এখন থেকে ঘটে যাওয়া সবকিছু
বাতি নিভিয়ে মদ খাওয়া চালিয়ে যেতে থাকলাম। আমার সৌভাগ্যই বলা চলে, সে রাতে নিশ্চিন্তে শান্তিমতো মাতাল হতে পেরেছিলাম। মাঝেমধ্যে বেসামাল অনুভূতিগুলোর সাথে লড়াই করার দরকার পড়ে না; বরং হতাশার বিশাল কালো গহ্বরে সোজাসুজি ঝাঁপ দিয়ে পড়াই তূলনামূলক ভাবে ভালো সিদ্ধান্ত। সেখানে ‘নিজেকে ছোট করে দেখা’র নোংরা প্রবণতার মধ্যে গড়াগড়ি খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানো যায়। উঠে দাঁড়ানোর সময়ও কম লাগে এতে।
আমার অতিপরিচিত অ্যাপার্টমেন্টটা নিজের চোখের সামনে পাল্টে যাচ্ছিল। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোর রং ছিল খানিকটা নেভি রঙের কাছাকাছি। গ্রীষ্মের রাতের মৃদু বাতাস ঘরের ভেতর প্রবেশ করছিল জানালা দিয়ে। আগে কখনো এরকম ভাবে নিজের ঘরটাকে অচেনা মনে হয়নি। এসবের সাথে ঘরের কোণে থাকা মিয়াগি’র নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছিল, সে একটা ভুতুড়ে প্রেতাত্মা।
নিজের আপন এই ঘরটাকেও যে এরকম লাগতে পারে, তা আমার জানা ছিল না।
মনে হচ্ছিল, আমি একটা মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এখান থেকে বের হলেই নাটকে আমার অংশটা অবশেষে শুরু হবে।
আচমকা মনে হতে লাগল, আমি সবকিছু করতে পারব। মাতাল হবার পর আমি আমার অযোগ্যতাটাকে, আমার তুচ্ছ অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাতাল অবস্থাতে মনে হচ্ছিল, আমার ভেতরে কিছু একটা পাল্টে যাচ্ছে।
অতি উৎসাহের সাথে আমি মিয়াগির সামনে ঘোষণা করলাম, “আমার কাছে যে তিনশো হাজার ইয়েন আর যে তিন মাস আয়ু বাকি আছে, তা দিয়ে আমি কিছু একটা পাল্টে দেব।”
তারপর হাতের বিয়ার ক্যানটা খালি করে দিয়ে সজোরে সেটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলাম।
মিয়াগির প্রতিক্রিয়া ছিল একদম ঠান্ডা মাছের মতো। সে তার চোখ কয়েক ইঞ্চি উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?” বলে আবার তার নোটবুকে ডুবে গেল।
অপ্রতিরোধ্য ভঙ্গিতে বললাম, “হ্যাঁ, যত অল্প টাকাই হোক না কেন, সেটা তো আমারই ‘জীবন’। আমি চাইলেই এর মূল্য কয়েক মিলিয়ন বা কয়েকশো মিলিয়ন বানিয়ে দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব।”
মাতাল অবস্থায় নিজের কথাবার্তাগুলোকে নিজের কাছেই অসাধারণ লাগছিল।
কিন্তু মিয়াগি ভ্রূক্ষেপও করল না। “সকলেই তাই বলে থাকে।”
পাশে কলমটা রেখে দুই কনুইয়ের ভাঁজের মধ্যে থুতনিটা বসিয়ে বলতে শুরু করল সে,
“এই ঘোষণা আমি অন্তত পাঁচবার শুনে এসেছি। মৃত্যু কাছাকাছি হতেই সকলের চিন্তাভাবনা এরকম ‘বাড়াবাড়ি’ আকার ধারণ করে। যাদের জীবন অপূর্ণ ও অর্থহীন ছিল, তাদের মধ্যেই এই বাড়াবাড়ি প্রকট আকারে দেখা যায়। ঠিক একই কারণে বাজিতে মানুষজন হেরে যাওয়া সত্ত্বেও স্বপ্ন দেখে, অস্বাভাবিক কোনো একটা কারণে জ্যাকপট জিতে যাবে সে। আমার ধারণা, যেসব মানুষেরা সারাজীবন ব্যর্থ হয়ে এসেছে তারাই এসব অসম্ভব ব্যাপারের মধ্যে সুখ খুঁজে পায়। ব্যর্থ মানুষগুলো যখন মৃত্যুর কাছাকাছি হয়, তাদের মনে হতে থাকে এক অজানা শক্তি ভর করেছে তাদের ওপর। তারা একটা বিশাল ফাঁদে পড়ে যায় এসব ভাবতে গিয়ে, ‘আগে আমি অপদার্থ একটা মানুষ ছিলাম। এখন আমি যেহেতু আমার ভুলগুলো বুঝতে পেরেছি, সেহেতু আমার পক্ষে এখন সবকিছু করা সম্ভব। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তারা এই অযৌক্তিক কথাগুলো বিশ্বাস করে ফেলে। অথচ তারা তখন কেবলমাত্র জীবন নামের রেসের স্টার্টিং লাইনে দাঁড়ানো, রেস শুরুই হয়নি তাদের। ‘এটাই আমার জীবনের একমাত্র সুযোগ’-এরকম চিন্তাভাবনা থেকে ভালো কিছু জন্ম নেয় না। তাই মিস্টার কুসুনোকি, সবকিছু ভালোমতো ভেবে দেখবেন। আপনার জীবনের মূল্য এত কম কেন জানেন? কারণ, অবশিষ্ট ত্রিশ বছরের মধ্যেও আপনার দ্বারা কোনোকিছু অর্জন করা সম্ভব হতো না। এটুকু তো আশা করি বুঝতে পেরেছেন, তাই না?” সে একটানা গড়গড় করে বলে গেল। “যদি আগামী ত্রিশ বছরেও আপনার দ্বারা কোনো কিছু অর্জন সম্ভব না হয়, তবে সামান্য তিন মাসে আপনি ‘কিছু একটা করে ফেলা’র আশা রাখেন কীভাবে?”
“চেষ্টা না করা পর্যন্ত তো আশা রাখা যায়,” আমি তর্ক করতে চেষ্টা করলাম। বলতে গিয়ে টের পেলাম, বিতৃষ্ণা বোধ হচ্ছে আমার। আমি চেষ্টা করার আগেই সত্যটা আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার একটা কথাও ভুল নয়।
“আমার মনে হয়, আপনার এখন সাধারণ কিছুর মধ্যে সুখ খোঁজা উচিত,” মিয়াগি উপদেশ দিল। “কোনোকিছু পরিবর্তন করার জন্য তিন মাস অনেক কম সময়। কিন্তু কিছু না করে কাটালে তিনমাস অনেক দীর্ঘ একটা সময়। এজন্য বিশাল কোনো পদক্ষেপ নেবার থেকে ছোট ছোট জিনিসে সুখ খুঁজে বের করাই আপনার জন্য মঙ্গলজনক হবে। কি, ভুল বলছি? তাহলে দিনশেষে ব্যর্থতার লম্বা ইতিহাসের মধ্যে ছোট ছোট এই সুখগুলো কিছুটা হলেও আপনার হতাশা দূর করবে।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি আপনার কথা। কিন্তু সবকিছু ‘সঠিক’ নিয়মে করার উপদেশ পেতে পেতে আমি বিরক্ত,” মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলাম। যদি মাতাল না হতাম, হয়তো তার সাথে আরও কিছুক্ষণ তর্ক করা যেত। কিন্তু এই অবস্থায় তার যুক্তিকে টেক্কা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। “আসলে আমি কতবড় একটা অপদার্থ, হয়তো সেটাই এখনও ভালোমতো উপলব্ধি হয়নি আমার- আচ্ছা, ভবিষ্যতে কী কী হতে পারত আমার সাথে, সেসব কি আমাকে বলা যাবে? আগামী ত্রিশ বছর আমি কীভাবে কাটাতাম, সেটা জানতে পারলে হয়তো আমার এরকম আকাশকুসুম কল্পনা করা বন্ধ হবে।”
মিয়াগি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। কিছু সময় পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার কথায় রাজি হলো সে।
“ঠিক আছে। হয়তো সবকিছু জানাটাই আপনার জন্য ভালো হবে এই মুহূর্তে কিন্তু আগেভাগেই
আগেভাগেই একটা কথা জানিয়ে রাখছি। আমার কথাবার্তাগুলো শুনে যদি আপনার নিজেকে ধ্বংস করে দিতে মন চায়, তবে এই কথাটা মনে রাখার চেষ্টা করবেন-এসব ঘটনা আগামী ত্রিশ বছরে আপনার সাথে ‘হতে’ পারত; আয়ু বিক্রি করে দিয়েছেন বিধায় সেসব এখন ঘটার কোনো সম্ভাবনাই নেই।”
“ঠিক আছে। ধরে নিব, আমি ভবিষ্যদ্বাণী শুনছি আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। সেটা হলো, নিজেকে ধ্বংস করার প্রয়োজন পড়ে না কারো। কোনোকিছু করার মতো না থাকলেই বরং মানুষ সেটা করে থাকে।”
“আশা করছি সেরকম কিছু ঘটবে না,” মিয়াগি জবাব দিল।
.
দূর থেকে একটা গমগম আওয়াজ ভেসে আসল। মনে হচ্ছিল, কোনো বিশাল টাওয়ারকে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, শব্দটা আতশবাজির। বেশ অনেকবছর কেটে গিয়েছে আমি আতশবাজির অনুষ্ঠানগুলোতে যাই না।
সবসময়ই সেসব জানালা দিয়ে দেখে এসেছি আমি। কখনো মেলায় গিয়ে সেখানকার দোকান থেকে খাবার কিনে খাইনি। কখনো প্রেমিকার হাত ধরে আতশবাজি দেখার পাশাপাশি আড়চোখে তার দিকে তাকানোর সুযোগ মেলেনি আমার।
যেদিন থেকে আমার বোধবুদ্ধি হয়েছে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি একজন সমাজচ্যুত মানুষ। মানুষের সমাগম যেখানে বেশি, সেসব জায়গা আমি সর্বদা এড়িয়ে গিয়েছি। কখনো ওরকম জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করার পর পুরোটা সময় একটা ভয় কাজ করেছে ‘বোধহয় কোথাও একটা ভুল হয়েছে। আমি তো এখানে থাকার যোগ্য নই’। আর ‘পরিচিত কারো সাথে যদি দেখা হয়ে যায়’—এই আতঙ্কটা আমাকে অসুস্থ করে ফেলত। স্কুলে থাকাকালীন সময়ে আমি কখনো পার্কে, পুলে, স্কুলের পেছনের টিলায়, শপিং ডিস্ট্রিক্ট, গ্রীষ্মের উৎসব কিংবা আতশবাজির অনুষ্ঠান- কোনোটাতেই যাইনি। কেউ জোর করে নিয়ে গেলে অবশ্য যেতে বাধ্য হয়েছি। কৈশোরে শহরে হেঁটে বেড়ানোর সময় সবসময় মানুষের ভিড় থেকে দূরে থেকেছি, বড় বড় রাস্তাও এড়িয়ে চলেছি আমি।
সর্বশেষ যেবার আতশবাজির অনুষ্ঠান সামনাসামনি দেখেছিলাম, তখন বয়স অনেক কম ছিল আমার।
হিমেনো বোধহয় তখন আমার পাশেই ছিল।
কাছ থেকে দেখলে আতশবাজি কতটা বিশাল যে লাগে, তা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। শব্দটাও যে কতটা জোরালো হয়, তা মনে পড়ছে না। প্রত্যেকটা আতশবাজি ফাটার পর কি আশপাশের এলাকা বারুদের গন্ধে ভরে যেত? কতক্ষণ সেই গন্ধটা বাতাসের গায়ে লেগে থাকত? আতশবাজি দেখার সময় মানুষের চেহারা কেমন থাকত? প্রত্যেকটা প্রশ্ন মাথায় আসতে শুরু করায় টের পেলাম, আতশবাজির অনুষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
জানালা দিয়ে আতশবাজি দেখার ইচ্ছেটা আমাকে ভর করে বসল। কিন্তু মিয়াগি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার সামনে এভাবে বেহায়ার মতো জানালা দিয়ে তাকানো চলবে না। যদি তাকাই তবে সে হয়তো এরকম কোনো কথা বলে বসবে, “এতই যখন আতশবাজি দেখার শখ, তবে গিয়েই দেখে আসুন না কেন?” তখন আমি তাকে কী জবাব দেব? আমি কি তাকে এই উত্তরটা দিতে পারব যে, আশপাশের মানুষজন আমাকে দেখে কী ভাববে, এই চিন্তায় আমি ওখানে যেতে ভয় পাচ্ছি?
অথচ আমার হাতে এখন সময় অত্যন্ত কম, এখনও আমি অন্যরা আমাকে দেখে কী ভাববে-এই চিন্তায় ভয় কেন পাচ্ছি আমি?
এই সময় মিয়াগি উঠে দাঁড়িয়ে জানালাটা খুলে দিয়ে বাইরে মাথা বের করে দিল। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে আতশবাজির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়নি, বরং জিনিসটাকে তার কাছে দুর্লভ আর অদ্ভুত মনে হয়েছে, তাই দেখছে। যে কারণই থাকুক না কেন, তার এ ব্যাপারে যে আগ্রহ রয়েছে এটুকু স্পষ্ট।
“সে কি মিস পর্যবেক্ষক, আপনি ওসব দেখতে চান নাকি? আমি যদি এই ফাঁকে পালিয়ে যাই তাহলে কী হবে?”
চোখ না সরিয়েই মিয়াগি বিদ্রূপের ভঙ্গিতে জবাব দিল, “আপনি কি চান আমি আপনার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকি?”
“মোটেই না। বরং আমি চাই আপনি এখান থেকে দূর হয়ে যান। এভাবে আপনার চোখের সামনে থেকে কিছুই করতে পারছি না আমি।”
“বুঝতে পেরেছি। তার মানে আপনি প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছেন। একটা কথা জানিয়ে রাখি, আপনি যদি পালিয়ে যাওয়ার সময় আমার থেকে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলেন—তবে সেটাকে ‘ক্ষতিকর কাজ’ বলে ধরা হবে। সাথে সাথে আপনি ঠুস করে মারা যাবেন। সাবধান করে দিলাম।”
“কতখানি দূরত্ব?”
“সঠিকটা জানা নেই। তবে আমার ধারণা একশো মিটারের মধ্যেই হবে ওটা।”
আরও আগেই ব্যাপারটা জানানো উচিত ছিল তার।
“আচ্ছা, আমি সাবধান থাকব,” তাকে জানালাম।
ঠিক তখন আকাশে একসাথে অনেকগুলো আতশবাজি ফাটতে শুরু করল। এর মানে অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পাশের অ্যাপার্টমেন্টের হইহুল্লোড়ও থেমে গিয়েছে এখন। হয়তো সবাই মিলে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বেরিয়েছে।
.
অবশেষে মিয়াগি আমার ‘হতে পারত’ ঘটনাগুলো একে একে বলতে আরম্ভ করল।
“হুম, যে ত্রিশ বছর আপনি হারিয়ে ফেলেছেন-সবার আগে আপনার কলেজ লাইফ শেষ হবে। দৈনন্দিন জীবন চালানোর মতো টাকা পয়সা আপনার থাকবে। সে টাকা দিয়ে বই পড়া, গান শোনা, ঘুমানো বাদে আর কিছুই করবেন না আপনি। আপনার দিনগুলো অর্থহীনভাবে কাটবে, কোনো রকমের বৈচিত্র্যতা থাকবে না সেসবের মধ্যে। এভাবে অনেকখানি সময় আপনার কেটে যাবে। গ্রাজুয়েশনও আপনি সম্পন্ন করবেন কোনোমতে, গুরুত্বপূর্ণ কিছুই শেখা হবে না আপনার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ছোটবেলায় যে কাজটা আপনার সবচাইতে অপছন্দ ছিল, সেটাকেই আপনার পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যদি তখনই সত্যটাকে গ্রহণ করে নিয়ে হাল ছেড়ে দিতেন, তাহলে অনেক ভালো হতো। কিন্তু না, আপনি তখনো ছোটবেলার সেই স্বপ্ন আর নিজেকে ‘শ্রেষ্ঠ’ভাবার প্রবণতাটাকে ভুলতে পারেননি। তাই ‘এই কাজটা আমার জন্য উপযুক্ত না’ এই ভেবে নিয়ে নিজের কাজটাকে কখনই আপন করে নিতে পারেননি আপনি। প্রতিদিন মরার মতো শরীরটাকে টেনে টেনে অফিস-বাসা- অফিস-এভাবেই রুটিন চলে আপনার। অনুভূতিশূন্য চোখ, প্রচণ্ড পরিশ্রম আর তার ফলে বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলার পরে মদের গ্লাসেই আপনি কেবল সুখ খুঁজে পেতে শুরু করেন। বিশাল মাপের, গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন হওয়ার স্বপ্নটা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। ছোটবেলায় যে আদর্শ জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত একটা কাটাতে শুরু করেন আপনি।”
“খুব একটা অস্বাভাবিক তো লাগল না,” বাঁধা দিলাম আমি।
“তা ঠিক, গল্পটা নতুন কিছু নয়। খুবই পরিচিত মনে হবে সবার কাছে। কিন্তু সেই একই জিনিস থেকে কে কতটুকু দুঃখ পায়, তার হিসাব কিন্তু প্রত্যেকের জন্য আলাদা। আপনি এমন একটা মানুষ ছিলেন, যার কিনা অন্যদের সাথে থাকার প্রচণ্ড দরকার ছিল। সঙ্গী হিসেবে কেউ না থাকায় আপনি মানসিক শান্তি কখনো খুঁজে পাননি, গোটা পৃথিবীটার ভারটাকে একলাই সামলাতে হয়েছে। কিন্তু এরকম কেউ একজন ভেঙে পড়লে যে কষ্টটা তাকে সহ্য করতে হয়, সেটা তাকে ধ্বংসের পথে নেবার জন্য যথেষ্ট।”
“ধ্বংস?” পুনরাবৃত্তি করলাম শব্দটা।
“এভাবে চলতে চলতে আপনি হঠাৎ করে একদিন আবিষ্কার করবেন, আপনার বয়স ত্রিশ পেরিয়ে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে এসে আপনার একমাত্র শখের কাজ হলো মোটরসাইকেলে করে গন্তব্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু একটা কথা তো জানেনই, মোটরসাইকেল কতটা বিপজ্জনক একটা যানবাহন। বিশেষ করে যদি চালক এমন একটা মানুষ হয়, যে কিনা জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে-বাকিটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। তবে সৌভাগ্যের কথা, আপনার কারণে অন্য কোনো গাড়ির চালক কিংবা পথচারী মারা যায়নি। নিজে থেকেই মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যান আপনি। কিন্তু সেই দুর্ঘটনার কারণে আপনি আপনার মুখের প্রায় অর্ধেকটা হারিয়ে ফেলেন, সেই সাথে হাঁটাচলার ক্ষমতা ও বেশিরভাগ আঙুলকে বিদায় জানাতে হয় আপনার।”
‘মুখের প্রায় অর্ধেকটা হারিয়ে ফেলা’ বাক্যটা দ্বারা এর অর্থ সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু সেটা মোটেও কল্পনা করা যায় না।
এর মানে আমার মুখের অবস্থাটা এতটাই বাজে হয়ে যায় যে, কেউই আমাকে আর চিনতে পারে না।
“আপনি সবসময় আপনার সুদর্শন চেহারাকে নিজের একটা গুণ ধরে এসেছেন। তাই মুখে এরকম আঘাত পাওয়ার পর আপনি ঐ ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তটা নেয়ার কথাও ভেবে দেখেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও আপনি কাজটা করার সাহস খুঁজে পান না। কারণ তখনো আপনি বুকের ভেতর সেই স্বপ্নটা লালন করে রেখেছেন যে, হয়তো সামনেই আপনার সাথে ভালো কিছু একটা ঘটবে। এই ‘আশা’টা হয়তো আপনার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, কিন্তু সেটার কাজ অতটুকুই। এ থেকে শয়তান যে আসলেই আছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এভাবেই আপনি পঞ্চাশ বছরে পা দেন—কিন্তু দেখানোর মতো আপনার কাছে কিছুই থাকে না। তাই একদিন আপনি অসুস্থ হয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান। ভালোবাসার অভাবে আর কারো স্মৃতিতে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়ে আপনি মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের সর্বশেষ মুহূর্তটাতেও আপনি আফসোস করেন, ‘এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না।”
কথাগুলো শুনতে খুবই অদ্ভুত লাগছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন জানি তার বলা সবগুলো কথা বিশ্বাস করে ফেললাম।
“শুনে কী মনে হলো?”
“হুম। শুরু থেকে বলি। প্রথমত, আমার এখন খুবই খুশি লাগছে যে আমি আমার এই ত্রিশ বছরের ভবিষ্যতটাকে বিক্রি করে দিয়েছি।” উত্তর দিলাম আমি। মিথ্যা বলব না, সত্যিই ভালো লাগছে আমার। কারণ মিয়াগির কথা অনুযায়ী এসব ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আর নেই।
“কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তিনমাস সময় বাকি না রেখে মাত্র তিনদিন রেখে দিলেই পারতাম।”
“এখনও কিন্তু আপনার সেই সুযোগ রয়েছে,” মিয়াগি জানাল। “আপনি আরও দুইবার আপনার আয়ু বিক্রি করতে পারবেন।
“শেষ তিনদিন চলে গেলে তো আপনি আমার ধারেকাছে থাকবেন না, তাই না?”
“সঠিক। যদি আমাকে এতটাই অপছন্দ হয়, তবে এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেন। ‘
“ব্যাপারটা মাথায় রেখে দিলাম,” আমি বললাম।
সত্যি বলতে কী, তিন মাস বেঁচে থাকার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তিনটে দিন হাতে রেখে বাকি সময়টুকু বিক্রি করে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু তা করলাম না, কারণ ঐ যে, ‘আশা’ এখনও ভেতরে রয়ে গিয়েছে। শয়তানের মতো ফিসফিসে গলায় সে আমাকে বলছে, “এখনও কিন্তু তোমার সাথে ভালো কিছু ঘটার সুযোগ রয়েছে।”
মিয়াগি আমাকে যে ত্রিশ বছরের গাঁথা শোনাল, তা থেকে আলাদা হবে আমার সামনের এই তিন মাস। ভবিষ্যৎ তো এখনও কেউ স্থির করে দেয়নি। হয়তো সত্যি সত্যিই ভালো কিছু ঘটবে আমার সাথে। হয়তো বেঁচে থাকার রসদ জোগানোর মতো অভিজ্ঞতা হবে আমার।
সেটা হবার সম্ভাবনা কিন্তু একেবারেই শূন্য নয়।
আর তার মানে এখনই মৃত্যুর মাতাল সুগন্ধে মাতোয়ারা হওয়া চলবে না।
.
রাতের গভীরে বৃষ্টির আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল আমার। টপটপ করে মাটিতে পড়তে থাকা বৃষ্টির শব্দ না চাইলেও কানে প্রবেশ করছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, রাত তিনটা বাজে এখন।
বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকদিন হলো গন্ধটা আমি শুঁকিনি, তাই এর উৎস বের করতে খানিকটা বেগ পেতে হলো : মেয়েদের শ্যাম্পুর গন্ধ ওটা।
স্বাভাবিকভাবেই ওটা মিয়াগির চুল থেকে আসছে। আন্দাজ করলাম, আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম, মিয়াগি তখন গোসল সেরে নিয়েছে।
কিন্তু যুক্তিটা মানতে আমার বেশ কষ্ট হলো। গর্ব করছি না, তবে আমার ঘুম খুবই পাতলা। সামান্য শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে যায় আমার। যেমন-সকালবেলা হকারের পত্রিকা দেয়ার আওয়াজ কিংবা ওপরের তলায় হাঁটাচলার শব্দ কানে গেলেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। তাই মিয়াগির গোসলের শব্দেও আমার ঘুম ভাঙেনি, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে। বোধহয় বৃষ্টির শব্দে সেটা চাপা পড়ে গিয়েছিল।
শেষমেশ যুক্তিটা মেনে নিতে বাধ্য হলাম। একটা অচেনা মেয়ে আমার বাসায় গোসল করেছে, জেনে খুব অদ্ভুত লাগছিল। তবে বেশিক্ষণ সেটা নিয়ে ভাবলাম না। তাছাড়া আমাকে কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। এরকম গভীর রাতে আমার করার মতো কিছুই নেই।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি চাইলেও তো ঘুম আসবে না। তাই গানের সাহায্য নিলাম। ‘প্লিজ, মিস্টার লস্টম্যান’ সিডিটা বিক্রি করতে পারিনি। সেটার সিডিটা বালিশের পাশে রাখা প্লেয়ারে ঢুকিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে নিলাম। আমার একটা থিওরি আছে, যারা ঘুমহীন রাতে এই গান শোনে, তারা কেউই সঠিকভাবে জীবন কাটানো মানুষ নয়। এই জগতে জায়গা করে নিতে না পারার ব্যর্থতা আর সর্বোচ্চ চেষ্টা না করার অপরাধবোধ থেকে নিজেকে ক্ষমা করে দেবার জন্য এই গান শুনতাম আমি।
হয়তো সে সুযোগ বেছে নেয়ার জন্য এখন আমাকে এর মাশুল গুনতে হচ্ছে।