ঝাঁপতাল – প্রথম অধ্যায়

প্রথম অধ্যায়

ঝাঁপতাল

খুব ভোরে তিথির ঘুম ভেঙে গেল। আজ মহালয়া। এটা কি ভোর, নাকি শেষ রাত? শরতের ভোরে অন্ধকার জড়িয়ে থাকে। হালকা চাদরের মতো। তার ঈষৎ স্বচ্ছ বুনোটের মধ্যে দিয়ে সকালের ফর্সা ফর্সা গায়ের আভাস পাওয়া যায়। আকাশ কালো থেকে নীল হয়ে আসে। অদ্ভুত অন্যরকমের নীল। এই রংটা শুধু মহালয়ার ভোরেই দেখতে পাওয়া যায়। আজও শুয়ে শুয়ে তিথি পায়ের দিকের জানলা দিয়ে দুটো বাড়ির মাঝখানে একচিলতে আকাশে সেই রংটা দেখতে পেল। রংটা যেন ভিক্সের মতো নীল।

ছোটোবেলা থেকেই তিথির এরকম মনে হয়। আজও হল। এটা তার অনেক বোকা বোকা ধারণার মধ্যে একটা, সে জানে। ভিক্স নীল হয় না, সাদা হয়। কিন্তু তার এমনই ভাবতে ভালো লাগে। আসলে, ছোটোবেলায় বাড়িতে ওষুধের তাকে রাখা থাকত পুরোনো ভিক্সের ঘন নীল কাচের শিশি, তার ভেতর থেকে ভিক্সটাকে ওইরকম নীল আলোর মতো কোমল দেখাত। তিথি কেমন একটা ছমছমে টান অনুভব করত ওই শিশিটার প্রতি। প্রত্যেকবার মহালয়ার ভোরে আকাশ দেখে সেই অনুভূতিটাই ফিরে ফিরে আসে। এছাড়া অন্য অন্য দিন এত ভোরে আকাশ দেখা তার সাধারণত হয় না।

আর ভিক্সের ওই গন্ধটা। সে এক অনির্বচনীয় রোমাঞ্চকর গন্ধ, সারা ছোটোবেলা থেকে বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে এই উত্তর-তিরিশ অবধি জুড়ে থাকা আসন্ন পুজোর গন্ধের মতো, প্রচুর রোদ্দুর আর অল্প অল্প হিমের ঝাঁঝ মেশানো। এই গন্ধটা নাকে লাগলেই আশা-আকাঙ্ক্ষা উত্তেজনা উদ্বেগ সব কিছু মিলিয়ে জটিল একটা ভালোলাগায় তিথির গা-হাত-পা শিরশির করে ওঠে। পুজো আসছে—বছরকার এই অতি পুরোনো ব্যাপারটা আজও তার বুকের মধ্যে একটা তীব্র ‘কী হয়-কী হয়’ সম্ভাবনার জন্ম দেয়।

অন্ধকার স্বচ্ছ বলে আলো জ্বালতে হল না, তিথি এমনিই উঠে বাথরুমে গেল। চারটে বোধ হয় বাজতে চলল। সাধারণত তার

ভোরে ওঠার অভ্যাস না থাকলেও, মহালয়ার দিন কীভাবে যেন ঠিক সময়ে ঘুম ভেঙে যায়। বাথরুম থেকে বেরিয়েই তিথি শুনল, উলটোদিকের মিন্টুদের বাড়ি থেকে আকাশবাণীর অধিবেশন শুরু হওয়ার সুর ভেসে আসছে।

এই আর একটা জিনিস, এই সুরটা। কোন যন্ত্রে যে সুরটা বাজানো হয় তিথি জানে না, হতে পারে পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান। কিন্তু মনে হয় যেন সুরটা ঠিক অন্য গ্রহ থেকে ভেসে আসে। চেনা কোনো গ্রহ নয়, একদম অচেনা ছায়াপথের অচেনা নক্ষত্রজগতের অজানা একটা গ্রহ। ওই সুর এই পৃথিবীর হতে পারে না। সুরটা যখন বাজে, বারবার একই চলনে ঘুরে ঘুরে, আর তার পেছন থেকে তানপুরার একটানা উত্তাল গুনগুন চলতেই থাকে চলতেই থাকে, তিথির মনে হয় সমস্তটাই একটা অপার্থিব মন্ত্র। মন্ত্রের জাদু তার স্নায়ুকে তরঙ্গে তরঙ্গে ঘিরে ধরতে থাকে। মহালয়ার দিন ছাড়া এই সুরটাও সারা বছরে বোধ হয় একদিনও শোনা হয় কি না সন্দেহ। হলে হয়তো তার এই ম্যাজিকটাই থাকত না।

সুরটা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করল তিথি। তারপর ঘরে এসে রেডিয়ো চালাল। তার আগে চালাল না, কারণ সুরটা যে তার ঘরের বাইরে অন্ধকার থেকে ভেসে আসছিল এর মধ্যে একটা বাড়তি রহস্য লুকিয়ে ছিল, নিজের রেডিয়োতে যেটা অনুপস্থিত।

এটা ঠিক রেডিয়ো নয়, সি ডি প্লেয়ার। এতেই রেডিয়ো ধরা যায়। সেন্টার ঠিক করতে করতে তিথি শুনল পাশের ঘর থেকে মায়ের কাশির আওয়াজ আসছে। তার মানে ঘুম ভেঙেছে। বাবার তো ভাঙবেই, বাবা রোজই আর একটু পরে উঠে হাঁটতে বেরোন। রেডিয়োর আওয়াজ মাঝারি রেখে তিথি খাটে এসে শুয়ে পড়ল। ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে আলো জ্বেলে বসে বসে মহালয়া শুনত, মনে আছে। বাবা টেপরেকর্ডারে টেপ করে নিতেন গোটা অনুষ্ঠানটা। সেইটেই আবার বেলায় চালানো হবে বলে। খুব মজা লাগত। চুপ করে শুনতে হত, কথা বললে ফিসফিস করে বলতে হত, নইলে টেপে উঠে যাবে যে! জোরে বলে ফেললে দাদা চাটি মারত মাথায়। তখন সেটাও হজম করতে হত চুপচাপ। মা অত সকালে চা করতেন। এখন সেসব আর হয় না। দাদা কবেই বাইরে চলে গেছে। মা বাবার বদলে তিথিই এখন রেডিয়ো খোলে। সবাই অন্ধকারে শুয়ে শুয়েই শোনে। অবশ্য রেডিয়ো

না চালালেও হয়, চারপাশের অনেক বাড়ি থেকেই গানটান সবই ভেসে আসে। কিন্তু এও যেন কেমন একটা সংস্কার, বছরকার দিনটা নিজেরা পালন না করলে মন খুঁতখুঁত করে।

তিথি চোখ বুজে শুনতে লাগল। সেই কবেকার মহালয়ার গান, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের প্রাণমাতানো স্তোত্রপাঠ। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এ যেন কিছুতেই পুরোনো হওয়ার নয়। একইরকম ভালো লাগে, একইরকম কান্না পায়, প্রতি বছর। সবারই ঠিক এমনটাই হয় কি না তিথি জানে না, তবে তার হয়। এও তো একরকম ধর্মাচরণই, সে ভাবল। এই যে আজকের দিনটিতে ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে বাঙালি ঘরে ঘরে রেডিয়ো খুলে দিচ্ছে, এই যে প্রতিবার এই সময়টাতে কেমন যেন বিনা কারণেই তার বুক ফেটে কান্না আসে, কী পবিত্র নয় এসব? এ সমস্ত উপচারেই যেন অমোঘ হয়ে ওঠে আয়োজন, প্রতি বছর পুজো ফিরে আসে।

ছেঁড়া ছেঁড়া তন্দ্ৰা আসছে, সেইসঙ্গে টুকরো টুকরো ছবি। তার কিছুটা স্মৃতি, কিছু নিছকই স্বপ্ন। আগমনী সুর আর দুর্গা রাগের উথালপাথালে ভাসতে ভাসতে ছবিগুলো চলেছে নিজের মতো।

ভালো করে ক্লাস শুরু হতে-না-হতেই লম্বা পুজোর ছুটি পড়ে গেল তিথিদের। নতুন কলেজ। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জিয়োগ্রাফি নিয়েছে তিথি, তার বরাবরের প্রিয় সাবজেক্ট।

এবারের পুজো খুব আগে আগে। বর্ষাই যেন এখনও ফুরোয়নি ভালো করে, রোদ্দুর তড়িঘড়ি ছুটি নিয়ে চলে এসেছে বাড়ি। সেই রোদটাই তিথির ঘরের জানলা দিয়ে লাফিয়ে ঢুকতেই তিথি তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়। আজই ষষ্ঠী না? পুজো এসে গেছে। ইশশ্—দেরি করে ফেলল নাকি তিথি? ন-টার মধ্যে তার মৌসুমীর বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আজ থেকেই ঘুরতে বেরোবে তারা।

তিথির মনটা ছটফট করে উঠল খুশিতে। এবারের পুজোটা খুব আনন্দে কাটবে। প্রত্যেকবারই এমন মনে হয় যদিও, শেষপর্যন্ত তেমন কিছুই ঘটে না। বলতে গেলে ম্যাড়মেড়েভাবেই কবে যেন ফুরিয়ে যায় চারটে দিন। কিন্তু এবার কেমন মনে হচ্ছে দিনগুলো তার জন্যে বহু কিছু সাজিয়ে বসে রয়েছে—অনেক আলো অনেক রোদ অনেক মজা অনেক অনেক কিছু। মাইকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ভেসে আসছে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি গিয়ে পড়তে হবে ওই উত্সবের মধ্যে, তিথি ভেতরে ভেতরে তীব্র তাড়া অনুভব করল।

মাকে বেরোনোর কথা আগে থাকতেই বলা ছিল। গত বছরই সে পুজোয় একদিন বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছিল, আর এখন তো সে কলেজে পড়ে। কাজেই আপত্তির কোনো কারণ নেই। যদিও বাড়িতে কেউই মনে করে না সে যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। চিরদিনই সে ছোটো, ফালতু। সে যে কাজগুলো করে সেগুলো সব ক-টাই বোকাবোকা, ভুলভাল। মা বাবার ততটা নয়, এগুলো প্রধানত দাদা তমালের অভিমত। তমাল বুদ্ধিমান, সব কাজে দক্ষ, দায়িত্বশীল। আর তিথি হাঁদা, ক্যাবলা, অপদার্থ। পরীক্ষায় ভালো

রেজাল্ট করে বুদ্ধি আছে বলে নয়, না বুঝে বই মুখস্থ করতে পারে বলে। তমাল শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। হোস্টেলে থাকে। পুজোতে বাড়ি এসেছে। আজ সকালেও তিথির বেরোনোর ব্যস্ততা দেখে তমাল নাক সিটকাল।

‘এ কী রে, এখন থেকেই পুজো শুরু? সবে তো ষষ্ঠীর সকাল, মা দুর্গারও তো ঘুম ভাঙেনি এখনও।’

তিথি জবাব দেয় না। মনে মনে খুব খারাপ লাগে তার। দাদার সবসময় ইচ্ছে থাকে তার সমস্ত উত্সাহ মাটি করে দেওয়ার, সে জানে। বেশিরভাগ সময় সে ইচ্ছে সফলও হয়। আজ তিথি কিছুতেই পাত্তা দেবে না। তাড়াতাড়ি আঙুল চালিয়ে চালিয়ে শ্যাম্পু করা চুল শুকোতে থাকে সে।

তমাল কিন্তু ছাড়ে না। বোনকে বিরক্ত করা তার নেশা। অকৃতকার্য হলে তার জেদ বেড়ে যায়। প্রথম মন্তব্যটা বিঁধল না দেখে এবার সে ধার বাড়াল, ‘দেখিস, চুল খুলে হাতে না চলে আসে, আঃ যা লাগবে না দেখতে—টাক মাথায় হেয়ারব্যান্ড, ফার্স্ট ক্লাস!’

তিথি রেগে কেঁদে চেঁচিয়ে উঠলে তমালের তৃপ্তি। ওটা হলেই সে ধীরেসুস্থে নিজের কাজে চলে যেতে পারে। কিন্তু তিথি এবারও খেপল না। বরং হেসে ফেলল। তমালও হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘আরিব্বাস, আজ সক্কাল সক্কাল শাঁকালুর দোকান খুলে গেছে দেখছি, শাঁকালু কত করে?’

তিথির বুকের মধ্যে জ্বালা করে। তবু হাসতে থাকে সে। হাসতে হাসতে মুখের সামনে হাত চাপা দেয়। আজ সে কিছুতেই রাগবে না। রাগলে তারই ক্ষতি, সারাটা দিন পড়ে রয়েছে সামনে, আজ পুজো।

আয়নার সামনে সরে এল তিথি, তার আনন্দের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ক-দিন আগেই একটা আইলাইনারের শিশি কিনেছে সে, কাউকে বলেনি। মৌসুমীকে পরতে দেখেছে, দেখে খুব ইচ্ছে হয়েছে সেও ওইরকম পরবে। তুলে রেখেছিল এ ক-দিন, পুজোয়

তার মুখের ওপরদিকটা মোটামুটি ভালো। নীচের দিকে এসে ছন্দপতন হয়ে গেছে। একেবারে ছোটোবেলায় তার দাঁত ভালোই ছিল, সুন্দর হাসিওয়ালা ছবিও আছে একটা। কিন্তু একটু বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, যখন দ্বিতীয়বার দাঁত উঠল, ওপরের পাটির সামনের দাঁতগুলো উঁচু হয়ে যেতে লাগল। হতে হতে শেষ পর্যন্ত অস্বাভাবিক উঁচু হয়ে গেছিল তার দাঁত, মুখ বন্ধ তো হতই না, কেমন যেন বীভৎস লাগত দেখতে। সে যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, বাবা নিয়ে গেছিলেন শিয়ালদার ডেন্টাল কলেজে। মনে আছে ডাক্তারবাবু তার মাকেও আসতে বলেছিলেন, একটা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিলেন এই লিখে যে উনি সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন কিন্তু ফল নাও পাওয়া যেতে পারে—এত সাংঘাতিক খারাপ অবস্থা হয়েছিল তার দাঁতের। ডাক্তার ভঞ্জ তাঁর ছাত্রদের নিয়ে এসে দেখাতেন, ছাত্ররাও সবাই তার মুখের ভিতর আঙুল পুরে কীসব দেখত। একদিন তিথি শুনেছিল ডাক্তারবাবু এক ছাত্রকে বলছেন, ‘কতদূর কী করতে পারব জানি না। চেষ্টা তো করতে হবে। এই দাঁত নিয়ে মেয়েটার বিয়ে হবে কী করে।’ শুনে লজ্জায় দুঃখে চোখে জল এসে গিয়েছিল তার, একদল যুবক ছাত্রদের সামনে সে কোনোরকমে কান্না সামলেছিল।

সাজবে বলে।

তার গায়ের রং কালো। সে মাথায় একটু বেশি লম্বা, রোগা। লম্বা হওয়া খারাপ নয়, কিন্তু তিথির মুশকিল হল সে পিঠ সোজা টানটান করে হাঁটতে পারে না। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে। মা বলেন কোলকুঁজো। আসলে, সে জানে তার পিঠটা তার মনেরই মতো, একটুক্ষণ পরপরই গুটিয়ে যেতে চায়।

ডাক্তার ভঞ্জের কৃতিত্ব বলতে হবে, তিথির দাঁত এখন অনেক ভদ্রস্থ। চার বছর মুখের মধ্যে ক্লিপ লাগানো প্লাস্টিকের প্যালেট পরে থাকতে হয়েছিল তাকে। দাঁত অনেক নীচু হলেও এখনও খুব বড়ো বড়ো, আর অসমান। এটা আর কিছু করা যায়নি। যা

ছিল, তার তুলনায় এটাই ডাক্তার ভঞ্জের ভাষায়—মিরাকল। তিথি এখন ঠোঁট বন্ধ করতে পারে। কিন্তু গোলমেলে সেটিং-এর জন্যে বন্ধ করলেও হাঁ মুখটা একটু ফুলে থাকে তার। হাসলেও ভালো দেখায় না। হাসতে গেলে তাই সে আপনা থেকেই মুখে হাত চাপা দেয়। বিশেষ করে বাইরে, অন্য লোকের সামনে। বাড়িতেও দাদা বলে, ‘শাঁকালুর দোকান বন্ধ কর।’ তাই সে আজকাল বাড়িতেও মুখে হাত আড়াল করে হাসে।

কিন্তু, কেউ না বলুক, তিথি জানে তার চোখ দুটি বেশ সুন্দর। আর ভুরু দুটি অসাধারণ। টানা লম্বা আর বাঁকানো। খুব সরু নয় আবার খুব মোটাও নয়। মাঝখানে, নাকের ওপর হালকা হালকা লোম দিয়ে জোড়া। এসবের বেশিটাই যদিও ঢাকা থাকে চশমায়। পাওয়ার মাইনাস পাঁচ। সবসময় চশমা পরতেই হয় তাকে, নাহলে সে প্রায় অন্ধ।

সাজতে গেলে চশমাটা খুলে রাখতে হয়, নাহলে মুখে কিছু মাখা যায় না। আবার চশমা খুললে নিজের মুখটাই আয়নায় ভালো করে দেখা যায় না। তিথি মুখ এগিয়ে আয়নার কাচে প্রায় নাক ঠেকিয়ে ফেলল। তার হাতে নতুন কেনা আইলাইনারের শিশি। চোখের ওপরপাতায় সরু একটা রেখা টানতে সে ভেবেছিল খুব একটা অসুবিধে হবে না। তার আঁকার হাত, তুলির টান ভালো। কিন্তু কার্যত দেখল দুটো ব্যাপার আলাদা। আয়নায় দেখে নিজের চোখে তুলি চালানো কাগজে তুলি টানার মতো সহজ লাগছে না। চোখের পাতা কাঁপছে থরথর করে, তুলি-ধরা হাতও কাঁপছে তার।

খুব সাবধানে ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত ঠিকঠাকই ম্যানেজ করতে পারল তিথি। বাঁ-চোখটা একটু জ্বালা জ্বালা করছে। ভিতরে একটু রং চলে গেছে বোধ হয়। তিথি আইলাইনার লাগানো নিজের দু-চোখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল, বাঃ কী সুন্দর মানিয়েছে। তার চোখ ভালো সে জানত। চাপা নাকের ওপর হাত রেখে মুখের নীচটুকু ঢেকে ফেলল তিথি, এবার কি খুব খারাপ লাগছে তাকে দেখতে? মোটেই নয়, বরং সুন্দরীই মনে হচ্ছে। তিথি হাতের আড়ালে হেসে ফেলল।

চারতলা বাড়ির প্রত্যেকটাতে আটটা করে ফ্ল্যাট। এরকম ছ-টা বাড়ি নিয়ে একটা হাউসিং কমপ্লেক্স। নাম নবরূপা। বছর ছয়েক হল হয়েছে। তিথিদের বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়, হেঁটে গেলে দশ-বারো মিনিট লাগে। মৌসুমীরা এখানেই থাকে। মৌসুমী তিথির স্কুলের বন্ধু। আগে ওরা শিলিগুড়িতে থাকত। ওর বাবা ডাক্তার, সরকারি চাকরি করেন। বদলি হয়ে যখন কলকাতায় এলেন, মৌসুমী বছরের মধ্যিখানে এসে ভরতি হল তিথিদের স্কুলে। সেটাও একটা সরকারি স্কুল। তখন ওরা ক্লাস এইটে। প্রথম দিন মৌসুমীর সঙ্গে তিথির তেমন আলাপ হয়নি। দারুণ সুন্দরী এই নতুন মেয়েটিকে ঘিরে ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা ভিড় জমিয়েছিল। তিথি ছিল দূরে দূরে, কিন্তু যখন জানা গেল মৌসুমীদের নতুন ফ্ল্যাট তিথিদের বাড়ির এত কাছে, তখন মৌসুমী যেচে এসে বলেছিল, ‘তিথি শোনো, আমরা একসঙ্গে যাওয়া আসা করব।’

তিথির খুব ভালো লেগেছিল। এটাও সে বুঝতে পেরেছিল ক্লাসের অন্য মেয়েরা কেমন একটা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল তার প্রতি। কেন কে জানে! ওদের মধ্যে বোধ হয় একটা চাপা প্রতিযোগিতা চলেছিল, মৌসুমীর বন্ধু কে হবে তাই নিয়ে। মৌসুমী সবারই বন্ধু ছিল, কিন্তু রোজ একসঙ্গে বাড়ি থেকে স্কুল আর স্কুল থেকে বাড়ির পথটুকু যেতে যেতে স্বাভাবিকভাবে তিথিই হয়ে দাঁড়ায় তার বেস্টফ্রেন্ড। অথচ ক্লাসের মধ্যে একমাত্র তিথিই বোধ হয় মৌসুমীকে অধিকার করার প্রতিযোগিতায় ছিল না। মৌসুমী আসার পর তাকে নিজের পাশে বসিয়েছিল মনিট্রেস সুদীপ্তা। সেই কারণে তার দাবি ছিল বেশি। শেষপর্যন্ত মৌসুমী যখন ক্লাসটিচারকে বলে তিথির পাশে নিজের সিট বদলে নিল, সুদীপ্তা বাঁকা সুরে বলেছিল, ‘হুঁ, রামের পাশে রামছাগল।’ আর একজন টিপ্পনী কেটেছিল, ‘না না, বল বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট!’

তিথি নিজেও অবাক হয়েছিল। হতে পারে সে পড়াশুনায় ভালো। কিন্তু মৌসুমীর সঙ্গে তার আকাশপাতাল পার্থক্য। প্রথমত চেহারায়। সুদীপ্তারা যে নেহাত মিথ্যে বলেনি তা সে নিজেই জানে। তারপর মৌসুমীরা রীতিমতো বড়োলোক। চাল না মারলেও

মৌসুমীর কথাবার্তা থেকেই সেটা বোঝা যায়। পরে মৌসুমীর বাড়ি গিয়েও তো তিথি দেখেছে। তারা মৌসুমীদের তুলনায় নিতান্তই সাধারণ মধ্যবিত্ত। এগুলো বন্ধুত্বের পথে যে কোনো বাধা নয়, মৌসুমী তার জীবনে না এলে তিথি বিশ্বাসই করত না।

মাধ্যমিক পর্যন্ত ওরা একসঙ্গে পড়ল। ইলেভেনে আলাদা হতে হল একটু। মৌসুমী ওই স্কুলেরই উচ্চমাধ্যমিক বিভাগে ভরতি হল, তিথি চলে এল অন্য স্কুলে। কিন্তু বন্ধুত্বে ভাঙন ধরল না। কেন ধরবে, তারা তো শুধু স্কুলের বন্ধুই নয়, পাড়ার বন্ধুও।

পার্থ সকাল থেকে বোনের সাজগোজ লক্ষ করছিল। মৌসুমী তার নিজের বোন নয়, খুড়তুতো বোন। পার্থর মা-বাবা-বোন বর্ধমানে দেশের বাড়িতে গেছেন, বাড়ির পুজো উপলক্ষ্যেই। পার্থ যায়নি। পুজোর ক-টা দিন কাকুর বাড়িতেই কাটিয়ে দেবে বলে কাল রাত্রে এখানে এসেছে।

পার্থর বাবা অলক মল্লিক বাড়ির বড়ো ছেলে। মৌসুমীর বাবা অরূপ মেজো। তার পরে আরও পাঁচ ভাই, বোন নেই। অরূপ মল্লিক ডাক্তারি পাশ করার পর বাবার অমতে বিয়ে করে শ্বশুরের টাকায় বিদেশ চলে যান। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে কয়েক বছর পর দেশে ফিরে আসেন কিন্তু বাবার সঙ্গে এখনও মিটমাট হয়নি। মা যখন কলকাতায় আসেন ঘুরে ঘুরে সব ছেলের কাছেই কিছুদিন থেকে যান, অরূপের কাছেও থাকেন। অরূপের বউ মিতাকে তাঁর অপছন্দ ছিল না। তাঁর স্বামীই আসলে এটা মেনে নিতে পারেননি যে ছেলে বিয়ের পরে শ্বশুরের পয়সায় বাইরে যাবে।

সেই কারণে মৌসুমীদের সঙ্গে বর্ধমানের বাড়ির বলতে গেলে কোনো যোগাযোগই প্রায় নেই। পার্থদের কিন্তু আছে। অলক-অরূপের বাবা, অর্থাৎ পার্থ-মৌসুমীদের ঠাকুরদা অঘোর মল্লিকরা তিন ভাই। সেই হিসেবে দেশের পুজোর দায়িত্বও পড়ে তিন শরিকের ওপর ঘুরে-ফিরে। গত বছরই ছিল অঘোর মল্লিকের পালা। তার মানে তাঁর ছেলেদেরই পালা, কেননা অঘোর মল্লিকের বয়স এখন আশির ওপর, বছর সাতেক আগে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পেয়েছিলেন, সেটা পুরোপুরি সারেনি, এখন লাঠি নিয়ে চলাফেরা করেন। কিন্তু ছেলেদের কাউকেই তেমন পাওয়া যায় না। অরূপের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, অলক ছাড়া

বাকিরাও এমন ভাব করে যেন পুজোর চার দিন সপরিবারে দেশের পুজোবাড়িতে গিয়ে দাঁড়ানো এবং ভোগ-প্রসাদ খাওয়াটাই শুধু তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। পুজোর পুরো ভারটাই চাপে অলকের কাঁধে। অলক এই দায়িত্ব থেকে পালাতে পারেন না, পালাতে চানও না সে-কথা ঠিকই, কিন্তু মজা এখানেই যে তাঁর কোনোরকম দায়দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাই নেই। এক ধরনের চরিত্র দেখা যায়, যারা তাদের সারাজীবন কাটিয়ে দেয় যে-কোনোরকম কাজকর্মেই ন্যূনতম দক্ষতা ছাড়া এবং নিজেদের এই অযোগ্যতার জন্যে তারা অন্যের কাছে করুণার পাত্র হতে পছন্দ করে, তবু কিছুতেই নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করে না। অলক মল্লিক একেবারে এই চরিত্রের মানুষ। কাজেই, ঠাকুরদা অশক্ত হয়ে পড়ার পর তাদের তরফের পুজোর পালা কার্যত পার্থকেই সামলাতে হয়েছে। এই ধরনের পালার পুজোয় একটা বিরক্তিকর ব্যাপার হল, শরিকরা সবসময় ওত পেতে থাকে পুজোর উপচারে আয়োজনে ব্যবস্থাপনায় আপ্যায়নে নানারকম ত্রুটি ধরার জন্যে। প্রত্যেকবারই এই নিয়ে একটা-না-একটা গোলমাল বাধে। গতবার পার্থর সঙ্গে বড়ো ধরনের ঝামেলা হয়েছিল অঘোর মল্লিকের মেজোভাই অর্থাৎ পার্থর মেজোদাদুর ছেলে বিলুকাকার সঙ্গে। মারামারি বাধার উপক্রম। সেই রাগ পার্থর আজও পড়েনি। এবারের পুজোয় মেজোতরফেরই পালা। আর কেউ হলে ওদের পুজোর খুঁত ধরে শোধ তুলতে পারত। কিন্তু পার্থর সে প্রকৃতি নয়, তাই সে মা-বাবাকে বলেছে, ‘তোমরা যাও, আমি মেজোকাকুর বাড়ি থেকে যাব এ ক-দিন।’

মৌসুমীর সাজ দেখতে দেখতে পার্থর মজা লাগছিল, সেইসঙ্গে কেমন একটা ভালো লাগছিল, যাকে স্নেহই বোধ হয় বলা যেতে পারে। স্নেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয়, মৌসুমী তার থেকে অনেকটাই ছোটো, প্রায় বারো বছরের। ওর জন্ম ইংল্যান্ডে। মেজোকাকু কাকিমা যখন ফুলের মতো ছোট্ট এইটুকু মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরলেন, পার্থর মনে হয়েছিল—এই সুন্দর সাহেবদের মেয়ের মতো বাচ্চাটা তারই খুড়তুতো বোন! অবশ্য মেজোকাকু আর কাকিমাই যে তাদের আত্মীয় এটাও কম আশ্চর্যের কথা নয়। তারা দেশের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসেছে আজ ছাব্বিশ বছর, এখনও ভাড়া বাড়িতেই পড়ে আছে। যে চাকরি নিয়ে তার বাবা এই শহরে এসেছিলেন, সেটা অতি সামান্য। সেটা বদলে আরেকটাতে ঢুকলেন, সেটাও ভালো কিছু নয়। আসলে তার বাবা চাকরি করা বা পয়সা রোজগার—এসব নিয়ে গুছিয়ে কিছু ভাবতেই পারতেন না। পার্থ ছোটোবেলায় বাবাকে বার বার দেশের

বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা বলতে শুনেছে। মা বলতেন, ‘সেখানে আছে কী যে ফিরে যাব! তার চেয়ে এখানেই মন দিয়ে দ্যাখো কিছু করা যায় কি না।’ সেই মনটাই বাবা কখনো দেননি। সংসারের হালও সেরকম। কোনোক্রমে ভদ্রভাবে চলে যায়। তার পাশে মেজোকাকুদের ঘরবাড়ি রূপকথার দেশ। সাজানোগোছানো ঘর, সুন্দর বাথরুম। পার্থর মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকতে ইচ্ছে করে। আজকেও আরাম করে সোফার একপাশে বসে থাকতে থাকতে তার মনে হল, মৌসুমী খুব সুন্দর হয়ে উঠেছে, ওর মুখ ক্যামেরায় খুব ভালো আসবে।

চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো হয়ে গেলেও মৌসুমী আর একবার আলতো হাতে ব্রাশ বোলাতে বোলাতে পার্থর দিকে তাকাল। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে প্রশংসা আশা করছে। বুঝতে পেরে পার্থ ডান হাতটা তুলে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ডগা জুড়ে তারিফসূচক একটা মুদ্রা করল, মুখে বলল, ‘ফ্যান্টাস্টিক!’

মৌসুমী খুশি হয়ে পার্থর পাশে এসে বসল। পার্থ সস্নেহে ওকে দেখতে দেখতে বলল, ‘এখন কী প্রোগ্রাম?’

‘তিথি আসবে। আমার বন্ধু। একসঙ্গে বেরোব। কিন্তু ও খুব দেরি করছে।’ মৌসুমী অধৈর্য ভঙ্গিতে ঘড়ির দিকে তাকাল।

‘তোর বন্ধুও নিশ্চয়ই তোর মতোই সাজগোজ করছে।’ পার্থ হাসল, বলল, ‘চল আমরা নীচে যাই, তোদের হাউসিং-এর ঠাকুর আমার দেখা হয়নি, দেখে আসি।’

মৌসুমীর মনে হল সেটাই ভালো হবে। তাদের এই ফ্ল্যাটটা চারতলার ওপরে। উঠতে নামতেই কত সময় লাগে, তার থেকে নীচে তাদের হাউসিং-এর পুজো হচ্ছে, ওখানে প্যান্ডেলে গিয়ে বসে থাকলে তিথির সঙ্গে নীচেই দেখা হয়ে যাবে, ওকে আর ওপরে উঠতে হবে না। মৌসুমী মাকে গিয়ে বলল, ‘মা, আমি আর বড়দা নীচে যাচ্ছি। তিথি এলে আমি কিন্তু ওর সঙ্গে বেরোব।’

মিতা রান্নাঘরে ছিলেন। রান্নার মেয়ে রান্না করছে, উনি তদারক করছিলেন। মৌসুমীর কথা শুনে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘নীচে যাচ্ছ যাও, তিথি এলে ওপরে এসে আমাকে বলে তারপর যাবে, হুট করে বেরিয়ে যাবে না।’

মৌসুমী আপত্তি করে বলে উঠল, ‘বা রে, এই তো বলে যাচ্ছি। তখন আবার উঠব, আবার নামব নাকি? আমার পা ব্যথা করবে

‘মৌ তর্ক কোরো না।’ মিতা শাসনের সুরে বললেন, ‘আমি কী করে জানব তুমি কখন বাড়ি থেকে বেরোলে, নাকি সেটা আমার জানবার দরকার নেই?…পা ব্যথা হলে তুমি এখন নীচে যেও না, তিথি এখানেই আসবে।’

মৌসুমী মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই পার্থ বলল, ‘কাকিমা তুমি ভেবো না, আমি তো আছি। এখন নীচে যাই। মৌয়ের বন্ধু এলে যখন ওরা বেরোবে, তখন আমি ওপরে এসে তোমাকে খবর দিয়ে যাব।’

নবরূপার ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর মাঝখানে মাঝারি আকারের একটা মাঠ। ওই মাঠেই পুজোর প্যান্ডেল, এখানকার বাসিন্দাদের নিজস্ব পুজো। প্যান্ডেলের সামনে সারি সারি কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার পাতা। এই সকালে বেশিরভাগই ফাঁকা, কয়েকটা এখানকারই কয়েক জন কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীর দখলে। তাদের মধ্যে অনেকেই বেশ সেজেছে। মৌসুমীর ছোটোভাই দীপ অনেকক্ষণ থেকেই মাঠে। অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করছে, সবার হাতে একটা করে পটকা ভরা খেলনা পিস্তল। ওদেরই চিৎকারহাসিতে হুটোপাটিতে জায়গাটা সরগরম।

পার্থ আর মৌসুমী প্যান্ডেলের কাছাকাছি আসতেই দু-তিনটি মেয়ে সমস্বরে মৌসুমীকে ডেকে উঠল। মৌসুমী ওদের দিকে এগোতে এগোতে পার্থর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘বড়দা তুমি ঠাকুর দ্যাখো, আমি এক্ষুনি আসছি।’

না?”

পার্থ মনে মনে হাসল। মৌসুমী মেয়েগুলির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই মিলে কলকল করে উঠল। উচ্চকিত কথা। হাসির ফোয়ারা। কথা বলতে বলতে মৌসুমী একবার পার্থর দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখমুখের করুণ ভঙ্গি করল, ভাবখানা এই যে, ওরা তাকে পার্থর কাছে আসতে দিচ্ছে না। পার্থ হাত তুলে ওকে নিশ্চিন্ত থাকার ইশারা করতেই মৌসুমী ওখানে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

একা একা বসে থাকতে পার্থর ভালোই লাগছিল। তার চোখ প্রতিমার দিকে। শোলার সাজ হয়েছে মা দুর্গার, তাঁর ছেলেমেয়েরও। ঠাকুরের মুখ সুন্দরই হয়েছে, কিন্তু পার্থ বুঝতে পারে না মা দুর্গার গায়ের রং বেশিরভাগ জায়গাতেই গোলাপি কেন করে। মায়ের রং তো কাঁচা হলুদের মতো, গলানো সোনার মতো। তা ছাড়া মুখের ছাঁদও যেন ঠিক দেবী দেবী নয়, কেবলই সুন্দরী মেয়ের মতো মুখ। মা দুর্গা বলতে যে মুখ যে রং যে টানা চোখ, ছোট্ট চিবুকের ডৌলটি মনে ভেসে ওঠে সে তাদের বর্ধমানের বাড়ির ঠাকুরের। একচালার ঠাকুর, বেশি বড়ো নয়। কিন্তু অপূর্ব একটা মহিমা আছে তার, আলাদা একটা ঐশ্বরিক প্রকাশ, তবুও কী ভীষণ মা মা। পার্থর সেরকমই মনে হয়। তাদের দেশের বাড়ির পশ্চিম দিকে পুজোবাড়ি। সারা বছর সেখানে কাঠামো পুজো হয়। দুর্গাপুজোর আগে ওই কাঠামোতেই প্রতিমা গড়া হয়। সে প্রতিমা যেন প্রত্যেক বছর অবিকল এক। পার্থর আশ্চর্য লাগে। ওই তার চেনা মুখ। সত্যিকারের মা-ই সেখানে ফিরে ফিরে আসেন। পার্থর বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হতে শুরু করল। এবার প্রথম সে পুজোয় দেশে যায়নি, মায়ের মুখ না দেখতে পেয়ে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। এখনও বর্ধমানে চলে যাওয়া যেতেই পারে—কিন্তু না, সে যাবে না। পার্থ চোখ বুজে ফেলল, মনে মনে বলল, ‘মা তোমার অন্য কোনো চেহারা আমার ভালো লাগে না, আমাকে ক্ষমা করো। আমি যে রূপে তোমার পুজো করেছি তোমার সেই রূপই আমার প্রিয়।’

পার্থ জানে না সে কতক্ষণ ওইভাবে চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। একমনে সে তাদের বাড়ির মা দুর্গার মুখই ধ্যান করছিল, বাচ্চাদের অবিশ্রান্ত চেঁচামেচি, মেয়েদের হাসির হুল্লোড়ও তার কানে আসছিল না। হঠাৎ কে যেন তার কানের কাছেই জোরে চেঁচিয়ে ওঠাতে তার ধ্যান ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখল, সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মৌসুমীরই বয়সি, মৌসুমী তার

মুখের সামনে হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় চেঁচিয়ে বলছে, ‘তোর এতক্ষণে আসার সময় হল, আমি কখন থেকে নীচে এসে বসে আছি।’

মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, মৌসুমীর তর্জনগর্জনে রাগ করছে না। তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমাতে অপরাধ স্বীকার আর কৌতুক মিলেমিশে আছে। খুব খানিকটা রাগারাগির পর মৌসুমী যখন একটু শান্ত হয়ে আসছে, তখনই যেন কী একটা লক্ষ করে সে আবার হইচই করে উঠল। তবে এখন তার গলায় রাগের বদলে খুশিমিশ্রিত বিস্ময়, ‘ওমা! তিথি, তোকে কী দারুণ দেখাচ্ছে রে! দেখি দেখি, তুই সেজেছিস!’

পার্থ দেখল মেয়েটি মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছে। তার হাসি দেখা যাচ্ছে না, তবু পার্থর মনে হল এমন হাসি সে আগে কখনো দেখেনি। মেয়েটি মুখ আড়াল করে আছে, অথচ ওর চোখ হাসছে, হাত, পা, সারা শরীর হাসছে। মৌসুমী ওকে আরও কী বলছে আর ও এদিক-ওদিক মাথা নাড়াচ্ছে, ওই মাথা নাড়ানোটাই ওর হাসি। পার্থর মনে হল, এখানে যতগুলি মেয়ে বসে আছে এদিক ওদিকে, এমনকি মৌসুমী, কেউই অত সুন্দর হাসতে পারে না। শুধু এখানে বলে নয়, এ ছাড়াও অন্য কোনো মেয়ে বা ছেলের পক্ষে এই হাসি সম্ভব নয়। এই হাসি দেখবে বলেই সে এবার দেশে যায়নি, এই হাসি দেখল বলেই সে দেখতে পেল, কলকাতাতেও পুজো এসে গেছে।

পার্থ বলে এসেছিল যে মৌসুমীরা বেরোলে সে ওপরে এসে কাকিমাকে খবর দেবে। কিন্তু ওপরে আসতে হল তিনজনকেই, আবার নামতেও হল। কারণ, মৌসুমী আর তিথি কিছুতেই স্থির করতে পারল না তারা কোথায় যাবে। কাছেপিঠে পাড়ার ঠাকুর দেখে আসতে পারত দুজনে, কিন্তু কারোরই সেটা ইচ্ছে নয়। মনে মনে ওরা চাইছে একটু দূরে কোথাও ভালো ঠাকুর দেখতে। এদিকে মুশকিল হচ্ছে, গড়িয়াহাট বালিগঞ্জ পার্কসার্কাস—যেখানেই যাও না কেন, এলোমেলো ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে বেড়াতে হলে রাস্তাঘাট যতটা চেনা থাকার দরকার, সেটা তো ওদের নেই। আর তা ছাড়া একটা আত্মবিশ্বাসও জরুরি। নির্দিষ্ট কোনো একটা জায়গায় যাওয়ার দরকার পড়লে, রাস্তা বাতলে দিলে বাসেট্রামে চেপে ওরা একা একাই হয়তো সেখানে পৌঁছে যেতে পারবে—সেটা আলাদা কথা। কিন্তু দুজনে মিলে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে যদি রাস্তা ভুলে ঘুরে মরতে হয় আর ক্রমাগত লোককে রাস্তা জিজ্ঞেস করতে হয়, তাহলে পুরো আনন্দটাই মাটি। ওরা এও জানে যে ওরা আর ছোটো নেই, উলটোপালটা লোক যদি বুঝতে পারে দুটি মেয়ে পথ হারিয়েছে, তাহলেও বিপদ।

একেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, তার ওপর বেড়াতে যাওয়া প্রায় কেঁচেই যাচ্ছিল আর কি! মৌসুমীর মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি এল, বলে উঠল, ‘আইডিয়া! বড়দা আমাদের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে। বড়দা প্লিজ চলো না, চলো চলো’

মৌসুমী পার্থর হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। তার প্রয়োজন ছিল না। পার্থর রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং সে অনেকক্ষণ থেকে পা বাড়িয়ে আছে। সে নিজেও বুঝতে পারেনি, ভেতরে ভেতরে সে ওদের সঙ্গে যেতেই চাইছিল।

সেটা অবশ্য পার্থ মুখের ভাবে প্রকাশ করল না। যেন মৌসুমীর টানাটানিকে প্রশ্রয় দিয়েই তিথির দিকে না তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, যাচ্ছি। তার আগে কাকিমাকে বলে আসতে হবে তো, না কি?’

তিথির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর পার্থর মনে হল ওকে সে আগেও দেখেছে। দেখাটাই স্বাভাবিক। কেননা তিথি মৌসুমীদের বাড়িতে প্রায়ই আসে। অতটা ঘন ঘন না হলেও পার্থরও এখানে ভালোই যাওয়া-আসা আছে। যদিও এর আগে মৌসুমীর কোনো বন্ধুর সঙ্গেই পার্থর তেমন পরিচয়-টরিচয় হয়নি। হওয়ার সুযোগ কিংবা কারণ ঘটেনি, তাই। ওরা সবাই তার থেকে এত ছোটো, অন্তত পার্থর তাই ধারণা ছিল। আজ তার মনে হল, সে যেন কবে থেকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যুবক হওয়ার পর থেকে তার আর বয়স বাড়েনি। কিন্তু বালিকারা কিশোরী থেকে হু-হু করে তরুণী হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে হাঁটতে, কথা বলতে আজ প্রতিটি মুহূর্তই মনে হচ্ছে নতুন, দারুণ উপভোগ্য। কিংবা না, এরকমটা ঠিক হয়তো সবার ক্ষেত্রেই হত না, হয় না—একেকজনের সঙ্গেই হঠাৎ কীভাবে যেন এরকম হয়ে যায়।

তিথিও বুঝতে পারছিল কোথাও একটা কিছু হচ্ছে। অদ্ভুত কিছু। কী, সেটা ঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার নিজেকেই কেমন অন্যরকম লাগছিল, অচেনা, সে এমনিতে যেমন, তার চাইতে অনেক, অনেক ভালো। সে সাধারণত নতুন মানুষের সঙ্গে প্রথমেই চট করে মিশতে পারে না। কিন্তু আজকের তিথি যেন আলাদা কেউ। ঝরঝর করে হাসছে, প্রতিটি কথার উত্তরে লাগসই কথাটা চটপট চলে আসছে তার জিভে। অন্যদিন এমন হয় না। উত্তর জানা থাকলেও সে মুখ খুলতে পারে না। আজ সে নিজের থেকেই দারুণ সব বুদ্ধিদীপ্ত মজার মজার কথা বলছে। তার কথা শুনে মৌসুমী হেসে কুটিপাটি হচ্ছে, পার্থর চোখেমুখেও সে আগ্রহ চিনতে পারছে। এসবই তার নতুন অভিজ্ঞতা। এমনকী, আয়না না দেখেও সে বেশ বুঝতে পারছে তার নিজেরই চোখের দৃষ্টি আজ খুব ঝকঝক করছে। তিথি এক অভূতপূর্ব স্রোতে ভেসে যেতে যেতে মাত্র কয়েক বারই মুহূর্তের জন্য ভাবার ফুরসত পেল—এ কী! সে হঠাৎ এমন বদলে গেল কী করে!

পার্কসার্কাস ময়দানে বিরাট মেলা বসেছে। সেখানে ঢুকেই তিথি আর মৌসুমী ছুটে গেল যেদিকে চুড়ি দুল মালা বিক্রি হচ্ছে সেদিকে। ওদের পিছন পিছন উত্সাহের সঙ্গে পার্থও।

দেখা গেল, চুড়ির প্রতি দুজনেরই ঝোঁক বেশি। মৌসুমী পছন্দ করল কালচে নীল কাচের চুড়ি, তার ফর্সা হাতে চমৎকার মানাবে। আরও অনেক সুন্দর সুন্দর রং থাকতেও তিথি বাছল হালকা বাদামি ঘেঁষা একটা চাপা রং। মৌসুমী ক্ষুণ্ণ স্বরে বলল, ‘ওই দ্যাখো, এত রং থাকতে ঠিক খুঁজে বার করেছে সবচেয়ে অফ্ কালারটা। কেন, ওই মেরুনটা তো তোকে দারুণ মানায়?’

‘রক্ষা কর। ওই রং আমি পরলে আর দেখতে হবে না। আমি নয়, চুড়িটাই লজ্জা পেয়ে যাবে।’

তিথি কথাটা এমন সহজ সুরে বলল যে পার্থ মুগ্ধ হয়ে গেল। আজ অবধি সে কখনো দেখেনি কোনো অল্পবয়সি মেয়ে নিজের চেহারা নিয়ে ঠাট্টা করছে, এমন অনায়াসে, অসংকুচিতভাবে।

মৌসুমী মানতে চাইছিল না। সে চায় তার বন্ধুও উজ্জ্বল রং পরুক। পার্থ অযাচিতভাবেই নাক গলাল, ‘থাক না, ওকে ওর পছন্দমতো নিতে দে। রংটা কিন্তু খুব অন্যরকম, তিথিকে সুন্দর মানাবে।’

মৌসুমী তিথির গায়ে কনুই দিয়ে আলতো গুঁতো মারল। এক চোখ টিপে ফিসফিস করে বলল, ‘এই, বড়দা তোকে কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছে রে!’

তিথির বুক থেকে গলা অবধি ছোট্ট একটা ঢেউ খেলে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, সে গুটিয়ে গেল না, আড়ষ্ট হয়ে উঠল না। তার চোখ নীচের দিকে, সে চুড়ি দেখছে, কিন্তু বেশ বুঝতে পারছে পার্থর দৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে আছে। এটা বুঝেও ঠিক ইচ্ছে করে নয়, বরং কেমন আপনাআপনিই তার চোখ উঠে এল পার্থর চোখে, এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ। তিথি একটা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল। এরকম আগে তার কখনো হয়নি। সব কিছুই স্বাভাবিক, পার্থর সঙ্গে তার যথেষ্ট দূরত্ব, চোখ থেকে চোখে এই বিদ্যুৎ বয়ে গেল কী করে! তবে কি এমন হবে জেনেই সে চোখ তুলেছিল? এসব কী হচ্ছে? কী হতে চলেছে?

পার্থ চুড়ির দাম দিয়ে দিল। তিথি ঝাঁকুনিটা সামলে নিয়েছিল। আপত্তি করে বলল, ‘না না, আমার কাছে আছে—’ বলতে বলতে সে ব্যাগ খুলে টাকা বার করছিল।

‘দুর, বড়দা আমাদের কিনে দিচ্ছে, তুই দিবি কেন?’ মৌসুমী এক ফুঁয়ে ওর আপত্তি উড়িয়ে দিল।

তিথির তবু অস্বস্তি হচ্ছিল। প্রায় অচেনা, সদ্যপরিচিত কারও কাছ থেকে উপহার পেতে সে অভ্যস্ত নয়, এরকম হয়নি কখনো এর আগে। অনিশ্চিত স্বরে বলল, ‘সে তোরটা পার্থদা দিতে পারে, আমারটার দাম আমি—’

মাঝপথেই থেমে যেতে হল, কেননা তার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই পার্থ তার দশ টাকার নোট ধরা হাতটার ওপর হাত রেখেছে। মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘ছি, এরকম করে না।’

তিথি চকিতে মুখ তুলতেই আবার চোখাচোখি হল। আবার বিদ্যুৎ। আগের বারের মতো অত তীব্র নয়। কোমল। তিথি চোখ সরিয়ে নিল না, হাসল। বড়ো হওয়ার পর এই প্রথম কোনো যুবকের চোখের দিকে এমন সরাসরি তাকিয়ে হাসল সে। মুখের সামনে হাত আড়াল করল না।

তিথির মনে হয়েছিল সে হঠাৎ এমন বদলে গেল কী করে! আসলে কিন্তু তার ভুল মনে হয়েছিল। সে একদিনে তো বদলায়নি, তার পরিবর্তন এসেছিল অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে। কোনো একটি দিনের কোনো একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে নিজের সেই পরিবর্তন লক্ষ করেছিল। এ যেন নিজের কাছেই একটা আবিষ্কার। প্রেম এসেছিল বলে সে বদলে যায়নি। সে বদলে গিয়েছে বলেই প্রেম এসেছিল।

এই বদলটা খুব নিঃশব্দে আর ভেতরে ভেতরে এসে পড়লেও, এটা কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ কোনো বদল ছিল না। সে যেন সাপের

মতো খোলস ছেড়েছিল। ছোটোবেলা থেকে নিজের চেহারা সম্বন্ধে বদ্ধমূল একটা সচেতনতা তাকে স্বেচ্ছানির্বাসনে সবসময় ঘিরে রাখত। এর মূল কোথায় কে জানে! হয়তো পরিবারের লোকজন, আত্মীয়, প্রতিবেশীদের কৌতুক আর বিরূপ মন্তব্যই হবে। হয়তো যে মেয়েটি ছোটোবেলা থেকেই রোগা কালো দাঁত-উঁচু আর অমিশুক স্বভাবের, তার এই অভিজ্ঞতাই স্বাভাবিক। হয়তো সে বাড়াবাড়ি-রকমের স্পর্শকাতর।

আজও সেই স্পর্শকাতরতা থেকে সে ভেতরে ভেতরে মুক্ত নয়, কিন্তু বাইরে, নিজেকে বহন করার একরকম কায়দা সে রপ্ত করেছে। সে নিজের অজান্তেই নিজের চেহারা নিয়ে ঠাট্টা করতে শুরু করেছে। সে দেখেছে, নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সেটা মন্ত্রের মতো কাজ করে।

স্কুল থেকেই সে এটা বুঝতে শিখেছিল। তার বদলে যাওয়ার আরও একটা সূত্র ছিল তার আঁকা। যে-কোনো অনুষ্ঠানে স্কুলের হলঘরে করিডোরে আর সিঁড়িতে আলপনা দিতে তারই সবার আগে ডাক পড়ত। আলপনা দিতও সে দেখার মতো। আলপনা দিতে দিতে, দেওয়ালে নিজের হাতে আঁকা ছবি টাঙাতে টাঙাতে তিথি ভাবত সে নিজে সুন্দর নয় তাতে কী হয়েছে, সে তো পারে তার চারপাশকে সুন্দর করে সাজাতে। এই ভাবনার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে ছিল তার নতুন মাথা-তোলা আত্মবিশ্বাসের বীজ।

নিজের সেই আত্মবিশ্বাসেরই চূড়ান্ত ছবি দেখতে পেয়েছিল তিথি, যখন তার মনে হয়েছিল সে সত্যি সত্যিই প্রেমে পড়ছে।

8

বিশ্বনাথ মিত্রকে বাইরে থেকে দেখে যেমন অকিঞ্চিত্কর ছাপোষা গেরস্থ মনে হয়, তেমনটা আসলে তিনি নন। এককালে যদিও তাইই ছিলেন। আজ এই ষাট বছর বয়সে পৌঁছে ব্যাঙ্কে তাঁর জমানো টাকার পরিমাণ নেহাত কম নয়। তার পুরোটাই সরকারি চাকরি আর টিউশনি করে, সেইসঙ্গে বাড়িভাড়ার টাকা। কিন্তু জীবনযাপনের ধরন তিনি বদলাতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যনতুন সুখস্বাচ্ছন্দ্যের আমদানি করতে চেয়েছে সংসারে, কিছু কিছু সফলও হয়েছে, কিন্তু বিশ্বনাথ মন থেকে সেগুলি মেনে নিতে পারেননি। এজন্যে তাঁকে কৃপণ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আসল ঘটনা হল এই যে, জীবনের শুরুতে প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে নিজেকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে গিয়ে তিনি কৃচ্ছ্রসাধনের অভ্যাস করেছিলেন। সেই অভ্যাস তাঁর মধ্যে এমন ঢুকে গেছে, যে আজ তার প্রয়োজন না থাকলেও তিনি তার থেকে বেরোতে পারেন না।

সরকারি অফিসে কেরানির চাকরিতে ঢুকেই বিশ্বনাথ সংকল্প করেছিলেন নিজের একটা বাড়ি করার। এটা ছিল তাঁর জেদ। সকাল সাতটা থেকে অফিস যাওয়ার আগে দুটো, আর পাঁচটার সময় অফিস থেকে বেরিয়ে আরও দুটো টিউশনি করতেন রোজ। রোববারেও কামাই ছিল না। লোকে নানা কথা বলে, কিন্তু তাঁর সাঁইত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়া এই দোতলা বাড়িটি তিনি বানিয়েছেন রক্ত জল করা পরিশ্রমের টাকায়, তার এক পয়সাও কেউ তাঁকে বিনাযুদ্ধে দেয়নি, তিনিও কোনো অসৎ উপায়ের সাহায্য নেননি। ততদিনে অদিতির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে তমালের আর মেয়ে তিথির জন্ম হয়েছে তাঁদের নিজেদের বাড়িতে।

অদিতি কিন্তু একান্ত সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। অদিতির বাবা রমাপদ দত্ত খুলনা থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। কালক্রমে তিনি সুন্দরবন অঞ্চলের সাতজেলিয়া নামে ছোট্ট একটা দ্বীপে এসে সংসার পাতেন। ওই দ্বীপটি ছিল স্কটিশ সাহেব

হ্যামিল্টনের নিজস্ব এস্টেটের অন্তর্গত। রমাপদ ওই এস্টেটে ম্যানেজারের চাকরি করতেন। হ্যামিল্টন সাহেবের পুরো নাম স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন। স্কটল্যান্ডেই থাকতেন। বছরে দু-একবার পরিদর্শন আর খাজনা আদায়ের কাজে আসতেন এস্টেটে। বাকি সময়টা সাতজেলিয়া দ্বীপে রমাপদ দত্ত ছিলেন সর্বেসর্বা। অসাধারণ প্রতিপত্তি ছিল তাঁর। সত্যিই তাঁর শাসনে সুন্দরবনে বাঘে গোরুতে একঘাটে জল খেত।

অদিতির ছোটোবেলা কেটেছিল সেই দ্বীপে। অন্যরকম পরিবেশে। সাধারণ গ্রামবাংলার সঙ্গে সেই পরিবেশের যেমন অমিল, শহরের সঙ্গেও তাই। হ্যামিল্টন সাহেব তাঁর এস্টেটের দ্বীপগুলিতে কমিউনের প্রচলন করেছিলেন। তিনি আসার আগে সাতজেলিয়া ছিল ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ঢাকা একটা আদিম নোনা দ্বীপ, চারদিকে সমুদ্রের মতো নোনা জলের বিশাল বিশাল নদী। সাহেব এখানে জঙ্গল কাটিয়ে বসতি করালেন। কয়েক ঘর চাষি নিয়ে এসে বসালেন, সেইসঙ্গে এক ঘর এক ঘর করে কামার, কুমোর, ঘরামি ইত্যাদি থেকে শিক্ষক, ডাক্তার অবধি। সাতজেলিয়া হয়ে উঠল একটি আদর্শ গ্রাম। সমবায়ের জন্য সেখানে যেমন কোনো প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব ছিল না, তেমনই মানুষের লোভও ছিল কম। ঈর্ষা নোংরামি বজ্জাতি থেকেও অনেক মুক্ত ছিল সেখানকার অধিবাসীরা। দ্বীপের জীবন এমনিতেই মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন আর স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়, দ্বীপের মানুষরাও সাধারণত স্বাধীন আর স্বতন্ত্র মানসিকতার অধিকারী হয়ে থাকে। যেমন সারা ইউরোপের সঙ্গে ইংল্যান্ডের আর সারা এশিয়ার সঙ্গে জাপানের বরাবর একটা পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। সেটা বোধ হয় এই দুটি দ্বীপরাষ্ট্র বলেই।

সেই স্বতন্ত্র ঘরানায় বড়ো হওয়া, প্রতিপত্তিশালী বাবার মেয়ে, রুচি এবং চিন্তাধারায় কিছুটা প্রত্যক্ষ বিদেশি প্রভাবে প্রভাবান্বিত অদিতি দুই দিদির সঙ্গে যখন কলকাতায় চলে আসেন, তখন তাঁর বয়স পনেরো বছর। রমাপদ দত্ত বালিগঞ্জে বিরাট এক বাড়ি কিনেছিলেন ছেলেমেয়েদের কলকাতায় থেকে পড়াশুনা করার জন্যই। তাঁর পক্ষে কাজকর্ম ফেলে কলকাতায় এসে থাকা সম্ভব ছিল না, অদিতির মা-ও আসতে পারেননি। কলকাতায় অদিতিদের অভিভাবক হয়ে এসেছিলেন তাদের জেঠিমা ভবতারিণী। জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর পর থেকে যিনি এই পরিবারেই আছেন।

কলকাতায় ভবতারিণীর কাজ ছিল বালিগঞ্জের বাড়িতে সংসার সামলানো, মেয়েদের আগলানো আর দু-তিনদিন অন্তর অবসরমতো টালিগঞ্জে তাঁর সহোদর দিদি জগত্তারিণীর বাড়িতে এসে গল্পগুজব করা। দিদি বাড়ি থেকে বেরোতে পারতেন না, তাঁর বয়স হয়েছে, তা ছাড়া বাতে প্রায় পঙ্গু।

জগত্তারিণীও বিধবা ছিলেন, থাকতেন ছেলেদের সংসারে। বিরাট গুষ্টি তাঁদের। দুই ছেলে, তাদের বউ। নাতিনাতনির সংখ্যা অঢেল। বড়ো ছেলে সুরথ শান্তশিষ্ট বোকাসোকা ভালোমানুষ। ছোটো সুধন্য ভয়ানক ধুরন্ধর, বিষয়বুদ্ধিতে ঘোড়েল। জগত্তারিণীর স্বামী কেশবনাথ মারা যান দেশবিভাগের ঠিক আগে আগে। তখন তাঁরা পূর্ববঙ্গে, ফরিদপুরের বাড়িতে। মৃত্যুর আগে কেশবনাথ সপরিবারে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। সেইমতো কলকাতার টালিগঞ্জে একটি মুসলমান পরিবারের সঙ্গে জায়গা জমির অদলবদল করে লেখাপড়াও করে রাখা ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর জগত্তারিণী ছেলে ছেলের বউ নাতিনাতনির সঙ্গে এসে উঠলেন টালিগঞ্জের বাড়িতে।

বাড়িটা তখন ছোটোই ছিল। একতলা, সেইসঙ্গে অনেকটা খোলা জমি। সুধন্য অল্পদিনের মধ্যে খোলা জমিতে বাড়ি তুলল, একতলা বাড়ি তিনতলা করল। কয়েকটা ঘরে ভাড়া বসাল। বাস কিনল গোটা তিনেক, একটা পেট্রোল পাম্পও। বাস আর পেট্রোল পাম্প চালিয়ে রীতিমতো ফুলেফেঁপে উঠল। পাশাপাশি তার দাদা সুরথ কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারল না, বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে সে এই বাড়িতে যেন ছোটোভাইয়ের একরকম আশ্রিত হয়েই রয়ে গেল।

এর মধ্যে একটা গভীর অন্যায় লুকিয়ে রয়েছে, জগত্তারিণী জানেন। কিন্তু কিছু বলতে পারেন না, কেননা তিনি নিজেই সুধন্যর আশ্রিত।

কেবলমাত্র ভবতারিণী যখন আসেন, দুই বোনে সুখদুঃখের কথা হয়। ভবতারিণীর কলকাতায় আসার পর তাঁদের সম্পর্কসূত্রে দুই পরিবারে বেশ একটা সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে, বহুদিন পরে মাসিকে দেখে সুধন্য বোধ হয় আত্মীয়তার টান

অনুভব করেছে। সেইসঙ্গে রয়েছে তিনটি তরুণী এবং তাদের মহিলা অভিভাবিকা সংবলিত একটি ‘অসহায়’ পরিবারের প্রতি কর্তব্যের অজুহাতও। সুধন্য সেখানে বেশ ঘনঘনই যাওয়া আসা শুরু করছে।

সেদিন দুপুরে জগত্তারিণী নির্জনে বোনকে বললেন, ‘ভব, সুধন্য তোদের ওখানে খুব যাতায়াত করছে দেখছি। একটু সাবধানে থাকিস।’

ভবতারিণী অবাক হলেন। দিদির মুখে নিজের ছেলের সম্বন্ধে এ কী কথা! সুধন্যর কি তবে মেয়ে সংক্রান্ত দোষ-টোষ আছে নাকি? বিস্ময়ের গলায় বললেন, ‘কেন দিদি, সুধন্য কি—’

‘ওর গতিক সুবিধের নয়। একে তো তোর ওপরে তিন-তিনটে দেওরঝির দায়িত্ব। কিন্তু আমি সে-কথাও বলছি না।’

‘টাকাপয়সার ব্যাপারে ওর সঙ্গে কোনো আলোচনা করিস না, ওর পরের সম্পত্তির দিকে খুব চোখ। বিশেষ করে অসহায় মেয়েমানুষদের সম্পত্তি দেখভাল করার নাম করে হাত করতে চায়। তোর দেওর যদিও আছে, কিন্তু সে তো এখানে থাকে না, তাই বলছি আর কি, সাবধানে থাকিস। বাড়ির দলিলপত্র কি এখানে?’

‘আমি ঠিক জানি না, বোধ হয় তাই।’

ভবতারিণীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। সুধন্যকে তিনি খুব ছোটোবেলায় দেখেছিলেন। তারপর এই দেখা। ওকে দেখে তাঁর ভালোই লেগেছিল। মাসিমা মাসিমা করে ডাকাডাকি করে, খোঁজখবর নেয়। মুখের কথা খুব মিষ্টি। তাঁর দেওরঝিদের সঙ্গে এরই

‘তবে?’

মধ্যে ভাব করে ফেলেছে। সবসময় বলে, ‘কলকাতায় এসে পড়েছ, তোমাদের কোনো চিন্তা নেই। অসুবিধে হলেই আমায় বলবে।’ সেই ছেলে এই জিনিস! সে-কথা আবার বলছে তার নিজের মা-ই। ভবতারিণীর দিদির কথা ভেবে কষ্ট হল। জগত্তারিণীর মুখ দেখে তাঁর মনে হল দিদির যেন আরও কিছু বলার আছে।

জগত্তারিণী মাদুরের ওপর কাত হয়ে শুয়েছিলেন। ভবতারিণী এসে তাঁর পায়ে তেল মালিশ করে দিয়েছেন অনেকক্ষণ ধরে, এখনও দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন দিদির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বোনের দিকে না তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ‘সবই তো জানি আমি। সুধন্য যে কী ধাতু দিয়ে গড়া—নিজের বড়োভাইকেও—’

ভবতারিণীর যে একটু সন্দেহ হত না তা নয়। তিনি জানতেন এই বাড়ি ছিল কেশবনাথের সম্পত্তি, তাঁর দেশের বাড়ির বিনিময়ে পাওয়া। তাহলে এখন এই বাড়িতে স্বাভাবিকভাবে সুরথ সুধন্য দুই ভাইয়েরই অধিকার থাকা উচিত। অথচ সুরথ থাকে পরাশ্রিতের মতো। ভবতারিণী দিদিকে চেপে ধরলেন, ‘ছেলের নামে এত বড়ো কথা বলছ দিদি, তুমি ঠিক জানো তো?”

জগত্তারিণী আর মুখ খুলতে চাইছিলেন না। মনের দুঃখে হঠাৎ যেটুকু বলে ফেলেছেন তার চেয়ে বেশি বলে লাভ কী? তিনি জানেন সব। জানেন বলেই যন্ত্রণায় ছটফট করেন। কিন্তু কিছু করার তো নেই। করতে গেলে সুরথকে সপরিবারে পথ দাঁড়াতে হবে, হয়তো তাঁকেও।

কিন্তু তবু বলতে হল। একটু একটু করে কথা আদায় করে নিলেন ভবতারিণী দিদির কাছ থেকে। বলতে পেরে জগত্তারিণীরও বোধ হয় একরমক হালকা লাগছিল।

সুধন্যর যে স্বভাবচরিত্র ভালো নয় এটা সে বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই জগত্তারিণী ধরতে পেরেছিলেন। কলকাতায় আসার পর সে কোথা থেকে কী উপায়ে টাকা রোজগার শুরু করল তা একটু-আধটু আঁচ করতে পারলেও তাঁর পক্ষে পুরোটা জানা

সম্ভব ছিল না। তবে সেটা যে খুব সাদাপথে নয়, এও তিনি বুঝতে পারতেন।

সুধন্য একটা বাস কিনল। একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে তিনটে। বাস চালানোর ব্যাবসায় নিশ্চয়ই খুব লাভ হয়। তারপর সুধন্য একটা পেট্রোল পাম্প কিনে দাদাকে এসে বলল, ‘তুমি তো বসেই আছ, তার চেয়ে পেট্রোল পাম্পটা দ্যাখো। টাকাপয়সার হিসাব তোমায় দেখতে হবে না, তুমি শুধু ওখানে গিয়ে বসবে। এর জন্যে আমি মাসে মাসে তোমাকে কিছু দেব।’

সুরথ দেশে থাকতে প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করত। কলকাতায় এসে কোনো কাজ জোটাতে পারেনি। ভাইয়ের কথায় রাজি হওয়া ছাড়া তার আর কিছু করারও ছিল না।

সুরথ পেট্রোল পাম্পে গিয়ে বসতে লাগল। লোকেরাই কাজকর্ম করে, গাড়ি এলে তেল ভরে দেয়, টাকাপয়সা নেয়। সুরথ মন দিয়ে তাদের কাজকর্ম দেখে। এটাই তার কাজ। তার মনে হয় সব ঠিকঠাকই চলছে, কোনো বেচাল নেই। হিসাবের ব্যাপারটা তার দেখার দরকার নেই, ওটা সরাসরি সুধন্যই কর্মচারীদের কাছ থেকে বুঝে নেয়। সুরথের কাজটা অনেকটা নজরদারির। সে জানত না তার নজরের আড়ালে সুধন্যই এই পেট্রোল পাম্পে একটা বেআইনি ব্যাবসা চালাচ্ছে, চোরাই পেট্রোলের কারবার।

জানল, যখন একদিন পেট্রোল পাম্পে পুলিশ এল। সুরথকে থানায় যেতে হল। তখনই সুরথ আর একটা ব্যাপার জানতে পারল যেটা জেনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পেট্রোল পাম্পটা সুধন্য কিনেছিল তার নিজের নামে নয়, সুরথেরই নামে। সে বুঝতে পারল, পুলিশ তাকে সহজে ছাড়বে না, জেলও হয়ে যেতে পারে।

থানায় গিয়ে সুরথকে ছাড়িয়ে আনল সুধন্য। বাড়ি এসে বলল, ‘চিন্তা কোরো না। আমি সমস্ত সামলে নিচ্ছি। আমাকে ফাঁসানোর জন্যে কেউ মিথ্যে নালিশ করেছে। কিন্তু আমার অনেকের সঙ্গে চেনাজানা আছে। দেখছি কী করা যায়, তুমি এটাতে একটা সই দিয়ে দাও।’

সুধন্যর হাতে একটা সাদা কাগজ। সুরথের তখন কোনো চিন্তা করারও মানসিক অবস্থা ছিল না। ভয়ে আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় তার আধমরা দশা। এসব সময়েই মানুষ সাদা কাগজে সই করে ফ্যালে। তবু সুরথ একবার ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কী?’

‘একটা চিঠি লিখতে হবে পুলিশের বড়োকর্তাকে, ব্যাপারটা যাতে মিটে যায় সেজন্য। ভালো করে ভেবে গুছিয়ে লিখতে হবে। সে হয়ে যাবে, ভেবো না। সইটা তোমাকেই করতে হবে কেননা পেট্রোল পাম্পটা তো তোমার নামে।’

সুরথ আর কথা বাড়ায়নি। সই দিয়ে দিয়েছিল। তার মাথায় একবারের জন্যেও আসেনি যে গোটা ব্যাপারটাই একটা সহজ ধাপ্পা। ছেলেমানুষের চোখে ধূলো দেওয়ার মতোই ভীষণ সোজাসাপটা একটা ষড়যন্ত্র। সে সুধন্যর কথার ওপর নির্ভর করে কিছুদিন ভয়ে ভয়ে কাটানোর পর যখন দেখল সত্যি সত্যি পুলিশ তাকে নিয়ে আর টানাটানি করল না, সে নিশ্চিন্ত হল। সুধন্যর কর্মকুশলতার জন্যে তার ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল তার, কৃতজ্ঞতাও।

তারপর একদিন, সুধন্য সুরথকে একটা কাগজ দেখাল। একটা হ্যান্ডনোট। তলায় সুরথের সই। ওপরে সুরথের জবানিতে যা লেখা আছে তার মর্ম এই যে, পেট্রোল পাম্প সংক্রান্ত মামলায় টাকা প্রয়োজন হওয়াতে সুরথ সুধন্যর কাছে পেট্রোল পাম্প এবং তার নামে এই বাড়ির যে অংশটা, সেটি বন্ধক রেখে তিরিশ হাজার টাকা ধার করেছে। আগামী সাত বছরের মধ্যে এই দেনা শোধ না করতে পারলে সমস্ত সম্পত্তি সুধন্যর অধিকারে চলে যাবে।

এ সমস্ত ঘটনা জগত্তারিণীকে কেউ বলেনি। তিনি কিছুটা দেখেছিলেন, কিছুটা আড়ি পেতে শুনেছিলেন, বাকিটা তাঁর অনুমান। ঠিকঠাক অনুমান করতে তাঁর অসুবিধে হয়নি, কারণ নিজের দুই ছেলেকেই তিনি ভালোমতো চিনতেন।

সুরথও এসব কথা বছর দুয়েক পরে একজনকেই শুধু বলেছিলেন। তাঁর বড়ো ছেলে বিশ্বনাথকে। বিশ্বনাথের মা নেই। ওর আড়াই বছর বয়সে সুরথের প্রথম স্ত্রী মারা যান। মাতৃহীন ছেলেটির প্রতি সেই থেকে সুরথের অতিরিক্ত স্নেহ। দেশেঘরে যা হয়ে

থাকে, ‘বাচ্চাটাকে কে মানুষ করবে’ এই অজুহাতে মায়ের অনুরোধে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সুরথকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে হয়। এপক্ষে তাঁর মোট চারটি সন্তান। তাদের সঙ্গে সুরথের হৃদয়ের তেমন যোগ নেই, ছেলেমেয়েগুলোও তাদের মায়ের মতো নির্বোধ আর ঝগড়াটে। সুরথের স্ত্রী, বিশ্বনাথের সৎমা কমলা সবসময়ই বিশ্বনাথকে লক্ষ্য করে বলে থাকেন, ‘ওই ছেলেই হল আপনার জান, আর আমরা সবাই ভেসে এসেছি।’

কথাটা একদিক দিয়ে সত্যি। বিশ্বনাথের ওপর সুরথের কেমন একধরনের মানসিক নির্ভরতা রয়েছে। ভাগ্যহত বৃদ্ধ পিতা সম্ভবনাময় পুত্রের ওপর যেভাবে নির্ভর করেন। বিশ্বনাথ পড়াশোনায় ভালো, অসম্ভব পরিশ্রমী, সৎ, সুরথ তাকে ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে সব কথা বলে বললেন, ‘তোমাকে বললাম এইজন্যেই যে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ এ বাড়ি আর আমাদের নয়। সুধন্য আমার এমন সর্বনাশ করতে পারে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু ঈশ্বর আমায় এমন কোনো জোর দেননি যাতে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি টু-শব্দটিও করতে পারি…’ সুরথ কেঁদে ফেলেছিলেন।

বিশ্বনাথ অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। বোধ হয় সে সর্বনাশের একটা পরিমাপ করবার চেষ্টা করছিল মনে মনে। তারপর মুখ তুলে শান্ত কঠিন স্বরে বলল, ‘আপনি আমায় কী করতে বলেন বাবা?’

‘আমার মনে হয় সুধন্য হয়তো আমায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে না। কিন্তু কিছু বলা তো যায় না। তোমার অতগুলি ভাইবোন, বোনেদের বিয়ে দেওয়া বাকি। তাড়িয়ে দিলে আমরা যে পথে বসব।’

বিশ্বনাথ চিন্তা করেছিল। আদালতে নালিশ করার সাধ্য তাদের নেই এ কথা সে খুব ভালো করেই জানে। প্রথমত, অত খরচ আসবে কোত্থেকে। দ্বিতীয়ত, তাদের কাছে কোনো প্রমাণও নেই যে সত্যিই সুরথ বাড়ির অংশ বাঁধা রেখে টাকা নেননি। তার থেকেও বড়ো কথা, তাদের পুরো পরিবারটা কাকার ওপর নির্ভরশীল। তার নিজের কয়েকটা টিউশনি ছাড়া তাদের নিজস্ব কোনো উপার্জন নেই। মামলা করলে কাকা তাদের মারতে মারতে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।

বিশ্বনাথ তখন পড়ছে। সামনেই তার বিএসসি ফাইনাল। সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বেশ, আমি কাল থেকে চাকরি খুঁজব।’

‘ন্‌ না!’ সুরথ যেন আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘তুই পরীক্ষাটা দিয়ে নে, পাশ করে নে। ততদিন আমরা অপেক্ষা করতে পারব, এত শিগগির করে কিছু হবে না।’

‘হবে না, সে-কথা এত জোর দিয়ে কী করে বলতে পারছেন?’

‘হ্যাঁ পারছি।’ সুরথের গলায় কেমন একরকম মরিয়া ভাব ফুটে উঠেছিল, স্বভাববিরুদ্ধ দৃঢ় গলায় বলেছিলেন, ‘যাই হোক না কেন, তুমি পরীক্ষা দেবে।’

বিশ্বনাথ পরীক্ষা দিতে পেরেছিল। পরীক্ষার ফি জোগাড় করেছিল বন্ধুদের কাছে ধার করে। কিন্তু তার আশঙ্কা সম্পূর্ণ মিথ্যে হয়নি। পরীক্ষার একমাস আগে থাকতে সুধন্য নানারকম উত্পাত শুরু করলেন। এ বাড়িতে সুরথের অংশ বলতে যা ছিল তা হল ফরিদপুরের সম্পত্তির বদলে পাওয়া পুরোনো বাড়ির দুটো ঘর। অধিকার হারালেও আশ্রিত হয়ে সুরথ এই দুটি ঘর নিয়েই থাকতেন। তার একটা বড়ো, আর একটা খুব ছোটো। এই ছোটো ঘরটি ছিল বিশ্বনাথের। এখানেই তার থাকা শোয়া পড়াশুনো। বড়ো ঘরে মা বাবা এবং ছোটো ভাইবোনেরা। আসলে, আশ্রিতদের একজন হয়েও বিশ্বনাথ তাদের থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিল, অনেকটা যেন ব্রাত্য, একা। পরীক্ষার কিছুদিন আগে সুধন্য বললেন তার ঘরটা ছেড়ে দিতে।

কেন, কী প্রয়োজন এ সমস্ত প্রশ্ন তোলারই কোনো প্রশ্ন ছিল না। বিশ্বনাথ বইখাতাপত্র নিয়ে নেমে গেল একতলার একটা গ্যারেজে। সেখানে একটাই ঘুলঘুলি, হাওয়া আসে না, আলো আসে না। ওইখানে থেকেই সে পরীক্ষা দিল, পাশ করল, চাকরিও পেল একটা। প্রতিমুহূর্তে একটাই ভয় পেতে পেতে—এই বুঝি কাকা তাদের পুরো পরিবারটাকে নামিয়ে দিলেন পথে।

এইরকম অবস্থাতেই বিশ্বনাথের অদিতির সঙ্গে আলাপ। তার পরের ঘটনাগুলি আরও দ্রুত। বাড়ি বন্ধকের সাত বছর কেটে যাওয়ার পর তিনি জানতেন যে-কোনো দিন কাকা তাঁদের তাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তার আগেই সুরথ সেই অবশ্যম্ভাবী সর্বনাশ এড়ালেন হঠাৎ মারা গিয়ে। তার তিন মাসের মধ্যে কমলাও। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোকে চাইলে সুধন্য বের করে দিতে পারতেন হয়তো, কিন্তু বিশ্বনাথ কাকাকে গিয়ে বললেন সংসার খরচের অর্ধেক তিনি দেবেন। তাঁদের আর কয়েকটা বছর এখানে থাকতে দেওয়া হোক।

এই কয়েকটা বছরে বিশ্বনাথ দুই বোনের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ভাই-ও কোনোরকমে মোটামুটি লেখাপড়া করে কাজেকর্মে ঢুকে গেছে। তারপর বিশ্বনাথের সময় হয়েছে অদিতিকে বিয়ে করার। ওঁদের প্রেম নিয়েও ডামাডোল কম হয়নি। সুধন্য চেষ্টা করেছিলেন বিয়ে ভেঙে দেওয়ার। ততদিনে অদিতির মা-বাবা কলকাতায় এসে গেছেন। তাঁরা সব জেনেও বিশ্বনাথকে পছন্দ করেছিলেন তাঁর সৎ পরিশ্রমী স্বভাবের জন্য। অদিতির মা সুধন্যকে বলে দিয়েছিলেন, ‘আমার মেয়ে আপনাদের বউ হতে চলেছে যে, এ শুধুমাত্র বিশ্বনাথের জন্য। আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, আপনি আর এখানে আসবেন না।’

বিয়ের পর মাত্র দেড় বছর বিশ্বনাথ অদিতি ভাড়াবাড়িতে ছিলেন। এই দেড়বছরেই অমানুষিক কষ্ট করে তৈরি হয়েছিল নতুন বাড়ি। বিশ্বনাথ খুব ভালোই জানেন, অনেকটাই তিনি একা লড়েছেন সত্যি, কিন্তু শেষপর্যন্ত অদিতিকে পাশে না পেলে হয়তো এত কিছু সম্ভব হত না।

বাস থেকে নেমে দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালাচ্ছিল তিথি। ন-টা বেজে গেছে। অনেক দিনই তার বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে আজকাল। বাড়িতে সেজন্য বকাঝকাও খেতে হচ্ছে। তাও ভাগ্য ভালো দাদা এখন বাড়ি নেই, শিবপুরে কলেজের হোস্টেলে চলে গেছে। তমাল বোনের এমন পাখা গজিয়েছে দেখলে ছেঁটে দিতে দেরি করত না। মা-বাবাকে তিথি ততটা ভয় পায় না, কিন্তু বকা খেতেও তার ভালো লাগে না। তবুও খেতে হচ্ছে। এর চাইতেও দুঃখের কথা, তিথি আজকাল বাধ্য হয়ে আরও একটা কাজ করছে, যেটা করতে তার সত্যি সত্যিই ভেতরে ভেতরে খুব খারাপ লাগে, কষ্ট হয়। তিথি বাড়িতে মিথ্যে কথা বলছে। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে সে কোনোদিন বলে ক্লাস শেষ হতে দেরি হয়েছে। ফিল্ডওয়ার্ক ছিল। কোনোদিন বলে লাইব্রেরিতে পড়ছিল, কোনোদিন বলে বন্ধুর বাড়িতে গেছিল। আসলে ওই দিনগুলিতে পার্থর সঙ্গে দেখা করে সে।

পার্থর সঙ্গে কী করে যে হু হু করে সময় কেটে যায়, তিথি বুঝতেই পারে না। ঘনঘনই দেখা হয় তাদের, অথচ কথা যেন আর ফুরোয় না। অবশ্য, সবসময় তারা শুধু কথাই বলে, তা তো নয়, চুপ করে কাছাকাছি বসেও তো থাকে অনেক সময়, নন্দনের পুকুরধারে বসে বসে জলে সেন্ট পল্স্ ক্যাথিড্রালের চূড়ার ছায়া ভাসতে দেখে। পাশাপাশি উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটে এপথ-সেপথ, এগলি-সেগলি। সে-সমস্ত রাস্তা তিথি কোনোটাই চেনে না, হয়তো পার্থও চেনে না। তারা শুধু হাঁটে এলোমেলো। সে পার্থর বাহু জড়িয়ে রাখে তার বাহু দিয়ে, পরস্পরের হাতের পাতা মুঠি করে ধরে রাখে দুজনে।

এরকম প্রেম তার জীবনে আসবে, তিথি কি কখনো ভেবেছিল! মৌসুমীর এরই মধ্যে দু-দুটো প্রেম হয়ে গেছে। এ ছাড়াও তার রূপমুগ্ধ পূজারির সংখ্যাও কম নয়। এখন যে ছেলেটির সঙ্গে ওর সম্পর্ক তার নাম রূপম। খুব সুন্দর দেখতে। মৌসুমী রবীন্দ্রভারতীতে ভরতি হয়েছে গান নিয়ে, সে ভালো গান গায়। রূপমও গায়ক, রবীন্দ্রভারতীতে মৌসুমীর সিনিয়র। ওদের দুজনকে পাশাপাশি দেখতে দেখতে তিথির মনে হয়েছে ওরা যেন রাজকন্যা আর রাজপুত্তুর, রূপকথার নায়ক-নায়িকা।

কিন্তু সে তো রাজকন্যা নয়। পার্থও যদিও রাজপুত্তুর নয়, তবে তার মুখচোখ মন্দ নয়। ছোটোখাটো চেহারা, মাথায় তিথির সমান, খুব রোগা। দাড়ি রাখে সে, মাথার চুল একটু পাতলা কিন্তু বড়ো বড়ো ঢেউ খেলানো। সেই পুজোয় দেখা হাওয়া থেকে আজ প্রায় ছ-মাস ধরে তিথি তাকে একই পোশাকে দেখে এসেছে। প্যান্টের ওপর সুতির রঙিন পাঞ্জাবি, পায়ে কাবলি চপ্পল, কাঁধে ঝোলা। তিথির এই সবই খুব ভালো লাগে।

আর ভালো লাগে ওর কথা শুনতে। পার্থ যে কত কথা জানে আর কত কথা বলে…তিথি সে সমস্ত অবাক হয়ে শোনে। পার্থ অনেক বই পড়ে, সে সব বইয়ের গল্প বলে তাকে। তিথি ওইসব বই একটাও পড়েনি শুধু নয়, অধিকাংশের নামই শোনেনি সে। তা ছাড়া সিনেমার গল্প—এই সিনেমা ঠিক তিথির জানাচেনা সিনেমা নয়। যদিও তিথি সিনেমা দেখেছে খুব কম, ছোটোবেলায় বছরে একবার, মা-বাবার বিয়ের দিন সবাই লে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হত। এখন সেও আর হয় না। আর টিভি আসার পর থেকে তো শনি-রবিবারে বাড়িতেই সিনেমা দেখা যায়। তিথি মাঝে মাঝে দেখে, কোনো কোনোটা ভালোও লাগে, সব নয়। কিন্তু পার্থ যেসব সিনেমার নাম বলে তিথি এর আগে তার নাম শোনেনি। পার্থ সিনেমা বলে না, বলে ছবি। আর নায়ক নায়িকার কথা বলে না, বলে পরিচালকদের কথা—কী সব নাম, বার্গম্যান, বুনুয়েল, ফুকো, ফেলিনি, ঋত্বিক ঘটক। এক সত্যজিৎ রায় ছাড়া অ্যাদ্দিন তিথি কোনো পরিচালকের নাম জানত না।

পার্থ যখন ওইসব পরিচালকদের তৈরি ছবির কথা বলে, ওর মুখচোখ কেমন পালটে যায়। চোখ দুটো কেমন উদাস, দৃষ্টি যেন অনেক অনেক দূরে। সেই অত দূর থেকেই যেন তার গলা ভেসে আসে, ‘আমি এইরকম ছবি বানাতে চাই তিথি, এই সব স্বপ্নের ছবি। খুব, খুব কঠিন কাজ,…কিন্তু দেখো, আমি পারব…

তিথি পার্থর সব কথা পুরোপুরি বুঝতেই পারে না। শুধু এইটুকু বোঝে, পার্থ কোনো বিরাট স্বপ্নের কথা বলে, দুরূহ মহৎ কোনো লক্ষ্যের কথা। পার্থর চোখের চাহনিতে, তার গলার স্বরে, এলোমেলো চুলে, রোগা হাতে, নরম কাপড়ের পাঞ্জাবির হাতায়, তার

মলিন কাঁধ-ব্যাগে সেই স্বপ্ন লেগে আছে, তিথি দেখতে পায়। তিথি সেই স্বপ্নগুলোকে ছুঁতে চায়। সে জানে, এত বড়ো আর উঁচু স্বপ্নদের ছোঁয়া তার পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়, সে তাই পার্থকেই আরও প্রবলভাবে ছুঁতে চায়। গভীর আবেগে তার পাঞ্জাবির হাতা আঁকড়ে ধরে মনে মনে বলে, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক পারবে, তুমি অনেক বড়ো হবে…আমি জানি…’

তিথি বুঝতে পারে পার্থ ভীষণ আলাদা, সে যেন অন্য কারও মতো নয়। এই অন্যরকম ছেলেটি তাকে ভালোবাসে, তাকেই। তার প্রেমিক! তারও একজন প্রেমিক আছে! সেই প্রেমিক তিথির জন্যে অপেক্ষা করে, তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটায়, তারই হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে, ‘আমি যদি ডাক দিই, তুমি আসবে তো?’

এই কথাটা তিথির শুনতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু কথাটার মানে তার কাছে ঠিক পরিষ্কার নয়। কথাটা পার্থ প্রায়ই বলে। আজও

তিথি আজকাল কলেজে খুব ক্লাস বাঙ্ক করছে। পার্থর সঙ্গে যেদিন দেখা হওয়ার কথা থাকে, সেদিন সে শুধু সকালের দিকের ক্লাসগুলোই করে। দুপুর নাগাদ পার্থ চলে আসে কলেজের সামনে। ওরা একসঙ্গে বেরিয়ে যায়। আজ ওরা ইডেনে গিয়ে বসেছিল। তিথি এখানে আগে আসেনি। তার খুব ভালো লাগছিল। কী সুন্দর সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ, মাঠটা আবার অল্প ঢেউ তোলা। লম্বা লম্বা ঘন পাতাওয়ালা সব গাছ, তাতে হাওয়া লেগে ঝিরঝির শব্দ হচ্ছে। একেই তো মর্মর বলে। আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে কিন্তু মেঘলা নয়। সচল মেঘগুলো সূর্যকে এক-একবার ঢেকে দিচ্ছে, আবার সরে যাচ্ছে। সারা মাঠটার বুকে খেলে যাচ্ছে সেই ভাসমান মেঘেদের ছায়া। বাগানে ঢোকার সময় প্যাগোডার মতো ছাউনি দেওয়া একটা ঘর চোখে পড়েছিল তিথির। এখন মাঠে বসে অন্য পাশে গাছপালার আড়ালে একটা ছোট্ট কাঠের সাঁকো চোখে পড়ল তার। বাঃ কী চমৎকার জায়গা! তিথি উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠল, ‘কলকাতায় এরকম একটা সুন্দর বাগান আছে আমি জানতামই না। আগে কখনো আসিনি এখানে।’

বলেছে।

জ্বালাতে জ্বালাতে

পার্থ ঘাসের ওপরে আধশোয়া হয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল। ঠোঁটে সিগারেট চেপে হাত আড়াল করে দেশলাই বলল, ‘তুমি এর আগে প্রেম করতে?’

‘যাঃ!’ তিথির কান গরম হয়ে উঠল, লজ্জায়।

‘তাহলে আসবে কী করে? এখানে শুধু প্রেমিক প্রেমিকারাই আসে।’

তিথি মুখ নীচু রেখে অল্প অল্প হাসছিল। হঠাৎ মুখ তুলে বলল, ‘

‘আমি এসেছিলাম কে বলল?’

তুমি তবে কার সঙ্গে এসেছিলে?’

‘এসেছিলে নিশ্চয়ই, নইলে তুমি জায়গাটা চিনলে কী করে?’

পার্থ হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে তিথির দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে পেল, তিথিও হাসছে, কিন্তু তার চোখে যেন একটুকরো ছায়া ভেসে এসেছে, তার মুখ অবিকল এই রোদছায়া ভাসা মাঠটার মতো। পার্থ একটা নিশ্বাস ফেলে ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। মিনিট খানেক চুপচাপ সিগারেট টানল। সে বুঝতে পারছিল, তিথি উত্তরের প্রতীক্ষা করছে।

পার্থ আকাশের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘না, এখানে আমি একাই এসেছিলাম। কিন্তু আমি স্বীকার করছি, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আমার অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।’ পার্থ তিথির দিকে মুখ ফেরাল। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তিথির ঘাসে লুটিয়ে থাকা কামিজের কোনা মুঠি করে ধরে আকুল স্বরে বলল, ‘প্লিজ তিথি, দুঃখ পেয়ো না। বিশ্বাস করো, ওটা শেষ হয়ে গেছে, তুমি আসার আগেই সেসব ফুরিয়ে গিয়েছিল।’

তিথি মুখ তুলতে পারছিল না। গলার কাছে প্রবল ব্যথা, চোখ জলে ভরে আসছে। কিন্তু এটা ঠিক দুঃখে বা অভিমানে নয়। পার্থ তার থেকে প্রায় বারো বছরের বড়ো। তিথিই তার প্রথম প্রেম, এমন না হওয়াটাই স্বাভাবিক, তিথি জানত। সে মৌসুমীকে জিজ্ঞেসও করেছিল। মৌসুমী কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু আজ, নিজের অজান্তে কেমন আপনা থেকেই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেল, যাতে সেও প্রশ্নটা করে ফেলল, আর পার্থও স্বীকারোক্তি দিল। এই পুরো ঘটনাটার একটা অন্তর্নিহিত অভিঘাত ছিল। এর মধ্যে ছিল একটা নাটকীয় রোমাঞ্চ আর গভীরতা, যা তিথির শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। পার্থর কাতর স্বর তখনও তার কানে আসছিল, ‘প্লিজ তিথি, আমায় ক্ষমা কোরো। কী করব, তোমার সঙ্গে দেখা হতে আমার যে বড়ো দেরি হয়ে গেল…’

তিথির ইচ্ছে করছিল পার্থর বুকের ওপর সে এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণভরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘কিচ্ছু দেরি হয়নি, যা হয়ে গেছে যাক, এসো আমরা পাগলের মতো ভালোবাসি।’

আবেগে তিথির স্বর ফুটছিল না। পার্থ তখনও আঁকড়ে আছে তার জামা। সেই হাতটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে পিষতে পিষতে তিথি ভাঙা গলায় শুধু বলতে পেরেছিল, ‘না না, এমন কোরো না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।’

পার্থ ধড়মড় করে উঠে বসেছিল। সজোরে তিথির দুটো হাত টেনে নিয়ে তাতে নিজের মুখ চেপে ধরে যেন ডুকরে উঠেছিল, ‘ওহ্ তিথি, আমার ছোট্ট তিতির পাখি, আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সোনা! তুমি তোমার কাছে—তুমিই আমার শেষ গন্তব্য।’ –

এর পরেও ওরা দুজনে অনেকক্ষণ ছিল ওই মাঠে। পার্থ তার সেই পুরোনো প্রেমের কথা বলছিল। তার দুঃখ পাওয়ার কথা। সেই মেয়েটি, সুদক্ষিণা, সে নাকি পার্থর সঙ্গে পাঁচ বছর রীতিমতো গভীর ভালোবাসার পর হঠাৎ অকারণে তাকে ছেড়ে যায়। এক ডাক্তারকে বিয়ে করে সুদক্ষিণা এখন দিব্যি সংসারী। পার্থ আজও বুঝতে পারেনি, সুদক্ষিণা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল কেন।

তিথি মন দিয়ে শুনছিল। শুনতে শুনতে তার বুকে টলটল করে উঠছিল মায়া, কূল ছাপানো প্রেম দিয়ে সে মনে মনে পার্থর সমস্ত ক্ষত ধুইয়ে দিতে চাইছিল। ভাবছিল, ইশ্, আহা রে, সে কখনো পার্থকে অমন দুঃখ দেবে না। কক্ষনো না।

পার্থ কথা থামিয়ে চুপ করে শুয়েছিল। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে আকাশের ঢালু গা বেয়ে। গাছে গাছে ঘরে ফেরা পাখিদের অবিশ্রান্ত তীক্ষ্ণ কলরব। তিথি দাঁতে ঘাস কাটছিল। বাড়ি ফিরতে হবে তাকেও, কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। শেষপর্যন্ত পার্থই বলল, ‘চলো উঠি, অন্ধকার হয়ে আসছে।’

তিথি উঠে জুতোয় পা গলাল। নিজের জামার পেছনটা ঝাড়তে ঝাড়তে দেখল পার্থ উঠে দাঁড়িয়েছে, ওর সারা মাথায় কাঁধে পিঠে বড়ো বড়ো শুকনো ঘাসপাতা লেগে রয়েছে, চুলে একগুছি ঘাস ঝুলছে কপালের সামনে, পার্থর যেন খেয়ালই নেই। তিথি হাসতে হাসতে বলল, ‘এই, তোমার সারা গায়ে ঘাস, ওগুলো ফ্যালো।’

বলে সে নিজেই পার্থর কপাল থেকে সেই ঘাসের গুছিটা ফেলে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াল, পার্থ চমকে বলল, ‘কী!’

‘কী আবার, দেখতে পাচ্ছ না, এখানেও তো ঘাস লেগে আছে হাঁদারাম!’

তিথির হাতটা নিজের কপালে চেপে রেখে পার্থ বলল, ‘সত্যি করে বলো, আমি যদি তোমাকে কখনো ডাকি, তুমি আসবে তো?’

পার্থ কোথায় যাওয়ার কথা বলছে তিথি ঠিক বুঝতে পারেনি। পার্থ তো তাকে সেই ছ-মাস আগেই ডেকেছিল। তিথি তো সে ডাকেই সাড়া দিয়ে তার কাছে এসেছে। তবুও পার্থ এ কথাটা এভাবে বার বার বলে কেন?

তিথি অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা কাত করল, বলল, ‘যাব।’

ইডেন থেকে বেরিয়ে ওদের খুব খিদে পেয়েছিল। কাছাকাছি রাস্তার ধারে একটা দোকানে গিয়ে চাউমিন খেল দুজনে। খেতে গিয়েই আরও দেরি হয়ে গেল। তারপর বাস পেতে পেতেও সময় গেল খানিকটা। পার্থ তিথির সঙ্গে ওদের বাড়ির স্টপেজ অবধি এল। প্রতিদিনই সে এরকম আসে। তিথিদের বাড়ির গলিতে ঢোকে না, বাস থেকে নেমে রাস্তা ক্রস করে উলটোদিকের ফুটপাতে চলে যায়। সেখান থেকে অন্যদিকের বাস ধরে নেয় আবার। অন্যদিন বাস থেকে নেমেও দু-চারটে কথা বলে তারা। আজ তিথি আর দাঁড়াল না, গলিতে ঢুকে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিল। ভয় ভয় লাগছে তার, কপালে আজ সত্যিই দুঃখ আছে।

বিশ্বনাথ টিভি দেখছিলেন। রিটায়ার করার পর এটাই তাঁর একটা অকুপেশন। ব্যাপারটা নেশাতে দাঁড়িয়েছে। সন্ধ্যে থেকে টিভি দেখেন সাড়ে আটটা অবধি, যতক্ষণ বাংলা অনুষ্ঠান চলে। তারপর ‘ওভার টু ডেলহি’ হয়ে গেলে টিভি বন্ধ করে দেন। হিন্দি প্রোগ্রাম তাঁর পোষায় না।

এই সময়টাতে কেউ তাঁকে বিরক্ত করে না, তিনিও কোনো ব্যাপারে মাথা দেন না। একমনে একাগ্র দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকেন। টিভিটা বসার ঘরেই রাখা। বাড়িতে এ সময়ে কেউ এলেও বিশ্বনাথ টিভি বন্ধ করেন না। একেই তিনি গল্প টল্প ভালো করতে পারেন না, কাজের কথা ছাড়া খুব একটা অন্য কথাটথাও বলেন না। বাড়ির লোকের সঙ্গেও না, বাইরের লোকের সঙ্গেও না। টিভি তাঁকে আরও অসামাজিক করে দিয়েছে। অদিতি বিরক্ত হন, ছেলেমেয়েরাও তাঁর টিভি দেখা নিয়ে মাঝেমধ্যে হাসি ঠাট্টা করে, কিন্তু বিশ্বনাথের ভ্রূক্ষেপ নেই।

অথচ মজার কথা হল, টিভিতে বিশ্বনাথের প্রবল আপত্তি ছিল। চারপাশে চেনাশোনা প্রত্যেকের বাড়িতে যখন টিভি এসে গেছে, বিশ্বনাথ তখনও টিভি কেনেননি। এ ব্যাপারে অদিতিরও সায় ছিল। টিভি এমন কিছু জরুরি জিনিস নয়, বরং ওতে কাজকর্ম পড়াশোনার ক্ষতিই হয়। তিথি আর তমালও ওদের সব বন্ধুদের বাড়িতে টিভি আছে তাদের কেন নেই এই নিয়ে কখনো অভিমান অভিযোগ করেনি। ওদের সে স্বভাবই নয়। তা ছাড়া, ছোটোবেলা থেকেই ওরা একটা নিপুণভাবে পরিচালিত কিন্তু সবরকম বিলাসিতাবর্জিত সংসারের মধ্যে বড়ো হয়েছে। প্রয়োজনের বাইরে যা, সেটা চাইতে নেই বা চাইলে পাওয়া যাবে না, এই বোধ তাদের তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তমাল বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে খেলা দেখত। আর তিথি সন্ধ্যেবেলা অঙ্ক কষতে কষতে পাড়ার কোনো একটা বাড়ির টিভি থেকে ভেসে আসা বিজ্ঞাপনের সুর শুনে আনমনা হয়ে যেত। তার কোনো অভাববোধ হত না, মনে হত, সুরটা যেন কোন দূরের একটা দেশ থেকে সমুদ্র পেরিয়ে কেঁপে কেঁপে ভেসে আসছে। কিংবা হয়তো, সুরটা পৃথিবীর

বাইরে কোনো নক্ষত্র থেকেই ঝরে পড়েছে।

তমাল যেবার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেল জয়েন্ট এন্ট্রান্সে, অদিতি স্বামীকে বললেন, ‘শুনছ, তমু বলছে এবারে তো আমরা একটা টিভি কিনতে পারি।’

বিশ্বনাথের মনটা ছেলের কৃতিত্বে তৃপ্ত ছিল। তবু দু-একবার গাঁইগুঁই করেছিলেন, ‘টিভি! ও বড়ো সর্বনেশে জিনিস, নেশা হয়ে যায়। তিথির সামনে মাধ্যমিক—’

‘তাতে কী হয়েছে, আজকাল সব বাড়িতেই টিভি, তাদের বাড়িতে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করছে না? আর তিথি টিভি দেখে পরীক্ষা খারাপ করার মেয়ে নয়।… অনেক দিনই তো হল, তমু অন্যের বাড়ি গিয়ে খেলা দেখে। ও বলছিল সামনে কী ক্রিকেট খেলাটেলা আছে…শোনো, তুমি আর না কোরো না।’

টিভি কেনা হল, একেবারে রঙিন টিভিই। বিশ্বনাথের মত হল, পয়সা যখন খরচ হচ্ছেই, তখন দেখেশুনে ভালো জিনিসটা কেনা ভালো।

তমাল খেলাটেলা থাকলে টিভি খোলে, সেও যখন সে বাড়িতে থাকে। তিথিও মাঝেমধ্যে টিভির সামনে এসে বসে, কিছুক্ষণ দেখে উঠে যায়। সময় পেলে অদিতিও দেখেন টুকটাক। কারোরই নেশা হয়নি। মাঝখান থেকে নেশা ধরে ফেলেছে বিশ্বনাথকেই। তবে, ওই বাংলা প্রোগ্রামটুকুই।

সাড়ে আটটা বাজলে টিভি বন্ধ করে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে বিশ্বনাথ দেখলেন, অদিতি বারান্দায় মোড়া পেতে বসে রয়েছেন।

বিশ্বনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিথি ফেরেনি এখনও?’

অদিতি রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, মুখ না ফিরিয়ে বললেন, ‘না।’

‘সে কী, এত রাত করছে, তোমায় কিছু বলে যায়নি?’

‘কী বলে যাবে? আজকাল প্রায়ই দেরি করছে, জিজ্ঞেস করলে বলে ক্লাস ছিল। কলেজে কি আজকাল রাত অবধি ক্লাস হয়!’

অদিতি কথাগুলো বললেন বিড়বিড় করে, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। তিনি অনেকক্ষণ থেকেই একা একা বারান্দায় বসে আছেন। বিশ্বনাথ এতক্ষণ টিভি দেখছিলেন, অদিতি একা একাই দুশ্চিন্তা ভোগ করেছেন। আসলে চিন্তা তাঁর বেশ কয়েক দিন থেকেই হচ্ছে। তিথি বরাবরই চাপা স্বভাবের মেয়ে, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু অদিতি বুঝতে পারছেন তার মধ্যে কোথাও একটা বড়ো পরিবর্তন ঘটে গেছে। সে ঠিক আগের মতো ভিতু, সাংঘাতিক মুখচোরা, জড়সড় মেয়েটি নেই। হয়তো এটা ভালো লক্ষণই, হয়তো সে বড়ো হচ্ছে, তাই। কথা-টথা এখনও বিশেষ বলে না, কিন্তু ওর মুখচোখের ভাষাও যেন বদলে গেছে। অদিতির মনে একটা সন্দেহ কাঁটার মতো খচখচ করতে থাকে। বিশ্বনাথকে সে-কথাটা বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারেন না।

বিশ্বনাথও রাস্তার দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, ‘কলেজে ঢুকেই এই অবস্থা, হ্যাঁ! সাড়ে আটটা বেজে গেল এখনও পাত্তা নেই!’

বারান্দায় আলো নেই, রাস্তার মিটমিটে আলোয় অদিতির মুখ দেখা যাচ্ছে না, বিশ্বনাথ আবার বললেন, ‘মৌসুমীদের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে আসব নাকি একবার?’

অদিতি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘যেতে পারো, তবে মেয়ে কি আর ওখানে বসে আছে? আমার মনে হয় তিথি আজকাল কারও সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

‘কারও সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানে?’ বিশ্বনাথের গলায় সংশয়।

‘মানে বুঝতে পারছ না? মানে প্রেম করছে’, অদিতির কথা বলার মধ্যে হতাশা ফুটে ওঠে, ‘বেশ বুঝতে পারি ও এখন আমাকে মিথ্যে কথা বলে…আগে কখনো বলত না। ওকে মিথ্যে কথা বলতে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছে—’

বিশ্বনাথ যেন কেমন হয়ে যান। তিথি প্রেম করছে? তিথি বড়ো হল কবে? এই তো সেদিনের কথা, দুধ খেতে চাইত না বলে ওর মা ওকে কোলে চেপে ধরে মুখের মধ্যে ঝিনুক ঠুসে দুধ ভরে দিত আর পরমুহূর্তেই তিথি উগরে দিত সবটা। একটু বড়ো হয়েও যে কথা বলতে শেখেনি, তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর ভয় হয়েছিল মেয়েটা বোবা কি না। মুখের মধ্যে বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল ভরে সারাক্ষণ চুষত, চুষতে চুষতে সামনের দাঁতগুলো উঁচু হয়ে গেল। সেই তিথি প্রেম করছে? এ কথা শুনে অন্য মেয়ের বাবাদের ঠিক কেমন মনে হবে তিনি জানেন না, কিন্তু তাঁর বড়ো ভয় ভয় করতে লাগল, যেন একটা দিশেহারা ভাব। ঢোঁক গিলে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’

‘কে তা আমি কী করে বলব!’ অদিতি চাপা গলায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। কিন্তু তাঁরও ভয় করছিল, চাপা গলাতেই থেমে থেমে বললেন, ‘আমার মনে হয় ওই ছেলেটা, মৌসুমীর দাদা। পুজোর মধ্যে একদিন আমাদের বাড়িতে এল না?’

বিশ্বনাথের চোখের সামনে ছেলেটার চেহারা ভেসে উঠল, যদ্দুর মনে পড়ছে রোগা, দাড়িওয়ালা, পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা। গত পুজোয় এক সন্ধ্যয় বাড়িতে এসেছিল তিথির বন্ধু মৌসুমীর সঙ্গে। মৌসুমীরা বেশ বড়োলোক, কিন্তু এই ছেলেটি, ওর জেঠতুতো না খুড়তুতো দাদা, তার চেহারা-ছবি দেখে তেমন মনে হয়নি, বরং খুব নিষ্প্রভই লেগেছিল। তিনি আর অদিতিও ছেলেটির সঙ্গে

আলাপ করেছিলেন। হ্যাঁ, তাঁর মনে পড়ছে, তিথিকে ওইদিন দেখে মনে হচ্ছিল যেন খুব উচ্ছল, খুব হাসছিল, আঁকার খাতা নিয়ে এসে ছেলেটিকে দেখাচ্ছিল, বেশ হইহই করে কথা বলছিল বন্ধু আর বন্ধুর দাদার সঙ্গে। দেখে তাঁর অবাক লেগেছিল, ভালোও লেগেছিল, মনে হয়েছিল— আহা, ওদেরই তো পুজো, ছোটোদেরই তো আনন্দ। ঘুণাক্ষরেও অন্য কিছু মনে হয়নি। কিন্তু অদিতি যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তবে তো—

বিশ্বনাথ ভয়ার্ত গলায় স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেটা কী করে জানো?’

অদিতি ঠোঁট কামড়ে ধরলেন, ‘মনে নেই তোমার? সেদিন গল্প করছিল কী নাকি ফিলম-টিলম বানায়, তার মানে সিনেমা লাইনের।’

বিশ্বনাথের চোখে প্রায়ান্ধকার গলি একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল, তিনি চোখ বুজে ফেললেন। শরীরে মনে কেমন একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়েছে যা তাঁর খুব অচেনা। তিথিকে এক্ষুনি শাসন করা দরকার, কিন্তু এ তাঁর কর্ম নয়। অদিতিও কি পারবে? ছোটোবেলা থেকে ছেলেমেয়েকে তাঁরা এমনভাবেই মানুষ করে তুলেছিলেন যে ওদের কখনো সেভাবে শাসন করারই প্রয়োজন হয়নি। আজ এ কী বিষম বিপদ! বিশ্বনাথ চোখ বুজেই শুনতে পেলেন অদিতি বলছেন, ‘ওই এতক্ষণে আসছেন।’

তিথি বাড়ি ঢুকে কোনো কথা না বলে সোজা বাথরুমে চলে গেল। সে বুঝতে পারছে আজ সে ধরা পড়ে যাবে—যাবে কি, ধরা পড়ে গেছে। মায়ের থমথমে মুখ দেখেই তার বুকে খামচে ধরেছে ভয়। তিথি মরিয়া হয়ে সিদ্ধান্ত নিল আজ আর সে মিথ্যের আশ্রয় নেবে না, সত্যি কথাই বলবে। বাথরুমের বন্ধ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে সে প্রাণপণে মনের সমস্ত জোর সঞ্চয় করে প্রস্তুত হতে লাগল।

দরজার বাইরে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন অদিতিও। তাঁরও যেন এই সময়টুকু বড়ো দরকার ছিল। বিশ্বনাথকে

তিনি কোনো কথা বলতে বারণ করে সরে যেতে বললেন। নিজে কী বলবেন, সেইটাই হাতড়াতে লাগলেন মনে মনে। তাঁর বিশ্বাস, তাঁর সমস্ত আশঙ্কাই সত্যি। তিথি ওই কাঁধে ঝোলা নেওয়া রোগাপটকা দাড়িওয়ালা ছেলেটার সঙ্গেই জড়িয়ে পড়েছে, যে কোনো চাকরিবাকরি করে না। ফিলম-টিলম বানানোর কথা কতটা সত্যি তাই-বা কে জানে, দেখে তো মনে হয় এমনিই ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। পুজোর সময় ছেলেটির বাড়িতে আসা, তিথির সঙ্গে কথা বলা দেখেই তাঁর খটকা লেগেছিল। তবু আজ তাঁকে প্রথমে নিশ্চিত হতে হবে, তারপর তিথিকে ফেরাতে হবে। এ হয়তো অন্য মায়েদের পক্ষে খুব কঠিন কাজ নয়, হয়তো সব বড়ো হয়ে ওঠা মেয়ের মাকেই এই কাজ কখনো-না-কখনো করতে হয়েছে, কিন্তু অদিতির খুব ভয় করছে। তিনি কি তিথিকে শান্তভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবেন, নাকি চিৎকারচেঁচামেচি করে ফেলবেন? তিথি নিশ্চয়ই মানতে চাইবে না, ওর সঙ্গে কি ঝগড়া করতে হবে তাঁকে? এ বাড়িতে সেরকম বিশ্রী রুচিহীন কোনো ঘটনা ঘটুক অদিতি চান না, অদিতি মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করলেন।

তিথি জানত, পাৰ্থ জীবনে প্রতিষ্ঠিত নয়। প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, তার পায়ের তলায় জমিই নেই কোনো। কিন্তু এসব নিয়ে সে ভাবনা করেনি। ভাবনা করেই বা কী করবে সে? পার্থকে ফিরিয়ে দেবে? সে জোর কি তার আছে? তার বদলে যাওয়া জীবনে পার্থ একটা নতুন জানলা। ওই জানলা দিয়ে আকাশ দেখেছে সে, আকাশের শূন্যতা দেখেনি। তার সদ্য-হওয়া ডানাদুটো মেলে সে ওই আকাশে উড়তে চাইবে না তো কি, জানলা বন্ধ করে দেবে? তিথি কি উন্মাদ! কিন্তু উন্মাদও তো নিজের ভালো বোঝে।

সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরে আসার পর মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেছিল তিথি। ধরা পড়ে অপমানিত হতে হয়েছিল তাকে। অপমান—হ্যাঁ, অদিতি তাকে যেভাবে, যে কথাগুলো বলে আঘাত করেছিলেন তাতে তিথি অপমানই বোধ করেছিল, কেননা, তিনি পার্থকে অপমান করেছিলেন।

‘কোনো ফিক্সড উপার্জন নেই, চাকরিবাকরি করে না। বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। বোনের বন্ধুর সঙ্গে মিশতে শুরু করে দিল! ওর এত সাহস হয় কী করে!’ অদিতি ফুঁসছিলেন। পার্থর সম্বন্ধে ওই কথাগুলো তিথিই বলেছিল তাঁর প্রশ্নের উত্তরে। অদিতি বুঝে উঠতে পারছিলেন না এসব জেনেও তিথি ছেলেটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল কীভাবে!

‘তাতে কী হয়েছে মা? তুমি যখন বাবার সঙ্গে মিশেছিলে, বাবার তো এর চাইতেও খারাপ অবস্থা ছিল!’

অদিতি প্রচণ্ড চমকে উঠেছিলেন। তিথি যে কখনো তাঁকে এভাবে বলতে পারে এ তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। গর্জন করে উঠেছিলেন, ‘না, তুমি ভুল বলছ। তোমার বাবা চাকরি করতেন, তাঁর ওপর সমস্ত পরিবারের দায়িত্ব ছিল, তিনি কোনো কর্তব্য এড়াননি। আর এই ছেলেটি তো একটি চালচুলোহীন উড়নচণ্ডী—’

‘মোটেই না। পার্থ ফিলম বানায়, এখন াগল করতে হচ্ছে—’

‘বড়ো বড়ো কথা বোলো না। ফিলম বানায়—ফিলম বানানো মুখের কথা! বানিয়েছে এখনও অবধি একটাও ফিলম?’

তিথির কাছে এর কোনো উত্তর ছিল না। তার গা-হাত-পা কাঁপছিল মানসিক ধকলে। তবু ভেঙে না পড়ে পিঠ সোজা রেখে দাঁড়িয়ে ছিল সে। অদিতি তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘তুমি ওদের বাড়িতে গেছ?’

তিথি মাথা নাড়ল—না, সে যায়নি। তবে পার্থ বলছিল সে বাড়িতে তিথির কথা বলেছে। তিথি মাকে কিছু বলল না।

অদিতির জেরা তখনও শেষ হয়নি। তাঁর মনে পড়ল পার্থ পুজোর সময় যখন এসেছিল, কথায় কথায় বলেছিল ওদের দেশের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। কয়েক বছর অন্তর অন্তর পার্থর ওপর সেই পুজোর ভার পড়ে। কথাটা যাচাই করার জন্যে অদিতি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদের দেশের বাড়িতে পুজো হয়, মানে দেশের অবস্থা ভালো?’

তিথি এ বিষয়ে কিছু জানে না। সে চুপ করে রইল।

‘কী হল, জবাব দিচ্ছিস না যে? পার্থ বলে গেছিল ও নাকি পুজো করে, পুজোর খরচ আসে কোত্থেকে?’

তিথি ভাবছিল। ভেবে ভেবে বলল, ‘পুজোর খরচ তো দেন ওর দাদু। তাঁরই তো পুজো, পার্থকে তো কেবল কাজকর্মের দিকটা

সামলাতে হয়।’

তিথির নির্বিকার সত্যকথনে অদিতির গলায় শ্লেষ উঠে এল, ‘তবে আর কি, কোনোদিকেই কোনো আশার আলো নেই। দেশের সম্পত্তিও নিশ্চয়ই এমন কিছু নেই যে পার্থর চাকরিবাকরি না করলেও দিব্যি চলে যাবে। তিথি আমার কথা শোনো, এখন এমন

ঝাঁপতাল

কিছু কোরো না যাতে তোমাকে পস্তাতে হয়। পড়াশুনা করো মন দিয়ে…তুমি পড়াশুনায় ভালো…বয়সে এত বড়ো একটা উলটোপালটা লোকের পাল্লায় মিছিমিছি সময় নষ্ট কোরো না, এতে তোমার ভালো হবে না।’

অদিতি যখন এতগুলো কথা বলছিলেন, সেই কথাগুলো তিথির মনের মধ্যে ঠোক্কর মেরে মেরে আরও অন্য কিছু কথা ছিটকে দিচ্ছিল। মাকে এমন টাকাপয়সা সম্পত্তি ইত্যাদি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ মন্তব্য আলোচনা করতে দেখে তার ঘৃণাবোধ হচ্ছিল, লজ্জা করছিল। মা-র মুখে এরকম কথা শুনতে এর আগে সে অভ্যস্ত ছিল না। বরং মা যে বড়োলোকের মেয়ে হয়েও তার গরিব বাবাকে নিজের ইচ্ছেয় ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এ নিয়ে তার গোপন গর্ব ছিল। আজ তার নিজের অপমানের পাশাপাশি মায়ের অধঃপতন দেখেও সে মরমে মরে যাচ্ছিল।

দ্বিতীয়ত, এই প্রথম সে বাড়িতে কারও মুখে শুনল সে পড়াশোনায় ভালো। আশ্চর্য, তার জীবনে মাত্র এক বছরের মধ্যে এত নতুন ঘটনা একসঙ্গে ঘটছে কী করে!

আর পার্থর সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য নিয়েও মা কটাক্ষ করলেন, অথচ তিথি জানে, মায়ের সঙ্গে বাবার পার্থক্যও প্রায় ওরকমই, হয়তো দু-এক বছর কম। পার্থ চাকরি করে না এটা যদিও-বা তার দোষ হতে পারে, সে তিথির থেকে বারো বছর আগে জন্মেছে এটাও কি তার দোষ?

তিথির মনে এই বিরুদ্ধ যুক্তিগুলো ঘাই মারছিল যদিও, তবু সে এটাও জানত যে বাড়িতে ঘটনাটা প্রকাশ হয়ে পড়লে তার হেনস্থাই হবে। মনে মনে অনেক ভয়াবহ অশান্তির ছবিও কল্পনা করে রাখা ছিল তার। মায়ের সঙ্গে এই ঘাত-প্রতিঘাতে তার কিছুটা মিলল, কিছুটা মিলল না। ঠিক তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত, যখন সে বাথরুমে ছিল, ভয় জমতে জমতে একটা চূড়ান্ত আকার নিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা বাস্তবে একবার ঘটতে শুরু করার পরে তিথির ভয়ে মরে গিয়ে খুব ক্লান্তি আসছিল।

একই রকমভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন অদিতিও। এতটাই যে তাঁর সে রাত্রে খেতে দিতেও ইচ্ছে করছিল না। তিথি খেল না। অদিতি বুঝতে পারলেন তাকে ডাকা বৃথা। তাঁর নিজেরও খাওয়ার ইচ্ছে নেই। একা বিশ্বনাথের খাবার গুছিয়ে দিয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন। কিন্তু শুধু শুয়েই পড়লেন, ঘুম এল না।

তিথি সমস্ত ঘটনাটাই পার্থকে বলেছিল। বলতে গিয়ে প্রথমে তার মনে হয়েছিল বলাটা হয়তো ঠিক হবে না। বলতে গেলে পার্থর প্রসঙ্গে যে অপ্রিয় সত্যগুলো তাকে উচ্চারণ করতে হবে তাতে পার্থর মনে ব্যথা লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিথি তো ওকে কষ্ট দিতে চায় না। পার্থ হয়তো লজ্জা পাবে, অভিমান করবে, হয়তো ভাববে এগুলো তিথির নিজেরও মনের কথা।

কিন্তু তিথি চেপে রাখতে পারেনি। পার্থর কাছে সে কিছু চেপে রাখতে পারে না। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল তার সদ্য-বিক্ষত মনের মধ্যে থেকে। পার্থর অপমান যে তারও অপমান, সেই যন্ত্রণা ছিটকে উঠেছিল তার চোখেমুখে। বলতে বলতে তিথি ফোঁপাচ্ছিল।

সব শোনার পর পার্থ কিন্তু যা বলল, তাতে তিথি কান্না ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল তার মুখের দিকে। ওই মুখে কোনো আহত রেখা নেই, কণ্ঠস্বরেও কোমলতার রেশমাত্র নেই। শুকনো খটখটে স্বরে পার্থ বলল, ‘এরকম হবে আমি জানতাম। তোমার মা-বাবা আমাকে মেনে নেবেন না। তিথি চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।’

তিথি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে পার্থ তার কাঁধে হাত রাখল, ‘তুমি বোধ হয় কথাটা ধরতে পারলে না। আমি রেজিষ্ট্রি করে রাখার কথা বলছি। তাহলে তোমার মা বাবার কিছু করার থাকবে না।’

তিথি বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। বিয়ে! এক্ষুনি পার্থ তাকে বিয়ে করতে বলতে পারে এতটা তার সুদূর কল্পনার বাইরে ছিল। এই তো মাত্র ক-মাস হয়েছে পার্থর সঙ্গে তার আলাপ। এর মধ্যে প্রথম প্রেমের অভিঘাতেই সে এখনও কাঁপছে, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া

এইমাত্রই শুরু হয়েছে তার। বিয়ের কথা যে তার মনে একবারও উঁকি দেয়নি এ বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু তিথি সে-কথা ভাবতেও যেন সাহস পায়নি, বহুদূরের সম্ভাবনা মনে করে তাকে মনের অতলে ছোট্ট একটা বাক্সে ঢাকনা বন্ধ করে লুকিয়ে রেখেছে। আজ পার্থ একেবারে বিনা ভূমিকায় ধাক্কা মেরে সেই বাক্সের ডালা খুলে টেনেহিঁচড়ে সেই লুকোনো স্বপ্নটিকে বার করে নিয়ে এল। এনে তিথির সামনে ঘাড় ধরে সেটাকে দাঁড় করিয়ে দিতেই তিথি স্তম্ভিত হয়ে গেল।

পার্থ বলল, ‘তার আগে তোমাকে একদিন আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।’ বলে একটু হাসল, ফ্যাকাশে ক্লিষ্ট হাসি, ‘আমার বাড়ি কিন্তু ভাঙাচোরা, তোমার যদি পছন্দ না হয়?’

তিথি আচ্ছন্নের মতো তাকিয়েই ছিল। জীবনের এ কোন অদ্ভুত বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে সে, সামনের পথ এত ঝাপসা লাগছে কেন! ওখানে কি কুয়াশা খুব? তা এত তাড়াতাড়ি কী আছে, ওই পথে পা বাড়ানোর আগে আর একটু অপেক্ষা করলে হয় না? কুয়াশা কেটে যেতে পারে, এখন যে তিথি চোখে কিছু দেখতেই পাচ্ছে না!

তিথির মনে হতে লাগল তার সামনে একটা গভীর, ভীষণ গভীর খাদ। খাদটা যেন খুব সবুজ, সেই সবুজ ঘন হতে হতে ক্রমশ নীচের দিকে নীল হয়ে গেছে। সেই অনেক অনেক নীচে একটা সুন্দর খরস্রোতা নদী বয়ে যাচ্ছে। তিথির সেখানে যেতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু ভয় করছে নামতে গেলে পড়ে যাবে। তা ছাড়া তিথির হাতে যেন একদম সময় নেই, ওখানে যেতে হলে তাকে নীচে ঝাঁপ দিতে হবে। তিথির ঝাঁপ দিতে খুব ভয় করছে, কিন্তু খাদটাও তাকে ডাকছে, তীব্রভাবে ডাকছে। কীসের ভয়? ওখানে কে একজন দাঁড়িয়ে আছে না, যাকে সে খুব ভালোবাসে, বিশ্বাস করে? সে তো তার থেকে বয়সে অভিজ্ঞতায় বুদ্ধিতে হৃদয়ে অনেক অনেক বড়ো। তিথি ঝাঁপ দিলে সে তিথিকে লুফে নেবে না? তিথি দ্বিধা করছে কেন?

পার্থ কঠিন স্বরে বলল, ‘আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তিথি, আমি ডাকলে তুমি আসবে কি না। আমি তোমাকে ডাকছি তিথি…তুমি না এলে আমি একাই ফিরে যাব।’

তিথির অন্তরাত্মা বলে উঠল, ‘না না না—

ঝাঁপতাল

তিথি চোখ বন্ধ করে ঝাঁপ দিল।

বাড়িটার বয়েস কত সঠিক বলা মুশকিল। তবে তার ভগ্ন জীর্ণ দশা দেখে বোঝা যায় কমপক্ষে তিরিশ বছর এর কোনো সংস্কার হয়নি। বাইরে এককালে প্লাস্টার ছিল। এখন পুরোটাই ইটের দাঁত বের করা, সারা গায়ে বহু বছরের জমা শুকনো শ্যাওলার ধূসর কালো আস্তরণ। দোতলা বাড়ি, চারপাশের খালি জমিতে বর্ষার জল আর নোংরা নালা উপচানো জল জমে বুনো গাছপালার জঙ্গল হয়ে গেছে। দূর থেকে তার একপাশে হেলে পড়া চেহারাটা দেখে মনে হয় যে-কোনো মুহূর্তে হুড়মুড় করে ধসে পড়বে।

চিলেকোঠার সিঁড়ির ধাপে বসে পার্থ তিথির মুখটা ধরে নিজের ঠোঁটের কাছে নিয়ে এল।

‘না, প্লিজ না!’

তিথি খপ করে পার্থর কবজি ধরে ফেলেছে, মুখটা পিছিয়ে নিয়ে গেছে পার্থর উদ্যত চুম্বন থেকে। তার গলায় অনুরোধের সঙ্গে মিশে আছে একটা স্থির আপত্তি।

পার্থ এক মুহূর্ত থামল। তিথি এখন তার স্ত্রী। সে তাকে চুমু খেতেই পারে। বিয়ের আগে পার্থ তাকে জোর করেনি। আজ যদি সে তিথিকে জোর করেই চুমু খায়, তাকে কি সত্যি জোর করা বলে?

পার্থ তিথির গাল থেকে হাত সরিয়ে নিল। ব্যথিত গলায় বলল, ‘কেন তিথি? তোমার ইচ্ছে করছে না?’

তিথি সিঁড়িতে বসে আছে। হাঁটুর ওপর কনুই রাখা। সে দু-হাতে মুখ ঢাকল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ভীষণ মা-র কথা মনে হচ্ছে। তিথি মাথা নাড়াতে নাড়াতে অবরুদ্ধ গলায় বলল, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি বিয়ে করলাম মাকে না জানিয়ে…আমি কখনো ভাবিনি..। মা! মা! আমি বিয়ে করেছি, মা—ও মা! আজ আমার বিয়ে হয়ে গেল…

তিথি আচমকা চাপা কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছিল। তার দু-হাতের পাতা চোখের জল, সর্দি আর লালায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। চশমাটা বেঁকে লেগে আছে তার কপালে।

তিথি আজ নিয়ে এই দু-বার এল পার্থর বাড়িতে। পার্থরা বাড়িটার একতলায় ভাড়া থাকে। এর আগে প্রথম যেদিন পার্থ তাকে নিয়ে এসেছিল, আগের দিন বলে রেখেছিল শাড়ি পরে আসতে। তিথি শাড়ি পরেই এসেছিল। আজ অবশ্য সে চুড়িদার পরে আছে। শাড়ি পরতে সাহস হয়নি। মা যাতে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ না করেন সে আজ বিয়ে করতে যাচ্ছে, তিথি তাই আজ খুঁজেপেতে সবচেয়ে পুরোনো আর প্রায় রং-জ্বলা একটা চুড়িদার পরে এসেছে। এটাও পার্থরই পরামর্শ ছিল।

প্রথম দিন পার্থর বাবা বাড়ি ছিলেন না, ওর মা আর বোনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মা ছোটোখাটো চেহারার মানুষ, খুব ঘরোয়া আর শান্ত। মাথায় অনেক চুল, বিরাট খোঁপা। পাণ্ডুর মুখে হাসিটা যেন স্বভাবতই ঈষৎ করুণ। আটপৌরে ধরনে শাড়ি পরা। তিথির মা এভাবে শাড়ি পরেন না। এরকম শাড়ি পরার ধরন তিথি বাংলা সিনেমায় দেখেছে। পার্থর মাকে দেখে সে চিনতে পেরেছিল, এঁকে সে মৌসুমীদের বাড়িতে কোনো একটা উপলক্ষ্যে একবার দেখেছিল। মৌসুমী আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, ‘আমার বড়োমা’ বলে।

পার্থর বোন সীমাকে কিন্তু তিথি আগে দেখেনি। সীমা পার্থর থেকে এক বছরের ছোটো। আলাপ হওয়ার পর সীমা প্রথমে তিথির দিকে তাকিয়ে হাসল, ওর হাসিটাও মায়েরই মতো চাপা। তারপর দাদার দিকে ফিরে বলল, ‘দেখে যদিও মৌয়ের মতো লাগছে না, তবু এ কিন্তু মৌয়ের বন্ধু। দেখিস দাদা, এ মেয়ে এ বাড়িতে থাকবে তো?’

তিথির খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। পার্থ ওকে আড়াল করল, সস্নেহ আস্থার স্বরে বলল, ‘সে আমার বোঝা হয়ে গেছে। তুই নিশ্চিন্ত থাক, তিথি মৌয়ের মতো নয়, ওর কোনো বায়নাক্কা নেই।’

পার্থর মা তিথিকে দেখছিলেন, আস্তে আস্তে বললেন, ‘আচ্ছা, ভালো হলেই ভালো।’ তিথি দেখল, তাঁর মুখে সংশয়।

তিথি নিজেও সংশয়ে আচ্ছন্ন হচ্ছিল। সে এ বাড়ির বউ হয়ে আসবে, তাকে সেভাবেই গ্রহণ করা হচ্ছে সে বুঝতে পারছিল। এই গ্রহণের মধ্যে একটা উত্কণ্ঠা লুকিয়ে আছে। তবুও এটা তার একরকম স্বীকৃতিই যে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই স্বীকৃতিতেও তো একটা সম্মান আছে, যাতে তিথির তৃপ্ত বোধ করা উচিত। কিন্তু তার সেরকম কিছু হচ্ছিল না। সে মনে মনে নিশ্চিন্ত আর আনন্দিত বোধ করতে চাইছে, কিন্তু সেটা পারছে না বলে নিজেকে নিয়ে ধন্দে পড়ছিল।

ছিঃ—তিথি ভাবল, আমাকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। এইরকম সংশয়ের অস্বস্তি নিয়ে সে কী করে পার্থকে ভালোবাসার কথা ভাবে? পার্থ, তার পরিবার, তার ঘরবাড়ি, এরা যদি তাকে আপন বলে মেনে নিতে পারে, সে কেন পারবে না?

ওইদিন পার্থ যখন তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পথে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লাগল?’ তিথি উত্তর দিতে একটু সময় নিয়েছিল। এই প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী ছিল, তিথি অনেকক্ষণ থেকেই মনে মনে তার উত্তর গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল। নিজেকে অবচেতনেই বোঝাবার চেষ্টা করছিল সে, সেই সঙ্গে নিজেকে ঢাকার চেষ্টাও—পার্থ যেন দুঃখ না পায়, তার প্রেমকে ভুল না বোঝে।

সে দেখে এসেছে পার্থর বাড়িতে দুটো ছোটো ছোটো ঘর। ঘর দুটোই জিনিসপত্রে ঠাসা। ঘরের মেঝে মাটি থেকে নীচু। দেওয়ালের চুন খসে খসে অজানা মহাদেশের ম্যাপ হয়ে গেছে। একটা ঘরে একটা উঁচু খাট, ড্রেসিংটেবিল আর আলনা। সব কিছুর ওপরে রাশিকৃত এলোমেলো বিছানাপত্র কাপড়জামা খবরের কাগজ গামছা ইত্যাদি ছড়ানো। আরেকটা ঘরে একটা ছোটো তক্তপোশ, একটা টেবিল। টেবিলের ওপর ডাঁই করা বই আর কাগজপত্র, ওরই মধ্যে একটা সাদাকালো পোর্টেবল্

টিভিও রাখা। সব কিছুই বড়ো অগোছালো, তিথির একঝলক দেখেই মনে হয়েছিল। তাদের বাড়িতে মা যেমন জিনিসপত্র গুছিয়ে পরিষ্কার করে রাখেন, একদমই সেরকম নয়। তিথি চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু দেখতে পারে না, নতুন জায়গায় এসে সে একটু জড়সড়ই থাকে, আজকের পরিস্থিতি তো সব মিলিয়েই তাকে আরও আড়ষ্ট করে রেখেছিল। কিন্তু চোখ না মেলেই এসব কিছু চোখে পড়েছিল তার। মনে হয়েছিল কোনো ঘরেই পা ফেলার জায়গা নেই, নিশ্বাস যেন বন্ধ বন্ধ লাগছে।

এসবের কোনোটাতেই তার সত্যি সত্যি কিছু যায় আসে না বলেই সে বিশ্বাস করে, কিন্তু একটা বেয়াড়া প্রশ্ন তার মনের তলায় একটা নাছোড়বান্দা কাকের মতো ক্রমাগত কা-কা করছে, তিথি তাকে ওড়াতে পারছে না।

সে বহু কষ্টে পাহাড়প্রমাণ সংকোচের ওপার থেকে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আচ্ছা..বিয়ের পর আমরা কোথায় থাকব?’

পার্থ পূর্ণদৃষ্টিতে তিথির চোখের দিকে তাকাল, কৌতুকের স্বরে বলল, ‘আরে, তুমি চিন্তা করছ নাকি?’ তিথির পিঠে হাত রেখে নিবিড় চাপ দিল সে, ‘এই বোকা মেয়ে, চিন্তা করে না। আমার ওপর ভরসা নেই তোমার?…সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নিজের প্রশ্নটাই নিজের কানে এত নির্লজ্জ আর রুচিহীন ঠেকেছিল তিথির, যে লজ্জায় তার কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। পার্থর কথায় তার চোখে জলে এসে গেল। সে অপরাধীর মতো তাকাল পার্থর দিকে, তার দু-চোখে ক্ষমাপ্রার্থনা। সত্যিই, পার্থ তার থেকে কত বড়ো, ওর দায়িত্ববোধ নেই? তিথি বোকার মতো কী কতগুলো আজেবাজে কথা ভাবছিল! সে পার্থর পাঞ্জাবির হাতা আঁকড়াল, এটা করলে তার সবচেয়ে নিশ্চিন্ত লাগে।

পার্থ তিথির করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কাঁধ জড়িয়ে নিল, নরম গলায় বলল, ‘ভেবো না তিথি। রেজিটিা হয়ে নিতে দাও। পৃথিবীর কোনোকিছুই তারপর আমাদের আর আলাদা করতে পারবে না। আমরা আর কয়েকদিন পরেই একসঙ্গে থাকতে

‘না না, শোনো, এত তাড়াতাড়ি কোরো না—’ তিথি কথাগুলো বলল এমন ছিটকে ওঠা স্বরে, পার্থ অবাক হয়ে তাকাল।

পারব—’

তিথির স্বরে দ্বিধা, ‘তোমার বোন…মানে, সীমাদির বিয়ে হয়নি এখনও। তুমি নিশ্চয়ই ওর বিয়ের আগে আমাকে এখানে আসতে

‘কেন!’ পার্থ আরও বিস্মিত, ‘সীমার সঙ্গে তোমার এখানে আসার সম্পর্ক কী? তুমি সীমার সঙ্গে থাকতে চাইছ না, ওর সঙ্গে তোমার বনবে না মনে হচ্ছে? ওকে পছন্দ হয়নি?’

বলবে না?’

‘আঃ কী যা তা বলছ!’ তিথি ব্যাকুল হয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

‘তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না তিথি!’

তিথি একটু থেমে বলল, ‘সীমাদির বিয়ের জন্যে তোমরা চেষ্টা করছ না?’

‘করছি। অনেকদিন থেকেই চেষ্টা চলছে। কিন্তু এসবে অনেক সময় লাগে। দু-পক্ষের পছন্দ হওয়া-হয়ির ব্যাপার আছে। যেগুলো একটুও-বা এগোয় মাঝেমধ্যে, সীমা নিজেই সেগুলো নাকচ করে দেয়।’

‘সীমাদি হয়তো অন্য কাউকে পছন্দ করে?’

‘না, ও কাউকেই পছন্দ করে না। ও শুধু আশা করে ও বাড়িতে বসে থাকবে আর ওর মা-বাবা ওর জন্যে রাজপুত্র খুঁজে নিয়ে

এসে ওর সঙ্গে বিয়ে দেবে!’

পার্থর গলায় বিরক্তি এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছিল যে তিথি আশ্চর্য হয়ে গেল। সে আর কোনো কথা বলল না। মনে মনে বুঝল, বোনের বিয়ে হতে দেরি হচ্ছে দেখে পার্থ অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সে আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়, তার বোধ হয় মনে হচ্ছে নিজেরও বিয়ের সময় চলে যাচ্ছে। তিথির মনটা একটা তেতো স্বাদে ভরে উঠছিল। সে যেন একটা সুর শুনছিল, হঠাৎ সেই সুরের একটা পর্দা যেন সেই সুরের সুতো ছিঁড়ে নীচে পড়ে যাচ্ছে। তিথির কানে এমন বেসুর বাজল যে তার মাথার মধ্যে ঝনঝন করে উঠল।

সে পার্থকে কীভাবে বোঝাবে, একটা মেয়ে হয়ে আজ সে সীমাকে দেখামাত্র যে কথাটা বুঝে ফেলেছে! সীমা বিষণ্ণ আর বিরক্ত। আজ তার বয়েস প্রায় তিরিশ ছুঁতে চলল, কিন্তু এখনও তার বিয়ে হয়নি। অথচ সে চাকরি-বাকরি বা অন্য কোনো পেশাতেই ব্যস্ত নয়। সে নিজে প্রেম করে না কিন্তু স্বপ্ন দেখে তার একটা ভালো বিয়ে হোক, নিজস্ব সংসার হোক। এটাই তার একমাত্র উচ্চাশা। যৌবনে পা দেবার পর থেকেই সেই অপেক্ষা করে করে আজ সে প্রায় আশা হারাতে বসেছে। সেই মেয়ের সামনে তার পিঠোপিঠি বয়সি দাদা বিবাহিত জীবনযাপন করবে, তিথিরই সঙ্গে, যে কিনা সীমার চাইতে এগারো বছরের ছোটো। এই পুরো ঘটনাটার মধ্যে একই সঙ্গে গভীর নিষ্ঠুরতা আর অশ্লীলতা দেখতে পেয়ে তিথির মনটা গুটিয়ে যেতে লাগল ভেতর দিকে, ঘন অন্ধকারে। তার আরও অসহায় লাগছিল এটা বুঝে যে পার্থ তার এ সমস্ত কথা বুঝতে চাইবে না, হয়তো বুঝবেও না।

সেই দিন থেকে আজ এই বিয়ের দিন অবধিও তিথি মনে মনে তীব্র অশান্তি ভোগ করেছে। পার্থকে যেন মাঝে মাঝে কেমন অচেনা লাগছে তার, মনে হচ্ছে যেন এক-একটা সময় তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্বের চর জেগে উঠছে। এরকম মনে হওয়া মাত্রই সে পার্থকে আরও দ্বিগুণ জোরে আঁকড়ে ধরছে, সমস্ত দূরত্ব পেরোতে চাইছে আপ্রাণ সাঁতারে, সাঁতরে সাঁতরে এসে সজোরে মুঠো করে ধরতে চাইছে পার্থর পাঞ্জাবির কোনা। সে ছাড়া আর কোনো আশ্রয় নেই, বন্ধুও নেই। মৌসুমীর কাছ

থেকেও যেন এই ডামাডোলে অনেকটাই দূরে ভেসে এসেছে সে। তা ছাড়া মৌসুমীকেও বিয়ের কথা বলতে পার্থর কঠিন নিষেধ

আজ তিথি কলেজে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে পার্থর সঙ্গে মিট করেছিল যাদবপুর থানার সামনে। সেখান থেকে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ম্যারেজ রেজিারের বাড়ি। সঙ্গে পার্থর দুই বন্ধু, যাদের তিথি আগে চিনত না, আর সীমা। এই তিনজনেই তাদের বিয়ের সাক্ষী। সীমার মুখ ছিল গম্ভীর আর পাথুরে। সে দু-একবার হাসছিল, সই করল পেনের নিবে খুব চাপ দিয়ে, ধীরে ধীরে। তিথির মনে হচ্ছিল সীমা যেন একটা যান্ত্রিক পুতুল, তার কোনো সাড় নেই, পড়ে থেকে থেকে যার কলকবজাতেও যেন একটু জং ধরেছে।

আইনি বিয়ের যেসব আইনকানুন, সেসব পালন করতে করতে তিথির নিজেকেও একটা কলের পুতুলের মতো লাগছিল। পার্থর মুখ অবশ্য উতফুল্ল ছিল। স্বামী-স্ত্রীর শপথ নেওয়ার সময় তিথির নিজেকে মনে হয়েছিল অন্য লোক। বিবাহিত, সে বিবাহিত! সে আজ থেকে একজনের স্ত্রী! এই ঘটনা একটা মেয়েকে কতটা বদলে দেয়!

রয়েছে।

পার্থর বাড়িতে এসে তিথি যখন পার্থর মাকে প্রণাম করল, সুধা তার মাথায় হাত ছুঁইয়ে বললেন, ‘এমন বিয়ে হল যে মাথায় একটু সিঁদুর পর্যন্ত দেওয়া যাবে না।’ তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘আশীর্বাদ করি যেন তেমন দিন তাড়াতাড়ি আসে।’

পার্থর বাবার সঙ্গে তিথির আজও দেখা হয়নি। পার্থকে সে বলেওছিল, ‘তোমার বাবাকে প্রণাম করা হল না—

—‘‘‘তোমার বাবা’’ নয়, শুধু বাবা।’ পার্থ হাসছিল।

তিথি লজ্জা পেয়ে জিভ কাটল, ‘সরি, কিন্তু…মানে, মাকে আমি কিন্তু বড়োমা বলব।’

‘সে বোলো, শুনতে ভালোই লাগবে। কিন্তু বাবাকে এক্ষুনি কিছু বলার দরকার নেই, বাবা বিয়ের ব্যাপারটা জানেন না।’

তাদের স্বামী-স্ত্রীর নিভৃত আলাপ চলছিল চিলেকোঠায় বসে। ঝিমঝিম করছে নিস্তব্ধ দুপুর। তিথির বুকের মধ্যে চুঁইয়ে চুঁইয়ে কী একটা জমছে। একটু আগেই সে মায়ের কথা ভেবে মনখারাপ করছিল, এবার মুখ ফিরিয়ে পার্থর দিকে তাকাল। পার্থ সিগারেট খাচ্ছে। বাড়ি এসে পাঞ্জাবি খুলে ফেলেছে, তার গায়ে এখন শুধু গেঞ্জি। গেঞ্জির গোল গলার ওপর দিয়ে তার বুকের রোম দেখা যাচ্ছে, তিথি দেখল, সেগুলো খুব ঘন। তিথি আড়চোখে দেখেই চোখ সরিয়ে নিল। তার বুকের মধ্যে চুঁইয়ে চুঁইয়ে যা জমছে, সেটা স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা মেশানো একটা চোরা স্রোত, তিথি তার টান টের পাচ্ছিল।

কলিং বেলটা বাজছে।

মিতা রান্নাঘরে পাঁপড় ভাজছিলেন। কাজের মেয়েটা ছুটি নিয়েছে। মিতা গলা তুলে বললেন, ‘মৌ, দ্যাখো তো!’

মৌসুমী সিরিয়াল দেখছিল। দীপ দিদির প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে তার বিনুনির প্রান্ত নিয়ে নিজের গোঁফ বানানোর চেষ্টা করছে, চুল ধরে টানাটানিও করছে বিস্তর। অন্য সময় হলে মৌসুমী নির্ঘাত ভাইকে একটি চড় কষাত, কিন্তু এখন সিরিয়ালের গল্পে একটা দারুণ ক্লাইম্যাক্স আসন্ন। এমন সময়ে বেলটা দ্বিতীয়বার বাজল।

মৌসুমী এক ধাক্কা মেরে ভাইকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ইডিয়েট, দরজাটা খুলতে পারছিস না?” দীপ চেঁচিয়ে উঠল, ‘মা, দিদি মারছে। আমি কেন দরজা খুলব, মা তোকে খুলতে বলেছে না?’ রান্নাঘর থেকে মিতা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মৌ ডোন্ট বি সিলি, বাইরে কেউ ওয়েট করছে!’ মৌসুমী অগত্যা বিরস মুখে উঠে দরজা খুলল। খুলেই চমকে উঠল। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় শিগগির এসো, জেঠু এসেছে।’

বলল, ‘মা

অলকের এ বাড়িতে আসাটা অপ্রত্যাশিত বা বিরল কিছু ঘটনা নয়। ভাইয়ের বাড়িতে তিনি প্রায়ই এসে থাকেন। আজও সেরকমই এসেছেন। তাঁর পরনে একটা দলামোচড়া কালো টেরিকটের প্যান্ট, ওপরের শার্টটা ভালো কিন্তু পুরোনো। এটা

অরূপের জামা। অরূপ হাসপাতালে বা চেম্বারে যে শার্টগুলো পরে যান, সেগুলো বছর খানেক পরার পর আর পরেন না। অলক সেগুলো মিতার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে যান। অরূপ জানতে পেরে রাগ করেন, দাদাকে নতুন শার্ট কিনে দিতে চান, কিনে দিয়েছেনও দু-একবার, কিন্তু অলক বলেন, ‘কেন, বেশ তো জামাগুলো। তুই ডাক্তার মানুষ—নতুন জামা পরবি, তোর এই পুরোনোগুলো দিয়েই আমার দিব্যি কাজ চলে যায়।’

আজ অলক আসতেই যেন একটা সাড়া পড়ে গেল। মিতা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন, ‘আসুন দাদা। আমরা আপনার কথা খুব বলছিলাম, আপনি কয়েক দিন আসেননি…’

অলক খুশি হলেন। সোফায় এসে জাঁকিয়ে বসলেন, আঃ কী নরম। মিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খুব ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে ক-দিন অফিসের কাজে, সময়ই পাচ্ছিলাম না। আজও সেই শ্যামবাজার থেকে আসছি, বাব্বা সে যে কতদূর…দুপুর থেকে ঘুরতে হয়েছে আজ…এই রোদ্দুরে…খুব খিদেও পেয়েছে।’

মিতা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, চা-ও দেব তো?’

অলক পা টানটান করে ছড়িয়ে দিলেন। পিঠ হেলিয়ে আরামের স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ-অ্যা, আপত্তি কী! তোমাদের বাড়ির চা তো বেস্ট কোয়ালিটি…

মিতা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে মৌসুমীকে ডেকে নিলেন, ‘মৌ ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম বের করে কিচেনে নিয়ে এসো তো।’ অলক প্রসন্ন মুখে দীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে, বিচ্ছু দি গ্রেট, আসুন ততক্ষণ আপনার সঙ্গে একটু যুদ্ধ করি। আপনার বন্দুক কই, বন্দুক দেখছি না যে?’

দীপ বন্দুক বার করার বা যুদ্ধের কোনো উত্সাহ দেখাল না। কিন্তু জেঠুর কাছে ঘেঁষে এসে বসল। একবার এদিক-ওদিক তাকাল, তার পরে দুম করে বলে বসল, ‘জেঠু জানো তো, বড়দা তোমাকে না বলে বিয়ে করেছে।’

মিতা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন, দরজার ফ্রেমে স্থির হয়ে গেলেন। মৌসুমী চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘এ-এ-এ বাবা, ভাই তুই—!’ মিতার ইশারায় চুপ হয়ে গেল।

অলক কিন্তু অট্টহাস্য করে উঠলেন, ‘তাই নাকি, বিচ্ছুবাবু! তুমি কোত্থেকে জানলে?’

দীপ বড়োদের মতো গলা করে বলল, ‘আমি সব জানি, বড়দা তো তিথিদিকে—’

‘দীপ!’ মিতা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘ছোটোদের এত কথা বলতে নেই জানো না! যাও এখান থেকে, যাও হোমটাস্ক করো—গো কুইক!’

অলক থই পাচ্ছিলেন না। দীপ কী বলছে আবোলতাবোল, মিতাই-বা এত রেগে যাচ্ছে কেন?

তারপর সব শুনলেন। মিতা আর মৌসুমী দুজনে মিলে তাঁকে বিস্তারিত শোনাল। মধ্যিখানে একবার উঠে গিয়ে মিতা চা আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট করে দিয়েছিলেন অবশ্য, সেই সঙ্গে পাঁপড়ভাজাও, কিন্তু অলকের আর খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তাঁর শরীর ঝিমঝিম করছিল।

তিথি বলে সেই মেয়েটি মৌসুমীর বন্ধু, অলক তাকে দেখেছেনও হয়তো। ভালো মেয়ে, পড়াশোনাতেও ভালো। সে যে কাউকে জানিয়ে এমন একটা কাজ করে বসবে মৌসুমী বা মিতা কেউই ভাবতে পারেনি। এটা হয়েছে প্রায় এক বছর হতে চলল।

না এর

মধ্যে পার্থ এই বাড়িতে দু-একদিনের বেশি আসেনি, শেষ এসেছিল সেও অনেকদিন হয়ে গেছে। তিথি আর পার্থ যে প্রেম করে এটা নাকি সবাই জানত, কিন্তু বিয়ের কথা তিথি নিজে থেকে বলেনি, মৌসুমীর সন্দেহ হওয়াতে সে তিথিকে জেরা করে জানতে পেরেছে।

কীভাবে জানতে পেরেছে তারও শ্বাসরুদ্ধ বিবরণ দিচ্ছিল মৌসুমী, হাত পা নেড়ে, চোখ বড়ো বড়ো করে। তিথির বাড়িতে নাকি প্রচণ্ড অশান্তি চলছে পার্থর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে। সামনেই পার্ট ওয়ান পরীক্ষা। তিথি পড়াশোনাও করতে পারছে না। সে খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে, মৌসুমীর সঙ্গে আজকাল দেখাসাক্ষাৎও কম হয়। সেদিন মৌসুমী ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। তিথি নাকি কেবলই কাঁদছিল আর বলছিল—হয় সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, নয় আত্মহত্যা করবে।

মৌসুমী জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই এত ভেঙে পড়ছিস কেন? ক-দিন একটু চুপচাপ থাক না, বড়দাকে বল তোর সঙ্গে এখন ক-দিন দেখা না করতে। তাহলেই মাসিমা একটু ঠান্ডা থাকবেন।’

‘মৌ তুই আমার অবস্থা জানিস না’। তিথি বলেছিল, ‘কেউ আমার কথা শুনছে না, বুঝছে না। বাড়িতে মায়ের সঙ্গে দিনরাত গণ্ডগোল আর ওদিকে পার্থ রোজ বলে চলে আসতে… আমি কোথায় যাব, আমার পড়াশোনারই-বা কী হবে, এ বছর পরীক্ষাও দিতে পারব কি না জানি না!’ সে হাউমাউ করে কাঁদছিল।

মৌসুমীর খটকা লেগেছিল, ‘বড়দা তোকে চলে আসতে বলে মানে? কোথায়, ওদের বাড়িতে? তোদের কি বিয়ে হয়ে গেছে যে বড়দা তোকে ও বাড়িতে রাখবে?’

তিথি নিঃশব্দে কাঁদছিল, কোনো উত্তর দেয়নি। ওর মুখ দেখে মৌসুমী স্পষ্ট বুঝেছিল সে কিছু একটা লুকোচ্ছে। আর-একটু ঝাকুনি দিতেই তিথি ভেঙে পড়ল। মৌসুমীকে সব বলে দিল সে।

মৌসুমী অলককে বলল, ‘আমার বন্ধু খুব ভালো মেয়ে, জেঠু। বড়দাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে। আমি কিন্তু বড়দাকেই দোষ দেব, বড়দা এটা খুব অন্যায় করেছে।’

মিতাও বললেন, ‘ছি ছি, পার্থর তো একবার ভেবে দেখা উচিত ছিল। মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে বলছে, অথচ এদিকে আপনি কিছু জানেন না। কী খাওয়াবে ও তিথিকে? তা ছাড়া তিথি মৌয়ের বন্ধু, ওর বাড়ির লোক তো আমাদেরই দোষী করবে!’

অরূপ চেম্বার থেকে বাড়ি এসে দেখলেন, অলক একটা ধ্বংসস্তুপের মতো বসে আছেন সোফাতে, সামনে গম্ভীরমুখে মিতা আর মৌসুমী। অলকের পাশে বসে টাই-এর গিঁট আলগা করতে করতে দাদার দিকে তাকালেন অরূপ, ‘সব শুনেছ নিশ্চয়ই!’

অলক নিরুত্তর।

অরূপ কঠোর গলায় বললেন, ‘পার্থটা একটা ওয়র্থলেস আমি জানতাম। কিন্তু এতটা ইরেসপনসিবল্, রাশ, আমার জানা ছিল না। সত্যি দাদা, তোমার জন্যে আমার দুঃখ হয়। আই ফিল ফর ইউ।’

১০

তিথি মৌসুমীকে যে কথাগুলো বলেছিল তার একবর্ণও মিথ্যে নয়। সে আজকাল আত্মহত্যার কথা ভাবে। গত এক বছরে অনেকবার ভেবেছে। সত্যি সত্যিই যে পরিস্থিতির মধ্যে তার দিন কাটছে তাতে আত্মহত্যা করলেই তার মুক্তি। সে একটা ধারালো সাঁড়াশির মুখে আটকে আছে, সাঁড়াশিটা তাকে দু-দিক থেকে চেপে ধরে একটু একটু করে কাটছে, একেবারে মেরে

রেজিটিা হয়ে যাওয়ার পর পার্থর মধ্যে একটা তীব্র পরিবর্তন লক্ষ করেছে তিথি। পার্থ তাকে আর প্রেমিকার মতো আদর করতে চায় না, বউয়ের মতো ভোগ করতে চায়। আগেও পার্থ তার শরীর চেয়েছে, কিন্তু তিথি আপত্তি করলে জোর করেনি। তিথির এ জন্যে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, সে কৃতজ্ঞ ছিলও। বিয়ের পর পার্থ স্বভাবতই আর বাধা মানছে না।

ফেলছে না।

পার্থ তাকে একবার চিঠিতে লিখেছিল সে ঠিক কীভাবে তার দেহকে কল্পনা করেছে, সেই দেহের কোথায় কীভাবে সে আদর করতে চায়। তিথি সে চিঠি প্রথমে ছিঁড়ে ফেলেছিল। পাপবোধে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল তার মন। কিন্তু ছিঁড়ে ফেলার একটু পরেই, সেই ছেঁড়া চিঠির টুকরোগুলো দেখতে দেখতে তার পাপবোধ ছাপিয়ে উঠেছিল খুব নতুন একটা তীব্র ভালোলাগা। প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেছিল সে চিঠির ওই গর্হিত নির্লজ্জ শব্দগুলির প্রতি, লোভ হয়েছিল আবার চিঠিটা পড়ে। ছেঁড়া টুকরোগুলো খুঁজে খুঁজে সাজিয়ে আবার পড়েও ছিল সে।

ওই শব্দগুলো তিথিকে যেন শরীরী চেতনায় দীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি পার্থকে শরীর ছুঁতে দিতে সে ভয় পেত। পার্থ মুখে তাকে অনেক কিছু বলত, সেসব শুনে তিথির যেমন ভীষণ লজ্জা করত, তেমনই গভীর ভালোলাগাও গ্রাস করত তাকে। সে জানত, একদিন একটা কিছু ঘটবে তার জীবনে, খুব সুন্দর আর গোপন একটা ঘটনা, যেদিন তার আর পার্থর মধ্যে সমস্ত

আড়াল উড়ে যাবে আকাঙ্ক্ষিত ঝড়ে। তিথি সেই সুন্দর ঝড়ের অপেক্ষা করত।

কিন্তু প্রথম যেদিন ঝড়টা এল, তিথির মনে হল—সে যে সুন্দর ঝড়ের স্বপ্ন দেখেছিল এ তো সে নয়! বিয়ের কয়েকদিন পরেই পার্থ এক দুপুরে তাকে কলেজ থেকে নিয়ে এসেছিল স্বপনের বাড়ি। স্বপন পার্থর সেই বন্ধু দুটির মধ্যে একজন, যারা বিয়েতে সই করেছিল। স্বপনের ফ্ল্যাটটা পার্কসার্কাসে, তিনতলার ওপর ছোটো ওয়ান রুম ফ্ল্যাট, তিথির মনে হল ঠিক যেন পুতুলের বাড়ি।

স্বপন যেন বাইরে যাবার জন্যে সেজেগুজে প্রস্তুত হয়ে ছিল, তিথিকে দেখে হেসে বলল, ‘আসুন মিসেস মল্লিক, আপনাদের দেরি দেখে একটু চিন্তা করছিলাম। হানিমুনের পক্ষে আমার খাটটা বেশ ছোটো, কিন্তু কী আর করা যাবে, আমি ব্যাচেলার…একা থাকি…’ স্বপন মুখটাকে করুণ বানাতে বানাতে হো-হো করে হেসে উঠেছিল। তারপর বেরিয়ে যেতে যেতে এক চোখ টিপে ডান হাতের বুড়ো আঙুল তুলে বলেছিল, ‘ওকে, সি ইউ বোথ! এনজয় ইওরসেলভস্!’

তিথি কিছুই বুঝতে পারেনি। স্বপন কীসব ইয়ার্কি মারছে, তিথির ভালো লাগছিল না। তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে বললআমরা এলাম, আপনি চলে যাচ্ছেন?’

স্বপন যেন একটু থমকে গেছিল। পার্থ ওকে ইশারা করতে সে হেসে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। তিথি অবাক হয়ে পার্থর দিকে তাকিয়ে দেখল পার্থ পাঞ্জাবি খুলছে।

তিথি সেদিন ঢিলেঢালা চুড়িদার পরে ছিল। কমলা রঙের কামিজে সাদা সাদা বোতাম, যেগুলো সত্যি নয়। পার্থ প্রথমে সেই বোতামে হাত দিল, তিথি বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘কী?’ পার্থ কামিজের নীচটা ধরে উলটে ওপরে তুলে দিল। জাপটে ধরে চুমু খেতে লাগল মুখে। তিথির চশমা খুলে যাচ্ছে দেখে সেটা টেনে নিয়ে ছুড়ে দিল খাটের ওপরে। পুরো ঘটনাটা ঘটে গেল এমন

, ‘এ কী!

মুখবন্ধহীনভাবে, এমন দ্রুত, তিথি বাধা দেওয়ার অবকাশই পায়নি। পার্থ যখন তার পিঠের দিকে হাত চালিয়ে ব্রা-এর হুক দিচ্ছে, সে তখনও যেন বুঝতেই পারছিল না পার্থ এমন করছে কেন। তারপর পার্থ যখন দাঁড়ানো অবস্থা থেকে তাকে খাটের ওপর চিত করে ফেলল, তিথির প্রায় অবশ দেহ-মন থেকে শুধু একটা কথাই এলোমেলোভাবে কেঁপে বেরিয়ে আসছিল, ‘না…না….না…না, ছেড়ে দাও আমাকে ছেড়ে দাও আমাকে ছেড়ে দাও…’

পার্থ তাকে দু-হাত আর মুখ দিয়ে খাবলাচ্ছিল, তার বেশি কিছু করেনি। একটা কথাও বলছিল না সে। তিথির স্বরটা ক্রমশ অনিয়ন্ত্রিত গোঙানির মতো লাগছিল শুনতে। হঠাৎ পার্থ এক ঝটকায় উঠে বসে তিথির গালের পাশে হাত রেখে সংজ্ঞাহীন মানুষকে নাড়া দেবার মতো করে ঝাঁকুনি দিল, ‘তিথি, ওরকম করছ কেন, আমার নিজেকে রেপিস্ট মনে হচ্ছে।’

তিথিরও যেন ওই ঝাঁকুনিতে চেতনা ফিরে এল। না না, সে ধর্ষিত হতে যাবে কেন? না ঈশ্বর! সত্যিই, সে এমন কেন করছে? সে তো বিবাহিত নারী, পার্থ তার স্বামী। পার্থ তাকে যা করছে এটা একটা শুদ্ধ স্বাভাবিক ব্যাপার, সে নিজেই এমন আচরণ করছে যাতে পুরো ঘটনাটাকে বীভত্স দেখাচ্ছে। তিথির মরে যেতে ইচ্ছে করছিল, সে নিজেকে পার্থর হাতে ধর্ষিত মনে করছিল—এই অপরাধে। সে নিঃশব্দে শুয়ে থাকল, চোখের কোণ থেকে কানের ফুটোর মধ্যে শিরশির করে ঢুকে যাচ্ছে গরম জলের ধারা—ওহ্ ঈশ্বর, একটুও বুঝি আনন্দ হয় না এতে! সারা শরীরে শুধু চাপ আর ব্যথা…

তারপর প্রথম যেদিন ওই স্বপনেরই ফাঁকা বাড়িতে, পার্থ তার সালোয়ারের দড়িতে হাত দিল, তিথি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল। ছটফট করে বলছিল—’না, প্লিজ না, আমার ভয় করছে—’

‘কীসের ভয়!’

‘যদি…যদি কিছু হয়ে যায়!

খুলে আহ্

পার্থ তিথিকে জড়িয়ে ধরেছিল, কানে চুমু খেতে খেতে বলেছিল, ‘বোকা মেয়ে, আমাকে তোমার ভরসা হয় না?’ সে একটা হাত নিয়ে এসেছিল তিথির চোখের সামনে, হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট, চুইংগামের প্যাকেটের মতো। তিথি ওপরের লেখাটা পড়ল—’কোহিনুর’।

শব্দটা তিথির পরিচিত কি না তিথি জানত না। জানলেও সেটা ঠিক কী সে সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল একেবারে অস্পষ্ট। কিন্তু আজ ওই নামটা দেখামাত্রই যেন সব বুঝে গেল। দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলল সে।

বাঁধটা একবার ভেঙে যেতেই তিথি দেখল, তার আর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। তার ভালোও লাগছে না, খারাপও লাগছে না। পার্থর সেই চিঠিটা পড়ে, কিংবা তার কথা শুনে তার শরীরে যে গোপন ঢেউ আসত, পার্থর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে সেটা আসে না। এরকমই হয়তো হয়, পার্থ তার ওপর থেকে নিজের শরীর সরিয়ে নেবার সময় প্রত্যেকবারই জিজ্ঞেস করো, ‘তোমার ভালো লেগেছে তো?”

তিথি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে, নিজেকে প্রাণপণে বলে—হ্যাঁ হ্যাঁ, এইটাই ভালোলাগা, এভাবেই ভালো লাগাতে হয়।

এবারের পুজোতেও পার্থ বর্ধমানে গেল না। তার মায়ের জ্বর বলে মা আর বোনও যাননি। শুধু তার বাবাই গেছিলেন দেশের বাড়িতে। সপ্তমীর দিন তিথি আর পার্থ ডায়মন্ডহারবার গিয়েছিল। একটা হোটেলে। খাতায় নাম লেখানোর সময় কাউন্টারের লোকটি তিথির দিকে উদাসীন তেরছা চোখে একবার তাকিয়েছিল। তিথির মনে হল খাতায় লেখা ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস’ শব্দগুলোকে লোকটা আমল দিচ্ছে না। ইশ্ কী বিশ্রী লাগছে, সে যদি সিঁদুর পরত তাহলে নিশ্চয়ই কেউ খারাপ সন্দেহ করত

না!

তিথির মনে হওয়া পুরোটাই ভুল ছিল। সেই হোটেলে যারা বিভিন্ন ঘরগুলো নিয়েছে, তারা যে প্রত্যেকেই অবিবাহিত নারী-পুরুষ স্পষ্টই বোঝা যায়। এ নিয়ে তাদের রাখঢাকও নেই। পাশের ঘর থেকে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারশুনে তিথি ভয় পেয়ে গেছিল, পরক্ষণেই শুনল সেই মেয়েটাই তীক্ষ্ণ সুরে খিলখিল করে হাসছে।

‘ওরকম করে হাসছে কেন মেয়েটা, কী বিচ্ছিরি!’ তিথির মুখে ঘৃণা।

পার্থ তার কোমর জড়িয়ে ধরে টানল, ‘বুঝতে পারছ না, ওরা ভালোবাসছে। এবার আমরাও বাসব।’

তিথির বিশ্বাস হয়নি। ভালোবাসার সময় কোনো মেয়ে বুঝি ওইরকম চেঁচায়? ছিঃ, এটা কেমন জায়গা! তিথি নিজেকে হোটেলের সেই অপরিসর ঘরে দাগ লাগা বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে সিটিয়ে উঠেছিল। গত পুজোর কথা মনে পড়ছিল তার, পার্থ সঙ্গে প্রথম পরিচয়, প্রেমে পড়া। আজ সে পার্থর স্ত্রী, কিন্তু…।

পার্থ তাকে আদর করছে। সে আর টু শব্দটিও করে না, অনেক সময়ই দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। নিজেকে ধর্ষিত ভাবতেই তার অসম্ভব ভয় করে। ধর্ষিত কারা হয়, সে কি তাদের মতো হতভাগ্য! ছি!

কিন্তু তিথি আর পারছে না। পার্থ তাকে মাঝ মাঝে পেয়েই তৃপ্ত নয়, তার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। স্বপনের বাড়ি আর হোটেল তো রোজ রোজ সম্ভব নয়। আজকাল রোজই তার সঙ্গে পার্থর দেখা হয়। পার্থ তাকে একই কথা বলছে, ‘আর পারছি না, তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না, তুমি চলে এসো।’ তিথির অস্থির অস্থির লাগে।

তার মানসিক অস্থিরতা থেকে থেকে বাড়ে। সে সময় মনে হয় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। তিথির ইচ্ছে করে সে চিৎকারকরে ওঠে, গলা ছেড়ে কাঁদে। এত চাপ সে আর বইতে পারছে না।

তারপরই ভয়

চাপের মুখে ভেঙে পড়েই মৌসুমীর কাছে সব বলে ফেলেছে সে। বলতে শুরু করে আর থামতে পারেনি। কিন্তু করেছে তার, পার্থ তাকে নিষেধ করেছিল।

পার্থর সঙ্গে দেখা হতেই তিথি একটা মরিয়া ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘আমি মৌকে বলে দিয়েছি—’

‘কী বলেছ?’ পার্থ চমকে গেছিল।

‘আমাদের বিয়ের কথা।’ তিথি স্বীকারোক্তির ধরনে মাথা ঝুঁকিয়ে ছিল, ওইভাবেই বলল, ‘আমি খুব সরি, কীভাবে যে বলে ফেললাম, আসলে আমি আর পারছি না…এইভাবে…, তুমি খুব রেগে যাচ্ছ, না! মিতাকাকিমারাও নিশ্চয়ই সব জেনেছেন…’

পার্থ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ভাবছিল। চিন্তিত স্বরে বলল, ‘বলে ফেলেছ যখন তখন ভেবে আর কী লাভ!…দেখি…’

তিথির মনে হয়, এখন সবাই সব কিছু জেনে গেলেই ভালো। তার ইচ্ছে করে সবাইকে সে নিজেই সব জানিয়ে দেয়। তাহলে সে পার্থর কাছে চলে যেতে পারে। তা ছাড়া বোধ হয় তার সামনে আর অন্য পথ খোলা নেই। বাড়িতে অশান্তি চরম পর্যায়ে উঠেছে। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয় তার। মায়ের কথার জ্বালায় সর্বাঙ্গে লঙ্কাবাটার মতো জ্বলে। বাবা এতদিন তেমন মাথা ঘামাতেন না, আজকাল তিনিও রাগারাগি করেন। তমাল পাশ করার পর বাড়িতে এসেছিল। সে দিল্লিতে চাকরি পেয়ে গেছে। বাড়ি এসে সব শুনে তিথিকে শাসিয়েছে বাড়াবাড়ি করলে চাবকে তার পিঠের ছাল তুলে দেবে আর পার্থকে ল্যাম্প-পোস্টে বেঁধে মারবে। তিথি স্থিরচোখে দাদার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনেছিল। তার চোখে কোনো ভয় ছিল না, ছিল জেদ আর আক্রোশ। তমাল বোনের সেই ভঙ্গি দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিল, দিল্লি যাওয়ার আগে অদিতিকে বলে গেছে, ‘তিথি টোটালি আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছে দেখছি, ওকে তো বাড়িতে বেঁধে রাখতে হবে!’

তিথি সেটা হওয়ার আগেই বাড়ি ছাড়বে, কিন্তু পার্থ তো তার জন্যে কোনো ব্যবস্থাই করেনি, কোনো প্রস্তুতিই নেয়নি। তার বোনেরও তো বিয়ে হয়নি এখনও। তিথি কোথায় যাবে? আর তার পড়াশোনা! পার্ট ওয়ান ড্রপ দিতে হবে মনে হচ্ছে, তার কোনো ক্লাসে পার্সেন্টেজও নেই। কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তার জন্যে?

১১

অদিতিরও আর সহ্য হচ্ছিল না। তাঁর কেমন পাগল পাগল লাগে। একটা ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো ফালতু অপদার্থ ছেলের মধ্যে কী দেখল তিথি যে সে কাণ্ডজ্ঞান খুইয়ে বসেছে! রোজ বাড়ি ফিরতে রাত করে সে, দিনরাত কী যেন একটা ঘোরের মধ্যে কাটায়। কোনো কথা বলতে গেলে হয় মুখে মুখে তর্ক করে, নয় দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে সোজা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর দু-চোখ যেন ধক ধক করে জ্বলে। মেয়েটা কি পাগল-টাগল হয়ে গেল, ওকে কি কেউ সম্মোহন করেছে! তিনি নিজেও তো প্রেম করেছিলেন, এমন দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন দশা তো তাঁর হয়নি!

অদিতির মনে হয় এ অবস্থায় তাঁর আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল। বকুনি দিয়ে, শাসিয়ে, অপমান করে তিথিকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। তমাল বলেছিল ওকে ঘরে আটকে রাখতে। না, এই সমস্ত অদিতি পারবেন না। তাঁর রুচিতে বাধে। তিথিকে মারধরও করেন না তিনি। এই অবস্থায় হয়তো সেটাই করা দরকার। কিন্তু ছেলেমেয়ের গায়ে কখনো হাত তোলেননি অদিতি। তিনি বিশ্বাস করেন, গায়ের জোরে যাকে শাসন করতে হয় সে অনেক আগেই শাসনের বাইরে চলে গেছে।

অদিতি পার্থকে আর দ্বিতীয়বার দেখেননি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিথি আর পার্থ যে অনেকদূর এগোচ্ছে, তাঁর মায়ের দৃষ্টি সেটা ধরে ফেলেছিল। তিথি রাত করে ফিরে যখন বাথরুমে চলে যায়, তাঁর ঘৃণাবোধ হতে থাকে।

তিথি আজ আবার রাত করছে। রাত ন-টার আগে আজকাল আর অপেক্ষা করা ছেড়েই দিয়েছেন অদিতি। কিন্তু আজ পৌনে দশটা বাজতে চলল।

বিশ্বনাথ অস্থির হয়ে বললেন, ‘দশটা বেজে গেল এখনও পাত্তা নেই, একেবারে গোল্লায় গেল মেয়েটা? একবার মৌসুমীদের

বাড়ি যাব?’

‘তিথি ওখানে নেই।’

বিশ্বনাথ অধৈর্য গলায় বললেন, ‘ওদেরই সমস্ত দোষ। ওরা সব জানে, একটা বদমাইশ ছেলে তিথিকে বোকা পেয়ে—’

‘তাই তুমি ওদের বাড়ি গিয়ে ঝগড়া করতে চাও?’ অদিতি নিজেই ঝগড়ার ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তোমার লজ্জা করবে না? ছেলেটা বদমাইশ, আর তোমার মেয়ে ধোয়া তুলসীপাতা, না? ছেলে ওদের, কিন্তু মেয়ে তো আমাদের। সে নিজেই আমাদের মুখে চুনকালি মাখাচ্ছে। মাখাক। সে মুখ আবার লোককে দেখাতে যাওয়া কেন?’

বিশ্বনাথ অন্যদিন চুপ করে যান, আজ তিনিও চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘খুব তো বলছ, তুমিই পারোনি ওকে শাসন করতে, নইলে ব্যাপার অ্যাদ্দুর গড়াতই না—’

‘ও আচ্ছা! কী করব আমি? বস্তিবাড়ির মতো পেটাব মেয়েকে? ঘরে বন্ধ করে রাখব? রাখলে ও থাকবে? তা কেলেঙ্কারি সব আমাকেই বা করতে হবে কেন? তুমিও কিছু করো, আমি দেখি তোমার কতদূর ক্ষমতা?’

সওয়া দশটারও পরে তিথি যখন ফিরল, অদিতি বিশ্বনাথ তখনও অসহায় আক্রোশে পরস্পরের ওপর দোষারোপ করছিলেন। তিথি ঘরে ঢুকতেই অদিতি তার চুলের মুঠি ধরলেন। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসে ওর মাথাটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ‘বল কোথায় গিয়েছিলি, বেহায়া বেয়াদব মেয়ে, বল কোত্থেকে এলি এতরাত্রে হারামজাদি…’ অদিতির সমস্ত ধৈর্য আর রুচির আত্মাভিমান ভেসে গেছিল।

তিথি চুল ছাড়াল না, চুলের টানে তার ঘাড় কাত হয়ে বেঁকে আছে। ওই অবস্থাতেই কেটে কেটে বলল, ‘গেছিলাম ডায়মন্ডহারবার।’

বিশ্বনাথ ফ্যালফ্যাল করে মেয়েকে দেখছিলেন। অদিতি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কেন গিয়েছিলে?’

‘একটা হোটেলে ছিলাম। আমি আর পা—’

অদিতি ঠাস করে একটা চড় কষালেন তিথির গালে। তারপর চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন, বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘এ মেয়েকে আমি কিছু করতে পারব না, ও সর্বনাশের রাস্তায় পা বাড়িয়ে আছে। তুমি ওকে মারো, ওকে মারো, এই সর্বনাশ হতে দিয়ো না…’

বিশ্বনাথ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। এ অবস্থায় কী করতে হয় তাঁর জানা নেই। তার ওপর জীবনে এই প্রথম অদিতিকে এভাবে খানখান হয়ে ভেঙে পড়তে দেখে তিনি বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন।

মার খেয়ে তিথি কাঁদল না। নির্লজ্জ সত্যি কথা বলতে তার ভয়ও করেনি একটুও। এই সত্যির মধ্যে স্বীকারোক্তির ভঙ্গি ছিল না, কোনো মরিয়া ঔদ্ধত্যও নয়। অত্যন্ত নির্বিকারভাবে সে হয়তো আরও কিছু বলতে পারত, অদিতি তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলেন। এখন মাকে কাঁদতে দেখেও সে খুব সহজ শীতল ভঙ্গিতে নিজের ঘরে চলে গেল।

সকালে তিথি যখন বেরোচ্ছে, অদিতি দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। সারারাত ঘুমোননি, চোখ দুটো খুব লাল হয়ে আছে। মায়ের দিকে তাকাল না। অদিতি বললেন, ‘কিছু খেয়ে বেরোলি না?’ তাঁর স্বর স্তিমিত, ক্লান্ত। তিথি জুতোর ্যাপ বাঁধছিল, উত্তর দিল

তিথি না।

তিথি সতর্ক হয়ে উঠল। অদিতি তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর স্বরে আক্রমণ নেই, আকুলতা আছে। তিনি হঠাৎ তিথির হাত ধরে ফেললেন, তাঁকে হঠাৎ কেমন বিপন্ন দেখাচ্ছিল।

‘আহ্ ছাড়ো!’ তিথি হাত টেনে নিতে চাইল।

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

এ কথার তিথি কোনো উত্তর দিল না। সজোরে মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খুব ঠান্ডা গলায় বলল ‘ছাড়ো মা, আমাকে যেতে দাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘ফিরবি তো?’ অদিতি যেন হাহাকার করে উঠলেন। তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে, বার বার খালি মনে হচ্ছে তিথি রোজকার মতো কলেজ যাচ্ছে না, একেবারে চলে যাচ্ছে। আর একবার তার হাত ধরার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘তিথি, লক্ষ্মী সোনা মা আমার, বাড়ি ফিরো কিন্তু—’

তিথি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। অদিতি সিঁড়ির মুখে এসে নীচে ঝুঁকে পড়লেন, ‘আমি, আমি ক্ষমা চাইছি তিথি…আর কক্ষনও তোর গায়ে হাত তুলব না…মা, শোন, তিথি…’

তিনি জানেন পিছু ডাকতে নেই, কিন্তু তিনি ডেকেই যাচ্ছিলেন।

তিথি সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে প্রায় দৌড়োচ্ছিল।

‘তিথি!’

১২

তিথিকে পার্থ বিয়ের পরেও যে ক-দিন বাড়িতে নিয়ে এসেছে, অলকের সঙ্গে একদিনও তার দেখা হয়নি। পাৰ্থ এটা খুব সচেতনভাবেই চেয়েছিল।

বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। বাবাকে সে মনে মনে অপছন্দই করে, অলকও তাই। কিন্তু সে বাবার সঙ্গে একই বাড়িতে একই ছাদের তলায় থাকে, এমনকী, এক বিছানায় পাশাপাশি শোয়ও। এটা এক ধরনের সমঝোতার ব্যাপার। এই সমঝোতায় যদিও পার্থর লাভই বেশি, সে এমন ভাব করে যেন যে-কোনোদিন সে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে।

সে বাড়িভাড়া আর ইলেকট্রিক বিলের টাকা দেয়। তারা অনেক কালের ভাড়াটে, বাড়িভাড়াও সামান্য। কিন্তু সেই টাকাটা প্রতি মাসে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, ইলেকট্রিক বিলও তাই। তবে সে হিসেব রাখে। চার-পাঁচ-ছয় মাস অন্তর অন্তর, যখন তার হাতে টাকা আসে তখন থোকে টাকাগুলো মিটিয়ে দেয়। দেরি হলে অলক খোঁটা দিতে ছাড়েন না, প্রত্যক্ষ পরোক্ষে অনেক অপমানকর মন্তব্য করেন। পার্থ সেগুলো চুপচাপ সহ্য করে। যখন সে টাকা দেয় তখন তার দেওয়ার ভঙ্গিতে অভিমান ফুটে বেরোয়, অলক টাকাগুলো নিতে নিতে বলেন— ‘হুঁ, ধন্য করে দিচ্ছেন।’

পার্থ গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেনি। বেলুড় বিদ্যামন্দিরে কেমি িনিয়ে পড়তে পড়তে ফার্স্ট ইয়ারেই পালিয়ে গিয়েছিল পুনেতে, ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভরতি হবে বলে। বন্ধুদের কাছে ধার করে যাওয়ার ভাড়া জোগাড় করেছিল। বম্বে থেকে সে যখন পুনের ট্রেনে উঠল, টিকিট ছাড়া তার পকেটে ছিল বাইশ টাকা। পকেট একেবারে ফাঁকা থাকলেও সে সামলে উঠতে পারত, যদি না তার কপালটাই ফাঁকা হত।

পুনে যাওয়ার পথেই ট্রেনে আলাপ হয়েছিল একটি বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা আর তাঁদের মেয়ে। মেয়েটি কলকাতায় থেকে পড়ে, আই. সি. এস. সি. পরীক্ষা দিয়ে মা-বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছে। ওঁরা পুনের বহুদিনের প্রবাসী বাঙালি। পার্থর সঙ্গে নিজে থেকেই ভদ্রলোক কথা বলতে শুরু করেছিলেন। তাঁর নাম মিস্টার চ্যাটার্জি। পরে তাঁর স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গেও আলাপ হল। সবারই ব্যবহার খুব মিষ্টি। কথায় কথায় তাঁরা পার্থর বিষয়ে জানতে চাইলেন। পার্থ কিছু গোপন করেনি। বলছিল, সে বাড়িতে না জানিয়ে পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভরতি হতে যাচ্ছে।

মিস্টার চ্যাটার্জি সকৌতুকে বললেন, ‘নায়ক হতে চাও?’

‘না, না’, পার্থ প্রতিবাদ করল, ‘এই চেহারায় নায়ক হওয়া যায় না আমি জানি, আমি ফিল্ম ডিরেকশনের কোর্স করব।’ ‘চেহারা তোমার খারাপ নয়, শুধু একটু রোগা’, মিসেস চ্যাটার্জি সস্নেহে বললেন।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। একটু পরে মিস্টার চ্যাটার্জি বললন, ‘কিছু মনে কোরো না, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি ইয়ং ম্যান। এসবে তো টাকাপয়সার ব্যাপার আছে, তোমার কাছে কি 7

পার্থ একমুহূর্ত দ্বিধা করেছিল। তারপর মাথা নেড়েছিল—না, তার কাছে কিছুই নেই।

এর পরের অংশটুকু একটি সম্পূর্ণ স্বপ্নের মতো হতে পারত। ঘটনা সেই দিকেই এগোচ্ছিল। মিস্টার এবং মিসেস চ্যাটার্জি পার্থকে বোধ হয় খুবই পছন্দ করে ফেলেছিলেন। বিদেশবিভুঁইয়ে একটি অসহায় অল্পবয়সি বাঙালি তরুণকে দেখে তাঁদের মায়া হয়ে থাকবে। তাঁরা পুনেতে নেমে পার্থকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যান। বিরাট বাড়ি। মিস্টার চ্যাটার্জি পার্থকে বললেন, ‘তুমি যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো, আমরা খুশি হব।’

কৃতজ্ঞতায় পার্থর মুখে কথা সরছিল না, কোনোরকমে বলল, ‘আপনারা যে আমার কী উপকার করলেন—’

‘না না,’ মিস্টার চ্যাটার্জি তাড়াতাড়ি পার্থর কৃতজ্ঞতার উচ্ছ্বাস চাপা দেওয়ার জন্যে বললেন, ‘উপকার-টুপকার নয়, যেটুকু আমাদের কর্তব্য বলে মনে করছি সেটুকুই—’ তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল লজ্জা পাচ্ছেন। একটু পরে বলছিলেন, ‘আর বাড়িতে একটা চিঠি লিখে দাও, এখানকার ঠিকানা দিয়ে, তোমার খবর জানিয়ে। তোমার মা-বাবা দুশ্চিন্তা করছেন নিশ্চয়ই, তাঁরা একটু নিশ্চিন্ত হবেন।’

পার্থ সেটাই করেছিল। মাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিল সে ভালো আছে, তার স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। কী কারণে সে এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে সেটা যতটা সম্ভব ব্যাখ্যা করে শেষে লিখেছিল, ‘তোমরা আজ হয়তো ভাবছ আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি, কিন্তু যেদিন আমি অনেক অনেক বড়ো হব, বুঝতে পারবে কেন আমি এমন করলাম।’

মিস্টার চ্যাটার্জির মেয়ে সুদক্ষিণার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল ট্রেনেই, বাড়িতে এসে বন্ধুত্ব হল। সুদক্ষিণা সুন্দরী আর দারুণ খোলামেলা। এরকম কোনো মেয়েকে পার্থ আগে দেখেনি। সুদক্ষিণারও বোধ হয় এই ঘর পালানো সদ্য দাড়ি-গজানো ছেলেটিকে দেখে খুব কৌতূহল হয়ে থাকবে। ওরা প্রেমে পড়ল।

কিন্তু একটা ব্যাপারে পার্থ প্রচণ্ড ভুল করে ফেলেছিল। সে এখানে পৌঁছে বুঝতে পারল একেবারে কোনো খোঁজখবর না নিয়ে শুধু স্বপ্নে ভর করেই সে এতদূর চলে এসেছে। পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভরতি হতে গেলে একটা সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসতে হয়, সে জানত না। তা ছাড়া, সেখানে ভরতি হওয়ার সময়ও এটা নয়। এমনি এমনি কপর্দকহীনভাবে সে যেভাবে পুনে পাড়ি দিয়েছে একে বোকামিই বলে। মিস্টার চ্যাটার্জিরা না থাকলে তাকে এতদিনে বোধ হয় না খেয়ে মরতে হত।

তার চিঠি মা-বাবার কাছে পৌঁছেছিল কি না সে জানে না, পৌঁছোলেও তার প্রতিক্রিয়া কী ছিল, তার বক্তব্যের মর্ম আদৌ তাঁদের

কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল কি না, এসবও তার অজানা। কিন্তু দিন পনেরো পরে বাবাকে পুনে পৌঁছোতে দেখে সে প্রমাদ গুনল। এই ঠিকানা তার চিঠি থেকেই বাবা পেয়ে থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক; কিন্তু তার কাছে সমস্ত পরিষ্কার হয়ে গেল যখন সে শুনল অলক মিস্টার চ্যাটার্জির দু-হাত ধরে বলছেন, ‘আপনার কাছে যে আমি কত ঋণী সে মুখে বলে বোঝাতে পারব না। আপনার চিঠি পেয়েই ট্রেনে চেপেছি।’

চলে আসার সময় মিস্টার চ্যাটার্জি আর তাঁর স্ত্রী পার্থকে বার বার করে চিঠি লিখতে বলেছিলেন, আবার আসার কথাও বলেছিলেন। সুদক্ষিণা কেঁদেছিল, আর চুপিচুপি বলেছিল, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই আমি আবার কলকাতায় দাদু-দিদার কাছে চলে যাব। প্রেসিডেন্সিতে ইংলিশ অনার্স নেব। বাবারও তাই ইচ্ছে কেন কি বাবাও প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছিল। তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।’

কলকাতার ফিরে আসার পর অলক পার্থকে আবার বেলুড়ে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পার্থ যায়নি। সে তখন পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখে ফেলেছে, কেমিেিত মন দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।

অলক যখন তাকে বলেলেন, ‘পড়বি না তো বেরো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা—’ সে সত্যি সত্যি বেরিয়ে আসছিল। সুধা ছুটে এসে তাকে আটকালেন, স্বামীর দিকে তাকিয়ে কান্নাভরা গলায় বললেন, ‘না, ওর যা ইচ্ছে ওকে তাই করতে দাও। একবার ও বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল, তখন আমি কী করে সহ্য করেছি আমিই জানি। আবার ওকে চলে যেতে বললে আমিও ওর সঙ্গে যাব।’

পার্থ কলকাতায় রয়ে গেল। সুদক্ষিণার জন্যে অপেক্ষা করেছিল সে। সুদক্ষিণা এসেও ছিল। পরের পাঁচ বছর ধরে গভীর প্রেম চলল তাদের। তারপর হঠাৎই সুদক্ষিণা ফিরে যায় পুনেতে। ফিরে গিয়ে পার্থকে একটা চিঠি দেয়। এই কথা জানিয়ে, যে তার মা-বাবা বম্বের এক ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ের ঠিক করেছেন। পার্থ যেন তাকে ভুলে যায়।

সুদক্ষিণা হয়তো ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু তার চিঠিতে সেরকম কোনো আভাসও ছিল না। বরং পার্থর মনে হয়েছিল, সুদক্ষিণা যেন খুশি। ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল তার, অনেকদিন সুদক্ষিণাকে ভুলতে পারেনি সে। তারপর তিথির সঙ্গে দেখা। তিথিকে এই সবকথাই বলেছে সে। তার এখন মনে হয়, ভালোই হয়েছে সুদক্ষিণার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে গিয়ে। সে ছিল তেজি আর খামখেয়ালি নদীর মতো, আর তিথি যেন শান্ত একটা দিঘি, নিশ্চিন্তে স্নান করা যায়।

পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তার পড়া হয়নি। কলকাতাতেই সে এদিক ওদিক খোঁজখবর নিতে শুরু করল। এডিটিং-এর বিদ্যে রপ্ত করল কিছু কিছু। বড়ো পর্দার নয়, ইউম্যাটিক ভিডিওর কাজ। অন্তত কিছু রোজগার তো চাই। এই লাইনে বন্ধুবান্ধবও হল কিছু, তাদের সূত্রে কিছু কাজও আসে হাতে। বেশিরভাগই অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর হিসেবে। দু-একটা ছোটোখাটো কাজ অবশ্য সে একাই নামিয়েছে। এগুলো সবই টিভির জন্যে তৈরি করা অনুষ্ঠান, যার অধিকাংশই টিভিতে দেখানো হয় না। তা না হোক, ওতে পার্থর এসে যায় না। এ সমস্ত করেই হাতে মাঝেমধ্যে চার-পাঁচ হাজার টাকা আসে তার, তাও অনেক ঘোরাঘুরির পর, পাঁচ-ছয়মাস কি তারও বেশি সময় অন্তর। তবু সে এখানেই মাটি কামড়ে পড়ে আছে। আজ সে যে জায়গায় সেখানেই তো চিরদিন আটকে থাকবে না, প্রতীক্ষা যত দীর্ঘই হোক না কেন—সে ভাবে। তার স্বপ্নগুলো বরাবরই তার তুলনায় আকারে আয়তনে অনেক বড়ো, সে দু-হাতে জাপটেও ঠিক সামলাতে পারে না। কিন্তু স্বপ্ন তো এমনই হয়!

যখন তার সমবয়সি চেনা পরিচিত বন্ধুবান্ধব আত্মীয় প্রতিবেশী ছেলেরা স্বপ্ন দেখেছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিএ, নিদেনপক্ষে সরকারি আমলা হওয়ার, সে স্বপ্ন দেখেছে সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক হবে। কীভাবে যে এই স্বপ্নের বীজ তার মধ্যে উড়ে এসে পড়ল, আলো হাওয়া জল পেয়ে তরতর করে বেড়ে উঠল স্বপ্নের চারাগাছ, সে জানে না। পরে সে নিজে নিজেই এ বিষয়ে বইপত্র জোগাড় করে পড়াশুনা করেছে, খুঁজে খুঁজে বিশ্ববিখ্যাত পরিচালকদের ছবি দেখেছে। ছবি দেখে বেরিয়ে এসে তার মনে হয়েছে এঁরাও কি জানতেন, বিশ্বে এত কিছু করার থাকতে তাঁরা ছবি বানাতে চেয়েছিলেন কেন। ভাগ্যিস চেয়েছিলেন, তাই না বার্গম্যানের সাইলেন্স, বুনুয়েলের ভিরিডিয়ানা, ত্রুফোর কুলেজিম, ঋত্বিকের কোমল গান্ধারের মতো ছবি সম্ভব হয়েছে। সেও

এঁদেরই মতো মহৎ সিনেমা সৃষ্টি করতে চায়, এই মহৎ স্বপ্নই তাকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে বাধ্য করে।

দশ বছর আগে অলক পুনে থেকে ঘাড় ধরে ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন, তারপর থেকেই পার্থর সঙ্গে তাঁর অগাধ দূরত্ব। অতদূর থেকে ছেলেকে নিয়ে আসতে তাঁর একরাশ টাকা খরচ হয়েছিল, কিন্তু কী করবেন, একটা মাত্র ছেলে। ভয়ও পেয়ে গিয়েছিলেন খুব। সুধা কেঁদেকেটে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পুনের সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে চিঠি না পেলে ছেলেকে হয়তো ফিরেই পেতেন না।

অলক ভেবেছিলেন, এসব বয়সে ছেলেদের মাথায় অনেক ভূত চাপে। ভূত নামতেও দেরি হয় না। কিন্তু পার্থর ভূত নামল না। যে যখন পড়াশুনাই ছেড়ে দিল, অলক প্রথম কিছুদিন রাগারাগি লাফালাফি চেঁচামেচি করলেন, তারপর আর কোনো আশা না দেখে হাল ছেড়ে দিলেন।

সেই থেকে দুজনে একই বাড়িতে থাকেন কিন্তু পারতপক্ষে বাবা আর ছেলের মুখোমুখি দেখা হয় না। অলক ন-টার সময় যখন ভাত খেয়ে অফিসে বেরোন, বেশির ভাগ দিনই পার্থ তখনও ঘুম থেকে ওঠে না। অলক যখন বাড়ি ফেরেন, পার্থ তখনও বাইরে। সে কোথায় যায়, কী করে, আদৌ কিছু করে কি না এসব সম্বন্ধে অলকের ধারণা স্পষ্ট নয়। আগে তিনি সুধাকে জিজ্ঞেস করতেন, এখন আর করেন না। তার কারণ, তিনি দেখেছেন সুধার পার্থর প্রতি একটা অকারণ পক্ষপাতিত্ব আছে, যেন তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ছেলেকে স্বামীর ভর্ৎসনার হাত থেকে আড়াল করতে বদ্ধপরিকর। অলকের মুখ থেকে পার্থ সম্বন্ধে একটিও বিরূপ বাক্য উচ্চারিত হলে তিনি অযৌক্তিক তর্ক করেন, কখনো কেঁদেও ভাসান। তাঁর ভয়, অলকের গঞ্জনায় ছেলে ফের বাড়ি-ছাড়া না হয়। পার্থ অবশ্য গত দশ বছরে মাঝেমধ্যেই সে হুমকি দিয়েছে, তবে সত্যি সত্যি কোথাও যায়নি।

অলক একবার বলেছিলেন, ‘তুমি ভাবো ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। যাবেটা কোথায়? একবার বাপ নিজে গিয়ে ফিরিয়ে এনেছিল, আর যে আনবে না সে ও ভালোই বোঝে। বিনে পয়সার বাপের হোটেল ছেড়ে যাবে কোথায় ও?’

সুধা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘ও বুঝি তোমার সংসারে কিছু দেয় না? ওকে দু-চক্ষে দেখতে পারো না তুমি, নিজের ছেলের সঙ্গে এ কী

ব্যবহার!’

‘দেখতে পারি না কি আর সাধে! আমি বুড়ো বাপ খেটে খেটে মরে যাচ্ছি আর সোমত্ত ছেলে কোনো কাজকর্ম নেই, পড়াশোনাও করল না, চাকরি-বাকরির পথ নিজেই বন্ধ করল। অপদার্থ ধাড়ি ছেলে কোলে নিয়ে বসে থাকতে মায়ের লজ্জা হয় না সুধা, বাপেরই লজ্জা হয়।’

‘ছেলেকে অপদার্থ বলছ, তুমিই-বা কোন পদার্থটা শুনি? বর্ধমান থেকে এসেছি আজ পঁচিশ বছরের ওপর। সেই এক ভাঙা বাড়িতেই পড়ে আছি। মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত দিতে পারলাম না এখনও। সবাই এখানেই কত কী গুছিয়ে নিচ্ছে। আর তুমি এখনও বর্ধমানে ফিরে যাওয়ার খোয়াব দ্যাখো!’

অলক আর কথা বাড়ান না। সুধা তাঁর আসল দুর্বলতার জায়গাতে ঘা দিয়েছেন। ইচ্ছে করেই দিয়েছেন। কলকাতায় আসার পর থেকেই এই নিয়ে সুধার সঙ্গে তাঁর অশান্তি হত। তিনি চাইতেন দেশে ফিরে যেতে, কারণ এখানে কিছু হচ্ছে না। সুধা যেতে দেননি। তাঁর আশা ছিল কলকাতাতে থাকলেই তাঁদের অবস্থা ফেরার সম্ভাবনা। সে আর সম্ভব হয়নি। এর জন্যেও সুধা স্বামীকেই দায়ী করেন। তাঁর এ বিরক্তি যাওয়ার নয়। ছেলের দোষ তিনি ধরেন না, ছেলের কথা উঠলে শেষ পর্যন্ত স্বামীকে খোঁটা দেন।

পার্থর ওপরে সুধার অসীম প্রশ্রয়। কিন্তু পার্থর এভাবে বিয়ে করায় তাঁর ঠিক সায় ছিল না। পার্থ যখন তাঁকে প্রথম বলেছিল তিথিকে সে বিয়ে করবে ঠিক করেছে, সুধা বলেছিলেন, ‘তুই বিয়ে করলে সীমার কী হবে!’

‘কেন মা, আমি বিয়ে করলে কি ওর বিয়ে হবে না ভেবেছ?’

‘না, তা নয়—।’ সুধা চুপ করে গেলেন। তিনি শুধু একটা কথাই মুখ ফুটে বলেছিলেন। তাঁর বলার ছিল অনেক কিছু।

প্রথমত কাগজে সই করে বিয়েটা ঠিক কতটা সত্যিকারের বিয়ে তাঁর সন্দেহ আছে। তা ছাড়া জাতেরও এত অমিল। আর যদি এটা বিয়ে হয়ও, তাহলে বিয়ের পরে বউ কোনো সধবার চিহ্ন ধারণ না করে কুমারী মেয়ের মতো বাপের বাড়ি থাকবে, এতে তাঁর ছেলের অকল্যাণ হবে না? তবে পার্থ বলেছে কিছুদিন পর সেও বউকে এখানে নিয়ে আসতে চায়। সুধার আসল ভয় সেখানেই। তাঁর স্বামী এখনও পর্যন্ত কিছু জানেন না। তখন জানলে তিনি কী করবেন? ভয়ে সুধার বুক ঢিপ ঢিপ করে। এতদিন তিনি ছেলেকে প্রাণপণে আড়াল করে এসেছেন, সেদিন স্বামীকে সামলাবেন কী করে!

কিন্তু এত কথা পার্থকে কিছুই বলতে পারলেন না সুধা। জাত-টাত আজকাল আর কেউ মানে না। পার্থকে সে বিষয়ে কিছু বলে লাভ নেই। তা ছাড়া, তাঁর বয়স্থ ছেলে বিয়ে করতে চলেছে, মা হয়ে কোন মুখে তাতে আপত্তি করেন তিনি! তিনি কি চান না তাঁর ছেলের বিয়ে হোক। আহা ষাট, ভগবান মুখ তুলে চাইলে সীমার বিয়েটাও যেভাবে হোক তিনি তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবেন।

এ বাড়িতে জলের ব্যবস্থা টাইমকলে। কলে জল এলে বালতি ভরে জমিয়ে রাখতে হয়। এই কাজটা সীমাই করে। আজ সে বাড়ি নেই। বিকেলে পাড়াতেই একজনের বাড়ি গেছে সে-বাড়ির মাসিমার কাছে টেবিলঢাকার এমব্রয়ডারি তুলতে। যাওয়ার আগে চারটে লোহার বালতিতে জল অবশ্য ভরে রেখে গেছে সে, বালতিগুলো শুধু বাথরুমেই তোলা হয়নি।

সীমা এখনও ফেরেনি। সুধা কলতলায় ছিলেন। জলভরা বালতিগুলো টেনে টেনে নিয়ে আসছিলেন বাথরুমে। অলকও ফেরেননি এখনও। পার্থর তো বাড়ি ফেরার সময়ই নয় এটা। বাইরের দরজা খোলা ছিল। খোলাই থাকে। দরজাটা কলতলার সোজাসুজি, কেউ এলে সুধা দেখতে পাবেন।

জল টানতে টানতে সুধা শুনতে পেলেন দরজায় আওয়াজ হল। মুখ তুলেই দেখতে পেলেন অলক স্খলিত পায়ে ঘরে ঢুকে

মেঝের ওপর এলিয়ে বসে পড়ছেন।

‘ও কী, কী হল গো—— সুধা বালতি রেখে হাঁকপাক করে ছুটে এলেন। অলকের চোখ বন্ধ। সুধা তাঁর কাঁধ ধরে নাড়া দিলেন, ‘কী হয়েছে, শরীর খারাপ করল নাকি, কথা বলছ না কেন—’ তাঁর স্বর ভয়ার্ত।

অলক চোখ মেলে তাকালেন। তাকিয়েই রইলেন সুধার দিকে। তাঁর রকম-সকম দেখে সুধার হাত পা ছেড়ে যাচ্ছিল। এমন করছে কেন মানুষটা!

হঠাৎ অলকের বাক্যস্ফূর্তি হল। তিনি তীব্রস্বরে বলে উঠলেন, ‘চক্রান্ত! অ্যাঁ, এত বড়ো চক্রান্ত! আমাকে না জানিয়ে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে?’

সুধা মূর্তির মতো জমে গেলেন। তাঁর আড়ষ্টতা লক্ষ করে অলকের গলায় আক্রোশ উঠে এল, তিনি দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘কতদিন লুকিয়ে রাখবে ভেবেছিলে কথাটা? তোমার গুণধর তো বউ নিয়ে এইখানেই ওঠবার প্ল্যান করছে শুনে এলাম। ওকে বলে দিয়ো এসব আমি বরদাস্ত করব না। ও যেন নিজের রাস্তা দেখে।’

সুধা ব্যাপারটার জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। কোথা থেকে কী হয়ে গেল তাঁর মাথায় কিছুই ঢুকল না। তিনি অসাড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

যদিও পাৰ্থ জানত এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। তিথি তাকে যেদিনই জানিয়েছিল সে মৌসুমীকে সব কথা বলে ফেলেছে, সেদিনই ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে যেতে পারে তার একটা আন্দাজ করেছিল সে। আজ সে বাড়ি ফিরতেই সুধা কোথায় ছিলেন, ছেলেকে আড়ালে ডেকে ফিসফিস করে বলে দিলেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে, তোর বাবার কানে সব উঠেছে।’

পার্থ চপ্পল ছাড়তে ছাড়তে শুনল, টিভিটা চলছে। তার মানে, বাবা টিভি দেখছেন। পার্থ সোজা টিভির ঘরে ঢুকেই কাঁধের ঝোলাটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। আজ আর এড়ানোর সুযোগ নেই, এড়িয়ে লাভও নেই।

তক্তপোশে শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে অলকের ঝিমুনি এসেছিল। চটকা ভেঙে দেখলেন, ঘরে পার্থ। পার্থ প্রস্তুত হয়ে অলকের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল, অলকও খানিকক্ষণ এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন তাঁর কিছু মনে পড়ছে না। পরক্ষণেই তিনি গর্জে উঠলেন, ‘রাস্কেল, তোমার এত হিম্মত, তুমি বিয়ে করেছ? নিজে তো কবেই গোল্লায় গেছ, আবার একটা পরের মেয়ের সর্বনাশ করলে তুমি কোন আক্কেলে——

‘তিথি নিজের ইচ্ছেয় আমাকে বিয়ে করেছে।’

অলক লাফিয়ে উঠলেন, তর্জনী তাক করলেন পার্থর দিকে, ‘বাস্ বাস্, একদম বাজে কথা বলবে না। মিতা আমায় সব একটা ভালো মেয়ের জীবন নষ্ট করলি তুই জানোয়ার, তোর নিজের কোনো সংস্থান নেই, সে মেয়ে, তাকে বিয়ে করল কী তুই তাকে কত মিথ্যে কথা বলেছিস?’

পার্থ শান্তমুখে বলল, ‘মিথ্যে কিছু বলিনি। বলেছি আমার যা শাকভাত জোটে তাই ভাগ করে খাব।’

‘কী বললি! এ কথা বলতে তোর লজ্জা করল না!’ অলক এত চিৎকার করছিলেন যে সুধার মনে হল সারা পাড়ার লোক সবাই বোধ হয় শুনতে পাচ্ছে। দোতলায় রুম্পারা তো বটেই। ছি ছি, লোকটা যেন রাগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

অলকের সত্যি রাগে সারা শরীর কাঁপছিল, ভাইয়ের বাড়িতে আজ তাঁকে যত কথা সহ্য করতে হয়েছে সে সমস্তই তাঁর মাথার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি মুখ বিকৃত করে বললেন, ‘শাকভাত? সেটাও তুই নিজে ব্যবস্থা করবি বলে দিলাম। বিয়ে

বলেছে। করে,

করেছ, নিজের পয়সায় শাকভাত খাওয়াও গে যাও। এখানে আর তোমার অন্ন জুটবে না।’

পার্থ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। সীমা ফিরে এসেছিল ইতিমধ্যে। সে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। এটা তার ঠিক কীসের কান্না বোঝা গেল না, তবে সুধার কান্না পাচ্ছিল না। তিনি খুব মাথা ঠান্ডা রেখে ভাববার চেষ্টা করছিলেন একটা কথাই—কী হবে!

১৩

তিথিদের স্টাডি লিভ পড়ে গেছে। টেস্ট পরীক্ষায় যে সে কীভাবে বসেছিল সেই জানে, ভাগ্যিস ভালো উতরে গেছে। সে অবশ্য শুনেছে টেস্টে সবাই এভাবেই পাশ করে, তারপর পড়াশুনা শুরু করে দেয়। তিথির পক্ষে সেটাও সম্ভব হয়নি। সে প্রায় রোজই বেরোয়, পার্থর সঙ্গে দেখা করে, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মাথা ঠান্ডা করে পড়তে বসার পরিস্থিতি তার নেই, সেজন্যে যেটুকু মনঃসংযোগ দরকার সেটাই তার নষ্ট হয়ে গেছে।

আজ তিথি কলেজে এসেছিল। সহপাঠীরা কেউ নেই, তিথি একা একা ভূতের মতো লাইব্রেরিতে বসে রইল। লাইব্রেরিও একদম ফাঁকা। সেটাই অবশ্য তিথির পক্ষে স্বস্তিদায়ক। দেড়টাতে পার্থর আসার কথা, ততক্ষণ যেভাবেই হোক কাটিয়ে দিতে হবে।

দেড়টা বাজার একটু আগে তিথি কলেজের সামনে সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল। তার সঙ্গের ব্যাগটা আজ ফুলে শক্ত টানটান হয়ে আছে। কাল রাত্রেই তিথি ওর মধ্যে ভরে রেখেছে দু-জোড়া অন্তর্বাস আর টুথব্রাশ। তবে ব্যাগটা ফোলা আর ভারী হয়ে উঠেছে ওতে তিন-চারটে মোটা বই ভরার জন্যে। তিথি মনে মনে এখনও আশা ছাড়েনি, যদি পরীক্ষাটা দেওয়া যায়। একটা এসপার ওসপার হয়ে গেলেই বোধ হয় সে পড়তে বসে যেতে পারবে।

দূর থেকে পার্থকে আসতে দেখেই তিথি ছুটে গেল তার দিকে। ঊর্ধ্বশ্বাসে বলল, ‘পার্থ, আমি চলে এসেছি পার্থ, আমি তোমার কাছে চলে এসেছি। আর আমি বাড়ি ফিরব না!’

পার্থ দাঁড়িয়ে পড়েছিল, মনে হল তার মাথায় বজ্রপাত হয়েছে।

তিথি পার্থর বাঁ-হাত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখে তার কাঁধে মাথা

রাখল। এত জোরে সে পার্থকে ধরে আছে যেন সে বহুদিন স্রোতে

ওলটপালট হওয়ার পর পাড়ের মাটি পেয়েছে। পার্থ কোনোরকমে বলল, ‘চলো কোথাও গিয়ে বসি।’

ওরা ইডেনে এল। সেই ছায়াচ্ছন্ন সবুজ মাঠ, সেই প্যাগোডার মতো ছাউনিওয়ালা ঘর, সেই সাঁকো। তিথি আজ এসব কিছুই দেখছিল না। পার্থও কোনো কথা বলছে না। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ঘটনার আকস্মিকতায় সে হকচকিয়ে গেছে।

‘তুমি এরকম হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে আসবে আমি বুঝতে পারিনি।’

‘মানে!’ তিথি পার্থর কাঁধে মাথা রেখেই বসে ছিল, একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে গেল।

‘মানে, আমার মনে হয় আজ তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আমায় দু-তিনদিন অন্তত সময় দাও ভাববার।’

তিথি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কয়েক মুহূর্ত নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থেকে সে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। চলতে শুরু

করল।

‘তিথি! কোথায় যাচ্ছ?’

তিথি জবাব দিল না। সে আর কাউকে কোনো জবাব দিতে বাধ্য নয়। যার জন্যে সে আজ সব কিছু ছেড়ে যে বাড়ি থেকে এক-কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে, তার জন্যেও আর কি সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব! তার চেয়ে মৃত্যু ভালো। তিথি হনহন করে হাঁটছিল।

পার্থ ছুটতে ছুটতে এসে তাকে ধরল, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘শোনো শোনো তিথি, আমার কথা শোনো, একটু বুঝতে চেষ্টা করো, কাল বাড়িতে একটা বিশ্রী ঝামেলা হয়েছে…আমি… আমি একেবারে প্রস্তুত নই—’

‘পার্থ!’ তিথির গলা বিকৃত হয়ে গেছে কান্নায়। এই নিশুতি দুপুরে বাগানের এদিকটা একদম ফাঁকা, নইলে তিথির চিত্কারে লোক জমে যেত। তিথির অবশ্য সে খেয়াল ছিল না, রাগে দুঃখে তার গলা চিরে যাচ্ছিল, ‘তুমি কোনোদিনই প্রস্তুত ছিলে পার্থ, কখনোই না। তুমি শুধু আমাকে ডেকেছ, ডাকতে ডাকতে পাগল করে দিয়েছ। আজ যখন আমি সত্যি সত্যি সব তোমার কাছে চলে এসেছি, তুমি পিছিয়ে যাচ্ছ—আমার ঘেন্না লাগছে পার্থ!…তোমাকে…আমার নিজের ওপরে ঘেন্না

তিথিই কাঁদতে কাঁদতে কুঁজো হয়ে বসে পড়ল ঘাসের ওপর। পার্থও হাঁটু গেড়ে বসল তার পাশে। নিঃশব্দে তিথির পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সে, ভেবে পাচ্ছিল না কী বলে তিথিকে শান্ত করবে।

তিথির কান্নার বেগ নিজে থেকেই কমে আসছিল। এখনও সে একই ভঙ্গিমায় কুঁজো হয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে, তার পিঠ থেকে থেকে কেঁপে উঠছে আটকে যাওয়া নিশ্বাসে। পার্থ তার চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে করুণ গলায় ডাকল—‘তিথি’!

‘আমার একটা কথা শুনবে?’

তিথি সাড়া দিল না।

পার্থ খুব আস্তে আস্তে বলল, ‘আসলে বাবা সব জেনে গেছে, মেজোকাকুরাই বলে দিয়েছে, কাল বাড়িতে এই নিয়ে খুব অশান্তি হয়েছে…আজই যদি তোমায় নিয়ে যাই——

তিথি মুখ তুলল, তার সমস্ত মুখ কান্নায় মাখামাখি। কিন্তু তার গলার স্বরে কান্না লেগে নেই, সে বলল, ‘উনি তো জানবেনই। তুমি

‘উঁ?’

না ছেড়ে হচ্ছে…..

যখন আমাকে চলে আসতে বলতে, তুমি কি জানতে না যে আমি এলেই উনি সব জেনে যাবেন? নাকি তুমি ভাবছ তখনও ওঁকে মিথ্যে কথা বলতে? বলতে আমি তোমার কেউ নই, এমনি এমনি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি? সেটাই ওর পক্ষে মেনে নিতে সুবিধে হত?’

তিথির পর পর করা প্রশ্নগুলোতে এমন শাণিত জ্বালা ছিল, পার্থ হঠাৎ কোনো উত্তর দিতে পারল না। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘বেশ, ঠিক আছে। বাড়িতে যা হয় ফেস করব। তুমি আমার স্ত্রী, আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবে এতে অত ভাবনার কিছু নেই।’ সে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে তিথির কাঁধ চেপে ধরল, ‘হ্যাঁ তিথি, তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব…সব ঠিক হয়ে যাবে….তুমি চিন্তা কোরো না।’

তিথি চোখ মুছল, চশমার কাচ মুছল, তারপর পার্থর দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসির মধ্যে আনন্দ বেদনা দুশ্চিন্তা স্বপ্ন ভয় মিলেমিশে আছে। হাসিটা দেখে মুহূর্তের জন্য পার্থর হঠাৎ মনে হল, তিথি যেন বড়ো হয়ে গেছে।

তিথি সারাদিন কিছু খায়নি, খাওয়ার কথা মনেও আসেনি একবারও। শুধু ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। পার্থকেও অসম্ভব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। সে ঘাসের ওপর শুয়ে ছিল। অনেকক্ষণ চুপচাপ সময় কাটানোর পর পার্থ উঠে বসে বলল, ‘চলো, ওঠা যাক।’

তিথির বুকের মধ্য ধড়াস করে উঠল। সে ভেবেছিল এখনই তারা পার্থর বাড়িতে যাবে। কিন্তু বাসস্টপে পৌঁছোনোর পর চোখের সামনে দিয়ে একটা বেহালার বাস বেরিয়ে গেল, পার্থ সেটাতে উঠল না।

তিথি অবাক হল, ‘কী হল, বাসটাতে খুব ভিড় ছিল না তো!’

‘না।’

‘তবে উঠলে না যে?”

ঝাঁপতাল

‘আমরা এখন বাড়ি যাচ্ছি না!’

‘কেন? তবে আমরা কোথায় যাচ্ছি!’ তিথি কিছু বুঝতে পারছিল না।

‘আজকের দিনটা খুব ভালো, মঙ্গলবার। কালীঘাটের মন্দির থেকে তোমাকে সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে যাব, আমরা এখন কালীঘাট যাচ্ছি।’

তিথি হাঁ হয়ে গেল, এ ধরনের কোনো সম্ভাবনার কথা তার মাথায় আসেনি। বাসে উঠে কালীঘাটে নামা অবধি পার্থর সঙ্গে কোনো কথা হল না। বাসে খুব ভিড়, কথা বলার সুযোগ ছিল না। মন্দিরের দিকে হাঁটার সময় সে পার্থকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি বুঝি মা কালীর ভক্ত?”

‘ঠিক ভক্ত নই হয়তো, ওঁকে নিজের মায়ের মতোই মনে হয়, তাই তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।’

তিথি আড়চোখে পার্থর দিকে দেখল। পার্থর মুখে তদগত ভাব, তিথির মনে পড়ল ওকে এ কথা সে আগেও বলতে শুনেছে। দেশের বাড়ির পুজোর কথা বলতে গিয়ে পার্থ ওকে বলেছিল মা দুর্গা তার সত্যিকারের মা হয়ে সেখানে ফিরে ফিরে আসেন। গত দু-বছর দেশের পুজোতে তাঁর কাছে যেতে পারেনি বলে পার্থর মনে মনে খুব কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু মা নাকি একদিন তার স্বপ্নে এসে বলেছেন, ‘তুই আমার কাছে যাসনি বলে আমারও কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তুই তিথির কাছে আছিস, আমার কোনো চিন্তা নেই। ওকে কখনো ছাড়িস না।’ সত্যি কথা বলতে কি, তিথির যেসব কথা মাথায় ঢোকে না, বা বিশ্বাস হয় না, সেসব সে বেমালুম ভুলে যায়। এই কথাটাও সে সেইজন্যে ভুলেই গিয়েছিল।

কালীঘাটের মন্দিরে তিথি এই প্রথম এল। সে জানে এটা একটা বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র, বহু মানুষ এখানে পুজো দিতে আসেন। কিন্তু তাদের বাড়িতে সে কাউকে এখানে আসার কথা বলতে শোনেনি। সে মা-বাবার সঙ্গে বেলুড় দক্ষিণেশ্বর গেছে। সেই যাওয়াতে বেড়ানোই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, পুজো দেওয়া নয়। বেলুড়ের মন্দির তো ছবির মতো চোখজুড়ানো সুন্দর। তুলনায় দক্ষিণেশ্বর বেশ অপরিষ্কার। কিন্তু কালীঘাটের মন্দিরে এসে তার চক্ষুস্থির হয়ে গেল।

একটা জায়গায় জুতো খুলে রেখে ওরা এগোনোর চেষ্টা করছিল। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, মন্দিরে জনসমুদ্র। তার ওপর আজ মঙ্গলবার। সারা প্রাঙ্গণ জলে কাদায় থকথক করছে। মন্দিরের সামনে থেকেই ভিখিরিরা ছেঁকে ধরেছে মাছির মতো, তিথি চোখে অন্ধকার দেখছে।

অবিশ্রান্ত চেঁচামেচি আর কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ। আওয়াজটার মধ্যে কোনো ভক্তির মাধুর্য নেই, উদ্দামতা আছে। তিথি ক্রমশ সিটিয়ে যাচ্ছিল। পার্থ তাকে হাত ধরে না হেঁচড়ালে সে বোধ হয় একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই ভিড়ের ধাক্কা খেতে খেতে দম আটকে মরে যেত। ভিড়ের মধ্যে একটা লোক তার বুকে হাত দিতেই সে আরও কাঠ হয়ে গেল।

ভিখিরিরা তার জামা ধরে টানছে। ওরা ছাড়াও আর একদল লোক তিথিদের ঘিরে ধরল। তাদের প্রত্যেকের কপালে বড়ো বড়ো সিঁদুরের তিলক, প্রত্যেকের হাতে একটা করে ছোটো ঝুড়ি, ঝুড়িতে লাল জবাফুল, আরও কী কী সব। ওইগুলো নিশ্চয়ই পুজোর উপকরণ, লোকগুলো নিশ্চয়ই ওদের পুজো দিতে বলছে, পুজোর জিনিস বিক্রি করতে চাইছে। কিন্তু ওদের হাবভাব কীরকম ডাকাত ডাকাত, তিথির ভয় করছিল।

পার্থ ওদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কী কথা বলল, তার হাতে কিছু গুঁজেও দিল। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের হটিয়ে দিল। তারপর খপ্ করে একহাতে পার্থর অন্যহাতে তিথির কবজি ধরে টানতে টানতে এগিয়ে চলল ভিড় ভেদ করে। লোকটার গায়ে অসম্ভব জোর, তার কাঁধের ধাক্কায় জমাট ভিড় ফেটে পথ হয়ে যাচ্ছিল। তিথি ঠিকঠাক পা ফেলতে পারছিল না, পায়ে পায়ে

জড়িয়ে হুমড়ি খেতে খেতে এগোচ্ছিল কিন্তু পড়েও যাচ্ছিল না। এত ভিড়ের মধ্যে পড়ে যাওয়া সম্ভব নয়, পড়ার জায়গাই নেই। তিথি ঘুমন্ত মানুষের মতো চলছিল।

লোকটা ওদের একটা ম্লান কমলা বালব জ্বলা প্রায়ান্ধকার ঘুপচি ঘরে এনে দাঁড় করাল। ঘরের মাঝখানে একটা কালো শিবলিঙ্গ, তার মাথায় আর চারপাশে স্তূপীকৃত ফুল বেলপাতা। শিবলিঙ্গের পাশে ময়লা ধুতি পরা অসম্ভব রুগ্ন একটা লোক বসে বসে বিড়ি টানছে। এই নিশ্চয়ই শিবের পূজারি। ঘরের সমস্ত মেঝে ভিজে চটচটে। এটা যে মূল মন্দির নয় সেটা তিথি বুঝতে পারছিল, এখানে কালীঠাকুরের মূর্তি নেই। যে লোকটা ওদের এখানে নিয়ে এসেছে সে বলল, ‘মায়ের ঘরে ঢোকা যাবে না, ওখানে আজ বেজায় ক্যাঁচাল। এখানেই সেরে নিন। দাঁড়ান আসছি।’

লোকটা চলে গিয়ে একটু পরেই আবার ফিরে এল। তার হাতে একটা জবাফুলের মালা, আর শুকনো শালপাতায় লাগানো একতাল চটচটে সিঁদুর। সেগুলো শিবলিঙ্গের পাশে বসে থাকা লোকটাকে দিয়ে বলল, ‘দাও দেখি, চটপট সেরে দাও।’

পূজারি লোকটা বিড়িতে দুটো টান দিয়ে ফেলে দিল। তারপর উঠে ওগুলো নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ল, তিথি আর পার্থর মাথায় ফুলজল ছেটাল। তিথি জড়বুদ্ধি শিশুর মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। পার্থর দিকে চোখ ফেলে দেখল পার্থ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছ। তার চোখ বন্ধ ঠোঁট নড়ছে অল্প অল্প।

তিথির মারাত্মক ভয় করে উঠল। এ তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে পার্থ! এসব কী ঘটনা ঘটছে তার চারপাশে? তিথির মনে হল সে এক দৌড়ে এখান থেকে পালায়। কিন্তু তার আগেই পূজারি লোকটা জবাফুলের মালাটা পার্থর হাতে দিল। পার্থ সেটা তিথির গলায় পরিয়ে দিল। তারপর সিঁদুরের পাতাটা থেকে আঙুলে চটচটে সিঁদুর নিয়ে তিথির কপালে আর সিঁথিতে মাখিয়ে দিল। তার ঠোঁট তখনও বিড়বিড় করে নড়ছে। পুরোহিতও একটানা মন্ত্র বলে চলেছে। প্রবল কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ আর উদ্দাম জয়ধ্বনি এসে আছড়ে পড়ছিল মুহুর্মুহু। তিথির মনে হল যেন বলির বাজনা বাজছে। তার মাথা ঘুরে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *