ঋজুদার সঙ্গে, রাজডেরোয়ায়

ঋজুদার সঙ্গে, রাজডেরোয়ায় — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

যাক। এতদিন বাদে আমার ইচ্ছা সফল হল।

ভটকাই বলল।

 তিতির বলল, আমার কিন্তু ভারী মন খারাপ লাগছে। আজকাল সব জায়গাতেই তোমরা আমাকে না নিয়েই যাচ্ছ রুদ্র।

আমি বললাম, দুঃখটা তো আমার। তুমি আমার আফ্রিকার পার্টনার। তখন এই ভটকাই ছিল কোথায়? আফ্রিকার রুআহার অভিযানের শেষে আমি ঋজুদার কাছে ভটকাইয়ের হয়ে ওভাবে হাতে পায়ে ধরে উমেদারি না করলে ঋজুদা কি কোনওদিনও নিত সঙ্গে ভটকাইকে? তুমি তো সাক্ষী আছ তিতির। আর আজকাল তুমি নিজেই সঙ্গে যেতে না-পারায় ক্রমেই এই বেঁটে-বক্কেশ্বর মাথায় চড়ে বসছে। তোমার ধারণা নেই, কী বাড় বেড়েছে ওর। আমার মতো সম্ভবত আর কেউই বোঝে না যে বাঙালির ভাল করতে নেই। কখনওই।

ভটকাই মনোযোগ দিয়ে একটা বেগনেরঙা ডটপেনের সামনেটা ওর বাঁ কানের ফুটোতে ঢুকিয়ে ডান চোখ বন্ধ করে কান চুলকোচ্ছিল।

এই বাজে অভ্যেস থেকে আমরা কেউই ওকে নড়াতে পারিনি, এমনকী ঋজুদার বকুনিও পারেনি।

ভটকাই ডটপেনটা কান থেকে বের করে বলল, আরে ক্যালি লাগে, ক্যালি! আমার ক্যালি না থাকলে কি আর মিস্টার ঋজু বোস এমনি এমনি আমাকে এত ইম্পর্ট্যান্স দিত। আমার ক্যালিটা অ্যাপ্রিসিয়েট করার মতো কলজে তো তোদের নেই! তাই…

এমন সময়ে ঋজুদা বসবার ঘরে এল। শোবার ঘরে গেছিল ই-মেইল দেখতে। বলল, কীসের ক্যালি? কার ক্যালি?

ভটকাই চকিতে কথা ঘুরিয়ে বলল, ক্যালি নয় কালী।

কালী?

হ্যাঁ, ট্রাঙ্গুলার পার্কের কাছে ডাকাতে কালীর কাছে পুজো দিয়ে আসার কথা বলছিল রুদ্র। কালই তো সকালে আমাদের যাওয়া। নাকি?

আমরা ওর উপস্থিত কুবুদ্ধিতে সকলেই একসঙ্গে হেসে উঠলাম।

ঋজুদা বলল, হলটা কী?

ভটকাই বলল,

 গুরুজি চিতং
মেরা সারংমে বাজিছে
নয়া নয়া রং।

আবারও হাসির হররা উঠল।

ঋজুদা বলল, দোষ তো আমারই। ওকে যে এতখানি বাড়তে দিয়েছি সে তো আমারই দোষ। ও এখন আমাকে নিয়েও ইয়ার্কি মারতে শুরু করেছে।

আমি বললাম, তুমি শুধু পারমিশানটা দাও একবার, তারপর দেখ হাউ ডু আই। কাট হিম টু হিজ ওন সাইজ।

ঋজুদা বলল, হবে, হবে। যথাসময়ে সব হবে।

 তারপর বলল, এ কী! তোরা চা খাসনি? নাঃ গদাধরা সত্যিই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।

তিতির বলল, না ঋজুকাকা। গদাধরদার দোষ নেই। ট্রেতে সাজিয়ে গুছিয়ে গদাধরদা তো চা নিয়েই এসেছিল। কিন্তু তোমার নতুন চেলার জিভে এই সাজ কোম্পানির বিস্কিট বিস…কুলোচ্ছে না।

সে কী! এত ভাল বিস্কিট তৈরি করেছেন বলে আমি তো মিঃ পালকে কনগ্রাচুলেট করে ফোন করেছি আজ সকালেই। ছেলেবেলাতে খাওয়া হান্টলিপামার বিস্কিটের মতো স্বাদ-গন্ধ একেবারে। ব্রিটানিয়াকে রীতিমতো ঘেবড়ে দিয়েছে। সেই বিস্কিটও তোর ভাল লাগল না। কী রে ভটকাই?

লাগবে কী করে। লেড়ো আর ভুসভুসি বিস্কিট খাওয়া যার অভ্যেস, তিতিরের কুকুর ম্যান্ডি যা খায় আর কী, তার ভাল বিস্কিট রুচবে কী করে!

ঋজুদা ঝগড়া আর বাড়াতে না দিয়ে বলল, ব্যাপারটা খোলসা করে বলই না?

অন্যায় কী করেছি? আমি বাঙালির ছেলে, বাঙালি খাওয়া-দাওয়াই আমার পছন্দ।

এই সাজ বিস্কিট কোম্পানিও তো বাঙালিরই!

আমি বললাম।

ব্যাপার হল, তিতির বলল ব্যাখ্যা করে, ভটকাই গদাধরদার কাছে লাউভাজা খেতে চেয়েছে। শুধু লাউভাজাই নয়, ক্যাম দিয়ে তার মধ্যে পোন্ত আর কাঁচালঙ্কা কুচি ফেলে সরষের তেলে কড়া করে ডিপ-ফ্রায়েড লাউভাজার অর্ডার দিয়ে সে বসে আছে। লাউ ভাজা না হলে চা খাবে না। আমাদেরও খেতে দেবে না।

তা খাই না বাবা। ও গদাধরদাকে নিজের শাশুড়িকে মতো আপন মনে করে যদি একটু-আধটু আবদার করেই, তোদের তাতে গায়ে লাগে কেন?

তিতির বলল, তা ঠিক রুদ্র। যার জীবনে সত্যিকারের শাশুড়ি কোনওদিন হবে না, সে না হয় গদাধরদাকে দিয়েই শখ পূরণ করুক। একটু উদার হওয়াই না হয় যাক।

ঋজুদা বলল, এক নতুন ফ্যাচাং হল। বুঝলি।

কী?

আমরা সকলেই একসঙ্গে বললাম।

 তোরা আসার একটু আগেই কাজমি সাহেব ফ্যাক্স করেছেন।

 কাজমি সাহেব কে?

এস ই এইচ কাজমি।

 হ্যাঁ। কিন্তু কে তিনি?

 আরে বহু দিন বিহারের পালাম সাউথ ডিভিশনের ডি এফ ও ছিলেন। এখন উনিই তো হাজারিবাগের ডি এফ ও। কী করে জানতে পেরেছেন জানি না যে আমরা রাজডেরোয়ার জঙ্গলে হারহাদ বাংলো বুক করেছি, সম্ভবত ফরেস্ট অফিস থেকেই জেনেছেন, জেনেই এই ফ্যাক্স। সত্যি! কোথাও যে গিয়ে নিরিবিলি ছুটি কাটাব তা বোধ হয় আমার কুষ্টিতে লেখেনি। মনে আছে রুদ্র, এই হাজারিবাগ জেলারই মুলিমালোঁয়াতে বেড়াতে গিয়ে ‘অ্যালবিনো’ বাঘের ঝক্কিতে পড়ার কথা?

মনে আবার নেই?

কী হয়েছে ঋজুকাকা?

আরে রাজডেরোয়াতে নাকি চোরাশিকারি আর কাঠচোরেদের দৌরাত্ম্য ভীষণই বেড়েছে। আমি যখন সেখানেই যাচ্ছি, আমার সাহায্য চান উনি।

তোমাকে চেনেন উনি?

ঋজুদা হেসে বলল, হ্যাঁ চেনেন। সেই প্রথম পরিচয়ের গল্প বলব এখন তোদের পরে। পালামৌতেই হয়েছিল প্রথম পরিচয়।

তা এতে ফ্যাচাংটা কীসের?

না, ভেবেছিলাম খালি হাতে দু’ হাত দু’দিকে ঝুলিয়ে আরামে যাব আর কুসুমভা থেকে আসোয়া বা নাগেশ্বরোয়ার কোনও পোতাকে জিপ পাঠিয়ে আনিয়ে ভাল করে সর্ষপ তৈল মর্দন করে শরীরটাকে একটু জুতসই করে নেব, তা না, কী ঝামেলা।

কী নেব সঙ্গে?

 আমি বললাম।

ভটকাই বলল, খালি হাতে গেলে হয় না? তুমি বলবে শেয়াল পণ্ডিতের মতো, ঝপাংটা দাও এখুনি ওকে ভতাং করছি।’

ঋজুদা বলল, সত্যি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনি বইয়ের কোনও বিকল্প পৃথিবীর সাহিত্যেই হয়তো নেই, অথচ উনি বাংলা ভাষায় লিখতেন শুধুমাত্র সেই কারণেই তাঁর প্রাপ্যর কিছুই পেলেন না। মাঝে মাঝে ভাবি, এত পয়সাওয়ালা, খেতাবওয়ালা, ডিগ্রি আর প্রাইজওয়ালা বাঙালি হলেন আজ পর্যন্ত অথচ বাংলা বই অনুবাদ করে তা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও কেউই করলেন না। ইচ্ছে হয় ঝপাংটা নিয়ে তাদেরই ভতাং করে দিয়ে আসি।

তোর ডাবল ব্যারেল শট গানটা নিবি। পয়েন্ট টু টু পিস্তলটাও। জাইস-এর বাইনাকুলারটা। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ। আমেরিকান। বন্ড-এর, আছে তো? না সেটিকেও খুইয়েছ?

এখন তো কাঁদলেও আর পাওয়া যাবে না ওসব জিনিস।

ভটকাই ফুট কাটল।

প্রচণ্ড রাগ হল আমার। হাবভাব তার এমনই যেন, সে এসব বিষয়ে সবজান্তা। দুদিনের বৈরাগী, ভাতকে কয় অন্ন।

আমি বললাম, এখন ওসব অ্যান্টিক হয়ে গেছে। এখন আলট্রাভায়োলেট বাইনাকুলার। ঋজুদার আছে। অবশ্য স্পেশাল পারমিশান আছে বলেই আছে। নইলে তোর-আমার কাছে পেলে আমাদের সঞ্জয় খান করে দেবে।

মানে?

মানে, পুরে দেবে গারদে?

এ দূরবিন পেয়েছিল সঞ্জয় খানের বাড়িতে?

দূরবিন নয় ইডিয়ট তার বাড়িতে এ কে ফর্টিসেভেন রাইফেল পেয়েছিল। খবরের কাগজটাও কি পড়িস না?

এখন আর কোনও খবরের কাগজ আছে নাকি? সবই তো বিজ্ঞাপনের কাগজ, Admag। অনেকে বলেন, কী করব! আমাদের অব্যেস হয়ে গেছে। সকালে উঠে না পড়লে বাদরুমই…। তা আমি তাঁদের বলি, ছাইভস্ম পড়ে মেজাজ খারাপ করার দরকার কী? তার চেয়ে ইসবগুল, মানে, ভুসি, খেলেই হয়। সস্তাও পড়বে অনেক।

ওই সবই লিস্টেড আর্টিকেল। প্রহিবিটেড। বেআইনিভাবে কেউ রাখলেই কালাপানি।

দূরবিন আবার দোষ করে কী করে?

করে। কারণ ওই দূরবিন দিয়ে অমাবস্যার রাতেও স্পষ্ট দেখা যায়।

 ইস। আমার যদি একটা থাকত রে!

ভটকাই প্রচণ্ড আপসোসের সঙ্গে বলল।

 কী করতিস?

আরে! পাশের বাড়ির ভুতোদের রান্না করে যে লোকটা, সোঁদরবনের হরিদাস, সে বাড়ির কাজের মেয়ে, মেদিনীপুরের ডেবরার সৌদামিনীকে ছাদে দাঁড়িয়ে…

নাঃ। কোনওই মানে হয় না। এই জন্যেই তোর রেজাল্ট এরকম খারাপ হয়েছে এবারে। দাঁড়া। তোর মাকে ঘটনাটা বলতে হবে। হরিদাস অ্যান্ড সৌদামিনী দেখলে নাম্বার পাবে কী করে পরীক্ষায়! তুই তার চেয়ে গদাধরদার আর্টিকেলড ক্লার্ক হয়ে যা। রান্না করাটাও আজকাল এ দেশে ফালতু প্রফেশন নয়।

আমি বললাম।

তোরা আজকাল বড্ড আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে কথাবার্তা বলছিস। বড় বেশি ট্রিভিয়াল। তোদের চরিত্রেরও দেখছি অনেক অবনতি হয়েছে।

তারপরই বলল, আমাকে একবার বেরোতে হবে। লাউভাজা হওয়া অবধি অপেক্ষা করলে চলবে না।

তিতির বলল, ভটকাইকে, দেখলে তো তোমার জন্যে ঋজুদার চা-টাও খাওয়া হল না।

ঋজুদা বলল, ছাড় তো। যেখানে যাচ্ছি সেখানেই চা খেয়ে নেব। শুনে রাখ যা বললাম। সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের ভাষাতে যার যার মাল জান’ সঙ্গে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাবি। ভেস্টিবল কটায় দেবে? কত নাম্বার প্ল্যাটফর্মে দেবে? তা জেনে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করবি। আর আমি যদি আগেই পৌঁছে যাই তবে পার্কিং লট-এ গাড়ি খুঁজে নিবি। গাড়িতেই এসে তখন বসবি দয়া করে। ট্রেন লাগলে তারপর না হয় একসঙ্গেই ট্রেনে ওঠা যাবে।

কোডারমাতে কটায় পৌঁছব আমরা ঋজুদা? সেদিনই পৌঁছব তো!

অবশ্যই কালকেই। তবে ঠিক কটায় জানি না। বিকেল-বিকেলই হবে।

তারপর বলল, গাড়িতে দুপুরে খাওয়ার জন্যে গদাধরদা হট-কেসে খাবার দিয়ে দেবে। শুকনো শুকনো কিছু দিতে বলিস। তোদের যা খুশি। বেতের বাস্কেটে নন-ব্রেকেবল ডিশ, কাঁটা, চামচ, ন্যাপকিন সব গুছিয়ে দিতে বলিস গদাধরকে। যদিও সে জানেই। আর জলের গ্লাসও। পেপার ন্যাপকিন বেশি করে দিতে বলিস, জঙ্গলে কাজে লাগবে। কী খাবার নিবি, তা রুদ্র তুই আর ভটকাই মিলে ঠিক করে দিস আজই চলে যাওয়ার আগে।

তারপর বলল, চল তিতির, তোকে নামিয়ে দেব। তোদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছি।

তুমি কি একা একা আমাদের ফেলে ডাকাতে কালীর কাছে পুজো দিতে যাচ্ছ নাকি? ভটকাই উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।

ঋজুদা বলল, তোর বিনাশের জন্যে প্রার্থনা করতে কি তোকেই সঙ্গে নিয়ে যাব?

ভটকাই অপ্রতিভ হয়ে মুখ নামিয়ে নিল। আমি আর তিতির জোরে হেসে উঠলাম।

ঋজুদা বলল, তুই সত্যিই রুদ্র আর তিতিরকে সব সময়েই সুপারসিড করতে চাস আজকাল।

নিজে যারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়; পড়িসনি ছোটবেলায়?

আমি তো এখনও ছোটই আছি ঋজুদা।

বলে, ভটকাই রীতিমতো সারেন্ডার করল।

অনেক অনেকদিন পরে ভটকাইকে ঋজুদা একটু টাইট দেওয়ায় খুব আনন্দ হল আমাদের।

.

কোডারমা স্টেশনে যখন আমরা ট্রেন থেকে নামলাম তখন বিকেল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। তবে সন্ধে হতেও অনেক দেরি। ট্রেনটা চলে গেল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ঋজুদা বলল, ওই যে অমলবাবু। উনি কিন্তু খুবই পীড়াপীড়ি করবেন রাতটা তিলাইয়ার দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের বাংলোতে কাটিয়ে যাওয়ার জন্যে। ডি ভি সি-র ইঞ্জিনিয়ার সেন সাহেবেরও তাই ইচ্ছে। কিন্তু এপ্রিলের গোড়ার একটি দিন বা রাতও জঙ্গলের এত কাছে এসেও জঙ্গলে না কাটাবার মানে হয় না। আসাই তো মাত্র তিন দিনের কড়ারে।

ভটকাই বলল, তিলাইয়া ড্যামের ওপরে বাংলোগুলো শুনেছি দারুণ।

তোকে কে বলল?

আমার মেজোমামার সেজো শালি ফুটুস দিদি বিয়ের পর হানিমুন করতে এসেছিল এখানে।

তা তুইও যখন হানিমুন করতে আসবি থাকিস না হয় এখানে।

ভটকাইয়ের এতা কাব, ওতা কাব, থব খাব’ অ্যাটিচুডটার কানে থাপ্পড় মারল ঋজুদা। খুব খুশি হলাম আমি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, অমলবাবু কে?

অমলবাবু এখানের পোস্টমাস্টার। আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল যখন এলাহাবাদে নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে গেছিলাম তখন। খুব সাহিত্যপ্রীতি ভদ্রলোকের। নিজেও লেখালেখি করেন। হাজারিবাগেরই বাসিন্দা।

তা এখানে কেন উনি?

বা, কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি। এখন এখানে বদলি হয়ে এসেছেন।

তারপর বলল, যেখানে এখন তিলাইয়া বাঁধ হয়েছে, মস্ত জলাধার তারই পাশে ছিল একটি গ্রাম। তার একাংশ অবশ্য আছে এখনও। নাম ঝুমরি তিলাইয়া।

কী নাম?

ভটকাই শুধল।

 ঝুমরি তিলাইয়া।

 বাঃ! কী সুন্দর নাম!

ঝুমকা গিরা রে। ঝুমকা গিরা রে। ঝুমকা! ঝুমকা! ঝুমকা গিরা রে/
বেরিলিকা বাজারমে ঝুমকা গিরা রে।

এ আবার কী গান! হিন্দি সিনেমার পোকা হয়েছিস দেখছি।

 হায়। হায়। ঋজুদা। এ কী আজকের গান। এ গান যখন বাজারে আসে তখন আমি হামাগুড়ি দিচ্ছি।

তুমি তখনও হামাগুড়ি দিচ্ছ।

আমি হেসে উঠলাম। সঙ্গে ঋজুদাও।

নমস্কার। ধুতি ও সাদা ফুল শার্ট পরা অমলবাবু হাত জোড় করে নমস্কার করলেন ঋজুদাকে। ঋজুদাও প্রতিনমস্কার করল।

থাকবেন তো একটা রাত। আজ শুক্লপক্ষের সপ্তমী। চৈত্র মাস। চাঁদটা যখন উঠবে তখন যা সুন্দর দেখাবে না তিলাইয়ার বাঁধের জল। লক্ষ লক্ষ রুপোর সাপ কিলবিল করবে।

ঋজুদা বলল, আমি যদি একা আসতাম তা হলে এখানেই ডেরা গাড়তাম। তিলাইয়া বাঁধের মাছ, রাতের রূপ, নৌকা চড়ে বেড়ানো। কিন্তু আমি তো এবারে মাইনরিটি। এদের ইচ্ছা সোজা জঙ্গলে যাওয়া। তা ছাড়া কাজমি সাহেব সেলাম দিয়েছেন। রাজডেরোয়াতে নাকি চোরাশিকারিরা হুজ্জত করছে। জানি না, তারা কী মারতে এসেছে। রাজডেরোয়াতে চিতল হরিণ, চিতা, ক্কচিৎ শম্বর, কিছু শুয়োর আর বেশ কিছু নীলগাই ছাড়া আর কী প্রাণী আছে? বাঘ তো আমরা ছেলেবেলাতে যা দেখেছি ওই। তারপরে খুব কম মানুষই বাঘ দেখেছেন ওখানে।

তা ঠিক। তবে চোরাশিকারিরাই জানে কী মারতে আসে তারা। কাঠশিকার করতেও আসতে পারে।

তা ঠিক। গেলেই জানা যাবে।

আপনারা উঠবেন কি শালবনিতে?

না, না। আমরা হারহাদ নদীর ওপরে যে ছোট্ট বাংলোটা আছে সেই হারহাদ বাংলোতেই উঠব।

রাস্তা কি ভাল হয়েছে? আমরা একবার এক বাসন্তী পূর্ণিমাতে পিকনিক করতে গেছিলাম। ট্রাকে করে। ট্রাকের অ্যাক্সেলই ভেঙে গেল।

হেসে ফেলল ঋজুদা, অমলবাবুর কথা শুনে।

 তারপর বলল, শুনেছি সাম্প্রতিক অতীতে হাজারিবাগ থেকে হারহাদে ঢোকার একটা রাস্তা হয়েছে। সেই নন্দী-ভৃঙ্গীর মতো পাথরগুলো পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না আর এখন।

তাই? যদি তাও হয়ে থাকে, তা হলেও জঙ্গলের ভিতরের পথ দিয়ে না গেলে তো হারহাদে যাওয়ার মজাই নেই।

ঠিক তাই। তবে আমাদের তো ছখানি পা আছে। হেঁটেই ঘোরাফেরা করব। তা ছাড়া কাজমি সাহেব একটা জিপেরও বন্দোবস্ত করেছেন, সেটি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এসে নদীর পাশেই মজুত থাকবে আমাদের জন্যে। আজকে যাওয়ার সময় অবশ্য নতুন রাস্তা দিয়েই যাব।

আপনাদের জন্যে একটা বড় রুইমাছ বন্দোবস্ত করে রেখেছিলাম। যাবেনই যখন তখন সঙ্গেই নিয়ে যান। জঙ্গলে তো আর মাছ পাবেন না।

অমলবাবু বললেন।

না, তা পাব না। কিন্তু কী দরকার ছিল? সব জায়গাতে যে সব কিছু পেতেই হবে তার কী মানে আছে।

তা নেই। তবু, আমাদের আনন্দ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।

কত দাম পড়েছে?

ঋজুদা হিপ পকেট থেকে পার্স বের করে বলল।

 ছিঃ ছিঃ ঋজুবাবু। অমন করে লজ্জা দেবেন না। আপনার চেনা এই রুদ্র রায়ের লেখা ‘ঋজুদা কাহিনী’গুলি তো এখানের এবং রেললাইনের ওপারের কোডারমা ও শিবসাগরের যত বাঙালি পরিবার আছে তাদের বড়-মেজো-ছোটরা সকলেই গোগ্রাসে গেলে। কথা ছিল, কাল সকালে আপনাকে একটা সংবর্ধনা দেবেন ওঁরা সকলে মিলে। ওঁরাই এই মাছ কিনেছেন।

দেখেছিস!

ঋজুদা লজ্জা, ভালা লাগা, কৃতজ্ঞতা, বিনয় সব কিছু মিলিয়ে একটা গুটকা করে তা গিলে বলল!

তারপর বলল, এই রুদ্র রায়ই আমার এই সব বিড়ম্বনার কারণ। ওকে এবারে এইসব লেখালেখি বন্ধ করতে বলতে হবে।

ছিঃ। ছিঃ। অমন বলবেন না! তাহলে আমরা সকলেই বড় বঞ্চিত-হব। তা ছাড়া রুদ্র রায়ের ঋজুদা কাহিনী’ পড়ে বাড়ি বসে আমরা কত জায়গাতে যেতে পারি, কত অ্যাডভেঞ্চারের শরিক হই। তা ছাড়া রুদ্র রায়ের লেখা তো গল্পের গোরু গাছে চড়ার মতো নয়। প্রত্যেকটি জায়গার ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক পরিবেশের এবং প্রতিবেশের বর্ণনা এমন নিখুঁত এবং সত্যনির্ভর থাকে যে, আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু শেখাও যায়। বাংলাতে যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার বা গোয়েন্দা কাহিনী বা শিকার কাহিনী এতদিন লিখে এসেছেন এবং আজও লেখেন তাঁদের মধ্যে নিরানব্বই ভাগই বন্দুকের সঙ্গে রাইফেল, পিস্তলের সঙ্গে রিভলভারের তফাতই জানেন না। তাঁদের গোয়েন্দারা রিভলভার’ হাতে মঞ্চে ঢোকেন এবং পরক্ষণেই ‘কোথা হইতে কী হইয়া যায়। তাঁদের হাতের ‘পিস্তল’ গজাইয়া ওঠে। যে লেখক যে বিষয় নিয়ে লিখবেন সেই বিষয় সম্বন্ধে ফাস্ট-হ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স না থাকলে তা না লেখাই ভাল। কল্পনা দিয়ে কি সব ঘাটতির পূরণ হয়? তাই যদি হত, তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঐকতান’ কবিতাতে লিখতেন না তাঁর আক্ষেপের কথা। তাঁর মতো যাঁর কল্পনাশক্তি ছিল তাঁর পক্ষে কি যা তিনি ফাস্ট-হ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্সে জানতেন না তা নিয়ে লিখতে পারতেন না? খুবই পারতেন। কিন্তু তাঁর মতো প্রতিভারও সেই সংযম জ্ঞানটি ছিল।

ঋজুদা বলল, আপনি সাহিত্যবোদ্ধা, নিজে লেখক, কত কী জানেন আপনি। সত্যি! দেখ রুদ্র, কত কী শেখার আছে অমলবাবুর কাছ থেকে।

একটু চুপ করে থেকে অমলবাবু বললেন, অবশ্যই লিখে যাবেন রুদ্রবাবু। কারণ অভিজ্ঞতার কোনও বিকল্প নেই। আপনি লেখেন বলেই না আমরা ভারতবর্ষের কত না রাজ্যর কত বন-জঙ্গল-নদী-পাহাড়ের কথা তো বটেই, ভারতের বাইরেরও, যেমন আফ্রিকার, স্যেশেলস-এর পটভূমিতেও নানা লেখা পড়তে পাই।

ঋজুদা বলল, ওকে মানা করি আমি ওসব লিখতে।

কেন ঋজুবাবু?

 অমল সেনগুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন।

আরে আমাদের নিজের দেশের মতো বড়, বিচিত্র ও সুন্দর দেশ কি আর পৃথিবীতে আছে অমলবাবু? নিজের দেশের কথাই বেশি করে লিখে দেশের মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা জরুরি। আমরা নিজের দেশ, নিজের দেশের মানুষ, বন, পাহাড়, নদীনালাকে জানি না বলেই অশিক্ষিত, নতুন এবং পুরনো বড়লোক হামবাগদের মতো কথায় কথায় বিদেশে দৌড়ে যাই, ফিরে এসে গরিব আত্মীয়-বন্ধুদের নানা গল্প করে তাদের মন খারাপ করে দেব বলে। যে মানুষ বিদেশে গিয়ে নিজের দেশের সঙ্গে সে দেশের তুলনাই না করতে পারেন তাঁর বিদেশ যাওয়াই তো বৃথা। আমার তো তাই মনে হয় অন্তত।

ঠিকই।

তারপর অমলবাবু বললেন, চলুন, কোন গাড়িটা আপনাদের?

 সে তো আমরাই জানি না। চলুন ওদিকে যাই, গেলেই জানা যাবে।

.

একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর পাঠিয়েছিল আমাদের জন্যে নাজিম সাহেবের ছোট ছেলে। এম এ পাস। সৈয়দ মহম্মদ জামালুদ্দিন তার নাম। হাজারিবাগে ওঁদের জুতো এবং গাদা বন্দুকের দোকান আছে। নাজিম সাহেব ঋজুদার খুবই কাছের মানুষ ছিলেন। নওয়াদাতে বাড়ি ছিল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, নওয়াদা জায়গাটা কোথায় ঋজুদা?

রেললাইনের ওপারে কোডারমা। কোডারমা অঞ্চল অভ্র খাদানের জন্যে বিখ্যাত। এখনও অনেক অভ্রর কোম্পানি আছে। রাজঘড়িয়া, সামন্ত এই সব পরিবার, এরা সব বিখ্যাত পরিবার এই ব্যবসায়ে। গিরিডিতেও তাই ছিল। কোডারমা থেকে বিখ্যাত রজৌলির ঘাট পেরিয়ে পাহাড়তলিতে পৌঁছলে পড়বে শিঙ্গার। শিঙ্গারের পরে বিহার শরিফ, নওয়াদা। আবার তারই কাছে জৈনদের বিখ্যাত মন্দির জলের ওপরে, পাওয়াপুরি। দেখবার মতো। সারা ভারতবর্ষে হিন্দু, মসুলমান, জৈন, খ্রিস্টান, শিখ, পারসি, হাজারো আদিবাসী সুখে একই সঙ্গে চিরদিন বাস করে এসেছিল। জিন্না সাহেব অ্যান্ড কোম্পানির মাথাতে যে কী পোকা কামড়াল–মুসলমানদের জন্যে আলাদা দেশ সৃষ্টি করার জেদ কেন যে ধরলেন তাঁরা, তা তাঁরাই জানেন। যেদিন থেকে ভারত ভাগ হল ধর্মের ভিত্তিতে সেদিন থেকেই তার কপাল পুড়ল। এখন যদি ভারতে বসবাসকারী মুসলমানেরা আবারও অন্যায়ভাবে সেই দাবি তোলেন, তবে সে দাবি বরদাস্ত করে নেওয়াটা চরম কাপুরুষতারই নামান্তর হবে।

আমি চুপ করে রইলাম। এসব আমার মাথায় ঢোকে না। তবে কাপুরুষ, সে যে। বিশ্বাসে ভর বা ভর-না-করেই কাপুরুষ হোক না কেন, তাকে আমি ঘৃণা করি। যে মানুষের বুকে সাহস নেই, যার মাথা সটান মেরুদণ্ডের ওপরে বসানো নেই তাকে আমি মানুষ বলে গণ্য করি না, মনুষ্যেতর প্রাণী বলে গণ্য করি। সেই মানুষ বড় সংস্থার চাকুরেই হোক বা সাহিত্যিক বা সাংবাদিক। ঘৃণ্য যে, সে সব সময়েই ঘৃণ্য।

ভটকাই বলল, তুমি অভ্র খাদান দেখেছে কখনও ঋজুদা?

ঋজুদা বলল, সে ব্যাপারে আমি বুক বাজিয়ে বলতে পারি যে সোনা-রুপোর খনি ছাড়া আমি সব খাদানই দেখেছি। কয়লা খাদান, সবরকমের, ইনক্লাইন মাইন, ওপেন-কাস্ট মাইন, পশ্চিমবঙ্গে, বিহারে, আসামে, মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গাতে তামার খনি, ঘাটশিলাতে, মালাখণ্ডে, লোহার খনি, বিহারের সিংভূম জেলাতে, লোহা ও ম্যাঙ্গানিজের খনি, ওড়িশার সুন্দরগড় জেলাতে, বক্সাইটের খনি বিহারের লোহারডাগা, মধ্যপ্রদেশের অমরকন্টকে, আর অভ্র খনি এই অঞ্চলে। পৃথিবীর গভীরতম অভ্র খনি ছিল রজৌলির ঘাটে। ক্রিশ্চিয়ান মাইকা কোম্পানির। কোডারমা থেকে নওয়াদা যাবার পথে ওই ঘাটের প্রায় মাথায়, ব্যাসাল্ট আর কোয়ার্টজাইট পাথরের পাহাড়ে, ঘন শাল ও হরজাই জঙ্গলের মধ্যে। সেই খনিটির নাম ছিল খলকতুম্বি।

কী নাম বললে?

খলকতুম্বি।

তাতে নেমেও ছিলাম। কাঠের জলে-ভেজা সিঁড়ি বেয়ে, কী পিছল। ছেলেবেলাতে জেঠুমনির দৌলতে কিছু ঘুরে নিয়েছি। ক্রিশ্চিয়ান মাইকা কোম্পানি ছিল সাহেবদের। পরে রামকুমার আগরওয়ালা গ্রুপ তা কিনে নেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। অনেক ক্যাপিটালিস্টদের খুব কাছ থেকে দেখে ছেলেবেলাতেই তাদের স্বার্থপরতা, অর্থান্ধতা, ক্ষমতান্ধতা সম্বন্ধে আমার মনে এক গভীর বিরাগ জন্মে গেছে। সে বড়লোক, খনি-মালিক হোক, কি মিডিয়া মালিক। তাদের হাল হকিকত, Modus-operendi আমার খুব ভালই জানা আছে। আর জেনেছি বলেই তাদের প্রতি আমার অনুকম্পা নেই। খাদানে খাদানে মাথা নিচু করা, কয়লা মাখা, গরিব মজুরদের যেমন ছেলেবেলাতে দেখে চোখে জল এসে গেছে, তেমনই সুবেশ, অর্থবান, মেরুদণ্ডহীন সাংবাদিক-সাহিত্যিকদের দেখেও ঘৃণা জন্মেছে। তারাই ক্যাপিটালিস্টদের দাঁত-নখ।

তারপর ঋজুদা বলল, জানিস রুদ্র, মাঝে মাঝে মনে হয়, যাদের অভিজ্ঞতা কম, যাদের মেরুদণ্ড নেই, তারাই সহজে সুখী হতে পারে জীবনে। বেশি জানলে, টান টান মেরুদণ্ড হলে সেই মানুষের পক্ষে এই মনুষ্যেতর প্রাণীতে থিকথিক করা পৃথিবীতে বাঁচাই মুশকিল।

আমি বললাম, মির সাহেবের একটা শায়েরি ছিল না?

কী?

ঋজুদা বলল।

 তারপর বলল, কী? তা বলবি তো!

হিয়া সুরত এ আদম বহত হ্যায়
আদম নেহি হ্যায়।

বাবাঃ। এই নইলে ফেমাস লিটারেটর মিস্টার রুদ্র রায়!

বাঃ। এখানে মানুষের মতো চেহারার জীব অনেক আছে কিন্তু মানুষ নেই।

 ইসি লিয়েই তো জামাল ভাইয়া সব লোগোঁকি লিয়ে রাতমে বিরিয়ানিকি ইন্তেজাম করকে রাখো হুয়ে হ্যায়। মুঝকো বোলিন, কি, যা আপনোগোঁকি উত্বারকে গাড়ি লেকর হাজারিবাগ লওটনে কি লিয়ে। গরম গরম উমদা বিরিয়ানি গুলহার ঔর বটি কাবাব, পায়া ঔর সিনা ভাজা লেক্কার উও খুদ আবেগা আপলোগোঁকি খানা খিলানে কি লিয়ে। উনোনে খুদ হান্ডিসে নিকালকে গরম খানা খিলায়েঙ্গা আপলোগোঁকি। হারহাদ নদীকি ঠাণ্ডা পনিসে নহা লেকর আপলোগ আরাম কিজিয়েগা। হামলোগোঁনেন বজি করিব আ পৌঁছেগা।

ঋজুদা বলল,

বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া,
 কুছ নেহিতো হোড় হোড়া।

 মহম্মদ নাজিমেরই তো ছেলে না!

বরহি হয়ে আমরা তিলাইয়া হ্রদের পাশ দিয়ে এসে বরহি-হাজারিবাগ রোডে পড়েছি। কয়েক মাইল গেলেই হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্কের নতুন বানানো শালপর্ণী। বাঁদিকে ঢুকে যেতে হয়। একটি সুন্দর ঝরনা আছে বাংলো আর গেটের মাঝে। আর ডানদিকে ন্যাশনাল পার্কের গেট। রাজডেরোয়ার গেট। আমরা ওই জায়গা ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে গেলাম। পদ্মার রাজার মস্ত বাড়ি। এখন কী সব সরকারি অফিস হয়েছে, পুলিশেরও হতে পারে। সেটা পেরিয়ে আমরা আরও এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে ঢুকে পড়লাম।

এই সেই নন্দী-ভৃঙ্গীর আকারের পাথর এড়ানো বাইপাস। বুঝলি রে রুদ্র। বাইপাস তো শুধু বুকেরই হয় না, পথেরও হয়।

একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। কিন্তু শুক্লপক্ষ বলে এখনই চাঁদ উঠেছে পুবাকাশে, সূর্য তখনও পশ্চিমে বহাল আছে। সূর্য অস্তমিত হলেই সবচেয়ে আগে উঠবে জ্বলজ্বলে নীলাভ সন্ধেতারাটি। নানা পাখি ডাকছে, মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে, সেই হাওয়াতে সুগন্ধর পিচকিরি ছুটছে। বসন্ত যে এসে পড়েছে, তাতে আর সন্দেহর জোটি নেই।

হারহাদ বাংলোর বারান্দাটা চওড়াতে খুবই কম। নীচ দিয়ে ছুটে চলেছে হারহাদ নালা। নদী না বলে তাকে নালা বলাই ভাল। ঝরঝর ঝরঝর শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন, তবে তেমন স্পষ্ট নয়। বাংলোর পেছনেই ঘর বাড়ি বস্তি ছেলেমেয়ে কুকুর মোরগ। মানুষের বসতির সব ন্যক্কারজনক চিহ্ন পুরোমাত্রাতেই উপস্থিত।

ঋজুদা বলল, আগে জানলে হারহাদে আসতাম না। এই বাইপাস হয়ে যাওয়াতে হাজারিবাগ শহর থেকে সহজে পিকনিক পার্টিরা চলে আসে, বহির দিক থেকেও আসে। গয়াও তো খুব দূরে নয়। বরহি হয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক ধরে এগোলেই তো ডোভি। আর ডোভি থেকে ডানদিকে গেলেই বুদ্ধগয়া আর গয়া।

আর উলটো দিকে গেলে?

উলটো দিকে গেলে চাতরা? মূল পথ থেকে ডানদিকে চলে গেলে হান্টারগঞ্জ প্রতাপপুর-জৌরি। আর সোজা গেলে বানারস।

এসব অঞ্চল তোমার হাতের তালুর মতো চেনা, না ঋজুদা?

ভটকাই বলল।

হাতের তালু বা মায়ের মুখের মতো চেনা মানুষের কোনও কিছুই থাকে না। নিজের বিপদকালে এবং শিশুকালে মানুষ নিজের হাতের তালু আর মায়ের মুখের দিকে যেমন একাগ্রভাবে ভালবেসে তাকায় তেমন কি আর পরে তাকায় কেউ বাছারা! তখন প্রেমিকার বা স্ত্রীর মুখই বেশি চেনা হয়ে যায়। ও সব কথারই কথা। মায়ের প্রয়োজন যত দিন থাকে ততদিন ছেলেরা সব হাম্বা-হাম্বা করে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই টা-টা! বাই! বাই!

তারপরই বলল, সকলেই যা করে তোরা কিন্তু তা করিস না। যে ছেলেরা মায়ের কথা ভুলে যায়, মাকে মনে না রাখে, তারা অমানুষ।

তা তুমি বলছ বটে ঋজুদা, কিন্তু এখন প্রচুর মায়েরা আছেন চারপাশে যাঁরা। ছেলেদের মুখই মনে রাখেন না। যে সব মা ছেলেদের ছেলে বলে না মানেন সেইসব মায়েদের ছেলেরাই বা মা বলে মানতে যাবে কেন।

আমি বললাম, আজ তো Mother’s Day নয়, তবে কেন হারহাদের এই বাংলোতে এত দূর ঠেঙিয়ে এসে রাজডেরোয়ার জঙ্গলে আসলাম তামরা? এসে উঠলাম? কথা একটু কম বল ভটকাই। প্লিজ।

ইতিমধ্যে চৌকিদার সেলিমের সহায়তায় চা নিয়ে এল বারান্দাতে। চা, ছোট ছোট করে কাটা বাখরখানি রোটি আর শিক কাবাব-মুরগির।

আর কালাজামুন। ই ক্যা টাটিঝরিয়াসে মাঙ্গায়া কা কামাল?

নেহি সাহাব, ই হাজারিবাগ টাউন কি বেঙ্গলি সুইটস সে মাঙ্গায়া।

ভটকাই বলল, সবই ভাল। কিন্তু বাইরে এসে চা খেয়ে সুখ নেই। এত চিনি আর এত দুধ দেয় চায়ে।

ঋজুদা হেসে বলল, এ শুধু হাজারিবাগের জঙ্গলেই নয়। এ হচ্ছে ভারতীয় গ্রামীণ ঐতিহ্য। চিনি ও দুধের পরিমাণ যত বেশি হবে তোর প্রতি ভালবাসার প্রকাশও তত বেশি হবে। এই নিয়ম আসমুদ্র হিমাচলের।

তফাত শুধু কাশ্মীরে। সেখানে তো চায়ে চিনির বদলে নুন দেয়।

আমি বললাম।

তাই হয়তো ভালবাসাটা এমন চটকে গেল।

 আমরা হেসে উঠলাম।

সেলিম সেলাম করে বলল, ম্যায় অব চলে হুজৌর। রাতমে কাজমি সাহাব কি ভি খানেমে সামিল হোনেকি বাত হ্যায়। অব দিখা যায়। আপকি বারেমে বহুত কুছ কহতেথে উনোনে।

ক্যা? ছিপানেওয়ালা বাতভি কুছ থা ক্যা?

 ঋজুদা হেসে বলল। তারপর বলল, ফিনকি বারেমে দুসরে বহুত কুছ কহতে হেঁ যব উনোনে খুদ উহা হাজির ন হো, তো শক হোতি হ্যায় কী জরুর কুছ। উলটা-সিধা ভি বোল চুঁকে হেঁ।

নেহি নেহি সাব। বলেই, তওবা তওবা বলার মতো করে সেলিম দু হাতের আঙুল ঠেকাল দু’কানে।

ঋজুদা বলল, ঠিক হ্যায়। আপ আইয়ে।

সেলিম চলে যাওয়ার পরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম পায়ে হেঁটে। ঋজুদা বলল, এই জন্যেই আমার চেনা পরিচিত জায়গাতে আসতে ইচ্ছে করে না আজকাল। এত বেশি খবরদারি, খিদমদগারি, প্যায়েরভি হয় যে নিজের খুশিমতো একা নির্জনতা উপভোগ করাই মুশকিল হয়ে ওঠে। কিছু অবশ্যই ভাল লাগে, কিছুর প্রয়োজনও ঘটে কিন্তু সব সময়ে এত মানুষজন, এত কথা ভাল লাগে না। ভাল তো লাগেই না, সত্যি কথা বলতে কী বিরক্তিই লাগে। এই জন্যেই এমন জায়গাতেই যাওয়া উচিত, যেখানে তাদের কেউই চিনবে না, চেনে না।

ভটকাই বলল, তা তো হবার নয় ঋজুদা। একেই বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা। ঋজু বোস বোরখার আড়ালে মুখ লুকিয়ে না বেড়ালে তাকে তো মানুষে চিনে ফেলবেই, বিশেষ করে পূর্ব ভারতে। এই সব ঝামেলা হয় তোমারই কারণে। আমাদের আর চেনেটা কে!

তারপর বলল, আজকাল তো মিস্টার ঋজু বোসের চেলা দ্য গ্রেট রাইটার রুদ্র রায়ও রীতিমতো ফেমাস হয়ে উঠছে।

আমি বললাম, আমার তো আরও যা-তা লাগে। Reflected glory-তে গর্বিত হয় বাজে টাইপের মানুষেরা। ঋজুদা সেলিব্রিটি, তা আমাকে নিয়ে টানাটানি করা কেন?

কী করবি বল রুদ্র। আজকাল পৃথিবীটাই ভরে গেছে গুচ্ছের বিচ্ছিরি, বাজে টাইপের মানুষে।

হুঁ।

ঋজুদা বলল। তারপর বলল, চা তো খাওয়া হল, এবারে চল একটু হেঁটে আসি। হাত পা তো ধরে গেছে বসে বসে।

যা বলেছ ঋজুদা। আমি বললাম।

 আমরা বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলে। লাল মাটির পথ যেন উড়ান দিয়েছে উড়াল হাওয়াতে। তিতির, বটের এবং ক্কচিৎ ময়ুরের ডাক ভেসে আসছে দিনকে বিদায় জানিয়ে। ছাতারেরা ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ করে দিনকে যা-তা বলছে চলে যাওয়ার জন্যে। কারণ, দিনের সঙ্গেই তাদের নাড়ি বাঁধা। দুটি প্যাঁচা কোটর ছেড়ে বেরিয়ে ঘুরে ঘুরে ওদের মাথার ওপর উড়ে উড়ে ঝগড়া করছে। ঋজুদাএকদিন বলেছিল, ওদের দাম্পত্য কলহের প্রক্রিয়াটা মানুষে রপ্ত করতে পারলে পাড়া-প্রতিবেশীরা রেহাই পেত। দূরের আকাশেই তাদের সব মামলা তারা নিষ্পত্তি করতে পারত। তবে মুশকিল হল এই যে, মানুষ তো উড়তে পারে না।

আঃ কী সুন্দর লাগছে রে রুদ্র। কত বছর পরে রাজডেরোয়াতে এলাম। আমার প্রথম যৌবনের কতগুলো বছর যে এই সব জঙ্গলে দস্যিপনা করে কেটেছে তা কী বলব। গোপাল, লালাদা, সুব্রত, নাজিমসাহেব, ভুতো পার্টি। সে সব দিনের অনাবিল আনন্দর কথা ভোলবার নয়।

ভুতো পার্টিটা কী ব্যাপার ঋজুদা?

সে ব্যান্ড পার্টির সমগোত্রীয়ই বলতে পারিস। তার কথা তো এত সংক্ষেপে বলা যাবে না। সময়-সুযোগ করে বলা যাবে’খন।

জানিস তো! এই যে নাজিম সাহেবের ছোট ছেলে, আমরা এসেছি শুনেই খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করেছে, গাড়ি পাঠিয়েছে, সেই নাজিম সাহেবের প্রতি গোপাল, সুব্রত, লালাদাদের এতই ভালবাসা ও ভক্তি ছিল যে, তাঁর মৃত্যুর পরে কবরখানাতে শ্বেতপাথরের ফলক বসিয়েছেন লালাদা। এখনও যদি কখনও এদিকে আসেন, তবে মোমবাতি জ্বালিয়ে যান কবরের ওপরে। আগামীকাল সকালে আমিও যাব একবার। তোরা কি যাবি?

হাজারিবাগ শহর এখান থেকে কত দূর?

বেশি দূর নয়। বরহি থেকেই প্রায় চল্লিশ কিমি যখন, তখন এখান থেকে তো। আরও অনেকই কম হবে। কাল সকালে তোদের পিচ রাস্তার ওপাশে শালপর্ণীতে নিয়ে যাব। রাজডেরায়ার টাইগার-ট্র্যাপ দেখাব। এই হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে অনেকগুলো ওয়াচ টাওয়ার আছে। এখন সেখানে বসে বন্যপ্রাণী যে খুব দেখা যাবে এমন নয়, তবে বনের প্যানোরমিক ভিউ অবশ্যই দেখা যাবে। হু হু করে হাওয়া বইবে। একবার মে মাসের লু বওয়া দুপুরে পাঁচ নম্বর টাওয়ারের ওপরে বসে ছিলাম দুপুরবেলা।

পাগল নাকি তোমরা!

পাগলই বলতে পারিস। বাজি হয়েছিল গোপাল আর লালাদার মধ্যে। কে জল না খেয়ে, মাথায় টুপি না পরে, চোখে সানগ্লাস না পরে ওই ভরদুপুরে বেশিক্ষণ ওই টাওয়ারের ওপরে বসে থাকতে পারে।

মানে, আমৃত্যু বলছ? ভটকাই বলল।

 বলতে গেলে তাই-ই এরকম।

বাজি কী ছিল?

এক ক্রেট কিংফিশার বিয়ার। গোপাল বিয়ার খেতে খুব ভালবাসত। ওই অত্যধিক বিয়ার খেয়ে খেয়েই ডায়াবেটিসে ধরেছিল শেষে। যাই বল আর তাই-ই বল, দে ওয়্যার গ্রেট গাইজ। যতটুকু শিখেছি, যা শিখেছি–সব ওদেরই কাছ থেকে।

 তা ওঁরা না হয় বিয়ার বাজি রেখে মরতে বসেছিল, তুমি কী করতে ওই আত্মহত্যাকামী দুই পাগলের সঙ্গে রইলে মরতে?

বাঃ। আমিই তো টেনিস খেলার আম্পায়ারের মতন টঙে বসে আম্পায়ারিং করছিলাম। আমাকে ওঁরা দুজনেই ভালবেসে কখনও কখনও বিটকেল বলে ডাকতেন। অমন বিটকেলমি জীবনে করিনি। তারপর দুদিন শুধু ফরেস্ট বাংলোয় রাখা যবের ছাতু জল দিয়ে গুলে গুলে খেয়ে চোখ উলটে পড়েছিলাম। হাজারিবাগের শীত আর হাজারিবাগের গরম–দুই-ই সমান বেশরম। যারা জানে, তারাই জানে।

কিছু কেলো করে নিয়েছ বটে জীবনে!

 ভটকাই বলল।

 তোমরাও কী কম করছ?

 ঋজুদা বলল।

আর ওই কাজমি সাহেব? তার সঙ্গে তোমার আলাপের কথা বলবে বলেছিলে। সেই কথাটি এবারে বলল।

ও হ্যাঁ, আমি গেছি পালামুর মারুমারে। সঙ্গে আমার তিন চেলা। বামাপ্রসাদ, সুশান্ত আর কৌশিক। বামাপ্রসাদ মুখার্জি, কাস্টমসের অফিসার, সুশান্ত ভট্টাচার্য, কলকাতার চিড়িয়াখানার অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর আর কৌশিক লাহিড়ী, ডাক্তার, চর্মবিশেষজ্ঞ। আগে ও আমার চেলা হলে ভাল হত, মানে যে সময়ে শিকার করতাম।

কেন?

আমরা সমস্বরে বললাম, অবাক হয়ে।

আরে, গুলি করার আগে জানোয়ারের চামড়ার কোয়ালিটি সম্বন্ধে ওকে বলতাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসতে। ট্যান করলে দারুণ হবে এমন গ্যারান্টি ও দিলে তবেই বন্দুক-রাইফেলের ঘোড়া দাবতাম।

ভটকাই বলল, তারপর ওঁর চামড়া কে ট্যান করত? জ্যান্ত বাঘের skin inspection-এ গেলে?

সে কৌশিকই বুঝত।

কিন্তু এতদিন তো জানতাম যে, আমরাই তোমার চেলা। এত বছর পরে তুমি বলছ যে ওই তিনজন তোমার চেলা। এটা কি আমাদের পক্ষে সুখের কথা?

আরে বোকা। তোরা তো আমার চামুণ্ডা। ওরা চেলা হোক না গিয়ে। ওরা যে তোদের চেয়ে বয়সে অনেকই বড়, তা ছাড়া ওরা চেলা হয়েছে ঋজু বোসের, তোরই জন্যে, তোরই লেখা পড়ে। বহুদিন ধরে ওদের শখ ছিল আমার সঙ্গে জঙ্গলে যাবে একবার, তাই রাঁচি অবধি ট্রেনে এসে তারপর সোহনলালবাবুর কাছ থেকে একটা গাড়ি নিয়ে ম্যাকলাক্সিগঞ্জ, ডালটনগঞ্জ বেড়িয়ে, বেতলাতে কিশোর-পাপড়ি চৌধুরিদের নইহারে’ দিন তিনেক থেকে মারুমারে এসে উঠেছিলাম।

বর্ষার দিন। এক দুপুরে ঘন কালো মেঘ করে এসেছে। আমি মারুমারের বাংলোর হাতা থেকে নেমে সামনের জায়গাটিতে, যেখানে বসে হুলুক পাহাড়ের পুরো শরীরটা ভাল দেখা যায়, সেখানে বসে লেবুপাতা, কাঁচালঙ্কা আর পাকা তেঁতুলের শরবত খাচ্ছি তারিয়ে তারিয়ে। বেলা দেড়টা-টেড়টা বাজে। চেলারা বাবুর্চিখানাতে চৌকিদারের সঙ্গে তরিবত করে কী সব রান্না-টান্না করছে, খেতে বসার সময় আমাকে একেবারে চমকে দেবে বলে। এমন সময়ে একটা জিপ বাংলোর হাতার মধ্যে ঢুকে এল তো বটেই, একেবারে আমার ঘাড়ে এসে পড়ল প্রায়।

একজন অত্যন্ত লম্বা-চওড়া হৃষ্টপুষ্ট মানুষ, গায়ে বনবিভাগের খাকিরঙা উর্দি পরা, জিপের সামনের সিট থেকে নেমে আমারই পেছনে একটি প্রকাণ্ড কুসুম গাছের ওপরে ছুতোর মিস্ত্রিরা যে দুটি tree cottage বানাচ্ছিল, সেই দিকে যেতে যেতে নিজেই নিজেকে ইনট্রোডিউস করলেন, আই অ্যাম এ সি এইচ কাজমি, ডি এফ ও সাউথ, কোয়েল ডিভিশন, পালাম।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে আমার পরিচয় দিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন কাজমি সাহেব। বললেন, আরে, আপনার কথা এত মানুষের কাছে শুনেছি। ইয়ে হামারা খুশনসিবি যো আপসে আজ ভেট হো গ্যয়ে।

বলেই, সেই লক্ষ্মৌওয়ালা আমাকে বললেন, চলুন চলুন, ওপরের দুটো বেডরুমে কোন ফার্নিচার কোথায় থাকবে, লেখার টেবিল কোথায় থাকবে, সব দেখিয়ে দেবেন। সে সব দেখানো-টেখানোর পরে উনি বললেন, আপনি তো খুব ঘামছেন। আপনি কি এই গরমে রাম খাচ্ছেন নাকি?

আমি তেঁতুলের শরবতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

 বললাম, খাবেন নাকি একটু?

ম্যায় পিতা নেহি হুঁ।

বলেই বললেন, আরেকটা ছোট অনুরোধ।

কী বলুন?

 আমি বললাম।

 কাজমি সাহেব বললেন, এই যে কুসুম গাছে ট্রি কটেজটি হচ্ছে দু’কামরার, এর একটি নাম আপনি দিয়ে দিন। কটেজকি ইজ্জৎ বাড় যায়েগি।

আমার মুখে এসে গেল, কুসুম গাছে কটেজ! নাম দিন কুমি।

বাঃ। বাঃ বহত খুব। বললেন, কাজমি সাহেব। বেহেতরিন। মগর ইস কটেজ ইনোগুরেট ভি করনে হোগা আপহিকো।

গেছিলে?

ভটকাই বলল।

কোথায় গেলাম। বিহারের গভর্নর গেছিলেন আমার জায়গায়। এক জায়গাতে গেলে, ইচ্ছে করে আবার কখনও গিয়ে সেখানে নিরিবিলিতে কটি দিন কাটিয়ে আসি। কিন্তু তা হয় কই? একই জায়গাতে দু’বার ফিরে যাওয়ার কপাল করে কি আর এসেছিলাম এ জন্মে। ইচ্ছে আর পূরণ হল কই? তার পরে পালাতেই আর যাওয়া হয়নি।

মারুমার জায়গাটার নামটা কেমন চেনা চেনা লাগছে।

লাগতেই পারে। পড়েছিস হয়তো কোথাও। কত বিখ্যাত সব বই আছে ওই সব অঞ্চলের ওপরে।

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ।

সে তো বহু যুগ আগের কথা। তার পরেও আর অনেকই ভাল বই লেখা হয়েছে পালামৌর ওই সব অঞ্চলের ওপরে।

যেমন…

থাক। ঋজুদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল।

যে পড়েই না, তাকে ভাল বইয়ের ফিরিস্তি দিয়ে নিজের মুখ নষ্ট করতে যাবি কেন?

ঠিক বলেছ।

আহা কি সুন্দর দেখাচ্ছে চারিদিক বলত। আর এই চৈত্র রাতের হাওয়া। গা না রুদ্র, আমার সেই প্রিয় গানটা।

কোনটা ঋজুদা?

‘চৈত্র পবনে মম চিত্ত বনে’।

তুমি গাও না ঋজুদা। কতদিন তোমার গলার গান শুনি না। তিতিরটা সঙ্গে থাকলে তাও জোরজার করে, নইলে তো তুমি গাই না।

চল, ওই বড় পাথরটার ওপরে গিয়ে বসি।

পেছনে কাঁকড়া বিছে কি চিতি সাপ কামড়াবে না তো ঋজুদা?

 কামড়াতেও পারে। জঙ্গলে গেলে these are all in the game.

কী আনফেয়ার খেলা রে বাবা! একেবারে hitting below the belt.

তুমি যে বললে, কী সব নন্দী-ভৃঙ্গী পাথরের কথা। আমরা তো প্রায় এক কিমি মতো চলে এলাম হারহাদ বাংলো থেকে, কই চোখে তো পড়ল না!

ভটকাই বলল।

এক কিমি মতো কী রে! দেড় কিমি এসেছি কম করে।

 আমি বললাম।

তাই তো। ঠিকই তো বলেছিস।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, সম্ভবত পথ থেকে সরিয়ে ফেলেছে বনবিভাগের মজুরেরা।

কোনও মিনিস্টার বা ভি আই পি হয়তো এসেছিলেন কোনও সময়ে।

 ভটকাই স্বগতোক্তি করল।

হয়তো তাই। কিন্তু করাটা আদৌ উচিত হয়নি। সঞ্জীববাবু পালামৌতেই লিখেছিলেন না বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে?’ সেই কথাটাই একটু টেনে আমি বলব, যা কিছুই এলোমেলো, বুনো, আমাদের কাছে অসুবিধেজনক, সেই সব কিছুই বনের সৌন্দর্য বাড়ায়, বনকে বুনো রাখে। আমাদের বিভিন্ন রাজ্যের বনবিভাগের যে এই প্রতিনিয়ত ‘খোদার ওপর খোদকারি’ করার প্রবণতা দেখতে পাই তাতে বনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য একেবারে নষ্ট যায়।

তারপর আজকাল আবার হয়েছে সোশ্যাল ফরেস্ট্রি।

আমি বললাম।

যা বলেছিস ভটকাই। মধ্যপ্রদেশের অচানকমার অভয়ারণ্য হয়ে অমরকন্টক যাবার পথে লামণি নামের একটি বনবাংলো আছে। তার মস্ত হাতায় একজোড়া মস্ত বড় বটলব্রাশের গাছ যেমন আছে তেমন দুটি বড় গামহারও আছে। কিন্তু মাটি করেছে পুরো ফাঁকা জায়গাটাতে লেবু গাছ লাগিয়ে। পেয়ারাও আছে কিছু।

ওই বাংলোর টালির ছাদের বসবার ঘরটি কী দারুণ। না?

আমি বললাম।

ঋজুদা বলল, তা ভাল, তবে তোরা সিমলিপালের জোরান্ডা বাংলোর হাতার মধ্যে যে বসার জায়গাটা আছে তা দেখিসনি। অসাধারণ।

শুনেছি জোরান্ডা নাকি খুব সুন্দর জায়গা?

আমি বললাম।

 সুন্দর মানে? আমার তো মনে হয় না ভারতবর্ষে তো বটেই, পৃথিবীতেই ওইরকম সুন্দর, ভয়াবহ, গা ছমছমে জায়গা আর বেশি আছে। সুন্দরবনের সঙ্গে তুলনা করা চলে এই eerie, uncanny অনুভূতির।

তারপর বলল, জোরান্ডা মানে জানিস?

না তো।

ভটকাই বলল, আমাদের নিয়ে যাবে না একবার?

 যাব। একবার এইরকমই চৈত্র মাসে গেছি, দেখি সমতল থেকে আদিবাসীরা পুজো দিতে এসেছে ওপরে। দল বেঁধে। ওখানে বনদেবতা আছেন ওদের। তাদের নাম বাথুরি।

জোরান্ডা খুব উঁচু বুঝি?

উঁচু নয়! ওইরকম সুন্দর panoramic view পাহাড়ের মেঘের পরে পাহাড়ের মেঘ। বৈশাখ মাসে গেলে রাতের বেলা পাহাড়শ্রেণীর এ মেঘ ও মেঘের গলাতে যখন দাবানলের মালা জ্বলে তখন যেমন দেখতে লাগে তেমন দৃশ্য এই পৃথিবীতেই খুব কম আছে। তবে জঙ্গলে গেলে চৈত্র-বৈশাখ মাসে যাওয়াই ভাল। মানে, ভারতের জঙ্গলে।

কেন?

কারণ, আমাদের অধিকাংশ বনের গাছপালাই পর্ণমোচী যদিও, কিন্তু সব গাছের পাতাই এক সঙ্গে মানে একই সময়ে ঝরে না। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লে কারও মনে হতে পারে শীতকালে বন বুঝি বিবস্ত্র হয়ে যায়। আসলে রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের মতো এত এবং এতরকম বনে বছরভর ঘুরে বেড়াননি! যা দেখেছেন তাই…

কেন যে ঘুরলেন না! ঘুরলে তো লাভ আমাদেরই হত!

তা তো একশোবার! বড় লোক যাঁরা, কবি যাঁরা, তাঁদের ব্যক্তিজীবনের যা কিছু অভিজ্ঞতা তা তাঁরা সুদসুদ্ধ পাঠক-পাঠিকাকেই তো ফিরিয়ে দেন।

তারপর বলল, তোরা আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কোনও লেখা পড়েছিস?

আমি বললাম, একটা মাত্র পড়েছি।

কোনটা? The Old Man And The Sea?

হ্যাঁ।

অধিকাংশ মানুষই প্রত্যেক লেখকের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত লেখাটিই পড়েন। সেটা কিন্তু ঠিক নয়। কোন লেখকের কোন বইটি সর্বোত্তম তার বিচার করতে হয় তাঁর অনেকগুলি বই পড়ে। এবং এই বিচারের ফল আলাদা আলাদা পাঠকের মতে আলাদা আলাদা হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।

তা ঠিক।

একদিন ভবিষ্যতে কখনও Old Man And The Sea নিয়ে তোদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা করব। দেখবি, মানে, বুঝবি ভাল লেখা, বড় লেখকের লেখা, কেমন অনুভূতি জাগায় মনে।

কী যেন বলছিলে না তুমি হেমিংওয়ে সম্বন্ধে?

হ্যাঁ। হেমিংওয়ে বলেছিলেন ‘Nothing is wasted in a writer’s life.’ একজন লেখকের জীবনের সব অভিজ্ঞতাই, তা ভালই হোক কি মন্দ, আনন্দের বা দুঃখের, তাঁর লেখাতে চুঁইয়ে আসে। কোনওনা-কোনও সময়ে।

আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ তো তাই-ই বলেছিলেন।

ঋজুদা বলল, কোথায়?

বাঃ। বলেননি? জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা, ধূলায় তাদের যত হোক অবহেলা, পুণ্যের পদপরশ তাদের পরে।

ঠিকই তো! বাঃ রে রুদ্র। পড়লে, বিশেষ করে প্রকৃত বড় কবি, বড় লেখকদের লেখা এমনি করেই পড়তে হয়। পড়ার পড়াই নয়, জীবনে সে সব কথা গেঁথে নিতে হয়, তবেই না কাব্য-সাহিত্য পাঠকের জীবনকে সার্থক করে, সমৃদ্ধ করে।

কিন্তু গানটা?

 নাছোড়বান্দা ভটকাই বলল।

আয় বসি।

 ঋজুদা আমাদের নিয়ে বসল।

তারপর বলল, গাইছি গানটা। কিন্তু রুদ্র তুইও গলা দে।

না। আমি গিলোটিনে অথবা হাঁড়িকাঠে গলা দিয়ে মরতে চাই না। তোমার এত বয়স হল ঋজুদা, কিন্তু গলা শুনলে কে বলবে…

আমার কত বয়স হল রে? আমার বয়স আঠারো। এই আঠারোতেই আটকে থাকব আমি চিরটাকাল। শরীরের বয়স তো বাড়বেই শরীরের নিয়মে। কিন্তু মনের বয়স আমার কোনওদিনও বাড়বে না। বাড়লে, এই নবযৌবনের দল নিয়ে বিশ্বময় বেড়িয়ে বেড়াব কী করে বল?

ভগবান করুন, তোমার এই ‘চিরটাকাল’ সত্যি সত্যিই অনিঃশেষ হোক।

বিজ্ঞর মতো বলল ভটকাই।

গাইছি কিন্তু গান শেষ হলে পাক্কা আধটা ঘণ্টা এখানে নিশ্চপে বসে থাকব। বনের কী বলার আছে আমাদের তা শুনব। একটা পাতা খসারও যে আলাদা শব্দ আছে, হাওয়াও যে নাচে, তার পায়েও যে অদৃশ্য নূপুর থাকে, তারাও যে কথা কয় তা নিজেরা চুপ না করলে জানবি কী করে। নৈঃশব্দ্যের মতো শব্দময়তা কি আর দ্বিতীয় আছে রে! আমাদের দেশের মুনি-ঋষিরা এই কথা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তো একা একা পর্বতে কন্দরে বছরের পর বছর চুপ করে থাকেন তাঁরা। তাঁর কথাটি শুনতে পাবার জন্যে। যুবরাজ শাক্যসিংহ যেমন এখান থেকে কিছু দূরেরই একটি জায়গাতে নির্বাক হয়ে বসে জানতে চেয়েছিলেন, এবং যা জানতে চেয়েছিলেন তা জানতে পেরেছিলেন বলেই তো নিছক একজন রাজকুমার থেকে বুদ্ধদেব হয়ে উঠতে পেরেছিলেন উনি।

ঠিক।

আমরা বললাম।

 ঋজুদা তারপরে গান ধরল।

 চৈত্রপবনে মম চিত্তবনে বাণীমঞ্জরী সঞ্চলি, ওগো ললিতা/যদি বিজনে দিন বহে যায়, খর তপনে ঝরে পড়ে যায়, অনাদরে হবে ধূলিদলিতা, ওগো ললিতা/তোমার লাগিয়া আছি পথ চাহিবুঝি বেলা আর নাহি নাহি, বনছায়াতে তারে দেখা দাও করুণ হাতে তুলে নিয়ে যাও–কণ্ঠহারে করো সঙ্কলিতা, ওগো ললিতা।

গান শেষ হলেও আমরা কথা বললাম না কোনও। ঋজুদার গান আমার ভাল লাগে এই জন্যে যে, প্রত্যেক শব্দ তার গলাতে আলাদা একটা মাত্রা পায়। শব্দসমষ্টির সঙ্গে সুরমঞ্জরীর যুগলবন্দি হয়ে ঋজুদার গলার গান এক বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেয় আমাদের কানে। ভটকাইয়ের কথা জানি না, কিন্তু আমি রবীন্দ্রসংগীতের পোকা। এই লিপ্ততা পেয়েছি আমি আমার মায়ের কাছ থেকে। রবীন্দ্রসংগীতের আবহর মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছি, বাড়িতে বহু বড় বড় রবীন্দ্রসংগীত গাইয়ে গান গেয়ে গেছেন, তাই বলতে পারি যে, ঋজুদা যদি ভাল করে, মানে সময় দিয়ে গান গাইত, জনকর্ণে আসত, তবে অন্য অনেক বড় তাবড় পুরুষ-নারী গাইয়েদের বিপদ হতে পারত খুবই। কিন্তু ঋজুদা তো আমাদের ছাড়া, গান শোনায়ই না কখনওই, তাও এই জঙ্গল-টঙ্গলেই। ঋজুদার গান শোনার ভাগ্য শুধু আমাদেরই হয়েছে। ঋজুদা নিজে বলে দূর, দূর! আমি চানঘরের গায়ক। আমি কি গাইতে পারি গান?

এই একটা দুঃখ রয়ে গেল আমার। রবীন্দ্রসংগীত গায়ক ঋজুদাকে দশজনের সামনে উপস্থিত করাতে পারলাম না।

একদিন ঋজুদা, যখন আমরা ‘নিনিকুমারীর বাঘের’ জন্যে ওড়িশার জঙ্গলে গেছিলাম, এ ব্যাপারে আমি খুব চাপাচাপি করতে বলেছিল, দেখ রুদ্র, প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষের কিছু কিছু জিনিস থাকা উচিত যা তার একান্ত নিজস্ব। নিজের সব কিছুই অন্যকে দিয়ে দেওয়া, দশজনের করে দেওয়াটা মূর্খামি। যারা নিজেদের প্রচার করে নিজেদের blow-up করে সুখ পান তাঁদের কথা আলাদা। নইলে আমার মতো গড়পড়তা মানুষের কখনওই উচিত নয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিজের পরিচয় নিয়ে গিয়ে দাঁড়ানো। এটা যাঁরা করেন, তাঁদের শালীনতার অভাব আছে।

কী আর বলব। ঋজুদা এই ঘোর প্রচারসর্বস্বতার দিনে সত্যিই এক ব্যতিক্রম। আর সেই জন্যেই তো আমরা তার অন্ধ চেলা। চুপ করে বসে আছি আমরা। অন্ধকার নেমে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ। তবে শুক্লপক্ষের অষ্টমীর চাঁদ অন্ধকারকে বাড়তে দেয়নি। তারাদের আলো আর সবে ওঠা অষ্টমীর চাঁদের আলো এই চৈত্র-সন্ধেতে এক ফিকে জল-ধোওয়া জলের মতো জ্যোৎস্নার বাতাবরণ তৈরি করেছে। হাওয়া বইছে একটা ঝিরঝির করে। সন্ধেতারাটার সবুজাভ আলোর দ্যুতি যেন আকাশকে একা হাতে শাসন করছে। ভারী সুগন্ধ উড়ছে চারধারে। ‘বনময়, ওরা কার কথা কয় রে। পিউ কাঁহা ডাকছে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে আর তার দোসর সাড়া দিচ্ছে। কীসের যে তাদের এত তাড়া কে জানে! প্রিয়া হারিয়ে গেছে। বলেই কি অমন তীরবেগে ওড়া! অথচ প্রিয়া যদি সত্যিই হারাত তবেও না হয় বোঝা যেত। সে তো মাঝে মাঝেই সাড়া দিচ্ছে।

আমার ঠাকুমা ছোটকাকুর বিয়ের পরে রসিকতা করে তাঁকে বলতেন, আহা। যেন পলকে হারায়। নেবে না। নেবে না। তোর বউকে কেউ নিয়ে পালাবে না। কাকিমা তখন অন্য দিকে মুখ করে হাসতেন।

সেইরকমই আমারও বলতে ইচ্ছে করল পিউ কাঁহাকে, হারাবে না। হারাবে না।

ঋজুদা পাইপের ছাই ঝেড়ে ফেলে ধরাল পাইপটা। পাইপের বোলের ভেতরে টোব্যাকো থাকে, তাই সিগারেটের আগুনের মতো তা পাশ থেকে বা চারধার থেকে দেখা যায় না, কিন্তু গোল্ড-ব্লক টোব্যাকোর গন্ধ এই চৈত্রবনের গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক দারুণ আবহর সৃষ্টি করেছে। খুব ইচ্ছে করছে ঋজুদার গলাতে আরও একটা গান শুনি। কিন্তু এখন taboo। আমরা তিনজন অন্ধকারে পাশাপাশি বসে আছি নীরবে। যার যার নিজের নিজের ভাবনা ভেবে চলেছি। আর সব থেমে থাকতে পারে, গাড়ি থামে, প্লেন থামে, পা থামে, কিন্তু মস্তিষ্ক ঠিকই তার কাজ করে যায় শুধু ঘুমের সময়টুকু ছাড়া। কিন্তু মজা এই যে, একজনের ভাবনা অন্যকে দেখানো যায় না। ভাগ্যিস যায় না। যদি এমন কোনও যন্ত্র আবিষ্কার হয় যে মানুষের মনের ভাবনা একটি কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটে উঠবে, তা হলে মানুষের সততা বলে আর কিছু থাকবে না। ধারেকাছে অন্য কেউ থাকলে তাকে নিজের ভাবনার অবদমন করতে হবে বা ভাবনাকে লুকিয়ে রাখতে হবে, অভিনয় করতে হবে। সে বড় দুর্দৈব হবে। মানুষ তার নিজস্বতাকে পুরোপুরি হারাবে। ..

হঠাৎ একটা কোটরা হরিণ ধ্বক ব্রাক ধ্বক করে ডেকে উঠল। সম্ভবত হারহাদ নালাতে জল খেতে গেছিল। চিতা-টিতা দেখে ভয় পেয়ে থাকবে। একটা শেয়াল ডাকল আর তার পরে পরেই একদল। এদিকে হায়না নেই। গভীর বন ছাড়া হায়না দেখা যায় না। তবে কখনও-সখনও জংলি কুকুর চলে আসে। তারা দেখতে বড় হয়, কিন্তু বড় সাঙ্ঘাতিক। একবার মধ্যপ্রদেশের সুফকরে দেখেছিলাম। একটা শম্বরকে তাড়া করে এক দল কুকুর মাটিতে ফেলে পনেরো মিনিটের মধ্যে অত বড় জ্যান্ত শম্বরটার গায়ের মাংস চামড়া সব চাঁচিপূচি করে খেয়ে শুধু কঙ্কালটিকে ফেলে রেখে চলে গেল। শিং-সুদ্ধ কঙ্কালটা পড়ে রইল হায়নাদের জন্যে। গভীর রাতে তারা কটাং কটাং করে হাড় ভেঙে ভেঙে খাবে। তাদের শক্ত চোয়ালে।

হায়নার কথা মনে হলেই আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি প্লেইনসের কথা মনে পড়ে যায়। সেই ‘গুগুনোগুম্বার’-এর দেশ থেকে ঋজুদাকে যে কীভাবে নাইরোবি সর্দারের সাহায্যে বাঁচিয়ে নিয়ে দেশে ফিরেছিলাম সে কথা ভাবলেও হাড় হিম হয়ে যায়। পুরানাকোটেও বাঘের হাতে যখন জখম হল ঋজুদা, তখন ভুবনেশ্বরে এসে প্লেন ধরে কলকাতাতে ফিরেছিলাম। তবে আমাকেও ঋজুদা আহত অবস্থাতে নিয়ে এসেছিল ঝিঙ্গাঝিরিয়ার জঙ্গল থেকে–যেবারে আমরা মধ্যপ্রদেশের সিধি জেলাতে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো মারতে যাই।

দূরে একটা গাড়ির আলো দেখলাম মনে হল। কিন্তু এঞ্জিনের শব্দ পেলাম না অত দূর থেকে। ন্যাশনাল পার্কে বন্যপ্রাণী দেখার জন্যে চেকনাকা পেরিয়ে কোনও গাড়ি ঢুকল কি? গাড়িটা বনে ঢুকল, না বন থেকে বেরুল, তা বোঝা গেল না। পথে যদি বাঁক থেকে থাকে ওখানে, তবে বন থেকে ফিরে গেল এমনও হতে পারে।

যার যেরকম মনে হয় সেইরকম ভাবছি। কার না জিপ না ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ভ্যান কিছুই সঠিক রোঝা গেল না। আলোর উচ্চতা দেখে অনুমান করলাম যার যার মতন।

সেই হেডলাইটের আলো কিছুক্ষণের জন্য বনের স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করে দিল। তারপরেই বন আবার নিজেকে ফিরে পেল। ঋজুদাই দিয়েছিল আমাকে রেডিয়াম-দেওয়া বড় ডায়ালের টাইমেক্স ঘড়িটা। জঙ্গলে ব্যবহার করার জন্যেই দিয়েছিল, তাই জঙ্গলেই ব্যবহার করি। খুবই কাজের ঘড়িটা। ঘড়িটার ডায়ালে তাকিয়ে দেখলাম আধঘণ্টা হতে এখনও অনেকই দেরি। বনের মধ্যে সময় কখনও আদিবাসী যুবকের মতো দ্রুত পায়ে চলে, কখনও বা পায়ে আরথ্রাইটিস হওয়া বালিগঞ্জি বৃদ্ধের মতো। তার চাল যে কখন কীরকম হবে, তা সে নিজেই শুধু জানে।

নিঃশব্দে বসে রইলাম আমরা পাথরের ওপরে। বনভূমিতে এখন যেই পা ফেলুক না কেন, মানুষ কিংবা জানোয়ার, শুকনো পাতাতে তার শব্দ হবেই। যদিও বনের সব পাতা শুকোবে এপ্রিলের শেষে।

আমরা যেদিকে আলো দেখেছিলাম সেদিকে ঋজুদার ভাষায় যাকে বলে উৎসুক, উদগ্রীব, উৎকর্ণ এবং যাবতীয় উঃ’ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। এমন সময়ে যেখানে আলো দেখেছিলাম গাড়ির হেডলাইটের, সেখানে আবারও দেখলাম আলো। তারপরই হেডলাইটের আলো দুটো লাফাতে লাফাতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি কোমরে হাত দিয়ে পিস্তলের হলস্টারের বোতামটা খুলে দিলাম। আলোর উচ্চতা দেখে আমার মনে হল, ওটা গাড়িও নয়, জিপও নয়, ট্রাকও নয়, অন্য কিছুর আলো। তবে কীসের আলো? মঙ্গল গ্রহ থেকেই এল কি এই প্রায়-নিঃশব্দ আশ্চর্য যান? ওই দিকেও পথটা ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। তার মানে আমরা যেখানে বসে আছি আর ওই অলৌকিক যানটি যেদিক থেকে আসছে, এই দুদিকেই উঁচু, আর এই দুই টিলার মধ্যে একটা উপত্যকা–তবে তা বিস্তারে সামান্যই। গাড়িটা পাথরের বুক কেটে বানানো অসমান পথের ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে আসছে, অথচ এখনও তার এঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ভারী আশ্চর্য তো! পরক্ষণেই বুঝলাম যে এঞ্জিন বন্ধ করে আসছে গাড়িটা,শব্দ যাতে না হয়, সেই জন্যেই। এমন সময়ে পথেরই একটা বাঁকে গাড়িটা আসতেই বোঝা গেল যে সেটা একটা তিন চাকার টেম্পো। অবাক হলাম, তিন চাকার টেম্পো নিয়ে কী করছে কারা এই জঙ্গলে?

টেম্পোটা থেমে গেল। আর তার হেডলাইট দুটোও নিভে গেল। ঝুপঝাপ করে চার-পাঁচজন লোক টেম্পোর পেছন থেকে এবং ড্রাইভিং কেবিন থেকে নেমে পড়ল। একজন গলা তুলে বলল, বড়ি বেহেতরিন সিন হ্যায় হো হিয়া। বম্বেকি ফিল্মওয়ালা লোগ হিয়া আকর শুটিং কাহে না করতা? শালে লোক সব বুদ্ধু হ্যায়।

অন্যজন বলল, ক্যা উজালা রাত!

আরেকজন বেসুরো গলায় গাইল: উজালা, উজালা। চার বুঁদওয়ালা।

আরও একজন গলা তুলে বলল, আর এ আফজল। সুরত হারাম। তু করতে ক্যা থা ইতনা টাইম?

যেখান থেকে টর্চের আলো জ্বলতে দেখেছিলাম আমরা সেদিক থেকে আফজল নামক লোকটা বলল, মাচান বাঁধনেমে টাইম তো লাগেগা।

আরে উল্লু। দো ঘণ্টা।

নেহি। ম্যায় বান্ধ তো লিয়া থা মগর টর্চ ফেককর জারা দিখ লেতা থা ঘোড়ফরাস যব আওবে করেগা তব উ মাচানসে ধড়কানেসে কোই দিককত আয়েগি ক্যা নেহি।

কওসি দিককত? আজিব আদমি হ্যায় ইয়ার তু।

হ্যায় কিতনা দূর হিয়াসে মাচান?

হ্যায় হোড়া দুর। মগর ইস পাহাড় কি উস তরফ।

কে যেন জোরে বলল, তব তো বহতই দূর।

 আরে দাদা চিল্লাও মাতা হর দোর কি কান হোতে হে। তুমলোগ ন্যাশনাল পার্ক কি অন্দর ঘোড়ফরাস মারনেকি ইন্তেজাম কর রহা হ্যায়, ইয়াদ রখনা। পাকড় যানে সে বিশ সাল অন্দর রহনা পড়েগা। হাঁ।

ছোড় ইয়ার। পাক্কাড় কেইসা যায়েগা? পাক্কাড় যানা অ্যায়সি আহসান হোতা থা তো আজ হাজারিবাগ কি জেলমে জায়ে নেহি হোতে থে। সমঝা। বুন্ধু। কঁহিকা।

তারপর বলল, আও, জারা চড়কে দিখো তো মাচান মজবুত বনা ক্যা।

আরে বৈঠেগা তো কাল্লু মিঞা এক্কেলেই। মাচানমে বৈঠকর হামলোলগানে ক্যা কাওয়ালি গাওবে গা? কালু যাও, তুমহি দিখকর আও। অগর গোলি ভি চালায় ঔর ঘোড়ফরাস ভি নেহি ধড়কায়া, তো তুমকো মারকর হামলোগ পায়া ঔর লাব্বা বানায়গা।

 আরেকজন বলল, ঠিকসে নিগা তো কিয়া না? ইস রাস্তেমে ঘোড়ফরাসকি কুন্ড সাচমুচ যাতে ক্যা নাল্লামে ইস পাকদণ্ডিসে?

আরে হাঁ জি হাঁ। সাম হোতে হোতেহি পুরা ঝুন্ড উও বাঁয়াওলা বড়া পাহাড়সে উতারকে হারহাদমে পানি পিনেকি লিয়ে আতে হ্যায়।

তো আজ আয়া কাহে নেহি?

আওবেগা। কুছ গড়বড়-সড়বড় লাগা হোগা উসলোগোকা। ম্যায় বাত্তি ভি ফেকা থা না!

কিউ ফেকা থা?

আরে! বোলা না! গোলি চালানেমে কোই মুসিবত হোগা ক্যায়া নেহি দিনে কি লিয়ে।

হিয়াকি গোল্লিকি আওয়াজ বাংলা, গাড় লোগগাঁকি গুমটি আউর রাজডেরোয়াকি নাকা তক পৌঁছে গা তো নেহি।

আরএ নেহি নেহি। উও সব জাগেমে রাত আট বাজিতক টারানজিস্টার আউর ২৭৪

টিভিমে বহুত তেজ গানাবাজানা হোগা। উসব কি ইন্তেজাম হাম পুরা কর চুকা। ফিক্কর মত করো।

আরে ঘোড়ফরাস ক্যা তুমহারা জরুকা নোকর হ্যায় যো আট বাজিকা অন্দর। হি আওবেগা।

আবেগা। আবেগা। আট বাজি কি অন্দর নেহি আনেসে ঝামেলা মচ যায়েগা। তব তো নাঙ্গা হাতমে লওটকে যানা হোগা কাল। নাসির মিঞাকি দুবারা ফিন শাদি করনা পড়েগা ঘোড়ফরাসকি কাবাব খানেকে লিয়ে।

হায়। হায়। জেসমিনকি তো তব তাল্লাকই দেনা হ্যায়।

 অ্যাই। জবান সামহালকে। মজাক মত উড়াও।

সব শেষে যে লোকটি কথা বলল, সেই নিশ্চয়ই নাসির মিঞা। তারই বিয়ে কাল। তারই শ্বশুরবাড়িতে বরযাত্রীদের খাওয়ার জন্যেই এই নীলগাই মারার পরিকল্পনা করা হচ্ছে তাহলে।

ইক সিগারেট ছোড়।

একজন বলল। গলা শুনে মনে হল ওই জলিল।

লো।

 মাচিস?

দেশলাই জ্বালাবার শব্দ শোনা গেল না অত দূর থেকে কিন্তু আলো দেখা গেল। ওরা সকলে অনেকই দূরে ছিল কিন্তু ওদের গলা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

এমন সময়ে হাওয়াটা কোনও ভয়-পাওয়া জানোয়ারের মতো আমাদের পেছন থেকে হঠাৎই দৌড়ে গেল ওদিকে। সঙ্গে সঙ্গে ওদের মধ্যে একজন শেয়ালের মতো নাক উঁচু করে হাওয়াতে গন্ধ নিল। তারপরই গলা নামিয়ে বলল, খামোশ। কওনচি কি বু আ রহি হ্যায়? খুশবু? মিলা তুমলোগোঁকো?

লাগতা হ্যায়, আরেকজন বলল, কোই আনজান চিজ কি বু।

সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলল, ইয়ে খুশবু কোই ইত্বর-উত্বর কি নেহি৷ জিনকি হোগি। চল জলদি ভাগা যায় হিয়াসে।

সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ধপাধপ করে টেম্পোতে উঠে পড়ে ওরা। টেম্পো ঘুরিয়ে জোরে চালিয়ে সত্যি সত্যিই চলে গেল।

ভাগ্যিস পথটি সোজা ছিল না, তাই ওদের হেডলাইট আমাদের ওপরে কখনওই পড়েনি। টেম্পো ঘোরাবার সময়ে আশঙ্কা ছিল, কিন্তু আমরা অনড় হয়ে গাছপাতার আড়ালে বসেছিলাম, তাই আলোর ঝলক পড়লেও আমাদের দেখতে পায়নি।

নীরবতা কাটিয়ে প্রথম কথা বললাম আমি। ভটকাইকে বললাম, আরও মেয়েদের পারফুম মাখ, পুরুষ হয়ে। তোর জন্য প্রাণ যেতে পারত আমাদের। তোকে এই জন্যই জঙ্গলে নিয়ে আসতে বারণ করি আমি ঋজুদাকে।

সে কী?

ভটকাই আকাশ থেকে পড়ে বলল, ওরা নিশ্চয়ই ঋজুদার পাইপের টোব্যাকোর গন্ধ পেয়েছিল।

তোর গায়ের গন্ধ পায়নি?

বাঃ রে। বউদি আমার জন্যে নিয়ে এসেছিল সিঙ্গাপুর থেকে। মেয়েদের হতে যাবে কেন এ পারফুম?

তা না হলে ওরা জিন বলে।

 ঋজুদা হেসে উঠল আমার কথাতে। বলল, এমনিতেই ভীমরুলের কামড়ের ভয় থাকে বলে জঙ্গলে শুধু পারফুমই নয়, কোনওরকম সুগন্ধীই ব্যবহার না করাই উচিত। অমরকন্টকে আমার পরিচিত এক সাধু মারা গেছিলেন ভীমরুলের কামড়ে জঙ্গলে ধূপ জ্বালিয়ে। ওপরেই চাক ছিল।

জিন কী জিনিস? হামদু বড় যা খায় দুপুরবেলা লিমকা দিয়ে?

ভটকাই বলল।

হামদু বড়টা কী জন্তু আবার?

ঋজুদা বলল।

আরে আমার বড়মামা। মামাদের আমরা হামদু বলি। হামদু বড়, হামদু ছোট এরকম।

তা বলার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তোর এই গণতন্ত্রে। হামদু কেন, তুই ইচ্ছে করলে মামদোও বলতে পারিস। তোর বড়ামামা ব্রতীনের চেহারা ও চরিত্রর সঙ্গে তাহলে মানাবেও ভাল। তবে তোর হামদু বড় দুপুরবেলা যা খায়, সেই জিন আর এই জিন এক নয়। এই জিন হচ্ছে পেত্নি। মুসলমান পেত্নি। পুরুষদের জলে ফেলে ডুবিয়ে মেরে ফেলে। এইরকম ডাইনি-জ্যোৎস্নার রাতেই তারা বেরোয় আর জঙ্গলেই তোর মতো গন্ধগোকুলদের ধরে ধরে ঘাড় মটকায়।

ঋজুদা হাসি থামিয়ে বলল, যাই হোক রুদ্র, ভগবানের দয়াতে কাল রাতেই যদি কাজটা সমাধা হয়, তবে বাকি কদিন নিজেদের মতো ছুটি কাটানো যাবে, কী বল!

তারপরই বলল, ব্যাপারটা কী বুঝলি বল তো তোরা?

ভটকাই বলল, ব্যাপারটা কী তা বলার আগে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল ঋজুদা।

কী প্রশ্ন?

ওরা যে হাজারিবাগি হিন্দিতে কথা বলছিল আমি অনেক শব্দের মানেই বুঝতে পারিনি।

হাজারিবাগি হিন্দিতে কথা ওরা তেমন বলছিল না। হাজারিবাগি হিন্দির বিশেষত্ব হচ্ছে য়া’ যোগ করা অনেকই শব্দের শেষে।

যেমন?

যেমন জিপকে বলবে জিপোয়া, টাঁড়কে বলবে টাঁড়োয়া, বাঘকে বলবে বাঘোয়া–এইরকম আর কী।

তা কী শব্দ তুই বুঝতে পারলি না?

ধড়কান বা ধড়কানা, তারপর ঝুণ্ড আর তারপর ঘোড়ফরাস।

ঋজুদা বলল, ধড়কান আর ধড়কানার মানে আলাদা। ধড়কান হচ্ছে ধুপপুক করা। বুক ধড়কানো। সেই শায়ের আছে না?

কী শায়ের?

আমি বললাম।

উলঝি সুলঝি রহনে দো
কিউ শরপর আফৎ লাতি হো
দিকা ধড়কান বাড়তি হ্যায়।
যব বালোঁকো সুলঝাতি হো।

ঋজুদা বলল।

মানে কী হল? এ তো দেখছি এক বিপদ থেকে উদ্ধার করে অন্য বিপদে এনে ফেললে।

ঋজুদা বলল, এও আমাদের নাজিম সাহেবেরই মুখ থেকে শোনা। মানে হল, উসকোখুসকো আছ, তাই থাক, অত সাজগোজের দরকার কী? কেন আমার মাথায় বিপদ ডেকে আনবে? তুমি চুল আঁচড়ে এলে আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়।

বাঃ। কী সুন্দর।

আমি বললাম।

তারপরই বললাম, ঋজুদা, তুমি ভটকাইকে ওয়ার্নিং দিয়ে দাও। ওর তো কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। এটা আবার ওর ছোটবোন কিটির কোনও বন্ধুর ওপরে না ঝেড়ে দেয়।

ঋজুদা হেসে উঠে বলল, ও নিজ দায়িত্বে কিছু করে যদি চড়চাপড় খায় তো খাবে। তারপর বলল, ধড়কা দেগা জানে মেরে দেব। ফেলে দেব, গুলি করে। ধড়কান আর ধড়কায়েগার মধ্যে তফাত আছে।

নেক্সট কোয়েশ্চেন?

 ঝুন্ড মানে কী?

 ঝুন্ড মানে দল। থুড়ি পাল। হাতির ঝুন্ড, শুয়োরের কুন্ড, বিদের কুন্ড, গাইয়ের ঝুন্ড, নীল গাইয়ের ঝুন্ড, এইরকম আর কী। ইংরেজিতে যাকে বলে herd। কিন্তু সিংহ যদিও দল বেঁধে থাকে, সিংহের বেলা কিন্তু herd হবে না, হবে pride

তাই?

ভটকাই বলল।

নেক্সট কোয়েশ্চেন?

 ‘নিগা কিয়া থা’? মানে কী?

 ‘নিগা বা নিগাহ’ উর্দু শব্দ। মানে চোখ। নিগা কিয়া থা’ মানে দেখেছিলে বা নজর চালিয়েছিলে কি?

তারপর বলল, দোরখ মানে কী?

আরে! এ তো মহা মুশকিলেই ফেলল দেখছি। আমি কি ল্যাঙ্গুয়েজের ক্লাস করব এখানে? দোরখ মানে পেঁড়।

পেঁড় মানে? পেঁড়ার ভাই?

 ধ্যাৎ

বিরক্ত হয়ে ঋজুদা বলল, পেঁড় মানে গাছ রে হাঁদা। উঃ। তোকে নিয়ে আর পারা যায় না।

আর ঘোড়ফরাস?

ঘোড়ফরাস, নীলগাইয়ের স্থানীয় নাম। বিহারের হাজারিবাগ, পালামৌ, তিলাইয়া ইত্যাদি অঞ্চলে নীলগাইকে বলে ঘোড়ফরাস। ইংরেজি নাম Blue Bulll নাজিম সাহেবের ইংরেজিতে বুলু বল।

এর মাংস কীরকম খেতে ঋজুদা যে বিয়েতে এর কাবাব খেতে হবে?

আরে এ একরকমের গোরু তো। বাংলায় বলে বনগাই। হিন্দুরা খায় তো নাই-ই, মারেও না। তাই যেখানে এদের সংখ্যা বেশি এরা ভারী ক্ষতি করে ফসলের। তবে এখন আর কোন জানোয়ার বেশি আছে দেশে? সর্বভুক মানুষ সবই খেয়ে শেষ করে এনেছে। এদের মাংস বড় শম্বরের মতো, বারাশিঙার মতো৷ শম্বরের ও বারাশিঙার মাংস খেয়েছি অনেক সময়ে। একটুও ভাল নয়। অনেক সেদ্ধ করে নানা উপচারের সঙ্গে কাবাব করে খেতে মন্দ লাগে না। কষা মাংসও মন্দ লাগে না। তবে মুসলমানেরা তো গোস্ত খায়ই, ওদের

যা বোঝা যাচ্ছে আমাদের কপাল খুবই ভাল। আজ কাজমি সাহেব যদি রাতে খাওয়ার জন্যে আমাদের হারহাদ বাংলোতে আসেনই তবে ওঁকে টিপস দিয়ে দিলে বাকি কাজটা উনি এবং পুলিশের লোকেরা মিলেই সমাধা করতে পারেন। আমাদের তাহলে আর ছুটি কাটাতে এসে গুলিগোলার হুজ্জোত করতে হয় না।

তোর কি আজকাল এইসব বিপজ্জনক ব্যাপার-স্যাপারকে, অ্যাডভেঞ্চারকে, হুজ্জোত বলে মনে হচ্ছে না কি রে রুদ্র?

না, আমার জন্যে নয়। আমাদের সঙ্গে মেয়েদের পারফুম-মাখা অনভিজ্ঞ এক খোকাবাবু আছেন তো। তাঁর মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে হয় বইকী।

ঋজুদা আমাদের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, বিহারে তো এখন একেবারে নৈরাজ্যের অবস্থা, পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও খারাপ। রাবড়ি দেবী প্রশাসনকে একেবারে রাবড়ি করে দিয়েছেন। কাজমি সাহেব পুলিশের সাহায্য চাইবেন বলে মনে হয় না। এই কদিন আগেই চৌপারণে কাণ্ডটা কী ঘটল তা পড়িসনি কাগজে?

না। কাগজ আমি পড়ি না। বিজ্ঞাপনই যদি পড়তে হয় তবে Admag পড়ব। কাগজ পড়ে পয়সা ও সময় নষ্ট কেন করতে যাব?

ভটকাই বলল।

তারপরই বলল, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনেও কি জ্যোতিবাবুর জ্যোতি ফুটে বেরুচ্ছে না?

ঋজুদা ভটকাইয়ের রাজনৈতিক মতামতকে উপেক্ষা করে বলল, কী গাছের নীচে বসে ছিলাম আমরা এতক্ষণ? লক্ষ করেছিলি?

ভটকাই ওর কাঁধে-ঝোলানো ঝোলা থেকে ছোট টর্চটা বের করে গাছটাতে ফেলতেই উজ্জ্বল লাল দুটি চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল; সেই আলো দুটির মধ্যের ফাঁক বড়জোর ইঞ্চি চারেক।

ঋজুদা হেসে বলল, রতনে রতন চেনে।

বলতেই কে এক গেছো-দাদা সড়সড় করে ডাল বেয়ে আরও ওপরের ডালে উঠে গেল।

কী ওটা? আমি বললাম।

উল্লু।

বলেই, হাসল ঋজুদা। অরপর বলল, গাছটা আমলকী। আমরা এসে গাছের গুঁড়ি গার্ড করে বসাতে ও বেচারি গাছ থেকে নামার অবকাশ পায়নি আর। চল, আমরা যাই, ও-ও ফিরে যাক ওর ডেরাতে। তবে খুশিও হয়েছে খুবই ওর স্কুলের বন্ধুকে এতদিন পরে দেখে। কি বল ভটকাই।

এই তাহলে উল্লুক?

 আমি বললাম।

 উল্লু। আগে দেখেছিস, তবে চিড়িয়াখানাতে। জঙ্গলে দেখলি এই প্রথম। তোরা ভাগ্যবান আমি নিজেও এর আগে মাত্র একবারই দেখেছিলাম এই অঞ্চলেই। শিবসাগরের ক্রিশ্চিয়ান মাইকা কোম্পানির পাঁচ নম্বর বাংলো, যেটি ওদের গেস্টহাউস ছিল, তার সামনের জঙ্গলে। তখন আমি স্কুলে পড়ি। এমনই রাতের বেলাই দেখেছিলাম। জেঠুমনির সঙ্গে ফিরে আসছিলাম রজৌলির ঘাট থেকে পাঁচ নম্বর বাংলোতে। যুগলপ্রসাদ টর্চ ফেলে দেখিয়েছিল একটি বয়ের গাছে। জিপ গাড়ির ডিপার করা হেডলাইটে দূর থেকে সে লাল চোখের ঝিলিক দেখতে পেয়েছিল গাছের ওপরে, তাই জিপ গাছের নীচে দাঁড় করিয়ে দেখিয়েছিল আমাদের।

আমি ভটকাইকে বললাম, এই উল্লুর সঙ্গে ভালুকের কোনও সম্পর্ক কিন্তু নেই। ও কালপেঁচা। গভীর জঙ্গলের বাসিন্দা। যখন ডাকে, তখন অনভিজ্ঞর নাড়ি ছেড়ে যায় ভয়ে।

তাই? জানোয়ার না, পাখি।

ইয়েস।

 আমি বললাম। এরপর আমাদের কী কর্তব্য ঋজুদা?

 বাংলোতে ফিরে গেলে হাঁটা হবে তিন কিমি মতো। ভাল করে চান করে আমরা হারহাদ বাংলোর বারান্দাতে বসব। নদীর আওয়াজ শোনা যাবে ঝরঝর করে। রাত যত বাড়বে নদীর আওয়াজ তত বাড়বে। তারপর জামাল বিরিয়ানি আর কাজমি সাহেবকে নিয়ে এসে গেলে কবজি ডুবিয়ে বিরিয়ানি খাব। তারপর কাজমি সাহেবের জিপে করে রাজডেরোয়ার পার্কে মাইল পঁচিশ-তিরিশের একটা চক্কর লাগিয়ে ফিরে এসে আবার বারান্দাতে বসে নদীর গান শুনব। তারপর যার যেমন ইচ্ছা ঘুমোতে যাব এক এক করে।

আর কালকের প্রোগ্রাম?

কাল সকালে তোদের টাইগার-ট্র্যাপ দেখাব। পদ্মার রাজারা কী করে বাঘ ধরতেন, তাই। রাজার ডেরা ছিল বলেই তো এই জায়গার নাম রাজডেরোয়া। করদ রাজ্যের রাজা। এই সমস্ত অঞ্চল ছিল তাঁদের ‘শুটিং প্রিজার্ভ। অন্য কারও অধিকারই ছিল না এ বনে ঢোকার বা শিকার করার। আমাদের দেশের অধিকাংশ জঙ্গলই তো আগে তাই-ই ছিল। উত্তরবঙ্গের রায়কত রাজাদের বৈকুণ্ঠপুর, ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের সিমলিপাল, পালামুর গাড়োয়া, রাংকা ইত্যাদি, মধ্যপ্রদেশে মান্দালা, রেওয়া, রাজস্থানের বান্ধবগড়, আলোয়ারের রাজাদের সারিসকা। তোদের একবার সারিসকাতে নিয়ে যাব। আমরা পূর্বাঞ্চলের লোক, আমাদের চোখে একেবারে অন্যরকম লাগে। জঙ্গল থেকে, জানোয়ারের চেহারা।

তারপর একটু থেমে বলল, তখনকার দিনে রাজাদের প্রহরীদের যতুটুকু ভয় পেত মানুষে এখন পুলিশ বা বনরক্ষীদের তা আদৌ পায় না। সবরকম আইন। অমান্য করাটাই আমাদের স্বাধীনতার একমাত্র প্রকাশ হয়ে উঠেছে। ভাবলেও বড় দুঃখ হয়।

তারপর? মানে কাল সকালে?

 রাজডেরোয়া ন্যাশনাল পার্ক দেখে বেরিয়ে যখন আমরা ডানদিকে হাজারিবাগের দিকে যাব, তখন ডানদিকেই দেখতে পাবি রাজপ্রাসাদ। ছেলেবেলাতে যখন আসতাম তখন চাঁদনি রাতে সাদারঙা ওই নির্জন খালি প্রাসাদ দেখে বুক ছমছম করত। এখন তো শুনেছি কী সব সরকারি অফিস-টফিস হয়েছে। নাস্তার পরে হাজারিবাগ শহরে তোদের নিয়ে যাব। হাজারিবাগ শহরের তিন দিকে তিন পাহাড়ের প্রহরা।

কী কী পাহাড়?

 সীতাগড়া, সিলওয়াব আর কানহারি। কানহারিই সবচেয়ে কাছে শহরের। কানহারির ওপরে একটি সুন্দর বনবাংলা আছে। আজই কাজমি সাহেবকে বলে দিলে কাল সকালে ওখানে নাস্তাও করতে পারি। তারপর নিয়ে যাব হাজারিবাগ শহরের বড়ি মসজিদের কাছে Bengal Fancy Stores-এ নাজিম সাহেবের দোকানে। সেখানে এক কাপ করে লাল চা আর কালি-পিলি জরদা দিয়ে দু’খিলি পান খেয়ে যাব নাজিম সাহেবের কবরে মোমবাতি দিতে।

কবরখানাটা কোথায়?

হাজারিবাগ-টুটিলাওয়ার পথে। যে পথ সীমারিয়া হয়ে জাবড়া মোড় এবং চাতরা চলে গেছে।

কাল রাতে কি আমরা বুলুবুল অপারেশনের অ্যাকশন ফোর্সে থাকব?

আমি বললাম।

 ধীরে বৎস, ধীরে। কালকের কথা কালই হবেন।

 তারপর বলল, ওই যে বললাম সীতাগড়ার কথা, ওই পাহাড়ের পাদদেশেই সুব্রত সীতাগড়ার মানুষখেকো বাঘটিকে মেরেছিল ষাটের দশকের গোড়াতে টুটিলাওয়ার ইজাহারুল হকের সঙ্গে।

তাই? আমি আর ভটকাই সমস্বরে বললাম।

 দুটো পাগলা কোকিল সাতকালে এমন ডাক ডাকতে লাগল যে শুয়ে থাকা। আর সম্ভব হল না। উঠে দেখলাম, মিস্টার ভটকাই ইতিমধ্যে উঠে পড়ে হারহাদ নদীর ঝরঝরানি জছে কোমরে হাত দিয়ে বারান্দাতে দাঁড়িয়ে।

নদীর শব্দটা সারারাত ঘুমপাড়ানি গানের মতোই কানে বেজেছে আমাদের। রাত যত গভীর রয়েছে, শব্দটাও ততই গভীরতর হয়েছে।

হঠাৎই ভটকাই আমার দিকে ফিরে বলল, কী বুঝতাছস?

 কী?

এরেই কয়, লানাবাই।

সেটা কী?

ইংরেজি তো মাঝে মধ্যেই ফুটাইস দেহি আর লানাবাইই জানস না?

দুর্গাবাই জানি, জিজাবাই জানি, শিবাজি মহারাজের মায়ের নাম, কিন্তু লানাবাই কোন বাই?

অ্যালিবাই তো জানস?

নাঃ।

জানস না? হাঃ। আরে। যারে কয় ছুতা।

ছুতা?

ইয়েস। ছুতানাতা। বাহানা। ইসবেরেই ইংরেজিতে কয় alibi৷ বোঝলা সর্বজ্ঞ।

এমন সময়ে ঋজুদা উঠে বারান্দাতে এল। বলল, কোথায় এমন সুন্দর জায়গাতে চুপ করে বসে সকালবেলার শব্দ-গন্ধ সব উপভোগ করবি, তা না! তারপরই বলল, এই কাজিয়া আরম্ভ করল কে?

কে আর? ভটকাই। লানাবাই কে, লানাবাই কী? এসব।

লালাবাই?

 বলেই ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, লালাবাই? ঘুমপাড়ানি গানের ইংরেজি। কী রে রুদ্র, জানিস না তুই?

ভীষণ রাগ হয়ে গেল আমার। বললাম, সাতসকালে উঠে মানুষকে কনফিউজ করবার জন্যে যদি লালাবাইকে লানাবাই উচ্চারণ করে তাহলে বুঝব কী করে! বিশেষ করে এমন লোকে যদি তা করে, যার ইংরেজি জ্ঞান সম্বন্ধে আমার ধারণাটা আদৌ উঁচু নয়।

বেশ। এবারে থাম। এবং চা খেয়ে তৈরি হয়ে নে। আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।

জামালের বাড়ি গিয়ে পাঁঠার মগজ দিয়ে লাচ্চা-পরোটা খাব না আমরা ব্রেকফাস্টে? সে যে দাওয়াত দিয়ে গেল।

ভটকাই মনে করিয়ে দিল।

সেটা মন্দ নয়। যার মগজ বলে কিছু নেই সেই পাঁঠার মগজ দিয়েই শুরু করা উচিত। আমি বললাম।

কাজমি সাহেবের বাড়িতে কী খাবি তোরা দুপুরে?

এই বাঙালি পেটে দু’বেলা অমন মোগলাই খানা খাওয়া কি ঠিক হবে ঋজুদা? পায়া, লাব্বা, চৌরি, টেংরি কাবাব, সিনা-ভাজা, কবুরার-চাট, চাঁব, গুলহার কাবাব, বটি কাবাব, শাম্মি কাবাব, শিক কাবাব তার পর উমদা বিরিয়ানি…।

তার ওপর ফিরনি…ভটকাই বলল, আমার কথা কেটে।

ঠিক বলেছিস। সকাল সকাল গিয়ে কাজমি সাহেবকে ওঁর দাওয়াতটা পোস্টপন করতে বলতে হবে। আমরা তো আছিই। পরে একদিন হবে। আমরা তো ওঁদের সকলকে নেমন্তন্ন করব একদিন। এখানে।

রাঁধবে কে?

কেন আমি, আমরা। আর জেঠুমনির বন্ধু বদি জেঠুর বাড়ি থেকে ওড়িশাবাসী রাঁধুনি পটা ঠাকুরকে ধরে নিয়ে আসব। সে যে বাঙালি রান্না রাঁধে একবার তা খেয়ে দেখতে পেলে মোগল নবাবেরা তাদের বাবুর্চিদের কোতল করে দিত।

বদি জেঠু কে?

বদি রায়। ধানবাদের কাতরাসের মুষ্টিমেয় বাঙালি কয়লা খাদানের মালিকদের মধ্যে একজন। হ্যাঁ, পয়সাওয়ালা মানুষ জেঠুমনির দয়াতে অনেকই দেখেছি কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে অমন রহিসি’ বেশি মানুষের মধ্যে দেখিনি। কয়লা খাদান সব যখন সত্তরের গোড়াতে জাতীয়কৃত হল, তারপর বদি জেঠু তাঁর প্রিয় জায়গা হাজারিবাগে কাতরাস থেকে পোঁটলাপুঁটলি গুটিয়ে এসে থিতু হলেন। এই সেদিনও আশি বছর বয়সেও মাথায় হেডব্যান্ড বেঁধে ব্যাডমিন্টন খেলতেন নাতিপুতিদের সঙ্গে। এত দামি দামি বন্দুক, রাইফেল, এতরকম ক্যামেরা আর কোনও বাঙালির বাড়ি দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

তারপর বলল, গোপালদের ভাইয়ের মতো ছিলেন তাঁর ভাইপো প্রণবদা, নর্থব্রুক কোলিয়ারির। মানভূমিয়া ভাষায় নাকি নাকি সুরে কথা বলতেন ওঁদের সঙ্গে মজা করে। খুব ভাল ট্র্যাপ ও স্কিট-শুটার ছিলেন প্রণবদা। অলিম্পিকেও গেছিলেন।

এই তোমার দোষ ঋজুদা। একজনের কথা উঠলে তোমার স্মৃতির মালগাড়ি আজকাল ডিরেইলড হয়ে যায়। গ্র্যান্ড কর্ড থেকে মেইন লাইনে চলে যাও, মেইন লাইন থেকে গ্র্যান্ড কর্ডে।

ভটকাই বলল।

ঋজুদা হেসে ফেলে বলল, সরি। কথাটা ঠিকই বলেছিস। আজকাল বড় নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি। বুড়ো হচ্ছি না কি রে?

তোমাকে বুড়ো হতে দিচ্ছে কে?

ঋজুদা বলল, যা, তৈরি হয়ে নে। চা খেয়েছিস তো?

না। এখনও দেয়নি তবে নিয়ে আসছে বোধ হয়।

তবে চা খেয়ে তোরা তৈরি হয়ে নে, আমিও চা খেয়ে পাইপটা ধরিয়ে বুদ্ধির গোড়াতে একটু ধোঁয়া দিয়ে নি। রাতে তো নাটক আছে। স্ট্র্যাটেজিটা এঁকে ফেলতে হবে।

কাজমি সাহেব যা বললেন, তাতে জানা গেল যে নাসির মিঞা, মানে, যার বিয়ে, তাকে তো উনি চেনেন। পাগমলে নাসিরের একটা জামা কাপড়ের দোকান আছে। নাসিরকে চিনলে ওর বন্ধুবান্ধবদের খুঁজে বের করাও অসুবিধের নয়। তবে কাজমি সাহেবের বরাতির দাওয়াত নেই। বউভাতের দাওয়াত আছে। আর নীলগাই তো ওরা বিয়েতেই বানাবে বরাতিদের জন্যে।

ওই কাল্লু মিঞা লোকটাকেও উনি চেনেন। বললেন, যদি ওই কাল্পই সেই কালু হয়। কাল্লু মিঞা কসাই। বড় মসজিদের কাছে ওর বড়াগোস্তের দোকান আছে। সে যে চোরাশিকারও করে, সে খবরও তাঁর কানে এসেছে কিন্তু সাবুদ-প্রমাণ ছাড়া ধরবেন কী করে! গোস্তের সঙ্গে পুরনো এবং ঘনিষ্ঠ খদ্দেরদের মাঝে মাঝে শম্বর, কোটরা চিতল আর নীলগাইয়ের মাংসও সাপ্লাই দেয় চড়া দামে, এও শুনেছেন।

কাজমি সাহেব তো বলছিলেন বরাতিরা তো আস্ত একটা নীলগাই খেয়ে উঠতে পারবে না। অন্য নানা পদও তো থাকবে। বাকিটা কাল্লু মিঞা নিশ্চয়ই বিক্রি করে দেবে ভাল মুনাফাতে।

ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, হবে হয়তো।

 ইতিমধ্যে চৌকিদার ট্রে-তে করে চা নিয়ে এল।

 ঋজুদা বলল, দাঁড়া। সাজ কোম্পানির বিস্কিট এনেছি সঙ্গে। খেয়ে দেখ। কেষ্টদার কোম্পানির বিস্কুট বিস্কুট তো নয় যেন ছেলেবেলার হান্টলি-পামার।

আমরা খেয়ে দেখলাম চায়ের সঙ্গে। সত্যিই চমৎকার বিস্কিট। নানারকম প্যাকে দিয়েছেন উনি ঋজুদাকে। ব্রিটানিয়ার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে সহজেই।

এই কেষ্টদা কে ঋজুদা?

কেষ্টধন পাল। খুব বড় একজন বাঙালি ব্যবসাদার-কাম-শিল্পপতি। আজকাল কাগজে ওঁর একটি ইন্টারভিউ বেরিয়েছিল, পড়িসনি?

আমি বললাম, না। মিস করে গেছি। যদিও আজকাল’ আমি রোজই রাখি।

 কাজমি সাহেবের বাড়িতে, জামালের বাড়িতে নাস্তা করে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তার আগেই একরামের বাড়ি থেকে দাওয়াত পেছোনোর কথা ওঁকে একরামই জানিয়ে দিল আমাদের কথামতো। একরাম জামালের চাচেরা ভাই।

কাজমি সাহেব বললেন, আজ সন্ধের সময়ে হুজ্জোতি আছে তাই হড়বড়ি হবে দুপুরের খাওয়াতে। ভাল করে জমিয়ে খেতে পারবেন না। ভালই হল পোস্টপন করে।

তারপর বললেন, শুনুন। সন্ধেতে আপনাদেরই ব্যাপারটাতে লিড নিতে হবে। আমি বা আমার অ্যাডিশনাল ডি এফ ও আজ জঙ্গলে গেলে ওদের সন্দেহ হবে। তবে আমি নিজে অপেক্ষা করব হারহাদের বাংলোতে।

ওরা বুঝতে পারবে না?

না। চেকনাকা দিয়ে ঢুকব না। নতুন শর্টকাট দিয়ে, যে শর্টকাট দিয়ে আপনারা কাল বিকেলে চুকেছিলেন তা দিয়ে ঢুকে আসব মন্টুবাবুর অ্যাম্বাসাডরে। জিপও আনব না। আসবও মুফতিতেই।

মুফতিটা কী ব্যাপার?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

 ঋজুদা হেসে বলল, মুফতিতে’ মানে, প্লেইন ড্রেসে। অর্থাৎ ইউনিফর্মে নয়। ইংরেজিতেও এই শব্দ চালু আছে।

ও। ভটকাই বলল।

 আমিও জানলাম শব্দটি। আগে জানা ছিল না।

আপনারা যা সাহায্য চাইবেন পাবেন। কিন্তু ব্লুবুলটাকে মেরে ফেলার আগেই ওদের ধরতে হবে। ব্যাপারটা কিন্তু খুবই রিস্কি হবে। ওরা তো আর্মডই থাকবে। তা ছাড়া ওরা যদিও বলছে যে কালু মিঞা একা বসবে মাচাতে কিন্তু ওরা জানে যে, গুলির শব্দের পরে ফরেস্ট গার্ডেরা যদি সে আওয়াজ শুনতে পায়, তাহলে তারাও আর্মড হয়ে আসবে এবং একটা কনফ্রনটেশন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই আমার দৃঢ় ধারণা, ওদের দলে আরও দু-তিনজন, কম হলেও আর্মড থাকবে। ওরা এও জানে যে, চেকনাকাতে ওয়্যারলেস আছে এখন। ওয়্যারলেসে খবর পেলে শালপর্ণীর গার্ডরাও চকিতে চলে আসবে। হাজারিবাগ থেকে পুলিশ ফোর্সও আসবে প্রয়োজনে।

তারপর বললেন, আমার সঙ্গে পুলিশের এস. পি. পাসোয়ান সাহেবেরও কথা। হয়েছে। আমারই সাজেশনে উনি ওঁর আর্মড পুলিশের একটি ক্র্যাক প্লাটুন। রাখবেন ট্রাকে করে রাজডেরোয়ার চেকনাকার ওদিকে। মানে, বহির দিকে। এই আধ কিমি মতো দুরে। তারা এসে ছোট্ট ট্রাকের বনেট খুলে পথের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকবে বরহি-হাজারিবাগ রোডে। ঠিক সন্ধের মুখে মুখে। যে সব গাড়ি বা বাস বা ট্রাক যাতায়াত করবে ওই পথে, তারা ভাববে, এঞ্জিন ট্রাবল হয়েছে। পুলিশের ট্রাকেও ওয়্যারলেস থাকবে। চেকনাকা থেকে খবর পেলে তারা দশ মিনিটে স্পটে পৌঁছে যাবে। নাজিম সাহেবের কবরখানা হয়ে আমরা এই নওজওয়ানদের রাজডেরোয়ার টাইগার-ট্র্যাপ দেখিয়ে জায়গাটাতে একবার যাব। তবে আমি নিজে যাব না। আমি রাজডেরোয়া থেকে ব্যাক করব।

কেন?

বাঃ। আমাকে যে সকলেই চেনে। আমি চেকনাকা অবধি গেলেই জানাজানি হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমার ডিপার্টমেন্টের সকলেই যে ধোওয়া তুলসিপাতা এমন তো নয়। ওদের চর কেউ কেউ তো থাকবেই। তাই আমার বদলে আমি আপনাদের সঙ্গে দেব শত্রুঘ্ন পাণ্ডেকে।

সে কে?

সে আমার সীমারিয়ার ফরেস্ট গার্ড। ডেয়ার ডেভিল। বন্দুকের হাতও খুব ভাল। ফরেস্ট গার্ডদের তো শটগানই দেয়। রাইফেলও দেয় থ্রি-ফিফটিন বোরের। তবে ও বন্দুকেই সড়গড়। ও তিন-চারবার পোচারদের ধরেওছে। ওর ওপরে গুলিও চলেছে দু’বার। একবার তো বুকে গুলি লেগেছিল। তবে গান-শট এবং দূর থেকে মারাএল. জির দানা লেগেছিল বাঁদিকের বুকে-একেবারে হার্টের ওপরে–তবে পেনিট্রেট করতে পারেনি বলে হাসপাতালে কয়েকদিন থেকে ছাড়া পেয়েছিল। ও দু’বার গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল।

ঋজুদা বলল, আমরা তো সিভিলিয়ান। আমরা যে তাদের এক্তিয়ারে ঢুকে এই সব কাণ্ডমাণ্ড করব, তাতে পুলিশের আপত্তি হবে না? তা ছাড়া যদি আমাদের গুলিতে পোচারদের কেউ মরে অথবা আহত হয় অথবা পোচারদের গুলিতে আমাদের কেউ–তাহলে নানারকম আইনি গোলমালও তো হবেই। তার কী করা যাবে?

সে সবও ভেবে নিয়েছি আমরা এবং পাসোয়ান সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়েছি। আপনাদের গুলিতে পোচারদের কেউ মারা গেলে তার দায়িত্ব পুলিশের। এস পি সাহেব নিজে নেবেন। বলা হবে, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। আর পোচারদের গুলিতে আপনাদের কেউ মরলে বা আহত হলেও তো পুলিশ কেস হবেই, তাই আপনাদের বন্ড সই করে নিতে হবে। তবে ঋজুবাবু একাই তো ইনভলভড হবেন, উনি বন্ড দিলেই হবে, খোকাবাবুদের নিতে হবে না। যেতেও হবে না।

আমার কান গরম হয়ে লাল হয়ে গেল। ভটকাই দেখলাম ওর জগিং শু্যর মধ্যে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটাকে ঘন ঘন আন্দোলিত করছে।

ঋজুদা চকিতে আমাদের মুখে একবার চেয়ে নিয়েই গলা খাঁকড়ে বলল, কাজমি সাহেব, আপনি বোধ হয় জানেন না যে এই রুদ্র আর ভটকাই ছেলেমানুষ হতে পারে, এরা আমার সঙ্গে দেশের বহু রাজ্য ছাড়া আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি প্লেইনস, গুগুনোগুম্বারের দেশে, রুআহা নদীর উপত্যকায় রুআহাতে, আফ্রিকা ও ভারতের মধ্যে ভারত মহাসাগরের স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জেও গেছে। গেছে, কখনও ম্যানইটার বাঘের মোকাবিলা করতে, কোথাও বিদেশি জলদস্যুদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের ইতি টানতে। গোয়েন্দাগিরি করতেও গেছে নানা জায়গাতে। ইন ফ্যাক্ট, একবার তামিলনাড় ও কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীরা যুগ্মভাবে কোল্লেগালে বীরাপ্পনকে ধরার জন্যেও বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমাকে। এবং তখনও এদের আমার সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। পরে অবশ্য এই দুই সরকার তাদের নিজ নিজ রাজ্যের পুলিশ ও আমলারা অপদস্থ হবেন এই অজুহাতে সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে নেন। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম।

আমার এই দুই খুদে সাকরেদ সবরকম আগ্নেয়াস্ত্রই চালাতে এবং বন ও বন্যপ্রাণী এবং চোরাশিকারিদের মোকাবিলা করতে যথেষ্টই পারগ। আপনি যদি চান তবে আমার এই দুই অ্যাসিস্ট্যান্টের মস্তিষ্ককে আপনার ডিপার্টমেন্ট এবং পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জওয়ানদের ট্রেনিংয়ের কাজেও লাগাতে পারেন।

কাজমি সাহেব খুবই বিব্রত হলেন। ঋজুদার গলাতে হয়তো একটু উষ্মাও লেগে থাকবে। কিন্তু কাজমি সাহেব কিছুমাত্র বলবার আগেই ঋজুদা বলল, আপনার এই হারহাদের কালু মিঞাদের শিক্ষা দেওয়াটা এদের কাছে এতই সামান্য ব্যাপার যে এদের দু’জনেরও একসঙ্গে যাবার দরকার হবে না। বন্ড শুধু একজনই সই করবে। ওয়ান ইজ এনাফ। বন্ডগুলো পাসোয়ান সাহেব আমাকে আজ ভোরেই পাঠিয়ে দিয়েছেন সিলডকভারে।

তাহলে বোস সাহেব, আপনারা তিনজনেই সই করে দিন। যাতে আমি বেরোবার আগে কারওকে দিয়ে এস পি সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারি।

ঋজুদা বলল, বললামই তো কাজমি সাহেব যে, ওদের মধ্যে একজনই সই করবে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কে?

‘কেবা আগে প্রাণ করিবেক দান’? আমার ও ভটকাইয়ের মুখ দেখে ওদের যেন তাই মনে হচ্ছিল। ঋজুদা অধুনা ভারতের আমলাতন্ত্রে চালু হয়ে যাওয়া টপকানো-টপকানো খেলায়, যাকে ভটকাইয়ের হামদু বড় বলেন ‘supersession’, তাতে শামিল হয়ে বলল, রুদ্রই করুক সই। ভটকাইয়ের চেয়ে ওর অভিজ্ঞতা বেশি, মাথাও অনেক ঠাণ্ডা।

আমি মনে মনে বললাম, হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল? কে কালু মিঞা! ফুঃ!

আমি এরপরে ভটকাইয়ের দিকে তাকিয়ে ওর অপ্রতিভতাকে আর মিছিমিছি বাড়ালাম না। বাড়ালাম না এই জন্যে যে, ছেলেবেলা থেকেই যোগ্য প্রতিপক্ষর কাছে হার স্বীকার করে নেওয়াটাকে ধাতস্থ করে নিতে পারলে জীবনে, যথাসময়ে নিজেও যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়া যায়। এই হার মেনে নেওয়াটা সহবত-এর মধ্যেই পড়ে। ঋজুদাই একদিন বলেছিল, বুঝলি রে, শিক্ষা শুধু বইয়েই থাকে না, প্রতিদিনের জীবনেও থাকে। চলতে চলতে যে সেই সব শিক্ষার টুকরোটাকরা লক্ষ করে চলার পথের দু’দিক থেকে নিজের ঝুলিতে তুলে নিতে পারে, সেই মানুষই কিন্তু পরে শিক্ষিত বলে পরিচিত হয়।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর কাজমি সাহেব বন্ডের কাগজটি এগিয়ে দিলেন, বললেন স্ট্যাম্প, সইসাবুদ সব ডি সি সাহেব করিয়ে দেবেন। কাগজটা পুলিশ সাহেব পাসোয়ান সাহেবকে পাঠিয়ে দিলেই আমার কর্তব্য শেষ। নাও, সইটা করে দাও বাবা।

তারপর বললেন, ইন ফ্যাক্ট, ডি সি সাহেবের কাছে পাসোয়ান সাহেব একটু বকুনিই খেয়েছেন।

বকুনি কেন?

 ঋজুদা শুধোল।

 বকুনি এই জন্যে যে, আমার ডিপার্টমেন্টের কেউ যা পারল না, পারল না পুলিশ ডিপার্টমেন্টেরও কেউও, আর তাই কিনা করছেন কলকাতা থেকে বেড়াতে আসা টুরিস্টরা! এতে কি বিহারের পুলিশ ও বনবিভাগের মান বাড়ে?

ঋজুদা বলল, তা কেন? এটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। এতে তো কারওরই মান বাড়া কিংবা কমার প্রশ্ন নেই। এই চোরাশিকারের সমস্যাটা সারা ভারতবর্ষে এমনই এক পর্যায়ে চলে এসেছে যে, এখন মান নিয়ে ভাগাভাগি করার চেয়ে বড় হচ্ছে সমস্যাটার মোকাবিলা করা। আরও একটা কথা, রুদ্র আপনাদের কাল্লু মিঞাদের কবজা করতে পারুক অথবা নিজেই ওদের গুলি খেয়ে মরুক মিডিয়াকে ওর নাম জানাবেন না। কোনওরকম প্রচারেরই প্রয়োজন নেই।

সেটা ঠিক।

কাজমি সাহেব বললেন। তারপর বললেন, আপনারা তাহলে এখোন কবরখানার দিকে নাজিম মিঞার কবরে ফুল দিতে। বিকেলে আমি হারহাদে গিয়ে পৌঁছচ্ছি ঠিক চারটের সময়ে।

তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, তাহলে তুমি বেটা জিম্মাদারি নিও। পুলিশ অথবা বনবিভাগের যাঁরা থাকবেন ওই অপারেশনে তাঁদের পাসওয়ার্ড হিসেবে তুমি বলবে কাউয়া’। মানে কাক। কাকের ডাক ডাকলেও দু’পক্ষেই জানবে যে মিত্রপক্ষ। ওদেরও এই পাসওয়ার্ডের কথা বলা থাকবে।

ঠিক আছে।

আমরা আমাদের গাড়িতে নাজিম সাহেবের দোকান বেঙ্গল ফ্যান্সি স্টোর্সে যেতেই জামাল অ্যান্ড কোম্পানি হইহই করে তেড়ে এল গাড়ি থেকে নামতে হবে বলে। ঋজুদা অনেক বুঝিয়ে জামালকে গাড়িতে তুলে নিল। বলল, আমরা তো আছি দিনকতক৷ পরে আসব, বসব, গল্প করব। তাড়া কীসের?

বাজারের মধ্যে দিয়ে কিছুদূর যেতেই পথে ভিড় কমতে লাগল। তারপর ফাঁকায় এসে পড়লাম। ঋজুদা বলল, আমাদের দেশের কোনও পথই আর নির্জন থাকবে না–সব পথেরই দু’পাশে বাড়ি হয়ে যাবে, সব শহরেই পপুলেশন এক্সপ্লোশান হবে। সুকুমার রায়ের খুড়োর কলের সামনে যে মাংসর টুকরো বাঁধা ছিল, সেই টুকরো আর খুড়োর মুখের মধ্যে দূরত্ব চিরদিন একই থেকে যাবে।

আমাদের দেশের দারিদ্র্য, প্রয়োজন–এসবের কোনওদিনও নিরসন হবে না যদি না জনসংখ্যা পিস্তলের নল দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিয়ন্ত্রণ যা হচ্ছে তা সচ্ছল মহলে, শিক্ষিত মহলে, যেখানে না হলেও চলত। কিন্তু অসচ্ছল মহলে এবং কোনও কোনও ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে চিন্তিত হবার কারণ আছে বইকী। হাজারিবাগে তো আমি বহুবার এসেছি ছেলেবেলা থেকে, কিন্তু মুসলমানদের সংখ্যা কখনও এত ছিল না। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িতরা এসেও জুটেছে আর এমনিতেই স্থানীয় মানুষদের মধ্যে জিওমেট্রিক প্রগ্রেশনে সংখ্যা বেড়েছে। বুঝলি রুদ্র, ভারতবর্ষ আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পাকিস্তান হয়ে গেলে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই, খুব অবাক হবার কিছু থাকবে না। পঞ্চাশ বছর অবধি আমি বেঁচে থাকব না কিন্তু দূরভিসন্ধিসম্পন্ন ধান্দাবাজ মানুষেরা জেনেশুনেই সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে দেশটাকে। দিচ্ছে কি, দিয়েছে।

তারপর বলল, কী হে জামাল, তুমি কী বল? খারাপ বলেছি আমি?

না ঋজুবাবু, খারাপ বলেননি। তবে মুসলমান বাড়লে ক্ষতি নেই কিন্তু ভারতবর্ষে থাকব আর রেডিয়ো পাকিস্তান ছাড়া কিছু শুনব না, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের খেলা হলে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করব, এটা চলতে পারে না।

তুমিই বল? ডুডুও খাব টামাকও খাব, সেটা কি ঠিক?

বলেই বুঝল যে, উপমাটা জামালের হজম হবে না। বুঝেই ভটকাইকে বলল, translate করে বল ভটকাই।

কোন ভাষায়? হিন্দিতে, উর্দুতে বা ইংরেজিতেই।

 দাঁড়াও। ভাবি। তুমি যা বলছিলে বল।

জামাল বলল, এ কথা আমার আব্বা সব সময়েই বলতেন, মুসলমানদের ভারতে বাস করতে হলে ভারতীয়ত্বে সম্পৃক্ত হয়েই থাকতে হবে। নইলে হিন্দুরা আমাদের সহ্য করবে কেন? পাকিস্তান তো তারা চায়নি, আমরাই চেয়েছিলাম। মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাজ্য চেয়ে স্লোগান তুলেছিলাম ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। পাকিস্তান পাওয়ার পরে এখানে অন্য পাকিস্তান গড়তে চাইলে হিন্দুরা তা মানবে কেন? তারা কি ডরপোক, কাপুরুষ? তারা কি নির্বোধ?

এই পথটা কোনদিকে গেছে?

আমার এই সব ধর্ম, তত্ত্বের কচকচানি ভাল লাগছিল না। আমি বললাম তাই।

এই পথ দিয়েই তো গোপাল, সুব্রত, লালাদারা নাজিম সাহেবের খামার কুসুমভাতে যেতেন। বনখেতিতে। আরও এগিয়ে গেলে বনাদাগ বলে একটা বস্তি পড়বে বাঁয়ে। সেখান থেকে মাইল তিন-চার হেঁটে যেতেন বন্দুক কাঁধে করে ওঁরা।

এই পথটা কোথায় গেছে?

ওঃ সরি। এটা গেছে টুটিলাওয়া, সীমারিয়া, হয়ে সোজা বাঘরা বা জাবড়া মোড়। সেখান থেকে বাঁয়ে গেলে চান্দোয়া-টোড়ি আর ডাইনে গেলে চাতরা।  

একটু পরই গাড়ি থামল। আমরা নামলাম কবরখানায়। সীমারিয়ায় যেতে পথের ডানদিকে পড়ে। গাছগাছালির নীচে নীচে কবরগুলি শুয়ে আছে। মুসলমান আর খ্রিস্টানদের এই ব্যাপারটা বেশ লাগে আমার।

আমি বললাম, মানুষ মরে গেলেই প্রিয়জনদের মন থেকে মুছে যায় না একেবারে। জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে ফুল দেওয়া যায় এসে, এই তুমি যেমন আজ মোমবাতি জালাচ্ছ তেমন মোমবাতি দেওয়া যায়।

তা ঠিক। তবে পারসিরা যে উঁচু টাওয়ারে রেখে মৃতদেহকে শকুন কাক-চিল-পেঁচা দিয়ে খাওয়ায়, সেটা কীরকম?

ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, পারসিরা সূর্যের উপাসক। ওদের প্রাণ-ছেড়ে-যাওয়া শরীরও যাতে নষ্ট না হয়, পাখিদের আহার হয় যাতে, সে জন্যেই অমন করে। প্রত্যেক ধর্মেরই আলাদা আলাদা আদর্শ থাকে। সবই ভাল। আমরা বলি, আত্মার মৃত্যু নেই, শরীরের আছে। আত্মার মুক্তিই আমাদের প্রার্থনার।

বলেই বলল, ওই দেখ। পাথরের ফলকটা।

আমরা দেখলাম একটা বড় শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা আছে লালা, গোপাল, সুব্রত এবং ভুতোর নাম। নাজিম সাহেবের স্মৃতিতে। যে নাজিম সাহেবের সঙ্গে এই অঞ্চলের নানা বনে, পাহাড়ে তাঁদের বড় সুখের দিন কেটেছে তাঁরই স্মৃতিতে।

কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে, ফুল রেখে আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলাম। তারপর গাড়িতে বসে, জামালকে তার দোকানে নামিয়ে দিয়ে আবার রাজডেরোয়র দিকে ফিরে চললাম।

গাড়িটা ছেড়ে দিতেই ঋজুদা হেসে বলল, কাণ্ডও করত বটে নাজিম সাহেব।

কী?

সুব্রতকে ডাকত সুরবোতবাবু বলে।

 কেন?

কে জানে। দাঁত ভেঙে যেত বোধহয় উচ্চারণ করতে।

ঋজুদা বলল, অ্যাই দেখ হাজারিবাগ ক্লাব। জেঠুমনির সঙ্গে এসে একবার ছিলাম এখানে। আর ওই পুলিশ ট্রেনিং কলেজ। পুরনো। নতুন একটা হয়েছে বিরাট, বগোদরের পথে।

ভটকাই বলল, যত পুলিশ-ট্রেনিং কলেজ হচ্ছে ততই আইনকানুন লাটে উঠছে।

যা বলেছিস।

 আমি বললাম।

ওই দেখ! বাঁদিকে রিফরমেটরির পথ গেছে। তারপর বিখ্যাত হাজারিবাগ জেল। আর ওই দেখ, ডানদিকে, গোপালদের বাড়ি পূর্বাচল। কত গল্পই যে শুনেছি এই বাড়ির লালাদার কাছে।

এখানে সুব্রতদের বাড়ি ছিল না?

থাকবে না কেন? ওদের বাড়ি ছিল কানারি হিল রোডে। কাল যখন কানহারির বাংলো দেখাতে আনব, তোদের দেখাব। সুব্রতর বাবা তো হাজারিবাগের এস পি সাহেব ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে। রিটায়ার করেন অবশ্য স্বাধীনতার পরে।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল চেকনাকাতে পৌঁছতে রাজডেরোয়ার। এই এখন আমরা প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকছি। ওই দেখ উলটো দিকে শালপর্ণী। ভিতরে আছে। এখান থেকে দেখা যাবে না। কাল শালপর্ণীও দেখাব এখন।

চেকনাকা দিয়ে ঢুকে কিছুটা গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাঁদিকে একটু গেলেই Tiger’s Trap! একটি বিরাট বাঁধানো কুয়ো। বিরাট মানে, যেরকম কুয়ো আমরা সচরাচর দেখে অভ্যস্ত তেমন কুয়োর পনেরো কুড়িটার সমান হবে এর পরিধি। সেই শুকনো কুয়োর নীচ থেকে একটা সুড়ঙ্গ উঠে এসেছে কিছুটা দূরের জমিতে। তার মুখে একটি শক্ত করে বানানো সিমেন্টের গেট। সেই গেটের মুখে মোটা মোটা লোহার গারদ দেওয়া খুব শক্ত লোহার ফ্রেমের খাঁচা। সেই কুয়োর ওপরে হালকা কাঠকুটোর এবং পাতা-টাতার আচ্ছাদন দিয়ে কুয়োর এক প্রান্তে একটা গোরু কিংবা পাঁঠা বেঁধে রাখা হত। এমনভাবে তা রাখা হত, যাতে বাঘকে তাকে ধরতে হলে ওই কুয়োর ওপরের আচ্ছাদনের ওপর দিয়েই আসতে হত এবং তাই। আসতে গিয়ে বাঘ কুয়োতে পড়ে প্রচণ্ড হাঁকাহাঁকি করত। সেই হাঁকাহাঁকি দু-পাঁচ মাইল দূর থেকেও শোনা যেত। বাঘ বেচারি লাফিয়ে লাফিয়ে কুয়ো থেকে উঠে আসতে চাইত এবং ধাঁই-ধাঁই করে আছাড় খেত। কয়েক দিন খাবার এবং জল ছাড়া ওইভাবে তাকে কুয়োবন্দি রাখার পর সে যখন খুবই ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে যেত তখন সেই সুড়ঙ্গের ওপরের মুখে লোহার খাঁচার মুখে একটি পাঁঠা দিয়ে দেওয়া হত। বাঘ সুড়ঙ্গ বেয়ে পাঁঠা ধরতে উঠে আসতেই খাঁচার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত। তারপর বিরাট পালকি করে তাকে নিয়ে যাওয়া হত।

কোথায়?

তা আমি ঠিক জানি না। এমনও হতে পারে যে, চিড়িয়াখানাতে বিক্রি করা হত বা অন্য কোনও রাজা-মহারাজকে বা ব্রিটিশ গভর্নর প্রমুখকে উপঢৌকন দেওয়া হত অথবা অন্য কোনওদিকে নিয়ে গিয়ে, যেখানে বাঘ নেই, বা কম, সেখানে ছেড়ে দেওয়া হত।

এই ব্যাপার! ভটকাই বলল! কী এমন বাহাদুরি!

বাহাদুরি না বলে রাজাউড়ি বল।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, কটা বাজে রুদ্র?

আমি ঘড়ি দেখে বললাম, এ কী, সাড়ে দশটা!

ভটকাই বলল, ইর লাইগ্যাই কয় টাইম ফ্লাইজ।

 ঋজুদা বলল, ঠিক করলাম আজকে তোদের ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে কটেজ, প্রধান বাংলো, ওয়াচ টাওয়ার–এই সব না ঘুরিয়ে চল বিকেলের রঙ্গমঞ্চটাই ভাল করে পরীক্ষা করি। আমার মনটা ভাল লাগছে না। কাজমি সাহেব নিজেও থাকছে, অবশ্য না-থাকার সঙ্গত কারণ আছে। তার ওপরে আমিও থাকছি না। রুদ্র একা। প্রতিপক্ষও ঘাঘু। তারা যে নিয়মিত চোরাশিকার করে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে এবং কাজমি সাহেবও তা জানেন।

সবাই সব জানে তবুও পুলিশ ওদের ছেড়ে রেখেছে কেন এতদিন কে জানে!

আরে জানলেই তো হল না। সাবুদ-প্রমাণের তো দরকার। তা ছাড়া শুনলি না কাল্লু মিঞা কী বলল কালকে! অপরাধ করলেই যদি জেলে যেতে হত, তবে তো হাজারিবাগ জেলে জায়গা হত না।

আমি বললাম।

গত রাতে ওরা যেখানে টেম্পোটা ঘুরিয়েছিল সেইখানে, জঙ্গলের মধ্যের বড় রাস্তা ছেড়ে হারহাদ বাংলোর পথে, সেই জায়গাটাকে আমরা আন্দাজ করে নেমে গেলাম। পাছে ড্রাইভার কিছু সন্দেহ করে, তাই ঋজুদা তাকে বলল, আমরা হেঁটেই যাব বাকি পথটুকু জঙ্গলে বেড়াতে বেড়াতে। তুমি বরং গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ঝুমরি তিলাইয়া চলে যাও। গিয়ে পোস্টমাস্টারবাবু অমল সেনগুপ্তকে বলে এস যে আগামীকাল রবিবার, উনি আমাদের সঙ্গে হারহাদেই খাবেন। তুমি গাড়ি নিয়ে গিয়ে ওঁকে নিয়ে আসবে এবং আবার বিকেল বিকেল পৌঁছে দিয়ে আসবে। উনি যেন মাছ-টাছ কিছু না আনেন, আমরা ভোরে বরহিতে গিয়ে নিজেরাই মাছ কিনে নিয়ে আসব।

ভটকাই বলল, এভাবে নেমন্তন্ন করাটা কি ভদ্রতা হবে? দু’লাইন লিখে দিলে হত না?

ঠিক বলেছিস। ঋজুদা বলল। তারপর বলল, দেখ তো রুদ্র, ভটকাই মাঝে মাঝে ঠিকও তো বলে। তুই-ও ওর পেছনে লাগিস। রুদ্র, তুই তো আমাদের মধ্যে একমাত্র লিটারেটর। লিখে দে দু’কলম। তোর সইও থাকবে। অমলবাবুর স্ত্রী আবার তোর ঋজুদা কাহিনীর খুবই ভক্ত।

হিপ পকেট থেকে পার্স বের করে তার মধ্যে থেকে কাগজ বের করে দু’ছত্রে নিমন্ত্রণ লিখে দিলাম অমলবাবুকে। শেষে লিখলাম, আসা চাই-ই-ঋজুদা, আমার এবং ভটকাইয়ের পক্ষে।

লেখা হয়ে গেলে কাগজটা ড্রাইভারকে দিয়ে দিলাম।

ঠিক হ্যায় সাব। বলে, সে চলে গেল। ভটকাই বলল, উনসে দো লাইন লিখাকর লানা

ক্যা লিখাউঙ্গা?

আরে উনোনে দাওয়াত মে আ রহাঁ হ্যায় ক্যা?

ওহ। সমঝা।

গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে ড্রাইভার চলে গেলে আমি বললাম, কাটালে তো!

না কাটিয়ে উপায় কী? তোর ভালর জন্যেই করতে হল। এবারে কথা না বলে চল নামি এই পাকদণ্ডিটাতে।

নেমে দেখলাম, জায়গাটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন এবং হারহাদ থেকে একটা শাখা বয়ে গেছে ওই দোলামতো জায়গাটা দিয়ে। নীলগাইয়ের পায়ের দাগ তো আছেই, কোটরা, শুয়োর, শজারু এবং একটি চিতার পায়ের দাগও আছে নালার পাশের নরম বালিতে। যে লোকটা মাচান বানিয়েছে সে রাজডেরোয়ার মধ্যে জানোয়ারদের রাহান-সাহানের খোঁজ রাখে। মিনিট দশেক হেঁটে গিয়ে মাচানটাকে দেখা গেল। সামান্যই উঁচুতে বাঁধা একটা পন্নন গাছে। একজন বেশ আরামে বসতে পারে।

ঋজুদা বলল, রুদ্র, ওই বড় শিমুল গাছটা দেখছিস পুব দিকে?

 হ্যাঁ।

তোর কিন্তু বিকেল চারটের মধ্যে এসে ওই শিমুলের কাণ্ডের একটা পার্টিশনের মধ্যে বসে থাকতে হবে। আমার ধারণা নীলগাইয়ের দল উলটো দিক থেকে এসে এই দোলা ধরে হারহাদ নালাতে যাবে। ওরা মাচানের রেঞ্জের মধ্যে আসার আগেই তুই তোর শটগান দিয়ে মাটিতে নীলগাইয়ের ঝুণ্ডের সামনে একটা গুলি করবি চার নম্বর শট দিয়ে।

চার নম্বর দিয়ে কেন?

আরে এমন অ্যাঙ্গেলে গুলিটা করবি যাতে ছররার দানাগুলো ফরফরিয়ে অনেকখানি জায়গাতে শুকনো পাতা ও কাঠকুটোতে গিয়ে পড়ে। তাতে নীলগাইয়ের দলের মধ্যে ত্রাসটা অনেক বেশি ছড়াবে।

তাতে কী হবে?

তারা মাঈরে মাঈ বলে অ্যাবাউট টার্ন করে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই দৌড়ে পালাবে। তোর গুলির আওয়াজে কাল্লু মিঞা ভাববে, হয় অন্য চোরাশিকারি গুলি করেছে, নয় পুলিশ বা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক। শত্রুঘ্ন পাণ্ডেকে আমি ব্রিফ করে দেব, যাতে ও টেম্পো হোক কি ট্রাক যা নিয়েই পোচারের দল হারহাদের পথে ঢুকে আসবে, তাদের মোকাবিলা করবে।

সেই ট্রাকে বা টেম্পোতে যদি কারও কাছে আর্মস থাকে?

থাকতে তো পারেই। আর পারে বলেই তো কাজমি সাহেব শত্রুঘ্নকে আনিয়েছেন সীমারিয়া থেকে। আর্মস থাকলে দু’পক্ষই গুলি চালাবে। এবং ওদের ভেহিকলের শব্দ শোনামাত্রই তুই আর একটা গুলি শূন্যে ছুঁড়ে তাদের দিকে এগিয়ে যাবি শত্রুঘুকে সাহায্য করার জন্যে।

আর কাল্লু সিং?

কাল্লু সিংয়ের ভার নেব আমি আর ভটকাই এবং হয়তো কাজমি সাহেবও।

 মানেটা বুঝলাম না।

 সব না বুঝলেও চলবে। প্রথমত, তোর প্রথম গুলি এবং দ্বিতীয় গুলির আওয়াজ শুনে এবং দ্বিতীয়ত ঘোড়ফরাসের ঝুণ্ড ভাগলবা হওয়ায় এবং তৃতীয়ত তোর বন্দুকের আওয়াজকে কালু মিঞার বন্দুকের আওয়াজ ভেবে ওরা ট্রাক নিয়ে এগিয়ে আসছে তা দেখে…

দেখবে কী করে?

আরে গাধা! হেডলাইটের আলো দেখবে না?

ও হ্যাঁ। কিন্তু দেখ…?

 শুধু দেখবেই নয়, গাড়িটা দাঁড়িয়ে যে গেল, তাও বুঝতে পারবে এবং গুলিগোলার আওয়াজও পেতে পারে।

তখন কাল্লু সিং বিপদের আশঙ্কা করে হয় ওদের দিকে দৌড়ে যাবে, যদি উদার হৃদয় এবং সত্যিই সাহসী হয়। যদি তা না হয়, তবে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে উলটোপানে দৌড়বে, হারহাদের দিকে, যাতে নদীটা পেরিয়ে নতুন রাস্তা দিয়ে বরহি-হাজারিবাগ রোডের যে কোনও একটা জায়গাতে এসে উঠতে পারে। আর উঠতে পারলে তো ট্রাক, বাস, ট্রেকার–কিছুরই অভাব নেই।

তাহলে তো পালিয়েই যাবে। লাভ কী হবে?

ভটকাই বলল।

লাভ হবে রে ভটকাই। তোর লাভই হয়তো সবচেয়ে বেশি হবে।

কীরকম?

তোকেই তখন ধরতে হবে কাল্লু মিঞাকে। আর তুই যদি ঠিকমতো ওকে কবজা করতে পারিস তো কম্ম ফতে। ওকে জেরা করেই কোতোয়ালির বড় দারোগা রামখিলাওন পাঁড়ে অন্য সকলের নাম, ওদের Modus Operandi, সব বের করে নেবে। তুই থাকবি ওই দোলার শেষে। আর আমরা থাকব কাল আমরা পথের যেখানে ছিলাম তার একটু আগে সেই নন্দী-ভৃঙ্গী পাথরগুলোর আড়ালে বসে। কাল্লু সিং যদি হারহাদ বাংলোতে রাস্তা ধরেই পৌঁছতে যায়, তবে আমরাই তাকে ধরব।

আমরা মানে?

মানে, আমি আর কাজমি সাহেব।

 তোমাদের প্ল্যান আমার মাথায় ঢুকল না।

 যখন রঙ্গমঞ্চে খেলোয়াড়েরা সব উপস্থিত হবে, একের পরে এক ‘অঙ্ক’ বদলাবে, তখনই তুই দেখবি তোর অঙ্কের ফল সব ঠিকঠাক আসছে। আর যদি তুই একাই ধরতে পারিস কালুকে আমাদের সাহায্য ছাড়া তবে কোল্লেগালে আমরা যখন বীরাপ্পনের সঙ্গে টক্কর দিতে যাব তখন তোর জায়গা আমার দলে পাক্কা।

ও সব তো মুখেই বল। কোশ্লোগালে তো যাব বলে সেবারেও ন্যাড়া হয়ে টিকিওয়ালা তামিল ব্রাহ্মণও সেজেছিলাম কিন্তু তুমিই তো শেষকালে দিলে সব কেঁচিয়ে।

সব কেঁচাইনি। কেমন মণিপুরে গেলি বল হত্যা-রহস্যের কিনারা করতে। সে কি কম?

আমার আদিখ্যাতা নেই। যাই পাই তাই-ই ভাল।

আরেকবার ভাল করে ঘুরে দেখ শিমুলগাছের গুঁড়ির কোন কম্পার্টমেন্টে থাকবি তুই। শত্রুপক্ষর গুলি থেকে প্রোটেকশনও নিতে হবে, আবার কী ঘটছে না ঘটছে তা চোখে দেখে বা কানে শুনে বুঝতে হবে।

ঋজুদা বলল, আমাকে।

আমাকে সত্যি সত্যিই বর রওয়ানা করিয়ে দেওয়ার মতো করে ঋজুদা রওয়ানা। করিয়ে দিল। শুধু বলল না যে বল, মা আমি তোমার জন্যে দাসী আনতে যাচ্ছি’! তখন চারটে বাজে। সন্ধে অর্থাৎ পুরো অন্ধকার হবে সাতটাতে। তবে কাল যেমন দেখলাম, পুরো অন্ধকার হবে না। বরং গত রাতের থেকেও আরও অনেক উজ্জ্বল হবে রাত। ভটকাইয়ের ভাষায় যাকে বলে উজালা উজালা চার বঁদওয়ালা।

আমার শটগানটা আমি নিয়েছি। কোমরে পিস্তলটাও আছে। ম্যাগাজিন পুরে লোড করে নিয়েছি, চেম্বারেও একটা গুলি আছে। তবে আমার পিস্তলটার একটাই। দোষ, স্টপিং পাওয়ার কম। পয়েন্ট টু টু, স্প্যানিশ, লামা। বানানটা LLAMA, তবে ঋজুদা বলে, তোর ভুল ধারণা এটা। হাত ভাল হলে ওরকম ওয়েপন আর দুটি নেই। গোপালদা নাকি পয়েন্ট টু টু পিস্তল দিয়ে উড়ন্ত তিতির মারত। তা ছাড়া জন কেনেডির ছোট ভাই সেনেটর রবার্ট কেনেডিকেও ওই পিস্তল দিয়েই মেরেছিল আততায়ী। একটা বুলেট মাথায় লেগেছিল। এই উপমাতে আমার হাসি পেত। ভাবতাম, ঋজুদারও মতিভ্রম হয় তাহলে। নইলে তিতিরের সঙ্গে রবার্ট কেনেডির তুলনা করে।

এখন কথা হচ্ছে ‘হাত ভাল হলে’। হাত ভাল হলে তো বাঘের কানের ফুটোতে এয়ার গান দিয়ে গুলি করলেও বাঘ মরে যেতে পারে। অকুস্থলে, অসময়ে, ভয় পেয়ে পিস্তলের ট্রিগার টানলে অনেক সময়েই গুলির বদলে মধু বেরোয়। সবাই তো আর ঋজু বোস বা ক্ষণজন্মা অগ্রজ গোপালদা, লালাদা, সুব্রতদা নয়।

হারহাদ বাংলো থেকে জায়গাটাতে পৌঁছতে আমার আধঘন্টাটাক সময় লাগল। আরও কম লাগতে পারত যদি লাল কাঁকরের পথ ছেড়ে দিয়ে ওই দোলাটার পাশ দিয়ে মাচানে পৌঁছতাম। কিন্তু ঋজুদা মানা করেছিল। দোলার দু’পাশে মাটি ভেজা ও নরম। সকাল বেলাতেও বারবার আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল। আমাদের পায়ের দাগ দোলার দু’পাশে সুন্দরবনের বড়-চামটা ছোট-চামটার গেঁয়ো গরান এবং কেওড়ার পাশে পাশে বাঘেদের থাবার শোভাযাত্রার দাগ যেমন দেখা যায়, তেমন করেই দেখা যেত। আমাদের সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘেদের কারওকেই কেয়ার না করলেও চলে, কিন্তু আমাদের তো অনেককেই কেয়ার করতে হয়। ভাবছিলাম, আমি তো বন্দুকটা নিয়ে এলাম, পিস্তলটাও কোমরের হোলস্টারে। কিন্তু বেচারা ভটকাইয়ের দুর্জয় সাহস এবং অ্যাডভেঞ্চারের দুর্মর শখ, সে কি শুধু সেটুকু সম্বল করেই এই রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হবে? ওর নিজস্ব তো কোনও ওয়েপন নেই। ঋজুদার টু সেভেন ফাইভ সিঙ্গল ব্যারেল রাইফেলটি ঋজুদা ওকে দেবে না ও এখনও ছেলেমানুষ বলে। তা ছাড়া বারো বোরের শটগান পাশি বা বেপাশি হাজার হাজার আছে এই সব বনবাসী মানুষদের কাছে। কিন্তু রাইফেল অত নেই। রাইফেলের গুলির টুকরোটাকরা ফোরেনসিক এক্সপার্টরা পরীক্ষা করে সেই রাইফেলের কত বোর তা সহজে বলে দিতে পারেন। রাইফেল নিয়ে সুকর্ম বা অপকর্ম–যাই করা হোক না কেন রাইফেলের কোষ্ঠী-ঠিকুজি জানা সোজা। আর তা জানলে কার কার সেই বিশেষ রাইফেল আছে তার হদিশ করা অপেক্ষাকৃত সোজা। যাই হোক, ভটকাইয়ের ভাবনা ভটকাইই ভাবুক আর ভাবুক তার গুরু ঋজুদা। এখন আমার ভাবনা আমি ভাবি।

জায়গামতো পৌঁছে মাচানটাকে ভাল করে লক্ষ করলাম। গাছেরই ছাল দিয়ে চারটি হোসপাইপের মতো চওড়া ডালকে ভাল করে একে অন্যের সঙ্গে এবং নীচের প্রায় সমান্তরাল ডালটির সঙ্গে বেঁধেছে শক্ত করে। ওই মাচানে বসে ঘোড়ফরাসদের যাতায়াতের পথের দিকে দৃষ্টি রেখে বসলে চোরাশিকারির চোখ এবং বন্দুকের নল কোন দিকে থাকা স্বাভাবিক সে সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিলাম। তার পর যদি শিকারির সঙ্গীরা এবং শত্রুরা (বনবিভাগের এবং পুলিশের) রাস্তা থেকে তার দিকে আসে তবে তারও বন্দুকের নল কোন কোণে থাকবে তারও একটা ধারণা করে নিলাম। শিমুলগাছের গুঁড়িতে পাঁচটি ভাগ হয়। যে গাছ যত বড়, তার কাণ্ড এবং কাণ্ডের কাণ্ডমাণ্ডও ততই বড়। তেমন বড় গাছ হলে অনায়াসে এক-একটি ভাগে জনা দশ পনেরো মানুষ গুঁড়ির অন্য ভাগের অজ্ঞাতে লুকিয়ে থাকতে পারে। এই শিমুলটি মাঝারি মাপের। কোন ভাগে লুকোলে আমার রথ দেখা কলা বেচা সম্পন্ন হয় তা ঠিক করে নিয়ে আমি সেই ডালের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম বন্দুকটি দু’ঊরুর ওপরে আড়াআড়ি করে রেখে। ডান হাতটি রইল বন্দুকের ‘স্মল অফ দ্য বাট’-এ ডান হাতের তর্জনী রইল ট্রিগার-গার্ডের ওপরে। ডান ব্যারেলে চার নম্বর পোরা আছে, আর বাঁ ব্যারেলে এল. জি.। বুশ শার্টের দু’দিকের বুক পকেটে আছে আরও একটি করে কার্তুজ। চারটি কার্তুজ ব্যবহার করার আগে হয় কাল্লু মিঞা কবজাতে আসবে, নয় আমি তার কবজাতে যাব। বেশি গুলি ভাল এবং আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন শিকারি কখনওই সঙ্গে নেয় না। যে সব শিকারি নিরীহ, হাতির দলই তোক কী নিরীহতর বগারি পাখির ঝাঁকই হোক, তাদের দিকে ‘জেনারেল ডিরেকশন’-এ নিশানা করে গুলি ছোড়েন, গুলি লাগবার অদম্য উচ্চাশা এবং যশের দেউলে পৌঁছনোর দুর্মর কিন্তু তার নিজের পক্ষে প্রায় অগম্য পথে আগুয়ান শিকারির মতো শিকারি আমি কোনও দিন ছিলাম না ছেলেবেলা থেকেই এবং হওয়ার কোনও বাসনাও নেই।

রোদের তেজ যতই কমে আসছে বনের পশুপাখিরা ততই সোচ্চার হচ্ছে। তারা একে অন্যকে বলছে ‘জলকে চল, জলকে চল। ময়ুর ডেকে উঠল বনের গভীর থেকে কেয়া-কেঁয়া-কেয়া করে তীক্ষ্ণ তীব্র স্বরে। টিয়ার ঝাঁক নীলাকাশে সবুজ চাবুকের সপাট তান ছুঁড়তে ছুঁড়তে অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। তিতিরের টিউ টিউ, ছাতারের ছ্যা ছ্যা, বুলবুলিদের চুলবুলি ডাক এবং পিউ কাঁহার হাহাকারে ভরে উঠল বেলাশেষের বন। এমনি করেই বেলা যাবে রাত নামার আগে, এমন সময় অদৃশ্য পাকদণ্ডির ওপরে খুরওয়ালা কোনও জানোয়ারের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজটি থেমে থেমে সাবধানে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি চোখ খুলে শিমুলের কাণ্ডর সেই বিভাজিত ঘরের কোনা অবধি নিঃশব্দে এসে ভাল করে নজর করে দেখি একটা প্রকাণ্ড নীলগাই, পুরুষ নীলগাই, সম্ভবত যূথভ্রষ্ট, একলা থেমে থেমে খুব সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছে হারহাদ নদীর দিকে। প্রমথেশ বড়ুয়ার মুক্তি’ ছবিতে পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া সেই মন উদাস করা গানটির কথা মনে পড়ে গেল তার দ্বিধাগ্রস্ত একলা চলার দিকে চেয়ে, ‘ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়… ঘরেও নহে পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে’ ইত্যাদি। ঠাকুমার প্রিয় গান ছিল।

অভিমানী সে বোধহয়, পাছে তার দলের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়, যে দল তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে শিংয়ের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে দিয়ে, আগে আগে চলেছে জল খেয়ে তারপর অন্য পথে ফিরে যাবে সারারাতের চাঁদের বনের সফরে।

বধ্য তো এল কিন্তু ব্যাধ কই? সেই না-দেখা কালু মিঞা?

কিছুক্ষণ পরেই একটা মোটর সাইকেলের শব্দ শোনা গেল। তার ভটভটানি থেমে গেল এক সময়ে।

ম্যায় হাজারিবাগ লওটকে যা রহা হ্যায়, বহতই কাম হ্যায়।

উ লোগ তুমহারা গোল্লি কি আওয়াজ শুনকরই আবেগা ট্রাক লেকর। ধড়কানেকো বাদ ঘোড়ফরাসকে হালাল জরুর করনা, জিন্দা রহতে রহতে।

ছোড় ইয়ার, দিখনেওয়ালা হিয়া হ্যায় কওন। কালু মিঞা কি গোল্লি খা কর কোই জিতা নেহি এক ভি পল। গোলি অন্দর ঔর জান বাহার। ইতমিনানসে হালাল কর লেগা জমিন পর গির যানেকি বাদ।

দিখনেওয়ালা ইক তো জরুর হ্যায়।

আমি তো বাক্যটি শুনে ঘাবড়ে গেলাম। ওরা কি জেনে গেছে আমার এখানে লুকিয়ে থাকার কথা?

মোটর সাইকেলওয়ালা বলল, খুদাই হ্যায়। যিনকি আঁখোসে সবহি দিখা যাতা হ্যায়।

যাকগে বাবা।

তারপর বলল, তুমহারা বন্দুকোয়া কৌনসা পেড়মে ছিপাকে রাখা হুয়া হ্যায় বাতাতো দিয়া না জালাল তুমকো ঠিকসে? বন্দুক তো টেম্পো মে লা কর জালাল রাখকে গ্যয়া। গোলি তো তুম লয়া না সাথ মে?

জি হাঁ।

তারপরেই বলল, ঔর চিল্লাও শালে সুরতহারাম! যাও ভাগো হিয়াসে আভুভি। ম্যায় মাচানকি নিচামে আভূভি ইতমিনানসে মগরেবকি নমাজ আদা করেগা তব ঘোড়ফরাস ধড়কায়েগা।

একলা পুরুষ নীলগাইটি মোটর সাইকেলের শব্দ শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিল, তারপর নাক উঁচু করে পেট্রোলের গন্ধ নিল বাতাসে। যে গন্ধ মানুষের নাকে পৌঁছয় না, পৌঁছবেও না তারা নিজেরা বায়ুদূষণে মরার আগে। সেই গন্ধে তার নাক জ্বালা করে উঠল। নাক দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে সে দুলকি চালে, যাকে ইংরেজিতে বলে trot, দৌড়ে হারহাদের দিকে চলে গেল।

কাল্লু মিঞা শিকারি ভাল। তার বন্দুকটা গোপন জায়গা থেকে উদ্ধার করে এনে তার মাচার কাছে এসে পৌঁছেই স্বগতোক্তি করল, ইয়া আল্লা। ইতনা বড়া নরপাঠঠা, ম্যায় পহুছনেকি পহিলেই সক্কল দিখাকে চল গ্যয়া। অজিব বাত।

তারপর বলল, ছোড়, আভভি ঝুণ্ড তো আইবেই করেগা।

শিকারি ভাল কাল্লু মিঞা, কিন্তু তার এই মস্ত দোষ শিকারে এসে কথা বলে। তার চেহারাটাও দেখা গেল মাচাতে চড়ার সময়ে। মাঝারি চেহারা। খাকি প্যান্ট আর খাকি ফুলশার্ট পরা। পায়ে বি এস সি কোম্পানির খয়েরি রঙা রাবারের কেডস জুতো। সে তরতরিয়ে উঠে গেল বন্দুকটা স্লিংসুদ্ধ কাঁধে ঝুলিয়ে।

দেখতে দেখতে আলো মরে গেল। সন্ধ্যাতারা উঠেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু শিমুলের ঝাঁকড়া ডালের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া সে তো উঠবে পশ্চিমে। চাঁদও উঠল। আজ শুক্লপক্ষের নবমী। গাছপালার চন্দ্রাতপের ফাঁকফোকর দিয়ে নীলাকাশকে রুপোর রাংতা মাখিয়ে দিল চাঁদ। মিনিটে মিনিটে আলোর দীপ্তি বাড়ছে। গাছগাছালির নীচে চুঁইয়ে আসছে সে আলো। রাত আরেকটু বাড়লেই জঙ্গলের নীচটাতে এক অদৃশ্য হাত পেতে দেবে আলোছায়ার বুটিকাটা সাদা-কালো গালচে। ঠিক এমন সময়ে বেশ দূরে ভারী পায়ের অনেকগুলো খুরের আওয়াজ শোনা গেল। শুকনো পাতা খুরের চাপে মচমচ করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। পাথরের সঙ্গে খুরের ঠোকাঠুকিতে খট খট করে আওয়াজ হচ্ছে। আমাকে পেরিয়ে গেলে নীলগাইয়ের দলের মধ্যে একজন তো অবশ্যই নিসারের বিয়ের রাতের মেনু বনে যাবে। আর দেরি নয়। বন্দুকটা তুলে নিয়ে তার নলটা জমির সমান্তরালে ধরে তাদের আসার পথের সামনে নিশানা নিয়ে আমি ট্রিগার টেনে দিলাম। ঝরঝর করে চার নম্বর শটসগুলো গাছেদের পায়ের কাছে, শুকনো পাতায় এবং পাথরে ফরফরিয়ে ছড়িয়ে গেল। হঠাৎই যেন ঝড় উঠল চৈত্রবনে। ফুল-পাতা-নুড়ি পাথর পদদলিত করে নীলগাইয়ের দল যে পথে এসেছিল সে পথেই দুড়দাড় শব্দ করে পাথরের ওপরে খুরে খুরে খটাখট শব্দ তুলে সজোরে দৌড়ে গেল। কালু খাঁ বলল চেঁচিয়ে, কওন হ্যায় রে সুরতহারাম। জরুর দুদু মিঞা। আজ হাম তুমকো কিমা বানায়গা। মজাকি করনেকি জাগে না মিলা।

বলেই কাল্লু মিঞা তরতরিয়ে গাছ থেকে নামতে লাগল। সে বন্দুকের আওয়াজ শুনে আমার অবস্থান সহজে আন্দাজ করেছিল, কিন্তু বুঝতে পারেনি যে আমি জমিতেই আছি, গাছে নয়। শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে উপায় থাকলে হরিণ শম্বর নীলগাই-মারা শিকারি নীচে থাকে না, গাছেই থাকে।

এদিকে আমার গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুতবেগে একটা ছোট ট্রাক হেডলাইট জ্বেলে এদিকে ছুটে আসতে লাগল। এবং একটু পরেই ট্রাকটা এসে পড়ল এবং ঘুরিয়ে নিল মুখ। দাঁড় করাল একেবারে জঙ্গলের বাঁদিকে ঘেঁষে একটু নিচু জায়গা দেখে যাতে নীলগাইটাকে যদি মারত মিঞা তো বয়ে এনে সরাসরি জঙ্গল থেকেই ট্রাকের মধ্যে চালান করা যেত।

কাল্লু, আরে এ কাল্লু। বলে কে যেন ড্রাইভিং কেবিন থেকে দরজা খুলে নামল। তার সঙ্গে আরও জনা ছয়েক লোক। আমি এবার তাদের ট্রাকের পেছনে একটু দূরে নিশানা নিয়ে বাঁদিকের ব্যারেলের এল. জি-টি ফায়ার করলাম এবং করামাত্র ওরা শোরগোল তুলল, বলল, ই কেয়্যা মজাক হো রহা হ্যায়। তারপরেই উলটো দিকের জঙ্গল থেকে বন্দুক হাতে দু’জন লোক দৌড়ে এসে ওদের ট্রাকের দু’পাশে দাঁড়িয়ে বলল, কোই হিলেগা মত। হিলনেসে গোল্লিমে ভুঞ্জ দিয়া যায়েগা।

ওরা কারা? কাজমি সাহেবের শত্রুঘ্ন পাণ্ডে অ্যান্ড পার্টি কি?

ততক্ষণে ট্রাকে করে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে অন্তত একজনের হাতে বন্দুক ছিল, সে গুলি চালিয়ে দিল। শত্রুঘর দলের একজনের মাটিতে পড়ে যাওয়ার শব্দ হল। তাড়াতাড়িতে বন্দুকের দু’ নলেই দুটো এল. জি. পুরে নিয়ে আমি পথের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা মস্ত বড় মহুয়া গাছের গুঁড়ির পেছনে আড়াল নিয়ে ঘটনা কী তা দেখার এবং শত্রুঘ্নর দলকে মদত দেওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে রইলাম। শত্রুঘর দলের একজন পড়ে যেতেই ওদের দলের তিনটি বন্দুক পর পর গুলি চালাল। তখন হাজারিবাগী পোচারের দল ট্রাকটার এদিকে আড়াল নিতেই আমি ওদের পা লক্ষ করে ডানদিকের ব্যারেলের এল. জি. ফায়ার করে দিলাম। তাতে এল. জির দানা লেগে দু’জন ‘ইয়া আল্লা’ বলে জমি নিল। আমার আর একটামাত্র গুলি আছে। ওরা সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালাল, কিন্তু সে সব গুলি মহুয়ার কাণ্ডে এসে বিঁধল। ইতিমধ্যে খুব জোরে একটা ট্রাক হেডলাইট ও স্পটলাইট জ্বেলে নাকার দিক থেকে এদিকে আসতে লাগল। ততক্ষণে শত্রুঘর দলের তিনজন এসে গেছে ওপাশ থেকে। ওদের মধ্যে একজন ড্রাইভিং কেবিনে উঠে স্টিয়ারিং সিটে বসে ট্রাকটাকে এগিয়ে দিল যাতে ওরা আড়াল না পায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে চিতাবাঘের মতো ছিপছিপে একটি লোক হাতের দু’ঝটকাতে ওদের দু’জনকেই একসঙ্গে পটকে দিল মাটিতে আর অন্যরা তাদের বন্দুকটাকে কবজা করে ফেলল।

ততক্ষণে এস পি পাসোয়ান সাহেবের ক্র্যাক প্লাটুন নিয়ে পুলিশের ট্রাকটিও এসে পড়েছে। কারণ, আমার গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সম্ভবত কাজমি সাহেব রাজডেরোয়ার গেটের কাকে বলে দিয়েছিলেন ওয়্যারলেসে ওঁদের খবর দিতে। তাই সব ঘটনা ঘটবার আগেই তারা নাকা পেরিয়ে এদিকে রওনা হয়েছিল ফুল স্পিডে।

এদিকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের শত্রুঘ্ন অ্যান্ড পার্টি আছে, আছে পুলিশের ক্র্যাক প্লাটুন, ওদিকে মিস্টার কাল্লু খাঁ কী করছেন এবং মিস্টার ভটকাইও কী করছেন তা একটু দেখা দরকার।

ওই দোলা ধরে হারহাদের দিকে খুব সাবধানে যতখানি কম শব্দ করে হয় এগোচ্ছিলাম। বিশ-পঁচিশ গজ গেছি এমন সময়ে সামনে একটা ধস্তাধস্তির শব্দ শুনলাম। আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি, ভটকাই কাল্লু মিঞার বন্দুকটা তারই দিকে বাগিয়ে ধরে প্রচণ্ড উত্তেজনাতে লাফাতে লাফাতে বলছে, আমি বাগবাজারের ভটকাই মিঞা। মাল চেনোনি বিশ্বেশ্বর। কোথায় খাপ খুলতে এসেছিলে তা বোঝ এবারে।

কী করে নিরস্ত্র ভটকাই এই অসাধ্য সাধন করল আমি তা ভেবে যত না অবাক হলাম তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক হয়েছিল কালু মিঞা। আমি ভেবে পেলাম কালু মিঞার বন্দুকটা কী উপায়ে নিজে গুলি না-খেয়ে ভটকাই হস্তগত করল?

আমি গিয়ে পৌঁছতে সে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। আমাকে দেখে ভটকাই বলল, যা তো রুদ্র, আমি তোকে কভার করে আছি। তোর বন্দুকটা ওই গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে রেখে মক্কেলের হাত দুটো ভাল করে দড়ি দিয়ে বাঁধ তারপর দড়ি ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে চল বড় রাস্তাতে। সেখানে নন্দী-ভৃঙ্গী পাথরের ওপরে Reception Committee নিশ্চয় মজুদ আছে।

আমি কাল্লু মিঞার কাছে গিয়ে দেখি একটা হলুদ-রঙা মোটা নাইলনের দড়ি দিয়ে একটি বড় ফাঁস বানানো হয়েছে। দড়িটি তার মাথার ওপর দিয়ে গলিয়ে তুলে নিতেই কাল্লু মিঞা পালাবার মতলবে ছিল কিন্তু ভটকাই বলল, তোমার খুপরি উড়ে যাবে বাছা। নড়েচ কী মরেচ। আমাদের দুজনের বয়স এবং ভটকাইয়ের ভাষাতে বেজায় আহত কাল্লু মিঞা আর বেয়াদবি করবে বলে মনে হল না। ধরেই নিল এই দু’জন কোনও কৃতবিদ্য মানুষ, এদের সঙ্গে ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই না করাই ভাল।

আমি বললাম, আপতত জানসে বাঁচ গয়্যা মিঞা, মগর হুয়াতো আপকি চার দোস্তোঁ মুর্দা বন গ্যয়ে। আপহি লোঁগোকি ট্রাকমে উনলোগোঁকি লা রহা হ্যায়, ঘোড়ফরাস শোচকর।

কওন?

পাসোয়ান সাহেবকি পুলিশলোঁগ।

আপলোগ কওন হ্যায়?

ভটকাই বলল, হামলোগ কাঁড়িয়া পিরেত বা। হাঁ।

কাল্লু মিঞার চোখমুখের অবস্থা এমনই হল যেন অক্কা পাবে।

একটু পর আমাকে বলল, আপহি ও গোলি চালায়া থা? পহিলেওয়ালা গোলি?

 জি হাঁ।

কিউ? উতনা নজদিকে সে এক ভি ঘোড়ফরাস ধড়কানে নেহি সেকা তো নিসার কি বরাতমে জানেকি হর্কে নেহি হ্যায় আপকো।

হামলোগোঁকো বরাত মে যানেকা দাওয়াত থোড়ি মিলা! মিলনেসে সায়েদ ধড়কা দেতা থা।

কথা বলতে বলতে আমরা যখন বড় রাস্তাতে উঠে এলাম তখন দেখি ঋজুদা একা উঁচু পাথরে বসে পাইপ খাচ্ছে। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশনস। তারপর কাল্লু মিঞার দিকে চেয়ে বলল, বোলো ভাই কাল্লু মিঞা, হাজারিবাগমে আচ্ছা খাসি কা ক্যা কম্মি পড়া থা যো ঝুটমুট বড়ি মুশকিলসে বাঁচাহুয়া ই ঘোড়ফরাসকি ঝুঁকি পিছে আপনোক পড় গ্যয়া?

গলতি হো গ্যয়া হুজৌর।

উও সব বাত ডি এফ ও সাহাব ঔর এস পি সাহাবসে কিজিয়ে গা। উও সব বাতে শুনেকি এক্তিয়ার হামে নেহি না হ্যায়।

বলতে বলতে কাজমি সাহেবের জিপ ওদিক থেকে এসে গেল। ফরেস্ট গার্ডরা কাল্লু মিঞাকে ধরে পেছনে ওঠাল।

ভটকাই বলল, আপ কি বন্দুকোয়া কাল্লু মিঞা?

বলেই, বন্দুকটা কাজমি সাহেবের হাতে তুলে দিল।

কাজমি সাহেব বললেন, বহুত বহুত শুকরিয়া খোকাবাবুলোগ।

 বলেই জিভ কেটে বললেন, গলতি হো গ্যয়া।

ঋজুদা বলল, কাল দোপহরমে খানা হারহাদমে। ইয়াদ রাখনা।

ঔর পরশু রাত কি খানা হামারি হুয়া। পাসোয়ান সাব ভি আইয়ে গা খোকাবাবুলোগকি, ধ্যাতারিকা! ইয়ে বাহাদুর-লোগোঁকো মিলনেকি লিয়ে।

বহত আচ্ছা। ঋজুদা বলল।

 তারপর জিপটা চলে গেলে বলল, তাহলে এখন কিংকর্তব্যম?

 চা খাওয়া আর পাইপ খাওয়া।

আর গান গাওয়া হবে না একটু?

কী গান? কার গান!

 ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো’। আজ ভটকাই গাইবে।

আমি বললাম, ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভাল।’ বলেই বললাম, ছিঃ ছিঃ ভটকাই মিঞা শেষে কাল্লু মিঞাকে পাশে পেয়ে এই গান।

ভটকাই ম্যাচিওরিটি দেখিয়ে আমাকে ইগনোর করে ঋজুদাকে বলল, লাস্ট কোয়েশ্চেন; প্ল্যাটুন শব্দটির মানে কী?

প্ল্যাটুন সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত শব্দ। দশজন সৈন্যর একটি দলকে বলে Platoon-আর্মির সবচেয়ে ছোট unit৷ জানি না, এখন সংখ্যা আরও বেড়ে থাকতে পারে। আমরা যখন এন.সি.সি-তে ছিলাম তখন এরকমই ছিল। যেমন একশো জনের দলকে বলে Company। আর পাঁচশো জনের দলকে বলে Battalion!

কেমন ভটকাই বাহাদুর? স্যাটিসফায়েড?

ইয়েস।

আচ্ছা। তুই বন্দুকধারী কাল্লু মিঞাকে কবজা করলি কী করে রে ভটকাই, খালি হাতে? ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।

ভটকাই তার ডান কপালের পাশে দুটো টোকা মেরে বলল, এখানে কিছু থাকতে হয়। ক্যালি।

তারপর বলল, চৌকিদারের বউয়ের কাছ থেকে দড়িগাছা চেয়ে নিলাম। এক প্রান্তে ফসকা-গেরো মেরে দোলাটি আর হারহাদের মাঝের জানোয়ার-চলা পথে একটা পইসার গাছে হাত পাঁচেক ওপরে এমন একটি ডালে বসে থাকলাম যে নীচ দিয়ে কেউ গেলে ওপর থেকে তার গলায় ফাঁসটি গলিয়ে দিয়ে টান মারলেই সে কবজাতে আসবে। তবে ওই পথে যদি না আসত কাল্লু মিঞা এবং দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য না হয়ে, তাহলে ওই মালা নিজের গলাতেই পরাতে হত। কিন্তু…

ঋজুদা বলল, As luck would have it!

আমরা সমস্বরে বললাম, ঠিক।

পথপাশের ঝোপ থেকে একটি বিচথুপড়াও বলে উঠল, ঠিক ঠিক। ঠিক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *