চন্দ্রকলা ও চন্দন পুরুষ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
প্রথম প্রকাশ – এপ্রিল ২০২১
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ – রঞ্জন দত্ত
.
আমার মা,
আমার প্রথম পাঠিকা
৺অমিতা দাশগুপ্তকে
.
তক্ষশীলা থেকে একদিন ছিন্ন বসনে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল। তাঁর সম্পদ বলতে শুধু ছিল প্রখর শাস্ত্রজ্ঞান, মেধা, ধী-শক্তি আর প্রখর ব্যক্তিত্ব। সময়ের রথচক্রে এইসব গুণাবলী তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে পাটলিপুত্রের রাজদরবারে প্রধান ব্যক্তি হিসাবে। শুধু পাটলিপুত্রই নয়, ষোড়শ মহাজনপদের সব মানুষই এই ব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করেন তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য। বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন মল্লিনাগ নামের এই ব্রাহ্মণ। তবে বাৎসায়ন ছদ্মনামে লেখা যে গ্রন্থটি তাকে আসমুদ্র হিমাচলে খ্যাতি এনে দিয়েছে তা হল—’কামসূত্রম্’। এই গ্রন্থে তিনি বিবৃত করছেন ‘চৌষট্টিকলার’ কথা।…বার্ধক্যের সীমান্তে উপনীত হয়েছেন ব্রাহ্মণ বাৎসায়ন। একটা কাজ এখনও তাঁর বাকি থেকে গেছে—’কামসূত্রম্’ গ্রন্থর উপসংহার নির্মাণ। আর সেই উপসংহার রচনার নিমিত্ত কাশী নগরীর নির্জন গঙ্গাতীরে অজ্ঞাতবাসে এলেন বাৎসায়ন। তিনি স্থির করেছেন, গ্রন্থের উপসংহারে ‘কাম’-কে তিনি ‘ধর্ম’-র আগে স্থান দেবেন। কিন্তু অকস্মাৎ তাঁর এই সিদ্ধান্তকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি। তারপর?…প্রাচীন ভারতের প্রেক্ষাপটে রচিত বইয়ের প্রথম উপন্যাস—’চন্দ্রকলা ও চন্দন পুরুষ’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয়া নবকল্লোল পত্রিকায়। সম্পাদক রূপা মজুমদারের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ এই কারণে যে কামসূত্রের মতো বিতর্কিত বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখাকে তাঁর পত্রিকায় স্থান দিয়েছেন।
‘সম্রাট ও সেনাপতি’—এই উপন্যাসটি সম্রাট আকবরের জীবন কাহিনি আধারিত। তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটা দিন বর্ণিত হয়েছে এই উপন্যাসে। সম্রাট তখন প্রায় নিঃসঙ্গ। তাঁর পার্শ্বচর, নবরত্ন সভার একে একে অনেকেই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন সেই রাজ্যে, যে রাজ্য সম্রাট কোনওদিন জয় করতে পারেন না। নবরত্নর প্রধান রত্ন মহেশদাস অর্থাৎ বীরবলের বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতায় আর কলহাস্যে মুখরিত হয় না সম্রাটের দরবার, চাঁদনি রাতে লাল পাথরের ফতেপুর সিক্রিতে শোনা যায় না ফৈজীর উদাত্ত কণ্ঠের শায়েরী পাঠ, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে আগ্রা কেল্লার গুলামবাগে বর্ষা আনে না তানসেনের কণ্ঠ। এমনকী নিয়তি কেড়ে নিয়েছে সম্রাটের পরম সুহৃদ আবুল ফজলকেও। তবে সম্রাটের পুরোনো সঙ্গীদের মধ্যে এখনও একজন আছেন তার সঙ্গে। তিনি সেনাপতি মান। রাজা মান সিংহ। সম্রাটের প্রতি যাঁর আনুগত্য এবং ক্ষুরধার তলোয়ার আজ আকবরকে ভারত সম্রাটের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছে। ইদানীং সম্রাট নিজেও যেন এন্তেকালের ডাক শুনতে পাচ্ছেন। নিঃসঙ্গ সম্রাটের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে—তাঁর মৃত্যুর পর কী হবে এই সাম্রাজ্যের? তাঁর রেখে যাওয়া সিংহাসনে কি ভারত-সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হতে পারবে পুত্র জাহাঙ্গীর? এই আশঙ্কা শেষপর্যন্ত কোথায় পৌঁছে দিল ভারত-সম্রাট মহান আকবরকে? এ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘কিশোর ভারতী’ শারদ সংখ্যায়।
এ বইয়ের তৃতীয় তথা শেষ উপন্যাস ‘বারুদ’। উপন্যাসের পটভূমি সিপাহী বিদ্রোহের কিছুকাল আগের ভারতবর্ষ। ইংরেজরা তখন কামানের জোরে, বারুদের জোরে, আবার কখনও বা নানা কৌশলে দখল করে নিচ্ছে ছোট-বড় দেশীয় রাজ্যগুলো। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ছোটরাজ্য শিভাগঙ্গাই। সেখানকার রাজাকে হত্যা করে শিভাগঙ্গাইয়ের দখল নিয়ে সেখানে ঘাঁটি গাড়ল ইংরেজ কোম্পানি। বিধবা রানি ভেলু তাঁর শিশুকন্যাকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন মহীশ্বর অধিপতি হায়দার আলীর কাছে। অসীম কষ্ট উপেক্ষা করেও চালিয়ে যেতে লাগলেন স্বামীর রাজ্য উদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা। তবে এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কিন্তু রানি ভেলু নন। অতি সাধারণ এক যুবতী। রানি ভেলুর অতি ক্ষুদ্র নারী বাহিনীর সেনাপতি কুইলি। রানি ভেলুর প্রাণ রক্ষাকারী বিশ্বস্ত অনুচর। আর পাঁচজন সাধারণ নারীর মতো সেও ঘর বাঁধতে চেয়েছিল! এই সামান্য যুবতী স্থাপন করেছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তারই রোমাঞ্চকর জীবনকথা—বারুদ। এ উপন্যাসটিও প্রকাশিত হয় শারদীয়া কিশোর ভারতী পত্রিকাতে। কিশোরদের পত্রিকা বলে এ উপন্যাসে কিছু অংশ স্বাভাবিক নিয়মেই বাদ দিতে হয়েছিল। এবার এই উপন্যাসে সেই বাদ পড়া অংশ সংযুক্ত করা হল।
প্রাচীন ভারত, মধ্য যুগের ভারত ও আধুনিক ভারতের জন্মলগ্ন—এই তিন সময়কালকে কেন্দ্র করে তিনটি ভিন্নস্বাদের ইতিহাসআশ্রিত উপন্যাস তুলে দিলাম আপনাদের হাতে। হ্যাঁ, বরাবরের মতোই আমার ঐতিহাসিক রচনা প্রকাশের দায়িত্ব এবারও গ্রহণ করেছেন আমার, আপনার প্রিয় প্রকাশনা সংস্থা পত্র ভারতী।
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
২ জানুয়ারি ২০২১
পড়া যায় না।