কৌতুক-নকশা
ভানুশ্বরানন্দ
প্রথম পর্ব
গান :
ভজ, দু-হাত তুলিয়া ভজ, কাঞ্চন গোঁসাই
তারই জোরে সবে তোমায় বাপ ডাকবে ভাই।
থাকলে তিনি ট্যাঁকের মাঝে বুকে বাড়ে বল
(দেখবে) স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বন্ধু তোমার পদতল।
(আহা!) টাকাই ধর্ম, টাকাই কর্ম কলিযুগের সার
সত্যনিষ্ঠা, আইন কানুনের মাথায় ঝাটা মার
(সুধীনের প্রবেশ)
সুধীন—আরে-আরে দেখি, লর্ড ভানু না!
ভানু—ওঁ কাঞ্চনং গোঁসাইয়ং আত্মসাতয়ং ভবতু।
সুধীন—নাও ঠ্যালা, এ আবার কী কাণ্ড লর্ড ভানু? ঘরবাড়ি ছাইরা একেবারে গাছতলায়?
ভানু—অখন আর লর্ড নাই। লর্ড ছাইরা অখন রোড-ভানু হইছি। আর জনগণের সেবায় নিজেরে বিলাইয়া দিতে আছি—নাম লইছি ভানুশ্বরানন্দ।
সুধীন—তাই বইলা সব ছাইরা দিয়া—
ভানু—দূর ভাই! জগতের নিয়ম বিস্তর পালটাইছে। সব কিছু বেশি কইরা পাইতে হইলে অখন একমাত্তর এই গেরুয়া লাইনটাই খোলা। ভারতবর্ষের যেইখানেই যাও গেরুয়ার মাইর নাই—আয়কর নাই, পৌরসংস্থার ঝামেলা নাই, লোডশেডিং-এর বালাই নাই। মাথার উপর কেবল উন্মুক্ত আকাশ।
সুধীন—তোমার শরীরও তো খুব খারাপ দেখতে আছি। একটু ওষুধ পত্তর খাও। সকালে উইঠা একটু হাঁটাহাঁটি করো।
ভানু—আরে ভাই হাঁটতে গিয়াই তো বিপদ।
সুধীন—কীসের বিপদ?
ভানু—সকালে টাইম ঠিক কইরতে না পাইরা রাইত তিনটায় বাইরে পরছি। তারপর ভাইরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে গাছের তলায় দেখি তিন রাজপুরুষ অর্থাৎ রাজপোশাক-পরা তিনজন লোক। আমি ভাইবলাম কোন থিয়েটার-যাত্রার লোক বোধ হয় মাইর খাওনের ভয়ে পলাইছে। কাছে আওগাইলাম। তারপর তাগো লগে কথা-বাত্তা হইল—তা টেপ কইরা রাখছি। এই শোনো : (আওয়াজ)
ভানু—আপনারা কে?
নাদীর—আমি নাদীর শা।
ভানু—নাদীর শা? সেই পারস্যের?
নাদীর—হ্যাঁ, আমার ডাইনে তৈমুরলঙ্গ, বামে সুলতান মামুদ। আর ওই যে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছেন উনি ওয়ারেন হেস্টিংস।
ভানু—তা আপনারা এইখানে?
নাদীর—যমরাজা আমাদের পাঠিয়েছেন দেখতে—ভারতবর্ষের যে ক্ষতি আমরা করেছি এখন সেই ভারতবর্ষের অবস্থা কী?
ভানু—কী দেখলেন?
নাদীর—নিজেরা নিজেদের দেশের লোককে যেভাবে ঠকাচ্ছে আর দেশের লোকের মাথায় যেভাবে লাঙল চালাচ্ছে তার তুলনায় আমাদের অপরাধ শিশুসুলভ চপলতা মাত্র।
ভানু—তাহলে এখন আপনাগো মুক্তি….
(তিনজনের হাসি হা:—হা:/ টেপের আওয়াজ বন্ধ)
গান—ভজ, দু-হাত তুলিয়া…
সুধীন—তখন থিকা দেখতে আছি গানের ফাঁকে ফাঁকে কেবল কাইপা কাইপা উঠতা আছ—ক্যান ভাই?
ভানু—কাপি কি আর সাধে রে ভাই—বউ যে গোপনে চিমটি মারে।
বউ—না চিমটি মারব না—কাস্টমার আইয়া পরছে দেখো না?
(গুঞ্জন : আপনারা লাইন দিন…)
ভানু—ভাইরে, চুপচাপ পাশে বইসা দ্যাখ লাইনের মাহাইত্ম।
বউ—আসেন, ফাসজন আসেন…।
১ম জন—বাবা, সারাটা জীবন পিংপিং মানে টেবিল-টেনিস খেলার জন্যে উৎসর্গীকৃত আমার প্রাণ। জানেন বাবা—
বউ—বাবায় জানব পরে। আগে ঝুলিতে আট টাকা ফেলেন।
সুধীন—সে কী! এক্কেবারে বারো টাকা থিকা আট টাকায় নাইমা আইলে ক্যান?
ভানু—আগেই কইছি—কোনওরকম ট্যাক্স নাই। তাছাড়া জনগনের সেবার দিকটাও তো আমাকে দেখতে হইব। হ, টেবিল-টেনিসবাবু আপনে কন।
১ম জন—বাবা এইবার যা খেলা দেখলাম চিন আর জাপানের—তাতে আমাদের ছেলেপুলেদের কোনও আশা আছে বলে তো মনে হয় না। আপনি কী বলেন?
ভানু—আশা পুরা আছে। বুদ্ধি থাকলেই সম্ভব।
১ম জন—কী রকম—কী রকম?
ভানু—আপনাগো চোখ নাই। লক্ষ করছেন চিনা-জাপানি যত খেলোয়াড়, তাগো সব চোখ ছোট। হাসলে তাগো চোখ আরও ছোট হয়—লক্ষ করছেন? সুতরাং এইদিক থিকা কাতুকুতু অথবা সুড়সুড়ি দিয়া হাসাইতে পারে এই রকম লোক ‘ফিট’ করেন। তবে ওরা আরও হাসব। চোখে আরও ছোট হইতে হইতে বন্ধ হইয়া যাইব। তখন আর কি—মারেন চাপ, মারেন চাপ। জিৎ নিশ্চিৎ।
বউ—নেক্সট—
২য় জন—চিৎকার করতে করতে প্রবেশ। বাবাজি…বাবাজি…
ভানু—অ্যাই—অ্যাই ঠ্যাং ছারো। সুড়সুড়ি লাগে।
বউ—ঝুলিতে আট—
২য় জন—আমার কাকা জানতে চাইল আজ তার শ্রাদ্ধ—শ্রাদ্ধটা কেমন হবে?
ভানু—যার শ্রাদ্ধ সে জানতে চাইল—আগো করো কী? ইয়ারকি মারো?
২য় জন—আজ্ঞে না। আজকে ময়দানের ফুটবল খেলায় আমার কাকা রেফারি কিনা—।
ভানু—অ—দেখি আইজকের কাগজটা।…না:, আইজ বিশেষ সঙ্কট নাই। ষোড়শ একদ্দিস্টর উপর দিয়াই চইলা যাইব। তবে আসছে শনিবার যেই দুই দলের খেলা জানো? তাতে যেন প্রাণ গেলেও তোমার কাকায় রেফারি হইতে রাজি না হয় বাছা। কারণ সেই দিন এক্কেবারে রেফারির বৃষোৎসর্গ কইয়া ছাইরব। বউ—নেক্সট
৩য় জন—এই নিন ঝোলায় আট। বাবা আমি ঝিঙেডাঙা স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে জড়িত। বয়স ৭৩। বড় মন:কষ্টে আছি।
ভানু—ক্যান—মন:কষ্ট ক্যান?
৩য় জন—দেখুন, আগে তবু অলিম্পিকে ভারতবর্ষে হকি মারফত সোনা পাওয়ার আশা ছিল। এখন তো তাও প্রায় যায়। এর কোনও উপায় হয় না বাবা?
ভানু—এইবার পাইবেন। আমি অলিম্পিক কমিটিতে চিঠি লিইখা দিছি একটা নতুন আইটেম-এর জন্য। সোনা আমাগো সিওর।
৩য় জন—কী আইটেম বাবা?
ভানু—আরে সাংঘাতিক আইটেম, এই আইটেম ইনক্লুড করলে সোনা মারে কে?
৩য় জন—কী এমন আইটেম?
ভানু—আইটেম হইল স্পিড।
৩য় জন—স্পিড?
ভানু—গত অলিম্পিকে ৪৪০ মিটার কাবার করছে যে রেকর্ড টাইম-এ তার থিকাও বেশি স্পিডে আমাগো দেশে এক-একজন নেতা দল বদল করে।
.
দ্বিতীয় পর্ব
(গুঞ্জন—বুড়ির বে-লাইনে ঢুকে পড়ায়—)
বিধবা—আছেলে, এইখানেও লাইন?
বউ—নেক্সট—নেক্সট—
ভানু—আসেন, আসেন—আউগাইয়া আসেন। ঝুলিতে আট—
বিধবা—পিছা মার তোর ঝুলিতে আট—
জনতা—আরে কী বলেন দিদিমা?
বিধবা—কমু না। যেখানেই যাও লাইন। রেশন-এ লাইন, কয়লায় লাইন, দুধের ডিপোতে লাইন, কেরাসিনে লাইন, পোড়া কপাল সাধুতেও লাইন। পিছা মার অমন সরকারের মুখে।
জনতা—সর্বনাশ! দিদিমা, ও কথা মুখেও আনবেন না। শেষকালে একেবারে জেলে পুরে দেবে।
বিধবা—অ্যা:, জেলে পুরব। আ-আসুক, নেউক না জেলে। ছাগল—তোর যেমন বুদ্ধি। সব বিধবাগো যদি সরকার জেলে ঢুকায় তাইলেই সরকারের হইয়া গেল।
জনতা—কেন—কেন—?
বিধবা—আমার মতন সব বিধবা বুড়িগো জেলে ঢুকাইব?
জনতা—এরকম কথাবার্তা বললে তো জেলে ঢোকাবেই।
বিধবা—তুই শুধু ছাগল না, ছাগলগো নেতা। আরে সামনে আম্বাবুচী না—। জেলখানায় অত ফল সাপ্লাই করব কই থিকা?
বউ—নেক্সট—নেক্সট—। ঝুলিতে আট—
লোক—আট টাকা তো দিলুম।
বউ—কই দিলেন?
লোক—বা:—এইতো এইখানে ফেললুম।
বউ—ফেললুম! তবে কই গেল টাকা?
ভানু—ও—এই যে আমার পায়ের তলায় ঢুইকা গেছে।
বউ—ঢুইকা গেছে? এইর মধ্যেই টাকা সরানোর তাল! তোমারে আমি চিনি না। দেও টাকা ঝুলিতে—।
ভানু—(কেশে…) হ—কন।
লোক—বাবা, আমাদের গ্রামে বড্ড চুরি বেড়েছে একটা কিছু উপায় বাৎলান বাবা।
ভানু—এর আর আমি কী উপায় বাৎলামু। সাহেব সাধুরাই তো কইয়া গেছে।
লোক—কী বাবা?
ভানু—চোর তো চুরি করিবেই। কিন্তু গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হইবে। নেক্সট—নেক্সট—
বউ—ঝুলিতে আট—
৪র্থ জন—এই নিন বাবা।
ভানু—কও, সমস্যার কথা কও।
৪র্থ জন—সমস্যা বিস্তর। কোনটা দিয়ে শুরু করি তাই ভাবি।
ভানু—ভাবেন পরে। অখন যে কোনটা দিয়া শুরু করেন। পিছনে বিস্তর কাস্টমার খাড়াইয়া আছে।
৪র্থ জন—বাবা, একটু-আধটু তবলা বাজানো আমার অভ্যেস। আপনার তো অনেক জানাশোনা, যদি কাউকে একটু বলে দেন আপনি।
ভানু—ঠিক আছে, নাম লিইখা যান। পরে দেখুম।
৪র্থ জন—আজ্ঞে আমার নাম কণিষ্ক রায়।
ভানু—আচ্ছা কণিষ্ক—রও, রও। কী নাম কইলা?
৪র্থ জন—কণিষ্ক রায়।
ভানু—(আচমকা চিৎকার) গিন্নী—গিন্নী—
বউ—কী হল, চিল্লাও কেন?
ভানু—অরে ফেরত দাও আট টাকা। শিগগির ফেরত দাও।
বউ—ক্যান?
ভানু—আরে দূর! টাকা তো আমাগোরই ওনারে দিতে হইব।
৪র্থ জন—কেন?
ভানু—আরে মশায় আপনে তো মহাপুরুষ!
৪র্থ জন—মহাপুরুষ?
ভানু—নিশ্চয়। মুন্ডুওয়ালা কণিষ্ক তো এই প্রথম দেখলাম।
বউ—নেক্সট—ঝুলিতে আট—
৫ম জন—বার করছি ঝুলিতে আট। পরশু দিন আমাকে বলেছেন আমার ছেলে হবে। হয়েছে মেয়ে।
ভানু—তা আমি কী করুম। এইটা তো ভগবানের মিসটেক।
৫ম জন—ইয়ারকি বার করে দেব। আমার আট টাকা ফেরত দিন।
ভানু—(হেসে) পাগল, তা কি হয়!
৫ম জন—হয় না মানে?
ভানু—এই বিষয়ে তো আমার গুরুভাই জহরানন্দ আগেই বইলা গেছে—দ্যাওতো ঝুলিটা।…এইটা কী?
৫জন—টুথপেস্ট।
ভানু—মাইরলাম টিপ—কী বাইরইল?
৫জন—কী আবার, পেস্ট।
ভানু—এইবার এইটারে ভিতরে ঢুকাইয়া দ্যান।
৫ম জন—দূর মশাই! তাও কি কখনও হয়?
ভানু—অ্যই তো, সেই জন্যই বলি টাকা যদি একবার বাইরয় সেই টাকা ফেরত ঢোকে না।
ভজ দু’হাত তুলিয়া ভজ, কাঞ্চন গোঁসাই
বাইরইলে টাকা ফিরত ঢোকা কোনও শাস্ত্রে নাই।
বউ—নেক্সট—
রবি—এই মশাই…আগে যাবেন না মারব ঝাপড়।…এই নিন আট টাকা।
বাচ্ছা—এই শালা সাধু।
ভানু—এ কী!
বাচ্ছা—চোপ শালা সাধু।
ভানু—আরে মশয়, কারে ট্যাকে কইরা লইয়া আইছেন?
রবি—আমার বোনের ছেলে—মানে ভাগনে।
বাচ্ছা—এই সাধু, কলা খাবি?
ভানু—কলা তোর মামারে খাওয়া, বান্দর।
বাচ্ছা—তুই শালা বাঁদর।
ভানু—ওই—এক্কেবারে থাপরাইয়া ফাটায়ে দিমু।
রবি—কাকে ধমকাচ্ছেন?
বউ—বোঝো না কারে ধমকায়? একটা অজাত ভাইগনা লগে লইয়া আইছ।
রবি—মুখ সামলে কথা বলবেন, কাকে কী বলছেন? ও হল বাঘের বাচ্ছা।
ভানু—কী বাচ্ছা—?
রবি—বাঘের, সুন্দরবনের বাঘের বাচ্ছা।
বউ—বাঘের বাচ্ছা তো খাঁচায় রাখেন নাই ক্যান?
রবি—ঠিক আছে, ঠিক আছে। শুনুন—
বাচ্ছা—এই শালা সাধু—
ভানু—ও মশয়, এইবার কিন্তু ত্রিশূল ঢুকায়ে দিমু।
রবি—মুখ সামলে কথা বলবেন। বাঘের বাচ্ছাকে ত্রিশূল ঢুকিয়ে দেখুন না।
ভানু—দেখেন আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে বাইধ্য করতে আছেন, আপনের ভাইগনা যদি সত্যি বাঘের বাচ্চা—তেইলে জিজ্ঞাসা করতে আছি—
রবি—করুন না মশাই প্রশ্ন।
ভানু—আপনের বোন সুন্দরবন গিছিল না বাঘটা আপনাগো বাড়িতে আইছিল?
(সমবেত হাসি—হা:—হা:)
রবি—দূর শালা। চল বিচ্ছু।
বউ—নেক্সট—
রুবি—এই যে, অরুণ কোথায়?
ভানু—ঝুলিতে আট—
রুবি—রাখুন মশাই ঝুলিতে আট। আগে বলুন অরুণ কোথায়?
ভানু—ঝুলিতে—
রুবি—আবার ঝুলিতে? আগে বলুন, অরুণ কোথায়?
ভানু—অত চিৎকার কইরা কথা কও ক্যান? জানো—রাগলে আমার জটা খাড়াইয়া যায়।
রুবি—আপনি জানেন আমার কাছে বড় কাঁচি আছে। কচ করে কেটে দেব জটা।
ভানু—কী—এত সাহস?
রুবি—চুপ। যে প্রশ্ন করেছি উত্তর দিন আগে। অরুণ কোথায়?
ভানু—বাবা! এ তো মাইয়া নয় যেন বোম্বাই মরিচ!
বউ—(ফিস ফিস করে) আগো করো কী? এই তো—রুবি। আমাগো অরুণের লগে প্রেম করে।
ভানু—আঁ—, নাকি? আগে কইবা তো। আসো, কাছে আসো, কী কও মা?
রুবি—অরুণ কোথায়?
ভানু—ক্যান? বোধ হয় বাড়িতেই আছে। বাড়িতে দেখছ?
রুবি—দেখেছি। সমস্ত চারু অ্যাভেনিউ তছনছ করে ফেলেছি—কোথাও নেই। টাইম দিয়ে টাইম রাখে না।
ভানু—আইচ্ছা কওতো মা—অরুণ তোমারে কখন আইতে কইছিল?
রুবি—আমাকে এগারোটায় আসতে বলেছিল। ঠিক এগারোটায় এসেছি।
ভানু—এগারোটায় আইতে কইছিল? তাইলে তুমি একটা দশ-এ আইস।
রুবি—বাবা! যেমন ছেলে তেমন বাবা। সাড়ে এগোরোটা, নয় বারোটা নয়—একেবারে একটা দশ-এ কেন?
ভানু—তাইলে তোমারে খুইলাই কই—অরুণ যখন জন্মায় তখন ডাক্তারে কইছিল নয়টায় জন্মাইব। কিন্তু জন্মাইছে এগোরোটা দশ-এ। হে:—হে:—হে:। জন্মের সময় ওই যে দুই ঘণ্টা দশ মিনিট লেট সেইটা আর জীবনে কভার করতে পারল না।
(সমবেত হাসি/…গান)
এমন দিনও আসবে
প্রথম পর্ব
বৃন্দা—খাইছে। এ আমি কোনখানে আইলাম?
টেপী—আপনি…আধ্যাত্মিক মনোন্নয়ন এবং সংকীর্ণতা বর্জন ও ভগবান স্মরণী আশ্রমে এসেছেন।
বৃন্দা—খাইছে! তা এই আশ্রমের মোহন্তটা কে?
টেপী—ওই যে, মোহন্ত শ্রীমৎ নবীনানন্দ উচ্চস্থানে ব্যাঘ্রচর্মাসনে বসে দিকে দিকে তাঁর দিব্যজ্যোতি বিকিরণ করছে।
মোহন্ত—জয় তারা।
বৃন্দা—আগে দশটা টাকা সাফ জায়গায় রাইখা লন তারপর তারার নাম লইবেন।
মোহন্ত—বৎসে টেপীরাণি, নবাগতকে বিষয়টা ক্লিয়ার করে বলতে বলো।
বৃন্দা—এর আবার কিলিয়ার ফিলিয়ার কী? আমার দুইটা বান্ধাইনা দাঁত আছিল, সেই দুইটা ছিটকাইয়া ট্রাম লাইনে পইরা গুড়া হইয়া গেছে—দাঁত দুইটার মূল্য দশ টাকা, সেইটা আগে দিয়া দ্যান, পরে কথা হইব।
মোহন্ত—ছিটকেই বা পড়ল কেন আর আমি টাকাই বা দেব কেন?
বৃন্দা—খাইছে, কয় ছিটকাইয়া পড়ল কেন? আশ্রমের এইরকম দাঁত-ভাঙা নাম কেউ রাখে? নাম উচ্চারণ করতে গিয়াই তো এই দুর্ঘটনা—কী নাম রে বাবা? আধ্যাত্মিক মনোন্নয়ন এবং সংকীর্ণতা বর্জন—গেল, খাইছে, এইবার বুঝি আমার অরিজিনাল দাঁত আরেকটা খুইলা গেল।
মোহন্ত—করেক্ট। আমার আশ্রমের নামটা পড়তে এরকম দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। তা দাঁত দুটো তো তোমার নিজের ছিল না, বাঁধানো। হারিয়ে যাবার জন্য দু:খ কোরো না। একদিন তো তুমি নিজেই হারিয়ে যাবে বৎস।
বৃন্দা—খাইছে, এ দেখি আবার বৎস কয়।
মোহন্ত—সাধু মোহন্তরা সকলকেই বৎস বলে থাকে, বৎস—।
টেপী—এবং ইহাই শাস্ত্রীয় বিধি। অনেক সময় উনি নিজেকেই বৎস বলে ফেলেন।
মোহন্ত—করেক্ট। তখন আমি নিজেকে একজন থার্ড পারসন বলে ভাবি।
টেপী—এবং সিংগুলার নাম্বার।
বৃন্দা—খাইছে, এ তো দেখি হালার পাঠশালায় ভর্তি হইলাম।
মোহন্ত—করেক্ট। এটাকে একটা পাঠশালাও বলতে পারো, এখানে অধ্যাত্মবাদ শিক্ষা দেওয়া হয়।
বৃন্দা—কয় কী, সারাজীবন ধইরা এত বেটারে শিক্ষা দিলাম, অখন বুড়া বয়সে আমি শিক্ষা লমু। খাইছে, কী দেখিলাম, কী হেরিলাম—আরে তুই কে? আমাগো টিক্কা না?
মোহন্ত—করেক্ট। নো—নো—নট করেক্ট, আমি টিক্কা নই, আমি মোহন্ত নবীনানন্দ।
বৃন্দা—(সুর করে) আর লুকাবি কোথা মা কালী আর তো তুই লুকাইতে পারলি না রে আমি তোর ‘করেক্ট করেক্ট’ শুইনাই তরে চিইনা ফালাইছি রে, টিক্কা। হালায় বুড়া বয়সে নবীনান্দ সাইজা বইছ। শোনো, তোমরা সবাই শোনো, তোমাগো এই যে মোহন্ত, অর আসল নাম হইল টিকেন্দ্র নারায়াণ চাকলাদার। অর বাপের নাম হইল বিদ্যুৎকেন্দ্র—না ভুল হইল—বিদ্যুতেন্দ্র চাকলাদার।
বৃন্দা—কী রে টিক্কা, আমারে চিনলি না, আমি বৃন্দাবন তালুকদার। মনে আছে আমাগো পাড়ায় ফুলিরে দেইখা টিটকারি দিছিলি, তারপর তরে পানাপুকুরে চুবাইছিলাম। তুই তো ছোটবেলা থিকাই লোচ্চা প্রকৃতির—সাধু হইলি কেমনে? খাইছে, কারে কইতাছি, ও দেখি চোখ বুইজা থাকে।
টেপী—উনি এখন ধ্যানস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আপনি কার নামে কী বলছেন জানেন না।
বৃন্দা—চোপ। কইয়াই যখন ফালাইছি তখন বাকিটাও শোনো। অর দুশ্চরিত্রের লিগা অর সতীলক্ষ্মী স্ত্রী বিষ খাইয়া আত্মহত্যা করছে, জনগন তাই জানে—আসলে ও-ই বিষ খাওয়াইয়া মারছে।
মোহন্ত—জয় তারা।
টেপী—উনি জেগেছেন।
বৃন্দা—জাগবই, অর সব কথা কইলে খারাইয়া উঠব।
মোহন্ত—বৎসে টেপীরানি, তুমি সবাইকে নিয়ে অন্ত:পুরে গমন করো। আমি এই নবাগতর সঙ্গে একটু কথোপকথন করে নি।
বৃন্দা—হ, তোমরা এখন অন্ত:পুরে গমন করো।
টেপী—গুরুভাই, গুরু ভগ্নীগণ, চলুন, আমরা অন্ত:পুরে যাই।
মোহন্ত—বৃন্দা, তুই একটা গাধা।
বৃন্দা—ঠিক। নইলে তরে চিনলাম কেমনে।
মোহন্ত—তুই আমার শিষ্য-শিষ্যাদের সামনে—
বৃন্দা—তুই আগে চিনা দিলি না ক্যান? তাইলে তো কুনো কথাই কওন লাগত না। টেপী বুঝি হেও শিষ্যা, বুড়া বয়সে তো ভালোই বাজাইছস।
মোহন্ত—ওসব কথা থাক। তা হঠাৎ এখানে এসে উদয় হলি কোত্থেকে?
বৃন্দা—তাইলে গোরা থিকা কই—আমার চাইর পোলা আর দুইখান মাইয়া।
মোহন্ত—জয় তারা। তুই করেছিস কী বেন্দা?
বৃন্দা—আরও হইতো—
মোহন্ত—অ্যাঁ?
বৃন্দা—হ, এগারো নম্বরের সময় গিন্নী মইরা গেল নাইলে একটা পুরা ফুটবল টিম হইয়া যাইত।
মোহন্ত—আবার বিয়ে করেছিলি?
বৃন্দা—আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা কইছিল, আমি বিরত থাকলাম। যাউক, এখন শোন আমার ইতিহাস—মাইয়াগুলিরে তো বিয়া দিছি, বড় তিন পোলারেও লেখাপড়া করাইয়া মানুষ কইরা বিয়া দিয়া দিছি, কিন্তু দু:খের কথা কী জানস—তিন পোলাই বিয়ার পর যার যার বউ লইয়া বাড়ি ছাইরা চইলা গেল।
মোহন্ত —জয় তারা। তাহলে এই বুড়ো বয়সে একা একা তোর তো বড় কষ্ট বেন্দা।
বৃন্দা—না, কোনও কষ্ট নাই। ছোট পোলা আমারে রাজার হালে রাখছে—এই পোলার বিয়ার লিগাই তর এইখানে আইছি—পাত্রীর বাবা নাকি তর খুব ভক্ত—তর এইখানেই আইজ মাইয়া দেখানের কথা।
মোহন্ত—করেক্ট। তুই রজনী রায়ের মেয়ের কথা বলছিস? হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আজই তো তার মেয়ে নিয়ে এখানে আসার কথা। তা তোর এই ছেলেটি কী করে?
বৃন্দা—খাইছে, করে কী মানে? আমার ছোট পোলা হইল হাওড়ার মুকুটহীন সম্রাট—হাওড়ার এই মাথা থিকা ওই মাথা অর ভয়ে কম্পমান—ভালো নাম বামাপদ তালুকদার—ডাক নাম পাকিস্তান।
মোহন্ত—পাকিস্তান? সে কী!
বৃন্দা—যেই বছর পাকিস্তান হইল সেই বছর ভূমিষ্ঠ হইছিল, সেই লিগা স্মৃতি হিসাবে নাম রাখছি পাকিস্তান। ওই নামেই এখন ভারতবিখ্যাত।
বৃন্দা—ওয়াগান ব্রেকার কও, ছিনতাই পার্টি কও, সব ওর হাতের মুঠার মধ্যে—আমি তো রাস্তায় বুক ফুলাইয়া চিৎ হইয়া হাঁটি—বাজারে গিয়া ইলশা মাছ তুইলা লইয়া আসি, মাছওয়ালা চাইয়া থাকে।
মোহন্ত—সে কী! কিছু বলে না!
বৃন্দা—কইব! আমি পাকিস্তানের বাপ না?
মোহন্ত—জয় তারা। তা তোমার এই গুণধর পুত্রটিও এখানে আসছে তো?
বৃন্দা—নিশ্চয়ই। পোলায়ই যদি মাইয়া না দেখল তাইলে তো আজকাল চলে না।
মোহন্ত—তা সে আসবে কখন?
বৃন্দা—আইতো তো আমার লগেই, কিন্তু অর বিরুদ্ধে পার্টির ওই ডঙ্কা আমাগো পাড়া অ্যাটাক করব শুইনা পাকিস্তান আমারে কইল—বাবা তুমি যাও, আমি ডঙ্কার হাত-পাগুলান অর প্যাটের মইধ্যে ঢুকাইয়া দিয়া আইতাছি।
মোহন্ত—এই যে, এসো, এসো, রজনী এসো।
রজনী—চরণে স্থান দিন প্রভু।
মোহন্ত—কল্যাণমস্তু। এই তো তোমার মেয়ে চণ্ডী, তাই না?
রজনী—আজ্ঞে আমার নয়, শ্রীভগবানের।
মোহন্ত—করেক্ট। তা বৎসে চণ্ডী, তোমার বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ কেন?
চণ্ডী—ও কিছু নয়, প্রভু। আমাদের পাড়ার শান্তি সংঘের আজ ইলেকশন হল কিনা।
মোহন্ত—শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে তো মা?
চণ্ডী—হ্যাঁ, শুধু আমি একাই লোহার রড চালিয়ে ওদের পাঁচটাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। আমাদেরও অবিশ্যি কিছু ঘায়েল হয়েছে। দু’পক্ষের মোট বারোজনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ইলেকশন শেষ হয়েছে, প্রভু।
মোহন্ত—জয় তারা।
চণ্ডী—তবে প্রভু আমরাই জিতেছি।
মোহন্ত—তা তোমার হাতে ব্যান্ডেজ কেন বৎসে?
চণ্ডী—ওদের একজন আমার মাথা লক্ষ্য করে ডান্ডা চালিয়েছিল—আমি বাঁ হাতে ঠেকিয়ে ডান হাতে ওর পেটে নেপালা চালিয়ে দিয়েছি—তাই বাঁ হাতটা একটু ফ্রাকচার হয়ে গিয়েছে।
রজনী—প্রভু, মাকে আমি লাঠি, ছোরা, চেম্বার, নেপালা সবই চালাতে শিখিয়েছি।
বৃন্দা—ভালো করছেন। নেপালা, দোনলা, একনলা না চালাইতে পারলে এ যুগে চলব কেমনে!
পাকিস্তান—বাবা।
বৃন্দা—এই যে, এই তো আমার সোনার চাঁদ পাকিস্তান আইসা গেছে—
মোহন্ত—দাঁড়াও, আগে দরজাটা ভেজিয়ে নি, তবে কথা হবে।
.
দ্বিতীয় পর্ব
বৃন্দা—বাবা পাকিস্তান, এই-কী এই-কী তর চোখে ব্যান্ডেজ বান্ধা ক্যান?
পাকি—শুধু চোখে নয়, বুকেও—এই দ্যাখ।
বৃন্দা—ছি: ছি:, তুই আমার নাম ডুবাইলি—শ্যাষে কিনা মাইর খাইয়া আইলি!
পাকি—আরে দূর, আমি কি মার খেতুম? ওই শালা জোজো—বেঁড়ে ওস্তাদ হয়ে গেছে, বললুম আগে বাড়িসনি, তবু ওদের মধ্যে গিয়ে পড়ল—আমি ভোজালি চালালুম—ওরাও বোমচার্জ করলে, তারই দুটো টুকরোর একটা আমার চোখে লাগল, আরেকটাতে বুকে একটা ফুটো হয়ে গেল।
চণ্ডী—আমার বুকেও ব্যান্ডেজ আছে। ওদের এক উটকো মাস্তানের ছোরার খোঁচা লেগেছিল। এই দেখুন—দেখাব?
বৃন্দা—না-না-না-না, তোমার আর দেখান লাগব না। কী কও মোহন্ত?
মোহন্ত—করেক্ট! কিন্তু পাত্র-পাত্রীর দুজনের বুকেই ব্যান্ডেজ—এই অবস্থায় যদিদং হৃদয়ং তব, তদিতং হৃদয়ং মম—বিয়ের এই মন্ত্রটা দুজনের হৃদয়ে প্রবেশ করবে কী করে? আর প্রবেশ না করলেই অদূর ভবিষ্যতে ডিভোর্সের সম্ভাবনা।
বৃন্দা—কী যে কও মোহন্ত, লোমকূপ দিয়া হৃদয়ে প্রবেশ করতেই বরং দেরি লাগত, অখন যখন দুইজনের বুক ফুটা হইয়া গ্যাছে—বিয়ার মন্ত্র তো হরবরাইয়া ঢুইকা যাইব।
মোহন্ত—করেক্ট।
পাকি—যাকগে, এই মেয়েকেই তো আমি বিয়ে করব?
চণ্ডী—কিন্তু বাবা, ও যে আমার দিকে এক চোখে তাকাচ্ছে, এক চোখে তাকালে ঝগড়া হয় শুনেছি।
রজনী—তাতে কী হয়েছে মা! তুমি তো ঝগড়াতে পেছপা নও, তোমাকে তো আমি সবরকম ট্রেনিং দিয়েছি।
বৃন্দা—বা: বেশ বেশ, দ্যাখেন রজনীবাবু, মাইয়া আমার পছন্দ হইছে, এইবার দেনা-পাওনার কথা হউক।
রজনী—হোক। বলুন আপনি কী চান?
বৃন্দা—ছেলে তো দ্যাখলেন, জমি দখল কইরা বাড়ি করতে আছে। ইট, কাঠ, সিমেন্ট সব ফ্রিতেই পাইব—তার উপরে ধরেন—
রজনী—আপনাকে কিছু বলতে হবে না—ছেলে সম্বন্ধে সব খোঁজই আমি নিয়েছি। এখন দেনা-পাওনার কথা বলুন।
বৃন্দা—পাঁচ হাজার টাকা নগদ, কুড়ি ভরি সোনা—এই হইল আমার দাবি—তারপর খাট-পালঙ্ক, দানসামগ্রী তো আছেই…
পাকি—আমাকে একটা পিস্তল কেনার টাকা দিতে হবে। মাল অবিশ্যি আমিই যোগাড় করে নেব।
রজনী—দেব বাবা, সবই দেব। তোমার মতো সুপাত্র যখন পেয়েছি—সবচেয়ে বড় কথা, একটা পরিচয় দেবার মতো জামাই পেলাম।
বৃন্দা—তা যা কইছেন, হাওড়া স্টেশনে গিয়া খালি কইবেন আমি পাকিস্তানের শ্বশুর, ব্যাস, মাথায় তুইলা নাচব।
পাকি—যাক, এবার আমি কনের সঙ্গে একটু বোঝাপড়া করতে চাই।
চণ্ডী—ঠিক আছে, আমি তৈরি।
পাকি—এই তোমার নাম কী?
চণ্ডী—কী ছোটলোক দেখছ বাবা—প্রথমেই আমাকে তুমি বলছে।
বৃন্দা—বাবা পাকিস্তান, মাইয়া ছেইলারে প্রথমেই তুমি কওনের প্রথা নাই।
পাকি—ঠিক আছে। নামটা কী?
চণ্ডী—চণ্ডী, চণ্ডী—
পাকি—আমি আগে থেকে বলে রাখছি, আমার কিন্তু রোজ এক বোতল বাংলা মদ লাগে।
চণ্ডী—আমার দুটো এল-এস-ডি অন্তত রোজ চাই-ই।
পাকি—আমি কিন্তু মাঝেমাঝেই মারামারি করি।
চণ্ডী—আমি মার খাই কম—মারি বেশি।
পাকি—এক কোপে মানুষের গলা কাটতে আমার মোটেই হাত কাঁপে না।
চণ্ডী—মানুষের বুকের ওপর চেপে বসে গলার নলিটা পুঁচিয়ে পুঁচিয়ে কাটতে আমার খুব ভালো লাগে।
পাকি—গুল মারবার আর জায়গা পেলে না?
চণ্ডী—এই বেশি বাতেলা করবে না বলে দিচ্ছি।
পাকি—মুখ সামলে কথা বলবে, মনে রাখবে আমার নাম পাকিস্তান।
চণ্ডী—চেপে যা পঞ্চা, অ্যায়সা ঝাড় ঝাড়ব—মায়ের ভোগে লাগিয়ে দেব।
পাকি—তবে রে শালি এটা দেখেছিস—
চণ্ডী—দূর দূর, ওই ছুরি দিয়ে তো পেনসিল কাটে রে—আমার এটা দেখেছিস। একদম বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।
মোহন্ত—জয় তারা! আহা—হা! হচ্ছে কী—এটা কী হচ্ছে?
বৃন্দা—অস্ত্র না, অস্ত্র না—খুনখারাবি হইলে বিয়া হইব না, ফ্রি হ্যান্ড ফ্রি হ্যান্ড হউক—কী কন রজনীবাবু?
রজনী—হোক, ফ্রি হ্যান্ডই হোক, চালিয়ে যা মামণি।
বৃন্দা—বাবা পাকিস্তান—আমার মুখ রাখিস।
পাকি—তুমি দেখো না বাবা ফ্রি হ্যান্ডেই ওকে ঘায়েল করব।
চণ্ডী—আয় না মাঁকড়া (ঘুষির আওয়াজ), কেমন লাগল পাকিস্তান?
বৃন্দা—চোখে মাইরো না, চোখে মাইরো না, একটা চোখ গ্যাছে, আরেকটা থাকতে দ্যাও।
পাকি—তুমি চুপ করো বাবা (ঘুষির আওয়াজ), কেমন লাগল চণ্ডীরাণি?
রজনী—মুখে মেরো না, মুখে মেরো না—
পাকি—একশোবার মারব।
রজনী—দে তো মা একটা আপার কাট—যাক ব্যাটা পাকিস্তানের ভূগোল পালটে।
চণ্ডী—বাবা, তুমি শুধু চুপ করে দেখে যাও—
(অনবরত ঘুষির আওয়াজ)
বৃন্দা—খাইছে রে—
রজনী—এই মেরেছে—
রজনী—অবজেকশন—ওরকম খাইছে রে খাইছে রে করবেন না মশাই। মেয়ের আমার মুখটা কী করে দিয়েছে দেখেছেন?
বৃন্দা—আর আমার ছেলের মুখটারে যে ঘুষাইয়া ঘুষাইয়া কাৎলামাছ বানাইয়া দিল সেইটা দ্যাখেন না? যেমন মাইয়া তার তেমন বাপ।
রজনী—অবজেকশন! আপনি একটা ইতর।
বৃন্দা—আপনে একটা বান্দর।
রজনী—আপনি একটা অক্টোপাস।
বৃন্দা—আপনে একটা গেরগেন্ডিভোরাস।
রজনী—এর অর্থ কী?
বৃন্দা—অর্থ দিয়া কাম নাই, শুইনা যান—স্টক অফ ওয়ার্ড বাড়ান।
রজনী—দেখুন আমায় খ্যাপাবেন না—আমি খেপে গেলে কিন্তু বাঘ।
বৃন্দা—বাঘ না কুত্তা।
রজনী—কি? কুত্তা—এক চড়ে গাল ফাটিয়ে দেব—
বৃন্দা—এক লাথিতে তর—
রজনী—খবরদার—
বৃন্দা—খবরদার—
(হঠাৎ পাকিস্তানের গলার আওয়াজ)
পাকি—বাবা, আমার নাক কামড়ে দিয়েছে। আমিও ওর নাক কামড়ে দেব—
বৃন্দা—না না, তাতে তোমারই ক্ষতি—বউ তোমার দাগী হইয়া যাইব—তুমি বরং চুল টাইনা ধর, তাতে যে-কয়গাছ যায় যাউক।
পাকি—আয়, আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন…
রজনী ও বৃন্দা—সাবাস সাবাস—চালাও…
মাস্তান—চোপ চোপ—কী মশাই, মগের মুলুক পেয়েছেন। এত চেঁচামেচি কীসের?
বৃন্দা—এইখানে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন হইতে আছে—বিয়া-শাদির ব্যাপারে একটু চেঁচামেচি তো হইবই। তা আপনি কে?
মাস্তান—এ পাড়ার লোক আমার কথায় ওঠে বসে—আমার নাম সাইক্লোন—তা মোহন্তজি, আপনার আখড়াকে যে প্রজাপতির অফিস বানিয়ে ফেললেন। শুনুন আর চেঁচামেচি করবেন না, পাড়ার ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর ডিস্টারব্যান্স হচ্ছে। বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে আমাদের বারোয়ারি শেতলা পুজোর জন্যে একান্ন টাকা দিয়ে যাবেন—নমস্কার।
মোহন্ত—যাক আর নয়, এবার আমি পাত্র-পাত্রীকে আশীর্বাদ করব— এরকম সবদিক দিয়ে মিল বড় একটা দেখা যায় না—তোমাদের দুই বেয়াইতেও একেবারে রাজযোটক।
রজনী—সবই আপনার আশীর্বাদ প্রভু। নাও, তোমরা প্রভুর চরণামৃত নাও।
মোহন্ত—জয় তারা!
পাকি—তাহলে আমি আর চণ্ডী একটু বেরিয়ে আসি।
মোহন্ত—ডাক্তারখানা হয়ে যেও—মুখের রক্ত-টক্তগুলো মুছে যেও।
চণ্ডী—বেশ, আমরা হাসপাতাল হয়ে সিনেমায় চলে যাব। এসো পাকিস্তান—আমার পাকু।
পাকি—চলো চণ্ডীরানি—আমার চণ্ডু।
রজনী—গুরুদেব—এই আপনার দক্ষিণা বাবদ কুড়ি টাকা রইল।
বৃন্দা—রজনীবাবু, বিয়ের পণ বাবদ পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেছিলাম—এইর লগে আরও একান্ন টাকা চাপাইয়া লইবেন ওই সাইক্লোনের শীতলা পূজা বাবদ।
রজনী—আমি তাহলে আসি গুরুদেব।
মোহন্ত—এসো—
বৃন্দা—টিক্কা, নগদ যেই কুড়ি টাকা পাইলি তার থিকা আমারে দশ টাকা দে—আর ট্রামে বাসে পারুম না, ট্যাক্সিতে বাড়িত যামু।
মোহন্ত—তাহলে তো দেখছি আমিই সবদিক দিয়ে ঠকলুম।
বৃন্দা—হে: হে: হে: কারেক্ট।
কর্তাবাবুর দেশভ্রমণ
কর্তা—কই গো, হইল তোমার? না, তোমাগো লইয়া চলাফিরা করাই অন্যায়।
গিন্নী—তুমি চুপ করো তো, কোনওখানে যাওনের হইলেই কেবল হুড়াহুড়ি।
কর্তা—সাধে হইচই করি! করি তোমাগো বুদ্ধির দোষে। তোমাগো সাজন-ই শেষ হয় না। কী অ্যাতো সাজো বুড়া বয়সে।
গিন্নী—বেশি প্যানর-প্যানর কইরো না, সব গুছাইয়া লইতে হইবো না। তোমারই তো পঞ্চাশরকমের ঝামেলা। এইটা দাও রে, সেইটা লও রে, কোনওটা না পাইলে তো চিৎকার কইরা অস্থির কইরা ফালাইবা।
কর্তা—আচ্ছা আচ্ছা হইসে, অখন দুগ্গা দুগ্গা কইরা রওনা হও। মদনা আয় আয়, শিগ্গিরি আয়। আর দেরি না, আরে ট্রেনের সময় হইয়া গ্যাসে।
মদনা—দেরি তো আপনের লিগাই।
কর্তা—হইসে, আর ওস্তাদি করন লাগবো না। না, অখনও গাড়ি আসে নাই। মদনা খুব ভালো দেইখা একটা বসনের জায়গা করবি। বিদেশে যামু, খুব আয়েশ কইরা যাইতে না পারলে, বুঝলি।
মদনা—তা আর কইতে হইব না। আপনে নিশ্চিন্ত থাকেন।
কর্তা—গাড়ির আর কত দেরি রে?
মদনা—সময় মতো আইবো।
কর্তা—আইবো তো?
মদনা—এইটা কী কন? আপনে যাইবেন আর গাড়ি আইবো না?
কর্তা—বলদের মতো কথা কইস না, আরে অ্যাতো বেশি কথা কস।
মদনা—যাউক গিয়া, আসেন আপনের বিছানা পাইতা দিই।
কর্তা—ও মশয়, আপনে একটু সরেন তো।
লোক—সেকী মশাই লোকে বসবার জায়গা পায় না আর আপনি বিছানা পাতবেন?
কর্তা—না, ঠিক সেরকম বিছানা না, এই একটু আয়াশ কইরা, পা ছড়াইয়া ভালো মতন বসনের জায়গা। নইলে আমার আবার অসুবিধা হয়। সঙ্গে স্ত্রীলোক রয়েসে।
লোক—সে তো বুঝলাম স্ত্রীলোক রয়েছে। এদিকে যে আমরা বসতে পারছি না।
কর্তা—দ্যাখেন সকলের তো সকল সময় সকল রকম সুবিধা হয় না। সংসারের এইটাই নিয়ম।
লোক—সংসারের নিয়মটি তো খুব জানেন দেখছি। তা সুবিধাটি যে কেবল আপনার ভাগেই পড়বে, এটাই বা কোন নিয়ম?
কর্তা—সঙ্গে স্ত্রীলোক রয়েসে।
লোক—দূর মশাই, তখন থেকে সঙ্গে স্ত্রীলোক রয়েছে স্ত্রীলোক রয়েছে, সরে বসুন।
কর্তা—মদনা লোকটারে একটু রগচটা ধরনের মনে হয়। ন্যান বসেন। আচ্ছা আপনের কি ব্ল্যাড প্রেসার আছে নাকি?
লোক—কেন?
কর্তা—হঠাৎ হঠাৎ চইটা যান কিনা, এইটা ব্লাড প্রেসারের লক্ষণ।
লোক—ডাক্তারিও জানেন দেখছি, আশ্চর্য।
কর্তা—যাক গিয়া, মদনা টিকিট আনসস, কত ভাড়া?
মদনা—জন প্রতি চোদ্দো টাকা।
কর্তা—ফিরনের ভাড়া কত?
মদনা—কত আবার। যাওনের ভাড়া চোদ্দো টাকা হইলে ফিরনের ভাড়া তো চোদ্দো টাকাই হইব।
কর্তা—কোনও আইনেই তা হয় না।
লোক—আরে মশাই রিটার্ন টিকিট হলে কিছু কম হত।
কর্তা—সেই কথা হইতাসে না। ফিরনের ভাড়া কত সেটাই জিগাই।
লোক—আরে দূর, চোদ্দো টাকাই হবে। যাবার ভাড়া যা আসার ভাড়াও ঠিক তাই হবে।
কর্তা—এই দিক থিক্যা ওই দিক যা, ওইদিক থিক্যা এইদিক তা, এই বুঝি নিয়ম?
মদনা—আরে কী খালি এদিক-ওদিক করতাসেন?
কর্তা—তুই থাম। আইচ্ছা, কন দেখি মশাই, দুগ্গাপূজার ক’দিন পর কালীপূজা?
লোক—মাসখানেক।
কর্তা—হ্যাঁ, কিন্তু কালীপূজার কয়দিন পরে দুগ্গাপূজা? একটাইম হইবটা ক্যান?
লোক—এটা কোনো যুক্তি হল?
কর্তা—হইলো। এই যুক্তির উপরেই আজকাল সংসার চলতাসে।
লোক—আচ্ছা মশাই, আপনার দেশ কোথায় বলুন তো?
কর্তা—ক্যান, বাংলাদেশ।
লোক—আহা, সে তো জানি কিন্তু বাড়িটা কোন গ্রামে?
কর্তা—কেরামতপুর।
লোক—এই জন্যই অ্যাতো কেরামতি। নামটা বদলে ফেলুন।
কর্তা—কন কী মশাই, নাম বদলাইয়া ফেলুম ক্যান?
লোক—নামটা বিশ্রী, নামটা বদলে ভালো একটা নাম রাখুন।
কর্তা—এইটা কী কন? বাপ ঠাকুরদা যে গ্রামে মানুষ, জননী জন্মভূমি, সেই গ্রামের নাম বদলাইয়া ফালাইতে কন?
লোক—হ্যাঁ হ্যাঁ, আশেপাশের একটা ভালো গ্রামের নাম বলুন। যাতে পাঁচজন চিনতে পারে।
কর্তা—ও, আপনের গ্রামের নামটা কী?
লোক—কেষ্টনগর। দেখলেন নামেই সবাই চেনে।
কর্তা—হ্যাঁ, নামখান সুন্দরই। আপনের নাম?
লোক—প্রাণকান্ত রায়।
কর্তা—বাপের নাম?
লোক—ঈশ্বর ধনকান্ত রায়।
কর্তা—বদলান, বদলান।
লোক—বদলাব?
কর্তা—ভালো না, ভালো না। আপনার বাপের নাম বদলাইয়া ফালান।
লোক—সেকী মশাই, বাপের নাম বদলে ফেলব?
ক্যান? দোষটা কী? চোদ্দো পুরুষের ভিটা যেই গ্রামে, সেই গ্রামের নাম যদি বদলাই, তবে এক পুরুষের বাবার নাম বদলাইতে দোষ কী? আশেপাশের কোনও ভালো বাপের নাম কন—যারে পাঁচজনে চিনতে পারে।
লোক—আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে দেখছি।
কর্তা—হা: হা:, মদনা, কেমন দিসি। তামুক দে।
(ট্রেনের শব্দ)
কর্তা—কী গো গিন্নী বোঝো ক্যামন?
গিন্নী—কী আবার বুঝুম, তুমি চুপ কইরা বসো তো। ক্যান মাইনসের লগে খামোখা ঝামেলা করো।
কর্তা—তুমি চুপ করো। যত বাজে লোকের বাজে কথা।
গিন্নী—তুমিও কম উলটাপালটা কওনা।
কর্তা—কীরকম?
গিন্নী—কইলে তো আবার রাগ করবা।
গিন্নী—না না করুম না, কও।
গিন্নী—একেক সময় তুমি বড্ড বাড়াইয়া বাড়াইয়া কও। মাইনসের সামনে লজ্জায় একেবারে আমার মাথাটা কাটা যায়।
কর্তা—তা কথাটা তুমি ঠিকই কইসো। আচ্ছা দ্যাখো যদি বোঝো আমি খুব বেশি কইয়া ফালাইসি—তবে তুমি জোরে কাশবা। তুমি কাশবা, আমি সংযত হমু।
মদনা—এইটা ভালো কথা। আপনার তো খেয়াল থাকে না একটু শাসনে রইলেন।
কর্তা—তুই চুপ কর। ও মশাই শুনছেন, এই লম্বালম্বা এইগুলা কীসের বাক্স?
লোক—এতে বন্দুক রাখে।
কর্তা—বন্দুক। বন্দুক লইয়া যান কই?
লোক—বন্দুক নিয়ে কি আর মশাই তীর্থে যাচ্ছি? যাচ্ছি শিকার করতে।
কর্তা—শিকার, কী শিকার?
লোক—বাঘ-টাঘ এই আর কী। কেন আপনারও কি এইসব শখ আছে নাকি?
কর্তা—বিলক্ষণ, বাঘের কথা যদি কইলেন তাইলে কই।
মদনা—এই সারসে।
কর্তা—তুই চুপ কর।
গিন্নী—ওগো মনে আসে তো।
কর্তা—হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আসে। আজ্ঞে বাঘের কথা যদি কইলেন।
লোক—কোথায় বলুন তো?
কর্তা—ভাঁটার মতো চোখ জ্বলজ্বল করতে আসে।
লোক—কোথায়?
কর্তা—শরীর কী, য্যান মখমল।
লোক—হাত দিয়ে দেখেছেন বুঝি, কোথায় বলুন না।
কর্তা—তা ল্যাজটাই ধরেন গিয়া লম্বা হইবো এই বিশ হাত। (গিন্নী কাশে) বিশ হাত না হইতে পারে তবে পনেরো হাত তো হইবোই। (আবার গিন্নী কাশে) তবে ব্যাপার কী জানেন, হাত দিয়া মাইপা তো আর দেখি নাই। চোখের নজরের ওপর কইতাসি, তবে দশ হাত তো হইবোই।
লোক—দশ হাত লেজ?
কর্তা—(গিন্নী কাশে) কাশো গিয়া, তোমার যত ইচ্ছা কাশো। কাইশা কাইশা মইরা যাও, আমি দশ হাতের নীচে নামুম না।
লোক—ঠিক আছে মশাই ওতেই হবে।
গিন্নী—একটু চুপ কইরা বসো তো। অ্যাতো কইরা যে কই।
কর্তা—কী করুম, পারি না গো পারি না, মদন, ও মদন।
মদনা—আবার কী হইলো?
কর্তা—এই যে খালি গাড়ি যায় আর যায়, আমার তো আর ভালো লাগে না।
গিন্নী—কী মুশকিল। দূরে দূরে ইস্টিশান। ইস্টিশান আইলে তবে তো গাড়ি থামবো।
কর্তা—তা বুঝি তো। আচ্ছা মদনা উটা কী ঝোলে রে?
মদনা—উটা শিকল। বিপদের সময় টানলে গাড়ি থামে।
কর্তা—টানলেই থামে? তবে টান না।
গিন্নী—তুমি পাগল হইলা নাকি?
কর্তা—তুমি চুপ করো। যে যা কউক তুই টান।
মদনা—টানুম? টানি।
(গাড়ি থেমে যায়)
গার্ড—এই, কে চেইন টেনেছে?
কর্তা—আমি। ক্যান কী হইসে?
গার্ড—কী হয়েছে? মাথা খারাপ নাকি? মিছিমিছি গাড়ি থামালে ৫০ টাকা জরিমানা দিতে হয়। লেখা রয়েছে দেখতে পাচ্ছেন না?
কর্তা—সাহেব দেখি নাই। কইরা ফালাইসি।
গার্ড—খুব সাবধান। এইসব করবে না কখনও।
কর্তা—আইচ্ছা।
(আবার ট্রেন ছাড়ে)
কর্তা—গিন্নী, ভালো লাগে না। কেউ কথা কয় না, বার্তা কয় না। আমার যেন কেমন কেমন লাগে।
গিন্নী—কিছু কেমন কেমন করে না। চুপ কইরা বসো তো দেখি।
কর্তা—পারি না গো পারি না। প্যাট গুলায়, মদনা টান আবার টান।
মদনা—আমি পারুম না। কী মুশকিল, ৫০ টাকা জরিমানা হইবো কইয়া গ্যাসে।
গিন্নী—মদনা খুব সাবধান, এই কাম করিস না কিন্তু।
কর্তা— মদনা টান।
মদনা—আপনি টানেন গিয়া। আমি পারুম না।
কর্তা—পারবি না? আচ্ছা আমিই টানি।
(ট্রেন থেমে যায়)
গার্ড—এবার কে টেনেছে?
কর্তা—আমি টান দিয়া ফালাইসি।
গার্ড—আপনি আবার টানিয়াছেন? দিন ৫০ টাকা জরিমানা দিন। আপনাকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ। স্টুপিড কাঁহাকার।
গিন্নী—কী, এখন ক্যামন হইলো?
কর্তা—দেখলি মদনা, সাহেব আমারে ইংরাজিতে গালাগালি দেয়। এক কাম কর, সাহেবের হাতে ৫০০টাকা দিয়া দে। আমি টানুম আর যামু, টানুম আর যামু।
সিনেমা বিভ্রাট
কর্তা—(গান) সকলি তোমারি ইচ্ছা। আগো শুনছো, শুনছোনি? অই হইসে কাম। আরে এ দেখি কথাও কয়না, লড়ে-চড়েও না। ওগো শুনছো?
গিন্নী—কে? ওমা তুমি? তুমি আইসো কোন সময়?
কর্তা—আহা হা। কী আমার আহ্লাদের কথা! বলি মন তোমার থাকে কোথায়? খালি উড়ুউড়ু। হাতে ওটা কী?
গিন্নী—আমের আঠি। ক্যান চোখ নাই? দেইখ্যা বুঝতে পারো না যে আমি শুইয়া শুইয়া একখান বই পড়তে আসিলাম।
কর্তা—বই পড়তে আসিলাম, আমার বিদুষী। আমি সারাদিন পয়সার চিন্তায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি আর উনি শুইয়া শুইয়া বই পড়েন। ইচ্ছা করে…।
গিন্নী—যাক, ইচ্ছার কাম নাই। সেদিন আর নাই।
কর্তা—চুপ থাকো। যত ভাবি কিছু বলব না। কী বই এটা?
গিন্নী—ক্যান, চোখ নাই? নিজে দেইখা বুঝতে পারো না?
কর্তা—দেখি ‘চিত্রলেখা’। বইখান তো ভালোই, কেবল মাইয়া লোকের ছবি। পাইলা কই গো? দিসে কে?
গিন্নী—বিমল ঠাকুরপো দিয়া গ্যাসে।
কর্তা—আমাগো বিমল? ও এইসব পায় কোথায়?
গিন্নী—ওমা, কী কয়? বিমল ঠাকুরপোর তো কামই ওই। বায়স্কোপের ছবির কাম করে। যত রাজ্যের মাইয়া গো লগে চিনাশুনা।
কর্তা—না না, পোলাটা এই দিক দিয়া করিৎকর্মা আসে। পয়সাকড়িও নাকি কামায় ভালোই। আর আমি পোড়াকপাইল্যা।
গিন্নী—শোনো, তোমারে একখান কথা কমু?
কর্তা—কী কথা?
গিন্নী—না যাউক।
কর্তা—দেখো কইবা কইয়া যদি না কও, তাহলে কইলাম আমার মাথায় রক্ত উইঠ্যা যায়।
গিন্নী—না না কই। কিন্তু তুমি যদি আবার রাগ করো?
কর্তা—আহারে উনি য্যান আমার রাগ দেখেন নাই। দেখামু, দেখামু?
গিন্নী—না, দেখান লাগবো না। খুব হইসে, যত মেজাজ আমার লগে।
কর্তা—চুপ কর আবার কথা বলে। কী বলবে বলো।
গিন্নী—আমি বায়স্কোপে নামুম।
কর্তা—কী কইলা? কীসে নামবে? কাম সারসে। তার থিকা বললেই হয়, আমি কুঁয়া খুঁড়েসি কুঁয়ায় নামব। তুমি পারবা?
গিন্নী—না, পারবে না! ক্যান আমাদের পুবের বাড়ির খেঁদি নামে নাই? কী আসিল আর কী হইসে। নামখান বড় সুন্দর রাখসে, ‘অনুপ্রভা দেবী’। তুমি দেখলে বুঝতেই পারবে না। তাছাড়া রামী, শ্যামী, খেঁদি…।
কর্তা—কী কী রামী? আহা হা কী দেখেসিলাম!
গিন্নী—কী দেখসিলা? কারে দেখসিলা? তলে তলে এত?
কর্তা—আরে না না। ‘রামী চন্ডীদাস’। তোমরা অবশ্য তখন খুবই ছোট। চোখ দুইটা সব সময় ঘোলা ঘোলা, উলটাইয়াই রইসে, পাতাও লড়ে না। সেইরকম যদি হইতে পারো, তবে অবশ্য কাম হয়।
গিন্নী—সেইর লিগাই তো বিমল ঠাকুরপোরে কত বইলা কইয়া রাজি করাইসি। কয়, দাদায় কি রাজি হইবো? তিনি তো কলকাতার নিময় কানুন জানেন না।
কর্তা—বলি বিমল আমায় ভেবেসে কী বলো দেখি? আমি জংলি বাঙাল নাকি? আরে আমার এখানে থেকে থেকে ভাষার এমন পরিবর্তন হয়েসে যে, লোকে বুঝতেই পারে না আমার বাড়ি পূর্ববঙ্গে। তাদের কথা শুইনাই আমি কেবল মুসকাইয়া মুসকাইয়া হাসি।
গিন্নী—কথাটা তুমি কিন্তু ঠিক-ই কইসো। মাঝে মাঝে তোমার কথা শুইনা আমারই ক্যামন সব গোলমাল হইয়া যায়। ওমা, বিমল ঠাকুরপো আইসা পড়সে।
বিমল—এই যে দাদা আপনিও আছেন। বউদির মুখে সব শুনেছেন তো? আপনি আর কিন্তু কিন্তু করবেন না। বউদির মধ্যে যেমন একটা ন্যাক দেখলাম, আমার তো মনে হয় ওর মধ্যে একটা বিরাট সম্ভাবনা আছে।
কর্তা—এর মধ্যেই তুমি তোমার বউদিদির মধ্যে সম্ভাবনা দেখতাসো? তোমাগো কাণ্ডকারখানা দেইখা তো…
গিন্নী—তুমি থামো তো, ঠাকুরপো তুমি ব্যবস্থা করসো তো?
বিমল—হ্যাঁ। তা করেছি। কালই দুপুরবেলায় এসে আমি আপনাকে নিয়ে যাব। কোনো অসুবিধে হবে না তো।
গিন্নী—না, কোনো অসুবিধা হইবো না।
কর্তা—বিমল আমি কিন্তু ওয়াইফস হাজব্যান্ড সঙ্গে যাব। সে কথা কিন্তু আগেই কইয়া রাখলাম।
গিন্নী—হু:, তা জানি। তোমারে আমি চিনি না? তুমি আমারে একলা বাইর হইতে দিবা? একেক সময় ইচ্ছা করে, গলায় দড়ি দিই।
কর্তা—থাউক, থাউক। এইটা কলিকাতা।
বিমল—এই যে আসুন বউদি। দাদা, এই চেয়ারটায় বসুন।
কর্তা—বা:! বাড়িখান তো বেশ ভালোই। ইস, এত বড় বাড়ি খালি ফালাইয়া রেখেসে কেন? আর আমরা থাকনের জায়গা পাই না।
বিমল—দাদা আস্তে। এটা ফিল্ম স্টুডিয়ো। চুপ করুন।
কর্তা—কেন আমি খারাপ কথা কী বলেসি? এতবড় ঘরখান খালি পড়ে রয়েসে।
বিমল—এখানে অন্য কাজ হয়। মানুষ থাকবার জায়গা নয় এটা।
কর্তা—সেটা তো দেইখাই বুঝতে পেরেসি।
বিমল—আচ্ছা দাদা, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। বউদি, আপনাকে একটু টেস্ট করে দেখবা।
গিন্নী—কী কইরা দেখবা?
বিমল—এই টেস্ট, মাইকে আপনার গলাটা কেমন আসে। তারপর এই বডি, মানে শরীর…।
কর্তা—মানে! মুখ তো সবসময়ই দেখতাসো, শরীর আবার দেখবা কী?
বিমল—না, না, মানে সব মিলিয়ে বউদিকে কেমন দেখায়, সেটা দেখব।
কর্তা—ক্যান? এমনি দেইখা বুঝি হয় না?
বিমল—না, না, তা হয়। তবে ক্যামেরার মধ্যে দিয়ে বউদিকে কতখানি সুন্দর করে তোলা যায়, কী ভাবে বসলে কিংবা দাঁড়ালে…
গিন্নী—ক্যান, আমারে বুঝি সবসময় ভালো লাগে না?
বিমল—না না, সেকথা হচ্ছে না। আপনি তো সব অবস্থাতেই সুন্দর। কিন্তু আমরা চাই…
কর্তা—ও, তবে আমি বুঝতে পেরেসি। আগেই আমার মনটায় কামড় দিয়েসিল। কিন্তু আমি বলি নাই। এদিকে চেয়ে আছে ক্যানো? ওরা সব চেয়ে আছে ক্যানো?
বিমল—ওরা সব স্টুডিয়োর লোক। এখানেই কাজ করে।
কর্তা—তারাও সব পরীক্ষা করবে নাকি? অ্যা:, অ্যা:, আচ্ছা, ওগো কী কাম এখানে? আচ্ছা, আমি এখানেই আসি।
বিমল—বউদি আপনি আসুন।
গিন্নী—আমার বুকটার মধ্যে য্যান কেমন কেমন করতাসে। দ্যাখো না তোমার দাদায় ক্যামন চোখ মটকাইয়া চাইয়া রইসে।
বিমল—ও ঠিক আছে। এবার একটু হাসুন।
কর্তা—ও বিমল, তোমরা আবার এখন হাসাহাসি আরম্ভ করলা নাকি?
বিমল—না দেখছিলাম বউদিকে হাসলে ক্যামন লাগে। কাঁদলে ক্যামন লাগে।
কর্তা—হাসলে ক্যামন লাগে সেইটা তো দেখলা। এইবার কাঁদলে ক্যামন লাগে সেইটা একদিন আমার বাড়িতে গিয়া দেইখা আইসো।
বিমল—বউদি, আপনি এই কাগজটা দেখে পড়ুন তো।
গিন্নী—ওগো তুমি এসেসো? এসেসো কি এতদিন পরে? কতরাত্রি ছিনু পথ চেয়ে, এইবার নিয়ে চলো মোরে।
কর্তা—আরে, এ আবার কই যাইতে চায়! অ্যাতো ব্যাপার তো আগে বুঝতে পারি নাই।
বিমল—বলুন বলুন, বলতে থাকুন।
গিন্নী—নিশিদিন তব মুখখানি, তব মধুর হাসি নয়নে আমার শুধু ওঠে ভাসি। কেহ তো বোঝে না, কেন এ সংসার মোর ভালো তো লাগে না।
কর্তা—সংসার ভালো লাগে না? বিমল, তোমারে আমি ভালো মনে করসিলাম। তোমার মধ্যে এ্যাতো ত্যাজ?
বিমল—আরে দাদা বুঝছেন না এ অভিনয়।
কর্তা—আরে আমি তো কিছুই বুঝি না। সব বোঝো তোমরা। তুমি আমারে ভাবছো কী? আলো, তুমি আবার খাড়াইয়া আসো? আসো, আসো।
গিন্নী—আরে না না। তুমি যা ভাবছ তা না। মানে বায়স্কোপে আইতে গেলে কিছু কইতে টইতে হয়।
কর্তা—অ্যা:, বায়স্কোপ? অন্য কথা কওন যায় না? আমার সোয়ামিরে ছাইড়া আমি আর থাকতে পারি না। আমার বুকের মধ্যে ক্যামন করে। আমার ইসে হয়। আমার ধ্যান, জ্ঞান। এইসব কওন যায় না?
বিমল—এইসব বললেও হয়, তবে আমি যেটা দিয়েছিলাম সেটা বেশি চলে।
কর্তা—ও:, পরস্ত্রীর সঙ্গে ভালোবাসাটা বুঝি জমে বেশি?
গিন্নী—ওগো তুমি একটু চুপ করো না। তোমারে লইয়া যে কী করি!
বিমল—না: আপনি একেবারে হোপলেস। এরকম যে কিছু হবে, এ আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।
কর্তা—ও পরাত ঠাউরাইসিলা? এইসব কয়াইয়া অর মাথাটা খারাপ কইর্যা দাও। আর আমার ঘরের বউ ভাইস্যা যাউক।
গিন্নী—না যাইবো না। তুমি যেইখানে যাইবা সেখানে গন্ডগোল লাগাইবা। তোমার এখানে আসনের কী দরকার আসিল শুনি?
কর্তা—আরে বলো কী? আমি ওয়াইফস হাজব্যান্ড, আমি আসুম না? চলো বাড়ি, গলায় মালা দিমু অনে।
সমাপ্ত
.
.