কবরের প্রহরী

ভলিউম ৫০ – কবরের প্রহরী – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৭

০১.

খাওয়ার পর আবার এসে মুসার শোবার ঘরে ঢুকল সবাই। মুসা, ফারিহা, কিশোর, রবিন আর টিটু।

ঢুকেই বলল কিশোর, রবিন, শুরু করো এবার তোমার ভূতের গল্প।

গ্রীনহিলস। বড়দিনের ছুটি কিন্তু বাইরে বেরোনোর উপায় নেই ওদের। প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে। তবে এ জন্যে বেরোতে পারছে না ওরা তা নয়। আসল কারণ, খুব ঠাণ্ডা লেগেছে মুসা ও ফারিহার। অসুস্থ বিছানায় পড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে ওরা।

কি আর করে? রবিন আর কিশোরেরও বাইরে ঘোরাঘুরি বন্ধ। মুসা এবং ফারিহাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে মুসাদের বাড়িতে এসে বসে থাকে ওরাও। গল্প করে কাটায়।

এদিনও গল্পই চলছে। ভূতের গল্প। প্রথম গল্পটা বলেছে মূসা এবার রবিনের পালা।

মুসা বালিশে আধশোয়া হলো তার বিছানায়। বাড়তি আরেকটা বিছানায় টিটুকে জড়িয়ে ধরে শুলো ফারিহা। মুসার বিছানায় দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল কিশোর আর রবিন যেহেতু গল্প বলবে, সবাই যাতে তার মুখ দেখতে পায় সেজন্যে একটা চেয়ারে সবার মুখোমুখি বসল সে।

পায়ের ছাপগুলো ছিল সত্যি বিশাল, বুঝলে, শুরু করল রবিন, অনেক বড়!

এই সময় ঝাড়া দিয়ে ফারিহার হাত ছাড়িয়ে একলাতে উঠে দাঁড়াল টিটু। আরেক লাফে বিছানা থেকে নেমে জানালার দিকে ছুটে গেল।

ব্যাপার কি? অবাক হয়ে তাকাল সবাই।

কারণটা জানা গেল একটু পরেই। জানালায় উঁকি দিল লাল টকটকে নোল একটা মুখ কুকুরটাকে দেখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে মুখ কুঁচকাল, আহ, ঝামেলা। অ্যাই, ওটাকে থামতে বলো!

অ্যাই টিটু, থাম, আয় এদিকে, ডাক দিল কিশোর। মিস্টার ফগ? আপনি এখানে?

ফগর‍্যাম্পারকট। শুধরে দিল পুলিশম্যান।

সরি, মিস্টার ফগর‍্যাম্পারকট, আগের প্রশ্নটাই করল কিশোর, আপনি এখানে?

এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। বাগানে সবগুলো সাইকেল একসঙ্গে দেখে বুঝলাম, আছো সবাই এখানেই। অনেকদিন দেখি না, তাই ভাবলাম…

দেখাটা করেই যাই, তাই না? হাসল কিশোর। আসলে কিজন্যে এসেছেন বলি? আমরা কোন রহস্য পেয়েছি কিনা খোঁজ নিতে।

লাল মুখ আরও লাল হয়ে গেল ফগের। ঝামেলা! না না, তা নয়…ইয়ে, ঝামেলা, সত্যি কোন রহস্য পেয়েছ নাকি?

মুচকি হাসল কিশোর। পেয়েছি।

গোলআলুর মত চোখগুলো আরও গোল আর বড় হয়ে গেল ফগের। জানালার। দিকে আরেকটু এগিয়ে এল মুখটা। পেয়েছ?

পেয়েছি।

গলা খাকারি দিল ফগ। এদিক ওদিক তাকাল। যেন দেখতে চাইল আড়াল থেকে কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে কিনা। তারপর স্বর নিচু করে জিজ্ঞেস করল, রহস্যটা কি?

ভূত!

ঝামেলা! রসিকতা কোরো না তো! ফগ ভাবল, সে যে ভূত হয়ে গিয়েছিল সেই কথাটাই খোঁচা মেরে মনে করিয়ে দিতে চাইছে কিশোর।

না, সত্যি বলছি, রহস্যটা ভূতেরই।

সত্যি? ঠাট্টা করছ না তো?

না, ঠাট্টা করব কেন?

 তা রহস্যটা কি?

আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসতে চাইছি, পৃথিবীতে ভূত বলে সত্যি কিছু আছে কিনা?

ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘামতে আরম্ভ করল ফগ। রুমাল বের করে মুখ মুছল। কৌতূহল ঝিলিক দিয়ে উঠল চোখে। কিভাবে সিদ্ধান্তে আসবে?

মুসা একটা ভূতুড়ে গল্প বলেছে, ওর আর ফারিহার বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প। এখন বলতে যাচ্ছে রবিন। শুরু করেছিল। আপনি আসাতে থেমে গেছে। তা আপনার কি কোন কাজ আছে আমাদের কাছে? কিশোরের ভঙ্গিটা এমন, থাকলে বলুন, নাহলে বিদেয় হোন।

উসখুস করতে লাগল ফগ। আবার এদিক ওদিক তাকাল। তারপর হে-হে করে একটা বোকার হাসি দিয়ে বলেই ফেলল, ঝামেলা! যদি কিছু মনে না করো তোমাদের আলোচনায় কি আমি অংশ নিতে পারি?

এ রকম একটা প্রস্তাব দিয়ে বসবে স্বয়ং ফগ, কল্পনাও করতে পারেনি গোয়েন্দারা। এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল ওরা। টিটু কি বুঝল কে জানে, ফপের দিকে তাকিয়ে খোক খোক শুরু করল সে।

ধমক দিয়ে ওকে থামাল কিশোর। আবার তাকাল ফগের দিকে। আপনি আমাদের আলোচনায় অংশ নেবেন?

কেন, অসুবিধে কি? হাতে কোন কাজ নেই আমার। আর কি যে তুষারপাত শুরু হলো, বিচ্ছিরি! সময় একদম কাটে না। বাইরে বেরোনোও মুশকিল। একটা রহস্য পেলেও হতো, সমাধানের চেষ্টা করতে পারতাম। শোনো, যদি চাও, ভূতের গল্প আমিও শোনাতে পারি তোমাদের। কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা আমারও আছে।

উৎসাহী হয়ে উঠল কিশোর। ফগের বাস্তব অভিজ্ঞতা! নিশ্চয় মজাদার কোন হাসির ব্যাপার হবে। সহকারীদের অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেল সে। বেশ, আসুন। রবিন, দরজাটা খুলে দাও, প্লীজ!

জানালা থেকে ফগের মুখ অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওকে ঢুকতে দিচ্ছ? ভাল লাগছে না রবিনের। ভূতের গল্প শোনা না ছাই। ও আসলে আমরা কোন রহস্য পেয়েছি কিনা জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে।

উঠুক। এখন কোন রহস্য নেই আমাদের হাতে, তদন্ত চলছে না, ও কোন বাগড়া দিতে পারবে না। তা ছাড়া ওকে সরাসরি মানা করে দেয়াটা অভদ্রতা হতো।

দরজা খুলে দিল রবিন।

ফগ ঘরে পা রাখতে না রাখতেই ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে পড়ল টিটু। পায়ের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে গোড়ালিতে কামড়ে দিতে চাইল। চিৎকার করে উঠল ফগ, ঝামেলা! আহ, ঝামেলা! অ্যাই কুত্তা, সর, সর! কুকুরটার পেটে কষে এক লাথি হাঁকানোর ইচ্ছেটা দমন করল, লাথি মারলে যদি আর থাকতে না দেয় ছেলেমেয়েগুলো, এই ভয়ে।

টিটুকে প্রচণ্ড ধমক লাগাল কিশোর। কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনল। এক চড় লাগাব ধরে! কখন কোন শয়তানিটা করতে হবে তাও বোঝে না। সব সময় এক। জলদি গিয়ে ফারিহার কাছে চুপ করে বোস!

আর কোন গণ্ডগোল করল না দিই। লেজ টিয়ে চুপচাপ গিয়ে ফারিহার বিছানায় উঠল।

একটা চেয়ার টেনে বসল ফগ। মুখের ঘাম মুছল।

দরজা লাগিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এল রবিন।

ঝামেলা! রবিনের দিকে তাকাল ফগ। নাও, এবার শুরু করতে পারো। আগে একটা প্রশ্নের জবাব দাও। যে গল্পটা বলবে, সেটা কি বানানো, না সত্যি?

বলাই তো হলো বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প। বানানো হবে কেন?

 ঠিক আছে। আর কোন প্রশ্ন নেই আমার।

গল্প শুরু করল রবিন।

.

০২.

অনেক বড় পায়ের ছাপ। কোন বিশাল জানোয়ারের। চেপে বসেছে। কারণ মাটি নরম। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল।

হান্টার রিজে যাচ্ছিলাম। ছাপগুলো চোখে পড়তে থমকে দাঁড়ালাম। চোখ বোলালাম চারপাশে।

পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কোথাও কোন শব্দ নেই। নিচে হারলে ক্রীকের নীল জল। মাথার ওপরে হান্টার রিজের ঘন গাছপালায় ছাওয়া বন!!

আবার তাকালাম মাটির দিকে। কিসের পায়ের ছাপ ওগুলো? কোন জন্তুর? একপাশের ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে বেরিয়েছে বোঝা যায়। পায়ের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে ঘাস। ঝোঁপের ডাল ভাঙা। ওপরের বন থেকে নেমেছিল ওটা। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আবার ফিরে গেছে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।

আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে নিচে আমাদের বাড়িটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। ধূসর পাথরে তৈরি পুরানো একটা বড় বাড়ি। বহুকাল আগে ইনডিয়ানদের বানানো।

আবার তাকালাম ছাপগুলোর দিকে। আমি জানি বনের মধ্যে হরিণ আছে। কিন্তু হরিণের পায়ের ছাপ নয় ওগুলো অন্য কিছু কুকুর জাতীয় কোন প্রাণীর। এখানে নেকড়ে আছে নাকি? না কায়োট?

ভালমত দেখতে গিয়ে আরেকটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল, কুকুরটার পায়ের ছাপের পাশে কোথাও কোথাও একধরনের ঘষার দাগ। খুবই অস্পষ্ট।

পেছনে শব্দ হলো। চমকে উঠলাম ফিরে তাকিয়ে দেখি বনমোরগের একটা পরিবার হেলেদুলে নেমে আসছে খোলা জায়গাটার দিকে আমাকে দেখে থমকে গেল। প্রায় মিনিটখানেক অপেক্ষা করল আমি কিছু করছি না দেখে পাশ কেটে চলে যেতে শুরু করল নিচে ক্রীকের দিকে, বোধহয় পানি খেতে

এত কাছে থেকে বনমোরগ আর কখনও দেখিনি বেশ বড় আকারের লাল আর ধূসরে মেশানো পালক। লাল লাল চোখ দেখে মনে হয় রেগে আছে। পায়ের। দিকে তাকালাম। একেবারেই খুদে। যে ছাপ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, ওগুলো বনমোরগের হতেই পারে না।

ঠক করে মাটিতে এসে পড়ল কি যেন আমার সামনে মাত্র দুই হাত দূরে। তাকিয়ে দেখি ছোট একটা পাথর। ঢালে ঠোকর খেতে খেতে লাফিয়ে নেমে গেল কিছুদূর।

চমকে গেল পাখিগুলো। কক কক করে ওড়াল দিল।

পেছনের বন থেকে হুড়মুড় করে দৌড়ে বেরিয়ে এল একটা মেয়ে। উত্তেজিত জিজ্ঞেস করল, লেগেছে?

ভাবলাম, আমার গায়ে লেগেছে কিনা জিজ্ঞেস করছে বুঝি। মাথা নেড়ে বললাম, না লাগেনি অল্পের জন্যে বেঁচেছি।

তোমার কথা কে বলছে, গাধা কোথাকার। পাখিগুলোর দিকে নজর মেয়েটার। কোনটা গিয়ে ঝাঁপ দিল ঝোঁপের মধ্যে, কোনটা বসল গাছের ডালে। বেশি ভীতুগুলো আরও দূরে উড়ে গেল গাছপালার মাথার ওপর দিয়ে। আমার দিকে ফিরল আবার মেয়েটা। হতাশ কণ্ঠে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, একটার গায়েও লাগেনি?

লাগলে তো তড়পাত দেখতেই পেতে।

এগিয়ে এসে আমার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা। পরনে শর্টস, গায়ে টি শার্ট, মাথায় লাল-সাদা একটা লস অ্যাঞ্জেলেস ডজারস বেজবল ক্যাপ, চোখে লাল কাঁচের সানগ্লাস আবার জিজ্ঞেস করল, সত্যি লাগেনি কোনটার গায়ে?

লাগলে মরে পড়ে থাকত।

অনেক সময় জখম হলেও উড়ে যায় বনমোরগ অন্যখানে গিয়ে মরে।

তাহলে খোজোগে ঝোঁপের মধ্যে, হাত তুলে দেখিয়ে দিলাম। পাথর ছুঁড়তে হলে একটু সাবধানে ছুঁড়ো। আশেপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে। আমার মাথাটাই ফাটিয়ে দিয়েছিলে আরেকটু হলে।

লাল কাঁচের ভেতর দিয়ে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল মেয়েটা। বড়দের মত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, বোকার মত ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কারও গায়ে লাগতে পারে।

রাগ লাগল মেয়েটার পাকামো দেখে। বললাম, আমি বোকাও নই, যে কারোও নই, আমার একটা নাম আছে-রবিন মিলফোর্ড।

হেসে ফেলল মেয়েটা, তুমি রেগে যাচ্ছ।

রাগিয়ে দেয়ার মত করেই তো কথা বলছ।

হাত তুলল ও, আচ্ছা ঠিক আছে, আর বলব না, সরি। তোমরা নতুন এসেছ এখানে, না?

 হ্যাঁ। বেড়াতে।

ঢালের নিচের ওই বড় বাড়িটাতে উঠেছ?

 হ্যাঁ, হাত বাড়িয়ে দিলাম। ওটা আমাদেরই। আমার মায়ের।

সেও তার হাত বাড়াল। আমি নিনা হাওয়ার্ডস কিন্তু সবাই ডাকে গগলস। সারাক্ষণ সানগ্লাস পরে থাকি তো, তাই।

হাত মেলালাম আমরা। ওর কনুইয়ের দিকে চোখ পড়ল। গোটা দুই গভীর আঁচড়ের দাগ। ঘষা লেগে কেটেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ফুটবল খেল নাকি? গোলকীপার?

হাসল ও। বলল, আমাকে নিনা ডাকলেই খুশি হব। গগলস শুনতে ভাল্লাগে না। ফুটবল খেলি না, শুধু বেজবল। এই দাগগুলো দেখে বলছ তো? এগুলো খেলার সময় পড়ে গিয়ে নয়, পাথরে ঘষা লেগে কেটেছে। ওপরের শৈলশিরাটা দেখিয়ে বলল, বেশির ভাগ সময় ওখানে কাটাই আমি। রাতে যখন অন্ধকারে আর কিছু দেখা যায় না তখন নামি  একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে নিয়ে দাতে কাটতে লাগল সে।

রাতেও ঘোরাঘুরি করো এই বনের মধ্যে?

করি, তাতে কি? অন্ধকারকে ভয় পাও নাকি তুমি?

প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ছাপগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নিনা, এগুলো কিসের ছাপ, বলো তো?

মাটির দিকে তাকায়নি এতক্ষণ ও। ছাপগুলো দেখে মুহূর্তে বদলে গেল চেহারা। দাঁত থেকে খসে পড়ল ঘাসের ডগা। সাদা হয়ে গেল মুখ। সানগ্লাস খুলে নিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল আরও ভাল করে দেখার জন্যে। যখন সোজা হলো আবার, চোখ বড় বড় করে ফেলেছে। বাদামী মণি দুটোতে আতঙ্ক।

এখানে কেন এসেছিল ওটা? ফিসফিস করে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল নিনা।

ঢোক গিলোম। জিজ্ঞেস করলাম, কিসে কি করছিল?

প্রহরী, বলল সে, কবরের প্রহরী! ছাপগুলোর কাছ থেকে এমন ভঙ্গিতে সরে গেল মনে হলো ভয় পাচ্ছে।

কবরের প্রহরী?

আবার ছাপগুলোর দিকে তাকাল ও। এত নিচে আর নামেনি কখনও, গলা কাঁপছে ওর। মুঠো করে ফেলেছে হাত।

নিনা?

 জবাব না পেয়ে ওর কাধ ধরে কঁকালাম, নিনা, কে ওই কবরের প্রহরী?

আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল ও। একটা কুকুর, রহস্যময় কণ্ঠে বলল। বিশাল। কালো। এত বড় কুকুর কোথাও দেখতে পাবে না আর। তবে ওটা কুকুর নয়।

দ্বিধায় পড়ে গেলাম। বলছে কুকুর, আবার বলে কুকুর নয়, সেটা আবার কি? বললাম, কি যা তা বলছ! হয় কুকুর, নয়তো অন্য কিছু; একসঙ্গে দুটো প্রাণী হতে পারে না।

পারে, নিচুস্বরে জবাব দিল নিনা। ভূত-প্রেতেরা পারে। বিশাল কালো কুকুরের রূপ ধরে থাকে ওটা। দানব!

ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাঁপছে। বিশ্বাস করতে পারলাম না, যত্তসব ফালতু কথা!

তোমার কাছে ফালতু মনে হতে পারে, কিন্তু এ এলাকার সবাই জানে ওটার কথা। পাহাড়ের ওপরে ওই চুড়ার কাছে ইনডিয়ানদের একটা গোরস্থান আছে। বহুকাল আগে নিচের উপত্যকায় বাস করত সেনিকা ইনডিয়ানরা। কবর দিত ওপরে। ওখানে যাদের কবর দেয়া হয়েছে, তাদের পাহারা দেয় ওই ভূতুড়ে কুকুরটা।

তাকিয়ে রইলাম নিনার দিকে। ভূত! প্রেত। দানব! কবরখানা পাহারা দেয় ভূতুড়ে কুকুর। এ সব কি বলছে?

 আবার তাকালাম ছাপগুলোর দিকে। কুকুরের পায়ের এতবড় ছাপ আর দেখিনি আমি। দানবই ওটা।

সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নামল পাহাড়ে। গাছের মাথায় কাপন তুলে বয়ে গেল একঝলক বাতাস। মর্মর শব্দে মাটিতে গড়াল শুকনো ঝরা পাতা।

আমারও ভয় লাগতে আরম্ভ করেছে। ওকে বললাম, ভূতেরা মাটিতে পায়ের ছাপ ফেলে না।

সে কথা আমিও শুনেছি। কিন্তু এই ভূতটা ফেলে। কুকুরের মত গলা ছেড়ে ডাকে। পাহাড়ের ওপর ঘুরে বেড়ায়। এমনকি খুনও করে। আমার দিকে তাকাল ও। রবিন, কখনও পাহাড়ের ওপরে যেয়ো না।

কোনখানে?

শৈলশিরাটা দেখাল নিনা। ওদিকে। বিরাট এক ওক গাছ আছে, তার কাছে মৃত্যুপুরী। গেলে মেরে ফেলবে তোমাকে। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো আমার কথা।

বিরাট ওক। মৃত্যুপুরী। রূপকথার মায়াপুরীর রাক্ষস-খোক্কসের কেচ্ছা শোনাচ্ছে যেন আমাকে নিনা। তাকালাম ওর দিকে। ওর চোখের আতঙ্ক আমাকেও যেন গ্রাস করতে আরম্ভ করল। অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে লাগল শরীরে। হাতের তালু ঠাণ্ডা হয়ে এল, মুখের ভেতরটা গেল শুকিয়ে। জোরাল হলো বাতাস। নড়িয়ে দিল ডালপালা। ঝরে পড়তে লাগল আরও অনেক শুকনো পাতা।

তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শোনা গেল আচমকা। কুকুরের ডাকের মত।

ভীষণ চমকে গিয়ে লাফ দিয়ে আমার কাছে চলে এল নিনা। আমিও লাফিয়ে উঠতাম, কিন্তু পা দুটো মনে হলো বরফের মত জমে গেছে।

কিসের ডাক? জিজ্ঞেস করলাম।

 ওটাই তো! ফিসফিস করে বলল নিনা। প্রহরী! সূর্য অস্ত গেলেই ডাকে।

কোনখান থেকে? আমিও ওর মত ফিসফিস শুরু করেছি।

ওই যে বললাম, পাহাড়ের ওপরে, চুড়ার কাছে। ওই যে আবার ডাকছে, ভয়ে ভয়ে বলল নিনা। ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও। আমি বাড়ি যাচ্ছি।

দাঁড়াও, দাঁড়াও! এক মিনিট, অস্বস্তি লাগছে আমার, ওই ডাক শুনেছ নাকি আরও?

মাথা ঝাঁকাল নিনা।

 দেখেছ ওটাকে?

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে আবার মাথা ঝাঁকাল সে।

 কোথায়?

পাহাড়ের ওপর।

অস্বস্তিটা বাড়ল আমার। তুমি বলছ সব সময় পাহাড়ের ওপর থাকে ওটা। কাল রাতে তাহলে এখানে নেমেছিল কেন? পায়ের ছাপই বলছে, নেমেছিল!

চোখ আরও বড় বড় হয়ে গেল ওর, মুখ সাদা। শুকনো গলায় জবাব দিল, জানি না! এতদিন তো পাহাড়ের ওপরেই থেকেছে ওটা।

কিন্তু কাল রাতে এখানে নেমেছিল। এ জন্যেই ভয় পাচ্ছ তুমি, তাই না?

আমার চোখের দিকে তাকাল নিনা, এর আগে আর কোনদিন নিচে নামেনি ওটা। ছাপগুলোর দিকে তাকাল ও, নিচের উপত্যকার দিকে, তারপর আবার আমার দিকে। কাল রাতে এখানে নেমে তোমাদের বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল ওটা। কার দিকে, কেন তাকিয়েছে, জানি না। আমি শুধু জানি, এর আগে আর কোনদিন নিচে নামেনি প্রহরী।

আরও জোরে চিৎকার করে উঠল ওটা। চমকে উঠলাম দুজনে।

ওই জানালাটার দিকে তাকিয়েছিল ওটা, হাত তুলে দেখাল নিনা, একমাত্র জানালা যেটা পাহাড়ের এই ঢাল থেকে দেখা যায়। জানালাটা কার ঘরের?

গরম নেই। তাও ঘামতে শুরু করলাম। জবাব দিলাম, আমার!

.

০৩.

দৌড় দিতে গেল নিনা। হাত চেপে ধরলাম ওর।

যেতে দাও, ও বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এক মিনিট, আমি বললাম। কিন্তু শুনল না ও। ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার দৌড় দিতে যাবে এই সময় মাটিতে পড়ে থাকা চকচকে একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার। নিচু হয়ে তুলে নিয়ে বললাম, তোমার সানগ্লাস।

দাও।

হাতটা পেছনে সরিয়ে নিলাম, আগে বলো, ভূতটাকে তুমি দেখার পর কি ঘটল?

দ্বিধা করতে লাগল ও। আগে আমার চশমা দাও।

দিয়ে দিলাম ওটা। চোখে পরে নিল সে। ছাপগুলোর দিকে আরেকবার তাকিয়ে আমার দিকে মুখ তুলল। রাতের বেলাও পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে আমার, বলেছি না?

মাথা ঝাঁকালাম।

হপ্তা দুই আগে ওরকমই এক রাতে বেরিয়েছিলাম। এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের ওপরের ঢাল বেয়ে ওপরের মাথা গেছে কবরখানার দিকে, নিচটা উপত্যকায় ওই পথের দিকেই যাচ্ছি, বেড়ানো শেষ হয়েছে আমার, বাড়ি ফিরছি আসলে তখন হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ওটাকে ওপরে, পথের একেবারে শেষ মাথায়, কয়েকটা গাছের কাছে।

দেখতে কেমন?

কতবার বলব? কুকুরের মতন। অনেক বড় কুকুর। রীতিমত একটা দৈত্য

 কি করলে তখন?

আমার দিকে তাকিয়ে রইল নিনা। কি আবার করব? পাগল নাকি তুমি? ভূতের বিরুদ্ধে কিছু করা যায়? কিছুই করিনি। পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। পা নড়াতে পারছিলাম না তারপর ওটা গায়েব হয়ে গেল।

গায়েব হয়ে গেল মানে?

গায়েব হয়ে গেল মানে-গায়েব একেবারে হাওয়া।

 সন্দেহ হলে আমার, জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি দেখেছিলে তো?

বুকের ওপর হাত দুটা আড়াআড়ি রেখে দাঁড়াল নিনা। তোমার অবগতির জন্যে একটা কথা জানাই মিস্টার রবিন মিলফোর্ড, যেখানে যে জিনিস থাকে না সেটা আমি দেখি না চিৎকারটার ব্যাপারে কি বলবে? এই ইকটু আগে যে দুজনে। শুনলাম? নাকি সেটাও শুনিনি?

তা শুনেছি অস্বীকার করতে পারলাম না কান পাতলাম। থেমে গেছে চিৎকার।

নিনা, তোমাকে মিথ্যুক বলছি না আসলে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না আমি।

এখানে এতদিন আসোনি বলে করোনি।

 হয়তো তবে এখানকার ইনডিয়ানদের কথা আমি অনেক কিছুই জানি। আমার মায়ের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন মোহক ইনডিয়ান। শার্টের গলার কাছের বোতাম খুলে কলারটা ট্র্যাক করে ধরলাম, এই দেখো!

কি ওটা?

দেখতে পাচ্ছ না একটা মালা? ওয়ামপাম গুটির। তাও আবার কালো গুটি। অনেক বড় মোহক যোদ্ধারাই কেবল এই মালা পরত। মালাটা কয়েক পুরুষ ধরে হাত বদল হতে হতে মার হাতে পড়েছিল। আমার গত জন্মদিনে আমাকে উপহার দিয়েছে মা।

ছুঁয়ে দেখতে পারি?

 মালাটা ধরতে দিলাম নিনাকে।

বহুকাল আগে এই উপত্যকায় বাস করত মোহকরা, নিনা বলল। হয়তো তোমার মায়ের পূর্বপুরুষ সেই ইনডিয়ান যোদ্ধাও এই এলাকায়ই ছিলেন।

ছিলেনই তো, আমি বললাম। ওই বাড়িটা তো তার কাছ থেকেই পাওয়া। মালাটার মতই হাত বদল হতে হতে ওটাও মার দখলে এসেছে।

তারমানে তোমার পূর্বপুরুষ সেই ইনডিয়ান যোদ্ধাকেও মৃত্যুপুরীতেই কবর দেয়া হয়েছে?

হতে পারে। ওই মৃত্যুপুরীটা কি, বলো তো?

অনেক বড় একটা গুহা। পাহাড়ের ভেতরে সুড়ঙ্গের মত ঢুকে গেছে। মৃত্যুর সময় হলে ইনডিয়ান যোদ্ধারা গিয়ে ঢুকত ওর মধ্যে। কেবল বীরেরাই ঢুকত, সাধারণ ইনডিয়ানদের জন্যে বারণ! কড়াকড়ি ভাবে এই নিয়ম মেনে চলত ওরা। একবার ঢুকলে কেউ আর জীবিত বেরোতে পারে না ওখান থেকে। সেজন্যেই নাম হয়েছে মৃত্যুপুরী।

তুমি ঢুকেছ কখনও?

 রাগ করে মালাটা ছেড়ে দিল নিনা। বললাম না কেউ জীবিত বেরোতে পারে না ওখান থেকে। কেউ না!

তাই?

তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি? দেখো, রবিন, বোকামি করে কিছু করে বোলো না। ওই চুড়ার কাছে যেয়ো না। গোরস্থানটা থেকে দুরে থাকবে। কোনমতেই মৃত্যুপুরীর ধারেকাছে যাবে না। যদি যাও, কোনদিন আর ফিরবে না, বলে দিলাম। কবরের প্রহরী ছাড়বে না তোমাকে।

গুডবাই জানিয়ে বাড়ি রওনা হলাম দুজনে।

বাড়ি ফিরতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগল না আমার। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। ভয়ও পাচ্ছি। চারদিকে নানা রকম শব্দ, আলো থাকতে যেগুলো ছিল না। বার বার মুখ ফিরিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালাম, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না।

রাতে ডিনার খেতে বসে মা আর বাবাকে বললাম গোরস্থানটার কথা। ভূতের কথাটা চেপে গেলাম। বললে যদি হাসাহাসি করে? ওই এলাকার অনেক ইতিহাসই জানে মা বলল ইনডিয়ানদের ছয় ছয়টা উপজাতি বাস করেছে ওখানে। গোরস্থানটার কথাও জানে। কথিত আছে-ওটাকে কেউ অবহেলা করলে, ওটার ওপর দিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেঁটে গেলে তার ওপর নাকি অভিশাপ নেমে আসে।

খাওয়ার পর পরই শুতে চলে গেল মা আর বাবা। সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত। কিন্তু আমার ঘুম এল না। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম কালো কুকুরটার কথা। ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই, অনেকের কাছেই শুনি। তাহলে নিনা কি দেখল? হতে পারে বড় নেকড়ে অথবা কায়োট। বুনো কুকুরও হতে পরে। মালিককে হারিয়ে বুনো হয়ে গেছে কোন পোষা কুকুর।

কিন্তু হঠাৎ করে ওটা নিচে নামল কেন? আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়েই বা থাকবে কেন?

মনে হচ্ছিল ঘুম আর আসবে না। তবে ঘুমিয়েছি। কতক্ষণ পরে জানি না, জেগে গেলাম। আপনাআপনি খুলে গেল চোখের পাতা। কেন জাগলাম? কিসের। শব্দে? মনে হলো বাইরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে।

চুপচাপ বিছানায় পড়ে থেকে কান পেতে রইলাম। প্রথমে রাতের স্বাভাবিক সব শব্দ কানে আসতে থাকল, এই যেমন আমার মাথার কাছে রাখা ঘড়িটা। টিকটিক টিকটিক করেই চলেছে। বাইরে গাছের ডালে বাতাসের কানাকানি। হারলে ক্রীক থেকে ভেসে আসছে রাতচরা হাঁসের ডাক। শুকনো পাতা গড়াচ্ছে। মাটিতে। তারপর আরেক ধরনের শব্দ করে উঠল পাতা। পা পড়লে যেমন হয়। শুকনো পাতা মাড়িয়ে হাঁটছে কেউ।

পুরো সজাগ হয়ে গেছি তখন। বাইরে কেউ আছে তাতে আর কোন সন্দেহ রইল না। মোলায়েম পা ফেলে আস্তে আস্তে হাঁটছে সে, কিন্তু শুকনো পাতা তার অস্তিত্ব জাহির করে দিচ্ছে। আমার জানালার কাছে এগিয়ে আসছে পদশব্দ। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এত ভারী আর জোরাল, কুকুর কখনও ওরকম নিঃশ্বাস ফেলে না। অনেকটা পরিশ্রমে হাঁপিয়ে পড়া মানুষের মত। কি ওটা?

ধীরে ধীরে কমে এল নিঃশ্বাসের শব্দ। আবার পাতায় পা পড়ার মর্মর ধ্বনি। আমার জানালার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল ওটা।

তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে নামলাম নিচতলায়। লিভিং রূম পার হয়ে ছুটলাম। মা আর বাবা যাতে শুনতে না পায় সেজন্যে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম সামনের ছড়ানো রেলিঙ দেয়া বারান্দায়।

এ সময় কানে এল চিৎকারটা।

ভয়াবহ আর্তচিৎকার। তাতে যন্ত্রণা তো আছেই, সেই সঙ্গে মিশে আছে আরও কিছু-আতঙ্ক।

তারপর আবার সব চুপচাপ। এতটাই নীরব হয়ে গেল, সন্দেহ হলো, সত্যি চিৎকারটা শুনেছি তো? নাকি সব আমার ভীত, ক্লান্ত মনের কল্পনা? ওপরে বাবা মার ঘরের দিকে তাকালাম, জানালায় আলো জ্বলে কিনা।

আগের মতই অন্ধকার। ওরা কিছু শোনেনি।

আমি কি একাই কি শুনলাম? সন্দেহটা বাড়ল-কল্পনাই করেছি।

চারদিক বড় বেশি নীরব। এতটা কেন? খেয়াল করলাম, হাঁসগুলো ডাকাডাকি বন্ধ করে দিয়েছে। সেটাও অস্বাভাবিক। এ ভাবে চুপ করে যাওয়ার একটাই কারণ, চিৎকারটা কানে গেছে ওদের। তারমানে ভুল শুনিনি আমি। কল্পনা নয়।

কিন্তু এল কোনখান থেকে?

সিঁড়ির দিকে এগোলাম। বারান্দার একধারে রয়েছে বাড়িটার সেলার। আগের। দিন মা আমাকে মাটির নিচের ওই ঘরটা দেখিয়ে বলেছে যে কদিন থাকব ওটাকে আমাদের সবজি রাখার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অদ্ভুত জায়গায় তৈরি করা হয়েছে সেলারটা। পাহাড়ের গোড়ায়। কতগুলো সাদা পাথরের পর ঢালটা উঠে গেছে চুড়ার সেই শৈলশিরার কাছে, যেটাতে রয়েছে ইনডিয়ানদের কবর।

অনুমান করলাম, চিৎকারটা এসেছে ওই মাটির নিচের ঘর থেকে।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেলারের দিকে এগোলাম। ঢালের দিকে চোখ! কেউ আছে। কিনা দেখছি। বড় বড় ঘাস জন্মে আছে। ঘাসের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে নজর চলে গেল চুড়ার দিকে। তারপর আরও ওপরে, আকাশের দিকে। আধখানা চাঁদ আর অসংখ্য বড় বড় তারা প্রচুর আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে উপত্যকায়। দেখার জন্যে যথেষ্ট। ঢালের ওপর কিছু দেখলাম না। দুই পাশে তাকালাম। নেই। যেটা এসেছিল, চলে গেছে। মনে হলো, তখনকার মত আমি নিরাপদ।

সেলারের কাছে পৌঁছলাম। অনেক বড় একটা গর্তকে যাতে পানি না পড়ে সেভাবে ঢেকেঢুকে নিয়ে জিনিসপত্র রাখার ঘর বানানো হয়েছে। মুখের কাছে ঝুঁকে বসে ভেতরে উঁকি দিলাম। ভেতরে গাঢ় অন্ধকার। টর্চ আনার দরকার ছিল। আরও ঝুঁকে, দুই হাতের তালুতে ভর দিয়ে মাথাটা ঝুলিয়ে দিলাম ভেতরে। তাও কিছু চোখে পড়ল না। সকালে আলোতে ছাড়া দেখতে পারব না চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে পিছিয়ে এলাম।

খুট করে পেছনে একটা শব্দ হলো। পাথরের মূর্তি হয়ে গেলাম যেন।

খেয়াল করলাম, ঝলমলে চাঁদের আলো নেই আর এখন! ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্না। ঢালের ঘাস, আশপাশের জমি, পাথর, গাছপালা সব অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার পেছনে কালো একটা ছায়া বড় হয়ে উঠছে আমার ছায়াও পড়েছে মাটিতে। চাঁদ পেছনে থাকায় ছায়াটা লম্বা হয়ে গেছে অনেক। পেছন থেকে আরও বড় একটা ছায়া ঢেকে দিচ্ছে আমারটাকে। আমি যে ভঙ্গিতে আছি, সেরকমই চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো।

ঠিক আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওটা।

.

০৪.

ফিরে তাকানোর সাহস তো হলোই না, চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঘাড়ে এসে পড়তে লাগল যেন ভারী নিঃশ্বাস। এত বেশি হাঁটু কাঁপতে লাগল মনে হলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব মাটিতে। ঠাণ্ডা রাতু। তার মধ্যেও ঘামতে শুরু করলাম। নিজের অজান্তে হাত উঠে গেল কালো গুটির মালাটার দিকে। চেপে ধরলাম। অপেক্ষা করছি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার। গালে গরম নিঃশ্বাস, তারপর ঘাড়ে দাঁত ফোঁটানোর তীক্ষ্ণ ব্যথা বা ওরকম কিছুর।

ওটাও যেন অপেক্ষা করে আছে, আমার পেছনে। আমার আঙুল, আমার হাত, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন কাঁপতে শুরু করল থরথর করে! চিৎকার করতে চাইলাম। স্বর বেরোল না ভয়েই অকেজো হয়ে গেছে যেন স্বরযন্ত্র সামান্যতম। শব্দও করতে পারলাম না। এমনকি দম নিতেও যেন কষ্ট।

প্রচণ্ড গর্জনের পর একটা ভারী শরীর আমার ওপর লাফিয়ে পড়ার অপেক্ষা করছি। কিছুই ঘটল না। চোখ মেলছি না। ভাবছি, যে কোন মুহূর্তে এখন অনুভব করব ব্যথাটা, যে কোন সময়।

জানি না কতক্ষণ ওভাবে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কুকুরের মত হয়েছিলাম। কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি তাও বলতে পারব না। অবশেষে মনে হলো একটা কিছু করা দরকার আমার চোখ বন্ধ রেখেই খুব ধীরে ধীরে এক দুই তিন করে শুনতে আরম্ভ করলাম। দশ গোণা শেষ হলেই ফিরে তাকাব। ঘুরতে আমি চাই না। ভয়ঙ্কর ওই চেহারাটা দেখার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। চুপ করে আছি বলে হয়তো কিছু করছে না। নড়াচড়া দেখলেই এসে ঘাড় কামড়ে ধরবে সেই ভয়ও আছে। কিন্তু তবু দেখতে হবে। আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না।

দশ গুনে, চোখ মেলেই ঝটকা দিয়ে ঘাড় ঘোরালাম!

ডানে বায়ে দুদিকেই তাকালাম। চাঁদের আলো খেলে যাচ্ছে ঘাসের ওপর। সেলারের ওপরের পাথরগুলো আগের মতই সাদা, কোথাও কোন ছায়া নেই, আমার পেছনেও নেই।

কিন্তু ছায়া তো ছিল একটা! নাকি চোখের ভুল আমার? বুঝতে পারলাম না।

শৈলশিরার কাছে বনটার দিকে তাকালাম। কোন নড়াচড়া নেই। সব স্বাভাবিক। আকাশে চাঁদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে এক টুকরো মেঘ। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়েছিল বলেই কি ছায়া নেমেছিল উপত্যকায়? তাই হবে। কিন্তু অন্য ছায়াটা? যেটা আমার ছায়াকে ঢেকে দিয়েছিল? নিঃশ্বাসের শব্দ? এ সবের কি ব্যাখ্যা? হতে পারে কুকুরটা এসে দাঁড়িয়েছিল আমার পেছনে। তাই যদি হবে, তাহলে ভূতুড়ে কুকুর নয় ওটা। যতদূর জানি, ভূতের ছায়া পড়ে না। নিনার কথামত অবশ্য ওই কুকুরটা ভূত হলেও অদ্ভুত। পায়ের ছাপ বসে যায় মাটিতে। ছায়া পড়তেই বা দোষ কি? খুট করে শব্দ যে হয়েছিল একটা আমার পেছনে, সেটাও স্পষ্ট শুনেছি। মন কিংবা কানের ভুল নয়। সময়মত ফিরে তাকাইনি বলে নিজেকে গাধা বলে গাল দিতে লাগলাম। তাকালে একটা বড় রহস্যের সমাধান হয়তো তখনই হয়ে যেত। তাকালে হয়তো ঘাড় মটকে মেরে ফেলত, এই বলে সান্তনাও দিলাম মনকে।

অন্ধকার সেলারটার দিকে তাকালাম আবার। ঠিক করলাম, কাল সকালেই জেনে নেব কি ঢুকেছিল ওখানে। দিনের আলো ফুটলে সেলারে নামব। কিসে চিৎকার করল জানতেই হবে।

ঘরে ফিরে এলাম। বিছানায় শুয়েও ঘুম এল না কখন ভোর হবে, কখন সূর্য উঠবে, কখন নামব সেলারে, দেখতে পাব কিসে করেছে চিৎকার, এই চিন্তায় সময় আর কাটছে না।

তবে ঘুমিয়ে পড়লাম এক সময়। আবার যখন চোখ মেলোম দেখি রোদ উঠেছে। সব কিছুই আলোয় উজ্জ্বল। হাসিখুশি দিন। রাতে যে অমন একটা কাণ্ড ঘটে গেছে বিশ্বাসই হতে চায় না।

বিছানা থেকে নেমেই রওনা হলাম সেলারের দিকে। আগে দেখতে হবে কিসে চিৎকার করেছিল। জানতে হবে স্বপ্ন দেখেছি, না সত্যি।

না, স্বপ্ন নয়। সেলারের কাছাকাছি গিয়ে মাটির দিকে তাকিয়েই থমকে গেলাম। আবার সেই পদচিহ্ন। বড় বড় পায়ের ছাপ। সন্দেহ হলো। বাড়ির চারপাশে খুঁজে দেখলাম, সবখানেই আছে। বাগান, আঙিনা সব ঘুরে তারপর এগিয়েছে সেলারের দিকে। পাহাড়ের ঢালে যেমন দেখেছিলাম, অদ্ভুত সেই ঘষার দাগ এখানেও আছে কোথাও কোথাও, কুকুরটার পায়ের ছাপের পাশে। আরও নানা রকম ছাপ দেখতে পেলাম। ছোট ছোট জানোয়ারের বেশির ভাগই চিনি না।

সেলারের প্রবেশ মুখের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতরে উঁকি দিলাম। বাইরে এত আলো থাকলেও ভেতরটা তখনও অন্ধকার।

হঠাৎ মনে হলো আরও বেশি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। চমকে উঠলাম। আবার! হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করল। ফিরে তাকালাম। চেয়ে দেখি সূর্যের মুখ ঢেকে দিচ্ছে এক টুকরো মেঘ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ধমক দিলাম-রবিন, অকারণ ভয়ে মনকে আচ্ছন্ন কোরো না। তাতে সত্য আবিষ্কারে ব্যাঘাত ঘটবে।

মেঘ সরে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। সরে গিয়ে আবার রোদ উঠল। ফিরে তাকালাম সেলারের দিকে। ভেতরে গলা বাড়িয়ে দিলাম। চোখে অন্ধকার সয়ে আসার অপেক্ষা করছি।

দেখতে পেলাম ওটাকে। একটা ব্যাকুন। গলায় মস্ত একটা ক্ষত। একগাদা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে। চিৎকার করার জন্যে হাঁ করেছিল যে, সেই ভঙ্গিতেই রয়েছে মুখটা। চোখ দুটো ভোলা। নিষ্প্রাণ। কিন্তু আতঙ্কের ছাপ মুছে যায়নি তা থেকে।

সেলারের মুখের কাছে হুমড়ি খেয়ে আছি। ড্রামের মত বাজতে আরম্ভ করেছে। হৃৎপিণ্ডটা। তাকিয়ে আছি র‍্যাকুনের কালো, ছোট ছোট চোখ দুটোর দিকে।

সবাই জানে ব্যাকুন খুব লড়াকু প্রাণী। বেকায়দায় পড়লে ভালুকেও ছাড়ে না, যুঝতে থাকে। কিন্তু এই হতভাগ্য ব্যাকুনটা বাধা দেয়ার কোন সুযোগই পায়নি। শেয়ালে মারেনি ওটাকে, তাহলে ধস্তাধস্তি হতো, পড়ে থাকার ভঙ্গিটা হতো অন্য রকম। কায়োটেও নয়। তার চেয়েও বড় প্রচণ্ড শক্তিশালী কোন জানোয়ারের কাজ। নেকড়ে বা ভালুকের পক্ষে এ ভাবে খুন করা সম্ভব। কিন্তু। সেটা মেনে নিতে পারলাম না। ওসব জানোয়ার হলে সেলারের কাছে পায়ের ছাপ থাকত

তাহলে কিসে? কুকুরটা? সেলারে নেমে দেখলে জানা যাবে, যদি পায়ের ছাপ থাকে। তবে সেলারের মাটি এত শক্ত, পায়ের ছাপ পড়বে বলে মনে হয় না।

 মিউ!

এতটাই চমকে উঠলাম, লাফিয়ে সোজা হতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল ওপরের বেরিয়ে থাকা একটা পাথরে মাথাটা ডলতে ডলতে ফিরে তাকিয়ে দেখি রোমার। আমাদের পড়শী মিসেস মারলোর ছোট কালো বেড়ালটা।

র‍্যাকুনের গন্ধ পেয়ে সেলারে ঢোকার চেষ্টা করা। ধরে ফেললাম।

এই যে, এখানে এসে বসে আছে, পেছন থেকে বলে উঠল একটা মহিলা কণ্ঠ। মিসেস মারলো। একটা বেড়াল আর একটা কুকুর পোষেন। কুকুরটার নাম ববি। রোমারকে আমার হাতে ছটফট করতে দেখে বললেন, যেই একটু ছাড়া। পেয়েছে অমনি চলে এসেছে। সারাটা রাত অস্থির হয়ে ছিল। খালি ডাকাডাকি করেছে।

কেন ডেকেছে বলতে পারি, মিসেস মারলো, বললাম আমি। কারণটা ওই যে ওখানে, হাত তুলে সেলারের দিকে দেখালাম। মিউ মিউ করে ছুটে গিয়ে সেলারে ঢুকতে চাইল আবার রোমার। ছাড়লাম না।

সেলারের ভেতরে উঁকি দিয়েই যেন বিদ্যুতের শক খেয়ে পিছিয়ে গেলেন মিসেস মারলো। মুখ সাদা।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন জানোয়ারে এ কাজ করেছে জানেন আপনি?

না, রবিন, জানি না, ঢোক গিলে কোনমতে জবাব দিলেন তিনি, শেয়াল টেয়ালে হবে। ভঙ্গি দেখে মনে হলো হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে শেয়ালের চেয়ে বড় কোন জানোয়ারের কাজ, বললাম তাকে। ভালুক কিংবা নেকড়ে।

আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি। মুখ তুলে তাকালেন হান্টার রিজের দিকে। ওসব জানোয়ার লোকালয়ে আসতে চায় না, গলা কাঁপছে তাঁর।

আপনি ঠিক জানেন?।

জানব না কেন? হারলে ক্রীকেই তো জন্মেছি।

কিছুতেই আমার চোখের দিকে তাকালেন না মিসেস মারলো। রোমারকে আমার হাত থেকে নিতে নিতে বললেন, আয়, রোমার, বাড়ি যাই। আর এ ভাবে যখন তখন ঘর থেকে বেরোবি না, বুঝলি? যাওয়ার জন্যে এত তাড়াহুড়া শুরু করলেন তিনি, ঘুরতে গিয়ে জ্যাকেট আটকে গেল একটা ঝোঁপের বেরিয়ে থাকা ভাঙা ডালের মাথায়। টান দিয়ে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় ছুটে চললেন।

মিসেস মারলো, পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললাম, কবরের প্রহরীর কাজ নয়তো?

যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। ফিরে তাকালেন, রবিন, তোমার ভালর জন্যেই বলছি, হান্টার রিজের ওপরে পাহাড়ের মাথায় যেয়ো না কখনও। তোমার মা আর বাবাকে বোলো, তারাও যেন না যান। বলবে, আমি বলেছি।

কেন যাব না, মিসেস মারলো? জিজ্ঞেস করলাম।

এত কথা জানার দরকার নেই। যা বলছি, করবে।

.

০৫.

কি করব বুঝতে পারলাম না। সবাই খালি পাহাড়ের মাথায় যেতে মানা করে। নাস্তার পর খানিকক্ষণ হারলে ক্রীক থেকে ঘুরে এলাম। বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করলাম।

দুপুরবেলা বাড়িতে খেতে এলাম। মাকে তখনও বলিনি মরা র‍্যাকুনটার কথা। বললেই সরিয়ে ফেলবে। ওটাকে ওই অবস্থায় নিনাকে দেখানোর ইচ্ছে আমার। আমি জানতাম, ও আমাদের বাড়িতে আসবেই।

ঠিকই এল। দুপুরের পর। এত দেরি করল কেন, জানতে চাইলাম? বলল, স্কুলে গিয়েছিল।

 রাতের ঘটনার কথা জানালাম ওকে। র‍্যাকুনটার কথা বললাম। দেখতে চাইল সে। নিয়ে গেলাম সেলারে।

নিচে নামলাম দুজনে। শক্ত মার্টিতে পায়ের ছাপ পড়েনি। অতএব কুকুরটাই খুন করেছে কিনা, নিশ্চিত হওয়া গেল না।

গম্ভীর হয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে মরা র‍্যাকুনটাকে দেখল নিনা।

পরামর্শ চাইলাম, কি করা যায় এটাকে, বলো তো?

ও বলল, এক কাজ করি, কবর দিয়ে দিই।

প্রস্তাবটা পছন্দ হলো আমার। আমাদের বাড়ির পেছনে একটা কবর খুঁড়লাম দুজনে মিলে। তারপর মরা র‍্যাকুনটাকে তুলে এনে কবর দিলাম। রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে গায়ে। অনেকক্ষণ আগে মরেছে, শক্ত হয়ে গেছে লাশ। কেমন। ঘিনঘিন করতে লাগল। ভালমত মাটি চাপা দিয়ে হাত ধুয়ে এলাম। ফিরে এসে দেখি, ডাল দিয়ে একটা ক্রুশ বানিয়ে কবরে পুঁতে দিয়েছে নিনা।

জিজ্ঞেস করলাম, এটা কেন? ব্যাকুনটা কি খ্রীষ্টান ছিল নাকি?

না সেজন্যে নয়, দিলাম অন্য কারণে। অনেক সময় ভূতে মারা প্রাণীও ভূত হয়ে যায়। কবর থেকে উঠে এটাও যাতে ভূত হতে না পারে সেজন্যে ক্রুশ গেঁথে দিলাম। এই বাধা ডিঙিয়ে যত চেষ্টাই করুক, আর ওঠার সাধ্য হবে না।

কোন মন্তব্য করলাম না। বিকেল প্রায় শেষ। আলো কমে আসছে। শৈলশিরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রহরী কি ওপরেই থাকে সব সময়? কখনও নিচে নামে না?।

এতদিন তো, তাই জানতাম।

তাহলে কিসে মারল র‍্যাকুনটাকে?

বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়তে নাড়তে জবাব দিল নিনা, সত্যিই আমি কিছু বুঝতে পারছি না, রবিন! সব সময় মৃত্যুপুরীর কাছাকাছি থাকে ওটা। দূরে যায় না। লোকালয়ে মানুষের ঘরের কাছে যেতে কেউ কখনও দেখেনি ওটাকে। আমাদের বাড়িটার দিকে ফিরে তাকাল সে। সেলারের দিকে তাকাল। আমার প্রশ্ন, এখন কেন নামল? আর তোমাদের বাড়িতেই বা কেন? সানগ্লাস খুলে নিয়ে ওটার একটা উঁটি কামড়াতে লাগল। গভীরভাবে চিন্তা করছে বোঝা যায়।

জানার একটাই উপায়, নিনা।

 কি?

 পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখতে হবে।

আরেকটু হলে হাত থেকে চশমাটা ফেলে দিয়েছিল নিনা। মাথা খারাপ! কবরের প্রহরী মৃত্যুপুরীতে যাবে!

না গেলে জানব কি করে?

জানার দরকারটা কি?

এত কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারছি না। তা ছাড়া এর একটা বিহিত করা দরকার। এতদিন লোকালয়ে আসত না। এখন আসতে আরম্ভ করেছে। কাল। ব্যাকুন মেরেছে, আজ কিংবা দুদিন পর যে মানুষ মারবে না তার নিশ্চয়তা কি?

মারলে কি করার আছে?

 ঠেকাতে হবে ওটাকে।

 পারলে তুমি ঠেকাওগে। আমি এর মধ্যে নেই।

ঘটনাটা কি, নিনা? এত ভীতু তো মনে হয় না তোমাকে?

আমি জানি খোঁচাটা লাগবে ওর। মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমি ভীতু, না?

নইলে কি?

আমি ভীতু?

যেতে যখন চাও না, ভীতুই তো। তবে তুমি যাই বলো আর না বলো, আমি ওপরে যাবই। ওই মৃত্যুপুরী না দেখে আমার শান্তি নেই।

নিনার চোখ দুটো দ্বিগুণ হয়ে গেল। কারও ঢোকার সাধ্য নেই ওখানে। সব সময় পাহারা দেয় কুকুরটা। যদি ঢোকো, কোনদিন আর বেরোতে পারবে না।

আমি যাব, গোঁয়ারের মত বললাম। মরার সময় হলেই কেবল ওখানে ঢুকত ইনডিয়ানরা, সেজন্যে আর বেরোত না। সুস্থ অবস্থায় কেউ নিশ্চয় ঢুকে দেখেনি বেরোতে পারে কিনা?

কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও বলল না নিনা।

আমি আজই যাব, জেদ চেপে গেছে আমার তখন, অন্ধকার হওয়ার আগেই। তুমি যাবে।

না বলার জন্যে মাথা নাড়তে গিয়েও থেমে গেল সে। সানগ্লাসটা তাড়াতাড়ি পরে ফেলে বলল, যাব।

তোমার সাহস আছে। হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে।

সাহস না, যা করছি আমরা, এটা স্রেফ পাগলামি! কপালে খারাপি আছে আজ আমাদের!

সে দেখা যাবে।

শৈলশিরায় উঠে এলাম আমরা। আগে আগে পথ দেখিয়ে চলল নিনা। এখানকার প্রতিটি রাস্তা, গলিঘুপচি ওর চেনা। পায়ে চলা সরু পথগুলো ঢেকে আছে ঝরা পাতায়। দুপাশে কোথাও গাছপালা, ঝোঁপঝাড়, কোথাও একেবারে খালি। শুধু বড় বড় ঘাস। নিনা সঙ্গে এসেছে বলে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। ও না এলে পথ খুঁজে বের করাই মুশকিল হয়ে যেত।

তবে ভয় যে পাচ্ছে ও, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। সে একা নয়, আমিও পাচ্ছি। বিকেল শেষ হয়ে এলেও পাহাড়ের ওপরে তখনও রোদ আছে, বেশ আলো। কিন্তু দিগন্তে যে মেঘ জমেছে সেটা লক্ষ করিনি। যখন করলাম, দেরি হয়ে গেছে তখন। ছড়িয়ে পড়ে ঢেকে দিল সূর্যকে। ধূসর করে দিল আকাশের রঙ। বার বার আকাশের দিকে তাকাতে লাগলাম। বোধহয় সেজন্যেই রাস্তার দিকে ভাল করে নজর দিতে পারিনি। একটা মোড় নিয়ে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল নিনা। এখান থেকে সোজা পাহাড়ের মাথায় উঠে গেছে রাস্তাটা। মুহূর্তে অনুমান করে নিলাম এই পথের। মাথায়ই কুকুরটাকে দেখেছিল ও।

যেতে চাও, এখনও বলো? জিজ্ঞেস করল নিনা!

দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এত তাড়াতাড়ি যে মেঘে ঢেকে অন্ধকার হয়ে যাবে ভাবিনি।

কি বলো, ফিরে যাব? আবার প্রশ্ন করল নিনা।

না, মনে সাহস এনে বললাম, এতদূর এসে ফিরে যাব না। এতক্ষণেও তো কিছু ঘটল না।

বোকার মত কথা বলে ফেলেছি সেটা আমিও বুঝলাম, নিনাও বুঝল, কিন্তু কিছু বলল না। মৃতের গুহার কাছেই যাইনি তখনও, ঘটবে কি? তবু কথাটা বললাম নিজের মনে সাহস রাখার জন্যে।

পথ বেয়ে উঠতে থাকলাম আমরা। শেষ মাথায় পৌঁছে থামলাম। আরেকটা পথ পাওয়া গেল। সেটা ধরে আরও ওপরে উঠতে লাগলাম। কিছুদূর ওঠার পর বড় বড় কতগুলো পাথরের পাশ কেটে কখনও মোচড় দিয়ে কখনও বা মোড় নিয়ে এগিয়েছে পথটা। পাহাড়ের মাথার কাছে পৌঁছে গেছি আমরা ফিরে তাকিয়ে দেখি অনেক নিচে হারলে ক্রীকের নীল জল। বাকি সব কিছু গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়েছে।

আরও ওপরে উঠতে থাকলাম। পথ ক্রমে সরু হয়ে আসছে। বড় বড় কতগুলো গাছের ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষ হলো এই পথটাও। সামনে বেশ বড় একটা আয়তাকার জায়গায় ঘাস জন্মে আছে। তিনপাশ ঘিরে আছে ঘন ঝোঁপঝাড়, গাছপালা; আর বাকি একপাশে পাহাড়ের দেয়াল, খাড়া হয়ে উঠে গেছে ওই পথটা ছাড়া আর কোনদিক দিয়ে জায়গাটাতে ঢোকার উপায় নেই। ঠিক মাঝখানে জন্মে আছে বিশাল এক ওক। গাছটা এতই বড়, পুরো জায়গাটাতে তার ছায়া পড়ে।

নিনা বলল, আয়তাকার জায়গাটাই ইনডিয়ানদের কবরস্থান গাছের পেছনে একটা গুহামুখ দেখা গেল। সেটা মৃত্যুপুরীতে ঢোকার পথ। পাহাড়টা দেখেই অনুমান করা যায়, সুড়ঙ্গটা অনেক গম্ভীর হবে।

০৬.

কবরস্থানে ঢোকার জন্যে পা বাড়াল নিনা। বাধা দিলাম আমি।

বাকা হেসে বলল সে, এবার বোঝো, ভীতুটা কে?

ভয় আমি পাইনি, বললাম বটে, কিন্তু আমি জানি কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, মা বলেছে, এই কবরস্থানে ঢোকার সময় কোনমতেই যেন অশ্রদ্ধা করা না হয়।

বেশ, তুমিই তাহলে আগে যাও। কি করে শ্রদ্ধা করতে হয় আমি জানি না, সরে জায়গা করে দিল আমাকে নিনা।

সরাসরি না ঢুকে গাছপালার কিনার ধরে ঘুরে রওনা হলাম আমরা। গুহামুখের কাছাকাছি গিয়ে ফিরে তাকালাম বিশাল ওকগাছটার দিকে। গোড়া থেকে কিছুটা ওপরে একটা ফোকর। হাত তুলে দেখালাম নিনাকে।

এই এলাকার সবচেয়ে বড় গাছগুলোর একটা ওটা, নিনা বলল। ভেতরটা ফোপরা। ইচ্ছে করলে ঢুকে বসে থাকতে পারো। আমি শুনেছি, পুরো একটা ফুটবল টীম ঢুকে থাকতে পারে ওর মধ্যে।

তাহলেই বোঝো, মানুষ কি রকম বানিয়ে কথা বলে, বললাম। ঢুকতে পারবে বড়জোর দুতিনজন, লোকে বলে এগারোজন। দেখবে, মৃত্যুপুরীর ব্যাপারটাও ওরকম। অনেক বাড়িয়ে বলা হয়েছে।

পাথরের দেয়ালে অনেক বড় একটা কালো গহবরের মত হয়ে আছে। গুহামুখটা। ভেতরে উঁকি দিলাম।

বেশি অন্ধকার, নিনা বলল। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চলো, বাড়ি চলে যাই।

টর্চ নিয়ে এসেছি, অসুবিধে নেই, বললাম ওকে। কিন্তু তাতেও খুশি হতে পারল না ও।

গুহার ভেতরে কয়েক কদম এগিয়েই থেমে গেলাম। পেছনে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে। অথচ গোধূলিও শেষ হয়নি তখনও। মেঘের কারণে অবেলায় সন্ধ্যা। যাই হোক, এই অন্ধকারের মানে আমাদের জানা। কুকুরটার বেরোনোর সময় হয়েছে। দেখার সময় বেশি পাব না।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে আলো ফেললাম। ভেতরের বাতাস ঠাণ্ডা, ভেজা ভেজা। পাথরের গায়ে শ্যাওলা জন্মে আছে।

কিছু দেখতে পাচ্ছ? এমন করে কানের কাছে কথাটা বলল নিনা চমকে গেলাম।

না, ফিসফিস করেই জবাব দিলাম। চলো, এগোই

মাটি তেমন শক্ত না হলেও পাথরের ছড়াছড়ি। যতই ভেতরে এগোলাম, মাথার ওপর উঁচু হতে থাকল ছাত। গুহা না বলে ওটাকে মস্ত এক সুড়ঙ্গ বলাই উচিত। কারণ লম্বা হয়ে আছে। কিছুটা এগোনোর পরই বাক নিল দেয়াল। পেছনে আড়ালে চলে গেল গুহামুখ। অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের পৃথিবী। আকাশ চোখে পড়ে না আর। আলো বলতে এখন শুধু টর্চের ওপর ভরসা। আপনাআপনি আঙুলগুলো শক্ত হয়ে চেপে বসল তাতে। আলো না থাকলে এখানে কি যে ঘটবে কল্পনা করারও সাহস হলো না।

কিন্তু টর্চের আলো সাহস জোগাতে পারল না বেশিক্ষণ। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল আমার। মনে হলো কেউ যেন আড়ালে থেকে আমাদের ওপর নজর রাখছে।

চারপাশে তাকালাম। সবখানে আলো ফেলে দেখলাম। একপাশে বড় বড় পাথরের চাঙড়। ভাবলাম, ওগুলোর ওপাশে লুকিয়ে নেই তো? কিন্তু বেরোল না কোন জানোয়ার বা আর কিছু। নজর রাখা হচ্ছে-এই অনুভূতিটাও গেল না আমার। বরং মনে হলো যা-ই হোক, সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে ওটা।

আচমকা আমার হাত খামচে ধরল নিনা।

কি? জিজ্ঞেস করলাম।

শুনছ না? ফিসফিস করে বলল ও।

কান পাতলাম। প্রথমে কিছু শুনলাম না তারপর মনে হলো, হ্যাঁ, শুনছি। বললাম, মৃদু গুঞ্জনের মত না?

মাথা ঝাঁকাল নিনা।

 আরেকটু এগোলাম।

গুঞ্জনটা হয়েই চলেছে। বাড়ছে আস্তে আস্তে। যতই এগোলাম, আরও স্পষ্ট হয়ে এল।

দাঁড়িয়ে গেলাম। নিনাও দাঁড়াল আমার সঙ্গে।

এখন আর গুঞ্জন নয়। মনে হলো একটা কণ্ঠ, সুর করে রঅবিন! রঅবিন বলে নাম ধরে ডাকছে আমাকে।

পরস্পরের দিকে তাকালাম আমরা।

তোমাকে চেনে ওটা, নিনা বলল। ওর বাদামী চোখ দুটোতে ভয়, বড় বড় হয়ে গেছে। ও জানে তুমি এখানে এসেছ!

রঅবিন, এসো! রবিন, এসো! বলছে একটা জড়ানো কন্ঠ, কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। তবে মানুষের গলা যে নয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

চলো; পালাই! নিনা বলল। আরও জোরে আঁকড়ে ধরেছে আমার হাত। ওটা তোমাকে চেনে। তোমার কাছে কিছু চায়। ভয় লাগছে আমার রবিন, চলো চলে যাই!

গুহামুখের কাছে টেনে নিয়ে চলল আমাকে ও। অনেক পেছনে ফেলে এসেছি ওটা।

ভয় আমিও পেয়েছি। বার বার আমার নাম ধরে ডেকেই চলল কণ্ঠটা, রঅবিন, এসো!

চোখ বুজে ফেললাম। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত বুঝতে পারলাম না কি করব? কল্পনায় ভেসে উঠল মিসেস মারলোর সকাল বেলাকার ভীত মুখ। কানে বাজতে লাগল নিনার কথা–মৃত্যুপুরী থেকে কেউ কোনদিন জীবিত বেরোতে পারেনি। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল গলার কাছে, কালো গুটির মালাটা চেপে ধরলাম। আমার জায়গায় যদি কোন মোহক বীর হতো, কি করত এই পরিস্থিতে পড়লে? মন থেকে পেয়ে গেলাম জবাবটা।

আমি ফিরে যাব না, নিনাকে বললাম। দেখতেই হবে সামনে কি আছে। কেন আমার নাম ধরে ডাকে, কি চায়, জানতে হবে।

কি আর চাইবে? তোমাকে খুন করতে চায়, নিনা বলল। দুজনকেই খুন করবে। সময় থাকতে চলো পালাই।

যেতে ইচ্ছে করলে তুমি চলে যাও আমি এগোব। কবরের প্রহরী

তাহলে আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

আবার এগিয়ে চললাম আমরা। সুড়ঙ্গের গভীর থেকে গভীরে। মাথার ওপরে ভেজা চুনাপাথরের ছাত! মৃত্যুর সময় হলে যারা এখানে চলে আসত সেই সব ইনডিয়ান যোদ্ধাদের কথা ভাবলাম,। জোর আনলাম মনে-ওরা আসত সময়মত; আর আমাদের সময়ই হয়নি এখনও, আমার এবং নিনার। সুতরাং বেরোতে পারব না কেন?

হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল গুহার দেয়ালে। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকালাম। নিনা চিৎকার করেছে। আবার চেঁচিয়ে উঠল সে। আবার। হাত তুলল। থরথর করে কাঁপছে। আমার পেছনে দেখাল।

তাকালাম সেদিকে। মাটিতে রেখেছিলাম টর্চের আলো, ওপর দিকে তুলতে লাগলাম। দুটো প্রবেশ পথ দেখতে পেলাম, সুড়ঙ্গমুখ–একটা আমাদের ডানে, আরেকটা বায়ে। দুটো পথের মাঝখানে দেয়ালের গা থেকে বেরোনো চ্যাপ্টা পাথরে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ কুৎসিত হাসি হাসছে যেন একটা মানুষের খুলি।

.

০৭.

চিৎকার করেই চলেছে নিনা। তাতে আরও ঘাবড়ে গেলাম আমি। হাত গেল কেঁপে। টর্চটা মাটিতে পড়ে নিভে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে চিৎকার বাড়ল ওর। হাতড়ে হাতড়ে ওটা তুলে নিয়ে ঝাঁকি দিতে জ্বলে উঠল আবার।

চেঁচানো বন্ধ হলো ওর। প্রলাপ বকার মত বলতে লাগল, তখনই বলেছিলাম আসা উচিত না, উচিত না, তাও এলে!

ও তো একটা খুলি, যেন কিছুই না এ রকম একটা ভঙ্গি করে আমিও যে ভয় পেয়েছি সেটা চাপা দিয়ে রাখতে চাইলাম।

কি বলছ!

তো আর কি? বহুদিন আগে মারা গিয়েছিল লোকটা।

কি করে বুঝলে?

তুমিই তো বলেছ মৃত্যুর সময় হলে এখানে এসে ঢুকত ইনডিয়ান যোদ্ধারা। সে তো অনেক কাল আগের কথাই।

খুলিটার ওপর আবার আলো ফেললাম আমি। স্কুলের বায়োলজি ক্লাসে কঙ্কাল দেখেছি, খুলিও। জানি ওগুলো দেখতে কেমন হয়। কিন্তু গুহার মধ্যের খুলিটাকে অন্য রকম লাগল। চোখের জায়গার গর্ত দুটো যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। দাঁত বের করে হাসছে বিকট হাসি।

খুলিটার নিচে দুই পাশের দুটো সুড়ঙ্গমুখে আলো ফেলে, দেখতে লাগলাম।

রবিন, নিনা বলল, আমার ধারণা খুলিটা ওখানে রাখা হয়েছে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে। আমাদের সাবধান করার জন্যে। যাতে ভেতরে না ঢুকি।

এতদূর এসে ফিরে যাব, সাধারণ একটা খুলির ভয়ে? আমি বললাম।

মৃত্যুপুরীতে একটা খুলিও ভয় পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট, নিনা বলল। তা ছাড়া। কোন পথটা দিয়ে ঢুকতে হবে আমরা, কি করে বুঝব?

সুড়ঙ্গমুখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আছি। দেয়ালের গায়ে কালো দুটো ফোকর। আবার তাকালাম খুলিটার দিকে। চ্যাপ্টা যে পাথরটাতে বসানো তার নিচে আরেকটা গোল পাথর আছে দেখতে অনেকটা চাকার মত। এ রকম আকৃতির। পাথর আর কখনও দেখিনি।

ডানের ফোকরটা দিয়ে বললাম, চলো, ওটাতে ঢুকি।

কেন?

দুজনে দুটোতে ঢুকতে চাও নাকি? আমি ডানেরটায়, তুমি বায়েরটায়?

মাথা খারাপ! একা আমি কিছুতেই যাব না। আর আমার কাছে টর্চও নেই।

আমিও জানি সেটা। অন্ধকারে সুড়ঙ্গে ঢোকা অসম্ভব।

ডানেরটাতেই ঢুকলাম দুজনে। মুখটা এত ছোট, হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হলো। তবে কয়েক হাত এগোনোর পর আস্তে আস্তে চওড়া হয়ে গেল। ছাতও উঠে গেল উঁচুতে। সোজা হয়ে হাঁটা যায়। সুড়ঙ্গে অনেক মোড় আর বাক। ঘোরপ্যাঁচও প্রচুর। কয়েক মিনিট হাঁটার পর নিনা জিজ্ঞেস করল, রবিন, একটা জিনিস লক্ষ করেছ?

এদিক ওদিক তাকালাম, কি?

শব্দটা কমে গেছে।

কোন শব্দ?

 তোমাকে যে ডাকছিল?

কান পাতলাম। তাই তো। ঠিকই বলেছে নিনা। খুলিটা দেখার পর শব্দের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেক কমে গেছে শব্দটা। যদিও একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে তখনও, রঅবিন! রঅবিন! রবিন!

সুড়ঙ্গের ভেতরে যতই এগোলাম আরও কমে এল শব্দ।

মনে হলো ভয় অনেকটা কমেছে নিনার। আমারও সাহস ফিরে এসেছে কিছুটা। শব্দ কমছে, তার মানে শব্দের উৎস থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে একেবারেই শোনা গেল না আর ডাকটা। পুরোপুরি নীরব।

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকালাম। পেছনে হাঁটছে নিনা। আমার দিকে তাকাল ও। আবার ভয় দেখা দিয়েছে চোখের তারায়। ডাকটা শোনার পর চমকে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে সয়ে এসেছিল ওটা। একেবারে যখন থেমে গেল, অখণ্ড নীরবতা আবার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিল আমাদের। মনে হতে লাগল, শব্দটা থাকলেই যেন ভাল হতো। আমার গা ঘেষে এল নিনা।

সামনে একটা বড় গুহায় বেরিয়ে এলাম আমরা। মেঝেতে টর্চের আলো ফেলেই স্থির হয়ে গেলাম। রাশি রাশি কঙ্কাল। তাকিয়ে রইলাম হাঁ করে। বুঝতে পারলাম, মৃত্যুর সময় হলে ওখানেই গিয়ে বসে থাকত ইনডিয়ানরা।

এত আওয়াজ কোরো না, ফিসফিস করে বললাম ওকে।

আওয়াজ কে করছে?

জুতো ঘষছ না…?

কথা শেষ করতে পারলাম না। আমার গায়ের ওপর এসে পড়ল নিনা। কিসে করছে… বলতে গেল। কিন্তু ওকেও কথা শেষ করতে দিলাম না আমি। চুপ করে থাকতে বললাম।

হালকা পায়ে হাঁটার শব্দ কানে আসছে।

আমার কানে কানে বলল নিনা, আমাদের সামনে থেকে আসছে!

যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার উল্টো দিকে গুহার দেয়ালে আরেকটা ফোকর। সুড়ঙ্গমুখ। তার ভেতরে হচ্ছে শব্দটা।

কান পাতলাম। এগিয়ে আসছে। পায়ের শব্দ, সন্দেহ নেই, কিন্তু শব্দটা যেন কেমন?

বুঝে ফেললাম। ওই শব্দ আমার পরিচিত। মানুষের পায়ের নয়। রাতের বেলা সেদিন আমাদের ঘরের কাছে শুনেছি।

নিনা! ফিসফিসিয়ে বলার কথা ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমি জানি ওটা কিসের শব্দ। গত রাতে শুনেছি! ওটা…

ভূত! নিনাও চিৎকার করে উঠল।

কে যে আগে দৌড় দিল, মনে নেই। শুধু মনে আছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ঝেড়ে দৌড় দিয়েছি আমরা পেছন ফিরে।

দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি। ভূতটাও আসছে আমাদের পিছু পিছু।

আরও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। আগে আগে ছুটছে নিনা। দৌড়ের রেকর্ড ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেন ও। কিন্তু তাতেও কুকুরটার সঙ্গে কুলাতে পারছে । আমাদের তাড়া করে না। নিশ্চয় আমাদের গন্ধ পেয়ে বুঝেছে আমরা সুড়ঙ্গে ঢুকেছি। ধরতে আসছে তাই।

জলদি, রবিন, আরও জোরে! চিৎকার করে তাগাদা দিল নিনা। ওই যে সুড়ঙ্গমুখ!

এত জোরে হাঁপাতে লাগলাম মনে হলো বুকটা ফেটে যাবে। আর কত জোরে ছুটব? সামনে বেশি দূরে নেই আর সুড়ঙ্গমুখ। মাথায় ঠোকর খেলাম। নিচু হয়ে গেছে ছাত। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কুকুরের মত ছুটলাম।

খোলা মুখটা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিনা। লাফিয়ে সোজা হয়ে উঠে দৌড় দিল গুহামুখের দিকে। ওখানে পৌঁছতে পারলেও লাভ হবে না। বাইরে নিশ্চয় এখন রাত। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও বেরোবে। যদি না থেমে বাইরেও আমাদের তাড়া করে? পারব না ওটার সঙ্গে। সহজেই ধরে ফেলবে। ওটাকে ঠেকাতে চাইলে আটকাতে হবে। আর সেটা গুহার বাইরে গিয়ে হবে না। যা করার ভেতরে থাকতেই করতে হবে। কিন্তু কি করব?

গোল পাথরটার দিকে তাকিয়ে একটা বুদ্ধি এল আমার মাথায়। ডাক দিলাম, নিনা।

থামার একবিন্দু ইচ্ছে নেই ওর, তবু ফিরে তাকাল। ওকে কাছে আসতে বলে একধার থেকে ঠেলতে আরম্ভ করলাম পাথরটা।

কি করছ? চিৎকার করে বলল নিনা। জলদি এসো! ওটা আমাদের ধরে ফেলবে!

পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করে দেব। বেরোতে না পারলে আর ধরবে কি করে?

কুকুরটার নিঃশ্বাসের শব্দও কানে আসছে তখন। নিনাকে বললাম, চলে এসেছে ওটা। এসো, হাত লাগাও, আমাকে সাহায্য করো।

সেও এসে ঠেলতে শুরু করল। নড়ে উঠল পাথরটা। আরেকটু…আর একটু…তাহলেই বন্ধ হয়ে যাবে সুড়ঙ্গমুখ। ঠেলতে থাকলাম প্রাণপণে।

চলে এসেছে তো! ককিয়ে উঠে পাথর ছেড়ে দিয়ে আবার দৌড় মারল নিনা।

জোরে এক ঠেলা মেরে গড়িয়ে দিলাম পাথরটা। সুড়ঙ্গমুখে বসে গিয়ে আটকে দিল ফোকরটা।

আরে এসো না! কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে ডাকল নিনা।

কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। সামান্য একটু ফাঁক রয়ে গেছে সুড়ঙ্গমুখে। সেটা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। দুর্গন্ধ মেশানো গরম নিঃশ্বাস এসে যেন ধাক্কা মারল নাকেমুখে। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ সোজা তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। হাঁ করা মুখে বড় বড় ধারাল দাঁত। পাথরের জন্যে আটকা পড়েছে দেখে এত জোরে হাঁক ছাড়ল, মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে আমার। অন্যপাশের সুড়ঙ্গে প্রতিধ্বনি তুলল সেই চিৎকার।

আর দেখার সাহস পেলাম না। দৌড় দিলাম নিনার পেছনে।

দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছি, পাথর গলে কি চলে আসতে পারবে ওটা? স্বাভাবিক জানোয়ার হলে হয়তো পারবে না। কিংবা পারতেও পারে। যে বিরাট শরীর, প্রচণ্ড শক্তিতে পাথরটা. ঠেলে ফেলেও দিতে পারে। কিন্তু যদি ভূত হয়, তাহলে পাথর কেন, পাহাড়ও ঠেকাতে পারবে না ওটাকে। ঠিক পার হয়ে চলে। আসবে।

পাথরের অন্যপাশে থেকে গর্জন করছে ওটা। ফিরে তাকালাম পাথরটা তখনও দাঁড়িয়েই আছে। তারপর কানে এল আরেকটা চাপা ভারী শব্দ। আমাদের দুইপাশের দেয়াল, ছাত কাঁপতে শুরু করল। মনে হলো যেন ভূমিকম্প। পায়ের নিচে মাটি কাঁপছে। ছাত থেকে ছোট ছোট পাথর খসে পড়তে লাগল।

গুহামুখের কাছে পৌঁছে গেছে নিনা। আমি তখন অনেক পেছনে। ও যখন ছুটে বেরিয়ে গেল মুখটা দিয়ে, তখনও আমি ভেতরে।

প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে কুকুরটা। থরথর করে কাঁপছে মৃত্যুপুরী। ছাত থেকে, চতুর্দিকের দেয়াল থেকে বৃষ্টির মত খসে পড়ছে পাথর। যেন ভূমিধস শুরু হয়েছে। ঘাবড়ে গেলাম ভীষণ। পাহাড়ের দেয়াল ধসে পড়ে আমাকে চাপা দেবে নাকি?

বাইরে থেকে নিনার ডাক শোনা গেল, রবিন, বেরোচ্ছ না কেন এখনও?

হঠাৎ যেন বোমা ফাটল। ফিরে তাকিয়ে দেখি, সুড়ঙ্গমুখের দেয়াল থেকে বিরাট এক পাথর খসে পড়েছে। ওটার ধাক্কায় সরে গেছে গোল পাথরটা। কামানের গোলার মত ছিটকে বেরিয়ে এল বিশাল একটা কালো শরীর। ভয়ানক রাগে গর্জন করতে করতে তেড়ে এল আবার।

ততক্ষণে গুহামুখের কাছে পৌঁছে গেছি আমি। দুই লাফে বেরিয়ে গেলাম। আকাশে তখন তারা ফুটেছে। চিৎকার করে ডাকলাম, নিনা, আই নিনা, কোথায় তুমি?

এই যে এখানে! জবাব এল। গাছের ভেতরে!

একটা মুহূর্তও দেরি করলাম না! দৌড় দিলাম কবরস্থানের মাঝখানে ওকগাছটার দিকে। পেছনে ঘেউ ঘেউ করছে কুকুরটা।

রবিন, ধরে ফেলল তো! জলদি করো না। গুঙিয়ে উঠল নিনা।

গাছের ফোকরটা দেখতে পাচ্ছি। মাটি থেকে বেশ কয়েক হাত ওপরে। প্রাণের তাগিদে মানুষ যে কত অসাধ্য সাধন করে, তার প্রমাণ পেলাম সেদিন। তড়াক করে এক লাফ দিয়ে ধরে ফেললাম ফোকরটার ঠিক নিচের একটা ডাল দোল দিয়ে শরীরটাকে তুলে নিলাম ওপরে। পা ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। আমাকে টেনে নিল নিনা।

গাছের গায়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুকুরটা। আমাদের মত হাত নেই, তাই ডাল ধরতে পারল না। বার কয়েক লাফ দিয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু ফোকরটার কাছে পৌঁছতে পারল না।

কি করছে ওটা দেখার কৌতূহল চাপা দিতে পারলাম না। নিনার বাধা অগ্রাহ্য করে আস্তে গলা বাড়িয়ে উঁকি দিলাম।

অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। সোজা তাকিয়ে আছে ফোকরটার। দিকে। আমি তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। ভয়ঙ্কর গর্জন করে লাফ দিল আবার।

ঝট করে মাথা নিচু করে ফেললাম।

.

০৮.

মৃত্যুপুরীর কাছে এক প্রাচীন কবরখানায় গাছের ফোকরে বসে রইলাম দুজনে। শুনতে লাগলাম কুকুরটার তর্জন-গর্জন। যখনই ওটার আস্ফালন বেড়ে যায়, গলার কালো গুটির মালাটা চেপে ধরি। এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতেও কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, জানি না। ঘুম ভাঙলে দেখি ভোর হয়ে গেছে। চলে গেছে কবরের প্রহরী। যাবেই। নিনা বলেছে, সূর্য ডোবার পরে বেরোয় ওটা, আবার সূর্য উঠলে চলে যায়।

বাড়ি ফিরে সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না মাকে, ভয়ে। শুনলে রেগে যাবে। জানালাম, রাত কাটিয়েছি নিনাদের বাড়িতে। মাকে না বলে গিয়ে অন্যখানে থাকার জন্যে বকা খেতে হলো। চুপ করে রইলাম।

দুপুরের পর স্কুল শেষ করে নিনা এল। মা দেখার আগেই তাকে ডেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বললাম, রাতে কবরস্থানে থাকার কথা যেন বলে না দেয়।

ও বলল, বলবে না। তার মাকেও সে মিথ্যে বলেছে–রাতে আমাদের বাড়িতে থেকেছে।

আমাকে হার্ব গ্যাটলিঙ নামে একজনের বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছে সে। ওদের পড়শী। নাম শুনেই বুঝলাম, লোকটা ইনডিয়ান।

নিনা জানাল, ও একজন শামান। সেনিকা ইনডিয়ান। শামান মানে জানো তো? ওঝা, কবিরাজ। খুব জ্ঞানী লোক। আমার মনে হয় ও আমাদের সাহায্য করতে পারবে।

গেলাম নিনার সঙ্গে। ওদের বাড়ির পাশে বনের মধ্যে একটা কাঠের বাড়িতে থাকে শামান। সেটার কাছে গিয়ে বন্ধ দরজায় টোকা দিল নিনা। বেরিয়ে এল হালকা-পাতলা একজন মানুষ। লম্বা কালো চুল। গালের চামড়া কুঁচকানো, অংখ্য ভাজ। অনেক বয়েস লোকটার। নিনাকে দেখেই হাসল। ভেতরে যেতে বলল আমাদের।

ওর বাড়িটা ভারি পছন্দ হলো আমার। আমাদেরটার মত অত বড় নয়, মোটে একটা ঘর, বেশ বড়, খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফায়ারপ্লেসের কাছে গাদা করে রাখা হয়েছে অনেকগুলো কম্বল। তার ওপর বসতে দিল আমাদের। ফায়ারপ্লেসের ওপরে কাঠের দেয়ালে ঝোলানো একটা লাল ওয়ামপাম গুটির মালা আর উজ্জল রঙের পালকে তৈরি ঝলমলে একটা হেডড্রেস, অনেকটা মুকুটের মত জিনিস, ইনডিয়ানরা যা মাথায় দেয়।

শামানের পরনে নীল জিনসের প্যান্ট, গায়ে ফ্লানেলের শার্ট। কিছুটা নিরাশই হলাম পোশাক-আশাক দেখে। আমি ভেবেছিলাম জবরজং কিম্ভুত পোশাক থাকবে। কিন্তু এ তো সাধারণ পোশাক। এই লোক কি সত্যি ভূত তাড়াতে পারবে? তবে শার্টের গলার কাছের বোতাম খুলে ভেতরের জিনিসটা দেখিয়ে দেয়ার পর কেটে গেল নিরাশা। তার গলায়ও একটা ওয়ামপাম গুটির মালা। আমারটার মত শুধু কালো গুটি নয়, নানা রঙের গুটি। মালাটাও অনেক বড়।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আমার মালাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। চোখ দুটো তার কুচকুচে কালো, একেবারে মালার গুটির মত! জিজ্ঞেস করল কোথায় পেলে ওটা?

জানালাম, কে দিয়েছে।

 ও বলল, কালো গুটি খুব ক্ষমতাশালী।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম, শামানরা কি ওঝা, না কবিরাজ? অনেক যাদু জানে?

ধীরে ধীরে হাসি ফুটল তার মুখে। কুঁচকানো মুখের ভাঁজগুলো গম্ভীর হলো আরও। মেঝেতে বিছানো একটা কম্বলে আসনপিড়ি হয়ে বসল। বলল, যাদু আমি জানি, তবে অনেক নয়, অল্প। ইচ্ছে করলে ওরকম যাদু তুমিও দেখাতে পারো, রবিন মিলফোর্ড। হয়তো আমার চেয়ে বেশিই পারো। কারণ তোমার গলার মালাটার ক্ষমতা অনেক।

সত্যি বলছেন?

 সত্যি।

 তাহলে আপনি কালো গুটির মালা পরেন না কেন?

নিয়ম অনুযায়ী আমি তো পরতে পারব না কালো গুটি পরে একমাত্র বীর যোদ্ধারা।

আমি তো বীর নই। আমার পরাটা ঠিক হলো কিনা বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, এই মালা দিয়ে কি ভূত ঠেকানো সম্ভব? কবরের প্রহরীকে বাধা দেয়া যাবে?

কবরের প্রহরীকে বাধা দেয়ার দরকারটা কি তোমার? কোথায় দেখলে ওকে?

 মৃত্যুপুরীতে। কাল ওই সুড়ঙ্গে ঢুকেছিলাম আমরা।

মুহূর্তে বদলে গেল শামানের মুখের ভঙ্গি। মৃত্যুপুরীতে ঢুকেছিলে! একবার আমার দিকে একবার নিনার দিকে তাকাতে লাগল সে। তারপর আমার ওপর দৃষ্টি স্থির হলো তার। মৃত্যুপুরী থেকে কেউ বেচে ফিরতে পারে না!

কিন্তু আমরা ফিরেছি, শান্তকণ্ঠে বললাম।

আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টিটা কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে গেল তার। নজর নামাল আমার গলার মালাটার দিকে। বলল, বেঁচে ফিরেছ, তার কারণ ওই মালা। ওটাই তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে। ওটা ছিল এক মহান বীর যোদ্ধার যাকে কবরের প্রহরীও নিশ্চয় সম্মান করে। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে তোমার পূর্বপুরুষ ওই মহান বীরকে স্মরণ করো মনে মনে, তাকে ধন্যবাদ দাও। মালাটা গলায় না থাকলে এখন আর এখানে বসে কথা বলতে পারতে না।

আমি তাকালাম নিনার দিকে। ও আমার দিকে।

শামান জিজ্ঞেস করল, মালাটা কি কখনও ছুঁয়ে দেখেছ?

 অবাক হলাম। ছুঁয়ে দেখেছি মানে? এই যে গলায় পরে আছি এটা কি ছোঁয়া নয়?

যখন বিপদে পড়েছ, ভয় পেয়েছ, তখন হাত দিয়ে ছুঁয়েছ?

মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, কাল রাতে কুকুরটা যখন তাড়া করল, তখন ছুঁয়েছি। গাছের ফোকরে যখন বসেছিলাম, আর চারপাশে চক্কর দিচ্ছিল ওটা, তখনও ছুঁয়েছি। বার বার। ভয় পেয়েছিলাম তো খুব, তাই আপনাআপনি হাত উঠে যাচ্ছিল গলার কাছে। এমনকি আগের রাতে আমাদের বাড়ির কাছে যখন গিয়েছিল কুকুরটা, তখনও ছুঁয়েছিলাম। কেন যেন ভয় পেলেই হাত উঠে যায় মালাটার কাছে।

আবার বদলে গেল শামানের চেহারা। বিস্ময় ফুটল কালো চোখে। তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল প্রহরী?

গিয়েছিল। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে গেলাম। সেলারে উঁকি দিয়ে দেখতে চাইছিলাম কিসে চিৎকার করেছে। ওই সময় মনে হলো আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওটা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছি গলা কামড়ে ধরবে। কিন্তু ধরেনি। খানিক পর পেছন ফিরে দেখি কিছু নেই।

আবার কালো মালাটার দিকে নজর গেল শামানের। চুপ করে রইল। তার কালো চোখে উদ্বেগের ছায়া।

প্রহরী এ রকম কেন করল, মিস্টার গ্যাটলিঙ? জানতে চাইল নিনা। হান্টার রিজ থেকে নিচেই নামেনি আর কখনও। রবিনদের বাড়িতে কেন গেল?

কারণ রবিনের ওপর চোখ পড়েছে ওর।

তাকিয়ে রইলাম শামানের দিকে, আমার ওপর? কেন?

আঙুল তুলে মালাটা দেখাল শামান, ওটার জন্যে।

নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল আমার। মালাটা ছুঁয়ে দেখলাম। গায়ের সঙ্গে লেগে থাকায় গরম হয়ে আছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে শামান বলল, ওই মালা তোমাকে রক্ষা করছে, রবিন মিলফোর্ড। আবার কবরের প্রহরীকেও আকৃষ্ট করছে। ও জেনে গেছে ওটা আছে তোমার কাছে। কখনও তোমার পিছু ছাড়বে না আর।

ঘাবড়ে গেলাম। তাহলে তো মহামুসিবত! শীত করতে লাগল। মনে হলো। একটা সোয়েটার পরে গেলে ভাল হতো। মগজে যেন কেটে বসে গেল শামানের কথা–কখনও তোমার পিছু ছাড়বে না আর! মালাটা চেপে ধরলাম গলার সঙ্গে। মনে হলো শান্তি পেলাম। ওরকম অনুভূতি আর কখনও হয়নি আমার। মুখ শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হলো। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? আমার কাছে কি চায় ওটা?

মাথা নাড়ল শামান। কি চায় জানি না। শুধু জানি, একটা হাত তুলল সে, যেহেতু কালো মালাটা গলায় পরেই ফেলেছ, ইনডিয়ানদের নিয়ম অনুযায়ী তোমাকে এখন বীর যোদ্ধা বলে প্রমাণ করতে হবে নিজেকে। তা নাহলে ওই প্রহরী ধ্বংস করে ছাড়বে তোমাকে।

আরও শুকিয়ে গেল গলার ভেতরটা। জিজ্ঞেস করলাম, কি করলে বীর যোদ্ধা হব? এখন তো আর লড়াই হয় না যে গিয়ে যুদ্ধ করে আসব।

যুদ্ধ না করেও বীর হওয়া যায়। এমন একটা কাজ করতে হবে তোমাকে, যাতে মৃত যোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পায়।

কাজটা কি?

 তা তো বলতে পারব না।

কাজটা কি, তাই যদি না জানি, কি করে করব?

দীর্ঘক্ষণ কোন কথা বলল না শামান আমার গলার মালাটার দিকে তাকিয়ে থেকে চুপ করে ভাবতে লাগল তারপর বলল, এমন কিছু করো, যাতে বর্তমান ইনডিয়ানদের উপকার হয়। ওদের জিনিস ফেরত পায়। তাহলেই ওদের পূর্বপুরুষের আত্মা শান্তি পাবে। প্রহরীকে সরিয়ে নেবে তোমার পেছন থেকে।

.

০৯.

 আকাশের অবস্থা ভাল না, রাতে খাবার টেবিলে বসে মা বলল। ঝড় আসবে আজ রাতে।

আকাশে মেঘ। দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়ল সেটা। ঢেকে দিল পুরো আকাশ। বিদ্যুৎ চমকাতে আরম্ভ করল। কিন্তু সেসব দিকে আমার তেমন নজর নেই। আমি ভাবছি, কি এমন জিনিস খোয়া গেছে ইনডিয়ানদের, যেটা ফেরত এনে দিতে না পারলে কুকুরটা আমার পিছু ছাড়বে না?

খাচ্ছিস না কেন, রবিন? মা জিজ্ঞেস করল, চিন্তা করছিস নাকি কিছু?

কই, না তো, মাকে দেখানোর জন্যে তাড়াতাড়ি বেশি বেশি করে খাওয়া শুরু করলাম।

কিন্তু কয়েক চামচ গিলেই আবার বন্ধ। গলায় আটকে যেতে লাগল। কুকুরটার কথা ভেবে খাবার নামতে চাইছে না গলা দিয়ে। গুহার ভেতরে ওটার ভয়ঙ্কর চেহারা, গরম দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস, বড় বড় দাঁত, লাল দুটো জ্বলন্ত চোখ, ওক গাছটাকে ঘিরে ভয়াবহ গর্জন, কিছুতেই দূর করতে পারছি না মন থেকে।

কি করব? কি করে ওটাকে আমার পেছন থেকে খসাব? ভেবে কোন কূলকিনারা করতে পারলাম না। কানে বাজছে শামানের কথা–এমন কিছু করো, যাতে বর্তমান ইনডিয়ানদের উপকার হয়। ওদের জিনিস ফেরত পায়। তাহলেই ওদের পূর্বপুরুষের আত্মা শান্তি পাবে। প্রহরীকে সরিয়ে নেবে তোমার পেছন থেকে।

কি উপকার করব? যদি দেখে কিছু করছি না তো কি করবে কুকুরটা?

 কারও উপকার করতে হলে তার কিসের অভাব কিংবা কোন কোন অসুবিধে সেটা আগে জানা দরকার। হাতের চামচটা নামিয়ে রেখে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, এখান থেকে সেনিকা ইনডিয়ানরা চলে গিয়েছিল কেন, জানো কিছু?

খেতে খেতে মুখ তুলল মা। অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। হঠাৎ সেনিকাদের ব্যাপারে এই আগ্রহ কেন?

দরকার আছে, মা, বলো না? অনুরোধ করলাম।

বাবার দিকে তাকাল মা। আবার আমার দিকে। গেছে কি আর সাধে? ওদের তাড়ানো হয়েছে।

কারা তাড়িয়েছে?

জবাবটা দিল বাবা, আর কারা? শ্বেতাঙ্গরা। স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এ সব দেশের লোক। বিদেশী হয়েও এলাকার আসল অধিবাসীদের বের করে দিয়েছে। ইনডিয়ানদের বাপ-দাদার সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে। জোর করে ওদের জমি দখল করে ওদের কুকুরের মত তাড়িয়েছে। যারা যেতে চায়নি, তাদের নিষ্ঠুরের মত খুন করেছে। এ সব ইতিহাস তো তোমার জানার কথা, রবিন।

কিছু কিছু জানি। সব নয়। আচ্ছা, পাহাড়ের মাথার ওই কবরখানাটার মালিক কে? জিজ্ঞেস করলাম, ইনডিয়ানরা নয়?

ছিল।

এখন?

ওরাই, তবে কবর আর দিতে আসতে পারে না, এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরল বাবা। চিবাতে চিবাতে বলল, এলেই লাঠি নিয়ে তাড়া করে শ্বেতাঙ্গরা।

ওরা আদালতে যায় না কেন? যদ্র জানি ইনডিয়ানদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে আমেরিকান সরকারের। জমির দলিল করে নিলেই তো ভোগদখল করতে পারে।

তাও করেছিল। কিন্তু দলিল করে আনার পর পরই কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে এখানকার সেনিকা সর্দার ব্ল্যাকফায়ার চার্লি টাসক্যানি। দলিলগুলো সব। ছিল তার কাছে। কোথায় যে সে গেছে কেউ জানে না। দলিলগুলোও নিখোঁজ হয়েছে তার সঙ্গে। গুজব আছে, চাঁদনি রাতে হান্টার রিজের মাথায় নাকি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় লম্বা-চওড়া এক জোয়ান পুরুষকে, সঙ্গে বিশাল এক কালো কুকুর। লোকের ধারণা, ভূত।

তারমানে মরে গেছে?

হয়তো গেছে। নইলে আসে না কেন?

 তার ছেলেমেয়ে কেউ নেই?

এক ছেলে ছিল। বাবা নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পর সেও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। লোকে বলে, তাকে যেতে বাধ্য করেছিল এখানকার কয়েকজন প্রভাবশালী লোক। তারপর একে একে সবাইকে জায়গা ছাড়তে হলো একজন ইনডিয়ানকেও আর টিকতে দেয়া হলো না।

শামান হার্ট গ্যাটলিং বাদে?

ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে নাকি তোমার?

হয়েছে। এতক্ষণে বুঝলাম এত জায়গা থাকতে বনে বাস করে কেন সে। তারমানে খোলা জায়গায় আসতেই দেয়া হয় না।

না, মাথা নাড়ল বাবা। বড় নিষ্ঠুরতা। অমানবিক। যাদের জায়গা, তাদেরই ঠাই নেই, ভোগ করছে অন্য লোক। উড়ে এসে জুড়ে বসা একেই বলে।

চুপচাপ ভাবলাম এক মিনিট। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, বাবা, দলিলগুলো যদি পাওয়া যায়, আবার কি তাদের জায়গায় ফিরে আসতে পারবে ইনডিয়ানরা?

তা পারবে। তখন অন্য কেউ বাধা দিলে পুলিশের সাহায্যও নিতে পারবে। তবে দলিল ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।

কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। এক সর্দার নাহয় গেছে, বাকি ইনডিয়ানরা আদালতে গিয়ে দলিলের নকল বের করে আনে না কেন?

ইনডিয়ানরা সাদাসিধা মানুষ। শ্বেতাঙ্গদের আইন-কানুনের জটিলতা, ঘোরপ্যাঁচ কমই বোঝে। ওরা এখনও অপেক্ষা করে আছে বোধহয়, ওদের সর্দার ফিরে আসবে, তৈরি করে দেবে ওদের বহু আশার স্বপ্নভূমি।

কতদিন হলো সর্দার নিখোঁজ হয়েছে?

এই বছর পাঁচেক। আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল বাবা, এত প্রশ্ন কেন? সর্দার আর দলিলগুলোর খোঁজ করছ নাকি?

এখনও করিনি। তবে করব ভাবছি।

আর কিছু না বলে দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠে গেলাম ওখান থেকে। নিজের ঘরে গিয়ে একটা বই বের করলাম। কিন্তু মন বসাতে পারলাম না। তা ছাড়া আগের রাতে ঘুমাতে পারিনি। বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে দুচোখ ভেঙে আসতে লাগল। শুয়ে পড়লাম বিছানায়। কিন্তু এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুমাতে ভয় পেলাম। মন বলছে কুকুরটা আসবে সেরাতেও।

ঠিক করলাম, যত যাই ঘটুক, ঘর থেকে বেরোব না। না বেরোলে কোন ক্ষতি করতে পারবে না কুকুরটা।

বেশিক্ষণ খোলা রাখতে পারলাম না চোখ। ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভেঙে গেল বজ্রপাতের শব্দে।

এত জোরে বাজ পড়তে আর শুনিনি। চোখ মেলোম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তীব্র নীল আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরও এসে পড়ল বিদ্যুতের আলো। দিনের মত আলোকিত হয়ে গেল।

আবার বজ্রপাত। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। জানালায় এত জোরে এসে আঘাত হানতে লাগল, ভয় হলো কাঁচ না ভেঙে যায়। কিন্তু ওটা তো খোলা ছিল? নিশ্চয় আমি ঘুমিয়ে পড়লে মা দেখতে এসেছিল। জানালা খোলা দেখে ঝড়ের কথা ভেবে বন্ধ করে রেখে গেছে। ভাল করেছে। নইলে ঘরের মধ্যে বন্যা বয়ে যেত। আমার পায়ের কাছের জানালাটার ছিটকানি বোধহয় ঠিকমত লাগেনি, বাতাসের ঝাঁপটায় সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে পাল্লা। সেখান দিয়ে ফিসফিস করে কে যেন ডাকল, রবিন!

বুকের মধ্যে ধক করে উঠল আমার। পুরুষের কণ্ঠ। কিন্তু বাবার নয়। কার তাহলে?

আবার ডাকল, রবিন?

গায়ের চাদরের ধার খামচে ধরলাম। একটানে নিয়ে এসে ফেললাম বুক থেকে গলার কাছে।

কে ডাকে? ভুল শুনছি না তো?

 আবার শোনা গেল ডাক, রবিন! শোনো!

গুহার মধ্যেও আমার নাম ধরে ডাকতে শুনেছি। তবে এ ডাক সেই ডাক নয়। স্বাভাবিক মানুষের কণ্ঠের মত। জানালার ফাঁকটা দিয়ে আসছে।

কোনমতেই বাইরে বেরোব না। ওই মায়াডাককে অগ্রাহ্য করতে না পারলে মারা পড়ব-নিজেকে বোঝালাম। যতই ডাকুক, ঘর থেকে আর বেরোচ্ছি না আমি।

রবিন! কথা শোনো?

ঘর থেকে নাহয় না-ই বেরোলাম, কে ডাকে দেখতে তো অসুবিধে নেই? আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। অন্ধকারে কিছু চোখে পড়ল না।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বাজ পড়ল বিকট শব্দে।

উঠে বসলাম। বিছানা থেকে না নেমে বাঁকা হয়ে এগিয়ে গেলাম জানালাটার দিকে। হাত দিয়ে দেখলাম, পায়ের কাছটায় বিছানা ভিজে গেছে। জানালা বন্ধ না করলে আরও ভিজবে।

আবার বাজ পড়ল। ভয়াবহ শব্দ। থরথর করে কেঁপে উঠল সবকিছু। বিকট শব্দে কি যেন ভেঙে পড়ল বাইরে। বিদ্যুতের আলোয় এমন একটা দৃশ্য দেখলাম, ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে গেল আমার।

দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম লম্বা এক লোককে। জানালার কাছ থেকে মাত্র চার ফুট দূরে। লম্বা চুল ঘাড়ের ওপর নেমে এসেছে। মাথায় পাখির পালকের মুকুট। গায়ে হরিণের চামড়ার হাতে বানানো জ্যাকেট, পরনে একই চামড়ার প্যান্ট। বহুকাল আগের ইনডিয়ান যোদ্ধারা যে রকম পরত। পাশে দাঁড়ানো একটা কালো কুকুর। মৃত্যুপুরীতে যেটাকে দেখেছি।

সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা।

জানালা বন্ধ করব কি, হাঁটু কাঁপতে শুরু করল আমার। জানালার শার্সিটা ধরে না রাখলে উপুড় হয়ে পড়েই যেতাম।

আবার বিদ্যুৎ চমকানোর অপেক্ষায় রইলাম।

চমকাল। আলোকিত করে দিল আমাদের পেছনের আঙিনা। আবার দেখলাম লোকটাকে। দাঁড়িয়ে আছে একই ভঙ্গিতে। কুকুরটারও নড়াচড়া নেই। আমার দিকে তাকিয়ে আছে দুজনেই।

হাত তুলল লোকটা। মনে হলো আমাকে বাইরে যাওয়ার জন্যে ইশারা করল। তারপর আবার অন্ধকার।

আর দেখার অপেক্ষা করলাম না। আমি যেতে না চাইলে কি করবে লোকটা কে জানে! তাড়াতাড়ি জানালার ছিটকানি লাগিয়ে দিয়ে বালিশে মাথা রাখলাম। চাদর টেনে দিলাম মুখের ওপর।

ঘুম নেই আর চোখে। কান পেতে শুনছি বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব।

.

১০.

সকালবেলা বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখলাম। মানুষের পায়ের ছাপ দেখলাম না। কুকুরটারও না। এমনকি আমার জানালার নিচে যেখানে লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি সেখানেও কোন ছাপ নেই। সবখানে কাদা। পানি জমে আছে। একটা ম্যাপল গাছের মাথা জ্বলে গেছে। কাণ্ডটা মাঝখান থেকে চিরে দুই টুকরো। একটা অংশ ভেঙে পড়েছে মাটিতে। বাজ পড়েছিল গাছটার মাথায়।

নিনার আসার অপেক্ষায় রইলাম।

কিন্তু দুপুরের পর এল না ও। গেলাম ওর বাড়িতে। ওর মা বললেন, স্কুল থেকে ফেরেনি। গেলাম স্কুলে। দেখি বেজবল খেলছে। মাথায় সেই লাল বেজবল ক্যাপ। আমাকে দেখে হাত নাড়ল। আমিও নাড়লাম। দুই ক্লাসের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। বুঝলাম খেলা শেষ না করে আসতে পারবে না ও। শেষ হতে সময় লাগবে।

ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। খেলা দেখতে ভাল লাগল না। মন জুড়ে। আছে ভূত। চলে এলাম ওখান থেকে।

কিন্তু বাড়ি যেতেও ইচ্ছে করল না। কি করব? পা দুটো যেন ঠেলে নিয়ে চলল পাহাড়ের দিকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ওই গুহার ভেতর।

ঝলমলে রোদ। আকাশে মেঘের চিহ্নও নেই কোনখানে। হান্টার রিজের পথ বেয়ে ওপরে উঠে চললাম আমি। এই রাস্তা, এই পাহাড়, সব নিনার মুখস্থ। আমার। অতটা চেনা হয়নি, তাই দ্রুত এগোতে পারলাম না।

সঙ্গে নিনা নেই। একা যেতে কেমন যেন লাগছে। মনকে বোঝালামও না আসাতে ভাল হয়েছে। ওর ভাল। কালো গুটির মালা আমি পরেছি, ও নয়। কুকুরটার নজর আমার দিকে। অতএব যা করার আমাকেই করতে হবে। ওকে এ সবে টেনে আনব কেন? মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে?

হারলে ক্রীকের ওপরে চলে গেছে সুর্য। ডুবতে তখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। সূর্যাস্তের আগে কখনও বেরোয় না কুকুরটা। ওটার মালিক ইনডিয়ান লোকটার ভূতও নিশ্চয় রাতের আগে বেরোবে না। অতএব ওই মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে যাওয়া আমার জন্যে নিরাপদ। আশা করলাম সুড়ঙ্গে ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে ভূত বেরোনোর আগেই বাড়ি ফিরে যেতে পারব।

কিন্তু জোর পেলাম না মনে। কেবলই চিন্তা হতে থাকল, আচ্ছা, সত্যি কি সূর্যাস্তের আগে বেরোয় না ভূতগুলো? ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা অবশ্য বেরোত না। কিন্তু ওটা তো কল্পিত ভূত। বিশাল কুকুরটার লকলকে লাল জিব, ধারাল দাঁত, হিংস্র চেহারা আর রক্ত পানি করা বিকট চিৎকারের কথা ভেবে দমে গেলাম। আবার ওটার মুখোমুখি হতে হবে ভাবতেই কলজের পানি শুকিয়ে গেল। মনকে সাহস জোগালাম এই ভেবে, দুই দুইবার দেখা হয়েছে ওটার সঙ্গে আমার। ইচ্ছে করলেই ক্ষতি করতে পারত। করেনি। কিংবা করতে পারেনি। এর একটাই কারণ হতে পারে, আমার গলার কালো মালাটা। দুবার যদি রক্ষা করে থাকতে পারে আমাকে ওটা, আরও একবার পারবে।

কবরস্থানে উঠে গেছে যে রাস্তাটা, সেটার গোড়ায় এসে দাঁড়ালাম। দ্বিধা করলাম একবার তারপর যা থাকে কপালে ভেবে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম।

পৌঁছে গেলাম ঘাসে ঢাকা সেই আয়তাকার জায়গাটায়। কবরস্থানে। মাঝখানে বিশাল ওকের অন্যপাশে মৃত্যুপুরীর কালো মুখটা যেন হাঁ করে আছে। অপরিচিত নয় আর এখন ওটা। তবু দিনের আলোতেও সেদিকে তাকিয়ে গা ছমছম করে উঠল।

আগেরবারের মতই সম্মান দেখানোর জন্যে কবরস্থান মাড়িয়ে না গিয়ে ওটার ধার ধরে এগোলাম। সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা হতে লাগল আবার–কে যেন আড়াল থেকে আমার ওপর নজর রাখছে। আমার প্রতিটি নড়াচড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছে। অদৃশ্য চোখের অধিকারী। চারপাশে তাকালাম। কেউ নেই। কবরস্থানটা একটা ঘাসে ঢাকা মাঠ। তাতে এমন কোন ঝোঁপ বা গাছ নেই যার আড়ালে লুকিয়ে আমার ওপর চোখ রাখবে কেউ। তাহলে কোনখান থেকে রাখছে? সব কি আমার মনের ভুল? কল্পনা? বনের দিকে তাকালাম। আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল যেন নীরব বনটা। মনে হলো আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসছে। ঘাড়ের পেছনটা শিরশির করতে লাগল।

মৃত্যুপুরীর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মনের পর্দায় ভেসে উঠল আহত ইনডিয়ান যোদ্ধাদের চেহারা। মৃত্যুর সময় হলে এখানে চলে আসত ওরা। ওই গুহার ভেতরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে কতজন! মনে মনে ঈশ্বরের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করলাম ওদের জন্যে। ওদের উদ্দেশ্যে জোরে জোরে বললাম, হে অশরীরী বীরেরা, আমি তোমাদের বিরক্ত করতে আসিনি। এসেছি তোমাদের বংশধরদের সাহায্য করতে। তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে নিতে। আমার গায়েও তোমাদের রক্ত আছে। তাই এই গুহাতে অধিকার আছে আমারও। আমাকে সাহায্য করো তোমরা।

শার্টের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে স্পর্শ করলাম একবার কালো মালাটা + ঢুকে পড়লাম গুহায়।

বাইরের চেয়ে ভেতরে অনেক ঠাণ্ডা। কয়েক পা এগোলাম। কি যেন পড়ল কাঁধে। চমকে গিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। আবার পড়ল। ওপর দিকে টর্চের আলো ফেলে দেখি পানির ফোঁটা। কোনও ফাটলে জমা হয়ে আছে বৃষ্টির পানি। ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে সেখান থেকে। নিজেকে বোঝালাম, সব কিছু সহজ ভাবে নাও, রবিন। অল্পতেই যদি এ ভাবে চমকে যাও, কাজ করবে কিভাবে?

মেঝেতে আলো ফেললাম। সুপ হয়ে আছে ধসে পড়া পাথর।

গুহার বাকটার অন্যপাশে চলে গেলাম। পেছনে আড়ালে পড়ে গেল গুহামুখ। বিকেলের রোদেলা আকাশও অদৃশ্য। চারপাশে শুধুই অন্ধকার। পাথর আর দেয়াল, দেয়াল আর পাথর ছাড়া অন্য কিছুই চোখে পড়ল না। ভয় তাড়ানোর জন্যে অন্যমনস্ক হতে চাইলাম। নিনার কথা ভাবলাম। কি করছে এখন ও? নিশ্চয় প্রতিপক্ষের ওপর প্রবল আক্রমণ চালিয়েছে। মাথায় লাল ক্যাপ। চোখের সানগ্লাসটা খুলে রেখেছে। খেলার সময় পরা যায় না।

আলো ফেললাম গুহার দেয়ালে। সুড়ঙ্গমুখ দুটোর ওপর। চ্যাপ্টা পাথরে বসে তেমনি বিকৃত হাসি হাসছে খুলিটা। যেন ব্যঙ্গ করছে আমাকে। ধস নেমে এত পাথর পড়ল, ওটার কিছু হয়নি। অবাক হলাম না। জানতাম, থাকবে ওটা। ফোকর দুটোর দিকে তাকালাম। একটার কাছে চিত হয়ে পড়ে আছে গোল পাথরটা, যেটা দিয়ে মুখ বন্ধ করেছিলাম। হয় আপনাআপনি পড়ে গেছে ওটা, কিংবা ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে কুকুরটা। পাহাড় কেঁপে ওঠায়, ধস নামায় হয়তো ফেলতে সুবিধে হয়েছে ওটার। ভাবলাম, ভূতই যদি হবে, তাহলে পাথর ফেলতে প্রকৃতির সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে কেন? নিজের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা নেই? মাথা চুলকালাম। কি জানি! কত রকম ভূত থাকে। একেক ভূতের একেক ধরনের ক্ষমতা।

আবার তাকালাম খুলিটার দিকে। কালো কোটর দুটোর দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে ভরে গেল মন। নিনার ধারণাই ঠিক মনে হতে লাগল। ওটাকে ওখানে ইচ্ছে করেই রেখেছিল সেনিকারা, যাতে অনুপ্রবেশকারীরা দেখলে ভয় পায়, সুড়ঙ্গে ঢুকতে সাহস না করে।

আড়াল থেকে কেউ যে লক্ষ করছে আমাকে সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা কিন্তু। আছেই। মনে হচ্ছে আমাকে অনুসরণও করছে ওটা। অশরীরী কিছু? নাকি আমার মতই শরীর আছে ওটার। দেখার জন্যে আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে আলো ফেললাম। নাহ, কেউ নেই। অন্ধকার গুহা। কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। কোন শব্দ নেই।

আবার ফিরলাম সুড়ঙ্গমুখ দুটোর দিকে। প্রথমে ডানে, তারপর বায়ে। দুটোই খোলা। ভেতরে অন্ধকার। আগের বার নিনার সঙ্গে ঢুকেছিলাম ডানেরটাতে। ওটা দেখা হয়ে গেছে। বায়েরটাতে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিলাম।

১১.

ঢুকে যেতে শুরু করলাম সুড়ঙ্গের গভীর থেকে গভীরে। মাটি ভেজা ভেজা। নরম। বাইরের পানি পড়ে ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। সেজন্যেই এই অবস্থা। আগেরটার। চেয়ে অনেক বেশি মোড় আর গলিঘুপচি এটাতে। দুদিকের দেয়ালে আরও অনেক ফোকর দেখা গেল। কোনটা শুধুই গর্ত, কোনটা সুড়ঙ্গের মুখ। এখানে পথ হারালে কিংবা ভুল করে যদি ওগুলোর কোনটাতে ঢুকে পড়ে কেউ, বেরোনো মুশকিল। কোনটা দিয়ে কোনটাতে চলে যাবে, চিহ্ন দিয়ে না রাখতে পারলে শেষে বোঝাই যাবে না।

টর্চের আলো ফেলে খুব সাবধানে এগোতে লাগলাম। ভূতের ভয় তো আছেই, পথ হারানোর ভয়ও আছে। কোথাও কোথাও নিচু হয়ে যাচ্ছে ছাত। সেসব জায়গায় মাথা নুইয়ে ফেলতে হচ্ছে। অসাবধান হলে ঠোকর লাগছে মাথায়। দুপাশ থেকে চেপে এসে কোথাও সরু হয়ে যাচ্ছে পথ। হাঁটার সময় বেরিয়ে থাকা পাথরে ঘষা লাগে।

কিছুদূর এগোনোর পর থমকে দাঁড়ালাম। ফিসফিসে একটা কণ্ঠ কানে আসছে। সেই প্রথম থেকেই। আগের দিনও শুনেছি বলে সেদিন আর গুরুত্ব দিইনি। আমার নাম ধরে ডাকাডাকি।

শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করলাম। কান পাতলে মনে হয়, চতুর্দিকেই হচ্ছে। যেদিকে তাকাই, সেদিক থেকেই আসে। বদ্ধ জায়গায় কিংবা সুড়ঙ্গের মধ্যে বোধহয় কোন রকম কারসাজি করে শব্দ, সেজন্যেই ওরকম লাগে।

কিন্তু এ ভাবে ডাকে কে? দেখা দরকার। কিছুটা সামনে এগিয়ে, কিছুটা পিছিয়ে, এদিক ওদিক আরও দুচারটা উপসুড়ঙ্গে ঢুকে বোঝার চেষ্টা করলাম। হদিস পেলাম না। বেশি ঘোরাঘুরি করতেও সাহস পেলাম না। অগত্যা ডাকে ডাকুক এ রকম একটা মনোভাব নিয়ে আবার ফিরে এলাম মূল সুড়ঙ্গে। এগিয়ে চললাম সামনের দিকে।

সুড়ঙ্গের আরেকটা বড় মোড় ঘুরে অন্যপাশে বেরোতেই দেখি সামনে দেয়াল। রুদ্ধ। আর যাওয়ার পথ নেই। ছোট একটা গুহায় ঢুকে শেষ হয়েছে পথ। প্রথমে দেয়ালগুলোতে আলো ফেললাম, তারপর মেঝেতে।

কি যেন একটা পড়ে আছে।

এগিয়ে গেলাম। একটা পুরানো ব্রিফকেস। ভেতরে কি আছে দেখার কৌতূহল হলো। কিন্তু তালা লাগানো। খুলতে পারলাম না। এখানে ব্রিফকেস ফেলে গেল কে? প্রথমেই মনে এল চোর-ডাকাতের কথা। হয়তো এর মধ্যে দামী অলঙ্কার কিংবা টাকাপয়সা আছে।

নিচু হয়ে হাতল ধরে তুলে নিলাম ওটা। হালকা। টাকা কিংবা অলঙ্কার বোঝাই হলে অনেক ভারী হতো। ঝাঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কি আছে। মৃদু খড়মড় শব্দ হলো। বোঝা গেল না কি আছে। একেবারে খালি নয়, এটুকু বোঝা গেল শুধু।

খোলার চেষ্টা করলাম। তালা লাগানো। চাবি নেই সঙ্গে। ভেঙে খুলতে হবে। বাইরে নিয়ে গিয়ে খুলে দেখব ভেবে রেখে দিলাম হাতে। বাঁ হাতে ব্রিফকেস ঝোলানো, ডান হাতে টর্চ। আর কি আছে গুহায় দেখতে লাগলাম। আমার একপাশে কয়েক হাত দূরে এক দেয়ালের গোড়ায় আলো ফেলতেই স্থির হয়ে গেল হাত। বরফের মত জমে গেলাম যেন। নড়তে পারলাম না। দম নিতে পারলাম না। এমনকি চিৎকারও করতে পারলাম না।

আগের রাতে ঝড়ের সময় যে লোকটাকে দেখেছি, সে পড়ে আছে দেয়ালের নিচে। তেমনি হরিণের চামড়ার পোশাক পরনে। মাথায় পালকের মুকুট।

ভাল করে দেখতে গিয়ে বুঝলাম, লোকটা নয়, তার কঙ্কাল। মাথার চুল সব খসে পড়েনি তখনও। শরীরের কিছু কিছু জায়গায় হাড়ের সঙ্গে চামড়া জড়িয়ে আছে।

টপ করে মাথায় পড়ল কি যেন। এতটাই চমকালাম, পানির ফোঁটা কিনা সেটা ভাবারও সময় হলো না। ঘুরে দৌড় দিতে গেলাম। দেয়ালে বাড়ি লেগে হাত থেকে ছুটে গেল টর্চ। মাটিতে পড়ে নিভে গেল। গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ শুনলাম। গাঢ় অন্ধকার যেন গিলে নিল আমাকে।

উবু হয়ে বসে হাতড়াতে শুরু করলাম।

টুপ করে ঘাড়ে পড়ল কি যেন। চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু না, পানির ফোঁটা। বেয়ে নামতে লাগল নিচের দিকে।

আবার হাতড়াতে শুরু করলাম মেঝেতে।

টর্চটা ঠেকল হাতে। তুলে নিয়ে সুইচ টিপলাম। জুলল না। ঝাঁকি দিলাম। তাও জ্বলল না। নানা ভাবে চেষ্টা শুরু করলাম জ্বালানোর জন্যে। জুলল না ওটা। হাত কাঁপছে। কিছুতেই স্থির রাখতে পারছি না। বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন।

যখন বুঝলাম, কিছুতেই জ্বালতে পারব না, আতঙ্কে অবশ হয়ে আসতে চাইল হাত-পা। এই অন্ধকারে বেরোব কি করে?

আন্দাজে পা বাড়ালাম সামনের দিকে।

কয়েক পা এগোতেই হোঁচট লাগল কিসে যেন। বিচিত্র খটমট শব্দ হলো। অকেজো টর্চটা মাটিতে রেখে নিচু হয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কিসে হোঁচট খেয়েছি। হাতে লাগল খসখসে, শক্ত কিছু। কঙ্কালের গায়ে হাত দিয়েছি বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাব। ঘুরে উল্টো দিকে দিলাম দৌড়।

সুড়ঙ্গমুখের কাছের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। পাগলের মত হাত বাড়িয়ে ফাঁকা জায়গা খুঁজতে লাগলাম। ফাঁকা মানেই সুড়ঙ্গমুখ।

পেয়ে গেলাম ওটা। ছুটতে শুরু করলাম অনুমানের ওপর নির্ভর করে।

অকেজো টর্চটা আর তুলে আনিনি। কঙ্কালের কাছেই রয়ে গেছে। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও ব্রিফকেসটা ফেলিনি হাত থেকে।

ছুটছি, ছুটছি, ছুটছি। গায়ে পাথরের ঘষা লাগতে বুঝলাম সুড়ঙ্গের সরু অংশটায় পৌঁছে গেছি। আরও কিছুদুর এগিয়ে মাথায় বাড়ি খেলাম। বুঝলাম, নিচু ছাত। আশা বাড়ল। ঠিকপথেই চলেছি।

ছোটা বন্ধ করে তখন হাঁটতে শুরু করলাম।

হাঁটছি তো হাঁটছিই, পথ আর শেষ হয় না। ঘটনাটা কি? এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়?

আরও প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট হাঁটার পর সন্দেহ হলো, পথ হারাইনি তো?

কথাটা মনে হতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। প্রচণ্ড আতঙ্কে মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করলাম আবার। দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছি। ঘষা লেগে ছড়ে যাচ্ছে কনুই। নিচু ছাতে ঠোকর খেয়ে মাথায় গোলআলুর মত ফুলে যাচ্ছে। কোন। কিছুরই পরোয়া করছি না। কেবল ছুটছি আর ছুটছি।

হঠাৎ ধাক্কা খেলাম দেয়ালে। কপাল ঠুকে গেল। হাত বাড়িয়ে দেখে বুঝলাম, সামনে এগোনোর পথ নেই। সরে গেলাম একপাশে। ফোকর পাওয়া গেল একটা। এগোতে গেলাম। কিন্তু সুড়ঙ্গমুখ নয় ওটা। দেয়ালের গায়ে বড় একটা গর্ত। পিছিয়ে এলাম। হাতড়ে হাতড়ে বের করার চেষ্ট করলাম সুড়ঙ্গমুখ। অনেক চেষ্টা করেও পেলাম না। যেটা দিয়ে ঢুকেছি, সেটার মুখও বের করতে পারছি না আর।

অবশ হয়ে গেছে শরীর। পরিশ্রমে হাপাচ্ছি। নাক দিয়ে শিস কেটে বেরোচ্ছে নিঃশ্বাস। একটা দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লাম।

হাল ছেড়ে দিয়েছি। মনে হলো, আর কোনদিন বেরোতে পারব না এই অন্ধকার গোলকধাঁধা থেকে। কেউ জানে না আমি এখানে আছি। কেউ আমাকে উদ্ধার করতে আসবে না।

মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি, বাইরে এখন বিকেলের রোদ। নীল আকাশ। সাদা সাদা মেঘ। পাখি গান গাইছে। ওসব আর কোনদিন দেখতে পাব না আমি! ভীষণ কান্না পেতে লাগল।

আরেকটা কথা মনে পড়তে আতঙ্কে সিটিয়ে গেলাম। বাইরে এখনও দিন, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না আর আলো। বিকেল শেষ হয়ে যাবে। সূর্য ডুববে। সন্ধ্যা নামবে। সূর্যাস্তের পর পরই বেরোয় কবরের প্রহরী! তারপর কি ঘটবে ভাবতে পারলাম না আর।

ঘাম ঝরছে দরদর করে। ঘাড়ের ঘাম মুছতে গিয়ে হাতে ঠেকল মালাটা। আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল মনে। এমন করে চেপে ধরলাম ওটা যেন ধরার ওপরই নির্ভর করছে আমার বাঁচা-মরা।

.

১২.

বাতাস ভেজা। মাটি ভেজা। বসে থাকতে থাকতে প্যান্টের হিপ ভিজে গেল। দেয়ালে হেলান দিয়ে থেকে শার্টের পিঠও ভিজল। শীত শীত করতে লাগল আমার।

কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম জানি না। হঠাৎ কানে এল, নাম ধরে ডাকছে। কেউ। গুরুত্ব দিলাম না। খিঁচড়ে গেল বরং মেজাজ। আরও যন্ত্রণা দিতে চাইছে। আমাকে।

বাড়তে লাগল ডাকটা। মনে হলো কাছে এগোচ্ছে।

 তারপর আস্তে আস্তে আবার দূরে সরে গেল।

কয়েক মিনিট পর আবার শোনা গেল ডাকটা। আবার এগিয়ে আসছে। জোরাল হচ্ছে শব্দ।

আরও এগোতে চেনা চেনা লাগল স্বরটা। তেতো হয়ে গেল মন। আমার সঙ্গে রসিকতা করছে ভূতটা। চেনা মানুষের কণ্ঠ নকল করে আমাকে ধোকা দিতে চাইছে।

আরও এগিয়ে এল ডাক।

আর সহ্য করতে পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম, যা ব্যাটা ভূতের বাচ্চা, ভূত! সর এখান থেকে! যা পারিস করগে আমার!

আরও এগোল কণ্ঠটা। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, রবিন, কোথায় তুমি? কোত্থেকে কথা বলছ?

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভুল শুনছি না তো? নিনার কণ্ঠ। নাকি ভূতটাই এসেছে নিনার রূপ ধরে আমাকে জ্বালাতে?

জবাব দিলাম না।

আবার শোনা গেল নিনার চিৎকার, রবিন, জবাব দিচ্ছ না কেন?

চিৎকার করে জবাব দিলাম, নিনা, আমি এখানে! এই যে, এখানে! তুমি কোথায়?

কয়েক সেকেন্ড পর আলো দেখতে পেলাম। এগিয়ে আসছে আলোটা।

 উঠে দাঁড়ালাম। আমিও এগোলাম সেদিকে।

মুখের ওপর টর্চের আলো পড়ল আমার। নিনা জিজ্ঞেস করল, এই অবস্থা কেন তোমার?

পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তুমি এলে কি করে?

 জবাবে বলল ও, কেন আমি কি রাস্তা চিনি না নাকি?

না, সেকথা বলছি না। তুমি জানলে কি করে আমি এখানে আছি?

তুমি তো আর খেলা দেখলে না, চলে গেলে। আমি খেলা সেরে তোমাদের বাড়ি গেলাম। আন্টি বলল, তুমি দুপুরে খেয়ে সেই যে বেরিয়েছ, আর ফেরোনি। সন্দেহ হলো। কোথায় গেলে? মনে হলো, মৃত্যুপুরীতে চলে যাওনি তো? দৌড়ে বাড়ি গিয়ে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তোমাকে এখানে খুঁজে বের করতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার।

টর্চটা হাত থেকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। পথ হারিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে খুঁজে বের করলে কি করে?

মাটি নরম। পায়ের ছাপ বসে গেছে। দেখে দেখে এসেছি। হাতে ওটা কি?

চলো, যেতে যেতে বলছি।

সুড়ঙ্গে চলতে চলতে সব কথা খুলে বললাম নিনাকে। আগের রাতে দেখা জীবন্ত লোকটা গুহার ভেতর কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে শুনে ওর গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাইল না। তাগাদা দিল, জলদি চলো, সূর্য ডোবার আগেই বেরিয়ে যেতে ইবে! ওই লোকটাই কুকুরের মালিক, বোঝা যাচ্ছে। মরে দুটোতেই ভূত হয়েছে।

হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল ও।

পেছন থেকে সাবধান করলাম, সাবধান, যত যাই করো, হাত থেকে টর্চ ফেলো না। তাহলে মরেছি!

আর কোন অঘটন ঘটল না। নিরাপদেই বেরিয়ে এলাম গুহাটায়, যেটা থেকে দুটো সুড়ঙ্গ দুদিকে চলে গেছে। ফিরে তাকালাম। পাথরের বেদিতে বসে নীরবে তেমনি বিকট হাসি হাসছে খুলিটা। ফিসফিস করে বললাম ওটাকে, সালাম, ভূতের রাজা, আর আসছি না এখানে! যত ইচ্ছে ভয় দেখাওগে এখন মানুষকে, আমাদের। আর পাচ্ছ না।

মৃত্যুপুরী থেকে বেরিয়ে এসে হাঁপ ছাড়লাম।

পশ্চিম দিগন্তে নেমে গেছে সূর্য। আড়ালে যেতে বেশি বাকি নেই।

জলদি হাঁটো! তাগাদা দিল নিনা। সূর্য ডোবার আগেই কবর এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

খাড়া পাহাড়টার নিচে যখন নামলাম, সূর্য তখন ডুবে গেছে। তবে আর ভয়। নেই ততটা। প্রহরীর এলাকা পার হয়ে এসেছি আমরা।

এতক্ষণে সহজ হয়ে এল নিনা। আমার হাতের ব্রিফকেসটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি আছে ওটাতে, বলো তো?

না খুললে বোঝা যাবে না। তবে অনুমান করতে পারছি।

কি?

দলিল। ইনডিয়ানদের জায়গার। আর গুহার ভেতরে মরে পড়ে থাকা লোকটা সেই ইনডিয়ান সর্দার, আমি নিশ্চিত।

অবাক হলো নিনা। এ ভাবে হেঁয়ালি করে কথা বলছ কেন? কোন ইনডিয়ান সর্দার?

ও, নিনা তাহলে জানে না ব্ল্যাকফায়ার চার্লি টাসকানির কথা। আগের রাতে বাবার কাছে যা যা শুনেছি সব বললাম ওকে।

মাথা দুলিয়ে নিনা বলল, তাহলে তো এখনই খুলে দেখতে হয় ব্রিফকেসটা।

এখানে না। বাড়ি গিয়ে।

আচ্ছা, ধরো, এটাতে দলিলই পাওয়া গেল। কি করবে?

নিয়ে যাব হার্ব গ্যাটলিঙের কাছে। ও-ই ভাল বলতে পারবে কি করতে হবে।

আমার সঙ্গে একমত হলো নিনা, তা ঠিক। সোজা ওর বাড়িতে চলে গেলেই পারি?

না। রাত হয়ে গেছে। রোজ রোজ এ ভাবে বাড়ি না ফিরলে মা বকা দেবে। তা ছাড়া ব্রিফকেসে দলিলগুলো নাও থাকতে পারে। বাড়ি গিয়ে আগে দেখব। যদি দলিলই থাকে, তাহলে কাল সকালে প্রথম কাজটাই হবে আমাদের গ্যাটলিঙের বাড়িতে চলে যাওয়া।

কিন্তু সকালে তো আমার স্কুল।

 তাহলে দুপুরে কিংবা বিকেলে যাব। তুমি স্কুল থেকে ফিরে এলে। তোমাকে না নিয়ে যাব না।

কথা দিচ্ছ?

দিচ্ছি। হাজার হোক, তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। উফ, তুমি না গেলে আজ কি যে হতো…

আর কোন কথা হলো না আমাদের। দুজন দুদিকে চলে গেলাম। পাহাড়ী পথ বেয়ে নীরবে আমি নেমে চললাম আমাদের বাড়ির দিকে। বেশি দূরে নেই আর।

.

১৩.

 গল্প শেষ করে একে একে সবার মুখের দিকে তাকাল রবিন। দম নিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কি বুঝলে?

মুসা বলল, এতে আর বোঝাবুঝির কি আছে? ভূত।

 ফারিহা কিছু বলল না। নীরবে হাত বোলাচ্ছে টিটুর মাথায়।

কি বলতে গিয়ে আবার বোকা বনে যেতে হয় এই ভয়ে কোন মন্তব্য করল না। ফগ। বিড়বিড় করে শুধু বলল, ঝামেলা!

কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। কিছু বলছ না?

নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন দুবার চিমটি কাটল কিশোর। কি আর বলব? ভূতুড়ে কোন কিছুই আমি দেখছি না এর মধ্যে।

ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন। দেখছ না মানে? সমস্ত ব্যাপারটাই তো ভূতুড়ে!

মোটেও না, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কিশোর। বলতে পারো, অনেকগুলো প্রশ্ন জমা হয়েছে, যেগুলোর জবাব জানা দরকার। ঠিকমত জবাব পেলেই আর ভূতুড়ে থাকবে না একটা ঘটনাও। তাই না?

চুপ করে রইল রবিন।

ফগের দিকে তাকাল কিশোর। আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না?

 কোন্ ব্যাপারটা? অস্বস্তিতে পড়ে গেল ফগ।

এই যে এতগুলো ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটল। কোনটা কেন, বলতে পারবেন না?

ঝামেলা! আমাকে আবার এর মধ্যে টানছ কেন? আমি কি ওখানে ছিলাম। নাকি?

এ সব বোঝার জন্যে ঘটনাস্থলে থাকা লাগে না।

তাহলে তুমিই বলো না, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ফগ।

গ্রহণ করল কিশোর। হাত নাড়ল, বেশ, তাই বলছি। তবে ঘটনা ব্যাখ্যা করার আগে একটা কথা জানা জরুরী, রবিনের দিকে তাকাল সে, রবিন, ব্রিফকেসটার মধ্যে দলিলই ছিল তো?

হ্যাঁ। ইনডিয়ানদের, জবাব দিল রবিন।

নিশ্চয় হার্ব গ্যাটলিঙের কাছে নিয়ে গিয়েছিলে। দেখে কি বলল ও?

অনেক ধন্যবাদ দিল আমাদের। কাগজগুলো বার বার মাথায় ছোঁয়াল। বলল, ব্রিফকেসটা ওর কাছেই থাক। জায়গামত পৌঁছে দেবে দলিলগুলো।

তারপর?

অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল আমাদের কাছে। চলে এলাম আমরা। তার পরদিন আবার গিয়ে দেখলাম বাড়িতে নেই ও। দরজায় তালা। কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। আর কখনও ওকে দেখা যায়নি ওই অঞ্চলে।

আবার মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বুড়ো হয়েছিল তো, নিশ্চয় মারাটারা গেছে। হারলে ক্রীকে যাওয়ার আর সুযোগ পায়নি। ঠিক আছে, এখন রহস্যগুলোর জট ছাড়ানো যাক একে একে। প্রথমেই ধরা যাক, পায়ের ছাপের কথা। খোলা জায়গায় পায়ের ছাপ। শুধু কুকুরের। পাশে মাটিতে অদ্ভুত ঘষার দাগ। ঝোঁপের ডালপাতা ভাঙা। ওই ঘষা দাগ আর ঝোঁপঝাড় ভাঙা থেকেই নিশ্চিত বলে দেয়া যায়, ওগুলো ভূতের কাজ নয়। ভুত কখনও পায়ের ছাপ ফেলে না। ছায়ার মত যেখানে ইচ্ছে চলে যায়। এর একটাই ব্যাখ্যা, ঝোঁপঝাড় ভেঙে কুকুরটার সঙ্গে একজন মানুষও বেরিয়েছিল। আর সে ইনডিয়ান। কুকুরের পায়ের ছাপের পাশে তার নিজের পায়ের ছাপও পড়েছিল। ডাল ভেঙে পাতা দিয়ে ডলে সেগুলো মুছে দিয়েছিল। কেউ যাতে অনুসরণ করতে না পারে, সেজন্যে ওরকম করে নিজের চিহ্ন মুছে রেখে যায় ইনডিয়ান শিকারী।

ও, তাই তো! ওয়েস্টার্ন গল্পে পড়েছি এ সব কথা। কিন্তু আমাদের বাড়িটার দিকে নজর দিয়েছিল কেন সে?

এই প্রশ্নটার জবাবের ওপরই নির্ভর করছে পুরো রহস্যটার সমাধান। শোনো, হারলে ক্রীকে তোমরা যাওয়ার পরই নজর পড়েছিল লোকটার। কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, তোমার রক্তে সেনিকাদের রক্ত মেশানো আছে। নিজের জাতভাই ধরে নিয়েছিল তোমাকে সে। কোনভাবে গলার কালো মালাটা দেখেছিল। বুঝেছিল, দলিলগুলো যদি উদ্ধার করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়, সে তুমি। তাই তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। প্রথম দিনই কুকুরটা ঘটাল এক অঘটন। বনে থেকে শিকার করতে করতে নিশ্চয় ওর স্বভাব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কুনটাকে দেখে খুন করে বসল। চিৎকার শুনে তুমি বেরিয়ে পড়লে ঘর থেকে। ভয় পাচ্ছিলে। ওই সময় তোমার সঙ্গে কথা বলে সুবিধে হবে না। বুঝে ফিরে গেল লোকটা। 

কোথায়?

তার গোপন আস্তানায়।

 সেটা কোনখানে?

হবে মৃত্যুপুরীর আশপাশে কোনখানে। বনের মধ্যে।

 গুহার ভেতর নয় কেন?

কারণ, সে ইনডিয়ান। ওদের সমাজের নিয়ম-কানুন কড়াকড়িভাবে মেনে চলেছে। প্রথমত, কোন বীর যোদ্ধা ছাড়া মৃত্যুপুরীতে ঢোকার নিয়ম নেই। দ্বিতীয়ত, একমাত্র মৃত্যুর সময় হলেই কেবল ওখানে ঢুকতে হয়, তার আগে কোনমতেই নয়। তাই দলিলগুলো গুহার ভেতরে আছে জানা থাকা সত্ত্বেও ওখানে ঢুকে বের করে আনতে পারেনি সে, আনার সাহস হয়নি। গুহার কাছাকাছি থেকেছে, কুকুরটাকে দিয়ে পাহারা দিয়েছে যাতে ওদের গোত্রের বাইরের কেউ ব্রিফকেসটা বের করে আনতে না পারে। সেই লোক জানত, গুহার ভেতর মরে পড়ে আছে সেনিকা সর্দার চার্লি টাসক্যানি। কোন কারণে ব্রিফকেসটা লোকটার হাতে দিয়ে যেতে পারেনি সর্দার। এমন হতে পারে, দলিলগুলো আনার পর লোকটা তার কাছাকাছি ছিল না। হঠাৎ করে সর্দার বুঝতে পারল, তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর কোন। উপায় না দেখে, ব্রিফকেসটা তুলে দেয়ার মত বিশ্বস্ত কাউকে হাতের কাছে না পেয়ে ওটা নিয়েই মৃত্যুগুহায় মরতে চলে গেল সে। যেহেতু সর্দার, সেও নিশ্চয় সেনিকা বীর ছিল।

যাই হোক, তোমাকে আর নিনাকে সুড়ঙ্গে ঢুকতে দেখল কুকুরের মালিক। কাকতালীয়ভাবে কুকুরটাও ওই সময় ঢুকে বসেছিল সুড়ঙ্গে। তাড়া করল ওটা তোমাদের। ঘেউ ঘেউ করে সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দ পাথর ধস নামিয়েছিল। এটা স্বাভাবিক। অনেক সুড়ঙ্গেই শব্দ ওভাবে ধস নামায়। তোমরা বেরিয়ে চলে এলে। কুকুরটা তোমাদের গাছ ঘিরে চক্কর দিতে থাকল। রাতের কোন এক সময়ে ওটাকে ডেকে নিয়ে গেল ওটার মালিক।

পরদিন শামানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তোমরা। আমার ধারণা, শামানের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও তোমার কথা ওকে বলার সুযোগ পায়নি তখনও কুকুরের মালিক। শামান তাই তোমার গলায় কালো মালা দেখে চমকে উঠেছিল। সেও বুঝেছিল, তোমাকে দিয়ে দলিলগুলো বের করানো সম্ভব। সরাসরি ওগুলো এনে দেয়ার কথা বলার সাহস পায়নি। কারণ তখনও বিশ্বাস করতে পারেনি তোমাকে। তুমিও শ্বেতাঙ্গ। যদি বেঈমানী করো? তাই ভুতুড়ে কুকুরের ভয়টা ভাঙেনি। বলেছিল সেনিকাদের জিনিস ওদের ফিরিয়ে না দিলে কুকুরটা পিছু ছাড়বে না তোমার। সত্যি ছাড়ত না, যতদিন তুমি বের করে না আনতে। ব্রিফকেসটা শামানকে দিয়ে আসার পর কি আর ওটা তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল?

মাথা নাড়ল রবিন, না।

বললাম না। যাই হোক, তোমার সাহস দেখে আরও নিশ্চিত হলো কুকুরের মালিক, তুমি সত্যি বের করে আনতে পারবে ব্রিফকেসটা। তাই ঝড়ের রাতে। আবার গেল তোমাদের বাড়িতে। ডাকাডাকি করল। কিন্তু ভয় পেয়ে তুমি আর বেরোলে না। ঘরে ঢুকে কথা বলার সাহস হলো না ওরও। ফিরে গেল।

পরদিন সকালে বাড়ির আশেপাশে কোন পায়ের ছাপ দেখলে না তুমি। অত বৃষ্টি আর কাদাপানিতে ছাপ কি আর থাকে নাকি। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

 তারপর গিয়ে বের করে আনলে ব্রিফকেসটা। শামানকে দিয়ে দিলে। চলে গেল সে। ওটার জন্যে সেও কুকুরের,মালিকের মত অপেক্ষা করছিল ওই বনে। পাওয়ার পর দুজনেই চলে গেল নিজের লোকেদের হাতে তুলে দিতে। এই হলো মোটামুটি গল্প। এখনও কি মনে হচ্ছে এর মধ্যে ভূতুড়ে কিছু আছে?

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন। আচ্ছা, কুকুরের মালিকটা কে বলো তো? সর্দারের ছেলে?

হাসল কিশোর, তাতে কি কোন সন্দেহ আছে? বাবা যেদিন মৃত্যুগুহায় চলে যায়, নিশ্চয় সেদিন বাড়ি ছিল না সে। সেবারের পর আর কখনও যাওনি হারলে ক্রীকে?

গেছি। বেশ কিছু ইনডিয়ান ফিরে এসেছে। বাড়ি করে বাস করছে। সর্দারের ছেলে কোনজন, জানতে পারিনি। কালো কুকুরটাকেও দেখিনি।

এমন হতে পারে, শামানের মতই আর হারলে ক্রীকে থাকতে আসেনি সর্দারের ছেলেও। ওদের একটা গোপন মিশন ছিল, দলিলগুলো উদ্ধার করা। তোমার সাহায্যে ওগুলো বের করে নিজের লোকের হাতে তুলে দিয়ে ওরা চলে গেছে অন্য কোনখানে। হতে পারে না এটা?

মাথা ঝাঁকাল রবিন। পারে। আর মাত্র দুটো প্রশ্নের জবাব দরকার। এক নম্বর প্রশ্ন–কেন মনে হয়েছিল আড়ালে থেকে কেউ নজর রাখছে আমার ওপর?

মনে হয়েছিল, তার কারণ সত্যি রাখা হচ্ছিল। সতর্ক থাকলে মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এ সব টের পায়। সর্দারের ছেলে লুকিয়ে থেকে নজর রাখছিল তোমার ওপর। শত শত বছর ধরে বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে বাস করে লুকিয়ে থাকার এক অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছে ওরা। ওরা লুকালে বনের জন্তু-জানোয়ারেই দেখতে পায় না, তুমি দেখবে কি?

আস্তে আস্তে মাথা দোলাল রবিন, হু। আমিও শুনেছি এ সব কথা। ঠিক আছে, মেনে নিলাম। এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দাও। পাহাড়ের মধ্যে আমার নাম ধরে কে ডাকছিল?

ওটা, আমার বিশ্বাস, বাতাসের কারসাজি। পাহাড়টাতে অনেক ফাটল আছে, তোমার কথাতেই বোঝা গেছে। নানা জায়গায় ওপর থেকে পানি পড়তে দেখেছ। ওরকমই কোন একটা ফাটল দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার সময় বিচিত্র শব্দ হয়, তোমার মনে হচ্ছিল তোমার নাম ধরেই ডাকছে।

তাই?

হ্যাঁ। কেন, প্রমাণ করতে যেতে চাও?

না বাবা, দুহাত নেড়ে বলল রবিন, ভূত থাকুক বা না থাকুক, আমি ওই মৃত্যুপুরীর ধারেকাছে নেই আর! একবারই যথেষ্ট। যত খুশি শব্দ করুকগে গুহাটা, আমার তাতে কি?

ফগের দিকে তাকাল কিশোর। চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে শুনছে পুলিশ। কনস্টেবল। ও তাকাতেই চঞ্চল হয়ে গেল চোখের তারা। ফগকে খোঁচানোর জন্যে কিশোর বলল, মিস্টার ফগর‍্যাম্পারকট, যাবেন নাকি ওই পাহাড়ে? চলুন না গিয়ে দেখে আসি কিসে শব্দ করে? খানিক আগে না বললেন রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন?

গলা খাকারি দিল ফগ। অহেতুক কাশল। বিড়বিড় করে বলল, ঝামেলা! আমাকে নিয়ে আবার টানাটানি কেন?

মুচকি হাসল কিশোর, ভয় পেলেন নাকি?

ভূতকে ভয় পাব আমি? আর লোক পেলে না, আবার কোন বেকায়দা প্রশ্নে ফেঁসে যায় এই ভয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল ফগ। ইস, অন্ধকার হয়ে গেল যে। ওদিকে কত কাজ পড়ে আছে। দরজার দিকে রওনা হলো সে।

পেছন থেকে ডেকে বলল মুসা, চলে যাচ্ছেন যে? আপনার অভিজ্ঞতার কথা শোনাবেন না?

ফিরল না ফগ। দরজার কাছে গিয়ে জবাব দিল, আহ, ঝামেলা! আজ না, আরেকদিন।

বেরিয়ে গেল সে।

মুখ বাঁকিয়ে ফারিহা বলল, ওর অভিজ্ঞতা না কচু। ও কোত্থেকে ভূত দেখবে? নিজেই তো ভূত হয়ে বসে ছিল একবার। আসলে জানতে এসেছিল, কোনও কেসের তদন্ত করছি কিনা আমরা। মাঝখান থেকে বিনে পয়সায় গল্পটা শুনে গেল।

খেক! খেক! করে উঠে যেন বলতে চাইল টিটু, আমি তো তখনই চেয়েছিলাম পায়ে কামড়ে দিয়ে আগাম পয়সা শোধ করে নিতে, তোমরাই তো দিলে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *