কাশ্মীরের রাজনৈতিক অর্থনীতি
কাশ্মীর সমস্যার নানা দিক নিয়ে কথা হলেও অর্থনৈতিক দিকটি আলোচনায় আসে খুবই কম। অথচ, এটিই সব কারণকে ছাপিয়ে গেছে। বিবদমান পক্ষগুলো তাদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণেই মূলত সমাধানের পথে যেতে অনাগ্রহী। পাছে স্বার্থহানি হয়- এই ভয় সবার। ভৌগোলিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিকভাবে জম্মু থেকে কাশ্মীরের অনেক তফাতের কথা অন্য অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু, যখন বিষয়গুলো আসে অর্থনীতি কেন্দ্রীক তখন প্রশ্ন আসে স্বনির্ভরতার। আপেল আর শাল চাদরে আজকের যুগের অর্থনৈতিক চাহিদা তো আর মেটানো যায় না। সুতরাং, আমদানি-রপ্তানির প্রশ্ন জরুরি।
প্রথমেই তুলে ধরা দরকার কাশ্মীরের অর্থনীতির স্বরূপ কী? জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে এখনকার সময়ে বলা হয় কনজিউমার ইকোনোমি’। অর্থাৎ, যেখানে উৎপাদনের চেয়ে আমদানি বেশি। ভারতের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয় এই রাজ্যের জন্য। কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিতে রাজ্যটি একটি সিকিউরিটি সেনসিটিভ স্টেট’। এমনকি জম্মু-কাশ্মীরের বিমানবন্দরগুলোতেও লেখা আছে ‘সিকিউরিটি এয়ারপোর্ট। এই সিকিউরিটি কাতরতার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার প্রচুর ভর্তুকি দেয়। ২০০৩ সালের ভারতীয় গণমাধ্যমের এক রিপোর্ট অনুসারে ১৯৯০-এ সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারত সরকারের মোট রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ১০ ভাগেরও বেশি খরচ করা হয় জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর রাজ্যে।
একজন কাশ্মীরির পেছনে ভারত যা খরচ করে তা অন্য যেকোনও ভারতীয় নাগরিকের জন্য করা ব্যয়ের আট গুণ বলে ওই রিপোর্টে দাবি করা হয়। ভারতীয় উন্নয়নের সূচক হিসাব করলে বিহার, উড়িষ্যাসহ অনেক রাজ্যের চেয়ে মানব উন্নয়ন সূচকে জম্মু-কাশ্মীরের অবস্থা ভাল। শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদিতে কাশ্মীরের অবস্থা বেশ অগ্রসর। সাধারণত, ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রচুর পরিমাণ ভর্তুকি কাশ্মীরিদের দেওয়ার পরও তারা অকৃতজ্ঞ। তারা অকারণে ‘আজাদি’ নাম করে হইচই করে। শান্তি বিনষ্ট করে। এ বিষয়ে ভারতীয় সৈন্যদের একটি শ্লোগান নিয়ে কাশ্মীরি তরুণদের কৌতুক করতে শোনা যায়, দুধ মাঙো গে, তো ক্ষীর দেঙ্গে/মাগার, আজাদি মাঙো গে, তো চির দেঙ্গে’। অর্থাৎ, দুধ চাইলে ক্ষীর খাওয়াবো কিন্তু, আজাদি যদি চাও, ছিড়ে ফেলবো’। আজাদির দাবি
যাতে ওরা না করে সে লক্ষ্যে ক্ষীর-মাখনের অংশ হিসেবে ওই রাজ্যে দেওয়া হয় ভর্তুকি। যদিও কাশ্মীরিদের অভিযোগ, কৃষি বা ফলের বাগানের উন্নয়নে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না, ভর্তুকি দেওয়া হয় সৈন্যদের ভরণ-পোষণ আর জম্মুর সমতল এলাকায় গড়ে ওঠা কলকারখানার জন্য।
কনজিউমার অর্থনীতিকে আরও সহজ করে বললে ‘নির্ভরশীল অর্থনীতি’ও বলা যায়। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হামিদা নাঈম কনজিউমার ইকোনোমি’ শব্দটির তীব্র বিরোধিতা করে থাকেন। এই অধ্যাপক কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের সক্রিয় সমর্থক। তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি স্বাবলম্বী ছিল। বিশ্বমানের অর্থনীতি ছিল। ধীরে ধীরে একে নিস্তেজ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এবং হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, কাশ্মীর এলাকাটি সমুদ্রসীমাবিহীন।
ফলে স্থলপথই এর মূল যাতায়াতের মাধ্যম। পর্বত বেষ্টিত হওয়ায় সুনির্দিষ্ট কিছু পাহাড়ি সুড়ঙ্গ বা উপত্যকার কাছ ঘেঁষেই এর রাস্তাগুলো তৈরি। ইতিহাসের যে সময়টিতে সিল্করুট এশিয়ার পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি বিস্তৃত ছিল তখন থেকেই কাশ্মীরে ছিল যুগোপযোগী রাস্তাঘাট। কাশ্মীর ছিল সিল্করুটের বিভিন্ন কারাভানের বিশ্রামকেন্দ্র। সেখানে গড়ে উঠেছিল সরাইখানা। এ কারণেই কাশ্মীর ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়া উভয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। সাংস্কৃতিকভাবেও বহু সভ্যতার সম্মিলিত চিত্র সেখানে দৃশ্যমান। মধ্য এশিয়া এবং ইরান থেকে ১৪ শতকে প্রায় সাত শ’ বুননশিল্পী কাশ্মীরে আসে, যারা শাল/চাদরের শিল্প গড়ে তোলে। কাশ্মীরি সুফি সৈয়দ আলী হামদানি (রহ.) তাদের নিয়ে আসেন। কাশ্মীরের উপকথায় প্রচলিত আছে, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তার স্ত্রী সম্রাজ্ঞী জোসেফাইনকেও উপহার দিয়েছিলেন কাশ্মীরি শাল।” এমনও কথিত আছে যে, একবার নেপোলিয়ান তার বান্ধবীকে চাঁদের আলোয় উন্মুক্ত দেখতে চেয়েছিলেন।
তিনি তার বান্ধবীর গায়ের চাদরটি ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এরপর তার বান্ধবী আরেকটা নতুন শাল গায়ে জড়ান। সেটি ছাড়িয়ে নেয়ার পর আরেকটা। এভাবে চাদর ছাড়িয়ে নিতে আর নতুন চাদর গায়ে জড়াতে জড়াতে ভোরের সূর্যোদয় হয়েছিল। কিন্তু নেপোলিয়ানের স্ত্রীর কাছে সংরক্ষিত কাশ্মীরি শাল শেষ হয়নি। গোটা ইউরোপ জুড়ে কাশ্মীরি পোশমিনা শালের খ্যাতি ছিল এবং তা এখনও আছে। চতুর্দশ শতকে তকালীন কাশ্মীরের বিখ্যাত বাদশাহর নাম জাইনুল আবেদীন। তিনি পাহাড়ি ঝরনার পানিকে নালা কেটে সমতলে প্রবাহিত করেছিলেন যাতে ফসলের মাঠে সেচ কাজে সুবিধা হয়। দক্ষিণ কাশ্মীরের সেসব নালা এখনও অব্যাহত আছে। দক্ষিণ কাশ্মীরের একটি জেলার নাম অনন্তনাগ। এই অনন্তনাগ শব্দটির অর্থ হচ্ছে অসংখ্য নালা। সংস্কৃত ভাষায় অনন্ত’ মানে অসংখ্য আর নাগ’ মানে নালা। সেই মধ্যযুগ থেকেই কাশ্মীরের মানুষের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজ ছিল স্বাবলম্বি। এখনও প্রতিটি বাড়িতে তাদের রয়েছে সবজির বাগান। প্রায় সব লোকের
রয়েছে নিজস্ব ফসলের জমি। বিশেষ করে ধান আর ভুট্টার ক্ষেত। তবে, আবহাওয়ার বৈরিতা ও তুষারপাতের কারণে শীতের চার মাস থাকে উৎপাদনহীন। মানুষ বাকি সময়ে উৎপাদিত শস্যের ওপর নির্ভর করে শীতকালে। এমনকি সবজিও শুকিয়ে বা আচার বানিয়ে রেখে দেয় শীতের জন্য। এসবের পাশাপাশি কাশ্মীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় অর্থকরি ফসল হচ্ছে আপেল। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই আছে উন্নত জাতের আপেল। ভারতের বাজারের সিংহভাগ আপেল আসে কাশ্মীর থেকে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর হলো আপেল পাকার ও সংগ্রহের মাস। ২০১৬ সালে কাশ্মীরে বিক্ষোভ আর কারফিউর কারণে আপেলগুলো সংগ্রহ ও বিক্রিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। শ্রীনগর থেকে এক সাংবাদিক জানিয়েছিল, মানুষ দিনে হরতাল ও কারফিউর মধ্যে থাকলেও রাতে তারা আপেল নিয়ে মণ্ডিতে হাজির হয়েছে।
কারণ, আপেল পচে গেলে চাষিদেরর আবারও অপেক্ষা করতে হবে রাজ্য সরকারের ভর্তুকির। আর রাজ্য সরকার তো ভারতের অনুকম্পার ওপরই নির্ভরশীল। আপেল ছাড়াও কাশ্মীরে উৎপন্ন হয় ওয়ালনাট (আখরোট), অ্যাপ্রিকট, পিয়ার, পিচ, চেরি, আলমন্ড, আঙুর প্রভৃতি শীতল আবহাওয়ার ফল বা টেম্পারেচার ফুটস। আখরোটের গল্পটাও খানিকটা তুলে ধরা জরুরি। ভারতের বাজারে সবচেয়ে ভাল মানের আখরোটের (কারনেল বাণিজ্যিক নাম) প্রতি কেজির মূল্য ছিল ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০০০ – ১২০০ রুপি। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় পশ্চিমা কোনো দেশ থেকে আখরোট আমদানি করেন স্বল্প মূল্যে।
ফলে ২০১৫ সালে ভারতের বাজারে কাশ্মীরি আখরোটের দাম নেমে যায় ৪০০ রুপিতে। অন্যদিকে সীমান্ত বন্ধ থাকায় এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের কোনো সুযোগ নেই রাজ্যের। ফলে, এই দরপতনের প্রভাব মেনে নিতে হচ্ছে আখরোটের উৎপাদক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। ষোড়শ শতক থেকে মোগলরা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর একে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। অর্থনীতির ছাত্ররা জানেন, পর্যটন হচ্ছে একটি বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক খাত। যেখানে পর্যটন শিল্প বিকাশ হয় সেখানে স্থানীয় প্রায় সব পণ্যের একটি বাজার তৈরি হয়, যার ক্রেতা হয় বিদেশিরা। এটা স্থানীয় পণ্যকে একটা বৈশ্বিক পরিচিতি এনে দেয়। কাশ্মীরেরও সেই খ্যাতি ছিল।
শেখ আবদুল্লাহ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ১৮ শতকের আফগান শাসনামলেও তার পূর্বপুরুষেরা পোশমিনা (পাহাড়ি ছাগলের পশম দিয়ে নির্মিত মিহি চাদর) রপ্তানি করত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে। পরে ১৮৪৬ সালে ডোগর মহারাজার কাছে কাশ্মীরকে ব্রিটিশরা বেচে দেওয়ার পরই শুরু হয় নতুন শোষণের অধ্যায়। সমস্ত জমিন ও সম্পদের মালিক হয়ে গেল মহারাজা। মহারাজা বিভিন্ন এলাকায় জমিদার নিয়োগ করলেন। এভাবেই একটি জাতি সম্পূর্ণ গোলামে পরিণত হলো। স্বভাবতই, সেখানে দুর্ভিক্ষ, মহামারী বাড়তে শুরু করে। মহারাজার সুবিধাভোগী কিছু ধনিক শ্রেণিও গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান চরমে ওঠে।
১৯৪৭ সালে মহারাজা কাশ্মীরকে ভারতে যুক্ত করলেও নেহরুর নির্দেশে মহারাজাকে সরে দাঁড়াতে হয়। শেখ আবদুল্লাহ সেখানে প্রধানমন্ত্রী হন। শেখ আবদুল্লাহর অন্যতম ইশতেহার ছিল নয়া কাশ্মীর মেনিফেস্টো’। এর মূল কথা ছিল জমির পুনর্বণ্টন। সে অনুসারে মহারাজার কাছ থেকে কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকার জমিদারিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জমিদারির অবসান হয়। কিছু বিতর্ক ছাড়া মোটামুটি সকল
কৃষকই সমান হারে বণ্টিত জমির মালিকানা পান। জমিতে ব্যক্তির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমানা করা হয়েছিল ১৮২ ইউনিট। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩৯৬ জন জমিদারের কাছ থেকে চার লাখ একর জমি নিয়ে দুই লাখ কৃষককে বিতরণ করে দেওয়া হয়। এই জমি বণ্টনও অন্যতম কারণ যে কাশ্মীরিরা আর্থসামাজিকভাবে মোটামুটি একই রকম, মধ্যবিত্ত ধরনের। মৎস্যজীবী ও পাহাড়ি লোকেরা ছাড়া ওখানকার অন্যদের মধ্যে বৈষম্যের হার তুলনামূলক কম।
অনস্বীকার্য বিষয় হলো, শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সচেষ্ট ছিলেন। এই সময়েই একদিকে পাকিস্তানপন্থী মুসলিম উগ্রবাদ তাকে কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে বিরোধিতা করছিল। অন্যদিকে আরএসএস-সহ ভারতীয় নিয়ন্ত্রণমুখী হিন্দুত্ববাদীরা তাকে ভারতের শত্রু ও পাকিস্তানের চর হিসেবে প্রচার করে আসছিল জম্মু থেকে। জমি হারানো জমিদারদের অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু। শেখ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে হিন্দুদের একাট্টা হওয়ার এও একটা কারণ বলে অনেকে মনে করেন। ১৯৫৩ সালে শেখ গ্রেপ্তার হওয়ার পর অর্থনৈতিকভাবে রাজ্যটিকে নির্ভরশীল করতে তেমন একটা অসুবিধা হয়নি।)
শেখ আবদুল্লাহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৯৫৩ সালে বকশি গোলাম মোহাম্মদকে প্রধান করেছিলেন নেহরু। বকশি দিল্লির আস্থার অধীনে থেকে প্রায় ১১ বছর কাশ্মীর শাসন করেছেন। সে সময়ে বাজারের মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে চাল বিতরণ শুরু হয় রাজ্যে। পরে কোনো সরকারই সেই ভর্তুকির চাল বিক্রি বন্ধ করতে পারেনি। এখন তো, ভারতীয় ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ৫-১০ রুপি কেজিতে চাল বিতরণ হয় গোটা ভারতেই। কাশ্মীরও তার ব্যতিক্রম নয়।
এ প্রসঙ্গে ২০১৫ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করা জরুরি। আমার এক বন্ধুর নিজের ঘটনা এটি। সে জানায়, তার পরিবারের নামে একটিমাত্র রেশন কার্ড ছিল। পরে সে জানতে পারল, অনেক পরিবারের একাধিক রেশন কার্ড আছে। সে গেল সরকারি কর্মকর্তার কাছে। বলল, আমাদের রেশন কার্ড লাগবে। অফিসার জানাল, তোমার ভাইয়ের নামে রেশন কার্ড হয়েছে। সে বলল, ভাই তো বিবাহিত। তার আলাদা সংসার। অফিসার বললেন, ঠিক আছে তুমি তোমার নাম বলো। আর তোমার যেহেতু স্ত্রী নেই, বিয়ে করোনি, একটা মেয়ের নাম বলো।
অফিসার ওর স্ত্রীর স্থানে এক মেয়ের নাম বসিয়ে দিলেন। তারপর ওর নামে রেশন কার্ড তৈরি করে দিলেন। সে প্রতি মাসে চাল ও চিনি পাওয়া শুরু করল কম দামে। আমি বন্ধুকে প্রশ্ন করলাম, তুমি এতে সুবিধা পাচ্ছ। কিন্তু এটা কি বৈধ? সে বলল, সবাই এভাবে সুবিধা নিচ্ছে। আমি না নিয়ে বঞ্চিত হবো কেন? অনুভব করলাম, কতটা খুল্লাম খুল্লা অনিয়ম চলে সেখানে। সরকারি কর্মচারিরাও মনে করে, ভারত সরকার মানুষের নিরাপত্তা দেয় না, অধিকার দেয় না। যা দেয় তা থেকে আর আইনের নামে বঞ্চিত করে লাভ কী? বরং যে যেভাবে চায় তাকে সেভাবে দিলেই লাভ! শুধু চাল নয়, সবকিছুতেই দিল্লির করুণার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে পরবর্তী শাসকদের। ডিএনএ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের অর্থনীতির অন্তত ৫৪০০-৫৭০০ কোটি রুপি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২০১৪’র সেপ্টেম্বরের বন্যায়।
ওই বন্যায় প্রায় ৩০০ লোক মারা যায়। অন্তত ৪৫ লাখ লোক সর্বস্ব হারায়। সেখানে বন্যার পরপরই স্বাভাবিকভাবেই সেনাসদস্যরা উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। সেনাবাহিনীর হিসাব অনুযায়ী শ্রীনগরসহ কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় দুই লাখ লোককে তারা উদ্ধার করেছে। অনেককে বিমানে করে ফেরত পাঠিয়েছে। এই অভিযানকে ‘অপারেশন মেঘ রাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যদিও অধিকাংশ সূত্রের দাবি, সেনাবাহিনীর উদ্ধার অভিযানের মূল মনোযোগ ছিল পর্যটন এলাকাগুলোতে আটকে পড়া ভারতীয় ও বিদেশি পর্যটকরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, সৈন্যরা সাধারণ মানুষের উদ্ধারে আগ্রহী হয়নি। এ প্রসঙ্গে কাশ্মীরি সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ হোসেন বলেছিলেন, সেনাবাহিনী রাবারের নৌকায় করে উদ্ধার
কাজ চালাচ্ছিল। বন্যার আগেই বিভিন্ন স্থানে টানিয়ে রাখা কাঁটাতারে বিঁধে ওই নৌকা ছিদ্র হয়ে পড়ে। এ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যে, কাশ্মীরিরা সেনাদের নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক মাস পর কাশ্মীরের বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য ১৬০২ কোটি রুপির তহবিল ঘোষণা করে। তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ৫০০ কোটি টাকার একটি বিল জমা দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর উদ্ধার অভিযানের খরচ বাবদ। এই অবস্থাকে সিটিজেন.ইন ব্লগের এক রিপোর্টে ‘নির রসিকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রাজ্য সরকার থেকে ৪৪০০০ কোটি টাকার পুনর্গঠন বাজেট দেওয়া হয়। এর বিপরীতে কেন্দ্র থেকে প্রাথমিক বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫৫১ কোটি টাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরগুলো পুনর্নির্মাণের জন্য। একে প্রহসন বলে উল্লেখ করে স্থানীয় রাজনীতিকরা। গত মার্চে (২০১৬) প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, ভারতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অ্যাক্ট২০১৩ অনুসারে দরিদ্র প্রত্যেক ব্যক্তি দুই রুপি কেজিতে আটা এবং তিন রুপি কেজি দামে চাল কিনতে পারবেন। এক মাসে একজন পাবেন সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি চাল। অতিদরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে নিয়মটি হলো প্রতি মাসে পরিবার প্রতি ৩৫ কেজি চাল পাবেন পাঁচ রুপি কেজি দরে।
নিয়মানুসারে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রায় ৭৩ লাখ লোক দরিদ্র হিসেবে এবং ১৩ লাখ লোক অতিদরিদ্র হিসেবে এই সেবার আওতায় আসে। তবে, ওই অ্যাক্ট ২০১৩ সালে ভারতে পাস করার পরও সেটি জম্মু-কাশ্মীরে ওমর আবদুল্লাহর সরকার অনুমোদন করেনি। কারণ, আবদুল্লাহ পরিবার শুরু থেকেই ভর্তুকি দেওয়া খাদ্য সরবরাহের প্রক্রিয়াকে নির্ভরশীলতার চেষ্টা হিসেবে সন্দেহ করেছে। এছাড়া যুক্তি ছিল, কাশ্মীরের প্রধান খাবার হলো চাল। সেখানে একজন লোক মাসে কমপক্ষে ১২ কেজি চাল খায়। কমদামে প্রত্যেকে পাঁচ কেজি চাল পেলেও তাদের পূর্ণ দাম দিয়ে আরও সাত কেজি চাল কিনতে হয়। পরে, মুফতি সাঈদের সরকার ২০১৫ সালে এই অ্যাক্টটি অনুমোদন দেয়। অবশ্য, ভারতবিরোধী রাজনীতিকরা এই ব্যবস্থাকে ‘আজাদি’র দাবির বিরুদ্ধে ঘুষ এবং গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে।
এই প্রক্রিয়ায় কাশ্মীরের যে কোনো মুখ্যমন্ত্রীকেই ঘুরে ফিরে দিল্লির কাছে ভিক্ষার পাত্র নিয়ে হাজির হতে হয়েছে। কারণ, যারা ভারতীয় ব্যবস্থার অধীনে কাশ্মীরে রাজনীতি করেন, মুখ্যমন্ত্রী হন, তাদের মূল প্রচেষ্টা থাকে জনগণকে বোঝানো যে, আর্থিকভাবে নিরাপত্তা এনে দেব। দিল্লির কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা এনে দেব। এই কথা রাখতে গিয়ে তারা বারবারই কঠোর সমালোচনা করেন দিল্লির। কী মুফতি, কী আবদুল্লাহ- সবাই ছিলেন এই পথের পথিক। ২০১৫ সালে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী, খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. হাসিব দ্রাবু তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, আমি ভিক্ষার থলি নিয়ে দিল্লি যাব না। তিনি একজন গবেষক হিসেবে স্বনামধন্য। তার ব্যক্তিগত মতামত হলো, কাশ্মীরের সীমান্ত খুলে দিয়ে যদি দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা
বাড়ানো যায়, আর যদি কাশ্মীরে দুই পাশের মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতি গতিশীল হবে। তিনি মনে করেন, অর্থনীতি-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলে শান্তি আসবে। তার ধারণা ছিল হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্টগুলো দিল্লির কাছ থেকে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। মনে করেছিলেন পাহাড়ি এলাকায় সিমেন্ট শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে। গুজরাট মডেলে হয়তো কাশ্মীরেও বিনিয়োগ শুরু করা যাবে। জনমনে ক্ষোভ কমে আসবে। অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনায় এসব দৃষ্টিভঙ্গি তিনি বলেছিলেন যেখানে, এই লেখক উপস্থিত ছিল। কিন্তু তিনি দেখলেন, আসলে অর্থনীতি তিনি যেভাবে চালাতে চান বাস্তবে তা হয় না।
কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলে না সংঘাতপ্রবণ এলাকায়। আজ সবকিছু স্বাভাবিক চলছে তো কাল অচল। কখনও কোনো কারণে অচলাবস্থা হবে তা অনুমান করা বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্থমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী কারোরই নেই। আর পুঁজি বা বিনিয়োগ তো হলো কবুতরের মতো, সামান্য গোলমাল যেখানে হয় সেখান থেকে সে উড়ে চলে যায়। এ অবস্থায় ২০১৫ সালে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও চলতি সরকারের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ওমর আবদুল্লাহ মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইগো কমান, অর্থের জন্য দিল্লির কাছে হাত পাতুন। তিনি বলেন, আমি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে দিল্লি যেতাম, আর হাতজোড় করে ভারতের অর্থমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করতাম অর্থছাড়ের জন্য।
এটা নিজের জন্য নয়, জনগণের জন্যই করতাম। এতেই খোলসা হয় মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা কতটুকু। আর কিভাবে রাজ্যটিকে নির্ভরশীল করা হয়েছে ভারতের ওপর। এই নির্ভরশীলতার আরেকটি প্রেক্ষিত হলো নিরাপত্তা বাহিনী। দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় এই লেখকের এক সহপাঠী বলেছিল যে, ওদের একটা উচু টিলা ছিল। সেখানে ছিল কয়েকশ’ আপেল গাছ। ওই বাগান থেকে বছরে অন্তত তিন লাখ রুপির আপেল বিক্রি হত। দুই দশক আগে ওই জমিটি দখল নিয়ে তাতে ক্যাম্প তৈরি করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। আপেল বাগানটি এভাবেই শেষ হয়। এখন ওরা প্রতিবছর জমির ভাড়া বাবদ টাকা পায়। কিন্তু ওদের কোনো আপেল বাগান নেই।
এই উদাহরণটি থেকে অনুমান করা যায় কিভাবে একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে নির্ভরশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়। কাশ্মীরের জেলায়। মহল্লায় গেলে দেখা যায় যেখানেই উঁচু টিলা সেখানেই আছে নিরাপত্তা বাহিনীর কাঁটাতার ঘেরা ক্যাম্প। মানসরওয়ার লেক, গুরেজ ভ্যালির মতো দর্শনীয় জায়গাগুলোতে নিরাপত্তার প্রয়োজনে জনগণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। শুধু পাহাড়ের টিলা নয়, সরকারি এবং বেসরকারি ভবনও দখলে আছে। ফেব্রুয়ারিতে (২০১৬) প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, রাজ্যে ১৬৪৮ টি ভবন নিরাপত্তা বাহিনীর দখলে রয়েছে। ২৭৮টি সরকারি ভবন, ১৩০২ টি ব্যক্তিমালিকানা ভবন, ৪৫টি হোটেল, ৫টি সিনেমা হলো, ১৮টি কারখানা স্থাপনা সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন
নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। ৬৪৭টি আছে সেনাবাহিনীর দখলে। অবশ্য, ওমর আবদুল্লার নেতৃত্বাধীন সরকার (২০০৯-১৪) তাদের ক্ষমতার ছয় বছরে ১৫৫৫ টি ভবনকে নিরাপত্তা বাহিনীর দখলমুক্ত করেছিল বলে দাবি করেছে। ভারতীয় তরফ থেকে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশিত নয় যে কী পরিমাণ নিরাপত্তা সদস্য কাশ্মীরে আছে। তবে, বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে এই সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এত লোকের বসবাস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিকে কেন্দ্র করেও আছে। একটা অর্থনীতি। সেটাও কাশ্মীরিদের করে তুলেছে নির্ভরশীল। আর এই নির্ভরশীলতার অর্থনীতি স্বভাবতই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভকে বাড়িয়ে তুলছে। সব মিলিয়ে গত সাত দশকের রাজনৈতিক বিরোধের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সমাজটি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে আজাদি শ্লোগানের পতাকাতলে।
অরেকটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া জরুরি। তা হলো, জম্মু ও কাশ্মীর একই রাজ্য হলেও তাদের ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভিন্নতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবস্থাও ভিন্ন। জম্মুর অধিকাংশ এলাকা সমতল এবং প্রায় নাতিশীতোষ্ণ। ফলে জম্মুর কৃষিপণ্য এবং কাশ্মীরের কৃষিপণ্যও ভিন্ন। জম্মু ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সহজে সম্পৃক্ত এবং তার নিরাপত্তা ঝুঁকি কম। ফলে সেখানে কলকারখানা গড়ে উঠেছে বেশি। এ নিয়েও রয়েছে জম্মুবাসী ও কাশ্মীরবাসীর মধ্যে টানাপড়েন।
পাশাপাশি জম্মু হচ্ছে সিটি অব টেম্পল। জম্মুর অর্থনীতির সিংহভাগ নির্ভর করে মাতা বৈষ্ণু দেবীর গুহার উদ্দেশ্যে অগণিত হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের তীর্থযাত্রার ওপর। কেবলমাত্র ওই গুহায় মানুষের উৎসর্গের যে অর্থ তা দিয়ে চলে একটি পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়: মাতা বৈষ্ণুদেবী বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া ওই তীর্থযাত্রাকে কেন্দ্র করে হোটেল, দোকানপাট, যোগাযোগ সেবা ও রেস্তোরার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন চলে। জম্মুর এই ধর্মীয় পর্যটন কাশ্মীরি শুকনো ফল ও শাল-চাদরেরও একটি বিশাল বাজার। কাশ্মীর থেকে পাকিস্তানমুখী শ্রীনগর-মুজাফফরাবাদ রাস্তাটি উন্মুক্ত
থাকায় কাশ্মীরের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগের একমাত্র পথ হচ্ছে এখন জম্মু। এছাড়া আছে বিমান। জম্মু-শ্রীনগর মহাসড়কটি অন্তত ৬০০০ ফুট উচু এবং সামান্য বৃষ্টিতে ধস নামার কারণে বন্ধ রাখতে হয়। তুষারপাত হলেও বন্ধ রাখা হয় এই রাস্তা। স্বাভাবিকভাবেই, জম্মু এবং কাশ্মীরের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য তাও রাজ্যটির অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামান্য অস্থিরতা সৃষ্টি হলেই সেই বাণিজ্য ব্যাহত হয়।
এ প্রসঙ্গে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। সে সময় গরুর চামড়া বহন করার অভিযোগে জম্মুর উদমপুরে এক কাশ্মীরি ট্রাকচালককে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে হিন্দু মৌলবাদী একটি গ্রুপ। এ নিয়ে জম্মু এবং কাশ্মীরর রাজনীতিকরা মুখখামুখি অবস্থান নেন। কাশ্মীরে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। অন্যদিকে জম্মুর হিন্দু নেতারা মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে কাশ্মীরিদের সব ধরনের পণ্যসরবরাহ বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। তখন জম্মু চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রধান রাকেশ গুপ্ত কাশ্মীরে গিয়ে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে
এ নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা বিভক্তি সৃষ্টি করছে। অন্যথায় ব্যবসায়ী এবং জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ সবসময়ই ভাল ছিল। তিনি দুই এলাকার অর্থনীতির প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে বলছিলেন, জম্মুতে ম্যানুফ্যাকচারিং কার্যক্রম বেশি। কিন্তু, কাশ্মীরকে পুরোপুরি কনজিউমার এলাকা বলতে পারি না। কাশ্মীরের হর্টিকালচার ও ফ্লোরিকালচার রয়েছে। আপেল, স্যাফরন (জাফরান) এবং রয়েছে হ্যান্ডিক্র্যাফট। সব মিলে জম্মু আর কাশ্মীর উভয়ই ক্রেতা এবং বিক্রেতা একই সঙ্গে। অর্থাৎ, একে অপরের ওপর নির্ভরশীল’ ১২)। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হাইড্রোপাওয়ার বা জলবিদ্যুৎ। হিমালয়ের অসংখ্য জলপ্রপাত আর স্রোতস্বিনী ঝরনা রয়েছে কাশ্মীরে।
প্রাকৃতিক ওই জলপ্রবাহ থেকে অন্তত ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। অনেকে ২২ হাজার মেগাওয়াট সম্ভাবনার কথাও বলেছেন। ২০১৪ সালে জুলাইয়ে নরেন্দ্র মোদি উরিতে ২৪০ মেগাওয়াটের (উরি-২) একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প উদ্বোধনকালে বলেছিলেন, পরিবেশবান্ধব জলবিদ্যুৎ খাতে ভারত খুবই মনোযোগী। এজন্য সবরকমের সহায়তা দেওয়া হবে। ওই একই এলাকায় উরি-১ প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই চালু আছে যেখান থেকে ৪৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এ মুহূর্তে জম্মু-কাশ্মীরের মোট বিদ্যুৎ উপাদনের পরিমাণ আড়াই হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি।
যার মধ্যে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে ১৪১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যা মোট উৎপাদনের ৪৫ শতাংশ। বাকি উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি ভারত সরকারের (এনএইচপিসি) তত্ত্বাবধানে। সাধারণত, শীতকালে সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। কারণ, তখন হিটার, বৈদ্যুতিক কম্বলসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যায়। পাশাপাশি শীতকালে প্রাকৃতিক ঝরনাগুলো থেকে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও কম হয়। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের উত্তরাঞ্চলীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে রাজ্য সরকার। সম্প্রতি প্রকাশিত পাওয়ার বাজেট অনুসারে সেখানে ১০৭টি গ্রাম তথা তিন লাখ ৫৬ হাজার বাড়ি বিদ্যুতায়নের আওতার বাইরে রয়েছে। তাতে আরও বলা হয়, রাজ্য সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৭.৭২ রুপি ব্যয় করে।
জনগণ ইউনিট প্রতি ৩.৬৪ রুপি হারে পরিশোধ করে। বাকি ৪.১৮ রুপি রাজ্য সরকার ভর্তুকি দেয়। অবশ্য, সেখানে মিটারবিহীন বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। বিদ্যুতের মালিকানা নিয়েও রয়েছে রাজ্যের সঙ্গে ভারতের টানাপড়েন। কাশ্মীরি নেতারা সবসময়ই দাবি করেন, দিল্লির সরকার কাশ্মীরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় (ভারতীয়) গ্রিডে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেখান থেকে রাজ্যসরকারকে তার জনগণের জন্য বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। এটাও ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের ক্ষোভের অপর এক কারণ। ২০১৫’র নির্বাচনে মুফতির অন্যতম নির্বাচনী ওয়াদা ছিল ভারত সরকারের কাছ থেকে অন্তত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। যদিও তা বাস্তবায়নে সমর্থ হননি
তিনি বা তার মেয়ে মেহবুবা। অন্যদিকে, ভারতবিরোধী শিবিরের দাবি, আজাদি ছাড়া এ অবস্থার অবসান সম্ভব নয়। কাশ্মীর সমস্যার অন্যতম দিক হচ্ছে পানির উৎসের নিয়ন্ত্রণ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধুবেসিনের ছয়টি নদী বহমান রয়েছে। এগুলো হলো সিন্ধু (ইন্দাস), ঝিলাম, চিনভ, সাতলেজ, রাভি ও বেইস। এগুলো ব্যবহার বন্টনের জন্য দুই দেশের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি (সিন্ধু পানি চুক্তি) নামে একটি চুক্তি হয় ১৯৬০ সালে। সেই চুক্তি অনুসারে তিনটি নদী নিয়ন্ত্রণ করবে ভারত আর তিনটি নদী নিয়ন্ত্রণ করবে পাকিস্তান।
দুই দেশের কূটনৈতিক প্রেক্ষিতে এটি মোটামুটি ভাল চুক্তি বলা যায়। কিন্তু প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণভাবে এই চুক্তি সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে। দেখা গেছে, ভারতের নিয়ন্ত্রণে যে তিনটি নদী রয়েছে তার উৎস কাশ্মীর হলেও মূলত প্রবাহিত হয়েছে পাঞ্জাব এলাকায়। ফলে ওই। তিনটি নদীর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভারতের পাঞ্জাব এলাকা ব্যাপক উপকৃত হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব। এ নিয়ে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানি পাঞ্জাবের রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষোভ আছে। আবার পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দেওয়া তিনটি নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও তিব্বত।
সেখানে পানির অভাবে বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে মানুষ। কাশ্মীরের নাগরিক সমাজ ও রাজনীতিকরা দাবি করে আসছে কেন্দ্রীয় সরকার (ভারত) পাকিস্তানের সঙ্গে এ চুক্তি করেছে। কিন্তু তা জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের সরকারের অজ্ঞাতে। পানির উৎস যেহেতু কাশ্মীরে সেহেতু পানি বণ্টনের চুক্তিতে কাশ্মীরি: রাজ্য সরকারকে আস্থায় নেয়া উচিত। ১৯৬০ সালে সিন্ধু পানি চুক্তি ভারতপাকিস্তান দ্বিপাক্ষিকভাবে করেছে। এখন সে চুক্তি পুনরায় সংশোধন করে কাশ্মীরিদের তাতে স্টেকহোল্ডার হিসেবে যুক্ত করার দাবি করা হচ্ছে। প্রায়ই কাশ্মীরি নেতারা বলে থাকেন, যেহেতু ভারত সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে পানি ভাগাভাগি করেছে সুতরাং এখন তাদের উচিত কাশ্মীরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের আপসহীন মনোভাবের এটাও একটা বড় কারণ যে, কাশ্মীরে তাদের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।
পাকিস্তানের কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সেচ ব্যবস্থায় ৬০ শতাংশ পানি সরবরাহ হয় ইন্দাস নদী থেকে, যার উৎস ইন্দাসকে বলা হয় পাকিস্তানের ওয়াটার টাওয়ার। সিন্ধু চুক্তির আগে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে ভারত সিন্ধুর পানি বন্ধ করে দিয়েছিল। এতে পাকিস্তান মারাত্মক বিপদে পড়েছিল। ওই সময় ডেভিড লিলিয়েনথাল (David Lilienthal) দুই দেশের মধ্যে সিন্ধুর পানি সংকট পর্যবেক্ষণ করে লিখেছিলেন, ‘বোমা কিংবা কামানের গোলা নিক্ষেপ করে কোনো সৈন্যবাহিনী পাকিস্তানকে এতটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না, যতটা ক্ষতি করা সম্ভব পানির উৎস স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়ে। এই নদীর পানিই পাকিস্তানের জনগণের কৃষিক্ষেতগুলোকে বাঁচিয়ে রাখছে। অবিভক্ত বৃহত্তর জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যটি যদি
ভারতের নিয়ন্ত্রণে আসত তাহলে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোসহ গোটা আরব বিশ্বে পাকিস্তানের ভূখণ্ড ছাড়াই যুক্ত হতে পারত ভারত। পাশাপাশি চীনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত পাকিস্তানের যোগাযোগ। এটা ভারতের জন্য কৌশলগত বিরাট সুবিধা বয়ে আনত। ফলে, কাশ্মীরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। একই কারণে পাকিস্তানের পক্ষেও কাশ্মীরকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে কাশ্মীরের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে। সেখানে চীনের অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে ইকোনোমিক করিডোর/হাইওয়ে। অন্যদিকে, ভারতকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া থেকে।
ভারতকে এখন আফগানিস্তান যাওয়ার জন্য সমুদ্রপথে ইরান গিয়ে সেখান থেকে ট্রানজিট নিতে হচ্ছে। এই কৌশলগত কারণেই দখল ছাড়তে দুই দেশই নারাজ। এমনকি সুউচ্চ হিমালয়ের বরফ আচ্ছাদিত সিয়াচেনেও দুই দেশের সৈন্যরা অবস্থান নিয়ে আছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। ক্যামেরন স্ট্রেচারের (২০১১) উপন্যাস দ্যা ওয়াটার ওয়ারস’ অনুসারে এক দেশের সরকার পানি অপচয় করে, নদীতে বাঁধ দেয়, মেরুর জমাটবাধা বরফ এমনকি মেঘগুলোকেও নিঃশেষ করে। তারপর বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ওই উপন্যাসের মূল চরিত্র ভেরা এবং তার ভাই কোনো একটা দেশে চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করে।’ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থাকে ২০১৬ সালে জুনে ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের একটি নিবন্ধে ওই উপন্যাসের সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছে।
নোট/সূত্র
১. Mani Shankkar Aiyar,; October 14, 2002; Great Sop Story; India Today; http://indiatoday.intoday.in/story/jammu-and-kashmir most-pampered-state-in-india/1/218463.html
২. Fida M Hassnain; The Impact of Muslim Rule on the Kashmiri Society; Journal of Kashmir Studies (Vol:III), 2009, pp: 6-36.
৩. Javed Iqbal, Zaldagar 1865; Greater Kashmir, P9; May 2, 2015.
৪. Sheikh Mohammad Abdullah (1983), Flames of Chinar, Penguin Books, P2.
৫. Sajad Padder (Feb 15, 2015); Kashmir’s Walnut Industry is Dying Unattended, Greater Kashmir.
৬. বন্যাপরবর্তী এক সেমিনার হয় কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের গান্ধী ভবনে। সেখানে লেখক উপস্থিত ছিলেন।
৭. ‘A Cruel Joke’: Centre Diverts Rs 500 Cr To Pay Army Bill For Flood Rescue (30 June, 2015).
৮. Bashaarat Masood & Mir Ehsan (03/03/2016); Why the Food Security Act has Kashmir in a rage; The Indian Express. http://indianexpress.com/article/explained/foodsecuritya ctjammuandkashmirpoklocinarage/
৯. Abid Bashir (June 9, 2015); Swallow Ego, Seek Funds From Delhi; http://www.greaterkashmir.com/news/kashmir/swallow ego-seek-funds-from-delhi-omar-to-drabu/188682.html
১০. Umar Maqbool (Feb 17, 2016), Greater Kashmir.
১১. Riyaz Ul Khaliq (Oct 19, 2015); You Never Know Who is Behind Such Attacks. There Are So Many Agencies Working on the Gorund; kashmirlife.net/
১২. Riyaz Ul Khaliq (Oct 12, 2015); K-J Chambers Join Hand to Ffight Divisive Elements, Protact J-K’s special Status; Kashmirlife.net/
১৩. IANS (July 14, 2014); All Help to Exploit Kashmir’s Huge-Hydro-power Potential-Modi; http://www.business-standard.com/article/news
১৪. Department of Ecology Environment and Remote Sensing J&K, http://jkenvis.nic.in/energy_introduction.html
১৫. JK Power Budget 2016-17: All you wanted to Know; http://kashmirreader.com/2016/05/30/
১৬. Baba Umar (June 9, 2016); Kashmir: A Water War in Making? http://thediplomat.com/2016/06/kashmir-awater-war-in-the-making/