জাগরণ – ০৪

চার

সন্ধ্যা সবেমাত্র উত্তীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু চাকররা তখন পর্যন্ত ঘরে আলো দিয়া যায় নাই। শ্রান্তি, পরিতাপ ও দুশ্চিন্তার গুরুভারে আলেখ্য সেইখানেই চুপ করিয়া বসিয়া ছিল, উপরে নিজের ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িবার জোরটুকুও যেন তাহাতে ছিল না, এমন সময়ে একজন অতিশয় বৃদ্ধগোছের ভদ্রলোক বলা নাই, কওয়া নাই, দ্বারের পর্দা সরাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। আলেখ্য বিস্মিত ও বিরক্তচিত্তে সোজা হইয়া বসিয়া কহিল—কে?

বৃদ্ধটি সম্মুখের একখানি চেয়ার সযত্নে ও সাবধানে টানিয়া লইয়া বসিতে বসিতে কহিলেন—আমার নাম নিমাই ভট্টাচার্য, দূরসম্পর্কে অমরনাথের আমি ঠাকুরদাদা হই,—আর শুধু অমরনাথের বলি কেন, এ অঞ্চলে সকলেরই আমি ঠাকুর্দা, আমার চেয়ে বুড়ো আর এদিকে কেউ নেই। তোমার বাবা রাধামাধবও ছেলেবেলায় আমাকে খুড়ো বলে ডাকতেন। কাশীতে ছিলাম, হঠাৎ যে গরম পড়েছে, টিকতে পারলাম না। যে যাই বলুক দিদি, বাঙ্গালাদেশের মত দেশ আর নেই—যেন স্বর্গ। এখানে এসে কেমন আছ? বাবা ভাল আছেন?

আলেখ্য ঘাড় নাড়িয়া কহিল—হাঁ, তিনি ভাল আছেন। আপনার কি প্রয়োজন? বাবা কিন্তু আজ বাড়ি নেই।

নিমাই বলিলেন—কিন্তু তাঁর ত আজ ফেরবার কথা ছিল?

আলেখ্য কহিল—ছিল, কিন্তু যে কারণেই হোক ফিরতে পারেন নি। কাল তিনি এলে আপনি দেখা করবেন।

বৃদ্ধ আলেখ্যের মুখের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন—না দিদি, আমার বেশ সচ্ছল অবস্থা, আমি ভিক্ষের জন্যে আসিনি। অমরনাথের মুখে শুনেছি, তুমি নাকি বিলেত পর্যন্ত গেছ। ভাল লেখাপড়া-জানা মেয়েদের আমি বড় ভালবাসি। তাদের সঙ্গে দুটো কথা কইবার আমার ভারী লোভ, কিন্তু কখনও সে সুযোগ পাইনি। তারা আমার মত একজন নগণ্য বুড়োমানুষের সঙ্গে কথা কইতে চাইবেই বা কেন? তাই ভাবলাম, ঘরের কাছে যদি এতবড় সুবিধে পাওয়াই গেছে ত ছাড়া হবে না। ক’টা দিনই বা বাঁচবো, কিন্তু বুড়োর উপর তুমি ত মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছ, না দিদি?

আলেখ্য মনে মনে লজ্জা পাইয়া সবিনয়ে কহিল—আজ্ঞে না; শুধু আজ বড় ক্লান্ত ছিলাম বলেই নিমাই বলিলেন সে আমি শুনেছি দিদি, অমরনাথ আমার কাছে সমস্ত বলেই তবে গেছেন। বড় ভাল ছেলে, এতখানি বয়সে তার আর জোড়া কোথাও দেখলাম না। পাগলা দুঃখের জ্বালা সইতে পারলে না, আপনাকে হত্যা করে ফেললে,—আহা! তাই ভাবি, দিদি, ভগবান শক্তি হরণ করে নিলে মানুষ কি-ই বা! আসবার পথে তাদের বাড়ির পাশ দিয়েই আসছিলাম, শ্মশান থেকে এখনও তারা ফেরেনি, ভেতরে মেয়েটা ডাক ছেড়ে চেঁচাচ্ছে,—আহা! সংসারে লঘু পাপে কত গুরু দণ্ডই না হয়! জিনিস হয়ে বয়ে চুকে যায়, কিন্তু দাগ তার সারা জীবনে মিলোয় না। ভাবলাম, একবার ভেতরে ঢুকে গিয়ে বলি, দুর্গা, অভিসম্পাত করে আর লাভ কি মা, সে যদি জানত, এতবড় ভয়ানক কাণ্ড হবে, তা হলে কি কখনও তোমার বাবাকে জবাব দিতে পারতো? তাকে আমি চিনিনে, তবু বলছি কখ্‌খনো না। যা হবার তা হয়েছে, কিন্তু যে বেঁচে রইল, তার মনস্তাপ কি কখনও ঘুচবে! এ কলঙ্কের দাগে তাকে চিরকাল দাগী হয়ে থাকতে হবে। অথচ তলিয়ে দেখলে এ ত সত্য নয়। তোমার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি দিদি, তার মেয়ের চেয়ে এ দুর্ঘটনা তোমাকে ত কম আঘাত করেনি!

এই আগন্তুকের অবাঞ্ছিত আগমনে আলেখ্যের পীড়িত চিত্ত তিক্ততায় পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার মন্তব্য শেষ হইলে সে সবিস্ময়ে ক্ষণকাল তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল—আপনাকে কে বললে আমি আঘাত পেয়েছি?

বৃদ্ধ কহিলেন—অমরনাথ আমাকে ত তাই বলে গেলেন।

আলেখ্য তেমনিই আস্তে আস্তে বলিল—অমরনাথবাবুর এরূপ অনুমানের হেতু কি, তা তিনিই জানেন। গাঙ্গুলীমশাই সম্পূর্ণ কাজের বার হয়ে গিয়েছিলেন। আমার জমিদারি সুশৃঙ্খলায় চালাবার চেষ্টা করা ত আমার অপরাধ নয়।

নিমাই বলিলেন—তোমার অপরাধের উল্লেখ ত সে একবারও করেনি দিদি।

আলেখ্য প্রত্যুত্তরে শুধু কহিল—আমি আমার কর্তব্য করেছিলাম মাত্র।

তাহার জবাব শুনিয়া বৃদ্ধ অন্ধকারে ঠাহর করিয়া তাহার মুখের চেহারা লক্ষ্য করিবার চেষ্টা করিয়া শেষে একটুখানি হাসিলেন।

বলিলেন—কর্তব্যের কি বাঁধাধরা কোন হিসেব আছে ভাই, যে, এই শক্ত সোজা জবাবটা দিয়েই এ সত্তর বছরের বুড়োটাকে ঠকিয়ে দেবে? বুদ্ধিহত অক্ষম এই যে দুঃখী মানুষটা তোমার অন্নেই চিরদিন প্রতিপালিত হয়ে অবশেষে তোমার ভয়েই কূল-কিনারা না পেয়ে নিজের প্রাণটাকে হত্যা করে সংসার থেকে বিদায় নিলে, কর্তব্যের দোহাই দিয়ে কি এর দুঃখকে ঠেকানো যায় দিদি? নিরুপায় মেয়েটা তার শোকে চেঁচাচ্ছে, তার উপবাসী নাতিটা গেছে কাঁদতে কাঁদতে শ্মশানে—এর দুঃখের কি আদি-অন্ত আছে? আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি দিদি, একলা ঘরের মধ্যে বসে ব্যথায় তোমার বুক ফেটে যাচ্ছে।—এই বলিয়া বৃদ্ধ উত্তরীয়-প্রান্তে নিজের দুটি আর্দ্র চক্ষু মার্জনা করিতে গিয়া সহসা সম্মুখে শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিলেন। এতক্ষণ আলেখ্য কোনমতে সহিয়াছিল, কিন্তু কথা তাঁহার সম্পূর্ণ শেষ না হইতেই সুমুখের টেব্‌লে সজোরে মাথা রাখিয়া একেবারে হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

বুড়া নিমাই নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন। অসময়ে সান্ত্বনা দিয়া তাহার কান্না থামাইবার চেষ্টামাত্র করিলেন না। মিনিট পাঁচ-ছয় এইভাবে কাটিলে আলেখ্য উঠিয়া বসিয়া নিজের চোখ মুছিতে লাগিল।

এতক্ষণে নিমাই কথা কহিলেন। সস্নেহ মৃদুস্বরে বলিতে লাগিলেন—এ আমি জানতাম দিদি। এ নইলে কিসের শিক্ষা, কিসের লেখাপড়া! এতবড় জমিদারির বোঝা সাধ্য কি তোমার বইতে পার!

কোন কারণে কাহারও কাছেই বোধ করি এমন করিয়া আলেখ্য আপনার দুর্বলতা প্রকাশ করিতে পারিত না, কিন্তু আজ সে এই অপরিচিতের কাছে নিজে মর্যাদা বাঁচাইবার এতটুকু চেষ্টা করিল না। হয়ত সে শক্তিও তাহার ছিল না। অশ্রুরুদ্ধ ভগ্নস্বরে সহসা বলিয়া উঠিল—আপনাদের দেশে এসেছিলাম আমি থাকতে, কিন্তু এর পরে এখানে মুখ দেখাতেও পারব না।

বৃদ্ধ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন—এ লজ্জা যে তোমার মিথ্যে, এ মিথ্যে সান্ত্বনা তোমাকে আমি দেব না। কিন্তু সমস্ত যদি চিরকালের মত ত্যাগ করে যেতে পারো, তবেই এ যাওয়ার অর্থ হবে, নইলে যতদূরেই কেন যাও না, এই রস শোষণ করেই যদি তোমাকে জীবনধারণ করতে হয় ত আর একজনের জীবন-হরণের পাপ থেকে তুমি কোনদিন মুক্তি পাবে না। এখানকার লজ্জা সেখানে চাপা দিয়েই যদি মুখ দেখাতে হয় দিদি, আমি বলি, তা হলে লোক ঠকিয়ে আর কাজ নেই। তুমি এখানেই থাকো।

আলেখ্য বলিল—কিন্তু আমি যে সত্যিকার অপরাধ কিছু করিনি, এখানকার লোকে ত তা বুঝতে চাইবে না।

নিমাই কহিলেন—বুঝতে চাওয়া ত উচিতও নয়।

আলেখ্য সহসা একটু কঠিন হইয়া বলিল—এ কথা আমি কোনমতেই স্বীকার করতে পারিনে।

বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ তাহার মুখের উপরেই জবাব দিলেন—আজ হয়ত পার না, কিন্তু আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি, আর একদিন যেন এ সত্য সবিনয়ে স্বীকার করার মত সাহস তোমার হয়।

ভৃত্য বাতি দিয়া গেল। সেই আলোকের সম্মুখে আলেখ্য কিছুতেই মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিল না। নিমাই কহিতে লাগিলেন—তুমি শিক্ষিতা মেয়ে, অনেক দূর থেকে তোমাকে আমি দেখতে এসেছি। যে শিক্ষা তুমি পেয়েছ, হয়ত সে কেবল এই কথাই তোমাকে শিখাতে চেয়েছে যে, এ দুনিয়ায় যোগ্যতাটাই একমাত্র এবং অদ্বিতীয়। কিন্তু আমাদের এই সোনার দেশ কোনদিন কিছুতে এ কথা স্বীকার করেনি। এদেশে অক্ষম, দুর্বল, একান্ত অযোগ্যেরও দুটো ভাত-কাপড়ের দাবী আছে। অযোগ্যতার অপরাধে বাঁচার অধিকার থেকে সংসারে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারে না; কিন্তু গাঙ্গুলীকে তাই তুমি করলে। তাদের সকল দুঃখের ইতিহাস শুনেও তোমার খাতা লেখবার যোগ্যতা দিয়েই শুধু তার প্রাণের মূল্য ধার্য করে দিলে। তুমি স্থির করলে, যে তোমার খাতা লিখতে আর পারে না, তার খাওয়া-পরার ওই ক’টা টাকা খরচ না হয়ে তোমার সিন্দুকে জমা হওয়াই দরকার। এই না দিদি?

আলেখ্যর কণ্ঠস্বর পুনরায় রুদ্ধ হইয়া আসিল, কহিল—আমি কখ্‌খনো এত কথা ভেবে করিনি। আমি কিছুতেই এত হীন নই।

নিমাই বলিলেন—সে আমি জানি, তাই ত তোমার শিক্ষার কথা আমি বলছিলাম দিদি। অমরনাথ বলছিলেন, তোমার জামা-কাপড়-জুতো-মোজার খরচ,—তিনি বলছিলেন, তোমার আয়না-চিরুনি-সাবান-গন্ধের অত্যন্ত ব্যয়; একজনের ভাত-কাপড়ের প্রয়োজনের চেয়ে আর একজনের এইগুলোর প্রয়োজন যে কোন অবস্থাতেই বড় হতে পারে, এ কুশিক্ষা যদি কোথাও পেয়ে থাক ত সে তোমাকে আজ ভুলতে হবে। যারা জন্মেছে, তারা যত দুর্বল, যত অক্ষম, যত পীড়িতই হোক, বাঁচবার অধিকারে তাদের কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না, এ সত্য তোমাকে শিখতেই হবে।

এত বড় জমিদারির দৈবাৎ আজ তুমি মালিক, তাই তোমার বিলাসিতার উপকরণ যোগাতে আর একজনকে অনাহারে আত্মহত্যা করতে হবে, এ ত হতেই পারে না; এবং যে সমাজবিধানে এত বড় অন্যায় করাও তোমার পক্ষে আজ সহজ হতে পারলে, এ বিধান যতদিনেরই প্রাচীন হোক, কিছুতেই এটা মানুষের সমাজের চূড়ান্ত এবং শেষ বিধান হতে পারে না। আমি বুড়ো হয়েছি, সেদিন চোখে দেখে যাবার আমার সময় হবে না, কিন্তু এ কথা তুমি নিশ্চয় জেনো দিদি, অক্ষম অকর্মণ্য বলে আজ যাদের তোমরা বিচারের ভান করছ, তাদেরই ছেলেপুলেদের কাছে আর একদিন তোমাদেরই কর্মপটুতার জবাবদিহি করতে হবে। সেদিন মনুষ্যত্বের আদালতে কেবল জমিদারির মালিক বলেই আরজি পেশ করা চলবে না।

আলেখ্য তাঁহার কথাগুলি যে বিশ্বাস করিল, তাহা নয়। বরঞ্চ, আর কোন সময়ে এই সকল অপ্রিয় কঠিন আলোচনায় সে মনে মনে ভারী রাগ করিত। কিন্তু আজিকার দিনে কতক কৌতুহলবশে, কতক বা লজ্জায় ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করিল—প্রজারা কি বিদ্রোহ করবে আপনি বলছেন? তাদের কি সব এইরকম মনের ভাব?

নিমাই কহিলেন—দিদি, বিদ্রোহ শব্দটা শুনতে খারাপ, অনেকেই ওটা পছন্দ করে না; এবং মনোভাব জিনিসটা অত্যন্ত অস্থির বস্তু। ওর নিজের কোন ঠাঁই নেই, অর্থাৎ ওটা নিছক অবস্থা এবং শিক্ষার ফল। এরা কাঁধ মিলিয়ে দ্রুতবেগে যেদিকে চলেছে, আমি শুধু তার দিকেই তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এদের ঠেকাতে না পারলে ওকেও ঠেকাতে পারা যাবে না। জগতে বুদ্ধিমানরা এতকাল তাদের আফিং খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল, আজ হঠাৎ তাদের ক্ষিদের জ্বালায় ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পেট না ভরলে আর যে তারা নীতির বচন এবং পুরানো আইন-কানুনের চোখ-রাঙানিতে থামবে এমন ত ভরসা হয় না দিদি।

আলেখ্য কিছুক্ষণ নীরবে চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল—আপনি কি বলেন এ-সমস্তই তবে বিলাতী শিক্ষার দোষ?

বৃদ্ধ কহিলেন—আমি দোষের কথা ত একবারও বলিনি দিদি। আমি বলি, এ তার ফল।

আলেখ্য কহিল—কুফল।

বৃদ্ধ হাসিলেন। বলিলেন—কথাটা একটু গুলিয়ে গেল ভাই। তা যাক। আমি সুফল-কুফলের উল্লেখ করিনি, শুধু ফলের কথাই বলেছিলাম।

ভাল, সেই কথাই যদি উঠলো, তবে বলি দিদি, আমার জীবনেই আমি দেখেছি, ছ’টা পয়সা ও এক পাতা দোক্তার বদলে একটা লোক সারাদিন মজুরি করে তার পরিবার প্রতিপালন করেছে। দুঃখে নয়, সচ্ছলে—আনন্দের সঙ্গে। দেশে টাকা ছিল না, কিন্তু প্রচুর খাদ্য ছিল। রেল ছিল না, জাহাজ ছিল না—বিদেশী সাহেব আর ততোধিক বিদেশী মারবাড়ীতে মিলে দেশের অন্ন বিদেশে চালান দিয়ে তখন সহস্র কোটি লোকের জীবন-সমস্যা এমন দুঃসহ, এমন ভীষণ জটিল করে তোলবার সুযোগ পেত না। তখন ক্ষুধাতুরের মুখের গ্রাস জুয়ার আড্ডার মধ্যে দিয়ে এমন করে সোনা-রূপোয় রূপান্তরিত হয়ে যোগ্যতমের সিন্দুকে গিয়ে উপস্থিত হ’ত না।—বলিতে বলিতে হঠাৎ বৃদ্ধের দুই চক্ষু সজল হইয়া উঠিল, কহিলেন—দিদি, আমার ছেলেবেলায় অক্ষম অযোগ্যের বেঁচে থাকবার অধিকার নিয়ে এমন নিষ্ঠুর পরীক্ষা ছিল না। আজ একমুঠো শাকান্নও দেশে নষ্ট হবার নয়, বুদ্ধিমান ও ব্যবসায়ীতে মিলে তাঁবার টুকরোয় তাকে দাঁড় করাতে দেরি করে না—অর্থবিজ্ঞানের পণ্ডিতরা বলবেন, এর চেয়ে মঙ্গল আর কি আছে। কিন্তু আমার মত যাকে গ্রামে গ্রামে দুঃখীদের মাঝখানে ঘুরে বেড়াতে হয়, সেই জানে মঙ্গল এতে কত!

এই বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর ও মুখের ভাবে আলেখ্যের নিজের চিত্তও করুণ হইয়া আসিল, কিন্তু সে আপনাকে সামলাইয়া লইয়া প্রশ্ন করিল—ট্রেন এবং স্টীমারকে আপনি ভাল মনে করেন না?

বৃদ্ধ হাসিয়া ফেলিলেন। কহিলেন—কোন কিছুর ভাল-মন্দই কি এমন বিচ্ছিন্ন করে নির্দেশ করা যায় দিদি? আর সকলের সঙ্গে যুক্ত করে, সামঞ্জস্য করে তবেই তার ভাল-মন্দের সত্যকার বিচার হয়।

আলেখ্যও হাসিল, কহিল—ওটা শুধু আপনার কথার মারপ্যাঁচ। আসল কথা, আপনাদের পণ্ডিত-সমাজ বিলাতী শিক্ষার অত্যন্ত প্রতিকূলে। ওদের যা-কিছু সমস্তই মন্দ এবং আপনাদের যা-কিছু সমস্তই ভাল, এই আপনাদের বদ্ধমূল ধারণা। যতক্ষণ না তাদের বিদ্যা, তাদের বিজ্ঞান আপনারা আয়ত্ত করবেন, ততক্ষণ কোনমতেই নিরপেক্ষ বিচার করতে পারবেন না।

বৃদ্ধ ক্ষণকাল নতমুখে চিন্তা করিয়া চোখ তুলিয়া চাহিলেন, বলিলেন—দিদি, নিজের মুখে নিজের পরিচয় দিতে সঙ্কোচ বোধ হয়, কিন্তু তোমার কথায় মনে হয় যেন, আচরণে আমার আত্মগোপনের অপরাধ হচ্ছে। সেকালে আমি একজন বড় অধ্যাপক ছিলাম। অমরনাথ আমারই ছাত্র। আমার কাছ থেকেই সে এম. এ. পাস করে; তার সংস্কৃত শিক্ষার গুরুও আমি। তুমি যে বিদ্যা ও বিজ্ঞানের কথা বললে, তা আয়ত্ত করতে পারিনি, কিন্তু একেবারে অনভিজ্ঞ বললেও মিথ্যাভাষণের পাপ হবে।

কথাটা শুনিয়া আলেখ্য চমকিয়া উঠিল, তাহাকে কে যেন মারিল। সেই তাহার আরক্ত মুখের প্রতি বৃদ্ধ নিঃশব্দে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন—আজ তুমি শ্রান্ত, তুমি উপরে তোমার ঘরে যাও দিদি, অমরনাথ কোন বিপদে যদি না পড়ে থাকে ত কাল এসে দু’জনে আবার দেখা করব। আমিও চললাম,—এই বলিয়া তিনি গাত্রোত্থান করিয়া পুনশ্চ কি একটা যেন বলিতে গেলেন, কিন্তু সহসা আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন। ( ‘মাসিক বসুমতী’, চৈত্র ১৩৩০ )

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *