একদা নিশীথে

একদা নিশীথে

ফাল্গুন প্রভাত, পাটলীপুত্রের একটি সুসজ্জিত উদ্দ্যানবাটিকার এক নিভৃত কক্ষ; জানালার পাশে রাখা পশমের আসনে বসে আছেন এক তরুণ, দীর্ঘ সুঠাম দেহ, কান্তিমান বুদ্ধিদীপ্ত মুখশ্রী। জানালার বাইরে চোখে পড়ে মনোরম কুঞ্জবীথি, সেখানে নব বসন্ত সম্ভারে প্রকৃতি অনুপমা; তবে তরুণের মন নেই সেদিকে, তিনি নিবিষ্ট হয়ে আছেন সামনের লেখন পীঠিকার ওপর। পীঠিকার একপাশে খোলা সূর্যসূত্র পুস্তক, আর সামনে রাখা লেখপট; তিনি দুরূহ জ্যামিতিক প্রহেলিকায় ভরিয়ে তুলছেন সে লেখপট একান্ত আগ্রহে। কোমল সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে তাঁর শ্বেত-শুভ্র উন্মুক্ত কাঁধে, ঘাড়ের কাছে মৃদু বাতাসে দুলছে কুঞ্চিত কেশ। আচমকা এক শুকশারী যুগলের প্রেম কলহে শান্তিভঙ্গ হয় বাগানের, চমকে বাইরে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তরুণের ঠোঁটে; কমনীয় সে হাসিতে হালকা কৌতুক খেলা করে যায়; শুকনো গাণিতিক বিদ্যা যে তাঁর রসবোধ ক্ষুণ্ণ করেনি তা বোঝা যায় মুহূর্তেই। তরুণের নাম পুষ্পকেতু, সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের বৈমাত্রেয় ভাই বিশাখগুপ্ত তাঁর পিতা। নামের মাহাত্ম্য রেখে পুষ্পকেতু সত্যিই রূপে কামদেব, তবে রাজকুলে জন্মেও যুদ্ধ পিপাসার থেকে জ্ঞানপিপাসা তাঁর অধিক; বাকি কুমারেরা যখন মৃগয়া বিহারে অবসর যাপন করেন, পষ্পকেতু গণিতের প্রহেলিকা সমাধানে ব্যস্ত রাখেন নিজেকে। তবে আরেকটি বিষয়েও তাঁর গভীর আসক্তি, সে হল সঙ্গীত; একারণেই প্রায় পিতৃব্যতুল্য সঙ্গীতজ্ঞ মহামন্ত্রী হরিষেণের সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতা, যা অনেককেই বিস্মিত করে।

বিশাখগুপ্ত পাটলীপুত্রের মহাদণ্ডনায়ক; নগরী ও তৎসংলগ্ন জনবীথির আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরুদায়িত্ব সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত অর্পণ করেছেন তাঁর অতিপ্রিয় কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে। তবে স্নেহ বশে নয়, ভ্রাতার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতি আস্থা রেখেই বিচক্ষণ সম্রাট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দীর্ঘ বারো বছর ধরে সে দায়িত্ব সুনিপুণ ভাবে পালন করে চলেছেন বিশাখগুপ্ত। তাঁর এই দায়িত্বভার পুষ্পকেতু গ্রহণ করবেন ভবিষ্যতে এমন আশা রাখেন মহাদণ্ডনায়ক; মেধাবী পুত্রের মানবিক গুণের কারণে মনে মনে সমীহ করেন তাকে, প্রয়োজনে পরামর্শ নিতেও দ্বিধা করেননা বিচারসংক্রান্ত সমস্যায়।

‘এমন বসন্ত প্রভাতে সখা কি জাগতিক রস ভুলে জ্যামিতিক প্রণয়ে লিপ্ত?’ কক্ষে প্রবেশ করেন এক সুবেশ তরুণ, বয়স পুষ্পকেতুর মতই, ভারি প্রসন্নতা মাখা তাঁর ব্যাক্তিত্ব। ঈষৎ হেসে মুখ তুলে তাকান কুমার, বাল্যসখা উল্মুককে দেখে পরিহাস ফুটে ওঠে তাঁর চোখে। অক্ষপটবালাধিকৃত অগ্রসেন, মগধ সাম্রাজ্যের আয়-ব্যায়ের হিসাব ব্যবস্থার আধিকারিক; উল্মুক তাঁরই পুত্র, বর্তমানে পিতার তত্ত্বাবধানে শিক্ষানবিশি করছেন পুস্তপালের দপ্তরে।

‘চম্পক ফুটেছে তোমার মালঞ্চে, ঋতুরাজের সংবাদ তুমিই তো রাখবে হে; আমার বর্ণহীন জীবনে জ্যামিতিতেই শান্তি।’ সম্প্রতি উল্মুকের বিবাহ স্থির হয়েছে, কন্যাটির নাম চম্পা, পুষ্পকেতুর ইঙ্গিত সেইদিকেই।

‘বর্ণহীন নও, তুমি বর্ণচোরা’ কথাটি বলে হেসে আসন গ্রহণ করেন উল্মুক।

‘তোমার গৃহের দ্রাড়িম্ব বৃক্ষটি এ বৎসর এখনও ফলবতী?’

‘অ্যাঁ?’ পুষ্পকেতুর অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে উল্মুক স্বভাবতঃই বিস্মিত।

‘প্রাতের ফলাহারে দ্রাড়িম্ব ভক্ষণ করেছ, উত্তরীয়ের রক্তচিহ্ন জানান দিচ্ছে সেকথা।’

‘দ্রাড়িম্বই যে জানলে কিরূপে?’

‘তাম্বুলে তোমার রুচি নেই, খয়ের নয় অতএব, জ্যামিতিক হিসাব’, কৌতুক খেলা করে পুষ্পকেতুর চোখে।

‘আরও কিছু বলে নাকি তোমার জ্যামিতি?’

‘জ্যামিতি নয় মিত্র, পর্যবেক্ষণ; কোনও কারণে তুমি আজ বিচলিত। বেশবাসে যত্নের অভাব, সুগন্ধ মাখতে ভুলেছ, তবে কোনও বিপর্যয় ঘটেনি, নতুবা হাস্যপরিহাস করতে না। ঘটনা কি বিবাহসংক্রান্ত?’

‘তুমি কি আজকাল তন্ত্রসাধনা করছ কেতু?’ বিমূঢ় দেখায় উল্মুককে।

‘শশ্রুদেবের আগমন ঘটেছে আজ, সঙ্গে বিস্তর উপঢৌকন। বৈশাখী পূর্ণিমার দিন বিবাহের জন্যে শুভ, জানিয়েছেন জ্যোতিষাচার্য’ প্রিয়সখার সলজ্জ স্বীকারোক্তিতে স্নেহাসিক্ত হয়ে ওঠে পুষ্পকেতুর মুখের ভাব।

***

মহাদণ্ডনায়কের কার্যালয় সকাল থেকেই ব্যস্ততামুখর; পিতার সাথে সভামণ্ডলীতে রয়েছেন পুষ্পকেতুও, আজ সকালে পরিস্থিতি বিশেষ গম্ভীর। গণিকা চারুশীলা এসেছে এক অদ্ভুত অভিযোগ নিয়ে, সঙ্গে নটীশ্রেষ্ঠা মদনপ্রিয়া; সাধারণ নাগরিকা নন এঁরা, সম্মানীয় রাজপুরুষদের কৃপাভোগী, অতএব ঘটনার গুরুত্ব অধিক।

‘শ্রেষ্ঠী পিনাকপাণি আমার গৃহে আসেন বেশ কিছুকাল হল; স্নেহ করেন আমায়; বস্ত্র ব্যাবসায়ী, সম্পন্ন ব্যাক্তি। সম্প্রতি উৎকৃষ্ট রেশমবস্ত্র এসেছে সুদূর প্রাচ্য থেকে, খরিদ করে সরবরাহ করতে চান মগধের বর্ধিষ্ণু জনবসতিগুলিতে জানিয়েছিলেন সেকথা। বস্ত্রসম্ভার মহার্ঘ, অর্থমূল্যে অকুলান ঘটেছিল, আমার গহনাগুলি চেয়েছিলেন সেকারণে কিছুদিনের জন্যে। বন্ধক রেখে মূল্য পরিশোধ করবেন, বাণিজ্যে অচিরেই ফেরত আসবে অর্থ, গহনাও ফেরত দেবেন, সাথে আরও উপঢৌকন’, ধীরে ধীরে নিবেদন করে চারুশীলা।

‘গহনা প্রত্যার্পনের সময় কি ফুরিয়েছে?’ প্রশ্ন করেন দণ্ডনায়ক।

‘না সময় পার হয়নি দেব।’

‘তবে সমস্যা কোথায়?’ চারুশীলা নিরুত্তর, ছলছল আঁখি, উত্তর দেয় মদনপ্রিয়া।

‘শ্রেষ্ঠীর জীবৎকাল ফুরিয়েছে, দশ দিবস পূর্বে অমানিশায় হত হয়েছেন তিনি।’

‘অহোঃ, ব্যাধিগ্রস্ত ছিলেন কি?’

‘না দেব, রাতের অন্ধকারে হিরণ্যবতীর জলে আত্মাহূতি দিয়েছেন শ্রেষ্ঠী।’এখনও সমস্যা কিসে বুঝতে পারেননা দণ্ডনায়ক, সময় দেন নারীদ্বয়কে ব্যাখ্যা করার।

‘শ্রেষ্ঠীপত্নী জানিয়েছেন গহনা বিষয়ে তিনি অবহিত নন’; ‘গৃহে সন্ধান করেও পাওয়া যায়নি একটি গহনাও। শ্রেষ্ঠীপত্নী আমাদের তঞ্চকতার অপবাদ দিচ্ছেন আর্য, বলছেন মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কল্পকথা রচনা করেছি’ কেঁদে ওঠে চারুশীলা।

‘হুমম…বুঝেছি; কোনও প্রত্যক্ষদর্শী ছিল কি গহনা প্রদান কালে?’ হতাশ মুখে অসম্মতি জানায় গণিকা।

‘তোমরা গৃহে যাও চারুশীলে, আমরা অনুসন্ধান করব যথাসাধ্য। যদি সত্য হয় তোমার কাহিনী, ন্যায় থেকে বঞ্চিত হবে না; তবে মিথ্যাচার করে থাকো যদি শাস্তি পেতে হবে মনে রেখো সেকথা।’

‘এবিষয়ে তোমার কি মত পুত্র?’ নারী দুজন প্রস্থান করলে প্রশ্ন করেন বিশাখগুপ্ত।

‘মতামত প্রদানের পূর্বে কিছু অনুসন্ধান প্রয়োজন; আজ্ঞা পেলে চেষ্টা করতে পারি।’

‘এহেন জটিল সমস্যা প্রতিদিন আসেনা, সুবিচারের লক্ষ্যে সাবধানতা প্রার্থনীয়; তোমার বিবেচনার উপর আমি আস্থাশীল কেতু, তুমি তথ্য সংগ্রহ করো, আমি অনুমতি দিলাম।’

শীতকাল সদ্য শেষ হয়েছে, অপরাহ্নের রৌদ্র এখনও মিঠে লাগে; পাটলীপুত্রের প্রাকারের বাইরে এক সম্পন্ন পল্লীতে পিনাকপাণির দ্বিতল গৃহটি ছোট হলেও সুশ্রী। বাড়ীর চারপাশের শ্যামলিমা সযত্ন লালিত, তবে ছায়াঘেরা বাসস্থান এই মুহূর্তে বড় বেশী স্তব্ধ মনে হয়। অশ্বদুটিকে কাছেই একটি বটবৃক্ষে বেঁধে, বেড়ার দরজা খুলে উঠোনে প্রবেশ করেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক। বন্ধুর কাছে অভিনব গণিকা কাহিনী শুনে আকৃষ্ট হয়েছেন উল্মুক, তথ্যসন্ধানে পুষ্পকেতুর সঙ্গী হয়েছেন তাই।

‘গৃহে আছেন কেউ? আমরা মহাদণ্ডকারিকের কার্যালয় থেকে এসেছি, শ্রেষ্ঠানীর সাথে দেখা করতে চাই’ হাঁক দেন পুষ্পকেতু। খুলে যায় ঘরের দরজা, নিঃশব্দে অলিন্দে এসে দাঁড়ায় এক রমণী, মোটা কাপাস বস্ত্রে সর্বাঙ্গ আবৃত; শ্রেষ্ঠানীর বয়স কম, শোকে তাপে শুকনো মুখখানি, তবু তার সুশ্রিতা চোখে পড়ে।

‘গৃহমধ্যে আমি একা, তাই আপনাদের অন্দরে আপ্যায়নে অক্ষম, দয়া করে এস্থানেই আসন গ্রহণ করুন’; দুখানি বেত্রাসন বিছিয়ে বলে ওঠে সে।

‘আত্মীয় কেউ সাথে নেই আপনার’?

‘স্বামী বাল্যকালেই অনাথ, অন্যের গৃহে বড় হয়েছেন; আত্মীয় পাই কোথায়?’

‘পিতৃকুলের কেউ আসেননি! এ অবস্থায় সম্পূর্ণ একা থাকা সহজ তো নয়’ পুষ্পকেতুর কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ ফুটে ওঠে।

‘আমার পিত্রালয় উজ্জয়িনী, পাটলীপুত্রে কেউ নেই; আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না দেব, একটি দাসী রাত্রে সঙ্গে থাকে।’

‘অহোঃ, উত্তম। প্রথমেই আমাদের আগমনের কারণটি আপনাকে জানাই; চারুশীলা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে গহনা আত্মসাতের, সে বিষয়ে কয়েকটি তথ্য জানতে চাই।’

‘অনুমান করেছিলাম কতক এরকমই; আপনি প্রশ্ন করুন’; শ্রেষ্ঠানির চেহারায় দৃঢ়তা ফুটে ওঠে।

‘যে রাতে শ্রেষ্ঠী হত হন সেই রাত্রির ঘটনা জানতে চাই, নদীতটে যাবার কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল কি?’

‘উনি প্রতিদিনের মতই অপরাহ্নে বন্দর-সংলগ্ন আড়ঙ্গে গিয়েছিলেন, ফিরতে বিলম্ব দেখে পল্লী প্রধানকে সংবাদ পাঠাই। তিনি সেখানে গিয়ে জানতে পারেন স্বামী গৃহের পথে রওয়ানা হয়েছেন। পরে জঙ্গল ও নদীতটে সন্ধান করতে গিয়ে ওঁর উত্তরীয়, উষ্ণীষ ও পাদুকা জোড়া খুঁজে পান নদীর এক খাড়াইয়ে।’

‘দেহ পাওয়া যায়নি?’

‘গিয়েছিল বোধকরি তিনদিন পরে, আমাকে দেখতে দেননি পল্লীপ্রধান।’ সদ্যবিধবার দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস।

‘আমাদের মার্জনা করবেন’ বিব্রত দেখায় তরুণদ্বয়কে। একটু সময় নিয়ে আবার শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘শ্রেষ্ঠী সম্প্রতি যে চৈনিক রেশমের বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু তথ্য জানার ছিল।’

‘শ্রেষ্ঠী কোনও রেশম-পণ্য খরিদ করেননি, ওঁর লেনদেন কাপাস ও মসলিন বস্ত্রের।’

‘সম্প্রতি ব্যবসায় বৃদ্ধিতে মনযোগী হননি তিনি?’

‘ব্যবসায়ে চূড়ান্ত অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন গত ছয়মাসকাল যাবৎ।’

‘বিষয়টি একটু বিশদে বর্ণনা করুন ভদ্রে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে সব কথা জানা দরকার’ পুষ্পকেতুর কপালে চিন্তারেখা ফুটে ওঠে।

শ্রেষ্ঠানী বল্লরিকা সময় নেয় কিছুটা, অতঃপর ধীরে ধীরে যা ব্যক্ত করে তা এইপ্রকার। পিনাকপাণি কিশোর বয়সে পিতা মাতাকে হারিয়ে এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় গৃহে আশ্রয় পান; পিতৃব্যতুল্য গৃহস্বামী পেশায় বস্ত্রব্যবসায়ী। তাঁর বিপণিতে সহায়কের কর্ম করতেন পিনাকপাণি, সেখানেই পরিচয় উজ্জয়িনীর বস্ত্র কারবারী সমরদত্তের সাথে। মধ্যবয়স্ক সম্পন্ন শ্রেষ্ঠীর ভালো লাগে কর্মদ্যোগী তরুণকে, সঙ্গে নিয়ে যেতে চান উজ্জয়িনীতে, রাজী না হওয়ায় তাকে পাটলীপুত্রে নিজস্ব প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। কালক্রমে, নিজকন্যার সাথে বিবাহ দেন পিনাকপাণির; বসতবাটি ও স্বাধীন ব্যাবসায়ের অর্থপুঁজি সেও শ্রেষ্ঠী সমরদত্তের বদান্যতায়। বিবাহের বেশ কয়েক বৎসর অতিক্রান্ত, মাঝে দুটি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে বল্লরিকা এখনও নিঃসন্তান।

‘শ্রেষ্ঠী দ্বিতীয়বার বিবাহের উদ্যোগ নেননি?’ জানতে চান পুষ্পকেতু।

‘পত্নীধনে বিত্তবান স্বামী, সপত্নী আনলে সম্মার্জনী প্রহারে গৃহছাড়া করতাম দুজনকে’; শ্রেষ্ঠানীর স্বভাবের প্রখরতা প্রকাশ পায় মুহূর্তেই; পুষ্পকেতু ও উল্মুক দৃষ্টি বিনিময় করেন অলক্ষ্যে।

‘ব্যবসায়ে অমনোযোগী হবার বিশেষ কোনও কারণ ছিল কি? কোনও দুশ্চিন্তা বা রোগব্যাধি’?

‘ব্যাধি তো বটেই, চারুশীলা ব্যাধি জুটেছিল যে শ্রেষ্ঠীর; আপনাদের প্রশ্ন শেষ হয়ে থাকলে আমি অন্দরে যাব, বেলা পড়ে এলো।’ দুই রাজপুরুষকে বিদায় করে বল্লরিকা প্রবল ঝঙ্কারে।

***

‘শ্রেষ্ঠানি যতটা রমণীয়, ততটা কমনীয় নন, কি বল হে?’ উল্মুক মন্তব্য করেন পথে।

‘তা বটে, তবে সমস্যা জটিলতর হয়ে উঠেছে। দিবালোক থাকতে থাকতে চল একবার পল্লীপ্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করে আসি।’

কতগুলি ক্রীড়ারত বালকের থেকে পথনির্দেশ নিয়ে পৌঁছে যান দুজনে পল্লীপ্রধান বিষ্ণুদত্তের গৃহে; ভাগ্যক্রমে গৃহস্বামী বাটিতেই ছিলেন, অতএব সাক্ষাৎ মেলে। বিষ্ণুদত্ত প্রৌঢ় তবে সুস্বাস্থের অধিকারি; সম্পন্ন গৃহস্থ। বংশ পরম্পরায় গন্ধদ্রব্যের কারবার, পুত্রেরাই ব্যবসায় তত্বাবধান করে আজকাল, তিনি পল্লীসমিতির প্রধান হিসাবে সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত রাখেন নিজেকে। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের শেষে কথাবার্তা শুরু হয়।

‘দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ঠিক কি ঘটেছিল যদি বর্ণনা করেন।’

‘তখন সায়াহ্ন গত, রাত্রি প্রগাঢ়-প্রায়; গৃহের পুরুষদের আহার সম্পন্ন হয়েছে। পিনাকপাণির প্রতিবেশী-পুত্র এসে খবর দিল সে গৃহে ফেরেনি, শ্রেষ্ঠানী অতীব চিন্তিতা। অগত্যা আমি দুটি ভৃত্য ও আমার কনিষ্ঠপুত্রকে সাথে নিয়ে আড়ঙ্গে যাই। সেখানে গিয়ে শুনি, পিনাকপাণি সময়ের পূর্বেই ভাণ্ডারগৃহ থেকে বাহির হয়েছেন। অগত্যা আশেপাশের জায়াগাগুলি খুঁজে দেখি, এদিকে রাত্রি গভীর হয়ে এসেছে, বাধ্য হয়ে গৃহে ফিরি।’

‘সেকি আপনারা নদীতটে সন্ধান করেননি সেরাত্রে?’

‘না করিনি, সে চিন্তা মনে আসেনি। শ্রেষ্ঠীর গনিকাগৃহে যাতায়াত আছে, তাই সেই সম্ভবনাই প্রবল মনে হয়েছিল; শ্রেষ্ঠানিও সেরকমই কতক সন্দেহ করেছিলেন।’

‘হুমম…. নদীতটে সন্ধান করলেন কবে?’

‘পরদিন দিবাকালে। আসলে, সেদিন প্রাতে শ্রেষ্ঠানির প্ররোচনায় আমার একটি ভৃত্যকে পাঠাই গণিকালয়ে। সে ফিরে খবর দেয় গণিকা অস্বীকার করেছে শ্রেষ্ঠীর উপস্থিতি। বল্লরিকা মানতে নারাজ, তিনি নিজে সে স্থানে যেতে উদ্যোগী দেখে আমিই বলি আগে চারপাশ খুঁজে দেখা কর্তব্য। বহির্প্রান্তরের বনভূমি ও নদীতটে লোক পাঠাই, তারা এসে খবর দেয় খাড়াইয়ের এক বিপজ্জনক স্থানে একটি উষ্ণীষ, উত্তরীয় ও একজোড়া পাদুকা পড়ে আছে, মনে হয় যেন নদীজলে লম্ফনের পূর্বে পরিত্যক্ত হয়েছে। সম্ভবনার কথা চিন্তা করে শ্রেষ্ঠানিকে দেখানো হয় সেসব, তিনি শনাক্ত করেন ওগুলি তাঁর স্বামীর ব্যবহৃত সামগ্রী হিসাবে।’

‘মৃতদেহ সন্ধানের প্রচেষ্টা করেননি?’

‘করেছিলাম, আশেপাশের গ্রামগুলিতে খবর পাঠিয়ে, নদীতে জাল ফেলে, তিনদিন যাবৎ কোনও চেষ্টাই বাদ রাখিনি। নিকটেই গঙ্গা ও হিরণ্যপ্রভার সঙ্গমস্থল, খাড়াইয়ের বাঁকে নদী ভীষণা, তার উপর অমাবস্যার রাত্রি, স্রোতে ভেসে গঙ্গায় গিয়ে পড়ে থাকলে পাবার আশা থাকে না। তবু, তৃতীয় দিবসে সংবাদ আসে মহুলীগ্রাম থেকে, দুটি শব ভেসে এসেছে নদীপথে। দেখে চেনা অসম্ভব, তবে একটির অঙ্গের কর্ণকুণ্ডল ও হস্ত বলয় দেখে সম্পন্ন ব্যক্তি বলে মনে করে গ্রামবাসীরা। পরে আভরণগুলি স্বামীর বলেই চিহ্নিত করেন বল্লরিকা।’একটি ক্ষুদ্র দীর্ঘশ্বাসের সাথে বর্ণনা সমাপ্ত করেন বিষ্ণুদত্ত।

‘আপনার ভৃত্যটি, যে গণিকালয়ে শ্রেষ্ঠীর খোঁজে গিয়েছিল, তার সাথে বাক্যালাপ করা সম্ভব কি?’ কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন থেকে জিজ্ঞাসা করেন পুষ্পকেতু।

‘অবশ্য, সে আমার ব্যাক্তিগত অনুচর। সুপর্ণ! সুপর্ণ!’ হাঁক দেন পল্লীপ্রধান।

‘গণিকালয়ে সেদিনকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা কর, ভীত হয়ো না, তোমার ক্ষতির কোনও আশঙ্কা নেই’, প্রয়োজনীয় আশ্বাস প্রদান করে সূপর্ণকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘তখন প্রাতঃকাল, গণিকালয়ের দু একটি দাসী ভিন্ন সকলেই নিদ্রামগ্ন। তাদেরই একজন চারুশীলার দাসীটিকে ডেকে দেয়। তাকে শ্রেষ্ঠীর কথা জিজ্ঞাসা করায় সে জানায় বিগত সন্ধ্যায় তিনি গিয়েছিলেন সেখানে, কিন্তু এখনও অন্দরে আছেন কিনা সে জানেনা। আমি কাকুতি মিনতি করায়, সে চারুশীলাকে খবর দেয়। অসময়ে নিদ্রাভঙ্গে গণিকা কুপিতা ছিলেন, নিজকক্ষের অলিন্দ থেকে আমাকে ভালমন্দ বলে বিদায় দেন; সঙ্গে একথাও জানান যে শ্রেষ্ঠী সেখানে নেই।’

‘বেশ, তুমি এখন আসতে পারো।’এরপর ধন্যবাদ জ্ঞাপনান্তে বিষ্ণুদত্তের গৃহ থেকে বিদায় নেন দুই মিত্র।

‘কি বুঝলে হে?’ উল্মুক জানতে চান ফেরার পথে।

‘আগে বল তুমি কি বুঝলে?’ প্রতিপ্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘কি জানি ভাই, গৃহস্বামিনীর প্রখরতার যে আঁচ পেলাম আজ, দেহত্যাগী না হোক গৃহত্যাগী হবার ইচ্ছা জাগরুক হওয়া অসম্ভব নয়।’

‘কিন্তু রসময়ী প্রণয়িনী? সেদিকটা ভেবেছ কি?’

‘না তা ভাবিনি, অত ভাবতে পারলে কি আর পুস্তপালের নীরস দপ্তরে যৌবন পাত করি?’ নির্মল রসিকতায় লঘু হয় গম্ভীর আলোচনা, হেসে ওঠেন দুজনেই।

‘কাল একবার গণিকালয়ে যাওয়া প্রয়োজন, সঙ্গী হতে চাও কি?’ আহারান্তে প্রসঙ্গ তোলেন কেতু। বন্ধুগৃহে রাত্রিযাপনের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন উল্মুক; যদিও উপলক্ষ তাঁর আশু বিবাহের আনন্দ উদযাপন, আসল উদ্দেশ্য ছিল রহস্যানুসন্ধানের বৃত্তকেন্দ্রে থাকা।

‘গণিকালয়ে!’ বন্ধুর প্রস্তাবে আতঙ্কিত দেখায় উল্মুককে।

‘তুমি যাবে না কি সেখানে? মানে, চারুশীলাকেই কার্যালয়ে আনয়ন করালে হতো না?’

‘না হে আমার প্রয়োজন শুধু চারুশীলার সাথে নয়, আমাকে যেতেই হবে। তবে তুমি যদি চম্পাবতীর কোপাগ্নির ভয়ে অরাজী থাকো, না হয় নাই গেলে’; কটাক্ষটি লক্ষভেদে সক্ষম হয়।

‘চম্পাবতীর তোয়াক্কা কে করে, চলো কালই যাওয়া যাক!’ রীতিমত উৎসাহিত শোনায় উল্মুকের কণ্ঠস্বর।

***

গণিকালয়টি পাটলীপুত্রের প্রাকারসীমার ভিতর হলেও নগরীর একপ্রান্তে। রাজপথের পাশেই একটি দ্বিতল অট্টালিকা, প্রধান দ্বারপথে সশস্ত্র দৌবারিক। প্রবেশদ্বার দিয়ে অন্দরে প্রবেশ করে একটি চতুষ্কোন অঙ্গন, তার চারিপাশ ঘিরে অট্টালিকার বিভিন্ন ভবন। একেকটিতে বাস করে একেকজন গণিকা নিজস্ব দাসী সহ। নটী মদনপ্রিয়া এখানকার প্রধানা, বাস করে বাটীর ভিতরভাগে একটি স্বতন্ত্র ভবনে, সুবিশাল দাসীবাহিনী তার। অঙ্গনের একপাশে প্রশস্ত নৃত্যমণ্ডপ, কারুকার্যময় তার চন্দ্রাতপ ও স্তম্ভসারি। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে সেখানে নৃত্যপরিবেশন করে মদনপ্রিয়া, অন্যসময়ে নৃত্যশিক্ষা চলে নবীনাদের। অট্টালিকার পশ্চাদ্ভাগে একটি অপ্ররিসর দ্বার, মূলতঃ শৌচকর্মীদের যাতায়াতের জন্য; তার বাইরে কিছুটা উদ্যান, আম্র ও পনস বৃক্ষের ছায়াসন্নিবিষ্ট। আগে থেকে সংবাদ পাঠিয়ে গণিকালয়ে উপস্থিত হন পুষ্পকেতু ও উল্মুক, সঙ্গে আসা সহচরদের বাইরে রেখে আপাতত তাঁরা মদনপ্রিয়ার অতিথিশালায় অপেক্ষমান।

‘বাইরে বসন্ত মলয়, কোকিলার কুজনে কান পাতা দায়, কামদেব এসেছেন মদনপ্রিয়ার কুঞ্জে; কি সেবা করতে পারি দেব?’ কক্ষে প্রবেশ করে নটী, তার অধরে কৌতুক হাসি, কাজলনয়নে বিদ্যুৎ। পুষ্পকেতুর কর্নমূল রাঙা হয়, অস্বাচ্ছন্দ্য ফুটে ওঠে মুখের ভাবে।

‘আমরা রাজকার্যে এসেছি, রসনা সম্বরন কর নটী’ উল্মুক উদ্যোগী হন বন্ধুকে সাহায্য করতে।

‘দেব কি কুপিত হচ্ছেন? দাসীর তবে মরণ ছাড়া গতি নেই’ উল্মুককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মদনপ্রিয়া।

‘চারুশীলার দাসীটির সাথে কিছু প্রয়োজন ছিল’, এতক্ষণে নিজস্ব দৃঢ়তায় বলে ওঠেন পুষ্পকেতু।

‘সেকি আমরা সকলে থাকতে শেষে চারুশীলার দাসী?’ মুচকি হেসে নিকটবর্তী অনুচরীকে নির্দেশ দেয় মদনপ্রিয়া দাসীটিকে ডেকে আনতে।

‘বার্তালাপ নির্জনে হওয়া প্রয়োজন।’

‘সে তো অবশ্য, আমরা বিদায় নিচ্ছি, তবে স্মরণ করলেই দেখা পাবেন’; পরিহাসের বাণে বিদ্ধ করে বিদায় নেয় মদনপ্রিয়া। কপালের স্বেদবিন্দু মোছেন পুষ্পকেতু, বন্ধুর বিপর্যয়ে চকিত হাসি দেখা দেয় উল্মুকের ঠোঁটে।

চারুশীলার দাসী উপলার বয়স অল্প, দেখলে বোধ হয় মস্তিষ্কে বুদ্ধিও অল্পই, কোনও প্রশ্নের উত্তরই সে নিশ্চিত করে দিতে পারে না।

‘শ্রেষ্ঠী পিনাকপাণি কতদিন হল যাতায়াত করতেন এখানে?’

‘সে অনেকদিন।’

‘অনেকদিন মানে কতদিন, ভেবে বল; অনেক বৎসর, না মাস?’

এরপর বহু চেষ্টায় তার কাছ থেকে যা জানা গেলো তা হল এই;-

গত শ্রাবণ পূর্ণিমার উৎসবে পণ্যবিথীর মেলায় গিয়েছিল চারুশীলা উপলাকে সঙ্গী করে, ফেরার পথে শকটের চাকা পথের পাশে পাঁকে আটকে যায়, চালক সাহায্যের আশায় নিকটস্থ পল্লীর দিকে যায় নারীদুজনকে যানমধ্যে বসিয়ে রেখে; এদিকে বলীবর্দ দুটি দুর্বার হয়ে ওঠে আচমকা, উপলা ভীত হয়ে চিৎকার শুরু করে, চারুশীলার অবস্থাও অজ্ঞানবৎ। সেসময় পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন পিনাকপাণি, তিনি সক্রিয় হয়ে বলীবর্দ দুটিকে শান্ত করেন, জল ছিটিয়ে চারুশীলার জ্ঞান ফেরান; ইতিমধ্যে শকট চালক ফিরে আসায় তিরস্কার করেন তাকে নারীদের একেলা ফেলে যাবার কারণে। কৃতজ্ঞ চারুশীলা শ্রেষ্ঠীকে নিজ গৃহে নিমন্ত্রণ করে, শ্রেষ্ঠী সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন সে প্রস্তাব। এরপরে, বিপণিতে বারম্বার অনুচর পাঠিয়ে চারুশীলা আকর্ষণ করে শ্রেষ্ঠীকে এবং কালক্রমে তিনি যাতায়াত শুরু করেন তার ভবনে।

‘এ তো রীতিমত কাব্যকাহিনী হে, শ্রেষ্ঠীর ভাগ্যকে ঈর্ষা হয়’, উল্মুক জনান্তিকে মন্তব্য করেন।

‘শ্রেষ্ঠীর পরিণতিকেও ঈর্ষা কর কি?’ পুষ্পকেতুর উত্তরে উল্মুক নিশ্চুপ।

‘যে রাত্রে শ্রেষ্ঠী নিরুদ্দিষ্ট হন, এসেছিলেন কি তোমার ভর্তিনির কাছে?’

‘এসেছিলেন প্রভু, স্বায়ংকালে এসেছিলেন, যেমন প্রায়ই আসতেন।’

‘কখন ফিরে যান মনে আছে?’

‘কি জানি,বলতে পারিনা; ভর্তিনি জানেন।’

‘ভর্তিনিকে ভয় পেয়োনা, তোমার কোনও কথাই তিনি জানবেন না। বরং রাজকর্মচারীর কাছে সত্য গোপনে দুর্ভোগ, ভেবে বল।’উপলা সময় নেয় কিছু, তার চোখে মুখে দ্বিধা স্পষ্ট।

‘শ্রেষ্ঠী আসায় আমি তাম্বুল করঙ্ক নিয়ে উপস্থিত হই ভর্তিনির শয়নকক্ষে, কিছু বিষয়ে কলহের উপক্রম হয়েছিল দুজনায়, আমাকে দেখে থেমে যায়; রাত্রে আমাকে প্রয়োজন নেই একথা জানান ভর্তিনি তখন, আর সেইমত স্থান ত্যাগ করি আমি।’উপলাকে দেখে মনে হয় আরও কিছু বলতে চায় সে, সঙ্কোচ বশতঃ বলতে বাধছে।

‘তোমার ধারণা সেইরাত্রে শ্রেষ্ঠী গণিকালয় ত্যাগ করেননি তাই তো?’

‘না মানে, রাতের দৌবারিক পরাশর বড় ভালো বাঁশী বাজায়, আমি দীর্ঘক্ষণ প্রবেশ দ্বারের নিকটস্থ বিশ্রাম কুঠুরীতে বসে তাই শুনছিলাম, সেরাত্রে শ্রেষ্ঠীকে বিদায় নিতে দেখিনি।’

‘তোমার অকপট ভাষণে আমরা প্রীত হয়েছি, এখন তোমার ভর্তিনির সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই, তাঁকে গিয়ে জানাও’, পুষ্পকেতুর প্রশংসাবাক্যে উচ্ছ্বসিত উপলা ছুটে যায় চারুশীলাকে সংবাদ দিতে।

চারুশীলার ভবনের বহির্কুঠুরিটি অতিথি সম্ভাষণের স্থান, কক্ষের রুচিশীল সাজসজ্জা দেখে বোধ হয় অনেক মানী ব্যাক্তির আগমন হয় সেখানে; চারুশীলা অবস্থাপন্যা বলাই বাহুল্য।

‘শ্রেষ্ঠী কি পূর্বাহ্নে জানিয়েছিলেন আসবেন সেদিন?’

‘আপনি কোনদিনের কথা বলছেন?’ চারুশীলা অকপট ভাষণে আগ্রহী নয় বুঝে নেন পুষ্পকেতু।

‘যেদিন শ্রেষ্ঠী নিরুদ্দিষ্ট হন সেই রাত্রির কথা।’

‘সেদিন শ্রেষ্ঠী আসেননি এখানে, প্রতিদিন আসতেন না তিনি।’

‘অযথা মিথ্যালাপে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী, সত্য ভাষণ কর চারুশীলা’ কঠিন শোনায় পুষ্পকেতুর কণ্ঠস্বর; ‘কলহের কারণই বা কি ছিল সেই সন্ধ্যায়?’ স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ গণিকা, তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দেয়।

‘আচমকাই এসেছিলেন সেদিন শ্রেষ্ঠী, এদিকে প্রখ্যাত জহুরী গোকুলস্বামী আসবেন সংবাদ পাঠিয়েছিলেন অপরাহ্নেই। সেকথা জানাতে ক্ষুব্ধ হন পিনাকপাণি, গোকুলস্বামী আমার দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষক, তাঁকে অগ্রাহ্য করি কীরূপে।’

‘পিনাকপাণি রাত্রিযাপন করেননি এখানে?’

‘বিশ্বাস রাখুন দেব, শ্রেষ্ঠীকে কিছুপরে শান্ত করে ফেরত পাঠাই আমি; শুধু সেদিন কেন, এখানে কোনওদিন রাত্রিযাপন করেননি তিনি।’

‘প্রবেশপথের প্রহরায় ছিল যে দ্বারী সে তো দেখেনি, শ্রেষ্ঠী কি আকাশপথে গমন করেছিলেন?’

‘গোকুলস্বামীর সাথে সাক্ষাৎ এড়াতে তিনি খিড়কির দ্বার দিয়ে উদ্যান হয়ে বেরিয়ে যান। দ্বারী কেমন করে জানবে সেকথা।’

‘আমি যদি বলি, রাত্রিভর তোমার কলহগঞ্জনায় উত্যক্ত হয়ে তিনি ভোররাত্রে নদীতে আত্মাহূতি দিয়েছেন?’

‘না না এ মিথ্যা, গঞ্জনা কেন দেব,আমার সর্বস্ব দিয়েছিলাম তাঁর হাতে, সারাজীবনের সঞ্চয় গহনা, জহরাত।’

‘সেও তো তোমার মুখের কথা।’

‘একথা বলবেন না দেব’, ডুকরে ওঠে চারুশীলা।

‘আমি কিছুই বলতে চাই না, তবে আপাততঃ গহনার বিবরণ সহ একটি তালিকা রচে পাঠিয়ে দিও আমাদের কার্যালয়ে।’এরপর বিদায় নেন দুই বন্ধু, স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে চারুশীলা বহুক্ষণ।

ইতিমধ্যে কর্মচারী পাঠিয়ে তন্ন তন্ন করে সন্ধান করা হয় পিনাকপাণির গৃহ; উদ্যানের মৃত্তিকা, শয়নকক্ষের ভূমিতল কিছুই বাদ থাকে না; শ্রেষ্ঠানী সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেন, ‘খুঁজে দেখুন ভালো করে, চারুশীলার গহনা চুরির অপবাদের থেকে মৃত্যুও ভাল’ এই ছিল তার বক্তব্য। আড়ঙ্গে শ্রেষ্ঠীর কর্মচারীকে প্রশ্ন করে জানা যায় তিনি এযাবৎ পণ্যসংগ্রহে আগ্রহী ছিলেননা তেমন, ভাণ্ডারে পণ্য অতি অল্পই রয়ে গিয়েছিল। নদীবন্দরে আগত আকর্ষনীয় মূল্যের উত্তম মসলিন উপেক্ষা করেছিলেন মাত্র কয়েকদিন পূর্বে।

‘সংসার থেকে মন উঠেছিল প্রভুর, হয়তো অর্থাভাবও ঘটেছিল’, চোখ মোছে পুরোনো কর্মচারী।

নগরীর পণ্যবীথিতে শ্রেষ্ঠীর বিপণীটি জনপ্রিয়, সেখানের তিনটি কর্মচারী, সর্বকনিষ্ঠটি বয়সে তরুণ। জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে চারুশীলার অনুচর প্রায়ই আসত বিপণিতে। শ্রেষ্ঠীর উপরোধে সে নিজেও গিয়েছে কয়েকবার গণিকালয়ে তাঁর বার্তা নিয়ে।

 পিণাকপাণির মিত্র সম্পাতি নিজেও বস্ত্র ব্যবসায়ী, নগরীমধ্যে দুখানি কর্মব্যাস্ত বিপণী তাঁর, বন্দর সংলগ্ন আড়ঙ্গে সুবিশাল ভাণ্ডারগৃহ।

‘পিনাকপাণি চৈনিক বস্ত্র সংগ্রহে আগ্রহী ছিল শুনিনি তো? হ্যাঁ কিছুকাল পূর্বে দুটি বাণিজ্যতরী এসেছিল বটে অঙ্গ থেকে উৎকৃষ্ট রেশমপণ্য নিয়ে‘, জানান তিনি।

‘তবে মনকষ্টে ছিল মিত্র আমার, দুই রমণীর প্রেমসঙ্ঘাতে জীবন বিষময় ছিল তার; সবই কর্মফল’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সম্পাতি। নগরীর স্বর্ণকার সমিতির মাধ্যমে অনুসন্ধান করে জানা যায় শ্রেষ্ঠী কোনও গহনা বন্ধক রাখেননি কোনও স্বর্ণব্যবসায়ী বা মণিকারের কাছে।

‘তোমার কি মনে হয় চারুশীলা মিথ্যাচার করছে?’ অপরাহ্নে গৃহের একান্তে প্রশ্ন করেন বন্ধুকে উল্মুক।

‘সে সম্ভবনাই তো প্রবল, নয় কি?’

‘আচ্ছা, বল্লরিকা গহনা সরিয়ে ফেলেনি তো কোথাও? মানে ধর শ্রেষ্ঠী গহনা গৃহে আনলেন বন্ধক দেবার উদ্দেশ্যে, জানতে পেরে ঈর্ষাকাতর পত্নী সরিয়ে দিল গহনা। ক্ষোভে, লজ্জায় আত্মাহুতি দিলেন পিনাকপাণি।’

‘শ্রেষ্ঠীপত্নীকে বড়ই বিষচক্ষে দেখেছ হে তুমি’ হেসে বলেন পুষ্পকেতু।

‘কেন এ যুক্তি কি এতই অসম্ভব?’

‘অসম্ভব কি না জানি না তবে দুঃসাধ্য তো বটেই। বল্লরিকার পরিজন কেউ নেই এ নগরে, গহনা সরিয়ে রাখবে কোথায়?’

‘ধর যদি নদীতে বিসর্জন দিয়ে থাকে?’

‘বিবাহ করতে চলেছ, নারী চরিত্র এখনও বুঝলে না। ঈর্ষা যতই প্রবল হোক, ওই মূল্যবান রত্ন আভুষন নদীবক্ষে নিক্ষেপ করবে না বল্লরিকা। গহনা নিজেরই হোক বা অপরের, তা জলে ভাসিয়ে দেওয়া যে কোনও রমণীর কল্পনার অতীত।’

‘তবে তোমার কি মত?’

‘মত প্রকাশের সময় এখনও আসেনি হে, তবে একটি বিষয়ে সংশয় রয়েছে, শ্রেষ্ঠী পাদুকা জোড়া খুলে রেখে কেন লাফ দিলেন জলে?’

‘মানে?’

‘না, উষ্ণীষ ও উত্তরীয় লাফানোর সময় খুলে গিয়ে থাকবে, কিন্তু পাদুকাজোড়া সযত্নে ছেড়ে যাবেন কেন?’

‘কেতু তোমার মস্তিষ্ক গরম হয়েছে; লাফানোর সময় পাদুকাও খুলে যেতে পারে।’

‘না লাফানোর সময় খুলে গেলে, চর্মপাদুকা নদীজলে পড়ত, নদীতটে নয়।’

‘কি জানি হে, হয়তো বৈতরণী সাঁতারে বাধা হত তাই পদুকা ত্যাগ করেছিলেন শ্রেষ্ঠী।’

‘পুস্তপালের দপ্তরই তোমার উপযুক্ত স্থান’ হেসে ওঠেন দুই তরুণ।

‘ভদ্রা বল্লরিকা বাসস্থান ও বিপনী বিক্রয় করেছেন শ্রেষ্ঠী সম্পাতির কাছে, স্বজনহীন পাটলীপুত্রে থাকতে চাননা আর। সংবাদ পাঠিয়েছিলেন পিতৃগৃহে, কনিষ্ঠভ্রাতা এসে পরবেন দুএক দিবসে, তার সাথেই উজ্জয়িনী পাড়ি দেবেন তিনি’, রাজকর্মচারী এসে সংবাদ দেয়। এরমধ্যে কেটে গেছে মাসাধিককাল, সমাধান মেলেনি গহনা রহস্যের।

‘এ অবস্থায় শ্রেষ্ঠী পত্নীকে আটকানো আইনসম্মত তো নয়ই, মানবিকও নয়’ মহাদণ্ডনায়ক মতামত দেন আলোচনা সভায়।

‘তাছাড়া কুমার জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে চারুশীলাও গহনা বিষয়ে কিছু গোল করেনি; মিথ্যাচার ধরা পড়েছে বুঝেছে সে বিলক্ষণ’, মন্তব্য করেন আর এক সভা সদস্য।

‘রাজকার্যে শ্রেষ্ঠী পত্নীর পীড়ন হয়েছে যথেষ্ট, বিদায়কালে একবার সাক্ষাৎ করা উচিত’, পুষ্পকেতু বলে ওঠেন। বিশাখগুপ্তের দৃষ্টিতে নীরব প্রশংসা ফুটে ওঠে মানবদরদী পুত্রের প্রতি।

‘চলে যাওয়াই মনস্থ করলেন শেষ পর্যন্ত?’ বল্লরিকার গৃহঅলিন্দে বসে কথপোকথন চলছে।

‘কিসের আশে পড়ে থাকি বলুন? তাছাড়া ব্যবসায় চালানো রমণীর কর্ম নয়, কর্জও ছিল কিছু শ্রেষ্ঠীর। তাই সম্পত্তি বিক্রয় করে কর্জমুক্ত হয়ে এবার চলে যাব স্থির করেছি।’

‘আপাততঃ সম্পত্তি গচ্ছিত রেখে যাওয়া চলত না কি? আপনার পিতা বিচক্ষণ ব্যাক্তি, পরে তাঁর পরামর্শ নিয়ে বিক্রয় করতেন।’

‘পিতা গত হয়েছেন দুইবৎসর হল, ভ্রাতাদের অত সময় কোথা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বল্লরিকা।

‘বেশ, আসি তবে, উপদ্রব যা করেছি সে কর্তব্যের তাগিদে, মার্জনা করবেন ভদ্রে।’এরপর বিদায় নেন পুষ্পকেতু।

***

‘চম্পাবতীর বিরহে অনিদ্রা হয়ে থাকে যদি, রাত্রিযাপনের নিমন্ত্রণ রইল আজ’, লিপিখানি পেয়ে হাসির ঝিলিক জাগে উল্মুকের চোখে।

রাত্রি তৃতীয়প্রহর, শুক্লপক্ষের নাতি উজ্জ্বল চন্দ্রমায় আবছায়া চারিদিক। ভৃত্য এসে পুষ্পকেতুর শয়নগৃহের কপাটে আঘাত করে, ‘ভদ্র ধর্মদাস দর্শনপ্রার্থী প্রভু।’

‘আসুন ভদ্র, সংবাদ শুভ তো?’ পুষ্পকেতু শয্যা ত্যাগ করেন নিমেষে, সেইসাথে জাগিয়ে দেন উল্মুককেও।

‘সংবাদ আশাপ্রদ, কুমার সঙ্গী হবেন কি?’

‘অবশ্য।’এরপর, দ্রুতগামী অশ্বে ঝড়ের বেগে অদৃশ্য হন তিন রাজপুরুষ আধো অন্ধকারে।

প্রাক-ঊষার ব্রহ্মমূহুর্ত্তে ঘুমন্ত পল্লী, অশ্বগুলিকে কিছুটা দূরত্বে বেঁধে রেখে সাবধানে এগিয়ে চলেন তিনজন। অন্ধকার গৃহ সাড়াশব্দহীন। শুধু অতিমৃদু পায়ের শব্দ ধ্বনিত হয় অঙ্গনে ঝরে থাকা শুষ্ক পত্রে; একটি মাত্র দীপের আলোয় এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে বহির্দ্বারের দিকে। দ্বারের সামনে অপেক্ষমান একটি গোশকট, তাতে কয়েকটি পেটিকা।

‘এতরাত্রে বহির্প্রকৃতি নিরাপদ নয় ভদ্রে’ নিস্তব্ধ রাত্রিতে পুষ্পকেতুর কণ্ঠস্বর বজ্রসম ধ্বনিত হয়। চমকে ওঠে ছায়াখানি, দীপের আলোয় প্রতিভাত হয় বল্লরিকার রক্তশূন্য মুখচ্ছবি।

‘আপনি এখানে কেন দেব?’ মৃদু স্বরে বলে ওঠে সে।

‘বিদায় জানাতে এসেছি মনে করুন’, মৃদু হেসে বলেন পুষ্পকেতু।

‘একাই চলেছেন না ভ্রাতা সঙ্গে আছেন?’ বল্লরিকা দৃষ্টিপাত করে শকটের পানে। চালকের স্থানে বসে এক বলিষ্ঠ পুরুষ, উষ্ণীষের কাপড়ে ঢাকা মুখ, একটি কালো কম্বলে সর্বাঙ্গ আবৃত। পুষ্পকেতুর নির্দেশে অপসারিত হয় পুরুষের উষ্ণীষ, মশালের আলোয় জিঘাংসাময় দেখায় তার আপাত সুশ্রী মুখমণ্ডল।

পুষ্পকেতু চালকের পাশে রাখা একটি কাপড়ে ঢাকা পেটিকা তুলে নিয়ে এগিয়ে দেন ধর্মদাসের দিকে, ‘ভদ্র, চারুশীলার তালিকা অনুযায়ী মিলিয়ে নেবেন গহনা গুলি। বোধ হয় সবকটিই আছে।’

‘স্বামী!’ ডুকরে কেঁদে উঠে ভুমিতে লুটিয়ে পরে বল্লরিকা অসহায় ক্ষোভে।

***

মহাদণ্ডনায়কের কার্যালয়, সভামণ্ডলীর সকলেই উপস্থিত, উল্মুকও যোগ দিয়েছেন আজকের আলোচনায়।

‘পিনাকপাণি জীবিত আছেন একথা মনে এলো কিভাবে কেতু?’ সভার মধ্যমনি বিশাখগুপ্তের মুখ পুত্রগর্বে উজ্জ্বল।

‘এক জোড়া পাদুকা, মানে নদীতটে সযত্নে ফেলে যাওয়া পাদুকাদুটি কেমন সন্দেহ জাগায়। এ যেন প্রমাণ সৃষ্টি করার চেষ্টায় রাখা হয়েছিল সেখানে।’

‘কিন্তু মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, এরপরে তো সন্দেহ থাকার কথা নয়।’

‘শ্রেষ্ঠীর মৃতদেহ হিসাবে সনাক্ত হয়নি সে শব। আভুষণ সনাক্ত করেছিল বল্লরিকা, সেও তো ষড়যন্ত্রের অংশীদার।’

‘ঘটনাটি একটু বিষদে ব্যখ্যা করলে আমাদের কৌতুহল নিবৃত্ত হয়’ অনুরোধ করেন কয়েকজন।

‘শ্রেষ্ঠী উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বহুদিন ধরেই বাসনা চম্পা থেকে বাণিজ্য তরী ভাসাবেন কম্বোজ, সুবর্ণভূমি, সুমাত্রায়; আশা আছে, সাধ্য নেই। বিত্তবান শশ্রুদেবও গত হয়েছেন বেশ কিছুকাল হল। হয়তো এ আশা স্বপ্নই রয়ে যেত যদি না ভাগ্যবলে চারুশীলা তাঁকে হৃদয় দিত। প্রথম দিকে বোধকরি, শ্রেষ্ঠী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন গণিকাকে; পরবর্তীকালে লোভ মাথা চাড়া দেয়। তবে শ্রেষ্ঠীপত্নীও সামান্যা নয়, যেভাবে এতদিন শোকার্তা বিধবার অভিনয় করে ধুলি দিয়েছে আমাদের চক্ষে সে বড় বিস্ময়।’

‘নদীবক্ষে প্রাপ্ত শবটি তবে কার?’ প্রশ্ন করেন বিশাখগুপ্ত।

‘গঙ্গাবক্ষে ভাসমান শব সাধারণ ঘটনা, এক্ষেত্রে সেটি সম্পূর্ন কাকতালীয়। মৃতব্যক্তির আভুষণ দেখানো হলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বল্লরিকা, তবে শব না পাওয়া গেলেও সকলে শ্রেষ্ঠীকে মৃত বলেই ধরে নিত। মাসাধিক কাল পিনাকপাণি বন্দর সংলগ্ন একটি নিকৃষ্ট শুণ্ডীগৃহে আশ্রয় নেন, বিদেশী নাবিকদের যাতায়াত সেখানে, পরিচয় গোপন করা সহজ। সন্দেহ ছিল তাই বন্দরের সকল শুণ্ডীগৃহ ও আবাসিকায় গুপ্তচর পাঠাই, সেখানেই একজন সনাক্ত করে শ্রেষ্ঠীকে। ততদিনে খবর আসে বল্লরিকা নগর ত্যাগে উদ্যোগী, আমি সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানাই; নিশ্চিন্ত হয় তারা। এরপর রাত্রিদিন নজর রাখা হয় শ্রেষ্ঠী গৃহে, পরের ঘটনা সকলেই জানেন। একবার বন্দরে পৌছলে নৌপথে পাড়ি দিত তারা কলিঙ্গে, নব পরিচয়ে শুরু হোত নতুন জীবন।’

‘চারুশীলা মিথ্যাচার করেনি বুঝলেন কিভাবে? শত হলেও সে গণিকা’ প্রশ্ন করেন কেউ।

‘পিনাকপাণির প্রতি তার প্রেম ছিল অকপট, প্রেমাস্পদের মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে মিথ্যাচার গণিকাও করেনা।’

বসন্ত সন্ধ্যার মনোরম বাতাস বয়ে এনেছে যুথীপুষ্পের গন্ধ, দেওয়ালের কুরঙ্গীতে জ্বলে অগরু চন্দন, নিভৃত কক্ষের একান্তে বসে বীণাবাদনে মগ্ন পুষ্পকেতু; সুমধুর সুরঝঙ্কারে স্বর্গীয় পরিবেশ। অতিচুপে প্রবেশ করেন উল্মুক, মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনতে থাকেন বহুক্ষণ। অবশেষে মিত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করে বিরতি নেন কুমার।

‘তোমার জীবনে জ্যামিতি সত্য না এই সঙ্গীত?’

‘উভয়েই’, মৃদু হেসে পুষ্পকেতু আবার শুরু করেন নতুন সুর লহরী।

*** ***

দুরূহ শব্দের অর্থ:

লেখপট – স্লেট, পুস্তপাল – হিসাববিদ, দ্রাড়িম্ব – বেদানা, অলিন্দ – বারান্দা, আড়ঙ্গ – আড়ত ও পাইকারী বাজার, সম্মার্জনী – ঝ্যাঁটা, দৌবারিক – দ্বারবান, পনস – কাঁঠাল, বলীবর্দ – বলদ, ভর্তিনি – মালকিন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *