৬
চিত্রাঙ্গদার সহচর-সহচরীগণ
অর্জুনের প্রতি
এসো এসো পুরুষোত্তম,
এসে এসো বীর মম।
তোমার পথ চেয়ে
আছে প্রদীপ জ্বালা।
আজি পরিবে বীরাঙ্গনার হাতে
দৃপ্ত ললাটে, সখা,
বীরের বরণমালা।
ছিন্ন ক’রে দিবে সে তার
শক্তির অভিমান,
তোমার চরণে করিবে দান
আত্মনিবেদনের ডালা,
চরণে করিবে দান।
আজ পরাবে বীরাঙ্গনা তোমার
দৃপ্ত ললাটে সখা,
বীরের বরণমালা।
সখী। হে কৌন্তেয়,
ভালো লেগেছিল ব’লে
তব করযুগে সখী দিয়েছিল ভরি
সৌন্দর্যের ডালি,
নন্দনকানন হতে পুষ্প তুলে এনে
বহু সাধনায়।
যদি সাঙ্গ হল পূজা,
তবে আজ্ঞা করো প্রভু,
নির্মাল্যের সাজি
থাক্ পড়ে মন্দির-বাহিরে।
এইবার প্রসন্ন নয়নে চাও
সেবিকার পানে।
চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ
চিত্রাঙ্গদা। আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
আজ শুধু করি নিবেদন–
আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী॥
অর্জুন। ধন্য ধন্য ধন্য আমি।
সমবেত নৃত্য
তৃষ্ণার শান্তি সুন্দরকান্তি
তুমি এসো বিরহের সন্তাপ-ভঞ্জন।
দোলা দাও বক্ষে,
এঁকে দাও চক্ষে
স্বপনের তুলি দিয়ে মাধুরীর অঞ্জন।
এনে দাও চিত্তে
রক্তের নৃত্যে
বকুলনিকুঞ্জের মধুকরগুঞ্জন।
উদ্বেল উতরোল
যমুনার কল্লোল,
কম্পিত বেণুবনে মলয়ের চুম্বন।
আনো নব পল্লবে
নর্তন উল্লোল,
অশোকের শাখা ঘেরী বল্লরীবন্ধন॥
_
এসো এসো বসন্ত, ধরাতলে–
আনো মুহু মুহু নব তান,
আনো নব প্রাণ,
নব গান,
আনো গন্ধমদভরে অলস সমীরণ,
আনো বিশ্বের অন্তরে অন্তরে
নিবিড় চেতনা।
আনো নব উল্লাসহিল্লোল,
আনো আনো আনন্দছন্দের হিন্দোলা
ধরাতলে।
ভাঙো ভাঙো বন্ধনশৃঙ্খল,
আনো, আনো উদ্দীপ্ত প্রাণের বেদনা
ধরাতলে।
এসো থরথর-কম্পিত
মর্মরমুখরিত
মধু সৌরভপুলকিত
ফুল-আকুল মালতীবল্লীবিতানে
সুখছায়ে মধুবায়ে।
এসো বিকশিত উন্মুখ,
এসো চিরউৎসুক,
নন্দনপথ-চিরযাত্রী।
আনো বাঁশরিমন্দ্রিত মিলনের রাত্রি,
পরিপূর্ণ সুধাপাত্র
নিয়ে এসো।
এসো অরুণচরণ কমলবরন
তরুণ উষার কোলে।
এসো জ্যোৎস্নাবিবশ নিশীথে,
এসো নীরব কুঞ্জকুটীরে,
সুখসুপ্ত সরসীনীরে।
এসো তড়িৎশিখাসম ঝঞ্ঝাবিভঙ্গে,
সিন্ধুতরঙ্গদোলে।
এসো জাগরমুখর প্রভাতে,
এসো নগরে প্রান্তরে বনে,
এসো কর্মে বচনে মনে।
এসো মঞ্জীরগুঞ্জর চরণে,
এসো গীতমুখর কলকণ্ঠে।
এসো মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে,
এসো কোমল কিশলয়বসনে।
এসো সুন্দর, যৌবনবেগে।
এসো দৃপ্ত বীর, নব তেজে।
ওহে দুর্মদ, করো জয়যাত্রা
জরাপরাভব-সমরে–
পবনে কেশররেণু ছড়ায়ে,
চঞ্চল কুন্তল উড়ায়ে॥
অর্জুন। মা মিৎ কিল ত্বং বনাঃ শাখাং মধুমতীমিং।
যথা সুপর্ণঃ প্রনতন্ পক্ষৌ নিহন্তি ভূম্যাম্
এবা নিহন্মি তে মনঃ।
চিত্রাঙ্গদা। যথেমে দ্যাবা পৃথিবী সদ্যঃ পর্যেতি সূর্যঃ
এবা পর্যেমি তে মনঃ|
উভয়ে। অক্ষৌ নৌ মধুসংকাশে অনীকং নৌ সমঞ্জনম্।
অন্তঃকৃণুষ্ব মাং হৃদি মন ইন্নৌ সহাসতি॥
***
মন্ত্রের অনুবাদ
ফুল্ল শাখা যেমন মধুমতী
মধুরা হও তেমনি মোর প্রতি।
বিহঙ্গ যথা উড়িবার মুখে
পাখায় ভূমিরে হানে
তেমনি আমার অন্তরবেগ
লাগুক তোমার প্রাণে।
আকাশধরা রবিরে ঘিরি
যেমন করি ফেরে,
আমার মন ঘিরিবে ফিরি
তোমার হৃদয়েরে।
আমাদের আঁখি হোক্ মধুসিক্ত,
অপাঙ্গ হয় যেন প্রেমে লিপ্ত।
হৃদয়ের ব্যবধান হোক্ মুক্ত,
আমাদের মন হোক্ যোগযুক্ত।