গুপ্তধন রহস্য

গুপ্তধন রহস্য

এক

ওরা তিন বন্ধু। অজয়, সুভাষ আর নরেন। একই গাঁয়ের ছেলে ওরা, ছোটবেলা থেকে একই স্কুলে পড়েছে, বিপদে-আপদে সবসময়ে একজন আরেকজনের পাশে পাশে আছে, কেউ কোনোদিন ওদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পারেনি। ইংরেজির মাস্টারমশাই ঠাট্টা করে ওদের নাম দিয়েছেন, ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’।

অজয় বরাবরই ফার্স্ট হয়, ইস্কুলের সেরা ছাত্র। বৃত্তি পরীক্ষায় গোটা জেলায় ও প্রথম হয়েছিল। ওর চেহারাটা ছোটোখাটো হলেও ঝকঝকে দু-চোখের দৃষ্টিতে যেন বুদ্ধি ঝরে পড়ছে। ইস্কুলের বই ছাড়াও দেশ-বিদেশের অনেক বই ও পড়ে। এই বয়সেই ওর জ্ঞানের ভাণ্ডার এত বেশি যে, ওকে ক্ষুদে এক এনসাইক্লোপিডিয়া বললে অন্যায় হবে না। অজয়ের বাবা ডাক্তার। গাঁয়ের সবার তিনি প্রিয়। কারও অসুখবিসুখের খবর শুনলে শত অসুবিধে থাকলেও ছুটে তিনি যাবেনই।

সুভাষ লেখাপড়ায় মন্দ নয়, তবে অজয়ের সঙ্গে তুলনা চলে না। কিন্তু খেলাধুলায় সে সবার সেরা। ফুটবলে ও ডিস্ট্রিক্ট ইলেভেনে নিজের জায়গাটি পাকা করে নিয়েছে। তা ছাড়া দৌড়ঝাঁপেও অনেক কাপ, মেডেল পেয়েছে। চাবুকের মতো চেহারা। ভয়-ডর বলে কিছু ওর অভিধানে নেই। একবার ভিনগাঁয়ে ফুটবল খেলতে গিয়ে ওরা খুব বিপদে পড়েছিল। বিপক্ষ দলের সমর্থকরা মারমুখী হয়ে উঠেছিল, ও তখন একাই রুখে দাঁড়িয়ে সামলে দিয়েছিল ব্যাপরাটা।

সুভাষের বাবা ইস্কুল মাস্টার। আপনভোলা মানুষ। সংসারের শত অভাব অনটনেও মুখে হাসিটি লেগেই আছে। একজন আদর্শ শিক্ষাগুরু।

নরেন লেখাপড়ায় চলনসই, কোনোমতে ক্লাসের সিঁড়িগুলো ডিঙিয়ে চলছে। আসলে লেখাপড়ায় ওর তেমন আগ্রহ নেই। শরীরটাকে মজবুত করে গড়ে তোলাই হল ওর জীবনের ব্রত। ডন, বৈঠক, ডাম্বল, বারবেল, কুস্তি সব কিছুই ও করে। ওর শরীরের মাংসপেশি যেন সাপের মতো কিলবিল করে, চওড়া বুকে যেন দুটো পাথরের চাঁই। যেমন অসাধারণ শক্তি ওর শরীরে তেমন অসীম সাহস। লম্বায় ও পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির কম নয়, কিন্তু চওড়ার জন্য ওকে লম্বা মনে হয় না। আড়ালে লোকে ওকে বলে ‘কলির ভীম’।

নরেনের বাবার অবস্থা ভালো। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। গাঁয়ে ও শহরে গোটাকয়েক কাপড়ের দোকান আছে।

গ্রামের নাম কালিকাপুর। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। লোক মুখে শোনা যায় প্রায় দুই কি আড়াই-শো বছর আগে কালিচরণ নামে একজন ধনী বনজঙ্গল কেটে এই গ্রামের পত্তন করেছিলেন। আশেপাশেও তাঁর জমিদারি ছিল। তাঁর বংশ এখনও প্রদীপের সলতের মতো টিকে আছে। জমিদারবাড়ি অবশ্য এখন আর নেই, আছে শুধু ভগ্নস্তূপ। সাপের ভয়ে দিনের বেলাতেই কেউ সেই ভগ্নস্তূপের ধারে ঘেঁষতে সাহস করে না। তবে সেই ভগ্নস্তূপের মধ্যে আশ্চর্যভাবে কয়েকটা ঘর এখনও অক্ষতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে বট আর অশ্বত্থগাছ ভগ্নস্তূপটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে।

কালিচরণের বর্তমান বংশধরের অবস্থা পড়ে এসেছে। ভদ্রলোকের নাম রামশংকর হালদার। গ্রামের মধ্যেই আরেকটি বাড়িতে তিনি বাস করেন। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, বিয়ে-থা করেননি। একাই থাকেন। পূর্বপুরুষের সঞ্চিত অর্থ আর জমিজমার অবশিষ্ট বলতে কিছুই আর নেই। কলসির তলা ফুটো হলে জল গড়িয়ে গড়িয়ে কলসি একসময় শূন্য হয়। কালিচরণের বিপুল সম্পদ তাঁর বংশধররা দু-হাতে শুধু উড়িয়েছেন, বৃদ্ধি করবার কোনো চেষ্টাই করেননি, তাই রামশংকরের ভাগ্যে আজ জুটেছে এই ছোটো বাড়িটা, বিঘা কয়েক জমি আর দুটো পুকুর।

ভদ্রলোক চাষিদের সঙ্গে জমি ভাগচাষের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন, তা থেকে যে ধান, তরিতরকারি আসে, তাতে এক জনের সারা বছর চলে যায়। আসলে পুকুর দুটো থেকেই তাঁর যা কিছু আয় হয়। জেলেদের সঙ্গে ব্যবস্থা আছে, তারা মাছ বিক্রির একটা ভাগ অনেকদিন ধরে তাঁকে দিয়ে আসছে, তা ছাড়া প্রথম বড়ো মাছটাই তাঁর পাওনা।

দিন কয়েক হল ভদ্রলোক তাঁর বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দিয়েছেন। তাঁর অবস্থা যাই হোক না কেন, রামশংকর হালদার যেন একটু দাম্ভিক প্রকৃতির। গাঁয়ের লোকজনের সঙ্গে তেমন মেলামেশা নেই। কারণটা বোধ হয়, এ গ্রামের পত্তন করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ, সুতরাং সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা তাঁর মতো বনেদি বংশের পুরুষের পক্ষে শোভন নয়। যেন সেই কবে ঘি খেয়েছিলাম, আজও তার গন্ধ আঙুলে লেগে আছে।

গ্রাম বর্ধমান শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গ্রামের কোল ঘেঁষে পুরোনো জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। বর্ষাকালে নদীতে জল যেন ধরে না, আবার গরমের সময় হাঁটুজল। গ্রামে অবস্থাপন্ন বেশ কিছু ঘর আছে।

আম-জাম-কাঁঠালের ছায়াঘেরা শান্ত, স্নিগ্ধ এক গ্রাম। রাসের মেলা, পালাকীর্তন, দুর্গোৎসব, যাত্রাগানের আসর, এসব নিয়ে গ্রামবাংলার একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আসছে কালিকাপুর।

কিন্তু হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে কালিকাপুরের শান্ত পরিবেশ অশান্ত করে তুলল, সেখানকার মানুষের নিশ্চিন্ত জীবনে বয়ে নিয়ে এল ঝড়ের সংকেত।

দুই

বিকেল বেলা তিন বন্ধু নদীর ধারে বসে গল্প করছিল। তিন জনেই এবার ইস্কুলের শেষ পরীক্ষা দিয়েছে, হাতে অফুরন্ত সময়।

অজয়ের বয়স ষোলো। সুভাষ সবে সতেরো ছাড়িয়েছে। ওদের মধ্যে নরেনের বয়সই একটু বেশি আঠেরো। তবে বয়সের এই হেরফের ওদের মনে কোনো দাগ কাটেনি, বরং অজয়ের বুদ্ধি বিবেচনার উপর সুভাষ আর নরেনের পূর্ণ আস্থা আছে। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে অজয়ের মতামতটাই মেনে নেয় ওরা। ধীর, স্থির, বুদ্ধিমান বন্ধুর জন্য মনে মনে ওরা গর্বিত।

কথায় কথায় সুভাষ বলল, রামশংকরবাবুর ভাড়াটেকে আজ দেখলাম। ভদ্রলোক শুনলাম একজন ইতিহাসের অধ্যাপক, এখানে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে এসেছেন।

এত জায়গা থাকতে ভদ্রলোক আমাদের গাঁ বেছে নিলেন, নরেন বলল, এটা আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগছে।

তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, অজয় মুচকি হেসে বলল ভদ্রলোকের অনুচর একজন হাবসি। দৈত্যের মতো চেহারা।

তবে হয়ে যাক একদিন একহাত, নরেন সোৎসাহে বলে উঠল, লড়াই করার একটা মানুষ নেই গাঁয়ে, এতদিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন।

কথায় বলে না, নেই কাজ তো খই ভাজ, অজয় বলল, তোর হয়েছে সেই অবস্থা। কে এক ইতিহাসের অধ্যাপক এখানে এসেছেন, সঙ্গে এক হাবসি। যেহেতু তার ষণ্ডামার্কা চেহারা, তাই তার সঙ্গে লড়ে যাও।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ, তারপর অজয়ই আবার বলে, আমার কিন্তু আশ্চর্য লাগছে অন্য কারণে। ভদ্রলোক এই হাবসিকে জোগাড় করলেন কোথা থেকে? গোটা ভারতবর্ষের হাবসির সংখ্যা বোধ হয় আঙুলে গোনা যায়। ব্যাপারটা আমার কেমন রহস্যময় ঠেকছে।

* * *

পরের দিন সকাল বেলা নরেন যথারীতি ডন, বৈঠক করে বাড়ি ফিরছিল। ওর সারা গায়ে আখড়ার মাটি। পরনে একটা কাপড়, লুঙ্গির মতো জড়ানো আর গায়ে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি। কদমছাঁট চুল। মাংসপেশি যেন গায়ের জামা ফেটে বেরোতে চাইছে।

হঠাৎ সেই হাবসির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। মুদির দোকান থেকে কিছু সওদা করে সে ফিরছিল। অজয় একটুও বাড়িয়ে বলেনি। সত্যিই দৈত্যের মতো চেহারা। মাথায় ছোটো ছোটো কোঁকড়ানো চুল, আবলুস কাঠের মতো গায়ের রং। যেমন লম্বা তেমন চওড়া, যেন পাথরে খোদাই করা মূর্তি।

নরেনের মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেল। হাবসির দিকে এগিয়ে উরুতে এক চাপড় মেরে ও হাসিমুখে বলল, হয়ে যাবে নাকি একহাত?

হাবসিটা এরকম আচমকা দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাই প্রথমে যেন একটু হকচকিয়ে গেল। তারপরই ব্যাপারটা বুঝে শক্ত হয়ে উঠল তার দু-চোয়াল, চোখে যেন ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। ঘুসি বাগিয়ে সে এগিয়ে এল।

দু-চার জন পথচারী দুঃসাহসী ছেলেটার এই হঠকারিতায় শঙ্কিত হয়ে উঠল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চোখে চোখ রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, এই বুঝি একজন আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে পথে ভিড় জমে গেলে, রুদ্ধনিশ্বাসে সবাই ভীষণ কিছু একটার প্রতীক্ষা করছে। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ন শিসের আওয়াজে চমকে উঠল সবাই, হাবসিটাও যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক। বলিষ্ঠ চেহারা, চুল ব্যাকব্রাশ করা, চোখে কালো চশমা।

নরেনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি শুধোলেন, কী ব্যাপার?

অনেকদিন মনের মতো লড়াইয়ের সঙ্গী পাইনি, একগাল হেসে জবাব দিল নরেন, তাই আজ একটু শক্তি পরীক্ষা করার ইচ্ছে হয়েছিল।

নরেনের ব্যায়ামপুষ্ট সংগঠিত শরীরের দিকে এক ঝলক চোখ বুলোলেন ভদ্রলোক, তারপর একটু ঠেস দিয়ে বললেন, আগুনে হাত দিতে যেও না, হাত পুড়ে যাবে।

আগুনে শুধু হাতই পোড়ে না স্যার, তার তাপে ব্যথারও উপশম হয়।

ভদ্রলোক ফিরে তাকালেন। একটি কিশোর তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।

আচ্ছা ডেঁপো ছোঁড়া তো হে তুমি…

ভদ্রলোকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কে একজন বলে উঠল, ছি ছি! কাকে কী বলছেন স্যার! এই জেলার ও যে সেরা ছেলে। একেবারে হিরের টুকরো।

ভদ্রলোক আবার ফিরে তাকালেন, আরেকটি মজবুত চেহারার ছেলে তাঁর দিকে যেন ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভদ্রলোক বুদ্ধিমান, বুঝলেন ব্যাপার সুবিধের নয়। হাবসির দিকে তাকিয়ে তিনি কী ইঙ্গিত করলেন, তারপর ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেলেন। হাবসিও সুড় সুড় করে তাঁর অনুসরণ করল। ভদ্রলোক যাবার আগে অস্ফুট কী একটা উক্তি করলেন, কিন্তু তা বোঝা গেল না।

তিন

কয়েক দিন কেটে গেছে। কয়েক পশলা জোর বৃষ্টিও হয়ে গেছে। বর্ষা আসতে দেরি নেই, তার আগেই শুরু হয়েছে জলভরা মেঘের আনাগোনা।

তিন বন্ধু নদীর ধারে আবার এসে বসেছে।

গতকাল সুভাষের খেলা ছিল, ওদের দল ভালো খেলেও হেরে গেছে, তাই সুভাষ খুব মনমরা। এর মধ্যে সেই ভদ্রলোক কিংবা তার হাবসি অনুচরকে আর দেখা যায়নি।

নরেন এক বার বলল, দূর ছাই, এই একঘেয়ে জীবন আর ভালো লাগে না। জীবনে যদি অ্যাডভেঞ্চার না থাকে, রোমাঞ্চ না থাকে, তবে সে জীবনের মূল্য কী! গোরু-বাছুরের সঙ্গে তফাতটাই বা কোথায়?

সুভাষ এতক্ষণে গা ঝাড়া দিয়ে বলে ওঠে, যা বলেছিস নরু, আমার মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াব, নতুন নতুন জায়গা দেখব, তার মজাই আলাদা।

অজয় এতক্ষণে মুখ খুলল, স্বপ্নালু কণ্ঠে বলল, আমার ইচ্ছে করে শার্লক হোমসের মতো বিখ্যাত গোয়েন্দা হবার। কত বড়ো জিনিয়াস ভেবে দ্যাখ, একটা সামান্য বেড়াবার লাঠি দেখে লাঠির মালিকের পেশা, স্বভাব, চরিত্র অনায়াসে বলে দিলেন। কী সূক্ষ্ম বিচারবিশ্লেষণ! তুলনা হয় না।

কিন্তু শার্লক হোমসের তো সাকরেদ ছিল এক জন, মুচকি হেসে নরেন বলল, আমরা যে দু-জন।

ওর কথা শেষ হতে-না-হতেই সুভাষ উত্তেজিতভাবে বলে উঠল দ্যাখ, দ্যাখ।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে অজয় আর নরেনও চমকে উঠল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। আলোটা আসছে পুরোনো জমিদার বাড়ির ভগ্নস্তূপ থেকে।

জায়গাটা লোকালয়ের বাইরে, এমনিতেই নির্জন। দিনের বেলাই লোকে ওখানে যেতে সাহস করে না, আর এই ভর সন্ধেয় কার এত বুকের পাটা ওখানে আলো জ্বালিয়েছে! অবশ্য ওই ভুস্তূপকে ঘিরে অনেক রসাল ভূতপ্রেতের গল্প দানা বেঁধে উঠছে। কালিকিংকর নাকি অসাধু উপায়ে প্রচুর সম্পত্তি করেছিলেন, তাঁর মৃত্যু হয় অপঘাতে। তারপর থেকেই বংশে অভিশাপ লাগে এবং একটার পর একটা অপঘাত মৃত্যু ঘটতে থাকে। এইসব মৃত ব্যক্তির অতৃপ্ত আত্মা নাকি সন্ধের পর ভগ্নস্তূপে এসে জড়ো হয়। মাঝে মাঝে ওখান থেকে ভেসে আসে নারীকণ্ঠের করুণ বিলাপ। তাই সন্ধের পর ওদিকে ভুলেও কেউ পা মাড়ায় না।

অজয়রা অবশ্য ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করে না। এই নদীর ধারে অনেক সন্ধায় ওর তিন বন্ধু গল্প করে কাটিয়েছে, কই ওদের চোখে তো কোনোদিন এমন কিছু পড়েনি যা দেখে ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস হতে পারে! তা ছাড়া মেয়েলি গলায় কোনো কান্নাও ওদের কানে কোনোদিন ভেসে আসেনি।

প্রথমেই যে সন্দেহটা তিন বন্ধুর মনে উঁকি দিল, সেটা হল ওই ভগ্নস্তূপের মধ্যে কোনো চোর ডাকাত আস্তানা গাড়েনি তো! কিন্তু তা যদি হয়, আলোটা শুধু আজই ওদের চোখে পড়ল কেন? তবে কি দু-চার দিনের মধ্যেই ওখানে কেউ আশ্রয় নিয়েছে?

একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে তিন বন্ধু মনে মনে উত্তেজনা অনুভব করল। পায়ে পায়ে ওরা এগিয়ে চলল সেই আলোর রেখা লক্ষ্য করে।

* * *

চারদিকে ঝোপঝাড় আর স্তূপীকৃত বট অশ্বত্থের পাতা। পর পর কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ায় একটা সুবিধে হয়েছে শুকনো পাতায় পা পড়লে খস খস যে শব্দটা হয় সেটা আর হচ্ছে না। ইট, পাথরের ঢিবি ও ভাঙাচোরা স্তূপীকৃত জঞ্জালের ভিতর দিয়ে সাবধানে হেঁটে সেই আলোর কাছাকাছি এসে পৌঁছোল ওরা। আলোটা আসছে দোতলার প্রায় অক্ষত একটা ঘরের জানলা দিয়ে। চারদিকে জমাট অন্ধকার, আকাশে আবার মেঘ জমেছে। উপরে উঠবার সিঁড়িটা ওদের জানা নেই।

দোতলার সেই ঘরের প্রায় লাগোয়া একটা বড়ো আমগাছ। ওদের মধ্যে সুভাষ গাছে চড়তে ওস্তাদ। তর তর করে নারকেল গাছের মাথায় উঠে ডাবের কাঁদি নামাতে ওর জুড়ি মেলা ভার।

অজয়ের নির্দেশে ও চটপট গাছে উঠে পড়ল। একটা মোটা ডাল জানলাটার দিকে চলে গেছে। লঘু পায়ে নেকড়ের মতো হানা দিয়ে ওই ডাল বেয়ে এগিয়ে গেল ও। কিছুক্ষণ চুপচাপ। গাছের নীচে অজয় আর নরেন রুদ্ধনিশ্বাসে অপেক্ষা করছে। খানিক বাদেই সুভাষ নেমে এল। ভীষণ উত্তেজিত ও। ফিস ফিস করে ও যা বলল, তা শুনে চমকে উঠল অজয় আর নরেন। ব্যাপারটা তো তবে সামান্য নয়, গভীর একটা ষড়যন্ত্রের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।

চার

চাপা অথচ উত্তেজিত গলায় সুভাষ যা বলল তার মর্মার্থ হচ্ছে, দোতলার ওই ঘরটিতে ও অধ্যাপক মহাশয় আর তাঁর হাবসি অনুচরকে দেখেছে। কিন্তু ওটাই সব নয়। আরও এক জন আছেন ঘরে, তিনি হলেন রামশংকরবাবু, যাঁর ভাড়াটে হয়ে আছেন অধ্যাপকমশাই। রামশংকরবাবুকে মোটা দড়ি দিয়ে একটা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। অধ্যাপকমশায়ের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি রামশংকরবাবুকে শাসাচ্ছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে হাবসিটা, তার হাতে একটা চাবুক।

আকস্মিক এই ঘটনায় তিন বন্ধু কিছুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে গেল, কী করবে ভেবে পেল না, তারপরই নরেন বলল, একি মগের মুলুক নাকি! চল, আমরা উপরে গিয়ে ওদের আক্রমণ করে রামশংকরবাবুকে মুক্ত করি।

সুভাষও ওই প্রস্তাবে সঙ্গেসঙ্গে সায় দিল। কিন্তু বাধা এল অজয়ের কাছ থেকে। ও বলল, তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে কাজ ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আমার মনে আর এখন সন্দেহ নেই যে, ভদ্রলোক ইতিহাসের অধ্যাপক নন। কোনো একটা উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এখানে এসেছেন, সঙ্গে এনেছেন ওই হাবসিকে। কিছু একটা লুকোচুরির ব্যাপার আছে, যার সঙ্গে হয়তো রামশংকরবাবুও জড়িত। যাহোক, ভদ্রলোককে এক নজরেই বোঝা যায় বেশ শক্তিমান পুরুষ, আর হাবসিটা একটা ছোটোখাটো দৈত্য। এখানে আমাদের কোনো সাহায্য পাবারও আশা নেই। এ অবস্থায় ওদের উপর চড়াও হওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

ওর কথায় নরেন আর সুভাষ মনে মনে ক্ষুণ্ণ হল, নিজেদের শক্তির উপর ওদের আস্থা পুরোমাত্রায়। অজয় ওদের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, মিছিমিছি দাঙ্গাহাঙ্গামা না করে যদি বুদ্ধির জোরে আমরা কাজ হাসিল করতে পারি তবে সেটা আমাদের পক্ষেই লাভ। তোরা তো পড়েছিস, বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য।

এই অকাট্য যুক্তির পর সুভাষ আর নরেনের ক্ষোভের কারণ রইল না। অজয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগল।

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল অজয়, তারপর বলল, আমার মনে হয় বুদ্ধির জোরেই আমরা কাজ হাসিল করতে পারব।

ফিস ফিস করে ওর মতলবটা দুই বন্ধুর কাছে খুলে বলল ও।

ওর কথা শেষ হতেই সুভাষ আর নরেনের মুখে ফুটে উঠল আমুদে হাসি।

পাঁচ

ঘরের মধ্যে তখন একটা চাপা আক্রোশ যেন ফেটে পড়তে চাইছে। হাবসিটাও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। তার হাতের চাবুকটা শূন্যে একটা শিসের মতো আওয়াজ করে মাটিতে আছড়ে পড়ছে। চেয়ারে বসে থাকা রামশংকরবাবুর মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে।

হঠাৎ খোলা জানলার পাশে আমগাছের একটা ডাল সজোরে দুলে উঠল, সঙ্গেসঙ্গে ভেসে এল বিচ্ছিরি একটানা কান্নার আওয়াজ। ঘরের মধ্যেই সবাই যেন হতভম্ব। তারপরেই রামশংকরবাবুর ভাড়াটে ব্যাপারটা কী দেখবার জন্য জানলার পাশে এসে দাঁড়ালেন। অমনি একটা ইঁটের টুকরো তাঁর কান ঘেঁসে জানলার কাচের শার্সিতে সজোরে এসে লাগল। চট করে তিনি মাথাটা সরিয়ে নিলেন।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। আবার সেই কান্নার আওয়াজ ভেসে এল, এবার কিন্তু শব্দটা আসছে উলটো দিকের জানলা দিয়ে। এবার হাবসি জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। সঙ্গেসঙ্গে ভেসে এল এক ঝলক হাসির শব্দ, আর সেই শব্দকে ছাপিয়ে আবার যেন কেঁদে উঠল কেউ। অমন অসম সাহসী হাবসির মুখও কেমন যেন বিবর্ণ। চারিদিকে জমাট অন্ধকার, একটা ভূতুড়ে পরিবেশ। কিছুক্ষণ চুপচাপ, ভিতরে বোধ হয় শলাপরামর্শ চলছে। খানিক বাদেই একটা জোরালো টর্চের আলো ছড়াতে ছড়াতে ভদ্রলোক নেমে এলেন, পিছনে হাবসি। দ্বিতীয় বার যেদিক থেকে কান্নার আওয়াজ আসছিল, ভদ্রলোক সেদিকে টর্চের আলো ফেলতে লাগলেন, কিন্তু তাদের চমকে দিয়ে পিছন থেকে ভেসে এল একটা চাপা হাসির আওয়াজ।

ভদ্রলোক সেই শব্দ লক্ষ্য করে এগুলেন, হাবসিও তাঁর অনুসরণ করল। যেখান থেকে হাসির আওয়াজ এসেছিল, তার কাছাকাছি যেতেই আরও একটু দূর থেকে আবার ভেসে এল সেই হাসি। ভদ্রলোক আবার এগুলেন। এবার শব্দটা এল তাঁর বাঁ-দিক থেকে। সেদিকে খানিকটা এগুতেই ডান দিক থেকে কে যেন তাঁদের ব্যঙ্গ করে হেসে উঠল। ভদ্রলোকও নাছোড়বান্দার মতো শব্দ লক্ষ্য করে এক বার বাঁ-দিক, এক বার ডান দিক, তারপরেই সামনের দিকে পাগলের মতো ছুটে চললেন।

* * *

রামশংকরবাবু একা ঘরের মধ্যে রামনাম জপছেন। সমস্ত ব্যাপারটা যে ভৌতিক সে বিষয়ে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ নেই। হঠাৎ জানলার কোলঘেঁষা আমগাছের মোটা ডালটা দুলে উঠল আর ভাঙা, গরাদহীন জানলা দিয়ে ঝুপ করে কে এক জন লাফিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। সঙ্গেসঙ্গে রামশংকরবাবু জ্ঞান হারালেন।

প্রবল ঝাঁকুনিতে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। চোখ খুলেই তিনি দেখলেন তাঁর বাঁধন মুক্ত আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাধন মাস্টারের ডানপিটে ছেলেটা। তিনি কিছু বলবার বা উঠবার আগেই ছেলেটা তাঁকে এক হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে বলল, চলুন আমার সঙ্গে, ওরা ফিরে আসার আগেই আমাদের পালাতে হবে।

রামশংকরবাবু মুহূর্তে নিজের বিপদ সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠলেন। ঘরের চৌকাঠের বাইরে পা দিয়ে কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার, সিঁড়ি দেখা যায় না, শেষকালে পা হড়কে পড়ে কি আরেকটা বিপদ ঘটবে।

ঘরের মধ্যে যে লন্ঠনটা জ্বলছিল সেটা হাতে করে এনে সুভাষ দেখল সর্বনাশ! সিঁড়িটা প্রায় ভেঙে পড়েছে, সব ধাপ অক্ষত নেই, সাবধানে না নামলে উপর থেকে গড়িয়ে একেবারে পপাত ধরণীতল হতে হবে।

লন্ঠনটা সিঁড়ির মুখে রাখাও নিরাপদ নয়, শত্রুদের নজরে পড়ে গেলেই ফাঁস হয়ে যাবে ওদের পরিকল্পনা। সুভাষ বুদ্ধি করে লন্ঠনটা ঘরে রেখে এল। রামশংকরবাবুর কাছে টর্চ ছিল না। কিন্তু একটা দেশলাই ছিল। মাত্র কয়েকটা কাঠি অবশিষ্ট আছে। সুভাষ সেটা চেয়ে নিল। প্রথম দুটো কাঠি জ্বালাবার সঙ্গে সঙ্গেই হাওয়ায় নিভে গেল। তৃতীয় কাঠিটা খুব সাবধানে দু-হাতের তালুতে আড়াল করে জ্বালাল সুভাষ, তার সেই ক্ষীণ আলোয় সাবধানে পা ফেলে নামতে লাগল। রামশংকরবাবু পায়ে পায়ে অনুসরণ করলেন ওর। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছোবার আগেই নিভে গেল কাঠিটা, আর প্রায় সঙ্গেসঙ্গে বাইরে জুতোর মস মস শব্দ শোনা গেল। মুহূর্ত দ্বিধা না করে সুভাষ রামশংকরবাবুর ডান হাত ধরে এক টান মেরে তাঁকে নামিয়ে আনল, তারপরই দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়াল। রামশংকরবাবু হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে আশ্চর্যভাবে সামলে নিলেন।

দরজাটা অনেকদিন থেকেই নেই। সেখানে মস্ত একটা হাঁ হয়ে আছে। ওরা তার পাশেই জীর্ণ ইটের দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে আর তখুনি টর্চের আলো এসে পড়ল সিঁড়ির মুখে। এক মুহূর্তের জন্য বেঁচে গেল ওরা। সুভাষ মনে মনে ভাবল ভাগ্যিস লন্ঠনটা ঘরের ভিতর রেখে এসেছিল।

জুতোর শব্দ আরও এগিয়ে এল। নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়েছে ওরা। টর্চ হাতে প্রথমে ঢুকলেন রামশংকরবাবুর ভাড়াটে, তার পিছন পিছন সেই হাবসি। সুভাষরা তাদের দিকে পিছন করে থাকায় ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল না। হাবসি উপরে সিঁড়ির প্রায় শেষধাপে পৌঁছে গেছে, সুভাষ প্রস্তুত হচ্ছে ওরা ঘরে ঢোকা মাত্র রামশংকরবাবুকে নিয়ে ছুট দেবে, আর তখুনি ঘটে গেল একটা অঘটন। অন্ধকারের নিস্তব্ধতা ভেঙে সশব্দে একটা হাঁচি দিলেন রামশংকরবাবু।

ছয়

হাঁচির শব্দ মেলাতে না মেলাতেই তীব্র টর্চের আলো এসে পড়ল ওদের মুখের উপর, চোখ ধাঁধিয়ে দিল, আর সঙ্গেসঙ্গে একটা হিংস্র গর্জন।

ফুটবল খেলায় অনেকরকম অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে সুভাষকে। উপস্থিত বুদ্ধি কখনোই হারায়নি। রামশংকরবাবুর হাত ধরে তাঁকে প্রায় টেনেই বাইরে নিয়ে এল ও, তারপর চাপা গলায় বলল, বাঁচতে চান তো ছুটুন।

সুভাষ নিজে একজন নামকরা অ্যাথলিট, গত বছর এক-শো মিটার আর দু-শো মিটার দৌড়ে জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছিল। কিন্তু রামশংকরবাবু প্রাণের ভয়ে মরিয়া হয়ে যে দৌড় দিলেন তা সুভাষকেও তাক লাগিয়ে দিল। হাবসিও ওদের পিছু নিয়েছিল, কিন্তু ওদের সঙ্গে দৌড়ে এঁটে উঠতে পারল না, তা ছাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে তার যেটুকু দেরি হয়েছিল, সেই সময়টুকু খুব কাজে লাগল সুভাষদের।

* * *

পরদিন সন্ধেবেলা। রামশংকরবাবুর বাড়িতে বৈঠক বসেছে। অজয়, সুভাষ আর নরেন একটা তক্তপোশের উপর বসে আছে, রামশংকরবাবু একটা আরামকেদারায় আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল তাঁর উপর দিয়ে কম ধকল যায়নি। হাবসিটা তাঁকে এমন শক্ত করে বেঁধেছিল যে, তাঁর সর্বাঙ্গে কালশিটে পড়ে গেছে, গায়ে ব্যথা।

হাবসি আর তার প্রভু সেই ঘটনার পর থেকে একেবারে নিপাত্তা। তারা যে অংশে ভাড়া ছিল, তার সদর দরজার তালা অজয়ের পরামর্শ মতো ভেঙে ফেলা হয়েছে। দুটো ঘর, কিন্তু আশ্চর্য, বাক্স বিছানা কিছুই নেই। নিশ্চয়ই গত রাত্রের ঘটনার আগেই তারা মালপত্তর সরিয়ে ফেলেছিল। তার অর্থ তারা আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল কাজে। যে দু-চারটে অপ্রয়োজনীয় জিনিস তারা ফেলে গেছে তা থেকে তাদের সম্বন্ধে কিছুই জানা গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অজয় একটা আধপোড়া খাম উদ্ধার করল। খামের উপর লেখা ছিল :

বাকি অক্ষরগুলো পুড়ে গেছে।

অজয় খামটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, ভদ্রলোকের নাম তাহলে কালিকিংকর।

ওকে বাধা দিয়ে রামশংকরবাবু বলে উঠলেন, কিন্তু উনি যে আমার কাছে নাম বলেছিলেন প্রেমাংশু মিত্র।

অজয় চোখের চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে কাচ দুটো মুছতে লাগল। সুভাষ আর নরেন জানে ওটা হল ওর গভীর চিন্তা করার লক্ষণ।

অজয় চশমার কাচ মুছতে মুছতেই রামশংকরবাবুর কথার জবাব দিল, বলল, ওটা ছদ্মনাম। ‘বর্ধ’ থেকে বোঝা যাচ্ছে ‘বর্ধমান’, আর ‘রামসদয়’ নিশ্চয়ই কারো নাম নয়, কারণ কালিকিংকরের পরে যদি অন্য একটা নাম থাকত তবে তার আগে কেয়ার অব কথা লেখা থাকত, যেমন কালিকিংকর কেয়ার অব রামসদয়। আমার মনে হয় ওটা কোনো বাড়ি কিংবা হোটেলের নাম— যেমন ‘রামসদয়’ লজ কিংবা ‘রামসদয় হোটেল’, বর্ধমান।

নরেন উরুতে চাপড় মেরে বলল, ঠিক বলেছিস। জানিস তো, বাবার বর্ধমানে কাপড়ের দোকান আছে। আমাকে মাঝে মাঝে ওখানে যেতে হয়। সেখানে ‘রামসদয় হোটেল’ আমার চোখে পড়েছে। কার্জনগেট পেরিয়ে শহরের দিকে যেতে বাঁ-হাতে ওই হোটেলটা।

রামশংকরবাবু এই কিশোর ছেলেটির বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে অবাক হলেন। অজয় কিন্তু চশমা মুছতে মুছতেই বলে চলল, তাহলে বোঝা যাচ্ছে প্রেমাংশু মিত্র ওরফে কালিকিংকর আসল ঘাঁটি গেড়েছিলেন বর্ধমানে এবং তার চিঠিপত্রও আসত সেই ঠিকানায়। এখানে ঘর ভাড়া নেওয়াটা উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু কী তার উদ্দেশ্য? রামশংকরবাবুকে অমন করে ধরে নিয়ে গিয়ে তিনি শুধু আইনভঙ্গই করেননি, মস্ত ঝুঁকিও নিয়েছিলেন। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায়, রামশংকরবাবুর কাছে তিনি এমন কিছু আশা করেছিলেন যার মূল্য এত বেশি যে, তারজন্য অমন ঝুঁকি নিতে তিনি পিছপা হননি। এখন রামশংকরবাবুই এই রহস্যে আলোকপাত করতে পারেন।

অজয় ওর বক্তব্য শেষ করল। ঘরে নেমে এল একটা নিস্তব্ধতা, যেন একটা আলপিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে।

তিন জোড়া চোখের উৎসুক দৃষ্টির সামনে রামশংকরবাবু যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন তিনি, তারপর সোজা হয়ে বসে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, অজয় যা বলেছে তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। তোমরা আমার জীবন রক্ষা করেছ, তোমাদের কাছে আমি চির ঋণী। আমি সবকথাই খুলে বলব, কিন্তু তার আগে একটা অনুরোধ করব। আজ তোমরা যা শুনবে তা যেন পাঁচকান না হয়, তোমরা তিন জন ছাড়া আর কেউ যেন জানতে না পারে।

তিন বন্ধু প্রায় সমস্বরে প্রতিশ্রুতি দিল।

রামশংকরবাবু বললেন, দাঁড়াও, কাহিনি শুরু করার আগে একটু চায়ের জল বসিয়ে দিই, গলাটাও ভিজিয়ে নেওয়া হবে। তা ছাড়া তোমরা আজ আমার অতিথি, চায়ের সঙ্গে একটু টায়ের ব্যবস্থাও করা দরকার, কি বল?

নরেন আবার একটু ভোজনবিলাসী, মাথা চুলকে ও বলল, তা প্রস্তাবটা মন্দ নয়।

আমার বাড়ির উঠোনে গোটাকয়েক মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখেছ তো? রামশংকরবাবু মুচকি হেসে বললেন, একদিন নিজের হাতে মুরগির মাংস রান্না করে খাওয়াব। আজ ওমলেট খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

সাত

চা ওমলেট পর্ব শেষ হবার পর রমাশংকরবাবু এবার আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন।

তোমরা হয়তো শুনেছ, এই গ্রামের পত্তন করেছিলেন আমার এক পূর্বপুরুষ, তাঁর নাম ছিল কালিচরণ। তাঁর পদবি ছিল রায়।

কিন্তু আপনি তো হালদার! অজয় বাধা দিয়ে বলে উঠল।

ঠিক ধরেছ, রামশংকরবাবু হেসে বললেন, ইউ আর ভেরি শার্প। আচ্ছা, আমাদের বংশ পঞ্জিটা তোমাদের দেখাই তবেই সমস্ত ব্যাপারটা তোমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

একটা বাক্স খুলে তিনি হলুদ রঙের বিবর্ণ একটা কাগজ বার করলেন। কাগজটা টেবিলের উপর খুলে ধরলেন তিনি। তিন বন্ধু ঝুঁকে কাগজটা দেখতে লাগল। কাগজে যেভাবে যা লেখা ছিল তা নীচে হুবহু তুলে দেওয়া হল।

কিরণশংকরের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না দেখছি, অজয় বড়োদের মতো গম্ভীরভাবে বলল, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কালিচরণের বংশের ধারা লোপ পেয়েছে। আপনি হলেন কিরণশংকরের মেয়ের পক্ষের নাতজামাইয়ের বংশধর।

এবং তাই আমি রায় না হয়ে হালদার হয়েছি, রামশংকরবাবু একটু কৌতুকের সঙ্গে বললেন।

কাগজটার ওপর আরেক বার চোখ বুলিয়ে অজয় শুধালো কালিচরণের মেয়ে কালিতারার বংশ তালিকাটা অসম্পূর্ণ কেন?

এই বংশ পঞ্জি, রামশংকরবাবু জবাব দিলেন, কালিচরণ রায়-ই প্রথম শুরু করেছিলেন, তারপর বংশ পরম্পরায় অন্যরা এটা সম্পূর্ণ করেছে। একথা অবশ্য আমার মায়ের মুখে শোনা। তারাসুন্দরীর কোনো সন্তান ছিল কি না সেটা জানা যায়নি, আর আমি জানতে চেষ্টা করিনি। বুঝতেই তো পারছ, কৃষ্ণমোহন আর কালিতারা ভাই-বোন হলেও তাদের বংশধরদের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বেড়েছে।

তা বটে, অজয় ঘাড় দুলিয়ে বলে, মৃগাঙ্ক হালদার আর কৃষ্ণকান্ত মল্লিকের বংশধরদের সম্পর্কটা একটু জটিলই বলা চলে, দূর সম্পর্কের পিসতুতো মামাতো ভাইটাই হবে।

এবার আসল ঘটনায় আসা যাক, রামশংকরবাবু আবার শুরু করলেন, কালিচরণ যে আমলের লোক ছিলেন, সে সময় বাংলাদেশে ডাকাতি একটা মস্ত বীরত্বের কাজ বলে মনে করা হত। এমন অনেক জমিদার ছিলেন, যাঁদের পেশা ছিল ডাকাতি করা, এজন্য তাঁরা লেঠেল পুষতেন। কালিচরণ রায় আসলে ছিলেন একজন ডাকাত সর্দার। ডাকাতি করে তিনি প্রচুর অর্থ ও সম্পত্তি করেছিলেন। এভাবেই তাঁর জমিদারি শুরু। শেষ জীবনে বোধ হয় তাঁর অনুশোচনা আসে, তিনি একটি জবানবন্দি লিখে যান। সেটা অনেকটা পুঁথির আকারে লেখা। যাহোক, সেটাও বংশপরম্পরায় আমার হাতে এসেছে। সেটা আমি তোমাদের পড়ে শোনাচ্ছি।

রামশংকরবাবু তুলোট কাগজে লেখা একটা পুঁথি বার করলেন, তারপর একটু কেশে পড়তে শুরু করলেন।

আমি কালিচরণ রায় সজ্ঞানে এবং সুস্থ মস্তিষ্কে এই কাহিনি লিপিবদ্ধ করিতেছি। বাল্য ও কৈশোরে আমি সাতিশয় দুরন্ত ছিলাম, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কুসংসর্গে পথভ্রষ্ট হই। স্নেহময় পিতা এবং স্নেহময়ী জননীর শত অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষা করিয়া যৌবনসন্ধিক্ষণে এক দস্যুদলে যোগদান করি। দস্যুতায় সেই আমার প্রথম হাতেখড়ি।

ক্রমে যতই বৎসর অতিবাহিত হইতে লাগিল, আমি দুর্দান্ত হইয়া উঠিলাম। আমার প্রচণ্ড শক্তি, সাহস এবং হিংস্রতায় আমার সঙ্গীরা পর্যন্ত আমাকে সমীহ করিয়া চলিত। প্রথম সুযোগেই আমি নিজের দল গড়িলাম। কালিডাকাতের নিষ্ঠুরতার কাহিনি এতই ব্যাপৃত হইয়াছিল যে তাহার নাম শুনিলেই গৃহস্থের হৃৎকম্প হইত। এই সময় বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁ কঠোর হস্তে দস্যুতা দমন করিতে সচেষ্ট হইলেন। বেগতিক দেখিয়া আমার মতো অনেক সর্দার দল ভাঙিয়া শান্তিপূর্ণ জীবন নিরাপদ গণ্য করিল।

দীর্ঘকাল দস্যুতায় লিপ্ত থাকায় আমার প্রচুর সম্পদ হইয়াছিল। অমি নামমাত্র মূল্যে জঙ্গলসমাকীর্ণ এই অঞ্চলের দখল লইয়া বসতি স্থাপনে সচেষ্ট হইলাম। কালিডাকাত, জমিদার কালিচরণ নামে খ্যাত হইল। জমিদারির পরিধি বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে আমি অনুগত প্রজাবসতির প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াছিলাম।

সুখেই দিন অতিবাহিত হইতেছিল, কিন্তু ঈশ্বর কেন আমার অতীতের অপরাধ ক্ষমা করিবেন! কত মানুষের আমি সর্বনাশ করিয়াছি, সর্বস্ব অপহরণ করিয়াছি, কত অসহায়া রমণীর কাতর মিনতি, অশ্রুজল, আমি পায়ে ঠেলিয়াছি, তাহাদের অভিশাপ কি বৃথা হয়! তাহাদের অভিশপ্ত নিশ্বাসের উষ্ণ স্পর্শ আমাকে অহোরাত্র যেন অগ্নিদগ্ধ করিতেছে। আমি দিব্য চক্ষে দেখিতেছি আমার বংশে অভিশাপ লাগিয়াছে। আমার জ্যেষ্ঠপুত্র, আমার স্নেহের দুলাল কালিকৃষ্ণ উন্মাদ হইয়া গিয়াছে। কনিষ্টপুত্র কৃষ্ণমোহন একটি নাবালক পুত্র রাখিয়া অকালে ইহলোক ত্যাগ করিয়াছে। আমার নয়নের মণি কালিতারার দেখিয়া শুনিয়া বিবাহ দিয়াছিলাম, কিন্তু জামাতা একটি পাষণ্ড। তাহার অত্যাচারে আমার নয়নের পুত্তলি একটি কন্যা রাখিয়া উদ্ধন্ধনে প্রাণ বিসর্জন দিয়াছে। তাহার নাবালক পুত্রটির পূর্বেই অপঘাতে মৃত্যু হইয়াছিল। শোকে, দুঃখে আমার স্ত্রী ভগ্নহৃদয়ে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছেন।

অভিশাপ! অভিশাপ! আমার বংশে ঘোর অভিশাপ লাগিয়াছে। ইহা শুধু আমার কৃতকর্মের ফল। যেসব ঘৃণ্য অপরাধ আমি করিয়াছি তাহার ক্ষমা নাই, তাই ঈশ্বর আমাকে জীবিত রাখিয়া দগ্ধাইয়া মারিতেছেন।

আমার বংশে প্রদীপ দিতে যদি কেহ বাঁচিয়া থাকে, যদি আমার মৃত্যুর সহিত এই করাল অভিশাপের পরিসমাপ্তি ঘটে, তবে তাহার নিকট আমার একান্ত অনুরোধ, সে যেন তাহার পূর্বপুরুষের জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করে, সামান্য সমবেদনা, একফোঁটা অশ্রু, তাহা হইলেই আমার আত্মা শান্তি লাভ করিবে। ইহার অধিক কিছু আমার কাম্য নহে।

পরিশেষে আমার উত্তরসূরিদের জ্ঞাতার্থে এক তথ্য লিপিবদ্ধ করিতেছি। লুণ্ঠিত সম্পদই আমার বংশে অভিশাপ বহন করিয়া আনিয়াছে এই বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। সুতরাং এই সম্পদ ভোগে না অসিয়া বরং অভিশাপরূপে দেখা দিবে ইহাই আমার আশঙ্কা। তথাপি আমি উহার সামান্য অংশ একটি গুপ্তস্থানে লুক্কায়িত রাখিলাম। আমার এই জবানবন্দির শেষ পৃষ্ঠায় সাংকেতিক ভাষায় উহার প্রকৃত অবস্থান বর্ণিত আছে। যদি আমার কোনো বংশধর ভাগ্যবান হন তবে তিনি উহা উদ্ধার করিয়া ভোগ করিবেন ইহাই আমার অন্তিম ইচ্ছা। কিন্তু সাবধানে, যদি বংশের অভিশাপের অবসান না ঘটিয়া থাকে তবে বিষবৎ উহা পরিত্যজ্য।

স্বাঃ ভাগ্যহত

কালিচরণ রায়।

আট

রামশংকরবাবু পড়া শেষ করলেন। ঘরে একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। তারপর রামশংকরবাবুই জবানবন্দির শেষ পৃষ্ঠা খুলে মেলে ধরলেন। প্রথমেই একটি কবিতা—

রণে দিল ভঙ্গ

সুবল না ছাড়ে সঙ্গ।

লক্ষ্মণ ভাই বল কোথা পাই?

পুরাইবার সাধ আর কেহ নাই।

রজনী পোহাল বিদায় লয়ে যাই।

এরপর কাগজের ওপর পটু হাতে আঁকা পরপর কতকগুলো ছবি। ছবিগুলো পরের পাতায় দেখানো হয়েছে।

ছবি :প্রসাদ রায়

অজয় রামশংকরবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই কাগজটা আমার কাছে রাখতে পারি?

রামশংকরবাবু একটু ইতস্তত করে সম্মতি জানালেন। অজয় সযত্নে কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে পুরল, তারপর চশমা খুলে রুমাল দিয়ে কাচ মুছতে মুছতে বলল, একটা জিনিস স্পষ্ট হল।

সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে।

এখন বোঝা যাচ্ছে, অজয় আবার বলল, কালিকিংকরের পদবি হল মল্লিক। তারাসুন্দরী ও কৃষ্ণকান্ত মল্লিকের ছেলে এবং আপনার জ্ঞাতি। আমরা যে খামটা পেয়েছি, তাতে কালিকিংকরের নামের পর পদবির প্রথম অক্ষর ‘ম’ আছে, বাকি সব পুড়ে গেছে। ওটা যে মল্লিকের আদ্য অক্ষর সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

চমৎকার! রামশংকরবাবু সপ্রশংস কণ্ঠে বলে উঠলেন, তুমি বড়ো হলে নিশ্চয়ই মস্ত বড়ো গোয়েন্দা হবে, এই বয়সেই তোমার যা বুদ্ধি!

এই সাংকেতিক লিপিটাই কালিকিংকর আপনার কাছ থেকে আদায় করতে চেষ্টা করছিল, অজয় যেন একটু চিন্তা করতে করতে বলল, আমার মনে হয় কালিচরণ রায়ের জামাতা অনঙ্গমোহন মিত্র যেমন করেই হোক এটার কথা জানতে পেরেছিলেন এবং তিনি তাঁর মেয়ে-জামাইকে তা জানিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই কালিকিংকর ওটার অস্তিত্বের কথা জেনেছে এবং ওটা দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

কে! কে ওখানে! সুভাষ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, আর চমকে মুখ ফেরাল সবাই। ছায়ার মতো যেন একটা মুখ সরে গেল জানালার ওপাশ থেকে। সকলে ছুটে বাইরে গেল, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। চিন্তিত মুখে আবার সবাই ঘরে ফিরে এল। অজয় সুভাষকে জিজ্ঞেস করল, তুই ঠিক দেখেছিস?

হ্যাঁ, সুভাষ জবাব দিল, কালিকিংকর ছাড়া আর কেউ নয়।

কালিকিংকর তবে গ্রাম ছেড়ে যায়নি। কিন্তু সে আছে কোথায়? অজয়ই এই প্রশ্নের জবাব দিল, বলল, আমরা কী বোকা! পুরোনো জমিদার বাড়িতে আজ দিনের আলোয় আমাদের ঢুঁ মারা উচিত ছিল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম কালকের ঘটনার পর কালিকিংকর তার অনুচরকে নিয়ে ওখান থেকে সরে পড়েছে। ও জায়গাটা ওদের পক্ষে মোটেই আর নিরাপদ নয়, তবু যখন ওরা ওখানেই আস্তানা গেড়েছে, তা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি সহজে হাল ছেড়ে দেবার লোক ওরা নয়।

রাত হয়ে গেছে তাই ঠিক হল পরদিন ওরা লোকজন নিয়ে পুরোনো জমিদার বাড়ি হানা দেবে।

পরদিন সকালে সুভাষ আর নরেন অজয়দের বাড়ি গিয়ে দেখে সেখানে হইচই পড়ে গেছে। অজয়কে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। খুব ভোরে ওর মা দেখতে পান ঘরের দরজা খোলা, বিছানায় অজয় নেই, আর সেই সঙ্গে বিছানার চাদরটাও উধাও। জানালার কাঠের দুটো গরাদ ভাঙা অবস্থায় বাইরে মাটিতে পড়ে আছে।

সুভাষ আর নরেনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। অজয়কে কে বা কারা গুম করেছে তা স্পষ্ট কিন্তু সেকথা ওরা বলে কী করে! সমস্ত ব্যাপারটা যে ভীষণ গোপনীয়।

ওরা তখুনি ছুটল রামশংকরের বাড়ি। তিনি নিশ্চয়ই একটা পরামর্শ দিতে পারবেন।

ওদের মুখে সব শুনে রামশংকরবাবুও মাথায় হাত দিলেন। সাংকেতিক লিপিটা গত রাত্তিরে অজয় নিয়ে গিয়েছিল। কালিকিংকর নিশ্চয়ই জানালার ওপাশ থেকে সেটা লক্ষ্য করেছে, আর ওটা হস্তগত করার উদ্দেশেই বন্দি করেছে অজয়কে।

সুভাষ আর নরেন তক্ষুনি পুরোনো জমিদার বাড়ি চড়াও হবার জন্য লাফিয়ে উঠল। রাতারাতি অজয়কে নিয়ে বেশি দূরে কোথাও কালিকিংকর যেতে পেরেছে বলে মনে হয় না। রামশংকরবাবুও ওদের সঙ্গে যাবেন বললেন। তাঁর জন্যই অজয় বিপদে পড়েছে, সুতরাং তাঁরও এ ব্যাপারে একটা দায়িত্ব আছে। সুভাষরা অবশ্য তাতে খুশিই হল, প্রতিপক্ষকে ওরা খাটো করে দেখতে চায় না। বলা যায় না, রামশংকরবাবুর সাহায্য হয়তো কাজে লাগতে পারে।

রামশংকরবাবু চট করে তৈরি হয়ে সঙ্গে একটা লাঠি নিলেন। লাঠিটার প্রান্ত টান দিতেই খুলে গেল, বেরিয়ে এল একটা ইস্পাতের ফলা। রামশংকরবাবু বললেন ওটাকে বলে গুপ্তি। পথে ঘাটে বিপদে পড়লে আত্মরক্ষার মোক্ষম অস্ত্র। তিনি আরও বললেন, তাঁর বাবার খুব শিকারের শখ ছিল, একটা বন্দুক কিনেছিলেন। সেটা এখনও আছে, রামশংকরবাবুও মাঝে মাঝে পাখি শিকারে বেরিয়ে পড়েন। দরকার পড়লে ওটা নিতে তিনি দ্বিধা করেন না।

তিন জনে বড়ো বড়ো পা ফেলে ভগ্নস্তূপের দিকে হাঁটা দিল।

নয়

এবার আমরা গত রাত্রে ফিরে যাই। বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে অজয় ওর ঘর বন্ধ করে নকসাটা নিয়ে বসল।

এখানে অজয়দের বাড়ির একটু বিবরণ দেওয়া যাক।

গ্রাম অঞ্চলে পাকা দালানকোঠার বদলে অনেক সময় টিনের চালার ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। গাঁথুনি আর দেয়াল হয়তো শক্ত মাটির আর চালাটা টিনের, কাঠের কড়িবরগা।

অজয়দের মূল ঘরটা ছিল পাকা গাঁথুনি, টিনের চালা। ওই ঘরের একপাশে রান্নাঘর। রান্নাঘরের দেয়াল মাটির আর চালা খড়ের। সামনেই মস্ত উঠোন। উঠোনের ওপাশে, রাস্তার ধারে আরেকটা টিনের চালার ঘর, পাকা গাঁথুনি, ওটা হল অজয়ের বাবার ডিসপেনসারি এবং বৈঠকখানা। বড়ো ঘরের কাছেই আরেকটা ছোটো ঘর। লেখাপড়ার সুবিধের জন্য অজয় একাই এই ঘরটা ব্যবহার করে, রাতে শোয়। কলঘর একটু দূরে। প্রত্যেকটি ঘর কিন্তু আলাদা।

অজয়ের ঘরের দরজা-জানালার ফ্রেম কাঠের হলেও পাল্লা কিন্তু টিনের। জানালার গরাদ পলকা কাঠের। আসলে ওদের ওখানে চোর-ডাকাতের ভয় কোনোদিন ছিল না।

অনেক রাত পর্যন্ত নকসাটা নাড়াচাড়া করে ওটাকে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে শুয়ে পড়ল অজয়। মাথার সামনের জানালাটা খোলাই ছিল।

ওর ঘুম গভীর, তবু হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে কার যেন মৃদু চলাফেরার শব্দ।

কে? ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠল ও।

সঙ্গেসঙ্গে থেমে গেল সেই শব্দ। পরমুহূর্তে একটা শক্ত হাত চেপে ধরল ওর মুখ, নিপুণ ক্ষিপ্রতায় বিছানার চাদর দিয়ে ওকে পেঁচিয়ে ফেলল কেউ। অজয়ের যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিশীথ রাতের আগন্তুক অবহেলায় কাঁধে তুলে নিল ওকে, তারপর দরজার খিল খুলে মিলিয়ে গেল বাইরের গাঢ় অন্ধকারে। বাইরের খোলা হাওয়ায় অজয় অনেকটা স্বস্তি পেল, চাদরে জড়াবার ফলে ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হয়েছিল।

হাবসিই যে ওকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে ওর মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। নিজেকে বড়ো বোকা মনে হতে লাগল অজয়ের। রামশংকরবাবুর ঘরের জানালায় কালিকিংকরের উঁকি মারার ঘটনা থেকেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল ওর। নকসাটা যে ওর কাছে আছে তা নিশ্চয়ই নজড়ে পড়েছিল কালিকিংকরের এবং তিনি যে ওটা হস্তগত করার জন্য শেষ চেষ্টা করবেন এ সম্ভাবনা ওর মনে যে কেন আসেনি, সেটাই আশ্চর্য।

চাদরটা বিচ্ছিরিভাবে মুখের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তারপর একসময় দু-চোখে অন্ধকার নেমে এল অজয়ের।

* * *

জ্ঞান ফিরে পাবার পর অজয় দেখল ও একটা জীর্ণ ঘরের ভাঙাচোরা মেঝের ওপর শুয়ে আছে, আর ওর পাশেই একটা পুরোনো খবরের কাগজের ওপর বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই নকসাটা দেখছেন কালিকিংকর।

অজয় উঠে বসল। সঙ্গেসঙ্গে কালিকিংকর নকসাটা পকেটে পুরে ফিরে তাকালেন ওর দিকে, একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, কি হে ডেঁপো ছোঁড়া, মূর্চ্ছা ভাঙল?

আজ্ঞে মূর্চ্ছা যাবার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত, অজয় মিষ্টি হেসে বলল, মরে যে যাইনি এই ঢের।

ভয় নেই, হয়তো শেষপর্যন্ত তোমাকে মরতেই হবে, গম্ভীর মুখে বললেন কালিকিংকর।

সে কী! মুখে ছদ্ম ভয়ের ভাব ফুটিয়ে তুলল অজয়, আমি যে মা-বাবার একমাত্র ছেলে…

চুপ কর, আর ডেঁপোমি করতে হবে না, কালিকিংকরের গলায় রাগের সুর। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, কাল রাতে তোমাদের কথাবার্তা আমি শুনেছি। তোমার বুদ্ধি আছে স্বীকার করছি। আমার মা হলেন তারাসুন্দরী, বাবা কৃষ্ণকান্ত মল্লিক। গুপ্তধনের নকসার কথা আমি জানতে পারি কালিতারার স্বামী অনঙ্গমোহনের লেখা একটা চিঠি থেকে। চিঠিটা প্রসন্ন গুহ ও শ্রীকান্তর হাত ঘুরে আমার বাবার কাছে আসে। তাঁর মুখেই আমি সব জানতে পারি।

ছোটোবেলায় দারুণ দারিদ্র্যে আমার দিন কেটেছে। দু-বেলা পেট ভরে ভাতও জোটেনি। তখনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই গুপ্তধন যেমন করেই হোক আমি উদ্ধার করব। তা ছাড়া রামশংকরের কী অধিকার আছে ওই গুপ্তধনে! সে তো কালিচরণের আদি বংশের কেউ নয়। কিরণশংকর অপুত্রক ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কালিচরণের বংশের ধারা শেষ হয়ে গেছে। কিরণময়ীর স্বামী মৃগাঙ্ক হালদারের আলাদা বংশ। ওই ধনে তাদের সন্তানের যা অধিকার, আমার তা হবে না কেন? কালিচরণের একমাত্র মেয়ে কালিতারা হলেন আমার মায়ের ঠাকুমার মা।

কালিকিংকর চুপ করলেন। উত্তেজনায় তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠেছে।

আচ্ছা আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? অজয় হঠাৎ প্রশ্ন করল, আপনাকে আগে কখনো দেখিনি তো।

তোমার কৌতূহলটা দেখছি বড্ড বেশি, একটু ব্যাঙ্গের কণ্ঠে জবাব দিলেন কালিকিংকর। একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বলতে থাকেন, কোথায় না ছিলাম! জীবিকার জন্য হেন কাজ নেই যে করিনি। শেষের দিকে বম্বে ছিলাম। সেখানেই সমরুর সঙ্গে আমার দেখা। বেচারা ভীষণ একটা বিপদে পড়েছিল, আমি ওকে সেই বিপদ থেকে বাঁচাই। তারপর থেকেই ও আমার সঙ্গ আর ছাড়ে না। এমন অনুগত সহচর সচরাচর ভাগ্যে জোটে না। আমার জন্য ও হাসিমুখে মরতে পারে।

অজয়ের এতক্ষণে খেয়াল হল, হাবসি ঘরে নেই। কালিকিংকর বোধ হয় ওর মনের কথা বুঝতে পারলেন, বললেন, এখান থেকে পালাবার চিন্তা মনে ঠাঁই দিও না। সমরু নীচে পাহারায় আছে। তা ছাড়া আমার চেহারাটা তো দেখছ, আমাকে কাবু করতে তোমার মতো গণ্ডাখানেক ছেলের দরকার হবে।

অজয় একটু নড়েচড়ে বসে বলল, একটু আগে আপনি বলছিলেন, শেষের দিকে আপনি বম্বে ছিলেন। আপনার পেশাটা জানতে পারি?

তোমার ধৃষ্টতা কম নয় দেখছি, কালিকিংকর ভ্রূকুটি করলেন, তারপর হেসে বললেন, অবশ্য তোমাকে বলতে বাধা নেই, জেনেই বা আমার কী ক্ষতি তুমি করবে! কে-ই বা তোমার কথা বিশ্বাস করবে! বম্বে হল স্মাগলারদের অর্থাৎ যারা চোরাই মালের কারবারি তাদের স্বর্গ রাজ্য। আমারও সেই ব্যবসাই ছিল। বেশ চলছিল, কিন্তু একজন শত্রুতা করে পুলিশের কাছে আমার নামে লাগিয়ে দিল। তারপর থেকেই আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে? তারপর মৃদু হেসে বললেন, একদিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে, না হলে এই গুপ্তধন উদ্ধারের কাজে হয়তো আর আসাই হত না।

দশ

অন্ধকার ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। পুবের আকাশে যেন একটু লাল ছোপ। অজয় ভালোমানুষের মতো বলল, এখন ক-টা বাজে স্যার?

কালিকিংকর একটু সন্দেহের চোখে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কেন?

অজয় সরল মানুষের মতো বলল, ওরা এসে পড়বে তো, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।

কালিকিংকর এবার সোজা হয়ে বসলেন, দু-চোখের দৃষ্টিতে যেন বিদ্যুৎ ঝলকাল, বললেন, কী বলতে চাও তুমি খুলে বল, নয়তো সত্যিকার বিপদে পড়বে।

আপনাকে কাল রাতে জানালায় দেখে আমরা বুঝেছিলাম আপনি এখানে আস্তানা গেড়েছেন, অজয় মৃদু হেসে বলল, আর সাংকেতিক লিপিটাই আপনার টার্গেট। আমাদের কথা হয়েছে ভোর হলেই আমার বন্ধুরা আমার কোনো বিপদ হয়েছে কিনা সেই খোঁজে আমাদের বাড়ি যাবে। ওখানে আমাকে না পেলে লোকজন নিয়ে সঙ্গেসঙ্গে এখানে চলে আসবে ওরা।

এতক্ষণে বোধ হয় ওরা আমার বাড়ি পৌঁছে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই এ জায়গাটা লোকজনে ভরে যাবে, আপনাদের পালাবার আর পথ থাকবে না।

অজয়ের কথা শেষ না হতেই কালিকিংকর লাফিয়ে উঠলেন। রাগে তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। অজয়ের দুই গালে সজোরে দুটো চড় মেরে খুব তাড়াতাড়ি তিনি নীচে চলে গেলেন, পরমুহূর্তে ফিরে এলেন হাবসিকে নিয়ে।

হাতে সময় নেই, তাই এ যাত্রা তুমি বেঁচে গেলে, অজয়কে লক্ষ করে বললেন কালিকিংকর, তবে জেনে রেখ, আমার পেছনে লাগলে তোমরা কেউই রেহাই পাবে না। দয়ামায়া আমার অভিধানে লেখা নেই।

তার নির্দেশে সমরু অজয়কে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখল।

সুভাষরা যখন ওখানে পৌঁছুলো, তখন ওই বন্ধনের মধ্যেও অজয় নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে।

* * *

রামশংকরবাবুর বাড়ি এখন হেডকোয়ার্টারস।

বাড়িতে অজয়কে খানিকটা ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ও বলেছিল, জানালার পলকা গরাদ ভেঙে ঘরে চোর ঢুকেছিল। ও টের পেয়ে হাঁক দিতেই চোর দরজা খুলে পালিয়ে যায়। অজয় চাদরটা গায়ে জড়িয়ে তাকে তাড়া করেছিল, একেবারে পুরোনো জমিদারবাড়ি পর্যন্ত। সেখানেই চোরটা গা ঢাকা দিয়েছে। কাউকে না ডেকে একা একা অমনভাবে চোরের পেছনে ছোটার জন্য বাড়ির সবাই অজয়কে খুব গালমন্দ করেছেন। যদি কিছু হয়ে যেত!

বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবার পরদিন ওরা আবার রামশংকরবাবুর বাড়িতে জড়ো হয়েছে। অজয়ের মুখে সব কথা শুনে রামশংকরবাবু ওর উপস্থিত বুদ্ধির খুব প্রশংসা করলেন।

কথা উঠল, কালিকিংকরের কথা পুলিশকে জানানো উচিত কিনা। অজয়ই আপত্তি তুলল। বলল, কালিকিংকর যে বোম্বাইয়ের এক কুখ্যাত চোরাকারবারি একথা পুলিশ হয়তো বিশ্বাসই করবে না। তা ছাড়া যদিও বা করে, তবে প্রশ্ন উঠবে অজয়রা তার সম্বন্ধে এত ওয়াকিবহাল হল কোন সূত্রে? তখনই গুপ্তধনের কথা এসে যাবে এবং সেটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। আর তা ছাড়া কালিকিংকর হয়তো তার অনুচরকে নিয়ে সেদিনই ওখান থেকে সরে পড়েছে, সুতরাং পুলিশে খবর দিয়েই বা কী লাভ!

সুভাষ আর নরেন অজয়ের যুক্তি সমর্থন করল, কিন্তু রামশংকরবাবু হতাশভাবে বললেন, নকসাটাই যখন চুরি হয়ে গেছে তখন আর গোপনীয়তার কী আছে!

নকসার কাগজটা না হয় ওরা চুরি করেছে। অজয় মুচকি হেসে বলল, কিন্তু মনে যেটা গাঁথা হয়ে আছে সেটা তো আর চুরি হয়নি।

রামশংকরবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, নকসার কাগজে যা যা ছিল সব তোমার মনে আছে?

উত্তরে অজয় একটা সাদা কাগজ টেনে নিল, তারপর মূল নকসায় যা ছিল, তার আদ্যোপান্ত একটা প্রতিলিপি করে রামশংকরবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দেখুন তো ঠিক আছে কিনা?

রামশংকরবাবু কাগজটাতে চোখ বুলিয়েই অজয়ের পিঠ চাপড়ে সোৎসাহে বলে উঠলেন, তুমি বড়ো হলে নির্ঘাত একজন কেষ্টবিষ্টু হবে। পরমুহূর্তে কী ভেবে তিনি সখেদে বললেন, কিন্তু কালিকিংকর যদি ওটার পাঠোদ্ধার করে?

কালিচরণ রায়ের মৃত্যুর পর আড়াই-শো বছর কেটে গেছে, অজয় অভয় দিয়ে বলল, আজ পর্যন্ত কেউ ওটার মানে করতে পারেনি। কালিকিংকর অত সহজেই পারবেন বলে আমার মনে হয় না। তারপরই একটু লাজুক গলায় ও বলল কবিতার মানে খুব সোজা, কিন্তু ছবিগুলোর মানে করতে দু-চার দিন দেরি হবে।

এই কিশোর ছেলেটির অগাধ আত্মবিশ্বাস দেখে রামশংকরবাবু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। ওকে একটু পীড়াপীড়ি করতে, আরও কয়েকটা দিন সময় চাইল অজয়।

এবার শুরু হল শলাপরামর্শ। ঠিক হল, অজয় সাংকেতিক চিহ্নগুলি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। সুভাষ আর নরেন বর্ধমানে গিয়ে রামসদয় হোটেলে কালিকিংকর ও হাবসির খোঁজখবর করবে।

রামশংকরবাবু একটু আহত কণ্ঠে বললেন, আমাকে নিয়ে যত কাণ্ড। আর আমিই বেকার হয়ে গেলাম।

নরেন তার কদমছাঁট চুলে আঙুল ঘষতে ঘষতে বলল, আমরা বর্ধমান থেকে ফিরে এলে আপনি আমাদের মুরগির মাংস রান্না করে খাইয়ে দেবেন।

আরে সে তো তোমাদের পাওনাই আছে, রামশংকরবাবু ব্যস্তভাবে বললেন, এমন মুরগির রোস্ট রান্না করব যে তোমাদের জিভে লেগে থাকবে।

সুভাষ তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে উঠল, ক্ষ্যামা দিন স্যার, নরেনের জিভ দিয়ে এক্ষুনি লালা গড়াতে শুরু করবে।

বন্ধুর দিকে একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হানল নরেন।

এগারো

পরের দিন সুভাষ আর নরেন বর্ধমান রওনা হয়ে গেল। বর্ধমানে পৌঁছে নরেন বলল, চল আগে পেটপুজো করে নিই।

একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে ওরা পেট পুরে মিহিদানা আর সীতাভোগ খেল। নরেন একাই সাবাড় করল কিলোখানেক সীতাভোগ। দোকানদার তো ‘থ’।

সেখান থেকে ওরা গেল রামসদয় হোটেলে। কালিকিংকর আর হাবসির চেহারার বর্ণনা দিতেই হোটেলের মালিক বললেন, তারা গতকাল হোটেল ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে তা তিনি বলতে পারলেন না। সুভাষের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন প্রায় দিন পনেরো আগে কালিকিংকর ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিল ওই হাবসি। তবে মাঝে মাঝে রাত্রিবাস ছাড়া হোটেলে তারা খুব কম সময়ের জন্যই থাকতেন। হোটেলে মালিককে বলা ছিল চিঠিপত্র এলে যেন রেখে দেওয়া হয়। তাদের সঙ্গে বাক্স-প্যাঁটরাও তেমন কিছু ছিল না।

সুভাষরা একটু হতাশই হল, তবে দমল না। অন্যান্য হোটেলে গিয়েও খোঁজখবর করল ওরা। কিন্তু কোথাও হদিশ পাওয়া গেল না কালিকিংকর আর তার অনুচরের। সারাদিন ওরা ঘোরাঘুরি করল।

বর্ধমানে নরেনদের যে কাপড়ের দোকান আছে সেখানেও ওরা ঢুঁ মারল। মালিকের ছেলেকে দেখে দোকানের কর্মচারীরা ব্যস্ত হয়ে উঠল, কিন্তু নরেন কালিকিংকরের আর হাবসির চেহারার বর্ণনা দিয়ে সবাইকে একটু চোখ খোলা রাখতে বলে সেখানে আর সময় নষ্ট করল না। নরেন ওর জানাশোনা একটা হোটেলে সেই রাতটা কাটাবার জন্য একটা ঘর ভাড়া করল। সন্ধেবেলা ওরা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে হাঁটছিল, অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় মন ভালো নেই ওদের। রাস্তা দিয়ে যেন গাড়ির মিছিল। সাইকেল রিকশাও কম নয়। হঠাৎ চমকে উঠল সুভাষ। একটা রিকশা ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। রিকশার আরোহী ওদের দেখেই চট করে ঘুরিয়ে নিল মুখ। ওই এক মুহূর্তই সুভাষের পক্ষে যথেষ্ট, আরোহী আর কেউ নয় স্বয়ং কালিকিংকর।

নরেনকে কথাটা বলতেই লাফিয়ে উঠল ও। রিকশাটা ততক্ষণে আরও কতগুলো রিকশাকে ছাড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে গেছে। ওরা এদিক-ওদিক তাকাল, কিন্তু একটাও খালি রিকশা চোখে পড়ল না। রিকশাটাকে অনুসরণ করার সব চেষ্টাই বৃথা, ওটা ততক্ষণে অদৃশ্য হয়েছে।

ভীষণ হতাশ হল ওরা। হাতে পেয়েও ছেড়ে দিতে হল কালিকিংকরকে এর চাইতে আফশোসের কথা আর কী হতে পারে! অনেক রাত পর্যন্ত ওরা শহরের নানান জায়গায় খোঁজখবর করল। কয়েক জনের মুখে ওরা জানতে পারল হাবসিকে গতকাল রাতেও দেখা গেছে। অমন চেহারা লুকিয়ে রাখা তো আর সম্ভব নয়।

ওরা যখন হোটেলে ফিরছে, সুভাষের মনে হল কেউ যেন অনুসরণ করছে ওদের। ও ফিরে তাকাল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।

হোটেলে ঢোকবার মুখে আরেক বার পেছন ফিরে তাকাল সুভাষ আর নরেন দু-জনেই।

একজন সাহেবি পোশাক পরা লোক, ফেল্টের টুপিতে মুখ অনেকটা ঢাকা হনহন করে যেন চলে গেল। একটা অস্বস্তিতে খচ খচ করতে লাগল ওদের মন।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর শুয়ে পড়ল ওরা। সারাদিন খুব খাটুনি গেছে। বিছানায় গা এলাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দু-জনের চোখে নেমে এল গভীর ঘুম।

হোটেলের মালিক নরেনের বাবাকে ভালো মতোই চিনতেন, তাই তিনি দোতলার এক প্রান্তের সবচেয়ে ভালো ঘরে ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।

গভীর রাতে সুভাষের ঘুম ভেঙে গেল। ওর দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। কে এক জন ওর বুকে বসে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে গলা। সুভাষ দু-হাত দিয়ে আততায়ীর হাত সরাবার চেষ্টা করল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। লোকটার হাত দুটো যেন লোহার মতো শক্ত। তার গরম নিশ্বাস যেন আগুনের হলকা ছড়াতে লাগল সুভাষের মুখে। পাশের বিছানায় নরেনের নাক ডাকছে, যেন সিংহের গর্জন।

সুভাষের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে, আর কয়েক মুহূর্ত, তারপরই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।

এই চরম বিপদেও সুভাষ কিন্তু হাল ছেড়ে দিল না। ওর মনের মধ্যে দুর্ধর্ষ খেলোয়াড়ের অপরাজেয় মনোভাব যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ফুটবল খেলে ওর পা দুটো হয়ে উঠেছিল লোহার মতো শক্ত। বিপক্ষের অনেক খেলোয়াড়কেই ওর পায়ের সঙ্গে ঠেকাঠেকির ফলে মাঠের বাইরে যেতে হয়েছে।

পা দুটোকে তুলে ও সামনের দিকে নিয়ে এল, তারপর দুই-পা আড়াআড়িভাবে কাঁচির মতো করে আততায়ীর গলায় চাপ দিয়ে প্রাণপণে পেছন দিকে ঠেলতে লাগল। আচমকা ওই চাপে যে লোকটা ওর বুকে চেপে বসেছিল সে পেছনে হেলল, আর সঙ্গেসঙ্গে শিথিল হল গলার প্রচণ্ড চাপ। নতুন উদ্যমে আরও জোরে চাপ দিতে লাগল সুভাষ, আলগা হয়ে এসেছে বজ্রমুষ্ঠি। আততায়ী ক্রমেই পেছন দিকে হেলছে, বেকায়দায় পড়ে গেছে।

হঠাৎ সুভাষের গলা ছেড়ে দিয়ে ওর পা দুটো সবলে ঠেলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল আক্রমণকারী, তারপর ছুটে গেল একটা জানালার দিকে। পরমুহূর্তে ঝুপ করে ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ। সেই শব্দে নরেনের ঘুম ভেঙে গেল। ও উঠে বসে চেঁচিয়ে উঠল, কে? কে?

সুভাষ ততক্ষণে জানালার কাছে ছুটে গিয়েছে। জানালার পুরোনো লোহার শিক দুমড়ে বাঁকানো। ওখানে কার্নিশ বেশ চওড়া, পাশেই একটা একতলা বাড়ির ন্যাড়া ছাদ। লোকটা জানালার শিক বাঁকিয়ে ঘরে ঢুকেছিল, সেই ফাঁক দিয়েই গলে ওই ছাদে লাফিয়েছে, তারপর ওখান থেকে নিশ্চয়ই আবার লাফিয়ে মাটিতে পড়েছে।

লোহার গরাদ যেভাবে দুমড়ে বাঁকানো হয়েছে, বুঝতে কষ্ট হয় না যে, লোকটি অসাধারণ শক্তিধর। ওই হাবসি ছাড়া এমন শক্তি আর কারুর হতে পারে না।

ততক্ষণে নরেন সুভাষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুভাষের মুখে সব শুনে ও হায় হায় করে উঠল, বলল, হাঁদারাম, আমাকে এক বার ডাকতে পারলি না। ইস, ওকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিতে হল!

সুভাষ ফোঁস করে বলল, তোর কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙানো আমার কর্ম নয়। প্রাণটা যেতে বসেছিল আমার, আর উনি মনের আনন্দে নাক ডাকাচ্ছেন, ভূতও পালায় সেই শব্দে।

বন্ধুর এই অহেতুক দোষারোপে মনে মনে ক্ষুণ্ণ হল নরেন।

সুভাষরা সকাল হতে সারা বর্ধমান চষে বেড়াতে শুরু করল, কিন্তু হাবসি আর কালিকিংকর যেন উবে গেছে, কোথাও তাদের সন্ধান পাওয়া গেল না। নিরাশ হয়ে গ্রামে ফিরে গেল ওরা।

কালিকিংকর অতিশয় ধূর্ত। কিছুদিন চোরা কারবারিতে থাকার ফলে মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে তার একটা ভালো ধারণা গড়ে উঠেছিল। সুভাষের ওপর আক্রমণের রাতটা কাটতে না কাটতেই তিনি তাঁর অনুচরকে নিয়ে কালিকাপুরে ফিরে এলেন, আশ্রয় নিলেন ওই পুরোনো জমিদার বাড়িতে। এখানেই তাঁরা সবচেয়ে নিরাপদ, কারণ রামশংকর আর তার বিচ্ছুর দল ভাবতেই পারবে না যে, এত কাণ্ডের পর আবার তাঁরা এখানে এসে ঘাঁটি গাড়বেন।

আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল কালিকিংকরের। তিনি বুঝেছিলেন সাংকেতিক চিহ্নগুলির পাঠোদ্ধার তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তাই অজয়দের ওপর নজর রাখাটাই হল শ্রেষ্ঠ উপায়। ওরা নিশ্চয়ই ওই সাংকেতিক চিহ্নগুলির একটা নকল রেখেছে এবং পাঠোদ্ধারের চেষ্টাও নিশ্চয়ই করছে।

বারো

সুভাষরা গ্রামে ফিরে যা যা ঘটেছে খুলে বলল। সব শুনে রামশংকরবাবু শিউরে উঠলেন। যদি সুভাষের কিছু হয়ে যেত! তিনি দুঃখ করে বললেন, কালিকিংকর যদি তাঁর সঙ্গে শত্রুতা না করে আপোশে একটা মীমাংসায় আসত তবে তিনি খুশি মনেই তাতে রাজি হতেন। গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারলে কালিকিংকরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে তাঁর কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু সে সবটাই ভোগ করতে চায়। তাই মরিয়া হয়ে উঠেছে, খুনজখমেও পিছপা নয়। তিনি এমন কথা বললেন, সোনার হরিণের পেছনে এমনভাবে ধাওয়া করে অজয়দের বিপদে ফেলতে তাঁর মন আর চাইছে না।

তিন বন্ধু সে কথায় কান দিল না। এমন রোমাঞ্চকর ঘটনা জীবনে দ্বিতীয় বার আসবে না।

আরও দু-দিন কেটে গেছে। অজয়ের আহার নিদ্রা প্রায় বন্ধ। দিনরাত সেই সাংকেতিক লিপিটায় মুখ গুঁজে আছে আর কাগজ পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি লিখছে। রামশংকরবাবু ওকে চোখে চোখে রেখেছেন।

সেদিন বিকেলে সুভাষ আর নরেন বেরিয়ে ফিরছে, রাস্তায় ইংরেজি মাস্টারমশায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মাস্টারমশাই ওদের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, পরীক্ষার ফল বেরুবার সময় হয়ে এসেছে, সে সম্বন্ধেও কথা বললেন। সবাই আশা করছেন অজয় ভালো রেজাল্ট করবে।

সুভাষের মনে হল মাস্টারমশায়ের মুখে যেন দুশ্চিন্তার ছাপ, খানিকটা যেন অন্যমনস্কও তিনি। একটু মাথা চুলকে ও বলল, স্যার, আপনাকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে…?

ঠিক ধরেছিস, মাস্টারমশাই বলে উঠলেন, গত দু-দিন ধরে রাত্রে কে যেন আমার বাড়ির বাগানে ঘোরাফেরা করছে চোর ডাকাত কিনা বুঝতে পারছি না।

সুভাষ আর নরেন আরও একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়ে উৎসুক হয়ে উঠল। মাস্টারমশায়ের বাড়িটা রামশংকরবাবুর বাড়ির পাশেই। অনেকটা জমি নিয়ে বাড়ি। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। পুবদিকে ওই বেড়ার প্রায় লাগোয়া রামশংকরবাবুর বাড়ি। তাঁর বাড়িটা ছোট্ট, জমিও কম। দাঁড়ালেই রামশংকরবাবুর বসবার ঘর চোখে পড়ে। মাস্টারমশায়ের বাড়িতে নানারকম ফলের গাছ, চোর ডাকাতের পক্ষে রাতের অন্ধকারে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা খুবই সহজ। মাস্টারমশাই এ-কথাও বললেন যে রহস্যময় সেই মানুষটিকে রামশংকরবাবুর আর তাঁর নিজের জমির সীমানার ধারেকাছেই ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।

ওরা মাস্টারমশাইকে আশ্বাস দিয়ে বলল, রাতে ওরা ওখানে পাহারা দেবে। তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন। এই ডানপিটে ছেলে দুটোর অসাধ্য যে কিছুই নেই তা গ্রামের কারও অজানা নয়।

সন্ধে থেকেই দুই বন্ধু মাস্টারমশায়ের বাড়ির ওপর নজর রেখেছিল। যেখানে লোকটাকে বেশি দেখা যায়, অর্থাৎ মাস্টারমশায়ের এবং রামশংকরবাবুর বাড়ির সীমানার একটা আমগাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল ওরা।

রামশংকরবাবুর বাইরের ঘরের জানালা খোলা, ঘর থেকে আলোর রেখা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। রামশংকরবাবু আর অজয় কী যেন আলোচনা করছে। হঠাৎ খস খস একটা শব্দ। দু-জনেই সজাগ হয়ে উঠল।

একটা কালো আবছা মূর্তি চোখে পড়ল ওদের। মূর্তিটা একটা পেয়ারা গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে, রামশংকরবাবুর ঘরের ভেতর কী হচ্ছে নিবিষ্ট মনে তাই দেখছে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, তারপরই মূর্তিটা দ্রুতপায়ে চলতে শুরু করল। মাস্টারমশায়ের বাড়ির কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে যেই সে মেঠো পথ ধরেছে, অমনি অন্ধকারে কে যেন তার হাতটা চেপে ধরল।

আচমকা বাধা পেয়ে মূর্তিটা বোধ হয় একটু হকচকিয়ে গেল। সে আর কেউ নয় সমরু, কালিকিংকরের হাবসি অনুচর। কিন্তু এক মুহূর্ত, তারপরই একটা হুংকার ছেড়ে সে আক্রমণ করল নরেনকে, ওই চেপে ধরেছিল তার হাত। দু-জনের প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়ে গেল।

সে যেন গজকচ্ছপের যুদ্ধ। শক্তিতে কেউ কম যায় না। এক জনের প্রথম যৌবনের প্রচণ্ড প্রাণশক্তির সঙ্গে মিলিত হয়েছে ব্যায়ামপুষ্ট দৈহিক শক্তি, আর অন্যজনের মধ্যে ঘটেছে পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতার সঙ্গে জন্মগত সহজাত শক্তির সংমিশ্রণ।

দু-জনে দু-জনকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দেবার প্রাণপন চেষ্টা করছে। হাবসি নরেনের চাইতে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা, তার পুরোপুরি সুবিধে নেবার চেষ্ট সে করছিল, অন্যদিকে কুস্তিগির নরেন খুঁজছিল একাট সুবিধেমতো দাঁওয়ের সুযোগ।

দু-জনের শরীরই ঘেমে নেয়ে উঠেছে, ঘন ঘন উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে। হঠাৎ মুহূর্তের সুযোগে নরেন হাবসির ডান হাতের কবজি শক্ত দু-মুঠিতে চেপে ধরে সাৎ করে ঘুরে গেল, পরক্ষণেই প্রতিদ্বন্দ্বীর সেই হাতটা নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে নিয়ে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে শরীরে এক ঝাঁকি দিল। কুস্তির একটা নিখুঁত প্যাঁচ।

সঙ্গেসঙ্গে বিরাট দেহ দিয়ে নরেনের মাথার ওপর দিয়ে সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল হাবসি, নিশ্চল হয়ে রইল মাটিতে। আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম ঝেড়ে ফেলে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দম নিল নরেন, তারপর এগিয়ে গেল।

হাবসির কাছে পৌঁছুতেই দম দেওয়া পুতুলের মতো হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠল, তারপরই নরেনের চোয়াল লক্ষ করে হানল আঘাত। প্রচণ্ড সেই ঘুসির জোর, ঠিকমতো লাগলে আর রক্ষে ছিল না। নরেন সাঁ করে সরে গেল, তবে ঘুসিটা সম্পূর্ণ এড়াতে পারল না। ওর মনে হল যেন হাতুড়ি দিয়ে কেউ ঘা মারল ওর চোয়ালে। দু-চোখে সরষে ফুল দেখতে দেখতে ধপ করে পড়ে গেল। হাবসি এবার হিংস্র উল্লাসে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। শুরু হয়ে গেল ধস্তাধস্তি। মাটিতে ওরা গড়াগড়ি খাচ্ছে, এক বার হাবসি ওপরে, তারপরই নরেন।

সুভাষ নীরব দর্শকের মতো অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে হাবসিকে আঘাত করতে গেলে যদি নরেন আহত হয় এই ভয়ে কোনো সাহায্যই করতে পারছে না ও। তা ছাড়া ওরা দু-জনে এমন নিবিড়ভাবে একে আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে গড়াগড়ি যাচ্ছে যে, বোঝা যাচ্ছে না কে ওপরে কে নীচে।

গড়াতে গড়াতে ওরা একটা বটগাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেল। দু-জনেরই মাথা সজোরে ঠুকে গেল শক্ত মোটা গুঁড়িতে। ছিটকে পড়ল দু-জন দু-দিকে, হাত-পা ছড়িয়ে দু-জনেই মড়ার মতো পড়ে আছে। সুভাষ তাড়াতাড়ি নরেনকে টেনে ফাঁকা জায়গায় সরিয়ে নিয়ে এল। কিছুক্ষণ শুশ্রুষার পরেই জ্ঞান ফিরে এল নরেনের, চোখ খুলে তাকাল। সুভাষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, নরেনের জন্য খুব চিন্তা হয়েছিল ওর।

নরেন উঠে বসে দু-পাশে সজোরে মাথা ঝাঁকাল, অবস্থাটা বোঝবার চেষ্টা করল। তারপরই লাফিয়ে উঠে ছুটল, সুভাষ পিছু নিল ওর।

কিন্তু কোথায় সেই হাবসি! তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না তাকে। সুভাষ যখন নরেনের সেবা শুশ্রুষায় ব্যস্ত ছিল তখনই নিশ্চয়ই, ওর জ্ঞান ফিরেছিল, তারপর সুযোগ বুঝে অন্ধকারে সরে পড়েছে।

তেরো

এই ঘটনার পর ওদের মনে প্রশ্ন জাগল, তবে কি কালিকিংকর আবার গ্রামে ফিরে এসেছেন? আর যদি এসে থাকেন তবে নিশ্চয়ই পুরোনো জমিদারবাড়ির ভগ্নস্তূপের মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছেন। এত সব ঘটনার পরেও তিনি এখানে ফিরে আসবেন তা যেন ভাবাই যায় না। শুধু দুঃসাহসীই নয়, বেপরোয়া এক মানুষ।

কিন্তু জমিদারবাড়ি হানা দিয়ে তাদের সন্ধান পাওয়া গেল না। আগেই বলা হয়েছে, কালিকিংকর ভীষণ ধূর্ত। তার গতিবিধি ছিল রাতের অন্ধকারে। সমরুর সঙ্গে নরেনের লড়াইয়ের পর সেই রাতেই তারা তাদের ঘাঁটি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কুটোটি পর্যন্ত ফেলে যায়নি, যা থেকে অনুমান করা যায় যে, ওখানে কেউ ছিল। ফলে অজয়দের মনে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হল।

* * *

ওই ঘটনার পর আরও কয়েকটা দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটেনি।

সেদিন সন্ধেবেলা ওরা তিন বন্ধু রোজকার মতো রামশংকরবাবুর বাড়িতে জড়ো হয়েছে। রামশংকরবাবু আজ রাতে ওদের মুরগির রোস্ট খাওয়াবেন। বিকেল থেকেই তিনি রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত, তাঁকে এ ব্যাপারে কে সাহায্য করছে তার নাম নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

রামশংকরবাবু পাকা রাঁধিয়ে। মশলাপাতি, আদা পেঁয়াজ দিয়ে মাংস মাখবার পরই সুগন্ধ ছড়াতে শুরু করল। তারপর ডেকচিটা যখন উনুনে, কিছুক্ষণ গরম হবার পর গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে, তখন নরেনের জিভ দিয়ে সত্যিই জল গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা। সুভাষের অবস্থাও প্রায় তেমন। অজয়ের কিন্তু এসব দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, ও সেই সাংকেতিক লিপিটা নিয়ে মুখ গুঁজে আছে।

ভোজনপর্ব শুরু হল। সরু চালের ভাত আর মুরগির রোস্ট। শুকনো মাংসের রোস্ট। কিন্তু তা দিয়েই নরেন যে পরিমাণ ভাত খেল তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। রামশংকরবাবু সত্যিই চমৎকার রেঁধেছিলেন। একটু টক টক মিষ্টি মিষ্টি, পেঁয়াজমশলা সঠিক পরিমাণে হওয়ায় অপূর্ব স্বাদ হয়েছিল, জিভে লেগে থাকার মতো।

সুভাষ একটা ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে বলল, প্রার্থনা করি আপনার মুরগিদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটুক, আর আমরা মাঝে মাঝে যেন অমৃতের স্বাদ থেকে বঞ্চিত না হই।

নরেনের অবশ্য কথা বলার ফুরসত নেই, কারণ ওর মুখ তখন ভীষণ ব্যস্ত, তবুও সজোরে ঘাড় দুলিয়ে সুভাষের কথায় সায় দিল।

রামশংকরবাবু হেসে বললেন, এর পরের বার তোমাদের কোর্মা খাওয়াব। কোর্মাও খুব সুস্বাদু তবে পাঁঠার মাংস হলে ভালো হয়, তার কারণ হচ্ছে বড়ো বড়ো টুকরো আর শিরদাঁড়ার মাংসে কোর্মা ভালো হয়।

নরেনের মুখ একটু হালকা হয়েছে, ও বলে উঠল, ঠিক আছে, আপনাকে একটা আস্ত পাঁঠা এনে দেব।

সুভাষ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ নরু, তুই যদি আমার কালুর গায়ে হাত দিয়েছিস তো খুনোখুনি হয়ে যাবে বলে রাখছি।

রামশংকরবাবু ওদের কথা বুঝতে না পেরে প্রশ্নভরা চোখে অজয়ের দিকে তাকালেন। ও হেসে বলল, কালু হচ্ছে সুভাষের পাঁঠা, বাচ্চা থেকে পুষেছে তাই ওটার ওপর খুব মায়া।

রামশংকরবাবু এতক্ষণে সুভাষের রাগের কারণ বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, ওসব তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। মৈনুদ্দিন হচ্ছে আমার প্রধান চাষি, আমার বেশিরভাগ জমি সেই ভাগচাষ করে। তার অনেকগুলো ছাগল আছে। আমি বললে খুশি হয়েই সে একটা দেবে।

নরেন সোৎসাহে বলে উঠল, থ্রি চিয়ার্স ফর রামশংকরবাবু, সুভাষ সঙ্গেসঙ্গে বলল, হিপ হিপ হুররে।

অজয় এবার বলল, আজ আমি একটা বোমা ফাটাব।

আচমকা ওর এই কথায় সবাই চমকে উঠল। রামশংকরবাবু তো প্রায় লাফ দিয়ে ওঠেন আর কী! সকলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে অজয় মৃদু হেসে বলল, ভয় নেই, সত্যিকার বোমা নয়। কালিচরণ রায়ের গুপ্তধনের গুপ্ত সংকেতের পাঠোদ্ধার আমি করেছি, আজ সেই রহস্যই ফাঁস করব আমি।

রামশংকরবাবু অভিভূতের মতো বললেন, বল কী অজয়! যে লিপির পাঠোদ্ধার দু-শো বছরের মধ্যে কেউ করতে পারেনি, সত্যিই তুমি এই ক-দিনেই তার মীমাংসা করে ফেলেছ! আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না!

আপনি তো জানেন, ওর জীবনের সাধ হচ্ছে শার্লক হোমস-এর মতো বিখ্যাত গোয়েন্দা হওয়া, গর্বের সঙ্গে বলল সুভাষ, আমাদের বন্ধু বলে বলছি না, দেখবেন ওর নাম একদিন সবার মুখে মুখে ঘুরবে।

ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তাই যেন হয়, আন্তরিক সুরে বললেন, রামশংকরবাবু।

চোদ্দো

খাওয়া-দাওয়ার পর রামশংকরবাবুর বাইরের ঘরে ওরা এসে বসল। অজয় টেবিলের ওপর কালিচরণের সাংকেতিক লিপিখানা খুলে ধরেছে। জ্বলজ্বল করছে ওর মুখ। ঘরের মধ্যে টুঁ শব্দটি নেই। সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে অজয়ের মুখের দিকে।

অজয় একটু ঝুঁকে পড়ে কাগজটার ওপর এক বার চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর শুরু করল, সাংকেতিক লিপিটার প্রথমেই আছে একটা কবিতা, ওটা হচ্ছে গুপ্ত সংকেতের চাবিকাঠি, তাই ওটা দিয়েই আমি শুরু করব। কবিতাটা হচ্ছে :

রণে দিল ভঙ্গ

সুবল না ছাড়ে সঙ্গ।

লক্ষ্মণ ভাই বল কোথা পাই?

পুরাইবার সাধ আর কেহ নাই।

রজনী পোহাল বিদায় লয়ে যাই।

কবিতাটার গূঢ় অর্থ কী হতে পারে তা নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করেও কোনো মীমাংসায় আমি আসতে পারিনি। প্রথম লাইন দুটো দেখুন, ‘রণে দিল ভঙ্গ, সুবল না ছাড়ে সঙ্গ’। এদের মধ্যে একটা মানে হয় তো হতে পারে, কিন্তু পরের লাইনগুলির একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো সামঞ্জস্যই নেই। সব মিলিয়ে কবিতাটির মধ্যে কোনো যুক্তিসঙ্গত অর্থ খুঁজে পেলাম না আমি। আমার মনে হতে লাগল ওটা আসলে একটা খোলস, খোলসটা সরিয়ে ফেলতে পারলেই আসল কথাটা বেরিয়ে পড়বে। আমি নতুন ভাবে কবিতাটার বিচার শুরু করলাম। হঠাৎ আমার চোখের সামনে থেকে যেন পর্দা সরে গেল। আমি কী বোকা! কবিতার অর্থ চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছে, আর আমি অন্ধের মতো অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি।

অজয় চশমা খুলে কাচ দুটো এক বার মুছে নিল, তারপর আবার বলতে লাগল, রামশংকরবাবু, কবিতাটির দিকে আরেক বার তাকিয়ে দেখুন। প্রথম লাইনের প্রথম অক্ষর হচ্ছে ‘র’, এভাবে সবকটা লাইনের প্রথম অক্ষর নিলে দাঁড়াচ্ছে রসুলপুর। কালিচরণের জমিদারি শুধু এখানেই ছিল না, আশেপাশের গ্রামেও ছিল, হয়তো রসুলপুরেও তার জমিজমা, সম্পত্তি ছিল। রসুলপুর এখান থেকে বেশি দূরেও নয়। রসুলপুরের কথা দিয়ে সাংকেতিক লিপির গোড়াপত্তন তিনি কেন করেছেন? এর উত্তর খুব সহজ, তিনি যে সম্পদের কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, তা নিশ্চয়ই রসুলপুরেই আছে।

এবার দ্বিতীয় পর্বে আসা যাক। পরপর সাজান কতগুলো ছবি। প্রত্যেকটা ছবির নিশ্চয়ই কোনো অর্থ আছে। অর্থাৎ ছবির ভেতর দিয়ে কালিচরণ তার গুপ্তধনের হদিশ দিয়ে গেছেন। অনেক চেষ্টার পর রহস্যটা আমি ধরতে পেরেছি।

প্রথম ছবিটাই ধরা যাক, একজন বৃদ্ধ, যাকে আমরা সোজা ভাষায় বলি বুড়ো। দ্বিতীয় ছবি হচ্ছে মা কালীর আর তৃতীয় ছবি হচ্ছে একজন বরের। এ ছবি দুটো একসঙ্গে ধরলে কী হয় মা কালী আর একজন বর অর্থাৎ মা কালীর বর—যাকে আমরা বলি ‘মহাদেব’ কিংবা শিব। চতুর্থ ছবি হচ্ছে একটি বউ পুজোর ডালি নিয়ে চলেছে, পুজোর ডালি নিয়ে বউটি কোথায় যেতে পারে? উত্তর খুব সহজ মন্দিরে। তাহলে প্রথম ছবি থেকে চতুর্থ ছবির অর্থ কী দাঁড়াল? বুড়োশিব মন্দির। রসুলপুরে একটি পুরোনো শিব মন্দিরের কথাই কালিচরণ বোঝাতে চেয়েছেন।

পঞ্চম ছবিটা হল সূর্যের। এখানে আমি একটু হোঁচট খেলাম। সূর্য বলতে এখানে কী বোঝাচ্ছে? চিন্তা করতে করতে ব্যাপারটা হঠাৎ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। সূর্য ওঠে পূর্ব দিকে, তাই সূর্যের ছবি দিয়ে এখানে দিক বোঝানো হয়েছে। তাহলে দাঁড়াল রসুলপুরে বুড়োশিব মন্দিরের পূর্ব দিকে।

ষষ্ঠ ছবি একজন কাঠুরের। কাঠুরের কাজ হল গাছ কাটা, তাই কাঠুরের ছবির প্রতীক দিয়ে একটা গাছের কথাই বলতে চেয়েছেন কালিচরণ। অর্থাৎ সেই বুড়োশিব মন্দিরের পুবে একটা বড়ো কোনো গাছের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এ পর্যন্ত।

সপ্তম ছবি হল, লাঠি হাতে খঞ্জ; আমরা কথায় বলি খোঁড়ার লাঠি হচ্ছে তার তৃতীয় চরণ, সোজা বাংলায় তিন পা।

অষ্টম ছবি হল, একজন মানুষের ডান হাতটা একটু ওপর দিকে ওঠানো। ডান হাত বলতে আমরা দক্ষিণ হস্ত বুঝি, অর্থাৎ ওই হাতটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে দক্ষিণ। এ ছাড়া আর কোনো সদুত্তর আমি খুঁজে পাইনি। তাহলে দাঁড়াল সেই গাছ থেকে তিন পা দক্ষিণে।

পরের ছবি হল উইপোকার। এখানে আবার আমি হোঁচট খেলাম। উইপোকা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন কালিচরণ। যখন কোনো আলোই দেখতে পাচ্ছি না তখন হঠাৎ আমার মনে পড়ল উইয়ের ঢিবির কথা, অর্থাৎ এখানে একটা ঢিবির ইঙ্গিত করা হয়েছে। উইপোকাটা প্রতীক মাত্র।

দশম ছবি হল সাপ। সাপ থাকে গর্তে। তাহলে দাঁড়াল একটা মাটির ঢিবির তলায় গর্ত। পরের ছবিতে আমরা দেখছি দশভূজা মা দুর্গার ছবি। এর মানে খুব সহজ, মাটির তলায় দশ হাত গর্ত বোঝানো হয়েছে।

শেষ ছবি হল সালংকারা এক বধূর। অর্থাৎ অলংকার। শেষ পর্যন্ত তবে দাঁড়াল, রসুলপুরে বুড়োশিব মন্দিরের পুবে একটা বড়ো গাছ, তার তিন পা দক্ষিণে একটা মাটির ঢিবি, সেই ঢিবির দশ হাত গর্তে লুকানো আছে অলংকার।

অজয় চুপ করল। রামশংকরবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, অজয় তোমার বুদ্ধির তুলনা হয় না, ইউ আর এ জিনিয়াস।

পনেরো

সকলের মনে একটা আনন্দের ঢেউ। রামশংকরবাবু ভাবছেন দু-শো বছরের ওপর যে গুপ্তধন মানুষের চোখের আড়ালে ছিল, এতদিনে তা ভোগে আসবে। বাকি জীবনটা তিনি পায়ের ওপর পা দিয়ে কাটিয়ে দেবেন। এখানকার একঘেয়ে জীবন আর নয়, শহরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করবেন তিনি, ভোগ করবেন জীবনটাকে। সম্পদের কী মোহ! মানুষের মন জুড়ে বসতে এতটুকু সময় লাগে না।

সুভাষ আর নরেনের আনন্দ ওদের বন্ধুর কৃতিত্বে। যে সাংকেতিক লিপিটার কিনারা এতকাল কেউ করতে পারেনি, মাত্র ক-দিনের চেষ্টায় তার পাঠোদ্ধার করেছে ওদের বন্ধু, এ কি কম গর্বের কথা! তা ছাড়া ওটা নিয়ে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি ওদের। এই সাফল্যই ওদের পুরস্কার।

হঠাৎ অজয়ের কথায় সবার চমক ভাঙল। একটু উত্তেজিত ভাবেই ও বলল, আচ্ছা রামশংকরবাবু, আপনার দেয়ালের ওই ঘুলঘুলির ভেতর দিয়ে ওটা কীসের তার গেছে? ইলেকট্রিক তার মনে হচ্ছে! আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না তো?

অজয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই ওপর দিকে তাকাল! সত্যিই তো, একটা তার দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে কালিচরণ রায়ের একটা বড়ো অয়েল পেন্টিং। কালের প্রবাহে ওটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। তারটা যেন সেই ছবির পেছন দিয়ে বেরিয়ে ভেন্টিলেটারের ফোকরের ভেতর দিয়ে বাইরের দিকে গেছে।

অজয় তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে সেটা লক্ষ্য করে বলল, আপনার বাড়িতে দু-একদিনের মধ্যে অচেনা কেউ এসেছিল।

রামশংকরবাবু মাথা চুলকে বললেন, কই তেমন কেউ এসেছিল বলে মনে পড়ছে না তো। তারপরই যেন মনে পড়েছে এমনভাবে বলে উঠলেন, ওঃ হো! আজ সকালেই একজন গোবেচারি বুড়ো মতো লোক এসে কিছু খেতে চেয়েছিল। তা লোকটার আবার মানসম্মান জ্ঞান টনটনে, ভিক্ষা নেবে না, পরিশ্রম করে তার বদলে চাট্টি খাবে। আমাকে বলল এ ঘরটা নোংরা হয়ে আছে, পরিষ্কার করে দেবে। আমি যত বলি দরকার নেই, তা কে কার কথা শোনে! দরজা জানালা বন্ধ করে এমন ঝাঁটাতে শুরু করল যে, আমি শেষটা ঘর থেকে পালিয়ে বাঁচি।

লোকটার হাতে কী ছিল? অজয় প্রশ্ন করল।

একটা ঝোলা, রামশংকরবাবু নিরুদবিগ্ন মনে জবাব দিলেন, বোধ হয় ওটায় লোকটার জিনিসপত্তর ছিল।

অজয় এবার সুভাষের দিকে ফিরে বলল, সু, তুই নরুর কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে দেখ তো, ছবির পেছনে কীসের তার ওটা।

অজয়ের কথামতো নরেন ওয়েল পেন্টিংটার তলায় দু-পা ফাঁক করে দাঁড়াল। আর সুভাষ তার দু-কাঁধে পা দিয়ে উঠে পড়ল। হাত বাড়িয়ে ছবিটা দেয়াল থেকে একটু সরিয়ে সবিস্ময়ে বলে উঠল, আরে! এখানে বাক্সর মতো কী একটা রয়েছে!

সাবধানে ওটা নীচে নামিয়ে নিয়ে আয়, অজয় নির্দেশ দিল।

সুভাষ সাবধানে জিনিসটা নামিয়ে আনল।

এটা যেন একটা মাইক্রোফোন মনে হচ্ছে। রামশংকরবাবু অবাক গলায় বললেন।

হ্যাঁ, খুব পাওয়ারফুল মাইক্রোফোন, অজয় ওটা পরীক্ষা করতে করতে জবাব দিল, জাপানে তৈরি, সেখানকার ট্রেড মার্ক রয়েছে। কাল যে গোবেচারি বুড়ো মানুষটা আপনার কাছে দুটি ভাত খেতে চেয়েছিল, তাকে অত অবহেলা করবেন না। ঘর পরিষ্কার করার অজুহাতে এই যন্ত্রটি সে ওই ছবির পেছনে বসিয়ে গেছে।

কিন্তু কে সেই বুড়ো? সুভাষ আর নরেন প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠল।

মাইক্রোফোনটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে অজয় বলল, এ প্রশ্নের জবাব খুব সোজা। বুড়ো আর কেউ নয়, ছদ্মবেশী কালিকিংকর। তার মতো একজন চোরা কারবারির পক্ষে এমন একটা বিদেশি যন্ত্র জোগাড় করা কঠিন ব্যাপার নয়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ও বলল, তারটা বাইরে কোথায় গেছে দেখতে হবে। যেখানে ওটা শেষ হয়েছে, আমার বিশ্বাস সেখানে একটা অ্যামপ্লিফায়ারও পাওয়া যাবে। এই ঘরে আমাদের যেসব কথাবার্তা হয়েছে, কালিকিংকর অ্যামপ্লিফায়ারের সাহায্যে সব শুনেছে বলেই আমার বিশ্বাস।

রামশংকরবাবু একটা টর্চ নিয়ে ওদের সঙ্গে বেরুলেন। বাইরে গিয়ে দেখা গেল ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে তারটা দেয়ালের গা বেয়ে নীচে এসেছে তারপর মাটির ওপর দিয়ে চলে গেছে। ওটা পাশের দেয়াল বলে চট করে নজরে পড়ে না, তা ছাড়া যেখানে মাটির ওপর দিয়ে চলে গেছে সেখানে এমনভাবে পাতা ছড়ানো যে তারটা প্রায় ঢাকাই পড়ে গেছে।

রামশংকরবাবুর বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে ইংরেজি মাস্টারমশায়ের বেড়া পেরিয়ে তারটা চলে গেছে। মাস্টারমশায়ের বাড়ি অনেকটা জমি নিয়ে, সবসময় সবদিকে কী হচ্ছে লক্ষ্য রাখা সম্ভব নয়। বুড়োর ছদ্মবেশে কিংবা পরে অন্য কোনো ছদ্মবেশে কালিকিংকর নিশ্চয়ই যন্ত্রটা বসিয়ে গেছে। হয়তো সে এমন কাজের ভান করেছে যে, কেউ তাকে সন্দেহ করেনি।

তার লক্ষ্য করে সবাই এগিয়ে চলেছে। মাস্টারমশায়ের বাড়ির সীমানায় একটা ঝোপ, তারটা ওদিকেই গেছে। হঠাৎ ঝোপটা নড়ে উঠল, আর একটা আবছা মূর্তি ঝোপ থেকে বেরিয়ে তির বেগে মারল ছুট। রামশংকরবাবুর টর্চের আলোয় সবাই দেখল এক লাফে তারের বেড়া ডিঙিয়ে সেই ছায়ামূর্তি ছুটে চলেছে। এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটে গেল যে, কেউ কিছু করার আগেই অন্ধকারে কোথায় যে মিলিয়ে গেল মূর্তিটা তার আর হদিশ পাওয়া গেল না।

ওই ঝোপে সত্যিই একটা অ্যামপ্লিফায়ার পাওয়া গেল।

রামশংকরবাবুর বাইরের ঘরে আবার ফিরে এল সবাই। সকলের মুখই গম্ভীর। এত করেও তীরে এসে বুঝি তরী ডুবল। অজয় বুদ্ধি করে যদিও সাংকেতিক লিপিটার পাঠোদ্ধার করল, কিন্তু কালিকিংকরের কাছে এখন আর তা অজানা নয়। হয়তো আজ রাতেই সে রসুলপুর রওনা হয়ে যাবে।

অনেক শলাপরামর্শের পর ঠিক হল পরদিন সকাল সকাল ওরা রওনা হবে রসুলপুরের উদ্দেশ্যে।

ষোলো

পরদিন বেশ ভোরেই তিন বন্ধু রামশংকরবাবুর বাড়ি এসে জড়ো হল। রামশংকরবাবু তৈরি হয়েই ছিলেন। তিনি বন্দুকটা আর কয়েকটা কার্তুজ সঙ্গে নিলেন। বলা যায় না, শত্রু পক্ষ মরিয়া হয়ে উঠেছে, তাদের কাছে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র থাকা অসম্ভব নয়।

কালিকাপুর থেকে রসুলপুর যেতে হলে বর্ধমান হয়ে যাওয়াই সুবিধে। বর্ধমান থেকে প্রায় আধ ঘণ্টার পথ। ওরা যখন বর্ধমানে পৌঁছল তখন সোয়া সাত। তক্ষুনি একটা বর্ধমান লোকাল ছাড়ছে। চটপট সেই গাড়িতে উঠে পড়ল ওরা।

রসুলপুর স্টেশনে নেমে রামশংকরবাবু প্রথমেই টিকিট কালেক্টরের কাছে বুড়োশিব মন্দির যেতে হলে কোন পথে যেতে হবে তা জিজ্ঞাসা করলেন। টিকিট কালেক্টর একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওদের সবার ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন যে, গতকাল রাত্তিরের শেষ গাড়িতে আরেকজন ভদ্রলোক এসে ওই মন্দিরের পথ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার সঙ্গে আবার কালো কুচকুচে ষণ্ডামার্কা এক জন কে ছিল। ব্যাপারটা কী তিনি জানতে চাইলেন।

অজয় তাড়াতাড়ি বলে উঠল ওরা ইতিহাসের ছাত্র, ওই বুড়োশিব মন্দিরের নাকি একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, তাই ওরা গবেষণার ব্যাপারে এখানে এসেছে। কাল রাতে যিনি এসেছেন তিনিও একজন অধ্যাপক। সকাল সকাল যাতে কাজ শুরু করা যায় তাই এক জন সঙ্গী নিয়ে কাল রাতেই তিনি এসেছেন।

টিকিট কালেক্টরের সন্দেহ তবু যায় না, রামশংকরবাবুর হাতের বন্দুকটার দিকে তিনি অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন। রামশংকরবাবুই এবার জবাব দিলেন। একটু হেসে বললেন, এই ছেলেদের অভিভাবক হয়ে তিনি এসেছেন। কিন্তু ইতিহাসের কচকচি তাঁর ভালো লাগে না, তাঁর শখ হল শিকার করা। তাই বন্দুকটা এনেছেন, নেহাত কিছু না পাওয়া গেলে নিদেন পক্ষে গোটা কয়েক বুনো হাঁস যদি জুটে যায়।

এতক্ষণে টিকিট কালেক্টরের সন্দেহের নিরসন হল। তিনি বুড়োশিব মন্দিরে যাবার পথটা ওদের বুঝিয়ে বললেন। একথাও তিনি বললেন যে, মন্দিরটা শুধু বহু পুরোনোই নয়, জায়গাটাও নির্জন, ওখানে নাকি সাপের খুব উপদ্রব। ওরা যেন সবাধানে চলাফেরা করে।

অজয়রা স্টেশন থেকে বেরিয়ে সদর রাস্তা ধরে মাইল খানেক যাবার পর টিকিট কালেক্টরের নির্দেশমতো একটা মেঠো পথ ধরল। বর্ষা আসতে দেরি নেই, তার আগেই বেশ ক-দিন জোর বৃষ্টি হয়েছে। মাটি ভেজা, চাষিরা লাঙ্গল নিয়ে মাঠে নেবে পড়েছে। তারা এই খুদে দলটার দিকে কৌতূহল ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছিল। অজয় এগিয়ে গেল, একজন বুড়ো চাষির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিন্ত হল যে, ঠিক পথ ধরেই চলছে ওরা।

লোকালয় পেছনে ফেলে ওরা এগিয়ে চলেছে। মেঠো পথ, দু-ধারে ঝোপঝাড়, জঙ্গল। সেই বুড়ো চাষি অজয়কে আরও একটা বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছিল। মন্দিরের কাছ দিয়েই একটা নদী বয়ে গেছে, সেই নদীতে ওরা যেন নাইতে না নামে। জলের তলায় কোথাও কোথাও চোরা স্রোত আছে, যারা জানে না তাদের টেনে নিয়ে যায়।

দূর থেকেই বুড়োশিব মন্দিরটা চোখে পড়ল ওদের। নামেই মন্দির, আসলে ভাঙাচোরা একটা স্তূপ, শুধু চুড়োটা আশ্চর্যভাবে অক্ষত আছে। ওটার গা বেয়ে উঠেছে বিরাট বটগাছ, তার অসংখ্য ঝুরিতে প্রায় ঢাকা পড়েছে মন্দিরের ভগ্নস্তূপ।

মন্দিরের পূর্বে একটা মস্ত বটগাছ। দেখেই বোঝা যায় খুব পুরোনো। সাংকেতিক লিপির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। একটা দারুণ উত্তেজনায় তিন বন্ধুর মুখে কথা নেই। রামশংকরবাবু উত্তেজনায় কাঁপছেন। গাছ লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল সবাই।

গাছের তিন পা দক্ষিণে একটা মাটির ঢিবি। কিন্তু ও কী! ঢিবির চারিদিকে সদ্য মাটি তোলার চিহ্ন, মাঝখানে একটা বড়ো গর্ত। গর্তের তলায় কিছু নেই। কালিকিংকর ওদের বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। নিদারুণ একটা হতাশায় ভরে গেল সকলের মন। এত চেষ্টা, এত শ্রম, সব ব্যর্থ!

সতেরো

হঠাৎ অজয় বলে উঠল, কালিকিংকরবাবু নিশ্চয়ই ধারেকাছেই আছেন। কাল ছিল অমাবস্যার রাত, ওই অন্ধকারে ঠিক জায়গা খুঁড়ে মাটির তলা থেকে দু-আড়াই-শো বছরের পুরোনো গুপ্তধন উদ্ধার করা অত সহজ নয়। তা ছাড়া কাল রাত্তিরেই ওরা এ জায়গাটার কথা জানতে পেরেছে। সময় নষ্ট না করেই ওরা চলে এসেছে এখানে, আগে থেকে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তাদের প্রস্তুতি ছিল না। সবদিক বিবেচনা করে আমার মন বলছে আজ সকালেই ওরা মাটি খুঁড়ে গুপ্তধন উদ্ধার করেছে, সুতরাং বেশি দূর ওরা যেতে পারেনি।

রামশংকরবাবুর মনে আবার আশা জেগে উঠল। তিনি বললেন, তবে কি তুমি বলতে চাও ওরা কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে?

আমার তাই মনে হয়, অজয় ঘাড় হেলিয়ে সায় দিয়ে বলল, এখন কথা হচ্ছে, কোথায় লুকোতে পারে!

ওর অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা চারদিকে পরশ বুলোচ্ছিল, হঠাৎ ও বলে উঠল, এখানে মন্দিরটাই লুকোবার একমাত্র জায়গা, আশেপাশে এমন আর কিছু নেই যেখানে গা ঢাকা দেওয়া সম্ভব।

তবে চল, আমরা এগিয়ে দেখি, রামশংকরবাবু নবীন উদ্যমে বললেন, দরকার হলে আমরা এই ভাঙা মন্দিরের ভেতরে ঢুকব।

এগিয়ে গেল ওরা।

মন্দিরের খুব কাছে এসে অজয় হাঁক দিয়ে বলল, কালিকিংকরবাবু, আমরা এবার মন্দিরের ভেতর ঢুকছি, ভালো চান তো বেরিয়ে আসুন, নইলে বিপদ হবে। আমরা এখানে আসার আগে পুলিশেও খবর দিয়ে এসেছি, তারা এসে পড়ল বলে।

অজয়ের কথা শেষ হবার কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, একটা অখণ্ড নিস্তব্ধতা। তারপরই মন্দির থেকে দুটি মূর্তি বেরিয়ে এল। প্রথমে কালিকিংকর আর তার পেছনে হাবসি। কালিকিংকরের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে একটা হিংস্র ছাপ, তার ভাবভঙ্গিও ভালো নয়। হাবসির হাতে একটা শাবল। সে শাবলটা মাথার ওপর তুলে ধরেছে, এই বুঝি তেড়ে এসে আক্রমণ করবে।

দুই দল পরস্পরের থেকে একটু দূরে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। সুভাষ আর নরেনও তৈরি। রামশংকরবাবু হঠাৎ বন্দুকটা উঁচিয়ে একটা গুলি করে বসলেন। আসলে দারুণ উত্তেজনায় তিনি ওই কাণ্ডটি করলেন; ভাগ্য ভালো, হাত কেঁপে যাওয়ায় গুলিটি ফস্কে কালিকিংকরের মাথার প্রায় চুল ঘেঁষে চলে গেল। আধ ইঞ্চি নীচ দিয়ে গেলেই হয়েছিল আর কী!

কিন্তু তার ফল হল দারুণ। কালিকিংকর দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে শুরু করলেন, অগত্যা তার অনুসরণ করল হাবসি। অজয়রাও হইহই করে তাড়া করল তাদের।

ছুটতে ছুটতে কালিকিংকর আর তার অনুচর নদীর ধারে এসে পড়ল। অজয়রাও সেদিকেই ছুটে আসছে। রামশংকরবাবু এবার ভয় দেখাবার জন্য ইচ্ছে করেই কালিকিংকরের মাথার ওপর দিয়ে একটা গুলি করলেন। তাতেই কাজ হল। কালিকিংকর আর কিছু চিন্তা না করেই নদীর জলে ঝাঁপ দিলেন। হাবসিও অনুসরণ করল তাকে।

ততক্ষণে অজয়রা নদীর ধারে এসে পড়েছে। গত কয়েক দিনের তুমুল বৃষ্টিতে নদীতে যেন জীবন এসেছে, খরস্রোতা নদী। জলের টানে দু-জন ভেসে চলেছে। কালিকিংকর বোধ হয় সাঁতারে তেমন পটু নন, খানিকটা গিয়েই হাঁপিয়ে পড়েছেন। হাবসি কিন্তু জল কেটে তর তর করে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ নদীর ধারে চমকে উঠল ওরা। কালিকিংকর স্রোতের টানে অন্য দিকে ভেসে যাচ্ছেন। কিছু দূরে একটা ঘূর্ণি, নদীর জল সেখানে চক্রাকারে ঘুরছে, আর কালিকিংকর ওই ঘূর্ণির টানে সেদিক পানেই ভেসে চলেছেন। ঘূর্ণিটাকে পাশ কাটিয়ে যাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কালিকিংকর, কিন্তু একটা দুরন্ত টানে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে তাঁর সমস্ত প্রয়াস।

তাঁর আর্ত চিৎকারে পেছন ফিরে তাকাল হাবসি, এক নজরে প্রভুর আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে নিজের জীবন তুচ্ছ করে বলিষ্ঠ দু-হাতে জল কেটে দ্রুত সে এগিয়ে গেল। চকিতে অজয়দের চোখের সামনে যা ঘটে গেল তা কোনোদিন ভুলতে পারবে না ওরা। হাবসি কালিকিংকরের নাগালের মধ্যে পৌঁছুতেই ডুবন্ত মানুষ যেমন প্রাণের আশায় খড়কুটো চেপে ধরে, কালিকিংরও তেমনভাবে জাপটে ধরলেন হাবসিকে। পরমুহূর্ত জড়াজড়ি অবস্থায় জলের টানে তারা দু-জনে ভেসে চলল ঘূর্ণাবর্তের দিকে। দেখতে দেখতে তারা গিয়ে পড়ল সেই ঘূর্ণির মধ্যে, কয়েক পাক চক্রাকারে ঘুরে নিমেষে তলিয়ে গেল তাদের দেহ জলের তলায়।

নদীর তীরে দাঁড়িয়ে এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল ওরা তিন বন্ধু। শত্রুপক্ষ হলেও, কালিকিংকরদের এমন চরম পরিণতি ওরা কখনোই কামনা করেনি।

বিষণ্ণ মনে ফিরে চলল ওরা। মন্দিরের ভেতর ঢোকা খুব সহজ নয়, এখানে-ওখানে ভেঙে পড়েছে, বটগাছের ঝুরি ঝুলছে সর্বত্র। তারমধ্যেই পথ করে ঢুকতে হল ওদের। ভেতরটা প্রায় অন্ধকার, সূর্যের আলো যেখানেই ছিদ্র পেয়েছে, সেখান দিয়ে ঢোকার ফলে যেটুকু আলো। সেই আলোতেই পেতলের ঘড়াটা চোখে পড়ল ওদের। একটা বড়ো পেতলের ঘড়া। যেন একটা জ্যোতি বেরুচ্ছে সেই ঘড়ার মুখ থেকে, আলো না থাকলেও ওটা চোখে পড়ত।

ঘড়ার মধ্যে ঝলমল করছে সোনা আর হিরের অলংকার। কঙ্কণ, কণ্ঠহার, মকরমুখী বালা, বাজুবন্ধ, সীতাহার, হিরের নাকছাবি, আংটি, টিকলি, দুল, টায়রা, মুক্তোর মালা আরও কত কী! চোখ যেন ঝলসে যায়।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওরা তাকিয়েছিল সেই বিপুল ঐশ্বর্যের দিকে। তারপরই হঠাৎ রামশংকরবাবু পাগলের মতো অলংকারগুলো মুঠো মুঠো তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, এসব আমার, এসব আমার।

তাঁর শেষের কথাটা বাতাসে মেলাতে না মেলাতেই তিন বন্ধুর চোখের সামনে দুলে উঠল কী একটা, পরমুহূর্তে রামশংকরবাবু কাতর একটা আর্তনাদ করে ডান-পা চেপে বসে পড়লেন। একবার ছোবল মেরেই ক্ষান্ত হয়নি সাপটা, আবার ফণা তুলবার চেষ্টা করছে। হতভম্বের ভাবটা কেটে যেতেই নরেন একটা আধলা ইট তুলে প্রচণ্ড শক্তিতে সাপের মাথা লক্ষ করে মারল। সাপের মাথাটা থেঁতলে গেল, কিন্তু তবু তার কী ফোঁসফোঁসানি! আরও কয়েক বার আঘাত করার পর নিস্তেজ হয়ে পড়ল ওটা।

এদিকে কেউটে সাপের তীব্র বিষে নীল হয়ে গেছে রামশংকরবাবুর সারা শরীর, যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত, ফেনা উঠেছে মুখে।

অ-ভি-শা-প…অ-ভি-শ-প্ত, অনেক কষ্টে টেনে টেনে উচ্চারণ করলেন তিনি কথা দুটি, তারপরই ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।

ঘটনার এই আকস্মিকতায় যেন বিমূঢ় হয়ে গেল ওরা। এই কয়দিনে রামশংকরবাবুর সঙ্গে ওদের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাই আপনজনের বিয়োগ ব্যথার মতোই আচ্ছন্ন হয়ে গেল ওদের মন।

কতক্ষণ যে ওরা অভিভূতের মতো দাঁড়িয়েছিল ঠিক নেই, অজয়ের কথায় সুভাষ আর নরেনের চমক ভাঙল।

এই ঘড়ায় যত গয়না আছে সবই কালিচরণ লুঠ করেছিল, অজয় বলল, অনেক মানুষের চোখের জল আর অভিশাপ জড়িয়ে আছে এগুলোর সঙ্গে। এ হল অভিশপ্ত, এদের স্পর্শেও অভিশাপের ছোঁয়া। রামশংকরবাবু তাই আমাদের সাবধান করে বলে গেলেন, অভিশাপ আর অভিশপ্ত। কালিচরণের বংশে বাতি দিতে তিনকুলে আর কেউ রইল না।

কিন্তু রামশংকরবাবুকে এখানে এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া আমাদের উচিত হবে না, সুভাষ বলল।

ঠিক কথাই বলেছিস, অজয় জবাব দিল, এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে ওকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া। আমি বইয়ে পড়েছি, সাপের কামড়ে মারা গেলে মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেবার নিয়ম আছে। আমার মনে হয় আমাদেরও তাই করা উচিত।

আর এই পেতলের ঘড়াটা? নরেন এবার প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, এটাও আমরা নদীতে ভাসিয়ে দেব, অজয় জবাব দিল, এই অভিশপ্ত ঘড়ায় আমাদের কাজ নেই। যাদের মেরেধরে এসব অলংকার লুঠ করা হয়েছে, তাদের অতৃপ্ত আত্মা হয়তো আজও গুমরে মরছে, ঘড়াটা বিসর্জন দিলে তাদের আত্মার শান্তি হবে।

ওর প্রস্তাবে সুভাষ আর নরেন একবাক্যে সায় দিল।

ভারী ঘড়াটা কাঁধে তুলে নিল নরেন, সুভাষ আর অজয় রামশংকরবাবুর মৃতদেহ ধরাধরি করে নিয়ে চলল।

নদীর জলে হাঁটু পর্যন্ত নেমে রামশংকরবাবুর দেহটা আস্তে আস্তে জলের ওপর শুইয়ে দিল ওরা, আর ঘড়াটা ঝপাং করে নদীর জলে বিসর্জন দিল নরেন।

রামশংকরবাবুর মৃতদেহ স্রোতের টানে ভেসে চলল, যতক্ষন দেখা গেল সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তিন বন্ধু, আপনজন বিয়োগের ব্যথার মতো বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে ওদের। তারপর একসময় নদীর বাঁকে মিলিয়ে গেল সেই দেহ।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অজয় বলে উঠল, কালিচরণের পাপে তার বংশে যে অভিশাপ লেগেছিল, রামশংকরবাবু নিজের জীবন দিয়ে আজ সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গেলেন।

ওরা ফিরে চলল কালিকাপুরে, পেছনে রেখে গেল দুঃস্বপ্নের এক স্মৃতি আর অভিশপ্ত গুপ্তধন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *