জিনার সেই দ্বীপ

ভলিউম ১৩ – জিনার সেই দ্বীপ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: জুলাই, ১৯৯৪

০১.

বাস থেকে নেমেই কুকুরটার ওপর চোখ পড়ল তিন গোয়েন্দার। কিংবা বলা যায় কুকুরটাই ওদেরকে তার দিকে তাকাতে বাধ্য করল, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে একনাগাড়ে ঘেউ ঘেউ করছে।

ওই যে রাফি, মুসা বলল। জিনা কোথায়?

কেন, রাফির পাশে দেখতে পাচ্ছ না? হেসে বলল কিশোর।

কই?…ও, আবার ছেলে সাজার ভূত চেপেছে মাথায়।

মালপত্রগুলো ভাগাভাগি করে হাতে তুলে নিয়ে সেদিকে এগোল তিনজনে। কাছে গিয়ে মুসা বলল, আর গম্ভীর হয়ে থাকার ভান করে লাভ নেই, জিনা, চিনে ফেলেছি।

ম্লান হাসল জিনা। তোমরা এলে তাহলে। খুব খুশি হয়েছি।

তুমি অমন মুখ গোমড়া করে রেখেছ কেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আম্মার শরীরটা ভাল না।

কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল তিন গোয়েন্দা। কেরিআন্টিকে খুব ভালবাসে ওরা।

কি জানি, গরমটা বোধহয় সহ্য করতে পারেনি।

 হু, গম্ভীর হয়ে মাথা দোলাল কিশোর। হতে পারে। যা গরম পড়েছে।

 রবিন জানতে চাইল, আংকেলের কি খবর?

— কি আর হবে, জবাব দিল জিনা। আম্মার শরীর খারাপ হলে যা হয়। দুশ্চিন্তা করে করে মেজাজ আরও চড়ে গেছে। কাউকে দেখলেই খেঁকিয়ে ওঠে।

খাইছে! শঙ্কিত হয়ে পড়েছে মুসা, ও-বাড়িতে থাকব কি করে তাহলে?

অত ভাবছ কেন? হেসে আশ্বাস দিল জিনা, থাকার কি আর জায়গা নেই? বাড়িতে থাকতে না পারলে আমার দ্বীপটায় চলে যাব। ছুটি কাটাতে কোন অসুবিধে হবে না।

গরমের লম্বা ছুটি শুরু হয়েছে। ছুটি কাটাতে গোবেল বীচে জিনাদের বাড়িতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। এখানে এলে খুব আনন্দে সময় কাটে ওদের। কিন্তু আসার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা দুঃসংবাদ শুনবে এবার, ভাবেনি। শুরুতেই কেমন গড়বড় হয়ে গেল।

কিশোর বলল, তা নাহয় গেলাম। কিন্তু আন্টির শরীর খারাপ থাকলে আমাদের আনন্দ জমবে না।

চলো আগে, বাড়ি তো যাই। তারপর দেখা যাবে।

জোরে জোরে লেজ নাড়ছে রাফি। তার দিকে কারও নজর নেই বলে খ করে অভিযোগ করল। এই

মুসা হেসে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস রে, রাফি?

 রাফি জবাব দিল, ঘউ, অর্থাৎ, ভাল।

ট্যাক্সি নিল ওরা।

গোবেল ভিলায় পৌঁছল। দরজা খুলে দিল এক মাঝবয়েসী গোমড়ামুখো মহিলা। চেহারা দেখে মনে হয়, হাসতে শেখেনি। এমন দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাল যেন, ওরা একেকটা শুঁয়াপোকা।

দরজা খুলে দিয়েই চলে গেল সে।

বাপরে বাপ, কি ভঙ্গি! কে? নিচু গলায় জিনাকে জিজ্ঞেস করল মুসা।

আমাদের নতুন রাঁধুনী।

কেন আইলিন কোথায়?

ওর মায়ের পা ভেঙেছে। মাকে দেখতে গেছে। কদিনের জন্যে মিসেস টোডকে রেখেছে আম্মা।

যেমন নাম তেমন চেহারা! হুহ। বেঙই বটে! বেশিদিন থাকবে না তো? আইলিন কবে আসবে?

ঠিক নেই।

ট্যাক্সি বিদেয় করে দিয়ে মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকল ওরা। বসার ঘরে সোফায় শুয়ে আছেন মিসেস পারকার। ওদের দেখে হাসলেন।

চেহারা দেখে চমকে গেল কিশোর। এ-কি হাল হয়েছে! চোখ বসা, মুখ শুকনো, ফ্যাকাসে, এক ছটাক রক্ত নেই যেন শরীরে।

কি হয়েছে, আন্টি? এ-অবস্থা হলো কি করে?

 ও কিছু না, সেরে যাবে। তোমরা কেমন আছ?

ভাল…

ওপরে যাও। ব্যাগট্যাগগুলো রেখে, হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি চা দিতে বলছি।

– আব্বা কোথায়? জানতে চাইল জিনা।

হাঁটতে বেরিয়েছে। গুহা ছেড়ে কি আর যেতে চায়। জোর করে পাঠালাম।

গুহা হলো জিনার বাবার স্টাডি, যেখানে ঢুকলে আর বেরোতে চান না তিনি, গবেষণা করে কাঁটান–জানা আছে তিন গোয়েন্দার।..

ওপরে উঠে পরিচিত সেই পুরানো শোবার ঘরে ঢুকল ওরা। জানালা দিয়ে সাগর চোখে পড়ে। অতি মনোরম দৃশ্য। কিন্তু এ-মুহূর্তে সাগর ওদেরকে খুশি করতে পারল না। কেরিআন্টির অসুখ মন খারাপ করে দিয়েছে।

*

পরদিন সকাল। কিশোরের ঘুম ভাঙল সবার আগে। জানালা দিয়ে রোদ। এসে পড়েছে। কানে আসছে সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একটানা ছলাৎ ছল, ছলাৎছল। বিছানা থেকে উঠে জানালায় এসে দাঁড়াল সে। ঘন নীল আকাশের ছায়া সাগরকেও নীল করে দিয়েছে। প্রণালীর মুখে যেন ফুটে রয়েছে জিনার সেই দ্বীপটা; গোবেল আইল্যান্ড।

খুব সুন্দর, না? পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মুসা। আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি।

নাস্তা না করেই?

এসে করব।

তিনজনে এসে দাঁড়াল জিনার ঘরের সামনে। একবার ডাকতেই সাড়া এল। দরজা খুলল জিনা। সে আগেই উঠেছে। ওদের অপেক্ষাতেই ছিল।

কিশোর বলল, চলো, আন্টিকে দেখে যাই।

উঠেই দেখতে গেছি আমি, জিনা বলল। দরজা খোলেনি। ঘুমাচ্ছে।

ও, তাহলে থাক। ঘুম ভাঙানো ঠিক না।

বাড়ির পেছন দিয়ে একটা পথ আছে সৈকতে যাওয়ার। সেটা ধরে চলল। চারজনে। পেছনে লেজ নাড়তে নাড়তে চলল রাফি। লম্বা জিভ বের করে দিয়েছে খুশিতে। সে জানে, মজা হবে এখন।

প্রচুর সাঁতার-টাতার কেটে বাড়ি ফিরল ওরা। খুব খিদে পেয়েছে। বাগানের কোণে বসা ছেলেটাকে নজরে পড়ল রবিনের। বোকা বোকা চেহারা। তেরো-চোদ্দ বছর বয়েস।

ও কে?

বেঙাচি, জবাব দিল জিনা।

মানে!

বেঙের পোনা তো বেঙাচিই হয়, নাকি?

মিসেস টোডের ছেলে? জানতে চাইল কিশোর।

 হ্যাঁ। টেরি।

 খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। আবার টেরি! শুঁটকি টেরির মত শয়তান না তো?

তার চেয়ে খারাপ। আমাকে দেখলেই ভেঙচি কাটে, আজেবাজে ছড়া বলে খেপায়।

মারছে রে! শুঁটকি থেকে শেষে বেঙাচি টেরির পাল্লায় এসে পড়লাম…

মুসার কথা শেষ হতে না হতেই সুর করে বলে উঠল ছেলেটা:

জিনা, ঘিনা; জিনার মুখে ছাই,
দাঁড়কাকে ঠুকরে দিলে আর রক্ষা নাই!

রাগে লাল হয়ে গেল জিনার মুখ। তিন গোয়েন্দা মনে করল, ছুটে গিয়ে ঠাস করে এখন ছেলেটার গালে চড় কষাবে সে। কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে কিছুই করল না। বরং রাফির কলার ধরে আটকাল, ছেলেটার কাছে। যেতে দিল না। করুণ কণ্ঠে বলল, আমাকে দেখলেই এই ছড়া বলে! আর সহ্য হয় না।

মুসা ধমক দিয়ে বলল, এই ছেলে, খেপাও কেন?

টকটকে লাল মুখ ছেলেটার। মুসার কথায় মুখ বাঁকিয়ে হাসল। আবার শুরু করল, জিনা, ঘিনা…

দেখো, ভাল হবে না কিন্তু! এগিয়ে গেল মুসা।

কিন্তু মুসা তার কাছে পৌঁছার আগেই একছুটে রান্নাঘরে ঢুকে গেল ছেলেটা।

জিনার দিকে ফিরে বলল বিস্মিত মুসা, জিনা, ওর অত্যাচার সহ্য করো! এখনও কিছু করোনি!

চড়িয়ে সবগুলো দাঁতই তো ফেলে দিতে ইচ্ছে করে, নিতান্ত অসহায় ভঙ্গিতে হাত ডলল জিনা, কিন্তু উপায় নেই। আম্মার শরীর খারাপ। টেরিকে কিছু করলে ওর মা যদি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে আম্মা। সেজন্যেই কিছু করতে পারি না।

জিনা, সত্যি অবাক করলে, কিশোর বলল। তোমার যে এতটা সহ্যশক্তি, জানতাম না।

আম্মা নিশ্চয় উঠে পড়েছে এতক্ষণে। বিছানায় নাস্তা দিয়ে আসতে হবে। তোমরা দাঁড়াও এখানে, আমি আসছি। রাফিকে আটকে রাখো, টেরিকে দেখলেই কামড়াতে যাবে।

 জিনা ঘরে ঢুকে যেতেই অস্থির হয়ে উঠল রাফি। নাক তুলে কি যেন শুঁকছে।

রান্নাঘরের দরজায় বেরিয়ে এল একটা ছোট কুকুর। সাদা রঙ, ময়লা, যেন বহুদিন ধোঁয়া হয়নি। মাঝে মাঝে বাদামী ছোপ। দেখতে একটুও ভাল না। রাফিকে দেখেই দু-পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে ফেলল।

ওটাকে দেখেই গলা ফাটিয়ে ঘাউ ঘাউ করে উঠল রাফি। কিশোরের হাত থেকে হ্যাঁচকা টানে কলার ছুটিয়ে নিয়ে দিল দৌড়।

রাফি, রাফি, আয় বলছি! চিৎকার করতে করতে তার পেছনে ছুটল কিশোর।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। কুকুরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাফি। ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে কুকুরটা। চার পা শূন্যে তুলে দিয়ে কেউ কেউ করছে। তার কান কামড়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল রাফি।

কুকুরটার চিৎকারে রান্নাঘরের দরজায় বেরিয়ে এল মিসেস টোড। হাতে একটা সসপ্যান।

হেই কুত্তা, হেই! বলে লাফ দিয়ে নামল নিচে। সসপ্যান দিয়ে বাড়ি মারল রাফিকে।

ঝট করে সরে গেল রাফি। বাড়িটা তার গায়ে না লেগে লাগল অন্য কুকুরটার গায়ে। আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল ওটা।

টেরিও বেরিয়ে এল। একটা পাথর তুলে নিয়ে রাফিকে ছুঁড়ে মারার সুযোগ খুঁজতে লাগল।

চেঁচিয়ে উঠল মুসা, খবরদার! মেরে দেখো খালি! শয়তান ছেলে কোথাকার!

ভীষণ চেঁচামেচি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পারকার আংকেল। ধমক দিলেন, অ্যাই, কি হচ্ছে! হচ্ছে কি এসব!

দমকা বাতাসের মত যেন ঘর থেকে উড়ে বেরোল জিনা। ছুটে গেল রাফির দিকে।

আবার কুকুরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাফি। কান না ছিঁড়ে আর ছাড়বে না।

অ্যাই, সরাও, সরাও কুত্তাটাকে! ধমকে উঠলেন মিস্টার পারকার।

কাছেই একটা কল আছে। পাইপ লাগানো। বাগানে পানি দেয়া হয়। ছুটে গিয়ে পাইপটা তুলে নিয়ে কুকুর দুটোর ওপর পানি ছিটাতে শুরু করল রবিন। হঠাৎ এভাবে গায়ে পানি পড়ায় চমকে গিয়ে লাফিয়ে সরে দাঁড়াল রাফি। এই সুযোগে উঠে সোজা রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিল অন্য কুকুরটা।

ইচ্ছে করেই পাইপের মুখ সামান্য সরিয়ে টেরিকেও ভিজিয়ে দিল রবিন। ছেলেটাও চেঁচিয়ে উঠে দৌড় দিল তার কুকুরের পেছনে।

কড়া চোখে রবিনের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে ধমক লাগালেন আংকেল, ওকে ভেজালে কেন?…জিনা, তোকে না কতবার বলেছি। কুত্তাটাকে বেঁধে রাখতে!…মিসেস টোড, তুমিও বাপু কথা শোনে না। রান্নাঘর থেকে বেরোতে দাও কেন কুত্তাটাকে? বেঁধে রাখলেই হয়। সবাইকে শাসিয়ে বললেন, আর যেন এমন না হয়।

চুপ করে আছে সবাই।

মিসেস টোডের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নাস্তা হয়েছে? বেলা তো দুপুর হয়ে গেল। রোজই এক অবস্থা!

গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেল মিসেস টোড।

পারকারও ঘরে চলে গেলেন।

রাফির গলায় শেকল বাঁধতে বাঁধতে খেঁকিয়ে উঠল জিনা, কতবার মানা করেছি ওটার সঙ্গে লাগতে যাবি না। তা-ও যাস। আটকে থেকে এখন মজা বোঝ…বাবাকে রাগিয়েছিস, সারাটা দিনই আজ রেগে থাকবে। বুড়িটাকেও খেপিয়েছিস। চায়ের জন্যে কেক-টেক কিছু বানাবে না আর।

বেচারা রাফি। খুব লজ্জা পেয়েছে। মাথা নিচু করে, লেজ গুটিয়ে মৃদু কুঁই কুঁই করল। থুক করে কয়েকটা লোম ফেলল দাঁতের আগা থেকে। কুকুরটার কান ছিঁড়তে পারেনি, তবে কানের ডগার লোম ছিঁড়তে পেরেছে। আপাতত তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

পুরো ঘটনাটার জন্যেই নিজেকে দায়ী মনে করছে কিশোর। বলল, কি করে যে ছুটে গেল…আসলে অনেক জোর ওর, ধরে রাখতে পারলাম না…

ওর গায়ে বাঘের জোর, খুশি হয়ে বলল জিনা। বেঙাচির কুকুরটাকে দুই কামড়ে খেয়ে ফেলতে পারে ও।

নাস্তা দেয়া হলো। কেরিআন্টি নেই টেবিলে। তার বদলে রয়েছেন পারকার আংকেল, যেটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছেলেমেয়েদের জন্যে। এমনিতেই তাঁর সঙ্গে খেতে বসতে চায় না কেউ, আজ তো মেজাজ আরও সপ্তমে চড়ে রয়েছে। কি যে করে বসবেন ঠিক নেই। শুরুতেই কয়েকটা বকা দিলেন। জিনাকে। কড়া নজর বুলিয়ে আনলেন সবার ওপর একবার। কুঁকড়ে গেল রবিন। এখানে বেড়াতে এসেছে বলে এবার আফসোসই হতে লাগল তার।

পরিজের প্লেট এনে ঠকাস করে টেবিলে ফেলল মিসেস টোড।

এটা কি রকম হলো? ধমকে উঠলেন আংকেল, আস্তে রাখতে পারো না!

তাঁকে ভয় পায় মহিলা। তাড়াতাড়ি চলে গেল। এরপর অন্যান্য প্লেট এনে যতটা সম্ভব ভদ্রভাবে শব্দ না করে রাখল।

কয়েক মিনিট নীরবে খাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের বিষণ্ণ মুখগুলো দেখে মায়া হলো পারকারের। কণ্ঠস্বর কোমল করে জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের কি কি করার প্ল্যান?

ভাবছি কোথাও পিকনিকে চলে যাব, জবাব দিল জিনা।

যাও না, মন্দ কি। বাড়িটা শান্ত থাকবে।

 যাব যে, খাব কি? মিসেস টোড কি স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেবে?

দেবে না কেন, নিশ্চয় দেবে। তাকে রাখাই হয়েছে খাবার তৈরির জন্যে। না দিলে আমার কথা বলবে।

চুপ হয়ে গেল জিনা। মিসেস টোডকে স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়ার কথা বলার সাহস বা মানসিকতা কোনটাই নেই তার। মহিলার সামনে যেতেই ইচ্ছে করে না তার।

কুত্তাটাকে কিছু কোরো না, তাহলেই আর রাগবে না তোমাদের ওপর, পারকার বললেন।

ডার্টিটাকে যে কেন আনতে গেল…

ডার্টি! ভুরু কোঁচকালেন পারকার, ছেলেটার নাম বুঝি? এটা একটা নাম হলো।

ছেলে নয়, কুত্তাটার নাম। ওরা ডাকে ডারবি। এক্কেবারে নোংরা তো; গোসল করায় না, গায়ের গন্ধে ভূত পালায়, উকুনে ভরা, তাই আমি রেখেছি ডার্টি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন পারকার। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন। মাঝপথেই হাসি থামিয়ে আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। খবরদার, মিসেস টোডের সামনে ডার্টি বলবে না। আর যেন ঝগড়াঝাটি না শুনি। আমি কাজ করতে চললাম।

নিজে বলতে গেল না জিনা, স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়ার কথা মাকে দিয়ে বলাল।

মুখ কালো করে মিসেস টোড বলল, আরও তিনজনের খাবার রান্না করার কথা কিন্তু ছিল না আমার।

ছিল না, তো কি হয়েছে, জিনার আম্মা বললেন। এসেছে ওরা, তাড়িয়ে দেব নাকি? তোমাকে যা করতে বলা হয়েছে করো, বেতন দেয়ার সময় বিবেচনা করব আমি। আমার শরীর ঠিক হয়ে গেলে তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। ওদের যেন কোন অসুবিধে না হয়।

খাবারের প্যাকেট নিয়ে বেরোল গোয়েন্দারা।

বাগানে টেরির সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?

তাতে তোমার কি দরকার! ঝাঁঝাল জবাব দিল জিনা।

 আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে, খাতির করতে চাইছে ছেলেটা। চলো না, ওই দ্বীপটায় যাই?

না! চাবুকের মত শপাং করে উঠল জিনার কণ্ঠ। ওটা আমার দ্বীপ তোমার মত ছেলেকে ওখানে নিয়ে যাব ভাবলে কি করে…

কে তোমার দ্বীপ? হি-হি! গুল মারার আর জায়গা পাও না! উনার দ্বীপ, ছাগল পেয়েছে আমাকে।

ছাগল না, বেঙাচি। এই চলো, এটার সঙ্গে কে কথা বলে…

তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে গেটের দিকে এগোল জিনা।

পেছনে সুর করে গেয়ে উঠল টেরি, জিনা, ঘিনা… ঘুরে দাঁড়াল মুসা।

খপ করে তার হাত চেপে ধরল জিনা, না না, মুসা, যেয়ো না। কিছু করলেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে, আর ওর মা এসে হাউকাউ শুরু করবে।

এত্তবড় ছেলে কাঁদে! রবিন অবাক।

এই বেঙাচিটা কাঁদে।

অ্যাই, এভাবে কথা বলবে না… রেগে উঠল ছেলেটা।

তুমিও তাহলে খেপাবে না, মুসা বলল।

কি করবে?

খেপিয়েই দেখো! গেয়ে উঠল টেরি, জিনা, ঘিনা…

তাকে শেষ করারই সুযোগ দিল না মুসা। সুর করে পাল্টা জবাব দিল,

ব্যাঙাচি করে ঘ্যানর-ঘ্যান
চাইরডা পয়সা ভিক্ষা দ্যান!

 হেসে ফেলল জিনা।

রবিন আর কিশোরও হাসতে লাগল।

লাল মুখ আরও লাল হয়ে গেল টেরির, চিৎকার করে মাকে ডাকল, মা, দেখো, কেমন করে! জিনার সেই দ্বীপ।

ভুরু নাচাল মুসা, এখন কেমন লাগে? অন্যকে যে খেপাও?

বেশি বেশি করলে তোমাকেও খেপাব।

আমি অত সহজে খেপি না।

এই, চলো চলো, এটার পেছনে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, গেটের দিকে পা বাড়াল কিশোর।

পেছনে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করল টেরি,

মুসা, ঘুসা, রামছাগলের ডিম...

 চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গেল মুসা। তবে রে, শয়তান ছেলে…

একটা মুহূর্ত দেরি করল না আর টেরি। লাফিয়ে উঠে. একদৌড়ে একেবারে রান্নাঘরে, মায়ের কাছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে ভেঙচাল।

ঘুসি তুলে শাসাল মুসা, ধরতে পারব তো একবার না একবার, হাড্ডি গুড়ো করে দেব তখন!

আবার মুখ ভেঙুচাল টেরি।

 গর্জে উঠল মুসা, কান ছিঁড়ে ফেলব কিন্তু বলে দিলাম!

আহ, কি শুরু করলে! ওর হাত ধরে টান দিল কিশোর, তুমি নাকি সহজে খেপো না?

কিন্তু ওটা একটা শয়তান! বিতিকিচ্ছি জন্তু! ইঁদুর, বিড়াল, বেঙ, ছুঁচো, হনুমান…

.

০২.

কোথায় যাবে ঠিক করলে? বাগান থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল রবিন।

রাগ এখনও পড়েনি মুসার। ফোঁস ফোঁস করছে।

কিশোর প্রস্তাব দিল, চলো, দ্বীপে চলে যাই।

আমার নৌকাটা রঙ করতে দিয়েছি, জিনা বলল। হলো নাকি দেখি। হলে যাওয়া যাবে।

নৌকা মেরামতের কারখানায় এসে দেখা গেল রঙ করা হয়েছে। লাল রঙ। দাঁড়গুলোর রঙও লাল।.

যে লোকটা মেরামত করে তার নাম ডক হুফার। জিনাকে দেখে বলল, ও, জর্জ, এসে গেছ। কেমন লাগছে রঙ?

জিনা যে ছেলে সেজে থাকতে পছন্দ করে, হুফার একথা জানে। জর্জ বলে ডাকলে যে খুশি হয় তা-ও জানে।

খুব সুন্দর হয়েছে, আংকেল, মাথা দুলিয়ে জিনা বলল। নিতে পারব?

মাথা নাড়ল হুফার। রঙ তো শুকায়নি। কাল নাগাদ হয়ে যাবে।

আজ বিকেলেও হবে না?

না। পানিতে নামালেই নষ্ট হবে।

কি আর করা। সৈকতে হাঁটতে লাগল ওরা।

মুসা বলল, সকালেই বুঝেছি, আজ দিনটা ভাল যাবে না। শুরুতেই গণ্ডগোল।

হাঁটতে হাঁটতে উঁচু একটা পাড়ের কাছে চলে এল। বড় বড় ঘাস বাতাসে দোল খাচ্ছে। পাড়ের নিচের ঝকঝকে সাদা বালিতে পা ছড়িয়ে বসল সবাই। ও, না, ভুল হয়ে গেছে, সবাই না; রাফি বসল লেজ ছড়িয়ে।

মুসা জিজ্ঞেস করল, তোমাদের খিদে পেয়েছে?

মোটামুটি হ্যাঁ-ই করল সবাই।

খাবারের প্যাকেট খোলা হলো। কিন্তু স্যান্ডউইচে কামড় দিয়েই মুখ বাকাল কিশোর, এহহে, বাসি রুটি দিয়েছে!

ইচ্ছে করে শয়তানিটা করেছে মিসেস টোড, বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও। বাসি রুটি, গন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরে মাখন দেয়নি বললেই চলে। ফেলে দিল কিশোর, খেতে পারল না।

জিনা আর রবিনও খেল না।

জোরজার করে দুটো স্যান্ডউইচ গিলল কোনমতে মুসা।

কেবল রাফির কোন ভাবান্তর নেই। সে এসব পচা-বাসি সবই খেতে পারে। গপগপ করে গিলতে লাগল। নিজের ভাগেরগুলো তো খেলই, অন্যদেরগুলোও খেয়ে চলল।

মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে সকলের।

খানিকক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর মুসা বলল, দূর, এভাবে বসে থাকতে ভাল্লাগছে না! ওঠো।

কোথায় যাব? রবিনের প্রশ্ন।

ওই টিলাটার চূড়ায় গিয়ে বসি। দ্বীপে যখন যেতে পারলামই না, বসে বসে দেখিই এখান থেকে।

হু, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিলোর, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আরকি। চলো।

টিলার মাথায় এসে বসল ওরা। চারপাশে অনেক দূর দেখা যায় এখান থেকে। চমৎকার বাতাস।

জিনার দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবিন জিজ্ঞেস করল, জিনা, সেই ভাঙা জাহাজটা এখনও আছে?

কোন জাহাজের কথা বলছে, বুঝতে পারল জিনা। সেই যে সেবার, প্রথম যখন তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল তিন গোয়েন্দা, তখন এক সাংঘাতিক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়েছিল ওরা। দ্বীপে গিয়েছিল বেড়াতে। প্রচণ্ড ঝড় হলো। ঝড়ে সাগরের নিচ থেকে উঠে এল পুরানো আমলের একটা ভাঙা কাঠের জাহাজ ম্যাপ পাওয়া গিয়েছিল। সোনার বার পেয়েছিল।

আছে, জানাল জিনা।

চকচক করে উঠল কিশোরের চোখ, আছে! আমি তো ভেবেছি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে তলিয়ে গেছে এদ্দিনে।

না যায়নি। পাথরের মধ্যে তেমনি আটকে আছে। বড় বড় ঢেউও ছাড়িয়ে নিতে পারেনি। দ্বীপে গেলেই দেখতে পাবে।

একেবারেই ভাঙেনি?

একেবারে ভাঙেনি তা নয়। খুলে খুলে পড়ছে তক্তা। দু-চারটে ঝড়ের বেশি আর হজম করতে পারবে বলে মনে হয় না।

দ্বীপের পুরানো ভাঙা দুৰ্গটার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। দাঁড়কাকের বাসা ছিল যে টাওয়ারটাতে সেটা এখনও তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।

জিজ্ঞেস করল, কাকগুলো এখনও আছে, না?

আছে, জানাল জিনা। প্রতি বছরই বাসা বানায়। কমেতেনিই, আরও বেড়েছে।

এই দেখো, দেখো, ধোঁয়া, মুসা বলল। দ্বীপে কেউ উঠেছে।

না, কে উঠতে যাবে। স্টীমারের ধোঁয়া হবে। দ্বীপের ওপাশে আছে, তাই দেখতে পাচ্ছি না আমরা।

 ওরকম স্টীমার এখনও আছে নাকি এ-অঞ্চলে? জিজ্ঞেস করল রবিন। ফকফক করে ধোঁয়া ছাড়ে যেগুলো?

তার চেয়ে প্রাগৈতিহাসিকগুলোও আছে। জেলেরা মাছ ধরতে যায় ওসব নিয়ে।

পুরানো জলযান নিয়ে আলোচনা চলল।

ঘড়ি দেখল কিশোর। এবার ওঠা যাক। চায়ের সময় হয়ে এসেছে। গিয়ে যদি দেখতাম আন্টি ভাল হয়ে গেছে, একটা চিন্তা যেত।

হ্যাঁ, মাথা দুলিয়ে মুসা বলল, আন্টি খাবার টেবিলে না থাকলে সবই বিস্বাদ।

উঠল ওরা।

কিছুদূর এসে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দ্বীপটার দিকে তাকাল কিশোর। ঘুরে ঘুরে উড়ছে কয়েকটা সীগাল। ধোঁয়া মিলিয়ে গেছে। ঠিকই বলেছে বোধহয় জিনা, স্টীমারই। সরে চলে গেছে, ফলে আর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু একটা খুঁতখুঁতানি থেকেই গেল তার সন্দেহপ্রবণ মনে।

ব্যাপারটা লক্ষ করল জিনা। কি হলো? ধোঁয়াতে রহস্য খুঁজে পেলে নাকি?

নাক চুলকাল কিশোর। কি জানি!

ভেবো না, কালই চলে যাব। স্টীমারের ধোঁয়া ছিল, না কেউ দ্বীপে উঠে। আগুন জ্বেলেছে, জানাটা কঠিন হবে না।

বাড়ি ফিরে এল ওরা। বসার ঘরে ঢুকে দেখে মহাআরামে সোফায় বসে জিনার একটা বই পড়ছে আর পা নাচাচ্ছে টেরি।

এই ছেলে, এখানে কি? ধমক দিল জিনা। আমার বই ধরলে কেন?

তাতে ক্ষতিটা কি হলো? বইই তো পড়ছি, নষ্ট তো আর করছি না কিছু।

না বলে তুমি ধরলে কেন? সাহস তো তোমার কম না! আমার ঘরে ঢোকো…

ঘরে ঢোকা কি অন্যায়?

নিশ্চয় অন্যায়। না বলে যে অন্যের ঘরে ঢুকতে নেই এই শিক্ষাটাও দেয়নি তোমাকে কেউ? যা করেছ, করেছ। আব্বার স্টাডিতে যেন ঢুকতে যেয়ো না, পিঠের ছাল ছাড়াবে তাহলে

ওখানেও ঢুকেছি, নির্দ্বিধায় স্বীকার করল ছেলেটা। কি সব বিচ্ছিরি যন্ত্রপাতি। ওসব দিয়ে কি করে?

রাগে ক্ষণিকের জন্যে কথা হারিয়ে ফেলল জিনা। চেঁচিয়ে উঠল, বলো কি! ওখানেও…আমরাই যেখানে সাহস পাই না…আব্বা কিছু বলেনি?

না।

ঘরে ছিল না বোধহয়, তাই বেঁচে গেছ। বলবে না আবার! দাঁড়াও গিয়ে বলছি, তারপর বুঝবে মজা…

 বলোগে, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল টেরি। পাবে কোথায় তাকে? জিনাকে আরও রাগানোর জন্যে সামনে-পেছনে শরীর দোলাতে লাগল। বইটা চোখের সামনে এনে গভীর মনযোগে পড়ার ভান করল।

ওর এই বেপরোয়া ভাবভঙ্গি সন্দেহ জাগাল জিনার মনে। পাব কোথায় মানে?

পাব কোথায় মানে, পাবে না।

হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে উঠল জিনা। আম্মা কোথায়?

ডাকো না। থাকলে তো সাড়াই দেবে, একই রকম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে জবাব দিল ছেলেটা।

ভয় পেয়ে গেল সবাই। টেরি এমন করে কথা বলছে কেন?

আম্মা, আম্মা! বলে ডাকতে ডাকতে ওপরতলায় দৌড় দিল জিনা। কিন্তু মায়ের বিছানা খালি। সব কটা বেডরুমে ছুটে বেড়াতে লাগল সে। কোথাও পাওয়া গেল না মাকে। সাড়াও দিলেন না মিসেস পারকার।

সিঁড়ি বেয়ে লাফাতে লাফাতে নিচে নামল জিনা। রক্ত সরে গেছে মুখ। থেকে।

দাঁত বের করে হাসল টেরি। চোখ নাচিয়ে বলল, কি, বলেছিলাম না? যত খুশি চিল্লাও এখন, কেউ আসবে না।

টেরির কাছে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল জিনা। কোথায় ওরা? জবাব দাও, কোথায়!

নিজেই খুঁজে বের করো।

ঠাস করে চড় মারল জিনা। যতটা জোরে পারল।

 লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল টেরি। গাল চেপে ধরেছে। বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল জিনার দিকে। তারপর সে-ও চড় তুলল।

চোখের পলকে সামনে চলে এল মুসা, আড়াল করে দাঁড়াল জিনাকে। মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না? মারতেই যদি হয়, আমাকে মারো, দেখি কেমন জোর?

টেনে তাকে সরানোর চেষ্টা করল জিনা। চিৎকার করে বলল, সরো তুমি, মুসা, সরো! অনেক সহ্য করেছি! পেয়েছে কি! আজ আমি ওর বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব!

কিন্তু সরল না মুসা।

তার গায়ে হাত তোলার সাহস করল না টেরি। পিছিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে।

পথ আটকাল কিশোর। দাঁড়াও। আন্টি কোথায়, বলো।

এই সময় টেরির বিপদ বাড়াতেই যেন ঘরে ঢুকল রাফি। এতক্ষণ বাগানে ছিল। ঢুকেই আঁচ করে ফেলল কিছু একটা ঘটেছে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গরগর করতে করতে এগোল।

আরে, ধরো না কুত্তাটাকে! কাঁপতে শুরু করল টেরি। কামড়ে দেবে তো!

রাফির মাথায় হাত রাখল কিশোর। চুপ থাক্।-হ্যাঁ, টেরি, এবার বলল, আন্টি কোথায়?

রাফির ওপর থেকে চোখ সরাল না টেরি। জানাল, হঠাৎ করে পেটব্যথা শুরু হলো। ডাক্তারকে খবর দিল জিনার আব্বা। ডাক্তার এসে দেখে বলল, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তখনই তাড়াহুড়া করে নিয়ে গেল।

ধপ করে সোফায় বসে পড়ল জিনা। দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল, আম্মা..ও আম্মা, তোমার কি হলো- কেন আজ বেরোলাম ঘর থেকে…আম্মাগো…

তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল সবাই, এই সুযোগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল টেরি। রাফি একবার খেক করে উঠল, কিন্তু ততক্ষণে রান্নাঘরের দরজার কাছে চলে গেছে সে। দরজা পেরিয়েই দড়াম করে লাগিয়ে দিল পাল্লা।

ফিরেও তাকাল না গোয়েন্দারা।

জরুরী কণ্ঠে কিশোর বলল, নিশ্চয় নোট রেখে গেছেন আংকেল।

খুঁজতে শুরু করল তিনজনে।

.

০৩.

চিঠিটা খুঁজে পেল রবিন। জিনার আম্মার বড় ড্রেসিং টেবিলে চিরুনি চাপা দেয়া। ওপরে জিনার নাম লেখা।

তাড়াতাড়ি খুলে জোরে জোরে পড়ল রবিন:

জিনা,

তোমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ভাল না হওয়া পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে থাকব। সেটা দু-দিনও হতে পারে, দুই হপ্তাও হতে পারে। রোজ সকাল নটায় ফোন করে তার খবরাখবর জানাব তোমাদের। চিন্তা কোরো না। মিসেস টোড তোমাদের খেয়াল রাখবেন। বাড়িঘর দেখেশুনে রাখবে। –তোমার বাবা।

 বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে হু-হু করে কাঁদতে লাগল জিনা। বলতে লাগল, আম্মা, আম্মাগো, তুমি আর আসবে না। আমি জানি! তোমাকে ছাড়া কি করে থাকব আমি!

তাকে সান্ত্বনা দিয়ে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল তিন গোয়েন্দা। সহজে কাঁদে না জিনা। তাকে এভাবে বিলাপ করতে দেখে অস্থির হয়ে পড়ল ওরাও।

রাফিও জিনাকে কাঁদতে দেখেনি। প্রথমে অবাক হলো, তারপর অস্থির হয়ে উঠল তিন গোয়েন্দার মতই। জিনার হাঁটুতে মুখ রেখে কুঁই কুঁই করতে লাগল।

অনেকক্ষণ কেঁদেকেটে অবশেষে কিছুটা শান্ত হলো জিনা। মুখ তুলে বলল, আমি আম্মাকে দেখতে যাব।

কোথায় যাবে? কিশোর বলল, কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানি না। আর আমরা গেলেও ঢুকতে দেবে না। সারাদিন কিছু খাওনি। চায়ের সময় হয়ে গেছে। চলো, কিছু খেয়ে নিলে ভাল লাগবে।

আমি কিচ্ছু খাব না! প্রায় ফুঁসে উঠল জিনা। তোমাদের ইচ্ছে হলে যাও! আবার মুখ গুঁজল বিছানায়।

চুপ করে রইল কিশোর। জিনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে।

কয়েক মিনিট পর আবার মুখ তুলল জিনা। চোখ মুছল। মলিন হাসি ফুটল ঠোঁটে। বলল, সরি! কিছু মনে কোরো না! যাও, চায়ের কথা বলে এসো।

কিন্তু কে যাবে মিসেস টোডকে চায়ের কথা বলতে? বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে যাওয়ার অবস্থা হলো যেন দূরদের। মুসা রাজি হলো না। রবিনও আমতা আমতা করতে লাগল। শেষে কিশোরই উঠল যাওয়ার জন্যে।

রান্নাঘরের দরজা খুলে উঁকি দিল সে। টেরি বসে আছে গুম হয়ে। গালের একপাশ লাল, যেখানে চড় মেরেছিল জিনা।

মুখ ভয়ানক গভীর করে মিসেস টোড বলল, আরেকবার খালি আমার ছেলেকে মেরে দেখুক, ওর অবস্থা কাহিল করে দেব আমি!

চড় খাওয়ার কাজ করেছে, খেয়েছে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। ওসব আলোচনা করতে আসিনি আমি।

তাহলে কি জন্যে এসেছ?

চা দিতে হবে।

পারব না।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে গরগর করে উঠল ঘরের কোণে বসে থাকা ডারবি, কিন্তু কাছে আসার সাহস করল না।

কুকুরটাকে পাত্তাই দিল না কিশোর। আপনি না দিলে আমিই নেব। রুটি কোথায় রেখেছেন? কেক?

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল মিসেস টোড। কিশোরও তাকিয়ে রইল একই ভঙ্গিতে। এরকম বাজে মহিলার সঙ্গে ভদ্রতা করার কোন প্রয়োজন মনে করল না সে।

দৃষ্টির লড়াইয়ে হার মানল মিসেস টোড। বলল, বেশ, এবারকার মত দিচ্ছি। কিন্তু এরপর শয়তানি করলে খাওয়া বন্ধ করে দেব।

অত সহজ না। সোজা পুলিশের কাছে যাব, কথাটা কিছু ভেবে বলেনি কিশোর, আপনাআপনি মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে।

চমকে গেল মিসেস টোড। তাড়াতাড়ি বলল, থাকগে, যা হওয়ার হয়েছে, কিছু মনে কোরো না। এই ডাক্তার, হাসপাতালে অস্থির করে দিয়েছে সবাইকে…যাও, আমি চা নিয়ে আসছি।

মহিলার এই হঠাৎ পরিবর্তন অবাক করল কিশোরকে। পুলিশের কথায় এমন চমকে গেল কেন? ভাবতে ভাবতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। একটা কারণ হতে পারে, পুলিশ এলে পারকার আংকেলকে খবর দেবে। ভয়ানক রেগে যাবেন তিনি। মিসেস টোডকেও ছাড়বেন না। তাঁকে ভয় পায় মহিলা।

সবাইকে এসে খবর দিল কিশোর, চা আসছে।

চা খাওয়া জমল না। কান্না থামালেও মন খারাপ করে রেখেছে জিনা। রবিন আর মুসা তাকে নানা ভাবে খুশি করার চেষ্টা করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। চায়ের সঙ্গে কি দিয়ে গেল মিসেস টোড, খেয়ালই করল না কেউ।

যদি কোন কারণে মিস্টার পারকার ফোন করেন, এ-জন্যে খাওয়ার পর দূরে কোথাও গেল না ওরা, বাগানে বসে রইল।

রান্নাঘর থেকে হঠাৎ শোনা গেল:

জিনা, ঘিনাঃ..

 উঠে দাঁড়াল কিশোর। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। একা বসে আছে টেরি।

এই, বেরিয়ে এসো! কঠিন কণ্ঠে ডাকল,কিশোর।

নড়ল না টেরি। গানও গাইতে পারব না?

নিশ্চয় পারবে। সেজন্যেই তো ডাকছি। এটা পুরানো হয়ে গেছে, এসো, নতুন আরেকটা শিখিয়ে দিই।  

বেরোলেই আমাকে মারবে।

না না, মারব কেন, আদর করব! একটা মেয়ের মায়ের অসুখ, তার এমনিতেই মন খারাপ, তাকে খেপাতে লজ্জা করে না! বেরোবে, না কান ধরে বের করে আনব?

কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল মুসা।

ভয় পেয়ে গেল টেরি। চিৎকার করে ডাকল, মা, ও মা! কোথায় তুমি!

জানালা দিয়ে আচমকা হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা। টেরির কান চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল।

ছাড়ো, ছাড়ো!…ওহ, কান ছিঁড়ে ফেলল-মা!

ঘরে ঢুকল তার মা। এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এল জানালার দিকে।

কান ছেড়ে হাতটা বের করে আনল মুসা। পালাতে গিয়েও পালাল না। কিশোরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে রইল।

চেঁচাতে লাগল মিসেস টোড, কত্তবড় সাহস! আমার ছেলেকে চড় মারে…কান টানে! কি, ভেবেছ কি তোমরা!

 কিছুই না, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। তবে আপনার ছেলের খানিকটা শিক্ষা দরকার। আপনারই সেটা দেয়া উচিত ছিল। পারেননি যখন আমাদেরই দিতে হচ্ছে।

তুমি..তুমি একটা শয়তান!

 গাল দেবেন না। যদি কাউকে দিতেই হয়, আপনার ছেলেকে দিন। ও ওই ডার্টি কুত্তাটার চেয়েও খারাপ।

আরও রেগে গেল মিসেস টোড, ওর নাম ডার্টি নয়, ডারবি।

ডার্টি। অত নোংরী কুত্তার এটাই ঠিক নাম। গা-টা ধোঁয়ান, উকুন পরিষ্কার করান, গন্ধ যাক, তারপর ভাবব ডারবি বলা যায় কিনা।

প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে লাগল মিসেস টোড।

কেয়ারই করল না কিশোর। মুসাকে নিয়ে ফিরে এল জিনা আর রবিন যেখানে বসে আছে।

যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেছে, ঘাসের ওপর বসতে বসতে বলল কিশোর।

 কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন।

মুসা টেরির কান টেনেছে। সেটা দেখে ফেলেছে ওর মা। এরপর আর আমাদের খেতে দেবে কিনা সন্দেহ আছে।

না দিলে নিজেরাই নিয়ে খাব, জিনা বলল। শয়তান মহিলাটাকে যে কেন জায়গা দিতে গেল মা…

ওই দেখো, ডার্টি, বলে উঠল মুসা।

রাফি, যাসনে, যাসনে! কলার ধরে আটকানোর জন্যে থাবা মারল কিশোর। ধরতে পারল না।

কেউ নেই ভেবে বেরিয়ে পড়েছিল ডারবি। রাফিকে দেখেই এমন এক চিৎকার দিল, মনে হলো মেরে ফেলা হচ্ছে ওকে।

তার ঘাড় কামড়ে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল রাফি।

লাঠি নিয়ে বেরোল মিসেস টোড। এলোপাতাড়ি বাড়ি মারতে শুরু করল। কোন কুকুরটার গায়ে লাগছে, দেখল না। রাগে অন্ধ হয়ে গেছে।

পানির পাইপের দিকে দৌড় দিল রবিন।

দরজায় দেখা দিল টেরি। রবিনকে পাইপের দিকে যেতে দেখেই ঘরে ঢুকে গেল আবার। গা ভেজাতে চায় না।

গায়ে পানির ঝাপটা লাগতে লাফিয়ে সরে দাঁড়াল রাফি। চোখের পলকে লাফিয়ে উঠে গিয়ে মিসেস টোডের স্কার্টের নিচে লুকাল ডারবি।

বিষ খাওয়াব আমি কুত্তাটাকে! মুখচোখ ভয়ঙ্কর করে গজরাতে লাগল। মিসেস টোড। এত্তবড় শয়তান! বিষ খাইয়ে না মেরেছি তো…

গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেল সে।

আগের জায়গায় এসে বসল গোয়েন্দারা।

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিনা বলল, সত্যিই কি বিষ খাওয়াবে?

 বলা যায় না, কিশোর বলল, ওই মহিলাকে বিশ্বাস নেই। চোখে চোখে রাখতে হবে রাফিকে। আমাদের নিজেদের খাবার থেকে ভাগ দিতে হবে।

কুকুরটাকে কাছে টেনে নিল জিনা। গলা জড়িয়ে ধরল। ইস, আম্মা আব্বা যে কবে আসবে! এই যন্ত্রণা থেকে তাহলে মুক্তি পাই!

হঠাৎ টেলিফোনের শব্দ চমকে দিল সবাইকে। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল ওরা। প্রায় উড়ে এসে ঘরে ঢুকল জিনা। থাবা দিয়ে তুলে নিল রিসিভার।

জিনা? বাবার গলা শুনে দুরুদুরু করে উঠল জিনার বুক।

আব্বা, আম্মা কেমন আছে? জলদি বলো!

পরশুর আগে বলা যাবে না। নানা রকম টেস্ট করছে ডাক্তাররা।

তুমি কবে আসছ?

বলতে পারছি না। তোমার মাকে ফেলে আসি কি করে? চিন্তা কোরো না। কাল সকালে আবার ফোন করব।

আব্বা, ককিয়ে উঠল জিনা, তোমরা নেই, খুব অশান্তিতে আছি। মিসেস টোড একটুও ভাল না।

শোনো, জিনা, অধৈর্য হয়ে বললেন মিস্টার পারকার, নিজে ভাল তো জগৎ ভাল। তোমরা তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার কোরো, সে-ও তোমাদের সঙ্গে করবে। এসব ফালতু কথা নিয়ে বিরক্ত করবে না আমাকে। এমনিতেই অনেক ঝামেলায় আছি।

আমি আসব। আম্মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।

না, আসবে না, বাড়িতে থাকো। বাড়ি থেকে যাবে না কোথাও। আরও হপ্তা দুয়েকের আগে তোমার আম্মাকে ছাড়বে বলে মনে হয় না। দেখি, ঝামেলা কেটে গেলে আমি একবার এসে দেখে যাব তোমাদের। গুড-বাই।

লাইন কেটে দিলেন তিনি।

রিসিভার রেখে বন্ধুদের দিকে ফিরল জিনা। হতাশ কণ্ঠে বলল, পরশুর আগে ওরা বলতেই পারবে না আম্মার কি অবস্থা। আব্বার আসারও কোন ঠিক নেই। ততদিন আমাদের কাটাতে হবে মিসেস টোডের সঙ্গে। ওই বুড়িটার সঙ্গে থাকার কথা ভাবতেই এখন কেমন লাগছে আমার।

.

০৪.

এতটাই রেগেছে মিসেস টোড, সেদিন সন্ধ্যায় ওদেরকে খাবারই দিল না। রাতের খাওয়া বন্ধ। বলতে গিয়ে কিশোর দেখে, রান্নাঘরে তালা লাগানো।

ফিরে এসে সবাইকে জানাল খবরটা। তালা লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে আমরা কিছু বের করে আনতে না পারি। এত্তবড় শয়তান মহিলা জীবনে দেখিনি আমি। কিন্তু

ঘুমাক, তারপর ভাঁড়ারে গিয়ে খুঁজে দেখব কিছু আছে কিনা, জিনা বলল।

খিদেয় পেট জ্বলছে। কান পেতে শুনছে কিশোর, মিসেস টোড আর টেরি ঘুমাতে গেল কিনা। ওপরতলায় উঠে গেল ওরা, দরজা লাগানোর শব্দ হলো, তারও কিছুক্ষণ পর পা টিপে টিপে নামল সে, রান্নাঘরের দিকে এগোল।

ঘর অন্ধকার, আলো জ্বালতে যাবে, হঠাৎ কানে এল ভারী নাক ডাকানোর শব্দ। কে? ডাটি? না, কুকুর তো ওরকম করে নিঃশ্বাস ফেলে না! মানুষের মত লাগছে।

সুইচে হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। চোর-টোর ঢুকল না তো?

নাহ, দেখতেই হচ্ছে। আলো জ্বেলে দিল সে।

ছোটখাট একজন মানুষ শুয়ে আছে সোফায়। গভীর ঘুম। হাঁ করে শ্বাস টানছে।

দেখতে মোটেও ভাল না লোকটা। কতদিন শেভ করেনি কে জানে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গোসল করে না, এমনকি হাতমুখও বোধহয় ঘোয় না, হাতে ময়লা, নখের ভেতর ময়লা ঢুকে কালো হয়ে আছে। মানুষ এত নোংরা হতে পারে ভাবা যায় না। চুল আর নাক টেরির মত।

ও, তাহলে এই ব্যাপার, ভাবল কিশোর। ইনি তাহলে টেরি মিয়ারই বাপ। বাপ-মা যার এরকম, সে আর ভাল হবে কি।

নাক ডাকিয়েই চলেছে লোকটা। কি করবে ভাবতে লাগল কিশোর। ভাঁড়ারে ঢুকতে গেলে যদি শব্দ শুনে জেগে যায় নোকটা? চেঁচামেচি শুরু করে দেবে না তো? অন্যায় ভাবে ঢুকেছে বলে যে বেরিয়ে যেতে বলবে তারও উপায় নেই। তার স্ত্রী চাকরি করে এখানে। তাকে দেখতে আসতেই পারে স্বামী। আংকেল-আন্টিও এতে দোষের কিছু দেখবেন না। বিপদেই পড়া গেল!

খুব খিদে পেয়েছে তার। এবার জিনাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই খাওয়া মোটেও সুবিধের হচ্ছে না। ফলে পেটের চাহিদা রয়েই যাচ্ছে। ভঁড়ারে লোভনীয় খাবার আছে ভাবতেই জিভে পানি এসে গেল তার। আলো নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে এগোল আবার।

দরজা খুলল। অন্ধকারেই হাত বাড়িয়ে তাক হাতড়াতে শুরু করল। হাতে ঠেকল একটা পাত্র, খাবার আছে। গন্ধ শুকে বুঝল, মাংস।

আরেকটা পাত্র রয়েছে ওটার পাশে। বেশ বড়। এটা আর শুঁকতে হলো না, আঙুল ছুঁইয়েই বুঝল, ভেজিটেবল। বাহ, চমৎকার! মাংস, ভেজিটেবল, আর কি চাই? রুটি হলেই হয়ে যায় এখন। সেটা পেতে দেরি হলো না। ট্রেতে অনেক আছে।

পাত্রগুলো ট্রেতে গুছিয়ে নিয়ে ভাঁড়ার থেকে বেরিয়ে এল সে। পা দিয়ে ঠেলে আস্তে লাগিয়ে দিল পাল্লা।

অন্ধকারে এগোতে গিয়ে পথ ভুল করে ফেলল। সোজা এসে হোঁচট খেল সোফায়। ঝাঁকি লেগে ছলকে পড়ল তরকারির ঝোল, কয়েক টুকরো তরকারিও পড়ল। আর পড়বি তো পড় একেবারে মিস্টার টোডের হাঁ করা মুখে।

চমকে জেগে গেল লোকটা।

তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল কিশোর। কোন শব্দ না শুনলে আবার ঘুমিয়ে পড়বে লোকটা। হয়তো পড়তও, কিন্তু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া তরকারির ঝোল বিরক্ত করছে তাকে। ঝটকা দিয়ে উঠে বসল। কে? কে ওখানে? টেরি? কি করছিস?

জবাব দিল না কিশোর। আন্দাজে দরজার দিকে সরে যেতে লাগল।

সন্দেহ হলো নোকটার। লাফ দিয়ে সোফা থেকে নেমে গিয়ে দেয়ালে সুইচবোর্ড হাতড়াতে লাগল। পেয়েও গেল।

অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তাকাও এদিকে! কি করছ?

আমিও তো সে-কথাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। আপনি এখানে কি করছেন?

 তুমি কে? হাত দিয়ে মুখে লেগে থাকা তরকারির ঝোল মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলল, তাকাও এদিকে!

বললে তো আর চিনবেন না। এটা আমার আংকেলের বাড়ি।

আমার স্ত্রী এখানে চাকরি করে, খসখসে গলায় বলল লোকটা। আমার জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে। ছুটি পেয়েছি। দেখতে এসেছি তাকে। তোমার আংকেলের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে আমার স্ত্রী, আমাকে আসার অনুমতি দিয়েছেন।

এই ভয়ই করছিল কিশোর। মহিলা টোড, আর একটা পুঁচকে টোডের জ্বালায়ই অস্থির হয়ে উঠেছিল, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এখন জলজ্যান্ত এক পুরুষ টোড! বাড়িতে আর টিকতে দেবে না ওদেরেকে।

অনুমতি দিয়েছেন, না? বেশ, কাল সকালে তো আংকেল ফোন করবেন, তখন তাকে জিজ্ঞেস করব। এখন সরুন সামনে থেকে। দোতলায় যাব।

দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছে টোড। কিশোরের হাতের ট্রে-র দিকে চোখ সরু করে তাকাল। আংকেলের বাড়ি, না! ভাড়ার থেকে খাবার চুরি করছ কেন তাহলে? চোর কোথাকার…

বাজে কথা বলবেন না, সরুন! ধমকে উঠল কিশোর। কাল সকালেই একটা ব্যবস্থা করব আপনার। চুরি করে অন্যের বাড়িতে রাতদুপুরে শুয়ে থাকা বের করব।

ধমকে কাজ হলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল টোড। সরার কোন লক্ষণ। নেই। কিশোরের সমানই লম্বা। মুখে শয়তানি হাসি।

ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা নোংরা চেহারাটা সহ্য করতে পারছে না কিশোর। ঠোঁট গোল করে জোরে শিস দিয়ে ডাকল রাফিকে।

লাফ দিয়ে জিনার বিছানা থেকে নামল রাফি। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে এল। দরজার কাছে এসেই গন্ধ পেল টোডের। একটুও পছন্দ হলো না। গেল খেপে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গরগর করতে করতে দরজায় এসে দাঁড়াল।

তাকাও এদিকে!একটানে পাল্লা লাগিয়ে দিল টোড। বাইরে রয়ে গেল রাফি। কিশোরের দিকে তাকিয়ে নোংরা হলদেটে দাঁত বের করে হেসে বলল, এখন?

এই তরকারিগুলো তোমার মাথায় ঢালব! ভেজিটেবলের পাত্রটা তুলে এগিয়ে এল কিশোর। মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেছে।

ঝট করে মাথার ওপর দু-হাত তুলে নিচু হয়ে গেল টোড। না না, এমনি…দুষ্টুমি করছিলাম তোমার সঙ্গে!…তাকাও এদিকেখাবারগুলো নষ্ট কোরো না। ওপরতলায় যাবে তো, যাও

সোফার কাছে সরে গেল আবার সে।

দরজা খুলল কিশোর।

গরগর করছে রাফি। শয়তান লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুমতি চাইছে।

তার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল টোড। ওটাকে আটকাও! কুত্তা দেখতে পারি না আমি!

ডারবিটাকে সহ্য করো কিভাবে তাহলে? বৌকে ভয় পাও বুঝি? রাফি, ছেড়ে দে। তোর গরগরানি শোনার যোগ্যও না ও।

ওপরে উঠে এল কিশোর। নিচতলায় কথা কাঁটাকাটির শব্দ শুনেছে, কি, হয়েছে শোনার জন্যে তাকে ঘিরে এল সবাই।

জানাল কিশোর। টোডের মুখে তরকারি পড়ার কথা শুনে হেসেই অস্থির সব। রাফি পর্যন্ত কিছু না বুঝে খেক খেক করে হাসল।

হাসতে হাসতে বলল রবিন, সবটা তরকারি মাথায় না ফেলে ভালই করেছ। তাহলে আমাদের খাওয়াটা যেত। মিসেস টোড শুনলে কি করবে ভাবছি।

কি আর করবে, খাওয়া শুরু করে দিয়েছে মুসা। বড়জোর নিজের মাথার চুল ছিড়বে যা-ই বলো, রাধে কিন্তু ভাল। মাংসটা চমৎকার হয়েছে।

চেটেপুটে সব সাফ করে ফেলল ওরা।

এরপর টোড পরিবারকে নিয়ে আলোচনায় বসল।

বেঙনি আর বেঙাচির জ্বালায়ই মরছি, আবার এসেছে একটা বেঙ, মুসা বলল তিক্তকণ্ঠে। এবার বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে আমাদের। জিনা, কাল তোমার আব্বাকে বুঝিয়ে বলো সব।

বলব। তবে শুনবে বলে মনে হয় না। কিছু শুনতেও চায় না, বুঝতেও চায় না, আব্বাকে নিয়ে এই হলো সমস্যা, হাই তুলতে শুরু করল জিনা। ঘুম পাচ্ছে আমার। রাফি, চল।

ছেলেদেরকে তাদের ঘরে রেখে নিজের ঘরে শুতে চলে গেল সে।

পেটে খিদে ছিল বলে এতক্ষণ ছটফট করেছে। কিন্তু এখন শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল চারজনেই।

সকালে ওদেরকে অবাক করে দিয়ে নাস্তা তৈরি করে দিল মিসেস টোড।

কিশোর অনুমান করল, আংকেল ফোন করবেন তো, আমরা যদি কিছু বলে দিই, এ-জুন্যে বানিয়ে দিয়ে গেল। মহা ধড়িবাজ মহিলা।

খাওয়ার পর ঘড়ি দেখল মুসা। মাত্র আটটা বেজেছে। বলল, ফোন তো করবেন নটায়। এখনও একঘণ্টা বাকি। চলো, সৈকত থেকে হেঁটে আসি।

বেরিয়ে পড়ল ওরা। বাগানে বসে আছে টেরি। জিনাকে দেখে মুখ ভেঙচাল। রাফি ঘাউ করে উঠতেই কুঁকড়ে গেল।

বাগানের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। রবিন বলল, আমার মনে হয় মাথায় দোষ আছে ছেলেটার নইলে এরকম করে না।

বাদ দাও ওর কথা, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিশোর।

নটা বাজতে দশ মিনিট বাকি থাকতে বাড়ি ফিরল ওরা। বাগানে ঢুকতেই কানে এল টেলিফোনের শব্দ।

দৌড় দিল জিনা। তার আগেই মিসেস টোড ধরে ফেলুক, এটা চায় না।

কিন্তু কাছেই ছিল মহিলা, যেন ফোন ধরতেই তৈরি হয়ে ছিল, ধরে ফেলল।

হলে ঢুকতেই গোয়েন্দাদের কানে এল, মিসেস টোড বলছে, হ্যাঁ, স্যার, সব ঠিক আছে, স্যার।…না, কোন অসুবিধে নেই, স্যার। আমার স্বামীও চলে এসেছে, ছুটি পেয়েছে জাহাজ থেকে। আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না, স্যার। সব সামলে রাখব। আপনার যখন ইচ্ছে আসুন…না না, বাচ্চাদের নিয়ে একটুও ভাববেন না…

 আর সহ্য করতে পারল না জিনা। বন্য হয়ে উঠেছে সে। এক থাবায় কেড়ে নিয়ে রিসিভার কানে ঠেকাল, আব্বা, আম্মা কেমন আছে?

আর খারাপ হয়নি। কিন্তু কালকের আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তোমাদের জন্যে খুব চিন্তায় ছিলাম। মিস্টার টোড এসেছে শুনে বাঁচলাম। আর কোন অসুবিধে হবে না তোমাদের। বাড়িঘরের জন্যেও চিন্তা নেই। তোমার আম্মাকে বলব সব ঠিক আছে।

না, নেই! ভয়ানক অবস্থা এখানে। আব্বা, শোনো, টোডদের বিদেয় করে দিই, আমরাই সব সামলাতে পারব…

বলো কি! আঁতকে উঠলেন যেন মিস্টার পারকার। অসম্ভব। তোমরা পারবে নাঃ..যা বলি শোনো…

আব্বা, কিশোর কথা বলবে।

অসহায় ভঙ্গিতে কিশোরের হাতে রিসিভার গুঁজে দিল জিনা। যদি সে কিছু করতে পারে, বোঝাতে পারে তার আব্বাকে।

হ্যালো, আংকেল, আন্টি কেমন?

 আগের মতই। তবে আর খারাপ হয়নি।

ভাল। শুনে খুশি হলাম। আংকেল, শুনুন, মিসেস টোডরা বড্ড জ্বালাচ্ছে…

আরে, তুমিও তো জিনার মতই কথা বলছ দেখছি! রেগে গেলেন মিস্টার পারকার। মহিলার বয়েস হয়েছে, সেটা দেখবে না? জোয়ান মানুষের মত কি আর সব ঠিকমত পারে? কোথায় জিনাকে বোঝাবে, তা না, তোমরাও অভিযোগ শুরু করলে। দেখো, যদি থাকতে পারো থাকো, বেশি কষ্ট হলে বাড়ি চলে যাও। তোমার আন্টি ভাল হলে আবার এসো। আমার আর কিছু বলার নেই।

অন্য কেউ এভাবে কথা বললে স্তব্ধ হয়ে যেত কিশোর। কিন্তু পারকার আংকেলকে চেনা আছে। তাই রাগল না। বোঝানোর চেষ্টা করল, আংকেল, আপনি বুঝতে পারছেন না, ওরা লোক ভাল না…

যত খারাপই হোক, বারো-চোদ্দ দিনে আর কিছু এসে যাবে নাঃ.. রাখলাম…

কিশোরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিলেন তিনি।

 আস্তে করে রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। কাছেই যে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস টোড, ভুলে গিয়ে, জিনার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, না, হলো না…

মিস্টার পারকার কি বলেছেন আন্দাজ করে ফেলেছে কুটিলা মহিলা। হাসিমুখে বলে উঠল, আমরা ভাল না, না? খারাপের কিছু তো দেখোনি এতদিন, এইবার দেখবে। মিস্টার পারকার থাকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন, আমরা থাকব, দেখি তোমরা কি করো?

০৫.

গটমট করে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল মিসেস টোড। চেঁচিয়ে কথা বলে সুখবরটা শোনাতে লাগল স্বামী আর ছেলেকে।

বসার ঘরে সোফায় বসে রইল ছেলেমেয়েরা। সবারই মুখ কালো। নীরবে তাকাচ্ছে একে অন্যের দিকে।

আব্বাটাকে যে দেখতে পারি না আমি, এ-জন্যেই! হঠাৎ ফুঁসে উঠল জিনা। কোন কথা কখনও শুনতে চায় না!

আসলে আন্টিকে নিয়ে খুব অস্থির হয়ে পড়েছেন তো, মুসা বলল। আমাদের কপালই খারাপ, নটার আগেই ফোন করেছেন। কোন আক্কেলে যে বেরিয়েছিলাম!

আব্বা তোমাকে কি বলেছে, বলো তো? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল জিনা।

বলেছেন, বেশি কষ্ট হলে বাড়ি চলে যেতে। আন্টি ভাল হলে আবার আসতে…

তুমি তো খালি আব্বাকে ভাল ভাল বললো, বোঝো এখন কার সঙ্গে বাস করি! শোনো, এখানে থেকে তোমাদের কষ্ট করার কোন দরকার নেই। চলে যাও। বেড়াতে এসে অযথা কেন অত্যাচার সহ্য করবে।

কি যে বলো না। তোমাকে একা বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যাব ভাবলে কি করে? যা-ই ঘটে ঘটুক, আমরা থাকছি। মাত্র তো দুটো হপ্তা, দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

না, যাবে না! এত শয়তান লোকের সঙ্গে থাকতে গেলে দুই হপ্তা দুশো বছরেও শেষ হবে না। বাড়ি সামলে রাখার জন্যে ওদেরকে জায়গা দিয়েছে তো আব্বা, রাখুক ওরা। তোমরা বাড়ি চলে যাও, আমিও আমার মত চলব।

ঘাবড়ে গেল কিশোর। খেপিয়ে দেয়া হয়েছে জিনাকে। কি করে বসবে এখন, তার ঠিক নেই।

বোকার মত কথা বোলো না। কিভাবে চললে ভাল হবে, সবাই মিলে আলোচনা করে একটা উপায় বের করে ফেলতে পারব।

দেখো, টিকতে পারবে না এখানে, চলে তোমাদের যেতেই হবে।…রাফি, চলো, ঘুরে আসি।

আমরাও যাব তোমার সঙ্গে, মুসা বলল।

বাধা দিল না জিনা।

সৈকতে এসে বসল ওরা।

গুম হয়ে আছে জিনা। মায়ের জন্যে দুঃখ, বাবার ওপর রাগ-অভিমান, টোডদের ওপর ঘৃণা, সব মিলিয়ে অস্থির করে তুলেছে তাকে। চিরকাল সুখে থেকে থেকে মানুষ, এসব সহ্য করতে পারছে না।

কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল কিশোর, আমরা চলে গেলে কি করার ইচ্ছে তোমার, বলো তো? কিছু একটা প্ল্যান তো নিশ্চয় করেছ।

না, বলব না। বললে আমাকে করতে দেবে না তোমরা।

কেন দেব না? রবিন বলল, খারাপ তো আর কিছু করবে না…

যদি করিই, তোমাদের কি? রেগে উঠতে গিয়ে সামলে নিল জিনা, সরি, ঝগড়া করতে চাই না। অহেতুক দাওয়াত দিয়ে এনে তোমাদের ছুটিটা পণ্ড করলাম।

পণ্ড হতে দিচ্ছি না, নিশ্চিন্ত থাকো, জোরগলায় বলল মুসা। দরকার হয় পিটিয়ে বের করব বেঙগুলোকে…বাড়িঘর যদি ঠিকঠাক রাখতে পারি আমরা, আংকেলের কিছু বলার থাকবে নাঃ..

ওই বাড়িটাতে ঢুকতেই ইচ্ছে করছে না আমার আর। বাইরেই ভাল।

চলো তাহলে, কিশোর বলল, দূরে কোথাও চলে যাই। তোমরা এখানে বসো, আমি খাবার নিয়ে আসি।

হুহ, গেলেই দেবে আরকি…

দেখোই না দেয় কিনা, উঠে বাড়ি রওনা হলো কিশোর।

রান্নাঘরে তখন হাসাহাসি চলছে, কথা বলছে তিন টোড। কিশোরকে ঢুকতে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেল।

পাত্তাই দিল না কিশোর। ভারী গলায় বলল, স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিন। বেড়াতে যাব আমরা।

বা-বা, আব্দার! মুখ ঝামটা দিয়ে বলল মিসেস টোড। রাতের বেলা সব চুরি করে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলেছে, এখন এসেছে স্যান্ডউইচের জন্যে। শুধু রুটি আছে ওখানে, নিলে নাও, নইলে বিদেয় হও।

সোফায় শুয়ে আছে টেরি। হাতে একটা কমিকের বই। সুর করে বলে উঠল, কিশোর, বিশোর...

এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব, শয়তান ছেলে কোথাকার!

কিশোরকে ভয় পায় টেরি। ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল।

খেঁকিয়ে উঠল মিসেস টোড, মারো তো দেখি চড়, কত্তবড় সাহস!

মারলে ধরে রাখতে পারবেন না। বজ্জাত বানিয়েছেন, আবার বড় বড় কথা…

গলা খাঁকারি দিল এককোণে বসা মিস্টার টোড। দেখো ছেলে, তাকাও এদিকে...

আপনার দিকে কে তাকায়!

দেখো, তাকাও এদিকে, রেগে গেছে টোড। বসা থেকে উঠল।

বার বার তাকাও এদিকে, তাকাও এদিকেকরছেন কেন? বললাম না। তাকাব না। দেখার মত আহামরি কোন চেহারা নয়।

চেঁচিয়ে উঠল মিসেস টোড, খবরদার, মুখ সামলে…

মুখ সামলে আপনি কথা বলবেন, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল মহিলার দিকে।

কয়েক মুহূর্তের বেশি তার চোখে চোখে তাকিয়ে থাকতে পারল না মিসেস টোড। ছেলেটার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অস্বস্তিতে ফেলে দেয় তাকে। শান্তকণ্ঠে কথা বলে, কিন্তু জিভে যেন বিছুটির জ্বালা। সসপ্যান দিয়ে মাথায় একটা বাড়ি মারতে ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু অতটা সাহস করল না। এই ছেলে বিপজ্জনক ছেলে।

কিশোরের মাথায় তো মারতে পারল না, টেবিলেই থ্রম করে সসপ্যান আছড়ে ফেলল মিসেস টোড।

আচমকা এই শব্দে ভাঁড়কে গিয়ে গোওও করে উঠল ডারবি।

 হাল্লো, ডার্টি! তীব্র ব্যঙ্গ ঝরল কিশোরের কণ্ঠে, আছিস কেমন? গোসল করানো হয়েছে তোকে? মনে তো হচ্ছে না…

ওর নাম ডার্টি নয়! ঝাঁঝিয়ে উঠল মিসেস টোড।

ধুয়েমুছে গন্ধ দূর করুন, ডারবিই বলব। যতক্ষণ গন্ধে বমি আসবে, ততক্ষণ ডাটি…যাকগে, ফালতু কথা বলার সময় নেই। আপনি ব্যস্ত, বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, স্যান্ডউইচই তো কটা, লাগবে না। বাইরে থেকেই কিনে খেয়ে নেব। তবে রাতের খাওয়াটা যেন ভাল হয়, বলে দিলাম।

বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঘুরল কিশোর। শিস দিতে দিতে এগোল দরজার দিকে। বেরিয়ে যাবে, ঠিক এই সময় আবার বলে উঠল টেরি, কিশোর, বিশোর…

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল কিশোর, কি বললে!

কুঁকুড়ে গেল টেরি। গোওও করে উঠল ডারবি।

বরফের মত শীতল কণ্ঠে বলল কিশোর, বলো তো আবার শুনি?

কিন্তু আর বলার সাহস করল না টেরি। কুকুরটাও ভয় পাচ্ছে। কিশোরকে। মিসেস টোড চুপ। মিস্টার টোড স্তব্ধ।

সবার ওপর একবার করে কড়া নজর বোলাল কিশোর। মিস্টার পারকার থাকার অনুমতি দিয়েছেন বলেই সাত খুন মাপ হয়ে যায়নি; ওদের সঙ্গে খারাপ। আচরণ করলে ওরাও ছাড়বে না, বুঝিয়ে দিল এটা। তারপর যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে আবার শিস দিতে দিতে বেরিয়ে এল।

বন্ধুদেরকে সব জানাল সে।

জিনা বলল, কিন্তু এভাবে মুখ কালাকালি করে বাড়িতে বাস করা যায়!

সারাটা দিন চুপচাপ রইল সে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তার মুখে। হাসি ফোঁটাতে পারল না তিন গোয়েন্দা।

কিশোর বলল, জিনা, চলো, তোমার দ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।

মাথা নাড়ল জিনা। ভাল লাগছে না। বাড়ির কাছাকাছি থাকতে চাই। আব্বা আবার ফোন করতে পারে। বুড়িটাকে ধরতে দেব না। ধরলেই সাতখান করে লাগাবে আব্বার কাছে।

চায়ের সময় বাড়ি ফিরল ওরা। রুটি, মাখন আর জ্যাম দিল ওদেরকে মিসেস টোড, কেকটেক কিচ্ছু না। রুটিও এত কম, শুধু ওদের চারজনেরই হবে, রাফির জন্যে নেই। দুধ টক হয়ে গেছে, খাওয়া গেল না। চায়ে যে মিশিয়ে খাবে, তারও উপায় নেই। বাধ্য হয়ে দুধ ছাড়াই চা খেল ওরা।

জানালায় দেখা দিল টেরি। হাতে একটা বাসন। বলল, এই যে, কুত্তাটার খাবার।

জানালার নিচে ঘাসের ওপর ওটা নামিয়ে রেখে পালাল সে।

মাংসের গন্ধ পেয়ে ছুটে বেরোল রাফি।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল জিনা। যাসনে, রাফি, যাসনে!

বেরিয়ে দেখল বাসনের মাংস শুকছে কুকুরটা।

খেয়ে ফেলিসনি তো!

 জানালা দিয়ে রবিন বলল, না, খায়নি। কেবল এঁকেছে। আমি দেখেছি।

জিনার পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছে কিশোর। বাসনটা তুলে নিয়ে শুকল। কাঁচা মাংসের গন্ধ। আর কোন গন্ধ পাওয়া গেল না।

রবিন আর মুসাও বেরোল।

খাইছে! মুসা জিজ্ঞেস করল, বিষটিষ দেয়নি তো?

দাঁড়াও, দেখি। গলা চড়িয়ে ডাক দিল কিশোর, ডারবি! ডারবি!

লেজ নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এল ছোট্ট কুকুরটা। মাংস দেখাতেই দৌড়ে আসতে লাগল।

আরেক দরজা দিয়ে ছুটে বেরোল টেরি। ডারবি, যাবি না, ডারবি! খবরদার, ওই মাংস খেতে দেবে না ওকে!

কেন দেব না? বলো, কেন দেব না?

 ও মাংস খায় না। কেবল কুকুরের বিস্কুট।

মিথ্যে কথা! চেঁচিয়ে উঠল জিনা, কালও ওকে মাংস খেতে দেখেছি। এখনও তো মাংস দেখে ছুটে এল!

হঠাৎ একটান দিয়ে কিশোরের হাত থেকে বাসনটা কেড়ে নিয়ে দৌড় দিল টেরি। রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

পেছনে দৌড় দিতে গেল মুসা, হাত ধরে তাকে থামাল কিশোর। যেয়ো না। গিয়ে দেখবে আগুনে ফেলে দিয়েছে। ওই মাংস আর পাবে না।

নিশ্চয় বিষ দিয়েছিল। শিউরে উঠল জিনা।

ইঁদুরের বিষটিষ হবে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। যাকগে, ভয় পেয়ো না। মুখে তো আর দেয়নি রাফি।

কিন্তু দিতে তো পারত..আবার খাওয়ানোর চেষ্টা করবে ওরা..

আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। শুধু হুমকি দিয়েছে ভেবেছিলাম। কিন্তু সত্যিই যে দেবে ভাবিনি।

আমাদেরও খাইয়ে দেবে না তো! শঙ্কিত হয়ে পড়েছে রবিন।

কুকুরকে যখন দিয়েছে, মানুষকেও দিতে পারে:

অত সাহস করবে না। চার-চারজন মানুষকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে, অতই সোজা!

.

০৬.

রাত হলো।

অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ল মুসা। বলল, রাতে খেতে দেবে বলে তো মনে হয় না। কিশোর, আজও কি চুরি করতে হবেনাকি?

যতই কঠোরতা দেখাক, গালাগাল করুক, আরেকবার টোডের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। ভয় পেয়েছে, তা নয়, আসলে বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ করেই রাগ হতে লাগল নিজের ওপর। জিনাদের বাড়ি মানে ওদেরও বাড়ি, টোডদের চেয়ে এখানে তাদের অধিকার অনেক অনেক বেশি, ওদের ভয়ে চুরি করতে যায় কেন সে? খাবারের জন্যে অনুরোধই বা করতে যায় কেন?

উঠে দাঁড়াল সে, রাফি, আয় তো আমার সঙ্গে।

আমি আসব? জিজ্ঞেস করল মুসা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আজ বেঙের বাচ্চার নাক ফাটিয়ে দেব।

না, তুমি থাকো। নাক ফাটানোর সময় এখনও হয়নি।

প্যাসেজ ধরে রান্নাঘরের দিকে এগোল কিশোর। রেডিও বাজছে। তাই ঘরের কেউ কিশোরের পায়ের আওয়াজ শুনল না। সে দরজায় গিয়ে দাঁড়ানোর আগে জানতে পারল না কিছু। সবার আগে চোখ পড়ল টেরির। দেখে দরজায় কিশোর, তার পেছনে রাফি।

এ বিশাল কুকুরটাকে বাঘের মত ভয় পায় সে। তাকে দেখে রাফি ঘাউ ঘাউ করে উঠতেই লাফ দিয়ে নেমে গিয়ে সোফার পেছনে লুকাল।

রেডিও অফ করে দিয়ে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল মিসেস টোড, কি চাই?

রাতের খাবার দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন?

রুটি আর কিছু পনির পাবে, ব্যস, আর কিছু না। নিয়ে যাও।

কেন, আপনার বাবার টাকায় কেনা খাবার, ভাল কিছু দিতে এত কষ্ট হয়?

ক্ষণিকের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল মিসেস টোড। চেঁচিয়ে উঠল, গাল দিচ্ছ কোন সাহসে!

কথা না শুনলে আরও খারাপ কিছু করব, কোনও বয়স্ক মহিলার সঙ্গে এতটা অভদ্র আচরণ জীবনে করেনি কিশোর। সহ্যের শেষ সীমায় চলে গেছে সে। রাফি, খেয়াল রাখ। সোজা কামড়ে দিবি, বলে রাখলাম তোকে।

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল রাফির চেহারা। গরগর করে গজরাতে লাগল।

জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল না কিশোর, মৃদু শিস দিতে দিতে এগোল ভাঁড়ারের দিকে। জানে তার এই আচরণ আরও খেপিয়ে দেয় মিসেস টোডকে, সেজন্যেই আরও বেশি করতে লাগল এরকম। বাহ, ভাড়ার কি করে বোঝাই করে রাখতে হয় আপনি জানেন, মিসেস টোড। মুরগীর রোস্ট। আহ, গন্ধেই পানি এসে যাচ্ছে জিভে। মনে হচ্ছে কত বছর খাই না। নিশ্চয় আজ সকালে জবাই করেছে মিস্টার টোড। অনেক কঁক-কঁক শুনেছি। আরে, টমেটো! চমৎকার! গাঁয়ের সবচেয়ে ভালটা নিয়ে আসা হয়েছে, বুঝতে পারছি। আরি সব্বেনাশ, আপেল-পাইও আছে। আপনি সত্যি ভাল রাঁধেন মিসেস টোড, স্বীকার করতেই হবে।

বড় একটা ট্রে নিয়ে এক এক করে তাতে পাত্রগুলো তুলতে শুরু করল সে।

চিৎকার করে বলল মিসেস টোড, জলদি রাখো! ওগুলো আমাদের খাবার!

ভুল করলেন, মোলায়েম স্বরে বলল কিশোর। এগুলো আমাদের খাবার। আজ সারাদিন খাওয়াটা ভাল হয়নি, রাতেও না খেয়ে থাকতে পারব না।

দেখো ছেলে, এদিকে তাকাও!এত সুস্বাদু খাবারগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে ঘোৎ-ঘোৎ করে উঠল মিস্টার টোড।

আপনার দিকে তাকাব? কেন? যেন সাংঘাতিক অবাক হয়েছে। কিশোর, এমন কি মহামানব হয়ে গেছেন আপনি? শেভ করেছেন? গোসল করেছেন? মনে তো হয় না। না, মিস্টার টোড, আপনার দিকে তাকানোর রুচি হচ্ছে না।

বাকহারা হয়ে গেল মিস্টার টোড। একটা ছেলের জিভে যে এতটা ধার থাকতে পারে, কল্পনাই করেনি। আরও দু-বার আনমনেই বিড়বিড় করল, দেখো, এদিকে তাকাও,এদিকে তাকাও!

উফ, আবারও সেই একই কথা! অসহ্য! আচ্ছা মিস্টার টোড, দুনিয়ায় এত নাম থাকতে আপনার নাম টোড রাখতে গিয়েছিল কেন? টোড কাকে। বলে জানেন তো? রেঙ। তা-ও ভাল জাতের হলে এককথা ছিল, গড়িয়ে গড়িয়ে যেগুলো চলে সেগুলো:

চুপ করো পাজি ছেলে কোথাকার! আর সহ্য করতে না পেরে ধমকে উঠল মিসেস টোড।

কিশোরকে কিছু বলতে হলো না, ঘাউ করে বিকট হাঁক ছাড়ল রাফি।

চমকে উঠে পিছিয়ে গেল মিসেস টোড। কণ্ঠস্বর নরম করে বলল, সব নিয়ে গেলে আমরা কি খাব, বলো?

কেন, রুটি আর পনির রয়েছে না, যেগুলো আমাদের জন্যে রেখেছিলেন। তাই খেয়ে নিন।

কুকুরের কথা ভুলে গিয়ে একটা চামচ তুলে কিশোরকে বাড়ি মারতে গেল মিসেস টোড।

আবার ঘাউ করে লাফিয়ে এসে সামনে পড়ল রাফি। কামড়ে দিতে গেল।

বাবাগো! বলে লাফ দিয়ে সরে গেল মিসেস টোড। কি শয়তান কুত্তারে বাবা! আরেকটু হলেই আমার হাত কেটে নিয়েছিল!

আপনাকে তো বলেছি, গোলমাল করবেন না, করছেন কেন?

দাঁড়াও, এমন শিক্ষা দেব একদিন.. ফোঁস ফোঁস করতে লাগল মিসেস টোড।

চেষ্টা তো আজও কম করেননি, পেরেছেন? আজকে মাপ করে দিলাম, আবার যদি এরকম করেন, ওই যে বলেছি, সোজা পুলিশের কাছে যাব।

আগের বারের মতই পুলিশের কথায় ভয় পেয়ে গেল মহিলা। চট করে একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে গেল।

সন্দেহ হলো কিশোরের, কোন অপরাধ করে এসে এখানে লুকায়নি তো লোকটা? নইলে পুলিশের কথা শুনলেই ঘাবড়ে যায় কেন? আসার পর থেকে একটিবারের জন্যে ঘরের বাইরেও যায়নি, এটাও সন্দেহজনক।

খাবারের ট্রে হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। পেছনে রাফি; খুব হতাশ হয়েছে কারও পায়ে একটা অন্তত কামড় বসাতে পারেনি বলে।

যুদ্ধজেতা বীরের ভঙ্গিতে বসার ঘরে ঢুকল কিশোর। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, এসো, দেখে যাও, কি নিয়ে এসেছি।

সব কথা শুনে হুল্লোড় করে উঠল সবাই।

রবিন বলল, সাহস আছে তোমার, কিশোর। ওই মহিলাটার সামনে যেতেই ভয় করে আমার।

ভয় কি আমারও কম করছিল। কেবল সঙ্গে রাফি থাকাতেই পার হয়ে এলাম।

ছুরি-চামচ-প্লেটের অভাব হলো না। সাইডবোর্ড থেকে বের করে আল জিনা। চায়ের সময় খাওয়ার পর রুটি বেঁচে গিয়েছিল, তারপরেও রান্নাঘর থেকে বড় আরেকটা নিয়ে এসেছে কিশোর। কারোরই কম পড়ল না, এমন কি রাফিরও পেট ভরল।

খাওয়ার পরই হাই তুলতে শুরু করল রবিন। আমি আর বসে থাকতে পারছি না।

আজকাল বড় বেশি ঘুমকাতুরে হয়ে পড়েছ তুমি, রবিন, অভিযোগ করল মুসা।

কি আর করব, বলো, হেসে বলল রবিন। সারাদিন থাকি খাবারের চিন্তায়। কখন পাব, কখন পাব এই টেনশনেই শরীর হয়ে থাকে ক্লান্ত। খাওয়ার পর আর থাকতে পারি না।

বিষণ্ণকণ্ঠে জিনা বলল, তোমাদের আসতে বলে এবার ভুলই করলাম…

সববারই তো শুদ্ধ হয়, এবার নাহয় একটু ভুল হলোই, পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বলল রবিন, তাছাড়া তুমি তো আর জানতে না আন্টির শরীর এতটা খারাপ হয়ে যাবে।

শুতে গেল ওরা। গোয়েন্দারা তাদের ঘরে, জিনা তার ঘরে। রাফি শুয়ে থাকল জিনার বিছানার কাছে। কান পেতে রইল সন্দেহজনক শব্দ শোনার জন্যে। টোডদেরকে শুতে যেতে শুনল সে। দরজা বন্ধ হতে শুনল। ডারবি গোঙলি একবার, তারপর সব নীরব।

থুতনি নামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল রাফি। তবে একটা কান খাড়াই রইল ঘুমের মধ্যেও। টোড পরিবারকে একবিন্দু বিশ্বাস করে না সে।

রাতে তাড়াতাড়ি শুয়েছে, পরদিন খুব সকালে বিছানা ছাড়ল। ছেলেমেয়েরা। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। সুন্দর দিন। আকাশের রঙ ফ্যাকাসে নীল, মাঝে মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে গোলাপি মেঘ। সাগর শান্ত, আকাশের মতই নীল। মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র ধোপাখানা থেকে ধুয়ে এনে বিছানো হয়েছে বিশাল এক নীল চাদর।

নাস্তার আগে সাগরে গোসল করতে গেল ওরা। বাড়ি ফিরে এল সাড়ে আটটার মধ্যে। আগের দিনের মত যদি নটার আগেই ফোন করেন মিস্টার পারকার, তাহলে যাতে ধরতে পারে। আজ আর মিসেস টোডকে ফোন ধরার সুযোগ দিতে চায় না।

মহিলাকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল কিশোর, আংকেল ফোন করেছেন?

না, মেজাজ দেখিয়ে বলল.মিসেস টোড। সে আশা করেছিল, আজও আগেই ফোন ধরে ফেলবে। পারল না বলেই এই রাগ।

নাস্তা দিতে হবে। ভাল জিনিস। আংকেলকে যাতে বলতে পারি ভাল খাবারই খাওয়ানো হচ্ছে আমাদের।

ছেলেটাকে বিশ্বাস নেই। খারাপ কিছু দিলে সত্যি বলে দিতে পারে। বানিয়েও বলতে পারে অনেক কিছু। তাই শুকনো রুটি আর মাখন দেয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করতে হলো মিসেস টোডকে।

খানিক পরেই রান্নাঘর থেকে মাংস ভাজার গন্ধ পেল কিশোর।

মাংস, ডিম ভাজা, টমেটোর সালাদ আর রুটির ট্রে ধাম করে টেবিলে নামিয়ে রাখল মিসেস টোড। মুচকি হাসল শুধু কিশোর, কিছু বলল না। যত খুশি মেজাজ দেখাক, খাবার না দিয়ে তো পারল না।

টেরি ঢুকল আরেকটা ট্রে হাতে। তাতে চায়ের সরঞ্জাম।

বাহ, এইতো লক্ষ্মী ছেলে, হেসে বলল কিশোর।

বিড়বিড় করে কি যেন বলল টেরি, বোঝা গেল না। মায়ের মতই আছাড় দিয়ে ট্রে রাখল টেবিলে। ঝনঝন করে উঠল কাপ-পিরিচ। এই শব্দ সহ্য করল না রাফি, হউক! করে ধমক লাগাল।

প্রায় উড়ে পালাল টেরি।

খবর শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছে জিনা। খাবারের দিকে নজর নেই। তার প্লেটে মাংস, ডিম বেড়ে দিল কিশোর।

খাওয়ার মাঝপথে বাজল টেলিফোন। হাতের চামচটা প্লেটে ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে গেল জিনা। দ্বিতীয়বার রিঙ হওয়ার আগেই ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার। আব্বা?…আম্মার খবর কি?

শুনল ওপাশের কথা।

তিন গোয়েন্দাও খাওয়া থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

তাই নাকি? জিনা বলল, উফ, বাঁচলাম। আম্মাকে বোলো, তাকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে আছি আমি! তুমি তো আবার ভুলে যাবে, বলবে না কিছু! বলবে কিন্তু বলে দিলাম! আব্বা, আমি আসতে চাই, কিছু হবে?

আবার ওপাশের কথা শুনতে লাগল সে।

শোনার পর আস্তে নামিয়ে রাখল রিসিভার।

রবিন বলল, নিশ্চয় যেতে মানা করেছেন?

মাথা ঝাঁকাল জিনা। আবার টেবিলে এসে বসল। আম্মার অপারেশন হয়েছে। ব্যথা নেই। ডাক্তাররা বলছে, দিন দশেকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। আব্বা আম্মাকে নিয়েই একবারে আসবে।

যাক, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর, এতদিনে একটা সুখবর পাওয়া গেল।

কিন্তু কুখবর যে ঘাড়েই চেপে আছে এখনও, মুখ বাঁকাল মুসা। বেঙ পরিবার। দশটা দিন ওদের সহ্য করব কি ভাবে?

.

০৭.

 জিনা ফোন ধরার সময় কাছেই ছিল মিসেস টোড। সব শুনল। মিসেস পারকার আসতে আসতে আরও দিন দশেক লাগবে। এ কদিন নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবে এ-বাড়িতে।

হঠাৎ করেই যেন রাক্ষুসে খিদে পেয়ে বসল জিনাকে। এতক্ষণ কেবল চামচ নাড়াচাড়া করছিল, এখন গপ গপ করে গিলতে শুরু করল।

আমার যে কি ভাল লাগছে। আবার হাসি ফুটেছে তার মুখে।

এরপর যে কথাটা বলল জিনা, সেটা আর ভাল লাগল না কিশোরের।

জিনা বলল, আম্মা ভাল হয়ে যাচ্ছে, টোডের গোষ্ঠীকে আর ভয় পাই না আমি। তোমরা রকি বীচে ফিরে যাও, খামাকা ছুটিটা নষ্ট কোরো না। আমি আর রাফিই সামলাতে পারব ওদের।

গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর, দেখো, জিনা, এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। একবার কিছু ঠিক করলে তুমি যেমন না করে ছাড়ো না, আমিও ছাড়ি না, ভাল করেই জানা আছে তোমার। আমাকে কিন্তু রাগিয়ে দিচ্ছ।

বেশ, জিনা বলল, তাহলে আমি যা ঠিক করেছি তাই করব। বাড়ি না যেতে চাইলে এখানেই থাকো, আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমি যে প্ল্যান করেছি, সেটা আমার একার। তোমরা এতে থাকছ না।

কি প্ল্যান তোমার? বলতে অসুবিধে কি? আমাদের বিশ্বাস করো না?

করি। কিন্তু বললে আমাকে করতে দেবে না, ঠেকাতে চাইবে।

তাহলে তো আরও বেশি করে শোনা-দরকার, শঙ্কিত হয়ে উঠল কিশোর। জিনাকে বিশ্বাস নেই, কারও ওপর রেগে গেলে যা খুশি করে বসতে পারে।

কিন্তু কোনভাবেই জিনার মুখ থেকে তার প্ল্যান সম্পর্কে একটা কথা আদায় করা গেল না।

গোপনে তার ওপর নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

জিনাও কম চালাক নয়। অস্বাভাবিক কিছুই করল না। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে সৈকতে বেড়াল, সাঁতার কাটল, খেলল। তার মায়ের শরীর ভাল হওয়ার খবর শুনেছে, আজ তার মন ভাল। দ্বীপে যাওয়ার কথা বলল একবার মুসা, এড়িয়ে গেল জিনা। তাকে আর চাপাচাপি করা হলো না এ-ব্যাপারে।

দিনটা ভালই কাটতে লাগল। বাড়ি গিয়ে খাবারের জন্যে মিসেস টোডের সঙ্গে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হলো না কারও, তাই বেকারি থেকে স্যান্ডউইচ কিনে খেল।

বিকেলে জিনা বলল, বাজারে যেতে হবে। আমি কয়েকটা জিনিস কিনব। চায়ের সময় হয়েছে, তোমরা বাড়ি যাও। আমি যাব আর আসব।

আমিও যাব তোমার সঙ্গে। রাফিকে নিয়ে রবিন আর মুসা চলে যাক। তিনজনে মিলে ভালই সামলাতে পারবে মিসেস টোডকে।

না, আমি একা যাব। তোমরা যাও।

শেষ পর্যন্ত সবাইকে সঙ্গে নিতে বাধ্য হলো জিনা। কারণ, কিশোর। তাকে একা যেতে দেবে না, ওদিকে মুসা আর রবিনও মিসেস টোডের মুখোমুখি হতে রাজি নয়।

এক একটা দোকানে ঢুকে টর্চের জন্যে নতুন ব্যাটারি কিনল জিনা। দুই বাক্স দিয়াশলাই, আর এক বোতল মেথিলেটেড স্পিরিট কিনল।

এসব কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।

কাজে লাগে না এসব? এড়িয়ে গেল জিনা, দরকারী জিনিস।

জিনার কেনাকাটা এ-পর্যন্তই। বাড়ি ফিরে এল ওরা। অবাক হয়ে দেখল, টেবিলে চা দেয়াই আছে। যদিও আহামরি কিছু নয়-রুটি, জ্যাম আর চা, তবু আছে তো। দেয়ার জন্যে যে মিসেস টোডকে কিছু বলতে হয়নি এতেই খুশি ওরা। যা পেল খেয়ে ফেলল।

সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি নামল। ঘর থেকে বেরোনোর উপায় নেই। বসে বসে কেরম খেলতে লাগল ওরা। কেরিআন্টির খবর শুনে মন অনেকটা হালকা ওদের।

এক সময় উঠে গিয়ে বেল বাজাল কিশোর।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা, বেল বাজালে কেন?

মিসেস টোডকে ডাকলাম, খাবার দিতে বলব।

কিন্তু তার ঘণ্টার জবাব দিতে এল না কেউ।

আবার বাজাল সে। আবার। যতক্ষণ না রান্নাঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল মিসেস টোড। মুখ কালো করে, চোখ পাকিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল সে। বেল বাজাচ্ছ কেন? তোমার বেলের জবাব দিতে যাচ্ছে কে?

আপনি, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর, আর কে আছে বাড়িতে? খাবার দিন। ফালতু জিনিস আনলে ভাল হবে না। কাল রাতে কাউকে কামড়াতে পারেনি বলে খুব বিরক্ত হয়ে আছে রাফি।

আজ যদি কিছু করতে আসো রান্নাঘরে…আমি..আমি…

কি করবেন? পুলিশে খবর দেবেন তো? আমিও সেটাই চাইছি। পুলিশকে বেশ কিছু কথা বলার আছে আমার। ডাকবেন নাকি এখনই?

চোখের দৃষ্টিতে কিশোরকে ভস্ম করে দেয়ার চেষ্টা চালাল যেন মিসেস টোড, ব্যর্থ হয়ে ক্ষুব্ধ আক্রোশে হাত মুঠো করে ফেলল। বিড়বিড় করে কি বলতে বলতে, বোধহয় তাকে অভিশাপ দিতে দিতেই চলে গেল রান্নাঘরে। বাসন-পেয়ালা আছড়ানোর শব্দ পাওয়া গেল বসার ঘর থেকেও।

বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর।

আগের দিনের মত এতটা ভাল খাবার পেল না ওরা, তবে তেমন খারাপও না। ঠাণ্ডা মাংস, পনির আর খানিকটা পুডিং। রাফির জন্যেও খানিকটা রান্না করা মাংস এনে দিল মিসেস টোড।

তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল জিনার দৃষ্টি। কড়া গলায় বলল, ওটা লাগবে না, নিয়ে যান। বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন তো? আপনাকে বিশ্বাস নেই…

না, থাক, বাধা দিল কিশোর, নিতে হবে না। কাল এই মাংস কেমিস্টের কাছে নিয়ে যাব পরীক্ষা করাতে। দেখি, কি জিনিস মেশানো আছে ওতে। তারপর পুলিশের কাছে যাওয়ার আরও একটা ছুতো পেয়ে যাব।

একটা কথা বলল না মিসেস টোড। কারও দিকে তাকালও না। নীরবে বাসনটা তুলে নিয়ে চলে গেল।

খাইছে! বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মুসা, কি ভয়ঙ্কর মেয়েমানুষরে বাবা?

মেঘ জমেছে জিনার মুখে। রাফিকে কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, সাংঘাতিক অবস্থা! রাফিকে তো মেরে ফেলবে! কতক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখব!

এই ঘটনা দিল ওদের সন্ধ্যাটাকে মাটি করে। .

খেলা তো নয়ই, আলাপ-আলোচনাও আর তেমন জমল না। হাই তুলল কিশোর। ঘড়ি দেখে বলল, রাত দশটা। বসে থেকে লাভ নেই। ঘুমাতে যাই।

সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করেছে, সাঁতার কেটেছে, হাঁটাহাঁটি করেছে, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল সবাই, এমন কি কিশোরও।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। মনে হলো, কোন একটা শব্দ শুনেছে। সব চুপচাপ। মুসা আর রবিনের নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। কেন ঘুমটা ভাঙল? টোডদের কেউ শব্দ করেছে? না, তাহলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত রাফি। তাহলে?

বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ল জিনার কথা, প্ল্যান করেছে! লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল তার ঘরের দিকে।

দরজা খোলা। জিনা, জিনা বলে ডাকল সে। জবাব নেই। উঁকি দিল ঘরে। খালি ঘর। খুব অল্প পাওয়ারের একটা সবুজ আলো জ্বলছে। জিনাও নেই, রাফিও না।

আবার দৌড়ে ঘরে ফিরে এল কিশোর। ডেকে তুলল মুসা আর রবিনকে।

 ঘুমজড়িত কণ্ঠে মুসা বলল, আবার কি হলো? টোডের মুখে তরকারি ফেলেছ?

জলদি ওঠো! জিনা নেই ঘরে!

গেল কোথায়? লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল রবিন।

সেটা তো আমারও প্রশ্ন। তোমরা এসো। আমি ওর ঘরে গিয়ে খুঁজে দেখি।

সুইচ টিপে উজ্জ্বল আলো জ্বালল কিশোর। বালিশে পিন দিয়ে আটকানো চিঠিটা চোখে পড়ল। তাড়াতাড়ি খুলে আনল সেটা। জিনা লিখেছে?

কিশোর,

রাগ কোরো না। রাফিকে নিয়ে আর ঘরে থাকার সাহস পেলাম না। ওর কিছু হলে যে আমি বাঁচব না তোমরা জানো। মিসেস টোডকে বিশ্বাস নেই। রাফিকে মেরে ফেলবে ও। আমি কয়েক দিনের জন্যে চলে যাচ্ছি, আব্বা আম্মা না এলে ফিরব না। তোমরা কাল বাড়ি চলে যেয়ো। আমাদের বাড়ি পাহারা দেয়ার দরকার নেই। টোডদেরকে যখন এতই বিশ্বাস আব্বার, ওরাই থাকুক, পাহারা দিক। ধ্বংস করে দিক বাড়িঘর, আমার কিছু না। আবার অনুরোধ করছি, রাগ কোরো না।

-জিনা।

ঘরে ঢুকল মুসা ও রবিন।

নীরবে রবিনের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে আনমনে বলল কিশোর, ইস, এরকম কিছু যে করবে আগে ভাবলাম না কেন! নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটতে শুরু করল সে। পুরোদমে চালু হয়ে গেছে মগজ।

চিঠিটা দ্রুত পড়ে ফেলল রবিন। নিজেকেই জিজ্ঞেস করল যেন, কোথায় যেতে পারে?

বিড়বিড় করছে কিশোর, টর্চ…স্পিরিট…দেশলাই… তুড়ি বাজাল দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে। বুঝে গেছি! জলদি এসো আমার সঙ্গে! 

কিছুই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না দু-জনে, করার সময়ও নেই, দরজার কাছে চলে গেছে কিশোর। তার পেছনে ছুটল ওরা।

নিজেদের ঘরে এসে টর্চটা বের করে নিল কিশোর। ছুটল সিঁড়ির দিকে।

বাগানে বেরিয়ে এল ওরা। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু মেঘ জমে আছে এখনও। সহসা কাটবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অন্ধকার রাত।

গেটের দিকে দৌড় দিল কিশোর। তার পাশে ছুটতে ছুটতে মুসা জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেছে?

এখনও বোধহয় যেতে পারেনি। দ্বীপে যাবে ও।

তাহলে আর অসুবিধে কি? যাক না। কাল আমরাও গিয়ে হাজির হব।

ভয় তো সেটা নয়, ভয় হলো অন্ধকারের। সাগরের অবস্থাও ভাল না, বড় বড় ঢেউ। এই ঢেউয়ে দ্বীপে নৌকা ভেড়াবে কি করে সে? ডুবে মরবে।

সৈকতে বেরিয়ে এল ওরা। নৌকাটা কোথায় রাখে জিনা, জানা আছে। সেদিকে তাকাতে টর্চের আলো চোখে পড়ল।

কিছু বলতে হলো না মুসাকে। ভেজা বালি মাড়িয়ে ছুটল। দেখতে দেখতে অনেক পেছনে ফেলে এল কিশোর ও রবিনকে।

জিনা, জিনা, থামো, যেয়ো না! চিৎকার করে বলল সে।

জোরে এক ধাক্কা মেরে নৌকা পানিতে ঠেলে দিল জিনা। ফিরেও তাকাল না। লাফিয়ে উঠে বসল। আগেই চড়ে বসে আছে রাফি। কিশোরদের আসতে দেখে ভাবল, রাতদুপুরে এ-এক মজার খেলা, খেক খেক করে চেঁচাতে শুরু করল।

ঝপাৎ করে পানিতে দাঁড় ফেলল জিনা।

একটুও দ্বিধা করল না মুসা। ড্রেসিংগাউন নিয়েই নেমে পড়ল পানিতে। চিৎকার করে বলছে, জিনা, শোনো, এই অন্ধকারে গেলে মরবে..

না, আমি যাবই। বাড়ি আর যাচ্ছি না, জোরে জোরে দাঁড় বাইতে শুরু করল জিনা।

নৌকার একটা গলুই ধরে ফেলল মুসা। টানতে লাগল। কিশোর আর রবিনও পৌঁছে গেল। ওরাও ধরে ফেলল নৌকাটা।

আর এগোতে পারল না জিনা।

লাফিয়ে নৌকায় উঠে পড়ল মুসা। জিনার হাত থেকে দাঁড় কেড়ে নিল।

আমার সর্বনাশ করে দিলে তোমরা! গুঙিয়ে উঠল জিনা। যা-ই করো, আমি আর ও-বাড়িতে ফিরে যাব না…

শোনো, জিনা,বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর, না যাও, নেই। কিন্তু তোমার প্ল্যানের কথাটা আমাদের বলতে কি অসুবিধে ছিল? আমরা কি বাধা . দিতাম? তুমি যদি বাড়ি ছাড়তে চাও, আমরাও ছাড়ব। দ্বীপেই চলে যাব।

এভাবে তোমার একা একা যাওয়ার চেয়ে, চলো, সবাই মিলেই যাই।

এক মুহূর্ত ভাবল জিনা। বেশ, চলো।

এখন না। এই অন্ধকারে গিয়ে মরার কোন মানে হয় না। কাল যাব আমরা। দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে, তৈরি হয়ে, যাতে আরামে থাকতে পারি। খালি হাতে গিয়ে শুধু শুধু কষ্ট করব কেন?

.

০৮.

টেনে নৌকাটাকে আবার বালিতে তুলল ওরা।

জিনা বলল, কিছু জিনিস আছে। নিয়ে নেব, নাকি নৌকায়ই থাকবে?

টর্চের আলো ফেলল কিশোর। বাহ, অনেক খাবার নিয়েছ তো। রুটি, মাখন, মাংস…টোডদের চোখ এড়িয়ে বের করলে কি করে?

রান্নাঘরে কেউ নেই। টোডও না। বোধহয় সে-ও আজ ওপরতলায় শুতে গেছে।

থাক এগুলো এখানেই। আরও আনতে হবে। অনেক। অন্তত দশদিনের খাবার।

কোথায় পাবে? রবিনের প্রশ্ন। কিনে নেবে?

আর কোন উপায় না থাকলে তাই করতে হবে।

জিনা বলল, আরেক কাজ করতে পারি কিন্তু। আম্মার ঘরে একটা বিশাল আলমারি দেখেছ না? ওটাতে কি আছে জানো? খাবার। সব টিনের খাবার। পর পর দু-বছর শীতকালে সাংঘাতিক অবস্থা হয়েছিল গোবেল বীচে। এমন তুষারপাত শুরু হয়েছিল, লোকে ঘর থেকে বেরোতে পারেনি অনেকদিন। খাবারের এত অভাব হয়ে গিয়েছিল, না খেয়ে থেকেছে অনেকে। তারপর থেকেই সাবধান হয়ে গেছে আম্মা। আলমারিটাতে প্রচুর খাবার জমিয়ে রাখে, যাতে আর বিপদে না পড়তে হয়।

ভেরি গুড, খুশি হয়ে বলল কিশোর, তাহলে তো কোন কথাই নেই। যা যা নেব লিখে রাখব আমরা। কেরিআন্টি এলে বাজার থেকে কিনে এনে আবার ভরে রাখব ওসব জিনিস।

তালা দেয়া দেখেছি, মুসা বলল। চাবি পাবে কোথায়?

আমি জানি আম্মা কোথায় রাখে, জবাব দিল জিনা।

বাড়ি ফিরল ওরা। পা টিপে টিপে চলে এল জিনার মায়ের ঘরে। শব্দ করলে টোডরা উঠে যেতে পারে, তাই রাফিকেও চুপ থাকতে বলে দিল জিনা।

চাবি দিয়ে তালা খুলে আলমারি খুলল সে।

মৃদু শিস দিয়ে উঠল মুসা। পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল, টোডদের কানে শিসের শব্দ চলে যাওয়ার ভয়ে। জেগে উঠলে আবার কোন গণ্ডগোল বাধাবে ওরা, কে জানে।

গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে খাবার। সব টিনে ভর্তি। স্যুপ, মাংস, ফল, দুধ, মাছ, মাখন, বিস্কুট, সব্জি, কিছুরই অভাব নেই।

বড় দেখে দুটো কাপড়ের থলে বের করে আনল জিনা। তাতে খাবার ভরতে শুরু করল সবাই মিলে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল খাবারের, সেটা মিটে যাওয়াতে খুশি হলো কিশোর।

বৃষ্টি হলে গোবেল দ্বীপে খাবারের পানির সাধারণত অভাব হয় না। তবু প্ল্যাস্টিকের কয়েকটা বোতল ভরে বিশুদ্ধ খাবার পানি নিয়ে নেয়া হলো, বাড়তি সাবধানতা।

ভাড়ার থেকে নিয়ে আসা হলো ভেড়ার মাংসের দুটো আস্ত রান। পরিষ্কার কাপড়ে পেচিয়ে নেয়া হলো ওগুলো।

এছাড়া প্রয়োজনীয় আরও অনেক টুকিটাকি জিনিস নিল ওরা; যেমন, মোম, দড়ি, বালিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে সোফার কুশন, বিছানো আর গায়ে দেয়ার জন্যে কম্বল। জিনা মাত্র দুটো দেশলাই কিনেছে, তাতে হবে না, তাই আরও কিছু দেশলাইও নিয়ে নিল কিশোর।

মুসা বলল, সবই তো হলো। আসল জিনিসই বাকি।

কী? জানতে চাইল রবিন। রু

টি।

ও নিয়ে ভাবনা নেই, কিশোর বলল। সকালে বেকারি থেকে নিয়ে নিলেই হবে।

কিন্তু এত সকালে দোকান খুলবে?

না খুললে ঘর থেকে ডেকে বের করে এনে খোলাব, জিনা বলল, অসুবিধে হবে না।

বেঙের গোষ্ঠী যখন দেখবে আমরা নেই, হেসে বলল মুসা, আকাশ থেকে পড়বে। তাজ্জব হয়ে ভাববে, কোথায় উধাও হলাম আমরা। ভয়ও পাবে নিশ্চয়।

উঁহু, ভয় পাওয়ানো চলবে না, কিশোর বলল। ওরা পারকার আংকেলকে বলে দেবে তাহলে। হয়তো ছুটে আসবেন তিনি। আমাদের বাড়ি ফিরতে বাধ্য করবেন।

করলে কি? আমরা না গেলেই হলো।

তার মুখের ওপর না বলতে পারবে না। থাক, এসব নিয়ে ভাবার অনেক সময় আছে। জরুরী কাজটা আগে সারি। অন্ধকার থাকতে থাকতেই মালপত্রগুলো নিয়ে নৌকায় তুলতে হবে।

মালের বোঝার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। এত জিনিস নেব কি করে? নিতে নিতেই ভোর হয়ে যাবে তো। কবার যেতে-আসতে হবে ভেবে দেখেছ?

একমুহূর্ত চিন্তা করে জিনা বলল, ছাউনিতে দুটো ঠেলাগাড়ি আছে আমাদের। একটাতে করেই সব নেয়া যাবে। গাড়িটা আবার জায়গামত রেখে দিয়ে গেলেই হবে।

 গাড়ি বের করা হলো। চাকার অতি মৃদু শক্তও ঠিকই কানে গেল। ডারবির, কিন্তু একবার চাপা গলায় গোওও করে. উঠল শুধু। রাফির ভয়ে জোরে চিৎকার করার সাহস পাচ্ছে না। তার গোঙানিটা মিসেস টোডের কানে গেল না। গভীর ঘুমে অচেতন। নাক ডাকছে জোরে জোরে। জানতেই পারল না, নিচে কি চলছে।

নৌকায় মাল বোঝাই করা হলো। গাড়িটা রেখে দেয়া হলো আবার ছাউনিতে। রাত এখনও বাকি। এত জিনিস এভাবে নৌকায় ফেলে সবার চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে মুসাকে পাহারায় থাকতে বলল কিশোর।

মুসারও আপত্তি নেই। কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল নৌকার পাটাতনে।

সব নেয়া হয়েছে তো? প্রয়োজনীয় কিছু নেয়া বাকি আছে কিনা দেখছে কিশোর। নাহ্, হয়েছে…ওহহো, আসল জিনিসটাই তো ভুলে গেছি, টিন ওপেনার। টিনের মুখ কাটব কি দিয়ে?

রাফির জন্যে একব্যাগ ডগ-বিস্কুটও নিতে হবে, জিনা বলল।

তা নেয়া যাবে। মুসা, চলি। আরামসে ঘুমাও। ভোরেই চলে আসব আমরা।

বাড়ি রওনা হয়ে গেল কিশোররা, সঙ্গে গেল রাফি।

সাগরের পাড়ে বেশ ঠাণ্ডা, শীত লাগে। কম্বল মুড়ি দিয়ে আকাশের তারা গুণতে লাগল মুসা। কখন জড়িয়ে এল চোখ, বলতে পারবে না।

.

হাঁটতে হাঁটতে কিশোর বলল, সকাল আটটায় একটা ট্রেন আছে। রেলওয়ের একটা টাইম-টেবল নিয়ে ডাইনিং টেবিলে খুলে ফেলে রাখব। টোডদের। দেখিয়ে দেখিয়ে চলে যাব স্টেশনের দিকে। তারপর ঘুরে আরেক দিক দিয়ে গিয়ে উঠব নৌকায়।

ওরা ভাববে আমরা রকি বীচে ফিরে গেছি, হেসে বলল রবিন। কল্পনাই করবে না, খাবার-দাবার নিয়ে দ্বীপে চলে গেছি পিকনিক করার জন্যে।

চমৎকার বুদ্ধি, জিনা বলল, এতে খানিকটা দুশ্চিন্তায়ও থাকবে ওরা। পুলিশকে ভয় পায়, ওদের সাহায্য নিতে পারবে না। আব্বাকেও কিছু বোঝাতে পারবে না। বোরতে গেলেই তো নিজেদের শয়তানির কথা ফাঁস। করতে হবে। কিন্তু দশদিনের আগেই যদি আব্বা-আম্মা চলে আসে, জানব কি করে?

তা-ও তো কথা, কিশোর বলল। এখানে এমন কেউ আছে, যাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলে যেতে পারো?

একমুহূর্ত ভাবল জিনা। আছে। ফগ। ওই যে, সেই জেলের ছেলেটা, যার কাছে রাফিকে লুকিয়ে রেখেছিলাম…

হ্যাঁ, মনে আছে। তাহলে তাকে বলে যেতে হবে।

বাড়ি ফিরে মায়ের লেখার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা টাইম-টেবল বের করে আনল জিনা।

কোন ট্রেনটায় যাচ্ছে ওরা, মোটা করে তার নিচে দাগ দিয়ে রাখল কিশোর। বইটা খোলা রেখেই উপুড় করে ফেলে রাখল টেবিলে।

এরপর একটা টিন ওপেনার বের করে পকেটে ভরল কিশোর।

শেষ হয়ে আসছে রাত। ঘুমানোর আর সময় নেই। বসার ঘরেই বসে রইল ওরা।

.

ফর্সা হয়ে এল পুবের আকাশ। সোনালি রোদ এসে পড়ল বাগানে।

এত সকালে কি বেকারি খুলবে, জিনা? জানতে চাইল কিশোর।

ছটা তো বাজে। চলো, গিয়ে দেখি।

দোকান খোলেনি রুটিওয়ালা। সামনের রাস্তায় পায়চারি করছে। ছেলেমেয়েদের চেনে। হেসে জিজ্ঞেস করল, এত সকালে এদিকে? কি ব্যাপার?

রুটি লাগবে, জিনা বলল।

ক’টা?

ছটা। বড় দেখে।

এত রুটি! কি করবে?

 খাব, হেসে জবাব দিল জিনা।

অবাক হলেও আর কিছু বলল না রুটিওয়ালা। দিয়ে দিল।

দোকান খুলে সবে ঝাড়পোছ করছে এক মুদী। তার কাছ থেকে একব্যাগ কুকুরের বিস্কুট কিনল জিনা।

জিনিসগুলো নৌকায় রাখতে চলল ওরা।

কম্বল মুড়ি দিয়ে কুঁকড়ি-বুকড়ি হয়ে তখনও ঘুমাচ্ছে মুসা।

ডাক দিল রবিন, এই মুসা, ওঠো। আরামেই আছো দেখি…

আরাম আর কই, হাই তুলতে তুলতে জবাব দিল মুসা, উফ, শীতে মরে গেছি।

কিশোর বলল, এত মালপত্রসহ নৌকাটা এখানে থাকলে লোকের চোখে পড়ে যাবে। জিনা, কি করা যায়? এটাকে লুকাতে হবে।

হাত তুলে একদিক দেখিয়ে জিনা বলল, ওদিকে একটা সরু খালমত আছে, একটা গুহার ভেতরে ঢুকেছে। গুহাটাতে লুকানো যেতে পারে। মুসা, বেয়ে নিয়ে যেতে পারবে?

আশা তো করি।

তাহলে যাও, কিশোর বলল।

 খিদে পেয়েছে। কিছু খেয়ে নিলে কেমন হয়?

খিদে পেলে খাবে। খাবারের কি অভাব আছে নাকি? আগে নৌকাটা। এখান থেকে সরাও, তারপর খেয়ো।

তোমরা খাবে না?

পরে এসে। আগে কাজ সেরে নিই।

 সবাই মিলে ঠেলে নৌকাটা পানিতে নামাল। দাঁড় তুলে নিল মুসা।

বাড়ি ফিরে এল কিশোররা। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল। টোডরা কেউ ঢুকতে দেখল না ওদের।

ওপরতলায় উঠে জোরে জোরে কথা বলতে লাগল, নানা রকম শব্দ শুরু করল, যেন এইমাত্র উঠল ঘুম থেকে। হুড়ুম-ধাড়ুম করে নামল নিচতলায়। বাগানে বেরিয়ে গেটের দিকে এগোল।

রান্নাঘরের জানালার দিকে তাকাল রবিন। নিচু স্বরে বলল, বেঙাচিটা চেয়ে আছে।

থাকুক, কিশোর বলল। দেখুক, আমরা কোনদিকে যাচ্ছি।

গেট খুলে বেরিয়ে এল ওরা।

০৯.

শান্ত সাগর। এই আবহাওয়ায় রাত থাকতেই মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে জেলেরা। সুতরাং পরিচিত কোন জেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয় নেই। হলোও না। গোবেল দ্বীপের যে প্রাকৃতিক বন্দরটা আছে, প্রণালী দিয়ে ঢুকতে হয়, নিরাপদেই তাতে নৌকা নিয়ে এল ওরা।

টেনে নৌকাটাকে তুলে আনল সৈকতের অনেক ওপরে। ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে। এখানকার সাগরে যখন-তখন ঝড় ওঠে, কোন ঠিকঠিকানা নেই। আর সে ঝড়ও যে-সে ঝড় নয়, ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়ে যায় সাগরের।

দাড় টেনে টেনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মুসা ও জিনা। মসৃণ সাদা বালিতে হাত-পা ছড়িয়ে প্রায় শুয়েই পড়ল।

শুয়ে পড়লে যে, রবিন বলল।

কি করব? পাথরের টিলায় বসা একটা সীগালের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।

খাওয়া লাগবে না? তোমার তো পেট ভরা, কিন্তু আমরা এখনও নাস্তাই করিনি।

আমিও খাইনি। ভাবলাম, একবারেই খাব।

 টিন ওপেনার বের করে খাবারের টিন কাটতে বসল কিশোর।

ঘেউ ঘেউ করে একটা খরগোশকে তাড়া করে গেল রাফি। ধমক দিয়ে তাকে ডেকে ফিরিয়ে আনল জিনা। চুরি,

আহ, হাত-পা টানটান করতে করতে বলল কিশোর, মনে হচ্ছে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলাম।

আমারও সে-রকমই লাগছে, রবিন বলল। আসলে, খারাপ মানুষের সঙ্গে বাস করা যায় না।

তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে হবে।

কেন, তাড়াতাড়ি কেন? ভুরু নাচাল মুসা, কি কাজ আছে আমাদের? সময় তো অফুরন্ত।

অনেক কাজ। প্রথমেই রাতে থাকার একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তো আর বাইরে থাকা যাবে না। সেখানে সরিয়ে রাখতে হবে মালপত্রগুলো। তারপর আমরা ঝাড়া হাত-পা। চুটিয়ে আনন্দ করব তখন।

রুটি, মাখন, ঠাণ্ডা মাংস, টমেটো আর কেক দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। তারপর রওনা হলো দুর্গে।

প্রথমবার এসে যেখানে রাত কাটিয়েছিল, সে জায়গাটা এবার আর পছন্দ করতে পারল না কিশোর। দেয়াল আরও অনেকখানি ধসে পড়েছে, ছাত প্রায়। নেই বললেই চলে। এখানে থাকা যাবে না।

জিনা প্রস্তাব দিল, পাতালঘরে থাকলে কেমন হয়?

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাল মুসা, ওই অন্ধকারে! আমি বাপু এর মধ্যে নেই। ভূতের আড্ডায় কে যায়…

মুসার কথা কানে তুলল না কিশোর, আর কোন জায়গা না পেলে থাকতেই হবে ওখানে। তবে খুব গরম লাগবে।

কথা বলতে বলতে দুৰ্গটার একধারে পাথরের চত্বরে এসে দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে সাগর দেখা যায়।

হাত তুলে জিনা দেখাল, ওই দেখো, আমাদের জাহাজটা।

দেখল তিন গোয়েন্দা। ঝড়ে ভেসে উঠেছিল যেটা। একটা নকশা পেয়েছিল ওরা, খুঁজে বের করেছিল সোনার বার।

পাথরের খাঁজে আটকে রয়েছে জাহাজটা, বড় বড় ঢেউও সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।

এক কাজ করলে কেমন হয়! ওটার দিকে তাকিয়ে চোখ চকচক করে উঠল কিশোরের। ওটাতেই গিয়ে থাকি না কেন? চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হবে..

খাইছে, বলে কি! আঁতকে উঠল মুসা। পোড়ো জাহাজে বাসা! ও তো মেছো ভূতের আড্ডা! জলদস্যুরা মরে গিয়ে সব ভূত হয়ে ওতে বাসা বেঁধেছে।

দেখো মুসা, তোমার এই ভূতের কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। আর ভাল্লাগে না। দয়া করে ভূতটুতগুলোকে মাথা থেকে একটু বের করো।…এই, চলো সবাই। দেখে আসি জাহাজটা।

কিছুদূর এগিয়েই থমকে দাঁড়াল জিনা।

 কি হলো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ওই যে কুয়াটা!

সেদিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। জানে ওরা, এই কুয়া নেমে গেছে অনেক নিচে, সাগর সমতলেরও নিচে, মিষ্টি পানি আছে ওটাতে। লোহার আঙটা বেয়ে নিচে নামা যায়। বেশ কিছুটা নামার পর একটা ফোকর আছে, ওটা দিয়ে ঢোকা যায় পাতালঘরে।

চমকালে কি দেখে? বুঝতে পারছে না মুসা।

দেখছ না, কুয়ার মুখের কাঠের ঢাকনাটা সরানো?

তাতে কি?

কে সরাল? আমি তো সরাইনি। নিশ্চয় কারও পানি খাওয়ার দরকার হয়েছিল!

কত লোক আছে এ কাজ করার ব্যাপারটাকে গুরুত্বই দিল না মুসা। আমরা সোনার বারগুলো খুঁজে পাওয়ার পর তো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল দ্বীপটা। নিশ্চয় লোকে দেখতে এসেছে। তাদেরই কেউ করেছে একাজ।

সেটা তো অনেক আগের কথা, রবিন বলল। জিনা, তারপর কি আর দ্বীপে এসেছ তুমি?

কতবার? সে জন্যেই তো বলছি…আরে, এই ঢাকনাটাও তো সরানো!

কোথায়? এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিশোর। জিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে সে-ও দেখে ফেলল। দুর্গের নিচে পাতালঘরে নামার একটা সিঁড়ি আছে, কুয়ার মুখের মতই সিঁড়ির গর্তের মুখটাও ঢাকা থাকে ঢাকনা দিয়ে। সেটা সরানো। অর্ধেক বেরিয়ে আছে গর্তের মুখ।

আমার দ্বীপে আমার অনুমতি ছাড়া নামে কার এতবড় সাহস! জিনিস উলট-পালট করে! ধরতে পারলে…

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, আচ্ছা, সেদিন যে ধোঁয়া দেখলাম, এসব তার জবাব নয় তো?

কৃত্রিম হতাশায় মাথা নাড়ল মুসা, এই তো, শুরু করল গ্রীক ভাষা!

খালি কথা ভুলে যাও, সেজন্যেই তো এত কঠিন লাগে। সেদিন যাকে আমরা স্টীমারের ধোঁয়া ভেবেছি সেটা হয়তো ক্যাম্পফায়ারের ধোঁয়া। দ্বীপে নেমে আগুন জ্বেলেছিল কেউ।

কিশোরের সন্দেহই যে ঠিক, তার আরও প্রমাণ মিলল। একজায়গায় পাওয়া গেল আগুন জ্বালানোর চিহ্ন। রান্না করে খেয়েছে কেউ। একটা সিগারেটের গোড়াও পড়ে আছে। দিন কয়েকের মধ্যে যে কেউ দ্বীপে উঠেছিল, তাতে আর সন্দেহ রইল না কারও।

তবে ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাল না তিন গোয়েন্দা। নির্জন দ্বীপ, যে কেউ উঠতে পারে এখানে, পিকনিক করার জন্যেও আসতে পারে। জিনা তো আর পাহারা দিয়ে রাখে না।

কিন্তু জিনা এত সহজে মেনে নিতে পারল না, ফুসতে লাগল, তাকে না বলে তার দ্বীপে লোকটা উঠেছিল বলে।

ভাটার সময় এখন। পানি নেমে যাওয়ায় মাথা উঁচু করে রয়েছে অসংখ্য পাথর। একটা থেকে আরেকটায় লাফিয়ে লাফিয়ে জাহাজটার কাছে পৌঁছানো যাবে।

তবে কাজটা মোটেও সহজ নয়। ক্রমাগত ভিজে ভিজে, শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে পাথরগুলো। পা পিছালানোর সম্ভাবনা প্রচুর।

খুব সাবধানে এগোল ওরা। নিরাপদেই এসে পৌঁছল জাহাজের পাশে। দূর থেকে যতটা মনে হয়, কাছে এলে তার চেয়ে অনেক বেশি বড় লাগে ওটা। আগের বার যেমন দেখেছিল, প্রায় তেমনি আছে, খুব একটা বদলায়নি। নিচের দিকটা পানিতে তলিয়ে আছে। শ্যাওলায় ঢাকা। কাঠ আঁকড়ে রয়েছে নানা রকম শামুক-গুগলি। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে জাহাজের গা থেকে। ( সঙ্গে করে দড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। বার তিনেক চেষ্টা করে জাহাজের ভাঙা মাস্তুলের গোড়ায় দড়ির ফাঁস আটকে ফেলল মুসা। দড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে।

একে একে উঠে এল অন্য তিনজন। রাফিকে কিনারে রেখে আসা হয়েছে। চুপচাপ থাকতে নির্দেশ দিয়েছে তাকে জিনা। এদিকেই তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে সে, আসতে পারেনি বলে মন খারাপ।

আগের চেয়ে করুণ অবস্থা জাহাজটার। ফোকরের সংখ্যা বেড়েছে। গন্ধও যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি। হাত নেড়ে রবিন বলল, অসম্ভব! এখানে বাস করা যাবে না। নিচেই নামব না আমি।

 জলজ প্রাণী, শ্যাওলা আর কাঠ পচে হয়েছে এই ভয়াবহ গন্ধ। নিঃশ্বাস নিতেই যেন কষ্ট হয়।

কিশোর বলল, এসেছি যখন না দেখে যাব না। তোমার সহ্য না হলে। এখানেই থাকো। আমরা নেমে দেখে আসি।

 এখানে যে থাকা যাবে না, বোঝা হয়ে গেছে। তবু পুরানো স্মৃতির আকর্ষণই যেন নিচে টেনে নামাল কিশোরকে। ক্যাপ্টেনের ঘরটা সবচেয়ে। বড়। তবে তাতে ঘুমানো তো দূরের কথা, জিনিসপত্র রাখারও প্রশ্ন ওঠে না। পুরো জায়গাটাই দুর্গন্ধে ভরা, ভেজা ভেজা। কাঠ এত পিচ্ছিল হয়ে আছে কোথাও কোথাও, পা রাখাই মুশকিল।

চলো, যাইগে, মুসা বলল। ইকটুও ভাল লাগছে না।

মই বেয়ে ওপরে উঠছে ওরা, এই সময় কানে এল রবিনের চিৎকার, কিশোর, দেখে যাও, দেখে যাও!

তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরেকটু হলেই পিছলে পড়ে হাঁটু ভাঙত মুসা। ডেকে উঠে এল সবার আগে। কি হয়েছে? কি দেখেছ?

চোখ চকচক করছে রবিনের। হাত তুলে দেখাল। আগের বার যখন এসেছিলাম, ওটা ছিল না!

ডেকের একধারে একটা লকার, হাঁ হয়ে খুলে আছে। তার মধ্যে একটা কালো ট্রাংক।

 তাই তো? রবিনের মতই অবাক হয়েছে কিশোর। আগের বার তো, এটা ছিল না! একেবারে নতুন জিনিস! কে রেখে গেল? কি আছে এর মধ্যে?

ডেকও পিচ্ছিল। সাবধানে লকারটার দিকে এগোল ওরা। দরজাটা বন্ধই থাকার কথা, কিন্তু বাতাসেই হোক, কিংবা ঢেউয়ের দোলায়ই হোক, খুলে গেছে।

ট্রাংকটা ছোট। বের করে আনল কিশোর।

ওখানে এই জিনিস রাখতে গেল কে? মুসার প্রশ্ন। চোর-ডাকাত নয় তো? স্মাগলার?

হতে পারে, ট্রাংকটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। চোরাই মাল লুকানোর দারুণ জায়গা এই জাহাজ। কেউ আসে না এখানে। হঠাৎ করে দেখে ফেলারও ভয় নেই।

যদিও আমরা দেখে ফেললাম, জিনা বলল।

আমাদের মত তো আর ছোঁক ছোঁক করে না কেউ, মুসা বলল।

 কি আছে ভেতরে? ঝুঁকে ট্রাংকটার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। এই কিশোর, কোকেন-টোকেন নয় তো? স্মাগল করে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছে।

দুটো নতুন তালা লাগানো রয়েছে। চাবি ছাড়া খোলা যাবে না।

ভেঙে ফেললেই হয়, জিনা বলল।

না। এটার কথা যে আর গোপন নেই, তালা ভাঙা দেখলেই বুঝে যাবে। চোরই হোক, আর চোরাচালানিই হোক, তাকে বুঝতে দেব না যে আমরা দেখে ফেলেছি।

ধরার ইচ্ছে?

নয় কেন? নিজেকেই যেন বোঝাচ্ছে কিশোর, আমরা যে দ্বীপে উঠেছি, কেউ জানে না। লুকিয়ে থেকে চোখ রাখব। কোনও বোট আসে কিনা দেখব।

মন্দ হয় না, মুসা বলল। একটা কাজ পেয়ে গেলাম। একঘেয়ে লাগবে আর এখানে

এমনিতেও লাগত না, বাধা দিয়ে বলল জিনা।

এখন আরও বেশি লাগবে না।

সাগরের দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল কিশোর, জোয়ার আসছে! জলদি নেমে যাওয়া দরকার।

ট্রাংকটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিল সে।

সমস্যা কিন্তু একটা হবে, রবিন বলল। দড়িটা রেখে যেতে হবে আমাদের। লোকটা এসে এই দড়ি দেখলেই তো বুঝে যাবে, কেউ উঠেছিল।

ভাল কথা মনে করেছ! ঘুরে তার দিকে তাকাল কিশোর, কি করা যায়?

সমাধান করে দিল মুসা, তোমরা নেমে যাও। দড়িটা খুলে নিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ব আমি।

না না, পা ভাঙবে।

 ভুলে যাচ্ছ কেন, আমি মুসা আমান। টারজানের চেয়ে কম যাই কিসে? নামো তোমরা।

আর কিসে কম যাও বলতে পারব না, তবে খাওয়ার ব্যাপারে যে যাও না, গলাবাজি করে বলতে পারব, হেসে বলল রবিন।

অন্যেরাও হাসল।

টারজানের চেয়ে কম যে যায় না, প্রমাণ করে ছেড়ে দিল মুসা। সবাই নেমে যেতেই মাস্তুলের গোড়া থেকে দড়িটা খুলে নিল। সেটা কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে জাহাজের কিনার ধরে ঝুলে পড়ল। নিচে ওখানটায় পাথর আছে কিনা দেখে নিয়েছে আগেই। আলগোছে ছেড়ে দিল হাতটা। ঝপ করে পড়ল পানিতে। পানি ওখানে নেহায়েত কম নয়, পাথরও নেই, কিছুই হলো না ওর।

এবারও নিরাপদেই কিনারে ফিরে এল সবাই। পিছলে পড়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটাল না।

এতক্ষণ একা বসে থেকে অস্থির হয়ে পড়েছিল বেচারা রাফি। আনন্দে হাত চেটে দিতে লাগল সবার।

কিশোর বলল, জাহাজে তো জায়গা হলো না, রাতে থাকি কোথায় বলো তো? জিনা, তোমার কোন জায়গা জানা আছে? গুহাটুহা হলে ভাল হত,..,

আছে! তুড়ি বাজাল জিনা। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চেহারা। এসো আমার সঙ্গে।

.

একটা পাহাড়ের কাছে ওদেরকে নিয়ে এল জিনা। ঢালে ঝোপঝাড় যেমন ঘন, পাথরেরও ছড়াছড়ি। হাত তুলে দেখাল, ওই যে।

কিছুই দেখতে পেল না তিন গোয়েন্দা।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কই?

ওই তো। চলো, আরও কাছে, তাহলেই দেখবে।

ঝোপঝাড় আর লতায় প্রায় ঢাকা পড়ে আছে গুহামুখটা। এখানে আছে ওটা জানা না থাকলে চোখেই পড়ে না।

আগে আগে ঢুকল জিনা। পেছনে অন্যেরা।

খাইছে! ঢুকেই বলে উঠল মুসা, দারুণ তো!

গুহার ভেতরটা আসলেও সুন্দর। সাদা পাউডারের মত মিহি, শুকনো বালিতে ঢাকা মেঝে। সমুদ্র সমতল থেকে অনেক ওপরে, সাংঘাতিক জলোচ্ছাসের সময়ও এখানে পানি ঢোকে কিনা সন্দেহ। একধারের দেয়ালে একটা তাকমত রয়েছে।

বাহ, খুশি হয়ে বলল রবিন, এক্কেবারে যেন আমাদের জন্যে বানিয়ে রাখা হয়েছে। জিনিসপত্র রাখতে পারব ওটাতে। কিশোর, ওই দেখো, স্কাইলাইটও আছে।

গুহাটা অনেক বড়। ছাতের একধারে একটা ফোকর। আলো আসছে সে পথে। ফোকর দিয়ে বৃষ্টির পানি গুহায় ঢোকে, তবে সরাসরি মেঝেতে না পরে দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে চলে যায় একটা গর্তের দিকে। দীর্ঘদিন পানি পড়ে পড়েই বোধহয় তৈরি হয়েছে গর্তটা। নিশ্চয় নালাও আছে পাহাড়ের ভেতরে।

কিশোর বলল, নৌকা থেকে আমাদের জিনিসগুলো এনে দড়িতে বেধে ওখান দিয়ে নামিয়ে দেয়াটা সহজ হবে, বার বার পাহাড়ের খাড়া দেয়াল। বাইতে হবে না আর। যে দিক দিয়ে ঢুকেছে সে পথটা দেখিয়ে বলল, সৈকত থেকে এ পথ দিয়ে আসা কঠিন।

গুহা থেকে বেরিয়ে প্রায় খাড়া দেয়াল বেয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। ওরা। প্রথম কাজ, বাইরে থেকে স্কাইলাইটের ফোকরটা খুঁজে বের করা।

ঢাল বেয়ে উঠতে সবচেয়ে অসুবিধে হলো রাফির। মানুষের মত হাত নেই তার, ঝোপ কিংবা লতা ধরে যে পতন ঠেকাবে, সে উপায়ও নেই। হড়হড় করে পিছলে পড়ে যেতে চায়। হাস্যকর ভঙ্গিতে শরীরটাকে বাকিয়ে নখ দিয়ে মাটি খামচে ধরে উঠতে লাগল সে।

ওপরে উঠে এল ওরা। ফোকরটা কোনখানে, মোটামুটি আন্দাজ থাকায় খুঁজে বের করা কঠিন হলো না। জানা না থাকলে গুহামুখের মতই এটাও সহজে দেখতে পেত না। এক ধরনের কাঁটাঝোপে ঢেকে রেখেছে।

কাঁটাডাল সরিয়ে নিচে উঁকি দিল কিশোর। ফোকরটা একটা সুড়ঙ্গমুখ। মাত্র কয়েক ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ, ওপর থেকে মোটা একটা পাইপের মত নেমে গেছে ঢালু হয়ে। গুহার ছাতে গিয়ে শেষ হয়েছে। দেখেটেখে মাথা দুলিয়ে বলল, হুঁ, বেশি নিচে না। কিন্তু বিপজ্জনক। না দেখে এই গর্তে পা দিলে নিচে পড়ে হাত-পা ভাঙতে পারে।

সবাই মিলে গর্তের মুখের কাছের ঝোপ আর লতা পরিষ্কার করে ফেলল। কাঁটার আঁচড় লাগল হাতে।

নিচের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, দড়ি ছাড়াও কিন্তু লাফিয়ে নামা যায়।

দরকারটা কি ঝুঁকি নেয়ার, কিশোর বলল। চলো, মালগুলো নিয়ে আসি।

সৈকতে চলে এল ওরা। যে যতটা পারল, জিনিসপত্র হাতে তুলে নিল। নিয়ে এল ফোকরের কাছে। সেগুলো রেখে আরও মাল আনতে ফিরে গেল। এভাবে কয়েকবারে সমস্ত মাল এনে জমা করল একজায়গায়। এইবার নিচে নামানোর পালা।

লম্বা একটা দড়িতে এক ফুট পর পর গিট দিল কিশোর। দড়ির একমাথা বাধল একটা বড় ঝোপের গোড়ায়। গাছটার শেকড় অনেক গভীরে, ভার রাখতে পারবে। দড়ি বেয়ে নেমে যেতে বলল জিনা আর রবিনকে। ওপর থেকে সে আর মুসা দড়িতে মাল বেধে নামিয়ে দেবে, নিচে থেকে ওরা দু জনে খুলে নেবে। তারপর আবার মাল পাঠানো হবে।

নেমে গেল রবিন ও জিনা। দড়িতে গিট থাকায় সুবিধে হলো, হাত পিছলে গেল না।

মাল নামানোটা আরও সহজ কাজ।

সমস্যা হলো রাফিকে নিয়ে।

মুসা জিজ্ঞেস করল, ওকে নামাব কি ভাবে?

বেঁধে নামাতে হবে, আর তো কোন উপায় দেখি না।

তবে সমস্যার সমাধান রাফি নিজেই করে দিল। হঠাৎ ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল একটা খরগোশ। কুকুরটাকে দেখে ভয় পেয়ে বিরাট লাফ দিয়ে ফোকর পেরিয়ে চলে গেল অন্যপাশে।

তাড়া করল রাফি। উত্তেজিত না হলে, সাবধান থাকলে সে-ও ফোকরটা পেরিয়ে যেতে পারত, কিন্তু তাড়াহুড়োয় কোন কিছু খেয়াল না করে লাফ দিয়ে বসল, পড়ল একেবারে ফোকরে। নিমেষে ঢালু সুড়ঙ্গ গলে পিছলে নেমে গেল নিচে। ধপ করে পড়ল মেঝেতে।

ওপর থেকে জিনার তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল মুসা আর কিশোর।

রাফির কিছু হয়েছে কিনা দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি দড়ি বেয়ে নেমে গেল মুসা।

তার পেছনেই নামল কিশোর।

রাফির কিছু হয়নি দেখে হাঁপ ছাড়ল। মিহি নরম বালি বাঁচিয়ে দিয়েছে কুকুরটাকে। হাড়টাড় ভাঙেনি।

প্রচুর পরিশ্রম করেছে। খিদে পেয়েছে সবারই। খাবারের টিন খুলে খেতে বসে গেল ওরা।

পেট কিছুটা শান্ত হয়ে এলে কিশোর বলল, কাজ কিন্তু আরও আছে। বিছানার জন্যে লতাপাতা জোগাড় করে আনতে হবে।

মুসা বলল, কি দরকার কষ্ট করার। যা মিহি আর নরম বালি, এর ওপরই কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ব।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সবাই ক্লান্ত। গুহা থেকে এখন আর বেরোতে ইচ্ছে করল না কারও।

মোম জ্বালল রবিন। গুহার দেয়ালে ছায়ার নাচন। কেমন রহস্যময় হয়ে উঠল গুহার পরিবেশ।

আরও কিছুক্ষণ জেগে রইল ওরা। কম্বলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্পগুজব করল। ঘুমে কখন জড়িয়ে এল চোখ, বলতে পারবে না।

গলে গলে শেষ হলো মোম, নিভে গেল আলো; কেউ দেখল না সেটা একমাত্র রাফি ছাড়া…।

.

১০.

পরের দিনটাও যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। হেসেখেলে, সাঁতার কেটে, আর দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দিল ওরা। সঙ্গে খাবার নিয়ে বেরিয়েছিল, ফলে আর একবারও গুহায় ঢোকার প্রয়োজন বোধ করেনি। ঢুকল একেবারে সন্ধ্যাবেলায়। মোম জ্বেলে খাওয়া সারল।

দেয়ালে ছায়া নাচছে। সেদিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিল মুসার। বলল, আগুন জ্বলতে পারলে ভাল হত। আলো আরও বেশি পেতাম…

হেসে ফেলল রবিন, ভুতের ভয় পাচ্ছ তো? আগুনে আলো বেশি পাবে বটে, কিন্তু গরম হয়ে যাবে গুহার ভেতর। ধোঁয়ায় যাবে দম আটকে। বেরোনোর তো পথ নেই।

আছে, ওপর দিকে আঙুল তুলল মুসা। ফোকরটা চিমনির কাজ করবে।

তা করবে, কিশোর বলল, কিন্তু বাইরে থেকে ধোঁয়া দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। স্মাগলারদের চোখে পড়ে যেতে পারে। ভুলে যাচ্ছ কেন, আমরা এখানে লুকিয়ে আছি। এমন কিছু করা চলবে না, যাতে ওদের চোখে পড়ে যাই।

আগুন জ্বালানো আর হলো না। আগের দিনের মতই গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। জেগে রইল কেবল রাফি। কান খাড়া।

হঠাৎ গরগর করে উঠল।

ঘুম ভেঙে গেল পাশে শোয়া জিনার। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, রাফি, কি হয়েছে?

রবিনও জেগে গেছে। মুসা আর কিশোর অনেকটা দূরে, তাই রাফির চাপা গরগর ওদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি।

নিচু স্বরে রবিন বলল, মনে হয় স্মাগলাররা এসেছে!

চলো, দেখি!

চলো।

দড়িটা বাঁধাই আছে, ঝুলে আছে ফোকর থেকে। সেটা বেয়ে প্রথমে উঠে এল রবিন। সাবধানে মাথা বের করল ফোকরের বাইরে। শরীরটা বের করার আগে উঁকি দিয়ে দেখে নিল কিছু আছে কিনা।

রাফিকে চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে তার পেছনে উঠল জিনা।

সাগরের দিকে তাকাল ওরা। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত। চাঁদ ওঠেনি এখনও। কোন জাহাজ চোখে পড়ল না। এমন কি ভাঙা জাহাজটাও না।

চাঁদ থাকলে ভাল হত, রবিন বলল।

নেই যখন, কি আর করা।

হঠাৎ রবিনের চোখে পড়ল আলোটা। দেখেছ!

হ্যাঁ। উত্তেজিত হয়ে বলল জিনা, ভাঙা জাহাজটার কাছ থেকে আসছে! কেউ উঠেছে ওটাতে! হ্যারিকেনের আলো!

স্মাগলারই! আরও মাল এনে লুকাচ্ছে।

কিংবা ট্রাংকটা নিতে এসেছে।…দেখো, নড়ছে আলোটা। নৌকা নিয়ে এসেছে ওরা। জাহাজের গায়ে বেঁধে রেখে উঠেছে।

যতটা সম্ভব কান খাড়া করে রেখেছে দু-জনে, শব্দ শোনার আশায়। কিছুই শুনল না। জাহাজটা অনেক দূরে।

 কয়েক মিনিট পর নিভে গেল আলো।

দাঁড়ের শব্দ শোনার অপেক্ষায় রইল ওরা। কিন্তু ঢেউয়ের একটানা শব্দের জন্যে আর কিছুই কানে ঢুকল না।

আরও মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে নেমে চলে এল ওরা। কিশোর আর মুসা ঘুমিয়েই আছে। খবরটা ওরা জানল পরদিন সকালে।

আমাদের ডাকলে না কেন? অনুযোগের সুরে বলল মুসা।

তেমন কিছু তো আর দেখিনি, জিনা বলল, শুধু হ্যারিকেনের আলো। এটা দেখানোর জন্যে আর কি ডাকব। ভাবলাম, ঘুমিয়ে আছ, থাকো।

তারমানেই মানুষ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। খেয়ে নাও। দেখতে যাব।

ভাটার সময় জাহাজটা দেখতে চলল ওরা। আগের বারের মতই পিচ্ছিল পাথর টপকে টপকে এসে দাঁড়াল জাহাজের ধারে। দড়ির সাহায্যে ডেকে উঠল।

লকারের দরজাটা বাতাসে আপনাআপনি খুলে যায় বলে ফাঁকে একটা কাঠের গোজ ঢুকিয়ে দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

গোঁজটা খুলে নিল কিশোর। দরজা খুলতে অসুবিধে হলো না।

পিচ্ছিল ডেকের ওপর সাবধানে পা ফেলে এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করল জিনা, ট্রাংকটা আছে?

আছে। অবাক কাণ্ড! আরও কি সব রেখে গেছে, দেখো! খাবারের টিন, কাপ, প্লেট, মোমবাতি, হ্যারিকেন, কম্বল, আমাদের মতই যেন দ্বীপে বাস করতে এসেছে কেউ! বার দুই ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। নিশ্চয় কেউ থাকতে এসেছে। চোরাই মাল আসার অপেক্ষায় থাকবে বোধহয়। দিন-রাত নজর রাখতে হবে আমাদের।

উত্তেজিত হয়ে জাহাজ থেকে নেমে এল ওরা। লুকিয়ে থেকে বাস করার চমৎকার একটা জায়গা পেয়ে গেছে বলে খুশি। এখানে থাকলে ওরা কারও চোখে পড়বে না, কিন্তু কেউ এলে ওদের চোখে ঠিকই পড়বে।

নৌকাটা লুকিয়ে ফেলতে হবে! হঠাৎ বলে উঠল জিনা। ও পথে ঢোকার সম্ভাবনাই বেশি। জাহাজটার এদিক দিয়ে ঢোকা ডেঞ্জারাস। বোকা না হলে এদিক দিয়ে দ্বীপে ওঠার কথা ভাববে না কেউ।

ভাববে, দক্ষ নাবিক হলে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। সামান্য একটু সরে গেলেই নৌকা ভেড়াতে পারবে।

কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার দরকার কি? মুসা বলল, নৌকাটা লুকিয়ে ফেলাই ভাল। চলো, এক্ষুণি।

কিন্তু লুকাব কোথায়? রবিনের প্রশ্ন, এতবড় একটা নৌকা?

জানি না, চিন্তায় পড়ে গেছে কিশোর। চলো আগে, যাই।–এখানে বসে কিছু বোঝা যাবে না।

দল বেধে সৈকতে চলে এল ওরা। সাগর থেকে এসে প্রণালীটা যেখানে খাঁড়িতে ঢুকেছে, তার একধারে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট গুহা আছে। সব সময় পানি থাকে। সেটা দেখিয়ে জিনা বলল, এর মধ্যে লুকানো যেতে পারে। ভেতরে অনেক বড় একটা পাথরের চাঙড় আছে। তার ওপাশে রাখলে সহজে চোখে পড়বে না। তবে ঝড় এলে, পানি ফেপে উঠলে আছাড় মেরে চুরমার করে দিতে পারে নৌকাটা।

 ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগল সবাই। কিন্তু আর কোন উপায়ই দেখল

 শেষে ওই গুহাতেই নৌকা ঢোকানো হলো। চাঙড়ের ওপাশে নেয়ার পরও পুরোটা আড়াল হলো না নৌকার। উজ্জ্বল লাল রঙের জন্যে হয়েছে বিপদ। তবে এই সমস্যারও সমাধান হলো। ডুব দিয়ে দিয়ে জলজ আগাছা আর শ্যাওলা তুলে ঢেকে দিল জিনা আর মুসা।

গুড। এপাশ থেকে ওপাশ থেকে দেখে মাথা ঝাঁকাল কিশোর, দেখা যায় না। চলো, চায়ের সময় হয়েছে। গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পর বলল, একটা বোকামি কিন্তু করে ফেলেছি। পাহারা দেয়ার জন্যে একজনকে পাহাড়ের চুড়ায় বসে থাকা উচিত ছিল।

তাই তো! একমত হয়ে বলল রবিন, বোকামিই হয়ে গেছে। কি আর, করা। তবে আমার মনে হয় না দিনে কেউ উঠবে। স্মাগলাররা এলে আসবে রাতের বেলা।

নিজেদের আস্তানায় ফিরে চলল, ওরা।

 কিছুদূর এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রাফি। গরগর শুরু করল।

দুর্গের দিকে এগোচ্ছিল ওরা, ওখান দিয়ে ঘুরে এসে ফোকর দিয়ে গুহায় নামার ইচ্ছে ছিল। এই সময় হুঁশিয়ার করল রাফি।

কিশোরের নির্দেশে তাড়াতাড়ি একটা ঝোপে ঢুকে পড়ল ওরা। রাফিকে চুপ থাকতে বলল জিনা।

আস্তে ডাল সরিয়ে ফাঁক করে উঁকি দিল কিশোর। কাঁটার খোঁচা লাগল। কিন্তু উত্তেজনায় খেয়ালই করল না সেটা। চত্বরে মানুষ দেখতে পেয়েছে। সে–তাকাতে না তাকাতেই অদৃশ্য হয়ে গেল লোকগুলো।

জিনাও দেখতে পেয়েছে। ফিসফিস করে বলল, কিশোর, পাতালঘরে চলে গেল না তো?

মনে হয়। ঢাকনা ওরাই সরিয়েছে। চোরাই মাল জমা করে রেখেছে হয়তো নিচে। মানুষ লুকিয়ে থাকতেও অসুবিধে নেই। চোর-ডাকাতের জন্যে স্বর্গ। ভাবল একমুহূর্ত। এখান থেকে ভালমত দেখতে পারব না। চলো, গুহায়। নিচের মুখটা দিয়ে ঢুকব। তারপর একজন উঠে বসে থাকব ফোকরের কাছে। দেখব, ব্যাটারা কি করে।রাফি, একদম চুপ, একটা শব্দ করবি না!

ওপর দিয়ে আর গেল না ওরা। নিচে নেমে দ্বীপের কিনার ঘুরে চলে এল গুহামুখের কাছে। ভাল করে তাকাল একবার আশপাশে। কেউ নেই। দেখছে না ওদেরকে। তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল ভেতরে।

ঢুকেই রবিনকে পাঠিয়ে দেয়া হলো নজর রাখার জন্যে।

দড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল রবিন। ফোকর দিয়ে মাথা বের করে তাকিয়ে রইল দুর্গের দিকে। ঝোপের ডাল তার মাথা আড়াল করে রেখেছে, ওদিক থেকে কেউ দেখতে পাবে না।

নিচে হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসল রাফি। ঘেউ ঘেউ করে দু-বার ডাক দিয়েই বেরিয়ে গেল গুহা থেকে। তাকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারল না। জিনা।

গুহামুখের কাছে এলে ডাকল সে, রাফি! কোথায় গেলি তুই! এই রাফি?

সাড়া দিল না কুকুরটা।

একটু পরেই তাকে দেখতে পেল রবিন। এক ঝোপ থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে আরেক ঝোপে ঢুকল রাফি। যেন শিকারের সন্ধান পেয়েছে। চিতাবাঘ, ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে এখন।

কিসের সন্ধান পেয়েছে সেটা জানতে ও দেরি হলো না। চত্বরের দিক থেকে ল্যাগব্যাগ করতে করতে বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট কুকুর। চোখের পলকে ঝোপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাফি।

এমন চিৎকার জুড়ে দিল ছোট কুকুরটা, যেন খুন করে ফেলা হচ্ছে। তাকে। কউউ উউ করে যেন চেঁচিয়ে বলছে, বাবাগো! মেরে ফেললগো! বাঁচাওগো!

শঙ্কিত হলো রবিন। সর্বনাশ করে দিল রাফি। চেঁচামেচি শুনে এখন বেরিয়ে আসবে স্মাগলাররা। রাফিকে সরে আসার জন্যে ডাক দিতে গেল

কিন্তু মুখ খোলার আগেই যারা বেরিয়ে এল, তাদের দেখবে কল্পনাই করেনি সে। টোড পরিবার–মা, বাবা, ছেলে, তিনজনেই আছে। ও, এ কারণেই কুত্তাটাকে চেনা চেনা লাগছিল!

ঝট করে ফোকরে মাথা নামিয়ে ফেলল রবিন। তার ধারণা, নিশ্চয় কোনভাবে টোডরা জেনে গেছে ওরা দ্বীপে পালিয়ে এসেছে। ধরে নিতে এসেছে এখন। খবরটা বন্ধুদের জানানোর জন্যে তাড়াতাড়ি নেমে এল নিচে।

কুকুরের ঝগড়া গুহার ভেতর থেকেও শোনা যাচ্ছে। রবিন বলল, জিনা, রাফিকে জলদি ডাকো! ডারবির সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে।

অবাক হলেও প্রশ্ন করল না জিনা। আগে রাফিকে ডেকে আনা দরকার। দুই আঙুল মুখে পুরে তীক্ষ্ণ শিস দিল। ডাকটা শুনতে পেল রাফি। এই আদেশ না মানার অর্থ তার জানা আছে। ভীষণ রাগ করবে জিনা। পিটুনিও লাগাতে পারে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডারবির কান কাঁটা স্থগিত রেখে ফিরে আসতে হলো তাকে। প্রথমবার যে ভাবে ঢুকেছিল, সে ভাবেই ফোকর গলে ধপ করে এসে পড়ল গুহার মেঝেতে। আরেকটু হলেই পড়েছিল মুসার মাথায়।

রাফির পিছু পিছু ছুটে এসেছে টেরি। হঠাৎ দেখল, কুকুরটা নেই। চোখের সামনে হাওয়া। একেবারে ভোজবাজি! চোখ ডলল। বিশ্বাস করতে পারছে না।

তার কাছে এসে দাঁড়াল তার বাবা-মা।

মিসেস টোড জিজ্ঞেস করল, কুত্তাটা গেল কোথায়? দেখতে কেমন?

মা, বললে বিশ্বাস করবে না, টেরি বলল, কুত্তাটা দেখতে ঠিক জিনার শয়তান কুত্তাটার মত!

গুহায় বসে তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পেল গোয়েন্দারা। ফিসফিস করে রাফিকে সতর্ক করল জিনা, শব্দ না করার জন্যে।

তা কি করে হয়! মিসেস টোড বলছে, ওরা তো গেছে রকি বীচে। কুত্তাটাকেও নিয়ে গেছে। নিজের চোখেই তো দেখলাম স্টেশনের দিকে যেতে। নিশ্চয় এটা অন্য কুত্তা। কেউ ফেলে গেছে।

তা তো বুঝলাম, শোনা গেল টোডের খসখসে কণ্ঠ, কিন্তু গেল কোথায়?

মাটিতে তলিয়ে গেছে! জবাব দিল টেরি।

তোর মাথা! ধমকে উঠল টোড। গাধা যে গাধাই রয়ে গেছে! মাটিতে তলায় কি করে! তুই তলাতে পারবি? মাটি কি পানি? এক হতে পারে, চুড়া থেকে নিচে পড়ে যেতে পারে। পড়লে মরবে। না মরলেও হাড্ডিগুড্ডি ভাঙবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

চূড়ার কাছে গর্তটর্তও থাকতে পারে, মিসেস টোড বলল। হয়তো তাতে লুকিয়েছে। এসো না, দেখি।

নিথর হয়ে বসে রইল গোয়েন্দারা। রাফির কলার চেপে ধরে রাখল জিনা। ঝোপঝাড়ের ডালপাতা সরানোর শব্দ কানে আসছে। সেই সঙ্গে কাঁটার আঁচড় খেয়ে উহ-আহ। ফোকরের মুখের কাছ থেকে দূরে রইল ওরা। বলা যায় না, যে কোন মুহূর্তে না জেনে গর্তে পা দিয়ে বসতে পারে কোন টোড, গুহায় এসে পড়তে পারে।

কিন্তু কাঁটার জন্যেই বোধহয়, গর্তটার বেশি কাছে এল না ওরা। ফলে দেখতেও পেল না।

মিসেস টোডের কথা শোনা গেল, টেরি, সত্যি ওই কুত্তাটাকেই দেখেছিস তো? তোর তো আবার কথার কোন ঠিকঠিকানা নেই।

খোদার কসম, মা, ওটার মতই লাগল!

হুঁ! বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানেই এসে লুকিয়েছে হয়তো বিচ্ছুগুলো। আমাদের বুঝিয়েছে, ট্রেনে করে চলে গেছে। এখানে এসে থাকলে আমাদের কাজ সব গড়বড় করে দেবে। নৌকা ছাড়া তো আসতে পারবে না, সেটা কোথায় আছে বের করা দরকার।

অত অস্থির হওয়ার কিছু নেই, টোড বলল। এসে থাকলে খুঁজে পাবই। এত ছোট দ্বীপে লুকানোর জায়গা কম। বিশেষ করে নৌকাটা পেয়েই যাব।

এখন খুঁজতে অসুবিধে কি?

অসুবিধে নেই। টেরি, তুই ওদিক দিয়ে ঘুরে যা। ডোরিয়া, তুমি দুর্গের দিকে যাও। আমি এদিকটায় খুঁজছি।

গুহার মধ্যে গা ঘেষাঘেঁষি করে বসে রইল ছেলেমেয়েরা, যেন এভাবে থাকলেই আর খুঁজে পাবে না ওদেরকে। আল্লাহ আল্লাহ করছে, যাতে নৌকাটা চোখে পড়ে না যায়।

তিন গোয়েন্দা, জিনা, রাফি; এদের কারও সামনেই পড়তে চায় না। টেরি। ভয়ে ভয়ে এগোল। চলে এল ছোট্ট সৈকতে। বালিতে নৌকার দাগ দেখতে পেল বটে, কিন্তু চিনতে পারল না। জোয়ারের সময় পানি এসে অনেকখানিই মুছে দিয়ে গেছে দাগ। পানি ঢুকে থাকা ছোট গুহাটার দিকে তাকাল ভয়ে ভয়ে। একবার এগোয় একবার পিছোয়, এরকম করতে করতে শেষমেষ এসে উঁকি দিল ভেতরে। অন্ধকার। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। ভেতরে ঢোকার আর সাহস করতে পারল না। ভাবল, কাজ কি বাবা ঢুকে! কোন জলদানব লুকিয়ে আছে এখানে কে জানে! ফিরে এল তার বাবা যেখানে খোঁজাখুজি করছে সেখানে।

ওদিকটায় কিছু নেই, জানাল টেরি।

তার মা-ও সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পেল না, ফিরে এল।

টোডও কিছু না পেয়ে বলল, না, ওই ছেলেমেয়েগুলো নয়। তাহলে নৌকা থাকতই। ওটা অন্য কুত্তা। কেউ ফেলে গেছে এখানে। আস্তে আস্তে বুনো হয়ে উঠেছে। সে জন্যেই কামড়াতে এসেছে ডারবিকে।

তাহলে তো ভয়ের কথা, মিসেস টোড বলল। আবারও আসতে পারে। আমাদেরকেই যে কামড়ে দেবে না তার ঠিক কি?

সাবধান থাকতে হবে। দেখলেই গুলি করে মারব এবার।

হাঁপ ছাড়ল গোয়েন্দারা। যাক, আপাতত ফাড়া কাটল। ফোকরটা দেখতে পায়নি কানাগুলো। নৌকাটাও না। তবে রাফির জন্যে শঙ্কিত হয়ে উঠল জিনা। তার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার একটা বড় কারণ, টোডেরা বিষ খাইয়ে রাফিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু এখানে এসেও নিশ্চিত হওয়া গেল না। সেই মেরে ফেলার ভয়। এখন বলছে, গুলি করে মারবে!

কথা বলতে বলতে সরে গেল টোডেরা। শেকল দিয়ে রাফিকে বেঁধে ফেলল জিনা। গুহা থেকেই বেরোতে দেবে না আর। ডারবির গন্ধ পেলেই ও খেপে যায়, এ এক অদ্ভুত কাণ্ড! সাধারণত এমন করে না রাফি। অন্য কুকুর দেখলে বরং বন্ধুতই করতে যায়।

খিদে পেয়েছে। টিন খুলে খাবার বের করতে লাগল রবিন। তাকে সাহায্য করল মুসা।

কিশোর বলল, একটা ব্যাপার পরিষ্কার, আমাদের খোঁজে আসেনি ওরা। ট্রেনে করে রকি বীচে চলে গেছি, এটাই বিশ্বাস করেছে।

তাহলে কেন এল? মুসার প্রশ্ন।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

আমরা পালিয়েছি বলেই হয়তো ওরাও ভয়ে পালিয়েছে, আনারসের টিন খুলে রেখে মাংসের টিন টেনে নিল রবিন। পারকার আংকেলকে কি জবাব দেবে?

জবাব তো সহজ। বলবে, আমরা বাড়ি ফিরে গেছি। আংকেলও কিছু সন্দেহ করবেন না। তিনিই তো আমাদের চলে যেতে বলেছেন।

ভয়ে পালিয়েছে, না মরতে এসেছে, ওসব জানার দরকার নেই আমার। ফুঁসে উঠল জিনা, এটা আমার দ্বীপ! এখানে আসার কোন অধিকার নেই ওদের! চলো, ঘাড় ধরে গিয়ে বের করে দিয়ে আসি!

উঁহু, মাথা নাড়ল কিশোর, ওদের সামনে যাওয়া যাবে না। আমাদের দেখলেই এখন গিয়ে বলে দেবে আংকেলকে। আংকেলেরও বিশ্বাস নেই। রেগেমেগে এসে হাজির হতে পারেন, আমাদের কান ধরে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। টিন থেকে চামচ দিয়ে আনারসের একটা টুকরো বের করে মুখে পুরল সে। চিবিয়ে গিলে নিয়ে বলল, তাছাড়া, আরও একটা কারণে ওদের সামনে যাব না এখন আমরা।

কি কারণ? গলা বাড়াল মুসা।

অন্য দু-জনও আগ্রহ নিয়ে তাকাল।

কেন, সন্দেহটা ঢোকেনি তোমাদের মাথায়? কিশোর বলল, টোডরাও হয়তো স্মাগলিঙে জড়িত। ওরা এখানে আসে স্মাগলারদের রেখে যাওয়া মাল সরিয়ে নিয়ে গিয়ে দেশের ভেতর চালান দিতে। টোড নাবিক। নৌকায় করে এখানে যাতায়াত করা তার জন্যে কোন ব্যপারই না। কি, খুব একটা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে?

না, মাথা নাড়ল জিনা, মোটেও অসম্ভব না। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। টোডরা চলে যাক, তারপর গিয়ে পাতালঘরে ঢুকব আমরা। দেখব, কিছু আছে কিনা। ব্যাটাদের শয়তানি বন্ধ করতেই হবে!

.

১১.

গেল না টোডেরা।

ফোকর দিয়ে মুখ বের করে দুর্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা করে ফেলল গোয়েন্দারা, কিন্তু টোডদের যাওয়ার কোন লক্ষণই দেখতে পেল না। চত্বরে এক-আধবারের জন্যে বেরোনো ছাড়া তেমন একটা বাইরে বেরোতেও দেখা গেল না ওদের। যেন ছুচো হয়ে গেছে, পাতালঘরের অন্ধকারে বসে থাকাটাই বেশি আরামের, দিনের আলো সহ্য করতে পারে না।

ইতিমধ্যে আরেকটা কাজ করে এসেছে রবিন। পাহাড়ে চড়ায় ওস্তাদ সে। তাই তাকেই পাঠিয়েছিল কিশোর, টোডরা কিসে করে এসেছে দেখে আসার জন্যে। এ পাহাড় সে পাহাড় করে ঘুরে ঘুরে একটা পাহাড়ের গোড়ায়। যেই নেমেছে, অমনি একটা পাথরের আড়ালে দেখতে পেয়েছে ছোট নৌকাটা।

প্রণালী দিয়ে ঢোকেনি টোডরা, সেজন্যেই জিনার নৌকাটা দেখতে পায়নি। তবে ওস্তাদ নাবিক বলতে হবে টোডকে। দ্বীপের যেখানে এনে নৌকা ভিড়িয়েছে, সেখানে আনাটা সত্যি কঠিন। ভাঙা জাহাজটার কাছাকাছিই, কিশোর যেখানে সন্দেহ করেছিল।

বিকেল পেরিয়ে গেল। আরেকটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই ছায়া নামতে শুরু করেছে পাহাড়ের গোড়ায়।

কিশোর বলল, মনে হচ্ছে রাতটা এখানেই কাঁটাবে ওরা।

বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে কোন লাভ হলো না, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। যাদের যন্ত্রণায় পালালাম, তারাই এসে হাজির। ধুর!

গুহার ভেতরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। মোম জালল রবিন। বলল, চলো, ভয় দেখাই ব্যাটাদের।

মানে? ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা।

আছে তো পাতালঘরে। তোমার মত ওদেরও ভূতের ভয় থাকতে পারে।

রবিনের পরিকল্পনা কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছে কিশোর। মুচকি হাসল।

মুসা বুঝল না। খুলেই বলো না ছাই!

রবিন বলল, বুঝলে না? দুর্গের নিচে কিছু কিছু জায়গায় প্রতিধ্বনি খুব বেশি হয়, ভুলে গেছ? পাতালঘরের কাছে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করব আমরা। ভূতের ভয় দেখাব ওদের।

চটাস করে নিজের উরুতেই চাটি মারল মুসা, দারুণ আইডিয়া! এক্ষুণি চলো! ব্যাটাদের কলজে শুকিয়ে না দিয়েছি তো আমার নাম মুসা আমান নয়!

এখন না, মুচকি হাসল কিশোর, আরেকটু রাত হোক।

জিনা বলল, রাফিকে কি করব? ও তো গিয়েই ঘেউ ঘেউ শুরু করবে। ভূত যে নয়, বুঝে ফেলবে টোড। ভাববে, বুনো কুকুরটাই, মারতে বেরোবে।

ওকে সিঁড়ির মুখে পাহারায় রেখে যাব। স্মাগলারদের কেউ এলে সতর্ক করতে পারবে আমাদের।

আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক পর রওনা হলো ওরা। চলে এল দুর্গের চতুরে। টোডদের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। আগুন নেই, আলো নেই। পাতালঘরে নামার সিঁড়ির মুখের পাথরগুলো সরানো, তাতে বোঝা গেল নিচেই রয়েছে ওরা।

রাফি, একদম চুপ করে থাকবি, কড়া নির্দেশ দিল জিনা। কেউ এলে আমাদের হুঁশিয়ার করবি। মানুষ না দেখলে চেঁচাৰি না, খবরদার!

ও কি আর বুঝবে নাকি কিছু? কিশোর বলল, খরগোশ দেখলেও চেঁচানো শুরু করবে। একজনকে এখানে থাকা দরকার।

কে থাকবে? ভয় পেয়ে টোডরা কি করে, মজা দেখার লোভ সবারই। শেষে জিনা নিজেই বলল, তোমরাই যাও। আমি থাকি। রাফিকে একা একা ছেড়ে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না আমি।

সিঁড়ি বেয়ে পাতালঘরে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। নিচে অনেক ঘর, কোনওটা সেলার, কোনওটা ডানজন। বদ্ধ বাতাসে একধরনের ভাপসা গন্ধ।

বড় একটা ঘরে ঢুকল ওরা। টর্চের আলোয় দেয়ালে গাথা লোহার সারি সারি আঙটা দেখা গেল। একসময় এটা বোধহয় জেলখানা ছিল, কিংবা টর্চার চেম্বার। দুর্ভাগা বন্দিদের ধরে এনে এখানে বন্দি করে রাখা হত, লোহার আঙটায় শেকল দিয়ে বেধে অমানুষিক অত্যাচার চালানো হত তাদের ওপর। মধ্যযুগীয় এসব বর্বতার ইতিহাস অনেক পড়েছে রবিন। মুসারও জানা আছে কিছু কিছু। তার মনে হতে লাগল, ভয়াবহ যন্ত্রণা পেয়ে মারা যাওয়া সে সব মানুষের প্রেতাত্মারা এখনও ঘুরে বেড়ায় পাতালের এসব ঘরে ঘরে, করিডরে। গায়ে কাঁটা দিল তার।

সঙ্গে টর্চ আছে। কিন্তু পারতপক্ষে সেটা জ্বালছে না কিশোর। প্যাসেজ ধরে যাওয়ার সময় দেয়ালে চক দিয়ে একে চিহ্ন দিয়ে রাখল, যাতে ফেরার। সময় অসুবিধে না হয়।

হঠাৎ কথার শব্দ কানে এল। আরেকটু আগে বাড়তেই একটা ফোকর। দিয়ে আলো চোখে পড়ল। সেই ঘরটায় আস্তানা গেড়েছে টোডরা, যেখানে সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছিল তিন গোয়েন্দা।

ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, আমি গরু।

মানে! চমকে গেল রবিন। ভাবল, ভূতের ভয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সহকারী গোয়েন্দার।

আমি গরুর ডাক ডাকব।

ও, তাই বলো। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। বেশ, আমি তাহলে ছাগল। কিশোর, তুমি? গাধা?

জন্তু-জানোয়ারের ডাক আমি ভাল পারি না। তবু দেখি, পারি কিনা।

একটা পাথরের থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে গরুর ডাক ডেকে উঠল মুসা। শব্দ শুনে সে নিজেই চমকে গেল। বিকট শব্দ হয়েছে বদ্ধ জায়গায়, সেই সঙ্গে প্রতিধ্বনি; মূল শব্দটাকে ভয়াবহ করে তুলেছে।

ফোকর দিয়ে তাকিয়ে আছে রবিন ও কিশোর। টোডদের প্রতিক্রিয়া দেখছে।

ভীষণ চমকে গিয়ে প্রায় ককিয়ে উঠল টেরি, মা, কিসের শব্দ!

তার কুকুরটা তার চেয়েও ভীতু। গিয়ে লুকাল ঘরের কোণে।

গরু, বলেই টোড নিজেও থমকে গেল। এখানে গরু আসবে কোত্থেকে।

মুসা সরে এল থামের আড়াল থেকে। সেখানে চলে গেল রবিন। মা-মা। করে উঠল ছাগলের মত। থামল না, ডেকেই চলল।

আরিসব্বোনাশ! চোখ বড় বড় করে ফেলল মিসেস টোড। এসব এল কোত্থেকে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল টোড। কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে মুখ।

কয়েকবার ডেকে চুপ হয়ে গেল রবিন।

কিশোরের গায়ে গুঁতো দিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করল মুসা। নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে।

 কিশোর ব্যাঁ-ব্যাঁ করে যে ডাকটা ডাকল, সেটা গাধায় শুনলেও চমকে যেত, এতটাই বিকৃত আর ভয়ঙ্কর, পিলে চমকে দেয়ার মত; এবং সত্যি সত্যি চমকেও দিল টোড পরিবারের।

শুধু ডাকাডাকি করেই থামল না কিশোর, এমন করে লাথি মারতে লাগল, মনে হচ্ছে সাংঘাতিক, রেগে গিয়ে মেঝেতে পা ঠুকছে সাংঘাতিক জানোয়ারটা।

ঘরের দরজার কাছে সরে এল মিসেস টোড। ভয়ে ভয়ে বলল, হেই হেই, যাহ, যাহ্!

ফিক করে হেসে ফেলল রবিন। কিন্তু তার হাসিটা শুনতে পেল না মিসেস টোড, কিশোরের চিৎকারে। নাকি স্বরে চেঁচিয়ে টেনে টেনে বলল গোয়েন্দাপ্রধান, সাঁব-ধাঁন! তারপর আবার গাধার ডাক, মেঝেতে পা ঠোকাঠুকি।  

লাফ দিয়ে গিয়ে ঘরের ভেতরে পড়ল মিসেস টোড। দড়াম করে লাগিয়ে দিল ভারি কাঠের দরজাটা। কাঁপা গলায় বলল, রোজ রাতেই যদি এই কাণ্ড চলে, এখানে থাকা যাবে না!

দাঁতাল শুয়োর রেগে গেলে যেমন করে তেমনি ভাবে ঘোৎ-ঘোৎ করে উঠল মুসা।

হা-হা করে হেসে ফেলল রবিন। ভীষণ প্রতিধ্বনি উঠল।

কিশোরও হাসছে। বলল, আর পারি না! চলো এখান থেকে! বেরোও!

বিকৃত হয়ে প্রতিধ্বনিত হলো তার কথা ও পারি না! পারি না। পারি না!…খান থেকে! খান থেকে! খান থেকে!…বেরোও! বেরোও! বেরোও।

সিঁড়ির ওপরে উঠেও তাদের হাসি থামল না।

সব শুনে জিনাও হেসে গড়িয়ে পড়ল।

গুহায় ফিরে চলল, ওরা। কিন্তু হাসি আর থামতে চায় না। কিছুই না বুঝে ঘউ ঘউ করল কয়েকবার রাফি।

আস্তে আস্তে কমে এল হাসি।

কিশোর বলল, ওরা যে আমাদের খুঁজতে আসেনি, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। স্মাগলারদের সঙ্গে জড়িত। এ কাজে সুবিধে হবে বলেই হয়তো মিসেস টোড চাকরি নিয়েছিল জিনাদের বাড়িতে।

এবার তো তাহলে বাড়ি ফেরা যায়, রবিন বলল।

চোরগুলোকে হাতেনাতে না ধরেই?

কথা বলতে বলতে পাহাড়ের চূড়ায় চলে এল ওরা। ফোকর দিয়ে গুহায়। নামবে। টর্চ জ্বালতে যাবে কিশোর, এই সময় তার হাত খামচে ধরল মুসা। ফিসফিস করে বলল, ওই দেখো!

সাগরের মাঝে একটা আলো, জ্বলছে নিভছে।

কিশোরের মনে হলো, কোন বোট কিংবা জাহাজ থেকে টর্চের সাহায্যে সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে। আবার বোধহয় পুরানো জাহাজের লকারে চোরাই মাল রেখে যাওয়া হয়েছে। সঙ্কেত দিচ্ছে টোডকে সে কথা জানানোর জন্যে।

অনেকক্ষণ ধরে চলল এই সঙ্কেত দেয়া।

এতক্ষণ কেন? রবিনের প্রশ্ন।

হয়তো এপাশ থেকে জবাব আশা করছে। না পেয়ে সঙ্কেত দিয়েই চলেছে।

আবার হাসতে শুরু করল মুসা, তাহলে জবাবের আশা আজ ওদের ছাড়তে হবে। মেরে ফেললেও জনাব বেঙ আজ আর গর্ত থেকে বেরোবে না।

একসময় থেমে গেল আলোর সঙ্কেত। আর জ্বলল না।

গুহায় ঢুকল গোয়েন্দারা।

কোন রকম অঘটন ঘটল না আর। নিরাপদে কাটিয়ে দিল রাতটা।

.

১২.

পরদিন সকালে নাস্তা খেতে বসেও প্রথমেই টোডদের কথা উঠল।

রেগে উঠল জিনা, বুড়িটা নাম্বার ওয়ান চোর! আমাদের ঘরের জিনিসপত্র সব ডাকাতি করে নিয়ে এসেছে, দেখোগে!

তা তো কিছু এনেছেই, জকুটি করল কিশোর। আন্টি এসে তাঁর ঘরের এ হাল দেখলে খুব কষ্ট পাবেন।

ভালমত একটা শিক্ষা দিয়ে দেয়া দরকার, গজগজ করতে লাগল মুসা।

হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন।

নৌকায় করে এনেছে, সেটা তো বোঝাই গেছে, বলল কিশোর। মালগুলো কোথায় রেখেছে দেখা দরকার। নিশ্চয় পাতালঘরে।

চলো, দেখে আসি।

ওরা যদি থাকে? মুনার প্রশ্ন।

আছে তো জানা কথাই, রবিন বলল। নজর রাখব। তারপর যেই দেখব সরেছে, অমনি নেমে যাব পাতালে।

বুদ্ধিটা মন্দ না, কিশোর বলল। চলো।

রাফিকে কি করব? জিজ্ঞেস করল জিনা।

এখানেই রেখে যেতে হবে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে সব ভজঘট করে দিতে পারে।

একা থাকবে? কেঁদেই মরে যাবে ও। এক কাজ করো, তোমরা যাও। আমি বরং ওর সঙ্গে থেকে যাই, আসলে গুহার মধ্যেও রাফিকে একা রেখে যেতে ভয় পাচ্ছে জিনা। যদি কোন কারণে ডাকতে শুরু করে কুকুরটা? আর তার ডাক শুনে এসে হাজির হয় টোড?

থাকবে? ঠিক আছে, থাকো।

দড়ি বেয়ে ফোকরের কাছে উঠে এল তিন গোয়েন্দা। বড় একট ঝোপে ঢুকে চোখ রাখল দুর্গের ওপর।

উফ, কি কাঁটার কাঁটারে বাবা! কনুই ডলতে ডলতে গুঙিয়ে উঠল মুসা, সব ছিলে ফেলেছে!

চুপ! সাবধান করল রবিন, বেঙের গোষ্ঠী বেরোচ্ছে।

একে একে বেরিয়ে এল তিন টোড। পাতালঘরে অমাবস্যার অন্ধকার। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় বেরিয়ে খুশি হয়েছে, ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যায়।

এদিক এদিক তাকাতে লাগল ওরা। ডারবি রয়েছে মিসেস টোডের পা ঘেষে। পায়ের ফাঁকে ঢোকানো লেজ।

গরু-ছাগল খুজছে! হেসে ফেলল মুসা।

চুপ। আস্তে! সাবধান করল তাকে কিশোর, শুনে ফেলবে!

দু-তিন মিনিট কথা বলল মিসেস আর মিস্টার টোড, তারপর এগিয়ে গেল দুর্গের কিনারের দিকে, যেখান থেকে ভাঙা জাহাজটা দেখা যায়। টেরি গেল দেয়াল ধসে পড়া একটা ঘরের দিকে। ছাতও বেশির ভাগই নেই ওটার।

আমি টোডদের পিছে যাচ্ছি, কিশোর বলল। টেরি কি করে দেখো তোমরা।

ঝোপের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে গেল সে।

মুসা আর রবিনও ঝাৈপ থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে চলে এল, দুর্গের কাছাকাছি, টেরি দেখে ফেলার আগেই চট করে বসে পড়ল আরেকটা ঝোপের আড়ালে।

খোলা চত্বরে ছোটাছুটি করছে ডারবি। শিস দিতে দিতে ভাঙা ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল টেরি। দু-হাতে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে রেখেছে কয়েকটা গদি।

জিনাদের জিনিস! দাঁতে দাঁত চেপে বলল মুসা,সবচেয়ে ভালগুলো নিয়ে এসেছে!

দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা, বলে একটা মাটির ঢেলা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল রবিন। টেরি এবং ডারবির মাঝখানে পড়ে ভাঙল ওটা।

হাত থেকে গদিগুলো ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল টেরি। ভয় পেয়েছে।

আরেকটা ঢেলা নিয়ে আবার ছুঁড়ে মারল রবিন। নিশানা ঠিক হলো, পড়ল ডারবির ওপর। ঘেউক করে উঠে একলাফে গিয়ে সিঁড়ির গর্তে ঝাঁপ দিল কুকুরটা।

 আবার আকাশের দিকে তাকাল টেরি। তারপর চারপাশে তাকাতে লাগল। ঢিল কোনখান থেকে আসছে বুঝতে পারছে না।

মুচকি হাসল মুসা। বুদ্ধিটা ভালই করেছে রবিন। টেরি ওদের দিকে পেছন করতেই অনেক বড় একটা ঢেলা তুলে ছুঁড়ে মারল সে। টেরির পায়ের কাছে পড়ে ভাঙল ঢেলাটা।

অবাক হয়ে নিচের দিকে তাকাল টেরি। তাকে কিছু বোঝার সামান্যতম সময় না দিয়ে ঢিল ছুঁড়ল রবিন।

কাঁধে পড়ল টেরির। মা-গো! করে চেঁচিয়ে লাফ দিয়ে সরে গেল সে।

চিৎকার করে গরুর ডাক ডেকে উঠল মুসা।

আর সহ্য করতে পারল না টেরি। দুই হাত তুলে চিৎকার করতে করতে গিয়ে তার কুকুরটার মতই লাফ দিয়ে পড়ল সিঁড়িতে।

শেষ চিলটা ছুঁড়ল মুসা। নিখুঁত নিশানা। সিঁড়ির গর্তে গিয়ে পড়ল ওটা। ভেতর থেকে আর্তচিৎকার শোনা গেল। নিশ্চয় মাথায় পড়েছে টেরির।

জলদি! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন, এটাই সুযোগ!

একদৌড়ে দু-জনে গিয়ে চত্বর থেকে গদিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলে এল ঝোপের কাছে।

ভেতরে কি আছে দেখে আসতে পারি, রবিন বলল। তুমি এক কাজ করো। সিঁড়ির মুখের কাছে গিয়ে বসে থাকো। টেরির মাথা দেখলেই গরু হয়ে যাবে। ব্যস, আর কিছু করা লাগবে না। মাটি ফেড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে চাইবে ও। আমি গিয়ে কুয়ার ভেতর দিয়ে পাতালঘরে নামব। দেখে আসি, কি কি জিনিস চুরি করেছে ধাড়ি বেঙগুলো।

আঙটা ধরে নামতে মোটেও অসুবিধে হলো রবিনের। এই কাজ আগেও একাধিকবার করেছে সে। দুর্গের নিচে নামা লাগতে পারে, এ জন্যে তৈরিই হয়ে এসেছে ওরা। কোমর থেকে টর্চ খুলে জ্বালল। রাতে যে ঘর থেকে ভয় দেখিয়েছে টোডদের, তার পাশের ঘরটায় এসে ঢুকল।

জিনিসপত্র কম আনেনি টোডেরা, তিনজনের সাধ্যে যা কুলিয়েছে, এনেছে। কম্বল, তৈজসপত্র, খাবার তো আছেই, হাতে করে আনা যায় দামী এরকম যা যা পেয়েছে নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুদিন থাকার ইচ্ছে এখানে ওদের।

কুয়া থেকে উঠে এসে দেখল রবিন, সিঁড়ির মুখের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে মুসা। তাকে নিয়ে সরে চলে এল ঝোপের কাছে। জানাল, কি দেখে এসেছে।

ফিসফাস করে কথা বলছে ওরা, এই সময় সেখানে এসে হাজির হলো কিশোর। বলল, পাথরের আড়ালে নৌকা লুকিয়ে রাখে টোড। বের করে নিয়ে ভাঙা জাহাজটায় গেছে, বোধহয় ট্রাংকটা আনতে। তীরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে মিসেস টোড।

মুসা আর রবিনও জানাল, ওরা কি কি করেছে।

 শুনে হাসল কিশোর। তাহলে এটাই সুযোগ।

কিসের? ভুরু কোঁচকাল রবিন।

জিনিসগুলো নিয়ে আসার। মুখ বাঁকাল কিশোর, আস্ত চোর! কেন যে এগুলোকে জায়গা দিয়েছিলেন কেরিআন্টি দাঁড়াও, সব নিয়ে আসব। একটা জিনিসও রেখে আসব না।

মুসাকে আবার সিঁড়ির মুখে পাহারায় রেখে নিচে নেমে গেল কিশোর আর রবিন। টেরি আর তার ভীতু কুকুরটার ছায়াও চোখে পড়ল না। নিশ্চয় সিঁড়ির নিচে কোথাও লুকিয়ে বসে আছে।

ব্যাগে ভরে জিনিসগুলো এনেছে টোডেরা। সেই সব ব্যাগে ভরেই আবার দড়িতে বেধে কুয়া দিয়ে বের করে আনল গোয়েন্দারা। একটা জিনিসও রাখল না।

দুই টোড এখনও ফেরেনি। এখানে আর থাকার প্রয়োজন মনে করল না তিন গোয়েন্দা। জিনিসগুলো সব বয়ে নিয়ে এল ফোকরের কাছে। দড়িতে বেধে গুহায় নামাল।

সর্বনাশ করে দিয়েছিল শয়তানগুলো! ফুসতে লাগল জিনা। তবে তার রাগ বেশিক্ষণ থাকল না। টেরিকে কি ভাবে ভয় দেখিয়েছে রবিন ও মুসা, শুনে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল।

কিশোর বলল, ট্রাংকটাও রাখতে দেব না ওদেরকে। মুসা, চলো, দেখি। এনে থাকলে ওটাও কেড়ে আনব।

ফোকর দিয়ে আবার বেরোল দু-জনে দেখে, ট্রাংকটা দূর্গের দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুই টোড! চত্বরের কাছে গিয়ে ওটা নামিয়ে রেখে এদিক ওদিক তাকাল মিসেল, টেরি গেল কোথায়?…টেরি। টেরি!

মায়ের ডাক শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল টেরি।

তোকে না বললাম এখানে থাকতে? নিচে কি করছিস?

এখানে থেকে মরব নাকি!

মরব নাকি মানে?

আবার সেই ভূতুড়ে গরু এসে হাজির! ডাকাডাকি করল, আমাদের ঢিল মারল… ভয়ানক জানোয়ার! ওরা কি ওপরে থাকতে দেয়?

ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে টোড, যেন বোঝার চেষ্টা। করছে পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি। গরু তোকে ঢিল ছুড়ল?

ছুঁড়লই তো, মিথ্যে বলছি নাকি? ডারবিকে জিজ্ঞেস করে দেখো। কি আর বলব তোমাকে, বাবা, একটা-দুটো না, হাজারে হাজারে গরু! একেক শিঙ কি! আট-দশ হাত করে লম্বা। দেখো না, ভয়ে ডারবিটা আর বেরোচ্ছেই না।

ভীতুর ডিমটাকে তো খামোকা খাওয়াস

এই, ডারবিকে কিছু বলবে না বলে দিলাম! রেগে উঠল মিসেস টোড। ওর কি দোষ? গরুর সঙ্গে কুকুর কখনও পারে নাকি?

না পারলে ওটাকে রাখার কি দরকার? ছেলের দিকে তাকাল আবার টোড, গদিগুলো কোথায়? নিচে রেখে এসেছিস?

রাখলাম আর কখন। সবে এনেছি, গর্তে নামব, এই সময় গরুগুলো এসে হাজির।

কোথায় ফেলেছিস? আশপাশে তাকাল টোড।

 এখানেই তো ছিল। ওরাই হয়তো নিয়ে গেছে!

গরুতে ঢিল ছোঁড়ে, গদি ছিনিয়ে নিয়ে যায়, একথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না, টোডও করল না। কেউ আছে এই দ্বীপে, আমি এখনও বলছি। সে-ই এই কাণ্ড করছে।

তা তো আছেই, ওই গরুগুলো

 চুপ, গাধা কোথাকার!

নিচ থেকে ডারবির করুণ চিৎকার শোনা গেল।

মিসেস টোড বলল, বেচারা! ওপরে আসতেও ভয় পাচ্ছে। এই ডারবি, ডারবি, আয়, আয়। কেউ কিচ্ছু করবে না।

কিন্তু মিসেস টোডের কথায় ভরসা করতে পারল না কুকুরটা। এল না ওপরে।

যাই, নিয়ে আসিগে। খাবারও আনতে হবে। এখানে বসেই খাব, নিচে নেমে গেল মিসেস টোড। একটু পর গর্তের মুখ দিয়ে প্রায় ছিটকে বেরোল সে। উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল, এই শোনো, কিছুই নেই কিছু না..সব নিয়ে গেছে

বললাম না, গরুগুলোর কাজ! টেরি বলল, তোমরা তো বিশ্বাস করতে চাও না…

তার কথায় কান দিল না তার বাবা। নেমে গেল গর্তের ভেতর। পেছনে গেল অন্য দুজন।

মুসার গায়ে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরেই উঠে দৌড় দিল কিশোর।

চত্বরে ফেলে রাখা ট্রাংকটা বয়ে নিয়ে এল দু-জনে। গুহায় এনে রাখল। এরপর কি ঘটে দেখার জন্যে আবার বাইরে বেরিয়ে এল কিশোর।

গর্ত থেকে বেরিয়ে এল টোড। ট্রাংকটা যেখানে ছিল সেদিকে চোখ পড়তেই হাঁ হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, ডোরিয়া, দেখে যাও, ট্রাংকটাও নেই!

দেখে মিসেস টোডও হাঁ। টেরির ভঙ্গি দেখে তো মনে হলো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে।

তার মা বলল, দ্বীপে যে, মানুষ আছে, আর কোন সন্দেহ নেই। ভূতেরা দিনের বেলা বেরোয় না। জন, তোমার পিস্তলটা আছে?

আছে, পকেটে চাপড় দিল টোড।

এসো, পুরো দ্বীপ খুঁজে দেখব আজ। বের করেই ছাড়ব।

তাড়াতাড়ি গুহায় ঢুকে বন্ধুদের খবরটা জানাল কিশোর। গুহার মধ্যে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আপাতত আর কিছু করার নেই। রাফিকে চুপ থাকতে বলল জিনা।

খুঁজতে খুঁজতে গুহার ওপরে চলে এল টোডেরা।

টেরির গলা শোনা গেল, বাপরে বাপ, কি কাঁটার কাঁটা!

টোড বলল, ডোরিয়া, দেখো, এই ঝোপটায় কেউ বসেছিল! ঘাস দুমড়ে গেছে, দেখেছ? ডালও ভেঙেছে।

তাহলে সেই কেউটা এখন কোথায়?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না!

আস্তে আস্তে সরে গেল দুই টোডের কণ্ঠ।

যাক, এবারেও দেখতে পায়নি ফোকরটা। সবে শরীর ঢিল করে বসেছে গোয়েন্দারা, এই সময় ঘটল ঘটনাটা। ওপর থেকে ধুড়ুম করে এসে মেঝেতে পড়ল টেরি। ঝোপে ঢুকে খুঁজতে খুঁজতে ফোকরে পা দিয়ে ফেলেছিল সে। আর ঠেকাতে পারেনি। ঢালু সুড়ঙ্গ দিয়ে পড়েছে এসে গুহার ভেতরে। নরম বালিতে পড়েছে বলে রাফির মতই সে-ও ব্যথা পায়নি। তবে অবাক হয়েছে খুব।

বিমূঢ় অবস্থাটা কাটতে সময় লাগল তার। কিশোরদের এখানে দেখতে পাবে কল্পনাই করতে পারেনি। চিৎকার করে মাকে ডাকার জন্যে মুখ খুলতেই মুসার থাবা এসে পড়ল তার মুখে। চেপে ধরল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, টু শব্দ করলেই রাফিকে ছেড়ে দেব। তোমাকে খাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে আছে ও।

কথাটা বিশ্বাস করল টেরি। চিৎকার করল না। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে রাফির দিকে।

টেরির মুখ থেকে হাত সরিয়ে আনল মুসা।

সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল টেরি। মিন মিন করে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি করছ তোমরা?

তোমার মুণ্ডু কাটতে এসেছি! ধমকে উঠল জিনা। এটা আমাদের দ্বীপ, ইচ্ছে হলেই আসব, কিন্তু তোমরা এসেছ কোন সাহসে? কাকে বলে এসেছ?

 তার সঙ্গে সুর মিলিয়েই কড়া গলায় ধমক দিল রাফিও, খউ, অর্থাৎ, জবাব দাও!

এই, তুই থাম! বেঙগুলো শুনে ফেলবে!

ভয়ে কেঁচো হয়ে গেছে টেরি।

 দ্বীপে এসেছ কেন তোমরা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

তা তো জানি না, ভোঁতা গলায় জবাব দিল টেরি। বাবা আসতে বলল, এলাম।

দেখো, মিথ্যে বলে পার পাবে না। স্মাগলিঙের সঙ্গে জড়িত না তোমার বাবা?

বিস্ময় ফুটল টেরির চোখে। স্মাগলিঙ!

 হ্যাঁ, স্মাগলিঙ। চোরাচালান।

কি বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না। দেখো, আমাকে ছেড়ে দাও…

এহ, মামার বাড়ির আবদার! মুখ ভেঙচে বলল মুসা, ছেড়ে দাও! দিই, তারপর গিয়ে বলো বাপ-মাকে, পিস্তল নিয়ে তেড়ে আসুক…ওসব ঘ্যানর ঘ্যানর করে লাভ নেই, বেঙাচি, ছাড়া তোমাকে হবে না। এসেই যখন পড়েছ, এখানেই থাকতে হবে।

আমার বাবা আমাকে খুঁজে বের করবেই…

যেন তার কথায় সাড়া দিয়েই ডেকে উঠল টোড, টেরি, টেরি, কোথায় গেলি? এই টেরি!

জবাব দিতে যাচ্ছিল, রাফির ওপর চোখ পড়ে গেল টেরির। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে কুকুরটা। হাঁ করা মুখটা হাঁ-ই থেকে গেল তার, শব্দ আর বেরোল না। ঢোক গিলল সে।

খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করে সেখান থেকে সরে গেল টোড।

অনেকক্ষণ পরও যখন আর কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না, কিশোর। বলল, ট্রাংকে কি আছে এবার দেখতে হয়।

রবিন বলল, তালা কি করবে?

একটা পাথর তুলে নিল মুসা, এই তালা কিছু না।

কয়েক বাড়িতেই তালা দুটো ভেঙে ফেলল সে।

ডালা তুলল।

ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে হুড়াহুড়ি করে এগিয়ে এল সবাই, টেরি বাদে। এসবে তার কোন আগ্রহ নেই। মুখটাকে করুণ করে রেখেছে সে। মনে হচ্ছে, ধমক দিলেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে এখন।

ট্রাংকের একেবারে ওপরে রয়েছে একটা ছোটদের কম্বল, এমব্রয়ডারি করে তাতে সাদা খরগোশ আঁকা। টেনে বের করল ওটা কিশোর, নিচে কি আছে দেখার জন্যে। দেখে অবাক হয়ে গেল। এক এক করে জিনিসগুলো বের করে রাখল বালিতে।

দুটো নীল রঙের জার্সি, দুটো নীল স্কার্ট, একটা গরম কোট, এবং আরও কিছু জামা-কাপড়। কাপড়ের নিচে রয়েছে চারটে পুতুল আর একটা খেলনা– ভালুক।

এগুলোর মধ্যে করেই হেরোইন পাচার করে, মুসা বলল। দেখো কেটে, কাটলেই পেয়ে যাবে।

কিন্তু কিশোরের সন্দেহ হলো। টিপেটুপে দেখল। ভেতরে কিছু আছে বলে মনে হলো না। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কেটে দেখল একটা পুতুল। অতি সাধারণ খেলনা। ভেতরে কিছুই নেই হীরা, মাদকদ্রব্য, কিংবা চোরাচালানি করে আনার মত কোন জিনিস, কিচ্ছু না।

অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল গোয়েন্দারা।

আনমনে নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটল কিশোর। বিড়বিড় করে বলল, এই জিনিস এত কষ্ট করে ভাঙা জাহাজে এনে লুকানোর অর্থ কি?

১৩.

অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করেও টেরির কাছ থেকে কোন তথ্য আদায় করা গেল না। আসলেই কিছু জানে না সে।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, রাতে যে একটা জাহাজ এসে সঙ্কেত দেয়, এ ব্যাপারেও কিছু জানো না?

মাথা নাড়ল টেরি। সঙ্কেতের কথা কিছু জানি না। তবে মাকে বলতে শুনেছি, আজ রাতে যোগাযোগ করার কথা মারিয়ার।

মারিয়া!কি ওটা? জাহাজ, বোট, না কোন মানুষ?

 জানি না। জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম, মাথায় গাট্টা মারল বাবা।

তারমানে গুরুত্ব আছে। গোপন ব্যাপার, তোমাকে জানাতে চায়নি। বেশ, আজ রাতে নজর রাখব আমরা।

সারাটা দিন গুহা থেকে বেরোল না ওরা, বেরোতে পারল না, টোডদের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে।

বহুযুগ পরে যেন অবশেষে সন্ধ্যা হলো। রাত নামল। তাড়াতাড়ি খাওয়ার পাট চুকিয়ে নিল সবাই। ভাল খাবার পেয়ে এত খাওয়া খেলো টেরি, পেট ভারী করে ফেলল। তারপর আর বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারল না। বালিতেই শুয়ে নাক ডাকাতে শুরু করল, অনেকটা বাপের মত করে।

দু-জন দু-জন করে পালা করে পাহারা দেবে, চোখ রাখবে সাগরের ওপর, ঠিক করল কিশোর। প্রথম উঠে গেল সে আর জিনা। রাত সাড়ে বারোটায় নেমে এসে মুসা আর রবিনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে জানাল, কিছু দেখেনি। ওদেরকে যেতে বলল।

টেরি গভীর ঘুমে অচেতন। তার কাছেই শুয়ে আছে রাফি। পাহারা দিচ্ছে।

ফোকরের বাইরে বেরোল দুই গোয়েন্দা।

চাঁদ উঠেছে। ঘোলাটে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিয়েছে সাগরের ওপর। আকাশে প্রচুর হালকা মেঘ, ছুটছে দিগ্বিদিক, আপাতত বৃষ্টি হওয়ার কোন লক্ষণ নেই।

আধঘণ্টা মত গেছে, হঠাৎ কানে এল কথার শব্দ।

রবিনের কানে কানে বলল মুসা, টোডরা বেরিয়েছে। ভাঙা জাহাজে যাচ্ছে বোধহয়।

দাঁড়ের শব্দ শোনা গেল। খানিক পরেই নৌকাটাও নজরে এল দু জনের।

মুসার গায়ে কনুই দিয়ে গুঁতো মারল রবিন। নীরবে হাত তুলে দেখাল সাগরের দিকে।

বেশ অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে আলো। আগের রাতের মতই জ্বলছে নিভছে। চাঁদের আলোয় বড় একটা বোটের অবয়বও দেখা যাচ্ছে, সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে ওটা থেকেই।

মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল চাঁদ। অন্ধকার হয়ে গেল সাগর। আর কিছু চোখে পড়ছে না।

একটু পরেই মেঘ সরে গেল।

ওই যে, আরেকটা নৌকা, মুসা বলল। বোটের কাছ থেকে আসছে।

নিশ্চয় দেখা করবে একটা আরেকটার সঙ্গে। মাল পাচার করে এভাবেই।

ঠিক এই সময় নিতান্ত বেরসিকের মত আবার মেঘের আড়ালে চলে গেল চাঁদ। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না গোয়েন্দারা। দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। গলা বাড়িয়ে দিয়েছে বকের মত। কিন্তু আলো না থাকলে কিছু করেই লাভ নেই।

কোন জায়গায় মিলিত হলো নৌকাদুটো, দেখতে পেল না ওরা। আবার যখন চাঁদ বেরোল, তখন দেখল, বোটের কাছ থেকে আসা নৌকাটা চলে যাচ্ছে।

বসেই রইল ওরা।

প্রায় বিশ মিনিট পর টোডদের নৌকাটাকে তীরে ভিড়তে দেখল।

কোন পথে ওপরে উঠল ওরা, দেখতে পেল না গোয়েন্দারা। দেখল, যখন একেবারে দুর্গের কাছে চলে এসেছে।

টোডের হাতে বড় বান্ডিলের মত একটা জিনিস।

অনেক মাল এনেছে আজ, ফিসফিস করে বলল মুসা।

এই সময় দুজনকেই চমকে দিয়ে শোনা গেল একটা চিৎকার, অনেকটা আর্তচিৎকারের মত। ভয়ে, বিরক্তিতে, যন্ত্রণায় কেঁদে উঠেছে যেন কোন ছোট্ট মেয়ে।

.

গুহায় ফিরে জিনা আর কিশোরকে সব জানাল দুজনে।

বুঝতে পেরেছি, বলে উঠল কিশোর, আর কোন সন্দেহ নেই!

কি বুঝেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।

বাচ্চাদের কম্বল, পুতুল, এসব।

আবার গ্রীক!

খুব সহজ করেই বলেছি। স্মাগলিং নয়, কিডন্যাপি।

তুমি বলতে চাইছ, রবিনের কণ্ঠে উত্তেজনা, কোন বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করে এনেছে টোডরা?

কিডন্যাপটা সম্ভবত জাহাজের লোকগুলো করেছে। মারিয়া ওটার নামও হতে পারে, মেয়েটার নামও হতে পারে। এনে তুলে দিয়েছে টোডদের হাতে। লুকিয়ে রাখার জন্যে। মেয়েটা যাতে শান্ত থাকে, সে জন্যে আগেই তার পুতুলগুলো এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কাপড়-চোপড়ও দরকার, সে জন্যে ওগুলো এনেছে।

খাইছে। তার মানে টোডের হাতের বান্ডিলটা মানুষ!

 হ্যাঁ। আমার অনুমান ঠিক হলে, ছোট্ট মেয়েটা। তাকে বের করে আনতে হবে আমাদের।

অনেক ঘুমিয়ে ঘুম পাতলা হয়ে গেছে টেরির। কথাবার্তায় জেগে গেল। কিশোরের শেষ কথাটা কানে গেছে। জিজ্ঞেস করল, কাকে বের করে আনবে?

সেটা তোমার জানার দরকার নেই।

ধাড়ি বেঙগুলো নিশ্চয় পাহারায় থাকবে, মুসা বলল। আনব কি করে?

একটা উপায় বেরিয়ে যাবেই।

রাত এখনও অনেক বাকি। আর কিছু করার নেই। রাফির ওপর টেরিকে পাহারা দেয়ার ভার দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা ও জিনা। কয়েক মিনিট জেগে জেগে মা-বাবার কথা ভাবল টেরি। ভীষণ কান্না পেতে লাগল তার। শেষে কাঁদতেই শুরু করল, নীরবে। রাফির ভয়ে জোরে কাঁদার সাহস পেল না।

.

১৪.

পরদিন সকালে সবার আগে ঘুম ভাঙল কিশোরের। দড়ি বেয়ে উঠে এল ফোকরের বাইরে। সময়মতই বেরিয়েছে। দেখল, সিঁড়ির গর্ত দিয়ে বেরিয়ে আসছে দুই টোড। ঝোপের আড়ালে আড়ালে ওদের কাছাকাছি চলে গেল সে, কি বলে শোনার জন্যে।

টেরির জন্যে অস্থির হয়ে আছে দু-জনে।

মিসেস বলল, ও পাতালঘরে নেই, কতবার বলব! খোঁজা কি আর বাকি রেখেছি?,

অনেক ঘর অনেক গলিঘুপচি আছে ওর মধ্যে, উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তায় অনেক বেশি খসখসে হয়ে গেছে টোডের কণ্ঠ। বাকি থাকলেও জানছি কি করে?

যে ভাবে চিৎকার করে ডেকেছি, তার কানে শব্দ যেতই।

না-ও যেতে পারে। মাটির নিচের এসব ঘরগুলো ভয়ানক…

তোমার মাথায় গোবর ভরা আছে, মিস্টার টোড! রেগে গেল মিসেস। আমি বলছি ও এ দ্বীপে নেই। ওকে গায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

কারা নিল?

যারা জিনিসগুলো নিয়ে গেছে। গুরু-ছাগলের ডাক ডেকে ভয় দেখিয়েছে। নৌকায় তুলে ওরাই নিয়ে গেছে আমার টেরিকে…

নৌকাটা তাহলে কোথায় ছিল?

সেটা আমি কি জানি? ছিল নিশ্চয় কোথাও। লুকিয়ে রেখেছিল। পুরো। দ্বীপের কোথায় কি আছে না আছে সব কি আমরা জানি নাকি?

 কি করতে বলছ তাহলে?

গাঁয়ে গিয়ে খুঁজতে হবে। ভয় লাগছে আমার, জন। টেরির যদি কিছু হয়ে যায় আমি বাঁচব না…

তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। নিজের ছেলেকে যখন খুঁজে পাচ্ছে না, তখন কান্নাকাটি শুরু করেছে। যে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে ওরা, তার মায়ের কি অবস্থা, মা হয়েও একবার ভাবেনি।

এখুনি চলো, তাগাদা দিল মিসেস।

ডারবিকে কি করব?

এখানেই থাকবে। মেয়েটাকে পাহারা দিক।

অন্ধকারে একা থাকবে মেয়েটা, ভয় পাবে না?

ডারবি তো থাকছেই, ভয় কিসের? চলো, চলো, দেরি করলে কি হয়ে যায় কে জানে!

কি মহিলারে বাবা!–ভাবছে কিশোর। ছোট্ট একটা মেয়েকে অন্ধকার পাতালঘরে রেখে যেতে এতটুকু মন কাঁপছে না। তবে একদিক থেকে ভালই হবে। ওরা চলে গেলে নির্বিবাদে গিয়ে মেয়েটাকে বের করে আনা যাবে, ঝামেলা হবে না।

কুকুরটাকে রেখে চলে গেল টোডেরা।

দু-পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের চলে যেতে দেখল ডারবি। তারপর দৌড়ে ফিরে গেল চত্বরে, অলস ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। দিনের আলোয় রোদের মধ্যে থেকেও ভারি অস্বস্তি বোধ করছে কুকুরটা। কান খাড়া, সারাক্ষণ তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। আজব এই দ্বীপটাকে মোটেও পছন্দ করতে পারছে না সে।

তাড়াতাড়ি এসে গুহায় ঢুকল কিশোর। বলল, বাইরে এসো সবাই। জরুরী কথা আছে। টেরি, তুমি বসে থাকো। এগুলো আমাদের কথা, তোমার শোনার দরকার নেই।

টেরির পাহারায় রইল রাফি। অন্যেরা কিশোরের সঙ্গে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল।

শোনো, বলল কিশোর, টোডেরা নৌকায় করে গায়ে চলে গেছে। টেরিকে খুঁজতে। বাচ্চা মেয়েটাকে রেখে গেছে পাতালঘরে, ডার্টির পাহারায়। মিসেস টোড সাংঘাতিক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। তার ধারণা, কেউ তার সোনামানিককে ধরে নিয়ে চলে গেছে, তার দুধের শিশুটা ভয়েই আধমরা হয়ে এখন তার জন্যে কান্নাকাটি করছে।

আহারে! জিভ দিয়ে চুকচুক করল মুসা।

শয়তান মেয়েমানুষ! ফুঁসে উঠল জিনা। ছোট্ট মেয়েটাকে যে ধরে এনেছে, কষ্ট পাচ্ছে অন্ধকার পাতালঘরে বসে, সেটা একবার তাবেনি! ওটা, মহিলা না, ডাইনী!

ঠিকই বলেছ, মাথা কাত করল কিশোর। আমার প্ল্যান শোনো। এখুনি গিয়ে মেয়েটাকে বের করে আনব। তারপর গুহায় ফিরে নাস্তা সেরে নৌকায় করে তাকে নিয়ে যাব থানায়। পুলিশই তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করবে।

টেরিকে কি করব? জানতে চাইল রবিন।

টেরিকে! একেবারে তিন গোয়েন্দার মনের কথাটা বলে ফেলল জিনা, ওকে রেখে যাব পাতালঘরে। মেয়েটার জায়গায়। ফিরে এসে তার জায়গায় ছেলেকে দেখে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে ধাড়ি বেঙগুলোর।

টেরির একটা ঠ্যাং-ঠুং ভেঙে দেব নাকি? পরামর্শ চাইল মুসা, য়াতে সারাজীবন খুঁড়িয়ে চলতে হয়…

না না, হাত নাড়ল কিশোর, ওসব ভাঙাভাঙির মধ্যে গিয়ে কাজ নেই। এমনিতেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে যাবে, দেখোই না খালি। এসো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

গুহায় ঢুকে টেরিকে বলল কিশোর, এই, এসো আমাদের সঙ্গে। রাফি, তুইও যাবি।

সন্দেহ ফুটল টেরির চোখে, কোথায়?

চমৎকার একটা জায়গায়, যেখানে এখানকার চেয়ে আরাম অনেক বেশি। মহাআনন্দে থাকতে পারবে। এসো।

সেখানে গরুগুলোও তোমাকে কামড়াতে পারবে না, হেসে বলল মুসা। নাও, ওঠো।

আমি যাব না।

রাফি, ওঠো তো, আদেশ দিল কিশোর।

গরগর করতে করতে এগিয়ে এল রাফি। নাক ঠেকাতে গেল টেরির পায়ে।

একলাফে উঠে দাঁড়াল সে।

দড়ি বেয়ে আগে আগে উঠে গেল মুসা ও জিনা। টেরিকে উঠতে বলল কিশোর। কিন্তু ভয়ে উঠতে চাইল না সে। আবার এগিয়ে এল রাফি। খাউ করে পায়ে কামড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল। লাফিয়ে উঠে দড়ি ধরে ফেলল টেরি। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে চলে গেল রাফির নাগালের বাইরে। তারপর চুপচাপ ঝুলে থেকে চেঁচাতে থাকল। বাধ্য হয়ে ওপর থেকে টেনে তাকে তুলে নিতে হলো মুসা ও জিনাকে।

রবিন আর কিশোরও উঠল।

জলদি করো, তাগাদা দিল কিশোর। ওরা ফিরে আসার আগেই কাজ সারতে হবে।

ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে প্রায় দৌড়ে এগোল ওরা। রাফি উঠে আসতে লাগল ঢাল বেয়ে। সবাই এসে দাঁড়াল দুর্গের চত্বরে।

ওদেরকে সিঁড়ির দিকে এগোতে দেখে ভয় পেয়ে গেল টেরি, আমি নিচে নামব না!

কেন, এত কিসের ভয়? তার মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল মুসা, গরুর? কিন্তু গরু তো বেঙাচি খায় না।

উদ্বিগ্ন হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে টেরি, আমার বাবা-মা কোথায়?

আছে, আছে, ভয় নেই। বাজারে গেছে তোমার জন্যে দুধের বোতল আনতে। চলে আসবে।

হেসে উঠল অন্য তিনজন। টেরির চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এমন বিপদে আর পড়েনি।

গর্তের মুখের ঢাকনাটা চাপা দিয়ে গেছে টোডেরা। তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে বড় বড় পাথর।

তোমার বাবা-মা কত্তবড় শয়তান, দেখো, জিনা বলল। ছোট্ট একটা মেয়েকে অন্ধকার ঘরে তো রেখেই গেছে, তার ওপর গর্তের মুখও বন্ধ করে গেছে, যাতে কোনমতেই বেরোতে না পারে। তোমার বিপদের জন্যেও ওরাই দায়ী, আর কাউকে দোষ দিতে পারবে না।

এটাকে দিয়েই পাথরগুলো সরানো যাক, টেরিকে দেখিয়ে প্রস্তাব দিল। মুসা। বাবা-মায়ের কাজ ছেলেরাই তো করে দেয়…

মাথা নাড়ল কিশোর, ও করে দেবে, আর লোক পেলে না। ও তো জানে খালি খাওয়া আর শয়তানি, অকাজের ধাড়ি। সময় নেই, এসো, হাত লাগাও সবাই।

পাথর সরানোর কাজে সাহায্য করতে টেরিকেও বাধ্য করল রাফি।

সিঁড়িতে পা রাখতে যাবে কিশোর, এই সময় একটা ঝোপের দিকে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল টেরি, ওই যে, ডারবি!

রাফির ভয়ে গিয়ে ওখানে ঢুকেছে নোংরা কুকুরটা। টেরিকে দেখে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। একবার মুখ বের করছে, আবার ঢুকে পড়ছে।

যেমন মনিব, তার তেমন কুকুর, হুহ! তীব্র ঘৃণা জিনার কণ্ঠে।. এই রাফি, ছেড়ে দে। ওটাকে কামড়ে মজা পাবি না। নিজের শরীরই দুর্গন্ধ করবি।

কিন্তু রাফি জানে, জিনা ভুল বলেছে, কামড়ে খুব মজা পাবে সে। বাধা দেয়ার কেউ নেই এখন, সহজেই কেটে নিতে পারে কুকুরটার একটা কান। মাঝে মাঝে জিনার এসব নির্দেশের কারণ বুঝতে পারে না সে। শত্রু কুকুরকে কামড়াতে মানা করে, খরগোশ তাড়া করতে দেয় নাঃ..এসব সময় মনে হয়, তার কুকুর-জন্মই বৃথা। মুখটাকে করুণ করে ফেলল সে।

কিন্তু তার অভিমান দেখার সময় নেই এখন জিনার। তাড়াহুড়ো করে অন্যদের সঙ্গে পাতালঘরে নেমে যেতে লাগল। দেয়ালে যে চকের চিহ্ন দিয়ে . রেখেছে কিশোর, তা দেখে সহজেই এগোতে পারছে ওরা।

যে ঘরে রাত কাটায় টোডরা সেটার সামনে এসে দাঁড়াল দলটা। দরজা লাগানো। বাইরে থেকে খিল তুলে দেয়া। ভেতরে কোন শব্দ নেই। দরজার গায়ে নখের আঁচড় দিতে দিতে মৃদু গোঁ গোঁ করতে লাগল রাফি। বুঝে গেছে, ভেতরে মানুষ আছে।

চিৎকার করে কিশোর বলল, কেউ আছ ভেতরে? আমরা তোমাকে বের করে নিয়ে যেতে এসেছি।

খসখস শব্দ হলো। উঠে দাঁড়াল যেন কেউ। দৌড়ে এল দরজার দিকে। জবার দিল একটা ছোট্ট কণ্ঠ, কে তোমরা! আমাকে বের করে নিয়ে যাও! আমার খুব ভয় লাগছে!

কথা শেষ হওয়ার আগেই খিল খুলতে শুরু করেছে কিশোর। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা। ভেতরে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। সেই আলোয় দাঁড়িয়ে। থাকতে দেখল ছোট্ট মেয়েটাকে। কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে মুখ। বড় বড় বাদামী চোখে আতঙ্ক। কাঁদছিল, গালে পানির দাগ, তাতে ময়লা লেগে কালচে হয়ে আছে।

সোজা গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল মু। হেসে বলল, আর ভয় নেই, আমরা এসে গেছি। কেউ আর কিছু করতে পারবে না তোমার।

আমি মার কাছে যার! ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। আমাকে এখানে। রেখেছে কেন? এখানে আমার ভাল লাগে না!

 তা তো লাগবেই না। এমন জায়গায় কি কারও ভাল লাগে? কোমল গলায় বলল কিশোর। তোমার মার কাছেই নিয়ে যাব আমরা। আগে চলো আমাদের গুহায়। নাস্তা খাবে। তারপর নৌকায় করে চলে যাব আমরা।

তোমাদের সঙ্গে যাব আমি, চোখ ডলতে ডলতে বলল মেয়েটা। তোমরা খুব ভাল। তোমাদেরকে আমার ভাল লাগছে। অন্য মানুষগুলোর মত খারাপ না তোমরা। ওদেরকে আমার ভাল লাগে না।

ওদেরকে কারোরই ভাল লাগে না, রবিন বলল।

রাফির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল জিনা, দেখো, ও হলো রাফি, আমাদের কুকুর। ও তোমার বন্ধু হতে চায়।

শরীর মুচড়ে মুসার কোল থেকে নেমে গেল মেয়েটা। রাফির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, খুব ভাল কুকুর, লক্ষ্মী কুকুর ও। কুকুর আমার খুব ভাল লাগে। আমারও আছে একটা।

গাল চেটে মেয়েটার মুখের পানি মুছিয়ে দিল রাফি।

তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

 ডরোথি হুবার্টসন। মা ডাকে, ডল।

ডলই তুমি, এক্কেবারে পুতুল। আদর করে ওর গাল টিপে দিল জিনা।

তুমিও খুব ভাল ছেলে।

 হাসল জিনা। আমি ছেলে নই, মেয়ে, তোমার মতই।

তাহলে ওরকম ছেলেদের মত কাপড় পরে আছ কেন?

পরে থাকতে আমার ভাল লাগে।

দাঁড়াও, আমিও পরব ওরকম। বাড়ি গিয়ে মাকে বলব এই কাপড় দিতে। তোমরা কে?

এক এক করে নিজেদের পরিচয় দিল গোয়েন্দারা।

 ও কে? টেরিকে দেখাল ডল।

ও? বেঙাচি, মুসা বলল। ও আমাদের কেউ নয়। ওর বাবা-মাই তোমাকে এনে আটকে রেখেছে এখানে। তোমার জায়গায় এখন ওকে রেখে যাব আমরা। ওর বাবা-মার জন্যে একটা সারপ্রাইজ।

পাতালঘরে একা থাকার কথা শুনেই চেঁচিয়ে গলা ফাটাতে শুরু করল টেরি। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মুসার সঙ্গে কি আর পারে। একটানে তাকে ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

তোমাদের মত শয়তানদের এই শাস্তিও খুব কম হয়ে গেল। তবু যা হোক, তোমার বাবা-মার ছোট্ট একটা শিক্ষা অন্তত হবে। অন্যের বাচ্চাকে ধরে এনে আটকে রাখলে তাদের কেমন লাগে, বুঝতে পারবে। থাকো এখানে। একা থাকতে ডলের কেমন লেগেছিল, বুঝিয়ে বোলো বাবা-মাকে। চলি। গুডবাই।

অন্যেরা আগেই বেরিয়ে গেছে। বেরিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিল মুসা।

পাল্লার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল টেরি। কিল মেরে মেরে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল, দোহাই তোমাদের, আমাকে বের করো! ভুতে খেয়ে ফেলবে আমাকে!

ভূতের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তোমাকে খেতে আসে! আর যদি তোমার মত কোন ছ্যাচড়া ভূত চলেই আসে, পচা পচা ছড়া শুনিয়ে দেবে। তোমার ওই জঘন্য ছড়া ভূতেরাও সইতে পারবে না।

গরুগুলো আসবে…

না, আসবে না। মানা করে দেব।

খিদেয় মারা যাব।

দু-একদিন না খেয়ে থাকলে মানুষ মরে না। চলি। যত খুশি চিল্লাও ওখানে বসে।

ফিরে চলল ওরা।

চিৎকার করে কাঁদতে লাগল টেরি।

লজ্জাও নেই! জিনা বলল, ঘেন্না লাগে এসব ছেলেকে দেখলে! এত্তবড় ছেলে, বাচ্চাদের মত কাঁদে, দেখো!

জলদি চলো, এতক্ষণে খিদে টের পাচ্ছে মুসা, আমার পেট জ্বলে গেল, খিদেয়।

আমারও খিদে পেয়েছে, মূসার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল ডল। ঘরটাতে যখন ছিলাম, তখন পায়নি। এখন খেতে ইচ্ছে করছে। তোমরা খুব ভাল, আমাকে বের করে এনেছ।

তোমাকে বের করে বেঙাচিটাকে যে রেখে আসতে পেরেছি, এতে আমরাও খুশি।

যেমন কুকুর তার তেমনি মুগুর, রবিন বলল। পাতালঘরে এসে ছেলেকে দেখলে আক্কেল হবে টোডদের।

যদি আক্কেল থাকে, জিনা বলল।

অনেক গলি-ঘুপচি আর ঘর পেরিয়ে অবশেষে সিঁড়ি বেয়ে আবার ওপরে উঠে এল ওরা।

উজ্জল রোদে বেরিয়ে যেন হা করে আলো-বাতাস গিলতে লাগল উল। ওহ, কি সুন্দর, কি সুন্দর! কোথায় আনা হয়েছে আমাকে?

একটা দ্বীপে, জবাব দিল জিনা, আমাদের দ্বীপ। এই যে ভাঙা দুৰ্গটা, এটাও আমাদের। কাল রাতে একটা নৌকায় করে তোমাকে এখানে আনা হয়েছিল। তোমার চিৎকার শুনতে পেয়েছি আমরা। তাতেই বুঝেছি, তোমাকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে।

একের পর এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে যেন ডলের জন্যে। ফোকর দিয়ে ঢুকে দড়ি বেয়ে গুহায় নেমে তাজ্জব হয়ে গেল।

কিশোরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল রবিন, সাহস আছে মেয়েটার! দেখলে, কেমন দড়ি বেয়ে নেমে পড়ল। ইকটু বাধাও দিল না। ভয় পেল না!

মুসা বলল, জিনার বোন হলে ভাল মানাত। এক্কেবারে এক চরিত্র মনে হচ্ছে।

জিনা নামটা কানে গেল জিনার। ঘুরে জিজ্ঞেস করল, আমার কথা কি বলছ?

না, কিছু না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল মুসা, তোমাকে কিছু বলছি না!

.

১৫.

ট্রাংকটার দিকে চোখ পড়ল ডলের। দেখল, পুতুলগুলো পড়ে আছে মাটিতে। চেঁচিয়ে উঠল, আমার পুতুল! কোথায় পেলে তোমরা? ইস, কত কেঁদেছি ওগুলোর জন্যে। ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে নিতে নিতে বলল, আমার টিনা, আমার রুবি, আমার শেলিতোমরাও কেঁদেছ, না? …পিটার দুষ্টুটাও আছে দেখি, খেলনা ভালুকটাকে আদর করল সে। এ কি! জেনির পেট কে কাটল! হায় হায়!

কাটা পুতুলটাকে তুলে নিল ডল।

প্রমাদ গুণল কিশোর। এমন জানলে কি আর ফেলে রাখে ওখানে। তাড়াতাড়ি ঢলের পাশে এসে বুঝিয়ে বলল, আমিই কেটেছি। ওকে না কাটলে তোমাকে বের করে আনা যেত না…

কেন, যেত না কেন?

ওকে কেটে সূত্র বের করার চেষ্টা করেছি আমরা।

সূত্র তো বের করে গোয়েন্দারা। মা বলেছে আমাকে।

 আমরা গোয়েন্দা।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল ডলের। জেনির শোক ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, তোমরা গোয়েন্দা! কি মজা! তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল হলো। ইস্কুলের সবাইকে গিয়ে বলতে পারব। …আমার খিদে পেয়েছে। খাবার দাও।

হাঁপ ছেড়ে বাঁচল কিশোর। দাঁড়াও, এখনই দিচ্ছি।

খাবারের টিন কাটতে বসল রবিন। একটিন স্যামন, দুই টিন পিচ, একটিন দুধ কেটে রেখে, বড় একটা রুটি টেনে নিয়ে স্লাইস করল। মাখন মাখাল। বড় এক জগ কোকা গুলল।

 খেতে বসল সবাই। গপ গপ করে গিলতে লাগল ডল। আস্তে আস্তে গালের ফ্যাকাসে ভাব কেটে গিয়ে গোলাপী হয়ে উঠল।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, ডল, এখানে কি করে এলে তুমি, বলতে পারবে?

আমার নার্সের সঙ্গে বাগানে খেলছিলাম আমি। আমার দুধ আনতে ঘরে গেল নার্স। হঠাৎ একটা লোক দেয়াল টপকে ঢুকে, আমার গায়ে একটা কম্বল ফেলে দিল। সেটা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে তুলে নিয়ে চলে গেল। একটু পরে সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পেলাম। সাগর আমি চিনি। ছুটির দিনে আব্বা সৈকতে নিয়ে যায় আমাকে। আমার গা থেকে কম্বল সরিয়ে ফেলল লোকটা। তারপর একটা বোটে তুলল। একটা ঘরে বন্ধ করে রাখল দুদিন। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। কত কাঁদলাম, কেউ শুনল না।  

লোকটাকে তুমি চেনো?

না। আগে কখনও দেখিনি। এখানে আনার পর মহিলাটাকে চিনলাম। আমাদের বাড়িতে রান্না করত। মিসেস টোড। খুব খারাপ। আমার কোন কথাই শুনল না। আমাকে বের করে বাড়িতে নিয়ে যেতে বললাম। ধমক মারল। মারবে বলেও ভয় দেখাল।

হুঁ, তাহলে এই ব্যাপার! আসল কিডন্যাপার তাহলে অন্য লোক, যার একটা বোট আছে। তোমাকে কিডন্যাপ করতে তাকে সাহায্য করেছে টোডেরা। তোমাকে ওদের কাছে তুলে দিয়েছে লোকটা, এখানে এনে লুকিয়ে রাখার জন্যে।

তারমানে, রবিন বলল, সেদিন যে দ্বীপে ধোঁয়া উঠতে দেখেছিলাম, ওই লোকই নেমেছিল এখানে। জায়গাটা দেখেছে। এখানে ডলকে লুকিয়ে রাখা যাবে কিনা বুঝতে চেয়েছে। শলা-পরামর্শ করেছে টোডের সঙ্গে।

ধরতে পারলে ওকে আমি দ্বীপে নামা বার করব! দাঁতে দাঁত চেপে বলল জিনা।

নাস্তা শেষ হলো।

কিশোর বলল, ডলকে থানায় নিয়ে যেতে হবে। পত্রিকাগুলো নিশ্চয় ওকে নিয়ে খবর ছেপে গরম করে ফেলেছে। পুলিশ দেখলেই চিনতে পারবে।

কিন্তু ডলকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনলেই তো পালাবে টোডেরা। একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, রবিন বলল। ওদের ধরা দরকার।

দেখি, বুদ্ধি একটা বের করেই ফেলব।

চলো তাহলে, মুসা বলল। দেরি করে লাভ কি?

এখানে আমার খুব ভাল লাগছে, ডল বলল। গুহাটা খুব সুন্দর। আমার থাকতে ইচ্ছে করছে। আমাকে রেখে তোমরা আবার এখানে আসবে?

হাসল জিনা। আসব। কেন?

আমিও আসব তোমাদের সঙ্গে। উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে তার চোখ। কোনদিন গুহায় থাকিনি তো, থাকতে ইচ্ছে করছে। কি সুন্দর গুহা, দ্বীপ, রাফির মত ভাল কুকুর…জিনাআপু, আমি তোমার মত প্যান্ট-শার্ট পরে আসব।

লও ঠ্যালা! চট করে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল।

মুচকি হাসল তিন গোয়েন্দা।

কিন্তু তোমার আব্বা-আম্মা তো তোমাকে আসতে দেবে না, জিনা বলল। তবু, বলে দেখতে পারো। তুমি এলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। বরং মজাই হবে। তুমি খুব ভাল মেয়ে।

রতনে রতন চেনে, ফস করে বলে ফেলেই জিভ কামড়াল মুসা।

ভুরু কোঁচকাল জিনা, কি বললে?

না, কিছু না, আরেক দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।

জিনা রেগে গেলে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলা যায় না। তাড়াতাড়ি রবিন বলল, বসে আছি কেন আমরা এখনও, যেতে হবে নাঃ..

খাঁড়ির গুহা থেকে নৌকাটা বের করা হলো। সেটা দেখে আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল ডল। বার বার বলতে লাগল, যে ভাবেই হোক, এই দ্বীপে সে ফিরে আসবেই।

নৌকায় উঠল সবাই। পঁাড় তুলে নিল মুসা ও জিনা।

অবাক হয়ে ডল বলল, জিনাআপু, তুমি নৌকাও চালাতে পারো! দাঁড়াও, আমি তোমার কাছে দাঁড় বাওয়া শিখব।

.

ঘাটের কাছেই দেখা হয়ে গেল জেলের ছেলে ফগের সঙ্গে। জিনার নৌকাটা দেখে দৌড়ে এসে ওটা তীরে টেনে তুলতে সাহায্য করল।

 আমি এখনই রওনা হতাম, বলল সে। দ্বীপে যেতাম, তোমাদের খবর দেয়ার জন্যে। মাস্টার জর্জ, তোমার আব্বা চলে এসেছেন। কাল রাতে। তোমার আম্মা আসেননি। তবে তার শরীর এখন অনেক ভাল, তোমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ছয়-সাতদিনের মধ্যেই বাড়ি চলে আসবেন।

আব্বা এসেছে কেন? জানতে চাইল জনা।

আসবেন না? তোমাদের কাছে টেলিফোন করেন, কেউ ধরে না। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। আমার কাছে তোমাদের খবর জানতে এসেছিলেন। আমি বলিনি। কি রাগা যে রেগেছেন তোমাদের ওপর। বাড়ি ফিরে দেখেন, জিনিসপত্র সব তছনছ। তোমরা নেই, টোডেরা নেই। এখন গেছেন থানায়, রিপোর্ট করতে।

ভাল হয়েছে, ওখানেই দেখা হবে আমাদের সঙ্গে। আমার কথায় কান না দিয়ে মিসেস টোডকে বিশ্বাস করার ফল তো পেল। আক্কেল হয়েছে।

ডলকে জিনাদের সঙ্গে দেখে খুব অবাক হয়েছে ফগ। বার বার তার দিকে তাকাতে লাগল।

জিনা বলল, সব তোমাকে বলব, ফগ। এখন সময় নেই। আমরাও থানায় যাচ্ছি।

সারি দিয়ে থানার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল গোয়েন্দাদের বিচিত্র দলটা। গেটে ডিউটিরত সেন্ট্রি ওদের চেনে। ভুরু কুঁচকে তাকাল। কি ব্যাপার, জিনা? তোমার আব্বা এল একটু আগে, তুমিও…।

জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা, আব্বা কোথায়?

শেরিফের রুমে।

আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করল না জিনা। সোজা এসে ঢুকল শেরিফের ঘরে।

দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকালেন মিস্টার পারকার। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এসেছ, না! ছিলে কোথায়? বাড়িঘর সব খালি ফেলে..ডাকাতি করে তো সব নিয়ে গেছে…

করেছে তো তোমার সেই অতি বিশ্বাসী বেঙের দল

কার দল!

বেঙ, বেঙ! বাবার ওপর প্রচণ্ড অভিমানে খেপে আছে জিনা। টোড মানে যে বেঙ, ভুলে গেছ!…জাহান্নামে যাক ঘরবাড়ি! আম্মা কেমন আছে, বলো!

ভাল। আগের চেয়ে অনেক ভাল, জিনাকে রেগে উঠতে দেখে শান্ত হয়ে গেলেন মিস্টার পারকার। জিনা যেমন তাকে ভয় পায়, তিনিও তাকে ভয় পান। ও রেগে গেলে ওর মা ছাড়া আর কেউ ঠাণ্ডা করতে পারবে না, জানেন। ঝামেলার মধ্যে গেলেন না। বসে পড়লেন আবার। তোমার মা-ই তো আমাকে পাগল করে দিল। আসতে বাধ্য করল। খালি এককথা, ছেলেমেয়েগুলো কেমন আছে, কি খাচ্ছে না খাচ্ছে…আমি এদিকে ফোন করে জবাব পাই না। তাকে কি জবাব দেব? মিথ্যেই বলতে হলো, ভাল আছ। কিন্তু কত আর মিথ্যে বলা যায়। শেষে দেখতে এলাম। এসে তো দেখি এই অবস্থা। ছিলে কোথায়?

দ্বীপে। কিশোরের মুখেই সব শোনো।

বাপ-মেয়ের এই ঝগড়া খুব উপভোগ করেন শেরিফ লিউবার্তো জিংকোনাইশান। জিনার বাবার বন্ধু তিনি, বাড়িতে যাতায়াত আছে। মুচকি মুচকি হাসছেন।

পাল্লা আবার ঠেলে খুলে ডাক দিল জিনা, কিশোর, এসো।

নাটকীয় ভঙ্গিতে ডলের হাত ধরে ঘরে ঢুকল গোয়েন্দাপ্রধান। পেছনে তার দলবল।

ডলকে দেখে হাঁ হয়ে গেলেন শেরিফ। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। একে কোথায় পেলে! এই খুকি, তুমি ডরোথি না?

ডরোথি হুবার্টসন, জবাব দিল সে। আম্মা ডাকে ডল।

খোদা! পুরো এলাকা চষে ফেলেছে পুলিশ, হন্যে হয়ে খুঁজছে একে, আর ও নিজেই এসে হাজির।

কি বলছ, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছেন মিস্টার পারকার। কেন খুঁজছ?

খবরের কাগজ পড়ো না নাকি…

না, কদিন ধরে পড়তে পারছি না..জিনার মাকে নিয়েই ব্যস্ত…

এ জন্যেই জানো না। কোটিপতি হুবার্টসনের মেয়ে ও। সাংঘাতিক প্রভাবশালী লোক। গরম করে ফেলেছে সব। ধমক দিয়ে দিয়ে অস্থির করে ফেলেছে আমাদের। মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নোট পাঠিয়েছে, দশ লক্ষ ডলার দিলে ফিরিয়ে দেয়া হবে।…কিশোর, তোমরা একে পেলে কোথায়?

জিনার দ্বীপে, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর।

ছেলেমেয়েদের বসতে বললেন শেরিফ। একজন সহকারীকে ডাকলেন নোট নেয়ার জন্যে।

গোড়া থেকে সমস্ত কাহিনী বলে গেল কিশোর। কিছুই বাদ না দিয়ে। লিখে নিল শেরিফের সহকারী।

শুনতে শুনতে এমন অবস্থা হলো মিস্টার পারকারের, কোটর থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে চোখ।

শেরিফ জিজ্ঞেস করলেন, যে বোটটা দিয়ে আনা হয়েছে ডলকে, সেটার ক্যাপ্টেনের নাম কি?

বলতে পারব না, মাথা নাড়ল কিশোর। টেরি কেবল বলেছে, তার মাকে নাকি মারিয়া নামটা বলতে শুনেছে।

মারিয়া! ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলেন শেরিফ। পুলিশের খাতায় নাম আছে ওটার, বদনাম। ক্যাপ্টেনের নাম হিউগো ব্রোকার, মারিয়া তার বোটের নাম। ডাকাতির দায়ে জেল খেটেছে বহুবছর হিউগে। বেরিয়েই আবার শুরু করেছে। টোডদের সঙ্গে জোট পাকিয়ে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেছে। কদিন ধরে এদিকের সাগরে তার বোটটাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে, রিপোর্ট পেয়েছি। কিডন্যাপের খবরটা শুনেই সন্দেহ হয়েছিল আমার, তার কাজ হতে পারে। হলোও তাই।

ওকে ধরা দরকার, কিশোর বলল। টোডদেরকেও।

বোটটা আটকানো কোন ব্যাপারই না। এখনই অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি, আমি। টোডরাও পালাতে পারবে না। কিন্তু ওরা তো সব অস্বীকার করবে। প্রমাণ করব কি করে এই কিডন্যাপিঙে ওরা জড়িত?

আমরা সাক্ষি দেব। তবে স্বীকারোক্তির সহজ একটা পথ আমি বাতলে দিতে পারি…

কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন শেরিফ, কি ভাবে?

চমকে দিয়ে। ওদের ছেলেকে পাতালঘরে আটকে রেখে এসেছি আমরা। সেই খবরটা কোনভাবে ওদের কানে তুলে দিতে হবে। ওরা তখন ছেলেকে বের করে আনতে পাতালঘরে নামবে। ডলকে যে নিয়ে এসেছি। আমরা, সেটা ওদেরকে জানানো হবে না। ওখানে ছেলেকে দেখে, ভীষণ চমকে যাবে ওরা। ডল কোথায় জিজ্ঞেস করবে। কাছেই লুকিয়ে থাকবে পুলিশ। আড়াল থেকে সব শুনবে। পুলিশ অফিসারের সাক্ষি নিশ্চয় আদালত গ্রহণ করবে।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলেন শেরিফ। হাসি ফুটল মুখে। ধীরে ধীরে চওড়া হলো হাসিটা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিলেন তাঁর সহকারীকে।

পুলিশকে সহায়তা করার জুন্যে বার বার ছেলেমেয়েদের ধন্যবাদ দিলেন তিনি। হাত বাড়ালেন ফোনের দিকে, ডলের বাবাকে খবর জানানোর জন্যে।

জিনার দিকে তাকিয়ে মিস্টার পারকার জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বাড়ি ফিরে যাবে?

গিয়ে আর কি করব এখন? কাজের মানুষ নেই, কিছু নেই…

আইলিনকে খবর পাঠিয়েছি। ও আজই চলে আসবে।

আম্মা না আসা পর্যন্ত আমরা দ্বীপেই থাকতে চাই, আব্বা। আম্মার ঘর খালি দেখলে ভাল লাগে না আমার। আইলিন যখন আসছে আর তো কোন চিন্তা নাই। ঘরদোর সে-ই দেখেশুনে রাখবে।

রাজি হয়ে গেলেন পারকার, বেশ। তবে তোমার আম্মা আসার পর আর একদিনও দেরি করতে পারবে না।

 দেরি করব মানে? তাকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে আছি আমি।

খবর পাবে কি করে?

হাসল জিনা। সে তোমাকে ভাবতে হবে না। আম্মা আসার সঙ্গে সঙ্গে খবর পৌঁছে যাবে আমার কাছে।

পারকারের দিকে তাকিয়ে হাসলেন শেরিফ। গোয়েন্দাগিরি করে ওরা, ভুলে যাচ্ছ কেন, জনাথন। একআধজন স্পাই থাকবে না, এটা কি হয়?

.

১৬.

সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন মিস্টার পারকার। ডল ইচ্ছে করেই চলে এসেছে তাদের সঙ্গে। শেরিফকে অনুরোধ করে এসেছে, তার বাবা-মা এলে যেন গোবেল ভিলায় পাঠিয়ে দেন।

হাসিমুখে বাগানের গেট খুলে দিল আইলিন। জরুরী তলব পেয়ে ছুটতে ছুটতে চলে এসেছে। কি ব্যাপার, কিছুই জানতে চাইল না। সবাইকে হাত মুখ ধুয়ে এসে আগে খেতে বসতে বলল, রান্না শেষ।

খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করল ছেলেমেয়েদের। গোবেল বীচে আসার মজা এতদিনে আরম্ভ হয়েছে।

খেতে খেতে আইলিনকে তাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনাল ওরা।

 অবাক হলো না আইলিন। এরকম অ্যাডভেঞ্চার অনেক করেছে ওরা। এসব দেখতে দেখতে গা-সওয়া হয়ে গেছে তার।

হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ পড়ল রবিনের। মুখের কাছে থেমে গেল চামচ। পাতাবাহারের বেড়ার ওপাশে উঁকিঝুঁকি মারছে একজন লোক।

এই, দেখো দেখো!

মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েই মুসা বলে উঠল, খাইছে! বড়-বেঙটা এখানে কি করছে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। তোমরা বসো এখানে। আমি আসছি। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

বেড়ার কাছে এসে ডাক দিল, মিস্টার টোড, শুনুন। টেরিকে খুঁজছেন?

 চমকে গেল টোড। তাকিয়ে রইল কিশোরের দিকে। কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

দুর্গের নিচে পাতালঘরে আছে ও, জানাল কিশোর। গেলেই পাবেন।

তাকাও এদিকে!ওর কথা তুমি জানলে কি করে? ছিলে কোথায় এ কদিন? বাড়ি যাওনি?

ওসব আপনার জানার দরকার নেই। টেরিকে পেতে চাইলে দ্বীপে চলে যান। পাতালঘরে আটকা পড়ে কান্নাকাটি করছে বেচারা।

চোখে চোখে তাকাল টোড। কিশোরের মনে কি আছে বোঝার চেষ্টা করল। তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল।

দৌড়ে ঘরে ফিরে এল কিশোর, থানায় ফোন করার জন্যে। সে নিশ্চিত, মিসেস টোডকে গায়ের ভেতর কোথাও রেখে এসৈছে টোড, টেরিকে খুঁজতে খুঁজতে নিজে চলে এসেছে এখানে। কিশোরদের এখানে দেখতে পাবে কল্পনাও করেনি। এখন গিয়ে মিসেসকে বলবে সব, যত তাড়াতাড়ি পারে চলে যাবে। দ্বীপে, টেরিকে বের করে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে।

খাওয়া শেষ করেই মিস্টার পারকার বললেন, হাসপাতালে চলে যাচ্ছেন। তিনি। খবর জানার জন্যে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছেন জিনার আম্মা।

তাকে বলব, পারকার বললেন, দ্বীপে চলে গেছ তোমরা। খুব ভাল আছ। তবে তোমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কথা এখন বলা যাবে না, দুশ্চিন্তা করতে পারে। বাড়ি এলেই বলব সব।

গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন তিনি।

তখুনি দ্বীপে চলে যাবে কিনা, এ নিয়ে আলোচনা শুরু করল। গোয়েন্দারা। যেতে কোন বাধা নেই, অসুবিধে হলো ডলকে নিয়ে। তাকে কি করবে বুঝতে পারছে না।

সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে ওরা, এই সময় বিরাট একটা গাড়ি এসে থামল গেটের বাইরে। লাফ দিয়ে নামলেন লম্বা একজন ভদ্রলোক, সঙ্গে খুব সুন্দরী একজন মহিলা।

জিনা বলল, ডল, দেখো তোমার আব্বা-আম্মা বোধহয় এলেন।

.

আদরের চোটে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হলো ডলের। জোর করেই শেষে বাবা-মা দুজনের কাছ থেকে সরে এল।

তাঁদেরকে জানানো হলো সব। মিনিটে অন্তত বিশবার করে গোয়েন্দাদেরকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন মিস্টার হুবার্টসন, তাতেও যেন মন ভরছে না, আরও বেশি করে দিতে চাইছেন।

যে কোন একটা পুরস্কার চাও তোমরা, বললেন তিনি। যা ইচ্ছে। কি খুশি যে হয়েছি আমি তোমাদের ওপর, বলে বোঝাতে পারব না।

আপনি যে খুশি হয়েছেন, এতেই আমরা খুশি, কিশোর বলল, এটাই আমাদের পুরস্কার। ডলকে শয়তানদের হাত থেকে বের করে আনতে পেরেছি, আর কি চাই।

কিন্তু আমার কাছ থেকে তোমাদের কিছু নিতেই হবে!

কি যেন ভাবছে জিনা। তার গা ঘেঁষে বসে আছে ডল। বাবা-মায়ের অলক্ষ্যে কনুই দিয়ে গুঁতো মারল জিনার পেটে।

সত্যিই দিতে চান? হঠাৎ প্রশ্ন করল জিনা।

চাই! কি চাও, বলো?

দেবেন তো?

দেব।

বেশ, ডলকে কয়েক দিন আমাদের সঙ্গে দ্বীপে থাকতে দিন।

থমকে গেলেন হুবার্টসন। বলো কি! কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল…এতদিন পর ফিরে পেলাম মেয়েকে, ছেড়ে দেব… না দেখে থাকব কি করে?

আব্বা, তুমি কথা দিয়েছ ওদেরকে, যা চায় দেবে। ছুটে এসে বাবার হাত চেপে ধরল ডল, আব্বা, আমাকে থাকতে দাও! দ্বীপটা যে কি সুন্দর। আর গুহাটা, উফ! দাও না, আব্বা! ওখানে যা একটা দুর্গ আছে না, মাটির নিচে ঘর…

 রাফিকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব আমরা, সুপারিশ করল রবিন, কোন ভয় নেই। বড় বড় চোর-ডাকাতকেও ঘায়েল করে ফেলতে পারে সে। ডলের কিছু করতে পারবে না কেউ। কি রে রাফি, পাহারা দিয়ে রাখতে পারবি না?

মাথা দোলাল রাফি। বলল, হাউ!

অবশেষে রাজি হলেন হুবার্টসন, এক শর্তে দিতে পারি। কাল আমি আর তোমার আম্মা দ্বীপে যাব দেখতে, জায়গাটা সত্যি থাকার মত কিনা। দিনটা তোমাদের সঙ্গে কাটাব। আমাদেরকে উৎপাত মনে করা চলবে না।

করব না আব্বা, করব না! খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল ডল। বাপের গা বেয়ে কোলে উঠে চপাৎ চপাৎ করে চুমু খেলো দুই গালে।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, আপনারা তো নিশ্চয় হোটেলে উঠবেন? ডল তাহলে আমাদের কাছেই থাক, নাকি?

এতক্ষণে কথা বললেন ডলের আম্মা, সঙ্গে নিতে পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু তোমাদের অখুশি করি কি করে। ঠিক আছে, থাক… হাসলেন তিনি।

গোয়েন্দাদের আরও কয়েকবার ধন্যবাদ জানিয়ে, গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন ডলের আব্বা-আম্মা।

মিনিটখানেক পর দরজায় টোকা পড়ল।

খুলে দিল জিনা। দেখে, একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, একটু আগে নৌকা নিয়ে দ্বীপে রওনা হয়েছে টোডরা। আমিও যাব। দ্বীপে ঢোকার রাস্তা চিনি না, পথটাও নাকি ভাল না শুনেছি। মিস জর্জিনা, তুমি তো সবচেয়ে ভাল চেনো। এলে ভাল হত।

আমি মাস্টার জর্জ, নট মিস জর্জিনা, গম্ভীর হয়ে বলল জিনা।

মুহূর্তের জন্যে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন পুলিশ অফিসার। সামলে নিয়ে বললেন, সরি, মাস্টার জর্জ। তো, আসবে?

খুশি হয়েই আসব। তবে একা নয়। আমার বন্ধুদেরও নিতে হবে।

কোন অসুবিধে নেই। এসো।

জিনার বোটে করে চলল সে আর তার বন্ধুরা। অফিসারও চললেন সেটাতে করেই। পেছনে বেশ কিছুদূর থেকে ওদেরকে অনুসরণ করে এল পুলিশের বোট।

 দ্বীপের একটা ধারে নৌকা নিয়ে এল জিনা, যেখান দিয়ে ডাঙায় উঠতে কষ্ট হয়, তবে ওঠা যায়। সহজ পথ গোপন সৈকতটা অফিসারকে চেনাল না। ওটা ওদের নিজস্ব বন্দর।

টোডরা নামল ভাঙা জাহাজটার কাছ দিয়ে ঘুরে গিয়ে, যেখানে ওরা নেমেছে এ কদিন। পুলিশকে দেখতে পেল না।

অফিসারকে নিয়ে নিঃশব্দে দুর্গের কাছে চলে এল গোয়েন্দারা।

সিঁড়িমুখে আগে নামল জিনা। টর্চ হাতে আগে আগে চলল। পেছনে

পুরো দলটা। এখানকার গলিঘুপচি সবচেয়ে বেশি চেনে সে।

যে ঘরটায় আটকে রেখে গেছে টেরিকে, সেখানে এসে দেখল, দরজা। বন্ধই আছে। খিল লাগানো।

ফিসফিস করে কিশোর বলল, টোডরা এখনও আসেনি। লুকিয়ে পড়তে হবে।

লুকানোর জায়গার অভাব নেই। প্রচুর থাম আছে, দেয়াল আছে।

 রাফিকে চুপ থাকতে বলল জিনা।

কয়েক মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। কথা বলতে বলতে আসছে টোডরা।

টেরিকে যদি ওখানে সত্যি আটকে রাখে, মিসেস টোড বলছে, যে রেখেছে, তার কপালে খারাপি আছে। দেখে নেব আমি! কিন্তু আটকাল কে, বলো তো? মেয়েটাই বা তাহলে কোথায়? আমার কি মনে হয় জানো, বস আমাদের সঙ্গে বেঈমানী করেছে। আমাদের যে দশ হাজার ডলার দেবে বলেছিল, দেবে না। বোটে যে তল্লাশি চালাবে পুলিশ, বুঝে গিয়েছিল। সে জন্যেই সরিয়ে ফেলেছিল মেয়েটাকে। পুলিশ দেখেটেখে সন্দেহমুক্ত হয়ে চলে গেছে। ও এসে চুরি করে নিয়ে গেছে মেয়েটাকে। মাঝখান থেকে আমার ছেলেটাকে আটকে রেখে গেছে। আমি বসকে ছাড়ব না!

কি করবে? খসখসে গলায় বলল টোড, ওর সঙ্গে পারা যাবে না। কিন্তু আমি ভাবছি, কিশোর ছেলেটা জানল কি করে টেরি কোথায় আছে? মাথায়ই কিছু ঢুকছে না আমার!

ঘরে ঢুকল ওরা। বন্ধ দরজার দিকে এগোল। পায়ে পায়ে রয়েছে ডারবি। লুকিয়ে থাকা গোয়েন্দাদের গন্ধ পেয়ে মৃদু গোঁ গোঁ করে উঠল।

লাথি মেরে ওকে সরিয়ে দিল টোড। শয়তান কুত্তা, কাজের কাজ কিচ্ছু নেই, খালি ভয়ে কেঁৎ-কোৎ করে!

বাবার গলা শুনেই ভেতর থেকে ককিয়ে উঠল টেরি, বাবা! এসেছ! জলদি খোলো! মরে গেলাম!

পাল্লার ওপর গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মিসেস টোড। টান দিয়ে খুলে ফেলল খিল।

মাকে এসে জড়িয়ে ধরল টেরি। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

কে রেখে গেছে তোকে এখানে! জলদি বল! তোর বাবা ওদের গুলি করে মারবে! মারবে না, জন? ছোট্ট একটা দুধের শিশুকে এভাবে আটকে রেখে যায়, কোন শয়তান! মায়াদয়া নেই প্রাণে!

থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন পুলিশ অফিসার। টর্চের আলো ফেললেন টোডের মুখে। এমন চমকান চমকাল দুই টোড, যেন ভূত দেখেছে।

ঠিকই বলেছ, ডোরিয়া টোড, ভারি গলায় বললেন তিনি, একটা দুধের শিশুকে এভাবে আটকে রেখে যাওয়াটা শয়তানের পক্ষেই সম্ভব, যাদের প্রাণে বিন্দুমাত্র মায়াদয়া নেই। তোমরা সেই শয়তান, তাই না? ডলের মত একটা শিশুকে এনে আটকে রেখেছিলে, টাকার লোভে। তারপর তাকে একা ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলে। একবারও ভাবনি, বাচ্চাটা এরকম জায়গায় একা থাকবে কি করে।

মাছের মত নিঃশব্দে মুখ হাঁ করে আবার বন্ধ করল মিসেস টোড। কথা। আটকে গেছে।

ফাঁদে আটকা পড়া ইঁদুরের মত চি-চি করে উঠল টোড, তাকাও এদিকে!

চার বছরের শিশুর মত কাঁদতে শুরু করল টেরি। এত্তবড় ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখে ঘৃণায় আরেকবার মুখ বাকাল গোয়েন্দারা।

হঠাৎ ওদের ওপর চোখ পড়তেই হিসিয়ে উঠল মিসেস টোড, তোমরা! মেয়েটাও আছে দেখি! ও, তাহলে বসকে খামোকা দোষ দিয়েছি। সব শয়তানি তোমাদের! টেরিকে কে আটকেছিল, বলো, জলদি বলো!

থানায় চলে আগে, ধমকের সুরে বললেন অফিসার, সব প্রশ্নের জবাব পাবে। টোডের পিস্তলটা কেড়ে নিলেন তিনি।

আর কিছু করার নেই। বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে যেতে হলো টোডদের।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে টেরি। বুঝতে পারছে, তার মা আর বাবাকে জেলে দেয়া হবে। তাকে পাঠানো হবে হয়তো কোন কঠিন স্কুলে, যেখানকার নিয়ম-কানুন ভীষণ কড়া। কত বছর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হবে না, জানে না। ওদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াটা এক হিসেবে ভালই হবে ওর জন্যে, স্কুলে গেলে অন্তত মানুষ হওয়ার সুযোগ পাবে, কাছে থাকলে, যেটা হত না। ক্রিমিন্যালই হত বাবা-মার মত।

বাইরে বেরিয়ে অফিসারকে বলল কিশোর, আমাদের আর সঙ্গে যাওয়ার দরকার নেই নিশ্চয়। টোডদের বোটে করেই চলে যেতে পারবেন।

কুত্তাটাকেও নিয়ে যান, জিনা বলল। ওই নোংরা জানোয়ার আমার দ্বীপে রাখব না।

টোডদের নৌকাতেই তোলা হলো ওদেরকে। বলতে হলো না, টেরিকে উঠতে দেখেই লাফিয়ে তাতে চড়ে বসল ডারবি। রাফির জ্বলন্ত দৃষ্টির কাছ থেকে দূরে যেতে পারলে বাঁচে সে।

পুলিশের বোটের সঙ্গে নৌকাটা বাঁধা হলো, টেনে নিয়ে যাবে।

ঠেলা দিয়ে নৌকাটা পানিতে নামিয়ে দিল তিন গোয়েন্দা।

হাত নেড়ে বিদায় জানাল মুসা, বিদায় জনাব বেঙ, জেলে গিয়ে আবার কোনও বাচ্চাকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করুন। বিদায় জনাবা বেঙনি, বেঙাচিকে কোলে বসিয়ে রাখবেন, যাতে আরও বেশি করে কাঁদতে পারে সে। বিদায় বেঙচি, স্কুলে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করে ভাল ছেলে হওয়ার চেষ্টা কোরো। বিদায় ডার্টি, তীরে নেমেই ভাল করে আগে গোসল করে নিবি। তোর গন্ধ রাস্তার কুত্তাও সহ্য করবে না, দূর দূর করে খেদাবে।

মুসার কথা আর বলার ভঙ্গি দেখে পুলিশরাও হাসতে শুরু করল।

হাত নেড়ে বিদায় জানালেন পুলিশ অফিসার।

গোমড়া মুখে নৌকায় বসে আছে দুই টোড, চোখ নামানো, তাকাতে পারছে না কারও দিকে।

পাহাড়ের একটা মোড়ের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল বোট দুটো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *