পাটলীপুত্র নগরীর রাজপুরী সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মন্ত্রীমণ্ডলী ও উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বসতি, সেখানকার মনোরম উদ্যান ঘেরা প্রতিটি অট্টালিকা যেন একেকটি সুরম্য পটচিত্র; তার মাঝেও মহামন্ত্রী হরিষেণের প্রাসাদ পদ্মবনে রাজহংসীসম স্বমহিমায় স্বতন্ত্র, এমনই তার শোভা। উদ্যান মাঝে পাথরে বাঁধানো সুদৃশ্য পুষ্করিণী, শ্বেত কুমুদ ফুটে আছে তার কাকচক্ষু জলে। একপাশে পনস বৃক্ষের ছায়াঘেরা প্রস্তর বেদিকা, সেখানে মুখোমুখি বসে হরিষেণ ও পুষ্পকেতু। আশু গ্রীষ্মের মায়াবী অপরাহ্নে হরিষেণের বাঁশীর লহরী আর পুষ্পকেতুর বীণার ঝঙ্কারে বসন্ত ভৈরবীর অপূর্ব যুগলবন্দী; সুরের মায়ায় উদ্যানবিথী যেন গন্ধর্বলোক। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের মন্ত্রীসভার অন্যতম শ্রেষ্ঠরত্ন হরিষেণ বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও জনপ্রিয়; মগধ সাম্রাজ্যের যে কোনও বিশেষ প্রশাসনিক বা কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে তাঁর মতামত অপরিহার্য। কিন্তু এই মেষ সংক্রান্তির শুভদিনে, কর্মব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে কয়েক দণ্ডের জন্যে তিনি শুধুই এক সঙ্গীত সাধক, আর সেই সঙ্গীত সাধনার প্রিয়সঙ্গী পুত্রসম পুষ্পকেতু। বেশ কিছু সময় পরে, মৃদু নূপুর নিক্বণ আর জাতিপুষ্পের সুগন্ধে আত্মস্থ হন হরিষেণ, এক হাস্যময়ী বালিকাকে দেখে বাঁশী থামান তিনি। বালিকা তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা হৈমন্তী, যার সারল্যমাখা মুখ, দুটি কৌতূহলী হরিণচোখ আর অধরের মিষ্টি হাসিতে চারপাশের সকলেই বশীভূত, হরিষেণও তার ব্যতিক্রম নন। হৈমন্তী ও তার সঙ্গিনী দাসী বেদিকার ওপর নামিয়ে রাখে রূপোর থালিতে সাজানো যব, গোধুমচূর্ণ, গুড়, ঘনদুগ্ধ আদি সহযোগে প্রস্তুত বিভিন্ন মিষ্টান্ন ও সাথে পানপাত্রে কর্পুর মিশ্রিত সুগন্ধি তক্র।
‘তুমি নিজে নিয়ে এলে পুত্রী?’
‘বা রে, আজ মেষ সংক্রান্তির বিশেষ মিষ্টান্ন যে, ধাই মা বলেছেন, মিষ্টান্ন সেবনেই নতুন বছরের শুভারম্ভ।’
‘মিষ্টান্ন কি তুমি নিজেই প্রস্তুত করেছ হৈম?’ পুষ্পকেতুর প্রশ্নে যে সুক্ষ পরিহাস রয়েছে বালিকা তা বোঝেনা।
‘না, আমাকে পাক শালে যেতে দিলেনা তো ধাই মা; তবে তক্র আমি নিজে বানিয়েছি, তাই না চপলা?’ সঙ্গিনী দাসীটিকে সাক্ষী মানে সে।
‘সেক্ষেত্রে তক্র পান করা উচিৎ হবে কি? মানে আমাদের দুর্বল পাকস্থলী এই স্বর্গীয় সুধা সইতে পারলে হয়।’কেতুর কথায় হেসে ওঠেন হরিষেণ, হৈম রাগ করে চলে যেতে চায়, কেতু প্রবোধ বাক্যে শান্ত করেন তাকে। পানাহার চলছে, এসময়ে ভৃত্যের সাথে রাজপুরী থেকে আগত এক দূত এসে হাজির হয়।
‘কি হয়েছে জয়ন্ত, এই অসময়ে হঠাৎ?’ হরিষেণ বিস্মিত হন।
‘ঘটনা কিছ গুরুতর প্রভু, অতিথি শালায় বিরিঞ্চিদেবের ভেদ বমি শুরু হয়েছে, মানী ব্যক্তি, রাজকার্যে এসে এই বিপত্তি; মহাপ্রতিহারি আপনাকে সংবাদ দিতে বললেন।’
‘রাজবৈদ্য বামদেবের কাছে সংবাদ গেছে কি?’
‘তাঁকে আনতে লোক পাঠানো হয়েছে আমি এখানে আসার পূর্বেই।’
‘তাই তো হে, চিন্তার কথা; তুমি এগোও আমি আসছি।’ কিছু পরে, চিন্তিত মুখে মহামন্ত্রী রওয়ানা দেন রাজ অতিথিশালার দিকে।
বৈশালীর উপারিক বিরাটসিংহ অতি ক্ষমতাবান পুরুষ, সম্রাটের প্রিয়পাত্র; সম্প্রতি রাজপরিবারের কুমার ময়ূখের সাথে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাটির বিবাহ প্রস্তাব করে রাজসভায় পাঠিয়েছেন কুলগুরু বিরিঞ্চিদেবকে। বিরিঞ্চি, নিজেও বিশিষ্ট ব্যক্তি,শাস্ত্র ও কূটনীতিতে পণ্ডিত; শোনা যায়, তাঁর পরিচালনায় একটি সুদৃঢ় গুপ্তচরবাহিনী অহোরাত্রো নজর রাখে প্রতিবেশী হিমালয় রাজ্যগুলিতে; অতএব রাজআতিথ্যে তাঁর এ হেন অসুস্থতা সম্রাটের পক্ষে বিব্রতকর।
হরিষেণ অতিথিশালায় পৌঁছে দেখেন বামদেবের পরিচালনায় তাঁর দুই সহচর রোগীর সেবায় ব্যস্ত। বিরিঞ্চিদেবের অচৈতন্য দেহ থেকে থেকেই ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছে, মুখখানি যন্ত্রণায় নীলবর্ণ।
‘কিরকম বুঝছেন দেব?’ হরিষেণের প্রশ্নের উত্তরে একটি হতাশাব্যঞ্জক দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রাজবৈদ্য।
‘আশা একরকম নেই বললেই চলে, ফুফ্ফুস রসস্থ হয়েছে, হৃদযন্ত্রের অবস্থাও ভালো নয়।’
‘ভেদবমির কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?’
‘পানাহারের অসাবধানতাতেই হয়ে থাকা সম্ভব, বৈশালী থেকে পাটলীপুত্র যাত্রাপথে যদি কলুষিত জল পান করে থাকেন কোনও পুষ্করিণী থেকে, সেক্ষেত্রে ভেদবমি অসম্ভব নয়।’
‘বিরিঞ্চিদেব আমাদের আতিথ্যে রয়েছেন গত পাঁচদিন যাবৎ, তাহলে এই অসুস্থতার দায় আমাদের উপর বর্তায় না তো?’
‘পাঁচদিন? না ভেদবমি তারও পূর্বে সেবিত পানীয় থেকে হওয়া সম্ভব নয়; অসাবধানতা ঘটেছে কিছু অতিথিশালাতেই।’
‘বটে! তাও তাঁর অনুচরের কাছে অনুসন্ধান করে দেখছি, যাত্রাপথে তিনি কি পানাহার করেছিলেন; এ বড়ো লজ্জার বিষয় হল আচার্য; আপনি যেভাবে হোক অতিথির প্রাণরক্ষা করুন।’ হরিষেণ আবেগে বামদেবের করস্পর্শ করেন।
বিরিঞ্চিদেবের অনুচর বটুক জানায়, পথিমধ্যে জলসত্র অথবা পান্থশালা ভিন্ন কোথাও তার প্রভু পানাহার করেননি; ‘তিনি মানীব্যক্তি, আমাদিগের মত যত্রতত্র জলপান করবেন কেন?’
সমস্ত রাত্রি চলে যমে মানুষে টানাটানি, বামদেব নিজে উপস্থিত থাকেন রোগীর পাশে সর্বক্ষণ। অবশেষে পূর্বাকাশে সূর্যোদয়ের কিছুপরে, শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন বিরিঞ্চিদেব। সংবাদ পেয়ে দ্রুত উপস্থিত হন হরিষেণ অতিথিশালায়, রাত্রিজাগরণের চিহ্ন তাঁর চোখে মুখেও সুস্পষ্ট।
‘এখন বিরাটসিংহের কাছে সংবাদ পাঠানো প্রয়োজন; সম্রাটকেও অবগত করা দরকার’, হরিষেণ কতক স্বগোক্তি করেন বামদেবের সামনে।
‘বিরাটসিংহের কাছে কি সংবাদ পাঠাবেন তা একবার আলোচনা করে দেখবেন মহামন্ত্রী’ রাজবৈদ্য মন্তব্য করেন।
‘আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন আচার্য?’
‘মৃতদেহ সম্পূর্ণ নীলবর্ণ ধারণ করেছে, রোগীর বমনও বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করেছি আমি; সব লক্ষণ থেকে সন্দেহ হয় বিষক্রিয়ায় ঘটেছে এই মৃত্যু।’
‘কি বলছেন আপনি বামদেব? আপনার কথা যদি সত্য হয়, এই মৃত্যুকে ঘিরে রাজনৈতিক অসন্তোষ তৈরী হবে, ঘোর অমঙ্গল!’
মন্ত্রণাগৃহের রূদ্ধকক্ষে বিরিঞ্চিদেবের মৃত্যুকে ঘিরে আলোচনা বসেছে মহামন্ত্রী হরিষেণ ও দ্বৈমাতুরদেব, মহাপ্রতিহারি সোমদত্ত, মহাদণ্ডনায়ক বিশাখগুপ্তের মধ্যে, সম্রাট স্বয়ং উপস্থিত সে আলোচনায়। মৃত্যু বিষয়ে ঠিক কি সংবাদ পাঠানো হবে বিরাটসিংহকে সে বিষয়ে চলছে মতান্তর।
‘হৃদরোগে প্রাণ হারিয়েছেন ব্রাহ্মণ, একথা জানালে তো সবদিক রক্ষা হয়’ দ্বৈমাতুরদেব মন্তব্য করেন।
‘না, আসল কথা বেরিয়ে পড়বে অচিরেই; বটুক প্রকাশ করবে সকল কথা বৈশালী ফিরে গিয়ে’, হরিষেণ বলেন।
‘তাছাড়া, সেবকদল, বামদেবের সহচর, যে কারও রসনা শিথিল হলেই কল্পকাহিনী ছড়াবে দাবানলের মত’, মহাপ্রতিহারি আশঙ্কার কথা জানান।
‘আমার মনে হয়, মৃত্যু রহস্যের সমাধান হওয়া প্রয়োজন; প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়লে বিরাটসিংহ জানবেন তাঁর কুলগুরুর মৃত্যুবিষয়ে সম্রাট কতটা আন্তরিক’, বিশাখগুপ্ত সুচিন্তিত মতামত জানান এতক্ষণে।
‘তবে আশু অনুসন্ধান কার্য আরম্ভ হোক; অপরাধী কে, কি বা তার উদ্দেশ্য, আমিও জানতে আগ্রহী’ সম্রাট নির্দেশ দেন মন্দ্রগম্ভীর স্বরে।
‘অনুসন্ধান অতিগোপনে করা প্রয়োজন, একার্যের দায়িত্ব আমার পুত্র পুষ্পকেতুর উপর দিতে চাই রাজন’; বিশাখগুপ্ত অনুরোধ করেন।
‘কেতু বুদ্ধিমান,বিচক্ষণ; একার্যের জন্য আমিও তাকে উপযুক্ত মনে করি মহারাজ’ হরিষেণ সমর্থন করেন বিশাখগুপ্তকে।
‘আমি অনুমতি দিলাম’ সম্রাটের ঘোষনার সাথে আলোচনা শেষ হয়।
***
‘ভদ্র, অতিথিশালের পরিচালন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রয়োজন; সেবকেরা কে কি কাজের দায়িত্বে থাকে, সর্বোপরি পানাহারের বন্দোবস্ত কি এ সবকিছুই জানতে চাই অনুসন্ধান আরম্ভের আগে।’ কথা হচ্ছে সোমদত্তের কার্যালয়ে; তাঁর কার্যালয় রাজ-অতিথিশালার উত্তরপ্রান্তে।
‘অবশ্য; আপনার কাজে যাবতীয় রকম সহযোগিতা করা আমার কর্তব্য।’
এরপর সোমদত্ত যা বললেন তা এই প্রকার। অতিথিশালাটি তিনটি ভাগে বিভক্ত, এক অংশ, যেটি রাজপথ সংলগ্ন, সেখানে মধ্যপদস্থ রাজকর্মচারীরা রাজকার্যে এসে আশ্রয় নেয়, দ্বিতীয় অংশটি দক্ষিণপ্রান্তে আম্রকুঞ্জসংলগ্ন; এটি মূলতঃ সামন্তরাজ্যেগুলির দূত ও প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত; তৃতীয় অংশটিতে দুইখানি মহল রাজপুরী সংশ্লিষ্ট বনবীথির একপাশে। এগুলি বিশেষ রাজপুরুষদের জন্য সংরক্ষিত; বর্তমানে একটিতে ছিলেন বিরিঞ্চিদেব, অন্যটি আপাতত অনধিকৃত। প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের অতিথিদের জন্য আহার প্রস্তুত হয় অতিথিশালার পাকশালে, কিন্তু তৃতীয় অংশের বিশেষ অতিথিদের পানাহার আসে রাজপুরীর পাকশাল থেকে। বিরিঞ্চিদেবের তিনবেলার খাদ্য বয়ে আনত রাজপুরীর দাসী সন্ধি, মাননীয় অতিথিকে সামনে বসে আহার করিয়ে শূণ্য বাসন নিয়ে ফিরে যেত সে প্রতিবার। এছাড়া শ্রীরূপ নামের অতিথিশালার এক সেবক নিযুক্ত ছিল বিরিঞ্চিদেবের সেবায়; অতিথিশালার যাবতীয় পানীয় জল আসে রাজপুরীর মিষ্টজলের কূপগুলি থেকে, মাননীয় অতিথির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এরপর পুষ্পকেতু জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন সন্ধি ও শ্রীরূপকে।
‘বিগত পাঁচদিন তুমিই খাদ্যপানীয় এনেছ বিরিঞ্চিদেবের জন্য?’
‘হ্যাঁ দেব, পাকশাল থেকে যেরূপ গুছিয়ে দেওয়া হোত সেভাবেই নিয়ে আসতাম প্রতিদিন।’
‘পানীয় জল কোথা থেকে এনেছিলে এই কদিন?’
‘পানীয় জল শ্রীরূপ ভরে দিত কলসে আমি খাদ্যের সাথে তক্র অথবা কালিঙ্গের রস নিয়ে আসতাম পাকশাল থেকে, আচার্য মিষ্ট কালিঙ্গ বড় পছন্দ করতেন’, একথা বলে চোখ মোছে সন্ধি।
‘মেষ সংক্রান্তির দিন দিবাকালে কি খাদ্য এনেছিলে?’
‘রোজকার মতই খাদ্য এনেছিলাম, কিন্তু প্রভু ফিরিয়ে দেন আহার্য্য, বলেন ক্ষুধা নেই, বমনেচ্ছা জাগছে; বয়স হয়েছে, হয়তো পূর্বরাত্রের আহার গুরুপাক হয়ে থাকবে।’
‘তুমি কতদিন হল রাজপুরীতে নিযুক্ত হয়েছ?’
‘বাল্যকাল থেকেই এই কার্যে আছি, আমার বড় ভগিনীও বিবাহের পূর্বে রাজপুরীতে দাসীকর্ম করত, এখন সে সভানায়কের অধীন দ্বাররক্ষীর গৃহিণী।’ কথাকটি বলে চকিতে হাসে সন্ধি। রাজপুরীর পরিচারিকারা সাধারণত সকলেই সুদর্শনা হয়ে থাকে, সন্ধিও ব্যতিক্রম নয়, উপরন্তু সদ্য যৌবনা; তবে তার চেহারা ও আচরণে একপ্রকার চপলতা আছে, যেন নিজসম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন।
‘বেশ, তুমি এখন আসতে পারো’, প্রয়োজনে ডেকে পাঠাবো আবার।’
‘অতিথিশালায় কতদিন হল নিযুক্ত হয়েছ?’
‘পাঁচবৎসর যাবৎ এখানকার অতিথিদের সেবায় আছি দেব, মহাপ্রতিহারি আমার নিষ্ঠায় খুশী হয়ে বিশেষ অতিথিশালার কার্যে নিযুক্ত করেছেন বিগত একবৎসর।’ মধ্যবয়স্ক শ্রীরূপের চেহারা বলিষ্ঠ, আচরণে বিনয়ের সাথে আত্মপ্রত্যয়ের মিশ্রণ, বোঝা যায় সে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, যে কোনও গুরুদায়িত্ব পালনের উপযোগী।
‘এর আগে কি কর্ম করতে?’
‘আমি কুম্ভকার, কর্মশালা ছিল একটি নিকটবর্তী গ্রামে। গৃহিণী কঠিন রোগে পড়ল মৃত সন্তান প্রসব করে, শেষে সেও চলে গেল। কর্জ হয়েছিল প্রচুর, শেষকালে সব ছেড়ে পাটলীপুত্রে আসি কর্মের আশায়। ক্রমে প্রভু সোমদত্তের নজরে পড়ি, তারপর থেকে এই অতিথিশালাতেই আছি।’
‘পুনরায় বিবাহ করনি?’
‘নাঃ, সংসারধর্মে রুচি নেই আর; এখানে বেশ আছি খাদ্য-বাসস্থানের চিন্তা নেই, বেতনও ভালো।’
‘বিরিঞ্চিদেবের পানীয় জল তুমি এনে দিতে কি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, রাজপুরীর মিষ্টজলের কূপ থেকে প্রতিদিন মাটির কলসে জল ভরে এনে, সিক্তবস্ত্রে জড়িয়ে শীতল করে রাখতাম।’
‘আচার্যের কক্ষে তুমি আর সন্ধি ভিন্ন কে কে আসত?’
‘বটুক আসত, আর গত দুইদিবসে তাঁর সঙ্গের লোকজন এসেছিল, এছাড়া কক্ষ পরিষ্কার করতে আসত মঞ্জরী।’
‘মঞ্জরী কে? সে কি অতিথিশালার পরিচারিকা?’
‘ঠিক তা নয়, তার স্বামীর একটি মালঞ্চ আছে, মঞ্জরী বাহারে পুষ্পস্তবক তৈয়ার করে সরবরাহ করে এই অতিথিশালায়, পণ্যবিথীতে একটি বিপণিও আছে তার। অতিথিশালার অন্য অংশে সেবকেরাই কক্ষ পরিমার্জনা করে থাকে, তবে বিশেষ অতিথি বিরিঞ্চিদেব, মঞ্জরীর পুষ্পবিন্যাস দেখে তুষ্ট হয়ে তাকে কক্ষসজ্জার অনুরোধ করেন; প্রভু সোমদত্তও আপত্তি করেননি তাতে। সেই আসত কক্ষ পরিমার্জনা করতে, সেইসাথে পুষ্পস্তবক, ধুপ ও গন্ধচূর্ণে শোভিত করত পরিবেশ।’
‘মঞ্জরীর সাথে একবার বার্তালাপ প্রয়োজন, ডেকে পাঠাবার বন্দোবস্ত কর তাকে; আর বটুককে প্রেরণ কর এখন। আর একটি কথা, বিরিঞ্চিদেবের কক্ষের পানীয়জল কি ফেলে দেওয়া হয়েছে?’
‘না দেব, ও কক্ষের কবাট বন্ধ রেখেছেন মহাপ্রতিহারি।’
‘বেশ তোমার প্রভুকে বল পানীয় জলের কলসীটি আমি সাথে নিয়ে যাব।’শ্রীরূপ অবাক হলেও বিস্ময় প্রকাশ করে না, প্রশিক্ষিত সেবকের মতই আজ্ঞাপালনে তৎপর হয়।
বটুকের পক্ক চেহারা দেখে তার বয়স অনুমান করা শক্ত, তবে যৌবন বিগত নয় সেকথা বোঝা যায়; তার সাথে একটি পাঁশুটে রঙের কুক্কুর প্রভুভক্ত সেবকের মতই দুম্ব নাড়িয়ে হাজির হয় পুষ্পকেতুর সমুখে; পালক ও পালিত দুজনের সখ্যতায় সম্ভবত প্রভুভক্তি একটি বিশেষ অঙ্গ। বটুকের রক্তবর্ণ চক্ষু ও শুস্ক মুখ দেখে বোধহয় প্রভুর এই অকস্মাৎ মৃত্যুর শোক সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
‘কতদিন হল কর্ম করছ বিরিঞ্চিদেবের সাথে?’
‘আজন্মকাল; আমি প্রভুর প্রাসাদের দাসীপুত্র, জ্ঞান হতে পিতাকে চোখে দেখিনি, প্রভুপত্নীর দয়ায় মানুষ।’
‘বটে, আচার্যের কক্ষে যেসকল পথসঙ্গীরা এসেছিল বিগত কয়েকদিনে তাদের নাম ও বিবরণ চাই।’
‘পথসঙ্গী নয়, তারা প্রভুর ভূসম্পত্তির সঞ্চালক ও গ্রামপ্রধান।’
‘তাঁর ভূসম্পত্তি কোথায়?’
‘অমরাপুরা আর সূর্যপুরায়, সূর্যপুরায় তাঁর বিশাল অট্টালিকা; দশ বৎসর পূর্বে বিরাটসিংহ বৈশালীর উপারিক পদ পেলে, তাঁর সঙ্গেই বৈশালী গমন করেন প্রভু। এদেশের ভূসম্পত্তি রক্ষার্থে আসেন সম্বৎসর; এক্ষণে পাটলীপুত্র এসেছেন জেনে, অনুচরেরা সংবাদ নিতে এসেছিল; রাজকার্য সেরে যাবেন নিজ আলয়ে এমনই কথা ছিল’; বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে বটুকের।
শ্রীরূপ অল্পক্ষণের মধ্যে মঞ্জরীকে তার বাটী থেকে ডাকিয়ে আনায়; সে মধ্যযৌবনা ও সুশ্রী, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা ভারি মধুর তার ব্যক্তিত্ব, এক নির্মল স্নিগ্ধতায় আকর্ষণীয় তার সুশ্রীতা। পরনে বাসন্তী অন্তরীয়, উত্তরীয়টি পলাশ রাঙা; গলায়, কানে গুঞ্জার গহনা, কবরীতে স্বর্ন চম্পক; সবমিলিয়ে সে যেন সত্যিই বসন্তকুঞ্জের মালিনী।
‘অতিথিশালায় তোমার নিত্য যাতায়াত ভদ্রে?’
‘হ্যাঁ দেব, পুষ্পরাজি নিয়ে আসি প্রাতে’; মঞ্জরীর গলার স্বরেও কোকিলার কুহুতান।
‘বিরিঞ্চিদেবের কক্ষে কখন আসতে?’
‘প্রাতে পুষ্পরাজি ভাণ্ডারিকের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে, আচার্যের কক্ষ পরিমার্জনা করতে আসতাম।’
‘বিরিঞ্চিদেব উপস্থিত থাকতেন কক্ষে?’
‘থাকতেন, তিনি জপ করতেন সেসময়ে।’
‘মেষ সংক্রান্তির দিন কি করছিলেন তিনি?’
‘সেদিন আমি আসিনি, গৃহকর্মে ব্যস্ত ছিলাম।’
‘সেকি, উৎসবের দিন, পুষ্পের বিশেষ প্রয়োজন থাকে সেইদিবসে, তাও এলেনা?’
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে আবার বলে ওঠে মঞ্জরী,’ বললাম তো গৃহে বিশেষ ব্যস্ত ছিলাম।’
সোমদত্তের অনুমতি নিয়ে পুষ্পকেতু শ্রীরূপকে সঙ্গী করে বিরিঞ্চিদেবের কক্ষটি পরিদর্শনে যান; উন্মুক্ত অলিন্দ সংলগ্ন সুবিশাল কক্ষটির জানালা দিয়ে চোখে পড়ে শ্যামল বনবীথি; কক্ষের একপাশে মৃতের পালঙ্ক শয্যাহীন। অন্যপাশে লেখনপীঠিকার উপর সযত্নে গোছানো লেখার সামগ্রী আর একটি শুষ্ক জাতিপুষ্পহার; কুরঙ্গীতে শূন্য ধূপাধার, শুধু ছাই পড়ে আছে কিছু চারপাশে। পানীয় জলের মৃৎকলস রাখা একটি কাঠের পাটাতনে, পাশে রাখা সুদৃশ্য তাম্বুলকরঙ্ক।
‘তাম্বুলের অভ্যাস ছিল আচার্যের?’ প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।
‘হ্যাঁ, বৈশালী থেকেই এনেছিলেন সব উপাচার, নিজহাতে রচনা করতেন সুগন্ধি তাম্বুল, কি তার গন্ধ! সংক্রান্তির দিন খাদ্য ফিরিয়ে দিলেন, তবু তাম্বুল খাওয়ায় ক্লান্তি ছিলোনা’, অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীরূপ।
‘জলাধারটি পাল্কীতে উঠিয়ে দাও হে, গৃহে নিয়ে যাব’, ব্যবস্থা সম্পন্ন করে গৃহে ফেরেন পুষ্পকেতু; মধ্যাহ্ন পার হয়েছে ততক্ষণে।
স্নানাহার সেরে কক্ষে ফিরে পুষ্পকেতু দেখেন প্রিয়মিত্র উল্মুক বসে আছেন তাঁর অপেক্ষায়।
‘শুনলাম বিশেষ রাজকার্যে ব্যস্ত আছো, নাওয়া খাওয়ারও সময় নেই, ব্যপার কি হে?’ ঘটনা জানতে ব্যগ্র হন উল্মুক।
‘কি করি বল, মিত্র যখন বিবাহের পাত্র, রাজকার্যে নিজেকে ব্যস্ত না রেখে উপায় কি!’ আগামী পূর্ণিমা তিথিতে বন্ধুর বিবাহকে ঘিরে রসিকতা করেন পুষ্পকেতু।
‘একথায় ভুলছিনা, আসল ঘটনা বিস্তারে বল’, উল্মুক ছাড়ার পাত্র নন; অতএব জানাতে হয় সকল কথা।
‘কাউকে সন্দেহ হয় তোমার?’
‘সন্দেহ সকলকেই হয়, প্রশ্ন হচ্ছে বিষক্রিয়া হল কি রূপে?’
‘পানীয় জলে মেশানো হয়েছে বিষ এই তো সন্দেহ তোমার?’
‘ভেবেছিলাম তাই, কিন্তু, দুটি পুঁটি মৎস্য ছাড়া হয়েছিল কলসের জলে, তারা দিব্য সন্তরণে ব্যস্ত।’
‘বিষ তো আহার্যেও মেশানো হতে পারে, আহার্যের পরীক্ষা তো হয়নি।’
‘হ্যাঁ পানীয়ে না মেশালে আহার্য থেকেই হতে হবে বিষক্রিয়া। সন্ধি চপলা নারী, তার কোনও গুপ্তপ্রেমী থাকা অসম্ভব নয়; হয়তো এ তাদেরই কাজ।’
‘পাকশালে সম্ভাবনা নেই বলছ?’
‘সেখানে সন্ধির চোখ এড়িয়ে বিরিঞ্চিদেবের আহার্যে বিষ কে মেশাবে? না হে কোনও কিছু স্পষ্ট নয়, উপরন্তু আচার্যকে হত্যা করে কিসের লাভ?’
‘আরে এ এক চক্রান্ত আমার বিরুদ্ধে, স্পষ্ট দেখছি আমি’ উল্মুক গম্ভীর স্বরে ঘোষনা করেন।
‘চক্রান্ত তোমার বিরুদ্ধে! কিরকম?’
‘আজ থেকে ছয়দিবস পরে আমার বিবাহ, এমত অবস্থায় তুমি কি আর যেতে পারবে হে? বিরিঞ্চিদেবের হত্যা যে আমার আনন্দ মাটি করার জন্যে একথা তো স্পষ্ট!’ উল্মুকের চোখে হাসির ঝিলিক।
‘নিশ্চিন্ত থাক হে বন্ধু, তোমার বিবাহে আমার উপস্থিতি আটকাতে পারবেনা কোনও অর্বাচীন’, প্রাণখোলা পরিহাসে মেতে ওঠেন দুই মিত্র।
***
‘কি প্রকার বিষ প্রয়োগ হয়েছিল আন্দাজ হয় কিছু বৈদ্যরাজ?’, বামদেবকে একান্ত সাক্ষাতে প্রশ্ন করে্ন পুষ্পকেতু।
‘স্পষ্ট করে বলা কঠিন, তবে বৃহৎ পরিমানে শরীরে প্রবেশ করেছিল সে বিষ, সমস্ত অঙ্গ বিকল হয়েছিল ধীরে ধীরে।’
‘সহজে পাওয়া যায় এমন কিছু, ধুতরো হতে পারে কি?’
‘না ধুতরো নয়।’
‘আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে?’
‘ধুতরোর বিষক্রিয়ায় রোগী ভুল বকে, উন্মাদপ্রায় হয়ে যায়; সেসব লক্ষণ ছিলোনা বিরিঞ্চিদেবের।’ চিন্তিত মুখে বামদেবের কাছে বিদায় নেন পুষ্পকেতু।
‘আহার্য পরিবেশনকালে আর কেউ থাকতো সেখানে?’ পুষ্পকেতু পরদিন প্রাতে সন্ধির সাথে নতুন করে শুরু করেন জিজ্ঞাসাবাদ।
‘হ্যাঁ বটুক থাকত, কখনও বা শ্রীরূপ, আর থাকত বক্র।’
‘বক্র কে?’
‘কেন, আচার্যের প্রিয় সারমেয়? বক্রকে না দিয়ে কিছু মুখে তুলতেন না তিনি, বড় স্নেহ করতেন অবলা জীবটিকে।’
***
‘বিরিঞ্চিদেবের কি শত্রুতা ছিল কারও সাথে, বলতে পারো?’ পুষ্পকেতু আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন বটুকের সাথে।
‘আমি সামান্য অনুচর, কেমন করে জানব? তবে বিত্তবানের প্রতি ঈর্ষা তো অনেকেরই থাকে?’
‘শুধুমাত্র ঈর্ষা থেকে কেউ প্রাণনাশ করেনা, কারও সাথে বিবাদ, দ্বন্দ কিছু ছিল কিনা নিজগ্রামে সেকথা জানতে চাইছি।’
‘তেমন কিছু আমার জানা নেই দেব; আমি থাকতে তাঁর এই সর্বনাশ ঘটে গেলো এই বড় ক্ষেদের বিষয় আমার কাছে।’
‘এ বিষয়ে তুমি আর কি করতে পারতে, অকারণে কষ্ট দিয়োনা নিজেকে’, পুষ্পকেতু স্বান্তনা দেন বটুককে।
‘প্রভুকে হারিয়ে বক্রও কি বেদনাগ্রস্ত?’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুক্কুরটিকে দেখে মন্তব্য করেন পুষ্পকেতু।
‘বিরিঞ্চিদেব ওর প্রভু ছিলেননা, ওকে পালন করেছি আমি।’
‘কিন্তু শুনলাম, স্নেহ করতেন খুব, নিজ থালি থেকে আহার্য খাওয়াতেন একে?’
‘প্রয়োজনকে স্নেহ ভাবা ভ্রম। প্রভু অতি সাবধানী ব্যক্তি ছিলেন, কোনও আহার্য বা পানীয় পরীক্ষা না করে গ্রহণ করতেননা পরগৃহে; আর বিষ পরীক্ষকের কার্যটি ছিল আমার; যবে থেকে বক্রকে পালন করেছি, আমার হয়ে এই কার্যটি ওই করে থাকে।’
‘সেকি একথা আগে বলনি তো? আহার্য-পানীয়, ওই মৃৎকলসের জল সকল কিছুই পরীক্ষা করে গ্রহণ করতেন বিরিঞ্চিদেব?’ বটুক উত্তরে সম্মতি জানায়।
***
‘এই মূহুর্তে একবার বিরিঞ্চিদেবের কক্ষটিতে যাওয়া প্রয়োজন, শ্রীরূপ নয়, আপনি নিজে আসুন আমার সাথে’ সোমদত্তকে বিস্মিত করে ছুটে যান পুষ্পকেতু তাঁর কার্যালয়ে। কক্ষদ্বার খোলা হলে সেখান থেকে তাম্বূলকরঙ্কটি সাথে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যান কেতু; বামদেবের হাতে প্রদান করেন সেটি পরীক্ষার জন্য।
‘উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করলে চোখে পড়ে চূর্ন পিণ্ডটির রঙ যেন ঈষৎ ধুসর; চূর্ণের ঝাঁজে বিষের স্বাদও ঢাকা পড়বে; অবশ্য খদিরেও মিশ্রিত হতে পারে বিষ, বর্ণে, স্বাদে চাপা পড়ে যাবে তার উপস্থিতি’ স্বগোক্তি করেন বামদেব। ‘আমি পরীক্ষা করে দেখব কেতু, তুমি এখন এসো।’
মহাদণ্ডকারিকের কার্যালয়ে আলোচনায় বসেছেন বিশাখদত্ত ও পুষ্পকেতু, দুজনের মুখেই চিন্তার ছাপ।
‘তোমার কথামত দৃষ্টি রাখা হয়েছে সন্ধি, শ্রীরূপ ও মঞ্জরীর গতিবিধিতে। সন্ধির একটি প্রণয়ী আছে, সে মহাপ্রতিহারির অধীনস্থ কর্মচারী; সম্ভবত সেকারণেই সন্ধি অতিথিশালায় যাতায়াতের সুযোগ পায়। বিশেষ অতিথিদের সেবা করে সে নিছক পারিতোষিক লাভের আশায়, নাকি আরও কোনও গভীর উদ্দেশ্যে সে এই কার্যে উৎসাহী বলা কঠিন। মঞ্জরী শ্রেষ্ঠীকন্যা, পিতৃকুলের স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে সাধারণ মালাকারকে প্রেম বিবাহ করেছিল সে কয়েক বৎসর পূর্বে, তার বিবাহিত জীবন সুখী বলেই বোধ হয়, একটি পুত্রসন্তান আছে। তবে সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পুত্রটিকে বিদ্যাশিক্ষা করাতে চায় আশ্রমে পাঠিয়ে, নগরবীথির বিপণিটিও তারই উদ্যোগের ফল। শ্রীরূপের সম্পর্কে যা জানা গেছে, বেশ চমকপ্রদ; সে সূর্যপুরা গ্রামের বাসিন্দা, শোনা যায় তার পত্নী বিরিঞ্চিদেবের গৃহে পরিচারিকার কর্ম করত; তার অসুস্থতার কালে বেশ কিছু অর্থসাহায্য যায় গৃহস্বামীর কোষাগার থেকে; রমণীর মৃত্যু হলে সমস্তই কর্জ বলে দাবী করে বিরিঞ্চিদেবের কোষাধ্যক্ষ। কার্যত ভূস্বামীর নিগ্রহেই সবকিছু ছেড়ে গৃহত্যাগী হয় শ্রীরূপ।’ পিতার বক্তব্য শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকেন পুষ্পকেতু বেশ কিছুক্ষণ।
‘নিরীক্ষা যেমন চলছে চলুক, সন্ধির প্রণয়ীর গতিবিধি নজরে রাখার ব্যবস্থা করুন পিতা, এদিকে দেখি বামদেব কি সংবাদ দেন।’
***
হরিষেণের গৃহের বিশ্রামকক্ষ, মধ্যাহ্নভোজন সেরে সেখানে মুখোমুখি বসে মহামন্ত্রী ও পুষ্পকেতু; পরিবেশ বিষাদ গম্ভীর।
‘শ্রীরূপের উদ্দেশ্য ও সুযোগ দুই ছিল, তাকে দেখেও বুদ্ধিমান বলেই মনে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র ঋণভার দুর্বহ হলে কেউ হত্যা করে কি?’ পুষ্পকেতু সংশয় প্রকাশ করেন।
‘বাকি সকলে? তারাও তো সন্দেহের উর্দ্ধে নয় কেউই?’
‘তা নয়, কিন্তু বিরিঞ্চিদেবকে হত্যা করে কার লাভ? কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা দেব, কালো যবনিকা ক্রমশঃ চিন্তার গতি রোধ করছে।’
‘সুযোগ তো সন্ধিরই সব চেয়ে বেশী ছিল, সে রমণী, উপরন্তু রমণীয়, আহার্য পরীক্ষার নিয়ম তার সমুখে শিথিল হয়ে থাকতেও তো পারে?’ হরিষেণ বলেন।
‘সে যুক্তি তো মঞ্জরীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য দেব।’
‘আহার্যে মঞ্জরী বিষ কিপ্রকারে মেশাবে?’
‘বিষ যদি তাম্বূলে থাকে? সুন্দরী যুবতী নিজহস্তে তাম্বূল রচে দিলে প্রৌঢ় কি প্রত্যাখ্যানে সমর্থ হতেন?’
‘আর বটুক, সুযোগ তো তারও ছিল?’
‘বিরিঞ্চিদেব কূটবুদ্ধি সাবধানী ব্যক্তি, বটুকের প্রভুভক্তি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ না হয়ে তাকে সর্বক্ষণের অনুচর করতেন না। তাছাড়া, প্রভুগৃহে আজন্ম লালিত হয়েছে সে বিরিঞ্চিদেবের আনুকুল্যে; তাঁর মৃত্যুর পশ্চাতে সেখানে তার স্থান নাও হতে পারে, অতএব এই হত্যায় বটুকের ক্ষতি ভিন্ন লাভ নেই কোনও।’
‘চিন্তায় বিনিদ্র রাত্রি যাপন করছি কেতু, রহস্যের কিনারা নাহলে সম্রাটের কাছে বড় অপদস্থ হতে হবে আমাদের’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন হরিষেণ। কোনও আশ্বাস বাণী শোনাতে পারেননা পুষ্পকেতু, কিছুপরে নিঃশব্দে বিদায় নেন তিনি গম্ভীর মুখে।
উদ্যানসংলগ্ন বহির্দ্বারের দিকে হেঁটে চলেছেন পুষ্পকেতু, আচমকা ক্রন্দনরতা হৈমন্তীকে দেখে গতিরোধ হয়।
‘কি হয়েছে হৈম, চোখে জল কেন?’ স্নেহভাষণ শুনে বালিকার কান্না আরও বেড়ে যায়।
‘ধাইমা ফেলে দিয়েছে আমার আভুষণ, চপলাকে দূর করে দেবে বলেছে।’
‘সেকি এতবড় নির্যাতন কিহেতু?’ হৈমন্তীর বালিকাসুলভ গৃহকলহে কৌতুক বোধ করেন পুষ্পকেতু, হয়তো বা গভীরসমস্যায় জর্জরিত চিত্ত কিছুটা বিনোদনের পথ খোঁজে।
‘চপলা ভারি সুন্দর একছড়া গুঞ্জামালা গেঁথে এনেছিল, আমার গলায় সেখানি দেখে ধাইমা কেড়ে নিল জোর করে, ফেলে দিল আবর্জনায়। চপলা এনে দিয়েছে শুনে, তিরষ্কার করেছে তাকে, বলেছে গুঞ্জাবীজে ভয়ানক বিষ, জেনেশুনে এনেছে, দূর করে দেবে ওকে আবার একার্য করলে।’
‘কি বললে?’ পুষ্পকেতু স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকেন বহুক্ষণ, হৈমর অভিযোগ কানে যায় না আর। এরপর অতিদ্রূত ফিরে চলেন আবার হরিষেণের প্রাসাদে।
‘আপনি শীঘ্র অতিথিশালায় যান আর্য, মঞ্জরীকে সেখানে আনবার ব্যবস্থা করুন; আমি বামদেবকে নিয়ে উপস্থিত হচ্ছি সত্ত্বর। হরিষেণকে আর কিছু জিজ্ঞাসার সুযোগ না দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যান পুষ্পকেতু বামদেবের গৃহের উদ্দেশ্যে।
‘গুঞ্জাবীজের বিষ মৃত্যুর কারণ হতে পারে কি বৈদ্যরাজ?’ বামদেবের গৃহে পৌঁছে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।
‘গুঞ্জাবীজ, মানে রক্তি?’ কিছুক্ষণ সময় নেন বামদেব কিছু বলার আগে।
‘রক্তির ভিতরকার অণ্ড অতি মারাত্মক একথা সত্য, তবে বাইরের শক্ত খোলস ভেদ করে তা বাইরে আসেনা। সেকারণেই, রত্নশ্রেষ্ঠীরা রত্নের ওজন মাপতে ব্যবহার করেন রক্তি।’
‘কিন্তু, কেউ যদি খোলস ভেঙে অণ্ডচূর্ণ করে আহার্যে মেশায় তাহলে?’
‘তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝেছি কেতু, রক্তিচূর্ণের রঙ প্রায় সাদা, ঈষৎ হরিদ্রাভ; বামদেবের মৃত্যু এই বিষ থেকে হওয়া সম্ভব, রোগের লক্ষ্মণও সেইরূপ। ভালো কথা, তাম্বূলকরঙ্কের প্রতিটি উপাচার আমি পরীক্ষা করেছি, চূর্ণপিণ্ডটি বিষাক্ত ছিল।’
‘যবণিকাপাতের সময় এসেছে দেব, আপনি দয়া করে একবার অতিথিশালায় চলুন’; বামদেবকে পাল্কীতে তুলে অশ্বপৃষ্ঠে রওয়ানা হন পুষ্পকেতু।
বিরিঞ্চিদবের কক্ষমধ্যে চারটি আসনে বসে চার রাজপুরুষ, হরিষেণ, সোমদত্ত, বামদেব ও পুষ্পকেতু, কক্ষসজ্জা হুবহু পূর্বের মত, এমনকি মৃৎকলসটিও কাঠের পাটাতনে রাখা আগের মতই, ভুল হয় বুঝিবা বিরিঞ্চিদেব এখনও বাস করছেন সেখানে। পুষ্পকেতুর আহ্বানে শ্রীরূপ, বটুক, সন্ধি ও মঞ্জরী কক্ষে প্রবেশ করে; সকলের চোখেই উৎকণ্ঠা, শুধু মঞ্জরীর শান্ত মুখে নেই কোনও ভাবাবেগ।
‘মেষ সংক্রান্তির আগেরদিন যখন তুমি কক্ষ পরিমার্জনায় এলে ঠিক কি ঘটেছিল?’ মঞ্জরীকে প্রশ্ন করে পুষ্পকেতু।
‘কিছু তো হয়নি দেব, রোজকার মতই কার্য শেষ করে বিদায় হই আমি।’
‘রোজকার মতই? তবে পরেরদিন এলেনা কেন অতিথিশালায়? গুঞ্জার বিষ সেদিনই প্রয়োগ করেছিলে তো?’ পুষ্পকেতুর প্রশ্নে চমকে ওঠে সকলে, মঞ্জরীর চোখে দেখা দেয় নিদারুণ ভয়, নিজের অজান্তেই ছুঁয়ে দেখে সে গলার মালাখানি।
‘সত্য করে বল, বিষ নিজে প্রয়োগ করেছিলে, না শ্রীরুপকে দিয়েছিলে যথাসময়ে প্রয়োগ করতে?’
‘এ আপনি কি বলছেন দেব? আমি কেন একার্য করব?’ শ্রীরূপ প্রবলভাবে প্রতিবাদ করে।
‘যে ব্যক্তি ভূসম্পদ কেড়ে নিয়ে গৃহছাড়া করল, হয়তো বা কেড়ে নিয়েছিল আরও বেশী কিছু, হাতে পেয়ে ছেড়ে দেবে তাকে বিশ্বাস করতে বল একথা?’
হঠাৎ শ্রীরূপের মুখের পেশী কঠিন হয়ে ওঠে, ‘হ্যাঁ, ইচ্ছা জাগেনি একথা বলব না; মনে হয়েছিল ঘুমের মধ্যে গলা টিপে তিল তিল করে হত্যা করি নরাধমকে, ঠিক যেভাবে মরেছিল বেতসী; কিন্তু পারিনি, বিশ্বাস করুন আমি পারিনি’; ভুমিতে বসে পড়ে শ্রীরূপ চূড়ান্ত হতাশায়।
‘এখনও সময় আছে সত্য প্রকাশ কর মঞ্জরী, নিজের শিশুপুত্রের কথা ভেবে সব খুলে বল’ পুষ্পকেতুর বক্তব্যে আবেদনের সুর। দীর্ঘ মূহুর্তের জন্য সময় নেয় মঞ্জরী, নীরব অশ্রুতে ভেসে যায় তার স্নিগ্ধ মুখখানি।
‘আচার্যের কুদৃষ্টি পড়েছিল আমার উপর, এ আমি বুঝেছিলাম প্রথম দিনেই; কিন্তু কাউকে বলতে পারিনি ভয়ে, কেই বা বিশ্বাস করত দরিদ্র মালিনীর কথা। সংক্রান্তির পূর্বদিন, কক্ষে একলা ছিলেন আচার্য; আমার পশ্চাতে কপাট রূদ্ধ করে কুপ্রস্তাব দেন তিনি, আমি অসম্মতি জানানোয় ভয় দেখান কুলটা অপবাদে সমাজ ছাড়া করবেন। তারপর বলপ্রয়োগের চেষ্টা করেন, কিন্তু সেসময়ে আচমকা বটুক এসে পড়ে, আমার চিৎকারে জানালা দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে সে, আমি সেখান থেকে ছুটে পালাই। বিশ্বাস করুন, আমি এর বেশী কিছু জানিনা’ ডুকরে কেঁদে ওঠে মঞ্জরী।
‘বটুক বাকী কথা কি তুমি বলবে, না আমাকেই বর্ণনা করতে হবে?’ পুষ্পকেতুর স্বর গম্ভীর।
‘বলবার তো বিশেষ কিছু নেই দেব, সামান্য অনুচর আমি, লোকে বলে দাসীর অবৈধ সন্তান। সেদিন মঞ্জরী চলে যেতে ক্রোধে উম্নত্ত হয়ে মস্তকে পদাঘাত করেছিলেন বিরিঞ্চিদেব, যাকে আমার মা আজন্ম দেবতা ভাবতে শিখিয়েছিল। জন্মদাতা হয়েও তিনি চিরকাল ব্যবহার করেছেন আমায় অনুগত কুক্কুরের মত, আমার অভাগা জননী কলঙ্কের কালি মেখে জীবনপাত করেছে অকালে। সব সয়েছি কর্তব্যজ্ঞানে, কিন্তু আমার সেই মাতাকে অপমান! বেশ্যাপুত্র বলে সম্বোধন করেছিল সেদিন ওই নারীলোভী ধর্ষক! যা করেছি কোনও পরিতাপ নেই আমার। মঞ্জরীর গলার ছিন্নমালা পড়েছিল ভূমিতে; প্রভু স্নানাগারে গেলে চূর্ণপিন্ডে মিশিয়ে দেই বিষ, তাম্বূল পরীক্ষা করিয়ে চর্বণ করবেন না জানতাম যে’, এক বিদ্বেষ হাসি জেগে ওঠে বটুকের মুখে, চোখের কোল হতে ঝরে পড়ে দুইবিন্দু অশ্রু।
‘বটুকই যে অপরাধী সে সন্দেহ হল কি রূপে?’ গৃহের একান্তে পুষ্পকেতুকে প্রশ্ন করেন হরিষেণ।
‘প্রথমে সন্দেহ হয়নি, বিষপ্রয়োগ সাধারণত রমণীর অস্ত্র, অথবা গুপ্তচরের বা কূটনৈতিক গুপ্তহত্যার হাতিয়ার। সেক্ষেত্রে শ্রীরূপের যতই উদ্দেশ্য থাক, তাকে অপরাধী ভাবতে পারছিলাম না, সে হত্যা করলে হয় ছুরিকাঘাতে অথবা শ্বাসরূদ্ধ করে কার্যসিদ্ধি করত। সন্ধি চপলমতি, হত্যা করার মত স্নায়ুবল তার নেই। গুঞ্জাবিষের কথা জেনে মঞ্জরীকেই সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু বিরিঞ্চিদেব যে কলসের জলও পরীক্ষা ভিন্ন পান করতেননা সেকথা তার জানার কথা নয়, অতএব সে এ কার্য করলে, জলেই বিষ মেশাতো। সেক্ষেত্রে, বাকী থাকে বটুক; কূটনীতিজ্ঞ প্রভুর অনুচর, গুপ্তহত্যা ও বিষবিজ্ঞান সম্পর্কে তার জ্ঞান থাকাই স্বাভাবিক। তাছাড়া, বিরিঞ্চিদেবের কক্ষে যখন মঞ্জরীকে বিষের কথা বলি, বটুক অজান্তেই কক্ষমধ্যে পূর্ববৎ রাখা তাম্বূলকরঙ্কটির দিকে দৃষ্টিপাত করে; আমি লক্ষ্য রেখেছিলাম। এই পরীক্ষাটি করার জন্যেই সকল বস্তু আগের মত কক্ষে সাজিয়ে রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলাম এই চারজনের অজান্তে।’
‘তোমাকে কি বলে আশীর্বাদ করি কেতু, আজ কতবড় লজ্জা থেকে রক্ষা করলে তুমি আমাদের সকলকে! বল বৎস, কি পুরস্কার চাও? তোমাকে কিছু দিতে পারলে তৃপ্ত হব আমি।’
‘পুরস্কার নয় আনুকুল্য চাই দেব।’
‘আনুকুল্য, কি বিষয়ে?’
‘সমুদ্রযাত্রা, ভিন্নদেশ, ভিন্নসংস্কৃতি, এ আমার বহুকালের অভিলাষ, আপনার পৃষ্ঠপোষকতায় সম্ভব হতে পারে তা।’
‘বেশ, আমি চেষ্টা করব; তুমি সম্ভবনাময় পুরুষ, ব্যপ্ত হোক তোমার অভিজ্ঞতা, ক্ষুদ্র গন্ডিতে বাঁধব না তোমায়, শুভমস্তু।’
বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি; মায়াবী চন্দ্রমা, ফুলসাজ আর উলূরবে স্বপ্নময় বিবাহসভা; সদ্য বিবাহিত বর-বধূকে ঘিরে রেখেছে আত্মীয় বন্ধুদল, আশীর্বাণী ও উপঢৌকনে উৎসব মাতোয়ারা। উল্মুকের একপাশে নিঃশব্দে এসে আসন গ্রহণ করেন পুষ্পুকেতু; উৎসবের বিশেষ সজ্জায় তিনি আজ সাক্ষাৎ কন্দর্প।
‘বাঁধা পড়লে অবশেষে? গৃহিণীর করায়ত্ত হয়ে বোধ করছ কেমন?’ পরিহাস করেন পুষ্পকেতু স্বভাবসিদ্ধ স্বরে।
‘এ বন্ধন ভারি মধুর; তুমিও বুঝবে অচিরেই।’
‘না বন্ধু, তুমি বন্ধন পিয়াসী; আমার মুক্তি সুদূর দিগন্তের পরপারে’ পুষ্পকেতুর উদাসী স্বর ভেসে যায় বাতাসে, প্রাসাদ অলিন্দে বেজে ওঠে মিলন রাগিণী, মায়াবী আলোয় জাগে ভবিষ্যতের আশ্বাস।
*** ***
দুরূহ শব্দের অর্থ:
শ্বেত কুমুদ – সাদা শালুক, পনস – কাঁঠাল, জাতিপুষ্প – জুঁই ফুল, তক্র – দইয়ের ঘোল, মহাপ্রতিহারি – রাজপুরীর ব্যাবস্থাপক, উপারিক – রাজ্যপাল, মেষ সংক্রান্তি – চৈত্র সংক্রান্তি, কালিঙ্গ – তরমুজ, গুঞ্জা – কুঁচফল, রক্তি – রতি, তাম্বুলকরঙ্ক – পানের বাক্স, অলিন্দ – বারান্দা