ছয়. আরণ্যক সাহিত্য
প্রথাগত ভাবে বৈদিক সাহিত্যকে যে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়— কর্মকাণ্ড (সংহিতা ও ব্রাহ্মণ) এবং জ্ঞানকাণ্ড (আরণ্যক ও উপনিষদ)— সেই বর্গীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বেদের অন্য একটি সংজ্ঞাও স্মরণ করতে পারি: ‘মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্’। এখানে বেদের দুটি ভাগ কল্পিত হয়েছে, মন্ত্র (বা সংহিতা) ও ব্রাহ্মণ। এই বিভাজনে আপাতদৃষ্টিতে আরণ্যক ও উপনিষদ উল্লেখিত হয়নি। বস্তুত দ্বিতীয় বর্গীকরণে বিষয়বস্তু অপেক্ষা আঙ্গিকের উপরেই যেন অধিক গুরুত্ব অরোপিত হয়েছে। কেননা, সংহিতা নিঃসংশয়ে একটি সাহিত্যমাধ্যম; পরবর্তী রচনাগুলির চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার কোনও সাদৃশ্য নেই। ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক কিংবা আরণ্যক ও উপনিষদ কিংবা ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের মধ্যে আমরা তেমন কোনও স্পষ্ট রচনাভঙ্গিগত ভেদরেখা কল্পনা করতে পারি না; মাঝে মাঝে এই তিন শ্রেণির রচনা পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে মিশ্রিত হয়ে পরস্পরের সীমা লঙ্ঘন করেছে। ফলে, মাধ্যমগত বিন্যাস অনুযায়ী আমাদের নিকট দুটি প্রধান ও স্পষ্ট শ্রেণি প্রকট হয়েছে— সংহিতা ও সংহিতা-পরবর্তী সাহিত্য, যাতে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ ইচ্ছা মতো সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে, বলা দরকার সংহিতা পরবর্তী সাহিত্যই অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে দুটি ভিন্ন যুগ, অঞ্চল বা ধর্মীয় দর্শনের মূল প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রত্যেক সংহিতার এক বা একাধিক পৃথক ব্রাহ্মণ রয়েছে, কিন্তু প্রত্যেক সংহিতার কিন্তু নিজস্ব আরণ্যক বা উপনিষদ নেই। কয়েকটি গ্রন্থ ব্রাহ্মণ অংশেই সমাপ্ত, আবার কয়েকটি গ্রন্থের সমাপ্তি ঘটেছে আরণ্যকে। তেমনই কয়েকটি সংহিতার অব্যবহিত পরবর্তী অংশ হল উপনিষদ, আবার কয়েকটিতে কোনও আরণ্যকই নেই। শুধুমাত্র তিনটি ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ— সবই পাওয়া যাচ্ছে: ঋগ্বেদের ঐতরেয় ও কৌষীতকি এবং যজুর্বেদের তৈত্তিরীয়। সুতরাং যে শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী রচনার প্রধান এবং সর্বতো ভাবে পরস্পর-নিরপেক্ষ দুটি মাধ্যম অর্থাৎ সংহিতা ও ব্রাহ্মণকে নির্দেশ করা হয়েছে, তারই যুক্তিযুক্ততা অবশ্যই স্বীকার করা উচিত। শেষোক্ত সাহিত্যরীতির তরলায়িত অবস্থা একটি গ্রন্থের যৌগিক নামকরণে ব্যক্ত হয়েছে: কৌষীতকি ব্রাহ্মণোপণিষদ্। লক্ষণীয় এই যে, এতে আরণ্যক উল্লেখিত হয়নি। তেমনি জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণেও আরণ্যকের উল্লখ নেই; তা ছাড়া ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটি এখানে উপনিষদের পরে ব্যবহৃত হয়েছে। এ সব থেকে সেই স্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যখন লেখকেরা নতুন ধরনের সাহিত্যিক প্রবণতা সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু পৃথক মাধ্যমরূপে নতুন রচনাগুলি তখনও নির্দেশিত বা বর্গীকৃত হয়নি। আরণ্যক নামটি সম্ভবত শুধু রচনার স্থানগত তাৎপর্যই বহন করছে; অরণ্যভূমি, যা বহু অনুপুঙ্খযুক্ত সুদীর্ঘ যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার পক্ষে মোটেই উপযুক্ত ছিল না, সেখানে অবসরপ্রাপ্ত গৃহস্থদের উপযুক্ত ন্যূনতম কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত, যার মধ্যে সম্ভবত ছিল অগ্নিহোত্র ও কিছু কিছু সরল গার্হস্থ্য অনুষ্ঠান।
কারও কারও মতে শুধু অরণ্যে বসবাসকারী ব্যক্তি অর্থেই পাণিনি আরণ্যক শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ‘অরণ্যে রচিত গ্রন্থ’ অর্থে আরণ্যক শব্দের প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন কাত্যায়ন— আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ওই সময়ের কাছাকাছি আরণ্যক পৃথক প্রকাশমাধ্যমরূপে স্বীকৃত হয়ে গিয়েছিল। আঙ্গিক ও মূলভাবের বিচারে আরণ্যক ও উপনিষদকে যুগ পরিবর্তনের সাহিত্য বলে গণ্য করা যায়। আরণ্যকের প্রবণতা অরণ্যভূমির অধিবাসীদের জ্ঞান ও সন্ন্যাসের অন্বেষণের প্রতি, কারণ তখনও স্পষ্ট ভাবে কোনও মতবাদ এরা প্রচার করেনি; অথচ পরবর্তী যুগের উপনিষদে কখনও নতুন মতবাদ প্রকাশের তাগিদ পরিস্ফুট হয়েছে।
আরণ্যকের বিষয়বস্তু
ঐতরেয় আরণ্যকের প্রথম ও শেষ অধ্যায়গুলিতে মহাব্রত অনুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত নয়টি ঋক্ বিবৃত হয়েছে; বিষয়বস্তুর বিচারে অন্তত এই অংশটি ব্রাহ্মণতুল্য। শুধু দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়কেই যথার্থ আরণ্যক লক্ষণযুক্ত বলে গ্রহণ করা যায়। গভীরতার বিচারে দেখা যায় যে, এই আরণ্যক বস্তুত ঐতরেয় ব্রাহ্মণের অন্তর্গত উপবিভাগ ও কাণ্ডমাত্র। যথার্থ ব্রাহ্মণসাহিত্যের ঐতিহ্য অনুযায়ী পাঁচটি অধ্যায়ের মধ্যে তিনটিতে যজ্ঞানুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে।
ঋগ্বেদের অপর আরণ্যকের নাম শাঙ্খায়ন বা কৌষীতকি আরণ্যক। এর পনেরোটি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম দুটিতে মহাব্রত অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে এবং তা ব্রাহ্মণ অংশেরই অন্তর্গত। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে যজ্ঞানুষ্ঠানের তাৎপর্য সম্পর্কে চিত্রগার্গ্য ও শ্বেতকেতুর মধ্যে সংলাপ। চতুর্থ অধ্যায়ে কৌষীতক পৈঙ্গেয় ও শুষ্কভূঙ্গারের মধ্যে একটি সংলাপে একটি সাধারণ বিষয়বস্তু— প্রাণ ও ইন্দ্রিয়সমূহের প্রতিযোগিতা— চিত্রিত হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে প্রতর্দন ও ইন্দ্রের সংলাপ এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে আছে গার্গ্য ও অজাতশত্রুর সংলাপ। শেষ অধ্যায়ের একটি অংশে এই আরণ্যক প্রতীকী বিশ্লেষণের প্রতি প্রবণতার মধ্যে স্পষ্টত নতুন সাহিত্যাদর্শের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছে। বিষয়বস্তুর মধ্যেও ঔপনিষদিক ভাবধারার উন্মেষের আভাস পাওয়া যায়। সপ্তম অধ্যায়ে বিবিধ বিষয়বস্তু, অষ্টম ও নবমে প্রাণের উপাসনা, দশমে আধ্যাত্মিক অগ্নিহোত্র এবং একাদশে প্রজাপতি কর্তৃক পুরুষের মধ্যে দেবতাদের প্রতিষ্ঠা বিবৃত হয়েছে। শেষোক্ত অধ্যায়ে সেই সঙ্গে স্বপ্ন ও অশুভ লক্ষণসমূহ আলোচিত হয়েছে বলে এর পৃথক গুরুত্ব রয়েছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে আশীর্বাদ ও সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে। ত্যাগের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ রয়েছে ত্রয়োদশ অধ্যায়ে। চতুর্দশ অধ্যায়ে বেদাধ্যয়নের মহিমা বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে অবহেলাকারীর উদ্দেশে নিন্দাবাদও বর্ষিত হয়েছে। পঞ্চদশ অধ্যায়ে বহুপ্রজন্ম-ব্যাপী শিক্ষকদের নামের এক সুস্পষ্ট তালিকা আছে। বহু অংশেই আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণসমূহ এবং পরলোক ও প্রেততত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে।
প্রচলিত আরণ্যকগুলির মধ্যে তৃতীয় ও শেষ রচনা হল তৈত্তিরীয় আরণ্যক; এতে এমন কিছু উপাদান আছে যা অন্য দুটি গ্রন্থে পাওয়া যায় না। দশ অধ্যায়ে বিন্যস্ত গ্রন্থটির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নানা ধরনের বিষয়বস্তু বিবৃত করেছে। বিভিন্ন প্রকারের নামের দীর্ঘ তালিকা, প্রতিশব্দ, নৈসর্গিক বস্তুর শ্রেণিবিভাজন এবং স্বাস্থ্য, ধন, সন্তান, পরমায়ু, বিজয় ও স্বর্গলাভের জন্য দেবতাদের কাছে অসংখ্য সংহিতা-জাতীয় প্রার্থনা। এ ছাড়া এতে ধর্মসূত্রের উপযোগী বিষয়বস্তুও খুঁজে পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে জাতিভেদ প্রথা স্বীকৃত সামাজিক সত্য হয়ে উঠেছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যক তিনটি ভিন্ন বর্ণের জন্য এমন সব ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম গ্রথিত করেছে, যার মধ্যে ধর্মসূত্রের প্রত্যক্ষ পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
আরণ্যকের আঙ্গিক
প্রাচীন দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদিত সূক্তগুলি সাধারণ ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পঙ্ক্তিতে গ্রথিত, আহুতি গ্রহণের জন্য সেখানে দেবতাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সর্বত্রই প্রকৃত যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রক্ষিত হয়েছে। অন্যের পক্ষে ক্ষতিকর ইন্দ্রজাল এতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে; চতুর্থ অধ্যায়ের অধিকাংশ স্থানেই ভবিষ্যদ্বাণী, শুভাশুভ লক্ষণ গণনা, ব্যাধি ও স্বপ্ন আলোচিত হয়েছে। তা ছাড়া, লোকায়ত ধর্মের উপাদানলব্ধ অসুর এবং রাক্ষস-রাক্ষসী প্রাধান্য পেয়েছে।
আঙ্গিক ও ভাষাগত বিচারে ঐতরেয় আরণ্যক সম্পূর্ণতই ব্রাহ্মণচরিত্রযুক্ত, যদিও এর বহু আঙ্গিকগত দিক ঋগ্বেদীয় পর্যায় থেকে উদ্ভুত এবং স্পষ্টত এতে সেই সময়ের অভিব্যক্তি ঘটেছে যখন যজ্ঞীয় ধর্ম পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত। রচনার সাধারণ কাঠামো হল কোনও নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক মন্ত্রসমূহের উদ্ধৃতি এবং পরে সেই অনুষ্ঠানের ব্যাখ্যা। উদীচ্য বা উত্তরাঞ্চলের উপভাষার তখনও প্রাধান্য আছে: ‘র’ ধ্বনির বিকল্পরূপে খুব কম ক্ষেত্রেই ‘ল’ ধ্বনির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে মধ্যদেশের উপভাষার প্রভাব বহু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষগোচর। তখনও উপসর্গ ক্রিয়াপদ থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রযুক্ত হয়েছে। ব্রাহ্মণসাহিত্যের ঐতিহ্যনুযায়ী শব্দসমষ্টির পুনরাবৃত্তি তখন পর্যন্ত সাধারণ ভাবে প্রচলিত। কখনও কখনও কয়েকটি নতুন ছন্দও ব্যবহৃত হয়েছে।
শাঙ্খায়ন আরণ্যকের মধ্যে আমরা ব্যাকরণ-সচেতনতার প্রমাণ পাই; ঐতরেয় আরণ্যকের রচনাশৈলীর মতো এই গ্রন্থের শৈলীও ব্রাহ্মণসাহিত্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সর্বতো ভাবে গতানুগতিক এবং একই কারণে এখানে সূত্রাকারে দীর্ঘস্তবকের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ছন্দে বহু শ্লোক গ্রথিত হয়েছে, কিন্তু গদ্য সাধারণ ভাবে নিষ্প্রাণ। পরবর্তিকালের অধিকাংশ ব্রাহ্মণের সমসাময়িক পাণিনির নিয়মাবলির সঙ্গে এই আরণ্যকে প্রতিফলিত ব্যাকরণের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
তৈত্তিরীয় আরণ্যকের প্রধান ছন্দ হল অনুষ্টুপ। এই তথ্য থেকে সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, আলোচ্য আরণ্যকের শ্লোকগুলি পরবর্তী যুগের মহাকাব্য এবং সমাজদেহে ভাসমান গীতিকাগুলির ভিত্তি রচনা করেছে। আলোচ্য আরণ্যকে কিছু কিছু কাব্যগুণান্বিত চিত্রকল্প পাওয়া যায়; মোটামুটি ভাবে ভাষার প্রাচীনতার অনেক লক্ষণ থাকায় তার সঙ্গে অব্যবহিত উত্তরসূরির উপনিষদ অপেক্ষা সংহিতার সঙ্গে অধিকতর সাদৃশ্য পরিস্ফুট হয়েছে। ভাষা ব্যবহারের আভ্যন্তরীণ প্রমাণ থেকে মধ্যদেশের উপভাষার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে গায়ত্রী বিধিবদ্ধ হয়ে পড়েছে; এটা এর বহু বিকল্প প্রয়োগ থেকে সুস্পষ্ট।
আরণ্যকের সাহিত্যগত তাৎপর্য যদিও নিতান্ত ক্ষীণ, তবুও কখনও কখনও কাব্যিক সৌন্দর্য্যের আভাস পাওয়া যায় অভিজ্ঞতার গভীরতা ও মহিমা এবং জীবন-সম্পর্কিত অন্তর্দৃষ্টির উপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীলতায়— শুধু আলঙ্কারিক প্রয়োগ বা প্রকৃতি-বর্ণনার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি। তবে, অতি দীর্ঘায়িত সূত্র এবং ঐন্দ্রজালিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত শব্দাড়ম্বরের পুনরাবৃত্তি অধিক স্থান অধিকার করার ফলে চিত্রকল্প ও প্রেরণালব্ধ রচনার মান রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। বহু সীমাবদ্ধতার মধ্যে দৈনন্দিন জীবন থেকে আহৃত উপমা কিংবা পর্যবেক্ষণলব্ধ বর্ণনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আরণ্যকে সমাজচিত্র
আনুষ্ঠানিক বা আধ্যাত্মিক আলোচনা উত্থাপন করার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাখ্যান ও লোকশ্রুতি একত্র করে আমরা আরণ্যকের সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। ঐতরেয় আরণ্যকে বলা হয়েছে যে, ইন্দ্র যখন উপদেশের জন্য বিশ্বামিত্রের নিকট গমন করেছিলেন, তখন ঋষির বিবৃতি হল: ‘অন্নই হল শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব’। (২:২:৪) শাঙ্খায়নেও এই ধারণার পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়। (৮:২:১, ৯:৭:১, ৯:৯:১) অনুরূপ ভাবে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে যে, ভৃগু যখন পিতা বরুণের নিকট উপদেশ চেয়েছিলেন, বরুণ তখন তাঁকে অন্ন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু তত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছিলেন। (৯:১১) এ ভাবে বিভিন্ন আরণ্যকের বিচ্ছিন্ন কিছু উপাখ্যান থেকে আমরা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তৎকালীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই।
ইতোমধ্যে সন্ন্যাস যে মহান ও গৌরবজনক একটি আধ্যাত্মিক চর্চার উপায় ও ধর্মস্পদরূপে স্বীকৃত, আরণ্যকে তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐতরেয়তে ভরদ্বাজকে সর্বাধিক বিদ্বান, সর্বাপেক্ষা দীর্ঘজীবী এবং ঋষিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। (১:২:২:৪) আরণ্যকে জাতিভেদ প্রথা সামাজিক বাস্তবরূপে প্রতিষ্ঠিত; বহু স্থানে আমরা বিভিন্ন বর্ণের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তির্যক কিছু উল্লেখ দেখতে পাই। পারস্পরিক অভিবাদনের রীতি সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায়, পরবর্তী ধর্মসূত্রের সঙ্গে তাদের বিশেষ সাদৃশ্য রয়েছে। আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের মধ্যেও যে শ্রেণিভেদ ছিল, তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত চোখে পড়ে। অরণ্য-মধ্যবর্তী আশ্রমনিবাসী শিক্ষকদের সঙ্গে রাজ-পুরোহিতদের যে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছিল তাও এতে বেশ স্পষ্ট। বিদ্যাদাতা ব্রাহ্মণরা অরণ্যবাসী হওয়ার ফলে সাধারণ ভাবে ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন, কিন্তু অন্য একটি কারণে তাঁরা ছিলেন অধিকতর সম্মানিত; কারণ ব্রহ্মজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁরা পুত্র বা শিষ্য ব্যতীত অন্য কাউকে শিক্ষা দিতেন না, বিশেষত অযজমান ব্যক্তিকে কখনওই ব্রহ্মবিদ্যা দান করা যেত না। অতএব, গুরুপরম্পরা বা প্রজন্মক্রমে এই সব গূঢ়তত্ত্বের আচার্যরা সমাজমানসে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তৈত্তিরীয় আরণ্যকে (১:১১:৮) বলা হয়েছে যে, জ্ঞানই মানবজাতির পক্ষে সর্বাধিক বাঞ্ছনীয় বস্তু; জ্ঞানী ব্যক্তিরাই প্রকৃত সজ্জন। নর-নারীর পারস্পরিক সান্নিধ্যের সম্বন্ধে কতকটা উদার মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে: বিবাহিত ও অবিবাহিত, এই উভয়বিধ নারীর গর্ভস্থ সন্তানকে রক্ষা করার জন্য প্রার্থনা নিবেদিত হয়েছে।
এই পর্যায়ে জাতীয় সম্পদ মূলত কৃষিকার্য থেকে উদ্ভূত হত; ভারবাহী পশু, কৃষক, লাঙল, চাবুক ও চামড়ার পাতলা ফালির স্পষ্ট উল্লেখ ছাড়াও পৃথিবীর উদ্দেশ্যে উচ্চারিত একটি দীর্ঘ সূক্তে প্রচুরতর শস্যের আকাঙ্ক্ষায় রচিত প্রার্থনার মধ্যে কৃষিকার্যের সীতা শুনাসীরের উপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছে। শাঙ্খায়ন আরণ্যকে পর্যাপ্ত শস্য-উৎপাদক পৃথিবীকে ভূষিত করা হয়েছে, বসুন্ধরা, ধরণী, লোকধারিণী, গন্ধদ্বারা, দুরাধা, নিত্যপুষ্টা ও করীষিণী নামে। এ সব বিশেষণ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হচ্ছে যে, তখনকার জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা প্রাথমিক ভাবে কৃষিনির্ভর ছিল। তবে খাদ্যের জোগান পর্যাপ্ত বা নিয়মিত ছিল না; দারিদ্র্যের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়— দারিদ্র্যের গ্রাস থেকে মুক্তি বহু প্রার্থনার মর্মবস্তু। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা তখনও প্রবল শত্রুরূপে গণ্য (অশনায়া পিপাসা অর্থাৎ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা); প্রজাপতি সৃষ্টি করার পরে তারা মানুষের শরীরে প্রবিষ্ট হয়েছিল। সংহিতার মতো আরণ্যকে ও সাধারণ ভাবে হৃতস্বাস্থ্যের উদ্ধার, কার্যশক্তির বৃদ্ধি, চমৎকারিত্ব এবং উত্তম সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা ব্যক্ত হয়েছে। অত্যন্ত কঠোর রীতিতে বিধিবদ্ধ ভাবে বিশেষ ধরনের কুবের-পূজার বিধান দেওয়া হয়েছে; দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সর্বহারাকে এই পূজা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য প্রেরণাও দেওয়া হয়েছে। পঞ্চমহাযজ্ঞের অন্যতম ‘নৃযজ্ঞ’ ইতোমধ্যে কেবল ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে অন্নদানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অরণ্যে থেকেই বেদাধ্যয়ন অভ্যাস করতে হবে, এমন কথাও পড়ি। দুর্বল ও অশক্ত ব্যক্তিদের জন্য নানাবিধ বিকল্প যজ্ঞানুষ্ঠানের বিধান দেওয়া হয়েছে। এটা এমন একটা সময় যখন প্রাচীন ধর্ম নানা রকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন একটি রূপ পরিগ্রহ করছিল। উপাসনা পদ্ধতিরূপে পূজার প্রবর্তন, গুরুত্বপূর্ণ নতুন দেবতারূপে কুবেরের আবির্ভাব, ইত্যাদি ছাড়াও ভাবী অমঙ্গলের লক্ষণ, স্বপ্ন, কবচ নির্মাণ ও পরিধানের ঐন্দ্রজালিক আচার সাহিত্যের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এ সময় ভৌগোলিক পরিসর আরও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিস্তৃত হয়েছে, কারণ গঙ্গা ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী জনসাধারণই অপেক্ষাকৃত শ্রদ্ধেয় পরিগণিত। আমরা কুরু, পাঞ্চাল, উশীনর, মৎস্য, কাশী ও বিদেহের কথা শুনতে পাই; এ সব অঞ্চল পরবর্তিকালে ‘মধ্যদেশ’ নামে পরিচিত হয়েছিল। সামাজিক জীবন সম্পর্কে সাধারণ চিত্রটি হল তুলনামূলক ভাবে শান্তিবৃদ্ধি ও সংস্কৃতির। তৈত্তিরীয়তে বীণা সম্পর্কিত (দৈব ও মানবিক— এই উভয়বিধ) একটি দীর্ঘ আলোচনা (২:৩:১) থেকে অনুমান করা যায় যে, সে সময় ললিতকলার, বিশেষত সঙ্গীতের চর্চা প্রচলিত ছিল।
আরণ্যকে প্রতিফলিত নীতিচিন্তা মুখ্যত সত্য ও অসত্য সম্পর্কে কাব্যিক অভিব্যক্তির মধ্যে আভাসিত হয়েছে। নারী-সমাজের শুচিতার সঙ্গে সতীত্বের ধারণা তখন থেকেই সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে পাপ সম্পর্কে নতুন চিন্তার সূত্রপাত লক্ষ করা যায়; বিশেষত, কুসীদ প্রত্যর্পণে ব্যর্থতার জন্য ক্ষয়রোগের অভিশাপ ছাড়াও মৃত্যুদণ্ড নিরূপিত হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে ঋণপরিশোধ ও শান্তি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার মধ্যে ধর্মবোধ ও মুক্তির নতুন চিন্তাও আভাসিত (৯২:৬); তবে, কৃষিজীবী সমাজের কাছে পাপ-পুণ্য যে সামাজিক প্রয়োজন অনুযায়ী নিরূপিত হচ্ছে, তার ইঙ্গিত খুবই স্পষ্ট। একই কারণে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল। নতুন একটি সাহিত্য শ্রেণিরূপে আরণ্যকের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এই যে, সর্বপ্রথম যজ্ঞানুষ্ঠানগুলি এতে অতিপ্রাকৃত ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নতুন ভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। দেবকাহিনি অনুষ্ঠান ও প্রার্থনা সম্পর্কিত পূববর্তী চিন্তাভাবনা পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতিতে এখন যেন অপর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হয়েছে। আরণ্যকে পূর্ববর্তী ধর্মচর্চার পুনর্বিশ্লেষণের পশ্চাতে যে যুক্তিবোধ ক্রিয়াশীল তা মূলত অতীন্দ্রিয় রহস্যজাত। ব্রাহ্মণ পর্যায়ের যজ্ঞ বিশ্লেষণে এর প্রাথমিক বীজ অঙ্কুরিত হলেও, এ ক্ষেত্রে তা নিশ্চিত ভাবে ভিন্ন দ্যোতনাযুক্ত।
আরণ্যকে ঐতিহ্যগত বিষয়বস্তুর প্রতীকী পুনর্বিশ্লেষণের মধ্যে উপনিষদের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। স্বাধ্যায়ের উপর আরোপিত বিশেষ গুরুত্ব, তার গৌরবায়ণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে অনধ্যায় সম্পর্কিত নতুন নিয়মাবলি সম্পূর্ণত নতুন দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয় বহন করছে। আরণ্যক পর্যায়ে স্বাধ্যায় যেন বিশেষ একা ঐন্দ্রজালিক পবিত্রতা অর্জন করেছে। স্পষ্টত স্বাধ্যায়ের মূল অর্থ ছিল দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের দ্বারা ঋগ্বেদ সংহিতার আবৃত্তি; পরবর্তী পর্যায়ে এর অর্থ দাঁড়াল ঋগ্বেদের অংশবিশেষ এবং আরও পরবর্তিকালে শুধু গায়ত্রীমন্ত্রের আবৃত্তি। কালক্রমে তাই আরণ্যকের নির্দেশক বক্তব্যে পরিণত হল। ঐতরেয় আরণ্যকের একটি প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের (৫:৩:২) তাৎপর্য একাধিক স্তরে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, স্বাধ্যায় এক সময় বহু ব্যক্তি দ্বারা অবহেলিত হয়েছিল বলে এখানে তার সামাজিক পুনর্বাসনের চেষ্টা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্বাধ্যায়ের অনুশীলন থেকে আত্মজ্ঞান ও সত্যবোধ অর্জিত হয়; এর দ্বারা বুঝি যে, জ্ঞান তৎকালীন সমাজে আকাঙ্ক্ষিত আধ্যাত্মিক মূল্য পেয়ে গেছে। তৃতীয়ত, মহাব্রত অনুষ্ঠান সম্পর্কিত নির্দেশাবলির উপসংহারে রয়েছে যে, এ অনুষ্ঠান নাকি স্বাধ্যায় ব্যতীত অসম্পূর্ণ— আনুষ্ঠানিক প্রসঙ্গে এ ধরনের বিবৃতি কতকটা অপ্রত্যাশিত।
দেবসঙ্ঘ
ধর্মভাবনার নতুনতর প্রবণতার উন্মেষের ফলে বৈদিক দেবতারা তাঁদের প্রাচীন মহিমার কিয়দংশ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ব্রাহ্মণ যুগে এই প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়ে সেই যুগেই চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হলেও, আরণ্যকে তার ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া অব্যাহত। ঐতরেয় আরণ্যকে (২:১:৮) বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে মানুষের প্রদত্ত খাদ্যসামগ্রীর উপরই দেবতারা নির্ভরশীল। এই পর্যায়ে দুটি স্পষ্ট প্রবণতা লক্ষণীয়: প্রথমত, লোকায়ত অনৈষ্ঠিক দেবতাদের প্রবর্তন এবং দ্বিতীয়ত, সমস্ত দেবতার এমন এক সর্বোত্তম দেবতার মধ্যে আশ্রয়লাভ, যিনি সমস্ত প্রাচীন দেবসঙ্ঘের সম্পূরক হয়ে উঠেছেন। কুবের বৈশ্রবণ এখন হোমের পরিবর্তে বলিভুক। এই নির্দেশের পরবর্তী স্তোত্রে ধর্ম সম্পর্কে পুরাণ-কথিত উপাসনাপদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আভাসিত হয়েছে, উদ্ভব ঘটেছে রতি বিশ্বাবসু, দণ্ডী, গরুঢ়, দুর্গী, তৎপুরুষ, কন্যাকুমারী, নারায়ণ ও বাসুদেবের। একই স্তবকে অগ্নিতুল্য উজ্জ্বল ও দুর্গতিতারিণী দুর্গাদেবীকে আহ্বান করা হয়েছে। নারায়ণের উদ্দেশে নিবেদিত সূক্তটিতেও দেখি নতুন বৈশিষ্ট্য: তিনি এখানে সমুদ্রনিবাসীরূপে বর্ণিত। বস্তুত, এখানেই মহাকাব্য ও পৌরাণিক ঐতিহ্যের অন্যতম কেন্দ্রীয়
দেবতা নারায়ণের প্রথম সাক্ষাৎ পাওয়া গেল।
অম্বিকার পতিরূপ রুদ্র আহূত হয়েছে শুক্ল যজুর্বেদে (১৬শ), তিনি অম্বিকার ভ্রাতা ও উমার স্বামী; স্বয়ং উমাকে পাওয়া গেছে কেনোপনিষদে। অদিতির উদ্দেশে নিবেদিত একটি আগ্রহহোদ্দীপক সূক্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ: সেখানে তাঁকে সকল প্রাণী, পৃথিবী এবং পরমপুরুষের মাতারূপে সম্বোধন করা হয়েছে। আমাদের কাছে সেই পরমা মাতৃকাদেবীর উত্থান এখানে আরও স্পষ্টতর হয়ে ওঠে, পৃথিবী যাঁর ভিত্তিভূমি; কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর পক্ষে তা-ই স্বাভাবিক— অথচ ইনি অন্যান্য মাতৃকাদেবীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যও আত্মস্থ করে নিয়েছেন। এই সঙ্গে আমরা যখন মনে রাখি যে, সংহিতা-ব্রাহ্মণ যুগের দেবসঙ্ঘে পুরুষদেবতাদের প্রাধান্য ছিল তর্কাতীত, তখন প্রাগুক্ত পরমা মাতৃকার উত্থান অধিকতর তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে; কারণ এই দেবী এখন আর অন্য কোনও পুরুষ দেবতার সঙ্গিনী নন, আপন অধিকারেই তিনি বিশিষ্টা মাতৃকা।
ব্রাহ্মণসাহিত্যে প্রজাপতির উত্থানের মধ্য দিয়ে একেশ্বরবাদী প্রবণতার সূত্রপাত হয়েছিল, কিন্তু আরণ্যক পর্যায়ে আরও বহু নতুন উপাদান যুক্ত হওয়ায় এই প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়ে উঠল: যে সমস্ত প্রাচীনতর রচনায় পুরুষ, অক্ষর, ওম্, ব্রহ্ম, ইত্যাদি মহিমান্বিত হয়েছিলেন সে সব ক্ষেত্রে এদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় অস্তিত্ব ছিল স্বীকৃত; কিন্তু এই পর্যায়ে তাঁদের একীভূত করে তোলার সচেতন প্রয়াস দেখা গেল। পরম দেবতার নাম যদিও তখনও পর্যন্ত অনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনশীল, ‘সমস্ত দেবতাই পুরুষে প্রতিষ্ঠিত।’ (শাঙ্খায়ন ১০:১) এমন বিবৃতি সাধারণ ভাবে লভ্য এবং তাতে ক্রমবর্ধমান একেশ্বরবাদী প্রবণতারই পরিচয় স্পষ্ট।
জ্ঞান ও জ্ঞানতত্ত্ব
আরণ্যক ও উপনিষদকে যে ‘জ্ঞানকাণ্ড’ বলে অভিহিত করা হয়, তার কারণ, ইতোপূর্বে জ্ঞানের প্রতি কখনও এত শ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়নি। ব্রাহ্মণসাহিত্যে জ্ঞান অর্জনের পুরস্কার সর্বতো ভাবে ছিল পার্থিব— পার্থিব আনন্দের চিরায়ত, মহিমান্বিত, পরিবর্তিত প্রকাশই স্বর্গকল্পনার ভিত্তি; কিন্তু আর্যণক পর্বে এর তাৎপর্য সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। ব্রাহ্মণসাহিত্যের লক্ষ্য ছিল, যজ্ঞানুষ্ঠানের নিগূঢ় রহস্যবাদী দুর্জ্ঞেয় ব্যাখ্যা বা স্তোত্রসমূহের অতীন্দ্রিয় তাৎপর্যনির্ণয়, কিন্তু আরণ্যকের উৎসাহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নির্যাস ও মানবজীবনের আধ্যাত্মিক ও উদ্ভবত্ত্বমূলক তাৎপর্য আবিষ্কারে। এই যুগে অন্য যে নতুন দিকে আগ্রহ দেখা গেল, তা হল জ্ঞানতত্ত্ব। সময় জ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত ও প্রসারিত হচ্ছিল। এগুলি হল জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত প্রাথমিক অনুমান-নির্ভর আলোচনা, ধাতুবিদ্যা ও স্বভাবত প্রাথমিক পর্যায়ের রসায়নবিদ্যা, কিছু কিছু ভূতত্ত্ব, অস্থিসংস্থান বিদ্যা, শরীরবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, ভাষাতাত্ত্বিক দর্শন (ব্যাকরণ ও নিরুক্ত), অধিকতর সুবিন্যস্ত ধর্মতত্ত্ব ও অনুষ্ঠান-বিদ্যা, সঙ্গীত এবং অন্যবিধ শিল্পকলা। সুতরাং জ্ঞানচর্চার মূল্য এ যুগে সাধারণ ভাবে উন্নতমানের স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
আরণ্যকের বহু স্থানে জ্ঞানের জন্য নবজাগ্রত তৃষ্ণা অভিব্যক্ত হয়েছে। এমন কিছু জ্ঞানের জন্য আগ্রহ দেখা গেছে যেগুলির সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য অনুষ্ঠান বা ঔপনিষদীয় আধ্যাত্মবিদ্যার কোনও সম্পর্ক নেই। যেমন, প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের উপায় কিংবা প্রকৃতি ও জীবনের মর্মর্গত বাস্তবতার সন্ধান। আবার যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রাচীন জ্ঞান যেহেতু এ যুগে অপর্যাপ্ত ও অতৃপ্তিকর বলে বিবেচিত হল, পরম সত্য অনুভবের আকাঙ্ক্ষা তাই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে গেল— বস্তুজীবন থেকে আধ্যাত্মজীবনের তাৎপর্য সন্ধানের উত্তরণ প্রবলতর হল। মেধার জন্য ইন্দ্ৰ, সরস্বতী ও অশ্বীদ্বয়ের উদ্দেশে প্রার্থনা আরণ্যকের এক নতুন বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে উপলব্ধি-বর্জিত জ্ঞানের অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসতা।
সৃষ্টিতত্ত্ব ও হেতুসন্ধান সম্পর্কিত জ্ঞানের জন্য যে অন্বেষণ শুরু হয়েছিল, আরণ্যকে তা অব্যাহত থাকে। তবে, বিভিন্ন প্রত্নকথায় বিশ্বস্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনই সেগুলির উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি কোথাও এক নয়। কোথাও বলা হয়েছে, আত্মার আকাঙ্ক্ষায় সমস্ত কিছু সৃষ্টি হয়েছিল, কোথাও বা প্রজাতির সৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষা, তাঁর তপস্যা ও তৎপ্রসূত সৃষ্টি-পরম্পরা বর্ণিত হয়েছে, কোথাও সৃষ্টির অব্যবহিত পরে প্রজাপতির ক্লান্তি ও ছন্দের সাহায্যে বর্ষকাল পরে তাঁর পুনরুজ্জীবন বর্ণনা করা হয়েছে। কোনও উপাখ্যানে বলা হয়েছে যে, অসৎ বা নাস্তি থেকে সৃষ্টির উদ্ভব ঘটেছিল। অর্থাৎ ব্রাহ্মণসাহিত্যে সৃষ্টি যেখানে যজ্ঞসম্ভূত, আরণ্যকে এই প্রথম সর্বতো ভাবে নতুন সৃজনশীল উপাদানরূপে কামনা জ্ঞান ও ‘তপস্’-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হল। ‘তপস্’ যজ্ঞের সম্পূর্ণ বিপরীত, কারণ তার দ্বারা যজ্ঞের মৌল বস্তুটি অর্থাৎ কর্ম প্রত্যাখ্যাত হয়; নতুন তত্ত্বটি তীব্র ধ্যানের উপর আরণ্যকের লক্ষ্যকে কেন্দ্রীভূত করেছে। দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, স্রষ্টার সৃষ্টি করার আকাঙ্ক্ষা, আকাঙ্ক্ষাই এখন সৃজন-প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
শারীরবিদ্যা চর্চার সূত্রপাত হওয়ায় মানুষ যেহেতু মৃত্যুর কারণ ও মরণোত্তর অবস্থান সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল, তাই এই যুগের চিন্তায় প্রাণবায়ু বিশেষ প্রাধান্য রয়েছে। একটি জনপ্রিয় দেবকাহিনিতে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতার মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব ও অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ-সময় থেকে প্রাণের নতুন নতুন বিশেষণ আবিষ্কৃত হতে থাকে, যা পরম দেবতার সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। যুক্তিযুক্ত ভাবে পরবর্তী স্তরে প্রাণই স্রষ্টার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হল। (ঐতরেয় আরণ্যক ২:১:৭) আরণ্যকের আধ্যাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তাই প্রাণ, যজ্ঞানুষ্ঠান ও আত্মভাবনার মধ্যবর্তী যোগসূত্ররূপে প্রতীকের মূল্য অর্জন করেছিল। কৌষীতকি ও পৈঙ্গ্য অনুযায়ী প্রাণ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মীভূত।
বিমূর্তায়নের ক্রমবর্ধমান যে প্রবণতা বৈদিক যুগের শেষ পর্বে সুরু হয়েছিল, আরণ্যকে তা অধিকতর পরিস্ফুট। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে শ্রদ্ধা ও কাল’-এর মতো বিমূর্ত ধারণার উদ্ভব; তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সূচনায় ‘কাল’ সম্পর্কিত আলোচনা রয়েছে। সেখানে অত্যন্ত প্রবল আধ্যাত্মবাদী ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবিভাজ্য মহাকালকে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতালব্ধ সময় থেকে পৃথকরূপে দেখা হয়েছে ও সমুদ্র ও নদীর তুলনা করা হয়েছে। মানবজীবনের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে অনুরূপ পার্থক্য প্রদর্শন প্রসঙ্গে দেহ ও মনের দ্বৈততা আলোচিত হয়েছে। দেহের নশ্বরতার সঙ্গে সঙ্গে আত্মার অমরতার দ্যোতনাও এখানে পাওয়া যায়। শাঙ্খায়ন আরণ্যক প্রাচীনতর ঐতিহ্যের উল্লেখ করে অতিজাগতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উপাদানসমূহের মধ্যে প্রায় যৌন সম্পর্কের অবস্থা কল্পনা করেছে। সমস্ত কিছুর মধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের তৃষ্ণা অভিব্যক্ত। তবে, নতুন প্রবণতার মধ্যে দেহ ও আত্মার দ্বৈতবোধ সম্পর্কে সচেতনতা নিয়ত উপস্থিত; দৈহিক ক্রিয়া ও তথ্যকে সতর্ক ভাবে মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তর থেকে পৃথক করে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য এই নবজাগ্রত আধ্যাত্মবাদী চিন্তা কখনও কখনও তৎকালীন লোকায়ত কুসংস্কারের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত। তাই, আন্তরিক ভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পর্যবেক্ষণ শুরু করেও বহু জ্ঞানান্বেষণ প্রক্রিয়া নানাবিধ সংস্কারের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তবতা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক মননের পরিচয় যেমন আছে, তেমনই পাশাপাশি রয়েছে ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসে প্রণোদিত দৃষ্টিভঙ্গি।
বৈদিক যুগের শেষ পর্বের সূচনায় চিন্তাশীল ও ধর্মতত্ত্ববিদরা মরণোত্তর জীবন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে (১:৮:৪; ৫) চার ধরনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে: স্বাভাবিক, সোম, অগ্নি ও চন্দ্র। একই গ্রন্থে চার ধরনের নরকও বর্ণিত: বিসৰ্পী, অবিসর্পী, বিষাদী ও অবিষাদী। (১:১৯:১) এরই বিপরীত মেরুতে রয়েছে স্বর্গকল্পনা (২:৬:১); প্রাচীন মানুষের ভাবনায় ব্যাধি থেকে মুক্ত এবং অতীত ও আগামী প্রজন্মগুলি দ্বারা ভোগ্য এমন একটি কল্পরাজ্য বর্ণিত হয়েছে, যা সুকর্মের দ্বারা অর্জন করা যায়। আবার শাঙ্খায়ন আরণ্যকে (৩:১:৭) সদ্য স্বর্গে উপনীত আত্মার বর্ণনায় ব্রহ্মের সঙ্গে আত্মার একাত্মীভবন বিষয়ে উপনিষদের প্রধান ভাবনার অন্যতম প্রাচীনতর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে। প্রজ্ঞানের মাধ্যমে স্বর্গলাভ করা যায়— এ রকম নতুন চিন্তাধারার উন্মেষও আরণ্যকে ঘটেছে। লক্ষণীয় যে, কর্মের পরিবর্তে এখানে জ্ঞানের মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও অমরতা লাভের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, সংহিতা ব্রাহ্মণের যুগে শুনি যে, শুধু জ্যোতিষ্টোমের মতো নির্দিষ্ট কিছু যজ্ঞ করার মধ্যে দিয়েই স্বর্গলাভ করা যায়। আরণ্যক ও উপনিষদের যুগে জ্ঞানের দ্বারা পুনর্জন্মধারা থেকে মুক্তিলাভের কথা বিবৃত হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, আরণ্যক সেই যুগ-সন্ধিক্ষণের সাহিত্য যখন প্রাচীনতর উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি নতুনতর ভাবনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংমিশ্রিত হচ্ছিল। স্বর্গলাভের তপস্যার ভূমিকা যেমন স্বীকৃত তেমনই ‘বৈরাগ্য’-ও দেহশুদ্ধি এবং মৃত্যুজয়ের উপায় রূপে বর্ণিত হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যক দেবযান ও পিতৃযানের কথা বলেছে; আত্মা প্রথম মার্গ দিয়ে যাত্রা করে ও দ্বিতীয় মার্গ দিয়ে পুনর্জন্মে উপনীত হয়। পরবর্তী সাহিত্যে যে পুনর্জন্ম অবিমিশ্র অমঙ্গলের প্রকাশ, আরণ্যকে তাকে সাধারণ ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে; এ সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট বক্তব্য এখনও রূপ নেয়নি। তেমনই মুক্তি সম্পর্কিত ভাবনাও অস্পষ্ট অবস্থায় ছিল; কখনও মুক্তি মৃত্যুজয়ের সমার্থক, কখনও বা এর তাৎপর্য হল দেব-সান্নিধ্য।
জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে ও আনন্দময় চূড়ান্ত অবস্থানে উপনীত হওয়ার নির্ভরযোগ্য পথের বিষয়ে আরণ্যক শেষ পর্যন্ত অনিশ্চিত রয়ে গেছে বলেই মুক্তি সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপিত করেছে। ‘ব্রহ্ম’ শব্দের পুংলিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গগত প্রয়োগের মধ্যে কোনও স্পষ্ট ভেদরেখাও দেখা যায় না। তবে ব্রহ্মের অবশিষ্ট দেবকাহিনি ও নররূপগত বৈশিষ্ট্য ক্রমশ লুপ্ত হওয়ায় তাকে অধিকতর ছায়াবৃত মূর্তিতে শুধু আধ্যাত্মিক সত্তাতেই দেখা যায়। ইন্দ্রজাল বা অলৌকিক ক্ষমতাযুক্ত শব্দ অর্থে ‘ব্রহ্ম’-র পুরাতন প্রয়োগ যদিও অক্ষুণ্ণ ছিল, তবুও তাৎপর্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষণও কতকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কারণ ধর্মতত্ত্ববিষয়ক আলোচনার অন্তর্বস্তুরূপেই এই শব্দটি আরণ্যকে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রহ্মবাদী শব্দে ব্রহ্মের মৌল তাৎপর্য অর্থাৎ অনুপ্রাণিত বাক্ নিহিত রয়েছে; বৈদিক সমাজের আধ্যাত্মিক সম্পদের অভিভাবকরূপে পরিচিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরই শুধু অধিকার ছিল ব্রহ্মবাদীর বিরল সম্মান লাভ করার। যজ্ঞের প্রতীকী বিশ্লেষণ করা ছিল তাঁদের দায়িত্ব। আরণ্যকে ব্রহ্মবাদীরা যজ্ঞের নিয়মাবলি প্রণয়ন করতেন; অনুষ্ঠানসম্পর্কিত সমস্যা ও সংশয় নিরসনের বিশেষজ্ঞরূপে তাঁরা উদ্ধৃত হতেন। তবু, অন্তত দেককাহিনির দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্রহ্মের প্রকৃতরূপ অস্পষ্টই থেকে গিয়েছিল। ব্রহ্মকে সত্য, জ্ঞান ও অনন্তরূপে অভিহিত করা হয়েছে; তাঁর অনির্দেশ্য বিমূর্ত সত্তার বৈশিষ্ট্য সন্ধানের প্রবণতা ক্রমাগত প্রবল হয়ে উঠেছে। সমস্ত সমুন্নত দেবকাহিনি ও আধ্যাত্মবাদ-সঞ্জাত ধ্যানধারণা ক্রমশ ব্রহ্মের একক অস্তিত্বে এসে আশ্রয় পেয়েছে।
অন্য দিক থেকে এ সময় আত্মার দার্শনিক ভাবমূর্তি নির্মাণের প্রয়াসও শুরু হয়েছে, যা পরবর্তী স্তরে অর্থাৎ উপনিষদে দৃঢ় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অবশ্য উপনিষদের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে আরণ্যকে জীবনের মর্মসন্ধানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা যে প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে কোনও সংশয় নেই। তখন পুরাতন মূল্যবোধ সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ায় তা অপর্যাপ্ত ব’লে বিবেচিত হচ্ছিল; ফলে, জীবনের পুনর্মূল্যায়নের প্রেরণা অনিবার্য হয়ে উঠল। প্রথম স্তরে প্রশ্নগুলি ছিল মূলত প্রকৃতি, কাল ও বিশ্বজগতের সমর্থন সম্পর্কিত; ওই সময় আর্যদের মধ্যে মৃৎকুটির নির্মাণের প্রাথমিক জ্ঞান পরিণততর হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে পোড়া ইট— দগ্ধ ইষ্টক বা পক্কেষ্টক— নির্মিত জটিলতর গৃহনির্মাণ পদ্ধতির সূচনা হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও স্থাপত্য-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনুপুঙ্খ সম্পর্কে আগ্রহ এ যুগের বিশিষ্ট লক্ষণ। দ্বিতীয় স্তরের প্রশ্নগুলো ছিল মূলত নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং প্রেততত্ত্ব বিষয়ক। অনেক ক্ষেত্রে অভিব্যক্তিতে স্পষ্টতার ও সামঞ্জস্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়; বহু বিবৃতি ও সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরোধী। সম্ভবত তৎকালে প্রচলিত লোকায়ত আরণ্যক সংস্কৃতির রহস্যবাদী প্রবণতার প্রভাবেই জ্ঞানচর্চা সর্বসাধারণের পক্ষে প্রতিষিদ্ধ হতে শুরু করে।
যুগসন্ধিক্ষণের সাহিত্য বলেই আরণ্যকের তাৎপর্য সম্পূর্ণ পৃথক, যদিও আয়তনের দিক থেকে এটি ক্ষুদ্রতম বৈদিক সাহিত্য। ব্রাহ্মণে যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির প্রতীকী ব্যাখ্যা ছিল; কিন্তু পরবর্তী আরণ্যক সাহিত্যেই প্রথম যজ্ঞপরায়ণ-জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত আদর্শ থেকে বিচ্ছেদের সূত্রপাত হল। যজ্ঞানুষ্ঠানের সীমাবদ্ধ গণ্ডি অতিক্রম করে প্রতি রচয়িতারদের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি অতিপ্রাকৃত বা অধ্যাত্মবাদী প্রতীকায়ণে নিবদ্ধ হতে শুরু করল। তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে আরণ্যকে এটি একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ; কারণ পাঁচ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে জনগোষ্ঠীর শ্রদ্ধা ও সমর্থনধন্য দেবকাহিনি ও অনুষ্ঠানমূলক ধর্মবোধের বৃত্ত-বহির্ভূত ক্ষেত্রে তার বিচরণের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। লঘু ঐতিহ্য ও লোকায়ত ধর্মের বিভিন্ন উপাদান নিঃসংকোচে আত্মস্থ ক’রে আরণ্যক শুধু বিশিষ্টই হয়ে ওঠেনি, পরবর্তী স্তরের বহুবিধ প্রবণতার প্রাথমিক উন্মেষের ক্ষেত্রও প্রস্তুত করেছে।