এক রগুড়ে নাটক ও তার কিছু কুশীলব
যজ্ঞেশ্বর চক্রবর্তী : বর। মোহতা ইনডাসট্রিজের কর্মচারী এবং ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ইউনিয়নের জেনারেল সেকরেটারি ও সংগ্রামী শ্রমিক নেতা।
রত্না : যজ্ঞেশ্বরের নব-বিবাহিত পত্নী।
ভুবনেশ্বর : যজ্ঞেশ্বরের দাদা। প্রবীণ কমরেড। সংগ্রামী বামপন্থী দলের প্রথম সারির নেতা।
গগন মুখুজ্জে : রত্নার পিতা। বিরাট কনট্রাকটার।
মিঃ মোহতা : আমন্ত্রিত অতিথি। মোহতা ইনডাসট্রিজের ম্যানেজিং ডিরেকটর। বণিকসভার সভাপতি।
শচী (এসবি) : আমন্ত্রিত অতিথি। মোহতা ইনডাসট্রিজের চিফ একজিকিউটিভ, সেল্স। প্রাক্তন কবি।
কেয়া : ঐ স্ত্রী। সুন্দরী, সুবেশা, সুশিক্ষিতা।
মিনু : মোহতা ইনডাসট্রিজের এক ক্ষুদে অফিসারের স্ত্রী। নিতান্ত সাধারণ মেয়ে। মিনুর স্বামী : আমন্ত্রিত অতিথি। যজ্ঞেশ্বরের ইউনিয়নের অরাজনৈতিক সদস্য। সাধারণ স্তরের লেখক। মনের আশা, একদিন রবীন্দ্র পুরস্কার, আকাদমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, নোবেল পুরস্কার এবং জয় বাংলা পুরস্কার পাবে। শচীর প্রাক্তন বয়স্য।
ফ্রনট সরকারের জনৈক মন্ত্রী (প্রাক্তন) : আমন্ত্রিত অতিথি
ঐ আরেকজন মন্ত্রী (ঐ)
ঐ আরও একজন মন্ত্ৰী : (ঐ)
পারটির সেকরেটারি : আমন্ত্রিত অতিথি
পুলিশ কমশিনার : (ঐ)
ডি সি ট্রাফিক : (ঐ)
ডি সি সিকিউরিটি : (ঐ) ডি সি সাউথ : (ঐ)
ডি আই জি, প্রেসিডেনসি রেনজ : (ঐ) ডিভিশনাল কমিশনার : (ঐ) আই জি : (ঐ)
ছকু বকশি : ভুবনেশ্বরের অন্তরঙ্গ বন্ধু, শ্রমিক কো-অরডিনেশন কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক। আজকের বউভাতের তত্ত্বাবধায়ক।
এ ছাড়া যজ্ঞেশ্বরের পিতৃকুল, মাতৃকুল ও শ্বশুরকুলের আত্মীয়স্বজনগণ, আফিসের ইউনিয়নের মাত্র কয়েকজন মাতব্বর, তত্ত্ববাহক এবং বাহিকাগণ, পরিবেশকগণ, যজ্ঞেশ্বর ও তার ছোট ভাই-এর কয়েকজন বন্ধু এবং আরও কেউ কেউ। অবশ্যই প্রবেশদ্বারে সানাই বাদক এবং আর সঙ্গতকারিগণ এবং বাড়ির সামনে সমবেত ভিখারি-ভিখারিগণ এবং কিছু পুলিশ।
.
পরের ব্যাচের প্রত্যাশায় ওরা এবং আরও অনেক
না, রাত এমন কিছু বেশি হয়নি। প্রথম ব্যাচটা ঠিক সন্ধের মুখেই খেতে বসেছিল। তাই সেটাতে তেমন লোক হয়নি। ও ঘড়ি ধরে লক্ষ করেছিল, ঠিক আধ ঘন্টার মধ্যেই সে ব্যাচটা উঠে গেল। দ্বিতীয় ব্যাচটা বসাতে বসাতে ও দেখল, দশ থেকে পনের মিনিট সময় লাগল। প্রতি ব্যাচে তা হলে মোট সময় লাগছে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। দ্বিতীয় ব্যাচটায় ওর বসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু যেহেতু ওর বউকে সময়মত খুঁজে পেল না এবং অকস্মাৎ ভিড় বেড়ে গেল, তাই ও সেটা মিস্ করল। তৃতীয় ব্যাচটা মেয়েদের।
যজ্ঞেশ্বর ওকে এসে জানাল, বউদিকে বসিয়ে দিয়েছি। চলো না দেখি, তোমাকেও যদি বসিয়ে দিতে পারি। তবে মেয়েদের মধ্যে তোমার অসুবিধে হবে না তো!
ও উঠতে যাচ্ছিল, হয়ত যেত, কিন্তু যজ্ঞেশ্বরের কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল।
ভালই হল, পরের ব্যাচটা একেবারে ভি-আই-পিদের জন্যই সংরক্ষিত, যজ্ঞেশ্বর চোখ টিপল, তুমি ওদের সঙ্গে বসে পড়ো।
কিন্তু যদি কেউ তুলে দেয়? ফস্ করে ওর মনের ভিতর প্রশ্নটা ভুস করে জেগে উঠল।
যজ্ঞেশ্বর পকেট থেকে রুমাল বের করতেই, কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে গেল। ইংরেজি সিনেমা দেখতে চৌরঙ্গী অঞ্চলে গেলে কিংবা এয়ারপোরটের লাউঞ্জে দু-একটা মেম পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে গেলে এই ধরনের গন্ধ নাকে টের পাওয়া যায়। যজ্ঞেশ্বর রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছল। তারপর কী জানি কেন যজ্ঞেশ্বর ওর মুখের দিকে চাইল। একটু হাসল। তারপর বলল, তোমার একটু অবাক লাগছে, না? আসলে ব্যাপারটা কী জানো, এসব দাদার কাণ্ড। বয়েস হয়েছে তো, এখন একটু সেনটিমেনটাল হয়ে পড়েছেন। বন্ধুবান্ধব সবাইকে নেমন্তন্ন করেছেন। টু মাচ্ ক্রাউড্।
যজ্ঞেশ্বরের কন্ঠস্বর যে এত মোলায়েম, তা ওর ধারণা ছিল না।
কেয়া আসতেই যজ্ঞেশ্বর ‘একটু আসছি ভাই’ বলে চলে গেল।
কেয়ার শরীর থেকেও যজ্ঞেশ্বরের রুমালের মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বিকীরিত হচ্ছিল।
কেয়া এত সুন্দর সেজেছিল যে, ওর পাশে এসে বসতেই সকলের নজর কেয়ার উপর পড়ল। শচী এতক্ষণ পর্যায়ক্রমে মিঃ মোহতা, পুলিশ কমিশনার আর ফ্রনট সরকারের জনৈক প্রভাবশালী প্রাক্তন মন্ত্রীর সঙ্গে সমানতালে কথা বলে চলেছিল, আর মাঝে মাঝে হাসছিল। ওকে বেশ হাসতে হচ্ছিল।
ও কেয়াকে বলল, তুমি যে এখানে! খেতে বসলে না?
কেয়া বলল, তোমার গিন্নি তো দিব্যি খাচ্ছেন।।
এরপর আর কী বলা যায়, ও চট করে ভেবে পেল না। কেয়া ওর পাশে এসে বসেছে, সবাই কেয়ার দিকে চাইছে, তার মানে ওর উপরও নজর পড়ছে সকলের। তার মানে ওরা দু’জন যে কথা বলল, এটা সবাই লক্ষ করেছে নিশ্চয়ই। তা হলে? এখন হঠাৎ চুপ করে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
এক ভদ্রলোক পান চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে এলেন। কেয়াকে দেখে—এই যে মা, সব ভাল তো? বাবার খবর কী? -বলে একটু দাঁড়ালেন।
কেয়া বলল, সব ভাল। বাবা এখন একবার করে নীচে এসে বসেন। ভালই আছেন।
ভাল ভাল, ভদ্রলোক খুশি হলেন। বললেন, যাদবপুরে বাড়ি করে মা, বড় ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছি। এত হাঙ্গামা। আর পারা যায় না। ও-বাড়ি বোধ হয় ছেড়েই দিতে হবে। তোমার মাসিমা তো ভয়ে আধমরা হয়েই আছে। সমাজে স্থিতি নেই। বাড়ি-ঘর করেই বা কী লাভ?
কেয়া বলল, মাসিমা এসেছেন নাকি?
এই মাত্তর এল বুলুর সঙ্গে। দেখা করবে নাকি?
কেয়া বলল, দেখা করে যাব।
আচ্ছা। ভদ্রলোক বললেন, এবার ওধারে একটু যাই।
আচ্ছা। ভদ্রলোক দূরে গেলে কেয়া বলল, এই বাড়িটা কার জানো? এই ভদ্রলোকের। এই ভদ্রলোক কে জানো? রত্নার বাবা।
ও-ও এতক্ষণে কথা খুঁজে পেল। বলল, যজ্ঞেশ্বরের শ্বশুর।
উনি আমার বাবার বন্ধু। কেয়া বলল, সামান্য অবস্থা থেকে প্রচুর খেটে প্রচুর পয়সা করেছেন। মেসোমশাই-এর দেবার হাতও খুব। মেয়েকে একেবারে ঢেলে দিয়েছেন। পায়ের গোড়ালিতে আর ঠোঁটের নীচে শ্বেতি আছে বলে বিয়ে হচ্ছিল না। রত্না মেয়ে কিন্তু খুব ভাল। এই বাড়িটাও যৌতুক দিয়েছেন কিনা, বুঝতে পারছিনে।
ও হঠাৎ যেন কেমন বিপন্ন বোধ করতে লাগল।
সে তৎক্ষণাৎ কেয়াকে বলতে গেল, কেয়া-
অন্য একজন লোক এসে কেয়ার সঙ্গে কথা বলতে থাকায় ও মনে মনে বলল, এতে যজ্ঞেশ্বরের কোনও হাত নেই। তার দাদাই সব ব্যবস্থা করেছেন। দাদার এখন বয়েস হয়েছে। বুঝতেই পারছ, এই বয়সে লোকে একটু সেনটিমেনটাল হয়ে পড়েই। কাজেই—
কেয়া লোকটাকে বলল, আমাদের ফ্রিজটায় আর তেমন কাজ চলছে না। আপনি তো তখন খুব গ্যারানটি দিয়েছিলেন।
লোকটা হাসল। বলল, সত্যিই ওটা খুবই ভাল ফ্রিজ। এখানেও তো ওই ফ্রিজই দিয়েছি। তবে মডেলটা অন্য। এটা অনেক বড়। ফ্রিজের কোনও দোষ নেই।
কেয়া বলল, তবে আমাদেরটা এত ট্রাবল দিচ্ছে কেন?
লোকটা হাসল। বলল, ট্রাবল দিচ্ছে কলকাতার ইলেকট্রিক সাপ্লাই। ভোলটেজ অনবরত ফ্লাকচুয়েট করছে। ওতে কি মেশিন ভাল থাকে। এদের মেশিনটা দেখবেন ট্রাবল দেবেই না।
কেয়া বলল, কেন?
লোকটা বলল, যজ্ঞেশ্বরবাবু সেদিন শালার সঙ্গে ফ্রিজের রং পছন্দ করতে আমাদের দোকানে এসেছিলেন। গগনবাবুকে জানেন তো, কীরকম দরাজ মন, আমাকে টেলিফোন করে বললেন, দত্ত, আমার মেজো মেয়ের বিয়ে। বড়কে যা যা দিয়েছি, মেজোকেও তাই দেব। ওর বড় জামাই-এর এখন দারুণ বাড়বাড়ন্ত। ফরিদাবাদে ফ্যাকটরি তুলে নিয়ে যাবার পর অবস্থা একেবারে ফিরে গিয়েছে। গগনবাবু বললেন, বড় মেয়েকে যেরকম ফ্রিজ দিয়েছিলে, মেজো মেয়েকেও তা-ই দেবে। বুঝলে। যজ্ঞেশ্বরবাবু যেটা পছন্দ করলেন, সেটাই দিলাম।
ও মনে মনে কেয়াকে প্রাণপণে বোঝাতে চাইল, যজ্ঞেশ্বর আসলে তার দাদাকে খুব মানে।
লোকটা বলল, তাঁকে বললাম, দেখুন, ফ্রিজ নিচ্ছেন নিন, কিন্তু কলকাতায় পাওয়ার সাপ্লাই-এর অবস্থা এখন দারুণ শোচনীয়, যখন-তখন ভোলটেজ ড্রপ করে। এতে মেশিন খুব ড্যামেজ হয়। আপনি এক কাজ করুন, এর সঙ্গে আরেকটা গ্যাজেটও নিন, এ ম্যাটার অব থ্রি হানড্রেড অ্যান্ড ফিফটি রুপিস। ভোলটেজ ঠিক একই থাকবে এবং মেশিনটা কোনও ট্রাবল দেবে না। নেভার। যজ্ঞেশ্বরবাবু ওর শালার মুখের দিকে চাইতেই তিনি বলে উঠলেন, এ-কথা আবার ওকে বলার কী দরকার। বিল তো আমরা পে করব। যা আপনি ভাল বোঝেন তাই করবেন। বুঝলেন।
ও মনে মনে কেয়াকে বলল, যজ্ঞেশ্বর এ ব্যাপারে খুব বিব্রত হয়ে পড়েছে। জানো কেয়া, ওর দাদা আবার যা সেনটিমেনটাল-
লোকটা বলল, এই কথা আমি শচীবাবুকেও বলেছিলাম, জিজ্ঞেস করে দেখবেন। কিন্তু উনি বোধ হয় আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি।
না না, তা ঠিক নয়। কেয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল, সে সময় আমাদের কিছু ডিফিকালটি ছিল।
লোকটা উঠে যেতেই কেয়া ওর দিকে চাইল। এবং চমকে উঠল, কারণ ও কেয়ার মনের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল।
কেয়া : আমরা ধার করে ফ্রিজ কিনেছিলাম। আমরা তো ওটা যৌতুক পাইনি।
ও মনে মনে বলল, এ ব্যাপারে যজ্ঞেশ্বরের কোনও হাত ছিল না। এবং আরও চমকে উঠল, কারণ ও দেখল, কেয়া ওর মনের কথাগুলো বেশ বুঝতে পারছে।
কেয়া : হাত ছিল না মানে?
ও : গোটা ব্যাপারটাই যজ্ঞেশ্বরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থা বন্দোবস্ত সবই ওর দাদা করেছে।
কেয়া : বটে! মেয়ে পছন্দ কে করেছে?
ও : ওর দাদা।
কেয়া : দেনা-পাওনা?
ও : ওদের কোনও দাবি ছিল না। একটা ভাল মেয়ে, শুধু শ্বেতি আছে এই কারণে তার বিয়ে হচ্ছিল না। যজ্ঞেশ্বর কোনও রকম সংস্কার মানে না। সে সংগ্রামী। সে বিপ্লবী। সে এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। বাকি ব্যাপারটা তার শ্বশুরের। তাঁর টাকা আছে। তিনি উদার। তিনি দেদার দিলেন তাঁর মেয়েকে। এ ব্যাপারে যজ্ঞেশ্বর কী করবে? এটা বরং বলতে পারো, তার একটা সেকেন্ড লাইন অব ডিফেনস্ হল।
কেয়া : থার্ড লাইন বলো। ডিফেনসের সেকেন্ড লাইন তো বাস এবং ট্যাকসি কিনেই হয়েছিল।
কেয়া বলল, লোকটা পাক্কা সেলম্যান।
শচী এবার কেয়ার কাছে এগিয়ে এল এবং ওকে আর না-দেখে পারল না।
শচী : যজ্ঞেশ্বর যে এতটা রিসোরফুল আমার তা ধারণা ছিল না। মিঃ মোহতা পর্যন্ত অবাক হয়ে গেছেন। আমাকে কী বললেন জানো, বললেন, এস বি, এরাই এখন সোরস্ অব পাওয়ার। এদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এই কথাটা মনে রেখেই
নতুন করে স্থির করতে হবে।
শচী অনেক দিন পরে আবার খুব উৎসাহ বোধ করছে। অনেক দিন পরে শচী আবার ওর সঙ্গে পুরনো অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলতে লাগল।
শচী বলল, অ্যান্ড আই থিংক, হি ইজ রাইট। কী বলো? তারপর তোমার খবর কী? তোমার বউ কোথায়? দেখছিনে তো!
কেয়া বলল, উনি খেতে বসে গিয়েছেন।
শচী আশ্চর্য হল, সো আরলি?
ও তাড়াতাড়ি বলল, কাজ যত এগিয়ে থাকে ততই ভাল। যেতে হবে সেই কোথায়।
শচী ওকে বলল, এঃ, যাবার জন্য আবার এত ভাবনা। আমরা তোমাদের একটা লিফট দিয়ে দেব।
শচী কেয়াকে বলল, আমি মিঃ মোহতাকে বললাম, যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে আমার তো এখন প্রায় একটা ফ্যামিলি দাঁড়িয়ে গেল। মিঃ মোহতা বললেন, হাউ? আমি বললাম, যজ্ঞেশ্বরের শ্বশুর আমার শ্বশুরের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। শুনে মিঃ মোহতা খুশিই হলেন। তুমি যজ্ঞেশ্বর আর তার বউকে একদিন আমাদের বাড়িতে আসতে নেমন্তন্ন করো।
শচী বলল, চলো তোমার সঙ্গে ওঁদের সব আলাপ করিয়ে দিই। ওঁরা সব টপ অফিসিয়াল। আলাপ থাকা ভাল। দিন দিন অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে!
কেয়া ক্লান্ত হয়ে হাই তুলল। বলল, তোমার সঙ্গে সকলের আলাপ তো হয়েই গিয়েছে। তা হলেই হল। আমরা বরং এখানে একটু গল্প করি।
ওর দিকে চেয়ে কেয়া বলল, এর তো আজকাল দেখাই পাওয়া যায় না! বউ বারণ করে দিয়েছে না কি?
.
লাল সিগন্যালের প্রতি মিনু : স্বগতোক্তি
এই যে তুমি এখন যেভাবে চেয়ে আছ, চোখে পলক পড়ছে না একটুও, আমার ধারণা ছিল ভগবানও ওইভাবে চেয়ে থাকেন আমাদের দিকে। আমরা ভালই করি আর মন্দই করি, ওই একটি লোকের চোখ কখনওই এড়াতে পারব না। ওই একটি লোকের কাছে সব হিসেব লেখা থাকছে। কিন্তু সত্যিই কী তা-ই? বলো না! যারা ভাল কাজ করে তাদের জন্য একটা আলাদা হিসেবের খাতা আছে, নয় কি? সেই খাতার হিসেব অনুসারে ভগবানের তো উচিত মাঝে মাঝে তাদের একটু পুরস্কার দেওয়া। নয় কি, বলো? অন্তত এমন কিছু করা যাতে তারা বুঝতে পারে, কোথাও ন্যায় বিচারক একজন কেউ আছে। নইলে আমি ভাল কাজ করেও যদি দেখি আমার কপালে সেই দুর্গতি, তবে ভাল কাজ করতে লোকে চাইবে কেন, বলো?
আমার ব্যাপারটাই বড় অদ্ভুত, জানো? আমি কোনও মানে খুঁজে পাইনে। রোজ রাত্রে শোবার আগে বিছানায় বসে একমনে ভগবানকে ডাকি, সেই ছেলেবেলায় ঠাকুমা যেমনটি শিখিয়ে দিয়েছিল ঠিক তেমনি ভাবে। রোজই আকুলভাবে তাকে বলি, ঠাকুর, বলো আমার অন্যায়টা কোথায়, আমার ত্রুটি কোথায়? কেন আমি কারও কাছ থেকে কোনও প্রতিদান পাইনে? কেন আমি ভালবাসা পাইনে? না চাইতেই তো আমি সংসারের সবাইকেই যেটা যার প্রয়োজন সব দিয়ে দিই, কত আশা করে অপেক্ষা করি, ওরাও আমার যা প্রয়োজন তা এইভাবে মেটাক। এটা কী দোষ? এটা কী অন্যায়? আর প্রয়োজনও কী এমন হাতি-ঘোড়া? আমাকে রাজা করে দেওয়া? আদপেই নয়। কেউ এসে আমাকে মুখ ফুটে বলুক, তোমার তো কাপড় জামা নেই গো, সব ছিঁড়ে গেছে! কি, খাও না গো। কিংবা, আহা, বড্ড খাটুনি গেছে গো, বিছানা পেতে রেখেছি শুয়ে পড়ো। কি, চোখ ছলছল করছে কেন, শরীরটা খারাপ নাকি? কিন্তু এটুকু পাওনাও আমার জন্য সংসারে বরাদ্দ নেই। সবাই শুধু আমার কাছ থেকে নিতে আসে। যদি কিছু দিই আমার সাধ্যমত, ওরা তার সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। আমার শাশুড়ির কথা শুনবে? পুরনো বাড়ি যখন তুলে দেওয়া হল, কেন হল? হ্যাঁ, আমার জন্য। সকলের জন্য মাপা জায়গা আর আমি স্রোতের শ্যাওলা, না? অনেক সহ্য করার পর একদিন আমি সাফ বলে দিলাম, ঘরভর্তি লোকের মধ্যে আমি স্বামীর পাশে শুতে পারব না। হয় আমার জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করো, নয় আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও।
.
সেদিনকার নাটকে মিনু, আর অন্যেরা
মিনুর এরকম অগ্নিমূর্তি দেখে সবাই স্তব্ধ। শাশুড়ি ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন। ননদরা দাপাদাপি করছে। মেজো জা’র সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ননদরা ওর ঘরে ঢুকে যেভাবে তেড়ে বেরিয়ে আসছে, তাতে মনে হয় ইন্ধন নিঃশব্দে উনিই জুগিয়ে যাচ্ছেন।
এক ননদ (চেঁচিয়ে) : বুঝতে কী আর অসুবিধে হয় কোথায় পুড়ছে? বোকা তো নই। ঘাসে তো আর মুখ দিয়ে চলতে হয় না আমাদের। এখন মেজো বউদির ঘরখানা ওর চাই। হিংসেয় বুক ফেটে পড়ছে। তুমি ও ঘর ছেড়ো না বউদি। দেখি ও কী করে?
[এই ননদ টাইফয়েডে মরমর হয়ে গিয়েছিল। তুমি তো দেখেছ ভগবান, না কী? মিনু বলল। বিছানায় পায়খানা পেচ্ছাব করে ফেলত। কেউ ওর কাছে ঘেঁষত না। মেজদির তো কথাই ওঠে না। তাঁর হার্টের অসুখ। তাঁর মন সব সময় প্রফুল্ল না রাখতে পারলে, ডাক্তার তাঁকে বলেছেন, তাঁর সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। তাই মন প্রফুল্ল রাখবার জন্য মেজদি যখন অন্য ননদদের সঙ্গে নিয়ে সিনেমায় কি থিয়েটারে যেতেন, মিনু বলল, তুমি তো দেখেছ ভগবান, তখন এই ননদের সব ঝক্কি আমাকেই পোয়াতে হত। না কী? একমাত্র ডাক্তারবাবু বা পাড়া-প্রতিবেশী বাড়িতে এলেই মেজদির উদ্বেগ উথলে পড়ত। একথা তো ঠিক, সবাই তো একথাই জানত যে, এই ননদের জন্য মেজদিই প্রাণপাত করছে, আমি নই। ক্রমে ক্রমে আমাদের বাড়ির লোকও একথা বিশ্বাস করে গেল এবং সব শেষে এই ননদও, যে কিনা এখন তার মেজো বউদির স্বত্ব রক্ষা করার জন্য এমন কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে লেগেছে আমার সঙ্গে। আমারই বিরুদ্ধে ওরা সবাই জোট বেঁধেছে। কোথাও যদি বিচার বলে কিছু থাকেই, তবে এটা কীভাবে সম্ভব হয়? বলো, তুমিই বলো। ]
সেই ননদ (চেঁচিয়ে) : আসলে তোমার ঘরটা দখল করার ফন্দি। তুমি ওই ঘরে সেই প্রথম থেকে আছ, ও ঘরে তুমিই থাকবে। দেখি ও কী করে?
মেজো বউ (মিষ্টি মধুর স্বরে) : তা কী করে হবে ভাই। শুনলেই তো ও বলল, বরের কোলে শোওয়ার জন্য ওর আলাদা ঘর চাই।
শাশুড়ি (কপালে করাঘাত করে) : দিনকাল কী হল? দিনকাল কী হল! লজ্জা শরম কোথায় গেল? লজ্জা শরম কোথায় গেল! কথাটা বলতে ওর মাথা কাটা গেল না, অ্যাঁ! আমাদের আমলে সোয়ামির মুখ পর্যন্ত দেখতে পেতাম না বাছা। আর আজকাল এরা বলে কী? বউদের ঘোমটা তোলার হুকুম ছিল না। আর এখন—(শিরে পুনরায় করাঘাত) হা!
[তা-ই যদি হবে মা, মিনু ভগবানের দরবারেই সওয়াল করল, তবে গোটা এগারো ছেলেমেয়ে আপনার হল কী করে? স্বামীর মুখ না দেখলে সুখটা যে স্বামীর কাছ থেকেই পাচ্ছেন, অন্যের কাছ থেকে নয়, এটা আপনারা কোন উপায়ে জানতেন মা? এ প্রশ্নটা, আমি যখন এতই খারাপ, করতে পারি কি না, ভগবান, বলো বলো?]
মেজো বউ (মিষ্টি মোলায়েম স্বরে) : আমি বরং এধারে ওধারে পড়ে থাকব ভাই, কী করব বলো, শরীরটা যখন খারাপ, আমার বরের কাছে যখন যেতে পারব না, বরের পাশে শোবার ভাগ্য যখন করে আসিনি
শাশুড়ি (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) : আহা মা, তোমার মুখে ওকথা শুনলে বুক আমার ফেটে যায়!
সেই ননদ (কাঁদো কাঁদো হয়ে) : ও কথা বোলো না বউদি, বোলো না, বোলো না-
[মিনু ভগবানের কাছে আরজি পেশ করল, দ্যাখো, দ্যাখো। ওদের সকলের হৃদয়ে সকলের জন্য দরদ ভালবাসা কত গভীর। কেননা এদের সকলের হাতে কত অফুরন্ত অবসর। ওরা কত সময় পায় ভালবাসার গাছে ফুল ফোটাবার। আমি অত সময় কোথায় পাব? সূর্য ওঠবার আগে আমাকে উঠতে হয়। চা করে ওদের ডেকে তুলতে হয়। সকলের সকালের সুখনিদ্রা চটিয়ে দেওয়ার অপরাধে আমিই একমাত্র অপরাধী। তারপরে সংসারের কাজের স্রোতে প্রবল বেগে ভেসে যেতে যেতে শ্রান্ত ক্লান্ত আমি যখন ভারী ভারী বিছানা পেতে সকলের ব্যবস্থা করে দিয়ে কূলে উঠতে পারি, তখন গভীর রাত্রি। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। তখন আমি আর আমার স্বার্থপর শরীর, এ ছাড়া আর কোনও কিছু মনে পড়ে না। তখন আর ভালবাসার গাছে ফুল ফোটাবার ইচ্ছে জাগে না। সময়ও থাকে না। তুমি তো সবই দ্যাখো। তবে চুপ করে থাকো কেন?]
মিনু : এ বাড়িতে জায়গার যখন এত অভাব, তখন ছেলের বিয়ে দিতে গেলেন কেন? এ রকম বেআবরু হয়ে শোয়া আমার অভ্যেস নেই।
শাশুড়ি (চেঁচিয়ে) : বিয়ে কি আমরা দিয়েছি? আমার ছেলেকে কী গুণ করেছ, তুমিই জানো।
মিনু : তবে আপনার ছেলেরই উচিত হয়নি। ব্রহ্মচারী থাকাই উচিত ছিল।
সেই ননদ : দাদাকে ভালমানুষ পেয়ে পটানোর সময় মনে ছিল না!
মিনু : তোমার সঙ্গে কথা বলছিনে। তুমি চুপ করো। আমি মাকে বলছি।
[শুনুন মা, মিনু ভগবানের দরবারে আবার সওয়াল করল, শুনুন। এ বাড়িতে খাটতে খাটতে আমার এত পরিশ্রম হয় যে, রাত্রে বিছানায় পড়ে এক ঘুম ছাড়া আর আমার অন্য কোনও ইচ্ছে জাগে না। আপনার অবুঝ ছেলে এটা বুঝতে চায় না। আমার অসাড় অনিচ্ছুক শরীরটার উপর সে তার দাবি মেটাতে চায়। প্রয়োজনটা ওরই বেশি। কিন্তু ওই ছোট্ট ঘরে, নীচের ঢালা বিছানায় যখন অত ছেলেমেয়ে ঘুমুচ্ছে, তখন সে দাবি কীভাবে আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব! বলুন। আমরা মানুষ তো। আমার খারাপ লাগে আপনার ছেলেকে মানুষের নির্ধারিত সীমা থেকে টেনে নামিয়ে আনতে। কিন্তু ও শোনে না। ও উন্মাদ হিংস্র হয়ে উঠে। তখন বাধা দিতেও আমার ভয় হয়। এটা কোনও রাগের, লোভের, অহমিকার কথা নয়, সুবিধা-অসুবিধার কথা। এ বাড়ির আড়াইখানা ঘরের সীমানার মধ্যে আপনাদের সোনার সংসারের কী যে মোহ আপনারা জিইয়ে রেখেছেন, আপনারাই জানেন। এ বাড়ির মোহ কেন আপনারা ছাড়তে পারেন না, ছাড়বার কথা উঠলেই কেন যে আতঙ্কে মৃতপ্রায় হয়ে যান, আমি বুঝতে পারিনে। শুধু বুঝতে পারি, এ বাড়ি ছাড়তে হলে কতকগুলো পুরনো অভ্যেস আপনাদের ছাড়তে হবে, যে অভ্যেস কতকগুলো অযৌক্তিক অধিকারবোধের জন্ম দিয়েছে, অর্থহীন সেই সব অধিকারবোধ শুধু আপনাদের অহমিকাকেই তৃপ্ত করছে। এই অহমিকা আবার বেঁচে আছে, আপনারা বাঁচিয়ে রেখেছেন, কল্পনায় অতীত সুখের সব ছবি এঁকে এঁকে। সেই সুখ হয়ত কখনওই ছিল না, কিংবা ছিল, আজকে কিছুই যায় আসে না তাতে। আজ আমাদের সকলের জন্য যতটুকু জায়গা দরকার, এই আশ্রয়ে তা নেই, এইটেই আসল কথা। নয় কি? মানুষ তো মা এইভাবেই এগোয়। ]
মিনুর অগ্নিমূর্তি ধারণের ফলে সেদিন এই লাভ হল যে, তাকে ও বাড়িতে সেদিন থেকে সবাই অন্য চোখে দেখতে আরম্ভ করল। তাকে প্রথম থেকে সকলে যেমন কাদার তাল ধরে নিয়েছিল, সেদিন প্রথম বোঝা গেল, সে তা নয়।
.
সেদিনকার ভোজে ওর কিছু সুখকর অভিজ্ঞতা
ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও ওর বউকে মাঝে মাঝে দেখছিল। মনে হচ্ছিল, ওর বউ খুব সুখ পাচ্ছে। কখনও সে উদাস, কখনও যেন স্বপ্নই দেখছে। এতে ও নিজেও কেমন সুখ পাচ্ছিল। কেমন নরম একটা ভাব ওর বউ-এর শরীরটা ছেয়ে আছে। বুফেই করতাম জানো? যজ্ঞেশ্বর এক ফাঁকে ওকে বলেছিল। কিন্তু করলাম না কেন, জানো? একটু কুণ্ঠিতভাবে যজ্ঞেশ্বর জবাব দিয়েছিল, ব্যাপারটার মধ্যে কোথায় যেন একটু বড়লোকি গন্ধ আছে। কেমন যেন বুরজোয়া বুরজোয়া ভাব। কিছুই না জানি, হে হে করে আপনমনেই হেসে উঠে সে বলেছিল, তবু লোকে হয়ত বলত, বিয়ের সময় যজ্ঞেশ্বর বুকে করেছিল। বুঝেছ। লোকে তো আর অত তলিয়ে বোঝে না। তাই দাদা বললেন, নাঃ, পাত পেড়ে খাওয়ানোই ভাল। আবহমানকাল ধরে যা চলে আসছে, তা-ই চলুক। এতে কথা-টথা কিছু উঠবে না। কী বলো?
তা ঠিক, ও ভেবে দেখল, যজ্ঞেশ্বরের বিয়েটা এমনভাবেই সমাধা হয়েছে যে, কোনও পক্ষ থেকেই কথা উঠবে না। কথা ওঠার মত সব রকম কাজই তারা এড়িয়ে গিয়েছে সযত্নে। যজ্ঞেশ্বর বামুন, সে বামুনের মেয়েই বিয়ে করেছে। আবহমান কাল ধরে বামুনের বিয়ে যেভাবে হয়, যজ্ঞেশ্বরের বিয়েও সেইভাবে হয়েছে। সেই অধিবাস, নান্দীমুখ। সেই গায়ে হলুদ, হাতে যজ্ঞসূত্র বাঁধা। সেই মায়ের কোলে বসে বলা, ‘মা তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।’ নিশ্চয়ই উপোস করে ছিল যজ্ঞেশ্বর। ভোর রাতে এয়োদের সঙ্গে দধিমঙ্গল সেরেছিল, সারাদিন দু-একটা সন্দেশ আর কাপ কয়েক চা খেয়েও থাকতে পারে। অর্থাৎ যতটুকু নিয়মভঙ্গ আচারসম্মত, সেটুকু সে ভেঙে থাকতে পারে। এইরকম সংলাপও হয়ে থাকবে, যজ্ঞেশ্বরকে ও যতটুকু জানে, তাতে হওয়া সম্ভব বলেই ও মনে করে, যথা :
যজ্ঞেশ্বর (কপট ক্রোধে) : দ্যাখ, ফাজলামি করলে মার খাবি।
যজ্ঞেশ্বরের বোন (বিবাহিত) : ফাজলামি নয় সেজদা, এটা করতে হয়।
যজ্ঞেশ্বর : আমি ওসব পারব না।
যজ্ঞেশ্বরের বউদি : যা বলছি করো ঠাকুরপো, নইলে বউ বশে থাকবে না। বুড়ো বয়সে বিয়ে করছ তো।
যজ্ঞেশ্বরের সেজো খুড়ি : নে বাবা নে, হাঁ করো, কয়েক দলা মেখে রেখেছি, আস্তে আস্তে মুখে তুলে দিই। সোনা ছেলে, লক্ষ্মী ছেলে, ওগুলো খেয়ে ফ্যালো! এ তো দই আর চিড়ে বাবা।
যজ্ঞেশ্বর : এই ভোর রাত্রে ওসব খেতে হবে! পেট গুলোবে আজু-মা।
যজ্ঞেশ্বরের সেজো খুড়ি : নিয়ম-রিত তো মানতে হবে বাবা। সারাদিন নিরঙ্কু উপোস যাবে যে।
যজ্ঞেশ্বর (খেতে খেতে) : এইজন্যই তো এদেশে একটা বিপ্লব এত জরুরি হয়ে পড়েছে। তোমাদের এইসব বস্তাপচা নিয়ম রীতি আর কতকাল পুষে রাখবে। (সেজো খুড়ির হাত মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে) আর না আজু-মা, প্লিজ, এবার সব পেট থেকে উঠে আসবে বলছি।
অথবা (বিকালে)-
যজ্ঞেশ্বর (কপট ক্রোধে) : এইবার সত্যিই এক থাপ্পড় খাবি!
যজ্ঞেশ্বরের বোন (তিন-চার ছেলের মা। নাকি-নাকি আধো-আধো সুরে) : ওমা, দ্যাখো, সেজদা মারবে বলচে। বোস না সেজদা, মায়ের কোলে তো বসবি!
যজ্ঞেশ্বরের বউদি : যা বলছি করো না ঠাকুরপো। সেই সকাল থেকে খামোকা জ্বালাচ্ছ।
যজ্ঞেশ্বর : আমি জ্বালাচ্ছি না তোমরা জ্বালাচ্ছ!
যজ্ঞেশ্বরের বউদি : বেশ, আমরাই জ্বালাচ্ছি বাবা, আমরাই জ্বালাচ্ছি। কিন্তু আজ রাতেই তো তোমার সব জ্বালা জুড়িয়ে যাবে।
মেয়েরা সব খিলখিল করে হেসে উঠল।
যজ্ঞেশ্বরের সেজো খুড়ি : বোসো বাবা বোসো, মায়ের কোল জুড়ে বোসো। বলো, ‘মা তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।’ শুভদিনে কাউকে কষ্ট দিতে নেই। এ বাড়ির রিত-কানুন একটা যখন আছে —
যজ্ঞেশ্বর : আচ্ছা, এ সবের কোনও মানে হয়! সিলি।
যজ্ঞেশ্বর মায়ের কোলে বসল। হুলুধ্বনি। মায়ের চোখ দিয়ে জল ঝরছে।
যজ্ঞেশ্বরের বউদি : বলো ঠাকুরপো’মা তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি। ‘
যজ্ঞেশ্বর : এই টোয়েনটিয়েথ সেনচুরিতে মানুষ যখন চাঁদে যাচ্ছে—তোমরা না—
যজ্ঞেশ্বরের বোন : বল না সেজদা-
যজ্ঞেশ্বরের বউদি : বলো, ঠাকুরপো বলো—
যজ্ঞেশ্বরের সেজো খুড়ি : বলো বাবা আমার-
যজ্ঞেশ্বর : মা, তোমার বউ আনতে যাচ্ছি-
যজ্ঞেশ্বরের বোন ও বউদি : ও কী, ও কী!
যজ্ঞেশ্বরের মা ও সেজো খুড়ি : থাক থাক, আজকালকার ছেলে-
যজ্ঞেশ্বর ওকে বলল, মেনু-টেনু সব ছকুদার, বুঝলে। একেবারে চয়েসেস্ট। খাও ভাই, আমি ওদিকটা দেখি।
সত্যিই ভাল খাবার। ফিশ ফ্রাই, মিহি মুগের ডাল, পটলের ভিতর ডিম পুরে দোরমা, রাধাবল্লভী লুচি, চিংড়ির মালাইকারি, রুই মাছ, ফ্রায়েড রাইস, ফার্স্ট ক্লাস রেজালা, আনারসের প্লাসটিক চাটনি, পাঁপর, দই, রসগোল্লা, সন্দেশ আর তবক মোড়া পান। একেবারে নিট।
আসলে কাছ থেকে না দেখলে, ওর মনে হল, মানুষ সম্পর্কে ধারণা সাফ হয় না। ওর সামনে বসে প্রাক্তন সরকারের সংগ্রামী মন্ত্রীরা বেশ তারিয়ে তারিয়েই নেমন্তন্ন খাচ্ছেন। তাঁদের পাশে বসে সরকারি অফিসারেরা, তাঁদের পাশে যজ্ঞেশ্বরের শ্বশুর এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং এদিকে শচী, তার পাশে কেয়া এবং তার পাশে ও। বেশ সুন্দর পরিবেশ।
হঠাৎ কেয়া (মনে মনে) : কে সরকারি অফিসার আর কে সংগ্রামী নেতা——ওদের এই ভোজের আসরে দেখে তা বোঝা যায়?
ও চমকে উঠে (মনে মনে) : না, কেয়া প্লিজ, খক্ থক্ খক্—
কেয়া ওর দিকে মুখ তুলে চাইল।
বলল, জল খাও, জল খাও। বিষম লেগেছে।
ও লজ্জিত হয়ে কয়েক চুমুক জল খেয়ে নিল।
ও (মনে মনে) : আসলে আমরা মানুষকে দেখি পরে, আগে তার পোশাক, পদবি এইসবই দেখি তো। তাই সব সময় বুঝতে পারিনে, কে কী।
কেয়া (মনে মনে) : এখন দেখলে কে বলবে ওদের এত তেজ?
ও (মনে মনে) : আসলে আমরা তো ওদের দেখছি বর্তমানের সামাজিকতার পটভূমিতে। নয় কি? যখন আবার অন্য—
কেয়া (মনে মনে) : ওঁরা কে কী দিয়েছে জানো?
ও বিপন্ন হয়ে (মনে মনে) : সামাজিকতা মানুষকে-
কেয়া (মনে মনে) : একজন দিয়েছেন চূড়, আরেকজন দিয়েছেন কড়িয়াল, আরেকজন দিয়েছেন বেনারসি। দাম কত জানো?
ও (মনে মনে) : আসলে মানুষকে
কেয়া (মনে মনে) : তবে আমাদের সঙ্গে ওঁদের তফাত কোথায়?
ও ভাল করে লক্ষ করে তাঁদের খাওয়া দেখতে লাগল।
একজন : আরে আরে, করছ কী
ছকু, মেরে ফেলবে নাকি?
ছকু : সি-আর-পি যা পারেনি, তা কি আমি পারব?
হো হো করে সবাই হেসে উঠলেন।
আর একজন : না না, আর একদম না। একটাও না।
ছকু : এক পিস। মাছটা একেবারে ফ্রেশ। সোনারপুরের মাছ।
ছকু বকশি যে কেন এত ভাল শ্রমিক নেতা, এই ভোজের আসরে বসে ও তা যেন উপলব্ধি করল। প্রাক্তন মন্ত্রী মহোদয়েরা হাত গুটিয়ে নিয়েও রেহাই পাননি। ছকুর অনুরোধে আরও কয়েক পিস ফিশ ফ্রাই (কারণ মাছটা খুবই ফ্রেশ) কি মালাইকারি (কেননা বাগদা চিংড়ি ছকু একটা একটা করে নিজে বেছে এনেছে) কি রেজালা (বেস্ট মোগলাই রেস্তোরাঁর বাবুর্চিকে ছকু এনে কাজে লাগিয়েছে) তাঁদের নিতেই হয়েছে। এবং না না, আর না ছকু, দিস ইজ এ ক্রিমিন্যাল অ্যাক্ট, এসব বলতে বলতেও বাড়তি একটা দুটো রসগোল্লা কি সন্দেশও নিতে হয়েছে। তাঁদেরও, প্রশাসনের ও শান্তিরক্ষার কর্ণধারদেরও এবং অন্যান্য অভ্যাগতদেরও।
একমাত্র কেয়া আর ও, ওদের ব্যাচে ও দেখল, ওরা দু’জনই রেহাই পেয়ে গিয়েছিল। পরিবেশক এসে কেয়াকে এক পিস কি একটা নেবার জন্য উপরোধ করতেই সে গলা দিয়ে অদ্ভুত রকম একটা স্বর বের করে এমনভাবে বলল, আমি ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা’ অমান্য করে বিপদে পড়ি, আপনি নিশ্চয়ই এটা চান না—সে লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে পিসটা শচীর পাতে ফেলে দিল।
ছকু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ব্যাপারটা হালকা করে দেবার জন্য বললেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা—এটা সত্যমেব জয়তের মতোই বিরাট একটা রসিকতা, ও কথা মনে রেখে রেজালার স্বাদ গ্রহণ না করলে আমরা খুব দুঃখ পাব মিসেস্ বাগচি।
কেয়া বলল, রসিকতাটা আপনার কাছে খুবই হালকা, কিন্তু আমার পক্ষে অত্যস্ত গুরুপাক। অতএব মাফ করবেন।
শচী কেয়ার ভাবগতিক দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে বলল, ও খুব স্ট্রিক্ট ডায়েটে থাকে, জানেন ছকুবাবু। একটু এদিক ওদিক হলেই ভয়ানক আপসেট হয়ে পড়ে।
তা-ই বলুন। ছকু হাসতে হাসতে ওধারে চলে গেলেন। যাবার সময় শচীকে বলে গেলেন, আপনি আবার যেন স্যার ওই অজুহাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না।
খেপেছেন ছকুবাবু! নিয়মগুলো আছেই তো মাঝে মাঝে ভাঙবার জন্য। শচী হা হা করে হেসে উঠল।
.
বিয়েবাড়িতে আসবার আগে শচীর সংকল্প
শচী বেশ ভাল করে চান করে নিল। পরিষ্কার করে কামানোর ফলে ওর গাল দুটো বেশ মোলায়েম হয়ে উঠেছে। সে ওলড্ স্পাইসের বোতল খুলে দু’ আঁজলা আফটার-শেভ লোশন তার দু গালে থাবড়ে দিল। ওল্ড স্পাইস আফটার-শেভ লোশন…ব্রিস্ক অ্যাজ অ্যান ওশ্যান ব্রিজ। কুলস্, স্টিমুলেটস, রিফ্রেশেস, মেকস্ ইউ ফিল ওয়াইড অ্যাওয়েক অ্যান্ড ভেরি মাচ ইন কম্যান্ড। হ্যাজ দি ক্লিন ওলড্ স্পাইস অ্যারোমা এভরিওয়ান এনজয়েস।
আফিসের টেনশন অনেকটা কমে এল। ভুরভুরে গন্ধটা তাকে বেশ খানিকটা উৎফুল্লও করে তুলল। সে অভ্যাসবশে পোশাকের আলমারিটা খুলল; একটা হাল্কা স্যুট বেরও করে ফেলল।
এতক্ষণ পর্যন্ত তার কোনও সমস্যা ছিল না। তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপে তার চেনা ছিল। এবং যে প্রত্যয় থাকলে মানুষ অনায়াসে লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, সে প্রত্যয়টুকু তাতে বর্তমান ছিল। তারপর অকস্মাৎ যে মুহূর্তে তার মনে হল যজ্ঞেশ্বরের বিয়েতে কী স্যুট পরে যাওয়া তার ঠিক হবে, ব্যস, সেই মুহূর্ত থেকেই তার মনের প্রশান্তির ভিতটা টলমল করে উঠল। ননসেন্স, সে নিজেকেই ধমক দিল, হোয়াই অ্যাম আই সো শেকি?
কেয়াকে সে বলল, কেয়া, ধুতি পাঞ্জাবিই দাও।
এবং সে হুইসকির বোতলটা নিয়ে বসল।
কেয়া তৈরি হয়ে এসে শুধু বলল, এখন ওটা কি না-খেলেই নয়!
গেলাসে ঢালতে ঢালতে শচী বলল, জাস্ট এ স্মল ওয়ান। ফর দি রোড। ঠিক করলাম বিয়েবাড়িতে ধুতি পরেই যাক। বেশিক্ষণ থাকব না, বুঝলে। ও দ্যাট ক্রাউড! আজকাল একদম সহ্য করতে পারিনে। অ্যাভয়েড করা ঠিক হবে না, তাই যাচ্ছি। কারসি কল আর কি।
কেয়া বলল, গগন মুখুজ্জের মেয়ের সঙ্গে তো ওর বিয়ে হল। বিয়েতেই যেতে বলে গিয়েছিলেন। সেদিন যেতে পারলাম না তাই আজ যাচ্ছি। নইলে আমারও তেমন যাবার ইচ্ছে ছিল না।
শচী বলল, আমারও তা-ই। গগন মুখুজ্জে কে?
কেয়া বলল, বাবার কে মক্কেল। তবে এক সময় এক পাড়ায় ছিলাম। কাছাকাছি। বেশ যাতায়াত ছিল তখন। এখন গগনবাবুর বিরাট অবস্থা।
আয়েশ করে গেলাসে চুমুক দিতে দিতে শচী বলল, আচ্ছা! শচীর আবার টেনশন কমে এসেছে।
কেয়া বলল, বেশ দিয়ে-থুয়েই মেয়ের বিয়ে দেবেন। বড় জামাইকে তো কারখানাই করে দিয়েছিলেন। রত্না ওঁর মেজো মেয়ে।
শচী আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বলল, ওঁর আর মেয়ে নেই?
কেয়া বলল, না বোধহয়, কেন?
শচী বলল, না এমনি। বড় জামাই কারখানার মালিক। মেজো জামাই শ্রমিক নেতা। বেশ খুঁজে বের করেছেন তো!
কেয়া বলল, তা উনি কী করবেন! যজ্ঞেশ্বরবাবু কী করেন তোমাদের অফিসে?
শচী আবার একটা ঢালছে দেখে কেয়া বলল, আরও খাবে?
শচী বলল, দিস ইজ দি লাস্ট। এটা গগনবাবুর জামাই-ভাগ্যের জন্য। যজ্ঞেশ্বর ইজ এ নাইস চ্যাপ। এমনি একটা কাজ করে আমাদের ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানে হি ইজ মোর দ্যান এ জেনারেল ম্যানেজার।
আসলে শচীর অস্বস্তির এইটেই কারণ। কেননা শচী সম্ভবত মিঃ ধারিয়ার জায়গায় জেনারেল ম্যানেজার হতে যাচ্ছে। অফিসের হাওয়া থেকে তা-ই মনে হয়। গত দু’ বছর ধরে ধারিয়াকে যেভাবে নাস্তানাবুদ করেছে যজ্ঞেশ্বর তাতে তার কথা মনে হলেই শচীর টেনশন বেড়ে যায়।
শচী ঠিক করল, যজ্ঞেশ্বরের বউভাতে যাবে। যতটা সৌজন্য দেখাতে হয় দেখাবে, উপহারটা দেবে, তারপর শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
.
কেয়া আর ওর কথোপকথন : (মনে মনে)
কেয়া : আচ্ছা, শচী এত ড্রিংক করে কেন?
ও (অবাক হয়ে) : বাঃ! আমি তার কী জানি?
কেয়া : কেন, জানো না?
ও : তুমি ওর বউ, তোমারই তো জানা উচিত।
কেয়া : প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? তুমিও তো ওর বন্ধু।
ও : বন্ধু! ও হ্যাঁ। সে তো কবেকার কথা। তখন শচী তো আর এ-শচী ছিল না, আমিও আর এ-আমি ছিলাম না।
কেয়া : শচী কী শচী ছিল আর তুমিই বা কোন তুমি ছিলে?
ও : এটা তো আমার জানা কথা কেয়া। সে শচী ছিল কবি। ব্রিলিয়ান্ট কবি। তুমি যার প্রেমে পড়েছিলে। আমিও তার প্রেমে পড়েছিলাম, সে তো অনেকদিনের কথা।
কেয়া : হ্যাঁ, অনেকদিনের কথা। অনেক কষ্ট সহ্য করেছিল ভাল কবি হতে গিয়ে। আমাদের চাঁদা করে বিয়ে হয়েছিল। বাবা অনেক করে বুঝিয়েছিলেন শচীকে। বিয়ের সব খরচ দিতে চেয়েছিলেন। আমি বাবার কথা শুনিনি। শচীর কথাই রেখেছিলাম।
ও : হ্যাঁ। শচীর কথা আমিও অমান্য করতে পারতাম না।
কেয়া : আমরা কেউ পারতাম না। ও সবাইকে বাগ মানিয়েছিল।
ও : ওর চরিত্রের সেইটেই সব থেকে বড় আকর্ষণ। ও যেন কঠিন পাথরে দুটো পা রেখে কথা বলত, আর আমাদের পা যেন শূন্যে ভাসত, তাই মনে হত ও যা বলছে, তার উপরে আর কথা নেই।
কেয়া : তারপর?
ও : তারপর!
কেয়া : তারপর কী হল?
ও : তারপর আবার কী হবে। আমাদের সকলের বয়স বেড়ে গেল।
কেয়া : বয়েস বেড়ে গেল বলে বন্ধুত্ব ফুরিয়ে গেল! বাঃ!
ও : এতে অবাক হবার কী আছে?
কেয়া : অবাক হচ্ছি তোমার বুজরুকি দেখে। সত্যি কথাটা তুমি কিছুতেই বলতে চাইছ না।
ও : কোন্ সত্য গোপন করছি?
কেয়া : শচীর পায়ের তলায় এখন আর কোনও শক্ত মাটি নেই, এই সত্যটা। এটা ও জানে। তাই ও ভয় পায়। কোনও সিদ্ধান্ত আর নিতে পারে না।
ও : শচী কাকে ভয় পায়?
কেয়া : মিঃ মোহতাকে, যজ্ঞেশ্বরকে, পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেদেরকে, তোমাকে, আমাকে, এমন কি ওর নিজেকেও। সে এক ছেলেমানুষি ভয়। জানো তো, এক সময় ওর কাগজ পড়া কী রকম নেশা ছিল। আদ্যোপান্ত কাগজ না পড়লে ওর ভাত হজম হত না। এখন আমাদের বাড়িতেই আর কোনও কাগজ আসে না। সব বন্ধ করে দিয়েছে।
ও : কেন?
কেয়া : রোজ রোজ খুনের খবর বেরোয়। পাছে তাতে চোখ পড়ে, তাই।
.
ব্রিজের উপরে দু’জনে : গার্হস্থ্য চিন্তা
শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে এলে ওর বউ-এর কথা বলার ইচ্ছে জাগে। মিনুর এই একটা বরাবরের ক্ষোভ। সে তার স্বামীর সঙ্গে কিছুতেই আশ মিটিয়ে কথা বলতে পারে না। তার সংসারে হাড়ভাঙা খাটুনি তার গায়ে লাগে না। কিন্তু তাকে কেউ গ্রাহ্য করছে না, এটা তার ভীষণ মনে লাগে। বিশেষ করে সে যখন তার স্বামীর সঙ্গে দুটো কথা বলতে যায়, এমন হাতি-ঘোড়া কথা কিছু নয়, সাধারণ সাদামাটা কথা, সে দেখে তার স্বামী হয় বই মুখে করে বসে আছে, না হয় হাই তুলছে, তখনই তার উৎসাহ নিবে যায়। তার প্রচণ্ড অভিমান হয়। সে কি তবে কিছু না? আর যখনই তার মনে হয় সে কিছু না, তখনই তার মনে পড়ে ওদের জন্য সে কত করে। ওরা তার দান দু’ হাত ভরে নেয় এবং এক কানাকড়ি প্রতিদান কেউ দেয় না। ওরা এতই স্বার্থপর! এসব কথা যখন তার মনে হয় তখন সে বোধ করে সংসারটা দ্রুত পেঁচিয়ে ধরছে। তার দেহে, তার গলায় ফাঁস পড়েছে। টান পড়ছে। অনেক রাতে আতঙ্কে তার ঘুম ভেঙে যায়। থাকে; তার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। অথচ আশ্চর্য, সে শুয়ে শুয়ে দেখে, সে যে যন্ত্রণা পাচ্ছে, সে মরছে তিলে তিলে, এ নিয়ে কোথাও কোনও চাঞ্চল্য নেই।
একটা দড়ি হয়ে তাকে ফাঁসে ক্রমে টান পড়ছে, সে গলগল করে ঘামতে
খুব কম সময় আসে তার জীবন যখন তার ভাল লাগে। যেমন এখন। তাই তার কথা বলার ইচ্ছে জাগে। মিনু তার স্বামীর মুখের দিকে চাইল। ওর চোখ দুটো কোন সুদূরে চলে গেছে। একেবারে তন্ময় হয়ে কী ভাবছে। ওর মুখখানা বেশ নরম, বেশ করুণ হয়ে এসেছে। কী যেন বলছিল একটু আগে ফিসফিস করে। কোথায় যেন যেতে বলছিল তাকে। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, লেকে যেতে চাইছিল তাকে নিয়ে। মিনুর তাপদগ্ধ বয়স্ক শরীরটাতেও একটা শিহরন খেলে গেল। লেকে যেতে চাইছিল মিনুর স্বামী তাকে সঙ্গে নিয়ে। ভরপেট নেমন্তন্ন খেয়ে। কিন্তু সে কলকাতা কি আর আছে বউদি! যজ্ঞেশ্বরের এক বোন মিনুকে বলেছিল।
হঠাৎ যেন একটা ভয়ানক জরুরি কথা মনে পড়ে গিয়েছে, মিনু সেইভাবে বলল, যজ্ঞেশ্বরবাবুর এক বোনকে আমি চিনি, জানো?
আচমকা ওর বউ-এর কথাটা ও ধরতে পারল না। আসলে অন্যমনস্ক ছিল। কেয়া তখন ওর মগজে। ও খুব বিব্রত হয়ে উঠল।
কেয়া বলল, শচী যজ্ঞেশ্বরদের বাড়িতে জাস্ট এ কারস্ িকল দিয়ে সরে পড়বে বলে এসেছিল। তুমি কি তা জানো?
ও বলল, তাই নাকি!
মিনু বলল, হ্যাঁ। ও যে আমাদের সমিতিতে আসত। ও যে যজ্ঞেশ্বরের বোন তা আমি অবিশ্যি এখানে এসেই জানলাম। মেয়েটা বেশ ভাল। ওরই মধ্যে বেশ যত্ন করে আমাকে কে কী দিয়েছে, দেখাল। পেয়েছেও খুব।
কেয়া বলল, শচী আসবার আগে তো আমাকে তা-ই বলল।
ও বলল, তাই বুঝি!
মিনু বলল, ওরা তো ওপাড়া থেকে চলে এসেছে। ওদের বাড়িতে তো খুব বোমা-টোমা পড়েছিল। যজ্ঞেশ্বরের ভাইকে একদিন পাইপগান নিয়ে তেড়েও এসেছিল। ওর বোন বলল, অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এলাম বউদি। না হলে কত বড় বাড়ি ছিল আমাদের। আর জলের দরে ভাড়া। যুদ্ধের মধ্যে আমার বাবা ওই বাড়ি ভাড়া করেছিলেন। পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায় আটখানা ঘর। আমাদের জন্মকম্ম সবই ওখানে। ওর বোন বলল কী জানো, এ পাড়াটা ওর দাদাদের দলের মুঠোয়। তাই এদিকে ওরা নিশ্চিন্ত।
কেয়া বলল, সেই শচীকে দেখলে তো। এল, ঘুরে ঘুরে গল্প করল, রসিকতা শুনল, রসিকতা করল, কত খেল। ও এত খায় না। মিঃ মোহতাকে খুশি রাখার ব্যাপার এটা নয়। ও যেন যজ্ঞেশ্বরের গুড বুকে ওঠার চেষ্টা করছে।
ও বলে উঠল, কী যে বলো!
মিনু বলল, হ্যাঁ। ওর বোন বলল যে। ওরা ভয়ে চলে এসেছে।
কেয়া বলল, আমি বলছি, শচী ভয় পেয়েছে। যজ্ঞেশ্বরকে, কেন জানিনে, ও ভয় করছে।
ও বলল, এ তোমার নিছক কল্পনা। এতে ভয়ের কী দেখলে!
মিনু বলল, ওর বোন বলল। আমি কি বানিয়ে বলছি। ওর বোন বলল, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ওদের চলাফেরা অবধি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সিনেমায় যেতে পারত না, বাজারে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল ওরা। শুধু যজ্ঞেশ্বর আর তার দাদাকে ওদের দলের ছেলেরা পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত। একা বেরোতে ওরা সাহস পেত না।
কেয়া বলল, বিয়েবাড়িতে আসার আগে শচী হঠাৎ দুটো হুইসকি খেয়ে নিল। যাতে ও এখানে আসতে সাহস পায়।
মিনু বলল, আমার তো মনে হয়, এ পাড়ায় এসেও ওরা খুব একটা নিশ্চিন্ত নেই। বাড়ির বাইরে কত পুলিশ, দেখেছিলে!
কেয়া বলল, পুলিশের বড় বড় কর্তাদের সঙ্গে শচী কীরকম ভাব জমাচ্ছিল, লক্ষ করেছিলে!
ও বলল, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে!
ও একথা বলল বটে, কিন্তু অকস্মাৎ নিজেই একটা অস্বাভাবিক কাজ করে বসল। ব্রিজের রেলিংটায় দু’হাতে ভর দিয়ে গোরিলার মত ঝুঁকে দাঁড়াল। তারপর আকাশ ফাটিয়ে হা হা করে হেসে উঠল। তারপর যাতে আকাশ-পাতাল কেঁপে ওঠে, মনে মনে তেমনিভাবে চেঁচিয়ে বলল, আর যাদের দলের ছেলে নেই, পুলিশ অফিসার নেই, হুইস্কি নেই, তারা কী করবে! ইউ বাস্টারস!
.