চেঙ্গিস খান – তৃতীয় পৰ্ব

১২. ইসলামের তরবারি

এতদিন পর্যন্ত চেঙ্গিস খানের রাজত্ব দূর এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি তার মরুভূমিতেই বড় হয়েছেন আর সভ্যতার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয়েছে ক্যাথিতে। 

ক্যাথির শহর থেকে তিনি আবার তার সমতলের চারণভূমিতে ফিরে গেলেন। অতিসম্প্রতি, ঘুচলুকের কার্যকলাপ আর মুসলমান ব্যবসায়ীদের আগমন এশিয়ার অন্য প্রান্ত সম্পর্কে তাকে জ্ঞান দিল। 

তিনি এখন জানেন যে তার পশ্চিমের সীমানার পর্বতমালার ওপারে দারুণ উর্বরা এক উপত্যকা আছে, যেখানে কখনো বরফ পড়ে না। এখানে এমন নদীও আছে যা কখনো শীতে জমে যায় না। এখানে কারাকোরাম আর ইয়েন লিংয়ের চেয়েও পুরনো শহরে অনেক লোক বাস করে। আর পশ্চিমের এই শহর থেকে যে কাফেলাগুলো এসেছিল, তাদের সঙ্গে ছিল খুব সুন্দর লোহার তৈরি পাতলা তলোয়ার, খুব সুন্দর লাগাম—সাদা কাপড় আর লাল চামড়ার তৈরি সুগন্ধি আর হাতির দাঁত, নীলকান্তমণি ও রুবি। 

তার কাছে পর্যন্ত পৌঁছতে এই কাফেলাকে পেরোতে হয়েছিল মধ্য এশিয়ার বাধা, ‘তাগধুম্বুশ’ বা পৃথিবীর ছাদের উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণপশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত এই পর্বতমালা। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই এই পাহাড়ের বাঁধা ছিল। প্রথম দিকের আরবদের কাছে এ ছিল ‘কাফ’ পাহাড়। গোবির উপজাতি আর বাকি পৃথিবীর মাঝে, একাকী আর নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে ছিল এই পাহাড়। 

মাঝে মাঝে কোনো উপজাতি, আরো পূর্বের অন্য কোনো শক্তিশালী জাতির আক্রমণে পালাতে গিয়ে এই বাধা অতিক্রম করেছিল। হুন আর আভাররা এই পাহাড়শ্রেণি অতিক্রম করতে গিয়ে হারিয়ে যায়, আর কখনো ফিরে আসেনি। 

কখনো পশ্চিমের বিজয়ীরা এই পর্বতমালার অপর প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। সতেরো শ বছর আগে, পারস্যের রাজারা তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পূর্বে সিন্ধু এবং সমরখন্দ পর্যন্ত এসেছিলেন ‘তাঘ-দুম্বাসে’র দৃষ্টিসীমায়। দুই শতাব্দী পরে বেপরোয়া আলেকজান্ডার অনেকটা একই দূরত্ব পর্যন্ত এসেছিলেন। 

ফলে এই পর্বতমালা একটি বিশাল আন্তঃমহাদেশীয় বিভেদরেখা তৈরি করে রেখেছিল চেঙ্গিস খানের সমভূমির মানুষদের সঙ্গে পশ্চিমের উপত্যকার মানুষদের। পশ্চিমের এই এলাকাকে ক্যাথিরা বলত ‘তাতসিন’ বা ‘দূরের দেশ’। একবার এক প্রতিভাধর ক্যাথি সেনাপতি তার সেনাদের নিয়ে এই এলাকায় এসেছিলেন। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো সেনাবাহিনী এই পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করার সাহস দেখায়নি। 

মঙ্গোল সেনাপতিদের মধ্য সবচেয়ে দ্রুতগতির খেপ নয়ন এখন তার সেনা নিয়ে এই পর্বতমালার মধ্যে ঘাঁটি গেড়েছেন। আর জুখি অস্তমিত সূর্যের দিকে, কিপচাক উপজাতির চারণভূমি এলাকায় ঘোরাঘুরি করছেন। তারা জানালেন পর্বতমালার ভেতর দিয়ে দুটো রাস্তা আছে। 

এই মুহূর্তে চেঙ্গিস খান আগ্রহী ছিলেন ব্যবসায়। বিভিন্ন জিনিসপত্র, বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের অস্ত্র, সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত মঙ্গোলদের কাছে ছিল বিলাস বস্তু। তিনি তার প্রজাদের মধ্যে থাকা মুসলমান ব্যবসায়ীদের বলতেন তাদের কাফেলা নিয়ে পশ্চিমে যাওয়ার জন্য। 

তিনি জানতে পেরেছেন যে পশ্চিমে তার নিকটবর্তী প্রতিবেশী হচ্ছেন খারেসমের শাহ। বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিপতি। এই শাহের কাছে খান তার প্রতিনিধি পাঠালেন। সঙ্গে একটি সংবাদ। 

“আমি এই শুভেচ্ছাবাণী পাঠাচ্ছি। আমি আপনার ক্ষমতা এবং আপনার বিশাল সাম্রাজ্য সম্পর্কে জানি। আমি আপনাকে খুব যত্নে লালিত একজন পুত্র হিসেবেই দেখি। আপনি অবশ্যই জানেন যে আমি ক্যাথি এবং অনেক তুর্কি দেশ জয় করেছি। আমার দেশ যোদ্ধায় পরিপূর্ণ একটি দেশ, একটি রুপোর খনি। অন্য কোনো দেশের আমার প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয় আমাদের দুই দেশের মধ্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক হলে দুই দেশের প্রজাদেরই উপকার হবে।” 

সেই সময়ের মঙ্গোলদের জন্য এটি ছিল খুব মোলায়েম একটি চিঠি। ক্যাথির মৃত রাজাকে চেঙ্গিস খান পাঠিয়েছিলেন দারুণ অপমানজনক আর উত্তেজক চিঠি খারেসমের শাহ আলাউদ্দিন মোহাম্মাদের কাছ পাঠানো এই চিঠি মূলত ছিল বাণিজ্যের প্রস্তাব। তবে তার চিঠিতে একটি শব্দ ছিল, শাহকে তিনি তার পুত্র বলেছিলেন। আর এশিয়াতে এই শব্দের অর্থ নির্ভরশীল। চিঠিতে আরো একটি খোঁচা ছিল। তিনি জানিয়েছিলেন—তিনি তুর্কি উপজাতিদের ওপর বিজয় পেয়েছেন। কারণ শাহ নিজেও একজন তুর্কি ছিলেন। 

খানের দূত, শাহয়ের জন্য খুব দামি উপহার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। দামি পাথর আর সাদা উটের লোমে তৈরি পোশাক। কিন্তু সেই খোঁচা তখনো কাজ করছিল। তিনি জানতে চাইলেন, “চেঙ্গিস খান কে? সে কি সত্যিই চীন জয় করেছে?” 

এই প্রশ্নের উত্তরে সেই দূত হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়েছিল। 

শাহ তখন জানতে চাইলেন, “তার সেনাবাহিনী কি আমার মতোই বিশাল?” 

এর উত্তরে দূত খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে উত্তর দিল, “আপনার সৈন্যরা মুসলমান, মঙ্গোল নয়। আর খানের সৈন্যদের সঙ্গে তার নিজের সৈন্যের তুলনা করাটা ঠিক হবে না।” এই উত্তর শুনে শাহ সন্তুষ্ট হলেন। বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরিতে সম্মতি দিলেন। প্রায় এক বছর সময়কাল সবকিছু বেশ ভালোই চলল। 

ধীরে ধীরে চেঙ্গিস খান নামটি মুসলমান দেশগুলোয় পরিচিত হয়ে উঠল। এই শাহ খারসেম তখন বাগদাদের খলিফার ওপর তার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় ছিলেন। বাগদাদের খলিফাকে বোঝানো হলো, শাহয়ের এই আধিপত্য বিস্তারের কারণ হচ্ছেন ক্যাথির পার্শ্ববর্তী দেশের চেঙ্গিস খান আর তার শক্তি। বাগদাদ থেকে কারাকোরামে তাই একজন দূত পাঠানো হলো। কিন্তু দূতকে যেহেতু পাড়ি দিতে হবে শাহের এলাকা, তাই দারুণ এক সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। 

শোনা যায়, দূতের পরিচয়পত্র লেখা হয়েছিল দূতের মাথায়। তার মাথা ন্যাড়া করে সেখানে গরম শিক দিয়ে লেখা হয়। এরপর অপেক্ষা করা হয় চুল গজানো পর্যন্ত। এরপরে দূতকে পুরো সাহায্যের অনুরোধ সংবলিত সংবাদটি মুখস্থ করতে দেয়া হলো। পুরোপুরি মুখস্থ করিয়ে তাকে পাঠানো হলো খানের কাছে। সবকিছু ভালোভাবেই পার হলো। খলিফার দূত মঙ্গোল খানের কাছে পৌঁছল। তার মাথার চুল আবার পুরোটা ফেলে দেয়া হলো। তার পরিচয় পাওয়ার পরে সে সংবাদ পরিবেশন করল। 

চেঙ্গিস খান এই সংবাদে খুব একটা মনোযোগ দিলেন না। সম্ভবত একজন মাত্র দূত আর তার ভীতু অনুরোধ তাকে বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট করল না। এছাড়া শাহরের সঙ্গে তার বাণিজ্য চুক্তিও আছে। 

বাণিজ্য নিয়ে মঙ্গোলদের এই প্রচেষ্টা আকস্মিকভাবে থেমে গেল। কারাকোরাম থেকে রওনা দেয়া অনেকজন ব্যবসায়ীর এক কাফেলায় কাতারের শাসক ইনালজুক হামলা চালাল। কাতার ছিল প্রান্তে শাহের দুর্গ। ইনালজুক তার সম্রাটকে বলল, এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে গুপ্তচর ছিল, ঘটনাটা হয়তোবা সত্যিও। 

মোহাম্মাদ শাহ কোনো কিছু না ভেবে তার সেই শাসককে নির্দেশ দিলেন সব ব্যবসায়ীদের হত্যা করার। সেই নির্দেশ অনুসারে সবাইকে হত্যা করা হলো। নির্দিষ্ট সময়ে এই খবর চেঙ্গিস খানের কাছে পৌঁছল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি শাহের কাছে কয়েকজন প্রতিনিধি পাঠালেন। মোহাম্মাদ শাহ সেই প্রতিনিধি দলের নেতাকে মেরে ফেললেন আর বাকিদের দাড়ি পুড়িয়ে দিলেন। 

এই প্রতিনিধি দলের জীবিত সদস্যরা যখন চেঙ্গিস খানের কাছে পৌঁছল, তখন গোবির সম্রাট পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে কিছুক্ষণের জন্য পাহাড়ে গেলেন। মঙ্গোল প্রতিনিধিকে হত্যা শাস্তিবিহীন যেতে পারে না, পরম্পরা এই অন্যায়ের প্রতিশোধ চায়। 

খান বললেন, “স্বর্গে দুটো সূর্য থাকতে পারে না, আর পৃথিবীতেও দুটো খাঁ খান থাকতে পারে না।” 

এরপরে পর্বতমালার ভেতর দিয়ে গুপ্তচরকে পাঠানো হলো। আর মরুভূমিতে দ্রুত দূত পাঠানো হলো। সবাইকে বলা হলো সেনাতে যোগ দেয়ার জন্য। শাহরের কাছে খুব ছোট আর ভয়ঙ্কর এক সংবাদ পাঠানো হলো। 

“আপনি যুদ্ধকে বেছে নিয়েছেন। যা হবার তা হবে, আর কী হবে তা আমরা জানি না। কেবল ঈশ্বর জানেন।” 

যে কোনো যুক্তিতেই হোক, এই দুই বিজয়ীর একমাত্র ভবিতব্য যুদ্ধ শুরু হলো। আর এজন্য সাবধানী মঙ্গোলদের কাছে কারণ তো ছিলই। 

তার সামনে কী ছিল তা বোঝার জন্য আমাদের তাকাতে হবে পর্বতমালার ওপারে, যেখানে রয়েছে ইসলাম এবং শাহরের পৃথিবী। 

.

এ ছিল সামরিক পৃথিবী। গানের প্রশংসক আর কানও বেসুরো নয়। এই পৃথিবীতে আছে অভ্যন্তরীণ কষ্ট, ক্রীতদাসের সমস্যা, সম্পদ আহরণ, অমানবিক আচরণ আর চক্রান্তের প্রতি একটু বেশি রকমের উৎসাহ। অত্যাচারীদের ওপর তারা ছেড়ে দিয়েছিল তাদের বিভিন্ন কাজকর্ম আর তাদের মহিলারা ছিলেন খোঁজাদের দায়িত্বে আর তাদের বিবেক রাখা ছিল আল্লাহ্র কাছে। 

বিভিন্ন অনুশাসন তারা মেনে চলত। কোরানকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হতো। তারা ভিখারিকে অন্ন দিত, নিয়মমতো নিজেকে পরিষ্কার রাখত, আদালত এলাকায় সূর্যের নিচে বসে গল্প করত আর বিশেষ করে জীবিত থাকত মহানদের উদারতায়। জীবনে অন্তত একবার মক্কার কাবাঘরের গিলাফের নিচে রাখা কালো পাথরের কাছে যেত। এই তীর্থযাত্রায় মুসলমানরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের নিজেদের মাঝের ভ্রাতৃত্ব নবায়ন করত। যখন ফিরে আসত তখন তারা থাকত আরো বিশ্বাসী আর দেশপ্রেমিক। 

কয়েক শতক আগে তাদের নবী যে প্রদীপ জ্বেলেছিলেন, এই আরবরা তা বয়ে নিয়ে চলছিল। আর তখন থেকে, ইসলামের বিভিন্ন রকমের মানুষ একটি উদ্দেশ্যেই একত্রিত হচ্ছিল, আর তা হচ্ছে বিজয়। যোদ্ধাদের প্রথম দল ছড়িয়ে গেল স্পেনের গ্রানাডা, উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি আর মিসরে। সময়ের সাথে সাথে ইসলামের সমর শক্তি আরবদের হাত থেকে তুর্কিদের হাতে চলে গেল। তবে তাদের কাছ থেকে জেরুজালেম ছিনিয়ে নিতে আসা খ্রিস্টান ক্রুসেডার অশ্বারোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা হাত মিলাল। 

ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে সমর শক্তিতে ইসলাম ছিল তুঙ্গে। দুর্বল হয়ে যাওয়া ক্রুসেডাররা কেবল তাদের পুণ্যভূমির তীরবর্তী এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকল। তুর্কি যোদ্ধাদের প্রথম আক্রমণ ক্ষয়ে আসা গ্রিক সাম্রাজ্যের কাছ থেকে এশিয়া মাইনর এলাকা কেড়ে নিচ্ছিল। 

বাগদাদ আর দামেস্কাস-এর খলিফা বা ইসলামের প্রধান তখন হারুন-উর—রশিদের সব ঐতিহ্য আর প্রাচুর্য তখনো বজায় রেখেছিলেন। কবিতা আর গান ছিল শিল্পের পর্যায়ের। প্রবাদ ছিল সে সময় মানুষ তৈরি হতো। ওমর আল খৈয়াম বলেছিলেন—যারা বলে কোরানে সব ইহজগতের কথা বলা আছে তারা আসলে একটি পাত্রের তলায় খোদাই করা নকশার কথা বলে। 

মাহমুদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী জামশিদের আদালতগুলোয় ওমরের নিরাশ শ্লোকগুলো খোদিত ছিল। ইসলামের যোদ্ধাদের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল স্বর্গপ্রাপ্তির সম্ভাবনা। 

ওমর আর হারুন দুজনই গত হয়েছেন। গজনীর মাহমুদের উত্তরসূরি তখন উত্তর ভারতে রাজত্ব করছেন। বাগদাদের খলিফা তখন আরো পরিণত হয়েছেন। এখন তিনি যুদ্ধ জয়ের চেয়ে রাজনীতিতে অধিক মনোযোগী হয়েছেন। তবে নিজেদের ভেতরের দ্বন্দ্ব ভুলে ধর্মের বিপক্ষের শত্রুর বিরুদ্ধে একত্র হওয়া ইসলাম ধর্মের সমর শক্তি তখন শৌর্যে-বীর্যে হারুনের সময় থেকে কোনো অংশে কম ছিল না। 

যুদ্ধবাজ রাজপুত্ররা থাকত মরু অঞ্চলে, নদীর ধারে বিস্তৃত উর্বরা ফসল ফলা এলাকাতে। গনগনে সূর্য তাদের বুদ্ধিমত্তা আর বিলাসী জীবনের ইচ্ছা বাড়িয়ে দিত। তাদের অস্ত্রগুলো দক্ষ কারিগর দিয়ে তৈরি হতো। লোহার পাতগুলোকে দুইবার বাঁকিয়ে, তার ওপর রুপোর কারুকাজ করে অস্ত্র তৈরি হতো। তারা বর্ম আর হালকা শিরস্ত্রাণ পরত। তেজস্বী ঘোড়া ছিল তাদের বাহন। এগুলো দ্রুতগামী হলেও খুব বেশি কষ্টসহিষ্ণু ছিল না। ন্যাপথা আর ভয়ঙ্কর গ্রিকের আগুনের গোপন রহস্য তাদের জানা ছিল। 

ইসলামী সাম্রাজ্যের মাঝে, খারেসমের মোহাম্মদ শাহ নিজেকে একজন যুদ্ধবাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ভারত থেকে বাগদাদ আর আড়াল সাগর থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার সাম্রাজ্য। ক্রুসেডারদের হারানো সেলজুক তুর্কিরা আর মিসরের উদীয়মান মামলুক সাম্রাজ্য ছাড়া বাকি সব এলাকায় ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। তিনি ছিলেন সম্রাট আর খলিফা—তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে গেলেও তার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে পারবেন না— পোপের ক্ষমতা যেমন আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বে সীমাবদ্ধ, অনেকটা তেমন। 

খারেসমীয় সাম্রাজ্যের মোহাম্মাদ শাহ চেঙ্গিস খানের মতোই উপজাতি থেকে এসেছিলেন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ক্রীতদাস, মহান সেলজুক মালিক শাহ-এর পানপাত্র বাহক। তিনি এবং তার পিতৃপুরুষরা ছিলেন জাতিতে তুর্কি। তুরানের প্রকৃত যোদ্ধা। তার ভেতরে ছিল একজন সমরবিশারদের মেধা, রাজনৈতিক মেধা আর ছিল সীমাহীন লোভ। 

তিনি যে খুব বেশি নিষ্ঠুরতা দেখাতেন তা আমরা জানি। নিজের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে তিনি তার অনুসারীদের হত্যা করতেন। একজন সম্ভ্রান্ত ‘সৈয়দ’কেও তিনি হত্যা করতে পারতেন। এরপর খলিফার কাছে ক্ষমাভিক্ষা করতেন। এ কাজে ব্যর্থ হলে তিনি খলিফাকে অস্বীকার করে অন্যজনকে সেখানে বসাতেন। এরপরে ঘটল সেই বিতর্কিত ঘটনা, যার কারণে বাগদাদ থেকে চেঙ্গিস খানের কাছে দূত পাঠানো হয়েছিল। 

তারপরেও মোহাম্মাদ শাহ ছিলেন উচ্চাভিলাষী। প্রশংসাও বেশ পছন্দ করতেন। তিনি নিজেকে যোদ্ধা পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। তার সভাসদ তাকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার বলে ডাকত। তিনি তার মায়ের উৎসাহকেও দমন করেছিলেন আর তার প্রশাসন চালানো উজিরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। 

তার চার লাখ সৈন্যের মধ্যমণি ছিল খারেসম তুর্কি। তবে পারস্যের সেনাদের ডাক দিলেই তিনি পাশে পাবেন। যোদ্ধা হাতি, বিশাল উটের বহর আর প্রচুর সশস্ত্র ক্রীতদাস তাকে অনুসরণ করত। 

তবে তার সাম্রাজ্যের প্রধান প্রতিরক্ষা ছিল নদীর পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিশাল সব শহরের সারি। বোখারা ছিল ইসলামের শিক্ষা আর মসজিদের পীঠস্থান। সমারখন্দে ছিল বড় সব দেয়াল আর প্রমোদ বাগান। বালখ আর হেরাত ছিল খোরাসানের প্রাণ। 

ইসলামের এই পৃথিবী, আর তার সঙ্গে উচ্চাভিলাষী শাহ, এর অসংখ্য সৈন্য আর এর শক্তিশালী শহর, পুরোটাই ছিল চেঙ্গিস খানের জন্য প্রায় অজানা। 

১৩. পশ্চিমের দিকে অভিযান 

মুসলমান তুর্কিদের বিরুদ্ধে অভিযানে যাওয়ার আগে চেঙ্গিস খানকে দুটো সমস্যার সমাধান করতে হবে। যখন তিনি চীন বিজয়ে যান, তখন মরুভূমির প্রায় সকল যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রায় কয়েক বছরেরে জন্য পেছনে ফেলে যেতে হবে— নতুন তৈরি হওয়া এই সাম্রাজ্যকে অবশ্যই পর্বতমালার ওপার থেকে শাসন করতে হবে। 

এই সমস্যাটা তিনি নিজের মতো করে সমাধান করলেন। মুহুলি অস্ত্র আর ভীতি দিয়ে ক্যাথিকে নিজের দখলে রাখছিলেন। আর লিয়াও ইয়াংয়ের রাজপুত্ররা তার সমর্থনে দেশে শান্তি বজায় রাখতে ব্যস্ত ছিলেন। চেঙ্গিস খান তার বাকি সাম্রাজ্যে চিরুনি অভিযান চালালেন। জয় করা রাজ্যগুলোতে যেসব পরিবারের কর্তারা মনে কিছু উচ্চাভিলাষ রেখেছিল, যারা তার অবর্তমানে ঝামেলা করতে পারে, তাদের খুঁজে বের করলেন। এরপর তিনি তাদের একটি করে রুপোর খণ্ড পাঠিয়ে তার সেনাতে যোগ দিতে বললেন। তাদের সাহায্য প্রয়োজন এমন এক মিথ্যা বাহানা দিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি সাম্রাজ্যের বাইরে চলে গেলেন। 

যে শাসনব্যবস্থা তিনি প্রস্তাব করলেন, তাতে তিনি যেখানেই যান না কেন, শাসনভার তার নিজ হাতেই থাকবে। গোবির খানদের রাজসভার সঙ্গে তিনি দূত মারফত যোগাযোগ রাখতেন। তার একজন ভাইকে তিনি কারাকোরামে শাসক হিসেবে রেখে এলেন। 

এই সমস্যার সমাধান তো হলো। এর পরের সমস্যাটি এর চেয়েও বড়—প্রায় পাঁচ লাখ সেনাবাহিনীটিকে বৈকাল হ্রদ থেকে মধ্য এশিয়ার এই পর্বতমালা অতিক্রম করিয়ে পারস্যে নিয়ে যাওয়া। প্রায় দুই হাজার মাইলের এক বিশাল দূরত্ব আর এমন এক দেশ, যেখানে ভ্রমণকারীরা প্রয়োজনীয় সব কিছুতে পরিপূর্ণ কাফেলা নিয়েই কেবল যায়। এত বড় আকারের কোনো আধুনিক সেনাবাহিনীর পক্ষে এমন যুদ্ধযাত্রা অসম্ভব। 

এই যুদ্ধযাত্রায় তার সেনাবাহিনীকে নিয়ে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। তার সেনায় তিনি এমন একটি যুদ্ধবাজ দল তৈরি করেছিলেন, যাদের সক্ষমতা ছিল পৃথিবীর যে কোনো এলাকায় যুদ্ধ করার। এদের অর্ধেকই আর কখনো গোবি মরুভূমি দেখতে পায়নি। তবে ওদের মাঝে কিছু মঙ্গোল ছিল যারা ৯০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছিল এবং ফিরে এসেছিল। 

১২১৯-এর বসন্তে দক্ষিণ-পশ্চিমের নদীর পাশের চারণভূমিতে তার সেনাদের তিনি একত্র হতে নির্দেশ দিলেন যুদ্ধযাত্রা শুরু করতে। কয়েকজন মার্শালের অধীনে তার ‘তুমান’দের বা সেনাদের ছোট দলগুলোকে একত্রিত করলেন। প্রত্যেক সেনার সঙ্গে থাকল চার থেকে পাঁচটি ঘোড়ার লাগাম। বিশাল গবাদির পালকে গ্রীষ্মকালে চারণভূমিতে নিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে স্বাস্থ্যবান করা হয়েছিল। খানের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রও নেতৃত্ব নিতে এলেন এবং হেমন্তের এক সুন্দর দিনে খান নিজে তার সেনাদের নিয়ে কারাকোরাম থেকে রওনা হলেন। 

তার উপজাতি সাম্রাজ্যের নারীদের উদ্দেশে তিনি একটি কথা বলেন, “আপনাদের হাতে হয়তো অস্ত্র নেই, তবে আপনাদের একটি দায়িত্ব আছে। আপনাদের বাড়ির পুরুষটি ফেরত না আসা পর্যন্ত, আপনাদের তাঁবুগাড়িটি খুব ভালোভাবে দেখাশোনা করে রাখবেন, যেন দূতরা এবং ভ্রমণরত ‘নয়ন’রা যখন রাতে আসবে, তখন তারা পরিষ্কার থাকা ও খাওয়ার জায়গা পায়। এভাবে একজন গৃহিণী সম্মান দেখাতে পারবেন একজন যোদ্ধাকে।”

সেনাবাহিনী নিয়ে চলতে চলতে তার মনে হয়েছিল তিনি হয়তো আর জীবিত ফিরে আসবেন না। একটি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, পাইন গাছের সারির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, “রো-হরিণ শিকারের জন্য সুন্দর একটি জায়গা। একজন বৃদ্ধ মানুষের জন্য সুন্দর একটি বিশ্রামের জায়গা।”

তিনি আদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পরে যেন তার তৈরি আইন, ‘ইয়াসা’, সর্বসমক্ষে জোরে জোরে পড়ে শোনানো হয়। সবাইকে সেই মোতাবেক চলতে হবে। সেনাবাহিনী আর তার কর্মকর্তাদের জন্য তার অন্য নির্দেশ ছিল : 

“তোমরা আমার সঙ্গে যাচ্ছ যে লোকটি আমাদের অপমান করেছে তাকে আমাদের পূর্ণ শক্তি দিয়ে আক্রমণ করতে। আমার জয়ে তোমাদেরও ভাগ থাকবে। দশজন সেনার নেতাও যেন হাজার সেনার নেতার মতো অনুগত আর দুর্ধর্ষ থাকে। কেউ যদি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তার জীবন কেড়ে নেয়া হবে। এবং সঙ্গে তার স্ত্রী আর সন্তানদের জীবনও।” 

তার পুত্রদের, ‘অর খান’দের এবং বিভিন্ন গোত্রপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনার পরে খান বেরিয়ে পড়লেন বিভিন্ন সেনা ছাউনি পর্যবেক্ষণ করতে। তার বয়স তখন ছাপ্পান্ন বছর, চওড়া মুখে তখন ভাঁজ, ত্বক শুষ্ক। সাদা দ্রুতগামী ঘোড়ার স্যাডলের ওপর উঠে বসলেন! 

ওপর দিকে তির্যক তার সাদা পশমি টুপিতে ছিল ঈগলের পালক। প্রত্যেকটি কানের ঠিক সামনে ঝুলে থাকত লাল রঙের নকশা করা এক টুকরো কাপড়— অনেকটা পশুর শিঙের মতো। তবে প্রচণ্ড বাতাসে টুপিটা বেঁধে রাখতে তা কাজে দিত। পশুর চামড়ায় তৈরি লম্বা হাতওয়ালা পোশাকগুলো সোনার পাতের বন্ধনী দিয়ে বা সোনার তৈরি পোশাক দিয়ে বাঁধা ছিল। খুব কম কথা বলে, তার সম্মিলিত সেনাদের সঙ্গে তিনি চলতে লাগলেন। সেনারা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো অস্ত্রে সজ্জিত। একটি দলের ঘোড়াগুলোর লাল অথবা কালো চামড়ার মুখোশ পরানো ছিল। প্রত্যেকের কাছে ছিল দুটি করে ধনুক আর একটি অতিরিক্ত তীরের বাক্স, আর্দ্রতা থেকে রক্ষার জন্য। তাদের শিরস্ত্রাণ ছিল হালকা এবং কাজের, সঙ্গে পিছন থেকে ঘাড়কে আড়াল করার জন্য চামড়ার পর্দা, তাতে লোহার জালের মতো লাগানো ছিল। 

শুধু খানের নিজস্ব সেনাদের ছিল ঢাল। ছোট শক্ত তলোয়ারের সঙ্গে ভারী অস্ত্রবাহী এই সৈন্যদের কাছে ছিল কোমরে ঝোলানো কুঠার আর ল্যাসো কিংবা দড়ি— আক্রমণকারীদের ঘোড়া কিংবা গাড়ি বেঁধে ফেলার জন্য। সঙ্গের আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো ছিল অল্প এবং খুব প্রয়োজনীয়— একটি চামড়ার থলেতে থাকতো ঘোড়াগুলোর নাকের কাছে ধরার ব্যাগ আর মানুষদের জন্য একটি পাত্র, মোম, তীরের মাথাগুলো ধারালো রাখবার জন্য লোহার পাত। পরে, প্রত্যেকের কাছেই ছিল জরুরি আহার—সিদ্ধ মাংস আর শুকনো দুধ। এই শুকনো দুধ পানিতে ঢেলে গরম করা যেত। 

এই মুহূর্তে তারা খুবই ধীরে এগোচ্ছে। তাদের সঙ্গে অনেক ক্যাথিবাসীও আছে আর আছে একটি নতুন সেনাদলও। দলটি দশ হাজার সেনার আর এর দায়িত্বেও একজন ক্যাথি সেনাপতি, কো পাও ইউ বা সমরাস্ত্রের সর্দার। আর তার সেনারা অবরোধ করার অস্ত্র তৈরি আর প্রয়োগে দক্ষ ছিল। বড় পাথর ছোড়ার এক ধরনের প্রক্ষেপক, আগুনের গোলা ছোড়ার প্রক্ষেপক— এই অস্ত্রগুলো পুরোপুরি সঙ্গে নিয়ে হয়তো যায়নি। তবে তাদের কাফেলায় এসব যন্ত্রের অংশ ছিল। কিছুটা পরেই আমরা দেখতে পাব ‘হো-পাও’ বা আগুন ছোড়া বন্দুকের ব্যবহার। 

.

খুব ধীরে ছোট ছোট পর্বতমালার ভিতর দিয়ে গবাদিপশুর পাল নিয়ে সেনাবাহিনী এগুতে লাগল। প্রায় দুই লাখ সেনার একটি দল। যেহেতু তাদেরকে বেঁচে থাকবার জন্য এই গবাদিপশু আর সেই দেশের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল, তাই একসঙ্গে রাখার জন্য এটি অনেক বড় এক সেনা দল। বড় পুত্ৰ জুখি একজোড়া সেনাদল নিয়ে ‘তিয়ান শান’-এর ওপর দিকে খেপ নয়নের সঙ্গে যোগ দিতে গেলেন। অন্যরা ছড়িয়ে উপত্যকা দিয়ে এগুতে লাগল। 

যুদ্ধযাত্রার প্রথম দিকে একটা ঘটনা ঘটল। হঠাৎ করে সময়ের আগেই তুষার পড়তে শুরু করল। খান তখন ইয়ে লিউ চুতসাইয়ের কাছে লোক পাঠিয়ে এর মানে জানতে চাইলেন। 

বুদ্ধিমান চুতসাই উত্তর দিলেন “এর মানে হচ্ছে শীত এবং শীতপ্রধান দেশের দেবতা, গ্রীষ্মের দেবতাকে হারিয়ে দিবে।” 

ক্যাথিবাসীরা নিশ্চিতভাবে সেই শীতে কষ্ট পেয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকে ছিল, যারা ওষুধি গাছ ব্যবহার করে অসুখ সারাতে পারত। যখন কোনো মঙ্গোল বর্শার ফলার আঘাতে আহত হয়ে তাঁবুর সামনে মাটিতে পড়ে যেত তখন এসব চিকিৎসার জন্য ওষুধি গাছ আর গ্রাহ-নক্ষত্রের এসব পণ্ডিতের ডাক পড়ত। আরো অনেকে অযোদ্ধা তাদের সঙ্গ দিচ্ছিল— দোভাষী, পরে গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহৃত হতে যাওয়া ব্যবসায়ী। কর্মকর্তারা, যারা পরে দখল হওয়া এলাকার প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়েছিল। কোনো কিছুই উপেক্ষা করা হয়নি। প্রতিটি ব্যাপার খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করা হয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্রেরও খেয়াল করা হয়েছিল—এসব দেখাশোনার জন্য একজন সেনাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। 

অস্ত্র আর স্যাডলের ধাতব অংশকে চকচকে রাখা হতো। সরঞ্জামগুলো পূর্ণ থাকত। ভোরের বাদ্য বাজলে গবাদিপশুর পালকে রওয়ানা করিয়ে দেয়া হতো, আর যোদ্ধারা তাদের গাড়িসহ পিছনে পিছনে চলত। সন্ধ্যার দিকে যোদ্ধাদের দলটি গবাদিপশুর দলকে অতিক্রম করে যেত। যখন নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা তার পতাকা মাটিতে নামাত, তখন তাকে ঘিরে চারপাশে তাঁবু ফেলা হতো। যোদ্ধারা উট বা গাড়ি থেকে তাদের তাঁবু নিয়ে আসত। 

নদী পার হতে হবে। স্যাডলের শিংয়ে দড়ি দিয়ে একসঙ্গে বেঁধে বিশ—পঁচিশটি ঘোড়ার একটি লাইন তৈরি করে স্রোতের মোকাবেলা করা হতো। কখনো আরোহীকে ঘোড়ার লেজ ধরে সাঁতরে পার হতে হতো। একটি ডাল চামড়ার ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে শক্ত করে বাঁধা হতো, ফলে তা ভাসত, আর সেটা যোদ্ধার বুকের সাথে বাঁধা হতো। কিছুদিনের মধ্যেই তারা বরফের ওপর দিয়ে নদী পার হলো। 

বরফ সবকিছু ঢেকে ফেলল, এমনকি বালুর ছোট ঢিবিও। আন্টিলোপ বা ভেড়ার সিং গেঁথে রাখা হতো, ফলে এই তীব্র বাতাসেও তা চিহ্ন হিসেবে জেগে থাকত। 

জুখির সেনাদল দক্ষিণের দিকে যাচ্ছিল, সাত হাজার ফুট উঁচু গিরিখাত থেকে নেমে, তিয়ান শানের উপরে ‘পি লু’ বা ‘গ্রেট নর্থ রোডে’ প্রবেশ করল। এখানে, মধ্য এশিয়ার অন্যতম পুরনো বাণিজ্যপথে তারা দেখল ভারবাহী উটের লম্বা লাইন। নাকের দড়ি লেজের সঙ্গে বাঁধা, বিশাল এক লাইন করে, কয়েক শ উট ধীরে ধীরে চলছে। উটগুলোর পিঠে রয়েছে পোশাক, নয়তো চাল, নয়তো অন্য কিছু! তাদেরকে অনুসরণ করছে অর্ধেক ডজন মানুষ আর একটি কুকুর। 

মূল সেনাদল খুব ধীরে পশ্চিমের দিকে চলল। সরু গিরিখাতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আর সাঙ্গেরীয় দ্বারের জমাট হ্রদের ওপর দিয়ে চলতে থাকল। এই গিরিখাতের ভেতর দিয়ে চলেই সব উপজাতি মধ্য এশিয়ার উঁচুভূমিতে পৌঁছত। এই পথ দিয়ে চলতে গিয়ে সৈন্য আর গবাদি সবাই জমে যেত যদি তারা কালো ধূলিঝড় বা ‘বুরানে’র কবলে পড়ত। এর মাঝে তাদের বেশিরভাগ গবাদিই হয় মারা গেছে নয়তো খেয়ে ফেলা হয়েছে। শেষ খড়ের গাদাটাও শেষ হয়ে গেছে। গাড়ির অপ্রয়োজনীয় অংশ পেছনে ফেলে আসা হয়েছে, শক্তি-সমৰ্থ কিছু উটই কেবল বেঁচে আছে। 

পশ্চিমের দিকে অভিযান সম্পর্কে ক্যাথিবাসী ইয়ে লিউ চুতসাই লিখেছিলেন, “মধ্য গ্রীষ্মেও এসব পাহাড়ে বরফ-চাকা তৈরি হয় আর তুষার পড়ে। ঐ পথ দিয়ে যাওয়া সেনারা এসব বরফ কেটে পথ তৈরি করতে বাধ্য। পাইন আর লার্চ গাছগুলো এত বড় যে, মনে হচ্ছিল ওগুলো স্বর্গ ছুঁয়ে ফেলবে। ‘চিন শান’ বা ‘সোনালি পর্বতে’র পশ্চিমের নদীগুলো সবই পশ্চিম দিকে প্রবাহিত।”

ঘোড়াগুলোকে রক্ষা করার জন্য ওদের ক্ষুরগুলো ইয়াক-এর চামড়া দিয়ে পেঁচিয়ে দেয়া হয়েছিল। মনে হচ্ছে ঘোড়াগুলো খাবারের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে আর বিভিন্ন জায়গা দিয়ে রক্ত ঝরছিল। 

বাতাসের দ্বার পেরিয়ে পশ্চিমের পর্বতমালায় প্রবেশের পরে যোদ্ধারা গাছগুলো কেটে ফেলল সঙ্কীর্ণ গিরিখাতগুলো পার হওয়ার জন্য সেতু হিসেবে সেগুলো ব্যবহার করবে। ঘোড়াগুলো ক্ষুর দিয়ে খুঁচিয়ে তুষারের নিচ থেকে ঘাস বের করে ফেলল। শিকারিরা এদিক-ওদিক শিকারের খোঁজে গেল। মধ্য এশিয়ার ভয়ানক শীতে আড়াই লাখ কষ্টসহিষ্ণু সেনা এগিয়ে চলতে লাগল। হয়তো আধুনিক সেনারা এই অবস্থায় থাকলে তাদেরকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়তে হতো। মঙ্গোলরা খুব একটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়নি। ভেড়ার চামড়ার তৈরি পোশাক পরে তারা তুষারপাতের মাঝেই শুয়ে পড়ত। প্রয়োজনে কখনো তাঁবুগাড়ি তাদের উষ্ণতা দিত। খাবার কম পড়লে কখনো তারা ঘোড়ার একটা শিরা কেটে ঘোড়ার রক্ত পান করে আবার শিরাটা বন্ধ করে দিত। 

এভাবে প্রায় এক শ মাইল পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে তারা চলতে লাগল। স্লেজ গাড়িগুলোতে চড়ে, মৃত পশুর হাড় দেখে পথ চিনে চলতে লাগল। 

বরফ গলে যাওয়ার আগেই তারা পশ্চিমের চারণভূমিতে পৌঁছে গেল। বালকাশ হ্রদের কাছাকাছি এলাকা খুব দ্রুত পার হয়ে গেল। নতুন ঘাস গজানোর সময়েই শেষ বাঁধা ‘কারা তাউ’ বা ‘কালো পর্বতমালা’ তারা পার হয়ে গেল। দুর্বল ঘোড়ায় তাদের যুদ্ধযাত্রার প্রথম বারো শ মাইল তারা সম্পন্ন করল। 

বিভিন্ন সেনাদল এখন কাছাকাছি চলে এসেছে, পরস্পরের মাঝে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার জন্য কয়েকজন সেনা সারাক্ষণ এক ছাউনি থেকে অন্য ছাউনিতে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া-আসা করতে লাগল। সাধারণ চেহারার কয়েকজন ব্যবসায়ী, দুই অথবা তিনজনের দল করে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে লাগল। প্রত্যেক দলের অগ্রভাগে একজন করে তথ্যানুসন্ধানী সেনা থাকল। 

সেনারা তাদের সরঞ্জামগুলো আরেকবার দেখে নিল, তীরগুলো গুনে নিল, হাসল আর আগুনের পাশে জমায়েত হলো, যেখানে হাঁটু ভাজ করে চারণকবিরা বসে আছে। তারা তাদের প্রয়াত নায়কদের জয়গাঁথা বর্ণনা করতে লাগল। 

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তারা তাদের নিচে মুসলমান সেনাদের প্রথম দলটিকে দেখতে পাচ্ছিল। বসন্তের আগমনে সীর নদী তখন ফুলে-ফেঁপে উঠছে। 

১৪. প্রথম অভিযান 

ইতিমধ্যে পৃথিবীর ছাদের নিচে জুখি আর খেপ নয়নের সঙ্গে মুসলমানদের একটা যুদ্ধ হলো। এটা বলার মতো একটা ঘটনা। 

মঙ্গোলদের সামনে ময়দানে ছিলেন মুসলমান শাহ। সবেমাত্র ভারত বিজয় করে আসা শাহ চার লাখ সেনাকে একত্রিত করেছেন। তিনি সম্প্রতি উপাধিগুলো (আতাবেগ) পেয়েছেন, আর তার তুর্কি সেনাদলকে আরব আর পারস্য সেনা দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। উত্তরে, মঙ্গোলদের খোঁজে এই সেনাদলকে তিনি 

নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনো দৃশ্যপটে মঙ্গোলরা ছিল না। যুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞাত, ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো খেপ নয়নদের দলের কিছু সেনার ওপর তিনি আক্রমণ করলেন। মোটা আলখাল্লা পরা, ধীর গতির টাট্টু ঘোড়ায় চড়া এসব উপজাতিকে দেখে দ্রুতগামী খারেসমীয় সেনাদের মনে আহঙ্কার জেগে উঠল। যখন গুপ্তচর এসে মূল সেনাদল পৌঁছার খবর দিল তখন শাহ তার ধারণার কোনো পরিবর্তন করলেন না— “তারা এতদিন শুধু অবিশ্বাসীদেরকে হারিয়েছে। এখন তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ইসলামের ঝাণ্ডা।” 

কিছু সময়ের মধ্যেই মঙ্গোলদের দেখা গেল। আক্রমণকারী সেনাদল পাহাড়ি এলাকা থেকে সির নদীর দিকে নেমে আসছে। তারা উর্বরা উপত্যকার গ্রামগুলোতে প্রবেশ করল, তাদের গবাদিগুলোকে নিয়ে গেল, প্রচুর শস্য আর খাদ্য সংগ্রহ করল আর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ধোঁয়ার ভেতর ফিরে চলে গেল। গরুগাড়ি আর গবাদিগুলো কিছু সেনাসহ উত্তরের যোদ্ধাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো আর একদিন পরে তারা পঞ্চাশ মাইল দূরে একটি গ্রামে আক্রমণ করল। 

এরা ছিল অগ্রগামী দল। এরা মূল সেনাবাহিনীর জন্য রসদ সংগ্রহ করছিল। তারা কোথা থেকে আসছিল, আর কোথায় চলে যাচ্ছিল তা কেউ বলতে পারছিল না। তাদেরকে জুখি পাঠিয়েছিলেন। আর তিনি নিজে পূর্ব দিক, পি লু থেকে লম্বা উপত্যকা হয়ে এগুচ্ছিলেন। মূল সেনাদলের চেয়ে সহজতর রাস্তা পেয়ে তার বাবার সেনাদলের চেয়ে একটু এগিয়ে তিনি শেষ পর্বতমালা পার হচ্ছিলেন। 

মুহাম্মাদ শাহ তার মূল সেনাদলটি সির নদীর কাছে রেখে, নিজে পূর্ব দিকের পর্বতমালার মধ্য দিয়ে নদীর উৎসের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। জুখির এগিয়ে আসার কথা হয় তিনি তার সংবাদদাতার কাছে জানতে পেরেছিলেন, আর নয়তো দুর্ঘটনাবশত এই মঙ্গোল সেনাদলের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি জঙ্গলময় পর্বতমালায় ঘেরা উপত্যকায় তাদের সঙ্গে মোকাবেলা শুরু করলেন। 

মঙ্গোলদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সমরশক্তি ছিল তার সেনাবাহিনীর, আর মোহাম্মাদ— প্রথমবারের মতো এই ঢাল আর বর্ম ছাড়া, শুধু পশুর চামড়ার আলখাল্লা পড়া উপজাতির মুখোমুখি হচ্ছেন— কেবল ভেবেছিলেন, এই আশ্চর্য ঘোড়সওয়ার পালিয়ে যাওয়ার আগেই তাদের আক্রমণ করতে হবে। 

তার তুর্কি সেনারা এ ধরনের যুদ্ধে বেশ ওস্তাদ। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল ইতিমধ্যে জুখির সঙ্গে থাকা মঙ্গোল সেনাপতি তখনই মঙ্গোল রাজপুত্রকে উপদেশ দিলেন পিছিয়ে যেতে, আর তাদের পিছে পিছে ধাওয়া করা তুর্কি সেনাদেরকে মূল মঙ্গোল সেনাদলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু খানের বড় পুত্র মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন, “আমি যদি পালাই, তবে বাবাকে কী উত্তর দেব?” 

তিনি সেনাদলটির নেতৃত্বে ছিলেন। যখন তিনি আদেশটি দিলেন তখন সেনারা কোনো প্রতিবাদ না করে ঘোড়ায় চড়ে বসল। চেঙ্গিস খান কখনোই এভাবে উপত্যকায় ধরা পড়ার মতো পরিস্থিতিতে অথবা সত্যিই ধরা পড়ার অবস্থায় নিজেকে ফেলতেন না। তিনি শাহের পুরো সেনাদল ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত তাদেরকে টেনে আনতেন। কিন্তু মাথা গরম জুখি তার সেনাদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সম্মুখভাগে ছিল তার ‘সুইসাইড স্কোয়াড’। পেছনে তার অশ্বারোহী সেনা। এক হাতে খোলা তলোয়ার আর আরেক হাতে বর্শা। অল্প অস্ত্রে সজ্জিত সেনারা প্রান্তগুলোকে পাহারা দিল। 

এভাবে এগিয়ে যাওয়ায় তাদের এদিক-ওদিক যাওয়ার জায়গা থাকল না, বা তাদের পছন্দের অস্ত্র তীর ব্যবহারের সময়ও পেল না। মঙ্গোল অশ্বারোহীরা তাদের ভারী আর ঈষৎ বাঁকা তরোয়াল নিয়ে তুর্কি সেনাদের ওপর নির্দয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। 

ইতিহাস বলে এই আক্রমণে মুসলমানদের প্রচণ্ড রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আর মঙ্গোলদের অগ্রযাত্রা যেহেতু তুর্কি সেনাদের কেন্দ্রের দিকে পৌঁছতে লাগল, শাহ নিজেই বিপদে পড়ে গেলেন। তিনি শিংওয়ালা পতাকার সেনাদলের তীরের আওতায় চলে এসেছিলেন। কেবল তার নিজস্ব রক্ষী বাহিনীর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় সে যাত্রা তিনি প্রাণে রক্ষা পান। আর জুখির জীবন রক্ষা করেন একজন ক্যাথি রাজপুত্র। সে জুখির সেনাদলে তার অধীনে লড়ছিল। 

ইতিমধ্যে মোঙ্গোলদের প্রান্তের দলগুলো এগিয়ে এলো, আর শাহের বড় পুত্র, সত্যিকারের তুর্কি, খারেসমীয় সেনাদের প্রিয়, জালাল উদ্দিন প্রতি-আক্রমণ চালালেন। ছোটখাটো গড়নের, কৃষ্ণকায় জালাল উদ্দিনের পছন্দ ছিল শক্ত পানীয় আর তলোয়ার খেলা। মঙ্গোল পতাকাকে তার কাহিনী হটিয়ে দিল আর দিনশেষে অশ্বারোহী সেনারা এই আক্রমণে ছড়িয়ে গেল। আর রাতের বেলা তাদের খুব পছন্দের, প্রথাগত চালাকি করল। যতক্ষণ অন্ধকার ছিল ততক্ষণ হয় তারা উপত্যকার ঘাসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল কিংবা তাদের ছাউনির আগুন প্রজ্বলিত রেখেছিল। এর মাঝে জুখি আর তার সেনারা পিছিয়ে এসে নতুন ঘোড়ায় চড়ে দুই দিন ধরে রাতের বেলা যুদ্ধযাত্রা করে এগিয়ে গেল। 

সকালবেলা দেখা গেল পুরো উপত্যকা শুধু মোহাম্মাদ শাহ আর তার সেনাবাহিনীতে পরিপূর্ণ, আর আছে নিহত সৈন্যদের মৃতদেহ। মঙ্গোলরা উধাও। 

যুদ্ধক্ষেত্র ঘুরে আপাত বিজয়ী তুর্কি সেনাদের দুর্ভাগ্যেরই দেখা পাওয়া গেল। ইতিহাস অনুসারে প্রায় ১, ৬০, ০০০ লোক মারা গিয়েছিল এই প্রথম যুদ্ধে। মনে হয় সংখ্যাটা অনেক বেশি বাড়িয়ে বলা। তবে মুসলমান সেনাদের ওপর মঙ্গোল সেনাদের দারুণ একটা প্রভাব পড়েছিল— মুসলমান সেনারা কোনো অভিযান শুরুর আগে জয় বা পরাজয়ে প্রভাবিত হতো। শাহের নিজের ওপরও উপত্যকার সেই যুদ্ধ কম প্রভাব ফেলেনি। “এই অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে একটা ভীতি আর তাদের সাহস সম্পর্কে একটা ধারণা সুলতানের মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল। কেউ যদি তার সামনে তাদের সম্পর্কে বলত, তখন তিনি উত্তর দিতেন, আমি জীবনে এমন সাহসী সেনা কখনো দেখিনি। তরবারির মাথা কিংবা ধার দিয়ে এত দক্ষ হাতে আঘাত করতে কাউকে দেখিনি।”

উঁচু উপত্যকায় সেনাদের খোঁজার কল্পনা শাহ আর করেননি। চিরুনি অভিযান চালিয়ে দেশটির সবকিছু মঙ্গোল সেনারা নিয়ে গেছে। তাদের এত বড় সেনার প্রতিপালন করার মতো ক্ষমতা তখন আর দেশটির নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এই শত্রু-সেনাদের প্রতি তার ভীতি তাকে বাধ্য করেছিল সির নদীতীরের তার সমৃদ্ধ শহরে ফিরে যেতে। নতুন সেনা, বিশেষ করে তীরন্দাজ সেনার জন্য তিনি দক্ষিণে সংবাদ পাঠালেন। ঘোষণা করলেন, তিনি পূর্ণ বিজয় অর্জন করেছেন, যুদ্ধ জয়ের নিদর্শনস্বরূপ তার সঙ্গী যোদ্ধাদের মাঝে সম্মানসূচক পোশাক বিতরণ করলেন। 

চেঙ্গিস খান দূতের কাছে প্রথম যুদ্ধের খবর শুনলেন। তিনি জুখির প্রশংসা করলেন— তাকে সাহায্য করার জন্য পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি সেনাদল পাঠালেন। আর সঙ্গে মুহাম্মাদ শাহের পিছু নেয়ার নির্দেশ। 

.

মূল সেনাদলের বাম প্রান্ত অর্থাৎ জুখির মঙ্গোল সেনারা এশিয়ার উঁচু এলাকার একটি উদ্যানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেখানকার প্রতিটি নদীর তীরে একটি দেয়ালঘেরা গ্রাম আর পর্যবেক্ষণ মিনার ছিল। এখানে তরমুজ আর সব আশ্চর্য ফল জন্মাত। মিনারের টাওয়ারগুলো উইলো গাছের ওপর বসানো ছিল। তাদের ডানে আর বামে ছিল ঈষৎ উঁচু এলাকা। সেই ঢালে গবাদিপশু চরে বেড়াত। আর সেসবের পেছনে ছিল সাদা উঁচু পাহাড়। আর তারও পেছনে আকাশ। 

ইয়ে লিউ চুতসাই তারই ভ্রমণের ভূগোলে এই ফলের কথা লিখে গেছেন। “দুই হাতের মুঠির মতো বড়, আর স্বাদ অম্লমধুর। লোকেরা এই ফল থেকে তার রস একটা পাত্রে বের করে—তৃষ্ণার্ত মানুষের জন্য দারুণ মজাদার এক পানীয় তাদের তরমুজগুলো হয় পঞ্চাশ পাউন্ডের। একটি গাধা অনেক কষ্টে মাত্র দুটো বহন করতে পারবে।” 

শীতের পরে, এই হিমশীতল গিরিপথ তখন মঙ্গোলদের জন্য হয়ে গেল একটি বিলাসিতা। নদী আরো প্রশস্ত হয়ে গেল আর তারা দেয়ালঘেরা বড় একটা শহরের কাছে পৌঁছল, নাম ‘খোজেন্দ’। এখানে তাদের সমর্থনে আসা পাঁচ হাজার সেনা, তাদের অপেক্ষায় ‘খোজেন্দ’ অবরোধ করে ছিল। 

শহরের তুর্কিদের সেনাপ্রধান ছিলেন এখন দারুণ সাহসী ব্যক্তি। তিমুর মালিক যার অর্থ লৌহ প্রভু। বাছাই করা এক হাজার সেনা নিয়ে তিনি একটি দ্বীপে অবস্থান নিয়ে সেখানেই অবস্থান করছিলেন। এরপরের ঘটনা, অদ্ভুত মোড় নিল। 

এখানে নদী ছিল চওড়া আর দ্বীপটিও ছিল প্রাচুর্যে ভরা। প্রাপ্ত সকল নৌকা তিমুর মালিক তার সঙ্গে নিয়ে গেলেন। সেখানে কোনো সেতু ছিল না। মঙ্গোলদের নির্দেশ দেয়া ছিল কোনো সমৃদ্ধ শহর পিছনে ছেড়ে আসা যাবে না। তারা পাথর ছুড়ে মারার অস্ত্র দিয়ে দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছতে পারছিল না। 

ধূর্ত আর সাহসী ব্যক্তিত্বের মিশ্রণ এই তুর্কি তিমুর মালিক। এই দ্বীপে বসে থাকলে তাকে কিছু করতে বাধ্য করা যাচ্ছিল না। মঙ্গোলরা তাদের চিরাচরিত উপায়ে অবরোধ করল—দেরি অপছন্দকারী জুখি একজন অর খানকে দায়িত্বে রেখে নদী বরাবর এগিয়ে গেলেন। 

কিছু সেনা পাঠিয়ে তারা আশেপাশের এলাকা থেকে বেশ কিছু লোক একত্রিত করলেন আর তাদের লাগিয়ে দিলেন বড় বড় আকারের পাথর সংগ্রহ করে সির নদীর তীরে জমা করতে। পাথর দিয়ে তৈরি সেতু তিমুর মালিকের দ্বীপের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তিনিও অলস বসে থাকলেন না। 

তিনি এক ডজন বড় নৌকা ঠিক করলেন। তাদের চারপাশে সেগুলো একটি কাঠের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করল। এরপর সেখানে তীরন্দাজদের রাখলেন। এরপরে প্রতিদিন তারা দাঁড় বেয়ে নদীর তীরে গিয়ে মঙ্গোলদের তীর মেরে আসত। ক্যাথির ক্ষেপণাস্ত্র বিশারদ এই বড় নৌকাগুলো মোকাবেলার জন্য একটা অস্ত্র উদ্ভাবন করলেন। প্রথম প্রক্ষেপক যন্ত্র তৈরি হলো—পাথর ছোড়ার প্রক্ষেপক। নৌকাগুলোর দিকে কেবল পাথর ছোড়ার বদলে তারা আগুনের গোলা ছুড়তে লাগল। একটি পাত্রে করে জ্বলন্ত সালফার বা সেই ক্ষেপণাস্ত্রবিশারদের তৈরি করা অন্য কিছু। তিমুর মালিক তার নৌকায় পরিবর্তন আনলেন। ধারের দেয়ালগুলো আর ছাদ ঢালু করে তৈরি করলেন। ওপরে মাটি লেপে দিলেন। শুধু তীর ছোড়ার জন্য একটু ফাঁকা জায়গা রাখলেন। 

ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিদিনের যুদ্ধ আবার শুরু হলো। কিন্তু পাথর দিয়ে তৈরি সেতু দৈর্ঘ্যে লম্বা হতে লাগল আর তিমুর মালিক বুঝতে পারলেন, এই দ্বীপে আর খুব বেশি সময় তিনি অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন না। তিনি তার সবচেয়ে বড় নৌকাটিতে সব লোক তুললেন— দেয়ালঘেরা নৌকাগুলোতে তার সবচেয়ে ভালো যোদ্ধাদের; এরপরে দ্বীপ ফাঁকা করে ফেললেন, রাতে নদীপথে আলো জ্বেলে রওনা হলেন। সির নদী বরাবর তৈরি করা ব্যূহ ভেঙে তিনি বেরিয়ে গেলেন। 

কিন্তু মঙ্গোল অশ্বারোহীরা নদী বরাবর তার এই পলায়নে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিছু নিল। ওদিকে নদী বরাবর অনেক আগেই এগিয়ে যাওয়া জুখি, নদীর ভাটিতে নৌকা দিয়ে সেতু তৈরি করছিলেন। তিনি তার প্রকৌশলীদের পাথর ছোড়ার যন্ত্র দিয়ে এই নৌবহরের মোকাবেলা করতে বললেন। এই প্রস্তুতির কথা তুর্কি সেনাপতির কানে পৌঁছল। তিনি তার লোকদের এক বিজন নদীতীরে নামিয়ে দিলেন। মঙ্গোলরা যখন তাদের নদীতে হারিয়ে ফেলল তখন তাদের খোঁজ শুরু করল, আর এক সময় খুঁজেও পেল। অল্পসংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে পলায়নরত তিমুর দেখতে পেলেন তার লোকদের কেটে ফেলা হচ্ছে। 

তিমুরের সঙ্গে এখন আর কোনো অনুসারী নেই। ভালো ঘোড়া থাকায় তিনজন ছাড়া বাকি সব মঙ্গোলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন। কাছাকাছি তিনজনকে তিনি সৌভাগ্যবশত হত্যা করতে সমর্থ হলেন। একটি তীর একজন অশ্বারোহীর চোখে লাগল। তিনি জীবিত বাকি দুজনকে বললেন, “আমার কাছে আর দুটি তীরই আছে। আর সেগুলোরও নিশানা ভুল হবে না।” 

কিন্তু এই শেষ তীরগুলির দরকার হয়নি। তিনি পরের রাতেই পালিয়ে যান এবং আরো দক্ষিণে, শাহ-এর পুত্র, যোদ্ধা জালাল উদ্দিনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে সমর্থ হন। তিমুর মালিকের সাহসের কথা মঙ্গোল আর তুর্কিরা একইভাবে স্মরণ করেছে আর সেভাবেই বর্ণনা করে গেছে। তিনি মঙ্গোল সেনাদলকে এক মাসের জন্য আটকে রেখেছিলেন। এই অবরোধ নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলায় মঙ্গোলদের ক্ষমতা প্রমাণ করেছিল। তবে এই ঘটনা এক হাজার মাইল এলাকা ধরে চলা আসল যুদ্ধের তুলনায় খুব নগণ্য একটি ঘটনা। 

১৫. বোখারা 

শাহ যখন উঁচু পর্বতমালা থেকে নিচে নামলেন, তখন তিনি তার সৈন্য নিয়ে উত্তরে সির নদীর দিকে ঘুরে গেলেন। সেনাদের আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। উদ্দেশ্য, যখনই তারা নদী পার হওয়ার চেষ্টা করবে তখনই আক্রমণ করা। কিন্তু বৃথাই তিনি অপেক্ষা করলেন। 

কী ঘটেছিল তা বোঝার জন্য আমাদেরকে ম্যাপের দিকে তাকাতে হবে। মোহাম্মদ শাহের সাম্রাজের উত্তর অংশ ছিল অর্ধেক উর্বরা এলাকা। আর বাকিটা বালুময় মরুভূমি, তবে সমতল। লালচে আর নিষ্প্রাণ। ফলে, কেবল নদীর ধার ঘেঁষে আর পাহাড়ের ভেতরে শহর গড়ে উঠেছিল। 

দুইটি বড় নদী এই মরু এলাকার ভিতর দিয়ে উত্তর-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে, ছয় শ মাইল পেরিয়ে লবণাক্ত আড়াল সাগরে পতিত হয়েছিল। এই নদী দুটোর প্রথমটি ছিল ‘সির’ নদী। আর এখানে ছিল দেয়ালঘেরা শহরগুলো, একটির সঙ্গে অন্যটির যোগাযোগ ছিল কাফেলা চলা পথ দিয়ে। এই ঊষর এলাকায় তৈরি হয়েছিল মানুষ আর গবাদির এক মেলবন্ধন। দক্ষিণের দ্বিতীয় নদীটি ছিল ‘আমু’। এক সময় বলা হতো ‘অক্সাস’। আর এর কাছেই অবস্থিত ইসলামের দুর্গ বলে পরিচিত ‘বোখারা’ আর ‘সমরখন্দ’। 

শাহ তার শিবির ফেললেন সির নদীর পেছনে। তবে মঙ্গোলরা এগিয়ে আসছে কিনা তা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি দক্ষিণ থেকে নতুন সেনা আর নতুন একটি এলাকা থেকে কিছু কর আসার প্রত্যাশা করছিলেন। সেনাদের অগ্রযাত্রা ভয়ঙ্কর এক খবরে বাধাগ্রস্ত হলো। মঙ্গোলরা নিচের দিকে নামছে তার দুশো মাইল ডানের উঁচু গিরিপথ দিয়ে, একদম তার পেছনে। 

আসলে যা ঘটেছিল তা হচ্ছে, জুখিকে ছেড়ে খেপ নয়ন পাহাড়ি এলাকা পেরিয়ে দক্ষিণে যাচ্ছিলেন। খারেসম যাওয়ার এই পথ পাহারার দায়িত্বে থাকা তুর্কি সেনাদের কাছ থেকে এলাকা দখল করে নিয়ে তার কাহিনী হিমবাহের ওপর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছিল বরফ হয়ে যাওয়া ‘আমু’ নদীর উৎসমুখের দিকে। তাদের পথে মাত্র দুশ’ মাইলের মধ্যেই পড়বে ‘সমরখন্দ’। খেপ নয়নের সঙ্গে বিশ হাজারের চেয়ে বেশি সৈন্য ছিল না। তবে সংখ্যাটা শাহ জানতে পারেননি। 

.

আমু নদী এবং দুই বড় শহর বোখারা আর সমরখন্দ ছিল তার দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ব্যূহ। আরো সৈন্যের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার বদলে দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ব্যূহর সঙ্গে তার যোগাযোগ এখন ছিন্ন হতে যাচ্ছে। নতুন বিপদ দেখে ভয়ে ভীত হয়ে মোহাম্মাদ শাহ এমন একটা কাজ করলেন, যে কারণে মুসলমান ইতিহাসবিদরা পরবর্তীতে তার প্রচণ্ড সমালোচনা করেছিলেন। তিনি তার সেনাদের দুই সমৃদ্ধ শহরে ভাগ করে দিয়েছিলেন। 

সির নদী বরাবর অবস্থান নেয়া সেনাদের শক্তিশালী করতে ৪০,০০০ সেনা পাঠানো হলো। আর তার বেশিরভাগ সেনাদল নিয়ে তিনি দক্ষিণে রওনা দিলেন। ৩০,০০০ সেনা পাঠালেন বোখারায় আর বাকিদের পাঠালেন সমরখন্দে, মূল আক্রমণের কেন্দ্রে। তিনি এই কাজ করেছিলেন এই ভেবে যে, মঙ্গোলরা তার দুর্গ দখল করতে পারবে না। একটা বছর আক্রমণ আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ক্ষান্ত দেবে। দুটো ধারণাতেই তিনি ভয়ানকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছিলেন। 

এর আগেই সির নদীর উত্তরে, ওত্রারে খানের দুই পুত্র পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই ওত্রারের শাসকই মঙ্গোল ব্যবসায়ীদের হত্যা করেছিল। আর সেই হত্যার নির্দেশ দেয়া ইনালজুক তখনো ওত্রারের শাসক। তিনি ভালোমতোই জানতেন মঙ্গোলদের কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার আশা খুবই ক্ষীণ। তিনি শ্রেষ্ঠ কয়েকজন যোদ্ধা নিয়ে নিজেকে দুর্গে অন্তরীণ রাখলেন, পাঁচ মাস সেখানে ছিলেন। তিনি শেষ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিলেন। যখন মঙ্গোলরা তার এলাকা দখল করে তার শেষ সেনাটিকে হত্যা করছিল, তখন তিনি একটি টাওয়ারে আশ্রয় নিয়েছিলেন যখন তার তীর শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি তার শত্রুদের দিকে পাথর ছুড়ছিলেন। এমন মরিয়া আচরণের পরও তাকে জীবিত ধরা হয় এবং খানের কাছে পাঠানো হয়। খান তখন তার চোখে আর কানে গরম রুপো ঢালার নির্দেশ দেন— তার কাজের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া একটি মৃত্যু। ওত্রারের দেয়াল ধ্বংস করা হয় আর সব মানুষকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। 

এ ঘটনা যখন চলছিল, মঙ্গোলদের দ্বিতীয় একটি দল তখন সির নদী বরাবর এগিয়ে গিয়ে তাসখন্দ দখল করল। তৃতীয় আরেকটি দল সির নদীর উত্তর ভাগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করল। ছোট ছোট শহরগুলো দখল করে ফেলল। তুর্কি সেনারা জেন্দ শহর ছেড়ে পালিয়ে গেল। আর মঙ্গোলরা যখন দেয়ালে মই লাগিয়ে শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করল, তখন শহরবাসী আত্মসমর্পণ করল। এমন অবস্থায় যুদ্ধের প্রথম বছরে, শাহের সেনাদেরকে আর তুর্কি সেনাদলকে গণহারে হত্যা করা হয়। আর মূল শহরবাসীদের, যাদের মধ্যে বেশিরভাগ পার্সি ছিলেন, তাদের শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর বেশ অবসর নিয়ে শহরটি ধ্বংস করা হয়। 

এরপরে বন্দিদের মধ্যে চলে বাছাই। শক্ত-সমর্থদের পরবর্তী শহর দখলের সময় কাজে লাগানোর জন্য শ্রমিক হিসেবে রেখে দেয়া হয়। শিল্পীদের কাজ ছিল বিজয়ীদের সুন্দর ছবি আঁকা। একবার মঙ্গোলদের কাছ থেকে আসা একজন দূত, যিনি নিজে মুসলমান ব্যবসায়ী ছিলেন, তাকে শহরবাসী ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ভয়ঙ্কর মঙ্গোলরা আক্রমণ চালাল। যুদ্ধ চলতেই থাকল। নতুন সেনারা মৃতদের স্থান নিল, স্থানটি দখল না হওয়া পর্যন্ত তীর বা তলোয়ার দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকল। 

সির নদীর ধারে চেঙ্গিস খান একেবারেই আবির্ভূত হননি। তিনি সেনাদলের মধ্যভাগকে নিয়ে যেন গায়েবই হয়ে গেলেন। কোন পথে তিনি নদী পার হয়েছিলেন বা তিনি কোথায় গিয়েছিলেন, তা কেউ জানে না। কিন্তু তিনি অবশ্যই লাল মরুভূমির ভেতর বড় একটি বৃত্ত রচনা করেছিলেন। কারণ এই মরু এলাকার বাইরে তিনি আবার উদয় হন, তিনি তখন পশ্চিম থেকে বোখারার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলেন। 

মোহাম্মদ শাহ কেবল তার দু’পাশের সৈন্যদেরই হারাননি। দক্ষিণের বাকি সৈন্যদের সঙ্গে, তার পুত্র, তাকে সাহায্য করতে আসা দল আর খোরাসান আর পারস্যের সমৃদ্ধ এলাকা, সব কিছুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার বিপদ তৈরি হতে যাচ্ছিল। যখন খেপ নয়ন পূর্বদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, চেঙ্গিস খান তখন পশ্চিম থেকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সমরখন্দে থাকা শাহ তখন ভাবছিলেন, তিনি ফাঁদে আটকা পড়েছেন আর সেই ফাঁদ ধীরে ধীরে গুটিয়ে আনা হচ্ছে। 

এই অস্বস্তিকর অবস্থার কারণে তিনি তার মূল সেনাদলকে বোখারা আর সমরখন্দে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তার অন্যান্য তুর্কী শাসকদের (আতাবেগ) বালখ আর কুন্দুজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার নিজস্ব বিশ্বস্ত কিছু সভাসদ, তার হাতিগুলো, উটের বহর আর গৃহস্থালি আসবাব নিয়ে তিনি সমরখন্দ ছেড়ে পালালেন। তিনি তার সম্পদ আর তার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। মনে আশা, নতুন সেনাদলের সেনাপতি হিসেবে শীঘ্রই ফিরে আসবেন। 

তার এই আশাতেও তিনি হতাশ হয়েছিলেন। 

মোহাম্মাদ শাহ, যাকে তার সেনারা দ্বিতীয় আলেকজান্ডার বলত, এই মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষণভাবে পরাস্ত। খানের পুত্রের অধীনে মঙ্গোলরা, আগুন আর তলোয়ার নিয়ে সির নদী বরাবর এগিয়ে আসছে। তবে সেগুলো আসল আক্রমণের অনেকগুলো মুখোশের একটি। খেপ নয়ন আর চেঙ্গিস খান এগিয়ে আসছেন আসল আক্রমণের জন্য। 

খান মরুভূমির ভেতর দিয়ে দ্রুত এগোতে থাকলেন। তার এতই তাড়া ছিল যে, পথে যেসব ছোটখাটো শহর পড়ছিল সেগুলো দখলের পরে ধ্বংস করার জন্য সময় নষ্ট করছিলেন না, কেবল তার ঘোড়াগুলোর জন্য পানি নিচ্ছিলেন। তিনি মোহাম্মদ শাহকে বোখারায় চমকে দিতে চাইছিলেন। কিন্তু যখন তিনি পৌঁছলেন তখন জানতে পারলেন শাহ আগেই পালিয়ে গেছে। তিনি ইসলামের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি, বিদ্বানদের শহর, বারো লীগ (এক লীগ আনুমানিক তিন মাইলের সমান) দীর্ঘ দেয়াল দিয়ে ঘেরা, তার মুখোমুখি হলেন— ইতিহাস বলে শহরের চারপাশ দিয়ে সুন্দর নদী বয়ে গিয়েছিলে। ছিল বাগান আর সুখী গৃহ। শহরটিতে ২০,০০০ তুর্কি সেনা আর বিশালসংখ্যক পার্সি সেনা ঘাঁটি করে ছিল। ছিলেন ইসলামের সম্মানিত পণ্ডিত ‘ইমাম’ আর ‘সৈয়দ’রা বা তাদের গ্রন্থ অনুবাদ করে বুঝিয়ে দেয়ার লোকেরা। 

শহরে সুপ্ত এক আগুন ছিল। মুসলমানদের মাঝে ধর্মের প্রতি গভীর এক অনুভূতি ছিল। তবে তারা এই মুহূর্তে একটা মিশ্র অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীরটা বেশ শক্ত, আক্রমণে ভেঙে পড়ার মতো নয়। যদি তারা শহরটি প্রতিরক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও মঙ্গোলরা এক ইঞ্চি জায়গাও দখল করতে পারবে না। 

চেঙ্গিস খান খুব সত্যি একটা কথা বলেছিলেন, “একটি দেয়ালের শক্তি এটিকে রক্ষা করা মানুষদের সাহসের চেয়ে বেশিও না, কমও না।” এক্ষেত্রে শহরবাসীকে তাদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে তুর্কি সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়ে শাহের সঙ্গে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা রাতের বেলা পানি নির্গমনের দরজা দিয়ে শাহের সৈন্যদের সঙ্গে আমু নদীর দিকে বেরিয়ে পড়ল। 

এই চলার পথে মঙ্গোলরা তাদের আঘাত করল। তবে তিনটি সেনাদল তাদের অনুসরণ করল আর নদীর কাছে গিয়ে তাদের ধরে ফেলল। এখানে তুর্কিরা আক্রান্ত হলো আর প্রায় সবাইকেই তলোয়ারের নিচে পড়তে হলো। 

সেনাদলের কাছে পরিত্যক্ত হওয়ার পরে শহরের মুরব্বি, বিচারক আর ইমামগণ নিজেরা আলোচনা করলেন আর আশ্চর্য, তারা খানের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ করতে বেরিয়ে এলেন। তাকে শহরের চাবি হস্তান্তর করলেন। বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি আনলেন শহরবাসীর কোনো ক্ষতি করা হবে না। বাকি যোদ্ধাসহ শহরের শাসক নিজেকে দুর্গে পিছনে বন্দি করে রাখলেন। মঙ্গোলরা খুব দ্রুতই সেই দুর্গে হানা দিল। ছাদে আগুন না লেগে যাওয়া পর্যন্ত তারা জ্বলন্ত তীর ছুড়ে আক্রমণ চালাতে লাগল। 

শহরের প্রশস্ত রাস্তাগুলো অশ্বারোহীতে ভরে গেল। শস্যভাণ্ডার আর গুদামগুলো লুটপাট শুরু হলো। লাইব্রেরিকে বানানো হলো ঘোড়ার আস্তাবল। মুসলমানদের দুঃখের সীমা থাকল না— যখন তারা দেখল তাদের পুণ্য গ্রন্থ কোরানের ছেঁড়া পাতা ঘোড়ার খুড়ের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খান নিজে একটি বিশাল দালানের সামনে তার ঘোড়া থামালেন। দালানটি ছিল শহরের বড় মসজিদ। তিনি জানতে চাইলেন এটাই কি সম্রাটের প্রাসাদ? তাকে জানানো হলো, এটা আল্লাহর ঘর। 

সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার ঘোড়া সিঁড়ির ওপর চড়িয়ে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করলেন। ঘোড়া থেকে নেমে মেহরাবে রাখা বড় কোরানটির কাছে গেলেন। এখানে কালো রঙের পোশাক আর চামড়ায় ঘেরা শিরোস্ত্রাণ পরে তিনি শহরের মোল্লা আর বিদ্বানদের সম্বোধন করলেন, যারা আশা করেছিলেন যে স্বর্গ থেকে আগুন এসে এই অদ্ভুত শক্তিকে ধ্বংস করে দেবে। 

তিনি তাদের বললেন, “আমি তোমাদের এই কথা বলতেই এখানে এসেছি যে, তোমাদের অবশ্যই আমার সেনাদের জন্য রসদ সরবরাহ করতে হবে। গ্রাম এলাকায় কোনো খড় আর শস্য নেই। আর আমার সৈন্যরা ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে। তাই প্রথমে দরজা খুলে দাও, এরপরে তোমাদের গুদাম।” 

এরপর যখন বয়স্ক লোকেরা দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন দেখলেন গোবির এসব যোদ্ধা ইতিমধ্যেই তাদের গুদাম থেকে জিনিসপত্র নেয়া শুরু করে দিয়েছে। আর ঘোড়াগুলোকে রেখেছে আস্তাবলে। সেনাদের এই দলটি মরুভূমির ভেতর দিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, তাই অনেক দিন তারা এমন প্রাচুর্য দেখেনি। 

মসজিদ থেকে খান শহরের মাঝের চৌরাস্তায় গেলেন। সেখানে বিজ্ঞান আর নিয়মের ওপর একজন ঘোষকের ভাষণ শোনার জন্য অনেক লোক জড়ো হতো। 

একজন আগন্তুক জানতে চাইলেন, “এই লোকটি কে?” 

অন্যজন উত্তর দিল, “চুপ! এ হচ্ছে আমাদের ওপর পাঠানো আল্লাহ্র ক্রোধ।”

খান জানতেন এত বড় জমায়েতে কীভাবে কথা বলতে হয়। ইতিহাস বলে, বক্তার জন্য নির্ধারিত স্থানে উঠে তিনি বোখারার লোকেদের মুখোমুখি হলেন। প্রথমে তিনি তাদের ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। এরপর তিনি জানালেন মক্কায় হজ করতে যাওয়া একটা বড় ভুল। ‘স্বর্গের ক্ষমতা কেবল এক জায়গায় থাকবে কেন? পৃথিবীর সব কোনাতেই থাকবে। 

বৃদ্ধ গোত্রপ্রধান চেঙ্গিস খান শ্রোতাদের ভাবনা বুঝতে পারলেন। মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ভীতি টের পেলেন। তিনি তাদের কাছে এখন ঐশ্বরিক বিনাশকারী বর্বর এক শক্তির পুনরুত্থান। বোখারা এতদিন প্রাচীরের অভ্যন্তরে ধর্মের অনুগত লোক ছাড়া আর কাউকে দেখেনি। 

তিনি তাদের আশ্বস্ত করলেন, “তোমাদের সম্রাটের পাপ অনেক। স্বর্গের বিনাশকারী যন্ত্র আমি। আমি এসেছি তোমাদের সম্রাটকে ধ্বংস করতে। অন্য সম্রাটদের যেভাবে শেষ করেছি সেভাবে। তোমরা কেউ তাকে রক্ষা বা সাহায্য কোরো না।” 

দোভাষী তার কথা ব্যাখ্যা করা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। তার কাছে মনে হলো মুসলমানরা ক্যাথিবাসীদের মতোই। শহরের স্রষ্টা আর বইয়ের লেখক। তাকে সুন্দরভাবে সাজাতে কাজে দেবে। তার সম্পদ বাড়াতে কাজে দেবে। আর কাজে দেবে পৃথিবী সম্পর্কে তথ্য জানতে। তার লোকদের জন্য শ্রমিক আর দাস পাওয়া যাবে। তিনি শিল্পীদের গোবি এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন। 

তিনি আরও বলে চললেন, “তোমরা আমার সেনাদের খাবারের ব্যবস্থা করে খুব ভালো কাজ করেছ। এখন যা কিছু মূল্যবান জিনিস তোমরা লুকিয়ে রেখেছ, সেসবও আমার সেনাদের কাছে নিয়ে আসো। যেসব জিনিস বাসায় এমনি পড়ে আছে, সেসব কষ্ট করে আনতে যেও না।”

বোখারার ধনী ব্যক্তিদের মঙ্গোলদের নজরদারিতে রাখা হলো। মঙ্গোলরা তখনো তাদের ছাড়েনি, দিনরাত তাদের সঙ্গে রক্ষী থাকত। যাদের সন্দেহ করত, হয়তো ওদের কাছের সব মূল্যবান জিনিস তারা বের করে দেয়নি— তাদের তারা অত্যাচার করত। মঙ্গোল সেনারা নর্তকী আর সঙ্গীত বাদকদের ডেকে ইসলামী সঙ্গীত বাজাতে বলত। মসজিদ আর প্রাসাদে বসে, হাতে মদের গ্লাস নিয়ে তারা শহর আর উদ্যানে থাকা এসব মানুষের মনোরঞ্জন মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করত। 

দুর্গের ভেতরে থাকা সেনারা সাহসিকতার সঙ্গে তখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। এতে মঙ্গোলদের ক্ষতিও হচ্ছিল। ক্ষুব্ধ মঙ্গোলরা শহরের গভর্নর আর অনুসারীদের খতম করে দিল। যখন শহরের সব মূল্যবাদ সম্পদ, মাটির নিচে রাখা গুপ্তধন তারা পেয়ে গেল, তখন তারা শহরবাসীকে তাড়িয়ে সমতল এলাকায় পাঠিয়ে দিল। এই কষ্টের বর্ণনা মুসলমান ইতিহাসবিদের লেখায় পাওয়া যায়। 

“দিনটি ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। কেবল পুরুষ, মহিলা আর শিশুদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এদেরকে চিরতরে আলাদা করে দেয়া হচ্ছে। বর্বররা এই নিরীহ মানুষদের সামনেই তাদের নারীদের ধর্ষণ করেছিল, এই দুঃখ সামলানোর কোনো সাধন তাদের ছিল না; এদের কেউ কেউ, তাদের পরিবারের এই অপমান সহ্য করার চেয়ে যোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল আর প্রাণ হারিয়েছিল।” 

শহরের বিভিন্ন এলাকা জ্বালিয়ে দেয়া হলো। আগুনের শিখা সব শুকনো কাঠ আর কাদার তৈরি জিনিসের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। বোখারার ওপরে যেন কেউ একটি ‘ধোঁয়া’র চাদর বিছিয়ে দিয়েছিল, সূর্য ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। বন্দিদের সমরখন্দের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। অশ্বারোহী মঙ্গোলদের সঙ্গে একই তালে চলতে না পেরে এই লোকেরা দারুণ কষ্ট পেল। 

.

চেঙ্গিস খান কেবল দুই ঘণ্টা বোখারায় ছিলেন। শাহকে খোঁজার জন্য তাড়াহুড়ো করে সমরখন্দের দিকে এগিয়ে গেলেন। পথে, সির নদীর তীর থেকে আসা তার অপর সেনাদলের সঙ্গে দেখা হলো, আর তার পুত্র নদীর উত্তর পারের শহরগুলো কব্জার খবর দিলেন। 

শাহের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল সমরখন্দ। তিনি নতুন একটি দেয়াল তৈরি শুরু করলেন। আকারে বিশাল, আর তার বাগান ঘিরে ফেলার মতো বিস্তৃত। কিন্তু মঙ্গোলদের দ্রুত এগিয়ে আসা তার এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শেষ করতে দিল না। পুরনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব খারাপ ছিল না। বারোটি লোহার দরজা। দরজার পাশে মিনার। বিশটি সশস্ত্র হাতি আর এক লাখ দশ হাজার তুর্কি আর পারস্যের সেনা রয়েছে শহর রক্ষার দায়িত্বে। মঙ্গোলরা এই সেনাদলের তুলনায় সংখ্যায় কম ছিল আর চেঙ্গিস খান দীর্ঘ সময়ের অবরোধের প্রস্তুতি নিলেন— আশপাশের এলাকার লোকজন আর বোখারার বন্দীদের এই কাজে ব্যবহারের জন্য জড়ো করলেন। 

যদি শাহ তার লোকদের মাঝেই থাকতেন বা তিমুর মালিকের মতো একজন সেনার হাতে নেতৃত্ব থাকত, খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত হয়তো সমরখন্দ এই অবরোধের মোকাবেলা করত। কিন্তু মঙ্গোলদের দ্রুত আর নিয়মতান্ত্রিক প্রস্তুতি মুসলমানদের শঙ্কিত করে দিল। কারণ তারা দূর থেকে বহুসংখ্যক বন্দিকে দেখতে পেল, আর বাস্তবিকপক্ষে সৈন্যসংখ্যা যত ছিল, তার চেয়ে বোধ অনেক বেশি ভাবল। সেনাদল একবার আকস্মিকভাবে বেরিয়ে এলো, আর তা করতে গিয়ে তারা মঙ্গোলদের চিরাচরিত অ্যামবুশের শিকার হলো। ভয়ানকভাবে পরাজিত হলো। এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি শহর রক্ষাকারীদের মনোবল ভেঙে দিল। যেদিন সকালবেলা মঙ্গোল সেনারা প্রাচীরের এক অংশে আক্রমণ চালাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেদিন ‘ইমাম’ আর বিচারকরা বেরিয়ে আসে আর শহর সমর্পণ করে। ত্রিশ হাজার কাঙ্কালি তুর্কি নিজে থেকেই মঙ্গোলদের কাছে গেলে তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করা হলো, তাদের মঙ্গোলদের সামরিক পোশাক দেয়া হলো আর এক বা দুই রাত পরে তাদের গণহারে হত্যা করা হলো। মঙ্গোলরা কখনোই খারেসমের তুর্কিদের বিশ্বাস করত না, বিশেষ করে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করত। 

শহরের দক্ষ শ্রমিকদের সেনাবাহিনীতে আনা হলো আর বাকি কর্মক্ষম লোকদের অন্য কাজে নিয়োগ দেয়া হলো। শহরের বাকি লোকদের তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানো হলো। কিন্তু এক বছর পরে তাদের পুনরায় সেনাবাহিনীতে ডেকে পাঠানো হলো। 

ইয়ে লিউ চুতসাই সমরখন্দ সম্পর্কে লিখেছেন, “শহরের চারপাশে, অনেক মাইল এলাকা জুড়ে, সবদিকে শুধু বাগান, একের পর এক ছোট-বড় ফলের বাগান, ফুলের বাগান, বয়ে চলা ঝরনা, ছোট পুকুর। সত্যিই, সমরখন্দ ছিল দারুণ একটি শহর।” 

১৬. সেনাপ্রধানদের যাত্রা 

সমরখন্দে চেঙ্গিস খানকে জানানো হলো যে মোহাম্মাদ শাহ শহর পরিত্যাগ করেছেন এবং আরো দক্ষিণ দিকে পালিয়ে গিয়েছেন। মঙ্গোল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে নতুন সেনা গড়ে তোলার পূর্বেই শাহকে বন্দি করবেন। তিনি খারাসেম-এর সম্রাটকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর তাই খেপ নয়ন আর সুবোতাইকে পাঠালেন আর তাদের আদেশ দিলেন—

মোহাম্মাদ শাহ পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক সেখানেই তাকে অনুসরণ করো। তাকে জীবিত কিংবা মৃত খুঁজে বের করো। যেসব শহর তোমাদের ঢোকার জন্য দরজা খুলে দেবে সেখানে কিছু কোরো না। তবে যেসব শহর প্রতিরোধ করবে, আক্রমণ করে সেসবের দখল নেবে। যতটা কঠিন মনে করছ, মনে হয় না কাজটা ততটা কঠিন হবে। 

প্রায় একডজন রাজ্য খুঁজে একজন সম্রাটকে খুঁজে বের করা অদ্ভূত এক কাজ। দারুণ নিষ্ঠুর আর নির্ভুল এই ‘অর খান’দের জন্য এটা একটা কাজই বটে! তাদেরকে বিশ হাজার সেনার দুটি সেনাদল দেয়া হলো। এই নির্দেশনা আর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তখনই দুই সেনাপ্রধান দক্ষিণের দিকে রওনা হলেন। ১২২০ সালের এপ্রিল মাস, সাপের বছর। 

মোহাম্মাদ শাহ সমরখন্দ থেকে দক্ষিণে বালখের দিকে গেলেন। আফগানিস্ত ানের পর্বতমালার প্রান্তে দারুণ উর্বরা একটি এলাকা। যথারীতি তিনি স্থান পরিবর্তন করে থাকছিলেন। জালাল উদ্দিন তখন অনেক দূরে, উত্তরে, আড়াল সাগরের কাছাকাছি মরু দেশগুলো থেকে সৈন্য জোগাড় করে সেনাবাহিনী গঠনের চেষ্টা করছেন। কিন্তু বোখারায়, শাহ আর তার সম্ভাব্য আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুর মাঝে অবস্থান করছেন চেঙ্গিস খান। 

তিনি একবার আফগানিস্তানে প্রবেশের কথা চিন্তা করলেন। ওখানে যুদ্ধবাজ উপজাতিরা তার অপেক্ষায় আছে। অবশেষে বিজ্ঞ সভাসদের ইতস্ততা আর তার সাহসের মাঝে তিনি পশ্চিমে যাত্রার সিদ্ধান্ত নিলেন। উত্তর পারস্যের ঊষর পাহাড়ি এলাকা পেরোলেন আর পৌঁছলেন নিসাপুরে। ভেবেছিলেন তার আর মঙ্গোল সেনাদের মাঝে এখন পাঁচ শ মাইলের ব্যবধান। 

আমু নদীতে যাওয়ার পথে একটি শক্ত শহরের দেখা পেলেন। ঘোড়াগুলোকে সাঁতার কাটিয়ে নদী পার করালেন আর তখন অগ্রবর্তী সেনাদলের কাছ থেকে খবর পেলেন যে, শাহ বালখ পরিত্যাগ করেছেন। তাই তারা পশ্চিমের মরু এলাকার দিকে ঘুরে গেলেন। একটু বেশি প্রতিরক্ষা আর ঘোড়ার ঘাস জোগাড় করার চেষ্টার জন্য তারা আলাদা হয়ে গেলেন। 

সেনাদল দুটির প্রত্যেকের কাছে সুস্থ একাধিক ঘোড়া আছে। আর ছড়ানো ঝরনা আর কুয়ার পাশেও রয়েছে ঘাস। তারা অবশ্যই দিনে প্রায় আশি মাইল পথ চলছিলেন, দিনের মধ্যে কয়েকবার ক্লান্ত না হওয়া ঘোড়াগুলো পাল্টে নিচ্ছিলেন আর কেবল সন্ধ্যায় থামছিলেন রান্না করা খাবার খাওয়ার জন্য। মরুভূমির শেষে তারা দেখা পেলেন গোলাপ বাগান আর প্রাচীন মার্ভের সাদা দেয়ালের। 

নিজেরা যখন সন্তুষ্ট হলেন যে, এখানে শাহ থাকতে পারেন না, তারা তখন নিসাপুরের দিকে রওনা হলেন। মোহাম্মাদ শাহ নিসাপুর পৌঁছার তিন সপ্তাহ পরে তারা সেখানে পৌঁছলেন। মোহাম্মাদ শাহ এই অভিযানের কথা আগেই জানতে পেরেছিলেন আর আক্রমণের আশঙ্কায় সেখান থেকে পালিয়েছিলেন। নিশাপুর তাদের দরজা বন্ধ করে দিল আর যোদ্ধারা ভয়ঙ্করভাবে আক্রমণ করলেন। প্রাচীর ভেঙে তারা ভেতরে ঢুকতে পারলেন না, তবে তারা জানতে পারলেন, ভেতরে শাহ নেই। 

তারা গন্ধ পেয়ে গেলেন আর পুনরায় কাস্পিয়ানের দিকে চলা কাফেলার রাস্তা ধরে পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। শাহের বাকি সেনারা, যারা মঙ্গোলদের ভয়ে এই পথে পালাচ্ছিল, তাদের ছত্রভঙ্গ করে ফেলছিলেন। বর্তমান তেহরানের কাছে ত্রিশ হাজার সৈন্যের এক পারস্য সেনাদলের মুখোমুখি হলেন আর তাদের হারিয়ে দিলেন। 

আবার তারা আলাদা হয়ে গেলেন— এই মুহূর্তে পলায়নরত শাহের সব চিহ্ন তারা হারিয়ে ফেললেন— সুবোতাই উত্তরে পর্বতময় এলাকার দিকে এগোলেন, খেপ নয়ন এগোলেন দক্ষিণে লবণাক্ত মরুভূমির শেষ প্রান্তের দিকে। তারা মূল খারাসেম পেরিয়ে চলে এলেন। যে কারণে তাদের এখানে আসা, সেই কারণ তারা ছাড়িয়ে গেলেন। 

ইতিমধ্যে মোহাম্মদ শাহ প্রথমে তার পরিবার আর পরে তার সম্পদ সরিয়ে ফেললেন। তিনি একটি দুর্গে সিন্দুক ভর্তি অলঙ্কার ফেলে এসেছিলেন—সেগুলো মঙ্গোলরা পরে সেখানে খুঁজে পায়—আর বাগদাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাগদাদে এখন সেই খলিফা শাসন করছেন, যার সঙ্গে কিছুদিন আগেই মোহাম্মদ শাহ ঝগড়া করেছিলেন। তিনি এখান-সেখান থেকে লোক জড়ো করলেন, কয়েক শ অনুগামী হলো। বাগদাদ যাওয়ার মূল সড়ক দিয়ে তিনি চলতে শুরু করলেন। 

কিন্তু হামাদানে মঙ্গোলরা তার পিছু নিল। তার লোকেরা ছত্রভঙ্গ হলো, আর তাদের হত্যা করা হলো। তার দিকেও বেশকিছু তীর ছোড়া হলো-—আসলে মঙ্গোলরা তাকে চেহারায় চিনত না। তিনি পালাতে সমর্থ হলেন, আর দ্বিগুণ গতিতে কাস্পিয়ানের দিকে ফেরত আসতে লাগলেন। তার কিছু তুর্কি যোদ্ধা ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহ করল। মোহাম্মদ শাহ দেখলেন তার তাঁবুর পাশে লাগানো আরেকটি ছোট তাঁবুতে ঘুমানো বেশি নিরাপদ। আর একদিন সকালে দেখলেন তার নিজের সেই খালি তাঁবুতে একরাশ তীর গেঁথে আছে। 

তিনি একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “পৃথিবীর কি কোনো জায়গা নেই, যেখানে মঙ্গোলদের এই আক্রমণ থেকে আমি নিরাপদ থাকব?’ 

তাকে উপদেশ দেয়া হলো ক্যস্পিয়ান সাগরে একটি জাহাজে চড়তে আর কোনো দ্বীপে চলে যেতে, যেখানে তিনি লুকিয়ে থাকতে পারেন, যতক্ষণ না তার পুত্ররা আর আতাবেগরা সেনা জোগাড় করে তাকে রক্ষা করার মতো সেনাদল তৈরি করতে পারেন। 

মোহাম্মাদ শাহ তাই করলেন। নিজে ছদ্মবেশ ধারণ করে কয়েকজন সাধারণ বেশের সহচর নিয়ে, গিরিখাত পেরিয়ে কাস্পিয়ানের পশ্চিম তীরে তিনি জেলে আর ব্যবসায়ীদের একটি শান্ত গ্রাম খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু ক্লান্ত আর অসুস্থ শাহের সঙ্গে তখন নেই কোনো রাজদরবার, নেই তার দাস, নেই কোনো পানপাত্র বাহক। তারপরও তিনি নিজের নামের সম্মান ত্যাগ করলেন না। তিনি সর্বসমক্ষে মসজিদে নামাজের সময় পাঠ করতে চাইলেন, আর তার পরিচয় খুব বেশিদিন আর গোপন থাকল না। 

শাহের হাতে একদা অত্যাচারিত এক মুসলমান মঙ্গোলদের কাছে তার পরিচয় ফাঁস করে দিল। মঙ্গোলরা তখন কাসভিনে অন্য একটি পার্সি সেনাদলকে ছত্রভঙ্গ করেছিল আর পাহাড় পর্যন্ত শাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল। তিনি যখন একটি মাছ ধরা নৌকায় করে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন শাহকে আশ্রয় দেয়া সেই শহরে তারা অভিযান চালাল। 

তীর ছোড়া হতে লাগল। তবে নৌকাটা তীর ছেড়ে তখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। কয়েকজন উপজাতি রাগের মাথায় ঘোড়াসহ সাগরের মধ্যেই এগিয়ে গেল। সেই নৌকার পিছু পিছু চলতে লাগল। মানুষ আর সেই পশুর ক্ষমতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা এগিয়ে গেল। এরপরে তারা সাগরের ঢেউয়ের মাঝে হারিয়ে গেল। 

যদিও তারা কখনো শাহ-এর গায়ে হাত দিতে পারেনি, তবে সত্যিকার অর্থে তারাই তাকে হত্যা করেছিল। রোগে আর কষ্টে দুর্বল হয়ে যাওয়া ইসলামের এই যুদ্ধবাজ নিজের এক দ্বীপে মারা যান। এতটাই দারিদ্র্যের মাঝে যে, মৃত্যুর সময় তার গায়ে থাকা পোশাকটিও ছিল তার এক অনুসারীর। 

.

দুই অভিজ্ঞ লুটেরা খেপ নয়ন আর সুবোতাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল শাহকে জীবিত অথবা মৃত ধরার। তারা কোনোদিন জানতে পারেননি যে শাহ তার নিজস্ব ঊষর দ্বীপে কবরে শুয়ে আছেন— ক্যাথিবাসী ওয়াই ওয়াং, প্রিস্টার জন, তুক্তা বেগ আর ঘুচলুকের মতোই আরেকজন দুর্ভাগা। তারা খানের কাছে পাঠালেন সুবোতাইয়ের জোগাড় করা সম্পদের বেশিরভাগ অংশ, আর তার পরিবার এবং একটি তথ্য যে, শাহ জাহাজে চড়ে পূর্ব দিকে চলে গেছেন। 

মোহাম্মদ শাহ তার পুত্রের সঙ্গে খানদের শহর উরঘেচে যোগ দিতে পারেন, এই চিন্তা করে, চেঙ্গিস খান একদল সেনাকে সেদিকে যেতে নির্দেশ দিলেন। 

কিন্তু কাস্পিয়ানের বরফ পড়া চারণভূমিতে শীত কাটানো সুবোতাইয়ের মাথায় সাগর ঘুরে উত্তরে যাত্রা করে খানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরিকল্পনা আসে। এই যাত্রা শুরুর ব্যাপারে অনুমতি চাইতে তিনি সমরখন্দে দূত পাঠালেন। চেঙ্গিস খান অনুমতি দিলেন এবং তার এই অর খানকে শক্তিশালী করতে কয়েক হাজার তুর্কেমেনীয় সেনা পাঠালেন। সুরোতাই তার নিজের দায়িত্বে বন্য কুর্দিদের তার সেনাবাহিনীতে নিচ্ছিলেন। মোহাম্মাদ শাহকে খোঁজার জন্য কিছুটা দক্ষিণে যাওয়ার পরে, চলার পথে যেসব গুরুত্বপূর্ণ শহর পড়ছিল সেসব অবরোধ বা আক্রমণ করে, মঙ্গোলরা উত্তরে ককেশাসের দিকে রওনা হয়ে যান। 

তারা জর্জিয়া আক্রমণ করলেন। সেখানে পর্বতের যোদ্ধা আর মঙ্গোলদের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ হয়। খেপ নয়ন নিজেকে তিফিস যাওয়ার লম্বা উপত্যকার একদিকে লুকিয়ে রাখেন। আর সুবোতাই ব্যবহার করেন মঙ্গোলদের ‘পালিয়ে যাওয়ার ভান করার’ পুরনো চালাকির। অ্যামবুশে পাঁচ হাজার সৈন্য দ্রুতবেগে জর্জীয়দের প্রান্তের ওপর হামলা করে, আর এই যুদ্ধে জর্জীয়রা ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

ককেসাসের গিরিখাতের ভেতর দিয়ে মঙ্গোলরা এগিয়ে চলল, আর আলেকজান্ডারের লৌহ দরজা পার হলো। উত্তরের ঢালে বেরিয়ে এসে তারা পাহাড়ি একদল সেনা দেখতে পেল। অ্যালান, সিরক্যাসিয়ান আর কিপচাকরা একত্রে তাদের বিরুদ্ধ লড়াই শুরু করল। তারা সংখ্যায় অনেক ছিল আর পিছিয়ে আসারও উপায় ছিল না। তবে সুরোতাই কিপচাক উপজাতিদের অন্যদের থেকে আলাদা করতে সমর্থ হলেন। মঙ্গোলরা সাহসী অ্যালান আর সিরকাসিয়ানদেরকেও হারিয়ে দিল। 

এরপর কাস্পিয়ান পেরিয়ে লবণাক্ত চারণভূমি পর্যন্ত তারা কিপচাকদের অনুসরণ করে ক্যাথি থেকে আসা এসব লুটেরাদের, এই ক্লান্ত উপজাতিদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়, ধীরে ধীরে তাদেরকে আরো উত্তরে, রাশিয়ার রাজপুত্রের এলাকায় তাড়িয়ে দেয়। 

এখানে তারা নতুন আর সত্যিকারের সাহসী একদল শত্রুর দেখা পেল। কিয়েভ আর দূরের রাজ্য থেকে বিরাশি হাজার রুশ সেনা জড়ো হয়েছিল। শক্তিশালী একদল কিপচাককে সঙ্গে নিয়ে তারা নেইপার পর্যন্ত নেমে এলো। তারা ছিল শক্ত-সমর্থ ঘোড় সওয়ারের দল, ঢাল বহনকারী। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে চারণভূমির উপজাতিদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা। 

রাশিয়ান সেনাদের ওপর নজর রেখে মঙ্গোলরা নয়দিন যাবৎ নেইপার থেকে পিছু হটল, যতক্ষণ না তারা যুদ্ধের জন্য পূর্বে ঠিক করে রাখা একটি জায়গায় পৌঁছল। উত্তরের যোদ্ধারা বিভিন্ন সেনা ছাউনিতে ছড়িয়ে গেছে, অনেকটাই শক্তিশালী, তবে বেশ ধীরগতির আর নিজেদের মাঝে শুধু ঝগড়া করে। সুবোতাইয়ের মতো তাদের কোনো নেতা ছিল না। চারণভূমিতে মঙ্গোল আর রাশিয়ানদের মধ্য প্রথম যুদ্ধ প্রায় দুই দিন ধরে চলল। মহান রাজপুত্র তার সঙ্গীসহ মঙ্গোলদের অস্ত্রের আঘাতে মারা গেলেন। নেইপারে ফেরত যাওয়ার মতো আর খুব কম সৈন্যই জীবিত থাকল। 

আবার নিজেদের মতো ঘুরে বেড়ানো জীবনে ফিরে, এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে সুবোতাই আর খেপ নয়ন একদিন ক্রিমিয়ায় গেলেন। আর সেখানে জেনোয়ার একদল ব্যবসায়ীকে আক্রমণ করলেন। তারপরে তারা কী করেছিলেন তা জানা যায় না। তারা নেইপার পেরিয়ে ইউরোপে যাওয়া মনস্থ করেছিলেন, তখন চেঙ্গিস খান, যিনি তাদের ঘোরাফেরার ওপর দূত মারফত নজর রাখছিলেন, তিনি তাদেরকে দুই হাজার মাইল পূর্বে এসে দেখা করতে বললেন। 

পথে খেপ নয়ন মারা যান। কিন্তু মঙ্গোলরা একদিকে অনেকটা সরে বুলগারদেরকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে। তারা তখন ভলগায় ছিল। 

এটা ছিল এক আশ্চর্য অভিযান। সম্ভবত আজ পর্যন্ত মনুষ্য ইতিহাসে অশ্বারোহণের দীর্ঘতম অর্জন। দারুণ সহ্য ক্ষমতার আর নিজের ক্ষমতার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে এমন ক্ষমতাধর মানুষের পক্ষেই কেবল এমন কাজ করা সম্ভব। 

একজন পার্সি ইতিহাসবিদ চিৎকার করে বলছিলেন, “তোমরা কি কখনো শোনোনি যে সূর্য উদয়ের এলাকা থেকে একদল লোক এই কাস্পিয়ান দ্বারে এসেছিল? সঙ্গে এনেছিল বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ আর চলার পথে বপন করে যাচ্ছিল মানুষের মৃত্যুর বীজ। এরপর, তাদের সম্রাটের কাছে ফেরত গিয়ে— একদম শান্ত হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল একরাশ লুটের মাল। আর এসবই ঘটেছিল দুই বছরেরও কম সময়ে।” 

দুই সেনাদলের নব্বই দ্রাঘিমাংশের শেষ পর্যন্ত এই যাত্রা আশ্চর্য এক ফল এনে দিয়েছিল। এই যোদ্ধাদের পাশে এবার ক্যাথিবাসী, উঘুইর, নেস্তোরীয় খ্রিস্টানদের পণ্ডিতরা ছিলেন। অন্তত সব সময় ব্যবসার ওপর দৃষ্টি রাখা মুসলমান ব্যবসায়ীদের কাছে এ রকমই শোনা যায়। আর ওরা খ্রিস্টান চার্চের পাণ্ডুলিপি এসব যোদ্ধাদের কাছে বিক্রি করেছিলেন। 

সুবোতাই অন্ধের মতো এগুচ্ছিলেন না। ক্যাথিবাসী আর উঘুইররা লিখে রাখছিল তাদের পার হওয়া নদী আর যে মাছওয়ালা হ্রদ —লবণের খনি আর রুপোর খনি, সব কিছুর অবস্থান। চলার পথে ডাকঘর বসানো হয়েছিল। দখল করা জেলাগুলোতে ‘দারোগা’ নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যোদ্ধা মঙ্গোলদের সঙ্গে প্রশাসনিক লোকজনও এসেছিল। তাদের হয়ে চিঠি লেখা ও পড়ার জন্য একজন বন্দি আর্মেনীয় বিশপকে রাখা হয়েছিল। তিনি জানান যে, ককেসাসের নিচের একটি রাজ্যে দশ বছরের বেশি বয়সের লোকদের একটি আদমশুমারি হয়েছিল। 

সুবোতাই দক্ষিণ রাশিয়ার বিশাল চারণভূমি আবিষ্কার করেন, ‘ব্ল্যাক আর্থ’ এলাকা। তিনি এই চারণভূমিগুলি মনে রেখেছিলেন। অনেক বছর পরে, পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে তিনি মস্কো দখল করতে ফিরে এসেছিলেন। খান যেখান থেকে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তিনি সেখান থেকে আবার তার অভিযান শুরু করেছিলেন। নেইপার পার হয়ে মধ্য ইউরোপ আক্রমণ করেছিলেন। 

জেনোয়াবাসী এবং ভেনিসবাসী ব্যবসায়ীরা মঙ্গোলদের সংস্পর্শে আসে। এক প্রজন্ম পরে ভেনিসের পোলোরা মহান খানের রাজত্বের উদ্দেশ যাত্রা শুরু করে। 

১৭. চেঙ্গিস খানের মৃগয়া 

দুইজন অর খান যখন ক্যাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিমে অভিযান চালাচ্ছেন, তখন তার দুই পুত্রও ভূমির অভ্যন্তরে থাকা সাগরে গিয়েছিলেন, এখন যার নাম আড়াল সাগর। তাদেরকে সেখানে শাহের খবর সংগ্রহ আর তার প্রত্যাবর্তন থামাবার জন্য পাঠানো হয়েছিল। পথেই যখন জানতে পারলেন শাহ মারা গেছেন, তখন তারা চারণভূমির ভিতর দিয়ে প্রশস্ত আমু নদী বরাবর খারেসমীয়দের মূল শহর পর্যন্ত এলেন। 

এখানে মঙ্গোলরা দীর্ঘ এবং তিক্ত অবরোধ শুরু করল— প্রক্ষেপক যন্ত্রের জন্য বড় আকারের পাথরের অভাবে তারা বড় গাছ বড় বড় টুকরোয় কেটে সেগুলো এই কাজে ব্যবহারের জন্য পানিতে ভিজিয়ে ভারী বানাল। প্রাচীরের ভেতরে এক সপ্তাহ ধরে চলা হাতে হাতে লড়াই সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা বলেন, তারা ‘নাপথা’ দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছিল। এই অস্ত্রটি তারা নিশ্চয়ই মুসলমানদের কাছ থেকে পেয়েছিল। কারণ তারা এই অস্ত্র ইউরোপের ‘ক্রুসেডার’দের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্করভাবে ব্যবহার করেছিল। উরগেচ’-এর পতন হলো, আর তারা বন্দি আর ধনসম্পদ নিয়ে খানের সদর দফতরে ফিরে এলো। কিন্তু দুর্বল পিতার সাহসী পুত্র জালাল উদ্দিন নতুন সেনা সংগ্রহ করে পুনরায় আক্রমণ করার জন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। 

এর মাঝে চেঙ্গিস খান গ্রীষ্মের গরমে নিচু এলাকা থেকে তার সেনাদের চলে আসতে বললেন— গোবির উঁচু এলাকায় বাস করতে অভ্যস্ত এই সেনাদের জন্য সেই গনগনে গরম খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি তাদেরকে নিয়ে আমুর ওপারের একটু ঠাণ্ডা পর্বতমালার দিকে চললেন। 

যখন তাদের ঘোড়াগুলো ঘাস খাবে, সে সময়টা তাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য— তাদেরকে কড়া নিয়মের ভেতরে রাখবার জন্য— তিনি উপজাতির সবচেয়ে পছন্দের প্রমোদের আদেশ জারি করলেন —“শিকারের মৌসুম। 

মঙ্গোল শিকার নিয়মিত অভিযানের চেয়ে কম কিছু ছিল না। শুধু মানুষের বদলে পশুর বিরুদ্ধে। পুরো সেনাবাহিনী এতে অংশ নিত, আর এর নিয়ম ঠিক করে দিয়েছিলেন স্বয়ং খান, তার মানে এই নিয়ম অলঙ্ঘনীয়। 

শিকারের ওস্তাদ, জুখি, তার কাজে ব্যস্ত থাকায় তখন সেখানে অনুপস্থিত। তার সেনাপতি বিভিন্ন স্থানে খোঁজ চালালেন, আর কয়ক শ’ মাইল এলাকার কয়েকটি পাহাড়ে চিহ্ন দিয়ে এলেন। যেখান থেকে শুরু হবে সেখানে বিভিন্ন সেনাদলের ব্যানার লাগানো হলো। একইভাবে ‘গুরতাই’ বা ‘যেখানে শেষ’ অর্থাৎ যে এলাকার পরে আর শিকার করা যাবে না, সেটিও একইভাবে চিহ্নিত করা হলো। 

দারুণ উৎসাহে, সেনা দলের বাকি সদস্যরা তখন সেনাদলের প্রধানের নির্দেশে ডানে-বামে ছোটোছুটি করছে। অপেক্ষা করে আছে, খান কখন পৌঁছবেন আর খেলা শুরুর ঘোষণা করবেন। এভাবে, তারা আশপাশের গ্রাম এলাকার প্রায় আশি মাইল এলাকা জুড়ে, একটা অর্ধবৃত্ত তৈরি করে অবস্থান করে ছিলেন। 

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজপুত্র আর যুবক দৌহিত্রদের সঙ্গে খান এসে পৌঁছলেন। অশ্বারোহীরা ঘোড়ায় চড়ে বসল, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একটি লাইন তৈরি করল। কখনো সামনে-পিছনে দুইটি লাইন। মনুষ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করা সব অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিল। সঙ্গে অতিরিক্ত ঢালও থাকল। 

ঘোড়াগুলো এগিয়ে গেল। বাকি সেনারা তাদের সেনাপতির পিছনে পিছনে রওয়ানা হলো। পশুগুলোর উত্তেজিত আওয়াজ শোনা গেল। পশুদের বিরুদ্ধে হাতের অস্ত্র ব্যবহার যোদ্ধাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। আর তাদের ঘেরাও থেকে কোনো চতুষ্পদের পালিয়ে যেতে পারা ছিল দারুণ অপমানজনক একটা ব্যাপার। তারা ঘন ঝোপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে, সরু নালা পেরিয়ে কিংবা ছোট পাহাড়ে চড়ে এগিয়ে গেল। এরপরে যখন ঝোপঝাড় থেকে কোনো বাঘ বা নেকড়েকে বেরিয়ে আসতে দেখতে পাওয়া যেত তখন তারা চিৎকার জুড়ে দিত। 

ঘটনা রাতের বেলা একটু কষ্টকর হয়ে যেত। শিকার শুরু হওয়ার এক মাস পরে মানুষের তৈরি এই অর্ধবৃত্তের সামনে অনেক প্রাণীই জমে যেত। যোদ্ধারা নিজেদের ক্যাম্পে ফেরত আসত, আগুন জ্বালত আর প্রহরী বসিয়ে রাখত। এমনকি তাদের ভেতর ‘পাসওয়ার্ড’ও ঠিক করা থাকত। কর্মকর্তারা টহলে বের হতো। তাদের সামনে জাগ্রত পাহাড়ি চতুষ্পদী জন্তুরা চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাতের আঁধারে তাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে আর চিৎকার করা নেকড়ে আর চিতার গোঙানির আওয়াজ রাতের নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে। এমন সময় একদল প্রতিবাদীকে নিজের অনুকূলে রাখা খুব সহজ কাজ ছিল না। 

এক মাস পরে ব্যাপারটা আরো কঠিন হয়ে যেত। বৃত্তটা তখন ছোট হয়ে আসত আর জন্তুগুলো বুঝতে পারত তাদের ঘিরে ফেলা হচ্ছে। এই কঠোর শিকার খেলায় কোনো ঢিল দেয়ার উপায় ছিল না। একটা শিয়ালও যদি মাটির নিচে লুকিয়ে থাকতো তো কোদাল দিয়ে খুঁড়ে এটিকে বের করা হতো। যদি কোনো ভালুক পাহাড়ের কোনো গর্তে ঢুকতো তবে কেউ একজন এটিকে আহত না করে বের করে আনতে। সেই যুবক যোদ্ধার সাহস আর দক্ষতা দেখাবার এটাই ছিল সুযোগ। বিশেষ করে যদি কোনো একাকী বন্য শূকর কিংবা একদল পশু হঠাৎ একসঙ্গে ঘেরাও তৈরি করে রাখা লোকদের দিকে ছুটে আসতো। 

ঘেরাও করে রাখা সেনাদের লাইনটি একটি নদীর বাঁকে পৌঁছলে তাদেরকে থামিয়ে রাখা হলো। সঙ্গে সঙ্গে অর্ধবৃত্ত বরাবর শিকারিদের কাছে দূত রওনা হলো, সঙ্গে একটি নির্দেশ— নদীটি না পেরোনো পর্যন্ত লাইনটিকে অটুট রাখবার। তাড়িয়ে আনা পশুগুলোর বেশিরভাগই ওদিকে চলে গেছে। 

যোদ্ধারা তাদের ঘোড়াকে এগিয়ে নিল, আর ঘোড়া থেকে নেমে, লেজ কিংবা কেশর ধরল। কেউ তাদের চামড়ার ব্যাগ এমনভাবে বেঁধে ফেলল যেন তার ভেতরে আর বাতাস ঢুকতে না পারে। আর সেগুলো ভাসিয়ে নিয়ে এগোল। একবার যখন তারা নদীর অপর পারে পৌঁছল, তখন তারা আবার ঘোড়ায় চেপে বসল, আর শিকার খেলা এগিয়ে চলল। 

বৃদ্ধ খান এখানে ওখানে যাচ্ছেন। সেনাদের আচরণ লক্ষ করছেন। কীভাবে কর্মকর্তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, তা দেখছেন। শিকারের সময় তিনি কিছুই বলেননি। তবে সবকিছু বিস্তারিত মনে রেখেছেন। 

শিকারিদের তত্ত্বাবধানে অর্ধবৃত্ত এখন ছোট হয়ে এসেছে, শিকারের এলাকার শেষ সীমা বা ‘গুরতাইয়ের’ কাছে চলে এসেছে। পশুগুলো এখন চাপ অনুভব করছে। এগিয়ে আসা সেনাদের বৃত্তের এক ধারে থাকা সেনারা এখন হরিণদের দেখতে পাচ্ছে— লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে। বাঘ এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিরীহ গবাদিপশুর দল মাথা নিচু করে চলছে। দৃষ্টির বাইরে, ‘গুরতাই” বা “শিকার বৃত্তের শেষ সীমার বাইরে বৃত্তটা পূর্ণ হয়ে গেছে, তাদের শিকারের চারপাশের আঁটুনি শক্ত করে ফেলেছে। পশুদের গর্জন এখন আরো উচ্চকিত হয়েছে। সেনারা এখন আর এক সারিতে নেই। দুই বা তিন সারি গভীর হয়ে গেছে। এই জমায়েত হওয়া সেনা আর ভয়ার্ত পশুদের কাছে পৌঁছে খান ইশারা করলেন। সবাই সরে খানকে প্রবেশ করার পথ করে দিলেন। 

প্রথা অনুযায়ী খান আটকে ফেলা প্রাণীগুলোর ওপর প্রথম আঘাত করবেন। তার এক হাতে থাকবে খোলা তরবারি আর অন্য হাতে ধনুক। এখন সাথে অস্ত্ৰ রাখার অনুমতি আছে। ইতিহাসবিদরা বলেন, তিনি তার এই প্রতিপক্ষের মাঝে সবচেয়ে ভয়ানকটিকে বেছে নিতেন। বাঘের বিরুদ্ধে তীর চালাতেন কিংবা নেকড়ের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিতেন। 

তিনি যখন কয়েকটি পশু মেরে ফেলতেন, তখন তিনি বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতেন। ‘গুরতাই’ বা ‘শেষ সীমা’ দেখার জন্য তিনি একটি পাহাড়ে চড়তেন, আর সেখানে একটি প্যাভিলিয়ানে বসে একে একে প্রবেশ করা রাজপুত্র আর তার সেনাদের শিকার চেষ্টা দেখতেন। এটি ছিল মঙ্গোল জামানায় গ্লাডিয়েটর ধাঁচের শিকার। এবং রোমের গ্ল্যাডিয়েটারদের মত ভেতরে প্রবেশ করাদের মধ্যে বেশি সংখ্যকদেরই প্রাণহীনভাবে বের করে আনা হতো। 

যখন সাধারণ হত্যার নির্দেশ দেয়া হতো তখন সেনাদলের যোদ্ধারা এগিয়ে যেত। পথে যা পড়ত, সব সঙ্গে নিয়ে নিত। এই শিকার হত্যায় পুরো দিন আর রাত পার হয়ে যেত—প্রথা ছিল এই খেলা তখনই থামবে যখন কোনো এক দৌহিত্র বা রাজপুত্রের শিশুপুত্র এসে খানের কাছে অনুরোধ করবে পশুদের ছেড়ে দিতে। আর সেই অনুরোধ রক্ষা করা হতো। শিকারিরা তখন ফিরে আসত আর মৃত পশুগুলো সংগ্রহ করত। 

এই শিকার খেলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষিত করত। এভাবে অশ্বারোহীদের দিয়ে বৃত্ত তৈরি, এভাবে গুটিয়ে আনা যুদ্ধে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তবে তা মানুষের বিরুদ্ধে। 

এ বছরে এবং একটি শত্রু রাষ্ট্রে, এই শিকার চার মাসের মতো চলল। খান হেমন্তের অভিযানের জন্য তৈরি হওয়ার আর জুখি ও ছাতাগাইয়ের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। হ্রদের কাছ থেকে তারা শাহের মৃত্যুর খবর নিয়ে ফিরে এসেছেন। 

এতদিন পর্যন্ত মুসলমানদের এলাকায় কোনো বাঁধা ছাড়াই খান এগিয়ে গেছেন। তারা নদী পার হয়েছেন, শহর দখল করেছেন, একজন আধুনিক পরিব্রাজক তার ভৃত্যদের নিয়ে কাফেলায় করে যত দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়, ততটাই দ্রুত। যোদ্ধা মোহাম্মাদ শাহ প্রথমটায় যতটা উচ্চাভিলাষী ছিলেন, শেষে ততটাই ভীতু হয়ে গিয়েছিলেন। নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজের লোকদের ফেলে তিনি পালিয়ে যান। ফলে দারুণ অপমানের আর ভিক্ষুকের একটি সমাধি জুটেছিল তার। 

ক্যাথির সম্রাটের মতো মঙ্গোলদের অশ্বারোহীদের হাত থেকে বাঁচতে তিনিও তার সেনাদেরকে শহরে পাঠিয়েছিলেন। মঙ্গোল সেনারা যুদ্ধ শুরুর আগের মুহূর্তেও অদৃশ্য ছিল, এরপর ভয়ঙ্কর নীরবতার মাঝে, পতাকা নড়িয়ে দেয়া ইশারার অনুসরণে— এই ইশারা বাকি সেনাদের মাঝে হাত নড়ানোর ইশারার মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি করা হয়। এই ঘটনাগুলো ঘটতো দিনের বেলায়, যখন পলায়নরত মানুষদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে কোনো কথাই শোনা যেতো না। রাতের জন্য ইশারা ছিল সেনাপতির পতাকার সামনে রঙিন প্রদীপ উপরে ওঠানো কিংবা নামানো। 

উত্তরে, সির নদীর রেখায়, প্রথম আক্রমণের পরে, চেঙ্গিস খান যেসব শহরকে মূল শহর মনে করলেন, সেসব শহরে তার সেনাদের জড়ো করলেন, বোখারা আর সমরখন্দে তিনি এই দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ব্যূহও কোনো সমস্যা ছাড়াই ভেঙে ফেললেন। এরপর সেনাদের নিয়ে নজর দিলেন, যেটাকে বলা যেতে পারে তৃতীয় প্রতিরক্ষা ব্যূহ, সেদিকে—উত্তর পারস্য আর আফগানিস্তানের উর্বর পাহাড়ি এলাকায়। 

এখন পর্যন্ত মঙ্গোল আর তুর্কি— অবিশ্বাসী আর মুসলমানদের মাঝের যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য ভয়ঙ্কর ফল ডেকে এনেছিল। হতাশ তুর্কিদের কাছে মঙ্গোলরা ছিল এক স্বর্গীয় শক্তির আবির্ভাব—তাদের পাপের শাস্তিস্বরূপ তাদের ওপর আসা গজব। 

এমন একটি চিন্তাকে উৎসাহ দিতে চেঙ্গিস খান কিছুটা কষ্ট অনুভব করছিলেন। তিনি তার সেনাদের প্রান্তকে নিষ্কণ্টক করতে পূর্ব দিকে মনোযোগ দিলেন। আমু নদীর উৎসমুখের চারপাশের মালভূমির ভেতর দিয়ে অভিযান চালিয়ে পশ্চিমের শহরগুলো দখল করলেন— খেপ নয়ন আর সুবোতাই কিছুদিন আগে যে এলাকাগুলো পেরিয়ে এসে খানকে তাদের মতামত জানিয়েছিলেন। কাজটা করার পরে তিনি নিজেকে বালখের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন, এবং আরেকটি গ্রীষ্মকে শিকারের জন্য উৎসর্গ করলেন। 

এখানে তিনি মুসলমানদের মধ্যকার বাণিজ্য পথ দখল করলেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই এসব সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করছিলেন। তিনি জানতে পারলেন আরো কিছু শক্তি আছে, যাদের সঙ্গে এখনো কোনো মোকাবেলা হয়নি, দিগন্ত রেখার ওপারে আরো বড় শক্তি। চীনারা যেমনটা করেছিল, মুসলমানরা তেমনি তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র হতে শুরু করল। তাদের শাহ তাদের কাছে পরাজিত হয়েছে, আর তার দুই পুত্র মঙ্গোলদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়েছে। তাদের স্বাভাবিক নেতা পারস্যের রাজপুত্র এবং নেতা বা ‘সাইয়িদে’র অধীনে তারা একত্রিত হতে শুরু করল। তাদের যোদ্ধা নবীর উত্তরসূরি। 

চেঙ্গিস খান তার অবস্থা সম্পর্কে বেশ সচেতন ছিলেন। তিনি জানতেন, আসল পরীক্ষা এখন তার সামনে— প্রায় দশ লাখ ভালো সেনা, খুব ভালো অশ্বারোহী এবং খুব ভালো রকম সশস্ত্র, যোদ্ধা এখন তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। এই মুহূর্তে তাদের কোনো নেতা নেই আর তাকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন রাজ্যে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। 

সেনারা এই দ্বিতীয় বছরের শুরুতে সংখ্যায় বারো ‘তুমান’ বা সেনাদলের বেশি ছিল না। মোটামুটি এক লাখের বেশি। উঘুইরদের মাঝের ইদিকুত আর আলমালাইকের খ্রিস্টান রাজা তাদের সৈন্যসহ তিয়ান শানে ফেরত যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। তাদেরকে সেই অনুমতি দেয়া হলো। তার সবচেয়ে ভালো সেনাপতি খেপ নয়ন আর সুবোতাই তখন দুটি ‘তুমান’ বা সেনাদলসহ পশ্চিমে। বাকি অর খানদের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তিলিক নয়ন নিসাপুরে এক আঘাতে মারা যান। মুহুলিও ক্যাথিতে ব্যস্ত। অর খানদের সংখ্যা কমে এসেছে। সুবোতাইয়ের উপদেশের প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন চেঙ্গিস খান। 

তাই তিনি তার পছন্দের সেনাপতির জন্য সুদূর কাস্পিয়ানে লোক পাঠালেন সুবোতাই তার সমনের কারণে সুদূর বালখ থেকে ফিরে এলেন। খানের সঙ্গে কয়েক দিন কথা বললেন। এরপর প্রায় হাজার মাইল দূরে তার নিজ সদর দফতরে ফিরে গেলেন। 

খানের মেজাজ এর পরে পাল্টে যায় এবং তারপর তিনি আর কখনো শিকারের কথা চিন্তা করেননি। যে ঝগড়ার জন্য উরঘেচ দখল করতে দেরি হয়েছিল, সেজন্য তিনি তার বড় পুত্র জুখিকে তিরস্কার করলেন— অথবা জালাল উদ্দিনকে পালিয়ে যেতে দেয়ার কারণে। একগুঁয়ে জুখিকে সেনাদল থেকে ফেরত পাঠানো হয়। তার নিজস্ব সেনাদের নিয়ে তিনি উত্তরের দিকে, আড়াল সাগর পেরিয়ে যে চারণভূমি, সেখানে চলে যান। 

এরপর থেকে চেঙ্গিস খান তার সেনাদের নির্দেশ দেন, এখন থেকে কখনো যেন অর্ধেক প্রচেষ্টা নিয়ে কেউ কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণে না যায়। সেই মানুষকে ঘিরে থাকা পুরো ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যায়। 

১৮. তুলির স্বর্ণ সিংহাসন 

খোরাসানের একজন রাজপুত্রের গল্পে জানা যায়, “আমি তখন উঁচু আর পাথুরে পাহাড়ের পাশে এক দুর্গে ছিলাম। এটি ছিল খোরাসানের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি। আর ঐতিহ্যের কথা যদি বিশ্বাস করি, তবে এই অঞ্চলে ইসলামি সজমের সময় থেকে এটি আমার পূর্বপুরুষদের অধীনেই ছিল। আর যেহেতু এলাকাটি প্রদেশের মধ্যভাগের কাছে ছিল, তাই জায়গাটা তাতারদের বন্দিদশা বা মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে পালিয়ে আসা অধিবাসীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজে করত। 

“কিছু সময় পরে তাতাররা এর সামনে এলো। যখন তারা দেখল তারা এটা দখল করতে পারবে না, তখন তারা ফিরে চলে যাওয়ার দাম চাইল। দশ হাজার কাপড়ের জামা আরো অনেক জিনিসপত্র— যদিও নেসার ব্যাগ থেকে তারা প্রাণভরে লুটপাট করেছে। 

“আমি এই প্রস্তাবে মত দিলাম। যখন এই মুক্তিপণ তাদের কাছে পৌঁছানোর প্রশ্ন উঠল, এই দায়িত্ব নিতে কেউ রাজি হলো না। কারণ খানের একটা স্বভাব আছে, কাউকে হাতে পেলেই তারা তাকে হত্যা করে। অবশেষে দুইজন বৃদ্ধ তাদের নিজেদেরকে উৎসর্গ করলেন, আমার কাছে তাদের সন্তানদের নিয়ে এলেন। যদি তারা মারা যান, সে ক্ষেত্রে তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমাকে দিলেন। সত্যিই, ফিরে আসবার পূর্বেই তাতাররা তাদেরকে হত্যা করে। 

“শীঘ্রই এই বর্বররা পুরো খোরাসান এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। যখন তারা কোনো একটি শহরে পৌঁছত, সব গরিব চাষিকে তাদের সামনে নিয়ে আসত, সব বন্দিকে তারা সঙ্গে নিয়ে যেত এরপর যে শহর তারা আক্রমণ করতে চায় সেখানে। এদেরকে অবরোধের সময় ব্যবহার করত। চতুর্দিকে ছিল ভয় আর দুর্দশা। যে মানুষটিকে বন্দি করা হলো সে বরং বাড়িতে থাকা মানুষটির চেয়ে শান্তিতে থাকতো। কারণ সে জানত না তার কী দশা হবে। গোত্রপ্রধান আর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে পেরে কৃতার্থ হতো। যারা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করত না, তাদের সবাইকে তরবারির নিচে পড়তে হতো। কোনো ব্যতিক্রম হতো না।” 

খানের কনিষ্ঠ পুত্র তুলি, যুদ্ধের ওস্তাদ, তিনি এভাবে দারুণ উর্বরা পারস্য প্রদেশগুলো আক্রমণ করেছিলেন। তার বাবা তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন জালাল উদ্দিনকে খুঁজে বের করতে। কিন্তু এই খারেসমীয় রাজপুত্র তাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। আর মঙ্গোল সেনারা শাহের প্রমোদ শহর, মরুভূমির ফুল, মার্ভের দিকে যাত্রা শুরু করে। শহরটি পাখির নদী বা ‘মুরখ আব’ নদীর তীরে ছিল। আর এই শহরের পাঠাগারে ছিল অনেক পুরনো পুঁথি। 

মঙ্গোলরা কাছাকাছি একদল তুর্কেমেনীয় সেনাকে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে দেখলেন, তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। তুলি তার সেনাদের নিয়ে প্রাচীর ঘিরে একটা চক্কর দিলেন, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ করলেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে মঙ্গোল সেনাদের এগিয়ে আনলেন, ঘেরাও সম্পন্ন হলো; তুর্কেমেনীয়দের গবাদিগুলোকে ঘাস খেতে পাঠানো হলো। 

প্রায় হাজারখানেক সবচেয়ে ভালো সৈন্য বা খানের রাজকীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্য হারিয়ে তুলি ভয়ানক রেগে গেলেন। তিনি মার্ভ শহরের প্রাচীরে একের পর এক আঘাত করতে লাগলেন। নদীতে মাটির বাঁধ তৈরি করলেন আর তার সেনাদের অগ্রযাত্রাকে তীরের মাধ্যমে রক্ষা করলেন। বাইশ দিন ধরে এমনটা চলল। এরপর অবস্থা কিছুটা শান্ত হলো। তখন একজন ‘ইমাম’ বা নেতাকে মঙ্গোলদের কাছে পাঠানো হলো। মঙ্গোলরা তাকে বেশ সাদরে গ্রহণ করলেন এবং তাকে নিরাপদে তার নিজের এলাকায় ফেরতও যেতে দিলেন। 

ধর্মীয় এই নেতা, মনে হলো, শহরের তরফ থেকে আসেননি। তিনি এসেছেন শহরের শাসক, মেরিকের কাছ থেকে। নিশ্চয়তা পেয়ে, মূল্যবান রৌপ্য পাত্র এবং অলঙ্কার খচিত পোশাক উপহারসহ গভর্নর দেখা করতে গেলেন। 

শঠতায় ওস্তাদ তুলি মেরিককে একটি সম্মানসূচক পোশাক পাঠালেন। তার তাঁবুতে ভোজের জন্য নিমন্ত্রণও পাঠালেন। সেখানে তিনি পার্সিকে আশ্বস্ত করলেন যে, তাকে কিছু করা হবে না। 

তুলি আগ্রহ জানালেন, “আপনি আপনার বন্ধু এবং পরিচিত সঙ্গীদের ডাকুন। আমি তাদের জন্য কোনো না কোনো কাজ খুঁজে দেব আর তাদের সম্মানিতও করব।” 

মেরিক তার এক ভৃত্যকে পাঠালেন তার ঘনিষ্ঠজনদের ডেকে আনার জন্য। তারা তার পাশে বসে ভোজে অংশগ্রহণ করলেন। তুলি তখন মার্ভের সবচেয়ে ধনী ছয় শ লোকের একটি তালিকা করে দিতে বললেন। শাসক এবং তার ঘনিষ্ঠরা বিশ্বস্ততার সঙ্গে সবচেয়ে ধনী জমিদার আর ব্যবসায়ীদের নামের তালিকা করে দিলেন। এরপর ভীতসন্ত্রস্ত মেরিকের সামনে, তার সঙ্গীদের মঙ্গোলরা খুন করল। শাসকের হাতে লেখা ছয় শ লোকের নাম সংবলিত তালিকা নিয়ে, তুলির একজন সেনাপতি, মার্ভের দরজায় গেল। সে সেই লোকগুলোকে চাইলো। 

সময়মতো তারা এলো এবং তাদেরকে অন্তরীণ করা হলো। মঙ্গোলরা নিজেরা রক্ষীদের প্রধান হলো। আর তাদের অশ্বারোহী দল মার্ভের রাস্তায় রাস্তায় চলে গেল। সকল বাসিন্দাকে পরিবারসহ এক জায়গায় একত্রিত হতে বলা হলো। সঙ্গে আনতে বলা হলো যা কিছু বয়ে আনা সম্ভব। এই কাজ চলল চার ঘণ্টা যাবত। 

এই বিশালসংখ্যক বন্দির মাঝে কারুকার্য করা এক ডায়াসে নিজের চেয়ারে বসে তুলি এই ঘটনাপ্রবাহ দেখতে লাগলেন। তার সেনারা পারস্য সেনাদের নেতাদের খুঁজে বের করে তার সামনে নিয়ে এলো। অন্যরা অসহায়ের মতো তাকিয়ে মার্ভের সেনাপতিদের মাথা কেটে ধড় থেকে আলাদা করে ফেলা দেখল। 

এরপরে পুরুষ, মহিলা আর শিশুদের তিনটি ভাগে আলাদা করা হলো–—পুরুষদের শুয়ে থাকতে বাধ্য করা হলো। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হলো। এরপর এসব অখুশি লোকদেরকে মঙ্গোল সেনাদের ভেতর ভাগ করে দেয়া হলো। তারা চাবুক মেরে আর গোলা টিপে তাদের মেরে ফেলল। কেবল চার শ শিল্পী বেঁচে গেল। সেনাদের ওদেরকে দরকার। কিছু শিশুকে দাস হিসেবে রেখে দেয়া হলো। ছয় শ ধনাঢ্য বাসিন্দাকে একটু ভালোভাবে খাতির করা হলো— যতক্ষণ না তারা মঙ্গোলদেরকে তাদের ধনসম্পদ লুকিয়ে রাখার গুপ্তস্থানের খোঁজ দিল ততক্ষণ তাদেরকে অত্যাচার করা হলো। 

খালি বাড়িঘরগুলো মঙ্গোলরা তছনছ করল। প্রাচীর ভেঙে চুরমার করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হলো। পাঁচ হাজার মুসলমান, যারা কোনো নালা বা বদ্ধ জায়গায় লুকিয়ে ছিল, তারাই কেবল বেঁচে গেল, এবং এরাও খুব বেশিক্ষণ বাঁচতে পারল না। কিছু সেনা পুনরায় শহরে ফিরে এসে তাদের খুঁজে বের করল আর পুরো এলাকা মানবশূন্য করে ফেরত গেল। 

এভাবে একে একে পার্শ্ববর্তী সব শহরগুলো চালাকি করে আক্রমণ করা হলো। এক জায়গায় খুন হয়ে যাওয়া মানুষের মাঝে শুয়ে থেকে, কিছু মানুষ বেঁচে গিয়েছিল। এ খবর মঙ্গোলরা শুনল, আর এরপরে নির্দেশ জারি হয় ভবিষ্যতে সব বাসিন্দাদের মাথা কেটে ফেলার। অন্য এক শহরের ধ্বংসাবশেষে কয়েকজন পার্সি বেঁচে গিয়েছিল। বেঁচে যাওয়া পার্সিদেরকে একেবারে শেষ করে ফেলার নির্দেশনা দিয়ে মঙ্গোলদের এক দল সেনাকে সেখানে আবার পাঠানো হলো। সেনারা সেখানে পুনরায় গেল, তাদের খুঁজে বের করল। এরপরে পশুর মতো তাড়া করে তাদের হত্যা করল। 

এটা অনেকটা পশু শিকারের মতো একটা ব্যাপার। মানুষদের খুঁজে বের করার জন্য যত ধরনের চালাকি বুদ্ধি ব্যবহার করা যায়, তা তারা করত। একবার এক এলাকার ধ্বংসাবশেষে এক মুয়াজ্জিনকে বাধ্য করা হয়েছিল এক মিনার থেকে আজান দিতে। মুসলমানরা ভাবলো হয়তো আক্রমণকারীরা চলে গেছে। এই ভেবে তারা তাদের লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে এলো। তাদেরকে তখন শেষ করে ফেলা হলো। 

যখন মঙ্গোলরা কোনো শহরের একটি এলাকা ধ্বংস করে ফেরত আসত, তখন তারা সে এলাকার সব শস্য নষ্ট করে আর পুড়িয়ে দিয়ে আসত, যাতে কেউ যদি তলোয়ারের কোপ থেকে বেঁচেও যায়, তারা যেন অনাহারে মারা যায়। উরঘেচে অনেক দিনের প্রতিরোধের কারণে তাদের কষ্টে পড়তে হয়েছিল, তাদের আসলে দুর্গের পাশের নদীর ওপর একটা বাঁধ বানানোর কষ্ট করতে হয়েছিল, যেন নদী তার গতিপথ পাল্টে বাড়িঘর আর প্রাচীরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আমু নদীর এই গতিপথ পরিবর্তন ভূগোলবিদদের অনেক দিন ধাঁধায় রেখেছিল। 

আজ পর্যন্ত বিস্তারিত জানতে পারা ঘটনাগুলোর মাঝে এইগুলিই হচ্ছে ভয়ঙ্করতম। এইটি ছিল শেষ সীমা পর্যন্ত যাওয়া একটি যুদ্ধ… শেষ ইউরোপীয় যুদ্ধটি এর প্রায় কাছাকাছি গিয়েছিল। এটি ছিল কোনো ঘৃণা ছাড়াই মানুষ হত্যা—শুধু তাদেরকে শেষ করে দেয়ার জন্য। 

এই ঘটনা ইসলাম ধর্মের পীঠস্থানকে একেবারে ফাঁকা করে দিয়েছিল। এই গণহত্যা থেকে যারা বেঁচেছিল তারা ভয়ে এতটাই ভীত ছিল যে তারা খাবার খুঁজে বেড়ানো আর লুকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবত না। আগাছা গজানো আবর্জনা থেকে বেরোতে সাহস করত না। কবর না দেয়া লাশের খোঁজে আসা নেকড়ে এলে হয় তারা ভয়ে বেরিয়ে আসত আর নয়তো নেকড়ের খাবার হতো। এমনভাবে ধ্বংস হওয়া শহরগুলো মনুষ্য প্রজাতির জন্য নিষিদ্ধ করা ছিল —একদা দারুণ উর্বরা পৃথিবীর বুকে একটি দগদগে দাগ। এই ধ্বংসের মাঝে অনেকবার হাল চালিয়ে শস্য জন্মাতে হয়েছিল। 

এই উপজাতির কাছে মানব জীবনের চেয়ে মাটি বেশি দামি ছিল, যে মাটি শস্য ফলাতে পারে আর তাদের গবাদিদের খাবার দিতে পারে। তারা তাই শহর ধ্বংস করছিল। বিদ্রোহের আনাগোনাকে চেঙ্গিস খান একেবারে পর্যুদস্ত করে দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধবার আগেই তাদের ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি কোনো দয়া দেখাননি। 

তিনি তার সেনাপতিদের বলতেন, “আমার কাছ থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা না এলে আমার শত্রুদের প্রতি কোনো দয়া দেখাতে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি। কড়াকড়িভাবে এই নিয়ম মেনে চলবে। একজন শত্রুকে জয় করলেই সে অনুগত হয় না, সে সব সময় তার নতুন প্রভুকে ঘৃণা করবে।” 

তিনি গোবিতে এমন প্রক্রিয়া ব্যবহার করেননি। ক্যাথিতেও এমন নিষ্ঠুরতা করেননি। এখানে, ইসলামের পৃথিবীতে, তিনি নিজেকে চাবুকের মতো করে উপস্থাপন করেছিলেন। সুলতান জালাল উদ্দিনের দশ হাজার পার্সি সেনাকে ছাড়া হেরাতের বাকি লোকজনদের ছেড়ে দেয়ার জন্য তিনি তুলিকে খুবই তিক্ততার সঙ্গে দোষারোপ করেন। আর, সত্যিই, হেরাত বিদ্রোহ করেছিল এবং সেখানকার মঙ্গোল শাসককে হত্যা করেছিল। 

অন্য শহরগুলোও কিছুক্ষণের জন্য জ্বলে উঠেছিল—যখন যুবক সুলতান তাদের কাছে এসে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু খানের সেনারা খুব দ্রুতই তাদের দরজায় পৌঁছে যেত। হেরাতের পরিণতি মার্ভের চেয়ে খুব কম ভয়ানক হয়নি। বিদ্রোহের আগুন ভয়ঙ্করভাবে উপড়ে ফেলা হয়েছিল। সেই মুহূর্তে একটাই সত্যিকারের বিপদ ছিল, আর তা ছিল ‘জিহাদ’ বা ‘পবিত্র যুদ্ধ”। 

ফিসফিস করে মুসলমানরা তখন মঙ্গোলদেরকে অভিশাপ দিচ্ছিল। উত্তাল আগুন তখন অনেকটাই থেমে গেছে। ইসলামের মানুষদের তখন একজন নেতা ছিল, কিন্তু তাদের পৃথিবী তখন ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে, যে জালাল উদ্দিন তাদেরকে এই বৃদ্ধ সম্রাটের বিরুদ্ধে একত্র করতে পারত, তিনি মঙ্গোলদের সীমানার চারপাশে মঙ্গোল সেনাদের নজরদারিতে আছেন। আর সেনাবাহিনী তৈরির জন্য তাকে কোনো সময় আর সুযোগও তারা দিচ্ছে না। 

যখন দারুণ গরম নিয়ে দ্বিতীয় গ্রীষ্ম এলো, খান তখন তার বেশিরভাগ সেনা নিয়ে উত্তপ্ত উপত্যকার ওপরে, জঙ্গলঘেরা পাহাড়ি এলাকা হিন্দুকুশে এলেন। এখানে তিনি তাদেরকে বিশ্রাম ঘাঁটি তৈরির অনুমতি দিলেন। বন্দি, দাস, সভাসদ, ভিক্ষুক সবাই গম চাষের কাজে লেগে পড়ল। এবার কোনো শিকার খেলা হলো না। অসুস্থতার কারণে সেনাদের বিশাল ক্ষতি হলো। 

এখানে পরাজিত রাজ্যের মসৃণ পথে তারা এক মাস বা তারও কিছু বেশি সময় বিশ্রাম নিতে পারতেন। তুর্কি পুত্ররা বা ‘আতাবেগ’ আর পার্সি ‘আমির’রা এখন তাদের মদের পেয়ালা এনে দিচ্ছে। সবচেয়ে সুন্দরী মুসলমান মহিলারা নগ্ন হয়ে বিভিন্ন ছাউনিতে যাচ্ছিল। গম চাষ করা শ্রমিকরা, যাদের নিজেদের পরনেও খুব অল্প পোশাক ছিল, তারাও লোভাতুর চোখে তাকিয়ে দেখত। যোদ্ধারা যখন তাদেরকে কুকুরদের খাবার দিতে বলত, তখন তাদের কাছ থেকে খাবার ছিনিয়ে তাদের খেতে হতো। 

কাফেলার ডাকাত, বন্য তুর্কেমেনীয়রা উঁচু এলাকা থেকে এসে এসব আক্রমণকারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত। তাদের রৌপ্য আর স্বর্ণ এবং নকশাখচিত অসংখ্য পোশাকের দিকে তাকিয়ে থাকত, যেগুলো গোবিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁবুর নিচে রাখা হয়েছিল। উপজাতিদের সঙ্গে ছিল একজন চিকিৎসক। তার কাজ ছিল অসুস্থদের সেবা করা। তিনি দারুণ বিদ্বান একজন মানুষ। তার কথা সহনশীলতার সঙ্গে শুনত, যদিও এই ক্যাথিবাসীর কথা তারা অল্পই বুঝতে পারতো, আর খুব কমই মেনে চলতো। 

তবে চেঙ্গিস খানের ওপর রয়েছে প্রশাসনের বিশাল দায়িত্ব। ক্যাথির অর খান আর রাশিয়ার চারণভূমির সুবোতাইয়ের কাছে দূত এসেছে। যখন তিনি এই দুই প্রান্তে সেনাদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তখন তাকে গোবি এলাকার খানের সভাসদের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে হচ্ছিল। 

সংবাদের ব্যাপারে চিন্তিত না হয়ে চেঙ্গিস খান তার এই চীনা সভাসদকে দূত মারফত হিন্দুকুশে ডেকে পাঠালেন, আর দূতরা যদিও বন্য উঁচু শৃঙ্গ আর মরুভূমির ওপর দিয়ে পাড়ি দেয়া এই পথ খুব খুশি মনে পেরোয়নি—কেউ নালিশ করেনি। 

পূর্ব এবং পশ্চিমের এই নতুন পথ খুলতে, খান, “ইয়ামবা মঙ্গোলদের ঘোড়ায় চালিত ডাক ব্যবস্থা চালু করেন—ত্রয়োদশ শতকে এশিয়ার টাট্টু ঘোড়ার ডাকব্যবস্থা। 

১৯. পথস্রষ্টারা 

বহু প্রজন্ম ধরে গোবির উপজাতি মানুষরা অভ্যস্ত ছিল এক তাঁবুগ্রাম থেকে অন্য তাঁবুগ্রামে একজন অশ্বারোহীর মাধ্যমে খবর পাঠানোতে। যখন একজন মানুষ ঘোড়ায় চড়ে এসে যুদ্ধে যাওয়ার সমন বা গল্পগুজব করত, তখন তাঁবুগ্রামের অন্য একজন তার ঘোড়ায় স্যাডল চাপিয়ে এই খবর একটু দূরের বন্ধুদেরকে পৌঁছে দিত। এই দূতরা দিনের মধ্যে পঞ্চাশ থেকে ষাট মাইল পর্যন্ত যেতে অভ্যস্ত ছিল। 

যখন চেঙ্গিস খান তার রাজ্যের পরিধি বাড়াতে শুরু করলেন, এই সংবাদ প্রেরণ উন্নত করা জরুরি হয়ে পড়ল। প্রথমে তার শাসনকার্যের প্রতিটি প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই যেমন ঘটেছে, তেমনই এই ব্যাপারটাও ছিল পুরোটাই সামরিক। সমর অভিযানের পথে, একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর, স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা হলো, আর প্রত্যেকটিতে রাখা হলো একপাল ঘোড়া, তাদের পরিচর্যা করার জন্য কয়েকজন যুবক, আর চোরদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কয়েকজন সৈন্য। যে এলাকা এই সেনারা একবার পার হয়ে এসেছে, সেখানে আর শক্ত রক্ষীর দরকার পড়ত না। 

এই ঘাঁটিগুলো— কিছু তাঁবু, শীতকালে সামান্য কিছু খড় আর বার্লির বস্তা দিয়ে তৈরি একটি ছাদ— প্রায় এক শ মাইলের পার্থক্যে, কাফেলার রাস্তাতে, এই যোগাযোগের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করত দামি পাথর, সোনার অলঙ্কার, উন্নত সব উটের চামড়ার তৈরি পোশাক আর বাদাক শান-এর দামি রুবি নিয়ে কারাকোরাম যাওয়া ‘সম্পদ বাহক’রা। 

এই পথে সেনাদের শস্য তাদের নিজ বাসভূমি গোবিতে যেত। এই উপজাতির আবাসভূমির জন্য ব্যাপারটা খুব অবাক করা ছিল। প্রতিমাসে অচেনা বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের এলাকায় এমন সব দুর্লভ জিনিসপত্র আর অজানা জায়গার মানুষ আসতো। বিশেষ করে খোরাসানে কিংবা দ্বীপের ধারে যুদ্ধ করা যোদ্ধারা তাঁবুর আগুনের পাশে বসে উপজাতির শ্রোতাদের কাছে তাদের সেনাদের অবিশ্বাস্য বিজয়ের গল্প বলত। 

যারা উটের পিঠে করে পাঠানো সম্পদ নিয়মিত তাদের তাঁবুর দরজায় দেখতে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এই গল্প খুব একটা অবিশ্বাস্য মনে হতো না। নারীরা সে অদেখা বিলাসিতার ব্যাপারে কী চিন্তা করত? বৃদ্ধরা চিন্তা করত তারাও কি এই সেনাপতিদের সঙ্গে অদেখা পৃথিবীর উদ্দেশে বেরোতে পারত? কত যে ধনী হয়ে যেত! পারস্যের এইসব মণিমুক্তা খচিত পোশাক পরতে মহিলাদের যে কী অনুভূতি হতো! 

আরবদের দ্রুতগামী ঘোড়ার লাগাম ধরে যেসব যোদ্ধা ফিরে আসতেন, আর তাদের স্যাডল ব্যাগ থেকে কোনো রাজপুত্র বা ‘আতাবেগে’র রৌপ্যখচিত তরবারি বের করে দেখাতেন, তাদের এসব উপজাতীয়রা আর বালকরা খুবই ঈর্ষার চোখে দেখত। 

মঙ্গোলরা আমাদের জন্য এসব অভিজ্ঞতার কোনো নথি রেখে যাননি। তবে আমরা জানি যে, তারা তাদের এই বিজয়কে খানের নিয়তি হিসেবেই দেখত। তিনি যদি ‘বোগডো’র প্রভু না হতেন, ঈশ্বরের পাঠানো কেউ না হতেন, আইনের স্রষ্টা না হতেন, তবে এমন জয় পাওয়া যেত না। পৃথিবীর যে অংশ পছন্দ তা কেন তিনি নেবেন না? 

চেঙ্গিস খান বাস্তবিক অর্থে তার জয়কে কোনো ঐশ্বরিক অবদান হিসেবে দেখতেন না। তিনি একাধিকবার বলেছেন, “আকাশে কেবল একটাই সূর্য আছে আর স্বর্গের একটাই শক্তি আছে। আর পৃথিবীর বুকে কেবল একটাই খাঁ খান থাকা উচিত।” 

বৌদ্ধদের ভীতি তিনি কোনো মন্তব্য না করেই মেনে নিয়েছিলেন। মুসলমানরা যে বলত তিনি হচ্ছেন তাদের ওপর আল্লাহ্র গজব, এই কথাটাও তিনি মেনে নিয়েছিলেন, তবে কিছুটা বিরক্ত হয়ে। তিনি যখন দেখতেন এই কথা মনে করিয়ে দিলে কিছু পাওয়া যাচ্ছে, তখন তিনি ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিতেন। তিনি জ্যোতিষীদের কথাও শুনতেন, তবে নিজের পরিকল্পনা নিজেই করতেন। নেপোলিয়ানের মতো তিনি ভাগ্যে বিশ্বাসী ছিলেন না, আর আলেকজান্ডারের মতো ঈশ্বরের ইচ্ছে হিসেবেও ভাবতেন না। যৌবনে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানো ঘোড়াকে যেভাবে তিনি বাগে আনতেন, ঠিক সেভাবেই অনমনীয় দৃঢ়তা আর ধৈর্যের সঙ্গে তিনি অর্ধেক পৃথিবী শাসন করেছিলেন। 

তিনি উপাধিকে খুবই অপছন্দের চোখে দেখতেন। একবার তিনি তার সীমান্তের এক মুসলমান রাজপুত্রকে চিঠি লিখতে নির্দেশ দিলেন। একজন পার্সি চিঠিটি লিখছিলেন, যিনি ইরানিদের পছন্দের সব বিশেষণ আর উপাধি যোগ করছিলেন। যখন বিশাল সেই চিঠিটা চেঙ্গিস খানকে পড়ে শোনানো হলো, বৃদ্ধ মঙ্গোল রাগে চিৎকার করে উঠলেন এবং চিঠিটা নষ্ট করে ফেলতে বললেন। 

চিঠিটার ব্যাপারে তিনি বললেন, “তুমি বোকার মতো চিঠি লিখেছ। সেই রাজপুত্র ভাববে, আমি তাকে ভয় পাই।”

তিনি তখন তার আরেক পত্র লেখককে তার প্রথাগত বার্তা, খুব ছোট এবং আগাম বার্তা দিয়ে লিখতে বললেন। চিঠি লেখা হলে নিচে স্বাক্ষর করে দিলেন। ‘খাঁ খান।’

.

তার সেনাদের ভেতর যোগাযোগ রাখতে চেঙ্গিস খান পুরনো কাফেলা চলার রাস্ত াগুলোকে নিবিড়ভাবে যুক্ত করেছিলেন। 

সেনা কর্মকর্তারা এসব সেনা চৌকিতে থামত। তাদের পরিচয়পত্র দেখাত। গবাদির দল থেকে একটি ঢিলেঢালা টাট্টু ঘোড়াকে সঙ্গে নিত। দাড়িওয়ালা ক্যাথিবাসীরা কম্বলে তৈরি কাপড়ে নিজেদেরকে জড়িয়ে, দু’চাকার পর্দাঘেরা ঘোড়াগাড়িতে চড়ে আসত আর তাদের ভৃত্যরা চায়ের দলা থেকে কিছু দামি চা পাতা ভেঙে আগুন জ্বেলে চা তৈরি করে দিত। সেনাদলের অন্যতম সদস্য, উঘুইর ভৃত্যরা, এখানে থামত। তাদের মাথায় থাকতো ভেলভেটের উঁচু টুপি, ঘাড়ের ওপর ঝুলে থাকা হলুদ আলখাল্লা। 

এসব ‘ইয়াম’ স্টেশন পেরোনোর পরে সামনে থাকত কাফেলার উটের পথচলার অন্তহীন দাগ। তারা সঙ্গে বোনা কাপড় আর হাতির দাঁতের তৈরি জিনিস আর মুসলমান ব্যবসায়ীদের সবকিছু মরুভূমিতে নিয়ে যেত। 

‘ইয়াম’গুলো ছিল টেলিগ্রাফ, রেলপথ আর পার্সেল পাঠানো রাস্তা— একের মধ্যে তিন। অজানা এলাকা থেকে আসা আগন্তুকদের গোবিতে মঙ্গোলদের খোঁজার সুযোগ করে দিয়েছিল। মসৃণ মুখের ইহুদিরা এই রাস্তা ধরে তাদের জিনিসপত্র ভর্তি গাধা আর গরুগাড়িগুলো নিয়ে যেত। চারকোনা থুতনিওয়ালা আর্মেনীয়রা কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে নীরব মঙ্গোলদের দিকে এগিয়ে যেত। আগুনের পাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে মঙ্গোল সেনারা সেখানে বসে থাকত বা খোলা তাঁবুর পর্দার নিচে ঘুমাত। 

এই মঙ্গোলরা ছিল রাস্তার রাজা। বড় শহরে থাকত একজন ‘দারোগা’ বা ‘রাস্তার শাসক’। সেই শহরের পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল তার। তার সঙ্গে থাকত একজন চাপরাসি। কারা সেই স্টেশন পার হচ্ছে, আর সঙ্গে কী নিয়ে যাচ্ছে এসব হিসাব রাখত সে। 

সেসব স্টেশনে রক্ষী এতই কম থাকত যে, কোনো কোনো সময় স্টেশন মাস্টারের কেবল একজন সঙ্গী থাকত। তাদের কাজও ছিল অল্প। তারা গ্রামাঞ্চল থেকে যা কিছু চেয়ে পাঠাত তা চলে আসত। মঙ্গোলদের কেবল লম্বা চুলওয়ালা ঘোড়ায় তাদের নিজেদের চেহারা দেখাতে হতো, ঘাড়ের পেছন থেকে দেখা যেত তাদের বর্শার ফলা আর নকশা করা পোশাকের পাশে তার ঢাল দেখা যেত। এসব দেখে পথিকরা দ্রুত তাদের নজরানা দিয়ে দিত। এশিয়ার সাধারণ চোরেরা এখানে চেহারা দেখাত না। এখানে এসে মঙ্গোলদের কাছে ঘোড়ার রশি চুরি করার সাহস কে দেখাতে যাবে? ঘুমন্ত থাকলেও এই কাজ কেউ করত না। 

এসব চৌকিতে ক্লান্ত মুসলমান শিল্পী, কাঠের মিস্ত্রি, সঙ্গীত শিল্পী, ইট প্রস্ত তকারী, তরবারি প্রস্তুতকারী বা কার্পেটের তাঁতিরা— কারাকোরামগামী বন্দিরা, যখন হ্রদের আবর্জনা পার হতো, তখন সেনাদলের গাইড এবং রক্ষী হিসেবে থাকা একমাত্র অশ্বারোহীর সামনে তারা ভয়ে কাঁপত আর হোঁচট খেত। তারা ভুলেও পালানোর কথা চিন্তা করত না। 

এই চৌকি পার হতো আরো অদ্ভুত কিছু দল। নিজেদের প্রার্থনার চক্র ঘোরাতে ঘোরাতে চলে যেত হলুদ টুপি পরা লামারা, দৃষ্টি সুদূর তুষারঢাকা পাহাড়ে স্থির—তিব্বতের ঊষর ঢাল থেকে আসা ‘ব্ল্যাক হ্যাট’রা— ছোট ছোট চোখের সদাহাস্য বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা তাদের পূর্বসূরিদের পথ বেয়ে বছরের পর বছর এভাবেই ঘুরে বেড়াতো। নগ্ন পায়ের আর লম্বা চুলের আত্মভোলা ফকিররাও পার হতো এসব চৌকি। নেস্তোরিয়ান যাজকরা অনেক আশ্চর্য জিনিস নিয়ে ঘুরত, তবে সময় বের করে নিজেদের প্রার্থনাটাও সেরে ফেলত। 

অনেক সময় শক্তিশালী ঘোড়ায় চেপে একজন অশ্বারোহী আসত, যাজক আর বাজিকরদের কাছে যা থাকত সব কেড়ে নিয়ে নিজের তাঁবুগাড়িতে চলে যেত। এসব লুটের জিনিস সে খানের জন্য নিয়ে যেত। সে সারাদিনে কোনো বিশ্রাম ছাড়াই দেড় শ মাইল পথ চলত। তার জন্য স্টেশনের সবচেয়ে ভালো ঘোড়াটা দ্রুত সরবরাহ করা হতো। 

এমনই ছিল ‘ইয়াম’। দুই পুরুষ পরে যার সম্পর্কে মার্কো পোলো, কাম্বালু যাওয়ার পথে যেমনটা দেখেছিলেন, বলে গিয়েছিলেন। শহরটি তখন ছিল খানের। “এখন আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, কাম্বালু থেকে আসা সম্রাটের দূত তার যাত্রাপথের প্রতি পঁচিশ মাইল পরে একটি করে ফাঁড়ি খুঁজে পাচ্ছিল। যেটাকে তারা বলত ‘ঘোড়ার বাড়ির ফাঁড়ি’। আর এমন প্রতিটি স্থাপনায় তাদের জন্য বড় আর সুন্দর একটি স্থাপনা থাকতো। বাড়িটির প্রতিটি কক্ষ সুন্দর বিছানা আর দামি সিল্ক দিয়ে সুন্দর করে সাজানো থাকতো। যদি কখনো রাজাও এখানে এসে থাকেন, তবে তিনিও ভাববেন—ভালোই থাকার জায়গা পেয়েছি। 

“এ রকম কোনো কোনো ফাঁড়িতে চার শ’র বেশিও ঘোড়া থাকত। এমনকি যখন দূতরা এমন সব রাস্তাবিহীন এলাকা পার হতো যেখানে কোনো সরাইখানা নেই, সেখানেও তারা এসব ফাঁড়ির দেখা পেত। অবশ্য একটু বেশি দূরত্বে। তবে সব সুযোগ-সুবিধা থাকত— যেন সম্রাটের দূত যেখান থেকেই আসুক, সব প্রয়োজনীয় জিনিস পেয়ে যায়। 

“কখনো কোনো সম্রাট, রাজা বা শাসকের এত সম্পদ দেখিনি। এইসব ফাঁড়িতে সব মিলিয়ে তিন লাখ ঘোড়া রাখা থাকতো। আর স্থাপনার সংখ্যা ছিল দশ হাজারের মতো। এটা এতটাই অদ্ভুত একটা ব্যাপার যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। 

“এভাবে দশ দিনের যাত্রার দূরত্বের কোনো স্থান থেকে পাঠানো কোনো জিনিস, সম্রাট একদিনে পেয়ে যেতেন। কাম্বালুতে সকালে সংগ্রহ করা কোনো ফল পরদিন সন্ধ্যায় মহান খানের রক্ষীর কাছে চান্দুতে পৌঁছে যেত। সম্রাটকে তাদের কোনো নজরানা দিতে হতো না, বরং তাদেরকেই সম্রাট পুরস্কৃত করতেন। 

“এছাড়াও এসব স্টেশনে এমন অনেক লোক থাকত, যারা প্রয়োজনে দিনের বেলা দুই শ কিংবা আড়াই শ মাইল যেতে পারত। শুধু দিনে নয় রাতেও। এমন দূতেরা চারদিকে ঘণ্টা লাগানো প্রশস্ত একটি বেল্ট পরত, যেন তাদের ঘণ্টার আওয়াজ অনেক দূর থেকেও শোনা যায়। ফলে কোনো একটি স্টেশনে পৌঁছে দেখতে পেত আরেকজন দূত একই রকম পোশাক পরে তৈরি হয়ে বসে আছে যে দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে তা পালন করতে পরের স্টেশনের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়ার জন্য। কর্মচারীর কাছ থেকে সে পেত একটি কাগজের টুকরো। প্রতিটি স্টেশনের ক্লার্কের কাজই ছিল দূতেরা কখন আসছে আর কখনো সেখান থেকে প্রস্থান করছে তার হিসাব রাখা। 

“তারা এসব স্টেশন থেকে একটি ঘোড়া নিত। ঘোড়াটি আগে থেকেই স্যাডল পরিয়ে তৈরি করে রাখা থাকত। দ্রুত গতিতে ছোটার জন্য একেবারে তরতাজা ঘোড়া। আর যখন পরের স্টেশনের লোকেরা ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পেত, তখন তারা আরেকটি ঘোড়া তৈরি করে রাখত। আর যে গতিতে তারা চলত, তা ছিল অপূর্ব, যদিও দিনের বেলার মতো দ্রুত গতিতে তারা রাতে চলতে পারত না। কারণ রাতে তাদের সঙ্গে থাকত আলো হাতে একজন পদাতিক 

“দূতদের দারুণভাবে পুরস্কৃত করা হতো। তারা তাদের পেট, মাথা আর বুক শক্তভাবে বেঁধে না রাখলে এই কাজ কখনোই করতে পারতো না। আর এদের প্রত্যেকেই তাদের সঙ্গে রাখত একটি ঈগলের চাকতি, যা থাকলে বোঝা যেত সে খুব জরুরি কাজের দায়িত্বে আছে। ফলে পথ চলতে যদি তার ঘোড়া কাহিল হয়ে পড়তো, তখন সে চাইলে পথ চলতি যে কারো ঘোড়া নিতে পারতো। এ কাজে বাধা দেয়ার সাহস কারো ছিল না।” 

.

এই খুঁটি রাস্তাগুলো ছিল খানের প্রশাসনের মেরুদণ্ড। প্রতিটি শহরের দারোগা স্বাভাবিক দায়িত্ব ছিল ঘোড়াগুলোর দেখাশোনা করা আর নিকটস্থ এলাকা থেকে কর আদায় করা। এছাড়াও, যেসব এলাকা খানের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, তাদেরকে নিয়মিত সেনাদলকে নজরানা দিতে হতো। ‘ইয়াসা’ বা খানের নিয়ম ছিল সেই এলাকার জন্য আইন। কোরান আর মুসলমান বিচারপতিদের পরিবর্তে এই আইনই পালিত হতো। আদমসুমারিও করা হতো। 

প্রত্যেক ধর্মের যাজক আর ধর্ম প্রচারকরা কর অব্যাহতি পেত। ইয়াসাতে এমনটাই বলা ছিল। সেনারা যেসব ঘোড়া নিত, সেগুলোতে মালিকের ছাপ লাগানো হতো। খানের একটি আলাদা ছাপ ছিল। 

আদমসুমারি পরিচালনার জন্য, দারোগার নথি রাখবার জন্য শিল্পোন্নত চীনা আর উঘুইররা ‘আমিন’ বা সরকারি বাড়ি তৈরি করেছিল। মঙ্গোল শাসকরা ছাড়াও জয় করা সেই শহরের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সেই অফিসে পদায়ন করা হতো। তারা মঙ্গোলদের প্রয়োজনীয় তথ্যের যোগান দিত, আর মধ্যস্থতাকারীর কাজ করত। 

চেঙ্গিস খান একটি প্রদেশের বিদ্বান শেখকে একবার বাঘের ছবি সংবলিত একটি চাকতি দিয়েছিলেন। শেখ চাইলে শহরের সব ‘দারোগা’র কার্যক্রম স্থগিত করতে পারতেন—মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তকেও বাঁচাতে পারতেন। স্থানীয় শাসকদেরকে খানের দেয়া ক্ষমতার এই ছায়া, ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করল। সময়টা এখনো আসেনি, কিন্তু খুব শীঘ্রই আসবে, যখন বিজয়ীরা এই এলাকায় ‘ইয়াসা’ এবং মঙ্গোল শাসন কায়েম করবে। সবচেয়ে বড় কথা, মঙ্গোলরা ছিল অটল। প্রথম সামরিক আগ্রাসনের পরে তিনি প্রায়ই একজন সহনশীল রাজা হওয়ার প্রমাণ দেন। 

তবে চেঙ্গিস খান সেনাবাহিনী, নতুন রাস্তা আর জয় করা এলাকা থেকে তার লোকের জন্য আসা ধন-সম্পদ ছাড়া আর কিছু নিয়ে খুব বেশি ভাবতেন না। সেনারা এখন সবচেয়ে সুন্দর তুর্কি বর্ম ব্যবহার করে আর তাদের তরবারি হচ্ছে দামেস্কের। সেই এলাকা থেকে পাওয়া নতুন অস্ত্র আর নতুন জ্ঞান ছাড়া, ইসলামের বিলাসিতা সম্পর্কে তেমন কোনো উৎসাহ তার ছিল না। তিনি গোবি এলাকার পোশাক আর স্বভাব বজায় রেখেছিলেন। 

তিনি কখনো কখনো অনেক ব্যাপারকে প্রশ্রয় দিতেন। তিনি বেশ মেজাজি ছিলেন আর যুদ্ধ জয়ের অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তার ভয়ঙ্কর মেজাজ মাঝে মাঝেই দেখা যেত। তার চোখের চিকিৎসা করা সমরখন্দের অদ্ভুতদর্শন চিকিৎসককে তিনি খুব পছন্দ করতেন। লোকটি খানের এই পছন্দকে ব্যবহার করে এমন কাজ করছিল যা সেনাদের খুব অপছন্দ হতো। তিনি উরঘেচ জয়ের পরে পাওয়া সুকণ্ঠী এক সুন্দরী বন্দিনীকে চেয়েছিলেন। 

তার পীড়াপীড়ি দেখে খান উৎসাহিত হয়ে আদেশ দিলেন মেয়েটিকে যেন তাকে দিয়ে দেয়া হয়। অসুন্দর দেখতে সমরখন্দের সেই চিকিৎসককে সেই বন্দিনী খুব একটা পছন্দ করত না। তাই সে পুনরায় খানকে জানালেন তাকে তার বাধ্যগত করতে হবে। একথা শুনে বৃদ্ধ প্রচণ্ড রেগে গেলেন, যে সকল পুরুষ নারীদের বাধ্য রাখতে পারে না কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাদের ওপর একটি বক্তৃতা দিলেন। এরপরে তিনি সেই চিকিৎসককে মৃত্যুদণ্ড দেন। 

এই হেমন্তে চেঙ্গিস খান তার উচ্চপদস্থ সেনাদেরকে রাজসভার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তার জ্যেষ্ঠ পুত্র জুখি আসেনি। পরিবর্তে সে বেশকিছু ঘোড়া উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছে আর জানিয়েছে যে, সে অসুস্থ। 

সেনাদলের অনেক রাজপুত্র জুখিকে পছন্দ করত না। তার জন্ম নিয়ে তৈরি কালিমার কারণে তাকে ‘তাতার’ বলে ডাকত। তারা খানকে জানাল যে, সে ‘কুরুলতাই’য়ের আদেশ অমান্য করেছে। ঘোড়াগুলো নিয়ে আসা সেনাটিকে বৃদ্ধ মঙ্গোল ডেকে পাঠালেন। জানতে চাইলেন, সত্যিই জুখি অসুস্থ কিনা। 

“আমি জানি না” কিপচাক থেকে আসা লোকটি উত্তর দিল। “তবে আমি যখন চলে আসি তখন তিনি শিকার করছিলেন।” 

ক্ষিপ্ত খান তার তাঁবুতে ফিরে গেলেন। আর তার সেনারা ভাবছিলেন তিনি বোধহয় জুখির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করবেন। কারণ সে ‘অবাধ্য’ হওয়ার অপরাধ করেছে। তিনি তা না করে একটি সংবাদ লিখতে আদেশ করলেন। এরপর সেই সংবাদ একজন দূতকে দিলেন। সে সেই সংবাদ নিয়ে পশ্চিমের দিকে রওনা দিল। তিনি তার সেনাদের দুই ভাগে ভাগ করতে রাজি ছিলেন না। আর সম্ভবত তিনি আশা করেছিলেন তার পুত্র তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না। কারণ তিনি সুবোতাইকে আদেশ করেছিলেন ইউরোপ থেকে ফেরত আসতে আর যেখানেই থাকুক জুখিকে তার সদর দফতরে নিয়ে আসতে। 

২০. সিন্ধুর যুদ্ধ 

সেই ঘটনাবহুল হেমন্তে ‘অ্যাকশন’ ছাড়া অন্য কিছুর জন্য কোনো সময়ই ছিল না। হেরাত এবং অন্যান্য শহর দখলদারদের বিরুদ্ধে জেগে উঠছিল। পূর্বদিকে জালাল উদ্দিন একদল সেনা একত্রিত করছিলেন—হিন্দুকুশ বরাবর অবস্থিত পর্যবেক্ষকরা এমনটাই জানিয়েছে। হেরাতে বিদ্রোহের খবর যখন চেঙ্গিস খান শুনলেন, তখন তিনি তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সেনাপতি তুলিকে সেখানে খারেসমীয় রাজপুত্রের পেছনে পাঠাবার পরিকল্পনা করছিলেন। সেটা না করে, কয়েকটি সেনাদলসহ তুলিকে তিনি পশ্চিমে, খোরাসানে পাঠালেন। 

নতুন খারেসমীয় সেনাবাহিনীকে খুঁজে বের করে তাদের ধ্বংস করার জন্য চেঙ্গিস খান নিজে ৬০,০০০ সেনাসহ ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। তিনি তার পথে ‘কোহ ই বাবা’ পর্বতমালায় অবস্থিত শক্ত শহর ‘বামিয়ানে’র মুখোমুখি হলেন। শহরটি আক্রমণের জন্য তিনি নিজে সেখানে থেকে গেলেন আর আরেকজন ‘অর খানে’র অধীনে বেশিরভাগ সেনাকে পাঠালেন জালাল উদ্দিনকে মোকাবেলা করতে। 

নির্দিষ্ট সময়ে বামিয়ানে দূত এসে জানাল, জালাল উদ্দিনের সঙ্গে রয়েছে ৬০,০০০ সৈন্য—মঙ্গোল সেনাপতি তার সংস্পর্শে এসেছেন, আর খারেসমীয় সেনাদের কয়েকটি অ্যামবুশ প্রচেষ্টা ব্যর্থও করেছেন। এই রাজপুত্রের চলাফেরা খুব ভালোভাবে লক্ষ রাখছে তাদের গুপ্তচরেরা। 

আসলে যা ঘটেছিল তা হচ্ছে, এই দুর্যোগ মুহূর্তে একদল আফগান যোদ্ধা জালাল উদ্দিনের সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছিল। খুব বেশি দিন হয়নি, খবর এলো, তুর্কি আর আফগানরা মঙ্গোল অর খানকে পরাজিত করেছে, তাদের পাহাড়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। 

নতুন ক্রোধে চেঙ্গিস খান তার সামনের শহরের দিকে ঘুরে গেলেন। শহরের লোকেরা পুরো শহর ফাঁকা রেখে দিয়েছিল, এমনকি অবরোধের জন্য ব্যবহার করা পাথরগুলোও তারা সরিয়ে নিয়েছিল। মঙ্গোলদের সঙ্গেও যুদ্ধের সব সরঞ্জাম ছিল না, কাঠের তৈরি যে মিনার তারা দেয়ালের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিল, তীর এবং জ্বলন্ত ন্যাপথা দিয়ে সেটায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো—যতক্ষণ না গরু জবাই করে তার চামড়া দিয়ে কাঠের কাঠামোটিকে ঢেকে দেয়া হলো। 

খান আক্রমণের নির্দেশ দিলেন— শহর দখল না হওয়া পর্যন্ত এই ঝড় থামল না। এই সময় তাকে অনুসরণ করে প্রাচীরের নিচে আসা তার একজন দৌহিত্র মারা যায়। বৃদ্ধ মঙ্গোল শিশুটির লাশ— সাহসের জন্য যে শিশুটিকে তিনি পছন্দ করতেন— তাঁবুতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। 

তিনি সেই অভিযানে এগিয়ে গেলেন। তার শিরস্ত্রাণ ছুড়ে ফেলে, যোদ্ধাদের ভেতর দিয়ে একেবারে সম্মুখভাগে এগিয়ে গেলেন। তারা একটি ফাটলে পা বসাতে পারল। এর কিছুক্ষণ পরেই তাদের কাছে বামিয়ানের পতন হলো। প্রাচীরের অভ্যন্তরে থাকা প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীকেই হত্যা করা হলো। মসজিদ আর প্রাসাদ ভেঙে ফেলা হলো। এমনকি মঙ্গোলরাও বামিয়ান সম্পর্কে বলত, ‘মৌ বালিঘ’ বা দুঃখের শহর। 

তবে চেঙ্গিস খান সঙ্গে সঙ্গেই সেই এলাকা ছেড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সৈন্যদের একত্রিত করতে চলে গেলেন। তারা তাদের পরাজয়ের জন্য অনুতপ্ত হয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে তার কাছে আসবার জন্যই এগোচ্ছিল। খান তাদের একত্রিত করলেন, তাদের সাহসের প্রশংসা করলেন। জালাল উদ্দিনের কাছে পর্যুদস্ত, দুঃখে ভারাক্রান্ত অর খানকে ব্যঙ্গ না করে তার সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে সেই যুদ্ধস্থলে গেলেন। কী হয়েছিল জানতে চাইলেন আর ভুলগুলো দেখিয়ে দিলেন। 

খারেসমীয় রাজপুত্র পরাজয়ের পরে যতটা দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন জয়ের পরে নিজেকে ততটা উপযুক্ত প্রমাণ করতে পারলেন না। জয়ের পরে, যখন তার সেনারা মঙ্গোল বন্দিদের ওপর অত্যাচার আর হত্যা চালিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছিল, ধরা পরা ঘোড়া আর অস্ত্রগুলোর ভাগ-বাটোয়ারা করছিল, তখন তার সেনাদের সঙ্গে আফগান সেনাদের বচসা হয় আর আফগান সেনারা চলে যায়। 

চেঙ্গিস খান তখন তার বিরুদ্ধে অভিযানে মনোযোগ দিলেন। তিনি আফগান সেনাদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য একদল সেনাকে পাঠিয়ে দিলেন। জালাল উদ্দিন গাজনার পূর্ব দিকে পিছিয়ে গেলেন। কিন্তু মঙ্গোলরা তার পিছু ছাড়ল না। তিনি নতুন সহযোগী জোগাড়ের উদ্দেশ্যে দূত পাঠালেন, কিন্তু দেখলেন সব পাহাড়ি গিরিপথই মঙ্গোলরা ঘেরাও করে রেখেছে। তার ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তখন জালাল উদ্দিন পাহাড়ি পথে নেমে সিন্ধু উপত্যকায় সরে গেলেন। 

তিনি আশা করছিলেন নদী পার হয়ে দিল্লির সুলতানের সঙ্গে মিলে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করবেন। কিন্তু গাজনায় পাঁচদিনের দূরত্বে থাকা মঙ্গোলরা এখন মাত্র অর্ধেক দিনের দূরত্বে তাদের পিছনে আছে। চেঙ্গিস খান তার সেনাদের ঘোড়া থেকে নেমে খাবার রান্নার সময়টুকুও অনেক সময় দিচ্ছিলেন না। 

খারেসমীয় রাজপুত্র তখন মরিয়া। নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন। আবিষ্কার করলেন, তিনি এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছেন যেখানে সিন্ধু খুবই খরস্রোতা আর গভীর। পার হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি ভাটির দিকে রওনা দিলেন। তার বাম প্রান্তকে রক্ষা করছে পাহাড়ের সারি আর ডান প্রান্ত নদীর একটি বাঁক। 

নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত ইসলামের অশ্বারোহী ভয়ঙ্কর মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষা করতে প্রস্তুত। জালাল উদ্দিন নদীর ধারে থাকা সব নৌকা ধ্বংস করে দিতে নির্দেশ দিলেন, যেন তার সেনারা পালাবার চিন্তাও না করে। তার অবস্থান শক্ত ছিল, কিন্তু তাকে সেই অবস্থান ধরে রাখতে হবে নয়তো ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। 

খুব সকালে মঙ্গোলরা নদীর পাড় বরাবর অগ্রযাত্রা শুরু করল। অন্ধকার থেকে চেঙ্গিস খানের সেনাদল আবির্ভূত হলো, সঙ্গে পতাকাসহ চেঙ্গিস খান, আর দশ হাজার সৈন্যের অশ্বারোহী সংরক্ষিত রাজকীয় সেনাদল ছিল মধ্যভাগের ঠিক পেছনে। এরা প্রথমে ব্যবহৃত হয়নি। 

হঠকারী খারেসমীয় রাজপুত্রই প্রথমে তার সেনাদের এগিয়ে যেতে বললেন। তার ডান প্রান্তের সেনাদলটি, যথারীতি সেই সময়ের একটি মুসলমান সেনাদলের মতোই ছিল বেশ শক্তিশালী। এমির মালিকের নেতৃত্বাধীন এই দলটি খানের বাম প্রান্তের সেনাদলের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ শুরু করল। সিন্ধু নদের পাড় বরাবর চলা এই অভিযানের ফলে মঙ্গোলরা তাড়া খেয়ে তাদের পূর্বের অবস্থানে পিছিয়ে গেল। তারা যথারীতি ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে গেল। আবার খানের একজন পুত্রের নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে পুনরায় আক্রমণ চালাল। 

ডানদিকে মঙ্গোলরা বিশাল আর ঊষর পাহাড়ের ঢালের বাধার কারণে আঁটকে গিয়েছিল এবং সেখানে তারা থেমে ছিল। এগিয়ে চলা এমির মালিকের ডান প্রান্তে র সেনাদের শক্তিশালী করার জন্য এই অংশ থেকে জালাল উদ্দিন তার সেনাদের সরিয়ে নিলেন। দিনের শেষ ভাগে, তার মধ্যভাগের সেনাদলকে শক্তিশালী করতে তিনি আরো সেনা পাহাড় প্রতিরক্ষাকারী সেনাদল থেকে সরিয়ে নিলেন। 

সৌভাগ্যের সন্ধানে তিনি চরমতম ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। তিনি তার সবচেয়ে ভালো সেনাদের নিয়ে মঙ্গোল সেনাদলের মধ্যভাগকে আক্রমণ করলেন। পতাকা অতিক্রম করে খানের খোঁজ করতে লাগলেন। বৃদ্ধ মঙ্গোল সেখানে ছিলেন না। তার নিচেই তার ঘোড়া মারা যায় আর তিনি আরেকটি ঘোড়ায় চড়ে অন্য জায়গায় চলে যান। 

প্রায় জয়ী হওয়ার মতো একটি অবস্থা তখন খারেসমীয়দের। মুসলমানদের উল্লসিত চিৎকারে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আর আহতদের চিৎকারও চাপা পড়ে যাচ্ছিল। 

আক্রমণে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মঙ্গোল সেনাদের মধ্যভাগ এরপরও দৃঢ়তার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছিল। পাহাড়ের ওপর থাকা খারেসমীয় সেনাদলের বাম প্রান্তের সৈন্য জমায়েতের প্রায় পুরোটাই সরিয়ে ফেলা চেঙ্গিস খান লক্ষ করলেন। তিনি বেলা নয়ন নামের একজন সেনাপতিকে নির্দেশ দিলেন একজন পথপ্রদর্শকের নেতৃত্বে একদল সেনা নিয়ে যে কোনো মূল্যে সেই পাহাড় পার হতে। মঙ্গোলদের পুরনো ঘোরাপথে চলার একটি কৌশল। 

নয়ন তার সেনাদলসহ সেই পথপ্রদর্শককে অনুসরণ করে ভীষণ দুর্গম গিরিখাত আর দুর্গম খাড়া ঢালের পথে চড়ে এগিয়ে গেলেন। বেশ কয়েক সেনা খাদে পড়ে গেল। তবে বেশিরভাগ সেনাই দিন শেষে সেই খাড়া ঢাল পেরিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। এরপর সেই এলাকা রক্ষার জন্য জালাল উদ্দিনের রেখে যাওয়া অল্প কিছু সেনাদের ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাহাড়ের বাধার ওপর খারেসমীয় সেনারা ঘুরে দাঁড়াল। বেলা নয়ন শত্রু সেনা ছাউনির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। 

ইতিমধ্যে চেঙ্গিস খান তার দশ হাজার অশ্বারোহীর নেতৃত্ব নিজ হাতে তুলে নিলেন। ভয়ঙ্কর মধ্যভাগ আক্রমণ না করে, আক্রমণ করলেন দুর্বল আর পরাজিত বাম প্রান্তে। এমির মালিকের সেনাদলের ওপর তার আক্রমণ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। তাদেরকে অনুসরণ করে সময় নষ্ট না করে, খান তার সেনাদলকে একেবারে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে ফেললেন, আর জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনাদলের মধ্যভাগকে আক্রমণ করলেন। তিনি নদীর পাশে থাকা সেনাদলের প্রান্তটিকে খারেসমীয় রাজপুত্রের মূল দল থেকে আলাদা করে ফেললেন। 

দৃঢ়চেতা তবে ক্লান্ত মুসলমান যোদ্ধারা তখন বৃদ্ধ মঙ্গোলের ভয়ঙ্কর আক্রমণ আর সেনা পরিচালনার নিপুণতায় অসহায় বোধ করছিলেন। অনেকটা দাবা খেলার শেষ ‘চেক মেট’ অবস্থার মতো অবস্থা তখন। এবং শেষটা এলো দ্রুত আর অপ্রতিরোধ্যভাবে। জালাল উদ্দিন এই অশ্বারোহীদের বিরুদ্ধে একটি অন্তিম এবং নিরাশ অভিযান চালালেন, আর তার সেনাদেরকে নদীর দিকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করলেন। তাকে অনুসরণ করা হলো, তার সেনাদলকে পর্যুদস্ত করা হলো; বেলা নয়ন তাকে ধাওয়া করতে লাগলেন এবং যখন তিনি সিন্ধু নদের খাড়া পাড়ে পৌঁছলেন তখন তার চারপাশে কেবল সাত শ অনুসারী ছিল। 

অন্তিম সময় চলে এসেছে বুঝতে পেরে তিনি নতুন একটি ঘোড়ায় চড়লেন, তার অস্ত্র ফেলে দিলেন এবং সঙ্গে কেবল তরবারি, ধনুক আর তূণ ভর্তি তীর এবং তার ঘোড়াকে নিয়ে নদীর পাড় থেকে দূরের বেলাভূমির উদ্দেশে তীব্র স্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। 

চেঙ্গিস খান নির্দেশ দিয়েছিলেন রাজপুত্রকে জীবিত ধরতে হবে। মঙ্গোলরা শেষ খারেসমীয়কেও পরাজিত করল আর খান তখন তার ঘোড়ার ওপর চাবুক চালিয়ে চলমান যুদ্ধের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলেন। বিশ ফুট উঁচু নদীতীর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া সেই অশ্বারোহীকে দেখলেন। কিছুক্ষণের জন্য তিনি জালাল উদ্দিনের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলেন। ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে দারুণ বিস্ময়ে প্রশংসা করে বললেন, “ধন্য সেই পিতা যে এমন সন্তানের জন্ম দিয়েছে।” 

যদিও তিনি খারেসমীয় রাজপুত্রের প্রশংসা করেছিলেন তারপরও তাকে ছেড়ে দেয়ার উদ্দেশ্য তার ছিল না। কয়েকজন মঙ্গোল সাঁতরে সেই শত্রুকে ধরার ইচ্ছে জানিয়েছিল, কিন্তু খান ব্যাপারটা অনুমোদন করেননি। তীব্র স্রোত থাকা সত্ত্বেও জালাল উদ্দিনের ওপারে পৌঁছে যাওয়া তিনি তাকিয়ে দেখলেন। নদী যেখানে পার হওয়া সম্ভব, পরের দিন সেখানে তিনি একটি সেনাদল পাঠালেন। এর দায়িত্ব দিলেন বেলা নয়নকে, অর্থাৎ সেই সেনাপতিকে, যিনি খাঁড়া পর্বতমালা পেরিয়ে তার সেনাদল নিয়ে খারেসমীয় সেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করেছিলেন। 

বেলা নয়ন মুলতান আর লাহোর তছনছ করে ফেলেছিলেন। তিনি পলাতকের নিশান খুঁজে খুঁজে এগোচ্ছিলেন। তবে দিল্লির রাস্তায় এসে অনেকের মাঝে হারিয়ে ফেললেন। প্রচণ্ড গরম গোবি থেকে আশা এই মানুষগুলোকে দারুণ অবাক করে দিয়েছিল। নয়ন ফিরে গেলেন, খানের কাছে এসে জানালেন, “এই এলাকার গরম মানুষকে মেরে ফেলবে, আর পানি সেখানে পরিষ্কারও নয় এবং টাটকাও নয়।” 

ফলে উত্তরের কিছু অংশ ছাড়া— ভারত মঙ্গোল বিজয় থেকে বাদ পড়ে। জালাল উদ্দিন বেঁচে যান, তবে তার সময় হারিয়ে গিয়েছিল। তিনি আবার এই উপজাতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন, তবে উদবাস্তু হিসেবে, দেশবিহীন একজন মানুষের অভিযান হিসেবে। 

সিন্ধুর যুদ্ধ ছিল খারেসমীয় অশ্বারোহীদের শেষ প্রতিরোধ যুদ্ধ। তিব্বত থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত প্রতিরোধ থেমে গিয়েছিল, আর ইসলামের জীবিত অনুসারীরা এই বিজয়ীদের দাস হয়ে গিয়েছিল। বৃদ্ধ মঙ্গোলের চিন্তায় তখন আবার ফিরে আসে তার মাতৃভূমি। “আমার সন্তানরা এমন একটি দেশ আর শহরের প্রত্যাশা নিয়ে বাঁচবে, কিন্তু আমি পারব না।”

প্রাচ্যের এশিয়ায় তাকে দরকার। মঙ্গোলদের জোয়াল আরো শক্ত করে চীনাদের কাঁধে চাপিয়ে মুহুলি মারা গেছেন; গোবিতে খানদের রাজসভা অস্থির আর তর্কে ব্যস্ত। ‘হিয়া’ সাম্রাজ্যে তখন বিদ্রোহের সুর বাজছে। চেঙ্গিস খান তখন তার সেনাদের নিয়ে সিন্ধু পর্যন্ত গিয়েছেন। যখন তিনি কাশ্মীরের উপত্যকায় প্রবেশ করেন, তখন জানতেন তিব্বতের অপর ঢালে অবস্থিত ‘হিয়া’ সাম্রাজ্য, মাত্র আট শ মাইল দূরে। কিন্তু, তার আগে যেমনটা আলেকজান্ডার করেছিলেন, তিনিও সেখানে গিয়ে দেখলেন সামনে দুর্ভেদ্য এক পর্বতমালা দিয়ে রাস্তা বন্ধ। হতাশায় আলেকজান্ডারের চেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটি তাই কোনো ইতস্তত না করে ফিরে এলেন। নিজের পদচিহ্ন অনুসরণ করে পুনরায় পৃথিবীর ছাদে চলে এলেন। এরপর কাফেলা চলার সেই পথ দিয়ে এগিয়ে গেলেন, যে পথ তার বিজয়ের পরে তিনিই খুলে দিয়েছিলেন। 

তিনি দ্রুত পেশোয়ারে পৌঁছলেন আর ফিরতি যাত্রা করে সমরখন্দে ফিরে এলেন। ১২২০ সালের বসন্তে তিনি প্রথমবারের মতো সমরখন্দের প্রাচীর আর বাগান দেখেছিলেন, আর এখন, ১২২১ সালের শীতে, পৃথিবীর ছাদের নিচে, তার কাজ শেষ হলো। 

ইয়ে লিউ চুতসাই বললেন, “মানুষ হত্যা বন্ধ করার এটাই সময়।” 

সেনারা যখন দক্ষিণের শেষ ধ্বংসস্তূপ পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন খান সকল যুদ্ধবন্দিকে মেরে ফেলার জন্য তার স্বভাবসুলভ আদেশ জারি করলেন। আর এভাবেই তাদের পেছন পেছন আশা অখুশি এই বিশাল লোকজনদের মেরে ফেলা হয়। 

মুসলমান রাজাদের স্ত্রীদের, যাদের ধরে গোবিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তাদের শেষবারের মতো তাদের মাতৃভূমি দেখবার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড় করানো হয়েছিল। 

এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল বৃদ্ধ মঙ্গোল তার এই জয়ের অর্থ ভাবছেন।

তিনি ইসলাম ধর্মের এক বিদ্বানকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কী মনে হয়, মানবজাতি কি আমার এই রক্তপাত ঘৃণাভরে মনে রাখবে?” 

তিনি ক্যাথির আর ইসলামের উচ্চস্তরীয় জ্ঞানের যে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছিলেন, সেগুলো মনে করলেন, আর এরপর অবজ্ঞাভরে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। “আমি এদের জ্ঞানের কথা চিন্তা করেছি। আমি এখন দেখছি, কোন কাজটি সঠিক তা না ভেবে আমি হত্যা করেছি। কিন্তু এসব লোকের জন্য আমি কী করতাম?” 

সমরখন্দে জড়ো হওয়া উদ্বাস্তুদের ভেতর যারা ভয়ে ভয়ে উপহার সামগ্রী নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এলো তাদেরকে তিনি দয়া দেখালেন। তাদের সঙ্গে কথা বললেন। নতুনভাবে বোঝালেন তাদের মৃত শাহের ত্রুটি সম্পর্কে, সে যেমন প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে জানত না, তেমনি জানত না কীভাবে তার লোকদের রক্ষা করতে হয়। তিনি তাদের ভেতর থেকেই একজনকে শাসক নিযুক্ত করলেন। তাদেরকে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রজা করে নিলেন— ‘ইয়াসা’র প্রতিরক্ষার অংশীদার। এই লোকেরা খুব শীঘ্রই, তার সন্তানের দ্বারা শাসিত হয়। 

তিনি এই খুঁটি রাস্তা দিয়ে তার সব বড় সেনা অধিকর্তার কাছে, সির নদীর তীরে, যেখান দিয়ে প্রথম তিনি খারেসম-এ প্রবেশ করেছিলেন, সেখানে অনুষ্ঠিতব্য বৃহৎ রাজসভায় যোগ দেয়ার জন্য সমন পাঠালে। 

২১. সাহসী যোদ্ধাদের রাজদরবার 

যে জায়গাটা জমায়েতের জন্য পছন্দ করা হয়েছে, তা ছোট ছোট ঘাসে ভরা একটা এলাকা, আয়তন সাত লীগ (আনুমানিক তিন মাইলে এক লীগ) —মঙ্গোলদের চিন্তা-ভাবনা করার জন্য আদর্শ জায়গা, কারণ নদীর পাশে জলাভূমিটা হাঁসে ভর্তি। সোনালি পাখিগুলো ঘাসের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পর্যাপ্ত ঘাস, ভোরবেলা শিকার করা যাবে। সময়টা ছিল বসন্তের শুরু, ‘কুরুলতাই’ বা রাজদরবার বসবার সময়। 

সমন পেয়ে সব নেতা নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে শুরু করলেন। শুধু সুবোতাইয়ের একটু দেরি হলো, কারণ তাকে ইউরোপ থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। 

চারদিক থেকেই তারা এসেছেন। সাম্রাজ্যের সব নেতা, বিভিন্ন অঞ্চলের সেনাপতিরা, ঘুরে বেড়ানো আর খান’রা, অধীনস্ত রাজারা, রাষ্ট্রদূতরা। উপজাতিদের এই রাজসভায় তারা এসেছেন অনেক দূর থেকে যাত্রা করে। আর তারা তাদের সঙ্গে কোনো নিকৃষ্ট সহযোগীকে আনেননি। ক্যাথি থেকে আসা ‘কিবিতকাস’ বা তাঁবুগাড়িটি বলশালী ষাঁড়েরা টেনে এনেছিল আর সেটি ছিল সিল্কের কাপড়ে মোড়া। 

তিব্বতের ঢাল থেকে আসা কর্মকর্তাদের সাথে আছে তাদের কারুকাজ আর রং করে ঢেকে রাখা গাড়িগুলো। সেগুলো টেনে এনেছে লম্বা চুলের এবং রেশমি সাদা লেজ আর বিশাল শিংয়ের ইয়াক। এই ইয়াকগুলো মঙ্গোলদের বেশ পছন্দের। যুদ্ধের ওস্তাদ তুলি এসেছেন খোরাসান থেকে, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সাদা উটের পশমে তৈরি সুতা। ছাতাগাই নেমে এসেছেন পাহাড়ের তুষার থেকে, সঙ্গে এনেছেন এক লাখ ঘোড়া। উপজাতিদের এই কর্মকর্তারা ছিলেন সোনা আর রুপোর কারুকার্য খচিত সুন্দর পোশাক পরিহিত। ওপরে ছিল পশুর চামড়ার তৈরি কোট। সেটা পেঁচিয়ে রাখত নেকড়ের চামড়ায় তৈরি খয়েরি রঙের একটি বন্ধনী, তাদের আত্মরক্ষার জন্য। 

তার সব সহযোগীর মধ্যে সবচেয়ে যত্নে আগলে রাখা উঘুইরদের ইদিকুতরা এসেছেন তিয়ান শান থেকে। খ্রিস্টানদের সিংহ সম্রাট, প্রশস্ত মুখের কিরঘিজ গোত্রপ্রধানও রাজার প্রতি তার কর্তব্য পালন করতে এসেছেন। আরো আছেন সাধারণ আলখাল্লা পরা লম্বা শরীরের তুর্কোমানরা। ঘোড়াগুলো চামড়ার তৈরি ফিতার বদলে আওয়াজ করা চেইন দিয়ে বাঁধা। আর সেই চেইনগুলো রুপোর কারুকার্য খচিত। 

গোবি থেকে একজন দুর্দান্ত বালক এসেছে, সে হচ্ছে তুলির পুত্র কুবলাই। এখন তার বয়স নয়। সম্রাটের এই দৌহিত্রকে এই প্রথম শিকারে যোগ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। চেঙ্গিস খানের দৌহিত্রের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান। চেঙ্গিস খান নিজ হাতে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন। 

তাঁবুগ্রামের মধ্যমণি যে তাঁবুটি, অর্থাৎ ‘কুরুলতাই’য়ে সব উপজাতি নেতা জড়ো হয়েছেন, সেই সাদা প্যাভেলিয়নটা এতটাই বিশাল, সেখানে প্রায় দুই হাজার লোক জমা হতে পারে। সেখানে একটি প্রবেশদ্বার আছে যেখান দিয়ে খান ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। দক্ষিণমুখী মুখ্য দরজাটায় বর্ম পরিহিত যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে আছে কেবল রুটিন প্রহরার জন্য। সেনাদের মধ্য নিয়মানুবর্তিতা এতটাই কঠোর আর এত শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত যে কোনো আগন্তুকের পক্ষে বিজয়ীর কক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। 

গোবিতে যেমনভাবে একবার তারা খানের কাছে ধরা পড়া ঘোড়া আর নারীদের নিয়ে এসেছিল, তেমনভাবে এবার বিভিন্ন অনুগামী রাজা আর গোত্রপ্রধানরা নিয়ে এসেছেন নতুন ধরনের উপহার। অর্ধেক পৃথিবী থেকে জোগাড় করা সর্বোৎকৃষ্ট ধন সম্পদ। ইতিহাসবিদরা বলেন, “এ রকম অপূর্ব উপঢৌকনের অনুষ্ঠান আগে কখনো দেখা যায়নি।” 

মাদী ঘোড়ার দুধের বদলে সাম্রাজ্যের রাজপুত্ররা সেদিন পান করেছিল মধু থেকে তৈরি মদ আর পারস্য থেকে আশা লাল আর সাদা রঙের মদ। খান নিজেও শিরাজের মদের প্রতি তার আকর্ষণের কথা স্বীকার করেছিলেন।

খান এখন মোহাম্মাদ শাহ-এর সোনার সিংহাসনে বসে আছেন, যেটা তিনি সমরখন্দ থেকে নিয়ে এসেছেন। পাশে রাখা আছে মৃত বাদশাহর রাজদণ্ড আর মুকুট। রাজসভা যখন বসল তখন শাহ-এর মাকে সেখানে নিয়ে আসা হলো। তার কোমরে শিকল বাঁধা। কিন্তু সিংহাসনের নিচে চারকোনা খয়েরি রঙের কার্পেট ছিল— পশুর লোমের তৈরি, গোবি এলাকায় তার পুরনো কর্তৃত্বের নিদর্শন। 

পূর্ব থেকে এসে একত্রিত হওয়া নেতাদের চেঙ্গিস খান গত তিন বছরের অভিযানের কথা শোনালেন। তিনি শান্তভাবে বললেন, “ইয়াসা’র কারণে আমি বিশাল কর্তৃত্ব অর্জন করেছি। তোমরাও এই আইন মেনে চলবে।”

ধুরন্ধর মঙ্গোল নিজের অর্জনের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে একটি শব্দও ব্যবহার করলেন না। তিনি যা অর্জন করলেন তা হচ্ছে এই আইনের প্রতি আনুগত্য। এরপরে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে কোনো উপদেশ বা কোনো সেনাকে আদেশ দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। এরপরে তারা নিজেরাই যুদ্ধ ঘোষণার যোগ্য হয়ে যায়। তাদের নিজেদের ভেতর বিভক্তির ভয়ঙ্কর পরিণাম তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তার জয়ের ব্যাপ্তি বোঝাতে সব রাষ্ট্রদূতকে তার সিংহাসনের কাছে এক এক করে দেখতে আসতে দিয়েছিলেন। 

তার তিন সন্তানের উদ্দেশে তিনি একটি সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন, “তোমাদের নিজেদের ভেতর ঝগড়া আসতে দেবে না। ওগোতাইয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে।” 

এরপরে এক মাস ধরে ‘কুরুলতাই’য়ে খাওয়া-দাওয়া চলল। আর এই সময় দুইজন গণ্যমান্য অতিথির আগমন হলো। পোল্যান্ডের সীমানা থেকে এলো সুবোতাই। সঙ্গে আনল জুখিকে। 

প্রথম সন্তান জুখিকে বয়স্ক ‘অর খান’ বা সেনাপতিরা বোঝালেন। রাজি করালেন রাজসভায় এসে পুনরায় তার বাবার মুখোমুখি হতে। তাই জুখি খানের সামনে উপস্থিত হলেন। হাঁটু ভাজ করে বসলেন যেন পিতা তার কপালে হাত রাখতে পারেন। বৃদ্ধ সম্রাট, যিনি জুখিকে খুবই আদর করতেন, তার এই আচরণে খুবই খুশি হলেন। যদিও তিনি তার আচরণে তা বুঝতে দিলেন না। চারণভূমির এই বিজয়ী তার সঙ্গে এক লাখ কিপচাক ঘোড়া উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। এই রাজদরবার জুখির খুব অপছন্দ হচ্ছিল। তাই তিনি ভল্গায় ফেরত যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। তাকে অনুমতি দেয়া হলো। 

সমাবেশ শেষ হলো। ছাতাগাই তার পাহাড়ে ফিরে গেলেন। অন্য যোদ্ধারা কারাকোরামের পথে রওয়ানা হলো। ইতিহাসবিদরা বলেন, যাত্রাপথে প্রতিদিনই চেঙ্গিস খান সুবোতাইকে তার পাশে ডাকতেন আর পশ্চিমা দুনিয়ায় তার অভিযানের গল্প বলতেন। 

২২. কার্য সমাপ্তি 

জীবনের শেষ বছরটা চেঙ্গিস খানের নিজ বাসভূমিতে থাকবার সৌভাগ্য হয়নি। দুটো ব্যাপার ছাড়া বাকি সবকিছু তার সন্তানদের জন্য তৈরি করা হয়ে গিয়েছিল। বৃদ্ধ খানের জানা মতে, পৃথিবীর দুটি ভয়ঙ্কর শক্তি তখন জীবিত— তিব্বতের কাছে ছিল উপদ্রবকারী ‘হিয়া’র রাজা আর দক্ষিণ চীনের প্রাচীন সুংরা। বৌরতাইকে পাশে নিয়ে তার লোকদের মাঝে একটি পুরো মৌসুম তিনি কারাকোরামে পার করলেন। এরপরে তিনি আবার ঘোড়ার স্যাডলে চেপে বসলেন। সুবোতাইকে পাঠালেন সুংদের এলাকা দখল করতে আর চেঙ্গিস খান নিজে হিয়ার মরু উপজাতিকে শেষবারের মতো মোকাবেলার দায়িত্ব নিলেন। 

এই কাজটা তিনি সমাধা করলেন। তুষার পড়া শীতে যুদ্ধযাত্রা করে, এক বরফ-জমা ভূমিতে দেখলেন তার শত্রুরা এদিকেই আসছে— বাকি ক্যাথি সেনা, পশ্চিম চীনের সেনা, তুর্কি আর হিয়ার সব সেনা। ইতিহাস এখানে আমাদের দারুণ এক ধ্বংসযজ্ঞের ঝলক দেখায়। পশুর চামড়া পরিহিত মঙ্গোলরা জমাট বাঁধা নদীর ওপর যুদ্ধ করছে। দেখে মনে হচ্ছে সম্মিলিত বাহিনী জয়ী হতে যাচ্ছে। তারা একত্রে বৃদ্ধ খানের সেনাদলের ঠিক মধ্যভাগকে আক্রমণ করছে। তিন লাখ লোক হয়তো এখানে ভয়ঙ্কর মৃত্যুবরণ করবে। 

এরপর এলো পরিণাম। প্রতারিত, ভীত এবং ধাওয়া আর সম্মিলিত বাহিনীর বাকি যোদ্ধাদের পলায়ন। সেনাদের চলার পথে, অস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম যাকেই পাওয়া গেল, সবাইকেই মেরে ফেলা হলো। হিয়ার রাজা পাহাড়ে তার দুর্গে পালিয়ে গেলেন। তুষার পড়া গিরিখাত দিয়ে ঘেরা তার দুর্গ থেকে, ভয়ঙ্কর খানের কাছে তার আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠালেন। বন্ধুত্বের আড়ালে পুরনো তিক্ততা আর শত্রুতা লুকিয়ে অনুরোধ করলেন অতীত ভুলে যেতে। 

চেঙ্গিস খান সেই দূতকে উত্তর দিলেন, “তোমার শাসককে বলে দিও, অতীত মনে রাখবার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। আমি তাকে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখব।” 

কিন্তু খান যুদ্ধ শেষ করলেন না। সুংদের মাঝে এমন লোক আছে যারা খুবই অমায়িক। যেমনটা তার মিত্ররা ছিলেন। সেনারা মধ্য শীতে পুরনো চীনের সীমানার দিকে অভিযান শুরু করলেন। বিদ্বান ইয়ে লিউ চুসাই সুংদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ করার সাহস দেখালেন। 

“আপনি যদি এই লোকদের মেরে ফেলেন, তবে কিভাবে তারা আপনাকে সাহায্য করবে কিংবা আপনার সন্তানদের জন্য সম্পদ তৈরি করবে?” 

বৃদ্ধ সম্রাট কথাটা ভেবে দেখলেন। সম্ভবত মনে পড়ল তিনি একদা জনবহুল এলাকাকে মরুভূমি বানিয়ে দেয়ার পরে কীভাবে এই ক্যাথিবাসী সবকিছু ঠিকঠাক করেছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি উত্তর দিলেন, “ঠিক আছে, তাহলে তুমি জনগণের দায়িত্ব নাও আর আমার সন্তানদেরও এভাবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেবা দিও।” 

সুংদের ওপর তার সামরিক বিজয়কে তিনি ত্যাগ করে যেতে পারেন না। কাজটা অবশ্যই শেষ করতে হবে। তিনি ঘোড়ায় চড়েই থাকলেন আর তার সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে ইয়োলো নদী পার হলেন। এখানে খান জানতে পারলেন চারণভূমিতে জুখি মারা গেছেন। তিনি জানালেন, তাঁবুতে তিনি একা থাকতে চান। তার প্রথম সন্তানের মৃত্যুতে, নীরবে তিনি শোক পালন করলেন। 

খুব বেশি আগের কথা নয়, যখন বামিয়ানে ওগোতাইয়ের ছোট ছেলে, তার পাশেই মারা যায়, তখন তিনি সন্তান হারানো সেই বাবাকে শোক না দেখাবার আদেশ দিয়েছিলেন। “এই ব্যাপারে আমার আদেশ মেনে চলবে। তোমার পুত্র খুন হয়েছে। আমি তোমাকে কাঁদতে নিষেধ করছি।” 

তিনি নিজেও বাইরে থেকে দেখাননি যে জুখির মৃত্যু তাকে কাতর করেছে। সেনাদল এগিয়ে গেল, সবকিছুই নিয়মমাফিক চলল, কিন্তু খান তার সেনাপতিদের সঙ্গে খুব কম কথা বললেন আর এই ব্যাপারটা সবাই লক্ষ করল যে কাস্পিয়ানে নতুন জয়ও তাকে উজ্জীবিত করতে পারল না, কিংবা তার কাছ থেকে কোনো প্রশংসাবাণী শোনা গেল না। যখন তার সেনাদল একটি গভীর ফার জঙ্গলে প্রবেশ করল, যেখানে উপরে সূর্য থাকা সত্ত্বেও চারিদিকে তুষার জমে আছে, তিনি সেখানে থামবার নির্দেশ দিলেন। 

তিনি দূতদেরকে দ্রুত ঘোড়ায় চড়ে তার নিকটতম পুত্র তুলির কাছে যেতে বললেন। তুলির ক্যাম্প খুব কাছেই ছিল। যদিও এখন পূর্ণ বয়স্ক, তারপরও, যখন যুদ্ধের ওস্তাদ খানের তাঁবুগাড়ির মুখে ঘোড়া থেকে নামলেন, তখন দেখতে পেলেন তার বাবা আগুনের পাশে একটা কার্পেটে শুয়ে আছেন। গায়ে জড়ানো পশুর চামড়ার চাদর। 

বৃদ্ধ মঙ্গোল রাজপুত্রকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, “এটা আমার কাছে স্পষ্ট যে, আমাকে সবকিছু ছাড়তে হবে আর তোমাদের কাছ থেকে চলে যেতে হবে।” তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন আর এখন তিনি বুঝতে পারছেন, তার এই অসুস্থতা তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দিচ্ছে। তিনি তার সেনাপতিদেরকে তার পাশে আসতে বললেন, আর যখন তারাও তুলির মতো তার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসল, তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল, তিনি পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন—সুংদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারলেন না, তা কীভাবে চালিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে তুলিকে পূর্ব দিকের দেশগুলোর দখল নেয়ার দায়িত্ব দিলেন আর ছাতাগাইকে পশ্চিমের। আর ওগোতাই থাকবে সবার ওপরে, কারাকোরামে, খাঁ খান হিসেবে। 

উপজাতিদের মতো কোনো অভিযোগ ছাড়াই তিনি এমনভাবে মারা গেলেন যেন তার অধিকারে কিছু তাঁবু আর গবাদি ছাড়া আর কিছু নেই। অথচ সন্তানদের জন্য তিনি রেখে গেলেন সবচেয়ে বিশাল এক সাম্রাজ্য আর সবচেয়ে বিধ্বংসী সেনাবাহিনী। সময়টা ১২২৭ সাল। বারো পশুর চক্রের মধ্যে ইঁদুরের বছরে। 

ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, অসুস্থতার সময়ে চেঙ্গিস খান, তার দিকে এগিয়ে আসা, তার পুরনো শত্রু, হিয়া রাজাকে ধ্বংস করার সব ব্যবস্থা করে যান। খান আরো নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে এই অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগে যেন তার মৃত্যুর খবর গোপন রাখা হয়। 

অগ্রভাগ মাটির দিকে লক্ষ্য করে সম্রাটের সাদা ‘ইয়ার্ট” বা তাঁবুর সামনে একটি বর্শা ছোড়া হলো। এই তাঁবুটা বাকি সব তাঁবু থেকে একটু দূরে, আলাদা জায়গায়। জ্যোতিষী আর বিদ্বানরা, যারা তার সঙ্গে দেখা করতে এলো, তাদেরকে রক্ষীরা দূরে সরিয়ে রাখলো, কেবল উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের অনুমতি ছিল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢোকার এবং বেরোবার। এমন একটা পরিস্থিতি দেখানো হতো, যেন খান অসুস্থ, আর তিনি বিছানায় থেকেই নির্দেশ দিচ্ছেন। যখন হিয়া রাজা আর তার সভাসদরা মঙ্গোলদের সঙ্গে দেখা করতে পৌঁছল, তখন মেহমানদের একটা দাওয়াতে আমন্ত্রণ করা হলো, তাদেরকে সম্মানসূচক আলখাল্লা দেয়া হলো এবং সব সেনা কর্মকর্তাদের মাঝে বসানো হলো। এরপর একজন সেনা সবাইকে হত্যা করল। 

যার কারণে আজ তারা এমন প্রভুত্ব করে বেড়াচ্ছে, যা চাইছে তাই পাচ্ছে, আজ তিনি অনুপস্থিত। আপাত অজেয় এই চেঙ্গিস খানের মৃত্যুতে স্তব্ধ সেই অর খান’ বা সেনাপতি আর রাজপুত্ররা তার শরীরকে সঙ্গে নিয়ে গোবিতে ফিরে যেতে শুরু করলেন। সমাধিস্থ করার আগে তার মৃতদেহ অবশ্যই তার লোকদের দেখাতে হবে, নিয়ে যেতে হবে তার প্রথম স্ত্রী বৌরতাইয়ের সমাধিস্থলে। 

চেঙ্গিস খান মারা গিয়েছিলেন সুংদের ভূমিতে। আর মোঙ্গোলরা কী হারিয়েছে তা শত্রুদের বুঝতে না দেয়ার জন্য তার মরদেহ বহনকারী যোদ্ধারা মরুভূমিতে না পৌঁছা পর্যন্ত পথে যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছিল, তাদের সকলকে হত্যা করে। আর গোবিতে উপজাতির সকল মানুষ, পুরনো যোদ্ধারা সবাই তার মরদেহ বহনকারী গাড়ির পাশে চলতে চলতে উচ্চস্বরে শোক জানিয়েছিল। 

তাদের কাছে অসম্ভব মনে হয়েছিল যে মহান খান আর পতাকার সামনে দাঁড়াবেন না। তার নির্দেশে এদিক-ওদিক যাওয়ার ঘটনাও আর কখনো ঘটবে না। 

ধূসর চুলের এক ‘আর খান’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হে ‘বগডো’ (স্বর্গের পুত্র) শাসক, আপনি কেন আমাদের এভাবে ছেড়ে চলে গেলেন?” আপনার জন্মভূমি আর এখানকার নদী আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এই সৌভাগ্যবান ভূমি, সোনালি ঘরবাড়ি ঘিরে বীরেরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। এত শত্রু যেখানে মৃত পড়ে আছে, সেই উষ্ণ ভূমিতে আপনি কেন আমাদের একা রেখে চলে গেলেন?” 

অন্যরাও তার মরদেহের পাশে এসে শোক জানাল। 

সম্রাটকে নিজ ভূমে নিয়ে আসা হলো। কারাকোরামে নয়, সেই উপত্যকায়, যেখানে তিনি বালক হিসেবে জীবনের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন সেই উত্তরাধিকারের জন্য, যা তিনি পরিত্যাগ করতে রাজি হননি। সেনাদলের দূতরা ঘোড়ায় চড়ে একসঙ্গে সেই চারণভূমি থেকে সেনাপতি, রাজপুত্র আর দূরে থাকা সেনাপতিদের জন্য সংবাদ নিয়ে গেলেন যে, চেঙ্গিস খান মারা গিয়েছেন। 

যখন শেষ সেনা কর্মকর্তাটি এসে, সেই মৃত্যু ‘ইয়ার্ট’ বা তাঁবুর সামনে ঘোড়া থেকে নামল, তখন তার শরীর শেষ বিশ্রামের স্থানে নামানো হলো—খুব সম্ভবত তার নিজের পছন্দ করে রাখা জঙ্গলে। কেউ জানে না তার সত্যিকারের সমাধি কোথায়। তার সমাধি খোঁড়া হয়েছিল একটি বড় গাছের নিচে। 

মঙ্গোলরা বলে, একটি নির্দিষ্ট গোত্রকে সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল এবং সেই এলাকাটি পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, আর যতদিন না আশপাশের জঙ্গল এতটা ঘন হলো যে সেই বড় গাছটা বাকি লম্বা গাছের মাঝে মিশে গেল, ততদিন সেই গর্তে ক্রমাগত সুগন্ধি পোড়ানো হলো। আর এরপরে সেই সমাধি হারিয়ে গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *