গোলাপ সুন্দরী – ০৩
হায় গোলাপের মত বিস্মৃত ফুল আর নাই সমস্ত মুহূৰ্ত্ত যাহার অনিত্যতা ; প্রথমে শুকায় ধীরে
ঝরিয়া চুপ, ক্ষণেকেই কোথাও ফুটিয়া উঠে, সমক্ষে থাকিয়াও চির-বিস্মৃত ।—বিলাস এই রুগ্ন কথাটি, প্রত্যহই, বারবার উদ্ভিন্ন প্রস্ফুটিত গোলাপের প্রতি চাহিয়া ভাবিয়াছে ; এ-সত্য তাহার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। এবং এ-কারণে তাহার দুঃখময় শরীরে আক্ষেপ ছিল, অস্থিরতা ছিল । গোলাপক্ষেত্রে কার্য্যের মাঝে সে যখন দূর রাস্তার প্রতি চাহিয়াছে যে পথ ঝিনকীর ঝরণার পাশ দিয়া গিয়াছে, যে পথে কখনও স্তন্যদণনরত মা আসে, বাকবাহী লোক আসে । বিলাস ঝরণার কথা ভাবে নাই, যদিও ঝরণাটি অতীব বিস্ময়কর, এখন যাহা মৃত তথাপি কিছুকাল যাবৎ তাহার দিকে চাহিলে অবৰ্ত্তমান জলধারার গুঞ্জনধ্বনি শুনা যায়, যে গুঞ্জনধ্বনি ভ্রমরগুঞ্জন সদৃশ, ফলে যখন এ ঝরণায় উল্লসিত আছে, তখন অনেক পথহারা ভ্রমর যাহারা সঙ্গলোভী তাহারা এ ঝরণা পরিক্রমণ করে ; এখন শুষ্ক তবুও ভ্রমর দেখা যায় । এ-ঝরণার দিকে চাহিয়াও গোলাপের দূরদৃষ্টের কথা ভাবিতে ভাবিতে আপনার হাতে লাগা লাল মৃত্তিকা ঝাড়িয়াছে । কেবলমাত্র স্মরণ করিয়াছে, কিন্তু গোলাপের উপর হাজার হাজার রোদ আসিয়াছে, চন্দ্রালোক মথিত করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু অদ্যও গোলাপকে কেহ দেখে নাই ।
অদ্য এখন সকাল, একটি গোলাপের প্রতি বিলাসের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ; সে-গোলাপের পিছনে অসংখ্য যোজন অবকাশ, চড়াই উৎরাই কখনও বা সমতল অনেক দূরে অজস্র পাহাড়ের সারি—যাহা । এখন গম্ভীর নীল । ইতিমধ্যে মিয়ানী মৌজার ছোট বিলাতী কটেজ, কটেজের গেটের দুই পাশ্বের বগনভেলিয়ার কমলানেৰু রঙের ফুল সহ লতাছড়ির অসহায়তা দৃশ্যমান ; আজ এই কুটিরখানি বিলাসকে কিছুটা বিমনা করিয়াছিল । এবং এ-কারণে গোলাপ সম্পর্কে নিত্যকার ভাবনা এবং সে-ভাবনা হইতে কোন এক আকাশ পস্থায় তথা শূন্ততায়, যে শূন্ততায় স্যানাটোরিয়ম হইতে প্রত্যাবৰ্ত্তন কালে, মোহিতের কথা সূত্রে তিৰ্য্যক দৃষ্টিতে সে দেখিয়াছিল যে, যে-শূন্ততা গোলাপের রক্তিমতা বহন করে—সে শূন্ততায় দৃষ্টি নিবদ্ধ-করা তাহা আজ তেমন করিয়া ঘটিয়া উঠে নাই ।
কেননা উক্ত বিলাতী কটেজে ইদানীং মনিক চ্যাটার্জ্জি আসিয়াছেন ।
দিশড়া মৌজার এক প্রান্তে বিলাস, অন্যপ্রান্তে গোলক মিত্তির । ইতিমধ্যে অনেক বাড়ী আছে, কিন্তু কচিৎ কখনও কেহ আসে, এখন সব বাড়ীই ফাকা । প্রতিদিন বৈকালে, গোলকবাবু বিলাসকে । দেখিতে আসেন, গোলকবাবু অসম্ভব—বারান্দায় আরাম কেদারায় আপনাকে নিৰ্ব্বিকারে ছাড়িয়া দিয়া যে কোন আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া আপনার একদার সময় ও সমৃদ্ধির গল্প করেন, কেননা ইদানিং তিনি সত্যই দুঃস্থ ; এখন তাহার ক্ষেতে পেয়াজ উঠিতেছে, ফলে জামার গায়ে অযথা পেয়াজের গন্ধ, গল্প করিতে করিতে যখন এখনকার জীবনের কথা মনে হয়, তখনই আরামকেদারা ছাড়িয়া বেতের চেয়ারে বসেন ; বিলাসের এ ধরনের ছড়া-কাটা গল্প শুনিতে কোন দিনই ক্লান্তি বোধ হয় না, একটি মুহূৰ্ত্তের লোভে সে উদ্গ্ৰীব হইয়া থাকে, বেতের চেয়ার ছাড়িয়া হঠাৎ যখন গোলকবাবু বিলস্থিত রুষ্ট সপের ন্যায় মহাদৰ্পে উঠিয়া একখানি হাতদ্বারা আপনাকে সুস্পষ্ট করত কহিতেন “দেখে নেব সব শালাকে. এইসা দিন নেহি রহে গা” বলিয়া অন্ধকারে তিনি প্রস্থান করিতেন ।
যে অন্ধকারে বৃদ্ধ গোলকবাবু—ইঁহার বয়ঃক্রম প্রায় সত্তর—সে অন্ধকার কিছুক্ষণ যাবৎ লাল হইয়া থাকে, এ-লাল মহাঈর্ষাবশত মহা আক্রোশ যে নিরীহ পশুবলি (ভুলক্রমে) সংঘটিত হয় তাহার রক্তধারা যেরূপ ; এরূপ অশরীরী রক্তিমতা দর্শনে বিলাসের ত্রাসের সঞ্চার হয় নাই, ‘যেহেতু তৎক্ষণাৎ আপনার মানসচক্ষে সুদীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ কালে গোলকবাবুর কণ্ঠে শিরা উপশিরা সকল কি ভয়ঙ্কর ভাবে ফুলিয়া উঠিত তাহা দেখিতে পাইত। এই গোলকবাবুই মনিক চ্যাটার্জ্জির খবর আনিয়াছেন ।
তখন সন্ধ্যা হয় হয়, তখন চন্দ্রমাধববাবু, দূর বিসর্পিল রাস্তা যেখানে চড়াইয়ে উঠিয়া হাওয়া, সেখানে সর্বপ্রথমে বিন্দুবৎ এবং কিছু ঊৰ্দ্ধমুখিন ধূলার ছটা, ক্রমে পরে, ঝিনকীর মৃত ঝরণার পাশ দিয়া, এখানে ক্ষণেকের জন্য তাহার ঘোড়া স্থিতি লাভ করে, পরে এ ঝরণাকে দক্ষিণে রাখিয়া চন্দ্রমাধববাবুর ঘোড়া ছোট-ছুটে অগ্রসর হয়, এবার তাহার বিরাট পাগড়ী দেখা যায় । গেটের নিকটে অসিয়া, ধীরে নামিয়া শ্লথ পদে বারান্দার দিকে যান । বিলাস গ্রাভেল ফেলা রাস্তায় সংযত পদক্ষেপ শুনিয়াই বাহিরে অগসিয়া যথারীতি অভ্যর্থনা করে ।
চন্দ্রমাধববাবু মাথা হইতে বিরাট পাগড়ীটা নামাইয়া মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে প্রশ্ন করেন “বল ছোট সাহেব তোমার গোলাপের খবর কি ? বৃয়ার বড় শক্ত হে, কারণ কি জান এই যে গরম ছুটে আসছে না, তোমাকে খুব সাবধান হতে হবে হে, বেচারী গাছগুনো…আজ কিন্তু কালো-কফি”
“বেশ” বলিয়া বিলাস তাহার অন্য কথার অপেক্ষার জন্য থাকে, আপনার হস্তদুটিকে লইয়া কি যে করিবে তাহা সে ভাবিয়া পায় না । চন্দ্রমাধববাবুর বয়স গোলকবাবুর না হইলেও ষাটের ঊর্দ্ধে নিশ্চয়ই, কিন্তু আশ্চৰ্য্য একই জিনিষকে নূতন করিয়া দেখিবার মন অনেক নিৰ্ম্মমতায় খোয়া যায় নাই “কফি পটের লতাপাতাগুনোর উপরে সন্ধ্যার আলো পড়লে বেশ দেখায় না, মনে হয় চেঞ্জে গেছি” আবার খানিক স্তব্ধতা “ঝিনকীর ঝরণার সঙ্গে আমাদের কেমন মিল আছে না, অথচ শুষ্ক একবার একবার জল চতুর্দিকে মানুষ আয়না খাড়া করচে…” আবার স্তব্ধতা “খোলা মাঠে যখন বাছুর লাফায় তখন—আজি দেখলুম— তখন বেশ লাগে না—তখন মনে হয় বাঃ বেশ ?” আবার স্তব্ধতা—বিলাস এসকল স্তব্ধতার সঙ্গে বিশেষ পরিচিত, এ স্তব্ধতা তথা বিরাম সঙ্গীতের— শেষ স্তব্ধতার পরেই অবলীলাক্রমে আসন্ন সন্ধ্যার আলোর সহিত চন্দ্রমাধববাবুর কণ্ঠস্বর এক হইয়া যায়, তখন কানে ভাসিয়া আসে “তুমি নেহাৎ ছেলেমানুষ না হলে তোমাকে অনেক কথা বলতুম” নিমেষেই তাঁহার আয়ত চক্ষুদ্বয় অত্যধিক করুণ হইয়া উঠে এবং দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করত বলিতেন “অত্যন্ত শকড হয়ে এখানে এসেছি । এই চল্লিশ বছর কেটে গেল—আচ্ছা ছোট সাহেব…কাল দেখা হবে”। গমনোদ্যত চন্দ্রমাধববাবুর পিছনে অস্তমিত সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু দেখা গিয়াছে। অদ্যও, নিশ্চয়ই, যদি বিলাস স্মরণ করে তাহা হইলে তাহার মনে পড়িবে, লিখার পরগণার রানীর পূজা উপচার লইয়া যাইবার কালে, সম্মুখেই ঢাক ঢোল তুরী পিছনে, সাদা ঘোড়ায় ম্যানেজার চন্দ্রমাধব ঘোষাল, রাজকীয় বেশ মাথায় উষ্ণাষ সবুজ ভেলভেটের খাপে তরোয়াল—তাহার পিছনে বিচিত্র সজ্জায় পাঁচটি হাতী, মধ্যেরটি শ্বেত। সে অবস্থাতেও চন্দ্রমাধববাবু নামিয়া বিলাসের সহিত দেখা করিবার সময় সেই এক কথু “নেহাৎ ছেলেমানুষ না হলে, বড় শকড হয়ে এখানে এসেছি—না না কফি না জল না…আজ শিবরাত্রি যে…যদি মোক্ষ দেন…আর মনুষ্য জীবন নহে” বলিয়া সবেগ প্রস্থান করিলেন ; লাল কিংখাবের ছত্রের রক্তিম আভা তখন তাহার মুখমণ্ডলে…বুদ্ধ হাসিলেন ।
চন্দ্রমাধববাবু আসিয়া বসিলেন। বিলাস তাহাকে দেখিয়া অল্প হাসিল, কহিল “বলুন চা না কফি…না…”
চন্দ্রমাধববাবু বিলাসের সুন্দর মুখখানির দিকে তাকাইয়া ভ্রূ তুলিলেন । বিলাস কহিল “হুইস্কি, ব্রাণ্ডি, ওয়াইনজাতীয়…কোন…মোহিতদার জন্য ওমি সব রেখে যায়—কখন…”
“হুইস্কি…”
বিলাস ঈষৎ উচ্চৈস্বরে তাহার কথার প্রতিধ্বনি করিয়াছিল ।
“জান মনিক এসেছে… সারা জীবন ত ফাঁকা, মানুষ আবার ফাকায় আসতে চায় মজা দেখ…
মনিক বললে কি না…এখানটা বেশ ফাঁকা তাই বেশ লাগে…কে কোথায় হাঁপিয়ে উঠছে বলা ভার কি বল.” বলিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিলেন, বিলাস বুঝিল এই মুহুৰ্ত্তটি চন্দ্রমাধববাবুর আপনার কথায় ভরিয়া ছিল, পরক্ষণে শোনা গেল “গ্রাণ্ড মেয়ে দারুণ স্কলার তেমনি অপূৰ্ব্ব সুন্দরী…বিয়ে যে কেন… বুঝি তা ওদের সমাজে…এই বয়সেই সেণ্ট স্কুলের হেডমিস্ট্রেস…বেরি বেরি…কলকাতা অতি নচ্ছার জায়গা হয়ে উঠেছে…হ্যাগা ছোট সাহেব তুমি ওকে নেমন্তন্ন…”
“আজ্ঞে আজ্ঞে মানে…বুঝলেন নেমন্তন্ন ঠিক নয়…লিখেছিলুম কারণ এ কয়েকদিন আগে হঠাৎ সকাল বেলা তখন বেলা ৮টা হবে জানেন…” বলিতে বলিতে সেই শূন্যতার দিকে চাহিতেই কয়েকদিন পূৰ্ব্বেকার পাহাড়ী সকালে গিয়া পৌঁছিল, দেখিল, তখন মেঘাচ্ছন্ন সূর্য্য ফলে আলো অতীব, মেষশাবকের গায়ের মত, কোমল, একজন অপুর্বরূপসী আপনার এলোখোঁপা বাঁধিতে বাঁধিতে সম্মুখের গোলাপের ইতস্তত প্ৰমত্ততা দর্শনে মগ্ন । মেঘ ছিন্ন হইল, তৎক্ষণাৎই সৰ্ব্বকালের আলোর কল্পনা আসিয়া সারা মুখমণ্ডল এবং অবয়বটি উদ্ভাসিত করে । এই অপসরা তাহারই বেড়ার ধারে তখনও দণ্ডায়মানা, গোলাপ দর্শনে স্থাবর । বিলাস তাঁহাকে দর্শন করিয়াও বুদ্ধি হারায় নাই, শুধুমাত্র একটি কুহকের মধ্যে ছিল যে কুহকের অর্থ মোহিনী মায়ার শ্বেত কবিপ্রসিদ্ধি ইঁহার চারি দিকে খেলা করিতেছে ; এই সেই লাল, আরবার মনে হইল, ওমি বোধ হয় ইহা হইতেও সুন্দরী কিন্তু বড় বেশী সোফিষ্টিকেটেড। সেদিনকার অভিজ্ঞতা সাধারণভাবে চন্দ্রমাধরবাবুকে নিবেদন করে ।
“ও বলেছে একদিন বাগান দেখতে আসবে… ব্যাপারটা কি জান, ওর মা…যাক, তাই বড় একা একা মিশতে চায় না…”
“আমি ভাবলুম…আমার ত টিবি, তাই হয়ত…”
সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রমাধববাবু এমন ব্যস্ত হইয়া বিলাসের গায়ে হাত দিয়া আদর করিতে গেলেন যে হুইস্কির গেলাসটি প্রায় পড়িয়া যাইতেছিল। বিলাস গেলাসটি ধরিয়া ফেলিল, চন্দ্রমাধববাবুর বড় আপনার করিয়া তাহাকে আদর করিলেন । ইহার পর হুইস্কিতে ঠোঁট ভিজাইতে ভিজাইতে কহিলেন “ও গো বাবু বেরি বেরি কি কম ছোঁয়াচে…যাক্ আজ রানীর জমিদারীর উত্তর দিকে গিয়েছিলুম, জানো সেখানে একটা ছোট নদী আছে…আহা, বলতেও কষ্ট হয়, গেল “এইখান যাত্রায়” (পরব) সাঁওতালরা, সেই নদীর তীরে বেশ কিছু হুপ্পি ছিল…সব মেরেছে গা… পাখী আমার বড় ভাল লাগে যখন এখানে আসি কত পাখী…এখন… আচ্ছা এখানে বেশ মন বসেছে ত…।“
“হ্যাঁ তবে একটু আপনার মত বেড়াতে পারলে…”
“না না বিলাস ছেলেমানুষী করো না…তোমার থেকে কয়েক বছর বড় হব, তখন, আমি এ অঞ্চলে অভ্যাসি, এখনকার মজা কি জান, নিজেকে পরিষ্কার দেখা যায়”
“সে ত আয়না… ”
এই উত্তরে চন্দ্রমাধববাবু চেয়ারে সজোর চাপড় মারিয়া কহিলেন “আঃ কচে বারো…দারুণ বলেছ…হ্যাঁগো গোলাপের কতদূর, খবর নেওয়া হয় না…”
“তাহলে তো ডায়েরী পড়ে শোনাতে হয়…একটু হুইস্কি…”
“আঃ গুড…তবে তোমার ডাইরী বড্ড বেশী সরলতা—ওটা বুঝতে আমার…”
“সত্যিই…”
“ওই যে ডাইরীর মাথায় লেখা—art is too long life is too short—এসব কথা দুঃখ থেকে বঞ্চিত করে…তুমি ত দুঃখ পাওনি তুমি ভয় পেয়েছ…তাই…থাক বৃয়ার রোজ কি বলে…”
এ সময় আঁধার করিয়া আসিয়াছিল ফলে নগেন আলো লইয়া আসিতেই, হাত তুলিয়া বিলাস তাহাকে নিষেধ করিল। বিলাস মন খারাপ করিতে গিয়া চন্দ্রমাধববাবুর দিকে তাকাইল, বুঝিল এই কয়েক আউন্সেই তাহার জিহ্বা বজ্জাতি করিতেছে। সহসা আপনার ভারী মাথাটা তুলিয়া নগেনকে দেখিয়া চন্দ্রমাধববাবু কহিলেন “নগা…তোর দাদার বৌ কেমন রে…”
বিলাস নগেনের পূৰ্ব্বেই উত্তর করিল “আর বলবেন না, বড় মুস্কিলে আছি, যক্ষ্মা তো, বলে কিনা রক্ত পিত্ত! হাসপাতালে গেল না…যখন যা পারি দি, অনবরত সেই টাকা দিয়ে রঙ্কিলি টিলায় পাঁঠা কাটাচ্ছে, আর ঢাকি ভাড়া কচ্ছে…”
“এ্যাঃ” চন্দ্রমাধববাবুর ম্যানেজারি ভাব ফুটিয়া উঠিল “শালা শুয়োরের বাচ্চা—হারামজাদা—ডাক শালা…তোর দাদাকে ছোট জাত…”
“আহা থাক্ চন্দ্রমাধববাবু.”
“কি সৰ্ব্বনাশ গো…তোমার ত বড্ড অসুবিধে হচ্ছে একমাত্র চাকর ভরসা…তা তার বৌ মরবে কবে ?”
“এখন ভূষণ বলছে গণৎকার বলেছে…একাদশী-দ্বাদশী কাটলে হয়”
“বাঃ সিদে কথা…হ্যারে তা মরবে, কত কাঠ যোগাড় করেছিস…”
“ভূষণ ত কাঠ কাঠ করে লাফাচ্ছে বলছে গোলকবাবুর উঠোনে মণ মণ কাঠ আছে…আচ্ছা বলুন ত সে ভদ্দরলোক কাঠ নিজের জন্যে জমিয়েছ…বিদেশ বিভূয়ে যদি…”
“আমাদের খেজুড়ী জঙ্গলে গেলে কাঠ দিতে পারি. তবে যে আবার যাবে সে ত মহুয়া খেয়ে বেহুঁস হয়ে থাকবে—তুমিও যেমন, মরুক শালারা…”
এখান হইতে দেখা যায়, হল-ঘরে এক পাশে, রাত্রের খাবার জন্য টেবিল সাজানো হইতেছে ; অসম্ভব গোপনীয় দৃশ্য, এই দিক হইতে চক্ষু ফিরাইয়া চন্দ্রমাধববাবু কহিলেন “তুমি কোথায় ছোট সাহেব”
প্রথম আঁধার, দ্বিতীয় অনন্ত দূরত্ব মানুষের অস্তিত্বকে ফুৎকারে উড়াইয়া দিতে চাহিতেছে, উপরন্তু এই অসহায় জিজ্ঞাসায় বিলাস রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, আপনার অভ্যন্তরে অসংখ্য পরিপ্রেক্ষিতের যাওয়া অভ্যাসা চলিতে লাগিল, আর সে, বিলাস, অদ্ভূত ভাবে মাথায় হাত দিয়া এক হাত ঊর্দ্ধে তুলিয়া কি যেন বলিবার জন্য ওষ্ঠবিদীর্ণ। চতুর বিলাস পলকেই এ দৃশ্য হইতে মন ঘুরাইয়া লইল ।
চন্দ্রমাধববাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল “বিলাস, তুমি বেশী ভূষণের ওখানে যেও না…”
“না গিয়ে কি করি বলুন, ওরা ভাব্বে…”
“তুমি ভয়ে…”
“আজ্ঞে তাই…তাই যেতে হয়…”
“যাতে ওরা বিশ্বাস করে তুমি মোটেই ভয় পাও না…যাক সব মার ইচ্ছা…”
চন্দ্রমাধববাবু, শেষোক্ত কথায়, বিলাস কালো হয়, এ-কারণে যে এক্ষণি তিনি প্রশ্ন করিবেন, “কি বিলাস তারা ব্ৰহ্মময়ীকে দেখছ ত” সে-ছবি মেরুদণ্ড সরল করিয়া দেখার মত সুযোগ সে খোঁজে নাই ; প্রকৃতি মাঠ ঘাট তেপান্তর লোক গল্পই ভাল, তাহাকে এরূপে দেখা তাহার পক্ষে সম্ভব নয় তবে এইটুকু সে বুঝিয়াছিল, সে-ছবি যখন চন্দ্রমাধববাবু তাহাকে উপহার দেন, তাহার মধ্যে প্রাচীন ভালবাসা ছিল ।
“মা মা” বলিয়া এমত কাতর উক্তি করিলেন, সম্মুখের বিলাস শিশু হইয়া গেল, যে বিলাস এতাবৎ ষড়যন্ত্র করিতেছিল, বাঁচিবার নামে জীবন ধারণের নামে, বহু বহু যুগের অনর্থ, ময়লা, অন্ধকার এবং কূট পদ্ধতি লইয়া খেলা করিতেছিল, সে বিমূঢ় হইল, বিলাস আর যাহা আকাঙ্ক্ষা । করুক, কোন ক্রমেই শিশু হইতে চাহে নাই। ফলে, বৃক্ষলতাদি এবং নিকটের গোলাপ ক্ষেত্র, উপরে নক্ষত্ররাজি সকলেই সাক্ষী রহিল যে, বিলাস রুক্ষ হইল…“রাত হয়েছে…”
বিলাসের এ কথা চন্দ্রমাধববাবু অল্প নেশার ঘোরে শুনিয়া কহিলেন “কথাটা বড় অর্থব্যঞ্জক, ইচ্ছা করলে আমি এখনি সন্ন্যাস নিতে পারি…যাক গোলাপের লাল, হ্যাঁ যে লাল তুমি বলেছিলে সে লাল অতীব গূঢ় সূর্য্যের আছে…আর আছে উষ্ণতার মধ্যে…” এইটুকু বলিয়াই চন্দ্রমাধববাবু কোথায় যেমন বা অন্তৰ্দ্ধান করিলেন ।
বিলাস যেন বা হাঁফ ছাড়িল, কেন না ভাগ্যে চন্দ্রমাধববাবু বলেন নাই তাই জগজ্জননী তারা লাল ভালবাসেন ।