বঙ্গভবনে চা-চক্র
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসেরই শেষদিকে একদিন রাষ্টপতি মোশতাক ঢাকায় অবস্থিত সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের বঙ্গভবনে চা-চক্রে নিমন্ত্রণ করেন। শাফায়াত জামিল আমাকে জানান, তিনি এ চা-চক্রে যোগ দেবেন না। বলে সেনাপ্রধানকে জানিয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর সন্দেহ বঙ্গভবনে নিয়ে মোশতাক এসব মেজরদের দিয়ে আর্মির সিনিয়র অফিসারদের আটক অথবা হত্যা করার জন্য ফাঁদ পেতে থাকতে পারেন। তা ছাড়া ওই চা-চক্রে ফারুক-রশিদ ইত্যাদি জুনিয়র অফিসারগণ থাকবেন। ফলে ওই চা-চক্র সিনিয়র অফিসারদের অসম্মানিত করারই শামিল হবে। এরপর আমি বিষয়টি সেনাপ্রধান জিয়াকে জানাই এবং বলি যে, মেজর ফারুক-রশিদ এবং অন্যরা যারা বঙ্গভবনে আস্তানা পেতেছে তারা এ চা-চক্রে আমন্ত্রিত হলে আমাদের যাওয়া সমীচীন হবে না। তিনি আমাকে এ সম্পর্কে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে বঙ্গভবনে কথা বলতে বলেন। আমি জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করি এবং জানাই, যদি ফারুক-রশিদ ও তার সহযোগীরা এ চা-চক্রে উপস্থিত থাকেন তা হলে আর্মির সিনিয়র অফিসাররা এতে অংশ নেবেন না। ওসমানী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন বলে আমাকে জানান। পরে ওসমানী ফোনে আমাকে জানান, আমার প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি সায় দিয়েছেন এবং মেজর ফারুক-রশিদ ও তার সহযোগীরা এ চা-চক্রে থাকবে না। শেষ পর্যন্ত আমি ও কর্নেল শাফায়াত একই জিপযোগে বঙ্গভবনে যাই। চা-চক্রে সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী ও সেনাপ্রধান জিয়া উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি মোস্তাককে বেশ অসহায় এবং বিচলিত দেখাচ্ছিল। ওই চা-চক্রে রাষ্ট্রপতি কিংবা অন্য কেউ দেশ বা সামরিক বাহিনী নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা করেননি এবং চা-চক্রের পরিস্থিতি ছিল অস্বাভাবিক ও থমথমে।
কোনো বর্ণনাতেই বঙ্গভবনের সেদিনের সেই চা-চক্রের অস্বাভাবিক পরিবেশকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। আমার দীর্ঘ সামরিক ও কূটনৈতিক জীবনে এমন চা-চক্র আর দেখিনি। প্রেসিডেন্ট মোশতাক নিজেও কোনো কথাবার্তা বলছিলেন না। আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম তারাও তেমন কোনো কথাবার্তা বলিনি। কথা বলার কোনো পরিস্থিতিই সেখানে ছিল না। ফলে চা-চক্র বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
এদিকে ফারুক, রশিদ ও তাদের সহযোগী জুনিয়র অফিসাররা বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারছিল এবং ভেতরের অবস্থা আঁচ করার চেষ্টা করছিল। এতো বড় জাতীয় দুর্ঘটনার পর সবাই মানসিকভাবে বেশ উত্তপ্ত ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল। দেশের, বিশেষ করে সামরিক পরিস্থিতি ছিল অস্থিতিশীল।
মোশতাকের প্রতি সিনিয়র অফিসারদের দৃষ্টিভঙ্গি আঁচ করার জন্যই ওই চা-চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল বলে আমার মনে হয়েছিল। চা-চক্রে যোগদানের ক্ষেত্রে আমাদের কয়েকজনের অনড় শর্তারোপের ফলে মোশতাক হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, সব সিনিয়র অফিসারই তাঁদের ধারণামতে, ভয়ভীতির মধ্যে চাকরি করছে এমনটি সত্য নয়। তাঁর দুশ্চিন্তার আরো কারণ ছিল। তিনি গুটিকতক জুনিয়র অফিসারের সহায়তায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছেন।
’৭৫-এর উত্তপ্ত নভেম্বর
শেখ মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ছিল দ্বিধাগ্রস্ত এবং দেশ প্রতিদিন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা সর্বজনাব নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও আবদুস সামাদ আজাদকে আটক করেন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে রাখেন। বাতাসে প্রতিনিয়ত নানা গুজব উড়ছিল ও সাধারণ নাগরিকগণ ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। সেনানিবাসেও অস্থিরতা বিরাজ করছিল এবং ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, নিজেদের মধ্যে যে-কোনো সময়ে সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে আর্মিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি ছিল। পদাতিক বাহিনীর মধ্যে, বিশেষ করে ঢাকা ব্রিগেডের ১ম, ২য় ও ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারগণ মেজর ফারুক, রশিদ ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছিল এবং আর্মির চেইন অফ কমান্ড পুনঃস্থাপনের জন্য তৎকালীন ব্রিগেড অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তাঁর অধীনস্থ অফিসার ও সৈন্যগণই তাঁর সার্বিক কর্তৃত্ব উপেক্ষা করে শেখ মুজিব হত্যায় জড়িত ছিল। এ পরিস্থিতিতে সেনাসদরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের অনিয়ম ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা বলে উত্তেজিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। কেননা, তিনি নিজেও জেনারেল জিয়ার অধীনে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। সামরিক বাহিনীর এই অস্থির অবস্থার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্নেল শাফায়াত জামিল ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াকে দায়ী করতেন। সেনাপ্রধান জিয়া এবং সেনাবাহিনীর অন্য অফিসাররা যদিও এ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হননি। কেননা জিয়া একধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে নিজের অবস্থান ঠিক রেখে আর্মির অধিনায়কত্ব করে চলছিলেন।
জিয়ার বন্দিত্ব
এরই মধ্যে চলে এলো ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর। আমি তখনও অসুস্থ এবং লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করি। বাসায় আমার স্ত্রী ও দুই মাসের কন্যাসন্তান। ভোর সাড়ে চারটা হবে তখন হঠাৎ আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে এবং অন্য প্রান্ত থেকে একজন মহিলা বলে ওঠেন, ‘ভাই, এখানে কী হচ্ছে? অফিসার ও সৈনিকরা আমার বেডরুম থেকে “ওকে” ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’ এ বলেই তিনি ফোন রেখে দেন। আমি ঘুমের ঘোরে পুরো ব্যাপারটি আঁচ করতে পারিনি এবং বুঝতেও পারিনি তিনি কী বলতে চাচ্ছেন। এক পর্যায়ে ভাবলাম, হয়তো বেগম রওশন এরশাদ, যিনি একাকী আর্মি হেডকোয়ার্টারের অফিসার মেসের পাশে থাকতেন, তিনিই হয়তো টেলিফোন করে থাকবেন কোনো ভীতির কারণে। কেননা তখন পর্যন্ত মেজর জেনারেল এরশাদ সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে ছিলেন। ঠিক ওই মুহূর্তে আবার টেলিফোন বেজে ওঠে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো–’ভাই, জিয়াকে বেডরুম থেকে ধরে নিয়ে ড্রইংরুমে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।’ আমি তৎক্ষণাৎ সম্বিৎ ফিরে পাই এবং অপর প্রান্তে বেগম খালেদা জিয়াকে বলি যে, ‘আমি আপনার বাড়িতে আসতে চেষ্টা করবো।’ এ বলেই আমি ফোন রেখে দিলাম।
আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে সামরিক পোশাক পরে বাইরে আসি। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে আমি ২য় ইস্ট বেঙ্গলের ১৫ জন বিশ্বস্ত নন-কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিককে আমার বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত করি। ১৯৬৪ সালে এই ২য় ইস্ট বেঙ্গলেই আমার সামরিক জীবনের শুরু। তারপর স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং পরেও আমি এই ২য় বেঙ্গলেরই অধিনায়ক ছিলাম। বাইরে এসে আমার গার্ড কমান্ডার হাবিলদার জাকিরকে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে সে আমাকে বিস্তারিত জানায়। হাবিলদার জাকির পুরো ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। সেনাপ্রধানের বাড়ি পাহারায় নিযুক্ত ছিল ১ম বেঙ্গলের সৈনিকেরা। আর ওই ইউনিটেরই অফিসাররা তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করেছে। সেনাপ্রধান জিয়াকে বাড়ির ভিতরে বন্দি করে রাখা হয়েছে বলে জাকিরকে তাঁর (জিয়ার) নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকজন জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সে আমাকে সেনাপ্রধানের বাড়িতে একাকী প্রবেশ করতে নিষেধ করে এবং প্রয়োজনে যেন তাদের নিয়েই প্রবেশ করি এমন অনুরোধ করে। আমি তাকে বলি, আমি একাই যাবো এবং তারা যেন আমার বাড়ির ছাদ ও অন্যান্য স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করে।
ভোরের আলো তখন ফুটছিল। আমি লাঠিতে ভর করে সেনাপ্রধানের বাড়িতে প্রবেশ করি। হাবিলদার জাকির আমার সঙ্গে গেট পর্যন্ত এসে আমার বাড়িতে ফেরত যায়। আমি সেনাপ্রধানের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন তাজ (বর্তমানে আওয়ামী লীগের এমপি) স্টেনগান হাতে পায়চারি করছে। আমাকে দেখে সে সেখান থেকে সরে যায়। বাড়ির গেটে তালা ঝুলানো ছিল এবং ১ম ইস্ট বেঙ্গলের একজন জেসিও দাঁড়িয়ে ছিল। এ ছাড়া সেনাপ্রধানের এডিসি ক্যাপ্টেন জিল্লুর (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.) বেসামরিক পোশাক পরে বাইরের গার্ডরুমে বসে আছে। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন তাজ, উক্ত জেসিও এবং ক্যাপ্টেন জিল্লুর—এরা সবাই আমার অধীনে ছিল। এ ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে আমি এদের ব্রিগেড অধিনায়ক ছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে তারা সবাই আমাকে চেনে। আমি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে জেসিওকে গেট খুলতে আদেশ করি। সঙ্গে সঙ্গে সে গার্ডরুম থেকে চাবি এনে গেট খুলে দেয়। আমি বাড়িতে প্রবেশ করি এবং ঘরে ঢুকেই দেখি বামদিকে সেনাপ্রধানের বসার ঘরে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লা (বর্তমানে ব্যবসায়ী) খুব সতর্কভাবে স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে জেনারেল জিয়া ইউনিফর্ম পরে স্থির হয়ে সোফায় বসা। আমাকে বাসার ভেতরে দেখে হাফিজউল্লাহ আঁতকে ওঠে এবং জেনারেল জিয়াও হতভম্ব হয়ে যান। আমি কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে জিয়ার শোবার ঘরে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি খালেদা জিয়া তাঁর দুই ছেলে পিনো (তারেক) ও কোকোকে (আরাফাত) নিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে তিনি অবাক হন। ফোন করলেও তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, এরকম পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি হয়তো তাঁর বাড়িতে যাব না। যাহোক আমি তাঁকে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য রেডি করতে অনুরোধ করি এবং বেডরুম থেকে চলে আসি। আমার উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমেই জিয়ার দুই ছেলেকে বাড়ি থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেওয়া। আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, প্রহরীরা আমার এই কাজে বাধা দেয় কি না তা যাচাই করা।
ড্রইংরুমে এসে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাকে একইভাবে দেখি এবং রাগান্বিত স্বরে বলি সে যেন ড্রইংরুম থেকে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমার আদেশ অনুযায়ী সে ড্রইংরুম থেকে চলে যায়। এরপর আমি জেনারেল জিয়ার পাশে গিয়ে বসি। জেনারেল জিয়া আমার কাছে জানতে চাইলেন, কর্নেল শাফায়াত জামিল কোথায়? আমি কথা বলতে চাই। আমি তাঁকে বলি, কর্নেল শাফায়াত জামিলের আদেশেই তিনি এখন বন্দি এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলে কী লাভ হবে। আমি প্রায় মিনিট দশেক তাঁর সঙ্গে আলাপ করি। এ পরিস্থিতিতে তাঁকে ধৈর্য ধরে এখানে থাকার জন্য বলি।
তিনি কর্নেল শাফায়াতকে ডেকে আনতে বললেন। আমি তাঁকে বললাম, আমি তো পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানি না। আপনার স্ত্রীর ফোন পেয়ে আমি সোজা আপনার বাসায় চলে এসেছি। তবে বাসায় ঢোকার সময় যা দেখলাম তাতে মনে হলো, কর্নেল শাফায়াতের ব্রিগেডের (৪৬ ব্রিগেড) অফিসার ও সৈন্যরা আপনাকে গৃহবন্দি করেছে। আপনি নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন।
তিনি আমার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন যার অর্থ হলো, এ পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে তাঁর বাড়িতে ঢুকলাম। আমি তাঁকে বললাম, আপনার ছেলেদের বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। তিনি বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ সময় খালেদা জিয়া তাঁর ছেলেদের নিয়ে ডাইনিংরুমে আসেন। আমি তাঁদের নাশতা করতে বললাম এবং নাশতা শেষ হলে ড্রাইভারকে ডেকে তাদের স্কুলে নিয়ে যেতে বললাম। এ সময় আমাকে কেউ কোনো বাধা দেয়নি।
জিয়া আমাকে বললেন, তুমি কি একা এসেছো? আমি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ। যদিও তিনি বেশ শান্ত ও ধীরস্থির ছিলেন, তবু তাঁর বাড়িতে আমার তৎপরতা দেখে তিনি বিস্মিত হন। এরপর আমি বাইরে চলে আসি। এ সময় জিয়াকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়েছিল।
ঘরের বাইরে এসে দেখি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেখানে এসে উপস্থিত। সম্ভবত ক্যাপ্টেন তাজ আমাকে সেনাপ্রধানের বাড়িতে অনায়াসে প্রবেশ করতে দেখেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন। তিনি প্রথমে আমার পায়ের ক্ষত এবং অসুস্থতার খোঁজখবর নেন। তারপর বলেন, চেইন অফ কমান্ড ঠিক করার জন্য এই অভ্যুত্থান জরুরি ছিল। আকাশে তখন মিগ ও হেলিকপ্টার উড়ছিল এবং সেদিকে তাকিয়ে খালেদ মোশাররফ আমাকে বললেন, চেইন অফ কমান্ড ঠিক না করলে দেশ ও সেনাবাহিনী শেষ হয়ে যাবে, তাই এ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছি। আমি তখন উল্টো প্রশ্ন করলাম, চেইন অফ কমান্ড ভেঙে সেনাপ্রধানকে বন্দি করে কি চেইন অফ কমান্ড ঠিক করা যায়? তিনি উত্তরে কিছুই বললেন না।
আমরা দুজনেই সেনাসদরে পিএসও (প্রধান উপদেষ্টা) তিনি সিজিএস আর আমি এজি। খালেদ মোশাররফ আমার এক র্যাংক সিনিয়র হলেও অ্যাপয়েন্টমেন্টের (পিএসও) দিক থেকে দুজনেই একই পর্যায়ের। জেসিও এবং অন্য সৈনিকগণ সেনাপ্রধান জিয়ার বাড়ির ভিতরে আমার কার্যকলাপে কোনো বাধা না দেওয়ায় তিনি চিন্তিত ছিলেন, যদিও তাদের ওপর নির্দেশ ছিল কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে অথবা বাড়ি থেকে বাইরে যেতে না দেবার। কিন্তু তারা নির্বিবাদে আমার আদেশ পালন করেছে। এতে একটি বিষয় আমার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সেনাপ্রধানের বাড়িতে নিয়োজিত এসব সৈনিক মনেপ্রাণে সেনাপ্রধানকে বন্দি করার পক্ষে ছিল না।
আমি সেনাপ্রধানের বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে হেঁটে আমার নিজের বাড়িতে ফিরে আসি। এসে দেখি আমার বাড়ির সামরিক ও বেসামরিক টেলিফোন দুটোরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এ হাঁটাচলায় আমার পায়ের ক্ষতে ব্যথা হচ্ছিল। একজন প্রহরীকে পাঠিয়ে গাড়ি আনি। প্রহরীরা আমাকে জানায়, তারা খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে যে, অভ্যুত্থানকারীরা আমার বাড়ির সন্নিকটে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সমবেত হয়েছেন। আমি নাশতা সেরে ওইদিকে রওনা দিলাম। প্রহরীদের সতর্ক থাকতে বললাম। আমার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় প্রহরীরা উত্তেজিত ছিল। তাদের আমি সান্ত্বনা দিই। আমার ভয় ছিল তারা যে কোনো সময়ে যে কোনো অঘটন ঘটাতে পারে। কারণ তারাও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত ছিল।
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলে অভ্যুত্থানকারীদের তৎপরতা
আমি সেখানে গিয়ে দেখি, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেনাসদরের ও ৪৬ ব্রিগেডের বেশ কয়েকজন অফিসার বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। তারা আলোচনায় রত। আমি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে লে. কর্নেল মালেক (পরে ঢাকার মেয়র এবং জাতীয় পার্টি হয়ে বর্তমানে আওয়ামী লীগার) আমার কাছে এসে বললেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাঁকে বলেছেন আমাকে জানানোর জন্য যে, আজ ভোরে সেনাপ্রধান জিয়ার সঙ্গে আমার যা যা আলাপ হয়েছে তা যেন কাউকে না বলি। আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলি, তিনি যেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন, আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কোনো আদেশ বা উপদেশ নিতে প্রস্তুত নই। তাঁকে আরো বললাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এখনও সেনাপ্রধান নন। আর যদি হয়েও থাকেন তাও আমার জানা নেই। এর একটু পরেই আমি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসে অনাহুতের মতো প্রবেশ করি। সেখানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ, মেজর গাফ্ফার ও অন্যান্য অফিসার যাঁরা এ অভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের বিভিন্ন আলাপচারিতায় দেখি। আমি একটি চেয়ার নিয়ে নিজেও বসে পড়ি। তখন সেখানে নানাবিধ আলোচনা চলছিল। বিভিন্ন স্থানে টেলিফোন করা হচ্ছে এবং সবাই উত্তেজিত।
কিছুক্ষণ পর বঙ্গভবন থেকে মেজর শরীফুল হক (ডালিম), মেজর নুর দুজন এসে উপস্থিত হলো। তাদের উপস্থিতি দেখে আমি অবাক হলাম। পরে বুঝতে পারলাম, তারা মেজর রশিদ-ফারুকের বার্তা নিয়ে এখানে এসেছে দুপক্ষের মধ্যে এ বিরোধের একটা সন্তোষজনক মীমাংসার জন্য, যাতে করে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো যায়। আলোচনায় বুঝতে পারলাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল মেজর ফারুক, রশিদ ও তাদের সহযোগীদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ চায়। এ বার্তা নিয়ে মেজর নুর ও শরীফুল হক (ডালিম) বঙ্গভবনে রওয়ানা হয়। তাদের বলা হয়েছে, এই বার্তা রাষ্ট্রপতি মোশতাক, মেজর রশিদ ও ফারুককে দেওয়ার জন্য এবং এর উত্তর সত্বর যেন দেওয়া হয়। তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। এরই মধ্যে জেনারেল ওসমানী বঙ্গভবন থেকে ফোন করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি হুঁশিয়ার করে দেন যেন কেউ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়। কারণ এ পরিস্থিতিতে দেশে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাঁকে উত্তরে জানান, যদিও তিনি বর্তমানে সেনাপ্রধান নন তবুও একটা মীমাংসার চেষ্টা করবেন। তিনি মেজর ফারুক-রশিদকে বুঝিয়ে আত্মসমর্পণ করানোর জন্য ওসমানীকে অনুরোধ করেন।
এর মধ্যে নানারকম হৈচৈ হচ্ছিল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হলো মেজর জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করানো হবে এবং জেনারেল ওসমানী ও রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে জানানো হবে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে যেন সত্ত্বর সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার কাছ থেকে ইস্তফাপত্র নেওয়ার জন্য কে সেখানে যাবেন তা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছিল এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছিলেন না। এসব দেখে আমার বেশ কৌতূহল হলো। কারণ এসব আলোচনায় অভ্যুত্থানকারীরা বেশ সময় নষ্ট করছেন। এ থেকে বোঝা যায়, এ অভ্যুত্থানের কোনো বিশেষ পরিকল্পনা তাদের ছিল না এবং নেতৃত্বের সমস্যা ছিল। তাদের উদ্দেশ্য তাদের কাছেই পরিষ্কার ছিল না।
জিয়ার ইস্তফা আদায়
শেষ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার রউফ (যিনি ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ডিজিএফআই প্রধান ছিলেন এবং বর্তমানে প্রয়াত) ও লে. কর্নেল আনোয়ার (পরে মেজর জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে ডিজি, এনএসআই এবং রাষ্ট্রদূত অব.) এ দুজনকে তাঁদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিয়ার বাড়িতে পাঠানো হলো ইস্তফাপত্রে স্বাক্ষর আনার জন্য। তাঁরা সেনাপ্রধান জিয়ার বাড়িতে যান এবং ইস্তফাপত্রে স্বাক্ষর নিতে সক্ষম হন। এদিকে অনেক আলোচনার পর ঠিক করা হয়, মেজর রশিদ-ফারুকসহ অন্য যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা রাতের বেলায় একটি বিশেষ বিমানযোগে তৃতীয় দেশের উদ্দেশে ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করবে।
বেলা বাড়ছিল। আমি সেখান থেকে আর্মি হেডকোয়ার্টারে আমার অফিসে চলে যাই। গিয়ে দেখি, অফিসে বিশেষ কোনো অফিসার নেই, শুধু সৈনিক ও স্টাফরা আছেন। আমার অফিসের টেলিফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন। আমি এতে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে পাশের কক্ষ থেকে কর্নেল শাফায়াতের সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করি, এসব করা কি ঠিক হচ্ছে? আমার টেলিফোন সংযোগ কেন বিচ্ছিন্ন করা হলো? উত্তরে তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে আমাকে জানান। তাঁর কথা আমি অবশ্য বিশ্বাস করেছি এজন্য যে, এসব ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নির্দেশেই করা হয়েছিল।
আর্মি হেডকোয়ার্টারে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে আলাপ-আলোচনায় বুঝতে পারলাম জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার, নন-কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিকগণ সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দি করার ঘোর বিরোধী ও মনঃক্ষুণ্ণ। এ অভ্যুত্থানে তাদের মোটেও সায় নেই। আমি দুপুরের দিকে বাড়িতে ফিরি। পথিমধ্যে কর্নেল শাফায়াতের সঙ্গে দেখা। আমি তাঁকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেসা করলাম, এ অভ্যুত্থানে কি বিভিন্ন পদবির সৈনিকগণের সমর্থন আছে? উত্তরে তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। আমি আর কিছু না বলে বাড়িতে চলে গেলাম।
খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান
এদিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জেনারেল জিয়ার ইস্তফার কারণে নতুন সেনাপ্রধান হলেন। তিনি রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হুদাকে (আগরতলা মামলার আসামি এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন) এবং কর্নেল নওয়াজীশের অধীন ১০ ইস্ট বেঙ্গল যা তাঁর অধীনে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে গঠিত হয়েছিল তাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। কর্নেল হুদাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল সম্ভবত আমার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য। কারণ আমি এসব অনাকাঙ্ক্ষিত উচ্ছৃঙ্খল ঘটনার বিরোধিতা করে আসছি। তাই খালেদ মোশাররফ আমার কার্যকলাপে বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন।
এদিকে ৪ তারিখ সকালবেলায় খবরে জানা যায়, ৩ তারিখ রাতেই জেলে আটককৃত সর্বজনাব নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান—এ চার নেতাকে রাষ্ট্রপতি মোশতাক, মেজর রশিদ ও ফারুকের আদেশে জেলের ভিতরেই নৃশংসভাবে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংক রেজিমেন্টের কজন সৈনিক হত্যা করে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জেলখানায় সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের খবর ৩০ ঘণ্টা পর বাইরের লোকজনের কাছে প্রকাশ পায়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও ফারুক-রশিদরা যখন ৩ তারিখের অভ্যুত্থানের খবর পায় এবং তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয় তখনই এদের ধারণা জন্মে যে, এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেলে আটককৃত চার নেতাকে বের করে এনে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে নতুন সরকার গঠনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলখানায় ওই জঘন্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ও শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি ঘটে। নতুন সেনাপ্রধান হওয়ার পর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ৫ তারিখে আর্মি হেডকোয়ার্টারে আর্মির সিনিয়র অফিসারদের একটি সভা আহ্বান করেন। সভায় তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। মূলত কোনো সমস্যারই তিনি সঠিক সমাধান করতে পারছিলেন না। বলা যায়, তিনি সমস্যার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলেন। তাই আমার মনে হতে লাগলো, তাঁর এ সেনাপ্রধানের চাকুরি বোধহয় খুবই ক্ষণস্থায়ী হবে। এর মধ্যে শহরে এবং সেনানিবাসে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগ ও ভারতের ইঙ্গিতে ও পরোক্ষ সহায়তায় ও তারিখের এ অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছেন। অর্থাৎ অভ্যুত্থানটি ভারতপন্থী। এর একটি সম্ভাব্য কারণ, আওয়ামী লীগ ৪ তারিখে এই অভ্যুত্থানের পক্ষে ঢাকায় একটি মিছিল বের করে যেখানে অন্যদের মধ্যে সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফের মাও অংশ নেন। এ ছাড়া মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে সেনানিবাসে রটনা ছিল যে, তিনি ভারতঘেঁষা।
এটা উল্লেখ করতে হয় যে, আমার জানামতে, এ অভ্যুত্থানে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল না। অভ্যুত্থানকারী অফিসারগণ মোটেই ভারতপন্থী ছিলেন না এবং এই অভ্যুত্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তাঁদের কোনো বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভ্যুত্থানকারী সিনিয়র অফিসারদের চিন্তাধারা সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলাম। এটা নিছক কাকতালীয় এবং সম্পূর্ণভাবে আর্মির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার ব্যাপার ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেনাবাহিনীতে ও দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ধারণা জন্মে যে, এটা ছিল আওয়ামী লীগ ও ভারতের পক্ষে অভ্যুত্থান। আর এটাই পরে তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
বিচারপতি সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি
এদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চার নেতাকে জেলখানায় বন্দি অবস্থায় হত্যার পর ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রপতি মোশতাক এ ঘটনা চেপে রাখেন যতক্ষণ মেজর ফারুক-রশিদ ও তাদের সহযোগীরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশত্যাগ না করেন। ফলে যখন এ ঘটনা প্রকাশ পায়, তখন জনগণ ও আর্মি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রপতি মোশতাক ও মেজর ফারুক-রশিদকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করে। তাই এ ঘটনার পর খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ফলে অভ্যুত্থানকারী অফিসারগণ প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তাঁদের অনুরোধের প্রেক্ষাপটে তিনি ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম।
আমার মনে হচ্ছিল, সবকিছুই কেমন যেন ‘এডহক ভিত্তিতে হচ্ছিল। সবকিছুই ঘোলাটে মনে হচ্ছিল। তখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়নি। তিনি বঙ্গভবন আর সেনাসদরের মধ্যেই দেন-দরবারে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে বা সেনাবাহিনীর উদ্দেশে কোনো বক্তব্য প্রচার করেননি। অথচ অভ্যুত্থানের ৭২ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। ফলে অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য এবং অভ্যুত্থানকারীদের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে কারোই পরিষ্কার ধারণা ছিল না। বিশেষ করে ভারতপন্থী বলে অভ্যুত্থান বিষয়ে যে গুজব ছড়িয়েছিল তার সঠিক কোনো প্রত্যুত্তর তার বা তাদের পক্ষ থেকে ছিল না। আর এই সুযোগে একের পর এক গুজব পুরো সেনানিবাসকে গ্রাস করে।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান
রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েমের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানশেষে আমি তাড়াতাড়ি আর্মি হেডকোয়ার্টারে চলে আসি। সেখানে এসে আমি আমার অধীনস্থ অফিসারদের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। বস্তুতপক্ষে ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না বললেই চলে। আর্মিতেও দৈনন্দিন কোনো কাজকর্ম চলছিল না। আর্মি হেডকোয়ার্টারে অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। পুরো সেনানিবাসের পরিবেশ ছিল অস্বাভাবিক ও থমথমে। কেউ কোনো কাজকর্ম করছিল না। সবাই এখানে-সেখানে জটলা পাকিয়ে আলাপ-আলোচনা করেই সময় কাটায়। আলোচনা শেষে অফিস থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সহকারী সুবেদার আলিমুদ্দিন আমাকে একটা বাংলা প্রচারপত্র দেখান। ওই প্রচারপত্র সেনানিবাসে প্রচুর পরিমাণে বিলি করা হয়েছে বলেও আমাকে জানান। প্রচারপত্রটি ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র নামে ছাপানো হয় এবং উত্তেজক ভাষায় বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হয়। উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে ছিল, সেনাবাহিনীতে কোনো অফিসার থাকবে না। কেননা অফিসারগণ সৈনিকদের তাদের নিজ ক্ষমতালাভের প্রয়াসে ব্যবহার করে। এ ছাড়া অফিসারদের জন্য ‘ব্যাটমেন’ প্রথা বন্ধ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রচারপত্রটি অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা বিলি করছে বলে আমাকে জানানো হয়।
জিয়ার মুক্তি
বিকেলে আমি বাসায় ফিরে আসি। শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তিবশত আমি আর বাড়ি থেকে বের হইনি। হঠাৎ মধ্যরাতের পর চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনি। গোলাগুলি প্রথমে শুরু হয় বর্তমান এয়ারপোর্ট রোডের পাশে অবস্থিত অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে, এরপর গ্যারিসন মসজিদের পাশে অবস্থিত সিগনাল ইউনিট থেকে। আমি উঠে ইউনিফর্ম পরি এবং বাইরে যেতে চাইলে আমার গার্ডরা আমাকে রাতের অন্ধকারে গোলাগুলির মধ্যে বাইরে যেতে নিষেধ করে এবং বাসাতেই থাকতে অনুরোধ করে। এর মধ্যে হঠাৎ করে আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে যা গত কয়েকদিন যাবৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। সিগনাল সেন্টার থেকে ফোন করে আমাকে জানানো হয় যে, খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান আরম্ভ হয়েছে। এরপর আমি বাড়ির বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম কিছু কালো পোশাক, কিছু খাকি এবং বেসামরিক পোশাকে সজ্জিত শ’খানেকের মতো লোক ওপরের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে জেনারেল জিয়ার বাড়িতে ঢুকছে। জিয়াকে তাঁর বাড়ির বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে পাশেই দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে নিয়ে যেতেও দেখলাম। জিয়া তখন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত ছিলেন।
একটু পর আবার আমার টেলিফোন বেজে ওঠে। এবার চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও লে. কর্নেল আমিনুল হক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার) আমাকে জানান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে। ৩ নভেম্বরের ক্যুর পর আমিনুল হককে চতুর্থ বেঙ্গলের অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে নিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টারে অ্যাটাচ করা হয়। এদিকে অভ্যুত্থানের গতি-প্রকৃতি ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম না। কোথায় কী ঘটছে তাও জানা সম্ভব না। ভোরবেলায় বাড়িতে তিন/চারজন লোক প্রবেশ করতে চেষ্টা করে। প্রহরীরা তাদের গেটে বাধা দেয়। তাঁরা বলেন, জিয়ার বাড়িসংলগ্ন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে আমাকে যাওয়ার জন্য জেনারেল জিয়া খবর পাঠিয়েছেন। এরপর বেসামরিক পোশাকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট মুনীর (মরহুম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের জামাতা, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল) আমার বাসায় আসে। সে আমাকে বিস্তারিত তথ্য জানায় এবং আমাকে বলে, জিয়া সত্বর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে যাওয়ার জন্য বলেছেন। সে আরো জানায়, ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলীকে নিয়ে আসার জন্য আর্মি ভিআইপি রুমেও লোক পাঠানো হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার শওকত যশোর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সম্প্রতি যে সভা আহ্বান করেছিলেন তাতে অংশ নেওয়ার জন্য। পরে শুনেছি মীর শওকত যে ভিআইপি রুমে ছিলেন সেখানেও সৈনিকরা গুলি চালায়। তিনি সেখান থেকে বের হয়ে পাশেই তৎকালীন মেজর জেনারেল এরশাদের বাসায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে মেজর মহিউদ্দীন (মুজিবহত্যায় দণ্ডপ্রাপ্ত) তাঁকে নিয়ে আসে।
রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য তাহেরের অনুরোধ
আমি ইউনিফর্ম পরে লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে পৌঁছি। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ছিল আমার ও জিয়ার বাসা থেকে শ’দুয়েক গজ দূরে, বর্তমান শহীদ সরণির পাশে। সেখানে গিয়ে দেখি হুলস্থুল অবস্থা। অফিসের ছোট একটি কামরায় জিয়া বসে ছিলেন। কর্নেল আমিনুল হক ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের সুবেদার মেজর আনিস ও কয়েকজন অফিসার সেখানে ছিলেন। একটু পরে একটি বেসামরিক জিপে করে দুই/তিনজন লোকসহ অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল তাহের সেখানে এসে উপস্থিত হন। লে. কর্নেল তাহের মঞ্জুর ও জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়ার অধীনে যোগদান করেন। পরে তিনি সেক্টর কমান্ডার হন এবং একপর্যায়ে যুদ্ধে আহত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন আর্মিতে ছিলেন এবং অবসর নেওয়ার পর ঐ সময় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ সংস্থায় চাকরি করতেন। এসেই তিনি জিয়াকে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আমরা জিয়াকে রেডিও স্টেশনে যেতে বারণ করি। এ সময় লে. কর্নেল আমিনুল হক ও তাহেরের সঙ্গে ঝগড়া বেধে যায়। একপর্যায়ে আমিনুল হক তাহেরকে বলে বসেন, ‘আপনারা (জাসদ) তো ভারতের বিটিম’। ফলে তাহের রাগান্বিত হয়ে সেখান থেকে চলে যান।
পরে রেডিওতে প্রচারের জন্য জিয়ার ছোট একটা বক্তৃতা টেপ করে পাঠানো হয়। তখনও সেখানে ইউনিফর্ম ছাড়া বেসামরিক পোশাকে কিছু অফিসার উপস্থিত ছিলেন। এঁদের অনেককেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকজন বাড়ি থেকে ধরে এখানে নিয়ে আসে। আমি মনে করি এরকম পরিস্থিতিতে আর্মি অফিসারদের ইউনিফর্ম ছাড়া বেসামরিক পোশাকে থাকা ঠিক নয়। কেননা বাস্তবে দেখা গেছে সামরিক অভ্যুত্থান বা বিশৃঙ্খলার সময়ে হতাহত অফিসারদের অধিকাংশই বেসামরিক পোশাক পরিহিত ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় শেখ মুজিবের সামরিক সচিব ড্রেসিং গাউন পরা অবস্থায় নিহত হন। (পৃষ্টা ৭৩, লেগ্যাসি অফ ব্লাড) তখন ঐ পোশাকেই তিনি গাড়ি চালিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। এ ছাড়া ৭ তারিখের সিপাহি অভ্যুত্থানে হতাহত আর্মি অফিসারগণের অধিকাংশই বেসামরিক পোশাকে ছিলেন। সংকটকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর অফিসারদের বেসামরিক পোশাকে থাকার প্রবণতা দেখা যেত যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
খালেদ মোশাররফ, হুদা ও হায়দারকে হত্যা
সকালেই খবর আসে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা এবং লে. কর্নেল হায়দারকে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে হত্যা করা হয়েছে। লে. কর্নেল হায়দার (১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন) স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধ করেন। ৩ তারিখের অভ্যুত্থানের পর তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দার এবং কর্নেল হুদা প্রমুখ ৭ নভেম্বর বঙ্গভবনে ছিলেন এবং পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে শুনে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। পথিমধ্যে তাঁরা কোথাও ইউনিফর্ম বদল করে বেসামরিক পোশাকে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হন। এই রেজিমেন্ট কর্নেল হুদার অধীনে রংপুরে ছিল এবং ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পরপর খালেদ মোশাররফ এই ইউনিটটিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন পর্যন্ত ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের খবর পাওয়া যায়নি। পরে অবশ্য খবর আসে, কর্নেল জামিল বঙ্গভবনের দেয়াল টপকানোর সময় পায়ে ব্যথা পান এবং আহত অবস্থায় ঢাকার অদূরে আত্মগোপন করে আছেন। এ খবরের পর আমি তাঁর সঠিক অবস্থান নির্ণয় করে নিরাপত্তার ব্যবস্থাদি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে ঢাকায় এনে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করি। এর মধ্যে খবর আসে যে, শহরে আরো কয়েকজন আর্মি অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে।
অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ
দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে বেরিয়ে জেনারেল জিয়া, আমি এবং ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আর্মি হেডকোয়ার্টারে যাই। আর্মি হেডকোয়ার্টারে আলাপ-আলোচনায় ঠিক করা হয়, অভ্যুত্থানকারীদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বক্তব্য রাখবেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেনাপ্রধান বক্তব্য রাখার পূর্বে অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ পর্যায়ে সেনাপ্রধান এবং ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আমাকে বললেন, যেহেতু আমি অনেকদিন থেকে ঢাকায় আছি এবং ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলাম এবং বর্তমানে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল সেহেতু এ দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হচ্ছে তাদের সংগঠিত করার কাজে। তাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে আমার মধ্যে অনেক সংশয় ও অনিশ্চয়তা ছিল। কারণ তারা হয়তো অনেক দাবি উত্থাপন করবে এবং তাদের বুঝিয়ে শান্ত করা কষ্টকর হবে।
যাহোক, আমি দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি, আর্মি এমপি ইউনিট ও আর্মি হেডকোয়ার্টারের সুবেদার মেজরদের খবর দিলাম যে, অপরাহে সেনা মিলনায়তনে (বর্তমান গ্যারিসন সিনেমাহল) আমি সৈনিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে বক্তব্য রাখবো। সে অনুযায়ী বিভিন্ন ইউনিটের জেসিও এবং এনসিওসহ তাদের প্রতিনিধিদের সেনা মিলনায়তনে উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা করতে বলি। তবে তখন বেশির ভাগ অফিসার সিপাহিদের অভ্যুত্থানের কারণে আর্মি হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত ছিলেন না। পরে মিলিটারি পুলিশ ইউনিটের ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক (বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত) যিনি একজন উদ্যোগী ও কর্তব্যপরায়ণ অফিসার, তাঁকে নিয়ে আমি সেনা মিলনায়তনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি কিছু সৈন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মিলনায়তনে উপস্থিত হয়েছে। আমি তাদের অস্ত্র বাইরে রেখে আসতে নির্দেশ দিই। এই নির্দেশের মাধ্যমে আমি মূলত তাদের পরীক্ষা করছিলাম যে, তারা আমার কথা আদৌ শুনবে কি না। জিয়া আমাকে সেখানে পাঠিয়েছেন তাদের মানসিক অবস্থা যাচাই ও শান্ত করার জন্য, যাতে পরে তিনি এসে বক্তৃতা দিতে পারেন। যাহোক, তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাইরে রেখে আসার পর আমি আমার বক্তব্য শুরু করি।
বিপ্লবীরা তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে। আমি তাদের জানাই, আর্মি শৃঙ্খলা, নিয়মকানুন ইত্যাদি তড়িঘড়ি করে বদলানো সম্ভব নয়। আমি আরো বলি, উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য দেশ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যাহোক, আলোচনা শেষে আমি তাদের জানাই, কিছুক্ষণ পর সেনাপ্রধান জিয়া এসে তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, ৭ নভেম্বর সৈনিকদের সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কিছু সরকারি কর্মচারীও যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তারাও বেসামরিক প্রশাসনে তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছিল। ফলে কিছু কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক তাদের সঙ্গে সেনানিবাসের বাইরে চলেও গিয়েছিল। কিন্তু সেনানিবাসের পরিস্থিতি আয়ত্তে আসায় পরে বাইরে তারা আর তেমন কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা করার সাহস পায়নি। আজও ভাবলে গা শিউরে ওঠে যে, ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকদের যদি সেদিন নিয়ন্ত্রণে আনা না যেত তাহলে সারা দেশে সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে একটা ‘নেতৃত্বহীন ভয়াবহ উচ্ছৃঙ্খল শ্রেণী-সংগ্রাম’ শুরু হয়ে যেত। সৈনিকদের সেদিনের স্লোগানই ছিল ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই। সিপাহি জনতা ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’।
যাহোক, আর্মি হেডকোয়ার্টারে আমি খবর পাঠানোর পর জেনারেল জিয়া এসে উপস্থিত হন। তখনও পরিস্থিতি কিছুটা অশান্ত ছিল। জিয়া তাদের শান্ত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে তাঁর কোমরের আর্মি বেল্ট খুলে মাটিতে ছুড়ে দেন এবং বলেন, এতো দাবিদাওয়া ওঠালে আমি আর এ আর্মি চিফ থাকতে চাই না। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। বক্তৃতাশেষে আমরা সবাই আর্মির হেডকোয়ার্টারে ফেরত যাই। এরপর ঠিক করা হয়, ঢাকার বাইরে থেকে কিছু পদাতিক সৈন্য এনে ঢাকা সেনানিবাসে উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদের আয়ত্তে আনা ও সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী যশোর থেকে কিছু পদাতিক সৈন্য এনে বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তার কাজে মোতায়েন করা হয়।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে আর্টিলারি, ল্যান্সার, আর্মার, সিগনাল, অর্ডন্যান্স ও সাপ্লাই কোরের বেশিরভাগ সৈনিক জড়িত ছিল। ঢাকায় অবস্থিত পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা এ অভ্যুত্থানে তেমন সাড়া দেয়নি। আবার প্রতিরোধও করেনি। এর কারণ ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল জামিল ঢাকা ব্রিগেডের পদাতিক বাহিনীকে ব্যবহার করেন। কিন্তু সে অভ্যুত্থানে সৈনিকদের তেমন সমর্থন ছিল না। শুধু আদেশের কারণে বাধ্য হয়ে হয়তো তারা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল যা আমি আগেও বর্ণনা করেছি। এখানে আরেকটি কথা বলতে হয়, অভ্যুত্থানের পরপরই রেডিওতে জিয়ার একটি রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করা হয়। এ ছাড়া তিনি কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে সাহসের সঙ্গে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন।
মীর শওকত ডিভিশন কমান্ডার
ঢাকা ও অন্যান্য সেনানিবাসে ৭ তারিখের সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব খুব ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে থাকে। কিন্তু তখনও সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা অত্যন্ত নাজুক এবং অধিকাংশ অফিসার দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন পদবির সৈন্যগণ আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে। এদিকে এ বিদ্রোহের সময় সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা, বিশেষ করে অফিসার হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী ব্যক্তিদের বিচার করার জন্য আমি অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে সেনাপ্রধানকে বলি। কিন্তু তিনি এতে উৎসাহী ছিলেন না। অপরদিকে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী যশোর সেনানিবাসে ফেরত না গিয়ে ঢাকায় একটা ডিভিশন গঠন করে তাঁকে ডিভিশন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগের জন্য সেনাপ্রধান জিয়াকে অনুরোধ করেন এবং চাপ দিতে থাকেন। আমি এর ঘোর বিরোধিতা করি এবং বলি যে, একটি করে ডিভিশন গঠন করা ঠিক হবে না। করলে সব স্থানেই একসঙ্গে ডিভিশন করা উচিত। যাহোক, শেষ পর্যন্ত ঢাকায় নবম ডিভিশন নাম দিয়ে একটা ডিভিশন করা হলো এবং ব্রিগেডিয়ার শওকতকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে ডিভিশন কমান্ডার করা হলো। তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর ১৯৭৩ সাল থেকে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁকে বদলি করে ঢাকায় এনে আর্মি হেডকোয়ার্টারে সিজিএস করা হলো। খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর পর থেকে মঞ্জুর আসার আগ পর্যন্ত মীর শওকত অস্থায়ীভাবে সিজিএস-এর কাজ করেন।
লন্ডন দূতাবাস কাউন্সিলর
এদিকে আমার পায়ের গ্রাফটিংয়ের চামড়া শক্ত হয়ে খসে যাচ্ছিল। ঊরু থেকে এই চামড়া নিয়ে পায়ে লাগানো হয়। তা শক্ত হয়ে যাওয়ায় পায়ের পাতা নাড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে একদিন আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে সেনাপ্রধান জিয়া আমাকে দেখতে বাড়িতে আসেন। আমি তাঁকে জানাই যে, আমার স্ত্রীর চাচা বিলাতের ম্যানচেস্টারে ডাক্তার। তিনি সত্তুর আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্য বলেছেন। আমি সেনাপ্রধানের কাছে তিন মাসের ছুটির জন্য বলি। তিনি তৎক্ষণাৎ কিছু বলেননি। পরদিন জানান, আমাকে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনে কয়েক মাসের জন্য অস্থায়ীভাবে কাউন্সিলর পদে পাঠাবেন যাতে সেখানে আমার পায়ের চিকিৎসা করাও সম্ভব হয়। কয়েকদিন পর আমাকে সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা দপ্তরের কাউন্সিলর পদে লন্ডন দূতাবাসে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আমি ও আমার স্ত্রী চার মাসের কন্যাসন্তানকে নিয়ে লন্ডনের পথে ঢাকা ত্যাগ করি।
লন্ডন পৌঁছে প্রথম দুদিন আমি ব্যক্তিগত কাজকর্ম ও পারিবারিক ঝামেলা মেটাতে ব্যস্ত ছিলাম। এরপর বাংলাদেশ দূতাবাসে উপস্থিত হই। সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সেখানেও তখন অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছিল। তখন লন্ডনে হাইকমিশনার ছিলেন ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আবদুস সুলতান। প্রেস কাউন্সিলর ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের চরমপত্র খ্যাত এম আর আখতার মুকুল এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার পদে পুলিশবাহিনীর কাউন্সিলর নুরুল মোমেন (মিহির)। এঁরা সবাই আওয়ামী লীগপন্থী ছিলেন বলে সবার প্রবল ধারণা ছিল। নুরুল মোমেনের বিরুদ্ধে ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের প্রচুর অভিযোগ ছিল। অনর্থক অনেক বাঙালির নাগরিকত্ব হরণ ও কালো তালিকাভুক্তিকরণের ব্যাপারেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। তাই শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর একদল ক্ষুব্ধ বাঙালি দূতাবাসে তাঁর ওপর হামলা করে এবং আসবাবপত্র ভাংচুর করে। এদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে নুরুল মোমেন (মিহির) আহত হন। ক্ষুব্ধ বাঙালিদের সেদিনের ওইসব কার্যকলাপ ব্রিটিশ টেলিভিশনেও প্রচার করা হয়েছিল।
মোশতাক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের হাইকমিশনার, প্রেস কাউন্সিলর ও কাউন্সিলর নুরুল মোমেনকে দেশে বদলি করা হয়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের ধারণা ছিল, এঁরা হয়তো রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে বিদেশেই থেকে যাবেন, দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন না। হাইকমিশনার সৈয়দ সুলতানের সঙ্গে আমার পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহে। তিনি আমাকে দেখে খুশিই হলেন। আমি তাঁকে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করি। পরবর্তী সময়ে তিনি ঠিকই দেশে ফিরে যান। নুরুল মোমেন ও এম আর আখতার মুকুলকেও দেশে চলে যেতে বলি এবং তাঁদের আশ্বাস দিই যে, সরকার দেশে তাঁদের চাকরিতে বহাল রাখবেন। কিছুদিন পর উভয়েই দেশে ফিরে যান এবং তৎকালীন সরকার তাঁদের চাকরিতে বহাল রেখেছিলেন। মূলত তাঁদের ব্যাপারে জিয়ার সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলোচনা হয়। আমি তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে হয়রানি বা নাজেহাল না করার জন্য জিয়াকে অনুরোধ করি। জিয়া আমাকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করলে আমি তাঁদের দেশে যেতে উৎসাহিত করি।
সৈয়দ আবদুস সুলতানের পর হাইকমিশনার নিযুক্ত হন প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবুল ফাতাহ। তিনি পাকিস্তান পররাষ্ট্র সার্ভিসের অফিসার ছিলেন। অনেকে ধারণা করতেন তিনি খন্দকার মোশতাকের প্রিয়ভাজনদের একজন। স্বাধীনতার সময় তিনি ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পরে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমার কাছে তাঁকে দূতাবাসের কাজকর্মে তেমন উৎসাহী মনে হতো না। সচরাচর রুটিন কাজ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে তিনি মনোযোগ দিতেন না। পরে তাঁকে আলজেরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বদলি করা হয়। তাঁর ধারণা ছিল, ওই বদলি আমার বিরূপ প্রতিবেদনের জন্য হয়েছিল। তাঁর ধারণা আংশিক সত্য ছিল।