ঝাঁপতাল – দ্বিতীয় অধ্যায়

দ্বিতীয় অধ্যায়

অথই ঘুমে তলিয়েই গিয়েছিল তিথি। ভুস্ করে আবার ভেসে উঠল যখন, রেডিয়োতে রূপং দেহি জয়ং দেহি গানটা হচ্ছে। সমবেত সুরের প্রদীপ থেকে পবিত্র শিখার মতো উপরদিকে কেঁপে কেঁপে উঠছে পঙ্কজ মল্লিকের গলা, মধুর, গম্ভীর, বিষণ্ন। বাইরে ভোর হয়ে এসেছে। কাক ডাকছে জানলার কার্নিশে। ঘরের ভেতরে ভোরের নরম আভা, তিথি নিজের হাত পা বেশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে। হু-হু করে উঠল তার বুক, কত গান শোনা হল না, মহালয়া শেষ হয়ে গেল। এ কোথায় চলে গিয়েছিল সে, কোন জন্মে? কত দূরে? সে কি তার জীবনেরই কোনো অংশ, নাকি অন্য কারও। নিজের ডান হাতটা তুলে চোখের কাছে নিয়ে এল তিথি—সেই মেয়েটি আর এই মেয়েটি এরা দুজন কি সত্যিই এক?

জীবনের বত্রিশটি মহালয়া পার হয়ে এসে আজ আবার তার স্মৃতি ছুটছে অন্য এক মহালয়ার দিকে। অন্য এক মহালয়ার ভোর, সেখান থেকে ট্রেন ছাড়ছে কাটোয়া-আজিমগঞ্জ লাইনে। ঝক্ ঝক্ করছে কয়লার ইঞ্জিন। পুরোপুরি লুপ্ত হওয়ার আগে এই লাইনেই তখনও শেষ কয়েকটা কয়লার ইঞ্জিন রয়ে গেছে।

তিথির চোখের সামনে দিয়ে আবার ছুটতে শুরু করল ছবি, দ্রুত পরিবর্তনশীল ফ্রেম, একটার পর একটা। তার সিট জানলার পাশে, চোখে উড়ে এসে পড়ছে কয়লার গুঁড়ো…তিথি তবু জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে…

তিথির পরনে একটা লাল সুতির শাড়ি, আগাগোড়া লাল, কেবল পাড়ে একটা সরু সবুজ রেখা। এটা বলতে গেলে তার বিয়ের শাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে আসার দু-তিন দিন পরে পাড়ার তিন-চারজন প্রতিবেশিনীকে ডেকে তার যে সামাজিক সিঁদুর পরার অনুষ্ঠান হয়েছিল, তাতে দোতলার ভাড়াটে রুম্পার মা তিথিকে এই শাড়িটা দিয়েছিলেন পরবার জন্যে। লাল ব্লাউজ কিনে এনেছিল পার্থ, তিথির টাইট হয়েছিল সেটা। শাড়ির নীচে যে কালো শায়া পরেছিল সে, সেটা সীমার। ওইদিনের পর শাড়িটা আর পরেনি তিথি, পাট করে রেখে দিয়েছিল তক্তপোশের গদির তলে। আজই আবার পরেছে।

মহালয়া শুনতে শুনতেই শাড়িটা জড়াচ্ছিল তিথি, সাদা শায়ার ওপরে। এই শায়াটা তার, পার্থ কিনে এনেছে। সীমাও তৈরি হচ্ছিল, তিথির দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বলল, ‘এই শাড়িটা পরছ? খুব ভালো, তলায় সাদা শায়া পরলে কেন, আমার কালোটা নাও না?’

‘থাক বড়দি, ওটা তুমি নিয়ে যাচ্ছ না?’ তিথির আর বদলানোর ইচ্ছে ছিল না। অলক খুব জোরে রেডিয়ো খুলে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দুলছেন। তিথিরও মনপ্রাণ মহালয়ার দিকে। কিন্তু সীমা বলেছিল, ‘না না, কেমন দেখতে লাগছে, সাদ ফুটে বেরোচ্ছে। আমি কালোটা বার করে দিই, তুমি পরো। তুমি পরলেও তো নিয়ে যাওয়াই হবে।’

সীমা আবার ব্যাগ খুলে শায়া বার করে দিল, তিথি বদলাল, আবার শাড়ি পরল। এসব করতে করতে এত দেরি হয়ে গেল যে তিথি ভালো করে মাথা আঁচড়াবার সময়ই পায়নি। গত রাত্রের বাসি বিনুনিটাই রয়েছে, শুধু সামনের এলোমেলো জট চুলগুলোকে কোনোরকমে চিরুনি বুলিয়ে ভদ্রস্থ করেছে সে। চিরুনি চুঁইয়ে সিঁদুর টানতে টানতেই শুনল পার্থ রেডিয়ো বন্ধ করে দিয়ে তাড়া লাগাচ্ছে, ‘চলো চলো বেরোও সব, আমি রুম্পাদের ঘরে চাবি দিয়ে আসছি।’

বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনে আসতে আসতেই তিথির শরীরে মনে আনন্দ উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। ট্রেনে ওঠার পর যখন ট্রেন ছেড়ে দিল, তার মনে হল গত চার-পাঁচ মাসের জটিল ম্রিয়মাণ জীবনযাপনে আজকের দিনটিই সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে মুক্তির। জানলার পাশে বসে জানলার হিমঠান্ডা শিকে গাল চেপে আছে সে, খুব ভালো লাগছে এই স্পর্শটুকু। শহরের আওতা ছাড়িয়ে ট্রেন যখন মাঠেঘাটে নামল, রোদ উঠে গেছে।

সীমা তার উলটোদিকের জানলায় বসে আছে। তারও চোখ বাইরের দিকে। তার পাশে সুধা। সুধার পাশে অলক, এক হাটু ভাঁজ করে সিটের ওপর পা তুলে দিয়েছেন। চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছিলেন, হঠাৎ পার্থর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘এত তাড়াহুড়ো করলি, স্টেশনে চা-টাও খাওয়া হল না।’

পার্থ তিথির পাশে বসে কাগজ পড়ছে, স্টেশনে কেনা ইংরেজি দৈনিক। অলকের কথার জবাব দিল না। সুধা বললেন, ‘বাড়ি থেকে তো বেরোলে চা খেয়ে, আবার কী? ঘুম পাচ্ছে তো ঘুমোও না, কে বারণ করেছে!’

তিথি উত্তেজিত হয়ে পার্থর ঊরু আঁকড়ে ধরল, ‘ওই দ্যাখো, দ্যাখো কাশফুল, বড়দি, বড়োমা…দ্যাখো কাশফুল…ওই যে!’ সীমা উত্সুক হয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখছিল, তিথি উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, ‘দেখতে পেলে? কী সুন্দর বলো? এক্কেবারে ছবি…’

সুধা তিথির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর সুরে বললেন, ‘চিরুনি বের করে চুলটা একবার আঁচড়াও তিথি, বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে।’ দেশের বাড়ির দু-তিনটে স্টেশন আগে সীমা হঠাৎ বলল, ‘কী হবে মা? আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।’

সুধারও মুখ শুকাচ্ছিল। তিনি নিরুত্তর রইলেন। চিন্তা হওয়ারই কথা। একে এ বছর তাঁদের পুজোর পালা। দুর্গাপুজো মানে তলকূলহীন খাটুনির কাজ। যদিও দায়িত্ব প্রতি দু-বছর অন্তরই পড়ে। প্রতিবার পালার বছরে এই মহালয়ার দিনটাতেই তাঁরা রওনা দেন। এর আগে যা টুকটাক কাজ থাকে সেসব তাঁর শ্বশুরই কিছুটা এগিয়ে রাখেন। কিন্তু একবার গিয়ে পড়ার পর পার্থর ওপর যেমন পুজোর বাজার থেকে যাবতীয় কাজের ভার পড়ে, তেমনই পুজোর গোছানোর দিকটা তাঁকে একা হাতেই সামলাতে হয়। সীমা সাধ্যমতো সাহায্য করে। এবার আবার সীমার মাসিকের তারিখ এগিয়ে আসছে। কিন্তু এ সমস্ত দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে উঠছিল অন্য একটা উদ্বেগ, সীমাও সেই ভয়ের কথাই বলছিল।

পার্থর বিয়ের ব্যাপারটা দেশের বাড়িতে সেভাবে কেউ জানে না। মানে, তাঁরাই কাউকে জানাননি। অরূপরা জেনে যাওয়ার পর অন্যান্য ভাইরা সবাই জেনে গেছে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই কথাটা দেশের বাড়িতে পৌঁছিয়েছে নিশ্চয়ই। তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সুধা ভাবার চেষ্টা করছিলেন। বেহালার বাড়িতে তিথিকে একরকম লুকিয়েই রাখা হয়েছিল। শাস্ত্রমতে বিয়ে হয়নি যার, লোকের কাছে তাকে বউ বলে পরিচয় দিতেই লজ্জা লাগে। পাড়ার লোকেদের জানতে যদিও বাকি ছিল না, আত্মীয়স্বজন এলে সুধা তিথিকে দোতলায় রুম্পাদের ঘরে পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল লোকজন ডেকে—যাঁদের না বললেই নয়, তাদের নেমন্তন্ন করে ব্যাপারটা সামাল দিতে। নেমন্তন্ন না করে তিনি কাকে বলবেন ছেলের বিয়ের কথাটা? অলক রাজি হলেন না, লোক খাওয়ানোর অবস্থা তাঁর নেই। এই করেই পুরো ব্যাপারটা আটকে রইল। তিথি আসার দিন কয়েকের মাথায় একটা দুপুরবেলায় সুধা অবশ্য পাড়ার কয়েক জন বউ-ঝিকে আসতে বলেছিলেন। তাদের সামনে লোহাসিঁদুর দিয়ে ওকে চলনসই ভাবে বরণও করে নিয়েছেন, যাতে পাড়ায় অন্তত হাসাহাসিটা না হয়। গত কয়েক মাস বাড়িতে তিথি সবার সঙ্গে মিলেমিশেই আছে, সিঁদুর শাঁখা-পলা সবই পরে। কিন্তু তাই বলে পুজোয় দেশের বাড়িতে, বাড়ি ভরতি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে—’না না, সে এক কেলেংকারি, ও…ওকে ওখানে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই!’ সুধা বলেছিলেন।

‘ওকে তবে কোথায় রেখে যাবে মা, ওর তো কোনো যাওয়ার জায়গা নেই!’ পার্থ হতাশ গলায় বলেছিল।

সুধা আকাশপাতাল ভাবছিলেন। তিথি দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, এক একবার চোখ তুলছে, আবার নামিয়ে নিচ্ছে। খুব ভয় পেয়ে গেছে সে, সেই সঙ্গে অভিমানও ফেঁপে উঠছে তার বুকে। বিনা দোষে অপরাধীর মতো চুপচাপ অপেক্ষা করছে জুরিবোর্ডের রায় শোনার জন্যে।

অলক মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন। ছেলের জন্যে জীবনে শান্তি নেই তাঁর, কিন্তু সেসব দুঃখ করার এটা সময় নয়। মেয়েটিকে তাঁর মনে মনে ভালো লেগেছে, সত্যি কথা বলতে কী, মেয়েটির মুখ চেয়েই তিনি পার্থকে বার করে দিতে পারেননি। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অলক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তাই তো, তিথি কোথায় থাকবে? তার চেয়ে ও আমাদের সঙ্গেই চলুক, এই পুজোতেই সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এখন। বোলো যে বিয়ে হয়ে গেছে—আর কী!’ অলক রাগের চোখে পার্থর দিকে তাকালেন, ‘মেয়েটা একটা ভুল করেছে ঠিকই, তবু আমরা থাকতে ওকে জলে ফেলে দিতে তো পারি না।’

তিথি তাই চলেছে পার্থর সঙ্গে, তার শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সঙ্গে, তার আরও বৃহত্তর আদি শ্বশুরভিটায়। তার বুক গুরগুর করছে। সুধা আর সীমা থেকে থেকে আশঙ্কিত দৃষ্টি ফেলছেন তার দিকে, তাঁদের উত্কণ্ঠাও বুঝতে পারছে তিথি। অলকের মুখ দেখা যাচ্ছে না, তিনি মুখ ফিরিয়ে ওপাশের একজন যাত্রীর সঙ্গে গল্প জুড়েছেন অনেকক্ষণ থেকে। আর পার্থ ঘুমোচ্ছে। তিথি দেখল, পার্থর মাথাটা পিছনদিকে হেলে গিয়ে মুখটা হাঁ হয়ে আছে।

যে স্টেশনে তিথিদের নামতে হল, সেটা আসলে একটা বহু পুরোনো শহর। শহরের একটু দূরেই অজয় আর গঙ্গার সঙ্গম। স্টেশনে নেমে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে একবার ট্রেনটার দিকে ফিরে তাকাল তিথি। কোনো কারণে নয়, এমনিই। ধক ধক করে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে ট্রেনটা। একরাশ উদ্বেগ আর অস্বস্তিতে ডুবে থাকতে থাকতেও তিথির একটা অদ্ভুত কথা মনে হল সেই চলে যাওয়া ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে। মনে হল, আহা রে, ট্রেনটা আরও কতদূর যাবে, সেই আজিমগঞ্জ—কী সুন্দর নামটা! ওই জায়গাটা কোথায়? ইশ্, তিথি যদি সেখানে যেতে পারত তো বেশ হত।

ব্যাগপত্র রিকশায় তুলে পার্থ আর তিথি একটা রিকশায় উঠল। আর একটায় সুধা আর সীমা। অলককে ধারকাছে দেখতে পাওয়া গেল না, তা নিয়ে তিথি অবশ্য কাউকে বিশেষ চিন্তা করতেও দেখল না। দেশে পা দেওয়ামাত্রই অলক নাকি এরকম করতে শুরু করেন। তাঁকে ধরে রাখা যায় না। পার্থ যখন রিকশায় মালপত্র তুলছে, তার আগেই অলক একা একটা রিকশায় চেপে গলা খুলে গল্প করতে করতে বাড়ির দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছেন। এই শহরের রিকশাওয়ালারাও সবাই তাঁর বন্ধু।

রিকশায় যেতে যেতে তিথি কৌতূহলের সঙ্গে চারদিকে দেখছিল। পার্থ চাপা গলায় বলল, ‘তিথি, মাথায় ঘোমটা দাও।’

এই শহরে সবচেয়ে বড়ো আর উঁচু বাড়িগুলো সবই এককালে মল্লিকদের ছিল। মল্লিকরা জাতিতে গন্ধবণিক, কিন্তু বেশ কয়েক পুরুষ ধরে তাঁদের পেশা ছিল লোহালক্কড়-বালি-সিমেন্ট-সুরকির কারবারের। সারা শহর জুড়ে অনেক দোকানও ছড়ানো ছিল তাঁদের। সেইসব বাড়ি আর দোকানের বেশিটাই এখন হাতছাড়া। মল্লিকদের অবস্থা এখন পড়ন্তবেলাও পেরিয়ে এসেছে।

তবু সব গিয়েও আঘোর মল্লিকের এখনও যা আছে তাতে তাঁর ভালোই চলে যায়। শহরের মাঝখানে দোতলা বড়ো বাড়ি, শহরের একপাশে একটা হার্ডওয়্যারের দোকান, আর কিছু জমানো টাকা। দোকানটা এখন আর খুব চালু নয়, কিন্তু ওই দোকানের আয়েই তাঁদের তিনটি প্রাণীর ভরণপোষণ চলে। তিনজন বলতে তিনি, স্ত্রী শিবানী আর ছোটো ছেলে অসীম। সাত ছেলের মধ্যে ওই একজনই তাঁদের কাছে আছে। আছে নিতান্ত নিরুপায় বলেই। অসীমের মাথাটা একটু খারাপ। ছোটোবেলা থেকেই ওইরকম। তাঁদের বেশি বয়সের সন্তান বলেই হয়তো, তার বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশটা একটু গোলমেলে। অসীম ঠিকঠাক হলে দোকানটা হয়তো সেই দেখতে পারত। দোকান চালানোর জন্যে অঘোরকে লোক রাখতে হয়েছে, এই বৃদ্ধ বয়েসে লাঠি ঠুক ঠুক করে তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে গিয়ে বসেন। অসীমকে দিয়ে সংসারের কোনো সাশ্রয় হয় না, কিন্তু অঘোর জানেন, সে যদি তেমন করিতকর্মা হত, তাহলে সেও এতদিনে বিয়ে করে সরে পড়ত। হোক পাগল-ছাগল, তবু তো একটা ছেলে আছে কাছে। বাকিরা তো নিজেদের সংসার নিয়ে যে যার আলাদা। দূরে দূরে। মেজোছেলের সঙ্গে অঘোর কোনো সম্পর্ক রাখেননি, শিবানী তাই নিয়ে কান্নাকাটি করেন। অঘোর স্ত্রীকে বলেন, ‘মেজো খোকা এখানে আসতে পারে না বলে কাঁদো, আসতে পারলেই বা কী হত? আর পাঁচজন ক-দিন আসে বুড়ো বাপ মাকে দেখতে। শুধু পুজোর সময় বই তো নয়!

অঘোর জানেন, আরও একসময় সবাই আসবে তাঁর কাছে, ছুটতে ছুটতে উঠতে-পড়তে এসে জুটবে, যখন খবর যাবে তিনি মৃত্যুশয্যায়। অঘোর মনে মনে ভাবেন, মৃত্যুর আগে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে যাবেন তিনি। দোকানটা অসীমকে লিখে দেবেন।

ওই দোকান থেকেই মায়ে-পোয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পারবে। আর কাউকে তাঁর কিছু দেওয়ার ইচ্ছে নেই।

মল্লিকদেরই বিভিন্ন শরিক ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রাচীন শহরের সর্বত্র। এই শরিকদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ তেমন নেই, শুধু পুজোর সময়ই সবাই পুজোবাড়িতে একত্র হন। এই পুজোবাড়িটা অঘোর মল্লিকের মেজো ভাইয়ের ভাগে, তাঁর বসতবাড়ির লাগোয়া। মেজোভাই নেই, বহুদিন আগেই মারা গিয়েছেন। তাঁর স্ত্রীই পুজোবাড়িতে কাঠামোর সামনে নিয়মিত সন্ধ্যে জ্বেলে আসছেন বছরভর।

মল্লিকদের রমরমা তলানিতে ঠেকলেও পুজো বন্ধ হয়নি, যদিও তার জাঁকজমক আর নেই। তা সত্ত্বেও, এখনও এই শহরের প্রধান পুজোই মল্লিকদের পুজো। পুজোর চারটে দিন পুজোদালানে ভিড় উপচে পড়ে। কয়েক বছর আগেও সবাইকে খিচুড়ি প্রসাদ দেওয়া হত, এখন সেসব বন্ধ হয়ে গেছে। ফলের কুচিই দেওয়া হয়। তবু শুধু পুজো দেখতে, এ বাড়ির মা দুর্গাকে প্রণাম করতেই লোকে আসে। তার একটা কারণ, এখনও এখানে বারোয়ারি পুজো বলতে গেলে নেইই। যা হয় তার বেশিরভাগই বাড়ির পুজো। একটা অলিখিত নিয়ম এখনও চালু আছে, ভাসানের দিন মল্লিকবাড়ির ভাসান হয় সবার আগে। এমনকী, এঁদের ভাসান হয়ে গেছে এই খবর পেলে তবে অন্যান্য ঠাকুর বেদি থেকে নামানো হয়। এসবই মল্লিকদের স্বর্ণযুগের ধুলোগুঁড়ো।

শিবানী থপথপ করে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। উত্তেজনা হলে তিনি এমন করেন। তিনি মোটা নন, কিন্তু মোটা মানুষের মতোই থপথপ করে হাঁটেন, একটু পা ঘষে ঘষে। বয়স হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর চলাফেরায় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু তিনি কিছুতেই লাঠি ব্যবহার করবেন না। তার ওপর শাড়ি পরেন আলুথালুভাবে, লম্বা আঁচল লুটিয়ে থাকে মেঝেতে। তিনি চললেন আর তাঁর পেছন পেছন তাঁর আঁচলও চলল ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে উঠোন, উঠোন থেকে রান্নাঘর। পায়ের কাছে শাড়ির ঝুলও মাটিতে লুটোয়। পায়ে বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়েনও মাঝেমধ্যে। বেশি চোট লাগলে পড়ে পড়েই কুঁইকুঁই সুর তোলেন মুখে, অসীম এসে গালাগাল করতে করতে তাঁকে ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। অল্পের ওপর দিয়ে গেলে তিনি নিজেই উঠে

আবার থপথপ করে দ্রুতবেগে চলতে থাকেন।

আজ তাঁর উত্তেজনার কারণ, তাঁর বড়ো ছেলে আসছে। সকালের ট্রেনেই আসার কথা, এখন ন-টা বাজে। এর মধ্যেই কি পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল না? শিবানী অসীমকে খুঁজছিলেন তাকে কথাটা জিজ্ঞেস করবেন বলে। স্বামীর সঙ্গে তিনি খুব একটা বাক্যালাপ করেন না।

অসীম বারান্দার কোণে উবু হয়ে বসে তেল মাখছিল। তার গা খালি, সে একটা নোংরা পাজামা পরে আছে। ওই একটাই পাজামা বোধ হয় সে তিন মাস ধরে পরে। তার সামনে একটা সরষের তেলের বাটি। বাটিতে ডান হাতের ঠিক দুটি আঙুল ডুবিয়ে সে সারা গায়ে ফোঁটা কাটছে আর ঘষছে। অত্যন্ত ধীরগতিতে। এটা একটা অতিদীর্ঘ প্রক্রিয়া। রোজ স্নানের আগে সে প্রায় অনন্তকাল ধরে গায়ে মাথায় তেল মাখে।

শিবানী তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ´ও অসীম! তোর বড়দারা যে এখনও এল না!’

অসীম শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না। সে নিমগ্ন হয়ে তেল মাখছিল।

শিবানী পা ঘষতে ঘষতে তার কাছে এসে দাঁড়ালেন। যথারীতি তাঁর আঁচল লুটোচ্ছে। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘ও অসীম, ন-টা যে

বাজল!’

অসীম মায়ের দিকে তাকাল, তাঁর লম্বা আঁচলের দিকে তাকাল, তারপর দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘ওই জন্যেই সকাল থেকে ঘরবাড়ি ঝাঁট দিয়ে বেড়াতে হবে? বলি শাড়িটাও ঠিক করে পরতে পারো না নাকি!’

শিবানী আহত হলেন না। অসীম তাঁর সঙ্গে এইরকমই ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও, অসীমই শিবানীর একমাত্র আশ্রয়, তাঁর বুকের কাছে আগলে রাখা ধন। তিনি আবার বললেন, ‘বড়ো খোকাদের দেরি হচ্ছে কেন বল তো!’

অসীম কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে তিনি আবার পা ঘষে ঘষে রান্নাঘরের দিকে চললেন। অসীম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নাকের মধ্যে একটা আওয়াজ করল। বিড়বিড় করে বলল, ‘ইঃ, ন-টার মধ্যেই ছটফটানি দ্যাখো না, কলকাতা যেন বাড়ির পাশে।’

অলক বাড়ি পৌঁছোলেন এগারোটা নাগাদ। অসীম তখনও তেল মাখছিল। রিকশা থেকে নেমেই অলক হাঁকডাক শুরু করলেন। রিকশাওয়ালাকে বললেন, ‘দাঁড়া বাবা, পেছনের রিকশাগুলো এলেই একসঙ্গে ভাড়া পাবি।’

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই চিৎকারকরতে লাগলেন অলক, ´ও মা, ও বাবা…কেমন আছ সব—কোথায় গেলে গো—’

শিবানী থপথপ করেই ছুটে আসছিলেন, ‘অ্যাতো দেরি করলি হ্যাঁ বাবা অলক, আমি সেই কখন থেকে পথ চেয়ে রয়েছি!—বড়ো বউমা কই? পার্থ সীমা ওরা?’

‘আসছে, সব আসছে। আমি চলে এলাম তাড়াতাড়ি, বলি যাই আমি আগে আগে। কতদিন তোমাকে দেখিনি—’ অলক গদগদ স্বরে কথাগুলো বলতে বলতেই ঢিপ করে মাকে প্রণাম করলেন। শিবানী আহ্লাদে চোখের জল ফেলছিলেন। আঘোরও ততক্ষণে লাঠি ঠুক ঠুক করে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঝের উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রণাম নিতে নিতে বললেন, ‘এলে? সব কুশল তো?”

অলক মাথা নাড়লেন, ‘তোমার শরীর কেমন?’

‘আর আমার শরীর! খোঁজখবর তো রাখে না কেউ, কোমরটা ভোগাচ্ছেই, তা ছাড়া আজকাল প্রায়ই জ্বর হয়।’

এটা অঘোরের একটা বাতিক, তাঁর এই জ্বর আসাটা। আজ বলে নয়, অনেক দিন আগে থাকতেই তাঁর কেবলই মনে হয় জ্বর আসছে। সত্যিকারের জ্বর নয়, এই জ্বর তাঁর মনের ব্যাপার। তিনি থার্মোমিটার বগলে চেপে পাঁচ মিনিট বসে থাকেন, যেন বেশিক্ষণ থার্মোমিটারটাকে শরীরের সঙ্গে ঠেসে রাখতে পারলেই তাতে বেশি তাপমাত্রার পাঠ উঠবে। কিন্তু পারার সুতোটা পারতপক্ষে সাড়ে সাতানব্বই ছাড়ায় না। অঘোর তখন থার্মোমিটারটাকে আরও দশ মিনিট বগলে নিয়ে বসে থাকেন। তাই বলে জ্বর যে সত্যি সত্যি তাঁর কখনো হয়নি তা নয়, কিন্তু কেউ আর ব্যাপারটাকে তেমন আমল দেয় না। অলকও দিলেন না। অসীম তেল মাখা বন্ধ করে এদিকে তাকিয়ে ছিল, এখনও সে একই জায়গায় একইভাবে উবু হয়ে বসে আছে। অলক তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী রে, তোর কী খবর? 1

অসীম সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে অলককে দেখছিল। এটা নতুন কিছু নয়। বছরে একবার ছাড়া দাদাদের কিংবা তাদের পরিবারের সঙ্গে তার বলতে গেলে দেখাই হয় না। এ বাড়িতে আসেও না কেউ। সে একাই পড়ে থাকে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সঙ্গে। এতে অবশ্য তার অভ্যাসই হয়ে গেছে। কিন্তু পুজোর সময় যখন সবাই একে একে আসতে থাকে, অসীম অত্যন্ত বিরক্ত ও বিব্রত বোধ করে, যেন তার নিশ্চিন্ত নিরিবিলি জীবনের মধ্যে কারা না বলেকয়ে অনুপ্রবেশ করছে। অনেককে অনেক সময় সে প্রথমটায় চিনতেও পারে না। এসব সময়ে তার পাগলামির লক্ষণগুলো বাড়ে। দু-একদিন পরে সে ক্রমশ একটু একটু করে মানিয়ে নেয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত ঈর্ষাকাতর হয়ে থাকে। তার মা বাবা, এই বাড়ি, এইটুকু ঘিরে তার যে একান্ত নিজস্ব জগতটুকু, সেখানে কারা যেন এসে অন্যায় উপদ্রব শুরু করেছে বলে মনে হয় তার। প্রবাসী দাদারা, যাদের সবারই নিজস্ব সংসার আছে, এবং প্রায় সবাইই প্রতিষ্ঠিত, তাদের প্রতি মায়ের আকুলতা দেখে তার মনে হয় আদিখ্যেতা। তাই দাদারা যখন এখানে এসে থাকে, মায়ের সঙ্গে আরও খারাপ ব্যবহার করে অসীম। তার অন্যায় অত্যাচার দেখে দাদারাও তাকে ধমকধামক দেয়, মাঝে মাঝে মারধরও খায় সে। তখন আবার শিবানীই তাকে আগলান। মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরে ফুঁসতে থাকে অসীম, বিড়বিড় করে, ‘হুঁ, এখন সব কত পিরিত, পিরিত তো উথলে ওঠে, সারাবছর মা-বাপ মরল কি বাঁচল কেউ তো দেখতেও আসে না, সব শালা সুখের পায়রা।’

অসীমের দৃষ্টিটা ক্রমশ সন্দেহ থেকে ঘৃণার দিকে এগোচ্ছিল, অলক সেটা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে বললেন, ‘তুই কি এখন চান করতে ঢুকবি নাকি, তাহলে তো সব্বোনাশ। খবরদার, বড়ো বাথরুমে তুই ঢুকবি না বলে দিচ্ছি। ওটাতে আমি চান করব।’

অসীম জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, এটা তার প্রতিবাদ। রাগে তার মুখ লাল হয়ে গেছে, হড়বড় করে বলল, ‘ইঃ, বললেই হল। ওটায় আমি যাব।’ রেগে গেলে কথা বলার সময় তার মুখ দিয়ে থুতু ছিটকায়।

অলক তার দিকে চোখ পাকাতেই শিবানী পড়িমরি করে অসীমের কাছে সরে এলেন। মিনতির গলায় বললেন, ‘ও অসীম, বড়োদাদার সঙ্গে অমন করে নাকি, লক্ষ্মীসোনা আমার, ছিঃ বাবা, ও অসীম!’

অঘোর আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন। বাড়িতে শিবানী আর অসীম নিত্যি হুটোপাটি লাগিয়ে রাখেন, পুজোর সময় লোকজন এলে এটা আরও বাড়ে। তাঁর এখানে কিছু করার নেই। অলকরা এসে গেছে, তিনি নিশ্চিন্ত। অঘোর আরামকেদারায় বসে থার্মোমিটার বগলে চেপে ঘড়ি দেখতে লাগলেন।

অলক শার্টটা খুলতে খুলতে বললেন, ‘মা তুমিই অসীমকে আদর দিয়ে দিয়ে এরকম বেয়াড়া করে তুলেছ। দু-একটা চড়চাপড় না খেলে ওর

এই অবধি বলেই তিনি স্থির হয়ে গেলেন। বাড়ি আসার আনন্দে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই তাঁর একেবারে খেয়াল ছিল না। এখন দেখলেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠে একে একে উঠোনে এসে দাঁড়াল ব্যাগ-ট্যাগ সমেত পার্থ, সীমা, সুধা,… আর ওদের সবার পেছনে, ঘোমটা দিয়ে, মাথা নীচু করে, জড়সড় তিথি।

অলকের শার্ট খোলা সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন শিবানী এগিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর

বিস্মিত চোখ তিথিরই দিকে। অসীম উঠে দাঁড়িয়েছিল, তার পাজামার পা দুটো ঊরু পর্যন্ত তোলা। একটা আটকে থাকল, আরেকটা নেমে এল পায়ের গোছ অবধি। নাকের মধ্যে ঘড়ঘড় আওয়াজ করে অসীম বলল, ‘হুঃ, এই মেয়েছেলেটা আবার কে!’

তিথির এ বছর পার্ট ওয়ানটা আর দেওয়া হয়নি। কিন্তু তার পরীক্ষা আর ফুরোচ্ছিল না। স্কুল কলেজের পরীক্ষা একটা না দিলে, বা পাশ না করলে সেইটাই আবার দিতে হয়। জীবনের পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হচ্ছে কি না বুঝতে না পেরেও তিথি দেখছিল, তাকে পর পর পরীক্ষা দিয়ে যেতে হচ্ছে, যেগুলো ক্রমশ কঠিনতর।

যেদিন তিথি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল, কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে বোধ হয় একটু অসুস্থই হয়ে পড়েছিল সে। পার্থর কাছে সেদিন টাকা ছিল। মন্দির থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিল সে। তিথি তখন প্রায় টলছে।

জবাফুলের মালাটা মন্দির থেকে বেরোনোর সময়ই খুলে ফেলেছিল তিথি। ট্যাক্সিতে উঠে কপালের মাখামাখি সিঁদুর ওড়না দিয়ে ঘষে ঘষে মুছছিল। ট্যাক্সির মধ্যের অন্ধকারে পার্থ চোখ সরু করে তিথির সিঁথির দিকে তাকাল, ‘আর না, আর ঘোষো থাক!’

না। ওটুকু

তিথি সত্যিই এমন ক্ষিপ্তভাবে হাত চালাচ্ছিল যেন পুরো সিঁদুরটাই মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেবে সে। পার্থর কথায় তার সংবিৎ ফিরল।

‘খুব শরীর খারাপ লাগছে তিথি?’

তিথি মাথা নেড়ে না বলল, তার মাথা ট্যাক্সির জানলায় হেলে আছে, তার চোখ বাইরে। রাস্তা থেকে রাস্তায় বিপরীতে ধাবমান আলো, কী জ্বলন্ত কী দ্রুত কী অর্থহীন!

‘আসলে সারা দিন খাওনি তো! আমার একবার মনে হয়েছিল, তারপরে ভাবলাম মায়ের মন্দিরে গিয়ে সিঁদুরটা পরিয়ে নিই, তার আগে উপোস থাকলেই ভালো।’ পার্থ জিভ দিয়ে আপশোসের শব্দ করল, ‘ওটাই ভুল হয়ে গেছে।…তিথি? খুব খিদে পেয়েছে, না? বাড়ি গিয়েই কিছু খেয়ে নেব!’

তিথির কানে তেমন কিছু ঢুকছিল না। পার্থও যেন অনেকটা নিজের মনেই বকছে। একবার তিথি শুনল সে বলছে, ‘জানো তিথি, আমি ঠিক এরকমই একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম যে আমায় ভালোবাসবে সে ঘর ছেড়ে, সব কিছু ছেড়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াবে। সঙ্গে একটা সুতোও আনবে না।’

তিথি ঠিক বুঝতে পারছিল না তার মাথার মধ্যে কী হচ্ছে। বুকের মধ্যে, সারা শরীরেই বা কী হতে চাইছে। খুব প্রবল একটা আলোড়নই হতে চাইছে হয়তো, কিন্তু সেই আলোড়ন ধারণ করার মতো কোনো শক্তিই তিথির আর ছিল না। অপরিসীম ক্লান্তিতে প্রায় মূর্ছাহতের মতোই ট্যাক্সির সিটে তলিয়ে ছিল সে।

পার্থ হঠাৎ তিথির কাছে সরে এসে তার হাত ধরে তাকে বুকের কাছে টানতে যেতেই তিথি যেন ইলেকট্রিক শক খেল। তার ভেতরে ভেতরে যে তীব্র ওলটপালটটা হতে চাইছিল কিন্তু ক্লান্তিতে ঠেকে যাচ্ছিল, পার্থর সামান্য স্পর্শে সেইটাই জ্বলে উঠে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘না, ছোঁবে না!’

পার্থ অসম্ভব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব ভয়ও পেয়েছে। তিথি তাকে চেয়েই এইভাবে সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছে না? তার এ কেমন আচরণ!

তিথি কথাটা এভাবে বলে ফেলে যেন আরও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তার ওপর তার শেষ প্রাণরসটুকু নিংড়ে নিংড়ে তার চোখে আবার জল আসছে। প্রথমবার যতটা তীব্রস্বরে বলেছিল, দ্বিতীয়বার ততটাই ক্ষীণ শোনাল তার স্বর, ‘না, আমাকে এখন

ছুঁয়ো না তুমি…আমাকে…অন্তত কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও…পার্থ…আজ আমি আমার মাকে ছেড়ে এসেছি… আমার মা…’ তার নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল। বুকে যেন কথা বলার মতো হাওয়া অবশিষ্ট নেই। ‘আমার মা’ কথাটা বলতে গিয়ে তার বুকে আর গলার কাছে এমন সুতীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল যেন কেউ সেখানে ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে পোঁচ দিচ্ছে।

পার্থ আর কোনো কথা বলেনি।

বাড়িতে সুধা তখন সন্ধ্যে দিচ্ছিলেন। সীমা কলতলায়। বাড়ির কাছে ট্যাক্সি আসে না, বেশ একটু দূরেই ট্যাক্সিটা থামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে পার্থ যখন তিথিকে নিয়ে ঘাসজঙ্গল ডিঙিয়ে সরু পথ বেয়ে বাড়ির দিকে আসছে, তখন চারিদিকে অন্ধকার। পাড়ার লোকেরা তিথিকে দেখতে পায়নি।

পার্থ যখন তিথির হাত ধরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল, তখন সুধা ধূপ হাতে ভেতরের প্যাসেজ দিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছিলেন। সীমাও কলতলা থেকে উঠে এসে দরজার সামনে পাতা ন্যাকড়ার ফালিতে পা মুছছিল। এক মুহূর্তের মধ্যেই দুজনের বুঝতে বাকি রইল না কী ঘটেছে। তিথির সমস্ত কপাল এখনও দগদগে লাল, কিছুটা প্রাণপণ ঘষার চোটে, কিছুটা উঠে যাওয়া সিঁদুরের আভায়। তার চুড়িদারের ওড়নায় চাপচাপ রক্তের মতো তেল-সিঁদুর মাখামাখি। তার ব্যাগটা পার্থর হাতে থলের মতো ঝুলছে।

‘কী সর্বনাশ! সীমা, শিগগির ওপরে গিয়ে রুম্পার মাকে ডাক।’ সুধা চাপা গলায় বলে উঠলেন। সীমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে, সে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ির দিকে দৌড়োল।

পার্থ দ্বিধার স্বরে বলল, ‘রুম্পার মাকে কেন?’

সুধা তিথিকে আপাদমস্তক দেখছিলেন। পার্থর কথা শুনে তার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘তিথিকে এখানে নিয়ে এসেছিস তো?’

‘হ্যাঁ। ও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। ওই বাড়িতে থাকতে পারবে না, ওর মা যা-তা শুরু করেছেন, কাল ওকে মেরেওছেন।’

‘সে যাই হোক, আমার শোনার দরকার নেই।’ সুধা কঠিন হলেন, ´ও এখানে এসেছে যখন এখানেই থাকবে। কিন্তু ওকে তো এমনি এমনি ঘরে তুলতে পারি না, বরণ তো করতে হবে?’

রুম্পার মা এলেন তড়িঘড়ি। দশাসই চেহারা। বয়স বেশি নয়। একেকজন মানুষ থাকেন যাঁরা যে কোনো অবস্থার সামাল দিতে পারেন সহজে। ইনি সেইরকম মহিলা। সুধা তাই এঁকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন।

রুম্পার মায়ের নাম মাধবী। পাড়ার লোকে তাঁকে মাধু, মাধুদি, কিংবা মাধুবউদি বলেই ডাকে, আড়ালে বলে রুম্পার মা। তিথি এখনও প্যাসেজে দাঁড়িয়ে। মাধবী এসেই তিথির হাত ধরলেন—’হ্যাঁ হ্যাঁ, ওকে তো আমি চিনি। আহা, মুখ একেবারে শুকিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। দাঁড়িয়ে কেন? বোসো বোসো। ও সীমা, তোর বউদিকে নিয়ে গিয়ে বসা একটা কোথাও?…নিজের বরের কাছেই এসে পড়েছ মা, নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ—সব তোমার আপনার লোক, চিন্তা কী?’

তাঁর গলায় একটা সহজ স্নেহের স্পর্শ ছিল। তিথির যেন ধড়ে প্রাণ এল একটু। মাধবী তাকে নিজেই হাত ধরে ঘরে এনে বসালেন। বসার পর তিথি দেখল তার উঁচু হয়ে থাকা হাঁটু দুটো থরথর করে কাঁপছে।

আচ্ছন্নের মতো একাই বসেছিল তিথি। এমনকী পার্থকেও দেখতে পাচ্ছিল না সে। পার্থ কোথায় গেছে কে জানে। মাধবী আর সুধা পাশের ঘরে চলে গেছেন বরণডালা গোছাতে, সীমাকেও দেখা যাচ্ছে না। তিথির এক-একবার মনে হচ্ছিল কারা যেন

দরজার কাছ থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে তাকে দেখে যাচ্ছে। তার দরজার দিকে ঘাড় ঘোরানোর শক্তিও ছিল না।

সুধা এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে পিতলের পুজোর থালা। তাতে ধূপ আর প্রদীপ জ্বলছে। থালায় সিঁদুরের প্যাকেট, শাঁখা-পলা। শাঁখা-পলাগুলো মাধবীই চটজলদি জোগাড় করে এনেছেন কোত্থেকে। মাধবী ঘরে ঢুকে তিথির কাঁধে হাত দিলেন, ‘ওঠো, ও তিথি, তোমার শাশুড়ি-মা তোমাকে বরণ করবেন।’

তিথি মুখ তুলল। অপরিসর দরজায় একটা ঠাসাঠাসি ভিড় চোখে পড়ল তার। এরা কারা, কখন এসেছে, তিথি কিছুই জানে না। নিশ্চয়ই পাড়ার মহিলারা, এ বাড়িতে কিছু একটা ঘটেছে—সেই আঁচটুকু পেয়ে ছুটে এসেছেন। তিথি শুধু দেখল জোড়া জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ স্থিরদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তার মাথার মধ্যে আবার গোলমাল হয়ে গেল। তা ছাড়া, কালীঘাটের ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন থেকে সে তখনও মুক্ত নয়। তার মনে হল, আবার সেরকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

তিথি আবার জ্ঞান হারাতে পারত। দু-হাতে মুখ ঢেকে কঁকিয়ে কেঁদে উঠতে পারত। কিন্তু সে সেসব কিছু করল না। যা করল সেটা সে নিজেও করতে পারবে বলে ভাবেনি। অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে মুখে সে একবার সুধার দিকে তাকাল, একবার চারিদিকে তাকাল, বোধ হয় পার্থকে খুঁজছিল সে। তারপর সুধার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বড়মা, আজ আমি আমার মাকে ছেড়ে এসেছি…আর কোনোদিনও মায়ের কাছে যেতে পারব না…আজ আমাকে ছেড়ে দাও…আজ আমি এইসব পারব না… আমাকে ছেড়ে দাও বড়মা…প্লিজ!…’

যে মায়ের পিছুডাক অগ্রাহ্য করে সে আজ সকালেই ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এসেছে, সেই মায়ের কথা বলেই সে আজ সবার কাছ পরিত্রাণ ভিক্ষে করছে, সামান্য একটু একা থাকার অবকাশ, একটু ব্যক্তিগত নিভৃতি। সে ওই ফেলে আসা জীবনের কথা, বিশেষত মায়ের কথা মনে করে নির্জনে নিজের মতো করে একটু কাঁদতে চায়। সেই সময়টুকুই পাচ্ছে না।

সুধা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর পেছনে জনতাও স্থির। কৌতূহলী চোখগুলো বিস্ময়ে নড়ছে। এ ভারি নতুনরকমের নাটক দেখছে তারা। দুর্বোধ্য কিন্তু টানটান।

মাধবী কথা বলে উঠলেন, ‘তাই তো তাই তো—দিদিভাই ওসব বরং আজ থাক। মেয়েটা সত্যিই আর পারছে না। সিঁদুর তো মাথাতে আছেই দেখছি, তুমি বরং থালা রেখে ওই শাঁখা-পলাগুলোই দাও ওকে পরিয়ে—’ সুধাকে হাত নেড়ে ইঙ্গিত করলেন তিনি। নিজেই সুধার হাত থেকে থালাটা নামিয়ে রাখলেন। তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘ও সান্যাল-মাসিমা, ও ইলাদি—তোমরাও এখন এসো না বাপু, ভিড় হালকা করো। কী যে দেখছ দাঁড়িয়ে বুঝি না। তিথি তো থাকতেই এসেছে, ইচ্ছে হলে দু-দিন পরেই এসো আলাপ করতে। আজ দেখছ না মেয়েটার শরীর অসুখ করছে?’

তাঁর কণ্ঠস্বরে রীতিমতো দাপট ছিল। ভিড় ছত্রভঙ্গ হল। নিঃশব্দে নয়, বিভিন্নরকম কথাবার্তা বলতে বলতে তাঁরা সরে যেতে থাকলেন। যাওয়ার আগে কেউ কেউ আবার উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছিলেন তিথিকে। একজনকে তিথি বলতে শুনল, ‘মাগো, মেয়েটা বুঝি এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছে? সন্ধ্যেবেলা এ কী বিপদ!’

তিথি তখনও হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে আছে। সুধাও ছবির মতো নিশ্চল। মনে হয় তাঁরও যেন নিশ্বাস পড়ছে না, চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। মাধবী সুধার হাতে শাঁখা-পলা তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘ও কী! ও দিদিভাই, ওদের কথায় কান দাও কেন? ওরা সব মজা দেখতে এসেছে। কিন্তু টের পেল কী করে তাই ভাবছি।…নাও নাও, এগুলো পরিয়ে দাও। তারপর বউকে কিছু খেতে-দেতে দাও। মুখ দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ কিছু খায়নি, কেমন মা-মা করছে দ্যাখো, আহা, আজ থেকে তুমিই তো ওর মা!’

সুধা যন্ত্রের মতো তিথির হাতে শাঁখা-পলা পরালেন। তার রোগা হাতে দুটোই বড়ো হল, কিন্তু ভারী নয়। শাঁখা বা পলা কোনোটাই সত্যিকারের নয়, প্লাস্টিকের। তিথি সুধাকে প্রণাম করল। সুধা বিড়বিড় করে কী বললেন বোঝা গেল না। তিথি মাধবীকেও

প্রণাম করল। মাধবী তার চিবুক ধরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আহা, ছেলেমানুষ!’

তিথির চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল চোখের জলে। মাধবী সুধার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও একটু শুয়ে বিশ্রাম করুক, নাকি, দিদিভাই?’

কিন্তু তিথির তখনও বিশ্রামের সময় হয়নি।

পার্থ এতক্ষণ পাশের ঘরের খাটে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল। সে বরণডালা সাজানো দেখেছে, তিথিকে মা কীভাবে বরণ-টরণ করেন তা দেখার জন্যেও তার অদম্য কৌতূহল হচ্ছিল। কিন্তু তার লজ্জা করছিল। সেই সঙ্গে অবশ্য চোরা গর্বও হচ্ছিল তার। তারই জন্যে জলজ্যান্ত একটি মেয়ে বাড়ি ছেড়ে তার কাছে চলে এসেছে, সেই মেয়েটিকে বরণ করার আয়োজন করছেন তার মা বউদি প্রতিবেশিনীরা, এই সিনেম্যাটিক ঘটনাটিকে সে উপভোগ করছিল খুব। তা ছাড়া, তার মন বলছিল এখন ওঘরে যাওয়াটা বোধ হয় ঠিক নয়। ওখানে যা ঘটবে সেটা একেবারেই মেয়েলি ব্যাপারস্যাপার। আর তিথিও একটু অস্বাভাবিক রয়েছে। পার্থ ভেবেছিল, এ অবস্থায় সে ওঘরে গিয়ে দাঁড়ালে আরও জটিলতার সৃষ্টি হবে, পাড়ার লোকে হাঁ করে দেখবে। তার চেয়ে মা যা পারে করুক। রুম্পার মা-ও আছে। ঝামেলাঝঞ্ঝাট সামলাতে মাধুবউদি একাই একশো।

এখন, লোকজন সব চলে যেতেই পার্থ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। নিজের ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল মাধবী তিথির বিশ্রামের প্রস্তাব করছেন। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘না না, তিথি আমার সঙ্গে একটু বেরোবে।’

‘যাঃ, এখন আবার ও বেরোবে কী? দেখছিস ও দাঁড়াতে পারছে না।’ মাধবী মুখঝামটা দিলেন।

পার্থ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘না মাধুবউদি, একটু কেনাকাটা আছে। তিথিকে আমার সঙ্গে যেতে হবে—তিথি চলো—’ সে আর

একমুহূর্তও যেন দেরি করতে রাজি নয়। তিথির অবাক হওয়ার অবস্থা ছিল না। বরং তার খুব ক্ষীণভাবে মনে হচ্ছিল, এখন এই বাড়িটা থেকে একটু বেরোতে পারলে সে বোধ হয় স্বস্তিই পাবে।

মাধবী বারণ করছিলেন, পার্থ সে-কথায় কান না দিয়ে তিথির হাত ধরে টান লাগাল, ‘আহ্, চলো তিথি, চলো—’

সুধার কিছু বুঝতে বাকি ছিল না। তিনি স্থিরদৃষ্টিতে পার্থকে দেখতে দেখতে ক্লান্ত প্রাণহীন গলায় বললেন, ‘দাঁড়া, ওকে টানাটানি করিস না। বেরোলে কিছু খেয়ে বেরোক। সীমা, ঝুড়ি থেকে একটা কলা এনে তিথিকে দে তো—!’

কলাটা খেতে গিয়ে তিথি বুঝল তার ভয়ংকর খিদেই পেয়েছিল। কিন্তু সে দ্রুত খেতে পারছিল না। গিলতে গিয়ে তার গলার মধ্যে একটা ধাক্কা লাগছিল উলটোমুখে। পার্থও কলা খাচ্ছিল, কিন্তু তিথির মনে হচ্ছিল সবাই যেন তার দিকেই তাকিয়ে তার খাওয়া দেখছে। অবচেতনেই সে খুব সচেতন হয়ে উঠল। খুব সতর্কভাবে মুখ বন্ধ করে চিবোনোর চেষ্টা করছিল সে, কিন্তু নরম কলার টুকরোটাও মুখের মধ্যে যেন কিছুতেই জব্দ হচ্ছে না।

পার্থ তিথিকে নিয়ে গেছিল বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে, বাসরাস্তা পেরিয়ে একটা মাঠের ধারে। মাঠটা খাটো পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পার্থ পাঁচিলে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, ‘বোসো।’

‘এখানে? এখানে এলে কেন?’ তিথি চারপাশটা দেখছিল। জায়গাটা বেশ অন্ধকার। ফাঁকা। দূরে ডায়মন্ডহারবার রোডের লালচে হ্যালোজেন আলোর আভা ছড়িয়ে আছে। তিথির গা ছমছম করছিল।

পার্থ একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটে টান দিয়ে কাশল দু-বার, বলল, ‘বোসো না একটু। একটু পরেই বাড়ি ফিরে যাব। মশা কামড়াচ্ছে?’

‘এখানে কেন নিয়ে এলে আমাকে?”

পার্থ তবু সময় নিচ্ছে। চুপচাপ সিগারেটে বেশ কয়েকটা টান দেবার পর সে বলল, ‘তিথি, বাবা বাড়ি আসার পর একটা ঝামেলা হবে। ওই ঝামেলার সময়টা অ্যাভয়েড করছি। আমার বাবার রেগে গেলে জ্ঞান থাকে না, খুব ইনডিসেন্ট হয়ে যান। তুমি তো বাবাকে আগে দ্যাখোনি, তুমি নিতে পারবে না। তার চেয়ে, মা ব্যাপারটা সামলে নিক, তারপর আমরা যাব।’

তিথির ঘেন্না লাগছিল। পার্থর তাকে নিয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসাটা যে পালানো, এটা বুঝে তিথির মনে হল তার চোখ ফেটে জল নয়, বোধ হয় আগুন বেরোতে চাইছে। এ কার জন্যে পাগলের মতো ছুটে এসেছে সে, কাকে ভালোবেসে? ও কি একজন পুরুষ? তিথি খুব ভালো করেই জানে সে যেভাবে এ বাড়িতে এসে উঠেছে সেটা একটা বিরাট বিড়ম্বনা। পার্থ তাকে বিয়ে করেছে অথচ সে নিজেই বহুলাংশে বাবার ওপরে নির্ভরশীল, কিন্তু আবার তাঁকেই বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। এত অপরাধের একটাও হয়তো ক্ষমার যোগ্য নয়। কিন্তু বাবার মুখোমুখি দাঁড়াতে না পেরে তাকে নিয়ে পার্থর এই পালিয়ে আসা, অন্ধকারে লুকিয়ে বসে থাকা, এ যেন তার সমস্ত অযোগ্যতাকে ছাপিয়ে গেল।

তিথি কোনোরকমে বলল, ‘তুমি বলেছিলে বাড়িতে যা হবে তুমি ফেস করবে, সেই ভার একা মায়ের ওপর ফেলে পালিয়ে এলে?’

পার্থ নির্বিকার গলায় বলল, ‘মা একা নয় তো, রুম্পার মা-ও আছে। ঝামেলা ট্যাকল করতে মাধুবউদি ওস্তাদ। ও-ই বাবাকে ঠান্ডা করে দেবে দেখো। চিন্তা কোরো না তিথি, আমি বলছি সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তিথির গা পাক দিচ্ছিল। কলাটা হয়তো হজম হয়নি। একটা উদ্যত ওয়াক চেপে সে বলল, ‘মাধুবউদি তোমাদের কে হন?’

‘কেউ না তো? এমনি, ওপরে থাকে। তবে আমাকে আর সীমাকে খুব ভালোবাসে। সীমা রুম্পাকে পড়ায়। মাধুবউদির হৃদয়টা খুব বড়ো। জানো, উনিও বাড়ির অমতে সলিলদাকে বিয়ে করেছিলেন। মাধুবউদি বোধ হয় এখনও বাপের বাড়িতে যেতে পারে না।’

তিথির মনে হচ্ছিল, ভাগ্যিস এই জায়গাটা এতই অন্ধকার যে তারা পরস্পরের মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

সত্যিই সেদিন অলক বাড়ি ফিরে আসার পর মাধবীই তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছিলেন। একজন গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলে অন্যেরা একপাশে দাঁড়িয়েই দেখে। সুধাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। সীমা শুয়েছিল দেওয়ালের দিকে মুখ করে। সেই যে সে দৌড়ে দোতলায় গিয়ে মাধবীকে ডেকে এনেছিল, তারপর থেকেই সে অন্যমনস্কভাবে কী যেন ভেবেই চলেছে।

অলক কোনো কথাই শুনতে চাইছিলেন না। তবে লাফঝাঁপ করে পরের দিকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। পার্থ আর তিথি যখন দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরল মাধবী তখনও নীচেই রয়ে গেছেন। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে তিনি জল খাচ্ছিলেন। সুধা রান্নাঘরে। অলক টিভি খুলে বসেছেন। তিথিরা ঢুকতেই মাধবী পার্থর দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে ওই ঘরের দিকে ইশারা করলেন। মৃদুস্বরে বললেন, ‘তুই আগে যাস না। তিথি গিয়ে আগে প্রণামটা সেরে নিক।’

পার্থ যে তার আগে যাবে না, তা তিথির বোঝা হয়ে গেছে। সে সোজা ঘরে ঢুকে অলকের সামনে গিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়াল। অলক তক্তপোশের ওপর বসে হাঁটু ভাঁজ করে তুলে টিভি দেখছিলেন, তাঁর লুঙ্গিটা গরমের জন্যে গুটিয়ে তোলা। তিথিকে দেখে তিনি প্রথমে চমকে উঠলেন। তারপর তটস্থ হয়ে লুঙ্গিটাকে ঊরুর ওপর থেকে টেনে নামিয়ে ভদ্রস্থ হওয়ার চেষ্টা করলেন। তিথির দিকে তাঁর আর চোখ ছিল না, তাঁর ভয়ংকর দৃষ্টি তখন পার্থকে খুঁজছে।

তিথি কখন নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে অলকের পা ছুঁয়েছিল, অলক বুঝতেই পারেননি। দরজায় পার্থ এসে দাঁড়ানোমাত্রই তিনি

গর্জন করে উঠলেন, ‘বেরিয়ে যা–বেরো…এক্ষুনি দূর হয়ে যা কুলাঙ্গার—এই মুহূর্তে তুই এই বাড়ি ছেড়ে বেরোবি’ মাধবী ছুটে এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ‘ও কী দাদা, তিথি আপনার পায়ের ধুলো নিল, ওকে আশীর্বাদ করলেন না? ওর তো কোনো দোষ নেই।’

অলক গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচাচ্ছিলেন। মাধবী কৌশলে তাঁকে থামিয়ে দিলেন। অলক তিথির দিকে এক ঝলক দেখেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ? অ, তাই বুঝি? কই…আমি তো…তা হ্যাঁ, আচ্ছা, ও—ওকে আশীর্বাদ করব না কেন?…’ আবার জ্বলে উঠে বললেন, ‘কিন্তু ওই পাপিষ্ঠটা যেন আমার সামনে না আসে, আমি ওর মুখদর্শন করতে চাই না——

সুধা কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে যেন নিজের মনেই বলছিলেন, ‘আর আমার সহ্য হয় না, কোন অপরাধে এত শাস্তি কপালে ছিল ভগবান!’

পার্থ ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়েই ছিল। সে জানে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই তাকে পার পেয়ে যেতে হবে। মাধবী তাকে এক ঠেলা মারলেন, ‘মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছিস কীরে, বিয়ে করে বউ এনেছিস, বাবার পায়ের ধুলো নে।’

তাঁর বলার মধ্যে একটা ইঙ্গিত ছিল। পার্থ এক মুহূর্ত ইতস্তত করে এগোল। অলকের পা লক্ষ্য করে ঝুঁকতেই অলক ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন, ‘নেই না, নেই না, নেব না আমি ওর প্রণাম যাঃ—’ বলেই পা ছুড়লেন। পা-টা এসে লাগল পার্থর ঊরুতে।

পার্থ ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সুধার দিকে তাকিয়ে হুমকির ভঙ্গিতে বলল, ‘মা! আমার বাক্সটা খালি করে দাও, আমরা চলে

যাব।’

সুধা হাঁ-হাঁ করে কেঁদে উঠলেন আরও জোরে, অলকের দিকে ধেয়ে গিয়ে পাগলের মতো মাথায় হাত চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, ‘তাই যা, তাই যা—এই না হলে বাপ! ঘরে যেদিনই বউ এল সেদিনই ছেলে-বউকে তাড়ালে? দু-দিন সবুরও করলে

পার্থ অর্ধমৃত তিথির হাত ধরে টানতে টানতে প্যাসেজে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি আসছি।’ সে অন্য ঘরটাতে ঢুকে বাক্স হাঁটকাতে লাগল। তার এখন অন্য চেহারা।

মাধবী সুধাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সুধাকে যেন সামলানো যাচ্ছিল না। মাধবী ব্যাকুল স্বরে অলককে বলেছিলেন, ‘ও দাদা, আমি তবে কী বোঝালাম আপনাকে এতক্ষণ ধরে? এত অধৈর্য হলে চলে?…কী মুশকিল, কেউ যে দেখি কোনো কথা শুনছে না, শেষে কি একটা অনর্থ হবে নাকি আজ! ও দাদা, মেয়েটাকে যে মরতে হবে তাহলে——

অলক হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছিলেন। পার্থ যে নাটকের রাশ এভাবে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি। মাধবীর কথাগুলো শুনে তিনি বিহ্বলের মতো বললেন, ‘অ্যাঁ? কী? না, তা আমি তো শুধু ওই ওকে বলেছি চলে যেতে…কই ওর বউকে তো কিছু বলিনি—এই যে, শুনছ? তোমাকে যেতে বলিনি আমি, দ্যাখো কাণ্ড, তোমার নামটা যেন কী—তুমি ঘরে এসে বোসো, শুনছ?’

তিনি তিথিকে ডাকছিলেন। পার্থ অন্য ঘরের ভেতর থেকে শাসানির সুরে গলা তুলে বলল, ‘তিথি! যাবে না বলে দিচ্ছি। আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’

তিথি কর্ণপাত করল না। ধীরে ধীরে অলকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমার নাম তিথি। আমাকে যদি দয়া করে এখানে থাকতে দেন, তাহলে ওকেও থাকতে দিন প্লিজ। ওকে তাড়িয়ে দিলে আমি তো এখানে থাকতে পারি না, আমাকে

না?”

আমার স্বামীর সঙ্গেই যেতে হবে।’

ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিথি নিজেও জানত না সে ওইভাবে কথাগুলো বলেছিল কী করে। ওগুলো যেন তার নিজের কথা নয়। যেন মুখস্থ সংলাপ কোনো। তিথি যেন অন্য কারও ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে।

অলক তিথিকে দেখছিলেন। মাধবী চোখ মুছে বললেন, ‘ঠিকই তো। দাদা, আর রাগ করবেন না। শান্তি মনে ওদের আশীর্বাদ করুন। ও সীমা, পার্থকে ডাক তো, দুজনে মা-বাবাকে এসে প্রণাম করুক ভালো করে।’

সীমাকে দেখা যায়নি, কিন্তু পার্থ এসেছিল। তিথি আর সে একসঙ্গে প্রণামও করেছিল অলক আর সুধাকে। তিথি মাধবীকেও আবার প্রণাম করতে গিয়ে দেখল, পার্থ মাধবীকে প্রণাম করল না।

রাত নিশুতি হয়ে আসছিল ক্রমশ। মাধবী ওপরে চলে গেছেন। খাওয়া-দাওয়ার পাট সারা। অলক খাটে শুয়ে পড়েছেন। সুধার তখনও কাজ ফুরোয়নি। তিথির চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল। কিন্তু সেদিনের মতো তার পরীক্ষা শেষ হতে তখনও কিছু বাকি।

খানিকক্ষণ থেকেই পার্থকে হঠাৎ খুব অধৈর্য দেখাচ্ছিল। যেন সে ভেতরে ভেতরে কী একটা উত্তেজনায় ছটফট করছে। সেটা সে চেপে রাখতে চাইছে কিন্তু পারছে না, তার আচরণের মধ্যে প্রকটভাবে ফুটে উঠছে। তিথি প্রথমে তেমন খেয়াল করেনি। হঠাৎ পার্থ তার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অদ্ভুতভাবে একটুখানি হাসতেই তার কাছে একঝলকে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

সীমা তার পাশে বসে বিমর্ষভাবে কালো সরু ফিতে দিয়ে টেনে টেনে চুল বাঁধছিল। তিথি তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,—‘বড়দি, আমি, তুমি আর বড়োমা একসঙ্গে শোব, হবে না?’

সীমার মুখটা পলকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, কেন হবে না? তাহলে আমরা ওই ঘরের খাটটায় শুই, বাবা আর দাদা এই তক্তপোশে—’

সীমা যেন অনুমোদনের আশায় তিথির দিকে তাকিয়ে হাসল। তিথি এমন নিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ল, যেন সে এই বাড়িরই অনেকদিনের লোক।

সীমা ত্বরিত পায়ে উঠে যেতে যেতে বলল, ‘ইশ, বাবা ওঘরে শুয়ে পড়েছে, আসলে আমরা ভেবেছিলাম ওঘরে আমরা তিনজনেই— দাঁড়াও বাবাকে এঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার খুব ঘুম পেয়ে গেছে, এক মিনিট দাঁড়াও, এক্ষুনি শুয়ে পড়বে—’

সীমা চলে যাওয়ার পরে সে-ঘরে পার্থ আর তিথি ছাড়া কেউ ছিল না। পার্থর সারা মুখে কে যেন কালি লেপে দিয়েছিল। তিথি মুখে কিছু বলেনি, তবে তার সারা শরীর দিয়ে একটাই শব্দ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল—ছিঃ!

8

ছেলেদের মধ্যে ছোটোর ওপরের জন, অনিলই নিয়মিত চিঠিপত্র লেখে। তিন মাস, চার মাস অন্তর হলেও, তার চিঠিতেই শিবানী কলকাতার খবরাখবর পান। অনিলই তাঁকে লিখেছিল, অলকের ছেলে পার্থ নাকি লুকিয়ে বিয়ে করেছে, পাত্রী অরূপের মেয়ে মৌসুমীর বন্ধু। ফলাও করে কিছু লিখতে পারেনি, পোস্টকার্ডে যতটুকু ধরে সেইটুকুই।

চিঠিটা হাতে নিয়ে শিবানী থপথপ করে স্বামীর কাছে গিয়েছিলেন, তবে চিঠি পড়ে অঘোর ব্যাপারটাকে তেমন আমল দেননি, শুধু বলেছিলেন, ‘অরূপের মেয়ের বন্ধু? তাহলে অরূপের মেয়ের বিয়ের বয়েস হয়ে গেছে?’

আজ দালানের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই লাল শাড়িপরা ঘোমটা মাথায় মেয়েটিই যে পার্থর বউ, সেটা হিসাব করতে শিবানী যেটুকু সময় নিলেন, সেটা তাঁর বয়সের কারণে। আজকাল তাঁর মাথা তেমন খেলে না। তারপর অস্ফুটে বললেন, ‘ও সুধা, কে?’

বাড়ি ছেড়ে আসার পর কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা তিথিকে অনেক ধাতস্থ করে দিয়েছে, যেন তার বয়স বেড়ে গেছে হঠাৎই। সেদিন মুহুর্মুহু বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কায় সে এতদূরে ভেসে গেছিল, যেখানে জল তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি গভীর।

আজ এ বাড়িতে পা রাখবার সময়েও সে মনে মনে প্রস্তুত ছিল। তবু অসীমের মন্তব্যে তার কানে সুচ বিঁধল। আসলে, তিথিকে কেউ বলেনি অসীমের মাথা খারাপ।

তিথি বুঝতে পারছিল, অলক কিংবা সীমা নয়, তার পরিচয় দেওয়ার ভার সুধা কিংবা পার্থর ওপরই বর্তাবে। কিন্তু ওই দুজনের কেউই যেন ঠিক এগোতে সাহস পাচ্ছেন না।

শিবানী সুধাকে প্রশ্নটা করেই তিথির দিকে এগিয়ে আসছিলেন। বাকিরা সবাই যেন নাটকের পার্ট ভুলে যাওয়া অবস্থায় নিথরকিংবা এই নীরবতাই হয়তো তাদের ভূমিকা, কে জানে। তিথি আর কালবিলম্ব করল না, সে শিবানীকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলঅন্যরা তখনও যেন শ্বাসরুদ্ধ করে কীসের অপেক্ষাই করে চলেছে।

শিবানী ফিক করে হাসলেন, পার্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আলাপ করিয়ে দিবিনে, ও দাদুভাই?’

তাঁর ওই একটি বাক্যে কী জাদু ছিল, মূর্তিগুলো সব প্রাণ ফিরে পেল। পার্থ দ্রুত একটা প্রণাম করেই তাঁকে জড়িয়ে ধরল, কানে কানে বলল, ‘বিয়ে করে ফেলেছি ঠাকুমা, তুমি রাগ করোনি তো?”

‘ও আমার গোপাল! তুমি নাতবউ এনেছ আমার, আমি রাগ করতে পারি? ওর নাম কী?

‘ওর নাম তিথি, মা! আপনার শরীর ভালো তো?’ সুধা শাশুড়ির পায়ের পাতা হাতড়াচ্ছিলেন। সীমা ঠাকুমার লুটোনো শাড়ি একটু তুলে ধরে হাসতে হাসতে বলল, ‘মা এই নাও ঠাকুমার পা, ঠাকুমা তুমি বুঝি পায়ে ধুলো পড়বে বলে এমনি ঢেকে, চেপে রাখো, আর সবাই তোমার পায়ের ধুলো খোঁজে।’ সীমা ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরল, ‘আমি তোমায় শাড়ি পরিয়ে দেব, হ্যাঁ ঠাকমা!’

‘বাবা কেমন আছেন?’ সুধা ঘরের দিকে মুখ ফেরালেন। অঘোরের জ্বরমাপা তখন শেষ হয়েছিল, আজকেও থার্মোমিটারের পারা আটানব্বই ছোঁয়নি, তিনি একটু নিরাশ মুখে বাইরে এলেন।

সুধা তাঁকে প্রণাম করার আগে মাথায় ভালো করে ঘোমটা তুললেন। এতক্ষণে কেবল তাঁর খোঁপাটাই ঢাকা ছিল। প্রণাম করে বললেন, ‘বাবা একটা অপরাধ হয়েছে আমার, আপনি বোধ হয় জানেন—আপনার নাতি বিয়ে করেছে।’

। ।

পার্থ তিথির দিকে ইশারা করে দাদুর দিকে এগোল। অঘোর নির্নিমেষে দেখছিলেন, আস্তে আস্তে বললেন, ‘তা ভালোই, নিজে নিজে বিয়ে করেছ? কাগজের বিয়ে?

পার্থ ঘাড় নাড়ল। তিথি তাঁর পা স্পর্শ করে উঠে দাঁড়াতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি অরূপের মেয়ের সঙ্গে পড়তে? বাবার নাম কী?”

তিথি নাম বলল।

অঘোর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘উচ্চ অবসর্ণ, তাও ভালো। কাউকে জানালে না কেন তোমরা?’ তাঁর প্রশ্নটা অলকের উদ্দেশে। অলক কপালে হাত দিলেন, কী বলতে চাইলেন সেটা অঘোর হয়তো ঠিক বুঝলেন না, কিন্তু নিরুৎসাহ গলায় বললেন, ‘ও, তা যাও সব হাতমুখ ধোও, পরে কথা হবে।’

‘উফ্, নিশ্চিন্ত!’ সীমা ফিসফিস করল। সে এখন তিথির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ‘চলো, তোমায় আমাদের বাড়িটা ঘুরিয়ে আনি।’ তিথি সীমার সঙ্গে যেতে রাজি ছিল, সুধা বললেন, ‘ও কী! আগে চানটান করে সুস্থ হও সব?’

‘বাথরুমে তো তিনটে, তোমরা ঢুকে পড়ো।’ সীমা চটপট উত্তর দিল, ‘আমরা পরে চান করব, আমার দেরি লাগবে।’ সে তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমিও নিশ্চয়ই পরে চান করবে?”

দেশের বাড়িতে এসে সীমাও যেন মন্ত্রবলে বদলে গেছে। সে এখন একটি আগাপাশতলা ছটফটে বাচ্চা মেয়ে। তিথির খুব ভালো লাগছিল। সে ঘোমটার আড়ালে হাসল।

উঠোন পেরিয়ে যেতে যেতে অসীমের দিকে চোখ পড়ল তিথির। অসীম তার দিকেই দেখছে। এই লোকটিই তাকে দেখে ওইরকম মন্তব্য করেছিল। তিথি নিজের সম্বন্ধে ‘মেয়েছেলে’ কথাটা কখনোই শোনেনি। তার ধারণা, কথাটা খুবই অশিষ্ট, অপমানকর। তিথি দেখল, লোকটি ভারি অদ্ভুত। ময়লা চিরকুট একটা পাজামা পরে হাতে তেলের বাটি নিয়ে এমনভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, যেন বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোটা তার এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। সীমা আবার তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করল, ‘আমার ছোটোকাকা, মাথায় একটু গোলমাল আছে, তা হোক, তুমি প্রণাম করো।’ তারপর অসীমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী গো ছোটকা, চান করতে গেলে না এখনও? এই দ্যাখো দাদার বউ, তোমায় প্রণাম করবে।’

তিথি প্রণাম করতেই অসীম প্রথমটায় চমকে উঠে জড়সড় হয়ে গেল। তারপর তার তেল ছপছপে ডান হাত তিথির ঘোমটা দেওয়া মাথায় জোরে চেপে রেখে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘চির সৌভাগ্যবতী হও।’

সীমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তিথি বাড়িটা দেখছিল। বিরাট বাড়ি। ঘরগুলোর মধ্যে কয়েকটা বড়ো বড়ো, তাতে তক্তপোশ জুড়ে জুড়ে ঢালাও বিছানা পাতা। বাকি ঘরগুলো মাঝারি। সব ঘরে কালো হয়ে যাওয়া কাঠের পুরোনো আসবাবপত্র। দেয়ালে বিভিন্ন সারিতে মোটা মোটা ফ্রেমে বাঁধানো ফটো ঝুলছে। ফটোগুলো বেশিরভাগই হলুদ আর ঝাপসা হয়ে গেছে, কোনোটায় কারও কোনো মুখ দেখা যায় না। ঘরগুলোতে অদ্ভুত প্রাচীন গন্ধ পাচ্ছিল তিথি। কিছুটা মিষ্টি, কিছুটা কটু, কিছুটা ঝাঁঝালো। পুরোনো, ঘন হয়ে আসা মাথার তেলের মতো।

দক্ষিণদিকে দুটো বড়ো ঘর, তার একটায় অঘোর থাকেন। তার পরে একটা খোলা উঠোন। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে এই উঠোনেই প্রথমে পা রেখেছিল তিথি। উঠোনের একপাশে অলকের ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুম। এটাই সবচেয়ে বড়ো। উঠোনের পর দুটো মাঝারি আকারের ঘর, ঘরের পুবদিক দিয়ে একটা প্যাসেজ, এদিকে দু-ধাপ উঠে আবার ওদিকে দু-ধাপ নেমে আর

একটা খোলা উঠোনে গিয়ে পড়েছে। এই প্যাসেজটা আসলে বারান্দারই একটা ভেতরে ঢুকে আসা অংশ। ওপাশের উঠোনটা অপেক্ষাকৃত ছোটো। এটাকে ঘিরেও আরও কয়েকটা ঘর। এখানেই একটা ঘরে থাকে অসীম, তার সঙ্গে শিবানীও। রান্নাঘর আর খাওয়ার ঘর আলাদা, দুটোই বেশ বড়ো। রান্নাঘরে বিশাল মাটির উনুন, তিথি আগে কখনো এত বড়ো উনুন দেখেনি। লোকজন এলে এইটাতে রান্না চাপে। অন্যসময়ের জন্য ছোটো উনুনও আছে। আর একদিকে ঠাকুরঘর। ঠাকুমা নাকি বৈষ্ণববাড়ির মেয়ে, ঠাকুরঘরে তাঁর পিতলের গোপাল দোলনায় দুলছে। এই সব ঘর আর উঠোনের সামনে দিয়ে পুবমুখো টানা বারান্দা। বারান্দাটা দক্ষিণ দিকে ক্রমশ সরু হয়ে ত্রিভুজের কোণের মতো মিলে গেছে। এই টানা বারান্দাই ঘুরে গেছে উত্তর-পশ্চিম কোণে, সেখানে পাশাপাশি আরও দুটো বাথরুম।

সীমা উৎসাহের সঙ্গে তিথিকে সব ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে বলল, ‘দেখেছ? কত বড়ো বাড়ি না? আমাদের এখানেই জন্ম। আর কলকাতায় কেমন ভাঙা বাড়িতে পড়ে আছি। শুনলে কেউ বিশ্বাসই করে না দেশে আমাদের এত বড়ো বাড়ি আছে!’ সীমার কথা বলার মধ্যে এমন একটা ছেলেমানুষি গর্ব আর নৈরাশ্য মিশে ছিল, তিথিকে খুব স্পর্শ করল। সত্যিই, ভাবা যায় না, কী বিশাল বাড়ি! দোতলার তুলনায় একতলাটা অদ্ভুত ফাঁকা। সেটাও সীমা পেছনদিকের একটা ছোটো সিঁড়ি দিয়ে নেমে তিথিকে দেখিয়ে এনেছে। সেখানে বড়ো বড়ো দরজা বন্ধ ঘর। সীমা বলল এগুলোর মধ্যে পুরোনো বাসন-কোসন, বাতিল আসবাব আর বিছানা, ভাঁড়ারের চালডাল, দোকানের জিনিসপত্র ভরতি। তিথির দমবন্ধ লাগছিল। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে আসতে বলল, ‘এসো বড়দি। আচ্ছা, ছাদে যাওয়া যায় না?’

খোলা উঠোনে দাঁড়িয়েই তিথি দেখেছিল এ বাড়ির তিনটে আলাদা আলাদা ছাদ, ছাদের ধারে কোনো রেলিং নেইযাওয়ার কোনো সিঁড়িও চোখে পড়েনি তার।

সীমা বলল, ‘ছাদে? একটা মই বোধ হয় আছে। ওইটে লাগিয়ে যাওয়া যায়। আমি কখনো যাইনি।’

। ছাদে

শিবানী মহাব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছেন। বাড়িতে একজন রাঁধুনি আছে, শিবানী এক-এক বার রান্নাঘরে এসে তাকে নানান নির্দেশে উদব্যস্ত করে তুলছেন, আবার দু-দুটো উঠোন পেরিয়ে সুধার কাছে যাচ্ছেন। অঘোরের ঘরের পাশের ঘরটাতেই সুধারা থাকবেন। এখনও স্নান করতে যায়নি সুধা, তিনটে বাথরুমে অলক, পার্থ আর অসীম ঢুকেছে।

পুরো বাড়িটা চক্কর দিয়ে ফিরতে ফিরতে তিথির শিবানীর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। চোখাচোখি। শিবানীর আঁচল এখন বেশ করে কোমরে পেঁচিয়ে গোঁজা, সীমা গুঁজে দিয়েছে। তাঁর মুখে হাসি। তিথি এমন হাসি আগে দেখেনি। শিবানীর মুখে অজস্র ভাঁজ, তাঁর হাসি যেন সেই ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে, ভাঁজ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে। তিনি তিথিকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

সীমা এগিয়ে গেল, ‘কী বলছ ঠাকমা?’

শিবানী হাসি হাসি মুখে গোপন কথা বলার মতো চাপা গলায় বললেন, ‘হ্যাঁরে সীমা, পার্থ বুঝি ঘরটর তুলে নিয়েছে?’

‘না, তো?’ সীমা ঠাকুমার প্রশ্নের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারছে, বলল, ‘আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকি ঠাকমা, ঘর তুলবে কোথায়?’ ‘তবে ও বউ নিয়ে কোন ঘরে থাকে রে? তোদের ওখানে তো দুটোই মাত্তর ঘর।’

তিথির কানমাথা গরম হয়ে উঠছিল। সীমা পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বলল, ‘না গো, তিথি আমাদের সঙ্গেই শোয়। আমি, মা আর তিথি একটা ঘরে, আর বাবা-দাদা আরেকটায়।’

শিবানী বোকার মতো তাকিয়ে ছিলেন। তিথির এত অপ্রস্তুত লাগছিল যে নিজের হাত দুটো নিয়ে যেন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। অকারণে ঘোমটা টানছিল, আঁচল গুছাচ্ছিল। এভাবে সবসময় শাড়ি পরার অভ্যাস আগে না থাকলেও তার শাড়িতে

অসুবিধে হয় না। শুধু মাঝে মাঝে খুব গরম লাগে।

ঝাঁপতাল

শিবানী হঠাৎ খুব নরম গলায় বললেন, ‘আমার কাছে আর অত মাথায় কাপড় দিতে হবে না। তুই বুঝি আমার নাতির ভালোবাসা করেছিস?’ শিবানী পা ঘষে ঘষে তিথির আরও কাছে চলে এলেন, মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, কিন্তু সব গল্প বলতে হবে, হুঁ!’

সঙ্গে ‘আমায়

তাঁর মুখে পানদোক্তার গন্ধ। তিথির হাসি পেয়ে গেল।

তিথি চলেফিরে বেড়াচ্ছে, কথাবার্তা বলছে, খাচ্ছে ঘুমোচ্ছে, এমনকি হাসছেও। কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে একটুও স্বাভাবিক নেই। সে যেন ধীরে ধীরে কেমন ভূতগ্রস্তের মতো হয়ে উঠেছে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, তিথি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছে না।

এ বাড়িতে আসার পর দু-দিন হয়ে গেছে। তিথি যেন কেমন নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে শুরু করেছে। তার সঙ্গে কেউই খারাপ ব্যবহার করছে না। শুধু অসীম তার দিকে মাঝে মাঝে ভুরু কুঁচকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়, যেন তাকে চিনতে পারছে না। এর মধ্যে একদিন দুপুরে তার বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল, কিন্তু এদিককার বাথরুমটা বন্ধ থাকায় সে বারান্দা দিয়ে ওদিককার উঠোন পেরিয়ে ওপাশের বাথরুমে যাচ্ছে, অসীম তার ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে রে? কে রে?’ বলে। তিথির বুক ধড়াস করে উঠেছিল, ভাবছিল সাড়া দেবে, না দেবে না। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে শুকনো গলায় বলেছিল, ‘আমি তিথি!’

অসীম চিনতে না পেরে আবার রাগের গলায় বলল, ‘কী তিতি, তিতি কে? এখানে এসেছিস কেন, শোন এদিকে, শোন!’

অসীম তার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তার পরনে আজও সেই পাজামাটা। গায়ে একটা হাফহাতা শার্ট। তিথি উঠোনের মাঝখানে। তার ভয়ের চোটে আরও জোরে বাথরুমে পেয়ে গেছে, কিন্তু ভয় হচ্ছে বাথরুমের দিকে যেতে গেলেই অসীম যদি তেড়ে আসে।

শিবানী অসীমের ঘরেই বেশিরভাগ সময় শোন, কিন্তু সেদিন তিনি কী কারণে ঠাকুরঘরের মেঝেতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। অসীম আর একবার চিৎকার করতেই তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি শুয়ে শুয়েই দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন, তিথি ফ্যাকাশে মুখে

উঠোনে দাঁড়িয়ে। তার চোখ অসীমের ঘরের দিকে।

‘কী হয়েছে রে, ও তিথি! কী হয়েছে?’ শিবানী প্রশ্নটা করতে করতেই বুঝে গেছিলেন কী হয়েছে। তিনি ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে সোজা অসীমের ঘরের দিকে চললেন, তাঁর শাড়ির প্রান্ত ঠাকুরঘরেই রয়ে গেল।

‘কী হয়েছে, ও অসীম! কী বলছিস তুই পার্থর বউকে?’

‘পার্থর বউ, পার্থর বউ কোত্থেকে এল? আমারই তো বিয়ে হয়নি এখনও—’

শিবানী অসীমের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কীসব সান্ত্বনার কথা বলছিলেন। তিথি আর দাঁড়ায়নি। তাড়াতাড়ি বাথরুমে চলে গিয়েছিল।

কিন্তু অসীম তো প্রকৃতিস্থ নয়। সে ছাড়া বাড়ির অন্য মানুষেরা তিথিকে যেভাবে বিনা আপত্তিতে গ্রহণ করেছে, তাতে বরং তিথির নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেওয়ার কথা। এতটা সে নিজেই আশা করেনি। কিন্তু তিথি মানসিক স্বস্তি পাচ্ছে না। তার শুধুই মনে হচ্ছে এ কোথায় এসে পড়েছে সে? এরা কারা? সে নিজেই-বা কে? এই বিরাট বাড়ি যেন তাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে ক্রমশ, এর পুরোনো গন্ধমাখা ভারী বাতাস-ভরতি ঘরদোর, অসংখ্য চিড়ের আঁকিবুকিময় লাল শানের উঠোন, এই বাড়ির লোকজন—সবই তার কাছে যেন জন্মান্তরের স্বপ্নের মতো লাগছে।

তার নিজেকে আরও অসহায় মনে হওয়ার কারণ, এখানে আসার পর পার্থর সঙ্গে সারাদিন তার প্রায় কথাই হচ্ছে না। পার্থ সকালে উঠেই বেরিয়ে যাচ্ছে পুজোর জোগাড়যন্ত্রে। দুপুরে ফিরতে ফিরতে অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে তার। খাওয়া-দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার বেরোয় সে, ফেরে সন্ধ্যের পর।

তৃতীয় দিন দুপুরে খাওয়ার পর তিথি পার্থর কাছ ঘেঁষে এল। ঘরে তখনও আর কেউ আসেনি।

‘তুমি এত দূরে দূরে থাকছ কেন আমার থেকে?’ তিথির গলায় করুণ অভিযোগ।

পার্থ চিত হয়ে শুয়েছিল। মুখ ফিরিয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘কই না তো? দূরে দূরে যাব কেন? তোমার খুব একা লাগছে, না!’ পাৰ্থ পাশ ফিরল। তিথির কোলের ওপর একটা হাত রেখে বলল, ‘অনেক কাজ, তিথি! সব একা দেখতে হচ্ছে। এমনিই হয় প্রতিবার। দুর্গাপুজো করা তো চাট্টিখানি কথা নয়!’

‘আমাকে তোমার সঙ্গে নাও না, আমি হেল্প করব?’

পার্থ মাথা নাড়ল, ‘এসব তোমার কাজ নয় তিথি, এসব বাইরের কাজ। সারাদিন চরকিপাক ঘুরতে হচ্ছে। তারচেয়ে, বাড়িতেও তো অনেক পুজোর কাজটাজ আছে। মা বোধ হয় এখনও ওসবে হাত লাগায়নি। আমি মাকে বলছি, তুমি মাকে হেল্প কোরো।’

তিথি ঘাড় নাড়ল। সে তার কোলের ওপর রাখা পার্থর হাতটা নিজের আঙুলে জড়িয়ে রেখেছিল, তার মুখে একটা ক্লিষ্ট করুণ ছায়া। পার্থ আন্তরিক স্বরে বলল, ‘তিথি? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?’

তিথি আবার নীরবে ঘাড় নাড়ল। শরীর তার খারাপই। থেকে থেকে জিভ শুকনো হয়ে ওঠে, নিশ্বাস গরম লাগে। এই মুহূর্তে সেরকম কিছু হচ্ছে না। কিন্তু শরীরটা সবসময়ই খুব দুর্বল মনে হয়। তার বোধ হয় রাত্রে ভেতরে ভেতরে জ্বর আসে। সে পার্থকে কিছু বলল না। একেই ওর কাজের চাপে নিশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই, ওকে সামান্য শরীর খারাপের কথা বলে ব্যস্ত করাটা ঠিক না। কিন্তু মনে মনে তিথির খুব ইচ্ছে করছে আজ দুপুরবেলাটা পার্থ না বেরোক, সে একটু পার্থর কোলে মাথা রেখে শোবে।

রাত্রে শুতে শুতে এখানে বেশ রাত হয়ে যায়। দক্ষিণের বড়োঘরে ঢালাও বিছানায় সবাই একইসঙ্গে শোওয়ার বন্দোবস্ত। জানলার ধারে অলক, তারপর সুধা, তারপর সীমা। সীমার পরে তিথি, তিথির পাশে পার্থ। একসঙ্গে শোওয়ার এই ব্যবস্থাপনায় তিথি প্রথমে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরে ভেবে দেখল, পুজোর সময় এ বাড়িতে রীতিমতো ভিড় লেগে থাকে। এক-একটি পরিবারের জন্য এক-একটি ঘরই সমীচীন।

সীমা যখন শিবানীর প্রশ্নের উত্তরে বলছিল তিথি আমাদের সঙ্গে শোয়, তখন তিথি একটা অন্যরকম লজ্জায় অভিভূত হয়ে যাচ্ছিল। সে বিবাহিত অথচ স্বামীর সঙ্গে রাত্রিবাস করে না, এ যে খুব গর্ব করে বলার কথা নয়, সীমা তা বোঝেনি। কিন্তু তিথির এই সিদ্ধান্তের পেছনে যে অতিসূক্ষ্ম শালীনতা বোধ কাজ করেছে, সেও কি কেউ বুঝেছে! কলকাতার বাড়িতে বিয়ের পরের সেই দুঃস্বপ্নের প্রথম দিনটিতে তার সঙ্গে রাত্রিযাপনের আগ্রহে পার্থর যাবতীয় ছটফটানিকে সে ঘৃণার সঙ্গে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। কেননা, সে আর পার্থ একঘরে থাকলে অলক, সুধা আর সীমাকে আর একটি ঘরে একখাটে গাদাগাদি করে শুতে হত। ওই বাড়ির মেঝে এত নীচু আর ড্যাম্পধরা যে মাটিতে বিছানা পেতেও শোয়া যায় না। একটি অনতিপরিসর খাটে তিনজন পূর্ণবয়স্ক নারীপুরুষ, যাঁদের মধ্যে তার শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন, তাঁরা কষ্ট করে শুয়ে রাত কাটাবেন, আর তারা দুজন অন্যঘরে দরজা দিয়ে মধুনিশি যাপন করবে এই সম্ভাবনাকেই তিথির মনে হয়েছিল চূড়ান্ত অশ্লীল, অশোভন। তাই সে যেচে সুধা আর সীমার সঙ্গে শোয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এক্ষেত্রেও তিনজনকে একখাটে শুতে হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু তিথির মনে হয়েছিল সে নিজেকে, আর অন্যদেরও, একটা পীড়াদায়ক অশোভনতা থেকে বাঁচাতে পেরেছে।

সে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল, যখন দেখল এই ব্যবস্থাই গত চার-পাঁচ মাস ধরে স্থায়ী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। সীমা আনন্দে আছে, অলকের এসব ব্যাপারে মাথা ঘামানোর কথাই নয়, সুধাও কিছু বলেন না। পার্থ আড়ালে তাকে সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য জোর করে, সে চায় তিথি তার সঙ্গে রাত্রে একঘরে থাকুক, যদিও সেজন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করতেও সে রাজি নয়। তিথিও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকল।

তিথি মনে মনে বুঝতে পারে যা ঘটছে তা পুরোটাই অত্যন্ত গোলমেলে, জটিল। বিয়ের পর সে স্বামীর সঙ্গে রাত্রিবাস করে না, এ কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। এ ছাড়া তার আর করারও কিছু নেই। বিয়ের আগেই সে জানত, তাদের কোনো আলাদা ঘর নেই। এ বিষয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে পার্থকে প্রশ্নও তো করেছিল সে। পার্থর আশ্বাসবাণীই তার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছিল। কিন্তু ওই মিথ্যে আশ্বাসটুকু ছাড়া পার্থর আর কিছু দেওয়ার ছিল না।

এর মধ্যে একদিন সে আর পার্থ রাত্রে একসঙ্গে শুয়েছিল বটে, তবে তাদের সঙ্গে সুধাও ছিলেন। পার্থ সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরে দু-বার বমি করল, বাইরের খাবার হজম হয়নি। তিথি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল, সুধাও। হঠাৎ তিথি শুনল পার্থ সীমাকে বলছে, ‘এই, আজ তুই আর বাবা ওঘরে শো তো। আমি, মা আর তিথি এঘরে শোব। আমার শরীর খারাপ, রাত্রে উঠতে-টুথতে হবে।’

পার্থ হয়তো সত্যি কথাই বলেছিল। কিন্তু তিথির কেমন সন্দিগ্ধ লাগছিল। পার্থর জন্যে উদ্বিগ্ন মনটা গুটিয়ে শক্ত হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে।

তার মনে হওয়াটা ঠিকই ছিল। সুধা শুয়েছিলেন খাটের একধারে পাশ ফিরে, পার্থ মাঝখানে, অন্যপাশে তিথি। সে রাত্রে তার বুকের মাংসে আর বুকের মধ্যে, কোমরের ওপরে ও নীচে নিঃশব্দে এত জ্বালা আর চাপ সহ্য করতে হয়েছিল, যে বলার নয়। পার্থ তার শরীর থেকে একমুহূর্তের জন্যেও হাত নামায়নি। সুধাও একবারের জন্যেও ওপাশ থেকে এপাশে ফেরেননি। তিথি প্রাণপণে বিশ্বাস করার চেষ্টা করছিল এও তার একটি বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা।

ভোরের দিকে পার্থ তাকে মুক্তি দিয়েছিল। সে শাড়ি ব্লাউজ গুছিয়ে নিয়ে পার্থর পায়ের দিকে মাথা রেখে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়েছিল। পার্থ এখন পড়ে পড়ে ঘুমোবে, কিন্তু তাকে তো ঠিক সময়ে বিছানা ছাড়তে হবে। তার আগে অন্তত একটু ঘুম তার প্রয়োজন।

এই ঘটনার পর সে কিছুদিন পার্থর সঙ্গে কথা বলেনি। সীমা কথা বন্ধ করে দিয়েছিল তার আর পার্থর সঙ্গে। সুধা স্বাভাবিক ছিলেন। পরে সব কিছুই আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

দেশের বাড়িতে শোওয়ার এই ব্যবস্থা দেখে তিথি প্রথমে সংকুচিত বোধ করলেও সে ভীষণ অবাক হয়ে গেল, যখন দেখল তার গোপনে খুব আনন্দ হচ্ছে। আসলে, সে তৃষিত হয়ে উঠেছিল। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায়, অচেনা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে সে যেন খেই হারিয়ে ফেলছে, এখনই পার্থকে তার নিবিড় প্রয়োজন। অথচ পার্থকেও যেন হঠাৎ কেমন দূরের, ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে মনে হচ্ছে তার। রাত্রিটুকু তাকে কাছে পাওয়া যাবে জেনে হোক না আরও সবার উপস্থিতিতেই, তিথির নিশ্চিন্ত লাগছিল।

পার্থও তাকে রাত্রে বিরক্ত করেনি। বোধ হয় সে খুব সতর্কভাবেই সংযত হয়ে আছে। তা ছাড়া সারাদিন খাটাখাটনিতে ক্লান্তও। তিথি বালিশ থেকে মাথা নামিয়ে এনে পার্থর বুকের কাছে রাখে, পার্থও সেই মাথাটা আলতো হাতে জড়িয়ে নেয়। অন্ধকারেও তিথি বুঝতে পারে, তার পাশে শোয়া সীমা ঘুমোচ্ছে না। পার্থর বুকের কাছে একঘুম ঘুমোনোর পর তিথি বালিশে উঠে আসে। পার্থ তখন ঘুমে অচেতন। তিথি কান খাড়া করে সীমার নিশ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করে। মনে হয় সীমা তখনও জেগে।

সীমা প্রথমদিন দেশের বাড়িতে এসে তিথিকে সঙ্গে নিয়ে যেভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল, তার সেদিনের সেই উৎসাহ যেন হঠাৎ নিভে গেছে। তিথির খুব মনখারাপ লাগে। ভাবে, আজ রাত্রে সে আর পার্থকে ছোঁবে না। কিন্তু পার্থর জন্যেই সারাদিন আকুল প্রতীক্ষা করে সে, আর তার খুব একা একা লাগে। রাত্রে পার্থর বুকে মাথা রাখার জন্যে মুখিয়ে থাকে সে।

দুপুর গড়িয়ে আসছিল। পার্থ বেরিয়ে গেছে। অঘোর আর অসীম যে যার ঘরে ঘুমোচ্ছেন। অলকও। শিবানী আজ বড়োঘরে এসে সীমার পাশে শুয়েছেন। একটু আগে সীমা তাঁর সঙ্গে বকবক করছিল, এখন আর কারোরই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ওরাও নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।

তিথি খাটের ধারে বসে বসে শাড়ির আঁচল মুড়ছিল। এই শাড়িটা শিবানী তাকে দিয়েছেন। নাইলনের শাড়ি। সে এখানে আসার পরের দিন শিবানী কাউকে দিয়ে শাড়িটা কিনে আনিয়েছিলেন। তিথির হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোর শাশুড়ি এমন করে বউ নিয়ে এল, কিছু কিনেকেটেও রাখতে পারিনি। দ্যাখ দেখি, এইটে পছন্দ হয় কি না?’

তিথি শাড়ির কিছু বোঝে না। সে শুধু রং দেখে। হালকা গোলাপি রং। তাকে এ রং মানায় না, কিন্তু রংটা সুন্দর। সে ঘাড় নাড়ল—পছন্দ। প্রণাম করে শাড়িটা নিয়ে ঘরে আসতেই সীমা বলল, ‘এমা, ঠাকমাটা যেন কী! দিল তো একটা সুতির শাড়িও তো দিতে পারত। নাইলনের শাড়ি ভদ্রলোকে পরে! ঠাকমা বোধ হয় ভেবেছে নাইলনের শাড়ি খুব হালফ্যাশন!’

অতশত কিছু বোঝেনি তিথি। শ্বশুরবাড়িতে এসে অবধি তাকে শাড়ি পরতে হয়। কিন্তু তার শাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। এমনিতে সে সুধা আর সীমার শাড়িই পরে। এখানে আসার আগে সুধা পুজোয় পরার জন্যে তাকে আর সীমাকে দুটো পাড়ওয়ালা তাঁতের শাড়ি আর ব্লাউজ কিনে দিয়েছেন। মাধুবউদি একটা শাড়ি দিয়েছিলেন যেটা পরে সে এসেছে। আর এই একটা শাড়ি হল। শাড়িটা মন্দ কী! শুধু ধারগুলোয় বড্ড সুতো উঠছে। ওইটুকু মুড়ে নিতে হবে। শিবানীর কাছ থেকে সুচসুতো চেয়ে নিয়ে আজ ওই শাড়িটাই মুড়ছিল সে।

সুধা ঘরে ছিলেন না। দরজার কাছে এসে তিথিকে ডাকলেন, ‘তিথি, এসো তো আমার সঙ্গে। চলো ঠাকুরঘরে যাই। আস্তে আস্তে গোছগাছ শুরু করতে হবে।’

তিথি শাড়ি রেখে ঘোমটা ঠিক করে সুধার সঙ্গে চলল। বাড়িতে সবাই ঘুমোচ্ছে, সুধার সামনে তার ঘোমটা দেওয়ার কোনোই কারণ নেই। তবুও তিথি দিচ্ছে। অভ্যাস করা ভালো। দু-দিন পরে লোকজন আসতে শুরু করবে, এখানকার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা হবে। সুধাই বলেছেন, তাঁদের সামনে ঘোমটা দিয়ে থাকতে। তা ছাড়া, তিথি নিজেই বুঝতে পারছে, সে আর পাঁচটা স্বাভাবিক বিয়ে হওয়া বউদের থেকে আলাদা। তার স্বীকৃতির চারপাশে একটা অদ্ভুত শূন্যতা ভাসছে। ওই শূন্যতাটুকু ভরানোর

চেষ্টা তাকে করে যেতে হবে।

পুজোর কাজ করতে করতে তিথি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। তার বুকের মধ্যে হু-হু করে ওঠে থেকে থেকে। বাড়ির কথা, মা-বাবার কথা সে একেবারে ভাবতে চায় না আজকাল। ভাবতে গেলে ভয় করে তার। এ ভাবনার কোনো তলকূল নেই। বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর একদিনও যোগাযোগ হয়নি, কোনো খবরও পায়নি সে। তারও কোনো খবর নেননি মা-বাবা, মৌসুমীদের বাড়িতেও কোনো খোঁজ করেননি। তিথিও প্রাণপণে ভাবতে চেয়েছে তার আগের কোনো জীবন ছিল না, জীবনের প্রথম উনিশ-কুড়ি বছর যেন কবে মুছে গেছে তার অস্তিত্ব থেকে, আর এখন এই বাড়িতে আসার পর থেকে একথাটাকে সে যেন কেমন বিশ্বাস করতেই শুরু করেছে। পুজোর কাজ করতে গিয়ে তার হঠাৎ মনে হল, তার মায়ের কিংবা বাবার দিকের কোনো বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় না। মা একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, বাড়িতে দুর্গাপুজো হওয়া, সেই পুজোর কাজে অংশ নিতে পারা একটা ভাগ্যের কথা, একটা বিরাট অভিজ্ঞতা। আজ সে তার শ্বশুরবাড়ির পুজোর কাজে অংশ নিচ্ছে, তিথি ভাবল, এই কথাটা জানতে পেলে মায়ের কি একটুও আনন্দ হত না!

রঙিন কাপড় দিয়ে ছোটো ছোটো পতাকা বানাচ্ছিল তিথি। সে আগে জানতই না, দুর্গাপুজোয় এরকম পতাকা লাগে। সুধা তাকে কাপড় ভাঁজ করার কায়দাটা দেখিয়ে দিয়েছেন। তারপর একটা সিন্দুক খুলে তার মধ্যে থেকে বিভিন্ন সাইজের কৌটো বার করে কোনোটা ঝাঁকিয়ে কোনোটা ঢাকা খুলে দেখছেন। ওই পুরোনো কাঠের সিন্দুক আর তার ভেতরের কৌটোগুলো থেকেও একটা বিচিত্র গন্ধ বেরিয়ে ঘরের বাতাস ভারী করে তুলেছে। বাইরে শরতের রোদে মুচমুচে দুপুর, ঠাকুরঘরের ভেতরটা অদ্ভুত ঠান্ডা। তিথির কেমন নেশাচ্ছন্ন লাগছিল। তার নিশ্বাসও আবার গরম হয়ে উঠেছে।

সুধা তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, ‘পারছ? হ্যাঁ ওই তো হচ্ছে। ওরকম হলেই চলবে। এগুলো অন্যবার সীমাই করে।’ সুধা আবার সিন্দুকে মন দিলেন, খানিকটা নিজের মনেই বললেন, ‘তা ওর যে আবার কী হল, দেখছি তো শুধু গড়াচ্ছে। শরীর

খারাপের তারিখটাও এগিয়ে আসছে অবিশ্যি…’ সুধা সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করলেন। তিথির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সীমার শরীর খারাপ হয়ে গেলে শুধু তুমি আর আমি—ব্যাস! আর সবাই আসবে আর কেবল গল্প করবে। দেখো না, এসে তো পড়ল বলে সবাই। আমাকে আর সীমাকেই খেটে মরতে হয়, যেন পুজো শুধু আমাদেরই।

তিথির পতাকা বানানো হয়ে গিয়েছিল। সে মুখ তুলে বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ করব, হ্যাঁ বড়োমা? আমাকে কাজ দাও, আর কী করতে হবে?’

‘আজ আর থাক। এবার ওঠো, আস্তে আস্তে হবে’খন।’

কিন্তু তিথির আরও কাজ করতে ইচ্ছে করছে, কাজে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছে নেশার মতো। সে জেদ ধরে বলল, ‘না বড়োমা, কাজ বলো। দেখো আমি ঠিক পারব, তুমি একটু শিখিয়ে দিলেই পারব। বলো না, কী করব আর?’

সুধা তিথির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে দেখলেন, সে সত্যিই আন্তরিকভাবে কাজ করতে চাইছে। খুশি হয়ে একটা কুলো পেড়ে তাতে ধান ঢাললেন, ‘তাহলে এগুলো বেছে রাখো। গোটা ধানগুলো বেছে সরিয়ে এই কৌটোয় তুলে রাখবে। খোসাওঠাগুলো কুলোয় থাকবে, কেমন?”

সুধা চলে গেলে তিথি একা একা একাগ্র হয়ে ধান বাছছিল। তার সমস্ত মন বড়ো অস্থির হয়ে আছে। অস্থির মনকে শাসন করবার এই একটিই উপায়, তাকে কোনো এক বিন্দুতে জড়ো করা। অস্থিরতার ভয়ে তিথি যেন নিশ্বাসও চেপে রাখতে চাইছিল।

জ্বর আসছে। সেইসঙ্গে পুজোও। এই প্রথম পুজোর সময় জ্বর হচ্ছে তিথির। এই প্রথম সে পুজোয় কলকাতার বাইরে, বাড়ির বাইরে—। তিথি নিজেকে সামলে নিল। বাড়ি বলতে এখনও কোন বাড়ি বোঝে সে? যে বাড়ি সে চিরদিনের জন্যে ছেড়ে চলে

এসেছে, সেই বাড়ি!

বাড়ি-ভরতি লোক। অলকের ভাইরা সবাই এসে গেছেন। তাঁদের স্ত্রীরা, ছেলেমেয়েরা। বাড়িটা যেন আমূল বদলে গেছে। সেই ফাঁকা ফাঁকা ঘর, খাঁ-খাঁ বারান্দা এখন হাঁকেডাকে, কথাবার্তায়, ঝগড়ায়, হাসিতে, বাচ্চাদের ছুটোছুটিতে মশগুল। কোথাও, এমনকী তিথির মাথার মধ্যেও যেন একচিলতে নিরিবিলি নেই। এই ক-দিনে তাকে এতরকম প্রশ্নের উত্তর এতবার করে দিতে হয়েছে যে বলার নয়। তার বিয়ের কথা সবাইই জেনে গিয়েছিলেন, এখানে আসার পর জলজ্যান্ত তাকে দেখে তাঁদের কৌতূহল আর বাধা মানছে না।

পার্থর সেজোকাকা অমল আর ভালোকাকা অনিল এলেন একই সঙ্গে, সপরিবারে। তাঁরা যখন এসে পৌঁছোলেন, তিথি তখন বাথরুমে স্নান করছে। উঠোনের পাশেই বাথরুম। তিথি যখন স্নান সেরে বেরোল, তখনও সবাই উঠোনেই দাঁড়িয়ে আছেন।

বাথরুমের মধ্যে শাড়িটা ভালো করে পরতে পারেনি তিথি, কেবল গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। এটা সেই শিবানীর দেওয়া গোলাপি নাইলনের শাড়িটা। তার বাঁ-হাতের ওপর জলকাচা ছাড়া শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ আর ভিজে গামছার বোঝা। ডান হাতে চশমা। বাথরুম থেকে বেরিয়েই সামনে উঠোন ভরতি লোক দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিল তিথি। তার ওপর চশমা ছাড়া সে তখন রীতিমতো ঝাপসা দেখছে। চশমাটা জলের ফোঁটায় ভরতি, ভালো করে না মুছে পরাও যাবে না। তিথি চশমা ছাড়াই বুঝতে পারছিল, আগন্তুকদের সবার মাথা তার দিকেই ঘোরানো। সদ্যআয়ত্ত রিফ্লেক্সে সে মাথায় শাড়ি টানল।

কয়েক মুহূর্তের রুদ্ধশ্বাস স্তব্ধতা ভেঙে দিলেন শিবানী। একগাল হেসে বললেন, ‘বলো দেখি কে?’

তাঁর প্রশ্নটা তিথির উদ্দেশে নয়, তাঁর পুত্র-পুত্রবধূদের উদ্দেশে। তিনি পা ঘষে ঘষে তিথির দিকে এগিয়ে আসছিলেন। যাঁদের

তিনি প্রশ্নটা করলেন তাঁরা জানেন উত্তরটাও শিবানীই দেবেন। তাঁরা সেই অপেক্ষাই করছেন।

‘এইটাই তো পার্থর বউ!’ শিবানী তিথির কাছে পৌঁছে তার হাত ধরলেন।

‘অনিল যখন আমায় চিঠিতে লিখেছিল, আমার তো প্রথমটায় বিশ্বেসই হয়নি। তারপর দেখি ও মা! এ যে সত্যিকারের দ্যাখ, তোরাই অ্যাদ্দিন দেখিসনি, আমি কেমন তোদের বউ দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিলুম!’

অমলের স্ত্রীর নাম দীপ্তি, তিনি বলে উঠলেন, ‘খবরটা তাহলে সত্যি! আমাকেও সুমিতা যখন বলেছিল আমিও বিশ্বাস করতে পারিনি। তার পরে মেজদাদের কাছে শুনেও—’

দীপ্তি কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই চকিতে একবার অঘোরের ঘরের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। অঘোর একটু আগেই উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, এখন ঘরে ঢুকে গেছেন। কিন্তু দীপ্তির মনে হল এখানে দাঁড়িয়ে অরূপদের কথা বলা হয়তো ঠিক নয়।

সুমিতা অর্থাৎ অনিলের স্ত্রীর যদিও এরকমটা মনে হয়নি। তিনি তিথিকে আগাপাশতলা দেখছিলেন, বললেন, ‘ও! এই তাহলে মৌয়ের সেই বন্ধু!’

তাঁর বলার ভঙ্গিতে একটা বাঁকা সুর ছিল। তিথির মনে হল উনি ভেবেছিলেন মৌয়ের বন্ধু নিশ্চয়ই সুন্দর দেখতে হবে। শিবানী তিথির পিঠে হাত রাখলেন, ‘ও তিথি! এঁরা তোর খুড়শ্বশুর খুড়শাশুড়ি। যা মা, পায়ের ধুলো নে। আর ওরা সব তোর ননদ আর দেওর।’

বউ! তা

তিথি চশমা ছাড়া সবার অবয়বের আন্দাজই শুধু পাচ্ছে, তার বেশি ভালো করে তেমন বুঝতে পারছে না। শিবানী যাঁর নাম বললেন অনিল, তিথি জানে, ইনিই পার্থর ভালোকাকু। তিথি পার্থদের বাড়িতে চলে আসার পর ইনি একবার সেখানে গিয়েছিলেন। তিথি তখন সুধার সঙ্গে রান্নাঘরে। সীমা ছুটে এসে বলেছিল, ‘মা! ভালোকাকু এসেছে, কী হবে?’

সুধা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললেন, ‘বসা গে যা, বল আমি আসছি। আর তিথি তুমি শিগগির রুম্পাদের ঘরে চলে যাও। আমি না ডাকলে নামবে না।’

তিথি তাই করেছিল। ওপরে মাধুবউদির কাছে বসে থাকতে থাকতে তার নিজেকে মনে হচ্ছিল ফেরারি আসামি।

শিবানীর কথা শুনে তিথি অনিশ্চিত পদক্ষেপে এগোল। অনিলের কাছে এসে প্রণামের জন্যে ঝুঁকতেই তিনি একটু সরে গেলেন, ‘না না, পরে হবে। স্নান করে বেরিয়ে আর পায়ে হাত দেওয়ার দরকার নেই।’

তিথি একটু থমকে গিয়েছিল। সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শুনল কোনো একজন কাকিমা তাকে প্রশ্ন করছেন, ‘এরকম ঘোমটা দিচ্ছ কেন? আমরাই তো ঘোমটা দিই না!’

তিথি কারও দিকে তাকাল না, মাথা নীচু রেখেই বলল, ‘বড়োমা বলেছেন এখানে ঘোমটা দিয়ে থাকতে।…আমি একটু আসি? এসে প্রণাম করব।’

তার হাত ধরে যাচ্ছিল ভিজে কাপড়ের ভারে। শিবানী বললেন, ‘আচ্ছা, তাই আয়। একেবারে কাপড়-টাপড় পরে চুলটুল আঁচড়ে সিঁদুর দিয়ে—’

তিথি চলে আসতে আসতে শুনল আরও একটা প্রশ্ন ছুটে আসছে, ‘বড়োমা কে?’ সে দ্রুতপদে ভিজে কাপড়গুলো বারান্দার তারে রেখে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। নিজেকে গুছিয়ে নেবার জন্যে তার একটু সময় দরকার।

তারপর অন্য দুই কাকাও এসে পড়লেন। অরুণ আর অশোক। এঁরা পার্থর ন-কাকু আর রাঙাকাকু। অরুণ অবশ্য একাই এসেছেন, তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছেন। অশোকের স্ত্রীর নাম মল্লিকা। দীপ্তি, সুমিতা আর মল্লিকা গত কয়েক দিনে তিথিকে একটুও একা থাকতে দেননি।

‘তুমি তো বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ?’

‘পালিয়ে আসিনি। চলে এসেছি।’

সুমিতা তাঁর প্রশ্ন আর তিথির উত্তরের পার্থক্যটা ঠিক বুঝতে পারলেন না, কিন্তু পরবর্তী প্রশ্নে চলে গেলেন।

‘বড়দিভাই, মানে তোমার শাশুড়ি, তোমায় কিছু দেননি?’

এবার তিথিই প্রশ্নটার মানে বুঝতে পারছিল না। সে সুমিতার দিকে অবাক চোখে তাকাল। দেখল, সুমিতা প্রশ্নটা করে তার সর্বাঙ্গে চোখ বুলাচ্ছেন। তিথি প্রশ্নটা ধরতে পারছে না দেখে মল্লিকা একটু ব্যাখ্যা করে দিলেন, ‘তুমি কানে গলায় হাতে-টাতে কিছুই পরে নেই দেখছি, মানে, সোনা-টোনা কিছু দেয়নি তোমায়?’

তিথি চোখে অন্ধকার দেখল, এ সমস্ত বিচিত্র প্রশ্নের সামনে সে কখনো পড়বে ভাবেনি, এর উত্তরে কী বলতে হয় তাও তার অজানা। সে নিজের দু-হাত দেখল, সেখানে লোহা আর প্লাস্টিকের শাঁখা-পলার সঙ্গে দুটো করে সরু সরু ব্রোঞ্জের চুড়ি।

এগুলো দেশের বাড়িতে আসার আগের রাত্রেই সুধা তাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। তার কানেও এতদিন কিছু ছিল না, মায়ের কাছে থাকার সময় যে সোনার রিং দুটো পরত সেগুলো ওই বাড়িতেই খুলে রাখা ছিল। ক-দিন আগে সীমা তাকে একজোড়া লালপাথরের টপ পরতে দিয়েছে। তার গলা এখনও খালি। কিন্তু এসব নিয়ে সে নিজের মধ্যে তো কোনো প্রশ্নের সামনে পড়েনি? এতগুলো তীক্ষ্ণ কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে আজ তার হঠাৎ মনে হল—সে কি নগ্ন? তার গায়ে কোনো আবরণ নেই! তার খোলা গায়ে দৃষ্টিগুলো যেন তীরের মতো বিঁধছে। তীরের আগায় কী যেন আদিম গুল্মের রস মাখানো…কৌতূহল ব্যঙ্গ অবজ্ঞার ঝাঁঝালো দ্রবণ, প্রাণঘাতী।

তার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ দেখে দীপ্তি নিজের মুখটা করুণ করলেন, সুমিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আহা!’ কিন্তু তাঁর চোখে কোনো দুঃখ ছিল না। মল্লিকা সাড়ম্বরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ চাপা দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন, ‘যাকগে যাকগে। কিন্তু তুমি এমন মনমরা হয়ে আছ এটাও তো ঠিক না! নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছ, হাসবে গল্প করবে আড্ডা মারবে—’ মল্লিকা মুখে হাসি টেনে চোখ নাচালেন, ‘তোমার বরটা তো মিষ্টি ছেলে, এবার ওকে একটা চাকরি-বাকরি করতে বলো।’

তিথি মুখ তুলছিল না। দীপ্তি তার চিবুকে হাত দিয়ে টানলেন, ‘দেখি দেখি, ওর তো মনখারাপ হবেই, মা বাবার জন্যে প্রাণ কাঁদছে, তাই না?”

তিথি আর সহ্য করতে পারছিল না। সব কিছু যেমন চলছে তেমনই চলুক। এর মধ্যে আবার মা-বাবার কথা মনে করানো ও তো তার গত জন্মের কথা, সে ওসব কিচ্ছু মনে রাখতে চায় না।

মল্লিকা উদাস উদাস গলায় বললেন, ‘তাও বটে! ওর মা-বাবারও এবারের পুজোটা খুব কষ্টে কাটবে।’

কেন?

ওঃ ঈশ্বর! তিথি এবার ঠিক পাগল হয়ে যাবে। যা সে প্রাণপণে ভুলে থাকতে চায়, এরা সেটা নিয়েই এমন নাড়াচাড়া শুরু করল কেন! সে মা-বাবাকে চায় না। সে পার্থকে চায়। তিথির মাথা ঝুঁকে পড়েছে তার বুকের কাছে, তার চারপাশে সবাই কে কী কথা বলে চলেছে, অনবরত আরও কী প্রশ্ন করে চলেছে সেসব সে যেন আর শুনতেই পাচ্ছে না। প্রবল জ্বরের প্রলাপের মতো সে মনে মনে চিৎকারকরে বলে যাচ্ছে, ‘পার্থ পার্থ পার্থ তুমি কোথায় কোথায় কোথায় আমাকে বাঁচাও আমি মরে যাচ্ছি-ই-ই-ই…’

এখানে আসার পর থেকে তিথি একদিনও বাইরে বেরোয়নি। বেরোনোর সুযোগই হয়নি। তার খুব ইচ্ছে ছিল প্রতিমা গড়া দেখবে। পুজোবাড়িতেই প্রতিমা গড়া হচ্ছে। কিন্তু পুজোবাড়িটা এই বাড়ি থেকে বেশ একটু দূরে, মেজোতরফের বাড়ির লাগোয়া। পার্থকে সেখানে দু-বেলাই যাতায়াত করতে হচ্ছে। তিথি পার্থকে একবার বলেছিল তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু পার্থ বলল, ‘আমি তো সোজা পুজোবাড়ি যাচ্ছি না, দোকানবাজার পুরোহিত মশাইয়ের বাড়ি এখানে-সেখানে ঘুরতে ঘুরতে কোনো দরকারে একবার হয়তো গেলাম, পরক্ষণেই আবার বেরিয়ে গেলাম অন্য কাজে। কী করে এখন তোমায় নিয়ে যাই বলো! তার চেয়ে পরেই যেয়ো।’

তিথির তাও ইচ্ছেটা মরেনি। সে ভাবছিল কথাটা আর কাউকে বলা যায় কি না। সীমাকে হয়তো বলা যেত, কিন্তু তিথি লক্ষ করেছে সীমা তাকে এড়িয়ে চলছে। বিশেষ কথাবার্তাও বলে না তার সঙ্গে। এটা হয়তো রাত্রের ব্যাপারটার জন্যেই। কিংবা এও হতে পারে তার শরীর ভালো নয় বলে বিশেষ কাজকর্ম করতে পারছে না, এদিকে সুধা পুজোর গোছগাছে তিথিরই সাহায্য নিচ্ছেন এতে সীমার দুঃখ হচ্ছে। সে সীমার মনের চলন সবসময় পুরোপুরি বুঝতে পারে না, তার একটু জটিলই লাগে।

কাকুদের ছেলেমেদের সঙ্গে তিথির মোটামুটি ভাব হয়েছে। অনেকেই তার চেয়ে বেশ ছোটো। দু-তিনজন তার প্রায় সমবয়সি বা একটু বড়ো। এদের মধ্যে সেজোকাকুর মেয়ে বান্টির সঙ্গে একটু বেশি কথাবার্তা হচ্ছে তার। বান্টি তিথির থেকে এক বছরের ছোটো, এ-বছর ইংরেজি অনার্সে ভরতি হয়েছে। একফাঁকে বান্টির সঙ্গে দেখা হতে তিথি বলল, ‘বান্টি, তুমি পুজোবাড়ির

‘হ্যাঁ! কেন বউদি?

ঠাকুরঘরের সামনে ছোটো উঠোনের একপাশে বসে একরাশ তামা পিতলের পিলসুজ ধূপদানি কোশাকুশি নিয়ে তিথি তেঁতুল দিয়ে ঘষে ঘষে মাজছিল। সুধা এগুলো ঠাকুরঘরের সিন্দুক থেকে বার করে দিয়ে নীচে গেছেন। বাসনের ঘর খুলিয়ে পুজোর বড়ো বড়ো পিতলের থালা বালতি গামলা, কাঠের বারকোশ-টারকোশ বার করতে। তাঁর নিশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। তিথি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না, কিন্তু সত্যিই এ বাড়ির এত লোকের মধ্যে আর কেউই পুজোর কোনো কাজ করছে না। যদিও কাকিমাদের দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা নিজেদের স্নানের জলগরম, কাপড় কাচা, নিজের ছেলেমেয়ের জলখাবার নিয়ে সারাদিন দারুণ ব্যস্ত। তাও তাঁরা এত গল্পের সময় কোত্থেকে পাচ্ছেন ওঁরাই জানেন। আর সীমা সারাদিন মনখারাপ করে শুয়ে থেকে কিংবা ঠাকুমার সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দিচ্ছে। তিথি খেয়াল করেছে, সীমার সঙ্গে, এমনকি সুধার সঙ্গেও অন্যান্য কাকিমা বা তাঁদের ছেলেমেয়েদের তেমন মাখামাখি নেই। এসবই নিশ্চয়ই অলকের আর্থিক অবস্থার জন্যে। তিথি এক

রাস্তাটা চেনো?’

‘চলো না, আমরা পুজোবাড়িতে গিয়ে ঠাকুর গড়া দেখে আসি?’

‘মাই গড!’ বান্টি চোখ কপালে তুলল, ‘পুজোর আগে পুজোবাড়িটা বিচ্ছিরি হয়ে থাকে। ফাঁকা, আলো নেই, ভেতরে ঢুকলে ভয় করে। তা ছাড়া রাস্তা চিনি মানে কি আর এমনি এমনি চলে যেতে পারব? বাবা কিংবা কাকু-জেঠুদের সঙ্গে যেতে হবে।’

তিথি আর কিছু বলেনি। কাকু-জেঠুদের আশা করা বৃথা। তাঁদের সঙ্গে তিথির যথেষ্ট দূরত্ব। তা ছাড়া, এখানে এসে অবধি তাঁরা শুধুই নিজেদের মধ্যে গল্প করে, তাস খেলে, খেয়েদেয়ে আর ঘুমিয়ে কাটাচ্ছেন। তিথির খুব অবাক লাগে দেখে। যাঁদের বাড়ির পুজো, তাঁরাই পুজো সম্বন্ধে এত উদাসীন কী করে? পার্থ একাই ছুটে ছুটে খেটে মরছে।

ভালোকাকু ছাড়া অন্য কাউকে পার্থদের বাড়িতে তো যেতেও দেখেনি। অরূপ বা মিতাও যে তাদের ওখানে খুব যাতায়াত করেন তা নয়, তবু যেন ওঁদের সঙ্গেই পার্থদের হৃদ্যতা আছে। সেটা হয়তো মিতা কাকিমা মানুষ হিসেবে খুব ভালো, সেই জন্যে। তিথি যেটুকু বুঝেছে, এই সব কাকিমাদের থেকে শিক্ষায়-দীক্ষায় রুচিতে, মনে হয় সচ্ছলতাতেও মিতাকাকিমারা অনেক এগিয়ে। তিথি একটা নিশ্বাস গোপন করল। ওই মিতা কাকিমাই এই দেশের বাড়িতে কোনোদিনও আসতে পারলেন না।

সীমা যে তার সঙ্গে কথা-টথা বলছে না, এ ব্যাপারটা কাকিমাদের চোখ এড়ায়নি। তিথি জানে তাঁরা সীমাকেও তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ছাড়েননি। এই তো গতকালই সকালে সে ঠাকুরঘরে বসে সলতে পাকাচ্ছিল, তার আগে একরাশ মাটির প্রদীপ ধুয়ে উঠোনে উপুড় করে শুকোতে দিয়ে গেছে। সলতে পাকানো শেষ হয়ে যেতে সে বাইরে এসেছিল প্রদীপগুলো চিত করে রাখতে, যাতে তার ভেতরটাও শুকোয়। সে উবু হয়ে বসে সেটাই করছিল, কানে এল, ‘যাই বল, মেয়েদের এত লম্বা হওয়া ভালো না, মন ছোটো হয়, তাই না সীমা?”

‘এই আস্তে, শুনতে পাবে!’

গলা দুটো সুমিতা আর মল্লিকার। তিথি শুনতে পেয়েও না শোনার ভান করছিল। জটলাটা হচ্ছিল বারান্দার কোণে। একটু পরে সে চোখ তুলে দেখল সেখানে কেউ নেই।

সকালের এই ঘটনার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু তারপর সন্ধ্যেবেলায়ই সুমিতা যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সীমার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়েছে?’ তিথি ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠেছিল। সে সোজা সুমিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না তো! ঝগড়া কেন হবে?

‘ও যে তোমার সঙ্গে কথা বলে না দেখি?’

‘বড়দির শরীর খারাপ।’ তিথি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে আসছিল, সুমিতা বললেন, ‘শরীর খারাপ না, আসলে মনখারাপ। বুঝতে পারো না, ওর তো কিছুতেই বিয়েটা হচ্ছে না, তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে তো?’

তিথির আবার শরীর খারাপ লাগছিল। মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছে, কানের মধ্যে গরম হাওয়া বইছে। তার মনে হল আবার জ্বর আসছে। আসুক। এই জ্বরটাই তার পালানোর, আত্মগোপনের, মুক্তির একমাত্র উপায়। জ্বর এলে মাথার মধ্যে রক্তগুলো ঝিমঝিম করে, কাঁপে, সে কোনো কথা শুনতে পায় না।

পিলসুজের খাঁজে খাঁজে জোরে জোরে তেঁতুল ঘষতে ঘষতে তিথি মন থেকে এইসব কথা তাড়ানোর চেষ্টা করছিল। তার সামনে একটা ছায়া পড়তেই মুখ তুলে দেখল বান্টি দাঁড়িয়ে আছে।

‘হাই বউদি!’ বান্টি তার সামনে ঝুপ করে বসে পড়ল, ‘একটু তেঁতুল দাও তো।’

তিথি ডান হাতের উলটোদিক দিয়ে তেঁতুলের বাটিটা ঠেলে দিল, ‘আমার হাত নোংরা। কী করবে তেঁতুল দিয়ে?’

‘কী আবার করব? খাব!’ বান্টি জিভ বার করল, ‘এই দ্যাখো বিট নুন, ঠাম্মার কাছ থেকে ম্যানেজ করেছি। মাকে বোলো না যেন, তেঁতুল খেলে আমার কাশি হয়।’

তিথি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘তবে খাচ্ছ কেন? তা ছাড়া ওটা থেকে হাত দিয়ে বার বার নিয়ে নিয়ে এইসব মাজছি, ওই নোংরা জিনিসটা মুখে দেবে?’

‘ছাড়ো তো! তেঁতুল দেখেই আমি ঠিক করে ফেলেছি খেতেই হবে। উফফ্ কতদিন যে খাইনি। মা এইমাত্র স্নান করতে ঢুকল,

মানে মিনিমাম ফটি ফাইভ মিনিটস্! তার আগেই আই মাস্ট ফিনিশ।’

বান্টি এক খাবলা তেঁতুল উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।

বেশ খানিকক্ষণ পরে, তিথির তখনও মাজাঘষা শেষ হয়নি, ওপাশের উঠোন থেকে নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকারশুনে তিথির প্রথমেই মনে হল—এই রে! বান্টি নিশ্চয়ই মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারে কেউ এমন চিৎকারকরতে পারে বলে তার বিশ্বাস হল না। তা ছাড়া চিত্কারটা ক্রমশ একটা গোলমালে পরিণত হচ্ছিল। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিথির মনে হল বাড়িতে একটা প্ৰলয় চলছে।

চিত্কারটা বান্টির মা দীপ্তিই করছিলেন বটে, তবে তার কারণ বান্টি নয়, অসীম। বাড়িতে লোকজন আসার পর যথারীতি অসীমের উপদ্রব বেড়েছে। তার সঙ্গে নিত্য ঝামেলা লাগছে সবারই। সে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। বাড়িতে এতগুলো লোক। বিনা কারণে একটা বাথরুম এতক্ষণ আটকে রাখলে সবারই অসুবিধে। এই নিয়ে সকাল থেকে রাগারাগি চিৎকারচেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আজকের ঘটনা আরও গুরুতর।

ব্যাপার হচ্ছে এই, অসীম রোজ সকাল থেকে বড়ো বাথরুমটা আটকে রাখে বলে দীপ্তি আজ তক্কে তক্কে ছিলেন। অসীমের তেল মাখা শেষ হতেই তিনি একরাশ জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেছিলেন। এতে অসীম খেপে গেছিল। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি। দীপ্তি যথেষ্ট সময় নিয়ে জামাকাপড় কেচে স্নান করে বেরোনো অবধি সে অপেক্ষা করেছে।

দীপ্তি কাচা জিনিসগুলো একটা বালতিতে নিয়ে বাইরে এসেছিলেন। বালতিটা উঠোনে রেখে তিনি সবে তারে একটা জামা মেলেছেন, বালতি থেকে আর একটা তুলতে যাবেন, এমনি সময় হঠাৎ অসীম কোত্থেকে এসে বালতি কেড়ে নিয়ে জামাকাপড়গুলো উঠোনে ছুড়ে ফেলে বলেছে, ‘এটা আমার চানের বালতি, তুমি হাত দিয়েছ কেন?’ শুধু তাই নয়, দীপ্তির

বক্তব্য অসীম তাঁকেও এত জোরে ধাক্কা দিয়েছে যে তিনি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন।

তিথি যখন ঘটনাস্থলে এসে দাঁড়াল তখন অবশ্য দীপ্তি নয়, অসীমই মাটিতে পড়ে। চারপাশে ভিজে জামাকাপড়গুলো ছড়ানো, সারা উঠোনও ভিজে। এত জল কোত্থেকে এল, তিথি ভাবল, সেজোকাকিমা কি জামাকাপড়গুলো কেচে ভালো করে নিংড়াননি?

উঠোনে ভিড়, তিথি ভিড়ের ফাঁক দিয়েই দেখল, অমল ঝাঁপিয়ে পড়লেন অসীমের ওপর, তাঁর উদ্যত হাতে একপাটি চটি। অসীম একটা জান্তব চিৎকারকরে মার বাঁচাতে দু-হাতের মধ্যে মুখ আর মাথা লুকাল।

তিথি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। মারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অমলের গর্জনও। পাগলটাকে তিনি আজ মেরেই ফেলবেন। তাঁর স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে, এত দুঃসাহস! দীপ্তিও সমানে পাগলের চোদ্দোগুষ্টি উদ্ধার করে যাচ্ছেন পরিত্রাহি চিৎকারকরে। কিন্তু আশ্চর্য, অত মার খেয়েও অসীম আর একটাও শব্দ করছে না, একটা কাতরোক্তিও আর বেরোচ্ছে না তার মুখ দিয়ে।

শিবানী পাগলের মতো ছুটে এলেন। তাঁর চিৎকারআর কান্না কানে যেতেই চোখ খুলল তিথি। শিবানী আসীমের ওপর লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর শরীর থেকে এখন শাড়িটা প্রায় সম্পূর্ণই বিচ্ছিন্ন। শুধু কোমরের গিঁটটা কোনোক্রমে লেগে আছে। শায়া আর ব্লাউজপরা অবস্থায় তিনি নিজের অক্ষম শরীর দিয়ে অসীমকে আপ্রাণ আড়াল করতে চাইছিলেন। আরও অন্যরাও তখন অমলকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছেন। তিথির মনে হল অসীম নয়, মারতে মারতে অমলই যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছেন। তাঁকে থামানো যাচ্ছে না। অসীমকে বাঁচাতে গিয়ে শিবানীও মার খাচ্ছেন। তিথি অস্থির হয়ে উঠছিল। বাড়ির এতগুলো লোক কেউ কিচ্ছু করতে পারছে না! শেষে কি একটা বীভত্স কাণ্ডই ঘটবে নাকি এখানে?

শিবানী বুকফাটা চিৎকারকরে কাঁদছিলেন, ‘আমায় মার, আমায় মার, ও অমল আমায় মার! ওকে আর মারিসনি, মরে

যাবে—পাগল ছাগলের ওপর এত রাগ করে না, ও বউমা আমায় মেরে ফ্যালো—ওগো, এ কী সব্বোনাশ হল গো—’

তিথির চোখ ফেটে জল আসছিল। তার মনে হল ছুটে গিয়ে শিবানীকে জড়িয়ে ধরে। তার আগেই দেখতে পেল, শিবানী হামাগুড়ি দিয়ে অমলের পা জড়িয়ে ধরলেন।

তিথি কয়েক মুহূর্ত নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তারপর ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে এল সে। দেখা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। সবাইই তাই দেখছে। কিন্তু তার পক্ষে আর দেখাও সম্ভব নয়। তিথির আবার মনে হল, এখানে যা ঘটছে সবই খুব অলীক। সে আসলে এখানে কোথাও নেই সত্যি সত্যি। সে যেন একটা দুর্বোধ্য জটিল স্বপ্নের মধ্যে ভাসছে।

তিথির মনে তিথি সরে এল বটে, কিন্তু তার চোখের সামনে থেকে দৃশ্যটা মুছল না। শিবানী তাঁর সেজোছেলের পায়ে পড়ছেন, হল—এই দৃশ্য সে কোনোদিনই ভুলতে পারবে না। হয়তো পরে তার মনে হবে এরকম কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেনি কখনো, পুরোটাই তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা।

আসলে, তিথি ভাবছিল, এটা তার কাছে যত অসম্ভব বলেই মনে হোক না কেন, শিবানীর এ ছাড়া আর কিছু করার নেই। সে নিজে শিবানীর মতো পরিস্থিতিতে পড়লে, যা একইসঙ্গে ভয়াবহ আর করুণ, হয়তো এরকমই করতে বাধ্য হত।

এখানে আসার পর থেকেই সে দেখেছে, শিবানী প্রতি মুহূর্তে অসীমের জন্যে আতঙ্কিত হয়ে আছেন। তাকে নিয়ে গোলমাল বাধলে তিনি একবার অসীমকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করছেন, আবার পা ঘষে ঘষে অন্য ছেলে বউদের কাছে গিয়ে হাত ধরে মিনতি করছেন। পুজোর সময়টাই তাঁর সবচাইতে ভয় আর অশান্তির সময়, কিংবা তাও হয়তো নয়, এই পুজোর সময়টাই তাঁর হয়তো সবচাইতে সুখের সময়। এ সময় তাঁর ঘর ছেলেপুলেতে ভরে ওঠে, তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া মারামারি

করে, তিনি ওদের শান্ত করেন, সামলান।

তাঁর সাত ছেলে, কোনো মেয়ে নেই। ছেলেরা বড়ো হয়ে তাঁর থেকে এত দূরে সরে গেছে যে শিবানী তাদের নাগাল পান না। শুধু ছোটো ছেলেটিই রয়ে গেছে তাঁর স্নেহের গণ্ডির মধ্যে। এমনকি তার যেন আর বয়স বাড়েনি। আজও সে একটা বাচ্চারই মতো মায়ের ওপর অসহায়ভাবে নির্ভরশীল। পক্ষীমাতার মতো শিবানী তাকে ডানার তলায় ঢেকে রেখে যাবতীয় ঝড়ঝাপটা থেকে রক্ষা করেন। তিথির হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা শিবানীর কি একটা ছেলে পাগল হয়ে ভালোই হয়েছে? তাঁরও কি তাই মনে হয়? অসীমের পাগলামি বাড়লে শিবানী তাকে কোলের ছেলের মতো স্নান করিয়ে মাথা আঁচড়ে দেন, জামাকাপড় পরিয়ে দেন, খাইয়ে মুখ ধুইয়ে দেন। এই উন্মাদ যুবকটিই হয়তো তাঁর আহত পরিত্যক্ত মাতৃহৃদয়ের একমাত্র চরিতার্থতা। তাঁর অন্য অন্য ছেলেরা, যারা বড়ো বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে জ্ঞানে বুদ্ধিতে যাবতীয় উচ্চতায় তাঁর স্নেহের নাগাল ছাড়িয়ে গেছে, অসীমকে বাঁচাতে গিয়ে তাদের পায়ে পড়া শিবানীর পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। বরং শিবানীর পক্ষেই সম্ভব।

শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা যে কীভাবে মিটবে তিথি বুঝতে পারছিল না। সে ছোটো উঠোন পেরিয়ে চলে এসে একেবারে বারান্দার উত্তর দিকে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘটনাস্থল থেকে যতটা সম্ভব দূরে। শিবানীর কান্না আর গোলমাল ছাপিয়ে একবার যেন মনে হল অঘোরের গলা পাওয়া যাচ্ছে। তিথি জায়গাটায় যতক্ষণ ছিল অঘোর ঘর থেকে বেরোননি। তিনি সাধারণত এসব অশান্তিতে মাথা গলান না। আজ তাঁর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছে।

তিথি বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিশেষ কিছু দেখবার নেই। যতদূর চোখ যায় ঘেঁষাঘেঁষি পুরোনো পুরোনো বাড়ি, তাদের উঁচু-নীচু ছাদ। গাছপালাও তেমন চোখে পড়ে না। দক্ষিণ দিকে একটা টানটান পিচের রাস্তা লম্বালম্বি পুব-পশ্চিমে বিছিয়ে আছে। ওই রাস্তাটা নাকি সোজা গঙ্গার ধারে গিয়েছে। তিথির খুব ইচ্ছে করে ওই পথটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে গঙ্গা দেখে আসতে। কিন্তু সে কী করে যাবে। আজ অবধি পুজোবাড়িতেই যাওয়া হল না তার। ভোররাতে যখন ঘুম ভাঙে শরীরটা ভীষণ

অবসন্ন লাগে, বোধ হয় রাত্রে জ্বর আসার জন্যেই। সে চুপচাপ বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে পড়ে থাকে। তখন শুনতে পায় কারা ওই রাস্তা ধরে খঞ্জনি বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে চলেছে, ‘রাই জাগো রাই জাগো বলে শুকশারি গাহে রে…’ ওরা বোধ হয় অত ভোরে গঙ্গাস্নানে যায়। গভীর ভালো লাগা আর দুঃখবোধ মিশিয়ে তার মনটা আবার দুমড়ে যেতে থাকে, তিথি দু-হাতে সেই মনটাকে ধরে কোঁচকানো কাগজের মতো চেপে চেপে টেনে সমান করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়। মনে খুব টান পড়লে উদাস হয়ে যেতে পারাটাই কাজের কাজ, তিথি এ বাড়িতে এসে বেশ বুঝতে পারছে।

এখনও তার মনটা একটা সাদা কাগজের মতোই হাওয়ায় ভাসছিল। হঠাৎ সে চোখে সত্যি সত্যি অন্ধকার দেখল। কে যেন পেছন থেকে তার চোখ চেপে ধরেছে।

হাঁকপাক করে উঠতেই পেছনে হাসির শব্দ শুনতে পেল তিথি। —পার্থ!

তিথি আনন্দ বিস্ময়ে পার্থকে প্রায় জড়িয়েই ধরতে যাচ্ছিল। কোনোরকমে সামলে নিল। দমবন্ধ হওয়া গলায় বলল, ‘তুমি!’ ‘উরিব্বাস, বাড়িতে কী ভয়ংকর অবস্থা গো। ছোটকাকে নিয়ে নিশ্চয়ই? কার সঙ্গে লাগল?’

তিথি এ কথার কোনো উত্তর দিল না। বলল, ‘তুমি কোত্থেকে এলে?’

‘আর বোলো না। আমি সত্যি একা হাতে আর পারছি না। মনে হয় তোমাকেই হেল্প করতে হবে।’ ‘সত্যি!’ তিথি নেচে উঠল।

‘ওইজন্যেই তো এলাম।’ পার্থ মাথা নাড়ল, ‘পুজোর কাপড় এসে গেছে। এ বাড়ির নিয়ম হল নতুন কাপড়ও গঙ্গায় কেচে

শুকিয়ে তবে মাকে দেওয়া হয়। তুমি চলো আমার সঙ্গে।’

‘গঙ্গায়?’ তিথি বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে এই মুহূর্তে যেতে রাজি কিন্তু উঠোনের পাশে তেঁতুলমাখা কোশাকুশি পিলসুজ পড়ে রয়েছে, ওগুলো ধোয়া হয়নি। পার্থকে সে-কথা বলতেই সে বলল, ‘আরে ওসব এসে কোরো। চলো এখন তাড়াতাড়ি। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে চলো, ওদিকে সিঁড়ির মুখে বহুত ভিড়।’

পেছনের সিঁড়ি দিয়ে শাড়ির কুঁচি তুলে ধরে তিথি লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে মুক্তির আনন্দে, উত্তেজনায় তার বুকের মধ্যে রক্ত লাফাচ্ছে। সে যেন বন্দিনী রাজকুমারী, রাক্ষসের পুরী থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে পার্থ, তার রাজকুমার। তারা যেন গোপনে পালিয়ে যাচ্ছে দুজনে, সবার চোখে ধুলো দিয়ে। আহ্ কী রোমাঞ্চকর!

নীচে একটা হুডতোলা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। রিকশার পাদানিতে কাপড়ের বিরাট গাঁঠরি। পা রাখবার জায়গা নেই। তিথি কোনোরকমে উঠে বসতেই পার্থ তার পাশে উঠে বসে রিকশাওয়ালাকে বলল, ‘চলো।’

তিথির মনে হল রিকশাটা যেন উড়ে চলেছে নদীর দিকে।

এবারের পুজো পড়েছে খুব সকালে। সুধা চিন্তা করছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতায় এত আগে পুজো কখনো পড়েনি। ষষ্ঠীর দিনটাতে তাও একটু সময় পাওয়া যাবে। ওইদিন পুজো সাতটা নাগাদ। তার পরের দিনগুলোতে পুজোর সময় ক্রমশ এগোচ্ছে। অত ভোরে উঠে সব কাজ গুছিয়ে পুজোর আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে। সব ঠিকঠাক সময়ের মধ্যে করতে পারবেন কি না এই নিয়ে সুধা খুব উদ্বেগে ছিলেন।

তিথির ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। পুজো এত ভোরে বলে ঠিক হয়েছে পুজোর ক-টা দিন রাত্রে পুজোবাড়িতেই থেকে যাওয়া হবে। থাকবে শুধু সে, পার্থ আর সুধা। আর কেউ নয়। সীমার জন্যে অবশ্য তিথির কষ্ট হচ্ছিল খুব। বেচারি তাদের সঙ্গে থাকতে পারবে না, তার পিরিয়ড শুরু হয়ে গেছে। অন্তত সপ্তমী অষ্টমীর আগে তার নিষ্কৃতি নেই। সীমা কান্নাকাটিও করেছে। পুজোর জায়গায় উঠতে পারবে না, এমনকি অঞ্জলিও দিতে পারবে না। তিথির খুব আপশোস হচ্ছিল। তাদের বাড়িতে মাকে সে এতকিছু মানতে দেখেনি। অদিতি পিরিয়ড হলেও ঠাকুরের জল দিয়েছেন, সন্ধ্যে দিয়েছেন। তিথিকেও কখনো কিছু ছুঁতে বারণ করেননি। তিনি বলতেন, মন আর শরীর পরিষ্কার রেখে সবসময়ই ঠাকুরের কাজ করা যায়। পিরিয়ড হওয়াটা মেয়েদের একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ঘটনা, ঈশ্বরেরই তৈরি করা নিয়ম, কাজেই ওই সময় নিজেকে অচ্ছুত মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এইসব কথা পার্থদের বাড়িতেই কেউ মানে না। আর এটা তো দেশের বাড়ি।

পুজোবাড়িতে তিথি প্রথম এল পঞ্চমীর সকালে। তখন প্রতিমা গড়ার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, সাজপোশাকও সারা। কেবল হাতে অস্ত্র দেওয়া বাকি। তিথি মুগ্ধ হয়ে প্রতিমা দেখছিল।

একচালার ঠাকুর। দুর্গাঠাকুরের গায়ের রং কাঁচা হলুদ, ঠিক অতসী ফুলের মতো। তাঁর ঠোঁটে হাসি নেই, কিন্তু সারা মুখ যেন

এক অপূর্ব হাসির ছটায় মাখামাখি। মা দুর্গা আর তাঁর ছেলেমেয়েদের সবার সাজ ঝলমলে, এমনকি সিংহের মাথাতেও একটা ছোট্ট মুকুট পরানো।

পার্থ তিথির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে হঠাৎ তিথির হাত ধরল, ‘তিথি, ইনিই আমার সেই মা যিনি তোমাকে আমার হাতে দিয়েছেন’, তার গলার স্বর ভারী হয়ে এল, ‘মাকে বলো, তিথি—পৃথিবীর কোনো শক্তি যেন আমাদের আলাদা না করতে পারে।’

মা দুর্গার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিথির একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। নিজেকে খুব শান্ত লাগছিল হঠাৎ। এ সময়ে পার্থর ওই কথাগুলো তার কাছে খুব অর্থহীন শোনাল। সে ঠাকুরের কাছে খামোখা আলাদা হওয়ার কথা তুলতে যাবে কেন। সে তো চলেই এসেছে পার্থর কাছে। তিথি গভীর মনঃসংযোগের সঙ্গে দু-হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এভাবে প্রণাম করতেই তার খুব আরাম হচ্ছে, কিছু চাইতে ইচ্ছে করছে না।

এই পুজোবাড়িটা অত্যন্ত প্রাচীন। মল্লিকদের কোনো সুদূর পূর্বপুরুষের আমলের। নিয়মিত পুজো হচ্ছে বলে সংস্কার করা হয়, কিন্তু তাতে তার গা থেকে প্রাচীনতার গাম্ভীর্যটুকু মুছে যায়নি। পুরো বাড়িটাই একটা বিরাট হলঘরের মতো মণ্ডপ। বাইরের দরজাটা বেশ চওড়া, তার দু-দিকে থাম আর বাঁধানো বসার আসন, দরজা দিয়ে ঢুকে ঘরের অপরপ্রান্তে একটা মঞ্চের মতো উঁচু জায়গা। এটাই পুজোর বেদি। বেদিতে প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। বেদি থেকে পাঁচ-ছ ধাপ সিঁড়ি নেমে এসে একটা চাতাল, চাতাল থেকে আবার সিঁড়ি নেমে এসেছে ঘরের প্রশস্ত মেঝেতে। এই মেঝেতেই পুজোর সময় সাধারণ লোকে পুজো দেখতে ভিড় করে। মেঝের দু-পাশে উঁচু টানা রোয়াক দু-দিক থেকে পুজোবেদির সামনে চাতালে গিয়ে মিলেছে। চাতালের দু-পাশে দুটি ছোটো ছোটো ঘর। এই ঘর দুটির ওপরেও একটি করে ঘর রয়েছে যার সিঁড়ি নেমে এসেছে দু-পাশের রোয়াকে। পুজোবেদি, চাতাল আর রোয়াক থেকে বড়ো বড়ো থাম উঠে গেছে ঘরের সিলিং-এ। তিথি মাথা পেছনে হেলিয়ে মুখ উঁচু করে দেখল বিশাল উঁচু সিলিং-এর মাঝখানে একটা ঝাড়লণ্ঠনের কঙ্কাল ঝুলছে। তাতে একটাও বাতিদান নেই। সারা ঘরে একটা আবছা অন্ধকার

ভাসছে, থোকা থোকা অন্ধকার জমে আছে ঘরের কোণগুলোতে, থামের পেছনদিকে। কিন্তু ছাদের কাছাকাছি কোথা থেকে যেন মৃদু আলো আসছে ঘরে। তিথি ভালো করে লক্ষ করে দেখল, দু-দিকের দেওয়ালের একদম ওপরে সারি সারি ছোটো ছোটো জানলা। জানলাগুলো রঙিন কাচের, যার অধিকাংশই ভাঙা। ওই জানলাগুলো দিয়েই বাইরের রোদ আসছে, রঙিন কাচের আভা মিশে সেই রোদটুকু বড়ো মায়াময়। তিথি চমত্কৃত হয়ে গেল। সমস্ত ঘরে একটা অদ্ভুত ভিজে ভিজে গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এই বাড়িটা যাঁর, তিনি পার্থর মেজোঠাকুমা। মেজোঠাকুরদা অনেকদিন হল মারা গেছেন। সুধা আর পার্থর সঙ্গে তিথি পঞ্চমীর সকালেই মেজোঠাকুমার বাড়ি গিয়েছিল। মেজোঠাকুমার বাড়ি যাওয়ার পথটাও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

পুজোবাড়ির একদিকের রোয়াক আর চাতালের সংযোগস্থলে একটা ঘরের বাইরে যাওয়ার দরজা আছে, তিথি আগে খেয়াল করেনি। এই দরজা দিয়ে বেরিয়েই একট গলি। গলিটা রাস্তার গলি নয়, বাড়ির ভেতরেরই গলি। দু-দিকে উঁচু দেওয়াল। তিথি খালি পায়ে হাঁটছিল বলে গলির বাঁধানো মেঝেটা পায়ে খুব ঠান্ডা লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে কতকিছু পেরোল সে। বাঁ-দিকে একটা গোয়ালঘর, সেখানে একটা বাছুর বাঁধা। গোবর আর খড়ের একটা ঘন গন্ধ জমে আছে সেখানে। দেশের বাড়িতে এসে তিথির গন্ধের বোধ খুব প্রখর হয়ে উঠেছে। তার মনে হল এই গোয়ালের গন্ধটা খুব শান্ত, আর আন্তরিক। আরও খানিকটা যেতে একটা বড়ো কুয়ো। এসবই কিন্তু বাড়ির মধ্যে। এ ছাড়াও আরও কত রোয়াক, কত সিঁড়ি, কত উঠোন পেরিয়ে, এ বারান্দা সে বারান্দা দিয়ে, দু-দুটো খিল লাগানো দরজা খুলে, একটা খোলা বাগান পেরিয়ে তিথি যখন মেজোঠাকুমাদের বাড়ি এসে পৌঁছোল, তখন তার ঘোর লেগে গিয়েছে। এই পুরো পথটাই অসম্ভব নির্জন, এখানে কেউ থাকে বলে বিশ্বাস হয় না। বাস্তবিক, সে শুনল এই বিরাট বাড়িতে জনপ্রাণী বলতে শুধু মেজোঠাকুমা আর তাঁর অবিবাহিত ছেলে বিলাস। তাও বিলাসও পুজোর সময় ছাড়া বাইরে বাইরেই থাকেন। মেজোঠাকুমা একপাশে তিন-চারটে ঘর নিয়ে আছেন, বাকি পুরো বাড়িটাই ফাঁকা। উনি নাকি রোজ সন্ধ্যেবেলা এই পথেই পুজোবাড়িতে সন্ধ্যে দিতে আসেন।

পার্থ ফিসফিস করল, ‘মেজোঠাকুমা কিন্তু খুব রাগি। কটকট করে কথা বলেন, ওঁর জ্ঞানদা নামটা সার্থক।’ সুধা চাপা গলায় ধমকে উঠল, ‘চুপ কর। কথা আবার কী? আমাদের সঙ্গে বছরে একবার দেখা, ওঁর আবার বলার কী আছে!’ পার্থ আবার ফিসফিস করল, ‘ভয় করছে, তিথি? মেজোঠাকুমা তাড়া করলে একা এই পথে পালাতে পারবে তো?’ সে খিকখিক করে হাসছিল।

তিথি শিউরে উঠল। মেজোঠাকুমার তাড়ার ভয়ে নয়। এই পথে একা যাওয়ার কথা ভেবে। এ তো জাদুকরের প্রাসাদ, রহস্যময় গোলকধাঁধা! এই পথ চিনে যাওয়া তার কর্ম নয়। সে কলকাতার বড়ো রাস্তাতেও একদিন হেঁটে পরের দিন আবার গুলিয়ে ফেলে।

মেজোঠাকুমা জ্ঞানদা তিথিকে মোটেও তাড়া লাগালেন না, তার সঙ্গে দু-একটা ছাড়া কোনো কথাই বললেন না। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাড়ি ছেড়ে চলে এলে, পড়াশোনাটা শেষ করতে পারবে তো!’

তিথি বলল, ‘এবার পার্ট ওয়ান দিতে পরিনি। সামনের বার নিশ্চয়ই দেব।’

মেজোঠাকুমা খুব নিরাসক্ত গলাতে বললেন, ‘সেটা বেশ কঠিন। যাই হোক, পড়াশুনা ছেড়ো না।’

ব্যাস ওইটুকুই। তিনি তিথির সঙ্গে আর কোনো কথা বলেননি। এমনিতেও কথা বলছিলেন খুব কম। তিথি দেখল, এই বৃদ্ধা অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী, আর তাঁর কোনো কৌতূহল নেই।

মেজোঠাকুমার ছেলে বিলাসের সঙ্গেও তিথির আলাপ হয় সেখানে। ইনিই সেই বিলুকাকা, যাঁর সঙ্গে কয়েক বছর আগে পার্থর

ঝামেলা হয়েছিল। বিলুকাকা খুব আলগা আলগাভাবে সবার সঙ্গে দু-একটা কথা বললেন, মনে হল ঝামেলার ব্যাপারটা তিনি সেভাবে মনে রাখেননি। তাঁর গলার স্বর খুব গম্ভীর। তিথি শুনল বিলুকাকা নাকি খুব ঘুরে বেড়ান, পাহাড়ে চড়েন। শুধু এই পুজোর সময়টুকু তিনি বাড়িতে থাকেন। তিথির খুব কৌতূহল হচ্ছিল জানতে তিনি কোথায় কোথায় গেছেন, কোন কোন পাহাড়ে চড়েছেন। কিন্তু সে বিষয়ে আর কোনো কথা হল না। তিথি আবার একঝলক মুখ তুলে দেখল বিলুকাকা বেশ লম্বা। বয়স হয়তো চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু পেটানো চেহারা। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, তাঁর হাতে একটা বই। বইটা পড়তে পড়তে উঠে এসেছেন বলে পাতার ফাঁকা আঙুল ঢোকানো। তিথির মনে হল মল্লিকবাড়ির মধ্যে এই লোকটি খুব আলাদা।

পুজোর আগে থাকতেই কাজের কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু পুজো শুরু হতেই আর যেন দিশা পাওয়া যাচ্ছে না। তিথির অবশ্য ভীষণ ভালো লাগছে এই তলকূলহীন খাটুনি। সে চেয়ে চেয়ে কাজ নিচ্ছে, পাগলের মতো খাটছে। কিছু কিছু নেশার জিনিস আছে যা শরীরে ঢুকলে মানুষের কর্মক্ষমতা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তিথির যেন সেরকমই কোনো নেশা হয়েছে। তার কোনো ক্লান্তিবোধ হচ্ছে না। বিশ্রামের কথা ভাবতে তার ভয় করছে। নিশ্ছিদ্র কর্মব্যস্ততা একটা বর্মের মতো, মন আর মস্তিষ্ককে চাপা দিয়ে রাখে।

পুজোবাড়িতে আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। ঢাকিরাও এসে গেছে। কাল রাত পোহালেই পুজো। সব কাজ গোছাতে গোছাতে এগারোটা বাজল। সুধা বাজার থেকে কিনে আনা ফুলগুলো বেছে ধুয়ে তার ওপর একটা ভিজে কাপড় চাপা দিয়ে রাখলেন। কাল ভোর অবধি ফুলগুলো তাজা থাকবে। পার্থ রোয়াকের একপাশে আপাদমস্তক চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। এখন এখানে বেশ ঠান্ডাই পড়ে গেছে। তিথি একটু আগে সুধার সঙ্গেই ছিল। এইমাত্র সে পুজোবেদিতে আলপনা দিতে শুরু করেছে।

সুধা ডাকলেন, ‘তিথি! আর না। এবার শুয়ে পড়ো। কাল অনেক ভোরে উঠতে হবে।’

তিথি মুখ তুলল, ‘তুমি শুয়ে পড়ো বড়মা। আমি একটু পরে শোব।’

সুধা একটু বিরক্ত হলেন, ‘আর কত দেরি করবে? আর আলপনা দিতে হবে না। ঠাকুরের সামনেটাতে তো দেওয়া হয়ে গেছে, আবার কী?’

তিথি আলপনা দিয়ে যাচ্ছিল। এবার মুখ না তুলেই বলল, ‘এই, জাস্ট আর একটু বড়োমা। এক্ষুনি হয়ে যাবে।’

সুধা শুয়ে পড়লেন। অদ্ভুত নিশুতি একটা রাত। তিথির ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না। তার ইচ্ছে করছে আজ সারারাত্রি ধরে আলপনা দিয়ে সে এই সমস্ত দালানটাকে ভরিয়ে দেবে।

তিথির ক্রমশ মনে হতে লাগল সে যেন একটা নিস্তব্ধ সমুদ্রের তলায় বসে আসে। নিস্তব্ধ, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতারও একটা কেমন নিজস্ব ধ্বনি রয়েছে। মনে হচ্ছে নৈঃশব্দ্য যেন ঝম ঝম করে বাজছে তার চারদিকে। কিংবা, ঝম ঝম শব্দটা তার মাথার মধ্যেই হচ্ছে কি? তিথি ঠাহর করার চেষ্টা করল। তার আবার জ্বর এসেছে। জ্বরটা রোজই আসছে তার। অন্য সময় হলে এইরকম একটানা জ্বরে সে নিশ্চয়ই দুর্বল হয়ে পড়ত, বিছানা ছেড়েই উঠতে পারত না। কিন্তু এখন ওই জ্বরটাই তার নেশার বস্তু, যা তাকে পাগলের মতো খাটার শক্তি জোগাচ্ছে। যে-কোনো কাজে তার মনঃসংযোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিথি দেখেছে, তার নিশ্বাস যত ঝাঁঝালো গরম হয়ে ওঠে, তার একাগ্রতাও তত বাড়ে।

সুধা পাশ ফিরতে ফিরতে ঘুমন্ত গলায় আর একবার ডাকলেন, ‘

তিথি—এখনও শুলে না!’

তিথি চমকে উঠল, ‘হ্যাঁ, এই আসছি বড়োমা। তুমি ঘুমোওনি?”

সুধার আর কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। তিথি সতর্কভাবে তাঁর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার গোলার বাটিতে ন্যাকড়া ডোবাল। তার বুকের মধ্যে রক্ত ছমছম করছে। কী অদ্ভুত একা লাগছে। কিন্তু কী রোমাঞ্চকর এই একা লাগা। কী অদ্ভুত এই পঞ্চমীর রাত, কী অদ্ভুত এই জীবন! ওই যে দুজন ঘুমন্ত মানুষ শুয়ে রয়েছে ওরা কারা? মানুষকে আলো-জ্বলা ঘরে ঘুমন্ত দেখলে কেমন অচেনা লাগে! যে মেয়েটি আলপনা দিচ্ছে সে কে? কোথায় আলপনা দিচ্ছে সে? এ তার কোন জন্মের পুজো আসছে কাল?

তিথি যেন চেতনা হারিয়ে ফেলছিল আস্তে আস্তে। সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত অবস্থাতেই আশ্চর্য দ্রুততায় নিপুণ ভঙ্গিমায় সে আলপনা দিয়ে চলছিল পুজোর প্রাঙ্গণে, প্রাঙ্গণ থেকে সিঁড়িতে, সিঁড়ি থেকে ঘরের মেঝেতে…

কাল রাত পোহালেই পুজো। তার আগেই তিথি তার শরীর মন নিংড়ে নিংড়ে যা কিছু সব নিঃশেষে ঢেলে দিতে চায়…

ঘুমোবে না মনে করেও শেষপর্যন্ত শুয়েই পড়েছিলে তিথি। যদিও ঘুম নয়, একটা তন্দ্রার ঘোরের মধ্যেই চোখ বুজে পড়ে ছিল খানিকটা সময়। একটা ঝটকা লেগে তন্দ্ৰাটা যখন ছুটে গেল তার, সে চোখ খুলে চশমাটা পরেই দেখল সুধা আর পার্থ তখনও আপাদমস্তক গভীর ঘুমে। কিন্তু তিথির মনে হল ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। পার্থর ঘড়ি পরা অভ্যাস নেই। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় তিথি নিজের হাতঘড়িটা ভুলে পরে আসেনি। কাল রাত্রে পার্থ অলকের হাতঘড়িটা নিয়ে এসেছিল। সেইটাই এখন তার কবজিতে বাঁধা। সে চিত হয়ে বাঁ-হাতটা কপালের ওপর রেখে ঘুমোচ্ছে। তিথি হাতটা তুলে দেখল ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজে। পার্থ বলেছিল পাঁচটায় উঠলেই যথেষ্ট।

একটু ইতস্তত করে তিথি উঠল। সকালে পরার জন্যে তিন জনেরই জামাকাপড় নিয়ে আসা হয়েছে। তিথি শাড়ি শায়া ব্লাউজ তুলে নিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে পা বাড়াল। মেজোঠাকুমার বাড়ি যাওয়ার পথেই একটা বাথরুম আছে। সুধা কাল দেখিয়ে দিয়েছিলেন, আপাতত যে ক-দিন তারা এখানে থাকছে, ওই বাথরুমেই স্নান-টান সবই সারতে হবে।

বাইরে পা দিতেই তিথির শীত করে উঠল। শেষরাত্রের হিমে গলিটা ভিজে রয়েছে। ভোর এখনও হয়নি, কিন্তু রাত্রির জমাট অন্ধকার পাতলা হয়ে এসেছে। তিথি একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারটাকে চোখে সইয়ে নিল। তারপর আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করল। তার বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন।

তিথি নিশ্চিত ছিল না এই পথটা সে চিনে চিনে যেতে পারবে কি না। কিন্তু আবছা অন্ধকারেও সে যেন অনেকটা গন্ধ অনুসরণ করেই এগোচ্ছে। গোয়ালঘরের কাছে আসতেই সেই শান্ত গন্ধটা তার নাকে মৃদু ঝাপটা মারল। বাছুরটাও জেগে গেছে, তিথিকে দেখে কিংবা তার পায়ের শব্দ শুনে গভীর স্বরে একবার ডাকল। তারপরে সেই কুয়োটা। তারপর একটা টানা রোয়াক, তারপর একটা দরজা। দরজাটার কাছে এসে দু-এক মুহূর্ত দ্বিধা করল তিথি। এইটাই সেই দরজা তো, নাকি এটা অন্য কোনো দরজা? ভয়ে ভয়ে খিল খুলল সে। না, একেবারে ঠিক আছে। দরজাটার ওপাশেই সেই চাতাল, চাতালের একপাশে বাথরুম, অন্যপাশে বাগানে যাওয়ার দরজা।

তিথি বাথরুমে ঢুকে দেখল অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শাড়ি-জামাগুলো আর চশমাটাও চাতালে রেখে এসে তিথি বাথরুমের দেওয়াল হাতড়াল। অন্ধকারে চশমা পরা আর না পরা সমান। কাল সুধার সঙ্গে এসেছিল বলে কলটা কোথায় সে মোটামুটি জানে। হাতে ঠেকতেই কলটা খুলে দিল সে। জলটা যেন ছোবল মারল, এত ঠান্ডা।

ওই হিমঠান্ডা জলেই স্নান সেরে নিল তিথি। এর আগে এত ঠান্ডা জলে সে স্নান করেনি কখনো। প্রথম জমে যাওয়া ভাবটা কেটে যেতেই তিথি দেখল তার বেশ আরামই লাগছে।

স্নান শেষ করতেই কিন্তু হাড়ে কাঁপুনি ধরল তার। হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে ছাড়া শাড়িটাই ধুয়ে ভালো করে নিংড়ে গা-মাথা মুছে নিল সে। তারপর ওইটাই জড়িয়ে বাইরে এসে চাতালের এককোণে দাঁড়িয়ে শুকনো শাড়িটা পরে নিল। এখন নিজেকে খুব পবিত্র লাগছে তার। আজ পুজো, আজ প্রথম পুজোর সকাল। সে সবার আগে স্নান করেছে আজ সকালে। তিথি বুক ভরে

নিশ্বাস টানল। ফুল ধূপ চন্দন আর কী কী সবের মিশ্রিত গন্ধ যেন ভেসে বেড়াচ্ছে তার চারপাশে। এই ঘুমিয়ে থাকা বিরাট বাড়িটার আনাচকানাচ থেকে একটু একটু করে উঠে আসছে গন্ধটা। এত ক্ষীণ সেই গন্ধ, যেন তার এখনও ভালো করে ঘুম ভাঙেনি। এটা কীসের গন্ধ! তিথি আবার বুক ভরে নিশ্বাস টানল। এ কি পুজোর গন্ধ?

তিথি বাগানের দরজাটা খুলে ফেলল। বাগানটা ঝুপসি হয়ে আছে। গাছগাছালির নীচে সাদা কুয়াশা। একটু একটু করে অন্ধকারে গুলে যেতে শুরু করেছে আলো। তিথি বাগানের মধ্যে এসে দাঁড়াতেই আবার তার নাকে সেই পুজোর গন্ধ ভেসে এল। হঠাৎ একটা অলৌকিক অনুভূতি ঘিরে ধরল তাকে। সে দেখল, সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার চারপাশে রাশি রাশি শিউলি ঝরে মাটি সাদা হয়ে আছে। তিথির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মুখ তুলে তাকাতেই দেখল সে একটা বিরাট শিউলি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। আর তার সারা মাথায়, মুখে আর কাঁধে ফুল ঝরছে টুপ টুপ করে। –

b

পার্থর বউ নিয়ে অঘোর বিশেষ মাথা ঘামাতে চাননি। ঘামিয়ে কী হবে? নিজেদের দেখেশুনে বিয়ে, এসব আজকালকার ব্যাপার। মেয়েটা নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। তা আসুক। ছেলের বউকে শ্বশুর শাশুড়ি মেনে নিয়েছে, বউ শ্বশুরঘর করছে এইটাই আসল কথা। মেয়েটা কায়স্থঘরের, জাত হিসেবে ওরা খারাপ নয়। মেয়েটা দেখতে ভালো নয় এই যা। সে পার্থ যা বুঝেছে তাই করেছে। তবে, অঘোর দেখেছেন, পার্থর বউ খাটিয়ে আছে, আর কথাবার্তাও মন্দ নয়। এর বেশি তিনি তার সম্বন্ধে আর কোনো উত্সাহ বোধ করেননি।

কিন্তু এর মধ্যে এমন একটা ঘটনা ঘটল, তিনি মেয়েটাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে বাধ্য হলেন। এটা সেদিনেরই ঘটনা যেদিন অসীম অমলের বউয়ের হাত থেকে বালতি কেড়ে হুজ্জোত বাধাল। গণ্ডগোল সেদিন এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে অঘোরকে অবস্থা সামাল দিতে হয়েছিল। তিনি না এসে দাঁড়ালে বোধ হয় অমল পাগলটাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলত।

ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর সবাই যে যার ঘরে দরজা বন্ধ করে গুজগুজ ফুসফুস করছিল। এটাই রীতি। অসীম মার-টার খেয়ে চোখ-ঢোখ উলটে দিয়েছিল। তাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছেন অরুণ আর অনিল মিলে চ্যাংদোলা করে। শিবানী তখনও গুনগুন করে কাঁদছেন আর অসীমের ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করছেন। এক সীমাই তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আছে, অসীমকে পাখার বাতাস করছে। অঘোর নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছেন। এসমস্ত কাণ্ডের পর সারা বাড়ি থমথম করছিল। থার্মোমিটার বগলে চেপে বসে থাকতে থাকতে অঘোরেরও ঝিমুনি আসছিল।

ঘুম ভাঙার পর অঘোর বুঝতে পারলেন তিনি ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। সারা বাড়ি এখনও নিশ্চুপ। অঘোরের মনে হল, তাঁর ঘুমটা ভেঙেছে যেন কীসের একটা আওয়াজ পেয়ে। একটু পরেই শুনলেন, ছাদের ওপর খসখস আওয়াজ হচ্ছে। কে যেন ছাদে

অঘোর হাত বাড়িয়ে লাঠিটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখতে পেলেন মইটা দরজার পাশে দেয়ালে ঠেকানো। ছাদের ওপরে উঠে ঠাকুরের কাপড় শুকোতে দিচ্ছে পার্থ আর তিথি।

এই দৃশ্য দেখবেন অঘোর কল্পনাও করেননি। তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘পার্থ! তুমি বউকে ছাদে উঠিয়েছ তোমার এত বড়ো সাহস!’

ঘরে ঘরে দরজা খুলে গেল। উঠোনে আবার ভিড় জমছে।

তিথি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ছাদে ওঠাতে কী দোষ হল তার মাথায় ঢুকছে না।

পার্থও অবাক গলায় বলল, ‘কী হয়েছে? পুজোর কাপড় মেলছি তো!’

অঘোর তাঁর লাঠি উঁচিয়ে ধরলেন, ‘কী হয়েছে! আবার জিজ্ঞেস করছ কী হয়েছে, অ্যাঁ! বলি, কেউ কখনো দেখেছে মল্লিকবাড়ির বউ ছাতে উঠে কাপড় শুকুত দিচ্ছে? তুমিই উঠিয়েছ ওকে, কেন, অ্যাঁ! কাপড় শুকুত দেওয়ার আর কোনো লোক জুটল না?’

তিথিদের কাপড় শুকোতে দেওয়ার কাজ প্রায় শেষই হয়ে এসেছিল। আর দু-একটাই বাকি। গঙ্গায় কাপড় কেচে ফিরে তারা দু-জনে মিলে এ বাড়ির তিনটে ছাদ ভরেই কাপড় মেলেছে। এপাশে অঘোরের ঘরের উপরকার ছাদে উঠেছিল সবার শেষে। এত কাপড় মেলার আর কোনো জায়গা নেই ছাদ ছাড়া। কাপড়গুলো ছাদের ওপর টানটান করে বিছিয়ে চারকোণে ইট চাপা

হাঁটছে।

দিয়ে রাখছিল ওরা। সব ছাদেই অনেক ইটের টুকরো আর আধলা ইট পড়ে আছে। তিথির হাত থেকে একটা ইটের টুকরো পড়তেই ওই শব্দে অঘোরের ঝিমুনি ছুটে গেছে। পার্থ তিথিকে নেমে যেতে ইশারা করল, বলল, ‘যাও, আমি এগুলো মেলে যাচ্ছি।’

তিথি সাবধানে শাড়ি সামলে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। অঘোর সভয়ে তাকে দেখছিলেন। কী কাণ্ড! বউমানুষ মই বেয়ে ওঠানামা করছে তিনি এই প্রথম দেখলেন। শাড়ি জড়িয়ে পড়লেই তো কেলেঙ্কারি!

সেরকম কিছু হল না। তিথি নেমে এসে ঘোমটা ঠিক করতে করতে অঘোরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, মৃদু গলায় বলল, ‘সরি দাদু। আমি জানতাম না আমার ছাদে ওঠা বারণ। তা ছাড়া ও একা একা সব করছে। আমি নিজেই বলেছিলাম হেল্প করব।’

অঘোর দেখছিলেন, তাঁর যতটা রাগ হওয়ার কথা ততটা হচ্ছে না। তাঁর গলাটাও অনেক নরম হয়ে এল, ‘না না, কাজ করা তো ভালো। ভালোই তো। তবে কিনা ছাদে উঠলে কে কোত্থেকে দেখে ফেলবে, মুশকিল হয় যাবে—’

তিথি হাসল, ‘মুশকিল কেন হবে দাদু, দেখে ফেললেই-বা! আমার তো খুব গর্ব হচ্ছে আমি এ বাড়ির পুজোর কাজ করতে পারছি বলে!’

তিথি ভালোই বুঝতে পারছিল উঠোন-ভরতি লোক সবাই তার কথা শুনছে। সে আবার খুব সহজ বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘কিন্তু, আপনার মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে আমি খুব সরি, আমি ক্ষমা চাইছি।’

অঘোর কী উত্তর দেবেন বুঝতে পারছিলেন না। প্রথমটায় তাঁর খুব রাগ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পার্থর বউ যেন কেমন সুরে কথা বলছে, অঘোরের রাগ পড়ে যাচ্ছিল। এমনকী তাঁর মনে হচ্ছিল মেয়েটা বোধ হয় ঠিক কথাই বলছে। তিনি একটু অনিশ্চিত

ভাবেই মাথা নাড়লেন, ‘ঠিক ঠিক। পুজোর কাজ। তুমি বেশ কাজের মেয়ে, আমি ক-দিন থেকেই লক্ষ করেছি। কিন্তু ছাদে-টাদে আর উঠে কাজ নেই বাপু! ওসব পুরুষের কাজ পুরুষেই করুক।’

অঘোর ফের ঘরে ঢুকে গেলেন। পার্থ ততক্ষণে নেমে এসেছে। বান্টি হঠাৎ ছুটে এসে তিথির হাত ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘কনগ্র্যাটস্! আ গ্রেট উইন ওভার এজ ওল্ড প্রহিবিশনস্!’ বান্টি চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে তোমরা সব চুপ করে আছ কেন? বলো—থ্রি চিয়ার্স ফর মিসেস তিথি মল্লিক, হিপ্ হিপ্—,

পার্থ হাসছিল, হাসতে হাসতে চাপা গলায় বলল, ‘চুপ চুপ। তাও তো দাদু তিথির গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার কথাটাই জানে না!’

এবারের পুজো এত সাতসকালে, অত ভোরে কারোরই পুজো দেখার গা নেই। বিশেষ করে ষষ্ঠীর দিনটা তো পুজোর মধ্যে পড়েই না বলতে গেলে। ওই দিন সকালে পুজোবাড়িতে যখন পুজো চলছে, এ বাড়িতে তখনও ঘুম ভাঙেনি অনেকের। শুধু অলক আর অরুণ গেছিলেন পুজো দেখতে। ঘণ্টা দুয়েক পরে সবাই যখন ঘুম থেকে উঠে মুখচোখ ধুয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বসেছেন, অরুণ পুজোবাড়ি থেকে ঘুরে এসে বললেন পার্থর বউ এমন আলপনা দিয়েছে, দেখবার মতো।

‘তাই নাকি, তাহলে তো রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী বলতে হবে।’ সুমিতা মন্তব্য করলেন।

বান্টি একটু ফোঁস করে উঠল, ‘ওরকম করে বলছ কেন, ভালোকাকিমা? বউদির দারুণ আঁকার হাত, আমাকে মৌদি বলেছে,

‘ও বাব্বা!’ সুমিতা চোখ ঘোরালেন, ‘কী বলেছি আমি, যে তোর গায়ে ফোস্কা পড়ল?’

জানো?’

‘বান্টি বোধ হয় নতুন বউদির ফ্যান হয়ে গেছে, তাই না বান্টি?’ মল্লিকা ফুট কাটলেন।

বান্টি আর কোনো কথা বলল না। তার মুখ দেখে মনে হল কাকিমাদের ওপর একটু রাগই হয়েছে।

তিথির আলপনার কথাটা অরুণ সবার সামনে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই বলেছিলেন। ব্যাপারটা সবার খুব একটা পছন্দ না হলেও সেটা নিয়ে একটা আলোচনা চলল। এমনকী, কথাটা অঘোরের কানেও পৌঁছোল।

যদিও এসব কথা তিথি কিছুই শোনেনি। সকালে স্নান করে আসার পর থেকেই সেই যে সে পুজোমঞ্চের পাশে ছোটো ঘরটায় ঢুকে ফল কাটতে বসেছিল, পুজো শেষ হওয়া অবধি সেখান থেকে বেরোতেই পারেনি। ফল কাটা, চাল ধোয়া, থালায় থালায় নৈবেদ্য সাজানো, পান সাজা, বারে বারে একশো আটটা করে বেলপাতা আর দূর্বা গোছাতেই হিমশিম খেয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু দু-একবার খুব কান্না পেয়েছে তার চোখে কোনো জল আসেনি যদিও। সে ভেবেছিল, পার্থ অন্তত তার আলপনা দেখে কিছু বলবে তাকে। কিংবা, কিছু বলাও নয়, আলপনাটা দেখবে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে, তারপর তিথির দিকে ফিরে একটু হাসবে…সেটুকুও কি আশা করার পক্ষে খুব বেশি, খুব ভুল!

পার্থ কিছু বলেনি, তবে সুধা বলেছিলেন। তিথি যখন আঁচলে রাশিকৃত শিউলি কুড়িয়ে পুজোবাড়িতে ফিরে এসেছিল, তখনও পার্থ শুয়ে। সুধা উঠে বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বোধ হয় তিথিকেই খুঁজছিলেন। তিথি উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, ‘বড়োমা, দ্যাখো কত শিউলি!’

সুধা অপ্রসন্ন মুখে তাকালেন, তাঁর চোখেমুখে তখনও ঘুম জড়িয়ে আছে, ‘এই কাকভোরে উঠে চুল ভিজিয়ে চান করে এলে! জ্বরজারি বাধালে কী হবে?”

তিথি অপ্রস্তুত মুখে চুপ করে থাকল। সুধা কাপড়চোপড় ঠিক করতে করতে উঠলেন, বললেন, ‘সব কিছু একটা বুঝমতো করবে তো! ঘরজুড়ে আলপনা দিয়েছ দেখছি, শুয়েছ কখন? এত অনিয়ম শরীরে সহ্য হলে হয়।’

পায়ে পায়ে সরে এসে তিথি ছোটো ঘরটায় ঢুকল। আঁচলের ফুলগুলো সে আলাদা একটা থালাতে নামাতে গিয়ে শুনল সুধা গলা তুললেন, ‘ওই ফুলগুলো পুজোর থালায় রাখছ নাকি! মাটিতে পড়ে ছিল না? ধুয়ে নাও, ধুয়ে নাও। ধোয়া ফুলের সঙ্গে এক কোরো না।’

পার্থ উঠতে দেরি করছিল, সুধা তাকে নাড়া দিলেন, ‘ও পার্থ, ওঠ ওঠ। কলাবউ চান করাতে বেরোবি তো! চান করে আয় বাবা, পুরুতমশাই এক্ষুনি এসে পড়বেন।’

তিথি ফুলগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে ভাবছিল পার্থ উঠে নিশ্চয়ই আলপনাটা দেখে চমকে যাবে, খুব খুশি হবে। তাকে এসে বলবে নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। কিন্তু পার্থ তার কাছে এলই না। স্নান করে এসে ধুতি চাদর পরল। পুরোহিতমশাই এসে গেলেন তার মধ্যে। ঢাকিরাও এসে জুটল। তাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে পুজোবাড়ির পাশে একটা ঘরে। তবে, তাদের পুজোবাড়িতে আসার পথ বাইরের রাস্তা দিয়ে বাড়ির ভেতর দিয়ে নয়। ঢাকিরা এসে ঢাকে কাঠি দিতেই তিথির বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠেছিল। সুধাও ততক্ষণে স্নান করে এসেছেন। কলাবউ স্নান করাতে বেরোনোর আগে সুধা পার্থ আর পুরোহিতমশাইকে বরণ করলেন। তারপর পার্থ কলাবউ নিয়ে পুরোহিতমশাইয়ের সঙ্গে গঙ্গার দিকে রওনা দিল, সঙ্গে ঢাকিরাও চলল ঢাক বাজাতে বাজাতে।

নৈবেদ্যর থালাগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে তিথি পুজোবেদির পাশে জড়ো করে রেখেছিল। সুধা সেগুলো পুজোর জায়গায় গুছিয়ে রাখছিলেন। পুজো শুরু হওয়ার পরে পার্থ একটা আসন পেতে পুরোহিতের ঠিক পাশেই বসে থাকল। তিথি একবার উঁকি দিয়ে দেখল, অলক আর অরুণ এসেছেন। মেজোঠাকুমা আর বিলাসও। ঢাকিরা নেচে নেচে ঢাক বাজাচ্ছে চাতালে। আর কাউকে

তার চোখে পড়ল না। মেজোঠাকুমা ধুনুচিটা এপাশে ওপাশে নাড়াচ্ছেন আর মুঠো মুঠো ধুনো ঢালছেন তাতে। গুলগুল করে ধোঁয়া পাকিয়ে উঠে পুজোর বেদি আর পুরো চাতালটাই ঝাপসা করে দিচ্ছে। ধুনোর গন্ধে থইথই করছে চারদিক। গন্ধটা যেন কেমন, তিথির আবার মনে হল। খুব পবিত্র সন্দেহ নেই, ভীষণ অভিজাত আর একটু অভিমানী।

পুজো মিটে যাওয়ার পর তিথি চাতালের একপাশে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে পার্থকে খুঁজছিল। দেখতে পাচ্ছিল না। পার্থ হয়তো আবার কোথাও বেরিয়েছে। চাতালে, সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন মেজোঠাকুমা, অলক আর বিলাস। অরুণকেও আর দেখা যাচ্ছে না। তিথি নিরাশ মুখে আবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। সুধা কাটা ফল গুছোচ্ছেন, সবার হাতে হাতে প্রসাদ দিতে হবে।

বারকোশে করে প্রসাদ নিয়ে এসে তিথি প্রথমে অলককে দিল। অলক প্রসাদ মুখে দেওয়ার আগে খুব দ্রুত ছ-বার ‘জয় মা’ বললেন। তিথি সরে এল মেজোঠাকুমার কাছে। মেজোঠাকুমা চোখ বুজে বসে ছিলেন, তিথি খুব আস্তে বলল, ‘ঠাকুমা, প্ৰসাদ!’ জ্ঞানদা চোখ খুলে হাত পেতে প্রসাদ নিয়ে মাথায় হাত ছোঁয়ালেন, কিছু বললেন না। বিলাস বসে আছেন চাতালের একেবারে শেষপ্রান্তের সিঁড়িতে। তিথি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি মুখ তুলে তাকালেন। তিথি বলল, ‘প্রসাদ নিন।’

‘খুব সুন্দর আলপনা দিয়েছ।’

বিলাসের স্বাভাবিক গম্ভীর স্বর তিথির কানে খুব স্নিগ্ধ ঠেকল। তার ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করে যে—কী করে জানলেন আমি দিয়েছি! কিন্তু সে চুপ করে শুধু হাসল। বিলাসও হাসলেন, বললেন, ‘এই পুজোবাড়িতে এমন আলপনা এর আগে কেউ দেয়নি। তুমি ঘরের মেঝেতে পর্যন্ত আলপনা দিয়েছ, ওখানে লোকে দাঁড়াবে, সব মুছে যাবে যে, অবশ্য এই সিঁড়ি আর চাতালেরটাও বাঁচিয়ে রাখা শক্ত।’

তিথি ঝরঝর করে হাসল। মুছে তো যাবেই, সে জানে। তার আগে একটু প্রশংসাই আশা করেছিল সে। খুব খুশি হয়ে উঠতে উঠতে আবার হঠাৎ কান্না পেল তার। পার্থ তাকে কিছু বলল না কেন, সে কি এতই ব্যস্ত! হবে হয়তো। তিথি ভাবল, সে নিশ্চয়ই আর একটু ধৈর্য ধরতে পারে।

সন্ধ্যেবেলা আরতির সময় পুজোবাড়িতে বেশ ভিড় হল। অসীম ছাড়া বাড়ির প্রায় সবাইই এলেন। অঘোর আর শিবানীও। মল্লিকবাড়ির অন্যান্য শরিকরাও এলেন কেউ কেউ। সুধা আলাপ করিয়ে দিচ্ছিলেন আর তিথি যন্ত্রের মতো প্রণাম করে যাচ্ছিল। সবার মুখ মনে রাখা সম্ভব নয়, তার খুব একটা প্রয়োজনও নেই। আজ সবে ষষ্ঠী, এর পরে সপ্তমী থেকে নবমী নিশ্চয়ই আরও সবাই আসবেন। তিথিকেও প্রণাম করে যেতে হবে। এইটুকুই।

আলপনা পায়ে পায়ে অনেকটাই মুছে গেল। তিথির মন থেকেও। সারা সকাল দুপুর বিকেল সে পার্থর প্রতীক্ষা করে করে ক্লান্ত। দুপুরে ওবাড়িতে খেতে গিয়ে পার্থর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার, কথাও হয়েছিল। আলপনা নিয়ে কোনো কথা হয়নি। পার্থ অত্যন্ত ব্যস্ত। এ কথা বুঝেও তিথির অভিমান হচ্ছিল, সেও এ বিষয়ে একটাও কথা তোলেনি।

সন্ধ্যেবেলা পুজোবাড়িতে আরতি হয়ে যাবার পর তিথি পুজোর বাসনপত্র ধোয়াধুয়িতে ব্যস্ত ছিল। বান্টি এসে বলল, ‘বউদি! দাদু ডাকছে। তুমি ফ্যান্টাস্টিক আলপনা দিয়েছ। দাদু একেবারে ফ্ল্যাট!’

তিথি মুখ তুলে তাকাল। বান্টি খুব সুন্দর একটা চুড়িদার পরেছে, সেজেওছে বেশ। খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। তিথি বলল, ‘তোমায় দারুণ দেখাচ্ছে বান্টি, আরও ফ্যান্টাস্টিক!’

বান্টি খুশি খুশি মুখে বলল, ‘থ্যাঙ্কস্। কিন্তু তুমি তো এক্কেবারে সাজো না। পুজোতে একটু সাজতে হয়। চলো চলো, দাদু ইজ ওয়েটিং ফর ইউ!’

অঘোর চুপচাপ প্রতিমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর আশেপাশে জটলা করে দাঁড়িয়ে সবাইই কথা বলছে, গল্প করছে। তিথি সেখানে এসে দাঁড়াতেই তার নাকে এসে লাগল আর একটা পরিচিত গন্ধ, নতুন শাড়িকাপড়ের। এ-ও পুজোরই গন্ধ। কাকিমাদের গায়ে ঝিকমিক করছে গয়না। তিথিকে দেখে জায়গাটা চুপ হয়ে গেল। বান্টি ডাকল, ‘দাদু, এই যে বউদি।’

অঘোর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তিথিকে কয়েক মুহূর্ত দেখে আবার ঠাকুরের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘সকালেই শুনলুম তুমি নাকি সুন্দর আলপনা এঁকেছ। তা তখন তো আর আসতে পারিনি। এখন এসে দেখে খুব আনন্দ পেলুম।’

তিথি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার আনন্দবোধের মধ্যেও একটা অদ্ভুত শূন্যতা ভাসছে যেন। অঘোর আবার বললেন, ‘তুমি বেশ গুণী মেয়ে দেখছি, বেশ বেশ! কার কাছে শিখেছ?’

তিথি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। অঘোরের প্রশ্নটা শুনে একটু কেঁপে উঠল সে। তারপর যেন বিস্মৃতির অতল থেকে একটা শব্দ উঠে এল তার মুখে, তার নিজেরই অজান্তে। থেমে থেমে উচ্চারণ করল, ‘আমার…মায়ের কাছে…।’

ভিড় গুনগুন করছিল। দীপ্তি বলছিলেন, ‘সত্যি বাবা, দ্যাখো কী বিরাট আলপনা দিয়েছে, কখন দিলে গো? আমি তো বাবা লক্ষ্মীপুজোয় কোনোরকমে লক্ষ্মীর পা-টা আঁকি, ব্যস।’

‘আমিও তাই, আসলে আমাদের ফ্ল্যাটে তো মোজাইকের মেঝে, আলপনা দেবার জায়গাই নেই!’ মল্লিকার গলায় আপশোস ঝরে পড়ছিল।

জ্ঞানদাও কাছাকাছি ছিলেন। তিনি একটু কেটে কেটে বললেন, ‘এ সমস্ত শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপার। আর কিছু না, পার্থর বউয়ের বাপের বাড়িটি কেমন, ওই আলপনাই তার প্রমাণ।’

তিথি হঠাৎ মুখ তুলে দেখতে পেল, চাতালের সিঁড়িতে বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে সীমা। সে একবারও তিথির দিকে দৃষ্টি ফেরাল

সপ্তমীর দিনটাও কেটে গেল হু-হু করে। অষ্টমীর দিন শেষরাত্রে ঘুম ভেঙে তিথির হঠাৎ সন্দেহ হল, তার বোধ হয় পিরিয়ড শুরু হয়েছে। এটা হওয়ার সময় নয় তার, কিন্তু সবসময় তার সময়ের ঠিকও থাকে না, গোলমাল হয়। তিথি মনে মনে হিসেব করল, তার শেষ পিরিয়ড হয়েছে সতেরো-আঠেরো দিন আগে। এত তাড়াতাড়ি আবার হয়ে গেল?

তিথি উঠে বসে দেখল, তার শাড়ির পেছনে সত্যি রক্ত লেগে আছে। এক মুহূর্তে করার নেই।

তীব্র অবসাদে ভরে উঠল তার মন। আর কিছু

হঠাৎ তিথির মনে হল— যাক, এইবার সীমার সঙ্গে বোধ হয় তার ভাব হয়ে যাবে।

না।

প্ল্যাটফর্মের এদিকটায় কোনো আলো নেই। কোনো লোকজনও নেই। একেবারে ফাঁকা। কেবল একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে ছায়ামূর্তির মতো পাশাপাশি বসে আছেন দুটি মানুষ। তাঁরা নিজেদের মধ্যেও কোনো কথা বলছেন না।

প্ল্যাটফর্মের সামনেই রেল লাইন, তার ওপারেই ঢাকুরিয়া লেকের বড়ো বড়ো শিরীষ আর রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়ার গভীর অন্ধকার অবয়ব। তারও ওপার থেকে চিকচিক করছে দূরবর্তী আলোর মালা। আর ভেসে আসছে দূরবর্তী ঢাকের আওয়াজ। অস্পষ্ট কিন্তু অমোঘ। আজ মহাষ্টমী।

একটা ছায়ামূর্তি খুক খুক করে কেশে উঠলেন। একবার, দু-বার। তৃতীয়বার কাশতেই পাশের জনের গলা শোনা গেল, ‘চাদরটা গলায় জড়িয়ে নাও।’ কাশিটা তাও চলতেই থাকল। থেমে থেমে, অনিয়মিত বিরতির পর পর। কিন্তু আর কোনো কথা শোনা গেল না। তারপর ঢাকের আওয়াজ কখন থেমে গেল, সামনের ঘন গাছপালার জঙ্গল থেকে ঝনঝন করে উঠল ঝিঁঝি, ঠান্ডা পড়তে শুরু করল, একজন আরেকজনকে বললেন, ‘চলো, উঠি।

নির্জন গলিপথ ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ফিরতে লাগলেন দুজন। ভাগ্যিস, এ শহরে এখনও এমন কোনো গলি আছে যেখানে কোনো পুজো নেই। এই উন্মত্ত উত্সবের দিনেও সেখানে লুকিয়ে হাঁটা যায়।

বাড়ি ফিরে এসে অদিতি রান্নাঘরে গিয়ে প্রেশার কুকারে চাল দিলেন, সেই সঙ্গে দুটো আলু আর কুমড়োর টুকরো। তিথি চলে যাওয়ার পর থেকে তাঁর আর রান্না করতে ইচ্ছে করে না। বিশ্বনাথও মুখ বুজে ভাতে সিদ্ধ ভাতই খেয়ে নেন। আসলে, তাঁদের বেঁচে থাকাটাই আজকাল ভীষণ নিরুত্সাহ, কেমন বায়বীয় হয়ে গেছে। তমালও বাড়ি আসেনি এই পুজোয়। তার নাকি

ভয়ংকর কাজের চাপ। অদিতি বা বিশ্বনাথ, দুজনেই জানেন, তমাল ইচ্ছে করেই আসেনি। তারও অসম্ভব ধাক্কা লেগেছে। সে যতই তিথির পেছনে লাগুক, আসলে মনে মনে সে বোনকে নিজের ধরনে গভীর ভালোবাসে। তিথি এমন বিশ্রী একটা কাণ্ড করে বসবে এটা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। সেও বোধ হয় এই ঘটনা থেকে পালাতে চায়। বাড়িতে না এসে সে একদিক থেকে ভালোই করেছে। অদিতি আর বিশ্বনাথেরও তো পালানো প্রয়োজন। নইলে, ভরা পুজোর রাত্রে তাঁরা লেক গার্ডেন্স স্টেশনের অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে শব্দহীন বসে থাকেন কেন!

যেদিন তিথি তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল, অদিতি জানতেন তিথি ফিরবে না। সারাদিন সমস্ত চাপ নিঃশব্দে বহন করে সন্ধ্যের পর তিনি বারান্দায় দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়েই রইলেন ঠায়। আটটা বেজে গেল, ন-টা, সাড়ে ন-টা। অদিতি খেয়ালই করেননি কখন তাঁর চোখ থেকে হু-হু করে জল বইতে শুরু করেছিল স্রোতের মতো। জল বয়েই যাচ্ছিল।

বিশ্বনাথ এসব কিছু জানতেন না। সকালের ঘটনাটার সময় তিনি মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরেননি। সাড়ে ন-টা নাগাদ তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, ‘তিথি এখনও ফিরল না।’

অদিতির সাড়া নেই। বিশ্বনাথ রাগে উত্কণ্ঠায় গজগজ শুরু করলেন, ‘রাতদুপুরের আগে বাড়ি ফেরার নাম নেই, বেয়াদবির একটা সীমা আছে তো!’ বিশ্বনাথ গলা তুলতে তুলতে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দায় পা দিলেন।

মুহূর্তের মধ্যে অদিতি আঁচলে চোখ মুছে নিলেন, পাথরের মতো ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘ঘরে চলো।’ বলে তিনি নিজেই ঘরের

মধ্যে চলে এলেন।

বিশ্বনাথ তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আস্ফালন করে চলেছেন, ‘আজ আসুক ও বাড়ি, এবার আমাকেই কিছু করতে হবে, কাল মার খেয়েও শিক্ষা হয়নি—আসুক আজ—’

অদিতি বিশ্বনাথের হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মেরে চাপা গলায় হিসহিস করে উঠলেন, ‘আহ্ ঘরে এসো বলছি না! এসো বারান্দায় নাচানাচি কোরো না।’

‘অ্যাঁ, আমি নাচানাচি করছি!’ বিশ্বনাথ আহত ক্রুদ্ধ স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন। অদিতি তখনও তাঁকে টানছেন।

‘কী হল কী!’ বিশ্বনাথের গলায় বিরক্তি, ‘টানছ কেন?’

অদিতি দরজায় ছিটকিনি লাগালেন, খিল তুলে দিলেন। বিশ্বনাথের মুখের ভাব বদলে যাচ্ছিল। তিনি সভয়ে সবিস্ময়ে অদিতিকে দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর মুখ দিয়ে কথাগুলো যেন আপনা থেকেই বেরিয়ে এল, ‘তিথি ফিরবে না?’

অদিতি দ্রুত মাথা নেড়ে না বলেই দু-হাতে মুখ ঢাকলেন। তাঁর সমস্ত মুখ কান্নায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল।

যথেষ্ট বুদ্ধিমান হয়েও গড়পড়তা বাঙালি পুরুষের মতো বিশ্বনাথ সাংসারিক সব ব্যাপারেই স্ত্রীর ওপর নির্ভর করেন। এখানে অদিতির সিদ্ধান্তই তাঁর সিদ্ধান্ত। কিন্তু তিনিও প্রথমে এটা মেনে নিতে পারেননি যে অদিতি এমন চুপচাপ পুরো ঘটনাটা মেনে নেবেন। সেই মেনে নেওয়াও এমন, যে না মানার সঙ্গে তার খুব একটা পার্থক্য নেই। অদিতি অস্বাভাবিক নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কোনো কথাবার্তা বললেন না, স্নানও করলেন না পর পর দু-দিন, মুখেও কিছু দিলেন না, শুধু শুয়ে রইলেন বিছানায় মৃত মানুষের মতো। এ ক-দিন বিশ্বনাথ পাগলের মতো ছটফট করলেন, কিন্তু তাঁর কী করণীয় ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না। শুধু কাজের লোক অন্নদাকে বললেন, ‘তোমার বউদির খুব জ্বর। তুমি রাত্রে গোটা পাঁচেক রুটি করে রেখে যেয়ো তো।’ দুপুরের ভাত আর আলু বিশ্বনাথ নিজেই সিদ্ধ করে নিয়েছেন, অন্নদা রুটি করে গোটা দুই বেগুনও ভেজে দিয়ে গেল।

ঘরে!

দু-দিন এভাবে কাটার পর তৃতীয় দিন বিশ্বনাথ আর না পেরে অদিতিকে একটা ঝাঁকুনি দিলেন, ‘শুনছ? এই যে, শুনছ? এরকম না খেয়ে না দেয়ে শুয়ে থাকলে হবে? কিছু একটা করতে হবে তো?”

অদিতি চোখ মেলে তাকালেন, তাঁর দৃষ্টি একেবারে শূন্য। বিশ্বনাথ আকুল গলায় বললেন, ‘তিথির তো একটা খোঁজ নেওয়া উচিত,…তমালকেও একটা চিঠি লেখা দরকার…’

‘ও কোথায় গেছে তুমি জানো না!’ অদিতির গলা ক্ষীণ, খসখসে। ‘সে নিজের ইচ্ছেয় সেখানে গেছে, তোমার আমার কিছু করার তো নেই!’

তাঁর কথাগুলোর মধ্যে কোনো আবেগ ছিল না, ছিল নিরাসক্ত সত্যকথনের ধার। বিশ্বনাথ খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন, ‘মৌসুমীদের কাছ থেকে একবার পার্থদের বাড়ির ঠিকানাটা—

‘না!’ অদিতির চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠেছিল, ‘সে আমাদের এভাবে ছেড়ে যেতে পেরেছে যখন, তখন মনে করব আমাদের তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমিও তার কোনো খোঁজ করব না।’

বিশ্বনাথের কান্না আসছিল, কিন্তু তাঁর বহুবছরের বিশ্বাস তাঁকে বলছিল, অদিতি ঠিক কথাই বলছেন।

অদিতি উঠে বসলেন। ক্লান্ত শুকনো গলায় বললেন, ‘তমালকে লিখে দাও। তবে চিন্তা করতে বারণ কোরো। আসতে-টাসতে বলার দরকার নেই। আর শোনো…লোকে জিজ্ঞেস তো করবেই।…কাউকে মিথ্যে বলতে যেয়ো না।…বোলো যে,…বোলো…তিথি নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করে চলে গেছে…’

তাঁর গলা ভেঙে যাচ্ছিল। জোর করে সামলে নিলেন। বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাথরুমে যাব, আমায় একটু ধরবে? মাথাটা বড়ো ঘুরছে…

বিশ্বনাথ তাঁর কাঁধ ধরতেই অদিতি একেবারে ছেলেমানুষের মতো তাঁর বাহুতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলেন, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘কী করে পারল, কী করে এমন করতে পারল গো! খুব কষ্ট হচ্ছে,…তোমারও হচ্ছে… আমি জানি… কিন্তু কী করব…ও যেন সুখে থাকে, ভালো থাকে যেন…’

বিশ্বনাথের হাঁ-হাঁ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, তার ফাঁকেই মনে হল, অদিতি তাঁকে ছুঁয়ে এভাবে শেষ কবে কেঁদেছিলেন তাঁর মনে নেই।

চিঠি পেয়ে তমাল এসেছিল, বিশ্বনাথ তাকে আসতে বারণ করা সত্ত্বেও। সে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি ঘটনাটা। বাড়ি এসে সব দেখেশুনে সেও হঠাৎ কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল। আর কোনো কঠিন পদক্ষেপের কথা উচ্চারণও করল না সে, প্রতিশোধের কথাও নয়। বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে গোপনে কাঁদছে। বারবার বলছিল, ‘তিথি! তিথি এমন করল!’ হতাশায় মাথা নাড়ছিল এদিক-ওদিক, ‘নিজের কেরিয়ারের কথা ভাবল না একবারও!’ সে একবারও পার্থর নাম উচ্চারণ করেনি। কলকাতায় দিন তিনেক থেকেই দিল্লি ফিরে গেল, এই নিস্তব্ধ অবসন্ন বাড়ির পরিবেশ তার অসহ্য লাগছিল।

যাওয়ার সময় অদিতি তাকে বললেন, ‘মন দিয়ে নিজের কাজকর্ম কোরো। এসব কথা বেশি ভাবার দরকার নেই। তার কোনো খবর নেই মানে ধরে নিতে হবে সে ভালোই আছে।’

ক্ষিপ্রহাতে জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে তমাল চোয়াল শক্ত করল, ‘হ্যাঁ, ভালো থাকতেই তো গেছে। তবে নিজের ভালো দেখতে গিয়ে আর কারও কথা ভাবল না এটাই হচ্ছে কথা। স্বার্থপর!’ তমাল এক ঝটকায় ভারী ব্যাগটা কাঁধে তুলে উঠে দাঁড়াল,

‘আসছি মা, বাবা এলাম। তোমরাও একটু ইজি হও, ভুলতে চেষ্টা করো। আফটার অল ইটস্ হার লাইফ অ্যান্ড হার ডিসিশন। ওর জন্যে তোমাদের এত কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।’

অদিতি হাসলেন, বিবর্ণ অদ্ভুত হাসি। বললেন, ‘সাবধানে।’

তমাল দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল, তার ট্রেন ধরবার তাড়া।

এই পাঁচ-ছ মাসে পাড়ার লোক, আত্মীয়স্বজন সবাইই সব জেনে গেছে। অদিতি বা বিশ্বনাথ কেউই কারও কাছে কিছু লুকোননি। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে তাঁদের কোনোকালে বেশি মাখামাখি নেই। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও কর্তব্য ও সৌজন্য ছাড়া অতিরিক্ত আত্মীয়তা নেই। তার কারণ, অদিতি বা বিশ্বনাথ কেউই কথা চালাচালি পছন্দ করেন না। পরনিন্দা পরচর্চা আর কূটকচালি, যে-কোনো প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়সভার যা প্রধান কর্মসূচি, তার থেকে সচেতনভাবে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন। তিথি চলে যাওয়ার পর এইসব সভায় সাড়া পড়ে গেল।

মাসের গোড়ায় ভাড়া দিতে এসে একতলার বিশ্বাসবাবু ঠোঁটে আক্ষেপসূচক চিক চিক শব্দ তুললেন, ‘সব শুনলাম, মিসেস মিত্র। স্যাড, খুবই স্যাড। আপনারা কিছু করতে পারলেন না!’

অদিতি হাত পেতে টাকাগুলো নিয়ে গুনতে শুরু করলেন। এটা করতে তাঁর খুব অস্বস্তি হয়। বিশেষত যিনি টাকা দিলেন তাঁরই সামনে দাঁড়িয়ে সেই টাকা গোনা খুব অভদ্রতা বলে মনে হয় তাঁর। আজ এইটাই তাঁর মুখ নীচু করে রাখার অছিলা।

‘ছেলেটি কী করে কী?

অদিতি মুখ তুললেন, ‘আমি ঠিক বলতে পারব না।

ঝাঁপতাল

‘সে কী! মানে, আপনি কিছুই জানেন না?’

‘তিথি নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে একজনকে বিয়ে করেছে, আমি শুধু এইটুকু জানি। এর বেশি যদি কিছু আপনার জানার ইচ্ছে থাকে, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না—দুঃখিত।’

বিশ্বাসবাবু হাঁ-করে তাকিয়ে থাকলেন। মেয়ে পালিয়েছে তবু কটকট করে কথা শোনাচ্ছে, এ আবার কেমনধারা মা!

তাই বলে অদিতি এত সহজেই সবার কাছে নিষ্কৃতি পেলেন তা নয়, তাঁর নিজের দিদি বাড়িতে এসে রীতিমতো রাগারাগি চেঁচামেচি শুরু করলেন, ‘থানা পুলিশ কিচ্ছু করলি না তোরা!’

‘খামোখা চেঁচাচ্ছ দিদি, তিথির বয়েস এই সেপ্টেম্বরে কুড়ি হবে। আঠেরো হয়ে গেছে দু-বছর আগে, ও সাবালিকা—’

‘থাম থাম’। দিদি চোখ বড়ো করলেন,—‘একমাত্র মেয়ে নিজের সর্বনাশ করল, আর তুই বসে বসে দেখলি? কী পাষাণী মা রে তুই?’

অদিতির কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল না। এসব কথার কী জবাব দেবেন তিনি! তাঁর দিদি একা নন। এই একই ক্ষুব্ধ অভিযোগের মুখে তিনি বার বার পড়ছেন। এ ছাড়াও আরও নানা কথা। তিথির আদৌ বিয়ে হবে কি না, নাকি সেই ছেলেটা তাকে ফেলে পালাবে, অদিতির সামনে এইসব সন্দেহও প্রকাশ করেছেন অনেকে। তাঁর আড়ালে লোকে যে আরও অনেক কিছু বলছে সেও অদিতি জানেন। অদিতির হঠাৎ খুব মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছিল, যে মা তাঁকে ছেড়ে অনেকদিন আগেই চলে

গেছেন, তিথির জন্মের ঠিক দশ মাস আগে। তার দু-বছর পরে বাবাও। অদিতির খুব মা-বাবার কথা মনে করে কান্না পাচ্ছিল।

বিশ্বনাথের চেহারা দেখেও বুক ভেঙে যায় অদিতির, বিশ্বনাথ যেন এই ক-দিনেই একেবারে বুড়ো হয়ে গেলেন। দাড়িটাড়ি কামান না একদম, সারা মুখে খোঁচা খোঁচা সাদাকালো দাড়ি। আর কেমন যেন একটা জবুথবু ভাব। চোখের কোণে পিচুটি লেগে আছে খেয়াল নেই।

‘দাড়ি কাটো না কেন! বড্ড যে ভেঙে পড়েছ দেখছি।’ অদিতি হাল ধরতে চেষ্টা করেন। এরকম করে চলতে পারে না। তাঁদের দুজনকেই শক্ত হতে হবে।

বিশ্বনাথ কোনো উত্তর দিলেন না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলেন অদিতির সামনে থেকে। তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও বাক্যালাপ যেন অসম্ভব বিরল হয়ে উঠেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যোগাযোগহীন হয়ে মূর্তির মতো বসে থাকেন দুজনেই। অদিতি কোনো কথা বললেও বিশ্বনাথের সাড়া পাওয়া যায় না। অদিতি বুঝতে পারেন বিশ্বনাথের এই চুপ করে থাকা, এই দীর্ঘশ্বাসে তাঁর প্রতি একটা অব্যক্ত অভিমানই প্রকাশ পায়। অদিতি জানেন বিশ্বনাথ মনে মনে প্রত্যাশা করেন অদিতি তাঁকে কোনো একসময় বলে উঠবেন, ‘তিথি যা করেছে, করেছে। চলো আমরা ওকে ক্ষমা করে দিই। ওখানেই ওর বিয়ে দিয়ে দিই।’ কিন্তু বিশ্বনাথ চুপ করে থাকেন। তিনিও জানেন অদিতির অভিমান স্পর্শ করার জোর তাঁর নেই। তিনি তাই নিজের অভিমানও মুখ ফুটে প্রকাশ করেন না।

তিথি আদৌ পার্থকে বিয়ে করেছে কি না, অদিতিও তা জানেন না। তবে তিনি আলাদা করে বিয়ে জিনিসটাকে তেমন গুরুত্ব দিয়েও ভাবতে বিশ্বাসী নন, যেভাবে সচরাচর সবাই ভেবে থাকে। দুজন সাবালক যে-কোনো মূল্যে পরস্পরের সঙ্গে থাকতে চাইলে তাদের বিয়ে করে নিতেই-বা কতক্ষণ, আর বিয়ে না করলেইবা তাদের কী আসে যায়! তাঁর একান্ত অনিচ্ছায় তিথি ভুল বয়সে ভুল সময়ে ভুল সঙ্গী নির্বাচন করে যে অনর্থ করেছে, তাতে শুধু তাদের ডেকে এনে বিয়ের আয়োজন করলেই সমস্ত

সংশোধন হয়ে যাবে, অদিতি এমন মনে করেন না। তাঁর বুকের মধ্যে নিরন্তর তীব্র টানাপোড়েনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর একটা মন আকুল প্রার্থনায় ঈশ্বরকে বলছে— ঠাকুর ও যেখানে গেছে যেন সুখে থাকে, আর একটা মন গোপনে অপেক্ষা করছে কবে তিথি পার্থকে ছেড়ে তাঁর কাছেই ফিরে আসবে।

অদিতির মনের মধ্যে যে তীব্র ওলটপালট চলেছিল, তার প্রতিফলন ঘটল বাইরেও। তিনি বদলাতে শুরু করলেন। অথবা, এটা ঠিক বদল নয়। তিনি বহুদিন ধরে নিজেকে যেভাবে যে রূপে সচেতনভাবে গেঁথে তুলেছিলেন, আজ সেটাই ভেঙে ফেলতে চাইলেন। অদিতি ছোটোবেলা থেকে যে আবহাওয়ায় যে পরিমণ্ডলে বড়ো হয়েছিলেন, বিশ্বনাথকে বিয়ে করার পর তার থেকে বহুদূরে সরে এসে আমূল পরিবর্তিত করে নিয়েছিলেন নিজেকে। কেতাদুরস্ত ধনীকন্যা থেকে সহায়সম্বলহীন কেরানির বউ। একমাত্র ভালোবাসাই মানুষকে এই পরিবর্তনের শক্তি জোগায়। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি, সংসারের প্রতি। বিশ্বনাথের অবস্থার প্রচুর উন্নতি হলেও তাঁর মতো অদিতিও বাইরে থেকে দেখতে একই রয়ে গেছিলেন। আসলে, ছেলেমেয়েকে নিপুণভাবে গড়ে তোলার জন্যেই তাঁরা দুজনে নিজেদের দিকে ফিরেও তাকাতে পারেননি, তাকাতে চানওনি। আজ তিথি সেইসব স্নেহ আর শাসনের যাবতীয় বন্ধন উপেক্ষা করে চলে যেতেই অদিতি হঠাৎ নিজের দিকে চোখ ফেরালেন। তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল কীসের জন্যে তাঁর এই নিজেরই চারপাশে ঢালাই করা ছাঁচ? কোনো লাভই তো হল না শেষপর্যন্ত! তিনি তিথিকে যেভাবে বড়ো করে তুলেছিলেন, যে শিক্ষা দিয়েছিলেন, সব তছনছ করেই তো সে এভাবে চলে যাতে পারল! তাহলে তাঁরইবা আর কী দায় নিজেকে এই সংসারের সাজে জড়িয়ে রাখার। অদিতি আবার আগের চেহারায় ফিরে গেলেন। বিয়ের আগে তাঁর চুল ছিল ছোটো ছোটো করে কাটা। তিনি আবার চুল কেটে ফেললেন। কখনোই তিনি সিঁথির প্রান্তে এক বিন্দুর বেশি সিঁদুর ছোঁয়াননি, সেটুকুও বর্জন করলেন। হাত থেকে খুলে ফেললেন চুড়ি। বিশ্বনাথের অবাক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রাগ করছ? আসলে এসবে তো আমি কোনোদিনও বিশ্বাস করিনি। তোমাকে বিয়ে করার পর কোনো সংঘাত চাইনি বলে সব কিছু মেনে নিয়েছিলাম। এতদিন মেনেও এসেছি। ভেবেছিলাম, আমার সংসারকে সব দিক থেকে আদর্শ সংসার হিসেবে গড়ে

তুলব। সেখানে কোনো অশান্তি থাকবে না। তোমার-আমার মধ্যেও নয়, আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়েও নয়। আমার খুব গর্বও

ছিল সেরকম একটা সংসার গড়তে পেরেছি বলে। এখন বুঝতে পারছি আমি আসলে কিছুই পারিনি। তাই এসব খুলে ফেলেছি। আজ থেকে আমি আবার আমার নিজের মতো থাকব।’

অদিতি একটানা কথা বলে দম নিলেন। বিশ্বনাথকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না তাঁর মাথায় আদৌ কিছু পৌঁছোচ্ছিল কি না। তিনি ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়েই ছিলেন। অদিতি বললেন, ‘রোজ ভোরে তোমার সঙ্গে হাঁটতে যাব ভাবছি। বাড়িতে বসে থেকে ভালো লাগে না——

বিশ্বনাথ মাথা নাড়লেন, আস্তে আস্তে বললেন, ‘তাই যেয়ো। লেকে এখন খুব কৃষ্ণচূড়া ফুটেছে, তোমার ভালো লাগবে।’ বিশ্বনাথ এভাবে কথা বলবেন, অদিতি আশা করেননি। তাঁর চোখে জল আসছিল, কৃতজ্ঞতায়।

এই প্রথম পুজোতে তিথি তমাল কেউ বাড়িতে নেই। পুজোর দিনগুলো কীভাবে কাটবে অদিতি ভেবে পাচ্ছিলেন না। পুজোর হাওয়ায় যে কী একটা দোষ আছে, প্রিয়জনদের কাছে না পেলে অদর্শনের কষ্ট পাগল করে মারে, অদিতি এর আগে কখনো এভাবে বোঝেননি। বাড়ির পেছনদিকে একটু দূরেই পাড়ার পুজো। মাইক বাজছে সকাল থেকে সন্ধ্যে। অদিতি বা বিশ্বনাথ কেউই মণ্ডপে গেলেন না। টিভিতে সন্ধ্যেবেলা মায়ের মুখ দেখে প্রণাম করলেন। তারপর সুতির চাদর জড়িয়ে টুকটুক করে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি বন্ধ করে। ঠাকুর দেখতে নয়, বাড়ির কাছে লেক গার্ডেন্স স্টেশন, সেইদিকে। অন্ধকার নির্জন প্ল্যাটফর্মে বসে থাকার মধ্যে এক ধরনের অসহায় শান্তি আছে, এই মারাত্মক পুজোর দিনগুলোতে শুধু এই প্ল্যাটফর্মে কোনো ভিড় নেই, আলো নেই, শব্দ নেই। মাঝে মাঝে একেকটা ট্রেন আসছে যাচ্ছে চিন্তাস্রোতের মতো, তারপর আবার শূন্যতা।

পুজোর পরে একদিন সকালে অদিতি বাজার করে ফিরছিলেন। সামান্যই বাজার হয় আজকাল। হেঁটেই আসছিলেন অদিতি। একটু অন্যমনস্কও ছিলেন হয়তো। হঠাৎ মোনালিসা সেলুনের সামনে একটা রিকশা তাঁর গায়ের কাছে এসে পড়াতে তিনি

তাড়াতাড়ি রাস্তার ধারের দিকে সরে গেলেন। সেলুনের সামনে একটা নীল মারুতি দাঁড়িয়ে। অদিতিও গাড়িটার কাছ ঘেঁষে সরে এলেন আর সেই মুহূর্তেই গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মিতা। এক্কেবারে মুখোমুখি, এড়ানোর কোনোই উপায় নেই।

এই ভয়টা অদিতির বরাবরই ছিল। মৌসুমীদের বাড়ি তাঁদের বাড়ি থেকে মাত্র মিনিট দশেকের পথ। বাজার যাওয়ার পথে একটা গলি ডান হাতে বেঁকে গেছে ভেতরে, ওইটা দিয়ে একটু ঢুকলেই মৌসুমীদের বাড়ি। যদিও ওদের বাড়ির লোকজন সবাই গাড়িতে করে বড়ো রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করে, গলি দিয়ে খুব একটা হাঁটে না। দোকানবাজারও করে কাজের লোক। তবু কখনো না কখনো দেখা হয়ে যাবার সম্ভাবনা তো ছিলই। আজ এভাবে দেখা হয়ে যেতেই অদিতি অসহায় বোধ করলেন।

অদিতির থেকে মিতাই অবশ্য চমকে উঠেছিলেন বেশি। প্রথম দু-এক মুহূর্ত তিনি অদিতিকে ঠিক চিনতে পারছিলেন না। তিথির মা বলতে যাঁর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল তিনি অত্যন্ত ঘরোয়া চেহারার এক মহিলা। তাঁর সঙ্গে এই অদিতির যথেষ্ট অমিল। অবশ্য ছোটো চুল বা সিঁদুরহীন সিঁথি কোনো মানুষকে একেবারে চিনতে না পারার মতো কোনো পরিবর্তন নয়। মিতার মুখ একটু পরেই লাল হয়ে উঠল। তিনি একবার বিব্রত মুখে একটু হাসার চেষ্টা করলেন, হাসিটা খুলল না। অরূপ ছিলেন চালকের আসনে। তিনি গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত একবার মিতার সঙ্গে চোখাচোখি করলেন। তারপর দ্বিধাজড়িত মুখে বললেন, ‘কেমন আছেন?’

অদিতি একটু সময় নিয়ে তারপর মাথা নাড়লেন, ‘ভালো, আপনারা?

মিতা চোখ নামিয়ে নিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি অদিতির চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছেন না। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘কী বলে যে আপনার কাছে, মানে, আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইব আমরা, আমাদের কোনো মুখ নেই।’

অদিতি একটু অস্থির হয়ে উঠলেন, মুখে কিছু বললেন না। অরূপ মিতাকে সমর্থন করার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ঠিকই, উই মাস্ট অ্যাপোলজাইস। কিন্তু, আমরা কিছু জানতা—’

‘আমি তো আপনাদের কিছু বলিনি!’

মিতা আর অরূপ দুজনেই চমকে তাকালেন অদিতির দিকে। অরূপ বলে উঠলেন, ‘না না, এটা আমাদের রেসপনসিবিলিটি আমরা স্বীকার করছি, আসলে—’

‘আমি সত্যিই তা মনে করি না।’ অদিতি বাধা দিলেন। খুব শান্তভাবেই বললেন, ‘বিশ্বাস করুন। সেরকম হলে আমি এতদিনে নিজেই আপনাদের কাছে গিয়ে কথা বলতে পারতাম।’

মিতা নির্নিমেষে দেখছিলেন অদিতিকে। অরূপও। অদিতি বাজারের ব্যাগটা হাতবদল করতে করতে বেশ সহজ গলায় বললেন, ‘তিথি যা করেছে সেটা ওরই দায়িত্ব। সেজন্যে আমি আপনাদের দোষী করব? ছি! এরকম ভাবলে আমার নিজেকেই খুব ছোটো লাগবে।’

অরূপ হঠাৎ খুব আবেগের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘মিসেস মিত্র, আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। আমরা সত্যিই খুব অপরাধী মনে করেছি নিজেদের। আপনাকে আমি সব বলতে পারি, তিথি এখন—’

অদিতি এক ঝটকায় অরূপের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, মিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মৌসুমী ভালো আছে? আর ওর ভাই?’ তাঁর গলার স্বর কাঁপছিল।

মিতার চোখে জল চিকচিক করছে, তিনি গাঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘মৌ খুবই দুঃখ পেয়েছে। আমরাও। তিথিকে আমরা খুব ভালোবাসি, দেখুন, আমরা আপনাকে হেল্প করতে চাই—’

অদিতি মাথা নাড়ছিলেন, কঠিন গলায় বললেন, ‘কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না আমার। আমার মেয়েকে আমি চিনি, এভাবে ওকে ফেরানো যাবে না।’ অদিতি এগোতে শুরু করেও থমকে গেলেন, একটু হেসে বললেন, ‘ও সব কথা বরং থাক। বিজয়ার পর দেখা হল, কোনো সম্ভাষণ করলাম না—শুভ বিজয়া।’

মিতা চট করে কোনো জবাব দিতে পারেননি, অরূপই তাড়াতাড়ি বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, শুভ বিজয়া। দেখা হবে!’

বিজয়ার ক-টা দিন ব্যস্ত থাকতেই হল। তাঁদের বিজয়ায় যেখানে যেখানে যাওয়ার থাকে সেসব মিটে গেল লক্ষ্মীপুজোর আগেই। লক্ষ্মীপুজোর পর ক-দিন ধরে চলল বাড়িতে লোকজন আসার ধুম। সেই একই প্রশ্ন আর অভিযোগ সামলাতে হল অনবরত, কখনো উত্তর দিয়ে, কখনো নিরুত্তর থেকে। এ ছাড়া আরও বিস্ময় এবং কটূক্তিও, অদিতির আচমকা বেশ পরিবর্তন সম্পর্কে। অদিতির কোনো ভাবান্তর হল না। তিনি প্রত্যেক বার বিজয়ায় বাড়িতে নানারকম মিষ্টি বানান, সেইসঙ্গে ঝাল নোনতা কচুরি নিমকি ঘুগনি আলুরদম। এ বছর কর্তব্য সারলেন কেনা মিষ্টি দিয়ে, অতিথিদের মন উঠল না।

কালীপুজোর আগের দিন সকাল থেকেই প্রবল উত্তুরে হাওয়া দিতে শুরু করল। তিথির ঘরে উত্তরদিকে দুটো জানলা আছে। সে চলে যাওয়ার পর অদিতি একদিনই মাত্র এ ঘরে ঢুকেছিলেন। তার এলোমেলো বিছানাপত্র গুছিয়ে রেখে জানলা বন্ধ করে দিয়ে এসেছিলেন। কাজের মেয়ে অন্নন্দা রোজ অন্য ঘরের সঙ্গে এ ঘরটাও ঝাঁট দিয়ে মুছে দিয়ে যায়, অদিতি আর সে ঘরে ঢোকেন না। ঢুকতে পারেন না। ঢুকলেই বুকের মধ্যে অদ্ভুত কষ্ট হতে থাকে। আজ উত্তুরে হাওয়ার দাপটে সে ঘরের একটা জানলার পাল্লা কীভাবে যেন খুলে গেল। বার বার আছড়ে পড়তে লাগল ঠাস ঠাস করে। অদিতি আজ প্রায় ছ-মাস পরে সেই ঘরে ঢুকলেন জানলাটা বন্ধ করার জন্যে। বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন ছিটকিনিটা লাগছে না। শক্ত হয়ে আটকে আছে। ওই জন্যেই জানলাটা ঠিক করে বন্ধই হয়নি নিশ্চয়ই, আজ দমকা হাওয়ায় একেবারে খুলে গেছে।

অদিতি ছিটকিনিটা নামানোর চেষ্টা করছিলেন। হচ্ছে না। খুব শক্ত। বাইরে বেল বাজল, অদিতি জানলা খোলা রেখে বাইরে

এসে সদর দরজার চাবি নিলেন। এখন সাড়ে এগারোটা বাজে, অন্নদার আসার সময়। অদিতি বারান্দা দিয়ে দেখে চাবি ছুড়ে দিলেন, অন্নদা আঁচল পেতে লুফে নিল। এটাই এ বাড়ির চালু রেওয়াজ। অদিতি ড্রয়ার খুলে ছোটো হাতুড়ি বার করলেন, ছিটকিনিটায় গোটা কয়েক ঘা দিতে হবে। তিনি তিথির ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, অন্নন্দা দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘বাবা গো আজ কী পাগলা পাগলা হাওয়া ছেড়েছে দ্যাখো, এইবার শীত পড়বে। ও বউদি, এই নাও নীচে একটা চিঠি ফেলে গেছে পিওন।’

অদিতি হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। ধড়াস করে উঠল তাঁর বুক। শরীরের সমস্ত রক্ত মহাবেগে ছুটে গেল মাথায়, তারপর হুড়হুড় করে নামতে লাগল শিরদাঁড়া বেয়ে। চিঠির ওপর তাঁরই নাম লেখা। হস্তাক্ষর তাঁর চেনা, গভীর চেনা।

১০

তিথি প্রাণপণে দৌড়োচ্ছিল আর চিৎকারকরছিল, নিঃশব্দে।

কপালে একটা ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে তার চোখ খুলে গেল। মাধুবউদির হাত। মাধবী ঝুঁকে মাথাটা তিথির মুখের কাছে নিয়ে এলেন, ‘এখন কেমন লাগছে শরীরটা? একটু ভালো?’

তিথি ঘাড় কাত করল। একটু হাসলও। মাধবী বললেন, ‘শুয়ে থাক। তোর আসলে রেস্টের দরকার। অত খাটুনি, তার ওপর আকাশপাতাল ভাবনা অত ভাববি না, মাকে চিঠি লিখেছিস, ব্যস। এবার সব মিটে যাবে।’

তিথি আবার চোখ বুজল। চোখ বুজেই মনে হল আবার সে ডুবে যাচ্ছে। ক্লান্তি, অতল ক্লান্তি। চোখ বুজেই সে শুনল, ‘ঘুমো, আমি আসছি।’ মাধবী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

এখন সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি একটা সময়। ঘরের জানলা বন্ধ, বাইরে খুব হাওয়া দিচ্ছে। বন্ধ জানলার খড়খড়ি দিয়ে হালকা আলো আসছে। তিথি আবার চোখ মেলে দেখল, ঘরে কেউ নেই। কারও সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে না। পার্থ বেরিয়ে গেছে। অলকও অফিসে। সুধা নিশ্চয়ই রান্নাঘরে, সীমাকেও দেখা যাচ্ছে না। সীমা সকালে তার পাশে কিছুক্ষণ বসে ছিল, তিথির খেয়াল আছে। তারপরই সে আবার কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল।

.পুজোবাড়ির চাতাল। ঢাক বাজছে প্রবল শব্দে। দশমীর বিকেল। প্রতিমা নামানো হচ্ছে বেদি থেকে। একটু আগেই মাকে সিঁদুর পরানো, হাতে পানের খিলি দেওয়া ইত্যাদি হয়ে গেছে, তারপর সবাই নিজেদের মধ্যে সিঁদুর দেওয়া-দেয়ি করছেন। সবাই বলতে সবাইই। শিবানী, সুধা, দীপ্তি, সুমিতা, মল্লিকা, আরও অন্যান্য শরিকদের বাড়ির বউরা। সবার সারা চুলে কপালে নাকে

গালে আবিরের মতো সিঁদুর মাখামাখি। তিথি চাতালের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, সিঁদুর দিতে পারেনি। তার অবশ্য সিঁদুর দেওয়ার কথা মনেও হয়নি, তার খেয়ালই ছিল না ওই বরণডালা হাতে বউদের ভিড়ে তার একজন হওয়ার কথা। বরং অবচেতনেই তার নিজেকে মনে হচ্ছিল বান্টিদের দলে, যারা বইয়ের মধ্যে রাখার জন্যে ঠাকুরের পায়ের ফুল বেলপাতা হাতড়াচ্ছে। হঠাৎ সুমিতা তার কাছে এসে দাঁড়ালেন, ‘আহা রে, মেয়েটা সিঁদুর খেলতে পারল না, বিয়ের পর প্রথমবারই

একজন প্রায় অপরিচিতা মহিলা পাশ দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সুমিতার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কেন গো? ওর বুঝি—’

সুমিতা চোখ মটকালেন, চাপা গলায় বললেন, ‘ওর মেনস্ হচ্ছে।’

তিথি সিটিয়ে উঠে চাতাল থেকে নীচে নেমে দাঁড়াল।

পুরোহিত লোকটির গায়ের রং বড্ড ফর্সা, ব্লটিং পেপারের মতো। শক্তপোক্ত চেহারা, মাথায় কদমছাট চুল। হলদে ধুতি আর নামাবলি গায়ে তিথির দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করলেন। দাঁতগুলো পান খাওয়া আর কালো। তিনি সুধার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও বউদি, আপনার এই বউমাটি তো বসে বসেই কাটিয়ে দিলেন দেখলাম। আপনি আর পার্থদা সীমাদি কী খাটনিটাই না খাটলেন। বউমাটির কি পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য?’

তিথি আঁতকে উঠে দু-হাতে কান চেপে ধরে ছুটতে শুরু করল। এটা কোন রাস্তা, সে কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। বোধ হয় মেজোঠাকুমাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটাই হবে। কিন্তু খুব অন্ধকার। বিকেলবেলায় এত অন্ধকার তো হওয়ার কথা নয়! তিথি অন্ধের মতো দৌড়োচ্ছে, পেছনে তাড়া করে আসছে ঢাকের আওয়াজ, পুরোহিতের পান-খাওয়া দাঁতের হাসি, আরও যেন কারা কারা। তারা সবাই হা-হা করে হাসছে, একজন একজনকে বলছে, ‘ওর মেনস্ হচ্ছে।’ সবাই আরও হেসে উঠেছে…হঠাৎ

তিথি দেখল সামনে সেই বাছুরটা। তারও সারা কপালে সিঁদুর আর গলায় জবাফুলের মালা। বাছুরটা গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোমার কি পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য?’

চারপাশে খুব জোরে ঢাক বেজে উঠল, কাঁসিও। এটা কি বিসর্জনের বাজনা? নাকি বলির? বলি, না বিসর্জন, ‘না বলি? তিথি চিৎকারকরে উঠল—’না না না ওমা না, ওমা ওমা ওমা….’

কপালে তখনই একটা ঠান্ডা হাত অনুভব করেছিল সে মাধুবউদির।

সেদিন পুরোহিতমশাই এরকম বিশ্রীভাবে কথাটা বলার পর সত্যিই তিথি কান্না চাপতে পুজোবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। মেজোঠাকুমাদের বাড়ি যাওয়ার পথে একটা রোয়াকে বসে কিছুতেই না কাঁদার শপথ করছিল সে, তবু তার চোখ ফেটে জল আসছে। সে কোনো কৃতিত্ব পাওয়ার লোভে কাজ করেনি। কিন্তু তাই বলে এত বড়ো মিথ্যে অপবাদ সে সইবে কেমন করে! সুধা কিংবা আর কেউ তার প্রতিবাদও করলেন না। তিথি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। ওঁরা প্রতিবাদ করে কী বলতে পারতেন, তিথির পিরিয়ড হয়েছে বলে সে পুজোর কাজ করতে পারছে না? এভাবে বলা যায় না। ওই পান-খাওয়া দাঁতের কদমছাট পুরুতটিকে দেখে বোঝা যায় একেবারেই অশিক্ষিত। তাকে এই কথা বললে সে হয়তো আরও একরাশ কুৎসিত কথাই শুনিয়ে দেবে। ওই লোকটি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে তিথি এ বাড়িতে বলতে গেলে একটা উটকো লোক। ওপরে ওপরে। কেউ তাকে দূর দূর না করলেও ভেতরে ভেতরে কেউই যে তাকে ঠিকমতো মেনে নিতে পারেনি সবার আচরণেই এটা দারুণ স্পষ্ট। লোকটা তাই তাকে অপমান করার সাহস পেয়েছে। কেননা ও জানে ওকে কেউ শাসন করবে না, বরং মনে মনে সমর্থন আর বাহবাই দেবে। তিথি চমশা খুলে হাঁটুতে মুখ গুঁজল। পার্থর ব্যস্ততা ফুরোয়নি। সে ভাসানের বাঁশ জোগাড় করতে বেরিয়েছে। তিথি সেটা জেনেও বিড়বিড় করল, ‘পার্থ তুমি কোথায়, ওই লোকটা আমাকে শুধু শুধু কীসব বলছে। পার্থ, বলো, আমি কাজ করিনি?’

‘আমি ঠিক জানতাম তুমি এখানে!’

তিথি আপাদমস্তক চমকে উঠল। সীমা হাসছিল, বলল, ‘পুরোহিতমশাই একটু ঠোঁটকাটা আছেন। অমনি করে মুখ ভার করে বসে থাকতে হবে না। চলো ওঠো। ঠাকুর বেরোচ্ছে দেখবে এসো।’

পুজোর ক-টা দিন পার্থ যেন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল। কর্মব্যস্ত, দায়িত্বশীল। তাকে কাছে না পাওয়ার সমস্ত অভিমান ছাপিয়ে তিথির মনে মনে তাকে নিয়ে গর্ব হচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে প্রবল আকর্ষণ বোধ করছিল সে পার্থর প্রতি, পার্থর আপাত-উদাসীনতা সে আকর্ষণের তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর তিথি আর পুজোবাড়িতে থাকেনি। রাত্রে সে শিবানীর পাশে শুত। বড়ো ঘরের ঢালাও বিছানার একপ্রান্তে অলক, আরেকপ্রান্তে শিবানী আর সে। সীমা অষ্টমী থেকে পুজোবাড়িতে চলে গিয়েছিল।

পুজো মিটে যাওয়ার পর সবাই বাড়িতে চলে এলে আবার শোয়ার পুরোনো ব্যবস্থাই চালু হল। তিথি পার্থর পাশে শুতে গিয়ে দেখল তার সারা শরীরে রোমাঞ্চ হচ্ছে। ঘরের আলো নিভিয়ে সুধা বিছানায় উঠলেন। তিনি শুয়ে পড়ামাত্র তিথি অনুভব করল পার্থর হাত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তীব্র ভালোলাগায় মথিত হয়ে তিথি পার্থর হাত চেপে ধরতে যেতেই তার চুড়ি ঝিনঝিন করে উঠল, তার ভয় করছিল পার্থ হুঁশ না হারায়।

বাড়ি ফাঁকা হতে শুরু করেছিল দ্বাদশীর দিন থেকে। কাকিমারা সবাই যে যার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো করেন। চতুর্দশীর মধ্যেই সবাই ফিরে গেলেন। বাড়িতে তখন শিবানী অঘোর অসীম, আর তিথিরা। চতুর্দশীর দিন দুপুরে, বাড়িসুদ্ধ সবাই যখন ঘুমোচ্ছে, পার্থও, তিথি একা একা দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দার কোণে, তার নিশ্বাস গরম। কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়েই সে চমকে দেখল পার্থ দাঁড়িয়ে তার পেছনে। তিথি শ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘ঘুমোওনি?”

‘না, সবার ঘুমের জন্যে ওয়েট করছিলাম।’

তিথির বুকের ঢেঁকির পাড় পড়ছে, সে নিশ্বাসের স্বরে বলল, ‘কেন!’

‘এসো।’ পার্থ তার হাত ধরে হালকা টান দিল।

একটা ফাঁকা ঘরে দরজাবন্ধ আবছায়ায় দুজনে দুজনকে প্রাণপণে হাতড়াচ্ছিল। পার্থ মুখ দিয়ে কাতরোক্তির মতো একটা শব্দ করে বলল, ‘উহ্ কতদিন, কতদিন পর তিথি! আমাকে তুমি এত শাস্তি কেন দিচ্ছ, কেন কেন কেন, জানো আমি পাগল হয়ে গেছি, তোমাকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাই তিথি…

পার্থ আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল একটানা। তিথির কথা বলারও সময় ছিল না। প্রবল জাগ্রত নিজের শরীরটাকে নিয়ে সে নিজেই কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না।

লক্ষ্মীপুজোয় তিথি আবার কাজ করতে পেরেছিল। আলপনাও দিয়েছিল ছোটো করে। সীমাকে নিয়ে মনে মনে ভয় ছিল তার। দুপুরের ব্যাপারটা সীমা নিশ্চয়ই জানতে পারেনি। কিন্তু রাত্তিরে চুড়ির শব্দ শুনেছিল। তিথি আশ্চর্যই হয়ে গেল যখন সীমা তার সঙ্গে বেশ মিলেমিশেই কাজ করল। সীমার মনখারাপ সেরে গিয়েছে, কিন্তু তিথিই অযথা অপরাধবোধে আড়ষ্ট হয়ে ছিল।

লক্ষ্মীপুজোর পরের দিনই কলকাতায় ফিরে আসা হল। ফেরার ট্রেন ছিল রাত্রে। চলে আসার সময় সে যখন অঘোর আর শিবানীকে প্রণাম করল, অঘোর কিছু বললেন না। শিবানী চিবুক ছুঁয়ে বললেন, ‘আসছে বছর ছেলে কোলে এসো।’ তিথি একটু কুঁকড়ে গেল। অসীম সন্ধ্যে থেকেই ঘুমোচ্ছে, আসার সময় তার সঙ্গে কারও দেখা হয়নি।

ট্রেনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিথির মনে হল, সে সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে। তার এই চলে যাওয়া একটা সত্যিকারের যাওয়া, চিরকালের জন্যে। আশ্চর্য, এই গভীর বিচ্ছেদবোধ তো তার মা-বাবা নিজের বাড়ি ছেড়ে আসার সময়ও হয়নি। কত বিচিত্র স্মৃতি সে ফেলে রেখে যাচ্ছে এখানে? তিথির বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কেন তার মনে হচ্ছে ওই বাড়িতে তার আর দ্বিতীয় কোনো ফিরে যাওয়া নেই!

দেশের বাড়িতে রাঁধুনির মুখে তিথি একদিন রাত্তিরে একটা কথা শুনেছিল। রাঁধুনিটি শিবানীকে বলছিল, ‘সেই ঝিকিমিকি বেলায় উনুনে আঁচ দিইছি, আর এই সবে রান্নাবাড়া সাঙ্গ হল, গতরে আমার আর কিছু নেই।’

তিথি পার্থকে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ঝিকিমিকি বেলা মানে কী?’

পার্থ বলেছিল, ‘মানে হল গোধূলি, কিংবা গোধূলি আর সন্ধ্যের মাঝামাঝি সময়। ওটা এই অঞ্চলের একটা ডায়ালেক্ট। সুন্দর, না?’

হু-হু করে ফিরতি ট্রেন ছুটছে কলকাতার দিকে। তিথির মনে হল, সে পেছনে ফেলে যাচ্ছে একটা আস্ত বিচিত্র জন্ম, একটা আলোআঁধারি জ্বরের ঘোর, একটা ঝিকিমিকি বেলা।

কলকাতায় ফেরার আগে তার জ্বরের কথাটা কেউই জানতে বুঝতে পারেনি। কিন্তু ট্রেনের ধকলেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে, বাড়ি পৌঁছেই তিথির মনে হল সে আর দাঁড়াতে পারছে না। ঘরে ঢুকে সে দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ল। মাধবী ঘরের চাবি দিতে নীচে নেমে এসেছিলেন। তিথিকে ওইভাবে বসে পড়তে দেখে ছুটে এলেন। তার গায়ে কপালে হাত দিয়ে আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘ওমা, তিথির যে গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে!’

তিথি হাঁসফাঁস করছিল। সুধা বললেন, ‘আমি তখনই বলেছিলাম, ঠান্ডা জলে অত সকালে চান কোরো না, সহ্য হবে না। খাটাখাটনিও গেছে তো খুব, অত করার অভ্যাস নেই, বারণ করলেও শোনে না।’

পরের দিন সকালে তিথি বিছানাই ছাড়তে পারল না। শুয়ে থাকতে হল। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তার। এভাবে সারাদিন শুয়ে থাকতে গেলেও একটা মনের জোর দরকার। তিথির সেটা নেই। অনুতপ্ত অপরাধী যেভাবে প্রাণপণে নিজের অপরাধ লাঘবের চেষ্টা করে, সেভাবেই তিথি বার বার জোর করে মাথা তুলে উঠে বসার চেষ্টা করছিল। পারছিল না। মাথায় যেন একটা দশমনি পাথর বাঁধা।

অলক ঘরে উঁকি দিলেন। তিথি টের পাচ্ছিল অলক ঘরের বাইরে সরে গিয়ে চাপা গলায় বলছেন, ‘ও সীমা, কী হয়েছে রে তিথির?’

‘জ্বর হয়েছে, শুনলে তো কাল!’ সীমার গলায় ঈষৎ বিরক্তির আভাস, ‘তুমি ওরকম চোখ কপালে তুলছ কেন?’ ‘তোর দাদাকে বল একটা ডাক্তার-টাক্তার দেখাতে।’ অলক চাপা গলাতেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘মেয়েটাকে এনে তো তুলল এখানে, একটা হুঁশগম্যি বলতে তো কিছু নেই।’

‘ও সব কথা আমায় বলছ কেন?’ সীমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘মিছিমিছি হাঁকপাক কোরো না তো বাবা! ওর জ্বর হয়েছে, আমরা ওকে দেখছি। মিটে গেল!’

কথাগুলো আসছিল প্যাসেজ থেকে। তিথি লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। ওহ্ ভগবান। সে কী বিশ্রীভাবেই না ঘর জুড়ে শুয়ে রয়েছে এখানে। না, আজ জোর করে উঠে মাথায় জল দিয়ে কিছু খেলেই সে ঠিক হয়ে যাবে।

পার্থ পাশের ঘরে বসে চা খাচ্ছে। তিথি আস্তে আস্তে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই পার্থ ঠোঁট থেকে চায়ের কাপ বিচ্ছিন্ন করে বলল, ‘এই তো, উঠেছ? চা খাবে?’

‘নিজের বউয়ের সঙ্গে ভদ্রতা করছ নাকি?’ তিথি হাসল, ‘আমি কি চা খাই?’

পার্থ হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরার চেষ্টা করে বলল, ‘দেখি? এখন বোধ হয় জ্বরটা আর নেই, না?” তিথি এ কথার কোনো উত্তর দিল না। পার্থকে তার হাত ছুঁতেও দিল না। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বড়োমা রান্নাঘরে? বড়দি কই?’

‘সীমা কলতলায়, জল ভরছে। কেন?’

‘বড়দি সকালে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।’ তিথি একটু থামল। তার মাথা ভার লাগছে। দরজার পাল্লায় মাথা ঠেকিয়ে বলল, ‘তুমি তো আমার কাছে একটুও বসলে না!’

‘বসেছিলাম তো! তুমি ঘুমোচ্ছিলে বলে বুঝতে পারোনি।’

‘আমি শুয়েছিলাম, একটুও ঘুমোইনি।’ তিথি বড়ো করে শ্বাস ফেলল, হলকার মতো গরম। খুব ভরসা হারা গলায় বলল, ‘তুমি আমার কাছে একটু থাকলেই আমি ঠিক হয়ে যাব, আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে।’

পার্থ উঠল। চায়ের কাপটা পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে বলল, ‘চলো যাচ্ছি। আমাকে একটু পরেই বেরোতে হবে—

তিথি খুব ছেলেমানুষি কান্নার সুরে বলল, ‘কোথায় যাবে? না প্লিজ…’

‘একটা এডিটিং আছে, সোনা। কলকাতায় ফিরেই যোগাযোগ করার কথা। মনে হয় কাজটা পেয়ে যাব। এমনি করে না, চলো শোবে।’

তিথি পার্থর গায়ে ভর দিয়ে এগোচ্ছিল। এক ঘর থেকে প্যাসেজ দিয়ে অন্য ঘরে। অলক কলতলার দিকে থেকে ছুটে আসছিলেন। রোজ অফিসে বেরোনোর আগে তিনি এরকম ছোটেন। কিছুতেই তাঁর সময়ের মধ্যে স্নান-খাওয়া সারা হয় না। কলতলা থেকে স্নান সেরে ভিজে লুঙ্গি ভাঁজ করে পরে আজও তাই অলক দৌড়ে দৌড়ে আসছিলেন, উপরন্ত তাঁর শীতও করছে। তিথি আর পার্থকে দেখে তিনি থমকে গেলেন।

‘জ্বর কত?’ প্রশ্নটা তিথিকে নয়, পার্থকেই করলেন অলক। পার্থ তিথির পিঠ বেড় দিয়ে ধরে রেখেছে। তিথি তার কাঁধ থেকে মাথা তুলে সোজা হওয়ার চেষ্টা করল।

অলক সরুচোখে তিথিকে একবার দেখে নিয়েই পার্থর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালেন, ‘ওর জন্যে একটা ডাক্তার-টাক্তারের ব্যবস্থা কর বলে দিচ্ছি!’ তাঁর গলায় শাসানির সুর।

তিথি মরমে মরে যাচ্ছিল। অলক এরকম হঠাৎ বিনা কারণে বকাবকি শুরু করে দেবেন সে ভাবেনি। নিজের কাঁধ থেকে পার্থর হাত নামিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আমার বেশি জ্বর হয়নি বাবা

অলক তিথির দিকে তাকালেন না। পার্থকেই জ্বলন্ত চোখে দেখতে দেখতে বললেন, ‘হুঁ, বিয়ে করেছে!’

অশান্তির গন্ধ পেয়ে সুধা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। অলকের ভাত বাড়ছিলেন তিনি। তাঁর ডান-হাতে একথাবা আলুভাজা, বাঁ-হাতে একটা বাটি। এ বাড়িতে হাতা চামচের ব্যবহার প্রায় নেই। হাতে করেই পাতে তরকারি-টরকারি দেওয়া সুধা উদ্বেগের গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে, কী বলছ কী তুমি?’

তাঁর প্রশ্নের উদ্দেশ্য অলক। সুধার গলা পেয়ে অলক দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। পার্থ হঠাৎ বড়ো গলায় বলল, ‘সকাল থেকে তুমি এক কথা বলে যাচ্ছ কেন বলো তো? তুমি কি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছ? তোমার ধারণা আমার কাছে ডাক্তার দেখানোর পয়সা নেই!’

অলক ভিজে লুঙ্গির ওপরে শার্ট গলাতে গলাতে ধমকে উঠলেন, ‘যা যাঃ, চ্যালেঞ্জ! খালি বড়ো বড়ো কথা। পয়সার কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? খাস তো বাপের পয়সায় ভাত, আবার বড়ো বড়ো কথা।

পার্থ আবার কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তিথি মরিয়া হয়ে তার হাত চেপে ধরল, ‘না! প্লিজ!’

সুধা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তোমার অত কথার কী আছে বলো তো? সবসময় অশান্তি করার চেষ্টা! তিথির জ্বর হয়েছে, কী করতে হবে সে আমরা বুঝব। ভাত দিয়েছি খাবে এসো।’

অলকের শার্টপ্যান্ট পরা হয়ে গিয়েছিল। তিনি ছুটে ছুটে এসে ভাত খেতে বসলেন। পার্থ খচমচ শব্দ করে চপ্পলে পা সে কাঁধে ঝোলা নিয়ে তৈরি। তার রাগের হাবভাব দেখে অলক নাক দিয়ে আবার শব্দ করলেন, ‘হুঁ!’

সুধাও পার্থকে দেখছিলেন, বলে উঠলেন, ‘বেরোচ্ছিস নাকি? খেয়ে গেলি না? কখন ফিরবি?’

গলাচ্ছিল।

হয়।

পার্থ সুধার দ্বিতীয় প্রশ্নটিরই অপেক্ষায় ছিল। বাকি প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর না দিয়ে সে বলল, ‘এসব কথা শোনার পর খাওয়ার আর ইচ্ছে থাকে!’ ঘটাং করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল সে। সুধা সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে তিথির দিকে চোখ ফেরালেন। তিথি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমি স্নান করে আসি বড়োমা? স্নান করলেই শরীরটা একটু ভালো লাগবে।’

সুধা কোনো জবাব দিলেন না।

পার্থ বলেছিল মাধুবউদি তাদের কেউ হন না। কিন্তু তিথি দেখেছে, মাধবী যেন এই পরিবারেরই একজন। ওপরের তলায় স্বামী আর ছোটো মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। সংসারের কাজকর্ম সেরে তিনি অনেকটা সময়ই নীচে থাকেন। বিশেষ করে সকালে তাঁর স্বামী অফিসে আর মেয়ে স্কুলে বেরিয়ে যাবার পর। সলিল ফেরেন রাত করে, রুম্পা সন্ধ্যেবেলায় পড়ে। সেই সময়টাতেও মাধবী নীচে নেমে আসেন। মাধবী বেশ গুছিয়ে সংসার করতে জানেন। তিথি ওঁদের ঘরে গিয়ে দেখেছে, খুব সাধারণ জিনিসপত্রই এমনভাবে রাখা, যাকে তার মায়ের ঘর সাজানোর মতো নিপুণ সুন্দর হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু তার মধ্যেই একটা গৃহস্থালির শ্রী ফুটে বেরোয়। নিজের অজান্তেই মনে মনে তুলনা করে ফেলে তিথি। অন্য কিছু নয়, তার মনে হয় একতলায় তাদের ঘরে যেন এই গৃহস্থ শ্রীরই বড়ো অভাব। সব কিছু এত এলোমেলো, স্তূপাকার করে রাখা যে তার মধ্যে আবদ্ধ থেকে তিথির স্নায়ু পীড়িত হতে থাকে। সে প্রাণপণে গোছাতে চায়।

এখানে কোনো আলমারি নেই। জামাকাপড় আলনাতেই স্তুপ করে ফেলে রাখা হয়। বাইরে পরার একটু ভালো কাপড় বেশিরভাগই কেচে ভাঁজ করে বিছনার তলে পাতিয়ে রাখা থাকে, আর যেসব পোশাক না পরে পরেই পুরোনো হয়ে যায়, সেগুলো থাকে দু-তিনটে বাক্সের মধ্যে বন্দি। তিথি সেদিন আলনা নিয়ে পড়ল। সারা দুপুর ধরে আলনা গোছাল। একটা একটা করে প্রতিটি কাপড় ভাঁজ করে থরে থরে সাজিয়ে রাখল পরিষ্কার করে। বাড়িতে থাকতে মায়ের তাড়নায় সে মাঝে মাঝে

টুকটাক কাজকর্ম করতে বাধ্য হত। সবসময় ইচ্ছে করত না, মায়ের ওপর রাগও হত। তবু অদিতি জোর করে তাকে দিয়ে নানানরকম কাজ করাতেন, এটা-ওটা রান্না করাতেন। তিনি বলতেন, ‘কাজ জানলেই তুমি স্বাধীন থাকতে পারবে, অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না। কাজ জানা মানে একটা আত্মবিশ্বাস, একটা তৃপ্তি।’ আজ সেই সবই মনে পড়ছিল তিথির। আর মন খুঁতখুঁত করছিল—কিছুতেই মায়ের মতো হচ্ছে না কেন! অবশেষে সে যখন মোটামুটি নিজের কাজে সন্তুষ্ট হল, ঘাড় ফিরিয়ে দেখল সুধা ঘুমাচ্ছেন। সীমা তাঁর পাশে শুয়ে মাধবীর কাছ থেকে নিয়ে আসা সানন্দার পাতা উলটাচ্ছে। তিথি ফিসফিস করে বলল, ‘বড়দি, দ্যাখো গুছিয়েছি।’

সীমা একঝলক তাকিয়েই বলল, ‘ভালো দেখাচ্ছে। কিন্তু কিছু তো খুঁজে পাওয়াই যাবে না।’

‘কেন বড়দি?’ তিথি একটু আহত।

‘এমন গুছিয়েছ যে কোনটা কার তলায় দেখাই যাচ্ছে না।’ সীমা বই বন্ধ করে হাই তুলল, বলল, ‘এবার একটু শুয়ে নাও। আজ তোমার জ্বর আসেনি তো?’

সন্ধ্যেবেলা মাধবী এসেই হইচই করে উঠলেন, ‘ওমা! এ নিশ্চয়ই তিথির কাজ। কেমন ঝরঝরে লাগছে আলনাটা। যাক এবার দিদিভাই আর সীমার অনেক কাজ হালকা হবে।’

সীমা ওপরের ঘরে রুম্পাকে পড়াচ্ছে। সুধা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘মাধু রান্নাঘরে আসবে? সীমার খিচুড়িটা বসিয়েছি। আমায় একটু এদিকে থাকতে হচ্ছে।’

মাধবী সেদিকে যাওয়ার তেমন গা দেখালেন না। খাটের ওপর জাঁকিয়ে বসতে বসতে গলা তুলে বললেন, ‘ও, আজ সোমবার,

না? সীমা উপোস করে যাচ্ছে, কবে যে ওর বিয়েটা লাগবে। দমদমের সম্বন্ধটা কী হল গো দিদিভাই?’

সুধা রান্নাঘর থেকেই বললেন, ‘ও হবে না। ছেলে বড্ড বেঁটে, সীমার পছন্দ নয়।’

মাধবী তিথির দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘সীমা খুব ভুল করছে, জানিস তো! বার বার সম্বন্ধ বানচাল করা কোনো কাজের কথা নয়। মা-বাবা ক-টা সম্বন্ধ আনবে? আমি দুটো এনেছিলাম, রীতিমতো ভালো, সীমাকেও তারা পছন্দ করেছিল। সীমাই রাজি হল না। একজনের বয়েস চল্লিশ বলে, আর একজন দূরে থাকে বলে, বরোদায়। বল তো, এরকম করলে চলে!’

তিথির এ বিষয়ে কোনো কথা বলা সাজে না, সে চুপ করেই থাকল। তারও আজকাল মনে হচ্ছে সীমার এমন করাটা ঠিক যুক্তিযুক্ত নয়। সীমা প্রতি সোমবার সারাদিন উপোস করে থাকে, শিবপুজো করে একেবারে রাত্তিরে সুজির খিচুড়ি খায়। তার বিশ্বাস, এত নিষ্ঠার সঙ্গে শিবপুজো করলে তার পছন্দসই বর হবে। কিন্তু কাউকেই পছন্দ হচ্ছে না তার, এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। যদিও, তিথি এ বাড়িতে এসে দেখেছে পার্থরা সবাই খুব জ্যোতিষে বিশ্বাস করে। সুধা প্রায়ই এক জ্যোতিষীর বাড়িতে যাতায়াত করেন। সেই জ্যোতিষী নাকি বলেছেন সামনের শ্রাবণে সীমার বিয়ে হয়ে যাবে। তিথির হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে যেতে সে বলল, ‘মাধুবউদি, বড়দির বোধ হয় এই শ্রাবণেই বিয়ে হবে।’

‘ধ্যুৎ, ছাড় তো!’ মাধবী বিরক্তির সঙ্গে হাতঝাড়া দিলেন, ‘ওই জ্যোতিষী বলেছে তো? শুনেছি, এ উনি গত পাঁচ বছর ধরে বলে যাচ্ছেন। তবু দিদিভাই এসব কথায় বিশ্বাস করে।’ মাধবীর ঘাড়ের কাছে একটা মশা বসেছিল। সন্ধ্যেবেলা দরজা জানলা বন্ধ করে দিলেও কোত্থেকে যে এত মশা ঢোকে তিথি ভেবে পায় না। মাধবী মশাটাকে সপাটে মারতেই তাঁর এলো খোঁপা খুলে গেল। সেটা হাতে জড়িয়ে বাঁধতে বাঁধতে তিথির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোর শরীর কেমন?’

‘ভালো না, মাধুবউদি! জ্বরটা হয়েই যাচ্ছে।’

মাধবীর মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল, ‘এটা ঠিক ভালো ঠেকছে না, ম্যালেরিয়া-ট্যালেরিয়া নয় তো? এখানে যা মশা! তোর বোধ হয় একবার ডাক্তার দেখানোই দরকার, বুঝলি?’

তিথি বিপন্ন মুখে বলল, ‘না না, ম্যালেরিয়া নয়। আমার তো জ্বর হয়েছে বর্ধমানে গিয়ে। ডাক্তার দেখানোর দরকার নেই। এটা এমনিই—’

মাধবী ভুরু কুঁচকালেন, ‘বর্ধমানে গিয়ে মানে? কবে থেকে জ্বর হচ্ছে ঠিক করে বল তো!’

তিথি ধরা পড়ে যাওয়া মুখে ঠোঁট কামড়াল, বলল, ‘পুজোর আগে থেকে কিন্তু এটা সত্যিই ডাক্তার দেখানোর মতো কিছু না।’ মাধবী একটুক্ষণ স্থির চোখে তিথির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আচ্ছা। সে আমি বুঝব।’

তিথির অসহায় লাগছিল। কেন সে খামোখা বলতে গেল মাধুবউদিকে জ্বরের কথাটা! অনেকদিন ধরেই জ্বরটা চলছে তার, এটা ঠিকই। তার মনে ভয়ও ঢুকেছে। শরীর দিন দিন কাহিল হয়ে যাচ্ছে, মুখে প্রচণ্ড অরুচি। আর জ্বর এলে তো কথাই নেই, মাথা তোলার শক্তি থাকে না। সেসময় সে একাই শুয়ে থাকে। সীমা মাঝেমধ্যে কাছে এসে বসে। সুধাও গায়ে কপালে হাত দিয়ে দেখে যান। অলককে আর কিছু বলতে শোনেনি তিথি। পার্থ তো অসম্ভব ব্যস্ত। একটা কাজ পেয়েছে সে। তিথি এ বাড়িতে আসার পর এই প্রথম পার্থ কাজ পেল। টানা এডিটিং চলছে সাত-আটদিন ধরে। তিথি তার শারীরিক অবস্থার কথা পার্থ ছাড়া কাউকেই মুখ ফুটে বলেনি, বরং এমন ভাব করেছে যেন তার কিছুই হয়নি, এরকম তার প্রায়ই হয়। সে মনে মনে অপেক্ষা করছিল পার্থর কাজটা শেষ হওয়ার জন্যে। কাজ শেষ হলে নিশ্চয়ই টাকা পাবে সে। তিথি সেদিন অবধিই অপেক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হল কই। মাধুবউদির কাছে কাঁদুনি গেয়ে বসল সে। তিথি নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল।

‘একটা কথা তোকে বলি শোন। তোর বাপের বাড়িতে ফোন আছে?’

তিথি হঠাৎ মাধবীর প্রশ্নের কোনো থই পাচ্ছিল না। মাথা নেড়ে বলল, ‘ফোন? না। কেন!’

‘তাহলে একটা চিঠিই লেখ, মাকে।’ মাধবী খুব নরম গলায় বললেন, ‘তোর বিয়ের কথাটাই তো মা জানে না, তাই না? সব লিখে দে। আর, মা-বাবাকে বিজয়ার প্রণামটাও তো জানাতে হয়।’

তিথি মুহূর্তের মধ্যে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুখে আঁচল চেপে ধরে কান্নার দমকে ফুলতে লাগল সে। মাধবী কোনো সান্ত্বনা দিলেন না। অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘তোর রোগের গোড়া কোথায় আমার কি আর জানতে বাকি আছে রে!’

মাধবীই তিথিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। তিথির আপত্তি কানে না তুলে। সুধা কিছু বললেন না। পার্থ অম্লানমুখে বলল, ‘মাধুবউদি, আমি শোধ করে দেব।’

তার কথাটা তিথির কানে এমন খট্ করে লাগল যে সে পার্থর দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল, তার চোখে বিস্ময় আর অবিশ্বাস মাখামাখি। পার্থ মাধবীর দিকে তাকিয়ে তখনও বলছে, ‘তুমি ফিজ আর ওষুধের দামটা মিলিয়ে আমায় হিসেবটা বোলো—’

‘যা তো, বকিসনি। তিথি আমার বোন জানিস?’ মাধবী মুখঝামটা দিলেন, ‘এ জগতে যারাই ভালোবেসে ঘর ছেড়ে আসে তারা সবাই সবার বোন, বল তিথি?’

ডাক্তার তিথিকে ভালো করে দেখে ধমক দিলেন একেবারে খাওয়া-দাওয়া না করার জন্যে। তার নাকি যথেষ্ট রক্তাল্পতা হয়েছে। জ্বর যেটা হচ্ছে সেটা ভাইরাসের সংক্রমণ। শরীর দুর্বল হলেই এটা চেপে ধরে। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করতে বললেন তিনি,

আর বিশ্রাম নিতেও। এ দুটিই প্রধান ওষুধ একথা বলেও আরও গোটা তিনেক ওষুধ খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তার একটা বোধ হয় ঘুমের ওষুধ। তার পর থেকেই তিথি ঘুমোচ্ছে।

ঘুমের মধ্যেই অনবরত চলেফিরে বেড়াচ্ছে তার মন। বর্ধমানের দেশের বাড়ি থেকে তার ছেড়ে আসা মায়ের বাড়ি। তীব্র বিপরীত টুকরো টুকরো ছবিতে সংঘর্ষ হয়ে বার বার ফুলকি ঠিকরে উঠছে তার বন্ধ চোখের অন্ধকার দেওয়ালে।

মা এতদিনে নিশ্চয়ই পেয়ে গেছেন তার চিঠি? ডাইনিং টেবিলের পাশে মায়ের প্রিয় সেই জানলাটার ধারে দাঁড়িয়ে মা নিশ্চয়ই অনেকবার উলটেপালটে পড়ছেন চিঠিটা? বেশি কিছু অবশ্য লেখেনি সে। প্রণাম জানিয়েছে মা-বাবা-দাদাকে। আর জানিয়েছে রেজিরি কথা, তার এ বাড়িতে থাকার কথা। না, তার অসুস্থতার কথা জানায়নি সে। লিখেছে, ‘আমি ভালো আছি, খুব ভালো।’

পার্থই ইনল্যান্ড কিনে এনে দিয়েছে তাকে। পার্থই পোস্ট করে দিয়েছে চিঠিটা। তিথির মাকে চিঠি লেখার কথা এ বাড়িতে সবাই জানে। সীমা বলেছিল, ‘তোমার মা খুব রাগি, না? আমারই ভয় করছে। চিঠিটা পেলে উনি নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবেন।’

ইনল্যান্ডটা পার্থর হাতে দেওয়ার আগের মুহূর্তে একবার দ্বিধা করেছিল তিথি। তারপর চিঠিটার উলটোপিঠে এবাড়ির ঠিকানাটা লিখে দিয়েছিল। দেখে পার্থ হাসল, সামান্য বাঁকা একচিলতে হাসি। বলল, ‘ঠিকানা দিচ্ছ? তোমার মা যদি এসে তোমাকে নিয়ে যান?

তিথি পার্থর চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসেই বলল, ‘ভয় পাচ্ছ নাকি? ভয় পেয়ো না। আমি এখানে চলে আসার দিনই মা সমস্ত বুঝতে পেরেছিলেন। মা জানেন জোর করে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে দিয়ে কিছু করানো যায় না!’

মাধুবউদি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল তিথি। মাধবী বলে গেছিলেন, ‘মাকে চিঠি লিখে দিয়েছিস,

এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তিথি দেখল মাধুবউদির সেই কথা থেকে শব্দগুলো কেঁপে কেঁপে ভেঙেচুরে একটা গান হয়ে গেল। গানটা যে ঠিক কোন গান, সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না সে, সুরটা একেকবার ধরা দিয়েই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিথি গানটার পেছনে পেছনে ডুবতে শুরু করল, গভীরে, আরও গভীরে। সেই যেখানে তার ছোটোবেলায় মা বসে আছেন প্রিয় জানলাটার পাশে, কোলে খোলা গীতবিতান। তিথি বহুদিন পর মায়ের গলার গান শুনতে পাচ্ছিল, গানটাকেও ক্রমশ চিনতে পারছিল সে। ছোটোবেলা থেকে যে যে রবীন্দ্রসংগীতগুলো মায়ের মুখে শুনতে শুনতে সে বড়ো হয়েছে এ তো তাদেরই মধ্যে একটি। চিত্ত পিপাসিত রে…। তিথি মায়ের সঙ্গে গলা মেলাল।

১১

কালীপুজো কেটে যেতেই হঠাৎ করে শীত পড়ে গেল।

রান্নাঘরটা দিনেও বেশ অন্ধকার। আর মশাও খুব। তিথি বঁটি পেতে সুস্থির হয়ে বসতে পারছিল না। সুধা কড়ায় খুন্তি নাড়ছেন। তাঁকেও মশা কামড়াচ্ছে নিশ্চয়ই, তবে তাঁকে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মশার কামড় সহ্য করাও একটা অভ্যাসের ব্যাপার। সুধা তিথির দিকে তাকালেন, ‘খুব মশায় ধরেছে, না? ঢেকে বোসো।’

তিথি তরকারি কুটছিল। জ্বর থেকে ওঠার পর সে সবসময়ই সীমার একটা চাদর গায়ে দিয়ে থাকে। চাদরটা আধা পশম। প্রথম শীতের পক্ষে বেশ আরামদায়ক। এখনও সেটাই তিথির গায়ে জড়ানো। কিন্তু হাত বের করে তরকারি চাদরটা গলার কাছে উঠে এসে শরীরের অনেকটা অংশই আলগা হয়ে যাচ্ছে। মশাও কামড়াচ্ছে সেখান দিয়ে, শীতও

আলু কাটার পর টুকরোগুলো জলে ভিজিয়ে রাখতে রাখতে তিথি জিজ্ঞেস করল, ‘বড়োমা বেগুনগুলো কি কুচি কুচি হবেএকটু বড়ো?’

সুতি আধা কুটতে গেলে ঢুকছে।

‘না ওই কুচি কুচিই করো।’ সুধা কড়ায় জল ঢাললেন। সামান্য ছ্যাঁক করে উঠেই তেলটুকু মিইয়ে গেল।

সীমা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, ‘মা! আমার বোরোলিনটা কোথায় রেখেছ, পাচ্ছি না!’

সুধা ঘাড় ঘোরালেন, ‘আমি কী করে বলব। দ্যাখ গে যা বালিশের ফাঁকেটাকে ঢুকে বসে আছে কি না।’

? না

সীমা রোজ রাত্রে বোরোলিন হাতে নিয়ে শোয়। শুয়ে শুয়ে ঠোঁটে কনুইয়ে বোরোলিন মাখে। তিথি ভাববার চেষ্টা করছিল। আজ সকালে সে-ই বিছানা গুছিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন বোরোলিনের টিউবটা সে দেখেছিল। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় সে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখেছি বড়দি, সকালে বিছানা তুলতে গিয়ে পেয়েছিলাম।’

সীমা কোনো উত্তর দিল না। চলে গেল। তার মুখ থমথমে। বিশেষ কোনো কারণে নয়। তার আবার মনখারাপ। তিথি খেয়াল করে দেখেছে, সীমার মোটামুটি পনেরো-কুড়ি দিন অন্তর এরকম মনখারাপ চলে। এ সময়টায় সে বাড়িতে সুধা ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলে না।

অলক কলতলায় তাড়াহুড়ো লাগিয়েছেন। খালি গায়ে তেল চাপড়াতে চাপড়াতে গলা ছেড়ে বলছেন ‘জয় গুরু জয় গুরু জয় গুরু জয় শ্রীরা—মকৃষ্ণ।’ সেটা শুনতে শুনতে তিথির মনে হচ্ছিল যেন একজন পেস বোলার বল করছে। অলক ‘জয় গুরু জয় গুরু’ বলছেন খুব দ্রুত তিন-চারবার, যেন বোলারটা ছুটছে, তারপর খুব জোরে আর টেনে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে হাত ঘুরিয়ে বলটা ছুড়ে দিচ্ছে সে। দৃশ্যটা কল্পনা করে তিথির হাসি পেয়ে গেল। শীতকাল ছাড়া অলকের এত ধর্মনিষ্ঠা দেখা যায় না। নামের জোরে শীত কাটে।

রান্নাঘরে আসার আগে তিথি দেখেছে পার্থ কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আজকাল সে আবার কর্মহীন। কাজ না থাকলে পার্থর ঘুম থেকে ওঠার কোনো তাড়া থাকে না। যখন ইচ্ছে ঘুম থেকে উঠে সে কোনো কোনোদিন বেরোয়, কোনো কোনোদিন বাড়িতেই থাকে।

সীমা রান্নাঘরের দরজা থেকে সরে যাওয়ার পরেই পার্থর গলা পাওয়া গেল, ‘এককাপ চা পাওয়া যাবে নাকি রে?’ প্রশ্নটা সীমাকে। সীমার কোনো উত্তর শোনা গেল না। পার্থ রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল, ‘সীমার ইঞ্জিন আবার বিগড়েছে?’

‘বিগড়াক, তোর তাতে কী?’ সুধা ধমকালেন, ‘ওকে ওর মতো থাকতে দে, পেছনে লাগার দরকার নেই।’ ‘পেছনে লাগিনি তো? চা চাইছিলাম। হবে না?’

‘দাঁড়া বাবা। এখনও ভাত-তরকারি নামেনি। তোর বাবার চান হয়ে গেল। হাত খালি হলে দিচ্ছি।’

তিথি মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘আমি দেব-খন, বড়োমা।’

পার্থ হাসি হাসি মুখে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ‘তিথি তাহলে তোমার সঙ্গে বেশ কাজ-টাজ করছে, না মা?’

সুধা ভাতের হাঁড়ি নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, উত্তর দিলেন না। তিথির খুব রাগ হচ্ছিল। সে কাজ করবে না তো কী? তাতে পার্থর অত গদগদ হওয়ার কী আছে। বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘যাও, আমি চা দিয়ে আসব।’

তিথি সকালে উঠে দু-ঘরের বিছানা গোছায়। সে এক জটিল কাজ। শীতকালে বিছানায় কাঁথা-চাদরের সংখ্যা বাড়ে। সেসব নিপুণভাবে ভাঁজ করে, মশারি ভাঁজ করে এক পাশে গুছিয়ে রাখে সে। বালিশ ঝেড়ে পর পর গুছিয়ে রেখে বিছানার চাদর টানটান করে গুঁজে দেয়। সুধা তখন পুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিথি বিছানা তুলে বাথরুমে যায়। সুধা সকালে কাপড় ছেড়ে কেচে রাখেন। মুখচোখ ধুয়ে তিথি বারান্দায় সেই শাড়িজামা মেলে রান্নাঘরে ঢোকে। সকালে একপ্রস্থ চা হয়। চা খেয়ে অলক বাজারে যান। বাজার এলে রান্না চাপে। সুধাই রান্না করেন, তিথি কুটনো কোটে, রান্নার জোগাড় দেয়। সীমাকে সকালের কাজে আজকাল পাওয়া যায় না। সে নতুন কয়েকটা টিউশনি ধরেছে, দু-তিনজন ছেলেমেয়ে বাড়িতে পড়তে আসে সকালে। সীমা রোজ ন-টা সাড়ে ন-টা অবধি তাদের পড়ায়। সেইজন্যে কলতলায় সকালের জল ভরাটাও এখন তিথির কাজ। বিকেলেও বেশিরভাগ দিন সে-ই জল ভরে। সকালের রান্না সারা হয়ে গেলেও সে বসে থাকতে পারে না। ছটফট করে কাজ খুঁজে বেড়ায়।

খুঁজেপেতে ময়লা কাপড় কাচে। ঘরদোর ঝেড়েঝুড়ে সাফ করে। এখানে ঘর ঝাড়া অবশ্য খুব ঝঞ্ঝাটের কাজ, ঝাড়তে গেলেই দেওয়ালের ড্যাম্প-লাগা চুন ঝরে পড়ে ঝুরঝুর করে। ঘর গুছিয়েও কূল পাওয়া যায় না। গোছানো আলনা একবেলার মধ্যেই একাকার হয়ে ওঠে। পার্থর টেবিলে কাগজপত্রে জঙ্গল হয়ে আছে তবু পার্থ সেখানে হাত দিতে দেবে না। তাতে নাকি বহুমূল্যবান কাগজপত্র হারিয়ে যেতে পারে। তিথি জোর করে টেবিল গোছালে পার্থ বিরক্ত হয়, দু-দিনে আবার টেবিলটাকে পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে আনে। তিথি দেখেছে, এখানে আসলে কারোরই ঠিক জিনিসটা ঠিক জায়গায় রাখার অভ্যাস নেই। অলকের ছাড়া জামা লুঙ্গি যত্রতত্র ঘরের মাঝখানে পড়ে থাকে, যতক্ষণ না তিথি সেটা তোলে। পার্থর ঝোলা, সীমার চুলের ফিতে, সেলাইয়ের বাক্স, জলের গ্লাস, মুড়ির বাটি সবই এখানে-ওখানে ছড়িয়ে পড়ে থাকে, যেন কোনো কিছুই রাখার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ফেলে রাখলেই হল। তিথি সারাদিন সেসব কুড়িয়ে কুড়িয়ে গুছিয়ে বেড়ায়।

সন্ধ্যেবেলা মাধবী ছাড়াও পাড়ার অন্য অন্য মহিলারা প্রায়ই গল্প করতে, খবরাখবর সংগ্রহ করতে আসেন। তিথি দেখেছে, সুধা, সীমা বা মাধবী কেউই ঠিক এঁদের সঙ্গে খুব একটা গল্পে যোগ দিতে পারেন না, বেশিরভাগ সময়ই শোনেন। সীমা প্রায়দিনই সন্ধ্যেবেলা দোতলায় রুম্পাকে পড়াতে যায়, আড্ডাতে খুব একটা থাকে না। মাধবী যাও-বা একটু কথা বলেন, সুধার গলা একেবারেই পাওয়া যায় না। আসলে পাড়ার ওই মহিলারা নিজেদের তাগিদেই খবর আহরণ এবং বিতরণ করতে আসেন। খবর বলতে পাড়ায় কার ছেলে বিয়ের পর মা-বাবাকে দেখে না, কোন কর্তা-গিন্নিতে তুমুল ঝগড়া হয়েছে, কোন মেয়েকে কার সঙ্গে ঘুরতে দেখা গেছে এইসব। সুধা বা মাধবীর সম্ভবত এসব খবরে খুব উৎসাহ নেই, কিন্তু পাড়াতে থাকতে গেলে পাঁচজনের সঙ্গে এইসব গল্পে যোগও দিতে হয়। এতদিন এ বাড়িতে পাড়ার লোকেদের কৌতূহল ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল তিথি। এখন ধাতস্থ হওয়ার পর সেই উৎসাহে একটু ভাঁটা পড়েছে। পাড়ার কেউ এলে তিথি আজকাল সে ঘর মাড়ায় না। তার মনে হয়, এই পাড়াটা বেশ একটু গ্রাম্যধরনের। সে ছোটোবেলা থেকে যে পাড়ায় বড়ো হয়েছে সেটা এর তুলনায় অনেক আধুনিক আর মার্জিত। সেখানে এরকম আড়ালের অভাব নেই।

যে যে সন্ধ্যেতে বাড়িতে এরকম আড্ডা জমে তিথি সেদিন পাশের ঘর থেকে বেরোয় না। অলক তক্তপোশে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখেন। আর তিথি মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে হয় ইস্ত্রি করে, নয়তো খুঁজেপেতে ছেঁড়া জামা সেলাই করে, বোতাম পরায়। অলক সাধারণত তার সঙ্গে কোনো কথা বলেন না, টিভি দেখতে দেখতে ঝিমুনি আসে তাঁর, তিনি ঘুমিয়েই পড়েন। পাড়ার লোকেরা চলে গেলে তিথি সুধার সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে যায়। কোনো কোনো দিন সে আটা মেখে বেলে দেয়, সুধা সেঁকেন। কোনোদিন সুধা রুটি বেলেন, তিথি সেঁকে।

তিথি প্রতিমুহূর্তে পাগলের মতো খোঁজে এর পরে আর কী করা যেতে পারে। কী করে এই সংসারে সে নিজেকে আর একটু প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারে সবসময় তার সেই চেষ্টা। এ বাড়িতে তার আশ্রয়ের বিনিময়ে নিজের পরিশ্রম আর মনোযোগ নিঃশেষে দিতে চায়। পার্থর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, কিন্তু তিথি তাদের দুজনের অপমানিত অবস্থানের লজ্জায় প্রতিপদে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। পার্থর অযোগ্যতাটুকু সে প্রাণপণে পুরিয়ে দিতে চায়, যেন এই পরিবারে তার অনাহূত অন্তর্ভুক্তির প্রায়শ্চিত্ত করছে।

দুপুরে সুধা ঘুমিয়ে পড়লেন। সীমা একটু আগেই ওপরে মাধবীর কাছে গেছে। পার্থ আজ বেরোয়নি। টিভিতে ক্রিকেটম্যাচ দেখছে। তিথিরও চোখ টিভি-র দিকে, তবে তার মন খেলার দিকে নয়। সে ভাবছিল, পার্থ ক-দিন আগে যে কাজটা করল, সেটায় টাকাপয়সা কিছু পেল কি না জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারছিল না।

পার্থ তক্তপোশে কাত হয়ে শুয়ে টিভি দেখছে, তিথি তক্তপোশে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে। পার্থ ডাকল, ‘এই, ওপরে উঠে এসো না।’

তিথির চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল। সে পার্থর দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসল, ‘ইশ্, তোমার মতলব কী?’

পার্থ উপুড় হয়ে শুয়ে তিথির ঘাড়ে কানে চুমু খেতে শুরু করল।

‘এই যাঃ, পাশের ঘরে বড়োমা।’

ঝাঁপতাল

‘মা ঘুমোচ্ছে।’ পার্থর হাত তিথির গলার কাছে, ক্রমশ নীচের দিকে নামছে।

‘ছাড়ো। বড়দি ওপরে গেছে, এক্ষুনি চলে আসবে।’

‘দরজাটা দিয়ে দাও,’ বলে পার্থ নিজেই এক ঝটকায় উঠে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিল।

তিথি আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘কী করছ কী? এই দুপুরবেলায় দরজা বন্ধ করে, বড়োমা বড়দি দেখলে কী ভাববে? না, এখন

এরকম কোরো না।’

‘এখন না তো কখন করব?’ পার্থ ঠান্ডা মেঝের ওপরেই তিথিকে শুইয়ে দিচ্ছিল, ‘কে কী ভাববে? ভাববে বউয়ের সঙ্গে আছি। কী হয়েছে তাতে?”

তিথি বাধা দিতে চাইছিল, কিন্তু বাধা দিতে পারছিল না। শরীরে ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। এই সুখ একটা বেয়াড়া বেড়াল, তিথি যতই তাকে থলের মধ্যে চেপে বেঁধে দূর করে দিতে চাইছে ততই সে ফিরে ফিরে আসছে।

বাইরে খুট করে একটা আওয়াজ হতেই তিথি ছটফট করে উঠল, কিন্তু পার্থ এমনভাবে তার বেণি ধরে রেখেছে যে তার ঘাড় মেঝের সঙ্গে আটকে আছে। তিথি মাথা তুলতে পারল না, চাপা অনুনয়ের গলায় বার বার বলতে লাগল, ‘ওই বড়দি এল, ছাড়ো প্লিজ, এ মা, কী করছ? প্লিজ ছাড়ো–

পার্থ যখন তাকে মুক্তি দিল, তার আগেই তার শরীর সিটিয়ে গেছে। কোনোক্রমে দ্রুত ঠিকঠাক হয়ে তিথি প্রথমে আস্তে আস্তে

দরজা খুলল। পাশের ঘরে সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে দেখল সুধা তখনও ঘুমোচ্ছেন। সীমাও আসেনি। পার্থর কাছে এসে স্বস্তির হাসি হাসল তিথি, ‘বড়োমা ওঠেননি, আওয়াজটা কীসের হল কে জানে! উফ্, আমি যা ভয় পেয়ে গেছিলাম না!’

পার্থ তখনও চিত হয়ে শুয়ে। তিথি হাঁটু গেড়ে বসে পার্থর গালে আঙুল বোলাল, ‘সত্যি, এভাবে হয় নাকি! তুমি কিছু ব্যবস্থা করো।’

‘কী ব্যবস্থা করব?’ পার্থ বুকে হাতে বোলাচ্ছিল।

‘ব্যবস্থা মানে,’ তিথির খুব অস্বস্তি হচ্ছিল বলতে, ‘আমাদের কোনো ঘর নেই।’

পার্থ তিথিকে দেখছিল, আপশোসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, ‘এই ঘরটাই আমাদের ঘর হতে পারত। তুমি ওই ভুলভাল জেদটা ছাড়ো না। বিয়ে করলাম অথচ বউয়ের সঙ্গে থাকতে পারি না।’ পার্থ বিরক্ত মুখে উঠে বসল, ‘তা ছাড়া এখন তো শীত পড়ে গেছে, ওই ঘরের খাটে বাবা মা সীমার শুতে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।’

‘তাও তুমি কিছু করবে না!’ তিথির গলাও তীব্র, সে শক্ত করে ঠোঁট টিপে পার্থর দিকে তাকাল।

‘কী করতে বলছ তুমি আমাকে?”

‘আমি কিছু বলছি না। আমি জানি না। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?’ তিথি দু-এক মুহূর্ত ঠোঁট কামড়ে চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি এই কাজটা করলে, কোনো টাকা পেলে না?’

‘টাকা? এত তাড়াতাড়ি!’ পার্থ যেন আকাশ থেকে পড়ল, হতাশার স্বরে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি টাকা পাওয়া যায় না তিথি,

অন্তত কয়েক মাস যাক।’

তিথি খুব দমে যাচ্ছিল। এই অবস্থা! কাজ করলেও টাকা পাওয়া যায় না! অথচ সে মনে মনে একটা স্থির আশা আঁকড়ে ছিল, একটু যেন ভরসা হচ্ছিল তার পার্থ কাজটা পাওয়ার পরে। সেটা ভেঙে ছিটকে চুরমার হয়ে যেতেই ভেতরে ভেতরে খুব মানসিক অবসাদ ঘিরে ধরছিল তিথিকে। সেটাকে জোর করে দু-হাতে ঠেলে সরাতে সরাতে সে ভাবছিল, কী করা যায়!

বাড়ি ছেড়ে আসার সময় যে বইগুলো সে নিয়ে এসেছিল সেগুলো কোথায় পড়ে আছে কে জানে। পার্থর টেবিলের কাগজপত্র গোছাতে গিয়ে সেখানে তো চোখে পড়েনি। সকালে রান্নাঘরের ব্যস্ততা মিটলে তিথি বইগুলো খুঁজছিল। মাধবী একবাটি তরকারি নিয়ে নীচে এলেন।

‘তোর বড়োমা কই রে তিথি? এই দ্যাখ চিংড়ি দিয়ে ফুলকপি রাঁধলাম, ভালোবাসিস?’

‘বড়োমা বারান্দায়।’ তিথি চিংড়ি ফুলকপির প্রতি উত্সাহ দেখাল না। মাধবী প্রায়ই এটা-সেটা রান্না করে নিয়ে আসেন, পরিবর্তে এখান থেকে কিছুই যায় না। অবশ্য লোককে দেওয়ার মতো রান্নাও হয় না এখানে। কী করেই বা হবে, অলকের সামান্য আয়েই এত বড়ো সংসার। একথা ভাবলেই তিথির নিজেকে বড়ো সংকুচিত লাগে।

‘কী খুঁজছিস রে তুই? কী হারাল?’

‘আমার বইগুলো মাধুবউদি! হারায়নি, এখানেই আছে কোথাও। পেয়ে যাব।’

মাধবী বারান্দার দিকে পা বাড়িয়েছিলেন, থমকে গেলেন। বললেন, ‘পড়াশুনা করবি বুঝি?’

‘হ্যাঁ মাধুবউদি। পরীক্ষাটা দিতেই হবে যে করে হোক।’

মাধবী গভীর চোখে তিথির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিথি ঘাড় ফিরিয়ে হাসল, করুণ হাসি। বলল, ‘গ্র্যাজুয়েট হতে এখনও অনেক দেরি, তার আগে তো চাকরি পাওয়া যাবে না। একটা বছর শুধু শুধু নষ্ট করলাম।’

‘ও নিয়ে ভাবিসনি। তুই ঠিক পারবি।’ মাধবী বারান্দার দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘বাড়ি থেকে চিঠি আসেনি কোনো, না রে?’ তিথির বুকে একটা কষ্ট হচ্ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘না। আমার দরকার নেই।’

১২

দরজায় পুরোনো ভারী পরদা উড়ছে। পরদার এপাশে দাঁড়িয়ে তিথি ইতস্তত করছিল। সামনের বছর পরীক্ষায় বসার আগে কিছু ক্লাস করা তার নিতান্ত প্রয়োজন, বিশেষ করে প্র্যাকটিক্যলগুলো তো বটেই। সে বিষয়ে হেড-ডিপের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু বরাবরের মতো আজও হেড-ডিপের ঘরে ঢুকতে তার বুক ঢিপঢিপ করছে। এ তার পুরোনো রোগ, স্কুলে থাকতে হেডমিসে কিংবা অন্য কোনো দিদিদের সঙ্গে কথা বলতে হলেই তার জিভ শুকিয়ে যেত।

তিথির পরনে সেই গোলাপি নাইলনের শাড়িটা, লাল ব্লাউজ। সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখাপলা। এই অভূতপূর্ব বেশে তাকে হেড-ডিপের ঘরের সামনে আবিষ্কার করল দীপান্বিতা, তিথির পুরোনো সহপাঠী।

‘মাই গড, তিথি। তুই। ইয়ে কেয়া হাল বনা রাকখা ইয়ার!’

তিথি চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দীপান্বিতা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকে আগাপাশতলা দেখছে। পরক্ষণেই আরও দু-তিনজন ঘিরে ধরল তিথিকে। অতসী আর বৃন্দা, আর একজনের নাম ঠিক মনে পড়ছে না, বোধ হয় সংযুক্তা।

পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরিয়ে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। কলেজের কেউই তিথির কোনো হদিস জানত না, কেন সে পরীক্ষা দিল না, তার পরেই-বা এতদিন তার খোঁজ নেই কেন এ সমস্ত নিয়ে সহপাঠীরা একটু ধাঁধায় থাকলেও কারও সঙ্গে তার এমন কোনো বন্ধুত্বও গড়ে ওঠেনি যে কেউ তিথির বাড়িতে খোঁজ করতে পারে। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার তেমন সুযোগ হয়নি, কেননা প্রথম থেকেই কলেজে তিথি অত্যন্ত অনিয়মিত ছিল। সেই জন্যেই অনেকের ধারণা হয়েছিল তিথি কলেজ ছেড়েই দিয়েছে।

আজ তিথিকে দেখে কলেজে সাড়া পড়ে গেল।

‘তুই বিয়ে করেছিস, তিথি! এইজন্যে তুই পরীক্ষা দিলি না?’

ওরা এত জোরে জোরে কথা বলছে, তিথি বাধ্য হল হেড-ডিপের ঘরের সামনে থেকে সরে আসতে। একপ্রস্থ অবধারিত জিজ্ঞাসাবাদের পর ওরাই অবশ্য তিথিকে অনেক সাহায্য করল। তিথি একা সাহস পাচ্ছিল না বলে ওর সঙ্গে দু-তিনজন ঢুকল হেড-ডিপের ঘরে।

হেড ডিপ ব্রততী সেন রাশভারী কিন্তু রাগি নন। বই পড়ছিলেন, ওরা ঘরে ঢোকার পর চশমা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন, ‘কী চাই?’

অতসী এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ম্যাম, আমাদের বন্ধু তিথি বিয়ে করেছে। ও পার্ট ওয়ান দিতে পারেনি, সামনের বার দেবেখুব ভালো মেয়ে ম্যাম, একটু ক্লাস টাস করতে চায়।’

। ও

তিথি কুঁকড়ে জড়সড় হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, ব্রততী তাকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘এত তাড়াতাড়ি বিয়ে? মা-বাবা দিয়ে দিলেন, না কি?”

‘না ম্যাম। ও নিজেই….মানে, ওর মা-বাবা মেনে নেননি।’ অতসীই তিথির মুখপাত্র।

‘চমৎকার! বিয়ের এত তাড়া যে লেখাপড়া শেষ করা অবধি অপেক্ষা করা গেল না!’

তিথি বুঝতে পারছিল অতসী তার হয়ে সব কথা বলবে, এটা ঠিক না। মরিয়া হয়ে সে মিনমিন করে বলল, ‘আমি লেখাপড়া শেষ করতে চাই, ম্যাডাম, আমি ক্লাস করব, আর প্র্যাকটিক্যালগুলো…’

ব্রততী সেন আবার বইয়ে মন দিলেন। চশমাটা পরতে পরতে বললেন, ‘সে যা পারো করো। ক্লাস করতে ইচ্ছে হলে আর আপত্তি কী। প্র্যাকটিক্যাল ফিল্ডওয়ার্ক যেটুকু যা বাকি আছে করে নিতে পারো। বলে দেব।’

তিথি হাঁপ ছাড়ল। এতেই তার হবে। এই পারমিশানটুকুই খুব জরুরি ছিল। বাকি চেষ্টা সে নিজেই করবে।

করবে, তাতে

হেড-ডিপের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বন্ধুরা কিন্তু তাকে সহজে ছাড়ল না। খবর পেয়ে অন্যরাও এসে জিওগ্রাফি অনার্সের, তাও নয়। অনেকেরই মুখও তিথির চেনা নয়।

জুটল। সবাই যে

‘দিস ইজ আনফেয়ার তিথি। বিয়ে করলি কাউকে জানালি না পর্যন্ত। নেমন্তন্ন তো দূরের কথা।’ ‘এই ওকে এভাবে বলিস না। জানিস, ও বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে?’

‘রেজি?ি মা-বাবা এখনও মেনে নেননি?’

‘তোর সাহস আছে তিথি, আমরা এরকম পারতাম না।’

‘বলিউড ব্লক বাস্টার! কিন্তু ওকে হিরোইন হিরোইন লাগছে না, যাই বল।’

‘তোর বর কী করে রে? কেমন দেখতে?

‘আরে দেখিসনি? কতবার কলেজে এসেছে, দাড়িওয়ালা। ইন্টেলেকচুয়াল। জার্নালিস্ট, না রে তিথি?’

‘তোকে শাঁখপলা পরে থাকতে হয়? তোর শ্বশুরবাড়ি খুব কনজারজেটিভ বুঝি?’

‘ইশ্, তুই চুড়িদারও পরতে পারবি না?’

‘এই খাওয়া খাওয়া। বিয়ে করেছিস খাওয়াবি না এ হতেই পারে না। চল সবাইকে অ্যাটলিস্ট চিকেন রোল খাওয়াতে হবে।’

তিথি প্রমাদ গুনল। পার্থর কাছ থেকে যাতায়াত বাবদ মাত্র দশ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল সে। করুণমুখে বলল, ‘পরে একদিন হবে রে। আজ আমি কিছু নিয়ে আসিনি। তা ছাড়া বাড়িও ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।’

ভিড় পাতলা হয়ে আসছিল। তিথি শুনল একটি মেয়ে তার পাশের জনের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠস্বর খুব একটা না নামিয়েই বলছে, ‘কীরকম বিয়ে রে, বিয়ের পর আরও হ্যাগার্ড দেখাচ্ছে!’

তিথি নিয়মিত ক্লাস শুরু করল। ক্লাসনোটসই তার প্রধান ভরসা। তার বইপত্র বিশেষ নেই। লাইব্রেরির বই দু-একটা করে অবশ্য বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। ভাগ্যিস লাইব্রেরির কার্ডটা বাড়ি ছেড়ে আসার সময় তার ব্যাগের সাইডগ্যাপেই ভরা ছিল।

কিন্তু তিথির সমস্যা শুরু হল অন্য জায়গায়। এত দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার পর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুধু ক্লাস করাই তো যথেষ্ট নয়। বাড়িতে নিজের মতো করে না পড়তে পারলে তিথি স্বস্তি পাচ্ছে না। চিরদিনই তার পড়ার অভ্যাস ঘরের দরজা বন্ধ করে। পড়ার সময় তার চোখের সামনে কেউ চলাফেরা করলে, কথাবার্তা বললেও তার মনঃসংযোগের ব্যাঘাত ঘটে। এখানে তাকে কে দেবে সেই পড়ার পরিবেশ? সকালে কলেজে বেরোনোর আগে সে দৈনন্দিন কাজগুলো করে। যতটুকু পারে রান্নাঘরে সুধাকেও সাহায্য করে। সারাদিন তো বাড়ি থাকে না, যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই যেন সেই খামতিটুকু পূরণ করতে চায়। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে আসার পর একটা ঘরে টিভি চলে, অন্যঘরে প্রায় প্রতিদিনই গল্পের আসর বসে। তারপর আবার রান্নাঘর। ফলে, রাত্তিরে

সবাই শুয়ে পড়ার আগে তিথি পড়তে বসার কাঙ্ক্ষিত অবসরটুকুই পায় না। যে ঘরে সে শোয়, সে ঘরে আলো জ্বললে সীমার ঘুমোতে অসুবিধা হয়। সুধারও হয়তো হয় কিন্তু তিনি মুখে কিছু বলেন না। তা ছাড়া তিথিই-বা সেই অসুবিধে দিতে যাবে কেন। সীমার বিরক্ত আর সুধার ক্লান্ত মুখ দেখে অপরাধীর মতো বলে, ‘প্যাসেজে আলো জ্বেলে পড়ব বড়োমা? দরজাটা ভেজিয়ে দেব, ঘরে আলো যাবে না।’

প্যাসেজের মেঝেতে বসে মশার কামড় খেতে খেতে বইয়ের পাতার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই থাকে তিথি। পড়া আর তার হয় না। শুধুই কান্না পায়। বইয়ের কালো কালো অক্ষরগুলো মশার মতোই বিনবিন করে ঘুরপাক খেতে থাকে চোখের সামনে। সবই যেন অপরিচিত লাগে। কিচ্ছু সে জানে না, কিছু মাথায় ঢুকছে না, সবই কি এ ক-দিনে একেবারে ভুলে গেছে! তিথির ভয় করে, মনে হয় আর পড়াশুনা করতে পারবে না, তার মস্তিষ্ক পাথর হয়ে গেছে।

এ কথাটা মনে হতেই তিথি কীরকম যেন অসাড় বোধ করতে শুরু করল। পড়াশুনা না করতে পারলে সে কী করে পরীক্ষা দেবে? এটা তো সবে পার্ট ওয়ান, তার পরেও তো তাকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হবে। পাশ করে চাকরি নিতে হবে একটা। হবেই। তাকেই কিছু একটা করতে হবে। কিছু করা মানে টাকা রোজগার করা। পার্থর ওপর নির্ভর করে লাভ নেই। কিন্তু সে তো বহুদূরের পথ। সে তো এক পাও চলতে পারছে না, একটা লাইনও ঠান্ডামাথায় পড়তে পারছে না।

পার্থ ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার ঘুমচোখ। তিথির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তিথি মুখ তুলে দেখল পাৰ্থ কলতলার দরজা খুলছে। বাথরুমে যাবে।

বাথরুম থেকে ফিরে এসে কলতলার দরজা লাগিয়ে পার্থ জল খেল। তিথি খুব অন্যমনস্ক চোখেই তাকে দেখে যাচ্ছে। পার্থ তিথির সামনে এসে দাঁড়াল, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে। শোবে না?’

তিথি মাথা ঝাঁকাল। আজ অন্তত একটা চ্যাপ্টার সে পড়বেই যে করে হোক, যত সময়ই লাগুক। পার্থ ঘরে গেল না। তিথির সামনে উবু হয়ে বসে বলল, ‘এখানে খুব মশা, তিথি, এর মধ্যে পড়তে পারছ কী করে?’ ‘পড়তে আমাকে হবেই পার্থ, আমি সব ভুলে গেছি।’

‘পরীক্ষার তো অনেক দেরি, তুমি এত টেনশন করছ কেন এখন থেকে?’

তিথি কিছুক্ষণ পার্থর চোখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি টেনশন না করে কী করব বলোতোমার যে কোনোই টেনশন নেই। এতদিন হয়ে গেল, তুমি একটা ঠিকঠাক কাজ জোগাড় করতে পারলে না। কিন্তু এভাবে হয় না পার্থ। আমাকে একটা চাকরি-বাকরি করতে হবে।’

পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল, ‘চাকরিবাকরি আমি করতে পারব না। কিন্তু কাজ আমি করব, দেখো। আসলে এই লাইনে ভালো কাজ পাওয়া খুব শক্ত। আমি যে-সে কাজ করতে পারি না, অন্তত একটু মিনিংফুল, একটু সিরিয়াস কাজ না হলে, বাজে কমার্শিয়াল জিনিস আমার পোষাবে না। আজ একটা নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে—’

ঘরের ভেতর থেকে অলকের জড়িত স্বরের বিরক্তি ছিটকে এল, ‘আরে মোলো! রাতদুপুরে বকবক শুরু করলি কেন, চুপ কর! সারাদিন খেটেখুটে শান্তিতে ঘুমোনোরও জো নেই।’

পার্থ মুখ বিকৃত করল। অপমানে তিথির কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। সত্যিই রাতের পক্ষে তাদের গলা একটু বেড়েই গিয়েছিল। তার রাগ গিয়ে পড়ল পার্থর ওপর। সে-ই তো এসে কথা শুরু করল। কী দরকার ছিল তার গায়ে পড়ে মায়া দেখানোর। দরদ উথলে

। তো

উঠল, বেশি বেশি।

পার্থ ফিসফিস করে বলল, ‘শুয়ে পড়ো। এখন আর পড়তে হবে না।’

‘তোমাকে আমার কথা ভাবতে হবে না,’ হিসিয়ে উঠল তিথি, ‘বিরক্ত কোরো না। যাও।’ রাগে দুঃখে অসহায় ক্ষোভে তার ক্ষিপ্ত লাগছে।

এ বাড়িতে পার্থর কোনো সম্মান নেই। উঠতে বসতে অলক তাকে সুযোগ পেলেই অপমান করেন। এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বলেন, এতখানি ঘৃণা আর অবজ্ঞা মিশিয়ে, লোকে চাকর বাকরের সঙ্গেও সেরকম ব্যবহার করে না। সত্যি কথা বলতে কী কোনো মানুষ আরেকজন মানুষের সঙ্গে এভাবে কথাবার্তা বলতে পারে তিথির ধারণা ছিল না। কিন্তু অলককেও কোনো দোষ দিতে পারে না সে। তিনি পার্থকে যদি মানুষ বলে মনে না করতে পারেন, তাঁর সেই অক্ষমতা খুব অযৌক্তিক নয়।

এই অপমানে পার্থকে কখনো অপমানিত হতে দেখেনি তিথি। এতেই তার আরও আশ্চর্য লাগে, যন্ত্রণা হয়। অলক যখন পার্থর সঙ্গে ওভাবে কথা বলেন, তিথির অপমানে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পার্থর মুখে কোনো লজ্জার ছায়া পড়ে না। উলটে সে সেই অপমান ভাঙিয়ে মায়ের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায় করে, সুধার স্নেহকে ব্ল্যাকমেল করে। তিথির দেখেশুনে ঘৃণাবোধ হয়।

পার্থ ঘরে চলে যাওয়ার পর তিথি আকাশপাতাল ভাবছিল। সমস্তই অন্ধকার ঠেকছে। সে অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু খাদে পড়ে গিয়েও ক্রমশ আরও অতলে পিছলে যাচ্ছে সে। যে ভরসায় সে চোখ বুজে ঝাঁপ দিয়েছিল, তা সত্যি হয়নি। কেউ তাকে লুফে নেয়নি। তাকে নিজের চেষ্টাতেই উঠে দাঁড়াতে হবে। অথচ খাদের গা এত ঢালু আর পিছল, সে দাঁড়ানোর জমি তো দূরের কথা, পতন আটকানোর জন্যে আঁকড়ে ধরারই কিছু পাচ্ছে না।

হঠাৎ তিথি দেখতে পেল খাদের গায়ে একটা চেনা গাছের শিকড়। মাধুবউদি, তিথি মরিয়া হয়ে শিকড়টার দিকে হাত বাড়াল। তাকে বাঁচতেই হবে।

পার্থদের মতো মাধবীরাও এই বাড়িতে ভাড়াই থাকেন। বাড়ির অবস্থা দেখেই বোঝা যায় বাড়ির মালিক তাঁর এই সম্পত্তিটিকে একেবারে খরচের খাতাতেই ফেলে রেখেছেন। এই বাড়িতে এখনও যে ভাড়াটে আছে এটাই তাঁর আশ্চর্য ভাগ্য। ভাড়া যদিও সামান্যই, মাসে মাসে ভাড়াটেরাই তাঁর কাছে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসেন। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে এই বাড়িটির আর কোনো সম্পর্ক নেই।

পার্থদের ঠিক ওপরেই মাধবীরা থাকেন। এই দিকটাই বাড়ির বাসযোগ্য অংশ। অন্য পাশটার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। বাড়িটা এই পাশে বেশি হেলে পড়া। সেদিকের একতলাটা মাটির নীচে অনেকটাই বসে গেছে। দরজা জানলায় পাল্লা নেই। বারান্দা আর ঘরের মেঝে ঝোপজঙ্গলে ভরতি। দোতলার বারান্দা থেকে রেলিং ভেঙে চাঙড় খসে পড়েছে বছর দুয়েক আগে। সেইভাবেই রয়ে গেছে। তবু দোতলায় লোক থাকে। পুরোটা নিয়ে নয়। মাধবীদের উলটোদিকের একটা ঘর ভাড়া নিয়ে আছে একটি ব্যাচেলার ছেলে। দিনের বেশি সময়টাই সে অবশ্য ঘরে থাকে না, রাত্রে ঘুমোতে আসে। তার পাশের ঘরটা এমনিই পড়ে আছে।

মাধবী বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বললেন। দোতলায় মাধবীদের উলটোদিকে যে ঘরটা ফাঁকা পড়ে আছে, সেখানে তিথির পড়ার বন্দোবস্ত হল।

মাধবী সুধাকে বলছিলেন, ‘ওরা লোক খুব ভালো দিদিভাই। আমি তিথির কথা সব বললাম ওদের। মেয়েটা পড়াশুনার জায়গা পাচ্ছে না বলতেই ওরা রাজি হল। ভাড়া-টাড়ার কথা কিছু বলেনি। শুধু বলল ওদের দরকার পড়লে ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে।’ মাধবী হাত নাড়লেন, ‘ওটা আসলে একটা কথার কথা। ওই ঘর আর ওদের কী দরকারে লাগবে। ওই একটু দর বাড়িয়ে রাখল আর কি। তবে মানুষ ভালো বলতে হবে। তিথি, এবার তোর একটা হিল্লে হল।’

তিথি ভাবছিল মাধবীকে প্রণাম করবে কি না। মনস্থির করে নীচু হতেই মাধবী বাধা দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘ওমা! মেয়ের কাণ্ড দ্যাখো। পায়ে হাত দিচ্ছিস কেন? পাশ করে চাকরি পেয়ে খাইয়ে দিস। এখন চল ওপরে। ঘরটায় গিয়ে দেখি কী অবস্থা।’

ঘরে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া গেল না। ওপরে যে ছেলেটা থাকে তার নাম হিমাংশু। একটা ঘর নিয়ে থাকলেও বাইরের দরজায় সে-ই তালা লাগিয়ে যায়। রাত্তিরে সে ফিরলে মাধবী তার সঙ্গে কথা বললেন। ঠিক হল, এবার থেকে সে শুধু নিজের ঘরে তালাচাবি দেবে। বাইরের দরজার জন্যে একটা ছোটো তালা মাধবীই এনে দিলেন নিজের ঘর থেকে। এর চাবি থাকবে তিথির কাছে।

হিমাংশুকে এর আগে কখনো খেয়াল করেনি তিথি। বস্তুত এই দিকটাতে কেউ থাকে সেটাই সে জানত না। হিমাংশুর ঘরে কম পাওয়ারের একটা বালব জ্বলছে। তা ছাড়া আর কোথাও আলো নেই। তবে হিমাংশু বলল পাশের ঘরেও ইলেকট্রিক লাইন সুইচ-টুইচ আছে।

মাধবী বললেন, ‘এখন আর ঘরে ঢুকে কাজ নেই, বুঝলি তিথি। যা অবস্থা হয়ে আছে, সাপ না বিছে কী কামড়ায় ঠিক নেই। কাল সকালে এসে দেখিস।’

হিমাংশুর ঘরের ম্লান আলোয় যতটা বোঝা গেল তিথির মনে হল পুরো প্যাসেজটা জঞ্জালে ঠাসা।

পার্থ ফিরল তারও পরে। সে ফিরতেই তিথি উচ্ছ্বসিত মুখে বলল, ‘জানো, মাধুবউদি ওপরের ঘরে একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে, কাল থেকে আমি ওখানে পড়াশুনা করব। শুধু একটা আলো লাগিয়ে নিতে হবে।’

পার্থর মুখে কোনো হাসি ফুটল না। সেখানে সীমাহীন ক্লান্তি আর নৈরাশ্যের ছাপ। তিথি উদ্বেগের গলায় বলল, ‘কী হয়েছে গো?

তোমায় এরকম দেখাচ্ছে কেন?’

কাঁধের ঝোলাটা ছুড়ে ফেলতে ফেলতে পার্থ বলল, ‘কিছু হয়নি। কিছু হল না।’

‘কী হল না?’

‘ওই প্রজেক্টটা। তুমি ভাবতে পারবে না তিথি, প্রজেক্টটা আলটিমেটলি কে পেল জানো? যার যোগ্যতা ডেডিকেশন সিনসিয়ারিটি সবই আমার চেয়ে অনেক কম।’

‘স্বপন। ও এত ধান্দাবাজ আমি আগে বুঝতে পারিনি। নির্ঘাত তলে তলে প্রোডিউসারের সঙ্গে লাইন করে রেখেছিল। তারপর এত বড়ো সাহস, আমাকে অফার দিল ওকে অ্যাসিস্ট করার, ভাবো।’

তিথি কিছু না ভেবেই বলল, ‘তুমি কী বললে?’

‘বললাম, আমি ডাইরেক্টর হলে কাজটা যেভাবে করার স্বপ্ন দেখেছিলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর হলে চোখের সামনে সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু দেখতে হবে। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।’

পার্থ অস্থির হাতে চুলের মধ্যে আঙুল চালাচ্ছিল, তিথি যন্ত্রের মতো বলল, ‘মুখ হাত ধুয়ে এসো, খেতে বসবে।’

পরের দিন সকালে পার্থ আর অলক বেরিয়ে যাওয়ার পরে তিথি চাবি নিয়ে দোতলায় উঠল। হিমাংশু তার ঘরে তালা দিয়ে

‘কে?’

বেরিয়ে গেছে। পাশের ঘরে পা দিয়েই তিথি দেখল ঘরটা একটা ছোটোখাটো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। ঘরময় আবর্জনা। ছেঁড়া কাগজ ছেঁড়া ন্যাকড়া শিশিবোতল ভাঙা চেয়ার টুল প্যাকিং বাক্স ছেঁড়া পিচবোর্ড প্লাস্টিকের প্যাকেট ঝুড়ি বস্তা ডাই করা। দেয়াল থেকে দেয়ালে লম্বা ঘন ঝুল। বাইরের প্যাসেজটাও তথৈবচ। কাল রাত্রে সে ঠিকই দেখেছিল। সর্বত্র একটা ছাতা ধরা ভ্যাপসা গন্ধ। প্যাসেজে কোনোরকমে জঞ্জাল ডিঙিয়ে পা ফেলে ফেলে তিথি বাথরুমের কাছে গিয়ে দেখল বাথরুমের দরজাটা ভাঙা। দুটো পাল্লারই নীচের দিকের অংশটা এবড়োখেবড়ো ভাবে ভেঙে ফাঁক হয়ে আছে। বাথরুমের মধ্যে পায়খানাটা একটু উঁচুতে, সেখানে আলাদা একটা দরজা। এই দরজাটা অতটা ভাঙা না হলেও অক্ষত নয়। বাথরুমে দুটো বালতি আর মগ রাখা। যদিও কলে কোনো জল নেই। হিমাংশু এই বাথরুমটা ব্যবহার করে।

সেদিন আর কলেজ গেল না তিথি। অমানুষিক পরিশ্রম করে ঘর পরিষ্কার করল, প্যাসেজের সামনেটাও। প্যাসেজটা পুরো পরিষ্কার করা গেল না কারণ ঘরের আবর্জনা সরাতে গিয়ে তিথি সব কিছু একেবারে ফেলে দিতে সাহস পায়নি। ঝুড়ি বস্তা ভাঙা বাক্স ইত্যাদি প্যাসেজের একপাশেই সরিয়ে রেখেছে। কে জানে এগুলো বাড়িওয়ালার কোনো কাজের জিনিস কি না। তবে ঘরটাকে সে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলল। সমস্ত দেয়াল, সিলিং, জানলা দরজার ঝুল ঝেড়ে, ঘরের মেঝে ঝাঁট দিয়ে মুছে তকতকে করে ফেলল সে। নীচের কলতলা থেকে লোহার বালতিতে করে জল টেনে নিয়ে এল, হাঁপ ধরলেও ক্লান্ত লাগছিল না তার। প্রবল উদ্দীপনায় কাজ করে যাচ্ছিল তিথি। কতদিন পর এই প্রথম তার একটা ঘর হতে চলেছে। ঘরটা তার নিজের নয়, একেবারেই অন্যের দয়ার দান। তবু, এই ভিক্ষালব্ধ ঐশ্বর্যই তার স্বপ্নপূরণের পথে প্রথম সহায়।

মাধবী সকালে একবার দরজায় উঁকি দিয়েছিলেন, তিথি তখন ধুলোয় ভূত। মাধবীকে সে ঘরে ঢুকতে দেয়নি। মাধবীর ইচ্ছে ছিল তিথির সঙ্গে হাত লাগাবার, সেটা বুঝেই তিথি বলেছে, ‘প্লিজ মাধুবউদি, তুমি এই নোংরায় হাত দিয়ো না। আমি করে ফেলব।’

মাধবী হেসেছিলেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, তোমার ঘর তুমি সামলাবে। কিন্তু এ তো একদিনের কম্ম নয়। চান করবি খাবিদাবি কখন?’

আজ তিথি পুরো ঘরটা না পরিষ্কার করে নাওয়াখাওয়ার সময় দিতে পারবে বলে মনে হয় না, সে মাধবীকে বলেছিল নীচে গিয়ে সুধাকে একটু বলে দিতে যে সে একেবারে সব কাজ সেরে তবে নামবে। সুধারা যেন খাওয়া-দাওয়া করে নেন।

ধ্বংসস্তুপের মধ্যে একটা প্রায় আস্ত চেয়ার পেয়ে গেছে তিথি। চেয়ারটা কাঠের, বেশ চওড়া আর নীচু। অনেকটা সোফার মতো, তবে তাঁতে গদি-টদি কিছু নেই। চেয়ারটা উলটে পড়েছিল। তিথি সেটাকে সোজা করতেই দেখল পিছনের একটা পায়া নড়বড় করছে, বাকি সমস্ত ঠিক আছে। খুব পুরোনো চেয়ার, গায়ের ছালবাকলা উঠে বিবর্ণ হতশ্রী চেহারা। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারে তিথির খুব আনন্দ হচ্ছিল। চেয়ারটাকে ধুয়েমুছে দেয়ালের একপাশে রেখে দেখছিল। এই তো! বেশ লাগছে। ফাঁকা ঘরটা যেন প্রাণ পাচ্ছে ওই একটা আসবাবে। পেছনের পায়াটাতে একটু পেরেক ঠুকে নিলেই হবে।

একটা জানলার দুটো পাল্লাই ভাঙা, শিকের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা। এই জানলাটা খোলা যাবে না। ঘরে অবশ্য আরও একটা জানলা রয়েছে। তিথি সেটা খুলে দিল। ঘরটা বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া। বারান্দার দরজা খুলে আঁতকে উঠল তিথি। ঠিক দরজার সামনেই বারান্দাটা শূন্যে ঝুলছে, সিমেন্টের চাঙড় খসে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে নিজেকে সামলে নিল সে, বারান্দা দিয়ে তার কী দরকার!

তিথি যখন ঘরটাকে ধুয়েমুছে ভদ্রস্থ করে তুলেছে, সুধা ওপরে এলেন। তাঁর খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে, তিনি বলতে বলতে আসছিলেন, ‘আর কত বেলা করবে, তিথি! এই সবে জ্বর থেকে উঠেছ—’ ঘরে পা দিয়েই তাঁর কথা থেমে গেল। তিথির কাণ্ড দেখে খানিকক্ষণ তাঁর মুখে কোনো শব্দ জোগাল না। তারপর ফেটে পড়লেন, ‘এসব কী করেছ তুমি, অ্যাঁ! কী সর্বনাশ! ওদের সব জিনিসপত্র সরিয়ে-টরিয়ে ঘর একদম ফাঁকা করে ফেললে!’

তিথি তাঁর উত্তেজনার কারণ বুঝতে পারেনি, ঝলমলে মুখে বলল, ‘হ্যাঁ বড়োমা! ঘরটা যা হয়েছিল না। তুমি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না!’

‘তুমি কি ভাবছ ঘরটা ওরা তোমায় দিয়ে দিয়েছে?’ সুধা মুখ কুঁচকালেন, ‘দু-দিন থাকতে দিয়েছে, যেদিন ইচ্ছে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। তার জন্যে এত কাণ্ড!’

তিথি অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় বিপর্যস্ত হতে হতে বলল, ‘ঘরটা খুব নোংরা ছিল বড়োমা। নোংরা ঘরে পড়ব কী করে!’ মাধবী সম্ভবত সুধার চড়া গলার আওয়াজ পেয়েই চলে এলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে দিদিভাই, বকছ কেন তিথিকে!’

‘তুমিই বলো মাধু!’ সুধা বিরক্তি রাখার জায়গা পাচ্ছেন না, ‘কী আক্কেল ওর, সমস্ত বাক্সপ্যাঁটরা হাঁটকে-পাঁটকে উজাড় করতে কে বলে দিয়েছিল ওকে!’

তিথি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে, তার মাথা-ভরতি ঝুল, সর্বাঙ্গ ধুলোয় ধূসর। মাধবী সুধার পাশ কাটিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন, এখনও চান করিসনি? বা রে, তোর হাতে জাদু আছে নাকি রে তিথি! ও দিদিভাই, দ্যাখো ঘরটাকে এরই মধ্যে কেমন ঝকঝকে করে তুলেছে!’

সুধা গজগজ করছিলেন, ‘বুঝি না বাবু তোমাদের মতলব। যার যেমন সাজে তেমনি থাকলেই তো হয়। দু-দিন পরে এসে অপমান করলে কী হবে তখন? কে সামলাবে?’

‘তুই

মাধবী হাসিমুখে ঘরের চারদিক দেখছিলেন, বললেন, ‘ওমা, অপমান করবে কেন! ছাড়তে বললে ছেড়ে তো দিতেই হবে। তাই বলে থাকতে গেলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবে না?’

সুধা অপ্রসন্ন মুখে নীচে গেলেন। তিথি মাধবীর কথায় মনে জোর পেয়েছে। সে ভাবছিল, যতদিন ওরা এ ঘরে তাকে থাকতে দেবে দিক, ওরই মধ্যে সে ঘরটাকে একটু একটু করে সাজিয়ে-গুছিয়ে তুলবে। মাধবীর দিকে খুশি খুশি মুখে তাকিয়ে বলল, ‘দ্যাখো মাধুবউদি ওই চেয়ারটা! এখানে ছিল। একটা পা ভাঙা। গোটা দুই পেরেক আর হাতুড়ি পেলে আমিই ওটা সারিয়ে নিতে পারব। আছে গো তোমার কাছে?’

‘হাতুড়ি তো আছে। পেরেক খুঁজতে হবে। ওসব পরে হবে। এ ঘরে একটা আলোরও ব্যবস্থা করতে হবে। তুই যা নীচে গিয়ে চান করে খেয়ে নে। আমি দেখছি কী করা যায়।’ মাধবী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েই একটু চিন্তিত মুখে তিথির দিকে তাকালেন, ‘শোন তিথি, আমার মনে হয় কী, ঘরটা যখন পাওয়াই গেছে, তুই আর পার্থ এই ঘরটায় থাক, বুঝলি? আমার কাছে একটা পুরোনো ক্যাম্পখাট আছে, তোর সলিলদার, বিয়ের আগেকার। ওইটে এ ঘরে দিয়ে যাই। শীতকালে তো মেঝেতে শোয়া ঠিক না।’

তিথির মনে হল সে মাধবীকে জিজ্ঞেস করে, ‘মাধুবউদি তুমি কি আমার মা?’ কিন্তু লজ্জায় তার গলায় স্বর ফুটল না।

স্নান করতে গিয়ে তিথি দেখল, তার একটু নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। ঘরের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে গিয়ে রাশি রাশি ধুলো ঢুকেছে তার নাকেমুখে। এমনিতেই ধুলো নাকে গেলে তিথির খুব অস্বস্তি হয়। আজ আর কোনো শারীরিক অস্বস্তির দিকে খেয়াল ছিল না। এখনও নিশ্বাসের কষ্টটাকে পাত্তা দিল না তিথি। বহুদিন পরে তার সামনে একটা আশার আলো এসে পড়েছে। তার আর পার্থর একটা আলাদা ঘর হয়েছে এতদিনে। ওই ঘরে সে মন দিয়ে পড়াশুনা করবে। পাশ করে চাকরি নিয়ে এই সংসারের হাল ধরবে। সুধা আজ যতই বিরূপ বিরক্ত হন, তিথি প্রমাণ করবে সে এই পরিবারেরই একজন। পার্থর হয়ে সে-ই সমস্ত কর্তব্য

করবে। সীমার পছন্দমতো বিয়ে দেবে। অলক যতই পার্থকে দূরছাই করুন, সে পার্থর সমস্ত অযোগ্যতাকে আড়াল করে দাঁড়াবে।

স্নান করে তিথি রান্নাঘরে গিয়ে দেখল তার ভাত ঢাকা আছে। খুব খিদে পেয়েছে তার, স্নান করবার পরই সেটা বুঝতে পারছে তিথি। দ্রুত খেতে বসল সে। ডাল ভাত আর একটা তরকারি। মাছ খুব একটা রান্না হয় না এ বাড়িতে। তিথি অবশ্য মাছ খেতে ভালোওবাসে না। বাড়িতে থাকতে মা জোর করে পাতে দিতেন, তিথি অর্ধেক দিন খেতে চাইত না। অশান্তি হত। এখানে তার খাওয়া নিয়ে অশান্তি করার কেউ নেই। তিথি এমনিতে কমই খায়, আজকাল তার খাওয়া খুবই কমে গেছে। সুধা যখন খেতে দেন তখন কাঁসিতে যা তরকারি থাকে সেটা ভাগ করে হাত দিয়েই প্রত্যেকের পাতে দিয়ে দেন। ভাতের হাঁড়ির পাশে একটা ছোটো চামচ থাকে। সুধা যখন খাওয়ার মাঝখানে একবার জিজ্ঞেস করেন, ‘আর ভাত দেব?’ তিথি প্রথমদিকে দু-একবার ঘাড় নেড়েছিল। সুধা তখন চামচ দিয়ে দু-তিনবার ভাত দিয়ে বলেন, ‘আর?’ তিথি ঘাড় নেড়ে বলে, ‘না না। আর না।’ আসলে, চামচটা এত ছোটো যে সেটাতে করে পাঁচ-ছয়বার ভাত দিলে তবে একহাতা ভাত হয়। তিথি কিছুতেই দু-বারের বেশি নিতে পারে না, তার মনটা লজ্জায় অস্বস্তিতে গুটিয়ে যেতে থাকে। আজকাল আর সেটুকুও নিতে ইচ্ছে করে না তার। আজ সে খুঁজে খুঁজে ভাতের শেষ কণাটিও মুখে দিয়ে পেট ভরে জল খেল। শীতকালে জল খেয়ে খুব তৃপ্তি, শরীরের ভেতরটা জুড়িয়ে যায়।

কলতলায় এঁটো থালাবাসন রেখে মুখ ধুল তিথি। ঠিকে কাজের লোক দিনে একবার এসে বাসন মেজে দিয়ে যায়। রান্নাঘরের খাওয়ার জায়গাটুকু মুছে তিথি যখন ঘরে এল, তখন সুধা ঘুমোচ্ছেন। সীমা খাটের ওপর জানলার ধারে বসে টেবিলক্লথের এমব্রয়ডারি নিয়ে ব্যস্ত। তিথিকে দেখে বলল, ‘তোমার একটা চিঠি এসেছে।’ সীমা দু-তিন দিন হল আবার তিথির সঙ্গে কথা

বলছে।

চিঠি শব্দটা শোনামাত্র তিথি কেঁপে উঠল। তার চিঠি!

তিথি দেখতে পেয়েছে চিঠিটা খাটের ওপরেই পড়ে আছে। এ বাড়িতে কোনো লেটার বক্স নেই। জানলা দিয়েই চিঠি দিয়ে যায় পোস্টম্যান। সীমা সুচে সুতো ভরাতে ভরাতে বলল, ‘এক্ষুনিই এল। তোমার মায়ের চিঠি নিশ্চয়ই। এ বাড়ির কারও নাম নেই। পিওন জিজ্ঞেস করল তিথি মিত্র বলে এখানে কেউ থাকে কি না।’ সীমা তিথির দিকে তাকাল, ‘তুমি বিয়ের পর মল্লিক হয়েছ ওঁর খেয়াল নেই।’

তিথির কানে এত কথা কিছুই ঢুকছিল না। মায়ের চিঠি যে, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। তার সমস্ত অন্তরাত্মা ছুটে যেতে চাইছে ওই হলুদ খামটার প্রতি, কিন্তু তার পা যেন উঠছে না। ভয় করছে তার, ভীষণ ভয়। কী লিখেছেন মা?

আস্তে আস্তে গিয়ে খামটা তুলে নিল তিথি। মা এর আগে কখনো তাকে চিঠি লেখেননি, লেখার দরকারই হয়নি। মাকে ছেড়ে কবেই বা থেকেছে সে! চিঠির খামটা ছিঁড়তে হাত কাঁপছিল তিথির। অদ্ভুত উদ্বেগে একটা পলায়নী ইচ্ছা কাজ করছিল তার ভেতরে ভেতরে। মায়ের চিঠি পড়ে সে এ বাড়িতে কাঁদতে চায় না। কিন্তু মা কী লিখলে যে তার কান্না আসবে না ভেবে পাচ্ছিল না।

কাগজের ভাঁজটা খুলে সম্বোধনটা পড়েই গলায় কান্নার ঢেউ আটকে গেল তার। ‘স্নেহের তিথি’। ঠোঁট কামড়ে ধরে দ্রুত চিঠিটা পড়ে ফেলল তিথি। একবার, দু-বার, তিনবার। চোখের জলে মাখামাখি মুখে তিথি সীমার দিকে তাকিয়ে আর্ত গলায় বলল, ‘বড়দি! মা মেনে নিয়েছে, মা সব মেনে নিয়েছে বড়দি!’

‘তবে আর কী! নিশ্চিন্ত।’ সীমা এমব্রয়ডারির ওপর ঝুঁকে পড়ল। তিথি চিঠিটা হাতে নিয়ে ছুটে চলে গেল বাথরুমে। দরজা বন্ধ করে, দেওয়ালে মুখ ঠেকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘পার্থ! মা আমাদের যেতে বলেছে, পার্থ!’ প্রবল কান্নার বেগে তিথির আরও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।

রাত্রে পার্থ আসা অবধি ছটফট করছিল তিথি। মাধবী হাসছিলেন, ‘পার্থ খুব চমকে যাবে। ও ভেবেছিল না, তোর মা চিঠি পেয়ে তোকে এখান থেকে টানতে টানতে বেঁধে নিয়ে যাবে? তার বদলে মেয়ে-জামাইকে জোড়ে নেমন্তন্ন! পার্থ বিশ্বাসই করতে পারবে না দেখিস।’

তিথিও বিশ্বাস করতে পারছে না। আজ এ কী অভাবনীয় দিন এসেছে তার জীবনে! কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও সে পাচ্ছে না। মাধবী সুধাকে বলেছেন তার আর পার্থর ওপরে থাকার কথাটা। সুধা আপত্তি করছিলেন, কিন্তু মাধবী এমন যুক্তি দেখিয়েছেন সুধা আর কিছু বলতে পারেননি। কথা হয়েছে তিথির সামনে নয়, আড়ালে। কিন্তু কথাগুলো তিথির আসছিল। মাধবীর যুক্তিগুলো শুনে তার লজ্জা করছিল, যদিও যুক্তিগুলো ভুল কিছু নয়। তারপর থেকেই সুধার মুখ সীমার মুখে বিষাদ ছেয়ে আছে। এ এক দুর্বোধ্য রহস্য, তিথি এর কিনারা পায় না।

মাধবীই দোতলার ঘরে একটা বালব লাগানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিথি তার বইপত্র নিয়ে গিয়ে দেয়ালের তাকে রেখেছে। ক্যাম্পখাটটাও পাতা হয়ে গেছে। ক্যাম্পখাটের নাইলনের ফিতেগুলো ঢিলে হয়ে একটু ঝুলে গেছে। তা কত! তার ওপরে পাতার জন্যে সুধার কাছ থেকে একটা চাদর চেয়ে দিলেন মাধবীই। সুধা চাদর দিলেন, তাঁর মুখ করছিল।

গুছিয়ে যাক। এই থমথম রাত্তিরে পার্থ সেই ঘরে ঢুকে বলল, ‘বাঃ এ তো দারুণ ঘর!’

‘তুমি তো দ্যাখোনি ঘরটার কী অবস্থা ছিল। সব পরিষ্কার করেছি। নাকে ধুলো ঢুকে অ্যালার্জি হয়ে গেছে।’

‘আজই তাহলে আমাদের ফুলশয্যার রাত!’ পার্থ তিথির কাঁধে হাত রাখল।

কোনো স্বস্তি এমন কানে অন্ধকার।

তিথি পার্থর গলা জড়িয়ে ধরল, কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘কিন্তু বড়োমা মনে হয় খুব রেগে গেছেন।’

‘তোমার মায়ের রাগ পড়েছে আর আমার মা রেগে গেছে। দিস ইজ লাইফ। ফরগেট অ্যাবাউট ইট।’ পাৰ্থ তিথিকে জাপটে ক্যাম্পখাটের ওপরে গিয়ে পড়ল। চাদরটা ডেবে গেল বেশ খানিকটা। তিথি পার্থকে চুমু খেতে খেতে বলল, ‘কবে যাব গো আমরা মায়ের কাছে।’

‘যাব যাব,’ পার্থ ব্যস্ত হাতে শাড়ি ব্লাউজের মধ্যে থেকে তিথির শরীর ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। তিথি ফিসফিস করল, ‘দরজায় ছিটকিনি দাওনি। দিয়ে এসো। আর আলো নিভিয়ে দাও।’

পরস্পরকে প্রবল আঁকড়াতে আঁকড়াতে তিথি হঠাৎ বলল, ‘এই যাঃ, খুব ভুল হয়ে গেছে। নীচ থেকে গায়ে দেওয়ার কোনো চাদর আনা হয়নি। রাত্তিরে শীত করবে।’

‘চাদর কাল আনলে হবে। আজ শীত করার কোনো প্রশ্নই নেই।’ পার্থ তার শরীরের নীচে তিথির শরীর পিষতে পিষতে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বরে বলল, ‘আজ আমরা সারারাত ভালোবাসব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *