একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ

একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ

জমিদারিপ্রথার সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের সংযোগের ফলে বাংলা দেশে একটি নতুন সামাজিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের কয়েক বছরের মধ্যেই পত্তনিদার, দরপত্তনিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীদের আবির্ভাব ঘটে। বাংলা দেশের ভূমি ব্যবস্থায় এই মধ্যস্বত্বপ্রথা ১৮০৬-০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই ক্রমান্বয়ে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিষ্ঠা করা। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব সুস্পষ্ট হয়। বড়ো জমিদার ও বড়ো ভূম্যধিকারীর সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু ছোটো জমিদার ও জমির মালিকের সংখ্যা ছিল অসংখ্য। আর তাদের নিয়েই মধ্যবিত্ত শ্রেণির পত্তন হয়। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের বিকাশে সরকারের পক্ষ থেকে উৎসাহই প্রদান করা হয়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই একটি সরকারি ডেসপ্যাচে (নং ১৪) সেক্রেটারি অব স্টেট পরিষ্কার করে বলেন :

…It is most desirable that facilities should be given for the gradual growth of a middle class connected with the land, without dispossessing the peasant proprietors and occupiers…The proprietors, tenure-holders, and other middle class people who stand between the zamindars and cultivators have built up the social and economic structure of Bengal.

এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, এই পত্তনিপ্রথার একটি সামাজিক ফল হল মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। ভারতের মতো একটি দেশে যেখানে শিল্পের প্রসার নেই বললেই চলে সেখানে এই অবস্থাই ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। এই ব্যবস্থায় জমিদার ও অন্যান্য জমির মালিকেরা খুবই লাভবান হয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভূমিরাজস্ব স্থায়ীভাবে যে নির্ধারিত করা হয় তার মোট পরিমাণ ছিল ২৮৬ লক্ষ টাকা। কিন্তু তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পতিত জমি উদ্ধার করে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, যোগাযোগের উন্নতি ও নতুন বাজারের প্রসারের ফলে কৃষিজাত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস ইত্যাদির ফলে জমিদারের আদায়ীকৃত খাজনার পরিমাণ ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ৩১৮ লক্ষ টাকা থেকে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ১,৪৭২ লক্ষ টাকা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে এই সময়ে ভূমি রাজস্ব ২৮৬ লক্ষ টাকা থেকে মাত্র ৩২৩ লক্ষ টাকা বৃদ্ধি পায়। জমিদারদের নিট আয় (gross income) এতটা বৃদ্ধি পায় যে সম্পদশালী আইনজীবী, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য জীবিকার লোকেরা, যাঁদের হাতে বিনিয়োগের মতো অতিরিক্ত অর্থ ছিল, তাঁরা জমিদারি ক্রয় করতে আগ্রহান্বিত হন। এইভাবে যাঁরা জমির মালিক হয়ে বসলেন তাঁরা তাঁদের জমিদারির পরিচালনার ভার তাঁদের এজেন্টদের ওপর অর্পণ করেন। তাঁরা যে এইসব জমিদারি ক্রয় করেন তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তাঁরা এর মাধ্যমে আরও মুনাফা লাভ করবেন এবং একইসঙ্গে বিশেষ সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা অর্জন করবেন। সুতরাং, এই সম্প্রদায়ের উদবৃত্ত অর্থ জমিতে এই অধিকার অর্জনের জন্যই ব্যয়িত হয়।১০

কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমির ও কৃষির উন্নতির জন্য ও কৃষকদের আর্থিক দুরবস্থা দূর করবার জন্য জমিদারদের উৎসাহিত করতে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু জনসাধারণের দারিদ্র্যের সুযোগে সুদখোর-মহাজনিপ্রথা গ্রাম্য অর্থনীতির রূপান্তর ঘটায়। জমিদার, ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিরা এই সুদখোর-মহাজনি ব্যবসায় অংশগ্রহণ করেন। আর সফল মহাজনেরা জমি নিয়ে ব্যাবসা শুরু করেন। গ্রাম্য অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই যে, সুদখোর-মহাজনি স্বার্থ জমির স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। জমিদারি ও মহাজনি স্বার্থের এই গভীর সংযোগ ভূমি ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে, আর তার ফলে তার সমস্ত বোঝাটাই কৃষকের ঘাড়ে চাপে।১১ এই জটিল ভূমি ব্যবস্থার মধ্য থেকেই এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে এবং এই বিশেষ শ্রেণিই ‘আধুনিক বাংলার’ গোড়াপত্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব সংরক্ষণ করা। এই সময়ে কৃষকদের জমিদারদের দয়ার ওপর ফেলে রাখা হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের খাজনা আইন প্রণয়ন পর্যন্ত যেসব আইন হয় তা থেকেই এই অবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যদিও এই সময়ে (১৭৯৩-১৮৫৯ খ্রি) জমিদারেরা আর্থিক দিক থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হন [যেমন সূর্যাস্ত আইনে (Sale Law) অনেক পুরোনো জমিদার অসুবিধায় পড়েন], তবুও ক্রমান্বয়ে জমিদারদের পক্ষে যেসব আইন প্রণয়ন করা হয় তার ফলে তাঁরা এই সাময়িক অসুবিধা কাটিয়ে ওঠেন এবং তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তার মনোভাব বৃদ্ধি পায়। এইভাবে বিভিন্ন আইনের ফলে জমিদারদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গত কানুন সপ্তমের (Reg. VII of 1799) ও কানুন পঞ্চমের (Reg. V of 1812) কথা উল্লেখ করা যায়।১২ এই সময়ে অনেক জঙ্গল ও পতিত জমি চাষযোগ্য করার ফলে জমিদারদের লাভের মাত্রা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সূর্যান্ত আইন জমিদারদের আর বিশেষ অসুবিধায় ফেলতে পারেনি।১৩

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভূমি ব্যবস্থায় আর একটি অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভূমি রাজস্বের ইতিহাসের প্রধান বিষয় ছিল কীভাবে দখলি স্বত্ববিশিষ্ট রায়তদের (occupancy ryot) ও কোর্ফা প্রজাদের (under ryot) জন্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জমিতে ভোগদখলের অধিকার প্রদান করা যায়।১৪ অবশ্য ১৮৫৯, ১৮৮৫, ১৯২৮ ও ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে চাষি প্রজাদের রক্ষার জন্য যেসব আইন প্রণয়ন করা হয় তা সমগ্র কৃষকসমাজের অবস্থার তুলনায় মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়। স্থিতিবান রায়তের তুলনায় দখলিস্বত্ববিহীন রায়তের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। স্বভাবতই এইসব জমি সংক্রান্ত আইনে জমিদারেরা সহজেই লাভবান হয়। যদিও এইসব আইনে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে রায়তদের জমিতে অধিকার দেওয়া হয়, তা হলেও ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভূমি ব্যবস্থার যে মূল কাঠামো প্রবর্তন করা হয়, তা অপরিবর্তিতই থাকে।১৫

.

৫. Quoted in India To-Day, pp. 192-193

৬. F Buchanan, A Geographical, Statistical and Historical description of the district, or Zila, of Dinajpur, in the Province or Subah, of Bengal, Calcutta 1833, chaps. VII-VIII; S G Panandikar, The Wealth and Welfare of the Bengal Deltta comprising the Districts of Mymansingh, Dacca, Bogra, Pabna, Faridpur, Bakarganj, Tippera and Noakhali, Calcutta, 1926, pp. 126-127; N K Sinha, op. cit, vol. II, chap. VII ; Amalendu De, Roots of Separatism in Nineteenth Century Bengal, Calcutta, 1974, pp. 15-18, 85-86 (Henceforth abbreviated as Roots of Separatism).

৭. Report, vol. I. Alipore, 1940, pp. 338-339

৮. Ibid, p. 339

৯. B H Baden-Powell, The Land-Systems of British India, vol. I. Johnson Reprint Corporation, NY, 1972, p. 439; Panandikar, op. cit. pp, 123-124; Radhakamal Mukherjee, The Changing Face of Bengal; a study of riverine economy, Calcutta, 1938; Roots of Separatism, p. 16

১০. Panandikar, op. cit. pp. 125-127

১১. C D Field, op. cit., pp. 819-820; Report, vol. VI, Alipore, 1941, pp. 435-450; N K Sinha, vol. II, p. 209; Roots of Separatism, p. 17

১২. C D Field, op. cit., chaps XXVII-XXVIII ; Report, vol;. I, p. 24 (see Reg. VII of 1799, Reg. V of 1812, Reg. XI of 1822, Report of the Select Committee of 1830 etc.) On Resumption and Settlement, Premanent Settlement, Rent Suits. Waste lands etc. See PBR, 1786-1858 (in State Archieves, West Bengal).

১৩. C D Field, op. cit., chap XXVIII; Report, vol. I. pp. 25-30 ; Baden-Powell, op. cit.; S Gopal, The Permanent Settlement in Bengal and its Results, London, 1949; Roots of Separatism, pp. 17-18, See Rent Act of 1859, Tenancy Act of 1885, Act of 1928 and Act of 1938.

১৪. Ibid

১৫. Ibid

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *