ক. নক্ষত্র নগরী

৩০০১ : দ্য ফাইনাল ওডিসি – আর্থার সি ক্লাক / অনুবাদ : মাকসুদুজ্জামান খান / প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৭

অনুবাদকের উৎসর্গ

ডক্টর মুহাম্মদ রহমতউল্লাহ
ছাত্ররা তাকে কত ভয় পায় তা ডিন স্যার জানেন,
কত শ্রদ্ধা করে আর ভালবাসে তা হয়ত তিনি জানেন না।

লেখকের কথা

২০১০ : ওডিসি টু যেমন ২০০১: আ স্পেস ওডিসি’র সরাসরি সিকুয়্যাল নয় তেমনি ২০৬১ : ওডিসি থ্রি ও দ্বিতীয়টার সরাসরি ঝাণ্ডাবাহী নয়। বরং এই সবগুলোকে একই থিমের উপর বিস্তৃতি ধরা যায়, আর সেই অর্থে, সময়কে মাপকাঠি ধরে সিকুয়্যাল বলা যায়। কিংবা, সরলতার জন্য একই নাম ও চরিত্র ঘটনা থাকা সত্ত্বেও যেন একই ঘটনা নয়, বরং সমান্তরাল চলতে থাকা বিভিন্ন ইউনিভার্সে একই ধারার ঘটনা।

মানুষের চাঁদে পা রাখার বছর পাঁচেক আগে, ১৯৬৪ সালে যখন স্ট্যানলি কুবরিক প্রস্তাব রাখলেন, সত্যিকার ভাল সায়েন্স ফিকশন মুভি বানাবেন, তখন ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। কিন্তু তারপর, এ ধারণায় আগের দুটি বই বিজ্ঞানে সরাসরি অনেক প্রভাব ফেলল, ফলে বলা চলে সেগুলো সার্থক সায়েন্স ফিকশন।

২০১০ লিখতে উৎসাহী হই ১৯৭৯ সালের সফল ভয়েজার অভিযানের পর। কিন্তু বৃহস্পতিয় অঞ্চলে ভয়েজারের অভিযানের পর আরো উচ্চাকাক্ষী অভিযান গ্যালিলিও পাঠানো হয়।

আশায় বুক বেঁধেছিলাম গ্যালিলিওকে নিয়ে, সে যাবে, বৃহস্পতির বাতাবরণে একটা প্রোব ছুঁড়ে দেবে, দু বছর খুঁটিয়ে দেখবে বৃহস্পতীয় উপগ্ৰহজগৎ। এর উৎক্ষিপ্ত হবার কথা ছিয়াশির মে মাসে। ডিসেম্বর আটাশিতে লক্ষ্যে যাবার কথা এবং উনিশশো নব্বইতে নূতন বাণীর স্রোতে ভেসে যাবার কথা আমার।

হায়, চ্যালেঞ্জটা পিছিয়ে গেল, জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে গ্যালিলিও তার ক্লিন রুমে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। আরেকটা লঞ্চ ভেহিকলের আশায় তার বসে থাকা। হয়তো নির্ধারিত সময়ের সাত বছর পর সেটা ঠিকই জায়গামতো পৌঁছবে, তদ্দিন আমার ধৈর্য থাকলেই হল।

গ্যালিলিওকে নিয়ে তৃতীয় স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, সেটায় চিড় ধরার আগেই আমি অপেক্ষা বন্ধ করে কলম হাতে নিলাম।

কলম্বো, শ্রীলঙ্কা,
এপ্রিল, ১৯৮৭

শুরুর কথা : ক্ষণজন্মা

ডাকুন তাদের প্রথম-জন্মা নামে। ঠিক মানুষ নয় তারা। রক্ত-মাংসের নশ্বর দেহধারী। মহাকাশের গহিনে চোখ যায়, অনুভব করে তারা কী এক অনির্বচনীয় একাকিত্ব; কী এক অস্থিরতা গ্রাস করে নেয় সমস্ত দেহ-মন-প্রাণ! হতবিহ্বলতায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারপর–ক্ষমতা এল। অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে সঙ্গীর খোঁজে আতিপাতি করে ফেলল নক্ষত্রলোক।

এবার চলার পালা। কত রূপ নিয়ে যে রূপোপজীবী মহাকাশ মাতা প্রাণের দেখা মিলিয়ে দিলেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সহস্র বিশ্বে বিবর্তনের অচিন্তনীয় সব পথের দেখা মিলল। মহাকাশের মহারাত্রির বুকে কী করে জীবনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে, কী করে হারিয়ে যায় বিশালতার বুকে, দেখল তারা।

আর, যেহেতু অযুত পৃথিবীর বুকে, নিযুত ছায়াপথের আলো আধারিতে মনের চেয়ে দামি আর কিছুর সন্ধান পাওয়া গেল না- এই মনের জন্মের পথেই অবদান রাখল। সর্বত্র তারার ভূমিতে চাষি তারা, বুনে চলল মনের বীজ, কখনো কখনো ফসলের কুঁড়ি মুখ তুলল।

কোথাও কোথাও দেখা দিল আগাছা।

বিশালদেহী ডায়নোসরেরা অনেক আগেই ডুবে গেছে কালের অতলে। হাজার বছরের পথপরিক্রমা শেষে এল তারা। এল এখানে। বাইরের জমাট গ্রহগুলোর উপর দিয়ে। মঙ্গলের মরতে বসা মরুভূমির উপর চোখ ফেলল। দৃষ্টি দিল ঠিক এখানটায়। যে জায়গার নাম- পৃথিবী।

নিচে নেমে এল দর্শনার্থীরা। ছড়িয়ে পড়ল। দেখল, প্রাণের মহাসাগর বয়ে চলেছে মৃদুমন্দ ঊর্মিমালা বুকে করে। বছরের পর বছর ধরে সংগ্রহ চলল। চলল হিসাব নিকাশের পালা, গবেষণা। জানার সবটুকু জেনে নেয়া শেষ। এবার হাত দেয়ার পালা। সৃষ্টির উপর হাত রাখার সময় এসেছে। সমুদ্রের বুকে, ভূমির উর্বরতায় এবার অনেক প্রজাতিকে পথ দেখাতে হবে। কিন্তু এ চেষ্টার কোন কোনটা সফল হবে আর কোন কোনটা একেবারে আস্তাকুড়ে পড়ে থাকবে তা জানতে হলে করতে হবে অপেক্ষা; লক্ষ লক্ষ বছরের অপেক্ষা।

ধৈর্য আছে তাদের, কিন্তু এখনো অমরত্ব আসেনি। অনেক কাজ বাকি। শত বিলিয়ন সূর্যের বুকে আরো সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা বাকি। ডাকছে। ডাকছে মহাকাশের বুকে লুকিয়ে থাকা আলোর উৎসরা।

পাল তোলার সময় এসেছে। আর কখনো পিছনে ফিরে আসা যাবে না, জানে তারা। যত্ন করে বোনা ফসলের কাছে ফিরে আসা যাবে না। আসার প্রয়োজনও নেই, পিছনে ফেলে আসা ভূত্যেরা বাকি কাজটুকু করে ফেলবে।

পৃথিবীর বুকে জমাট বাধানো হিমবাহেরা নেমে এল নিষ্ঠুরের মতো। ঝেড়ে মুছে সাফ করে দিল হাজার হাজার প্রজাতিকে। তারপর, অনেক অনেক দিন রাজত্ব করার পর চলেও গেল। কিন্তু এসবের উপরে শান্তভাবে চোখ রাখছে পরিবর্তনহীন চাঁদের বুকে লুকিয়ে থাকা এক অস্তিত্ব। বরফের রাজত্বের চেয়েও অনেক ধীর গতিতে গ্যালাক্সি জুড়ে নেমে এল জীবনের জয়গান। সভ্যতার জলস্রোত। অদ্ভুত, সুন্দর, ভয়ানক সব সাম্রাজ্যের উত্থান দেখা গেল, দেখা যায় তাদের পতনও। পুরনোরা তাদের স্মৃতি আর সাফল্য বয়ে নিয়ে গেল নতুনদের কাছে।

আর এখন, বাইরে, তারায় তারায়, বিবর্তন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হাটি হাটি পা পা করে। যারা এসেছিল, পরিবর্তনহচ্ছে তাদের মধ্যেও। শরীরগুলো নশ্বর। ধ্বসে যায় খুব সহজেই। যন্ত্রগুলো তার চেয়ে অনেক ভাল। পরিবর্তন আনতে হবে। যন্ত্রের গায়ে আশ্রয় নিল মস্তিষ্কগুলো। তাতে বেড়ে গেল জীবনকাল, বেড়ে গেল চিন্তার ক্ষমতা, কাজের ক্ষমতা, হিসাবের ক্ষমতা। কিন্তু পরিবর্তন চলবেই। এ ব্যবস্থাও খুব বেশি স্থায়ী নয়। এরপর আর ব্রেইন জায়গা করে নিচ্ছে না যন্ত্রের গায়ে। জায়গা করে নিচ্ছে শুধু ভাবনাগুলো। ধাতু আর দামি পাথরের খোলসই এখন তারা। এ রূপ নিয়ে নিহারিকা থেকে নিহারিকায়, পথ থেকে পথে ছুটে গেল।

এখন আর তারা স্পেসশিপ বানায় না। তারাই মহাকাশতরণী।

কিন্তু যন্ত্র-জীবদের সময় পেরিয়ে গেল খুব দ্রুত। জ্ঞান আহরণের বিরামহীন পথপরিক্রমায় তারা শিখল। শিখল আরো বিচিত্র সব ব্যাপার। শিখল কী করে স্পেসের গায়ে জমা করা যায় জ্ঞান। আলোর জমাট আকৃতিতে তাদের অস্তিত্বকে কী করে স্থান দেয়া যায় তা শিখল।

আর তাই, খাঁটি শক্তিতে রূপান্তরিত করে নিল নিজেদেরকে। হাজার হাজার পৃথিবীতে তাদের ফেলে আসা খোলস ভেসে বেড়াল। পরিত্যক্ত হয়ে রইল অনেক কাল ধরে। মৃত্যু তুর্কি নাচন নাচল তাদের ঘিরে ধরে। তারপর মহাকালই সেগুলোকে ধূলিকণায় পরিণত করে নিষ্ঠুর হাতের ছোঁয়ায়।

এখন, তারা তারার দেশের ভাগ্যবিধাতা। সূর্যের বক্ষভেদ করতে জানে, জানে মহাকাশের মহাস্রোতের ভিতরে তলিয়ে যেতে। অনেক বদল এসেছে, এসেছে অচিন্তনীয় সব পরিবর্তন, কিন্তু আজো সেই সাগরের বুক থেকে চরম বিস্ময়ে চোখ মেলার মুহূর্তের কথা ভুলতে পারে না। আজ আর নেই সে মহাসাগর, নেই সেখানকার উষ্ণতা। কালের অতল গর্ভে তলিয়ে গেছে সেই কবে। কিন্তু অনেক আগে স্থাপন করা তাদের সেসব অসাধারণ সৃষ্টি এখনো বিকল হয়ে যায়নি। এখনো কর্মক্ষমতা ফুরিয়ে যায়নি সেসবের।

হ্যাঁ, মহাকাল থাবা বসিয়েছে। অনেকগুলোই ক্ষয়ে যাচ্ছে।

তার পরও, মাঝে মাঝে, পথ দেখায় সেসব। পথ দেখায় অচেনা মহাকাশে।

ক. নক্ষত্র নগরী

১. ধূমকেতুর রাখাল ছেলে

ক্যাপ্টেন দিমিত্রি চ্যান্ডলার [এম ২৯৭৩.০৪.২১/ ৯৩.১০৬// মঙ্গল// স্পেস এ্যাকাড ৩০০৫] সবচে কাছের বন্ধুদের কাছে “দিম”। বিরক্ত সে। স্পষ্ট বোঝা যায়, চরম বিরক্ত। কারণও আছে। পৃথিবী থেকে মেসেজটা স্পেসটাগ গোলিয়াথ এ আসতে সময় নিয়েছে পুরোদস্তুর ছটা ঘন্টা। গোলিয়াথ এখন নেপচুনের কক্ষপথ ছেড়ে চলে এসেছে। আর মাত্র দশটা মিনিট পরে এলেই কর্ম সারা হয়ে যেত। জবাব দিত সে, স্যরি, এখন আর সম্ভব নয়। আমরা এইমাত্র সানস্ক্রিন ডিপ্লয় করেছি।’

কাজটী মোটেও খারাপ হত না। একটা আগাপাশতলায় পরিপূর্ণ এবড়োথেবড়ো ধূমকেতুকে মাত্র কয়েক অণু পুরু কিন্তু কয়েক কিলোমিটার লম্বা পর্দা দিয়ে পুরোপুরি জড়িয়ে দেয়ার কাজ আধাআধি করা অবস্থায় ছেড়ে দেয়াটা ছেলেখেলা নয়।

এখনো এই বিদঘুঁটে অনুবোধ মেনে চললে আখেরে ভালই হবে। এখন সে সূর্যের অন্যদিকে, পৃথিবী আরেকদিকে। শনির বলয় থেকে বরফ তুলে আনা আর এটাকে শুক্রের দিকে নিয়ে যাবার কাজ শুরু হয় সেই দু হাজার সাতশ সালের দিকে। তিনশ বছর আগের কথা। ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের চোখে সেই অতীত আর বর্তমানের মধ্যে তেমন কোনো ফারাক ধরা পড়ে না। সেই সে সময় থেকেই সূর্যের হাত থেকে রক্ষার কাজে সোলার কনসার্ভার ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষ এখনো বেঁকে বসে। গত কয়েক শতকের বাস্তুতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভুলতে পারে না কিছুতেই। ‘শনি থেকে হাত গুটিয়ে নাও’ ভোটে তারা জিতে যায় স্পষ্ট ব্যবধানে। তাই আজ আর চ্যান্ডলার কোনো রিং রাসলার নয়, বরং এখন সে ধূমকেতুর রাখাল ছেলে।

আলফা সেন্টাউরি থেকে তারা অনেক দূরে, কুইপার বেল্ট অভিশাপ ঝাড়তে পারবে না। এখানে অনেক বরফ আছে, শুক্রকে সাগরে পরিণত করার চেষ্টাও করা যায়। কিন্তু সেখানকার আগুনকে নিভিয়ে দিয়ে প্রাণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার স্বপ্ন এখনো সুদূর পরাহত। কথা সত্যি সোলার কনসার্ভারগুলো সে জায়গাকে সূর্যের দোর্দন্ড প্রতাপ থেকে সরিয়ে রাখার কাজ করছে। দু হাজার তিনশো চার সালের উল্কাপাতে ঘটা সুনামির জন্য মারা গেছে লাখো লোক- অথচ কী আফসোসের কথা, একটা ল্যান্ড ইম্প্যাক্ট থাকলে তেমন কোনো সমস্যাই হত না। পুরো মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছে ঘটনাটা মানুষ আসলে একটা ভর ঝুড়ির মধ্যে অনেক বেশি ডিম রাখার ঝুঁকি নিচ্ছে।

যাক, চ্যান্ডলার নিজেকেই শোনায়, এই প্যাকেজটা জায়গামত পৌঁছতে পৌঁছতে বছর পঞ্চাশেক লেগে যাবে, তাই একটা সপ্তাহের হেরফেরে তেমন কোনো কিছু আসে যায় না। কিন্তু ঘূর্ণনের সমস্ত হিসাব নিকাশ, র আর কেন্দ্রের গাণিতিকতা, থ্রাস্ট ভেক্টর আবার বের করতে হবে। মঙ্গলে ফেরৎ পাঠাতে হবে সমস্ত হিসাব, যেন রিচেক করা যায়। মিলিয়ন টনের বরফকে পাঠানোর আগে হিসাবটা কয়েকবার করে নিলে ভালই হয়, ভুল হলেই উটকো সমস্যা হাজির হবে।

আগেও অনেকবার দেখেছে, ডেস্কের উপরে থাকা ছবিটাকে এখনো দেখছে চ্যান্ডলারের চোখজোড়া। তিন মাস্তুলের একটা বাস্পপোত। জাহাজটার উপর ঝুঁকে আছে হিমবাহ। ঠিক একই অবস্থা এখন গোলিয়াথের। বিশ্বাসই হতে চায় না তার, এই শিপটার নামও ছিল ডিসকভারি তখন শিপগুলো সমুদ্রে চলত বাষ্প ইঞ্জিনে, আর একটা মানুষের জীবনকাল ফুরিয়ে যাবার আগেই একই নামে এই মানবজাতি বৃহস্পতির দিকে স্পেসশিপ পাঠিয়ে দিয়েছিল। শিপটার ব্রিজ থেকে দক্ষিণ মেরুর অভিযাত্রীরা কী ভেবে বাইরে তাকাত তা এখনো সে ভেবে পায় না।

এই এখানে, দিগন্ত বিস্তৃত বরফের মধ্যে মাত্র নব্বই ভাগ বিশুদ্ধ পানির বরফ আর বাকিটা কার্বন-সালফারের যৌগ। লোকে শুধু শুধু বলত না আগের দিনে, ‘ধূমকেতুতে খারাপ বাতাস ভর করে। এখানে আছে খারাপ ধরনের বিস্ফোরক সব গ্যাস। বিপজ্জনকভাবে জমা হয়ে থাকে। কোনটায় কতটুকু ঝুঁকি আগে থেকে বোঝ যায় না।

স্কিপার টু অল পার্সোনেল, ঘোষণা করল চ্যান্ডলার, প্রোগ্রামে সামান্য রদবদল হয়েছে। আমাদের অপারেশনে একটু এদিক সেদিক হবে। আপাতত বন্ধ থাকবে। কারণ একটা টার্গেটের ব্যাপারে স্পেসগার্ড রাডারের কিছু বলার আছে।

‘বিস্তারিত জানা যায় কিছু?’ শিপের ইন্টারকমের গুঞ্জন কমে এলে একজন প্রশ্ন তুলল।

খুব বেশি কিছু না। জানতে পারলাম এটাও মিলেনিয়াম কমিটির কারসাজি।

আরো গুঞ্জন উঠল। সবাই দু হাজারের সময়টাকে বিদায় দেয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল। তিন হাজার সালের পহেলা জানুয়ারি কোনো রকম অঘটন ছাড়াই পেরিয়ে যাবার পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। মানবজাতি স্বাভাবিক কাজে ফিরে এসেছিল আরেকবার।

‘এনিওয়ে, গতবারের মতো এটাও আরেক ফলস এ্যালার্ম হতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব কাজে নেমে পড়ব আমরা। স্কিপার আউট।’

চ্যান্ডলার ভাবে, ক্যারিয়ারে এটা তৃতীয়বারের মতো আলেয়ার পিছনে ছোটা। কত শতাব্দি ধরে সৌরজগতকে চষে ফেলছে মানুষ, তার পরও বিস্ময় দেখা দেয়। স্পেসগার্ডের অনুরোধের জোরালো কারণ থাকে সব সময়। মনে মনে একটাই আশা জাগছে, কোনো কল্পনাবিলাসি বোকার হদ্দ সেই বহুচর্চিত ‘সোনালি গ্রহাণুপুঞ্জ দেখেনিতো! যদি সত্যি সত্যি স্বর্ণালি এ্যাস্টেরয়েডের অস্তিত্ব থাকে–যা চ্যান্ডলার বিশ্বাস করতে চায় না এ মুহূর্তে–তাতে আহামরি কোনো লাভ হয়ে যাবে না। তাল তাল সোনা দিয়ে মানুষ কচুটা করবে। বরং এর চেয়ে অনেক মূল্যবান এই পানির বরফ; একটা খালি অঞ্চলকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে এটা।

এসবে খুব বেশি কিছু এসে যায় না। এর মধ্যেই মানুষ তাদের রোবট পোব পাঠিয়ে দিয়েছে একশ আলোকবর্ষ দূরে, চতুর্দিকে। টাইকো মনোলিথ আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে উন্নততর বা আগে জন্মানো সভ্য প্রাণিরা আগেই সে কাজটা করেছিল। সৌরজগতে অন্য সভ্যতার নিদর্শন এখনো থাকতে পারে যেগুলোর নাগাল পায়নি মানুষ। এর ভিতর দিয়ে যেতে থাকতেও পারে। ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের মনে ক্ষীণ সন্দেহ, স্পেসগার্ড তেমন কিছুই ধারণ করে। তা না হলে একটা প্রথম শ্ৰেণীর স্পেসটাগকে তার কাজ ফেলে রেখে রাডারে ধরা পড়া অচিহ্নিত গতিশীল বম্ভর পিছু ধাওয়া করতে বলত না।

ঘন্টা পাঁচেক পর গোলিয়াথ সত্যি সত্যি একটা সিগন্যাল ধরতে পারল। অত্যন্ত শক্তিমান সিগন্যালসময়ের সাথে সাথে আরো তীব্র হচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে একটু হতাশার ভাব দেখা দেয়। না, জিনিসটা যাই হোক, খুব ছোট। এবং ধাত। মাত্র মিটার দুয়েক লম্বা। এর অর্বিট দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, গন্তব্য এ সৌর জগতের কোথাও নয়, বাইরে কোথাও।

চ্যান্ডলারের মনে একটা সন্দেহ দেখা দেয়, এটা গত সহস্রাব্দে মহাকাশে মানুষের পাঠানো জিনিসগুলোর কোনো ধ্বংসাবশেষ নয়ত।

এরপর, ভিজুয়াল ইন্সপেক্টরের কল্যাণে কাছে এগিয়ে এল সেটা। বিস্মিত ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার ঠিক ঠিক বুঝতে পারে, এ মূহুর্তে পৃথিবীতে এবং মানুষের অন্যান্য কলোনিতে মহাকাশ ইতিহাসবিদরা আতিপাতি করে মহাকাশ যুগের প্রথম দিকের রেকর্ডগুলো খুঁজে দেখছে। কোনো সন্দেহ নেই।

শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে।

‘গোলিয়াথ থেকে বলছি,’ পৃথিবীর উদ্দেশ্যে গর্ব আর স্থিতার সুরে বলে চলে সে, ‘আমরা হাজার বছরের পুরনো এক এ্যাস্ট্রোনটকে তুলে আনছি। সহজেই অনুমান করতে পারি কে তিনি’

২. কে জানিত আসবে তুমি গো, অনাহুতের মতো

জেগে উঠল ফ্র্যাঙ্ক পোল। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না সে। এমনকি নিশ্চিত হতে পারল না নিজের নাম সম্পর্কেও।

অবশ্যই, এ এক হসপিটাল রুম। চোখ বন্ধ, তাতে কী, স্পষ্ট বোঝা যায়, প্রাচীনতম অনুভূতি তাকে বলে দেয়, এখন সে একটা হাসপাতালেই শুয়ে আছে। কেন যেন মনে পড়ছে না কী হয়েছে… তারপর হঠাৎই পুরোটা বুঝে ফেলল সে। অবশ্যই!- এ্যারিজোনার হ্যাঁঙ গ্লাইডিং চ্যাম্পিয়নশিপের সময় ঘটেছিল এ অঘটনটা।

এবার আস্তে আস্তে পুরোটা ফিরে আসছে মনে। আমি ডেপুটি কমান্ডার ফ্র্যাঙ্ক পোল, এক্সিকিউটিভ অফিসার, ইউ এস এস এস ডিসকভারি, বৃহস্পতির পথে একটা টপ সিক্রেট মিশনে আছি

যেন কোনো বরফ শীতল হাত চেপে রেখেছে তার হৃদপিন্ড। আস্তে আস্তে, স্লো। মোশন প্লেব্যাকের মতো করে সব কথা মনে আসতে থাকে… সরে যাওয়া স্পেস পোডট তেড়ে আসছে তার দিকে, ধাতব নম্বরগুলো সামনে বাড়ানো… তারপর নিরবতা, আর সেই নিরবতায় চিড় ধরে যায় স্পেস স্যুটের বাতাস বাইরে বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে। তারপর শুধু একটা স্মৃতি, মহাশূন্যে অসহায়ভাবে ডিগবাজি খেতে খেতে ভেসে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া এয়ার হোসটাকে আবার লাগিয়ে দেয়ার অর্থহীন চেষ্টা…

স্পেসগোড কন্ট্রোলের যে সমস্যাই হয়ে থাক না কেন, সে এখন নিরাপদে আছে। সম্ভবত ডেভ সময় মতো ই ভি এ ঠিক করেছিল, তাকে তুলে এনেছিল স্পেস থেকে, কোনো বড় ক্ষতি হয়ে যাবার আগেই।

ভাল মানুষ ডেভ। নিজেকে শোনায় সে। আমার ভাবতেই হবে- এক মিনিট। আমি নিশ্চয়ই এখন আর ডিসকভারিতে নেই। নিশ্চয়ই পৃথিবীতে ফিরে যাবার মতো লম্বা সময় জুড়ে অজ্ঞান ছিলাম না।

তার কল্পনার লাগাম ছাড়া ঘোড়া থেমে গেল ম্যাট্রন আর দুজন নার্স আসার সাথে সাথে। তাদের পরনে সেই পুরনো ইউনিফর্ম। সাদা। তারা যেন অবাক হয়ে গেছে। তাহলে কি ফ্র্যাঙ্ক পোল আগেভাগেই জেগে গেল। ভাবনাটা তাকে একটু আমোদিত করে।

‘হ্যালো!’ অনেক চেষ্টা কসরৎ করে বলে ফেলে সে, ভোকাল কর্ডের কী সমস্যা হল কে জানে! “আমার খবর কী?

ম্যাট্রন সুন্দর একটা হাসি দিল। তারপর মেয়েটা নিজের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় জানাল, খবরদার, কথা বলার চেষ্টা করোনা।

এরপরই নার্স দুজন তাদের পেশাদারি দক্ষতার সাথে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সব চেক করে দেখা শুরু করে। পালস, তাপমাত্রা আর রিফ্লেক্স খতিয়ে দেখে। একজন তার হাতটাকে তুলে ধরে আবার ছেড়ে দিল, পোল টের পেল যে কিম্ভূত কিছু একটা ঘটছে। খুব আস্তে আস্তে পড়ে গেল হাতটা, পৃথিবীর বুকে হলে সেটার ধপাস করে পড়ে যাবার কথা ছিল। নড়ার চেষ্টা করে বাকিটা বুঝে নিল সে।

আমি অবশ্যই কোনো না কোনো গ্রহে বা কৃত্রিম মহাকাশ স্টেশনে আছি যেখানকার গ্র্যাভিটি পৃথিবীর চেয়ে কম।

প্রশ্ন করবে এমন সময় ম্যাট্রন তার গলায় কিছু একটা চেপে দিল। স্বপ্নহীন। ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল সে। অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে একটা অন্য চিন্তা মাথায় ঢুকতে পারল কোনোমতে।

কী অবাক ব্যাপার- এতক্ষণ আমার সাথে থাকার সময় তারা একটা কথাও বলল না কেন?

৩. আদ্যিকালের মানুষ

আবার জেগে ওঠার পর দেখল ম্যাট্রন আর নার্স দুজন দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিল পোল।

‘কোথায় আমি? তোমরা নিশ্চয়ই বলতে পারবে!’

নময় করল। যেন জানে না কী বলতে হবে। এরপর খুব ধীরে ধীরে মুখ খুলল ম্যাট্রন, আলতো করে তুলে আনল শব্দগুলো ধীরলয়ে, সব ঠিক আছে, মিস্টার পোল। প্রফেসর এ্যান্ডারসন এক মিনিটের মধ্যে হাজির হবে এখানে… ব্যাখ্যাটা সেই করবে।

কী ব্যাখ্যা করবে? ভেবে পায় না পোল। যাক, মেয়েটা অন্তত ইংরেজি বলতে পারে, যদিও তার উচ্চারণের আগামাথা ধরতে পারছি না কিছুই…

এ্যান্ডারসন নিশ্চয়ই এগিয়ে আসছে, না হলে দরজা খুলে যাবে কেন! কিন্তু দরজার অন্য প্রান্তে তাকিয়েই শিউরে উঠল পোল। নিজেকে খাঁচায় আটকানো জম্ভ বলে মনে হল। বাইরে থেকে অনেকেই চেয়ে আছে তার দিকে।

প্রফেসর এ্যান্ডারসন বেটেখাটো এক লোক। প্রথম নজরে মনে হতে পারে তার পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে- চাইনিজ, পলিনেশিয়ান, নরডিক কোনোটাই পুরোপুরি নয়। ডান হাতের তালুটা তুলে নিল লোকট, হ্যান্ডশেক করল।

‘আপনাকে একটু সুস্থ দেখাচ্ছে দেখে ভাল লাগছে, মিস্টার পোল… দ্রুত আপনাকে উপরে নিয়ে যাব।’

আবারো দ্বিধায় ফেলে দেয়া উচ্চারণ, কোন দেশের কে জানে! কিন্তু সেই কণ্ঠের আড়ালে লুকিয়ে আছে দৃঢ়তা। সব যুগে চিকিৎসকরা যে নিশ্চয়তার সুরে কথা বলে সে সুরের খোঁজ পাওয়া যায়।

কথাটা শুনে ভাল লাগল, কিন্তু আপনি যদি দয়া করে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেন তো…’

‘অবশ্যই। অবশ্যই। কিন্তু আমাকে একটু সময় দিতে হবে। এক মিনিট।’

এ্যান্ডারসন নিচু স্বরে খুব দ্রুত কথা বলল ম্যাট্রনের সাথে। মাত্র কয়েকটা শব্দ

চিনতে পারল সে। অনেকগুলোর কোনো মানেই পেল না। এরপর ম্যাট্রন নড করল নার্সদের দিকে ফিরে। সাথে সাথে তারা একটা ওয়াল কাপবোর্ড তৈরি করে নিল। একটা পাতলা ধাতব ব্যান্ড দিয়ে পোলের মাথা মুড়ে দিবে তারা, বোঝা যায়।

‘এটা আবার কীজন্য?’ প্রশ্ন তুলল সে সেসব কঠিন রোগিদের মতো করে যারা সর্বক্ষণ ডাক্তারদের কানের পোকা বের করে ফেলে কী হচ্ছে তাদের সাথে তা জানার জন্য। ই ই জি রিডআউট’।

প্রফেসর, ম্যাট্রন আর নার্সরা বিস্মিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি বিনিময় করল।

‘ও- ইলেক্টো… এনচেপ… এলো… গ্রাম, খুব ধীরে বলে সে, যেন স্মৃতির গহিন থেকে তুলে আনতে পারছে না কথাগুলো। ইউ আর কোয়াইট রাইট। আমরা আপনার ব্রেন ফাংশন তলিয়ে দেখতে চাই।’

আমার মস্তিষ্ক তখনি কাজ করবে যখন আপনারা নাছোড়বান্দার মতো আমাকে ধরে না রেখে একটু ভেবে নিতে দিবেন! মনের খেদ লুকিয়ে রাখতে পারছে না পোল। যাক, কোনো একটা সমাধানের কাছে আসছি আমরা।

মিস্টার পোল,’ বলল এ্যান্ডারসন, এখনো কণ্ঠে সতর্কতার ছোঁয়া, যেন কোনো ভিনদেশি ভাষা কচলে তেতো করে ফেলছে, আপনি জানেন, অবশ্যই, যে আপনি আপনি একটা খুব নচ্ছাড় টাইপের এ্যাক্সিডেন্টে পড়েছিলেন… ডিসকভারির বাইরে কাজ করার সময়…’

পোল নড় করল। মনে আছে তার।

‘আমার একটু সন্দেহ হয়, নিরস কষ্ঠ পোলের, ‘সেই “ডিজএ্যাবল” টা আসলে খাটো করে দেখানো হয়েছিল।

দেখেই বোঝা যায়, বেশ হালকা বোধ করছে এ্যান্ডারসন। খুব ক্ষীণ একটা হাসির রেখা ছড়িয়ে যায় তার মুখ জুড়ে।

‘আলবৎ! বলুন দেখি কী হয়েছিল… মানে আপনি কী মনে করেন?

যাক, কী বলব, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ার পর ডেভ বোম্যান উদ্ধার করে আনল। ডেভ কেমন আছে? কেউ কোনো জবাব দিবে না?’

‘সময়ে থলির সব বিড়াল বেরিয়ে আসবে… সবচে খারাপ হলে কী হতে পারে?

পোলের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শিতল একটা স্রোত নেমে গেল কুলকুল করে। মনে যে চিন্তাগুলো এল সেগুলোকে ঠিক জুড়ে দিতে পারছিল না সে।

সব চেয়ে খারাপ কী হতে পারে? সবচে খারাপ হতে পারে এই যে আমাকে ডেভ উদ্ধার ঠিকই করেছিল, মৃত অবস্থায়। আর এখানে, তা এ জায়গা যেখানই হোক, এখানে অবশেষে আনা হয় এবং কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় সজাগ করা হয়। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ…’।

‘ঠিক তাই। আপনাকে পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আসলে… এর খুব কাছাকাছি কোথাও।

মানে? এর খুব কাছাকাছি কোথাও মানে? মাধ্যাকর্ষণের একটা টান যে আছে তা তো সত্যি খুব ধীরে ঘুরতে থাকা মহাকাশ স্টেশনেও একই হাল হবে। চুলায় যাক, আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে এখন।

মনে মনে খুব দ্রুত কিছু আঁক কষে নিল পোল। ডেভ যদি তাকে হাইবারনেকুলামে আর সব ক্রুর সাথে শুইয়ে রেখে থাকে, বৃহস্পতির মিশন শেষ করে থাকে- তাতেই বা কী এসে যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যাবার কথা তার, ফিরে আসতে আসতে।

আজকের তারিখটা ঠিক কত? যথা সম্ভব শান্ত থেকে জিজ্ঞেস করল সে। প্রফেসর আর ম্যাট্রন সাথে সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। গলার কাছে আবার ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া টের পায় পোল।

আপনাকে বলতেই হবে, মিস্টার পোল, যে, বোম্যান আপনাকে উদ্ধার করেনি এজন্য তাকে দোষ দেয়ারও কোনো উপায় নেই- আপনাকে জীবিত পাবার কোনো পথ খোলা ছিল না। এদিকে তার নিজের জান নিয়েই মরণপণ টানাটানি পড়ে যায়…

‘আপনি মহাকাশে ভেসে বেড়ালেন, পেরিয়ে গেলেন মহাদেবতা বৃহস্পতির বিশাল জগৎ, এগিয়ে চললেন অন্তহীন তারার দেশে। কিন্তু একটা ব্যাপার অবাক করার মতো, সূর্য থেকে এমনিতেই দূরে ছিলেন, আরো অনেক অনেক দূরে চলে গেলেন, ফ্রিজিং পয়েন্ট থেকে অনেকটা নেমে গেল তাপমাত্রা, এত নিচে, যে কোনো প্রকার মেটাবলিজম চলা সে অবস্থায় অসম্ভব। কিন্তু সবচে অবাক করা ব্যাপার হল, ফিরে পাওয়া গেছে আপনাকে। জীবিত মানুষদের মধ্যে আপনিই যে সবচে ভাগ্যবান সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই- ভুল বললাম, কোনোকালে আপনার মতো ভাগ্যবান কেউ ছিল না।

আসলেই ভেঙে পড়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করে পোল । পাঁচ বছর, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মধ্যেতো একটা শতাব্দিও পেরিয়ে যেতে পারে, পেরিয়ে যেতে পারে আরো অনেকটা সময়।

‘লেট মি হ্যাভ ইট, সামলে নিচ্ছে সে।

প্রফেসর আর ম্যাট্রন যেন কোনো অদশ্য দর্শকের সামনে নিজেদের সামলে নিচ্ছে। তাদের কানের সাথে একটা কিছু লাগানো হল। পোল বুঝে নেয়, এখন তারা হসপিটালের নেটওয়ার্কে যুক্ত।

ফ্র্যাঙ্ক, চিরচেনা পারিবারিক ডাক্তারের মতো করে বলল এ্যান্ডারসন, ব্যাপারটা তোমার কাছে খুব বড় শক হয়ে আসবে, কিন্তু আমি জানি, এটা হজম করার ক্ষমতা তোমার আছে- আর যত দ্রুত জেনে যাও ততই ভাল।

‘চতুর্থ সন্ত্রা শুরু করতে যাচ্ছি আমরা। বিশ্বাস কর পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলে প্রায় এক হাজার বছর আগে।

বিশ্বাস করছি তোমার কথা, একেবারে শান্ত স্বর ফ্র্যাঙ্ক পোলের। তারপর কী যেন হয়ে গেল। চোখের সামনে দোদুল্যমান পুরো ঘরটা। ঘুরছে। কোথায় যেন তলিয়ে গেল সেই প্রাচিন ডিসকভারির ত্রু।

* * *

আবার ফিরে আসছে সচেতনতা। একটু অবাক হয়ে দেখল, এখন আর কোনো হাসপাতালের কামরায় নেই। শুয়ে আছে মনোরম এক স্যুইটে। দেয়ালে দেয়ালে ফুটে উঠছে অসাধারণ সব দৃশ্য। কোনো কোনোটা বিখ্যাত চিত্র, বাকিগুলো। ল্যান্ডস্কেপ আর সমুদ্রের ছবি, সম্ভবত তার সময়কার। কোনো কিছুতেই অপরিচিতের ছাপ নেই। কিন্তু সেগুলো আসবে, ভাবে সে।

কোন সন্দেহ নেই, বর্তমানে তার চারপাশটাকে খুব সাবধানতার সাথে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। টেলিভিশনের কাছাকাছি কী আছে এখন? এটাই কিন্তু বিছানার আশপাশে কোনো কন্ট্রোল দেখা যাচ্ছে নাতো। কত চ্যানেল থাকতে পারে তৃতীয় সহস্রাব্দে?

এ নতুন পৃথিবীতে কত কী যে নতুন করে শিখে নিতে হবে তার লেখাজোকা নেই। যেন কোনো বুনো এসে হঠাৎ হাজির হয়েছে উন্নত সভ্যতার সামনে।

কিন্তু প্রথমে তাকে শক্তি ফিরে পেতে হবে- শিখে নিতে হবে ভাষাটা; পোলর জন্মস্থানেই তার সেই জীবনটায় ভাষা কত পাল্টে গেল, উল্টে গেল কত ব্যাকরণ। নিশ্চয়ই আরো হাজার হাজার নতুন শব্দ এসেছে, বেশিরভাগই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত, কোনো কোনোটার অর্থ সে মোটামুটি ধারণ করে নিতে পারে।

আরো হতাশাজনক ব্যাপার হল, হাজার বছরে অনেক অনেক নতুন নাম এসেছে। আগাপাশতলা কিছু বুঝে উঠতে পারে না সে। সপ্তাহ ধরে তার কথাবার্তায় বাধা পড়ে পটে আঁকা জীবন-ইতিহাসের সামনে।

আস্তে আস্তে ফিরে আসছে শক্তি, একই সাথে বাড়ছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। সেই সাথে শ্যেনদৃষ্টিতে নজর রাখছে প্রফেসর এ্যান্ডারসন। অতিথিদের মধ্যে মেডিক্যাল স্পেশালিস্ট আছে, আছে নানা শাখার তুখোড় সব স্কলার এবং তার সবচে বেশি নজর যাদের দিকে, তারা হল স্পেসক্র্যাফট কমান্ডার।

ডাক্তার আর ইতিহাসবেত্তাদের নতুন করে জানানোর খুব বেশি কিছু নেই, প্রায় সবই এবং তার চেয়েও বেশি জমা হয়ে আছে মানবজাতির অকল্পনীয় বিশাল সব ডাটাব্যাঙ্কে। কিন্তু সে একটা কাজ ভাল করতে পারত, নানা ইতিহাসের বেড়াজালের পথে আটকে পড়া বাদ দিয়ে তার সময়টাকে একেবারে সাদাসিধাভাবে তুলে আনতে পারত।

সবাই দু চোখে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে তার কথা শোেনন। প্রশ্নের জবাব লুফে নেয়। কিন্তু কিছু জানতে চাইলেই কেন যেন শামুকের মতো গুটিয়ে যায় নিজেদের ভিতরে। পোল আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, কালচারাল শক থেকে তাকে অতিমাত্রায় সাবধানতার সাথে দূরে রাখা হচ্ছে। নিজের অজান্তেই যেন পায়তাড়া কষে, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া চাই। যতক্ষণ একা থাকছে, দেখে অবাক হচ্ছে না যে দরজাটা লক করে রাখা হয়।

এবার আসবে ডক্টর ইন্দ্রা ওয়ালেস। পাল্টে গেল পুরো পাশার দান। মেয়েটার নাম যেমনই হোক, রক্তমাংসের গঠনে জাপানি ভাবটাই বেশি। কল্পনার প্রলেপ মিশিয়ে পোল মাঝে মাঝে তাকে গেইশী ভেবে বসে- যে জাপানি মেয়েরা সেবাকর্মে দক্ষ। একটা ভার্চুয়াল চেয়ার আঁকড়ে থাকা কোনো বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি লেকচারারের সাথে তার কল্পনা যে মিলবে না তাতো স্বাভাবিক। মেয়েটার আসার সাথে সাথে সব পাল্টে যাওয়াটা শুধু শুধু নয়। অনর্গল পোলের আমলের ইংরেজি বলে যাচ্ছে সে।

‘মিস্টার পোল, শুরু করল সে, খুব দরকারি আঙ্গিকে, আমাকে আপনার অফিসিয়াল গাইডের কাজ দেয়া হয়েছে- কিম্বা বলা ভাল, মেন্টর। আমার কোয়ালিফিকেশন- আপনার সময়ের উপর বিশেষজ্ঞ আমি। অভিসন্দর্ভের বিষয়, ‘জাতিগত রাষ্ট্রের পতন- ২০০০-৫০’। আমার বিশ্বাস দুজনে দুজনকে দারুণ হেল্প করতে পারব।’

‘আমি নিশ্চিত, পারব। আপনার প্রথম কাজ আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে এ নতুন পৃথিবীটাকে দেখতে দেয়া।

‘ঠিক যেটা আমরা চাই। কিন্তু প্রথমেই আপনাকে একটা আইডেন্ট দিতে হবে। যে পর্যন্ত একটা পরিচিতি না থাকছে সে পর্যন্ত আপনি একজন- কী বলে ব্যাপারটাকে- ননপারসন। কোথাও যেতে পারবেন না, করতে পারবেন না কোনো কাজ। কোনো ইনপুট ডিভাইস আপনার অস্তিত্বের কথা স্বীকারও করবে না।

‘ঠিক এমনি আমি আশা করছিলাম, একটু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল পোল, ‘পদ্ধতিটা আমার সময়েই শুরু হয় হয় করছিল। লোকে ব্যাপারটাকে কী ঘেন্নাইনা করত।

‘কেউ কেউ এখনো করে। হাল ছেড়ে দিয়ে, রণে ভঙ্গ দিয়ে সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যায় প্রকৃতির কাছে। বাস করে বনে জঙ্গলে। আপনার শতাব্দিতে যতটা অবারিত প্রকৃতি ছিল এখন তেমন নেই। অরণ্যে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। তারা কিন্তু জাতে মাতাল তালে ঠিক। কম্প্যাক সাথে নিয়েই যায়। যে কোনো বিপদের চোরাবালিতে পা পড়ে গেলেই হাউমাউ করে সাহায্য চায়। গড়পড়তায় তাদের ডাক আসে দিন পাঁচেকের মধ্যেই।

‘আফসোসের কথা। মানবজাতির আরো অবনতি হয়েছে।

সে আসলে মেয়েটাকে খতিয়ে দেখছে। দেখছে কতটা সহ্য করে সে, কতটা গভীর তার ব্যক্তিত্ব। বোঝাই যায়, তাদের আরো অনেকটা সময় একত্রে কাটাতে হবে, আরো ভয়ানক ব্যাপার হল, এ মেয়ের উপর তাকে অহর্নিশি হাজারটা ব্যাপারে নির্ভর করতে হবে। এখনো জানে না তাকে ভাল লাগবে কিনা- হয়ত এ মেয়ে তাকে জাদুঘরের বস্তু হিসাবে ধরে নিয়েছে।

অবাক হয়ে দেখে পোল, তার কথায় নির্ভয়ে সায় দিচ্ছে ইন্দ্রা।

কথাটা সত্যি- কোনো কোনো হিসাবে। হয়ত শারীরিক দিক দিয়ে আমরা অনেক দূর্বল কিন্তু এখনকার মানুষ যেভাবে বাস করে ততটা সুখে এবং ঐশ্বর্যে কোনোকালে খুব বেশি মানুষ বাস করেনি।’

ছোট একটা চৌকো প্লেটের কাছে হেঁটে গেল মেয়েটা। দরজার গায়ে আঁটা আছে চৌকো জিনিসটা। ছাপার যুগে এমন সব আকৃতির পত্রিকা বের হত। পোল দেখেছে সব ঘরেই এমন কিছু আছে। সাধারণত ফাঁকা। মাঝে মাঝে সেখানে ধীর গতিতে টেক্সট ফুটে ওঠে, উপরের দিকে চলে যায়। বেশিরভাগ শব্দ পরিচিত হলেও পোলের কাছে সেগুলো কোনো অর্থ বয়ে আনে না। একবার তার ঘরের ঐ ডিসপ্লেগুলো জরুরি ভঙ্গিতে বিপ বিপ করেছিল, গা করেনি পোল, এসব নিয়ে যদি কেউ মাথা ঘামায় তো সে অন্য কেউ, সে নয়। ভাগ্য ভাল, শব্দটা যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবেই থেমে যায়।

প্লেটটার উপর ডক্টর ওয়ালেস হাতের তালু রাখে, সরিয়ে নেয় কয়েক সেকেন্ড পর। পোলের দিকে কটাক্ষ হেনে বলে, ‘আসুন, দেখুন একবার।

সেখানকার লেখাটুকুর উপর চোখ ফেলে অনেকটাই বুঝে ফেলে পোল । ওয়ালেস, ইন্দ্রা [এফ২৯৭০.০৩.১১/৩১.৮৮৫/হিস্ট.অক্সফোর্ড]

আমার যদ্দূর মনে হয় এফ মানে ফিমেল, তারপর আছে জন্মতারিখ- এগারোই মার্চ, উনত্রিশশ সঙুর- আর আপনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সাথে যুক্ত। আর আমার যতদূর মনে হয় সেই ৩১.৮৮৫ হল পার্সোনাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার, ঠিক তো?”

‘একসেলেন্ট, মিস্টার পোল। আমি আপনাদের সময়কার কিছু ই-মেইল এ্যাড্রেস আর ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দেখেছি। এমন সব সংখ্যা আর শব্দ যেগুলো মানুষের মনে রাখতে হলে নাভিশ্বাস উঠে যাবে। কিন্তু আমরা সবাই যার যার জন্মতারিখ জানি আর সে তারিখটা ৯৯,৯৯৯ জনের বেশি লোক শেয়ার করবে না। তাই আপনার প্রয়োজন মাত্র পাঁচটা নাম্বার… আর তাও যদি ভুলে যান, কোনো সমস্যা নেই। দেখতেই পাচ্ছেন, ব্যাপারটা আপনার অস্তিত্বের সাথে যুক্ত।

‘গেঁথে দেয়া?

ইয়েস-জন্মের সাথে সাথে ন্যানোচিপ লাগানো হয় দু হাতে। কিন্তু আপনাকে নিয়ে একটা সমস্যা হবে।’

কী?

‘বেশিরভাগ সময় আপনি যেসব রিডারের সম্মুখীন হবেন তাদের মন-মগজ এত বেশি সরল যে বিশ্বাসই করবে না আপনার জন্মতারিখ। তাই আপনার অনুমতির সাথে জন্মতারিখটা এক হাজার বছর এগিয়ে আনব।’

‘অনুমতি দেয়া হল। আর আইডেন্টের বাকিটুকু?

‘অপশনাল। আপনি এটাকে খালি রাখতে পারেন। বর্তমান কাজ বা আগ্রহ যুক্ত করে দিতে পারেন- গ্লোবাল বা টার্গেটেড পার্সোনাল মেসেজের জন্য ব্যবহার করতে পারেন।

কিছু কিছু ব্যাপার, জানে পোল, হাজার বছরেও বদলায় না। ঐসব টার্গেটেড’ মেসেজের গোপনীয়তাটা এখনো বদলে যাবে না।

জানতে হবে, এত নিরাপত্তা আর একীভূত অবস্থায় মানুষের নৈতিকতা কিছুটা সেরেছে কিনা।

তার আগে ডক্টর ওয়ালেসের সাথে তাকে আরো মিশতে হবে।

৪. দৃষ্টি যায় দূরে

ফ্র্যাঙ্ক- প্রফেসর এ্যান্ডারসন মনে করেন তোমার শরীরে একটু বল ফিরে এসেছে। ইচ্ছা হলে পায়ে দিয়ে হেঁটে যেতে পার কিছুটা।

‘খুব ভাল লাগল কথাটা শুনে। তুমি কি ‘স্টির ক্রেজি’র মানেটা জান?”

না, কিন্তু আন্দাজ করে নিতে পারি।

লো গ্র্যাভিটিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে পেপাল যে ঠিক ঠিক পা তুলে ফেলতে পারছে। জি’র অর্ধেক, আন্দাজ করে সে। খুব একটা সমস্যা হবে না এখানে। পথে দেখা হয়ে গেল অনেকের সাথে। কেউ পরিচিত নয়। কিন্তু তাদের হাসির ভঙ্গি, মুখের ভাব পরিচিত পরিচিত। ভেবে নেয় পোল, আমি নিশ্চয়ই পৃথিবীর সেলিব্রিটিদের মধ্যে কেউকেটা টাইপের একজন হয়ে গেছি ইতিমধ্যে। বাকি জীবন নিয়ে কী করব সে সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে ব্যাপারটা সাহায্য করবে আমাকে। অন্তত

আরো একটা শতাব্দি, যদি এ্যান্ডারসন…

পুরো করিডোরটায় কোনো কিছু নেই, একটু পর পর শুধু দরজায় নাম্বার দেয়া, প্রতিটায় সেই চিরাচরিত রিকগ প্যানেল। ইন্দ্রার পিছনে পিছনে প্রায় দুশো মিটার এগিয়ে গেল পোল। থমকে গেল হঠাৎ করে ব্যাপারটা তার কাছে একেবারেই অপরিচিত।

‘এই স্পেস স্টেশন নিশ্চয়ই ইয়া বড় বিস্ময় লুকাতে পারল না সে। জবাবে মোহনীয় এক হাসি দিল ইন্দ্রা।

‘তোমাদের সময়ে কি একটা কথা প্রচলিত ছিল না, ‘কিছুই এখনো দেখনি বৎস! ইউ এই সিন এনিথিং ইয়েট।’

“নাথিং,” ‘ শুধরে দিল সে, অন্যমনস্কভাবে। বিশাল এ সৃষ্টির সবটুকু খতিয়ে দেখার একটা ইচ্ছা মনে ঘাপটি মেরে আছে। অন্য সব চিন্তা সরে যাচ্ছে দূরে। তার মনে বড়জোর ডজনখানেক সিট ওয়ালা একটা স্পেস স্টেশনের কথা আসে ।

‘অবজার্ভেশন লাউঞ্জ থ্রি, আদেশ দিল ইন্দ্রা, সাথে সাথে চলে গেল তারা টার্মিনাল থেকে।

বিরাট এক রিস্টব্যান্ডে সময় দেখছে পোল; এখনো এর মাথামুণ্ডু খুব একটা বুঝে উঠতে পারেনি। একটা ব্যাপারে একটু আশ্চর্য হয় সে, পুরো পৃথিবীর সময় এখন এক। টাইম জোনের জটিল ব্যাপারস্যাপারগুলো ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। গ্লোবাল কম্যুনিকেশনের পথে এ এক অন্তরায়। সেই একবিংশ শতাব্দিতে এ নিয়ে জোর শোরগোল উঠেছিল। বলা হত সোলার বা সৌর সময়ের বদলে সাইডরিয়েল টাইমের প্রবর্তন করতে হবে। তখন, সূর্য চলবে ঘড়ির কাঁটা ধরে।

যাই হোক, হালে পানি পায়নি সূর্যের একই সময় প্রস্তাবটা। ক্যালেন্ডারের হিসাব বদলে দেয়ার প্রস্তাবও মানা হয়নি। সবাই মেনে নিয়েছিল, টেকনোলজি আরো এগিয়ে যাক, তখন সেসব নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে। কোনো একদিন, অবশ্যই, ঈশ্বরের ছোটখাট ভুলগুলো শুধরে নেয়া হবে পৃথিবীর কক্ষপথের সামান্য যে কটিটা তিনি রেখেছিলেন আবহমান কাল থেকে, সেটাকে সারিয়ে নেয়া হবে… তখন, মানুষ বারো মাসে বছর হিসাব করবে, প্রতি মাসে দিন থাকবে কাঁটায় কাঁটায় ত্রিশটা….

গতি আর পেরিয়ে যাওয়া সময়ের হিসাবের সাথে সাথে পোল বুঝতে পারে যানটা তাদের নিয়ে কমসে কম তিন কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছে থেমেছে একটা দরজার সামনে। হাট হয়ে খুলে গেল দুয়ার, অটোভয়েস বলে উঠল, হ্যাভ এ গুড ভিউ। আজ পঁয়ত্রিশ ভাগ মেঘ আছে।’

অবশেষে, ভাবে পোল, আমরা আউটার ওয়ালের কাছাকাছি চলে আসছি। কিন্তু বিধি বাম, সেখানেও লুকিয়ে আছে রহস্য। এই এতটা পথ পেরিয়ে আসার পরও গ্র্যাভিটির হেরফের হয়নি, দিকের বদলতো দূরের কথা। এখনো ভাবতেই পারছে না একটা ঘূর্ণায়মান মহাকাশ স্টেশনের জি ভেক্টরের কোনো পরিবর্তনই হয়নি এতটা দূরত্ব পেরিয়ে আসার পরও… নাকি কোনো গ্রহের উপর আছে। কিন্তু সৌরভুবনের বাসযোগ্য যে কোনো গ্রহের অভিকর্য তো অনেক কম হওয়ার কথা।

খুলে গেল টার্মিনালের আউটার ডোের। পোল একটা ছোট এয়ারলকে ঢুকছে। নিশ্চয়ই এটা স্পেস, কোনো গ্রহ নয়। কিন্তু স্পেসস্যুট কোথায়? ব্যগ্রভাবে চারদিকে তাকায় সে, শূন্যতার এত কাছে আসাটা তার স্বভাবের সাথে ঠিক মেলে না একবার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে… দুরস্ত।

‘এইতো, চলে এসেছি প্রায়,’ আশ্বস্ত করার ভঙ্গি ইন্দ্রার কণ্ঠে।

খুলে গেল শেষ দুয়ার। মহাশূন্যের স্তব্ধ করা চির তিমিরে চোখ পড়ল সাথে সাথে। একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা। জানালাটা উপর-নিচ ডান বামে ভিতরের দিকে বাকানো, মাঝের দিক সামনে বাড়ানো। যেন কোনো গোল কাঁচের পাত্রে আটকে পড়েছে ছোট্ট কোনো গোঙফিশ- এমনি অনুভূতি হল পোলের। মনে একটা নিশ্চয়তা কাজ করছে, এ বিশাল কর্মযজ্ঞের দভমুন্ডের বিধাতারা নিশ্চয়ই ঠিক ঠিক জানত কী করছে তারা… পোলের আমলের স্ট্রাকচারাল ম্যাটেরিয়ালের চেয়ে অনেক আধুনিক জিনিসের সাথে নিশ্চয়ই এরা পরিচিত।

দুরে, বহুদূরে তারার দল ঝিকমিক করছে, কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু আলোয় চোখ সয়ে যাওয়া পোল কিছুই দেখতে পায় না মিমিষে কালো ছাড়া।

সামনে এগিয়ে যেতে নিয়েছিল, ইন্দ্রা সেখানেই দাঁড় করিয়ে রাখে।

কী ব্যাপার, ভাল করে তাকাও দেখি। দেখতে পাচ্ছ না কিছুই

চোখ পিটপিট করে পোল, তারপর নিকষ কালো অন্ধকারে চোখ রাখে। ঠিক বিশ্বাস করার মতো ব্যাপার নয়… জানালার গায়ে ফাটল।

একপাশ থেকে আরেক পাশে চোখ বোলায় সে। না, দৃষ্টি বিভ্রম নয়; সত্যি। ইউক্লিডের সেই সংজ্ঞার কথা মনে পড়ে যায়, একটা রেখার দৈর্ঘ্য আছে কিন্তু কোনো প্রস্থ নেই।’

সামনে এগোয় সে। দাগটা এতই হালকা যে একে ঠিক সরুও বলা যায় না। যেন ইউক্লিডের সেই কথা, কোন প্রস্থ নেই।

কিন্তু এখানে অন্য একটা ব্যাপার আছে। অনিয়মিত বিরতিতে রেখার গায়ে বিন্দু বিন্দু পুরুত্ব দেখা যায়, ঠিক যেমনটা হয় কোনো মাকড়শার জালে জলকণা লেগে থাকলে।

জানালার দিকে আরো এগিয়ে যাচ্ছে পোল। দৃষ্টি নিচের দিকে। না, দৃশ্যটা অনেক অনেক পরিচিত। ভেসে উঠেছে পুরো ইউরোপা মহাদেশ, উত্তর আফ্রিকার অনেকটা অংশ। স্পেস থেকে এ দৃশ্য কতবার দেখেছে সে তার ইয়ত্তা নেই। আচ্ছা, তাহলে আর কোথাও নয়, অর্বিটেই আছে সে। সম্ভবত কোনো ইকুয়েটরিয়াল অর্বিটে- হাজার খানেক কিলোমিটার উপরে তো হবেই।

রহস্যমাখা হাসি ইন্দ্রার অধরে।

‘জানালার আরো কাছে যাও,’ মৃদু কণ্ঠে বলল সে, তাহলে সরাসরি নিচে তাকাতে পারবে। আশা করি তোমার উচ্চতাভীতি নেই।’

কোনো মহাকাশচারীকে এ কথা বললে আর কী বলা যায়। নিজেকে শোনায় পোল মনে মনে, সামনে এগিয়ে যেতে যেতে। কখনো ভার্টিগোর সমস্যা থাকলে আমি এ পেশায় পা ফেলতেই পারতাম না…

আর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে সত্যি সত্যি ভিড়মি খেল সে। চিৎকার করে উঠল, ‘মাই গড! সাথে সাথে সরে এল জানালার সামনে থেকে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে তাকাল আবার।

একটা সিলিন্ডারের মতো শহরের উপর থেকে চোখ রাখছে সে। এর ভদ্রোচিতভাবে গোল হয়ে যাওয়া প্রস্থ কম করেও কয়েক কিলোমিটার হবে। কিন্তু উচ্চতার সাথে এর কোনো তুলনাই নেই। নেমে গেছে এটা। নিচে, নিচে, আরো আরো নিচে। আফ্রিকার উপরে কোথাও ধোঁয়াশার ভিতরে গেছে হারিয়ে। আন্দাজ করে নেয় পোল, জায়গাটা উপরিতলে কোথাও গিয়ে মিশবে।

কত উঁচুতে আছি আমরা?’ ফিসফিস করে সে। হাজার দুয়েক কে। এবার উপরে তাকাও।

এবার ব্যাপারটা তত বিস্ময় নিয়ে আসে না, কী দেখা যাবে তা আগে থেকেই যেন জানত সে। মহাশূন্যের গায়ে একটা বিন্দুতে পরিণত হবার আগ পর্যন্ত উঠেই গেছে, উঠেই গেছে। কোনো সন্দেহ নেই, চলে গেছে একেবারে জিওস্টেশনারি অর্বিটে; বিষুবের ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার উপরে। পোলের আমলে এমন সব ফ্যান্টাসির কথা শোনা যেত; কিন্তু বাস্তবে তা দেখার সৌভাগ্যের কথা কোনো মানুষ সে আমলে স্বপ্নেও ভাবত না।

এবার রেখাটার মানে ধরতে পারে সে। সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছোটাছুটি করে টগবগে রক্ত।

‘ওটা নিশ্চয়ই আরেকটা?

হ্যাঁ- এশিয়ান টাওয়ার। তাদের কাছে আমাদেরকে ঠিক এমনি দেখায়। কটা আছে?

মাত্র চারটা। ইকুয়েটরের গায়ে সমানভাবে ছড়ানো। আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা, প্যাসিফিকা। শেষেরটা এখনো প্রায় খালি। মাত্র কয়েকশ লেভেল পূর্ণ হয়েছে। পানি ছাড়া আর কিছু দেখার নেই…’

এই বিবশ করে দেয়া ধারণাটাকে কোনোক্রমে গলাধকরণের চেষ্টায় প্রাণ আইঢাই করছে এমন সময় একটা বিরক্তিকর চিন্তা মনে এল।

আমাদের আমলেই হাজার হাজার স্যাটেলাইট ছড়ানো ছিল সবখানে। তোমরা কী করে সেগুলোর সাথে সংঘর্ষ এড়ালে?

এবার ইন্দ্রার অস্বস্তিতে পড়ার পালা।

‘ইউ নো- আমি কখনো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি এটা আমার ফিল্ড নয়। থামল সে। মনের অলিগলি ধরে সার্চ চালাচ্ছে। এরপর উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখাবয়ব।

যদ্দূর মনে হয় বড়সড় কোনো পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমেছিল তারা। এখন স্টেশনারি অর্বিটের নিচে কৃত্রিম উপগ্রহ বলতে কিছু নেই।’

এতেই বোঝা যায়, নিজেকে জানায় পোল। এই চার দানবীয় টাওয়ারই হাজার হাজার স্যাটেলাইটের কাজ করতে পারবে।

‘আর এম্নিতেও কোনো দূর্ঘটনা হয়নি? পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া বা এ্যাটমোস্ফিয়ারে ফিরে আসতে থাকা স্পেসশিপের সাথে ধাক্কা অথবা তেমন কোনো ঘটনা?

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রা। এক দৃষ্টিতে।

একটু পর বুঝতে পারল ব্যাপারটা। সে সবের কোনো প্রশ্নই ওঠে না আর। উপরের দিকে আঙুল তাক করে, যেখানে থাকা উচিৎ সেখানেই আছে সব স্পেসপোর্ট। উপরে। আউটার রিঙে। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে শেষ রকেটটা উড়েছে কম করেও চারশ বছর আগে।

ব্যাপারটা হজম করতে করতে আরেক কথা মনে পড়ে যায়। এ্যাস্ট্রোনটের ট্রেনিং নেয়ার সময় তাকে অনেক ব্যাপার শিখানো হয়েছিল। স্পেসে ব্যাপারটা জীবন মরণের খেলা।

সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে না। দৃষ্টিসীমার অনেক উপরে। ঠিক মাথার উপর। কিন্তু কিছুটা সূর্যরশ্মি জানালা ভেদ করে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে। সেখানে আলোর আরো একটা ব্যান্ড চোখে পড়ে। অনেক ক্ষীণ, কিন্তু একজন মহাকাশচারীর কাছে আলোর খেলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এ ব্যাপার তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না। এ কী করে সম্ভব? ফ্রেমে দ্বৈত ছায়া পড়ছে অবলীলায়।

আকাশে তাকানো প্রয়োজন। দেখতে হবে। হাটু ভেঙে সাথে সাথে বসে পড়ে পোল। এবং জমে যায় তার চোখ। দূরে আরেকটা সূর্য দেখা যাচ্ছে।

‘হোয়াটস দ্যাট? কোনোক্রমে শ্বাস বন্ধ রেখে প্রশ্ন তোলে সে।

‘ও- কেউ তোমাকে বলেনি? ওটা লুসিফার।

‘পৃথিবীর আরেকটা সূর্য আছে?”

‘আসলে, এটা তেমন উত্তাপ দেয় না আমাদের কিন্তু চাঁদের কাজটা বন্ধ করে দিয়েছে আর কী… তোমাদের খোঁজার জন্য যখন দ্বিতীয় মিশন পাঠানো হয় তখনো

সেটার নাম ছিল… নাম ছিল কী যেন? বৃহস্পতি।

স্থাণুর মতো চুপ করে থাকে পোল।

আমি জানি, শিখতে হবে অনেক কিছু এই নতুন পৃথিবীর সাথে তাল মিলাতে হলে। কিন্তু কতটা শিখতে হবে তা জানি না।

৫. শিক্ষা

পোল খুশি হয়েছে টেলিভিশন সেটটাকে ঘরের ভিতরে চাকার মাধ্যমে সরিয়ে এনে খাটের পাশে রাখায়। খুশি হয়েছে, কারণ সে মধ্য-সংবাদ-খরায় ভুগছিল খুব। পরিচিত জিনিস দেখে কার না আনন্দ হয়।

জাদুঘরকে কথা দিয়ে এসেছি আপনার কাজ হয়ে গেলে আবার ফিরিয়ে দিব।’ বলল মার্টন, ‘আশা করি জানেন কী করে ব্যবহার করতে হয়?

রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল পোল। নস্টালজিয়ার সুতীব্র এক স্রোত কোত্থেকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে। মাত্র কয়েকটা জিনিসই বাল্যকালে ফিরিয়ে নিতে পারত। সেসব দিনের টেলিভিশনগুলো যেমন ছিল কালা তেমনি বোকার হদ্দ। কঠের আদেশ বুঝতে পারত না।

‘থ্যাঙ্ক ইউ, মার্টন। কোনটা সবচে ভাল নিউজ চ্যানেল । প্রথমে প্রশ্নটার কিছুই বুঝল না মেয়েটা। তারপর উজ্বল হয়ে উঠল চোখমুখ।

‘ও- বুঝতে পারছি কী বলছেন আপনি। কিন্তু প্রফেসর এ্যান্ডারসন মনে করেন এখনো আপনি পুরোপুরি প্রস্তুত নন। তাই আর্কাইভসকে এভাবে সাজানো হয়েছে। যেন আপনি ভাল বোধ করেন। কোন…’

পোল ভেবে পায় না ডাটার জন্য এ যুগে স্টোরেজের কোন মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। তার এখনো কম্প্যাক্ট ডিস্ক এর কথা মনে আছে। আদ্যিকালের মানুষ আল জর্জ খুব গর্বিত ছিল অনেকগুলো এল পির কালেকশন থাকায়। কিন্তু টেকনোলজির এই হাঁটি হাঁটি পা পা করে সামনে এগুনো আর গজ-কচ্ছপের লড়াই নিশ্চয়ই অনেক শতাব্দি আগে হাপিস হয়ে গেছে। সবচে ভাল টেকনোলজি সেই ডারউইনিয় সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’ নীতি ধরে টিকে গেছে, কোনো সন্দেহ নেই।

তার জন্য মিডিয়াম বেছে নেয়াটা চমৎকার কেউ একজন (ইন্দ্রাঃ) একবিংশ শতাব্দির একেবারে গোড়ার দিকের সাথে পরিচিত, সেই এ ব্যবস্থাটা করেছে। বিরক্ত করার মতো কিছুই নেই। নেই যুদ্ধের ডামাডোল, কাটাকাটি মারামারি নেই। রাজনীতি আর ব্যবসার কপচানি আছে যৎসামান্য। এসবই এখন মান্ধাতা আমলের কথা, বোঝা যায়। কিছু হাকা হাস্যরসের অনুষ্ঠান আছে। আছে স্পোর্টস ইভেন্ট (তারা কী করে জানল যে সে টেনিসের ব্যাপারে পাড় মাতাল?)। ক্ল্যাসিক্যাল আর পপ মিউজিক। আর বন্যপ্রাণির উপর ডকুমেন্টারি।

যেই এগুলোকে একত্র করেছে তার সেন্স অব হিউমারের সুর যে কড়া ধাতে বাধা এটুকু অন্তত নিশ্চিত। নাহলে তারা স্টার ট্রেকের পর্বগুলো এখানে ঢোকাত না। ছেলেবেলায় পোল প্যাট্রিক স্টুয়ার্ট আর লিওনার্দো লিময়ের দেখা পেয়েছিল। কে জানে কী ভেবেছিল তারা সেই সময়টায়। অটোগ্রাফ চাইতে আসা এই পুচকে দস্যি ছেলেটার শেষ গন্তব্যের ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল কি?

একটা বিবশ করা ভাবনা মনে উঁকি দিল। কোথায় যেন পড়েছিল যে তার সময়টায় তার শতাব্দিতে অর্ধলক্ষাধিক টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং কোম্পানির অস্তিত্ব ছিল। এখন সংখ্যাটা কত? মিলিয়ন মিলিয়ন সারাক্ষণ কোটি কোটি ঘন্টার টেলিভিশন প্রোগ্রাম ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে? এত এত অনুষ্ঠান, বিলিয়ন বিলিয়ন সম্প্রচারের ভিড়ে কতগুলো সর্বোচ্চ মান অর্জন করছে, আর সেগুলো কীভাবে চাপা পড়ে যাচ্ছে?

চিন্তাটা এতই বেদনাদায়ক, এত বেশি নীতিহীনতা বয়ে আনে যে সপ্তাহখানেক অজানা চ্যানেলের সাগরে পাড়ি দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পোল সেটটাকে নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করল। সৌভাগ্য বলতে হয়, জেগে থাকার সময় তার হাতে নিজেকে নিয়ে ভাবার মতো ফুরসত খুব একটা মেলে না। ফলে কখন যে শরীরের হাপিস হয়ে যাওয়া শক্তিটুকু আস্তে আস্তে ফিরে এসেছে তার হদিস পায় না সে।

বোর হয়ে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু সিরিয়াস রিসার্চাররাই দল বেঁধে আসছে না, আসছে কৌতূহলী- সম্ভবত সেই সাথে প্রভাবশালী লোকজন। এদের এখানে আসাটাও অনেকটা সাগর সাঁতরে আসার মতো। মার্টন আর প্রফেসর এ্যান্ডারসন ফিল্টারিং প্যানেল বসিয়েছে যাতে কারো কোনো কথায় বা ইনফরমেশনে তার মনে কোনো আঘাত না পড়ে। তারপর, একদিন তার আনন্দই হল টেলিভিশন সেটটা আবার আসায়। উইথড্রয়াল সিম্পটমে ভুগতে শুরু করেছিল সে। এবারের দেখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সিলেক্টিভ হতে হল।

দামি এ্যান্টিকটার সাথে এগিয়ে এসেছে ইন্দ্রা ওয়ালেসও। মুখে তার হাসির ঝিলিক।

‘তোমার দেখতেই হবে এমন কিছু পেয়েছি, ফ্র্যাঙ্ক। যদ্দূর মনে হয় এতে তুমি এ্যাডজাস্ট করে নিতে পারবে- যাই হোক, তুমি যে ব্যাপারটাকে উপভোগ করবে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি।’

পোল মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিল, যে বিষয়ে মানুষ একটু প্রশংসা করে সেটা উল্টো বোরিং হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তার চেয়েও খারাপ কিছু। কিন্তু প্রথম মুহূর্তটাই আকর্ষণ করল ভীষণভাবে, নিয়ে গেল তাকে সেই পুরনো জীবনে। চিনে ফেলল সে তার আমলের বিখ্যাত কটাকে। ঠিক এ প্রোগ্রামটাই দেখেছে আগে।

আটলান্টা, ডিসেম্বর একত্রিশ, দুহাজার…

‘দিস ইজ সি এন এন ইন্টারন্যাশনাল, নতুন সহস্রাব্দের আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি, নতুন সহস্রাব্দ তার সব প্রতিশ্রুতি, ভাল আর মন্দ দিক নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে আসছে…

কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর আগে, চলুন এক হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক, প্রশ্ন করা যাক আমাদের: “এক হাজার সালের কোনো লোক কি দূর থেকে আমাদের পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা জানতে পারত বা বুঝতে পারত, জাদুমন্ত্রের মাধ্যমে তাকে যদি নিয়ে আসা হত এত দূরে?”

যতটুকু প্রযুক্তিকে আমরা প্রযুক্তি হিসাবে ধরি তার প্রায় পুরোটাই গড়ে উঠেছে এ সহস্রাব্দের শেষ প্রান্তে এসে। বেশিরভাগই গত দুশ বছরে। স্টিম ইঞ্জিন, ইলেক্ট্রিসিটি, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা, এ্যাভিয়েশন, ইলেক্ট্রনিক্স এবং মাত্র একটা জীবদ্দশায়, নিউক্লিয়ার এ্যানার্জি এবং স্পেস ট্রাভেল অতীতের সবচে বড় বড় মনগুলোও এসব দেখেশুনে ভড়কে যেত না কি? কী ভাবতেন তারা? মহান আর্কিমিডিস অথবা লিওনার্দোর জড় উপড়ে যদি কোনোভাবে আমাদের এ সময়ে এনে হাজির করা যেত, কী ভাবতেন তারা?

‘এটা আমাদের ভাবায় যে যদি হাজারখানেক বছর পিছনে চলে যাই তো আমাদের আন্দাজ আর বিস্ময় খুব একটা হেরফের হবে না। কথা সত্যি, মৌলিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো করা হয়ে গেছে; টেকনোলজিতে বড় ধরনের উন্নয়ন হবে, কিন্তু সেখানে কি এমন কোনো ডিভাইস থাকবে যেটা আমাদের কাছে ততটা কাজের আর বিস্ময়ের হবে যতটা আইজ্যাক নিউটনের কাছে একটা পকেট ক্যালকুলেটর আর ভিডিও ক্যামেরা হতে পারে?

হয়ত আমাদের সময়টী সমস্ত অতীতের চেয়ে বর্ণিল। টেলিকমিউনিকেশন্স, ছবি আর শব্দ রেকর্ড করার ক্ষমতা, আকাশ বাতাস আর মহাশূন্যজয় এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যা আদ্যিকালের মানুষ তার সবচে উন্নত স্বপ্নেও দেখতে পায়নি। এবং একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ কোপার্নিকাস, নিউটন, ডারউইন আর আইনস্টাইন আমাদের চিন্তা করার পৃথিবীকে এতটাই বদলে দিয়েছেন, মহাবিশ্ব সম্পর্কে ভাবনাকে এতটাই পাল্টে দিয়েছেন যে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আমরা একেবারে আনকোরা এক নূতন প্রজাতি হয়ে দেখা দিব।

‘এবং আমাদের বংশধররা, এখন থেকে হাজারখানেক বছর পরে, আমাদের দিকে কি এমন করুণা নিয়েই তাকাবে যেভাবে আমরা তাকাই আমাদের অবহেলিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, রোগে ভোগা, সামান্য সময় বেঁচে থাকা পূর্বপুরুষের দিকে? আমরা জানি এমন সব প্রশ্নের জবাব তাদের দিতে পারব যেগুলোর কথা তারা ভাবতেও পারেননি। কিন্তু তৃতীয় সহস্রাব্দ আমাদের জন্য কী কী চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে?

‘ওয়েল, এইতো, চলে আসছে সে মাঝ রাতকে কাঁপিয়ে দিয়ে একটা বিরাট ঘন্টা বেজে উঠল ঢং ঢং করে। রাতের একাকীত্বের বুক চিরে দিয়ে শেষ কম্পনটা হারিয়ে গেল…

এবং এমনই ছিল সেই সহস্রাব্দ গুডবাই, ওয়ান্ডারফুল এ্যান্ড টেরিবল টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি…’

এরপর ছবিটা পরিণত হল অজস্র টুকরায়, ভার তুলে নিল নতুন এক ধারাভাষ্যকার, তার সেই উচ্চারণ কত চেনা! এক টানে নিয়ে যায় অতীতে, হাজার বছর আগে…

‘অবশ্যই, এ দু হাজার এক সালের মানুষ এ মুহূর্তটাকে যেভাবে অনুভব করছে, যেভাবে নতুন সহস্রাব্দকে বরণ করে নিচ্ছে তেমন কিছু করেনি এক হাজার এক সালের মানুষ। আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নতির অনেকগুলোর স্বপ্নই হয়ত তারা দেখেছিল; আমরা জানি, স্যাটেলাইট সিটির স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়েছিল তাদের মনের গহিনেও, চেয়েছিল চাঁদ আর অন্য সব গ্রহের গায়ে বাড়ি তুলতে। তারা হয়ত আফসোসও করত এ সময়টাকে দেখে, কারণ আমরা এখনো অমর নই। মাত্র কাছের সূর্যটায় পোব পাঠিয়েছি, এই যা…’

মাঝপথে সুইচ অফ করে দিল ইন্দ্রা।

‘বাকিটা পরে দেখে নিও, ফ্র্যাঙ্ক। ক্লান্ত হয়ে পড়ছ তুমি। আশা করি এটাই তোমাকে এ্যাডজাস্ট করে নিতে সহায়তা করবে।

‘ধন্যবাদ, ইন্দ্রা। এখন হয়ত ঘুমাতে হবে। কিন্তু একটা পয়েন্ট ধরিয়ে দিয়েছে এটা।

কী?

‘আমি অনেকটা আহ্লাদিত যে হাজার বছর বয়েসি করে আমাকে দুহাজার এক সালে পাঠানো হয়নি। কোয়ান্টাম জাম্পের পক্ষে সেটা খুব বেশি অসহ্য হয়ে উঠত… অসম্ভব! কেউ সেটার সাথে মানিয়ে নিতে পারত না। অন্তত আমি ইলেক্ট্রিসিটির ব্যাপারটা জানি, আর আমার সাথে কোনো ছবি কথা বলতে শুরু করলে ভয়ের চোটে আধমরা হয়ে যাব না।

আশা করি, বলল পোল নিজেকেই, এই আত্মবিশ্বাসটা উপযুক্ত। কে যেন বলত, যথাযথ উন্নতি করা প্রযুক্তিকে জাদু থেকে আলাদা করা যাবে না, যদি যায়, তাহলে সেটা উন্নত নয়।

এ ভুবনে আমাকে কি জাদুর মুখোমুখি হতে হবে? আর আমি কি সেটার সাথে মানিয়ে নিতে পারব?

৬. ব্রেইনক্যাপ

‘একটা যন্ত্রণাময় সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে আপনাকে,’ বলল প্রফেসর এ্যান্ডারসন মুখে ঝুলে আছে এমন এক হাসি যাতে কথাটার গুরুত্ব একটু হাল্কা হয়ে যাবে।

‘আই ক্যান টেক ইট, ডক্টর। সরাসরি আমার কাছে দিন, ব্যস।

‘আপনার ব্রেইনক্যাপের জন্য কষ্টকর একটা ব্যাপার যে থাকবে তা আগেই বলে দিয়েছি। আপনাকে টেকো হয়ে যেতে হবে। হয় সব সময়ের জন্য, নয়ত মাসে একবার করে মাথা মুড়িয়ে নেয়াই নিয়ম। এখন, কোনটা বেছে নিবেন তা আপনার সিদ্ধান্ত।‘

স্থায়ী পদ্ধতিটা কী রকম?’

‘লেজার স্কাল্প ট্রিটমেন্ট। গোড়া থেকে ফলিকল মেরে ফেলে।‘

‘হুম… পরে পাল্টানো যায়?’

‘ধরে নিতে পারেন যায় না। কাজটা ভজঘট লাগিয়ে দিবে। ব্যথা ট্যথা পাবেন। সময় লেগে যাবে হপ্তা কয়েক।‘

‘তাহলে আগে দেখতে হবে চুল ছাড়া আমাকে দেখায় কেমন। স্যামসনের কপালে কী ঘটেছিল সেটা ভুলে যাবার চেষ্টা করব।‘

‘কে?’

‘অনেক পুরনো এক বইয়ের চরিত্র। ঘুমিয়ে থাকার সময় তার গার্লফ্রেন্ড কচ করে চুল কেটে দিয়েছিল। জেগে ওঠার পর বেচারা সমস্ত শক্তি খুইয়ে বসে।‘

‘ও, এবার মনে পড়েছে- একেই বলে মেডিক্যাল সিম্বলিজম।‘

‘তবু, দাড়ি হারাতে কোনো আপত্তি নেই আমার। দিনকে দিন শেভ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছি।‘

ব্যবস্থা নিচ্ছি আমি। আর কোন ধরনের উইগ পছন্দ করেন?

হেসে উঠল পোল। চারপাশের সবাই যে পাকাপাকিভাবে টাকমাথা সেটা আবিষ্কার করতে পোলের একটু সময় লাগল। সময় লাগল মেনে নিতেও। তার নার্স দুজনেই এর মধ্যে কৃত্রিম চুল সরিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলছে, আরো কয়েকজন টেকো স্পেশালিস্ট তার মাইক্রোবায়োলজিক্যাল টেস্টের জন্য এলে মেয়েগুলো মোটেও অস্বস্তিতে পড়ে না। এত বেশি চুলছাড়া মানুষ আশপাশে আর কখনো দেখেনি সে। জীবাণুর বিরুদ্ধে অশেষ যুদ্ধে এটাই যে মেডিক্যাল সায়েন্সের সর্বশেষ পদক্ষেপ তা বোঝা যায়।

প্রফেসর এ্যান্ডারসন সময় নষ্ট করার মানুষ নয়। সেদিন বিকালেই বিকট গন্ধওয়ালা কী এক ক্রিম পোলের মাথায় মাখিয়ে দিল নার্সেরা। ঘন্টাখানেক পরে সে যখন আয়নায় নিজেকে দেখে, প্রথমে চিনতেই পারে না। আসলে, বলে সে আপন মনে, আমার মনে হয় একটা পরচুলার ধারণা মন্দ নয় মোটেও…

ব্রেইনক্যাপ ফিটিঙে আরো একটু বেশি সময় লাগল। প্রথমে একটা মন্ড বানানো হবে। তাকে বসে থাকতে হবে অনড়, যেন প্লাস্টারটা সেট হয়ে যায়। মনে মনে ক্ষীণ আশা, তারা বলবে পোলের মাথাটা ঠিক শেপে নেই যে ব্রেইনক্যাপ বসানো যাবে।

একটু পর নার্সেরাই নার্ভাস হয়ে যায়- কঠিন সময় পেরিয়ে যেতে যেতে পোল বলে, আউচ- ব্যথা করছে তো!

এবার স্কালক্যাপের পালা। নস্টালজিক চিন্তা ভর করে মনের ভিতরে- আহা, আমার ইহুদি বন্ধুরা এখন যদি দেখতে পেত। কয়েক মিনিট পর এত বেশি স্বাভাবিক লাগে যে সে এটার অস্তিত্বের কথাই ভুলে যায়।

ইন্সটলেশনের জন্য প্রস্তুত সে। সময় এসে গেছে। আধ মিলিয়ন বছরের চেয়েও বেশি বয়েসি মানবজাতির কথা মনে পড়ে যায়।

.

‘চোখ বন্ধ করার কোনো দরকার নেই, টেকনিশিয়ান বলল, লোকটাকে “ব্রেইন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল, সংক্ষেপে তাদের ব্রেইনম্যান” বলা হয়, সেটআপ শুরু হয়ে গেলে আপনার সমস্ত ইনপুট নিয়ে নেয়া হবে। চোখ ভোলা থাক আর বন্ধ, তাতে কোনো উনিশ বিশ হবে না। কি দেখতে পাবেন না আপনি।

কে জানে, সবাই আমার মতো এতটা নার্ভাস হয়ে পড়ে কিনা, প্রশ্ন তোলে পোল নিজের কাছে। আমার নিজের মনের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখার এই কি শেষ মূহুর্ত? তবু, একালের টেকনোলজির উপর বিশ্বাস রাখতে শিখেছি আমি। অন্তত এখন পর্যন্ত এরা আমাকে ঠকায়নি। অবশ্যই, সেই পুরনো দিনের কথাটা ভুলে গেলে চলবে না, ‘দেয়ার ইজ অলওয়েজ এ ফাস্ট টাইম…’

যেমনটা কথা দেয়া হয়েছিল, সে কি অনুভব করছে না। মাথার খুলি কামড়ে ধরে ন্যানোওয়্যার একটু একটু করে গরম হয়ে উঠছে, টের পাওয়া যায়। এখনো অন্য সব অনুভূতি টনটনে একেবারে স্বাভাবিক। যখন সে পরিচিত ঘরটার খোঁজে চারপাশে তাকায়, দেখা গেল সব ঠিকই আছে।

ব্রেইনম্যানও একটা কালক্যাপ পরে আছে, পোলেরটার মতোই তার লাগানো। সাথে একটা ইকুইপমেন্ট, বিংশ শতাব্দির ল্যাপটপ কম্পিউটারের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে সেটাকে সহজেই। আশ্বস্ত করার ভঙ্গি তার হাসিতে।

‘রেডি? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে।

‘রেডি, যেমনটা আমি সব সময় থাকব। জবাব ছুঁড়ল পোলও।

আস্তে আস্তে নিভু নিভু হয়ে এল আলো। হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে। ঝপ করে নেমে এল নিঝুম নিরবতা। টাওয়ারের মৃদু গ্র্যাভিটিও যেন ভুল করে তার উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছে মুহূর্তে। যেন কোনো ণ শূন্যতার উপর ভাসছে; পুরোপুরি অন্ধকার নয় চারপাশটা। সে এমন অঞ্চলকে চেনে, আন্ট্রা ভায়োলেট আসার ঠিক আগের যে আলোকে মানুষ কিছু কিছু দেখতে পায়, সে অঞ্চলে আছে যেন। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের কাছে ডুবতে থাকার সময় একবার সে এমন অভিজ্ঞতার কাছাকাছি পৌঁছেছিল। ক্রিস্টালাইন শূন্যতার ভিতর দিয়ে শত শত মিটার নিচে তাকিয়ে থেকে গুলিয়ে উঠেছিল ভিতরটা। একাকীত্বের অসম্ভব এক যন্ত্রণা মুচড়ে দিচ্ছিল ভিতরটাকে। আতঙ্কটা কেমন করে যেন বেড়ে যাচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। বলাই বাহুল্য, সে কখনো স্পেস এজেন্সির সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে এ কথা ভুলেও উচ্চারণ করেনি…

অনেক অনেক দূর থেকে একটা গমগমে স্বর এসে তার শূন্যতাকে কাঁপিয়ে দিল। কিন্তু কঠটা কানে কানে আসেনি। এসেছে মস্তিষ্কের প্রতিধ্বনির গোলকধাঁধা থেকে।

ক্যালিব্রেটিং স্টার্টিং। শুরু হচ্ছে মান নির্ণয়। একটু পর পর আপনাকে প্রশ্ন করা হবে- আপনি মনে মনে উত্তর দিতে পারেন, আবার পারেন ভোকালি। বুঝতে পারছেন?

হ্যাঁ। বলল পোল । জানে না ঠোঁট নড়ল কিনা তা জানার আর কোনো উপায় নেই।

শূন্যতার বুকে কিছু একটা ফুটে উঠছে। পাতলা রেখার একটা গ্রিড। যেন গ্রাফ পেপারের বিশাল কোনো পাতা। বর্ধিত হচ্ছে উপরে আর নিচে। ডানে আর বামে। দৃষ্টি যতদূরে যায় ঠিক ততদূরে। মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করে সে মরিয়া হয়ে। চোখের সামনে থেকে সরে না দৃশ্যটা।

গ্রিডের ওপার থেকে সংখ্যা উঠে আসছে। পড়ার কোনো উপায় নেই, এত দ্রুত। কিন্তু সম্ভবত কোনো একটা সার্কিট তাদের রেকর্ড করে নেয়। পোল না হেসে পারে না। (গাল কি নড়েছিল সে হাসির সময়ে?) এসবইতো পরিচিত! এটাতো সেই কম্পিউটার চালিত চোখ পরীক্ষার মতো যেটা তার আমলের অকুলিস্টরা রোগিদের উপর চালাত।

উবে গেল গ্রিডটা। রঙের পরিচ্ছন্ন শিটে ভরে গেল দৃষ্টিসীমা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেগুলো বর্ণালির সবগুলো রঙে ঝলকে উঠতে লাগল। তোমাদের আগেই বলে রাখতে পারতাম,’ বলল পোল নিরবে, আমার কালার ভিশন খুবি স্বচ্ছ। একেবারে যুতসই। পরের পরীক্ষাটা নিশ্চয়ই শ্রবণশক্তির?

আন্দাজটা ঠিক। প্রথমে মৃদু লয়ে একটা ঢাকের গুড়গুড় আওয়াজ উঠল। আস্তে আস্তে আরো নিচু হয়ে তারপর উঁচু হতে শুরু করল। সবশেষে শ্ৰবণসীমার শেষপ্রান্তে নেমে গেলে, নেমে গেল বাদুড় আর ডলফিনের রাজ্যে।

সরল, সোজাসাপ্টা পরীক্ষার এখানেই ইতি। একটু পরই অনেক ধরনের ঘ্রাণে ভরে গেল মনোজগত। কিছু কিছু খুবি মিষ্টি। বাকিগুলো বীভৎস। এরপর সে পরিণত হল, মনে হয় এমনি, পরিণত হল অদৃশ্য কোনো হাতের পুতুলে।

ধারণা করল সে, নিউরোমাস্কুলার কন্ট্রোল চেখে দেখা হচ্ছে। আশা করছে, এসবের কোনো প্রভাব তার শরীরে পড়বে না। শরীর, হাত, পা নড়বে না। যদি তাই হয় তো বেশ হাস্যকর ব্যাপার। দেখাবে সেন্ট ভিটাসের নাচের টার্মিনাস এন্ডের মতো।

এরপর কী হল সে বুঝতে পারল না। তলিয়ে গেল স্বপ্নহীন ঘুমের জগতে।

নাকি শুধু স্বপ্নে দেখল ঘুমের ব্যাপারটা? জেগে ওঠার আগে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মাথায় আর হেলমেটটা নেই। হদিস নেই ব্রেইনম্যান বা তার সেই ল্যাপটপের মতো যন্ত্রটারও।

‘সব চলেছে ঠিকমত।’ বলল মার্টন, কোন সমস্যা যে নেই সেটা বের করতে মাত্র ঘন্টা কয়েক লাগবে। যদি আপনার রিডিং কে. ও. হয়- আই মিন ও. কে. হয়- কালই পেয়ে যাবেন আপনার ব্রেনক্যাপ।

পোল বেচারার আদ্যিকালের ইংরেজি শিখে নেয়ার খাটুনির ব্যাপারটা ঠিক ঠিক টের পেয়ে গেল। তবু, কপাল খারাপ, মার্টনের স্লিপ অব টাং হতেই পারে।

ফাইনাল ফিটিংয়ের সময় চলে এসেছে। পোল যেন কোনো বাচ্চা ছেলে। ফিরে গেল সে ছেলেবেলায়। যেন ক্রিসমাস ট্রির নিচ থেকে কোনো আনকোরা নতুন উপহার তুলে আনবে।

‘আপনাকে আবার সেসব সেটিংআপের সাথে মানিয়ে নিতে হবে না এবার। ব্রেইনম্যান আশ্বস্ত করছে, মুহূর্তেই ডাউনলোড় শুরু হয়ে যাবে। মাত্র মিনিট পাঁচেকের একটা ডেমো দিচ্ছি। আশা করি আপনি উপভোগ করবেন।

শান্ত, নিবিড় হয়ে আসে মিউজিকের লয়, ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাকে। সেই হাজার বছর আগের চির পরিচিত কোনো এক বাজনা। কোনোটা, ধরা যায়শা। চোখের সামনে কুয়াশার ভারি পর্দা। সামনে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে সরে গেল সেটা…

তাইতো, সে হাঁটছিল। কল্পনাটা একেবারে বিশ্বাসযোগ্য; মাটিতে পা পড়ছে। তরঙ্গ উঠছে সেখান থেকে। পায়ে মাটির ঈষৎ কোমল অনুভূতি হচ্ছে। কোথায় হারিয়ে গেল বাজনাটা, বোঝা যায় না। চারধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল বৃক্ষরাজি। ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড। কে জানে, এখনো তারা এই পৃথিবীর কোনো না কোনো জায়গায় উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে কিনা হাজার বছরের প্রযুক্তিগত বিবর্তনের পথ পেরিয়ে।

আস্তে আস্তে বেড়ে যায় চলার গতি। সময়ও যেন বয়ে যাচ্ছে দ্রুতলয়ে। আরো গতি বাড়ে। আরো, আরো। গতি বাড়ানোর চেষ্টার যে একটা ধাক্কা আছে সেটা গায় লাগছে না। যেন অন্য কোনো মানুষের গায়ে ভর করেছে প্রেতাত্মা হয়ে। উত্তেজনাটা থিতিয়ে এল একটা ভাবনার সাথে, তার এসব কাজে তো নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই! থামা বা দিক বদলানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হল না।

তাতে কিছু এসে যায় না। সে এ মাদকতায় চুর হয়ে যাচ্ছে। এ ছুটাছুটি ভাল লাগছে তার। সেই ‘ড্রিম মেশিন’ যেটার আশায় বুক বেধে ছিল তার আমলের অনেক বিজ্ঞানী, সেটা এখন হাতের মুঠোয়। পোল ভেবে পায় না কী করে মানুষ সারভাইভ করল, তাকে জানানো হয়েছিল যে মানবজাতির বেশিরভাগই টিকে যেতে পারেনি। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মস্তিষ্ক জ্বলে গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল তারা অতলে।

অবশ্যই, সেসবের দিন অনেক আগে কেটে গেছে। এখন, এই অসাধারণ যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে চিনতে হবে তৃতীয় সহস্রাব্দটাকে। কয়েক মিনিটে এমন সব ব্যাপার মাথায় চলে আসবে যেগুলো আগে আয়ত্ত করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যেত। অবশ্য, সে মাঝে মাঝে, খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে গেলে, ব্রেনক্যাপকে নিখাদ উপভোগের জন্য ব্যবহার করবে….

বনের শেষপ্রান্ত হাজির, সামনে খরস্রোতা এক চওড়া নদী। কোনো প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই নেমে পড়ল সেখানে। চারধারে পানি। পানি গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে আস্তে আস্তে। উঠে যাচ্ছে শরীর ছাড়িয়ে উপরে, আরো উপরে। নেমে যাচ্ছে সে অতলে। সেখানেও স্বাভাবিকভাবেই শ্বাস নেয়া যাচ্ছে দেখে একটু অবাক না হয়ে পারল না। আরো অবাক করা ব্যাপার, ভোলা চোখে মানুষ যেখানে খুব একটা বেশি দেখতে পাবে না এমন এক মাধ্যমে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এই অবাক করা দুনিয়ায় পাশ কেটে চলে গেল একটা ট্রট মাছ। সেটার গায়ের প্রতিটা অংশ স্পষ্ট দেখা যায়।

মৎস্যকন্যা! আসলে, সে সব সময় এমন কোনো প্রাণির দেখা পেতে চাইত, কিন্তু ধারণা ছিল সেগুলো সামুদ্রিক জীব। হয়ত মাঝে মাঝে, কোনো বিশেষ কারণে তারা স্রোতের বিপরীতে উঠে আসে; স্যামনের মতো করে। বাচ্চাদের পাবার জন্য? কোনো প্রশ্ন করার আগেই চলে গেল মেয়েটা; এই যুগান্তকারী তত্তের তোয়াক্কা না করেই।

একটা অর্ধস্বচ্ছ আলোকিত দেয়ালের কাছে এসে শেষ হয়ে গেল নদীটা। ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে এলেই হাজির হয় ধু ধু মরুভূমি। উপরে গনগনে সূর্য দীপ্তি ছড়াচ্ছে। চিড়বিড় করে ওঠে শরীর। জ্বালা ধরে যায় ভিতরে। তার পরও, প্রখর দুপুরের বুক চিরে দৃষ্টি ফেলা সম্ভব।

সব মিলিয়ে গেল মিশকালো অন্ধকারে। ভূতুড়ে বাজনা ফিরে এল আবার। ফিরে এল ঘরের শান্ত, শীতল আবহাওয়া। চোখ খুলল সে (এতক্ষণ এগুলো বন্ধ ছিল তো?)। অবাক ব্যাপার, তার রিএ্যাকশন দেখার জন্য অনেকেই ভিড় করে আছে।

‘ওয়ান্ডারফুল,’ আটকে রাখা দম ছাড়ল সে, কিছু কিছু অংশ বাস্তবের চেয়েও বাস্তব।

এবার ইঞ্জিনিয়ারের কাছে চলে গেল তার দৃষ্টি।

‘অনেক ডাটা দেয়া যায় এর মাধ্যমে, মানি। কিন্তু কীভাবে সেগুলোকে স্টোর করা হয়?

‘এ ট্যাবলেটগুলোয়। আপনাদের অডিওভিজুয়াল সিস্টেম যেগুলো ব্যবহার করত, তেমনি, শুধু অনেক বেশি ক্ষমতাবান।

ব্রেইনম্যান হাতে ধরিয়ে দিল একটা ছোট চৌকো জিনিস, সম্ভবত কাঁচের তৈরি। এক পাশে রূপার পরত দেয়া। যৌবনের কম্পিউটার ডিস্কেটের মতো। পুরুত্ব দ্বিগুণ। সামনে পিছনে নিল সেটাকে পোল। ভিতরের জায়গাটায় রঙধনুর মতো আলোর খেলা। এই সব।

হাতের মুঠোয় হাজার বছরের ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল টেকনোলজির সর্বকনিষ্ঠ উপহার। আকৃতিটা নিয়ে প্রথমে একটু খটকা লাগে। আকৃতির খুব একটা হেরফের হয়নি কেন? কিন্তু এরও একটা ব্যাখ্যা থাকে। প্রতিদিনের জিনিসগুলোর একটা নির্দিষ্ট আকৃতি তো থাকবেই। ছুরি, কাঁটাচামচ, বই, হ্যান্ড টুল, আসবাব পত্র- আর কম্পিউটারের রিমুভেবল মেমোরি।

‘এর ক্যাপাসিটি কতটুকু? আমাদের আমলে এটুকু আকৃতিতে টেরাবাইট রাখা যেত। আশা করি আপনারা আরো অনেকটা এগিয়ে নিয়েছেন ব্যাপারটাকে।’

না, যতটা আপনি কল্পনা করতে পারেন, এখানে একটা সীমাবদ্ধতা কাজ করে; নির্ভর করছে বস্তুটার উপর। বাই দ্য ওয়ে, টেরাবাইটটা কী? ভুলে গেছি।

‘শেম অন ইউ। কিলো, মেগা, গিগা, টো… টেন টু দ্য টুয়েত্ব বাইট। তারপর পেটাবাইট- টেন টু দ্য ফিফটি- এর উপরে কিছুর কথা জানি না।

‘মোটামুটি এখান থেকেই আমাদের হিসাব শুরু। এক জীবনে একজন মানুষ যা চায় তার সবটুকু এতেই রেকর্ড করে রাখা সম্ভব।

আশ্চর্য করা ভাবনা। তবু, এতে অবাক হবার মতো তেমন কিছু নেই। কেজিখানেক জেলি যে মানুষ তার খুলির ভিতরে লুকিয়ে রাখে তার চেয়ে অনেক বেশি আছে হাতের তালুতে বন্দি এ জিনিসটার গায়ে। আসলেই, একটু একটু সব চেখে দেখতে গেলেও মানুষের জীবনটা ফুং করে উড়ে যাবে।

এই সব নয়,’ বলে যায় ব্রেইনম্যান, কিছু ডাটা কম্প্রেস করে এটা শুধু মেমোরি স্টোর করতে পারে না- পারে আসল মানুষটাকে জমা করে রাখতে।

আর তাদের রিপ্রোডিউসও করতে পারে?

‘অবশ্যই; ন্যানো এ্যাসেমব্লির কাছে বাঁ হাতের খেল।

তাই আমি শুনেছিলাম, ভাবে সে, কিন্তু কখনো বিশ্বাস করিনি।

তার আমলে এটুকুতেই মানুষ সন্তুষ্ট ছিল যে একজন মানুষের সমস্ত জীবনের কাজ হোট ডিস্কেটে আটকে রাখা যেত।

কিন্তু আজকের দিনে এরা শুধু কাজটাকেই ধরে রাখতে পারে না, চিরঞ্জীব করে তুলতে পারে স্বয়ং শিল্প স্রষ্টাকেও।

৭. ডিব্রিফিঙ

‘আমি খুব খুশি,’ বলল পোল, ‘যে, এই এত শতাব্দি পরেও স্মিথসোনিয়ান এখনো বেঁচে আছে।’

‘আপনি সম্ভবত এটা বুঝে উঠতে পারবেন না,’ বলল নিজেকে ডক্টর এ্যালিস্টার কিম নামে পরিচয় দেয়া এ্যাস্ট্রোনটিক্সের ডিরেক্টর লোকটা, বিশেষত যখন এটাকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে পুরো সৌরজগত জুড়ে। মূল অফ-আর্থ কালেকশন রাখা হয়েছে চাঁদ আর মঙ্গলের বুকে। বেশিরভাগ এক্সিবিট, যা আসলেই আমাদের মালিকানাধীন, চলে যাচ্ছে তারার রাজ্যে। একদিন তাদের ধরে ফেলব আমরা। তারপর ফিরিয়ে আনব আপন দেশে। এমনকি সৌরজগতের বাইরে মানুষের পাঠানো প্রথম বস্তু পাইয়োনিয়ার টেনের উপর কজা করারও অনেক ইচ্ছা ছিল আমাদের।’

‘মনে হয় আমিও সে কাজই করতে যাচ্ছিলাম, মহাশূন্যে ভেসে ভেসে। তার পরই তো তারা নাগালে পেয়ে গেল আমাকে।

‘আপনার এবং আমাদের সবার সৌভাগ্য। না জানা অনেক ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন আপনি নিঃসন্দেহে।

ফ্র্যাঙ্কলি বলতে গেলে, সন্দেহ আছে পারব কিনা। তবে চেষ্টা করব। রানওয়ে পোডটা গলাধাক্কা মেরে বের করে দেয়ার পর আর কিছুই মনে নেই আমার। বিশ্বাস হয় না ব্যাপারটা। তারা তো বলেছিল, হাল নির্ভরযোগ্য।

‘কথা সত্যি। কিন্তু কাহিনীটা অনেক প্যাচানো। বলে বোঝানো যাবে না এক কথায়। আপনি জানেন, ডেভ বোম্যান আপনার জন্য শিপের বাইরে গিয়েছিল? তারপর হাল তাকে ভিতরে ঢুকতে দিতে চায়নি।

‘কেন, ফর গডস সেক?

একটু যেন সঙ্কুচিত হয়ে গেল ডক্টর কিম। আগেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে পোল।

(ভাষায় সংযত হও, ফ্র্যাঙ্ক পোল। এ যুগে ‘গড’ শব্দটা খুব একটা প্রচলিত নয় বোঝা যাচ্ছে- ইন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করতে হয়।)

হালের ইন্সট্রাকশনে একটা বড় ধরনের প্রোগ্রামিং ক্রটি ছিল। মিশনের এমন সব ব্যাপার তার জানা ছিল যা আপনি বা ডেভ বোম্যান কেউ জানতেন না। রেকর্ডিংয়ে সব পাবেন…

যাই হোক, সে একই সাথে তিনজন হাইবারনটের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমও কাট অফ করে দেয়। তারাই ছিল আলফা ক্রু। বোম্যান তাদের দেহেরও সদগতি করে।

(ওরে বাবা! তাহলে আমি আর ডেভ বেটা কু? দ্বিতীয় স্তরের? আরো একটা ব্যাপার যা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই…)

‘তাদের কী হল? প্রশ্ন তুলল পোল, আমার মতো করে উদ্ধারের কোনো আশা ছিল না?

‘আই এ্যাম এ্যফ্রেইড, না। চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। হালের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কয়েক ঘন্টা পর বোম্যান তাদের ইজেক্ট করে। আপনার অর্বিট থেকে তাদেরটা সামান্য এদিক সেদিক হয়ে গিয়েছিল। বৃহস্পতির গায়ে পড়তে পড়তে ভস্ম হয়ে যাবার জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। অথচ আপনার কক্ষপথ কী করল জানেন? বৃহস্পতির অভিকর্ষকে কাজে লাগিয়ে আপনাকে অসম্ভব দ্রুতিতে পাঠিয়ে দিল বাইরের দিকে। আর মাত্র কয়েক হাজার বছর পরই চলে যেতেন ওরিয়ন নেবুলার দিকে…

‘তারপর কী করে যে সব ঠিক ঠিক চালাল বোম্যান তা ভাবতেও অবাক লাগে। সময় মতো বৃহস্পতির অর্বিটে নিয়ে গেল ডিসকভারিকে। দেখা পেল দেখা পেল এমন একটা কিছুর দ্বিতীয় অভিযানে যাকে নাম দেয়া হয়েছিল বিগ ব্রাদার। টাইকো মনোলিথের যমজ। শত শত গুণ বড়।

‘এবং ঠিক সেখানেই আমরা হারিয়ে ফেলি তাকে। বাকি স্পেস পোডটায় চড়ে বেরিয়ে গেল ডিসকভারি থেকে। নেমে গেল বিগ ব্রাদারের দিকে। হাজার বছর ধরে আমরা তার সেই শেষ বাক্যের প্রহেলিকায় আটকে আছি, ‘বাই ডিউস- এ তো তারায় তারায় জা!”

(এইতো, পথে এসেছ! পোল বলল নিজেকেই। ডেভ কখনো এমন কথা বলবে না। সে নিশ্চয়ই বলেছিল, মাই গড- এ তো তারায় তারায় ভরা!)

‘বোঝাই যাচ্ছে, পোডটাকে মনোলিথের ভিতরে কোনো অসম্ভব শক্তিশালী বল টেনে নিয়েছিল। কারণ এটা সম্ভবত বোম্যান- এই প্রচন্ড ত্বরণের হাত থেকেও বেঁচে যায় যদিও তার একেবার চূর্ণ হয়ে যাবার কথা। এবং এটুকুই জানা ছিল আমাদের। দশটা বছর ধরে। পরে এল আমেরিকা আর রাশিয়ার যুক্ত অভিযান লিওনভ মিশন।

ফলে সেটা ডিসকভারির সাথে একটা সংযোগ তৈরি করে আর ডক্টর চন্দ্র হালের সাথে মোলাকাত করে। হ্যাঁ, এটুকু আমার জানা আছে।

ডক্টর কিমকে সামান্য অপ্রতিভ দেখায় এবার।

‘স্যরি- আমি ঠিক জানি না কতটা জানানো হয়েছে আপনাকে এর মধ্যেই। আর ঠিক তখন থেকেই অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে শুরু করে।

‘বোঝা গেল, লিওনরে আসার সাথে সাথে বিগ ব্রাদারের ভিতরে কিছু গড়বড় হয়ে যায়। বলা ভাল, সেখানে কোনো ব্যাপার ঘটে। আমাদের কাছে রেকর্ড না থাকলে কেউ কস্মিন কালেও বিশ্বাস করত না ব্যাপারগুলো। আসুন, দেখানো যাক… এখানে আছে ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, ডিসকভারিতে রাতের উপর চোখ রাখছে। আগেই পাওয়ার রিস্টোর করা হয়েছিল। অবশ্যই, সবকিছু চিনতে পারবেন আপনি।

(অবশ্যই পারছি, আর অনেক আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া হেউড ফ্লয়েডকে আমারই সিটে বসে থাকতে দেখতে কী অদ্ভুতই না লাগছে! হালের অপলক লাল চোখটা সর্বক্ষণ চেয়ে নেই।)।

একটা মেসেজ দেখা যায় মনিটরে। অলসভাবে প্রশ্ন তোলে ফ্লয়েড, আচ্ছা, হাল, কে কল করছে?

নো আইডেন্টিফিকেশন।

একটু যেন বিরক্ত হল ফ্লয়েড।

‘ভাল। খুব ভাল। মেসেজটা দাও দেখি।’

এখানে থাকা নিরাপদ নয়। পনের দিনের মধ্যে তোমাদের পাততাড়ি গোটাতে হবে।

‘একেবারে অসম্ভব। এখন থেকে ছাব্বিশ দিনের মধ্যে আমাদের লঞ্চ উইন্ডো খুলবেই না। আগেভাগে ডিপারচার নেয়ার মতো যথেষ্ট প্রোপ্যালান্ট নেই।

এসব ব্যাপারে আমি সচেতন। তবু। পনের দিনের মধ্যে তোমাদের চলে যেতে হবে।

‘প্রেরক সম্পর্কে জানার আগে আমি এ মেসেজের কোনো গুরুত্বই দিতে পারব না… কার সাথে কথা বলছি?

আমি ছিলাম ডেভ বোম্যান। আমার কথায় বিশ্বাস করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পিছনে তাকাও।

খুব ধীরে হেউড ফ্লয়েড তার সুইভেল চেয়ারটাকে ঘোরায়। কম্পিউটার মনিটর সুইচ অফ করে দিয়েছে আগেই। পিছনের ভেলক্রো মোড়া ক্যাটওয়াকে তার দৃষ্টি।

(এবার গুরুত্ব দিয়ে দেখুন।বলল ডক্টর কিম।
আহা, এই কথাটাও যেন আমাকে বলা দরকার, ভাবে পোল…)

যতটা মনে পড়ে পোলের, ডিসকভারির অবজার্ভেশন ডেকের শূন্য অভিকর্ষের এলাকাটায় আগে এত ধূলাবালি গিজগিজ করত না। এয়ার ফিট্রেশন প্লান্ট তখনো মনে হয় ঠিক করা হয়নি। ব্রাউনিয় গতির মোক্ষম নিদর্শন দেখানোর জন্যই যেন দূরের সূর্য থেকে আসা আলোর রেখায় বালিকণাগুলো নেচে বেড়াচ্ছে চঞ্চল হয়ে।

আর এবার, এই কণাগুলোর কী যেন হয়ে গেল। খুব অদ্ভুত একটা কিছু। কোনো শক্তি যেন আধিপত্য বিস্তার করেছে তাদের উপর। সবগুলো কণাকে জড়ো করছে একটা জায়গায়। আস্তে আস্তে ফাঁপা একটা গোলকে পরিণত হল সেগুলো। মিটারখানেক প্রস্থের বুদবুদটা কিছুক্ষণ ভেসে থাকে। আস্তে আস্তে যখন সেটার আকার পরিবর্তন হতে থাকে, বদলাতে থাকে আকৃতি, পোল স্তম্ভিত হয়ে যায়। একটু পর মানুষের আদল নেয়ায় আর খুব বেশি বিস্মিত হয় না সে।

কাঁচের বাইরে এমন সব ফিগার সে আগেও দেখেছে। নানা প্রদর্শনী আর বিজ্ঞান জাদুঘরে। কিন্তু এটা একেবারে নিখুঁত কোনো আকৃতি নিল না। অনেকটা যেন ফিনিশিং টাচ দেয়ার আগের এবড়ো থেবড়ো ভাস্কর্য। প্রস্তর যুগে এমন সব গড়ন তৈরি হত। শুধু মাথাটাকে খুব যত্নে গড়ে তোলা হয়েছে। আর সেই মুখাবয়ব, কোনো সন্দেহ নেই, কমান্ডার ডেভিড বোম্যানের।

হ্যালো, ডক্টর ফ্লয়েড। এবার আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে

আকৃতির ঠোঁটগুলো কখনো নড়েনি। পোল বুঝতে পারে, কঠটা অবশ্যই বোম্যানের, তবে আসছে স্পিকার থেকে।

কাজটা আমার জন্য খুব কঠিন। হাতে সময়ও খুব কম। এ সতর্কবাণী দেয়ার অনুমতি জুটেছে কোনোক্রমে। তোমাদের হাতে সময় মাত্র পনের দিনের।

‘কেন- আর তুমি কী?’

কিন্তু এর মধ্যেই ভূতুড়ে আদলটা হারিয়ে যাচ্ছিল। এর ফাঁপা অবয়ব হারিয়ে যাচ্ছিল আশপাশের সাথে মিশতে মিশতে।

বিদায়, ডক্টর ফ্লয়েড। আমাদের আর দেখা হবে না। কিন্তু আরো একটা মেসেজ আসতে পারে যদি সব ঠিকঠাক চলে।

হারিয়ে যায় ইমেজটা। একটু না হেসে পারে না পোল। তার মুখের কোণে ঝিকিয়ে ওঠে হাসি। যদি সব ঠিকঠাক চলে! সেই পুরনো কথা। মহাকাশ অভিযানে এ কথাটা কতবার কতভাবে কতজনকে যে বলতে হত, তার ইয়ত্তা নেই। হারিয়ে গেল ছবিটা। মিশে গেল ধূলিকণার সাথে। ঘুরে তাকাল ডক্টর কিম। যাক, কমান্ডার- কী মনে হয় আপনার?

এখনো আঁকি কাটিয়ে উঠতে পারেনি পোল। জবাব দিতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে যায়।

‘মুখের আদল আর কষ্ঠ যে বোম্যানের তা আমি কসম কেটে বলতে পারি কিন্তু এটা কী?’

‘ঠিক এ ব্যাপারটা নিয়েই আমরা আজো মাথা কুটে মরছি। একে হলোগ্রাম বলে ডাকতে পারেন। একটা প্রজেকশন, এটুকু নিশ্চিত। কেউ চাইলে সে সময়টাতেও এমন সব মিথ্যা ব্যাপার গড়তে পারত। কিন্তু এ অবস্থায়? অসম্ভব। আর তারপরই, বুঝতে পারছেন কি…?’

‘লুসিফার?’

‘ঠিক তাই। সেই সতর্কবাণীর জন্য ধন্যবাদ। তারা কোনোক্রমে লেজ গুটিয়ে পালায়। আর বিস্ফোরিত হয় বৃহস্পতি।‘

‘তাহলে, সে যাই হোক না কেন, বোম্যানের মতো দেখতে-শুনতে জিনিসটা বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। চেষ্টা করেছিল সাহায্য করতে, তাই না?’

‘মনে হচ্ছে তাই। এখানেই তার আনাগোনা শেষ নয়। হয়ত সেই আরো একটা মেসেজ এসেছিল। আমরা যেন ইউরোপায় নাক গলানোর কোনো প্রকার চেষ্টা না করি সে সম্পর্কে জানান দিতে চেয়েছিল সে।‘

‘আর আমরা কখনো সে চেষ্টা করিনি?’

শুধু একবার, তাও দূর্ঘটনায় পড়ে গ্যালাক্সিকে হাইজ্যাক করে জোর দিয়ে নামানো হল। মাত্র ছত্রিশ বছর পরের ঘটনা। সিস্টার শিপ ইউনিভার্স সেটাকে রক্ষার জন্য যায়। সামান্য কিছু জানতে পেরেছি আমাদের রোবট মনিটরের মাধ্যমে। ইউরোপানদের বিষয়ে এই আমাদের সঞ্চয়।

‘দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি।’

‘তারা উভচর। সব আকার প্রকারে পাওয়া যাবে। লুসিফার তাদের পুরো দুনিয়া জুড়ে থাকা বরফ গলাতে শুরু করল। সাগর থেকে মুখ তুলল তারা। তখন থেকে যে গতিতে উন্নতি করছে, জীববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা বলা চলে একেবারে অসম্ভব।‘

‘আমার যদ্দূর মনে পড়ে, ইউরোপার বরফে অনেক অনেক ফাটল ছিল। হয়ত তারা তখন থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে।

‘এ তত্ত্ব অনেকেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু আরো একটা মত আছে। আরো বেশি বিশ্বাস্য এবং যৌক্তিক। মনোলিথ হয়ত সেখানে কাজে লাগছে। এমন কোনো পথে, যার হদিস আমরা পাইনি। এই চিন্তাকে আরো বেগবান করে টি এম এ জিরো। সেটাকে পাওয়া যায় শ পাঁচেক বছর পরে। কোথায় জানেন? পৃথিবীর বুকে। আশা করি সেটার কথা বলা হয়েছে আপনাকে?’

‘ভাসাভাসা। এত কম সময়ে এতকিছু জানতে চেয়েছি আমি। কিন্তু নামটা বিদঘুঁটে, তাই না? এটা তো কোনো ম্যাগনেটিক এ্যানোমালি নয়। তার উপর অবস্থান ছিল আফ্রিকায়, টাইকোর বুকে না।‘

‘আপনার কথা পুরোপুরি সত্যি, কিন্তু নামটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে। সমস্যা হল, মনোলিথের পানি যত নাড়তে যাই ততই ঘোলাটে হয়ে ওঠে। অন্তত এখনো পৃথিবীর বাইরের এ্যাডভান্সড টেকনোলজির নিদর্শন তারাই।

ব্যাপারটা আমাকে চমকে দিচ্ছে। আমি মনে করেছিলাম এ্যাদ্দিনে আমরা তাদের কাছ থেকে রেডিও সিগন্যাল পেয়ে গেছি। আমি একেবারে বাচ্চা ছেলে থাকার সময় এ্যাস্ট্রোনোমাররা এ খোঁজ শুরু করে।’

‘আসলে, একটা ইশারা এসেছিল। কিন্তু ইশারাটা এত বেশি ভয়ানক যে আমরা এসব নিয়ে আলাপ করতেও ভয় পাই। কখনো নোভা স্করপিওর কথা শুনেছেন?’

‘মনে হয় না।’

‘তারকারা নোভায় পরিণত হয় সব সময়, আর এটা খুব বেশি ভাল কিছু ছিল । কিন্তু এটা ধ্বসে যাবার আগে এন স্করপিওতে অনেক গ্রহ থাকার ব্যাপারটা ধরা পড়ে।’

‘এবং সেখানে বসবাস করা হত?

‘বলার আর কোনো উপায় নেই; রেডিও সার্চাররা কোনো কিছুই ধরতে পারেনি। এবং এখানেই দুঃস্বপ্নটার শুরু…

‘সৌভাগ্যক্রমে একটা স্বয়ংক্রিয় নোভা প্যাট্রল ব্যাপারটাকে ধরতে পেরেছিল একেবারে গোড়াতেই। ঘটনার শুরু অকল্পনীয়। নক্ষত্রেই হবার কথা, তাই না? তা। হয়নি। হয়েছে একটা গ্রহ থেকে। সেই গ্রহ নক্ষত্রটাকে এবং পুরো জগৎকে ধ্বংস করেছে।’

‘মাই গড… স্যরি! বলে যান।‘

ব্যাপারটাকে কি আপনি ধরতে পারছেন? একটা গ্রহের পক্ষে নোভায় পরিণত হবার কোনো উপায় নেই। কোনোই উপায় ছিল না। পরে… আমরা যেহেতু জানি, একটা উপায় আছে।

‘আমি একবার এক সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসে সস্তাদরের কৌতুক পড়েছিলাম সুপারনোভাই (supernovae) হল ইন্ডাস্ট্রিয়াল এ্যাক্সিডেন্ট।

‘না-না। কোনো সুপারনোভা ছিল না। কিন্তু কথাটা হয়ত কৌতুক নয়। সবচে গ্রহণযোগ্য মতবাদ হল, অন্য কেউ ভ্যাকুয়াম এ্যানার্জি ট্যাপ করছিল। তারপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।‘

‘অথবা যুদ্ধ।‘

‘একই কথা; কে জানে, কোনোদিন জানতে পারব কিনা! কিন্তু যেহেতু আমাদের সভ্যতাও একই ধরনের শক্তির উৎস ব্যবহার করে, আপনি বুঝতেই পারছেন কেন এন স্কৰ্প মাঝে মাঝে আমাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ফেলে দেয়।‘

‘আর আমাদের শুধু গলতে থাকা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর আছে যা নিয়ে আমরা ভাবিত হতে পারি, তাই না?’

‘এখন আর না, থ্যাঙ্ক ডিউস। কিন্তু আমি আপনাকে টি এম এ জিরোর আবিষ্কারের ব্যাপারে আরো বলতে চেয়েছিলাম, কারণ এটা মানব ইতিহাসের সবচে বড় মোড়ের মধ্যে একটা।

‘টি এম এ এক পাবার পর মানুষ যথেষ্ট ঝাঁকি খেয়েছে। কিন্তু পাঁচশ বছর পর সেটা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয় টি এম এ জিরো আবিষ্কারের সাথে সাথে। এটা বাসার অনেক কাছে। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, এইতো, নিচে, আফ্রিকার বুকে। রীতিমত আতঙ্কের ব্যাপার, তাই না?

৮. ওলডুভাইয়ে ফিরে দেখা

এই লিকিরা, নিজেকেই শুনিয়ে বলে ডক্টর স্টিফেন ডেল মার্কো মাঝে মাঝে, হয়ত কখনোই এ জায়গাটা চিনতে পারত না, যদিও পাঁচ শতাব্দি আগে লুইস আর মেরি আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষকে খুঁড়ে তুলে এনেছিল এখান থেকে মাত্র বারো কিলোমিটার দূরে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর ছোট্ট আইস এজটা বদলে দেয় ভূ-চিত্র। যদিও অসম্ভব অগ্রসর টেকনোলজির সহায়তায় সরিয়ে দেয়া হয়েছিল বরফ যুগকে, তবু তার প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে চারপাশের দৃশ্যপট। ওক আর পাইন গাছেরা এখনো যুঝছে; জানে না প্রতিকূল পরিবেশে কে টিকে যাবে শেষ পর্যন্ত।

ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কষ্টকর যে এই ২৫১৩ সালেও অতি উৎসাহী এ্যানথ্রোপোলজিস্টদের খোঁড়াখুঁড়ির হাত থেকে ওলডুভাইয়ে কিছু বেঁচে আছে। যাই হোক, সাম্প্রতিক ঝড়ো বন্যায়, যা হবার কথা ছিল না, তার কবলে পড়েই, উপরের দিকের কয়েক মিটার মাটি ক্ষয়ে যায়। ডেল মার্কো এ সুযোগটাই নেয়। তারপর, সেখানে সামান্য ডিপ স্ক্যান করে যা দেখতে পায় তা ঠিক বিশ্বাস্য নয়।

এক বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে গহিন খনন চলল, চলল সাবধান পর্যবেক্ষণ, তিলতিল করে। কখনো কল্পনা করতেও যা বাধে তার চেয়ে বেশি অদ্ভুত এই বাস্তবতা, ভেবে হয়রান হয় সে। রোবট ডিগিঙ মেশিনগুলো খুব দ্রুত প্রথম কয়েক মিটার খুঁড়ে ফেলল। এবার ট্র্যাডিশনাল গ্র্যাজুয়েশন ছাত্রদের দাস-দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের সাথে কাজ করেছিল চারটা কঙ। দানবীয় কঙ। ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখেনি ডেল মার্কো। কিন্তু ছাত্রেরা জেনেটিক্যালি মডিফাইড গরিলাগুলোকে মনে করে নিজেদের দস্যি ছেলে। এমনকি গুজব উঠেছিল যে তাদের এই ভালবাসার খেলাটা পুরোপুরি তুলসী পাতায় বোয়া না।

প্রথম কয়েক মিটারের কথা। পুরো কাজটাই মানুষের হাতের। সামান্য টুথব্রাশ ব্যবহার করেই তাদের মাটি খুঁড়তে হয়। খুঁড়তে হয় বললে ভুল বলা হবে, মাটিকে তোয়াজ করে করে ধুলা উড়াতে হয়। একটু একটু করে। অনেক অনেক সময় নিয়ে। এবার কাজটা শেষ হল; যেন হাওয়ার্ড কার্টার তুতেনখামেনের সমাধিমন্দিরের ভিতরে থাকা স্বর্ণসম্ভারের ঝলক দেখতে পাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই নিশ্চিত হয়ে গেল ডেল মার্কো, মানবেতিহাসের পাতায় পাতায়, মূল্যবোধ আর দর্শনের পথে পথে নতুন মোড় সৃষ্টি হবে। বদলে দিতে হবে অনেক কিছুই।

পাঁচ শতাব্দি আগে চাঁদের বুকে আবিস্কৃত মনোলিথ টি এম এ একের সাথে এর অনেক অনেক মিল। হুবহু একই রকম। কাজেও একই। আলল শুষে নিচ্ছে। বুভুক্ষুর মতো শুষে নিচ্ছে সর্বক্ষণ। লুসিফারের ক্ষীণ আলো কি সূর্যের খরতাপ, কোনোটাই তার গা থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নিয়ে আসতে পারে না।

সে, তার কলিগেরা, পৃথিবীর সবচে বিখ্যাত আধ ডজন জাদুঘরের ডিরেক্টর, উজ্জ্বলতম তিন এ্যানথ্রোপোলজিস্ট, সবচে বড় মিডিয়া সাম্রাজ্যের দুই কর্ণধার সেই গর্তের ভিতরে, একেবারে নিশ্চুপ হয়ে আছে। ডেল মার্কো জানে না এত বেশি দামি মানুষ এতক্ষণ একসাথে চুপ করে কখনো ছিল কিনা।

এখানে, চারপাশে যেখানে মানুষ, আদিম মানুষ, মানুষের পূর্বপুরুষ, নানা আদিম জন্তু জানোয়ার ফসিল হয়ে আছে সেখানে, সেসবের নিচে যাকে পাওয়া গেল তার কথা ভাবা সম্ভব হয় কীভাবে?

এখানেই- সময় এবং স্থানের হিসাবে ঠিক এখানেই- মানব সম্প্রদায়ের পথচলা শুরু হয়েছিল।

আর এই মানবজাতির শত সহস্র ঈশ্বরের মধ্যে এই মনোলিথই প্রথম।

৯. স্কাইল্যান্ড

‘কাল রাতে আমার বেডরুমে ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি করেছে,’ মৃদু স্বরে অভিযোগ করল পোল, ‘একটা বিড়াল যোগাড় করা যায় নাকি কোনোমতে?’

ডক্টর ওয়ালেসের চোখেমুখে বিভ্রান্তি। তারপর হঠাৎ হাসির দমকে ভেঙে পড়ল সে।

‘তুমি নিশ্চয়ই কোনো ক্লিনিং মাইক্রোটের আওয়াজ পেয়েছ- আমি প্রোগ্রামিং চেক করে রাখব যেন সেগুলো তোমাকে না জ্বালায়। সাবধান, কোনোটাকে ধরে ফেললে আবার পা দিয়ে চেপে ধরো না। তাহলেই কর্ম সারা। সে সহায়তার জন্য খবর পাঠাবে আর সব বন্ধু চলে আসবে চটজলদি।’

অনেক শিখতে হবে অনেক কম সময়ে। না, ভাবনাটা ঠিক নয়, ধমকায় পোল নিজেকে। সামনে হয়ত আরো একটা শতাব্দি পড়ে আছে- এ যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ। দীর্ঘজীবী হয় মানুষ। চিন্তাটা তাকে আনন্দের বদলে বিমর্ষ করে তোলে।

এতদিনে সে অন্তত বেশিরভাগ কথা বুঝে উঠতে শিখেছে, উচ্চারণ করতে শিখেছে এমন সব শব্দ যাতে তার কথা শুধু ইন্দ্রাই বুঝতে পারে না, বুঝে উঠতে পারে আরো কেউ। তার অনেক ভাল লাগে এই জেনে যে এ্যাংলিশ এখনও পৃথিবীর ভাষা যদিও ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান আর মান্দারিন সুপ্ত হয়ে যায়নি, বেঁচে আছে সগর্বে।

‘আমার আরো একটা সমস্যা আছে, ইন্দ্রা- আর যন্দুর মনে হয় একমাত্র তুমিই সহায়তা করতে পার। যখন আমি “গড” শব্দটা উচ্চারণ করি, মানুষ এত কুঁকড়ে যায় কেন?’

ইন্দ্রাকে ততটা অপ্রস্তুত মনে হয় না, বরং হেসে কুটিপাটি হয় সে।

‘কাহিনীটা অনেক জটিল। আহা, আমার পুরনো বন্ধু ডক্টর খান যদি এখানে থেকে তোমাকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারত। কিন্তু সে এখন লেগে আছে গ্যানিমিডের পিছনে। সেখানে যে ক’জন সত্যিকারের বিশ্বাসীর খোঁজ পাবে তাদের যত্ন আত্তি করবে। সারিয়ে তুলবে মনের ক্ষত। যখন সব পুরনো ধর্মগুলো ধ্বসে পড়তে শুরু করল- ধরা যাক পোপ বিংশ পিউসের কথা- ইতিহাসের সবচে বড় মানুষদের একজন!- আমাদের এখনো একজন প্রাইম কজকে খুঁজে বের করতে হবে, যে কারণ সৃষ্টি করেছে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড- যদি কেউ থেকে থাকে আর কী…

‘অনেক সাজেশন এল- ডিও-পিও-জোভ-ব্রাহ্ম- তাদের সবাইকে নিয়ে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হল না… কোনো কোনো শব্দ এখনো টিকে আছে আশপাশে। এমনকি আইনস্টাইনের প্রিয় “সেই পুরনো জন” উক্তিটাও চলে ঈশ্বর বোঝতে। কিন্ত কেমন করে যেন ডিউস চলতি ফ্যাশন হয়ে গেল এবার।’

‘মনে রাখার চেষ্টা করব, কিন্তু আমার কাছে এখনো বেখাপ্পা লাগছে যে!’

তুমি অভ্যস্ত হয়ে যাবে। কোনো চিন্তা নেই। আরো কয়েকটা ভদ্রোচিত শব্দ আর প্রকাশ দেখিয়ে দিতে পারব। আস্তে আস্তে সেগুলোও ধাতে সয়ে যাবে…’

বলছ সব পুরনো ধর্ম ধুয়েমুছে গেছে? তাহলে আজকাল মানুষ কী বিশ্বাস করে? যত কম সম্ভব। আমরা সবাই আজকাল ডেইস্ট অথবা থেইস্ট।

‘আমার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছ। সংজ্ঞা দাও দেখি।

‘তোমাদের আমলে যেমন ছিল সেটা আর এখন এমন নেই। থেইস্ট বিশ্বাস করে একের বেশি ঈশ্বর নেই, ডেইস্টরা মনে করে একের কম ঈশ্বর নেই।’

ব্যাপারটা আমার কাছে খুব বেশি স্পষ্ট হল না তো?

সবার কাছে স্পষ্ট নয়। পাঁচ শতাব্দি আগের কথা শুনে অবাক হবে। কে যেন রিয়াল ম্যাথমেটিক্স ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে থেইস্ট আর ডেইস্টদের মধ্যে অসীম সংখ্যক শ্রেড আছে। যাই হোক, আমেরিকানরা সবচে বেশি পরিচিত ডেইস্ট- ওয়াশিংটন, ফ্র্যাঙ্কলিন, জেফারসন।

‘আমার সময়ের একটু আগে, তুমি বিশ্বাস করবে না, অনেক মানুষই এসব বুঝতে পারত না।’

‘এখন, আমার হাতে কয়েকটা ভাল খবর আছে। জো- প্রফেসর এ্যান্ডারসন অবশেষে দিয়ে দিয়েছে তার ফ্রেজটা যেন কী? ওকে। স্থায়ী কোয়ার্টারে তোমাকে এখন নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।’

খবরটা আসলেই ভাল। এখানে সবাই ভাল ব্যবহার করেছে আমার সাথে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে নিজের একটা বাসা চাই না তা কে বলল?

‘তোমার নতুন জামা কাপড় দরকার। কেউ একজন জানিয়ে দিবে কী করে সেগুলো পরতে হয়। প্রতিদিনকার শত শত সময় নষ্ট করা কাজ শিখিয়ে দিবে, সময় নষ্ট করতে যেগুলোর কোনো জুড়ি নেই। তাই তোমার জন্য একজন পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট যোগাড় করার স্বাধীনতা পেয়েছি। এস, দানিল…’।

মধ্য ত্রিশের কোটার ছোটখাট অবয়বের এক লোক এই দানিল। গায়ের রঙ বাদামি। সে শুধু পাম টু পাম স্যালুটই দিল না, সেই সাথে অটোম্যাটিক ইনফরমেশন এক্সচেঞ্চও করল। বোঝা গেল, দানিলের কোনো আইডেন্ট নেই; কখনো প্রয়োজন পড়লে সে একটা চৌকো প্লাস্টিকের কার্ড তৈরি করে নেয়, একবিংশ শতাব্দিতে যেগুলোকে স্মার্ট কার্ড বলা হত তেমন কিছু আর কী।

‘দানিল তোমার গাইডও হবে- আর কী সেই শব্দটা? কখনো সময়মত মনে পড়ে না- “ব্যালের সাথে কবিতা। সে এ কাজে বিশেষ ট্রেনিং পেয়েছে। আমি নিশ্চিত তার সাথে পুরোপুরি সন্তষ্ট হতে পারবে।

হাসি পেল পোলের। সেই সাথে একটু অস্বস্তিতেও পড়ে গেল। ভ্যালে বা ভদ্রলোকের সহায়ক, সোজা কথায় চাকর রাখার চল সে সময়টাতেই একেবারে কমে এসেছিল। যেন সে বিংশ শতাব্দির প্রথমদিকের কোনো উপন্যাসের চরিত্র।

‘দানিল তোমার যাবার যোগাড়যন্ত্র করতে করতে আমরা একটু উপর থেকে ঘুরে আসব, চলে যাব লুনার লেভেলে।

দারুণ! কত উপরে?

‘ও… প্রায় বারো হাজার কিলোমিটার হবে।

বারো হাজার! ঘন্টার পর ঘন্টা লেগে যাবে!

প্রথমে ইন্দ্রা অবাক হল। হাসল তারপর।

না, যত ভাবছ তত সময় কখনো লাগবে না। তাই বলে ভেবোনা, আমরা স্টার ট্রেক মার্কা ট্রান্সপোর্টার বানিয়ে ফেলেছি- তবু, কাজ চলছে যে সেসব নিয়ে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তো, তোমার এখন বেছে নিতে হবে, অবশ্য আমি জানি, কী বেছে নিবে তুমি… একটা এক্সটার্নাল এলিভেটর ধরে উঠে যেতে পার, দেখতে পার বাইরের দৃশ্যগুলো, কিম্বা ধরতে পার কোনো ইন্টারনাল লিফট। একটু খেয়ে নিতে নিতে কিছু লাইটভিউ দেখতে পার সময়টাতে।

‘কেউ ভিতরে থেকে উঠতে চাইবে তা তো কল্পনাও করতে পারি না আমি।

‘তুমি অবাক হবে। কোনো কোনো মানুষের কাছে ব্যাপারটা এত বেশি উচ্চতাভীতিকর যে তারা আঁৎকে ওঠে। বিশেষ করে যেসব ভিজিটর আসে নিচের তলাগুলো থেকে তাদের কথা বলতে পার। এমনকি পর্বতারোহীদের উচ্চতাগর্বও মিনমিনে হয়ে যায় মাঝে মাঝেই।’

‘আমি এ ঝুঁকিটুকু নিচ্ছি। এর চেয়ে উপরে ওঠার অভিজ্ঞতা আছে আমার।

দু সেট এয়ারলকের ভিতর দিয়ে গিয়ে টাওয়ারের এক্সটেরিয়র ওয়ালে যাবার পর যেখানে গেল তারা সেটাকে খুব ছোট কোনো থিয়েটারের অডিটরিয়াম বলে চালানো যায়। ভিতরে থরে বিথরে সাজানো সিট। বসে আছে অনেকে। পোলের মনে কেন যে লক্ষ কোটি টন বাতাসের চাপের কথা উঠল যেগুলো স্পেসের গায়ে হারিয়ে যাবার জন্য পাগল হয়ে আছে।

জনা বারো প্যাসেঞ্জারকে একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক লাগল। তাদের মনের জগতেই যেন সেসব চিন্তা নেই। সবাই চিনতে পারছে তাকে। একটা দ্ৰ হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে ঠোঁটে। একটু নড করেই ঘুরিয়ে নিয়েছে মাথা বাইরের দিকে।

‘ওয়েলকাম টু স্কাইলাউঞ্জ,’ বলল সেই অপ্রতিরোধ্য অটোভয়েস, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে আরোহন শুরু হচ্ছে। নিচতলায় রিফ্রেশমেন্ট আর টয়লেট পাবেন আপনারা।

কিন্তু এ ভ্রমণে ঠিক কতটা সময় লাগবে? ভেবে পায় না পোল। আমরা উঠতে আর নামতে গিয়ে বিশ হাজারে বেশি কিলোমিটার পেরিয়ে যাব। আমার পৃথিবীতে এসব কথা ভাবাও পাপ ছিল…

উপরে ওঠা শুরু হবে, অপেক্ষা করছে সে। দু হাজার কিলোমিটার নিচের বিবশ করা চিত্রটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। উত্তর গোলার্ধে এখন শীত। কিয় পরিবেশ যে অনেকটা বদলে গেছে তার প্রমাণ, বিষুব রেখার নিচে বরফের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।

ইউরোপের আকাশে কোনো মেঘ নেই। এত বিস্তৃত দেখা যাচ্ছে সবকিছু যে চোখ আর সহ্য করতে পারে না। একের পর এক বিশাল মহানগরীর চিহ্ন চোখে পড়ে যেগুলো শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিল। শহরগুলো ছোট হতে শুরু করে তার সময় থেকেই যখন কম্যুনিকেশন টেকনোলজি পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিতে শুরু করে। আরো বিচিত্র সব ব্যাপার চোখে পড়ে। সাহারার বুকে লেক সালাদিন এখন আর কোনো হ্রদ নয়, পুরোমাত্রায় সাগরের মতো বলা চলে।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পোল ভুলে গেল সময়ের কথা। হঠাৎ খেয়াল হয়, পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে কিন্তু এলিভেটরের নড়ার নামগন্ধও নেই।

কোনো সমস্যা নাকি? নাকি অন্য কিছুর জন্য অপেক্ষা চলছে।

এরপর সে এমন অদ্ভুত কিছু চোখে দেখতে পেল যা অস্বীকার করার তীব্র ইচ্ছা জাগে প্রথমে। পৃথিবীর ফ্রেমটা উঠে আসছে আস্তে আস্তে। নিচের দৃশ্যগুলো এখন অনেক বেশি বিস্তৃত। তাহলে কি তারা নিচে নামছে।

হেসে ফেলল পোল। স্বাভাবিক ব্যাখ্যাটা মনে পড়ে গেছে চট করে।

“আর একটু হলেই বোকা বানিয়ে ছেড়েছিলে, ইন্দ্রা। মনে করেছিলাম এটা বাস্ত ব, কোনো ভিডিও প্রজেকশন নয়।

চাপা হাসি মুখে নিয়ে তার দিকে চোখ তুলল ইন্দ্রা।

‘আবার ভেবে দেখ, ফ্র্যাঙ্ক। মিনিট দশেক হয়ে গেছে আমাদের চলার। এতক্ষণে আমাদের গতি ঘন্টায় হাজারখানেক কিলোমিটার। যদিও এ এলিভেটরগুলোয় একশ জি’র বেশি উঠে যায় তৃরণ, আমাদেরটা দশের বেশি হবে। না। এত ছোট দূরত্বে এর চেয়ে বেশি ওঠার সুযোগ নেই।

‘অ-অসম্ভব। সেন্ট্রিফিউজে তারা আমাকে বড়জোর ছ জি দিয়েছিল। চিন্তা কর, ওজন বেড়ে গেল দু গুণ! আধ টন ওজন নিয়ে আমার খুব একটা যুত হয়েছিল তা কি বলতে পারি না। ভিতরে ঢোকার পর থেকে যে আমরা নড়িনি এটুকু হলপ করে বলতে পারি।’

পোলের কণ্ঠ একটু উঁচু মাত্রায় চড়ে আবার সরসর করে নিচে নেমে এল। আশপাশের যাত্রিরা কথা না শোনার ভাণ করছে।

‘আমি ঠিক বুঝি না কী করে ব্যাপারটা করল তারা, ফ্র্যাঙ্ক। নাম দিয়েছিল ইনাটিয়াল ফিল্ড। সম্ভবত শার্প নামে ডাকে- এস অক্ষরটা বিখ্যাত রাশিয়ান বিজ্ঞানী শাখাররে প্রতিনিধিত্ব করে- বাকিগুলো যে কী কে জানে।

আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে এল পোল। এখানে নিশ্চয়ই জাদু থেকে ভিন্ন করা যাবে না এমন এক টেকনোলজি ব্যবহার করেছে তারা।

‘আমার কয়েকজন বন্ধুর মনে ‘স্পেস ড্রাইভ’ এর স্বপ্ন ছিল- এমন এনার্জি ফিল্ড যেগুলোকে রকেটের বদলে কাজ করবে, এমনভাবে নড়বে যেন গতিবৃদ্ধি টের পাওয়া না যায়। আমরা প্রায় সবাই তাদের পাগলাটে ভাবতাম। কিন্তু তাদের কথাই যে ঠিক তা আমাকে দেখে যেতে হল। এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না… আর, যদি ভুল না হয়ে থাকে তো, আমরা আসলে আস্তে আস্তে ওজন হারাচ্ছি।’

হ্যাঁ- চান্দ্র ভ্যালুর সাথে মানিয়ে নিচ্ছে। বাইরে বেরুনোর পর তোমার মনে হবে আমরা চাঁদের বুকে আছি। কিন্তু কল্যানের কসম, ফ্র্যাঙ্ক- তোমার ইঞ্জিনিয়ার হবার কথাটা ভুলে গিয়ে চিত্রটা উপভোগ কর।

উপদেশটা ভাল। আফ্রিকা আর ইউরোপের পুরোটা এবং এশিয়ার অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। মন বিবশ হয়ে যেতে চায়। পোল প্রস্তুত ছিল অনেকটাই। ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার লম্বা ও কয়েক কিলোমিটার চওড়া গগনচুম্বী অট্টালিকার কথা ভুলতে পারছে না কিছুতেই।

রকেটের যুগ নিশ্চয়ই কয়েক শতাব্দি আগে হারিয়ে গেছে। প্রোপ্যাল্যান্ট সিস্টেম আর কমবাশন চেম্বার বিষয়ক তার সমস্ত জ্ঞান- আয়ন প্রাস্টার আর ফিউশন রিএ্যাক্টরের সমস্ত অভিজ্ঞতা আজ অন্তসারশূন্য। এসবের দিন আর নেই কিন্তু মাস্তুলে বসে থাকা নাবিক যখন বাতাস পড়ে যেতে দেখে, তখন যেমন আহত হয় তেমনি আহত বোধ করে সে।

আস্তে আস্তে মুড বদলে যায়, নিরব হাসিতে ভরে ওঠে মুখটা। অটোভয়েস বলছে, যাত্রা শেষ হতে আর দু মিনিট বাকি। লক্ষ্য রাখুন, আপনার কোনো জিনিস যেন এখানে না থেকে যায়।

কমার্শিয়াল ফ্লাইটগুলোয় এ কথা কতবার শুনতে পেয়েছে সে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল, আধঘন্টাও হয়নি যাত্রার। তার মানে গড় গতি ঘন্টায় বিশ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি! গত দশ মিনিট ধরে তারা এত তীব্র গতিতে মন্দনের শিকার হয়েছে যে সেটা বাস্তবে অনুভব করলে পা ঠেকে থাকত ছাদে আর মাথা হয়ে যেত পৃথিবীমুখো।

নিরবে খুলে গেল দরজা। বাইরে পা রেখে পোল সেই ঢোকার মূহুর্তের মতো একটু এলোমেলো অনুভব করল। এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারে সে, ট্রানজিশন জোন দিয়ে পার হয়েছে যেখানে ইনার্শিয়াল ফিডের উপর প্রভাব ফেলছে গ্র্যাভিটি। এখানে সেটা চাঁদের বুকের মতো।

পা দিয়েই থমকে গেল পোল। সামনের বিশাল অঞ্চলটা প্রাকৃতিক। কোনো দেয়াল নেই ভিতরে। পাঁচ কিলোমিটার দূরে আছে অপর প্রান্তের দেয়াল। কোনো মহাকাশবিদের কাছেও এটা বিস্ময় নিয়ে আসবে নিঃসন্দেহে। চাঁদের বুকে, মঙ্গলের বুকে নিশ্চয়ই এর চেয়ে বড় ঘের দেয়া এলাকা আছে, কিন্তু এটুকু বুকে হাত দিয়ে বলা যায়, মানুষের তৈরি মহাকাশের কৃত্রিম এলাকাগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম বৃহত্তম।

আউটার ওয়ালের কাছে পঞ্চাশ মিটার ভিউয়িং প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে তারা। দেখা যাচ্ছে বিচিত্র কিছু গাছ। বিশাল। প্রথমে চেনা যায় না। পরে বোঝা গেল, ওক। কিন্তু এত বড় কেন? চাঁদের মতো অভিকর্ষে খুব দ্রুত বেড়েছে সেগুলো। তাহলে তালগাছের কী দশা হত। আর জায়ান্ট রিডের কথা ভাবতে গেলে…।

মাঝামাঝি একটা হ্রদ দেখা যাচ্ছে। ছোটখাট। ঘাসে মোড়া সমভূমি থেকে কুলকুল করে ক্ষীণ স্রোতস্বিনী নেমে আসছে সেটার বুকে। একটা ব্যাপার চোখ কেড়ে নেয়। বিশাল দানবীয় গাছ ঝাঁকড়া। নিশ্চয়ই বট! কিন্তু পানির উৎস কোথায়? মৃদু ড্রামের আওয়াজ ভেসে আসছে পোলের কানে। বাকানো গোল হয়ে যাওয়া দেয়াল ধরে সামনে তাকাতেই রহস্য ধরা দিল। ছোটখাট নায়াগ্রা থেকে পানি ছিটকে পড়ছে। তার উপরে জলকণা নাচানাচি করে অহর্নিশি। একেবারে নিখুঁত রামধনু ঝিকমিক করছে।

ঘন্টার পর ঘন্টা প্রশংসার দৃষ্টিতে এ দৃশ্যগুলো দেখা যায়। নিচের পৃথিবী ছেড়ে আসার পরও মানুষ যে এ বিশাল কৃত্রিম কফিনে পৃথিবীরই ছোট মডেল গড়ে নিবে তাতে আর অবাক হবার কী হল। মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে উকার বেগে। এগিয়ে যাচ্ছে দূর দূরান্তে। তারপরও, নিজের উৎসটাকে কে ভুলতে চায়? অবশ্যই, তার আমলেওতো প্রতিটা মহানগরীতে ছিমছাম উদ্যান ছিল- কৃত্রিমতার দোষে দুষ্ট তার পরও, মানুষ সেখানে গিয়ে হাপ ছেড়ে বাঁচত। সেই কল্পনাই এখানে পবিত হচ্ছে। এখানে, সেন্ট্রাল পার্ক, আফ্রিকা টাওয়ারে।

‘আর কত দেখবে দূর থেকে। কপট রাগ ইন্দ্রার চোখেমুখে, হাসির ভাজে ভাজে, চটজলদি নেমে পড় দেখি। এখানে তো আর চাইলেই আমি এসে পড়তে পারি না।’

এ কম মধ্যাকর্ষণের জায়গায় হাঁটা কোনো সমস্যাই নয়। টের পাওয়া যায় না। তবু সময় সময় তারা মনোরেলের সুবিধা উপভোগ করে। একটু ঝরঝরে হয়ে নিতে থামে কোনো এক ক্যাফের সামনে। কমপক্ষে পোয়া কিলোমিটার লম্বা রেডউডে বানানো জায়গাটা।

আশপাশে মানুষ নেই। শুনশান প্রকৃতি। সহযাত্রিরা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে সুদর্শন এলাকার আড়ালে। এখন যেন এ পুরো স্বপ্নরাজ্য শুধু তাদের। সবকিছু ঠিকঠিক নিয়ন্ত্রণ করা হয় কীভাবে কে জানে! সম্ভবত রোবটদের কোনো সেনাদল আছে সেসব কাজের জন্য। ডিজনি ওয়ার্ল্ডে সেই ছেলেবেলায় যাবার কথা এখনো মনের পর্দায় ভাসে। কিন্তু এ তো তার চেয়ে অনেক অনেক ভাল। লোকজনের ভীড়বাট্টা নেই। নেই কলরোল। সবচে বড় কথা, মানবজাতি আর তাদের বানানো কৃত্রিমতার প্রায় কোনো ছোঁয়াই দেখা যাবে না।

সামনে অর্কিডের চমৎকার এক কালেকশন। কিছু কিছু আকার আকৃতিতে রীতিমত দানবীয়। এসব দেখতে দেখতেই পোল জীবনের সবচে বড় ধাক্কাগুলোর একটা খেল। ছোটখাট চিরাচরিত এক বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তারা। খুলে গেল দরজা- বেরিয়ে এল মালি।

আত্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক পোলের অহঙ্কারের শেষ নেই, কিন্তু একেবারে পুরোদস্তুর বয়েসি হয়ে যাবার পরও আতঙ্কে সে গলা চিরে চিৎকার দিবে সেটা কল্পনাতেও ছিল না। তার সময়কার আর সবার মতো সেও জুরাসিক মুভিগুলো পটাপট গিলেছিল, তাই র‍্যাপ্টর চিনে নেয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এমন জিনিস যে স্বচক্ষে দেখা যাবে তা ভাবাটা অবশ্যই কঠিন।

‘ও, আই এ্যাম টেরিবলি স্যরি,’ থই পাচ্ছে না ইন্দ্রা, তোমাকে সাবধান করে দেয়ার কথাটা আমার মনেই আসেনি।

পোলের উত্তেজিত স্নায়ুগুলো আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসে। অবশ্যই, এ সুন্দর ও গোছানো পৃথিবীতে কোনো রকম ঝুঁকি যে নেই তাতো নিশ্চিত; তবু…

কিন্তু ডাইনোসরের কোনো উৎসাহ নেই তাদের ব্যাপারে। চোখ ফিরিয়ে নিল সে। তারপর সোজা চলে গেল, বাগানের জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এল আবার। কাঁধের পিছনে একটা ঝোলা ঝোলানো। পাখির মতো ডানা ঝাঁপটানোর ভাব করে চলে গেল সে দূরে। তারপর একবারো পিছনে না ফিরে হাপিস হয়ে গেল দশ মিটার উঁচু সব সূর্যমুখীর পিছনে।

‘আমার একটু ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে, খেই ধরল ইন্দ্রা, যখন সম্ভব, আমরা বায়ো অর্গানিজম ব্যবহার করতে পছন্দ করি। রোবট আর পছন্দ নয়, বুঝতেই পারছ, যত্তসব কলকজার কারবার। আমাদের বিশ্বাস কার্বনের উপর, ধাতুর উপর নয়। কাজে লাগতে পারে এমন মাত্র কয়েকটা প্রাণি আছে আর আমরা তাদের কখনো না কখনো লাগিয়ে বসে আছি।

আর এখানে এমন এক রহস্য লুকিয়ে আছে যেটার সুরাহা কেউ করতে পারেনি। তুমি ভাবতে পার উন্নত করে তোলা হার্বিভোররা, যেমন শিম্পাঞ্জি আর গরিলা- এসব কাজে খুব দক্ষ হবে। আদতে তা মোটেও সত্যি নয়। তাদের ধৈর্যের খুব অভাব।

কিন্তু মাংসাশীরা খুব কাজের। এখানে আমার যে বন্ধুকে দেখলে তার কথাও বলতে পার। খুব সহজেই ট্রেইন্ড করে নেয়া যায়। আরো বড় কথা হল- এখানে একটা প্যারাডক্স আছে। তাদের মডিফাই করে নেয়ার পর আচার আচরণে খুব সভ্য হয়ে যায়। অবশ্যই, তাদের পিছনে কাজ করছে হাজার বছরের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। আর দেখ, এককালের গুহাবাসী মানব হিংস্র নেকড়ের কী দশা করেছে সামান্য ট্রায়াল এ্যান্ড এরর পদ্ধতি অনুসরণ করে।

হাসল ইন্দ্রা মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়া সুরে, তুমি হয়ত ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারবে না, ফ্র্যাঙ্ক, কিন্তু সেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা ভাল ভাল বেবিসিটারও তৈরি করে যাদের অনেক পছন্দ করে বাচ্চারা। এ নিয়ে পাঁচশ বছরের পুরনো একটা রসিকতা চালু আছে, ‘তোমার বাচ্চার দেখভালের জন্য যদি কোনো ডাইনোসরকে বিশ্বাস কর তো ভাল, বিশ্বাস করেই দেখ, দেখ পস্তাতে হয় কিনা?”

হাসিতে যোগ দিল পোলও, নিজের ভয়ের ব্যাপারটায় এখনো ধাতস্থ হয়ে নিতে পারছে না। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য সে অবশেষে ইন্দ্রার কাছে সেই প্রশ্নটা তুলল। যেটার জন্য মন খচখচ করছে।

‘এই এতকিছু নিয়ে কষ্টের প্রয়োজন কী, যখন টাওয়ারের যে কেই একটু চেষ্টা করলেই আসল ভূমিতে গিয়ে দেখে আসতে পারে?

চিন্তান্বিত চোখে চেয়ে থাকে ইন্দ্রা। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেয়।

কথাটা আসলে পুরোপুরি ঠিক নয়। ঝুঁকি আছে। আছে বিপদের সম্ভাবনা। ঝক্কি-ঝামেলারও কোনো অভাব নেই। ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার এলাকার প্রায় সবটাই হাফ জির কম। আর সেখান থেকে পৃথিবীর বুকে পুরো এক জিসহ নেমে যাওয়াটা কষ্টকর, এমনকি কোনো হোভারচেয়ার থাকলেও সে ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না।

‘আমার ক্ষেত্রে কথাটা খাটবে না। আমার জন্মই এক জিতে। বেড়ে ওঠা পৃথিবীর পৃষ্ঠে। সেই হিসাব ঠিক রাখার জন্য ডিসকভারির বুকে এক্সারসাইজ করার কাজে কখনো হেলাফেলা করিনি।’

কথাগুলো বলতে হবে প্রফেসর এ্যান্ডারসনের সাথে। বলার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু তোমার শরীরটা এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি, সেটার জৈবঘড়ি এখনো শক্তি পায়নি পুরোপুরি। সেটা কখনো থামেনি এবং তার ধারণা তোমার বয়স পঞ্চাশ থেকে সতুরের মধ্যে। যদিও তোমার শরীর ভালই আছে, তবু এক হাজার বছর হিমশীতলে থাকার পর পুরো শক্তি ফিরে পাবার আশা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।’

আচ্ছা, একটু একটু বুঝতে পারছি এখন, তিক্তকণ্ঠে নিজেকে শোনায় পোল। এতক্ষণে বোঝা গেল কেন এ্যান্ডারসন তার শরীরের শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন, কেন পেশিশক্তি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে অষ্টপ্রহর।

আমি বৃহস্পতির এলাকা থেকে পৃথিবীর মাত্র দু হাজার কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছি। কিন্তু কী কপাল, আমার সেই হামল্যান্ডের উপরে ভেসে থাকতে পারব সারা জীবন, কখনো তার কোমল ভূমিতে পা ফেলে চলতে পারব না যেমনটী চলেছিলাম একেবারে বাচ্চা একটা ছেলে হিসাবে।

জানি না কী করে ব্যাপারটায় নিজেকে মানিয়ে নিব, জানি না…

১০. ইকারুসের বসতবাড়ি

তার হতাশা কেটে যায় দ্রুত : অনেক অনেক কাজ পড়ে আছে সামনে। দেখার আছে অনেক কিছু। মানবজাতি বিস্ময়ের মেলা বসিয়ে দিয়েছে। হাজারটা পূর্ণ জীবনেও তা দেখে কুলানো যাবে না। যাবে না স্বাদ-গন্ধ নেয়া। এখন ঠিক করার পালা এই বিস্ময় ভুবনের কোন কোন জাদুকে উপভোগ করতে হবে, কোনটাকে যেতে হবে পাশ কাটিয়ে। অযথা বিনোদনগুলোকে পাশ কাটিয়ে যায় সে। চিনতে চায় নতুন যুগের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে, জানতে চায় সমাজ সভ্যতা আর জ্ঞানের নতুন নতুন দুয়ারের চাবিকাঠির ঠিকানা।

ব্রেইনক্যাপ আর সেই সাথে সেই বই আকারের প্লেয়ারগুলোর (নাম ব্রেইনবক্স) সহায়তা নেয়া চলে দেদার। দ্রুত সে ইন্সট্যান্ট নলেজ ট্যাবলেটের একটা লাইব্রেরি গড়ে ফেলল। প্রতিটায় একটা কলেজ ডিগ্রিতে যা কিছু দরকার তার চেয়ে বেশি জ্ঞান আছে নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট বিষয়ে, সব ধরনের ইন্টার্যাক্টিভ সুবিধা সহ। ব্রেইনক্যাপের আসল মজা সে প্রথমে জানতে পারেনি। এখন পারছে। এটাকে তীব্র গতিতে মাথার সাথে তাক করে নেয়া যায়। মানুষ যে গতিতে পড়ে বা লেখে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত এটা ব্যবহারকারীকে আনন্দ বা তথ্য দেয়। শোয়ার আগে ঘন্টাখানেকের জন্য সহনীয় গতিতে সেট করে নাও। যখন খুলবে, তখন দেখতে পাবে জ্ঞানের নতুন নতুন অভাবনীয় দ্বার খুলে গেছে হাট হয়ে। এ যেন কোনো বইপোকা লাইব্রেরিয়ানের মতো যে হঠাৎ দেখতে পায় তার মালিকানায় আরো একটা অজানা বিষয়ের তাক জোড়া বইপত্র আছে।

বড় হিসাবে ধরতে গেলে, তার সময়ের তুলনায় সে ছিল অনেক অগ্রসর আর জ্ঞানী এক লোক। আর সে এখন বেছে বেছে মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়। যখনি কোনো সায়েন্টিস্ট, ইতিহাসবেত্তা, লেখক বা শিল্পী আসে যারা মিডিয়ার এমন সব ক্ষেত্রে কাজ করছে যেগুলো এখনো পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি বা কুঁড়ি মেলেনি স্বাগত জানায় সে তাদের। চার টাওয়ার থেকে হাজারটা অনুষ্ঠানের দাওয়াত, দেখা করার অনুরোধ উপরোধ আসে অজস্র; প্রতিদিন। খোঁড়াই পরোয়া করে এসবের।

কিন্তু যাদের প্রতিরোধ করা কঠিন এবং যাদের অবহেলাও করা যায় না তারা হল- নিচের মোহময়ী নীলচে গ্রহের মাটির কাছে বাস করা মানুষেরা।

‘অবশ্যই,’ বোঝয় প্রফেসর এ্যান্ডারসন, তুমি নিচে নেমে গেলে, সঠিক লাইফ। সাপোর্ট সিস্টেম নিয়ে গেলে, বাঁচবে, ভালভাবেই বাঁচবে, কিন্তু ব্যাপারটাকে মোটেও উপভোগ করতে পারবে না। সবচে ভয়ের কথা, এটা তোমার নিউরোমাস্কুলার সিস্টেমকে ক্ষত্মিস্থ করতে পারে। হাজার বছরের ঘুম থেকে জেগে উঠে সেটা আগের মতো কার্যকর হবে তা আশা করা ঠিক নয়।’

তার আরেক অভিভাবক ইন্দ্রা ওয়ালেস জানিয়ে দেয় কোন কোন অনুরোধ রাখতে হবে আর কোনটা ভদ্রভাবে করতে হবে প্রত্যাখ্যান। জানিয়ে দেয় অপ্রস্তুত অবস্থা থেকে সরে আসার পথ সম্পর্কে। নিজে নিজে এ অকল্পনীয় জটিল সভ্যতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি সম্পর্কে থোড়াই জানা সম্ভব। সহায়তা করছে ইন্দ্রা, সহায়তা করছে অগ্রসর প্রযুক্তি।

মানুষের মাঝে আগের মতো আর শ্ৰেণীভেদ নেই, তাতে সহজ কথা, হাজার বছরের পুরনো কথা, তার পরও, কয়েক হাজার সুপার সিটিজেন আছে এ সভ্যতায়। জর্জ অরওয়েলের কথাই বোধহয় সত্যি, কিছু মানুষ বাকিদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে এবং নিয়ন্ত্রণ করবে সব সময়। ভদ্রভাবে তিনি যা বলেছিলেন, কেউ কেউ বাকিদের চেয়ে বেশি ‘সম’ থাকবে।

মাঝে মাঝে একটা দার্শনিক চিন্তা চলে আসে মাথায়। এই এতসব নিয়ন্ত্রণ করে কে? কে এসবের খরচ যোগায়? কোনোদিন কি পোলের সামনে খুব ভদ্রভাবে হোটেলের বিশাল একটা বিল ধরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু আশ্বস্ত করে ইন্দ্রা, সে আসলে একটা অমূল্য বস্তু। যাদুঘরের এমন বস্তুকে কখনো অবহেলা করা হবে না। যা চায় তার সবই হাজির করা হবে চোখের সামনে, একেবারে অকারণে না চাইলেই হল। পোল ভেবে পায় না এ নিয়ন্ত্রণ সীমাটা কোথায়, কিন্তু কোনো একদিন সেটার মুখোমুখি হতে হবে তা জানে না।

.

জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো অযাচিতভাবে হঠাৎ করে ঘটে যায়- এমনি করে একটা ব্যাপার চলে এল পোলের সামনেও। ওয়াল ডিসপ্লে ব্রাউজারকে র‍্যান্ডম রেখে সে দেখে যাচ্ছিল সামনের নিরব ফ্রেমগুলো। একটা ব্যাপার নজর কাড়ে তখনি।

‘স্টপ স্ক্যান সাউন্ড আপ!’ সে চেঁচিয়ে ওঠে অনেকটা অকারণেই। আস্তে বললেও চলত।

প্রথমেই বাজনাটা পরিচিত মনে হয়। তারপর মনে পড়ে যায় বাকি সবটুকু। সামনের দেয়ালে ফুটে ওঠা মানুষগুলো একে অন্যকে ঘিরে পাক খাচ্ছে অবিরত। তাদের পিঠজোড়া মস্ত ডানা। কিন্তু শেইকোভস্কি সোয়ান লেকের মঞ্চায়ন দেখে অবাক না হয়ে পারতেন না, কারণ চরিত্রগুলো আসলেই একে অন্যকে ঘিরে পাক খাচ্ছে উড়তে উড়তে…

কয়েক মিনিট ধরে তাকিয়ে থাকে পোল, নিশ্চিত হয়ে নেয় এটা কোনো সিমুলেশন নয়। এমনকি তার দিনগুলোতেও মানুষ হলপ করে বলতে পারত না কোনটা সিমুলেশন আর কোনটা বাস্তব। অভিনয়টা নিশ্চয়ই কোনো লো গ্র্যাভিটির পরিবেশে হয়েছে, হয়ত আফ্রিকা টাওয়ারের উঁচুতে থাকা কোনো বিশাল হলরুমে।

এবার একটা সুযোগ নিবেই সে। কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবে না স্পেস এজেন্সির সেই কথা। তার প্যারাস্যুট জাম্পিং আর গ্লাইডিং বন্ধ করে দিয়েছিল তারা। হ্যাঁঙ-গ্লাইডিং নিয়ে সেই দূর্ঘটনা… কপাল ভাল ছিল, কমবয়েসি হাড়গুলো সেরে ওঠে খুব দ্রুত।

‘আসলে,’ বলে মনে মনে, ‘আমাকে থামানোর কেউ নেই, যদি প্রফেসর এ্যান্ডারসন বাগড়া দিয়ে বসে তো…’।

বাধা দেয়া তো পরের কথা, লাফিয়ে উঠল প্রফেসর। এক দশমাংশ জি’র লেভেলগুলোয় প্রত্যেক নাগরিকের এভিয়ারি আছে। কিন্তু সোয়ান লেকের মতো পালকওয়ালা ডানা দেয়া হল না পোলকে। দেয়া হল ঝিল্লির মতো ডানা। সেগুলো লাগিয়ে নিয়ে নিজের দিকে তাকাতেই কলজে লাফিয়ে ওঠে। সাক্ষাৎ বাদুড়।

‘চল, ড্রাকুলা!’

কিন্তু এ কথার ঘোড়াই পরোয়া করে ইনস্ট্রাক্টর। সে ভ্যাম্পায়ের নাম-গোষ্ঠিরও হদিস জানে না।

প্রথম দিকে তাকে বেধে রাখা হয় হালকা এক ফিতা দিয়ে, যেন উড়তে যাবার প্রাথমিক শিক্ষাগুলোয় কোনো গলদ থেকে না যায়, উড়তে গিয়ে বেসিক স্ট্রোকগুলোয় কোনো হেরফের না হয়ে যায়। সবচে বড় কথা, স্থিতাবস্থা শিখতে হবে তো! আর সব দক্ষতার মতো এটাও দেখতে যতটা সহজ কাজে তার ধারে কাছেও নয়।

বেধে রাখার ব্যাপারটা বিদঘুঁটে লাগে, সন্দেহ নেই, সেই সাথে এ চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খায়, এক দশমাংশ মধ্যাকর্ষণে মানুষ নিজেকে আর কতটা আঘাত দিতে পারবে পড়ে গিয়ে উইংমাস্টার গর্বের সাথে বলে, আর কাউকে এত সহজে শেখানো যায়নি। কথাটা হয়ত সত্যি; হাজার হলেও, ফ্র্যাঙ্ক পোল একজন সাবেক এ্যাস্ট্রোনট। কিন্তু মিথ্যাও হতে পারে, হয়ত সে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই গৎ বাধা কথাটা বলে ইন্সপায়ারড করে। কে জানে!

চল্লিশ মিটার লম্বা চেম্বারে ডজনখানেক ফ্রি ফ্লাইট দিয়ে, আশপাশে উড়তে থাকা ও উঁচু নিচু হয়ে থাকা জিনিসপত্রকে সাবধানে এড়িয়ে প্রথম সলো ফ্লাইটের সার্টিফিকেট পেয়ে গেল পোল। ফ্ল্যাগস্টাফ এরো ক্লাবের এ্যান্টিক সেসনায় উনিশ বছরের টগবগে মন নিয়ে উড়ল সে।

প্রথম উড্ডয়নের জন্য ‘দ্য এভিয়ারি’ নামটা খুব একটা সহায়ক হয়নি। চান্দ্র সীমার ঐ বিশাল অঞ্চলটার মতোই এটাও। গোলাকার। আধ কিলোমিটার উঁচু, চার কিলোমিটার ব্যাস। কোথাও চোখ আটকে যায় না। খটকা লাগে না কোথাও। দেয়ালের রঙ ফিকে নীল, ঠিক যেন দিগন্তের আকাশ। এলাকাটা যেন অসীম।

পোল প্রথমে উইংমাস্টারের কথায় কান দেয়নি। আপনি চাইলে যে কোনো দৃশ্য দেখতে পারেন। কে-ই বা বিশ্বাস করে। পঞ্চাশ মিটার উপর থেকে নিচে তেমন কিছু দেখা গেল না। শুধু ফিচারলেস তারের গোলকধাঁধা। ফ্লেক্সিবল ক্যাবল। পুরো মেঝেটাই যেন পেল্লায় ট্রাম্পোলিন। না উড়েও মানুষ অনেক মজা লুটে নিতে পারবে। এখান থেকে সরাসরি শক্ত কিছুর উপর পড়ে গেলে খারাপ ব্যাপার হবে তাতে সন্দেহ নেই, পৃথিবীর বুকে পাঁচ মিটার উপর থেকে পড়ে কি মানুষ ঘাড় ভাঙেনি।

দু ডানার আলতো ঝাঁপটায় বাতাসে ভেসে এল পোল। একটু পরই দেখতে পেল, উড়ছে সে। উড়ছে। শত মিটার উপরে চলে এসেছে। আসছে আরো আরো উপরে।

‘এবার একটু ধীরে!’ বলল উইংমাস্টার, আমিতো আপনার সাথে পাল্লা দিয়ে পারছি না।

একটু ঢিল দিল পোল। আলতো করে গড়িয়ে দিল শরীরটাকে। বাতাসের উপরে। ডিগবাজি খেল গিরিবাজের মতো। অনেক হাল্কা লাগছে, শরীরের ওজন তো দশ কেজিও নয়। কে জানে, অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে গেল কিনা।

ব্যাপারটা অসাধারণ। শুন্য গ্যাভিটির চেয়ে অনেক বেশি ব্যতিক্রমী, একটু শারীরিক চ্যালেঞ্জ আছে। স্কুবা ডাইভিণ্ডের সাথে এর এক আধটু তুলনা করা যেতে পারে।

আহ, যদি পাখি থাকত এখানে যেমন স্কুবা ডাইভিভের সময় রিফগুলোয় দেখা দিয়ে যায় রঙ বেরঙের কোরাল মাছের দল, তেমন।

উইংমাস্টার একে একে ওড়ার বাহারি জাদু শিখিয়ে দিচ্ছে রোলিং, লুপ তৈরি করা, মাথা নিচে রেখে উড়ে যাওয়া, শুধু ডানায় ভর করে ভেসে থাকা… সবশেষে বলল, আর কিছু শিখাতে পারব না। আমার বিদ্যার ঝোলা খালি হয়ে এসেছে। এবার ভিউ উপভোগ করা যাক।

এক মুহূর্তের জন্য যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল পোল, এমনটাই হবে, আশা করেছিল, কারণ, মূহুর্তের ব্যবধানে চারপাশে মাথা তুলে ধরেছে শুভ্র কিরিটি পরা পর্বতগুলো। উন্নতশির। এবড়োথেবড়ো পাথর দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উড়ে যাচ্ছে সে দুইটা শিখরের কাছ দিয়ে। খুব কাছ দিয়ে। এগিয়ে যেতে যেতে দেখল একটা ঈগলের বাসা। বাসায় পড়ে আছে ডিম। একটু হলেই ছুঁয়ে দেখতে পারত সেটাকে। কিন্তু সামনে যেতে হবে। আর একটু ফ্রি স্পেস দরকার।

হারিয়ে গেল পর্বতমালা। নেমে এল নিকষ কালো রাত। আকাশে ফুটকি তুলে তুলে জেগে উঠল তারার ফুলেরা। আকাশের খুব বেশি নক্ষত্র তো আর দেখা যায় না! আস্তে আস্তে আরো বেশি কিছু দেখা দিল। দেখা দিল নিহারিকাগুলো, গ্লোবুলার ক্লাস্টার।

এসব বাস্তব হবার কোনো উপায় নেই। যদি জাদুমন্ত্রে কোনো ভিন্ন পৃথিবীতে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়, তবু বিশ্বাস্য নয়। কারণ চোখের সামনে জন্ম নিচ্ছে নক্ষত্ররাজি। তিমির অমানিশা থেকে নক্ষত্রবীথি যেমন ফুটে উঠছে তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে উধাও। প্রতি পল-অনুপলে লাখ-কোটি বছর যে কেটে যাচ্ছে তা বোঝা যায় বেশ…

মন বিবশ করা দৃশ্যগুলো হারিয়ে গেল, যেমন করে এসেছিল একেবার শূন্য থেকে… এবার খালি এক আকাশের বুকে আবিষ্কার করল পোল নিজেকে। সে আর তার সাথে উইংমাস্টার। সেই পরিচিত সিলিন্ডার, সেই এ্যাভিয়ারি।

‘একদিনের পক্ষে এটুকুই যথেষ্ট, কী বলেন? প্রশ্ন তোলে উইংমাস্টার, ‘পরেরবার এলে কোন ধরনের দৃশ্য চান দেখতে?’

একটুও দ্বিধা নেই পোলের মনে। এক ঝলক হাসি দিয়ে জানিয়ে দিল কী দেখতে চায়।

১১. ড্রাগনের নিঃশ্বাস

এমনধারা কাজ যে সম্ভব তা বিশ্বাস করা কোন মানুষের কম্ম। এ যুগের উন্নতি দিয়েও ঠিক হজম করা যাচ্ছে না। এত বড় একটা ভুবনে কত কত টেরাবাইট… পেরাবাইট কাজে লাগানো হয়েছে? প্রযুক্তির উন্নয়নের ধারা ধরে স্টোরেজ মিডিয়াম এখন কোন পর্যায়ে? এ নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ করার মানে হয় না। বরং ইন্দ্রার কথা মেনে চলাই শ্রেয়, তুমি যে একজন ইঞ্জিনিয়ার সেসব কথা মাথা থেকে স্রেফ হাপিস করে দিয়ে উপভোগ করা

এখন সে উপভোগ করছে, আকণ্ঠ পান করছে প্রযুক্তির আশীর্বাদ-অমিয়। সেই সাথে ধেয়ে আসছে নস্টালজিক সব ভাবনা। একেবারে মনমরা করে দিচ্ছে তাকে। সে উড়ছিল প্রায় হাজার দুয়েক কিলোমিটার উচ্চতায়, তার যৌবনের মন মাতাল করা ভূমির উপর। অবশ্যই, অনুভূতিটা কৃত্রিম, এভিয়ারি মাত্র আধ কিলোমিটার উঁচু, তাতে কী, অনুভূতি তো।

উল্কাপাতে তৈরি হওয়া জ্বালামুখের উপর দিয়ে উড়ে গেছে সে মনে পড়ে গেছে এ্যাস্ট্রোনট ট্রেনিঙের সময় কীভাবে এগুলোর আশপাশে যেত সেসব কথা।

পোল নিশ্চিত তার আরামে উড়ে যাবার গতি শ দুয়েক কিলোমিটার নয়, বড়জোর টেনেটুনে বিশ কিলোমিটার হবে। কিন্তু ফ্ল্যাগস্টাফের কাছে পনের মিনিটেরও কম সময়ে যাবার অনুমতি আছে। এইতো, লোয়েল অবজার্ভেটরির ঝকঝকে গম্বুজগুলো! একেবারে কিশোর, দুরন্ত পোল এ জায়গায় কতবার এসেছে তার কোনো লেখাজোকা নেই। এ থেকেই তো এমন একটা কাজ বেছে নেয়ার চিন্তা মাথায় এসেছিল। এখানকার স্টাফরা কি মুখে মধু নিয়ে জন্মেছিল? এ্যারিজোনায়, মঙ্গলিয় ফ্যান্টাসিগুলোর যেখানে জন্ম, সেখানে সেও না জন্মালে এ জন্মে আর এ্যাস্ট্রোনট হওয়াটা কপালে জুটত না। হয়ত স্রেফ কল্পনা, মনে হচ্ছে লোয়েলের সেই বিখ্যাত সমাধি নিচেই কোথাও; কল্পনার লাগাম ছুটিয়ে দেয়া বিশাল সেই টেলিস্কোপটার কাছেই।

কোন সময়টায়, কোন আবহাওয়ায় এ ছবি তুলে আনা হয়েছিল? একবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে পৃথিবীর বুকে চোরাগোপ্তা দৃষ্টি হানা স্পাই স্যাটেলাইটের তোলা ছবি, এটুকু আন্দাজ করা যায়। তার সময় থেকে খুব বেশি পরে নেয়া হয়নি, হলপ করে বলতে পারে সে; এখানকার আশপাশ যে এমন ছিল তা মনে পড়ে। একটু, আর একটু নিচে নামতে পারলে খোদ নিজেকে দেখা যাবে হয়ত…

কিন্তু বাড়া ভাতে ছাই দেয়ার কোনো ইচ্ছাও নেই। আর নিচে গেলে দৃশ্য ভেঙে যাবে, বেরিয়ে পড়ছে প্রযুক্তির তীক্ষ্ণ দাঁত। পিক্সেলগুলো ভাঙা ভাঙা চলে আসবে। কী দরকার সুখস্বপ্ন নষ্ট করার?

আরে… কী অবাক ব্যাপার! এইতো সেই পার্ক… সেই ছোট্ট পার্ক যেখানে তার জুনিয়র আর হাইস্কুলের বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়েছিল, ডানপিটে সব কাজ করেছিল, খেলেছিল নাওয়াখাওয়া ভুলে। সিটির হর্তাকর্তারা অহর্নিশি এর জিম্মাদারি নিয়ে হা পিত্যেশ করে বেড়াত, পানির সরবরাহ নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। যাক, এটাতো টিকে ছিল ছবি তোলা পর্যন্ত, এই যথেষ্ট।

আরেক ভাবনা চোখ ফাটিয়ে পানি নিয়ে আসে। ঐ সরু গলিগুলো ধরে হেঁটে বেড়াত সে সময় পেলেই। হিউস্টন থেকে বেরুতে পারলে বা চাঁদ থেকে একটু অবসর পেয়ে পৃথিবীতে এলেই পায়চারি করত অনেক আবেগমাখা সেই রোডেশিয়ান রিজব্যাকে। হাতে থাকত একটা ছড়ি আর পোষা কুকুরটা।

বৃহস্পতি থেকে আসার চিন্তার সাথে সব সময় মনে একটা উদ্বেগ থাকত, রিক্তি তার ছোট ভাই মার্টিনের কাছে ভাল থাকবে তো? ভাবনাটা কেমন যেন স্থবিরতা এনে দেয়। কিছু বোঝার আগেই নেমে যায় বেশ কয়েক মিটার। ফিরিয়ে আনতে হয় শক্তি। কী করে নিজেকে বোঝায় যে রিক্কি আর মার্টিন দুজনেই শত শত বছর আগে মিশে গেছে ধূলার সাথে।

ঝাপসা চোখ পরিষ্কার হয়ে এলে এ্যান্ড ক্যানিয়নের কালো রেখা দেখা যায়। এগিয়ে যাবে কিনা ভেবে পায় না। আকাশে একা নয় সে। মানুষ যে উড়ছে না এটুকু বোঝা যায়। একটু বেশিই বড়।

‘যাক,’ বলল সে নিজেকে, এখানে একটা টেরোডাকটাইলের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা মোটেও আজব নয়। আশা করি প্রাণীটা ফ্রেন্ডলি হবে… ও, নো!

টেরোডাকটাইলের আন্দাজটা একেবারে ভুল নয়। সম্ভবত দশে আট দিয়ে দেয়া যায়। রূপকথার দেশ থেকে পাখা মেলে এগিয়ে আসছে যেটা তাকে ড্রাগন বললে কোনো ভুল হবে না। দৃশ্যটাকে পূর্ণতা দিতে সেটার পিঠে চড়ে আসছে রূপবতী এক মেয়ে।

সৌন্দর্য এতদূর থেকে মেপে নেয়া একটু কঠিন। কল্পনার রঙ চড়িয়েছে পোল। রীতিবদ্ধ চিত্রটায় চিড় ধরেছে একটা বিশেষ কারণে। প্রথম মহাযুদ্ধের বাইপ্লেনের পাইলটরা যেমন পরত, এভিয়েটর গগলে মেয়েটার মুখের বেশিরভাগ ঢাকা।

ভেসে থাকে পোল। বিশাল জটার ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ ওঠে। এগিয়ে আসে সেটা। মাত্র বারো ফুট দূর থেকেও সিদ্ধান্তে আসতে পারে না সে, এটা কোনো মেশিন, নাকি বায়ো-কনস্ট্রাক্ট…হয়ত দুইটাই।

এরপর ড্রাগনের কথা মন থেকে উধাও হয়ে গেল, কারণ মুখ থেকে আবরণ সরিয়ে নিয়েছে মেয়েটা।

এসব কথা আদিকাল থেকে বলে আসছে সাহিত্যিকরা, আর আদিকাল থেকেই সে কথার কোনো মূল্য দেয় না পাঠক মাঝে মাঝে।

কিন্তু প্রথম দেখায় ভালবাসার আবেদন ফুরাবে না কখনো।

.

দানিল কোনো তথ্যই জানাতে পারল না, পোলও খুব বেশি আশা করেনি। কিন্তু পোল যে মানসিকভাবে অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে তা অস্বীকার করে কী করে। এ বায়ো-রোবটটা কাজের নয়- গৃহস্থালির কাজে তার তুলনা নেই, কথা সত্যি, কিন্তু

ভদ্রভাবে কারো ব্যাপারে জানতে চাইলে সে চট করে বলে ফেলতে পারবে না। মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে যায় সে, নিজেও কি একটা বায়ো-রোবট?

ইন্দ্রা অবশ্য ঠিকভাবে জবাবটা দিতে পেরেছিল।

‘ও, ড্রাগন লেডির সাথে দেখা হয়েছে তোমার?

‘এ নামেই ডাক নাকি? আসল নামটা কী? আইডেন্ট বের করে দিতে পারবে? হাত স্পর্শ করার উপায় ছিল না তখন।

‘অফকোর্স- নো প্রবলেমো।‘

‘এটা আবার কোত্থেকে কুড়ালে?

ইন্দ্রার চোখেমুখে বিভ্রান্তি।

মনে নেই- হয়ত কোনো পুরনো মুভি বা বই থেকে। কেন, কথাটা কি বেমানান

বয়সটা পনেরর বেশি হলে বেমানান।’

বাদ দাও, মনে রাখব। বলতো, কী হয়েছিল তখন? এর মধ্যেই হিংসা হচ্ছে আমার।

বন্ধুত্বের একটা পর্যায়ে এলে মানুষ সহজভাবে যে কোনো কথা বলতে পারে। এখনো একে অন্যের বিচিত্র সব আগ্রহের কথা খেয়াল করে শোনে। একবার ইন্দ্রা বলেছিল, আমার মনে হয় দুজনে যদি কোনো বিচিত্র গ্রহাণুতে ধ্বসে পড়তাম, একটা না একটা উপায় বের করে ফেলতাম, কী বল?

‘প্রথমে বলতে হবে মেয়েটা কে।

নাম অনোরা ম্যাকঅলি। আরো অনেক ব্যাপারের সাথে সে সোসাইটি ফর ক্রিয়েটিভ এ্যানাক্রোনিজমের প্রেসিডেন্ট। আর তুমি যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক যে ড্রাকো দেখতে বেশ ভাল, তাহলে বলতেই হয়, তাদের জাতের আরো কয়েকটাকে দেখতে হবে আগে। দেখতে হবে তাদের অন্যান্য সৃষ্টি। যেমন মবি-ডিক আর ডাইনোসরের আত্মীয়স্বজনের বিশাল এক দলকেও দেখতে হবে, দেখে শেষ করতে পারবে না।’

সত্যি হতে হলে এত বেশি ভাল না হলেও চলে, ভাবে পোল।

পৃথিবী গ্রহের বুকে আমিই সবচে বিচিত্র এ্যানাক্রোনিজম।

১২. হতাশা

এখন পর্যন্ত, স্পেস এজেন্সি সাইকোলজিস্টদের সাথে তার বাতচিতের কথা ভুলে বসেছিল সে।

‘আপনি পৃথিবী ছেড়ে যাবেন, যদি যান, কমপক্ষে তিন বছরের জন্য। আমরা আপনাকে একেবারে নির্বিষ, মানে গোবেচারা একটা এ্যানাফ্রোডিসিয়াক ইমপ্ল্যান্ট দিতে পারি। মিশনের শেষ পর্যন্ত থাকরে। আশ্বস্ত করছি, আমরা ব্যাপারটাকে ভালভাবেই শেষ করতে পারব।’

‘নো থ্যাঙ্কস,’ জবাব দিয়েছিল পোল, কথা বলার সময় মুখটাকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণান্ত চেষ্টাও চালাচ্ছে, মনে হয় আমি সামলে উঠতে পারব।’

এবং তারা সন্দিহান হয়ে পড়েছিল মাত্র তিন চারটা সপ্তাহ পেরিয়ে যাবার পরই। তারা। সে এবং ডেভ বোম্যান।

‘আমিও ব্যাপারটা খেয়াল করেছি, ডেভ বলে উঠেছিল তখন, ‘ঐ মরার ডাক্তাররা আমাদের খাবারে যে কিছু একটা মিশিয়ে দিয়েছে আগেই বুঝতে পেরেছি।’

সেই কিছু একটা যাই হোক না কেন- যদি আদৌ কিছু মিশিয়ে দেয়া হয়ে থাকে- শেলফের জীবন পার করে এসেছে। কিন্তু এসবে কিছু এসে যায় না। খুব ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। ভাবা হয়ে পড়ার সময় নেই। তরুণী এবং পুরোপুরি তরুণী নয় এমন অনেক মেয়ের অফার প্রতিনিয়ত ফিরিয়ে দিতে হয়। তার রূপ নাকি মনের দক্ষতা নাকি খ্যাতি- কোনটা তাদের আকর্ষণ করে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার। ব্যাপারটা সম্ভবত স্রেফ কৌতূহল, বিশ ত্রিশটা জেনারেশন পার করে আসা মানুষটার প্রতি আগ্রহ।

পোলের মনে বেশ স্বস্তির একটা পরশ বয়ে যায় যখন সে আইডেন্ট থেকে বের করে দেখে যে মিস্ট্রেস ম্যাকঅলি বর্তমানে প্রেমিকদের মাঝেই আছে এবং তার সময় খুব স্বল্প। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সে চলে গেল অন্য এক অবস্থায়। মেয়েটার সরু কোমরে তার হাত, উড়ে চলেছে পুরোপুরি রোবট এক ড্রাগন, ড্রাকোর পিঠে চড়ে। এভিয়েটর্স গগল পরতে হবে কারণ ড্রাকোর গতি ‘আসল’ ড্রাগনদের চেয়েও অনেক বেশি, যন্দুর মনে হয়।

নিচের চির পরিবর্তনশীল চিত্রে এখন অন্য আবহ। উড়ন্ত কার্পেট থেকে আলি বাবা হাত নাড়ছে খুশি মনে… না, খুশি মনে না, চিৎকার করছে, দেখতে পাও না। নাকি! কোথায় যাচ্ছ?”

সে নিশ্চয়ই বাগদাদ থেকে অনেক দূরে। কারণ নিচে এখন অক্সফোর্ডের চিত্র।

অরোরা নিচে আঙল নির্দেশ করল, ঐ পাবটাতেই ইনটাতেই- লুইস আর টোকিন বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতেন। আর ঐ নদীটা দেখুন ব্রিজ থেকে মাত্র যে নৌকাটা বেরিয়ে এসেছে না? উপরের ছোট যাজক আর মেয়ে দুইটাকে দেখতে পাচ্ছেন?

‘পাচ্ছি, ড্রাকোর নিঃশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করে ওঠে সে, এবং ধারণা করছি তাদের একজন এলিস।

অরোরা সাথে সাথে ঘুরে তাকায়। বোঝা যাচ্ছে, বেশ আনন্দিত।

ঠিক তাই। একেবারে নিখুঁত রেপ্লিকা, কী বলেন? আপনার সময়টা পেরিয়ে যাবার পরই মানুষ পড়ার অভ্যাস একেবারে ছেড়ে দেয়।’

উষ্ণ একটা প্রবাহ বয়ে যায় পোলের ধমনীতে।

আশা করি আরো একটা পরীক্ষায় পাশ করেছি, বলে সে নিজেকে। ড্রাকোর পিঠে চড়াটা একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা, কিন্তু আর কী কী বাকি আছে? বিশাল বিশাল তলোয়ারের সাথে লড়াই ।

কিন্তু আর কিছু বাকি ছিল না। তোমার জায়গায়, নাকি আমার ওখানে প্রশ্নটা তুলেছিল পোলই।

.

পরদিন সকালে, স্তব্ধ হয়ে, প্রফেসর এ্যান্ডারসনকে কল করল সে।

‘সব চলছিল ঠিকঠাক। কোনোক্রমে কথাগুলো উগড়ে দিল, তারপর হঠাৎই হিস্টিরিক্যাল হয়ে গিয়ে আমাকে ঠেলে দিল। ভড়কে গেলাম সাথে সাথে, নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে আঘাত দিয়েছিলাম–

তারপর রুমলাইট কল করল, আমরা অন্ধকারেই ছিলাম তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানা থেকে। সম্ভবত বোকার মতো শুরু করেছিলাম আমি… সে নিশ্চয়ই তাকিয়ে ছিল…’

‘আমি বুঝতে পারছি। বলে যাও।

কয়েক মিনিট পর একটু রিল্যাক্সড হল। এমন কিছু বলল যা কখনো ভুলতে পারব না।’

অপেক্ষা করছে এ্যান্ডারসন। পোল নিশ্চয়ই নিজেকে সামলে নিয়ে ভালভাবে বলতে পারবে।

বলেছিল, আমি সত্যি সত্যি দুঃখিত, ফ্র্যাঙ্ক। আমরা হয়ত ভাল সময় কাটাতে পারতাম। কিন্তু জানতাম না যে- তুমি মিউটিলেটেড।

শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে প্রফেসর। একটু পরই বুঝতে পারল।

‘ও- বুঝতে পারছি। আমিও দুঃখিত, ফ্র্যাঙ্ক- হয়ত তোমাকে সতর্ক করা উচিৎ ছিল। আমার ত্রিশ বছরের প্র্যাকটিসে মাত্ৰ জনা ছয়েকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দেখেছি।

প্রতিটাই মেডিক্যাল কারণে হয়েছিল যা তোমার বেলায় খাটবে না…

‘আদ্যিকালে সারকামসেশন বা শরীরের স্পর্শকাতর অংশবিশেষ সরিয়ে ফেলা অনেক গুরুত্ব বহন করত- এমনকি তোমার আমলেও। অস্বস্তিকর, মরণ ডেকে আনতে পারে এমন বেশ কিছু রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রাথমিক শতাব্দিগুলোয় কাজটা করা হত। তখন হাইজিন খুব একটা উচ্চ স্তরে পৌঁছেনি। কিন্তু তার পরই, সময় এগিয়ে চলল, এর পক্ষে আর কোনো যুক্তি রইল না বরং থাকল বিপক্ষে, নিজেই আবিষ্কার করলে।

‘তোমাকে প্রথম পরীক্ষা করার আগে রেকর্ড চেক করে নিয়েছি। একবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এত বেশি অপব্যবহার শুরু হয় যে আমেরিকান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন ব্যাপারটা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এ বিষয়ের ডাক্তারদের আলোচনা বেশ মুখরোচক।’

‘আমি নিশ্চিত, খুৰ মুখরোচক।’ তিক্ত মুখে বলল পোল।

কিছু কিছু দেশে আরো একটা শতাব্দি ব্যাপারটা চলে। তারপর কোনো কোনো জিনিয়াস দারুণ একটা শ্লোগান তৈরি করে, শব্দের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করবে, ঈশ্বর আমাদের ডিজাইন করেছেন; সারকামসেশন ইজ ব্লাসফেমি। মোটামুটি এটাই এ রীতির পথ রুদ্ধ করে দেয়। কিন্তু তুমি চাইলে একটা ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করা যায় সহজেই। তুমি কিন্তু মেডিক্যাল হিস্টোরিতে নাম লিখিয়ে ফেলবে না এমন কিছু করলে।

‘আমার মনে হয় না এতে কোনো কাজ হবে। প্রতিবারই হেসে ফেলব।

দ্যাটস দ্য স্পিরিট- তুমি এর মধ্যেই চলে আসছ।

অবাক হয়ে দেখল, পোল সত্যি সত্যি এ্যান্ডারসনের মুখের উপর হেসে ফেলছে।

‘আবার কী হল, ফ্যাঙ্ক?

‘অরোরার সোসাইটি ফর এ্যানাকোনিজমস। আশা করি এতে আমার সুযোগ আরো বাড়বে। আমার কপাল ভাল বলতে হয়, সে এমন এক এ্যানাকোনিজমের মুখোমুখি হয়েছে যা ঠিক পছন্দ করে না।

১৩. আজব সময়ে অচেনা অতিথি

ইন্দ্রা খুব একটা গা করল না সব শুনে, সম্ভবত তাদের সম্পর্কটার মধ্যে কিছু সেক্সয়াল জেলাসি আছে। প্রথম যুক্তিতর্কে নামল তারা এ নিয়েই।

খুব স্বাভাবিকভাবেই রু হয়েছিল। ইন্দ্রা বলল, ‘মানুষ সব সময় আমাকে দোষ দিয়ে বেড়ায়। কোন দুঃখে আমি ঐ ভয়ঙ্কর সময় নিয়ে গবেষণা করে মরছি। কিন্তু আরো ভয়াল একটা ব্যাপার ছিল তো, এ কথাই তা সবটুকুর জবাব নয়।’

‘তাহলে আমার শতাব্দি নিয়ে তোমার এত আগ্রহ কেন?’

‘কারণ তখন থেকেই বর্বরতা আর আধুনিকতার মধ্যে পার্থক্য সুচিত হয়।‘

 ‘থ্যাঙ্ক ইউ, জাস্ট কল মি কোনান।‘

‘কোনান? কোনান নামে মাত্র একজনকেই আমি চিনি। তিনি শার্লক হোমসের জন্ম দিয়েছিলেন।’

‘নেভার মাইন্ড- স্যরি, বাধা দিয়েছিলাম কথার মধ্যে। অবশ্যই, আমরা তথাকথিত ডেভেলপড শতাব্দিগুলোয় নিজেদের সভ্য মনে করতাম। অন্তত সেসব দিনে যুদ্ধকে আর শ্রদ্ধা করা হত না। জাতিসংঘ সব সময় যুদ্ধ বাধতে নিলেই থামানোর চেষ্টা করত।

‘খুব বেশি সফল যে হত তা কিন্তু নয়। আমি তাদের সে চেষ্টাকে দশে বড়জোর তিন দিতে রাজি। আর আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি যে তখনকার মানুষ এমনকি দু হাজারের প্রথম দিকেও!- শান্তভাবে এমন সব আচরণকে মেনে নিত এখন যেগুলোকে আমরা বর্বরপূর্ব হিসাবে অভিহিত করি। তারা বিশ্বাস করত মাথা ঘাপলিয়ে—’

‘ঘাবড়ে।’

‘-ননসেন্স। বিশ্বাস করত এমন সব ব্যাপারে আধুনিক মানুষ যেগুলো শুনলে মানুষকে মস্তিষ্কবিকৃত ভাবে।‘

‘উদাহরণ, প্লিজ।‘

‘তোমাদের এসব আচরণের দু একটা উদাহরণই আমাকে এসব নিয়ে গবেষণা করতে বাধ্য করে। তারপর কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ বেরিয়ে পড়েছিল। তুমি কি জান কয়েকটা শতাব্দির প্রতি বছর হাজার হাজার বাচ্চা মেয়েকে মিউটিলেট করা হয়েছিল শুধু এ আশায় যে তারা কুমারীত্ব রক্ষা করে চলবে? অনেকেই স্রেফ মারা পড়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেন একচোখা হরিণ।‘

‘আমি মানি, ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর- কিন্তু এ নিয়ে আমার সরকার কী করতে পারত?

অনেক কিছু যদি ইচ্ছা থাকত। কিন্তু তারা কিছুই করেনি। করেনি কেন? কারণ তাদের তেল সরবরাহকারী এবং অস্ত্র ক্রেতা দেশগুলো নাখোশ হবে, সেসব অস্ত্র, যেমন ল্যান্ড মাইন যেগুলো হাজার হাজার নিরীহ ছা-পোষা মানুষের প্রাণ নিয়েছিল।

বুঝতে পারছ না, ইন্দ্রা। আমাদের হাতে এত বেশি উপায় ছিল না। আমরা পুরো পৃথিবীটাকে বদলে দিতে পারতাম না। কে যেন একবার বলেছিল না, সম্ভাব্যতার শিল্পই রাজনীতি

‘খুব সত্যি- এ কারণেই দ্বিতীয় শ্রেণীর মাথাগুলো এ কাজে যেত। জিনিয়াস অসম্ভবের পিছু ছোটে, পলিটিক্সের নয়।

যাক, আমি খুব আহাদিত যে তোমাদের ভাল মেধার সাপ্লাই আছে, যাতে তোমরা সব ঠিকঠাক রাখতে পার।’

‘আমি কি বিন্দুমাত্র ইশারাতেও সারকামের প্রসঙ্গ তুলেছি? আমাদের কম্পিউটার সিস্টেমকে অনেক অনেক ধন্যবাদ- রাজনীতিকে মাঠে নামানোর আগে আমরা আগাগোড়া সব দেখে নিতে পারি। সব সম্ভাব্যতার প্রয়োগ দেখতে পাই সিমুলেশনে। লেনিনের কপাল খারাপ; বেচারা শত বছর আগেই জন্মেছিল। রাশিয়ান কম্যুনিজম কাজে লেগে যেতে পারত। অন্তত কিছু সময়ের জন্য যদি তাদের হাতে মাইক্রোচিপ নামের কোনো বস্তুর নাম নিশানা দেখা যেত। তাহলে এড়িয়েও যেতে পারত স্ট্যালিনকে।

পোল রাগবে কী, তার শতাব্দির বিষয়গুলোয় ইন্দ্রার দখল দেখে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্যকে অম্লানবদনে সহ্য করে যাচ্ছে। এদিকে তার সমস্যা ঠিক উল্টে গেছে। একশ বছর বাঁচলেও সে এ জটিল, বর্তমান, মানব সভ্যতাকে বুঝে উঠতে পারবে না পুরোপুরি। এমন সব রেফারেন্স অহরহ টানা হয় যার কোনো কূল-কিনারা করতে পারে না সে। এমন সব কৌতুক বলা হয় অহরহ যেগুলো সোজা মাথার উপর দিয়ে চলে যায়, হৃদয় স্পর্শ করে না। সর্বোপরি, মাঝে মাঝে তাকে রীতিমত ঘর্মাক্ত থাকতে হয় কোন কথা বলে নতুন বন্ধুদের সামনে হেয় হয়ে যায়…।

…এমনি এক ঘটনা ঘটেছিল খাবার সময়। ভাগ্য ভাল, খাচ্ছিল নিজের কোয়ার্টারে। এবং ইন্দ্রা আর প্রফেসর এ্যান্ডারসন ছাড়া আর কেউ ছিল না আশপাশে। অটোশেফ থেকে বের হওয়া খাবার সব সময় অতি উত্তম হয়। শারীরিক-মানসিক অবস্থার সাথে মানানসই করেই পাঠানো হয় সেসব। কিন্তু একবিংশ শতাব্দির এক গেঁয়োর কাছে সেগুলো সব সময় আহাদের হবে এমনটা আশা করাও বোকামি।

তারপর, একদিন, একেবারে সুস্বাদু একটা ডিশ এল। যৌবনের হরিণ শিকার আর বার্বিকিউর স্মৃতি টগবগিয়ে ফুটল মনের ভিতরে। ফ্লেভার আর বাহ্যিক আকৃতিতে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল, সুতাং পোল স্বাভাবিক প্রশ্নটা করেই বসে।

এ্যান্ডারসন হেসেছিল কোনোক্রমে। কিন্তু ইন্দ্রা এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন সে একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়বে। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, ‘তুমি বলবে তাকে অবশ্যই খাবার পর।

এখন আবার কোন মহাভারত অশুদ্ধ করলাম আমরা? প্রশ্ন করে পোল নিজেকেই। আধঘন্টা পর, একটা ভিডিও ডিসপ্লেতে ঘরের অন্য কোণায় ইন্দ্রা একেবারে ডুবে যাবার পর, তৃতীয় সন্ত্রাব্দের ব্যাপারে আরো একটু অগ্রসর হল পোলের জ্ঞান।

মৃতদেহের খাদ্য এমনকি তোমার সময়েই শেষ হয়ে যাচ্ছিল।’ ব্যাখ্যা করে এ্যান্ডারসন, জীবজ জন্ম দিয়ে- উহ- পাবার জন্য জীবজ জন্ম দেয়ানো অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব হয়ে পড়ে। জানি না একটা গরুকে খাবার দেয়ার জন্য কত একর জমি নষ্ট করতে হত কিন্তু এটুকু জানি ঐ জায়গায় জন্মাতে পারত এমন গাছের উপর অন্তত দশজন মানুষ জীবন চালাতে পারে। আর হাইড্রোপোনিক টেকনিক অবলম্বন করলে নির্বিঘ্নে শ খানেক মানুষ চলে যেতে পারত।

কিন্তু অর্থনীতি নয়, এ ব্যবসাটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল রোগ। ভাইরাসটা প্রথমে চারপেয়ে প্রাণিগুলোর মধ্যে ছড়ায়, তারপর অন্যান্য জম্ভর মধ্যে। ভীষণ এক ভাইরাস। খুব খারাপভাবে মরতে হত মানুষকে। তারপর চিকিৎসা বেরোয়, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা উল্টে দেয়ার কোনো উপায় ছিল না। তদিনে সিনথেটিক খাবারের জয়জয়কার। খুব সস্তাও। কোনো জীবাণু থাকার প্রশ্ন ওঠে না। পেতে পার যে কোনো তোরে।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে চলা তুষ্ট করার মতো কি মোটামুটি বিস্বাদ খাবারের কথা মনে পড়ে যায় পোলের। ভেবে পায় না সে, এখনো কি মনে স্টেক আর কাবাবের লোভ জেগে আছে।

অন্যান্য স্বপ্ন আরো সমস্যা সৃষ্টি করে। বুঝতে পারে সে, খুব বেশি দেরি নেই, এ্যান্ডারসনের কাছে মেডিক্যাল হেল্প চাইতে হবে। অস্বস্তি বাড়ছে, অস্বস্তি বাড়ছে এই বিচিত্র, জটিল, পরিবর্তিত পৃথিবীর সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করার সাথে সাথে। স্বপ্নে মাঝে মাঝে সে আগের পৃথিবীতে চলে যায়। চলে যায় তার আসল বনে। তারপর যখন বাস্তবটী ফিরে আসে, ফিরে আসে চরম অতৃপ্তি, বেদনা আর কষ্ট। পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়ে।

আমেরিকা টাওয়ারের পথে চলে যাওয়াটা খুব বেশি কাজের হবে বলে মনে হয় না। গিয়ে নিচে তাকালেই যে অনেক কিছু দেখা যাবে তাও ভুল। বাস্তবে, সিমুলেশনকে পাশ কাটিয়ে তার কৈশোর-যৌবনের ভূমিতে চোখ রাখা একেবারে বোকামি হবে। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে অপটিক্যাল এইড নিয়ে সে আলাদা আলাদা মানুষকে যার যার কাজ করতে দেখবে। দেখবে নিজের পুরনো সব পথঘাট, যদি এখন থেকে থাকে…

এবং এসব চিতা যখন মাথায় আসে, আসে আরো একটা ভাবনা, সে জায়গাটা দেখতে পাবে যেখানে তার ভালবাসার সব মানুষ এক সময় বসবাস করেছিল- মা, বাবা (আরেক মহিলার সাথে চলে যাবার আগে), প্রিয় আঙ্কল জর্জ, লিল আন্টি, ভাই মাটিন- আর একপাল কুকুর যেগুলোর মধ্যে ছিল তার রিকি।

সব ছাড়িয়ে সেখানে ম-ম করত একজনের গায়ের গন্ধ, তার স্মৃতি, মেয়েটার নাম হেলেনা…

এ্যাস্ট্রোট্রেনিঙের গোড়ার দিকে একেবারে সাদামাটাভাবে শুরু হয়েছিল এ্যাফেয়ারটা। সময় বয়ে যায়। আরো আরো সিরিয়াস হয়ে পড়ে সম্পর্ক। বৃহস্পতির পথে যাবার ঠিক আগে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, তারা এ সম্পর্কটাকে স্থায়ীত্ব দিতে যাচ্ছে ফিরে আসার পর।

সে ফিরে না এলেও হেলেনা তার সন্তান ধারণ করতে খুব আগ্রহী ছিল। সেই প্রয়োজনীয় কাজকর্মের, আইনি জটিলতাগুলো কাটিয়ে যখন পদক্ষেপ নিচ্ছে, কী খুশি ছিল তারা।

এখন, হাজার বছর পরে, জানার হাজার আকুতি থাকলেও জানার আর কোনো উপায় নেই হেলেনা কথা রেখেছিল কিনা। তার স্মৃতিতে আছে, হয়ত আছে পৃথিবীর অযুত নিযুত তথ্যভান্ডারের কোথাও। আবার নাও থাকতে পারে। ২৩০৪ সালে এ্যাস্টেরয়েডের প্রভাবে যে তড়িৎচৌম্বক পালস আঘাত হানে তাকে এ গ্রহের সমস্ত উপাত্তের বেশ অনেকটা অংশ হারিয়ে গেছে চিরতরে। ব্যাকআপ আর সেফটি সিস্টেমকে কাঁচকলা দেখিয়েছিল আক্রমণটা। হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য এক্সাইটের সাথে তার সন্তানদের তথ্যগুলো সরে গেছে কিনা তাই বা কে জানে। এখনো, এই পৃথিবীর বুকে তার ঔরসের ত্রিশতম বংশধরা হয়ত পা ফেলে বেড়াচ্ছে, শুধু সে চিনতে পারবে না তাদের কোনোদিন।

অরোরার মতো কোনো কোনো মেয়ে যে এখনো তাকে আস্তাকুড়ের আবর্জনা মনে করে তাতেই সে খুশি। এখন আর কাছের সম্পর্ক দানা বাধানোর চেষ্টা করে না। আশাও করে না খুব কাছে চলে আসবে কেউ, আপনজন বলতে যা বোঝায় তা ভাবা যাবে কারো কারো ব্যাপারে। ভাল আছে সে, এসব মাথাহীন কাজকর্ম নিয়ে দিব্যি ভাল আছে।

মাথাহীন-এটাই সমস্যা। এখন আর এ জীবনের কোনো মানে নেই। যৌবনে পড়া বিখ্যাত এক বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়, ‘আজব সময়ে আমি এক আজব মানুষ।

মাঝে মাঝে নিচে তাকায় সে। তাকায় সে গ্রহটার দিকে যেখানে আর কখনো হেঁটে বেড়াতে পারবে না। কোনো না কোনো এ্যালার্ম বাজিয়ে দেয় মানুষ এখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। বিচিত্র আত্মহত্যা। জ্বলন্ত উদাপিত হয়ে খসে পড়ে মানুষ পৃথিবীর কাছাকাছি আকাশে।

.

‘দ্বিতীয়বার আপনার দেখা পেয়ে ভাল লাগছে, কমান্ডার গোল।

‘আই এ্যাম স্যরি- এত মানুষের সাথে দেখা হয়- মনে পড়ছে না।

‘ক্ষমা চাওয়ার কোনো কারণ নেই। দেখা হয়েছিল নেপচুনের কাছে।

‘ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার- ডিলাইটেড টু সি ইউ। অটোশেফ থেকে কিছু খাবার পরিবেশন করতে পারি আপনার জন্য?

বিশভাগের উপর এ্যালকোহল মিশানো যে কোনো কিছু চলবে।’

‘পৃথিবীতে কী করছেন? তারা বলল কখনো মঙ্গলের আর্বিটের ভিতরে আসেন না আপনি।

কথাটা সত্যি। এখানেই জন্মেছি, কিন্তু আসতে তিতিবিরক্ত হয়ে যাই। মানুষ আর মানুষ। গিজগিজ করছে। আবার বিলিয়ন ছুঁয়ে ফেলবে সংখ্যাটা।’

‘আমার সময়ে দশ বিলিয়ন ছিল। বাই দ্য ওয়ে, আমার থ্যাঙ্ক ইউ মেসেজ পেয়েছেন?

হ্যাঁ- আসলে আগেই আপনার সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ ছিল। সূর্যের দিকে আসার অপেক্ষায় ছিলাম। এলামতো। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা।

ড্রিঙ্ক নিয়েছে চ্যান্ডলার। পোল খুঁটিয়ে দেখছে অতিথিকে। এ সমাজে দাড়ি, বিশেষত থুতনিতে সামান্য দাড়ি দেখা যায় না। বিশেষত এ্যাস্ট্রোনটদের মধ্যে এমন কখনো দেখেনি। স্পেস হেলমেটের সাথে মিলবে না। ই ভি এর যুগ অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। বাইরের কাজ এখন রোবট করবে এই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আচমকা বাইরে যাবার প্রয়োজন যে কোনো সময় পড়তে পারে।

আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু দেননি। পৃথিবী ভাল না লাগলে এলেন কেন?

‘ও- বিশেষত বন্ধুদের জন্য। ঘন্টা পেরিয়ে তারপর তাদের কথা শুনতে পাই, দেখতে পাই। ভাল্লাগে না। এই একমাত্র কারণ নয়। আমার বদলাতে হবে। কয়েক সেন্টিমিটার পুরু হয়ে গেলে ঘুমের অত্তি কমে যায়।’

‘আর্মার?’

‘ডাস্ট শিশু। আপনাদের সময়ে এসব ছিল না, তাই না? কি বৃহস্পতির এলাকা বিরক্তিকর। আমাদের গতি সেকেন্ডে কয়েক হাজার ক্লিক। তাই গায়ে সব সময় ময়লা হামলে পড়ে। অনেকটা বৃষ্টির মতো।’

‘ইউ আর জোকিং।’

অবশ্যই। এসব শুনতে পেলে মরেই যেতাম। শেষ দুর্ঘটনা ঘটেছিল বিশ বছর আগে। আমরা প্রধান প্রধান ধূমকেতু স্রোতের খবর রাখি। সেখানেই বেশিরভাগ জল। সাবধানে এড়িয়ে চলি।

যাই হোক, বৃহস্পতির পথে বেড়িয়ে যাবার আগে একবার ঢু মেরে যান না আমাদের এখানে।

আপনি কি বৃহস্পতিবললেন?

আসলে গ্যানিমিড। আনুবিস সিটি। আমাদের অনেকেই সেখানে আপনজন রেখে এসেছে। দেখা পাচ্ছে না অনেকদিন হল।

হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল পোলর।

একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে জীবনের একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেল সে। একেবারে নিষ্কর্মা বসে থাকার ধাত নেই কমান্ডার ফ্র্যাঙ্ক পোলের। সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার গতি, ধূলির পরশ, উত্তেজনা। হাজারখানেক বছর আগে সে এই বৃহস্পতিয় অঞ্চলে শেষ না করা কিছু কাজ ফেলে এসেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *