প্রস্তাবনা
চোখ মেলতেই আমার মনে হল আমার অসুখ নেই। আমার সব ক’টা ইন্দ্ৰিয় হঠাৎ তাজা, ঝরঝরে হয়ে উঠেছে। আর খোলা জানলা দিয়ে বাইরে নজর পড়ল। এক দিব্য আলোর আভায় সব কেমন সুন্দর হয়ে উঠেছে। না-শীত না গরম বাতাস বইছে মৃদু। ফুল ফুটেছে অজস্র রংবাহার। পাখিদেরও আজ কোনও অসুখ নেই। তাদের গানের সঙ্গে আমার স্নায়ুতন্ত্রীগুলো এমন আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে সাড়া দিয়ে চলেছিল, যেন আমি এতেই অভ্যস্ত। শুয়ে থাকতে আর একটুও ইচ্ছে হল না। যেন এই মুহূর্তেই জন্মেছি, এমন একটা হালকা আর টাটকা আর মুক্ত শরীর নিয়ে আমি সেই দিব্য আলোর প্রবাহিত পথে বেরিয়ে পড়তে চাইলাম।
কে যেন তক্ষুনি বলল, তুমি আর ফিরবে না?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথায়!
সে বলল, কেন, তোমাতে?
আমি জবাব দিতে যাব, এমন সময় যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, দৈব ও পুরুষকার এই দুই-এর মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ?
স্স্স্। পাছে কেউ বোকার মত শব্দ করে ওঠে আর ওঁদের ওই কথোপকথনে বিঘ্ন ঘটে তাই ঠোঁটে আঙুল চেপে অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করে চুপ হয়ে যেতে বললাম। কেননা, এই মৌল প্রশ্নটির জুতসই একটা উত্তর শোনবার জন্য উত্তেজনায় আমার বুক থরথর করছিল।
ভীষ্ম বললেন, এ সম্বন্ধে লোকপিতামহ ব্রহ্মা বশিষ্ঠকে যা বলেছিলেন, শোনো। –কৃষক তার ক্ষেত্রে যেরূপ বীজ বপন করে সেইরূপ ফল উৎপন্ন হয়; মানুষও তার সৎকর্ম ও অসৎকর্ম অনুসারে বিভিন্ন ফল লাভ করে। ক্ষেত্র ব্যতীত ফল উৎপন্ন হয় না; পুরুষকার ব্যতীত দৈবও সিদ্ধ হয় না।
আগে লক্ষ করিনি, কখন যেন কতগুলো ক্রুদ্ধ মুখ আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। তাদের কর্কশ কোলাহলে আমার ভয় হল, বাকি কথা শোনাই যাবে না।
বিস্ময়ে বলে উঠলাম, এরা কারা?
কে যেন বলল, ওরা আমাদেরই আত্মজ।
আমি বললাম, সে কী! কিন্তু ওদের তো চিনিনে।
সে বলল, দূরে আছে তাই অচেনা ঠেকছে। কাছে এলে একেবারে মিশে যাবে।
স্স্স্। আবার চুপ করতে বললাম।
ভীষ্ম বললেন, পণ্ডিতগণ পুরুষকারকে ক্ষেত্রের সহিত এবং দৈবকে বীজের সহিত তুলনা করেন। যেমন ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগ, সেইরূপ পুরুষকার ও দৈবের সংযোগে ফল উৎপন্ন হয়। ক্লীব পতির সহিত স্ত্রীর সহবাস যেমন নিষ্ফল, কর্মত্যাগ করে দৈবের উপর নির্ভরও সেইরূপ।
সেই ক্রুদ্ধ মুখগুলো এমন চিৎকার করে তালে তালে এমন ধ্বনি দিতে লাগল যে, সত্যিই মনে হল আমি আর কিছুই শুনতে পারব না। আমার স্নায়ু! আমার স্নায়ু! আমার এবার ভয় হল, এই চিৎকারে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। ঝিমিয়ে যাবে ক্রমশ।
হা ঈশ্বর, আমি আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, এমন কি কেউ নেই যে এদের থামাতে পারে?
আমার আর্তস্বর অনুকরণ করে কে যেন বলল, কেউ নেই, কেউ নেই।
বিস্মিত হয়ে আমি বললাম, কিন্তু এরা চেঁচায় কেন?
সে বলল, ওরা এসব কথা শুনতে চায় না, তাই।
আমি ক্লান্ত হয়ে বললাম, কিন্তু আমি তো শুনতে চাই। শোনো, শোনো তোমাদের তো একথা শুনবার জন্য কেউ ডাকেনি। তোমরা গোল করছ কেন?
এ কথা শুনে ওরা উচ্চৈঃস্বরে হা হা করে হেসে উঠল।
স্স্স্ স্স্স্!
ভীষ্ম বললেন, পুরুষকার দ্বারাই লোকে স্বর্গ, ভোগ্য বিষয় ও পাণ্ডিত্য লাভ করে।
হাহা হাহাহা হাহা।
উচ্চ হাসির দাপটে আমার কানে তালা লাগবার জো হল।
ভীষ্ম বললেন, কৃপণ ক্লীব নিষ্ক্রিয় অকর্মকারী দুর্বল ও যত্নহীন লোকের অর্থলাভ হয় না।
হা হা হা হা হা।
ভীষ্ম বললেন, পুরুষকার অবলম্বন করে কর্ম করলে দৈব তার সহায়ক হয়, কিন্তু কেবল দৈবে কিছুই পাওয়া যায় না।
সেই ক্রুদ্ধ মুখগুলো এবার ইঁট ছুড়তে শুরু করল।
আমি আতঙ্কিত হয়ে শুধু শব্দ করলাম, একী! একী!
কে যেন বলল, ওরা সব ভেঙে ফেলবে।
ধীরে ধীরে আবার অন্ধকার হয়ে এল। পাখিদের গান ভয়ার্ত চিৎকারে মিশে গেল। আমার শরীরটা আবার পুরনো হয়ে এল। অসুখে ছেয়ে গেল। আমার জিভটা বিস্বাদে ভরে উঠল। আমার স্নায়ু! আমার স্নায়ু!
ও বলল, হায়, কলকাতায় কোনও দিব্য প্রভাতই স্থায়ী হয় না। এখানে সব মুহূর্তই অনিশ্চিত। আর অস্থির।
.
ও আর ওর জগৎ
ওরা বিয়েবাড়ি থেকে ফিরছিল। ও আর ওর বউ!
একটা ট্যাকসি করবে? ওর বউ আবদার ধরল। এতখানি পথ বাসের এই ভিড়ে, সত্যি আজকাল খু-উ-ব ক্লান্ত লাগে।
বাঃ! এই তো শচী এত সাধাসাধি করল। তুমি বললে তুমি ছুটকির বাড়ি ঘুরে যাবে। ও সত্যিই অবাক হয়ে ওর বউ-এর মুখের দিকে চেয়ে রইল।
বা রে। তোমার বন্ধুর গাড়িতে আমি শুধু শুধু চড়তে যাব কেন? তার চেয়ে বাবা, বাসের ভিড়ে গুঁতো খাওয়াও ঢের ভাল। নিজের গাড়ি কেনার মুরোদ যাদের নেই তাদের পরের গাড়ি চড়ে বড়লোকি না দেখানাই ভাল। আমার বাবা, ওসব চাল আদপেই ভাল লাগে না।
ওর মাথায় রক্ত উঠে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করল।
বলল, শচী আমার কাছে কখনও চাল দেখায় না। কেন জানো? প্রথমত আমরা দীর্ঘকালের বন্ধু এবং সহকর্মী এবং দ্বিতীয়ত আমি কখনও–
তোমার দীর্ঘদিনের বন্ধুর সহধর্মিণীটি তোমার কতদিনের বন্ধু, শুনি।
কেয়া? কেন?
ভাবসাব দেখে তো মনে হয় বেশ ঘনিষ্ঠই ছিলে একসময়। বাবা কী ঢং! দু’জনে এমনই গল্পে মত্ত যে একেবারে বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত। বাবা!
ট্যা-ক-সি! ও তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। এই ট্যাকসি, শ্যামবাজার যাবে?
ট্যাকসিওয়ালা নির্বিকার। কোনও জবাব দিল না।
ও বলল, কী, যায়েগা?
কোনও উত্তর নেই।
এইসব সময়ে ওর মাথায় খুন চেপে যায় এবং ওর মনে এই ধরনের চিন্তা লহমার মধ্যে খেলে যায়, যথা : (ক) রিভলভারের এক গুলিতে ট্যাকসির টায়ার পাংচার করে দাও। এই আক্রার বাজারে দুটো টায়ার কিনতে গিয়েই বাছাধনের আক্কেল হবে, প্যাসেনজারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার পরিণামটা কী, (খ) একটা গুপ্ত সমিতি গঠন করো। বাস-ট্যাকসি-ট্রাম-যাত্রী বান্ধব সমিতি। ট্যাকসির স্ট্যানডে, বাস-ট্রামের স্টপে স্টপে সমিতির সদস্যরা ওত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাস যদি স্টপে না দাঁড়ায়, ওভারটেক করে চলে যায়, কি নামবার যথেষ্ট সুযোগ না দেয়, কি কনডাকটার যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে গুপ্ত অস্ত্রের প্রয়োগে তার ঢাকা পাংকচার করে দাও। নো আপিল, নো আরগুমেন্ট। কি ট্যাকসিওয়ালা যদি–
ট্যাকসি! ট্যাকসি!
ও দৌড়ে ওদিকের ফুটপাথে গেল। ট্যাকসি দাঁড়াল। ড্রাইভার তাগড়াই এক পাঁইয়াজি। ও দরজা খুলতে খুলতে ওর বউকে ডাকল। বউ যখন প্রায় এসে গিয়েছে, হাঁফাচ্ছে, অমনি ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, ও কিথে যানা?
ও জবাব দিল, শ্যামবাজারসে থোড়া আগে।
ভস্ করে ট্যাকসি বেরিয়ে গেল।
ওর বউ জিজ্ঞেস করল, কী হল, চলে গেল যে!
সে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে, ফাঁসির আসামি আপিলেও হেরে গিয়েছে, শুধু বলল, হ্যাঁ, চলে গেল।
বাঃ, তুমি ওকে ডাকলে, কথা বললে, আর ও চলে গেল! ওর বউ যেন বিস্মিত হল। কোনও কথা না বলেই চলে গেল?
ওর ইচ্ছে হল ওর বউ-এর—না, ইচ্ছেটা চেপে দিল। অবদমিত ক্রোধ ব্লাড় প্রেশার বাড়িয়ে দেয়। টেনশনই এই শতাব্দীর মারাত্মক শত্রু। বুঝলেন। কাজেই রিল্যাক্স্। রিল্যাক্স্।
ও শুধু বলল, হ্যাঁ বলল বই কী!
কী বললে?
বললে, ও ওর বউ-এর দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, যে বউ পরের গাড়িতে চড়ে আরামে বাড়ি পৌঁছুতে আপত্তি জানায়, তার স্বামীর দুর্গতি কেউ খণ্ডাতে পারে না।
সত্যি! ওর বউ এবার সত্যিই অবাক করে দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। এবং বউ-এর এই মনখোলা হাসির ছোঁয়াচে, আরও আশ্চর্য, তার প্রবল উত্তেজনা দ্রুত কমে এল। সে বউ-এর দিকে বেশ ভাল করে চাইল।
হ্যাঁ। এবার ও-ও হেসে ফেলল। এবং ভোঁ করিয়া চলিয়া গেল। তারপর অকারণে দু’জনেই একসঙ্গে জোরে হেসে ফেলল।
আসলে তোমার ব্যক্তিত্বই নেই। হাসতে হাসতে ওর বউ বেশ গুছিয়ে কথাটা বলল। দেখলাম তো তফাত থেকে দাঁড়িয়ে। তুমি পয়সা দেবে ট্যাকসি চড়বে। তুমি তো মাঙনা চড়বে না। তবে তোমার চোখে মুখে অমন ভিখিরির মত কাকুতি মিনতি ফুটে উঠবে কেন?
এবার ওর হাসিটাই আগে শুকিয়ে এল।
আমি ভিখিরির মত কাকুতি মিনতি করছিলাম!
তা নয় তো কী? এবার ওর বউ-এর একটু আগের সেই প্রাণখোলা হাসি তলোয়ারের ফলার মত ধারালো হয়ে এল। আমি তো দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আমার তো মনে হল, তুমি ড্রাইভারের কাছে গিয়ে হাত কচলাচ্ছ। তোমার এই স্বভাবের জন্যই কেউ তোমায় মানে না। যত লম্ফঝম্প আমার কাছে।
এবার ও সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। ও জানে ওর বউ এবার লাইন নিয়ে ফেলেছে। এবার তাকে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে মেয়াদি অভিযোগের ক্লান্তিকর জটিল গোলকধাঁধায়। যেখানে কেবল ঘুরপাক খাবে, ঘুরপাক খাবে। বেরিয়ে আসবার পথ সে জানে না।
মিনু! বাস, বাস! রোকে, এই বাস, রোকে রোকে।
প্রবল উত্তেজনাবশে ও আর ওর বউ আবার দৌড় দিল থপথপ করে রাস্তার ওপাশে। রোকে রোকে রোকে। ও দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে বাসের পিছু দৌড় দিল মরিয়া। এই রোকে রোকে। ও, আর কাকুতি মিনতি নয়, সিংহনাদ ছাড়তে লাগল।
বাস থামল না। ভিড়ে আগাগোড়া ভর্তি বাস থামি-ভামি ভাব দেখিয়ে ওকে বেশ খানিকটা দূর বেদম দৌড় করাল। তারপর একসময় ওর মনে হল, ওর বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। ও চোখে অন্ধকার দেখল। হাঁ করে খাবি খেতে লাগল। ওর বুকে এবং মাথায় ধ্বক ধ্বক করে আওয়াজ হতে লাগল। আর ঘাম। অবিরলধারে ঘাম ঝরতে লাগল। ও মনে মনে আর্তস্বরে ডাক দিল, মিনু, কোথায় তুমি! আমি মরছি, মরে যাচ্ছি, আমার কাছে এসো।
ওর বউ ততক্ষণে ওর চশমা খুলে নিয়েছে। সেও হাঁফাচ্ছে। তারও পিঠ কোমর অসহ্য যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের ব্যথা সে আমল দিচ্ছে না। আঁচল দিয়ে ওর মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। তার এখন দারুণ উদ্বেগ।
তুমি কি পাগল? তুমি কি পাগল? ওর বউ-এর কন্ঠস্বরে মমতা, ওর বউ-এর আঙুলের প্রতিটি স্পর্শ থেকে এখন অনাবিল মমতা ঝরে পড়ছে। তুমি কি জানো না তোমার দৌড়ঝাঁপ করা এক্কেবারে বারণ? তুমি কি জানো না কী সাংঘাতিক বিপদ তোমার হতে পারে? হতে পারত এক্ষুনি। ওর বউ উদ্বেগে অধীর হয়ে বিড়বিড় করছে আর কখনও কখনও বা আঁচল দিয়ে ওকে হাওয়া দিচ্ছে, ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে।
একটু বসবে? আমার গায়ে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নেবে? একটু ভাল লাগছে এখন? জল খাবে?
বুকে এবং মাথায় সেই উত্তাল খিচুনির জন্য ওর মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। তবু ও চাইছিল, ওর শেষ কথাটি শুনিয়ে দিয়ে যেতে। মুখে পারল না, তাই মনে মনেই বলল, আমার ব্যক্তিত্ব আছে, অন্তত ছিল, কিন্তু এটা কলকাতা শহর মিনা, সেটা ভুললে চলবে না, এখানে এই শহরে আজকাল অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ট্যাকসি ড্রাইভার বা বাস ড্রাইভারকে যদি তুমি আমার ব্যক্তিত্ব পরীক্ষার কষ্টিপাথর বলে ধরে নাও, তা হলে ভুল করবে। অন্তত আমার তাই ধারণা।
এই কথাটা মনে মনে বলার পরই, সঙ্গে সঙ্গে ও একটি বাতকর্ম সারল। এবং তার পরক্ষণেই আরেকটা। এবং আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে ও বোধ করল, ওর বুকটা বেশ খালি হয়ে গেল এবং শরীরটা হালকা।
দেখল, ওর বউ সেই রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে লাজলজ্জা ভুলে তার রোলেকস্ শাড়ির লদলদে (কারণ ততক্ষণে ওরই ঘামে শাড়ির আঁচল লদলদ করছে) আঁচল দিয়ে ওর মুখ গলা মুছিয়ে দিচ্ছে। গাভী যথা পরম আদরে তার বৎসের গা চেটে দেয়। এবং রাস্তার এপারে এই রমণীয় দৃশ্য দেখবার জন্য কিছু লোক জুটে গিয়েছে।
ও বেশ লজ্জিত হয়ে উঠল। বলল, থাক থাক, ও কী করছ!
ওর স্বাভাবিক আওয়াজে ওর বউ-এর মুখমণ্ডল ট্ করে এক দিব্য আভায় দীপ্ত হয়ে উঠল।
একটু ভাল লাগছে এখন? জল খাবে? বসবে একটু?
আবার একটা বাতকর্ম সারল ও। এবার আরও খানিকটা আরাম পেল।
তোমার উচিত হয়নি বাসটার পিছনে ওভাবে ছোটা। ওর বউ অনুযোগ করতেই ব্যাপারটা ওর মনে পড়ল।
ও ভাবল, (গ) গুপ্ত সমিতির সদস্যদের কাছে একটা ছোট্ট অথচ শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র থাকবে। যে-বাস যাত্রীদের আকুল আবেদন অগ্রাহ্য করে এইভাবে বেরিয়ে যেতে চাইবে, সদস্যগণ তৎক্ষণাৎ অব্যর্থ লক্ষ্যে ওই ক্ষেপণাস্ত্র মারফত একটা চৌম্বক আংটা বাসের পিছনের বামপারে ছুঁড়ে মারবে। ওই আংটা সুদৃঢ় ইস্পাতের তারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে এবং ওই তারের অন্য অংশটি খুটার সঙ্গে বাঁধা থাকবে। ফলে কোনওও বাসের পক্ষেই আর পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। গুপ্ত সমিতির সদস্যগণ অতঃপর মনের সুখে পিস্তল ছুঁড়ে বাসের টায়ারগুলো পাংকচার করে দিতে পারবে।
ওর বউ বলল, আর সে ওর গা মুছিয়ে দিচ্ছে না, মাঝে মাঝে তোমার ঘাড়ে যে কী ভূত চাপে! জল খাবে? একটা সোডা খাও না?
ও ভাবছে, ট্যাকসি সম্পর্কেও ওই একই ব্যবস্থা। একমাত্র এই উপায়েই কলকাতার বাস ট্যাকসি এবং ট্রামকে কর্তব্যপরায়ণ করে তোলা যেতে পারে।
ওর বউ বলল, শরীর খারাপ লাগছে? এনে দেব একটা সোডা?
এমন সময় নিকটস্থ গাছের পাতাগুলো দুলে উঠল।
ও হাঁফ ছেড়ে বলল, যাক, এতক্ষণে তবু একটু বাতাস পাওয়া গেল। আসলে হয়েছিল কী জান, ও কৈফিয়ত দিতে শুরু করল, সারাদিন গুমোট ছিল তো, তারপর বিয়েবাড়ির এই ভিড়, তারপর এই বয়সে বাওয়েলস্ ক্লিয়ার না থাকলে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব থাকেই, ওইজন্যেই তো আজকাল আর নেমন্তন্ন-টেমন্তন্ন রাখতে যেতে উৎসাহ পাইনে।
ওর বউ বলল, তুমি আসবে শুনে আমিই তো অবাক হলাম।
অফিসের ব্যাপার তো, সব সময় ঠিক এড়ানো যায় না। তা ছাড়া কী জানো, যজ্ঞেশ্বর আবার ইউনিয়নের পাণ্ডা। ওর দারুণ পাওয়ার।
এই ট্যাকসি!
ওর বউ বলল, না, তুমি যাবে না। তুমি দাঁড়াও, আমি দেখছি।
ট্যাকসি দাঁড়াল। ‘গুর বউ এগিয়ে গেল দ্রুত। কিন্তু ওর বউকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গোটা পাঁচেক জোয়ান ট্যাকসিতে গিয়ে উঠল। তারপর হাঁক দিল, অ্যাই চল।
ওর বউ ফিরে এল এবং বিরক্ত হয়ে বলল, অসভ্য!
ওর বউ-এর এই ব্যর্থতা ওর মনোবলকে চাঙ্গা করে দিল। বলল, চলো পান খাই। তারপর হাঁটি। ব্রিজটা পার হয়ে ওধারে গেলে হয়তো ট্যাকসি পাওয়া যাবে।
ওর বউ বলল, তুমি হাঁটতে পারবে?
ও বলল, তুমি তো আছ। না পারলে তোমার পিঠে উঠব। না হয় কোলে করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ো।
অসভ্য! ওর বউ হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ফেলল।
এবং আশ্চর্য, ও সেই হাসিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়াও দিল। এবং ভাবল, এর পরেও কোন উৎস থেকে ওদের হাসি আসে এবং হাসতে থাকলেই বা কেন মনে হয়, বয়েসটা কিছু কমে গেছে?
ওরা তারপর ধীরে ধীরে ব্রিজটার উপর উঠতে লাগল। পাশাপাশি। সেই তো দুটো পুরনো শরীর, তবু কখনও কখনও কেন মনে হয় এরই মধ্যে কোথাও অনাবিষ্কৃত এমন জায়গা রয়ে গিয়েছে যেখানে এখনও ওরা পা দেয়নি?
নীচে দিয়ে উঁ উঁ শাঁখ বাজিয়ে বৈদ্যুতিক ট্রেন বেরিয়ে গেল। আলোআলো কামরাগুলো একেবারে ঠাস বোঝাই।
এই এখানে একটু দাঁড়াই, কেমন?
এপাশে ওপাশে রেলের লাইন এঁকেবেঁকে চলে গেছে। অন্ধকারের ভিতর আলোর মালা ফুটে রয়েছে। কাছ দিয়ে বাস, দোতলা-একতলা গাড়ি, ট্যাকসি, লরি ব্যস্ত ছুটে চলেছে। বেশ বাতাস। এখন ব্রিজের এই শীর্ষদেশে উঠে ওদের বাড়ি ফেরার তাড়াটা কেমন যেন জুড়িয়ে এল।
এই, ও খুব নরম গলায় বলল, লেকে যাবে?
ওর বউ চোখ তুলে চাইল। কেমন যেন উদাস, কেমন বিভ্রান্ত। চাপা গলায় বলল, যাবে?
ওর গলা আরও নেমে এল। বলল, তোমার ভয় করবে না?
ওর বউ-এর গলা ধরে এসেছে। বলল, উহু।
ওর কথা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। বলল, কেন?
ওর বউ চোখ বুজে ফেলেছে। খুব আস্তে বলল, জানিনে।
.
কেয়া আর ওর বর্তমানের একটুকরো
বেশ বাতাস বইছে। সেই রাত্রে বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন সেরে ও আর ওর বউ গড়িয়াহাট ব্রিজের সবথেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। একেবারে নিঃশব্দে। কতগুলো জরুরি ব্যাপারকে ওরা একদম আমল দিল না। যথা : (এক) ওদের ফিরতে হবে সেই টালা, (দুই) আজকাল কলকাতায় ভয়ের চোটে সন্ধে হলেই সবাই ঘরে ঢুকে পড়ে, (তিন) যানবাহন সংগ্রহ করা দুরূহ হয়ে ওঠে, (চার) নিজের পাড়ার নিতান্ত পরিচিত পরিবেশের বাইরে থাকা উচিত নয়, বিপজ্জনক, যে-কোনও সময় যে-কেউ যে-কারও হাতে খুন হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি।
তথাপি গড়িয়াহাট ব্রিজের সেই তুঙ্গ স্থান থেকে, রাত দশটা বেজে যাবার পরও ওদের নড়তে ইচ্ছে হল না।
আমার বউ-এর চুল কত পাতলা হয়ে এসেছে! জোর বাতাসে ওর বউ-এর সামনের দিকের কয়েকটা চুল ফুরফুর করে উড়ছিল। আর তাইতে ও দেখল ওর বউ-এর মাথা কত পাতলা হয়ে এসেছে। কত চুল ছিল আমার বউ-এর মাথায়। গোছা গোছা। আমি আর আমার বউকে কখনও অযত্ন করব না। সিগন্যালের লাল টকটকে চোখের দিকে চেয়ে ও প্রতিজ্ঞা করল। খুব ভালবাসব। খুউব আদর করব। ওর চুলের গোছায়, অবিশ্যি যে-কয় গোছ অবশিষ্ট আছে, মুখ গুঁজে চুপ করে শুয়ে থেকে আমার বউ-এর চুলের শরীরের ঘ্রাণ নেব।
অবিশ্যি চুলের গোছার ঘ্রাণ নিতে ওকে ওর বউ নয়, কেয়াই শিখিয়েছিল। চান করে বাথরুম থেকে বেরিয়েই কেয়া চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে ওর সামনে এসে দাঁড়াত, অবিশ্যি সেই সময় ও যদি কেয়াদের বাড়ি উপস্থিত থাকত, তবে। এই দ্যাখো তো, বলেই ভিজে ভিজে চুল ওর নাকে গুঁজে দিত। কী, কেমন গন্ধ? বলেই কেয়া হাসতে থাকত। সেটা কেয়ার সুদূর অতীত। ওরও। কেয়া বর্তমানে শচীর বউ। শচী মানে এস. বি., মানে ওদের প্রতিষ্ঠানের চিফ একজিকিউটিভ, সেল্স। ওর বস্। কেয়া ওর একেবারে উঠতি বয়সের মেয়ে-বন্ধু। কেয়া এখন রয়ে গিয়েছে শুধু ওর স্ত্রীর চুলে। ওর শরীরে যখন সাড়া জাগে না, তখন ও ওর বউ-এর চুল খুলে, বউ খোঁপা ভাঙা পছন্দ করে না, রেগে যেত এক সময়, এখনও বিরক্ত হয়, চুলের ভিতর মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেয়, নিতে নিতে বোধ করে সুদূর অতীত থেকে উঠে আসা এক জোয়ার, জ্বর, কাম সব বাধা জটিলতা ভেঙে ভাসিয়ে দুকূল ছাপিয়ে উপছে পড়ে তার শরীরে। আছড়ে পড়ে। সেই রাত্রে অথবা দিনে যখনই এই ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটে, তখন ও বোধ করে, ওর আর কোনও অসুখ নেই। ওর শরীরটা টাটকা, তাজা, ঝরঝরে হয়ে ওঠে।
অথচ কেয়াকে কোনওদিনের জন্যও বিছানায় পেতে ইচ্ছে করেনি, এখনও না। কেয়া যদি এসে আমার গা ঘেঁষেও বসে, সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে, তবু আমার কোনও চাঞ্চল্য হয় না। আমি শপথ নিয়ে তা বলতে পারি। আমি তখন কেয়ার সামনে কঠোর নীতিবাগীশ হয়ে পড়ি। ও বউ-এর দিকে চাইল এবং ওই মুহূর্তে ও যখন ওর বউ-এর প্রতি ভালবাসায় সহানুভূতিতে টইটম্বুর, ঠিক তখনই চরম স্বীকারোক্তিটা করল, কিন্তু তুমি আমি যখন চরম সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে উঠি, কেয়া তার আগের মুহূর্তেই কোত্থেকে ছুটে আসে আর তৎক্ষণাৎ তার অশরীরী হালকা দেহটা তোমার শরীরের উপর বিছিয়ে দেয় মিনু, অনেস্ট্, তোমাকে আগাগোড়া সে ঢেকে রাখে। ওকে ভেদ করে তোমার কাছে পৌঁছুতে পারিনে। তোমার কাছেই আমি পৌঁছুতে চাই মিনু। কেননা আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি চাই তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।
.
বউ-এর কাছে ওর চাহিদার ফর্দ
ও যদি ওর বউকে চিঠি লিখত, তবে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াত :
প্রিয়তমাসু,
আমি তোমার কাছে আসতে চাই, তুমি আমার কাছে আসতে চাও। নয় কি? অথচ আমরা তো একই বিছানায় থাকি। পাশাপাশি বালিশে মাথা দিয়ে। গায়ে গা ঠেকিয়ে। অথচ একে আমরা কাছে-আসা বলি না। আমিও না, তুমিও না। তা হলে? তা হলে কাছে আসা কী? কী সেই অভিলাষ, যা অচরিতার্থ, যা তোমার আমার সম্পর্ককে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমরা ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠছি ক্রমশ। এবং ক্লান্ত। এবং পরস্পরের প্রতি নিরুৎসাহ। এবং কখনও কখনও নির্দয়। মাঝে মাঝে আমি যখন আমাদের, বিশেষিত আমার এবং তোমার ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তখন আমার মনে হয় আমরা যেন প্রচণ্ড বেগবান দুটো উত্তাল ঢেউ মুখোমুখি ছুটে আসছি, যার পরিণাম অনিবার্য সংঘাত। আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেলি। তুমিও কি আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুরূপ ছবি দ্যাখো? ভয় পাও? চোখ বুজে ফ্যালো? না কি অন্য কোনও ছবি তোমার চোখে আঁকা? কিন্তু আমার চোখে যেহেতু অন্য বিকল্প নেই, এই ছবিই ভাসছে এবং যার ফলে তুমি আমি আর আমাদের পাতানো সংসারে ছন্দ-পাত ঘটছে, সেই হেতু এর একটা আশু প্রতিকার অত্যন্ত জরুরি বলে আমি বোধ করছি। সংঘাত আমাদের স্বধর্ম নয়, কাম্যও নয়। আমরা প্রত্যেকেই চাইছি একটা সামঞ্জস্যে পৌঁছুতে, চলার সঠিক ছন্দটি নিরূপণ করে নিতে। কারণ সেটাই জরুরি
প্রিয়তমাসু, এটা তো ঠিক, আমরা কেউ কারও শত্রু নই। আমরা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। আমাদের ত্রুটি নেই, আমরা কেউ কারও প্রত্যাশা ষোল আনা পূরণ করতে পারিনি। এ জগতে কেউ কারও প্রত্যাশাই ষোল আনা পূরণ করতে পারে না। কেননা সাধের কোনও ভৌগোলিক পরিধি নেই এবং সাধ্য অতি সীমাবদ্ধ। অতএব সাধ ও সাধ্যে একটা ফারাক থেকেই যায়। এই অতি মূল্যবান সূত্রটি আমরা যদি মেনে নিই, তা হলে আমার মনে হয়, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হিংস্রতামুক্ত হতে পারে। হিংস্রতাই সংঘাতের জনক। ঘৃণা এবং বিদ্বেষ এবং ঈর্ষা ও সন্দেহ হিংস্রতারই মন্ত্রণাদাতা সব পারিষদ। হিংস্রতাকে দূরে রাখতে পারলেই আমাদের অসুখ ভাল হয়ে যাবে। অতএব এসো, আমরা নীরোগ হই।
অতএব এসো :
(১) আমরা হিংস্রতাকে দূরে রাখি,
(২) আমরা পরস্পরের কাছে আসি (৩) আমরা পরস্পরকে ভালবাসি
(৪) আমরা পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখি।
ওর এক লহমার স্বগতোক্তি
ব্যাপারটা এইরকম, তবে এটা চিঠিতে লিখলে বা বক্তৃতা দিলেই ভাল মানায়। কেননা আটপৌরে ঘরোয়া কথাগুলো এতই হালকা যে, ওগুলো দিয়ে বিষয়ের গুরুত্বটা সম্যক ফুটিয়ে তোলা যায় না। কিন্তু যার সঙ্গে অহরহ ঘর করতে হয়, তাকে এই ভাবে তোলা যায় না। কারণ প্রতি মুহূর্তে সংসারে এমন সব বখেড়ার সৃষ্টি হয়, একেবারে তুচ্ছ কারণে যে, বক্তা এবং শ্রোতা উভয়ের মধ্যেই মুহূর্তে মুহূর্তে ব্যবধানের দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল গজিয়ে উঠে। স্বাভাবিক যোগসূত্র একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। আবার দেখুন, যে সর্বদাই পাশাপাশি থাকে তাকে চিঠি লেখাই বা যায় কী করে? ব্যাপারটা নাটুকে হয়ে ওঠে না? বউ-এর কাছে বক্তৃতা দেওয়ার চিন্তাটা তো আরও হাস্যকর। কিন্তু মিনু, তোমাকে যে জরুরি কথাগুলো আমি বলতেই চাই। আমাকে বলতেই হবে।
মিনু, লাল সিগন্যাল আর তার খেলাঘর
কিছুক্ষণের জন্য মিনু সব ভুলে গিয়েছিল। সিগন্যালের টকটকে লাল আলোটার সম্মোহন। মিনু এখন উদাস। পাশে গায়ে প্রায় ঠেস দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে তার স্বামী। সে জানে না। শীতল বাতাস তার চোখে মুখে আরাম বুলিয়ে দিচ্ছে। তার আর কোনও অসুখ নেই। পায়ের নীচ দিয়ে সবেগে ট্রেন বেরিয়ে গেল। এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক। ব্রিজের উপর দিয়ে চলে গেল অনেক বাস, প্রাইভেট, লরি, ট্যাকসি। তার খেয়াল নেই।
এখন ধীরে ধীরে সে সজাগ হতে লাগল। লাল সিগন্যাল কড়া চোখ চেয়ে আছে। রেলের লাইন এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। ডানদিকে একটা বিরাট বাড়ি। ঘরে ঘরে আলো। মিনুর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস হঠাৎ বেরিয়ে এল। এখন তার কোথাও যাওয়ার কথা মনে পড়ল না। তার মনে উদ্বেগ অস্থিরতা জ্বালা কিছুই নেই। তার ঘাড়ে সুঁচ ফোটানো ব্যথা, না তাও বুঝি নেই।
হঠাৎ তীব্র হর্নে সে চমকে উঠল। পরক্ষণেই তার মনে হল ডান হাতটা টনটন করছে। এবং মনে হল, তার স্বামীর সঙ্গে সে বউভাতের নেমন্তন্ন খেতে এসেছিল যোধপুর পার্কে এবং এখন দাঁড়িয়ে আছে গড়িয়াহাট ব্রিজের সব থেকে উঁচু জায়গায়।
সে এই বউভাতে এসেছিল কেন, যে বাড়ির কারও সঙ্গেই তার পরিচয় নেই? এখানেই বা এত রাত্রে দাঁড়িয়ে আছে কেন? আর বাড়ি যেতেই বা ইচ্ছে করছে না কেন? মিনু বিভ্রান্ত বোধ করছে কিছুটা। বাইরে সে বড় একটা বেরোয় না। বেরোতে চায় না। কারণ সে চট করে কারও সঙ্গে আলাপ করতে পারে না। তার বন্ধু নেই কেউ। বাসের ভিড়ে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তার ভয় হয়। ট্রামে চড়তে তার ভয়, পাছে মাঝরাস্তায় ট্রাম বন্ধ হয়ে যায়। সে লিফটে চড়তে পারে না, পাছে মাঝপথে লিফট আটকে বিপত্তি ঘটে। তার সাধ যায় শুধু স্বামী আর ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে এমন সব জায়গায় যেখানে তার স্বামীর পরিচিত জন কেউ নেই। সে আর তার আপনজনদের মধ্যে কোনও আড়াল, কোনও ছায়া ভালবাসে না সে। কেননা তার, সে জানে, কোনও ছুটি নেই। এতক্ষণে চাঁদ উঠল। এখান থেকে আকাশটা কত বড়, চাঁদটা কত ভাল দেখায়। সাদাটে একটা মেঘ যেন মলমলের ওড়নাই চাঁদটার মুখে বিছিয়ে ধরল। ঘোমটা পরা চাঁদ, তার মনে হল এখন হালকা ভেলায় ভেসে চলেছে। সেও যদি ওই রকম ভেসে ভেসে বাড়ি পৌঁছুতে পারত! গিয়ে দেখত বিছানা পাতা সারা! ছেলেমেয়েরা সব খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে! শাশুড়ি দরজা খুলে হাসিমুখে এসে দাঁড়িয়েছেন! বলছেন, এসো মা এসো, আহা, মুখখানা শুকিয়ে গেছে একেবারে। যাও, আজ আর কোনও কথা নয়, বিয়ের গল্প কাল শুনব, এখন বিশ্রাম নাও!
সে : মা, আপনার খাওয়াদাওয়া-
শাশুড়ি (হাসতে হাসতে) : কিছু বাকি নেই মা, সব হয়ে গেছে। এঁটো বাসন সব গুছিয়ে রেখে দিয়েছি। ঝি কাল এসে ধুয়ে দেবেখন। চায়ের কাপ কেটলি সব ধুয়ে গুছিয়ে রেখেছি।
সে (কপট অনুযোগের স্বরে) : এ মা আপনার ভারী অন্যায়। আপনাকে এসব আবার করতে বলল কে?
শাশুড়ি (হাসতে হাসতে) : নাও পাগলি আবার এত রাত্রে ঝগড়া করতে এল। যাও যাও বিশ্রাম নাও। কলকাতায় একদিন চলাফেরা করা মানেই এক বছরের আয়ু কমে যাওয়া।
সে আর কথা না বাড়িয়ে, কাপড়-টাপড় না ছেড়েই বিছানায় লুটিয়ে পড়বে। স্বামীকে বলবে, পাখা ফুল স্পিড করে দাও লক্ষ্মীটি!
অথবা
সে (সোৎসাহে) : জানেন মা—
শাশুড়ি (বাধা দিয়ে) : উহু, এখন কোনও কথা নয়। মুখখানা শুকিয়ে গেছে একেবারে। বাসে এলে বুঝি। যাও, আগে মুখে চোখে জল দাও। বিয়ের গল্প পরে শুনব।
শাশুড়ি পাখার স্পিডটা বাড়িয়ে দেবেন।
শাশুড়ি : দু মিনিট বসে একটু জিরিয়ে নাও। এতখানি পথ আসা নয় তো, পরমায়ু চিবিয়ে খাওয়া।
সে : মা, চোখ বুজুন তো।
শাশুড়ি (হাসতে হাসতে) : আবার পাগলামি শুরু হল তো।
সে (আবদারের ভঙ্গিতে) : চোখ বুজুন, চোখ বুজুন।
শাশুড়ি চোখ বুজবেন। হাসতে থাকবেন।
শাশুড়ি : নাঃ, এই পাগলের যন্ত্রণায় আর পারা যায় না। হ্যাঁ, চোখ বুজলাম।
সে : হাত পাতুন।
শাশুড়ি (হাত বাড়িয়ে) : পাতলাম।
সে রুমালের গিঁট খুলে শাশুড়ির হাতে দু’ খিলি মিঠে পান গুঁজে দিল।
শাশুড়ি (চোখ খুলে) : ওমা, পান! আমি বলি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা এটা আবার কী?
শাশুড়ি হাসতে থাকবেন, সেও হাসতে থাকবে।
সে : চুরি করে নিয়ে এলাম। (সে হাসবে)
শাশুড়ি : বেশ করেছ। (শাশুড়িও হাসবেন অথবা-
শাশুড়ি দরজা খুলে দেবেন।
শাশুড়ি : বাসে এলে বুঝি বউমা!
সে (খুব ক্লান্ত স্বরে) : হ্যাঁ!
শাশুড়ি (ব্যস্ত হয়ে) : এসো, এই পাখার তলায় বোসো।
শাশুড়ি পাখাটা ফুল স্পিডে চালিয়ে দেবেন। একটু পরে এক গ্লাস জল নিয়ে আসবেন।
শাশুড়ি : নাও মা, জল খাও।
সে ঢকঢক করে জল খেয়ে নেবে।
শাশুড়ি: নাও, এবার একটু গড়িয়ে নাও। একটু বিশ্রাম করে তারপর কাপড়-টোপড় ছেড়ো’খন। ঢাকুরিয়া কি এখানে, বাবা! বাসে চড়ে কোথাও যাবার কথা শুনলেই আমার এখন গায়ে জ্বর আসে।
তার চোখের উপর দেখতে দেখতে চাঁদটা মিলিয়ে গেল। মেঘের পর মেঘ ক্রমশ গাঢ় হয়ে চাঁদটাকে মুছে দিল। চোখ নামিয়েই দেখল সিগন্যালটা লাল টকটকে চোখে নিষ্পলক চেয়ে আছে শুধু তারই দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুক চিরে বেরিয়ে এল। একবার তার মনে হল, তবে কি তারা সারারাত এই ব্রিজের উপরেই কাটিয়ে দেবে? বাড়ি ফিরবে না? মন্দই বা কি?
.
লাল সিগন্যালের প্রতি মিনু (স্বগতোক্তি )
কী দেখছ আমার দিকে অমন করে? কী দেখতে চাইছ—আমাকে? আমার ভিতরের অন্ধকারকে? আমার ভিতরে আজ বড় অন্ধকার। বড় জমাট। সেদিকে চাইতে যেয়ো না। ভয় পাবে। আমি নিজেই যে ভয় পাই। অথচ জানো এক সময় কত আলোই না খেলতো সেখানে। কত আলো ছিল, কত ভাল ছিল সেখানে। সবাই আমাকে ভাল মেয়ে বলত। এসব অবিশ্যি আমার বিয়ের আগের ঘটনা। তারপর বিয়ে হল। ঘর-সংসার শাশুড়ি ননদ জা হল। আরও তো ভাল হবার কথা। কিন্তু দেখ কী কপাল! কোথায় আমার ভিতরটা আরও আলো হয়ে উঠবে, আরও ভাল হয়ে উঠবে, তা নয়, সমস্ত অন্তরটার উপর একটা কালো পর্দা বিছিয়ে গেল। একদিন নয়, ঝপাত করে নয়। দিনে দিনে, ধীরে ধীরে।
আমি কী করে বুঝব, ওরা আমাকে গ্রহণ করেনি। আমি মফস্বলের মেয়ে, গ্রামের। শহুরে চালচলন কিছুই বুঝতাম না তো। আমি নতুন এসেছি, আর ওরা এ বাড়ির পুরনো বাসিন্দা। বাড়ি তো ছাই, ভাড়া বাড়ি। আমার বাবার বাড়িতে বড় বড় ঘর, লোকও কম, হাত-পা ছড়িয়ে শোয়া অভ্যেস। ছোট জায়গায় দম বন্ধ হয়ে আসে। এদের বাড়িতে ঘর তো মোটে আড়াইখানা। ভাই বোন ভাজে থিকথিক করছে। ওরই মধ্যে আবার যারা এ বাড়িতে আগে এসেছে, আগে থেকে আছে, তারা যে যতটা পেরেছে জায়গার দখল নিয়ে রেখেছে। একদিন এদিক ওদিক হলেই কুরুক্ষেত্র। মেজো ভাশুরের মফস্বলের চাকরি। সেখানে ভাল সিনেমা যায় না, তাই মেজো জা’র সেখানে শরীর টেকে না। ভাল ঘরখানায় তাই ঊনি জাঁকিয়ে বসে আছেন। দুনিয়া উল্টে গেলেও সে ঘরে মেজো জা’র বিনা অনুমতিতে প্রবেশাধিকার নেই কারও। আধখানা ঘরে মা আর বিধবা ননদ। আর সংসারের যাবতীয় জিনিস। বাকি ঘরখানা আর সকলের। তাই আমি নতুন বউ উড়ে এসে জুড়ে বসেছি, ওদের প্রতিপক্ষ হয়ে গেলাম। ওই এজমালি ঘরে ঠাঁই জুটল আমার। বিশ্বাস করবে? যেন আমি একটা উটকো, পথের ভিখিরি, ওদের বাড়া ভাতে ভাগ বসিয়েছি।
ওরা যে আমাকে এই চোখে দেখে, এটা আমি গোড়ায় আদপেই বুঝিনি। তার কারণ আমি ‘গেঁয়ো মেয়ে এটা ওদেরই কথা, আমি ‘লেখাপড়া শিখিনি’- এটাও ওদের কথা, আমার ‘কী-ই বা জ্ঞান, কী-ই বা বুদ্ধি–এটাও কিন্তু ওদেরই কথা।
ওরা আমাকে বোন বোন, বউদি বউদি করত, আমার বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া সাবান স্নো মেখে সব শেষ করে দিত, আমার শাড়ি শায়া ব্লাউজ পরত ছিঁড়ত, আর আমি ভাবতাম ওরা আমার আপনার, কত আপনার! তখনও আমার ভিতরে আলো ছিল।
তারপর যখন একদিন দেখলাম, আমার সব ফুরোল, প্রসাধনের বাক্স খালি, শাড়ি জামা সব ছেঁড়া, আর ওরা মেজদির ঘরে বসে বসে আমার খুঁত কাড়ছে, তখন থেকে আমার মনের আলো নিবতে লাগল একটি একটি করে। আমি তো মেজদির ঘরে আড্ডা দেবার সময় পেতাম না। রান্না করা, খেতে দেওয়া, আবার রান্না করা, খেতে দেওয়া। দিনরাতের ভাগগুলো আমার কাছে এমনিভাবেই মিশে যেত। সকলের আগে ঘুম থেকে উঠতাম, সকলের শেষে ঘুমুতে যেতাম। স্বামীর সঙ্গেও কি ছাই সবদিন শুতে পেরেছি! এক একদিন এমন হয়েছে, মাঝরাতে স্বামীকে বুক থেকে ঠেলে নামিয়ে উঠে যেতে হয়েছে। বাড়িতে মাঝরাত্রে হঠাৎ নন্দাই এসেছেন, তার শোবার জায়গা সেই আমাকে করে দিতে হয়েছে আমার স্বামীর পাশে। ঘর নেই। মেজদির শরীর খারাপ, তাঁর কাঁচা ঘুম ভাঙানো ডাক্তারের বারণ। মায়ের ঘরে বাকি সবাই গাদাগাদি। বাড়িতে আমার জন্যই শুধু জায়গা হয় না।
যতদিন আমার ভিতরে আলো ছিল, ভাল ছিল, ততদিন আমি একতরফা খেটেছি। হ্যাঁ, একতরফা। আমি সবাইকে খেতে দিই, আমার ভাতও আমাকেই বেড়ে নিতে হয়। রোগ ব্যাধি হলে আমাকেই সেবা-শুশ্রুষা করতে হয়, আমার কিছু হলে আমি নিঃশব্দে নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাতরাই। আমার কথা আর কারও মনে পড়ে না। ছোট বড় নানা ঘটনায় আমার ভিতরের বাতি নিবে গিয়েছে। হ্যাঁ, এখন সেখানে অন্ধকার। আমি নিজেও কিছু দেখতে পাইনে আর।
ওরা এখন বলে, আমি স্বার্থপর, নীচ। আমি এসেই ওদের সোনার সংসার ভেঙে দিলাম। কেন ভাঙব না? তোমাদের সংসার তোমাদের কাছে সোনা হতে পারে, আমার কী আছে? শুধু অবিশ্রান্ত খাটুনি, শুধু উপেক্ষা, শুধু তো এক তরফা দেওয়া।
.
ব্রিজের উপরে ওরা দু’জন
ও বলল, আসলে রাত কিন্তু বেশি হয়নি, জানো? লেকে যাবে? চলো না?
ওর বউ ঘোর-লাগা গলায় বলল, না।
ও : ভয় পাচ্ছ?
ওর বউ : না। এখানেই ভাল লাগছে।
ও : তা অবিশ্যি। আসলে বাতাস ছেড়েছে কিনা।
ওর বউ নিরুত্তর।
ও : কলকাতার সবই তো গিয়েছে। শুধু আছে এই বাতাসটুকু। এখনও শরীর জুড়িয়ে যায়।
ওর বউ : দ্যাখো আবার কবে এটাও বধের পাল্লায় পড়ে।
ওর বউ হাসল। বউকে হাসতে দেখে ও-ও হাসল।
ও : সেই যে দেওয়ালে দেওয়ালে ঋতুবন্ধের অব্যর্থ ওষুধের বিজ্ঞাপন দেয় না, ভাবছি সেই কোম্পানিকে দিয়ে কলকাতা বন্ধের প্রতিষেধক একটা অব্যর্থ দাওয়াই বের করানো যায় কি না। শালা এক বটিকাতেই বন্ধ খুলে যাবে।
ওর বউ : যাঃ অসভ্য!
ওর বউ জোরে হেসে ফেলল।
ও : গোড়াতেই একটা ভুল করে বসে আছি। ও-বাড়ি থেকে বেরুবার সময় যজ্ঞেশ্বরকে যদি বলতাম, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দাও, বাড়ি যাব, তাহলে ও-ই একটা আস্ত গাড়ির ব্যবস্থা করে দিত।
ওর বউ : তোমার যজ্ঞেশ্বরের বুঝি অনেক গাড়ি?
ও : গাড়ি কি আর ওর নিজের। আমাদের কোম্পানিরই তো গোটা পাঁচেক গাড়ি খাটছে ওর বিয়েতে। ওর পাওয়ার কত! ইউনিয়নের চাঁই তো। একবার যদি মুখ দিয়ে বলে বন্ধ তো বন্ধ। ওর অবিশ্যি একটা বাস আর ট্যাক্সি আছে।
ওর বউ : কত পুলিশ মোতায়েন রেখেছে!
ও: সেটা অবিশ্যি ওর দাদার খাতিরে। ওর দাদা ফ্রনটের একজন বিরাট মাতব্বর। দেখলে না, মন্ত্রী, বড় বড় অফিসার, পুলিশের কর্তা গিজগিজ করছে।
ওর বউ : আমার খুব খারাপ লাগছিল জানো। আমার তো শাড়িটা দিতেই হাত উঠছিল না।
ও : কেন?
ওর বউ : এত সস্তার শাড়ি আর কে নিয়ে গিয়েছে শুনি!
ও : শাড়িটা সস্তার হল! উনত্রিশ টাকা দাম।
ওর বউ : উনত্রিশ টাকার খদ্দের আমরা ছাড়া আর কে ছিল? তোমার বন্ধুর বউ স্টাইল দেখিয়ে যে শাড়িটা দিল, তার দাম কত জানো? টিকিটটা অবধি খুলে দেয়নি। আড়াইশ টাকার মুগা। আসাম না কোথাকার। সবাই খুলে খুলে দেখল। বলো, তারপর ওই শাড়িটা দিতে কারোর হাত ওঠে?
ও শুম মেরে গেল।
ওর বউ : তবু দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতে নিয়ে ওটা একজন গাদায় রেখে দিল। তোমার জন্য আমায় এত ছোট হয়ে যেতে হয় না!
ও (অপ্রস্তুত হল, কিছুটা ক্ষুব্ধ) : এতে ছোট হওয়ার কী আছে! আমাদের যা সামর্থ্য, আমরা সেই রকমই দিয়েছি।
ওর বউ (আহত অভিমানে) : তাহলে তোমার নিজের হাতেই ওটা দেওয়া উচিত ছিল। দিলে না কেন?
ও : বাঃ!
ওর বউ : বাঃ কী? সামাজিকতা সমানে সমানেই হওয়া উচিত। তবেই মান-মর্যাদা থাকে। আমাকে আনতে গেলে কেন?
ও : বাঃ!
.
যজ্ঞেশ্বরের রাজসূয় এবং তার শ্রেণী-চেতনা : (ওর জবানী )
যজ্ঞেশ্বর, আমাদের আফিসের এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের জেনারেল সেকরেটারি, অত্যন্ত শ্রেণী-সচেতন এবং স্পিরিটেড ছেলে বলেই আমার বরাবরের ধারণা। স্পিরিটেড কেন? যজ্ঞেশ্বর কাউকে খাতির করে কথা বলে না। কোনও খাতির নেয় না। পুজোর মুখে আমাদের আফিসে প্রতি বছর একটা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কোনও কোনও বার শোনা যায়, এবার আর চালাকি নয়, নির্ঘাত স্ট্রাইক হবে। এবার আট মাসের বোনাস হয় ঘরে আসবে, আর না-হয় আট মাস কোম্পানির চাকা চলবে না। এখানে বলে রাখা ভাল, আমাদের কোম্পানির বিলডিং ব্রেবোর্ন রোডে শিট পাইলিং করা ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত, চাকার উপর নয়। অতএব চাকা চলবে না কথাটার অর্থ আমরা কাজ চলবে না, এই অর্থেই ধরে নিয়েছিলাম।
যজ্ঞেশ্বর বলত, আপনার এককাট্টা হয়ে আমার পিছনে এসে দাঁড়ান, দালালি করে নিজেদের বিপদ ডেকে আনবেন না, দেখুন, এই সংগ্রামে জয় আমাদেরই হবেই। কোম্পানিকে আমি ভয় করিনে, ভয় করি দালালদের, তাদের ঘৃণা করি। মিডল ক্লাস, মানে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিশ্বাস করিনে আমি। ওরা পেটি বুরজোয়া। শ্রেণীগতভাবেই সুবিধাবাদী।
যজ্ঞেশ্বর বলত, এই পেটি বুরজোয়া শ্রেণীকে নিয়ে সংগ্রাম করা এবং সেই সংগ্রামে জয়লাভ করা খুবই শক্ত।
এবং সে কথা যে ঠিক, তা আমরা প্রত্যেক বছরেই টের পেতাম। প্রথম প্রথম আটমাসের বোনাসের দাবিটা আমাদের বেশ উত্তেজিত করে তুলত। এমনকি সেকশনের বড়বাবুকেও দেখেছি লুকিয়ে রাফ কাগজে ফর্দ করতে।
এরপর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক চলত, ভেঙে যেত, আবার বসত। দাবির মিটার আট মাস থেকে ছয় মাস, ছয় থেকে চার এবং অবশেষে দু’মাসে নেমে আসত। যজ্ঞেশ্বরের নাওয়া-খাওয়া থাকত না। প্রতি সেকশনে ঘুরে ঘুরে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাইকে ওয়াকিবহাল রাখত। সংগ্রামীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করত।
আর দালালদের উদ্দেশে চরম হুঁশিয়ারি দিত। তোমাদের দিন ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। দালালির প্রতিফল একদিন তোমাদের পেতেই হবে।
তারপর একদিন কোম্পানি ও ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হবার দিন এগিয়ে আসত। মহলয়ার দু’দিন আগেও আমরা জানাতে পারতাম না, এবার বোনাস ঠিক ক’মাসের পাব। ঠিক মহালয়ার আগের দিন চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর পড়ত। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। এবং তারপর যজ্ঞেশ্বর কোম্পানির সঙ্গে তার নেতৃত্বে ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা যে অবিরাম আলোচনা-সংগ্রাম চালিয়েছিল, জেনারেল মিটিং-এ তার বিস্তারিত বিবরণ (মায় সে জেনারেল ম্যানেজারের পাইপ ধরার কায়দাটি পর্যন্ত নকল করে দেখাত এবং এটা আমাদের অর্থাৎ ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যদের মনোবল অটুট রাখার পক্ষে সহায়ক হত বলে সে বিশ্বাস করত) দাখিল করে সবার শেষে বিজয়বার্তাটি ঘোষণা করত : জেনারেল মিটিং-এর অনুমোদন সাপেক্ষে এবার দু’মাসের বোনাসের চুক্তি আমরা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেছি। কিছু দালালের শ্রেণীস্বার্থ বিরোধী ক্রিয়াকলাপের ফলে ওটা আর আড়াই মাস করা গেল না। তবে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে সকলের টাকা মিটিয়ে দিতে হবে, এটা মানতে আমরা কোম্পানিকে বাধ্য করেছি। এখন, আপনারা বলুন, এটা গ্রহণ করবেন না বর্জন করবেন?
যেন কিছুটা আতঙ্কিত হয়েই, পাছে এটাও ফসকে যায়, সকলে এক বাক্যে চেঁচিয়ে উঠতাম, গ্রহণ করলাম, গ্রহণ করলাম। অন্যের কথা বলতে পারিনে, আমার তো ভয়-ভয় করত, প্রতি বছরই কেমন ধারণা হত, ডামাডোলে এ বছর পুজোর মুখে এ টাকা ক’টা ফসকে যাবে নির্ঘাত। তারপর আমরা উচ্চৈস্বরে বিজয়োল্লাস করে উঠতাম এবং ভয়-ভয় ভাবটা তারপর কেটে যেত।
যজ্ঞেশ্বরের আরেকটা গুণ ছিল, অফিসের কাছ থেকে সে কোনওদিন কোনও ফেবার চায়নি। অবিশ্যি ওর চাইবার কোনও দরকারই হত না। ফ্রনট সরকারের আমলে ওর দাদার তদ্বিরে একখানা বাস আর একখানা ট্যাকসি পারমিট বের করে ফেলল।
আমাদের বলেছিল, ভালই হল, আমাদের একটা সেকেনড্ লাইন অব ডিফেনস্ হল। বাস আর ট্যাকসি কেনার টাকাও সে খুব স্পিরিট দেখিয়ে জোগাড় করেছিল। একদিন সটান ও ম্যানেজিং ডিরেকটারের কামরায় ঢুকে পড়ল। ও কখনও স্লিপ-টিলিপ দিয়ে ঢুকত না। কারণ ওসব বুরজোয়াসুলভ রীতিপদ্ধতিতে ওর বিশ্বাস ছিল না। ওটাকে সে একটা অবমাননাকর শ্রেণীচেতনা-বিরোধী কার্য বলে মনে করত।
ম্যানেজিং ডিরেকটরকে যজ্ঞেশ্বর বলল, দেখুন, আজ ইউনিয়নের কোনও কাজ নিয়ে আসিনি, এটা আমার ব্যক্তিগত কাজ। যদি শুনতে রাজি থাকেন তো বলি, নইলে চলি।
মিঃ মোহতা বললেন, আপনি ঘোড়ার উপরে জিন চড়িয়ে আসেন কি? বোলেন আপনার কী কাজ?
যজ্ঞেশ্বর স্পষ্টাস্পষ্টি বলে ফেলল, সে বাস আর ট্যাকসি কিনবে। পারমিট পেয়েছে, টাকা নেই। আশি হাজার টাকা তার দরকার।
যজ্ঞেশ্বর বলেছিল, আমি কোনও ফেবার চাই না। লোন হিসাবে টাকাটা আপনি সংগ্রহ করে দিতে পারেন কি না। যা ইনটারেস্ট হয়, আমি দেব। আর আট বছরে টাকা শোধ করে দেব।
মিঃ মোহতা বললেন, কিছু অসুবিধা হোবে না। এটা কোনও ফেবারই নয়। নরমাল বিজিনেস। আমার ব্যাংককে আমি বোলে দিব। আমি পারসনালি গ্যারানটি দাঁড়াব। কোম্পানির সঙ্গে কিছু থাকবে না। আপনি ব্যাংক থেকেই লোন নিয়ে নিবেন। কারুর কাছে কারুর কোনও ওলিগেশন থাকবে না। ব্যাস্।
মিঃ মোহতা অসুস্থ। একটা জড়োয়ার সেট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। সেই জড়োয়ার সেট পরে বসে আছে যজ্ঞেশ্বরের বউ। দারুণ মানিয়েছে। মিঃ মোহতা বলেছিলেন আসবেন না। এসেছেন।
যজ্ঞেশ্বরকে ঢিলে গরদের পাঞ্জাবি, সোনার চেন আর কোঁচানো ধুতি পরে বেশ দেখাচ্ছে। আমাদের দেখে সে ‘এই যে’ বলে এগিয়ে এল। ইনডিয়া কিং-এর প্যাকেট খুলে বলল, ‘আজ এটা খাও ভাই।’ আমি আমার বউ-এর সঙ্গে যজ্ঞেশ্বরের পরিচয় করিয়ে দিলাম। সে হেসে বলল, ‘আসুন বউদি।’ আমি বললাম, “ওকে ভাই একটু ভেতরে নিয়ে যাও।’ সে বলল, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়। চলুন।’ এমন সময় শচী ঢুকল কেয়াকে নিয়ে। সে প্রথমে আমার দিকে চাইল না। যজ্ঞেশ্বরের দিকে চাইল। কেয়া আমার বউ-এর দিকে চাইল না। আমার দিকে চেয়ে হাসল। যজ্ঞেশ্বর আমার বউকে ছেড়ে শচী আর কেয়ার দিকে ‘আসুন, আসুন’ বলে এগিয়ে গেল। তারপর ওরা ভিতরে ঢুকে গেল। আমি আর বউ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বউ আমার দিকে চাইল, আমি দেখলাম, একজন সংগ্রামী শ্রমিক নেতা লাইটার বের করে মিঃ মোহতার সিগারেট ধরিয়ে দিচ্ছেন। শ্রমিক নেতাটি যজ্ঞেশ্বরের দাদার অন্তরঙ্গ বন্ধু। বিশিষ্ট অতিথিদের আপ্যায়নের দায়িত্ব তাঁরই।
যজ্ঞেশ্বর একটু পরেই ব্যস্ত হয়ে ফিরে এল। আমাদের দেখে বলল, একী, আপনারা এখনও এখানে দাঁড়িয়ে। আসুন বউদি, এসো ভাই।
আমি দেখলাম আমার বউ ইতস্তত করছে। বললাম, চলো চলো। যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায়, ততই ভাল। অনেক দূর যেতে হবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, যজ্ঞেশ্বর বলল, একটু ফাঁক পেলেই বসিয়ে দেব আপনাদের। এই তো সবে সন্ধে হল। আমাদের সব রেডি। বেস্ট ক্যাটারার এনগেজ করেছি। বেশি লোককে তো বলতে পারিনি। আফিসে যারা থিক অ্যান্ড থিন, তাদেরও সবাইকে বলতে পারিনি।
.