্যান্ট। ভাবেনি নির্জন বিচ হাউসে আসবে কেউ। মেয়েটা আগ্রহ নিয়ে দেখছে ওর শরীরের আবছা হয়ে আসা পুরনো ক্ষতচিহ্নগুলো।

বিয়ারের ক্যানে চুমুকের ফাঁকে আরেকবার দুদিকের সৈকত দেখল রানা।

কেউ নেই।

চট করে কয়েকটা প্রশ্ন জাগল ওর মনে:

কে এই রূপসী?

কেউ নেই তো পেছনের জঙ্গলে?

 সুন্দরীরা কখনও কখনও হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিপজ্জনক।

তবে ওর মনে হলো, এর সঙ্গে কেউ নেই। জঙ্গলে স্বাভাবিক সুরে ক্যাঁ-কিঁচ-কিঁচ শব্দে ডাকছে পাখি।

একটু কাত হয়ে দাঁড়াল মেয়েটা। ঊরুর পাশে ঝুলছে সুতলিতে বাঁধা দুপাটি স্যাণ্ডেল। সহজ সুরে আবারও জানতে চাইল, তুমিই তো মাসুদ রানা?

তাই তো মনে হয়, বলল রানা। তুমি?

আমার নাম জুডি ব্ল্যাকউড, রানার পাশে মেঝেতে বসে পড়ল সে। আমার ভাইকে চিনতে। ওর নাম ছিল মাইক ব্ল্যাকউড।

চট করে মাইক ব্ল্যাকউডের কথা মনে পড়ল রানার।

সিআইএর তুখোড় স্পাই হওয়ার যোগ্যতা ছিল তার। চাকরি নিয়েছিল নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। বয়স যখন বত্রিশ, বড় পদের কজন ঘুষখোর অফিসারের সঙ্গে মত বিরোধ হওয়ায় গেল চাকরি। শতখানেক প্রতিযোগীকে হারিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যোগ দিল রানার এজেন্সিতে। মাত্র কমাসে হয়ে উঠল নিউ ইয়র্ক শাখার ডেপুটি চিফ। কিন্তু রাশান মাফিয়ার ড্রাগস বিক্রেতা একটি উপদলের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গভীর রাতে খুন হয়েছিল হার্লেমের এক পতিতালয়ে। তিন দিন পর পাওয়া গেল ক্ষত-বিক্ষত লাশ।

তার শেষকৃত্যের কদিন পর নিউ ইয়র্কে পৌঁছে রানা। পুরো সাত দিন ব্যয় করে সংগ্রহ করল তথ্য। তারপর রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির কজন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পুব মিডটাউনে রাশান মাফিয়ার হেডকোয়ার্টারে হামলা করল ভোর রাতে।

মাত্র বিশ মিনিট নিয়েছিল ওরা। তারপর সরে যায় পুলিশ আসার আগেই।

পরদিন মাঝ সকালের দৈনিক পত্রিকার সংস্করণে প্রথম পাতায় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হলো: কারা এরা?

আর্টিকেলের মূল বক্তব্য: খুন হয়েছে নিউ ইয়র্কে জেঁকে বসা রাশান মাফিয়া ডন মিখাইল জাকায়েভ এবং দলের ঊর্ধ্বতন সদস্যরা! কৃতিত্ব নেয়নি কেউ! সরকারের উচিত এই লোকদেরকে খুঁজে বের করে পুরস্কার দেয়া!

আকারে ঠিক গণ্ডারের মত ছিল মাইক।

এই অপ্সরা তা হলে ওর বোন?

তুমি মাইকের বোন? উঠে বসল রানা। তোয়ালের নিচে ডানহাতে পিস্তল।

দুই বোনের একজন, বলল জুডি। আমার বোনের নাম নিনা। বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়।

মেয়েটা কেন এসেছে, ভাবছে রানা। রিং খুলে বাড়িয়ে দিল ঠাণ্ডা একটা ক্যান। জুডি ওটা নেয়ায় দিতে চাইল গ্লাস। কিন্তু মাথা নেড়ে মানা করল মেয়েটা। দীর্ঘ চুমুক দিল বিয়ারে।

হয়তো ভাবছ কেন এখানে এসেছি?

কথাটা মিথ্যা নয়, স্বীকার করার সুরে বলল রানা।

ছিমছাম বিচ হাউস দেখছে মেয়েটা। কসেকেণ্ড পর বলল, খুব সুন্দর। তবে বড় নির্জন। ভাল লাগে একা এখানে থাকতে?

মন্দ লাগে না। ছুটি কাটাচ্ছি। অবাক হচ্ছি, আমাকে খুঁজে বের করলে কী করে।

বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান, প্রিয় বন্ধু সোহেল আহমেদ, জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স ছাড়া কেউ জানে না ও আছে এখানে। ওর বস্ অথবা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কারও কাছে মুখ খুলবে না।

বারবার অনুরোধ করেছি, তাই ঠিকানা দিয়েছে জন হার্বার্ট, বলল জুডি।

অর্থনৈতিক মন্দা চলছে বলে নিজের ডিটেকটিভ এজেন্সি বন্ধ করে দিয়েছে জন হার্বার্ট। বাধ্য হয়েই চাকরি নিয়েছে প্রিয় বন্ধু রানার ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিতে। কদিন হলো ফ্লোরিডার টাম্পা শহরে খোলা হয়েছে এজেন্সির শাখা। ওটার চিফ করা হয়েছে জন হার্বার্টকে।

রানা গভীর মনোযোগে দেখল মেয়েটাকে। তার চোখে কীসের এক বিষাদ। আরও কয়েক সেকেণ্ড কালো দুই মণি লক্ষ করে রানা বুঝে গেল, এই মেয়ে হুমকি নয় ওর জন্যে। আছে মস্তবড় কোনও বিপদে।

জন হার্বার্ট নিজে একটা কেস নিয়ে ব্যস্ত, তুমি হয়তো আমাকে সাহায্য করবে, তাই পাঠিয়ে দিয়েছে তোমার কাছে। জানিয়ে দিয়েছে, কল করলে বিরক্ত হতে পারো, কাজেই তা করবে না। শেষে উপায় না দেখে চলেই এসেছি।

চুপ করে আছে রানা।

খুব বিপদে আছি, বলল জুডি, তা ছাড়া, জানতাম কার কাছে আসতে হবে। আমার বড়ভাই মাইক দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করলে, সে লোক ছিলে তুমি। ও বলেছিল, ওর কিছু হলে যেন প্রয়োজনে যোগাযোগ করি তোমার সঙ্গে। আগে কখনও ভাবিনি সত্যিই সাহায্য চাইতে হবে।

মাইক আর কিছু জানায়নি আমার ব্যাপারে?

তেমন কিছু না। অবশ্য, তুমি নাকি দুনিয়ার সেরা কজন কমাণ্ডোদের একজন। বলতে পারো সেজন্যেই ছুটে এসেছি এত দূর থেকে।

চুপ করে থাকল রানা।

তোমার বন্ধু হার্বার্ট বলেছে, আমার জন্যে না হলেও মাইকের খাতিরে হয়তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে তুমি।

ঠিক কী ধরনের আশা করছ? বলল রানা।

আমি খুঁজে বের করতে চাই আমার বড় বোনকে। 

হারিয়ে গেছে? সেক্ষেত্রে যাওয়া উচিত পুলিশের কাছে।

লাভ নেই। ওখানকার পুলিশ কোনও সাহায্য করবে বলে মনে করি না। আমার ভয় হচ্ছে: হয়তো খুন করা হয়েছে ওকে, বিয়ারের ক্যান শক্ত হাতে ধরল জুডি।

নিজের ক্যানটা মেঝেতে রাখল রানা। কী ধরনের সাহায্যে আসব ভাবছ?

হতে পারে, এখনও খুন হয়নি নিনা।

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সুন্দরীর নাক এখন ঠিক ওর ভাইয়ের নাকের মত ফুলে উঠেছে, খেয়াল করল রানা। চেহারায় ভীষণ জেদ।

নিনা বেঁচে আছে কি নেই, তা জানতে চাই, বলল জুডি, এমনও হতে পারে, হয়তো জোর করে আটকে রেখেছে ওকে কেউ। উদ্ধার করা এখনও সম্ভব হতে পারে। তাই সাহায্য চাইছি। চোখেমুখে করুণ আর্তি ফুটে উঠল মেয়েটার, ওই বড় বোন ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই আমার।

রানা এজেন্সির কাজ করতে গিয়ে খুন হয়েছে এজেন্ট মাইকেল ব্ল্যাকউড। তার পরিবারের বিপদে অবশ্যই সহায়তা করবে রানা। কোনও অবস্থাতেই পিছিয়ে যাবে না। তার মানে কষ্টার্জিত ছুটিটা এখন তুলে রাখতে হবে শিকেয়। মনে মনে বলল ও, যা, ব্যাটা, এবার খতম হলো তোর বিশ্রাম! ভাবল, ছুটিতে ও যা খুশি করতে পারে, তবে বিষয়টা বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানকে জানিয়ে রাখা ভাল।

ঠিক আছে, সাধ্যমত চেষ্টা করব আমি, মেয়েটিকে আশ্বস্ত করল রানা। ওর খোঁজে কোথায় যেতে হবে? কোথা থেকে হারিয়ে গেছে তোমার বোন?

কেন্টাকির ছোট এক শহর থেকে শুরু করব আমরা, ওখানেই ছিল ও।

আমরা মানে? তুমিও যেতে চাও? এই কাজে বিপদ হতে পারে, তুমি সঙ্গে থাকলে আমার কাজের অসুবিধা হবে। আমি একাই যাব।

প্লিয, আমি সঙ্গে থাকতে চাই। কথা দিচ্ছি, তোমার কাজে কোনও রকম অসুবিধা করব না। কী ঘটছে জানতে না পারলে উদ্বেগেই মরে যাব আমি।

মানা করে দিতে যাচ্ছিল রানা, কিন্তু মেয়েটির কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখে মায়া হলো। খানিক ভেবে নিমরাজি হলো ও, যদিও জানে কাজটা ঠিক হচ্ছে না।

আজ তিন দিন হয়েছে পরিচিত কেউ বা বিসিআই থেকে কল করেনি কেউ। মোবাইল ফোনের দিকে হাত বাড়াল ও, কল করল ওর বসের অফিসে।

দুসেকেণ্ড পর ওদিক থেকে এল গম্ভীর কণ্ঠ: হ্যাঁ, রানা?

বাংলায় বলল রানা, স্যর, জরুরি কাজে ফোন করেছি। সংক্ষেপে মাইক ব্ল্যাকউডের দুবোনের কথা জানাল ও।

ওর বক্তব্য শেষে বিসিআই চিফ বললেন, মেয়েটাকে সাহায্য করা তো তোমার দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে। আর কিছু বলবে?

না, স্যর।

কেটে গেল স্যাটেলাইট ফোনের সংযোগ।

চুপচাপ রানার কথা শুনেছে জুডি। বলল, শুনতে খুব মিষ্টি শোনায় তোমাদের ভাষাটা।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। এই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন অনেক বাঙালি। মাতৃভাষা ও ভাষা সৈনিকদের সম্মান দিতে গিয়ে বছরে একটি বিশেষ দিবস পালন করে জাতিসংঘ। কসেকেণ্ড পর বলল, গুছিয়ে নিতে সামান্য সময় লাগবে আমার।

রওনা হতে চাই কাল সকালে, প্লেনের টিকেটও কেটে ফেলেছি।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। বইয়ে পড়লেও আগে কখনও যাওয়া হয়নি কেন্টাকির অ্যাপলেচিয়া পাহাড়ি এলাকায়। সবুজ উপত্যকা ঘেরা পাহাড় ও গভীর অরণ্য। বছরের এ সময়ে অপরূপ ছবির দৃশ্যের মতই। আরেকবার জুডিকে দেখল রানা। ভাবল, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু কী ঝামেলা পাকাবে এই মেয়ে আল্লাই মালুম!

কোথায় উঠেছ? জানতে চাইল ও।

ম্যারিয়েট হোটেলে।

 গুড। ওটা এয়ারপোর্টের কাছেই। সকালে পৌঁছে যাব।

কৃতজ্ঞ বোধ করছি, বলে খালি বিয়ারের ক্যান মেঝেতে রেখে ঝুঁকে রানার গালে চুমু দিল জুডি। উঠে দাঁড়িয়ে নেমে গেল সান ডেক থেকে। ফিরে চলেছে নিজের হোটেলে।

পেছন থেকে চেয়ে রইল রানা। মেয়েটা চলে যেতেই ঘরে ঢুকে গুছিয়ে নিল মাঝারি এক ব্যাকপ্যাক। কাজ শেষ করে আবারও বেরোল সান ডেকে। হলদে সূর্য ডুবছে মেক্সিকো উপসাগরের রক্তলাল দিগন্তে। 

রানার মনে পড়ল ওর খোঁচা-খোঁচা দাড়ি ভরা রুক্ষ গালে জুডির ঠোঁটের কোমল স্পর্শ ও তপ্ত শ্বাস। কেন যেন নিজেকে মনে হলো ওর খুব নিঃসঙ্গ। ধীরে ধীরে আকাশ থেকে বিদায় নিল রঙ, রইল শুধু কালো আঁধার আর মিটমিট করা অসংখ্য নক্ষত্র। কী অর্থ জীবনের কিছু বোঝা যায় না।

আরও অনেকক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিচ হাউসে ঢুকল রানা। কাল বিদায় নিচ্ছে। উচিত নয় রাত করা। নানান ফলের সালাদ ও তিনটে বিয়ার শেষ করে শুয়ে পড়ল ও। অন্তরে কে যেন ফিসফিস করল: প্রস্তুতি নিয়ে নে! সামনে কিন্তু মস্ত বিপদ!

.

০৩.

কাকডাকা ভোরে বিচ হাউস থেকে বেরোল মাসুদ রানা। বরাবরের মতই দৌড়াল টানা পাঁচ মাইল। করে নিল হালকা ফ্রিহ্যাণ্ড ব্যায়াম। তারপর শাওয়ার সেরে নতুন পোশাক পরে পৌঁছে গেল সাতটা বাজার আগেই টাম্পা শহরে। অডি এ৬এস রাখল লং-টার্ম পার্কিং লটে। ম্যারিয়েট হোটেলের ডেস্কে খোঁজ নিল জুডির। এক বয় ওকে পৌঁছে দিল ডাইনিং হলে। একই সময়ে ওখানে পৌঁছুল জুডি।

গতকালকের মত মেয়েটাকে আজও তাজা ফুলের মত মনে হলো রানার। তবে বোঝা গেল রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেনি অলরা।

আলাদাভাবে অর্ডার করা পছন্দমত নাস্তা চুপচাপ খেল ওরা। রানা ঠিক করেছে, আপাতত জিজ্ঞেস করবে না কিছু। বিমানে ওঠার পর জেনে নেবে দরকারি তথ্য।

এয়ারপোর্টে এয়ার মার্শালের নকল কাগজপত্র দেখাল রানা। ফলে সাথে অস্ত্র থাকলেও কোনও প্রশ্ন তুলল না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু জুডির সঙ্গে পিস্তল আছে বলে আপত্তি তুলল তারা। অবশ্য, উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারায় মেনেও নিল। বিষয়টা মনে রাখল রানা। প্রথম সুযোগেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রানা এজেন্সির শাখা চিফ জন হার্বার্টকে নির্দেশ দেবে, যাতে চেক করে মেয়েটার ব্যাকগ্রাউণ্ড।

বিমানে করে প্রথমে ওরা পৌঁছুল ক্যাপিটাল সিটি এয়ার পোর্টে। জায়গাটা ফ্র্যাঙ্কফোর্টের কাছেই। ওখান থেকে আরেক বিমানে চেপে গেল মানচিত্রে দেখানো ফুলস্টপের সমান শহর লিটল ফোর্কে। প্রায় সারাদিন বিমানে কাটিয়ে তারপর শুরু হলো সড়ক পথে জিপ-যাত্রা। শেষদিকে রাস্তা হয়ে গেল খুবই সরু। উপত্যকা থেকে এঁকেবেঁকে নুড়িপাথর ও কাঁচা মাটির পথ পেরিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বেশ অনেকটা দূর গিয়ে থামল জুডির বড়বোন নিনা ভেঞ্চুরার বাড়ির সামনে।

পাহাড়ের কাঁধে A আকৃতির বাড়িটা থেকে দেখা যায় নিচের খাড়া উপত্যকা। আরও দূরে নিকেলের মত চকচকে আকাশে খোঁচা দিচ্ছে প্রকাণ্ড সব পাথরের রুক্ষ চাই। নিনার কাঠের বাড়ি ঘেরা উঁচু বারান্দায় উঠেছে সামনের সিঁড়ি। বাড়ির পাশের ছাউনিতে এখন কোনও গাড়ি নেই।

চারপাশে নির্জন, বিশাল অ্যাপলেচিয়ান রেঞ্জ। পাহাড়ে চমৎকার কাঠের বাড়ি বা প্রাকৃতিক দৃশ্য রানাকে মনে করিয়ে দিল, এখানে কোনও মেয়ে একা বসবাস করলে তার ওপর যে-কোনও সময়ে হতে পারে হামলা। হয়তো ঠিক তা-ই হয়েছে নিনা ভেঞ্চুরার ভাগ্যে।

এখানে একা থাকত নিনা? জানতে চাইল রানা।

গত এপ্রিল পর্যন্ত ছিল ওর স্বামী, তারপর মোলো বছরের একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে সে। পরে পাঠিয়ে দিয়েছে ডিভোর্সের কাগজপত্র। এরপর থেকে নিনা এখানে থেকেছে একাই। অবশ্য কখনও কখনও চলে গেছে মেইনে আমাদের বাড়িতে।

রানার মনে পড়ল প্লেনে জুডি বলেছিল, তালাক হওয়ার পর ওয়েবসাইট খুলে ব্যবসা করছিল নিনা। অবসরে ঘুরে বেড়াত গ্রেট ওয়েস্ ফল আর আশপাশের পাহাড় ও জঙ্গলে।

এই নীরব এলাকা ও খুব পছন্দ করত, বলল জুডি।

চারপাশটা ছবির মতই সুন্দর, স্বীকার করল রানা।

নিনা ফ্রিল্যান্স ফোটোগ্রাফার। নানান ধরনের ম্যাগাযিনে আর ইন্টারনেটে পাঠাত ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফ। আসত যথেষ্ট টাকা।

ফোর্ড এক্সপ্লোরার ফোর হুইল ড্রাইভ জিপ ভাড়া নিয়ে এখানে এসেছে রানা ও জুডি। সামনের সিটের পেছনে গান। র‍্যাক। যারা এ গাড়ি ভাড়া নেয়, অনেকেই চায় বুনো এলাকায় শিকার করতে। বাড়ির সামনের চওড়া জায়গায়। গাড়িটা ঘুরিয়ে রেখে নামল রানা। ওর ডানহাতটা স্পর্শ করল বাম বগলের হোলস্টারে রাখা ওয়ালথার পি.পি.কে. পিস্তল।

চারপাশ খুব নীরব, মন্তব্য করল রানা। জুডির চোখে দেখল সান্ধ্যকালীন আকাশের রঙের প্রতিচ্ছবি। বইছে। মৃদুমন্দ ঝিরঝিরে হাওয়া। দূর থেকে আসছে গ্রেট ওয়েস ওঅটার-ফলের চাপা গর্জন। আশপাশে কোনও জন্তু বা পাখির ডাক নেই। পরিবেশটা অস্বাভাবিক মনে হলো রানার কাছে। উপত্যকার দুরে তাকাল ও।

নিচে জলপ্রপাতে তৈরি আঁকাবাঁকা নদী। আরও দূরে গিয়ে হারিয়ে গেছে গাছের আড়ালে। ডানে বাড়ি ও পেছনে খাড়া টিলা। ওদিকে তাকাল জুডি। অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না।

সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল ওরা।

আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা।

হাতব্যাগ হাতড়ে কী যেন খুঁজল জুডি।

রানার মনে হলো, মেয়েটা বের করবে পিস্তল।

আমার কাছে চাবি আছে, বলল জুডি।

বাড়িতে অ্যালার্ম সিস্টেম আছে? জানতে চাইল রানা।

জঙ্গলে অ্যালার্ম বসিয়ে লাভ কী? মাথা নাড়ল জুডি।

সদর দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা। প্রথমতলা খোলামেলা, কোনও ঘর নেই। পেছনে কিচেন। একপাশে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি। দোতলার মেঝে গিয়ে মিশেছে প্রায় টিলার গায়ে। ওপরেই বেডরুম ও বাথরুম। একনজরেই রানা বুঝল, তচনচ হয়েছে প্রথমতলার সবকিছু। যে-কেউ বুঝবে এখানে বয়ে গেছে ছোটখাট একটা টর্নেডো। উল্টেপাল্টে পড়ে আছে আসবাবপত্র। দেয়াল থেকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ছবি। মেঝেতে ভাঙা টিভি সেট ও ডিভিডি প্লেয়ার। ছিটিয়ে আছে কাবার্ড, টেবিলের ড্রয়ারের জিনিসপত্র ও ফায়ারপ্লেসের তাকের শো-পিস।

স্তম্ভিত দৃষ্টিতে কোমরে দুহাত রেখে চারপাশ দেখল জুডি।

সর্বনাশ! ডাকাতি হয়েছে!

ওর কাঁধে টোকা দিল রানা। নিচু গলায় বলল, বাইরে গিয়ে গাড়িতে ওঠো।

ঘুরে ওর দিকে তাকাল জুডি, কালো মণিতে বিস্ময়।

কে করল এই কুকীর্তি?

কিছু হয়তো বলত রানা, কিন্তু তখনই শুনল দোতলায় মৃদু আওয়াজ। হালকা পায়ে হাঁটছে কেউ।

জুডিও শুনেছে ওই পদশব্দ।

 রানা সতর্ক করার আগেই ডেকে উঠল জুডি, নিনা?

ঝট করে হোলস্টার থেকে ওয়ালথার বের করল রানা। ও জানে নিনা ভেঞ্চুরার ওজন বড়জোর পঁয়ষট্টি কেজি, দোতলার বুট পরা মানুষটা অন্তত আশি কেজি। এমনি সময়ে বাইরে থেকে এল আরেকটা পায়ের আওয়াজ। এই লোক রীতিমত হাতি। ম-ম করে উঠেছে বাইরের কাঠের বারান্দার মেঝে।

গাড়ির ইঞ্জিনের বা কারও গলার আওয়াজ পায়নি রানা। নিঃশব্দে বাড়িতে ঢুকতে চায় হাতি। রানার মনে হলো না সে আইনের লোক। এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে দোতলার লোকটার। গোপনে হামলা করতে চাইছে তারা।

জুডির মুখে হাতচাপা দিয়ে ওকে কাছে টানল রানা। কানের কাছে ফিসফিস করল ও, কিচেনের কাউন্টারের পেছনে লুকাও।

বাইরের লোকটা আর ওপরের বদমাস সার্চ করেছে নিনার বাড়ি। এরাই কি কিডন্যাপ করেছে মেয়েটাকে।

সতর্ক হয়েছে জুডি। যদিও ভয় নেই চোখে-মুখে। শক্ত মনের মেয়ে। কিন্তু রানা বুঝল, বিপদের মুহূর্তে ওর কথামত না চললে মেয়েটা হয়ে উঠবে সত্যিকারের বোঝা।

রানার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল জুডি। পা টিপে চলে গেল কিচেনের মার্বেল কাউন্টারের ওদিকে। সদর দরজা বা ওপরে ওঠার সিঁড়ি থেকে দেখা যাবে না ওকে। তবে দেখা যাবে পেছনের জানালা ও দরজা দিয়ে।

চাপা শ্বাস ফেলে ভাবল রানা, আশা করি দলে এই দুজনই। আরও কেউ থাকলে মস্তবড় বিপদে পড়বে ওরা।

চট করে সিঁড়ির ওপর দিকে একবার তাকাল রানা।

কেউ নেই ওখানে।

হালকা পায়ে সরে গিয়ে সদর দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকাল রানা। দরজার কবাট খুলবে ভেতরের দিকে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না ওকে।

মোচড় খেয়ে ঘুরল হ্যাণ্ডেল, পরক্ষণে ঝটকা দিয়ে ভোলা হলো দরজা। এক সেকেণ্ড পর ঢুকল একটা শটগানের ব্যারেল। রানা দেখল পাহাড়ের মত বিশাল আকারের এক দৈত্যের মোটা বাহু ও কাঁধ। মস্ত হাঁ করেছে ধমকে ওঠার জন্যে।

থ্যাক শব্দে তার বাহুর নার্ভ ভরা মাংসে নামল রানার ওয়ালথারের নল। পরক্ষণে খটাস্ করে পিস্তলের নল পড়ল লোকটার কলারবোনের ওপর। এরা কারা জানা নেই বলেই গুলি করতে পারল না রানা। নিরস্ত্র করাই মূল উদ্দেশ্য। হাতির হাত অবশ হতেই খটাস্ করে মেঝেতে পড়ল বন্দুক। বামহাতে লোকটার দাড়ি খামচে ধরল রানা, হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে দিল মাথা, পরমুহূর্তে হাতির ঘাড়ে নামল পিস্তলের তৃতীয় বাড়ি।

বিশাল লোক, গর্দানে পুরু চর্বির আস্তর। তবে কঠিন হামলায় অনেকটা কাবু হয়ে গেছে সে। ঘাড় চেপে ধরে তার মাথাটা ওপরে তুলল রানা, চোয়ালের নিচে ঠেসে ধরল পিস্তলের নল। জণ্ডিসের রোগীর মত হলদে চোখে রানাকে দেখল হাতি। বুঝে গেছে, ধরা পড়েছে বোকামি করে।

অ্যাই, ওপরের তুমি, গলা ছাড়ল রানা। নেমে এসো, নইলে তোমার দোস্তের মোটা মাথায় ঢুকবে বুলেট!

সিঁড়ির ওপরের ধাপে পায়ের নড়াচড়ার আওয়াজ পেল রানা।

ওদিকে তিন ধাপ নেমে রাইফেল কাঁধে তুলে ট্রিগার চাপল ওই লোক। দাঁড়া, শালা!

রানার পেছনে দরজার লিস্টেলে বিঁধল বুলেট।

এক লাফে হাতির পেছনে সরল রানা। তাক না করেই গুলি পাঠাল রাইফেলওয়ালার দিকে।

জবাবে আবারও গুলি করল ওই লোক।

দ্বিতীয় বুলেট বিঁধল হাতির বুকে। পিঠ ফুটো করে বেরিয়ে গেল গুলিটা। তাজা রক্ত ছিটকে লাগল রানার জ্যাকেটে। কিছু তপ্ত ফোঁটা অন্ধ করে দিল ওকে। বামহাতে শক্ত করে ধরেছে হাতির ঘাড়, কিন্তু জবাইয়ের আগে ল্যাং মেরে ফেলা ষাঁড়ের মতই ধড়াস করে মেঝেতে পড়ল লোকটা। রানা বুঝে গেল, তৃতীয় বুলেটটা এবার বিধবে ওর বুকে। রক্ত ভরা চোখ মুছেই ওপরের লোকটার কপাল লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল ও।

একই সময়ে বজ্রপাতের মত কড়াৎ করে উঠল আরেকটা আগ্নেয়াস্ত্র। ডানদিকের মেঝেতে লাফিয়ে পড়ে মনে মনে বলল রানা, এইবার মারা পড়েছি!

একের পর এক বুলেটের বিকট আওয়াজে ভরে উঠেছে চারপাশ। চেয়ে দেখল মার্বেলের কাউন্টারের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে নিচ থেকে সোজা সিঁড়ির কাঠের ধাপ লক্ষ্য করে ম্যাগাযিন খালি করছে মেয়েটা। দড়াম করে রাইফেলটা পড়ল নিচে, তার পরপরই পড়ল লাশ।

মার্বেল কাউন্টার থেকে লাফিয়ে নেমে গ্লক নাইন্টিন হাতে ওর দিকে দৌড়ে এল জুডি।

মৃতরা সবসময় নীরব। জানার উপায় নেই কেন এসেছিল এরা। জুডির দিকে তাকাল রানা। সিঁড়ির নিচে কপালে গুলি খাওয়া লাশটা দেখছে মেয়েটা। ওর চোখে ভয় নেই, চেহারায় কেমন একটা বিহ্বল ভাব।

আরও সতর্ক হয়ে উঠল রানা।

কখনও হামলা করে না দুটো বেবুন, আসে দল বেঁধে।

জুডি, বাইরে গিয়ে গাড়িতে ওঠো।

রানার কথা শুনে চোয়াল শক্ত হলো মেয়েটার, চলে গেল দরজার কাছে। দাড়িওয়ালা দৈত্যের লাশ টপকে যাওয়ার সময় একবার দেখল রানাকে।

লাশের পাশে বসে পকেট সার্চ করছে রানা। চোখ তুলে তাকাল জুডির চোখে। মানিব্যাগ বা আইডেন্টিফিকেশন কিছু নেই।

দরজার কাছে থেমে গেল জুডি। সিঁড়ির মুখে অপর লাশের পোশাকও সার্চ করছে রানা। ব্যক্তিগত কোনও তথ্য পাওয়া গেল না এর কাছেও।

খালি ম্যাগাযিনটা হাতব্যাগে ভরে পিস্তলে আরেকটা লোডেড ম্যাগাযিন ভরল জুডি। পেশাদারী ভঙ্গিতে টানল স্লাইড। বামহাতের কব্জির ওপর পিস্তল ধরা হাত রেখে চারপাশ ঘুরে শত্রু খুঁজল মার্কিন পুলিশের ভঙ্গিতে। গুলি ছুঁড়তে তৈরি।

তুমিও চলে এসো, রানা, কাঁপা কণ্ঠে বলল মেয়েটা। 

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

পিস্তল হাতে বারান্দায় বেরিয়ে এল ওরা। ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা গেল, নিচে উপত্যকার সরু পথ ধরে ছুটে আসছে তিনটে গাড়ি। প্রথম দুটো এসইউভি, পিছু নিয়ে একটা ফ্ল্যাট-বেড পিকআপ। এখনও যদিও বহু দূরে, রানা পরিষ্কার দেখতে পেল তৃতীয় গাড়ির সব কজনের হাতে রয়েছে লম্বা ব্যারেলের আগ্নেয়াস্ত্র।

তৃতীয়বারের মত বলল রানা, জুডি, গাড়িতে ওঠো।

.

০৪.

 রিক বেণ্ডার মস্তবড় হাতে বারবার ওপরে ছুঁড়ে লুফে নিচ্ছে বড়সড় একটা মোবাইল ফোন। কারা যেন গেছে ওই মেয়েলোকটার বাড়িতে।

সামনের টেবিলে বসেছে ডিযাইনার সুট পরা এক লোক। কাঁটাচামচে তুলে মুখে পুরছে রোস্ট করা বনমোরগের বুকের মাংস। তোমার ভাই কোথায়?

বাইরে, সিগারেট ফুকছে।

ওকে নিয়ে ওই বাড়িতে যাও, বলল সুট পরা লোকটা, অন্য গাধাগুলোকে বিশ্বাস করি না। ডুবিয়ে দেবে।

আমাদেরকেও গাধা বলছে নাকি?- ভাবল রিক একবার, তারপর প্রশংসাই করেছে ধরে নিয়ে হাসল রিক বেণ্ডার। কৈশোর থেকেই ওরা দুভাই আছে অসহায় মানুষকে কষ্ট দেয়ার পেশায়। কখনও ত্রুটি করেনি একাজে। ওরা দুই যমজ ভাই এতটা দক্ষ হয়ে উঠেছে বাবার কাছ থেকে নিষ্ঠুর জিন পেয়ে। ওদের বাবা ছিল কেন্টাকির কয়লা খনির মজুর। ছুটির দিনে গলা পর্যন্ত গিলত মদ। কুঁ মারত পতিতালয়ে। বাড়ি ফিরলে গা থেকে ভুসভুস করে বেরোত পতিতার ব্যবহৃত সস্তা পাউডারের গন্ধ। কারও রক্ত হাতে বা জামায় মেখে না থাকলে ঘুমই আসত না। তবে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না তার। সেটা পেয়েছে রিক ও নিক বেণ্ডার। ওদের পেছনে আছে ক্ষমতাশালী এই লোক। খরচ করছে প্রচুর। সব ঝড় ঝাপটা থেকে আড়াল করে রেখেছে ওদেরকে। বাড়তি প্রশ্ন তুলবে না বেয়াড়া পুলিশ সদস্যরাও। রিক ও নিকের বাবার ছিল না এ সুবিধা। একদিন খুনের দায়ে চড়ল ইলেকট্রিক চেয়ারে। রিক শুনেছে, মরার সময় নাকি বিকট চিৎকার ছেড়ে পাতলা পায়খানা করে ওই চেয়ারের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল ওদের বাবা। এটা আপত্তিকর লেগেছে রিকের। পরে ভেবেচিন্তে দেখেছে, বাবার পরিণতি হবে না তার নিজের বা ছোটভাই নিকের।

এজন্যেই কখনও কড়া কথা বললে বা গালি দিলেও বসের ওপর বেজার হয় না রিক বেণ্ডার। মৃদু মাথা দোলাল। কোমরের বেল্টে গোঁজা প্রকাণ্ড ম্যাগনামটা ঢাকল জ্যাকেট দিয়ে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোবে বলে ঘুরল। ভাল করেই ওকে চিনে গেছে খদ্দেররা। অজানা নেই, দূরে থাকতে হবে রিকের কাছ থেকে। এজন্যেই ডাইনিং এরিয়া থেকে ভেস্টিবিউলের পথে ওর সামনে পড়ল না কেউ।

দরজা খুলতেই রিক বেণ্ডারের পেরেকের মত খাড়া চুলের ভেতর দিয়ে সরসর করে বইল শেষ বিকেলের হিমেল হাওয়া। রাস্তায় পা রেখে তাকাল দূরে। ছোট শহর লিটল ফোর্ক। কাঁধের ওপর ঝুঁকে এসেছে প্রকাণ্ড পাহাড়। উঁচু সব চূড়ায় সফেদ তুষার। কদিন পর পুরো শহরটা ঢাকা পড়বে তুষারের চাদরে। জ্যাকেট থেকে মার্লবোরোর প্যাকেট বের করে ঠোঁট দিয়ে একটা শলা তুলল রিক। ধরিয়ে নিল ম্যাচ জ্বেলে। ফুসফুঁসে ভরল একরাশ ধোঁয়া। জোর টানে অর্ধেক করল সিগারেট। নিকোটিনের চাহিদা মিটতেই দালানের গায়ে ঠুসে ওটা নিভিয়ে দিল সে।

তাই দেখে নিজের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলল নিক বেণ্ডার। তাকাল বড়ভাইয়ের মুখের দিকে। দুই ভাইয়ের বয়স তেত্রিশ, গোটা সময়টা কাটিয়েছে একসঙ্গে, তবুও ছোটভাইয়ের বিদঘুটে, ত্যাড়া দৃষ্টি আজও সহজভাবে হজম করতে পারেনি রিক বেণ্ডার। ছোটভাইয়ের ডান চোখ ফ্যাকাসে নীল, অন্যটা বাদামি। এক চোখ থাকে সরাসরি সামনে, অন্যটা দেখে দূরের দেয়াল। রিকের মনে আছে এক চোখ-ত্যাড়া প্যালোমিননা স্ট্যালিয়নের কথা। শান্ত চোখটা দিয়ে দেখত ওকে, পরক্ষণেই বড় বড় দাঁতে কামড়ে কেটে নিতে চাইত ওর নাকটা। ঠোঁট মুচড়ে ফেলল রিক বেণ্ডার। নিকের মোহক-হেয়ারস্টাইলটা পর্যন্ত ওই পাগলা ঘোড়ার কেশরের মত!

কাজ পেলে? জানতে চাইল নিক।

হ্যাঁ।

পাশাপাশি হেঁটে গেল ওরা গাড়ির কাছে। ওটা নিয়ে ওদের অনেক গর্ব। নাম দিয়েছে: দ্য বাইসন। আসলে ডজ র‍্যাম কোয়াড-ক্যাব পিকআপ ট্রাক। দুই মালিকের মতই শক্তিশালী, কুচকুচে কালো। উঁচু সাসপেনশনে আছে প্রকাণ্ড চারটে চাকা। সামনের হুডে আঁকা বিশাল বাইসনের মাথা। নাক দিয়ে বেরোচ্ছে লকলকে হলদে আগুন। সেই শিখা চাটছে গাড়ির দুপাশ। ক্যাবের বাতির র‍্যাকে রয়েছে প্রকাণ্ড দুই শিং। দুই বেণ্ডার ভাইয়ের মতই পিকআপ ট্রাকটা যেন খ্যাপা কোনও দানবীয় বাইসন।

দুই ভাই নিজেদের পছন্দ মত গুছিয়ে নিয়েছে ক্যাব। চার সিটের বদলে আছে মাত্র দুটো সিট। এ ছাড়া উপায়ও নেই। একেকজনের ওজন কমপক্ষে পাঁচ শ ষাট পাউণ্ড। উচ্চতায় ছোটজন সাত ফুট দুই ইঞ্চি বলে, তার সুবিধার জন্যে সব সময় গাড়ি চালায় ছয় ফুট এগারো ইঞ্চির বড় ভাই রিক বেণ্ডার। উচ্চতা যেমনই হোক, দুজনের সম্পর্ক নির্ধারিত হয়েছে তেরো মিনিটের ব্যবধানে চিরকালের জন্যেই এখন বড়ভাই হয়ে গেছে রিক বেণ্ডার।

ইঞ্জিন চালু করে খ্যাপা তরুণদের মত বারকয়েক অ্যাক্সেলারেটর দাবাল সে। পরক্ষণে তুমুল বেগে বাঁক নিল সামনের পথে। কেউ চাপা পড়লে মরুক শালা! শীতের পরিবেশেও উত্তেজিত। হাতে কাজ পেলে ফুর্তি লাগে তার। মানুষকে কষ্ট দেয়ার পাকা শিল্পী। আরও বড় কথা, অন্তর থেকে ভালবাসে ও এই কাজ।

লিটল ফোর্ক থেকে দশ মাইল দূরে নিনা ভেঞ্চুরার বাড়ি। ওই দশ মাইল খুব দুর্গম। পেরোতে হবে পাহাড়ি সব বিপজ্জনক বাক ও মোড়। তাতে লাগবে কমপক্ষে আধঘণ্টা। নিনার বাড়িতে গোলাগুলি হয়েছে, সে কথা বস্ ন্যাশ ময়নিহানকে বলেনি রিক বেণ্ডার। এ-ও বলেনি, কোনও শক্তপাল্লাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ওই মেয়েলোক। রিক ভাবছে, রুপার ট্রেতে করে ওদের মাথা হাজির করবে বসের সামনে। ওটা হবে দামি রেস্টুরেন্টে দেখার মত একটা দৃশ্য।

পাহাড়ি এলাকায় ঠিকভাবে কাজ করে না সেল ফোনের নেটওঅর্ক। কনুই দিয়ে ছোটভাই নিকের কাঁধে খোঁচা দিল রিক। অ্যাই, নিকি, পেট ফোলা ব্যাঙের মত বসে না থেকে রেডিয়ো করো। শুনে রাখি কী বলে ওরা।

ফ্যাকাসে মণিটা ঘুরিয়ে বড়ভাইকে দেখল নিক। অলস ভঙ্গিতে ড্যাশবোর্ড থেকে নিল সিবি হ্যাণ্ডসেট। মর্দা গরিলার আঙুলের মত মোটা আঙুলে কষ্টেসৃষ্টে ছোট্ট সুইচ অন করল সে। তাদের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে একটা চ্যানেল। ওটা ব্যবহার করবে না আর কেউ। দলের ভিতু এক লোকের কাছে রেডিয়ো করল নিক। ওই, শুয়োরের বাচ্চা! কানে ঢোকে না কিছু? কই তুই!

নিক? তুমি? বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল কেউ।

আমি না তো কি তোর বাপ বলে মনে করেছিলি?

চলে এসো, মস্ত ঝামেলা বেধেছে, ভীত, কাঁপা কণ্ঠে বলল ওদিকের যুবক। ভাল ঝামেলা… খরচ হয়ে গেছে লুইচ্চা লিউস। মদ্দা রাস্টিও শেষ। যে শালা নরক ডেকে এনেছে, সে সহজ কেউ না! আমরা লুকিয়ে আছি জঙ্গলে!

পরস্পরের দিকে তাকাল দুই যমজ। খুশিতে চকচক করছে নিকের ফ্যাকাসে মণি। পরস্পরের দিকে চেয়ে চওড়া হাসি দিল দুই ভাই।

বড়ভাই, মনে হচ্ছে আজ দারুণ জমবে!

সন্দেহ কী! আবারও কনুইয়ের তো দিল রিক। এবারের গুঁতোটা আদরের। রেডিয়োতে অন্যদের বলো, ওরা যেন রওনা হয় ওই বাড়ির দিকে।

মাথা দোলাল নিক বেণ্ডার।

হাততালি দিল রিক। ময়নিহানকে দিনের পর দিন বসে বসে খেতে দেখে বিরক্ত হয়ে গেছি।

তা-ও তো তুমি রেস্টুরেন্টে থাকতে পেরেছ। আমি শালা থেকেছি ঠাণ্ডার ভেতর রাস্তায়। বরফ হয়ে গেছে পাছা!

বুঝতেই তো পারো কেন, বলল রিক।

ন্যাশ ময়নিহান চাঁছাছোলা সুরে বলে দিয়েছে, নিকের ত্যাড়া চোখ দেখলে খেতে বসে অরুচি হয়, বিরক্তি লাগে তার। এর চেয়ে অনেক কম বাড়াবাড়ি করে লোকে খুন হয়ে গেছে নিকের হাতে। কিন্তু সব মাফ করে দিয়েছে বসের বেলায়। সে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা দিচ্ছে দুই বেণ্ডার ভাইকে।

.

০৫.

 কখনও সহজ কাজ হয়ে যায় প্রায় অসম্ভব। পথের শেষমাথায় নিনার বাড়ি। পেছনের জঙ্গল ও বোল্ডারের মাঝ দিয়ে পালাতে গেলে সামনে পড়বে দেয়ালের মত খাড়া পাহাড়ি ঢাল। বহু নিচে উপত্যকার বুক চিরে নদী। অর্থাৎ, উপায় নেই ওই পথে যাওয়ার। হাল ছেড়ে হাতের অস্ত্র ফেলে একদল খুনির জন্যে বসে থাকলে পার পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তা ছাড়া, অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি রানা। ট্রেনিং নিয়েছে স্যাণ্ডার্স মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে। ওকে শেখানো হয়েছে: শত্রুরা হামলা করবে বুঝলে আগেই লড়াইটা পৌঁছে দাও তাদের কাছে।

ঠিক তা-ই করবে রানা। এক্সপ্লোরার জিপের প্যাসেঞ্জার সিটে জুডি উঠতেই একগাদা নুড়িপাথর ও ধুলো ছিটিয়ে রওনা হলো ও। নিচে গেছে সরু পথ। পাহাড় ও উপত্যকার আকাশে নানা রঙ মাখিয়ে ডুবছে সূর্য। একটু পর কয়লার কালির মত রাত নামবে ঝুপ করে। কালো চাদরে ঢাকা পড়বে চারপাশ। আলো কমে গেলেও হেডলাইট জ্বালল না রানা। টিলার খাড়া পথে বাড়াল জিপের গতি। শত্রুদের অগ্রসরমাণ তিন গাড়ি লক্ষ্য করে চলেছে ঝড়ের বেগে।

লড়তে হবে, তৈরি হও, জুডি, বলল রানা, একটু পরেই হামলা হবে।

কারা এরা? আনমনে বলল জুডি।

বন্ধু বলে মনে হচ্ছে না, মন্তব্য করল রানা। দূরে দেখল পিকআপের পেছনে কজন। একজন কাঁধে তুলল হান্টিং রাইফেল। গুলিও পাঠাল, তবে রানার ধারণা, অন্তত একমাইল দূর দিয়ে গেছে ওটা। যখন তোমার বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখবে খুন হয়েছে ওদের দোস্তরা, ভীষণ নাখোশ হবে। জুডির দিকে তাকাল রানা।

মুক্তোর মত দাঁতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে মেয়েটা। চোখে মানসিক কষ্টের ছাপ।

আগেও পিস্তল ব্যবহার করেছ, বলল রানা।

কাগজের টার্গেটে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল জুডি।

তার মানে আগে কাউকে খুন করোনি?

না।

জানলে হয়তো স্বস্তি পাবে, তুমি গুলি করার আগেই আমার বুলেট ফুটো করেছিল সিঁড়ির লোকটার মগজ।

ওর কপালের জখম দেখেই বুঝেছি। তবুও… গুলি তো করেছি মানুষের দিকে, ফিসফিস করল জুডি।

আমাদেরকে খুন করতে গিয়ে মরেছে ওরা। যা প্রাপ্য তাই পেয়েছে।

পাশ থেকে রানাকে দেখল জুডি।

আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছ, জুডি। তোমার গুলির ফলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল লোকটা, স্থির টার্গেট পেয়েছিলাম আমি। কথাটা ভাবলে দেখবে আর অতটা খারাপ লাগছে না। মেয়েটার বাহুতে হাত রাখল রানা। ওর হাতে ডানহাত রেখে মৃদু চাপ দিল জুডি। চুপ করে চেয়ে আছে দূরে।

রানা বুঝল, মানুষের প্রাণ নেয়া নৈতিক কি অনৈতিক কাজ, তাই ভাবছে মেয়েটা। এদিকে সামনে আসছে মস্ত বিপদ। ড্রাইভিঙে মন দিল রানা।

সামনের এসইউভির ড্রাইভারের মনে বেশ দ্বিধা। সরু পথের একপাশে সরল, তারপর সরল অন্যদিকে। থামল কড়া ব্রেক কষে। পাশে থামল পেছনের এসইউভি। দুই গাড়ি প্রায় পথরুদ্ধ করতেই ব্রেক কষে থেমেছে পেছনের পিকআপ। ভারসাম্য রাখতে গিয়ে টলমল করছে কজন। তারই ফাঁকে রানাদের দিকে তাক করতে চাইল রাইফেল।

তীরের বেগে চলেছে এক্সপ্লোরার জিপ। নিচু গলায় বলল রানা, ঠিক আছে, জুডি, শক্ত হয়ে বোসো। ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাব।

ওরা আমাদেরকে খুন করবে!

চেষ্টা করবে, শুধরে দিল রানা।

পাশাপাশি দুই এসইউভির মাঝে সংকীর্ণ জায়গা। পাশ কাটিয়ে নিরাপদে যেতে পারবে না রানার ফোর্ড। অবশ্য, ওকে ঠেকাতে পারবে না দুই গাড়ি। সংঘর্ষের তিন সেকেণ্ড আগে আরও শক্তি পেতে নিচু গিয়ার ফেলল রানা। বডির সঙ্গে চেপে ধরল অ্যাক্সেলারেটর পেডাল। ডানের এসইউভির ওপর চড়াও হলো এক্সপ্লোরার। জোরালো ধুম শব্দে সরিয়ে দিল হালকা গাড়িটাকে। তাল সামলাতে ব্যস্ত ওটার আরোহীরা। কিন্তু বামের গাড়ির লোক দুজন পিস্তল তাক করছে রানা ও জুডির দিকে।

নিনার বাড়িতে খুন করতে চেয়েছে সঙ্গীরা, কাজেই এদের উদ্দেশ্য বুঝতে বাকি নেই রানার। ওয়ালথার তুলেই প্রায় পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে বামের গাড়ির ড্রাইভারের খুলির বড় একটা অংশ উড়িয়ে দিল ও। ক্যাবের নানাদিকে ছিটকাল হলদেটে মগজ। ঝটকা দিয়ে থকথকে ফোয়ারা থেকে সরে গেল পাশের প্যাসেঞ্জার সিটের আরোহী। নড়ে গেছে পিস্তলের নল। তখনই গলা ভেদ করে তার চোয়াল চুরমার করল রানার দ্বিতীয় বুলেট।

দুই গাড়ি ঘষ্টে বেরিয়ে এল ফোর্ড এক্সপ্লোরার। সামনে রানার ডানে পিকআপ। গুলি করতে হলে তাক করতে হবে জুডির জানালা দিয়ে। কাজটা কঠিন। গুলি লাগতে পারে জুডির গায়ে। কী করবে ভাবছে রানা, এমনসময় দেখল অটোমেটিক জানালার বাটন টিপল মেয়েটা। অন্যহাতে পিস্তল। পিকআপ লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল জুডি। আওয়াজটা শোনাল পটকার মত। কারও গায়ে গুলি না লাগলেও পেছনের লোকগুলো প্রাণের ভয়ে লাফিয়ে নামল ট্রাক ছেড়ে। ঝাঁপ দিয়েছে কাভার নিতে। সিটে শুয়ে পড়েছে ড্রাইভার। পিকআপটাকে পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথে লিটল ফোর্ক শহরের দিকে ছুটল রানার এক্সপ্লোরার।

পিছু নেয়ার আগে সামলে নিতে হবে লোকগুলোকে।

এসইউভির দুই লোক খুন হয়েছে রানার বুলেটে। আপাতত ওই গাড়ি নিয়ে পিছু নেবে না কেউ। কিন্তু আছে আরও দুটো গাড়ি। ধাক্কা খেলেও বড় ক্ষতি হয়নি ডানের এসইউভির। পিছু নেবে ওটার ড্রাইভার। লাফিয়ে নেমে পড়া লোকগুলো উঠলেই ধাওয়া শুরু করবে পিকআপও।

অবশ্য কিছুক্ষণ বাড়তি সুবিধা পাবে রানা।

সরু পথে দুই গাড়ি ঘুরিয়ে পিছু নিতে সময় লাগবে।

রিয়ার ভিউ মিররে রানা দেখল, পিকআপের সামনে এক লোক। হাতে মোবাইল ফোন। ও বুঝে গেল, এবার আরও লোক ডাকবে এরা।

সামনে আরও লোক থাকবে, বলল রানা, অস্ত্রটা তৈরি রাখো।

দিগভ্রান্ত চেহারা জুডির। ভাবছে জড়িয়ে গেছে কীসে! মাত্র কয়েক মিনিটে দুবার গুলি করেছে ও মানুষের দিকে।

মেয়েটা এখনও কাঁদতে শুরু করেনি, তাই মনে মনে ওর প্রশংসা করল রানা। খুন তো দূরের কথা, অনেকে ভাবতেও পারে না গুলি করবে কোনও মানুষের দিকে। সে তুলনায় রীতিমত ভালই দেখাচ্ছে মাইকেলের বোন।

চমকার লড়াই করেছ, জুডি, বলল রানা।

কাউকে লাগাতে পারিনি, প্রায় ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল মেয়েটা। তবে কণ্ঠে আছে নিখাদ স্বস্তি।

তুমি শুধু খেয়াল রাখবে, যেন নিচু রাখে ওরা মাথা। তাতেই হবে।

আবার দুজন মানুষকে খুন করলে। জুডির কণ্ঠে প্রতিবাদের সুর। বলতে চাইছে, লুকিয়ে পড়ার সুযোগ দিতে পারতে।

খুব কাছে ছিল, দেরি হলে খুন হতাম, বলল রানা।

ফ্যাকাসে মুখে কোলে পিস্তল রাখল জুডি। বাড়িতে ওরা আমাদের জন্যে যায়নি।

তা ঠিক।

অপেক্ষা করছিল নিনার জন্যে।

আমারও তা-ই ধারণা।

সুযোগ পেলেই খুন করবে ওকে। এ ছাড়া ওখানে যাওয়ার অন্য কারণ নেই। টিলার নিচে ফাঁদ পেতেছিল। যাতে ধরতে পারে নিনাকে। মৃদু কাঁপছে জুডি। তাকাল রানার দিকে। এখন চোখে নতুন আলো। নিচু গলায় বলল, তার মানে, নিনা এখনও বেঁচে আছে, তাই না?

আগেই খুন হলে এরা বাড়িতে যেত না, সান্ত্বনা দিতে বলল রানা। খুন করার পরেও অন্য কারণে যেতে পারে। হয়তো ওই বাড়িতে জরুরি কিছু রেখেছিল নিনা।

কিন্তু তা হলে ফোন করছে না কেন নিনা? প্রায় আনমনে বলল জুডি। হয়তো খুব ভয় পেয়েছে? এরা তো দেখা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর খুনি। নিনা বোধহয় ভেবেছে আমি এসবে জড়িয়ে গেলে আমার ওপর হামলা হবে।

ভাবছ, তুমি জড়িয়ে যাওয়ায় আড়াল থেকে বেরোবে নিনা? তা না-ও হতে পারে। ও জানে না তুমি এখানে। আমি হলেও লুকিয়ে থাকতাম।

খুঁজে বের করতে হবে ওকে।

জবাব খোঁজার জন্যে ভাল অস্ত্র আছে তোমার কাছে, বলল রানা।

জুডির চোখ পড়ল পিস্তলের ওপর। ঝকঝকে সাদা দাঁতে আবারও কামড়ে ধরল নিচের ঠোঁট।

তুমি বিপদের জন্যে, মনে মনে তৈরি ছিলে, জুডি। আসলে কী ঘটছে এখানে?

আমি শুধু জানি হারিয়ে গেছে নিনা। আর ওকে খুন করবে বলে খুঁজছে একদল লোক।

মাথা নাড়ল রানা। আমি বিচারক নই, জুডি। তবে জানতে চাই সত্যটা।

যা জানি, সবই বলেছি। আজ থেকে কয়েক দিন আগে ফোন করেছিল নিনা। বলল খুব বিপদে আছে। পরে যখন ফোন করলাম, বন্ধ পেলাম ওর মোবাইল ফোন। তারপর থেকে আর কথা হয়নি। তখন ব্যবহার করলাম ভয়েসমেইল।

কিন্তু তুমি গেলে না পুলিশের কাছে, বলল রানা, তাদের বদলে খুঁজে নিলে আমাকে। এর কী ব্যাখ্যা?

কিছুই করত না পুলিশ, বলল জুডি। বড়জোর পাহাড়ে নিনার বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসত জনা দুই পুলিশ অফিসার। অফিসে ফিরে রিপোর্ট দিত, বাড়ি আছে নিরাপদে। হয়তো গাড়ি নিয়ে কোথাও গেছে ওটার মালিক। সবাই ধরে নিত, কদিন পর ফিরবে নিনা। তদন্ত শেষ। এসব কেসে কী হয় ভাল করেই জানি, রানা।

অনেক কিছুই ধরে নিচ্ছ, যেসব হয়তো সত্য নয়।

ওটাই আনঅফিশিয়াল কপ প্রোটোকল। যা, করতেই হবে, সেটা করবে, কিন্তু দুনিয়া নরকে গেলেও বাড়তি কোনও কাজ করবে না।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সম্পর্কে কোথা থেকে পেলে এত নিচু ধারণা?

চাপা গলায় বলল জুডি, কারণ আমি নিজেও একজন পুলিশ অফিসার, রানা।

ওর কথা শুনে শুকনো ডাঙায় পিছল খেল রানা। বিস্মিত চোখে আবার দেখল মেয়েটাকে।

.

লিটল ফোর্ক শহর ও গ্রেট ওয়েলস ফরেস্ট পার্কের মাঝের ভাঙাচোরা রাস্তায় ঝোড়ো বেগে চলেছে দুই বেণ্ডার ভাইয়ের ডজ র‍্যাম কোয়াড-ক্যাব পিকআপ ট্রাক: দ্য বাইসন। গত কদিনে ওই পথে বেশ কবার গেছে রিক বেণ্ডার। প্রতিটি বাঁক ও মোড় তার চেনা। জানে প্রতিটি শাখা পথ। ভাল করেই চেনে কোথায় করা উচিত অ্যাম্বুশ।

ছাউনির মত প্রকাণ্ড এক পাথরখণ্ড বেছে নিয়েছে সে। ওখানে বিশাল দুটো বোল্ডারের মাঝে বাঁক নিয়েছে পথ।

পাথরের ছাউনির আগে ট্রাক রাখল রিক। কোমর থেকে শক্তিশালী ম্যাগনাম রিভলভার নিয়ে রাখল বিশাল মোটা ঊরুর ওপর। পাশেই সিবি হ্যাণ্ডসেটে চিৎকার করছে নিক।

ছোটভাইকে বলল বিরক্ত রিক, সর্বক্ষণ চেঁচাতে হবে?

তো চেঁচাব না? শুয়োরের বাচ্চারা মানুষের পচা গু! ক্রেডলে ঠাস্ করে হ্যাণ্ডসেট রাখল নিক। ওই বাড়িতে যে দুই হারামজাদা লুইচ্চা লিউস আর মদ্দা মোষ রাস্টিকে রেখেছিল ময়নিহান, তারা তো মরেইছে, খুন হয়েছে আরও দুই কুত্তা। মানে বুঝতে পারছ? চারজন শেষ! অথচ আমরা এখনও জানিই না খুন করছে কে!

তার মানে ভেঞ্চুরা মাগী ফেরেনি?

মাথা নাড়ল নিক। না। অচেনা কুত্তী। সঙ্গে হারামি এক লোক। সে খতম করেছে ওদেরকে। বেটির কাছেও পিস্তল। তার গুলিতেই জানের ভয়ে কাভার নিয়েছে পেছনের পিক আপের বীরপুরুষ হারামজাদারা।

ম্যাগনাম নাড়ল রিক বেণ্ডার। এখন কোথায় আছে ওই দুই কুত্তা-কুত্তী?

দুজনই আসছে এদিকে।

রেডিয়ো করো, বলল রিক, বলো, যেন ধারে-কাছে না যায় ওরা। সময় মত সব ঝামেলা মিটিয়ে দেব আমরা।

বড়ভাইয়ের কথায় হলদে কোদালের মত দাঁত বের করে হাসল নিক। ভাল হয় না মেয়েটাকে কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখলে, রিক?

ক্ষতি কী? ময়নিহান তো চায় নিনা ভেঞ্চুকে। অন্য কুত্তী আমাদেরকে একটু মৌজ দিলে কার কীসের ক্ষতি? বাটন টিপে জানালার কাঁচ নামাল রিক। ওপরের রাস্তা থেকে এল ইঞ্জিনের গর্জন। গাড়িটা ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে আসছে বলে বোঝা গেল না ঠিক কোথায় আছে। এবার যে-কোনও সময়ে শুরু হবে মজা। ট্রাক থেকে নেমে পড়ল রিক। ওজন। কমতেই কইঞ্চি ওপরে উঠল গাড়ির চেসিস। ম্যাগনাম হাতে শিকারীবাঘের ভঙ্গিতে এগোল দানব। টের পেল ট্রাক থেকে নেমেছে তার ছোটভাইও। পেছনে রিক শুনল শটগান পাম্প করার আওয়াজ। নিকের মস্ত দুই হাতে শটগান ছাড়া আর কিছুই আঁটে না।

দুই বোল্ডারের মাঝে এলে অ্যাম্বুশ করব, বলল রিক বেণ্ডার। গাড়িটা তো চালাচ্ছে লোটা, ঠিক?

হ্যাঁ।

তো গুলি করবে তাকেই। চেহারা উড়ে গেলে আমাদের খায়েস মেটাতে পারবে না কুত্তীটা।

আমি কি তার চেহারা দেখব নাকি? আমার নজর থাকবে ওর দুই পায়ের ফাঁকে।

কড়া চোখে ছোটভাইকে দেখল রিক বেণ্ডার। ধর্ষণ ঠিক আছে, জীবনে কম করেনি সে ওই কাজ; কিন্তু নিক যে ইঙ্গিত দিল, তাতে আপত্তি আছে তার। ক্ষত-বিক্ষত মুখের লাশের সঙ্গে যৌনমিলন মেনে নেয়া কঠিন। তবে কে জানে, তাতে হয়তো খুব ফুর্তি হবে নিকের। ঘোটর অসুস্থ মনে যে পাগলাটে চিন্তা ঘুরছে, তাতে সন্দেহ নেই। চকচক করছে নীল ট্যাড়া চোখ। চার দিন আগে এ শহরের শেরিফ ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভিকে খুনের সময় তার কানটা ছিঁড়ে নিয়েছে সে। ওটা ঝুলছে তার বুকের চেইনে। দুদিন হলো বমি আসছে ওর কানের পচা মাংসের গন্ধে।

ম্যাগনাম রিভলভারের হ্যামার তুলল রিক। সেকেণ্ডের জন্যে ভাবল, গেঁথে দিই ছোটর মগজে একটা বুলেট! দূর হোক ওর জীবনের সব কষ্ট। ওটা দয়াই বলা যায়। ক্রমেই আরও বড় ঝামেলায় জড়াচ্ছে ছোকরা। শেষে হয়তো ময়নিহানের টাকাও বাঁচাতে পারবে না ওদেরকে।

রাস্তার দুপাশের বোল্ডারের দিকে চলেছে রিক। ভাবছে, খারাপ কী, উদ্ভট চিন্তা নিয়ে যা খুশি ভাবুক নিক। যেসব বদমাসের শাস্তি হওয়া উচিত, তাদেরই তো বিচার করছে। তারা। তা ছাড়া, ওই কান নিয়ে অত ভাবার কী আছে! ওটা আর কোন কাজে লাগবে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির? সে তো শুয়ে আছে গ্রেট ওয়েলস জলপ্রপাতের ওদিকে জঙ্গলের কবরে। ওখানে কী আছে যে দুইকান পেতে শুনতে হবে? এক কানই যথেষ্ট।

জিপগাড়ির ইঞ্জিন এখন জোরাল গর্জন।

ওই দুজনকে ফাঁদের দিকে তাড়িয়ে আনছে ন্যাশ ময়নিহানের নিরেট গাধার দল। কড়াৎ শব্দ হলো গুলির। রাগে দাঁত পিষল রিক। শুয়োরগুলো দেখছি নষ্ট করবে সব মজা!

কুকুরগুলো জানে বোকার মত শুধু গুলি খেয়ে মরতে। পথের আরেকদিকে সরল নিক। আজকের কাজ শেষে আমাদের উচিত ওদের কটার মাথা ভালভাবে ঠুকে দেয়া। তাতে যদি বুদ্ধি খোলে। তুমি কী বলল, বড়ভাই?

মন্দ বলেনি।

মূল কথা হচ্ছে ঝড়ের বেগে গুলি করা। এবার সেটাই করব। ঝাঁঝরা করে দেব ওই কুকুরটাকে। 

তোমার কথা ঠিক, কিন্তু বাড়তি ঝুঁকি নেব না আমরা। ওই হারামজাদা জানে কীভাবে গুলি করতে হয়। কাজেই ওকে খুন করবে প্রথম সুযোগে।

ভেবো না, বড়ভাই। হাসিমুখে শটগান তুলল নিক। অনেক কাছে গাড়িটা। ধরে নাও খুন হয়ে গেছে শালা।

জিপের গর্জন শুনছে রিক। নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই, তবে বোধহয় গতি কমতেই বদলে গেছে ইঞ্জিনের গর্জন। দুবোল্ডারের মাঝে সরু পথে বিকৃত হচ্ছে আওয়াজ। ডানের পাথরে হেডলাইটের আলো। সত্যি কমেছে ইঞ্জিনের গর্জন। অ্যাক্সেলারেটর থেকে পা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। অবাক হলো রিক। দুই বোল্ডারের মাঝের সরু পথে কমাতে হবে গতি। তাই অ্যাম্বুশের জন্যে এই জায়গা বেছে নিয়েছে সে। এবার সোজা আসবে জিপ। ম্যাগনাম তুলে এক পা এগিয়ে গেল সে।

ওই যে বাক্সের মত দেখতে ফোর্ড এক্সপ্লোরার গাড়িটা!

আসছে দুই বোল্ডারের মাঝ দিয়ে।

পুরো আলো দিচ্ছে হেডলাইট।

কড়া আলো থেকে বাঁচতে চোখ সরু করল রিক। ভাল করেই জানে, কোথায় থাকবে ড্রাইভার। ওর হাতে লাফিয়ে উঠল ম্যাগনাম রিভলভার।

বুমম!

 নিশ্চয়ই মাথা নিচু করেছে ড্রাইভার। স্টিয়ারিং হুইল যেখানে আছে, তার ঠিক ওপরে গুলি করেছে সে।

আরেকদিক থেকে বন্দুকের গুলি পাঠাল নিক। লক্ষ্য ড্রাইভার। দ্বিতীয় গুলিটা করল সামনের চাকার ওপর।

চাকা ফাটতেই কাত হয়ে খুঁড়িয়ে রিককে পাশ কাটিয়ে বাঁক নিল গাড়ি। ক্যাবে আরেকবার গুলি করল সে।

বুমম!

রিক ভাবছে, মেয়েলোকটা মরলে ক্ষতি কী? এমনিতেই তো মরবে! ওটাকে নিয়ে ফুর্তি না করলেও, শহরে তো আর মেয়েলোকের অভাব নেই! তা-ও যদি বেশি শখ হয় নিকের, যা খুশি করুক না লাশের সঙ্গে…।

তৃতীয়বারের মত ম্যাগনাম রিভলভার স্থির করল রিক। কিন্তু প্রয়োজন পড়ল না গুলির। পথ থেকে পাশের খাদে পড়ল এক্সপ্লোরার। তার আগে গুতো দিয়েছে একটা গাছে। ঝড়ে পড়া মাস্তুলের মত দুলছে ওটা। ঝরঝর করে রিকের চারপাশে ঝরল পাইনের কাঁটা। খাড়া চুল থেকে ওগুলো ঝেড়ে ফেলল সে। ঘোটর দিকে তাকাল। কাঁধে বন্দুক তুলে কাঁকড়ার ভঙ্গিতে গাড়িটার পেছন পেছন ছুটছে নিক।

মেয়েলোকটাকে সামলাও, হারামজাদাকে শেষ করছি। আমি, বলল রিক।

সাবধান, বড়ভাই, বলল নিক।

ছোটর কথাটা শুনে নরম হলো রিকের মন। মনে নেই, একটু আগে নিককে খুন করার কথা ভাবছিল। চওড়া একটা হাসি দিয়ে ছোটভাইকে দেখল সে।

ক’পা গিয়ে উঁকি দিল ড্রাইভারের খোলা জানালা দিয়ে। তিন সেকেণ্ড পর ঘুরে তাকাল ভাইয়ের দিকে। গাড়ির ওদিক থেকে চেয়ে আছে নিক। কুঁচকে গেছে ভুরু। আবারও দেখল খালি দুই সিট। শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায় গেল, নিক?

.

০৬.

রানা এখনও হজম করতে পারেনি জুডি আসলে পুলিশ অফিসার। বড়বোনকে খোঁজার কাজে ওর সাহায্য চেয়েছে মেয়েটা। ভাল করেই জানে, প্রয়োজনে আইনের বাইরে যাবে রানা। আগেই বলতে পারতে, তুমি পুলিশের লোক। কড়া চোখে জুডিকে দেখল ও।

জানলে তো সাহায্য করতে না, বলল মেয়েটা।

করতাম, তবে…

যদি জানতে যে পাশে পুলিশ অফিসার থাকবে, তখন?

সতর্ক হতাম। কিন্তু যা হয়েছে সেসবই হত। ওদেরকে গুলি না করে উপায় ছিল না আমার।

ওর বড়ভাই মাইকের মতই নাক ফুলিয়ে ফেলল সুন্দরী। আমি পুলিশ অফিসার হলেই বা কী? আমি কি তোমাকে গ্রেফতার করতে চেয়েছি?

তা চাওনি। তবে কে জানে পরে ঝামেলা করবে কি না।

ভুলে যাচ্ছ একই কাজে এসেছি দুজন। প্রথম এবং শেষ। কাজ নিনাকে খুঁজে বের করা। তর্কের জন্যে তৈরি জুডি। আমার গ্লক কিন্তু পুলিশের অস্ত্র নয়। গোপনে ওটা রাখতে গিয়ে অনুমতি নিতে হয়েছে। তা করেছি, কারণ ভাল করেই জানি বিপদ আছে সামনে। এরপরেও বলবে যে তোমাকে গ্রেফতারের কথা ভাবছি?

কসেকেণ্ড ওকে দেখল রানা। অন করল হেডলাইটের হাই বিম। আশা করি পরে এসব নিয়ে আবার তর্ক করবে না। এবার নেমে পড়ো গাড়ি থেকে।

অবাক চোখে ওকে দেখল জুডি। তুমি কি জোর করে আমাকে…

এক্সপ্লোরারের গতি কমিয়ে দিয়েছে রানা। অত কথা চলবে না, যা বলব করবে, নামো। খুলে দিল জুডির সিটবেল্ট। ঝুঁকে খুলল ওদিকের দরজা। পরক্ষণে এক ধাক্কায় মেয়েটাকে ধপাস করে ফেলল রাস্তায়।

গতি কম, আহত হবে না জুডি। পরের সেকেণ্ডে নিজের দরজা খুলে ডাইভ দিল রানা। দুই বোন্ডারের মাঝের রাস্তা ধরে গাড়িটা যেতেই উঠে দাঁড়াল। একটু দূরেই দুই প্রকাণ্ড বোন্ডার।

পেছনের রাস্তায় এক লোকের হাতে মোবাইল ফোন দেখেছে, মনে আছে রানার। সামনে থাকবে আরও লোক। অ্যাম্বুশ করবে তারা। সেক্ষেত্রে সেরা জায়গা সামনের ওই দুই বোল্ডারের মাঝের রাস্তা।

হতভম্ব হয়ে রাস্তায় বসে আছে জুডি। নিজে উঠে হাত ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে দিল রানা। মেয়েটার মুঠোয় এখনও গ্রক পিস্তল। চোখ গরম করে দেখল রানাকে। মনে হলো পিস্তল ঘুরিয়েই গুলি করবে।

ঠিক আছ তো? নরম সুরে জানতে চাইল রানা।

এর মানেটা কী? ধাক্কা মেরে… আরেকটু হলে তো খুনই হয়ে যাচ্ছিলাম!

এত কম স্পিডে পড়লে খুন হয় না কেউ। আর বুঝতেই পারছ, আমার কাজের ধারা একটু অন্যরকম।

তুমি কি পাগল?

জবাবে দুই বোল্ডারের দিকে আঙুল তাক করল রানা।

পরক্ষণে রাতের নীরবতা চিরে ওদিক থেকে এল উপযুপরি গুলির বিকট আওয়াজ। শটগানের বিকট শব্দে কেঁপে উঠেছে জুডি। ভড়াম্ শব্দে ফাটল জিপের চাকা, তার একটু পর ওদের গাড়িটা ভেঙে পড়ল খাদে।

অপেক্ষা করছিল, নিচুগলায় বলল রানা। ওই পথে গেলে এতক্ষণে কিমা হতাম। এবার বলো, আমি কি পাগল?

আপত্তির সুরে বিড়বিড় করে কী যেন বলল জুডি।

ওর হাত ধরে পাশের জঙ্গলে ঢুকল রানা। সরে যেতে হবে। আমাদেরকে বেশি ভালবাসে না ওরা।

ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে চলল দুজন। বামে সেই দুই বোল্ডারের একটার পেছনদিক। পাশেই খাড়া পাহাড়ে বুনো জন্তুর তৈরি পথ। কিছু দূর যেতেই দুদিকে চলে গেল পথ। যেদিকটা উঠেছে পাহাড়ে, জুডিকে নিয়ে সেদিকে চলল রানা।

গতি কমিয়ে দুই বোল্ডারের মাঝে পৌঁছেছে পিকআপ ও এসইউভি। হৈ-হুঁল্লোড় করে গাড়ি থেকে নামল কজন। এবার শুরু হবে ধাওয়া। জুডির হাত ধরে হাঁটার গতি বাড়াল রানা। শিরার ভেতরে টগবগ করে ফুটছে অ্যাড্রেনালিন।

একা রানা খুশি মনেই নিত এদের চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ওর মনে রাখতে হবে জুডির নিরাপত্তার কথা। সামনে হাঁটছে মেয়েটা। সাবলীল গতি অ্যাথলেটদের মত। নিনার বাড়িতে বা পরে দেখিয়ে দিয়েছে সাহসের অভাব নেই। পুলিশ অফিসার। কিন্তু ওর জানা নেই যুদ্ধের সময় কীভাবে লড়ে কমাণ্ডোরা। রানা নিজেকে মনে করিয়ে দিল: জুডির দায়িত্ব কিন্তু তোর। খেয়াল রাখবি ওর যেন ক্ষতি না হয়।

পেছনে কড়াৎ শব্দে গর্জে উঠল একটা রাইফেল।

থমকে গেছে জুডি। ঘুরে তাকাল রানার দিকে। উঁচু করে ধরেছে গ্লক পিস্তল।

হালকা চালে ছুটতে শুরু করো, বলল রানা, আন্দাজে গুলি করছে। জানে না আমরা কোথায় আছি।

কিন্তু যাব কোথায়? রানার পাশে জগিঙের ভঙ্গিতে ছুটল জুডি।

হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে! নোবেল বিজয়ী বাঙালি কবিকে কপি-পেস্ট করল রানা।

কিন্তু পালিয়ে গেলে তো আমার বোনকে পাব না!

 তা ঠিক। কিন্তু বাঁচলে পরে খুঁজে নিতে পারব।

একবার ওদের কাউকে বন্দি করলে, তার মুখ থেকে বের করতে পারব আমার বোন কোথায় আছে।

লাভ নেই, বলল রানা। ওরা জানে না নিনা কোথায়। নইলে ওই বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করত না। ওরা আমাদের চেয়ে কম খুঁজছে না ওকে।

কিন্তু ওরা কেন ওকে খুঁজছে, তা তো জানতে পারব?

নিনাকে পাওয়ার পর জেনে নেব কী হয়েছে। দৌড়ের গতি বাড়াও। পেরোতে হবে সামনের পাহাড়। ওদিক দিয়ে নেমে গিয়ে লুকিয়ে পড়ব জঙ্গলে।

ঢিবির মত পাহাড়টা উচ্চতায় সত্তর ফুট। ওদিক দিয়ে নামলে কয়েক শ গজ দূরে রাস্তা। চূড়ায় ঘন ঝোপঝাড় ও গাছ। ওদিকের ঢালে বাঁকা হয়ে ঝুঁকেছে বিশাল এক মহীরুহ। পাহাড়ের গা থেকে উপড়ে এসেছে অসংখ্য শেকড়। বড় পাথরের কিছু খণ্ড ঘিরে তৈরি করেছে ছোটখাটো গুহা। অন্ধকারময় ছায়া। কিছুক্ষণ লুকানোর জন্য জায়গাটা বেশ ভাল। ওদিকটা দেখাল রানা। ওখানে লুকিয়ে পড়ো।

তুমি কী করবে? জানতে চাইল জুডি।

গাড়ি জোগাড় করব, নইলে যেতে হবে পায়ে হেঁটে। দশ মাইলেরও বেশি দূরে লিটল ফোর্ক। আকাশ দেখাল। রানা। ওই মেঘ দেখেছ? আসছে ব্লিযার্ড। আমাদের পরনে পাতলা জ্যাকেট আর জিন্স। সারারাত ঝড় হলে বরফে জমে মরব।

দশ মাইল যেতে সারারাত লাগে না।

যদি রাস্তা ধরে যেতে পারো তা হলেই। কিন্তু পিছু নেবে লোকগুলো। বারবার সরতে হবে জঙ্গলের মাঝে। পাহাড়ের ওপর দিয়ে গেলে ওই দশ মাইল হবে বিশ মাইল। তা ছাড়া, জানি না সামনের এলাকা কেমন। হয়তো নদী পেরোতে হবে। তুষার ঝড়ে ভিজে গেলে…।

বুঝেছি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল জুডির। কিন্তু…।

রানা ভাবল, আবারও নাক ফোলাবে মেয়েটা। তাই গম্ভীর চেহারায় বলল, আর কোনও কিন্তু নেই, অফিসার ব্ল্যাকউড!

আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত ওপরে তুলল জুডি। মুঠোয় আলগা করে ধরেছে গ্লক পিস্তল।

বিপদ দেখলে ওটা ব্যবহার করবে, বলল রানা। কিন্তু বাধ্য না হলে গুলি করবে না।

কাছে এলে গুলি করব, যেন মিস না করি, মৃদু হাসল জুডি।

ঝাঁকড়া শেকড়ের ভেতর মেয়েটা লুকিয়ে পড়ার পর নিচু গলায় বলল রানা, অপেক্ষা করবে দশ মিনিট। এর ভেতর ফিরলে ধরে নেবে ব্যর্থ হয়েছি।

তখন কী করব?

নিজের প্রাণ বাঁচাতে যা দরকার, তাই করবে।

তুমি নিজের কাজে ডাব্বা মারবে, তা চাই না, বলল জুডি, চারপাশে নেকড়ে-হায়েনার দল। দেখো, ডুবিয়ে দিয়ো না আমাকে।

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করে ভাবল রানা, না, তোমাকে ডুবিয়ে দেবে না মাসুদ রানা, হয়তো তুমিই দেবে!

.

০৭.

বিরক্ত বলে দুকাঁধ ঝুঁকে গেল নিক বেণ্ডারের। ভেবেছিল দেখবে শটগানের গুলিতে ঝাঁঝরা লাশ, কিন্তু কোথায় কী! অবাকও লাগছে। অবশ্য, কসেকেণ্ড পর চেহারায় ফুটল কদর্য হাসি।

অত হাসির কী আছে? জানতে চাইল রিক বেণ্ডার।

 আয়নায় তো আর নিজের চেহারা দেখোনি, বড়ভাই!

আকারে বড় ছোটভাইয়ের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। রিক। আমার আয়না দেখতে হবে কেন? নিজের চেহারা দেখো, একদম গাধার মত! সবাই বলে আমি সুদর্শন।

মলিন হলো না নিকের মুখ। বিশাল বুক থেকে বেরোল হাসির গুমগুম আওয়াজ। ঘুরে দেখল দুই বোল্ডারের মাঝের রাস্তা। ময়নিহানের লোক থেমে হৈ-চৈ করছে। পিকআপ থেকে লাফিয়ে নেমেছে কেউ কেউ।

গাধাগুলো এসেছে।

জড় করো, নিক, ঘোঁৎ করে উঠল রিক। সার্চ পার্টি নিয়ে বেরোতে হবে। বেশি দূর যেতে পারেনি ওরা।

আমাকে কী করতে বলল, রিক?

রাস্তায় চোখ রাখবে। এদিকে এলেই ধরবে।

বড়ভাইকে দেখল নিক, ঠোঁটে টিটকারির হাসি। এতে খেপে গেল রিক। তার কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করছে হাঁদাটা!

রওনা হও, ধমকের সুরে বলল রিক।

খুব ধীরে বুজল নিকের নীল চোখের পাতা। আবারও চোখ মেলে অলস দৃষ্টিতে দেখল বড়ভাইকে। রিকের মনে হলো ঝিনুকের মত ওই চোখে আছে নীল মুক্তা। ওটা উপড়ে নেয়াই উচিত। দেরি করবে না, নিক, নইলে অন্ধকারে নিজেরা গুলি খেয়ে মরবে শুয়োরগুলো।

চওড়া হাসল নিক। শটগান তুলে ইজেক্ট করল খরচ করা কার্তুজের খোসা। নতুন করে ভরল গুলি। আকাশের ভারী মেঘ থেকে প্রথমবারের মত ওর মুখে পড়ল কয়েক পশলা তুষার।

ঠিকই বলেছ, রিক। রাতের আঁধারে ঝড়ের মধ্যে কে কাকে গুলি করবে কে জানে! নিকের কণ্ঠে কেমন যেন হুমকির ভাব।

সুরটা লক্ষ্য করে চটে গেল রিক। ভাবল, ভাল করেই জানি কে আগে ট্রিগার টিপবে, আর মরবে কে! এখনই ম্যাগনামটা তুলে ঝেড়ে দেব বেয়াদবটাকে?

রীতিমত লোভই হলো তার। কিন্তু তুলল না অস্ত্র। মাঝে মাঝে বেয়াড়াভাবে কথা বলে নিক, মনে হয় বেশি আস্পর্ধা হয়েছে ওর। বেশি করে ময়নিহানের গাধাদের সামনে। ভুলে যায় কে বড়ভাই! হতে পারে, খামোকা ভাবছে রিক। তবে এ কথা ঠিক, প্রয়োজনে এক গুলিতে নিককে নিকেশ করে দেবে সে।

বাইসন গাড়ির দিকে চলেছে রিক। বসে থাকবে হিটার চালিয়ে দিয়ে। চোখ রাখবে রাস্তায়। বাইরে শীতে শয়তান দুটোকে খুঁজে মরুক নিক।

পকেট থেকে মার্লবোরোর প্যাকেট নিয়ে সিগারেট ঠোঁটে ঝোলাল রিক। ম্যাচ দিয়ে জেলে নিল শলা। তাকাল আকাশের দিকে। ঘুরতে ঘুরতে তুষারের পেঁজা তুলো পড়ছে পাপড়িতে। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করল সে।

ফোর্ড এক্সপ্লোরার থেকে নেমেই দুবোল্ডারের মাঝের সরু পথে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে লোকটা। পেছনেই ছিল ময়নিহানের ছেলেরা। অর্থাৎ, বেশি দূরে যায়নি হারামজাদা আর হারামজাদী। বাধ্য হয়েই বেছে নিয়েছে দুই পথের একটা। এই এলাকা ভাল করেই চেনে রিক। ডানের পাহাড় খাড়া। পিচ্ছিল পাথরে ভরা। ধরে নেয়া যায়, ওরা গেছে বামের ট্রেইলে। পথে ফিরতে চাইলে আসতে হবে এদিকে। কিন্তু তারা আসেনি। অর্থাৎ, পাহাড় বেয়ে উঠেছে চূড়ায়। ওদিকেই ওপরে কোথাও আছে তারা।

নিককে ডাকবে কি না, ভাবল একবার। বাতিল করল চিন্তাটা। কী ঠেকা পড়েছে মজার ভাগ দেয়ার? বেশি বাড়াবাড়ি করছে ছোকরা। মাথায় নেই দলের নেতা কে!

ট্রাক পেরিয়ে বামের পাহাড় লক্ষ্য করে চলল রিক। সামনেই আছে রাস্তায় নামার মত একটা জায়গা। অন্ধকারে পরিষ্কার চোখে পড়বে সিগারেটের আগুন। আধটানা শলা ফেলে কোমরের বেল্ট থেকে ম্যাগনাম রিভলভার নিল রিক। বিড়বিড় করল, ধূমপান খুন করে!

আকারে সে প্রকাণ্ড। যেমন শক্তিশালী, তেমনি ক্ষিপ্র। নিঃশব্দে যেতে পারে এক-এর নাকের ডগায়। মাঝে মাঝে ভেবেছে, ভাল হতো পেশাদার কুস্তি প্রতিযোগিতায় নামলে। পার্টনার হিসেবে নিক থাকলে ওরা হতো পৃথিবী-সেরা জুটি। কিন্তু কাউকে ব্যথা দেয়ায় বা মানুষ খুন করতে যে আনন্দ, তা পেত না কুস্তি লড়লে। ওটা নকল লড়াই। তা ছাড়া, কুস্তির চৌকো রিঙে এত টাকা নেই, যতটা খরচ করছে। ময়নিহান তাদের পেছনে।

বাইসন গাড়ির বিশ কদম দূরেই মিলিয়ে গেছে পাহাড়ি ট্রেইল। তবে বোঝা যায়, জঙ্গলে খাড়া এক বুনো পথ গেছে পাহাড়ের চূড়ায়। ওই ট্রেইল ধরে উঠবে কি না ভাবল রিক। সেক্ষেত্রে হয়তো ওর হাতে বন্দি হবে দুই পলাতক। তাতে বাহবা দেবে অন্যরা। কিন্তু এমনিতেই এদিকে আসতে হবে ওই দুজনকে। সুতরাং খাটা-খাটনির কোনও মানে হয় না।

নিরালা এক জায়গায় মস্তবড় দুই গাছের মাঝে বসল রিক। পাশেই ট্রেইল, তবে ভাল দেখা গেল না ওটাকে। অন্ধকার রাতে চট করে বুঝবে না আসছে দুজন না একজন। তবে তাদেরও সমস্যা হবে ওকে খুঁজে নিতে। রিকের ধারণা, একটু পরেই চলে আসবে তারা। ম্যাগনামের দুই গুলিতে খতম করবে দুজনকে।

ওই যে, খুব সাবধানে আসছে কে যেন!

 এবার ঝট করে উঠেই…

মাত্র ভেবেছে রিক, এমনসময় শীতল ধাতুর কী যেন ঠেসে ধরা হলো ওর ঘাড়ের পাশে।

কামানটা ফেলো, ফিসফিস করে বলল কে যেন।

ঘোঁৎ করে উঠল রিক। মাথার ওপরে তুলল দুহাত। মাটিতে পড়ে, ধপ আওয়াজ তুলল ভারী ম্যাগনাম।

পিস্তল তাক করে রিভলভারটা লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল  রাতের আগন্তুক। চাপা স্বরে বলল, এবার ট্রাকের চাবিটা।

নেই আমার কাছে, কয়েক সেকেণ্ড পর বলল রিক।

ফাজলামো কোরো না।

কারও সঙ্গেই ফাজলামো করছি না, সঙ্গে চাবি নেই। প্রাণ থাকতে প্রিয় গাড়িটা কেড়ে নিতে দেবে না রিক।

হঠাৎ চোখে উজ্জ্বল আলোর বিস্ফোরণ দেখল সে। দুই সেকেণ্ড পর এল ব্যথাটা। পিস্তলের নল দিয়ে মাথায় বাড়ি দিয়েছে লোকটা। সত্যিকারের হারামজাদা! রিক বুঝে গেল, চুলের মাঝ দিয়ে কুলকুল করে নামছে রক্ত। টপটপ করে পড়ল জ্যাকেটের কলারে। গর্জন ছাড়ল সে: হারামজাদা!

চাবি দেয়ার শেষ সুযোগ, বলল আগন্তুক। এরপর দুভাগ হবে খুলি।

আমার জিন্সের প্যান্টের পকেটে। ওটা বের করতে হলে হাত নামাতে হবে।

ডানের না বামের পকেটে চাবি?

ডানে।

খুব সাবধানে হাত নামাও।

বামহাত সামনে বাড়াল রিক। ডানহাত নামল কোমরে। কুঁজো হয়ে বসেছে সে। চাবি বের করতে হলে সিধে হতে হবে। আধবসা অবস্থায় পকেট থেকে চাবি নিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চালান দিল সে। ছোঁ মেরে নেয়া হলো চাবি।

ঘুরেই হামলার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে রিক।

কিন্তু তার খুলির নিচে ঠেসে ধরা হয়েছে পিস্তল। চেষ্টা কোরো না। ভুল হবে।

পিঠ কুঁজো করে বসল রিক।

চাবি দেয়া সহজ কাজ, তাই না?

তুই শালা কী বুঝবি, ভাবল রিক। ভাল হতো শুরুতেই হামলা করলে। এখন রিভলভার তো নিয়েইছে, হারাতে হলো গাড়িটা। আরও খারাপ কথা, জানেই না কোন্ সম্বন্ধির পুত ডাকাতি করছে! যেভাবে হোক কুত্তাটার কাছ থেকে ফেরত নিতে হবে নিজের সব।

তুমি কে, নাম কী? জানতে চাইল রিক।

ওই একই কথা আমিও জানতে চাইতে পারি, বলল আগন্তুক। কিন্তু জবাব দেবে না। তাই মুখ খরচ করব না।

দুকাঁধ ঝাঁকাল রিক। ফাটা করোটির রক্ত কুলকুল করে নামছে মেরুদণ্ড বেয়ে। মিথ্যা বলোনি। তবে একটা কথা বুঝতে পেরেছি, তুমি পুলিশ নও।

বলিনি আমি পুলিশ। রিকের কানের নিচে পিস্তলের নল ঠেকাল আগন্তুক। দ্বিধা করব না খুন করতে।

নিজেকে কাপুরুষ মনে করে না রিক। কিন্তু মগজে বুলেট ঢুকবে আর সে খুন হবে, তাতে আপত্তি আছে তার। তা-ও আবার জঙ্গলে। আনুষ্ঠানিক কবর পাবে না। তুমি তো আর গুলি করছ না, ঠিক না?

কে বলল?

গুলি করলে ওই আওয়াজে ছুটে আসবে অন্যরা। বাধ্য হয়েই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

আপাতত, বলল আগন্তুক। রিকের ঘাড়ে খটাস্ করে আবার নামল পিস্তলের নল। তাৎক্ষণিক জ্ঞান হারাল না দানব। মনে হলো কী যেন হচ্ছে চারপাশে। ঘুমিয়ে পড়ছে সে। আবছা বুঝল, আবারও ঘুম ভাঙবে। আর তখন যে লোক জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে, খুঁজে বের করে তাকে খুন করবে সে।

.

০৮.

জুডি, ফিসফিস করল রানা, ওখান থেকে সরে ভাল করোনি।

দশফুট ওপরের ট্রেইলে আছে জুডি, বামহাত গলায়। অন্যহাতে গ্লক পিস্তল। ওটার নল যথেষ্ট স্থির। বিস্ফারিত চোখে দেখছে পড়ে থাকা বিশাল লোকটাকে।

কাছে চলে এসেছিল ওরা। ওখানে থাকলে ধরা পড়তাম।

তর্কে না জড়িয়ে ভাবল রানা, ভাল হয়েছে চলে এসেছে মেয়েটা। নইলে ওকে আনতে গিয়ে নষ্ট হতে সময়। তা ছাড়া, ওর পায়ের শব্দে ওদিকে মন দিয়েছিল গ্রিজলিটা। সহজেই পেছনে পৌঁছুতে পেরেছে রানা।

চলো, গাড়ি পেয়েছি।

ঢালু ট্রেইলে জগিঙের মত করে নেমে এল জুডি। পিছলে পড়ত, কিন্তু কনুই ধরে তাল সামলে দিল রানা। ওর বুকে বামহাত রেখেছে জুডি। কসেকেণ্ড পরস্পরের চোখে চেয়ে রইল ওরা, তারপর চোখ নামিয়ে নিল মেয়েটা। সরে দাঁড়িয়ে পিস্তল তাক করল দানবের দিকে।

এই লোক কে?

জানি না। ঘুম ভাঙলে খেপে উঠবে।

শুধু জ্ঞান হারিয়েছে? অবাক কাণ্ড! আমি তো ভেবেছি অচেনা কাউকে দেখলেই খুন করো তুমি।

খুন করলেই বোধহয় ভাল করতাম।

রানার কাছ থেকে সরে দানবকে সার্চ করল জুডি। আইডেন্টিফিকেশন নেই। অন্যদের মতই।

নিনার বাড়িতে দুই লাশেরও নাম-পরিচয় ছিল না। অবশ্য, রানা বুঝেছে, তারা পেশাদার খুনি নয়। অন্যদের চেয়ে অভিজ্ঞ ও অত্যন্ত বিপজ্জনক হলেও প্রশিক্ষিত খুনি নয় এই দানবও।

পথের বাঁকে খাদে পড়ে আছে রানাদের জিপ। ওটা পেরিয়ে বাইসন পিকআপের দিকে চলল ওরা।

আপত্তির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল জুডি। এই জিনিস নিয়ে শহরে গেলে সবার চোখ পড়বে আমাদের ওপর।

শহরে পৌঁছে কোথাও লুকিয়ে ফেলব।

যান্ত্রিক বাইসনের দিকে চলেছে জুডি।

সাবধান, জুডি, বলল রানা। ধারেকাছে কেউ থাকতে পারে।

সতর্কই আছি।

জুডির পিছু নিয়ে পাহাড়ের চূড়া দেখল রানা। ওদিকেই আছে লোকগুলো। সাড়াশব্দ নেই। থমথম করছে চারপাশ। মৃত্যুর ভয়ে চুপ তারা। সবাই জানে, পাহাড় ও জঙ্গলে আছে আততায়ী। যে-কোনও সময়ে শুরু করবে গুলি।

জুডিকে পুরো সময় কাভার করল রানা। ডজ র‍্যাম পিকআপের ক্যাবে উঠল মেয়েটা। ও নিরাপদ বোঝার পর সামনে বেড়ে ক্যাবে উঠল রানা। ড্যাশবোর্ডে রাখল ম্যাগনাম। পরক্ষণে ইগনিশনে ভরল চাবি। পুলিশী চোখে সব দেখছে মেয়েটা। খুলল গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট। আগ্রহ তৈরি হবে এমন কিছু পেল না। ড্ডার পকেটেও কিছু নেই। সান ভাইসর নামাতেই টুপ করে হাতে পড়ল ছোট প্যামফ্লেট।

দেখেছ, রানা? আনমনে বলল জুডি।

অন্ধকারে আবছাভাবে পুস্তিকার মত কিছু দেখছে রানা। ইঞ্জিন চালু করে জানতে চাইল, জিনিসটা কী?

খাবারের একটা মেন্যু।

খাওয়ার সময় নেই এখন আমার।

রানার কথা শুনতেই পায়নি, এমন ভঙ্গিতে বলল জুডি, লিটল ফোর্কের একটা রেস্টুরেন্টের।

তাতে কী? জানোয়ার গাড়ি নিয়ে রওনা হলো রানা।

গণ্ডারের মত যাকে অজ্ঞান করলে, বা তার কোনও সঙ্গী… ওদেরকে দামি ফ্রেঞ্চ কুসিনের ভক্ত মনে হয়েছে তোমার?

এবার মন দিয়ে মেন্যু দেখল রানা।

ব্রোশারটা চকচকে।

 দামি রেস্টুরেন্টের।

নাম: ভিলাজ-ও-সঁও বা গ্রামের কেন্দ্র।

ঠিকই বলেছে জুডি, যারা খুন করতে এসেছে, সবাই নেবে পাঁচ ডলারের মুরগির উইঙের বাকেট ও কয়েক ক্যান বিয়ার। ভিলাজ-ও-সঁও-এর মেন্য অনুযায়ী পেটপূর্তি করতে হলে চাই অন্তত এক শ ডলার। দানবকে বারে মারপিট ঠেকানোর মালম্যান বলে মনে হয়েছে রানার। অত খরচ পোষাবে না তার।

পাহাড়ে ফেলে আসা অচেতন দানবের কথা ভাবছে রানা। দূরে শুনল রাইফেলের চাপা গর্জন। গুলি যে-ই করুক, নিশানা খুব কাঁচা তার। সামনের বাঁক ঘুরে লাইন অভ ফায়ার থেকে সরে গেল বাইসন পিকআপ। কী ভাবছ, জুডি? চুপ করে আছে দেখে জানতে চাইল রানা।

গতবার নিনার সঙ্গে ডিনারে গেছি ওই রেস্টুরেন্টে, বলল জুডি, আগেই তোমাকে বলেছি, নিনা কমপিউটারে দক্ষ। ওই রেস্টুরেন্টের মালিকপক্ষের হয়ে তৈরি করেছিল ওয়েবসাইট। দিয়েছিল পাবলিসিটি ফোটোগ্রাফ ও ডিজিটাল গ্রাফিক্স।

জুডি কী বলছে, আঁচ করতে চাইল রানা। রেস্টুরেন্টের এই ব্রোশার আর ওর বোনের সম্পর্কটা পরিষ্কার হচ্ছে না।

আমি ফেরার পর ফোনে কথা হলো নিনার সঙ্গে। রাগে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল।

কী কারণে?

রেস্টুরেন্টের কাজ শেষ, এমনসময় বদলে গেল ওটার মালিকানা। নতুন মালিক মানা করে দিল: চাই না ওর কাজ। এতদিন যত পরিশ্রম করেছে, সেজন্যে ক্ষতিপূরণও দেবে না। এতে খেপে গিয়ে উকিলের নোটিশ পাঠাল নিনা।

সেজন্যে কেউ ওকে খুন করতে চাইবে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বড়জোর নিনার প্রাপ্য ছিল হাজার খানেক ডলার। তাই না?

রানার কথাটা ভাবছে জুডি। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, অন্য কোনও কারণেও ওকে খুন করতে চাইতে পারে।

প্রয়োজনীয় সূত্র নেই, বলল রানা, আমরা যতটুকু জেনেছি, সেই অনুযায়ী এগোতে হবে। রানা এজেন্সির শাখা প্রধান জন হার্বার্ট হয়তো জানাতে পারবে এই গাড়ির মালিক কে। ওই সূত্র ধরে এগোলে হয়তো জানব, নিনার পেছনে এদেরকে পাঠিয়েছে কে।

অনেক পেছনে পড়েছে শত্রুরা। রানা দেখল, বিপদ হবে মনে করে পার্সে পিস্তল রাখল জুডি। নিজে রানা হাতের কাছেই রাখল ওয়ালথার। এ ছাড়া, ড্যাশবোর্ডে আছে ওটার মালিকের মতই বিশাল ম্যাগনাম রিভলভার। প্রয়োজনে আসবে কাজে।

চোখ বুজে বসে আছে জুডি। আবারও কামড়ে ধরেছে নিচের ঠোঁট। ওকে দেখল রানা। নরম সুরে বলল, ভালই লড়লে, জুডি। এতটা আশা করিনি।

বলতে চাইছ পুলিশের তুলনায়?

পুলিশদের ঘৃণা করি না, জুডি। তবে… 

আগেই বলেছ, আমার জন্যে কাজে সমস্যা হবে।

চুপ থাকল রানা। আড়চোখে দেখল, হাসছে জুডি।

এবার কোথায় যাব? জানতে চাইল মেয়েটা।

লিটল ফোর্ক।

ওখান থেকেই না এসেছে এসব খুনি?

তা ঠিক। কিন্তু ওরা ভাববে না ওদের শহরে যাওয়ার সাহস হবে আমাদের। তা ছাড়া, জানতে হবে কার হয়ে কাজ করছে এরা। একটু ভেবে রানা বলল, নিশ্চয়ই ভাবছ, এবার পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত হবে আমাদের?

কথাটা মিথ্যা নয়… রানার দিকে তাকাল জুডি।

কিন্তু ভুলেও ওদের কাছে যাব না, কথা শেষ করল রানা।

নিনার বাড়িতে কী হয়েছে তা রিপোর্ট করতে হবে। ওখানে আমাদের খুন করতে অপেক্ষা করছিল একদল খুনি। পুলিশের জানা দরকার কী হচ্ছে এখানে।

না, সোজা-সাপটা নিষেধ করল রানা। তোমার কথামত চললে, হাতকড়া পড়বে তোমার হাতেও। লিটল ফোর্কের মত ছোট শহরের পুলিশ ঝামেলার মধ্যে যাবে না, স্রেফ আমাদেরকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে পাঠিয়ে দেবে ফ্র্যাঙ্কফোর্ট বা লিউইসভিলে। এ কথাটা মাথায় রেখো, জেলে পচলে খুঁজতে পারব না তোমার বোনকে।

কোথা থেকে পেলে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কে এত খারাপ ধারণা? রানার কথাই ফিরিয়ে দিল জুডি।

তোমার কাছ থেকে, সহজ সুরে বলল রানা। তুমি তো আমার চেয়ে ভাল চেনো। পুলিশ অফিসার বলে কথা!

তর্ক না করে একটু পর বলল জুডি, কিন্তু ভুলে গেছ আমিও পুলিশ অফিসার। সব খুলে বলতে পারব পুলিশকে। এমন নয় তোমাকে জড়াতে হবে। তাতে রাজি আছ?

ওকে দেখল রানা। দায় নেবে চারজনের খুনের?

এমনিতেই সিঁড়ির লাশের জুতো থেকে পুলিশ পাবে আমার পিস্তলের গুলি। শেষে আইপি প্যানেলের সামনে দাঁড়াতে হবে।

বলেছ তোমার পিস্তল পুলিশের দেয়া নয়।

এনওয়াইপিডির নয়। তার মানে এমন নয়, রেজিস্ট্রি করা হয়নি ওটা। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ব্যালিস্টিক টেস্ট করলেই সব বেরিয়ে আসবে।

পুলিশ রেজিস্টারে গুলির টেস্ট-রোল্ট বা রাইক্লিং মার্কসের রিপোর্ট না-ও থাকতে পারে। আর পিস্তলই যদি না, থাকে, কীসের প্রমাণ? ফেলে দাও নদীতে। বাধা দিচ্ছে কে?

কাজটা বেআইনী। আমি তা করব না।

সেক্ষেত্রে বুজে রাখো মুখ। খুন করতে এসেছিল ওরা। জানেও না আমরা কারা। ধরে নিতে পারো, পুলিশের কাছে লিশ করতে যাবে না কেউ।

রিপোর্ট তো দেবেই। মারা পড়েছে চারজন সঙ্গী।

 হাত তুলে জঙ্গল দেখাল রানা। পুঁতে দেবে জঙ্গলে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জুডি। পুলিশকে বলতেই হবে, রানা। এভাবে খুনোখুনি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।

ওদের হাতে খুন হয়ে যাওয়াই আইনসম্মত হতো বলে ভাবছ? হাসল রানা, কী ভয়ানক বিপদে আছে নিনা এখনও বোঝনি? ওকে পেলে ভাবা যাবে পুলিশের কাছে যাব কি যাব না। এখন আমাদের প্রথম কাজ: এসবের পেছনের লোকটাকে খুঁজে বের করা।

ভাল না লাগলেও আপাতত মেনে নিলাম তোমার কথা, জানাল জুডি।

পাহাড়ি বিপজ্জনক পথে ড্রাইভিঙে মন দিল রানা।

.

০৯.

এখনও পাওনি ওকে?

না। তবে ঠিকই পাব।

বুঝতেই পারছ, মেয়েটা সব ফাঁস করে দিলে কী সর্বনাশ হবে আমাদের।

অত ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই, প্যাট্রিক, বলল ন্যাশ ময়নিহান। নিয়ম মেনে কাগজে সই করো। ঠিক জায়গায় লাগাও রাবার স্ট্যাম্প, তাতেই হবে। বাকি সব সামলাচ্ছি আমরা।

প্রকাণ্ড টেবিলের ওদিকে বসে আছে জাজ প্যাট্রিক হোল্ড। ভাল করেই জানে, বাড়তি কথা বললেই বিপদ। ময়নিহানের হাতে সিগার, যে-কোনও সময়ে চেয়ারের হাতলে পড়বে ছাই। বিরক্তির চোখে তাকে দেখল জাজ। আণ্ডারওঅর্ল্ড গ্যাংস্টার বারবার বলছে, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ঠিকভাবে চলবে সব। কিন্তু না ভেবে পারছে না সে। নরম সুরে বলল, হয়তো সবই হারিয়ে বসব আমরা, ন্যাশ।

সিগার দুলিয়ে কথাটা উড়িয়ে দিল ময়নিহান। ঝুলছে দীর্ঘ ছাই। ঘাবড়ে যেয়ো না, কাজে নেমেছে বেণ্ডাররা।

নাক ঝাড়ার শব্দ তুলল অফিসের তৃতীয়জন। এহ্! তুমি না দেখিয়ে দিলে তো নিজেদের পাছাও খুঁজে পায় না ওরা!

তোমার গাধাগুলোর চেয়ে ভাল, জানাল ময়নিহান।

হয়তো। তবে তার কারণ: আমার হাত-পা বাঁধা।

বাড়ার শব্দ নিজেদের পাছজানাল মুয়ৰধা।

কাজেই ফালতু প্যাঁচাল বাদ দাও। সমালোচনা নিজের কাছেই রাখো। তার দিকে সিগার তাক করল ময়নিহান। ভুলোলা না, বাড়াবাড়ি পছন্দ করি না আমি। নাকি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে?

আমি শুধু বোঝাতে চাইছি পরিস্থিতি, ঢোলের মত ফোলা বুকে দুহাত বাঁধল লোকটা। ন্যাশ ময়নিহানের কঠোর চোখ দেখে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে দুই গাল।

ওই যে এল নতুন দুজন, তাদের কী করবে? জানতে চাইল জাজ হোল্ড। মনে হচ্ছে না তাদেরকে সামলাতে পেরেছে বেণ্ডাররা।

অস্টিন ম্যাকলাস্কির গাধাবাহিনীর জন্যে কঠিন হয়েছে বেণ্ডারদের কাজ, তৃতীয় লোকটার দিকে সিগার তাক করল ময়নিহান। এসব কাঁচা তোক নিলে যা হয়। আমাদের প্রথমেই উচিত ছিল কাজটা বেণ্ডারদের দেয়া।

ওরা নিজেদের কাজ করলে আজ এমন বিপদে পড়তাম, ঢোলের মত বুক আরও ফোলাল তৃতীয়জন। ওদের উচিত ছিল গোপনে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভিকে খুন করা। সে মরার আগে যে চিৎকার করেছে, শুনতে পেয়েছে পুরো কাউন্টির অর্ধেক লোক।

আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে দরকার ছিল ওটা, নাকি ভুলে গেছ?

মনে আছে। কিন্তু আমার ধারণা, আমাদের জন্যে মস্তবড় ঝুঁকি ওই অপদার্থ নিক বেণ্ডার।

দুসারি দাঁতের মাঝে সিগারটা কামড়ে ধরল ময়নিহান। পরক্ষণে ঝট করে উঠেই বামহাতে চেপে ধরল ঢোলের টাই। অন্য হাতে সড়াৎ করে নামল ধারালো ক্ষুর। চকচকে ফলাটা ধরল মোটকুর চোখের সামনে। সিগারের গোড়া চিবুতে শুরু করেছে ন্যাশ ময়নিহান। আমি তো মাত্র একটা অপদার্থকেই দেখতে পাচ্ছি!  

বাড়াবাড়ি এনে দেবে বিপদ, জানে জাজ প্যাট্রিক, তাই বসে থেকেই নরম সুরে বলল, মাথা ঠাণ্ডা রাখো, ন্যাশ। অস্টিন দুশ্চিন্তা করছে বলেই এসব বলেছে।

বেশি বাড়াবাড়ি করছে, আমার ব্যবসায় নাক গলাবার অনুমতি ওকে দিইনি। অস্থায়ী শেরিফের নাকের ডগায় ক্ষুরের ফলা রাখল ময়নিহান। ভাবছি, কেটে নেব কি না।

নিচু স্বরে বলল জাজ, ও কিন্তু কাজে লাগবে, ন্যাশ।

তা ঠিক, এখনও। টাই ছেড়ে দিল ময়নিহান।

ঝটকা দিয়ে পেছাল ম্যাকলাস্কি। চেহারা ফ্যাকাসে। দাঁত দিয়ে কামড়ে কেটে ফেলেছে ঠোঁট। থুতনিতে স্থির হলো এক ফোঁটা রক্ত। আবারও বসল ময়নিহান। ক্ষুর ফিরল কবজির খাপে। হাতে নিল সিগার। ঝুলছে ছাই। বিস্মিত চোখে ওটা দেখল সে।

বড় করে দম নিল শেরিফ। আলতো করে হাত বোলাল নাকে। ভেবেছিল কাটা পড়েছে। কিন্তু তা নয়।

তাকে পাত্তা দিল না ময়নিহান। ম্যাকলাস্কির মতই রিক বেণ্ডারও আমাদের একটা হাতিয়ার। এর বেশি কিছুই নয়।

ভাবছ কাজটা শেষ করতে পারবে রিক? জানতে চাইল জাজ। পানি কিন্তু গড়িয়ে গেছে অনেক দূর।

পারবে। হাসল ময়নিহান। আমি বলব, যা হয়েছে, এরপর আরও খেপে গিয়ে ব্যস্ত হবে সে। অস্থায়ী শেরিফের দিকে তাকাল। তা ছাড়া, আসতে বলেছি আরও কজনকে। প্রত্যেকে ওরা দক্ষ লোক। কাজেই চুক্তির বরখেলাপ করবে না তোমরা; নইলে বাঁচবে না তোমাদের নিকট আত্মীয়স্বজন।

ঘন ঘন মাথা দোলাল অস্থায়ী শেরিফ।

বাড়তি লোক? তিক্ত হলো জাজের চেহারা। তাদের পেছনে কত খরচ হবে?

নিনা ভেঞ্চুরাকে না পেলে যা হবে, তার চেয়ে অনেক কম। অলস ভঙ্গিতে জাজের টেবিলের অ্যাশট্রের দিকে হাত বাড়াল ময়নিহান। দুইঞ্চি দূরে ছাইদানী, এমনসময় টুপ করে, জমির বিবরণপত্রে পড়ল ছাই। ওরা দুজন অফিসে ঢোকার আগে ওটাতেই চোখ বুলাচ্ছিল জাজ। তার ভুরু কুঁচকে গেছে। দেখে হাসল ময়নিহান। টোকা দিল ফোল্ডারের ওপর। চকচক করছে কাভার। মাত্র কয়েক হাজার ডলার বাঁচাতে গিয়ে হাতছাড়া করবে সব?

ক্রাইসেলিস শহরের মতই নতুন করে জমে উঠছে লিটল ফোর্ক। তাতে এ এলাকা হবে অকল্পনীয় সুন্দর, অথবা ভয়ানক নোঙরা। একসময়ে শহরটা ছিল স্থানীয় কয়লা খনি মজুরদের আস্তানা। অনুভূমিকভাবে খুঁড়ে তোলা হতো কয়লা। কিন্তু কয়েক পুরুষ আগেই ফুরিয়ে গেছে খনি। রাজ্যের আরও বহু শহরের মতই ভুতুড়ে বসতি হয়ে উঠেছিল। লিটল ফোর্ক, কিন্তু পরে ওটাকে রক্ষা করল টুরিযম। কেন্টাকির ওয়াইল্ড রিভার্সে উন্মত্ত নদীর পানিতে ফুর্তি করতে এল শত শত টুরিস্ট। উনিশ শ নব্বই সালে এ শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুহাজার। কিন্তু এখন হয়েছে দশ গুণ। আরও বাড়ছে মানুষ। খোলা হচ্ছে নতুন নতুন হোটেল, শপিং মল, মাল্টিস্ক্রিন মুভি থিয়েটার, রেস্টুরেন্ট এবং অন্যান্য ব্যবসা। জমি কিনে বাড়ি করছে অনেকে। আর যারা আগেই কিনেছে শত শত একর, পোয়াবারো তাদের। হাজার গুণ বেশি দামে বিক্রি করছে জমি। ব্যবসার সুযোগ আছে বলেই আবারও বড় হচ্ছে এ শহর। এ কারণে নিজ পকেট ভরতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আণ্ডারওঅর্ল্ড-এর এক ক্ষমতাধর নেতা, নিষ্ঠুর খুনি ন্যাশ ময়নিহান। তাতে বেড়েছে হানাহানি। নিয়মিত খুন হচ্ছে মানুষ। ব্যবসার নামে চলছে ডাকাতি ও লুটপাট। এটা স্বাভাবিক। ময়নিহানের পথে বাধা হয়ে উঠলে, রক্ষা নেই কারও।

লিটল ফোর্কের বাসিন্দা নয় ন্যাশ ময়নিহান, এসেছে ডালাস থেকে। তিনবছর আগে এসে টাকা ঢালতে শুরু করেছে ছোট এ শহরে। খরচ করেছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এরই মধ্যে পকেটে পুরেছে অন্তত বিলিয়ন ডলার। বুঝে গেছে, কাঁচা সোনার খনিতে হাত দিয়েছে সে। তাই চাইছে না নিনা ভেঞ্চুরার মত কেউ ভেস্তে দিক সব। উপস্থিত এ দুজনের ওপর খেপে গেছে ন্যাশ ময়নিহান। স্বাভাবিক। আরে, শালা, পাবি লাখে লাখে ডলার, তো খরচ করবি না মাত্র কয়েক হাজার?

আগামীকাল পৌঁছুবে, চেয়ার ছাড়ল ময়নিহান। বুঝিয়ে দিল, আজকের মিটিং শেষ। অস্থায়ী শেরিফের দিকে ফিরল। কাজে নামবে ওরা। ওদের পথ ছেড়ে দূরে থাকবে। পুলিশ টাইপের লোকদের পছন্দ করে না ওরা।

.

১০.

 প্রথম কাজ কোথাও আশ্রয় খুঁজে নেয়া, ভাবছে রানা। পরে স্থির করবে পরের প্ল্যান।

ফ্লোরিডা ত্যাগের সময় লিটল ফোর্কের এয়ারপোর্টের কাছে বুক করেছিল একটা হোটেল। কিন্তু এখন উচিত হবে না ওখানে যাওয়া।

ম্যাপ দেখে শহরের প্রায় বাইরের এক মোটেল বেছে নিল রানা। সিঙ্গেল ঘরের জন্যে টাকা নেয়ার সময় লোভী চোখে জুডিকে দেখল গুণ্ডা-চেহারার মোটেল ক্লার্ক। বুঝে গেছে, রাতের জন্যে এই সুন্দরী পতিতাকে জুটিয়ে নিয়েছে সুদর্শন যুবক। আহা, আধঘণ্টার জন্যে যদি পাওয়া যেত এটাকে! রানার দিকে চেয়ে চওড়া হাসল সে। চাবি দেয়ার সময় বার কয়েক চোখও টিপল। রানা নির্বিকার।

ঘরের দরজা খোলার সময় নাক ফুলিয়ে বলল জুডি, বুদ্বুটা ভেবেছে আমি তোমার রক্ষিতা বা রাস্তা থেকে তুলে আনা পতিতা। সন্দেহের চোখে দেখল নিজের পোশাক। বলো তো, আমাকে দেখতে সত্যিই পতিতার মত লাগে?

না তো! আকাশ থেকে পড়ল রানা। আমার তো মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ রাজকুমারী! জুডি ঘরে ঢোকার পর দরজা আটকে দিল।

শহরে গড়ে উঠছে নতুন হোটেল ও মোটেল। কিন্তু ভাল হোটেলে না উঠে এ মোটেল বেছে নিয়েছে রানা। এটা আছে বহুকাল ধরেই। এমনই জায়গা, যেখানে একঘণ্টার জন্যেও ভাড়া দেয়া হয় রুম। এক ডজন রুমের মধ্যে পেছন থেকে তৃতীয় রুম ওদের। কেউ চট করে ভাববে না এখানে এসে উঠবে ওরা।

কয়েক ঘণ্টা থাকার জন্যে খারাপ নয় ঘরটা। ছোট বাক্সের মত। পাশেই বাথরুম। যথেষ্ট পরিষ্কার।

বেড মাত্র একটা, বিরক্তি প্রকাশ করল জুডি। তুমি কোথায় ঘুমাবে?

ঘুমাব না, ম্যাগনাম রিভলভারটা ম্যাট্রেসের নিচে রেখে সিধে হয়ে দাঁড়াল রানা।

কাউন্টারের ওই শয়তানের ইঙ্গিত পেয়ে বাড়াবাড়ি করবে না তো? সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল জুডি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। দেখতে তুমি সত্যিই সুন্দর! তবে নিশ্চিন্তে থাকতে পার, কক্ষণো জোরাজুরি করব না!

বিশ্বাস করি তোমাকে। কপা বেড়ে রানার বাহুতে হাত রাখল জুডি। চোখে কাতর দৃষ্টি।

রানা বুঝে গেল, প্রাণ রক্ষা করেছে, সেজন্যে ওর কাছে ঋণী থাকতে চাইছে না মেয়েটা।

মুখ তুলে রানার ঠোঁটে চুমু দিল জুডি।

সাড়া দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল রানা। নরম গলায় বলল, আমরা কেউ কারও কাছে ঋণী নই, জুডি। হয়তো ভুল হবে কাছে এলে।

রক্তিম হলো জুডির দুগাল। তবে বুঝল, ওকে অপমান করতে এ কথা বলেনি রানা। সুযোগ পেয়েও তা নেয়নি। ম্লান হাসল ও। ধরে নাও, বন্ধু হিসেবে ধন্যবাদ দিতেই চুমু দিয়েছি। ও বিছানায় বসতেই কাঁচকোচ আওয়াজ তুলল স্প্রিং।

অস্বস্তিতে পড়ে দরজা লক্ষ্য করে চলল রানা। সরিয়ে ফেলব ডজ র‍্যাম ট্রাক। দরজা লক রেখো। ফিরতে একটু সময় লাগবে।

ইয়েস, স্যর, উঠে বাথরুমের দিকে চলল জুডি। আনমনে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। চোখে রাগের ছাপ।

বেরিয়ে এসে রুমের দরজা বন্ধ করল রানা। মোটেল থেকে বেরোতেই হাড়ে কাপ ধরিয়ে দিল কনকনে শীতল হাওয়া।

বেশ অনেকটা দূরে একঝাড় গাছের আড়ালে ডজ র‍্যাম ট্রাক রেখেছে রানা। পরের পাঁচ মিনিটে ট্রাক নিয়ে শহরের আরেকপ্রান্তে পৌঁছুল। থামল আরেক মোটেলের কাছে। হাইওয়ে থেকে দেখা যাবে না এমন এক জায়গায় রাখল ট্রাক। চারপাশে পাইনের জঙ্গল।

পুলিশ বা শত্রুপক্ষের কেউ ওটা পেলে ভাববে, আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে গাড়িটা লুকিয়ে রাখতে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই মনে হবে, খোঁজ নেয়া উচিত কাছের মোটেলে।

গাড়ির সামনের মাডগার্ডের নিচে চাকার ওপর চাবি রেখে পায়ে হেঁটে নিজেদের মোটেলের উদ্দেশে চলল রানা। একবার থামল এক জেনারেল স্টোরে। কিনল স্ন্যাক্স ও জুস। কী ভেবে নিল মস্ত একটা চকলেট বার। ঠিক করেছে, শান্তি বজায় রাখতে জুডিকে ঘুষ দেবে। দোকানের বাইরে ছাউনির নিচে থামল ও। পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে কল দিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু জন হার্বার্টকে। ওদিক থেকে কল রিসিভ হতেই বলল, কী ব্যাপার, নিজে সাহায্য করবি না বলে মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলি আমার কাছে?

ও, তা হলে যোগাযোগ করেছে?

 হ্যাঁ।

দেখতে দারুণ, তাই না?

হোক, তাই বলে পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিবি?

খুকখুক করে কাশল হার্বার্ট। ওহ্, বলে দিয়েছে? যাহ!

ভাবতে পারিনি মাইকের বোন হতে পারে।

আমিও পারিনি। সে তো ছিল মদ্দা মোষের মত। ওর ওপর খরচ করে ফেলেছিল ওর বাপ সব বাজে জিন। তারপর স্বর্গ থেকে নেমে এল ওই মেয়ে।

চুপ করে আছে রানা।

কী রে, প্রেমে পড়ে গেলি? জানতে চাইল জন।

এখনও না, বলল রানা।

ওর কথা শুনেই বুঝেছি, তোকে পছন্দ করে। ক্ষতি কী মেলামেশা করলে?

উচিত হবে না, জন। পাহাড়ে ওর বোনের বাড়িতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছি, ব্যস, আরেকটু হলেই মাথা উড়ে যেত আমার। এক সেকেণ্ড দেরিতে খুনির দিকে গুলি পাঠিয়েছি।

গোলমাল শুরু হয়ে গেছে? জানতে চাইল জন হার্বার্ট।

প্রথম থেকে সব খুলে বলল রানা। এরই ভেতর খতম হয়েছে চারজন। অথচ জানা নেই কে-কেন-কী করছে। খোঁজও নেই নিনা ভেঞ্চুরার।

চলে আসব? জানতে চাইল জন।

আপাতত দরকার নেই, বলল রানা। টাম্পা শহরেই থাক। তুই ঠিক সময়ে হাজিরা না দিলে কেসটা বাতিল করে দেবেন বিচারক।

টাম্পার কোর্টে বিচার চলছে টম কোয়োর্কের। কমবয়সী মেয়েদের ড্রাগ দিয়ে তৈরি করত পর্নো সিনেমা। নিজেও ভোগ করত তাদেরকে। বড়সড়ো দল ছিল। কিন্তু বাঙালি এক মেয়ের অসহায় বাবা রানা এজেন্সির সাহায্য চাইলে তদন্ত শুরু করে হার্বাট। জোগাড় করে জোরালো প্রমাণ। এখন আশা করছে, কদিনের মধ্যেই টম কোয়োর্ক ও তার দলের লোকদের ভরতে পারবে জেলে।

কালকে সাক্ষ্য দিতে ডাকবেন বিচারক, বলল জন, কাজটা শেষ করেই চলে আসব।

জানি না আগামীকাল কোথায় থাকব, বলল রানা, তবে তুই ওই ডজ র‍্যাম ট্রাকের মালিকের ব্যাপারে তথ্য পেলে, বুঝব কোথা থেকে শুরু করতে হবে।

দেখছি কী করা যায়।

ঠিক আছে, জন।

হ্যাঁ, সাবধানে থাকিস। মেয়েটাকে আগলে রাখিস। আর কিছু বলবি?

না। কল কেটে দিল রানা। মেঝে থেকে ব্যাগ তুলে রওনা হলো ওদের মোটেলের উদ্দেশে।

.

জ্ঞান ফিরতেই সচেতন হয়ে উঠেছে রিক বেণ্ডার। কাজ করছে না মাথা। চোখের সামনে কালো সব ধোয়া। ঘাড় নাড়তেই লাগল দারুণ ব্যথা। মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগের কথা। স্বস্তি পেল, এখনও খুন হয়নি। সেইসঙ্গে এল রাগ। যে-লোক এমন ব্যথা দিল, খুঁজে বের করে তাকে খুন করবে সে। আঁধারে গুলি না করে গলা টিপে মারবে হারামজাদা ওই কুত্তার বাচ্চাটাকে।

তোমার মাথা ফেটে গেছে, বড়ভাইকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল নিক বেণ্ডার।

আহত খুলি স্পর্শ করল রিক। বলো তো কী হয়েছিল? কানের কাছে গর্জে উঠল রাইফেল। প্রচণ্ড আওয়াজে নাক কুঁচকে ফেলল সে। দূরে দেখল বাইসন গাড়ির লাল বাতি। বাঁক নিয়ে চলে গেল ওটা।

চোখে আগুন নিয়ে ঘুরে তাকাল রিক। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে লম্বা এক তরুণ। হাতে রাইফেল। নল থেকে বেরোচ্ছে। ধোঁয়া। হঠাৎ করেই দুহাতে তরুণের গলা টিপে ধরল রিক। একটানে তুলে ফেলল মাটি থেকে। ধুলোয় পা ছুঁড়ছে ছোকরা। বেগুনী হয়ে গেছে মুখ।

হার্ভে, আমার গাড়িতে গুলি করিস, শুয়োরের বাচ্চা? অসহায় তরুণকে ছুঁড়ে ফেলল রিক। ডানা ভাঙা পাখির মত কাছের ঝোপে গিয়ে পড়ল ছোকরা। ডাল ভেঙে চিত হয়ে পড়ল মাটিতে।

বুটের ধুপ-ধাপ শব্দ তুলে রাস্তায় এসে থামল রিক ও নিক। চাইল দূরের শহরের পথে। কোথাকার এক বদমাস চুরি করেছে ওদের সাধের গাড়ি!

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। পেছনে ঝোপ থেকে হার্ভেকে উদ্ধার করল তার কয়েকজন বন্ধু মিলে।

হতভম্ব তরুণের দিকে কড়া চোখে তাকাল রিক। ঠিক আছিস?

দ্বিধা নিয়ে মাথা দোলাল তরুণ। ছড়ে-কেটে গেছে কপাল, জ্বলছে। বামহাতে কপাল স্পর্শ করল সে।

তোর কপাল ভাল, এই মুহূর্তে খারাপ না আমার মেজাজ, বলল রিক। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে দলের অন্যরা। কর্কশ সুরে বলল সে, যা খুশি করবি, তা হবে না, শুয়োরের বাচ্চা মাদার…রা! নইলে ঘাড় থেকে ছিঁড়ে নেব মাথা!

নিক ছাড়া সবাই মাথা দোলাল সম্মতির ভঙ্গিতে। ভাল করেই জানে, অন্তরের কথা বলেছে দানবটা।

তোদের কারও ফোনে সিগনাল আছে?

একজন বাড়িয়ে দিল মোবাইল ফোন। মাত্র একটা বার। তবে তাতেই কাজ হওয়ার কথা, রিক।

নিয়ে আয় গাড়ি, দুই ড্রাইভারকে বলল দানব। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ নেই।

জটলা ভেঙে গাড়ির দিকে চলল বেশিরভাগ যুবক। তবে রিকের সামনে রয়ে গেল নিক। ফোনে ন্যাশ ময়নিহানকে রিপোর্ট দিতে শুরু করেছে তার বড়ভাই।

রিক কথা শেষে কল কেটে দিতেই জানতে চাইল নিক, কী বলল লোকটা?

পুরনো কথা, বলল রিক, আমাদেরকে সাহায্য করতে ডেকেছে আরও কয়েকজনকে।

কিন্তু আমাদের কোনও সাহায্য লাগবে?

খুলির রক্তাক্ত অংশ স্পর্শ করল রিক। তিক্ত সুরে বলল, না, লাগবে না।

শহরে ফেরার আগে নিনা ভেঞ্চুরার বাড়িতে গেল ওরা। লিভিংরুমে রাখল চার লাশ। পিকআপ থেকে গ্যাসোলিন এনে আসবাবপত্র ভিজিয়ে দিল নিক। সবাই বেরোবার পর বারান্দা থেকে ম্যাচের জ্বলন্ত কাঠি ভেতরে ফেলল রিক। বাড়ি জুড়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আকাশ থেকে পড়ে মুহূর্তেই গলে যেতে লাগল তুষার।

একটা এসইউভি দখল করেছে রিক ও নিক।

অবশিষ্ট মার খাওয়া এসইউভি ও পিকআপে উঠে রওনা হলো অন্যরা। এসইউভি ও পিকআপের পেছনে চলেছে দুই ভাইয়ের গাড়ি।

কাঁচা মগজের আঁশটে গন্ধে বমি আসছে, নালিশ করল নিক। গাড়ির ভেতর ছিটিয়ে আছে রক্ত ও মাংসের টুকরো।

ওঅর্কশপে যাওয়ার পর পরিষ্কার করব, বলল রিক। বরাবরের মতই চালাচ্ছে গাড়ি। দুই বোন্ডারের মাঝের সরু পথে পৌঁছে রাখল এসইউভি। ক্যান ভরা গ্যাসোলিন নিয়ে গাড়ি থেকে নামল নিক। ভালভাবে ভিজিয়ে দিল ফোর্ড এক্সপ্লোরার, তারপর আগুন জ্বেলে দিল ওটাতে।

আবার রওনা হলো তারা।

পেছনের পাহাড়ে রইল লেলিহান আগুন।

কপাল ভাল এখন শীতকাল, ভাবল রিক। নইলে পুরো জঙ্গল পুড়িয়ে ছারখার করত নিক। কিছুদিন হলো আগুন নিয়ে খেলতে শুরু করেছে ছোট। এজন্যে ওর ওপরে যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে।

শহরে যাওয়ার পথে সর্বক্ষণ নালিশ করল নিক। ছাত থেকে প্রতিবার ঝাঁকি খেয়ে টপ-টপ করে পড়ছে মগজ, মাংস ও রক্তের ফোঁটা। গন্তব্যের কাছে পৌঁছুবার আগে অন্তত বারোবার বলল সে, আমি, বাবা, ধুতে পারব না শালার গাড়ি।

একবারও আপত্তি তুলল না রিক। বড় এক হাতুড়ি যেন ধুম-ধাম বাড়ি দিচ্ছে মাথার ভেতর। ওঅর্কশপে গিয়ে প্রথম কাজ হবে ব্যথা কমানো।

.

চুপচাপ হাঁটছে রানা। কয়েক শ গজ গেলে পৌঁছুবে ওদের মোটেলে। একবার চোখ তুলে দেখল আকাশ। ঝরঝর করে ঝরছে ধবল তুষার। থমথম করছে শহরের এদিকটা। একটু দূরের গলিটা পেরোলে সামনে মোড়, ওখান থেকে যেতে হবে ডানে।

পেছনের সড়কে বাঁক নিয়েছে কোনও গাড়ি। চাপা গর্জন ছাড়ছে ইঞ্জিন। বিপদের জন্যে তৈরি হয়ে গেল রানা। হয়তো ওই গাড়ি পুলিশের। কোমরের কাছে চলে গেছে ওর হাত। প্রয়োজন হলে ঝট করে বের করবে ওয়ালথার। কিন্তু ওকে পাশ কাটিয়ে গেল পিকআপ। পেছনে বেশ কজন তরুণ ও যুবক। প্রত্যেকের সঙ্গে রাইফেল ও পিস্তল।

এরাই গিয়েছিল পাহাড়ে ওদেরকে খুন করতে, বুঝে গেল রানা। এখন কোনওদিকে মনোযোগ নেই। হামলার সময়েও দেখেনি ওকে। আর এখন দেখছে, শপিংব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরছে সংসারী এক লোক।

এদের পিছু নেয়া সম্ভব হলে ভাল হতো, কিন্তু তা পারবে না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বঁটছে রানা। পিকআপের পর পর গেল একটা মার খাওয়া এসইউভি। আবারও গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন শুনল রানা। পাশেই সরু গলি-মুখ। পেছনের গাড়িও পাশ কাটাবে ভেবে ওটার দিকে চাইল রানা। কমিয়ে দিয়েছে হাঁটার গতি।

কড়া ব্রেক কষে ওর ঘাড়ের কাছে থামল এসইউভি। জোর হর্ন বাজাল ড্রাইভার। বোধহয় ঢুকবে রানার পাশের গলিতে। ওই গাড়ি চিনে গেল ও। মগজ, মাংস ও রক্তে ভরা। ভেতরের অংশ। গাড়িটার ড্রাইভারও অচেনা নয়। এই দানবেরই মাথা ফাটিয়ে এসেছে রানা। ছিনতাই করেছে তার গাড়িটা।

আবারও হর্ন বাজাল দৈত্যটা।

প্যাসেঞ্জার জানালা দিয়ে মাথা বের করে ধমকে উঠল কেউঃ অ্যাই, শুয়োরের বাচ্চা, রাস্তা ছাড়! পাছাটা সরা! নইলে পড়-পড় করে ওদিক দিয়ে ভরে দেব গাড়িটা!

গলি-মুখ পেরোবার সময় তাদেরকে আরেকবার দেখল রানা। ড্রাইভারের চেয়েও আকারে বড় প্যাসেঞ্জার সিটের দৈত্য। মাথার দুপাশ চাঁছা। মোহক-স্টাইলে খুলির মাঝে চুল। চোখদুটো অস্বাভাবিক। একটা দেখছে ওকে, অন্যটা আকাশ।

হাট, শালা! নইলে পিটিয়ে হাগিয়ে দেব!

মৃদু মাথা দুলিয়ে মোড় লক্ষ্য করে চলল রানা। কিন্তু পেছনের গলিতে এসইউভি ঢুকতেই থামল। আবার ফিরল গলির মুখে। হালকা চালে দৌড়ে পিছু নিল গাড়িটার।

দেড় শ গজ দূরে থেমেছে কানাগলি।

একমিনিট পর খটাং আওয়াজ শুনল রানা।

তালা খুলেছে কেউ। খড়খড় শব্দে সরল একটা দরজা। গর্জন ছাড়ল এসইউভির ইঞ্জিন। ঢালু পথে উঠছে ওটা।

গলির পাশৈর দেয়ালে সদাইয়ের ব্যাগ রেখে নিঃশব্দে হেঁটে চলল রানা। হাতে উঠে এসেছে কক করা ওয়ালথার।

.

১১.

 ওই কুত্তার বাচ্চাকে গাড়িচাপা দিতে! রাগ করে বলল নিক বেণ্ডার। সময় নষ্ট করছিল!

নিক…।

আবার কী? ত্যাড়া চোখে বড়ভাইকে দেখল দানব।

এইমাত্র গ্রাউণ্ড-ফ্লোরে উঠেছে এসইউভি। হেডলাইট বন্ধ করল না রিক। গাড়ি থেকে নেমে দেয়ালের সুইচ টিপল নিক। শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোয় ঝকঝক করে উঠল বারো শ স্কয়ার ফিটের ওঅর্কশপ।

গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে অভ্যেসবশে ড্যাশবোর্ড হাতড়াল রিক। কোথাও নেই ম্যাগনাম। তিক্ত মনে ভাবল, ভালই হলো। নইলে হয়তো সত্যিই একটা বুলেট গেঁথে দিত নিকের মগজে!

গাড়ি থেকে নেমে রিক দেখল, তার জ্যাকেটের আস্তিনে রক্তমাখা এক টুকরো মগজ। ভীষণ বিরক্ত হয়ে এসইউভির হুডে থকথকে জিনিসটা মুছল সে।

আশ্চর্য, রিক! ত্যাড়া চোখে ওকে দেখল নিক। এমনিতেই যথেষ্ট নোংরা, আরও মাখাতে হবে গাড়িতে!

অ্যাই, চুপ, নিক! দূরের দেয়ালে টুল-বেঞ্চ, ওদিকে চলল রিক। ওখানে কোনও বাক্সে আছে মরফিন। ব্যথায় টনটন করছে মাথা। তার ওপর পোশাক থেকে আসছে তাজা রক্ত, মগজ ও মাংসের রোটকা গন্ধ। যে-কোনও সময়ে পেট থেকে সব উগরে দেবে। এরচেয়ে খারাপ আর কী হবে!

হতেও তো পারে! বলে উঠল কে যেন।

ঝট করে ঘুরে রানার দিকে তাকাল রিক ও নিক।

এত বিশালদেহী লোক কমই দেখেছে রানা। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পেছনের দেয়াল আড়াল করে ফেলেছে দুই ভাই। রানার বন্ধু সোয়া ছয় ফুটি জন প্রায় পাহাড়ের মত, কিন্তু এই দুজনের তুলনায় সে হচ্ছে কোলের শিশু।

অবশ্য, ওর আর এদের মাঝে আছে বিরাট ফারাক। ওই দুজনের কাছে অস্ত্র নেই, কিন্তু রানার হাতে ওয়ালথার। ক্ষমতার পাল্লায় বিসিআই এজেন্টের ওজন বেশি।

কড়া চোখে ওকে দেখল দুভাই। কসেকেণ্ড পর তাদের চোখ স্থির হলো ওয়ালথার পিস্তলের ওপর।

বাড়াবাড়ি করলে মরবে! ত্যাড়া-চোখ দানবের নাক লক্ষ্য করে ওয়ালথার তুলল রানা। দুশত্রুর মধ্যে কথা বেশি বলে দৈত্য। হামলা হলে খুব সম্ভব আগে হবে তার তরফ থেকেই।

তুই শালা নিজেই বাড়াবাড়ি করছিস, রানার বুকের দিকে তর্জনী তুলল নিক। পাঞ্জাটা প্রমাণ সাইজের বেলের সমান। গালি দিয়েছি বলে মরতে এসেছিস, নাকি?

অপেক্ষাকৃত ছোট দানব সামান্য সরে বলল, নিক! জঙ্গলের সেই লোক!

ঠিক বলেছ, ওঅর্কশপে ঢুকল রানা।

একদিকের দেয়ালে অসংখ্য যন্ত্রপাতি।

ঘরের মাঝে এসইউভি।

 মেঝেতে মোবিলের দাগ।

 একই তেল দেয়াল ও আসবাবপত্রে।

চিনেছি গলা, বলল রিক বেণ্ডার, কে তুমি?

জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলল রানা, কী কারণে নিনা ভেঞ্চুরাকে খুঁজছ তোমরা?

পরস্পরকে দেখল দুই দানব।

চেহারায় দেখে রানা বুঝল, এরা একই মায়ের পেটে জন্মেছে। যেন বর্তমান পৃথিবীতে ফিরেছে দুই নিয়ানডারথাল ভাই!

তোমরা আপন ভাই, ঠিক? এক পা এগোল রানা। কোজন বয়সে ছোট?

আমরা যমজ, গম্ভীর হয়ে গেল ত্যাড়া চোখ।

তাকে নিক বলে ডেকেছে অন্যজন, মনে আছে রানার। ও, তো তুমি ছোট? আপত্তি ফুটল দানবের চেহারায়। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে বড়জনের দিকে তাকাল রানা। ঠিক আছে, যা জানতে চাইব, দেরি না করে জানাবে, নইলে গুলি করব তোমার ছোটভাইকে। বুঝতে পেরেছ?

অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওকে দেখছে রিক বেণ্ডার।

রানা বুঝল, ওর হুমকি শুনে ভীত নয় লোকটা।

কাঁধ ঝাঁকাল রিক। নিজের দেখভালের বয়স হয়েছে ওর। তুমি ওকে গুলি করতে চাইলে আমি ঘাবড়াব কেন?

ভুরু কুঁচকে তাকে দেখল নিক, তারপর রানার দিকে চেয়ে হাসতে শুরু করে ধমকে উঠল, আরে, শালা…

তুমি বেশি কথা বলো, পাল্টা ধমক দিল রানা। ওর প্রথম গুলি ফুটো করল নিকের বাম হাঁটুর বাটি। যত শক্তিশালীই হোক, কলা গাছের মত মেঝেতে পড়ে লাথি খাওয়া কুকুরের মত কেউ করে উঠল সে।

শুয়োরের বাচ্চা! খানিকটা টলতে টলতে রানার দিকে এগোল রিক বেণ্ডার। কিন্তু থেমে গেল বুকে পিস্তলের নল স্থির দেখে।

সামনে বাড়লে গুলি ঢুকবে বুকে, আরেক পা এগোল রানা।

থেমে গেছে রিক। মুখ বিকৃত হয়েছে রাগে। তুই যা করেছিস, ঘাড় থেকে উপড়ে নেব তোর মাথা!

ফালতু বকবক না করে মুখ খোলো, আবারও নিক বেণ্ডারের দিকে ঘুরল ওয়ালথার। নইলে দেখবে হলো পয়েন্ট বুলেট কতটা ক্ষতি করে তোমার ভাইয়ের মুখের।

হলো-পয়েন্ট .৩৮ বুলেট রুখে দেবে ছুটন্ত গণ্ডার। মাত্র একটা গুলি চুরমার করবে বয়সে ছোট দানবের আস্ত মাথা ও মুখ। আরও এক পা বাড়ল রানা।

দুহাত ওপরে তুলল রিক বেণ্ডার। ওকে, ওকে, গুলির দরকার নেই। অস্বীকার করব না, নিরেট গাধা ভাইটার জন্যে বহু কিছুই করব।…আসলে কী জানতে চাও তুমি?

শুরু করো তোমার নাম দিয়ে, বলল রানা।

 রিক। আর ও নিক।

বংশ পরিচয়?

শুয়োরটাকে কিছুই বোলো না, গুঙিয়ে উঠল নিক। কাত হয়ে বসেছে মেঝেতে। কমেছে শক, কিন্তু তার জায়গায় এখন তীব্র ব্যথা।

যন্ত্রণা পাত্তা দেবে না এরা, মানুষ খুনেও দ্বিধা নেই, বুঝে গেছে রানা। শান্ত মাথায় আরেক গুলিতে নিকের ডান হাঁটুর বাটি ফুটো করল ও।

এহূহে, দুঃখ পেয়ে মাথা নাড়ল রিক বেণ্ডার। চেয়ে আছে ভাইয়ের ব্যথা-বিকৃত মুখের দিকে।

হেঁড়ে গলায় হুক্কা-হুয়া বোল তুলেছে নিক বেণ্ডার।

এখন থেকে স্রেফ প্রশ্নের জবাব দেবে, জানাল রানা।

আমরা বেণ্ডার, প্রায় চিৎকার করল রিক। বেণ্ডার ভাই, বুঝতে পেরেছ? …ঠিক আছে?

বুঝেছি। এবার বলো, কার হয়ে কাজ করছ।

খুনির চোখে রানাকে দেখল রিক। বাধ্য হয়েই দানবের মাথার পেছন দেয়ালে গুলি করল রানা।

তপ্ত ধাতু কানের পাশ কাটিয়ে যেতেই চমকে গেছে লোকটা।

ন্যাশ ময়নিহান।

এই শহরের লোক?

না, ডালাসের। টেক্সাস। হেড অফিস ওখানে।

 এখানেও অফিস আছে?

 হ্যাঁ।

রিকের মাথার অন্যপাশ দিয়ে গেল রানার গুলি। আবারও ফুটো হয়েছে দেয়াল। জলদি জবাব দেবে। ময়নিহানের অফিসের ঠিকানা কী?

ভুরু কুঁচকে জানাল দানব, শহরের অভিজাত এলাকায় ন্যাশ ময়নিহানের অফিস। ওটা আছে একটা রেস্তোরাঁর ওপরতলায়।

নিনা ভেঞ্চুরাকে কী কারণে দরকার তার?

মিথ্যা বলে লাভ হবে না জানে রিক বেণ্ডার। চাপা কণ্ঠে বলল, কেন মেয়েটাকে খুঁজছে ময়নিহান। কথা শেষ করে তাকাল ছোটভাইয়ের দিকে।

তার চোখে হে ও মমতা দেখল রানা।

 আশা করি আমাদের বাঁচতে দেবে? জানতে চাইল রিক।

আমার বদলে তোমরা হলে দিতে? জানতে চাইল রানা।

নিশ্চয়ই! চওড়া হাসল দানব।

ক্ষণিকের জন্যে রানার মনে হলো, ওর পেছনে কাউকে দেখছে লোকটা। নইলে এত হাসি কীসের?

একটু সরে দাঁড়াল রানা।

না, ওঅর্কশপে অন্য কেউ ঢোকেনি।

মুচকি হাসল রিক। আমি হলে বাঁচিয়ে রাখতাম। তারপর একটা একটা করে ছিড়তাম তোমার হাত-পা। লাথি মেরে ফাটিয়ে দিতাম পেট। ওঅর্কশপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত তোমার লাশ।

শুনে খুব খুশি হলাম শুকনো গলায় বলল রানা। বুঝে গেছে, কী ঘটবে এবার।

রিকের চোখের কোণে বাড়তি ভাঁজ। ধরে নিয়েছে: মরবে, কাজেই উচিত শেষ চেষ্টা করা। এবার কুঁজো হয়ে তেড়ে আসবে রানার দিকে।

রিকের চোখ বিস্ফারিত হতেই একই সময়ে তার বুকে ওয়ালথার তাক করল রানা। কিন্তু চোখের কোণে দেখল,

উঠে বসেছে নিক, ডানহাতে মেঝে থেকে ভারী একটা রেঞ্চ তুলেই ছুঁড়ল রানার মাথা লক্ষ্য করে।

যন্ত্রটা এল ঘুরতে ঘুরতে।

 রানা চট করে বসতেই মাথার এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে গেল রেঞ্চ। নিশানা নড়ে গেলেও ট্রিগার টিপল রানা।

রিক বেণ্ডারের বাম কাঁধের ওপরের মাংস ফুটো করেছে। বুলেট। তাতে থামল না দানব। যেন ছুটন্ত ট্রাক। রানার মনে হলো, আকাশ থেকে ঝুঁকল বিশাল দৈত্য! থাবা বাড়িয়ে খপ করে পিস্তল কেড়ে নিতে চাইল সে। অন্য হাতে চেপে ধরেছে রানার গলা। ঘুরিয়ে নেয়া হলো ওকে, পরক্ষণে দড়াম করে ফেলল এসইউভির ছাতের কিনারায়। থরথর করে কেঁপে উঠেছে গোটা গাড়ি।

শুয়োরের বাচ্চা! রানার চোখের কাছে নাক নিল রিক বেণ্ডার। তোর উচিত ছিল আগেই খুন করা! এবার মরবি তুই!

পিঠে বেদম খোঁচা দিচ্ছে গাড়ির ছাত, ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে রানা। চাপা স্বরে বলল, কথা… ঠিক!

খল-খল করে হাসল রিক বেণ্ডার, পরক্ষণে রানাকে সরিয়ে আবারও ধুম করে ফেলল গাড়ির পাশে।

রানার মনে হলো ফেটে গেছে কিডনি। ব্যথা এতই বেশি, চোখে দেখল গাঢ় অন্ধকার। দানবের হাত দীর্ঘ, তার মুখ আছে আওতার বাইরে। শক্তহাতে ধরেছে রানার গলা।

শ্বাস আটকে যেতেই বামহাতে লোকটার বাহুর নার্ভে চাপ দিল রানা। কিন্তু ওক গাছের মত কঠিন হাতে ডাবতে চাইল না ওর আঙুল।

আবারও হাসল রিক। তুই আমার কাছে শিশু! আরও শক্তভাবে চেপে ধরল ওর গলা।

রানার কপাল ভাল, দানবের হাত এতই বড় যে ঠিকভাবে চাপ দিতে পারছে না শ্বাসনালীতে, নইলে মটু করে ভাঙত কার্টিলেজ; নিজের রক্তে ডুবে মরত রানা। না মরলেও প্রচণ্ড ব্যথা ও শ্বাসকষ্টে জ্ঞান হারাচ্ছে ও। মগজে আটকা পড়া রক্তের ধুপ-ধুপ শব্দ।

প্রাণে বাঁচতে হাঁটু তুলে দানবের ঊরুসন্ধিতে গুঁতো দিল রানা। এখন চাই দূরত্ব, ঠেলে সরাতে হবে পাহাড়টাকে। আবছাভাবে রানা শুনল নিকের কন্ঠ: খুন করো, রিক! খুন করো! মাদারচো…কে!

বড় দানবের চিৎকার কাজে এল রানার।

রিক বেণ্ডার বুঝে গেল, বেশি দ্রুত খুন করছে সে।

তা হতে পারে না!

আগেই বলেছে, এক এক করে ছিঁড়বে রানার হাত-পা। কথাটা মনে পড়তেই ওকে কাঁধে তুলে দূরে ছুঁড়ল সে।

উড়ে চলল রানা, তবে দুসেকেণ্ড পর ভারী পাথরের মত চিত হয়ে পড়ল মেঝেতে। ঠাস্ করে ঠুকে গেল মাথা। দাঁতের কামড় লেগে কেটে গেছে জিভ। তবুও খুশি, অন্তত বুক ভরে পাচ্ছে অক্সিজেন। তা ছাড়া, হাতে এখনও রয়ে গেছে ওয়ালথার।

ধুপ-ধাপ পায়ে ওর দিকে আসছে রিক বেণ্ডার।

তার দিকে পিস্তল তুলল রানা।

বসে নেই নিক। ঝাঁপিয়ে পড়ে খপ করে ধরল রানার বাহু। টানল নিজের দিকে। পুরক্ষণে বুলডোরের মত উঠে এল ভারী ওজন নিয়ে বুকের ওপর। ছোটভাই ঢেকে ফেলার আগেই রানার অরক্ষিত পাঁজরে কষে দুটো লাথি দিয়েছে রিক। কিন্তু নিজে খুন করবে বলে বাঁদর সাইযের লোকটাকে বড়ভাইয়ের বুট থেকে আড়াল করেছে নিক। প্রচণ্ড কিল বসাল রানার মাথার তালুতে। একটু পিছিয়ে বসল ভালভাবে মুখে ঘুষি মারতে।

রানার মনে হলো বুকে বিশাল পাহাড়। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। বামহাত তুলে নিকের মুখ কোথায় খুঁজতে লাগল ও। ওর বুড়ো আঙুলটা পেয়ে গেল লোকটার নীল চোখ। দেরি না করে গায়ের জোরে বুড়ো আঙুল ইসল চোখের ভেতর। আকারে যত বড়ই হোক, চোখ গলে যেতেই স্বস্তিতে থাকল না দানব। জেলির মত কী যেন নামছে রানার আঙুল বেয়ে। ঝটকা দিয়ে সরে বেসুরো আর্তনাদ ছাড়ল নোকটা। তারই ফাঁকে খপ করে ধরল রানার গলা, ছিঁড়বে কণ্ঠনালী।

নিকের বুকে পিস্তলের নল তাক করল রানা, পরক্ষণে টিপল ট্রিগার। দানবের পিঠ থেকে বেরোল রক্তের ফোয়ারা। লাল একটা ধারা ফিনকি দিয়ে গিয়ে লাগল ছাতে। গুঙিয়ে উঠে কাত হয়ে পড়ছে দানব। মানসিক কষ্টে চিৎকার করে উঠল রিক বেণ্ডার। আবারও ট্রিগার টিপল রানা।

দুটো গুলিই ফুটো করেছে নিকের হৃৎপিণ্ড। মুহূর্ত পর রানার ওপর আবারও নামল পাহাড়। দুহাতে ধাক্কা দিয়ে ওজন সরাতে চাইল ও। নিক ছিল ওর আর রিকের মাঝে। লাশ সরলেই হামলে পড়বে অপেক্ষাকৃত ছোট দানব। পিস্তল হাতে ধড়মড় করে উঠে বসে তাকে খুঁজল রানা।

এসইউভির মুখ আড়াল করেছে ওঅর্কশপের একদিক। আশপাশে নেই রিক। চারপাশ দেখল সতর্ক রানা। ভেবেছিল তেড়ে আসবে লোকটা। কিন্তু প্রতিশোধের জন্যে অপেক্ষা করছে না সে। পালিয়ে গেছে ওঅর্কশপ ছেড়ে।

পিছু নেব না, ভাবল রানা।

আগে চাই সুস্থতা। মনে হচ্ছে চাপা পড়েছে গাড়ির নিচে। পরে দরকার হলে খুঁজে নেবে দানবটাকে। তা ছাড়া, যেজন্যে আসা, সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। এখন জানে, কে শত্রু এবং কেন খুন করতে চাইছে নিনা ভেঞ্চুরাকে।

গুলির শব্দে যে-কোনও সময়ে পৌঁছুবে পুলিশ। যদিও এখনও নেই সাইরেনের আর্তচিৎকার। এর কারণ বোধহয়, ওদের ওঅর্কশপ ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার একেবারে শেষমাথায়। নিয়মিত হাতুড়ির আওয়াজ ও চেঁচামেচি এখানে স্বাভাবিক।

সামান্য খুঁড়িয়ে হেঁটে ওঅর্কশপ ত্যাগ করল রানা। গিয়ে থামল সদাইয়ের ব্যাগের সামনে। ওটা তুলে বেরিয়ে এল গলি ছেড়ে। জুডি নিশ্চয়ই ভাবছে কেন এত দেরি। রেগেও গেছে বোধহয়। মোটেলের দিকে পা চালাল রানা।

.

১২.

নিনা ভেঞ্চুরাকে খুন করতে চেয়েছে দুই বেণ্ডার ভাই। সুযোগ পেলে খুন করত জুডি ও রানাকেও। এদের মত লোক যতদিন বাঁচবে, খুন হবে নিরীহ মানুষ। কাজেই রানার দায় নেই এদের প্রতি। কিন্তু আইনের লোক দেখবে অন্য দৃষ্টিতে। প্রথম সুযোগে চাইবে ওকে গ্রেফতার করতে। সুতরাং, এখন থেকে আরও সতর্ক হতে হবে ওকে।

সামনে হয়তো পড়বে আরও লাশ। আগেই কোথাও সরিয়ে দিতে হবে মাইকের দুই বোনকে, নইলে যখন-তখন খুন হবে তারা।

মোটেলের পার্কিং লটের হ্যালোজেন আলোয় রানা দেখল কাত হয়ে পড়ছে তুষারের তুলল। উঠানে পৌঁছে ওদের ঘরের দিকে তাকাল। জানালায় আবছা আলো।

লবি পেরিয়ে সংসারী লোকের মতই ঘরের সামনে হাজির হলো রানা, বামহাতে সদাইয়ের ব্যাগ। ডানহাতে টোকা দেয়ার আগে ভাবল: ভুললে চলবে না, জুডি পুলিশ অফিসার। সহজে মানবে না ও খুনোখুনি করে এসেছে। হয়তো এজন্যে তীব্র ঘৃণা করবে ওকে। সেক্ষেত্রে আরও কঠিন হবে ওর কাজ। মেয়েটার জন্যে মনোযোগ নষ্ট হলে হয়তো খুন হবে ওরা দুজনেই। এত রূপসী মেয়ে খুব কমই দেখেছে রানা। জুডি চুমু দেয়ায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্টই হয়েছে ওর।

ঠিক করে ফেলল রানা, আপাতত কিছুই জানাবে না। ভাল হতো মাথার পাশে হাঁসের ডিমের মত ফোলা জায়গাটা জাদু দিয়ে হাওয়া করে দিতে পারলে। নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা। ভেজা পরিবেশ ঘরে। জুডি, আমি, রানা!

বেডরুমে নেই জুডি।

বিছানা এলোমেলো। চলছে টিভি। ধরা হয়েছে স্থানীয় স্টেশন। ভলিউম নিচু করা। বাথরুমের দরজা বন্ধ। তিরতির করে পানি পড়ছে শাওয়ার থেকে।

চেয়ারে সদাইয়ের ব্যাগ রেখে ওটা থেকে চকোলেট নিয়ে বিছানায় রাখল রানা। ওটা শান্তি চেয়ে সাদা পতাকা ওড়ানোর মত। জ্যাকেট খুলে রাখল চেয়ারের পিঠে। চেস্ট অভ ড্রয়ারের ওপরে আয়না দেখে চলে গেল ওখানে। ঘুষি পড়েছে চুলের আড়ালে। মুখে মারধরের চিহ্ন নেই। তবে ঘাড় ফুলেছে হাতির গর্দানের মত। শার্ট তুলে টিপেটুপে দেখল বুক। না, চিড় ধরেনি হাড়ে। বুটের ডগা ব্যবহার না করে ফুটবল প্লেয়ারের মত লাথি মেরেছে লোকটা। শার্ট ঠিকঠাক করে সব প্রমাণ লুকিয়ে ফেলল রানা।

 মেয়েটা উলঙ্গ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিব্রত হোক, তা চায় না, তাই গলা উঁচু করে ডাকল, জুডি? আমি এসে পড়েছি!

জবাব নেই ভেতর থেকে।

 রানার মেরুদণ্ড বেয়ে নামল শিরশিরে ঠাণ্ডা অনুভূতি।

জুডি!

সাড়া দিল না কেউ।

হ্যাণ্ডেল মুচড়ে বাথরুমের দরজা খুলল রানা।

কেউ নেই ভেতরে। বাতাসে জলীয় বাষ্প। শাওয়ার হেড থেকে পড়ছে সরু রেখায় পানি। একটু আগেও এখানে ছিল মেয়েটা। তা হলে গেল কোথায়?

হয়তো চিন্তার কিছু নেই, নিজেকে বুঝ দিল রানা।

নিরীহ মেয়ে নয় জুডি। জানে কীভাবে রক্ষা করতে হয় নিজেকে। ফ্লোরিডা থেকে রওনা হওয়ার পর বিমানে দেয়া সামান্য খাবার ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি ওদের। হয়তো বাইরে গেছে খাবার কিনতে।

এসব ভাবলেও কু ডাকছে রানার মন।

গেল কোথায় মেয়েটা?

প্রত্যাখ্যাত হয়ে রেগে গিয়েছিল?

 সেজন্যে চলে গেছে?

 মনে হয় না!

ঝুঁকে ম্যাট্রেস তুলল রানা। নিচে রয়ে গেছে ম্যাগনাম। ওয়ালথারের পাশে কোমরে জল ওটা। সরে দাঁড়াতেই বিছানার পাশে কীসের সঙ্গে যেন খট শব্দে পা লাগল ওর।

জুডির মোবাইল ফোন!

ওটার ফ্লিপ খুলতেই দেখল স্ক্রিন সেভার। এক মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে জুডি। বয়সে ওর চেয়ে কয়েক বছরের বড় মেয়েটা। চুল সোনালি। গড়ন মাঝারি হলেও ভারীর দিকে। চেহারা দেখে বোঝা যায়, ওরা দুই বোন। হাসিখুশি।

কারও মোবাইল ফোন আজকাল হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত ডায়রির মত। অন্যের জিনিস অনুমতি ছাড়া ধরা অপরাধ। পরিবেশ স্বাভাবিক থাকলে মোবাইল ফোনটা ছুঁয়েও দেখত না রানা। কিন্তু পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্বাভাবিক।

ওকে সংকেত দিতে মোবাইল ফোন রেখে গেছে জুডি। যে বা যারা কিডন্যাপ করেছে, হয়তো তুলেছে তাদের ছবি। ফোটোগ্রাফ ফাইল ঘেঁটে ডজনখানেক ছবি পেল রানা। বেশিরভাগই নিনা ও জুডির। একটা ছবিতে পুলিশ ইউনিফর্মে ফুলের মত সুন্দর জুডি। এ ছাড়া আছে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ছবি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য। একটা ছবি নিনার পাহাড়ি বাড়ির সামনে।

কল রেজিস্টার ও ডায়াল করা নম্বর দেখল রানা। কদিন আগে ছবার কল করা হয়েছিল জন হার্বার্টের কাছে। তবে ওসবের পর কল করেছে আরও দুটো নম্বরে। প্রথম কলটি নিনা ভেঞ্চুরাকে। অন্তত বারোবার কল দিয়েছে জুডি। তারপর ঘন্টাখানেক আগে কল করেছে জন হার্বার্টের কাছে। এরপর বোনের ফোনে। শেষের কলটি ছিল ত্রিশ মিনিট আগে। সংখ্যাগুলো আরেকবার দেখে ভিউ বাটন টিপল রানা। মাত্র দুমিনিট কথা বলেছে জুডি। মেয়েটা কল দিয়েছিল কাকে?

সবুজ কল বাটন টিপল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে রিসিভ হলো কল। মহিলা কণ্ঠ জানাল: লিটল ফোর্ক শেরি ডিপার্টমেন্ট। কী সহায়তা দিতে পারি?

যা জানার জানা হয়েছে। লাল বাটন টিপে কল কেটে দিল রানা। আস্তে করে শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, মস্ত ভুল করে ফেলেছ, জুডি!

কথা রাখেনি মেয়েটা। পুলিশ অফিসার। এড়াতে পারেনি দায়িত্ব। সেজন্যে ওকে দোষও দিল না রানা।

বড় কোনও ভুল করলে শেষ হবে ওর ক্যারিয়ার, তাই পাহাড়ে কী হয়েছে, শেরিফের অফিসে জানাতে চেয়েছে জুডি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিজের ক্যারিয়ার রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে বসেছে সে।

রানাকে সব কথা খুলে বলেনি রিক বেণ্ডার।

 কিন্তু যতটুকু বলেছে, তা-ও কম নয়।

শহরের আণ্ডারওঅর্ল্ডের সর্বোচ্চ নেতা ন্যাশ ময়নিহানের হয়ে কাজ করছে শেরিফ অস্টিন ম্যাকলাস্কি। তার আগের শেরিফকে যখন পিটিয়ে মারছে রিক ও নিক, তখন ওখানে উপস্থিত ছিল লোকটা। একবারের জন্যেও বাধা দেয়নি। তার চোখের সামনেই শেরিফের কান ছিঁড়ে নিয়েছিল নিক।

পুরো খেলা চালাচ্ছে ন্যাশ ময়নিহান।

তার দলে আছে অস্থায়ী শেরিফ।

জুডি ফোন দিতেই ওর কল গেছে ম্যাকলাস্কির কাছে। এরপর দেরি না করে এখানে এসেছে লোকটা। কিছুই সন্দেহ করে দরজা খুলেছে জুডি। অস্ত্রের মুখে ওকে তুলে নিয়ে গেছে শেরিফ। সেসময়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মোবাইল ফোন ফেলে গেছে জুডি। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, এ মুহূর্তে এই ঘর রানার জন্যে মরণফাঁদ। দেরি না করে বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।

সেরেছে! বিড়বিড় করল রানা। হাতে উঠে এসেছে দুই আগ্নেয়াস্ত্র। দরজার দিকে পা বাড়াবার আগেই হঠাৎ ঝনঝন করে জানালার কাঁচ ভেঙে মেঝেতে পড়ল কী যেন! দেখতে ওটা ছোট সিলিণ্ডারের মত। মুখে ধূসর ধোঁয়া।

সতর্ক করেনি কেউ। নীরবে কাজে নেমেছে লিটল ফোর্কের শেরিফ ডিপার্টমেন্ট। আগে ঘরে ফেলেছে টিয়ার গ্যাসের ক্যানিস্টার। এরপর পাঠাবে গুলি।

বুকের মাঝে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের গম্ভীর কণ্ঠ শুনল রানাঃ জলদি পালাও, রানা!

.

১৩.

সামনে আছে মাত্র দুটো পথ। আত্মসমর্পণ করতে হবে, নইলে ঠেকাতে হবে গ্রেফতার।

পারতপক্ষে আত্মসমর্পণ করবে না রানা। সেক্ষেত্রে একমাত্র পথ আইনের লোক এড়িয়ে যাওয়া। খুনিদের নেতা ময়নিহানের লোক শেরিফ ম্যাকলাস্কি। কিন্তু অধীনস্থদের ওপর তার কতটা প্রভাব আছে, জানার উপায় নেই। জুনিয়ররা পালন করে ঊর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশ। ম্যাকলাস্কির লোকদের কাছে রানা পিস্তল হাতে এক অপরাধী, ঝামেলা তৈরি করছে শহরে এসে। কাজেই তারা চাইবে ওকে গ্রেফতার করতে। তা যদি না পারে, প্রয়োজনে দেরি করবে না গুলি করে মারতে।

রানা চাইছে না, আইনের কেউ আহত বা নিহত হোক। কিন্তু আত্মসমর্পণ করলেই হারাবে অস্ত্র। সাইডওঅকে উপুড় করে শুইয়ে হাতদুটো আটকে দেবে হ্যাণ্ডকাফে। নিয়ে ভরে দেয়া হবে সেল-এ। ওখানে রানা হবে ম্যাকলাস্কির অসহায় শিকার। পরে ওকে সরিয়ে নেয়ার সময় কোনও দুর্ঘটনায় মরবে ও। হতে পারে, ওই সেল-এ ওর প্রথম দর্শনার্থী হবে রিক বেণ্ডার। সেক্ষেত্রে খুব দ্রুত আসবে মৃত্যু। হয়তো মোটেল কক্ষ ছাড়লেই খুন হবে শেরিফের গুলিতে।

যা করার করতে হবে এখনই!

শেরিফের লোক চাইছে টিয়ার গ্যাস সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসুক রানা। যদি তা না করে, গ্যাসের মুখোশ পরে ঘরে রেইড দেবে তারা। আশা করছে শ্বাস আটকে কাশছে বলে কিছুই করতে পারবে না ও। বাইরে নির্দেশ দিচ্ছে কারা যেন। ওদিকে মনোযোগ দিল না রানা। দরজা খুললেই খেলা শেষ ওর।

নিশ্চয়ই এই ঘরের দরজা বা বাথরুমের জানালা কাভার করেছে কয়েকজন অফিসার। ভাল অবস্থানে সন্তুষ্ট। ভাবছে বেরোবার কোনও পথ নেই। রানা ভাবছে, হয়তো জুডির কাছ থেকে এরা জানতে পারেনি, ও বাংলাদেশ মিলিটারির স্পেশাল ফোর্সের কমাণ্ডো ছিল। জানার কথা নয়, বিপদে পড়লে আমৃত্যু লড়াইয়ের ট্রেনিং আছে ওর। টিয়ার গ্যাস, সিএস, পাভা, নন-লিথাল কেমিকেল বা ইরিট্যান্ট বিষয়েও বিশেষ ট্রেনিং আছে।

ছোট ঘর ভরে গেছে গ্যাসে।

চেয়ারের পিঠ থেকে জ্যাকেট তুলে মুখে পেঁচিয়ে নিল রানা। ওটা কাজ করবে মুখোশের মত। তাতে ফুসফুস রক্ষা পেলেও ভীষণ জ্বলছে চোখ। পাতাদুটো বুজে চেস্ট অভ ড্রয়ারের কাছে গেল রানা। জোর একটানে মেঝেতে ফেলল টিভি। খাটের নিচের দিকে চেয়ে বকবক করছে আবহাওয়া বার্তা প্রচারক।

টিভিটাকে সিঁড়ির ধাপ হিসেবে ব্যবহার করে চেস্ট অভ ড্রয়ারে উঠল রানা। মোটেলের বাইরে শুনল অ্যাসল্ট টিমের বুটের আওয়াজ। চেঁচিয়ে বলছে কে কোথায় থাকবে। প্রায় সিধে হয়ে ছাতের সার্ভিস হ্যাঁচ খুলল রানা। দুহাতের জোরে উঠে এল নিচু ছাতের অ্যাটিকে। দেহ গড়িয়ে দেয়ার ফাঁকে লাথি মেরে আটকে দিল হ্যাঁচ। চিৎকার ও বুটের শব্দের নিচে চাপা পড়ল ধুপ শব্দ। এক সেকেণ্ড পর ধুম আওয়াজে ভেঙে পড়ল দরজা। নিচের ঘরে চিৎকার করছে কজন অফিসার। টেনে সরিয়ে দিচ্ছে আসবাবপত্র। মুখে মুখোশ, কিন্তু পরিষ্কার দেখছে না ধোয়ায়। আরও কসেকেণ্ড পর বুঝল, কেউ নেই ঘরে। লাথি মেরে খুলল বাথরুমের দরজা।

ওদিকে ওপরের ঘরে উঠে ডানদিকে ছুটল রানা। মোটেল তৈরির সময় অ্যাটিকে বসানো হয়নি দামি ফিটিং। মাঝেও নেই দেয়াল। একদৌড়ে দালানের আরেক মাথায় পৌঁছুল ও। জানা নেই নিচের ঘরে কী দেখবে। সাবধানে তুলল বৃত্তাকার হ্যাঁচ। নিঃশব্দে ভারী পাথরের মত খসে পড়ল নিচের অন্ধকারে।

ঘর খালি।

সরিয়ে রাখা হয়েছে জানালার পর্দা। বাইরে শেরিফ ডিপার্টমেন্টের গাড়িগুলোর উজ্জ্বল সাদা আলো। ঝরঝর ঝরছে তুষার। মুখ থেকে জ্যাকেট সরিয়ে গায়ে পরে নিল রানা, চলে গেল দরজার কাছে। কবাট এক ইঞ্চি ফাঁক করে উঁকি দিল বাইরে। সারি দেয়া পেছনের ঘরগুলোর কাছে অফিসাররা। বড় শহরের আইনরক্ষাকারী বিভাগের সোয়্যাট টিমের মত নয়। বাইরে তিনটে স্কোয়াড কার। দলে ডেপুটিরা বড়জোর দশ বা বারোজন। বেশিরভাগই গিয়ে ঢুকেছে রানা ও জুডির ছোট্ট ঘরে। মোটেলের বাইরে মাত্র দুজন। তাদের মাত্র একজনকে নিয়ে ভাবতে হবে, বুঝে গেল রানা। বেঁটে, মোটা লোকটার পরনে পুলিশ ইউনিফর্ম। দাঁড়িয়ে আছে শেরিফের গাড়ির পাশে।

আগে কখনও অস্টিন ম্যাকলাস্কিকে দেখেনি রানা, তার দৈহিক বর্ণনাও দেয়নি রিক বেণ্ডার, তবে পিপের মত বুকের লোকটাকে চিনতে দেরি হলো না ওর। এ ধরনের খুনি কাপুরুষ আগেও দেখেছে। গোলাগুলি হবে ভেবে পেছনে রয়ে যায় এরা। বিশেষ করে যখন বিপজ্জনক কাজে ঝাঁপ দেয়ার জন্যে রয়ে গেছে অধীনস্থ, নিরীহ কেউ।

ডেপুটিদের বুঝতে সময় লাগবে না কীভাবে বেরিয়ে গেছে রানা। দুমিনিট পরেই সার্চ শুরু করবে মোটেলের প্রতিটি ঘর। কাজেই উচিত সরে যাওয়া। পালিয়ে যাচ্ছে, তা নয়। তৈরি করবে কার্যকর প্ল্যান। এ মুহূর্তে কী করবে, স্থির করে নিল রানা। পরক্ষণে দরজা পেরিয়ে ছুটে গেল লবিতে। মেইন গেট পার হয়ে উড়ে চলল মোটা শেরিফকে লক্ষ্য করে।

জানালার দিকে চেয়ে আছে হোঁৎকা লোকটা। দেখছে না লবি থেকে উড়ে আসছে কে যেন। লম্বাটে চাঁদের মত চেহারা ম্যাকলাস্কির। সামান্য হাঁ হয়ে আছে মুখ। এই বুঝি ধরা পড়ল কালপ্রিট! ঊরুর পাশে রেখেছে রিভলভার। হয়তো প্রথম সুযোগেই খুন করবে রানাকে।

শেরিফ অপদার্থ হলেও চোখের কোণে ছুটন্ত রানাকে দেখেছে তার ডেপুটি, ঝট করে ঘুরে তাকাল সে। বিস্মিত, কেন হঠাৎ ছুটে আসছে লোকটা! তবে দুসেকেণ্ড পর তার চোখ পড়ল রানার হাতের উদ্যত দুই আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর। দেরি হলো না বিপদ বুঝতে। ঝট করে রানার দিকে শটগান ঘোরাল সে। কিন্তু ততক্ষণে তার গায়ের কাছে পৌঁছে গেছে। রানা, ওপরে তুলল ওয়ালথারের নল।

ডেপুটি ট্রিগার টেপার আগেই তার বুকে লাগল রানার গুলি। গাড়ির দরজার পেছনে পিছলে পড়ল সে। লোকটাকে খুন করতে চায় না, তাই জেনেবুঝেই বুলেটপ্রুফ ভেস্টে গুলি করেছে রানা। ঠিকই ঠেকিয়ে দিয়েছে কেভলার, কিন্তু বুকের ব্যথায় তার মনে হবে আকাশ ছুঁড়ে পৌঁছে গেছে নরকে।

গতি হ্রাস না করে কোনাকুনিভাবে শেরিফের দিকে ছুটছে রানা। ওকে দেখল লোকটা। ঘুরে ওপরে তুলছে রিভলভার। তার পরনেও কেভলার ভেস্ট। রানার মন চাইল মাথাটা উড়িয়ে দিতে। কিন্তু উচিত হবে না সেটা। তাকে জীবিত চাই ওর। মোটকু বলতে পারবে কোথায় আছে জুডি।

রানাকে খতম করতেই এখানে এসেছে ম্যাকলাস্কি, নিজে খুন হতে নয়। রিভলভার তুলেই গুলি পাঠাল সে। কিন্তু তার লাইন অভ ফায়ারের তলে রয়ে গেল রানা। শরীর পিছলে তুষারে পা হড়কে সরসর করে চলেছে শেরিফের দিকে। মুহূর্তে পেরোল দুজনের মাঝের দশ ফুট দূরত্ব। সরে না গিয়ে রানাকে ফুটো করতে চাইছে লোকটা। কিন্তু রানার ডান পা সোজা লাগল তার হাঁটুর নিচের হাড়ে।

রানার ওপর ধুপ করে পড়ল ভারী লোকটা। হাত থেকে ছুটে গেছে রিভলভার। শেরিফকে নিয়ে এক গড়া দিয়ে তার বুকে উঠে এল রানা। থলথলে মাংসে গেঁথে গেছে হাঁটু। লোকটার থুতনির নিচে ম্যাগনামের নলের খোঁচা দিল ও। অন্যহাতের ওয়ালথার তাক করেছে মোটেলের দিকে।

গুলির শব্দে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মোটেলের অফিসাররা। দৌড়ে উঠানে বেরোল এক অফিসার, মুখে মুখোশ। হাতে পাম্প-অ্যাকশন শটগান। ওটা তাক করল রানার দিকে।

ভাল লোক হোক বা মন্দ, তার গুলিতে মরতে আপত্তি আছে রানার। ওয়ালথার ঘুরিয়েই ডেপুটির বাম উরু ফুটো করল ও। করুণ আর্তনাদ ছেড়ে মাটিতে পড়ল লোকটা।

মোটেল থেকে কেউ বেরোলে খুন হবে! গলা ফাটিয়ে সতর্ক করল রানা। হুমকি হিসেবে জানালা দিয়ে পাঠিয়ে দিল দুটো গুলি। ছাতে গিয়ে লাগল ওগুলো।

অ্যাই, ওঠো! শেরিফ ম্যাকলাস্কিকে ধমক দিল রানা।

ধড়মড় করে উঠে বসল লোকটা। দুহাত তুলেছে মাথার ওপর। সাবধান, বাছা! গুলি কোরো না! আমার কাছে অস্ত্র নেই!

আমি তোমার বাছা নই! ওয়ালথার নেড়ে গাড়ি দেখাল রানা। ওঠো! ড্রাইভ করবে!

মস্তবড় ভুল করছ…

ম্যাগনাম রিভলভারের ব্যারেলের বাড়িতে লোকটার চোয়ালের মাংস ফাটিয়ে দিল রানা। একমাত্র ভুল হচ্ছে যে তোমাকে এখনও খুন করিনি। ড্রাইভিং সিটে ওঠো। নইলে ফুটো হবে মগজ।

দ্বিতীয়বার বলতে হলো না ম্যাকলাস্কিকে। লাফ দিয়ে উঠল ড্রাইভিং সিটে। এক সেকেণ্ড পর দরজা খুলে পেছনের সিটে চাপল রানা। শেরিফ আর ওর মাঝে স্টিলের জালের দেয়াল। কিন্তু ওটা ঠেকাতে পারবে না গুলি। রওনা হও! ধমক দিল রানা।

কোথায়? ব্যাক গিয়ার ফেলে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে এল ম্যাকলাস্কি।

বুকে গুলি খেয়েছে যে, এইমাত্র উঠে বসল সে-লোক।

রানা খুশি, আহত নয় ডেপুটি। আরেক ধমক দিল ম্যাকলাস্কিকে: গাড়ি নিয়ে রওনা হও। ভুলেও ফাঁদ পাতবে না। নইলে তোমার সামনে সত্যিকারের শেরিফের যা করেছিল বেণ্ডাররা, তেমনই কিছু করে ছাড়ব তোমার।

এ কথায় পুরু গর্দানটা কাঁধে ডেবে বসল ম্যাকলাস্কির।

হ্যাঁ, সবই জানি, বলল রানা। এ-ও অজানা নেই কী করছ ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে যোগ দিয়ে। পেছনের মোটেলে পার্কিং লটের দিকে ছুট দিয়েছে ডেপুটিরা। গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করবে। রেডিয়ো চালু করো, ম্যাকলাস্কি। ওদের বলে দাও যেন পিছু না নেয়। নইলে খুন হবে তুমি।

রেডিয়ো হাতে নিল ম্যাকলাস্কি। অনুসরণ করতে নিষেধ করল ডেপুটিদের। ঝড়ের গতি তুলে ছুটছে গাড়ি। পেছনের তুষার ঝড়টাকে যেন টেক্কা দেবে।

শহর থেকে বেরিয়ে যাও, নির্দেশ দিল রানা। 

যাব কোথায়?

 পছন্দমত জায়গা দেখলে বলব কোথায় থামতে হবে।

তারপর কী হবে? মেরে ফেলবে আমাকে?

এখনও জানি না। তবে আগে জানব কী করেছ জুডির। ওর ক্ষতি না হলে খুন তোমাকে না-ও করতে পারি।

ঈশ্বরের শপথ, ওর ক্ষতি করিনি। নিরাপদেই আছে।

সেক্ষেত্রে বেঁচেও যেতে পারো, বলল রানা, তবে তোমার বলতে হবে ও এখন কোথায়।

মিথ্যা বলব না। ও আছে এখন ময়নিহানের ওখানে।

জায়গাটা কোথায়?

 জানি না।

 দুবার ক্লিক-ক্লিক শব্দে কক হলো ম্যাগনামের হ্যামার।

মনে মনে কুঁকড়ে গেল ম্যাকুলাস্কি। ঈশ্বরের শপথ… যিশুর কসম… জানি না ওকে কোথায় নিয়ে গেছে সে।

ভেবে বের করো কোথায় থাকবে, স্টিলের জালে ম্যাগনামের নল দিয়ে খড়-খড় আওয়াজ তুলল রানা। তোমাকে থামতে বলার আগপর্যন্ত সময় পাচ্ছ। এমনিতেই বেঁচে আছ খামোকা। ঠিক তথ্য না দিলে ধরে নেব আর বাঁচার আগ্রহ নেই তোমার।

.

১৪.

 হারামজাদি কুত্তী! বল ওই শুয়োরের বাচ্চা কে! নইলে ভাবতেও পারবি না কী পরিমাণ ব্যথা পাবি!

বুলেটের ক্ষতে কোমর থেকে কাঁধ পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করা হয়েছে রিক বেণ্ডারের। দাঁত খিঁচিয়ে জুডিকে দেখছে সে।

জুডির মনে হচ্ছে সামনে হাজির হয়েছে রূপকথার ভয়ঙ্কর কোনও রাক্ষস। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঘরে ধাতব এক চেয়ারে বসে আছে ও। চেয়ারের পেছন পায়ে হ্যাণ্ডকাফে আটকে রাখা হয়েছে ওর হাতদুটো। কেড়ে নেয়া হয়েছে লিনেন জ্যাকেট। খানিকটা ছিঁড়ে গেছে ঘি রঙা ব্লাউস। দেখা যাচ্ছে ব্রা। পায়ে বুট নেই। খালি পা স্পর্শ করছে বরফ শীতল মেঝে। রিক বেণ্ডারের প্রতিটি কথায় শিউরে শিউরে উঠছে জুডি।

কে ওই কুত্তার বাচ্চা! আবারও জানতে চাইল রিক।

চোখে জেদ নিয়ে তার দিকে চেয়ে রইল জুডি।

চড়াৎ করে ওর গালে কষে একটা চড় দিল রিক। কড়া পড়ে যাওয়া হাতের আঘাতে প্রায় ফেটে গেছে জুডির গালের গোলাপি বৃক। ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেছে মাথা। আপাতত চোখের সামনে দেখছে ঝিলমিলে সব নক্ষত্র।

কে খুন করেছে আমার ভাইকে? আবারও হাত ওপরে তুলল রিক।

বাদ দাও, ডেস্ক ঘুরে এগিয়ে এল ন্যাশ ময়নিহান। তুমি তো দেখছি খুন করবে মেয়েটাকে!

হ্যাঁ, তা-ই করব, যদি মুখ না খোলে! বল, কুত্তী! আবারও উল্টো হাতের চড় দিল রিক।

এবার ঠোঁটের পাশে রক্ত বেরোলেও জোর খাঁটিয়ে মাথা উঁচু করে বসল জুডি। শক্ত মেয়ে, ভাল পুলিশ, তবুও মুখ থেকে বেরোল মৃদু গোঙানি।

যথেষ্ট হয়েছে, রিক!

ন্যাশ ময়নিহানের কথা না মেনে মুঠো করে জুডির চুল ধরল রিক। হ্যাঁচকা টানে আরেক দিকে সরিয়ে দিল মাথা। ডানহাত মুঠো করেছে ঘুষি মারতে। কিন্তু তার বাইসেপ চেপে ধরল ন্যাশ ময়নিহান। যথেষ্ট, রিক! এবার নরম সুরে বলেছে। হাত সামলে, নইলে ভাল হবে না।

অন্য কেউ গায়ে হাত দিলে মটমট করে তার আঙুল ভাঙত রিক বেণ্ডার, কিন্তু অন্য জিনিস ময়নিহান। আস্তে করে মাথা দোলাল রিক।

খুন করলে লাভ নেই, বলল ময়নিহান, তাতে ফিরবে না নিক।

না, তা ঠিক। কিন্তু রাগ কমবে আমার।

ছোটবেলা থেকেই হাজারবার ছোটভাইকে খুন করতে চেয়েছে সে। কীভাবে করবে রীতিমত গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছিল ওটা। কখনও ভাবত পাথর দিয়ে খুঁড়িয়ে দেবে ওর মাথা। কিন্তু বড় হওয়ার পর ভাবতে লাগল ঠিক কী অস্ত্র দিয়ে খতম করবে নিককে। বারবার ভেবেও স্থির করতে পারেনি খুনের সময় ছোরা, কুঠার বা রিভলভার কোটা ব্যবহার করবে। কিন্তু সত্যিই যখন ওকে ফেলে মরেই গেল নিক, ভীষণ খারাপ লাগল তার।

নিকের হাঁটু ফুটো করেছে বাদামি লোকটা। গলিয়ে দিয়েছে নীল চোখ। তারপর ফুটো করে দিয়েছে হৃৎপিণ্ড। গুলি যেখান দিয়ে বেরিয়েছে সেই গর্তে অনায়াসেই মুঠো ঢুকবে রিকের। কখনও ভাবেনি এভাবে শেষ হবে ওর ছোটভাই। জীবনের বড় আনন্দ ছিল, ভেবেছে কীভাবে খুন করবে নিককে। কিন্তু সেই আনন্দ থেকে ওকে বঞ্চিত করেছে বাদামি কুকুরের বাচ্চা। ঠিক সেজন্যেও নয়, অন্য কারণে শীতল রাগে কুত্তাপাগল হয়ে গেছে সে।

একটু পর পর খুন করতে চাইলেও সারাজীবনেও কখনও নিকের ক্ষতি করেনি রিক। কাউকে যদি সত্যিই ভালবেসে থাকে, সে মানুষ ওই নিক বেণ্ডার। রিক আর নিক যমজ ভাই, ছিল অদ্ভুত এক বাঁধন। হ্যাঁ, এটা ঠিক, ট্যাড়া ছিল নিক, মগজটাও ছিল বিকৃত, কিন্তু তবুও সে ছিল ওরই ছোটভাই। বড়ভাই হিসেবে ভেবেচিন্তে ওকে পরিচালনা করত সে। ওদের মা ছিল বাজে মেয়েলোক। সর্বক্ষণ মগজে খেলত কোথায় পাবে আরেকটা ড্রিঙ্ক। একদিন লিউইসভিলের পতিতালয়ে গিয়ে ভর্তি হলো সে। তারপর আর খোঁজ পাওয়া গেল না তার। আর বাবা? সে ছিল রাগী বাইসন। সুযোগ পেলেই পিটিয়ে খুন করতে চাইত ওদের দুভাইকে। তারপর একদিন ধর্ষণ করে দুই মহিলাকে মেরে ফেলল লোকটা। তখন চড়িয়ে দেয়া হলো ইলেকট্রিক চেয়ারে। খেল খতম। নানান এতিমখানায় কাটল কবছর। তারপর পালিয়ে গিয়ে অপরাধ জগতে ঠাই নিল রিক ও নিক। কিছু দিন পর ভরে দেয়া হলো কিশোর কারাগারে। এভাবেই বড় হয়েছে ওরা। বারবার গেছে জেলখানায়। তবে বছরের পর বছর ধরে ছোটভাই নিকের সব দায় ছিল রিকের কাঁধে।

এতদিন ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে রিক।

কিন্তু এবার আর পারেনি।

মেয়েটা বাঁচলে কাজে লাগবে, রিককে জানাল ময়নিহান, ওর মাধ্যমে পাওয়া যাবে নিনা ভেঞ্চুরাকে।

আমাদেরকে কিছুই বলবে না এই মেয়ে, বস্, জুডির চুল ছেড়ে দিল রিক।

বুকে নেমে গেল জুডির মাথা। মার খেয়ে এবং ভয়ে প্রায় অচেতন।

সত্যিই হয়তো কাজে আসবে না, বলল ময়নিহান। তবে হয়তো ওর কারণে গর্ত থেকে বেরোবে ওর বোন। রিকের সুস্থ কাঁধ চাপড়ে দিল টপ টেরর। তা ছাড়া, এর কারণে হাজির হবে ওই লোক। খুঁজতে যাব কেন, নিজে এসে আমাদের হাতে ধরা দেবে সে।

এই বেটি মরলে ভাল লাগবে আমার, জোর দিয়ে বলল রিক। পেছনে ঠেলে দিল জুডির মাথা। শক্ত করে ধরল বেচারির চোয়াল। 

এক পা সরে রিক ও জুডির মাঝে থামল ময়নিহান। বিরক্ত হয়ে সরে গেল দানব।

আগেই বলেছি, রিক, বাড়াবাড়ি নয়, আবারও বলল ময়নিহান। কণ্ঠস্বরে কী যেন। মুখে প্রকাশ না করেও বুঝিয়ে দিয়েছে, এরপর আর সাবধান করবে না সে।

বসের দিকে তাকাল রিক।

স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখছে ময়নিহান, ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি।

মানুষকে ব্যথা দিতে ওস্তাদ রিক।

 কিন্তু তার চেয়েও অনেক দক্ষ বস্ ন্যাশ ময়নিহান। এমনি এমনি ভূমিদস্যু হয়নি সে।

চোখ সরিয়ে নিল রিক। হাত বোলাল মাথার চুলে। হাতে লাগল কীসের ছোট্ট গুটলি। ওই রক্ত ওর না নিকের, ভাবল সে। বাদামি লোকটা খুনের সময় ওর ছোটভাইয়ের বুক থেকে ছিটকে উঠেছিল রক্ত। আবার এমনও হতে পারে লোকটা জঙ্গলে মাথা ফাটানোর সময় জমেছে রক্তের এই মার্বেল। করুণ অবস্থা ওর। এটা পিছিয়ে যাওয়ার ভাল অজুহাত। মুখ রক্ষা হবে তাতে। আমি চললাম, গোসল করতে হবে।

পিঠটান না দিয়ে উপায় নেই রিকের। ন্যাশ ময়নিহান সম্পর্কে যা শুনেছে, তার অর্ধেক সত্যি হলেও তা ভয়ঙ্কর আতঙ্কজনক। তা ছাড়া, ন্যাশ ময়নিহান আগেই ওর হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিলে উপায় থাকবে না বাদামি কুকুরটাকে খতম করার। দরজার দিকে রওনা হলো সে।

পেছন থেকে ওকে দেখছে ন্যাশ ময়নিহান। ঘর ছেড়ে দানবটা বিদায় নেয়ায় জুডির দিকে তাকাল সে।

চোখ তুলে তাকেই দেখছে মেয়েটা।

ময়নিহানের তালু থেকে কবজির খাপে সড়াৎ করে ফিরল ক্ষুর। ঠিক করে নিল ভারস্যাক সুটের হাতা। ঠোঁটে শীতল হাসি। জুডির চোখ দেখে বুঝল, বেচারি ভাবছে ভালই হত ঘরে রিক বেণ্ডার রয়ে গেলে।

.

১৫.

 আবারও বলছি… ভুলেও পিছু নেবে না, পুলিশ রেডিয়ো চ্যানেলে বলছে শেরিফ ম্যাকলাস্কি। আমাকে উদ্ধার করতে কোনও ধরনের চেষ্টা করবে না। নিজেই সমাধান করব এই সমস্যা। আবারও বলছি…

ডেপুটিরা হয়তো উল্টে ব্যস্ত হবে তাকে খুঁজতে। যোগাযোগ করবে স্টেট ট্রুপার ও ফ্র্যাঙ্কফোর্টের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে। বাদ পড়বে না এফবিআই ফিল্ড অফিস। ফলে কঠিন হবে জুডিকে উদ্ধার করা।

রানার পিস্তলের ভয় করছে না ম্যাকলাস্কি। তার মূল ভয় উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নেবে ডেপুটিরা। প্রথমে দলের সবাইকে পিছিয়ে যেতে বলেছে সে। এরপর শুরু করেছে হুমকি দিতে। খবরদার, পিছু নেবে না কেউ!

বেশিরভাগ পুলিশের গাড়িতে থাকে ট্র্যান্সপণ্ডার ও জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম, কিন্তু বাজেট নেই বলে ওগুলো ব্যবহার করে না লিটল ফোর্কের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুরু হয়েছে মাঝারি তুষারপাত। আকাশ থেকে চোখ রাখবে কপ্টার বা হালকা বিমান, তা হবে না। তবে রানাদের গাড়ি দেখে পুলিশে জানাতে পারে স্থানীয় কেউ। অবশ্য সে সম্ভাবনা কমই। আরও বাড়ছে তুষার ঝড়। শহর থেকে পাঁচ মাইল সরে এসেছে রানারা। এখন আছে খনি এলাকায়। দশ বছর আগে এখান থেকে তল্পি গুটিয়ে নিয়েছে শেষ খনি কোম্পানির মালিক।

পাহাড়ি এক তাকের নিচে অযত্নে পড়ে থাকা কাঠের কেবিন দেখে ওটার পাশেই গাড়ি রাখতে বলল রানা।

তুষারে ছাওয়া কেবিনের ছাত ও দেয়াল। পিস্তলের মুখে শেরিফকে কেবিনে ঢোকাল-রানা। আবছা আলোয় দেখল ভেতরে কটা ভাঙা চেয়ার ও একটা মাঝারি টেবিল। টেবিলের পাটাতনটা তুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল রানা। লাথি দিয়ে ভাঙল মাঝখান থেকে। দেয়ালে খাড়াভাবে রাখল দুই তক্তা। শেরিফের হাতদুটো তক্তার পেছনে নিয়ে আটকে দিল হ্যাণ্ডকাফে। রানা চলে যাওয়ার পর লোকটা পালাতে চাইলে সেটা কঠিন হবে তার জন্যে।

ওই তক্তা মেঝেতে পড়লেই গুলি করব তোমার বুকে, দুশ্চিন্তার ভেতর ম্যাকলাস্কিকে রাখতে চাইছে রানা।

তক্তা যেন কাত হয়ে পড়ে না যায়, সেজন্যে সাবধানে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়াল শেরিফ।

কোমরে ওয়ালথার খুঁজে হাতে রিকের ম্যাগনাম রিভলভারটা নিল রানা। চকচকে স্টিলের অস্ত্রটা দেখতে ভয়ঙ্কর।

এবার মুখ খোলো, ম্যাকলাস্কি। প্রমাণ করো তোমার জীবনের কোনও মূল্য আছে আমার কাছে।

আগেই বলেছি, জানি না মেয়েটা এখন কোথায়। নিয়ে তুলে দিয়েছি ন্যাশ ময়নিহানের হাতে। তারপর ওরা কোথায় গেছে, জানা নেই। তখন মোটেল থেকে খবর এল, তুমি ফিরেছ। তারপর দেরি না করে ওখানে গেলাম।

কোথায় পৌঁছে দিয়েছ মেয়েটাকে?

শহরে একটা রেস্তোরাঁ আছে, ওটার নাম…

ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁ? জুডির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছিল রানার। তখন বিষয়টি খুব গুরুত্ব দেয়নি। পুরনো মালিকের কাছ থেকে ওই রেস্তোরাঁ কিনেছে ন্যাশ ময়নিহান। লিটল ফোর্কের বহু সম্পত্তিই কিনছে সে। নিজের জন্যে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে ওই রেস্তোরাঁ।

হ্যাঁ… অবাক চোখে ওকে দেখল ম্যাকলাস্কি। ভিলাজ ও-সঁও।

জায়গাটা কোথায়?

এলাকাটা কোথায় তার বর্ণনা দিল ম্যাকলাস্কি।

ন্যাশ ময়নিহান। তার সম্পর্কে জানাও।

কী জানাব?

 প্রথমে বলো দেখতে কেমন সে।

যাতে চিনলেই খুন করতে পারো?

হয়তো।

পুলিশী বর্ণনা দিল ম্যাকলাস্কি: শ্বেতাঙ্গ, পুরুষ। লম্বায় তোমার সমানই। ওজন দু শ পাউণ্ড। অ্যাথলেটিক শরীর। বয়স পঞ্চাশ মত। মাথায় হেঁটে রাখা ধূসর চুল। খুব ভাল করে আঁচড়ানো। পরনে ডিযাইনার, সুট। বুঝতেই পারছ, টাকার অভাব নেই।

বুঝলাম। এবার এমন কিছু বলো, যেগুলো চট করে বোঝা যায় না।

যেমন? আসলে কী জানতে চাও?

কথা বললে গুলি খেয়ে মরবে না, সেটা মাথায় রাখো, ম্যাকলাস্কি, ম্যাগনামের নল দিয়ে শেরিফের বুকে মাঝারি এক খোঁচা দিল রানা।

ওর বক্তব্য বুঝতে পেরেছে লোকটা। আন্দাজ তিন বছর আগে এসেছে সে, সঙ্গে এনেছে প্রচুর টাকা। ভাল বিনিয়োগকারীদের মত কিনেছে শহরের এবং বাইরের অনেক জমি। এসেছে টেক্সাস থেকে। ওখানে তার বড় ব্যবসা আছে। 

কী ধরনের ব্যবসা?

উদাস হয়ে অন্যদিকে তাকাল ম্যাকলাস্কি।

 রানা কক করল ম্যাগনামের হ্যামার।

বুঝতেই পারছ কী ধরনের ব্যবসা।

 অর্গানাইযড ক্রাইম?

ওই ধরনেরই, ঠোঁট বাঁকা করল শেরিফ। জানোও না কীসে নাক খুঁজেছ। একা মানুষ। বোকার মত ভাবছ লড়বে ন্যাশ ময়নিহানের বিরুদ্ধে! ওর আণ্ডারে আছে অনেক গুণ্ডা।

যা দরকার, সেটা করব।

খুন হবে।

 হয়তো।

তাতে ভুল নেই। রাগ নিয়ে মাথা নাড়ল ম্যাকলাস্কি। শুনেছি অনেকেই চেয়েছে ওকে খুন করতে। কিন্তু কিছুই হয়নি তার। তবে যারা খুন করতে চেয়েছে, তারা এখন দুনিয়ায় নেই।

বাধ্য হয়ে আমারও অনেককে খুন করতে হয়েছে।

রাগের জায়গায় ম্যাকলাস্কির মুখে ফুটল ভয়। তবুও বলল, তোমার উচিত ন্যাশ ময়নিহানের কথা ভুলে যাওয়া। মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাও। ভাল হবে তোমার।

আগে চাই জুডিকে, বলল রানা, আপাতত কতজন লোক আছে ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে?

স্থানীয় ছোকরা? আট-দশজন। নাক দিয়ে ঘোঁৎ শব্দ করল শেরিফ। তুমি আসার আগে ছিল বারো-চোদ্দজন।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। তা ঠিক।

কিন্তু এরা পাতি মস্তান। এবার তোমাকে খতম করতে বাইরে থেকে তোক আনছে সে। তারা হবে অন্যরকম।

বেশ্যার ভাইদের মত? বেণ্ডাররা? ওরা কিছুই না। এবার আসবে একদল আসল খুনি। তাদের কাছে বেণ্ডাররা দুধের শিশু।

বেণ্ডারদের নিক আর নেই, বলল রানা।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল শেরিফের। ফাঁক হতেই লালা দেখা গেল ঠোঁটের কশে। খুন করেছ নিক বেণ্ডারকে? হায়, ঈশ্বর! এবার…।

আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। পাহাড়েও চেষ্টা করেছে কজন। এমনকী তুমিও চেষ্টার ত্রুটি করোনি। ম্যাকলাস্কির ফোলা বুকে ম্যাগনামের নল দিয়ে হালকা একটা খোঁচা দিল রানা। হ্যাঁ, তুমিও!

খুন করে দায় এড়াতে চাইছ? মাথা নাড়ল শেরিফ। হয়তো উপায় আছে তোমাকে সাহায্য করার। একটা চুক্তি করতে পারি আমরা। …তুমি কী বলে?

আমি কোনও দায় এড়াচ্ছি না, ম্যাকলাস্কি। কথাগুলো বলেছি তোমাকে অবস্থার গুরুত্ব বোঝাতে। লোকটার পেটে নল দিয়ে গুতো দিল রানা। যাতে বুঝতে পারো, হাল ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে আসিনি আমি। কথাটা বুঝতে পেরেছ?

ভুরু কুঁচকে মেঝে দেখল ম্যাকলাস্কি। হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।

কাজেই সময় নষ্ট না করে বলতে থাকো ময়নিহানের ব্যাপারে।

তুমি তো এমনিতেই আমাকে খুন করবে, কর্কশ স্বরে ফিসফিস করল ম্যাকলাস্কি। তা হলে মুখ খুলে লাভ কী?

সহজে মরার পথ আছে, আবার আছে কঠিন উপায়ও, যখন মনে হবে মরে গেলেই ভাল হতো, বলল রানা। রিক বেণ্ডার বলেছে কীভাবে খুন করেছ তোমরা শেরিফ ফ্র্যাঙ্ক। ম্যালভিকে। আমি হয়তো তোমার ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি কিছু করতে চাইব।

ফ্র্যাঙ্কের খুনের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

তাকে বাঁচাবার কোনও চেষ্টাই করোনি তুমি। এটাও সমান অপরাধ। তুমি খুনির সহযোগী, মাফ পাবে না আদালতে।

নিজ দোষে মরেছে ফ্র্যাঙ্ক, বুকের কাছে ঝুলে গেছে ম্যাকলাস্কির থুতনি। বুঝতে পারছে, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে লাভ নেই। যদি আমাদের মত টাকা নিয়ে মুখ বুজে থাকত, বা টাকা নিয়ে চলে যেত, কিছুই হতো না ওর। ময়নিহানের কথা শুনল না সে।

ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভি চায়নি শহরে অপরাধের রাজত্ব তৈরি করুক ময়নিহান। নিজ দায়িত্ব পালন করছিল সে। ওই একই দায়িত্ব তোমারও।

তুমি প্রায় কিছুই জানে না।

কী জানি না?

একটা চুক্তি করেছে ন্যাশ ময়নিহান আর জাজ হোল্ড।

বিচারক জড়িয়ে গেছে অপরাধে?

হ্যাঁ। জাজ এসবে জড়িয়ে না গেলে একা কিছুই করতে পারত না ময়নিহান।

ওদের চুক্তিটা কীসের, খুলে বলো।

শহরে বিনিয়োগ করতে লাগল ময়নিহান। তারপর টুরিযমের জন্যে সাড়া পড়তেই নিজেই কিনতে লাগল শহরে জমি আর বাড়ি। প্রতিযোগিতা করতে আসেনি কেউ। যে সম্পত্তি পছন্দ করেছে ময়নিহান; রাবার স্ট্যাম্পে সই করে সেটা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জাজ হোল্ড। নিজেরা নিয়েছে সেরা দর্শনীয় সব জায়গা। পরে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করবে। কিন্তু এসব টের পেয়ে গেল শেরিফ ম্যালভি। জাজ হোল্ড আর ময়নিহানকে হুমকি দিল, জেলের রুটি খাইয়ে ছাড়বে সে।

তদন্ত করতে শুরু করেছিল?

নাক দিয়ে আবারও ঘোৎ আওয়াজ করল ম্যাকলাস্কি। কীসের তদন্ত! সে ব্ল্যাকমেইল করছিল ওদেরকে।

জাজ ও ময়নিহানের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইল, যাতে টাকা বা সম্পত্তির ভাগ পায়?

তার দাবি ছিল নগদ টাকার। সেসব দেবে বলল ওরা। ম্যালভি বলেছিল দূরে কোথাও চলে যাবে।

কিন্তু তাকে বাঁচতে দিল না ময়নিহান। টাকা দেয়ার বদলে দুই বেণ্ডার আর তোমাকে পাঠাল খুন করতে।

না, ভুল ভাবছ। চুক্তি মত টাকা দিয়েছিল ময়নিহান। যাতে ম্যালভি চলে যায়। কিন্তু বোকা শুয়োরের মত লোভী হয়ে উঠল ম্যালভি। শেরিফ হিসেবে এসবে গলাতে গেল নিজের নাক। যাতে আরও টাকা আদায় করতে পারে। হয়তো ভেবেছিল হুমকি দিয়ে ওদেরকে কাত করে দেবে। এরপরই ম্যালভির সঙ্গে কথা বলতে গেল বেণ্ডাররা।

এই চুক্তি থেকে তুমি নিজে কী পাচ্ছ?

হোয়াইট র‍্যাপিডে পারিবারিক জমি আছে, সেজন্যে ভাল টাকা দিচ্ছে ময়নিহান। বাঁকা হয়ে বেকায়দাভাবে কাঁধ ঝকাল ম্যাকলাস্কি। তা ছাড়া, ম্যালভি পথ থেকে সরে যাওয়ায় আমাকে দেয়া হয়েছে শেরিফের পদ।

অর্থাৎ, সবই করা হচ্ছে টাকার জন্যে?

শুধু তা নয়, প্রায় ফিসফিস করল ম্যাকলাস্কি, আমার স্ত্রী বা ছেলেটা বাঁচবে না ময়নিহানের কথামত না চললে। আমার ছেলের বয়স মাত্র বারো বছর। মাঝে মাঝেই ময়নিহান জিজ্ঞেস করে, ওরা কেমন আছে। আসলে বুঝিয়ে দেয়, তেড়িবেড়ি করলে দুনিয়ায় রাখবে না ওদেরকে।

চুপ করে রানার দিকে চেয়ে রইল লোকটা! নীরবতা নেমেছে কেবিনে।

তুমি তো পুলিশ অফিসার, হুমকি দেয়া হচ্ছে জানাতে পারতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। তা করোনি কেন?

ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির কাছে যাব? মুখের ওপর হাসত। আমাদের মতই সমান দুর্নীতিপরায়ণ ছিল সে।

ছোট শহরের রাজনীতি, অবল রানা। এসবে জড়িয়ে গিয়ে বিরক্তি বোধ করছে এখন। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, তার মানে, শেরিফের কাছে গেলে লাভ হতো না। ময়নিহানের মতই অপরাধে নাক ডুবিয়ে রেখেছে জাজ হোল্ড। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে সাহায্য চাইলে না কেন? বসে থাকত না এফবিআই।

কিন্তু তারা আসার আগেই মরত আমার স্ত্রী ও ছেলে। চাইনি বাড়ি ফিরে ওদের গলা কাটা লাশ দেখতে।

আরও বাড়ছে তুষার ঝড়ের প্রকোপ। বরফের মত ঠাণ্ডা হাওয়ার তোড়ে ধুপ-ধাপ শব্দে বাড়ি খাচ্ছে ভাঙা জানালার কবাট। ম্যাকলাস্কির জন্যে মনে করুণা এল না রানার। লোকটা সত্যিকারের কাপুরুষ। কোনও চেষ্টা বা প্রতিরোধ না করেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতাকে। সাধারণ মানুষ উপায় না পেলে ভেগে যেত স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। বা, গেঁথে দিত ময়নিহানের মগজে বুলেট। না, আসলে পয়সার লোভ পেয়ে বসেছে একে। জমি বিক্রি করে পাবে লাখ লাখ ডলার। এমন এক লোক, যে কি না নিজ বিপদ দেখলে শত্রুর হাতে তুলে দেবে স্ত্রী-পুত্রকে। অন্যরা মরলে মরুক, যেন ফুলের টোকাও না দেয়া হয় তার গায়ে।

নিনা ভেঞ্চুরা সম্পর্কে বলো, বলল রানা। ওর পেছনে লেগেছে ময়নিহান। কেন? শেরিফ ম্যালভির মৃত্যুর সময় সব দেখে ফেলে, ঠিক?

হ্যাঁ, ওখানেই ছিল। কিন্তু শুধু সেজন্যে তাকে খুঁজছে না।

ভুরু কুঁচকে ম্যাকলাস্কিকে দেখল রানা।

মুখ তুলে ওকে দেখছে লোকটা। রানা অনেক কিছুই জানে না বুঝে খুশিতে চকচক করছে চোখ। মাথা নাড়ল। ভেবেছিলে সবই জেনে গেছ, তাই না? তা নয়, পুরো ঘটনার অর্ধেকও বুঝতে পারোনি এখনও।

কড়া চোখে তাকে দেখল রানা। তুমি জানাবে বলে অপেক্ষা করছি।

তুমি তো চিনতে ওই মেয়েলোকটাকে, ঠিক? জানো ডিভোর্স হওয়ার পর কী হয়েছে?

চুপ করে আছে রানা।

 নতুন নাগর জুটিয়ে নিয়েছিল।

সে-লোক বোধহয় ময়নিহান নয়? জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল ম্যাকলাস্কি। ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভি। ময়নিহান বা আমাদেরকে ব্ল্যাকমেইলিঙের সময় তাকে সাহায্য করেছে নিনা ভেঞ্চুরা।

হতবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল বিস্মিত রানা।

এখনও চাইছে ব্ল্যাকমেইল করতে। তার চাই কমপক্ষে দুই মিলিয়ন ডলার।

.

১৬.

 আবার শেরিফের গাড়িতে চাপল রানা বিশ মিনিট পর। এখন সঙ্গে নেই অস্টিন ম্যাকলাস্কি। তার কথা শুনে চমকে গেছে ও। লিটল ফোর্কের দিকে রওনা হয়ে ভাবছে।

জানত না নিরপরাধ নয় নিনা ভেঞ্চুরা। ওর ধারণা হয়েছিল, বিপজ্জনক ক্রিমিনালদের এড়াতে প্রাণ ভয়ে লুকিয়ে আছে সে। কিন্তু ওই মহিলা এ শহরের অন্য ক্রিমিনালদের মতই। ঘটনা শুরু হয়েছিল ভিলাজ-ও-সঁওর ছোট এক কাজ হাতে নিয়ে, তারপর একসময়ে নিনা ভেঞ্চুরা জানল অপরাধে জড়িয়ে গেছে জাজ হোল্ড ও ন্যাশ ময়নিহান। আইনের সহায়তা না নিয়ে ওই গোপন তথ্য ব্যবহার করতে গিয়ে জড়িয়ে নিল নিজের নতুন প্রেমিক শেরিফ ম্যালভিকে। তারা ঠিক করল, এই সুযোগে হাতিয়ে নেবে অনেক টাকা। ময়নিহান জানত না এসবে জড়িয়ে গেছে নিনা। সে চিরকালের জন্যে বন্ধ করল শেরিফ ম্যালভির মুখ। এরপর নিজেই নিনা চেয়ে বসল বিশাল অঙ্কের টাকা। বিশ হাজার ডলার চেয়েছিল শেরিফ ম্যালভি। নিনা চাইল দুমিলিয়ন ডলার। চাহিদা পূরণ করলে চলে যাবে এ শহর ছেড়ে। কিন্তু যদি দেয়া না হয়, সব প্রমাণ তুলে দেবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের হাতে। স্বাভাবিকভাবেই বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা নিনার কারণে হাতছাড়া করতে চাইল না ময়নিহান।

তিক্ত হয়ে গেছে রানার মন। এসেছিল অসহায় এক মহিলার হয়ে লড়তে। আগে যদি জানত এখানে কী হচ্ছে, ভুলেও আঙুল নাড়ত না। এমন নয় মহিলার ক্ষতি হোক তা চাইত, কিন্তু দেখত গোটা ব্যাপারটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে।

এসেছে জুডির কথায়। এজন্যেই বুকের ভেতর অস্বস্তি। জানতে হবে কতটুকু জানে মেয়েটা।

এখানে যা ঘটেছে, সেটা কি আগেই জানত জুডি?

হয়তো জানত বহু কিছুই। আর তাই পুলিশের সাহায্য না নিয়ে গেছে ওর কাছে। সেক্ষেত্রে গোপন করেছে জরুরি তথ্য। এ-ও জানত, মুখোমুখি হবে বিপজ্জনক লোকদের, তাই জড়িয়ে নিয়েছে ওকে।

রানাকে ব্যবহার করেছে জুডি?

অপরূপ মুখ দেখে রানার হুঁশ ছিল না, ওর দিকেই তাক করা হচ্ছে গুলি ভরা পিস্তল।

প্রতিটি তথ্য এখন চোখের সামনে পরিষ্কার।

তবে ওর নিজের যুক্তির মাঝেও রয়েছে বড় গলদ।

বড়বোনের ধনী হওয়ার পরিকল্পনায় জড়িত হলে জুডির কীসের ঠেকা পড়েছিল খুঁজতে আসার?

ওর মোবাইল ফোন প্রমাণ করছে গত চারদিনে বহুবার কল করেছে বোনকে। জুডি, ব্ল্যাকমেইলের সঙ্গে জড়িত হলে ভাল করেই জানত কারা বোনের শত্রু। সেক্ষেত্রে ভুলেও ফোন দিত না অস্টিন ম্যাকলাস্কিকে।

সব তথ্য রানাকে দেয়নি জুডি। আবার এ-ও ঠিক, জানত না কীসে জড়িয়ে গেছে ওর বড়বোন। কিছুই না বুঝে পা দিয়েছে ময়নিহানের পাতা ফাঁদে। এবার ওকে ব্যবহার করে নিনাকে আড়াল থেকে বেরোতে বাধ্য করবে লোকটা।

মস্তবড় বিপদে আছে মাইকের দুই বোনই।

প্রথম কাজ জুডিকে এ শহর থেকে সরিয়ে দেয়া, ভাবছে রানা। ম্যাকলাস্কি বলেছে, রেস্তোরাঁয় নিয়ে মেয়েটাকে তুলে দিয়েছে ময়নিহানের হাতে। খুঁজতে হলে প্রথমেই যাওয়া উচিত ওখানে।

প্রবল ঝড়ের প্রকোপে অ্যাপলেচিয়ার এদিকে জমছে প্রচুর তুষার। ঝামেলা ছাড়াই শেরিফের গাড়িতে চেপে শহরে পৌঁছে গেল রানা। অবশ্য, প্রথম বাড়িটা চোখে পড়তেই গভীর এক নালায় নামাল গাড়ি। ওটা দেখা যাবে না রাস্তা থেকে।

হেঁটে শহরে ঢুকল রানা। এবার চাই আরেকটা গাড়ি। জানা আছে, কোথায় পাবে ওই জিনিস।

পৌঁছে গেল রানা লুকিয়ে রাখা বাইসন গাড়িটার কাছে। রিক বেণ্ডার অন্যান্য কাজে ব্যস্ত, তাই ওটা খুঁজতে বেরোবার সময় পায়নি। সামনের চাকার ওপরই পেল চাবি। ইঞ্জিন চালু করে ওয়াইপার দিয়ে পরিষ্কার করল তুষার ভরা উইণ্ডস্ক্রিন। গাছের জটলা থেকে বেরিয়ে ফিরল শেরিফের গাড়ির কাছে। তুষারে আর কোনও গাড়ির চাকার চিহ্ন নেই। শেরিফের গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে তাড়া দিল রানা, ভাবছ হাইপোথারমিয়ায় মরবে? নাও, বেরোও! 

ট্রাঙ্ক থেকে চোখ পিটপিট করে ওকে দেখছে শেরিফ। শার্ট পেঁচিয়ে তার মুখ বেঁধেছে রানা। বাকি আছে শুধু চোখদুটো। শার্টের বাঁধন খুলল ও।

কী যেন বলল লোকটা, কিন্তু মুখে রুমাল আছে বলে জাবড়ে গেল কথা।

বগলে হাত ভরে তাকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল রানা। খিচ ধরেছে ছোট জায়গায় বন্দি হয়ে টলে পড়ছিল লোকটা। কাঁধ ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল রানা। একমিনিট পর ঠেলে নিয়ে তুলল বাইসন গাড়িতে। পকেট থেকে নিল চাবি। খুলে দিল হ্যাণ্ডকাফের একটা কড়া। চট করে ওটা আটকে দিল প্যাসেঞ্জার সিটের পাশের হাতলে। নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠে বলল, হয়তো ভাবছ লোকটা কী করছে, তাই না?

স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখল ম্যাকলাস্কি।

আগেই বলেছি, তুমি কাজে না এলে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম অন্য কাজে আসবে। ট্রাক চালু করে আবারও শহরের কেন্দ্রের দিকে চলল রানা।

.

লিটল ফোর্কের প্রধান সড়কে ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁ ভিলাজ-ও-সঁও। নিচতলায় লোভনীয় খাবারের ডাইনিং রুম। ওপরের দোতলা ও তৃতীয়তলায় ন্যাশ ময়নিহানের অফিস। ঝড়ের কারণে আপাতত বন্ধ রেস্তোরাঁ। শহরের প্রায় সবাই ফিরেছে যে-যার বাড়িতে, রাস্তা জনশূন্য। দোতলা অন্ধকার হলেও তৃতীয়তলায় শাটারের ওদিকে রয়েছে আলো।

ময়নিহানের অফিস কয়তলায়? জিজ্ঞেস করল রানা।

থুতনি বাঁকা করে তৃতীয়তলা দেখিয়ে দিল ম্যাকলাস্কি।

নিচতলায় বারো ফুট উঁচু কাঁচের তৈরি চওড়া দরজা। দালানের সামনে রয়েছে টিনটেড কাঁচের দেয়াল। বাইরে থেকে গরিব-গুরবো কেউ দেখতে পাবে না কী দারুণ খাবার সাঁটাচ্ছে বড়লোক খদ্দেররা। সদর দরজাটা আরেকবার দেখল রানা।

না, ওই পথে ঢুকবে না ও।

গাড়ি নিয়ে প্রধান সড়ক থেকে বামের গলিতে ঢুকল রানা। কিছুটা দূরে ইন্টারসেকশন। ভিলাজ-ও-সঁওর পেছনে সরু গলি পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তায় গাড়ি রাখল রানা। চোখ রেখেছে রেস্তোরাঁর ওপর। এদিকের রাস্তায় সাধারণ সব দোকান, কয়েকটা বার ও রেস্তোরাঁ। এরা ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁর মত জমজমাট ব্যবসা করে না। পথের শেষমাথায় সেভেন-ইলেভেন থেকে বেরোচ্ছে আলো। তুষার ঝড়ের জন্যে ওটা ছাড়া বন্ধ হয়েছে সব দোকান। রাস্তায় একজন পথচারীও নেই।

হাতঘড়ি দেখল রানা।

একটু পর বন্ধ হবে সেভেন-ইলেভেন দোকানও।

রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা ময়নিহানের অপরাধে জড়িত? জানতে চাইল রানা।

মুখে রুমাল, বিড়বিড় করে কী যেন বলল ম্যাকলাস্কি। তার মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে নিল রানা। তাতে বার কয়েক চোয়াল এদিক-ওদিক নাড়ল লোকটা। জবাব দিতেই হবে বুঝে বলল, তারা স্থানীয় সাধারণ মানুষ। অল্প বেতন পায়। মালিক কী করছে জানলেও নাক গলাবে না।

তাদের কেউ ভেতরে থাকতে পারে?

এত রাতে? না। তা ছাড়া, আলো নেই কিচেনে। নিচতলার সরু এক জানালা দেখাল ম্যাকলাস্কি।

হুম।

ভেতরে ঢুকবে ভাবছ?

ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে কারা আছে?

জানি না। নিক… ও… মানে রিক থাকতে পারে। এ ছাড়া দুচারজন পাতি মস্তান।

পাহাড়ে জুডি আর আমার ওপর যারা হামলা করেছিল, তারা নেই ভেতরে?

অনেক আগেই বাড়ি ফিরেছে। এতক্ষণে মরা বন্ধুদের শোকে বিয়ার গিলছে।

গম্ভীর হয়ে গেল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল ম্যাকলাস্কি, তা দুঃখপ্রকাশের জন্যে নয়।

তুমি বলেছিলে মনিহান আঁরও লোক আনছে। তারা কি ভেতরে আছে?

হয়তো, ঠোঁট চাটল ম্যাকলাস্কি।

রানা বুঝে গেল মিথ্যা বলছে সে। একটু সরে তার মুখে আবারও গুজল ভেজা রুমাল। কথা বলা সময় নষ্ট।

দুএক মিনিটের জন্যে দূরে গেলে ঝামেলা করবে না তো? নির্মল হাসল রানা।

আগ্রহ নিয়ে বারকয়েক মাথা ঝাঁকাল শেরিফ।

মাথা নাড়ল রানা। কিন্তু আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করি না? ওর ডানহাতি ঘুষি পড়ল ম্যাকলাস্কির চোয়ালে। ভালভাবে ব্যথা বোঝার আগেই জ্ঞান হারাল লোকটা। বুকে নেমে এল থুতনি। ভেস-ভোস শব্দে ডাকছে লালচে নাক।

জুডির মোবাইল ফোন বের করে কললিস্ট থেকে নির্দিষ্ট নম্বরে কল দিল রানা।

ওদিক থেকে রিসিভ করল জন হার্বার্ট। জুডি?

না, আমি, রানা।

জুডির ফোন তোর কাছে কেন?

পরে সব বলব। সংক্ষেপে পরিস্থিতি জানাল রানা। শেষে বলল, বদমাশটার হাত থেকে ছুটিয়ে নিতে হবে জুডিকে।

আমার মালপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি। পৌঁছে যাব কয়েক ঘণ্টার ভেতর। একটু অপেক্ষা কর।

না, আগে জেলে পুরে নে টম কোয়োর্ককে।

আদালত ওকে ছেড়ে দিলেও আবার বাগে পাব। তোর ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস। একা তুই এতজনের বিরুদ্ধে…

মাথা ঠাণ্ডা রেখে শেষ কর নিজের কাজ, বলল রানা।

পরেও কোয়র্কের বারোটা বাজাতে পারব। অপেক্ষা কর। তিন বা চারঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল জন, কিন্তু বাধা দিল রানা।

সে-সময় আমার হাতে নেই, জন। ময়নিহান কোথাও সরিয়ে ফেলতে পারে জুডিকে। ঘড়-ঘড় শব্দে নাক ডেকে নড়ে উঠল ম্যাকলাস্কি। জেগে উঠছে। চোখ খুলেই জুলজুল করে চাইল রানার দিকে। একমিনিট, জন।

ফোলা চোয়ালে কঠিন আরেকটা ঘুষি মেরে লোকটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল রানা। নরম সুরে বলল, আপাতত তোর আসতে হবে না। তবে আমার চাই জরুরি কিছু তথ্য।

বল কী জানতে চাস।

এ শহরের হেডম্যান এক লোক, নাম ন্যাশ ময়নিহান। ডালাস থেকে এসেছে। ওখানে অর্গানাইড় ক্রাইমের চিফ। জানাবি কত বড় চাই আর মেশে কাদের সঙ্গে।

ঠিক আছে। এখনও জানতে চাস ডজ র‍্যামের মালিক কে?

রিক বেন্ডার?

হ্যাঁ। ব্যাটা ভয়ঙ্কর হারামি, রানা। দুই যমজ তারা। অন্য ভাই নিক বেণ্ডার। ওটা আরও খারাপ।

নিক আর আসবে না।

কোথায় গেছে?

সংক্ষেপে ওঅর্কশপের লড়াইয়ের বর্ণনা দিল রানা।

সব শুনে আঁৎকে উঠল জন, সর্বনাশ, রানা! তুই দেখি খুন হয়ে আমাকে এতিম করবি! আবার খুঁজতে হবে চাকরি!

মৃদু হাসল রানা। জায়গাটা সুবিধের নয়, তবুও আসতে চাস?

আবার জিগায়! পরের ফ্লাইটেই! 

তা হলে এয়ারপোর্ট নেমে ফোন দিস।

দেব, বাপ, কিন্তু দেখিস ফোনটা যেন ধরতে পারিস, বলল জন, অন্তত সেই পর্যন্ত টিকে থাকিস।

প্রিয় বন্ধু দুশ্চিন্তা করছে বুঝে গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা, আপাতত ঠিক করেছি মরব না।

জন হার্বার্ট ওর ঘনিষ্ঠ বুন্ধুদের একজন, ভাইয়ের মতই। একে অপরের জন্যে মরতেও দ্বিধা করবে না ওরা।

ধমক দিল জন, চাপা বনধ! কাজে নামছি!

কল কেটে পকেটে ফোন রাখল রানা।

নিভে গেছে সেভেন-ইলেভেনের বাতি। কুঁজো, বয়স্ক এক লোক বাড়ি ফিরছে তুষার ঝড় ঠেলে। সে যাওয়ায় আশপাশে রইল না আর কেউ।

ডজ গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল রানা। কষে ঠা-ঠাস্ করে গালে কটা চড় মেরে স্বপ্নের মায়াবী, রঙিন জগৎ থেকে ডাউনলোড করল শেরিফ ম্যাকলাস্কিকে। মিষ্টি স্বরে বলল, ওঠো, বাবু সোনা! দেখি তো তুমি কতটা ভাল!

.

১৭.

মাতাল হলে চূড়ান্ত বদ হয়ে ওঠে রিক বেণ্ডার। বিশেষ করে উইস্কি তাকে করে ফেলে সত্যিকারের হিংস্র পশু এ কারণে গত বারো বছর অ্যালকোহল ছুঁয়ে দেখেনি। শেষবার গিলেছিল এক পাইন্ট জে.ডি। সেসময় নিক আর সে মিলে চুরমার করে ছয়টি বার। হাসপাতালে ভর্তি হয় নয়জন লোক। তাদের একজন আর কখনও হাঁটতে পারবে না। আরেকজন ছয় মাস নাক দিয়ে খেয়েছে তরল খাবার। চুরচুর হওয়ায় চোয়ালটা মেরামত করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিল একদল ডাক্তার। মেডিকেল রিটায়ারমেন্টে যায় যুবক এক পুলিশ অফিসার। কখনও বাবা হবে না সে। এক লাথিতে তার প্রিয় থলেটা ফাটিয়ে দিয়েছিল রিক। এসব করার জন্যে নিক আর ওকে আঠারো মাস সাজা দেয়া হয় এডিভিলের রাষ্ট্রীয় কারাগারে।

মদের জন্যে বন্দি হয়েছিল ওরা। ওই একই জিনিস খুন করেছে ওর বাবাকে। তাই আর কখনও মদ ছুঁয়ে দেখেনি রিক।

প্রিয় ভাইয়ের স্মৃতি রোমন্থন থেকে বাঁচতেই আজ গিলতে বসেছে সে। তরল গরল রাগিয়ে তুলছে তাকে। প্রথম পনেরো মিনিটে গিলেছে ছয় পেগ উইস্কি। আধঘণ্টা পর বোতল তুলে গলায় ঢেলেছে আরও দুপেগ। তারপর গুলিয়ে গেছে সব হিসাব। মনে নেই পেটে গেছে মোট কয় আউন্স।

আরও দুই আঙুল পরিমাণের উইস্কি গলায় চালান দিল রিক। ওই পরিমাণ শুনলে যে-কেউ বলবে, ওটা বেশি নয়। কিন্তু সাধারণ নয় রিকের আঙুল। একেকটা সাগরকলা সাইযের। হাতের দিকে তাকাল রিক। ভাবতে লাগল, শালা, পারলাম না কুত্তাটার গলা ছিঁড়ে নিতে? মাথাটা ছিঁড়ে নিলে এখনও বেঁচে থাকত নিক! আমি কী করলাম? পালিয়ে গেলাম! আমি শালা দেখছি পুরোপচা বাতিল মাল!

কাউন্টারে গ্লাস রাখল রিক। তুলে নিল ইমপোর্ট করা অ্যাবেরলৌর স্কচ উইস্কির বোতল। চোখের সামনে নিয়ে দেখল ওটাও খালি। একেক বোতলের দাম আশি ডলার। তাতে ক্ষতি নেই। শেরিফকে খুনের জন্যে নিকের প্রাপ্য টাকা থেকে কেটে নেবে ময়নিহান। বারের পেছন থেকে নতুন বোতল নিতে ঝুঁকল সে। বিলাসবহুল বার। চকচক করছে বার কাউন্টারের পালিশ করা ওয়ালনাট। কোনও দাগ নেই। তরুণ বয়সে যেসব বারে চুকত ওরা, তেমন নয়। তাকের ব্র্যাণ্ড বেশিরভাগই চিনল না রিক। শালার হয়েছেটা কী কুত্তার বাচ্চাগুলোর, রাখে না কেন কেন্টাকি সাওয়ার ম্যাশ?

একটা বোতল ওয়ালনাট কাউন্টার থেকে নেবে রিক, তখনই শুনল ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ।

কান ভনভন করছে অ্যাবেরলৌরের নেশায়।

তবুও চিনল ওই শব্দ।

দ্য বাইসন!

ওদের গাড়ি!

ঘাড় কাত করে বারকাউন্টারের ওদিকে তাকাল রিক। আওয়াজ আসছে রেস্তোরাঁর দিকেই। বিশেষ কোটিং করা জানালার কাঁচের ওদিকে অত্যুজ্জ্বল আলো!

আরও বাড়ল ইঞ্জিনের গর্জন!

শালা করেটা কী?

পরক্ষণে দরজা-জানালা ভেঙে ঢুকল ডজ। নানাদিকে ছিটকে গেল কাঁচের হাজারো টুকরো। জোর গুঁতো খেয়ে সূরছে চেয়ার, টেবিল ও ফুলের টব! আসবাবপত্র ঠেকাতে পারল না দানবীয় ট্রাকটাকে। প্রকাণ্ড চাকার নিচে চাপা পড়ছে। বা ঠেলা খেয়ে ছিটকে যাচ্ছে সব।

গোঁ-গোঁ আওয়াজে তেড়ে এল ঠিক রিকের দিকেই!

টরর হয়ে আছে রিক। উঠে দাঁড়াতে কুঁজো হলো। বুঝল ডানে নাকি বামে ঝাঁপ দেবে। হতবাক হয়ে দেখছে ছুটন্ত যান্ত্রিক দানব! ক্যাবের ওপরে লাগানো চোখ ধাঁধানো সাদা আলো পড়ছে তার চোখে। ঝট করে হাত বাড়িয়ে দিল রিক। কিন্তু এত শক্তি নেই যে ঠেকাবে প্রকাণ্ড ট্রাক। মড়মড় শব্দে ওয়ালনাটের বার উপড়ে নিল ওটা। হুড়মুড় করে পেছন দেয়ালে গিয়ে পড়ল ভারী কাউন্টার। শত বোতলের ভাঙা কাঁচের মধ্যে কী যেন চেপে বসল রিকের ওপর। ভালমত কিছু বুঝবার আগেই জ্ঞান হারাল সে।

.

১৮.

 আজ মানব-হত্যা করেছে মাসুদ রানা। অস্ত্রের মুখে বন্দি করেছিল দানবীয় দুই লোককে। বাধ্য হয়ে খুন করেছে। তাদের একজনকে। মোটেলে ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছে পুলিশের লোক। তাই তাদের দিকে গুলি ছুঁড়েছে ও। কিডন্যাপ করেছে শহরের শেরিফকে। তার পেট থেকে বের করেছে জরুরি তথ্য। সুতরাং, আরও কিছু বেআইনী কাজ করলেও কিছু যায় আসে না ওর।

এইমাত্র ডজ র‍্যাম ট্রাক পাঠিয়ে দিয়েছে রেস্তোরাঁর দরজার দিকে। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে শেরিফ অস্টিন ম্যাকলাস্কি। আপত্তি তোলেনি সে। তবে স্বেচ্ছায় ড্রাইভ করছে না। স্টিয়ারিং হুইলে তার হাত হ্যাণ্ডকাফে আটকে দিয়েছে রানা। ব্যবহার করেছে ক্যাবে পাওয়া লম্বা রেঞ্চ। ওটার চাপ খেয়ে পুরো ডেবে গেছে অ্যাক্সেলারেটর পেডাল। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ারস্টিক ফেলেছে ড্রাইভ স্লটে। সরাসরি কাঁচের দেয়াল লক্ষ্য করে ছুটে গেছে দানবীয় ট্রাক। ম্যাকলাস্কি জানে, গন্তব্য থেকে গাড়ি সরালে কপালে খারাবি আছে তার। তাই চুপ করে বসে আছে সে।

কাঁচ উড়িয়ে রেস্তোরাঁয় ট্রাক ঢুকছে, এমনসময় পেছন গলিতে পৌঁছুল রানা। শুনল কাঁচ ও কাঠ ভাঙার বিকট শব্দ। কসেকেণ্ড পর কোথাও আটকে গিয়ে ক্রুদ্ধ, চাপা গর্জন ছাড়তে লাগল ট্রাকটা।

ভিলাজ-ও-সঁওর কিচেনের দরজার হ্যাণ্ডেলে চাপ দিল রানা। ওটা লক করা। ম্যাগনামের গুলিতে উড়িয়ে দিল ওটা। পরের গুলি লাগল দরজা ও চৌকাঠের মাঝের মেকানিযমে। এবার সহজেই খুলল দরজা। ঠুং-ঠুং শব্দে ধাতব, ভাঙা মেকানিযম পড়ল রানার পায়ের কাছে।

সামনে অন্ধকার প্যাসেজ। একটু দূরে আরেক দরজা। কসেকেণ্ড রেস্তোরাঁর ভেতরের আওয়াজ শুনল রানা। মনে হলো, মৃদু কাঁপছে মেঝে। গিয়ে খুলল সামনের দরজা, হাতে ম্যাগনাম। চট করে দেখল ওদিকের ঘরটা।

কিচেন।

কেউ নেই।

ঘরে জ্বলছে যিরো পাওয়ারের বাবু।

তবে সে আলোতেও দেখা গেল চারপাশ। বিশাল এক স্টিলের ওঅর্ক-টেবিলে হাঁড়ি, কড়াই, চামচ, ছুরি ইত্যাদি।

এ ঘরের ভাল বর্ণনা দিয়েছে ম্যাকলাস্কি।

ডানে ডাবল সুইং-ডোর। ওপাশে ডাইনিং রুম। ওখানে না গিয়ে রানা চলে গেল বামের দরজার কাছে। কবাট খুলল। কফুট দূরেই ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি।

দালানে আরও আছে সিঁড়ি, তবে দোতলা পর্যন্ত। ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ। তবে এটা গেছে তিনতলায়। বিপদ হলে বা পালাতে চাইলে ওপরতলার কেউ ব্যবহার করবে এই সিঁড়ি।

এখন নেই চেয়ার-টেবিল সরে যাওয়ার খড়-খড় শব্দ। সামনে কোথাও বাধা পেয়ে রাগী ষাড়ের মত গর্জন তুলছে ট্রাক। ওপরতলার কেউ সিঁড়ি বেয়ে নামলে ওই আওয়াজে পদশব্দ শুনতে পাবে না রানা। পেছনে দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ওয়ালথার হাতে। কোমর থেকে তাক করেছে অস্ত্রের নল। পরের বাঁক ঘুরে ওঠার সময় কেউ পিস্তল কেড়ে নিতে চাইলে তা হবে তার জন্যে প্রায় অসম্ভব কাজ।

প্রথম ল্যাণ্ডিঙে থেমে আবারও কান পাতল রানা।

চলন্ত ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে এল ওপরতলায় কারও দৌড়ের আওয়াজ। লোকটার পরনে বুট জুতো।

সিঁড়ির পাশ দিয়ে উঁকি দিল রানা। ওপরে জ্বলছে হলদে বাতি, দেয়ালে বাদুড়ের মত বিদঘুটে ছায়া। সিঁড়ির বাঁক ঘুরে দুদ্দাড় করে নেমে এল মাঝারি গড়নের লোকটা, পরনে শার্ট ও প্যান্ট। খাটো করে ছাঁটা ধূসর চুল। রেস্টুরেন্টের কর্মচারী নয়, হাতে পিস্তল। রানাকে দেখে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো চোখ। বেঁকে গেল ঠোঁট। রানার বুকের দিকে তুলছে। পিস্তলের নল। সে ট্রিগার টেপার আগেই কোমরের কাছ থেকে গুলি করল রানা। লোকটার তলপেট দিয়ে ঢুকে শোল্ডার ব্লেডে গিয়ে বিঁধল বুলেট। সিঁড়িতে দর্শনীয় ডিগবাজি দিয়ে থ্যাপ-থ্যাপ শব্দে কয়েক ধাপ নেমে রানার পায়ের কাছে থামল লাশ।

এ ময়নিহান নয়। পোশাক সাদামাঠা, জুতো কমদামি। এর তিন মাসের বেতনের চেয়ে টপ টেররের তিন মিনিটের রোজগার অনেক বেশি।

লাশ টপকে পিস্তলটা তুলে নিল রানা। গ্লক সতেরো। অর্থাৎ, জুডিরটা নয়। ওরটা ছিল গ্লক নাইন্টিন। আকারে একটু ছোট। কোমরে ম্যাগনামের পাশে অস্ত্রটা গুঁজে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা। স্থানীয় মস্তানদের ওপর ভরসা না করে বাইরে থেকে লোক এনেছে ময়নিহান। রানার ধারণা: সংখ্যায় বেশি নয় তারা। তবে সতর্ক না হলে মাত্র একটা বুলেট ওপারে পাঠাতে পারবে ওকে।

সিঁড়ির শেষধাপে থামল রানা। একটু দূরেই বন্ধ দরজা। হয়তো এগোলেই ওদিক থেকে আসবে গুলি। কয়েক কদমে দরজার কবজার পাশে পৌঁছুল ও। হাত বাড়িয়ে চাপ দিল, হ্যাণ্ডেলে। ভেতর দিকে খুলল দরজা। গুলি করল না কেউ।

সামনে গোছানো অফিস। ডেস্কের ওদিকে আরামদায়ক চামড়ার চেয়ার। ল্যাম্পের আলো পড়েছে কটা ফাইলের ওপর। দেয়ালে তৈলচিত্র। হামলার জন্য লুকিয়ে নেই কেউ। ঘরে ঢুকে সতর্ক চোখে চারপাশ দেখল রানা। কোণে আরেকটা খোলা দরজা দেখে চলল ওদিকে।

পরের ঘরের একপাশে চওড়া জানালা। ওদিক দিয়ে দেখা যাবে নিচের রাস্তা। ঝরঝর করে ঝরছে তুষার। নিচতলা থেকে এল পোড়া পেট্রলের ঝঝ। ডাইনিংরুম ভেঙে বেরোতে চাইছে ডজ ট্রাক। বনবন ঘুরছে চাকা। মৃদু কাঁপছে গোটা কাঠের বাড়ি। কিন্তু ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে এল একলোকের কণ্ঠস্বর। হড়বড় করে কী যেন বলছে কাউকে।

কে জানে, হয়তো মস্তান বা পুলিশ ডাকছে।

দরজা পেরিয়ে রানা দেখল ঘরের মাঝে এক লোক। কানে মোবাইল ফোন। পরনে দামি পোশাক। কিন্তু তাকে ন্যাশ ময়নিহান বলে মনে হলো না ওর।

এর বয়স ষাটমত। কুঁচকে গেছে গালের চামড়া। মাথার তালুতে মস্ত টাক। চোখের নিচে বড় বড় দুটো টোপলা। মণির চারপাশটা হলদে। পাকা ডাক্তারের ভঙ্গিতে ভাবল রানা, এর কঠিন কিডনি সমস্যা আছে!

মোবাইল ফোনে বলল লোকটা, হ্যাঁ, পৌঁছে গেছে। রানার দিকে বাড়িয়ে দিল ফোনটা।

তার বুকে পিস্তল তাক করে ফোন নিল রানা। কানে ঠেকিয়ে বলল, ন্যাশ ময়নিহান?

বেশ ঝামেলায় ফেললে, খুশি-খুশি স্বরে বলল ওদিকের লোকটা। কথায় টেক্সাসের মৃদু টান। কী নামে ডাকব তোমাকে?

তুমি জুডির কোনও ক্ষতি করলে আমাকে বলতে পারো তোমার যম বা মৃত্যুদূত, জানাল রানা।

মৃদু হাসল ময়নিহান। ক্লিন্ট ইস্টউডের সিনেমা বেশি দেখো?

পাল্টা জিজ্ঞেস করল রানা, জুডি এখন কোথায়?

কোথায় থাকবে ভাবছ?

তোমার ওখানে?

ভাবছ বলব কোথায় আছি? হাসল ময়নিহান। ভেবো না, নিরাপদেই আছে। যা চাই, সেটা পেলে বিপদ হবে না ওর।

কী চাও? জানতে চাইল রানা। ভাল করেই মনে আছে, কাউন্টার-টেরোরিযমের প্রথম শর্ত: কখনও মেনে নেবে না সন্ত্রাসীর কোনও দাবি।

আগে বলো তুমি কে।

পরিচয় গোপনের কারণ নেই। জুডিকে অত্যাচার করে এসব তথ্য জেনে নিতে পারবে ময়নিহান। আমার নাম মাসুদ রানা। একটু আগে বলছিলে কী যেন চাই। সেটা জানাও। আমি ফেরত চাই জুডিকে। প্রয়োজনে চুক্তি করতে আপত্তি নেই।

জুডি সত্যিই সুন্দরী। বুঝেছি কেন ওকে ফেরত পেতে তুমি এত ব্যস্ত। ঠিক আছে, তো এসো চুক্তি করা যাক।

তুমি চাও জুডির বদলে নিনা ভেঞ্চুরাকে?

 ঠিক।

আমার জানা নেই ওই মেয়েটা কোথায় আছে।

তা হলে খুঁজে বের করো। ধরে আনো আমার কাছে। সেক্ষেত্রে ফেরত পাবে জুডিকে।

ঠিক কোথায় পৌঁছে দেব নিনা ভেঞ্চুরাকে?

ভালই বলেছ। নিনাকে খুঁজে আনতে রাজি হয়েছ এককথায়। তর্কও করবে না? হাহ্, সন্তুষ্ট হলাম! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে উপযুক্ত লোকই তুমি। হয়তো সত্যিই পারবে কাজটা করতে। 

কোথায় নিয়ে যাব ওকে?

সেটা পরে জানাব।

তুমি তো বোধহয় এখন লিটল ফোর্কে নেই?

একটু পরেই পেরোচ্ছি কেন্টাকি বর্ডার। যাক গে, একটা কথা, তোমার মাথার ওপরে ঘোষণা করেছি পুরস্কার। তাই রয়ে গেছে আমার কজন।মাথাটা সামলে রেখো।

আমার জন্যে দুশ্চিন্তা করছ বলে বড় খুশি হলাম।

আমার ছেলেরা ব্যস্ত রাখবে তোমাকে। আর তুমি খুন হলে বাতিল হবে চুক্তি। অবশ্য, তাতে কিছুই যায় আসে না আমার। হাতের মুঠোয় জুডি, কাজেই আসতে হবে নিনা ভেঞ্চুরাকে। যা খুশি করব ওই দুই বোনকে নিয়ে। নিনাকে এনে দিলে অবশ্য সত্যিই ফেরত পাবে জুডিকে।

বুঝলাম।

তবে কিছু করার আগেই হয়তো লাশ হবে।

 তা মনে হয় না। অপেক্ষা করো, নিজেই হয়তো দেখবে বডিব্যাগে করে পৌঁছাচ্ছে তোমার ছেলেরা।

গুড! এ-ই তো সঠিক স্পিরিট! জানতাম তোমার ওপর ভরসা রাখা যায়।

বেশি দেরি হবে না তোমার সঙ্গে দেখা হতে।

আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, হালকা হুমকির সুরে বলল ন্যাশ ময়নিহান। কসেকেণ্ড পর বলল, ওই ফোনটা নিজের কাছে রেখো, কাজে আসবে নিনাকে পাওয়ার পর।

পরে কথা বলব, অন্য ফোনে। ময়নিহানের নাম্বারটা দেখে নিয়ে জাজের দামি মোবাইল ফোনটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে চুরমার করল রানা। ফলে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে একটা জোরালো প্রমাণ নষ্ট হলো বটে, কিন্তু রানাকে ট্র্যাক করার মতলবটা বানচাল করা গেল।

আলাপের সময় নড়েনি অসুস্থ লোকটা। কষ্টের দৃষ্টিতে দেখল ভাঙা মোবাইল ফোন।

আপনার নামটা বোধহয় প্যাট্রিক হোল্ড?

 জণ্ডিস রোগীর হলদে চোখ পিটপিট করল দুতিন বার।

ন্যাশ ময়নিহান এখন কোথায়?

ডালাসের পথে, লোকটার কণ্ঠে হতাশা। হঠাৎ বুঝতে পেরেছে, ভয়ঙ্কর এক লোকের মুখোমুখি হতে তাকে ফেলে গেছে ব্যবসায়িক পার্টনার।

আপনিও ন্যাশ ময়নিহানের চাপে অন্যায় করতে বাধ্য হয়েছেন? জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল জাজ। না। আমার জানা আছে কী করছি। মরব কদিন পর। তার আগে স্ত্রী, ছেলে ও নাতি-পুতির জন্যে রেখে যাচ্ছি প্রচুর টাকা, বিশাল সম্পত্তি। এ সুযোগ দিয়েছে ময়নিহান।

তুমি না বিচারক? বলল বিরক্ত রানা, অপরাধী থেকে বাঁচাবে সাধারণ মানুষকে, তা না করে পড়ে গেছ লোভের ফাঁদে। উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত তোমার।

কাঁপা গলায় বলল হোল্ড, তুমি আমাকে খুন করবে?

না, তবে যাদের প্রতি অন্যায় করেছ, বিচার করবে তারাই। সামনে বেড়ে লোকটার মাথার পাশে আদর করে ওয়ালথারের একটা টোকা দিল রানা। ধুপ করে ওর পায়ের কাছে পড়ল, জাজ হোল্ড। বিড়বিড় করল রানা, আমার ধারণা, তোমার চেয়ে ভাল বিচারক হবে ওরা।

রিক বেণ্ডারের ট্রাক রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে সুবিধা হয়নি। রানা ভেবেছিল, ডাইনিংরুমে থাকবে ন্যাশ ময়নিহানের বেশিরভাগ বডিগার্ডরা। তাদের ঘাবড়ে দিয়ে ওই সুযোগে অন্য পথে ঢুকবে নিজে। কিন্তু যেন নিশ্চিন্তে ঢুকতে পারে, সে ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে লোকটা। টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে নিজের এক লোককে। মরলে মরুক সে!

তাকে খুন না করে উপায় ছিল না রানার। প্রথম কথা: বাঁচাতে হবে নিজেকে। খুঁজে নিতে হবে নিনা ভেঞ্চুরাকে।

নইলে খুব কঠিন হবে জুডিকে উদ্ধার করা।

জাজের কাছ থেকে নতুন কিছু জানতে পারেনি রানা। তবে ফোনে ময়নিহানের সঙ্গে কথা বলে এটা বোঝা গেছে, একপাল নেকড়ে লেলিয়ে দিয়েছে সে। বলেছে, নিনাকে তার হাতে তুলে দিলে ছেড়ে দেবে জুডিকে। সবই মিথ্যার ফুলঝুরি। দলের লোক মরলেও কিছুই পাত্তা দেয় না সে। খুশিই হবে রানা এবং তার লোক লড়ে মরলে।

জুডি বা নিনাকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই ময়নিহানের, এটা পরিষ্কার। অন্তর থেকে চায়, খুন হোক রানা। সেক্ষেত্রে ছেঁড়া কোনও সুতোই থাকবে না।

এবার খুঁজতে হবে নিনা ভেঞ্চুরাকে। হাতে সময় নেই। এখন প্রথম কাজ হওয়া উচিত রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়া। যে-কোনও সময়ে পৌঁছুবে ময়নিহানের খুনির দল।

কেন্টাকিতে এসে প্রথমে এয়ারপোর্টের কাছে যে হোটেলে উঠেছিল রানা ও জুডি, এখন যাবে ওখানে। নেবে বাড়তি পোশাক ও অন্যান্য জিনিস। এ ছাড়া রয়েছে নকল ডকুমেন্ট। ওসব লাগবে বিমানে উঠতে।

অচেতন জাজ হোল্ডকে মেঝেতে রেখে সিঁড়ির কাছে ফিরল রানা। পকেট থেকে বের করল জুডির মোবাইল ফোন। ময়নিহানের মোবাইল নম্বরটা সেভ করল জুডির ফোনে।

নিনা ভেঞ্চুরাকে কল দিয়ে ভাবল, রিসিভ করবে না কেউ। কবার বাজার পর কেটে গেল লাইন। ট্র্যাক করা হবে ভেবে নেটওঅর্ক ব্যবহার করবে না মেয়েটা। কিন্তু ফোন মাঝে মাঝে চেক করবে না, তা না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভয়েস মেসেজ পাবে সে।

এবার ভয়েসমেইলে মেসেজ পাঠাল রানা। নিনা, আমি মাসুদ রানা। আপনার বড়ভাইয়ের পরিচিত। হয়তো শুনেছেন আমার কথা। যাদের কাছ থেকে লুকিয়ে আছেন, সেই দলের লোক তুলে নিয়ে গেছে জুডিকে। চেষ্টা করছি ওকে উদ্ধার করতে। কিন্তু সেজন্যে আপনার সাহায্য দরকার। প্রথম সুযোগে কল করবেন আমাকে।

এবার জন হার্বার্টকে কল দিল রানা। শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

তাই? কেন? অবাক হলো ওর বন্ধু।

ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে যে-কথা হয়েছে, খুলে বলল রানা।

সে চুক্তি করল তোর সঙ্গে? বিস্ময় বাড়ল জনের।

হ্যাঁ। বাধ্য হয়ে ধরে নিচ্ছি মিথ্যা বলছে না।

ভয় দেখাতে চেয়েছে, বলল জন, যাতে দেরি না করে নিনা ভেঞ্চুকে খুঁজে তুলে দিস্ তার হাতে। লোকটা জানে না, ঘাবড়ে যাওয়ার লোক নয় আমরা নই।

আমারও ধারণা ভয় দেখাচ্ছে। তবে পেছনে খুনি লেলিয়ে দেয়া হলে স্বস্তি পাওয়া কঠিন।

এখন কী করবি?

ময়নিহান চলেছে ডালাসে। আমিও যাচ্ছি।

তা হলে ফ্লাইট প্ল্যান পাল্টে নিচ্ছি, বলল জন। ওখানেই দেখা হবে তোর সঙ্গে।

দুবন্ধু ঠিক করল ডালাসের ফোর্ট ওঅর্থ এয়ারপোর্টে আগামীকাল সকালে দেখা করবে ওরা।

তুই আপত্তি না তুললে সঙ্গে নেব বাড হিগিন্সকে, বলল জন হার্বার্ট। ও অস্থির হয়ে আছে।

মন্দ হয় না ওকে নিলে, বলল রানা, বাড়তি হাত আর অস্ত্র কাজে আসতে পারে।

রানার কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে বলে কৃতজ্ঞ বাড হিগিন্স। সে-ও রানা এজেন্সিতে কাজ করে এবং রানার বন্ধু।

একবছর হলো অ্যাকটিভ অ্যাসাইনমেন্টে নেই, ওকে সঙ্গে নিবি শুনলে খুশি হবে, বলল জন। এরই ভেতর খুঁজে বের করুক ন্যাশ ময়নিহান সম্পর্কে তথ্য।

বিদায় নিয়ে ফোন রাখল রানা। ভাবছে, ও খুন হলে বাঁচবে না জুডিও। পেছনে লেগেছে চুক্তিবদ্ধ একদল খুনি। ভাল হলো, পাশে পাবে দক্ষ দুজন বন্ধু।

নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নামল রানা। কিচেনের দরজার কাছে পৌঁছে শুনল টিকটিক আওয়াজ। ঠাণ্ডা হচ্ছে ডজের তপ্ত ইঞ্জিন। ম্যাকলাস্কি বা অন্য কেউ অফ করে দিয়েছে ওটা।

ডাইনিং রুমে থাকুক শেরিফ। হয়তো জাজ বা শেরিফকে গ্রেফতার করবে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কেউ।

ডজ ট্রাক ব্যবহার করে এয়ারপোর্টে গেলে রানা হয়ে উঠবে টার্গেট। কিচেন কাউন্টারে ম্যাগনাম রেখে কোমরে ওয়ালথার ও গ্লক সতেরো গুঁজে দালান থেকে বেরিয়ে এল ও।

নির্জন রাস্তা। কেউ নেই। আরও বেড়েছে তুষারপাত। জোরালো ঝরঝর শব্দে চাপা পড়ছে আর সব আওয়াজ।

ফুটপাথে উঠল রানা। একটু পর হারিয়ে যাবে পদচিহ্ন। জ্যাকেটের কলার তুলে হেঁটে চলল এয়ারপোর্ট লক্ষ্য করে। আশা করছে, প্রবল তুষারঝড়ে বন্ধ হবে না বিমানবন্দর।

.

১৯.

মাঝে মাঝে নেকড়ের মত একপাল লোকের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে মার খেয়েছে রিক বেণ্ডার, কিন্তু শেষে দেখা গেছে তাদের হাড়গোড় ভেঙে বেরিয়ে এসেছে বিপদ থেকে। জীবনে প্রথম এবং দ্বিতীয়বারের মত জ্ঞান হারিয়ে এখন রীতিমত লজ্জা হচ্ছে ওর।

ছি-ছিহ্! সারাজীবন দুনিয়ার মানুষকে পিটিয়ে অজ্ঞান করল, আর আজ তার নিজেরই এই হাল!

এজন্যে দায়ী ওই বাদামি বদমাস হারামজাদাটা!

অবশ্য এ-ও ঠিক, কপাল ভাল যে খুন হয়নি সে!

জঙ্গলে জ্ঞান ফিরলে পাশে ছিল নিক। এবার চেতনা ফিরতে দেখছে পাশে নেই ছোটভাই।

নিক নেই তা দগদগে ক্ষতের মত জ্বলছে বুকের ভিতর। কাঁদতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু ঠিক সে-ধরনের লোক নয় রিক। দুঃখের কারণে এল মনে প্রচণ্ড ক্রোধ। তা ছাড়া, পেটে কুলকুল করছে অন্তত এক বোতল উইস্কি।

বারকাউন্টারের তলা থেকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বিস্ফোরণের মত উঠে এল সে। ডজ ট্রাক ভেঙেচুরে হাজির হতেই ভাবছিল ঝাঁপ দেবে কোন্‌দিকে। কুঁজো হয়েছে, এমনসময় ওকে উড়িয়ে নিয়ে কাউন্টারের আরেকদিকে ফেলেছে যান্ত্রিক দানব। ভারী ওয়ালনাট কাঠের কাউন্টার আড়াল দিল বটে কিন্তু কী যেন লাগল মাথায়।

বারকাউন্টারটাকে ভাঙতে পারেনি ট্রাক, নইলে নির্ঘাত খুন হতো ও। তবে এখন ওয়ালনাটের এই মোড়ক চাই না তার। কাঁধ দিয়ে ঠেলে ভারী কাউন্টার সরিয়ে দিল রিক। রাগে গর্জন ছাড়ছে ক্ষিপ্ত ভালুকের মত। কপা সরে দেখল সর্বনাশ হয়েছে বিলাসবহুল ভিলাজ-ও-সঁও রেস্টুরেন্টের। 

একটু দূরে দেয়ালের কোণে নাক ঠেকিয়ে ওরই মত কর্কশ গর্জন ছাড়ছে ট্রাকটা। আকাশে উঠেছে মুচড়ে যাওয়া হুড। ভাঙা কিছু টেবিল-চেয়ারের মধ্যে বনবন ঘুরছে সামনের দুচাকা।

রিক বেণ্ডার চোখে অস্পষ্ট দেখলেও টের পেল ক্যাবের ভেতর বসে আছে কে যেন। ওর মনে হলো, ওই লোক নিশ্চয়ই নিকের খুনি! পরক্ষণে ভাবল: সেক্ষেত্রে রেস্টুরেন্ট ভেঙেছে কেন? আরও বড় প্রশ্ন: চুপ করে বসে আছে কেন ব্যাটা?

চুরমার হওয়া আসবাবপত্র সরিয়ে গাড়ির দিকে চলল রিক। গা থেকে টুপটাপ ঝরছে কাঁচের টুকরো। চুল ঝাড়তে গিয়ে টের পেল, কপাল আর গালে চটচট করছে আঠালো কিছু। গা থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে মদের দুর্গন্ধ। ভীষণ জ্বলছে হাতের পিঠ। যেন কামড়ে দিয়েছে কাঠ পিঁপড়ে। আগুনের মত ঘঁাৎ-ঘঁাৎ করছে কাঁধের ক্ষত। এ ছাড়া ঠিকই আছে সে।

সর্বনাশ হয়েছে তার ট্রাকের। আগেই রিক ভেবেছে, যে খুন করেছে ওর ভাই নিককে, তাকে ছাড়বে না সে। কিন্তু এখন দ্য বাইসনের করুণ হাল দেখে বিড়বিড় করে রানাকে শাপ-শাপান্ত করল। নিজ হাতে বাদামি কুত্তার বাচ্চাটার দুই পা দুদিকে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে সে।

কে ওখানে? ক্যাব থেকে জানতে চাইল কেউ।

 ম্যাকলাস্কি?

রিক? …রিক… তুমি?

ভাঙা টেবিলের মাঝ দিয়ে চলতে গিয়ে পিছলে থামল রিক। পায়ের নিচে তেলতেলে মোবিল। কপা সরে ড্রাইভারের দরজায় পৌঁছুল সে। জানালা দিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। গাট মেরে বসে আছে শেরিফ অস্টিন ম্যাকলাস্কি। ছড়ে গেছে চোয়াল। কপালে ছোট ক্ষত। বাড়ির ভেতরে ট্রাক ঢোকার সময় উইণ্ডস্ক্রিনের বাড়ি লেগে ব্যথা পেয়েছে লোকটা।

আমার ট্রাকের এই অবস্থা করেছ কেন?

আমি না, রিক, স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরাবার ভঙ্গি করল ম্যাকলাস্কি। রিক দেখল তার হাতে হ্যাণ্ডকাফ। এবার বুঝতে পেরেছ?

গাড়ি নিয়ে অন্যদিকে সরে যেতে পারতে।

মাথায় পিস্তল তাক করেছিল ওই লোক, কাফ দিয়ে ঠুং টুং শব্দ তুলল শেরিফ। বের করো এখান থেকে।

ওই লোক এখানে এসে ঢুকেছিল তোমার সঙ্গে?

না, মাথা নাড়ল ম্যাকলাস্কি। শেষ সময়ে নেমে গেছে লাফ দিয়ে। বোধহয় কিচেন দিয়ে ঢুকেছে ভেতরে। সুযোগ পেলেই খুন করবে ময়নিহানকে। বুঝলে, রিক, কিছুই করার ছিল না। বাদ দাও, পরে এই ফালতু ট্রাকের চেয়ে অনেক ভাল একটা কিনে নিতে পারবে।

এটা ফালতু ট্রাক? রাগ বাড়ল রিকের। এমনিতেই ভণ্ড শেরিফকে পছন্দ করে না। লোভী পাঁঠা একটা। ওকেও সমান অপছন্দ করে সে। তা ছাড়া, নিককে ঘৃণা করত শুয়োরটা।

অ্যাক্সেলারেটর থেকে পা সরিয়ে নিতে পারতে।

রেগে গিয়ে চেঁচাল ম্যাকলাস্কি, পারতাম না! আরে, প্যাডেলে রেঞ্চ আটকে দিয়েছে! হতাশার কারণে গায়ের জোরে হ্যাণ্ডকাফে টান দিল সে। ছুটিয়ে নেবে, না কি?

হ্যাঁ, ছুটিয়ে নেব। একটু রোসো। তারপর দেখো কী করি। ক্যাবের ভেতর দুই মস্ত হাত ভরল রিক।

যাক, এতক্ষণে তোমার আক্কেল…।

দুহাতে ম্যাকলাস্কির মাথা চেপে ধরল রিক, পরক্ষণে মারাত্মকভাবে মুচড়ে দিল গায়ের জোরে। শেরিফের ঘাড়ের হাড় মড়াৎ শব্দে ভেঙে যাওয়ায় মনে হলো এইমাত্র গুলি করা হয়েছে ছোট ক্যালিবারের পিস্তল থেকে।

কুত্তার বাচ্চা, তোর উচিত ছিল রেঞ্চটা লাথি মেরে ফেলে দেয়া, মৃত শেরিফের উদ্দেশে নরম সুরে বলল রিক। রওনা হলো চুরমার হওয়া আসবাবপত্রের মাঝ দিয়ে। পরিষ্কার মেঝেতে পৌঁছে কার্পেটে ঘষে নিল বুটের হিল। ভাবছে, এবার কী করবে। মনেই নেই এইমাত্র খুন করেছে  অসহায় এক লোককে।

একবার দেখল দালানের সামনের ভাঙা অংশ। খসে পড়েছে কাঁচের দেয়াল। মেঝেতে তার হাজার টুকরো। দমকা হাওয়ায় ঢুকছে ভারী তুষার। সাদা হয়ে উঠছে শহরের চারপাশ। অ্যাপলেচিয়ান এলাকায় এমন ভারী তুষারপাত অস্বাভাবিক নয়। তবে বহুদিন পর রিক দেখছে এমন ঝোড়ো পরিবেশ। আরও বাড়ছে হাওয়ার বেগ। এভাবে তুষারপাত হলে অন্তত কদিনের জন্যে আটকে যাবে গিরিপথ। তখন বেরোবার জন্যে থাকবে মাত্র দুটো পথ। হয় যেতে হবে বিমানে বা হেলিকপ্টারে, নয় হেঁটে। থাকুক তা হলে ওর ভাঙা বাইসন গাড়ি।

কিচেনের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে ঢুকল রিক। সার্ভিস এরিয়া থেকে এল মৃদু আলো। ওই পথেই এসেছিল নিকের খুনি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রিক। কান পাতল প্রথম ল্যাণ্ডিঙে থেমে। ভাবছে, কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল সে?

মন বলল, বাদামি ওই লোক এখন এ দালানে নেই।

আরও কধাপ উঠতেই পেল হেনরি রাইডারকে। সে পড়ে আছে দ্বিতীয়তলার সিঁড়ির গোড়ায়। পেটে গোলাপের কুঁড়ির সমানলাল গর্ত। গোলাপ ফুটেছে পিঠে।

লাশ সার্চ করল রিক।

লোকটার কাছে অস্ত্র নেই। অথচ, সবসময় ময়নিহানের এই স্যাঙাৎ কাছে রাখত গ্লক সতেরো পিস্তল।

একটার পর একটা অস্ত্র সংগ্রহ করছে নিকের খুনি শালা। ব্যাটা করবেটা কী এতগুলো নিয়ে? লাশ টপকে তৃতীয়তলায় উঠল রিক। মাথার ওপর জ্বলছে হলদে বাতি। ছায়ায় কেউ নড়বে ভেবে অপেক্ষা করল সে। কেউ নেই। সাবধানে ঢুকল প্রথম অফিসে। পরের অফিসের দরজা খোলা। ওখান থেকে এল ভেস-ভোস শব্দ। পানি থেকে ওঠা পরিশ্রান্ত ভোঁদড় যেন।

কসেকেণ্ড পর রিক বুঝল, ওটা কে হতে পারে।

ওই ঘড়-ঘড় ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

সতর্ক পায়ে পরের অফিসে ঢুকল রিক। হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে সিলমাছের মত মেঝেতে পড়ে আছে অচেতন জাজ হোন্ড। কাত হয়ে আছে মাথা। হাঁ করা মুখ থেকে বেরোচ্ছে বিশ্রী ওই আওয়াজ। মাথার একপাশে বেগুনী দাগ। বাদামি বদমাসের কথা মনে পড়ল রিকের। ওই শালা সুযোগ পেলেই যার-তার মাথায় পিস্তলের বাড়ি মারছে!

শেরিফ ম্যাকলাস্কির মতই জাজ হোল্ডকেও পছন্দ করে না রিক। এই শালাও পাকা ভণ্ড! লোভী কুত্তা!

ময়নিহানের অফিসে আবার ফিরল রিক। লুকিয়ে নেই কেউ। যে চেয়ারে ছিল সুন্দরী মেয়েটা, সেটা এখন খালি।

ভুরু কুঁচকে চারপাশ দেখল রিক। ময়নিহান সঙ্গে নিয়ে গেছে মেয়েটাকে। এখানে থাকলে এতক্ষণে বাদামি বদমাস বা ময়নিহান, যে-কোনও একজন লাশ হয়ে পড়ে থাকত মেঝেতে। আশপাশে নেই রক্তের চিহ্ন। হাতাহাতি হয়নি কোনও।

আবার জাজ হোন্ডের পাশে ফিরল রিক। ঝুঁকে বারকয়েক চড়িয়ে দিল বয়স্ক লোকটাকে। আগের চেয়েও হলদে দেখাচ্ছে জাজের মুখ।

হোল্ড! ওঠো তো, বাপু! আরেহ, কী হল? ওই, শালার পো! আবারও জাজের গালে চড় দিল রিক।

সামান্য নড়ল, লোকটা। তিরতির করে কাঁপল পাপড়ি, তারপর খুলল চোখ। মনে হলো না দেখছে কিছু। অবশ্য কসেকেণ্ড পর হাত তুলে ঠেলে সরাতে চাইল রিককে।

হাতটা ধরে একটানে তাকে বসিয়ে দিল রিক।

আচমকা ঘুম ভেঙে হতভম্ব হয়েছে হোল্ড। আধ মিনিট লাগল নিজেকে ফিরে পেতে। চারপাশ দেখল আতঙ্কের চোখে। যাক, বিদায় নিয়েছে ওই পিস্তলওয়ালা লোকটা! 

দাঁড়িয়ে আছে রিক। বুকে আড়াআড়িভাবে রেখেছে দুহাত। লালচে দুই চোখে তাকে দেখছে দানব।

রিক? প্রায় ফিসফিস করল জাজ হোল্ড।

 হ্যাঁ। আমি। এখানে কী হয়েছে, হোল্ড?

দুপেগ উইস্কি এনে দাও। গলা শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে মরেই যাব!

আগে বলো কী হয়েছে। ন্যাশ ময়নিহান কোথায়?

মুখের ভেতরটা শিরিষ কাগজ, জিভ নেড়ে লালা তৈরি করতে চাইল হোল্ড। চেয়ে আছে রিকের দিকে। কসেকেণ্ড পর বলল, বাড়ি ফিরে গেছে ময়নিহান।

ডালাস?

হ্যাঁ। মেয়েটাকে নিয়ে। পিস্তলের নলের বাড়ি খেয়ে ব্যথায় টিসটিস করছে জাজের মাথা। বলেছে, সামলে নেবে পরিস্থিতি।

বলতে পারো যে পালিয়ে গেছে। মাঝখান থেকে ধরা খেয়েছি আমরা।

মাথা দোলাল হোন্ড। কখনোই আমাদের ভালমন্দ নিয়ে ভাবেনি। ব্যাপারটা সবসময় এমনই ছিল।

অথচ আমরা না থাকলে এ পর্যায়ে আসতে পারত না! রেগে গিয়ে হাতের মুঠো পাকাল রিক। ব্যাণ্ডেজের ভেতর কুলকুল করে পড়ছে রক্ত। শার্টে তৈরি হচ্ছে বড় একটা ফুল। ওর কারণে মারা গেছে নিক।

টাকা পেতে হলে ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই কারও, রিক। আমরা ময়নিহানের হাতের ময়লা। কথাটা মেনে নেয়াই ভাল। সামনে ঝুঁকল হোল্ড। কনুই রেখেছে হাঁটুর ওপর। দুহাতে চেপে ধরল মাথা।

আমার ভাই ওর খেলনা ছিল না, ধমকের সুরে বলল রিক। আমি নিজেও কারও পুতুল নই।

হাতের ইশারায় কথাটা উড়িয়ে দিল হোল্ড। পরিকল্পনা তৈরি করে কাজে নেমেছে ময়নিহান। এরার হাতের মুঠোয় পাবে নিনা ভেঞ্চাকে। টোপ হিসেবে আছে ওর বোন। সব শেষ হলে আবারও লিটল ফোর্কে ফিরবে রাজার মত।

নিশ্চয়ই এখানে এসেছিল জুডি ব্ল্যাকউডের বডিগার্ড? নাম কী লোকটার?

নাম বলেছে মাসুদ রানা। মিথ্যা নামও হতে পারে।

মাসুদ রানা, বিড়বিড় করল রিক। নামটা ভাল লাগল না তার। থুতু ফেলল কার্পেটে। ওকে যেভাবে পারি খুঁজে বের করব। খতম করে দেব চিরতরে।

তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে ময়নিহান। বলে দিয়েছে, যেন নিনা ভেঞ্চুরাকে নিয়ে ওর কাছে যায়।

চুপ করে থাকল রিক। ভাবছে, কীভাবে খুন করবে বাদামি লোকটাকে।

অবাক কাণ্ড কী, সেটা জানো? বলল জাজ। ময়নিহান সতর্ক করেছে, তাকে খুন করতে লোক পাঠাবে সে।

জাজ হোন্ডের দিকে তাকাল রিক। মনে পড়েছে, নিককে বলেছিল, আরও লোক ডাকছে ময়নিহান। তবে তার লোক লাগবে না আমাদের, বলেছিল নিক। তখন ওর সঙ্গে একমত হয়েছিল রিক। এখনও একই কথা বলবে। চাপা স্বরে জানাল, মাসুদ রানা আমার!

মাথা নাড়ল জাজ হোল্ড। এসব থেকে বাইরে থাকো, রিক। নইলে খুন হয়ে যাবে।

আমার ভাইকে খুন করেছে ওই লোক!

ব্যাপারটা তুলে দাও পেশাদারদের হাতে, বলল হোল্ড, নইলে বাঁচবে না। ওসবে না জড়িয়ে আমাকে সাহায্য করো, যাতে সামলাতে পারি এদিকের বিপদ।

হঠাৎ কেন তোমার মনে হচ্ছে যে আমি তোমাদের পরিচ্ছন্নকর্মী? ত্যাড়া সুরে জানতে চাইল রিক। ভাবছ আমি ময়নিহানের হাতের পুতুল?

রেগে লাভ নেই, রিক, বলল হোল্ড, সব গুছিয়ে না নিলে ফেঁসে যাব আমরা। তাতে ডুববে তুমিও। এখন প্রথম কাজ পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে আনা। খুঁজে বের করতে হবে অস্টিন ম্যাকলাস্কিকে।

ম্যাকলাস্কি মারা গেছে, জানাল রিক।

মারা গেছে? কী করে? মাসুদ রানার কাজ?

জবাব দিল না রিক।

পেশায় প্যাট্রিক হোল্ড বিচারক। থমকে গিয়ে দেখছে। দানবটাকে। থমথম করছে চেহারা। কসেকেণ্ড পর জানতে চাইল, তুমি খুন করেছ ওকে? কী কারণে?

কারণ সে ছিল ময়নিহানের পুতুল। তুমি যেমন বলেছ, আমরা সবাই ছিলাম তার খেলনা।

কড়া চোখে তাকে দেখল হোন্ড। তুমি গাধা নাকি!

আবারও ঝুঁকল রিক। দুহাতে তুলে নিল ভগ্ন দেহের জাজকে। সোজা চলে গেল জানালার সামনে।

আর্তচিৎকার ছাড়ল হোন্ড: আরে… আরে… এসব কী? পাগল হয়ে গেলে?

ঝাড়দারের কাজ করছি, বলল রিক, নইলে ন্যাশকে জানিয়ে দেবে আমি যাচ্ছি ডালাসে। দুর্বল শরীরের জাজকে দুহাতে মাথার ওপর তুলল সে, পরক্ষণে ছুঁড়ে ফেলল চওড়া জানালার ওপর। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাঁচ। জাজের সঙ্গে চলল চৌকাঠের হালকা, ভাঙা একটা অংশ। তবে ওটা পড়ার আগেই হাত-পা ছড়িয়ে ধুপ শব্দে রাস্তায় ভূপাতিত বিমানের মত পড়ল হোল্ড। ভোঁতা শব্দটা শুনে তিনতলা থেকে উঁকি দিল রিক। সন্তুষ্ট হয়ে ভাবল, ভাগ্যিস তুষার ঠিক তুলোর বাণ্ডিল নয়!

মেনে নেব পেশাদার খুনিদেরকে, তাই না, হোল্ড? হাসল রিক। মরুক শালারা! রানা শুধু আমার! কোনও কুত্তার বাচ্চাকে দেব না ওকে খুন করতে! ওকে খতম করব আমি, নিজের হাতে!

.

২০.

খুব ছোট লিটল ফোর্কের এয়ারপোর্ট। ওখান থেকে বিমানে ওঠে না আন্তর্জাতিক যাত্রীরা। গত দুবছর হলো কিছু আমেরিকান যাত্রীবাহী বিমান এলেও আগে আসত শুধু মালবাহী। হঠাৎ করেই এদিকের জমির দাম এবং টুরিস্টের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় সার্ভিস ভাল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

অনেকক্ষণ আগে তুষারপাত মাথায় নিয়ে টার্মিনালে পা রেখেছে রানা। এখন চেয়ারে বসে দেখছে দূরে প্রকাণ্ড, নির্মাণাধীন দোতলা দালান। বাইরের বিলবোর্ডে লেখা: নতুন টার্মিনাল চালু হবে আগামী বসন্তে।

আপাতত পুরনো, ছোট এবং চৌকো একতলা টার্মিনাল দিয়েই কাজ চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ওটার চারপাশে কাঁচের দেয়াল। ছাত টিনের। তবে মেঝে কংক্রিটের। দালানের একদিক আগত যাত্রীদের জন্য, অন্যপাশ বহির্গমন যাত্রীদের। একই দরজা ব্যবহার করছে সবাই। নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বহির্গমন এলাকায় আছে মাত্র কজন যাত্রী। একটু পর পর মাথা তুলে দেখছে অ্যানাউন্সমেন্ট বোর্ড। কারও মনোযোগ নেই রানার দিকে।

বিলম্বিত করা হয়েছে ফ্র্যাঙ্কফোর্টের বিমান। একইভাবে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে লেক্সিংটন, জ্যাকসন ও হার্ডিংস্বার্গের বিমানের শেজিউল। তুষার ঝড়ের কারণে একই হাল এ রাজ্যের প্রতিটি বড় বড় এয়ারপোর্টের। দীর্ঘ সময়ের জন্যে আটকা পড়েছে রানা।

একটা ভেণ্ডিং মেশিন থেকে কফি নিয়েছে, আরেকটা থেকে স্যাণ্ডউইচ। ঘরের কোণে বসে দেখছে একটু দূরের আগমন ও নির্গমন দরজা। বড় বিমানবন্দর হলে ওকে সার্চ করত কর্তৃপক্ষ, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিমানযাত্রী ভেবে নজর দেয়নি কেউ। রানার কাছে রয়ে গেছে ওয়ালথার। ব্যাগেজে রেস্টুরেন্টে মৃত লোকটার গ্লক পিস্তল। কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদ করলে ও দেখাবে নকল ইউএস এয়ার মার্শালের কাগজপত্র।

হোটেল থেকে ব্যাগ সংগ্রহের সময় ফোন করে ফ্লাইট বুক করেছে রানা। কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, দেরি হবে বিমানে উঠতে। তবে আবহাওয়া দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, আশা করা যায় আগামী এক থেকে দেড় ঘণ্টার ভেতর থামবে ব্লিযার্ড। কিন্তু সেটা তিন ঘণ্টা আগের কথা। রওনা হতে না পেরে বিরক্ত রানা। কিন্তু কিছু করারও নেই।

পেরোল আরও দুঘণ্টা, লিটল ফোর্ক এয়ারপোর্ট ছেড়ে গেল না কিংবা নামলও না কোনও বিমান। এর ভাল দিক: তুষার ঝড়ের কারণে ও যেমন চলে যেতে পারছে না, তেমনি এখানে পৌঁছুতে পারবে না ময়নিহানের খুনিরাও।

নিনা মেসেজ দিয়েছে কি না দেখতে জুডির ফোন অন করল রানা। না, যোগাযোগ করেনি মেয়েটা। আবারও পকেটে মোবাইল ফোন রাখল ও। চেয়ার ছেড়ে গেল টার্মিনালের আরেক প্রান্তে। প্রতিটি বিমান ছাড়তে বা আসতে দেরি হবে, জানিয়ে দেয়া হয়েছে বোর্ডে। আজ সারাদিন জার্নি শেষে নানান বিপদে জড়াতে হয়েছে পাহাড়ে ও শহরে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। নতুন করে কফি কিনল রানা।

আবার আগের সিটে ফিরে চোখ রাখল দরজার ওপর। ভাবছে, যে-কোনও সময়ে পৌঁছুবে ম্যাকলাস্কি ও তার ডেপুটি শেরিফরা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই হ্যাণ্ডকাফ খুলে ফেলেছে লোকটা। খুঁজছে ওকে। এদিকে জ্ঞান ফিরতেই খেপে গেছে জাজ হোল্ড। ম্যাকলাস্কিকে জানাবে ওর নাম। ফ্লাইট বুকিং চেক লিস্ট দেখবে তারা। ওখানে পাবে না মাসুদ রানা নামটা। ও এখন মরিস রেনার। এই নাম ব্যবহার করেও সুবিধা হবে না, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলবে তারা।

এখনও পুলিশ হাজির হয়নি দেখে বিস্মিত রানা। খোঁজ নেয়ার কথা এয়ারপোর্টে। নাকি ন্যাশ ময়নিহান মানা করে দিয়েছে জাজ হোল্ড ও শেরিফ ম্যাকলাস্কিকে? রানা জেলে গেলে লড়তে পারবে না খুনিদের বিরুদ্ধে। তাতে মাটি হবে লোকটার আনন্দ? জেলে থাকলে খুঁজতে পারবে না নিনা, ভেঞ্চুরাকে। ময়নিহান চায় ও খুন হোক, তবে তার আগে খুঁজে বের করুক নিনা মেয়েটাকে।

চতুর্থ কাপ কফি শেষ করেছে রানা, এমনসময় সত্যিই থামল ব্লিযার্ড। তবে আরও দুঘণ্টা পর ডিসপ্লে বোর্ডে লেখা ফুটল: ফ্লাইট টু ফ্র্যাঙ্কফোর্ট উড বি লিভিং অ্যাট ০৯:৫৫ এ.এম.। অর্থাৎ পঁচিশ মিনিট পর রওনা হবে বিমান। বাইসন ট্রাক দিয়ে ভিলাজ-ও-সঁও রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেয়াল ধসিয়ে দেয়ার প্রায় এগারো ঘণ্টা পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ও।

যাত্রীদের সবার শেষে ছোট্ট বিচক্ৰা ১৯০০ এয়ার ট্যাক্সিতে উঠল রানা। সিট সব মিলে উনিশটি। নেই ফ্লাইট অ্যাটেণ্ড্যান্ট। সে কাজ করবে কো-পাইলট। দরজা বন্ধ করে ককপিটে ফিরল সে। সবাইকে লক্ষ করে দেখেছে রানা, বিপজ্জনক মনে হয়নি কাউকে। পেছনের সিটে বসে মুদে ফেলল চোখ।

বারকয়েক টেনিসবলের মত লাফিয়ে আকাশে ভাসল পিচ্চি বিমান। কিছুক্ষণ পর তুষারভরা মেঘ ফুঁড়ে উঠল ওপরে। এরপর যাত্রা হলো মসৃণ। গতকাল ভোর থেকে টীম। অর্থাৎ পঁচিশফট উড বি লিপপ্লে বোর্ডে লেখা চলেছে রানার কায়িক পরিশ্রম। আর জেগে থাকতে পারছে না। চোখে আধো ঘুম আর আধো জাগরণ নিয়ে নামল ফ্র্যাঙ্কফোর্টে।

প্রবল তুষার ঝড়ের আওতার বাইরে শহরটি রয়ে গেলেও আকাশ ধূসর মেঘে ভরা। ক্যাপিটাল সিটি এয়ারপোর্টে পড়ছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বিমান ত্যাগ করে অ্যারাইভাল টার্মিনালে ঢুকল সবাই। সঙ্গী যাত্রীদের পরনে ভারী কোট, ব্যতিক্রম শুধু রানা। যে কারও চোখে পড়বে ওর হালকা জ্যাকেট। নকল আইডি ব্যবহার করে ডালাসের টিকেট কিনল ও। নতুন করে যাত্রার জন্যে পরিষ্কার করা হচ্ছে বিমান। সময় লাগবে।

লিটল ফোর্কের চেয়ে ক্যাপিটাল সিটির এয়ারপোর্ট বড় হলেও এটাও আন্তর্জাতিক মানের নয়। ভেণ্ডিং মেশিন থেকে আবার নিল কফি-স্যাণ্ডউইচ। আধঘণ্টা পর রানা দেখল লাইন দিয়ে ছেড়ে আসা বিচক্রাফটে উঠছে আবার যাত্রীরা। তাদের কাউকে মনে হলো না পেশাদার খুনি। অবশ্য, পেশাদার খুনি মোটেই দেখতে খুনির মত হয় না। যে-কেউ বলবে রীতিমত ভদ্রলোক, পাশের বাড়ির বাসিন্দা। জানার উপায় নেই এই প্লেনে করে ওরা লিটল ফোর্কে যাবে কি না। তবে সম্ভাবনা বেশি, সামান্য সময়ের ব্যবধানে সরাসরি মুখোমুখি হলো না ওরা।

বারকয়েক রানার এ-ও মনে হলো, খুনির দলের সঙ্গে দেখা হলেই ভাল ছিল। তাহলে এখন আর থাকত না মানসিক চাপ। নিজেকে ওর মনে হচ্ছে যেন তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে।

একঘণ্টা পর কর্পোরেট জেটস্ট্রিম ৪১ বিমানে চেপে দক্ষিণ-পশ্চিমের ডালাস লক্ষ্য করে উড়ে চলল রানা। একসময় পেছনে পড়ল শীতার্ত আর্কানসাস। বিমান চলেছে টেক্সাসের সোনালি রোদ ভরা আকাশে। সামনে আসছে শত্রু এলাকা। আরও সতর্ক হতে হবে রানাকে।

বিমান অবতরণের পর প্রথমেই জুডির ফোন চেক করল ও। এখনও নেই কোনও মেসেজ। কল দিল জন হার্বার্টকে।

তুই কই, রানা? জানতে চাইল জন।

ডালাস ফোর্ট ওঅর্থে।

এত দেরি?

তুষার ঝড়ের কথা জানাল রানা। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই কোথায়?

এয়ারপোর্টের বাইরে, সঙ্গে বাড। মালামাল নিতে আসব?

না। কেউ জানে না তোদের কথা, ব্যাপারটা তেমনই থাকুক। আমি ট্যাক্সি নিলে পিছু নিবি। লেজ থাকতে পারে।

কিছুক্ষণ পর রানার ট্যাক্সিটাকে অনুসরণ করল জন ও বাড। রুট আশি থেকে নেমে পৌঁছুল আর্লিংটন শহরের প্রান্তে। যখন বুঝল পিছু নেয়নি কেউ, ট্যাক্সি ছেড়ে দিল রানা। ড্রাইভার বিদায় নেয়ার পর ওকে নিজেদের গাড়িতে তুলল জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স।

ভাবতেও পারবি না কী জেনেছে বাড, বলল জন। দারুণ এক ক্যারেকটার ন্যাশ ময়নিহান। একদম পচা মাল!

মোটেলে উঠি, তারপর বলিস, সিটে হেলান দিল ক্লান্ত রানা।

.

২১.

কিচেনের কাউন্টারে ম্যাগনাম রিভলভারটা পেয়ে খুশি হয়ে উঠল রিক বেণ্ডার। বেরিয়ে এল ভিলাজ-ও-সঁওর পেছনের দরজা খুলে। তুষার ঝড়ের মাঝে দেখল ফুটপাথে একজোড়া পদচিহ্ন, সোজা গেছে দূরে। আগের চেয়েও বেশি পড়ছে তুষার। প্রায় চোখেই পড়ছে না পায়ের আবছা চিহ্ন। তবে খুব এগিয়ে নেই ওগুলোর মালিক। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না রিক। জানা আছে কোথায় যাবে মাসুদ রানা। তার পিছু না নিয়ে সোজা ফিরল রিক ওদের ওঅর্কশপে।

আগের মতই মেঝেতে পড়ে আছে ছোটর লাশ। জমাট বেঁধেছে থকথকে রক্ত। শেরিফ ম্যাকলাস্কি আর জাজ হোল্ডকে খুন করেছে বলে এখন একটু আফসোসই হলো রিকের। রাগ আর পেটের উইস্কি বাধ্য করেছে অযৌক্তিক আচরণ করতে। তবে এ-ও ঠিক, এখন আর ওকে বাধা দেয়ার কেউ রইল না। এবার নেবে প্রতিশোধ গলা থেকে ছিঁড়ে নেবে মাসুদ রানার মাথাটা।

আবারও ছোটভাইকে দেখল রিক। এক পা ভাঁজ করে পড়ে আছে লাশ। ফার্স্ট এইড রিকভারি পযিশনে শুয়ে এখনই যেন হাত নেড়ে বাই-বাই দেবে। তবে রোগী নয়, আর কখনও সুস্থ হবে না নিক। পিঠের গর্ত দুটোয় অনায়াসেই ডানমুঠো ভরতে পারবে রিক।

ঝুঁকে ছোটভাইয়ের গাল স্পর্শ করল ও। রিগার মর্টিসে শক্ত হচ্ছে ঠাণ্ডা লাশ। সময় নিয়ে ওঅর্কশপ থেকে নিজের আঙুলের ছাপ মুছল রিক। কাজ শেষে ফিরল ভাইয়ের পাশে। আস্তে করে নিজের দিকে ফেরাল নিকের মুখ। গলে গেছে। লাশের ফ্যাকাসে নীল মণিটা।

হাসি না এলেও কর্কশ হাসল রিক। ভেবো না, চোখ নেই বলে বরং দেখতে ভালই লাগছে! বড় করে দম নিল সে। ছোটর চোখের পাতা টেনে বুজিয়ে দিল রক্তাক্ত গর্তটা।

উঠে আবারও তাকাল লাশের দিকে। বিড়বিড় করল, ছোট, যে কুত্তীর বাচ্চা এটা করেছে, খুনের আগে এমন অবস্থা করব তার, মেরে ফেলার জন্যে পায়ে ধরবে।

ঘুরে এসইউভিতে চাপল রিক। ভেতরে রক্ত, মগজ ও মাংসের আঁশটে দুর্গন্ধ। বরফঠাণ্ডা পরিবেশও এরচেয়ে ভাল, খুলে দিল সব জানালা। এসইউভি নিয়ে গলিতে থামল সে। ওঅর্কশপের দরজা টেনে আটকে দিল প্যাডলক। রানাকে খুন করে এসে ছোটভাইয়ের শেষকৃত্য সারবে রিক। আপাতত থাকুক সে ওই সমাধির মত বদ্ধ জায়গায়।

সোজা এয়ারপোর্টে এলেও ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকল না রিক। এমন জায়গায় রাখল এসইউভি, যেখান থেকে দেখা যায় ভেতরটা। যাত্রীরা দরজা দিয়ে বেরোলে পরিষ্কার দেখবে। হাতে ম্যাগনাম রিভলভার। পাশের সিটে নিকের মসবার্গ পারসুয়েডর শটগান। অবশ্য বাধ্য না হলে অস্ত্র ব্যবহার করবে না রিক। প্রথম সুযোগে নিজ হাতে খুন করবে মাসুদ রানাকে। তবে সে পালিয়ে যেতে চাইলে ফুটো করবে, চুরমার করে দেবে দুই হাঁটুর বাটি। কাঁধ থেকে ছিঁড়ে নেবে আস্ত মাথাটা। পেট ফেড়ে ওটা খুঁজে দেবে পেটের মধ্যে।

বেড়েছে তুষারপাত। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কাঁচের ওদিকে মাসুদ রানাকে। বসেছে দালানের দূর কোণের সিটে। হাতে কাগজের কাপে কফি। কখন যেন পাল্টে নিয়েছে পোশাক। না পাল্টে উপায় ছিল না, আগেরটা ছিল নিকের রক্তে ভেজা।

লোকটা একবার বেরিয়ে দেখুক!

কিন্তু টার্মিনাল ছেড়ে বেরোল না মাসুদ রানা। অন্তত এক শবার এসইউভি থেকে নামল রিক। এয়ারপোর্টে ঢুকে কোণঠাসা করতে পারবে হারামজাদাটাকে, কিন্তু বারবার চিন্তাটা মাথায় এলেও নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। মদ ভরা মগজে মনে হলো টগবগ করে ফুটছে শিরার ভেতর আগুনের মত গরম রক্ত। প্রতিজ্ঞা করেছে: ওই লোকটাকে খুন করবে সে ঠাণ্ডা মাথায়।

রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরোবার সময় ভারী ওভারকোট পরে নিয়েছে রিক। তবুও ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছে। এসইউভিতে ঢুকছে। বরফশীতল হাওয়া। সঙ্গে তুষারের বড্ড ঠাণ্ডা কণা। মন চাইলেও জানালা বন্ধ করল না রিক। নাকে আসছে কাঁচা মগজের বিশ্রী দুর্গন্ধ। নিজের রোমকূপ থেকেও এল মদের কুবাস। তবে মাথা ঠাণ্ডা করছে হিমশীত।

একটু পর থামল তুষারপাত।

কিছুক্ষণ পর রানওয়েতে দেখা গেল ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এয়ারপোর্ট কর্মীরা। শক্তিশালী হিটার ও কোদাল লাগানো ট্রাক সরিয়ে দিচ্ছে ভারী তুষার। ভেণ্ডার মেশিনের কাছে মাঝে মাঝে যাওয়া ছাড়া আর কোনওদিকে যায়নি মাসুদ রানা। নিজে পাথরের মূর্তি রিক, জায়গা থেকে নড়েনি। থরথর করে কাঁপছে শীতে। দেখল সিট ছেড়ে রাখস্যাক কাঁধে তুলল রানা। পেরোল ডিপারচার ডোর। আবারও এসইউভি থেকে নামল রিক। কোটের পকেটে ম্যাগনাম। সিটেই থাকল মসবার্গ শটগান। দুমিনিট পেরোবার আগেই বুকিং ডেস্কে পৌঁছে গেল রিক।

একটু পর ফ্লাইট আছে, জানাল টিকেট বিক্রেতা। সাহস নেই রিকের চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। দানবের মত লোকটার গা থেকে ভুসভুস করে বেরোচ্ছে বিশ্রী বাজে গন্ধ। কমপিউটারের কিবোর্ডে টোকা দিয়ে বলল সে, খালি আছে কয়েকটা সিট। আপনি চাইলে একটা সিট বুক করতে পারি।

কতক্ষণ পর পরের ফ্লাইট? জানতে চাইল রিক।

দুঘণ্টা পর, স্যর, চোখে চোখ তুলেও চট করে অন্য দিকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল কর্মচারী। যদি তুষার বন্ধ থাকে।

আমাকে পরেরটার টিকেট দাও, জানাল রিক। প্যান্টের পকেট থেকে ডলারের বাণ্ডিল নিয়ে টিকেটের মূল্য পরিশোধ করল সে। ওখান থেকে সরে গেল রেস্টরুমে। আয়নায় নিজেকে দেখে বুঝল, কেন আড়চোখে দেখছিল টিকেট বিক্রেতা। ওর গায়ে ধুলোবালি ও কাঁচের টুকরো। ভাল করে ধুয়ে নিল চুল ও মুখ। বেসিনে দুহাত রেখে অনেকক্ষণ নিজেকে দেখল আয়নায়। একসময়ে স্বাভাবিক হলো লালচে দুই চোখ। ক্ষণিকের জন্যে কাকে যেন দেখল আয়নায়। ওই লোকের একটা চোখের মণি বাদামি, অন্যটা ফ্যাকাসে নীল।

হাজির হয়েছে নিকের প্রেতাত্মা। রিক যখন দুহাতে গলা থেকে ছিঁড়ে দেবে মাসুদ রানার মাথা, তখনও সঙ্গে থাকবে সে।

.

২২.

আর্লিংটনের একটু দূরে ছোট এক মোটেলে উঠেছে রানা। দরজায় টোকার আওয়াজে বলল, একমিনিট!

বিছানায় বসে আছে ও, পাশে ওয়ালথার পি.পি.কে.। উঠে গিয়ে পিপহেল দিয়ে দেখল বাইরেটা।

দুই বেণ্ডার ভাইকে না দেখলে কেউ কেউ বলতে পারে, পৃথিবীর প্রকাণ্ডদেহীদের দুজন জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। জন অর্ধেক জাপানি, বাবার দিক থেকে আমেরিকান। দৈর্ঘ্যে সাড়ে ছয় ফুট।

তার চেয়েও তিন ইঞ্চি উঁচু কালো-মানিক বাড।

জন সুঠাম ও দুর্দান্ত হ্যাণ্ডসাম।

আর বাড যেন তরুণ মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর যমজ। ওকে চালিয়ে দেয়া যাবে তার আপন ভাই হিসেবে।

ওদের দুজনের পরনে টি-শার্ট, ডেনিম জ্যাকেট ও জিন্স প্যান্ট। বাডের কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ।

দরজা খুলে রানা সরতেই ভেতরে ঢুকল জন ও বাড। তার আগে দেখে নিয়েছে করিডোরের দুপাশ। ঘুরে এসেছে চারপাশ থেকে। আপাতত বিপদের সম্ভাবনা নেই।

দেখা হওয়ার পর বরাবরের মত রানাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি দুবন্ধু। দরুজা বন্ধ করে ঘুরতেই ওকে জড়িয়ে ধরল বাড। তাতে প্রকাশ পেল আন্তরিকতা। রানা আলিঙ্গন মুক্ত হতেই ওকে জাপ্টে ধরল জন। রানা ভাবল, মরেছি আজ ভালুকদুটোর মৃত্যু-আলিঙ্গনে! মনে পড়ল রিক বেণ্ডারের লাথি পড়েছে পাঁজরে। আপত্তি তুলল ও, ছাড়-ছাড়, খুন করবি নাকি!

ব্যথা দিয়ে ফেলেছি? কোথায় লেগেছে? লজ্জা পেয়ে পিছিয়ে গেল জন। সরু কাঠবাদামের মত চোখে দুশ্চিন্তা।

তেমন কিছু না, বলল রানা। তবে লাথ মেরে, আমার বুক আর পিঠ এক করে দিতে চেয়েছিল।

বলিস কী!

বাদ দে, চেয়ারে বসল রানা। বিছানায় বসেছে জন ও বাড। তোরা না বললি ন্যাশ ময়নিহান সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছিস?

কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে ওটা থেকে আসুস বি ৮৪৩ ইউএ সিক্সথ জেন কোর ল্যাপটপ বের করল বাড হিগিন্স। দেয়ালের সকেটে আটকে নিল কেবল। এ মোটেলটাকে রানার বেছে নেয়ার বড় একটি কারণ; প্রতিটি ঘরে রয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস। একটু পর কিবোর্ডে ঝড় তৈরি করল বাড়। মিনিটখানেক পর স্ক্রিন ঘুরিয়ে দিল রানার দিকে।

উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী ন্যাশ ময়নিহান, আমাদের প্রিয় মাল্টি মিলিয়োনেয়ার, জানাল জন।

ময়নিহান সুদর্শন লোক। গায়ের রং রোদে পোড়া ব্রোঞ্জের মত। সুঠামদেহী। চুল ছোট করে ছাটা। জায়গায় জায়গায় ধূসরের ছোঁয়া। পরনে দামি পোশাক। নীল নেভি স্যুট, সাদা শার্ট, হালকা লাল টাই। যে-কেউ বলবে ভদ্রলোক। ছবিতে হাসছে সে। কিন্তু ওই হাসির ছোঁয়া নেই শীতল চোখে। ও-দুটোয় আক্রমণে প্রস্তুত হাঙরের নির্বিকার দৃষ্টি।

স্ক্রিনে আরেকটা ছবি আনল বাড।

কমবয়সী ময়নিহানের ছবি। চুল কুচকুচে কালো। চোখে একই দৃষ্টি। পরনে কমলা রঙের জাম্পস্যুট। নামের নিচে কয়েকটি সংখ্যা।

জেল খেটেছে, বলল বাড, ইউএস হাইওয়ে ৭৫ ধরে গেলেই চোখে পড়বে ফেডারাল প্রিযন সিগোভিল। ডালাস থেকে দক্ষিণ-পুবে। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

মিনিমাম সিকিউরিটি, বলল জন, ময়নিহান ছিল মাত্র কিছু দিনের জন্যে। সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়নি।

কী কারণে জেল হয়? জানতে চাইল রানা।

গলা কেটেছিল এক লোকের,বলল বাড।

অথচ রাখা হলো মিনিমাম সিকিউরিটি প্রিযনে?

গুরুত্বপূর্ণ রাজসাক্ষী, বলল বাড, তলিয়ে দিয়েছে তার মালিকদের, সঙ্গে তাদের টেক্সাস সিণ্ডিকেট। খুনি ফিলিক্স ভাইদের জেলের ব্যবস্থা করেছে বলে তার খুনের অভিযোগ হালকাভাবে বিচার করে আদালত। নিরাপদে আরাম করে পার করেছে তিনটে বছর।

বেঈমানদেরকে পছন্দ করে না কেউ, বেরোবার পরে বাঁচল কীভাবে? জানতে চাইল রানা।

ক্ষুরওয়ালা জল্লাদকে সবাই ভয় পায়, বলল বাড।

জল্লাদের মতই নির্বিকারভাবে গলা কাটে, বলল জন। সে ছিল টেক্সাস সিণ্ডিকেটের টপ টেরর। ওর মালিকরাও ওর সামনে সামলে রাখত মুখ। ঠাণ্ডা মাথার খুনি। চারপাশের সবাই নাম দিয়েছে: ক্ষুরধার। টেক্সাসে এমন কোনও রঙবাজ নেই যে টক্কর দেবে তার সঙ্গে।

তা ছাড়া, আগেই চারপাশে ছিল হাত, বলল জন, ফিলিক্সদেরকে সরাবার পরিকল্পনা হয়েছিল বহু আগেই। সেটা করে ডিইএ। সঠিক সময়ে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে টেক্সাস সিণ্ডিকেটের বড় নেতাদের। আর তাদের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে ক্ষুরধার ন্যাশ ময়নিহানকে।

কিন্তু অপরাধী জগতে শূন্যতা তৈরি হলে চট করে পূরণ করে অন্য অপরাধীরা, বলল রানা। এক্ষেত্রে তেমন হলো না কেন? তিন বছর জেলে ছিল ময়নিহান।

গুড পয়েন্ট, রানা, বলল বাড, কিন্তু ন্যাশ ময়নিহান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। দূরে থাকল অন্যান্য সিণ্ডিকেট।. হাসতে হাসতে এসে ডালাস দখল করে নিল লোকটা।

বেশিদিন লাগল না অন্যান্য সিণ্ডিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নিতে, বলল জন। কেউ কেউ বলতে লাগল, লোভী ফিলিক্সদেরকে শেষ করে কাজের কাজই করেছে ময়নিহান।

তার মানে ফিলিক্সদের জুতো পরে ঘুরতে লাগল সে? জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল বাড। ঠিক তা নয়। ডিইএর লোকের সঙ্গে লড়ে মরতে আপত্তি আছে সিণ্ডিকেটের হেডদের। ডালাসকে এড়িয়ে গেল তারা। এদিকে ময়নিহান তিন বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে দেখল, ড্রাগ ও পতিতালয় দখল করতে কামড়াকামড়ি করছে রাস্তার মস্তানরা। এতটা নিচে নাক গলাল না ময়নিহান। মন দিল রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়। হুড়মুড় করে আসতে লাগল কোটি কোটি ডলার। তুই তো দেখেছিস, রানা, গপ করে গিলে নিয়েছিল লিটল ফোর্ক শহর। ওই ধরনের প্রজেক্টে তার পার্টনার হিসেবে আছে শক্তিশালী কয়েকটা সিণ্ডিকেট।

লিটল ফোর্কের মত আরও প্রজেক্ট আছে তার? জানতে চাইল রানা।

বেশ কয়েকটা, বলল জন।

লোকবলের অভাব নেই, বলল বাড। অসংখ্য বেণ্ডার বা ম্যাকলাস্কি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

তবে আমাদের ক্ষেত্রে তাদেরকে কাজে লাগাবে না সে, বলল জন, ফিলিক্সদের ফাঁসিয়ে দিয়েছে বলে ময়নিহানের কাছে কৃতজ্ঞ অন্যান্য সিণ্ডিকেটের হেডম্যানরা। বিপদ এখানেই। ন্যাশ ময়নিহান সাহায্য চাইলে তাদের সেরা খুনিকে পাঠাবে তারা। ধরে নিতে পারিস, এ দেশের টপ টেররদের বিরুদ্ধে লড়ব আমরা।

আসুক, বলল বাড, নিজ এলাকার বাইরে সুবিধে করতে পারে না বেশিরভাগ খুনি।

তা ছাড়া, দেশের প্রতিটা সিণ্ডিকেট থেকে সেরা খুনি আসবে, তা না-ও হতে পারে, বলল রানা, নিজেদের ভেতর থাকবে তাদের প্রতিযোগিতা। আমাদেরকে খোঁজার চেয়ে নিজেরা লড়বে বেশি।

কিন্তু জীবন শেষ করতে একটা বুলেটই যথেষ্ট, মনে করিয়ে দিল জন।

কথা ঠিক, নড়েচড়ে বসল বাড।

মাত্র একজন খুনি পাঠাবে বলেনি ন্যাশ ময়নিহান, ভাবছে রানা। তারা হবে কজন, তা দেখা যাবে ভবিষ্যতে। আপাতত ওই বিষয়ে ভেবে লাভ নেই। যাই করুক, পালিয়ে যাবে না বা লুকিয়ে পড়বে না ওরা।

আমরা গুরুত্ব দেব ময়নিহানকে, মন্তব্য করল জন। হয়তো তাকে বাগে পেতে কষ্ট হবে। শুনেছি, ক্ষুর দিয়ে মানুষের গলা কাটতে ওস্তাদ সে। তেমনি জীবিত শত্রুর মুখ থেকেও ছাড়িয়ে নেয় চামড়া। ওর চেয়ে নিষ্ঠুর লোক নাকি নেই ডালাসে।

ক্রাইম সিণ্ডিকেটের হওয়া কঠিন, বলল বাড, বদনামটা এমনি এমনি হয়নি।

নিনা ভেঞ্চুরার মেসেজ পেলি? জানতে চাইল জন।

 মাথা নাড়ল রানা।

নম্বর দে, দেখি জানা যায় কি না ওই ফোন এখন কোথায়, বলল বাড।

ওর হাতে ফোনটা দিল রানা। মনে হয় না এতে কাজ হবে। নিশ্চয়ই একই চেষ্টা করে দেখেছে ময়নিহান।

হাসল বাড। কিন্তু সে কোথায় পাবে আমার কন্ট্যাক্ট? নম্বর মুখস্থ করে রানার কাছে ফেরত দিল ফোন। ওটা কাছে রাখিস। ফোন করতে পারে মেয়েটা।

জ্যাকেটের পকেটে মোবাইল ফোন রেখে বলল রানা, আরেকটা কল পাব ভাবছি।

ন্যাশ ময়নিহান? জানতে চাইল জন।

জুডির ফোন। যোগাযোগ করবে সে। ওর, জানার কথা এই ফোন এখন আমার কাছে।

তা হলে ওটা সরিয়ে ফেলাই ভাল, বলল জন। একটু চেষ্টা করলেই আমাদের লোকেট করতে পারবে।

হয়তো বাডের মত কন্ট্যাক্ট নেই তার, বলল রানা।

তা বলিনি, আপত্তি তুলল বাড, বলতে চেয়েছি, অ্যাকটিভ ফোন খুঁজে বের করা সহজ। তবে নিনার ক্ষেত্রে ওই ফোন খুঁজতে হলে সাহায্য নিতে হবে ওর সার্ভিস প্রোভাইডারের। অতটা ওপর লেভেলে হয়তো লোক নেই ময়নিহানের।

অত চিন্তা করিস না, জন, বলল রানা। ময়নিহান আমাকে খুঁজে বের করার আগে নিজেই আমি পৌঁছে যাব তার কাছে।

যদি এ এলাকায় থাকে, বলল জন।

ডালাসেই আছে, বলল রানা, নিজ আঙিনায় নিজেকে নিরাপদ ভাবছে।

কঠিন হবে না খুঁজে নেয়া, বলল বাড। একবার পাবলিক রেকর্ডস্ সার্চ করলেই পাব। রেজিস্ট্রি অফিসে গেলেই জানব কোথায় কী আছে তার।

অথবা পাবি ফোন বুকে। বিছানার পাশের টেবিল থেকে ইয়েলো পেজের বইটা নিল রানা। ধপ করে ফেলল বাডের কোলে। ন্যাশ ময়নিহান বড় ব্যবসায়ী। এই বইয়ে তার নাম-ঠিকানা থাকবে না, তা হতেই পারে না।

মৃদু হাসল বাড। কমপিউটার বন্ধ করে মন দিল টেলিফোন ডিরেক্টরিতে।

কখনও কখনও পুরনো উপায় ভাল, মন্তব্য করল রানা।

.

২৩.

 লিটল ফোর্ক থেকে যোগাযোগ করেছে দলের লোক, তাতে চমকে গেছে ন্যাশ ময়নিহান। রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল রানা। চুরমার করেছে ওটা। ভেতরে যারা ছিল, বাঁচতে পারেনি কেউ। খতম হয়েছে ময়নিহানের স্যাঙাৎ হেনরি রাইডার। লাশ হয়েছে জাজ হোল্ড। বেঁচে নেই শেরিফ ম্যাকলাস্কি। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না রিক বেণ্ডারকে। ধরে নেয়া যায় বেঁচে নেই সে-ও। এমন কেউ নেই, সামলাবে ঝামেলা। লিটল ফোর্কে গিজগিজ করছে স্টেট ট্রুপার ও ফ্র্যাঙ্কফোর্টের অফিস থেকে আসা এফবিআই ফিল্ড এজেন্টরা।

তাড়া খাওয়ার আগেই ফিরছে পেশাদার খুনিরা।

 যা ভেবেছি, তার চেয়ে দেখছি অনেক বিপজ্জনক লোক এই মাসুদ রানা, বলল ময়নিহান, জরুরি ভিত্তিতে খুন করতে হবে ওকে। ফোন রেখে জুডিকে দেখল সে। মাসুদ রানা এখন কোথায়? তার সম্পর্কে কতটা জানো?

জুডির হাতে হ্যাণ্ডকাফ না থাকলেও এখনও সে বন্দি। বসে আছে চেয়ারে। ওর: ওপর চোখ রাখছে দুজন খুনি। হাত হোলস্টারের কাছে। জুডি এরই ভেতর বুঝে গেছে, অনুমতি না নিয়ে চেয়ার ছাড়তে পারবে না। টয়লেটে গেলেও সঙ্গে থাকছে একজন। দেয়া হচ্ছে খাবার ও পানি, তবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের সব গ্লাস, বাসন, চামচ। 

তার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না, বলল জুডি।

হাতদুটো পিঠে বেঁধে ওর সামনে থামল ময়নিহান। রিক বেণ্ডারের মত করে ভয় দেখাতে চাইছে না। ঠোঁটে ফুটল দয়ালু হাসি। তাতে তাকে আরও ভয়ঙ্কর লাগল জুডির।

যতটুকু জানতে পেরেছ, তা জানাও, বলল ময়নিহান।

এটা জানি, মস্তবড় বিপদে পড়েছ। যেসব অপরাধ করেছ, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পুলিশ অফিসারকে কিডন্যাপ করা। আগ্রহী হয়ে উঠবে এফবিআই। ফলে জীবনের বাকি দিন পার করবে জেলখানায়।

মৃদু হাসল ময়নিহান। সামনে আনতেই দেখা গেল তার ডানহাতে ক্ষুর। চেয়ারে গুটিসুটি হয়ে গেল জুডি।

হয়তো আর কখনও তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, অফিসার ব্ল্যাকউড। হাসিটা চওড়া হলো ময়নিহানের। কেউ জানে না তুমি এখানে। আইন মেনে লিটল ফোর্কে পুলিশী কর্মকাণ্ডে ছিলে না। সোর্সের কাছ থেকে জেনেছি, তুমি আছ ছুটিতে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ খোঁজ করলে জানবে ছিলে কেন্টাকিতে। এখন টুকরো টুকরো করে তোমাকে বিরাট এই এলাকায় ছড়িয়ে দিলে কে জানবে তুমি কোথায়?

আমার কলিগদের বলেছি, যাচ্ছি বড়বোনের সঙ্গে দেখা করতে। ওখানে না পেলে সোজা তোমার এখানে খুঁজবে ওরা। তুমি প্রথম লোক, যার ওপর চোখ পড়বে এফবিআই এর।

আমার কাছে আসবে কেন?

কারণ তাদেরকে বলেছি, আমার বড়বোনের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে তোমার।

ও, ওই সামান্য টাকার বিল?

হ্যাঁ। নিশ্চয়ই সেজন্যে পাগল হয়ে ওকে খুঁজছ না? নতুন তথ্য চাইছে জুডি। এসবের ভেতরে অন্য কিছু আছে।

মাথা নাড়ল ময়নিহান। তোমার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানাব, কিছুই জানি না। গত দুসপ্তাহ হলো ডালাস ছেড়ে কোথাও যাইনি। সাক্ষ্য দেবে শতখানেক লোক। ক্ষুর তুলে ফলা দেখছে ময়নিহান। যথেষ্ট হয়েছে, জুডি, ধৈর্য হারাতে বসেছি। এবার মুখটা খোলো।

প্রায় অচেনা লোক মাসুদ রানা। ভাড়া করেছি, যাতে খুঁজে বের করে আমার বড়বোনকে।

টাইয়ে অদৃশ্য সুতো দেখেছে, এমন ভঙ্গিতে বুকের কাছে ক্ষুর চালাল ন্যাশ ময়নিহান। সাধারণ এক ডিটেকটিভ? গম্ভীর হয়ে গেল তার চেহারা। তাকে কোথায় পেয়েছ?

বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছি।

মিথ্যা, জুডি, আবারও হাতের ভেতর ক্ষুর লুকিয়ে ফেলল ময়নিহান। চলে গেল জুডির পেছনে। হাত রাখল কাঁধে।

জুডির মনে হলো তৃক স্পর্শ করল কোনও শীতল সাপ। শিউরে উঠতে গিয়েও থেমে গেল।

তুমি ওকে আগে থেকেই চিনতে।

না, ভুল ভাবছ।

কোথায় পরিচয় হয়েছে?

 নিউ ইয়র্কে।

জুডির এক গোছা চুল আঙুলে পেঁচিয়ে নিল ময়নিহান। নিউ ইয়র্কেই পরিচয় হলে ফ্লোরিডায় কী করছিলে?

মাথা সামনে বাড়িয়ে নোকটার আঙুল থেকে চুল ছুটিয়ে নিল জুডি।

খোঁজ নিয়েছি। তোমরা টাম্প থেকে বিমানে করে গেছ লিটল ফোর্কে। তার আগে বিমানে করে নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছ একা। নিউ ইয়র্ক থেকে আসেনি মাসুদ রানা। ফ্লোরিডাতেই ছিল। আমি কি মিথ্যা বলেছি, জুডি?

দেখা হয় ফ্লোরিডায়। ওদিকে তার কাজ ছিল।

 জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ তুলল ময়নিহান। ব্যাপার কী, জুডি? তাকে বাঁচাতে চাইছ কেন? সে না সাধারণ এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ? সেক্ষেত্রে তার জন্যে এত মিথ্যা কেন? আবারও জুডির চুলের গোছা হাতে নিল সে। তোমরা কি পরস্পরকে ভালবাস?

না, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল জুডি। সরিয়ে নিল মাথা।

এবার আঙুলে ভালভাবে চুল পেঁচিয়ে নিল ময়নিহান।

আগেই তো বলেছি, মাত্র পরিচয় হয়েছিল।

তা হলে রেগে উঠছ কেন? তোমার চুল স্পর্শ করছি। বলে? নাকি সত্যিই ভালবেসে ফেলেছ মাসুদ রানাকে?

কোনও কারণ নেই ভালবাসার, চাপা স্বরে বলল জুডি, পাগলের মত বকবক করছ কেন?

ওর সঙ্গে কথার সময় মনে হয়েছে, সে তোমাকে পছন্দ করে।

ওর সঙ্গে কথা হয়েছে? প্রায় ফিসফিস করল জুডি। কী বলেছে?

নিষ্ঠুর হাসল ময়নিহান। জুডি পুলিশ অফিসার। এ ধরনের বিপদের জন্যে ট্রেনিং আছে। এজন্যেই ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলাপ শুরু করেছে সে। টের পেল, একবার শিউরে উঠল মেয়েটা। ময়নিহান বুঝল, যা বলছে, তার চেয়ে অনেক বেশি জানে জুডি।

তোমাকে ফিরে পেতে চায় রানা। হয়তো প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না। এতে অবাক হচ্ছ না? তোমরা না প্রায় অচেনা দুজন মানুষ?

বড়বোনকে খুঁজতে পয়সা দিচ্ছি ওকে, বলল জুডি। আমি তার খাবারের টিকেট। কেন আমাকে ফেরত চাইবে না?

না, জুডি, এর ভেতর আরও কিছু আছে। তোমাকে ভালবাসে মাসুদ রানা। আমার ধারণা, তুমি নিজেও তাকে ভালবাস। আর তাই, যা বলছ, তার চেয়ে বেশি জানো।

মাথা নাড়ল জুডি। সেটা হলো বেশি দ্রুত এবং আনাড়ির মত। আমি তো আগেই বলেছি…।

বলেছ মাত্র পরিচিত হও তোমরা। আবারও জুডির কাঁধে হাত রাখল ময়নিহান। ক্ষুরের চেপ্টা দিক বেলাল মেয়েটার কলারবোনে। ভুলিনি তোমার কথা। তবে অনেক সময়ে প্রথম দর্শনেই পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ হয় মানুষের। আমি আবার পুরনো আমলের রোমান্টিক লোক। বিশ্বাস করি এখনও সম্ভব প্রথম দর্শনে প্রেম।

চুপ থাকল জুডি। ময়নিহান ওর কলারবোন পেরিয়ে আরও নিচে নামাল ক্ষুর। ওটা থামল সুউচ্চ বুকে। এক সেকেণ্ড পর ঢুকে পড়ল ব্রার স্ট্র্যাপের ভেতর। সরে গেল ব্রা। দেখা গেল গাঢ় গোলাপি রঙের স্তনবৃন্ত। বুক ঢাকতে হাত তুলল জুডি, কিন্তু ক্ষুরের চেপ্টা দিক দিয়ে ওর আঙুল সরিয়ে দিল ময়নিহান। ঘুরে তাকাল দুই গার্ডের দিকে। তারা কঠোর মনের বলেই জুডির পাহারাদার হিসেবে রেখেছে ময়নিহান। নরম সুরে বলল সে, ছেলেরা, কতক্ষণ ধরে চেনো জুডিকে?

কয়েক ঘণ্টা, বস, বলল ডানদিকের জন।

ওকে অপরূপ সুন্দরী লাগছে?

বিছানায় পেলে ধন্য হতাম, বলল ডানদিকের লোকটা। অন্যজন চুপ।

জুডির দিকে তাকাল ময়নিহান। ধীরে ধীরে ঘুরছে চেয়ার ঘিরে। বুঝতেই পারছ, জুডি, কত দ্রুত একজন অন্যের প্রতি আকর্ষিত হয়! সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলতে পেরেছে আমাদের প্রিয় লোগান টার্সন।

সত্যিকারের কাদা মাখা শুয়োর! তুমি নিজেও তাই!

তা ঠিক। তবে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। তুমি বরং খুলে বলো কে এই মাসুদ রানা।

চোখ বুজল জুডি। কোটি কোটি মানুষের একজন সে।

ক্ষুর স্পর্শ করল জুডির চোয়াল। এখন যদি তোমার চেহারা ফালি ফালি করে দিই, তবুও কি তোমাকে ফেরত চাইবে মাসুদ রানা?

গালের মাংসে শীতল ধাতু ডেবে বসলেও সরার চেষ্টা করল না জুডি। ত্বক কেটে বেরিয়ে এল একফোঁটা রক্ত। সেক্ষেত্রে পয়সা পাবে না সে। তাতে আরও খেপে যাবে।

সরে গেল ময়নিহান।

ঠিক জায়গায় ব্রা বসিয়ে নিল জুডি।

দারুণ দেখালে, জুডি, বলল ময়নিহান। রক্ষা করতে চাও ভালবাসার মানুষটাকে। মন্দ নয়।

সে আমার ভালবাসার পাত্র নয়।

ঘরের আরেকপ্রান্তে গিয়ে দুহাত বুকে ভাঁজ করল ন্যাশ ময়নিহান। দেখছে মেয়েটাকে। কমুহূর্ত পর বলল, এই প্রথম মিথ্যা বললে না, জুডি। বুঝতে পারছি, পরস্পরকে বুঝতে শুরু করেছি আমরা।

ময়নিহানের দিকে না চেয়ে মেঝেতে চোখ রাখল জুডি। গাল থেকে এক ফোঁটা রক্ত নামছে চিবুকে।

লোগানের দিকে মাথার ইশারা করল ময়নিহান। একটু আগে যা বললে; সেই কাজে ওকে ব্যবহার করতে পারো। তথ্য চাই আমার। তবে খেয়াল রাখবে, মরে যেন না যায়।

ঝট করে চোখ তুলে তাকাল জুডি।

 কাঁধ ঝাঁকাল ময়নিহান। রানা যদি তোমার ভালবাসার মানুষ না হয়ে থাকে, তো অন্য কেউ তোমাকে শারীরিক আনন্দ দিতেই পারে- তাই না?

চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাল জুডি, কিন্তু সেসবে কান না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ময়নিহান। পেছনে আটকে দিয়েছে দরজা। লোগান সত্যিকারের শুয়োর, বস্ সুযোগ করে দেয়ায় যে-কোনও সময়ে হামলে পড়বে এখন জুডির ওপর। পেট থেকে বের করতে চাইবে সব কথা। তাতেও মেয়েটা মুখ না খুললে ক্ষুর দিয়ে ওর শরীর কাটবে ময়নিহান। তখন উপায় থাকবে না নীরব থাকার।

সিঁড়ি বেয়ে তেতলার প্রশস্ত লিভিংরুমে চলে এল ন্যাশ ময়নিহান। পেরোল ছোট ভেস্টিবিউল। সামনেই বারান্দা। রেলিঙে দুহাত রেখে দেখল চারপাশ। ডালাসে নেই সে। এই কাঠের মস্ত বাড়ি বিশাল এক র‍্যাঞ্চের মাঝে। একমাইল দূরে গাছের সারির ওদিকে র‍্যাঞ্চের তারকাঁটার বেড়া। কাউকে আসতে হলে পেরোতে হবে খোলা এলাকা। মাসুদ রানা এলে অনেক আগেই তাকে দেখবে তার লোক।

নিনা ভেঞ্চুরা সহ, অথবা একা আসবে ওই লোক!

মাসুদ রানার মুখোমুখি হওয়ার উদগ্র আগ্রহ জন্মেছে ময়নিহানের মনে। এটা ঠিক, লোকটা ব্যবসার জন্যে খুব ক্ষতিকর, তবে এর আগে ওর মৃত এত করিৎকর্মা মানুষ দেখেনি সে।

ময়নিহান ভাবছে, ব্যবসা আর টাকার নেশা নষ্ট করেছে। তার মুক্ত মনটাকে। আজকাল মনে হয় যেন সে বন্দি। ইচ্ছে করে আবার ফিলিক্সদের হতে। আগের মতই করবে যা খুশি। বিদ্যুদ্বেগে চালাবে প্রিয় ক্ষুর। কচাকচ কাটবে মানুষের গলা। আসলে রানার বিরুদ্ধে লড়লে নিজেকে তার মনে হবে সত্যিকারের পুরুষ।

দূরের আউট বিল্ডিঙের দিকে তাকাল ন্যাশ ময়নিহান।

আগে এই র‍্যাঞ্চের একমাত্র মূলধন ছিল অসংখ্য গরু। এখন মেশিন দিয়ে সেগুলোর মাংস কুচি কুচি করে ক্যান-এ ভরে বিক্রি করা হচ্ছে দেশের নানান এলাকায়। হয়তো মাসুদ রানাকেও ওভাবে কুচি কুচি করবে সে। ক্যানে ভরে ছড়িয়ে দেবে সারা দেশে।

.

২৪.

 ক্যাপিটাল সিটি এয়ারপোর্টে নামার পর ভীষণ রেগে গিয়েছিল রিক বেণ্ডার। অস্ত্র নিয়ে বিমানে উঠবে তার উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষকে। দরকারী কাগজপত্রও ছিল না। শেষে এক স্টোরেজ ফ্যাসিলিটির স্ট্রংক্সে রেখেছে তার অস্ত্র। সংগ্রহ করবে বাড়ি ফেরার সময়। এরপর কানেক্টিং ফ্লাইটে চেপে রওনা হয়েছে ডালাসের ফোর্ট ওঅর্থ এয়ারপোর্ট লক্ষ্য করে। একমাত্র উদ্দেশ্য: নির্মম হত্যা। ভাল হতো ম্যাগনামটা সাথে থাকলে। তবে তা খুব বড় কোনও সমস্যা নয়। আসলে তো খালি হাতে মাসুদ রানাকে খুন করবে সে।

অবশ্য হাতে একটা আগ্নেয়াস্ত্র চাই। প্রতিদ্বন্দ্বী কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাকে খুন করতে হবে না? রানাকে হত্যার সময় কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার বুকে বুলেট গেঁথে দিতে দেরি করবে না রিক।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে চাপল সে। সোজা যাবে কাছের কোনও রোডহাউসে।

মেয়েলোক চাই? জানতে চাইল শুয়োরের মত লালচে মোটা ড্রাইভার। আঙুলে নিকোটিনের কালচে দাগ। একহাতে রিয়ার ভিউ মিরর ঠিক করে দেখল রিক বেণ্ডারকে।

হ্যাঁ। ওরকম কোনও জায়গাতেই যাও। গা গরম করে দেয়া নাচুনে মেয়েলোক চাই।

ভাল জায়গা চিনি।

বিশ মিনিট পর ড্রাইভারের হাতে ভাড়া ও দশ ডলার টিপস দিল রিক। নেমে পড়ল মামা লিলি-এর পার্কিংলটে। রাতের আঁধারে ওই বাড়ি হবে জমজমাট। জ্বলবে নিয়ন সাইন, ভেতরে থাকবে বিশাল স্তনের কয়েকটি মেয়ে। আঁকাবাঁকা হরফে লেখা: ওরা খুবই দক্ষ! দারুণ মজা! চলে আসুন!

আপাতত ঝিম ধরে আছে মামা লিলিয। পার্কিংলটে মাত্র দুটো গাড়ি। পুরনো এক পন্টিয়াক, অন্যটি কফি রঙা ক্লাসিক মডেলের একটা ক্যাডিলাক। পুরনো হলেও দেখতে বেশ।

জানালায় কনুই রাখল ড্রাইভার। মামা লিলিয কখনও বন্ধ হয় না, পেছন দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ন। খুঁজে নেবেন হেনিকে। রিকের মুখে একরাশ ধুলো ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল গাড়ি।

রিকের পরনে ভারী ওভারকোট। রীতিমত গরম লাগলেও গা থেকে-ওটা খুলল না। কোট বইতে গিয়ে একটা হাত আটকা পড়লে, যে-কোনও সময় আসতে পারে বিপদ। ওভারকোটের বোতাম খুলে মামা লিলিয-এর সদর দরজার দিকে চলল রিক।

আয়তাকার পোক্ত বাড়িটা কাঠের তৈরি। কবে যেন কালো রঙ করেছিল, জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। অস্বাভাবিক নিচু ছাত। এখানে যারা আসে, তাদের ভাল লাগবে না হাইওয়ে দিয়ে চলে যাওয়া সাধারণ মানুষের বিরক্তিভরা দৃষ্টি, তাই সামনে কোনও জানালা নেই। সদর দরজা আপাতত বন্ধ। হ্যাণ্ডেলে ঝুলছে একটা কাগজ। তাতে লাল রঙে মোটা করে আঁকা ডানদিকে যাওয়ার জন্য তীরচিহ্ন। না থেমে দুই গাড়ি পার হয়ে রিক চলে এল বাড়িটার পেছনে।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কঠোর চেহারার দুই যুবক। আকারে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশ বড়। পেশিবহুল। হাতে ও ঘাড়ে টাটু। চোখে নিস্পৃহ দৃষ্টি। এদের তুলনায় রিক রীতিমত দানব। ওকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিল না দুই যুরক। তাদের একজন খুলে দিল কবাট।

বাড়িটার বাইরের মত ভেতরের রঙও কালো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টেবিল ও চেয়ার। মাঝে উঁচু এক মঞ্চ। ওখানে সন্ধ্যার পর নাচবে স্ট্রিপাররা। ঘরের আরেক প্রান্তে বার কাউন্টারের উপর সিলিঙে জ্বলছে একটা মাত্র বা। কাউন্টারের পেছনে এক মহিলা। মিউট করে দেখছে টিভি। একবারের জন্যেও রিককে ঘুরে দেখল না মহিলা।

ঘরে কারা আছে চোখ বুলিয়ে বুঝে নিল রিক।

সব মিলে খদ্দের হাফ ডন। দূরে একা বসে ড্রিঙ্ক করছে বয়স্ক এক লোক। অন্য পাঁচজন যুবক। বসেছে ঘরের পেছনের এক বুথে।

জ্যাকপট, নিচু গলায় বিড়বিড় করল রিক। বয়স্ক লোকটা বা মহিলাকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি ওই পাঁচ যুবকের সামনে হাজির হলো সে। এদের মত যুবকদেরকেই খুঁজছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েস করে বসে আছে সবাই। টেবিলের ওপর একগাদা বিয়ারের সবুজ বোতল। রিক টেবিলের সামনে থামতেই কঠোর চোখে ওকে দেখল তারা। মনে হলো না বিন্দুমাত্র কেয়ার করছে। অবশ্য রিক বুঝে গেল, দৈহিক আকার দিয়ে চমকে দিয়েছে ওদের সবাইকে।

ইচ্ছে করেই টেবিল ঘেঁষে দাঁড়াল রিক। ওপর থেকে তাকাল যুবকদের দিকে। ওকে দেখছে না এমন ভাব করার উপায় নেই তাদের। এক এক করে প্রত্যেকের চেহারা দেখল রিক। কড়া চোখে ওকে দেখছে তারা।

কথা বলতে চাইলে বলব কার সঙ্গে?

সেই লোক আমি, দলের মাঝ থেকে বলল এক যুবক।

এ-ই দলনেতা, বুঝল রিক। নিজের নিরাপত্তার জন্যে দুদিকে রেখেছে দুজন করে। বয়স ত্রিশ মত। খুলি কামড়ে আছে ঘন কালো চুল। শরীরে রেড ইণ্ডিয়ান রক্ত আছে। দুদিকের অন্য চারজন বয়সে কম। ছেলেমানুষ, তবে নিজেদের ভাবছে পুরুষমানুষ।

বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে রিক বলল, আমার একটা আগ্নেয়াস্ত্র দরকার।

তুমি কি পুলিশ? জানতে চাইল নেতা।

আমাকে অতটা খারাপ মনে হয় তোমার?

ভাবলে কেন যে আমার কাছে অস্ত্র আছে?

নীরবে তার চোখে তাকাল রিক। বুঝে গেছে, নাইট ক্লাবের বাউন্সার এই লোক। এদেরকে ছাড়া চলে না এই ধরনের পতিতালয়। কেউ বিনা পয়সায় স্ট্রিপারদের ন্যাংটো করতে চাইলে, প্রয়োজনে লাথিয়ে তার ডিমদুটো ফাটিয়ে দেবে এরা। পয়সা ছাড়া কিছুই হয় না এখানে।

পয়সা ছাড়বে কত? জানতে চাইল লোকটা।

তোমার কাছে কী আছে, তা দেখে তারপর ঠিক করব। রিক বুঝল, কথাটার ওজন মাপছে এমন ভঙ্গি নিয়েছে লোকটা। সবই নাটকের অংশ। ঘুরে দরজার দিকে রওনা হলো রিক। বাদ দাও। আমার পয়সা যাবে আর কারও পকেটে।

একমিনিট!

টেবিল নড়ে ওঠার খড়মড় আওয়াজ পেল রিক। কাঠের মেঝেতে বুটের শব্দ। থমকে ঘুরে তাকাল ও।

নেতার দুপাশে দাঁড়িয়ে গেছে চার যুবক।

 এত তাড়া কীসের? হাসল দলনেতা। অস্ত্র, দরকার, তাই না? আমার কাছে আছে। অন্য কোথাও যেতে হবে না।

ফালতু কথার লোক নই; ব্যবসা করতে চাইলে করবে ঝটপট। বুক পকেটে চাপড় দিল রিক।

বারকাউন্টারের পাশের দরজা দেখাল দলনেতা। এসো আমার সঙ্গে।

তার পিছু নিল রিক। পেছন পেছন আসছে অন্য চারজন। থমকে এক এক করে তাদের চোখে তাকাল রিক। আমি ব্যবসা করব তোমাদের বসের সঙ্গে। তোমাদের সঙ্গে না।

রিক যেন মস্তবড় ভালুক, আর ওকে ঘিরে ফেলেছে কটা টেরিয়ার কুকুর। এরা কেউ একা কিছুই নয় দানবের কাছে। কিন্তু ভাবছে, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লে কাবু করতে পারবে। ফুলিয়ে ফেলেছে বুক। দলনেতা বললেই হামলে পড়বে অচেনা লোকটার ওপর।

কাছের যুবককে বেছে নিল রিক। দলে সবচেয়ে বড় সে। বামকানের লতি থেকে ঝুলছে ইয়াররিং। চোখে টিটকারি। মুখে ক্ষতচিহ্ন। আগে হেরেছে লড়াইয়ে। ডানহাত বাড়িয়ে তার গাল ধরে প্রচণ্ড এক চাপ দিল রিক। পরক্ষণে ধরল চোয়াল। আঙুল ডেবে গেল দুকানের নিচের নার্ভে। তীব্র ব্যথায় চিৎকার ছাড়ল সে। কিন্তু কঠিন হাতে ঘাড় চেপে ধরে তাকে পিছনে ছিটকে ফেলল রিক। পিছিয়ে একটু আগে ত্যাগ করা টেবিল ভেঙে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল যুবক।

আগেই বলেছি, নিজের কাজে যাও। কুত্তার মত পিছু নিতে হবে না।

কসেকেণ্ড দ্বিধায় পড়ল অন্যরা। পথ মাত্র দুটো। হয় হামলা করো, নইলে পিছিয়ে যাও। লড়তে আপত্তি নেই রিকের। আগে নড়ল বারকাউন্টারের মহিলা। হঠাৎ দৌড় দিয়েও তেলাপোকার মত ব্রেক কষে অন্যদিকে গেল সে।

খেপা কুকুরের মত স্যাঙাদের ধমক দিল দলনেতা, হচ্ছেটা কী? টাকা নিয়ে হাজির হয়েছে এক কাস্টোমার, আর তোমরা ঝামেলা করছ? বিদায় হও এখান থেকে!

কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে রিককে দরজা দেখাল সে। দলনেতার পেছনে ঢুকে কবাট বন্ধ করল রিক। ভাবছে, ওরা অপেক্ষা করবে। এরপর যখন ও বেরোবে, হাজির থাকবে বাইরের দুজনও। ওর অপেক্ষায় থাকবে ওরা ছয়জন।

গুদামের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রিক। দেয়ালের পাশে গাদি করে রাখা হয়েছে বিয়ার ও মদের কেস। এক কোণে তরল সাবান ও হাত মোছার কাপড়। চারপাশ দেখে নিল সে। পেছনের এক দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালল দলনেতা। এবারের ঘর জেলের সেলের মতই ছোট। ঘরের একপাশে ছোট জানালা। ওটা পেরেক মেরে বোর্ড দিয়ে বন্ধ করা। ছোট টেবিলের দুদিকে প্লাস্টিকের কম দামি দুটো চেয়ার। পায়া লোহার। টেবিলের ওপর কফির মগের দাগ। একপাশে স্টিলের কেবিনেট। প্যান্টের পকেট থেকে একগোছা চাবি নিয়ে নির্দিষ্ট চাবি বেছে বের করল লোকটা। তালা খুলে সড়সড় শব্দে টানল কেবিনেট।

তোমার নাম হেনি? জানতে চাইল রিক।

বরফের মূর্তি হলো লোকটা। চোখে সন্দেহ। অপেক্ষা করছে এরপর কী বলবে দানব।

টেবিলে রাখা মগ দেখাল রিক। ড্রাইভার বলল হেনির সঙ্গে দেখা করতে। মগেও একই নাম।

হাসল দলনেতা। হ্যাঁ, আমিই। মগটা প্রেযেণ্ট করেছে মেয়েদের একজন। বুঝতেই পারছ, ওকে সন্তুষ্ট করেছি বলে খুব খুশি ও।

চুপ করে থাকল রিক।

কেবিনের ড্রয়ার থেকে কাঠের বাক্স নিল হেনি। আরেকটা চাবি ব্যবহার করে খুলল তালা। ছোট্ট বাক্সের ড্রয়ার টানতেই দেখা গেল অস্ত্রগুলো।

টরাস আমার কাজে আসবে না, বলল রিক। অস্ত্রটা পাঁচ বুলেটের। নাম স্যাটারডে নাইট স্পেশাল। ওর হাতের তুলনায় অনেক ছোট। অন্যদুটো নেব।

সেমি-অটোমেটিক পিস্তলদুটো বের করল হেনি। প্রথমটা ড্যান ওয়েসন। পয়েন্টম্যান সিরিযের। উনিশ শ এগারো মডেলের। পেটে থাকে সাতটা ৪৫ ক্যালিবারের বুলেট। নীলচে রঙ। গ্রিপ রোজউডের। এই অস্ত্রটাও রিকের হাতের তুলনায় ছোট। তবে ব্যাকআপ অস্ত্র হিসেবে একেবারে খারাপ নয়। শেষ অস্ত্রটার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে। ওটা ডেযার্ট ঈগল মার্ক নাইন্টিন। ব্যারেলটা দশ ইঞ্চি। ম্যাগাযিনে থাকে .৩৫৭ ম্যাগনাম বুলেট। আকারে ও ওজনে ড্যান ওয়েসনের প্রায় দ্বিগুণ। এ ধরনের জিনিসই পছন্দ রিকের।

গুলি?

দুটো বাক্স বের করে অস্ত্রদুটোর পাশে রাখল হেনি।

 সব মিলে দাম কত? জানতে চাইল রিক।

 দুহাজার ডলার। অ্যামিউনিশন দেব বিনা পয়সায়।

 নতুন অস্ত্র কিনলে এমনিতেই বিনা পয়সায় দেবে।

তা ঠিক। কিন্তু সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রি করতে হবে। চাইলেই হাতে পাবে না অস্ত্র। দরখাস্ত জমা দেয়ার কয়েক দিন পর হয়তো অনুমতি দেবে কর্তৃপক্ষ। আমার মনে হয়নি তুমি সময় নষ্ট করার মানুষ।

অসন্তুষ্ট হয়ে গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলল রিক। বুক পকেট থেকে নিল ডলারের বাণ্ডিল। পুরো পনেরো শ। ব্যস, এর ওপর এক পয়সাও না।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল হেনি। মুখে দুখী-দুখী ভাব।

 কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট লোভ দেখছে রিক। বাণ্ডিল থেকে পনেরোটা এক শ ডলার নিয়ে রাখল টেবিলে। উঁচু হয়ে আছে নোট।

ডলারগুলো নিয়ে গুনতে লাগল হেনি। এদিকে ডেযার্ট ঈগলের ম্যাগাযিনে বুলেট ভরছে রিক। কোটের পকেটে রাখল ড্যান ওয়েসন। আরেক পকেটে গেল অ্যামিউনিশনের বাক্স।

তোমার ছেলেরা দরজার ওপাশে থাকবে, হেনি? জানতে চাইল রিক।

প্যান্টের পকেটে ডলার রেখে বলল হেনি, ওদেরকে ওই শিক্ষা দিইনি।

দুঃখের কথা, চওড়া হাসল রিক, তা হলে অস্ত্র ঠিক আছে কি না বুঝতে আর কারও বুকে গুলি করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *