মার্কারের সঙ্গে বিলিয়ার্ডস খেলতে খেলতে প্রিন্সিপাল সাহেব দারুণ একটা ‘ব্রেক’ করলেন। কিন্তু এর জন্যে তাঁকে বাহবা দেবার জন্যে সন্ধ্যা বেলা ক্লাবে মার্কার ভিন্ন আর কেউ ছিল না।

‘শাবাশ হুজুর! শাবাশ! বহুত ফাস কিলাস!’ মার্কার তাঁকে হাস্যমুখে অভিনন্দন জানাল। তাঁর কাছ থেকে তাঁর কিউ চেয়ে নিয়ে চক ঘষতে লাগল ওর ডগায়।

‘কিন্তু আজ জজসাহেবের এত দেরি হচ্ছে কেন?’ প্রিন্সিপাল সাহেব তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্বিতীয় কি তৃতীয় বার এই প্রশ্ন করলেন।

মার্কার বলল, ‘শায়দ মালুম হোতা কি জজসাব আজ নেহি আওয়েঙ্গে হুজুর।’ পরবর্তী প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা না করেই উত্তর দিল, ‘বড়া জবর খুনি মামলা হুজুর।’

খুনি মামলা শুনে প্রিন্সিপাল বিস্মিত হলেন না, কিন্তু জজসাহেব আসবেন না শুনে খেলা থেকে তাঁর মন উঠে গেল। মার্কারের সঙ্গে কাঁহাতক খেলা যায়। যেন সে তাঁকে জিতিয়ে দেবে বলে বদ্ধপরিকর। ওই ‘ব্রেক’-টা তা বলে মার্কারের অনুগ্রহ নয়। কিন্তু মজা হচ্ছে এই—জজসাহেবের সঙ্গে খেলবার সময় এত বড়ো একটা ‘ব্রেক’ হয় না।

এবার মার্কারের পালা। সে ওস্তাদ লোক। ছেলেবেলা থেকে এই কর্ম করে আসছে। একবার আস্তে আলগোছে কিউ ছুঁইয়ে দেয়, অমনি খেলার টেবিলের সবুজ মসৃণ আস্তরণের উপর দিয়ে সাদা বল গড়িয়ে যায় ধীর মন্থর গতিতে। অব্যর্থ তার টিপ। পট করতে চায় পট হয়, ইন অফ করতে চায় ইন অফ, ক্যানন করতে চায় ক্যানন। কিন্তু ইচ্ছে করেই সে পয়েন্ট সংখ্যা বাড়তে দেয় না। প্রিন্সিপালকে হারিয়ে দেওয়া তার পলিসি নয়। সে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে পিছিয়ে থাকে।

মার্কারের সঙ্গে খেলে প্রিন্সিপাল সাহেব জয়ী হন, কিন্তু জয়গৌরব পান না। সেদিন আরও কিছুক্ষণ খেলে তিনি কিউ ফেরত দিলেন। মার্কার একটু সকাল সকাল বাড়ি যাবার তালে ছিল। একগাল হেসে হাসি চেপে বলল, ‘বড়ি আফশোসকি বাত হুজুর। জজসাব আজ আনেওয়ালা নেহি হ্যায়।’

তারপর সেলাম ঠুকে পুছল, ‘হুজুরকা ওয়াস্তে’?

প্রিন্সিপাল নিজেই নিজেকে পান করাচ্ছেন। হুকুম করলেন, ‘পানি।’

‘বহুত খুব।’ বলে মার্কার সেলাম ঠুকে অদৃশ্য হল।

এমন সময় শোনা গেল বাইরে মোটরের আওয়াজ। মার্কার সেই দিকেই ছুটল।

‘হ্যালো প্রিন্সিপাল।’

‘হ্যালো জজ।’

দুজনে দুজনের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। দুজনেই উৎফুল্ল। কিন্তু সবচেয়ে উৎফুল্ল হল মার্কার। যদিও সবচেয়ে দুঃখিত। হয়েছে এখন তার বাড়ি যাওয়া। জজসাহেব আর প্রিন্সিপালসাহেব একসঙ্গে খেলতে শুরু করলে রাত ন-টার আগে ছুটি মিলবে না। একটু সরে দাঁড়িয়ে থেকে একবার এঁকে ‘শাবাশ’ ও একবার ওঁকে ‘বাহ বাহ’ দিতে হবে। মাঝে মাঝে কিউ হাতে নিয়ে চক মাখিয়ে দিতে হবে। ডাকলে খেলা দেখিয়ে দিতে হবে। ঝগড়া বাঁধলে আম্পায়ার হতে হবে। আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর পুছতে হবে ‘হুজুরকা ওয়াস্তে’? নেপথ্য থেকে নিয়ে আসতে হবে ফরমাইশি পানীয়।

জজ আর প্রিন্সিপাল দুজনে দুটো কিউ বেছে নিয়েই হাঁক ছাড়লেন, ‘মার্কার।’ তা শুনে মার্কার সেলাম ঠুকে হাজির হতেই এককন্ঠে বললেন, ‘পুছো।’

বেচারা পড়ে গেল উভয়সংকটে। যদি জজসাহেবকে পহিলে পোছে তাহলে তার মানে দাঁড়ায় সে প্রিন্সিপালসাহেবের হুকুম পহিলে মানে। আর যদি প্রিন্সিপালসাহেবকে আগে প্রশ্ন করে তবে তার কাছে জজ সাহেবের আদেশ অগ্রগণ্য। বহুকালের মার্কার। চাকরিটা এককথায় যাবে না। তবু কাজ কী কাউকে চটিয়ে? সাহেবসুবোদের মেহেরবানিতে তার ছেলে ভাইপো ভাগনে জামাই কেউ বসে নেই। শীতের এই ক-মাস পরে হুজুরদের আপিসে ‘পাংখা পুলার’ দরকার হবে। তখন জ্ঞাতিদের জন্যে দরবার করতে হবে তো!

মার্কার জানত যে প্রিন্সিপালসাহেব যদিও বিদ্বানশ্রেষ্ঠ ও বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে, তবু জজসাহেব হলেন দন্ডমুন্ডের মালিক। চাইকী ফাঁসি দিতে সমর্থ। স্ব এলাকায় তাঁকেই পূজা করতে হয়।

‘হুজুরকা ওয়াস্তে?’ সে প্রিন্সিপালসাহেবকেই আগে পুছল।

তিনি হেসে ফেললেন। যা ভেবেছিলেন তাই। বললেন, ‘নেম্বু পানি।’

জজ বললেন, ‘জিন।’

এরপরে দুজনে খেলায় মেতে গেলেন। তাঁদের মুখে কেবল খেলার বুলি। মতভেদ হলে মার্কারকে ডাকেন। সেক্ষেত্রে তার বাক্যই আপ্তবাক্য। সে তখন কারও মুখ চেয়ে রায় দেয় না। তারও একটা কোড আছে। তার দিকে তাকালেই বোঝা যায় সে তার মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন। জান গেলেও সে তার মহিমা থেকে বিচ্যুত হবে না। অন্যায় করে জজসাহেবকে জিতিয়ে দেবে না। যদিও তার মাইনে হয়তো জজের মাইনের শতাংশ। সাহেবরাও তাকে চটাতে চান না। সে যদি চাকরি ছেড়ে দেয় আর ওরকম ওস্তাদ পাওয়া যাবে না।

সেদিন খেলা কিন্তু জমল না। জজ অন্যমনস্ক ছিলেন। তাঁর কিউ বার বার বল ছুঁতে গিয়ে কুশন ছোঁয় কিংবা তাঁর বল অপর বলকে ছুঁতে না পেয়ে ভ্রষ্ট হয়। মার্কার পয়েন্টের হিসেব রাখে। বোর্ডের দিকে নজর পড়লে তিনি শিউরে ওঠেন। মাইনাস পয়েন্ট। তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন ‘নো লাক।’

‘ব্যাপার কী, সুর?’ প্রিন্সিপাল বললেন, ‘তুমি যে একেবারেই খেলছ না?’

‘আর বল কেন মৈত্র?’ জজ বললেন পাংশুমুখে, ‘যেখানে একজনের প্রাণ নিয়ে টানাটানি সেখানে আর একজন খেলা করবে কোন সুখে? খেলতে পারো তোমরা মাস্টাররা। তোমরাই ভাগ্যবান।’

প্রিন্সিপাল প্রতিবাদ করলেন। বললেন, ‘মানুষকে ফাঁসি দিতে সকলেই পারে, কিন্তু মানুষের ছেলেকে মানুষ করে দিতে পারে ক-জন! অথচ মজুরি কিনা তাদেরই সবচেয়ে কম!’

‘ফাঁসি দিতে সকলেই পারে!’ জজ আশ্চর্য হলেন। ‘বাইশ লাখ লোকের এই দুই জেলায় মাত্র এক জনকেই সে-ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমি হলুম ওয়ান ইন টু মিলিয়ানস।’

মাথার চুল চামরের মতো সাদা আর নরম। কিন্তু বয়স এমন কিছু হয়নি। সবে চল্লিশের কোঠায় পড়েছে। আঁটসাঁট মুখমন্ডল। ঠোঁট জবা ফুলের মতো রাঙা। সিভিলিয়ান মানুষ পান খান না। এ রং কৃত্রিম নয়। চেহারাও বাঙালির পক্ষে অসাধারণ ফর্সা। তিন-চার বছর অন্তর অন্তর বিলেত ঘুরে আসা অভ্যাস। বিয়ে করেননি। জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেন, ‘হাতে কিছু জমলে তো বিয়ে করার কথা ভাবব।’

ওদিকে প্রিন্সিপাল হচ্ছেন গ্রাস উইডোয়ার। তাঁর স্ত্রী থাকেন কলকাতায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে। ভদ্রলোক প্রেসিডেন্সি কলেজে দীর্ঘকাল থাকার পর এই প্রথম প্রিন্সিপাল পদ পেয়ে মফস্সলে বদলি হয়েছেন। যদি ভালো না লাগে তবে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন। নাই-বা হল প্রোমোশন। আর যদি ভালো লাগে তাহলে সবাইকে নিয়ে আসবেন। একদা লণ্ডনে পড়েছেন। সে-সময় জজ ছিলেন তাঁর সমকালীন ছাত্র।

‘তোমার অত মাথাব্যথা কীসের?’ প্রিন্সিপাল বললেন জজের শুক্ল কেশের ওপর কটাক্ষ করে, ‘সিদ্ধান্তটা তো তুমি করতে যাচ্ছ না হে! করবে জুরি। জুরি যদি বলে আসামি ৩০২ ধারা অনুসারে অপরাধী আর তুমি যদি একমত হও তাহলে আইনে বলে দিয়েছে তুমি তাকে ফাঁসি দেবে। যদি-না তুমি তার অপরাধ লাঘব করার মতো কোনো অবস্থা দেখতে পাও। সেক্ষেত্রে তুমি দ্বীপান্তরের আদেশ দেবে। এই পর্যন্ত তোমার স্বাধীনতা। যেখানে স্বাধীনতা নেই সেখানে দায়িত্ব নেই। যেখানে যতটুকু স্বাধীনতা সেখানে ততটুকু দায়িত্ব।’

মৈত্র কিছুদিন ব্যারিস্টারি করেছিলেন। পসার জমেনি। ধাতটা পন্ডিতের। ভালো ডিগ্রি ছিল। ডিপিআই-এর সঙ্গে দেখা করতে না করতেই অমনি নিযুক্তিপত্র এল। সিদ্ধান্তটা তিনি সরকারি চাকরির বয়স পেরিয়ে যাবার আগেই নিয়েছিলেন। নইলে তাঁর মুখেও শোনা যেত ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায়’ মাইকেলের মতো।

তর্ক করতে করতে তাঁরা টেবিল ছেড়ে কিন্তু কিউ হাতে করে অদূরে উঁচু বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন। মার্কার ধরে নিল যে তাঁরা একটু পরে নেমে এসে খেলা চালিয়ে যাবেন। কাশতে কাশতে সে বাইরে গেল জজসাহেবের শোফারের সঙ্গে গল্প করতে।

‘হায় বন্ধু!’ জজ বললেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘যদি অত সহজ হত! কী করে আমি তোমাকে বোঝাব যে বিচারের পরিণামের জন্যে জুরির চেয়ে আমারই দায়িত্ব বেশি। তোমার কথায় মনে পড়ল আর একজনের কথা। তিনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, যাকে মারবার তাকে শ্রীভগবান স্বয়ং মেরে রেখেছেন। হে অর্জুন, তুমি শুধু তাঁর হাতের অস্ত্র। নিমিত্ত মাত্র ভব সব্যসাচী।’

‘ওই গীতার বচনই শেষ কথা। সমস্ত দায় ওই ব্যাটা ভগবানের। তোমার আমার কীসের দায়! অত বেশি সিরিয়াস হতে যাই কেন আমরা! প্রতিদিন এ জগতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরছে। একটা মানুষ বেশি মরলে কী আসে-যায়!’ প্রিন্সিপাল উদাসীনভাবে বললেন।

‘মরবে মরুক, কিন্তু আমার হাত দিয়ে কেন মরবে? কপালের দোষে মরতে পারে, কিন্তু বিচারের দোষে কেন মরবে? এক জনও নির্দোষ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায় এই আমাদের ধর্মাধিকরণের মূলনীতি। আমি সেই মূলনীতির সংরক্ষক। মাথাব্যথা আমার হবে না তো কার হবে? আমি এটাকে সিরিয়াসভাবে নিই।’ জজ নাছোড়বান্দা।

‘বেশ। তোমার ভাবনা তোমার। মাঝখান থেকে আমারই সন্ধ্যাটা মাটি। মার্কার! মার্কার ব্যাটা ভাগল কোথায়?’ প্রিন্সিপাল হাঁক দিলেন।

মার্কার পাগড়ি খুলে রেখে আরাম করছিল। পাগড়ি বাঁধতে বাঁধতে ছুটে এল। তখন প্রিন্সিপাল বললেন, ‘পুছো।’

‘না না, এবার তোমার পালা নয়, আমার পালা। মার্কার!’ জজ ইঙ্গিত করতেই মার্কার তাঁর আদেশ মান্য করল। প্রিন্সিপালের পাশে সেলাম ঠুকে দাঁড়াল।

মৈত্র বললেন, ‘নারঙ্গি!’

আর সুর চাইলেন ছোটা পেগ।

দুজনে দুজনকে ‘চিয়ারিও’ জানিয়ে পানীয় তুলে মুখে ছোঁয়ালেন। কিন্তু সেই উচ্চাসন থেকে নামবার নাম করলেন না। মার্কার বেচারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

হঠাৎ মার্কারের মুখের উপর নজর পড়ায় অন্তর্যামী জজ অনুমানে বুঝলেন তার মনের ভাষা। ডান হাত উঠিয়ে বললেন, ‘ব্যাস।’

সে তখন সাহেবদের হাত থেকে কিউ দুটি নিয়ে প্রাচীরে লগ্ন করল আর টেবিলের উপর বলগুলোকে সাজিয়ে রাখল। আর টেবিলের উপরকার কড়া আলোর বাতির সুইচ টিপে নিবিয়ে দিল। তা সত্ত্বেও সে বিদায় নিতে পারে না, যতক্ষণ সাহেবরা ক্লাবে থাকেন ও পানীয় ফরমাশ করেন। ন-টা এখনও বাজেনি, তবু মনে হয় গভীর রাত। নিঝুম শহর।

তার দশা দেখে জজ বলেন, ‘মৈত্র, এখন এ বেচারাকে আটকে রেখে আমাদের কী লাভ? ক্লাবে তো আজকাল কেউ আসতেই চান না টেনিসের পরে।’ ইংরেজিতে যোগ করলেন, ‘কীসের টানে আসবেন? মোহিনীশক্তি কোথায়? স্টেশনে উপস্থিত মহিলারা সকলেই পর্দা। ইন্ডিয়ানাইজেশনের পরিণাম।’

‘এবং ইসলামাইজেশনের।’ মৈত্রও বললেন ইংরেজিতে। ‘কিন্তু সেই একমাত্র কারণ নয় সুর। তুমি বিয়ে করনি। সিভিল সার্জনও চিরকুমার। তোমরাও যদি ওভাবে শত্রুতা কর তাহলে ক্লাব উঠে যেতে কতক্ষণ? আমি তো মনে করি সমাজও উঠে যাবে।’

জজ হেসে বললেন, ‘হা-হা! আমরা করছি শত্রুতা! চলো হে চলো আমার ওখানে চলো। খেতে খেতে গল্প করা যাবে। ডিনারে আজ তুমি আমার অতিথি হলে ধন্য হব।’

মার্কারকে ছুটি দিয়ে দুই বন্ধু মোটরে উঠে বসলেন।

দুই

খেতে খেতে বিস্তর আজেবাজে কথা হল। তারপর কফির পেয়ালা হাতে করে দুজনে গিয়ে বসলেন ফায়ারপ্লেসের ধারে। শীত পড়ছিল সে কথা ঠিক। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কথা সুর সাহেবের বৈলাতিক অভ্যাস। আগুন পোহাতে পোহাতে তিনি রেডিয়োতে বিবিসি-র সংগীত শুনতে ভালোবাসেন। তাঁর পায়ের কাছে তাঁর প্রিয় কুকুর জলি।

‘আচ্ছা, মৈত্র,’ সুর পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, ‘তুমি নিজে ফাঁসি দিতে পার? মানে জজ হলে তুমি ফাঁসির হুকুম দিতে পারবে?’

‘আলবত।’ মৈত্র সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আমি তো দিচ্ছিনে। দিচ্ছে আইন। দেশের সরকার যদি ক্যাপিটাল সেনটেন্স রহিত করে আমিও দেব না।’

‘কিন্তু সেই তিনিও, যিনি আমাকে নিমিত্ত মাত্র হতে উপদেশ দিয়েছিলেন, তিনিও দেখলুম আমার প্রশ্ন শুনে পিছিয়ে গেলেন। বললেন, না আমি পারিনে। তারপর আমাকে এক কাহিনি শোনালেন। তাঁর নিজের জীবনের কাহিনি।’ এই বলে আবার অন্যমনস্ক হলেন। তাঁর স্মৃতি ফিরে গেল জজিয়তির প্রথম দিনগুলিতে।

‘মামলাটা তো আমার কোর্টের নয়। খুঁটিনাটি আমার মনে নেই।’ তিনি একটু একটু করে স্মরণ করে বলতে থাকলেন থেমে থেমে, এখানে-ওখানে শুধরে দিতে দিতে, নিজেই নিজের প্রতিবাদ করতে করতে। মোটামুটি দাঁড়াল এইরকম :

নিয়োগী সাহেব যখন রাজশাহি জেলার দায়রা জজ তখন তাঁর আদালতে এক খুনির মামলা আসে। ইংরেজ মোল্লা খুন হয়েছে। আসামি আর কেউ নয়, তার বেটা গোপাল মোল্লা। গোপালের বয়স আঠারো-উনিশ হবে। মা নেই। আদুরে গোপাল। সে যা চায় তাই পায়। কখনো বাপের মুখে ‘না’ উত্তর পায়নি। মহা শৌখিন ছোকরা গোপাল। গ্রামে এক আলকাপ দল গড়েছে। একরকম যাত্রার দল। রাতদিন ওই নিয়ে থাকে। তার সুন্দর রূপ আর সুন্দর কন্ঠ কত মেয়েকে যে আকর্ষণ করে! তাদের স্বামীরা শত্রু হয়, কিন্তু গোপাল ছেলেটা সৎ। কেউ তাকে দোষ দিতে পারে না।

এমন যে গোপাল সে একদিন বায়না ধরল নিকা করবে। কাকে? না সোনাভানকে। অসমবয়সিনি রসবতী বিধবা। চারদিকে দুর্নাম। কিন্তু বহু সম্পত্তির মালিক। তাই তার প্রার্থীও অনেক। প্রস্তাবটা শুনে ইংরেজ বলল, ‘না।’ গোপাল বিগড়ে গেল। ইংরেজ তখনও দিব্যি জোয়ান। তারও প্রচুর সম্পত্তি। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার। গোপালকে বাঁচানোর জন্য গোপালের বাপ করে বসল সোনাভানকে নিকা। ভেবেছিল গোপাল তার কপালকে মেনে নিয়ে আর একটি লক্ষ্মী মেয়েকে বিয়ে করবে। কিন্তু গোপাল বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে ভিন্ন গাঁয়ে গিয়ে দিওয়ানা হল। আলকাপের ভার নিল তার ইয়ার কালু।

সুখেই ঘর করছিল ইংরেজ মোল্লা। আর একটি বেটাও হয়েছিল তার। একদিন অন্ধকার রাত্রে কে একজন তার ঘরে ঢুকে তাকে হেঁসো দিয়ে মেরে খুন করে। ইংরেজ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘গোপাল তুই?’ চিৎকার শুনে পাড়ার লোক ছুটে আসে। দেখে ইংরেজ অজ্ঞান। একটু পরেই সে মারা যায়। গোপালকে তারা কেউ দেখেনি, কিন্তু তারাও শুনেছিল ইংরেজের চিৎকার, ‘গোপাল, তুই!’ সোনাভান সে-সময় ছিল না। আলকাপ শুনতে গেছল। গোপালকে গ্রেপ্তার করা হয় পরের দিন আলকাপ দলের আখড়ায়। সে বলে, আমি তো ওবাড়ি চিরদিনের মতো ছেড়েছি। আমি কেন যাব? কিন্তু অবস্থাঘটিত প্রমাণ তার বিরুদ্ধে। একখানা রুমাল কুড়িয়ে পাওয়া গেল। সেখানা গোপালকে দিয়েছিল সোনাভান। তাতে রক্তের দাগ ছিল।

খুনি মামলায় জুরি সাধারণত ঝুঁকি নিতে চায় না। একেবারে খালাস দিতে কুন্ঠাবোধ করলে ৩০২ ধারাকে দাঁড় করায় ৩০৪ ধারার ক-তে কিংবা খ-তে। এ মামলায় জুরি ইচ্ছা করলে অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে আনতে পারত, কিন্তু ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করল। পাবলিক প্রসিকিউটর তাদের ভালো করে ভজিয়েছিলেন যে, বউ মারা গেলে বউ হয়, ছেলে মারা গেলে ছেলে হয়, কিন্তু বাপ মারা গেলে বাপ আবার হয় না। পিতৃহত্যার মতো দুষ্কর্ম আর নেই। গোপাল যদি সৎমাকে পাবার আশায় এমন গর্হিত কাজ করে না থাকে তবে আপনারা তাকে খালাস দিন, যদি আপনাদের মনে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ থাকে তবে সন্দেহে সুফল দিন। কিন্তু পাবলিক প্রসিকিউটর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ইংরেজ মোল্লাকে যে হত্যা করেছে সে যদি তার পুত্র গোপাল ভিন্ন আর কেউ না হয়ে থাকে তাহলে, তিনি চোখে জল এনে ফেলে জুরির সামনে চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, আপনাদের কর্তব্য অতি কঠোর। কোনোরকম কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেবেন না। গোপাল গেলেও ইংরেজের বংশলোপ হবে না। আপনারা শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমান। বিজ্ঞের কাছে একটি শব্দই যথেষ্ট।

মৈত্র আর ধৈর্য ধরতে পারছিলেন না। বললেন, ‘তারপর বিচারক নিশ্চয় তার বয়স বিবেচনা করে তাকে ফাঁসি দিলেন না। দ্বীপান্তর দিলেন।’

‘না, বন্ধু। গোপাল আর গোপাল নয়। সে সাবালক হয়েছে। সাবালকের ছাড় নেই, মাফ নেই। নিয়োগী জুরির সঙ্গে একমত হয়ে গোপালকে চরম দন্ড দিলেন। ভালো উকিল দিলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত। কিন্তু আসামির মামা গরিব লোক। সে সরে দাঁড়ায়। সরকারি ডিফেন্স প্যানেল থেকে যথারীতি একজন উকিল দেওয়া হয়। সরকারি খরচে। সামান্য ফি। ভালো উকিলরা কেউ সে প্যানেলে নাম দেন না। যাঁকে উকিল দেওয়া হয়েছিল তিনি পাবলিক প্রসিকিউটরের সামনে দাঁড়াবার অযোগ্য। নিয়োগী কী করতে পারেন? ফাঁসিই দিলেন।’ সুর বললেন করুণ সুরে।

‘আহা! ফাঁসি!’ মৈত্র শিউরে উঠলেন। ‘হাই কোর্ট কনফার্ম করল?’

‘শোনো তারপর কী হল। আসামি কাঁদল না কাটল না। নীরবে দন্ডগ্রহণ করল। শুধু একবার সামনের দিকে হাতজোড় করে তাকাল। এরপরে আরম্ভ হল বিচারকের বিচার। তিনি বাংলোয় ফিরে গিয়ে অন্য কাজে মন লাগাতে পারলেন না। তাঁর আহারে রুচি নেই। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন, আর ঘুমোতে পারেন না। তাঁর নিজের শান্তির জন্যে তিনি দিন কয়েক পরে জেলখানা পরিদর্শনের ছলে গোপালের সঙ্গে কথা বলতে যান। বলেন, গোপাল তোমার জন্যে আমি আন্তরিক দুঃখিত। কিন্তু কী করব বলো। আমারও তো ধর্মভয় আছে। গোপাল বলে, ধর্মাবতার, কেয়ামতের দিন খোদাতালা আমার বিচার করবেন। সাক্ষীদেরও, জুরি সাহেবানেরও। ধর্মাবতারেরও। নিয়োগী ভড়কে গিয়ে বলেন, তুমি আপিল করো। গোপাল বলেন, নিজের বাপ যাকে মেরে রেখেছে, সে কি আপিলে বাঁচবে ধর্মাবতার! আর মরতেই আমি চাই। যে-মেয়ে আমার সৎমা হয়েছে তার সঙ্গে কি নিকেয় বসা যায়! খালাস হলেও আমি মুখ দেখাতে পারতুম না ধর্মাবতার। লোকে বিশ্বাস করত যে সৎমাকে নিকা করবার জন্যে আমিই আমার বাপজানকে মেরেছি।’

মৈত্র কন্ঠক্ষেপ করলেন। ‘এরই নাম ইডিপাস কমপ্লেক্স।’

সুর বলতে লাগলেন, ‘ছেলেটির কথাবার্তায় এমন একটা সত্যের ঝংকার ছিল যে নিয়োগীর মনে হল আর সকলে অভিনয় করে গেছে, শুধু গোপাল তা করেনি। তিনি স্থানকাল ভুলে তাকে মিনতি করে বললেন, গোপাল, তুমি একবার শুধু বলো আসলে কী হয়েছিল। গোপাল বলল, খোদায় মালুম। আমি তো সেখানে যাইনি। রুমালটা সোনাভান আমাকে দিয়েছিল নিকার আগে, আমি সেটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসি নিকার পরে। তাতে রক্ত কী করে এল খোদা জানেন। এর পরে গোপাল চুপ করে। নিয়োগীও আর তাকে খোঁচান না। কিন্তু সেই যে তাঁর মাথায় পোকা ঢুকল সে-পোকা সেইখানেই থেকে গেল! তিনি সরকারকে চিঠি লিখলেন যে, তিনি ছুটি নিতে চান। ছুটির পর আর যেন তাঁকে জজ করা না হয়। করলে তাঁর নার্ভাস ব্রেকডাউন হবে।’

মৈত্র বললেন, ‘তাঁর মতো লোকের জজ না হওয়াই ভালো। যে যা বলে তাই তিনি বিশ্বাস করবেন। আরে, ফাঁসির কয়েদি তো অমন কথা বলবেই।’

‘ফাঁসির কয়েদি,’ সুর বললেন, ‘আপিল করে না কোথাও শুনেছ একথা?’

‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বল গোপাল আপিল করেনি?’ মৈত্র পালটা শুধালেন।

‘না, বন্ধু। গোপাল আপিল করেনি। এটা এমন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার যে কেবল নিয়োগী কেন, অনেকের মনেই ধোঁকা লেগেছিল। পাবলিক প্রসিকিউটরও পরে স্তম্ভিত হয়েছিলেন, কিন্তু শোনো তারপরে কী হল। নিয়োগী ছুটি পেলেন, কিন্তু ছুটির পরে তাঁকে সেই জেলারই কালেক্টর পদে অফিশিয়েট করতে বলা হল। তিনি তার সুযোগ নিয়ে টুর ফেললেন বদলগাছি থানায়। পাহাড়পুরের স্তূপ পরিদর্শন করবেন। সরেজমিনে গিয়ে হারুন অল রশিদের মতো ছদ্মবেশে অনুসন্ধান করতে লাগলেন। দফাদার চৌকিদারদের মুখেই শুনলেন যে হালিম মির্ধা এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। বাপকে আর বেটাকে। সোনাভান আর তার সম্পত্তির লোভে। কাজিয়া একটা অনেক দিন থেকে চলছিল। নিকার আগে সোনাভানের জমিজমা তারই হেফাজতে ছিল। তার বিবি না থাকলে সোনাভান তার সঙ্গেই নিকায় বসত। তার মুখের গ্রাস কেড়ে নিল ইংরেজ মোল্লা। তলে তলে ফন্দি আঁটছিল। একদিন অন্ধকার রাত্রে ‘বাপজান’ বলে ঘরে ঢুকে ইংরেজকে নিকাশ করল। ঘুমের ঘোরে ইংরেজ চেঁচিয়ে উঠল, ‘গোপাল, তুই!’ সোনাভান ছিল না। সাক্ষীরা আসবার আগে হালিম অন্তর্ধান।’

মৈত্র ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘গাঁজা। গাঁজা। বদলগাছিতে তো গাঁজার চাষ হয় শুনেছি। নিয়োগীকেও গাঁজা খাইয়ে দিয়েছে। তারপর?’

‘হালিম অনেক দিন নিরুদ্দেশ ছিল। গোপালের সাজা হওয়ার পর সে আবার গ্রামে ফিরে এসেছে, কিন্তু গ্রামের লোক তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। সে খুব সাবধানে চলাফেরা করছে। গোপালের ফাঁসি হয়ে গেলে পরে সোনাভানকে নিকা করবে। নিয়োগী সাহেব যখন সদরে ফিরলেন তখন তাঁর ১০২ ডিগ্রি জ্বর। সেই জ্বর নিয়েই তিনি নতুন জজের বাড়ি গিয়ে দেখা করলেন। বললেন, এখনও সময় আছে, ছেলেটার যাতে ফাঁসি না হয় তার জন্যে আসুন আমরা চেষ্টা করি। নতুন জজ ম্যাকগ্রেগর কি রাজি হন! বললেন, কেসটা আমি করিনি। আমার কোনো লোকাস স্ট্যাণ্ডাই নেই। আর আপনিও এখন জজ নন। আপনি ফাংটাস অফিসিও। কাগজপত্র হাই কোর্টে চলে গেছে। প্রাণদন্ড তাঁরা হয়তো কনফার্ম করবেন না। তাহলে তো ছেলেটা মরছে না। তা শুনে নিয়োগী বললেন, যদি কনফার্ম করে তখন যে খুব দেরি হয়ে গিয়ে থাকবে। ম্যাকগ্রেগর বললেন, তখন গভর্নরের কাছে করুণাভিক্ষা করলে তিনি তার বয়স বিবেচনা করে প্রাণদন্ড মকুব করবেন। এর নজির আছে। নিয়োগী বললেন, যে মানুষ আপিল করল না সে কি মার্সি পিটিশন দেবে? তাহলে তো স্বীকার করে নেওয়া হয় যে সে-ই তার বাপকে খুন করেছে। ম্যাকগ্রেগর বললেন, স্বীকার তাকে করতেই হবে যদি প্রাণে বাঁচতে চায়। চোদ্দো বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। জীবন নতুন করে আরম্ভ করার পক্ষে তেত্রিশ বছর এমন কিছু বেশি নয়। চাষির ছেলে। অন্য কোনো গ্রামে গিয়ে বাস করলে কেই-বা তাকে সমাজে ঠেলবে!’

‘হ্যাঁ। ম্যাকগ্রেগরই জজ হবার যোগ্য।’ মৈত্র তারিফ করে বললেন। ‘তারপর?’

‘তারপর যা হবার তাই হল। হাই কোর্ট দেখল গোপাল আপিল করেনি। কেউ তার হয়ে একটি কথাও বলবার জন্যে দাঁড়ায়নি। প্রাণদন্ড কনফার্ম করল। তা শুনে নিয়োগী আবার গোপালের সঙ্গে জেলখানায় গিয়ে কথা বললেন। সে মার্সি পিটিশন দিতে নারাজ হল। যে দোষ করেনি সে কেন করুণাভিক্ষা করবে? তখন নিয়োগী একটা অভূতপূর্ব কাজ করলেন। জুডিশিয়াল সেক্রেটারিকে চিঠি লিখে সব কথা জানালেন। উত্তর এল, আদালতের বাইরে ভূতপূর্ব জজ যদি কিছু শুনে থাকেন তবে সেটার উপর কোনো অ্যাকশন নেওয়া যায় না। মার্সি পিটিশন না দিলে ধরে নেওয়া হবে যে দন্ডিত ব্যক্তি অননুতপ্ত। সুতরাং করুণার অযোগ্য। নিয়োগী হাল ছেড়ে দিলেন। ফাঁসির আগেই তাঁর অস্থায়ী কার্যকাল শেষ হয়ে যায়। তিনি অন্যত্র বদলি হন। তারপর তিনি মদ ধরলেন, রেস ধরলেন। উপরন্তু গীতা ধরলেন। আশা করলেন এইসব করলে তিনি বাঁচবেন।’

মৈত্র বিস্মিত হয়ে সুধালেন, ‘কেন? তিনি কি বাঁচলেন না?’

‘আহা! শোনোই-না সবটা!’ সুর বলতে লাগলেন, ‘আমার সঙ্গে যখন তাঁর প্রথম আলাপ তখন তিনি কমিশনার পদে অফিশিয়েট করছেন। না বাঁচলে কি কেউ এতদূর উন্নতি করতে পারে! আমি যখন তাঁকে বলি যে জজের কাজ আমার ভালো লাগে না, অথচ কালেক্টর পদ হচ্ছে দিল্লিকা লাড্ডু যা খেয়ে আমি পস্তাচ্ছি, তখন তিনিই আমাকে উপদেশ দেন, নিমিত্ত মাত্র ভব সব্যসাচী। কিন্তু তাঁর নিজের জবানিতে তাঁর জজিয়তির গল্প শুনে আমার মনে ভয় ঢুকল যে আমিও হয়তো তাঁরই মতো কোনো নিরপরাধীকে ফাঁসি দিয়ে আজীবন পস্তাব। তাই ফাঁসির মামলা আমার কোর্টে এলেই আমি গীতা খুলে বসি। কিন্তু তাতে কোনো শান্তি বা সান্ত্বনা পাইনে। ঈশ্বর বলে কেউ আছেন কি না তর্কের বিষয়! তাঁর হাতের অস্ত্র বলে নিজেকে ঘুম পাড়াতে পারিনে। জজকে সমস্তক্ষণ হুঁশিয়ার থাকতে হয়। পাছে কোনো নির্দোষের সাজা হয়। প্রাণদন্ড দূরের কথা, কারাদন্ডই-বা কেন হবে? বিচারটা যতদিন চলে ততদিন আমার সোয়াস্তি নেই। যেন বিচারটা আসামির নয়, আমার নিজের। বিচার শেষ হলে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু মনে একটা সংশয় থেকে যায়। কে জানে প্রকৃত সত্য কী? পাইলেট যা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যিশুর বিচারের সময়। পাইলেটের মতো আমি অজ্ঞেয়বাদী। কই, সাক্ষাৎ ভগবানের পুত্রকে দেখেও তিনি তো ভগবদ্বিশ্বাসী হননি। আসলে কী হয়েছিল তা আমার জানবার উপায় নেই, আমি অসহায়, তাই যদি না জানতে পেলুম তো কেবল দন্ডমুন্ডের নিমিত্ত হয়ে আমার কী লাভ!’

‘তোমার লাভ না হোক, সমাজের লাভ’। মৈত্র সে-বিষয়ে সুনিশ্চিত।

‘হ্যাঁ। একদিক থেকে সেটা ঠিক। বিচারের একটা ঠাট বজায় না রাখলে লোকে আইনকে নিজেদের হাতে নেবে। প্রত্যেকেই হবে এক একজন দন্ডদাতা ও জল্লাদ। কিন্তু আমি চাই নিশ্চিতি, শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিতি। যাকে সাজা দিলুম সে যে আর একজন গোপাল নয় এই নিশ্চিতি। অবশ্য গোপালের মতো আমি আর এক জনকেও দেখিনি যে আপিল করবে না, মার্সি পিটিশন দেবে না, কেয়ামতের উপর বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্বেগে মরবে। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি যে, জেলা থেকে বিদায় নেবার আগে নিয়োগী আরও এক বার জেলখানায় গিয়ে গোপালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এবার তাকে কাতর কন্ঠে বলেছিলেন, গোপাল, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমিও সামান্য একজন ভ্রান্তিশীল মানুষ। ভুলচুক তো মানুষ মাত্রেরই হয়। গোপাল বলে, ধর্মাবতার, আপনার কী দোষ যে ক্ষমা করব? রাখে আল্লা মারে কে? মারে আল্লা রাখে কে? খোদা আপনাকে দোয়া করুন। আপনি লাটসাহেব হন।’

‘ছেলেটা সত্যি বড়ো ভালো বলতে হবে।’ স্বীকার করলেন মৈত্র।

‘কোয়াইট রাইট।’ সুর অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘কিন্তু কী ট্র্যাজিক! কেন এরকম হয়? মানুষ কী করতে এ জগতে আসে? কী করে? কেন শাস্তি পায়? সে-শাস্তি কি ইহজন্মের কর্মফল না পরজন্মের জের? না পরবর্তী জন্মের প্রস্তুতি? যারা পরজন্ম বা পরকাল মানে না তাদের তুমি বুঝ দিচ্ছ কী বলে?

তিন

মৈত্র মৌন হয়ে বসে রইলেন। তখন সুর বললেন, ‘আজ খুব ভালো মিউজিক আছে হে। বিবিসি ধরব?’

মৈত্র হাত নেড়ে বললেন, ‘না থাক।’

থমথমে পরিস্থিতি। কিছুক্ষণ পরে মৈত্র নীরবতা ভঙ্গ করলেন। বললেন, ‘সুর, তুমি এইবার একটি বিয়ে করো।’

‘কেন, বলো দেখি? তোমাকে কেউ ঘটকালি করতে বলেছে?’

‘না হে। তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। চুল পেকে শণ হয়েছে বটে কিন্তু শরীর শক্ত আছে। এ বয়সে কত লোক বিয়ে করছে, করে সুখী হচ্ছে।’

‘হা হা! তোমাকে বলিনি মিসেস নিয়োগী আমাকে কী বলেছিলেন।’

মৈত্র থতোমতো খেয়ে সুধালেন, ‘কী বলেছিলেন?’

‘বলেছিলেন, অভিলাষ, আমাকে দিদি বলে যখন ডেকেছ তখন সেই সুবাদে একটা কথা বলি। বিয়ে কোরো না। বউটা বাঁচবে।’

‘অ্যাঁ! তাই নাকি?’

‘শুধু এই নয়। পরে একদিন তিনি সোজা আমার বাংলোয় এসে হাজির। বললেন, অভিলাষ, তোমার কাছে লিগাল অ্যাডভাইস চাইতে এসেছি। উকিলবাড়ি যেতে লজ্জা করে। তা ছাড়া তুমি আমার ভাই, ভাইয়ের কাছে লজ্জা কীসের? তোমার আপন দিদিকে তুমি এ অবস্থায় যা করতে বলতে আমাকেও তাই করতে বলবে আশা করি।’

‘ব্যাপার!’ মৈত্র চঞ্চল হয়ে উঠলেন।

‘গুরুতর। মিসেস নিয়োগী বললেন, অভিলাষ, ওঁর পরিবর্তনের জন্যে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এতদিনে বুঝতে পেরেছি আমি ফেল। মদ আর রেস হলেও ক্ষমা করা যায়। কিন্তু নিজের দেশকে উনি ইংরেজের পায়ে বিকিয়ে দিচ্ছেন। ওঁর সরকারি নথিপত্র আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি। ওঁর প্রশ্রয় পেয়ে অধীনস্থরা অবাধে দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বললে উনি রাগ করেন। আমি জানতে চাই ডিভোর্সের এটা একটা গ্রাউণ্ড হতে পারে কি না।’

মৈত্র চমকে উঠলেন। বললেন, ‘না না, এ হতেই পারে না! এ অসম্ভব!’

‘আমিও তাঁকে সেই কথাই বোঝাই। বরং একটু ভয় দেখিয়ে দিই। স্বামীর সরকারি নথিপত্র লুকিয়ে লুকিয়ে পড়াও একটা গ্রাউণ্ড হতে পারে।’ সুর মুচকি হাসলেন।

মৈত্রর মুখ শুকিয়ে গেল। ‘কা-কাজটা খু-খুবই খারাপ। কি-কিন্তু তা বলে ডি-ডিভোর্স হতে পারে না কি? না, তুমি আমার লেগ পুল করছ? তুমি জানো আমি ডিভোর্সের শত্রু।’

সুর বললেন, ‘আমার উদ্দেশ্য তুমি ধরতে পারনি, মৈত্র। আমি চাইনি যে আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন পরামর্শদাতার জীবন আরও দুর্বহ হয়। ডিভোর্সের আমি লেশমাত্র প্রশ্রয় দিইনি। তোমার সমাজ আমার হাতে নিরাপদ।’

‘আমি হলে কী করতুম বলি।’ মৈত্র কথার সূত্র নিজের হাতে নিলেন। ‘আমি ভদ্রমহিলার মনোবিশ্লেষণ করতুম কেন তিনি তাঁর স্বামীর উপর এতদূর বিরক্ত যে পরের কাছে যান বিবাহবিচ্ছেদের পরামর্শ চাইতে। এর মূলে কী আছে? দেশঘটিত পরস্পরবিরোধী চিন্তা না অন্য কিছু ঘটিত সন্দেহ?’

‘ওই যাঃ! পন্ডিতি আরম্ভ হল!’ সুর হেসে উঠলেন, ‘একজন বিপন্ন হয়ে এসেছেন মুক্তির উপায় খুঁজতে, আমি বসে মনোবিশ্লেষণ করব পান্ডিতিক সত্যনির্ণয় করতে? আমি যদি তোমার মতো মনোবিশ্লেষণ করতে যেতুম তাহলে হয়তো কত কী জট আবিষ্কার করতুম। ওই যেমন একটু আগে বলেছিলে ইডিপাস কমপ্লেক্স, তেমনি তোমাদের ফর্দে আর কী কী কমপ্লেক্স আছে জানিনে। হয়তো জুপিটার কমপ্লেক্স।’

দুজনেই হাসতে লাগলেন। হাসি থামলে সুর বললেন, ‘তা ছাড়া সত্য বলতে আমি যা বুঝি তা অন্য জিনিস। গোপালের হয়তো ইডিপাস কমপ্লেক্স ছিল, যদি সে আদৌ খুন করে থাকে। কিন্তু আমি যদি তার বিচারক হতুম আমি তোমার মতো মনোবিশ্লেষণ করতুম না। আমার সত্যনির্ণয়ের পদ্ধতি নয় ওটা। আমার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, সিচুয়েশনটা কী? সিচুয়েশনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটা কী? এক-একটা সিচুয়েশন এমন যে তার পরিণতি ট্র্যাজিক না হয়ে পারে না। তার থেকে উদ্ধারের অপর কোনো পন্থা নেই। মানুষ অনেকসময় খুন করে ফাঁসি যায় উদ্ধারের আর কোনো পন্থা খুঁজে না পেয়ে। সিচুয়েশনটা কী তা তো জজকে বিশ্বাস করে কেউ বলবে না, বলতে জানেও না। তাদের চোখে আমি কালান্তক যম। আসলে আমি মানুষের বন্ধু। যাকে ফাঁসি দিই তাকে মনে মনে বুকে জড়িয়ে ধরি। ওর চেয়ে ভয়ংকর দন্ড তো নেই। তবু ওই দন্ড আমি প্রেমের সঙ্গে উচ্চারণ করি। আমার চোখে সব খুনিই গোপাল। কেয়ামতের দিন তার প্রকৃত বিচার হবে। এ যা হল তা সমাজের প্রয়োজনে, সমাজবিহিত পদ্ধতিতে।’

মৈত্র আবেগে আপ্লুত হয়ে সুরের হাতে চাপ দিলেন। কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ। তারপর চটকা ভাঙল। মৈত্র সুধালেন, ‘শেষপর্যন্ত হলটা কী? ডিভোর্স না সেপারেশন?’

‘কোনোটাই না।’ সুর একটু থেমে বললেন, ‘আরও বছর সাতেক তাঁরা একসঙ্গেই কাটালেন। তারপরে…’ সুরের সুর বিকৃত হয়ে এল।

‘বলো, বলো, বলেই ফ্যাল।’ মৈত্রর কৌতূহল উদগ্র।

‘ভদ্রলোক একদিন মাঝরাত্রে রাস্তার ধারে নর্দমায় পড়ে মারা যান। শুনেছি মদের নেশায়।’ বলতে বলতে কন্ঠরোধ হল সুরের।

‘আহা! মারা যান!’ মৈত্র অভিভূত হলেন। মনে হল তন্দ্রায় অভিভূত।

বন্ধুকে এক ধাক্কা দিয়ে সুর বললেন, ‘তাহলে দেখতে পাচ্ছ বিবাহ সর্বরোগহর নয়? নারীও পুরুষকে রক্ষা করতে পারে না, গীতাও না। আমি চিন্তা করে এর একটি মাত্র সমাধান পেয়েছি। এরকম বিপজ্জনক কাজ না করা। এর চেয়ে কয়লার খনিতে নামা কম বিপজ্জনক। কিন্তু আমি যদি কয়লার খাদে নামি আমার হাত ধরতে কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে রাজি হবেন না। অমন একটি হাতি পুষতে আমিই-বা কেমন করে পারব! তোমার ভদ্রারা আমাকে খনিতে নামতে দেবেন না। কিন্তু তার চেয়েও যা বিপজ্জনক সেই জজ-কালেক্টরের কাজে নামতে দিয়ে পরে মই কেড়ে নেবেন। জজ হয়ে আমি হয়তো দশটা অপরাধীর সঙ্গে একটা নিরপরাধকেও জেলে পাঠাব বা ফাঁসিতে ঝোলাব। কালেক্টর হয়ে আমি হয়তো দুরন্ত জনতার উপর গুলি চালানোর হুকুম দেব। মরবে কয়েকটা পাজি লোকের সঙ্গে এক-আধটি নিরীহ ছেলে কি মেয়ে। অমনি আমার সহধর্মিণী বাম হবেন। কী করে তাঁকে বোঝাব যে আমি মানুষটা খারাপ নই, আমার পেশাটাই খারাপ! পারলে আমি ইস্তফা দিয়ে সরে যেতুম। তারপরে যদি ফকিরের সঙ্গে ফকিরনি হয়ে গাছতলায় বাস করতে কেউ রাজি হতেন তাহলে বিয়ে করা যেত।’

চার

মৈত্র তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। ওদিকে ফায়ার প্লেসের আগুন নিবুনিবু করছিল। সুর তার উপর আরও কয়লা চাপিয়ে তাকে তেজ করে তুললেন। ও যেন তাঁর নিজের জীবনের প্রতীক।

‘এখন তোমার কথাই শোনা যাক। যদি তোমার কোনো কাজে লাগতে পারি।’ বললেন মৈত্র তাঁকে আবার স্থির হয়ে বসতে দেখে।

‘থ্যাঙ্ক ইউ মাই ফ্রেণ্ড। কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। গীতার সব কথা না হোক একটি বচন আমি মানি—‘‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ’’।’

এরপরে দুজনেই অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ। কখন একসময় সুর আপন মনে বলতে আরম্ভ করলেন তাঁর আত্মকাহিনি। মৈত্র শুনতে লাগলেন বিনা কন্ঠক্ষেপে।

‘লণ্ডনে যখন তোমার সঙ্গে পড়তুম তখন কি সংসারের খবর কিছু জানতুম! তখন আমার একমাত্র ধ্যান ছিল ভালো পাস করে ভালো চাকরি নিয়ে দেশে ফিরতে হবে। বুড়ো বাপকে রেহাই দিতে হবে। আমার জন্যে কি শেষে ফতুর হবেন। তখন অত খতিয়ে দেখিনি কোন চাকরিতে মনের শান্তি, কোনটাতে অপ্রসাদ। আইসিএস হয়ে যেদিন বাবাকে পুত্রদায় থেকে অব্যাহতি দিই সেদিন এই ভেবে আমার আনন্দ হয়েছিল যে, এখন থেকে আমি স্বাধীন। যথাকালে দেশে ফিরে চাকরিতে যোগ দিই। ভালোই লাগে। একমাত্র কাঁটা রাজনৈতিক মনোমালিন্য। ওদের পলিসি আমি ক্যারি আউট করতে কুন্ঠিত দেখে ওরাই আমাকে জজ করে দেয়। আমি তার ফলে আরও স্বাধীন।

‘কিন্তু ক্রমেই আমার প্রতীতি হতে থাকে যে, আমি আমার মনের স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলছি। রাতদিন যাদের নিয়ে আমার কারবার তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা খুন কিংবা ডাকাতি কিংবা নারীধর্ষণ করেছে। সমাজের সবচেয়ে পঙ্কিল স্তরের জীব তারা। তাদের মামলা হাতে নিয়েছে যারা তারাও হাতে-পায়ে সারা গায়ে পাঁক মেখেছে। এক এক সময়ে মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখেছি। কোনটা ক্রিমিনালের আর কোনটা পুলিশের তা নিয়ে ধাঁধায় পড়েছি। জেলখানায় গিয়ে দেখেছি জেল ওয়ার্ডদের মুখও জেল কয়েদির মতো। উকিলের মুখ দেখেও ধোঁকা লেগেছে। পোশাক ভিন্ন, মুখ অভিন্ন। ক্রাইম যাকেই ছোঁয় তাকেই ক্রিমিনালের চেহারা দেয়। এই সর্বব্যাপী পাঁকের মধ্যে আমি কেমন করে পাঁকাল মাছ হব? আমার নিজের চেহারা দেখি আয়নায়। ভয় পেয়ে যাই।

‘একদিন বোর্ড অফ রেভিনিউয়ের মেম্বার ও. নিল এলেন আমার স্টেশনে। এককালে আমার ওপরওয়ালা ছিলেন। আবার দেখা হল। কথায় কথায় বললেন, ‘সুর, জজিং তোমার ভালো লাগে? আমার ধারণা ছিল তোমার অভিরুচি শাসনে। উত্তর দিলুম, আপনার অনুমান ঠিক। কিন্তু ফিরে যেতেও আমি চাইনে। ও. নিল চলে গেলেন। কিন্তু কথাটা আমার মন থেকে গেল না। শাসন বিভাগ থেকে সরে আসার পরও আমি তার সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে কম চেষ্টা করিনি। ধাতটা আমার এগজিকিউটিভ। কিন্তু চার বছরে একটা ছেদ পড়ে গেছল। ফিরে গেলে আমি জোড় মেলাতে পারতুম না। রাজনৈতিক মনোমালিন্য তো চরমে উঠেছিল। কেবল ইংরেজে-বাঙালিতে নয়, হিন্দুতে-মুসলমানে।

‘তবু ক্রিমিনালদের সঙ্গে ক্রিমিনাল বনে যাবার চেয়ে ওই অশান্তির মধ্যে ফিরে যাওয়াও ভালো। চিফ সেক্রেটারিকে চিঠি লিখলুম একদিন। আমাকে কি চিরকাল জজিং করতে হবে আমার রুচির বিরুদ্ধে? তিনিও আমার পুরোনো অতিথি। সহানুভূতির সঙ্গে উত্তর দিলেন, তোমার সম্বন্ধে কাগজপত্র আনিয়ে দেখলুম। আগে থেকেই ঠিক হয়ে রয়েছে যে তোমার স্থান জুডিশিয়ালে। তোমার নিজের পছন্দ হোক আর নাই হোক এই হচ্ছে তোমার বরাদ্দ। ভালো জজেরও তো দরকার। আশা করি তুমি এটা স্বীকার করবে যে ব্যক্তিগত অভিরুচির চেয়ে পাবলিক ইন্টারেস্ট বড়ো। তোমার সাফল্য কামনা করি।

‘মনটাকে মানাতে আমার কত কাল যে লেগে গেল! কেমন করে যে পারলুম! একবার ভেবে দ্যাখো। মড়ার মাথার খুলি পর্যন্ত কোনো কোনো কেসে আলামত হয়। শুক্র আর শোণিতমাখা কাপড়জামা তো আকছার। আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে হয় সেসব। নাড়াচাড়া করে পুলিশের লোক। ডাক্তার এসে বলে যান মৃতদেহের অঙ্গে কী কী জখম ছিল। ব্যবচ্ছেদের পর কোন কোন অর্গানে কী কী লক্ষণ দেখা গেল, কী কী বস্তু পাওয়া গেল, আমাকেই স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করতে হয়। বীভৎস সব খুঁটিনাটি। তার চেয়েও বীভৎস বলাৎকারের মামলায় স্ত্রী-অঙ্গের রিপোর্ট! ডাক্তারের মুখে তবু সহ্য হয়। নারীর মুখে পাশবিক অত্যাচারের আদ্যোপান্ত বিবরণ! উকিলেরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করে ৩৭৬ ধারার অত্যাবশ্যক উপাদান আছে কি না। অন্তর্ভেদ ঘটেছে কি না। আমার ইচ্ছা করে উকিলদের ধরে চাবকাতে। সতী মেয়েকেও তারা প্রতিপন্ন করতে চায় অসতী। যেন অসতী হলে তার অনিচ্ছা থাকতে মানা। যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেকোনো পশু ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এর পিছনে ক্রিয়া করছে আমাদের বৈষম্যময় সামাজিক মূল্যবোধ। একবার যে অভাগিনীর পদস্খলন হয়েছে, যেকোনো দিন যে-কেউ তার উপর আক্রমণ করলেও সেটা হবে সম্মতিসূচক। পুরুষ কিন্তু হাজার পদস্খলন সত্ত্বেও আইনের দ্বারা সুরক্ষিত।

‘এখন ওইসব হতভাগিনী মেয়েদের এই বৈষম্যময় সমাজে আমি ভিন্ন আর কে রক্ষক আছে এই বাইশ লক্ষ লোকের মাঝে? শুধু ওদের নয়, যারা একবার চুরি করে দাগি হয়েছে কেউ কি তাদের বিশ্বাস করে স্বাভাবিক কাজকর্ম দেয়? অগত্যা আবার চুরি করতে হয় তাদের। দ্বিতীয় বার চুরি করলেই ডবল সাজা। অনেকসময় দেখা যায় দ্বিতীয় অপরাধটা প্রথম অপরাধের তুলনায় লঘু। তবু আমাদের হাকিমরা চোখ বুজে প্রথম দন্ডটাকে দ্বিগুণিত করে দেন। আপিলে আমি দন্ড হ্রাস করি। বলি, লোকটার পাওনা যদি হয় ছ-মাস, হাকিম তার পূর্ব অপরাধের কথা স্মরণ করে এক বছর দিতে পারেন। কিন্ত পূর্ব অপরাধের জন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন হাকিমের হাতে সে হয়তো পেয়েছিল দশ মাস। সেটাকে কলের মতো নির্বিচারে দ্বিগুণিত করে বিশ মাস করলে বর্তমান অপরাধের সঙ্গে সামঞ্জস্য হয় না। হাকিমেরা করবেন কী! কোর্ট সাব ইনস্পেকটর তাঁদের তাই বুঝিয়েছেন। আমি যখনই সুযোগ পাই সাজা কমিয়ে দিই আর পুলিশের অভিশাপ কুড়োই। একটা প্রতিষ্ঠানও খাড়া করি কয়েদিদের জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর স্বাভাবিক কাজকর্ম জোটানোর আশায়। দেখি কেউ ওদের কাজ দেবে না। দিলে পুলিশ পিছনে লাগবে। তা ছাড়া দাগি চোরকে বিশ্বাস কী! কোনদিন আবার চুরি করে পালাবে! তখন পুলিশে খবর দিলে পুলিশ বলবে, কেমন? সাবধান করেছিলুম কি না? সাহস করে আমিই মালি রাখি। কোনদিন আমাকে বোকা বানাবে! পুলিশ সাহেব বলবেন, রাইটলি সার্ভড! আরে কুকুরের ল্যাজ কখনো সিধে হয়?

‘সমাজে ভালো জজেরও দরকার আছে। কিন্তু এই বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়। চাই আরও একটা বিশ্বাস। সেটা না থাকলে আমার মতো লোকের পক্ষে বেঁচে থাকাই এক যন্ত্রণা। জগতে যা কিছু কুৎসিত, যা কিছু মিথ্যা, যা কিছু কু তাই নিয়ে আমার কারবার। জগৎ সম্বন্ধে আমার ধারণা কি তা বলে এই যে, জগতে সুন্দর নেই, সত্য নেই, সৎ নেই? আমার এই নরকবাস থেকে অনুমান করা শক্ত যে স্বর্গ বলে কিছু থাকতে পারে বা ঈশ্বর বলে কেউ থাকতে পারেন। মানুষ আছে তা তো প্রত্যক্ষ সত্য। কিন্তু মানুষের চেহারা দেখে কি বিশ্বাস হয় যে, ভগবান তাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর আপনার আদলে? তাঁর উপর পিতৃত্ব আরোপ করবার মতো কী এমন প্রমাণ আছে?

‘অল্পবয়স থেকেই আমি সৌন্দর্যদেবীর অন্বেষক। বিউটি আমার কাছে কথার কথা নয়। ওকে আমি প্রথম যৌবনে সর্বঘটে দেখতে চাইতুম। আভাসও পেতুম ওর আঁচলের। ওর অলকের। কিন্তু এই নরকপুরীতে কোথায় ওর হাতছানি? কোথায় ওর চাউনি? আমার জজিয়তির জীবনে প্রায়ই হা-হুতাশ করেছি। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতে গেছি। দশ বছর পরে এই সম্প্রতি আমার অন্তর্দৃষ্টি খুলেছে। এতদিনে আমার প্রত্যয় হয়েছে, ও আছে।

‘ও আছে। ওর পথ গেছে এই ক্লেদের ভিতর দিয়ে, এই আস্তাকুঁড়ের ওপর দিয়ে; এইসব মাজাভাঙা পুরুষের, এইসব পড়ে-যাওয়া নারীর দ্বারা আচ্ছন্ন গিরিসংকট দিয়ে। ওর পথ হচ্ছে এই পথ, এই পথে আমি ওর পথেরই পথিক হয়েছি ওরই দর্শন পাব বলে। ও আমার আগে আগে চলেছে, উড়ে চলেছে মাটি না ছুঁয়ে ক্লেদ না ছুঁয়ে অন্তরিক্ষে। ও যেন সূর্যকন্যা তপতী, আর আমি ওকে ধরবার জন্যে মাটিতে পা ফেলে জলকাদায় নেমে ডাঙায় পা তুলে ছুটে চলেছি ভূতলে। আমি যেন রাজা সংবরণ। দৃষ্টি আমার ঊর্ধ্বমুখীন। ওর আর আমার উভয়েরই পথ এই ভীষণ কুৎসিত অশুভ অমাবস্যার ছায়াপথ।

‘ও যেন আমার চোখে ধুলো ছুড়ে মারে যাতে আমি ওকে দেখতে না পাই, চিনতে না পারি। কিংবা ধুলো আপনি ওড়ে ওর গতিবেগের হাওয়ায়। আমি অন্ধকার দেখি। সেই অন্ধকারের নাম নিষ্ঠুর বাস্তব। যে বাস্তব আমাকে নিত্য অভিভূত করে নিত্যনূতন অপরাধে। এই তো সেদিন আমার কোর্টে এল এক তরুণী জননী। নিজের হাতে নিজের শিশুর গলা টিপে মেরেছে। তার আগে এসেছিল এক বন্ধু। বন্ধুকে ভুলিয়ে নিয়ে যায় এক পোড়োবাড়িতে—সেখানে তার নিদ্রিত অবস্থায় তাকে বলি দেয়। মুণ্ডুটা পুঁতে রাখে নদীর বালিতে। এবার যে এসেছে তার কথা বলব না। কেসটা সাব-জুডিস, কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবেরই অভিনব প্রকাশ। স্তব্ধ হয়ে ভাবি এই তমসার অপর পারে কি ও আছে? ডাকলে কি ওর সাড়া পাব? চোখ মেলে আমি ওর দেখা পাইনে তবু চোখ আমার ওর ওপরেই—এর ওপরে নয়।

‘না, তোমার এই নিষ্ঠুর বাস্তব আমার দৃষ্টি হরণ করে না। দৃষ্টিকে পীড়া দেয় যদিও। আমার দৃষ্টি একে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করে। আমার মন একে ছাড়িয়ে যায়। আমার পা একে মাড়িয়ে যায়। এর সম্বন্ধে আমার মোহ নেই। আমি একে ভালোবাসিনে। একে ভালো বলিনে। শুধু একে মেনে নিই। একদা আমার পণ ছিল বিনা পরীক্ষায় কিছুই মেনে নেব না। না ঈশ্বর, না পরকাল, না পুনর্জন্ম। এখনও গীতার মূলতত্ত্ব মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু অর্জুনের মতো আমিও সভয়ে উচ্চারণ করি, ‘দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি দৃষ্টৈব কালানলসন্নিভানি দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম’। বাকিটুকু বাদ দিই।

‘নিষ্টুর বাস্তব, তোমাকে আমি মানি। কিন্তু তুমিই শেষ কথা নও। তোমাকে আমার চোখের ওপর ছুড়ে মেরেছে যে, আমার দৃষ্টি তারই প্রতি নিবদ্ধ। সে করালদশনা নয়। তার মুখ কালানলসন্নিভ নয়। ‘সে’ বললে কেমন পর পর ঠেকে। তাই ‘সে’ না বলে আমি বলি ‘ও’। ও আমার একান্তই আপন। আমি ওর, ওর সঙ্গেও আমার নিত্য সম্পর্ক। এমন দিন যায় না যেদিন আমি ওর উড়ে চলার ধ্বনি শুনতে না পাই। আদালতের চাপা কোলাহলকে ছাপিয়ে ওঠে ওর পলায়নধ্বনি। আমি এজলাস ছেড়ে উঠে যেতে পারিনে। আমার আসনের সঙ্গে আমি গাঁথা। আমার দুই কানই সাক্ষীর বা আসামির দিকে, পাবলিক প্রসিকিউটর বা আসামির উকিলের দিকে। তবু কেমন করে কানে এসে বাজে অন্তরালবর্তিনীর নূপুর শিঞ্জন। আছে আছে আরও একজন আছে, যে এদের সকলের প্রতিবাদরূপিণী। যে এদের কারও চেয়ে কম বাস্তব নয়, কম প্রমূর্ত নয়। যাকে ধরতে জানলে ধরা যায়। ছুঁতে জানলে ছোঁয়া যায়।

‘নিয়োগীর উনি তাঁকে নর্দমার থেকে বাঁচাতে পারেননি। আমার ও আমাকে কর্দম থেকে বাঁচিয়েছে। আমি যে বেঁচে আছি এটা ওরই কল্যাণে। বিয়ের বউ যা পারে না ও তা পারে। কেন তাহলে আমি বিয়ের কথা ভাবতে চাইব! তোমরা এমন কী জিতেছ! আমি এমন কী হেরেছি! আমার শুভ্র কেশ আমার শ্বেতপতাকা নয়। আমি পরাজয় স্বীকার করিনি। নিষ্ঠুর বাস্তবের সঙ্গে আমার নিত্য সংঘর্ষ। তা সত্ত্বেও আমি অপরাজিত। আপন ভুজবলে নয়, ওর রক্ষাকবচ ধারণ করে। পুরুষ চায় রণে অপরাজেয়। যে নারী তাকে অপরাজিত থাকতে সহায়তা করে সে-ই তার এষা। এ যদি পার্থিব নারী না হয় তাতে কী আসে-যায়!

‘মৈত্র, তুমি হয়তো ভাবছ আমি কী হতভাগ্য! আমাকে চালতার অম্বল রেঁধে খাওয়াবার কেউ নেই। বাবুর্চিটা সুক্তো পর্যন্ত রাঁধতে জানে না। পাটনার লাটভবনে লর্ড সিনহার মতো হাজার সাহেব সাজলেও আমার রসনাটি তো বাঙালির। আমিও এককালে নিজেকে হতভাগ্য মনে করেছি, কীসে এ দশা থেকে পরিত্রাণ পাই তার উপায় অন্বেষণ করেছি। বিবাহের মধ্যে পরিত্রাণের কূলকিনারা পাইনি। মানুষ তো কেবল রুটি খেয়ে বাঁচে না। তেমনি পুরুষ তো কেবল বউ পেয়ে বাঁচে না। তাকে তার জীবনের দুই দিক মেলাতে হয়। সুন্দরের সঙ্গে কুৎসিতের। শ্রেয়ের সঙ্গে প্রেয়ের। আমার জীবনে আমি কোনোমতেই দু-দিক মেলাতে পারিনি। তাই ঐশ্বর্যের মধ্যেও জ্বলেছি। অবশেষে একপ্রকার পরিত্রাণের পন্থা পেয়েছি। এখন আমার সে-জ্বালা নেই, আমি শান্ত। আমার পরিত্রাণের পন্থা পলায়নে নয়, পলায়মানার পশ্চাদ্ধাবনে।’

পাঁচ

রাত হয়েছিল। তন্দ্রায় জড়িত কন্ঠে মৈত্র বললেন, ‘সুর, তুমি আজ আমাকে কী এক আজব রূপকথা শোনালে! এমন বানাতেও পার!’

সুর একটু হাসলেন। বললেন, ‘তা কাহিনিটা লাগল কেমন?’

‘স্রেফ ফাঁকি দিলে।’ মৈত্র বললেন হাই তুলতে তুলতে। ‘আমি আশা করেছিলুম তোমার জীবনের প্রচ্ছন্ন করুণ রোমান্স শুনতে পাব। তার কথা, যাকে তুমি বিয়ে করতে চেয়েছিলে, পাওনি বলে অবিবাহিত রয়েছ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে আছে। এদেশে না হোক ওদেশে। ‘সে’ একদিন ‘ও’ হবে কি না জানিনে, কিন্তু তোমার ‘ও’ যাকে বলেছ ও তার বিকল্প নয়। আচ্ছা আজ তবে আসি।’

‘হবে না, হবে না। ‘সে’ তার স্থান ছেড়ে দিয়েছে। ‘ও’ আমার নয়ন জুড়েছে ও জুড়িয়েছে। আচ্ছা, শুনতে চাও তো শোনাব আরেক দিন।’ এই বলে সুর তাঁকে মোটরে তুলে দিতে চললেন। শোফারকে হুকুম দিলেন, ‘প্রিন্সিপাল সাবকা কোঠি।’

বেয়ারা এসে তাঁর সান্ধ্য পোশাক খুলে নিল। পরিয়ে দিল শোবার পায়জামা। এখন রাত জেগে মামলার নথি পড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *