অন্তর্ধান
লিভারপুল শহর থেকে মাইল দশেক দূরে বিশপস্ ক্রসিং নামে একটা ছোট গ্রামে এক ডাক্তার থাকতেন। তাঁর নাম ডাঃ অ্যালোইসিয়াস লানা। তিনি কেনই বা এই অখ্যাত গ্রামে এলেন বা তার পূর্বপরিচয় কী–এ ব্যাপারে কেউ বিশেষ কিছু জানত না। কেবল এটা সবাই জানত যে তিনি গ্লাসগো শহর থেকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে ডাক্তারি পাশ করেছিলেন। এও বোঝা যেত যে তিনি বিদেশি–সম্ভবত স্পেনের লোক। গায়ের রং প্রায় ভারতীয়দের মতো–ফ্যাকাশে ফরসা নয়। মাথার চুল কালো কুচকুচে। ঘন কালো ভ্র জোড়ার নীচে ঝকঝকে চোখে বুদ্ধির ছাপ। ব্যবহার ও চলাফেরায় যথেষ্ট আভিজাত্য। লোকে তাকে কালো ডাক্তার বলে উল্লেখ করত–প্রথমদিকে কৌতুকে, পরে সম্মানের সঙ্গে।
ডাঃ লানা মেডিসিন এবং সার্জারি–দুটোতেই ছিলেন সমান পারদর্শী। এমনকী লিভারপুলের মত বড় শহরের ডাক্তারদের থেকেও তাঁর খ্যাতি বেশি ছিল। লিভারপুলের এক লর্ড-এর ছেলেকে অস্ত্রোপচার করে সারিয়ে ডাঃ লানা বেশ নাম করেছিলেন। আর তার সুন্দর চেহারা ও বিনীত ব্যবহারের জন্যও সবাই তাকে পছন্দ করত। কেউ আর তার বংশপরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাত না।
এত গুণের অধিকারী ডঃ লানার বিরুদ্ধে সবাইয়ের একটাই অভিযোগ ছিল তিনি বিয়ে করছেন না কেন? ভালো পসারের জন্য প্রভূত অর্থের মালিক ডাঃ লানার বাড়িটা ছিল বিশাল। অনেকেই তার বিয়ের সম্বন্ধে এনেছিলেন, কিন্তু ডাক্তার বিয়ের ব্যাপারে কোনও উৎসাহ দেখাননি। যাই হোক, সবাই যখন ধরেই নিয়েছে যে ডাক্তার-পাকাপাকিভাবে অবিবাহিত থাকবেন, তখনই হঠাৎ জানা গেল যে, লি হল নামে একটা বাড়ির মেয়ে মিস ফ্রান্সেস মর্টনের সঙ্গে ডাঃ লানার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
ফ্রান্সেস-এর বাবা-মা দুজনের কেউই বেঁচে নেই। ও থাকে ভাই আর্থারের সঙ্গে। ওদের বিশাল সম্পত্তির দেখাশোনা করে আর্থারই। ফ্রান্সেসের চেহারার আভিজাত্য এবং ওর সংবেদনশীল স্বভাব দেখে ডাঃ লানা একটা পার্টিতে ওর সঙ্গে আলাপ করেন এবং তারপর কিছুদিন মেলামেশার পরে এই বিয়ের প্রস্তাব। ফেব্রুয়ারি মাসে ঠিক হল যে, অগাস্ট মাসে বিয়ে হবে। ডাক্তারের বয়স সাঁইত্রিশ ও ফ্রান্সেসের বয়স মাত্র চব্বিশ হলেও, সব মিলিয়ে ওদের জুড়িটা ভালোই হয়েছে বলে সবার ধারণা।
৩ জুন আর্জেন্টিনার বুয়েনস এয়ার্স থেকে ডাঃ লানার নামে একটা খামে ভরা চিঠি এল। খামের ওপর ঠিকানাটা কোনও পুরুষের হস্তাক্ষর বলেই মনে হল পোস্টমাস্টারের। এই প্রথম ডাঃ লানার নামে বিদেশ থেকে কোনও চিঠি এল।
পরের দিন, অর্থাৎ ৪ জুন ডাঃ লানা ফ্রান্সেসদের বাড়িতে গেলেন এবং মিস ফ্রান্সেসের সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর ডাক্তার বেশ উত্তেজিত অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন। এদিকে মিস ফ্রান্সেসও সারাদিন আর নিজের ঘর থেকে বেরোল না। বাড়ির পরিচারিকা বেশ কয়েকবার ফ্রান্সেসকে চোখের জল ফেলতে দেখেছিল।
এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে ডাক্তার ও ফ্রান্সেসের বিয়ে হচ্ছে না। ডাক্তার নাকি ফ্রান্সেস-এর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন এবং ফ্রান্সেস-এর ভাই আর্থার ডাক্তারকে চাবুক দিয়ে মারবে বলে শাসিয়েছে।
ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছিল, তা কেউ বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে ডাক্তার লি হল-এর দিকের রাস্তায় যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, এমনকী চার্চে যাওয়াও। অর্থাৎ, ডাক্তার ফ্রান্সেসকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে লাগলেন। স্থানীয় খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন (বিজ্ঞাপনদাতার নাম ছিল না) থেকে অনেকেই অনুমান করলেন যে ডাক্তার তার প্র্যাকটিসটাও বিক্রি করে দিতে চাইছেন।
এরকম যখন পরিস্থিতি, তখন ২১ জুন সোমবার এমন একটা ঘটনা ঘটল যে পুরো ব্যাপারটা আর স্থানীয় গল্পগুজব কিংবা কানাঘুষোর পর্যায়ে রইল না। কী হয়েছিল, বলি।
ডাক্তারের বাড়িতে কাজ করতেন দুই মহিলা–মার্থা ও মেরি। প্রথমজন গৃহস্থালীর তত্ত্বাবধান করতেন, আর মেরি ছিল কাজের মেয়ে। এ ছাড়া ছিল আরও দুজন–একজন কম্পাউন্ডার আর অন্যজন ঘোড়াগাড়ির চালক। দুজনেই থাকত বাড়ির কম্পাউন্ডের আউটহাউসে।
ডাক্তারের অপারেশনের ঘরের পাশেই ছিল তার পড়ার ঘর। অনেক রাত অবধি ডাক্তার সেখানে পড়াশোনা করতেন। অপারেশনের ঘরের একটা দরজা ছিল বাইরের দিকে–এই দরজা দিয়ে কেউ যাওয়া আসা করলে বাড়ির লোকে কেউ কিছু জানতে পারত না। অনেক সময় রাতের দিকে কোনও রোগী এলে তারা বাড়ির প্রধান দরজায় না গিয়ে এই দরজা দিয়েই ডাক্তারের কাছে যেত।
২১ জুন রাত সাড়ে নটার সময় মাখা ডাক্তারের পড়ার ঘরে গিয়ে দেখেন, ডাক্তার পড়াশোনায় ব্যস্ত। মার্থা তখন ডাক্তারকে শুভরাত্রি জানিয়ে মেরিকেও শুয়ে পড়তে বলেন। তারপর মাথা রাত পৌনে এগারোটা পর্যন্ত বাড়ির টুকিটাকি কাজে ব্যস্ত থাকেন। হলঘরের ঘড়িটায় যখন এগারোটা বাজছে, তখন মাথা নিজের ঘরে যান। তার পনেরো-কুড়ি মিনিট পরে বাড়ির মধ্য থেকে একটা তীব্র চিৎকারের আওয়াজ তার কানে আসে। তক্ষুনি ড্রেসিং গাউন পরে মার্থা দৌড়ে যান ডাক্তারের পড়ার ঘরের দিকে। ঘরের দরজায় তিনি টোকা দিলে ভেতর থেকে আওয়াজ আসে–কে?
–স্যর, আমি মার্থা।
-আপনি এই মুহূর্তে নিজের ঘরে চলে যান। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
কথাগুলো কর্কশ লাগলেও এবং এই ধরনের কথা বলা ডাক্তারের স্বভাব বিরুদ্ধ হলেও, মার্থার ধারণা কথাগুলো ডাক্তারেরই এবং গলার আওয়াজও তার। যাই হোক, সাড়ে এগারোটা নাগাদ মার্থা নিজের ঘরে ফিরে যান।
রাত এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে কোনও সময়ে ডাঃ লানার সঙ্গে দেখা করতে আসেন মিসেস ম্যাডিং। তার স্বামী টাইফয়েড-এ ভুগছিলেন, এবং ডাক্তার বলেছিলেন রাতের দিকে রোগীর অবস্থাটা তাকে জানিয়ে যেতে।
মিসেস ম্যাডিং দেখেন ডাক্তারের ঘরে আলো জ্বলছে। কিন্তু বেশ কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়েও ডাক্তারের সাড়া না পেয়ে তিনি ভাবলেন যে ডাক্তার হয়তো কোথাও বেরিয়েছেন। অগত্যা মিসেস ম্যাডিং নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়ান। কম্পাউন্ডের ভেতর থেকে গেটের কাছে যাওয়ার সময় গেটের আলোয় তিনি একজন লোককে আসতে দেখেন। প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো ডাক্তারই ফিরে আসছেন। কিন্তু মিসেস ম্যাডিং কিছুটা অবাক হয়েই দেখেন যে আগন্তুক আর কেউ নন, ফ্রান্সেস মর্টনের দাদা আর্থার মর্টন। আর্থারের হাবভাবে উত্তেজনা, হাতে একটা চাবুক।
ডাক্তার বাড়িতে নেই, এ কথা বলার পরও আর্থার বেশ কড়াভাবে বলল,-ঘরে যখন আলো জ্বলছে, কখনও
কখনও তো ডাক্তার ফিরবেনই। এই বলে আর্থার বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে গেল আর মিসেস ম্যাডিং চলে গেলেন নিজের বাড়ির দিকে।
রাত তিনটে নাগাদ অসুস্থ মিঃ ম্যাডিং-এর অবস্থার দ্রুত অবনতি হল। মিসেস ম্যাডিং তক্ষুনি আবার ডাক্তারের বাড়িতে যান। বাড়ির কম্পাউন্ডে ঝোঁপের আড়ালে একটা লোককে তিনি দেখতে পান। মিসেস ম্যাডিং-এর ধারণা, লোকটা আর্থার মর্টন। যাই হোক, এ ব্যাপারে আর মাথা না ঘামিয়ে বাড়ির কাছে গিয়ে তিনি দেখতে পান, পড়ার ঘরের সেই আলোটা একইরকম উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে। দরজায় বহুবার করাঘাত করে এবং জানালায় টোকা দিয়েও ডাক্তারের সাড়া পাওয়া গেল না। তখন বাধ্য হয়েই জানলার কাঠের ফ্রেম ও পরদার মধ্যে এক জায়গায় একটু ফাঁক পেয়ে ঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলেন মিসেস ম্যাডিং।
ঘরের মাঝখানে একটা বড় বাতি জ্বলছে। টেবিলের ওপর ডাক্তারের বইপত্র, যন্ত্রপাতি ছড়ানো। প্রথমে মনে হল, ঘরের মেঝের ওপর একটা ময়লা সাদা দস্তানা পড়ে আছে। কিন্তু আলোয় চোখটা একটু সয়ে যেতেই মিসেস ম্যাডিং বুঝতে পারলেন যে দস্তানাটা আসলে একটা মানুষের হাত আর মানুষটা মেঝের ওপর নিঃসাড়ভাবে পড়ে আছে।
সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটেছে এটা বুঝতে পেরে তিনি তখন বাড়ির সামনের দরজায় গিয়ে বেল বাজিয়ে মার্থাকে ডাকলেন। তারপর মার্থা ও তিনি ঢুকলেন ওই পড়ার ঘরে। আর মেরিকে পাঠানো হল পুলিশে খবর দিতে।
টেবিলের পাশেই, জানলার থেকে একটু দূরে ডাঃ লানা চিত হয়ে পড়ে আছেন এবং নিঃসন্দেহে তিনি মৃত। মুখে ও ঘাড়ে কালশিটে পড়া আঘাতের চিহ্ন। একটা চোখের ওপরেও আঘাত লেগেছে মনে হল। মুখচোখের ফোলাভাব দেখে মনে হয়, ডাক্তারকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।
ডাক্তারের পরনে তার ডাক্তারি অ্যাপ্রন, পায়ে কাপড়ের চটি। চটিজোড়া কিন্তু পরিষ্কার, তাতে কোনও ময়লা লেগে নেই। অথচ কার্পেটের ওপর কাদামাখা বুটজোড়ার ছাপ– হয়তো খুনির বুট জোড়ারই।
সবকিছু দেখে শুনে পুলিশ এই সিদ্ধান্তে এল যে অপারেশনের ঘরের দরজা দিয়েই খুনি ঘরে ঢুকেছিল, এবং কাজ সেরে লুকিয়ে পালিয়ে গেছে। আঘাতের প্রকৃতি ও জুতোর ছাপ দেখে মনে হয়, খুনি পুরুষ।
ঘরের ভেতর থেকে কোনও কিছু চুরি যায়নি–এমনকী ডাক্তারের সোনার ঘড়িটাও তাঁর পকেটে আছে। ফ্রান্সেস মর্টনের একটা ছবি থাকত এই ঘরে–মার্থা দেখলেন, ছবিটা নেই। মেঝের ওপর সবুজ রঙের একটা চোখ-ঢাকা দেওয়ার প্যাঁচ পড়ে আছে। এটা অবশ্য ডাক্তারেরই জিনিস হতে পারে, যদিও মার্থা আগে কখনও এটা দ্যাখেননি।
সমস্ত সন্দেহ গিয়ে পড়ল একজনেরই ওপর–আর্থার মটন। এবং পুলিশ তকে গ্রেফতার করল। আর্থারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও আনুষঙ্গিক প্রমাণ সাংঘাতিক। বোনের সঙ্গে ডাঃ লানা বিচ্ছেদ হওয়ার পর আর্থারের প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি অনেকেই শুনেছে। পুলিশের অনুমান, চাবুক হাতে রাত এগারোটায় আর্থার ডাক্তারের ঘরে ঢোকে। সেই সময় ভয়ে বা রাগে ডাক্তার চেঁচিয়ে ওঠেন, মার্থা সেই চিৎকার শুনেছেন। তারপর আর্থার ও ডাক্তারের মধ্যে বাবিতণ্ডা এমন পর্যায় পৌঁছয় যে, আর্থারের আঘাতে ডাক্তারের মৃত্যু হয়।
ময়না তদন্তের রিপোর্টে জানা যায় যে, ডাক্তারের হার্টের রোগ ছিল–সেটা অবশ্য তার পরিচিতরা কেউ জানত না। হয়তো দুর্বল হার্টের জন্যই তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। তার পরেই আর্থার বোনের ছবিটা ফ্রেম থেকে ছিঁড়ে নিয়ে কম্পাউন্ডের ঝোঁপঝাড়ের পাশ দিয়ে লুকিয়ে বাড়ি চলে যায়। সরকার পক্ষের উকিল এই ঘটনাচক্রের ভিত্তিতেই তার বক্তব্য রাখলেন।
অবশ্য আর্থারের স্বপক্ষেও কিছু তথ্য ছিল। একটু গোঁয়ার ভাব থাকলেও ওর সরলতা ও দিলখোলা স্বভাবের জন্য সবাই ওকে ভালোবাসত। ও পুলিশকে শুধু এটুকুই বলেছিল যে, ডাক্তারের সঙ্গে পারিবারিক কিছু ব্যাপারে কথা বলার জন্যই ও ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছিল। নিজের বয়ানে বা পুলিশের জেরার উত্তরে ও কিন্তু কখনও নিজের বোনের সম্বন্ধে কোনও কথা বলেনি। যাই হোক, ডাক্তারকে না পেয়ে কম্পাউন্ডে অপেক্ষা করে করে শেষে রাত তিনটের সময় ও বাড়ি ফিরে যায়। ডাক্তারের মৃত্যুর ব্যাপারে ও কিছুই জানত না।
সত্যিই কিছু তথ্য আর্থারের নির্দোষিতা প্রমাণ করে। ডাঃ লানা রাত এগারোটার সময় তার পড়ার ঘরে ছিলেন–জীবিত, কেন না মার্থা ওই সময় ডাক্তারের গলার আওয়াজ শুনেছিলেন। হতে পারে, তখন ডাক্তারের সঙ্গে অন্য কেউ ছিল। যেভাবে ডাক্তার অধৈর্যের সঙ্গে মার্থাকে ওই সময় চলে যেতে বলেন, তাতে তাই মনে হয়। এই যুক্তি যদি সত্যি হয়, তাহলে ডাক্তারের মৃত্যু হয়েছিল এই দুই ঘটনার মধ্যে কোনও সময়ের গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া এবং মিসেস ম্যাডিং-এর ডাক্তারের বাড়ি আসা। সে ক্ষেত্রে আর্থার নির্দোষ, কেন না মিসেস ম্যাডিং আর্থারকে দেখেন এর পরে, গেটের কাছে।
এবার প্রশ্ন, ডাক্তার লানার ঘরে তাহলে কে এসেছিল এবং কী উদ্দেশ্যে। আর্থারকে ছাড়া বাড়ির ত্রিসীমানায় আর কাউকে দেখা যায়নি। তা ছাড়া, ডাক্তারের প্রতি তার বিরূপ মনোভাব ছিল সুবিদিত। কাদামাখা জুতোর ছাপ দেখেও কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। সেদিন বৃষ্টি হওয়ায় যে কেউই ডাক্তারের ঘরে এসে থাকুক, তার জুতোর ছাপ কাদামাখাই হত। ফ্রান্সেসের ছবিটা আর্থারের কাছে না পাওয়া গেলেও তার মানে এই নয় যে, আর্থার নির্দোষ কেন না ছবিটা সরিয়ে ফেলার বা নষ্ট করার যথেষ্ট সময় আর্থারের হাতে ছিল। সব মিলিয়ে এটা কিছুতেই বোঝ যাচ্ছিল না যে আর্থার দোষী না নির্দোষ।
রহস্যময় এবং বিয়োগাত্মক ঘটনাটির এই হল সংক্ষিপ্তসার। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আয়ার্ল্যান্ডে লোকজন এই রহস্য নিয়ে প্রচুর আলোচনা করেছিল। সমাধানের বিভিন্নরকম সূত্রও দিয়েছিল। কিন্তু আদালতে বিচারের সময় যে চাঞ্চল্যকর পরিণতির ইঙ্গিত পাওয়া গেল, তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। তখনকার “ল্যাংকাশায়ার উইলি” নামের খবরের কাগজে এই বিচারের যে রিপোর্ট বেরিয়েছিল, তারই একটা সংক্ষিপ্তসার এখানে দেওয়া যায়।
সরকার পক্ষের উকিল মিঃ কার আর্থারের বিরুদ্ধে এমনভাবে কেস সাজিয়েছিলেন যে আর্থারের উকিল মিঃ হামফ্রি প্রায় অসহায় হয়ে পড়লেন। বেশ কয়েকজন সাক্ষী জানাল যে, বোনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্য ডাক্তারের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার বাসনা তারা আর্থারের মুখে শুনেছে। মিসেস ম্যাডিং বললেন যে, তিনি আর্থারকে ওই রাতে ডাক্তারের বাড়ির কম্পাউন্ডে দেখেছেন। আরেকজন সাক্ষী বলল যে, আর্থার ভালোভাবেই জানত যে ডাঃ লানা
অনেক রাত অবধি মূল নিবাস থেকে বিচ্ছিন্ন তার চেম্বারে কাজ করেন এবং সেই জন্যই সে অত রাতে এসেছিল। ডাক্তারের এক চাকর তো মিঃ কারের জেরায় নাজেহাল হয়ে বলেই ফেলল যে ডাক্তার রাত তিনটের সময় বাড়ি ফিরেছিলেন। সুতরাং, মিসেস ম্যাডিং যেহেতু রাত তিনটের সময় আর্থারকে দেখেছিলেন, ব্যাপারটা দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল।
এমনকী ডাক্তারের ঘরে পাওয়া জুতোর ছাপের সঙ্গে আর্থারের জুতোর ছাপের মিল সরকার পক্ষ প্রায় প্রমাণ করে দিল।
বেলা তিনটের সময় যখন মিঃ কার তার বক্তব্য শেষ করলেন এবং আদালত দ্বিপ্রহরিক বিরতির জন্য বন্ধ রইল, তখন উপস্থিত সবাই এটা বুঝে গেল যে, আর্থারকে নির্দোষ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব।
সাড়ে চারটের সময় আবার আদালত চালু হতেই বেশ হই-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, কেন না আর্থারের উকিল পেশ করলেন তাঁর প্রথম সাক্ষীকে মিস ফ্রান্সেস মর্টন। ফ্রান্সেসকে একটু বিচলিত দেখালেও সে কিন্তু নীচু গলায় অথচ পরিষ্কারভাবে সাক্ষ্য দিল।
ও বলল, ডাক্তারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের শীঘ্রই ছাড়াছাড়ি হতে চলেছে। ওর ভাই আর্থার ডাক্তার সম্বন্ধে যেসব মন্তব্য করেছে, সেগুলো অনুচিত, কেন না ডাঃ লানা অত্যন্ত সজ্জন এবং তিনি ফ্রান্সেস-এর সঙ্গে কোনওরকম দুর্ব্যবহার করেননি। আর্থারকে প্রচুর বোঝানো সত্ত্বেও ফ্রান্সেস ওকে শান্ত করতে পারেনি। এমনকী ঘটনার দিন সন্ধেবেলায় “ওই ডাক্তারকে আমি দেখে নেব” বলে আর্থার শাসিয়েছিলেন।
ফ্রান্সেস-এর বক্তব্য এখনও পর্যন্ত আর্থারের বিরুদ্ধেই যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই আর্থারের উকিল মিঃ হামফ্রি ব্যাপারটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন।
মিঃ হামফ্রি : আচ্ছা, ফ্রান্সেস, তোমার কি বিশ্বাস তোমার ভাই অপরাধী?
জজ : আদালতে বিশ্বাসের কোনও জায়গা নেই– প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করুন।
মিঃ হা : তুমি কি জানো তোমার ভাই ডাঃ লানাকে খুনের অপরাধে অভিযুক্ত নয়?
ফ্রান্সেস : জানি।
মিঃ হা : কীভাবে?
ফ্রা : কেন না ডাঃ লানা মারা যাননি।
এই চাঞ্চল্যকর উক্তিতে আদালতে বেশ গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। একটু পরে আবার শুরু হল সওয়াল জবাব।
মিঃ হা : ফ্রান্সেস, তুমি কী করে জানলে যে ডাঃ লানা মারা যাননি?
ফ্রা : কেন না তার তথাকথিত মৃত্যুর তারিখের পরে লেখা তাঁর চিঠি আমি পেয়েছি।
মিঃ হা : চিঠিটা তোমার কাছে আছে?
ফ্রা : আছে, কিন্তু সেটা আমি দেখাতে চাই না।
মিঃ হা : খামটা?
ফ্রা : হ্যাঁ–এই যে খামটা। লিভারপুল পোস্ট অফিসের ছাপ–তারিখ ২২ জুন।
মিঃ হা : তার মানে, তার তথাকথিত মৃত্যুর পরের দিন। তুমি শপথ করে বলতে পারো–এই হাতের লেখা ডাঃ লানার?
ফ্রা : অবশ্যই। আমি আরও ছজন লোককে আনতে পারি যারা এই হাতের লেখা চেনে।
জজ : মিঃ হামফ্রি, তাহলে আপনি সেই সাক্ষীদের কাল কোর্টে আসতে বলুন।
সরকার পক্ষের উকিল মিঃ কার তখন বললেন,–চিঠিটা আমাদের দেওয়া হোক, যাতে বিশেষজ্ঞ দিয়ে আমরা পরীক্ষা করাতে পারি হাতের লেখাটা সত্যিই ডাঃ লানার না নকল। এই চিঠিটা যখন মিস ফ্রান্সেস মর্টনের কাছেই ছিল, তাহলে সেটা উনি আগেই পুলিসকে দিলেন না কেন? তাহলে মামলাটা এতদুর গড়াত না। হয়তো অভিযুক্তকে বাঁচানোর জন্য শেষ মুহূর্তে এই নকল চিঠিটা দেখিয়ে আদালতের রায় বদলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
মিঃ হা : ফ্রান্সেস, এই ব্যাপারে তোমার কি কোনও বক্তব্য আছে?
ফ্রা : ডাঃ লানা চিঠির ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেছিলেন।
মিঃ কার : তাহলে তুমি এখন এই চিঠিটা পেশ করলে কেন?
ফ্রা : আমার ভাইকে বাঁচানোর জন্য।
জজ : ঠিক আছে। আপাতত আদালত মুলতুবি রইল। আগামীকাল আবার শুনানি হবে। মিঃ হামফ্রিকে প্রমাণ করতে হবে মৃত মানুষটির দেহটা কার।
রহস্যের এই আকস্মিক মোচড় নিয়ে খবরের কাগজে প্রচুর লেখালেখি হয়। যদি সত্যিই প্রমাণ হয় যে ডাঃ লানা জীবিত, তাহলে সেই অপরিচিত লোকটির মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। হয়তো তার চিঠিতে এই ব্যাপারে স্বীকারোক্তি আছে। অর্থাৎ, ফ্রান্সেস যদি তার ভাইকে বাঁচাতে চায়, তাহলে ডাঃ লানাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হবে–কেন না হত্যার শাস্তি মৃত্যু।
পরের দিন সকালে আদালত লোকজনে ভরতি। মিঃ হামফ্রির হাবভাব বেশ বিচলিত। উনি সরকার পক্ষের উকিল মিঃ কারের কানে কানে কিছু বললেন। তা শুনে মিঃ কারের মুখ চোখের চেহারা পালটে গেল। এর পর মিঃ হামফ্রি জজসাহেবকে বললেন যে, তিনি ফ্রান্সেসকে সাক্ষী দিতে আর ডাকছেন না এবং এ-ব্যাপারে মিঃ কারের কোনও আপত্তি নেই।
জজ : তাহলে কিন্তু, মিঃ হামফ্রি, এই রহস্যের সমাধান করা মুশকিল হয়ে পড়বে।
মিঃ হা : আমি অন্য একজন সাক্ষীকে পেশ করছি, যার সাক্ষে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
জজ : ঠিক আছে। তাহলে ডাকুন আপনার সাক্ষীকে।
মিঃ হা : সাক্ষী ডাঃ অ্যালোইসিয়াস লানাকে ডাকা হোক।
বলা বাহুল্য, বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো আদালত এবং সমবেত লোকজন।
যে ডাক্তারকে নিয়ে এত আলোচনা এবং যার মৃত্যু নিয়ে এই বিচার, তাকে আদালতে সশরীরে দেখতে পেয়ে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। যারা ডাঃ লানাকে আগে দেখেছে, তাদের মনে হল ডাক্তারের চেহারা যেন একটু শুকিয়ে গেছে, মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ব্যক্তিত্বের বিশিষ্টতা ও আভিজাত্য একটুও কমেনি। জজসাহেব অনুমতি দিলে ডাঃ লানা তার বিবৃতি শুরু করলেন ।
২১ জুন রাতে যা ঘটেছিল, তা আমি সম্পূর্ণ খোলাখুলিভাবে বলব। যদি আগেই জানতে পারতাম যে এই ঘটনার জন্য নিরপধ কেউ শাস্তি পেতে চলেছে, তাহলে আরও আগেই আমার বক্তব্য জানাতাম কিন্তু আমি নিজেও জানতাম না জল এতদূর গড়িয়েছে। যাই হোক, আমার দ্বারা যেটুকু ভুলভ্রান্তি হয়েছে, সেটাও আমি ঠিক করার চেষ্টা করছি।
আর্জেন্টিনা সম্বন্ধে যারা জানেন, তাদের কাছে লানা পরিবারের নাম সুবিদিত। প্রাচীন স্পেনের এক অভিজাত বংশের লোক আমরা। আমার বাবা আর্জেন্টিনা উচ্চ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। দাঙ্গায় তার মৃত্যু না হলে হয়তো আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতিও হয়ে যেতেন। আমি আর আর্নেস্ট ছিলাম দুই যমজ ভাই। আমাদের দুজনকে অবিকল একরকম দেখতে ছিল। লোকে প্রায়ই বুঝে উঠতে পারত না–কে আর্নেস্ট আর কে অ্যালোইসিয়াস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার ভঙ্গি বা মুখের অভিব্যক্তি একটু আলাদা হতে থাকলেও আমাদের শারীরিক মিল ছিল একইরকম।
মৃত ব্যক্তির সম্বন্ধে কোনও বিরূপ মন্তব্য করা ঠিক নয়, আর বিশেষত সেই ব্যক্তি যদি নিজের ভাই হয়। তবুও আপনাদের এটুকু জানা দরকার যে, আমার ভাই মোটেই ভালো মানুষ ছিল না। ওকে আমি রীতিমতো ভয় পেতাম, কেন না ওর অনেক অপকর্মের দায় আমাকে বহন করতে হয়েছিল আমাদের চেহারার সাদৃশ্যের জন্য।
অবশেষে একটা অত্যন্ত বিশ্রী ব্যাপারে যখন ওর কৃতকর্মের পুরো দায়টাই আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিল, তখন আমি জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে চিরদিনের মতো ইউরোপে চলে এলাম। গ্লাসগো থেকে ডাক্তারি পাশ করে এই অঞ্চলে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম। ভেবেছিলাম, ল্যাংকাশায়ারের এই প্রত্যন্ত গ্রামে আর্নেস্টের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, এত বছর পরেও ও আমার খোঁজ পেয়ে গেল। ওর টাকাকড়ি কিছু নেই, পুরোপুরি নিঃস্ব। একটা চিঠি লিখে আমাকে জানাল, ও আসছে। ও জানত, আমি ওকে ভয় পাই। তাই ওর মতলব, আমাকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা। আমি বুঝতে পারলাম, আর্নেস্টের আগমন যথেষ্ট বিপজ্জনক, এবং সেটা শুধু আমার কাছে নয়, আমার পরিচিত ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছেও।
যাই হোক, ওই দিন রাত দশটা নাগাদ, আমার ভাই এসে হাজির হল। জানলার কাঁচের বাইরে ওর মুখটা দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিলাম–এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল ওটা আমারই প্রতিচ্ছবি। এত মিল আমাদের দুজনের। চোখে পড়ল, ওর ঠোঁটের কোণে সেই পুরোনো বদমায়েসি হাসি। এই আমার সেই ভাই, যার জন্য আমি দেশছাড়া। মাথা ঠান্ডা রেখে দরজা খুলে দিলাম। ও ভেতরে এল।
দেখেই বুঝলাম ওর অবস্থা খুব খারাপ। হতদরিদ্র অবস্থায় লিভারপুল থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে। জাহাজে নাবিকদের সঙ্গে হয়তো মারপিট করেছিল। একটা চোখে আঘাত লেগেছে–সেই চোখের ওপর একটা প্যাঁচ লাগানো। কিন্তু আমার ডাক্তারি চোখে বুঝতে পারলাম যে ওর শরীরে সম্ভবত কোনও সাংঘাতিক ব্যাধিও আছে।
ও আমাকে কেমনভাবে অপমান করল বা কীসের ভয় দেখাল, সে বিষয়ে এখানে আর কিছু বলতে চাই না। কিন্তু এটুকু বলা দরকার যে ওর চরম দুর্ব্যবহার ও গালিগালাজ সত্ত্বেও আমার মাথা ঠান্ডা রেখেছিলাম। বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে ওর দারিদ্র্য ওকে আমার প্রতি এমন বিদ্বেষপূর্ণ করে তুলেছে–কেন না আমি প্রভূত বিত্তের মালিক।
চেঁচামেচি করে ঘুষি পাকিয়ে আমার দিকে হঠাৎ একবার এগিয়ে আসার সময় ও হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে বুকের একপাশ চেপে ধরে একটা চিৎকার করে ধড়াস করে মেঝের ওপর পড়ে গেল। ওকে তুলে ধরে সোফাতে শোওয়ালাম। কোনও সাড়াশব্দ নেই মুখে, হাত ঠান্ডা। ওর বদমেজাজ ও অসুস্থ হার্ট–দুয়ে মিলে ওর মৃত্যু হয়েছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। পুরো ব্যাপারটা একটা সাংঘাতিক দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিল। আর্নেস্টের শেষ চিৎকারটা শুনে মার্থা দরজায় করাঘাত করেছিলেন–তাকে আমি চলে যেতে বলেছিলাম। তারপরে আমার চেম্বারের দরজায় টোকা দিয়েছিল কেউ সম্ভবত কোনও রোগী। আমি দরজা খুললাম না। বসে বসে বিশেষ কোনও চিন্তা ছাড়াই মাথায় হঠাৎ একটা প্ল্যান এসে গেল।
আপনারা জানেন, বিশপস ক্রসিং-এ থাকা আমার পক্ষে ব্যক্তিগত কারণে একটু অসুবিধাজনক হয়ে পড়ছিল। বিশেষত ফ্রান্সেস-এর সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার ব্যাপারটা ভেঙে যাওয়াতে আমি লোকের সহানুভূতির বদলে খারাপ ব্যবহারই পেয়েছিলাম। আর্নেস্টের মৃতদেহ দেখে আমার মনে হল, বিশপস্ ক্রসিং থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ এখন আমার হাতে।
শরীরটা আমার থেকে একটু বেশি ভারী ও মুখে একটা কর্কশভাব–এ ছাড়া আমার আর আর্নেস্টের মধ্যে কোনও শারীরিক তফাত নেই। এমনকী দুজনেরই দাড়িগোঁফ কামানো। মাথার চুলও প্রায় একই দৈর্ঘের। যদি ওর সঙ্গে আমার পোশাকটা বদলে নিই, তাহলে সবাই ভাববে, ডাঃ লানা মারা গেছে।
প্ল্যানমতে এক ঘণ্টার মধ্যে ভাইয়ের সঙ্গে আমার পোশাক বদল করে বাড়িতে যা টাকাকড়ি ছিল তা সঙ্গে নিয়ে আমার চেম্বারের বাইরের দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম=-সঙ্গে ছিল একজনের একটা ছবি। ভুল করে ফেলে এসেছিলাম খালি একটা জিনিস–ভাইয়ের চোখের ওপর লাগানো সেই প্যাঁচটা। সেই রাতেই পৌঁছে গেলাম লিভারপুল।
জজসাহেব, আমি শপথ করে বলতে পারি যে আমি কখনও ভাবিনি যে লোকে বুঝবে আমাকে খুন করা হয়েছে, এবং সেইজন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। বরং আমি ভেবেছিলাম এখান থেকে চলে গেলে কিছু লোক আর আমাকে দেখে বিবিব্রত বোধ করবেন না।
কোনও দূর দেশে চলে যাওয়ার আগে কিছুদিনের জন্য জাহাজ ভ্রমণে যাব এই ভেবে লিভারপুলে একটা জাহাজের টিকিট কেটে ফেললাম। কিন্তু জাহাজে ওঠার আগে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। মর্টন পরিবারের আর সবাই আমার সঙ্গে যেরকম ব্যবহারই করে থাকুন না কেন, আমি জানতাম আমার মৃত্যু সংবাদে ফ্রান্সেস খুবই কষ্ট পাবে। তাই ফ্রান্সেসকে সবকিছু জানিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। চিঠিটার কথা আদালতে জানিয়ে ফ্রান্সেস ভালোই করেছে—না হলে নিরপরাধ আর্থার হয়তো শাস্তি পেত। যদিও আমি ওকে চিঠির ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেছিলাম।
গতরাতেই জাহাজ ভ্রমণে শেষ করে লিভারপুলে ফিরেছি। আমার তথাকথিত মৃত্যু নিয়ে জল কতদূর গড়িয়েছে অথবা আর্থার মর্টন আমাকে হত্যার ব্যাপারে অভিযুক্ত হয়েছে–এসব আমি কিছুই জানতাম না। গতকাল সন্ধের কাগজে আইন-আদালত সংক্রান্ত পাতায় খবরটা পড়েই একটা এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে এখানে চলে এসেছি–আদালতকে সত্যিটুকু বলব বলে।
বলা বাহুল্য, ডাঃ লানার এই বিবৃতির পরে মামলা খারিজ হয়ে গেল। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য পুলিশ আরও খোঁজখবর নিল। যেমন, যে জাহাজে ডাঃ লানার ভাই আর্জেন্টিনা থেকে ইংল্যান্ডে এসেছিল, সেই জাহাজের ডাক্তার পুলিশকে জানালেন যে, আর্নেস্টের হৃদরোগের ব্যাপারটা জাহাজেই ধরা পড়েছিল এবং পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেও ওর মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ।
ডাঃ লানা আবার থাকতে শুরু করলেন তার হঠাৎ ছেড়ে যাওয়া বিশপস ক্রসিং-এই। আর্থার বুঝতে পারল, কি কারণে ডাক্তারের সঙ্গে তার বোন ফ্রান্সেস-এর ছড়াছড়ি হয়ে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে ডাক্তারের পুরোনো সহজ সম্পর্ক আবার গড়ে উঠল।
এর কিছুদিন পরে মর্নিং পোস্ট কাগজে ব্যক্তিগত কলমে নিম্নোক্ত খবর অনেকেরই চোখে পড়েছিল :
“গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিশপস্ ক্রসিং চার্চে রেভারেন্ড স্টিফেন জনসন-এর পৌরোহিত্যে আর্জেন্টিনার প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী ডন অ্যালফ্রেডো লানার পুত্র অ্যালোইলিয়াস জেভিয়ার লানার সঙ্গে লি হল নিবাসী স্বর্গীয় জেমস্ মর্টনের একমাত্র কন্যা ফ্রান্সেস মর্টনের শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হয়।”
The Block Doctor গল্পের অনুবাদ