জীবিত হে নক্ষত্র সময়, ডানা
যদি আমার ঠাণ্ডা না লাগত, যদি কম্প দিয়ে না আসত
জ্বর
যদি আমার নাক দিয়ে গড়িয়ে না পড়ত গরম কাঁচা
ঘিলু
যদি আমার মাথার মধ্যে ধীরে ধীরে না জমে উঠত
তেল
কোটি কোটি বছরের জমানো তেল আমার মাথার মধ্যে
টগবগ ক’রে না ফুটত যদি
যদি আমার ব্রহ্মতালু ফুটো ক’রে না ঢুকত
কয়েকশ’ পাইপ
যদি আমার শীর্ষ থেকে আকাশে ছিটকে না উঠত
রক্ত মেশানো বীর্য
যদি আমার হৃৎ, অখণ্ড হৃৎপিণ্ড আমার যদি নিজে থেকেই
কড়কড় শব্দে দুভাগ হয়ে না যেত দুই অন্ধকার অলিন্দে
যদি রাতের বেলায় তার মধ্যে নেমে না পড়ত
মহিলারা আর স্ত্রীলোকেরা
আর যদি সেখানে খুঁজে না পেত কয়লার স্তর
যদি তারা শাবল গাঁইতি আর বেলচা নিয়ে
ঠংঠঙাস্ ক’রে না ভাঙত রাশি রাশি কয়লা
না কামড়াত যদি রাশি রাশি কয়লা
না গিলত যদি
যদি দেবদূত বা তাঁর সুপুত্র নিজে এসে আমাকে না বলতেন
পিনাকী, সেই প্যাগোডার মতো মেয়েছেলেটা কোথায় রে, সেই যে
তুই চা আনতে যাচ্ছিলি আমি হাত বোলাচ্ছিলাম আর
আমি চা আনতে যাচ্ছিলাম তুই হাত বোলাচ্ছিলি
যদি খনিগর্ভ থেকে দলবেঁধে উঠে না আসত বিশাল বক্ষ
অন্ধকার রমণীরা, যদি বুকে করাঘাত করতে করতে
হি হি ক’রে না কাঁদত তারা, হাউ হাউ ক’রে না হাসত যদি
আর সেই শব্দে শব্দে কুয়ো আর ডোবা আর পায়খানার ট্যাঙ্কির
ভেতর থেকে যদি হিল হিল ক’রে না বেরিয়ে আসত
কবেকার বস্তাবন্দী গুম-করা সব দোমড়া মোচড়া শরীর, তাদের
সন্তানদের শরীর
যদি আমি যে-কোনো দেয়ালেই ভালোভাবে মূত্রাঘাত
করতে পারতাম সকল লোকের মতো
আলোয়, আঁধারে চলতে পারতাম যদি সকল লোকের মতো
আমিও হতাম আর্নিং মেম্বর, যদি বেশ আমারও থাকতো
বৈধ অবৈধ নানান সব সম্পর্ক, যদি বেশ আমারও থাকতো
সংগ্রামী চেতনা, কিংবা আপোষহীন
মনোভাব কিংবা ‘এও বলা যায় মা, তোমার কী মহিমা’
যদি একদিন ভোরবেলা আমার একটি হাত রূপান্তরিত না হত
গন্ধরাজের একটি শাখায়, আর কবিতাপাগল মেয়েটির কপালে
একগুচ্ছ পাতা, কেবল একগুচ্ছ পাতা ছুঁইয়ে দিয়ে যদি
না বলতাম: না মামণি, বাড়ি যাও, আমি নয়, অন্য কেউ
অন্য কেউ, সে তোমার ভাল বন্ধু হবে
যদি আমি না ঘুমাতাম বাজারের মধ্যে রাত্রিবেলার নিঃঝুম
বাজারের মধ্যে কপিপাতার স্তূপের নীচে না ঘুমতাম যদি ষাঁড়ের
নাদি আর পচা আনাজতরকারি মাঝখানে ইসমাইলের বঁটির
ছায়ায় বরফদেওয়া মাছের ঝুড়ির মধ্যে ঘুমতাম যদি
মাছ হয়ে
যদি বেশ আমারও কে-জি হত ৪৭ টাকা পরদিন সকালে,
যদি আমাকে লা’ইন দিয়ে কিনে নিয়ে যেতেন বড়বাবু মেজবাবু
ন-বাবু ফুলবাবু, যদি কিনতেন বালতি ব্যাগ ও চাকর সহ
ববকাট বৌদি, যদি দারুণ ভাল রান্নাঘরে দারুণ যত্নে
রান্না হতাম আমি আর আমার মুড়োটা চুরি করে
পালাত পাশের বাড়ির পাজির পাঝাড়া বেড়াল
যদি হঠাৎ একদিন অর্ধেক রাতে জেগে ওঠে আমি না বুঝতাম যে আমি
অযোনিসম্ভূত
যদি না বুঝতাম যে কাব্যদেবীর স্ত্রীঅঙ্গ থেকে নয়, তাঁর
ইস্পাত নির্মিত জন্মদ্বার থেকে নয়, আমি বেরিয়েছি তাঁর
পায়ুবিবর থেকে
বেরিয়েছি আর ছিটকে পড়েছি একখণ্ড নিটোল মলের ন্যায়
ছিটকে পড়েছি যশঃপ্রার্থনার ধবধবে শাদা কমোডে
টলটল করছি স্বচ্ছ জলে
ওডোনিল, ওডোনিল
যদি আমি এই আমি না হয়ে হতাম অন্য একটি পুরুষ
আর ভালবাসতাম সেই মেয়েটিকে যে আগুনের মধ্যে
বমি করেছিল শ্বশুরবাড়ির ভাত
যদি আমি এই আমি না হয়ে হতাম একটি মেয়ে
আর ভালবাসতাম সেই ছেলেটিকে যাকে ছিন্ন ভিন্ন করেছিল
একদল ক্রুদ্ধ সমকামী
যদি আমি বখে না যেতাম, ও শঙ্খবাবু, শ্রীচরণেষু শঙ্খবাবু,
সাহিত্য সাহিত্য করে যদি চিরকাল না লাফাতাম
অল্প বয়েস থেকেই যদি উচ্ছন্নে না যেতাম আপনার কবিতা পড়ে,
যদি আমি নাচতে পারতাম তাসা-র সঙ্গে, সিটি মারতে পারতাম
যদি আমি ব্যাঞ্জো বাজাতেও শিখতাম অন্তত
চটরপটর বাজাতেও শিখতাম যদি
যদি চটরপটর বাজিয়ে বাজিয়ে ট্রেনের কামরা থেকে কামরায়
গান গাইতাম আর পয়সা তুলতাম যদি অনায়াসেই চলে যেতাম
এদেশ থেকে সেদেশ একজন চমৎকার ভিখিরি হিশেবে নাম করতাম, উঃ
ভিখিরিদেরও কী ভাল স্বাস্থ্য হয়, যদি আমি গাইতে পারতাম
রাত তিনটের গান
রাত তিনটের গান: অ্যাকাডেমি বা নেতাজি ইনডোরের নয়
রবীন্দ্রসদন বা কলামন্দিরের নয়
যদি গাইতে পারতাম বাগনান আর বেলঘরিয়া স্টেশনের
ধুলিয়া আর পলাশপুর স্টেশনের ভুবনগড় আর
কাঁচরাপাড়া স্টেশনের রাত তিনটের গান
যদি আমার গান হত শীত তাড়ানোর জন্য, যদি আমার গান হত
শীত তাড়ানোর জন্য ভিখিরিদের সমবেত হস্তমৈথুনের উল্লাস
যে-মিলন তারা কখনো পায়নি কল্পনা করেনি স্বপ্নেও, যদি
আমার গান হত সেই মিলনের সমস্ত সম্ভব অসম্ভব চূড়া, যদি হত
ধাপে ধাপে স্বর্গ, অর্গ্যাজ্ম্
স্বর্গ, অর্গ্যাজ্ম্
স্বর্গ
অগ্যাজ্ম্
স্বর্গ, স্বর্গের রাস্তা, স্বর্গের রাস্তায় যদি শেষরাত্রে আমাদের
তাঁবুর পর তাঁবু মাড়িয়ে না যেত ট্যাঙ্ক
যদি ঘুমন্ত আর স্বপ্নাতুর অবস্থায় স্বর্গের রাস্তায় আমাদের
তাঁবুর পর তাঁবু মাড়িয়ে না যেত ট্যাঙ্ক
যদি চুম্বনরত অবস্থায়, ওঃ যদি চুম্বন শেষ করার আগেই
আমাদের তাঁবুর পর তাঁবু মাড়িয়ে না যেত ট্যাঙ্ক
যদি সাঁজোয়ার চাকায় চাকায় পিষে না যেত যদি
একসঙ্গে মিশে না যেত আমার কিশোর দেহ তোমার কিশোরী শরীর
আর সেই মুহূর্ত থেকে, হে জীবিত নক্ষত্রসময়, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই
যদি আগুনের মধ্যে আমরা না জন্মাতাম
যদি না মেঘের দিকে উঠিয়ে দিতাম আমাদের শীষ
যদি হাওয়া আমাদের নাম ধরে না ডাকত
যদি আমাদের চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে আদর না করত বর্ষা
যদি আমরা ডুব না দিতাম সমুদ্রে যদি ঘোড়াসুদ্ধু লাফিয়ে
ঘোড়াসুন্ধু লাফিয়ে যদি আমরা পাহাড় থেকে ঘোড়াসুদ্ধু লাফিয়ে
মাটিতে পড়ার বদলে হুউশ করে চাঁদের দিকে উড়ে না যেতাম
যদি আমরা আকাশ থেকে না দেখতাম মগডালের ছুটন্ত কাঠবেড়াল
যদি আমাদের হাত না হত, পা না হত
যদি আমাদের নাম না হত ঘূর্ণিহাওয়া আর জলোচ্ছ্বাস
যদি আমাদের নাম না হত বৃষ্টি আর ধান
যদি আমরা না হতাম দীপঙ্কর সংযম স্বপ্নময়
না হতাম তিস্তা শর্মিষ্ঠা বৈশাখী
যদি আমরা নিজের মধ্যে না রাখতাম অশ্রু আর আলো
যদি আমরা শরীরের মধ্যে একই সঙ্গে বইতে না পারতাম মৃত্তিকা আর বীজ
তোমার ডিম, ও বুনো কোকিল, যদি তোমার ডিম
তোমার ডিম বুকে করে যদি না আমি আগ্নেয়গিরির গহ্বর থেকে
ভেসে উঠতাম চূড়ায়
যদি সেই জ্বালামুখের দুই কিনারে দুই পা রেখে না দাঁড়াতাম
আর আকাশ ভরে উৎক্ষিপ্ত ছাতার মতভস্মমেঘ সরিয়ে
যদি তারার হাতে আমি তুলে না দিতাম তোমার শিশু
তাহলে,তাহলে, বলো, তাহলে, তাহলে
কী হত তোমার আর কী হত আমার
কী হত আলোর গতি, কী হত পদার্থপ্রাণ
কী হত সমুদ্রশূন্যে শতাব্দী শতাব্দীব্যাপী ডানা