কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮:১৪০৪)

কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু
হুমায়ুন আজাদ

আমার কুঁড়েঘরে

আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
 তুষার জমে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ পড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
 বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক

আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমি
সবুজ পাতা নেই সোনালি লতা নেই শিশির কণা নেই
ঘাসের শিখা নেই জলের রেখা নেই
 আমার মরুভূর গোপন কোনো কোণে একটু নীল হয়ে
বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটি শীষ আজ উঠুক

আমার গাছে আজ একটি কুঁড়ি নেই
 একটি পাতা নেই শুকনো ডালে ডালে বায়ুর ঘষা লেগে
 আগুন জ্বলে ওঠে তীব্র লেলিহান
বাকল ছিঁড়েফেড়ে দুপুর ভেঙেচুরে আকাশ লাল করে
আমার গাছে আজ একটি ছোটো ফুল ফুটুক

আমার এ-আকাশ ছড়িয়ে আছে ওই
পাতটিনের মতো ধাতুর চোখ জ্বলে প্রখর জ্বালাময়
সে-তাপে গলে পড়ে আমার দশদিক
জল ও বায়ুহীন আমার আকাশের অদেখা দূর কোণে
 বৃষ্টিসকাতর একটু মেঘ আজ জমুক

আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
 তুষার জমে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ পড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভরে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক

*

সেই কবে থেকে

সেই কবে থেকে জ্বলছি
জ্বলে জ্বলে নিভে গেছি বলে
তুমি দেখতে পাও নি।

সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতিস্তম্ভের মতো ভেঙে পড়েছি বলে
 তুমি লক্ষ্য করো নি।

সেই কবে থেকে ডাকছি
 ডাকতে ডাকতে স্বরতন্ত্রি ছিঁড়ে বোবা হয়ে গেছি বলে
 তুমি শুনতে পাও নি।

সেই কবে থেকে ফুটে আছি
 ফুটে ফুটে শাখা থেকে ঝরে গেছি বলে
তুমি কখনো তোলো নি।

সেই কবে থেকে তাকিয়ে রয়েছি
তাকিয়ে তাকিয়ে অন্ধ হয়ে গেছি বলে
 একবারো তোমাকে দেখি নি।

*

হাঁটা

একসাথে অনেক হেঁটেছে।
আজ তুমি মনে করতেও পারবে না
শেষ কবে একলা হেঁটেছে। যেদিন প্রথম টলোমলো
দাঁড়াতে শিখেছিলে
সেদিন থেকেই তোমার একলা হাঁটার ঝোঁক।
একলা হেঁটেই তুমি ছুঁয়েছিলে মেরু।
 একা হেঁটে শুধু নতুন পায়ের জন্যে প্রস্তুত এক পথ
দিয়ে পৌচেছিলে তুমি বাঁশবাগানে, পুকুরপারে,
সবাই তোমাকে যেখানে খুঁজছিলো
তুমি সেখানে ছিলে না,
একা হেঁটে লেবুগাছ কুমড়োর জাংলা পেরিয়ে
চলে গিয়েছিলে হিজলের বনে।
 তারপর ওই পথে সবাই হেঁটেছে।
একলা হেঁটে তুমি ঢুকেছো দিগন্তে,
একা হেঁটে গেছো তুমি পদ্মার সবচেয়ে বিপজ্জনক
ভাঙনের ধারে,
একা হেঁটে গেছো মাঘের কুয়াশায়,
বোশেখের তীব্র পানীয়র মতো রৌদ্রে।
তুমি একলা হেঁটেছো
সামনে কেউ নেই
পেছনেও কেউ নেই
ডানে কেউ নেই বাঁয়ে কেউ নেই
তোমার সাথে হেঁটেছো একা তুমি।
তারপর পথে নামলেই
অসংখ্য পায়ের শব্দ,
পথে নামলেই অসংখ্য পায়ের দাগ।
 তখন তোমার কোনো নিজস্ব পথ ছিলো না
 তোমার কোনো নিজের পায়ের দাগ ছিলো না
নিজের পায়ের শব্দ ছিলো না।
 তখন দিগন্তে যাওয়ার ছিলো একটিই পথ
দিগন্ত থেকে ফেরারও একটিই পথ
তখন নদীতে যাওয়ার পথ ছিলো একটিই
 ফেরারও একটিই বিধিবদ্ধ পথ
সব পায়ের একই শব্দ
সব পায়ের একই দাগ
ঘর থেকে বেরোনোর একটিই পথ
ঘরে ফেরারও একটিই পথ
তখন গন্তব্য একটিই
ফেরাও ছিলো একই অভিমুখে।
 একসাথে স্বপ্ন দেখেছো; প্রতিঘুমে একই স্বপ্ন
তোমার নিজের কোনো স্বপ্ন ছিলো না
 একসাথে গান গেয়েছো : প্রতিদিন একই গান
তোমার নিজের কোনো গান ছিলো না
তখন একসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছো
তোমার নিজের কোনো দীর্ঘশ্বাস ছিলো না।
এখন আবার একা পথে নামো,
 প্রথম যেমন টলোমলো দাঁড়াতে শিখেছিলে
তেমনি দাঁড়াও,
একা হাঁটো,
 সম্পূর্ণ নতুন পথে, একা, হেঁটে যাও।

*

ভালো নেই

তুমি চলে গেছো, ভালো নেই।
তাই বলে গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি নেই
তাই বলে গায়ে ছেঁড়াফাড়া জামা নেই
 তাই বলে জেগে জেগে কাটাই না রাত
তাই বলে একলা ঘুরি না বনে বনে।

তুমি চলে গেছো, ভালো নেই।
তাই বলে ঠাই নিই নি মাজারে
 তাই বলে বিড়বিড় করি না দিনরাত
 তাই বলে ভর্তি হই নি হৃদরোগ হাসপাতালে
 তাই বলে পালিয়ে বেড়াই না ফেরারির মতো।

তুমি চলে গেছো, ভালো নেই।
তাই বলে খাই না মুঠোমুঠো ঘুমের অষুধ
তাই বলে লাফিয়ে পড়ি নি ছাদ থেকে
তাই বলে ছুঁই নি তাজা বৈদ্যুতিক তার
তাই বলে ঘোরাফেরা করি না রেললাইনের আশেপাশে।

তুমি চলে গেছো, ভালো নেই।
তাই বলে নির্বাসিত হই নি দেশ থেকে
তাই বলে কারাদণ্ড হয় নি যাবজ্জীবন
 তাই বলে ঝুলি নি ফাঁসিকাঠে
তাই বলে দাঁড়াই নি ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে।

তবে এর চেয়ে অনেক থাকতাম ভালো
যদি লাফিয়ে পড়তাম ছাদ থেকে
 যদি ছুঁয়ে ফেলতাম তাজা বৈদ্যুতিক তার
 যদি লাফিয়ে পড়তাম দ্রুততম রেলগাড়ির নিচে
যদি ঝুলতাম ফাঁসিকাঠে
 যদি দাঁড়াতাম ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে।

*

এমন হতো না আগে

এমন হতো না আগে; ফড়িং, মানুষ, ঘাস, বেড়াল, বা পাখি
দেখে মনে হতো এরা তো আমারই। চোখ ভ’রে, ইচ্ছে হতো, দেখি
 মুখ, চিবুকের রঙ; কিছুক্ষণ থাকি সাথে, দু-হাতে জড়িয়ে রাখি
রক্তের ভেতরে, কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে আর গালে নাম লেখি।
দেখা হবে বারবার মনে হতো; মাঠে, ধানখেতে,
 পুকুরের পাড়ে, দেখা হবে মাঝরাতে যখন সে ফেলবে জাল জলে,
নিশ্চিত ছিলাম যখন ছিলাম জীবন ও ভবিষ্যতে মেতে
সারাবেলা, যখন অবধারিত ছিলো সূর্য রাত শেষ হলে।
এখন কিছুই মনে হয় না নিজের-সব কিছু অত্যন্ত অচেনা;
আজ যার ছুঁই হাত মনে হয় না কালও ফের দেখতে পাবো তাকে,
আমার জন্যে আর ঝরে না শিশির, পাপড়িতে জমে না
সুগন্ধ;–মনে হয় সেও হয়তো দেখতে আর পাবে না আমাকে।
কিছুই আমার নয় আজ আমিও কিছুর নই আর,
আমাকে চেনে না ওই মেথিশাক কুমড়ো ফুল সামাজিক কাক,
কুয়াশায় মিশে যাচ্ছে দিকে দিকে শিশুর চিৎকার,
 আমাকে শোনে না কেউ আমিও শুনি না মানুষ বা উদ্ভিদের ডাক।

*

এক দশক পর রাড়িখালে

এক দশক পর রাড়িখাল গিয়ে পৌঁছোতেই
আমার গাড়ির ওপর অবিরল
 পড়তে লাগলো চাপ চাপ কবরের মাটি।
 যেনো দশ লাখ মানুষ দু-হাতে
মাটি খুঁড়ছে ছুঁড়ে দিচ্ছে গাড়ির ওপরে,
যেনো পাঁচ হাজার বিষণ্ণ কোদাল
স্তূপ স্তূপ মাটি জড়ো করছে গাড়ির ওপর,
আমি দরোজা ঠেলে খুলতে পারছি না।
 আমার পাঁচ বছরের পুত্র, যে এই
প্রথম এসেছে রাড়িখালে, নিজের বাড়িতে,
লাফিয়ে নামলো, তার পায়ের ঘষায়
 পাঁচ হাত ছুলে গেলো রাড়িখাল। মনে হলো
রাড়িখাল ওরই মতো
 কারো পায়ের জন্যে অপেক্ষা করছিলো।
 আমার মেয়েরা কলকল ঝলমল
 করে তাদের অচেনা রাড়িখালকে
একঝাক শালিকের মতো মাতিয়ে তুললো।
 দুটি পাখি ফিরে পেয়ে রাড়িখাল
ডাল মেলতে লাগলো দিকে দিকে, একটা অরণ্যের
 সূচনা ঘটলো। আমি শুধু একলা গাড়িতে
চাপা পড়তে লাগলাম
 চাপ চাপ মাটির গভীরে।

*

রাড়িখাল এলে

আর কোনোখানে নয় শুধু রাড়িখাল এলে
 মুহূর্তে আমাকে ঢেকে ফেলে
প্রাচীন কুয়াশা। যে আমাকে জন্ম দিলো হাঁটতে শেখালো
সে-ই আমাকে দেখায় আজ কবরের কালো।
আমার অপরিচিত আজ রাড়িখালে যা কিছু জীবিত,
 শুধু চেনা তারা যারা অস্তমিত
 একদিন যা ছিলো এখন যা নেই।
যাদের সৌন্দর্য দেখে বেড়ে উঠলাম তারা অনেকেই
অন্ধকার, যারা আছে তারাও অসম্ভব ভীত
না থাকার ভয়ে, তারা অত্যন্ত পীড়িত।
 যে-যুবকেরা একদিন বেড়ার আড়ালে
হঠাৎ জড়িয়ে ধরে চুমো খেতো অনিচ্ছুক যুবতীর গালে,
রাখতো হাত বুকে, তারা আজ নিস্পৃহ কঙ্কাল।
 যা ছিলো এখন নেই তাই আজ আমার ভেতরে রাড়িখাল।
 আমাকে ঘিরেছে আজ কাল আর কুয়াশার রীতি,
থাকাই সত্য আজ, সত্য শুধু একে একে অনুপস্থিতি।

*

এই তো ছিলাম শিশু

এই তো ছিলাম শিশু এই তো ছিলাম বালক
এই তো ইস্কুল থেকে ফিরলাম এই তো পাখির পালক
কুড়িয়ে আনলাম এই তো মাঘের দুপুরে
বাসা ভাঙলাম শালিকের সাঁতরিয়ে এলাম পুকুরে
এই তো পাড়লাম কুল এই তো ফিরলাম মেলা থেকে
এই তো পেলাম ভয় তেঁতুলতলায় এক শাদাবউ দেখে
এই তো নবম থেকে উঠলাম দশম শ্রেণীতে
 এই তো রাখলাম হাত কিশোরীর দীঘল বেণীতে
এই তো নিলাম তার ঠোঁট থেকে রজনীগন্ধা।
এরই মাঝে এতো বেলা? নামলো সন্ধ্যা?

*

পিতার সমাধিলিপি

এখানে বিলুপ্ত যিনি ব্যর্থ ছিলেন আমার মতোই
 কিছুই যায় আসে না তার যদি ঝরে কবরে শিশির
নিরর্থক এইখানে সব ফুল-বকুল বা গন্ধরাজ জুঁই
এখানে তাৎপর্যহীন সব ধ্বনি শব্দ বাক্য পৃথিবীর
এখানে শূন্যতা শুধু সত্য-শূন্যতাই জ্বলে অহরহ
পশুর পায়ের দাগ আর ফুল এইখানে এক অর্থবহ

*

বেশি কাজ বাকি নেই

বেশি কাজ বাকি নেই; যতোটুকু বাকি বেলা পড়ার আগেই
শেষ করে উঠতে হবে। তবে খুব তাড়া নেই, যদি শেষ করে
উঠতে না পারি, থেকে যাবে, ওরা আমার বা নিজেদের হয়ে
সম্পন্ন করবে, ওদের যতোই বকি তবু ভার দিয়ে যেতে
হবে ওদের ওপরই। নিজের সমস্ত কাজ কখনোই কেউ শেষ করে
উঠতে পারে না। যদি শেষ করে উঠতে না পারি ভারি হয়ে উঠবে না বুক;
দুপুর পর্যন্তই যতো অসন্তোষ, তারপর শুধু নিরুদ্বেগে কাজ করে যাওয়া।
মাঠে যেতে হবে একবার, দেখতে হবে আগাছা উঠেছে কিনা,
 পানি পৌঁচেছে কিনা ধানের শেকড়ে; দেখতে হবে গাভীদের দড়ি
কতোটা বাড়াতে হবে। কয়েক বালতি জল ঢালতে হবে
বেগুনচারায়, পথটাও ক্ষয়ে আসছে, কয়েক চাঙাড়ি মাটি ফেলতে
 হবে এপাশে ওপাশে। উত্তরের জমিটায় যেতে হবে একবার;
বহুদিন হয় নি যাওয়া দিঘির ওপারে। বেশি কাজ
বাকি নেই, বেলা পড়ার আগেই শেষ করে উঠতে হবে;
তবে কাজই বড়ো কথা নয়, ধানের শেকড়ে পানি
দেয়ার সময় সবুজের ঢেউয়েই মুগ্ধ হয়েছি বেশি, কাজ করছি বলে
 কখনো হয় নি মনে, মনে হয়েছে আনন্দ করছি। গরুর দড়িটা
বাড়াতে গিয়ে ঘাসের মতোই মাংসে ঢুকেছে সুখ, উত্তরের জমিটায়
গেলে ঢেকে গেছি লাউয়ের পাতার মতো দিগ্বলয়ে। বেশি কাজ
বাকি নেই, বেলা পড়ার আগেই গোধূলি দেখতে দেখতে
ফিরবো ঘরে, যদি শেষ নাও হয় সব কাজ দুঃখ থাকবে না,
আমাকে থাকবে ঘিরে গোধূলির খুরের শব্দ পাখিদের স্বর উত্তরের জমির
 গন্ধ রাতের আকাশ অসমাপ্ত অশেষ সুন্দর।

*

আমাদের মা

আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মতো দাঁড়াতো বাবার সামনে
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ করে উঠতে পারতো না
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
 মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয় নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড়ো ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান,
 আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেণীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
 বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
 বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়ল বিলের প্রচণ্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
 আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কি না আমরা জানি না
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমো খেয়েছেন কি না
 চুমো খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোটো ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড়ো হতে থাকি
আমাদের মা বড়ো ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম
সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়ে না
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
 আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করি না
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।

*

রাজনীতিবিদগণ

যখন তাদের দেখি অন্ধ হয়ে আসে দুই চোখ।
ভয় পাই কোনো দিন দেখতে পাবো না হায়
মেঘ পাতা সবুজ শিশির। আমার সামনে থেকে মুছে যায়
গাছপালা রোদ শিশু, জোনাকির সামান্য আলোক।
চর পড়ে নদী জুড়ে, ছাইয়ে ঢাকে ধানখেত মধুমতি মেঘনার তীর।

যখন তাদের দেখি মনে হয় কোনো দিন
জড়িয়ে ধরি নি কাউকে, চিরকাল দিকে দিকে খুঁড়েছি কবর,
শুধু খুলি উঠে আসে দুই হাতে অঢেল মাটির তলদেশ থেকে,
পাই নি ফুলের গন্ধ অন্ধকারে; পরিচিত শুধু ঘৃণা, মহামারী, জ্বর।
লেলিহান লাল রক্তে চাপা পড়ে চাঁদ আর সূর্যের আকাশ।

যখন তাদের দেখি অবিরাম বজ্রপাত হয় নীল থেকে।
 পোকা জন্মে আম্রফলে, শবরিতে; ইক্ষুর শরীর ভরে কালান্তক বিষে,
পচে ওঠে পাকা ধান, পঙ্গপাল মেতে ওঠে আদিগন্ত ছড়ানো সবুজে,
 ভেসে ওঠে মরা মাছ, বিছানায় বিষাক্ত সাপ ওঠে এঁকেবেঁকে।
 স্বপ্নাতুর দুই ঠোঁট ভরে ওঠে মরারক্তে-ঘনীভূত পুঁজে।

যখন তাদের দেখি হঠাৎ আগুন লাগে চাষীদের মেয়েদের
বিব্রত আঁচলে; সমস্ত শহর জুড়ে শুরু হয় খুন, লুঠ, সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
ভেঙে পড়ে শিল্পকলা, গদ্যপদ্য; দাউদাউ পোড়ে পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল,
আর্তনাদ করে বাঁশি যখন ওঠেন মঞ্চে রাজনীতিবিদগণ।

*

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
 আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে
 একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এককণা জ্যোৎস্নার জন্যে
 এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
 হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
একফোঁটা সবুজের জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোটো একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোটো দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে

*

আমার পাঁচ বছরের মেয়ের ব্যর্থতায়

তোমাকে সুন্দর লাগে, রাজহাঁস; তোমাকে সুন্দর লাগে,
নীলপদ্ম! তুমি আছো এটা এক অসম্ভব সুখ-আমি ঋণী তোমার মুখের কাছে,
ওই ওষ্ঠ, কালো চোখ, তোমার বাহুর কাছে, যার আলিঙ্গনে
 আমি স্বপ্ন দেখি বুক জুড়ে। তুমি আছো, তাই ঋণী হয়ে আছে মেঘ, নদী,
বনের সমস্ত পাখি, একটি সম্পূর্ণ পৃথিবী। তুমি আছো বলে
পরিপূর্ণ হয়ে আছে ভয়ানক শূন্য এই গরিব গ্রহটি।
তুমি আছো-নীলপদ্ম, রাজহাঁস-এটা সভ্যতার বিরাট সাফল্য।
তুমি জানো সব কিছু রূপময় তোমার হাসির মতো, তোমার হাসিতে
মেঘ ঘিরে বোনা হয় চিকন রুপোলি পাড়, তোমার চোখের
জলে লাশের মুখেও লাগে অলৌকিক সুন্দরের ছাপ। তুমি জানো না সাফল্য
কাকে বলে, কিন্তু তোমাকে ঘিরে সব কিছু সফলতা পায়
 পূর্ণিমার চাঁদের মতোই। পাঁচ বছর বয়সেই তোমাকে পৃথিবী মন্ত্রণা দিচ্ছে
 নিজ হাতে নিতে নিজ ভার;–নিজ হাতে তুমি তুলে নিয়েছিলে
তোমার পৃথিবী, কিন্তু তুমি ব্যর্থ হয়েছো;–ওরা তোমাকে ব্যর্থ বলে
ঘোষণা করেছে;–আর তুমি হঠাৎ উঠেছে হয়ে পৃথিবীর
 সমান বয়সী, পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা জমেছে তোমার এক টুকরো বুকে।
তোমার যে-মুখে চাঁদ ছাড়া কিছুই ছিলো না, সেখানে জমেছে
যন্ত্রণার অন্ধকার; গতকালও তোমার অশ্রু ছিলো মুক্তোবিন্দু, কিন্তু ব্যর্থতা
 তোমার অশ্রুকে করেছে অগ্নিগিরির মতো ভয়াবহ। অশ্রুর আগুনে
তুমি পুড়ে যাচ্ছো পাঁচ বছরের নীলপদ্ম, পাঁচ বছরের শুভ্র রাজহাঁস!
এ-প্রথম তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছো, পৃথিবী ও মানুষকে ঘৃণা
করতে শিখেছো-ব্যর্থতা মানুষকে একদিনে ভয়ঙ্কর জ্ঞানী করে তোলে।
তুমি আজ প্লাতোর সমান জ্ঞানী, রবীন্দ্রনাথের সমান অভিজ্ঞ।
 এই সৌরলোক আর তোমার নিকট আগের মতোন
কখনো থাকবে না-মেঘে তুমি দেখতে পাবে বজ্র, গোলাপে কন্টক!
পাঁচ বছরের নীলপদ্ম, রাজহাঁস, মিটিমিটি তারা, পাঁচ বছর বয়সে তোমার
জন্ম হলো-ব্যর্থতায়-তুমি ভুলবে না ব্যর্থতাই সুন্দরের অন্য নাম।
 জেনে রেখো নীলপদ্ম, রাজহাঁস, এ-মাটিতে তোমার মতোই ব্যর্থ
ওই মেঘ, শাদা চাঁদ, এখানে ভীষণ ব্যর্থ অনন্ত সুন্দর।

*

আমার কোনো শব্দ যেনো আর

আমার কোনো শব্দ
 যেনো আর সরব না হয়। আমি আর
কথা বলবো না শব্দে,
হাহাকার করবো না
এমন বস্তুতে যা হয় ধ্বনিত,
ভালোবাসবো না
বাক্যে
 যা শ্রুতিকে আলোড়িত করে।
আমি কথা বলবো
অশব্দে।
আমার ভাষা
দিগন্ত-ছোঁয়া ঘাসের মতো সবুজ,
সুখ-অশব্দ শিশির,
হাহাকার
অশব্দ নীলিমার পর অশব্দ নীলিমার
পর অশব্দ নীলিমা।
আমার গান
সবুজ পাতার ওপর
ভুল-করে-ঘুমিয়ে-পড়া প্রজাপতি,
ভালোবাসা
 জলে ডোবা চাঁদ-নীরব নির্জন।

*

প্রার্থনালয়

ছেলেবেলায় আমি যেখানে খেলতাম
তিরিশ বছর পর গিয়ে দেখি সেখানে একটি মসজিদ উঠেছে।
আমি জানতে চাই ছেলেরা এখন খেলে কোথায়?
 তারা বলে ছেলেরা এখন খেলে না, মসজিদে পাঁচবেলা নামাজ পড়ে।

 বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বুড়িগঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়ে
যেখানে একঘণ্টা পরস্পরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলাম আমি আর মরিয়ম,
গিয়ে দেখি সৌদি সাহায্যে সেখানে একটা লাল ইটের মসজিদ উঠেছে।
কোথাও নিষ্পলক দৃষ্টি নেই চারদিকে জোব্বা আর আলখাল্লা।

পঁচিশ বছর আগে বোম্বাই সমুদ্রপারে এক সেমিনারে গিয়ে
যেখানে আমরা সারারাত নেচেছিলাম আর পান করেছিলাম আর নেচেছিলাম,
১৯৯৫-এ গিয়ে দেখি সেখানে এক মস্ত মন্দির উঠেছে।
দিকে দিকে নগ্ন সন্ন্যাসী, রাম আর সীতা, সংখ্যাহীন হনুমান;
নাচ আর পান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ফার্থ অফ ফোর্থের তীরের বনভূমিতে যেখানে সুজ্যান আমাকে
জড়িয়ে ধরে বাড়িয়ে দিয়েছিলো লাল ঠোঁট,
সেখানে গিয়ে দেখি মাথা তুলেছে এক গগনভেদি গির্জা।
 বনভূমি ঢেকে আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত ঝুলছে এক ক্রুদ্ধ ক্রুশকাঠ।

আমি জিজ্ঞেস করি কেনো দিকে দিকে এতো প্রার্থনালয়?
কেনো খেলার মাঠ নেই গ্রামে?
কেনো নদীর ধারে নিষ্পলক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার স্থান নেই?
কেনো জায়গা নেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনের?
 কেনো জায়গা নেই নাচ আর পানের?
তারা বলে পৃথিবী ভরে গেছে পাপে, আসমান থেকে জমিন ছেয়ে গেছে গুনাহয়
 তাই আমাদের একমাত্র কাজ এখন শুধুই প্রার্থনা।

চারদিকে তাকিয়ে আমি অজস্র শক্তিশালী মুখমণ্ডল দেখতে পাই,
তখন আর একথা অস্বীকার করতে পারি না।

*

বৃদ্ধরা

বৃদ্ধদের দিয়ো না দায়িত্ব, শিশুদের থেকেও দায়িত্বহীন তারা।
বৃদ্ধদের বাহু নেই, বৃদ্ধরা জড়িয়ে ধরতে জানে না
 কাউকে, জানে শুধু নিজেকেই জড়িয়ে ধরতে; নিজেদের ছাড়া
 সব কিছু অর্থহীন বৃদ্ধদের কাছে; নিজে ছাড়া আর সব তাদের অচেনা।

বৃদ্ধদের ওষ্ঠ নেই, দাঁত নেই, বৃদ্ধরা চুম্বন করতে জানে না;
চুম্বনের ছলে তারা খায়, চোষে, গেলে জরাজীর্ণ হিংস্র পশুদের মতো;
লোভে জ্বলে বৃদ্ধদের ঠাণ্ডা রক্ত, কশ বেয়ে ঝরে লালসার ফেনা
বৃদ্ধদের, মেঘ শিশু জ্যোৎস্না নারী তারা চাটে অবিরত।

বৃদ্ধরা অশ্লীল, কপট; বৃদ্ধরা অত্যন্ত পাকা অভিনেতা;
যেখানে যথেষ্ট চুপ থাকা সেখানে বৃদ্ধরা কেঁদে হয় বেদনায় নীল;
 কষ্ট পেলে সুখী হয়, বৃদ্ধদের সুখী করে অন্যদের ব্যথা।
বৃদ্ধরা চরিত্রহীন, এবং বৃদ্ধরা বড়ো বেশি প্রতিক্রিয়াশীল।

ঈর্ষা বৃদ্ধের ধর্ম, ঘৃণা করে তারা সব যা কিছুর রয়েছে সময়,
 রক্তে ভাসমান তারা দেখতে চায় মাটি, দেখতে চায় যুবকের লাশ
 পড়ে আছে খানাখন্দে, তারা শিশুদের মতো পায় ভয়
এবং চিৎকার করে দেখে দিকে দিকে কমে আসছে আলো ও বাতাস।

*

বিভিন্ন রকম গন্ধ

বহু দিন পর আমি এসে এইখানে দাঁড়ালাম, একশো বর্গকিলোমিটার
জুড়ে আমার সামনে এখন অখণ্ড উদ্দাম সবুজ; আমি একে চিনি,
এবং চিনতে পারি না। ক-বছর হলো এখানে দাঁড়াই নি আমি? দশ?
 বারো? বিশ? না পঁচিশ? হিশেব করতে আমার ইচ্ছে হয় না।
 উগ্র চৈত্রে আমি দাঁড়াই একটি অচেনা গাছের সবুজ ছায়ায়,
গাছটি চিনি না আমি, যখন ছিলাম আমি এ-পল্লীর
এ-গাছ ছিলো না; তবে তার ছায়া তার মতোই সবুজ, আমি ভালোবেসে
 ফেলি তাকে; আমার সামনে একশো বর্গকিলোমিটার জুড়ে সবুজ ধানখেত।
আমার হৃদয়-নাকি মাংস-নাকি রক্ত ভরে ওঠে কোমল সবুজে।
আমি ঠিক বুঝতে পারি না আমার কেমন লাগছে,
যদি হতাম কৃষক এই প্রান্তরের হয়তো বুঝে উঠতে পারতাম
আদিগন্ত সবুজের অনুভূতি। যখন ছিলাম আমি এ-মাটির,
 যখন ছিলাম আমি এ-জলের তখন নিবিড় সম্পর্ক ছিলো এসব জমির
সাথে এক বালকের। কতোবার সে-বালক দাঁড়িয়েছে
এইখানে, চোখ ভরে দেখেছে সুন্দর, বুক ভরে নিয়েছে সুগন্ধ।
 আমার বাল্যকালে এ-প্রান্তর এরকম একটানা সবুজ ছিলো না।
কোথাও কালচে ছিলো, ফিকে সবুজ কোথাও,
 কোথাওবা ছিলো ঝলমলে সবুজ যেনো মাটির ভেতর থেকে
গলগল করে উঠে আসছে সবুজের প্রচণ্ড প্রপাত, কোথাও বিবর্ণ,
আর কোথাও বিছিয়ে থাকতো রাশিরাশি অবর্ণনীয় সোনা।
আজ আমার চোখের সামনে আদিগন্ত ধানের সবুজ। আমি চিনি
এই ধান, এর নামও আমি জানি, আর যাকেই জিজ্ঞেস করি
সে-ই একটি অসুন্দর নাম বলে, তবে তাদের সবার চোখেমুখে
সুখ দেখে আমি সুখী হই। শুধু দুঃখ লাগে ওর কি কোনো
নাম হতে পারতো না রূপশালি আমন বা আউশের মতো হৃদয় ব্যাকুল
করা? তবে আমি সুখী, অজস্র রূপসী ধান আমার বাল্যকালকে
বাঁচাতে পারে নি ক্রুদ্ধ আকালের গ্রাস থেকে, দিকে দিকে আমি
দেখেছি ক্ষুধার আগুন, আমি সুখী এ-সবুজ নিভিয়েছে সেই
ভয়াবহ অগ্নির তাণ্ডব। আমি নেমে যাই ধানখেতে, হাঁটি আলপথে,
 গন্ধ শুঁকি দুটি-একটি পাতা ছিঁড়ে। দিকে দিকে একই অভিন্ন গন্ধ আর রঙ
আমাকে বিবশ করে। তবু আমি হাঁটতে থাকি, হঠাৎ আমার
চোখের সামনে ঝলমল করে ওঠে তিরিশ বছর আগের
এই সব জমি, রঙে আর গন্ধে ভরে ওঠে আমার শরীর। এটা সরষের
খেত ছিলো, সরষের তীক্ষ্ণ গন্ধ ঢুকতে থাকে
আমার গেঞ্জি আর জিন্স ভেদ করে, আমি দু-হাতে জড়িয়ে
 ধরতে থাকি সরষের সরু সরু গাছ, কেঁপে উঠি
স্পর্শে; এই খেতে তিল হতো, দেখতে পাই, ঘন কালচে
 সবুজ পাতায় মেঘলা হয়ে আছে জমিগুলো। দেখতে পাই
 হঠাৎ বর্ষা এসে গেছে, থইথই করছে চারদিক, তিল কাটা
হয় নি এখনো কেননা পাকতে তার আরো দু-একদিন
বাকি। এই খেতে পাট হতো, বিশাল বনের মতো এই খেতের ভেতরে
লুকিয়ে থেকেছি কতো দিন; পাটের পাতার গন্ধে
ভরে উঠেছে শরীর। এখানে তরমুজ হতো, এটা ছিলো ঘাসখেত,
ওইগুলো বোরোজমি, সোনার মতোই ধান বিছিয়ে থাকতো,
 ওখানে বেগুন হতো, লাউ আর কুমড়ো পড়ে থাকতো
মাটির চাকার মতো; এই চৈত্রে মাঠে কেনো গরু নেই?
দেখতে পাই লাল কালো শাদা গরু, ষাঁড়, অণ্ডহীন অসংখ্য বলদে
 ভরে উঠেছে দূরের ঘাসখেত। এই একটানা সবুজের মধ্যে আমি বসে পড়ি,
আমার ভেতরে ঢুকতে থাকে ধান, পাট, তিল, সরষে, মটর,
 তরমুজ, বাঙি, আমন, আউশ আর বোরোর সুগন্ধ।
কে যেনো আমাকে ডাকে দূর থেকে আমার হারানো নাম ধরে।

*

দেশপ্রেম

আপনার কথা আজ খুব মনে পড়ে, ডক্টর জনসন।
না, আপনি অমর যে-অভিধানের জন্যে, তার জন্যে নয়, যদিও আপনি
তার জন্যে অবশ্যই স্মরণীয়। আমি অত্যন্ত দুঃখিত তার জন্যে
আপনাকে পড়ে না মনে। আপনাকে মনে পড়ে, তবে আপনার
 কবিদের জীবনীর জন্যেও নয়, যদিও তার জন্যেও আপনি অবশ্যই
স্মরণীয়। আমি আবার দুঃখিত, ডক্টর জনসন। আপনার কথা মনে পড়ে
সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে; আপনার একটি উক্তি আমার ভেতরে বাজে
সারাক্ষণ। আড়াই শো বছর আগে একবার আপনার মুখ থেকে
 বের হয়ে এসেছিলো একটি সত্য যে দেশপ্রেম বদমাশদের
শেষ আশ্রয়। আপনার কাছে একটি কথা জানতে খুবই
 ইচ্ছে করে স্যামুয়েল জনসন;–কী করে জেনেছিলেন আপনি
এই দুর্দশাগ্রস্ত গ্রহে একটি দেশ জন্ম নেবে একদিন,
যেখানে অজস্র বদমাশ লিপ্ত হবে দেশপ্রেমে? তাদের মনে করেই কি
আপনার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিলো এই সত্য?
ডক্টর জনসন, আপনি আনন্দিত হবেন জেনে যে বদমাশরা
এখানে দেশের সঙ্গে শুধু প্রেমই করছে না, দেশটিকে
পাটখেতে অলিতেগলিতে লাল ইটের প্রাসাদে নিয়মিত করছে ধর্ষণ।

*

মানুষ ও প্রকৃতি একইভাবে বাঁচে মরে

কতো ভুল বোধ নিয়ে আমরা যে বেঁচে থাকি। আমার ধারণা
 ছিলো মানুষেরই বাড়ে বয়স, মৃত্যু হয়, প্রকৃতি চিরকাল
 সজীব সবুজ। কী করে এমন বোধ জন্মেছিলো
আমার ভেতরে জানি না তা; তবে বুঝি এ-বোধ আমার
একান্ত নিজস্ব নয়, আমাদের জ্ঞানী পূর্বপুরুষেরাই
 দিয়েছিলেন এ-জ্ঞান। তিরিশ বছর পর রাড়িখালে পা রেখেই
 কেঁপে উঠি, চেয়ে দেখি আমার বেড়েছে বয়স,
চারপাশে গাছপালা সবুজ উজ্জ্বল। তাহলে আমারই শুধু চামড়ায়
ভাঁজ, আমার মুখমণ্ডলেই শুধু সময়ের কামড়ের দাগ?
দিন দিন প্রকৃতি হয়েছে সবুজ? আমি সামনে হাঁটি,
একটু পরেই চোখে পড়ে যেই হিজলের নিচে
কেটেছে আমার ভীষণ বৈশাখ, যার ছায়া ছিলো দিঘির মতোই
ঠাণ্ডা, ফুল ছিলো স্বপ্নের থেকেও লাল, সেটি ভেঙে
পড়ে আছে; আরো এগোতেই চোখে পড়ে জরাজীর্ণ
হয়ে আছে আমার বাল্যকালের বিশাল তেঁতুলগাছ,
আর বহুপ্রসারিত বট। তাদের চারপাশে এখন তরুণ
 মেহগনি সেগুনের শিহরণ। বিকেলে বেরোই আমি, বাড়ি বাড়ি
যেতে থাকি, পরিচিত মুখগুলো দেখতে পাই না; অনেকেই
 মরে গেছে, অনেকেই অন্ধ আর অত্যন্ত জীর্ণ।
কিন্তু ঘরের পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে তরুণতরুণী
শিশু, যাদের চিনি না আমি, যারা শুধু শুনেছে আমার
নাম, আমাকে চেনে না। এই গ্রাম আজ
নতুন মানুষ আর প্রকৃতির, যা ছিলো আমার আর ওই হিজলের;
আমি বুঝতে পারি একই সুতোয় গাঁথা মানুষ ও প্রকৃতি একইভাবে
 বাঁচে মরে, পুরোনো গাছের পর দেখা দেয় নতুন গাছেরা।

*

দ্যাখো আমি

দ্যাখো আমি কী রকম হয়েছি সরল;
পঞ্চাশ বছর ছিলাম দুরূহ, মিশরি ধাঁধার থেকেও দুর্জ্ঞেয়,
আজ রাখালের বাঁশি, ঘাস, মেঘ, পুকুরের জল।

একান্নো বছর কাটলো পাগলামোতে দীর্ঘ জাগরণে;
দুঃস্বপ্নে কেটেছে কমপক্ষে সাতটি দশক;
আজ দুই চোখে ঘুম-কচিপাতা-আমলকি বনে।

চল্লিশ বছর বাইরে থেকেছি-ছিন্নমূল আর বহিরস্থিত;
এবার বাঁধবো ঘর নদী কিংবা পুকুরের পাড়ে;
একটি নারীও হয়তো থাকবে সঙ্গে নিবিড় সুস্মিত।

আবার গুছিয়ে তুলবো দুঃখ আর দীর্ঘশ্বাসগুলো ভাঙাচোরা বুকে;
একটি দুপুর ভরে অন্তত তুলবো বাঁশি কিংবা বেহালায় সুর,
 ভুলে যাবো একটি সম্পূর্ণ শতক কেটেছে অসুখে।

দ্যাখো আমি কী রকম হয়েছি সরল;
একটি জীবন ছিলাম দুরূহ, শিল্পের থেকেও দুর্জ্ঞেয়,
 আজ ভোরের বাতাস, মাটি, হাঁস, পুকুরের জল।

*

সেই সব কবিরা কোথায়

সেই সব কবিরা কোথায়, যাঁরা একদিন
কবিতা পেতেন পথেঘাটে, আকাশে জমলে মেঘ
যাঁদের খাতার আদিগন্ত ঢেকে বৃষ্টি নামতো
 থইথই মাত্রাবৃত্ত স্বরবৃত্তে, থরেথরে ফুটতো কদম
পাতায় পাতায়, ভাসতো পথ হিজলের রঙিন বন্যায়?
 কোথায় এখন তাঁরা, সেই সব সহৃদয় কবি,
শিশুর মৃত্যুতে যাঁরা হাহাকার করতেন ছন্দে ছন্দে,
অশ্রুভারাতুর করে তুলতেন বাঁশবাগানের মাথার ওপর
একাকী চাঁদকে, জলে ভরে তুলতেন বুলবুলিটার
চোখ? কোথায় এখন তাঁরা, সেই সব গৃহধর্মী
কবি, ধবলী ফিরেছে কিনা তার জন্যে যাঁরা
 উদ্বিগ্ন থাকতেন, আর শুনতে পেতেন কারা যেনো
খেয়াঘাটে ডাকছে মাঝিরে? সেই সব
কবিরা কোথায়, পল্লীজননীর সাথে যাঁরা সারারাত
 জেগে থাকতেন মুমূর্ষ শিশুর পাশে,
কোথায় কবিরা যাঁরা পায়ের তলায় ঝরা বকুলের
স্পর্শে উঠতেন কেঁপে আর একাকী বিষণ্ণ
তরুচ্ছায়ে সারাদিন বাজাতেন বাঁশি?
 আজকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে সেই
 সব কবিদের মানবিক মুখ, এবং তাঁদের পদ্যে
শূন্য বুক ভরে নিতে।

*

আমরা যখন বুঝে উঠলাম

আমরা যখন বুঝে উঠলাম সেই দুপুরে
ভালোবেসে আমরা খুবই ক্লান্ত, অন্য কিছু
 চাই আমাদের, তখন আমরা একটুকু দূরে
স’রে বসলাম; আমাদের খুব হাল্কা লাগলো,
সারা বন ভরে শুকনো পাতারা ঝরতে থাকলো;
মনে হলো যেনো মাংসের থেকে নেমে গেছে ভার
আমরা যখন বুঝে উঠলাম খুবই দরকার
অন্য কিছু, ভালোবেসে নষ্ট করেছি চোদ্দো বছর,
তখন আমাদের রক্তনালিতে থেমে গেলো জ্বর।
আমাদের খুব শান্তি লাগলো লঘু মনে হলো
 কাঁঠাল পাতায় তখন রৌদ্র অতি ঝলোমলো,
 পাখিদের দেখে মনে হলো আমরা মুক্ত হলাম;
আমরা আরো একটুকু দূরে সরে বসলাম;
মনে হলো আমরা একে অন্যকে চিনি না আর
পালকের মতো হাল্কা লাগলো চমৎকার;
তুমি উঠে ধীরে হাঁটতে লাগলে দিঘির দিকে
আমি হাঁটলাম যেদিক আকাশ হলদে ফিকে;
আমরা দুজন খুব দূরে গিয়ে মুহুর্মুহু
বুকের ভেতর শুনতে পেলাম জলের হুহু;
আমরা তখন অনেক দূরে আমাদের থেকে
দেখতে পেলাম আঁধার নামছে দুপুর ঢেকে;
তখন আমরা দুজনের থেকে অনেক দূরে
 মুঠোয় অশ্রু নিয়ে চেয়ে থাকি সেই দুপুরে।

*

এতোখানি মরে আছি

তোমার কথাও মনে পড়ে না
আর, এতোখানি মরে আছি; এবং যখন
মনে পড়ে তোমাকে ভেবেও আর
কষ্ট পাই না, এতোখানি
মরে আছি। দুপুরে ঘুমোই,
মাঝরাতেও একবারও
 ভাঙে না ঘুম, বুকের ভেতরে কোনো
 দাঁত বেঁধে না আর, এতোখানি
মরে আছি। কেঁপে উঠি না আর
বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা রিকশায়
তোমার মুখের ছায়া দেখে, এতোখানি
মরে আছি। মাঝেমাঝে মনে
পড়ে যখন ছিলাম বেঁচে-ঘুমহীন, রক্তে
নদী আর কারখানার উত্তেজনা, মহাজগতের
 শূন্যতা বুক জুড়ে, মাংসে শুধু ক্ষুধা-ক্ষুধা
ক্ষুধা-ক্ষুধা-ক্ষুধা। ক্ষুধা
 নেই, না মাংসে না বুকে না স্বপ্নে,
 এতোখানি ম’রে আছি। বুকের ভেতরে
 খুঁজে খুঁজে একবারও তোমাকে
পাই না, হাতে ঠেকে না তোমার
মুখ, এতোখানি মরে আছি। কতো দিন
 দেখি না আকাশ ঘাস, এতোখানি ম’রে আছি।
তুমি আজ অন্য শয্যায় পুলকে
 বিহ্বল ভেবেও আর কষ্ট পাই না,
এতোখানি মরে আছি।

*

আমার ভুলগুলো

ভুলগুলো আমার সুন্দর করুণ ভুলে-যাওয়া ভুলগুলো
যেখানে ফেললে পা ফুটতে পারতো রক্তপদ্ম
 ভুলে সেখানে পা ফেলতে পারি নি
আমার রক্তপদ্ম তাই কোনোদিন ফুটলো না

ভুলগুলো আমার বিপ্ন কোমল ভুলে-যাওয়া ভুলগুলো
 যেখানে রাখলে হাত বইতে পারতো ঝরনাধারা
ভুলে সেখানে হাত রাখতে পারি নি
 আমার ঝরনাধারা তাই কোনোদিন বইলো না
ভুলগুলো আমার অমল সুদূর ভুলে-যাওয়া ভুলগুলো
যে-ঠোঁটে রাখলে ঠোঁট জ্বলতে পারতো পূর্ণিমার চাঁদ
 ভুলে সে-ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে পারি নি
আমার পূর্ণিমার চাঁদ তাই কোনোদিন উঠলো না

ভুলগুলো- আমার অমল কোমল ভুলে-যাওয়া ভুলগুলো
যেদিকে তাকালে দেখতে পেতাম বিশুদ্ধ সুন্দর
ভুলে সেদিকে তাকাতে পারি নি
বিশুদ্ধ সুন্দরকে তাই কোনোদিন দেখতে পেলাম না।

ভুলগুলো- আমার সুন্দর করুণ ভুলে-যাওয়া ভুলগুলো
 যে-জলে সাঁতার দিলে পেতে পারতাম অমরতা
 ভুলে সে-জলে সাঁতার কাটতে পারি নি
মুমূর্ষ আজকে তাই অমরতা আমার হলো না

*

স্ত্রীরা

বড়ো বেশি ক্লান্ত, সিঁড়ি ভেঙে ওঠে থেমে থেমে;
 কয়েক ধাপের পর জিরোয় রেলিং ধরে, কাঁপে পদতল;
আঠারো তলার মতো বিবশতা দেহে আসে নেমে,
পশ্চাৎ বক্ষ বাহু তলপেট মাংসের আক্রমণে বিপন্ন বিহ্বল;
বুঝতে পারে না তারা কোথা থেকে এলো এই স্তব্ধ ঘোলা ঢল।

কী যেনো হারিয়ে গেছে, কী যেনো অজ্ঞাতসারে হয়ে গেছে চুরি;
খোঁচা দেয় ভারি ত্বকে, কোথাও জাগে না তবু স্বল্পতম সাড়া,
হাহাকার করে ওঠে- ‘আমরাও একদিন ছিলাম কিশোরী’;
 দিকে দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী নিজেদেরই জরায়ুর কোমল কন্যারা,
পায়রার মতো উড়ে সারা বন মুখরিত করে আছে যারা।

কী দিয়েছে সহস্র সঙ্গম? কী দিয়েছে ফ্রিজ, গাড়ি, সুসজ্জিত গৃহ?
স্বামীরা সম্ভ্রান্ত; আর প্রত্যহ বাড়ছে তাদের যৌন-আবেদন;
তারাই পচলো শুধু? আবর্জনা হয়ে উঠলো তাদেরই দেহ?
স্বামীদের জন্যে আছে একাধিক উপপত্নী, সভা, উল্লসিত বিদেশভ্রমণ;
 বাতিল শুধুই তারা? ময়লায় পরিণত শুধু তাদেরই জঘন?

ক্লান্তিকর ভারি সব কিছু, তবু ক্লান্ত হলে চলবে না তাদের;
 কী করে বইবে ভার? কী করে দমন করবে রক্তের প্রদাহ?
 প্রেম আর কাম কবে মরে গেছে-(তারা আজো পায় নাই টের);
তবুও সযত্নে টিকিয়ে রাখতে হবে নিরন্তর একটি উৎসাহ-
আঁকড়ে থাকতে হবে-সবই পণ্ড যদি পণ্ড হয় পবিত্র বিবাহ।

*

শূন্যতা

শূন্যতাই সঙ্গ দেবে যতো দিন বেঁচে
আছো, শূন্যতাই পূর্ণ করে রাখবে তোমাকে;
অরণ্যে সবুজ হয়ে বেড়ে উঠবে শূন্যতা, শূন্যতার
অরণ্যে তুমি ঘুরবে একাকী; ফাল্গুনে হেমন্তে
শূন্যতার ডালে ডালে ফুটবে শূন্যতা হলদে বেগুনি
 লাল হয়ে, যত দিন বেঁচে আছো; গন্ধ হয়ে
ছড়িয়ে পড়বে দিকে দিকে শূন্যতা, কেঁপে উঠবে
শূন্যতার সুগন্ধে, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়বে
অন্যমনস্ক। যখন দাঁড়াবে গাছের ছায়ায়, ছায়া নয়
শূন্যতাই ঢেকে রাখবে তোমাকে; প্রত্যেক নিশ্বাস
ফুসফুস ভরে দেবে শূন্যতায়, বেঁচে থাকবে
তুমি শূন্যতার শ্বাসপ্রশ্বাসে। পানের সময়
তোমার গেলাশ ভরে রাখবে শূন্যতা, শূন্যতাই
মেটাবে তোমার তৃষ্ণা, মাতাল করে রাখবে
 তোমাকে। ঘুমোবে শূন্যতার ওপর মাথা রেখে বুকে
 জড়িয়ে রাখবে শূন্যতা, ঘুমের ভেতরে দেখবে
স্বপ্ন নয় সীমাহীন এলোমেলো শূন্যতা। শূন্যতাই পড়বে
 তুমি গ্রন্থে গ্রন্থে, আর যা কিছু লিখবে
তার প্রতিটি অক্ষরে লেখা হবে শূন্যতা, শূন্যতাই
 পূর্ণ করে রাখবে তোমাকে, যতো দিন বেঁচে আছো।

*

সামান্য মানুষ

সামান্য মানুষ; অসামান্য কিছু দেখার সৌভাগ্য
 হয় নি, দেখতেও চাই নি কখনো; যে-ক-বছর বেঁচে আছি,
সুখী ও অসুখী হয়ে আছি নিজের মতোই সামান্য ঘটনা
বস্তু আর দৃশ্য নিয়ে। কী করে অসামান্য হবো? চারপাশে
যদি সব ক্ষুদ্র হয়, তুচ্ছ হয় খুব, তাহলে কী করে
অসামান্য হতে পারি আমি? বেশি সংবাদ রাখি না,
গুজবেও কান দিতে ইচ্ছে করে না; তাই দূরে ঘটে যাচ্ছে
যে-সব ঘটনা, অসামান্য ও ঐতিহাসিক, তার থেকে
দূরে আছি; সামান্য মানুষ, বেঁচে আছি নিজের মতোই
সামান্য বস্তুদের নিয়ে। শুনতে পাই দূরে মাঝেমাঝে
ঘটছে অসামান্য কতো কিছু; কিন্তু আমি ধানের গুচ্ছের
 থেকে মহৎ কিছুই দেখি নি। কে কোথায় খুন হলো,
 কোথায় মিশলো কে নামহীন গোরে, সকাল বেলায়
কে দেখা দিলো অধীশ্বররূপে, সে-সব আমার কাছে
 একতাল গোবরের থেকে মূল্যবান মনে হয় নি কখনো; বুঝি
ওই সব মানুষেরা, এবং তাদের সমস্ত ঘটনা অতিশয়
অসামান্য; কিন্তু আমি সামান্য মানুষ কোনোদিন ঢুকি নি প্রাসাদে,
তাই আমি অসামান্য কিছুই দেখি নি। দেখেছি সামান্য
সব কিছু জোনাকি উড়ন্ত তারার মতো একঝোপ
অন্ধকারে, বেলের হলদে শক্ত ডিম, চিতই পিঠার মতো
চাঁদ শ্রাবণের প্লাবিত আকাশে; এসব, এবং এসবের মতো
সামান্য বস্তুতে ভরে আছি আমি। আমার কি লোভ ছিলো দেখতে
অসামান্য কিছু? আমি কি কখনো নিজে অসামান্য হয়ে
উঠতে চেয়েছি? কী করে অসামান্য হবো? অত্যন্ত সামান্য
 মানুষের অধীনে করেছি বাস, অতো তুচ্ছ সামান্যদের অধীনে
থেকে কেউ কি কখনো হয়ে উঠতে পারে অসামান্য? বদ্ধ ঘরে
বাড়তে পারে শালতাল? আমি বেড়ে উঠতে পারি নি;
 সামান্য মানুষ-মাছরাঙা, ঘোলাজল, আউশ, আমন, খড়কুটো,
আমের বউল আর হঠাৎ বৃষ্টির থেকে অসামান্য কিছুই দেখি নি।

*

দ্বিতীয় জন্ম

তখন দুপুর বিকেল হয়েছে, গাছের পাতা
সোনালি এবং সবুজ এবং নরম ঘোলা;
আমরা তখন পৃথিবীর থেকে অনেক দূরে
আমাদের ঘিরে কুয়াশাবিবশ নদীর দোলা।
যেনোবা সবাই আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে
 চলে গেছে আর ফিরবে না আজ নদীর কূলে;
পৃথিবী নীরব বাতাস স্তব্ধ আমরা শুধু
 তাকিয়ে রয়েছি আমাদের দিকে দু-চোখ খুলে।
 তোমার আঙুল আমার আঙুলে মাছের মতো
ঘুরে ঘুরে ঢুকে বেরোতে না পেরে জড়িয়ে পড়ে,
আমি খসে পড়ি তোমার গ্রীবায় ফলের মতো
 দাঁড়াতে পারি না কেঁপে কেঁপে উঠি সোনালি ঝড়ে।
ঝড় বয়ে যায় আমাদের ঘিরে প্লাবন জাগে
নদীতীর জুড়ে খেজুর বাগানে কাশের বনে,
আমরা তখন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে
 বেঁচে থাকবার সাধনা চালাই শরীরে-মনে।
তোমার দু-চোখে জ্বলে ওঠে চাঁদ স্নিগ্ধ শাদা
 দিগন্ত জুড়ে ব্যাকুল বিশাল কামিনী ফোটে,
 আমরা তখন গন্ধে পাগল অন্ধের মতো
দুই ঠোঁট রাখি আমাদের দুই বধির ঠোঁটে।
কুয়াশায় ভরা সেই আশ্বিনে নদীর পারে
বদলে গেলাম, আমাদের পুনর্জন্ম হলো;
 মাটির তখন অনেক বয়স-তিরিশ কোটি
আমরা তখন কুয়াশাকাতর পনেরো-ষোলো।

*

সাপের গুহায়

বাস করে গেছি সাপের গুহায়; সাবধান হতে
শিখি নি কখনো; কতো বিষধর বসিয়েছে দাঁত, ক্ষতে
ছেয়ে গেছে দেহ, বিষে ভরে গেছে নালি,
বিষকে করেছি রক্ত, ক্ষতকে সোনালি রুপালি।

*

দলীয় কবিদের প্রশংসায় কয়েক পংক্তি

তাদের প্রশংসা করি, করবো চিরকাল;
কবিদের বহু বদনাম ঘুচিয়েছে তারা; কবিরা নির্বোধ,
অবাস্তব, জানে না কোন দিকে নোয়ালে মাথা
 জুটবে স্বর্ণ, লক্ষ্মী খুলবে কাপড়, এই সব অখ্যাতি
 ঘুচিয়েছে তারা। তাদের প্রশংসা করি। তাদের মুখের
দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন বাল্মীকি, চণ্ডীদাস,
রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, জীবনানন্দ। তারা অবশ্য
 বাল্মীকিরই উত্তরাধিকারী, কেননা ওই প্রচণ্ড দস্যু
 পরে নিজের সুবিধা বুঝে একটি সম্পূর্ণ কাব্য
লিখে গেছে একটি রাজার স্তুতিগান করে, বিনিময়ে
নিশ্চয়ই পেয়েছে তমসার তীরে দুশো বিঘে জমি, একপাল
গাভী, একটি ভবন, আর একখানি গতিশীল রথ।
দলীয় কবিরা আজ রাজাদের পদতলে রাখছে
পদ্য, থেকে থেকে ধ্বনিত করছে স্তব; এবং কবিতা
পাচ্ছে মূল্য রাজাদের পায়ের ছোঁয়ায়; তাদের প্রশংসা করি,
এই সব দলীয় কবিরা মুখ ভরে কলঙ্কের বিনিময়ে কবিতাকে
না বাঁচালে কে এই দুঃসময়ে  বাঁচাতো কবিতাকে।

*

আষাঢ়ের মেঘের ভেতর দিয়ে

আকাশে জমাট মেঘ, গর্জনে শিউরে উঠছে
গাছপালা, গাছের প্রতিটি পাতা
বৃষ্টির ছোঁয়ার জন্যে তরল সবুজ।
 আমাকে অনেক দূর যেতে হবে, অন্তত পাঁচ মাইল
যেতে হবে বৃষ্টির আগেই। এ-বয়সে
বৃষ্টিতে ভেজা ভালো নয়; আমার সামনেই
 তিনটি স্কুটার দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারা কথা দিচ্ছে
নিরাপদে পৌঁছে দেবে বৃষ্টির আগেই।
কিন্তু এ কী, আমার ভেতরে
আমি টের পাই জেগে উঠছে মেঘ বজ্র
বৃষ্টি আর বিজলির ক্ষুধা-আমি হাঁটতে
শুরু করি; আর অমনি আকাশ চৌচির
 হয়ে ভেঙে গলে ঝরে পড়তে
থাকে বৃষ্টি, অন্ধকার হয়ে আসে সমস্ত সবুজ,
 বজ্রে কেঁপে ওঠে মাটি আর জল, এঁটেল কাদার
মতো হয়ে ওঠে সন্ধ্যা। আমি দৌড়োই
 পিছলে পড়ি আবার দৌড়োই-আশ্চর্য সুখে
আমার ভেতরে জেগে ওঠে একটি বালক,
 যাকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম
 ১৩৭০-এর এমনই আষাঢ়ে।

*

কী নিয়ে বাঁচবে ওরা

কী নিয়ে বাঁচবে ওরা শেষ হলে ফ্লোর শো। যখন
থামবে ড্রাম, অর্গান; ঝিলিক আসবে নিভে প্রেক্ষাগারে,
ক্লান্তি নামবে দেহ জুড়ে; শেষ হবে তীব্র আলিঙ্গন,
চুম্বন, সঙ্গম, আর হাহাকার উঠবে শেয়ার বাজারে;
 ওদের ভেতরে কোনো নদী নেই, মেঘ জমে আসে না আকাশে,
কাঁপে না শিশির, ভোরের অনেক আগে বাজে না দোয়েল;
বজ্র নেই, বৃষ্টি নেই, হঠাৎ আকাশ ফাড়া বিদ্যুতের ত্রাসে
 ওদের ভেতরে জন্ম নেয় না স্বপ্ন; রক্ত থেকে ঝরে শুধু তেল,
গাড়ি, ফ্রিজ, টেন্ডার, লেনদেন; কাল এবং পরশু
 কী নিয়ে বাঁচবে ওরা শেষ হলে এই উৎসব, এই ফ্লোর শো।

*

সাধারণ মানুষের কাজের সৌন্দর্য

যাকে ঠিক কাজ বলা যায়, আজ মনে হয়, কখনো করি নি।
যা করেছি তা নিয়ে আজকাল আমি খুবই বিব্রত; আমার
লোমকূপ দিয়ে কোনোদিন দরদর করে ঝরে নি রক্ত নোনা ঘাম
 হয়ে, কখনো ক্ষুধায় ভেতরে বিস্ফোরিত হয় নি অগ্নিগিরি;
ঘাম আর আগুনে বাসের অভিজ্ঞতা আমার হয় নি।
আমার শ্ৰেণীরা যা করে তা দেখেও কখনো আমি মুগ্ধ হই
নি, তাদের কাজে আমি কোনোদিন কোনো সৌন্দর্য দেখি নি।
তাদের উদ্বেগ নেই রক্তে, তাদের ভেতরে কোনো ঘাম
নেই, তাদের পেশিতে কোনো টান নেই, শীততাপনিয়ন্ত্রিত
 কক্ষে আমি কোনোদিন কোনো কাজই দেখি নি।

একটি বালক ইঁট ভাঙছে; তার কাজের সৌন্দর্যে ভয় পেয়ে
 আমি হঠাৎ থমকে দাঁড়াই, দেখি হাতুড়ির নিচে ভাঙছে সে তার
সামান্য জীবন; একটি বালিকা মেশিনে শেলাই করছে
 তার অন্ধ বর্তমান, আমি ওই সৌন্দর্যে কেঁপে উঠি; দিকে দিকে
 দেখতে পাই সাধারণ মানুষের কাজের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য।

ক্ষুধার্তরা কাজ করে; ক্ষুধার্তদের কাজেরই শুধু সৌন্দর্য রয়েছে,
যা জীবনের মতোই ভয়ঙ্কর; আলিঙ্গন চুম্বন সেতারের ঝালার
থেকে অনেক সুন্দর ট্রাক থেকে ইট কাঠ বালু নামানোর
দৃশ্য; প্রচণ্ড সুন্দর ঠেলাগাড়ির পেছনে একজোড়া পায়ের দৃঢ়তা-
 ঘাম আর ক্ষুধা আর রক্ত থেকে জন্ম নেয়া আশ্চর্য সুন্দর।

*

ভালোবাসবো, হৃদয়

ভালোবাসবো, হৃদয়, তুমি সাড়া দিলে না।
শুধু দাউদাউ জ্বলে উঠলো রক্ত
দাবানলে পুড়লো স্বর্ণলতা, ছাই হলো
শাল তাল শিমুল সেগুন, দিগন্ত জুড়ে
দগদগ করতে লাগলো একটা গনগনে ঘা।

ভালোবাসবো, হৃদয়, তুমি সাড়া দিলে না।
শুধু মাংস গললো এঁটেল মাটির মতো
 বিষাক্ত কাবাবের গন্ধ উঠতে লাগলো
প্রত্যেক কোষ থেকে, তার ভেতর থেকে
 ঝরতে লাগলো অবিরাম লকলকে লালা।

ভালোবাসবো, হৃদয়, তুমি সাড়া দিলে না।
একপাল কুকুরের মতো এগিয়ে এলো ওষ্ঠ
 মাতালের মতো টলতে টলতে এলো একজোড়া
হাত, আর একটা মত্ত অন্ধ অজগর
 ঢুকতে লাগলো অন্ধকার আদিম বিবরে।

ভালোবাসবো, হৃদয়, তুমি সাড়া দিলে না।

*

অশ্রুবিন্দু

বেরিয়ে এলাম একা শূন্য লঘু বিবর্ণ মলিন।
আমার পেছন জুড়ে শূন্যতা; ফিরে তাকানোর সামান্য সাহস
 হলো না, সত্যিই যদি শূন্যতা দেখতে পাই দাঁড়িয়ে রয়েছে
তোমার মতোই দরোজায়, তাহলে কীভাবে ফিরবো ঘরে?
কীভাবে হাঁটবো আরো তিন যুগ ধরে?

জানালায় দাঁড়িয়ে হয়তো তুমি দেখছো জটলাবিহ্বল পথে
বাতাসের তাড়া খেয়ে এদিক সেদিক অসহায় বিব্রত উড়ছে
একটা ছেঁড়া কাগজের টুকরো, কেউ ছিঁড়েফেড়ে
উড়িয়ে দিয়েছে–ছেঁড়া কাগজের মতো আমি উড়ছি রাস্তায়।

হয়তো দেখছো একটা শুকনো পাতা খসে পড়লো চৌরাস্তার
 তুচ্ছ গাছটির ডাল থেকে। এর আগে চৌরাস্তার গাছটিই
পড়ে নি তোমার চোখে; আজ দেখছো চোখ ভরে একটা মুমূর্ষ পাতা
ভাঙা ময়লা প্রজাপতির মতো আটকে যাচ্ছে রিকশার চাকায়।

 যত দূর দেখতে পাচ্ছো তুমি দেখছো শুধু ধুলোবালি, আবর্জনা,
ধ্বংসস্তূপ; আকস্মিক ভূমিকম্পে ধসে গেছে সমগ্র শহর;
 হয়তো দেখছো তুমি ধসে পড়া টাওয়ারে তলে পিশে গেছে
একটা তুচ্ছ কাক; তুমি ওই কাকটিকে চিনতে পারছে না।

হয়তো এখনো তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্যমনস্ক জানালায়;
এবং দেখছো তোমার চোখের সামনে কোনো রাজধানি,
আকাশ ও মেঘ নেই; শুধু দূরে, বহু দূরে, টলমল করছে একবিন্দু অশ্রু
 তোমারই চোখ থেকে গলে পড়ছে তোমার মুঠোতে।

*

এটা কাঁপার সময় নয়

এটা কাঁপার সময় নয়, যদি সারা রাজধানি থরথর করে ওঠে
ভূমিকম্পে, ভেঙে পড়তে থাকে টাওয়ার গম্বুজ, তাহলেও স্থির দাঁড়িয়ে
থাকতে হবে একলা তোমাকে, পঞ্চাশ তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছে।

স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে, অবিচল, মুহূর্তের জন্যেও একটুও টলবে না।

তুমি তো জানোই তোমার সামনে আর কিছু নেই, সামনের কিছুই আর
মূল্যবান নয়, সবই তুচ্ছ নিরর্থক তোমার নিজের জন্যে,
তবুও তোমাকে বুনে যেতে হবে বীজ নামাতে হবেই বৃষ্টি সারা ক্ষেত জুড়ে।

স্থির জ্ঞানী চাষীর মতোই বীজ বুনে যাবে, মুহূর্তও অন্যমনস্ক হবে না।

তোমার সামনে আছে মরুভূমি, তোমার দায়িত্ব ওই মুমূর্ষ মাটিকে
সবুজের সমারোহে আদিগন্ত ভ’রে তোলা; তোমার সামনে শুধু বিকট পাথর,
তোমার দায়িত্ব ওই পাথরের দেহ থেকে রূপ ছেনে আনা।

প্রাজ্ঞ শ্রমিকের মতো কাজ করে যাবে, মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নেবে না।

কিছুই নিজের জন্যে নয় মনে রেখো, ভুলে যাও কামুক ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন,
আর স্বর্ণচাপা; তার জন্যে কামময় পুরুষ রয়েছে; তোমার দায়িত্ব
শুধু নিজেকেই জ্বেলে জ্বেলে রূপময় শরতের জ্যোত্সা ঢেলে যাওয়া।

চোখ অন্ধ করে জ্যোৎস্না জ্বালো, তুমি দেখবে না, অন্যরা দেখুক।

কাঁপবে না, একবারও টলে উঠবে না; হও অদ্বিতীয় নৃশংস নিষ্ঠুর
 নিজেরই প্রতি, কোনো দীর্ঘশ্বাস যেনো বুক থেকে
বেরিয়ে না আসে, শুধু বেরোক ঝরনা পাখি চাঁদ অথবা কবিতা।

এটা কাঁপার সময় নয়, স্থির হও, মুহূর্তের জন্যেও আর কেঁপে উঠবে না।

*

লেজারুস

গরিব ছিলাম না কখনো, ভিখিরি তো নয়ই, বরং ছিলাম অদ্বিতীয়
ধনসম্পদ স্বর্ণমুদ্রায়, এটা গর্ব নয়; ক্ষমতায়ও সম্ভবত কেউ সমান ছিলো না;
দক্ষিণ সমুদ্র থেকে উত্তর সমুদ্র মেঘেল পর্বত থেকে হীরক পর্বত
আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত ছিলো আমার শস্যশ্যামল রাজ্য, আজ সবই
 জীর্ণ উপকথা, অন্নহীন বস্ত্রহীন জড়াগ্রস্ত মুমূর্ষ পড়ে আছি চৌরাস্তায়।
কণ্ঠ ছেঁড়া বলে কেউ শুনতেও পায় না আমার তীব্র হাহাকার।

ছিলাম অজস্র সোনার খনির অধিপতি, মাটির গভীর নিচে অন্ধকার
কয়লা পেরিয়ে ঝলমল করতো আমার হীরকরাশি; আমার সমুদ্রে
ঝিনুকেরা ঋতুতে ঋতুতে গর্ভবতী হতো উজ্জ্বল মুক্তোয়; আমার জমিতে
 বৈশাখে আশ্বিনে পেকে উঠতো সোনারুপো, উদ্যান আর অরণ্য
জুড়ে ছিলো দিনরাত পাখি আর পুষ্পের মধুর উল্লাস।
আজ কিছুই আমার নেই, আমি আছি কি না তাও বুঝতে পারি না।

আমার আকাশে ছিলো সংখ্যাহীন চাঁদ, আমি চাইলেই উঠতো
পশ্চিমে, মধ্য-আকাশে, আমি চাইলেই বসন্তের বাতাস বইতো পৌষ
মাসে, মাঘের নিশীথে আম হিজলের ডালে বসে ডাকতো পাখিরা;
আমার স্বাস্থ্য ছিলো, এবং যৌবন, সৌন্দর্যও সামান্য ছিলো না,
একদিন পারতাম জাগাতে সুর পাথরে আমার আঙুল বুলিয়ে।
আজ কিছু নেই, আমার আঙুল আজ পচে পচে অদৃশ্য বিলীন।

লেজারুসের থেকেও নিঃস্ব আমি আজ, মূঢ়তায় ধ্বংস
করেছি রাজ্য, অপচয়ে সমস্ত সম্পদ, মুদ্রা; আমার সোনার খনি
ভরে আজ আবর্জনা, দুর্লভ সোনাকে আমি আবর্জনায় পরিণত করেছি;
আমার আকাশে কোনো চাঁদ নেই, একরত্তি জমিও আমার নেই,
চৌরাস্তায় পড়ে আছি নিঃস্ব, স্বাস্থ্যহীন, কুষ্ঠআক্রান্ত ভিখিরি।
লেজারুসের থেকেও নিঃস্ব, যার ভিক্ষাভাণ্ডে একটি কণাও পড়ে না।

*

আমি কি পৌঁছে গেছি

আমি কি পৌঁছে গেছি, আমার মাংসের কোষে কোষে কিলবিল
 করছে অজেয় পোকারা? ঘোলাটে হয়েছে রক্ত? আমার ভেতরে
বেড়ে চলছে গোরস্থান? মগজের পথে পথে চলছে মিছিল
প্রেতদের? যেই সব সোনা ছিলো পচে গেছে? পদ্মরা কি চরে
আটকে মরে গেছে? ডাল থেকে ঝরে যাচ্ছে পাতা আর পাখি?
বহু দূর যাব ইচ্ছে ছিলো, এরই মধ্যেই ধূসর বাদামি
পাল দেখতে পাচ্ছি? হাহাকার ওঠে রক্ত জুড়ে, সাধ ছিলো ধরে রাখি
 হাত। কিন্তু আমি কি পৌঁছে গেছি, এতো দ্রুত পৌঁছে গেছি আমি?

*

প্রিয় মৃতরা

খুব প্রিয় মনে হচ্ছে মৃতদের আজ। সেই সব মৃত যাদের দেখেছি
এবং দেখি নি। তাদের হাঁটতে দেখি দূরে কাছে, একা একা, কণ্ঠস্বর
শুনি খুব কাছে থেকে বুকের ভেতরে। যারা এসেছে এবং আমি গেছি
 যেই সব মৃতদের কাছে, যখন সবুজ পাতার মতো উজ্জ্বল অক্ষর
ছিলো তারা। কেউ লাল জামা গায়ে মাঠে যাচ্ছে, কালো মুখে কেউ
ফিরে আসছে ঘরে, কবিতা পড়ছে কেঁপে কেঁপে, রূপে বহু রূপে
দেখি প্রিয় মৃতদের, আমাকে দোলায় ঠাণ্ডা কালো সমুদ্রের ঢেউ।
আমার ভেতরে ঢুকে কী যেনো খুঁজছে তারা ম্লান মুখে খুব চুপে চুপে।

*

ভাঙন

অনেক অভিজ্ঞ আজ আমি, গতকালও ছিলাম বালক
 মূর্খ জ্ঞানশূন্য অনভিজ্ঞ; আজ আমি মৃতদের সমান অভিজ্ঞ।
মহাজাগতিক সমস্ত ভাঙন চুরমার ধরে আছি আমি
রক্তে মাংসকোষে, আমি আজ জানি কীভাবে বিলুপ্ত হয়
নক্ষত্রমণ্ডল, কীভাবে তলিয়ে যায় মহাদেশ
অতল জলের তলে। রক্তে আমি দেখেছি প্রলয়, চূড়ান্ত ভাঙন।
 ধসে পড়ছে অজেয় পর্বত, সূর্য ছুটে এসে ভেঙে পড়ছে
আমার তরল মাংসে, আগুন জ্বলছে, অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে,
যেখানে পাখির ডাক নেই, নেই এক ফোঁটা তুচ্ছ শিশির।
অনেক অভিজ্ঞ আমি আজ, মৃতদের সমান অভিজ্ঞ।

*

প্রেম

প্রেম, দ্বিতীয় নিশ্বাস, এই অসময়ে তুমি হয়তো অমল
থাকবে না। ঘিনঘিনে নোংরা মাছি ঢুকতে পারে
তোমার ভেতরে, পচন ধরাতে পারে, পচনের কাল আসে
একদিন সব পুষ্পেরই, পচে যেতে পারো তুমি, প্রেম,
অজস্র ওষ্ঠ দিয়ে আমি চেটে নেবো সমস্ত পচন, শুষে নেবো পুঁজ,
শুদ্ধ করে তুলবো তোমাকে। পড়ে যেতে পারো তুমি
অতল পাতালে, ডুবে যেতে পারো উদ্ধারহীন আবর্জনায়,
পাক থেকে তুলে আনবো অসংখ্য ওষ্ঠের আদরে আমার দূষিত
পতিত সুন্দর, পরিশুদ্ধ করে তুলবো শুভ্র পদ্ম, সরোবরে
ভাসবে তুমি শুদ্ধ রাজহাঁস। ক্ষয়ে যাবো আমি,
খসে পড়বে ওষ্ঠ, গলে যাবে চোখ, বধিরতা হবে সঙ্গী, হৃৎপিণ্ড ছেয়ে
 যাবে ঘায়ে, পচবে মগজ, তুমি থাকবে অনশ্বর বিশুদ্ধ অমল।

*

নিরাময়

রাতভর দুঃস্বপ্নের পর ভোরে উঠে যার মুখ দেখলাম
 তাতেই উঠলো ভরে রক্ত, শাদা লাল কণিকারা
কেঁপে উঠলো সুখে–একটি চড়ইয়ের ঠোঁট থেকে ঝরছে
রোদ, ডানা থেকে সোনার গুঁড়োর মতো ছড়িয়ে পড়ছে
অমল জীবন। বারান্দায় খুঁটে খুঁটে আমি জীবন কুড়োতে থাকি,
 আমার বিষাক্ত ঠোঁটে জড়ো হয় মধু, আমার ভেতর
থেকে কেটে যেতে থাকে মধ্যরাত, লাশের গন্ধ, শেয়ালের ডাক,
ভোর হতে থাকে আমার ভেতরে নরম কুয়াশা আর শিশিরের
রূপ গলে গলে; তার কণ্ঠ থেকে ঝরতে থাকে
সুর না অমৃত আমি বুঝতে পারি না, আমি শুধু ঝরনাধারায়
 নিজেকে ডুবিয়ে পান করে চলি অমল জীবন।

*

দীর্ঘশ্বাস

আমাদের চুম্বন আজ দীর্ঘশ্বাস।
নগ্ন আলিঙ্গন রক্তের হাহাকার।
অশ্রু হয়ে গলে পড়ে ওষ্ঠ ও আঙুল
খসে পড়া মাংসে বাজে বেহালার
ব্যর্থ সুর। জানালায় কেঁদে যায় রাতের বাতাস।
 নগ্ন আলিঙ্গনে আছি–তবু কতো দূর,
হাজার বছরে আর নিজেদের কাছে হয়তোবা
পৌঁছোতে পারবো না, শুধু শুনি সুর
ভারাক্রান্ত বাঁশরির, প্রত্যেক লোমকূপ চেনা
ছিলো আমাদের, একই শয্যায় আমরা, তবু আজ
নিজেদের চোখ আজ নিজেদের চিনতে পারে না।
 নগ্ন আলিঙ্গন আজ ঠাণ্ডা দীর্ঘশ্বাস।
হাহাকার করে পাখি আর মাঘের বাতাস।
আমাদের চুম্বন আজ হাহাকার।
 সবাই নিশ্বাসে বাঁচে, আমরা বেঁচে আছি
দীর্ঘশ্বাসে, আমাদের ঘিরে কাঁদে রাত্রি
 কুয়াশার জ্যোৎস্নার চাঁদের তারার।
আমাদের চুম্বন আজ দীর্ঘশ্বাস।
চায়ের পেয়ালা ভরে অশ্রু বিষণ্ণ আকাশ।