এরশাদের প্রকাশ্য তৎপরতা
১৯৮১ সালের নভেম্বরে দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এবং ড. কামাল হোসেন ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। নির্বাচনে সেনাবাহিনী বিএনপি প্রার্থী সাত্তারকে খোলাখুলি সমর্থন দিল। সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি সাত্তারের ক্ষমতাগ্রহণের পর সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এরশাদ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে দেশে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন এবং রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা রাখা উচিত বলে দাবি তোলেন। চাকরিরত একজন সেনাপ্রধান একজন রাষ্ট্রপতির কাছে পত্রিকায় প্রবন্ধের মাধ্যমে এরকম দাবি তুলে ধরায় অনেকেই আশ্চর্যান্বিত হন। সেনাপ্রধান এরশাদের প্রবন্ধটি ছাপা হওয়ার পর জেনারেল ওসমানী পত্রিকার মাধ্যমে তার সমালোচনা করে বলেন যে, এটা গণতন্ত্রবিরোধী। কিন্তু এর পরের দিনই লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন (অবঃ) পত্রিকাতে আরেকটি প্রবন্ধের মাধ্যমে সেনাপ্রধান এরশাদকে সমর্থন করেন এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন এবং রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনের কথা আগেই বলেছি। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগমনের দিন জেনারেল ওসমানী তাঁকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান এবং পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। যাহোক, ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাদখলের পর জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন।
এদিকে রাষ্ট্রপতি সাত্তারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলাদলি চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এ সুযোগে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতালাভের পথও সহজ হয়ে উঠছিল। বিএনপির অনেক নেতা, মন্ত্রী এবং কয়েকজন সচিব ও বিভিন্ন দলের পরিচিত লোকজন জেনারেল এরশাদের সঙ্গে গোপনে এবং সময় সময় খোলাখুলিভাবে বৈঠক ও শলাপরামর্শ করতেন। পরে এঁদের অনেকেই এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য হন এবং বিভিন্ন রকম ফায়দা লুটেন। এসব কার্যকলাপে সামরিক গোয়েন্দাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী ও আরো কিছু উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। এঁরাই কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও কয়েকজন সচিবের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতালাভের পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপ দিচ্ছিলেন। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাদখলের পর এসব মন্ত্রী, সচিব ও রাজনীতিবিদগণ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন।
জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাদখলের পাঁয়তারা তেমন কোনো গোপন বিষয় ছিল না। কারণ পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, বেসামরিক কর্মকর্তা ও আর্মির সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে তাঁর কার্যকলাপ ছিল মূলত তৎকালীন সরকারের প্রতি চরম অবজ্ঞাসূচক। যদিও রাষ্ট্রপতি সাত্তার এসব বিষয়ে অবগত ছিলেন কিন্তু সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে কোনোকিছু করার মতো ক্ষমতা তাঁর সরকারের ছিল না। আর্মিকে মোটামুটি মুক্তিযোদ্ধাবিহীন করে পুরো আর্মিকে এরশাদ তাঁর কব্জায় নিয়ে আসেন। বলতে গেলে ওই সময় আর্মিতে তৎকালীন সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণই ছিল না।
আমার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হওয়ার পরও আমি সেনানিবাসে আমার আগের বাড়িতেই অবস্থান করছিলাম। সেনাবাহিনীর অফিসারগণ ও অন্যান্য লোকজন আমার বাড়িতে তেমন আসতেন না। কারণ, তখনও আমার বাড়ি সর্বক্ষণ গোয়েন্দা বাহিনীর পর্যবেক্ষণে ছিল। তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল হক আমাকে জানালেন সরকার আমাকে ফিলিপাইনে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করেছে। তিনি আমাকে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর (বর্তমানে স্পিকার) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রশাসনিক ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে অতি সত্বর ফিলিপাইনে যাওয়ার জন্য বলেন। আমি এর পরও মাস দুয়েক ইচ্ছে করে ঢাকায় ছিলাম। ওই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক (প্রশাসন) মহিউদ্দিন আহমেদকে প্রায়ই সামরিক গোয়েন্দা অফিস থেকে তাগাদা দেওয়া হতো যেন আমাকে তাড়াতাড়ি ফিলিপাইনে পাঠানো হয়। এরই মধ্যে ডিসেম্বরের কোনো একদিন আমি রাষ্ট্রপতি সাত্তারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য বঙ্গভবনে যাই। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রপতি সাত্তার আমাকে আগে থেকে ভালোভাবেই জানতেন।
রাষ্ট্রপতি সাত্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ
আমি যখন রাষ্ট্রপতি সাত্তারের অফিসকক্ষে প্রবেশ করি, তখন তাঁকে বিষণ্ণ ও বিমর্ষ দেখি। উনি আমাকে নিজে থেকে বলেন যে, এ পরিস্থিতিতে আমার কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে থাকাই শ্রেয়। তখন আমি উত্তরে তাঁকে নির্দ্বিধায় জানাই যে, আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন সেনাপ্রধান এরশাদ মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিচ্যুত ও বিদেশে পাঠিয়ে তাঁর অবস্থান পাকাপোক্ত করছেন এবং শিগগিরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার জন্য তৈরি হচ্ছেন। এর উত্তরে রাষ্ট্রপতি কিছুই বললেন না। তিনি কোনো উত্তর না দেওয়ায় আমি নিজেও অস্বস্তি বোধ করছিলাম। ফলে অন্য কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে সালাম জানিয়ে তাঁর অফিসকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসি। সেদিন তাঁর চেহারায় একজন অসহায় রাষ্ট্রপতির যে প্রতিকৃতি দেখেছি, অদ্যাবধি আমার স্মৃতিতে তা অটুট আছে।
আজ বলতে হয়, তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কথা প্রসঙ্গে একদিন আমাকে বলেছেন যে, সামরিক বাহিনী থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে নিয়োগ করার জন্য প্রথমে আমার ফাইল যখন রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়, তখন রাষ্ট্রপতি ফাইল অনুমোদন করেননি এবং ফেরত পাঠিয়ে দেন। পরে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের চাপের মুখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি আমাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের আদেশ অনুমোদন করেন।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ
জেনারেল জিয়া ও মঞ্জুরের হত্যার পর আমার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। আমি তখন বেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম এবং আমাকে মানসিক চাপের মধ্যে রাখা হয়। আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা আমার নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ মঞ্জুরের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ও যোগাযোগকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে আভাসে ইঙ্গিতে জিয়াহত্যার সঙ্গে আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়। আমার প্রতিবেশী বেগম খালেদা জিয়াকে এ ব্যাপারে বিভিন্নভাবে আমার বিরুদ্ধে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। তাই রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফিলিপাইনে যাওয়ার পূর্বে আমি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সস্ত্রীক দেখা করার ব্যাপারে মনস্থির করি। মে মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হওয়ার পর থেকে আমাদের সঙ্গে তাঁর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আমার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। কারণ জেনারেল জিয়া নিহত হওয়ার পর মৃতদেহ যখন সেনানিবাসে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়, তখন আমার স্ত্রী খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানানোর জন্য তাঁর বাড়িতে যান। সেখানে অনেক লোকজনের সামনে খালেদা জিয়া আমার স্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, ‘৩০ মে সকালে মইন ভাইয়ের সঙ্গে জেনারেল মঞ্জুরের কী আলাপ হয়েছিল?’ এই প্রশ্ন শুনে আমার স্ত্রী অনেকটা হতভম্ব হয়ে যান এবং উপস্থিত লোকজনের সামনে লজ্জিত হয়ে পড়েন। কারণ, পরোক্ষভাবে এ প্রশ্নের মাধ্যমে আমার স্ত্রীকে অবহিত করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যা সম্পর্কে আমি পূর্ব থেকেই হয়তো অবগত ছিলাম কিংবা ষড়যন্ত্রে জড়িত। বস্তুতপক্ষে আমার সঙ্গে জেনারেল মঞ্জুরের টেলিফোন আলাপ সম্পর্কে আমার স্ত্রী কিছুই জানত না। কারণ, এ সম্পর্কে তাকে আমি কিছুই বলিনি।
খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে তৎক্ষণাৎ ফিরে এসে আমার স্ত্রী অফিসে ফোন করে আমাকে এ ঘটনা জানান। আমি তখন তাকে মঞ্জুরের সঙ্গে আমার কথোপকথনের সবকিছু খুলে বলি। বেগম খালেদা জিয়ার এ প্রশ্ন থেকে আমার বুঝতে বিলম্ব হলো না যে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জেনারেল এরশাদ এবং তাঁর সহযোগীরা ইতিমধ্যেই তাঁকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে এবং তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছিল যে, সেনাবাহিনীর প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধা অফিসার রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত। যাহোক, বিশেষ করে ওই কারণেই আমি ফিলিপাইনে যাওয়ার পূর্বে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য মনস্থির করি।
এক সন্ধ্যায় আমি সস্ত্রীক খালেদা জিয়ার বাসায় যাই। বাড়িতে গিয়ে কোনোরকম ভূমিকা না রেখে সরাসরি আমি তাঁকে জানাই যে, আমার স্ত্রী আপনার বাড়িতে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। যাহোক, আমি তাঁকে নিয়ে এসেছি; জুন মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হওয়ার পর সমবেদনা জানাতে এলে আপনি আমার স্ত্রীকে যে প্রশ্ন করেছিলেন তার উত্তর দেওয়ার জন্য। তবে সে ব্যাপারে কিছু বলার আগে আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৩ তারিখের কথা। সেদিন জেনারেল জিয়া যখন গৃহবন্দি হলেন আপনার টেলিফোন পেয়ে অসুস্থ শরীরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন একমাত্র আমিই আপনার বাড়িতে এসেছিলাম, আর কেউ তো আসেননি। এসব বলার পর তিনি একটু সংকোচ বোধ করছিলেন বলে মনে হলো। এরপর তিনি নিজে থেকে বললেন যে, এখন তিনি সবকিছু ভালোভাবে জানেন এবং জেনারেল মঞ্জুর যে রাষ্ট্রপতি-হত্যায় জড়িত ছিলেন না, তা তিনি বুঝতে পারছেন। কথা প্রসঙ্গে আরো জানতে পারি যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যার পরপর যারা তাকে ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিল তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখন তিনি ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। আমি যখন তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছিলাম তখন তিনি বললেন যে, আপনি এখন দেশে থাকলেই ভালো হতো। আর কোনোকিছু না বলে আমি ও আমার স্ত্রী বিদায় নিয়ে চলে আসি।
আত্মকথা : শেষ পর্ব
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফিলিপাইনে যোগদান করি ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে। সেখানে বসেই খবর পাই মার্চ মাসের ২৪ তারিখ দেশে রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছেন। এ খবর অপ্রত্যাশিত ছিল না। কেননা, ১৯৮১ সালের মে মাসে জেনারেল জিয়াহত্যার পর তাঁর উপরাষ্ট্রপতি সাত্তার নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বটে; কিন্তু না ছিলেন তিনি একজন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্ব কিংবা ছিল না তাঁর তেমন কোনো ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব। ফলে তিনি সেনাপ্রধান এরশাদ ও আর্মিকে তাঁর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হননি যা আমি ইতিপূর্বে বর্ণনা করেছি। তাই জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাদখলের প্রক্রিয়া বস্তুতপক্ষে শুরু হয় জেনারেল জিয়াহত্যার পর এবং সে ধারাবাহিকতা চূড়ান্ত রূপ পায় ২৪ মার্চে!
ফিলিপাইনে ছিলাম আট মাসের মতো। সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ লাওস, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ও পাপুয়া নিউগিনিতে প্রেষণে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। দীর্ঘ ১৬ বছর দেশের বাইরে। আমার চাকরিজীবনের প্রধান সময়গুলো কেটেছে সামরিক বাহিনীর বাইরে, দেশের বাইরে। তাই অপেক্ষা করেছি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের জন্য। ১৯৯০ সালে পতন হলো এরশাদ সরকারের। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচিত বিএনপি সরকার। তাই আশা করেছিলাম এবার হয়তো আমি সেনাবাহিনীতে ফিরতে পারবো। কারণ, সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। আমি মনে করতাম আর্মি পোশাকের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আত্মসম্মান, গৌরব ও মর্যাদা। আমার কাছে সামরিক পোশাক ছিল নৈতিকতা আর দেশপ্রেমের প্রতীক। এ পেশাই ছিল আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়। তাই সর্বদা চেয়েছি পেশাগত দায়িত্বকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে, এমনকি নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদানের ফলে পাকিস্তান আর্মি এপ্রিল মাসে সিলেট শহরে আমাদের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে বাড়ির বংশানুক্রমিক সংগৃহীত মূল্যবান জিনিস -কাগজপত্র, দলিলাদি, পারিবারিক ছবি থেকে শুরু করে অন্যান্য সব অস্থাবর সম্পত্তি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ছাড়া ‘৭১ সালের ১৯ মার্চের জয়দেবপুরের ঘটনাবলির জন্য পাকিস্তানবাহিনীর প্রচণ্ড ক্রোধ ছিল আমার ওপর। ঐ দিন জয়দেবপুরে কী ঘটেছিল সচেতন পাঠকরা হয়তো তা জানেন। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহানবার আরভার (পরে লে. জেনারেল) যাঁর হুকুমে ২৫ ও ২৬ মার্চ ঢাকায় তাণ্ডবলীলা সংঘঠিত হয়, সেই আরবার জয়দেবপুরে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে যখন সৈন্যদের জনতার ওপর গুলিবর্ষণের জন্য আমাকে আদেশ দিতে বললেন, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি সৈন্যদের মাটিতে গুলি করার জন্য বাংলায় নির্দেশ দিই। এরপর ব্যারিকেডদানকারী স্থানীয় নেতাদের আমার ওপর বিশ্বাস রেখে ব্যারিকেড সরিয়ে নিতে বললে তারা তা মেনে নেন। ঐ বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে জনতার পক্ষ নেওয়াকে ব্রিগেডিয়ার আরবার আপসকামিতা আখ্যায়িত করে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। যাহোক, এ যুদ্ধের কারণে আমার মা স্মৃতিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেন এবং পরে মৃত্যুবরণ করেন। আমার পরবর্তী প্রজন্ম ১৯৭১-পূর্ব পারিবারিক কোনো জিনিসপত্র, ছবি ইত্যাদি দেখা থেকে বঞ্চিত হলো।
১৯৯২ সালে সিগনাল কোরের মেজর জেনারেল লতিফ (জেনারেল মঞ্জুরহত্যায় অভিযুক্ত) বিডিআর-এর মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় সেখানে কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেয় এবং শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি প্রায় ভেঙে পড়ে। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল নূরুদ্দিন। তিনি পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার এবং চাকরিতে আমার জ্যেষ্ঠ ছিলেন। আমি এবং জেনারেল নূরুদ্দিন ১৯৮০ সালে একই দিনে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পাই। সেনাপ্রধান জেনারেল আতিক অবসর গ্রহণ করলে জেনারেল এরশাদ তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন।
যাহোক, বিডিআর-এর উচ্ছৃঙ্খলতার প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে আমাকে বিডিআর-এর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে সরকার তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল অলি আহমদকে গোপনীয়তা রক্ষাপূর্বক আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যাংককে পাঠান। কিন্তু সে সময় আমি বেইজিং ছিলাম এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসমূহের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন এসকাপের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি জানতেন না যে, আমি তখন ব্যাংককের বাইরে যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমার অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিল।
আমি ব্যাংককে ফিরে এসে কর্নেল অলির আসার খবর জানতে পারি। এর কদিন পর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে প্রয়াত) ঢাকা থেকে ফোনে আমার সঙ্গে বিডিআর-এর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে আলোচনা করেন। আমি এ নিয়োগে সম্মতি জানাই।
কয়েকদিন পর ব্যাংকক থেকে টেলিফোনে সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান মেজর জেনারেল (পরে সেনাপ্রধান ও অবসরপ্রাপ্ত) নাসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার বদলিসংক্রান্ত আরো বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আলাপের পর বুঝতে পারি যে, তৎকালীন সরকার তাঁকে এ ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। বরং তিনি আমার কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে উৎসুক হয়ে ওঠেন।
উল্লেখ্য, মেজর জেনারেল নাসিম আমার অনেক দিনের পরিচিত এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ছিলেন। মেজর জেনারেল নাসিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৬৫ সালে কমিশনের জন্য যোগ দেন এবং একই সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের ফলে আড়াই বছরের প্রশিক্ষণের পরিবর্তে মাত্র সাত মাসের প্রশিক্ষণের পরেই কমিশন লাভ করে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন ক্যাপ্টেন নাসিম জয়দেবপুর থেকে আমার সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর মেজর জেনারেল নাসিমকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
যাহোক, ফোনে নাসিম আমাকে জানান যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে তিনি আমাকে এ ব্যাপারে জানাবেন। কিন্তু পরে আমি এ সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারিনি এবং শেষ পর্যন্ত বিডিআর-এর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাইনি। জানতে পারলাম, অন্য একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর কয়েক মাস পরে আমি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি।
সাক্ষাৎকালে তিনি আমাকে বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে এবং কোনোরকম ইতস্তত না করে সরাসরি বলেন, ‘আমি নিজেও জানি এবং সেনাবাহিনীতেও সবাই জানে, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ এবং অধিনায়কত্ব প্রয়োগে আপনি অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ এবং কঠোর। সবাই আপনার এই দিকটির প্রশংসা করে।’ এরপর একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘আবার অনেকে বলেন, আপনি তো অধীনস্থদের কন্ট্রোল করতে জানেন, কিন্তু আপনাকে কন্ট্রোল করবে কে?’
শুনে আমি একটু থমকে গেলাম। তারপর বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘ম্যাডাম প্রাইমমিনিস্টার, আমি আগাগোড়াই একজন পেশাদার সৈনিক। দেশে এ পর্যন্ত এত অঘটন ঘটেছে কিন্তু একজন সিনিয়র অফিসার হয়েও কোনোকিছুতে জড়াইনি। আপনিও অবগত আছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আর্মির শৃঙ্খলারক্ষায় আমি পিছ-পা হইনি। আর এ পর্যন্ত বেআইনি ও শৃঙ্খলাগর্হিত কোনো কাজ আমাকে দিয়ে করানো যায়নি।’ এরপর আমি তাঁকে বলি, ‘দেশ ও আর্মির প্রচলিত আইনই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।’
এই আলাপ-আলোচনা থেকে আমার ধারণা জন্মে এবং অন্যান্য সূত্র থেকে পরোক্ষভাবে আবারও আভাস দেওয়া হয় যে, শিগগিরই আমাকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান জেনারেল নূরুদ্দিন অবসরে গেলে আমার পাঁচ ব্যাচ জুনিয়র মেজর জেনারেল নাসিমকে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে এনে লে-জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করা হলো।
এরপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন সেনাবাহিনীতে উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে লে. জেনারেল নাসিমকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস মেজর জেনারেল মাহবুবকে লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন। জেনারেল মাহবুবও আমার জুনিয়র এবং তিনি ১৯৬৪ সালে সামরিক বাহিনীতে ‘স্পেশাল পারপাস কমিশনে গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে যোগদান করে আট মাসের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের পর কমিশন পান। শুধু নির্দিষ্ট কাজের জন্য, যেমন ইলেকট্রিক, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইএমই) গ্র্যাজুয়েট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি, বিশেষ কোর্সের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের পর এঁদের কমিশন দিয়ে অফিসার বানানো হয়। এ ধরনের স্পেশাল কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসারদের সেনাপ্রধান বানানোর নজির কোনো দেশে আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।
১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আমি নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাকে আর্মিতে ফিরিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করি। পরে লিখিতভাবেও তাঁর কাছে আবেদন করি এবং ওই পত্রের অনুলিপি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছেও পাঠিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সরকার থেকে সাড়া না পেয়ে আমি বাধ্য হয়ে আর্মিতে ফিরে যাওয়ার জন্য সংবিধানের আওতায় ১৯৯৭ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করি।
উল্লেখ্য, শৃঙ্খলাজনিত কারণ ছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যরাও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। এর নজির অন্যান্য দেশেও আছে। উদাহরণস্বরূপ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯৫ সালের মামলা নং-৩৮৩ (মেজর জেনারেল এলপিএস দেওয়ান বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া)-এর কথা উল্লেখ করা যায়। যাহোক, বাংলাদেশ হাইকোর্ট আমার রিট আবেদনটি খারিজ করেন। পরে আমি ওই রায়ের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হই। বিস্তারিত শুনানির পর আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন।
সমাপনী সারকথা
আমাদের সামরিক বাহিনী স্বাধীনতাযুদ্ধে গৌরবের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে। সামরিক বাহিনীতে যাঁরা আছেন তাঁরাও এদেশের সন্তান। অথচ, আজ যেন সামরিক বাহিনী একটা দ্বীপের মতো যার সঙ্গে মনে হয় জনগণের এবং দেশের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কেন এমন হলো? কে এজন্য দায়ী? কীভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো মহান যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরও সামরিক বাহিনীর মনোবল ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে।
একটি সামরিক বাহিনীকে দক্ষ, কৌশলী, সৎ ও নিষ্ঠাবান করে গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন সৎ, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব—যার মধ্যে রয়েছে চারিত্রিক দৃঢ়তা, উন্নত আত্মমর্যাদাবোধ, পেশার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং নৈতিক শৃঙ্খলা। আমাদের সেনাবাহিনীতে এসব বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে গঠিত নেতৃত্বের অভাবই ছিল প্রকট। নেতৃত্ব-বিকাশের সুযোগও হয়েছে হীন রাজনৈতিক কারণে বাধাগ্রস্ত। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসৃত হয়নি। বারবার ভঙ্গ করা হয়েছে সেনাবাহিনীর প্রচলিত নিয়মের। এতে সামরিক বাহিনীর সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা এসেছে, নিয়মনীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমেছে এবং অজানা আশঙ্কায় সবাই কমবেশি বিচলিত হয়েছেন। সামরিক বাহিনীর চেইন অফ কমান্ড, শৃঙ্খলাবোধ ও দেশপ্রেম যা সবচেয়ে জরুরি, তাই প্রকারান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজারো উদাহরণ দেওয়া যাবে। এমন কতগুলো ঘটনা রয়েছে যেগুলো উল্লেখ করা না হলে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বাদ পড়বে। যেমন, জেনারেল শফিউল্লাকে যখন সেনাপ্রধান করা হয় তখন জিয়াউর রহমান চাকরিতে বহাল আছেন এবং তিনি ছিলেন সিনিয়র। অথচ এই জিয়াউর রহমানই যখন রাষ্ট্রপতি হলেন তখন তিনিও সিনিয়রিটি ভঙ্গ করে জেনারেল এরশাদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন যেখানে জেনারেল দস্তগীর ছিলেন এরশাদের সিনিয়র। এই অনিয়মের পুনরাবৃত্তি হয়েছে আরো অনেকবার। যদি মেনে নেওয়া যায়, যিনি সিনিয়র ছিলেন তিনি যোগ্য ছিলেন না বলেই ব্যতিক্রম ঘটানো হয়েছে, তবে পরবর্তী সময়ে সেই যোগ্য (!) সামরিক কর্মকর্তাদের কর্মের খেসারত কেন পুরো জাতিকে দিতে হয়েছে? তখন আরো প্রশ্ন জাগে, কী সেই যোগ্যতার মাপকাঠি? সে কি কেবলই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি, ব্যক্তি পছন্দ কিংবা নতজানু তাঁবেদারি সামরিক নেতৃত্ব-প্রতিষ্ঠার কূটচক্র?
দেশের শান্তিকালীন অবস্থায় আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ও আনুগত্য প্রদর্শনমূলক মহড়া ও ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করা সেসব যোগ্য কর্মকর্তার দ্বারা সম্ভব হলেও দেশের সংকটকালে তাঁদের নেতৃত্ব অধিনস্থদের নিকট প্রশ্নাতীতভাবে গৃহীত হয়নি। ফলে সেনাবাহিনীর একক সত্তা হয়েছে বহুধাবিভক্ত। সেসব অধিনায়কের নেতৃত্ব জাতির ক্রান্তিলগ্নে ভেঙে পড়েছিল, যা পুরো দেশ ও জাতিকে ঠেলে দিয়েছিল সংঘাত ও বিপর্যয়ের মুখে।
আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝতে চান না যে, সেনাবাহিনী একটি ভিন্ন ধরনের সংগঠন এবং এর নেতৃত্ব দেওয়ার যে যোগ্যতা তার মাপকাঠিও ভিন্ন। সামরিক শাসকের পক্ষে যা মানায়, গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও যদি তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়, তবে তার প্রতিফলন সামরিক বাহিনীর সমগ্র কাঠামোয় পড়বে না কেন? ফলে সততা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার বদলে সামরিক বাহিনীতে এসেছে দলাদলি, অবিশ্বাস, প্রতারণা ও ভণিতা।
আজ ভাবতে কষ্ট হয়, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে-যুবক জীবনের বিনিময়ে মাতৃভূমির প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষার শপথ নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে, মুষ্টিমেয় কয়েকজন উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসারের ব্যক্তিগত হীনস্বার্থে সে কেবল রাজনীতি ও ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ, সামরিক বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের মধ্যে কোনোকিছুরই অভাব নেই। সঠিক প্রশিক্ষণ, যোগ্য নেতৃত্ব ও সুদক্ষ পরিচালনা তাদের গড়ে তুলতে পারে দেশপ্রেমিক সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী রূপে।
আমাদের সামরিক বাহিনীর সামনে এখন সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। লক্ষ্যহীন সামরিক বাহিনী তাই কেবল উদ্দেশ্যহীন বৈষয়িক লাভ-লোকসান বিচারে ব্যস্ত। এ ধরনের অফিসার দ্বারা যখন সামরিক বাহিনী পরিচালিত হয় তখন সমগ্র বাহিনীর চারিত্রিক দৃঢ়তা ভেঙে পড়ে। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তখন বিপথে পরিচালিত হয়। মনে করে ক্ষমতার অপব্যবহার আর বৈষয়িক লাভ গনাই তাদের কাজ। রাজনীতি অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আশেপাশে ও ক্ষমতাসীনদের সুনজরে থাকাই তাদের দায়িত্ব। এভাবেই নৈতিকতাহীন কূপমণ্ডূক নেতৃত্ব সমগ্র সামরিক বাহিনীকেই লক্ষ্যভ্রষ্ট করে তুলেছিল।
স্বাধীনতার পর সামরিক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় অফিসারদের অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এদের ৭০ ভাগ আবার ছিলেন স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এঁদের মেনটাল অ্যাটিচ্যুড অ্যাডজাস্টমেন্ট ট্রেনিং হয়নি। ৬ মাসের প্রশিক্ষণে তা সম্ভবও নয়। অপর দিকে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসাররা সামরিক দিক দিয়ে দক্ষ হলেও মানসিকতায় তাঁরা ছিলেন ঔপনিবেশিক। এঁদের অধিকাংশই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি মানসিকতা বদলাতে পারেননি। ফলে জনসাধারণের প্রতি থেকেছেন উন্নাসিক। নিজ সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের প্রতি থেকেছেন উদাসীন। ফলে নিজেদের মধ্যেও তাঁরা রচনা করেছিলেন মানসিক দূরত্ব যা জন্ম দিয়েছে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, দেশপ্রেম ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবর্তে সৃষ্টি করেছে ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থান।
সামরিক বাহিনীর পেশা ও শৃঙ্খলাকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে হীন ব্যক্তিস্বার্থে তা পদদলিত করা হয়েছে। শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের ব্যাপারে কঠোর নিয়ম অনুশীলন করা হয়নি বরং তথাকথিত রাজনীতি ও দলীয় স্বার্থে দেখানো হয়েছে অর্বাচীন উদারতা যা জন্ম দিয়েছিল একের পর এক বিশৃঙ্খলার। দেশের ইতিহাসের সবকটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে জড়িত ছিল সামরিক বাহিনী। কিছু অফিসারের জন্য এই কলঙ্ক বহন করতে হচ্ছে সমগ্র সংগঠনকে।
সামরিক বাহিনী শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি জীবনধারা, দেশের জন্য ত্যাগই হলো এর মৌলিক উপাদান। কেননা, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যোগদানের সময়ই অঙ্গীকারবদ্ধ হন দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার। এই সেনাবাহিনীকে ক্ষমতাসীনদের হীনস্বার্থে, অযোগ্য নেতৃত্বে আরাম-আয়েশ, আনুগত্যের মহড়া, উৎসব, অপেশাদার কাজে ও রাজনীতিতে অভ্যস্ত করে ফেলা হয়েছিল, যার ফলে সেনাবাহিনীতে ঘনঘন বিশৃঙ্খলা ও অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে এবং তা দেশকে বারবার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
বস্তুত উন্নয়নশীল দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধের মোক্ষম উপায় হলো সুসংহত গণতান্ত্রিক কাঠামো যেখানে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিস্বার্থের কাছে দেশের স্বার্থ কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ হবে না এবং যেখানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই হবেন জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। যদি তাঁরা দেশের স্বার্থে সর্বদা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব সচ্চরিত্র, যোগ্য, পেশাদার ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হাতে অর্পণ করতেন, তবে কোনো মেজর, কর্নেল বা জেনারেলের দুঃসাহস হবে না গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার।
আমাদের সামরিক বাহিনী অমিত সম্ভাবনা ধারণ করে আছে। এখনই সময় এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার। এজন্য অগ্রসর হতে হবে পেশাগত নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে, যেখানে প্রাধান্য পাবে দেশের স্বার্থ, পেশার বিশুদ্ধতা, সততা ও কর্মনিষ্ঠা। কেননা, পেশাদার সৈনিক গণতন্ত্র, সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আমরা একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এই শতাব্দী আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। দূরদর্শী নেতৃত্ব বিনা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ নয়। সামরিক বাহিনী কি এই চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? হাজারো সুযোগ-সুবিধা ও টাকা-পয়সা দিয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ্য নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করা যাবে না। ‘মানি ইজ পুওর সাবস্টিটিউট ফর গুড কম্যান্ড’। টাকা-পয়সা দিয়ে আনুগত্য ভাড়া করা যায়, কিন্তু ক্রয় করা যায় না।
সময় বয়ে যায় তার আপন গতিতে। সে কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আজকের সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বই আগামীর বিশ্বস্ত সৈনিক তৈরি করবে। এই কাজে এই নেতৃত্ব ব্যর্থ হলে সময় তার চাহিদা পূরণ করে নেবে ঠিকই। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে আজকের নেতৃত্বের স্থান হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কারণ, ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর, বড় নির্মম।