অমৃৎসরে কেনাবেচা: আজন্ম বঞ্চিত এক হতভাগ্য জাতি

অমৃৎসরে কেনাবেচা: আজন্ম বঞ্চিত এক হতভাগ্য জাতি

কাশ্মীরের দখলে মোগলদের কথা আগেই বলেছি। মোগল শাসনামলের পরে কাশ্মীরের দখল নেয় আফগানরা। তারপর শিখ (১৮১৯ – ১৮৪৬)। শিখদের মূল দরবার ছিল লাহোরে (খালাসা দরবার)। শিখ সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন রঞ্জিত সিং। ওই সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল অনেক প্রশাসনিক প্রভিন্স। এর মধ্যে জম্মু, লাদাখ, বালতিস্তান, গিলগিত ও কাশ্মীর আলাদা আলাদা অঞ্চল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীর সংকট আলোচনার জন্য এই অঞ্চলগুলো খুবই জরুরি। শিখ সাম্রাজ্যের অধীনে জম্মুর ডোগরা (হিন্দু বর্ণবিশেষ) জমিদার ছিল গুলাব সিং। তিনি ছিলেন লাহোর শিখ সাম্রাজ্যের প্রিন্স হিসেবে জম্মুর অধিকর্তা।

পরে তিনি জম্মুর পাশাপাশি ইন্দাস (সিন্ধু) নদীর দুই পাড়ের লাদাখ ও বালতিস্তানকে তার অধীনে নেন। অর্থাৎ, লাদাখ ও বালতিস্তান হয়ে পড়ে গুলাব সিংয়ের জম্মু রাজ্যের অধীন। কাশ্মীর ছিল লাহোর রাষ্ট্রের আলাদা প্রদেশ। গিলগিত ছিল পাঞ্জাবি মুসলিম কমান্ডার সাঈয়েদ নথু শাহের অধীনে আলাদা। শিখ রাজার সাম্রাজ্যের অধীনস্থ অবস্থায়ই ওই ডোগরা জমিদার তোষামোদি শুরু করে ব্রিটিশদের। ভারতের অধিকাংশ এলাকায় তখন ব্রিটিশ শাসন বিস্তৃত। উপনিবেশের সীমানায় পাঞ্জাবকে যোগ করার জন্য তারা তখন পেয়ে যায় এক বড় সুযোগ। অপেক্ষা করতে থাকে রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যুর। ১৮৩৯ সালে রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যুর পর দুর্বল হয়ে পড়ে শিখ সাম্রাজ্য।

১৮৪৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল হেনরি হার্ডিঞ্জ শিখদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেন যুদ্ধ। শিখদের সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়েও গুলাব সিং কোনো সাহায্যে এগিয়ে যাননি ওই যুদ্ধে। অবশেষে ১৮৪৫ – ৪৬ সালে প্রথম ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে পরাজিত হয় শিখেরা। ৯ মার্চ, ১৮৪৬ ব্রিটিশদের কাছে শিখ সাম্রাজ্যের পরাজয়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় লাহোরে। সে চুক্তি অনুসারে, সিজ-সাতলেজ টেরিটরিজ, বেইস-সাতলেজ ডোব, হাজারা ও কাশ্মীর এলাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়। এভাবে পাঞ্জাব, কাশ্মীরসহ উত্তর ভারতের গোটা শিখ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে আসে ব্রিটিশদের। তার এক সপ্তাহ পর (১৬ মার্চ, ১৮৪৬) গুলাব সিংয়ের পুরস্কারস্বরূপ অমৃৎসরে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তিতে ৭৫ লাখ রুপির বিনিময়ে গুলাব সিংকে কাশ্মীরসহ পাহাড়ি কয়েকটি জেলার সার্বভৌম মালিকানা দেয় ব্রিটিশরা। চুক্তি অনুসারে, ওখানকার মানুষগুলোও হয়েছিল কেনাবেচা। প্রথম ধারা

অনুসারে, ইন্দাস (সিন্ধু) নদীর পূর্বদিক এবং রাভি নদীর পশ্চিম দিকের জায়গা ব্রিটিশদের কাছ থেকে গুলাব সিংকে হস্তান্তর করা হয়েছিল। নবম ধারা অনুসারে, ব্রিটিশ সরকার যেকোনো বহিস্থ আক্রমণে সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয় মহারাজাকে। দশম ও শেষ ধারাটি সবচেয়ে মজার এবং গোলামির চিহ্নবাহী। তাতে বলা হয়, ব্রিটিশ সরকারের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেবেন মহারাজা। এর স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর একটা ঘোড়া, ১২টা ছাগল (৬টি মাদী এবং ৬টি মর্দা) এবং তিন জোড়া কাশ্মীরি শাল ব্রিটিশ সরকারকে প্রদান করবেন মহারাজা।

Article 10: Maharajah Gulab Singh acknowledges the supremacy of the British Government and will in token of such supremacy present annually to the British Government one horse, twelve shawl goats of approved breed (six male and six female) and three pairs of Cashmere shawls.

হতভাগা কাশ্মীরিদের এই কেনাবেচাকে ১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধী ডিড অব সেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবালও কাশ্মীরকে উপমিত করেছিলেন বিক্রীত জাতি হিসেবে। তার কবিতায় বলেন, হায়! ফসলের মাঠ, পানির ছড়া, উপত্যকার কৃষকদেরও ওরা বেচে দিল! বেচতে বাদ রাখেনি কিছুই। এ নিয়ে হাফিজ জালান্দারি তার বিখ্যাত উর্দু কবিতার শিরোনাম দিয়েছিলেন ৭৫ লাখ কা সওদা’। সাংবাদিক আর এস গুল লিখেছেন, “ডাচদের কাছে নিউ ইয়র্ক সিটি বিক্রি হয়েছিল ১৬১৪ সালে ২৪ ডলারে।

রাশিয়ানদের কাছ থেকে ১৮৬৭ সালে আমেরিকানরা কিনেছিল রাশিয়ান আমেরিকা’ ৭.২ মিলিয়ন ডলারে। পরে তার নাম রেখেছিল আলাস্কা। কিন্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৮৪৬ সালে কাশ্মীরকে বিক্রির ঘটনা কোনো জাতির বিক্রি হওয়ার সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। ১৭০ বছর পরও ৭৫ লাখ রুপির এই ক্রয় চুক্তি, যা কাশ্মীর থেকে ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অমৃতসরে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, এখনও কাশ্মীরি জাতিসত্তার সমস্যার মূল হিসেবে সামনে আসছে।” তবে, কেনাবেচার পর কাশ্মীরের মানুষ সহজেই গুলাব সিংয়ের মালিকানা মেনে নেয়নি।

শিখ শাসকদের নিযুক্ত কাশ্মীরের গভর্নর ছিলেন শেখ গোলাম মহিউদ্দীন। তিনি তখন মৃত্যুশয্যায়। তার পুত্র শেখ ইমামুদ্দিন তখন গভর্নরের দায়িত্ব নেন। তিনি উপত্যকাকে ডোগরা রাজার কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন। ফলে সেখানে গভর্নর ও রাজার মধ্যে সংঘটিত হয় আরেক যুদ্ধ। পরাজিত হয় ডোগরা রাজা। তখন তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে ব্রিটিশ সৈন্য। সেখানে ব্রিটিশদের বিজয়ের পর গুলাব সিং কৃতদাসের (gold-boughten slave) মতো, কাশ্মীরি ভাষায় যাকে বলে ‘জার খরিদ গোলাম’, কৃতজ্ঞতা জানান ব্রিটিশ

প্রভুদের।” তারপরই মহারাজা তার বিনিয়োেগ করা অর্থ আদায়ের জন্য চালু করেন ট্যাক্স। এমন কিছু বাকি ছিল না যার জন্য ট্যাক্স দিতে হয়নি। পরের এক শতাব্দীতে ডোগরা পরিবার বিনিয়োগের চেয়ে বহুগুণ বেশি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। ১৯ শতকের প্রতি বছরে কাশ্মীর থেকে গড়ে তাদের আদায় করা ট্যাক্সের পরিমাণ ছিল ২৫ লাখ রূপি। উদাহরণস্বরূপ, শুধু ১৮৬৮ সালে উপত্যকায় রেভিনিউ আদায় হয়েছিল ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৮ রুপি। তারপরের ইতিহাস আরও নির্মম। আরও ভাগ্যাহতকর। হিন্দু জমিদারের শোষণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, খোদ ব্রিটিশ কর্মকর্তা লর্ড কিম্বারলি ১৮৮৪ সালে তখনকার ভাইসরয়ের কাছে লিখেছিলেন, ‘যদিও হিন্দু পরিবারকে রাজ্যের সার্বভৌমত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিল, তবুও মহামেডান জনগণের পক্ষে ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ করতে ইতোমধ্যেই বেশি দেরি হয়ে গেছে।

কিন্তু, সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। যদি ১৮৮৪ সালে কাশ্মীরকে ব্রিটিশরা কিম্বারলির ওই পরামর্শ অনুসারে নিজেদের দখলে ফের নিয়ে নিত তাহলে এর ভাগ্য হয়তো একটি গণভোটের মাধ্যমে অন্যরকমভাবে নির্ধারিত হতো। যেমনটা হয়েছে নর্থ-ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সের ক্ষেত্রে। যাই হোক, ব্রিটিশরা লাহোর বিজয়ের পর জম্মুর প্রিন্সকে (গুলাব সিং) স্বাধীনতা দেয়। পাশাপাশি কাশ্মীর দিয়ে দেয় পঁচাত্তর লাখ রুপির বিনিময়ে। কাশ্মীরের মতো আরেক আলাদা প্রশাসনিক অঞ্চল ছিল গিলগিত। এর শাসক ছিলেন পাঞ্জাবিমুসলিম কমান্ডার সাঈয়্যেদ নথু শাহ। তিনি ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় কাশ্মীরে দখলের দৃশ্য দেখে গুলাব সিংয়ের অনুগত হন। সুতরাং, মহারাজা তখন জম্মুকাশ্মীর-লাদাখ-গিলগিত-বালতিস্তান মিলে বিশাল সাম্রাজ্যের নিরাপদ মালিক হয়ে যান।

এর নাম দেন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’। এভাবেই ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় গুলাব সিংহের ‘জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর প্রদেশের অংশ হয় কাশ্মীর উপত্যকা।) কাশ্মীরি ইতিহাসবিদ ফিদা এম হাসনাইন লিখেছেন, ললিতাদিত্য (৬৯৭-৭৩৮ খ্রি) আর সুলতান শাহাবুদ্দিনের (১৩৫৫ – ১৩৭৩) সময় কাশ্মীর ছিল একটি বিজয়ী জাতি। গত ছয় শতকে সেই জাতি ক্রমে গোলামে পরিণত হয়েছে।’ তবে, গিলগিতের নথু শাহ গুলাব সিংকে মেনে নিলেও গিলগিতবাসীরা মেনে নেয়নি। ১৮৫২ সালে গৌর আবদুর রহমানের নেতৃত্বে গিলগিতবাসী বিদ্রোহ করে। তারা মহারাজার জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর থেকে স্বাধীন হয়ে যায়। ১৮৫৭ সালে গুলাব সিংয়ের পুত্র রণবীর সিং ফের গিলগিত ‘জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের অধীনে আনার উদ্যোগ নেন।

আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জন্য গিলগিতের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল খুবই বেশি। সুতরাং, স্বাধীনতার আট বছর পর ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের সহায়তায় ফের ডোগরা রাজ্যের অধীন হয়ে পড়ে গিলগিতবাসী। এখান থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, ঐতিহাসিকভাবে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর এক ছিল না। অমৃতসর চুক্তির পর এক

মহারাজার অধীনে শাসিত হয়েছে একাধিক অঞ্চল। কিন্তু, সেখানে ঐক্যের কোনো লক্ষণ কখনই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কাশ্মীরিরা কখনও জম্মুকে নিজেদের ভাবতে পারেনি। জম্মুবাসীও কাশ্মীরিদের নয়। গিলগিতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

যেভাবে উত্থান মহারাজার গুলাব সিং শিখ রাজা রঞ্জিত সিংয়ের সৈন্য বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন একজন তুচ্ছ ঘোড়সওয়ারী হিসেবে। ১৮১০ সালে। কিছু দিনের মধ্যে গুলাব সিংয়ের বাবা কিশোর সিং, ভাই ধিয়ান ও সুচিত সিং লাহোর দরবারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৮২০ সালে এই ডোগরা পরিবারটি জম্মু অঞ্চলকে তাদের একটি বিশেষ জায়গীর হিসেবে পেয়ে যায়। শিখ রাজার বিরুদ্ধে জম্মুতে বেশ কিছু ভোগরা বিদ্রোহীকে দমন করা ছিল এর পেছনে শর্ত। পাশাপাশি, কিশতোয়ারের (বর্তমানে জম্মু অঞ্চলের একটি জেলা) রাজা টেগ সিংকেও একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল।

কারণ, টেগ সিং ভয়ঙ্কর আফগান রাজা শাহ সুজাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ১৮২১ সালে গুলাব সিং কিশতোয়ার আক্রমণ করে সেখানকার রাজাকে আটক করে লাহোরে পাঠান। ১৮২২ সালে গুলাব সিং ত্রিকোটা পাহাড় এলাকায় বৈষ্ণু দেবীর মন্দিরের সামনে ডিডো নামে একজনকে হত্যা করেন, যিনি লাহোরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ডিডডাকে হত্যার খবরে রঞ্জিত সিং খুশি হয়ে লাহোর থেকে জম্মু চলে আসেন। তিনি গুলাব সিংয়ের কপালে বিজয় তিলক পরিয়ে দেন। এবং তাকে জম্মুর প্রিন্স ঘোষণা দেন। এভাবে গুলাব সিং হয়ে যান লাহোর রাজার কাছে আকাশচুম্বি প্রভাবশালী। এরপর সেই লাহোর দরবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে তার দেরি হয়নি খুব বেশি। মাত্র দুই দশক পরই ব্রিটিশদের সঙ্গে ওই প্রিন্স গড়ে তোলেন সখ্য।১৩)

মহারাজার জটিল রাজ্যের জটিল সীমানা মহারাজা নেই। রাজ্য আছে এখনও। বিভক্ত তিন অংশ তিন দেশের দখলে। এখনও আছে সীমানা নিয়ে সেই পুরনো জটিলতা। মহারাজার রাজ্যের একপাশে ছিল রাশিয়ার জার সাম্রাজ্য, অন্যপাশে ব্রিটিশ ভারত, আরেক দিকে ছিল চীন। তার মধ্যে ব্রিটিশদের প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে শাসন করতেন মহারাজা। ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পরও সেই জটিল হিসাব জটিলই রয়ে গেছে। শুধু খেলোয়াড় বদলে গেছে। এশিয়ার তিন পারমাণবিক সুপারপাওয়ার ভারত, পাকিস্তান ও চায়নার মিলনস্থল হিসেবে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর আজও হয়ে আছে এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক বাহাসের ইস্যু। এ অধ্যায়ের শুরুতে অমৃতসর চুক্তির বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। সেই চুক্তি অনুসারে ইন্দাস নদীর দুই পাশের এলাকা গুলাব সিংয়ের অধীনস্থ হয়েছিল। কিন্তু, ইন্দাস নদীর উত্তর ও পূর্বদিকের সীমানার

বিষয়টি তখনও নির্দিষ্ট ছিল না। এ কারণে চুক্তির দ্বিতীয় ধারায় মহারাজাকে হস্তান্তরকৃত জমির পূর্বদিকের সীমানা পরবর্তী জরিপের পর নির্ধারিত হবে বলে উল্লিখিত ছিল। এছাড়া মহারাজার শাসিত পূর্বতন জম্মু স্টেটের (কাশ্মীর সংযুক্তির আগে) লাদাখ প্রদেশের সঙ্গে পূর্ব তুর্কিস্তান (বর্তমান জিংজ্যাং) এবং তিব্বতের সীমানাও ছিল অনির্ধারিত। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে তিব্বত, পূর্ব ও পশ্চিম তুর্কিস্তানসহ চায়না ও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত গোটা এলাকায় ছিল নানা যুদ্ধবিগ্রহ। এই অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে মহারাজার ছেলে রণবীর সিং ১৮৬৪ সালে ওই অমীমাংসিত সীমানার কারাকোরাম পর্বত অতিক্রম করে শহিদুল্লাহ (জাইদুল্লাহ) নামক স্থানে একটি ঘাঁটি স্থাপন করেন। আর ব্রিটিশ সার্ভেয়ার ডব্লিউ এইচ জনসন সে অনুসারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্রে লাদাখের সীমানা কারাকোরাম পর্বতমালা ছাড়িয়ে সেখান থেকে ১০০ মাইল বেশি যোগ করে নেন। কিন্তু, কলকাতার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এটা জানার পরই কড়াভাবে তিরস্কার করেন রণবীর সিং ও সার্ভেয়ারকে।

চুক্তির চতুর্থ ধারা অনুসারে ব্রিটিশ রাজ্যের সীমান্ত বিস্তারের মতো সামরিক উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষমতা মহারাজার ছিল না। এরকম উদ্যোগ নিয়ে মহারাজা মূলত ফাউল খেলছেন এমনটাই ছিল কলকাতার প্রতিক্রিয়া। সুতরাং, তারা ওই বর্ধিত মানচিত্র অনুমোদন না করে সেখানে দৃষ্টি রাখার জন্য একজন ব্রিটিশ এজেন্ট নিয়োগ করে। ফলে রণবীর সিংয়ের সামরিক জেটি তুলে নিতে হয়। মূলত ব্রিটিশ সরকার পাহাড়ি এই এলাকার জমি নিয়ে চাইনিজ প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে আগ্রহী ছিল না। নীতিগতভাবে ব্রিটিশ সরকার ওই ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত অবৈধ দখল অনুমোদন না দিলেও নতুন কোনো সার্ভেও করেনি। ফলে, পরবর্তী অনেক বছর ধরেই জনসন ম্যাপ ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার প্রচলিত ম্যাপ। ১৮৮৫ সালে গুলাব সিংয়ের নাতি প্রতাপ সিং হন মহারাজা (রণবীর সিংয়ের পর)। তিনি ১৯৮৮ ও ১৮৯২ সালেও ওই বর্ধিত এলাকার সীমানায় ফের সৈন্য মোতায়েনের প্রস্তাব দেন ব্রিটিশ রাজ্যের কাছে।

কিন্তু, একই যুক্তিতে তা প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশ সরকার। ১৮৯৯ সালের ১৪ই মার্চ ব্রিটিশ ভারত সরকার চায়নিজ কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায় কারাকোরাম এলাকার সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য। এতে কিছু সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ প্রস্তাব অনুসারে, কারাকোরাম পর্বতমালাকে দুই সাম্রাজ্যের বিভাজক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু, চায়নিজ সরকার এর কোনো জবাব দেয়নি তখন। ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ, তিব্বতীয় এবং চায়নিজ কর্তৃপক্ষ এক সমঝোতায় বসে শিমলায়। সেই সমঝোতা অনুসারে ‘অক্ষয় চীন’ তিব্বতের মধ্যে রাখা হয়। ওই সমঝোতা বৈঠকে প্রণীত ম্যাপে চায়নিজ প্রতিনিধি স্বাক্ষর করলেও পরে সেটি পিকিংয়ে তার সরকার মেনে নেয়নি। সুতরাং, ওই সমঝোতা কার্যকর হয়নি। ফলে, ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৯ সালে প্রস্তাবিত সীমানাই জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ও চীনের সীমানা হিসেবে সর্বশেষ অমীমাংসিত সীমানা। এরপর অবশিষ্ট সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সীমান্ত সমাধানের আর সুযোগ পায়নি। ফলে, মানচিত্রে সীমানা নির্ধারিত হয়নি। ওই এলাকাটি

আনডিফাইন্ড সীমানা হিসেবেই উল্লিখিত থেকে যায়। দেশ ভাগের পরবর্তী। ঘটনাপ্রবাহে যখন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরও ভাগ হয় তখন, কারাকোরাম পর্বতমালা বরাবর ওই সীমানা অমীমাংসিতই রয়ে যায়। পাকিস্তান শাসিত অংশে হাঞ্জা এলাকা এবং ভারত শাসিত অংশে লেহ থেকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চল নিয়ে চায়নিজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেই বিবাদ অব্যাহত থেকে যায়। ১৯৬৩ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তান ও চীন এক। চুক্তির মাধ্যমে হাঞ্জা এলাকার সীমান্ত সমস্যার একটি আপাত সমাধান করে। তবে, সেখানে উল্লেখ করা হয়, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হলে সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ের পুনরালোচনা হবে। সে অনুসারে পাকিস্তান ৫৮০০ বর্গকিলোমিটারের মতো জমি চীনের কাছে হস্তান্তর করে।

ওই জমি ‘অক্ষয় চীন’ হিসেবে পরিচিত। ওই অঞ্চল দিয়ে চীন ও পাকিস্তান একটি বাণিজ্যিক মহাসড়কও নির্মাণ করেছে। চায়নাপাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে এটি বেশ পরিচিত। অবশ্য, ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের জমিন চীনকে অন্যায়ভাবে উপহার দিয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে চীনের সমস্যা এখনও রয়েছে অমীমাংসিত। আশিক হোসেন ভাট আরও উল্লেখ করেন, দেশ ভাগের পর ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার মহারাজার পূর্ণ জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। অক্ষয় চীনকেও ওই মানচিত্রে জেঅ্যাডকের অন্তর্ভুক্ত উল্লেখ করা হয়। ইতোমধ্যে চায়নিজ কর্তৃপক্ষ সিংকিয়াঙ এবং তিব্বতকে সংযোগ করে ওই এলাকা দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করেছে যা ভারত সরকার অবগত ছিল না।

১৯৫৭ সালে ভারত সরকার চায়নিজ কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ছবি থেকে বিষয়টি জানতে পারে। ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে জওহরলাল নেহরু ফের চিঠি লেখেন চায়নিজ প্রেসিডেন্টকে। তারও কোনো উত্তর আসেনি। মোদ্দাকথা, চীন ও জেঅ্যান্ডকে’র সীমান্ত রয়েছে এখনও অমীমাংসিত। লেহ জেলা ছাড়িয়ে কারাকোরাম বরাবর হিমালয়ান ওই রেঞ্জে কোনো জনবসতি নেই বলেই সেই অমীমাংসিত সীমান্ত তেমন আলোচনায় আসে না। কেবল কৌশলগত কারণে দুই দেশের কাছে রয়েছে এর গুরুত্ব। তবে, কাশ্মীর বিরোধের সমাধানের জন্যও চায়না কোনো পার্টি এখানে নয়। কারণ, চায়না কাশ্মীরের জমিন ও জনগণের মালিকানা দাবি করে না।

ঐতিহাসিকভাবে সীমানা অনির্ধারিত থাকার কারণে সেখানে অস্পষ্টতা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। অবশ্য, এ নিয়ে চীন, ভারত ও পাকিস্তানের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক এম শফী ভাট উল্লেখ করেন (৩১ জুলাই, ২০১৫), চায়নিজ ম্যাপ অনুসারে শুধু জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের বিরাট এলাকাই নয়, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, হিমাচল প্রদেশ চায়নার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। চায়না দাবি করে এসব এলাকা ব্রিটিশ সরকার অবৈধভাবে ভারতের অধীনে দিয়েছে। অবশ্য, বর্তমানে সীমান্ত সংক্রান্ত এই বিষয়াবলী এড়িয়ে দুই দেশ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে কাজ করেছে। পাকিস্তানের মানচিত্রে সম্পূর্ণ জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরকে দেখানো

হয় তাদের অধীনে। আবার ভারতের মানচিত্রেও তাই। অধ্যাপক শফি ভাট এ বিষয়ে ভারতের কৌশলকে উল্লেখ করেন দ্বিমুখী হিসেবে। তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের নীতি আগ্রাসী কিন্তু চীনের প্রতি ভারতের নীতি নমনীয়।

নোট/সূত্র

১. Prem Nath Bazaz; History of Independent Movement of Kashmir (1954); P121.

২. The Treaty of Amritsar; The Kashmir Life; March 17, 2013; http://www.kashmirlife.net/treaty-of-amritsar25679/ (accessed on 10/05/2015); চুক্তির সবগুলো ধারা পরিশিষ্টে সংযোজিত।

৩. A. G Noorani; The Kashmir Dispute (1947-2012); Volumel; New Delhi: Tulika Books; 2013; P5.

৪. Mridu Rai; Hindu Rulers Muslim Subjects; P19.

৫. R S Gull; The Man who Purchased Kashmir; Kashmir Life, June 29, 2015; http://www.kashmirlife.net/the man-who-purchased-kashmir-issue-15-vol-07-81400

৬. Walter R Lawrence; The Valley of Kashmir (1895), P201

৭. Joseph Davey Cunningham (An East India Company official); History of Sikhs (1974); P16

৮. Ashik Hossain Bhat; The Day Kashmir Was Sold;

Kashmir Life; March 17, 2013; http://www.kashmirlife.net/the-day-kashmir-was-sold 25669/ (Accessed 10/05/2015)

৯. A. G Noorani (2013); P5.

১০. Ashik Hossain Bhat; The Day Kashmir Was Sold; Kashmir Life; March 17, 2013.

১১. Fida M Hasnain; Journal of Kashmir Studies; 2009; 14.

১২. Ashik Hossain Bhat; The Day Kashmir Was Sold; Kashmir Life; March 17, 2013.

১৩. প্রাগুক্ত।

১৪. Ashik Hossain Bhat; The Dragon Myths; Kashmir Life; May 5, 2013;

http://www.kashmirlife.net/the-dragon-myths-30008/ (Accessed in 10/05/2015).

১৫. কারাকোরাম হিমালয়ের একটি বৃহৎ পর্বতমালা। গিলগিত, বালতিস্তান, লাদাখসহ জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের গোটা উত্তরাঞ্চল মূলত কারাকোরাম পর্বতমালা পেরিয়ে যেতে হয়। ১৯৪৭ সালের পর কারাকোরাম অঞ্চলের গিলগিত বালতিস্তান অংশ রয়েছে পাকিস্তানের অধীনে। আর লাদাখ রয়েছে ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ভারত নিয়ন্ত্রিত লাদাখ এবং চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশের মধ্যবর্তী এলাকায় রয়েছে সুবিস্তৃত কারাকোরাম পর্বতমালা।

১৬. তখন ব্রিটিশ সরকারের রাজধানী ছিল কলকাতায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *