খেলনা ভালুক

ভলিউম ৫০ – খেলনা ভালুক – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: ২০০২

০১.

গোবেল বীচ গাঁয়ের পথ ধরে সাইকেল চালাচ্ছে জিনা। পাশে তার বন্ধুরা, কিশোর, মুসা আর রবিন। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। তবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে এ রকম হবেই। চকচক করছে তার চোখ। ঠাণ্ডা আবহাওয়া খারাপ লাগে না তার, যদি দিনটা হয় মেঘমুক্ত, উজ্জ্বল। অন্যদেরও খারাপ লাগছে না। গান গাইছে চারজনেই। কেউ গলা ফাটিয়ে, কেউ গুনগুন করে।

চারটে সাইকেলের পাশে দৌড়াচ্ছে রাফি, গা আর পায়ের পাতা গরম করার চেষ্টা করছে। পাঁচজনের মধ্যে এই একটি চরিত্র, যার ভাল লাগছে না এই আবহাওয়া। কান চেপে রেখেছে মাথার সঙ্গে। কারণ মাথা গরম রাখার আর কোন ব্যবস্থা নেই তার। উলের গরম টুপি নেই মানুষের মত। ঘরে থাকলে অবশ্য এই কষ্টটা করতে হত না, তবে সেটা চায় না সে। জিনাকে ফেলে একলা থাকতে ভাল লাগে না তার। মাঝে মাঝে হেঁড়ে গলায় ডেকে উঠছে ঘাউ ঘাউ করে। তাতে গানের সঙ্গে সঙ্গত হচ্ছে না, বরং বেসুরো বেতাল করে দিচ্ছে।

রাস্তার শেষ মোড়টা পেরোতেই চোখে পড়ল সামনে গোবেল বীচ গির্জার উঁচু স্তম্ভ।

এসে গেছি, খুশি খুশি গলায় বলল জিনা। দেখো, গ্রামটাকে কি রকম বদলে দিয়েছে বড় দিনের উৎসব।

গাঁয়ের সবচেয়ে বড় দোকান গোবেল বীচ স্টোর। সেটার সামনে আসার আগে সাইকেল থেকে নামল না ওরা। নানা রকম জিনিস বিক্রি হয় দোকানটায়। জানালার কাছে শো-কেসে অসংখ্য খেলনা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আর রয়েছে উপহারের বিভিন্ন সামগ্রী। থাকবেই। কারণ আজ হলোগে ক্রিসমাস ইভের আগের দিন।

ইস্কুল ছুটি। গোবেল বীচে, জিনাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। জিনার আব্বা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জনাথন পারকার আর জিনার আম্মা মিসেস ক্যারোলিন, তিন গোয়েন্দার কেরিআন্টি, ভীষণ আদর করেন ওদের। এখানে এলে একেবারে ঘরোয়া পরিবেশ পেয়ে যায় ওরা। তার ওপর লেখাপড়ার চাপ না থাকলে তো কথাই নেই। তাই ছুটি কাটানোর কথা ভাবলে প্রথমেই মনে চলে আসে গোবেল ভিলার কথা। এটা হলো জিনাদের বাড়ির নাম। সত্যিই যেন চিরবসন্ত বিরাজ করে এই বাড়িটাতে। এখানে যেন শুধুই সুখ, দুঃখ নেই। বাড়িটা অনেক বড়। বহু বছরের পুরানো। কিনে সংস্কার করে নিয়েছেন জিনার আব্বা।

 সেদিন সকালে ছেলেমেয়েদেরকে ডেকে বাজার করে আনতে বললেন কেরিআন্টি। সেজন্যেই বেরিয়েছে ওরা।

এই দেখো! প্রায় চিৎকার করে উঠল রবিন। জানালার কাঁচে নাক ঠেসে ধরেছে। দারুণ সুন্দর, না? ওই যে ওই জেট প্লেনটা? আর ওই যে ওই ইলেকট্রিক ট্রেন, কি বিশাল! আর…কিন্তু আন্টিকে তো এগুলো উপহার দিতে পারব না…

জিনা আর মুসাও জানালার কাঁচে নাক চেপে ধরে খেলনা দেখছে।

হ্যাঁ, ভাল ভাল খেলনা আছে, একমত হল মুসা। আর ওই যে সাইকেলগুলো দেখো। কি সুন্দর! কোন্ কোম্পানির বুঝতে পারছি না। ওরকম একটা সাইকেল পেলে চুটিয়ে চালাতে পারতাম, যেখানে খুশি যেতে পারতাম। ভাড়া করা সাইকেল দিয়ে কি আর মজা হয়।

এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলনা আর সাইকেল দেখলে কাজ হবে না, তাগাদা দিল কিশোর। জিনিসপত্রগুলো কিনে ফেলা দরকার। আন্টি নিশ্চয় বসে আছেন। তাড়াতাড়ি যেতে বলে দিয়েছেন মনে নেই?

ঠেলে দোকানের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সে। পেছনে ঢুকল অন্য তিনজন। ভেতরে উজ্জ্বল আলো। আর বেশ গরম। সব কিছুতেই কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব গন্ধ। বাজারের তালিকা নিয়ে কাউন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ওরা।

জিনিসপত্র বের করে সাজিয়ে গুছিয়ে প্যাকেট করে ব্যাগে ভরে দিল সেলসম্যান। হিসেব মিলিয়ে দাম মিটিয়ে দিল কিশোর। বেরোনোর আগে আরেকবার ঘুরে ঘুরে দেখল রবিন আর জিনা। অনেক চমৎকার জিনিস রয়েছে, দেখলেই কিনতে ইচ্ছে করে।

দোকানের একজন কর্মচারী এককোণে একটা মলাটের বড় বাক্স খুলছে। বয়েসে তরুণ। নাম ডিক, তাকে চেনে জিনা! জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?

মুখ তুলে তাকিয়ে হাসল লোকটা। বলল, আরে, তুমি। ওরা কারা? বন্ধু বুঝি?

হ্যাঁ।

তা বন্ধুদের নিয়ে চলে এসো না আমাদের বাড়িতে। বড়দিনের দাওয়াত।

আরও অনেক দাওয়াত পেয়েছি, হেসে বলল জিনা। দেখি, চেষ্টা করব যাওয়ার। থ্যাংক ইউ।

বাক্সটা খোলা শেষ করল ডিক। ইতিমধ্যে মুসা আর কিশোরও এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। এ-হপ্তায় সাংঘাতিক বিক্রি হচ্ছে, তরুণ কর্মচারী জানাল। বিশেষ করে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর জিনিসপত্র। লোকের কাণ্ড! কিনতেই যখন হবে আগে কিনলেই হয়ে যায়। অনেক ঝামেলা বেঁচে যায়। দামেও সস্তা পায়। তা না। কিনবে তো কিনবে, একেবারে শেষ মুহূর্তে। তবে লোকের দোষও একতরফা ভাবে দেয়া যায় না। কোম্পানিগুলোরও দোষ আছে, যারা বানায়। আরে বাবা আরেকটু আগে বানিয়ে দিলে কি এমন ক্ষতি হয়? দিলি তো দিলি, সেই পনেরো দিন পর। পনেরো দিন ধরে বসে আছি এই ভালুকগুলোর জন্যে।

বড় বাক্সের ভেতর থেকে ছোট একটা বাক্স বের করল সে। ভেতরে আরও দুটো ওরকম বাক্স রয়েছে। একটা বাক্সের ডালা খুলে দেখাল ছেলেমেয়েদেরকে। ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট খেলনা ভালুক সাজানো রয়েছে। বিভিন্ন রঙের। গাঢ় লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সাদা, বেগুনি আর কমলা।

আরে, দারুণ তো! রবিন বলল। এগুলো অবশ্য উপহার দেয়া যায়। কেরিআন্টি সাজিয়ে রাখতে পারবেন।

ক্রিসমাস ট্রি ভালুক দিয়ে সাজাতে দেখিনি আর কখনও! অবাক হয়ে বলল কিশোর।

আসলে, ডিক বলল। ট্রি সাজানোর জন্যে নয় এগুলো। ম্যাসকট হিসেবে ব্যবহার হয়। গাড়ির মধ্যে ঝুলিয়ে রাখে না লোকে, ওরকম। এই কিছুদিন আগেও এ রকম খেলনা ঝোলানোর ধুম পড়ে গিয়েছিল। এখন একটু কমে এসেছে। তবে এ রকম ভালুক জনপ্রিয় হয়ে গেছে বেশ, বিশেষ করে এদিকটায়। তাই আমার বস্ মিস্টার ফোকসন বেশি করে অর্ডার দিয়েছেন এবার। মনে করছেন বড়দিনের সময় বেশি বিক্রি হবে। লোকের তো ঠিকঠিকানা নেই, হয়তো ট্রিতেও নিয়ে গিয়ে ঝুলিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু দিল তো অনেক দেরি করে, জিনা বলল। লোকের কি আর কেনার সময় আছে? কেনাকাটা যা করার করে ফেলেছে। কালকের আগে বেচে শেষ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। অনেক আছে।

তিন ডজন। একেক বাক্সে এক ডজন করে, জানাল ডিক। অত ভাবনা নেই। আগে না হলেও পরে হবে। সুন্দর জিনিস। লোকে কিনবেই। বারোটার অর্ডার ইতিমধ্যেই এসে গেছে, হাসল সে। মিস্টার মরিস দিয়েছেন। তার মানে বারোটা বিক্রি হয়ে গেছে ধরে রাখা যায়। তার মেয়ে পলি বন্ধুদের নিয়ে একটা পার্টি দেবে। সেজন্যেই কিনছে। ক্রিসমাস পার্টি। ক্রিসমাস ট্রিতে লাগাবে এই ভালুক। যাই, ফোন করিগে তাকে। এসেছে যে খবরটা দিই।

জিনা হাসল। হ্যাঁ, পলি যে পার্টি দিচ্ছে জানি। আমাদেরকেও দাওয়াত করেছে। যাই বলেন, ভালুকগুলো কিন্তু সুন্দর। ট্রিতে ঝোলালে ভালই লাগবে। অন্যান্য সাজ আর আলোতে একেবারে ঝলমল করবে, যা সুন্দর রঙ!

নীল রঙের একটা ভালুক হাতে নিয়ে দেখতে লাগল রবিন। বাদামী কাঁচের চোখ যেন জ্যান্ত হয়ে আছে ওটার। ঝিক করে উঠছে আলো লাগলেই। নরম মখমলের শরীর। আদর করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, বাহ, খুব মিষ্টি!

তার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর। বলল, নিয়ে নাও। কেরিআন্টির পছন্দ হবে।

ভালুকটার দাম মিটিয়ে দিচ্ছে রবিন, এই সময় দোকানের একধারে ডন নামে একজনকে ডাকল কেউ।

কমে গেল একটা, হাতের বাক্সটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল ডিক। মিস্টার মরিসকে বারোটা পুরো করে দিতে হলে আরেকটা বাক্স খুলতে হবে। থাক এখন। খোলার সময় নেই। পরে।

আমরা খুলে দেব? সাহায্য করতে চাইল জিনা।

না, না, লাগবে না। থ্যাংক ইউ। অসুবিধে হবে না। কিছু জরুরী কাজ আছে, সেগুলো সেরে নিই আগে। কয়েকটা ভালুককে শো-কেসেও সাজাতে হবে, লোকের নজর কাড়ার জন্যে। অনেক সময় আছে। কাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখব। গুডবাই।

তার পরদিন বিকেল চারটে। জমজমাট হয়ে উঠেছে ডক্টর মরিসের বাড়ির পার্টি। তার মেয়ে পলি, জিনার বয়েসী, খুব খাতির যত্ন করছে মেহমানদের। ক্রিসমাস ট্রির। চারপাশে জড়ো হয়েছে তার বন্ধুরা। অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস দিয়ে সাজানো হয়েছে গাছটা। চকচকে রঙিন কাগজের মোড়ক, সিল্কের ফিতে, কাগজের ফুল, ঘোট ঘোট রঙিন বালব, আর সাজানোর আরও নানা জিনিস যা যা পেরেছে, সব লাগিয়েছে এতে। এমনকি বারোটা রঙিন ভালুকও ঝুলছে গাছের ডালে।

বিরাট ঘরের এককোণে বিশাল এক টেবিল বোঝাই নানা রকম লোভনীয় খাবার। কোন কিছুর কমতি রাখেনি পলি। বন্ধুদেরকে খুশি করার জন্যে সব রকম চেষ্টা করেছে সে।

প্লেটে করে হাতে হাতে খাবার দেয়া হলো। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠল পলি। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরছে, তদারকি করছে। এটা সেটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আরও খাবার নেয়ার জন্যে চাপাচাপি করছে। কেউ নিতে না চাইলে জোর করে তুলে দিচ্ছে তার প্লেটে।

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে খেলার আয়োজন করল পলি। চমৎকার জমল মিউজিক্যাল চেয়ার। হৈ-হুঁল্লোড় আর হাসাহাসি চলল একনাগাড়ে।

তুমি ঠকিয়েছ, বব!

কে বলে রে! তুমি যে রবিনকে ধাক্কা মারলে সেটা কি?

না, আমি মারিনি! সে-ই বসতে পারেনি ঠিকমত!

বাইরে রাত নামছে। দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে গেল। পরীর রাজ্যের পরীরানীর বাগান থেকে যেন তুলে আনা হয়েছে ক্রিসমাস ট্রিটা। এতই সুন্দর, এতই ঝলমলে।

এবার পুরস্কার দেয়া হবে, ঘোষণা করল পলি। ক্রিসমাস ট্রিতে ঝোলানো রয়েছে উপহার সামগ্রী, সেগুলো খুলে আনল সে। আরও নানা রকম জিনিস রয়েছে বাক্সে, টেবিলে স্তূপ করে রাখা। এক এক করে নাম ধরে ডাকতে শুরু করল পলি, ডায়না, এসো। এই দেখো, কি সুন্দর একটা পোশাক। নার্সের ইউনিফর্মের মত লাগে দেখতে, না?

খুব সুন্দর! এ রকমই একটা জিনিস চাইছিলাম, খুশি হয়ে বলল ডায়না।

মুসা আর জিনা পেল রোলার-স্কেট।

গুড! হেসে বলল জিনা। দুজনে এক জিনিস পেয়ে ভাল হলো। পাল্লা দিয়ে স্কেট করতে পারব।

কিশোর পেল বহু ফলাওয়ালা একটা ছুরি। রবিনকে দেয়া হলো চামড়ার একটা চমৎকার নোটবুক। রাফিকে পর্যন্ত দেয়া হলো একটা পুরস্কার। রবারের একটা হাড়, গলায় ঝোলানোর জন্যে, দেখতে একেবারে আসল হাড়ের মতই লাগে। কামড় বসিয়ে দিল রাফি। যখন দেখল রবার, ফেলে দিল মুখ থেকে।

তারপর হঠাৎই দপ করে নিভে গেল সমস্ত বাতি। আলোয় ঝলমল ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠল একটা ছোট মেয়ে। তার পর পরই আরও কয়েকজন চেঁচাল।

ভয় পেও না, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। ভয়ের কিছু নেই নিশ্চয় ফিউজ কেটে গেছে। ছোটাছুটি কোরো না। গায়ের ওপর পড়বে জিনিসপত্র ফেলে দেবে। ফিউজটা লাগিয়ে দিলেই আলো জ্বলে যাবে আবার

কিশোরের পরামর্শ কেউ শুনল, কেউ শুনল না ত চেঁচামেচি কমে এল। অনেকখানি। শোনা গেল ডক্টর মরিসের ভারী গমগমে কণ্ঠ, সমস্ত কোলাহল। ছাপিয়ে, শোনো, গোলমাল কোরো না কেউ। চুপ করে থাকো আমি সেলারে যাচ্ছি, ফিউজটা লাগিয়ে দেব।

তার কথাও অনেকেই শুনল না। কথা বলতে লাগল কেউ কেউ নড়তে শুরু করল অন্ধকারের মধ্যেই। দরজার কাছে রয়েছে মুসা। বাতাস লাগল গায়ে। ফিরে তাকিয়ে দেখে, কে যেন বেরিয়ে যাচ্ছে। কাপড়ের ঘষা লাগল তার মুখে। এক পা বাড়াল সে, কে দেখার জন্যে। জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঠেলে দিল আবার তাকে মূর্তিটা।

এই, শুনুন, শুনুন! চিৎকার করে বলল মুসা। কি করছেন?

তার কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর আর রাফি ছুটে বেরিয়ে গেল কুকুরটা একটু পরেই বাগানে শোনা গেল তার উত্তেজিত চিৎকার।

ব্যাপার কি? অবাক হলো কিশোর। কে বেরোল? দরজা খোলা ফেলে। রেখে?।

কাউ করে উঠল রাফি ব্যথায়। কেউ মেরেছে মনে হয় তাকে।

 রাফি! ডাকল কিশোর। কি করছিস ওখানে?

বেরোতে যাবে সে, এই সময় আলো জ্বলে উঠল। হাসিমুখে ফিরে এলেন ডক্টর মরিস। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে গিয়েই থমকে গেলেন ছেলেমেয়েদের মাথার ওপর দিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। চোখে বিস্ময়। তাঁর এই অবস্থা ওদেরকেও অবাক করল। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল তার দৃষ্টি অনুসরণ করে। বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল ওরাও।

আরে, ক্রিসমাস ট্রিটা কই!

নেই তো!

হলো কি!

চুরি করেছে।

 হ্যাঁ হ্যাঁ, চুরি করে নিয়ে গেল কে যেন!

.

০২.

অবাক কাণ্ড! ক্রিসমাস ট্রি চুরি করার কথা কে কবে শুনেছে? তবে সেটা মেনে না। নিয়েও উপায় নেই জায়গামত নেই ওটা। ঘরের কোথাও নেই ডক্টর মরিস আর মিসেস মরিস স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে চুরিই হয়েছে ওটা আর কোন ব্যাখ্যা নেই বাতাসে তো মিলিয়ে যেতে পারে না।

আরেকটা ব্যাপার দেখে এসেছেন ডক্টর মরিস। ফিউজ কাটেনি। মেইন সুইচ অফ করে দেয়া হয়েছিল। তারমানে ওটা অফ করে আলো নিভিয়েছে চোর গাছটা চুরি করার জন্যে। কিন্তু কে করল?

শুনছেন, আংকেল? কিশোর বলল। আমার কুকুরটা এখনও ঘেউ ঘেউ করছে। বাগানে। নিশ্চয় চোরের পিছু নিয়েছিল।

দরজার দিকে দৌড় দিল সবাই। হুড়াহুড়ি শুরু করে দিল। আগে গেছেন ডক্টর মরিস। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে চলেছে রাফি। বাগানের গেট বন্ধ থাকায় বেরোতেও পারছে না, ফলে রেগে গেছে আরও। রাস্তায় একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো, একটা ভ্যান চাঁদ উঠেছে। সেই আলোয় মুসা আর কিশোর দেখতে পেল গাড়িটার পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে ক্রিসমাস ট্রির দুটো ডাল।

ওই যে যাচ্ছে! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। চোর! চোর!

মুসার মনে পড়ল, অন্ধকারে ঘষা লেগেছিল তার মুখে। অবশ্যই গাছের ডালের, কোন ভুল নেই তাতে। কিন্তু কে এই কাজটা করল? একটা ক্রিসমাস ট্রি চুরি করে কি লাভ? এমন কোন দামী বস্তু নয় ওটা, অবশ্যই টাকার হিসেবে। বিক্রি করতে পারবে না। তাহলে এত কষ্ট করে এ রকম একটা জিনিস চুরি করতে এল কেন?

ডক্টর মরিস আর তার স্ত্রীও একই কথা বলাবলি করতে লাগলেন, কে চুরি করল? কেন? পাগল-টাগল নাকি?

ছেলেমেয়েদেরকে আবার ঘরে যেতে বললেন তারা। বাইরে থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। ঘরে এসে পুলিশকে ফোন করলেন ডক্টর মরিস, চুরির খবর দিলেন। দেরি হলো না। খানিক পরেই দুজন পুলিশম্যান এসে হাজির। সবাইকে অনেক অনেক প্রশ্ন করল তারা। নোটবুকে লিখে নিয়ে চলে গেল। ওরাও অবাক হয়েছে। কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছে না কেউ, এ রকম জিনিস চুরির জন্যে এতটা ঝামেলা কেন করতে গেল চোর!

জিনাদের বাড়িতে ফিরে এল জিনা আর তার বন্ধুরা। চারজনের মুখে কেবল একই কথা, ক্রিসমাস ট্রি চুরি। ভাবছে, আলোচনা করছে। যতই করছে, ততই অবাক হচ্ছে। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না।

চোরেরা গাছটা নয়, অনুমানে বলল রবিন, উপহারগুলোই চেয়েছে। খুলে নিতে অনেক সময় লাগত। তাই গাছটাই তুলে নিয়ে গেছে।

আমার তা মনে হয় না, জিনা বলল। উপহারগুলো ভাল, সন্দেহ নেই। তবে তেমন দামী নয় যে চুরি করতে আসবে। না, গাছটাই ওদের দরকার ছিল। প্ল্যানট্যান করেই এসেছে।

কিন্তু ক্রিসমাস ট্রি একটা সাধারণ ফার গাছ, মুসা বলল। এটা দিয়ে কার কি কাজ হবে? ক্রিসমাসের পরে এটার কোন প্রয়োজনই নেই।

কি জানি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। এই বিশেষ গাছটা দিয়ে হয়তো হবে। কি হবে সেটা যদি বুঝতে পারতাম!

রাত হলে শুতে গেল সবাই। চারজনেরই মাথায় ঘুরছে শুধু গাছটার ভাবনা। অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসছে মনে। জবাব মিলছে না কোনটারই।

কিশোর ভাবছে আরেকটা কথা। ক্রিসমাস ট্রি চুরি হয়েছে যখন, নিশ্চয় এর পেছনে কোন রহস্য রয়েছে। তবে কি আরেকটা রহস্য এসে হাজির হয়েছে ওদের কাছে? সমাধানের জন্যে? এলে ভালই হত। রহস্য পেলে ভাল লাগে। আর এ রকম জটিল আর আশ্চর্য হলে তো কথাই নেই।

*

পরদিন সকালে আরেকটা রহস্য পাওয়া গেল। রাতে ঘুমাতে দেরি করে ফেলেছে, পরদিন তাই ঘুম ভাঙতেও বেলা হয়ে গেল। নাস্তার টেবিলে এসে বসল গোয়েন্দারা। খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে বাজারে গিয়েছিলেন কেরিআন্টি। ওরাও বসল, তিনিও ফিরলেন। সাথে করে নিয়ে এসেছেন কিছু চমৎকার কেক, আর একটা দারুণ খবর। আগের দিন রাত দুটোয় নাকি গোবেল বীচ স্টোরে চোর। ঢুকেছিল।

তাজ্জব ব্যাপার, বুঝলি জিনা, আন্টি বললেন। এত কষ্ট করে ঢুকল চোর। কিন্তু কিছুই নিল না। শুধু কিছু খেলনা ভালুক ছাড়া। বাক্সে ভরা ছিল, নিয়ে চলে। গেছে। শো-কেসে ছিল একটা না দুটো, তা-ও নিয়ে গেছে। মিস্টার ফোকসন বললেন, পুলিশও নাকি অবাক হয়েছে। কি ব্যাপার, বুঝতে পারছে না। ওদের ধারণা। হয় চোরটা পাগল, নয়তো বড়দিনে রসিকতা করেছে।

আজব ব্যাপার! কিশোর বলল।

 হ্যাঁ। সে-রকমই লাগছে, বলল মুসা।

কয়েকটা খেলনা ভালুক শুধু? জিনা বলল। আর কিছুই নেয়নি? কোন মানেই হয় না এর।

নাহ! মাথা নাড়ল মুসা।

পলির গাছ চুরির চেয়ে আজব কিন্তু নয় ব্যাপারটা, বলল কিশোর।

কি যেন ভাবছে রবিন। মোলায়েম গলায় বলল, মনে আছে, গাছটা থেকে সমস্ত উপহার খুলে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভালুকগুলো সব রয়ে গিয়েছিল। গাছের সঙ্গে ওগুলোও নিয়ে গেছে চোর।

রবিনের মত একই খাতে বইতে শুরু করল মুসা, জিনা আর কিশোরের ভাবনাও।

ঠিকই বলেছ, কিশোর বলল। লোকটা পাগলই হবে। খেলনা ভালুকের ওপর তার লোভ। যেখানেই দেখেছে, লোভ সামলাতে না পেরে তুলে নিয়ে গেছে।

তবে আইডিয়াটা এতই হাস্যকর মনে হলো, হাসির পাত্র হওয়ার ভয়ে কারও কাছে কথাটা বলল না ওরা। বলার মত আর কেউ তখন অবশ্য নেইও ওখানে। আন্টি চলে গেছেন রান্নাঘরে। হাঁড়িপাতিলের খুটখাট শব্দ হচ্ছে। লোভনীয় গন্ধ আসছে। কোথায় কার গাছ চুরি হলো, ভালুক চুরি হলো, পারকার আংকেলের এ সব ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা নেই। তিনি গিয়ে ঢুকেছেন তার পড়ার ঘরে। নিশ্চয় জটিল কোন বৈজ্ঞানিক থিউরি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন এখন।

কি আলোচনা হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না রাফি। যেন সেটাই জিজ্ঞেস করল, ঘাউ! অর্থাৎ ব্যাপার কি? কি নিয়ে অমন মাথা গরম করছ তোমরা?

রাফি, তুই কি ভাবছিস বল তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর, আসলে নিজেকেই করল প্রশ্নটা। বলছি বটে পাগল, কিন্তু সে-রকম ভাবতে পারছি না লোকটাকে। এর অন্য কোন ব্যাখ্যা আছে…

খেলনা ভালুক সংগ্রহ করে না তো? বাধা দিয়ে বলল মুসা।

না, মাথা নাড়ল জিনা। সংগ্রাহক হলে একজন হত। ভেবে দেখো, ক্রিসমাস ট্রিটা যথেষ্ট ভারী। সেটাকে নিয়ে ভ্যানে তুলে ওরকম তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া একজনের পক্ষে সম্ভব না। কমপক্ষে দুজন। পাগল হলেও একজন হত। তারমানে সগ্রহ কিংবা পাগলামি কোনটাই নয়।

ঠিকই বলেছ, একমত হলো কিশোর। কয়েকটা খেলনা ভালুক জোগাড়ের জন্যে শুধু এতসব করেনি লোকগুলো।

কি মনে হয় তোমার? ওই ভালুকগুলোর কোন বিশেষত্ব আছে?

থাকতে পারে। সে-কথাই ভাবছি আমি।

সে-কারণেই যেখানে যত ভালুক পেয়েছে সব তুলে নিয়ে গেছে ওরা। গাছটা নিয়েছে, দোকানের বাক্সগুলো নিয়েছে, এমনকি শো-কেসে একটা যে ছিল, সেটাও নিয়ে গেছে। তার মানে জানত কোথায় ওগুলো পাওয়া যাবে।

হ্যাঁ, একেবারে ঝেড়েপুছে নিয়ে গেছে, কিশোর বলল। একটাও রাখেনি।

এখন কি করবে ওরা? মুসার প্রশ্ন। সব তো নিল…

না, সব নিতে পারেনি, হাত নাড়ল রবিন। একটা রয়ে গেছে আমার কাছে। যেটা আন্টিকে উপহার দিতে কিনেছি।

তাই তো!

রবিন, উত্তেজিত কণ্ঠে কিশোর বলল। জলদি যাও! নিয়ে এসো!

ছুটে ওপরতলায় চলে গেল রবিন। একটু পরেই ফিরে এল নীল ভালুকটা নিয়ে।

কৌতূহলে ফেটে পড়ছে চারজনেই। গাঁ ঘেঁষাঘেঁষি করে এল দেখার জন্যে। কিছুই অস্বাভাবিক লাগছে না খেলনাটার। সাধারণ, ছোট, নরম একটা জিনিস, যেটার কোন বিশেষত্বই চোখে পড়ল না।

নাহ! মাথা নাড়তে লাগল মুসা। কিছু নেই। বাকিগুলোও, যেগুলো দেখেছিলাম, একই রকম দেখতে। ছোট ছোট, সুন্দর। তবে অস্বাভাবিক কিছুই নেই।

ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়, কিশোর বলল। আমার মনে হচ্ছে দুটো চুরিরই কোন একটা সম্পর্ক আছে। আচ্ছা, রহস্যটা কি তা বের করলেই তো পারি আমরা? অন্তত করার চেষ্টা তো করতে পারি?

অন্য তিনজনও ভেবে দেখতে লাগল কথাটা।

হ্যাঁ, তা করতে পারি, মাথা দোলাল মুসা। শুরুটা করা যায় গোবেল বীচ স্টোর থেকেই। ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারি আমরা। কিভাবে কি হয়েছে তদন্ত করে আসতে পারি।

হ্যাঁ, তা পারি, জিনা বলল। এখন নিশ্চয় খোলাই আছে দোকান। এ সময়ে থাকে।

ওঠো তাহলে, উঠে দাঁড়াল কিলোর। চলো, যাই।

যত তাড়াতাড়ি পারল বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। মিনিটখানেক পরেই গোবেল বীচ কটেজের দিকে চলল চারটে সাইকেল আর একটা কুকুরের মিছিল।

.

০৩.

দোকানে পৌঁছে দেখল আরও অনেক লোক রয়েছে ভেতরে। কেউ কেউ সত্যি এসেছে জিনিস কিনতে, কেউ এসেছে কৌতূহল মেটাতে। কাউন্টারে কাউন্টারে লোক ঘুরছে। যারা কিনতে এসেছে তারাও কম কৌতূহলী নয়। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছে। তাদের মাল প্যাকেট করতে আর প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে দোকানের তিনজন কর্মচারী। প্রসঙ্গ একটাই, গতরাতের চুরি।

কিশোর দেখল, বেঁটে, গাট্টাগোট্টা এক লোকের সঙ্গে কথা বলছে ডিক। লোকটার বয়েস চল্লিশ-টল্লিশ হবে। চোখে কালো কাঁচের সানগ্লাস। সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়েছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আর ডিক যা বলছে সব লিখে নিচ্ছে নোটবুকে। কাছে গিয়ে দাঁড়াল ছেলেমেয়েরা। ওদেরকে একটা আন্তরিক হাসি উপহার দিল ডিক।

হাল্লো, বলল সে। কি চাই? আরও খেলনা?

না, এমনি এলাম, হেসে বলল জিনা। জাস্ট কৌতূহল।

 মেটাতে, হেসে যোগ করল কিশোর।

বাধা পড়ায় বিরক্ত হলো চশমাওয়ালা লোকটা। ছেলেমেয়েদের দিকে ফিরেও তাকাল না। ডিককে বলল, ওদেরকে বাদ দিন না। যা, কোথায় যেন এসেছিলাম?

নতুন আর কি বলব, যা বলার তো বলেই দিয়েছি, ডিক বলল। চোরেরা আর কিছুই নেয়নি, শুধু…।

হ্যাঁ, জানি, শুধু রঙিন খেলনা ভালুকগুলো নিয়েছে, অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল লোকটা। আমার কথার জবাব কিন্তু এখনও পাইনি। আমি জানতে চাইছি সবই কি নিয়ে গেছে? দোকানে যা ছিল…মানে, এসেছিল? কটা এসেছিল?

এসেছিল ছত্রিশটা, ডিক বলল। চশমাওয়ালা লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। তার মনে হলো, সেলসম্যানের জবাব শুনে সামান্য যেন চমকে গেল লোকটা। তবে মুহূর্তে সামলে নিল সেটা। দ্রুত লিখে নিল নোটবুকে। বারোটা নিয়ে গেছেন ডক্টর মরিস। আর চব্বিশটা… রবিনের ওপর চোখ পড়তে থেমে গেল সে। না না, তেইশটা ছিল দোকানে। কারণ এই ছেলেটা একটা নিয়ে গিয়েছিল, রবিনকে দেখাল সে।

এতক্ষণ এমন ভাব করছিল লোকটা যে ছেলেমেয়েগুলো চলে গেলেই বাঁচে। হঠাৎ করেই তার আচরণ বদলে গেল। এখন যেন ওদের প্রতিই বেশি মনোযোগ। আন্তরিক হওয়ার জন্যে হাসল। তাই নাকি? রবিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। তাহলে তুমিও একটা নিয়েছ? আমি শুনলাম, চোরেরা নাকি সব চুরি করেছে, যতগুলো ভালুক এসেছিল।

হ্যাঁ, সবই নিয়েছে, আরেকবার বলল ডিক। ডক্টর মরিসের বারোটা, আর এই ছেলেটার একটা বাদে। তার মানে দোকান থেকে চুরি হয়েছে তেইশটা।

কিশোর বুঝল, পলিদের ভালুকগুলো চুরি হওয়ার খবরটা জানে না সেলসম্যান।

রবিনের দিকে তাকিয়েই রয়েছে চশমাওয়ালা। একটা তাহলে আছে তোমার কাছে? কেন জিজ্ঞেস করছি জানো? পত্রিকায় লেখার জন্যে।

অ, পকেটে হাত ঢোকাল রবিন। নীল ভালুকটা সঙ্গেই রয়েছে। সেটা বের করে দেখিয়ে বলল, এই যে এটাই। খুব মিষ্টি, না?

রবিনের হাত থেকে ভালুকটা নিয়ে দেখতে লাগল সাংবাদিক। বলল, হ্যাঁ, মিষ্টি! ফিরিয়ে দিল আবার। শোনো, খবরের কাগজে নাম আর ছবি ছায়া দেখতে। কেমন লাগবে? আমার প্রতিবেদনে তোমার নাম আমি উল্লেখ করতে পারি। হেডলাইনটাও বলে দিতে পারি এখনি। বড়দিনের অপরাধ: নীল ভালুকের রহস্য। খুব আকর্ষণীয় হবে, তাই না?

লোকটার হাবভাব একটুও ভাল লাগল না কিশোরের। রবিনের হাত ধরে টান দিল, এসো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেরোই। কিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে বুঝল না রবিন। তবে জিজ্ঞেসও করল না। যা বলছে করার জন্যে ঘুরতে গেল।

এক মিনিট, হাত তুলল লোকটা। আর দুএকটা কথার জবাব দিয়ে যাও, কাগজের জন্যে। আমার কলামটা পুরো করতে হবে তো… রবিনের নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করল সে।

বাড়ি তো এখানে না, জবাব দিল রবিন। বেড়াতে এসেছি। ওদের বাড়িতে, জিনাকে দেখাল সে। বাড়ির নাম গোবেল ভিলা। আর আমার আংকেলের নাম জনাথন পারকার। তিনি বিজ্ঞানী।

পুরোপুরি অধৈর্য হয়ে গেছে কিশোর। লোকটা এখন রবিনকে ছেড়ে দিলেই খুশি হয় সে। চশমাওলাকে প্রথম থেকেই খারাপ লাগছে তার। আর এখন সন্দেহ ঢুকে গেছে মনে। লোকটার প্রশ্নগুলো বিশেষ পছন্দ হচ্ছে না, খটকা লাগছে। কি করে চুরি হয়েছে, সেটা নিয়ে মোটেও আগ্রহ নেই, যত আগ্রহ কটা চুরি হয়েছে সেটা নিয়ে। কেন?

কোন কাগজে কাজ করেন আপনি? আচমকা জিজ্ঞেস করে বসল কিশোর।

হঠাৎ করে নোটবুক বন্ধ করল লোকটা। দা নিউজ! যাই এখন। তাড়াতাড়ি গিয়ে প্রতিবেদনটা লিখে ছাপতে দিতে হবে…গুডবাই!

বেরিয়ে গেল সে। ব্যাপারটা মুসারও অবাক লাগল। ভুরু কুঁচকে বিড়বিড় করতে লাগল সে, দা নিউজ তো বুঝলাম, কিন্তু কোন নিউজ? ডেইলি নিউজ? ইভনিং নিউজ? গোবেল বীচ নিউজ? কাগজের পুরো নাম বলেনি লোকটা। ওর কথাবার্তা হাবভাব কিছুই ভাল লাগেনি আমার।

আমারও না, জিনা বলল।

এতক্ষণে সুযোগ পেয়েছে কিশোর। দেরি করল না আর। প্রশ্ন শুরু করল ডিককে। তবে নতুন কিছু তেমন জানতে পারল না। আগেই জেনেছে এ সব। গত রাতে দুটোর দিকে চোর ঢুকেছিল দোকানে। ওদের জানা ছিল কোথায় রয়েছে বার্গলার অ্যালার্ম। তারগুলো কেটে দিয়েছে ঢোকার আগে, যাতে ঘণ্টা বেজে ওদেরকে ধরিয়ে দিতে না পারে। বাক্সে যতগুলো ভালুক ছিল, সব নিয়েছে। শো কেসেরটাও নিয়ে গেছে। অন্য কোন জিনিসে হাত দেয়নি।

এটাই অবাক লাগে, ডিক বলছে। এত দামী দামী জিনিস থাকতেও কিছুই নিল না। নিল কিনা শুধু কয়েকটা সাধারণ খেলনা ভালুক! আরও আশ্চর্য, শো কেসেরটা পর্যন্ত বের করে নিয়ে গেছে। এতে পরিষ্কারই বোঝা যায়, ওরা এসেছিলই শুধু ওগুলো নিতে। আর কোন কিছুতে ইন্টারেস্টেড নয়। এই কাজ করতে ভেতরের কারও সাহায্য নিয়েছে। এই দোকানেরই কেউ! পুলিশের তাই ধারণা।

কেমন যেন লাগে! দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল কিশোর। স্বাভাবিক মনে হয় না। মাথা নাড়ল সে। বিড়বিড় করল, পলিদের বাড়ি থেকে গাছ নিয়ে যাওয়াটাও অদ্ভুত। ভাবছি, কি আছে এ সব চুরির পেছনে? কারণটা কি?

একজন খরিদ্দার এগিয়ে এল ডিকের দিকে। জিনিস চাইল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল সেলসম্যান। আর কথা বলা যাবে না, বুঝতে পারল ছেলেমেয়েরা। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে।

আপাতত আর কিছু করার নেই। কাজেই ভালুক চুরির ব্যাপারটা মন থেকে দূর করে দিয়ে লোকের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়ায় মন দিল। জিনাকে দাওয়াত করে গেছে.তার অনেক বন্ধু। একলা গেল না কোথাও সে, মুসা, কিশোর আর রবিনকে নিয়েই গেল।

উড়ে যেতে লাগল যেন সময়। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া হলো। সেই সাথে পেল অনেক সুন্দর সুন্দর উপহার। খুব খুশি ওরা। একে অন্যের উপহারের প্রশংসা করল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে। তারপর সাগরের ধারে বেড়াতে বেরোল।

সারাদিনে এত খেয়েছে, সাগরের তীরে খোলা বাতাসে ঘুরে আসার পরেও খিদে পেল না তেমন। কাজেই হালকা কিছু খেয়ে খেলতে বসে গেল। তারপর ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গেল।

ঘুমানোর আগে মুসার শেষ কথা, কাল আমার কিছু খাওয়া লাগবে না, বুঝলে।

শুধু হুঁ বলতে পারল কিশোর। তার পরেই ঘুম।

কথাটা একেবারেই ভুল বলেছে মুসা। সকালে উঠেই ভীষণ খিদে। প্রচুর খেতে পারল। অন্য তিনজনও কম গেল না। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাগানে ঘোরাঘুরি করল খানিকক্ষণ। শেষে চলল সৈকতে। দুপুরের খাওয়ার সময় আবার যে খিদে সেই খিদে।

সেদিনটাও কেটে গেল খুব দ্রুত। নতুন কিছু ঘটল না।

তার পর দিন সকালে উঠে কেরিআন্টি দেখলেন খাবারে টান পড়েছে। দোকান থেকে আনতে হবে। তালিকা লিখে ছেলেমেয়েদের ডেকে বললেন বাজার থেকে নিয়ে আসতে।

 এই যে এগুলো দরকার, বললেন তিনি। ডিম, ফল, সবজি…সব লিখে দিয়েছি। দুটো ঝুড়ি নিয়ে যাও। সাইকেলের স্যাডল ব্যাগে এত কিছু ধরবে না।

সাইকেল নিয়ে রওনা হলো ওরা। সাথে চলল রাফি। আকাশ মেঘলা নয়, বৃষ্টি পড়ছে না, পথঘাটও খটখটে শুকনো। এমন দিনে সাইকেল চালাতে ভাল লাগে ওদের। বাজারে পৌঁছে কেনাকাটাগুলো জিনাই করতে লাগল, আর ছেলেরা বোঝ বইতে লাগল।

রবিন পকেটে হাত দিতেই হাতে ঠেকল খেলনা ভালুকটা। আন্টিকে দিতে ভুলে গেছে। হাতের কাছে পেল যখন বের করে হাতে নিয়ে দেখতে লাগল নেড়েচেড়ে। বোঝার চেষ্টা করল কি এমন মাহাত্ম্য আছে? রাফিকে দেখাল।

রাফি, দেখ। সুন্দরই জিনিসটা, কি বলিস? কি নাম রাখা যায়, বল তো? এক কাজ করি। নীল রঙ যখন, নীল ভালুকই নাম রেখে দিই।

শান্তকণ্ঠে পেছনে বলে উঠল কেউ, বাহ্, খুব সুন্দর ভালুক তো। হাতে নিয়ে দেখতে দেবে?

ফিরে তাকিয়ে রবিন দেখল এক তরুণী মহিলা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে হাসিমুখে। চোখগুলো কেমন বিষণ্ণ। হাত বাড়িয়ে রেখেছে ভালুকটার জন্যে।

দিল রবিন। চকচক করে উঠল মহিলার চোখ। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ভালুকটার শরীর টিপে টিপে দেখছে।

আমাকে দেবে এটা? অনুনয় শুরু করল মহিলা। দাম আমি দিয়ে দেব। যত চাও, দেব। খেলনাটা আমাকে দিয়ে দাও। আমার ছেলের জন্যে। তার খুব অসুখ। বিছানায় পড়ে আছে। এটা পেলে খুব খুশি হবে।

মহিলার এই অনুনয় অবাক করল রবিনকে। মনটা হঠাৎ নরম হয়ে গেল। খেলনাই তো একটা, এতে যদি মহিলার ছেলে খুশি হয়, তোক না। হ্যাঁ বলতে যাবে সে, এই সময় একটা হাত এগিয়ে এল তার কাঁধের ওপর দিয়ে। মহিলার হাত থেকে প্রায় থাবা মেরে কেড়ে নিল ভালুকটা।

.

০৪.

খুবই দুঃখিত আমি, কিশোর বলল ভদ্র কণ্ঠে। কিন্তু এটা অন্য একজনের জন্যে কেনা হয়েছে, ক্রিসমাস প্রেজেন্ট। এই উপহারের মূল্য আপনার জানা আছে। এটা আর কাউকে দেয়া যাবে না। আপনি চাইলে এ রকম ভালুক অনেক কিনতে পারেন, গোবেল বীচ স্টোরে পাওয়া যায়। ওদের কাছে এখন না থাকলেও অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নিতে পারবেন।

প্রতিবাদ করার জন্যে মুখ খুলল মহিলা। কিন্তু শোনার অপেক্ষায় থাকল না কিশোর। রবিনকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল ক্রেতার ভিড়ে।

কাজটা কি ঠিক হলো? রবিন বলল। কি আর এমন জিনিস? মহিলাকে দিয়ে দিলেই হত। তার ছেলেটার খুব অসুখ।

অসুখ না ছাই! বানিয়ে বলেছে। জিনাদের বাড়ি থেকেই আমাদের পিছে লেগেছে। তুমি খেয়াল করোনি। অবাকই লাগছে আমার এখন! আর কত লোক ওই খেলনা ভালুকের ব্যাপারে আগ্রহী!

মানে? চোখ বড় বড় হয়ে গেছে জিনার। ওই মহিলা আমাদের বাড়ি থেকে পিছে লেগেছে?

হ্যাঁ। বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখলাম ছোট একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার পাশে। আমাদেরকে দেখে স্টার্ট নিল। খুব ধীরে ধীরে আসতে লাগল আমাদের সাইকেলের পিছে। পুরো রাস্তাটা সেকেন্ড গীয়ারে এসেছে। অথচ ইচ্ছে করলেই আমাদের পাশ কাটিয়ে অনেক আগে চলে আসতে পারত। আসেনি। কেন? আমাদেরকে অনুসরণ করছিল বলে। বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে তারপর পাশ কাটাল। ওই মহিলাই গাড়িটা চালাচ্ছিল, আমি দেখেছি।

কিন্তু কেন? মুসার প্রশ্ন। তোমার কি মনে হয় এই মহিলাও ভালুক শিকারীদের একজন?

তাই তো মনে হচ্ছে এখন। আরও একটা ব্যাপার, যে চশমাওয়ালা লোকটা সেদিন ডিককে প্রশ্ন করছিল, খবরের কাগজের লোক বলে পরিচয় দিয়েছিল, তাকেও এখন চোরের দলের লোক বলেই মনে হচ্ছে। একটা ব্যাপার খেয়াল করোনি, কটা ভালুক ছিল, কটা চুরি হয়েছে, খালি সে-কথা জিজ্ঞেস করছিল বার বার লোকটা। রবিনের কাছে একটা আছে শুনে কেমন চমকে গিয়েছিল।

কিশোরের কথা শুনে রবিনও অবাক। তাই তো! হা হা, এই একটা ভালুকই নিতে পারেনি চোরেরা। সেজন্যেই এটা নিয়ে যেতে চেয়েছিল মহিলা!

দিয়ে তো দিয়েছিলে আরেকটু হলেই, মুসা বলল। আরেকটা বোকামি করেছ চশমাওয়ালাকে বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দিয়ে। উচিত হয়নি। ওই ব্যাটা সাংবাদিক না কচু। মহিলাকে বলেছে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমাদের পিছু নিতে। কোনভাবে ভালুকটা জোগাড় করে নিয়ে যেতে। হয়তো এর জন্যে টাকাও দিয়েছে মহিলাকে।

নিয়ে গিয়েছিল আরেকটু হলেই! জিনা বলল। কিশোর বাধা না দিলে তো যেতই।

চিন্তিত লাগছে কিশোরকে। বলল, এবার পারল না বটে, তবে আমার বিশ্বাস, আবার চেষ্টা করবে ওরা।

অতি কল্পনা হয়ে যাচ্ছে না তো? মুসা বলল। হয়তো বেশি বেশিই ভেবে ফেলছি আমরা। দোকানে চুরি হয়েছে, ঠিক। পলিদের বাড়িতেও হয়েছে। কিন্তু তাতেই কি মনে হয় ঘটনাগুলোর মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে? খেলনা ভালুকগুলোর পিছেই লেগেছে চোর, এমন তো না-ও হতে পারে। আর ওই মহিলা সত্যি কথাও বলে থাকতে পারে। হয়তো তার বাচ্চার সত্যিই অসুখ।

তার দিকে তাকিয়ে অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিশোর। দূর! একেবারেই মিছে কথা বাড়ি চলো। ভালুকটা খুলে দেখব ভেতরে কি আছে।

ভেতরে? ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন।

হ্যাঁ। আমি কি ভাবছি বলছি। আমার ধারণা, ওই ভালুকগুলোর কোনটার মধ্যে রয়েছে মূল্যবান কিছু। চোরেরা ছত্রিশটার মধ্যে পয়তিরিশটাই নিয়ে গেছে। ওগুলোতে যদি থাকত এই একটা নেয়ার জন্যে আর অত চেষ্টা করত না। তারমানে রবিনের ভালুকটার মধ্যেই রয়েছে সেই জিনিস, তুড়ি বাজাল সে। গোপন কথা বলতে আমরা বাধ্য করব নীল ভালুককে!

তাড়াতাড়ি বাজার শেষ করল ওরা। তারপর বাড়ির পথ ধরল। অস্বস্তি বোধ। করছে। বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। কেউ অনুসরণ করছে কিনা দেখছে। কিন্তু সন্দেহজনক কোন গাড়িকে পিছু নিতে দেখল না।

দুশ্চিন্তা গেল না তবুও। গোবেল ভিলার বাগানে ঢোকার আগে আর নিশ্চিন্ত হতে পারল না। ঢুকে, তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক! এবারে শান্তি!

জিনিসপত্রগুলো রান্নাঘরে নিয়ে এল ওরা। সেখানে ওগুলো রেখে রওনা হলো একটা পুরানো স্টোর রূমে। পারকার আংকেলের স্টাডি থেকে দূরে ঘরটা। ওখানে চেঁচামেচি করলেও তার কানে পৌঁছবে না। বিরক্ত হবেন না তিনি। কাজে বিঘ্ন ঘটবে না। গোলমাল একেবারেই সইতে পারেন না তিনি।

স্টোর রূমে ঢুকে পকেট থেকে ভালুকটা বের করল কিশোর।

 ঘাউ! আগ্রহী মনে হলো রাফিকে।

দেখি তো, কিশোরের হাত থেকে ভালুকটা নিল মুসা। ছোট। খেলনা। এর ভেতরে কি থাকতে পারে বুঝতে পারছি না।

হীরাটীরা কিছু? রবিনের অনুমান।

কিংবা হয়তো এক টুকরো কাগজ, আবার মুসার হাত থেকে ভালুকটা নিয়ে ওটার পেট টিপেটুপে দেখতে শুরু করল কিশোর। দাঁড়াও! জোরে টিপলে কি যেন লাগছে!

কেটে ফেলো, মুসা বলল।

ঠিক। পকেট থেকে বহু ফলাওয়ালা ছুরিটা বের করল কিশোর, যেটা পলির কাছ থেকে উপহার পেয়েছে।

আমার কাছে দাও! উত্তেজনায় কাঁপছে মুসা।

বন্ধুর দিকে তাকাল কিশোর। কি ভাবল। তারপর হেসে ভালুক আর ছুরিটা বাড়িয়ে দিল। নাও, কাটো।

হাত কাঁপছে মুসার। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে দিল ছেড়ে। একসাথে ধরতে গেল জিনা আর কিশোর। ঠোকাঠুকি হয়ে গেল হাতে হাতে। ভালুকটার গায়ে লেগে লাফ দিয়ে ওপরে উঠে গেল ওটা। পড়তে লাগল আবার। রাফি ভাবল, এটা এক ধরনের মজার লোফালুফি খেলা। সে-ও অংশ নিল তাতে। ভালুকটা মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিল, দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল জোরে, যাতে না ফসকাতে পারে।

এই, এই! চিৎকার করে উঠল রবিন।

ফেল! ছাড়, জলদি! রাফির কলার ধরে ঝাঁকি দিল কিশোর।

কুকুরটার মুখ থেকে ভালুকটা বের করে নিতে গেল মুসা। কিন্তু এটাও খেলা ভেবে ছাড়ল না রাফি। আরও জোরে কামড়ে ধরল। গরগর শব্দ বেরোচ্ছে গলার ভেতর থেকে। যেন চ্যালেঞ্জ করছে, দেখি বের করো তো, কেমন পারো!

হয়েছে, রাফি! ধমক দিয়ে বলল কিশোর। ফেল ওটা! ছাড়! দেখি, দে আমাকে!

মুসাও হাত বাড়িয়েছে। দুজনে দুদিকে ধরে টান মারল। প্রচণ্ড টান, সইতে পারল না সামান্য একটা খেলনা। ছিঁড়ে গেল ওটা।

অবাক হয়ে অবশেষে কামড় ছেড়ে দিল রাফি। ছেঁড়া ভালুকটা তুলে নিল মুসা। দেখার জন্যে এত দ্রুত ঝুঁকে এল চারজনে, ঠোকাঠুকি হয়ে গেল মাথায়। ভেতরে আর কিছুই চোখে পড়ল না, তুলা ছাড়া। শেষে ফুটোর ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে দিল রবিন।

এই, আছে তো! কি যেন রয়েছে!

ভালুকটা নিয়ে ফুটোটা টেনে আরও বড় করল জিনা। কিছু তুলা টেনে টেনে বের করে ফেলল। তারপর ফুটোটা নিচের দিকে করে ঝাঁকি দিল জোরে। নিচে বাড়িয়ে রাখল আরেক:হাত। শক্ত করে পাকানো এক টুকরো কাগজ পড়ল তার ছড়ানো তালুতে।

 একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল সকলেই। নীরবে তাকিয়ে রয়েছে জিনার হাতের কাগজটার দিকে। তাহলে নীল ভালুক মুখ খুলল অবশেষে, বলতে যাচ্ছে তার। গোপন কথা!!

ভাল, কথা বলল কিশোর। লুকানোর চমৎকার জায়গা! এখন দেখা যাক কাগজে কি রয়েছে!

খুলতে আরম্ভ করে দিয়েছে জিনা। চুপ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল অন্য তিনজনে। উত্তেজনায় এখন সবাই কাঁপছে। ভাজ খুলে হাতের তালুতে বিছিয়ে ডলে। কাগজটা সমান করল জিনা। কি আছে পড়ার জন্যে ঝুঁকে এল সকলেই।

কালো কালিতে নিখুঁত করে আঁকা রয়েছে কতগুলো আয়তাকার চিহ্ন। তার মধ্যে থেকে গজিয়ে উঠেছে কিছু নকশা, কিংবা জ্যামিতিক চিহ্ন। আর কিছু লেখা রয়েছে ভেতরে।

নকশা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

 হু! চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল জিনা। তাহলে এর পেছনেই লেগেছিল ওরা!

কারা সে-কথাটা জিজ্ঞেস করল না কেউ। জানাই তো আছে। চোরের কথা বলছে জিনা। ক্রিসমাস ট্রি আর দোকানে ঢুকে খেলনা ভালুক চুরির রহস্যের একটা জবাব এখন পরিষ্কার।

আমাদের অনুমানই ঠিক! বেশ সন্তুষ্ট লাগছে কিশোরকে। মুসা, এখন তো বিশ্বাস করবে? নীল ভালুকটার পেছনেই লেগেছিল চোরেরা।

হায়রে আমার নীল- ভালুক! ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। কি নিষ্ঠুর ভাবেই না খুন করা হলো তোকে!

কিশোর বলল, ঠিক করে ফেলা যাবে। নষ্ট হয়নি। ভাল করে দেখো, শুধু জোড়াটা ছুটেছে। তুলা ভরে আবার সেলাই করে নিলেই হয়ে যাবে।

কাজে বসে গেল রবিন। ও যখন খেলনা মেরামতে ব্যস্ত, অন্য তিনজন তখন নকশাটা নিয়ে বসল। মানে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।

নকশা, তাতে কোন সন্দেহ নেই, মুসা বলল। কিন্তু কিসের নকশা? হাতমাথা তো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।

এত সহজে হাল ছাড়ছি না, জিনা বলল। হয়তো কোন বাড়ির নকশা…

কিংবা গুপ্তধনের! বলে উঠল কিশোর। কোন নির্জন দ্বীপে লুকানো থাকলেও অবাক হব না। সব সময়েই কল্পনার বন্ধু ছেড়ে দেয় সে। তাতে ক্ষতি বিশেষ হয় না। রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রে বরং লাভই হয়েছে এতে, বহুবার দেখেছে।

রান্নাঘর থেকে কেরিআন্টির ডাক শোনা গেল। এই জিনা, তোরা কোথায় গেলি? খাবার রেডি।

দাঁত দিয়ে কামড়ে সুতো কাটল রবিন। হয়েছে! ভালুকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাতের কাজ দেখতে দেখতে বলল, একেবারে নতুনের মত। হ্যাঁ রে নীল ভালুক, আর কোন দুঃখ নেই তো তোর?

এটা আর আন্টিকে দেয়া যাবে না, মুসা বলল।

খাওয়ার পর আবার নকশাটা নিয়ে বসব, বলল কিশোর। এখন লুকিয়ে রাখি। কোথায় রাখব?

ঘাউ! জবাব দিল রাফি।

বাহ, ভাল জায়গার কথা বলেছিস তো, হেসে বলল কিশোর। ও বলছে, কুকুরের ঘরে রেখে দিতে। তারমানে ওর ঘুমানোর জায়গায়। ভালই হবে, কি বলো?

রাফির কথা বললেও তার বন্ধুরা জানে বুদ্ধিটা কিশোরের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। একটা খাম খুঁজে বের করল সে। ভাজ করে কাগজটা তাতে ভরে টেপ দিয়ে মুখ আটকে দিল। খামটা নিয়ে গিয়ে আটকাল কুকুরের ঘরে ছাতের ভেতর। দিকটায়।

চলো, জলদি চলো, জিনা বলল। টেবিলে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখলে রেগে যায় আব্বা।

বকা খেতেই হবে, ধরে নিল সে। তবে খেতে হলো না। একটা জরুরী কাজে এতই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন পারকার আংকেল, কয়েকবার করে ডেকে তারপর বের। করে আনতে হলো তাকে। টেবিলে আসতে বরং তিনিই দেরি করে ফেললেন।

খুশি মনে খেতে বসল ছেলেমেয়েরা। একটা রহস্যের কিনারা করতে না করতেই এসে হাজির হয়েছে আরেকটা রহস্য।

নকশা!

.

০৫.

সেদিন বিকেলেও আবহাওয়া ভাল রইল। তুষার পড়লেও অবশ্য ক্ষতি ছিল না। এই সময়টায় ভালই লাগে তুষার। ঘরে বসে লুডু-কেরম খেলা যায়। তবে পড়ল না। পরিষ্কার দিন। শুকনো। উজ্জ্বল। বাইরে বেরোনোর সুযোগটা হাতছাড়া করল না ওরা।

চলো, সাইকেল নিয়ে বেরোই, প্রস্তাব দিল জিনা।

চলো, রাজি হলো কিশোর। নকশা নিয়ে বিকেলেও বসা যাবে। এত তাড়াহুড়ো নেই।

 কিশোরের পরামর্শে নীল ভালুকটা সাইকেলের স্যাডল ব্যাগে ভরে নিল রবিন।

নিচ্ছ যে, মুসা হাসল। ভয় লাগছে না? কেড়ে নিতে পারে ওরা…

খুব ভাল হয় তাহলে, কথাটা ধরল কিশোর। ব্যাটাদের ওপর নজর রাখার একটা ব্যবস্থা হয় নিতে এলে। চোরাই মাল সহ হাতেনাতে ধরেও ফেলা যেতে পারে। জানা যাবে ওরা কারা।

ঠিক, জিনা বলল। কড়া নজর রাখব আমরা। তবে রাখছি যে সেটা বুঝতে দেয়া চলবে না।

টোপ একবার গিললেই হয়, মুসা বলল। চোরগুলোর পিছু নিয়ে গিয়ে ব্যাটাদের গোপন আস্তানা বের করে ফেলব। গিয়ে বলব পুলিশকে। পুলিশ গিয়ে ধরবে…

হয়েছে, বকবক থামাও এখন, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে সোজা করল, উঠে বসার জন্যে। কোথায় যাওয়া যায়? চলো, বনের দিকেই চলে যাই।

কেউ অরাজি নয়।

গোবেল বীচের একধারে ছোট বন। সেখানে পৌঁছে সাইকেল রেখে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে জিরাতে লাগল কিশোর। দেখাদেখি অন্যেরাও তাই করল। তবে এ সময়টায় ঠাণ্ডা এত বেশি, বনের ভেতর ভাল লাগে না। বেশিক্ষণ থাকল না ওখানে ওরা। আবার সাইকেলে চেপে বসল।

ফেরার পথে ছোট একটা দোকান দেখে কিছু কেনাকাটার ইচ্ছে হলো রবিনের। দোকানটা নতুন খুলেছে। কাঠ কুঁদে নানা রকম খেলনা আর ঘর সাজানোর জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে দোকানদার। চালাক-চতুর লোক।

দোকানের দেয়ালে সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকল ছেলেমেয়েরা। রাফিও ঢুকল। লোকটার তৈরি জিনিসপত্র দেখতে লাগল প্রশংসার দৃষ্টিতে। সালাদের বাটি, চামচ, কাটাচামচ, খেলনা, জীবজন্তুর মডেল, সবই কাঠের তৈরি। পুঁতির মালাও আছে অনেক রকমের। কেরিআন্টিকে উপহার দেয়ার জন্যে একটা। সালাদের বাটি কিনল কিশোর।

রবিনের কিছু পছন্দ হলো না। কেনার মত জিনিস পেল না

। উপহার দেয়ার জন্যে মুসা কিনল একটা কাঠের অ্যান্টিক।

 ঠাট্টা করে রবিন বলল, দেখো, এর ভেতর থেকে আবার কি বেরোয়।

দোকান থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বেরোতেই রবিনের চোখে পড়ল, সাইকেলের স্যাডল ব্যাগ খোলা। দৌড়ে গেল কাছে।

হায় হায়, চিৎকার করে উঠল সে। আমার ভালুক!

তন্ন তন্ন করে খুঁজল ব্যাগটা, যদিও এত খোঁজার প্রয়োজন ছিল না। নেই তো নেইই। গায়েব হয়ে গেছে খেলনাটা।

ঠোঁট কামড়াল রবিন। আ-আমারই দোষ! আগেই তো আলোচনা হয়েছে, চুরি হতে পারে। তার পরেও মনে রাখলাম না কেন? ভুলে গেলাম কেন? নিশ্চয় কেউ নজর রেখেছে আমাদের ওপর। হয়তো বাড়ি থেকেই অনুসরণ করে এসেছে। তারপর যেই সুযোগ পেয়েছে, নিয়ে চলে গেছে। ইস, রাফিকে পাহারায় রাখলেও হত।

তোমার একার দোষ না, জিনা বলল। দোষ আমাদের সবারই। এতটা পথ আমাদের অনুসরণ করে আসবে, কে ভাবতে পেরেছিল? তবে আমি তেমন কাউকে কিন্তু দেখিনি পথে, যাকে সন্দেহ করা যায়।

আমিও না, মুসা বলল।

কিশোর কিছু বলছে না। চুপ করে ভাবছে। তার মনে পড়ছে এখন, মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ শুনেছিল, যখন সাইকেল রেখে দোকানে ঢুকছে ওরা, তখন। না না, ওরা যখন দোকানের ভেতরে ঢুকে গেছে, তখন।

নিশ্চয় চোরটা, চিন্তিত ভঙ্গিতে যেন নিজেকেই কথাটা বলল সে। একটা গাধা আমি! ছাগল! কেন পাত্তা দিলাম না!

গালাগাল করার কারণ আছে। সব সময় এতটা বেখেয়াল হয় না। সেজন্যেই এতগুলো জটিল রহস্যের সমাধান করতে পেরেছে। ভালুকটা চুরি যাওয়ায় একটা মূল্যবান সূত্র হারাল। চোরকে কাছে পাওয়ার জন্যে এটা একটা টোপ ছিল।

এবার কি করব? জিনার জিজ্ঞাসা।

কি আর। পুলিশের কাছে যাব, রবিন বলল। জিনিসটা তো চুরিই হয়েছে, নাকি? জিনিস চুরি গেলে পুলিশের কাছেই যেতে হয়।

পুলিশের কাছে? মুসা যুক্তি দেখাল। গিয়ে কি বলব ওদেরকে? পঞ্চাশ পেন্স দামের একটা খেলনা চুরি গেছে? হেসে খুন হয়ে যাবে না।

হবে না, গম্ভীর হয়ে বলল রবিন। যদি ওদেরকে বোঝাতে পারি, ভালুকটা কত দামী। আর নকশাটা দেখাই ওদের।

কিন্তু এখনই নকশাটার কথা পুলিশকে বলতে যাব না আমরা, কিশোর বলল। একবার দিলে আবার কবে ফেরত পাব, কোনদিন পাব কিনা, ঠিকঠিকানা নেই। ব্যাপারটাকে ওরা সিরিয়াসলি নিলে অবশ্য আমার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু নেবে তো না।

গ্রহণযোগ্য তেমন কোন যুক্তি অবশ্য দেখতে পারল না সে। তবে সেজন্যে চাপাচাপিও করল না কেউ। ওদেরও তেমন ইচ্ছে নেই পুলিশকে দেয়ার। হাজার হোক, রহস্যটা ওদের। ওরাই এটা খুঁচিয়ে বের করেছে। নিজে নিজে সমাধান করতে পারলে মজাটা ষোলো আনা। তবে সেটা করার কোন উপায় আপাতত দেখতে পাচ্ছে না।

পথের ওপর দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা নিয়ে কয়েক মিনিট আলোচনা করল ওরা। তারপর সাইকেল নিয়ে আবার রওনা হলো।

চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল কিশোর। বলল, এই, শোনো, একটা বুদ্ধি করেছি! আমাদের সাথে চোরের সম্পর্ক এখনও কাটেনি। ভালুকটা নিয়ে গেছে একটা বিশেষ কারণে। নিশ্চয় এখন পেট কাটা হচ্ছে ওটার। ভেতরের জিনিসটা বের করার জন্যে। সকালে আমরা যা করেছিলাম।

তাতে কি? বুঝতে পারছে না মুসা।

কেটে কিছু পাবে না ওর ভেতরে, তুলা ছাড়া। অবাক হবে। পরীক্ষা করতে বসবে তখন। নতুন করে সেলাই করা হয়েছে যে, দেখতে পাবে।

তাতেই বা কি?

কেন, বুঝতে পারছ না? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কিশোর। নকশাটা পাবে না। বুঝে ফেলবে, ওটা আমাদের হাতে পড়েছে!

হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আবার আমাদের পিছে লাগবে তখন। ভালুকের ভেতরে যে জিনিসটা পেয়েছি, সেটা কেড়ে নেয়ার জন্যে। কিংবা চুরি করার জন্যে। এইবার আর চোখের আড়াল করব না আমরা ওকে। কড়া নজর রাখব।

তবে কিশোরকে এতটা খুশি লাগল না। ভুরু কুঁচকে ফেলেছে। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, টোপটা কোথায় কিভাবে পাতব? ও জানছে না কোথায় রেখেছি আমরা নকশাটা। পেতে হলে পুরো গোবেল ভিলা আতিপাতি করে খুঁজতে হবে তাকে। সেটা করতে যাবে বলে মনে হয় না। সহজ উপায় একটাই আছে…

ঠিক! বুঝে ফেলেছে জিনা। আমাদের একজনকে তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে! জোর করে কথা বের করবে মুখ থেকে!

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মুসার। কাছছাড়া হব না আমরা। কোনমতেই আলাদা হব না। আর রাফির মত একটা কুকুর পাহারায় রয়েছে আমাদের। তুলে নিয়ে যাওয়া কি মুখের কথা? অত সহজ না।

এমনও হতে পারে, রবিন বলল। শুরুতে ওসব কিছুই না করে অন্যভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করবে আমাদের সঙ্গে। এই যেমন টেলিফোন, কিংবা চিঠি।

তা না হয় করল, কিশোর বলল। কিন্তু আমরা তো দিতে চাইব না। তখন বাধ্য করবে কিভাবে? তবে একটা কথা ঠিক, কোন না কোনভাবে যোগাযোগের। চেষ্টা করবেই। তখন আমাদের কাজ হবে, বুদ্ধির খেলায় তাকে পরাজিত করা।

সেই চেষ্টাই করা হবে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল চারজনে। তারপর অনেকটা হালকা মন নিয়ে ফিরে চলল গোবেল ভিলায়।

*

দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে ওরা কিছু একটা ঘটার। ঘটল না। সেদিন তো নয়ই, পরের দিনও না। নকশারও সমাধান হলো না। অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না কিছু।

তার পরদিন এত উজ্জ্বল রোদ উঠল, সৈকতে খেলতে বেরিয়ে পড়ল ওরা। সাগর শান্ত। বালি বেশ গরম। গায়ের কোটও খুলে ফেলতে হলো এক সময়।

সৈকতে আর কেউ নেই। যত খুশি চেঁচাতে পারল ওরা, যে ভাবে খুশি ছোটাছুটি করতে পারল। বিরক্ত হওয়ার কেউ নেই, ফলে ওদেরকেও অস্বস্তিতে থাকতে হলো না। সবচেয়ে বেশি লাফাচ্ছে রাফি, চেঁচামেচি করছে। এমন সব অঙ্গভঙ্গি করছে, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ছেলেমেয়েরা।

খেলায় এতই ব্যস্ত রয়েছে ওরা, মোটর সাইকেলটা আসার শব্দও শুনল না। সৈকতের ওপরের পথে এসে থেমে গেল ওটা।

টের পেল প্রথমে রাফি। পেয়েই খেলা থামিয়ে দিল আচমকা। ওপরের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে চাপা গরগর শুরু করল।

অবাক হলো কিশোর। ঘুরে তাকাল। অপরিচিত লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মাত্র কয়েক ফুট দূরে।

.

০৬.

এগিয়ে আসতে লাগল লোকটা। তরুণ বয়েসী। উঁচু গোড়ালি ঢাকা বুট পায়ে। মাথায় হেলমেট, মুখে টেনে দেয়া সামনের স্বচ্ছ অংশ, ফলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। গলায় জড়ানো একটা স্কার্ফ।

লোকটাকে অদ্ভুত লাগছে, বোধহয় মুখ ঠিকমত দেখা না যাওয়াতেই লাগছে ওরকম। লোকটাকে পছন্দ হয়নি রাফির। ভাল লোক হলে এমন রেগে যেত না। সে। তাতে সবাই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। জিনা আর রবিন কাছাকাছি হয়ে গেল, যেন পরস্পরকে রক্ষা করার জন্যে। মুসার হাতে বল। ছোঁড়ার জন্যে। নিয়েছিল। ধীরে ধীরে নামিয়ে নিল হাতটা। কি করবে বুঝতে পারছে না।

এই যে, এগিয়ে আসছে লোকটা। খেলছ বুঝি? রোদটাও ভাল উঠেছে, না? খেলার মতই।

আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরই ফাস করে দিল সব। মেকি। তার কথা একটুও ভাল লাগল না ছেলেমেয়েদের।

হ্যাঁ, মুখ গোমড়া করে রেখে জবাব দিল মুসা। ভালই দিন। কিন্তু তাতে কি?

মিষ্টি কথা বলে সুবিধে হবে না বুঝে গেল লোকটা। তাই আর ওসবের মধ্যে গেল না। তার আসল চেহারায় ফিরে এল। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, তাতে? কাগজটা কই?।

চুপ হয়ে গেল মুসা। জিনা বলল, কিসের কাগজ?

দেখো, ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা কোরো না। ভাল করেই জানো কিসের কাগজ। নীল খেলনা ভালকটার মধ্যে ছিল।

কিশোর বলল, কি বলছেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আর ভালুকটাও নেই। কোন শয়তান লোক জানি সাইকেলের স্যাডল ব্যাগ থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। বিশ্বাস না হলে ওকে জিজ্ঞেস করুন, রবিনকে দেখাল সে। ওর ছিল। হারিয়ে খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। বেচারি।

কিশোরের কথার সমর্থনে মাথা ঝকাল রবিন। দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে তুলল চেহারায়।

কঠিন দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল লোকটা, মিথ্যে কথা তো ভালই বলতে পারো। তবে ওসব কেচ্ছা গেলাতে পারবে না আমাকে। খেলনাটা চুরি হয়েছে, বিশ্বাস করছি, কিন্তু নকশাটা নেই ওর মধ্যে। তারমানে তোমাদের হাতেই পড়েছে।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর কিশোর। বেশি কথা বলে ফেলেছে লোকটা। নিজের পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে। সে জানে নকশাটা নেই খেলনার ভেতরে। তার অর্থ হয় সে-ই চুরি করেছে, কিংবা তার কোনও দোস্ত। নকশা বলেছে, শুধু কাগজ বলেনি, সুতরাং ওটা নকশাই। কিশোরেরা আন্দাজ করেছিল বটে ওরকম কিছুই হবে, কিন্তু নিশ্চিত ছিল না। এখন হলো।

যাক, এক চোরের দেখা পাওয়া গেল। এখন খুব বুদ্ধি করে মাথা ঠাণ্ডা রেখে চাল চালতে হবে, যাতে ওদের ফাঁদে ফেলা যায়।

কিন্তু গোলমাল করে দিল রাফি। সে খুব বুদ্ধিমান কুকুর, সন্দেহ নেই, তবে কুকুরের তুলনায় বুদ্ধিমান। মানুষের তুলনায় কিছুই না। মানুষের মত মাথা খাঁটিয়ে, চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করতে পারে না। যা করার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই করে ফেলে। এখন তার প্রবৃত্তি বলল, নোকটা খারাপ, তার বন্ধুদেরকে হুমকি দিচ্ছে, ক্ষতি করতে চায়, তার মত একটা কুকুরের উচিত তাকে তাড়ানো।

কাজেই সেই কাজই করে বসল রাফি। আক্রমণ করে বসল লোকটাকে। লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পা কামড়ে ধরল সে। পায়ে মোটা চামড়ার ভারী বুট থাকায় কামড়টা মাংসে বসল না, বেঁচে গেল লোকটা। তবে ভয় যেমন পেল, রেগে গেল তেমনি।

শয়তান! কুত্তা! চেঁচিয়ে উঠল সে। পকেট থেকে একটা কশ (সীসা ভরা পাইপ) টেনে বের করে জোরে এক বাড়ি মারল রাফির মাথায়। টু শব্দটিও আর করতে পারল না কুকুরটা। বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নড়লও না আর।

রাফি! চিৎকার করে উঠল জিনা। হাঁটু গেড়ে বালিতে বসে পড়ল কুকুরটার পাশে। আপনি…আপনি আমার রাফিকে মেরেছেন! পস্তাতে হবে! এর জন্যে পস্তাতে হবে আপনাকে! আমরা আপনাকে ছাড়ব না… ফুঁসতে থাকল সে।

চুপ! ধমক লাগাল লোকটা। তুমিও যদি ওরকম একটা বাড়ি খেতে না চাও, চুপ করে থাকো!

রাগে ফেটে পড়বে যেন মুসা আর জিনা। আগে বাড়ল। লোকটার ওপরে ঝাঁপিয়েই পড়বে বুঝি।

খেঁকিয়ে উঠল লোকটা, এই, থামো! ভাল চাইলে আর এক পা এগোবে না! কশটা মাথার ওপর তুলল সে, বাড়ি মারার ভঙ্গিতে। এখানে খেলতে আসিনি আমি। আবার জিজ্ঞেস করছি। ভালুকের ভেতরে যে নকশাটা পেয়েছ সেটা কোথায়?

একটা কথাও বলল না মুসা, জিনা আর রবিন। কিশোর তো যেন শুনতেই পায়নি। এক জায়গায় পাথরের খাজে জমে রয়েছে পানি। বোধহয় তুষার গলেই হয়েছে। আঁজলা ভরে তুলে এনে ছিটিয়ে দিতে লাগল রাফির নাকেমুখে।

জোরে জোরে নাক টানছে রবিন। তার দিকে ফিরল লোকটা। বলল, এরা তো মুখ খুলবে না। তোমাকেই জিজ্ঞেস করছি। সত্যি সত্যি বলবে। নকশাটা কোথায়?

রাস্তার দিকে তাকাল রবিন। যদি কেউ আসে? কিন্তু কেউ আসছে না। ওদেরকে বাঁচানোর মত কেউ নেই কোথাও। কাঁপা গলায় বলল, আমি…আমি…মানে আমার কাছে নেই।…এখানে নেই আরকি। টা রয়েছে আমার আংকেলের বাড়িতে লুকানো! মনের সমস্ত সাহস এক করে জোর গলায় বলল, কোথায় আছে বললাম, কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না আপনার। গোবেল। ভিলাকে টুকরো টুকরো করে ফেললেও বের করতে পারবেন না। পাবেন না ওটা। এমন জায়গায় লুকানো হয়েছে।

রবিন ভেবেছে এ রকম করে বললেই লোকটা নিরাশ হয়ে চলে যাবে। গেল তো না-ই, তাকে আতঙ্কিত করে দিয়ে হা হা করে হেসে উঠল সে।

হাহ্ হাহ্ হাহ্! হো হো হোহ্! বোকা ছেলে! তুমি কি ভেবেছ আমি আনতে যাব ওটা? এত কষ্ট করব? কক্ষনো না। সেধে গিয়ে ধরা দেব ভেবেছ?

হাসি থামিয়ে দিল হঠাৎ। হ্যাঁ, এখন লক্ষ্মী হয়ে যাও সবাই। ভালয় ভালয় দিয়ে দাও ওটা। কাল পর্যন্ত সময় দিলাম। কাল দুপুর বারোটার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ওই পাথরটার তলায় চাপা দিয়ে রাখবে।

কশটা দোলাল আরেকবার, ওদেরকে দেখিয়ে। হুমকি দিল। এ সম্পর্কে পুলিশকে কিংবা আর কাউকে যদি একটা বর্ণ বলল, ভাল হবে না মনে রেখো। আর নকশাটা না দিলেও খারাপ হবে। খুব খারাপ, শুধু এটুকুই বললাম, হ্যাঁ!

ওরকম করে সিনেমায় হুমকি দেয় খারাপ চরিত্রের লোকেরা দেখেছে ওরা। কেমন হাস্যকর লাগে ওখানে। তবে বাস্তবে সেটা মোটেও হাস্যকর লাগল না ওদের কাছে। যা বলছে, করবে লোকটা। মিথ্যে হুমকি দিচ্ছে না।

কি, বুঝেছ? জিজ্ঞেস করল লোকটা।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল মুসা। পাবেন আপনার নকশা। নিচু স্বরে লোকটা যেন বুঝতে না পারে এমন ভাবে অভিশাপ দিল, সেটা তোমার গলায় ঢুকে গিয়ে যেন দম বন্ধ করে মারে!

কশটা পকেটে রেখে দিল লোকটা। কাল দুপুর বারোটা। মনে থাকে যেন।

ঘুরে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সে। উঠে গেল সৈকতের ওপরের রাস্তায়। নীরবে তাকিয়ে রয়েছে গোয়েন্দারা। তখনও রাফির পাশে হাটু গেড়ে বসে রয়েছে কিশোর। হুঁশ ফিরছে কুকুরটার।

হ্যাঁ, নকশা তুমি পাবে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, ঠিক সময়েই। তবে সেটা দিয়ে কোন লাভ হবে না তোমার।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল মুসা। কি বললে?

নকশা একটা দেব তাকে, তবে নকল। আসলটা দিয়ে দেব, এত বোকা নাকি আমি।

ওই, যাচ্ছে, রবিন বলল।

 রাস্তায় মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন স্টার্ট নিল।

খেলা আর জমবে না। রাফি দুর্বল হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে গিয়ে এখন খেতে দেয়া দরকার। তারপর লম্বা একটা ঘুম।

ওঠ, রাফি, ওঠ, ডাকল কিশোর। লক্ষ্মী ছেলে, ওঠ। তোর আর কি দোষ? পেছন থেকে মেরে তো অনেক বাহাদুরকেও চিৎ করে ফেলা যায়। নইলে কি আর ছাড়তি? এতক্ষণে কামড়ে হয়তো কিমাই বানিয়ে ফেলতি।

তারপর সেই কিমাগুলো পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে চুলায় চাপিয়ে দিত, হেসে বলল মুসা।

দুর্বল কণ্ঠে রাফি বলল, ঘাউ! কিমার চেয়ে হাড়ই তার বেশি পছন্দ।

*

বাড়ি ফিরে নিজের বিছানার পায়ের নিচে কার্পেটে রাফিকে আরাম করে শুইয়ে দিল জিনা। তারপর সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসল। উঠে চলে গেল মুসা। নকশাটা আনতে। কুকুরের ঘর থেকে ওটা খুলে এনে টেবিলে বিছাল।

তুমি তো বললে, একটা নকল নকশা দেবে, কিশোরকে বলল মুসা। পাবে কোথায়?

আঁকব, জবাব দিল কিশোর। বানিয়ে বানিয়ে দেব একটা এঁকে। দেখতে যাতে এটার মতই লাগে। তাহলে প্রথমে ধোকা খাবে মোটর সাইকেলওয়ালা লোকটা। নিয়ে চলে যাবে। বুঝবে, আসল নয়। আবার লাগবে তখন আমাদের পেছনে।

তাহলে কাগজও একই ধরনের ব্যবহার করতে হবে, রবিন বলল।

আগেই ভেবেছি সেটা, হেসে বলল কিশোর। সাধারণ কাগজ। সাদা খাতা থেকে ছিঁড়ে নিয়েছে ওরা। ইস্কুলে যেগুলো ব্যবহার করি আমরা। আমরাও ওরকমই একটা পাতা নেব…

খুব সাবধানে আঁকতে হবে, মুসা বলল। দেখতে যেন একেবারে আসলের মত লাগে।

তা লাগবে। শোনো, আরও সহজেই কাজটা করা যায়। এটার ওপরেই ছাপ দিয়ে আঁকতে পারি। কিছু কিছু জায়গা সামান্য বদলে দিলেই হবে।

প্রশংসার দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। ভাল বুদ্ধি বের করেছ।

নকশাটার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। নিজেকেই যেন বলল, হ্যাঁ, হবে। জিনার কাছ থেকে একটা খাতা চেয়ে নিয়ে একটা পাতা ছিঁড়ে নিল। তারপর গিয়ে বসল জানালার কাছে, আলো বেশি পাওয়ার জন্যে। ছাপ দিয়ে আঁকতে সুবিধে হবে। একটা ট্রেসিং পেপার আর বলপেন নিয়ে কাজ শুরু করল। আঁকাটা খুব সহজ। কঠিন হলেগে আসল নকশাটার মানে বোঝ। ঘোড়ার ডিম কিছুই বোঝা যায় না।

কয়েক মিনিট পর ট্রেসিং পেপারে আঁকা হয়ে গেল। সেটাকে তখন সাদা কাগজের ওপর রেখে জোরে চাপ দিয়ে রেখাগুলোর ওপর কলম বোলাতে লাগল কিশোর। নিচের কাগজে দাগ পড়ে যাবে। তখন তার ওপর কলম বুলিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে নকশা। বদলাতে হলে ট্রেসিং পেপারেই বদলাতে হবে। যাতে নিচে। ভুল চাপ পড়ে। তা-ই করতে লাগল সে।

হয়েছে। কিছুক্ষণ পর সন্তুষ্ট হয়ে মুখ তুলল কিশোর। চমৎকার! সামনে রেখে দুটো মিলিয়ে দেখেও সহজে ধরা যায় না।

হ্যাঁ, খুব ভাল, উত্তেজিত হয়ে বলল মুসা। দারুণ এঁকেছ। চোরেরা বুঝতেই পারবে না কিছু। আর যখন বুঝবে, দেরি হয়ে যাবে তখন। আমরা সময় পেয়ে যাব। কিছু করার।

সংখ্যা আর লেখাগুলোর ব্যাপারে কি হবে? রবিনের প্রশ্ন।

সংখ্যা আর লেখা? ভুরু কোঁচকাল মুসা।

দেখছ না, লেখা রয়েছে এন এস ই ডব্লিউ। এর মানে নিশ্চয় নর্থ সাউথ ঈস্ট ওয়েস্ট বোঝাতে চেয়েছে। তারপর রয়েছে সংখ্যা।

লেখাও লিখব, কিশোর বলল। কিছু নকশা দেখে, কিছু বানিয়ে বানিয়ে লিখতে শুরু করল সে। যা মাথায় এল।

অবশেষে শেষ হলো কাজ।

ব্যস, বলল সে। এখন শুধু এটা তুলে নেয়ার অপেক্ষা। কাল গিয়ে বসে থাকব। মোটর সাইকেলওলা নিতে এলে সাইকেল নিয়ে অবশ্যই তার পিছু নিতে পারব না। তবে ভাল একটা সূত্র পেয়ে যাব। মোটর সাইকেলের নম্বর। কে জানে, ওই একটা সূত্রই হয়তো ওর দোস্তদের কাছে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে আমাদের। হয়তো দলবল সহ ধরিয়ে দিতেও। সমাধান হবে নীল ভালুক রহস্যের।

.

০৭.

পরদিন সকাল দশটায়ই সৈকতে চলে এল গোয়েন্দারা। লোকটা বলে গেছে বারোটায় আসবে। এর আগে ওর আসার আশা করেও লাভ নেই। কিন্তু বলা যায়। অতি উত্তেজনায় চলেও আসতে পারে। তাই আগেভাগেই চলে এসেছে ওরা।

লুকোছাপার ধার দিয়েও গেল না সে। সহকারীদের নিয়ে সোজা নেমে এল। সৈকতে। কেউ যদি ওদের ওপর নজর রেখে থাকে, রাখুকগে।

প্রাস্টিকের একটা ব্যাগে ভরে নকল নকশাটা নিয়ে এসেছে কিশোর। নির্জন। সৈকত। কাউকে চোখে পড়ল না। আগের দিনের মতই। যে পাথরের নিচে ওটা রাখতে বলেছে, সেটার নিচেই রেখে দিল সে। তারপর সবাইকে নিয়ে ফিরে চলল গোবেল ভিলায়।

কিন্তু বাগানের ভেতরে ঢুকে গেটটাও বন্ধ করতে পারল না মুসা, জলদি চলো বলে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। শুরু হলো তার পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ। দৌড়ে বাগান পেরিয়ে, বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে চলে এল পেছনের গেটের কাছে। সেটা দিয়ে বেরোলে আরেকটা সরু গলিপথ পড়ে, দুপাশে উঁচু বালির পাড়। পথটা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে একেবারে পাড়ের কিনারে এসে না দাঁড়ালে দেখা যায় না।

বেশ ঘুরে গেছে পথটা। তবু ওটা দিয়ে সৈকতে যাওয়ার রাস্তায় উঠতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগল না।

লুকাব কোথায়? জানতে চাইল রবিন।

বাস স্টপেজের পাশে ছোট একটা ছাউনি আছে, রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলেই পড়ে। সেটা দেখাল কিশোর। ওটার পেছনে। কাল এখানটাতেই কোথাও মোটর সাইকেল ফেলে গিয়েছিল লোকটা।

রাফিকে শান্ত থাকতে বলল সে। বুঝতে পারল কুকুরটা। নীরবে চলল ওদের সাথে সাথে। এ রকম খেলা তার জন্যে নতুন নয়, আগেও বহুবার খেলেছে। ব্যাপারটা ভালই লাগে তার। শিক্ষিত কুকুর সে। কিশোরের আদেশ একটুও অমান্য করল না।

অনেকক্ষণ কিছুই ঘটল না। বারোটার বাস এল। থামল না। সোজা চলে গেল গোবেল বীচের দিকে। এই ছাউনিটায় এমনিতে থামে না বাস। কেউ যদি নামতে চায়, তাহলে শুধু থামে। আজ এখানকার কোন যাত্রী নেই। ফলে থামল না।

এবার সতর্ক থাকতে হবে, মুসা বলল। বারোটা বাজে। যে কোন সময় এসে হাজির হতে পারে লোকটা।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল জিনা।

ওই যে, হাত তুলল মুসা। একটা মোটর সাইকেল আসছে।

কিন্তু থামল না মোটর সাইকেলটা। চলে গেল। কয়েক মিনিট পর গেল একটা কোচ। তারপর একটা লার। এবং তারপর…

চুপ! নোড়ো না! একটানে জিনাকে ছাউনির আড়ালে নিয়ে এল কিশোর। ওই লোকই!

ছাউনির পেছনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে ওরা। পারলে দেয়ালের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে ফেলতে চায়। শোনা যাচ্ছে মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ। বাড়ছে… বাড়ছে…থেমে গেল। উঁকি দিতে ভয় পাচ্ছে গোয়েন্দারা। যদি লোকটা দেখে ফেলে? শেষে আর থাকতে পারল না মুসা, মাথা বের করে দিল একপাশ দিয়ে।

হ্যাঁ, মোটর সাইকেল! ফিসফিসিয়ে বলল সে। পথের অন্যপাশে রেখেছে। সৈকতের কিনারে। ওপরে। চলো, দেখি কি করে।

সাবধানে রাস্তা পেরোল ওরা। কোন শব্দ করছে না। রাস্তাটা পেরিয়েই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল কিশোর। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে চলে এল ঢালের কিনারে।

গলা বাড়িয়ে তাকাতেই দেখল, নেমে গেছে লোকটা। পাথরের দিকে এগোচ্ছে।

নকশাটা তুলতে যাচ্ছে, জানাল কিশোর। জলদি করতে হবে। সময় নেই।

সরে চলে এল চারজনেই। দ্রুত হাতে মোটর সাইকেলের নম্বর লিখতে শুরু করল রবিন। মুসা আর রাফি চুপ করে দেখছে। ক্যারিয়ার বক্স খুঁজছে কিশোর আর জিনা। আশা করছে এমন কোন কিছু পেয়ে যাবে, যেটা চোরকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবে।

ভাগ্য ওদের পক্ষে। একটা চিঠি পেল জিনা। তাতে নাম-ঠিকানা লেখা রয়েছে। কে পাঠিয়েছে সেটা লেখা থাকলে ভাল হত! বিড়বিড় করল কিশোর। ঠিকানাটা পড়ে ফেলেছে। মিস্টার ডন হারভে। মিডলটন। জায়গাটা গোবেল বীচের কাছেই।

যেখানে পেয়েছিল খামটা আবার সেখানে রেখে দিল জিনা। একেবারে সময়মত।

চাপা ঘাউ করে উঠেছে রাফি। লোক আসছে, বুঝিয়ে দিল।

আসছে! রাফির পর পরই বলে উঠল রবিন। সৈকতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ফিরে আসছে লোকটা!

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখান থেকে সরে এল ওরা। এমন কিছু করল না যেটা অস্বাভাবিক লাগে।

গোবেল ভিলায় ফিরে এসে আবার মাথা ঘামাতে বসল।

তেমন কিছুই পেলাম না, জিনা বলল। মাঝে মাঝে হতাশার কথা শোনানো। তার স্বভাব। তবে ঠিকই করে। সব সময় আশার কথা শোনালে অনেক সময়। খারাপ হয়।

কে বলল! কথাটা পছন্দ হলো না কিশোরের। অনেক পেয়েছি। এত যে পাব। সেটাই আশা করিনি। মোটর সাইকেলের নম্বর বড়জোর ওটার মালিকের সন্ধান দিত আমাদের। কিন্তু এখন ওই খামের ঠিকানা তার নাম-ধামও জানিয়ে দিল।

খুশি হতে পারল না জিনা। মাথা নাড়ল। কি করে জানছি ওটা ওরই নাম? সে ডন হারভে না-ও হতে পারে। হয়তো চুরি করেছে মোটর সাইকেলটা। কিংবা, চেয়ে এনেছে। চিঠিটা হয়তো মোটর সাইকেলের আসল মালিকের।

অযৌক্তিক কথা বলেনি জিনা। তবু মানতে পারল না কিশোর। জিনা, এত হতাশার কথা বলো কেন! তোমার বরং বলা উচিত মোটর সাইকেল আর ওই খামের নাম-ঠিকানা লোকটারই।

বেশ, না হয় বললাম। তাতে কি?

তাতে আলোচনাটা চালিয়ে যেতে পারি আমরা। অনুমান করে। ভুল হতেই পারে। হলে হবে। তখন আবার নতুন উপায় বের করব। আগেই না না করে সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে বসে থাকলে তো আর কাজ হবে না।

কিশোর ঠিকই বলেছে, জিনার দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।

হ্যাঁ, আলোচনা চালানোই উচিত, রবিন বলল। দেখাই যাক না কিছু বেরোয় কিনা।

কিন্তু সেটা আর হলো না। খাবারের ডাক পড়ল। ডাকতে এলেন কেরিআন্টি। ডাইনিং রুমে যেতে হলো ওদের।

যাবার আগে কিশোর বলল, আজ বিকেলে মিডলটনে যাব আমরা। গোবেল বীচের কাছে হয়ে থাকলে বেশি সময় লাগবে না যেতে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে। ওতে কিছু হবে না। অল্পস্বল্প বৃষ্টিতে ভিজে অভ্যেস আছে আমাদের, কি বলো?

অল্পস্বল্প কেন, মুষলধারে নামলেও অ্যাডভেঞ্চারের এই পর্যায়ে গোয়েন্দাদেরকে থামাতে পারত না বৃষ্টি। সেটা বুঝেই যেন বিকেলের শুরুতেই থেমে গেল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ততক্ষণে মিডলটনের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। রাফি খুশি হলো বৃষ্টি থেমে যাওয়ায়। শরীর ভেজাতে ভাল লাগে না তার, বিশেষ করে এই আবহাওয়ায়। সাঁতার কাটাটা অবশ্য আরেক রকম মজা, তাতে কিছু মনে করে না সে।

মিডলটনের বাইরে সাইকেল রেখে হেঁটে গাঁয়ের ভেতর ঢুকল ওরা। ঢোকার মুখেই বিশাল এক অ্যালসেশিয়ানের সঙ্গে দেখা, এদিকেই আসছে। কাছে এসে বেশ গুরুগম্ভীর চালে রাফির শরীর কল কুকুরটা। মুরুব্বিয়ানা দেখিয়ে বলল, গারররর!

রাফি বুঝতে পারল তার ভাষা। কুকুরটা বলেছে, এই আজব কুত্তাটা আমাদের গায়ে কি করছে? সে একই সুরে জবাব দিল, ঘাউ! ঘাউ! ঘাউ! অর্থাৎ, আমাকে পছন্দ না করতে পারলে শুনে রাখো, তোমাকেও আমি পারছি না!

গারর! খেঁকিয়ে উঠল অ্যালসেশিয়ান। শয়তান কোথাকার!

রাফিও কম যায় না। রেগে গিয়ে কুকুরের ভাষায় গালাগাল শুরু করে দিল। হাবভাবে মনে হলো চ্যালেঞ্জ করে বসেছে বড় অ্যালসেশিয়ানটাকে।

গাররর! ধাড়িটাও কি আর কম যায়।

কেউ বাধা দেয়ার আগেই বেধে গেল ঝগড়া। ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা আরেকটার ওপর। রাস্তার কাদার ওপরই গড়াগড়ি শুরু করল দুটো কুকুর। কামড়াকামড়ি, চেঁচামেচি, খামচা-খামচি এবং এই জাতীয় যত রকম ব্যাপার আছে। কোনটাই বাদ রাখছে না।

শোরগোল শুনে বেশ কিছু গ্রামবাসী বেরিয়ে এল ঘরের দরজায়। জিনা লজ্জায় পড়ে গেছে। রাফিকে এখানে আনতে চাপাচাপি করায়। যতটা ভদ্রভাবে আর নীরবে সম্ভব গ্রামে ঢুকে খোঁজখবর করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তা আর হলো না।

রাফিকে সরে আসার জন্যে চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে কিশোর। কে শোনে কার। কথা। লড়াইয়ে মশগুল এখন দুই কুত্তা। কে কাকে পরাজিত করবে, সেই চেষ্টা। এখন কি আর শোনার সময় আছে নাকি। লোকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। হাসাহাসি করছে। কথা বলছে জোরে জোরে। এ রকম একটা লড়াই দেখতে পেয়ে যেন খুশিই হয়েছে। বাজি ধরতে আরম্ভ করে দিয়েছে।

পঞ্চাশ পেন্স, বলল একজন। বড় কুত্তাটার ওপর। ওটা ভারী বেশি। জোরও বেশি।

ছোটটাও কম না, আরেকজন বলল। বয়েস আরেকটু বাড়লে বাঘের বাচ্চা হবে!

এখন তো ছোট। পারবে না, বলল তৃতীয় আরেকজন। আর ওটা টাইগার। ডেভির কুকুর। ছোটটাকে খুনই করে ফেলবে।

না না! চিৎকার করে উঠল জিনা। লোকগুলোর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেছে।

আমি ছোটটার ওপর পঞ্চাশ পেন্স! বলল অন্য আরেকজন লোক। করছে কি। দেখো! এত মার খেয়েও গলার কামড় ছাড়ছে না! এ রকম কিছুক্ষণ থাকতে পারলেই টাইগারের বারোটা বাজবে!

ওই যে, ডেভি আসছে, একটা ছেলে বলল।

লম্বা, শক্তিশালী একজন মানুষ এগিয়ে এল। করছেটা কি দেখো! চিৎকার করে বলল সে। এ রকম কাণ্ড তো করেনি কখনও! এই টাইগার! টাইগার! ছাড়, ছাড় বলছি! সামান্যতম দ্বিধা করল না লোকটা। উন্মত্ত, লড়াইয়ের একেবারে মধ্যিখানে গিয়ে দাঁড়াল। দুহাতে দুটো কুকুরের ঘাড় চেপে ধরে জোর করে টেনে ছাড়াল।

ঝাঁকি দিয়ে তার হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করছে কুকুর দুটো। আবার গিয়ে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। ছাড়ল না লোকটা। রেগে উঠে বলল, রক্ত বেশি গরম হয়েছে? পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলব। সর, যা!

তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল জিনা। রাফির কলার ধরে টেনে সরিয়ে নিল। বড় কুকুরটাকে নিয়ে চলে যেতে লাগল ডেভি। টাইগারের যাবার ইচ্ছে নেই। বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে, আর রাফিকে ধমক মারছে।

রাফির কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখতে বসল জিনা। যতটা ভয় পেয়েছিল ততটা জখম হয়নি। একটা কান থেকে রক্ত পড়ছে। গলার কাছে কিছু আঁচড়, বোম উঠে গেছে। আরও কয়েক জায়গায় নখের আর দাঁতের দাগ রয়েছে। কোন কোনটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।

ভেবো না, মুসা বলল জিনাকে। ঠিক হয়ে যাবে। কিছু হয়নি।

কানটা তো ছিঁড়েছে! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে জিনা। মুসার মত কিছু হয়নি বলে উড়িয়ে দিতে পারছে না।

ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে, কিশোরও চিন্তিত। অষুধ-টষুধ লাগানো দরকার। এ গায়ে ওষুধের দোকান আছে? জিনার দিকে তাকাল সে।

কুকুরের লড়াই দেখার জন্যে দুটো ছেলে বেরিয়ে এসেছিল। তারা এগিয়ে এল। গোয়েন্দাদের দিকে। আন্তরিক হাসি হেসে দুজনের মাঝে বড়টা জিজ্ঞেস করল, কিছু দরকার? দারুণ একটা কুত্তা তোমাদের! এত বড় অ্যালসেশিয়ানটাকে যে মার মারল! বয়েসকালে সত্যিই বাঘের বাচ্চা হবে! অ, আমার নাম রবি। এ আমার ভাই টেড। কাছেই আমাদের বাড়ি। রাফির ছেঁড়া কানের দিকে তাকিয়ে বলল, এক কাজ করো না। চলে এসো আমাদের বাড়িতে। স্পিরিট-টিরিট দিয়ে মুছে ওষুধ লাগিয়ে দেব।

কথাটা মন্দ না। ভেবে দেখল কিশোর। রাজি হয়ে গেল সে।

রবি আর টেডের বাবা-মা বাড়িতে নেই। তবে যা দরকার সেগুলো পেতে বাবা-মাকে দরকার হলো না। বাথরূমের ওষুধ রাখার বাক্সেই পাওয়া গেল সব। লড়াইয়ের সময় যে রাফি এতটা সাহসের পরিচয় দিয়েছে, ওষুধ লাগানোর সময় সে-ই একেবারে ভীতুর ডিম হয়ে গেল। কিছুতেই জখমে স্পিরিট লাগাতে দেয় না।

অনেক কায়দা-কসরৎ করে তারপর লাগাতে হলো। সময় লেগে গেল বেশি।

আসল কাজের সুযোগ মিলল এতক্ষণে, যা করতে এসেছিল ওরা। তদন্তটা ওবাড়ি থেকেই শুরু করল। নব পরিচিত বন্ধুদের জিজ্ঞেস করল মোটর সাইকেলওয়ালা লোকটার কথা। প্রশ্ন করল বেশ চালাকির সঙ্গে, যাতে ছেলে দুটো কিছু সন্দেহ করতে না পারে।

গ্রামটা কিন্তু খুব সুন্দর, মুসা বলল। লোকজনও ভালই মনে হচ্ছে।

ঠিক, তার সঙ্গে সুর মেলাল কিশোর। মনটন বেশ ভাল। ডেভি রাগ করল না। নিজের কুকুরটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।

এখানকার একটা লোককে অবশ্য পছন্দ হয়নি আমার, জিনা বলল। ছেলে দুটোর দিকে তাকাল। চেনো নাকি তাকে? মোটর সাইকেল আছে। আরেকটু হলেই চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিল আমাকে। অল্প বয়েসী। এই তেইশ-চব্বিশ হবে। ওর মুখ দেখতে পাইনি। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা প্যাকেট পড়ে গেল। নাম-ঠিকানা লেখা। ভাবছি ওটা ফিরিয়ে দেব। নামটা হলো কি যেন…ও, ইয়ে, ডন হারভে।

ডন হারভে! চেঁচিয়ে উঠল টেড। ঠিকই আছে। তাকে তোমাদের ভাল লাগেনি, লাগার কথাও নয়। তোমাদের আর দোষ দেব কি, আমরাও দেখতে পারি না! ভীষণ পাজি লোক!

০৮.

চেনো নাকি তাকে? রবিন জিজ্ঞেস করল। ডন হারভেই তো নাম?

মিডলটনের সবাই চেনে ওকে, জবাব দিল রবি। এ গাঁয়ের সে কুলাংগার, বড়রা তাই বলে। দেখো বাড়ি গিয়ে, পাবে বলে মনে হয় না। বেশির ভাগ সময়ই বাইরে বাইরে থাকে। কি করে আল্লাই জানে! ভাল কিছু করে বলে তো মনে হয় না। বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। ওই লোকটা ভাল। ডনের এ সব কাণ্ডকারখানায় সাংঘাতিক বিরক্ত।

ডনকে তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে? জানতে চাইল কিশোর।

কে জানে! রবি বলল। মোটর সাইকেল নিয়েই ঘোরে সারাক্ষণ। তা নাহলে হাই স্ট্রীটের গ্র্যান্ড কাফেতে বসে থাকে। থাকার কোন ঠিকঠিকানা নেই তার।

নামেই গ্র্যান্ড, টেড বলল। আর কিছু নেই। আহামরি কিছু নয়। মিডলটনের সমস্ত শয়তান লোকগুলো গিয়ে বসে ওখানে, আড্ডা মারে। ডন প্রায়ই বলে, তার একটা কাজ দরকার। সেজন্যেই নাকি গ্র্যান্ড কাফেতে যায়, কাজ জোগাড়ের জন্যে। নানা ধরনের লোক আসে ওখানে, কে যে কখন কাজ দিয়ে ফেলবে বলা যায় না। কাজ অবশ্য একটা না একটা পেয়েই যায় সে। তবে ধরে রাখতে পারে না। অল্পদিনও টেকে না। কাজটা ভাল না বলে ছেড়ে দিয়ে চলে আসে। আব্বা বলে অন্য কথা। কাজের লোকই নাকি নয় ও।

চিনব কি করে তাকে? গ্র্যান্ড কাফেতে যদি পাই? জিজ্ঞেস করল জিনা। মোটর সাইকেলের পোশাকে দেখেছি তাকে। হেলমেট পরা। চেহারা দেখিনি।

পাতলা, লম্বাটে মুখ, যেন একটা ইঁদুর। কথা বলে ক্যাচক্যাচ করে, দরজার কজায় তেল না থাকলে যে রকম শব্দ হয়।

টেডের মুখে লোকটার চেহারার বর্ণনা শুনে না হেসে পারল না গোয়েন্দারা। তারপর দুই ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল। আবার বেরোল পথে।

চলো, এ্যান্ড কাফেটা ঘুরেই আসি একবার, কিশোর বলল। হয়তো পেয়েও যেতে পারি আমাদের চিড়িয়াকে।

যা শুনলাম, মুসা বলল। আজব চিড়িয়াই মনে হলো। একের পর এক কাজ বদলায়। মোটর সাইকেল নিয়ে ঘোরে। বাকি সময় কাফেতে বসে থাকে। চুরিদারিগুলোতে সে জড়িত থাকলে মোটেও অবাক হব না।

মিডলটন জায়গাটা বড় না। মাত্র দুটো কাফে আছে। তার মধ্যে একটা হলো গ্র্যান্ড কাফে। নোংরা, মলিন একটা বাড়ি। ভেতরে কান ঝালাপালা করে দিয়ে ভীষণ জোরে মিউজিক বাজছে। ডনের মোটর সাইকেলটা দেখা গেল কাফের বাইরে। থমকে গেল গোয়েন্দারা। কি করবে ঠিক করতে পারছে না।

জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া উচিত হবে না, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। আমাদের ওপর ডনের চোখ পড়লে সব শেষ। আর এগোতে দেবে না। হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। কিছু খুঁজে বের করতে পারব না তখন।

রাস্তার অন্য পাশে কয়েকটা গাড়ি দেখিয়ে মুসা বলল, ওগুলোর পাশে লুকালে কেমন হয়? ও কোথায় আছে, জানি। এক সময় না এক সময় বেরোবেই সে। সাথে কেউ থাকলে…

শশশ! ঠোঁটে আঙুল রেখে হুঁশিয়ার করল রবিন। ওই, আসছে!

কাফে থেকে বেরিয়ে আসছে লোকটা। দেখেই তাকে চিনতে পারল। এই সেই লোক, কোন সন্দেহ নেই। উঁচু বুট পায়ে। নকশা যখন নিতে এসেছিল তখন হেলমেটটা মাথায় ছিল, এখন খুলে হাতে নিয়েছে। টেড আর রবির দেয়া বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে তার চেহারা। ইঁদুরমুখো। সঙ্গে আরেকজন লোক রয়েছে। বেঁটে, গাট্টাগোট্টা, বয়েস চল্লিশ মত হবে। রাস্তায় নেমে এল দুজনে।

দ্বিতীয় লোকটাকেও চিনল মুসা। ফিসফিসিয়ে বলল, এই সেই লোক, গোবেল বীচ স্টোরে কালো চশমা পরা ছিল। সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়েছিল নিজেকে।

কিশোর, রবিন আর জিনাও চিনল তাকে।

দুজনে জোট বেঁধেছে, কিশোর বলল একই সঙ্গে কাজ করে মনে হয়।

কি বলছে শুনতে পারলে হত, আফসোস করে বলল রবিন।

একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়! ফিসফিস করে বলল কিশোর। লোকগুলোকে বেরোতে দেখে গাড়ির আড়ালে এসে লুকিয়েছে সবাই ওরা। ওই দেখো, মোটর সাইকেলটার কাছে দাঁড়িয়েছে। ওখানে যতক্ষণ থাকবে, ওদের কথা শুনতে পাব আমরা।

কি ভাবে? জিনার প্রশ্ন।

এসো আমার সঙ্গে।

মাথা নিচু করে রেখে এগোল কিশোর। গাড়ির জন্যে মোটর সাইকেলের কাছ থেকে ওকে দেখতে পাবে না লোকগুলো। চত্বরের একধারে রাস্তার কাছে চলে। এল সে। রাস্তা পেরোতে হবে এখন খুব সাবধান! দেখে না ফেলে!

কিশোরের কথামতই কাজ করল রবিন, জিনা আর মুসা। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে না। কি করতে চাইছে? প্রশ্ন করার সময় নেই। অনেক ঘুরে রাস্তা। পেরোল ওরা।

কোন বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন লোকগুলো। কোন দিকেই তাকাচ্ছে না।

এবার ওই কোণায় যেতে হবে, দেখাল কিশোর। তারপর ওই গলিটা ধরে চলে যাব কাফের কাছে। গলি আর হাই স্ট্রীটের মোড়ে রয়েছে কাফেটা তখনি দেখেছি সেজন্যেই যেতে চাইছি ওখানে।

কোণের কাছে চলে এল ওরা। বাড়িটার কোণ ঘুরলেই এখন ডন আর অন্য লোকটাকে দেখা যাবে। তবে দেখার প্রয়োজন নেই, ওদের কথা শুনতে পেলেই হয়। শোনা যাচ্ছে।

ঠিক আছে বলছ? ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল বেঁটে লোকটা রেগে গেছে মনে হয়। শুরুতেই সব গোলমাল করে না ফেললে…

আমার দোষ নয়, মারভিন। তীক্ষ্ণ শোনাল ডনের গলা। ঠিকই বলেছে টেড, ইঁদুরের মত চিচিই করে।

আস্তে! শুনে ফেলবে! এদিকে এসো। বেঁটে লোকটা বলল।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলল গোয়েন্দারা। নিরাশ হয়েছে। এত কষ্ট করে এখানে এসেও লাভ হলো না। সরে যাচ্ছে লোকগুলো।

চলো, পিছু নিই, মুসা বলল। কি বলে শুনতে হবে।

ভাগ্য আরেকবার গোয়েন্দাদের পক্ষ নিল। এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল লোক দুজন, ওদের কথা শুনতে পেল ওরা। তবে আগের জায়গা থেকে সরে যেতে হলো অবশ্যই। নির্জন এক টুকরো পতিত জায়গা। একপাশে বেড়া।

আরেক পাশে বাড়ি। কাজেই লুকাতে অসুবিধে হলো না ওদের। ডন সিগারেট ধরাল। তার সঙ্গী ধরাল পাইপ। আবার কথা বলতে শুরু করল।

বেড়ার আড়ালে ঘাপটি মেরে শুনতে লাগল গোয়েন্দারা। আগের জায়গা থেকে লোকগুলো সরে আসায় বরং ভালই হয়েছে। এখন ওদের কথা আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। …এ সব বলেছি আমি, মারভিন, ডন বলছে। সুবিধে করতে পারিনি। আর তাতে আমার দোষটা কোথায়? কি করে জানব জিনিসগুলো আসতে এত দেরি হবে? ওগুলো আসার আগেই আমার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল ওখানে।

বেশ, ধরলাম সেটা ব্যাড লাক। তোমার কাজ শেষ হওয়ার আর সময় পেল না …যে কাজটা পানির মত সহজে সেরে ফেলা যেত, তার জন্যে ঝুঁকি নিতে হলো, তালা ভেঙে ঢুকতে হলো-সবই বুঝলাম, তারপরও…

যা-ই করে থাকি, কাজটা তো হলো। এটাই আসল কথা। নকশাটা দরকার। ছিল আপনার, পেয়েছেন। মালও পেয়ে যাব শীঘি, যদি নকশার নির্দেশমত এগোতে পারি। তারপর আমাদের কাজ হবে ওগুলো দেশ থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়া। ভাল লাভ হবে।

হোরেসের ভাগ দিতে হবে, ভুলো না। জেল থেকে বেরোবেই। তখন তার পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে আমাদের।

ফন্দিটা ভালই করেছিল। নকশাটা ইসের মধ্যে ভরে…

ইসেটা যে কিসে তা আর শোনা গেল না। বাকি কথাগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল বাতাসে। কান খাড়া করে অনেক চেষ্টায় আরও কয়েকটা শব্দ শুনতে পেল গোয়েন্দারা। মারভিন বলছে, কাল রাত নটায়, পিংক হাউসে…

হাঁটতে শুরু করল দুজনে। আর ওদের কথা শোনা গেল না। শুনতে হলে আবার পিছু নিতে হবে। আর ঝুঁকি নিল না গোয়েন্দারা।

অন্ধকারও হতে শুরু করেছে। গোবেল বীচে ফিরে যাওয়া উচিত। ঘরে আরাম করে বসে বিকেলের এই অভিযান নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

গোবেল ভিলায় ফিরে এল ওরা। ছেলেদের ঘরে এসে বসল সবাই।

আলোচনা শুরু করল কিশোর, তাহলে কি জানলাম আমরা? ডন হারভে চোরের দলের একজন। কথা শুনে মনে হলো অন্য লোকটা, অর্থাৎ মারভিন হলো তার বস।

কিংবা আরেকটা লোকের কথা যে বলল, সে-ও হতে পারে, জিনা মনে করিয়ে দিল। যার নাম হোরেস।

যে লোকটা জেলে রয়েছে, রবিন বলল।

সূত্র তো ভালই পেলাম, বলল মুসা। এখন এগুলো জোড়া দিয়ে খাপে খাপে মেলাতে পারলেই হয়। অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব। মারভিন বেশ রেগে গেছে মনে হলো। কোন একটা ভুল নিশ্চয় করে চলেছিল ডন। সে বলল, তার কিছু করার ছিল না। কারণ মাল আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে তার কাজের মেয়াদ শেষ। এখন প্রশ্ন হলো, কি কাজ? কোথায়? আর কি জিনিসের ডেলিভারি, যা আসতে দেরি হলো?

ভাবছে কিশোর। নাক কুঁচকে রেখেছে সামান্য। মনে হয় বুঝতে পারছি, বলল সে। ঝুঁকি নিতে হলো বলল মারভিন। তারপর বলল তালা ভেঙে ঢোকার কথা। আমার বিশ্বাস, পলির ক্রিসমাস ট্রি, আর গোবেল বীচ স্টোরে চুরি করার কথা বলেছে ও।

আর জিনিস নিশ্চয় সেই খেলনা ভালুকগুলো, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে রবিন। ওগুলো আসতেই দেরি হয়েছে, জানি আমরা, ডিক বলেছিল। আর চুরিও হয়েছে শুধু ওগুলোই।

হ্যাঁ, জিনা বলল। বেশ মিলে যাচ্ছে। কিশোর, ডন মনে হয় গোবেল বীচ স্টোরে একটা টেমপোরারি কাজ নিয়েছিল। বড়দিনের সময় কাজ বেশি, বাড়তি লোকের দরকার হয় ওদের। ওই সময়ই তাকে গোপন খবর পাঠানো হয়েছিল, যে কোন একটা খেলনা ভালুকের ভেতরে থাকবে নকশাটা। এল খেলনাগুলো। কিন্তু দেরি করে। তখন তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। খেলনাগুলোর ভেতরটা দেখার আর কোন উপায় না পেয়ে শেষে চুরিই করে বসল সে। সময় পেলে অবশ্য দেখেটেখে যে ভালুকটার ভেতরে রয়েছে, সেটাই খুলত। তারপর আবার সেলাই করে রাখলেই কেউ ধরতে পারত না।

ঠিক! কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত মনে হলো কিশোরের। আর এমনই কপাল ওদের, চুরি করে নিয়েও লাভ হলো না। রবিন যে একটা ভালুক কিনল, কাকতালীয় ভাবে তার মধ্যেই থেকে গেল নকশাটা। যা-ই হোক, চুরি রহস্যের সমাধান হয়েছে। এখন আমাদের জানতে হবে, নকশা দেখে কি জিনিস বের করতে চাইছে ওরা। কি হতে পারে, বলো তো?

বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়ল মুসা। তবে দামী কোন কিছু। বলল না, দেশ থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করলে ভাল টাকা পাবে। দামী জিনিসই।

তিন ভাগ করবে সেই টাকা, জিনা বলল। একটা ভাগ দেবে জেলের লোকটাকে। হোরেস।

আমার মনে হয় ও-ই নেতা। যদিও এখন জেলে রয়েছে। প্ল্যানট্যান সব সে-ই করেছে, শুনে সে-রকমই মনে হলো। নকশাটা সে এঁকেছে। আর সেটা পাচারের ব্যবস্থা করেছে …

খেলনা ভালুকের ভেতরে ভরে! বুঝে ফেলল রবিন।

হ্যাঁ। একটা ব্যাপার অবশ্য এখনও পরিষ্কার হয়নি। জেলে ওরকম একটা খেলনা কি ভাবে পেল হোরেস? সেটা আবার বাক্সে ভরে অন্য খেলনাগুলোর সঙ্গেই বা পাঠাল কিভাবে?

আমি জানি! বলে উঠল মুসা। কপালে টোকা দিয়ে বলল, এটা আজ ভালই খেলছে মনে হয়!

হাসল কিশোর। বলে ফেলো।

জেলে কাজ করতে হয় কয়েদীদের। অনেক রকম কাজ। শ্রমিকের কাজই বেশি। কাপড় সেলাই থেকে শুরু করে মেইল ব্যাগ বানানো পর্যন্ত সব করে। খেলনাও বানায়। শুনেছি, খেলনা বিক্রি করেও জেলখানার ভাল আয় হয়। জেলে হোরেসের কাজ খেলনা বানানো। কিংবা ইচ্ছে করেই কাজটা নিয়েছে সে, নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে। যাতে নকশা এঁকে সেটা একটা খেলনা ভালুকের ভেতর ভরে দিতে পারে সহজেই। কোন ভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, কোন দোকানে। জিনিসগুলো চালান যাবে। সেটা জেনে নেয়াটা কঠিন কাজ নয়। জেনে, খবর দিয়েছে তার বন্ধুদের, কোত্থেকে কিভাবে জোগাড় করতে হবে নকশাটা।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ! তুড়ি বাজাল কিশোর। এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। কি ভারে পাঠিয়েছে জানার জন্যে মনটা খুঁতখুঁত করছিল। যদিও সেটা এখন জেনে আর লাভ নেই, দরকারও নেই আমাদের। এখন যে কাজটা করতে হবে, তা হলো। নকশার মানে বের করে জিনিসগুলো খুঁজে বের করা! লোকগুলোকে ঠেকানো। মারভিন আর ডন কাল রাতে পিংক হাউসে দেখা করবে বলেছে। হয়তো ওখানেই রয়েছে জিনিসগুলো। পিংক হাউসটা কোথায়, খুঁজে বের করতে হবে আগে।

কোথায় যে জায়গাটা, কিছুই বলতে পারব না, জিনা বলল। নামই শুনিনি। এই এলাকায় না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে হলে ভাল হত, সুবিধে হত আমাদের জন্যে। সময়টা ভাল বেছেছে, তাই না? কাল নিউ ইয়ারস ইভ। রাত নটায় বাইরে বেশি লোক বেরোবে না। লোকে হয় বাড়িতে থাকবে, নয়তো পার্টিতে, নিউ ইয়ারের অপেক্ষায়।

আমরা বাদে! ঘোষণা করে দিল কিশোর। রাতের খাওয়া হয়ে গেলে, কেরিআন্টিকে বলব, আমরা স্টোররূমে খেলতে যাচ্ছি। ঘুমাতে দেরি হবে।

না বললেও কিছু এসে যায় না, জিনা বলল। আব্বা তো খেয়ে গিয়ে ঢুকবে স্টাডিতে। আম্মা টিভি দেখবে। আমরা সেই সুযোগে বেরিয়ে যাব। বলা যায় না, দাওয়াতও পেয়ে যেতে পারে, পার্টির। তাহলে তো কাজের কাজই হবে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়ব আমরা…

পিংক হাউস শিকারে, হেসে জিনার কথাটা শেষ করে দিল রবিন।

তা তো বেরোব, মুসা বলল। কিন্তু জানিই তো না ওটা কোথায়

তা জানা যাবে, বলল কিশোর। সময় আছে কালকের সারাটা দিনই পড়ে আছে। যেতে যেতে তো সেই রাত নটা!

কপাল আমাদের ভালই বলতে হবে, জিনা বলল সব কিছুই কেবল পক্ষে যাচ্ছে। যেন আমাদের ইচ্ছেমতই ঘটছে সব আশা করি পিংক হাউসটাও পেয়ে যাব। কি বলিস, রাফি?

গররর! বিজ্ঞের ভঙ্গিতে জবাব দিল রাফি

.

০৯.

পরদিন সকালে আবার মিডলটনে এল গোয়েন্দারা। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। সাইকেল চালানোটা মোটেও আরামদায়ক হলো না। গায়ে পৌঁছে খেয়াল হলো, তদন্তটা কি করে চালাবে, আলোচনা করে ঠিক করে আসেনি। খোঁজ করতে গেলে যদি কোনভাবে টের পেয়ে যায় ডন? তাহলে এত দিনকার সব পরিশ্রম শেষ।

তবে বুদ্ধি একটা বের করে ফেলল কিশোর। চলো, ওই কাফেটায় ঢুকি। গ্র্যান্ড কাফে বাদে আরেকটা যেটা আছে সেটার কথা বলল সে। ওটার নাম ব্ল্যাক। ক্যাট, দেখতে পাচ্ছে। ঠাণ্ডা লাগছে। গরম গরম কোকা কিনে খেতে চাইলে কেউ সন্দেহ করবে না। তখন কায়দা করে জেনে নেয়ার চেষ্টা করব, পিংক হাউসটা কোথায়।

কাফেতে এসে ঢুকল গোয়েন্দারা। একটা টেবিল বেছে বসে পড়ল। সকালের এই সময়টায় খরিদ্দারের ভিড় নেই। সুন্দর চুলওয়ালা একটা ছেলে ওয়েইটারের কাজ করছে। হাসি হাসি মুখ। তার নাম হ্যারি। ব্ল্যাক ক্যাটের মালিক ছেলেটার বাবা।

অর্ডার নিতে এগিয়ে এল হ্যারি। আদর করে রাফির মাথা চাপড়ে দিয়ে বলল, বাহ, বেশ সুন্দর কুকুর তো।

খুশি হলো রাফি। সেই সাথে জিনা। হ্যাঁ, বলল সে। আর খুব সাহস! বুদ্ধিও আছে। ঘরে বসে থাকার বান্দাই সে নয়। ওই যে কিছু কিছু কুকুর থাকে না, খালি ড্রইং রুমে বসে থাকে।

তা যে নয়, সে তো দেখতেই পাচ্ছি, হেসে বলল ছেলেটা। কথায় কথায় হাসে। ওর চেহারাই বলে, গলায় লাল ফিতে বেঁধে কোলে বসে থাকতে রাজি নয়।

সুযোগ পেয়ে গেল কিশোর। পিংক শব্দটা বলার এইই উপযুক্ত সময়, রঙের কথা যখন উঠলই। না, সহ্যই করতে পারে না অলস হয়ে বসে থাকা, বলল সে। তবে ফিতে পছন্দ করে রাফি। একবার পিংক একটা রিবন বেঁধে দিয়েছিলাম গলায়। সেটা পরে সৈকতে তার সে-কি নাচানাচি। রবিন, তোমার মনে আছে? পিংক রিবন। পিংক, বুঝলে তো? ওই পিংক হাউসের মত।

আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে কিশোর। লাগবেই, আশা করেনি। তবে লাগল।

ভুরু কুঁচকে হ্যারি বলল, পিংক হাউসের নামও জানো! অবাক হয়েছে। কি করে জানলে? এই এলাকায় থাকো না তোমরা, বুঝতে পারছি। আগে কখনও দেখিনি।

সত্যি কথা খানিকটা বলে দেয়া উচিত মনে করল মুসা। দেখবে কোত্থেকে? হাসল সে। এদিকে আমরা এলে তো। প্রথম এসেছি কাল। তখনই শুনেছি, একটা লোক বলছে পিংক হাউসের কথা। নামটা অদ্ভুত। সেজন্যেই কৌতূহল হচ্ছে আমাদের। ওই রঙের বাড়ি নিশ্চয় খুব একটা নেই। ওটার সম্পর্কে জানার খুব ইচ্ছে আমাদের।

বেশ বড় একটা বাড়ি, হ্যারি জানাল। পুরানো। লাল রঙের। সেজন্যেই ওরকম নাম হয়েছে। তবে বাড়িটার অনেক বদনাম। ওটার মালিক হোরেস ট্রিমেইনির গ্রেপ্তারের পর থেকেই।

উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে গোয়েন্দাদের মুখচোখ পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল ওরা। দ্রুত হয়ে গেছে হৃৎপিণ্ডের গতি। বুঝতে পারছে, তদন্তে অনেক এগিয়ে গেছে।

খাবারের অর্ডার দিল কিশোর।

ধূমায়িত কোকার মগ নিয়ে এল হ্যারি। আর বড় একটা কেকের অর্ধেকটা। সেগুলো টেবিলে নামিয়ে রেখে সাজিয়ে দিল।

আগের আলোচনাটা আবার চালিয়ে গেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, হোরেস ট্রিমেইনিকে গ্রেপ্তার করছে কেন?

সে এক মজার গল্প। শোনোনি? সত্যি? কেন, চোরাই ছবিগুলোর কথা শোনোনি?

পেইন্টিং?

হ্যাঁ, পেইন্টিং।

মাথা নাড়ল কিশোর। মুসা আর জিনাও নাড়ল। রবিন চুপ করে আছে। অবাক হয়েছে অন্য তিনজনের মতই।

ও। শোনো তাহলে, বলতে লাগল হ্যারি। বছরখানেক আগে লন্ডনের এক আর্ট গ্যালারি থেকে চুরি যায় ছবিগুলো। খুঁজতে খুঁজতে পুলিশ এসে ধর। হোরেসকে। চার বছরের জেল হয়ে যায়। তাকে দোষী প্রমাণ করতে পেরেছে বটে পুলিশ, তবে ছবিগুলো বের করতে পারেনি। কিছুতেই কথা বের করা যায়নি হোরেসের মুখ থেকে। তারপর থেকে ওই বাড়িটাতে আর কেউ বাস করে না।

বাড়িটা কোথায়? রবিন জিজ্ঞেস করল।

হ্যারি জানাল, বাড়িটা মিডলটন আর গোবেল বীচের মাঝে একটা সাধারণ রাস্তার ধারে। এটাই জানতে চেয়েছিল গোয়েন্দারা। কোকা শেষ করে উঠল ওরা। হ্যারিকে গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে এল কাফে থেকে।

দুপুরের খাওয়ার অনেক দেরি, কিশোর বলল। সময় আছে হাতে। ইচ্ছে করলে এখুনি ঘুরে দেখে যাওয়া যায়। এখন পেয়ে গেলে বিকেলে আর আসতে হবে না। মিডলটনে যত কম লোকে আমাদেরকে দেখে ততই ভাল। ডন কিংবা মারভিনের সামনে পড়তে চাই না কিছুতেই।

চলতে চলতে রবিন জিজ্ঞেস করল, কিশোর, এই হোরেস লোকটা ছবিগুলো কি তার বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছে? কি মনে হয় তোমার? নিশ্চয় গ্রেপ্তার যে হবে সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলেছে। এগুলোর কথাই বলছিল ডন আর মারভিন।

মুসাও রবিনের সঙ্গে একমত। কিশোর জবাব দেয়ার আগেই বলে উঠল, আমারও তাই মনে হয়। পুলিশ নিশ্চয় খোঁজা বাকি রাখেনি। আর সেটা ভাল করেই জানত হোরেস। কাজেই এমন জায়গায় লুকিয়েছে, যেখান থেকে খুঁজে বের করা কঠিন। কোথায় লুকিয়েছে সেটা বলে যেতে পারেনি সঙ্গীদের। তবে জেলে ঢুকে যোগাযোগ করেছে কোনভাবে। তারপর খেলনার ভেতরে নকশা ভরে সেটা পাচারের ব্যবস্থা করেছে।

আর জেল থেকে বেরিয়ে, জিনা যোগ করল। অবশ্যই তার ভাগটা চাইবে। ছবি বিক্রির টাকার। টাকা নিশ্চয় অনেক পাবে। বাকি জীবন আরামে কাটিয়ে দিতে পারবে।

সেটা আর হতে দিচ্ছি না আমরা, কিশোর বলল।

 যেন তার কথার সমর্থনেই বলে উঠল রাফি, ঘাউ!

হেসে উঠল মুসা। শুনলে তো রাফির কথা। ও বলতে চাইছে, হোরেস মিয়া, ওই টাকা জিন্দেগিতেও তুমি পাবে না। আর পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে পোলাও কোরমা খাওয়াও চলবে না। তোমাকে আবার জেলেই ঢুকতে হবে, শুকনো রুটি খাওয়ার জন্যে।

অতটা জোর দিও না, জিনা বলল। বলা যায় না কি হয়। যে লোকের পেট থেকে পুলিশ কথা আদায় করতে পারেনি সে নিশ্চয় সাধারণ লোক নয়। তাকে এত ছোট করে দেখা উচিত না। আরেকটা কথা হয়তো জানো, জেলে কোন কয়েদী যদি ভাল ভাবে থাকে, ভাল আচরণ করে, তাকে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মুক্তি দেয়া হয়। বলা যায় না, হোরেসকেও তেমনি ভাবে ছেড়ে দেয়া হতে পারে।

দিক না। আবার ঢোকাবে।

যদি চোরাই মাল সহ ধরতে পারে।

পারবে…

মুসা আর জিনার তর্কাতর্কিতে বাধা দিল কিশোর, ওই যে পিংক হাউস!

থেমে গেল পাঁচজনেই, রাফি পর্যন্ত। মুখ তুলে তাকিয়ে রয়েছে লাল বাড়িটার দিকে। সত্যিই লাল! দুই-আড়াইশো বছরের পুরানো। অর্ধেক কাঠ, অর্ধেক ইট সুরকি দিয়ে তৈরি। লাল রঙ করা হয়েছে। জানালার কাঠের শাটারগুলোও লাল। খড়-পাতা দিয়ে বানানো চালা। সামনের দরজায় উঠতে হয় সিঁড়ি বেয়ে। নির্জন, নিঃসঙ্গ। আশপাশে আর কোন বাড়িঘর নেই। বিশাল বাগান রয়েছে চারপাশ ঘিরে। তবে সেটাকে এখন আর বাগান বলা যাবে না। অযত্ন অবহেলায় জঙ্গল হয়ে গেছে।

চলো, ঢুকে দেখি, প্রস্তাব দিল মুসা। ধারে কাছে কেউ আছে বলে মনে হয় না। ভেতরে কি আছে দেখতে চাইলে এটাই সুযোগ। এখন দেখে রাখলে রাতে। এলে সুবিধে হবে।

কথাটা মন্দ বলেনি মুসা। কিশোরের পছন্দ হলো। গেটে ঠেলা দিল সে। কজায় এমন ভাবে জং পড়েছে, খুলতে জোর লাগল। কিচকিচ করে আর্তনাদ করে উঠল। তবে খুলল।

খুশি হয়ে উঠল কিশোর। তালা নেই। বাচলাম।

পথের পাশের খাদে সাইকেলগুলো লুকাল ওরা। তারপর সারি বেঁধে গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। খোয়া বিছানো পথ ধরে এগোল বাড়ির দিকে। আগে আগে হাটছে রাফি। নাক উঁচু করে বাতাস শুঁকছে। সন্দেহজনক কিছুর গন্ধ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেবে।

বাগানে ঢোকার গেটটার মত বাড়ির দরজা খোলা নয়। এখানে তালা দেয়া।

হলো না, নিরাশ হয়ে বলল মুসা। নিচতলার সমস্ত জানালা-দরজা ঠেলেঠুলে দেখল কোনটা খোলা আছে কিনা। মাথা নাড়ল, নাহ, আটকে রেখে গেছে! ঢোকা আর হলো না!

এক হিসেবে ভালই হলো, জিনা বলল। ঢুকতেও পারব না, ধরাও পড়ব না, তাতে কেউ বলতেও পারবে না বেআইনী ভাবে ঢুকেছি।

ওই আঙুর ফল টকের মত আর কি, ফোড়ন কাটল রবিন।

কিশোর কিছু বলছে না। নীরবে তাকিয়ে রয়েছে একেবারে মাটির কাছাকাছি। দুটো ভেনটিলেটরের গ্রিলের দিকে। লম্বা, সরু জানালার মত ফোকর, কাঁচটাচ নেই। এমন ভাবে তৈরি হয়েছে যাতে বাতাসের সাথে সাথে কিছু আলোও দিতে পারে মাটির তলার ঘরে।

আমি শিওর, ছবিগুলো থাকলে সেলারেই আছে, বলল সে। ইস, যদি কোনভাবে ঢুকতে পারতাম! নকশাটার সাহায্যে বের করতে পারতাম ছবিগুলো।

অনেক চেষ্টা করেও ঢোকা সম্ভব হলো না। আর কিছু করার নেই। বাড়ির পথ। ধরল ওরা।

তারপর সময় যেন আর কাটে না। সাংঘাতিক দীর্ঘ লাগছে। যেন সন্ধ্যা আর হবেই না সেদিন। আর যদি হয়ও, কেরিআন্টি কিংবা পারকার আংকেলের চোখ এড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে না পারলে, এত চেষ্টা, এত পরিশ্রম, সব বিফল।

কয়েক বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে, নিউ ইয়ার ইভের পার্টিতে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু রাজি হলেন না জিনার আব্বা আম্মা। দুজন আত্মীয় বেড়াতে আসছেন সন্ধ্যায়। জিনার দূর সম্পর্কের চাচা-চাচী। তাদেরকে ফেলে দাওয়াতে যাওয়া যায় না।

সন্ধ্যা হলো। মেহমানরা এলেন। রাতের খাওয়া শেষ হলো। তার পরেও অনেক সময় বাকি। বড়রা সিটিং রূমে তাস খেলতে বসলেন।

ভালই হলো, কিশোর বলল। তাসে একবার ডুবে গেলে আর কোনদিকে খেয়াল থাকবে না। আর টেলিভিশন তো রয়েছেই। মাঝরাতের আগে আর উঠবে না কেউ। বাতাসের মত স্বাধীন আমরা। যেখানে খুশি চলে যেতে পারি, আনন্দে শিস দিতে শুরু করল সে।

এত খুশি হয়ো না, রবিন অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। যদি কোন কারণে উঠে আসেন আন্টি? হাজারটা কারণ থাকতে পারে ওঠার। আমরা ঘুমিয়েছি কিনা সেটাই যদি দেখতে আসেন?

তাহলে আর কি, লক্ষটা কৈফিয়ত দিতে হবে। তবে এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ঝুঁকি নিতেই হবে। এতখানি এগোনোর পর শুধু কৈফিয়তের ভয়ে তো আর ঘরে আটকে থাকতে পারি না।

বেরিয়ে পড়ল ওরা। ক্যারিয়ারে অনেক বড় একটা ঝুড়ি বাধল জিনা, রাফিকে বয়ে নেয়ার জন্যে। কাদার মধ্যে দৌড়ালে অনেক কষ্ট করতে হবে বেচারাকে।

ঝুড়িতে তোলা হলো রাফিকে। এ ভাবে চলার অভ্যাস আছে তার। কাজেই গোলমাল করল না, যে ভাবে রাখা হলো, চুপ করে গুটিসুটি হয়ে রইল ঝুড়ির মধ্যে।

রওনা হলো গোয়েন্দারা। যত দ্রুত সম্ভব প্যাড়াল করতে লাগল, সময় মত ওখানে পৌঁছানোর জন্যে। আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই কিশোরের। ভয় তেমন করছে না। তবে পিংক হাউসে পৌঁছে কি দেখবে, আন্দাজও করতে পারছে না।

যে কাজে চলেছে, তাতে সফল হবে কিনা, এ ব্যাপারে সবারই সন্দেহ আছে। লুকিয়ে শোনা কয়েকটা কথার ওপর নির্ভর করে চলে এসেছে ওরা। লোকগুলো আদৌ পিংক হাউসে আসবে কিনা, তাই বা কে জানে? আগের দিন কথা বলার পর অনেক সময় পেরিয়েছে, ইতিমধ্যে অনেক সময় পেয়েছে ওরা মত বদলানোর।

আসবে কিনা কে জানে? ভাবনাটা প্রকাশই করে ফেলল রবিন।

জিনারও একই প্রশ্ন, তবে সেটা বলল না। আরেকটা ব্যাপারে সন্দেহ আছে। তার। নকশাটা সত্যিই ছবিগুলোর কাছে নিয়ে যাবে তো?

মাঝে মাঝেই পকেটে চাপড় দিচ্ছে কিশোর। নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে, নকশাটা আছে কিনা। তার ভয়, কোন ভাবে খোয়া না যায়। পকেট থেকে পড়েও যেতে পারে। হারানোর ভয়ে কুকুরের ঘর থেকে বের করেছে ওটা বেরোনোর ঠিক আগের মুহূর্তে। নকল নকশা একে দেয়ার বুদ্ধিটা করেছিল বলে খুশি এখন সে। ঠিক কাজটাই করেছে।

পিংক হাউস থেকে একটু দূরে সাইকেল রেখে হেঁটে চলল ওরা। খুব সাবধান রইল। কোন রকম শব্দ করল না।

গেটের কাছে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল কিশোর। আগে আগে হাঁটছিল সে। তাহলে তার অনুমানই ঠিক! গেট খোলা। অথচ দুপুরে নিজের হাতে লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল পাল্লাটা। লোকগুলো যে এসেছে, তার আরও প্রমাণ আছে। ম্লান আলো দেখা যাচ্ছে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে। একটা ভেনটিলেটরের ভেতর থেকে আসছে।

দেখলে তো! ফিসফিস করে বলল কিশোর, খুশি খুশি গলায়। আমার কথাই ঠিক!

.

১০.

অন্ধকারে গা ঢেকে রয়েছে গোয়েন্দারা।

ভাল করে তাকালেই শুধু চোখে পড়বে পাঁচটা ছায়ামূর্তি-চারটে মানুষের, আর একটা কুকুরের।

নিঃশব্দে ভেলটিলেটরের কাছে এসে থামল ওরা। ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাল। গ্রিলের মাঝে যথেষ্ট ফাঁক। মুখ ঢুকিয়ে দেখতে তেমন অসুবিধে হয় না। সেলার, অর্থাৎ মাটির নিচের ঘরের বেশ অনেকখানিই চোখে পড়ে। ডনও আছে, তার সঙ্গী মারভিনও আছে। সেলারের মেঝেটা কাঁচা। পশ্চিমের কোণে মাটি খুঁড়ছে ডন, আর নকশা দেখে দেখে নির্দেশ দিচ্ছে মারভিন। নকল নকশা, যেটা এঁকে দিয়েছে কিশোর। তৃতীয় আরও একজন রয়েছে সেখানে, হাতে একটা বড় হ্যারিকেন। হোরেস ট্রিমেইনি জেলে যাওয়ার পর নিশ্চয় বাড়ির বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে, অনুমান করল কিশোর।

গলা বাড়িয়ে দিল মুসা।

দেখো দেখো! রবিন বলে উঠল। সেই মহিলা। যে ছেলের জন্যে ভালুকটা নিতে চেয়েছিল আমার কাছ থেকে।

তাই তো!

 ভালমত খেয়াল করে দেখতেই বাকি তিনজনও চিনতে পারল মহিলাকে।

একটা শাবল নিয়ে কাজ করে চলেছে ডন। মেঝে থেকে উঠে আসছে তাল তাল মাটি।

ওখানেই তো থাকার কথা! ওই খানেই! মারভিন বলল। নকশার ওপর থেকে চোখই সরাচ্ছে না। ডন, চালিয়ে যাও।

কিছুক্ষণ পর মুখ মোছার জন্যে থামল ডন। দরদর করে ঘাম ঝরছে মুখ বেয়ে।

আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? রেগে গেল উন। কথাই তো বলে চলেছেন খালি। এক-আধ বার খুঁড়লে হয়টা কি? টাকা তো আর কম নেবেন না! ইস, মাটি তো না, যেন সিমেন্ট!

মনে হলো রেগে যাবে মারভিন। কিন্তু রাগল না। মহিলার দিকে ফিরে বলল, দেখি, আলোটা আরেকটু এদিকে সরাও তো, ইসাবেল।

একটাতে হবে না, বলে হ্যারিকেনটা মাটিতে রেখে দিল ইসাবেল। আরেকটা হ্যারিকেন বের করে ধরাল। ততক্ষণে শাবল নিয়ে মাটি কোপাতে শুরু করেছে মারভিন। কিছুক্ষণ কাজ করে ফিরিয়ে দিল আবার ডনকে।

পালা করে দুজনে মিলে মাটি কুপিয়ে চলল। সেলারের পুরো পশ্চিম কোণটা যেন খুড়ে তুলে ফেলবে।

ওপরে, ভেনটিলেটরের কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। এতই মগ্ন হয়ে আছে, ঠাণ্ডার কথাও ভুলে গেল। কখন যে ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়তে শুরু করেছে টের পেল না। কিছুই না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ডন যখন শাবলটা ছুঁড়ে ফেলল, হাসি চাপতে কষ্ট হলো ওদের।

কোন চিহ্নই তো নেই! বলল সে। আমি আর পারছি না! হোরেস নাকি ট্রাঙ্কটা লুকানোর পর চিহ্ন দিয়ে রেখেছে। কই?

আরও খুঁড়তে হবে, মারভিন বলল। নকশায় লেখা রয়েছে এক ফুট। হাতের লেখা তো। সেভেনকেও ওয়ানের মত লাগে অনেক সময় লেখার দোষে।

তারমানে সাত ফুট খুঁড়তে হবে! ঘাবড়ে গেল ডন। এত নিচে রাখতে গেল কেন? পাগলামি, স্রেফ পাগলামি!

যা-ই হোক, খুঁড়তে তো হবে, ইসাবেল বলল। তাড়াহুড়ো নেই আমাদের। আস্তে আস্তে খোড়ো।

তা তো বলবেই! ফুঁসে উঠল ডন। তোমাকে তো আর পরিশ্রম করতে হচ্ছে না!

কথাটা এড়িয়ে গেল ইসাবেল। বলল, দুটো শাবল আছে। একজন এজন করে না খুঁড়ে দুজনে মিলে একবারেই খোড়ো। সহজও হবে, তাড়াতাড়িও।

বুদ্ধি-পরামর্শ ওরকম অনেকেই দিতে পারে। যে করে সে বোঝে ঠেলা! দুজনে যে খুঁড়ব, যদি কারও মাথায় লেগে যায়? একজন একজন করেই করতে হবে।

সোজা হলো কিশোর। সঙ্গীদের ইশারা করল। যেমন এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে আবার ভেনটিলেটরের কাছ থেকে পিছাতে শুরু করল ওরা।

এখানে থাকলে বরফ হয়ে যাব, কিশোর বলল। যা ঠাণ্ডা পড়ছে! নকল নকশা দিয়ে ছবিগুলো ওরা খুঁজে পাবে না। চলো, কোথাও গিয়ে বসে থাকি। ওরা বেরোক। চলে গেলে তারপর ঢুকব আমরা। ছবিগুলো বের করার চেষ্টা করব।

ঠিক আছে, মুসা বলল। কিন্তু বসবটা কোথায়? বাইরে থাকলে সত্যিই মরে যাব!

চোরের গাড়িতে বসব, নির্দ্বিধায় বলে দিল কিশোর। আর তো কোন জায়গা। দেখছি না। বাগানের গেটের কাছে গাছের নিচে গাড়িটা দেখেছি। দরজায় তালা না থাকলেই বাঁচি…।

তালা লাগানো নেই। প্রয়োজন বোধ করেনি চোরেরা। ওরা কি আর ভাবতে পেরেছে এই রাতের বেলা এসে কয়েকটা ছেলেমেয়ে ওগুলোতে ঠাই নেবে ঠাণ্ডার কবল থেকে বাঁচার জন্যে?

গাড়িতে উঠে বসল সবাই, রাফি সহ। ঠাণ্ডা থেকে রেহাই মিলল। চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে পেরে খুশি লাগছে ওদের।

ঘুমাতে চাও? আরাম করে সীটে হেলান দিয়ে বলল জিনা। ঘুমিয়ে নিতে পারো। আমি পাহারায় থাকি।

রবিনের আপত্তি নেই। ঢুলতে শুরু করল। কিশোর আর মুসাও ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু মনে হলো, চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গেই ওদেরকে জাগিয়ে দিল জিনা। কিশোরের কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, এই, জলদি ওঠো! ওরা আসছে!

চোখের পলকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ওরা। ডন তার দুই সঙ্গীকে আসতে দেখল। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে তিনজনেরই। গরম গরম কথা বলছে।

হোরেস আমাদেরকে ফাঁকি দিয়েছে! ডন বলল।

না, তা হতে পারে না, মানতে পারল না মারভিন। কেন ফাঁকি দিতে যাবে? কাল রাতে আবার আসব। দরকার হলে পুরো সেলারটাই খুঁড়ে ফেলব।

ইস, কি শীতরে বাবা! ইসাবেল বলল।

 গাড়িতে উঠে চলে গেল লোকগুলো।

যাক, গেল, কিশোর বলল। খেয়াল করেছ, শাবল-টাবলগুলো আনেনি। খালি হাতে বেরিয়ে এসেছে। তারমানে ওগুলো রয়ে গেছে সেলারে। আমাদের কাজ সহজ করে দিয়ে গেল।

সহজ? জিনা প্রশ্ন করল, ঢুকতে পারলে সহজ। ঢোকাটাই তো আসল সমস্যা।

পথ একটা ঠিকই বের করে ফেলব, হাল ছাড়তে রাজি নয় মুসা।

কিন্তু সেই একই ব্যাপার, দিনের মতই। দরজা জানালা সব বন্ধ। ঢোকার কোন পথ নেই। ভেনটিলেটর দিয়ে ঢাকা যেত, যদি শক্ত গ্রিল না থাকত। আর মাঝে যে ফাঁক রয়েছে, তা দিয়ে ঢোকা অসম্ভব।

দূর! হতাশ হয়ে গেল মুসা। হবে না! ফিরে যেতে হবে দেখছি!

ঠিক এই সময় একটা জিনিসের ওপর চোখ পড়ল রবিনের। চাঁদের আলোয় চকচক করছে। খোয়া বিছানো পথের ওপর পড়ে রয়েছে। নিচু হয়ে তুলে নিল জিনিসটা। একটা চাবি!

আরি! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। চাবি! মনে হয় সামনের দরজার!

এটা এখানে এল কিভাবে? জিনার প্রশ্ন।

বড়ই কাকতালীয় ব্যাপার! চোরগুলো এনেছিল হয়তো, কিশোর বলল। পড়ে গেছে কোনভাবে। যাক, ভালই হলো। ঢোকাটা হয়ে গেল আমাদের।

চাবিটা নিয়ে প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল মুসা। তালার ফোকরে লাগিয়ে মোচড় দিতেই খুলে গেল। পিংক হাউসে ঢুকতে আর অসুবিধে হলো না ওদের।

ঝগড়া করার শাস্তি, রবিন বলল। ঝগড়াঝাটি না করলে, আর মাথা ঠাণ্ডা রাখলে চাবিটা যে পড়েছে টের পেয়ে যেত।

ভাল হয়েছে, কিশোর বলল। এসো, সেলারে ঢুকি।

নিচে নেমে প্রথমেই হ্যারিকেন দুটো জ্বালানো হলো। শাবল তুলে নিল মুসা। কিশোর বের করল নকশাটা। আসল নকশা। মিনিট দুই পরেই ঘরের পূর্ব দিকের। কোণায় খুঁড়তে আরম্ভ করল ওরা। মাটি ওখানটায় ঝরঝরে, শক্ত, জমাট হয়ে নেই। পালা করে খুঁড়তে লাগল কিশোর আর মুসা। মাঝে মাঝে জিনাও ওদেরকে সাহায্য করল। তবে তার গায়ে ছেলেদের চেয়ে জোর কম, তাই একটানা বেশিক্ষণ খুড়তে পারে না, হাঁপিয়ে যায়।

এক সময় বিড়বিড় করে বলল কিশোর, মাত্র এক ফুট। মুসা, চালিয়ে যাও। হয়ে এল বলে।

অবশেষে ঠং করে কিসে লাগল মুসার শাবল। উৎসাহ পেয়ে আরও তাড়াতাড়ি খুঁড়তে লাগল সে। বেরিয়ে পড়ল একটা টিনের ট্রাঙ্ক।

এরপরে ডালা তোলার পালা। বুকের কাপুনি বেড়ে গেছে ওদের। সবাই ঝুঁকে এল ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে।

কয়েকটা রঙিন ক্যানভাস রোল পাকিয়ে বেঁধে রেখে দেয়া হয়েছে। একটা তুলে সাবধানে মেলে ধরল কিশোর।

ছেলেদের মত শিস দিয়ে উঠল জিনা। চিনি ওটা! ইস্কুলের লাইব্রেরিতে একটা রেফারেন্স বইতে দেখেছি। ওটার নাম উয়োম্যান উইথ ওয়াটার লিলি। সাদা কালো ছবিও দেখেছি এটার, পত্রিকায়। চুরি হওয়ার খবর বেরিয়েছিল যখন, তখন ছেপেছিল।

খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এগুলোই তাহলে চোরাই পেইন্টিং। এখন শুধু গোবেল ভিলায় নিয়ে যাওয়া। তারপর পুলিশের হাতে তুলে দেবেন পারকার আংকেল।

ট্রাঙ্ক, ট্রাঙ্কটা ভীষণ ভারী, কিশোর বলল। বয়ে নিয়ে যেতে পারব না। সবচেয়ে ভাল হয়, বাগানে কোথাও লুকিয়ে রেখে গেলে। তারপর থানায় গিয়ে খবর দিতে পারব।

সেটাই ভাল হবে, হেসে বলল জিনা। এখন এসে ডন আর মারভিন দেখলে কি যে করত…

কি আর করবে? বলে উঠল একটা কণ্ঠ। তোমাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দেবে। কারণ আমাদের কাজটা তোমরাই সেরে দিয়েছ। চাবিটার জন্যে ফিরে এসেছিলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি, নেই। সেলারে আলো দেখে নামলাম। খুব ব্যস্ত ছিলে তো তোমরা, আমরা যে এসেছি, শোনোনি।

কথা বলছে মারভিন। তার পেছনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডন। স্তব্ধ হয়ে গেছে গোয়েন্দারা। যখন ভাবছে, সফল হয়েছে, তখনই এল চরম ব্যর্থতা।

ঝট করে কথাটা মনে পড়ল জিনার। চোরগুলো যে এল, রাফি হুশিয়ার করল কেন? বুকের রক্ত ছলকে উঠল তার। দ্রুত চোখ বোলাল সেলারে। রাফি নেই!

আমার কুকুর! ককিয়ে উঠল সে। তাকে কি করেছেন আপনারা?

হেসে উঠল মারভিন। ওটা ঠিকই শুনতে পেয়েছে, আমরা যে এসেছি। কামড়ানোর চেষ্টাও করেছে। পারেনি। পিটিয়েছি।

কেঁদে ফেলবে যেন জিনা। মেরে ফেলেছেন! আমার রাফিকে মেরে ফেলেছেন! লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল ডনের মুখে খামচি মারার জন্যে। খপ করে তার হাত চেপে ধরল লোকটা। মুসা আর কিশোর জিনাকে সাহায্য করতে এগোল। কিন্তু এক কথাতেই ওদের থামিয়ে দিল মারভিন, খবরদার! এক পা এগোলে মেয়েটার পেটে ছুরি মেরে দিতে বলব ডনকে!

তারপর দ্রুত ঘটতে থাকল ঘটনা। কিছু দড়ি পড়ে রয়েছে সেলারে। তুলে এনে ডন আর মারভিন মিলে বেঁধে ফেলল গোয়েন্দাদেরকে।

যাক, হলো, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল মারভিন, গোয়েন্দাগিরির শখ খানিকটা মিটবে। চালাকিটা ভালই করেছিলে, আমাদের নকল নকশাটা দিয়ে। তবে শেষ দিকে সন্দেহ হতে আরম্ভ করেছিল আমার। যাই হোক, সব ভালয় ভালয়ই শেষ হলো। তোমাদেরকে হ্যাপি নিউ ইয়ার জানাতে অসুবিধে নেই। হাহ হাহ হাহ! তোমাদেরকে যখন পাবে তোমাদের আত্মীয়-স্বজনরা, তখন সত্যি নতুন বছর এসে যাবে, আর আমরা অনেক দূরে চলে যাব। হয়তো আরও কিছুদিন থাকতাম এখানে, তোমরা যেতে বাধ্য করলে। যাব, কি আর করা। আসল জিনিসটা তো পেয়ে গেলাম। ডন, এসো। হ্যারিকেনগুলো নিয়ে নাও।

দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল সেলারের দরজা। বেরিয়ে গেছে চোরেরা। সাথে করে নিয়ে গেছে দামী ছবিগুলো।

.

১১.

 প্রচণ্ড রেগে গেছে কিশোর। ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে রাফির জন্যে। লোকগুলো তাকে এ ভাবে বোকা বানিয়ে গেল, এটা সহ্য করতে পারছে না। গালমন্দ করছে নিজেকে মনে মনে। বেরোতে হবে! চিৎকার করে উঠল সে। বেরোতেই হবে, যে ভাবে হোক!

মুখ আটকে রেখে যায়নি আমাদের, জিনা বলল। তার মানে দরকার মনে করেনি। যদি আমরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাইও, আমাদের চিৎকার কারও কানে যাবে না। রাস্তা থেকে অনেক দূরে রয়েছি। আর এত রাতে আসবেও না কেউ। নিউ ইয়ারের পার্টি নিয়ে সবাই ব্যস্ত।

হ্যারিকেনও নিয়ে গেছে! রবিন বলল ভীত কণ্ঠে। কিছু দেখারও উপায় নেই। চাঁদের আলো যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাতে যদি কিছু করা যায়!

দেয়ালে ঘষে দড়ি যদি ছিঁড়তে পারি! মুসা বলল। দেখি সেই চেষ্টাই করে। এ ভাবে বাধা থাকতে একটুও ভাল্লাগছে না আমার!

কিন্তু যত ভাবেই ঘষুক, কিছুই করতে পারল না সে।

হঠাৎ কান খাড়া করে ফেলল জিনা। একটা গোঙানি শুনেছে মনে হলো। সেলারে নামার সিঁড়ি থেকে এসেছে শব্দটা।

রাফি! চেঁচিয়ে উঠল সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মরেনি! আল্লাহ, রাফি মরেনি! বেঁচে আছে! আমার রাফি বেঁচে আছে!

তারপর শোনা পেল আরেকটা শব্দ। মরচে পড়া কজার ক্যাচকোচ। খুলে যাচ্ছে সেলারের দরজা।

লাগেনি! এবার চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এত জোরে টান দিয়েছিল পাল্লাটা, লাগেইনি! আটকায়নি! ফাঁক হয়ে ছিল!

রাফি! রাফি! চেঁচাতে লাগল জিনা।

দরজা ঠেলে ফাঁক করে ঢুকে পড়ল রাফি। তিন লাফে কাছে চলে এল। জিনার গাল চেটে দিল। নাক ঘষতে লাগল মুখে।

আরে ছাড় ছাড়! জিনা বলল। ওসব পরেও করতে পারবি। আগে খোল তো। দড়িটা খোল পারলে।

রাফির বুদ্ধি আছে, ঠিক, কিন্তু হাত নেই। অত সহজে খুলতে সে পারে না। তবু চেষ্টার ত্রুটি করল না। প্রথমে কাপড় কামড়ে ধরে টেনে হিঁচড়ে জিনাকে বের করার চেষ্টা করল। পারল না। পারার কথাও নয়। এত ভারী একটা শরীর নেয় কি করে। ওসব বাদ দিয়ে দড়ি খুলতে পারে কিনা, সেই চেষ্টা করতে বলল তাকে জিনা। শেষে হাতের দড়ি কামড়াতে শুরু করল রাফি। এই কাজটাও সহজ নয়। মাঝে মাঝেই হাল ছেড়ে দেয়। আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে চিবাতে রাজি করাতে হয়। এমনি ভাবে চলল। শেষে জিনা যখন হতাশ হয়ে পড়ল, ভাবল আর হবে না, তখনই কেটে গেল দড়ি।

উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সে। খুলে গেছে! খুলে গেছে! ইস, অবশই হয়ে গেছে! নড়াতেও পারছি না! জোরে জোরে বাঁধনের জায়গাগুলো ডলতে লাগল সে। রাফি! লক্ষ্মী ছেলে! কাজের কাজই করেছিস!

হাতের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এল। পায়ের বাধন খোলার জন্যে দেরি করল না সে। গড়িয়ে চলে এল অন্যদের কাছে। কিশোর মনে করিয়ে দিল ছুরিটার কথা। দড়ি কেটে ফেললে খোলার চেয়ে সহজ হবে। ওর পকেটেই রয়েছে উপহার পাওয়া বহু ফলার ছুরিটা।

ছুরি বের করে তিন গোয়েন্দার দড়ি কেটে ওদের মুক্ত করতে বেশি সময় লাগল না জিনার।

তাগাদা দিল কিশোর। জলদি চলো। চোরগুলোকে ধরে ওদের কাছ থেকে ছবিগুলো আদায় করে নিতে হবে।

সেলার থেকে বেরিয়ে এল ওরা। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে গেছে। চোরেরা। তবে ঢুকতে অসুবিধে হলেও বেরোতে অসুবিধে নেই। জানালার ছিটকানি খুলে বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা।

থানায় যাব? জিজ্ঞেস করল মুসা।

মিডলটনের থানা চিনি না, জিনা বলল। গোবেল বীচ বেশি দুরে না। ওই থানায়ই যেতে পারি। ওখানকার পুলিশও আমাদের চেনে। মিডলটন থেকে অর্ধেক দূরে তো চলেই এসেছি, আর অর্ধেক গেলেই হলো।

হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। তাতে সময়ও বাঁচবে। মিডলটনে গিয়ে থানা খুঁজে বের করতেও তো সময় লাগবে। চলো।

তবে বলা যত সহজ করা ততটা হলো না। ভীষণ ঠাণ্ডা রাত। ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। ফলে আলোও নেই। সাইকেল চালাতেও অসুবিধে। চলছে ওরা, চলছেই, তার পরেও পথ ফুরায় না। আস্তে আস্তে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সবাই। রবিন বলেই ফেলল, অবাক কাণ্ড! এতক্ষণে তো গোবেল বীচে ঢুকে পড়ার কথা!

পথ হারাইনি তো? দুশ্চিন্তাটা প্রকাশ করে ফেলল মুসা। দাঁ

দাঁড়াও তো, কিশোর বলল। একটা সাইনবোর্ড মনে হচ্ছে।

সাইকেল থেকে নামল সবাই। সাইনবোর্ডই। তবে লেখা পড়া গেল না।

চৌরাস্তায় ভুল করেছি, চিন্তিত হয়ে বলল জিনা। আরেক পথে চলে এসেছি ভুল করে। ফিরে গিয়ে খুঁজে বের করা ছাড়া উপায় নেই।

ইস, একটা আলোটালো যদি পেতাম! বলেও সারতে পারল না রবিন, সামনে দেখা গেল হেডলাইট। দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল আলো দুটো। কাছে এসে ব্রেক কষল, টায়ারের আর্তনাদ তুলে থেমে গেল গাড়ি।

পুলিশের পেট্রোল কার। ভেতরে দুজন অফিসার। একজন ইন্সপেক্টর। আরেকজন সার্জেন্ট। টহলে বেরিয়েছে। লোকে পার্টিতে ব্যস্ত। অপরাধগুলো এ সময়ই বেশি হয় রাস্তায়, কারণ নির্জন থাকে পথঘাট। কড়া নজর রেখেছে দুই পুলিশ অফিসার। এত রাতে চোর-ডাকাত আশা করছে তারা, চারটে কিশোর-কিশোরী আর একটা কুকুরকে অবশ্যই নয়। ওদেরকে খুঁজতে যে পুলিশ আসেনি, নিশ্চিত কিশোর। কারণ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ওরা বেশিক্ষণ হয়নি। এত তাড়াতাড়ি খোঁজ পড়ার কথা নয়।

পথ হারানোতে বিশেষ চিন্তিত ছিল না কিশোর। খুঁজে বের করতে সময় হয়তো লাগত, কিন্তু অসম্ভব ছিল না। তবু পুলিশ দেখে হাঁপ ছাড়ল।

ভালই হলো, ভাবল সে। গোবেল বীচে ফেরার পথ বাতলে দিতে পারবে। পুলিশ।

জিজ্ঞেস করার সময় পেল না সে। তার আগেই বেরিয়ে এল দুই পুলিশ অফিসার। কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল একজন, এই, এত রাতে কি করছ এখানে?

ইন্সপেক্টরের কণ্ঠস্বর পছন্দ হলোনা রাফির। গরগর শুরু করল সে।

সরাও ওটাকে! চুপ করাও! ধমক দিয়ে বললেন পুলিশ অফিসার। চেহারাটা তো বিটকেলে!

প্রতিবাদ জানাল জিনা। তার রাফি এত খারাপ হতেই পারে না। কিন্তু মানতে রাজি নয় ইন্সপেক্টর। মেজাজ ভাল নেই তার। রেগে আছে। এই রাতে ডিউটি দিতে ভাল লাগছে না। সবাই বসে বসে বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে নিউ ইয়ারের আনন্দ করবে, আর তাকে ডিউটি দিতে হবে, এটা মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই।

দেখো, ভদ্রভাবে কথা বলো! আবার ধমক দিল সে। আদব-কায়দা শেখোনি নাকি? ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোরের দিকে। আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু দাওনি। এত রাতে এখানে কি করছ?

গোবেল বীচে যাচ্ছি, জবাবটা দিল জিনা।

বানিয়ে বলার আর জায়গা পাওনি! গোবেল বীচ কি উল্টোদিকে নাকি?

পথ ভুল করেছি। সেটা যখন বুঝলাম, আপনারাও চলে এলেন।

তাই? কোত্থেকে এসেছ?

গোবেল বীচ, জানাল রবিন।

দেখো, ফালতু কথা বলবে না আমার সঙ্গে! গোবেল বীচ থেকে গোবেল বীচে যায় কি ভাবে? আর এই রাতের বেলা, এত ঠাণ্ডায়, নিউ ইয়ারের পার্টি ফেলে কোন ছেলেমেয়ে বেরোয়? ব্যাপারটা সুবিধের লাগছে না আমার।

গোবেল বীচ থেকে গোবেল বীচে যাওয়া যায় না, ব্যাখ্যা করে বোঝাল কিশোর। কিন্তু গোবেল বীচ থেকে এসে তারপর তো আবার ফেরত যাওয়া যায়। মিডলটনে গিয়েছিলাম আমরা। ফিরে চলেছি গোবেল বীচে।

তার পরেও সুবিধের লাগছে না, কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজি নন ইন্সপেক্টর। নিশ্চয় বাড়ি থেকে পালিয়েছ তোমরা।

যদি ভবঘুরে কিংবা জিপসি না হয়ে থাকে, সার্জেন্ট বলল। বিদেশীই লাগছে। জিপসি হলে অবাক হব না। কাপড়-চোপড়ের অবস্থা দেখেছেন, স্যার? ছেঁড়া, ময়লা। হাতে মুখে এত মাটি লাগল কোত্থেকে!

সেলারে মাটিতে গড়াগড়ি করে এলে এর চেয়ে ভাল অবস্থা আশাও করা যায় না।

দেখুন, মুসা বলল। আপনারা ভুল করছেন।

সাইকেলগুলো কিন্তু একেবারে নতুন! সন্দিহান হয়ে উঠেছে ইন্সপেক্টর। চুরিটুরি করে আনেনি তো?

দেখুন, বাজে কথা বলবেন না! রেগে গেল জিনা। দেখে কি চোর মনে হয় আমাদের? গোবেল বীচে কোথায় যাচ্ছি, জানেন? থানায়। একটা খবর দিতে।

বেশ, বেশ, বেশ! ব্যঙ্গ করার ভঙ্গিতে বলল সার্জেন্ট।- তা জানতে পারি কি, খবরটা কী?

অফিসারদের এহেন আচরণে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে কিশোরের। মাথা সোজা করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল সে, খবরটা হলো, এক বছর আগে হোরেস ট্রিমেইনি যে ছবিগুলো চুরি করেছিল, সেগুলো খুঁজে পেয়েছি আমরা। মাল সহ চোরগুলোকে আটক করতে হলে এটাই সুযোগ!

তাই নাকি? টেনে টেনে বলল সার্জেন্ট। তারপর হো হো করে হেসে উঠল। গালগল্প তো বেশ ভালই বলতে পারো। বই লেখার চেষ্টা করো না কেন? ভাল পারবে। এ সব কাহিনী পুলিশকে বিশ্বাস করাতে পারবে ভেবেছ?

করা না করা সেটা পুলিশের ইচ্ছে!

 কিন্তু সত্যি বলছি আমরা! প্রায় চিৎকার করে উঠল রবি।

বেশি ঠাণ্ডা, ইন্সপেক্টর বলল। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলাই মুশকিল। সাইকেলগুলো রেখে গাড়িতে এসে ওঠো। ওগুলো পরে তুলে নিয়ে যেতে পারব। পেনড়ল সেইন্ট জনে নিয়ে যাব তোমাদের। সেখানে তোমাদের আইডেনটিটি চেক করব। তোমাদের কথা কতটা সত্যি থানায় বসেই খোঁজ নিতে পারব। নেয়া সহজও হবে। সময় অবশ্য লাগবে। তবে নিয়মের বাইরে তো আর যেতে পারি না।

মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা, কিন্তু তাইলে যে বেশি দেরি হয়ে যাবে। অনেক দূরে চলে যাবে চোরেরা। আর তখন ধরা যাবে না ওদের। ছবিগুলোও যাবে।

আমাদেরকে এ ভাবে আটকানোর কোন অধিকার আপনার নেই, কিশোরও রেগে গেল। আমরা কোন অন্যায় করিনি। বরং পুলিশকে সাহায্যই করতে চাইছি।

শোনো শোনো, কথা শোনো, হাসতে লাগল ইন্সপেক্টর। কি ভাবো নিজেকে? শার্লক হোমস?

না, তা ভাবি না! আমার নাম কিশোর পাশা। বেড়াতে এসেছি গোবেল বীচের বিখ্যাত বিজ্ঞানী…

কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দিল সার্জেন্ট, যাও, গাড়িতে ওঠো!

প্রতিবাদ জানাল ছেলেমেয়েরা। আরও তর্ক করল। কোন কথাই শুনল না পুলিশ। কিছুতেই বোঝানো গেল না ওদের।

অনেক বকবকানি হয়েছে, ইন্সপেক্টর বলল। আর কিছু শুনতে চাই না আমি। ভাল চাইলে গাড়িতে ওঠো।

মুখ কালো করে গিয়ে গাড়িতে উঠল গোয়েন্দারা। তবে চুপ করে বসে থাকল না কিশোর। গাড়ি যখন চলছে, পকেট থেকে তার রুমালটা বের করে, কলম দিয়ে তাতে একটা চিঠি লিখল সে, অন্ধকারে কাপড়ের মধ্যে যতটা পারল। সেটা বাধল রাফির কলারে। সামনের সীটে বসে এ সবের কিছুই জানল না সার্জেন্ট কিংবা ইন্সপেক্টর।

পেনডল সেইন্ট জন থানার সামনে গাড়ি থামল। পেছনের দরজা খুলে অন্যদেরকে নামতে বলল কিশোর। রাফির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, বাড়ি চলে যাবি! সোজা বাড়ি! জিনাদের বাড়ি! বলেই ঠেলে বাইরে বের করে দিল কুকুরটাকে। পেছনে আলতো চাপড় দিয়ে আবার বলল, যা! বাড়ি!

এই কয়েকটা কথাই রাফির জন্যে যথেষ্ট। একবার ফিরে তাকাল কিশোরের মুখের দিকে। বোঝার চেষ্টা করল, সত্যিই যেতে বলছে কিনা। তারপর লেজ নাড়তে নাড়তে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা, দুই পুলিশ অফিসার থানায় ঢোকার আগে লক্ষই করল না যে কুকুরটা নেই।

আরে, সার্জেন্ট বললেন। কুকুরটা গেল কোথায়?

হাত নেড়ে ইন্সপেক্টর বললেন, যেখানে খুশি যাক। ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে এসো।

.

১২.

 পেনডল সেইন্ট জন থানায় মাত্র দুজন পুলিশ পাহারায় রয়েছে, একজন কনস্টেবল, আরেকজন সার্জেন্ট। ছেলে-মেয়েদেরকে তাদের হাতে সোপর্দ করল ইন্সপেক্টর। মনে হয় বাড়ি থেকে পালিয়েছে, বলল সে। রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছিল। ওরা বলেছে গোবেল বীচ যাচ্ছে, কিন্তু সেটা উল্টো দিক। আরও কিছু গল্প বলল, বিশ্বাস করতে পারলাম না।

মুখ কালো করে জিনা বলল, বার বার একই কথা! কত বার বলব, বাড়ি থেকে পালাইনি! আর দল বেঁধে পালাতে যাবই বা কেন?

 তোমাদের বাবা-মায়ের সাথে আগে কথা বলি, জানা যাবে। ততক্ষণ এখানেই থাকতে হবে তোমাদের। গোলমাল করবে না। রিপোর্ট লিখতে বসব এখন।

চারজন লোক বসে চারটে ফর্ম পূরণ করতে লাগল। চুপ করে বেঞ্চে বসে। একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল ছেলেমেয়েরা।

রাফি কোথায়? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রবিন।

বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি! জবাব দিল কিশোর। পথে গলা থেকে রুমালটা খুলে পড়ে না গেলেই হয়। মেসেজ লিখে দিয়েছি পারকার আংকেলের কাছে, চুলে হাত বোলাল সে। অনেক দেরি হয়ে গেল!

হ্যাঁ, মাঝরাত, ঘড়ি দেখল মুসা। আংকেল কি ভাববেন কে জানে! তবে মেসেজ পাঠিয়ে ঠিক কাজই করেছ। আর কিছু করার ছিল না। এ রকম জরুরী একটা ব্যাপার…

কাছে এসে ওদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল পুলিশ। গোবেল ভিলায় ফোন করার পরামর্শটা জিনাই দিল। কিন্তু করা হলে দেখা গেল, লাইন ডেড। কি করে যে হলো, কিছুই বোঝা গেল না। অনেক সময় হয় এ রকম। সবচেয়ে কাজের জিনিসটা বিকল হয়ে যায় প্রয়োজনের সময়ে। নিউ ইয়ারের ছুটি শেষ না হলে আর মেরামত হবে না।

উত্তেজনা অসহ্য হয়ে উঠছে ওদের কাছে। প্রতিটি মিনিট যাচ্ছে, আর অস্বস্তি বাড়ছে ওদের। কারণ যতই সময় যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে চোরেরা। কমে যাচ্ছে ধরা পড়ার সম্ভাবনা।

দূরে গির্জায় ঘন্টা বাজিয়ে সময় ঘোষণা করা হলো। এই সময় বাইরে একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হলো। তারপর শোনা গেল দৃঢ় গমগমে কণ্ঠ।

আব্বা এসে গেছে! বলে উঠল জিনা।

ঘরে ঢুকলেন পারকার আংকেল। সাথে রাফি। নিজের পরিচয় দিলেন পুলিশের কাছে। তারপর ফিরলেন ছেলে-মেয়েদের দিকে।

মুখ লাল হয়ে গেছে ইন্সপেক্টরের, লজ্জায়, যখন বুঝল সত্যি কথাই বলেছে ছেলেমেয়েগুলো।

কড়া চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আংকেল, ব্যাপারটা কি, অ্যাঁ? স্টোররূম থেকে বেরোলে কখন? আমরা ভাবছি তোমরা খেলছ, আর এদিকে…রাফি ঠিকমত না গেলে তো…কিশোর, ব্যাপারটা কি, বলো তো?

বলার সুযোগ পেয়েছে, আর কি ছাড়ে সে। পরে আংকেল বাড়ি নিয়ে গিয়ে বকাবকি করুন আর যাই করুন, তখন চুপ করে থাকা যাবে না হয়। বলল, আংকেল, আরেকটা রহস্য সমাধানের চেষ্টা করছিলাম আমরা। দোকানের খেলনা চুরি আর পলিদের নীল ভালুক চুরির রহস্য…

শুরু থেকে গল্পটা বলে যেতে লাগল কিশোর। মাঝে মাঝে কথা জোগান দিল রবিন, জিনা আর মুসা। শুনে তো থ হয়ে গেল পুলিশেরা।

অসম্ভব! এক সময় আর থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল ইন্সপেক্টর। সব বানিয়ে বলছে ওরা!

আমার তা মনে হয় না, গম্ভীর মুখে বললেন পারকার আংকেল। ওরা মিথ্যুক নয়। মাঝেসাঝে এ রকম রহস্যে জড়িয়ে পড়ে। বেশ কিছু রহস্যের সমাধানও করেছে। ওদের কথা বিশ্বাস করা উচিত। যা বলছে করা উচিত। অবিশ্বাস করে চুপ। করে থাকতে পারেন অবশ্য, পরে পস্তাবেন।

এই শেষ কথাটা ম্যাজিকের মত কাজ করল। হঠাৎ যেন সাড়া পড়ে গেল। পুলিশদের মাঝে। ফোন তুলে নিল একজন সার্জেন্ট। রেডিওতে পেট্রোল কারগুলোকে হুঁশিয়ার করতে ছুটল ইন্সপেক্টর আর আরেকজন সার্জেন্ট। মিনিট কয়েক পরেই ফিরে এল ইষ্ণপক্টর।

সাহায্য আসছে, জানাল সে। ফোর্স পাঠাতে বলেছি। বসে থাকলে চলবে না। বেরোতে হবে আমাদের। পারকার আংকেল আর ছেলেমেয়েদের দিকে ফিরে বলল, ডন হারভের বাড়ি চেনো কেউ? তাকে ধরতে পারলে বাকিগুলোকে ধরার ব্যবস্থা হতে পারে। কোথায় পাওয়া যাবে অন্যদেরকে হয়তো বলতে পারবে সে।

বেরিয়ে গেলেই মুশকিল, গম্ভীর হয়ে আছে সার্জেন্ট। ছেলেমেয়েদের কথা অবিশ্বাস করে সময় নষ্ট করেছে বলে এখনই অনুশোচনা আরম্ভ হয়েছে।

সেটা ভেবে বসে থাকলে তো আর চলবে না। চেষ্টা করতে হবে। আবার ছেলেমেয়েদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, চেনো?

না, বাড়িটা চিনি না, জবাব দিল কিশোর। তবে মিডলটনে থাকে, জানি। ওখানকার কাউকে জিজ্ঞেস করলেই চিনিয়ে দেবে। আমরা আসব আপনাদের সঙ্গে?

মানা করে দিল ইন্সপেক্টর।

তবে তাকে বোঝাতে পারল কিশোর, ওদেরকে সঙ্গে নিলে অনেক সুবিধে হবে। কারণ চোরগুলোকে ওরা চেনে, দেখেছে। চিনিয়ে দিতে পারবে।

আপনারা আপনাদের গাড়িতে যান, পারকার আংকেল বললেন। আমি ওদেরকে নিয়ে আসছি আমার গাড়িতে করে।

হেডকোয়ার্টারে আরেকটা মেসেজ পাঠাল ইন্সপেক্টর। মিডলটনে যাচ্ছে সে কথা জানাল। অনুরোধ করল ফোর্স যেন তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয় পেনড় সেইন্ট জনে।

রওনা হয়ে গেল দলটা। আগে আগে পুলিশের গাড়ি। পেছনে পারকার আংকেলের। তার সঙ্গে রয়েছে কিশোররা চারজন আর রাফি।

ব্ল্যাক ক্যাট কাফেতেও চলছে নিউ ইয়ারের পার্টি। বাইরে থামল দুটো গাড়ি। পুলিশের আগেই নেমে পড়ল কিশোর, ছুটে গেল সামনের গাড়িটার কাছে। ইন্সপেক্টরকে বলল, মালিকের ছেলে হ্যারিকে চিনি আমরা। যদি বলেন, আমি একাই গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসতে পারি ডনের বাড়িটা কোথায়। তাতে কেউ কিছু ভাববেও না, কারও নজরে পড়ার সম্ভাবনাও কম।

ঠিক আছে, রাজি হলো ইন্সপেক্টর। বুদ্ধিটা ভাল। ডনের পেছনে যে পুলিশ লেগেছে, এ কথা লোকে এখন না জানলেই ভাল। তাহলে সতর্ক করে দেয়া হবে তাকে।

মুসা বলল, কিশোর, আমার সঙ্গে হ্যারির খাতির বেশি। আমি যাই?

 বেশ, যাও।

কাফেতে ঢুকে পড়ল মুসা। অনেক লোক। হ্যারিকে দেখা গেল ব্যস্ত হয়ে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ছোটাছুটি করছে। অনেক কষ্টে তাকে থামিয়ে কথা বলতে পারল মুসা! হ্যারি, চিনতে পারছ? আমি, মুসা। একটা কথা জানতে। এলাম। আচ্ছা, ডন হারভের বাড়িটা চেনো?

ডন হারভে? তার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? সে তো লোক ভাল নয়!

জানি। তবু তার সঙ্গে দেখা করা খুব দরকার।

অবাক হলেও সময় নেই বলে আর কোন প্রশ্ন করল না হ্যারি। বলল, হাই স্ট্রীটের গ্র্যান্ড কাফে চেনো? আচ্ছা। ওখানে গিয়ে বয়ের প্রথম গলিটায় ঢুকবে। চলে যাবে শেষ মাথায়। একেবারে শেষ বাড়িটাই। ওটা তার ভাইয়ের বাড়ি। ওখানেই থাকে ডন।

অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, হ্যারি!

বেরিয়ে এসে পুলিশকে ঠিকানা জানাল মুসা। আবার চলল দুটো গাড়ি। বাড়িটায় পৌঁছে দেখা গেল, একটা জানালায়ও আলো নেই। দরজায় থাবা দিল। সার্জেন্ট। একটা জানালায় আলো জ্বলল। খুলে গেল দরজা।

খুলে দিয়েছে লম্বা, স্বাস্থ্যবান এক যুবক। অন্ধকারে পুলিশের পোশাক ঠিকমত দেখা যায় না। চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কি চাই? কে আপনারা?

পুলিশ। ডন হারভে এখানে থাকে? এগোল ইন্সপেক্টর।

চমকে গেল লোকটা। আবার তাহলে বাধিয়েছে! হ্যাঁ, এখানেই থাকে…

ঘরে আছে?

নেই।

কখন গেল?

এই তো, ঘণ্টা দুই আগে এসে জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম। বলল, বাইরে কোথায় নাকি একটা চাকরি পেয়েছে। ও এ রকম মাঝে মাঝেই আসে যায়। অবাক হইনি। তবে মনে হলো, এবার বেশ কিছুদিনের জন্যেই যাচ্ছে। জলপথেই যাবে মনে হলো। ওর কথায় বুঝলাম।

জিজ্ঞেস করেননি কোথায় যাচ্ছে?

না। এখন আর করি না। করলে সত্য জবাব দেয় না, খামোকা কি লাভ। তবে বেশ খুশি খুশি মনে হলো আজ। কি করেছে?

এখন বলা যাবে না। তবে সত্যি কথা বললেন, সেজন্যে ধন্যবাদ। বিরক্ত করলাম। গুড নাইট।

দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

 পারকার আংকেলের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করে নিল ইন্সপেক্টর আর সার্জেন্ট।

গোবেল বীচ বড় বন্দর নয়। দেশের ভেতরে বেশিদূর যাওয়ার মত ইন্টারনাল ফেরি যোগাযোগ নেই। সে-কথাই বলল ইনসপেক্টর, যেতে হলে ফিশিং বোটে করে যেতে হবে। কিংবা মোটর লঞ্চ। বলেই তো দিয়েছে, দেশের বাইরে চলে যাবে। ছেলেমেয়েরা শুনেছে সে-কথা। নিয়ে গিয়ে ছবিগুলো বিক্রি করে টাকা ভাগাভাগি করে নেবে।

হয়তো চলেই গেছে এতক্ষণে, নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে সার্জেন্টের।

না, তা বোধহয় যেতে পারেনি, কিশোর বলল। এতটা তাড়াহুড়ো তো দেখলাম না। ওরা নিশ্চয় ভাবছে আমরা এখনও সেলারেই আটকে রয়েছি। কাজেই ততটা সতর্ক হবে না।

আরও একটা ব্যাপার। এক মুহূর্ত চুপ থেকে, বলল সে, আমাদের জন্যে ওদের প্ল্যান বদলাতে হয়েছে। আজ রাতে যাওয়ার কথা ছিল না, আমরা বাদ। সাধলাম বলেই যেতে হচ্ছে। ধরা যাক, বোট আছে ওদের। তবে তাতে দুরে পাড়ি দেয়ার মত রসদ, নেই। সে-সব জোগাড় করে রওনা হতে সময় লাগবে। ট্যাংকে তেল ভরারও ব্যাপার আছে। আজ ছুটির দিন। সব কিছু বন্ধ। তেল জোগাড় করতেও অসুবিধে হবে ওদের, সময় লাগবে।

অবাক হয়ে কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ইন্সপেক্টর। শার্লক হোমসই তুমি। তখন ওভাবে তোমাকে টিটকারি দেয়াটা উচিত হয়নি। মাথায় ঘিল আছে তোমার, সত্যি!

.

১৩.

 আবার এসে গাড়িতে উঠল সবাই। পুলিশেরা পুলিশের গাড়িতে, ছেলেমেয়েরা পারকার আংকেলের গাড়িতে। দ্রুত ছুটল গোবেল বীচের উদ্দেশে। পিংক হাউসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেটা দেখিয়ে জিনা বলল তার আব্বাকে, চোরাই ছবিগুলো ওখানেই পেয়েছি। রাফি না থাকলে আর বেরোতে হত না আজকে আমাদের। এখনও ওখানেই আটকে থাকতাম।

গোবেল বীচে পৌঁছল ওরা। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। কোমল আলোয় ভাসিয়ে দিল পুরো বন্দর এলাকা। নানা রকম বোট রয়েছে জেটিতে। মোটর বোট, ফিশিং বোট, লঞ্চ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ভাসছে পানিতে। শান্ত পরিবেশ। সব কিছু চুপচাপ, শুধু ঢেউয়ের মৃদু ছলাৎছল ছাড়া। মাঝেসাঝে একআধটা বোট গায়ে গায়ে ঘষা লেগে ক্যাচকোচ করে উঠছে।

কোনখান থেকে শুরু করব? সার্জেন্ট জিজ্ঞেস করল।

জেটিতে দাঁড়িয়ে দুজন পুলিশ অফিসার, পারকার আংকেল আর ছেলেমেয়েরা ঘুরে ঘুরে তাকাতে লাগল। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না।

তীর ধরে হেঁটে যাই, ইন্সপেক্টর বলল। কিছু চোখে পড়তে পারে।

আমরাও আসি, বললেন পারকার আঙ্কেল। ছেলেমেয়েদেরকে বললেন, শোনো, তোমরা গিয়ে গাড়িতে বসে থাকো।

আব্বা! আবদার ধরল জিনা। আমরাও আসি না! কি হবে?

না, জিনা, যা বলছি শোনো। তোমাদের আসা লাগবে না। বসে থাকো। আমরা আসছি।

পেনডল সেইন্ট জন থানায় রেডিওতে মেসেজ পাঠাল ইন্সপেক্টর। পুলিশ ফোর্স এসেছে কিনা জানতে চাইল। আসেনি শুনে বলল, এলে যেন তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয় গোবেল বীচ বন্দরে। তারপর হাঁটতে শুরু করল।

অন্ধকার ছায়ায় হারিয়ে গেল তিনটে ছায়ামূর্তি।

গাড়ির ভেতরে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল গোয়েন্দারা। শেষে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল জিনা, আব্বটা যে কেন আমাদের নিল না!

তাতে কি? কিশোর-বলল। আমরা তো আর কথা দিয়ে ফেলিনি যে গাড়িতেই বসে থাকব। বেরিয়ে গেলেই পারি। চলো, আমরাও খোঁজাখুজি করি, অন্য ভাবে।

না না! রবিন গুরুজনের কথা অমান্য করতে রাজি নয়। আজ রাতে এমনিতেই অনেক অন্যায় করে ফেলেছি, না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে। আর করতে চাই না।

হঠাৎ এই সময় ঘাউ ঘাউ করে উঠল রাফি। সামনের পা জানালার ওপর তুলে দিয়ে নাক বের করে দিল। তার ঘাড়ে হাত দিল কিশোর। রোম দাঁড়িয়ে গেছে কুকুরটার। ব্যাপার কি!

 এই, চুপ করো তোমরা! সঙ্গীদের হুঁশিয়ার করল সে। রাফি নিশ্চয় কিছু টের পেয়েছে!

হালকা মেঘের ভেতরে ঢুকে গেছে আবার চাঁদ। জ্যোৎস্নার উজ্জ্বলতা অনেক কমে গেছে তাতে। সেই আলোয় দেখা গেল একটা আবছা মত ছায়ামূর্তি এগিয়ে। চলেছে, হাতে দুটো পেট্রোলের ক্যান।

ডনের মতই লাগছে! মুসা বলল ফিসফিসিয়ে। পারকার আংকেল আর পুলিশ। অফিসারেরা যে দিকে গেছে, তার উল্টো দিকে যাচ্ছে লোকটা।

কিছু একটা করা দরকার আমাদের! কিশোর বলল।

আবার মনে করিয়ে দিল রবিন, কিন্তু আংকেল তো এখানেই থাকতে বললেন!

তা বলেছেন। কিন্তু আমরা তো তার অবাধ্য হচ্ছি না। ধরা যাক, রাফি কিছুতেই গাড়িতে থাকতে রাজি হলো না। তাকে বের করে দিতে বাধ্য হলাম আমরা। ছাড়া পেয়েই একটা লোকের পেছনে ছুটল সে। আমাদেরকেও যেতে হলো, তাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে।

মিথ্যে বলবে?

এখন কাজ উদ্ধার করা দরকার। সত্যি-মিথ্যে নিয়ে ভাবছি না।

দরজা খুলে দিয়ে রাফিকে নির্দেশ দিল সে। এক মুহূর্তও দেরি করল না কুকুরটা। তীরবেগে দৌড় দিল লোকটার পেছনে। সেলারের লোকগুলোর গন্ধ। ভোলেনি সে। ওদেরই একজন তাকে পিটিয়েছিল। জিনাদের বেঁধে রেখেছিল। প্রতিশোধ নেবে সে!

গাড়ি থেকে নেমে রাফির পেছনে ছুটল কিশোর।

এতই দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা, কিছুই করার সুযোগ পেল না অন্য তিনজনে। বোকা হয়ে গেল যেন ওরা।

দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল রাফি। কিশোরকে দেখা যাচ্ছে, অস্পষ্ট। দৌড়াচ্ছে। তবে শিগগিরই তাকেও আর দেখা গেল না।

দেখো, মস্ত ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে কিশোর, জিনা বলল। এটা বসে বসে দেখতে পারি না আমরা। চুপ করে থাকা উচিত হবে না।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরাও।

কি করতে চাও? মুসা জিজ্ঞেস করল।

যাব।

আমিও যাব। রবিন, তুমি বসে থাকো। আমরা না ফিরলে আংকেলকে বলবে।

বসে থাকার ইচ্ছে নেই রবিনের। ওদের সঙ্গে যেতে পারলেই বেশি খুশি হয়। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো গাড়িটা পাহারা দিতেই হবে, বিশেষ করে আংকেল যখন বলে গেছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুপ করে গাড়িতে বসে রইল সে।

অনেক ভারী লাগছে ক্যানগুলো। হাত ধরে এসেছে। জিরিয়ে নেয়ার জন্যে ও দুটো নামিয়ে রাখল ডন।

এখনও বহুদূর! মরার বোটটা আরেকটু কাছে হলে কি হত! বিড়বিড় করে গাল দিল সে। আর ওই ব্যাটা মারভিন, নিজে কিছু করবে না! খালি আমাকে হুকুম দেয়! বসে বসে থাকে!

বেজায় ঠাণ্ডা পড়েছে। তার ওপর বোঝা বইতে গিয়ে যেন অবশ হয়ে গেছে আঙুলগুলো। মুখের কাছে এনে ফুঁ দিয়ে গরম করতে লাগল সে। জিরাতে পারল না বেশিক্ষণ। পিঠে এসে লাগল প্রচণ্ড আঘাত। সামলাতে না পেরে উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে।

উঠে দাঁড়ানোর আগেই ডান কাঁধে কামড় লাগল। চেঁচাতে শুরু করল ডন।

ছাড়বি না, রাফি, ধরে রাখ! চিৎকার করে বলল কিশোর– আমি আসছি!

মুহূর্ত পরেই পৌঁছে গেল সে। কামড় ছাড়ানোর জন্যে ধস্তাধস্তি করছে ডন। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। তার বিপদের কথা জানিয়ে দিতে চায় যেন জেটির সবাইকে।

গড়াগড়ি করছে কুকুর আর মানুষ। কিশোর কি করবে ঠিক করতে পারছে না। এই সময় সেখানে পৌঁছে গেল মুসা আর জিনা।

এসেছ! ওদেরকে দেখে খুশি হলো কিশোর। ধরো ব্যাটাকে! আমি একলা পারতাম না। রাফি, ছেড়ে দে!

কামড় ছেড়ে সরে এল রাফি। উঠে বসল ডন। করুণ অবস্থা হয়েছে তার। আতঙ্কিত করে দিয়েছে তাকে অ্যালসেশিয়ানের বাচ্চা। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। কুকুরটার দিকে। তাকে যখন চেপে ধরল জিনা, মুসা আর কিশোর, বাধা দিল না সে।

চলো, গাড়ির কাছে নিয়ে যাই, কিশোর বলল। কিছু করতে চাইলে রাফি তো আছেই। এবার অ্যায়সা কামড় দিতে বলব, কথা শেষ করল না সে, ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিল। পুলিশও আছে। ধরে প্যাঁদানি দিলেই সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে পেটের কথা।

উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে জিনা। অনেক বেশি শব্দ করে ফেলেছে। মারভিন আর ইসাবেল এখন বেরিয়ে না এলেই বাঁচি।

ঠিকই বলেছ! একমত হলো কিশোর। জলদি করা দরকার! হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে।

কিন্তু পারকার আংকেলরা কোথায় আছেন, কে জানে! অন্ধকারে তাদেরকে খুঁজে বের করব কি ভাবে?

তবে যতই সমস্যা আসুক, একটা না একটা সমাধান করেই ফেলবে কিশোর। উপায়ের অভাব নেই তার বুদ্ধির ভাণ্ডারে। বলল, চলো তো আগে গাড়ির কাছে যাই।

নিরাপদেই গাড়ির কাছে পৌঁছল ওরা। মারভিন বা ইসাবেল কোন বিপদ ঘটাল না। গাড়ির কাছে এসেই হর্ন টিপে ধরল কিশোর। তিনবার লম্বা, তিনবার খাটো, আবার লম্বা, আবার খাটো, এ ভাবে বাজাতে লাগল। এক ধরনের মেসেজ এটা। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার একই ভাবে বাজাল।

বাহ, সত্যি, কিশোর, তোমার তুলনা নেই! উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল মুসা। তিনটে লম্বা, তিনটে খাটো…এ তো এস ও এস। পুলিশ অফিসারেরা শুনলেই বুঝে যাবে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।

উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে গোয়েন্দারা। দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না কিছুতেই। হয়তো কানে যাবে পুলিশের, ছুটেও আসবে হয়তো, কিন্তু সময় মত আসবে তো? মারভিন আর আইরিনকে ধরতে পারবে? ওরা ঘুণাক্ষরেও যদি বুঝতে পারে, ডন ধরা পড়েছে, আসবে না আর। সোজা পালানোর চেষ্টা করবে। ডনের জন্যে নিজেদেরকে বিপদে ফেলতে রাজি হবে না কিছুতেই।

আরেকটা উপায় বের করা দরকার।

বুদ্ধিটা বের করল এবার জিনা।

.

১৪.

 ডন, শোনো, জিনা বলল, একটা কাজ করলে বেঁচে যেতে পারো। অন্তত শাস্তি কম করাতে পারো। আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে। বলে দাও, তোমার সঙ্গীরা কোথায় আছে, ছবিগুলো কোথায় আছে। পুলিশের কাছে তোমার পক্ষে সুপারিশ করব আমরা। আমার বিশ্বাস, সরকারী উকিলও তাই করবেন।

আর না বললে, কিশোর বলল, আবার কুত্তা লেলিয়ে দেব। রাফিকে যে পিটিয়েছেন সেই জেদ এখনও যায়নি…

এমনিতে যত বাহাদুরিই দেখাক, ডন খুব ভীতু! কুকুরের কামড় খাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইল না। তা ছাড়া ধরা যখন পড়েই গেছে, বললে যদি কিছু সুবিধে হয়, সেটা নেয়াই উচিত। আর দ্বিধা করল না সে। বলল, মারভিনের বৌ ইসাবেল। মোটর বোটে রয়েছে দুজনে। আমার জন্যে বসে আছে। জেটির শেষ মাথায় ছোট একটা খাড়িতে আছে বোটটা। আমি যখন বেরোচ্ছি, তখন ক্যানভাসে মোড়াচ্ছিল ছবিগুলো। ফুয়েল ট্যাংক একেবারে খালি। তাই আমাকে পাঠিয়েছে তেল নিয়ে যেতে।

গুড। খুশি হলো কিশোর। তারমানে আটকা পড়েছে ওরা!

মোটর বোট! অবাক লাগল মুসার। তারমানে বেশি দূরে যেতেন না আপনারা?

না। কাছেই একটা বড় বন্দর আছে। সেখানে যাবে ঠিক করেছিল মারভিন। ওখানকার অনেককে চেনে সে। বড় একটা বোটের মালিক আছে, যে তার বন্ধু। তার বোটে করে দূরে কোথাও চলে যেতাম…

ওই যে, আংকেল এসে গেছেন! আনন্দে চিৎকার করে উঠল রবিন।

পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে ছুটে আসছেন তিনি। কি, হচ্ছেটা কি? কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ও, তাহলে আমার কথা শোনোনি! গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলে! ডনের ওপর চোখ পড়তে জিজ্ঞেস করলেন, এই লোক কে?

ওর নাম ডন হারভে, আব্বা, জিনা জানাল। রাফি ধরেছে।

একটা মুহূর্ত দেরি করল না দুই পুলিশ অফিসার। লোকটাকে প্রশ্ন শুরু করল। করে গেল একনাগাড়ে। জবাব দিতে দিতে হাঁপিয়ে গেল ডন। ছেলেমেয়েদের যা বলেছিল, সেই একই কথা বলতে হলো আরেকবার। জানাল, কোথায় মোটরবোট নিয়ে অপেক্ষা করছে মারভিন আর তার স্ত্রী। এই উত্তেজনার মুহূর্তে ছেলেমেয়েদেরকে বকতে ভুলে গেলেন পারকার আংকেল। ওদের সঙ্গে আসার কথা বারণ করতেও মনে রইল না। কাজেই ওরাও চলল পুলিশের সাথে।

এই সময় পৌঁছে গেল বাড়তি ফোর্স। বড় কালো একটা গাড়ি এসে থামল। নামল ছয়জন পুলিশম্যান। তারাও চলল সঙ্গে।

নীরবে চলল দলটা। কিছুদূর এগোনোর পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল ডন। হাত তুলে দেখাল একদিকে। ওই যে, ওখানে। …ওই তো, বোটটা, সাদা।

ম্লান জ্যোৎস্না। তার ওপর বোটটা সাদা হওয়ায় ভালমতই দেখা যাচ্ছে ওটা। সাগরের পানির রঙ এখন কালচে।

ঠিক এই সময় চালু হয়ে গেল বোটের ইঞ্জিন। বেড়ে গেল গর্জন। খোলা সাগরের দিকে রওনা হয়ে গেল বোট। নিশ্চয় পুলিশকে দেখে ফেলেছে মারভিন আর ইসাবেল। পালাতে চাইছে। উন ধরা পড়েছে কিনা জানার কথা নয় ওদের। ওর জন্যে নিশ্চয় একটুও ভাবেনি, তাহলে এ ভাবে রওনা দিত না। আরও একটা ব্যাপার, জানে, ট্যাংকে তেল খুব কম। সাগরে গিয়ে যে কোন মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে ইঞ্জিন। সেই পরোয়াও করেনি। তবে তাদের এই আচরণে অবাক হয়নি কেউ ও রকম চোরের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কি আশা করা যায়?

কোস্টগার্ডকে সতর্ক করে দেয়া দরকার! বলল সার্জেন্ট।

কিন্তু তাতে সময় লাগবে, ইন্সপেক্টর বলল ওরা কিছু করার আগেই পালিয়ে যাবে চোরগুলো। কি একখান জোড়া, আহা! স্বামীও চোর, বৌটাও চোর! মিলেছে!

আরেকটা বুদ্ধি এসে গেল কিশোরের মাথায়। এ রকম জরুরী অবস্থায় একের পর এক আইডিয়া খেলে যায় তার মাথায়। ওই যে দেখুন, আরেকটা বোট! তেরপল নেই। ওটাতে উঠে যেতে পারব। ইঞ্জিনটা কোনমতে স্টার্ট নেয়াতে পারলেই পিছু নিতে পারব ব্যাটাদের!

কথাটা পছন্দ হলো ইন্সপেক্টরের। দেরি করল না। গিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল বোটে। তার পর পরই উঠল সার্জেন্ট আর পারকার আংকেল। গোয়েন্দারাও দাঁড়িয়ে রইল না, কিংবা কারও অনুমতির অপেক্ষায় রইল না। সোজা গিয়ে উঠে পড়ল।

তীরে দাঁড়ানো পুলিশম্যানদের ডেকে বলল সার্জেন্ট, তোমরা যাও! কোস্টগার্ড স্টেশনে গিয়ে জানাও ওদের। জলদি!

ইগনিশন কী নেই। চাবি ছাড়াই ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার কায়দা জানে সার্জেন্ট। হুইল ধরল ইন্সপেক্টর। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগছে মুখে। কান খাড়া করে ফেলল রাফি ঢেউয়ের ছিটে এসে লাগছে, যেখানটায় লাগছে লবণ লেগে গিয়ে মোনতা হয়ে যাচ্ছে। চড়চড় করে চামড়া! কেয়ারও করল না গোয়েন্দারা। তাকিয়ে রয়েছে সাদা বোটটার দিকে। একটাই ভাবনা, কিছুতেই চোরগুলোকে পালাতে দেয়া চলবে না।

কিন্তু দুটো বোটের মাঝের দূরত্ব বাড়ছেই। ধরা কি যাবে না? পালিয়ে যাবে মারভিন আর ইসাবেল?

ভাবনাটাই গায়ে জ্বালা ধরায়। ইসি, রাফিরে! মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে কিশোরের। এত কষ্ট খামোকাই করলাম রে!

ভাবছ কেন? মনে করিয়ে দিল রবিন, ভুলে গেছ, ওদের পেট্রোল কম?

তাই তো! বলে উঠল মুসা। এ কথাটা তো মনে ছিল না!

এই দেখো, দেখো! চিৎকার করে বলল জিনা।

দেখার জন্যে চোখ বড় বড় করে ফেলল গোয়েন্দারা! সত্যিই তো! সাদা জিনিসটা বড় হচ্ছে!

ধরা যাবে! ধরা যাবে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন, বলেছিলাম না, ধরা যাবে…

গেছে! কিশোর বলল, ব্যাটাদের পেট্রোল ফুরিয়ে গেছে! আর নড়তে পারবে না!

ঘটেছেও তা-ই। মোটর বোটের ট্যাংকে তেল শেষ। কিছুই করার নেই আর মারভিন এবং ইসাবেলের। চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থেকে পুলিশের হাতে ধরা দেয়া ছাড়া। আরেক কাজ করতে পারে। সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাতরে পালানোর। চেষ্টা করতে পারে। তবে এই ঠাণ্ডার মধ্যে সেটা হবে আত্মহত্যার সামিল। মরার চেয়ে জেলে গিয়ে বেচে থাকাও ভাল, কাজেই সেটা করতে গেল না ওরা।

গুলি না চালিয়ে বসে! ছেলেমেয়েদের জন্যে শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন পারকার আংকেল। ওদেরকে ছোট কেবিনটায় ঢুকে পড়তে বললেন তিনি। গোলাগুলি চললে ভেতরে কিছুটা অন্তত নিরাপদ।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও আদেশ পালন করল ওরা।

সাদা বোটের কাছাকাছি চলে এল পুলিশের বোট। মুখে হাত জড়ো করে চেঁচিয়ে বলল ইন্সপেক্টর, অ্যাই, সারেন্ডার করো! তোমাদেরকে গ্রেপ্তার করা হলো। কোন গোলমাল করবে না! হাত তুলে উঠে এসো!

গুলি হওয়ার আশঙ্কায় রইল ইন্সপেক্টর আর সার্জেন্ট। তৈরি হয়ে আছে দুজগেই। তবে তেমন কিছু ঘটল না। বোট দুটো গায়ে গায়ে লাগতেই নীরবে পুলিশের বোটে উঠে এল মারভিন। তারপর ইসাবেল। সঙ্গে সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে দিল সার্জেন্ট।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন পারকার আংকেল।

কেবিন থেকে সবই দেখল গোয়েন্দারা। হুড়াহুড়ি করে আবার ডেকে বেরিয়ে এল। হাসি ফুটেছে মুখে। ধরা পড়েছে চোরগুলো, আর পালাতে পারবে না।

ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করল মারভিনকে, ছবিগুলো কোথায়?

নিরীহ কণ্ঠে জবাব দিল মারভিন, ছবি! কিসের ছবি? যেন কিছুই জানে না। কি বলছেন বুঝতে পারছি না। আমরা তো সাগরে হাওয়া খেতে বেরিয়েছি। নিউ ইয়ারস…

ধানাই-পানাই রাখো! ধমক দিয়ে বলল ইন্সপেক্টর। ভেবেছ কিছু দেখিনি? পানিতে তখন ওটা কি ছুঁড়ে ফেললে?

ও, ওটা? একটা পোটলা। পুরানো কাপড়ের। বাতিল জিনিস। বোঝ না বাড়িয়ে ফেলে দিলাম।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নিল দুই পুলিশ অফিসার। তবে কি এত দামী জিনিসগুলো পানিতে ফেলে নষ্টই করে ফেলল মারভিন। তার পুরানো কাপড়ের। গল্প এক বর্ণ বিশ্বাস করেনি তারা। ফেলে দেয়ার আরেকটা খারাপ দিক হবে, ওদেরকে আর আটকাতে পারবে না। কারণ কোন অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না। বোট নিয়ে রাতের বেলা খোলা সাগরে হাওয়া খেতে বেরোনো কোন অপরাধ নয়।

যেন সেটা বুঝেই জোর দিয়ে বলল মারভিন, ইচ্ছে হলে বোটে খুঁজে দেখতে পারেন।

খুঁজে দেখা হলো। জানে পাবে না, তবু না পেয়ে হতাশই হলো দুই অফিসার। ছবিগুলো বোটে নেই।

রাগে, ক্ষোভে পারলে কেঁদে ফেলে কিশোর। এত কষ্ট করে এসে শেষে এ ভাবে বিফল হবে! কিছুতেই মেনে নিতে পারল না সে। বলল, আমরা একবার খুঁজে দেখি!

খুব বেশি আত্মবিশ্বাস, তাই না? ইন্সপেক্টর বলল ওদেরকে। তবে রাজি হলো, বেশ, দেখো।

মারভিনের বোটে উঠে গেল গোয়েন্দারা। আতিপাতি করে খুঁজেও কিছু পেল না। কোন চিহ্নই নেই ছবিগুলোর।

 ভাবছে কিশোর। এ হতে পারে না। কিছুতেই না! জীবন থাকতে এত দামী জিনিস হাতছাড়া করতে পারবে না মারভিনের মত চোর! তাহলে? নিশ্চয় বোটেই লুকিয়ে রেখেছে কোথাও কোথায়?

নিরাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে একটা সীটের ওপর বসে পড়ল মুসা। প্ল্যাস্টিকে মোড়া গদি। ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, এই মুসা, সরো তো!

কী?

সরো!

উঠে দাঁড়াল মুসা।

প্রায় হুমড়ি খেয়ে এসে সীটের ওপর পড়ল কিশোর। হাত বোলাল প্ল্যাস্টিকের কভারে। যে রকম মসৃণ আর সমান হওয়ার কথা তেমন নয়। কিছু যেন রয়েছে। ভেতরে।

ঝুঁকে নিচে দিয়ে তাকাল সে। অ, এই ব্যাপার! কভারটা চিরে ফেলা হয়েছে। তারপর সেলাই করে দিয়েছে। আঙুল ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টানে সেলাইয়ের জায়গাটা ছিঁড়ে খুলে ফেলল সে। হাত ঢুকিয়ে দিল ভেতরে।

হ্যাঁ, আছে! বেশ কায়দা করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ছবিগুলো! সহজে বোঝার উপায় নেই যে ওখানে রেখেছে।

ছবিগুলো নিয়ে হাসিমুখে কেবিন থেকে বেরোল কিশোর। পেছনে তার দলবল।

হাঁ হয়ে গেল দুই পুলিশ অফিসার। ছেলেমেয়েগুলোর তারিফ করল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে। হাত মেলাল ওদের সঙ্গে। দুর্ব্যবহার করে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করল।

হুঁ, সবশেষে বলল, বুঝেছি। জিনিস ঠিকই ফেলেছে পানিতে। সাধারণ ক্যানভাস গুটিয়ে নিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে ফেলে বোঝাতে চেয়েছে ছবিগুলোই ফেলেছে, ধোঁকা দেয়ার জন্যে। পড়েও গিয়েছিলাম ধোকাতে। কিশোরের কাঁধে হাত রাখল সে। আমাদের ইয়াং শার্লক হোমস না থাকলে পার পেয়ে গেছিল চোরগুলো আরেকটু হলেই।

.

খুব ধুমধাম করে নিউ ইয়ারস ডে পালন করা হলো সেবার গোবেল বীচ গাঁয়ে। আবার দাওয়াত এল পলিদের বাড়ি থেকে। পার্টির আয়োজন পলিই করেছে। ক্রিসমাস ডে-র পার্টিতে যারা যারা উপস্থিত ছিল, তাদের সবাইকে দাওয়াত করেছে। সে। আসল উদ্দেশ্য, গোয়েন্দাদের মুখ থেকে চোর ধরার রোমাঞ্চকর গল্প শোনা। খবরটা সকাল বেলায়ই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে গোবেল বীচ আর আশপাশের গাঁয়ে।

দুপুর বারোটায় রেডিওর স্থানীয় খবরেও প্রচার করা হলো সংবাদটা। জানানো হলো, হোরেস ট্রিমেইনির দল ধরা পড়েছে, ছবিগুলোও উদ্ধার করা হয়েছে। কিশোরদের নাম বলা হলো। এমনকি রাফিও বাদ পড়ল না।

বাহ, চমৎকার! হেসে বলল পলির বাবা ডক্টর মরিস। পেপারেও বেরোবে সংবাদটা। ছবি সহ। কেমন লাগছে তোমাদের?

ভালই, জবাব দিল জিনা। তবে তারচেয়ে ভাল লাগছে চোরগুলোকে ধরতে পেরে, আর ছবিগুলো উদ্ধার করতে পেরে।

আর দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চারও করতে পারলাম, মুসা বলল। সেটাও মস্ত বড় পাওয়া।

ঠিক, একমত হলো কিশোর। মাঝে মাঝে এ রকম অ্যাডভেঞ্চার ভালই লাগে। ছুটি শেষ হতে হতে আরেকটা যদি পেয়ে যেতাম!

যেতেও পারি, হেসে বলল রবিন। ঠিক আছে নাকি কিছু! আমরা তো যেখানেই যাই, রহস্য নিজে নিজে এসে হাজির হয়!

কোইনসিডেন্স, পলি বলল। কাকতালীয় ঘটনা।

মাথা নেড়ে কিশোর বলল, আমি সেটা মনে করি না। আর রহস্য নিজে নিজে এসে হাজির হয়, এ কথাটাও ঠিক না। ঘটনা তার স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে। কারও চোখে ধরা পড়ে, কারও পড়ে না। গোয়েন্দার চোখে পড়ে যায়। আর এই জন্যেই। মনে হয়, গোয়েন্দারা যখন যেখানে থাকে, ঘটনাগুলো ঘটে।

ইনটেলিজেন্ট বয়! কিশোরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ডক্টর মরিস। আমিও তোমার সঙ্গে একমত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *