বিলাস অন্যত্রে, কেননা সম্মুখেই, নিম্নের আকাশে, তরুণসূর্য্যবর্ণ কখনও অচিরাৎ নীল, বুদ্বুদসকল, যদৃচ্ছাবশতঃ ভাসিয়া বেড়াইতেছে। একটি আর একটি এইরূপে অনেক অনেক–আসন্ন সন্ধ্যায়, ক্রমে নক্ষত্র পরম্পরা যেমন দেখা যায়–দূর কোন হরিত ক্ষেত্রের হেমন্তের অপরাহ্ন মন্থনকারী রাখালের বাঁশরীর শুদ্ধনিখাদে দেহ ধারণ করত সুডৌল দ্যুতিসম্পন্ন বুদ্বুদগুলি ইদানীং উঠানামা করে, এগুলি সুন্দর, উজ্জ্বল, বাবু, অভিমানী আশ্চর্য্য! এ কারণেই বিলাস, চমৎকার যাহার রূপ, যে বেশ সুস্থ, এখন অন্যদিকে আপনার দৃষ্টি ফিরাইয়াছিল কেননা এসকল বুদ্বুদ সম্মুখে থাকিয়াও পশ্চাদ্ধাবন করে কিন্তু এ-দৃষ্টিতে তাহার কোনরূপ অভিজ্ঞতা ছিল না, এ কথা সত্য যে, তাই মনেতে নিশ্চয় সে কুণ্ঠিত কেননা ইতঃপুর্ব্বে অজস্র দিনের আত্মসচেতনতার কুজঝটিকার মধ্যে সে একা বসিয়া কবিতা লিখিবার মনস্থ করে – কবি হইবার নয়, যেহেতু, সম্ভবত, রূপকে রূপান্তরিত না করিয়া ভালবাসার শুদ্ধতার দিব্য উষ্ণতা ক্রমে অস্পষ্ট অহঙ্কার পর্য্যন্ত, তাহার ছিল না যদিও – তাহার নিঃসঙ্গতা নাই শুধুমাত্র স্বতন্ত্রতা ছিল।
ক্রমাগতই সকালের আলোকদীপ্ত বুদ্বুদসকল ইতস্তত ভ্রাম্যমাণ।
বালকটি, কালো সুঠাম ন্যাংটো, মোটর গাড়ীর ফুটবোর্ডে বসিয়া একটির পর একটি বুদ্বুদ নির্ম্মাণ করিয়া চলিয়াছে; ক্বচিৎ ঊর্দ্ধে অদ্ভুত ভাবে, যে ভাবে পলাতক কাঠবিড়ালীকে দেখে, অর্থাৎ মাটির দিকে চাহনি লইয়া, বালক আপনার আয়ত চক্ষুদ্বয় তুলিয়া কি যেন বা দর্শনে হাসিয়াছে সম্ভবত প্রথম রৌদ্র অথবা গতিমান দিগ্ভ্রান্ত বুদ্বুদনিচয়। তাহার, বালকের, পিছনেই দরজায় এবং মাড্গার্ডের অবিশ্বাস্য ধূলার স্তরে অসংখ্য রেখাচিত্র, না শিশুওষ্ঠের অজস্র এলেবেলে স্পন্দন। এগুলি প্রতীকমাত্র কারণ ইহার ছাপা আতপ নাই, এগুলি প্রতীকমাত্র কারণ, ইহা গণিতের সংখ্যা আত্মিক নহে; ইহাতে দৃষ্টির অভিজ্ঞতার স্বকীয়তা নাই, শুধুমাত্র খুশীর ব্যক্তিগত অনুভব আছে। কখনও বা দুঃসহ ঝটিতি আরবীটান যখন মানসিক অধৈর্য্য, নিঃসন্দেহে, অনুভূত হয়। হায়! বালকের মধ্যেও ক্ষুব্ধ বিরক্তি আকাশ হইয়া আছে। এই গাড়ীতেই বিলাস যাইবে।
গাড়ীখানি দাঁড়াইয়াছিল, মরুপথিপ্রজ্ঞ উট যে উট বৃদ্ধ যে উট ক্লান্ত, যাহার সমক্ষে দৃশ্যমান জগতই পথ বৈ অন্য নহে; উহার ড্রাইভার, দেহা যায়, আরামে ঘুমায়, তাহার রুক্ষ গৈরিক চুলগুলি, যাহা রঙিন রুমালে বাঁধা, এখনকার হাওয়ায় ত্রস্ত, স্বস্তিহীন প্রমত্ত। এই গাড়ীর ফুটবোর্ডে, চিত্রসমূহের সম্মুখে বসিয়া বালকটি, সে শুধু বা সকালের—এখন রাত্রি শেষে দিনের সুরু হয় এ-খেলা খেলিতেছিল। তাহার হস্তধৃত এনামেলের বাটির সাবানজল-সম্ভব্ব ফেনিল উচ্ছ্বাসের নিকটে তাহারই দীঘল নয়ন যুগল যাহা অযথা ক্রুর; এবং পদদ্বয় দ্রুত ব্যগ্রভাবে নাচিয়া উঠে কখন সখন, এ-হেন বালখিল্য আধিক্য বিলাসকে যারপরনাই ব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল; ফলে ক্ষণেকের জন্য তাহার, বিলাসের, মনে হয় সে খাটে শুইয়া আছে, এবং মাথার কাছে শুভ্র চার্ট করা কাগজ হাওয়ায় হাড়ের শব্দ করিতেছে ফলে ইদানীং আপনার সুমার্জ্জিত রুচিসম্পন্ন পোষাক কেমন গুরুভার—এতকাল ধরিয়া যাহা পরিধেয় ছি;, তাহা হাল্কা যাহাতে সে অভ্যস্ত—তাহার জন্যই বিলাসের মনে এরূপ বিকার উপস্থিত এবং এই একই মুহূর্ত্তেই রেশমী রুমালের সিভেটের দন্তযুক্ত সৌরভকে বিদীর্ণ করিয়া আবছায়া একটি প্রায়-হারমানা-পৃথিবীর হিমবাহ তৎসহ উৎকট রাসায়নিক গন্ধ পরিব্যপ্ত হয়। সে, বিলাস, আপন অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে, দ্রুত একটি কোটের বোতাম খুলিতে উদ্যত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘প্যাচ’ পকেটের দিকে লক্ষ্য করিয়াছিল, এবং এ সময়ে তাহার বাম ভ্রূ বিস্ময়কর ভাবে উপরে উঠে, সে অত্যন্তই উদ্গ্রীব কাহার একটি মন্তব্য পুনরায় শুনিবার জন্য আপনাকে একাগ্র করে। বিলাস স্থির করিয়াছিল। কিছুক্ষণ পূর্ব্বে ডাক্তার রঙ্গস্বামীর ঘরে প্রবেশ করিবার সময়, এই করিডোরেই দাঁড়াইয়া মোহিতদা বলিয়াছিলেন “প্যাচ পকেট তোমার কেমন লাগে ডিয়ার? অফুলি (হাসিয়া) স্পোর্ট নয়? দারুন স্পোর্ট!” আরও কিছু কথা হয়ত মোহিতের বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ওমি অর্থাৎ বিলাসের দিদি তাঁহাকে এক প্রকার টানিয়া লইয়া অদৃশ্য হয়।
‘স্পোর্ট’ কথাটা বিলাসকে বড় খুসী করে, বড় সুন্দর করে, উহা যেন বাক্য নয়, তাহা যেন সত্যই নয়ন-অভিরাম সহজ, একটি ব্রাহ্মণী হংস, যে হাঁস তুষার অভিমানী, যৌবনশালিনী এবং যে হাঁস শূন্যতা লইয়া খেলা করে। ‘স্পোর্ট্স’ কথাটার উচ্চারণের সঙ্গেই—ইচ্ছাকৃত কষ্টসাপেক্ষ স্বরভঙ্গের সময়ই—মোহিতের পুরুষালি মুখখানি সুপ্রসন্ন সুপ্রভ নাটকীয় হইয়া উঠিয়াছিল। বিলাস দেখিল কালোসাদা ব্রোগ, সিয়াসেকার কাপড়ের, সোজা ইস্ত্রির, পাতলুন এবং কোট, পোলকা ডট সার্ট, সুঠাম বো, পকেটে ব্লু রুমালে স্থাপত্যের পরিচ্ছন্নতা, বাটনহোলে সোনার চাকতিতে M লেখা এবং সেখান হইতে ঘড়ির চেন নামিয়া আসিয়াছে। বঙ্গের গোলাপ বলিতে যে আহ্লাদ উদাত্ত হইয়া উঠে আহা নিশ্চয়ই মোহিতকে ধারণ করিয়াছিল। এইটুকু ভাবিবার পরক্ষণেই, বিলাস অস্থির হইল, এমত সময়ে কাহার জুতার শব্দ পাইয়া দৃষ্টি ফিরাইতেই দেখিল মোহিত।
মোহিত তাঁহার সরু ভ্রূ যুগল তুলিয়ে আপনকার হস্তদ্বয় ছেলেমানুষের মত ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করিয়া কহিলেন।—“আও গাড্ অয়লমাইটি তোমার দিদি কি গল্পই করতে পারে” বলিয়াই প্রথমে বাঁ হাতে আপনার পিছু পকেটে পরে চঞ্চলতা সহকারে আপনার ডান হাতে ডানদিকের পকেট হইতে লিমুজকৃত রৌপ্য নির্ম্মিত ফ্লাস্ক বাহির করিয়া ছিপিটি খুলিয়ে এক ঢোক গলায় ঢালিয়া দিলেন।—এই ছোট সুরা আধারেও তাঁহার নামের আদ্য অক্ষর ছিল—ঝটিতি সুন্দর মুখমণ্ডলে তড়িৎ প্রবাহ খেলিয়া গেল। বিলাস দেখিল মোহিতের চক্ষুর্দ্বয় অসম্ভব মঙ্গলীয়; সে স্থির ভাবে মোহিতের প্রতি চাহিয়াছিল। মোহিত রৌপ্য আধারটি তাহার দিকে ধরিয়াই অতিভদ্র ‘সর্ রে’ বলিয়া যথাস্থানে আধার রাখিয়া, সৌখীন সিগারেট কেস বাহির করিল, এখানেও লেখা ‘M’…।
বিলাস কেমন করিয়া ডাক্তারের সহিত এতদিন ধরিয়া কথা বলিয়াছে, তেমনি ওষ্ঠদ্বয় কাঁপাইয়া ধীরে ধীরে কহিল “এম এম এম, এত মোনগ্রাম তোমার ভাল লাগে?”
মোহিত কি যেন বলিতে গিয়া খুব সাধারণ করিয়া উত্তর করিল “হ্যাঁ…আমার কাছে আমি অন্যন্ত ফেমাস ম্যান” বলিয়া হাসি দিয়া আপনার উচ্ছল রসিকতাকে বাধাঁন দিল না, বরং সিগারেটে একটি টান দিয়া কহিল “আমার এক মুহূর্ত্তও এখানে ভাল লাগছে না, পাগল হয়ে যাচ্ছি…কি অদ্ভুত dull জায়গা, নিঃশ্বাসের কি বিশ্রী শব্দ…”
বিলাসের রুগ্ন বরফচাপা রঙটা মোহিতের এহেন কথায় রক্তিম হইয়াছিল, শিশুসুলভ মুখখানি তুলিয়া সে সভয়ে সজল নেত্রে তাঁহার প্রতি চাহিয়া, পরে, ধীরে, আপনার চতুষ্পার্শ্ব উপলব্দি করিল; এই করিডোরের সাদা একটানা দেওয়াল—মধ্যরাতে রমণীয় চোখের পলকের মত—মধ্যে মধ্যে। সোনার জড়োয়া ফ্রেমে প্রসিদ্ধ ডাক্তারদের ছবি; নিকটেই কোক! সমস্ত দেওয়াল আলোর তারতম্যে। কখন বা অতীব দীন, এখানে চাপাগলার শব্দ, কোথাও অভিমান, এমন কি করাঘাত কভু বা দীর্ঘশ্বাস! এ দীর্ঘশ্বাস সম্ভবত তাহার নিজের, বিলাসের। বোধ হয় বিলাস এই বাড়ী, তথা স্থান—অথবা তাহার ইহকালের কিছুটা—সমস্ত অতীত ভালবাসিয়াছে।
এরূপ আত্মস্থ মুহূর্ত্তে সহসা বিলাস আপনার পকেটে হস্ত প্রদানের সঙ্গেই বপথুমান, যে কি সে অনুভব করে? অস্ফূট নিবিড় ঘোর এক খস্খস্ কাগজের শব্দ; এ রৌদ্রকর্ম্মা শব্দ তাহাকে চকিত রোমাঞ্চিত করিয়াছিল। কাংড়া কলমের ‘অভিসারিকা’ চিত্র দর্শনে মানুষের যেরূপ একা বোধ হয়, ধৈবতের গাম্ভীর্য্যের রাজ্যে যেরূপ একাকী বোধ করে, সেইরূপ এইক্ষেত্রে বিলাসকে পকেটস্থ এই খস্খস্ শব্দ—যাহা অন্ধকারকে নাম ধরিয়া ডাকে—বড় একা করিয়াছিল।
অন্যপক্ষে মোহিত দেখে নাই, যে সেইক্ষণে বিলাস আপনার উদ্বেগ চাপিবার জন্য, আপনার ওষ্ঠের একপাশ দাঁত দিয়া চাপিয়া ধরিয়াছিল, হঠাৎ সে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করত, পকেটের কাগজের টুকরো দুটিকে মুঠা করিয়া ধরিয়া ঝটিতি বাহিরে নিক্ষেপ করিতেই একই ত্রস্ত উড়ন্ত পাখীর ছায়া পলকেই সবেমাত্র-পতিত কাগজের পিণ্ডের উপর দিয়া রেশ টানিয়া চলিয়া গেল। ইহাতে মনে হয়, কাগজের পিণ্ড বিলাসের সমক্ষ হইতে বহু বহু কাল দূরে সরিয়া চলিয়া গিয়াছে, নিশ্চয়ই সেখানে গাঢ় অন্ধকার। ভগবানকে ধন্যবাদ অন্ধকারের রেখা নাই।
এ কারণে মোহিত অনভিজ্ঞ চোখটি বাঁকাইয়া, নীল কাগজের পিণ্ড যাহা ইদানীং গাড়ীর ড্রাইভারের ঘুমন্ত মাথার নিম্নে বুদ্বুদ-নির্ম্মাণকারী বালকের এবং এইখানকার সিঁড়ির মধ্যবর্ত্তী যে জমি—এখানে ফুলের কেয়ারী বর্ত্তমান—সেখানে খেলিয়া বেড়ায় তাহার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া কহিল—“বিলে দু?”
মোহিতের এ প্রশ্ন বিলাসের নিকট রূঢ় বিদ্রুপ হইয়া দেখা দিল, সে কঠিন ভাবে চাহিতে জানে না শুধুমাত্র আপনার সৃজিত পৃথিবীতে চিত্রার্পিতের মত দাঁড়াইয়া রহিল। সে নিশ্চয়ই বলিতে চাহিয়াছিল “ও নো…” উহা বিলে দু নহে তথা পুনরায় জাগিয়া, পুনরায় বিশ্বাস ফিরিয়া পাইয়া প্রথম ভোরের দিকে চাহিয়া শ্বাশত হইবার মানসে কোন যুবতীজন কর্ত্তৃক লিখিত উহা কোন ডাগর বিদ্রোহের জয়ধ্বনি নয়। কিন্তু বিলাস মরিয়াছিল ফলে কোন কথাই সে বলে নাই, এ কারণে যে এখনও স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গতার দুর্জ্জয় বীরত্ব তাহার নাই!
বিলাসকে আর উত্তর করিতে হইল না, এ-হেন সময়ে অদূরে ডাক্তার রঙ্গস্বামীর কক্ষের দোলান-দরজাটা একটু ফাঁক করিয়া ওমি বিলাসকে ইসারা করিল। বিলাসকে যাইতে দেখিয়া মোহিত অসম্ভব চঞ্চল হইয়া উঠিল।
রঙ্গস্বামীর ঘর।
রঙ্গস্বামীকে দেখিবা মাত্রই বিলাসের মনে হইল সে যেমত বা শুইয়াই আছে, পরক্ষণেই সহজ হইয়া অল্প একটু হাসিল। আশ্চর্য্য, এই ঘরে ঔষধের কোন গন্ধ নাই, পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র, এ-ঘর বিল্বদলের মত শুদ্ধ। একমাত্র রঙ্গস্বামীর আঙুলের নখগুলি প্রতীয়মান হয় যে, অদ্ভুত শক্ত, কেন যে শক্ত তাহা কাহারও এতাবৎ মনে হয় নাই; এখন বিলাস যেমন বা এ নখগুলির সম্মুখেই দাঁড়াইয়া ছিল, নিমেষেই সে অনুভব করে, যে না তাহা নয়, সে ঐ নখগুলির পিছনেই আছে, নিশ্চিন্তে, সুখে নিদ্রায়, এ নখে বন অন্ধকার নাই!
রঙ্গস্বামী মুখ তুলিয়া হাসিলেন “হ্যালাও ডিয়ার” ইহার পরে কণ্ঠস্বরকে সঠিক কর্ত্তব্যপরায়ণ করিয়া কহিলেন, “মাই চাইণ্ড, সব কথার তোমার ভগনীকে আমি বলেছি, তেমনভাবে চলবে, আমাকে চিঠি লিখবে, অবশ্য যার উত্তর আশা করা বৃথা…নিশ্চয়ই আমি তোমার চিঠি পড়ব…কোন রকম ভারী কাজ” বলিয়াই হাসিয়া উঠিয়া কহিলেন, “তোমার কর্ম্ম উঠে গেছে” এখানে গলার স্বরটা কেমন যেন বা অস্পষ্ট হইয়া চকিতেই পুরুষালি সদা রসিক আওয়াজ শোনা গেল “হ্যাঁ কর্ম্ম নয় কোনরূপ নয়…” এসময় একটি ভ্রূ অত্যাধিক উঁচু হইয়া উঠে “কর্ম্ম নেই—মুক্ত…সম্পূর্ণ অনাসক্ত…খ বৎ”
বিলাসের নবতম দিব্য জামা কাপড়—যাহা স্পোর্টস ধরণের—তাহার নীচে অতি সূক্ষ্ম দেহ যেন বা প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল, একদা তাহার মনে হইল, রঙ্গস্বামী কি এই যশস্বিনী ধরিত্রীর লোক নহে? এ কথা এ অভিমান মনে উঠে সঙ্গে সঙ্গেই মিলাইয়া গেল, কেন বা রঙ্গস্বামী উচ্চশ্রেণীর দক্ষিণ ভারতীয়—ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের স্বর্গীয় সুষমায় যে জীবনধারা গঠিত, ফাঁকি নাই। এখন, বিলাস—সাঁওতাল রমণীরা যেরূপ হাটে আসিয়া আপনার বিক্রয়ার্থে ঠেকাপূর্ণ সামগ্রীর সম্মুখে, মুখে একটি হাত দিয়া নির্ব্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে সেইরূপ দণ্ডায়মান।
সঘন ট্রাজেডির অভিনেতার মতই টেবিলের সবুজ বনাতের উপর দিয়া বার বার ঘুরাইয়া গভীর কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন “ভগবানকে ধন্যবাদ যে তুমি এই শতাব্দীতে জন্মেছ…(তবু এখানে রঙ্গস্বামীর স্বর নিদাঘের দ্বিপ্রহরের ফেরিওয়ালার ডাকের মতই ক্লান্ত শোনাইল) যখন দিন দিন রাত্র রাত্র—আপনার সহজ রূপে এসেছে; বহু মহাপুরুষকে তুমি কল্পনা করে নিতে পারো…আমার বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে…”
বিলাস সত্যই রঙ্গস্বামীর এই সরলতায় মুগ্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল, সহসা তাহার মনে হইল, এই স্যানাটোরিয়ামের সাজগোজ আসবাবপত্রের সহিত কি মিল আছে? এখানে ওখানে সর্ব্বত্রে লুই কাতজ আমলীয় সাজসজ্জা তাহাকে এখন বুদ্ধিহীন করিল, কেন এত ঝাড় লণ্ঠন, সেজ, বাতিদান, ঈবনী, গোল্ড ওরমলু, কারপেট…এক মাত্র এপরন, চার্ট, খাট এবং এটা সেটা ছাড়া সবই ভারী সুন্দর শান্তি উপত্যকা! এই স্যানাটোরিয়ামকে সাজাইতে যখনই মহামান্য রাহা বাহাদুরকে কোন কিছু প্রয়োজন এ-প্রার্থনা জানাইয়াছে, তৎক্ষণাৎই তাহা মঞ্জুর হইয়াছে। কিছুদিন পূর্ব্বে নয়টি পরীধৃত সোনার সৌখীন কাজ করা একটি ঘড়ি পাঠাইয়া দিয়াছেন—রঙ্গস্বামী ঘড়িটি ঈবনীর ম্যানটেল-পিসে রাখার সময় হাঁকিয়া বলিয়াছেন “চিলড্রেন…জগতের যত সুসময় এই ঘড়িটিতে জমা হয়ে আছে…তোমরা যদি লাভ করতে চাও…এটার দিকে তাকিও” বিলাস ছেলেমানুষ যেমত কঠিন অঙ্কের সামনে ঘর্ম্মাক্ত হইয়া উঠে, তেমনি অদ্ভুত অদ্ভুত কথা এবং আপনার অভিজ্ঞতার সমক্ষে সে অস্থির।
“আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি…ভগবানকে বিশ্বাস ক’রো” রঙ্গস্বামী বলিতেছিলেন। ‘বিশ্বাস ক’রো’ কথাটা ভোরের হাওয়ার মত বিলাসের শীর্ণ মুখে আসিয়া লাগিল; এবং সে উদ্গ্রীব হইয়া রঙ্গস্বামীর মুখপানে তাকাইল, পুনরায় তাঁহার স্বর শোনা গেল “মাই ডিয়ার এ এক অদ্ভুত শতক, দেখ না একজনকে একজনের বলতে হয়, তাঁকে বিশ্বাস করো…” বলিয়াই আপনার দুঃসাহসিক হাতখানি বাড়াইয়া দিলেন, এখন তাঁহার সার্টের হাতার হীরকখণ্ড দেখা দিল। ওমি হীরকখণ্ড দেখিয়া মনে মনে প্রশংসা করিয়াছিল।