চেঙ্গিস খান – চতুর্থ পৰ্ব

পরিশিষ্ট

শোকে দুই বছর পার হলো। এই দুই বছর রাজপ্রতিনিধি হিসেবে তুলি কারাকোরামে ছিলেন। নিয়োগের নির্দিষ্ট সময় পেরোনোর পরে রাজপুত্র এবং সেনাপ্রধানরা গোবি অঞ্চলে ফেরত এলেন মৃত সম্রাটের ইচ্ছা অনুসারেই নতুন খাঁ খান বা সম্রাট নির্বাচন করার জন্য। 

তারা নিজের যোগ্যতায় সম্রাট হিসেবে নির্বাচিত হতেই এসেছেন। উত্তরাধিকার এবং চেঙ্গিস খানের ইচ্ছে— এই দুই কারণেই তারা সম্রাট হওয়ার অধিকার রাখেন। ছাতাগাই এখন সবচেয়ে বড় সন্তান। স্বভাবে রগচটা, তিনি এসেছেন মধ্য এশিয়া এবং মুসলমান এলাকা থেকে। রসিক ওগোতাই এসেছেন গোবি অঞ্চলের সমভূমি থেকে। জুখির সন্তান দুর্দান্ত বাতুর এলাকা ছিল রাশিয়ার বিস্তীর্ণ চারণভূমি। 

তারা ছোট থেকে বড় হয়েছেন একজন মঙ্গোল উপজাতি হিসেবে। এখন তারা পৃথিবীর একেকটি এলাকার শাসক। এলাকার সব সম্পদেরও তারা মালিক, যে সম্পদ সম্পর্কে তারা জানতেনও না। তারা ছিলেন এশিয়াবাসী, বড় হয়েছেন বর্বরদের মধ্যে। এই চারজনের প্রত্যেকের রয়েছে একদল করে শক্তিশালী সশস্ত্র সেনাবাহিনী। নিজেদের নতুন এলাকায় মহাপ্রাচুর্যের স্বাদ এতদিন তারা ভোগ করেছেন। চেঙ্গিস খান বলেছিলেন, “আমার বংশধরেরা স্বর্ণ খোচিত কাপড় পরবে, মাংস খাবে আর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ঘোড়ায় চড়বে। তাদের বাহুতলে থাকবে সুন্দরী যুবতী। আর এসব পছন্দের জিনিসের কোনটা তাদের, এ নিয়ে কোনো চিন্তা তাদের থাকবে না।” 

তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। সেই দুই বছর পরে, ব্যাপারটা প্রায় অনিবার্য হয়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে ছাতাগাইয়ের ক্ষেত্রে। সে এখন বয়োজ্যেষ্ঠ, মঙ্গোল নিয়ম অনুযায়ী সে-ই এখন খান হওয়ার দাবি জানানোর যোগ্য। কিন্তু মৃত সম্রাটের ইচ্ছে ছিল সবার ওপরে। শক্ত হাতে যে নিয়মানুবর্তিতা তিনি তৈরি করে গিয়েছিলেন, তা এখনও তাদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। আনুগত্য, ভাইদের প্রতি সততা এবং সকল ঝগড়ার অবসানকারী ছিল, ‘ইয়াসা’ নিজে! 

বেশ অনেকবার চেঙ্গিস খান তাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, “তোমাদের নিজেদের মধ্যে যদি মতের মিল না থাকে তবে তোমাদের এই ক্ষমতা এবং তোমরা নিজেরা হারিয়ে যাবে।” তিনি এটা খুব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন, এই নতুন সাম্রাজ্য একত্রে করে রাখার একটাই উপায়— একজনের নেতৃত্বে সবার সম্মতি। তাই তিনি যুদ্ধপ্রিয় তুলি কিংবা অনমনীয় ছাতাগাইকে তার উত্তরাধিকার করেননি। করেছিলেন উদার এবং সৎ ওগোতাইকে। তার সন্তানদের সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। ছাতাগাই কখনই সর্বকনিষ্ঠ তুলিকে মেনে নিত না। আর দুর্দান্ত যোদ্ধা তুলি খুব বেশি দিন তার বদরাগী বড় ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করত না। 

রাজপুত্ররা সবাই যখন কারাকোরামে মিলিত হলেন তখন রাজপ্রতিনিধির পদ থেকে তুলি ইস্তফা দিলেন এবং ওগোতাইকে রাজত্বের ভার নিতে অনুরোধ করলেন। সভাসদদের প্রধান আপত্তি তুললেন। তার বড় ভাই আর চাচা বেঁচে থাকতে এই দায়িত্ব তাকে দেয়া যায় না। হয় ওগোতাই রাজি হচ্ছিলেন না, কিংবা ভবিষ্যৎদ্রষ্টারা তার পক্ষে ছিলেন না, যে কারণেই হোক, অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠায় চল্লিশ দিন পার হলো। এরপর ‘অর খান’ আর বয়স্ক যোদ্ধারা ওগোতাইকে রাগতস্বরে বললেন, “তুমি এটা কী করছ? খান নিজে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে তোমাকে পছন্দ করে গেছেন!” 

তুলিও যোগ দিলেন, তার বাবার শেষ কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন। মহান ক্যাথিবাসী, অর্থমন্ত্রী ইয়ে লিউ চুসাই, আসন্ন দুর্যোগ আটকাতে তার পুরো বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করলেন। বিরক্ত তুলি গনক সাহেবকে বললেন, দেখুন তো আজকের দিনে কোনো সমস্যা আছে কিনা? 

ক্যাথিবাসী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, এরপরে, কোনো দিনই আর ভালো দিন হবে না। 

সময় নষ্ট না করে ওগোতাইকে তাগাদা দিলেন ফেল্ট আবৃত ডায়াসের ওপর রাখা সোনার সিংহাসনে আরোহণ করতে। নতুন সম্রাট যখনই তেমনটা করলেন, ইয়ে লিউ চুতসাই তার পাশে চলে গেলেন আর ছাতাগাইয়ের সঙ্গে কথা বললেন, “তুমি ওর বড় ভাই, কিন্তু তুমি তো আবার তার প্রজাও। বড় ভাই হওয়ার কারণে সিংহাসনের সামনে নতজানু হয়ে তাকে কুর্নিশ করার প্রথম সুযোগটা তুমিই নাও।” 

ছাতাগাই একটু ইতস্তত করলেন, এরপর ভাইয়ের সামনে নতজানু হয়ে কুর্নিশ করলেন। সকল জ্ঞানী সভাসদ এবং কর্মকর্তা তাকে অনুসরণ করলেন। সবাই ওগোতাইকে খাঁ খান হিসেবে মেনে নিলেন। সম্মিলিত জনতা বেরিয়ে গেল আর দক্ষিণ দিকে, সূর্যের দিকে কুর্নিশ করল। পুরো শিবিরও একই কাজ করল। এরপর শুরু হলো বেশ কয়েক দিনের বিশাল ভোজ। চেঙ্গিস খান যা সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন, বিভিন্ন অজানা এলাকা থেকে যে প্রাচুর্যের সমাবেশ তিনি করেছিলেন, তা বাকি সব রাজপুত্র এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আর মঙ্গোলদের মধ্যে বিতরণ করা হলো। তার পিতার মৃত্যুর পরে যত মানুষ বিভিন্ন অপরাধে সাজা পাচ্ছিল, সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দেয়া হলো। 

(কথিত আছে সুন্দর পোশাক এবং অলঙ্কারে সজ্জিত চল্লিশজন সুন্দরী রমণী এবং চল্লিশটি স্ট্যালিয়ন চেঙ্গিস খানের সমাধিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে মেরে ফেলা হয়)। 

ওগোতাই ইয়ে লিউ চুতসাই-এর উপদেশমতো চলে, সেই সময়ের মঙ্গোলদের তুলনায় অনেক বেশি সহৃদয়ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তিনি কঠোর পরিশ্রম করে একদিকে যেমন তার সাম্রাজ্যকে আরো সংগঠিত করেছিলেন, অন্যদিকে মঙ্গোলদের অযথা রক্তপাতও বন্ধ করেছিলেন। ভয়ঙ্কর সুবোতাই যখন সুংদের এলাকায় তুলিকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, শহরের সব মানুষকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন, তখন ইয়ে লিউ চুতসাই এই অর খানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন। এই বিচক্ষণ পরামর্শদাতা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, “এতদিন ক্যাথি এলাকায় আমাদের সেনারা, এইসব লোকের উৎপাদন করা শস্য আর ধন-সম্পদের ওপরই জীবনধারণ করেছে। আমরা যদি তাদেরই শেষ করে দিই, এই পরিত্যক্ত এলাকা আমাদের কী দেবে?” 

ওগোতাই যুক্তিটা মেনে নিয়েছিলেন। পনেরো লাখ লোকের এক বিশাল গোত্র এবং পুরো শহরটা সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। ইয়ে লিউ চুসাই নিয়মিতভাবে সম্মানী গ্রহণের প্রথা চালু করেছিলেন। প্রত্যেক এক শ মঙ্গোলের জন্য একটি ছাগলের মাথা আর প্রতি ক্যাথি পরিবারের জন্য কিছু পরিমাণ রুপো কিংবা সিল্ক। তিনি যুক্তি দেখিয়ে লেখাপড়া জানা ক্যথিবাসীদের কোষাগার এবং প্রশাসনের উচ্চ পদে বসানোর ব্যাপারে ওগোতাইকে রাজি করিয়েছিলেন। 

তার উপদেশ ছিল, “একটা ফুলদানি বানাতে আপনার নিজেকে কুমার হওয়ার তো দরকার নেই। হিসেব আর নথি দেখার জন্য শিক্ষিত লোকদের ব্যবহার করা উচিত।” 

মঙ্গোল উত্তর দিয়েছিলেন, “ঠিক আছে, ওদের ব্যবহার করতে কে আপনাকে বাধা দিচ্ছে?” 

যখন ওগোতাই নিজের জন্য একটা প্রাসাদ বানালেন, তখন ইয়ে লিউ চুতসাই যুবক মঙ্গোলদের জন্য স্কুল খুলেছিলেন। প্রত্যেক দিন পাঁচ শ গাড়ি কারাকোরামে প্রবেশ করত। এখন শহরটা ‘ওরদু বালিঘ’ বা প্রশাসনিক শহর নামে পরিচিত। এই গাড়িগুলো বিভিন্ন সরঞ্জাম, শস্য, দামি জিনিস সম্রাটের কোষাগারে আর গুদামে জমা দেয়ার জন্য নিয়ে আসত। এই মরুভূমির খানদের আইন অর্ধ পৃথিবী জুড়ে আরো শক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

মঙ্গোল সম্রাটের কর্তৃত্ব তার মৃত্যুর পরও প্রতিষ্ঠিত ছিল, আলেকজান্ডারের মতো হয়নি। তিনি মঙ্গোল গোত্রকে একজন শাসকের প্রতি অনুগত হতে শিখিয়েছিলেন। তিনি তাদের খুব শক্ত এক আইন দিয়েছিলেন। পুরনো কিন্তু তার কাজ চালানোর জন্য যা খুবই উপযোগী। আর তার সেনা অভিযানের সময়েই তিনি সেই সাম্রাজ্যের প্রশাসনের কাঠামো তৈরি করেছিলেন। এই প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির কাজে ইয়ে লিউ চুতসাই ছিলেন তার অমূল্য সহকারী। 

সন্তানদের জন্য সবচেয়ে অমূল্য যে ঐতিহ্য তিনি রেখে গিয়েছিলেন, তা ছিল সম্ভবত মঙ্গোল সেনাবাহিনী। তার অন্তিম ইচ্ছে অনুসারে এই সেনা ওগোতাই, ছাতাগাই আর তুলির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। এদেরকে বলা যায় তার ব্যক্তিগত সেনা। তবে তাদের সম্মিলিত করা, প্রশিক্ষণ দেয়া এবং যুদ্ধক্ষেত্রে পরিচালনা করা চেঙ্গিস খানের দেখিয়ে দেয়া নিয়মেই হতো। এছাড়াও, সুবোতাই এবং অন্যদের ক্ষেত্রে, বিজয়ীর সন্তানরা অভিজ্ঞ সেনাপতিদের সমানভাবে পেয়েছিল, যেন সমানভাবে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করতে পারে। 

চেঙ্গিস খান তার সন্তান আর তার প্রজাদের মধ্যে এই ধারণা প্রবেশ করিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, মঙ্গোলরা হচ্ছে এই পৃথিবীর স্বাভাবিক শাসক। তিনি সবচেয়ে শক্তিধর সাম্রাজগুলোর প্রতিরোধও এমনভাবে ভেঙে ফেলেছিলেন যে, বাকি কাজ তার সন্তান এবং সুবোতাই-এর জন্য খুবই সহজ হয়ে গিয়েছিল। অনেকটা প্রথম যাত্রার পরই সব কিছু পরিষ্কার করে দিয়ে আসা। 

ওগোতাই-এর শাসনকালের প্রথম দিকে, একবার মঙ্গোল সেনাপতি, ছারমাগান জালালউদ্দিনকে পরাজিত করেন আর তার ক্ষমতা চিরতরে শেষ করে দেন এবং কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিমের এলাকা, যেমন— আর্মেনিয়ায় পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সেই একই সময়ে সুবোভাই আর তুলি হোয়াং হোর দক্ষিণে অভিযান চালান এবং অবশিষ্ট চীনাদের শান্ত করে দেন। 

১২৩৫ সালে ওগোতাই রাজসভা ডাকলেন। এরপরে শুরু হলো মঙ্গোলদের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধযাত্রা। স্বর্ণালি গোত্রের প্রথম খানকে সুবোতাইয়ের সঙ্গে পশ্চিমে পাঠানো হলো ইউরোপের দুঃখ’ অভিযানে, অ্যাড্রিয়াটিক এবং ভিয়েনার দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত। অন্য সেনারা কোরিয়া, চীন এবং দক্ষিণ পারস্যে অভিযান চালাল। ১২৪১ সালে ওগোতাইয়ের মৃত্যুর পরে এই অভিযান থেকে তারা ফিরে আসে। কঠোর সমন জারি করে, ইউরোপ জয়ের পরিকল্পনা থেকে সুবোতাইকে আবার জোর করে ফিরিয়ে আনা হয়। 

এর পরের দশ বছর ছিল উত্তাল তরঙ্গের মতো। ছাতাগাই এবং ওগোতাই—এর উত্তরপুরুষের মধ্যে শুরু হয় শত্রুতা। কিছুদিনের জন্য আবির্ভূত হন ওগোতাইয়ের উত্তরপুরুষ কিউক। কিউক নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টান ছিলেন, না ছিলেন না, তা খুব ভালো জানা যায় না। তবে তিনি নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টান মন্ত্রিসভা দিয়ে শাসনকার্য চালিয়েছিলেন। সেই মন্ত্রিসভায় একজন ছিলেন ইয়ে লিউ চুতসাইয়ের পুত্র। তার তাঁবুর সামনে একটা উপাসনালয়ও তিনি তৈরি করেন। এরপরে শাসনক্ষমতা ওগোতাইয়ের গৃহ থেকে চলে যায় তুলির পুত্রদ্বয় — মাঙ্গু ও কুবলাই খানের কাছে। এরপরে মঙ্গোলদের বিশ্বজয়ের তৃতীয় এবং সবচেয়ে বিশাল যুদ্ধযাত্রা শুরু হয়। 

কুবলাই-এর ভাই হালাগু সুবোতাইয়ের পুত্রের সহযোগিতায় মেসোপটেমিয়া আক্রমণ করেন। বাগদাদ ও দামাস্কাসের দখল নিয়ে তিনি সেখানকার খলিফাতন্ত্রের ক্ষমতা চিরতরে ভেঙে দেন। জেরুজালেমের প্রায় দৃষ্টিসীমায় চলে আসেন। খ্রিস্টান ক্রুসেডকারীদের উত্তরপুরুষদের অধিকারে থাকা আন্তিয়াক মঙ্গোল হামলার তারা এশিয়া মাইনরের স্মিরনা আর কনস্ট্যান্টিনোপোল থেকে এক সপ্তাহের দূরত্বে পৌঁছে যায়। 

সেই একই সময়ে কুবলাই খান জাপানে আক্রমণ চালান। সেখান থেকে যুদ্ধযাত্রা প্রলম্বিত করেন মালায়য়ে। এরপর তিব্বত পার হয়ে বাংলা পর্যন্ত। তার শাসনকাল (১২৫৯-১২৯৪) ছিল মঙ্গোলদের স্বর্ণযুগ। কুবলাই তার বাবার ঐতিহ্য থেকে সরে আসেন এবং তার রাজ্যসভা তিনি ক্যাথিতে স্থানান্তর করেন। চালচলনে নিজেকে মঙ্গোলের চেয়ে অনেক বেশি চৈনিক করে ফেলেন। অনেক নমনীয়ভাবে তিনি শাসনকার্য চালিয়েছিলেন আর প্রজাদের সঙ্গে তার আচরণ ছিল অনেক মানবীয়। মার্কো পোলোর লেখায় তার রাজসভা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। 

রাজসভা ক্যাথিতে স্থানান্তরিত করার আসল কারণ ছিল মূল সাম্রাজ্যের ভেঙে পড়া। হালাগু খানের উত্তরসূরি পারস্যের ইল খানরা (তৃতীয় প্রজন্মের মঙ্গোলদের উপাধি) খাঁ খান থেকে এত দূরে ছিল যে তাদের সঙ্গে সর্বক্ষণিক সম্পর্ক রাখা সম্ভব ছিল না। আনুমানিক ১৩০০ সালে, হালাগু খানের উত্তরসূরি গাজান খানের সময়ে ইল খানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। এছাড়াও তারা খুব দ্রুত মুসলমান হয়ে উঠছিলেন। রাশিয়ায় অবস্থানরত স্বর্ণালি গোত্রের অবস্থাও একই। কুবলাইয়ের মঙ্গোলরা বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। চেঙ্গিস খানের এই দৌহিত্রের মৃত্যুর পরে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়। ধীরে ধীরে মঙ্গোল সাম্রাজ্য আলাদা আলাদা রাজত্বে বিলীন হয়ে যায়। 

(কুবলাই খান অন্য যে কোনো মঙ্গোলের চেয়ে, বা বলা যায় যে কোনো সম্রাটের চেয়ে অনেক বেশি এলাকার ওপর রাজত্ব করেন। তিনি রাজত্ব করেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে। তার রাজসভার ঔজ্জ্বল্য আর তার সভাসদদের দক্ষতা পশ্চিমা যে কোনো শাসককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল)। 

১৪০০ সালে একজন তুর্কি যোদ্ধা তৈমুর লং মধ্য এশিয়া আর পারস্য অংশকে পুনরায় একত্র করেন। তিনি জুখির পুত্র বাতুর তৈরি স্বর্ণালি গোত্রকে পরাজিত করেন। 

১৩৬৮ পর্যন্ত মঙ্গোলরা চীনের শাসক ছিল। ১৫৫৫ সালে রাশিয়ায় তাদের শেষ শক্ত ঘাঁটি (ভয়ঙ্কর) আইভান প্রজনির কাছে তারা হারায়। কাস্পিয়ান সাগরের আশপাশে তাদেরই উত্তরপুরুষ, উজবেকরা ১৫০০ সালে শাইবানির নেতৃত্বে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে আর চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরি বাবরকে বিতাড়িত করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। বাবর সেখানে নিজেকে মহান মোগলদের প্রথম মোগল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। 

সময়টা ছিল অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি, চেঙ্গিস খানের জন্মের ছয় শ বছর পরে এই সম্রাটদের সর্বশেষ রাজত্ব তারা হারায়। এরপরে ভারতে ব্রিটিশদের কাছে মোগলরা ক্ষমতা হারায়। আর পূর্বে অবস্থানরত মঙ্গোলরা বিখ্যাত চীনা সম্রাট কিয়েন লুংয়ের কাছে পরাজিত হয়। 

ক্রিমিয়ার তাতার খানরা ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট-এর হামলার শিকার হন। ঠিক একই সময়ে ভল্গার চারণভূমিগুলো দুর্ভাগা কালমুক বা তোরগুত গোত্ররা ফাঁকা করে দেয় আর তারা তাদের প্রাক্তন নিজস্ব ভূমির উদ্দেশ্য পূর্ব দিকে দীর্ঘ কষ্টকর যাত্রা শুরু করে। ডি কুইন্সির বই ‘ফ্লাইট অব এ তাতার ট্রাইব’-এ এই যাত্রার এক সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। 

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এশিয়ার মানচিত্রের দিকে তাকালে চেঙ্গিস খানের গোত্রের উত্তরসূরিদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সম্পর্কে বোঝা যাবে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বৈকাল হ্রদ এবং লবণাক্ত উরাল সাগরের মাঝের বিশাল এলাকা সেই সময়ের মানচিত্রে কদাচিৎ দেখা যেত। সেখানে লেখা থাকত, ‘তারতারি’ বা ‘স্বাধীন তারতারি’। মহাদেশের এই মধ্যাঞ্চলে তারা শীত এবং গ্রীষ্ম—এই দুই সময়ের চারণভূমির মধ্যে অবস্থান পরিবর্তন করত। কারাইত, কালমুক আর মঙ্গোলরা গরুগাড়িতে বসানো তাঁবুতে (ইয়ার্ট) চলাফেরা করত। নিজেদের গবাদিগুলো তাড়িয়ে সঙ্গে নিয়ে যেত। অনেকেই জানত না এই চারণভূমিতেই এক সময় এশিয়ার প্রিস্টার জন পালাতে গিয়ে মারা যায় আর চেঙ্গিস খানের পতাকা (ইয়াক টেইল) অগ্রসর হতো সারা পৃথিবী কাঁপাতে। 

এভাবে যে ছোট গোত্র থেকে এই সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছিল, সেই ছোট গোত্রে বিভক্ত হয়েই এক সময় এই মঙ্গোল সাম্রাজ্য বিলীন হয়ে যায়। যেখানে এক সময় যোদ্ধারা জড়ো হতো সেখানে থেকে যায় শান্তিপ্রিয় অবশিষ্ট উপজাতি। 

মঙ্গোল অশ্বারোহীদের এই ছোট এবং ভয়ঙ্কর নাট্যাভিনয় প্রায় কোনো চিহ্ন না রেখেই শেষ হয়ে যায়। মরুশহর কারাকোরাম নিষ্ফলা বালির স্রোতের নিচে চাপা পড়ে যায়। তার জন্মস্থানে, কোনো একটি নদীর কাছে, কোনো অজানা জায়গায় রয়েছে চেঙ্গিস খানের সমাধি। বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের পর সংগ্রহ করা সম্পদ তিনি বিলিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তার জন্য যারা কাজ করেছিল তাদের মাঝে। তার যুবক বয়সের স্ত্রী বৌরতাইয়ের কোনো সমাধিচিহ্ন নেই। তার সময়ের কোনো মঙ্গোল সাহিত্যিক তার জীবনকাহিনী সংগ্রহ করে মহাকাব্য রচনা করে নি। 

তার অর্জনগুলোর বেশিরভাগ নথিভুক্ত করেছিল তার শত্রুরা। সভ্যতাকে তিনি এতটাই গুঁড়িয়ে দিতেন যে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীতে নতুন করে সভ্যতা শুরু করতে হয়েছিল। ক্যাথির, প্রিস্টার জনের, কালো ক্যাথির, খারেসমের সাম্রাজ্য এবং তার মৃত্যুর পরে বাগদাদের খলিফাতন্ত্র আর রাশিয়ার সাম্রাজ্য এবং কিছুদিনের জন্য পোল্যান্ডও ছিল এর মধ্যে। যখন এই অজেয় বর্বর কোনো দেশ জয় করতেন, তখন সে এলাকায় আর কোনো কোন্দল থাকত না। দুঃখজনক লাগুক কিংবা অন্য রকম লাগুক, মঙ্গোলদের যুদ্ধ জয়ের পরে পুরো পরিস্থিতি এমনভাবেই পরিবর্তিত হতো যে, সে এলাকার জীবিত অধিবাসীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় শান্তি বিরাজ করত। 

প্রাচীন রাশিয়ার মহান রাজপুত্রগণ, টুইর এবং ভালদিমির-এর রাজা এবং সুসদালদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আরো বড় দুর্যোগের মধ্যে শেষ হয়। প্রাচীন পৃথিবীর এই চরিত্রগুলো আমাদের কাছে অনেকটাই ছায়ার মতো। মঙ্গোল আক্রমণে সাম্রাজ্য ধসে পড়ে আর রাজারা ভয়ে পালিয়ে মারা যায়। চেঙ্গিস খান যদি না জন্মাতেন, তবে কী হতো, আমরা জানি না। 

রোমের শান্তির যেমনটা হয়েছিল, তেমন করে মঙ্গোলরা একেবারে নতুন করে সভ্যতা গড়েছিল। পুরো জাতি বা বলা উচিত জাতির যারা বেঁচে ছিল, তাদের জীবন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের বিজ্ঞান এবং দক্ষতা শারীরিকভাবে দূর প্রাচ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। চীনাদের উদ্ভাবনী শক্তি আর প্রশাসনিক দক্ষতা প্রবেশ করেছিল পশ্চিমে। ইসলামের বিধ্বস্ত বাগানে, মুসলমান বিদ্বান ও স্থপতিরা মঙ্গোল ইল খানের সময়ে স্বর্ণ যুগ না হলেও রৌপ্যযুগ উপভোগ করেছিলেন। ত্রয়োদশ শতকে সাহিত্য, বিশেষ করে নাটক এবং এর উৎকৃষ্টতার জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল চীন-একে বলা হয় ইউয়ানয়ের শতক। 

মঙ্গোলদের পিছু হটার পরে যখন পুনরায় রাজনৈতিক একত্রীকরণ শুরু হয়, খুব স্বাভাবিক, তবে দারুণ অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা ঘটে। রাশিয়ার যুদ্ধরত রাজতন্ত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকে আইভান দ্য গ্রেট-এর সাম্রাজ্যের জন্ম হয়। মঙ্গোলদের অধীনে প্রথমবারের মতো একত্রিত হওয়া চীন একক দেশ হয়ে ওঠে। 

মঙ্গোল এবং তাদের শত্রু মামলুকদের আগমনের সাথে সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলা ক্রুসেড থেমে যায়। মঙ্গোলদের রাজত্বকালে, কিছু সময়ের জন্য, খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা নিরাপদে পবিত্র কবরে আর মুসলমানরা সোলায়মানের মাজারে যেতে পারত। প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা ধর্ম প্রচারের জন্য এশিয়া পর্যন্ত আসার ঝুঁকি নিয়েছিল। 

মনুষ্য জাতির এই বিশাল হুলস্থূলে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনাটা ঘটেছিল তা ছিল ইসলামের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার ধ্বংস হওয়া। খারেসমের সেনাদলের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের মূল সমরশক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর বাগদাদ ও বোখারার সঙ্গে খলিফাতন্ত্র এবং ইমামদের পুরনো সংস্কৃতি হারিয়ে যায়। আরবি ছিল অর্ধেক পৃথিবীর বিদ্বানদের সর্বজনীন ভাষা। তুর্কিদের পশ্চিমে তাড়িয়ে দেয়া হয়, আর একটি গোত্র, অটোমান, হয়ে যায় কনস্ট্যান্টিনোপোলের শাসক। লাল টুপি পরা একজন লামা, কুবলাই খানের রাজ অভিষেকে পৌরোহিত্য করার জন্য তিব্বত থেকে ডেকে আনা হয়। তিনি তার সঙ্গে তার পাহাড় থেকে নিয়ে আসেন লাসার ধর্মযাজকদের ক্রমাধিকারতন্ত্র। 

বিধ্বংসী চেঙ্গিস খান অন্ধকার যুগের বাধা ভেঙে ফেলেছিলেন। তিনি রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন। ক্যাথির শিল্পকলার সংস্পর্শে এসেছিল ইউরোপ। তার পুত্রের রাজসভায় আর্মেনীয় রাজপুত্র আর পারস্যের হোমরা-চোমড়ারা রাশিয়ার রাজপুত্রের সঙ্গে কোলাকুলি করেছিল। 

এই রাস্তা খোলার ফলে কল্পনার আদান-প্রদান হয়েছিল। এশিয়া সম্পর্কে জানবার একটা আগ্রহ ইউরোপীয়দের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। ফ্রা রুব্রুকের পরে মার্কো পোলো কাম্বালু গিয়েছিলেন। দুই শতাব্দী পরে ভাস্কো দা গামা সমুদ্রপথে ভারতের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। কলম্বাস আমেরিকা নয়, মহান খানদের দেশ খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *