ভক্তচরিতামৃত। শ্রীঅঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রণীত। মূল্য দশ আনা।
রঘুনাথ দাস গোস্বামীর জীবনচরিত। শ্রীঅঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রণীত। মূল্য দুই আনা।
এই দুইখানি গ্রন্থে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভক্তপ্রবর শ্রীমৎ রূপ, সনাতন, জীবগোস্বামী এবং রঘুনাথ দাস গোস্বামীর জীবনচরিত প্রকাশিত হইয়াছে।
সম্প্রতি শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র বটব্যাল মহাশয় নব্যভারতে রূপ ও সনাতনের অকৃত্রিম সাধুতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করিয়া প্রবন্ধ রচনা করিয়াছেন। আমাদের সমালোচ্য গ্রন্থে রূপ সনাতনের জীবনের প্রথমাবস্থার বিবরণ সুস্পষ্ট নহে। এমন-কি, গৌড়েশ্বর হুসেন্ সাহা [শাহ্] রূপকে পরস্বলুণ্ঠনকারী পলাতক দস্যু জ্ঞান করিতেন ইহাতে তাহার উল্লেখ আছে, এবং সনাতন রাজকার্য হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য পীড়ার ভান করিয়া মিথ্যাচার অবলম্বন করিয়াছিলেন এ কথাও চরিতলেখক স্বীকার করিয়াছেন।
কিন্তু তথাপি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের পূজ্য ভক্ত সাধুচরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করিতে সংকোচ বোধ হয়। তাহার অনেক কারণ আছে।
প্রথমত, মানুষের চরিত্র আদ্যোপান্ত সুসংগত নহে। অনেকগুলি ছিদ্র সত্ত্বেও মোটের উপরে চরিত্রবিশেষকে মহৎ বলা যাইতে পারে।
দ্বিতীয়ত, কালবিশেষে ধর্মনীতির আদর্শের কথঞ্চিৎ ইতরবিশেষ ঘটিয়া থাকে। অর্থাৎ, এক সময়ে ধর্মনীতির যে অংশে সাধারণের শৈথিল্য ছিল এখন হয়তো সে অংশে নাই অপর কোনো অংশে আছে। এক সময়ে ছিল,যখন সম্রাটের প্রাপ্য নবাব লুণ্ঠন করিত, নবাবের প্রাপ্য ডিহিদার লুন্ঠন করিত এবং দস্যুতা রাজ্যতন্ত্রের মধ্যে আদ্যোপান্ত ধারাবাহিকভাবে বিরাজ করিত। সে দস্যুতা এক প্রকার প্রকাশ্য ছিল এবং সাধারণের নিকট তাহা লজ্জার কারণ না হইয়া সম্ভবত শ্লাঘার বিষয় ছিল। সকলেই জানেন অল্পকাল পূর্বেও উপ্রি পাওনা সম্বন্ধে প্রশ্ন ভদ্রসমাজের মধ্যেও শিষ্টাচারবিরুদ্ধ বলিয়া গণ্য হইত না। মিথ্যাচার, বিশেষত সদুদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিথ্যাভান, যে, আমাদের দেশে অত্যন্ত নিন্দনীয় নহে এ কথা স্বীকার করিতে আমরা লজ্জিত হইতে পারি কিন্তু এ কথা সত্য। অতএব, সাময়িক সাধারণ দুর্নীতিবশত কোনো কোনো বিষয়ে সৎপথভ্রষ্ট হইলেও মহৎলোকের সাধুতার প্রতি সম্পূর্ণ সন্দিহান হইবার কারণ দেখি না।
তৃতীয়ত, আমাদের সন্মুখে সমস্ত প্রমাণ বর্তমান নাই। সামান্য দুই-একটা আভাস মাত্র হইতে বিচার করা সংগত হয় না।
চতুর্থত, রূপ এবং সনাতন তাঁহাদের স্বসাময়িক প্রধান প্রধান লোকের নিকট সাধু বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। তাঁহাদের চরিত্রের মধ্যে এমন সকল গুণ ছিল যাহাতে নিকটবর্তী লোকদিগকে তাঁহারা আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করিয়াছিলেন — এবং আজ পর্যন্ত তাহারই স্মৃতি অক্ষুণ্নভাবে প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে। আমাদের মতে অন্য সমস্ত প্রমাণাভাবে ইহাই তাঁহাদের মহত্ত্বের যথেষ্ট প্রমাণ ।
সমালোচ্য গ্রন্থে অঘোরবাবু ভক্তচরিত্র অবলম্বন করিয়া বৈষ্ণব ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বসকল ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এজন্য তিনি ধন্যবাদের পাত্র। ভক্ততত্ত্ব ভক্তের জীবনীর সহিত মিশ্রিত করিয়া প্রকাশ করিলে পাঠকের নিকট উভয়ই সজীব হইয়া উঠে। শুষ্ক শাস্ত্রের মধ্যে তত্ত্ব পাওয়া যাইতে পারে কিন্তু সেই তত্ত্বের গভীরতা, মাধুর্য– মানবজীবনের মধ্যে তাহার পরিণতি, অনুভব করিতে গেলে ভক্তচরিত্রের মধ্যে ইহাতে তাহাকে উদ্ধার করিয়া দেখিতে হয়। অতএব বৈষ্ণবধর্মের সুগভীর তত্ত্বসকল যাঁহারা লাভ করিতে ইচ্ছা করেন তাঁহারা অঘোরবাবুর এই গ্রন্থ পাঠ করিয়া পরিতৃপ্ত হইবেন ।
চরিত রত্নাবলী। প্রথম ভাগ। শ্রীকাশীচন্দ্র ঘোষাল প্রণীত। মূল্য চারি আনা।
ইহাতে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী অনেক সাধু নরনারীর সংক্ষিপ্ত চরিত্র বর্ণিত হইয়াছে । ইহার মধ্যে কেবল করমেতি বাইঞ্জ নামক প্রথম চরিতটি আমাদের ভালো লাগে নাই। মানবহিতৈষণার জন্য যাঁহারা সংসার বিসর্জন করেন তাঁহাদের জীবনচরিত বর্ণনযোগ্য। কিন্তু আত্মসুখের আর্কষণে যাঁহারা সুকঠিন সংসারকৃত্য ত্যাগ করিয়া পলায়ন করেন তাঁহাদের চরিত্রকে আর্দশ জ্ঞান করিতে পারি না। করমেতি বাই স্বামীগৃহ ত্যাগ করিয়া বৃন্দাবনে “শ্যামল সুন্দর সিন্ধু তরঙ্গ মাঝারে” নিমগ্ন হইবার জন্য গমন করিয়াছিলেন। সুখী হইয়া থাকেন তো তিনিই সুখী হইয়াছেন –আমাদের তাহাতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই; আমরা তাঁহার হতভাগ্য স্বামীর জন্য দুঃখিত।
অর্থই অনর্থ। দারোগার দপ্তর। শ্রীপ্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত। মূল্য তিন আনা।
ঠগী কাহিনী। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। শ্রীপ্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত। মূল্য দেড় টাকা।
রোমহর্ষণ গল্প অনেকের ভালো লাগে, তাঁহাদের জন্য উপরিলিখিত গ্রন্থদ্বয় রচিত হইয়াছে।
সাধনা, অগ্রহায়ণ, ১৩০১