ঙ. সমাপ্তি
পরের হাজার চেষ্টা
শুরুর ভুলগুলোকে আর শুধরে দেয় না;
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে সাগরের বুকে,
তবু সিন্ধুর লবণ কমে না।
এ ই হাউসম্যান
মোর পয়েমস
৩২. সময় এক বহতা নদী
সব মিলিয়ে আগ্রহজাগানিয়া কিন্তু বিশেষ কোনো ঘটনাবিহীন তিন দশকের কথা। সময় আর ভাগ্য মানবজাতির জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছে। ছিনিয়ে নিয়েছে অনেক কিছু। গ্যানিমিডের জন্য পৃথিবী ছেড়ে যাবার পর অনেক স্রোত বয়ে গেছে সৌরজগতের জগতগুলোর নদ-নদীতে।
প্রচলিত একটা কথায় অনেক সত্য লুকিয়ে আছে অনুপস্থিতি মনকে আরো নরম করে দেয়। ইন্দ্রা ওয়ালেসের সাথে আবার দেখা হবার পর দুজনেই বুঝতে পারে, এত সব যুক্তিতর্ক, কথা কাটাকাটির পরও কেমন করে যেন অনেক কাছে চলে এসেছে তারা। তাদের সম্মিলিত চেষ্টা এখন ডন ওয়ালেস আর মার্টিন পোলের ধমনীতে বয়ে যায়।
হাজার বছর পর একটা পরিবার গড়ে তোলা অনেক ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। প্রফেসর এ্যান্ডারসন ব্যক্তিগতভাবে সায় দেয়নি…
‘তুমি অনেক দিক দিয়ে ভাগ্যবান, বলেছিল সে পোলকে, রেডিয়েশন ড্যামেজ সামান্য অবাক হয়েছি দেখে, ইনট্যাক্ট ডি এন এ থেকে অনেক রিপেয়ারের কাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আরো কিছু টেস্ট না করে জেনেটিক ইন্টেগ্রিটির নিশ্চয়তা দিতে পারি না। উপভোগ কর সঙ্গ, কিন্তু আমরা ওকে করার আগে পরিবার শুরু করোনা।
টেস্টগুলোয় আরো অনেক সময় লাগে। প্রফেসর এ্যান্ডারসনের ভয় ছিল, আরো রিপেয়ার করতে হবে। ভয় ছিল সর্বক্ষণ। এ্যান্ডারসনের মতে পোল আর কিছুদিন পরে এলে হয়ত রেডিয়েশন ড্যামেজ মারাত্মক হত। দেখা গেল মার্টিন আর ডন একেবারে নিখুঁত। নির্দিষ্ট সংখ্যক মাথা, হাত, পা আছে। বেশ বুদ্ধিমান আর স্মার্ট হয়েছে, বাবা-মায়ের আদর পেয়ে মাথায় ওঠেনি। পনের বছর পর দুজনেই স্বাধীনতা চায়, তার আগ পর্যন্ত মা বাবাই তাদের বেস্ট ফ্রেন্ড। সোশ্যাল এ্যাচিভমেন্ট রেটিং ভাল হওয়ায় তাদের আরো একটা সন্তান নেয়ার জন্য রীতিমত উৎসাহ দেয়া হয়। কিন্তু বিচিত্র সৌভাগ্যের উপর র করে আরো একবার ঝুঁকি নেয়ার কোনো মানে হয় না।
পোলের জীবনে একটা দূর্ঘটনা পুরো সৌর সমাজকে নাড়া দিয়েছিল। ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার আর তার ক্রু গোলিয়াথে থেকে যথারীতি ধূমকেতুর কোর সংগ্রহ করার সময় বিস্ফোরিত হয় তাদের যানটা। শতছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কালো মহাকাশে। খুব নিচু তাপমাত্রায় থাকা অস্থিতিশীল অণুর বদৌলতে এমন দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ধুমকেতু সগ্রাহকদের মাথার উপর খড়গ হিসাবে সব সময় এ ঝুঁকি থাকে। চ্যান্ডলারের ক্যারিয়ারেই বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে। কেউ জানে না এমন দূর্ঘটনা কখন ঘটতে পারে।
চ্যান্ডলারকে সাজ্জাতিক মিস করে পোল। জীবনের এতটা অংশ জুড়ে যে মানুষ থাকতে পারে তা ভাবা যায় না। এখন, আর একজনই এ শূন্যতা পূরণ করতে পারত, ডেভ বোম্যান। তারা আবার স্পেসে যাবার পরিকল্পনা করেছিল। একেবারে ওর্ট মেঘের কাছে। অনেকটা অজানা এ অঞ্চলের বরফরাজ্যে যাবার আশা যে কোনো এ্যাস্ট্রোনোমারের কাছে সুখস্বপ্ন। পরিকল্পনায় হরদম বাগড়া দিয়েছে শিডিউলের ঝামেলা, সবশেষে স্বপ্নটা অধরা থেকে গেল।
আরো একটা দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটেছে- ডাক্তারদের হাজার মানা থাকা সত্ত্বেও। পৃথিবীর বুকে নেমে গেছে পোল একবার। একবারই যথেষ্ট।
তার আমলের শারীরিক প্রতিবন্ধি লোকজন যে ধরনের জিনিসে যেত, হুইলচেয়ার, তেমনি একটা যানে করে পৃথিবীর মাটির স্পর্শ নেয় সে। জিনিসটা মোটোরাইজড, গাড়ির টায়ারের মতো বাতাস ভরা চাকা আছে। মোটামুটি মসৃণ এলাকায় চলতে পারে। উড়তেও পারে জিনিসটা বিশ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। উড়ে যাবার কাজটা চালায় নিচের দিকে বসানো শক্তিমান ফ্যানের বাতাসে সৃষ্ট এয়ার কুশন। পোল প্রথমে আশ্চর্য হয়ে যায়, এত পুরনো টেকনোলজি এখনো পৃথিবীতে আছে। কিন্তু ইয়ার্শিয়া-কন্ট্রোল ডিভাইস দিয়ে সূক্ষ্ম যাতায়াত সম্ভব নয়।
হোভারচেয়ারে আরাম করে বসে সে বাড়তি ওজন তেমন টের পায়নি। নেমে গেছে আফ্রিকার হৃদপিন্ডে। শ্বাস নিতে একটু কষ্ট হলে কী হবে, এ্যাস্ট্রোনট ট্রেনিঙের সময় এর চেয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সূর্যের তাপ সহ্য করা যাচ্ছিল না সকালেই, দুপুরে কী হবে কে জানে!
পৃথিবীর, মাটির যে একটা নিজস্ব ঘ্রাণ আছে সে কথাও মনে ছিল না। বিচিত্র সব গন্ধ মনটাকে চনমনে করে তোলে।
চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল পোল, খোলার আগে ঘাড়ের কাছে লকলকে কীসের যেন স্পর্শ পায়।
‘এলিজাবেথকে হ্যালো বলুন, বলেছিল গ্রেট হোয়াইট হান্টার গ্রাব পরা গাইড, ‘সে আমাদের অফিশিয়াল গ্রিটার।’
চেয়ার ঘুরিয়ে পোল একটা বাচ্চা হাতি দেখতে পায়।
‘হ্যালো, এলিজাবেথ,’ একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে স্বাগত জানায় সে। সাথে সাথে স্যালুট করে এলিজাবেথ, গুড়টাকে উঁচিয়ে। এমন একটা আওয়াজ ওঠে তার কণ্ঠ চিরে, সভ্য সমাজে যেটাকে ঠিক স্বাগত জানানোর মতো মনে হয় না, কিন্তু সে নিশ্চিত, এটাই এ বন্ধুভাবাপন্ন প্রাণির বন্ধুত্ব করার রীতি।
পৃথিবী নামক নীলচে সবুজ গ্রহটায় সব মিলিয়ে ঘন্টাখানেক সময় ব্যয় করে সে। কৃত্রিমতা ছাড়াই সিংহগুলোর হুঙ্কার দেখে সে, দেখে হাজার হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত অকৃত্রিম আফ্রিকার কুমিরগুলোকে।
টাওয়ারে যাবার আগে পোল একটু ঝুঁকি নিয়ে পা বাড়ায় মাটির দিকে। দু- এক কদম হেঁটে নেয়। কিন্তু সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল না। আরো কম তাপমাত্রায় চেষ্টা করা উচিৎ। আবার চেয়ারের নরম গদিতে তলিয়ে গিয়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় সে।
‘অনেক হয়েছে, কাতর গলায় বলে সে, এবার টাওয়ারের দিকে ফিরে যাওয়া যাক।
এলিভেটর লবির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আসার সময় চোখে পড়েনি এমন এক সাইনে চোখ পড়ে যায়:
আফ্রিকায় স্বাগতম!
“বনানীতেই পৃথিবী সংরক্ষিত।”
–হেনরি ডেভিড থোরিউ(১৮১৭-১৮৬২)
আগ্রহ দেখে হাইড জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি তাকে চেনেন?
এমন সব প্রশ্ন সব সময় শুনে এসেছে পোল। প্রায়ই জবাব খুঁজে পায় না।
মনে হয় না, বলল সে একটু বিতৃষ্ণা নিয়ে।
তার ঠিক পরের মুহূর্তেই পিছন থেকে বন্ধ হয়ে গেল বিশাল দরজা। বন্ধ হয়ে গেল আদি বসুধামাতার রূপ, রস, গন্ধ, রঙ। নেমে গেল মানুষের আদি নিবাসের ঝাঁপ।
লেভেল দশ হাজারের এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসার পর পৃথিবী দেখার ফল ফলল। অবশ্য গায়ের নানা জায়গায় ব্যথা-বেদনার কোনো মূল্য নেই তার কাছে। এ গণতান্ত্রিক সমাজেও তার এ্যাপার্টমেন্টের অবস্থানটা অভিজাত। ফিরে আসা পোলকে দেখে ভড়কে গেছে ইন্দ্রা। সোজা বিছানার পথ দেখিয়ে দিয়েছে।
‘এন্থেউসের মতো হাল হয়েছে- বিপরীত আর কী! ইন্দ্রা বলল মুখ কালো করে।
মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে সে কথায় পারে না। অনেক রেফারেন্সই মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।
‘কার মতো?’
‘পৃথিবী-দেবী গায়ার ছেলের মতো। হারকিউলিস তার সাথে লড়েছিল। কিন্তু যতবার মাটিতে পড়ে যায়, ততবার শক্তি ফিরে পায় এহেউস।
তারপর? কে জিতল?
হারকিউলিস, অবশ্যই। এন্থেউসকে বাতাসে, মাটির উপর ধরে রাখে যেন মা ছেলের ব্যাটারি চার্জ করে দিতে না পারে।
যাক, আমার ব্যাটারি চার্জ হতে বেশি সময় নিবে না। একটা শিক্ষা হয়ে গেছে। আরো অভিজ্ঞতা না নিলে হয়ত এক সময় চান্দ্র এলাকায় গিয়ে হাপ ছাড়তে হবে।
পেপালের মনোভাব পুরো এক মাস ঠিক থাকে। প্রতি সকালে ঝাড়া পাঁচ কিলোমিটার হাঁটে সে। প্রতিদিন আফ্রিকা টাওয়ারের এক একটা লেভেল ধরে নেয়। কোনো কোনো লেভেল এখনো ফাঁকা। খা খা শূন্য ধাতব গড়নে মরুভূমির হাহাকার। কখনো ভরে উঠবে কিনা এ জায়গা কে জানে। অন্য লেভেলগুলোর আলাদা আলাদা সৌকর্য আছে। আছে ভিন্নতর স্থাপত্যশৈলি, প্রকৃতি। অনেকগুলো অতীত থেকে সংস্কৃতি ধার করেছে। কোনো কোনোটা ভবিষ্যতের পথ দেখায়। সেগুলোকে এড়িয়ে যায় সে। অনেক জায়গাতেই হাঁটার সময় সম্মানজনক দূরত্ব রেখে কৌতূহলী ছেলেমেয়েরা ভিড় জমায়। সাধারণত বেশি সময় তার সাথে হেঁটে পারে না।
একদিন পুরনো দিনের কায়দায় সাজানো এক লেভেলে হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত মুখের সামনে পড়ে যায়।
দানিল!
কোন সাড়া নেই, লোকটা চলেই যাচ্ছে। কিন্তু পরিচয় নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই পোলের মনে।
দানিল। আমার কথা মনে নেই? এবার তাকায় সে। চোখেমুখে বিস্ময়।
“স্যরি,” বলল লোকটা, আপনি নিশ্চয়ই কমান্ডার ফ্র্যাঙ্ক পোল, কিন্তু আমাদের তো আগে কখনো দেখা হয়নি।’
এবার পোলের অস্বস্তিতে পড়ার পালা।
‘বোকামি করেছি, মাফ চাওয়ার ভঙ্গি পোলের কথায়, কিন্তু বেশিরভাগ লোকই আর একজনের সাথে আপনাকে গুলিয়ে ফেলবে। হ্যাভ এ গুড ডে।’
দেখা হওয়ায় তার পরও খুশি সে। খুশি এই দেখে যে দানিল ফিরে গেছে স্বাভাবিক জীবনে। অতীত জীবনে একজন মানুষের সাথে যে সে থেকেছিল, সহায়তা করেছিল, সেসব কথা লেখা বইগুলো এখন হারিয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে স্মৃতির দুয়ার। যৌবনে দেখা চোর-পুলিশ ছায়াছবিগুলোকে মাঝে মাঝে মিস করে সে। এখন এসবের প্রতি আগ্রহ নেই তেমন।
মিস প্রিজলের সহায়তা নিয়ে সে এমন একটা শিডিউল তৈরি করে নেয় যেন অবসর সময়গুলো নানা ঝক্কি-ঝামেলার যোগাযোগ কাটিয়ে ব্রেইনক্যাপ পরে নিয়ে র্যান্ডম সার্চ করা যায়। পরিবারের বাইরে তার আগ্রহের সীমা বৃহস্পতি/লুসিফারের চাঁদগুলো। এখন সে ইউরোপা কমিটির সদস্য।
হাজার বছর আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়া হয়েছে বৃহস্পতির চাঁদগুলোর ব্যাপারে। সেখানে মানুষ কী করবে আর না করবে তা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ১৯৭৯ সালের ভয়েজার উড্ডয়ন আর ১৯৯৬ সালের গ্যালিলিও অভিযানের সময় থেকেই এ ইতিহাসের শুরু।
বেশিরভাগ দীর্ঘদিন টিকে থাকা সংস্থার মতো ইউরোপা কমিটিও আস্তে আস্তে ফসিলায়িত হয়ে যাচ্ছে। নতুন কোনো চমক না থাকলে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। হালম্যানের আবির্ভাবের পর চাঙা হয়ে উঠেছিল, নতুন একজন টগবগে চেয়ারপার্সন নিয়োগ দেয়া হয় পোলকে সহায়তা করার জন্য।
এর মধ্যে রেকর্ড হয়নি এমন নতুন তথ্য খুব বেশি দিতে পারেনি সে, তবু কমিটিতে থেকেই সে খুশি। এসব কাজে নিজেকে জড়িত রাখাকে দায়িত্ব মনে করে, তার উপর কোনো না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ না থাকলে খারাপ লাগে। আগে সে ছিল একজন জাতীয় বীর’, পরে ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজের তুলনায়, সামরিক ক্ষেত্রে সব টাকা ঢালা দেশগুলোর তুলনায় এবং প্রযুক্তি ও উপভোগের সুবিধার তুলনায় এ সমাজ অনেক অনেক অগ্রসর হলেও নিজের অস্তিত্বকে কোনো কিছুর সাথে যুক্ত করতে না পারলে জীবনটা একঘেয়ে হয়ে যায়।
আরো একটা প্রয়োজন মাঝে মাঝে মনে দানা বাঁধে, যা নিজের কাছে স্বীকার করতেও ভাল লাগে না তার পরেও হালম্যান তার সাথে কথা বলেছে, সংক্ষেপে। পোল জানে, চাইলেই আবার এমন করা যায়। মানুষের সাথে কথা বলার ইচ্ছা কি আস্তে আস্তে উবে যাচ্ছে? তা যেন না হয়।
থিওডোর খানের সাথে এখনো কথা হয়। ধান এখন ইউরোপা কমিটির গ্যানিমিড রিপ্রেজেন্টেটিভ। সে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর থেকে সর্বক্ষণ খানের প্রাণান্ত চেষ্টা- আর একবার যেন বোম্যানের সাথে যোগাযোগ হয়। ইতিহাস আর দর্শনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পড়ে আছে সামনে।
মনোলিথ কি তোমার বন্ধু হালম্যানকে সব সময় এত ব্যস্ত রাখে যে সে আমার সাথে একটু সময় দেয়ার মতো সময়ও পাবে না? পোলের কাছে তার চিরদিনে আক্ষেপ, এত সময় জুড়ে কী করে ব্যাটা?
খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন। জবাব এল পরিষ্কার আকাশে বঙ্খপাতের মতো। জবাব দিয়েছিল ডেভ বোম্যান। একটা ভিডফোন কল করে।
৩৩. কন্ট্যাক্ট
হ্যালো, ফ্র্যাঙ্ক। ডেত বলছি। তোমার জন্য খুব জরুরি একটা মেসেজ নিয়ে এসেছি। মনে হয় এখন তুমি আফ্রিকা টাওয়ারে নিজের স্যুইটে। যদি সেখানে থেকে থাক, তাহলে প্লিজ নিজেকে নির্দেশিত কর আমাদের অর্বিটাল মেকানিক্সের ইন্ট্রাক্টরের নাম বলে। আমি ষাট সেকেন্ড অপেক্ষা করছি। জবাব না এলে আরো এক ঘন্টা পর কল করব।
শক কাটিয়ে ওঠার জন্য এক মিনিট খুব কম সময়। প্রথমে আনন্দ, তারপর বিস্ময়, তারপর অন্য এক অনুভূতি গ্রাস করে তাকে। আনন্দ হয় ডেভের কাছ থেকে কল আসায়, আর উদ্বেগ আসে খুব জরুরি একটা মেসেজ’ এর কথা শুনে।
কপাল ভাল, ভাবে পোল, যে কয়েকটা নাম আমার মনে থাকে তার একটা বলতে বলেছে সে। কে গ্লাসগো উচ্চারণের একজন স্কটের কথা ভুলে যেতে পারে যার উচ্চারণ বুঝতে বুঝতে পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল শিক্ষার সময়টায়? কিন্তু লেকচারার হিসাবে তার তুলনা নেই। সবচে সহজে মানুষের মনের ভিতরে কথা ঢুকিয়ে দিতে পারার গুণ ছিল।
‘ডক্টর জর্জ ম্যাকভিটি।
‘এ্যাকসেপ্টেড। এখন প্লিজ তোমার ব্রেইনক্যাপ রিসিভারটার সুইচ অন কর। মেসেজটা ডাউনলোড হতে তিন মিনিট সময় নিবে। মনিটরিংয়ের চেষ্টা করোনা। আমি দশভাগের একভাগ কমপ্রেস করে পাঠাচ্ছি। শুরু করার আগে দু মিনিট অপেক্ষা করব।’
কীভাবে কাজটা করছে সে জানে না পোল। এখান থেকে বৃহস্পতি/লুসিফার পঞ্চাশ আলোকমিনিট দূরে। তাহলে নিশ্চয়ই মেসেজটা অন্তত এক ঘন্টা আগে পাঠানো হয়েছে। নিশ্চয়ই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কোনো প্রোগ্রামের সাথে এসেছে গ্যানিমিড-আর্থ বিমের মধ্য দিয়ে। ইন্ট্রাক্টরের নাম বললেই প্যাকেজটা অন হবে।
ব্রেইনবক্সের ইন্ডিকেটর লাইট জ্বলছে নিভছে- রিসিভ করছে মেসেজটা।
যে কম্প্রেশনে হালম্যান পাঠাল, তাতে পুরো মেসেজ দেখতে পাকা আধঘন্টা লাগবে পোলের। কিন্তু তার শান্তিময় জীবনে পরিবর্তন আসতে মাত্র দশ মিনিট বাকি।
৩৪. বিচার
‘অবিচ্ছিন্ন, সর্বব্যাপী যোগাযোগের ভুবনে কোনো বিষয় খুব বেশিক্ষণ গোপন করে রাখা যায় না। তাই এ ব্যাপারে মুখোমুখি আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয় পোল।
ইউরোপা কমিটির সদস্যরা ভেঙে পড়ে পোলের এ্যাপার্টমেন্টে। সাতজন। লাকি নাম্বারটা এসেছে চন্দ্রকলার সাতদিন থেকে। কমিটির তিনজন সদস্যের সাথে পোলের এই প্রথম দেখা, যদিও ব্রেইনক্যাপের আগের যুগে সে এত ভালভাবে কাউকে জানতে পারত না…
‘চেয়ারপার্সন ওকনর, কমিটির সদস্যগণ- ইউরোপা থেকে পাওয়া এ মেসেজ আপনারা ডাউনলোড করার আগে আমি কিছু কথা বলতে চাই- সামান্য কিছু, প্রমিজ করছি। কথাগুলো মুখে মুখে বলতেই ভাল লাগবে- এটাই আমার কাছে বেশি ন্যাচারাল। মনে হয় কখনো মনের সাথে মনের যোগাযোগের ব্যাপারটা ভালভাবে নিতে পারব না।
‘আপনারা সবাই জানেন, ডেভ বোম্যান আর হালকে ইউরোপার মনোলিথে ইমুলেশন হিসাবে স্টোর করে রাখা হয়েছে। সময়ে সময়ে মনোলিথ হালম্যানকে
এ্যাক্টিভেট করে। এ্যাকটিভ করে আমাদের উপর চোখ রাখার জন্য।
হালম্যান কিন্তু পুরোপুরি যান্ত্রিক অস্তিত্ব নয়। ডেভ অংশটা এখনো মানবীয় কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। সামান্য আবেগও আছে তার। একসাথে ট্রেনিং নিয়েছি, বছরের পর বছর ধরে একে অন্যের সমস্ত অনুভূতি জেনেছি- তাই আর যে কোনো মানুষের সাথে যোগাযোগ না করে আমার সাথে কম্যুনিকেট করতে ভালবাসে সে। সম্ভবত এভাবে কাজ করতে গিয়ে উপভোগ করে, কথাটা বেশি শক্ত হয়ে গেলেও…’
‘সে আগ্রহী, উৎসাহী, বন্ধুভাবাপন্ন। যেন বুনো একটা নমুনা তুলে এনেছে মনোলিথ তার কাজের জন্য। টি এম এর স্রষ্টাদের কাছে আমার হয়ত এখনো বুনো।
কিন্তু সেই বুদ্ধিমত্তা এখন কোথায়? হালম্যান জানে জবাবটা। সেই জবাব আমাদের হাড়মাংস জমিয়ে দিবে।
‘আমরা সব সময় যা অনুমান করে এসেছিলাম- মনোলিথ আসলে গ্যালাক্টিক নেটওয়ার্কের টুল। আর কাছের নডটা- যেটা মনোলিথকে নিয়ন্ত্রণ করে সেটা সাড়ে চারশ আলোকবর্ষ দূরে।
‘স্বস্তির জন্য যথেষ্ট কাছে। তার মানে একবিংশ শতাব্দিতে আমাদের ব্যাপারে যে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে সেটা পৌঁছে গেছে আধ-সহস্রাব্দ আগেই। যদি সেই মনোলিথের- আচ্ছা, তাকে সুপারভাইজার বলা যাক- সাথে সাথে জবাব পাঠিয়ে থাকে, সেটা এসে পৌঁছবে এমনি এক সময়ে। বর্তমান সময়ে।
‘এবং এখন হয়ত তেমন কিছুই ঘটছে। গত কয়েকদিন ধরে মনোলিথ অসংখ্য তথ্যের স্রোত রিসিভ করে। এখন নতুন প্রোগ্রাম সেটআপ করা হচ্ছে, সম্ভবত এসব তথ্যের ভিত্তিতেই।
‘দুর্ভাগ্যবশত হালম্যান শুধু আন্দাজ করতে পারে। মনোলিথের অসংখ্য সার্কিট আর মেমোরি ব্লকের সামান্য কয়েকটায় যাতায়তের সুযোগ আছে তার। চাইলে এর সাথে আলোচনা করতে পারে। আমি এখনো মেনে নিতে পারি না যে এত বেশি ক্ষমতা থাকার পরও মনোলিথের আলাদা কোনো সচেতনতা নেই- এমনকি সচেতনতা সম্পর্কেও তার ধারণা নেই।
এ সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে আছে হালম্যান হাজার বছর ধরে। অন ও অফ। আমাদের মতো একই সিদ্ধান্তে এসেছে। তার আভ্যরীণ জ্ঞানের জন্য এ সমাপ্তি অনেক বেশি ওজন বহন করে।
‘আমাদের সৃষ্টি করায় নাকি বলব আমাদের পূর্বপুরুষদের মন ও জিন নিয়ে খেলার ফলে যে সমস্যাই হয়ে থাক না কেন এখন সে পরের ধাপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। হালম্যানের মনে হচ্ছে আমাদের কপালে ভাল কিছু নেই। মানুষের মানবজাতির টিকে থাকার সমস্যাটা তার কাছে আগ্রহোদ্দীপক একটা ব্যাপার, এর চেয়ে বেশি কিছু না। আর সে সেজন্য আমাদের সহায়তা করতে চায়।
স্তব্ধ হয়ে থাকা শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে গোল।
‘অদ্ভুত ব্যাপার, আমার একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল… এতে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্লিজ, খেয়াল করুন…’
‘আমি আর ডেভ একদিন হাঁটছিলাম সাগরপাড়ে, উড্ডয়নের দিন কয়েক আগের কথা। দেখি বালির উপরে একটা বড়সড় বিটল পোকা উল্টে পড়ে আছে। প্রায়ই এমন দেখা যায়, পা উপরে, নাড়াচ্ছে সর্বক্ষণ, সোজা হওয়ার চেষ্টা করছে।
‘গা করলাম না- জটিল কিছু টেকনিক্যাল আলোচনায় মেতে আছি আমরা। সামনেই উড়তে হবে। চিতি। ডেভ কিন্তু খেয়াল করল- সরে গিয়ে পা দিয়ে সোজা করে দিল।
‘আমি প্রশ্ন তুললাম, ‘কাজটা কি ঠিক হল? এখনি এটা উড়ে গিয়ে কারো না কারো মূল্যবান জিনিসের বারোটা বাজিয়ে দিবে। হাসল ডেভ, ‘হয়ত, হয়ত না। আমি এটাকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছি।’
মাফ চাচ্ছি, আমার মাত্র কয়েকটা কথা বলা উচিৎ ছিল। কিন্ত ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় ভাল লাগছে। এখন দেখুন, হালম্যানের মেসেজের মর্মার্থ এখানেই।
সে মানবজাতিকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে চায়…’
‘এখন, প্লিজ, আপনাদের ব্রেইনক্যাপ চেক করুন। রেকর্ডিংটা হই ডেনসিটি ইউ ভি ব্যাঙের উপরে। চ্যানেল একশ দশ। স্বস্তি নিয়ে দেখুন, শুরু করছি…’
৩৫. সাজ সাজ রব
কেউ দ্বিতীয়বার দেখতে চায় না। একবারই যথেষ্ট।
প্লেব্যাক শেষ হবার পর প্রথমে কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর চেয়ারপার্সন ডক্টর ওকনর ব্রেইনক্যাপ খুলে ফেলে মাথা দলাই মলাই করতে করতে বলল:
‘আপনার সময়ের একটা ফ্রেজ আমাকে শিখিয়েছিলেন। সেটা কাজে লাগবে। দিস ইজ এ ক্যান অব ওয়ার্মস।
‘কিন্তু শুধু বোম্যান- হালম্যান এটাকে খুলেছে।’ বলল কমিটির এক সদস্য, মনোলিথের মতো জটিল জিনিসের অপারেশন বুঝতে পারা কি তার পক্ষে সম্ভব? নাকি এসব কল্পনাপ্রসূত
মনে হয়না তার খুব একটা কল্পনাশক্তি আছে, জবাব দিল ডক্টর ওকন, ‘সবকিছু ভালভাবেই চেক করেছে। আর নোভা স্করপিওর রেফারেন্স আছে যখন… আমাদের ধারণা ছিল সেটা কোনো দূর্ঘটনা। এখন দেখা যাচ্ছে- বিচার।
‘প্রথমে বৃহস্পতি, তারপর স্করপিও, ডক্টর কাউসম্যান বলছে, আইনস্টাইনের সাথে টক্কর দেয়ার জন্য সে খুব বিখ্যাত এক পদার্থবিদ, ‘এখন লাইনে কে থাকবে?
‘আমরা সব সময় ধারণা করেছি,’ বলল চেয়ার, যে টি এম এ গুলো আমাদের দেখভাল করে, এক মুহূর্তের জন্য থামে সে, তারপর শক্তি দিয়ে বলে, কী দূর্ভাগ্য কী চরম দূর্ভাগ্য- মানবজাতি তার খারাপ অধ্যায়গুলো শেষ করে এসে এ রিপোর্ট পাঠাল নিজ হাতে।
আবার নিরবতা। সবাই জানে যে বিংশ শতাব্দিকে অত্যাচারের শতাব্দি বলা হয়।
কোন বাধা না দিয়ে শুনছে পোল। আবারো কমিটির মান নিয়ে সন্তুষ্ট হয় সে। কেউ নিজের নিজের তত্ত্ব কপচানোর বা তর্ক তোলার চেষ্টা করছে না। আত্মম্ভরিতা প্রকাশেরও অবকাশ নেই। তার সময়ে এমন সব বিচিত্র তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যেত সবার মধ্যেই স্পেস এজেন্সি ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে এ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের, কংগ্রেশনাল স্টাফ আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিকিউটিভদের মধ্যে…
সত্যি, মানবজাতির উন্নতি হয়েছে। ব্রেইনক্যাপ শুধু অকেজো ধারণাগুলোকে বাতিল করে দেয়নি, শিক্ষার ব্যবহারের হার বাড়িয়ে দিয়েছে সাঘাতিকভাবে। একটু সমস্যাও আছে এতে, এখনকার সমাজে খুব বেশি ব্যতিক্রমী চরিত্র দেখা যায় না। মাত্র চারজনের কথা সে মনে করতে পারে- ডক্টর খান, ইন্দ্রা, ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার আর ড্রাগনলেডি।
চেয়ারপার্সন প্রথমে সবার কথা শুনল, সবাইকে সবটুকু প্রকাশ করতে দিল, এরপর যোগবিয়োগের পালা।
‘প্রথমেই যে প্রশ্নটা এসে পড়ে- এ হুমকিকে আমরা কতটা সিরিয়াসলি নিব সময় নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট আছে এখানে। মিথ্যা এ্যালার্ম বা ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকলেও ব্যাপারটা এত বেশি জটিল যে আমাদের সিরিয়াসলি নিতে হবে। সত্যি বলে ধরে নিতে হবে। বিপরীত কোনো বিষয় নিয়ে প্রমাণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত এটাই আমাদের করণীয়, সবাই রাজি?’
‘ভাল। আর আমরা জানি না কতটা সময় আছে হাতে। সুতরাং ধরে নিতে হবে বিপদ ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। হয়ত পরেও হালম্যান নতুন কিছু জানাতে পারে, তদ্দিনে দেরি হয়ে গেলে?
তাই এখন সিদ্ধান্তে আসতে হবে: কী করে আমাদের টিকিয়ে রাখতে পারি? বিশেষত মনোলিথের মতো শক্তিমান কিছুর বিরুদ্ধে বৃহস্পতির কপালে কী
জুটেছিল একবার ভেবে দেখুন! আর নোভা স্করপিও’….
জানি না কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করে লাভ হবে কিনা। তবু, খতিয়ে দেখতে হবে। ডক্টর ক্রাউসম্যান, একটা সুপারব বানাতে কতদিন সময় লাগবে?
‘আশা করি ডিজাইনগুলো এখনো আছে, তার মানে রিসার্চ করতে হবে না উ… সম্ভবত হপ্তা দুয়েক। থার্মোনিউক্লিয়ার উইপন বানানো সহজ, সেখানে কমন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয় হাজার হলেও, জন্ম নিয়েছিল দ্বিতীয় সহস্রাব্দে। কিন্তু আরো ভাল কিছু চাইলে- যেমন এন্টিম্যাটার ব, অথবা ছোট ব্ল্যাকহোল- তখন কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ। দেখাশোনা শুরু করে দিতে পারবেন কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, এতে কাজ হবে না। এত শক্তিশালী জিনিস যারা তৈরি করবে তারা কাছাকাছি প্রযুক্তির ধ্বংস-ক্ষমতার জিনিসের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থাও করবে। তাহলে আর কোনো সাজেশন?
‘আমরা কি মধ্যস্থতা করতে পারি? খুব বেশি আশা না রেখেই প্রশ্ন তুলল এক কাউন্সিলর।
কীসের সাথে… বা কার সাথে? জবাব দিল কাউসম্যান, আমরা এর মধ্যেই আবিষ্কার করে ফেলেছি, মনোলিথটা একেবারে খাঁটি মেকানিজম। যা করার কথা শুধু তাই করছে। প্রোগ্রামে ফ্লেক্সিবিলিটি থাকতেও পারে। আছে কি নেই সেটা আমরা জানি না। আর হেড অফিসের কাছে আপিল করার উপায়ও নেই- মাত্র সাড়ে চারশ আলোকবর্ষ দূরে সেটা।
কোন বাধা না দিয়ে শুনছিল পোল; এ আলোচনায় কাজে লাগবে এমন কথা বলতে পারবে না সে। বেশিরভাগই মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এখন, এ কথা যদি বাইরে প্রকাশ পেয়ে যায়, আর ভুল হয়, তাহলে সমস্যা আছে। ল না হলে মানবজাতির মঙ্গল হোক।
পরিচিত একটা বাক্যাশং শোনার আগ পর্যন্ত এসব ভাবনায় মগ্ন ছিল সে।
কমিটির সাধারণ এক সদস্য, নামটা এত বড় তার যে পোল কখনো মনে রাখতে পারে না, শুধু দুইটা শব্দ ঢেলে দিল আলোচনায়।
‘ট্রোজান হর্স!
প্রথমে সবাই নিশ্চুপ, তারপর একজন বলে উঠল, ‘প্রেগন্যান্ট।’
সবাই একবাক্যে বলা শুরু করল, ইস! আমার মনে কেন আগেই এল না কথাটা!”
‘অবশ্যই।
দারুণ আইডিয়া।
অবশেষে প্রথমবারের মতো সবাইকে চুপ করতে বলল চেয়ারপার্সন।
‘ধন্যবাদ, প্রফেসর থিরুগনানাসাম্পায়ামূর্তি!’ বলল সে, একটুও ভুল না করে, ‘আরো একটু খুলে বলবেন কি?
‘অবশ্যই। যদি মনোলিথ সবার ধারণা অনুযায়ী সত্যি সত্যি একটা অনুভূতিহীন যন্ত্র হয়ে থাকে এবং সেলফ মনিটরিং সিস্টেম যদি সীমিত হয়ে থাকে তাহলে আমাদের হাতে এর মধ্যেই এমন কিছু অস্ত্র আছে যা কাজে লাগবে। ভন্টে লুকানো আছে সেটা।
‘এবং একটা ডেলিভারি সিস্টেম হালম্যান!
‘ঠিক তাই।
‘জাস্ট এ মিনিট, ডক্টর টি, আমরা কিছুই জানি না একেবারে কিস্যু জানি না মনোলিথের স্থাপত্যের ব্যাপারে। এর বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা কাজে লাগবে কী করে?
‘পারব না–কিন্তু মনে রাখুন, মনোলিথ যতই জটিল আর আধুনিক হোক না কেন, একে সৃষ্টি জগতের যৌক্তিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। মেনে চলতে হবে শত শত বছর আগে এ্যারিস্টটল আর বোলের গেঁথে দেয়া রীতি। আর এজন্যই এটা হয়ত- না, এটার উচিৎ!- ভল্টে লুকানো জিনিসগুলোর দাম দেয়া। আমরা সেগুলোকে এভাবে এ্যাসেম্বল করব যেন অন্তত দুইটার একটা কাজে লাগে। এছাড়া আর কোনো আশা নেই- কেউ কি এর চেয়ে ভাল বিকল্পের সন্ধান দিতে পারবে?
‘এক্সকিউজ মি, ধৈর্য হারিয়ে পোল বলল, কোন একজন কি আমাকে দয়া করে বলবেন এই মহামূল্যবান ভল্টটা কী এবং কোথায় আছে?
৩৬. আতঙ্কের কুঠুরি
ইতিহাস দুঃস্বপ্নে ভরা। দুঃস্বপ্নের কোনো কোনোটা প্রাকৃতিক, কোনো কোনোটা মানবসৃষ্ট।
একবিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে প্রাকৃতিকগুলোর বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বসন্ত, কালোমৃত্যু, এইডস, আফ্রিকার বন-বাদাড়ে থাকা অন্যান্য বীভৎস ভাইরাস। কোনো কোনোটাকে অবলুপ্ত না করে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামনে এগিয়ে চলার সাথে সাথে মানুষের গায়ে তাদের অনেকের কার্যকারীতা বন্ধ হয়ে গেছে। তবু, প্রকৃতিমাতার সৃষ্টিশীলতাকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। কে জানে, ভবিষ্যতের প্রকৃতি হয়ত আরো ভয়ঙ্কর সব রহস্য লুকিয়ে রেখেছে।
তাই সব ধরনের আতঙ্কজনক জিনিসের স্পেসিমেন রেখে দেয়া হয় রেখে দেয়া হয় সায়েন্টিফিক রিসার্চের জন্য। সাবধানে পাহারা দেয়া হয় সেগুলোকে, অবশ্যই। বেরিয়ে এসে মানবজাতির উপর আবার ছড়ি ঘুরাবে এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারে যে এই লুকিয়ে রাখা জিনিসগুলো বিপদ বয়ে আনবে না?
বিংশ শতাব্দির শেষভাগে স্মলপক্সের শেষ জীবাণুগুলোকে আমেরিকা আর রাশিয়ার কাছে রাখার সিদ্ধান্ত হলে তাই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল সর্বত্র। ভয় ছিল
ভূমিকম্প, যান্ত্রিক গোলযোগ বা সন্ত্রাসী দলের আক্রমণে বেরিয়ে পড়তে পারে জিনিসগুলো।
সবাইকে একটা সমাধান সম্ভষ্ট করে (একেবারে নিখাদ পাগলাটে চরমপন্থি কয়েকজন ছাড়া), এগুলোকে চাঁদে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আলাদা করা পিকো পর্বতের ভিতরে একটা ল্যাবরেটরিতে রাখা হবে। এখানে মানবজাতির আরো অনেক পাগলামির নিদর্শন রাখা হয় পরে।
এমন সব গ্যাস আর কুয়াশা ছিল যার এক বিন্দুই মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কোনো কোনো ধর্মীয় সন্ত্রাসীদল বিজ্ঞানে অগ্রসর হয়ে এসব আবিষ্কার বা পুনরাবিষ্কার করে। তাদের বেশিরভাগই বিশ্বাস করত পৃথিবীর শেষ সময় চলে এসেছে এবং তাদের অনুসারীরাই শুধু মুক্তি পাবে)। হয়ত ঈশ্বর সময়ের কথা ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে।
প্রথম দিকে তাদের লক্ষ্য ছিল সাবওয়ে ট্রেন, আন্তর্জাতিক মেলা, স্টেডিয়াম, পপ কনসার্ট… লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা পড়ে, আহত হয় আরো অনেকে। একবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে নিয়ন্ত্রণে আনা পর্যন্ত এসব চলতেই থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খারাপের ভিতর থেকে ভাল বেরিয়ে আসে- আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো পরস্পরকে সহায়তা করতে থাকে সেভাবে, যেভাবে আর কখনো করেনি। এমনকি এও নির্ধারিত হয়ে যায় যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এমন আচমকা বিচিত্রভাবে আসবে না।
এসব এ্যাটাকে ব্যবহৃত কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল উইপনগুলোও পিকোর সংগ্রহে জমা হয়। সেখানেই জমা হয় তখন আবিস্কৃত এ্যান্টিডোটগুলো। আশা করা হয়েছিল এসব জিনিসের সাথে মানুষের আর কোনো সংশ্রব থাকবে না। কিন্তু বিশেষ কিছু প্রয়োজনে যদি কাজে লাগে, সে আশায় এখনো পাওয়া যায় মাটির তলায়। চাঁদে।
পিকো ভল্টের তৃতীয় ক্যাটাগরির আইটেমগুলোকে প্লেগ হিসাবে গণ্য করা গেলেও কখনো কাউকে সরাসরি আহত করেনি। বিংশ শতাব্দির শেষভাগের আগে তাদের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকে হাজার কোটি টাকার সমতুল্য ক্ষতি করে ফেলেছে। ক্ষতি করতে পারত যে কোনো রোগের সাথে পাল্লা দিয়ে। এরা কোনো প্রাণি নয়, বস্তু নয়, শুধুই ক্ষমতা। মানবজাতির সবচে দামি সেবক, কম্পিউটারের রোগ তারা।
নামগুলো নেয়া হয়েছে মেডিক্যাল ডিকশনারি থেকে ভাইরাস, প্রিয়ন, টেপওয়ার্ম আর তাদের কাজও সেই জীবন্ত জিনিসগুলোর মতোই। কোনো কোনোটা একেবারে নির্মল সামান্য জোক নিয়ে আসে, কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের কাছে নিয়ে আসে আচমকা আনন্দ বা বিরক্তি।
বাকিরা সত্যিকার ধ্বংসাত্মক। স্রেফ অকল্যাণ বয়ে আনাই সেগুলোর উদ্দেশ্য।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ব্যবহৃত হয় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কম্পিউটার চালিত ও নিয়ন্ত্রিণ ব্যাঙ্ক বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কজা করার জন্য। সেসব প্রতিষ্ঠান জানতে পারে, তাদের সমস্ত ডাটা উধাও হয়ে যাবে, বিপুল অঙ্কের ডলার একটা এ্যানোনিমাস এ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেই রক্ষা। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিতে চায় না। অধোবদনে দিয়ে দেয় তারা, চুপিসারে। মানুষের কাছে বা ব্যক্তিগতভাবে খাটো হবার ভয় থাকে মনে।
এমন সুযোগ পেয়ে মাথায় ওঠে ইনফরমেশন হাইওয়ে জিনিয়াসরা। বাগে পায় সবাইকে। ধরা পড়লেও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার উপায় নেই। তারা জিনিয়াস, দ্র, মার্জিত। সর্বোপরি, কাউকে আহত করেনি, করেছে।
তারপর, ছোটখাট সাজার মেয়াদ শেষ হলে কেঁচো থেকে তারা কেউটের রূপ নেয়। যে বা যারা ধরা পড়ার জন্য দায়ী তাদের কম্পিউটার সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। কেউ কেউ যে ভাল হয়ে যায় না তা নয়….
সাধারণত তারা উঠতি বয়সের ছেলেপেলে, একেবারে একা একা কাজ করে, গোপনে। ওয়ার্ল্ডওয়াইড কেবল আর রেডিওর কল্যাণে সৃষ্টি করে- এটুকুতেই অনেকের আনন্দ। ছড়িয়ে পড়ে ডিস্কেট আর সিডিরমে। তারপর পৃথিবীজোড়া চিৎকার শুনে শুনে হেসে কুটিপাটি হয়।
মাঝে মাঝে এসব জিনিয়াসকে ক্যাক করে ধরে জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো। তারপর তাদের নিজস্ব গোপন কাজে বেগার খাটায়। সাধারণত শত্রুদের ডাটাব্যাঙ্কে আঘাত হানাই মূল উদ্দেশ্য।
এখন গ্যাস আর জীবাণুর চেয়ে কার্যকর অস্ত্র হাতে, বস্তুতান্ত্রিক যুদ্ধের সময় শেষ।
২০০৫ সালে নিউইয়র্ক-হাভানা ব্যাঙ্ক ভেঙে পড়া, ২০০৭ সালে ভারতীয় পারমাণবিক মিসাইলের আঘাত হানা (কপাল ভাল, ওয়্যারহেড এ্যাক্টিভেট হয়নি), ২০০৮ সালে প্যান ইউরোপিয়ান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ধ্বসে যাওয়া, উত্তর আমেরিকার টেলিফোন সিস্টেমের প্যারালাইসিস- সবই ধ্বংসদিবস চাওয়া গোপন সংস্থাগুলোর কাজ। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স আর জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান আস্তে আস্তে এসব স্তিমিত করে দেয়।
অন্তত তাই বিশ্বাস করে লোকে। শতাব্দির পর শতাব্দি পেরিয়ে গেছে, সমাজের ভিত্তিমূলে এখনো কোনো আঘাত আসেনি। বিজয়ের পথে অন্যতম প্রধান অস্ত্র ছিল ব্রেইনক্যাপ। অনেকে মনে করে এসব এ্যাচিভমেন্ট এসেছে অনেক বেশি মূল্যের বিনিময়ে।
সেই প্লেটো আর সক্রেটিসের সময় থেকে মানুষ আর রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে কথাবার্তা চলে আসছে। ধীরে ধীরে সবাই রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে তৃতীয় সহস্রাব্দে। সাধারণত ধরে নেয়া হয় সমাজতন্ত্রই সবচে ভাল রাষ্ট্রব্যবস্থা; এর একটা মহড়া দেয়া হয় শতকোটি প্রাণের বিনিময়ে সামাজিক পোকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর রোবট সহ আরো কিছু স্তরে দেখা হয়। সবশেষে দেখা গেল মানবজাতির জন্য সবচে কম অকল্যাণকর পদ্ধতির নাম গণতন্ত্র।
ব্রেইনক্যাপ সাধারণ মানুষের নাগালে আসার পর থেকে কিছু উচ্চবুদ্ধিসম্পন্ন একই সাথে উচ্চঈর্ষাসম্পন্ন মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, এটা আগেই ওয়ার্নিং সিস্টেম হিসাবে কাজ করতে পারে। ভয়ানক হয়ে পড়ার আগেই অনেক ধরনের সাইকোসিস ধরা পড়ে যায়। মানুষের মানসিক বিকৃতির পধ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তার পরও, কেউ খারাপ কাজ করলে বা মানসিকভাবে অসুস্থ হলে ইলেক্ট্রনিকভাবে ট্যাগ করে রাখা হয় বেশি হলে সরিয়ে নেয়া হয় সমাজ থেকে। ব্রেইনক্যাপ দিয়ে তখন এসব কাজই বেশি করা হত। কিন্তু আস্তে আস্তে পার্সোনাল টেলিফোনের মতো জরুরি জিনিসে পরিণত হল এটা- অবিচ্ছেদ্য। পুরো সমাজের সাথে যে-ই খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয় সেই সন্দেহের মুখে পড়ে। ফলে চিকিৎসাও হয় ত্বড়িৎগতিতে।
পরে যখন শত্রুদের মতানুসারে, ‘মাইপ্রোবিং’ পুরোপুরি সচল হল, তখন থেকে মানুষ শোর তোলে, ব্রেইনক্যাপ নাকি ব্রেইনকপ?
অনেকে মেনে নেয়, এ ধরনের নজরদারির ফলে অনাগত বহু বিপর্যয় রোধ করা যাবে। গড়া যাবে সুন্দর সমাজ। তারপর মানসিক স্বাস্থের উন্নয়নের সাথে সাথে অবলুপ্তির পথ পায় ধর্মীয় পাগলামি।
সাইবারনেট ক্রিমিনালদের সাথে চলা লম্বা যুদ্ধ শেষপর্যায়ে এলে বিজয়ীরা দেখতে পেল হাতে পর্বতপ্রমাণ জঞ্জাল জমেছে। হাজার হাজার কম্পিউটার ভাইরাস, বেশিরভাগই ধরতে পেরে শেষ করে দেয়া কঠিন। আর আছে এমন কিছু অস্তিত্ব যার কোনো সমাধান নেই, সমাধানের পথও নেই…।
বেশিরভাগই মহান মহান গণিতবিদ-সম্পর্কিত, যারা তাদের আবিষ্কারের ফলে আসা ধ্বংস দেখে বিস্মিত হতেন। হ্যাকার আর ভাইরাসের জনকরা একের পর এক গাণিতিক আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যায় গডেল গ্রেমলিন, ম্যান্ডেলট মেজ, কম্বিনেটোরিয়াল ক্যাটাট্রফি, ট্রান্সফিনিট ট্র্যাপ, কনওয়ে কোনানড্রাম, তুরিং টর্পেডো, লরেঞ্জ ল্যাবিরিন্থ, বুলিয়ান বৰ, শ্যানন স্নের, ক্যান্টর ক্যাটাক্লিজম…
কোনো সাধারণ নিয়মে ফেলতে পারলে বোঝা যেত এসব গাণিতিক ভয়াবহতা এক নিয়মে কাজ করে। এগুলোর কাজ মেমোরি ইরেজার আর কোড ব্রেকার হিসাবে যতটা, আর কোনো ক্ষেত্রে ততটা নয়। এমন কোনো কাজ দিবে, এমন কোনো প্রোগ্রাম শুরু করতে বাধ্য করবে যা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের শেষ দিনেও শেষ করা সম্ভব নয়। ক্ষতির দিক দিয়ে ম্যান্ডেট মেজ এক কাঠি বাড়া। বাস্তবেই এটা অসীম কতগুলো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে।
পাই বা তেমন অসীম কোনো সংখ্যার মান বের করা তেমনি এক উদাহরণ। যাই হোক, একেবারে বোকার হদ্দ কোনো কম্পিউটারও এমন সহজ ফাঁদে পা দিবে না। কম্পিউটার এত বেশি এগিয়ে গিয়েছিল হাজার বছর আগে যে শূন্যের নিচে মান বের করতে গেলে কম্পিউটার সংখ্যাটাকে পিষে ফেলে একটা ফল দেখিয়ে দিবে…
এখন, চালাক প্রোগ্রামারদের টার্গেট সেট করতে হবে এভাবে, যেন সংখ্যাটা নির্দিষ্ট কোনো সময়ে শেষ হয়।
আসলে, সিদ্ধান্ত একটাই, ডিজিটাল অকল্যাণের প্রতিনিধিদের বায়োলজিক্যাল আর কেমিক্যালদের সাথেই বসিয়ে রাখতে হবে। আশা করা যায় চিরদিনের জন্য। পিকো ভন্টে।
৩৭. অপারেশন ডেমোক্লেস
পোল মানুষ আশা করে কখনো ব্যবহার করতে হবে না- সেই অস্ত্র এ্যাসেল করা লোকদের সাথে খুব বেশি যোগাযোগ করেনি। অপারেশনটার নাম দেয়া হয় ডেমোক্রেস। ব্যাপারটা এত বেশি উচ্চ স্তরের যে সে খুব বেশি অবদান রাখতে পারবে না। টাস্কফোর্সের যে রূপ সে দেখেছে, তাতে স্পষ্ট মনে হয় তারা মানুষ নয়, এ্যালিয়েন। একজন পাগলাগারদের ছিল, এখনো এ জিনিসের অস্তিত্ব আছে ভেবে অবাক হয় পোল। চেয়ারপার্সনের অভিমত অবশ্য স্নি, একজন কেন, অত আরো দুজনকে সেখানে পাঠানো উচিৎ।
‘এনিগমা প্রজেক্টের কথা কখনো শুনেছ নাকি? মন নষ্ট করা একটা সেশনের পর জিজ্ঞেস করে মহিলা পোলের দিকে তাকিয়ে।
মাথা ঝাঁকায় পোল।
বলে যাচ্ছে চেয়ারপার্সন, ‘আমি ভেবে অবাক হই তোমার জন্মের মাত্র কয়েক দশক আগের কথা। ডেমোক্রসের জন্য আমি এসব ঘেঁটেঘুঁটে এসেছি। সমস্যার ধরণ মোটামুটি একই রকম- তোমাদের আমলের এক যুদ্ধে শত্রুদের কোড ভাঙার জন্য একদল মেধাবী গণিতবিদকে একত্র করা হল, অত্যন্ত গোপনে… ঘটনাক্রমে, কাজটাকে বাস্তবরূপ দিতে তারা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সত্যিকার কম্পিউটারটা বানিয়ে ফেলে।
‘এ নিয়ে দারুণ গল্প আছে একটা আশা করি ঘটনাটা সত্যি, কারণ এতে আমাদের টিমে দারুণ উৎসাহ জাগবে- একদিন প্রধানমন্ত্রী ভিজিটে এল, তারপর এনিগমার ডিরেক্টরকে বলল: “দুনিয়া ছেনে ফেলে হলেও কাজের লোক নিয়ে আসুন, যখন বলেছিলাম, ভাবিনি সত্যি সত্যি আমার কথাটাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন।’
প্রজেক্ট ডেমোক্লেসের জন্যও দুনিয়া ছেনে ফেলা হয়েছে। সবচে বড় কথা, এ প্রজেক্টের লোকেরা জানে না কখন কাজে লাগবে এটা- কয়েকদিন পর, কয়েক মাস পর, নাকি বছর কয়েক পর… প্রথম দিকে তাড়া দিয়েও কাজ হচ্ছিল না। খুব একটা গা করছিল না গবেষকরা। গোপনীয়তাও সমস্যা সৃষ্টি করে। তথ্য এখন যে কোনোভাবে যে কোনো জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে বলে এ ডোমোক্র প্রজেক্টের কথা আর কেউ জানে না সংশ্লিষ্ট পঞ্চাশজন ছাড়া। কিন্তু এসব লোকের হাতেই সর্বময় ক্ষমতা- যে কোনো তথ্য লুকাতে পারবে, যে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারবে, যে কোনো শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে, একাই পিকো ভল্ট খুলতে পারবে পাঁচশ বছর পর…
ক্রমবর্ধমান ফ্রিকোয়েন্সিতে গ্রেট ওয়ালের ডাটা পাবার কথা হালম্যান প্রকাশ করার পরই ধারণা করা হয় কোনো একটা গন্ডগোল আছে। এই কদিন ব্রেইনক্যাপের এন্টি-ইনসমনিয়া প্রোগ্রাম নিয়েও পোলের ঘুমাতে সমস্যা হয়েছে। অবশেষে ঘুমাতে গেলে মনে প্রশ্ন জাগত, আর জেগে ওঠা হবে তো? কি অবশেষে অস্ত্রের সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়ে গেল। অস্পৃশ্য, অদৃশ্য, অকল্পনীয় এক মারণাস্ত্র। ঢুকিয়ে দেয়া হয় বিশালবপু এক ক্রিস্টালাইন বস্তুতে, ধাতব আবরণে ঢেকে কিছুতকিমাকার করা হয়।
পোল অনিশ্চয়তার সাথে গ্রহণ করে জিনিসগুলো। কে জানে, হিরোশিমার জাপানি ঘাঁটিতে ফেলার জন্য পারমাণবিক বোমা বহনকারী পাইলটেরও এমন লেগেছিল কিনা। তাদের সব ভয় যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে দায়িত্ব আরো বেড়ে যাবে, কমবে না।
মিশনের প্রথম ভাগ সফল হবে কিনা তাও জানা নেই। কারণ কোনো সার্কিটই পুরোপুরি নিখাদ হতে পারে না। হালম্যানকে এখনো প্রজেক্ট ডেমোক্লেসের ব্যাপারটা জানানো হয়নি। গ্যানিমিডে ফিরে আসার সময় কাজটা করবে পোল।
এখন শুধু একটাই আশা- হালম্যান ট্রয়ের ঘোড়র কাজ নিবে এবং, হয়ত, এ পদ্ধতির শিকার হয়ে মিলিয়ে যাবে শূন্যে।
৩৮. প্রিম্পটিভ স্ট্রাইক
এত বছর পর হোটেল গ্যানিমিডে ফিরে আসাটা বিচিত্র লাগে- সবচে অবাক ব্যাপার, সবকিছু একেবারে অপরিবর্তিত মনে হয় এত ঘাত-প্রতিঘাতের পরও। ঘরে প্রবেশ করে পোল। আবারও খুব অস্বস্তি হয়, এ সুইট এমন এক লোকের নামে যে তার সফরসঙ্গি ছিল তখন পর্যন্ত মানব ইতিহাসের সবচে বড় অভিযানে। ছবির ভিতর থেকে তাকিয়ে আছে ডেভ বোম্যান। অন্যদিকে বোম্যান/হালম্যান অপেক্ষা করছে ইউরোপার বুকে।
স্যুইটের পুরনো ধাচের ভিডফোনে পরিচিত মুখাবয়ব ফুটে উঠল।
ফ্র্যাঙ্ক! চিৎকার করে কান ঝালাপালা করে দিতে চায় যেন থিওডোর খান, আসবে সেকথা আমাকে আগে বলনি কেন? ভিডিওতে আর কাউকে দেখা যাচ্ছেনা কেন? তোমার সাথে ল্যান্ড করা পোশাকি অফিশিয়াল ধাচের লোকগুলোই বা কে
প্লিজ, টেড। হ্যাঁ, আমি দুঃখিত, কি বিশাস কর, এসবের পিছনে কারণ আছে, খুবই ভাল কারণ আছে। পরে ব্যাখ্যা করব। যা, সাথে আরো একজনতো আছেই। যত দ্রুত সম্ভব কল করছি। গুডবাই।
‘ডু নট ডিস্টাব সাইন অন করে দেয়ার পর মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, স্যরি এ্যাবাউট দ্যাট- তুমিতো জানই লোকটা কে, তাই না?
হ্যাঁ- ডক্টর খান। মাঝে মাঝে আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে যায়।
“আর তুমি কখনো জবাব দাওনি। কেন, জানতে পারি কি? আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকতে এ প্রশ্নটা না করে পারে না পোল।
শুধু আমাদের চ্যানেলটা ভোলা রাখতেই ভাল লাগে। মাঝে মাঝে দূরে চলে যাই। কখনো বছরের পর বহর দুরেই থাকি।’
এ কথায় একটু অবাক হয় পোল। এমনটা হবার কথা ছিল না। জানে, হালম্যানের অস্তিত্বের কথা বারবার নানা জায়গায় উঠেছে, তবু, বছরের পর বহর দূরে থাকা? সে সবত অনেকগুলো নবজগৎ ঘুরেছে- হয়ত এ কারণেই নোভা স্করপিওর ব্যাপারটা জানে। জানার কথা, জায়গাটা মাত্র চরিশ আলোকবর্ষ দূরে, মহাজাগতিক হিসাবে প্রতিবেশী। কি একেবারে নডের কাছে গেছে, তা হতে পারে না। গিয়ে ফিরে আসতে আসতে নশ বছর লেগে যাবে।
কপাল ভাল, প্রয়োজনের সময় তোমাকে এখানে পেলাম।
জবাব দেয়ার আগে হালম্যান সাধারণত ইতস্তত করে না। এবার করছে। তিন তিনটা লম্বা সেকেন্ড পেরিয়ে গিয়ে জবাব আসে, তুমি কি নিশ্চিত যে ব্যাপারটা স্রেফ ভাগ্য?
মানে?
‘এসব নিয়ে কথা বলতে চাইনি। কিন্তু আমি… অন্তত দুবার এমন অস্তিত্বের সন্ধান পেয়েছি যা মনোলিথের চেয়ে শক্তিমান; সম্ভবত তারাই মনোলিথের জন্মদাতা। হয়ত আমাদের কল্পনার চেয়ে কম স্বাধীনতা ভোগ করতাম…’ ।
ভাবনাটা আসলেই ভয় ধরিয়ে দেয়। জোর করে এসব চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সমস্যায় মনোনিবেশ করে পোল।
‘আশা করা যাক আমাদের স্বাধীনতা অনেক বেশি। আশা করা যাক প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারব। কে জানে প্রশ্নটা বোকাটে কিনা… আমাদের দেখা হবার কথা জানে নাকি মনোলিথ সন্দেহ করতে পারে?
‘এমন আবেগ নেই সেটার। অসংখ্য ফল্ট প্রটেকশন ডিভাইস আছে, কোনো কোনোটা বুঝতে পারি আমি। এই সব।
‘এখন আমাদের উপর নজরদারি করতে পারবে?
মনে হয় না।’
আশা করি আমার আশাটাই ঠিক, সে সিম্পলমাইন্ডেড সুপার জিনিয়াস। ব্রিফকেস খুলল সে। একটা ট্যাবলেট বের করল। এ সামান্য গ্র্যাভিটিতে এর ওজন একেবারে সামান্য। কে সন্দেহ করবে মানবজাতির ভাগ্য এখন এ ট্যাবলেটের ভিতরে
‘তোমার কাছে একটা সিকিউরড সার্কিট পাঠানোর কোনো উপায় ছিল না আমাদের হাতে। ডিটেইলে যেতে পারিনি এজন্যই। এ ট্যাবলেটে এমন সব প্রোগ্রাম করা আছে যার ফলে মানুষকে ধ্বংস করে দেয়ার মতো যে কোনো আদেশ পালন করতে বাধা দিবে। মানবজাতির ইতিহাসে ডিজাইন করা সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটা ভাইরাস আছে এখানে। বেশিরভাগের কোনো এ্যান্টিভোট নেই, এমনকি বিশ্বাস করা হয় কোনো এন্টিডোট তৈরি করাও যাবে না। প্রত্যেকটার পাঁচটা করে কপি। আমরা চাই প্রয়োজন পড়লে তুমি এগুলো রিলিজ করে দিবে। ডেভ হাল- কখনো কারো কাঁধে এত বড় দায়িত্ব দেয়া হয়নি। কী করব, অন্য উপায় যে নেই।
আবারো, জবাবটা ইউরোপা থেকে আসতে সময় নেয়, তিন সেকেন্ডের চেয়েও বেশি।
‘আমরা এমন কিছু করলে মনোলিবের সমস্ত ফাংশন সিজড় হয়ে যাবে। জানি না তখন আমাদের ভাগ্যে কী ঘটবে।
‘আমরা আগেই বিবেচনায় নিয়েছি ব্যাপারটা, অবশ্যই। কি সে সময়ের মধ্যে তোমার হাতে আরো অনেক ফ্যাসিলিটি চলে আসবে। কোনো কোনোটা আমরা বুঝতেই পারব না। সেই সাথে একটা পেটাবাইট মেমোরি ট্যাবলেটও পাঠাচ্ছি। এই টেন টু দ্য ফিফটিন্থ বাইট অনেক জীবনের পূর্ণ স্মৃতি ধরে রাখতে পারবে। তোমাদের জন্য যথেষ্ট। জানি, পালানোর অন্যান্য পথও তৈরি করে রেখেছ তোমরা নিজেরা।
‘ঠিক। কোনটা ব্যবহার করতে হবে সে সিদ্ধান্ত নিব সময়মত।
একটু হাপ ছেড়ে বাঁচে পোল- এমন পরিস্থিতিতে যতটা পারা যায় ততটা। হালম্যান সহায়তা করতে চায়, তার উৎসের সাথে মনের যোগাযোগ আর ভালবাসা আছে এখনো, এটাই অনেক কিছু।
‘এখন, ট্যাবলেটটা তোমাদের কাছে দিয়ে আসতে হবে আমাকে- ভার্চুয়ালি নয়, ফিজিক্যালি। কনটেন্টগুলো এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে রেডিও বা অপটিক্যাল কোনো চ্যানেল দিয়ে পাঠানো সম্ভব নয়। জানি, বস্তুর উপর অনেক দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ আছে। তোমাদের: একবার অর্বিটে ভাসতে থাকা বোমা নষ্ট করে দিয়েছিলে না? এটাকে কি ইউরোপায় নিয়ে যেতে পারবে? বিকল্প ভাবা আছে- অটোক্যারিয়ারে পাঠাতে পারি, যেখানে বলবে সেখানেই।
‘এটাই ভাল হয়: জিয়াংভিল থেকে সংগ্রহ করে রাখব। কোঅর্ডিনেট দিচ্ছি…’
.
চিন্তায় ডুবে আছে পোল… ডুবে আছে চেয়ারে এমন সময় বোম্যান স্যুইট মনিটর জানাল পৃথিবী থেকে আসা ডেলিগেটদের হেড অপেক্ষা করছে তার জন্য। কে জানে কর্নেল জোন্স আসলেই কর্নেল কিনা, অথবা তার নাম জোন্স কিনা। এসব সামান্য রহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই পোলের। সংগঠক হিসাবে যে তার তুলনা নেই, অপারেশন ডেমোক্লেসকে যে সূচারুভাবে চালিয়েছে এই যথেষ্ট।
ফ্র্যাঙ্ক, পথে নেমে গেছে এটা। এক ঘন্টা দশ মিনিটের মধ্যে ল্যাভ করবে। কিন্তু এখনো জানি না কী করে হালম্যান হ্যান্ডল করবে- ঠিক আছে তো হ্যান্ডল করবে কথাটা?- ট্যাবলেটগুলো।
ইউরোপা কমিটির কেউ ব্যাখ্যা করলে পরিষ্কার হতে পারে। খুব বিখ্যাত একটা কথা আছে না কম্পিউটার সম্পর্কে আমাদের সময়ে প্রচলিত ছিল না। যে কোনো কম্পিউটার যে কোনো কম্পিউটারকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই আমি নিশ্চিত হালম্যান করণীয় সম্পর্কে জানে। সব ঠিক না থাকলে কখনোই রাজি হত না।’
‘আশা করি, আপনার কথা ঠিক, জবাব দিল কর্নেল, যদি ভুল হয় তাহলে কোনো বিকল্প আছে কিনা আমার জানা নেই।
ঝপ করে একটু নিরবতা নেমে আসে। দুশ্চিন্তা কমানোর জন্য প্রসঙ্গ পাল্টায় পোল।
আমাদের আসা নিয়ে যে ভাল গুজব ছড়িয়েছে সে সম্পর্কে জানেন নাকি
।‘কোন গুজবটা?
‘যে আমরা এখানে পাঠানো বিশেষ তদন্তকারী দল- ছোট শহরটার অপরাধ দুর্নীতি খতিয়ে দেখব।মেয়র আর শেরিফের লেজ তুলে পালানোর দশা হয়েছে।
‘আহা! তাদের হিংসা করতে ইচ্ছা হচ্ছে, আফসোসের সুরে বলে কর্নেল জোন্স, সামান্য কোনো কারণে চিন্তিত হতে পারতাম যদি তাদের মতো।
৩৯. অমানিশা
আনুবিস সিটির আর সব অধিবাসীর মতো (এখন জনসংখ্যা ৫৬,৫২১) ডক্টর থিওডোর খানও স্থানীয় মাঝরাতে জেনারেল এ্যালার্মের আওয়াজে জেগে যায়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা স্বাভাবিক, আবার কোনো বরফ-ভূমিকম্প নয়ত, ফর ডিউস সেক।
জানালার কাছে ছুটে গিয়ে ‘ওপেন এত জোরে বলল যে ঘরটা বুঝতেই পারল । কী আর করা, উত্তেজিতভাব চেপে রেখে শান্ত সুরে আবার বলে সে কথাটা। লুসিফারের আলোর মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বর্ণিল নকশা তৈরি করার কথা। পৃথিবী থেকে আসা মানুষের কাছে এ মহা দুর্লভ দৃশ্য, তীব্র নকশার এক মিলিমিটারও স্থানান্তর হয় না মিনিটের পর মিনিট চলে গেলেও…
সেই চিরাচরিত আলোর বন্যা নেই। আনুবিস ডোমের বিশাল, স্বচ্ছ বুদবুদের ভিতর থেকে উপরে তাকায় থিওডোর খান। তাকায় চরম অবিশ্বাস নিয়ে। হাজার বছর ধরে গ্যানিমিডের এমন আকাশ দেখা যায়নি। আকাশ শুধু তারায় তারায় ভরা, লুসিফার নামের কোনো নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
তারপরই, আরো আত জাগানো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে খান। যেখানে লুসিফার থাকার কথা সেখানে কিছুই নেই। এমনকি ওপারের তারাগুলোও দেখা যায় না। সম্ভবত লুসিফার ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়েছে। আর এ কৃষ্ণগহ্বরের করাল থাবায় এরপর যে পড়বে তার নাম গ্যানিমিড।
গ্যানিমিড হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পোলও একই দৃশ্য দেখছিল, আরো জটিল ভাবনা চলছে তার মনে। জেনারেল এ্যালার্মের আগেই তার কমসেক জাগিয়েছে, হালম্যানের কাছ থেকে মেসেজ নিয়ে এসে।
ঘটনার এখানেই শুরু। আমরা মনোলিথকে ইনফেক্টেড করেছি। কিন্তু একটা… সম্ভবত একাধিক ভাইরাস আমাদের সার্কিটগুলোতেও ঢুকে পড়েছে। জানি না তোমার দেয়া মেমোরি ট্যাবলেটে ঢুকতে পারব কিনা। সফল হলে জিয়াংভিলে দেখা হবে।
এরপরই সে বিচিত্র কথাগুলো আসে যার মানে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনুভূতি নিয়ে বিতর্ক থাকবে না মানবজাতির ইতিহাসে।
যদি ডাউনলোড করতে না পারি, মনে রেখ আমাদের।’
তার দরজার পিছনে মেয়রের কণ্ঠ শোনা যায়। আনুবিসের ঘুমভাঙা মানুষগুলোকে অভয় দেয়ার চেষ্টায় প্রাণপাত করছে লোকটা।
জানি না কী ঘটছে, কিন্তু লুসিফার এখনো স্বাভাবিকভাবে জ্বলছে। আমি আবার বলছি, লুসিফার এখনো জ্বলন্ত! ইন্টারঅবিট শাটল এলসায়নের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। মাত্র আধঘন্টা আগে ক্যালিস্টোর উদ্দেশ্যে সেটা ছেড়ে গেছে। এখানে ভিডিওগুলো দেখানো হল।
বারান্দা ছেড়ে পড়িমড়ি করে ভিডক্রিনের সামনে চলে আসে পোল। লুসিফার পূর্ণ প্রতাপ নিয়ে ভেসে আছে আকাশে।
আসলে, কোনো এক কারণে সাময়িক গ্রহণ হচ্ছে’ বলে মেয়র, ভালভাবে দেখার জন্য জুম ইন করব… ক্যালিস্টো অবজার্ভেটরি, কাম ইন প্লিজ…’।
আমি কী করে বিশ্বাস করি যে এ গ্রহণটা সাময়িক স্ক্রিনে আসতে থাকা পরের দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবে পোল।
হারিয়ে গেল লুসিফার। আকাশজোড়া নক্ষত্রের রাজ্য। মেয়রের কঠ স্নান করে আরেকটা কষ্ঠ বলে উঠল।
‘–দু-মিটার টেলিস্কোপ, কিন্তু প্রায় যে কোনো ইনমেন্টেই কাজ চলবে। নিখুঁত কালো জিনিসে ঘেরা একটা ডিস্ক দেখা যাচ্ছে। দশ হাজার কিলোমিটারের সামান্য বেশি এলাকা জুড়ে আছে ডিটা। এত পাতলা যে এর কোনো দৃশ্যমান পুরুত্ব নেই। এটা এমনভাবে সাজানো যেন গ্যানিমিডে কোনো আলো আসতে না পারে ।
‘আরো জুম ইন করছি, কোনো ডিটেইলস দেখা যায় কিনা দেখতে হবে, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করি না যে…’
ক্যালিস্টোর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় ডিস্কটা অর্ধবৃত্তাকার। ডিমের খোসা অর্ধেক করলে যেমন হয় তেমন। যতটা চওড়া তার দ্বিগুণ লম্বা। পুরো ক্রিনজুড়ে আসার আগ পর্যন্ত ছড়াতে থাকে কিন্তু জুম করা হয়েছে কিনা বোঝার কোন উপায় নেই, কারণ গড়নটায় কোনো হেরফের হয়নি, একটুও ডিটেইল দেখা যায় না।
‘যেমন ধারণা করেছিলাম, কোনো কি দেখা যাবে না। জিনিসটার প্রান্তে প্যান করা যাক…’
তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। ভুবনজোড়া চাকতির একপ্রান্তে উদিত হয়েছে নক্ষত্রবীথি। যেন তারা কোনো মসৃণ, বায়ুমন্ডলহীন গ্রহের উপর কালো রাত দেখছে। না, একেবারে মসৃণ নয়…। ইন্টারেস্টিং ব্যাপারতো…’ মন্তব্য করল এ্যাট্রোনোমার, যার এতক্ষণের কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল এমন ঘটনা হরদম ঘটে। প্রান্তগুলো যেন অসমান জিগজ্যাগ- কিন্তু নিয়মিত ঠিক যেন করাতের কিনারা…’
বৃত্তাকার করাত, পোল গুঙিয়ে ওঠে। আমাদের ঘিরে ফেলবে নাতো! বিচিত্র সব ভাবনা আসে এমন সময়ে…
সরণের জন্য চিত্র নষ্ট হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত এটুকুই দেখতে পারি আমরা প্রসেস করে পরে আরো ভাল চিত্র পাওয়া যাবে আশা করি।’
চিত্রটা এখন এত বড় যে চাকতিটাকে সমতল দেখাচ্ছে। ভিডক্রিনজুড়ে কালো ফিতা দেখা যায়। প্রান্ডটা এত বেশি নিখুঁতভাবে ত্রিকোণ অবয়বে জানো যে চাইলেও করাতের কথা ভোলা যায় না। মনের গহিনে কী চিতা যেন ঘাই দিচেহ…
গ্যানিমিডে থাকা সবার মতো সেও এখন ত্রিকোণ পর্বতের আড়ালে থাকা তারাগুলোর আসা যাওয়া দেখতে পায়। সম্ভবত সে সিদ্ধান্তে আসার আগে আরো অনেকে চলে এসেছে।
যদি কেউ চতুষ্কোণ ব্লক দিয়ে একটা বৃত্ত গড়তে চায়- অনুপাত ১:৪:৯ হোক আর যাই হোক- প্রান্তগুলো সম্ভবত মসৃণ হবে না। অবশ্যই, ছোট ছোট রক ব্যবহার করে প্রায় মসৃণ করা যাবে, কিন্তু গাণিতিক হিসাবে সত্যিকার নিখুঁত বৃত্ত গড়া যাবে না। বাইরের প্রান্ত একটু এবড়োথেবড়ো থাকবেই। কি উদ্দেশ্য যখন সূর্য আড়াল করার মতো স্ক্রিন তৈরি করা, তখন কে নিখুঁত করার ঝামেলায় যাবে?
মেয়রের কথা সত্যি, ক্লিনটা সাময়িক। কি সৌরসময়ের হিসাবে এ সাময়িক সময়টা কত ল তা জানা সম্ভব নয়।
আরো জুম করা হয়েছে। আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লুসিফার আড়াল করা জিনিসটার গাঠনিকতা। ঠিকই, অসংখ্য একক দিয়ে গঠিত। সম্ভবত ইউরোপার মহাপ্রাচীরের সমান লাখ লাখ ক’ দিয়ে গড়া। এখন তারা সরে যাচ্ছে। আলো আসহে ফাঁকফোকড় দিয়ে। যেন দানবীয় এক জিগস পাজলকে এলোমেলো করে দেয়া হচ্ছে আস্তে আস্তে।
এলোমেলো আলো এসে পড়হে গ্যানিমিডের বুকে। আস্তে আস্তে বাশীভূত হচেই চতুষ্কোণগুলো, যেন একত্রে থাকলেই ব্লক করে রাখতে পারত, এখন আর সম্ভব নয়।
আনুবিস সিটির মানুষের কাছে যেন ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কেটে গেল, আসলে পুরো ব্যাপারটা ঘটে মাত্র পনের মিনিটে। পুরো ব্যাপারটা ফুরিয়ে যাবার আগে কেউ ইউরোপার দিকে মন দিতে পারেনি।
সেখানে মহাপ্রাচীরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘন্টাখানেক পর পৃথিবী, মঙ্গল, চাঁদ থেকে খবর এল, সূর্যও সামান্য সময়ের জন্য মিটমিটে হয়ে গিয়েছিল, আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
খুব সাবধানে বেছে নেয়া হয়েছিল চন্দ্রকলার মতো গড়নগুলোকে উদ্দেশ্য মানবজাতি। সৌরজগতের আর কোথাও অন্য কিছু টের পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর মানুষ টের পায়, টি এম এ-জিরো আর টি এম এ-ওয়ান নেই। টাইকো আর আফ্রিকার বুকে রেখে গেছে তাদের চরিশ লাখ বছরের স্মৃতিচিহ্ন।
.
হয়ত এই প্রথম ইউরোপানরা তাদের মাঝে মানুষের সন্ধান পেল। কিন্তু বজ্রগতিতে চলতে থাকা বিশালবপু প্রাণিগুলোকে দেখে তারা না পাচ্ছে ভয়, না হচ্ছে অবাক।
এই বিচিত্র পাতা ও প্রশাখাহীন ছোট গাছগুলোকে দেখে তাদের কী অনুভূতি হয় তা জানা সহজ নয়। যোগাযোগের কোনো মাধ্যম আছে কি তাদের?
তারা যদি এলসায়ন নামার পর সেখান থেকে অভিযাত্রীদের বেরুতে দেখত, তাহলে গুটিশুটি মেরে ইগলুতে গিয়ে লুকাত এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফ্যাৰু পোল স্পেসস্যুটের ভিতরে থেকে উজ্জ্বল তামার তারের উপহার নিয়ে যেতে যেতে ভাবে, ইউরোপারা কী ভাবছে সাম্প্রতিক এ ঘটনার ব্যাপারে তাদের সাপেক্ষে ইউরোপায় কোনো গ্রহণ হয়নি, কিন্তু মহাপ্রাচীরের অন্তর্ধান নিশ্চয়ই অবাক করেছে। স্মৃতিরও আগে থেকে জিনিসটা এখানেই ছিল, বর্ম হিসাবে, প্রতিরক্ষা হিসাবে, এবং আরো অনেক কিছু হিসাবে যা তারা বুঝতে শিখেনি; তারপর, আচমকা চলে গেল সেটা, এমনভাবে চলে গেল যেন কোনোদিন ছিলই না…।
পেটাবাইটের ট্যাবলেটটা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, জিনিসটার চারপাশে জটলা পাকাচ্ছে একদল ইউরোপা, এই প্রথম দেখল, আগ্রহ দেখাচ্ছে তারা কোনো বিষয়ে। কে জানে, হালম্যান তাদের বলে দিয়েছে কিনা এটার কথা, বলে দিয়েছে কিনা দেখভাল করার কথা- সে আসার আগ পর্যন্ত।
এখন এটাকে সরিয়ে নিতে হবে। সরিয়ে নিতে হবে এর ভিতরে থাকা বন্ধু সহ, ভিতরে থাকা এমন আতঙ্ক সহ, যার সমাধান করবে ভবিষ্যতের কোনো মানবসমাজ, তারপর মুক্ত করবে ভিতরের অস্তিত্বটাকে। সে পর্যন্ত রেখে দিতে হবে বিশেষ এক জায়গায়…
৪০. মধ্যরাত্রি : পিকো
এর চেয়ে বেশি শান্তিময় দৃশ্যের কথা কল্পনা করা কঠিন, ভাবে পোল। গত কয়েক সপ্তাহের ঝক্কি-ঝামেলার পর এখন মন জুড়ে আছে অবসাদ। পূর্ণ পৃথিবীর আলোয় ভাসছে জলহীন বৃষ্টিসাগর।
চান্দ্রযানের ছোট্ট বহর পিকো পর্বতের ভল্টটার সামনে অর্ধবৃত্ত রচনা করে দাঁড়ানো। পর্বতটা মোটামুটি গোলাকার, আর সব পাহাড়ের মতো খাড়া তীক্ষ্ণ চূড়া নেই। স্থানীয় বাইসাইকেল রাইডাররা তীব্রগতিতে চলে যায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সময়, এর উপর দিয়েই। তারা কল্পনাও করতে পারবে না এর ভিতরে কী লুকানো আছে। জানলে তাদের স্বাস্থসম্মত এসব চর্চা কোথায় উবে যেত কে জানে!
ঘন্টাখানেক আগের কথা। মনের যন্ত্রণা লুকাতে পারে না পোল। গ্যানিমিড থেকে সোজা চাঁদে নিয়ে আসার পথে জিনিসটাকে একবারও চোখের আড়াল করেনি সে।
‘বিদায়, প্রিয় বন্ধুরা, নিচু স্বরে বলে সে, ভাল কাজ করেছ। হয়ত পরের কোনো এক প্রজন্ম জাগাবে তোমাদের। কিন্তু সব মিলিয়ে আমার খুব একটা আশা নেই।
সে ভালভাবেই জানে কেন হালম্যানের স্মৃতি প্রয়োজন। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো মেসেজ চলে গেছে নিয়ন্ত্রকের কাছে। কপাল ভাল, জবাব পৌঁছতে সাড়ে নয়শ বছর লাগবে।
আগের দিনে পোল মাঝে মাঝেই আইনস্টাইনকে অভিশাপ দিত। এখন দেখা যাচ্ছে মনোলিথের পিছনে যে বিপুল শক্তিমত্তা কাজ করে তারাও আলোর গতি ভেদ করতে পারেনি। তাই মানবজাতির হাতে আরো হাজারখানেক বছর আছে পরের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার পথে- যদি আদৌ যুদ্ধ থেকে থাকে। হয়ত ততদিনে প্রস্তুতি ভালভাবেই নেয়া হয়ে যাবে।
সুড়ঙ্গ থেকে কী যেন বেরিয়ে আসছে- ট্যাবলেটটাকে ভন্টে নিয়ে গিয়েছিল যে সেমি-হিউম্যানয়েড রোবট, সেটা। এই বায়ুমন্ডলহীন চাঁদের বুকে একটা রোবটকে আইসোলেশন স্যুট পরা অবস্থায় দেখলে হাস্যরসাত্মক মনে হতে পারে পুরো ব্যাপারটা। কিন্তু কেউ কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। ভিতরের অসংখ্য ক্যামেরা থাকার পরও যে কোনো সময় যে কোনো ক্যানিস্টার লিক হয়ে যাবার বা কোনো দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। চান্দ্ৰপরিবেশ অনেক স্থিত, কিন্তু অনেক আগে এখানে ভূকম্পন আর উল্কাপাতের ঘনঘটা দেখা যেত।
সুড়ঙ্গের মুখ থেকে অর্ধশত মিটার দূরে এসেই থেমে যায় রোবটটা। যে বিশাল পাগটা এটাকে ধরে রেখেছিল সেটাই এক সময় ঘুরতে শুরু করে।
‘ডার্ক গ্লাস পরেননি এমন সবাই রোবটের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। চান্দ্রযানের ভিতর থেকে রেডিওতে চিৎকার করে ওঠে এক ড্রাইভার।
সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নেয় পোল। একই সাথে দেখতে পায়, আমোর একটা ঝলক খেলে যাচ্ছে যানগুলোর উপর দিয়ে।
ফিরে তাকায় রোবটটার দিকে। জলছে সেটা। চাঁদে বাতাস নেই, তাই পাক খেয়ে খেয়ে ধোয়া উঠে যায় না উপরদিকে, তবু, ব্যাপারটা না দেখলে কেমন যেন অস্বস্তি হয়।
‘স্টেরিলাইজেশন কমপ্লিট। ঘোষণা করল একজন, লোকটা মিশন কন্ট্রোলার, ‘ধন্যবাদ সবাইকে। এখন প্লেটো সিটিতে ফিরে যাচ্ছি আমরা।’
কী অবাক ব্যাপার! মানবজাতি তারই তৈরি করা অকল্যাণের কারণে আজ বেঁচে গেল। এ থেকে কোনো নীতিকথা বের করে নিবে মানুষ?
সুন্দর, নীল এক গ্রহ ভেসে আছে আকাশে। পৃথিবী। উপরে পাক খেয়ে বেড়ায় মেঘের দল। মহাকাশের হিমশীতলতা থেকে রক্ষা করে। সেখানে, আর কয়েক মাস পর, প্রথম দৌহিত্রকে কোলে তুলে নেয়ার আশা করে পোল।
তারার রাজ্যের আড়ালে ঈশ্বরতুল্য যে ক্ষমতাবানরাই থাক না কেন, মনে করিয়ে দেয় পোল নিজেকে, সাধারণ মানুষের জন্য দুইটা ব্যাপারই সবচে বড় ভালবাসা আর মৃত্যু।
শরীরের বয়স এখনো একশ হয়নিঃ দুইটার জন্যই অনেক সময় পড়ে আছে।
সমাপ্তি
তাদের হোট সৃষ্টিজগত এখনো নবীন। এর ঈশ্বর এখনো শিশুতুল্য। কিন্তু তাদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসছে শেষ দিনগুলোতে আমরা ফিরে এলেই সিদ্ধান্ত নিব কোনটাকে রক্ষা করতে হবে।