ঘটনাটি

ঘটনাটি

পরলোকগত আত্মার সঙ্গে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করার সময় এই ঘটনাটি শুনেছিলাম। প্ল্যানচেটের মিডিয়ম যে ভাবে ঘটনাটি বলে গেছল, হুবহু সেইভাবে বর্ণনা করছি :

সেদিন রাতের কিছু ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে আছে, আবার কিছু ঘটনা যেন অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো। তাই ঠিক কী হয়েছিল, তা গুছিয়ে বলা বেশ কঠিন। যেমন, কেন সেদিন লন্ডনে গিয়েছিলাম আর কেনই বা অত রাতে লন্ডন থেকে ফিরছিলাম, তা ঠিক মনে পড়ছে না। লন্ডনে আগে যতবার গেছি, সেদিনের লন্ডন যাত্রাটাও যেন সেগুলোর সঙ্গে মিশে তালগোল পাকিয়ে গেছে। তবে রাতে সেই ছোট্ট গ্রামের স্টেশনে নামার পর থেকে সবকিছু আমার স্পষ্ট মনে আছে—প্রতিটি মুহূর্ত।

ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের ঘড়িতে দেখলাম রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। ভাবলাম, বাড়ি যেতে যেতে হয়তো রাত বারোটা বেজে যাবে। স্টেশনের বাইরে এসে দেখলাম বড় মোটর গাড়িটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঝকঝকে পেতলের পার্টস আর জোরালো হেডলাইটের জন্য অন্ধকারের মধ্যেও গাড়িটা সহজেই চোখে পড়ল। গাড়িটার ডেলিভারি পেয়েছি সেই দিনই। ত্রিশ অশ্বশক্তির ইঞ্জিনওয়ালা বরাবার গাড়ি। আমার ড্রাইভার পার্কিনসকে জিগ্যেস করলাম,গাড়িটা কেমন চলছে?

ও বলল,–ভীষণ ভালো।

–আমি একটু চালিয়ে দেখব? এই বলে আমি ড্রাইভারের আসনে বসে পড়লাম।

–স্যর, এই গাড়ির গিয়ারগুলো একটু অন্য ধরনের। এই রাতে আর আপনাকে চালাতে হবে না। আমিই চালাই। বলল পার্কিনস্।

–না-না! আমিই চালাব। এই বলে গাড়ি স্টার্ট করে দিলাম। আমার বাড়ি স্টেশন থেকে পাঁচ মাইল দূরে।

গিয়ার বদলানোর পদ্ধতিটা একটু অন্যরকমের হলেও আমার ব্যাপারটা কঠিন বলে মনে হল না। রাতের অন্ধকারে নতুন গাড়ি নিয়ে এইরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাটা যদিও সম্পূর্ণ বোকামি, তবু মনে হল, মাঝে মাঝে এইরকম বোকামি করলে ক্ষতি কী। তা ছাড়া, সব নির্বুদ্ধিতারই তো আর ফল খারাপ হয় না।

ক্লেস্টাল হিল পর্যন্ত ভালোই চালালাম। কিন্তু এর পরের দেড়মাইল রাস্তার বদনাম আছে সারা দেশে-–শুধু চড়াইটা খাড়া বলে নয়, তিনটে বিপজ্জনক বাঁকও আছে। এই পাহাড়টা পেরোলেই আমার বাড়ি।

পাহাড়টার মাথা থেকে নীচে নামার সময় সমস্যা শুরু হল। বেশ দ্রুত গতিতে চলছিল গাড়িটা। হঠাৎ ভাবলাম, গিয়ারে না দিয়ে গাড়িটা নিউট্রালে উত্রাইয়ের রাস্তা দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু গাড়িটাকে নিউট্রালে আনা গেল না। শুধু তাই নয়, গাড়িটা টপ গিয়ারেই ফেঁসে রইল। উত্রাইয়ের রাস্তায় ঝড়ের বেগে নামছে গাড়ি, বাঁকগুলো আসবে একে একে।

সুতরাং গাড়িটা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্রেক কষলাম কিন্তু ব্রেক লাগল না। তাতেও ঘাবড়াইনি। কিন্তু এর পর হ্যান্ডব্রেকও যখন কাজ করল না, তখন আশঙ্কায় রীতিমতো ঘামতে শুরু করলাম। গাড়ির উজ্জ্বল হেডলাইটের আলোয় রাস্তা দেখে কোনেওরকমে প্রথম বাঁকটা পেরোলাম। এরপর প্রায় খাদে পড়তে পড়তে কোনওভাবে দ্বিতীয় বাঁকটাও পেরোনো গেল। এখন এক মাইল সোজা রাস্তা–তারপর তৃতীয় ও শেষ বাঁক। এই বাঁকটা কাটাতে পারলে এ যাত্রা বেঁচে যাব–কেন না, এরপর আমার বাড়ির রাস্তাটা একটু চড়াইয়ের মতো, গাড়ির গতি আপনা আপনি কমে যাবে।

এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও পার্কিনস্ ছিল সতর্ক ও তৎপর। মাথা একদম ঠান্ডা। ও বলল, স্যর, এভাবে কিন্তু আমরা শেষ বাঁকটা কাটাতে পারব না, গাড়ি অবশ্যই খাদে পড়ে যাবে। তার পরেই পার্কিনস ইঞ্জিনের সুইচ অফ করে দিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও গাড়ি অসম্ভব দ্রুতগতিতে গড়িয়ে চলল। তখন পাশের সিট থেকে হাত বাড়িয়ে স্টিয়ারিং হুইলটা সামলাতে সামলাতে পার্কিনস্ বলল,–স্যর, এই শেষ বাঁকটা আমরা কিছুতেই কাটাতে পারব না। আপনি বরং গাড়ির দরজা খুলে লাফিয়ে পড়ুন।

আমি বললাম, না! দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়! তোমার ইচ্ছে হলে তুমি লাফাতে পারো।

–না, স্যর, আমিও তাহলে আপনার সঙ্গেই থাকব। বলল পার্কিনস্।

এটা যদি আমার পুরোনো গাড়ি হত, তাহলে গাড়িটা রিভার্স গিয়ারে দিয়ে গিয়ার বক্স জ্যাম করে একটা সুযোগ নিতে পারতাম। কিন্তু এই গাড়িতে তা করা গেল না। পার্কিনস্ আমার জায়গায় ড্রাইভারের সিটে চলে আসার চেষ্টা করেও পারল না–যে গতিতে গাড়ি চলেছে, তাতে সেটা সম্ভব হল না। স্টিয়ারিং থেকে যেন কীরকম শোঁ শোঁ করে আওয়াজ হচ্ছে আর বিশাল ঝকঝকে নতুন গাড়িটা ক্যাচ কাঁচ আওয়াজ করে তীব্রগতিতে চলেছে। হেডলাইট জ্বলছে উজ্জ্বলভাবে। পলকের জন্য আমার মনে হয়, উলটোদিক থেকে যদি কোনও মানুষ বা বাহন আসে, আমাদের এই গাড়ি তাদের কাছে হবে মৃত্যুর উজ্জ্বল পরোয়ানার মতো।

তৃতীয় বাঁকটা কাটানোর সময় গাড়ির একটা চাকা মুহূর্তের জন্য খাদের ওপর ঝুলে থাকলেও খাদে না পড়ে কোনওরকমে আমরা বেঁচে গেলাম। এবার খালি একটা পার্কের গেট, যার ভিতর দিয়ে আমার বাড়ি যাব। কিন্তু গেটটা আমাদের ঠিক সামনে নয়, আমাদের এই রাস্তা থেকে বাঁদিকে বিশ গজ দূরে। স্টিয়ারিং হুইলটা ঠিকমতো ঘুরিয়ে নিশ্চয়ই ওই গেটের কাছে পোঁছোতে পারতাম। কিন্তু তৃতীয় বাঁকটা কাটানোর সময় সম্ভবত স্টিয়ারিংটা খারাপ হয়ে গেছল–সেটা আর ঠিকমতো ঘোরানো গেল না।

প্রাণপণ চেষ্টা করেও যখন গাড়িটাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখা গেল না, তখন আমি আর পার্কিনস দুজনেই গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়লাম। পরমুহূর্তেই পঞ্চাশ মাইল স্পিডে চলতে থাকা ওই গাড়ি গিয়ে ধাক্কা মারল পার্কের গেটের ডান দিকের থামে। সংঘর্ষের আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আর আমি? আমি তখন হাওয়ায় ভাসছি। কিন্তু তারপর তারপর কী হল?

পরে যখন আমি আমার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আবার সচেতন হলাম, তখন দেখি রাস্তার ধারে একটা ওক গাছের নীচে ঝোঁপের মধ্যে পড়ে আছি। একটা লোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে। প্রথমে মনে হল, লোকটা বোধহয় পার্কিনস্। তারপর লোকটাকে চিনতে পারলাম আমার কলেজ জীবনের প্রিয় বন্ধু স্ট্যানলি। আমাদের দুজনের মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। এই সময়ে এবং এই পরিস্থিতিতে ওকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে একটু অবাক হলাম। কিন্তু তখন আমার যা অবস্থা– বিপর্যস্ত, আচ্ছন্ন ভাব–সবকিছুই স্বপ্নের মতো লাগছে। যা দেখছি, বিনা প্রশ্নে বা সংশয়ে তাই মেনে নিচ্ছি।

আমি বললাম,–ও! কী সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট।

স্ট্যানলি মাথা নাড়ল। ওর মুখে আগের মতো সেই স্বচ্ছসুন্দর মৃদু হাসি।

আমি নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। নড়াচড়া করার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ। দেখতে পাচ্ছিলাম, কিছু লোক হাতে লণ্ঠন নিয়ে গাড়িটার ভগ্নাবশেষের গাছে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় কথা বলছে। চিনতে পারলাম ওদের। বাড়ির দারোয়ান, তার বউ আর দু-একজন। ওরা কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছিল না, গাড়ি নিয়েই ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ যেন কেউ যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল।

একজন বলল,–পুরো গাড়িটার ওজন ওর ওপর পড়েছে। খুব আস্তে করে গাড়িটাকে তুলে ধরো।

–এটা আমার পা! কে যেন বলে উঠল। গলাটা চিনতে পারলাম–পার্কিনস্ কথা বলছে।

–স্যর কোথায়? বলে চেঁচিয়ে উঠল পার্কিনস্।

–এই তো আমি এখানে। আমি উত্তর দিলাম। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতে পেল না। সবাই গাড়ির সামনে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছিল।

স্ট্যানলি আলতো করে আমার কাঁধে হাত রাখল। আঃ! কি আরাম ওর স্পর্শে। আমার ভারী ভালো লাগল।

–ব্যথা-ট্যথা নিশ্চয়ই নেই, কী বল? স্ট্যানলি জিগ্যেস করল।

–না, না। একদম ব্যথা নেই। আমি বললাম।

–হ্যাঁ, সেটাই তো স্বাভাবিক। ব্যথা একদম থাকে না। বলল স্ট্যানলি।।

এবং তখন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আমার মনে পড়ে গেল–স্ট্যানলি! স্ট্যানলি! ও তো অনেকদিন আগে আন্ত্রিক রোগে মারা গেছে, সেই বুয়র যুদ্ধের সময়।

কান্নায় অবরুদ্ধ গলায় ওকে আমি বললাম,–ভাই স্ট্যানলি! তুমি তো বেঁচে নেই!

স্ট্যানলি ওর সেই সহজ সুন্দর হালকা হাসি হেসে বলল,তুমিও।

How it happened গল্পের অনুবাদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *