১
প্রথম দৃশ্যে চিত্রাঙ্গদার শিকার আয়োজন
গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে পর্বতশিখরে,
অরণ্যে তমশ্ছায়া।
মুখর নির্ঝরকলকল্লোলে
ব্যাধের চরণধ্বনি শুনিতে না পায় ভীরু
হরিণদম্পতি।
চিত্রব্যাঘ্র পদনখচিহ্নরেখাশ্রেণী
রেখে গেছে ওই পথপঙ্ক-‘পরে,
দিয়ে গেছে পদে পদে গুহার সন্ধান।
বনপথে অর্জুন নিদ্রিত
শিকারের বাধা মনে করে চিত্রাঙ্গদার সখী তাঁকে তাড়না করলে
অর্জুন। অহো কী দুঃসহ স্পর্ধা,
অর্জুনে যে করে অশ্রদ্ধা
কোথা তার আশ্রয়!
চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন! তুমি অর্জুন!
বালকবেশীদের দেখে সকৌতুক অবজ্ঞায়
অর্জুন। হাহা হাহা হাহা হাহা, বালকের দল,
মা’র কোলে যাও চলে, নাই ভয়।
অহো কী অদ্ভুত কৌতুক!
[প্রস্থান
চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন! তুমি! অর্জুন!
ফিরে এসো, ফিরে এসো,
ক্ষমা দিয়ে কোরো না অসম্মান,
যুদ্ধে করো আহ্বান!
বীর-হাতে মৃত্যুর গৌরব
করি যেন অনুভব–
অর্জুন! তুমি অর্জুন!
হা হতভাগিনী, এ কী অভ্যর্থনা মহতের
এল দেবতা তোর জগতের,
গেল চলি,
গেল তোরে গেল ছলি–
অর্জুন! তুমি অর্জুন!
সখীগণ। বেলা যায় বহিয়া,
দাও কহিয়া
কোন্ বনে যাব শিকারে।
কাজল মেঘে সজল বায়ে
হরিণ ছুটে বেণুবনচ্ছায়ে।
চিত্রাঙ্গদা। থাক্ থাক্ মিছে কেন এই খেলা আর।
জীবনে হল বিতৃষ্ণা,
আপনার ‘পরে ধিক্কার।
আত্ম-উদ্দীপনার গান
ওরে ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার
শুকনো পাতার ডালে,
এই বরষায় নবশ্যামের
আগমনের কালে।
যা উদাসীন, যা প্রাণহীন,
যা আনন্দহারা,
চরম রাতের অশ্রুধারায়
আজ হয়ে যাক সারা;
যাবার যাহা যাক সে চলে
রুদ্র নাচের তালে।
আসন আমার পাততে হবে।
রিক্ত প্রাণের ঘরে,
নবীন বসন পরতে হবে
সিক্ত বুকের ‘পরে।
নদীর জলে বান ডেকেছে
কূল গেল তার ভেসে,
যূথীবনের গন্ধবাণী
ছুটল নিরুদ্দেশে–
পরান আমার জাগল বুঝি
মরণ-অন্তরালে॥
সখী। সখী, কী দেখা দেখিলে তুমি!
এক পলকের আঘাতেই
খসিল কি আপন পুরানো পরিচয়।
রবিকরপাতে
কোরকের আবরণ টুটি
মাধবী কি প্রথম চিনিল আপনারে।
চিত্রাঙ্গদা। বঁধু, কোন্ আলো লাগল চোখে!
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে!
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে,
জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে।
অস্ফুটমঞ্জরী কুঞ্জবনে,
সংগীতশূন্য বিষণ্ন মনে
সঙ্গীরিক্ত চিরদুঃখরাতি
পোহাব কি নির্জনে শয়ন পাতি!
সুন্দর হে, সুন্দর হে,
বরমাল্যখানি তব আনো বহে,
অবগুণ্ঠনছায়া ঘুচায়ে দিয়ে
হেরো লজ্জিত স্মিতমুখ শুভ আলোকে॥
[প্রস্থান