ঊনবিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

ঊনবিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

এখন দেখা যাক, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি ঊনবিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত মনোভাব কী ছিল? এই বিষয়ে মুসলিম ও হিন্দু বুদ্ধিজীবী কী মনোভাব অবলম্বন করেন? সংক্ষেপে এই প্রশ্নগুলি এখানে আলোচনা করা হল :

(ক) মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মনোভাব :

(১) অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মুসলিম বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রভাবশালী অংশ তাঁরাই ছিলেন যাঁরা ইসলাম ধর্মচর্চায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। তাঁদের মধ্যে খ্যাতিমান ছিলেন শরিয়তউল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি), তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১ খ্রি) এবং দুদু মিঞা (১৮১৯-১৮৬২ খ্রি)। তাঁরা ছিলেন বাংলার মুসলিম সমাজের ধর্মীয় সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের নেতা। শরিয়তউল্লাহ ও তাঁর পুত্র ফরাজিদের নেতৃত্ব দেন, আর তিতুমীর ওয়াহাবিদের পরিচালনা করেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলে আলোড়িত হয়। এই আন্দোলনসমূহ গ্রাম-বাংলার মুসলমানদের এক নতুন চিন্তায় উদ্দীপিত করে। এর প্রকৃতি ছিল প্রধানত ধর্মীয়। অ-ইসলামি রীতিনীতি পরিহার করে বাংলায় ইসলামকে বিশুদ্ধ করবার জন্যই এই আন্দোলনসমূহ পরিচালিত হয়, কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রোগ্রাম যুক্ত হওয়ার ফলে এই আন্দোলনসমূহ মিশ্র আন্দোলনে পরিণত হয়— সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। কৃষির ক্ষেত্রে এই আন্দোলনসমূহ জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকের সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করে।১৬ এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এক ধরনের ‘সাম্যের বাণী’ প্রচার করেন। স্বভাবতই এই ‘সমীকরণের ব্যবস্থা’ নিম্নশ্রেণির মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ফরাজিরা সাফল্যের সঙ্গে জমিদারদের ও তালুকদারদের কৃষকের নিকট থেকে অতিরিক্ত ও বেআইনি আদায় করতে বাধা দেন। তাঁরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ‘জমির মালিক ঈশ্বর। তিনিই তা জনসাধারণকে দান করেন। সুতরাং, জমির ওপর কর বসানো বেআইনি। জমি তাঁদেরই যাঁরা চাষ করেন।’ ফরাজিরা কৃষকদের এই কথাও বলেন, অদূর ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে যখন জমির ওপর থেকে সমস্ত রকমের খাজনারই অবসান হবে।১৭ এইভাবে ফরাজিরা জমিদারিপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত করেন। কিন্তু কী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের ফলে ইংরেজরা বাংলায় প্রাধান্য স্থাপন করতে সক্ষম হল তার কোনো যথার্থ বিশ্লেষণ ফরাজি-ওয়াহাবি নেতৃবৃন্দ করতে পারেননি। এইজন্য এইসব আন্দোলনকে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ বলা চলে, কোনো সমাধান নয়।১৮ তবুও একথা অনস্বীকার্য, এই ফরাজি-ওয়াহাবি তত্ত্বেই জমির ওপর কৃষকের মালিকানা স্বত্বের প্রশ্নটি মূর্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালের ‘লাঙল যার জমি তার’ এই রণধ্বনির মধ্যে তার অনুরণন প্রতিফলিত হয়।

(২) এইসব ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কার আন্দোলনসমূহ ব্রিটিশবিরোধী চরিত্র অর্জন করলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে তার প্রভাব মুসলিম সমাজে হ্রাস পায়। ইতিমধ্যে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম নেতৃবৃন্দ এই কথা উপলব্ধি করতে পারেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুদৃঢ়ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করে মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করা ও তাঁদের উন্নতিসাধন করা অসম্ভব। সুতরাং, নবাব আমির আলি খান বাহাদুর (১৮১৭-১৮৭৯ খ্রি.), আবদুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৩ খ্রি.) এবং সৈয়দ আমির আলি (১৮৪৯-১৯২৮ খ্রি.)—বাঙালি শিক্ষিত মুসলমানদের এই তিন জন নেতা ব্রিটিশ শাসনের কাঠামোর মধ্যে শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের উন্নতি ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হন। তাঁরা এই বিষয়ের প্রতি শিক্ষিত মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে আবদুল লতিফ ও আবদুর রউফ প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানই ইসলামি কলিকাতা (১৮৫৫ খ্রি.), নবাব আমির আলির ন্যাশনাল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যালকাটা (১৮৭৭ খ্রি.), আবদুল লতিফের ‘মহামেডান লিটারেরি অব ক্যালকাটা’ (১৮৬৩ খ্রি.) এবং সৈয়দ আমির আলির ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যালকাটা (১৮৭৭ খ্রি.) উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলমানদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত থেকে তাঁরা মুসলমানদের অবস্থার উন্নতি করতে চেষ্টা করেন।১৯ তাঁরা কখনোই কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত ভূমি ব্যবস্থাকে তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থল করেননি। বাঙালি মুসলিম লেখকেরা খুব তিক্ততার সঙ্গে অভিযোগ করেন, বেশিরভাগ মুসলিম জমিদারেরাই অলসপরায়ণ। হিন্দু আমলাদের দ্বারা তাঁরা সবসময়ে পরিবৃত হয়ে থাকেন। এই আমলারা সহজেই তাঁদের জমিদারি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন। তার ফলে খুব অল্পসংখ্যক মুসলিম জমিদার সম্পদশালী।২০ লক্ষ করার বিষয় এই যে, মুসলিম বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মুসলিম জমিদারদের দুরবস্থা দেখে খুবই উদবেগ বোধ করেন, কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে কৃষকের দারিদ্র্য প্রকট হল তাতে তাঁরা ততটা বিচলিত হননি।২১

(৩) অবশ্য তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন যাঁরা জমিদারি নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত লেখক মীর মশাররফ হোসেন। তিনি ‘জমিদার দর্পণ’ নামক নাটকে কৃষকের ওপর জমিদারের অত্যাচারের চিত্র অঙ্কিত করেন। এই নাটকটি তিনি ১৮৭২-১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের পাবনার কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিতে রচনা করেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই নাটকটি প্রকাশিত হয়।২২ সন্দেহ নেই মীর মশাররফ হোসেন প্রজাদের পক্ষে দাঁড়ান এবং নিপীড়িত জনসমষ্টির প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।২৩ তবুও, যেহেতু তিনি ছিলেন জমিদারের সন্তান, সেজন্য তিনি তাঁর শ্রেণি সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। নিপীড়িত জনসাধারণের প্রতি তাঁর গভীর সমবেদনার সঙ্গে মিশে রয়েছে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত ক্রোধ আর ব্রিটিশ শাসনের ও ইউরোপীয়দের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা। তাঁর চরিত্রের এই পরস্পরবিরোধী উপাদানের প্রতিফলন তাঁর রচনায় পাওয়া যায়।২৪

মুসলিম সমাজের আর একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন সৈয়দ আমির আলি। যদিও তিনি মূলত ব্রিটিশ সৃষ্ট ভূমি ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন না, তবুও তিনি কৃষকের পক্ষে কথা বলেন। অবশ্য তিনি কোনো শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেননি। তিনি এই কারণে উৎসাহিত হন যে, বাংলার কৃষকেরা তাঁরই ধর্মের অনুসরণকারী। তাঁর এই ধর্মীয় মনোভাব পরিষ্কার হয়ে ওঠে যখন তিনি ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে টেনান্সি বিল বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তিনি এই বিষয়ে বিবৃতি দেন। তাঁর ভাষণে আক্রমণের লক্ষ্যস্থল ছিল হিন্দু জমিদার শ্রেণি। তিনি মুসলিম জমিদারদের অত্যাচারের বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি। সুতরাং, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে আমির আলি ভূমি সমস্যাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেন।২৫

ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমির আলি প্রতিষ্ঠিত মহমেডান লিটারেরি সোসাইটির এবং ন্যাশনাল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশনের শাখা-প্রশাখা বাংলার গ্রামাঞ্চলেও গড়ে ওঠে। এই শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন স্থানে যেসব সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হল :

ঢাকা মহমেডান ফ্রেণ্ডস অ্যাসোসিয়েশন (১৮৮৩ খ্রি), কলিকাতায় মহমেডান ইউনিয়ন (১৮৯০ খ্রি.), মালদহ মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৯১ খ্রি), পাবনায় আঞ্জুমান-ই-ইসলামিয়া (১৮৯৮ খ্রি) ইত্যাদি। এইসব সংস্থা ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে উদ্যোগী হয়নি। আবদুল লতিফ ও আমির আলি উভয়েই ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে এবং কংগ্রেস বিরোধী। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আবদুল লতিফের মৃত্যুর পরে সৈয়দ আমির আলিই ছিলেন প্রভাবশালী নেতা। তাঁর প্রতিষ্ঠানের শাখা-প্রশাখা সুদূর লাহোর, করাচি ও লখনৌতে প্রসারিত হয়। আবদুল লতিফ ও আমির আলির অনুগামীরা তাঁদের পথই অনুসরণ করেন। পরবর্তীকালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি মুসলিম গ্র্যাজুয়েট দিলওয়ার হোসেন আহমদ মির্জা (১৮৪০-১৯১৩ খ্রি) আমির আলি প্রতিষ্ঠিত সংস্থার সহ-সভাপতিও হন। দিলওয়ার হোসেন অনেক ইংরেজি প্রবন্ধের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে সংস্কারসাধন করে তার উন্নতির চেষ্টা করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Essays on Mohammadan Social Reform প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করলেও ভূমিসমস্যার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেননি। তিনি লিখেছেন, গত একশত বছর ধরে অসংখ্য মুসলমান ভূস্বামী জমিজমা হারিয়েছেন এবং হিন্দুরা তার অধিকারী হয়েছেন। তা ছাড়া ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুসলমানেরা হিন্দুদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকায় তিনি আক্ষেপ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর আর একজন বিশিষ্ট মুসলমান লেখক হলেন পন্ডিত রেয়াজউদ্দিন আহমদ মাশহাদি (১৮১৯-১৯১৯ খ্রি.)। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী। সংস্কৃত ভারাক্রান্ত বাংলা ভাষায় অনেক বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করলেও তাতে ভূমিসমস্যা সম্বন্ধে কোনো সুচিন্তিত বিশ্লেষণ নেই।২৬

বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্য থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিম সমাজের যাঁরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন তাঁরা বাঙালি হিন্দুসমাজের মতোই প্রধানত শিক্ষা সংস্কারের ও কৃষিতে অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলমানদের বিকাশ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। তাঁরা উপলব্ধি করেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তাঁদের সামনে অনেক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সুতরাং, তাঁরা এই ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন কামনা করেননি, যদিও তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ব্যক্তি তাঁদের রচনার ও বক্তৃতার মাধ্যমে জমিদারদের অত্যাচারের চিত্র উদঘাটিত করেন।

(খ) হিন্দু ও ব্রাহ্ম বুদ্ধিজীবীদের মনোভাব :

প্রায় একই ধরনের মনোভাব শিক্ষিত হিন্দুদের ও ব্রাহ্মদের মধ্যে দেখা যায়। গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরেই হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখকেরা অসংখ্য গ্রন্থে ও প্রবন্ধে কৃষকদের দুরবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। এই বিষয়ের ওপর রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, অক্ষয়কুমার দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নবীনকৃষ্ণ বসু, শিশিরকুমার ঘোষ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকে গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। এখানে সংক্ষেপে কয়েক জনের রচনা সম্পর্কে উল্লেখ করা হল :

(১) রামমোহন রায়ের রচনাবলি থেকে তাঁর সময়কার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে রায়তদের অসুবিধা সম্পর্কে রামমোহন যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং তিনি সেইসব অসুবিধা দূর করার কথাও বলেন। তবুও তিনি কখনো এই ভূমি ব্যবস্থার অবসান দাবি করেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই ব্যবস্থার সাফল্যের দিক উল্লেখ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যাণ্ডে রামমোহন তাঁর সাক্ষ্যে এই ব্যবস্থা সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেন তা এখানে উদ্ধৃত করা হল :

If it (the Permanent Settlement) had not been formed, the landholders would always have taken care to prevent the revenues from increasing by not bringing waste lands into cultivation and by collusive arrangements to elude further demands; while the state of the cultivators would not have been at all better than it is now.

ফরাজি-ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলে বাংলার সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনে যে-আলোড়ন ঘটেছে তা অবলোকন করেও রামমোহন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করেননি।২৭

(২) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সে-আমলের একজন বিখ্যাত লেখক ছিলেন। তিনি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সংবাদ প্রভাকর নামক কাগজে নিয়মিত এই বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন। কোনো কোনো প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ব্রিটিশ রচিত ভূমি আইনের এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রসূত নতুন মধ্যস্বত্বভোগীদের আবির্ভাবের ফল কৃষকেরা এক নিদারুণ দুরবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে। আবার একইসঙ্গে ঈশ্বর গুপ্ত জমিদারদের সমর্থনে প্রবন্ধ রচনা করেন। এইসব প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, তিনি পৃথক শ্রেণি হিসেবে জমিদারদের ও কৃষকদের মধ্যেকার পার্থক্য উল্লেখ করতে পারেননি।২৮

(৩) তা ছাড়া ইয়ং বেঙ্গলের নেতৃবৃন্দ যাঁরা মার্কিন ও ফরাসি বিপ্লবের কথা বলতেন, তাঁরাও জমিদারিপ্রথার ফলে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা সমাধানের জন্য বাংলার কৃষিজীবনকে রূপান্তরিত করার কোনো প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হতে পারেননি, যদিও পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ রচনা করেন। বস্তুত, কৃষি সমস্যা নিয়ে কোনো প্রামাণ্য আলোচনা সোসাইটি ফর দি একুইজিশন অব জেনারেল নলেজের কার্যবিবরণীতে (১৮৩৮-১৮৪৩ খ্রি.) পাওয়া যায় না।২৯

(৪) ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা নামক কাগজে ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা’ এই শিরোনামায় তিনটি প্রবন্ধ রচনা করেন। তাতে তিনি জমিদারদের ও নীলকরদের অত্যাচার আলোচনা করেন। এই প্রবন্ধের প্রথম অংশে তিনি কৃষকদের ‘আমাদের প্রতিপালক’ বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু কৃষকেরা নিরন্ন থাকায় ও উৎপীড়িত হওয়ায় তিনি গভীর বেদনা প্রকাশ করেন। বাংলার ভূস্বামীদের ব্যবহার লক্ষ করে তিনি বলেন, ‘যে রক্ষক সেই ভক্ষক’ এই প্রবাদের বাস্তব প্রকাশ এখানে সূচিত হয়। ‘ফৌজদারি উপদ্রব’ তাদের অবস্থাকে দুর্বিষহ করে তোলে।৩০ এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে প্রজাদের ‘ধন-মান প্রাণাদি’ রক্ষার জন্য কর আদায়কারী রাজপুরুষেরা দায়িত্ব পালন না করায় অক্ষয়কুমার দত্ত আক্ষেপ করেন। তা ছাড়া তিনি ভূস্বামীদের নিপীড়নের কথাও উল্লেখ করেন।৩১ এই প্রবন্ধে তৃতীয় অংশে তিনি নীলকরের অত্যাচার সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেন। এই তিনটি প্রবন্ধে তিনি বাংলার কৃষকের দুরবস্থা গভীর দরদ দিয়ে আলোচনা করেন। এই প্রবন্ধে তিনি এই প্রশ্নও উত্থাপন করেন : ‘তাহাদের এই দারুণ দুরবস্থা নিরাকরণেরই বা উপায় কি?’ এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর অক্ষয়কুমার দিতে পারেননি। জমিদারিপ্রথা ও পত্তনিপ্রথা পরিবর্তন না করে যে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তা তাঁর রচনায় প্রতিফলিত হয়নি। তাই তিনি লেখেন : ‘আমাদিগের দেশীয় লোকের পরস্পরের ঐক্য নাই, এবং জনসমাজের অধস্তন শ্রেণীর সহিত উপরিতন শ্রেণীর মিলন নাই। যাহাদের স্বদেশের দুরবস্থা মোচনের ইচ্ছা আছে, তাহাদের তদুপযোগী সামর্থ্য নাই; যাহাদের সামর্থ্য আছে তাহারদের ইচ্ছা নাই। কোনো পর্বতোপরি আরোহণ করিতে গেলে যতদূর উত্থিত হওয়া যায় ততই গ্রীষ্ম হ্রাস ও শীতাধিক্য বোধ হয়, সেইরূপ এদেশীয় জনসমাজরূপ গিরিশিখরের যত ঊর্দ্ধভাগ প্রত্যক্ষ করা যায় ততই অনুৎসাহ, অননুরাগ, অযত্ন ও ঔদাস্যেরই নিদর্শন সকল দৃষ্ট হইতে থাকে। কি প্রকারে যে এই সকল দুর্নিবার প্রতিবন্ধক মোচন হইয়া এদেশের পরিত্রাণ সাধন হইবে তাহা জগদীশ্বরই জানেন। রাজপুরুষেরা মনোযোগ করিলে প্রজাদিগের বর্তমান দুরবস্থার অনেক প্রতিকার করিতে পারেন তাহার সন্দেহ নাই। যদি তাঁহারা বিশিষ্টরূপে তদ্বিষয়ে কারণ সমুদায় অনুসন্ধান করেন ও কায়মনোবাক্যে তন্নিরাকরণের চেষ্টা করেন তবে দুঃখিত প্রজাদিগের অবশ্যই দুঃখ হ্রাস হইতে পারে। তাহাদিগকে যন্ত্রণানলে অহরহ দগ্ধ হইতে দেখিয়াও যে কিছুমাত্র দয়া প্রকাশ করেন না, ইহা অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়। ইহাতে তাহাদের কর্তব্য কর্মের অন্যথা হইতেছে, এবং তন্নিমিত্তে তাঁহারা ঈশ্বর সন্নিধানে অপরাধী হইতেছেন তাহার সংশয় নাই।’৩২

(৫) হিন্দু পেট্রিয়ট-এর সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কৃষিসমস্যা বিশেষ করে নীল চাষিদের বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু এই বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারার প্রকৃত মূল্যায়ন করতে হলে একটু পেছনের দিকে তাকানো প্রয়োজন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে যখন জর্জ টমসন কলকাতায় আসেন তখন তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী এখানকার বুদ্ধিজীবীরা একটি সভা গঠন করেন। এই সভার নাম প্রথমে ছিল জমিদারদিগের সভা বা Land Holders’ Association। এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতির চর্চা করা, দেশের অহিতকর রাজনিয়মাবলির কিংবা আইনের পরিবর্তন বা সংশোধনের জন্য ইংরেজরাজের নিকট দরখাস্ত পেশ করা, জমিদারদের মঙ্গলসাধন ও স্বার্থরক্ষা করা। এই সভার উদ্যোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রামগোপাল ঘোষ, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেব, হরিমোহন সেন, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি।৩৩ পরে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে এই সভার নাম পরিবর্তন করে ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ রাখা হয়। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর এই সভার প্রথম অধিবেশন হয়।৩৪

১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভ্য হন। স্বভাবতই তিনি প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যেই জমিদারদের স্বার্থের কথা ভেবে কৃষিসমস্যা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, তিনি ‘সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি’ নামক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট কিশোরীচাঁদ মিত্রের বাসভবনে সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতি। এই সমিতিতে স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তন, হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সমাজ সংস্কারের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।৩৫ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই সমিতির একটি বাৎসরিক কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় যে, এই সমিতি বাঙালি কৃষকগণের যথার্থ দুরবস্থা ইংল্যাণ্ডের জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর করবার উদ্দেশ্যে ‘প্রজাদিগের সামাজিক অবস্থা’ বিষয়ে সর্বোৎকৃষ্ট প্রবন্ধের জন্য পাঁচশত টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। এই প্রবন্ধের পরীক্ষক ছিলেন সমিতির সভাপতি, সম্পাদক ও রেভারেণ্ড জেমস লঙ। কিন্তু কোনো প্রবন্ধ তাঁদের নিকট পুরস্কারযোগ্য বিবেচিত হয়নি। সুতরাং স্থির হয়, এই প্রাইজ ফাণ্ডের টাকায় প্রজাগণের অবস্থা সম্বন্ধীয় মৌলিক ও গবেষণাপূর্ণ পুস্তক ও রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। এর বেশি আর এই সমিতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় না।৩৬

১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগে হিন্দু পেট্রিয়ট নামক ইংরেজি সাপ্তাহিক কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই কাগজের দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই চাপে। কলকাতার দু-জন ধনী ব্যক্তি তাঁর বন্ধু ছিলেন, প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ অর্থ সাহায্য দিয়ে এই কাগজ পরিচালনায় তাঁকে সাহায্য করেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই এই কাগজ লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এই কাগজে হরিশচন্দ্র হিন্দু সভ্যতায় ও ইউরোপীয় সভ্যতায় প্রভেদ উল্লেখ করে হিন্দু সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে প্রবন্ধ লেখেন। অবশ্য সমাজ সংস্কারের পক্ষপাতী বিশেষ করে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সমর্থক হরিশচন্দ্রের সঙ্গে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের পার্থক্য যথেষ্ট ছিল। তা ছাড়া ইংল্যাণ্ডের শ্রমিকদের কর্মবিরতি বা স্ট্রাইকের সঙ্গে ভারতবর্ষের ধর্মঘটের প্রভেদ উল্লেখ করেও তিনি প্রবন্ধ লেখেন। প্রধানত তিনি শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে যৌথভাবে অসহযোগ বা ধর্মঘট করার পদ্ধতিকেই দাবি আদায়ের প্রকৃষ্ট পন্থা মনে করেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময় তিনি ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষার্থে প্রয়াসী হন। তাই দেখি তিনি এই সময়ে ভারতীয়দের অত্যাচারের যেমন নিন্দা করেন, তেমনি প্রতিহিংসাপরায়ণ ইংরেজদেরও নিন্দা করেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রজার পক্ষ অবলম্বন করে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধারণ করেন এবং বাংলার জনমত গঠন করেন। হিন্দু পেট্রিয়ট-এর মাধ্যমে বাংলার জাতীয় চেতনা বিকাশে তাঁর অবদান স্মরণযোগ্য।৩৭ তবুও ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব বিশ্লেষণ করলে তাঁর চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি স্বীকার করেন, গ্রাম্যজীবনে জমিদারদের অত্যাচার মস্তবড়ো এক সমস্যা। খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিরোধের কথাও তিনি বলেন।৩৮ তা সত্ত্বেও তিনি কৃষকসমাজের ওপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবের কথা আলোচনা করে তার প্রতিকারের কোনো পন্থা নির্দেশ করেননি। এমনকী কৃষকের ওপর জমিদারের অত্যাচারের বিষয়টি আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার ব্যাপারেও তাঁর দ্বিধা ছিল।৩৯

(৬) ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন সোসাইটির সেক্রেটারি নবীনকৃষ্ণ বসু ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। অসংখ্য মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণির ও মহাজনের ভূমিকা উল্লেখ করে তিনি জমিদারদের নিপীড়নের কথা আলোচনা করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে লর্ড কর্নওয়ালিশের উদ্দেশ্য বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য নবীনকৃষ্ণ বিশদভাবে জরিপের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। যাতে সকলেই সুবিচার পায় সেজন্য তিনি বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেন। তিনি একথাও স্বীকার করেন যে, কৃষকের দিক থেকে যে-ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো হত তা হল তার ওপর জমির মালিকানা স্বত্ব অর্পণ করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, বর্তমানে জমিতে কৃষকের মালিকানা স্বত্ব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি পরামর্শ দেন, সরকার যেমন ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করেছে, তেমনই আইন করে জমিদারদের বাধ্য করা হোক যাতে তারা কৃষকদের সঙ্গে একই ধরনের বন্দোবস্ত করে। অর্থাৎ নবীনকৃষ্ণ বসু জমির ওপর কৃষকের অধিকার আরও সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন শুধু।৪০

(৭) তা ছাড়া কৃষিসমস্যার বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যবিবরণী (১৮৬৭-১৮৭১ খ্রি), অমৃতবাজার পত্রিকা, , বঙ্গদর্শন, সোমপ্রকাশ, সাধারণী ও অন্যান্য অনেক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।৪১ ১৮৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দের পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কারণসমূহ আলোচনা করে হিন্দু পেট্রিয়ট, অমৃতবাজার পত্রিকা, সাধারণী ও আরও কয়েকটি কাগজ সঠিকভাবেই আইনের ও শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি উদঘাটন করে। কিন্তু এইসব পত্রপত্রিকা এইসব ত্রুটি দূর করবার জন্য জমিদারিপ্রথা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি।৪২ যদিও সাধারণী প্রজার পক্ষ অবলম্বন করে, তথাপি এই কাগজ জমিদারিপ্রথার অবসান দাবি করেনি। এই কাগজ জমিদারের নিপীড়নের ক্ষমতা হ্রাস করে জমিদার-প্রজা দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে প্রয়াসী হয়।৪৩ প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের শেষে হিন্দু পেট্রিয়ট জমিদারের পক্ষ অবলম্বন করে। বাংলার জমিদার শ্রেণির মুখপাত্র কৃষ্ণদাস পাল ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন।৪৪

লক্ষণীয় এই যে, এই সময়ে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা খুবই বলিষ্ঠ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দীর্ঘ বাইশ বছর (১ বৈশাখ, ১২৭০ বাংলা সন আত্মপ্রকাশ করে) হরিনাথ মজুমদারের সম্পাদনায় এই কাগজটি চলে। এই কাগজ জমিদার, মহাজন ও নীলকর প্রভৃতির অত্যাচার উদঘাটিত করে এবং প্রজাদের প্রতি সরকারের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। কৃষকদের পক্ষ অবলম্বন করায় এই কাগজ গ্রামের মানুষকে খুবই প্রভাবান্বিত করে। সেই সময়ে অন্য কোনো কাগজ এতটা বলিষ্ঠতার সঙ্গে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। গ্রামবাংলায় হরিনাথ মজুমদার ‘কাঙ্গাল হরিনাথ’ নামেই খ্যাত ছিলেন। তিনি কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের গন্ডির বাইরে ছিলেন।৪৫

(৮) ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইংরেজ আগমনের আগে কৃষকদের অবস্থা ও ইংরেজ কতৃক প্রবর্তিত ভূমি আইনের ফলাফল আলোচনা করে কৃষকের দুরবস্থা লাঘবের জন্য কয়েকটি পন্থা নির্দেশ করেন। সঞ্জীবচন্দ্র লেখেন, মুসলিম শাসনের পরিবর্তে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে সরকারের জনহিতৈষী নীতি দেশে এক নতুন আশার সঞ্চার করে। কয়েকটি ক্ষেত্রে এই আশা বাস্তবে রূপায়িত হয়। শিক্ষার ও বাণিজ্যের ক্রমোন্নতির ফলে দ্রুত এক মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হয়। কিন্তু কৃষকের অবস্থা অপরিবর্তিতই থাকে। কৃষিপণ্যের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেলেও কৃষকের দারিদ্র্য পূর্বের মতোই রয়েছে। কৃষকের এই দুরবস্থার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তসমূহের ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়। এই বন্দোবস্ত অনুযায়ী জমিদারেরা জমির প্রকৃত মালিক হন। তা ছাড়া জমিদারেরা খাজনা বৃদ্ধি করার ও লিখিত দলিলের অভাবে কৃষকদের উচ্ছেদ করার অধিকারও অর্জন করেন। এই অধিকারের ফলে কৃষকের ওপরে জমিদারের নিপীড়নের মাত্রা সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বন্দোবস্তে এমন কোনো শর্ত নেই যার ফলে জমিদারের এই অধিকার সীমিত করা যায়।৪৬

সঞ্জীবচন্দ্র ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আইনসমূহের বিস্তারিত আলোচনা করেন। কিন্তু অসংখ্য মধ্যসত্ত্বভোগীদের মারফত ভূমি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে তার বিষয়ে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মৌলিক পরিবর্তন করে বাঙালি জীবনকে গড়ে তোলা প্রয়োজন কি না এই বিষয়ে তিনি কোনো আলোচনা করেননি। ব্রিটিশ শাসনের জনহিতৈষী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কৃষকদের দুরবস্থা ও ভূমি ব্যবস্থা পর্যালোচনা করেন।৪৭

(৯) এই প্রসঙ্গে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদর্শন কাগজে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ নামক প্রবন্ধের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা যায়। এই প্রবন্ধটি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন, ‘১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ কৃষকদের যে-অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছিল তা আর এখন নেই। এখন আর জমিদারদের সেরূপ অত্যাচার নেই। নতুন আইনে তাঁদের ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে। এমনকী কৃষকদের ক্ষমতারও অনেক উন্নতি হয়েছে।’৪৮ বঙ্কিমচন্দ্র এখানে যে নতুন আইনের কথা উল্লেখ করেছেন তা হল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন। এই গ্রন্থে ভূমি ব্যবস্থা, জমিদারদের অত্যাচার ও কৃষকদের দুরবস্থার এক বিবরণ পাওয়া যায়। এই কথাও বঙ্কিমচন্দ্র পরিষ্কার করে বলেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের সঙ্গে না হয়ে প্রজার সঙ্গেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু একইসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র আবার এই কথাও স্বীকার করেন, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে যে-ভুল করা হয় তা আর এখন সংশোধন করা সম্ভব নয়। আধুনিক বঙ্গসমাজ সেই ভ্রান্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান ঘটালে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। যেহেতু বঙ্কিমচন্দ্র সমাজবিপ্লবের সমর্থক নন, সেজন্য তিনি ইংরেজদের এমন কোনো পরামর্শ দেবেন না যার ফলে তাঁরা প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হন এবং চিরকাল প্রজাদের নিকট অবিশ্বাসভাজন হয়ে থাকেন। বঙ্কিমচন্দ্র তখনই এই ধরনের পরামর্শ দেবেন যখন তিনি ইংরেজের ও সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হবেন।৪৯ সুতরাং, বঙ্কিমচন্দ্র কৃষকদের দুঃখে সমবেদনা প্রকাশ করলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভিত্তি করে যে-সমাজকাঠামো গড়ে ওঠে তা অপরিবর্তনীয় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন।৫০ তা ছাড়া এই গ্রন্থের কোথাও বঙ্কিমচন্দ্র এই ভূমি ব্যবস্থা বাংলা দেশে কীভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদের উপকরণ পুষ্ট করে চলেছে সেই বিষয়ে কোনো আশঙ্কা প্রকাশ করেননি। আর যে-প্রজাস্বত্ব আইনকে (১৮৮৫ খ্রি.) তিনি স্বাগত জানান তা ভূমি ব্যবস্থার মূল কাঠামোকে রূপান্তরিত করতে কতটা সহায়ক হল তার কোনো ইঙ্গিতও তাঁর রচনায় নেই। প্রকৃতপক্ষে এই আইনের ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের মালিকানা স্বত্ব পুরোপুরি অটুট থাকে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে : এই অবস্থা বজায় রেখে কৃষকের দুরবস্থা কতটা লাঘব করা সম্ভব? কিন্তু এইসব প্রশ্ন বঙ্কিমচন্দ্রকে উদবিগ্ন করে তোলেনি। কী করে বিশ্বাস করা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ব্যক্তি এইসব প্রশ্ন সম্পর্কে আদৌ সচেতন ছিলেন না? শুধু বঙ্কিমচন্দ্র নন, কৃষকের দুরবস্থা নিয়ে যাঁরাই সুচিন্তিত বক্তব্য রেখেছেন তাঁদের রচনাতেও এই দিক থেকে সমস্যার বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না।৫১

(১০) ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রমেশচন্দ্র দত্তও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে আলোচনা করেন। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কৃষকদের দুরবস্থার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমালোচনা করেন। তিনি এই সময়ে লেখেন, ‘আশি বছর অতিক্রান্ত হল এই ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এর ফল দরিদ্র কৃষকের ক্ষেত্রে কী হল? বাণিজ্যের অগ্রগতি হলেও কৃষকেরা তার দ্বারা লাভবান হয়নি। যদি কৃষির প্রসার হয়ে থাকে তাহলে তার ফলে জমিদারেরাই উপকৃত হয়েছে, কৃষকেরা নয়। লর্ড ওয়েলেসলির আমলে যেসব নিপীড়নমূলক আইন হয় তার ফলে কৃষককে সম্পূর্ণভাবে জমিদারের দয়ার ওপরে ছেড়ে দেওয়া হয়। কৃষকের অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে অসংখ্য আইন প্রণয়ন করা হলেও কৃষকের অবস্থার উন্নয়নে তা মোটেই সহায়ক হয়নি। জমিদার এখনও অনেক ক্ষমতার অধিকারী যার ফলে সে সহজেই কৃষককে নিগৃহীত করতে পারে। প্রতিদিনই জমিদার-কৃষক বিরোধ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই জমিদারের বিরুদ্ধে কৃষকেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। সম্প্রতি নদিয়ায় নীল চাষের ও পাবনায় খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তারই প্রকাশ দেখা যায়। অবশেষে দাসত্বের দীর্ঘ নিদ্রা থেকে কৃষকেরা জেগে উঠছে।’৫২

কিন্তু পরবর্তীকালে রমেশচন্দ্র দত্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি লেখেন, ‘যদি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে একটি অনুগত জমিদার শ্রেণি ও আর একটি সম্পন্ন কৃষক শ্রেণি তৈরি করা তা হলে এই উদ্দেশ্য আশাতীত সাফল্যলাভ করেছে বলা যায়।’৫৩ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে রমেশচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমর্থনে বিস্তৃত আলোচনা করেন। তিনি লেখেন, ‘এই বন্দোবস্তের ফলে জনসাধারণের আর্থিক স্বার্থ রক্ষিত হয়। বাংলায় কৃষির সম্প্রসারণ হয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলায় এমন কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি যার ফলে অনেক লোক প্রাণ হারায়। যদি সম্পদ ও সুখ একটি জাতির সাফল্যের ও বিজ্ঞতার মাপকাঠি হয় তাহলে কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে এক বিজ্ঞজনোচিত ও সাফল্যজনক ব্যবস্থা বলা চলে।’৫৪

১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে অভয়চরণ দাস ও ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে তারিণী দাস ব্যানার্জি তাঁদের গ্রন্থে জমিদার-কৃষক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন।৫৫ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ও কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু তিনি জমিদারদের ভালো ও মন্দ এই দুই ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করেন। তিনি কেবলমাত্র মন্দ জমিদারদের সমালোচনা করেন।৫৬

(গ) বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (১৮৮৫ খ্রি.) সম্পর্কে জমিদারদের মনোভাব :

বাংলার ও বিহারের জমিদারেরা খুবই শঙ্কিত হন যখন নতুন প্রজাস্বত্ব আইনের জন্য ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনেকগুলি বিলের খসড়া রচিত হয় এবং চূড়ান্ত খসড়াটি কেন্দ্র করে যখন ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে আলোচনা শুরু হয়। এই কাউন্সিলে জমিদারদের শক্তি যথেষ্ট ছিল। সুতরাং, তাঁদের স্বার্থ বিরোধী কোনো বিলের বিরোধিতা তাঁরা সহজেই করতে পারেন। এই কাউন্সিলে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মনোনীত প্রতিনিধি ছিলেন কৃষ্ণদাস পাল। কাউন্সিলে আর একজন শক্তিশালী মুখপাত্র ছিলেন দ্বারভাঙার মহারাজা। কৃষ্ণদাস পালের মৃত্যুর পরে উত্তরপাড়ার রাজা পিয়ারীমোহন মুখার্জি কাউন্সিলে জমিদারদের প্রতিনিধিত্ব করেন। অন্যদিকে কৃষকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলার কেউ কাউন্সিলে ছিলেন না। যেহেতু ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রজাস্বত্ব বিলটি জমির ওপর কৃষকের কয়েকটি অধিকার অর্পণের প্রস্তাব করে, সেজন্য জমিদারেরা তার বিরুদ্ধে কাউন্সিলের ভেতরে ও বাইরে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই বিলের বিরুদ্ধে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান জমিদারেরা মিলিতভাবে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে একটি প্রতিবাদ সভা করেন এবং বিলের এইসব ধারার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তাঁরা এই প্রস্তাবে বলেন, বিলের এইসব ধারা গৃহীত হলে জমির সঙ্গে যুক্ত সকলেরই স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। প্রস্তাবটির মূল অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল :

That this meeting desires to record its opinion that the Government has entirely failed to show that any grounds exist for introducing into the Bengal Tenancy Bill revolutionary provisions which are a novel departure from the ancient custom, and the existing law relating to landlord and tenant, and which will most injuriously affect all classes of community who are in any way interested in the land.৫৭

সংক্ষেপে বলতে গেলে এই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি জমিদারদের মনোভাব।

(ঘ) জমিদারিপ্রথা সম্পর্কে সরকারি রিপোর্ট :

ইংরেজ সরকার জমিদারদের ভূমিকায় খুবই সন্তুষ্ট হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫ -১৮৫৬ খ্রি.) এবং সিপাহি বিদ্রোহের (১৮৫৭-১৮৫৮ খ্রি.) সময়ে বাংলার জমিদারেরা সরকারের প্রতি অনুগত থাকেন।৫৮ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্ধমান প্রেসিডেন্সি, রাজসাহি ও ঢাকা ডিভিশনের অফিসারেরা যে অসংখ্য রিপোর্ট রচনা করেন তাতে স্বীকার করা হয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলেই দেশের সম্পদ ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে।৫৯ স্বভাবতই সরকার এই ভূমি ব্যবস্থার মূল কাঠামোকে অপরিবর্তিত রাখে, যদিও মাঝে মাঝে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকের ওপর কিছু কিছু অধিকার অর্পণ করা হয়। এইসব সরকারি রিপোর্ট থেকে এও জানা যায়, সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল জমিদার-কৃষক বিরোধ যতটা সম্ভব হ্রাস করা।৬০

.

১৬. Jagadish Narayan Sarkar, Islam in Bengal, Thirteenth to Nineteenth Century, Calcutta, 1972; Amalendu De, Bengali Buddhijibi O Bichchinnatabad, Calcutta, 1974, pp. 61-142 (Henceforth abbreviated as Bangali Buddhijibi); Roots of Separatism, pp. 19-22

১৭. PJD, OC No. 25, 29 May, 1843, p. 461 ; OC No. 99, 7 April, 1847, p. 147. এই অপ্রকাশিত সরকারি দলিলে ফরাজিদের বিষয়ে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল : ‘The Earth is Gods who gives it to his people—the land tax is accordingly held in abomination, and they are taught to look forward to the happy time, when it will be abolished’. (Ibid)

১৮. K A Nizami, Socio-Religious Movements in Indian Islam (1763-1898), in India and Contemporary Islam, Edited by S T Lokhandwalla, Simla, 1971, pp. 107-108

১৯. Durbeen, a Persian weekly, edited by Abdur Rauf, one volume containing the issues of 1855, 1856, 1857, 1858 in the Library of Dacca University; A R Mallick, British Policy and the Muslims of Bengal 1757-1856, Dacca, 1961; Anil Seal, The Emergence of Indian Nationalism, Cambridge University Press, 1968; Enamul Haque (compiled), Nawab Bahadur Abdul Latif, His Writings and Related Documents, Dacca 1968; Bangali Buddhijibi, Chapter 2; Roots of Separatism; Sufia Ahmed, Muslim Community in Bengal 1884-1912, Dacca, 1974. আবদুল লতিফ, আবদুর রউফ ও আরও কয়েক জন মিলিত হয়ে ‘আঞ্জুমান-ই-ইসলামি কলিকাতা’ নামক প্রতিষ্ঠান ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২ মে কলিকাতা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণ করা এবং ইংরেজ কোম্পানির শাসনকে সমর্থন করা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই সংস্থা মুসলমানদের সিপাহি বিদ্রোহে যোগ দিতে নিষেধ করে। এই সংস্থার সদস্যদের বার্ষিক চাঁদার হার ছিল পঁচিশ টাকা। আবদুর রউফ ছিলেন ক্যালকাটা মাদ্রাসার আরবি বিভাগের প্রধান। তিনি এই সংস্থার মুখপত্র দুরবীন নামক সাপ্তাহিক ফারসি ভাষার কাগজের সম্পাদক ছিলেন। এই কাগজের একটি খন্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। আঞ্জুমান-ই-ইসলামি কলিকাতা এই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল। এর শাখা ছিল আঞ্জুমান-ই-ইসলামি মেদিনীপুর (১৮৫৫), আঞ্জুমান-ই-ইসলামি সিলেট (১৮৫৫)।

২০. শেখ আবদুস সোভান, হিন্দু-মোসলমান, কলিকাতা, ১৮৮৮; কাজী আবদুল মান্নান, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিমি সাধনা, ঢাকা, ১৯৬৯; আনিসুজ্জমান, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, ১৭৫৭-১৯১৮, কলিকাতা, ১৩৭৮ বাংলা সন; Roots of Separatism, p. 43

২১. ওই

২২. মীর মশাররফ হোসেন, জমিদার দর্পণ, আশরাফ সিদ্দিকি কতৃক সম্পাদিত গ্রন্থ, ঢাকা, ১৯৫৮; মুনীর চৌধুরী, মীর-মানস ঢাকা, ১৯৬৮

২৩. মীর মশাররফ হোসেন, জমিদার দর্পণ; মীর মশাররফ হোসেন, উদাসীন পথিকের মনের কথা, ঢাকা, ১৩৭৭ বাংলা সন (এ কে এম সামসুল ইসলাম কর্তৃক সম্পাদিত); গ্রামবার্তা প্রকাশিকা কাগজে প্রকাশিত মীর মশাররফ হোসেনের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।

২৪. ওই ; মুনীর চৌধুরী, মীর-মানস, পৃ ৫৫

২৫. Legislative Proceedings of the Council of the Governor General, March 1885, p. 156; p. 156; Ameer Ali, The Life Problem of Bengal, in the Nineteenth Century and After, September, 1883, pp. 421-440; Sufia Ahmed, op. cit. pp. 111-113

২৬. Delawarr Hosaen Ahamed Meerza, Essays on Mohammadan Social Reform, vols. I-II, Calcutta, 1889; মাশহাদী রচনাবলি, প্রথম খন্ড, আবদুল কাদির সম্পাদিত, ঢাকা, ১৯৭০। হুগলি জেলা নিবাসী দিলওয়ার হোসেন আহমদ মির্জা ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে বিএ পাস করেন। পন্ডিত রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদী কলিকাতা মাদ্রাসার ‘আলীয়া’-র সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গতা ছিল।

২৭. Report, vol III, Alipore, 1940. P 159 ; S C Sarkar (ed.) Rammohun Roy on Indian Economy, Calcutta, 1965; Bhabatosh Datta. The Evolution of Economic Thinking in India, Calcutta, 1962; B N Ganguli, Rammohun Roy on India’s contemporary Economic Problems, Economic and Social Development Essays in Honour of Dr C D Deshmukh, Bombay, 1972; বাঙালি বুদ্ধিজীবী, প্রথম অধ্যায়।

২৮. সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার ফাইল ; বিনয় ঘোষ, সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সামাজিক ভূমিকা, দ্র ইতিহাস, নবম খন্ড, চতুর্থ সংখ্যা, ১৩৬৬ বাংলা সন।

২৯. A C Gupta (ed.) Studies in the Bengal Renaissance, Jadavpur, 1958, pp. 16-32; Gautam Chattopadhyay (ed.), Awakening in Bengal in Early Nineteenth Century (Selected Documents), vol. I, Calcutta, 1965, vide Introduction and other papers.

৩০. অক্ষয়কুমার দত্ত, ‘পল্লী গ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা’, দ্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বৈশাখ, ১৭৭২ শক

৩১. ওই, শ্রাবণ, ১৭৭২ শক

৩২. ওই, অগ্রহায়ণ, ১৭৭২ শক

৩৩. রামগোপাল সান্ন্যাল, হিন্দু পেট্রিয়টের ভূতপূর্ব সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের জীবনী, কলিকাতা, ১৮৯০, পৃষ্ঠা : ১৯

৩৪. ওই, পৃ. ২০। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন-এর কার্যসভার বিবরণে যাদের নাম এই সময়ে পাওয়া যায় তা এখানে উল্লেখ করা হল : রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, সভাপতি; রাজা কালীকৃষ্ণ দেব বাহাদুর, সহ-সভাপতি; রাজা সত্যচরণ ঘোষাল (ভূকৈলাসের রাজা), বাবু হরকুমার ঠাকুর (মহারাজা যতীন্দ্রকুমার ঠাকুরের পিতা), বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর (যতীন্দ্রকুমার ঠাকুরের খুড়া), রাজা রমানাথ ঠাকুর (যতীন্দ্রকুমার ঠাকুরের খুড়া), বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (উত্তরপাড়ার জমিদার), বাবু আশুতোষ দে, বাবু হরিমোহন সেন (নরেন্দ্রনাথ সেনের পিতা), রামগোপাল ঘোষ, বাবু উমেশচন্দ্র দত্ত, বাবু কৃষ্ণকিশোর ঘোষ, বাবু জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, শম্ভুনাথ পন্ডিত (হাই কোর্টের জজ), বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (পরে রাজা), সম্পাদক; দিগম্বর মিত্র, সহকারী সম্পাদক। [ দ্র ওই ]

৩৫. মন্মথনাথ ঘোষ, কর্মবীর কিশোরী চাঁদ মিত্র, কলিকাতা, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৯৯-১০০, ১১০

৩৬. ওই, পৃ: ১১০

৩৭. Files of Hindoo Patriot. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জীবনের কয়েকটি বিশেষ দিক আলোচনার জন্য দ্র হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, ‘হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়’ প্রবন্ধ, মন্দিরা, ভাদ্র, ১৩৬২ বাংলা সন, পৃ: ২৮৩-২৯১

৩৮. ‘Lattyalism in Bengal’, in The Hindoo Patriot, April 9, 1857.

৩৯. ‘The condition of the Ryot in Bengal’, in the Hindoo Patriot, April, 16, 1857.

৪০. Nobin Kristo Bose, ‘The Landed Tenure in Bengal in the Procedings of the Bethune Society’, For the Sessions of 1859-60, 1860-61, Calcutta, 1862, pp. 45-74

৪১. Transactions of the Bengal Social Science Association, 1867-1871, Calcutta (The first session of this Association was held in July, 1867); Files of Amrita Bazar Patrika, বঙ্গদর্শন, সোমপ্রকাশ, সাধারণী, Bengal, Magazine (1872-1882) ইত্যাদি।

৪২. Ibid; Roots of Separatism, pp. 77, 104

৪৩. সাধারণী (১৮৭৩) পত্রিকার ফাইল দ্রষ্টব্য

৪৪. Files of Hindoo Patriot (1861-1884); Ramgopal Sanyal, The Life of Babu Kristo Das Pal, Calcutta, 1887, pp. 115, 167

৪৫. গ্রামবার্ত্তা প্রবেশিকা (১৮৭২-১৮৭৪) পত্রিকার ফাইল; কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার, হরিনাথ গ্রন্থাবলি (প্রথম ভাগ), কলিকাতা ১৩০৮; জলধর সেন, কাঙ্গাল হরিনাথ, কলিকাতা (বৎসর ?)।

৪৬. Sanjib Chandra Chatterjee, Bengal Ryots; their rights and liabilities, Calcutta, 1864.

৪৭. Ibid. এই গ্রন্থখানি রচনার পর সঞ্জীবচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ পান। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘একদিন এই পুস্তক হাইকোর্টের জজদিগের হাতে হাতে ফিরিয়াছে।’

৪৮. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ কলিকাতা, ১৯৫৭ (সাধন চট্টোপাধ্যায় কতৃক মুদ্রিত ও সম্পাদিত), পৃ: ৪-৫, ৮৪-৮৫

৪৯. ওই, পৃ: ৮৪-৮৫

৫০. ওই

৫১. ওই ; Roots of Separatism, pp. 51-52

৫২. Romesh Chunder Dutt, The Peasantry of Bengal, Calcutta, 1874, pp. 52-53, 55, 74, 77-78, 80. এই গ্রন্থ থেকে রমেশচন্দ্র দত্তের কিছু মন্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা হল : ‘Four scores of years have rolled away since the Permanent Settlement,—what fruits have these eighty years of active legislation borne for the poor ryot ? … Commerce has thriven, but commerce to them is practically forbidden, and if agriculture has been extended, the Zemindars and not the ryots reap the blessings… Lord Cornwallis was succeeded by Lord Wellesly as the Governor General of India, and as if to mock the misfortunes of the peasantry he passed coercive measures to subject the persons and property of the peasantry to the tender mercies of the Zemindar! … Despatch after despatch came from the Court of Directors, minute after minute was written by Governors-General, measure after measure proposed, rejected, and proposed again, enquiries set on foot, regulations multiplied beyond number,—and all for the protection and welfare of ryots. And yet the fatality which seemed to hang over the spirit of English legislation ever since Warren Hastings left India, rendered every proposal ineffectual, every attempt abortive.’ (Ibid, pp. 52-53, 55)

৫৩. R C Dutt, Famines in India, Calcutta, 1900. এই গ্রন্থে রমেশচন্দ্র দত্ত লেখেন : ‘If the object of the Permanent Settlement of 1793 was to create a thoroughly loyal class of landlords and a prosperous class of peasantry in Bengal, that object has succeeded beyond all expectation.’

৫৪. R C Dutt, The Economic History of India under Early British Rule, London, 1901. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সমর্থন করে এই গ্রন্থে রমেশচন্দ্র দত্ত যে-মন্তব্য করেন তা এখানে উদ্ধৃত করা হল : ‘Since 1793 there has never been a famine in permanently settled Bengal which has caused any serious loss of life. In other parts of India, where the land-tax is still uncertain and excessive, it takes away all motives for agricultural improvements and prevents saving and famines have been attended with the deaths of hundreds of thousands, and sometimes of millions. If the prosperity and happiness of a nation be the criterion of wisdom and success, Lord Cornwallis’s Permanent Settlement of 1793 is the wisest and most successful measure which the British nation has ever adopted in India.’

ভূমি ব্যবস্থা, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে, রমেশচন্দ্র দত্ত ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ভাইসরয়কে যেসব পত্র লেখেন তা নিয়ে সরকারি মহলে দীর্ঘ আলোচনা চলে। অবশেষে ভারত সরকার ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি সরকারের ভূমি রাজস্ব নীতি নির্ধারণ করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ১৮ জানুয়ারি এই প্রস্তাবটি Gazette of India-তে প্রকাশিত হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে একটি গ্রন্থে এইসব বিষয় বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়। এই গ্রন্থখানি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। (দ্র. Land Revenue Policy of the Indian Government, Calcutta, 1920).

৫৫. Abhoy Charan Das, Indian Raiyat, Land Tax, Permanent Settlement and the Famine, Calcutta 1881; Tarini Das Banerjee, Zamindar and Raiyat of Bengal, Calcutta, 1883.

৫৬. ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস, তৃতীয় ভাগ, চুঁচুড়া, ১৩১০ সাল, পৃ: ২৬, ৩৪, ৫৬

৫৭. PBLC 1883-1902; Ram Gopal Sanyal, op. cit., p. 167; Sufia Ahmed, op. cit., p 111. রাজা পিয়ারীমোহন মুখার্জির ভূমিকা আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য Nilmani Mukherjee, A Bengal Zamindar, Calcutta, 1975

৫৮. Files of Hindoo Patriot (1855-1859); Report, vol. III, p. 170; K K Dutta. The Santal Insurrection of 1855-57, Calcutta, 1940; S B Chaudhuri, Civil Disturbance during the British Rule in India (1765-1857), Calcutta, 1955; P C Joshi, Rebellion 1857; a sympostium, New Delhi, 1957, সুকুমার মিত্র ১৮৫৭ ও বাংলাদেশ, কলিকাতা, ১৯৬০।

৫৯. Report, vol. III, pp. 126-128

৬০. Ibid.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *