গুপ্তচর শিকারি

ভলিউম ১৩ – গুপ্তচর শিকারি – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৯৬

০১.

দেখতে এমন সাধারণ হলে কি হবে, হাতের যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল মুসা, সাংঘাতিক জিনিস। যে কোন জিনিস খুঁজে বের করতে পাররে এটা দিয়ে, ধাতু হলেই হলো।

যেমন? জানতে চাইল রবিন।

 গহনা, মুদ্রা, সোনার কলম…

বলো কি হে, কৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল রবিন, বাড়ির আশপাশের গুপ্তধন তো আর রাখবে না তুমি..

 দেখো, অত ইয়ার্কি মেরো না, আদর করে পুরানো যন্ত্রটায় হাত বুলাল মূসা, আসলেই রাখব না। এর ক্ষমতা তুমি জানো না।

আমি জানি, কিশোর বলল, এ সব মেটাল ডিটেক্টর সত্যিই কাজের জিনিস। কিনে ফেলেছ নাকি? দাম দিয়ে দিয়েছ?

হ্যাঁ, পানির দাম বলতে পারো। নষ্ট ছিল। কিনে নিয়ে নিজেই মেরামত করেছি। চমৎকার কাজ করে এখন। কিন্তু পরীক্ষাটা কোথায় চালাব বুঝতে পারছি না।

কেন, তোমাদের বাড়ির আশেপাশে? রবিন বলল, ওখানে তো গুপ্তধন আছে বলে গুজব রয়েছে।

চেনা জায়গায় অনুসন্ধান চালাতে ভাল্লাগে না।

তা বটে, মাথা দোলাল রবিন, চেনা জায়গায় গুপ্তধন আছে, ভাবা যায়। না। গুপ্তধন শব্দটা শুনলেই মনে হয় অচেনা, ভয়ানক দুৰ্ম কোন জায়গা…

মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল, কিশোর কোথায় তোরা? একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে তোদের সঙ্গে।

অর্কশপ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর।

 জঞ্জালের স্তূপের পাশে মেরিচাচীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। কালো চুল, বাদামী উজ্জ্বল চোখে রাজ্যের উদ্বেগ। কিশোরকে দেখে এগিয়ে। এল, আমি ইভা গেনার। জিনার বন্ধু! ওর কাছে তোমাদের কথা শুনেছি।

চুপ করে রইল কিশোর। মেয়েটা কি বলে শোনার অপেক্ষা করছে।

রবিন আর মুসাও বেরিয়ে এল।

 মেরিচাচীর তাড়া আছে, চলে গেলেন।

 ইভা বলল, তোমাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি… জিনা বলল…

এসো, ভেতরে এসো, ওঅর্কশপের দরজা দেখাল কিশোর।

 ইভাকে ভেতরে নিয়ে এল সে। চারপাশে তাকাতে লাগল মেয়েটা। অবাক হলো না। তিন গোয়েন্দার ওঅর্কশপে কোথায় কি আছে জিনার কাছে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে।

একটা টুল দেখিয়ে ওকে বসতে বলল কিশোর।

বসল ইভা। কোন রকম ভূমিকার মধ্যে গেল না। বলল, একটা সাংঘাতিক বিপদে পড়েছি…তোমরা কি আমাকে সাহায্য করবে? বলেই কেঁদে ফেলল।

এ সব পরিস্থিতিতে বিব্রত বোধ করে কিশোর। কি করে কান্না থামাবে বুঝতে পারছে না। মুসা তাড়াতাড়ি ওর মেটাল ডিটেক্টরে হাত দিল। কেবল রবিন স্বাভাবিক রইল, শান্তকণ্ঠে বলল, কেঁদো না। কি হয়েছে, বলো, সাহায্য আমরা অবশ্যই করব।

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ডলল ইভা। ফোপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার মা-বাবা কেউ নেই। দুজনেই মরে গেছে।

এইবার থমকে গেল রবিন। কি করে সাহায্য করবে মেয়েটাকে? কারও বাবা-মা মরে গেলে তো আর এনে দেয়া যায় না।

সহানুভূতির সুরে কিশোর বলল, কেঁদে আর কি হবে? তোমার কষ্ট আমি খুব বুঝতে পারছি, আমিও তোমার মতই এতিম।

ওদের জন্যে কাঁদছি না আমি, আরেকবার চোখ ডলল ইভা। ওরা অনেক ছোটবেলায় মারা গেছে, চেহারাও ভালমত মনে নেই। কাঁদছি আমার ভাইয়ের জন্যে।

খাইছে! সে-ও কি মারা গেছে নাকি? ফস করে বলে ফেলেই পস্তাতে শুরু করল মুসা, এ ভাবে বলাটা বোকামি হয়ে গেছে।

মাথা নাড়ল ইভা, জানি না! ওকে খুঁজে বের করে দেয়ার জন্যেই এসেছি তোমাদের কাছে।

কি হয়েছে ওর? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

চোখের পানি মুছতে মুছতে ইভা বলল ওর ভাইয়ের নাম হ্যারিস গেনার। আরলিংটন কলেজের ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ইনস্ট্রাক্টর ছিল। হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গেছে। এবং আমি চাই তোমরা ওকে খুঁজে বের করো, অনুরোধের সুরে বলল সে। পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু কিছুই করতে পারছে ওরা।

জানা গেল, আরলিঙটন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ইভা। স্প্রিঙ টার্ম সবে শেষ হয়েছে। ভেবেছিল গরমের ছুটিতে ভাইকে নিয়ে ওয়েস্ট কোস্টে। আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। এই সময় হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল ওর ভাই।

কি করব, বুঝতে পারছি না আমি, কিশোর, ককিয়ে উঠল ইভা। প্লীজ, কিছু একটা করো আমার জন্যে!

দুই সহকারীর মতামতের জন্যে ওদের দিকে তাকাল কিশোর।

ইভার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল রবিন, দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমার ভাই কিছুদিন আগে বিদেশে পলিটিক্যাল মেথড নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল, তাই না?

অবাক হলো ইভা, তুমি জানলে কি করে?

পত্রিকায় পড়েছি। তোমার ভাইয়ের নিরুদ্দেশের খবর ছাপা হয়েছে। ওখানেই লিখেছে কথাটা।

মাথা ঝাঁকাল ইভা। কোন দেশে পড়তে গিয়েছিল ওর ভাই, জানাল। দেশটার সঙ্গে আমেরিকার সদ্ভাব নেই। ওখানে থাকতে নাকি একদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় খুব আঘাত পেয়েছিল হ্যারিস গেনার। দেশে ফেরার পর ওকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে, ইভা বলল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছিল না। নিশ্চয় স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে দাদার। পথ ভুলে কোনদিকে চলে গেছে কে জানে।

ওই আঘাতের কারণে নষ্ট হয়েছে ভাবছ? প্রশ্ন করল কিশোর।

হ্যাঁ। ডাক্তারের কাছে শুনেছি এ ধরনের আঘাতের প্রতিক্রিয়া আঘাত পাওয়ার বেশ কিছুদিন পরেও হয়ে থাকে।

কিশোর, মুসা বলল, আমার মনে হয় কেসটা নিয়ে ফেলা উচিত আমাদের।

হাসল কিশোর। তা তো নেবই…

উজ্জ্বল হলো ইভার মুখ। কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে বলে উঠল, ওহ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ!…কেঁদেকেটে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড করে ফেলেছি, সরি!

না না, ঠিক আছে, ও কিছু না, তাড়াতাড়ি বলল রবিন। আর বিব্রত হতে চায় না।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, ইভা, তোমার ভাইয়ের কোন ছবি আছে তোমার কাছে?

হাতব্যাগ থেকে একটা ফটোগ্রাফ বের করে দিল ইভা। এই একটাই ছিল আমার কাছে, হাসল সে, হারালে আর পাব না। উঠে দাঁড়াল। তো, চলি আজ।

কোথায় থাকো, ঠিকানা দিয়ে যাও। তোমার সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন হতে পারে।

ইভা বেরিয়ে গেলে দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, যাক, অনেক দিন পর কেস একটা পাওয়া গেল।

তেমন জটিল কোন রহস্য বলে তো মনে হচ্ছে না, মুসা বলল। একজন মাথা খারাপ লোককে খুঁজে বের করতে হবে, ব্যস। এ আর এমন কি কঠিন।

পুলিশ যে রহস্যের সমাধান করতে পারেনি, ওটাকে এত সহজ ভাবছ কেন? বলা যায় না কি খুঁজতে গিয়ে কি বেরোয়।

তাহলে আরলিংটনে যাচ্ছি আমরা?

অবশ্যই। ইভাকে কথা দিয়ে দিলাম না আমরা। তুমিও তো বললে কাজটা নেয়া উচিত আমাদের।

তা তো বলেছি, কিন্তু আমার গুপ্তধন খোঁজার কি হবে? যন্ত্রটা কেনার পর ব্যবহারই করতে পারলাম না।

গাড়িতেই রেখে দাও, হেসে বলল রবিন। গুপ্তধন বাদ দিয়ে আপাতত মানুষ খুঁজতে কাজে লাগাবে।

মানুষের ব্যাপারে সঙ্কেত দেয় না। শুধু ধাতব জিনিস।

মানুষও অনেক ধাতুতে গড়া। আমাদের শরীরে কত রকমের ধাতু আছে, শুনতে চাও?

না, চাই নাওসব শুনতে এ মুহূর্তে ভাল লাগবে না আমার!

.

০২.

 পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা মুসার পুরানো জেলপি গাড়িটাতে করে। দ্রুত ছুটল সাগরতীরের রাস্তা ধরে।

রবিন বলল, তোমার এই ভটভটি নিয়ে তো বেরোলাম, শেষে রাস্তাঘাটে না আটকে পড়ি। চলবে তো?

চলবে না মানে! দেখতে খারাপ, আওয়াজও করে, কিন্তু কোনদিন কোথাও বিপদে ফেলেনি আমাকে, আদর করে স্টিয়ারিঙে হাত বোলাল মুসা।

ওর কথা ঠিক। এবারও ওদের ঝামেলায় ফেলল না গাড়িটা। ঠিকমতই পৌঁছে দিল আরলিংটনে। শহরে ঢোকার পর কিশোর বলল, ভালমত নজর রাখো। থাকার জায়গা দেখলেই থামতে হবে।

কয়েকটা মোটেল পেরিয়ে এল ওরা। কোনটাই পছন্দ হলো না। হয় বেশি দামী, নয়তো একেবারে সাধারণ। অত সাধারণ জায়গায় থাকতে ইচ্ছে করে না কিশোরের। ওর মতে ওগুলোতে থেকে কষ্ট করার চেয়ে বাইরে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানো অনেক আরামের!

অ্যাই, কিশোর, ওটা কেমন মনে হয়? হাত তুলে একটা সাইনবোর্ড দেখাল রবিন।

রিজ মোটেল, নাম লেখা রয়েছে। নিজেদের গুণকীর্তন সবিস্তারে লিখে রেখেছে নিচে।

মনে হয় খারাপ হবে না, কিশোর বলল। মুসা, ঘোরাও তো। যাও ওদিকে।

ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢোকাল মুসা। পাতার ছাউনি দেয়া একটা সুন্দর কটেজ দেখা গেল। সাইনবোর্ড লেখা রয়েছে: অফিস। বাঁয়ে লম্বা একটা নিচু একতলা বাড়ি। প্রতিটি ঘরের সামনে একটা করে পামগাছ লাগানো হয়েছে। ডানে রয়েছে একসারি কটেজ। মোট বারোটা, সব একই রকম দেখতে। অফিস বাড়িটার মত ওগুলোরও পাতার ছাউনি।

কোথায় উঠলে ভাল হয়? রবিনের প্রশ্ন। লম্বা বাড়িটাতে ঘর নেব, নাকি একটা কটেজ ভাড়া করব।

চলো, আগে দাম জিজ্ঞেস করে দেখি, কিশোর বলল। অফিসের দিকে যেতে বলল মুসাকে।

অফিসে ডেস্কের ওপাশে বসে থাকতে দেখা গেল মাঝবয়েসী এক লোককে। পুরো মাথা জুড়ে গোল টাক, কেবল কান আর ঘাড়ের ওপরে অল্প কিছু পাতলা ফুরফুরে চুল বাদে। টাকে হাত বুলিয়ে হাসি দিয়ে ছেলেদের স্বাগত জানাল সে, এসো এসো। বেড়াতে এসেছ? ছাত্র নিশ্চয়? বেড়াতে এলে ছাত্ররা এই মোটেল ছাড়া আর কোথাও ওঠে না।

প্রশ্নের জবাব দিয়ে মোটেলে রূম খালি আছে কিনা, ভাড়া কত জানতে চাইল কিশোর। একটা ঘরই খালি আছে, জানাল ম্যানেজার। রেজিস্টারে নাম সই করে, ক্লার্কের হাতে টাকা গুণে দিল কিশোর। ঘরের চাবি দিল ওকে লোকটা।

সাত নম্বর রূম। চাবি দিয়ে দরজা খুলে মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকল ওরা।

রবিন বলল, কিছু মানুষ আছে অতিরিক্ত কথা বলে, অহেতুক।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, তা ঠিক। দেখলে না কেমন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করছিল। কেন এসেছি আমরা। এটা যত কম লোকে জানবে, ততই ভাল।

ওদের কথায় কান দিল না মুসা, সুটকেস খুলতে খুলতে বলল, আমার খিদে পেয়েছে। তোয়ালে বের করে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে।

হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় পরে, আবার বেরোল ওরা। দরজায় তালা দিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল। মুসা বলল, রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি তো, নাকি?

হ্যাঁ, কিশোর বলল, আগে খাওয়া। তারপর থানায় যাব পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে।

হ্যারিস গেনারের ব্যাপারে কতটা জানে ওরা জানার জন্যে? রবিনের প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

খাওয়া সেরে নিয়ে থানায় রওনা হলো ওরা।

নতুন তৈরি একটা বিল্ডিঙের মাটির নিচে পুলিশ হেডকোয়ার্টার। ওপরটায় টাউন হল। পুলিশ চীফ অফিসে নেই, সুতরাং ডেস্ক সার্জেন্টের কাছে নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর। রকি বীচের পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচার তিন গোয়েন্দাকে একটা সার্টিফিকেট দিয়েছেন, শহরের বাইরে অন্য অঞ্চলে কাজ করতে গেলে সেটা দেখালে যাতে পুলিশ ওদের সহায়তা করে। সেটা দেখিয়ে সার্জেন্টের কাছে গেনারের কেসটার কথা জানতে চাইল কিশোর।

ও কিছু না, গুরুত্বই দিল না সার্জেন্ট, অন্যমনস্ক হয়ে কলেজ থেকে হেঁটে বেরিয়ে গায়েব হয়ে গেছে হ্যারিস গেনার। ওয়াল্ট ডিজনির অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর দেখোনি, ওরকম ব্যাপার আরকি।

কোন সূত্র পাওয়া যায়নি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

 না, কিছুই না। আশা করছি দুচারদিনের মধ্যেই ওর খবর পাব। সামনে ঝুঁকল সার্জেন্ট, একটা গোপন কথা বলি তোমাদের, আমার ধারণা লোকটা পাগল। অতিরিক্ত মাথা ঘামিয়ে অনেক বিজ্ঞানী আছে না পাগল হয়ে যায়, মগজে চাপ পড়ে বলে, এরও হয়েছে ওরকম।

মন্তব্য করল না গোয়েন্দারা। চুপচাপ বেরিয়ে এল থানা থেকে। বাইরে বেরিয়েই ফুঁসে উঠল মুসা, এই সার্জেন্ট নোকটাও পাগল! জ্ঞান দিতে আসে!

 জ্ঞান আর উপদেশ বিতরণ করা অনেক মানুষের স্বভাব, কি আর করা, আনমনে মাথা চুলকাল কিশোর।

এরপর কলেজের ডিনের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল সে।

কলেজটা কোথায় একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল মুসা। গাড়ি চালাল সেদিকে। শহরের একধারে ছোট্ট একটুকরো বনের মাঝে কলেজটা। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিঙের সামনে এনে গাড়ি রাখল সে।

একসঙ্গে সবার যাওয়ার দরকার নেই। গাড়িতে বসে রইল মূসা। কিশোর আর রবিন নেমে মার্বেল পাথরে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। একটা হলওয়েতে ঢুকল।

ডিনের অফিসটা খুঁজে পেতে দেরি হলো না। দরজার গায়ে লেখা রয়েছে:

DEAN WALTER FOLLETT.

ডিনের ঘরে ঢুকতে হলে অনুমতি নিতে হয়। একজন রিসেপশনিস্টকে বুঝিয়ে বলল কিশোর, জরুরী কারণে দেখা করতে এসেছে ওরা। ব্যাপারটা গোপনীয়। সবাইকে বলা যাবে না, কেবল ডিনকেই বলবে।

অনুমতি মিলল। ওদেরকে ডিনের অফিসে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে গেল রিসেপশনিস্ট।

বড় ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন লম্বা একজন মানুষ, ঝাঁকড়া চুল বয়সের কারণে ধূসর হয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার ফলেট। হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দন হয়ে গেলে বললেন, বসো। কি নাকি গোপন কথা আছে আমার সঙ্গে? বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে।

ডেস্কের অন্যপাশে ডিনের মুখোমুখি বসল তিন গোয়েন্দা।

 হ্যারিস গেনারকে খুঁজতে এসেছে, জানাল কিশোর।

ভাল করেছ, ডিন বললেন, আমরা সবাই তাকে খুঁজছি। তা তোমরা কে, তাই তো জানা হলো না।

পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে দিল কিশোর।

হাতে নিয়ে দেখলেন ফলেট। তারপর কার্ডটা টেবিলে রেখে দিয়ে। বললেন, বুঝলাম। হ্যাঁ, তা আমার কাছে কি জানতে চাও, বলো?

হ্যারিস গেনারের নিরুদ্দেশের ব্যাপারে যতটা জানাতে পারেন।

আশা করি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জেনে যাবে তোমরা শিগগিরই, গোয়েন্দা যখন। আনমনে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলেন তিনি, অদ্ভুত! ভারি অদ্ভুত!

কি? জানতে চাইল কিশোর।

ওই তো, যেভাবে গায়েব হয়ে গেল গেনার। কি করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন লেকচারার, জানালেন ফলেট। পরদিন নাকি ছেলেদের পরীক্ষা ছিল, এর জন্যে প্রশ্নপত্রও তৈরি করেছেন গেনার। তারপর রহস্যজনক ভাবে সেটা ডেস্কের ওপর ফেলে রেখে রাতের বেলা কোথায় চলে গেছেন।

পরদিন সকালে কাগজগুলো পাওয়া গেছে, ডিন বললেন। পেয়েছে। ওরই একজন সহকারী। সেই সব প্রশ্ন ছেপে পরীক্ষাও নেয়া হয়েছে। ছেলেদের।

অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে একটা পেন্সিল তুলে নিয়ে ডেস্কে ঠুকতে লাগলেন তিনি। কিন্তু সেই যে গেল, আর ফিরে এল না গেনার। ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত!

সহকারীর নাম কি, যিনি কাগজগুলো পেয়েছেন? জানতে চাইল রবিন। বলতে অসুবিধে আছে?

প্রশ্নটায় অবাক হলেন যেন ডিন। একটা ভুরু সামান্য উঁচু হলো। না, অসুবিধে থাকবে কেন? ওর নাম মেরিন ডিগ। গেনারের সহকারী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। একই কথা খেলে গেল দুজনের মনে, মেরিন ডিগের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ও-কে, বয়েজ, আর কিছু বলার নেই আমার, যা যা জানি, বলেছি, উঠে দাঁড়ালেন ডিন। আমার ধারণা, মাথায় কোন গোলমাল দেখা দিয়েছে গেনারের। স্মৃতিবিভ্রমও ঘটে থাকতে পারে।

মিস্টার ডিগের সঙ্গে দেখা করতে চাই আমরা, অনুরোধ করল কিশোর, আপনি কি কোন সাহায্য করতে পারেন? আর, মিস্টার গেনারের ঘরটাও একবার দেখতে চাই।

একটা কাগজে ঠিকানা লিখে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলেন ফলেট। জানালার কাছে গিয়ে হাতের ইশারায় কিশোরকে ডাকলেন। মাঠের শেষধারে কতগুলো বাড়ি দেখিয়ে বললেন, বড় বিল্ডিঙটাতে গ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা থাকে। আর তার ওপাশের ছোট ছোট বাড়িগুলোতে ইনস্ট্রাক্টর আর লেকচারাররা।

ডিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল দুজনে। গাড়িতে উঠে মুসাকে বলল, মাঠের ধারের বাড়িগুলোর কাছে নিয়ে যেতে।

.

০৩.

গাড়ি চালাল মুসা। ডিনের কাছে কি জেনে এসেছে, সব জানাল ওকে রবিন আর কিশোর। পথে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে দেখা গেল-সামার সেশনের জন্যে নাম রেজিস্ট্রি করতে এসেছে।

বাড়িটা থেকে খানিক দূরে গাড়ি রেখে বসে রইল মুসা। কিশোর আর রবিন নেমে গেল আগেরবারের মত। সামনে বেটেমত এক লোক হেঁটে যাচ্ছে। বয়েসে তরুণ। ওকে চোখে পড়ে যায় তার কারণ গাঢ় রঙের জ্যাকেট গায়ে দিয়েছে, আর হাস্যকর ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। দ্রুত হেঁটে ওর পাশকাটিয়ে এল দুজনে।

পাশ কাটানোর সময় রবিনের গায়ে আলতো খোঁচা দিল কিশোর। ইঙ্গিত করল লোকটার দিকে। একবার পেছনে ফিরে তাকানোর কৌতূহল সামলাতে পারল না রবিন। গোলগাল, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা লোকটার।

বাড়িটাতে পৌঁছে ১৭ নম্বর রূম খুঁজে বের করুন কিশোর। দরজার পাশে বসানো কলিং বেলের সুইচ টিপল। কান পেতে রইল ভেতরের শব্দ শোনার আশায়। নেই, কোন শব্দ নেই। আবার বেল টেপার জন্যে হাত বাড়াল কিশোর, এই সময় পেছন থেকে বলে উঠল একটা হাসিখুশি কণ্ঠ, আমাকে খুঁজছ?

চমকে গিয়ে ঘুরে তাকাল কিশোর আর রবিন। সেই লোকটা।

মেরিন ডিগ? আপনা থেকেই প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল কিশোরের মুখ থেকে।

হ্যাঁ। কি সাহায্য করতে পারি?

নিজের আর রবিনের পরিচয় দিল কিশোর।

দরজা খুলে ওদেরকে নিজের ঘরে নিয়ে এল ডিগ।

কেন এসেছে, জানাল কিশোর। হারিস গেনার সম্পর্কে যা যা জেনেছে, ভিগকে জানিয়ে জিজ্ঞেসকরুল সে এর বেশি আর কিছু জানে কিনা।

জানি, জবাব দিল ডিগ, তবে পুলিশের ধারণা, ওগুলো জরুরী কোন বিষয় নয়।

কি জানেন? আগ্রহে সামনেকে এল রবিন।

দাঁড়াও, বলছি, ওদের বসতে বলে একটা চেয়ার টেনে এনে মুখোমুখি কুসল ভিগ। খুব শীঘ্রি বিয়ে করতে যাচ্ছে হারিস, এই খবরটা কি জানো তোমরা?

অবাক হলো দুজনেই। মাথা নাড়ল।

ডিগ জানাল, ইয়োরোপের যে দেশটায় লেখাপড়া করতে গিয়েছিল গেনার, ওখানে একটা মেয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠত হয়। ওই মেয়েটাকেই নাকি বিয়ে করবে সে। যেহেতু দেশটার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভাল না, ওই দেশের মেয়েকে বিয়ে করার কথা তার বোনকেও বলতে অস্বস্তি বোধ করেছে গেনার।

তারমানে আপনি বলতে চান স্মৃতি হারানো কি পাগল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক না? জিজ্ঞেসকরুল কিশোর।

মাথা নাড়ল ডিগ, একেবারেই না।

এটা অবশ্য নতুন তথ্য; তবে এর বেশি আর কিছু জানাতে পারল না। ডিগ। গেনারের সুরটা দেখিয়ে দেয়ার জন্যে ওকে অনুরোধ করল কিশোর।

এসো, উঠে দাঁড়াল ডিগ, এই তো, পাশের ঘরটাই।

গেনারের ঘরের চাবি আছে তার কাছে। খুলে দিল। দুই গোয়েন্দার সঙ্গে ভেতরে ঢুকে বলল, দেখেছ, কি রকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন? সব ঠিকঠাক। বোঝাই যায় না পালানোর প্ল্যান করছিল গেনার। আমিও কিছু বুঝতে পারিনি।

কিন্তু বিয়ে করার জন্যে একটা লোক পালাবে কেন, এটাও তো মাথায় ঢুকছেনা, রবিন বলল।

আমার মাথায়ও না।

এগুলো কি? টেবিলে হাত রেখে কুঁকে দাঁড়িয়ে কতগুলো কাগজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। আপনি বলতে পারবেন?

অবশ্যই পারব। পরীক্ষার প্রশ্ন। নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে এগুলো তৈরি করেছিল গোনার…

কিশোর আর রবিন মিলে পুরো ঘরটা তন্নতন্ন করে খুঁজল। সঙ্গে সঙ্গে থেকে চিলের নজর রাখল ডিগ, তার সামনে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল ওরা। কিন্তু লোকটাকে সরানোর কোন ছুতো বের করতে পারল না। অগত্যা ওর সামনেই খুঁজতে হলো। কোন সূত্র পেল না। পাওয়ার আশাও অবশ্য করেনি, কারণ এর আগে পুলিশ এসে খুঁজে গেছে।

থ্যাংক ইউ, কিশোর কলল, এখন যাই। সময় করে আবার আসব। আরেকবার খুঁজে দেখব ঘরটা।

যখন খুশি এসো, নির্দ্বিধায় স্বাগত জানাল ডিগ। এক কাজ করো না বরং, আমার এখানেই থেকে যাও। আলাদা বিছানা আছে, থাকার অসুবিধে হবে না।

হেসে মাথা নেড়ে বলল কিশোর, না, না, ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। লোক বেশি আমরা, সঙ্গে আরও একজন আছে। যাই। পরে আসব।

 গাড়িতে ফিরে এল ওরা। উদিত হয়ে অপেক্ষা করছে মুসা, ওরা কি খবর আনো শোনার জন্যে। যা জানল, তাতে তেমন খুশি হতে পারল না। তদন্তের অগ্রগতি হয়নি প্রায় কিছুই। এখনও এমন কোন জরুরী সূত্র পায়নি যেটা গেনারকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।

মোটেলে ফিরে চলল ওরা।

হঠাৎ জিজ্ঞেস করল রবিন, ডিগলোকটাকে কেমন মনে হলো তোমার?

উ। চিন্তিত ভঙ্গিতে ফিরে তাকাল কিশোর, কি জানি, ঠিক বুঝতে পারছি না।

আজব চরিত্র মনে হয়নি?

আজব কিনা জানি না, তবে হাঁটার ভঙ্গি দেখলে ভাঁড় বলবে ওকে লোকে, আবার চিন্তায় ডুবে গেল কিশোর।

ঘরে যাওয়ার আগে কোথাও কিছু খেয়ে নিলে হয় না? গাড়ি চালাতে চালাতে আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল মুসা।

তা যায়, রাজি হলো কিশোর।

রবিন বলল, আমারও খিদে পেয়েছে।

একটা ফার্স্টফুড শপ থেকে হালকা খাবার খেয়ে নিল ওরা। ফিরে এল মোটেলে। ঘরের দরজা খুলেই থমকে দাঁড়াল কিশোর। দুজন বয়স্ক মানুষ বসে আছে–একজন পুরুষ, আরেকজন মহিলা। লোকটা খবরের কাগজ পড়ছে, মহিলা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।

মাফ করবেন, ভদ্রকণ্ঠে রবিন বলল, আপনারা বোধহয় ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছেন।

হ্যাঁ, এটা আমরা ভাড়া নিয়েছি, বলল কিশোর। সাত নম্বর।

ফিরে তাকিয়ে হাসল মহিলা, তোমরা নিশ্চয় তিন গোয়েন্দা? তোমাদের মালপত্র বের করে নিয়ে গেছে ম্যানেজার। অসুবিধে নেই, সব পাবে ওর কাছে।

কেন, নেবে কেন? কিশোর অবাক। আমরা এটা ভাড়া নিয়েছি। রেজিস্টারে নাম সই করে চব্বিশ ঘণ্টার ভাড়াও অগ্রিম দিয়েছি।

বলেই বুঝল, এদেরকে, প্রশ্ন করে লাভ নেই, ঠিকও হবে না, কারণ দোষটা এদের নয়। যা করার ম্যানেজার করেছে। চাবি না দিলে এরা খুলতে পারত না। নিশ্চয় কোন গোলমাল হয়েছে, কিছু একটা ঘটেছে, নাহলে ম্যানেজারও এ রকম করত না। কি ঘটল?

জানার জন্যে উত্তেজিত হয়ে ম্যানেজারের অফিসে ছুটল তিন গোয়েন্দা।

ওদের দেখে চওড়া হাসি হাসল টেকো লোকটা। এসো, এসো, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি আমি। মালপত্র তোমাদের ঘরে পৌঁছে গেছে। ভাল জায়গা পছন্দ করেছ। আগেই বলেছিলাম, কটেজ নাও…তুবে আগে সাধারণ রূমটা দেখে নিয়ে ভালই করেছ, নিজেরা বুঝে নিয়েছ, আমি চাপাচাপি করলে। ভাবতে জোর করে গছাতে চাইছি…

মানে? অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।

যা করতে বলেছ তাই করেছি। তোমাদের মেসেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কটেজ ঠিক করে, রূম থেকে তোমাদের মালপত্র বের করে এনে ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি, টাকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ম্যানেজার। যাও, সব ঠিকঠাক পাবে। একটা জিনিসও খোয়া যাবে না। এ সব দিকে আমার কড়া নজর। ম্যানেজারি করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললাম…

টাকমাথা লোকটার মুখে চুল পাকানোর কথা শুনতে কেমন হাস্যকর লাগল। মুসার তো শুধরেই দিতে ইচ্ছে করল–বরং বলুন, চুল খসিয়ে ফেললাম; কিন্তু বলল না কিছু, চুপ করে রইল।

বোকা হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল তিনজনে। কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

বকবক করে চলেছে ম্যানেজার, কটেজ, নিয়ে ভাল করেছ। আরামে থাকবে, শান্তিতে থাকবে, রুমের চেয়ে ভাড়াও তেমন বেশি না, অথচ দুটো জায়গায় পার্থক্যটা অনেক। যে তিনজন বন্ধুকে পাঠালে তোমরা, ওরা এসে মেসেজটা দিয়ে বলল, আগের ঘরটা পছন্দ হয়নি তোমাদের, নিরিবিলি থাকতে চাও, একটা কটেজ যেন রেডি করে রাখি আমি। তা রেখেছি। তোমাদের আসতে দেরি হবে জেনেও একমুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। বোর্ডাররা বিরক্ত হয় এমন কোন কাজ আমাকে দিয়ে হবে না…

তা কটেজটা কোথায়? কিছুটা রেগে গিয়েই জানতে চাইল মুসা।

ওর রাগটা বোধহয় ধরতে পারল না ম্যানেজার। হাত তুলে ছোট ছোট বাড়িগুলো দেখিয়ে বলল, অসুবিধে নেই, খুব সুন্দর, গিয়ে দেখোই না…

আবার ছুটল তিন গোয়েন্দা। কটেজের কাছে এসে জানালা দিয়ে দেখল ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে গাট্টাগোট্টা এক তরুণ, ওদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই রেগে চিৎকার করে উঠল মুসা, এ সবের অর্থ কি?

ঘুরে দাঁড়াল তরুণ। কালো একটা মুখোশে মুখের ওপরের অংশ ঢাকা, বড় বড় ফুটো দিয়ে চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা বড় আলমারির দরজা। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আরও চারটে মুখোশধারী ছেলে।

আরি, হচ্ছেটা কি! কে আপনারা? চিৎকার করে উঠল রবিন।

তার কথার জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করল না ছেলেগুলো। তিনজনকে মেঝেতে ফেলে চেপে ধরে বেধে ফেলল। বয়ে এনে তুলল একটা গাড়িতে। মোটেল থেকে বেরিয়ে মহাসড়ক ধরে কয়েক মাইল এগোল গাড়িটা। তারপর মোড় নিয়ে একটা সরু রাস্তায় নামল। সেটা ধরে মাইলখানেক এগোতে দেখা গেল রেললাইন।

তিন গোয়েন্দাকে বয়ে আনা হলো লাইনের ধারে। ছোট ছোট ঝোপঝাড় জন্মে আছে ওখানে। ওগুলোর জন্যে রাস্তা থেকে লাইনটা ভালমত চোখে পড়ে না। তিনটে তক্তায় ওদেরকে চিত করে বেঁধে ওগুলো লাইনের ওপর আড়াআড়ি ফেলে চলে গেল ছেলেগুলো।

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। রাতের অন্ধকার। এগিয়ে আসছে। ছেলেগুলো সরে যেতেই বাধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল তিন গোয়েন্দা। টানাটানি করতে করতে ঘেমে গেল, কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ঘাম। কিন্তু বাধন ঢিল করতে পারল না একচুল।

ঠিক এই সময় কলজে কাঁপিয়ে দিয়ে দূরে শোনা গেল রেলইঞ্জিনের বাঁশি।

.

০৪.

মাথা ঘুরিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিনজনে। প্রাণপণে আরেকবার বাধন খোলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। আর কোন আশা নেই। কপালে মৃত্যুই আছে বুঝি এবার।

এগিয়ে আসছে ইঞ্জিনের ভারি শব্দ। ওদের ধ্বংস করে দিতে ছুটে আসছে যেন এক ভয়াল দানব। আতঙ্কে অবশ হয়ে আসছে হাত-পা।

এসে গেছে। আর একশো গজ দূরেও নেই। শেষবারের মত পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। যেন নীরবে শেষ বিদায় জানাল একে অন্যকে।

এসে গেল ইঞ্জিন। তারপর যেন কোন অলৌকিক কারণে ওদের গায়ের ওপর দিয়ে না গিয়ে কানফাটা ভয়ানক শব্দ আর প্রবল কম্পন তুলে পাশ দিয়ে। চলে গেল। বেঁচে আছে, বিশ্বাস হতে চাইল না ওদের। কি করে ঘটল ঘটনাটা? ঘটারং-ঘট ঘটারং-ঘট করে এখনও পার হচ্ছে একের পর এক মালবাহী ওয়্যাগন।

থরথর করে কাঁপছে শরীর। বেঁচে গেছে এটা যখন বিশ্বাস হলো মুসার, বাঁধন খোলার চেষ্টা চালাল আবার সে। বড় ধাক্কাটা কেটেছে, ওদেরকে লাইনের ওপর ফেলে রেখে যাওয়ার পর এই প্রথম মাথাটা আবার ঠিকমত কাজ করতে আরম্ভ করেছে। আড়চোখে অস্পষ্টভাবে দেখল লাইনের একটা মোটা পেরেকের চোখা মাখা বেরিয়ে আছে। শরীরটা আঁকাবাকা করে ঝাঁকাতে লাগল সে। তিল তিল করে ওর মাথার দিকটা এগিয়ে চলল পেরেকের দিকে। অনেক কষ্ট করে, লাইন আর পাথরের ঘষায় শরীরের কয়েক জায়গার চামড়া ছিঁড়ে-কেটে অবশেষে হাতের বাঁধন পেরেকটার কাছে নিয়ে যেতে পারল। দড়ি ঘষতে লাগল পেরেকের সঙ্গে। এক সুতা এক সুতা করে কাটতে লাগল দড়িটা।

আবার শোনা গেল ট্রেনের শব্দ। আরেকটা ট্রেন আসছে। একবার বেঁচেছে বলেই যে আবার বাচবে এমন সম্ভাবনা নেই। তাড়াহুড়া শুরু করল। সে। অবশেষে যেন দীর্ঘ কয়েক যুগ পর দড়িটা কাটতে সক্ষম হলো।

দড়িটা ছাড়িয়ে নিয়েই উঠে পড়ল সে। পকেটনাইফ বের করে পায়ের বাঁধন কাটল। তারপর কেটে দিল কিশোরের হাতের বাঁধন।

তিনজনেই মুক্ত হয়ে সরে গেল লাইনের ওপর থেকে। অনেক কাছে এসে গেছে দ্বিতীয় ট্রেনটা।

 বিমূঢ় ভাব কাটেনি এখনও রবিনের। কব্জি ডলতে ডলতে বলল, এপারে আছি তো? না মরণের ওপারে চলে গিয়ে অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখছি?

চলে যেতাম, যদি পাশের লাইনটা দিয়ে না যেত ট্রেনটা, কিশোর বলল। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্যে হাত-পা ঝাড়ছে।

চাঁদের আলোয় চকচক করছে কয়েক গজ দূরের আরেকটা লাইন। সেদিকে তাকিয়ে তারপর আবার ওদের পায়ের কাছের লাইনটার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল সে, দেখো, এটায় মরচে পড়া।

তাতে কি? মুসার প্রশ্ন।

 এটা সাইডলাইন, জবাব দিল কিশোর, পুরানো। ব্যবহার হয় না।

তারমানে আমাদের ভাগ্যের জোরে ওরা ভুল করে বাতিল লাইনে ফেলে গেছে আমাদের।

আমার তা মনে হয় না, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কিশোর, জেনেশুনে ইচ্ছে করেই ফেলে গেছে। হয়তো কেবল ভয় দেখানোর জন্যে। মারতে চায়নি।

 দাঁতে দাঁত চাপল মুসা, কায়দা মত পেয়ে নিই! ভয় দেখানো ওদের আমি বের করব!

পাঁচজনের সঙ্গে পারব না আমরা, মুসা, মনে করিয়ে দিল রবিন।

সে দেখা যাবে। ওরা আমাদের সঙ্গে এ রকম করতেই থাকবে আর আমরা মুখ বুজে সহ্য করব, কিছুই না করে ছেড়ে দেব, এটা ভাবলে মহাভুল করবে ওরা।

 কি করবে তাহলে?

আপাতত মোটেলে ফিরে যাব, জবাব দিল কিশোর।

লাইন ধরে কয়েক মিনিট হাটার পর সরু রাস্তাটা চোখে পড়ল ওদের। সেটা ধরে এগিয়ে এসে উঠল মহাসড়কে। রাতের বেলা জোয়ান ছেলেছোকরা হাত তুললে গাড়িগুলো থামতে চায় না। সবাই বা ডাকাতিকে ভয় পায়। তবে একজন ট্রাক ড্রাইভারের মনে হলো, ছেলেগুলো খারাপ নয়। থামল সে। কোথায় যাবে জানতে চাইল। লিফট দিতে রাজি হলো।

ড্রাইভারের পাশে গাদাগাদি করে বসল তিনজনে। মুসার পাশের দরজাটা খোলা রাখতে হলো, নইলে বসা যায় না। তার অর্ধেকটা শরীরই বেরিয়ে রইল।

ড্রাইভার যখন গাড়ি চালাচ্ছে, নিচুস্বরে কিশোরের সঙ্গে কথা বলল রবিন, আচ্ছা, ওরা কোন ভুল করেনি তো? ভুল করে আমাদের শাস্তি দিয়েছে হয়তো। স্কুলের দলাদলি হতে পারে।

ভ্রূকুটি করল কিশোর। অন্ধকারে কারও চোখে পড়ল না সেটা। বলল, উঁহু, ভুল ওরা করেনি। ভয় দেখাতে চেয়েছে আমাদের, যাতে গেনারকে খোঁজাখুঁজি না করে আরলিংটন থেকে কেটে পড়ি আমরা।

তারমানে তোমার ধারণা গেনারকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?

হওয়াটা কি অসম্ভব? হয়নি যে তেমন কোন সূত্র তো এখনও পাইনি আমরা।

ওদের আলোচনায় যোগ দিল না ড্রাইভার। বেশি কথা বলার মানুষ না সে। নীরবে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছল আরলিংটনে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। সোজা রওনা হলো ম্যানেজারের অফিসে।

টেকোকে ভালমত চেপে ধরার সময় হয়েছে এখন, ভারি গলায় বলল কিশোর। আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে ওকে।

দরজা বন্ধ। বেল টিপে ধরল কিশোর। কয়েকবার করে টেপার পর আলো জ্বলল ভেতরে। দরজা খুলে দিল ম্যানেজার। ঘুমে জড়ানো ফোলা ফোলা চোখ, চকচকে টাক, পায়জামা আর গেঞ্জি পরা পৈটমোটা লোকটাকে হাস্যকর লাগছে এখন। মেজাজ খারাপ না থাকলে হেসে ফেলত মুসা।

রাত দুপুরে ঘুমন্ত মানুষকে বিছানা থেকে টেনে তোলার অর্থ কি, আঁ? কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করল ম্যানেজার। অফিসের চেয়ারে বসা বিগলিত হাসিওয়ালা সেই লোকটার সঙ্গে একে মেলানো যায় না। যেই মনে করেছে, ওরা কটেজ ছেড়ে দিচ্ছে, ওদের সঙ্গে ব্যবসা শেষ, অমনি বদলে গেছে আচরণ। মোটেল ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন কিছু করতে পারব না।

আর কিছু না পারেন, আমার কিছু প্রশ্নের জবাব আপনাকে দিতে হবেই, কিশোরও সমান তেজে বলল আমাদেকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ারই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

থমকে গেল ম্যানেজার। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল ঘরে ঢোকার জন্যে। সব শোনার পর বলল, ছেলেগুলোকে চিনতে পেরেছে। আরলিঙটন কলেজে পড়ে। এই এলাকারই ছেলে খুব পজি মারামারি, দলাদলি এ সূৰ্ব করে বেড়ায়।

মনে হয় নতুন মুখ দেখে তোমাদের সঙ্গে একটু মজা করতে চেয়েছিল ওরা, ম্যানেজার বলল।

মনে করা ওদের বের করব এবার গজগজ করতে লাগল মুসা।

পুলিশকে খবর দিতে যাচ্ছি আমরা, কিশোর কাল। নাম কি ওদের? কোথায় থাকে?

সুব্রার নাম জানে না ম্যানেজার। দুতিনজনের জানে, ওদের নাম আর ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিল। পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে একটা বাড়িতে ঢু মেরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। মুসাকে বলল সেদিকে যেতে। নীরব রাতে বিকট শব্দ তুলে ছুটল জেলপি। পর্ব আকাশে অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। ভোর হতে দেরি নেই।

বাড়ির সামনে এসে আগের মতই গাড়িতে বসে রইল মুসা, রবিন আর কিশোর নেমে গেল। কলিং বেলের বোতাম টিপল কিশোর। সাড়া না পেয়ে দরজায় থাবা মারতে লাগল রবিন।

অবশেষে দরজা খুলে দিল পায়জামা পরা একটা ছেলে। খালি পা। ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলল, মাঝরাতে এত ডাকাডাকি কিসের? আমরা তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না।বলে দরজা লাগিয়ে দিতে গেল।

চট করে একটা পা ঢুকিয়ে দিয়ে আটকাল কিশোর, মজা করতে আসিনি আমরা। বব বোম্যান কোথায়?

বড় করে হাই তুলল ছেলেটা, ওকে জাগানো যাবে না।

যাবে না কেন? কিশোরের কাঁধের কাছ থেকে বলে উঠল মুসা, গাড়িতে বসে থাকতে পারেনি, কি ঘটছে এখানে দেখার জন্যে চলে এসেছে। জোরেজোরে ধাক্কা দাওগে, জেগে যাবে।

কিন্তু তোমরা বুঝতে পারছ না, ও আমাদের প্রেসিডেন্ট…

কিশোরকে সরিয়ে তার জায়গায় চলে এল মুসা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নাকি ও? যাও, জুলদি গিয়ে উঠতে বলো নাকি থানায় যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে?

ভেতরে চলে গেল ছেলেটা। উত্তেজিত কথা আর ধমক শোনা গেল। বেরিয়ে এল গাট্টাগোট্টা আরেকটা ছেলে। পরনে লাল-সাদা স্ট্রাইপের পায়জামা। তিন গোয়েন্দার ওপর চোখ পড়তেই থমকে গেল। দুচোখে বিস্ময়।

তোমরা…

ওকে কথা শেষ করতে দিল না মুসা, বলল, হ্যাঁ, আমরা। নরক থেকে প্রেতাত্ম হয়ে বেরিয়ে এসেছি তোমার চোয়ালের হাড্ডি কখান ভাঙার জন্যে। আরও কাছে এসো, কোনখান থেকে শুরু করা যায় বুঝে দেখি..

ওর কাঁধে হাত রেখে বাধা দিল কিশোর, দাঁড়াও, পেটে কি কি কথা লুকিয়ে আছে, আগে বের করি, তারপতেমাকে একটা চান্স দেয়া যাবে…

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে আরও এক পা এগিয়ে এল বব। কি করবে বুঝতে পারছে না।

ওর দিকে এগিয়ে গেল কিশোর। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, রেললাইনের ওপর আমাদের ফেলে আসার মানেটা কি? মোটেলে আমাদের ঘর থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করেছ কেন?

এমন ভঙ্গি করছ তোমর, যেন আমি তোমাদের শত্রু, ছেলেটা বলল। একটু পরখ করতে চেয়েছিলাম, যে যাচাই করে নেয়া, আর কিছু তো না। এত রাগীর কি হলো?

রেললাইনের ওপর ফেলে এসেছ মরার জন্যে, আর বলছ যে যাচাই? মানেটা কি এসবের?

মারার জন্যে ফেলে আসিনি, বব বলল, যেটাতে রেখে এসেছিলাম, ওটা বাতিল লাইন, ট্রেন চলাচল করে না। তারপরেও আড়াল থেকে নজর রেখেছিলাম, বাই চান্স যদি কোন বিপদ ঘটে যায় সাহায্য করার জন্যে। দেখলাম, তোমরা নিজেরাই নিজেদের জন্যে যথেষ্ট, সাহায্যের কোন প্রয়োজনই নেই। তোমরা আরলিংটনে ভর্তি হতে এসেছ, তাই না?

না, জবাব দিল রবিন।

আমাদের কি পরখ করছিলে? আবার প্রশ্ন করল কিশোর। কার হুকুমে?

প্রশ্নটা দ্বিধায় ফেলে দিল ববকে পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ফিরে তাকাল সে। এই অসময়ে কার সঙ্গে কথা বলছে দেখার জন্যে আরও কয়েকটা ছেলে নেমে আসছে দোতলা থেকে।

 কিশোরের দিকে ফিরল বব, এর জবাব তোমাকে দিতে পারব না আমি।

যদি কথা দিই, মুখ খুলব না? কাউকে বলব না ওর কথা?

কিশোরের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বব বলল, আমরা ভেবেছি তোমরা লায়ন কাবসে যোগ দিতে এসেছ, কসম—

লায়ন কাবসটা কি?

আমাদের তরুণদের একটা সংঘঠন। তোমাদের পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলাম। আমরা ভেবেছি তোমরা আরলিঙটনে ভর্তি হবে, তাই আগে থাকতেই আমাদের দলে টানতে চেয়েছি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ববের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ওর মনে হলো সত্যি কথাই বলছে ছেলেটা। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার হাতের সুখ মেটাতে পারলে না, মুসা। অন্য সময় দেখা যাবে। চলো এখন, যাই।

সারারাত ঘুমায়নি, তার ওপর নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর পরিশ্রম, ঘুমে ভেঙে আসতে চাইছে চোখ। তবু মোটেলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আরও খাকিটা তদন্ত সেরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

বাইরে এসে সঙ্গীদের বলল, ডিগ ঘুম থেকে ওঠার আগেই গেনারের ঘরটা আরেকবার দেখব, চলো।

হাতঘড়ি দেখল রবিন, ছটা বাজে। এত সকালে নিশ্চয় ঘুম থেকে ওঠেনি ডিগ। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, চলো।

গেনারের কোয়ার্টারের দিকে রওনা হলো ওরা। পথে কয়েকটা দুধের গাড়ি আর একজন খবরের কাগজের হকারকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না। এত ভোরে অন্য কেউ নেই রাস্তায়। কলেজের কোয়ার্টার গুলোতেও প্রাণের সাড়া নেই, ঘুমন্ত।

কোয়ার্টারের সামনে এসে আগের মতই গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল মুসা। কিশোর আর রবিন নেমে গেল।

সোজা গেনারের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। পকেট থেকে মাস্টার কী বের করে তালা খুলতে একটা মিনিটও লাগল না তার। রবিনকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। ডিগ যে পাশে থাকে সেপাশের দেয়ালে কান ঠেকিয়ে শুনল। নীরব।

এখনও স্বপ্নের জগতেই আছে, ফিসফিস করে রবিনকে বলল সে।

কি দেখতে এসেছ?

 জানি না। এসো, খুঁজি।

বাতি জ্বালতে হলো না। সামনের দুটো জানালা দিয়ে দিনের আলো ঢুকছে। এখনও অস্পষ্ট, তবে ঘরের জিনিসপত্র সব দেখা যায়। রবিনকে আসবাবগুলো পরীক্ষা করতে বলে নিজে ডেস্কে রাখা নোট আর বইগুলো দেখতে এগোল কিশোর।

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নতুন কিছু পেল না ওরা, গেনারের কি হয়েছে বা ও কোথায় গেছে এ ব্যাপারে সামান্যতম সুত্র পাওয়া গেল না।

পুলিশ এত করে খুঁজে যাওয়ার পর আর কিছু পাওয়ার কথাও না, হাল ছেড়ে দিয়ে বলল রবিন। আসলে কি খুজছ তুমি, কিশোর?

জবাব না দিয়ে একটা প্রশ্নপত্রের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ঘনঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। গভীর মনোযোগ। কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চেহারা।

এগিয়ে গেল রবিন। কিছু পেয়েছ মনে হচ্ছে?

 দেখো এটা! উত্তেজনায় গলা কেঁপে উঠল কিশোরের।

.

০৫.

ওর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রবিন। কই, কি আছে এতে? কয়েকটা প্রশ্ন ছাড়া তো আর কিছু দেখছি না।

হ্যাঁ, এই প্রশ্নগুলোর মধ্যেই রয়েছে একটা জরুরী সূত্র, কিশোর বলল।

আমি কিছুই দেখছি না।

প্রথম প্রশ্নটা দেখো…

দেখলাম। রাশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আমার।

আমারও না। পরের প্রশ্নটা দেখো।

আফ্রিকায় কি ঘটছে..তাতেই বা আমার কি?

আমারও না, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল কিশোর। রবিন বুঝতে পারছে না দেখে মজা পাচ্ছে সে।

দেখো, কিশোর, অধৈর্য হয়ে বলল রবিন, দোহাই তোমার, যা বুঝেছ, বলে ফেলো! না বোঝালে বুঝব না!

মোট কটা প্রশ্ন আছে?

দশটা।

 প্রতিটি প্রশ্নের প্রথম অক্ষরটা নিয়ে পর পর সাজাও কি হয়?

দ্রুত ওপর থেকে নিচে চলে গেল রবিনের চোখ। অক্ষরগুলো সাজালে হয়:

S-H-E-E-P-R-I-D-G-E

শিস দিয়ে উঠল সে, শিপরিজ! কোনও শহরের নাম!

হ্যাঁ, কিশোর বলল, বেশ চালাকি করে সূত্র রেখে গেছে গেনার। আমার ধারণা পুলিশ এটা বের করতে পারেনি। সম্ভবত গেমারের নিরুদ্দেশের ব্যাপারে তেমন গুরুত্বই দেয়নি পুলিশ।

তাতে আমাদেরই ভাল হয়েছে, রহস্যটার মীমাংসা করতে পারব। কিন্তু, আর তো দাঁড়াতে পারছি না, চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোন রকম চিন্তা-ভাবনা করতে পারব না এখন। মাখা কাজ করছে না।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে নাস্তা খেয়ে নিতে হবে, খালি পেটে ঘুম ভাল হবে না, কিশোর বলল। ঘুম থেকে উঠে পোস্ট অফিসে যাব শিপরিজটা কোথায় জানতে।

কমন নেম। পুরো আমেরিকায় অন্তত পঁচিশটা শিপরিজ পাওয়া যাবে। কটাতে খুঁজব? সবগুলোতে খুঁজতে গেলে খোঁজা শেষ হতে হতে আশি বছরের বুড়ো হয়ে যাবে গেনার। বড় করে হাই তুলল রবিন। তাড়াতাড়ি গিয়ে কান পাতল দেয়ালে।

শুনেছ নাকি কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মনে হয় ডিগ উঠে পড়েছে। জলদি পালানো দরকার। ধরা পড়লে প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে জান খারাপ হয়ে যাবে।

বেরিয়ে এল দুজনে। দরজার তালাটা আবার লাগিয়ে দিল কিশোর। নিচে নেমে দেখল স্টিয়ারিঙে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে মুসা। ধাক্কাধাক্কি করেও তাকে জাগানো গেল না। তবে নাস্তার কথাটা কানের কাছে বলতেই মুহূর্তে পুরো সজাগ হয়ে গেল। স্টার্ট দিল গাড়িতে।

ক্যামপাসের ক্যাফেটেরিয়া এখনও খোলেনি। তাই শহরের একধারে একটা অল-নাইট কাফের সামনে গাড়ি রাখল মুসা।

ভরপেট খেয়ে কাফে থেকে বেরোল ওরা। মোটেলে ফিরে চলল।

ঘরে ফিরে একটানে জুতো খুলেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। কাপড় বদলানোর কষ্টও সহ্য করতে রাজি নয়। বলল, আমি গেলাম, আর পারছি না!

অন্য দুজনেরও একই অবস্থা। বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল তিনজনেই।

কয়েক ঘণ্টা টানা ঘুম দিয়ে জাগল ওরা। ঝরঝরে লাগছে এখন শরীর। হাতমুখ ধুয়ে, তৈরি হয়ে রওনা হলো ওরা। দরজা দিয়ে বেরিয়েই থমকে দাঁড়াল রবিন। ঘোষণা করল, ঝামেলা আসছে! লড়াইয়ের জন্যে তৈরি হও!

কি হয়েছে? রবিনের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল কিশোর।

 মুসা এসে দাঁড়াল তার পেছনে।

রিজ মোটেলের চওড়া লন পেরিয়ে হেঁটে আসছে চারজন তরুণ। দলপতি বব বোম্যান।

লায়ন কাবস, বিড়বিড় করল মুসা। আজ যদি আবার সিংহগিরি দেখাতে এসে থাকে, ভাল হবে না। কেশর কেটে দিয়ে তবে ছাড়ব।

আগেই মারামারি শুরু করে দিয়ো না, সাবধান করল কিশোর, কি জন্যে এসেছে দেখি।

দরজা দিয়ে আগে বেরোল সে।

 এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল বব, হাই! তোমাদের চমকে দিতে এলাম।

কিশোরের দুপাশ দিয়ে বেরোল মুসা আর রবিন।

মুসার মারমুখো ভঙ্গি ভাল ঠেকল না ববের, ওর হাতের কিলবিলে। পেশীগুলোর দিকে তাকাল চোখে সন্দেহ নিয়ে। বলল, দেখো, মারামারি করতে আসিনি আমরা।

তাহলে কি করতে এসেছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।

কি জন্যে এসেছে, বলল বব। তিন গোয়েন্দাকে ওর পছন্দ হয়েছে। সে চায় ওরা লায়ন কাবসে যোগ দিক।

কাজ নেই তো আর খেয়েদেয়ে, মানুষ থেকে শেষে পশুর বাচ্চা হতে যাই… বলে ফেলল মুসা।

অহেতুক ঝগড়া বাধাতে চায় না এখন কিশোর, তাই মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, যোগ দিতে পারি, এক শর্তে। কাল রাতে কে আমাদেরকে লাইনের ওপর ফেলে আসতে বলেছিল, যদি তার নাম বলো।

দ্বিধায় পড়ে গেল বব। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বলতে চায় সে, কিন্তু কোন কারণে পারছে না। শেষে বলল, দেখো, বলতাম, সত্যি। কিন্তু একজন বন্ধুকে ফাঁসিয়ে দেয়া কি ঠিক?

তাহলে বোলো না।

 কিন্তু তোমরা তো তাহলে আমাদের দলে আসবে না।

শর্ত না মানলে কি করে আসব। এলে খুব ভাল হত। মুসার দিকে তাকাল বব, তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি, মুসা আমান। দারুণ বাস্কেটবল খেলো। তোমার খেলা দেখেছি। আরলিংটনের যে কোন টিম তোমাকে পেলে লুফে নেবে।

ধন্যবাদ, মুসা বলল, আপাতত আরলিঙটনের কারও লোফালুফির পাত্র হবার ইচ্ছে আমার নেই, এমনিতেই খুব ভাল আছি।

কোনমতেই তিন গোয়েন্দাকে লায়ন কাবসে ঢোকাতে রাজি করতে না পেরে হতাশ হয়েই ফিরে চলল বব। তবে বোঝা গেল, আশা ছাড়েনি সে। আবার আসবে চাপাচাপি করতে।

বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। পোস্ট অফিসে ঢুকে একজন ক্লার্ককে অনুরোধ করতেই একটা পোস্টাল ডিরেক্টরি বের করে কাউন্টারের ওপর দিয়ে ঠেলে দিল। তার ওপরহুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর আর রবিন।

অনেকক্ষণ পাতা ওল্টানোর পর নিশ্চিত হলো, শিপরিজ অনেকগুলো আছে আমেরিকায়, তবে লস অ্যাঞ্জেলেসে আছে মাত্র একটা। কাজ সহজ হয়ে যাওয়ায় খুশি হলো ওরা। ডিরেক্টরিটা ক্লার্ককে ফেরত দিয়ে, তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পোস্ট অফিল থেকে বেরিয়ে এল।

মুসা জিজ্ঞেস করল, এবার কোথায়?

জবাব দিল কিশোর, অবশ্যই শিপরিজে, তবে তার আগে ক্যাম্পাসে যাও। ডিন আর মেরিন ডিগেরকাছ থেকে বিদায় নিতে হবে।

তার কোন প্রয়োজন আছে?

আছে।

আগেরবারের মতই শীতলভাবে ওদেরকে গ্রহণ করলেন ডিন ফলেট। ওরা চলে যাচ্ছে শুনে জানতে চাইলেন কোথায় যাচ্ছে।

জানাল কিশোর।

কোন ভাবান্তর হলো না তার। গেনারকে খোঁজার জন্যে ওদের একটা শীতল ধন্যবাদ জানিয়ে আবার কাজে মন দিলেন।

বেরিয়ে এল ওরা। ডিগের সঙ্গে দেখা করতে চলল।

 ঘরেই পাওয়া গেল তাকে।

কিশোর বলল, আমরা চলে যাচ্ছি। এখানে আমাদের কাজ শেষ।

হাত মেলাতে মেলাতে রবিন বলল, আপনার সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

দুঃখ একটাই, বলল কিশোর, আপনার বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারলাম না।

তাতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, বিন্দুমাত্র উদ্বিয় মনে হলো না ডিগকে, বরং তিন গোয়েন্দা চলে যাচ্ছে শুনে যেন খুশিই হলো। আমার এখনও। বিশ্বাস, ইয়োরোপেই গেছে সে, বিয়ে করতে, হয়তো এতক্ষণে করেও ফেলেছে। হানিমুন করছে নতুন বউকে নিয়ে। হাহ হাহ হা! নিজের রসিকতায় নিজেই হাসল।

সেটা হলে তো ভালই। যাই হোক, অনেক সাহায্য করেছেন আমাদের। থ্যাংক ইউ।

তা কোথায় যাচ্ছ তোমরা? বাড়ি?

না, ইচ্ছে করেই সত্যি কথাটা জানিয়ে দিল কিশোর, ডিগের চোখের দিকে তাকিয়ে, ভাবছি শিপরিজটা একবার ঘুরে যাব-..

চমকে গেল মনে হলো ডিগ, কেন? ওখানে কেন? গুহাটা দেখতে নাকি?

গুহা! সতর্ক হলো কিশোর।

ও, জানো না। একটা বিখ্যাত গুহা আছে ওখানে, নাম ব্ল্যাকহোল। তবে বিখ্যাত না বলে কুখ্যাত বলাই ভাল…

আপনি দেখেছেন নাকি গুহাটা?

উ! থমকে গেল ডিগ। হাসল। দেখেছি। আমার এক চাচা থাকে ওখানে, তার কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম তো, ঠিক আছে, যাও। দেরি করিয়ে দিচ্ছি। আমারও কাজ আছে। লেকচারের জন্যে কিছু কাগজ রেডি করতে হবে।

কিশোরের মনে হলো, কোন কথা চেপে যাচ্ছে ডিগ। ওরা যে মেরিনকে খুঁজতে যাচ্ছে ওখানে সন্দেহ করেছে নাকি? সন্দেহ কাটানোর জন্যে বলল, শুনেছি, শিপরিজটা সুন্দর জায়গা, দেখার মত। গুহাটা যাওয়ার আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিল। গুহার ভেতরে রাত কাটানো খুব মজার, কি বলেন?

০৬.

মোটেলে ফেরার পথে রবিন বলল, শিপরিজের কথা শুনে অমন চমকে উঠল কেন? আমার মনে হয় কিছু লুকাচ্ছে ডিগ।

কি জানি, চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, হতে পারে গেনারের প্রশ্নপত্রে শিপরিজের নামটা সেও আবিষ্কার করে ফেলেছে। কিন্তু কথা হলো, সে জানে আমরা গোয়েন্দা, আবিষ্কারই যদি করে থাকে, আমাদের সেকথা জানাল না কেন?

নিজেই যেতে চায় হয়তো ওখানে। বন্ধুকে খুঁজে বের করে সবাইকে চমকে দেয়ার জন্যে।

মাথা নাড়ল কিশোর, আমার তা মনে হয় না। লোকটার ব্যাপারে সাবধান থাকা দরকার।

কি করে থাকব? মুসার প্রশ্ন। আমরা তো চলেই যাচ্ছি এখান থেকে।

জবাব দিল না কিশোর। ভাবনায় ডুবে গেল।

মোটেলে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে লাগল রবিন আর মুসা, কিশোর ফোন করল রকি বীচে, গোয়েন্দা ভিকটর সাইমনের পাইলট ল্যারি কংকলিনকে। বাড়িতেই পাওয়া গেল ওকে। মেরিন ডিগের কথা তাকে। জানিয়ে অনুরোধ করল কিশোর, লোকটার ওপর সন্দেহ হচ্ছে আমাদের, ওর ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে আমাদের জানাবেন?

তোমাদের ঠিকানা বলো।

শিপরিজে যাচ্ছি। কোথায় উঠব বলতে পারছি না। আপনি খোঁজখবর নিন, আমি আবার ফোন করব।

টাকমাথা বাচাল ম্যানেজারকে অফিসে পাওয়া গেল। বিল মিটিয়ে দিল কিশোর। আবার তিনজনে গাড়িতে উঠতে মুসা বলল, তাহলে শিপরিজেই যাচ্ছি?

কেন, কোন সন্দেহ আছে নাকি তোমার? প্রশ্ন করল কিশোর।

 না না, বলছিলাম কি ব্ল্যাকহোল গুহায় যাব নাকি?

দরকার পড়লে যাব।

হেসে বলল রবিন, ভয় করছে নাকি তোমার?

তা একটু-আধটু যে করে না তা নয়। আমি ভাবছি, আমার মেটাল ডিটেক্টরটা এবার কাজে লাগানো যাবে কিনা?

গুহার মধ্যে কি খুঁজবে? ভূত?

আরে দূর! জোরে হাত নাড়ল মুসা, এটা কি গোস্ট ডিটেক্টর নাকি? আমি বলছি গুপ্তধনের কথা। সোনার মোহর-টোহর যদি লুকানো থাকে…

তাহলে বড়লোক হয়ে যাবে, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। নাও, বকবকানি থামিয়ে এখন গাড়ি চালাও।

রওনা হওয়ার সময় আকাশটা ভালই ছিল, এখন যতই সামনে এগোচ্ছে ধূসর হয়ে আসছে আকাশের রঙ। একসময় কুয়াশায় ঢেকে গেল সবকিছু। হেডলাইট জ্বেলে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে মুসাকে। ঘন্টাখানেক পরই কুয়াশা কেটে গেল, হেসে উঠল উজ্জল রোদ। আবহাওয়ার এই যখন তখন পরিবর্তনে অবাক হলো না ওরা, এদিকে এ রকমই হয়, জানা আছে।

সাগর সমতল থেকে এখানে দুশো ফুট ওপরে রাস্তা। পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে। সাগরের দিকটায় কোথাও খাড়া, কোথাও ঢালু হয়ে নেমেছে পাহাড়ের দেয়াল। ঢালু অংশগুলোতে সাগর আড়াল করে দিয়ে ঘন হয়ে জন্মেছে গাছপালা, ঝোপঝাড়।

কিছুদূর এগোনোর পর সামনে ঢালু হয়ে এল পথ। লম্বা একটা পাহাড়ের কিনার দিয়ে নিচে নামতে নামতে একসময় চোখে পড়ল শিপরিজ। মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা অতি খুদে একটা গ্রাম। সৈকতের ধারে ছোট্ট জেটি তৈরি করেছে জেলেরা। শান্ত, সুন্দর গ্রাম। দেখে মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য। রাস্তার পাশে একটা পুরানো বাড়ি দেখা গেল। রোদ-বৃষ্টি আর নোনা হাওয়ায় রঙ এমন চটেছে, যতটা না পুরানো তার চেয়ে অনেক বেশি পুরানো মনে হয়।

দরজায় বড় করে সাইনবোর্ড লেখা:

 HARRYS GENERAL STORE.

মুসাকে বলল কিশোর, থামো, কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে ক্যাম্প করার জন্যে।

বাড়িটার সামনে গাড়ি রেখে মুসা বলল, একটা করে বার্গার খেয়ে নিলে কেমন হয়?

মন্দ হয় না।

কাউন্টারের ওপাশেবসে আছে মাঝবয়েসী, ঝাড়ুর শলার মত খাড়া খাড়া গোঁফওয়ালা এক লোক। পত্রিকা পড়ছে।

সাড়া পেয়ে কাউন্টারের ওপর কাগজটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল সে। চশমার ভারি লেন্সের ওপাশ দিয়ে গভীর কৌতূহলের সঙ্গে তাকাল ওদের দিকে। ভঙ্গি দেখে মনে হয় যেন বহুদিন বাদে এই প্রথম মানুষ চোখে পড়েছে।

আপনিই মিস্টার হ্যারি? জানতে চাইল কিশোর।

হ্যাঁ, খসখসে গলায় জবাব দিল লোকটা, কি সাহায্য করতে পারি?

 ব্ল্যাকহোলটা কতদূরে, বলতে পারেন?

চোখ বড় বড় হয়ে গেল হ্যারির, ব্ল্যাকহোল! ওখানে যাওয়ার জন্যে এসেছ নাকি?

হ্যাঁ, গুহার কাছে ক্যাম্প করতে চাই।

কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে সামনের দিকে গলা বাড়িয়ে দিল হ্যারি। ক্যাম্প করবে? ব্ল্যাকহোলে?

কেন, অসুবিধে আছে নাকি?

আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করল লোকটা, এখানে এই প্রথম এলে নাকি?

হ্যাঁ, রকি বীচ থেকে। বেড়াতে বেরিয়েছি।

শিপরিজ বেড়ানোর জন্যে খুব ভাল জায়গা।

 গুহাটা কতদূরে, বলেননি কিন্তু।

এই রাস্তা ধরেই চলে যাও পাঁচ মাইল। তারপর খানিক হাঁটতে হবে।

কাউন্টারে কনুই ঠেকাল মূসা। বার্গার আছে নাকি?

আছে,হ্যারি বলল, খুব ভাল বার্গার। তাজা। তাজা জিনিস ছাড়া বেচি আমি।

দিন তাহলে। তিনটা।

 প্লেটে করে বার্গার এনে দিল হ্যারি।

বার্গারের কাগজের মোড়ক ছাড়াতে ছাড়াতে জিজ্ঞেস করল রবিন, গুহার কাছে ক্যাম্প করার জায়গা আছে নাকি?

আছে। কাছেই একজন জেলে থাকে, নাম রিক ভেলভার। খাতির করে নিতে পারলে ওর বাড়ির কাছে তোমাদের থাকতে দেবে সে। তোক ভাল। গুহার কাছে না গিয়ে ওর বাড়ির কাছাকাছি থাকলেই ভাল করবে। এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে মুখ খুলল হ্যারি, আমি হলে অন্তত ওই গুহার কাছে ক্যাম্প করতে যেতাম না কিছুতেই।

শুধু ক্যাম্প করা নয়, আমরা তো ভাবছি গুহাটাতেই ঢুকব।

পাগল! ঢোক গিলল হ্যারি।

 কেন, বেআইনী নাকি?

না। তবে সুস্থ মস্তিষ্ক কোন লোক এখন আর ওই গুহায় ঢুকতে চাইবে না।

কেন?

বললাম তো, মাথা খারাপ না হলে ওই গুহায় ঢোকার কথা ভাববে না কেউ, এমন ভঙ্গি করল হ্যারি, যেন এতেই সর প্রশ্নের জবাব হয়ে গেছে।

আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না! রবিন বলল।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, গুহায় ঢোকাটা বিপজ্জনক নাকি?

নাহলে এত কথা বলব কেন? আমার পরামর্শ শুনলে, ওই গুহার ধারেকাছে যেয়ো না।

কাউন্টারে কনুই রেখে অধৈর্য হয়ে বলল রবিন, দয়া করে কারণটা কি আমাদের খুলে বলা যায়?

এক মুহূর্ত চিন্তা করে নিল হ্যারি। বেশ, না শুনে যখন ছাড়বে না..ইদানীং অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে গুহার মধ্যে।

এইবার টনক নড়ল মুসার। খাড়া করে ফেলেছে কান। বার্গার চিবানো বন্ধ হয়ে গেল। খাইছে! ভূত নাকি?

তা বলতে পারব না, মাথা নাড়ল হ্যারি। কয়েক দিন আগে আমার পরিচিত এক জেলে গিয়েছিল গুহার কাছে। এত ভয় পেয়েছিল, আরেকটু হলে হার্টফেল করেই মরত বেচারা। নেহাত হাটটা শক্ত আর নীরোগ বলে বেঁচে গেছে। গুহার ভেতরে আর আশোঁপাশে নাকি আজব আলো দেখা যায়, শব্দ শোনা যায়, গোলাগুলি চলে।

গোলাগুলি! ভুরু কুঁচকে ফেলল কিশোর।

হ্যাঁ। দুজন অতি উৎসাহী লোক গুহার আলোক-রহস্য জানতে গিয়েছিল, তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। আততায়ীকে দেখতে পায়নি ওরা।

কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো মুসা, আর যাই করুক, ভূতে গুলি ছোড়ে না। গলা টিপে ধরে, নয়তো ঘাড় মটকে দেয়। কোন কোন ভূত জীবন্ত মানুষের শরীর থেকেই চুপচাপ রক্ত খেয়ে চলে যায়।

আবার বার্গার খাওয়ায় মন দিল সে।

 চট করে ভাবনাটা খেলে গেল কিশোরের মাথায়–ওই গুহার মধ্যেই ঢোকেনি তো হ্যারিস গেনার? জিজ্ঞেস করল, লোক দুজন কারা, এই এলাকার কেউ?

না, চিনি না। আগে নাকি কখনও এখানে দেখা যায়নি ওদের।

ওদের চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন? তাদের মধ্যে কি হ্যারিস গেনার নামে একজন কলেজের লেকচারার আছেন?

তা বলতে পারব না। ওদের সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। যে জেলের কাছে গুহার কথা শুনেছি, লোকগুলোর কথাও সেই বলেছে।

জেলের নাম কি? ওকে কোথায় পাওয়া যাবে?

আপাতত পাওয়া যাবে না ওকে। ওর মায়ের শরীর খারাপ, তাকে দেখতে গেছে। অনেক দূরে থাকে ওর মা। কিশোরের চোখের দিকে তাকাল। হ্যারি। মনে হচ্ছে নোক দুজনকে তোমাদের দরকার?

না না, এমনি, গুহাটার ব্যাপারে কৌতূহল হচ্ছে তো, ওদের মুখ থেকেই সক শুনতাম, কোনমতে দায়সারা জবাব দিয়ে হ্যারির প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। সে।

ক্যাম্প করার জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো চাইল কিশোর। এগুলো নিয়ে, খাবার আর জিনিসের দাম মিটিয়ে, হ্যারিকে ধন্যবাদ দিয়ে দরজার দিকে এগোল।

 গুহার কাছে না যাওয়ার জন্যে আরেকবার ওদেরকে সতর্ক করল দোকানদার।

.

০৭.

 মহাসড়ক ধরে মাইল পাঁচেক এগোনোর পর ডানে একটা সরু কাঁচা রাস্তা দেখা গেল। এবড়োখেবড়ো, নুড়িতে ভরা রাস্তাটা চলে গেছে সৈকতের ধারে তৈরি একসারি বাড়ির দিকে। জেলেদের বাড়ি ওগুলো।

রাস্তাটা ধরে গাড়ি চালাল মুসা। দুশো গজ দূরে পাহাড়ের গোড়ায় গিয়ে সৈকতটা যেখানে আচমকা শেষ হয়েছে সেখানে একটা ছোট বাড়ি। ওটার খানিক দূরে পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। বাড়ির পেছনে পাহাড়, একটা আঁকাবাঁকা পথ উঠে গেছে চুড়ার দিকে।

ওটাই সভবত রিক ডেলভারের বাড়ি, হাত তুলে দেখিয়ে কিশোর বলল।

যাব নাকি ওদিকে? জানতে চাইল মুসা।

যাও।

বাড়ির কাছ থেকে সামান্য দূরে এনে গাড়ি রাখল মুসা। নেমে গেল। কিশোর আর রবিন। ড্রাইভিং সীট থেকে মুসাও নেমে এসে এগোল ওদের পেছন পেছন।

 দরজায় টোকা দিল কিশোর।

 খুলে দিল একজন বেঁটে লোক। বুড়ো হয়ে গেছে। ভাঁজ পড়া, খসখসে মুখের চামড়া। তিন গোয়েন্দাকে দেখে অবাকই হলো। যেন ওদের মত কাউকে এখানে দেখতে পাবে আশা করেনি।

আপনি রিক ডেলভার? প্রশ্ন করল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল লোকটা। হাসল।

মূসার গাড়িটা দেখিয়ে কিশোর বলল, গাড়িটা রাখলাম। কোন অসুবিধে হবে?

না, অসুবিধে হবে না। ঘুরতে যাবে নাকি? কতক্ষণ লাগবে তোমাদের? ঘণ্টাখানেক?

আসলে কয়েকদিন থাকব ভাবছি। যদি আপনার কোন অসুবিধে না হয়…

গুহা দেখতে আসোনি তো? মুখের ভাব বদলে গেছে বুড়োর। চোখ পিটপিট করে একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকাচ্ছে।

ঠিকই ধরেছেন, গুহা দেখতেই এসেছি।

হাসি চলে গেছে বুড়োর। ভারী গলায় বলল, ভাল চাও তত বাড়ি ফিরে যাও। গুহার অবস্থা ভাল না। খামোকা কেন প্রাণটা খোয়াতে যাবে।

কে, রিক? ঘরের ভেতর থেকে প্রশ্ন করল একটা মহিলাকণ্ঠ, কার সঙ্গে কথা বলছ?

এই তো, কয়েকটা ছেলে, বেড়াতে এসেছে, ফিরে তাকিয়ে জবাব দিল রিক। গুহা দেখতে যেতে চায়।

বলে কি! ভেতর থেকে বেরিয়ে এল গোলগাল এক মহিলা।

এত ভয় পাচ্ছেন কেন আপনারা? জিজ্ঞেস করল কিশোর। কি আছে গুহায়?

আলো আর গুলি! রহস্যময় স্বরে জবাব দিল বুড়ো।

লোকজন দেখেছেন? আছে ভেতরে?

কারও ছায়াও নেই।

তাহলে গুলি করে কারা?

জানি না!

অবাক কাণ্ড!

অবাক বলে অবাক! এক্কেবারে ভূতুড়ে কাণ্ড! খোদাই জানে এ কোন ধরনের ভূত, গুলিও চালায়!

হাঁ হয়ে গেছে মুসা। চট করে তাকাল চারপাশে। গায়ে কাঁটা দিল ওর। মনে হলো, গুহা থেকে বেরিয়ে এই বুঝি ওর ঘাড় মটকাতে এল কোন ভূত।

ওই গুহায় কখনও ঢুকেছেন আপনি, মিস্টার ডেনভার? জানতে চাইল কিশোর।

এত লম্বা নামের দরকার নেই, আমাকে শুধু রিক ডাকলেই চলবে, বুড়ো বলল। জানাল কয়েকদিন আগে নাকি রাতে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল। আবহাওয়া ভাল ছিল না। বাতাস আর সেই সঙ্গে বড় বড় ঢেউ। তীর থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ দেখল আলো। বুড়ো বলল, গুহার কাছে দুটো আলো দেখলাম। খানিক পর দুতিনটে গুলির শব্দ। চিৎকার করে উঠল কে যেন।

 চিৎকারটা কেমন? আর্তনাদ? মানে কাউকে খুন করা হচ্ছে, এমন?

সে বলে বোঝানো যাবে না। এমন চিৎকার জীবনে শুনিনি আমি। ভয়ঙ্কর!

তারমানে বোঝা যাচ্ছে, বিড়বিড় করল রবিন, ভেতরে কেউ আছে। দোকানদার হ্যারির কাছেও শুনলাম এই গপ্পো। পুলিশকে জানালেই পারেন?

জানানো হয়েছে। পুলিশ এ সব বিশ্বাস করে না। বুড়ো জেলেদের কুসংস্কার বলে হেসে উড়িয়ে দেয়। একটিবার দেখতেও আসেনি গুহাটা।

ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করা গেল না তিন গোয়েন্দাকে।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, গুহায় যাওয়ার সবচেয়ে সহজ পথটা বলতে পারেন?

কোনভাবেই নিরস্ত করতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল বুড়ো। জেলে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। তারপর নেমে এল দরজা থেকে। ওদেরকে নিয়ে সৈকত ধরে কিছুদূর চলার পর হাত তুলে পাহাড়ে উঠে যাওয়া রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, ওটা ধরে চূড়ায় উঠে যাও। নিচে তাকালে ওপাশে একটা খাদ দেখতে পাবে। ওই খাদ ধরে এগোতে থাকলে পেয়ে যাবে গুহাটা।

গাড়ির কাছে ফিরে এল ওরা। ক্যাম্প করার জিনিসপত্র বের করে কাঁধে তুলে নিল। জেলে দম্পতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হয়ে গেল পাহাড়ের দিকে।

দূর থেকে যতটা মনে হয়েছিল, তারচেয়ে খাড়া পাহাড়টা। চূড়ায় উঠতে পুরো একটা ঘণ্টা লেগে গেল।

এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল ওপর থেকে। অনেক নিচে সৈকতে জেলেদের ঘরগুলোকে খেলনার মত লাগছে। সাগরকে মনে হচ্ছে বিশাল এক নীল রঙের মেঝে, ঘরের মেঝের মতই সমান।

চুড়ার অন্যপাশে সাগরের দিকটার একেবারে কিনারে গিয়ে নিচে তাকাল রবিন। পাথরের খাড়া দেয়াল নেমে গেছে। নিচে আছড়ে পড়ছে। উত্তাল ঢেউ। শক্ত জাতের কিছু ঝোপঝাড় জন্মে রয়েছে এখানে ওখানে।

সৈকত ধরে হেঁটে গুহায় যাওয়া অসম্ভব, অনুমান করল সে। সাগরের দিক দিয়ে যেতে হলে নৌকায় করে যেতে হবে।

ঝোড়ো বাতাসে ভর করে ভেসে এল মেঘের শুড়গুডু। আকাশের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, জলদি চলো। ঝড় আসছে। এখানে থাকলে মরব।

বড় বড় পাথরের চাঙড়ের মধ্যখান দিয়ে চলে গেছে সরু পায়ে চলা পথ। সেটা ধরে হাঁটতে শুরু করল ওরা। একটু পর পরই সরে গিয়ে নিচে তাকাচ্ছে রবিন। গিরিখাদটা দেখতে পাচ্ছে না। অবিশ্বাস্য দ্রুত মেঘে ঢেকে ফেলছে। আকাশ। অন্ধকার করে ফেলেছে। এর মধ্যে খাদটা চোখে পড়বে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। হয়তো দেখা যাবে হঠাৎ করেই ওটাতে নেমে পড়েছে। ওরা।

মুখে এসে পড়ল বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা। কালো আকাশকে চিরে দিয়ে ছুটাছুটি শুরু করল বিদ্যুতের তীব্র উজ্জ্বল নীলচে-সাদা সাপগুলো। কানফাটা বিকট শব্দে ঘন ঘন বাজ পড়তে লাগল। শুরু হলো ঝমঝম করে মুষলধারে বৃষ্টি।

তা বাড়ছে বাতাসের বেগ। অনেক নিচে পাথুরে দেয়ালে কামানের গর্জন তুলে ভাঙছে ঢেউ। চলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছে গোয়েন্দারা। সামনের পথ ঠিকমত চোখে পড়ছে না। ভোতা গোঁ গোঁ শব্দ তুলছে বাতাস, আকাশে বিদ্যুতের চমক, আর চলছে একনাগাড়ে বজ্রপাত।

আগে আগে চলেছে মুসা। মাঝে কিশোর, সবার শেষে রবিন। বৃষ্টি আর বাতাসের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে মাথা নুইয়ে রেখেছে। বুঝতে পারছে না এই দুর্যোগের মধ্যে আদৌ খুঁজে পাবে কিনা গিরিখাদটা।

হঠাৎ কি মনে হতে ফিরে তাকাল কিশোর। ধড়াস করে উঠল বুক। চিৎকার করে উঠল, আরি, রবিন গেল কোথায়!

উধাও হয়েছে রবিন। শত চিৎকার করেও তার সাড়া পাওয়া গেল না।

.

০৮.

 গেল কোথায়? বিমূঢ় হয়ে গেছে মুসা।

প্রবল বৃষ্টি আর অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টি চলে ভালমত। কয়েক গজ দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।

ফিরে যাওয়া দরকার, কিশোর বলল। কোন কারণে আমাদের কাছ থেকে পিছিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। কিংবা ক্লান্ত হয়ে গিয়ে কোথাও বসে বিশ্রাম নিচ্ছে।

বলল বটে, কিন্তু কথাটা সে নিজেও বিশ্বাস করল না।

প্রায় গা ঘেষাঘেঁষি করে ভেজা পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে ফিরে চলল দুজনে। বার বার চিৎকার করে রবিনের নাম ধরে ডাকছে। জানে, ঝড়ের গর্জনের মধ্যে এই চিৎকার রবিনের কানে পৌঁছার সম্ভাবনা খুব কম।

অ্যাই, শঙ্কিত হয়ে বলল মুসা, পা পিছলে পড়েটড়ে যায়নি তো! হাত পা ভেঙে পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে হয়তো কোথাও এখন।

থমকে দাঁড়াল কিশোর। হতে পারে। দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি। কান পেতে শুনতে লাগল কোথাও কিছু শোনা যায় কিনা।

বাতাসের শব্দকে ছাপিয়ে আগে মুসার কানে ঢুকল শব্দটা। অতি মৃদু চিৎকার।

খাইছে! শুনছ!

কিশোরও কান পাতল।

আবার শোনা গেল চিৎকার, মুসা! কিশোর!

পিছলে পড়ার ভয়কে পরোয়া না করে পাহাড়ের কিনারে ছুটে গেল দুজনে। উঁকি দিয়ে নিচে তাকাল। ফুট চারেক নিচে একটা কালো দেহ চোখে পড়ল।

রবিন, কোন সন্দেহ নেই। একটা ঝোপ আঁকড়ে ধরে ঝুলছে। ওদেরকে উঁকি দিতে দেখে প্রায় ককিয়ে উঠল, জলদি করো! গাছের গোড়া উপড়ে আসছে।

ধরে রাখো! মুসা বলল। রবিনকে ধরে তুলে আনার চেষ্টা করল। নাগালই পেল না। দমে গেল সে।

এ ভাবে পারবে না, কিশোর বলল। দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি।

দড়ি বের করল সে। এক মাথা পাথরের সঙ্গে বেঁধে আরেক মাথা ঝুলিয়ে দিল রবিনের নাগালের মধ্যে।

এক হাত বাড়িয়ে থাবা দিয়ে দড়িটা ধরে ফেলল রবিন। একেবারে শেষ মুহূর্তে। সেও দড়ি ধরল, ঝোপের গোড়াটাও উপড়ে এল পাহাড়ের গা থেকে। ধক করে উঠল বুক। একটা হার্টবীট মিস হয়ে গেল তার।

দড়ি ধরে টেনে ওকে ওপরে তুলে আনল মুসা আর কিশোর।

ওপরে উঠে ভেজা মাটিতেই গড়িয়ে পড়ল রবিন। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। ভীষণ ক্লান্ত।

ওখানে গেলে কি করে? জানতে চাইল মুসা।

একটু শান্ত হওয়ার পর রবিন বলল, জুতোর ফিতে ছিঁড়ে গিয়েছিল। হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে বসে ছেঁড়া মাথাটা বাধলাম। উঠে দেখি তোমরা নেই। ধরার জন্যে দৌড়াতে শুরু করলাম। এত কিনারে যে চলে গিয়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একটা পাথর ভেঙে সরে গেল পায়ের নিচ থেকে। পিছলে পড়ে গেলাম। গাছটা কখন কিভাবে ধরেছি বলতে পারব না।

কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা। এবার আর কেউ পেছনে পড়ে রইল না। দেয়ালের বেশি কিনারেও গেল না।

আচমকা চিৎকার করে উঠল মুসা, পেয়ে গেছি। খাদ!

হুড়াহুড়ি করে তার দুপাশে চলে এল অন্য দুজন। সামনে গলা বাড়িয়ে তাকাল। পাহাড়ের গায়ে গভীর একটা ক্ষতের মত হয়ে আছে খাদটা।

সাবধানে তিনজনেই পা রাখল ওটাতে। অনেক নিচে আবছাভাবে চোখে পড়ল সৈকত। বড় বড় ঢেউ আছড়ে ভাঙছে তীরে। চওড়া একটা বিরাট ফাটলের মত পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে গিরিখাদ। পথ গেছে তার মধ্যে দিয়েই। নামতে শুরু করল তিনজনে।

সবার আগে নিচে নামল রবিন।

ওই দেখো! গুহা! হাত তুলে চিৎকার করে বলল সে।

কিশোর আর মুসাও দেখল। সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সামান্য দূরে পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে একটা কালো ফোকর।

গুহার দিকে আগে এগোনোর সাহস হলো না মুসার। কোমরে ঝোলানো টর্চ খুলে পা বাড়াল কিশোর। আগে আগে চলল। তার পেছনে এগোল অন্য দুজন।

গুহামুখে দাঁড়িয়ে ভেতরে আলো ফেল কিশোর। তিনজনেই দেখল, গুহা না বলে ওটাকে সুড়ঙ্গ বলা ভাল। কালো কক্ষটার পেছন দিকটা হারিয়ে গেছে ভেতরের ঘন কালো অন্ধকারে।

ইচ্ছে করলে কি আছে ভেতরে এখনই দেখা যায়, কিশোর বলল।

মাথা খারাপ! আঁতকে উঠল মুসা। রাতের বেলা এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে যাব গুহায় ঢুকতে!

গুহার ভেতরে তো আর বৃষ্টি নেই।

তাতে কি? বাইরে তাঁবু পাতব আগুন জ্বালতে হবে। ভিজে একেবারে হাত-পা সিটিয়ে গেছে।

দেখো, গুহায় থাকলে আরামে থাকতে পারতাম…

এখন আমি ঢুকতে পারব না, সাফ মানা করে দিল মুসা।

আগুন জ্বালার লাকড়ি পাবে কোথায়? প্রশ্ন করল রবিন।

তাই তো? একথা তো ভাবেনি। জবাব দিতে পারল না মুসা। আশোঁপাশে গাছপালা আছে, লাকড়ির অভাব হত না, কিন্তু সব ভিজে চুপচুপে।

লাকড়ির যা হোক একটা ব্যবস্থা করো তোমরা, কিশোর বলল, আমি আসছি। গুহায় ঢোকার জন্যে পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না সে। টর্চ হাতে ঢুকে পড়ল। কয়েক পা এগিয়েই চিৎকার করে উঠল, অ্যাই, দেখে যাও কাণ্ড!

তার চিৎকারে মুসাও সাবধান হবার কথা ভুলে গেল। রবিনের সঙ্গে ছুটে এল।

কি দেখেছে টর্চের আলো নেড়ে দেখাল কিশোর, লাকড়ি! শুকনো?

সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা লাকড়ির স্তূপটা দেখল রবিন। কে রাখল?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না!

আ-আমি জানি…

ভূতে…

তাড়াতাড়ি রবিনের মুখে হাতচাপা দিল মুসা, খবরদার, ওই নাম মুখে এনো না! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল সে।

ওদের কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে গেল কিশোর। একটা লাকড়ি হাতে তুলে নিল। খটখটে শুকনো। হাসিমুখে ফিরে তাকিয়ে বলল, এবার আর আগুন জ্বালতে কোন অসুবিধে নেই।

কিন্তু কার লাকড়ি? জোরে কথা বলতে সাহস করছে না মুসা।

যারই হোক, আমাদের এখন দরকার, নিয়ে আগুন জ্বালব। তারপর দেখা যাবে।

তারমানে গুহাতেই থাকবে তুমি?

তো কি বাইরে গিয়ে সারারাত ধরে ভিজব নাকি? বোকামি করতে ইচ্ছে করলে তুমি করোগে, আমি যাচ্ছি না।

আমিও না,বলে দিল রবিন।

অগত্যা আর কি করে মুসা। বাইরে একা থাকার চেয়ে ভূতের ভয় নিয়েও গুহায় থাকা ভাল। সঙ্গে অন্তত দুজন সঙ্গী তো থাকছে। কোন কথা না বলে লাকড়ি জড় করে আগুন জালার ব্যবস্থা করতে লাগল সে। খিদে পেয়েছে।

ব্যাকপ্যাক খুলে ভেজা কাপড় খুলতে শুরু করল রবিন।

আগুন ধরিয়ে ফেলল মুসা। ধোঁয়া উঠছে অগ্নিকুণ্ড থেকে। ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিশোর আগুন তো জ্বালা হলো, ধোঁয়া যাবে কোথায়? বেরোনোর পথ না থাকলে অক্সিজেন শেষ করে দিয়ে দম আটকে মারবে ওদের।

 কিন্তু স্বস্তির সঙ্গে দেখল, সোজা ওপরে উঠে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া। তারমানে ফাটল আছে পাহাড়ের গায়ে, চিমনির কাজ করছে।

ভেজা কাপড় বদলে, শরীরে কম্বল জড়িয়ে, আগুনে হাত-পা সেকে গরম করতে লাগল ওরা। কিশোর ভাবছে, কে লাকড়ি রাখল এখানে? এর সঙ্গে কি রহস্যময় চিৎকার আর গুলির কোন সম্পর্ক আছে?

উঁকি দিয়ে গিয়ে গুহার বাইরেটা দেখে এল রবিন। বৃষ্টি একবিন্দু কমেনি। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি জোয়ারের পানি ঢোকে?

মনে হয় না। মেঝে তো শুকনোই দেখছি।

খাবারের টিন আর ফ্রাইং প্যান বের করে রান্না করতে বসল মুসা। তাকে সাহায্য করল রবিন। মাংস ভাজার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। মুসার ক্ষুধা দশগুণ বাড়িয়ে দিল। চমৎকার জমল খাওয়া। গুহার মাঝখানে অগ্নিকুণ্ড, দেয়ালে আর ছাদে লালচে আলোয় ছায়ার নাচন, বাইরে ঝড়বৃষ্টি। দারুণ এক পরিবেশ। আগুনের সামনে বসে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল তিনজনেই।

রবিন বলল, কম্বলের বদলে এখন পশুর ছাল পেলে ভাল হত। গুহামানব হয়ে যেতাম।

খাওয়ার পর কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। সারাদিনে প্রচুর পরিশ্রম করেছে। বুজে আসছে চোখ। কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল বলতে পারবে না।

চড়চড়, ফুটফাট, নানা রকম বিচিত্র শব্দ করে পুড়তে থাকল লাকড়ি।

এক ঘণ্টা কাটল।

দুই ঘন্টা।

হঠাৎ জেগে গেল রবিন। অলস ভঙ্গিতে ঘুরে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে পুরো সজাগ হয়ে গেল। পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছে।

কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা তুলে কে আসছে দেখার চেষ্টা করল। আগুন নিভে গেছে। পুড়ে শেষ হয়ে গেছে কাঠ। কেবল কয়লার আগুন লালচে একটা আভা তৈরি করে অতি সামান্য আলো দিচ্ছে।

কাউকে না দেখে ভাবল রবিন, কিশোর উঠেছে বুঝি, প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্যে। ডেকে জিজ্ঞেস করুল, কে, কিশোর?

সাড়া দিল না কিশোর। জবাবে চাপা শব্দ করে উঠল কে যেন। মনে হলো খুব অবাক হয়েছে। মেঝের ওপর দিয়ে দ্রুত ছুটে গেল পদশব্দ।

.

০৯.

কে? লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন।

জবাব নেই।

কিশোর! মুসা! জলদি ওঠো! অন্ধকারে টর্চটার জন্যে হাতড়াতে শুরু করলা সে।

কি হয়েছে? ঘুমজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মুসা। সকাল হয়ে গেল নাকি? এত তাড়াতাড়ি

ওঠো, জলদি! কে জানি ঢুকেছে!

কি করে বুঝলে?

হাঁটতে শুনলাম।

 কিশোর হবে হয়তো। টয়লেট করতে বেরিয়েছিল।

আমি বেরোইনি, জবাব দিল কিশোর।

খাইছে? তাহলে কে? চমকে উঠে বসল মুসা। বদলে গেছে কণ্ঠস্বর। আগুনটার কি হলো টর্চ জালছ না কেন?

হাতের কাছেই টর্চ রেখেছে কিশোর তুলে নিয়ে জালল। আলোর রশ্মি ঘুরিয়ে আনল গুহার দেয়ালে, ছাদে। অপরিচিত কাউকে দেখা গেল না।

চোখ পিটপিট করছে মুসা। রবিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি শুনেছিলে, বলো তো?

খুলে বলল রবিন ৷

সামনের দিকে গেছে? জানতে চাইল কিশোর।

 মাথা নাড়ল রবিন, না, পেছনে। সুড়ঙ্গের ভেতরে।

ওঠো, দেখে আসি।

 এই এখন, অন্ধকারের মধ্যে..চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার।

সুড়ঙ্গের মধ্যে দিনের বেলাও যা রাতেও তাই, সব সময়ই অন্ধকার, ভোরের জন্যে বসে থেকে লাভ নেই।

উঠে পড়ল কিশোর। টর্চ হাতে এগোল গুহার পেছন দিকে।

তিরিশ কদম এগোনোর পর সামনে একটা খিলান দেখা গেল, ওপরটা ধনুকের মত বাকা। গুহা থেকে সুড়ঙ্গে ঢোকার প্রবেশপথ। পেছনে তাকিয়ে দুই সহকারীর দিকে নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। সামনে টর্চ অব্রে রেখে সাবধানে এগোল। খেয়াল রাখল যাতে চোরা গর্তে না পড়ে।

খুব খাটো সুড়ঙ্গ, লম্বায় বড়জোর পনেরো ফুট, মেঝে থেকে ছাদ ছয় ফুট উঁচু কঠিন পাথুরে মেঝেতে পায়ের ছাপ পড়ে না। সুতরাং কেউ এসে থাকলেও ছাপ দেখে বোঝার উপায় নেই।

সুড়ঙ্গটা দিয়ে আরেকটা গুহায় ঢোকা যায়।

রবিন বলল, মনে হয় অনেক গুহা আছে এখানে। সুড়ঙ্গ দিয়ে যুক্ত। কোনটা দিয়ে কোনটায় ঢুকে গেছে লোকটা কে জানে।

আলো ফেলে দেখতে লাগল কিশোর। বিশাল এক গুহায় ঢুকেছে। চারপাশের দেয়ালে অনেক গর্ত, সুড়ঙ্গমুখ ওগুলো, বুঝতে অসুবিধে হলো না।

ঠোঁট কামড়াল কিশোর। আনমনে বিড়বিড় করল, একডজন গর্ত। কোনটা দিয়ে ঢুকেছে লোকটা, কি করে বুঝব?

চলো, প্রথমে সবচেয়ে বড়টা ধরেই যাই, পরামর্শ দিল মুসা। না পেলে ফিরে এসে বাকিগুলোতে ঢুকে দেখব।

ভাল বলেছ। চলো।

সোজা এগিয়েছে বড় সুড়ঙ্গটা। কিছুদূর এগিয়ে থমকে দাঁড়াল কিশোর।

আরেকটু হলে তার গায়ের ওপর এসে পড়ত মুসা। কি হলো?

দেখো! মাটির দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।

ওর কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বলে উঠল মুসা, আরি, পায়ের ছাপ।

পাহাড়ের গভীরে সুড়ঙ্গের মেঝেতে এখানে পাথর নেই, বালি। তার ওপর ভেজা ভেজা। সুতরাং ছাপ পড়েছে। স্পষ্ট বসে গেছে বুটের ছাপ।

মনে হয় ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা, কিশোর বলল। এসো।

উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তিনজনেই। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ঢুকল আরেকটা গুহায়। এটাও বিশাল। এখানে যতগুলো দেখেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। তিনটে টর্চের মিলিত আলোতেও দেয়াল বা ছাদের সমস্ত জায়গী একবারে দেখা গেল না।

পাথরের ছড়াছড়ি এখানে। মেঝেতে পাথর স্তূপ হয়ে আছে। দেয়ালে অসংখ্য সুড়ঙ্গমুখ।

আলো আরও বেশি হলে ভাল হত, রবিন বলল, ভাল করে দেখতে পারতাম।

আলোর ব্যবস্থা হয়তো করা যায়, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কিন্তু কত সুড়ঙ্গ দেখেছ? পাহাড়ের নিচে জালের মত বিছিয়ে আছে। সবগুলো দেখতে হলে অনেক সময় লাগবে। ততক্ষণ বসে থাকবে না লোকটা, যার পেছনে লেগেছি।

তবু আরেকটু খুঁজে দেখা দরকার।

আলোর ব্যবস্থা কি করে করবে? জানতে চাইল মুসা।

লাকড়ি দিয়ে মশাল বানাতে পারি, জবাব দিল কিশোর। তিনজনের হাতে তিনটে মশাল থাকলে অনেক আলো হবে। তা ছাড়া টর্চের ব্যাটারি ফুরানোরও ভয় থাকবে না।

চলো তাহলে, বানিয়ে নিয়ে আসি।

 প্রথম গুহাটায় ফিরে এল ওরা।

লাকড়ির স্তূপের দিকে এগোতে গিয়ে ভুরু কুঁচকে গেল রবিনের। চেঁচিয়ে উঠল, একি!

কি হলো? একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল কিশোর আর মুসা।

তাকিয়ে আছে রবিন। টর্চের আলো ফেলেছে যেখানে ওদের জিনিসপত্র রেখেছিল সেখানে। খাবারের টিনগুলো সব গায়েব। পড়ে আছে কেবল খাওয়া পাউরুটির খানিকটা অবশিষ্ট আর মাছের একটা খালি টিন।

নিয়ে গেছে! কিশোর বলল।

নিশ্চয় সেই লোকটা, বলল রবিন, যার পেছনে আমরা লেগেছি। আমরা জেগে যাওয়ায় লুকিয়ে পড়েছিল। যেই আমরা গুহা থেকে বেরিয়েছি, চুপচাপ বেরিয়ে এসে খাবারগুলো সব চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।

খাবার আমাদের দরকার নেই আপাতত, কিশোর বলল, ওব্যাপারে চিন্তা না করলেও চলবে। চলো, যা করছিলাম, করি। লোকটাকে খুঁজে পেলে খাবারগুলোও ফেরত পাব।

ওর সঙ্গে কথা আছে আমার, রাগ চেপে বলল মুসা।

কথা আমাদেরও আছে।

কিন্তু গেল কোনদিকে? রবিনের প্রশ্ন।

 জুতোর ছাপ যেখানে পেয়েছি, তার আশোঁপাশেই আছে হয়তো। যেখান থেকে এইমাত্র ফিরে এলাম ওদিকেই খুজব।

বাইরে চলে গিয়ে থাকে যদি?

মাথা নাড়ল কিশোর, মনে হয় না। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বোঝা নিয়ে বাইরে বেরোবে না সে। লুকিয়ে আছে এই পাহাড়ের নিচেই কোথাও।

হাতে কয়েকটা করে লাকড়ি নিয়ে বড় গুহাটায় আবার এসে ঢুকল তিনজনে। মশালের আলোয় ভাল করে দেখতে লাগল গুহাটা। এত বেশি সুড়ঙ্গমুখ আর ফাটল দেখা গেল, সবগুলোতে ঢোকার কথা ভেবে দমে গেল ওরা।

তবে হাল ছাড়ল না। একধার থেকে খোঁজা শুরু করল। কোনটা ছোট সুড়ঙ্গ, কোনটা বেশ লম্বা। কোন কোন ফাটলের ওপাশে কয়েক হাত দূরেই দেয়াল।

কোনখানেই লোকটার আর কোন চিহ্ন দেখা গেল না।

হতাশ হয়ে মুসা বলল, অহেতুক খুঁজে আর লাভ নেই। চলো, চলে যাই।

প্রথম গুহাটায় ফিরে চলল আবার ওরা।

.

১০.

বাকি রাতটা নিরাপদেই কাটল।

ঘুম ভাঙতে দেখল ওরা, ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। গুহা থেকেই চোখে পড়ল সাগরের রোদ ঝলমলে নীল জল! পর

পেটে মোচড় দিল মুসার। জিজ্ঞেস করল, কি করব? খাবার তো একদম নেই। আনতে যেতে হবে না?

হবে, বলে চুপ করে ভাবতে লাগল কিশোর।

 রবিন বলল, লোকটাকে এখন আরেকবার খুঁজতে বেরোলে কেমন হয়?

ওকে পেলেই সমস্যা চুকে যায়, খাবারগুলো আদায় করে নিতে পারব।

মাথা নাড়ল কিশোর। লাভ হবে বলে মনে হয় না। রাতেই যখন পাইনি, ও কি আর এখন আমাদের জন্যে বসে আছে নাকি?

 মুসা বলল, অ্যাই, কিশোর, এক কাজ তো করতে পারি, আমার মেটাল ডিটেক্টরটাকে কাজে লাগাতে পারি…

তাতে কি হবে? বাধা দিল রবিন। তুমিই তো সেদিন বললে এই যন্ত্র মানুষ খুঁজে বের করতে পারে না…

মানুষ না পাক, সূত্র তো খোঁজা যায়। এমনও তো হতে পারে, টিনগুলো সঙ্গে না নিয়ে আশপাশেই কোথাও লুকিয়ে রেখে গেছে লোকটা? ভারী বোঝা, একার পক্ষে বয়ে বেশিদুর নেয়া কষ্টকর।

ওর কথায় যুক্তি আছে। তবে অতটা আশা করতে পারল না বলে চুপ করে রইল কিশোর।

রবিন বলল, দেখো আধাঘণ্টা, তারপর না পেলে অহেতুক সময় নষ্ট না করে খাবার আনতে যাওয়াই উচিত হবে আমাদের। শরীরে শক্তি থাকতে থাকতে যাওয়া ভাল, এই পাহাড় পেরোনো চাট্টিখানি কথা না। কি বলো, কিশোর?

মাথা ঝাঁকিয়ে তার সঙ্গে একমত হলো কিশোর।

মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে কাজে লেগে গেল মুসা। তার ইচ্ছে কোনভাবে যন্ত্রটাকে ব্যবহার করা, খাবার পাক আর না পাক।

তবে কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই ওদেরকে অবাক করে দিয়ে সঙ্কেত দিতে শুরু করল যন্ত্রটা। গুহামুখের কাছে যেখানে সঙ্কেত দিল সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মুসা। একটা পাথরের আড়াল থেকে বের করল জিনিসটা। তুলে দেখাল সঙ্গীদের।

তাকিয়ে আছে রবিন, কি জিনিস?

পিস্তল! খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে মুসার। জলদস্যুর জিনিস, কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় জাহাজডুবি হয়ে এখানে এসে উঠেছিল ওরা। বহুদিন আগে।

দেখি তো? হাত বাড়াল কিশোর।

হাতে নিয়ে ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আবার মুসাকে ফেরত দিতে দিতে বলল, বেশি পুরানো তো মনে হচ্ছে না।

রবিনও দেখল। তাই তো। একেবারেই মরচে পড়েনি। কোম্পানির নামটাও পড়া যাচ্ছে-স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন।

হ্যাঁ, স্পেনের তৈরি, কিশোর বলল।

আচ্ছা, এটা দিয়েই গুলি করা হয়নি তো? কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। গুহার মধ্যে রহস্যময় যে গোলাগুলির কথা বলল জেলেরা?

ওদের কথাবার্তায়, অবাক হয়ে দুজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। মূসা। এ সব বলে কি বোঝাতে চাইছ তোমরা?

বোঝাতে চাইছি, পিস্তলটা অত পুরানো নয়, যতটা তোমার মনে হচ্ছে।

তারমানে জলদস্যু নয়? আধুনিক পিস্তল দিয়ে আধুনিক কাজকারবার করছে কোন আধুনিক মানুষ?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

কাকে সন্দেহ হয় তোমার? মুসার প্রশ্ন 1 রহস্যময় হ্যারিস গেনার? মেরিন ডিগ?

হতে পারে, এখনও জানি না। তবে ডিগকেই বেশি সন্দেহ হয়।

সেই পিস্তলটা ফেলে গেছে এখানে?

তাও জানি না।

 কেন ফেলবে?

সেটা জানলে তো অনেক প্রশ্নের জবাবই পেয়ে যেতাম।

দারুণ! একটা জটিল রহস্যের সূত্র খুঁজে বের করে দিলাম, দেখা যাক। আরও পারি কিনা। ক্ষুধার কথা ভুলে গিয়ে মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে আবার কাজে লেগে গেল মুসা।

খুঁজতে খুঁজতে গুহা থেকে বেরিয়ে সৈকতে চলে এল। বালিতে ঢাকা জায়গাটা সরে গেছে বিশাল কালো একটা পাথরের টিলার দিকে। সেটা ঘুরে আসতেই পাহাড়ের গায়ে একটা ফোকর দেখা গেল।

আরেকটা গুহা! ভুরু কুঁচকে ফেলল কিশোর।

ডিটেক্টর হাতে হাসিমুখে ওটার দিকে এগোল মুসা। এক গুহার মুখে পেয়েছে পিস্তল, আরেকটার মুখেও যদি কিছু পাওয়া যায়, এই আশায়।

গেল পাওয়া, সত্যিই! তবে ওটা পেতে ডিটেক্টর লাগল না, খালি চোখেই দেখা গেল গুহামুখের ঠিক ভেতরে একটা কাঠের তক্তা পুতে তাতে কাগজে কি যেন লিখে আঠা দিয়ে সাটিয়ে দেয়া হয়েছে। নিচের দিকের আঠা ছুটে গিয়ে বাতাসে ফড়ফড় করছে কাগজটা। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে টেনে সোজা করে পড়ল রবিন। কালো কালি দিয়ে বড় বড় করে লেখা হয়েছে:

প্রবেশ নিষেধ।
বিনা অনুমতিতে ঢুকলে সেটাকে
 বেআইনী বলে গণ্য করা হবে।

লেখাটা তিনজনকেই অবাক করল। মুসা বলল, শিপরিজের পুলিশ চীফ হয়তো লাগিয়ে দিয়ে গেছে।

পুলিশের কি ঠেকা পড়েছে? রবিন বলল। মজা করেছে কেউ। ট্যুরিস্ট হতে পারে।

ভেতরে উঁকি দিল কিশোর। ঢুকবে কি ঢুকবে না ঠিক করতে পারছে না যেন। শেষে বেআইনী বলে গণ্য হওয়ার প্রতিই ঝোঁক বেড়ে গেল তার। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল, রসিকতা নয়, সত্যি এখানে নোক বাস করে!

অনুমতি নেয়ার জন্যে কাউকে দেখা গেল না। কৌতূহল না ঠেকাতে পেরে শেষে বেআইনী কাজ করে বসল তিনজনেই। ঢুকে পড়ল ভেতরে। গুহায় আলো তেমন নেই, গুহামুখ দিয়ে সামান্য যা ঢুকছে। আনাড়ি হাতে তৈরি একটা কাঠের টেবিল পড়ে আছে এককোণে। মাটিতে বিছানো একটা মলিন গদি, তার ওপর কম্বল পাতা। সাবানের বাক্সের কাঠ দিয়ে তৈরি একটা আলমারি রাখা হয়েছে একটা চ্যাপ্টা পাথরের ওপর। তাতে ভরা টিনের খাবার।

যাক বাবা, বাঁচা গেল, খুশি হয়ে বলল মূসা, আমাদের একজন পড়শী আছে, তার কাছে খাবারও আছে। খালি পেটে পাহাড় পেরোতে হলো না আর।

আস্তে! সাবধান করল রবিন। ফিসফিস করে বলল, ওই যে, আসছে আমাদের পড়শী।

সৈকত ধরে হাঁটতে দেখা গেল একজন লম্বা মানুষকে। ধূসর চুল। গায়ে নীল শার্ট, পরনের ওভারঅলের পা দুটো ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে উঁচু গোড়ালিওয়ালা রবারের বুটের ভেতরে। বা হাতে একটা বিউগল। সাগরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল। বিউগল ঠোঁটে লাগিয়ে ফুঁ দিল জোরে। একবার বাজিয়ে বিউগল নামিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছল, তারপর ঘুরে এগিয়ে আসতে শুরু করল গুহার দিকে।

গুহামুখে বেরিয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা। ওদের দেখে থমকে দাঁড়াল সে। নিজের অজান্তেই যেন বিউগল বাজাল আরেকবার। আবার পা বাড়াল।

আমি কমান্ডার জিন মরিস, কুইন্স নেভি, অবসরপ্রাপ্ত, ছেলেদের কাছে এসে ঘোষণা করল সে। আমাকে তোমাদের স্যালুট করা উচিত ছিল। বুঝতে পারছি, নেভির নিয়ম-কানুন কিছুই জানেন না তোমরা। স্যালুট করতে জানো?

নিখুঁত ভাবে স্যালুট করল তিন গোয়েন্দা।

খুশি হলো লোকটা, জিজ্ঞেস করল, বাহ, জানো তো দেখি। কিন্তু নাবিক বলে তো মনে হচ্ছে না।

হেসে জবাব দিল কিশোর, নাবিকরাই কি শুধু স্যালুট দেয়?

তাও বটে। তা ছাড়া সবাইকেই নাবিক হতে হবে, এমনও কোন কথা নেই।

এই গুহাতে আপনিই বাস করেন নাকি? জানতে চাইল রবিন।

হ্যাঁ, ডাঙায় আপাতত এটাই আমার ঘর। তোমাদেরকে তো চিনলাম না?

পরিচয় দিল তিন গোয়েন্দা।

হাত মেলানোর পালা শেষ করে কমান্ডার বলল, সচরাচর এখানে কেউ আসে না। আর না এলেই ভাল। আমি একা থাকতেই ভালবাসি। লোকের কোলাহল আমার ভাল লাগে না।

জায়গাটা একেবারেই নিরিবিলি, কিশোর বলল।

আছে, তবে অতটা না। যাতায়াতের অসুবিধে খুব বেশি নেই তো, পাহাড়টা পেরোলেই হলো, মাঝেসাঝে চলে আসে লোকে। গুহা দেখতে আসে টুরিস্ট, জেলেরা নামে বিশ্রাম নিতে। আমার জন্যে সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল দক্ষিণ সাগরের সেই দ্বীপটা, যেখানে নির্বাসিত হয়েছিলাম আমি।

মানুষটার ব্যাপারে নতুন করে কৌতূহল দেখা দিল তিন গোয়েন্দার।

খাইছে! মুসা বলে উঠল। নির্বাসিত হয়েছিলেন?

কোন অপরাধে? কে দিল নির্বাসন? প্রশ্ন করল রবিন।

কেউ দেয়নি। নিজে নিজেই হয়ে গেলাম। বেশ কয়েক বছর আগে একটা ডেস্ট্রয়ারে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলাম। দক্ষিণ সাগর দিয়ে চলছিল জাহাজ। খাওয়ার পানি নেয়ার জন্যে একটা ছোট দ্বীপে নোঙর করলাম। ম্যাপে নেই ওই দ্বীপ, নাম খুঁজে পাবে না। গরমও পড়েছিল সেদিন, সাংঘাতিক গরম। ছায়ার মধ্যেও একশো ডিগ্রির বেশি। আমার লোকেরা যখন পানি তুলছে জাহাজে, আমি বসলাম একটা ক্যাকটাসের ছায়ায় জিরাতে। কখন ঘুমিয়ে গেলাম বলতে পারব না।

আপনাকে ওখানে ফেলেই চলে গেল নাবিকেরা? আন্দাজ করল রবিন।

হ্যাঁ।

কিন্তু কমান্ডারের খোঁজ করল না একবারও?

ওরা জানতই না আমি নিচে নেমেছি। গাছের গোড়ায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছি এটা কল্পনাই করতে পারেনি কেউ। ঘুম ভাঙলে দেখলাম, জাহাজটা চলে গেছে, সিন্দবাদ নাবিকের মত আমি একা পড়ে আছি ওই দ্বীপে।

দারুণ ব্যাপার তো! তারপর? জানতে চাইল মুসা। বাচলেন কি করে?

কি করব বুঝতে পারলাম না প্রথমে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটার পর মনে হলো, ফেলে গেছে, ভালই হয়েছে। রবিনসন ক্রুসো হয়ে কাটাব। একটা কুঁড়ে বানিয়ে ছয়টা মাস একা কাটিয়েছি ওই দ্বীপে। একেবারে একা, শুধু আমি।

আপনাকে নিতে ফিরে যায়নি জাহাজটা?

যায়নি। পরে জেনেছি দ্বীপটা নাকি খুঁজে পায়নি ওরা। তবে আমার বিশ্বাস, মিথ্যে কথা বলেছে। যায়ইনি ওরা! জাহাজের কোয়ার্টার মাস্টার, যে আমার জায়গাটা দখল করেছিল সে আর খুঁজে বের করতে যায়নি। তাহলে আবার তাকে কমান্ডারের পদটা হারাতে হত।

দ্বীপে থাকতে খেয়েছেন কি?

খাওয়ার অভাব ছিল না। শুয়াপোকা থেকে শুরু করে পাখি আর কচ্ছপের ডিম, যা পেয়েছি সব খেয়েছি। আদিবাসীরা যদি এ সব খেয়ে তাগড়া জোয়ান হয়ে বেঁচে থাকতে পারে, আমি পারব না কেন?

তা বটে। অথৈ সাগর অভিযানে বেরিয়ে দক্ষিণ সাগরের দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে বেচে থাকার জন্যে এ সব আজেবাজে জিনিস খাওয়ার অভিজ্ঞতা তিন গোয়েন্দারও আছে। অবাক হলো না ওরা।

তবে খাবারের কথা উঠে পড়ায় সুযোগটা ছাড়ল না মুসা, বলে বসল, আমাদের খাবার ফুরিয়ে গেছে। আপনার কাছে কি কিছু ধার পাওয়া যাবে?

চুপচাপ উঠে চলে গেল কমান্ডার। ফিরে এল একটা পাউরুটি আর একটিন মাছ নিয়ে। মুসার হাতে দিতে দিতে বলল, চলবে এতে?

চলবে মানে! কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আরও দুচারটা টুকটাক কথাবার্তার পর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের গুহার দিকে রওনা হলো গোয়েন্দারা। সকালে নাস্তাটা তেমন জমেনি, খিদে পেয়ে গেছে। টিন থেকে মাংস বের করে রান্না করতে বসে গেল মুসা।

খাওয়ার পর বলল সে, এখন নিশ্চিন্তে রওনা হওয়া যায়।

কোথায়? আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

কোথায় আবার, খাবার আনতে। একবেলা খেয়েই কি শেষ হয়ে গেল নাকি? খানিক পরেই তো আবার খিদে লাগবে।

ওর দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন দুতিনবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এখনই যাব? অন্যমনস্ক হয়ে আছে ওর ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল।

এখনই তো যাওয়া উচিত। দেরি করলে রোদ চড়বে, খিদে লাগবে…

আচ্ছা লোকটাকে তোমাদের কেমন লাগল?

জিন মরিসের কথা বলছ? রবিন বলল, মোটেও ইংরেজ মনে হয়নি। আমার। ব্রিটিশ নেভিতে চাকরি করার কথাটা বিশ্বাস করতে পারছি না।

আমিও না, কিশোর বলল। চিন্তাটা সেজন্যেই হচ্ছে

আচ্ছা, আমাদের খাবার এই লোকই চুরি করেনি তো?

কথাটা আমারও মনে হয়েছিল। ভাল করে দেখেছি। তার খাবারের ভাঁড়ারে আমাদের টিনগুলো নেই।

লোকটাকে অবশ্য এতটা খারাপ মনে হয়নি আমার।

তবু কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারলে ভাল হত। বলা তো যায় না কার মনে কি আছে।

চলো তাহলে, যাই আবার।

এখনই?

গেলে এখনই। দেরি করলে আমাদের রওনা হতে দেরি হয়ে যাবে।

বেশ। চলো।

আবার কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে চলল ওরা। গুহার ভেতরে আগুনের ধারে বসে আছে সে। পাশে পড়ে আছে একটা ফ্রাইং প্যান। এইমাত্র খাওয়া শেষ করেছে বোঝা গেল।

শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল কমান্ডার। ভোঁতা গলায় ধমকে উঠল, কে তোমরা?

আমরা! অবাক হয়ে বলল কিশোর, আরে আমরা, চিনতে পারছেন না? তিন গোয়েন্দা, একটু আগেই তো দেখা হলো…

যাও, ভাগো এখান থেকে! এখানে ঘুরঘুর করা আমার পছন্দ না।

১১.

কমান্ডারের এহেন আচরণে চমকে গেল তিন গোয়েন্দা। হাঁ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

কিন্তু, স্যার, বলল রবিন, এই খানিক আগে অপিনিই…

স্যার স্যার করতে হবে না আর! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কমান্ডার। মুঠো চাল ছেলেদের দিকে। যাও এখন। বেরোও। আমাকে একা থাকতে দাও।

রবিনের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল কিশোর, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, বোঝানো যাবে না কমান্ডারকে।

ফিরে চলল তিনজনে।

গুহার কাছ থেকে সরে এসে মুসা বলল, ও ব্যাটা পাগল। বদ্ধ উন্মাদ! একা থাকতে থাকতে মাথাটা পুরোপুরিই গেছে!

হুঁ! কিশোর বলল, যতই দেখছি নোকটাকে, ততই অবাক হচ্ছি। সন্দেহ বাড়ছে আমার।

কোন ব্যাপারে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

তা জানি না। তবে মন বলছে, রহস্য একটা অবশ্যই আছে এখানে।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের আসল রহস্যের তো কিনারা হলো না। একটা করতে এসে আরেকটাতে জড়িয়ে পড়ছি। হ্যারিস গেনারের খোঁজ নেয়ার দরকার না?

কার কাছে নেব?

তার আমি কি জানি? হাত ওল্টাল রবিন।

একটা ব্যাপার কিন্তু হতে পারে, হয়তো শিপরিজে এ সব গুহাতে খোঁজ নেবার কথাই বলেছে গেনার। গুহাগুলোতে যে রহস্য আছে, তার প্রমাণ তো ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি আমরা। একটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল কিশোর, ঠিক আছে, চলো আগের কাজ আগে সারি, তারপর অন্য কথা। প্রথমে রিক ডেলভারের কাছে যাব খাবার চাইতে। তার কাছে না পেলে শিপরিজে দোকানে যেতে হবে।

মনে কোরো তো এবার, বড়শিটা নিয়ে আসব এবার, মুসা বলল। ঝড়-বৃষ্টির পর মাছে খায় ভাল। মাছ পেলে খাবারের সমস্যা অনেকটা মিটবে।

কেন, আসার সময় বড়শি তো নিলে দেখলাম? রবিনের প্রশ্ন। কোথায় ফেললে?

আমারও মনে হচ্ছে এনেছি, কিন্তু সকালবেলা খুঁজতে গিয়ে দেখি নেই। হয় খাবার চোরই ওগুলো গাপ করে দিয়েছে, নয়তো ভুলে আনিইনি। গাড়িতে ফেলে এসেছি। ঠিক মনে করতে পারছি না। গুহার কাছে এসে জিজ্ঞেস করুল মুসা, আমাদের জিনিসপত্রগুলো কি করব? এখানে ফেলে গেলে না ওগুলোও চুরি হয়ে যায়।

মনে হয় না, কিশোর বলল, তাহলে রাতেই চেষ্টা করত। কেবল খাবারের ওপরই নজর ছিল চোরের।

ঠিক আছে, সব জিনিস ফেলে গেলেও ডিটেক্টরটী ফেলে যাচ্ছি না। যাওয়ার সময় খুঁজতে খুঁজতে যাব, খোঁজাও হবে, সময়ও কাটবে।

কি খুঁজবে তুমি? রবিনের প্রশ্ন।

কি করে বুলব? মাটির নিচে, পাহাড়ের খাঁজে কত জিনিসই থাকতে পারে। জলদস্যুর গুপ্তধনও থাকতে পারে। এই যে খানিক আগে একটা নতুন পিস্তল পেয়ে গেলাম, এটা কি কম কথা?

পিস্তলের কথায় মনে পড়ল কিশোরের, ওহহো, কোথায় ওটা?

লুকিয়ে রেখেছি, মুসা জানাল। কেন, দরকার?

না। লুকানো আছে, থাক। বলা যায় না, ওটা একটা জরুরী সূত্র হতে পারে।

রওনা হলো ওরা। ডিটেক্টরটাকে লাঠির মত করে সামনে বাড়িয়ে ধরে হাঁটছে মূসা। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেইবিকট চিৎকার করে উঠল।

আগে আগে হাঁটছিল রবিন আর কিশোর। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল।

পাহাড়ের দেয়ালের কাছে উন্মাদ নৃত্য জুড়েছে মু। কড়কড় কড়কড় করছে ওর যন্ত্র। যেন পাল্লা দিয়ে চিৎকার করছে মনিবের সঙ্গে।

চিৎকার করে বলল সে, এখানে একটা-দুটো পিল নয়, পুরো এক অস্ত্রাগার রয়েছে। যন্ত্রটাকি ভাবে চিৎকার করছে দেখো।

যন্ত্রের চেয়ে তো বেশি চেঁচাচ্ছ তুমি, কিশোর কাল। চুপ করো না। দেখোই না আগে কি আছে।

পাহাড়ের গোড়ায় একটা পাথরের কাছে যন্ত্রটা নিয়ে গেলেই শব্দ করছে। পাথরটা সরানোর জন্যে হাত বাড়াল কিশোর আর রবিন। যন্ত্র ধরে রেখেছে মুসা, ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে লুকানো হাড়ের সন্ধান পেয়েছে ক্ষুধার্ত ককর।

পাখরটা সরাতেই দেখা গেল একটা গর্ত। ভেতরে একটা বস্তা। তার ভেতর থেকে বেরোল ওদের খাবারের টিনগুলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।

এই তো আমার বড়শি বলে উঠল মুসা। তারমানে ঠিকই এনেছিভুলিনি, খাবারের সঙ্গে এগুলোও চুরি করেছিল ব্যাটা।

জিনিসগুলো তাহলে বের করেই ছাড়লে, হাসতে হাসতে বলল কিশোর।

যন্ত্রটার গায়ে আদর করে হাত বুলিয়ে মুসা বলল, পয়সা উসুল। এত … উপকার করবে এটা কল্পনাও করিনি। বাঁচালি তুই, ডিটেক্টর। উফ, পাহাড় ডিঙানোর কথা ভাবতেই হাত-পা সেধিয়ে যাচ্ছিল আমার পেটের মধ্যে।

খাবার দেখেই খিদে মাথা চাড়া দিল ওর। গুহায় ঢুকে আগুন জ্বেলে, ফ্রাইং প্যান বের করে রাখতে বসে গেল। মাংস ভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।

রবিন আর কিশোর আলোচনা করছে বস্তাটা গর্তে কে রাখল, সেটা নিয়ে। কমান্ডারের প্রসঙ্গ উঠল।

তাকে প্রশ্নগুলো করা হলো না, কিশোর বলল, দাঁড়াতেই দিল না আমাদের।

দেবে কি? পাগল তো। মুসার কথাই ঠিক–ওর মাথায় বড় রকমের গোলমাল আছে, তাতে আমারও কোন সন্দেহ নেই।

হতে পারে, আবার নাও হতে পারে, রহস্যময় স্বরে বলল কিশোর। যাই হোক, প্রশ্নগুলো ওকে করতেই হবে, যেভাবেই হোক।

মাংস ভাজা সেরে ডিম ভাজছে মুসা।

সেদিকে একবার তাকিয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, কি প্রশ্ন করবে? মেরিন ডিগকে এদিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে কিনা?

খাবার রেডি, ঘোষণা করল মুসা। দেরি করলে ভাগে কম পাবে।

তাড়াতাড়ি যার যার প্লেট মেলে দিল কিশোর আর রবিন। খাবার তুলে দিল মুসা।

এক চামচ ডিম মুখে ফেলে আগের প্রশ্নটাই করল কিশোরকে রবিন, কই, বললে না কি প্রশ্ন করবে?

কিন্তু জবাব দিল না কিশোর। অন্যমনস্ক হয়ে রইল।

মুসা বলল, ডিগ আর কমান্ডারকে নিয়ে যত খুশি গবেষণা করো তোমরা, খাওয়ার পর আমি আর এসবে নেই। আমি যাব মাছ ধরতে। খাবার চুরি করে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে শাস্তি দেয়ার সুযোগ আর দেব না চোরটাকে।

কোথায় ধরবে? জানতে চাইল রবিন।

ঢালের নিচে চলে যাব। অনেক লম্বা সুতো; ঢালের ওপরে বসলেও বেড় পাওয়া যাবে।

আবার চোরের আলোচনায় ফিরে এল রবিন। নিজে খাওয়ার জন্যে নিয়ে যায়নি, বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে চুরি করল কেন?

আমাদের এখান থেকে তাড়ানোর জন্যে; সহজ জবাব, কিশোর বলল। সে চায় না আমরা এখানে থাকি।

কমান্ডারকে সন্দেহ হয় তোমার? মুসার প্রশ্ন।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে জবাব দিল কিশোর, ওই লোক হতে পারে, কিংবা অন্য কেউ। একজন হতে পারে, কিংবা একাধিক।

এটা তো কোন জবাব হলো না।

ঠিক। জবাবটা জানলে তো দেব।

যাই হোক, রবিন বলল, দ্বিতীয়বার আর চুরি করতে দিচ্ছি না ওকে। খাদের পাশে পাহাড়ের গায়ে একটা খাজ দেখে এসেছি। ওর মধ্যে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখব। হাজার খুঁজলেও আর পাবে না ব্যাটা।

খাওয়া শেষ করে আগুন নেভাল ওরা। বেরিয়ে পড়ল। ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে চলল মুসা। কিশোর আর রবিন খাবারের টিনগুলো নিয়ে চলল খাদের ধারে পাহাড়ের খাজে লুকাতে।

লুকানো সেরে রবিন জিজ্ঞেস করল, কমান্ডারের ওখানে যাবে নাকি। আবার?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, যাব।

যদি মারতে আসে?

 পালিয়ে আসব। তবে প্রশ্নগুলো না করা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।

কমান্ডারের গুহায় রওনা হলো দুজনে।

দূর থেকেই দেখল, গুহার সামনে কি যেন করছে বুড়ো নাবিক। কাছে গিয়ে দেখল, একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে কিছু আঁকছে সে। ওদের সাড়া পেয়ে জুতো দিয়ে ডলে তাড়াতাড়ি মুছে ফেলল। হাক দিল, এই যে ছেলেরা, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?

পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। আরেকবার অবাক করেছে। ওদের কমান্ডার।

কিশোর জবাব দিল, হ্যাঁ। আমাদের চিনতে পেরেছেন?

 পারব না কেন, নিশ্চয় পেরেছি।

কই, তখন তো পারলেন না?

পারিনি নাকি? কি জানি! মাথা চুলকাল কমান্ডার, মাঝে মাঝে মাথাটার মধ্যে কি যে হয়ে যায়…যাকগে, তোমাদের আরেক বন্ধু কোথায়?

মাছ ধরতে গেছে। পাহাড়ের ঢালের নিচে।

ও। ওদিকটায় যাওয়া ঠিক হয়নি। জায়গা ভাল না।

 কেন ভাল না, জিজ্ঞেস করল রবিন। জবাব পেল না।

আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে, পিঠের ওপর দুহাত নিয়ে গিয়ে, একহাত দিয়ে আরেক হাতকে আঁকড়ে ধরে গুহামুখের সামনে পায়চারি শুরু করল কমান্ডার।

কমান্ডার মরিস, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার গুহার সামনে কোন লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন?

যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল কমান্ডার। চোখ সরু করে তাকাল কিশোরের দিকে। দেখো, আমি একজন সন্ন্যাসী, জায়গাটা অতিরিক্ত নির্জন দেখে একা বাস করতে এসেছি এখানে। আমার কাছাকাছি কেউ আসে না। ওরা ভাবে আমি পাগল।

গেনার আর ডিগের চেহারার বর্ণনা দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এ রকম কাউকে দেখেছেন?

বললাম না কেউ আসে না!

তবু, একটু ভাল করে ভেবে যদি বলেন…চোখে হয়তো পড়েছিল, ভুলে

না, ভুলিনি…দাঁড়াও, দাঁড়াও… ভাবতে গিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল কমান্ডার।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল দুই গোয়েন্দা। ভাবছে, গেনারকে কি দেখেছে সত্যি?

কাকে দেখেছেন? জানতে চাইল কিশোর। যে দুজনের কথা বললাম, তাদের কোনজন?

প্রথমজন।

গেনার?

হ্যাঁ, একবার ওরকম চেহারার একজনকে দেখেছিলাম বটে। ফিলিপাইনে আমার ক্রুজারের মেট হয়েছিল।

হতাশায় মুখ বাঁকাল রবিন। এই পাগলের কাছ থেকে কোন তথ্য আদায় করার চেষ্টা বৃথা।

কমান্ডার বলতে থাকল, ওর নাম মনে পড়েছে আমার, গেনারই ছিল। আমাকে জাহাজ ছাড়তে বাধ্য করেছিল সে। জংলীরা এসে ঢাক বাজানো। শুরু করল। ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শেষে আনারস গাছে চড়ে বাঁচলাম।

কিশোরের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল রবিন, আবার গেছে ওর মাথাটা। আর কথা বলে লাভ নেই।

বকবক করেই চলেছে কমান্ডার। কোন দিকে খেয়াল নেই।

পাগলকে প্রশ্ন করে কি হবে!। কিশোর বলল, ঠিক আছে, কমান্ডার, আমরা এখন যাই।

ওর কথার জবাব না দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল কমান্ডার, সাঁতার। কাটতে যেতে হবে আমাকে। প্রচণ্ড গরম। আফ্রিকার কাছাকাছি এলেই এ রকম গরম লাগে। কারও দিকে তাকাল না সে। আর একটাও কথা না বলে ঘুরে গিয়ে ঢুকল তার গুহায়।

সৈকতে ফিরে চলল দুই গোয়েন্দা। শুহামুখের কাছ থেকে সরে এসে রবিনের হাত ধরে একটা বড় পাথরের আড়ালে তাকে টেনে নিয়ে এল কিশোর।

অবাক হলো রবিন। কি ব্যাপার?

দাঁড়াও, ও কি আসলেই পাগল, না আমাদের দেখলে ভান করে, সেটা বুঝতে চাই। পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দিল কিশোর।

কি দেখছ?

ও বেরোয় কিনা।

বেরোলে কি করবে?

জবাব দিল না কিশোর। তাকিয়ে আছে গুহার দিকে।

কয়েক মিনিট পরই গুহা থেকে বেরিয়ে এল কমান্ডার। পরনে শুধু হাফপ্যান্ট। এদিক ওদিক তাকাল। তারপর এগিয়ে আসতে শুরু করল। ভাবভঙ্গিতে এখনও বোঝা যাচ্ছে না পাগল না ভালমানুষ।

রবিনকে নিয়ে পাথরের আড়ালে আরেকটু সরে গেল কিশোর।

পাশ দিয়ে চলে গেল কমাণ্ডার। দেখতে পেল না ওদের।

ফিসফিস করে রবিন বলল, যাচ্ছে কোথায়, বলো তো? সত্যি সাঁতার কাটবে নাকি?

যাক যেখানে খুশি। এসো। এত তাড়াতাড়ি সুয়োগ দেবে কল্পনাই করিনি।

কিসের সুযোগ।

ওর গুহায় ঢোকার। চলো, জলদি!

পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে একছুটে কমান্ডারের গুহার কাছে চলে এল ওরা। ঢুকে গেল ভেতরে।

বাপরে! গভীর কত! রবিন বলল। পেছনের কিছুই দেখা যায় না।

কিশোর খুঁজছে একদিকে, রবিন আরেক দিকে। পাথরের একটা তাকের কাছে চলে এল সে। চিৎকার করে বলল, দেখে যাও!

রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর। একনজর তাকিয়েই বলে উঠল, বাহ, বন্দুকও আছে! রহস্যময় গুলির শব্দের রহস্য ভেদ হলো। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তাকের কাছে। শটগানটার কাছে পড়ে আছে পুরানো একটা নোটবুক আর একটা ক্যাপ। ক্যাপটা হাতে নিয়ে কি যেন ভাবল সে। আগের জায়গায় রেখে দিয়ে নোটবুকটা তুলে নিল।

কোডবুক! পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল সে। দূর, আলো এত কম, কিচ্ছু দেখি না। বাইরে চলো।

কি লেখা আছে জানার জন্যে অস্থির হয়ে গেল রবিনও।

গুহামুখের দিকে রওনা দিল দুজনে।

কিন্তু বেরোনোর আগেই মুখ জুড়ে দাঁড়াল কমান্ডার। আলো আসার একমাত্র পথটা আটকে দিয়ে আরও অন্ধকার করে দিল গুহা। ওদের দেখে চিৎকার করে উঠল, চোর! চোর কোথাকার! চুরি করতে ঢুকেছ আমার গুহায়! নোটবুকের জন্যে হাত বাড়াল, দাও ওটা!

দিল না কিশোর। চট করে সরে গেল ভেতরে।

 ওকে ধরার চেষ্টা করল না কমান্ডার। দৌড় দিল তাকের দিকে।

সাবধান, কিশোর, চেঁচিয়ে বলল রবিন, বন্দুক আনতে যাচ্ছে ও!

.

১২.

গুহামুখের দিকে দৌড় দিল কিশোর। পেছনে রবিন।

ওরা বেরোনোর আগেই তাকের কাছে পৌঁছে গেল কমাণ্ডার। বন্দুক তুলে হুমকি দিল, খবরদার, এক পা নড়লেই গুলি খাবে?

হোঁচট খেয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। তার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রবিন।

ফিরে তাকাল দুজন।

ওদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখে এগিয়ে এল কমান্ডার। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তাহলে এই নোটবই চুরি করার জন্যেই আমার গুহায় ঢুকেছিলে। আস্তে করে মাটিতে রেখে দাও ওটা। চালাকি করতে গেলে মরবে।

চালাকি করতে গেল না কিশোর। পাগলের হাতে শটগান-ভয়ানক ব্যাপার, কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাইল না সে। যা করতে বলা হলো, করল।

রবিন বলল, নোটবই চুরি করতে না, এমনি ঢুকেছিলাম। স্রেফ কৌতূহল।

আচমকা প্রশ্ন করল কিশোর, ক্যাপটা কার, কমাণ্ডার?

 ভুরু কুঁচকে ফেলল কমান্ডার। মানে?

মানে, ওটা কার জিজ্ঞেস করছি। আপনার বলে তো মনে হয় না। নাবিকেরা এ জিনিস পরে না।

তাহলে কে পরে?

আর কেউ আছে নাকি এখানে?

থাকলে সে এখন কোথায় গেল? ধমকে উঠল কমাণ্ডার।

 সেটা তো আপনি বলবেন।

আমি কিছুই বলতে পারব না, কারণ আমি কিছু জানি না।

এই ক্যাপটা কোথায় পেলেন?

একমুহূর্ত চিন্তা করে নিল কমাণ্ডার। জবাব দেবে কিনা ভাবল বোধহয়। বলল, শিপরিজে হ্যারির দোকান থেকে কিনেছি। কুইন্স নেভি রসদ পাঠাতে ভুলে গিয়েছিল। শেষে দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে আনতে বাধ্য হলাম।

ওর কথার একবর্ণ বিশ্বাস করল না কিশোর। প্রকাশ করল না সেটা। পাগল খেপালে বিপদ। কি করে বসে ঠিকঠিকানা নেই।

আবার গুহায় ঢুকলে ভাল হবে না–শাসিয়ে দিয়ে, ওদের বেরিয়ে যেতে বলল কমান্ডার।

বেরোতে সামান্যতম দেরি করল না দুজনে। নিজেদের গুহার দিকে এগোচ্ছে, এই সময় দেখল মুসাও আসছে। হাতে ছিপ আর কাঁধে বিশাল এক মাছ ঝুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে এল সে। কাছে এসে বলল, দেখো কি ধরেছি!

হেসে বলল রবিন, কি এটা, তিমির বাচ্চা?

সী ব্যস।

কি করে মাছটা ধরেছে সেই বীরত্বের কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনা করতে গিয়ে খেয়াল করল মুসা, তার কথায় বিশেষ মনোযোগ নেই কিশোরের। কি হয়েছে জানতে চাইল সে।

জানাল কিশোর।

মাথা নেড়ে মুসা বলল, আজব লোক। এখানে করছে কি আসলে লোকটা?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না, কিশোর বলল।

ক্যাপটা কার? গেনারের না তো?

সে রকমই সন্দেহ করছি।

 তুমি বলতে চাও, সে এখানেই কোন গুহার মধ্যে আটকে আছে?

অসম্ভব কিছু না। তবে যেটা ধারণা করছি সেটা হলো, সে আর ডিগ এসেছিল এখানে। দেখতে পেয়ে গুলি করেছিল মরিস। পালিয়েছিল দুজনে। পালানোর সময় তাড়াহুড়োতে ক্যাপটা খুলে পড়ে যায় গেনারের মাথা থেকে, তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পায়নি।

এটা যে ওরই ক্যাপ, কি করে বুঝলে?

গুহায় ফিরে ছবিটা দেখে নিয়ো, ব্যাগের মধ্যে রেখেছি, তাহলেই বুঝবে।

হুঁ, নাটক তাহলে জমে উঠেছে, মাথা দোলাল মুসা। জানো, আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। দেখলে তোমরাও অবাক হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে একটা ধাতুর খনিটনি আবিষ্কার করে বসেছি।

শুনেই অবাক হয়ে গেল রবিন, ধাতুর খনি!

সোনার খনিও হয়ে যেতে পারে, মুসা বলল। এমন হতে পারে, খনিটার খোঁজ পেয়েই এখানে এসে হাজির হয়েছে কমান্ডার। সোনা তুলে নিয়ে যেতে চায়। অন্য কাউকে আসতে দেখলে রেগে যায় সেজন্যে। নোটবইটাতে হয়তো খনির নকশা আঁকা আছে।

ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে কিশোর আর রবিন।

কি ঘটেছে, খুলে বলল মুসা। মাছটা ধরার পর মেটাল ডিটেক্টরটা ব্যবহারের ইচ্ছে হয়েছিল ওর। মাটির নিচে বিশাল কিছু থাকার সঙ্কেত দিয়েছে যন্ত্র।

কিশোর বলল, চলো তো দেখি।

 আগে খনি দেখবে, না মাছের কাবাব খাবে?

খাওয়া-টাওয়া পরে। চলো আগে, তোমার খনি দেখব।

এক মিনিট দাঁড়াও। চট করে মাছটা গুহায় রেখে আসি আমি।

ডিটেক্টরটা কোথায়?

 পাহাড়েই ফেলে এসেছি। জানি তো, তোমরা দেখতে যাবে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই খাদ পেরিয়ে আবার পাহাড়ের ওপর এসে উঠল তিনজনে। জায়গাটা দেখিয়ে দিল মুসা।

ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে যন্ত্রটা মাটির কয়েক ইঞ্চি ওপরে ধরল রবিন। শুনতে শুনতে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। ইয়ারফোনটা কান থেকে খুলে কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সাংঘাতিক কাণ্ড! সত্যি কিছু আছে। এখানে। কানের মধ্যে মনে হলো মেশিনগানের গুলি ফুটল।

যন্ত্রটা হাতে নিয়ে কিশোরও পরীক্ষা করে দেখল। ডান থেকে বাঁ দিকে সরে যেতে লাগল। সরতে সরতে কয়েক গজ চলে গেল, তাও শব্দ বন্ধ হয় না। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, আশ্চর্য! ঘটনাটা কি? কি আছে এখানে? মাটির তলা দিয়ে সোজাসুজি চলে, গেছে লম্বা কোন জিনিস।

পাইপটাইপ না তো? রবিন বলল।

কিসের পাইপ? মুসা বলল। এমন একটা জায়গায় পানির পাইপ কসাতে আসবে কে? আভাউড ড্রেনেরও কোন প্রয়োজন নেই এখানে।

যাই থাক, নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর, জিনিসটা গেছে পুর থেকে পশ্চিমে, সাগরের তীর থেকে মহাসড়কের দিকে।

দাঁড়াও, কি আছে ওদিকে রাস্তার ধারে, দেখছি, রবিন বলল।

কয়েকটা পাইন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে জমে আছে একজায়গায়। তারই একটাতে চড়ল সে। পশ্চিমে তাকাল।

কি আছে? নিচে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

একটা বাড়ি। ডিশদেখেমনে হচ্ছে রাডার স্টেশন।

 আর কিছু না?

আর কিছু না।

নেমে এল রবিন।

খুড়ে দেখলে হত নিচে কি আছে, মুসা বলল।

তার জন্যে শাবল-কোদাল দরকার। কোথায় পাবে? রবিন বলল।

সেটা অত সমস্যা নয়। ব্রিক ডেলভারের কাছে গেলেই পাওয়া যাবে। রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। চলো, গিয়ে নিয়ে আসি। মুসা ততক্ষণে মাছটার একটা ব্যবস্থা করে ফেলক।

মুসা চলে গেল গুহার দিকে। কিশোর আর রবিন রওনা হলো ডেলভারের কেবিনে।

আসার সময় অচেনা পর্ব ছিল, তার ওপর ঝড়বৃষ্টি, সেজন্যে বড় বেশি দাম আর অনেক লম্বা মনে হয়েছিল পথ। এখন তার অর্ধেকও লাগল না। অল্প সময়েই চলে এল ডেলভারের কেবিনে।

বুড়োকে পাওয়া গেল না। মাছ ধরতে গেছে। তবে মহিলা আছে বাড়িতে। চমৎকার একটা হাসি উপহার দিয়ে তার কাছ থেকে একটা শাবল আর একটা কেলচা চেয়ে নিল রবিন। আবার রওনা হলো গুহার দিকে।

গুহায় ফিরে দেখল গনগনে আগুনের সামনে বসে আছে মুসা। মাছের কাবুব ঝমানো হয়ে গেছে প্রায়। গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।

দুই দুইবার পাহাড় ডিঙিয়ে এসে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে কি, মার রবিনের। গপ গপ করে খেতে শুরু করল ও।

খাওয়ার পর আগুন নিভিয়ে দিয়ে তিনজনে মিলে রওনা হলো জায়গাটা খুঁড়ে দেখতে।

খুঁড়তে খুঁড়তে তিন ফুট খুঁড়ে ফেলেও ধাতব জিনিসটার দেখা মিলল না।

বেলচায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রবিন বলল, কই, মুসার খনির তো চিহ্নও নেই। কিশোর, ঘটনাটা কি বলো তো? ধাতব জিনিস না থাকলে তো সাড়া দিত না যন্ত্র।

চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, আমিও বুঝতে পারছি না। বিদ্যুতের তার গেছে হয়তো মাটির নিচ দিয়ে। সেসবের পাইপ হতে পারে। কত নিচে আছে কে জানে। অহেতুক কষ্ট না করে শিপরিজে গিয়ে খোঁজ নেয়া দরকার।

সুতরাং রওনা হলো ওরা।

শাবল আর বেলচা ফেরত দিতে প্রথমে ডেলভারের বাড়িতে এল। এবার পাওয়া গেল ওকে। হাসিমুখে বেরিয়ে এসে স্বাগত জানাল ছেলেদের, ভূতের। গুহা থেকে তাহলে ভালয় ভালয়ই ফিরলে।

হ্যাঁ, হেসে জবাব দিল কিশোর, দেখতেই পাচ্ছেন।

এগুলো নিয়েছিলে কেন? হাত তুলে শাক আর বেলচা দেখাল বুড়ো। বাড়ি ফিরে বেগম সাহেবের কাছে শুনলাম তোমরা এসেছিলে।

মুসার একটা মেটাল ডিটেক্টর আছে। পাহাড়ের ওপর খুঁজতে গিয়ে ওর মনে হয়েছে মাটির নিচে সোনার খনি আছে। তাই খুঁড়ে দেখলাম আরকি।

বুড়োর চোখে অবিশ্বাস। এই এলাকায় সোনার খনি? অভিব! থাকলে কবে বেরিয়ে যেত।

আমারও তাই ধারণা, বলল কিশোর। মনে হয় মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের তারটার গেছে, সেগুলোর পাইপ..

হুঁ, তাই হবে। এখন কোথায় যাচ্ছ?

হ্যারির দোকানে। কয়েকটা জিনিস দরকার।

জিনিস দরকার মানে? আবার গুহায় যাবে নাকি?

বলতে পারি না। তবে গেলেও আর বোধহয় ভয়ের কিছু নেই। রাতে তে থাকলাম, গুহাতেই, ভূতে তো কিছু করল না।

বুড়োকে গুডবাই জানিয়ে গাড়িতে চড়ল ওরা। রওনা হলো হ্যারির স্টোরে।

দোকানেই আছে হ্যারি। তিন গোয়েন্দাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে এল, কি, বলেছিলাম না? নিশ্চয় বিপদে পড়েছিলে গুহায় ঢুকে।

কে বলল বিপদে পড়েছি, হাত নেড়ে বলল কিশোর।

বেশ, বিপদে হয়তো পড়েনি। কিন্তু কিছুই ঘটেনি এ কথা আমাকে অন্তত বিশ্বাস করাতে পারবে না। তোমাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। উত্তেজিত হয়ে আছ। কিছু একটা তো নিশ্চয় ঘটেছে।

মিথ্যে বলব না, ঘটনা সত্যিই ঘটেছে। তবে ভুতুড়ে কিছু নয়, হ্যারির টেলিফোন্টা দরকার, তাই তার কাছে সব কিছু চেপে গেল না কিশোর। আচ্ছা, টাউন ইঞ্জিনিয়ারের অফিসটা কোথায়, বুলবেন? কয়েকটা ম্যাপ আর সার্ভে রিপোর্ট দেখতে চাই।

ম্যাপ? ভুরু কোঁচকাল হ্যারি। ব্যাপারটা কি, বলো তো?

মুসার সোনার খনি আবিষ্কারের সম্ভাবনার কথা জানলি কিশোর।

ডেলভারের মতই অবিশ্বাসের হাসি হাসল হ্যারি। বলল, দেখো, ভাগ্য খোলে নাকি! তবে ম্যাপ দেখার জন্যে ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে যাওয়া লাগবে। না। আমি শিপরিজের মেয়র। এখানেই আর্কাইভ আছে, ডান হাতের বুড়ো। আঙুল দিয়ে দোকানের পেছনের একটা দরজা দেখাল সে।

ওখানে? অবাক হলো রবিন।

ওটা মেয়র আর টাউন ইঞ্জিনিয়ারের অফিস।

হ্যারির পেছন পেছন ঘরটায় এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। ছিমছাম সাজানো-গোছানো। একটা ডেস্ক, একটা ফাইলিং কেবিনেট আছে। দেয়ালে ঝোলানো একটা বড় ম্যাপ।

ওটার সামনে এসে দাঁড়াল তিনজনে। খুঁটিয়ে দেখতে লাগল রবিন আর কিশোর। মুসা এ সব বোঝে না, ওর ভালও লাগে না।

পাহাড়টা বের করতে দেরি হলো না কিশোরের। মাটির নিচ দিয়ে যাওয়া পানির পাইপ বা বিদ্যুতের পাইপের চিহ্ন নেই ম্যাপে। মাথা নেড়ে সরে এল ওটার কাছ থেকে।

অফিসের বাইরে বেরোতে হ্যারি জিজ্ঞেস করল, কই, পেলে তোমাদের সোনার খনি?

মাথা নাড়ল কিশোর, নাহ। রসিকতার সুরে বলল, আবিষ্কারই করলাম। আমরা আজ, ম্যাপে থাকবে কোত্থেকে। তবে এরপর ম্যাপ আকলে থাকবে অবশ্যই।

জবাবে হ্যারিও হাসল। হুঁ, তা বটে। আর কি করতে পারি তোমাদের জন্যে?

কিছু জিনিস লাগবে। মূসা আর রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, তোমরা নাও ওগুলো, আমি একটা ফোন সেরে নিই। হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল, অসুবিধে নেই তো?

না না, অসুবিধে কিসের? করো।

.

১৩.

 ল্যারি কংকলিনকে ফোন করল কিশোর।

ওকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। মেরিন ডিগের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে। কিনা জিজ্ঞেস করল কিশোর। ওপাশের কথা শুনতে শুনতে কপাল কুঁচকে গেল তার।

ব্যাপারটা চোখ এড়াল না রবিনের। কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে এত নিচু স্বরে কথা বলছে কিশোর, কিছুই শুনতে পেল না সে। দোকান। থেকে বেরিয়েই জিজ্ঞেস করল কি জেনেছে।

সাংঘাতিক তথ্য, বলল কিশোর। ভাল ছাত্র ছিল মেরিন ডিগ। ভাল ফ্যামিলির লোক। ওর বিরুদ্ধে কোন খারাপ রিপোর্ট নেই। বেড়াতে ভালবাসে। তিন বছর বেড়িয়ে বহুদিন কাটিয়ে এসেছে বিদেশে।

কিশোর চুপ করতে রবিন বলল, এর মধ্যে সাংঘাতিক তথ্যটা কোথায়?

বলিনি এখনও। গত গ্রীষ্মে একটা বিশেষ দেশে বেড়াতে গিয়েছিল সে।

কোন দেশ?

হ্যারিস গেনার যেখানে পড়তে গিয়েছিল সেখানে।

তাতে কি? বুঝতে পারল না মুসা।

রবিন বলে উঠল, আমি বুঝেছি! ওই দেশের কোন প্রতিষ্ঠান ওদের দুজনকে ধরে ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছে, যাতে ওরা ওদের হয়ে কাজ করে।

গুপ্তচরগিরি?

এ ছাড়া আর কি? কিশোর, ঠিক না?

আমি ভাবছি, ধীরে ধীরে বলল কিশোর, মতের অমিল হয়নি তো দুজনের?

মানে?

মানে, একজনকে ব্রেন ওয়াশ করেছে–ধরা যাক, ডিগের; গেনারের করতে পারেনি, কিন্তু ব্যাপারটা সে জানে। তাকে দলে আনার চেষ্টা করেছে ডিগ। পারেনি। হয়তো কথা ঁ থেকে ঝগড়া। শেষমেষ গায়েব করে দেয়া হয়েছে গেনারকে। ওর নিরুদ্দেশের এটা একটা জোরাল যুক্তি হতে পারে।

হুঁ, তা পারে, একমত হয়ে মাথা দোলাল রবিন। তবে কি লায়ন। কাবসদের দিয়ে ভয় দেখিয়ে ডিগই আমাদের তাড়াতে চেয়েছে যাতে গেনারের ব্যাপারে তদন্ত করতে না পারি?

হয়তো। তোমরা এখানে দাঁড়াও, আমি আরেকটা ফোন সেরে আসি।

আবার কাকে?

আরলিঙটনের পুলিশ চীফকে। তাকে অনুরোধ করব ডিগের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করার জন্যে।

মুসা আর রবিনকে গাড়ির কাছে রেখে আবার গিয়ে দোকানে ঢুকল কিশোর। কয়েক মিনিট পর বেরিয়ে এল উত্তেজিত হয়ে। খবর জানাল, এইবার মেরিন ডিগ গায়েব! তাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

শিস দিয়ে উঠল মুসা, দারুণ! তার সঙ্গে আবার কার মতের মিল হলো না?

তাকে না ধরতে পারলে আর সেটা জানা যাবে না।

কি করে ধরা যায়?

সেটা পুলিশ জানে। তাদের কাজ।

তা ঠিক। তো আমাদের কাজ তাহলে এখন কি? আবার গুহায় ফিরে যাওয়া?

তা তো বটেই। আর কি করব? আমাদের মিশন এখনও শেষ হয়নি। গেনারকে খুঁজে পাইনি আমরা।

কিন্তু গুহায় ফিরে লাভ কি? ওখানে তো নেই গেনার। দুটো গুহার একটাতেও লুকিয়ে রাখা হয়নি তাকে, তাহলে কি আর দেখতাম না?

কমাণ্ডারের গুহাটার ব্যাপারে সন্দেহ এখনও যায়নি আমার। মন বলছে, সব রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ওই গুহায়। ভেতরে ঢুকে ভালমত খুঁজে দেখতে পারলে কিছু না কিছু পাবই।

তোমার কি মনে হয় গেনারের গায়েব হওয়ার পেছনে কমান্ডারের কোন। হাত আছে? প্রশ্ন করল রবিন।

হাত না থাকলেও যোগাযোগ যে একটা আছেই, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নইলে গেনার শিপরিজের কথা লিখে রেখে গায়েব হবে কেন? আর গুহার মধ্যে রহস্যময় কাণ্ডকারখানাই বা ঘটবে কেন? দুটোর মধ্যে মিল দেখতে পাচ্ছি আমি।

তাহলে ফিরে যেতে বলছ? জানতে চাইল মুসা।

হ্যাঁ, যাও।

 গাড়ি স্টার্ট দিল মুসা।

রিক ডেলভারের বাড়ির সামনে পৌঁছে গাড়ি থামাল সে। মালপত্র নিয়ে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা।

শব্দ শুনে বেরিয়ে এল ডেলভার। ওরা আবার গুহায় ফিরছে শুনে বাধা

কিন্তু শুনল না ওরা। জোর দিয়ে বলল কিশোর, গুহার রহস্য ভেদ না করে কিছুতেই নিরস্ত হবে না সে।

আগের বারের মত ডেলভারের বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে হেঁটে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা।

রাত হয়ে গেছে।

সৈকত থেকে আকাশের পটভূমিতে বিশাল দৈত্যের মত লাগছে পাহাড়ের চুড়াটা। এগিয়ে গিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল ওরা।

আকাশে কয়েক দিনের চাঁদ, আলো এখনও উজ্জল হয়নি, ঘোলাটে কমলা রঙ। সেই আলোয় পথ দেখে এগেল ওরা।

গিরিখাতটা চোখে পড়ল একসময়। আরও এগিয়ে কালো গুহামুখটা চোখে পড়ল। সেদিকে তাকিয়ে গা ছমছম করে উঠল মুসার। মনে হলো যেন কোন দানবের খুলি থেকে চেয়ে আছে কালো অক্ষিকোটর।

গুহামুখটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল কিশোর, কি করছে এখন। আমাদের কমান্ডার মরিস? নিশ্চয় নাক ডাকিয়ে ভয় পাওয়াচ্ছে গুহার ইদ্রগুলোকে।

কিংবা ভূতকে, আড়চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল রবিন। গুহায় ভূত থাকে। ইঁদুরদের মতই রাত জাগে ওরাও। আর আমার তো ধারণা ওই রকম একটা কমান্ডারকে ভূতেও ভয় করে চলবে।

কেঁপে উঠল মুসার কণ্ঠ, চুপ! চুপ! কি যে বলো আর না বলো, তাও এমন জায়গায় এসে…

জোরে হেসে উঠল রবিন।

হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। ঝট করে বসে পড়ল ওরা। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল, কমান্ডারের গুহার কাছ থেকে জ্বলেছে আলোটা, তীব্র উজ্জ্বল আলোর রশ্মি গিয়ে পড়েছে সাগরের পানিতে।

ফিসফিস করে কিশোর বলল, সার্চলাইট!

বার দুই জ্বলল-নিভল আলোটা, তারপর নিভে গিয়ে আর জ্বলল না।

 আরেকটু হলেই দেখে ফেলত আমাদের, মুসা বলল।

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, আর কত চমক জমা আছে কমান্ডারের ভাঁড়ারে? সার্চলাইট! একজন সন্ন্যাসীর কি দরকার এই জিনিস? সন্দেহ আরও জোরাল হচ্ছে আমার।

সন্ন্যাসী না ছাই, ঝাঁজের সঙ্গে বলল রবিন, ব্যাটা আস্ত ভণ্ড। পাগলামিটাও তার অভিনয়।

আলো জ্বালল কেন? মূসার প্রশ্ন। কি দেখল?

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, যে ভাবে আলোটা নাড়ল, মনে হলো কোন রকম সঙ্কেত দিল।

কাকে? রবিনের প্রশ্ন।

কি জানি। কোন জাহাজ হয়তো নোঙর করেছে এখন তীর থেকে দূরে। ওটাকে সঙ্কেত দিয়েছে।

কেন?

কারণ তো নিশ্চয় আছে। আরও তথ্য না পেলে সেটা জানা যাবে না। তবে সবার আগে দেখতে হবে, জাহাজ সত্যি আছে কিনা।

উঠে পড়ল ওরা। চুপচাপ এসে গুহায় ঢুকল।

রান্না করে খেয়ে নিয়ে আলোচনায় বসল। কিভাবে কি করা যায়, তার নানারকম ফন্দি আঁটতে লাগল।

মুসা বলল, বাইরে কোথাও লুকিয়ে থেকে সাগরের দিকে নজর রাখলে কেমন হয়?

মন্দ হয় না, কিশোর বলল। চলো যাই। জাহাজ থেকে বোটটোট পাঠালে দেখতে পারব।

কিন্তু গুহা থেকে বেরিয়েই ওরা পড়ে গেল কমান্ডারের সামনে। মনে হলো যেন আড়ি পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল লোকটা। ওদেরকে দেখে কেমন থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, তোমাদের কাছেই যাচ্ছিলাম…

কেন? জানতে চাইল কিশোর।

এই এমনি…ইয়ে, তোমরা আর কতদিন আছ এখানে… কথা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেল কমান্ডার।

আমরা চলে গেলে খুশি হন মনে হয় আপনি? ফস করে বলে বসল মুসা।

না না…তা কেন? কয়েকজন পোড় খাওয়া নাবিক পড়শী হলে বরং ভালই লাগে। মনে নেই সেই দ্বীপটার কথা? তোমাদের নিয়ে নামলাম…তারপর..তারপর কি যেন ঘটল?

কি আর ঘটবে? মগজে গোলমাল! বলে দিল মুসা। মাথার ছিটে খোঁচা লাগল।

মানে? রেগে উঠল কমান্ডার।

তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, না না, আপনি রাগবেন না। আমরা কাল সকালেই চলে যাচ্ছি।

চুপ হয়ে গেল কমান্ডার। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কিশোরের মুখের দিকে। যেন তার কথা বুঝতে পারছে না। তারপর আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল নিজের গুহার দিকে।

বড় একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসল তিন গোয়েন্দা।

রাত দুটো পর্যন্ত বসে থেকেও সাগরের দিক থেকে কোন জাহাজ বা বোট আসতে দেখল না। ঘন ঘন হাই তুলছে তিনজনেই। প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে।

মুখের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে রবিন বলল, নাহ, আজ রাতে আর কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না।

ঘটার আশাও করিনি।

তবে শুধু শুধু বসে রইলে কেন?

 শিওর হয়ে নিলাম, আমার সন্দেহ ঠিক আছে কিনা।

কি বুঝলে?

 ঠিকই আছে।

তোমার কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, কিশোর, মূসা বলল। এই ভোররাতে অত হেয়ালি ভাল্লাগছে না। যা বলার পরিষ্কার করে বলো।

একটা ব্যাপার তো অবশ্যই খেয়াল করেছ, কিশোর বলল, কমান্ডার চায় না আমরা এখানে থাকি। কায়দা করে জানতে এসেছিল, আমরা কখন যাব। বলে দিলাম, কাল যাব। সুতরাং আজ রাতে যেটা ঘটাতে চেয়েছিল, সেটা কাল ঘটাবে সে। আজ আমরা আছি বলে অপেক্ষা করবে। কাল আর থাকব না…

না থাকলে দেখব কি করে কি ঘটাচ্ছে?

বুড়ো ডেলভারের সাহায্য নিতে হবে।

কিভাবে?

সেটা কালই দেখো। চলো, এখন আর বকবক না করে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

.

১৪.

পরদিন খুব সকালে ওর মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখে কমান্ডার দাঁড়িয়ে আছে সৈকতে। ওদের দেখে হেসে জিজ্ঞেস করল, তাহলে চলেই যাচ্ছ?

হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর, একজায়গায় আর কত। দেখারও নেই তেমন কিছু।

আমার কিন্তু ভালই লাগে এখানে।

আমাদেরও লাগা শুরু করেছিল, কিন্তু থাকতে আর দিলেন কই?-বলার ইচ্ছে ছিল মুসার, কিন্তু চেপে গেল। মুখে বলল, দূর, এই পাগলের আড্ডায় কে থাকে। তা ছাড়া খাবার নেই, কিছু না, আনতে গেলেও বিরাট ঝামেলা…

কমান্ডারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিরিখাতের দিকে এগোল ওরা। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেত মুখে মুচকি হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে কমান্ডার।

পাহাড় পেরিয়ে ডেলভারের বাড়িতে পৌঁছল ওরা। তখনও মাছ ধরতে বেরোয়নি বুড়ো। ওদের দেখে অবাক হলো। কি ব্যাপার? এত সকাল সকাল? চোখমুখের অবস্থা দেখে তো মনে হয় না রাতে ভাল ঘুম হয়েছে। ভূতের পাল্লায় পড়েছিলে নাকি?

মুসা জবাব দিল, ভূত নাহলেও পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম…

কনুইয়ের গুঁতো মেরে ওকে থামিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, গুহাটার একটা রহস্য আছে, মিস্টার ডেলভার, ঠিকই বলেছিলেন আপনি। রোখ চেপে গেছে আমার। এর রহস্য ভেদ না করে ছাড়ব না। এ জন্যে আপনার সাহায্য দরকার আমাদের।

চোখ কপালে উঠল বুড়োর। আমার সাহায্য! দেখো বাবা, আর যাই করতে বলো, গুহার কাছে যেতে বোলো না আমাকে, দুহাত নেড়ে বলল সে, আমি সেটা পারব না।

না, গুহার কাছে যেতে বলব না আপনাকে আশ্বস্ত করল কিশোর। মাছ ধরতে বেরোবেন না আজ?

বেরোব। নাস্তাটা সেরেই। তোমরা খেয়েছ?

 না।

তাহলে এসো, বসে যাও আমার সঙ্গে।

হ্যাঁ। বসব। আপনার সঙ্গে মাছ ধরতে বেরোব আজ আমরাও আপত্তি আছে?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বুড়ো। তারপর মাথা নাড়ল, না, আপত্তি নেই। আরও অনেক কথা আছে তোমার পেটে, বুঝতে পারছি। এসো, খেতে খেতে ঢেলে দাও।

.

অতি পুরানো একটা মোটর বোট। ইঞ্জিনটাও আদিম। তবু ওটারই গায়ে আদর করে হাত বোলাল বুড়ো ডেলভার। গর্ব করে বলল, এটা আমার তিরিশ বছরের সঙ্গী। একসঙ্গে সাগরে বেরিয়েছি আমরা, কত মাছ ধরেছি!

ডোবাবে না তো আমাদের? মুসা বলল।

আহত হলো ডেলভার। কি যে বলো! তোমাদের কাজ যদি কেউ উদ্ধার করে দিতে পারে, আমার এই বোটটাই পারবে।

আর কথা না বলে দড়ি ধরে টান দিল সে। একটানেই স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। মৃদু হেসে গর্বিত চোখে মুসার দিকে তাকাল বুড়ো। নীরব ইশারা করে বুঝিয়ে দিল, কেমন বুঝলে?

ঢ্যাঙ্ক- ঢ্যাঙ্ক – ঢ্যাঙ্ক -ঢ্যাঙ্ক করে ইঞ্জিনের বিচিত্র আওয়াজ তুলে ঢেউ কেটে এগিয়ে চল বোট। কোনদিকে যেতে হবে বলে দিয়েছে কিশোর। সেদিকেই চালাল বুড়ো।

উপকূল একপাশে রেখে তীরের বেশ খানিকটা দূর দিয়ে এগিয়ে চলল বোট। ডেকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে রইল তিন গোয়েন্দা। গুহা থেকে নজর রাখলেও ওদের দেখতে পাবে না কমান্ডার।

গুহার কাছ থেকে অনেক দূরে নোঙর ফেলল বোট, যাতে কমান্ডারের সন্দেহ না হয়। বুড়ো ডেলভার মাছ ধরতে লাগল, আর বিনকিউলার দিয়ে গুহার দিকে নজর রাখল গোয়েন্দারা।

আচমকা শক্ত হয়ে গেল রবিন। অ্যাই কয়েকজন লোক!

 পাশ থেকে কিশোর বলল, আমিও দেখতে পাচ্ছি।

মুসা বলল, সামনের লোকটা কে? কমান্ডার মরিস না?

মনে হয়। ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।

কমান্ডারের সঙ্গে আরও তিনজন লোক রয়েছে। একটা বাক্স ধরাধরি করে নিয়ে গুহার ভেতর চলে গেল।

এরপর দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেল। বিনকিউলার ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দার। কিন্তু নোকগুলো আর বেরোয় না।

রবিন বলল, নেমে গিয়ে দেখব নাকি ভেতরে কি করছে ওরা?

না, এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না, কিশোর বলল, দেখে ফেলতে পারে।

আকাশের অবস্থা ভাল না। বারবার দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছে ডেলভার। পানির রঙ গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে। বড় হচ্ছে ঢেউগুলো। বাতাস বাড়ছে। দিগন্তেরকালো মেঘের ভেতরে বিদ্যুৎ চমকাল একবার।

ঝড় আসছে, ঘোষণা করল বুড়ো। ফিরে যেতে হবে আমাদের।

আর কয়েক মিনিট থাকা যায় না? অনুরোধ করল রবিন।

না, লক্ষণ খুব খারাপ। এখুনি রওনা হতে হবে আমাদের।

ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ডেলভার।

ঠিক এই সময় গুহা থেকে বেরিয়ে এল কমান্ডার। লোকগুলো নেই সঙ্গে। সৈকত দিয়ে পানির দিকে এগেলি সে।

কিন্তু কি করে সে, দেখার সুযোগ হলো না গোয়েন্দাদের। তার আগেই বাঁকের আড়ালে সরে এল বোট।

ঢ্যাঙ্ক-ঢ্যাঙ্ক করে এগিয়ে চলেছে বোট। বাতাস আর ঢেউ যে হারে বাড়ছে তাতে সময়মত জেটিতে পৌঁছতে পারবে কিনা সন্দেহ হলো মূসার। জিজ্ঞেস করল, স্পীড আর বাড়ানো যায় না?

না, মাথা নাড়ল ডেলভার, সাধ্যমত চলছে এটা।

বিশাল এক ঢেউ এসে ভেঙে পড়ল বোটের ওপর। পানির ছিটে ভিজিয়ে দিল আরোহীদের।

ঢেউয়ের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যেন এগিয়ে চলেছে বৃদ্ধ জল্যানটা। দমছে না কোনমতেই।

আকাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কালো মেঘ। কয়েক মিনিট পর আঘাত হানল বৃষ্টি।

মুসার মনে হতে লাগল, আজ ওদের ডুবিয়েই ছাড়বে বোট। সাগরের যা অবস্থা, এখন বোট ডুবলে মরতে হবে, বাঁচার কোনই আশা নেই।

কিন্তু বুড়োর কথাই ঠিক, ডুবল না বোট। ধুকতে ধুকতে প্রায় ডুবন্ত অবস্থায় এসে তীরে ভিড়ল। দড়ি আর শেকল দিয়ে শক্ত করে বোট বেধে নেমে পড়ল ডেলভার আর তিন গোয়েন্দা। বৃষ্টির মধ্যে মাথা নিচু করে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল।

বিকেলের দিকে ঝড় থামল, কমে এল বৃষ্টি। পরিষ্কার হতে লাগল। আকাশ। পেটভরে খেয়ে আয়েশের ঢেকুর তুলে চেয়ারটা ঠেলে পেছনে সরাল ডেলভার। পাইপ ধরাল। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, ঝড় তো থামল। এবার কি করার ইচ্ছে?

গুহার কাছে যাব, কিশোর বলল, কি ঘটে ওখানে দেখব।

দাঁতের ফাঁকে পাইপটা চেপে ধরল ডেলভার। ধোঁয়া টানা থামিয়ে দিয়েছে। চোখে ভয়। রাতের বেলা!

হ্যাঁ। অন্ধকার নামলেই বেরিয়ে পড়ব আমরা। রাত বারোটার মধ্যে ফিরে আসব। টর্চটা বের করে ব্যাটারিগুলো খুলে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর।

যা বলছে তাই করবে ছেলেগুলো, এতদিনে বুঝে ফেলেছে ডেলভার, ওদের ঠেকানো যাবে না। তাই বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না আর। তবে কয়েকবার করে সাবধান করল। বলল, যেতে বাধা দেব না, তবে আমার একটা পরামর্শ শোনো। সবার একসঙ্গে গিয়ে কাজ নেই। যে কোন দুজন। যাও। একজন আমার এখানে থাকো। সময়মত যদি না ফেরো তোমরা, সাহায্য করতে পারবে সে।

পরামর্শটা মনে ধরল কিশোরের। রাজি হলো।

সন্ধ্যা হতেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল সে আর মুসা। রবিন রয়ে গেল ডেলভারের বাড়িতে। যদিও এভাবে একা পড়ে থাকার ইচ্ছে তার ছিল না। তবু নেতার নির্দেশ, মানতেই হয়।

পাহাড়ে উঠতে শুরু করল দুই গোয়েন্দা। বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল আর নরম হয়ে আছে মাটি। অন্ধকার হলে এ পথে চলার সাহস করত না ওরা। চাঁদের আলো আছে বলে এগোতে পারছে।

নিরাপদেই ওপরে উঠে পাহাড়ী পথ ধরে হেঁটে চলল দুজনে। গিরিখাতটা দেখা গেল একসময়। ওটা ধরে চলে বেরিয়ে এল সৈকতে।

পৌঁছে গেছে। ওখানে বসে জিরিয়ে নিল কয়েক মিনিট। তারপর উঠে পাহাড়ের দেয়ালে গা মিশিয়ে পা টিপে টিপে এগোল কমান্ডারের গুহার দিকে।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিশোর।

তার গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা। কি হলো!

 হাত তুলে দেখাল কিশোর।

মুসাও দেখল। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে অস্পষ্টভাবে বেরিয়ে এল, খাইছে!

তীর থেকে তিনশো গজ দূরে সমুদ্রের পানিতে মিটমিট করে জ্বলছে একটা লাল আলো, যেন কোন একচোখো সাগর-দানবের চোখ। কিন্তু চাঁদের আলোয় লাল আলোর নিচের কালো অবয়বটাকে চিনতে ভুল হলো না। একটা সাবমেরিনের কনিং টাওয়ার।

.

১৫.

প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেল দুজনে। এই তাহলে ব্যাপার। কমান্ডার মরিস কোন ধরনের গোপন দলের নেতা, বেআইনী কিছু করছে এই পাহাড়ের গুহায় থেকে। সাবমেরিনে করে রসদপত্র নিয়ে আসা হয়েছে।

গুহামুখের কাছ থেকে আগের রাতের মত সার্চলাইট জ্বলে উঠল। সাবমেরিনের দিকে তাকিয়ে দুবার জলল-নিভল আলোটা।

ধীরে ধীরে পানির ওপর ভেসে উঠল সাবমেরিনের পুরো পিঠ, অতিকায়। একটা মাছের মত। লাল আলোর নিচে কালো শরীর, অন্ধকারে ভয়ঙ্কর লাগছে অবয়বটা।

আলোর সাহায্যে ওটাকে সঙ্কেত দিল কমান্ডার, কিশোর বলল। ইস্, একটা বোট যদি পেতাম গিয়ে দেখে আসতাম সাবমেরিনে কি ঘটছে।

মুসা বলল, এক কাজ করি, সাঁতরে চলে যাই আমি ওটার কাছে। বেশি দূর তো না। তুমি বসে থাকো এখানে।

কিশোর বাধা দেয়ার আগেই কাপড় খুলতে আরম্ভ করল সে।

সাবধানে যেয়ো, শুধু বলল কিশোর।

পাহাড়ের দেয়ালের সঙ্গে মিশে এগোল মুসা। পানির কাছে এসে ফিরে তাকাল একবার। কিশোরকে দেখা যায় না। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে আছে সে। ধীরে ধীরে পানিতে নেমে এল মুসা। মাথাটা কেবল ভাসিয়ে রেখে নিঃশব্দে সাঁতরে চলল সাবমেরিনের দিকে।

সেও পৌঁছল ওটার কাছে, সাবমেরিনের হ্যাচও খুলে গেল। পিচ্ছিল খোলসের গায়ে ধরার মত কিছু পেল না মুসা। ওটার গায়ে গা ঠেকিয়ে শুধু নাকটা পানির ওপরে ভাসিয়ে তাকিয়ে রইল হ্যাঁচের দিকে।

ছয়জন মানুষ বেরোল। কথা বলছে একটা অপরিচিত ভাষায়।

দশ ফুট দূর থেকে দেখছে মুসা। দুরুদুরু করছে বুক। ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ইংরেজিতে বলে উঠল একজন, আমার মনে হয়। এখানে আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলা উচিত না। কেউ শুনে ফেললে সন্দেহ করবে।

কে আর আসছে এখানে দেখতে, ইংরেজিতেই বলল আরেকজন।

তবু…এটা আমেরিকা, আমাদের সমঝে চলাই উচিত। অভ্যাস বদলাতে হবে।

ওদের সঙ্গে একটা রবারের ভেলা। ভেলাটা পানিতে ভাসিয়ে তাতে চড়ে বসল লোকগুলো। দাঁড় তুলে নিল দুজন। বেয়ে চলল তীরের দিকে।

বন্ধ হয়ে গেল হ্যাচ।

আর কিছু দেখার নেই এখানে। ভেলার পিছু পিছু মূসাও আবার তীরে ফিরে চলল। সাবধান রইল যাতে কোনমতেই লোকগুলোর চোখে পড়ে না। যায়।

কিছুদূর এসে কি মনে হতে ফিরে তাকাল। দেখল, পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে কনিং টাওয়ার। লোকগুলোকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে সাবমেরিন।

আবার জ্বলে উঠল সার্চলাইট। ভেলার দিকে মুখ করে জ্বলল-নিভল দুবার।

মাথা যতটা সম্ভব নিচে নামিয়ে ফেলল মূসা। আলো নেভার পর আবার মাথা তুলে শুনল ভেলার একজন বলছে, মরিস জ্বেলেছে।

আরেকজন জবাব দিল, হ্যাঁ। তা ছাড়া এই পাহাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থেকে আর সঙ্কেত দিতে আসবে কে?

তীরে পৌঁছল ভেলা। লোকগুলোকে চলে যাওয়ার সময় দিল মুসা। তারপর সেও উঠে এল সৈকতে। পাহাড়ের গা ঘেষে ফিরে এল পাথরটার কাছে, যেখানে কিশোর লুকিয়ে আছে। সবকথা জানাল ওকে।

পা টিপে টিপে কমান্ডারের গুহার কাছে চলে এল দুজনে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, লোকগুলোকে স্বাগত জানাচ্ছে মরিস। এক এক করে হাত মেলাচ্ছে ওদের সঙ্গে।

একটা ব্যাপার দৃষ্টি আকর্ষণ করল দুজনেরই, বদলে গেছে মরিসের চেহারা। অনেক বেশি তরুণ মনে হচ্ছে তাকে। কেন এমন দেখাচ্ছে সেটা কিশোর প্রথম বুঝতে পারল। ওদের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে লোকটার, ততবার পরচুলা পরে ছিল। এখন কুচকুচে কালো ওর মাথার চুল। এগুলোই আসল, পরচুলা খুলে ফেলেছে। মুখের ভাজও এখন অদৃশ্য, তারমানে মেকআপও নিত দিনের বেলা।

হাত মেলানো শেষ করে লোকগুলোকে নিয়ে গুহার পেছন দিকে চলে গেল কমান্ডার। সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে যাওয়াতেই বোধহয় মিলিয়ে গেল ওর হাতের আলো।

চলো, আমরাও ঢুকে পড়ি, কিশোর বলল।

ভেতরে ঢুকল দুজনে। গুহার গভীর থেকে ভেসে আসছে কথা বলার মৃদু শব্দ। অনেকটা গুঞ্জনের মত শোনা যাচ্ছে। খুব সাবধানে এগোল ওরা। ফিসফিস করে মুসাকে বলল কিশোর, দেখো তো, সুড়ঙ্গের মুখে কেউ আছে। কিনা? গার্ড রেখে যেতে পারে।

ভাল করে দেখল মুসা, অন্ধকারে কাউকে চোখে পড়ল না। কোন নড়াচড়া নেই। কাউকে দেখছি না।

আবার এগোল দুজনে। মিলিয়ে গেল কথার শব্দ। আলো ছাড়া আর এগোনো অসম্ভব। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে লোকগুলোকে আরও ভেতরে চলে যাওয়ার সময় দিয়ে যা থাকে কপালে ভেবে কোমর থেকে টর্চ খুলে নিয়ে জ্বালল কিশোর। আলোর রশ্মি ঘুরিয়ে আনল একবার চারপাশে। 

তাকের ওপর আগের মতই পড়ে আছে শটগানটা। পাশে নোটবইটাও আছে, তবে ক্যাপটা নেই। বোধহয় সরিয়ে ফেলেছে কমান্ডার। নিচে জড় করে রাখা খাবারের টিন।

লোকগুলো যেদিকে গেছে সেদিকে এগোল দুজনে। যতই ভেতরে ঢুকল বিস্ময়ে হা হয়ে গেল মুখ। গুহার পেছন থেকে বৈদ্যুতিক তারের মোটা পাইপ চলে গেছে সুড়ঙ্গের ভেতরে।

তোমার কথাই ঠিক, মুসা বলল। এই পাইপই আমার যন্ত্রে ধরা পড়েছিল। কিন্তু এ সব দিয়ে এখানে কি করছে ব্যাটারা?

চলো, গেলেই দেখতে পাব। আমার মনে হয় ওরা কোন দেশের স্পাই। রাডার স্টেশনটার দিকে লক্ষ। ওটাকে কিছু করতে চায়। ও কিন্তু ডিগ আর গেনারের ব্যাপারটা তাহলে কি? ওরা এর মধ্যে আসছে কি করে?

এখনও বুঝতে পারছি না। চলো, এগোই…

কিন্তু কিশোরকে কথা শেষ করতে দিল না একটা কণ্ঠ, অন্ধকার থেকে বলে উঠল, আর এগোনোর দরকার নেই। থাকো ওখানেই।

চমকে গেল কিশোর। আপনাআপনি টর্চ ধরা হাতটা ঘুরে গেল, আলো গিয়ে পড়ল লোকটার হাসি হাসি মুখের ওপর।

মেরিন ডিগ!

বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন মুসার শরীরে। তিন লাফে চলে গেল তাকের কাছে। আবছা অন্ধকারে আন্দাজেই থাবা দিয়ে তুলে নিল শটগানটা। তাক করল ডিগের দিকে।

কিন্তু পরক্ষণেই আকাশ ভেঙে পড়ল যেন ওর মাথায়। পেছন থেকে শক্ত কিছু দিয়ে সজোরে বাড়ি মারা হয়েছে। অন্ধকারে আরও একজন লোক লুকিয়ে ছিল।

টলে পড়ে গেল মুসা।

.

জ্ঞান ফিরলে দেখল সে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গুহার মেঝেতে পড়ে আছে। কিশোরকে একইভাবে বেধে ফেলে রাখা হয়েছে ওর পাশে। কাছেই পিস্তল হাতে বসে আছে ডিগ। একটা ল্যাম্প জ্বলছে, তার আলোয় কুৎসিত লাগছে। ওর মুখটা।

যাক, ঘুম তাহলে ভাঙল, হেসে বলল ডিগ। আমি জানতাম তোমরা এমন কিছু একটা করবে, আসবে, তাই লুকিয়ে ছিলাম তোমাদের অপেক্ষায়।

তা তো বুঝলাম, নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল মুসা, কোলাব্যাঙের স্বর বেরোচ্ছে তার গলা দিয়ে। কিন্তু এ ভাবে কতক্ষণ আটকে রাখবেন আমাদের?

বেশিক্ষণ না। এই আর কয়েক ঘণ্টা, ততক্ষণে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে।

তারপর ছেড়ে দেবেন? ফিরে গিয়ে যদি পুলিশকে সব কথা বলে দিই আমরা?

সেজন্যেই তো ছাড়ব না। আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাব। তোমাদের দিয়ে কাজ হবে। বুদ্ধিমান ছেলে তোমরা, ব্রেন ওয়াশ করে নিলে অনেক কাজ করাতে পারব।

কোথায় নিয়ে যাবেন আমাদের? জানতে চাইল কিশোর।

সেটা বলা যাবে না। গেলেই দেখতে পাবে।

এখানে কি, করছেন আপনারা, সেটা তো বলা যাবে? রাডার স্টেশনটাতে কিছু করছেন, তাই না?

হাসল ডিগ। অতটা আন্দাজ করে ফেলেছ! হ্যাঁ, ওখানেই…

কথা শেষ হলো না তার। একসঙ্গে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল অনেক লোক। কঠিন গলায় আদেশ হলো, খবরদার, নড়বে না কেউ! পুলিশ!

 স্তব্ধ হয়ে গেল ডিগ। হাত থেকে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখল পিস্তলটা।

উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল কয়েকটা, পুলিশের ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক ল্যাম্প।

হাসিমুখে মুসা আর কিশোরের পাশে এসে বসল রবিন। এগিয়ে এল ডেলভার।

বাঁধনের দড়ি কাটতে কাটতে রবিন বলল, সময়মতই এসে পড়েছি, তাই? তোমাদের জন্যে কাটায় কাটায় বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি আমরা। তারপর থানায় গেছি।…তা ভাল আছ তো তোমরা? মারধর করেনি?

করেনি বললে ভুল হবে, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। মাথায় বাড়ি দিয়ে বেঁহুশ করে ফেলেছিল আমাকে…

.

১৬.

 পরদিন বিকেল। রকি বীচে তিন গোয়েন্দার ওঅর্কশপে বসে আছে ওরা। এই সময় একটা গাড়ি ঢুকল ইয়ার্ডে। গাড়ি থেকে নামল একজন লম্বা, সুদর্শন, লোক। গোয়েন্দাদের খোঁজ করল। নিজের পরিচয় দিল-ফিন রিগসন, এফ বি আইয়ের লোক। জানাল, হ্যারিস গেনারের নিরুদ্দেশের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে।

তিন গোয়েন্দাও আগ্রহী হলো। ডেকে নিয়ে গিয়ে বসাল ওঅর্কশপের ভেতর।

ভদ্রলোককে দেখে সেরাতে গুহায় ঢোকার কথা মনে পড়ল কিশোরের। একজন স্পাইও পালাতে পারেনি। দল বেঁধে সুড়ঙ্গে ঢুকেছে পুলিশ। ঢোকার আগে হেডকোয়ার্টারে ওয়্যারলেস করে বলে দিয়েছে একজন অফিসার, বাইরে থেকে যাতে রাডার স্টেশনটা ঘিরে ফেলা হয়।

সেইমত কাজ করেছে হেডকোয়ার্টার থেকে আসা পুলিশ বাহিনী। অতএব কেউ পালাতে পারল না। স্টেশনের নিচের একটা গুপ্তকক্ষ থেকে সব কজন স্পাইকে গ্রেপ্তার করা হলো। গুহাটা থেকে প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ বেরিয়ে চলে গেছে স্টেশনের দিকে। মূল সুড়ঙ্গ থেকে আরেকটা শাখা-সুড়ঙ্গ খুঁড়ে স্টেশনের নিচে চলে আসার ব্যবস্থা করেছে স্পাইরা। একটা কক্ষ বানিয়ে নিয়েছে যাতে ওখান থেকে ওপরে উঠে গোপনে স্টেশনের কাজকর্ম দেখতে পারে।

সাবমেরিন থেকে আসা সব কজনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ, সেই সঙ্গে কমান্ডার মরিস আর মেরিন ডিগকেও। যাকে উদ্দেশ্য করে এই তদন্তের শুরু, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে গুহা বা সুড়ঙ্গের কোথাও পাওয়া গেল না।

ডিগকে বার বার করে জিজ্ঞেস করা হলো, কিন্তু জবাব পাওয়া গেল একটাই–সে কিছু জানে না।

কিন্তু নিরাশ হলো না অফিসার। থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কথা আদায়ের চেষ্টা করা যাবে।

সে ব্যাপারেই হয়তো কিছু বলবে, ভাবল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, হ্যারিস গেনারের কোন খোঁজ পাওয়া গেছে?

মাথা ঝাঁকাল রিগসন, গেছে। ওকেও পাওয়া গেছে। হাসপাতালে আছে এখন।

তাই নাকি! খুব খারাপ অবস্থা?

শরীর ঠিকই আছে, তবে বোধহয় মাথায় কোন গোলমাল হয়েছে। একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। ওষুধের রিঅ্যাকশনও হতে পারে।

তার বোন ইভা গেনারকে খবর দেয়া হয়েছে?

সেজন্যেই তো তোমাদের কাছে এলাম, ঠিকানা জানার জন্যে।

ও, চলুন তাহলে, আগে তাকে গিয়ে খবরটা দিই। তারপর একসঙ্গে হাসপাতালে যাব গেনারকে দেখতে। তা কোথায় পেলেন ওকে?

সাবমেরিনের মধ্যে, রিগসন জানাল। ওকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল ওটা। স্পাইগুলোকে ধরার পর তোমাদের কথামত সাবধান করে দেয়া হয়েছিল কোস্টগার্ডকে। নৌবাহিনীর সহায়তায় সাবমেরিনটাকে ধরে ফেলা। হয়েছে। তার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে গেনারকে। গুহাতেই রাখা। হয়েছিল ওকে। ওখান থেকে সাবমেরিনে পাচার করা হয়েছে।

ও তো নিশ্চয় কিছু বলতে পারেনি? জানতে চাইল রবিন।

আবার মাথা নাড়ল রিগসন।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, রাডার স্টেশনটাতে কি করছিল ওরা জানা। গেছে?

দুটো উদ্দেশ্যে ব্ল্যাক হোল কেভে আস্তানা গেড়েছিল ওরা। ওই উপকূলে গুপ্তচরদের একটা ঘাটি বানিয়েছিল। ওখানে লুকিয়ে থেকে নানা রকম ধ্বংসাত্মক কাজকারবার চালানোর পরিকল্পনা করেছিল ওরা দেশের ভেতর। সেই সঙ্গে রাডার স্টেশনটাকেও অকেজো করে রাখার চেষ্টা চালাত। তাতে বিমান আর নৌবাহিনীর অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত।

রাডার স্টেশন অকেজো করত কিভাবে? জানতে চাইল মুসা।

একটা বিশেষ যন্ত্র গুহার ভেতর থেকে রাতের বেলা বাইরে ঠেলে দিত, রিগসন জানাল, তাতে বাধা পেত রাডার সিগন্যাল, জ্যাম হয়ে যেত।

বাপরে বাপ, কত্তবড় শয়তান, ব্যাটারা!

হ্যাঁ, লোক খুব খারাপ ওরা। মজার ব্যাপার হলো, কমান্ডার জিন মরিস নিজেকে জাহাজের কমান্ডার বলে পরিচয় দিলেও কোনদিন নাবিক ছিল না সে। অল্প বয়সে কিছুদিন এক তৃতীয় শ্রেণীর থিয়েটারে অভিনয় করেছে। বিদেশে একটা সাংস্কৃতিক ভ্রমণ করার সময় স্পাইয়ের খপ্পরে পড়ে খারাপ হয়ে যায়, বিদেশী সংস্থার হয়ে নিজের দেশের বিরুদ্ধে বেঈমানী শুরু করে…

বাধা দিল রবিন, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে?

আরে নাহ, ইংল্যান্ড কোথায়? আমেরিকা। ও আমেরিকান। কোনকালেই ইংরেজ ছিল না, শরীরে কোনভাবেই ইংরেজ রক্ত আসেনি, মায়ের দিক থেকেও না, বাপেরও না। ব্রিটিশ জাহাজের কমান্ডার বলে ফাঁকি দিয়েছে তোমাদেরকে। আরও বহুজনকে দিয়েছে। পাগলের অভিনয় করাও তার আরেকটা ফাঁকিবাজি। মহাধড়িবাজ লোক।

হ্যাঁ, মুসা বলল, আমরা তো সত্যি সত্যি পাগল ভেবে বসেছিলাম। ভেবেছি একলা থাকতে থাকতে মাথাটা ওর বিগড়ে গেছে।

পাগলামি করাতে অবশ্য সুবিধেই হয়েছে আমাদের, কিশোর বলল, সন্দেহটা তাড়াতাড়ি জেগেছে। আচ্ছা, মুসা যে পিস্তলটা পেয়েছে, ওটার। ব্যাপারে কিছু জেনেছেন নাকি? অস্ত্রটা মরিসেরই, তাই না?

হ্যাঁ, রিগসন বলল, মরিস সব স্বীকার করেছে। তোমাদের গুহা থেকে যে রাতে খাবার চুরি করেছে, সে রাতে ওটা হারিয়ে ফেলেছিল। অন্ধকারে তাড়াহুড়োয় আর খুঁজে পায়নি। খাবার চুরি করেছিল তোমাদের তাড়ানোর জন্যে। ভেবেছিল, খাবার না পেলে আপনিই চলে যাবে তোমরা।

সেটা তখনই বুঝতে পেরেছি।

ক্যাপটা কার? নিশ্চয় গেনারের?

মাথা ঝাঁকাল রিগসন। হ্যাঁ।

সে ওই গুহায় কি করে গিয়েছিল, কিছু জেনেছেন?

ডিগের কথাবার্তায় সন্দেহ হয়েছিল তার, ব্ল্যাক হোল গুহায় কিছু ঘটছে। একরাতে গোপনে ওর পিছু নিয়ে চলে যায় সেখানে। কিন্তু মরিসের চোখে পড়ে যায়। পালানোর চেষ্টা করে গেনার। কিন্তু বন্দুকের ফাঁকা গুলি করে তাকে ভাঁড়কে দেয় মরিস। আটকে ফেলে।…যাই হোক, কথা তো অনেক হলো। চলো এবার, গেনারের বোনকে খবরটা দেয়া যাক।

রিগসনের সঙ্গে বেরোল তিন গোয়েন্দা।

  খবর শুনে তো কেঁদেই ফেলল ইভা। তখুনি ওদের সঙ্গে রওনা হলো হাসপাতালে।

ঘোর কেটেছে গেনারের। তবে অতিরিক্ত দুর্বল। দুজন পুলিশ অফিসার বসে আছে, তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্যে।

তিন গোয়েন্দা কি করেছে শুনে কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে এল তার। ধরা গলায় বলল, তাহলে তোমরাই আমাকে বাঁচিয়েছ! সময়মত সাবমেরিনটাকে আটকাতে না পারলে আমাকে কোথায় যে নিয়ে যেত ওরা কে জানে! সারাজীবনে হয়তো আর দেশের মুখ দেখতাম না। হয়তো ব্রেন ওয়াশ করে মাথাটাই বিগড়ে দিত চিরকালের জন্যে। কি বলে যে ধন্যবাদ দেব তোমাদেরকে…

2 Comments
Collapse Comments

পুরনো দিনে ফিরে গিয়েছিলাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *