জাগরণ – ০৭

সাত

রে-সাহেব কমলকিরণকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন—এ সম্বন্ধে তোমার কি মত হে?

কমলের চোখের দৃষ্টি চোখের পলকে ইন্দু ও আলেখ্যের মুখের উপর দিয়া গিয়া সাহেবের প্রতি স্থির হইল।

অমরনাথ গমনোদ্যত হইয়াও তখনও দাঁড়াইয়া ছিল; নিজের পূর্ব-কথার অনুবৃত্তিস্বরূপে বিনীতকন্ঠে কহিল—সম্পত্তি আপনাদের, এর ভালমন্দ আপনাদেরই নিরূপণ করতে হবে, কিন্তু যাই করুন, আমাকে উপলক্ষ করে যেন কিছুই করবেন না, এই আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ।

সাহেব ব্যস্ত হইয়া বলিতে গেলেন—না না, তুমি যখন তা চাও না, কি বল ইন্দু? কি বল আলো? এই বলিয়া তিনি উপস্থিত সকলকে, বিশেষ করিয়া যেন নিজেকেই নিজে আবেদন করিলেন।

ইন্দু ঘাড় নাড়িল, কমলকিরণও বোধ হয় যেন সায় দিতে যাইতেছিল এবং আলেখ্য ত গাঙ্গুলী বৃদ্ধের আত্মঘাতের ভারে চাপা পড়িয়াই ছিল—স্বাধীন মতামত দিবে কি, প্রকাশ্যে মুখ দেখাইতেও সঙ্কোচ বোধ করিতেছিল, কিন্তু হঠাৎ উত্তর বাহির হইল তাহারই মুখ দিয়া। এই নবীন অধ্যাপকের সহিত প্রথম পরিচয়ের দিনে তাহাদের সদ্ভাব জন্মে নাই; তাহার পরে যতবারই উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটিয়াছে, অসদ্ভাব বৃদ্ধির দিকেই বরাবর গিয়াছে। গাঙ্গুলীর মৃত্যুর ব্যাপারে সেদিন রাত্রে অমরনাথের কাছে সে সহানুভূতি পাইয়াছিল, বিরুদ্ধতা সে করে নাই, তথাপি আলেখ্যের মনের লজ্জা তাহাতে গোপনে বাড়িয়াছিল বৈ লেশমাত্র কমে নাই; এবং ইহারই সম্মুখে আপনাকে যেন সে সামান্য, একাকী ও সর্বাপেক্ষা বেশী অপরাধী না ভাবিয়া পারিত না। আজ এইসকল পরিচিত বন্ধুদের মধ্যে বসিয়া অকস্মাৎ আপনাকে যেন সে ফিরিয়া পাইল। বেশ সহজভাবে মুখ তুলিয়া স্বাভাবিক শান্তস্বরে বলিল—হাঙ্গামা বাধালেন আপনি, আর বিপদ ভোগ করব শুধু আমরা? এ কি-রকম প্রস্তাব হ’ল আপনার?

কমলকিরণ সজোরে মাথা নাড়িয়া বলিল—একজ্যাক্ট্‌লি! ঠিক তাই আমি বলি।

অমরনাথ পা বাড়াইয়াছিল, থমকিয়া দাঁড়াইল।

আলেখ্য কহিল—আপনার বাড়ি এখানে, আপনি গেছেন আর একটা জায়গায় হাটের মধ্যে মেড্‌ল করতে। জানিনে, তাতে দেশের ভাল হবে কি মন্দ হবে। ধরে নিলাম, ভালই হবে, কিন্তু সম্পত্তি আমার, তার ভালমন্দতে আমারও একটু শেয়ার আছে। অথচ, আমার অভিমতের কোন মূল্য আপনার কাছে নেই, এখানে আমাকেই বলতে এসেছেন, আপনাকে যেন না উপলক্ষ সৃষ্টি করি। এ অনুরোধ আপনার নিতান্ত অসঙ্গত।

তাহার মুখের এই অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত মন্তব্য শুনিয়া শুধু কেবল তাহার শ্রোতাই নয়, উপস্থিত সকলেই যেন অবাক্‌ হইয়া গেল। সবচেয়ে বেশী হইলেন রে-সাহেব নিজে।

বিস্মিত অমরনাথ আলেখ্যের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল, সুসঙ্গত উত্তর সহসা তাহার মুখে যোগাইল না।

সাহেব কি একটা বলিতে চাহিয়া শুধু বলিলেন—না না, ঠিক তা নয়—কিন্তু কি জান, অমরনাথ বোধ করি—

আলেখ্য হাসিয়া কহিল—কি বোধ কর বাবা?

ইন্দু এবং কমলকিরণ দুইজনেই মুখ টিপিয়া হাসিল।

অমরনাথ আপনাকে লাঞ্ছিত বোধ করিয়া কহিল,—বেশ, আমার অনুরোধ আপনি রাখবেন না।

আলেখ্য কহিল—অনুরোধ রাখব না, এ আমি বলিনি। কিন্তু ন্যায়-অন্যায় যাই হোক, কেবলমাত্র তারা আপনার প্রতি আর বেশী অপ্রসন্ন না হয়, এই অসঙ্গত অনুরোধ আমি রাখব না বলেছি।

অমরনাথ কহিল—কোনরূপ অনুরোধ করার সঙ্কল্প নিয়ে আপনাদের কাছে আমি আসিনি। আমাকে তারা আঘাত করেছে, কিন্তু এই নিয়ে তাদের শাস্তি দিতে যাবার মত নিরর্থক কাজ আর নেই, এই কথাই শুধু আমি জানাতে এসেছিলাম।

আলেখ্য বলিল—একজন তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষে যা নিরর্থক, জমিদার এবং প্রজার পক্ষে তা নিরর্থক না-ও হতে পারে। অন্তত:, সে স্থির করবার ভার আমাদের উপরেই থাক।

কমলকিরণ কহিল—ঠিক তাই। আমাদের রেস্‌পন্‌সিবিলিটি আমরা নিজেদের হাতেই রাখবো। থার্ড পারসনের মাঝখানে আসবার একেবারেই প্রয়োজন দেখিনি। মিস্টার রে, আপনি কি বলেন?

সাহেব সকলের মুখের দিকেই চাহিলেন। এই কালই ত আলেখ্য বাঙলাদেশের দরিদ্র প্রজাদের দুঃখে বিগলিত হইয়া কত কথাই বলিয়াছিল এবং অমরনাথ যে তাহাদেরই কাজে আত্মনিয়োগ করিয়াছে, এ কথাও ত সে জানে।

আঘাত খাইয়া যে প্রতিঘাত করিতে চাহে না, তাহাদেরই কল্যাণের জন্য যে নিঃশব্দে সমস্ত সহ্য করিতে প্রস্তুত হইয়াছে, তাহার সহিষ্ণুতায় হঠাৎ কেন যে আর একজন এতখানি অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল, তাহা তিনি ভাবিয়া পাইলেন না। তিনি এদিকে-ওদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া শেষে ধীরে ধীরে বলিলেন—এ ত অতিশয় সাধারণ আলোচনা কমল, এর ভিতর হিট্‌ কিসের জন্য উঠছে, আলো? বেশ ত, কি করা উচিত অনুচিত, শান্ত হয়েই তোমরা তার বিচার কর না, অমরনাথ! আর এখনই বা কেন? কালও হতে পারে।

অমরনাথ কহিল—রায়-মশায়, তৃতীয় ব্যক্তির মাঝখানে আসাটা কেউ পছন্দ করে না। সংসারে জমিদার ও প্রজা ছাড়া যদি না আর কিছু থাকতো ত কোন কথাই ছিল না, কিন্তু বিপদ এই যে, তৃতীয় ব্যক্তি বলে একটা বস্তু সংসারে আছে, এবং পছন্দ না করলেও ও-বস্তুর অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত করা যাবে না। এঁরা এত বোঝেন, এই তুচ্ছ কথাটাও যদি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতেন!—এই বলিয়া সে শুষ্ক হাস্য করিবার একটুখানি প্রয়াস করিলেও কথাগুলা যে পরিহাস নয়, বিদ্রূপ, তাহা বুঝিতে কাহারও বিলম্ব হইল না; এবং ইহার মধ্যে খোঁচা যাহা ছিল, তাহা বিদ্ধ করিতেও ত্রুটি করিল না।

আলেখ্য কঠিন হইয়া বলিল—ইংরাজিতে ‘বিজি-বডি’ বলে একটা শব্দ আছে, মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, সংসারে সর্বত্রই এই লোকগুলোর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। না হলে পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষার জন্য এমন ছুটোছুটি করে বাবাকেও আসতে হ’ত না, আমাকেও না। দেখুন অমরনাথবাবু, অনাহুত অপরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে আমি লজ্জাবোধ করি, কিন্তু অপরের যদি এ লজ্জাবোধ না থাকে ত অপ্রিয় হলেও কর্তব্য আমাকে করতেই হবে।

কন্যার কথা শুনিয়া সাহেবের ক্ষোভের সীমা রহিল না। হৃদয়ে যথার্থ বেদনা বোধ করিয়া কহিলেন—কাজের চেয়ে তোমাদের বাক্যগুলো যে ঢের বেশী কটু হচ্ছে, মা! বিশেষ করে যখন অমরনাথ আমাদের বাড়িতে এসেছেন।

মেয়ে কহিল—অমরনাথবাবু সম্ভ্রান্ত লোক, তথাপি বলার যদি কিছু আমার থাকে ত আমার নিজের বাড়ি ছাড়া আর কোথায় বলতে পারি বাবা? এ অপরাধ নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করবেন। আর অপরাধ যদি হয়েই থাকে, তাকে সম্পূর্ণ করে দেওয়াই ভাল।

আমাদের শিক্ষা-সংস্কার, আমাদের সংসার-যাত্রার বিধি-ব্যবস্থা অমরনাথবাবুর ধারণার সঙ্গে এক নয় বলেই যে আমাদের প্রজাদেরই আমাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে হবে, এ আমি কোনমতেই সঙ্গত মনে করিনে।

অমরনাথ উত্তর দিল—কাজ যদি আমাকে করতেই হয়, নিজের ধারণা নিয়েই করতে পারি। নইলে আপনার ধারণা অনুমান করে বেড়াবার মত সময় বা কল্পনা আমার নেই। একে যদি উত্তেজিত করা মনে করেন, উত্তেজিত করা ছাড়া আমার উপায় কি আছে?

আলেখ্য কহিল—তা হলে আত্মরক্ষা করা ছাড়া আমারই বা কি উপায় আছে, আপনি বলে দিতে পারেন?

রে-সাহেব দুই হাত উঁচু করিয়া ধরিয়া বাধা দিয়া বলিলেন—না, অমরনাথ, তুমি কিছুতেই এর জবাব দিতে পারবে না, এ আমি কোনমতেই হতে দিতে পারব না। এই বলিয়া একপ্রকার জোর করিয়া তাহাকে ঘরের বাহিরে লইয়া গেলেন। সিঁড়ির কাছে আসিয়া বলিলেন—অমরনাথ, আজ আমার বিস্ময়ের অবধি নেই।

অমরনাথ এ কথার তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া প্রশ্ন করিল—কেন?

রে-সাহেব বলিলেন—কেবল বিস্ময় নয়, বাবা, আমার দুঃখেরও আজ সীমা নেই।

বারান্দার একধারে ঘষা-কাচের একটা লন্ঠন ঝুলিতেছিল, সেই অস্পষ্ট আলোকে অমরনাথ বক্তার মুখের ‘পরে অকৃত্রিম বেদনার ছায়া দেখিতে পাইয়া বলিল—দুঃখ কিজন্যে রায়-মশায়? ওঁদের শিক্ষা ও সংস্কার যে আমাদের ধারণার সঙ্গে কিছুতেই মিলতে পারে না, এই ত স্বাভাবিক। তবে, আমার হয়ত এত কথা না বলাই শোভন ছিল, কিন্তু আপনার সমস্ত জমিদারির তিনিই না কি সত্যকার কর্ত্রী, তাই বোধ হয়, চুপ করে থাকতে পারলাম না। আপনার কাছে প্রগল্‌ভতা-প্রকাশের জন্য আমি লজ্জা বোধ করি, কিন্তু আপনি নিজে যদি আমাকে ক্ষমা করতে পারেন ত আমার তরফ থেকে দুঃখ করবার আর কিছুই নেই।

সাহেব বলিলেন—ক্ষমার কথাই বলো না অমরনাথ,—তোমাকে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, তাতে আমার কাছে তোমার অপরাধ বলে কিছু হতেই পারে না। দোষ অপরাধ নয় বাবা, আজ তোমাদের মস্ত বড় ভুল হয়ে গেল।

ভুল কিসের?

সাহেব বলিলেন—ভুল এই যে, তুমি যা বলেছো, সে-ও তোমার সত্য বলা নয়, এবং আলেখ্য যা-কিছু বলেছে, সমস্তই তার অপরের। সে জবাব তোমার কথার নয়।

সাহেবের কথা অমরনাথ বুঝিতে পারিল না, বুঝিবার জন্য পুনরায় জিজ্ঞাসা করিবার তাহার ইচ্ছাও ছিল না, সময়ও ছিল না। যাইবার জন্য নমস্কার করিয়া শুধু কহিল—কাজ আমার ঢের শক্ত হয়ে গেল, কিন্তু উপায় কি! প্রথম জীবনে যে ব্রত গ্রহণ করেছি, সারা জীবন ধরে তার উদ্‌যাপন আমাকে করতেই হবে।—এই বলিয়া সে অন্ধকার প্রাঙ্গণে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

সাহেব ঘরের মধ্যে ফিরিয়া আসিতেই আলেখ্য কহিল—বাবা, তুমি যতদিন বেঁচে আছ, জমিদারির সত্যিকার মালিক তুমি, আমি নয়। কোনদিন আমার হবে কি না, সে-ও ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু, আমাকে দিয়ে যদি বাস্তবিক শাসন করিয়ে নিতে চাও, আমি আমার বুদ্ধি-বিদ্যের মতই করতে পারি। কিন্তু, একবার এ-দিক, একবার ও-দিক যদি হয় ত, বরঞ্চ যা ছিল তাই থাক্‌, আগে যেরকম চলে আসছিল, তেমনই চলতে থাকুক!

তাহার পিতা জবাব দিলেন না, চুপ করিয়া আসিয়া তাঁহার চৌকিতে বসিলেন। এই নীরবতার তাৎপর্য আর কেহ বুঝিল না, বুঝিল শুধু আলেখ্য, কিন্তু বুঝিয়াও সে আপনাকে দমন করিতে পারিল না, কহিল—বাবা, তোমার কথায়, তোমার আচরণে অনেকে যারপরনাই প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। এ তুমি বুঝতে না পারো, কিন্তু আমি একেবারে হাড়ে হাড়ে বুঝছি।

সাহেব এ অভিযোগেরও কোন উত্তর দিলেন না, তেমনই মৌন হইয়াই বসিয়া রহিলেন। আগন্তুক অতিথিদ্বয়ও নীরবে রহিলেন; কারণ, এখন বোধ হয়, কন্যা ও পিতার মাঝখানে সহসা একটা কথা যোগ করিয়া আতিথ্যের নিয়ম লঙ্ঘন করিতে তাঁহাদের বাধিল, কিন্তু তাঁহাদেরই মুখের ওপরে নিঃশব্দে অনুমোদনের সুস্পষ্ট আভাস দেখিতে পাইয়া আলেখ্যের উত্তেজনা চতুর্গুণ বাড়িয়া গেল, কহিল—দেশে কি যে একটা হাওয়া এসেছে বাবা, কতকগুলি ভদ্রসন্তান হঠাৎ সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে একেবারে নিঃস্বার্থ পরোপকারে লেগে গেছেন, নিজেরা বুদ্ধদেব, যীশুখ্রীস্ট হয়ে গেছেন, স্থির করেছেন, এক গালে চড় খেলে আর এক গাল পেতে দেবেন। গাল তাদের এবং সে সহিষ্ণুতা থাকে, পেতে দিন, আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই, কিন্তু সেই জোরে ত এ জোর প্রতিপন্ন হয় না বাবা যে, অপরের সম্পত্তি নিয়ে তারা যা খুশি তাই করতে পারেন। কেমন করে যেন তাদের বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, যাদের কিছু আছে, তাদের ক্ষতি করতে পারলেই যাদের কিছু নেই তাদের পরম উপকার হয়ে যায়।

কমলকিরণ বোধ করি আর থাকিতে পারিলেন না, কহিলেন—এই যেমন বাবার গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন ভেঙ্গে দেওয়া।

আলেখ্য কহিল—হ্যাঁ, কিন্তু এগুলো সহ্য করে যাওয়াই বোধ হয় কর্তব্য নয়।

কমলকিরণ কহিলেন—বাবারও ঠিক তাই মত।

উৎসাহ পাইয়া আলেখ্যের কণ্ঠস্বর অধিকতর তীব্র হইয়া উঠিল। কহিল—কিন্তু বিপদ হয়েছে এই যে, বাবার সে মত নয়। কিন্তু তুমি ত জান বাবা, এতকাল জমিদারির তুমি কোন খবর রাখনি। সমস্ত সিস্টেমটা একেবারে মরচে ধরে গেছে। সেইসব পরিষ্কার করতে গিয়ে যদি কেউ আত্মহত্যা করে বসে, সে কি আমার অপরাধ? কিন্তু সমস্ত আমার ঘাড়ে তুলে দিয়ে যারা হৈহৈ ক’রে বেড়াচ্ছে, আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারিনে—না বাবা, হয় তুমি সত্যিই আমাকে ভার দাও, না হয়, যা ছিল তাই থাক, আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানে আবার ফিরে যাই।

এ অভিযোগ যে কাহার উপর, তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। সাহেব বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিলেন এবং ক্ষুণ্ণস্বরে কহিলেন—কিন্তু অমরনাথ ত এ প্রকৃতির লোক নয় আলো! বরঞ্চ, আমি যেন তার কথার ভাবে বুঝলাম—

তাঁহার কথাটা শেষ হইল না, কমলকিরণ বলিয়া উঠিলেন—রাদার আমার মনে হয় মিস্টার রে, তিনিই জ্যাস্ট্‌ দি ম্যান্‌—এইসব পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত ভট্‌চায্যি বামুনগুলো—তোমার কি মনে হয় ইন্দু? ঠিক না—এই বলিয়া তিনি আলেখ্যের মুখের প্রতি চাহিয়া তাঁহার অসমাপ্ত বাক্য এইভাবেই শেষ করিলেন।

উত্তর-প্রত্যুত্তরের যে প্রবাহটা এতক্ষণ অনর্গল বহিয়া আসিতেছিল এইখানে তাহাতে বাধা পড়িল। কমলকিরণের বাক্য ও ইঙ্গিতের সমতা রক্ষা করিয়া আলেখ্যের মুখ দিয়া যাহা বাহির হইবে বলিয়া সকলে প্রত্যাশা করিল, তাহা বাহির হইল না। কারণ, অমরনাথ লোকটিকে পল্লীগ্রামের ব্রাহ্মণ বলিয়া গালাগালি দেওয়াও যদি বা চলে, অশিক্ষিত বলা চলে না। অন্ততঃ, শিক্ষার যে-সকল ট্রেডমার্ক, ছাপছোপ ভদ্রসমাজে প্রচলিত, তাহার অনেকগুলিই যে ওই লোকটির গায়ে ছাপ দেওয়া আছে, আলেখ্য তাহা জানিত। আরও একটা কথা এই যে, গাঙ্গুলী-মহাশয়ের আত্মহত্যায় বিচলিত ও ক্ষুব্ধ হইয়া গ্রামের আর যাহারাই কেননা আন্দোলন করিয়া থাকুক, অমরনাথ করে নাই।

এ কথা শুধু সে তাহার নিজের মুখ হইতে নয়, অপরের মুখ হইতেও শুনিয়াছিল। স্বর্গীয় গাঙ্গুলীর দুর্ভাগ্য ও দুঃস্থ পরিবারের জন্য অমরনাথ অনেক করিয়াছে, কিন্তু আলেখ্যের বিরুদ্ধে বিষ ছড়াইবার প্রতিকূলেও সে কম যত্ন করে নাই। এ কথা সত্য, এবং সত্য বলিয়া আলেখ্যের নিজেরও বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, কিন্তু এখন ঝোঁকের উপর কথাটা যখন আর একপ্রকার দাঁড়াইল, বিরক্তির মাত্রাধিক্যে এই অনুপস্থিত লোকটির স্কন্ধে অপরাধের বোঝা চাপাইবার অশোভন উদ্যমে একটা মিথ্যা ভারও যখন চাপিয়া গেল, তখন তাহাকে মিথ্যা জানিয়াও আলেখ্য প্রতিবাদ করিতে পারিল না।

স্পষ্টই বুঝা গেল, সাহেব অন্তরে বেদনা বোধ করিলেন, কিন্তু শক্ত কথা সহজে তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইত না, মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে শুধু কহিলেন—তাই ত, এ কাজটা তার ভাল হয়নি। কিন্তু সাধারণতঃ এ রকম সে করে না।

কমলকিরণ কহিলেন—সাধারণতঃ, বাবার মোটরের কাচও লোকে ভাঙে না মিস্টার রে।

সাহেব বলিলেন—হুঁ।

কমলকিরণ কহিলেন—আমার মনে হয়, আলেখ্য যা বলছিলেন, এদের পরের উপকার, অর্থাৎ অপরের অপকার করার এ্যাক্টিভিটি একটু সংযত করে আনা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। কোন একটা এফেক্টিভ চেক—

সাহেব অন্যমনস্কভাবে বলিলেন—হুঁ, প্রয়োজন হলে করতেই হবে বৈ কি।

কমলকিরণ বলিলেন—আমাকে ক্ষমা করবেন মিস্টার রে, কিন্তু আপনি নিজে জমিদার হলেও অনেক বিষয়ে ইনডিফারেন্ট; আমি কয়েকটা বড় এস্টেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে একটা ব্যাপার সর্বত্রই ওয়াচ্‌ করে যাচ্ছি! কতকগুলো স্বদেশী ছাপমারা প্যাট্রিয়টের পেশাই হয়ে দাঁড়িয়েছে জমিদার ও প্রজার মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দেওয়া। বলশেভিক প্রোপাগান্ডা ও তাদের টাকাই হচ্ছে এর মূলে। আপনি নিশ্চয় জানবেন মিস্টার রে, গভর্নমেন্ট এমন অনেক কথাই জানে, যা এদেশের জমিদাররা ড্রিমও করে না। গোড়াতেই বিশেষ একটু সচেতন না হলে সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়, আপনি নিশ্চয় জানবেন।—এই বলিয়া দুশ্চিন্তায় মুখ কালো করিয়া তিনি অপর দুইটি শ্রোতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।

কিন্তু জমিদারি যাঁহার, তাঁহার মুখে আশঙ্কার কোন চিহ্ন প্রকাশ পাইল না, শান্তভাবে তিনি বলিলেন—পশ্চিমের ব্যাপার আমি ঠিক জানিনে বটে, কিন্তু আমাদের এই বাঙলাদেশে রাজা-প্রজার সম্বন্ধ একটু অন্য রকমের, কমল! কিছু করা যদি তোমরা দরকার বোঝ, কর, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ভয় পাবার কিছু নেই।

কমল প্রতিবাদ করিয়া প্রশ্ন করিলেন—পঁচিশ বৎসর পূর্বে যা ছিল, আজও ঠিক তাই আছে, কোন চেঞ্জ হয়নি, এ আপনি কি করে মনে করছেন?

সাহেব কহিলেন—চেঞ্জ হয়নি, এ ত আমি বলিনি।

কমল কহিলেন, আমিও ত ঠিক সেই ভয়ের কথাই বলছি মিস্টার রে।

সাহেব হাসিলেন। বলিলেন—কমল, শিক্ষার গুণে হোক, সময়ের গুণে হোক, জমিদারদের অত্যাচারের ফলে হোক, দেশের প্রজাদের মধ্যে যদি এতবড় পরিবর্তনই এসে থাকে, জমিদার তারা চায় না, দু-দিন আগে হোক, পরে হোক, তাদের যেতেই হবে, তোমরা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু শুধু যদি আমার এই ছোট্ট জমিদারিটুকুর কথাই বল, তাহলে এই কথাটা আমার শুনে রাখ যে, প্রজাদের আমি বাস্তবিক ভালবাসি। জমিদার হিসাবে নিজে কখনও অত্যাচার করিনি, কর্মচারীদের সাধ্যমত করতে দিইনি। এ তারা জানে। আলো এই সম্বন্ধটুকুই যদি ভবিষ্যতে বজায় রেখে যেতে পারে ত তার ভয় নেই। কিন্তু আমার যে আবার রাত হয়ে যাচ্ছে—

এতক্ষণে বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে আলেখ্য একটি কথাও যোগ করে নাই, কিন্তু পিতা উঠিবার উপক্রম করিতেই সে বলিয়া উঠিল—বাবা, তুমি কি আমাকে লক্ষ্য করে এ কথা বললে?

পিতা সহাস্যে কহিলেন—লক্ষ্য করে কেন মা, তোমার নাম ধরেই ত এ কথা বললাম।

কন্যা জিজ্ঞাসা করিল—কতবার আমাদের প্রাপ্য খাজনা তুমি মাপ করে দিয়েছ, বাবা, একি তোমার মনে আছে?

আছে বৈ কি মা।

তুমি কি আমাকে প্রজাদের সেই অন্যায়ের প্রশ্রয় দিতে বল বাবা?

সাহেব সস্নেহকণ্ঠে ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন—প্রাপ্য মানেই ন্যায্য নয় আলো—আমাদের যা প্রাপ্য, প্রজাদের তা ন্যায্য দেয় না-ও হতে পারে। আমি সেইটুকুই কেবল তাদের ক্ষমা করে এসেছি।

কমলকিরণ ইহার তাৎপর্য গ্রহণ করিতে পারিল না, কিন্তু আলেখ্য পারিল। ছেলেবেলা হইতেই পিতাকে সে অত্যন্ত ভালবাসিত।

মা তাঁহাকে দুর্বল বলিয়া যতই অবজ্ঞা করিতেন, ততই সে তাঁহাকে শ্রদ্ধা করিবার পথ খুঁজিয়া ফিরিত। ঘরের ও বাহিরের উৎপীড়ন ও অপমান হইতে তাঁহাকে অহরহ রক্ষা করিবার একান্ত চেষ্টায় এই শক্তিহীন মানুষটিকে একদিন সে সত্য সত্যই চিনিতে পারিয়াছিল! তাঁহার চিন্তা ও বাক্যের কোন অর্থ বুঝিতেই তাহার কোনদিন বিলম্ব ঘটিত না। আজিও বুঝিয়াও প্রশ্ন করিল—বাবা, এই কি তোমার আদেশ? এমনিভাবেই কি চলতে আমাকে তুমি উপদেশ দাও?

সাহেব তৎক্ষণাৎ বারংবার মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন—না মা, এ আমার আদেশ নয়, তোমার পিতার উপদেশও নয়। এ সংসারে সবাই একভাবে চলতে পারে না—শক্তির অভাবেও বটে, প্রবৃত্তির অভাবেও বটে। যদি পারো, মনে মনে খুশী হব, এইটুকুই শুধু তোমাকে বলতে পারি।

আলেখ্য কহিল—বাবা, আমার ভারী ইচ্ছে, কোথায় কি আছে, সব দেখে আসি। যেখানে হাঙ্গামা বেধেছে, নিজে একবার সেখানে যাই।

সাহেব সম্মতি দিয়া কহিলেন—বেশ ত মা, কালই আমি ম্যানেজারবাবুকে ডেকে সমস্ত উদ্যোগ করে দিতে বলবো। নদীতে এখন জল আছে, হয়ত শেষ পর্যন্তই বজরা যেতে পারবে।

ইন্দু এতক্ষণ কোন কথা কহে নাই, জল-যাত্রার প্রস্তাবে প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, বলিল—আমিও তোমার সঙ্গে যাবো, আলো। কমলের প্রতি চাহিয়া কহিল, দাদা, তোমার কি এ সময়ে খুব জরুরী কাজ আছে? দু-চারদিন থেকে যেতে পারবে না?

কেন বল ত?

ইন্দু বলিল—আমাদের সঙ্গে যেতে। ছোট্ট নদী দিয়ে নৌকোর মধ্যে যাওয়া-আসা, এ ত তোমার কক্ষণো হয়নি দাদা। যাবে?

কমলকিরণ আলেখ্যের মুখের ভাব লক্ষ্য করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু সে তখন অন্যত্র চাহিয়াছিল। মুখ দেখা গেল না, কিন্তু ভগিনীর আবেদনের ইঙ্গিত উপলব্ধি করিল। বুকের মধ্যে তরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, কিন্তু প্রাণপণে তাহা সংবরণ করিয়া নিস্পৃহকন্ঠে কহিল—দেরি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু—আচ্ছা বেশ, না হয় যাবো।

সাহেব ধীরে ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন— সেই ভাল। কিন্তু অমরনাথও শুনলাম যাবে; দেখো, যেন একটা বিবাদ না হয়। কিন্তু আমি এখন উঠি ইন্দু, গুড্‌নাইট। এই বলিয়া চিন্তান্বিত মুখে আস্তে আস্তে তিনি ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *