ঋজুদার সঙ্গে বক্সার জঙ্গলে — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ
০১.
কী রে রুদ্র!
ভটকাই মনমরা হয়ে বলল, ঋজুদা কি শুধু শুধুই বেড়াতে যাবে! এবারেও? সেবারে বলল, ভীরাপ্পানের খোঁজে যাবে নীলগিরি পাহাড়ে কর্ণাটক আর তামিলনাড়ুর সীমান্তে, শেষ অবধি তাও গেল না, মধ্যে দিয়ে আমার মাথাটাই ন্যাড়া করতে হল। মিছিমিছি। ছিঃ।
তাতে আর ক্ষতি কী হল! তোর মাথার ভিতরে যে গোবরের ঢিবি তা তো আর লোকে দেখতে-জানতে পায়নি। চুল ফেলে বিশেষ ক্ষতি তো করিসনি নিজের।
ঋজুদার উপরে ভটকাই এতটাই বিরক্ত ছিল যে আমার এই কথার একটা লাগসই পাল্টাই দেবারও ইচ্ছে দেখাল না।
ভাবলাম, ভেরী মাচ আনলাইক ভটকাই!
ঋজুদা একটু বাথরুমে গেছিল। আমি আর ভটকাই ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের বসার ঘরে বসে কথা বলছিলাম।
বললাম, সেবারে নীলগিরিতে আমাদের নিয়ে যায়নি বটে ঋজুদা কিন্তু তার বদলে মণিপুরে যে গেলাম আমরা। ইম্ফলে এবং নাগাল্যান্ডেও। কোহিমা, তাদুবী, মাও এবং কাঙ্গপোকপি। মণিপুর আর মাইনমারের সীমান্ত ‘মোরে’তে? আর কাঙ্গপোকপির রহস্যর জট খোলাতে কি কম অ্যাডভেঞ্চার ছিল? ঋজুদার গোয়েন্দা কাহিনীর মধ্যে তো শুধুই অ্যালবিনো আর কাঙ্গপোকপি। কত যে নাম হল আমাদের। তোর সবটাতেই বাড়াবাড়ি।
ঋজুদা ফিরে এল। বলল, কী হল? মিস্টার ভটকাই-এর মুখ গোমড়া কেন রে রুদ্র?
তারপর বলল, এবারে অ্যাডভেঞ্চার করতে, খুনিকে খুঁজে বের করতে বা নিনিকুমারের বাঘের মতন মানুষখেকো বাঘ বা লবঙ্গীর পাগলা হাতি মারতে যাওয়া নয়। এবারে বক্সার জঙ্গলে এমনিই যাব। শুধুই জঙ্গল দেখতে। যে-কোনও জঙ্গলের মধ্যে, যে-কোনও পাখির ডাকের শব্দে, ইশারা করে চলে যাওয়া অচেনা নদীর বাঁকে বাঁকে যে কত গভীর গোপন সব রহস্য, কত কিছুর আবিষ্কার, তার সঙ্গে কি কোনও একটিমাত্র রহস্যের বা রহস্য উদঘাটনের তুলনা চলে রে! বক্সাতে এমন অনেক গাছপালা, পাখি, নদী দেখতে পাবি, যা সব তোরা আগে তো দেখিসইনি, এমনকী আমিও দেখিনি। তবে পড়েছি। ছবি দেখেছি সেই সব গাছ-গাছালির, পাখ-পাখালির।
তারপর একটু থেমে বলল, আমি তো উত্তেজনাতে অধীর হয়ে আছি, সেই জঙ্গলে, সেই টাইগার প্রজেক্টে যাব বলে, আর তোরা অত মনমরা কেন? ইচ্ছে না করলে, যাস না। আমি তো জোর করিনি। কৌশিক, সুশান্ত, বামা, মধুমিতা এরা সব আমার সঙ্গে যেতে পারলে খুশিতে একেবারে ডগমগ করত। এখন মনে হচ্ছে আমার যে, আমি ভুল করেই চেলা বানিয়েছি তোকে আর ভটকাইকে। তোরা আমার চেলা আসলে নোস, চামুণ্ডা।
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, আমি নই ঋজুদা, আমি কিন্তু মনমরা নই। বরং আমি তো লাফাচ্ছিই যাব বলে। আমি তোমার চেলা ছিলাম, চেলা আছি। ভটকাইটাই চামুণ্ডা।
.
০২.
ডিমা আর নোনাই নদীর আঁচলের শহর আলিপুরদুয়ারের সার্কিট হাউসের হাতার লন-এ ঋজুদা বসেছিল পাইপ-মুখে একটি চেয়ারে। আর ঋজুদার পায়ের কাছে বাধ্য বাঁদরের মতন বসেছিল ভটকাই। তেল কিছু লাগাতে পারে বটে! আমি চান করতে করতে বাথরুমের খোলা জানালা দিয়ে দেখছিলাম।
একটুও ইচ্ছে ছিল না আমার, ভটকাই আসুক এভাবে আমাদের সঙ্গে এই বক্সার জঙ্গলে। তিতির দিল্লীতে গেছে জে. এন. উ্য-তে কী কাজে, তাই যেতে যে সে পারবে না, তা আগেই জানিয়েছিল।
ভটকাইটা আগে ভাগেই গন্ধ পায় প্রতিবারে ঋজুদা কোথাওই গেলে। গন্ধগোকুল হয়েছে আজকাল। কিন্তু ও জানে না যে, আমিও ওর গন্ধ পাই I can very well smell a rat. তাও, কী ছল্লাটাই করল আসার আগে! ঢঙ।
আজ দুপুরে কামরূপ এক্সপ্রেস থেকে আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নামার পরই খুব ঝড় উঠেছিল। সারা রাত উথাল-পাথাল করেছে হাওয়া। তবে ঝড়টা ওঠাতে আবহাওয়া ভারী মনোরম হয়েছে দুপুরের পর থেকেই। দুপুরে সার্কিট-হাউসেই মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়ে ঘুম লাগিয়েছিলাম আমরা। রাতে ট্রেনে ভাল ঘুম তো হয়নি!
চান করতে করতেই দেখলাম একটা মোটর সাইকেল ঢুকল গেট পেরিয়ে। দেখলাম, তপনদা আর বিদ্যুৎদা এলেন। সঙ্গে কোলবালিশ-এর মতন বড় দুটি টিফিন ক্যারিয়ার। আমাদের সার্কিট হাউসের খাওয়া রাতে খেতে দেবেন না বলেছিলেন ওঁরা। বিদ্যুৎদার বাড়ি থেকে এখন রান্না করা খাবার এল তাই।
ভারী মজার এই দুই ভদ্রলোক। তপনদা, মানে তপন সেন, আলিপুরদুয়ার কোর্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকুটার। ঋজুদার একেবারে অন্ধ ভক্ত। আলিপুরদুয়ারে নন্দাদেবী ফাউন্ডেশান আছে। মিনি পর্বতারোহীদের ক্লাব। তপনদারা সে ক্লাবের সভ্য। সেখানে বিকেলে ঋজুদাকে ধরে নিয়ে গেছিলেন ওঁরা। ঋজুদা ফ্যান ক্লাবও করেছেন একটা। দেখে খুব ভাল লাগল যে, শুধু আমরাই ঋজুদার ভক্ত নই। বইয়ের দোকান লিপিকা’-তেও গেছিলাম। মালিক বিজুবাবু চা খাওয়ালেন। দারুণ ঝাল ঝাল সিঙ্গারাও। ঋজুদার অনেক বইই রাখেন যে। আমার একটু গর্ব হল। বইগুলি লেখাতো রুদ্র রায়েরই।
পশ্চিমবঙ্গর এই বক্সার জঙ্গলে কোনওদিনও হয়তো আসাই হত না ঋজুদার। যদি বক্সা টাইগার প্রজেক্টের ডিরেক্টর এস. এস. বিস্ত সাহেব ঋজুদাকে একাধিকবার ফোন না করতেন। অবশ্য তাঁর উৎসাহের পেছনে আমার অর্থাৎ এই রুদ্র রায়ের লেখা ঋজুদা কাহিনীগুলিই!
তিনি ঋজুদার ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন বটে কিন্তু বিস্ত সাহেবের আমন্ত্রণের পেছনে তপনদাদের উৎসাহও অবশ্যই ছিল। বিস্ত সাহেব দেরাদুনের মানুষ অথচ চমৎকার বাংলা বলেন এবং বাংলা পড়তেও পারেন।
রাজাভাতখাওয়া ইনফরমেশান সেন্টার উদ্বোধন করতে কিন্তু ঋজুদা যেতে পারেনি। বম্বেতে খুবই জরুরি কাজ পড়ে গেছিল। কিন্তু তখনি বিস্ত সাহেবকে কথাও দিয়েছিল যে, পরে একবার অবশ্যই যাবে। অবশেষে আসার সময় যখন করতে পারল বক্সা টাইগার রিসার্ভ-এ ততদিনে বিস্ত সাহেব নিজেই বদলি হয়ে দার্জিলিং পাহাড়াঞ্চলের কনসার্ভেটর হয়ে দার্জিলিং-এ চলে গেছেন।
এবারে সুশান্তদার খুব ইচ্ছে ছিল আমাদের সঙ্গে আসার। কিন্তু জিরাফের বাচ্চা হবে সেই টেনশন-এ আসা হল না। সুশান্তদা কলকাতার চিড়িয়াখানার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ঋজুদার একজন ভক্ত। ব্যাচেলর। ঋজুদা বলে যে, জীব-জানোয়ার, পাখি এবং গাছ-গাছালি সম্বন্ধে সুশান্তদার সত্যিকারের আগ্রহ এবং ভালবাসা আছে। অনেক জানে-শোনে, পড়াশুনোও করে। সুশান্তদাকে ঋজুদা ডাকেন পাগলা বলে। তিনি বন-জঙ্গল পাগল তো বটেই, ঋজুদা-পাগল বলেও। সুশান্তদাকে একবার বেতলাও ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছিল ঋজুদা বছর তিনেক আগে।
বিদ্যুৎদা, গ্রামীণ স্কুলমাস্টার। বিদ্যুৎ সরকার। আরেক পাগল। সার্কিট হাউসের ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে দুই কোমরে দু হাত রেখে হাঁক দিলেন, আরে ও তপনদা! আপনারা করেনটা কী! খাবার লাগাইয়া দিছে যে। তাড়াতাড়ি আসেন। ফ্যান ঘোরতাছে বাঁই বাঁই কইর্যা। সবোই ঠাণ্ডা হইয়া যাইবনে।
তপনদা আমাদেরই মধ্যে থেকে বিদ্যুৎদার এজেন্ট হয়ে তাড়া লাগালেন। বললেন, চলো দাদা, চলো।
ডাইনিং রুমে সকলে পৌঁছে দেখি ইলাহি ব্যাপার।
ঋজুদা শুঁটকি মাছ খেতে ভালবাসে তাই লইট্টা শুঁটকি রান্না হয়েছে।
ভটকাই, ল্যব্রাডর গান-ডগ-এর মতন মুখ ছুঁচলো করে নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে দূরে চলে গেল। এক কোণে চেয়ার টেনে বসে বলল, আমি হলুম গিয়ে নর্থক্যালকাটার বনেদি পরিবারের ছেলে। এই সব বাঙালের খাদ্য খেয়ে জাত খোয়াতে মোট্টে রাজি নই। বমি হয়ে যাবে।
ঋজুদা বলল, তুই দূরেই বোস।
তারপর বলল, বাঃ বাঃ! এ করেছ কি বিদ্যুৎ? এ যে ফাঁসির খাওয়া। কত্ত পদ! এত পদ মানুষে খাবে কী করে?
তা কী করন যাইব। মায়ে রাঁইধলো দুই পদ, বৌ-এ রাঁইধলো এক, আর ভাই বৌ-এ রাঁইধলো আর এক। হক্কলেই যে আপনের ভক্ত। নৈবেদ্য। বোঝলেন কিনা!
কথা তো শিখেছ খুব।
ঋজুদা বলল।
তপনদা বলল, উকিলে আর মাস্টারে যদি কথাই না কইতে পারব তাইলে তো না খাইয়াই থাকন লাগব।
তা অবশ্য ঠিক।
খাওয়া শুরু করার আগে ঋজুদা বলল, কী কী আছে বল দেখি বিদ্যুৎ?
কইতাছি। শুরু তো করেন। ঠাণ্ডা হইয়া যাইবনে।
আগে বলই শুনি।
আছে, ভাত, কাতল মাছের মাথা-দেওয়া ভাজা মুগের ডাইল, শিলবিলাতি আলু ভাজা।
শিলবিলাতি আলু? সেটা আবার কী জিনিস?
ভটকাই পাকার মতন বলল। অবশ্য মতন আর কী! ও তো পরম পাকাই!
হ। তাইলে আর কই কী? এই আলু আমাগো এই অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও পাওনই যাইব না।
আমি দেখলাম, মিনি আলু ভাজা। সাইজ যা, চার-পাঁচটা আলু যোগ করলে একটি বড় আঁশফল-এর সাইজ হবে। এমন আলু সত্যিই দেখিনি আগে কোথাওই। নতুন আলু ছোট ছোট হয়, যখন ওঠে। কিন্তু এই পুঁটকি পুঁটকি শিলবিলাতি আলু সত্যিই অবাক করল।
ঋজুদা বলল, গাড়োয়ালে একরকমের আলু খেয়েছিলাম তার নাম যোশীমারী আলু। সেগুলো অবশ্য ছোট নয়। কিন্তু শিলবিলাতি কখনও খাইনি।
ভটকাইকে বললাম, নে রে খা। এ তোর বনেদি নর্থ ক্যালকাটাতে পাবি না। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ফুরিয়ে যাবে।
ঋজুদা বলল, বলল, বলল, কোনটা কী তা বলে দাও বিদ্যুৎ।
এ্যা। এই তো হইল শিলবিলাতি আলু, ওই লইট্টা শুঁটকি। আর এইটা হইতাছে তেকাটা মাছের ঝালচচ্চড়ি।
তেকাটা মাছটা আবার কী মাছ?
তেরে কেটে তেরে নাক!
বলল, ভটকাই। আমি ওর মধ্যে নাই। একেবারে লাল যে! এই বুনো বাঙালদের রাজত্বে বেচারি ঘটি কি মারা যাবে? পেকৃতই মারা যাবে? নিনিকুমারীর বাঘ-এর জাল থেকে বেঁচে এসে শেষে কি বাঙালদের ঝালে মৃত্যু হবে র্যা আমার? কী রে মিস্টার রুদ্র রায়?
আমি বললাম, বিহেভ। বিহেভ। তোর এই সব রসিকতা পুরনো হয়ে যাচ্ছে ভটকাই। এঁরা বোরড হয়ে যাচ্ছেন।
এই তেকাটা মাছও কিন্তু অন্যত্র পাওয়া যায় না। শুধু এই অঞ্চলের নদ-নদীতেই হয়। বোঝলা দাদা।
তপনদা বললেন।
আর এইটা হইল গিয়া বোরোলি মাছের ঝোল। কাতল মাছের ঝোলও আছে।
বোরোলি মাছটা কী মাছ?
এও এখানকার নদ-নদীতেই পাওয়া যায়।
কী কী নদী আছে এখানে? মানে নদ এবং নদী?
ভটকাই শুধোল।
গণ্ডায় গণ্ডায় আছে। কয়বচ্ছর আগেইত শ্যাষ কইরা দিছে এই হক্কল অঞ্চল। কী বন্যা, কী বন্যা! কী কমু! মানুষ মরে নাই বটে কিন্তু বাড়ি-ঘর ভাইস্যা গেছে মেলাই। গরু মরছে কত্ত। ইস রে! ল্যাখাজোখা নাই। আলিপুরদুয়ার শহরে কার বাড়িতে জল ঢোকে নাই তখন? ঈঃ! সে এক ন্যাচারাল ক্যালামিটি যারে কয়, তাই আর কী!
কোন নদীতে বান ডেকেছিল?
আমি বললাম।
সব নদীতেই। ডিমা, নোনাই, জয়ন্তী, সংকোশ, ফাসখাওয়া, রায়ডাক, কালচিনি। এক নদী ফুইল্যা গেলেই তো অন্যে ফুইল্যা যায় অটোম্যাটিকালি। বোঝলেন কি না!
এখন এতরকম অদৃষ্টপূর্ব এবং অনাঘ্রাত খাবার সামনে সাজিয়ে রেখে বন্যা-শাস্ত্র নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা আমার আদৌ নেই। নে রুদ্র। শুরু কর। এদিকে এসে বোস ভটকাই, ফাজলামি না করে।
ঋজুদা বলল।
আরে ওইটা আবার কী পদ?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
কই? কোনটার কথা কন? ওঃ। ওইটা হইল গিয়া এক্কেরে শ্যাষে খাওনের। রুসগুল্লার লগ্যে খাইবেন অনে।
আরে জিনিসটা কী তা বলবে তো!
ইটা আমাগো বাণেশ্বরের দই।
বাণেশ্বরটা কোথায়?
এতরকম পদের মধ্যে রীতিমতো দিকভ্রান্ত হয়ে ঋজুদা বলল।
কুচবিহার জেলাতে পড়ে।
তাই?
ইয়েস।
বিদ্যুৎদা বললেন।
.
০৩.
আজ সকালে ব্রেকফাস্টের পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। ব্রেকফাস্টের বর্ণনাও আর নাইবা দিলাম, দিলে সকলেই মনে করতে পারে আমরা শুধু পেটুকই নই, রাক্ষসও বটে!
রাজাভাতখাওয়ার রেঞ্জার সাহেব নীলরঙা জিপ পাঠিয়েছিলেন আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে। সঙ্গে অনুপ দাস ফরেস্ট গার্ড। আর তাঁর সুন্দর ছেলে। সে পরীক্ষা দিতে এসেছিল শহরে। পথে তাকে আমরা নামিয়ে দিলাম অনুপবাবুর বাড়িতেই।
দশ মিনিটের মধ্যেই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়লাম। নিবিড় জঙ্গল বললে সব বোঝায় না। উত্তর বাংলার হিমালয়ের পাদদেশের জঙ্গলের নিবিড়তার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য বহু জায়গার জঙ্গলের তো বটেই, আফ্রিকার জঙ্গলেরও তুলনা হয় না। এমন নিচ্ছিদ্র বন এখানে যে, দৃষ্টি বাধা পায়। মন খারাপ হয়ে যায়। ঠিক এই ধরনের জঙ্গল আমি আসাম আর তেরাই অঞ্চল ছাড়া আগে দেখিনি। ঋজুদা অবশ্যই দেখে থাকবে।
অনুপ দাস বললেন, এই যে স্যার, ডানদিকে দেখুন মধু গাছ।
মধু গাছ মানে?
মানে জানি না। এর নীচে ঢিল-খাওয়া ঠাকুর আছেন।
তাই?
ভটকাই বলল, বিজ্ঞর মতন।
ঋজুদা কিছু বলল না।
এইখানে প্রায়ই ছিনতাই হয়।
অনুপবাবু বললেন।
কী করে?
জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। গাড়ি বা স্কুটারের শব্দ শুনলেই বেরিয়ে এসে ছিনতাই করে জঙ্গলে পালায়। কিন্তু জিপের শব্দ শুনলে আসে না। জানে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বা পুলিশের গাড়ি হবে।
এই ছিনতাইবাজেরা কারা?
অধিকাংশই নেপালি উদ্বাস্তু। ভুটান থেকে তাড়া খেয়ে এসে এই সব করে।
মাত্র আধঘন্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম রাজাভাতখাওয়াতে।
রাজাভাতখাওয়াতে ঢোকার পথেই পড়ল, ডানদিকে, বক্সা টাইগার প্রজেক্টের ইনফরমেশান সেন্টার।
মালপত্র সব নামিয়ে রেখে তারপর এখানে আসা যাবে। কী বলিস?
ঋজুদা বলল।
আমি বললাম, হুঁ।
কী মাম রে বাবা! রাজাভাতখাওয়া।
লাগাতার কথা বলা ভটকাই বলল।
ওর কথার তোড়ে মাথা ধরে যাওয়ার জোগাড় হল আমার।
হ্যাঁ। কোচবিহারের রাজা আর ভুটানের রাজার মধ্যে অনেকদিন আগে যুদ্ধ লেগেছিল। সেই যুদ্ধে সন্ধি হয়। তখন দুই রাজাই এখানে একসঙ্গে ভাত খেয়েছিলেন। অনুপবাবু বললেন।
তাই?
আমি বললাম।
একটি ছোট লাইনের লেভেল-ক্রসিং পেরিয়ে সুন্দর এবং ছোট্ট জনপদ রাজাভাতখাওয়াতে এসে পৌঁছলাম আমরা। নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে এক স্কোয়ার কিমি, মতন জায়গা জুড়ে এই জনপদ।
বন-কেটে করা। তবুও বন যেন ঝুঁকে পড়ে চারপাশ থেকে ঘাড়ের উপরে নিঃশ্বাস ফেলছে। বাঁদিকে একটি সুন্দর একতলা বাংলো। অনুপবাবু বললেন, এখন এটা রেস্ট হাউস। আগে ছিল ডি. এফ. ওর বাংলো। বক্সা ডিভিশানের ডি. এফ. ও.র হেড কোয়ার্টার্স যখন রাজাভাতখাওয়াতে ছিল।
এখন কোথায়?
এখন টাইগার প্রজেক্ট হয়ে যাবার পরে আলিপুরদুয়ারে চলে গেছে। টাইগার প্রজেক্টের হেডকোয়ার্টার্সও তো সেখানেই।
আমরা কি ওই বাংলোতেই থাকব?
ভটকাই শুধোল।
না। এটা ভি. আই. পি.-দের জন্যে।
ভি. আই. পি. কারা? ঋজুদা কি ভি. আই. পি. নন?
কিছু মনে করবেন না স্যার।
উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে ভি. আই. পি. হচ্ছেন গিয়ে শুধু হাতি আর কনসার্ভেটর অফ ফরেস্টস। এখন পালিত সাহেব আছেন বাংলোতে।
তিনি কে?
তিনি সিলিভিকালচারের কনসার্ভেটর।
সিলিভিকালচারটা কী জিনিস?
আমি বললাম।
ঋজুদা যেন কী বলতে গেল কিন্তু বলার আগেই অনুপবাবু বললেন, গাছপালা এই সবের কালচারকে বলে সিলিভিকালচার। মাছেদের বেলা যেমন পিসি কালচার। শোনেননি?
হ্যাঁ।
ভটকাই বলল, মাসি কালচারও আছে নাকি?
তারপরই দ্বিতীয় বাংলোটা দেখিয়ে বলল, এই বাংলোটাতে থাকব আমরা?
না, এটাতেও নয়। এটা ডর্মিটরি। এখানে প্রাণীতত্ত্ব নিয়ে যে সব ছাত্র পড়াশুনো করেন তাঁরা থাকেন। ডক্টরেট-এর জন্যে হাতেকলমে বন ও বন্যপ্রাণীদের যাতে জানতে পারেন, সেজন্যেই কিছু ছাত্র এসে আছেন এখানে এখন। খালি থাকলে, বাইরের লোকও অবশ্য পেতে পারেন।
তবে কি আমরা ওই দোতলা বাংলোটাতে থাকব?
হ্যাঁ। ওইটা ছিল অ্যাডিশনাল ডি. এফ. ও.র কোয়ার্টার আগে।
বাঃ!
ঋজুদা স্বগতোক্তি করল।
বন্ধ গেট-এর সামনে জিপ দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার ডাকল, নর্বু, নর্বু।
তারপর হর্ন বাজাল।
ভিতর থেকে একটি বেঁটেখাটো নেপালি লোক, বছর পঁচিশেক বয়স হবে, দৌড়ে এসে গেট খুলল।
ও কি চৌকিদার?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ স্যার। চৌকিদার কাম কুক কাম-সবকিছু।
ওর পুরো নাম কী?
নর্বু তামাং।
গেট বন্ধ করে রেখেছে কেন?
গোরু ঢুকে বাগানের ফুলের গাছ খেয়ে ফেলে। ঘাস বা পাতা-টাতা তো এখানে অঢেল। রাজাভাতখাওয়ার গরুরা খুব ফুল-বিলাসী।
ওদের দুধে কি ফুলের গন্ধ হয়?
ওরিজিনাল মিস্টার ভটকাই প্রশ্ন করলেন।
আমি জোরে হেসে উঠলাম।
বিরক্ত হয়ে ও বলল, হাসার কী আছে বোকার মতন? ঋজুদা বলে না যে, ইনকুইজিটিভনেসই শিক্ষিত মানুষের লক্ষণ। সব কিছুই জানতে দোষ কী? তোর মতন কোনও পাঁঠা আমাকে বোকা ভাববে এই ভয়ে কি আমি আমার জ্ঞানলাভের সদা-সজাগ ইচ্ছেটাকে গলা টিপে মারব?
ঋজুদা বলল, জানার বা জ্ঞানের ইচ্ছাকে এককথায়, মানে এক শব্দে কী বলে?
জ্ঞানপিয়াসা।
ওভারস্মার্ট ভটকাই সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল।
আমাদের নামিয়ে একতলা দোতলা ঘুরিয়ে দেখিয়ে অনুপবাবু চলে গেলেন।
.
০৪.
আমরা দোতলার বারান্দাতে বসে ছিলাম।
ভটকাই বলল, প্রায় এগারোটা বাজে। ছিন-ছিনারি দেখতে দেখতে এক এক কাপ করে চা হয়ে গেলে জমে যেত, না?
তা যা বলেছিস। নীচে গিয়ে বলে আয় তবে।
সঙ্গে সঙ্গে ধ্বপ ধ্বপ শব্দ করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ভটকাই নেমে গেল নীচে।
একতলাতে থাকার ঘর নেই। একটাই ঘর। সেটি খাবার। লাগোয়া কিচেন। দোতলায় দুটি ঘর পাশাপাশি। বিরাট বিরাট চানঘর। একটি ড্রয়িং রুম। তিন দিকে অগণ্য জানালা আছে। চমৎকার। আর ড্রয়িং রুম আর বেডরুম দুটির সামনেই এই মস্ত চওড়া বারান্দা। যেখানে আমরা এখন বসে আছি।
একটু পরেই আবারও ধ্বপ ধ্বপ করতে করতে ভটকাই উঠে এসে বলল, টি ইজ কামিং। দুপুরের মেনুটাও জেনে এলাম।
কী?
বাসমতি চালের ভাত, বেগুন ভাজা, বিউলির ডাল, স্যালাড আর মুরগির মাংস হচ্ছে। ব্রয়লার চিকেন নয়। বড়কা, দিশি মুরগি। ছাইয়ে আর সাদায় মেশা রং ছিল।
কী করে জানলি?
আমি বললাম।
পালক দেখেই বুঝলাম। যেমন তোকেও তোর পালক দেখেই চিনি ইডিয়ট। আর তার সঙ্গে তোর জন্যে একটু গাছ-পাঁঠারও বন্দোবস্ত করে এলাম। ওঃ। বাংলোর পেছনেই একটি কাঁটাল গাছে যা এঁচড় এসেছে না! গাছ কাঁচা রিয়্যাল কাঁচা-এঁচড়। তোর মতন এঁচড়ে-পাকা নয়।
তারপরই বলল, ঠিক করিনি? বলল, ঋজুদা?
ঠিক। উ্য আর ওলওয়েজ রাইট।
ঋজুদা সত্যিই খুবই বদলে গেছে। ভাবছিলাম আমি। আফ্রিকার রুআহাতে আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের শেষে আমিই ঋজুদার হাতে-পায়ে ধরেই প্রায় রাজি করিয়েছিলাম ভটকাইকে দলে নিতে আর এখন ভটকাইই ঋজুদার ব্লু-আইড বয় হয়ে গেল! সংসারে কারওই ভাল করতে নেই। বাঙালির তো নয়ই! ন’জ্যাঠাইমা ঠিকই বলেন।
বাঃ। এখানে চেয়ার পেতে বসে থাকলেই দিব্যি দিন কেটে যাবে।
আমি বললাম।
কেন? তুই কি রিটায়ার্ড জজসাহেব?
ভটকাই ফুট কাটল।
আমার পক্ষে ওকে আর সহ্য করাই সম্ভব হচ্ছে না।
বললাম, হঠাৎ জজসাহেব হতে যাব কেন? তা ছাড়া, জজসাহেবরা ছাড়া। আর কেউই কি চেয়ার পেতে দোতলার বারান্দায় বসেন না?
হয়তো বসেন কিন্তু রিটায়ার্ড জজসাহেবরা বসেনই। বসতে হয়ই!
কেন?
পথের দিকে চেয়ে, জনস্রোতের দিকে চেয়ে ভাবেন ঈসস। যে-মানুষগুলোর জেলের বাইরে থাকার কথা ছিল না, তোরই মতন, তাঁর দেওয়া রায়-এ তারাই সকলে বাইরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর যারা নিরপরাধ তারাই সব জেলে পচছে।
ঋজুদা বলল, জজসাহেবদের কী দোষ? দোষ তো দেশের আইনের। এই সব আইন বাতিল করে নতুন সব আইন করা উচিত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন না কমলাকান্তর দপ্তরে? পড়েছিস রুদ্র?
কী?
সেই যে রে! আইন! সে তো তামাশামাত্র। বড়লোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে।
সত্যি! আমাদের দেশে যার পয়সা আছে, কোনও আইনই তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না।
সংস্কৃতে বলল ভটকাই, কেশাগ্র।
শুধু আমাদের দেশে-ই বা কেন? এমনটা হয় হয়তো আজকাল সব দেশেই।
ঋজুদা বলল, চল, চা-টা খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। সার্ভে করে আসি জায়গাটা। এখানে থাকব তো মোটে এক রাত। কাল দুপুরেই তো চলে যাব জয়ন্তী।
ঠিক।
জয়ন্তী না একটা নদীর নাম?
তাইতো!
ঋজুদা বলল।
আবার জায়গারও নাম?
তাও ঠিক। তুই কি প্রথম শুনছিস এমন ভটকাই? ভারতের বনে-পাহাড়ের আনাচে-কানাচে এমনই গ্রাম আছে হাজারে হাজারে যাদের নাম নদী বা ঝোরা বা নালা বা খোলার নামে। আরে আগে নদী না আগে গ্রাম? নদী কোথা দিয়ে বইছে তা দেখেই তো জলের সুবিধের জন্যে তার আশেপাশেই বা উপরে নীচে গ্রামের পত্তন হয় আস্তে আস্তে।’
তাই?
হ্যাঁ।
এগুলো কী গাছ ঋজুদা? বাবাঃ কী বিরাট বিরাট গাছ! আর গাময় লাল লাল পাতা এসেছে, কুসুম গাছের মতন।
ভটকাই জিজ্ঞেস করল।
আমি বললাম, বাসনাকুসুম।
সেটা আবার কী?
একটা উপন্যাস, মা পড়ছিলেন সেদিন।
ঋজুদা বলল, চিনতে পারলি না গাছটাকে? তা পারবিই বা কী করে! তুই তো এদের দেখেছিস, হয় শুধুই শান্তিনিকেতনে, নয় অন্য কোনও বড়লোকের বাড়ির বাগানে। এগুলো শিরিষ। পড়িসনি? প্রাঙ্গণে মোর শিরিষ শাখায়..
গাছগুলো এইখানে এইরকম বিশাল বিশাল কেন ঋজুদা? এতবড় শিরিষ তো আগে দেখিনি।
আমি বললাম।
এসব যে ভার্জিন ফরেস্টস রে বোকা। এসব কি আর বনবিভাগের লাগানো প্ল্যানটেশানের গাছ? না, বড়লোকের মালীর? দ্যাখ চারধারে আরও কত রকমের গাছ। সবই প্রাচীন। শাল, সেগুন, শিশু, চিকরাসি, আকাতরু। আর ওই দ্যাখ, দূর থেকে শালের মতন দেখতে অথচ অনেকই উপরে সোজা উঠে তারপর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে, ওগুলোর স্থানীয় নাম গোকুল। এমন বনে এলে গা ছমছম করে। না?
কী সব নাম রে বাবা! চিকরাসি।
গাছগুলো আমাকে ভাল করে চিনিয়ে দেবে কে?
ভটকাই বলল।
কেন? তোর জিগরী-দোস্ত রুদ্রই।
আমার বয়েই গেছে। তা ছাড়া এখানকার সব গাছ আমি নিজেই থোরি চিনি।
আমি বললাম।
হবে হবে। বৎসগণ। সব হবে। শনৈঃ শনৈঃ।
ঋজুদা বলল।
তারপরই বলল, শাল, সেগুন, কিন্তু এই অঞ্চলের স্বাভাবিক বাসিন্দা নয়। বন-বিভাগেরই লাগানো।
কী বলো তুমি! কী বিরাট বিরাট সব গাছ।
বন-বিভাগও তো বহু পুরনো। আরে বোকা! প্রাচীন আর আদিম শব্দ দুটোর মধ্যে তফাত আছে। এই শাল-সেগুনেরা এই সব বন প্রাচীন অবশ্যই কিন্তু প্রাকৃত নয়। বাসিন্দা আর আদিবাসীদের মধ্যে যা তফাত তাই আর কী। দেখেছিস, ওই দ্যাখ, ওই শিরিষ গাছটার ডালে অর্কিড এসেছে।
এই উচ্চতাতেই অর্কিড? হয় বুঝি?
উচ্চতা কম হলেও আবহাওয়ার আর্দ্রতার কারণেও হয়। এসবই তো হিমালয়ান ফুটহিলস।
ভটকাই বলল, দেখতে পাচ্ছিস না? মেঘের মতন দেখা যাচ্ছে, ঢেউ-এর পরে ঢেউ, পাহাড়শ্রেণী।
বলেই, আবার চেঁচিয়ে উঠল ভটকাই, দ্যাখ দ্যাখ রুদ্র। ময়ূর। ময়ূর।
দেখেছি। অত চেঁচাচ্ছিস কেন?
দ্যাখ, আমাদের বাংলোর দিকেই আসছে। ঢুকবে মনে হয়।
স্বাভাবিক।
আমি বললাম।
কেন? স্বাভাবিক কেন?
স্বাভাবিক এই জন্যে যে, সাপ দেখেছে।
সাপ? কোথায়?
চমকে উঠে বলল, ভটকাই। বলেই, চেয়ার ছেড়ে রেলিং-এ দু হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে বাংলোর হাতার এদিকে-ওদিকে দেখতে লাগল। হাতার মধ্যেটাতে গাছ-গাছালি বিশেষ নেই। কাঠটগর, রঙ্গন, কাঁঠালিচাপা ইত্যাদি গাছ, যেসব গাছ বিনা যত্নে বড় হয়। গেট-এর পাশেই একটি গাছ আছে, এই দু মানুষ মতন উঁচু। জংলি গাছ। ফুলও এসেছে হলদেটে-লাল। চিনতে পারিনি এখনও।
বাংলোতে, নীচে, নেই তো রে সাপ? এই বাংলোর একতলার কাঠের পাটাতনের নীচেও যতখানি জায়গা ফাঁকা, সাপ তো কিসসুই নয়, বাঘও থাকতে পারে।
ভটকাই বলল। উত্তেজিত গলায়।
তা পারে। কিন্তু ময়ুর সাপ দেখেছে বাংলোর কাঠের পাটাতনের নীচে নয়, দোতলার বারান্দাতেই।
মানে?
বললাম, ঢোঁড়া সাপ। এইমাত্র চেয়ারে এসে বলল।
ভটকাই ঋজুদার দিকে ফিরে বলল, ঋজুদা, তোমার চামচে রুদ্র রায়কে বলে দাও সবসময়ে যেন এইরকম না করে।
আমি চামচে আর তুই হলি হাতা। তোকে আমি ঋজুদার হাতে-পায়ে ধরে দলে ঢোকালাম আর তুই সঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোলি। আর যেই ছাড়ক, তোকে আমি ছাড়ছি না। তুই একটা বহুতই বাজে লোক।
এই যে, চা এসে গেছে। এবার থামা তোদের কিচির-মিচির। তোরা দুটোই বাঁদর।
ঋজুদা বলল।
নর্বু তামাং টি-কোজিতে মোড়া পট-এ করে চা এবং দুধ চিনি আলাদা আলাদা করে ট্রেতে করে এনে ঝকমকে পেয়ালা পিরিচ চামচ সব সাজিয়ে সেন্টার-টেবিলের উপরে রাখল। কায়দাকানুন জানে।
ঋজুদা বলল, চা কর রুদ্র।
ভটকাই বলল, আমার তিন চামচ চিনি। মনে থাকে যেন। তুই তো কেবলই ভুলে যাস। তারই বলল, ঋজুদা, দ্যাখো, ওই গাছটার কাঁধ থেকে একটি সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির গাছ বেরিয়েছে। এটা কীরকম হল? হলই বা কেমন করে?
ঋজুদা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বলল, এরকম তো হয়! প্রকৃতির রাজ্যে কত কিছু হয়। শিরিষ গাছের মধ্যে রাধাচুড়ো।
কিন্তু হল কী করে?
হয়তো ওই শিরিষ গাছের কাণ্ডর জায়গাতে একটা ফোকর ছিল। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ছিল। কোনও পাখি হয়তো বীজ এনে ফেলেছিল রাধাচূড়া গাছ থেকে। অনেক সময় হাওয়াতেও ফুলের পরাগ উড়ে আসে। ফোকরটার মধ্যে বৃষ্টির জল পড়ে নরম হয়ে-যাওয়া ফোকরের নোংরার সঙ্গে ঝড়ে ও হাওয়ায় ওড়া পাতাগুলোও পড়ে পচে। সেই পচনধরা কাঠ ও পাতার বীজ ধারণের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই বীজ পড়তেই প্রকৃতির অদৃশ্য নিয়মে গাছ জন্মাল। অন্য গাছের কাঁধ বা উরু বা কোমর থেকে।
এমন করেও জন্মায়? আমি জিজ্ঞেস করলাম, অবাক হয়ে।
অবশ্যই। আর এই প্রক্রিয়াকে বলে symbiosis.
উচ্চারণ কী? বটানিক্যাল আর মেডিক্যাল নাম কোনও ভদ্রলোকের পক্ষে ঠিকমতন উচ্চারণ করা সম্ভবই নয়। থাইসিস, নিউমোনিয়া এই সব বানানের আগেও একটা ‘P’ বসবে। কোনও মানে হয়? গভীর চক্রান্ত।
ভটকাই বলল, উত্তেজিত হয়ে।
ঋজুদা হেসে বলল, তুই যে দেখি, জ্যোতি বসু হয়ে গেলি! সবেতেই গভীর চক্রান্ত দেখছিস। উচ্চারণটা সীমবাওসিস।
নাও, চা খাও।
বলে, ঋজুদাকে আমি পিরিচসুন্ধু পেয়ালাটা এগিয়ে দিলাম। পাতলা লিকার, কম দুধ, এক চামচ চিনি। ইদানীং সকালের প্রথম কাপের পরে চা খেলে দুধ-চিনি ছাড়া শুধুই পাতলা লিকার খায় ঋজুদা। তাই বললাম, দুধ-চিনি দিয়েই দিলাম।
দে। যা তোর দয়া।
চায়ে চুমুক দিয়ে ঋজুদা বলল, এই প্রকৃতির মধ্যে, বন-জঙ্গল নদীর মধ্যে কত যে রহস্য! যতই জানবি, ততই অবাক হবি। কতরকম মানুষ এই পৃথিবীতে, কতরকম গাছ, ফুল, ফল, কত হাজার রকমের পাখি, সাপ, পশু, কতরকম প্রজাপতি, কত কোটি বছর ধরে আমাদের এই পৃথিবী এবং সূর্য, চন্দ্র, অগণিত গ্রহ, উপগ্রহ এবং নক্ষত্র নির্ভুল সময়ে এই ব্রহ্মাণ্ডে আবর্তিত হচ্ছে। কে যে অদৃশ্য থেকে অলক্ষ্যে এই বিরাট ক্রিয়া কাণ্ড পরিচালনা করছেন তা আমরা বুঝি, মনে মনে জানি, কিন্তু স্বীকার করতে চাই না। আমরা যে বিজ্ঞান-বিশ্বাসী। বিজ্ঞানের সঙ্গে যে এই অদৃশ্য পুরুষের কোনও ঝগড়া নেই এ কথা যে সবাই মানতে চায় না।
চলো এবারে বেরোই। চা তো খাওয়া হল।
হ্যাঁ।
বাংলোর হাতার গেট-এর কাছে যে গাছটাকে চিনতে পারিনি, তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ঋজুদাকে বললাম, এটা কী গাছ ঋজুদা?
এটা গামহার রে। চিনতে পারলি না? গামহার তো তুই দেখেছিস আগে।
কোথায়?
বাঃ। অ্যালবিনো বাঘের ডেরা হাজারীবাগের মুলিমালোয়ার জঙ্গলে। শুধু একটা দেখেছিস? গামহার তো সে অঞ্চলে, গদাধরের বনবিবির বনে যাকে বলে টিপ্পি নেগে রয়েছে, সেইরকমই ছিল।
কিন্তু এটাকে দেখে তো গামহার বলে চেনা যায় না।
আমি বললাম
যাবে কী করে! এর যে বালক বয়স! তুমি যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়তে তখন যেমন দেখতে ছিলে, আজও কি তেমন দেখতে আছ সোনা?
ঋজুদা আমার প্রতি এই ঠাট্টাতে ভটকাই পরম খুশি হয়ে গলা আর নাক দিয়ে ঘোঁৎ আর হোঁৎ-এর মাঝামাঝি একটা শব্দ করল আমার দিকে ট্যারা চোখে তাকিয়ে।
আমি ইগনোর করলাম।
চল, রেল স্টেশানে যাই। ছোট লাইনের ট্রেন।
চলো।
হেঁটে হেঁটে আমরা চললাম। স্টেশানটা ছোট্ট। ঘুমন্ত। সকালে বিকেলে দুটি করে প্যাসেঞ্জার ট্রেন যায় এখন। দেশভাগের আগে এই স্টেশানই গমগম করত! স্টেশান দেখে আমরা ইনফরমেশান সেন্টারের দিকে এগোলাম। পথে বন-বিভাগের নানা কর্মীর কোয়ার্টার। হাতির ভয়ে এখানে সব বাড়িই দোতলা। কাঠের বাংলো অবশ্য। সিমেন্ট কংক্রিটের উপরে ভারতীয় বুনো হাতিদের খুবই রাগ। আফ্রিকার হাতিদের কথা জানি না।
এগুলো কী গাছ ভটকাই? জানিস?
ঋজুদা বলল।
না জানলে, চলবে কী করে! এটা জারুল। অর ওই যে সিঁদুরে-লাল ফুল ফুটেছে উঁচু গাছটাতে ওটার নাম পারুল।
পারুল মানে? ওরে বকুল পারুল শাল পিয়ালের বন?
হ্যাঁ। যিনি বকুল পারুল পিয়াল কোনওদিন দেখেনইনি চোখে, শাল দেখলেও দেখে থাকতে পারেন হয়তো, তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গাইবেন কী করে? চোখের সামনে চিত্রকল্প না ফুটে উঠলে কী ভাব ফুটবে গানে? ফুটবে
বলেই আজকালকার তাবড়তাবড় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়কের গানের অমন ছিরি। কাষ্ঠং শুষ্কং স্বরলিপি পাঠ করা।
পারুলের ফুলগুলো অগ্নিশিখার মতন না অনেকটা?
ভটকাই বলল।
তুই অগ্নিশিখা কোথায় দেখলি?
বা রেঃ। শান্তিনিকেতনে!
শান্তিনিকেতনে যে গাছে ওইরকম ফুল দেখেছিস সেগুলো আসলে আফ্রিকান টিউলিপ।
আফ্রিকান টিউলিপ? তা হলে মন্টিদাদু বললেন যে অগ্নিশিখা!
দুইই ঠিক। রবীন্দ্রনাথই দিয়েছিলেন ওই নাম। অনেক ফুলেরই দিয়েছেন। সাহিত্যিক বনফুল, মানে, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ও যেমন পাখিদের সুন্দর সুন্দর নাম দিতেন নিজের ইচ্ছেমতন। ওঁরা কবি-সাহিত্যিক। ওঁরা দিতেই পারেন। কিন্তু তোর আমার মতন সাধারণ মানুষের তো আসল নাম আর ভালবেসে-দেওয়া নাম এই দুইই নামই জানতে হবে। কত গাছ, কত পাখি আছে আমাদের দেশে, তাদের কত বিচিত্র সব নাম, রাজ্য ভেদে, লোকালয় ভেদে। ইংরেজি নামই আমি জানি, যাদের নাম জানি, কিন্তু তাদের দিশি নামগুলোও তো কম মজার নয়। কি গাছেদের আর কি পাখিদের!
যেমন?
ভটকাই বলল, যেন ঋজুদাই কিন্ডারগার্টেনের ছাত্র আর ও ক্লাসটিচার।
যেমন ধর, Short Toed Eagle বলে আমি যে পাখিকে জানি তার নাম বাংলাতে সাপমারিল। কেন না, সাপ মেরে খায়। কেউটেশঙ্খচূড় সব বিষধর সাপ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারে এরা। আবার ধর, যে পাখির মেঠো ইঁদুর না হলে লাঞ্চ খাওয়াই হয় না, যার ইংরেজি নাম বাজার্ড, তার দিশি নাম চুহামার।
কী নাম বললে?
আমি বললাম।
চুহামার। ঋজুদা বলল।
লালুপ্রসাদ যাবদের রাজ্যের বাসিন্দা?
ভটকাই বলল।
তারপরই বলল, দারুণ লাগে কিন্তু আমার।
কী দারুণ লাগে? চুহামারকে না। লালুপ্রসাদ যাদবকে?
লাল্লুবাবুকে।
কেন?
আরে কথা বলে কি মানুষটা! একেবারে দিলচসপি।
কীরকম?
সেদিন টি.ভি.তে দেখলাম, একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন ওঁকে, আপনার রাজত্ব আর কতদিন?
তা উনি চোখ পিটপিট করে বললেন, যবতক সামোসামে আলু রহেগা, তবতক বিহারমে লালু রয়েগা।
আমি আর ঋজুদা হেসে উঠলাম কথা শুনে।
বললাম, সত্যি?
সত্যি।
ভটকাই বলল, জোরের সঙ্গে।
বুঝলি। একেই বলে সেল্ফকনফিডেন্স। তুড়ি মেরে রাজত্ব না করতে পারলে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে, আমাকে দয়া করো আমাকে দয়া করো বলে ভোট ভিক্ষা যারা করে, তারা কি নেতা নাকি?
থামা এবার তোদের নেতাতত্ত্ব। ওই দ্যাখ সামনে একটা মিনি-চিড়িয়াখানা। অনেক জানোয়ার আছে মনে হচ্ছে। ঋজুদা বলল। তারপরই বলল, নিশ্চয়ই ধরা পড়েছে। পরে জঙ্গলে ছেড়ে দেবেন হয়তো কর্তৃপক্ষ।
আমরা পায়ে পায়ে গিয়ে সেখানে পৌঁছতেই জানোয়ারগুলোর যিনি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন তিনি বললেন এটা Rescue Centre। Rescue Centre কেন নাম হল বুঝলাম না।
দেখলাম, একটা অল্পবয়সী চিতা, একটা হগডিয়ার, একটা বার্কিং-ডিয়ার (কোটরা) এবং একটা ক্লাউডেড লেপার্ড আছে। ক্লাউডেড লেপার্ডটিকে দেখে কষ্ট হল। এদের বাস ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়। অথচ এখানে তার খাঁচার মধ্যে রোদ এসে পড়েছে। মাথার উপরের পাতার আস্তরণ পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। রোদের তাপও কিছু কম নয়। তা ছাড়া, যে খাঁচাটিতে তাকে রাখা হয়েছে, সেটি এতই ছোট যে, সে বেচারি নড়াচড়াই করতে পারছে না। অত্যন্ত নোংরাও হয়ে ছিল সেই খাঁচা। দেখে, কষ্ট হল। শুনলাম, তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে কখন এবং কোথায় সে ব্যাপারে উপরওয়ালাদের কাছ থেকে এখনও কোনও স্পষ্ট নির্দেশ আসেনি। কবে আসবে, জানাও নেই কারও। তবে যত শিগগির আসে, ততই মঙ্গল। প্রাণীটি বেঁচে যাবে! তাকে কিছুদিন আগেই ধরা হয়েছিল। জঙ্গলের গ্রামের এক বুড়িকে নাকি কষে থাপ্পড় কষিয়েছিল। জানি না, সেই বুড়ি কষতে-দেওয়া অঙ্ক পারেনি, না অন্য কোনও অপরাধে দোষী ছিল।
ভটকাই বলল, দ্যাখ দ্যাখ ল্যাজটা কী লম্বা। নিজের শরীরের দৈর্ঘ্যের প্রায় দুগুণ।
ওদের লেজ অমন লম্বাই হয়। তবে সবচেয়ে লম্বা লেজ হয় স্নো-লেপার্ডের।
আমি বললাম, বিজ্ঞর মতন।
এমন সময়ে উল্টোদিক থেকে এক লম্বামতন ভদ্রলোক এসে ঋজুদার নাম করে বললেন, চলুন ‘ইনফরমেশান সেন্টার’-এ নিয়ে যেতে এলাম আপনাকে।
আপনার নাম?
আমার নাম প্রদীপ ভট্টাচার্য। আমি রাজাভাতখাওয়ার বীট-অফিসার।
নমস্কার।
বলল, ঋজুদা। রেঞ্জার সাহেব কোথায়?
তিনি ব্যস্ত আছেন। কনসার্ভেটর পালিত সাহেব এসেছেন তো। তাঁর সঙ্গে থাকা, তাঁর খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই তো দেখাশোনা তাঁরই করতে হয়।
ইনফরমেশান সেন্টারে পৌঁছবার আগেই সম্ভবত আমার আর ভটকাই-এর লাগাতার প্রশ্নবাণে তিতিবিরক্ত তো বটেই কিঞ্চিৎ ভীতও হয়ে (এটা কী গাছ? ওটা কী ফুল? এটা কী লতা? সেটা কী অর্কিড? ওটা কী পাখি?) ভটচায্যি মশায় অন্য একজনকে ডেকে আমাদের দায়িত্ব তাঁর উপরে দিয়ে বললেন, আমার একটু যেতে হবে। ইলেকট্রিক-এর পোল মেরামতি হচ্ছে তো।
বলেই, পালালেন।
ঋজুদা পাইপটা মুখ থেকে বের করে হেসে বলল, কী বিপদেই যে তোরা ফেলেছিলি ভদ্রলোককে! অনেক মানুষের কাছেই গাছের নাম, গাছই! পাখির নাম পাখিই। নদীর নাম নদী। এইরকম উত্তরেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত তোদের। তার চেয়ে বেশি জানতে চাওয়া সবসময়েই অপরাধের।
রাজাভাতখাওয়া টাইগার প্রজেক্ট-এর ইনফরমেশান সেন্টারটি সত্যিই চমৎকার। এটি এস. এস. বিস্ত সাহেবই করে গেছেন। অভিনন্দন তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য। এই এলাকার নানা পাখি, জানোয়ার, ফুল এবং অর্কিড ইত্যাদির কিছু কিছু নিদর্শন রাখা আছে। অডিও-ভিজুয়াল ডিসপ্লের বন্দোবস্তও। মালায়ান জায়ান্ট স্কুইরেল, ওড়িশার লবঙ্গীর জঙ্গলের স্থানীয় মানুষেরা যাদের বলতেন ‘নেপালি মুসা’ অর্থাৎ নেপালি ইঁদুর। পায়েড হর্নবিল, অর্থাৎ আমাদের দেশের ধনেশ পাখি। ওড়িশার জঙ্গলে এদেরই আবার বলে বড়কি (গ্রেটার) ধনেশ আর ছোটকি (লেসার) ধনেশ। আরও নাম আছে। কুচিলা খাঁই ও ভালিয়া খাঁই। এত খাই খাই ওদের বেশি খাঁই-এর জন্যে কিন্তু আদৌ নয়। বড়কি ধনেশ কুচিলা গাছে আর ছোটকি ধনেশ ভালিয়া গাছে বসে সেই সব গাছের ফল খায় বলেই ওদের এরকম নামকরণ হয়েছে। ইন্ডিয়ান বাইসন বা গাউরও আছে। ময়ূর, ময়ূরী, পরিযায়ী কালো সারস, নানারকম সাপ, পাইথন, মোলারাস এবং রেটিকুলেট পাইথন, হগডিয়ার, চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন, হাতি, লেপার্ড, ক্লাউডেড লেপার্ড ইত্যাদি।
যিনি সেন্টারের চার্জ-এ ছিলেন তিনি বললেন, হাতির কথা না বলাই ভাল। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দলে হাতি দেখা যায় এখানে। এই তো কলকাতা থেকে সেদিন মস্ত দল নিয়ে এসেছিলেন ওয়াইল্ডলাইফ-এর কনসার্ভেটর অতনু রাহা, চিফ গেম ওয়ার্ডেন সুবিমল রায় এবং আলিপুরদুয়ার থেকে বনবিভাগের কয়েকজন কর্মী কদিন আগেই। ওঁরা একটি বড় হাতিকে ঘুমপাড়ানি ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে গলায় রেডিয়ো কলার লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। ওই হাতির গলার বিপ বিপ বিপ আওয়াজ শুনেই পুরো দলের রাহান-সাহান জানা যাবে এবার থেকে।
এ দলে কতগুলো হাতি ছিল?
শুনেছি, আশিটা।
ভটকাই বলল, এই ঘুমপাড়ানি ওষুধটা কী ব্যাপার বলো তো ঋজুদা? ঘুম পাড়ানো হল তা নয় ঠিকই আছে কিন্তু ঘুমটা ভাঙায় কী করে?
ঋজুদা বলল, সে অনেক গোলমেলে ব্যাপারস্যাপার। তবে তোদের অল্পকথাতে বলছি, শোন।
তারপর ঋজুদা আমার দিকে ফিরে বলল, রুদ্র, তুই তো আমার সঙ্গে আফ্রিকাতে গেছিলি, আহা’ আর ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’তে। তখন তো আফ্রিকান আদিবাসী ওয়ান্ডারাবো চোরাশিকারিদের কথা জেনেইছিলি। তারা যেমন Blow Pipe দিয়ে বিষ মাখানো তীর ছুঁড়ে হাতির মতন বড় জানোয়ারকেও শিকার করে, তেমনই আর কী। তবে ওরা মারে। এঁরা ঘুম পাড়ান এই তফাত। ঘুমপাড়ানি ওষুধের ডার্ট BLOW GUN দিয়েও ছোঁড়া হয় কাছাকাছি থেকে। ধর, চিড়িয়াখানার কোনও অসুস্থ জানোয়ারকে চিকিৎসা করার জন্যে বা অন্য চিড়িয়াখানায় চালান দেওয়ার জন্যে তাদের ঘুম পাড়ানোর প্রয়োজন হয় অনেকই সময়। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে BLOW GUN-এ ভাল কাজ হয় না। কারণ দূর থেকে ছুঁড়তে হয়। সেখানে Blow Rifle দিয়ে ডার্ট ছুঁড়ে ঘুম পাড়ানো হয়। রাইফেলের রেঞ্জ তো অনেকই বেশি গান-এর চেয়ে। তা ছাড়া, ব্যারেলের উপরে রিয়ার সাইট থাকাতে তা ঠিক মতন বেশি বা কম উঠিয়ে নিয়ে অ্যাডজাস্ট করে বেশ দূর থেকেও ছোঁড়া যায় সেই ডার্ট।
কোথায় মারে? মানে শরীরের কোন অংশে? রাইফেল বা শট-গান দিয়ে শিকার করতে হলে আমরা জানোয়ারের যে-সব ভাইটাল জায়গায় মারতে চাই, সেইসব জায়গাতেই কি?
আরে না, না। সেখানে নয়। রাইফেল-এ বন্দুকের মার তো জানোয়ারকে একেবারে মেরে ফেলারই জন্য। এবং তাও যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এবং যথাসম্ভব কম কষ্ট দিয়ে। ভাল শিকারি মাত্ররই তাই করণীয়।
হঠাই ভটকাই গেয়ে উঠল–
তোমায় গান শোনাব।
ও মোর ঘুমপাড়ানিয়া
তোমায় গান শোনাব
ও মোর ঘুমভাঙানিয়া
তোমায় গান শোনাব।
ভাগ্যিস সেন্টারে তখন আর কেউই ছিলেন না আমরা ছাড়া। ইন-চার্জ ভদ্রলোক অবশ্য ওই ভটকাই-এর আচমকা কায়দায় ছোঁড়া বোমার মতন গান শুনে হেসে ফেললেন জোরে।
আমি ভটকাই-এর এহেন কদাকার চ্যাংড়ামিতে অপরিচিতের সামনে লজ্জা পেয়ে ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ঋজুদাও পিছু পিছু এল।
ঋজুদা কিছু লিখল Visitors Book-এ বেরিয়ে আসার আগে।
বাইরে এসে বললাম, আচ্ছা ঋজুদা, ঘুম তো পাড়ান এঁরা কিন্তু জাগান কেমন করে? নিজের থেকেই জেগে যায় কি ঘুমন্ত জানোয়ার?
তা হয়তো জাগে কিন্তু ওই অবস্থাতে তাদের ফেলে রেখে গেলে নানারকম ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রায় সবসময়েই কাজ হয়ে গেলে অন্য ইনজেকশান দিয়ে ওষুধের ঘোর ভাঙানো হয়।
শরীরের কোথায় মারতে হয় ডার্ট গান দিয়ে বললে না তো?
নাছোড়বান্দা ভটকাই বলল।
ও হ্যাঁ। সাধারণত মারে সামনের দু পা যেখানে শরীর থেকে বেরিয়েছে সেইখানে, মানে গলা, ঘাড়, হার্ট এবং লাংস-এর নীচে। নয়তো মারে, পেছনের দু পা যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে শরীরে, ঠিক সেইখানে। মানে যে জায়গাকে ইংরেজিতে আমরা বলি ‘Rump’। মোদ্দা কথা, মাংসল জায়গাতে মারে।
কী ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ায়?
আমি জিজ্ঞেস করলাম। আর এইসব বন্দুক রাইফেল পাওয়াই বা যায় কোথায়?
এই সব বিশেষ বন্দুক, রাইফেল বানায় জার্মানি, স্টেটস এবং সুইটজারল্যান্ড। আরও হয়তো অনেক দেশই বানায়। আমি জানি না। সেইসব দেশ থেকেই ইমপোর্ট করতে হয়। আর ওষুধ তো অনেকই রকম আছে। ওষুধও স্পেশ্যাল ইমপোর্ট লাইসেন্স-এর জোরে আমদানি করতে হয়।
কী নাম ওষুধের?
ওষুধটা হচ্ছে জাইলাজাইন হাইড্রোক্লোরাইড কিন্তু রমপান (Rompun) ট্রেড নেম-এ বাজারে ছাড়ে প্রস্তুতকারীরা। Bayer Company। পাউডারের মতন, জলে গুলে নিয়ে ডার্ট-এ ভরতে হয়। ইম্মোবিইলন নামেরও অন্য ওষুধ আছে। Immobile, মানে চলচ্ছক্তিহীন করে, তাই এই নাম।
এখন Immbobilon বা Rompun এই দুই ঘুমপাড়ানো ওষুধ কেথায় পাব তা কি বলবে?
ভটকাই সিরিয়াস মুখ করে বলল।
কেন?
আমি একটা জানোয়ারকে ইম্মোবাইল করব।
কী জানোয়ার?
তার প্রজাতিতে মাত্র একটিই প্যায়দা করেছিলেন মিস্টার ব্ৰহ্মা।
নাম কী?
রুদ্র রায়।
ঋজুদা জোরে হেসে উঠল।
আমি বালখিল্য ভটকাইকে উপেক্ষা করে বললাম, আচ্ছা! এই যে ঘুম-পাড়ানো-ঘুম-ভাঙানো হয় এসব কীসের জন্যে?
বাঃ। বললামই তো। কত কিছুর জন্যে।
যেমন?
চিড়িয়াখানাতে কত জানোয়ার অসুস্থ হয়। তার মধ্যে বাঘ, সিংহ, চিতাও। যেমন আছে আবার গণ্ডার, জলহস্তী, হাতি, জিরাফও থাকে। ধর, গণ্ডারের কানে ঘা হয়েছে বা জিরাফের ঠ্যাং ভেঙে গেছে, তা তাদের ঘুম না পাড়ালে ভেটরিনারি সার্জন অপারেশনটা করবেন কী করে? টু-এ এবং চাট-এ তো ডাক্তারের পেট ফেঁসে যাবে, নইলে মুণ্ডু গড়াবে ভঁয়ে। তা ছাড়া, বন্য প্রাণীদের মধ্যেও যখন কোনও প্রাণী হঠাৎ বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে বা মানুষ অথবা গবাদি পশুর ক্ষতি করে তখনও তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে, হয় খাঁচায় পোরা হয়, নয় চিড়িয়াখানাতে দিয়ে দেওয়া হয়। কখনও বা আবার বনেই ছেড়ে দেওয়া হয়। দেখিস না এইসব খবর কাগজে?
আমি কাগজ পড়ি না। সব গুলতাল ছাপে, পড়ে কে সময় নষ্ট করে!– আচ্ছা ঋজুদা, বিপজ্জনক জানোয়ারেরা কখনও চিকিৎসা করার বা কলার-পরানোর আগেই ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে না? তখন কী হয়?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ঋজুদার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ভটকাই বলল, আবার কী হয়? অন্য কী হতে পারে? কেলো হয়! গ্রেট কেলো।
এমন ঘটনা ঘটে বইকী! আবার এও ঘটে যে, ওষুধের ডোজ বেশি হয়ে যাওয়াতে বা কোনও বন্য প্রাণীর হৃদয় দুর্বল থাকাতে বা হঠাৎ শক-এই তারা মারা যায়। ঘুম আর ভাঙেই না।
কই? এমন খবর তো পড়িনি কাগজে।
কাগজে যা ছাপা হয় বা পড়িস তোরা তা আসল খবরের এক সামান্য ভাগ মাত্র। প্রত্যেক কাগজই এক-একটি আইসবার্গ, হিমবাহ। এক-অষ্টমাংশ দেখা যায় আর বাকিটা অগোচরে থাকে।
কিন্তু এও তো এক ধরনের খুনই হল। শিকারিরা মারলেও মরল আর এঁরা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মারলেও মরল! মরবে?
এঁরা তো আর ইচ্ছা করে মারেন না। অনেক সময় ভাল করতে গিয়েও খারাপ হয়ে যায়। তার আর কী করা যাবে? ইটস ওল ইন দ্যা গেম।
যারা মরে, তারা কি জানতে পায় যে, তাদের ভালর জন্যেই তারা মরল? ইটস্ অল ইন দ্যা গেম?
ভটকাই গম্ভীর মুখে বলল।
ঋজুদা হেসে উঠল ভটকাই-এর কথা শুনে। বলল, ফাজিল।
ভটকাই বলল, দ্যাখ রুদ্র, তোকে যখন আমি ঘুম পাড়াব তখন তুই মরে গেলেও যেন ভাবিস না যে, তোর খারাপের জন্যেই মারলাম তোকে। সবসময়ই আমি তোর ভালই চাই।
ওরে, সাড়ে বারোটা যে বেজে গেল। রোদ চড়া হয়ে যাবে। চল এবারে Whispering Trail’-এ একটু হেঁটে, বাংলোতে ফিরে যাই।
ঋজুদা বলল।
ইনফরমেশান সেন্টারের হাত থেকে বেরোতে বেরোতে ভটকাই বলল, আবার উল্টোদিকে হাঁটাবে ঋজুদা? এই রোদে? চাঁদি যে ফেটে যাবে। এমনিতেই তো বহুদূর হাঁটতে হবে শুধু গাছ দেখতে দেখতে এমন গেছো দাদার মতন হাঁটতে কি ভাল লাগে?
চল চল। এত সব পদ রান্না হল, ক্ষিদে না হলে সব নষ্ট হবে যে। তা ছাড়া সব জায়গাতেই কাঙ্গপোকপির ইবোচবা সিং আর নিনিকুমারীর বাঘ’ থাকতে হবে নাকি! আরে দ্যাখ দ্যাখ…।
ঋজুদা বলল।
আমরা দেখলাম ইনফরমেশান সেন্টারের একদিকের দেওয়ালে দারুণ একটি রঙিন ছবি। রাজাভাতখাওয়ার। দুই রাজা মহা সমারোহে ভাত খাচ্ছেন।
ভারী কালারফুল কিন্তু। তাই না?
ঋজুদা বলল।
সত্যি!
সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন, কলকাতা থেকে আর্টিস্ট আনিয়ে আঁকানো হয়েছে।
নাম জানেন কি?
তা বলতে পারব না। আর্টিস্ট।
বাইরে বেরিয়ে Whispering Trail-এ একটু ঢুকতেই দু পাশের জঙ্গল যেন গলা টিপে ধরল। সত্যি!
আক্ষরিকার্থে যাকে বলে Suffocating! এরকম জঙ্গল আমার ভাল লাগে না। সরু পায়ে-চলা পথ দেড় কিমি. মতন চলে গেছে গহন বনের মধ্যে দিয়ে। দু পাশেই আন্ডারগ্রোথ, মানে, গাছেদের পায়ের কাছে ঝোপঝাড় লতা-পাতা এই মার্চ মাসেও এত নিচ্ছিদ্র যে, রীতিমতো একধরনের ভয়মিশ্রিত অসহায়তার বোধ জন্মায় মনে।
আমাদের ভয় একরকমের, আর সঙ্গী ভদ্রলোকের, মানে, ভটচায্যিবাবু যাঁকে আমাদের সঙ্গে দিয়েছিলেন, তাঁর ভয় অন্যরকমের। সেকেন্ডে সেকেন্ডে এটা কী গাছ? ওটা কী লতা? এটা কী ঝাড়? সেটা কী ঝোপ? শুনতে শুনতে এবং প্রায় কোনওটারই উত্তর না দিতে পেরে উনি দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, আমারে এবারে বাড়ি যেতে হবে স্যার। ছেলেটার খুব জ্বর। ওষুধ আনতে হবে।
ঋজুদা বলল, হ্যাঁ, আপনি যান। এতক্ষণ বলেননি কেন? আশ্চর্য মানুষ তো আপনি! আমরাও ফিরছি। রোদও খুব চড়া হয়ে গেছে। তবে এখানে আমরা আবারও আসব। Whispering Trail-এ শেষ অবধি যাব। তখন খবর দেব আপনাকে, মানে ভটচায্যিবাবুর মাধ্যমে।
ভদ্রলোকের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আপাতত। বললেন, আমার চেয়ে ভাল অনেকেই আছেন, যাঁরা সব গাছ-মাছ চেনেন। তেমনই কারোকে পাঠিয়ে দেব তখন।
ঠিক আছে।
উনি প্রায় দৌড়েই আমাদের মায়া কাটালেন।
ঋজুদা বলল, এই ভদ্রলোক কী কাজ করেন জানি না। বন বিভাগের কোনও কর্মীর বেড়াতে-আসা শালা বা ভগ্নিপতিও হতে পারেন। কিন্তু কনসার্ভেটরেরা সব গাছ ঝোপ লতা পাতা না চিনলেও না চিনতে পারেন, তাঁদের অনেকটা সময় ঘরে বসে কাজ করতে হয় কিন্তু রেঞ্জাররা, ফরেস্টগার্ডেরা বা বীট-অফিসারেরা, যাঁদের কাজই হল জঙ্গলের গভীরে সারাবছর থাকা, তাঁরা কেন সব গাছ ঝোপ ঝাড় পাখি প্রজাপতি চিনবেন না? আসলে বুঝলি না, ভালবাসাটা অনেকেরই নেই।
আর্টিস্টও চেনা উচিত।
ভটকাই বলল।
মানে?
রাজাদের ভাত খাওয়ার ছবির আর্টিস্ট।
আমি বললাম, এমার্সনের সেই কবিতাটার কথা মনে পড়ে? কোনটা?
Bold as the engineer
Who fells the wood
Love not the flower they pluck
Know it not,
And all their Botany
Is Latin names!
বাঃ!
ঋজুদা বলল।
ভটকাই বলল, তোর স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল। কবে ঋজুদার মুখে একবার শুনেছিলি, হুবহু মনে রেখেছিস। নাঃ, তুই ছেলেটার অনেকই গুণ। শুধু আমার পেছনে সবসময় লাগিস, এই যা দোষ।
তারপরই বলল, থাকগে! ভদ্রলোক পালিয়ে বাঁচার আগে দুটো নতুন গাছের নাম তো জানলাম। চিনলামও।
কী কী?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
লালি আর দুধে লালি।
বাঃ! চিনিয়ে দে রুদ্রকে।
ভটকাই বলল, আমাদের পাড়ার ভুট্টাদার ছোট বোনের নাম লালি। ভুরু-টুরু চেঁচে, আইব্রো পেনসিল ঘষে সে নিজেকে ইন্দ্রাণী হালদার ভাবছে আজকাল। কিন্তু গায়ের রং কেলে-হাঁড়ির মতন আর মুখটাও হাঁড়িচাঁচার মতন। ফিরে গিয়েই ওকে একটা আয়না প্রেজেন্ট করব আর ওর নাম দেব দুধে লালি।
ঋজুদা বলল, ভটকাই, তুই মহা ফক্কড় হয়েছিস।
ভটকাই বলল, না হলে তোমাদের এনটারটেইন করত কে এখানে? গুণ্ডা হাতি নেই, মানুষ-খেকো বাঘ নেই, খুনি নেই কোনও, শুধু গাছ আর পোকা আর ছারপোকা। বোরড হয়ে যেতে যে একেবারে!
আমি ভটকাইকে বললাম, ছারপোকার বৈজ্ঞানিক নাম জানিস?
নাঃ।
বিরক্ত হয়ে বলল, ভটকাই।
আমাদের সর্বজ্ঞ ভটকাই উত্তর হিসেবে ‘না’কে বড়ই অপছন্দ করে। ‘না’ বলা মানেই যে, হেরে যাওয়া। হারতে একদমই ভালবাসে না ভটকাই।
একদিন ঋজুদা বলেছিল আমাকে, এইটাই মস্ত গুণ ভটকাই-এর। যারা হারতে ভালবাসে না, দেখা যায়, জীবনে তারাই শেষ পর্যন্ত জেতে।
ভটকাই বলল, তুই জানিস, তো তুইই বল। আমি ছারপোকাবিশারদ নই।
নাছোড়বান্দা ভটকাই বলল।
হেটেরোপটেরা।
কী বললি?
হেটেরোপটেরা। অর্থাৎ ছারপোকার বংশ।
আমি বললাম।
ছারপোকার আবার জ্ঞাতি-গুষ্ঠিও আছে নাকি? আমি তো জানতাম সে একাই একশো!
আছে বইকী! এই বক্সা বাঘ প্রকল্পের এলাকাতেই আছে তেষট্টি রকমের।
উরিঃ ফাদার!
তবে নাম না জানলেও তোর ক্ষতি নেই। পশ্চাৎদেশ, নাম জানলেও যেমন জ্বলবে, নাম না-জানলেও তেমনই জ্বলবে।
কী জ্বালাতন! ছারপোকারও এতো জ্ঞাতি গুনল কারা? কোন অকর্মারা?
সে সব সাহেবরাই গুনে-গেঁথে গেছে। যে-ইংরেজদের রাজত্বে একসময়ে সূর্য কখনও অস্ত যেত না, সেই ইংরেজদের অনেকই গুণ ছিল রে!
ঋজুদা বলল।
.
০৫.
বিকেলেও আমরা চা খাওয়ার পরে হাঁটতে বেরিয়ে ছিলাম। নর্বু বলল, জঙ্গলের ভিতরে যাবেন না।
কেন?
হাতি আছে। আর ছিনতাই পার্টিও আছে।
হাতিরা ছিনতাই পার্টিদের কিছু বলে না?
দেখি না তো বলতে।
হাসি পেল আমার নর্বুর কথা শুনে। বেঁটেখাটো, পিটপিটে চোখের নর্বু তামাং ভারী ইন্টারেস্টিং মানুষ।
ভটকাই বলল, হাতিরা আমাদের পোষা।
তাই?
নর্বুর মুখে এমন একটা ভাব ফুটে উঠল যেন ও বলছে যে, ব্যাটারা হাতি নাতি খেয়ে মরলে খুবই খুশি হই।
জঙ্গলের মধ্যে বেড়িয়ে শেষ বিকেলে ফিরে এসে গরম জলে চান-টান করে আমরা পরদিন জয়ন্তী জায়গাটা কেমন হবে সেই আলোচনাতে উত্তেজনার সঙ্গে মগ্ন হলাম। জয়ন্তীর নাম শুনছি সেই কবে থেকে! ভারী সুন্দর জায়গা নাকি? এতদিনে সত্যি সত্যিই যাওয়া হবে।
গল্পে গল্পে সন্ধে হল। সন্ধে থেকে রাত।
ঋজুদা বলল, কাল সকাল সকাল জয়ন্তীর পথে বেরিয়ে পড়া যাবে।
কতক্ষণ লাগবে যেতে?
জানি না। যতক্ষণ খুশি লাগুক। আমাদের হাতে অঢেল সময়।
যা বলেছ! সময় দিয়ে গোল্লা পাকিয়ে ঢিল মারা যায়।
ভটকাই বলল।
যত উদ্ভট উদ্ভট আইডিয়া তোর মাথাতেই আসে।
এমন সময় ওয়্যারলেস টেলিফোনে খবর এল যে, জয়ন্তীর রেঞ্জার বিমান বিশ্বাস, জিপ পাঠাবেন দুপুরের খাওয়ার পরে আগামীকাল আমাদের নিয়ে যেতে। সকালে নয়।
ভটকাই বলল, যাক। কাল দুপুরেও তা হলে গাছ-পাঁঠা খাওয়া যাবে। যাই বল আর তাই বল এখানের এঁচোড়গুলোর স্বাদই আলাদা। তা হলে কাল ব্রেকফাস্টের পরে হুইসপারিং-ট্রেইলের শেষ অবধি যাওয়া যাবে।
কালকের কথা কালকে। রাতে কী মেনু করে এসেছিস রে ভটকাই?
আমি বললাম।
হ্যাঁ। তুইই তো আমাদের কোয়ার্টার-মাস্টার!
ঋজুদাও বলল।
রাতে বিশেষ কিছু বলিনি। নর্বুকে বলেছি এই সাহেবকে, মানে ঋজুদাকে ভাল করে খাওয়াও। সাহেব সারা পৃথিবীর বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। আর আরও যত্ন করে খাওয়াও ওই রুদদরবাবুকে, কারণ, তাঁর হাতে কলম এবং দারুণই নিন্দুক সে। যত্ন-আত্তির একটু খামতি হয়েছে তো সঙ্গে সঙ্গে নাম উঠে যাবে খাতায়। পরে কেঁদে কূল পাবে না।
আহা, মেনুটা কী বল না?
ঋজুদা বিরক্ত হয়ে বলল।
সিম্পল। ভটকাই বলল, এই জঙ্গলে বিশেষ কিছু তো পাওয়া যায় না। তাই ও মুগ-মুসুরি মেশানো খিচুড়ি করবে, মধ্যে জম্পেশ করে গাওয়া ঘি ঢেলে, কড়কড়ে করে আলু ভাজা, মুরগি ভাজা, লেড়ো বিস্কুটের ক্র্যাম দিয়ে, পাথালি করে বেগুন ভাজা, মানে, যজ্ঞিবাড়িতে আগে যেমন হত আর কী! এঁচড়ের চপ, টোম্যাটো-প্যাঁজ কাঁচালঙ্কা দেওয়া স্যালাড আর শুকনো লঙ্কা ভাজা। এই। সিম্পল-এর উপরেই করতে বললাম আর কী!
ঋজুদা বলল, পশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগের নেমন্তন্ন এই প্রথম এবং এই শেষ। আর নেমন্তন্ন করবেন না ওঁরা। জঙ্গলের কোনও হাতিও বোধহয় এত খায় না।
ভটকাই বলল, খাও রেলিশ করে তোমরাই আর আমি খাই তোমাদের গালাগালি।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পরে আমরা বারান্দাতে সব আলো নিভিয়ে দিয়ে চাঁদের আলো উপভোগ করছি। বিজলি আছে এখানে। বিজলি আলো থাকলে আলোপাখার আরাম পাওয়া যায় অবশ্য কিন্তু জঙ্গলকে জঙ্গল বলে মনে হয় না। আজ সপ্তমী বা অষ্টমী হবে। শুক্লপক্ষ। চাঁদটা, মেঘ-মেঘ ভুটান পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। আকাশ মাঝে মাঝেই মেঘলা হয়ে যাচ্ছে। আলিপুরদুয়ারের কাল রাতের সেই পাগলা হাওয়াটা আমাদের পিছু নিয়ে এখানেও এসে দাপাদাপি করছে। দিনে বেশ গরমই ছিল। রাতে বাইরে বসলে ভারী প্লেজেন্ট। কী সাবান দিয়ে চান করেছে জানি না ঋজুদা, গা দিয়ে ভুরভুর করে চন্দনের গন্ধ বেরুচ্ছে।
ভটকাই বলল, হাতিরা তোমার গায়ের গন্ধেই চলে আসবে কিন্তু বাংলোর কাছে।
আমি বললাম, ওই গন্ধের জন্যেই হয়তো আসবে না।
কেন?
ভাবতেও পারে তো চন্দনবনের চোরা শিকারি ভীরাপ্পানের কাজিন!
আমার বাক্যটিও শেষ হয়েছে আর সঙ্গে পটকার আওয়াজ, ক্যানেস্তারা বাজানোর আওয়াজ, কাঁসর-ঘণ্টা ও শাঁখ বাজানোর আওয়াজে রেললাইনের ওদিকটাতে, স্টেশানের কাছকাছি একেবারে সরগরম হয়ে উঠল। মশালে আগুন জ্বেলে লোকজন চিৎকার করতে করতে ছুটে বেড়াতে লাগল ওইদিকে। আমরা উঠে রেলিং-এ হাত রেখে অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকারতর চলমান কোনও তূপ দেখা যায় কিনা তা দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। ভটকাই দৌড়ে তার ফ্ল্যাশ-লাগানো ক্যামেরাটা নিয়ে এল। যদিও ফ্ল্যাশের রেঞ্জ মাত্র পনেরো ফিট। কিন্তু হাতি যে যায়নি, যাচ্ছে না, তা বোঝা গেল।
এমন সময় দেখলাম নর্বু তামাং পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বাংলোর দিকে আসছে।
চিট্টি আয়ে না।
মেনো মায়ানুকো মলাই চিট্টি আয়ে না।
চিট্টি আয়ে না।
গানের মানে না বুঝলেও ভারী চমৎকার লাগছিল শুনতে নর্বুর গান ওই পরিবেশে। বাংলোর পাশেই একটা ছোট্ট সরু নালা। তার ওপারে একটি দোতলা বাংলোতে অনেক নেপালিরা রয়েছেন সংসার নিয়ে। সেদিক থেকেই আসছিল সে।
ভটকাই উত্তেজিত হয়ে নর্বুর ভালর জন্যেই চেঁচাল, নর্বু! নর্বু! বি কেয়ারফুল। এলিফ্যান্ট! হাতি!
নর্বু বলল, গণেশটা। ওইটা প্রায়ই আসে তো। কলা খাইতে।
কলা খেতে? হাতি? হাতি কি হনুমান?
ভটকাই না-দমে বলল।
কখনও হাতিও খায়। কলাগাছও খায় ডালবহিস্যা।
নর্বু বলল।
থোড় খায়? বেড়ে তো! রাঁধে কী দিয়ে? তাতে নারকোলও কুরিয়ে দেয়? আহা!
কিছুক্ষণ পর শোরগোল ধীরে ধীরে কমে এল। মশালও নিভে এল।
নর্বু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এসে বলল, এই জন্যেই আপনাদের জঙ্গলে যাইতে মানা করছিলাম। রাজাভাতখাওয়ার চারধারেই হাতি। দিন রাত বলিয়া কিছু নাই। বাইরাইলেই হইল। ভালবাসিয়া একখান পা তুইল্যা দিলেই তো শ্যাষ। অথবা শুড় দিয়া উঠাইয়া একখান আছাড়। মাইনষের জানের থিক্যা তো ইঁদুরের জানও শক্ত।
পরদিন বেড-টি খাওয়ার পরই যেদিকে কাল রাতে হাতি এসেছিল সেই দিকেই হেঁটে রওয়ানা দিলাম। কাক-উড়ান-এ যেতে পারলে সামান্যই দূরত্ব কিন্তু এঁকে বেঁকে হেঁটে গেলে আধ মাইলটাক পড়ে। যেখানে পৌঁছে দেখা গেল নর্বুর কথাই ঠিক। হাতিটা একটা কুঁড়েঘরকে প্রদক্ষিণ করেছে অতি সামান্য জায়গার মধ্যে দিয়ে ওই বিরাট শরীর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তারপর ছোট্ট একখানি চষা ক্ষেতের উপরে দাঁড়িয়ে একটা কলাগাছ উপড়ে নিয়ে ফিরে গেছে পেছনের জঙ্গলে রেলের হাসপাতালের একেবারে গা ঘেঁষে। সেই কুঁড়েতে তখন একজন বুড়ি আর একটি বছর বারো-তেরোর মেয়ে ছিল। মেয়েটি আমাদের চেয়ে অনেকই সাহসী। গত রাতের অতিথির কথা বলছিল নির্বিকারভাবে। চষা ক্ষেতে তার পায়ের পাতার গোলাকার ছাপ পড়েছে।
ভটকাই ফটাফট ছবি তুলল। বলল, আমাদের বাগবাজারের পাড়াতে ফিরে গেলে পরেশ, নান্টা, অভিষেক, দীপ্ত বিশ্বাসই করবে না যে হাতির সঙ্গে এনকাউন্টার করে এলাম।
আমি বললাম, ওরা তোকে জানে ভাল করেই। তোর এনকাউন্টার যে কী প্রকারের হতে পারে সে সম্বন্ধে…
নিনিকুমারীর বাঘ-এর চামড়াটার বোঁটকা গন্ধ কি ওরা নিজ নিজ নাসিকাতে শোঁকেনি? ভটকাই যে কী জিনিস তা ওরা জানে। তুই আমাকে চেপে রাখার চেষ্টা করলে কী হবে!
হাতিটার পেছনের একটা পায়ে চোট আছে কোনওরকম। পায়ের দাগ লক্ষ করে বলল ঋজুদা।
কিন্তু হাতিটা গণেশ কি না তা কী করে জানা যাবে?
আমি বললাম।
পায়ের দাগ দেখে শুধু গণেশ কেন, কার্তিকও বোঝা যাবে না। যারা হাতিটাকে কাছ থেকে কখনও দেখেছে তারাই নিশ্চয় দেখেছে যে সেটা গণেশ।
গণেশ কাকে বলে?
ভটকাই শুধোল।
যে পুরুষ-হাতির একটা দাঁত থাকে তাকে বলে গণেশ। আর মাকনা হল, সেই হাতি, যে পুরুষ-হাতির দাঁতই থাকে না, থাকে না মানে, বাইরে থেকে দেখা যায় না।
কী সব অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার!
হাতির দলের যে নেতা তার দাঁত নিশ্চয়ই বিরাট হয়।
হাতির দলের নেতা সাধারণত পুরুষ-হাতি হয়ই না। মেয়ে-হাতি হয়। তবে বিরাট হাতি।
মেয়ে-হাতিদের দাঁত থাকে?
না। মানে বাইরে থেকে দেখা যায় না। তবে, আফ্রিকার হাতিদের মধ্যে মেয়েদেরও দাঁত দেখা যায়।
অসভ্য মেয়ে।
ভটকাই বলল।
.
০৬.
শিলিগুড়ি থেকে সিলিভিকালচারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডি. এফ. ও. ভগবান দাস সাহেব এসেছিলেন পালিত সাহেবের সঙ্গে। উনিই বলে গেছিলেন আমাদের বাংলোতে এসে যে, জয়ন্তীতে যাওয়ার সময়ে যেন বনের মধ্যের কাঁচাপথ দিয়ে ওয়াচ টাওয়ার হয়ে যাই।
ভটকাই বলল, আচ্ছা ঋজুদা, কনসার্ভেটর পালিত সাহেব তো তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এলেন না?
কেন আসবেন? আমি তো ওঁর উপরওয়ালা নই। সরকারি আমলাও নই। তাছাড়া আমি কে এমন মানুষ যে আমার সঙ্গে সকলের এসে আলাপ করতেই হবে? আমি বন-বিভাগের উপদেষ্টা-টেষ্টা হলেও না হয় কথা ছিল। বন-জঙ্গলকে ভালবাসি, এটুকু ছাড়া অন্য কোনও পরিচয়ই তো আমার নেই! যার পদাধিকার নেই তাকে এদেশে কেই-বা চেনে বা মান্য করে, বল? তা ছাড়া, উনি এসেছেন নিজেরই কাজে। কাজ নিয়েই আছেন। আর ওঁদের কাজ তো ঘড়ি-ধরাও নয়। খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক থাকে না কোনও। পরে কোনওদিন আলাপ নিশ্চয়ই হবে, বনে অথবা কলকাতাতেই।
খাওয়া-দাওয়ার পরে আমরা যখন বেরোলাম তখন মেঘলা করেছিল আকাশ। রেললাইনটা পেরিয়ে স্টেশানের পাশ দিয়ে একটু গিয়েই ঘন বনের মধ্যের কাঁচাপথে ঢুকে পড়ল পথটা। দু পাশে হাজার হরজাই গাছ উপরে চন্দ্রাতপের সৃষ্টি করেছে। অধিকাংশ গাছই আমার অচেনা। ঋজুদাও দেখি মনোযোগ দিয়ে দেখছে দু পাশে। বলল, ওই দ্যাখ, ওই সবকটা মহীরুহই শিরিষ। চাঁপ গাছ আর জারুল আছে। দ্যাখ, হালকা সবুজ নতুন পাতা এসেছে। মনে হচ্ছে সবে যেন বসন্ত এল।
ভটকাই বলল, ও মা! কী সুন্দর লাল ফুল ফুটেছে ওই মস্ত গাছটাতে! ওটা কী গাছ ঋজুদা?
গতকাল সকালে দেখালাম না তোকে ইনফরমেশান সেন্টারে যাওয়ার পথে! পারুল রে!
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলে গেছিলাম।
এই গাছগুলো কী গাছ? প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড।
ড্রাইভারই বলে দিলেন ঋজুদা বলে দেবার আগেই, চাঁপ গাছ।
চাঁপা?
ঋজুদা বলল, চাঁপা না রে চাঁপ।
একী! কলকাতার মুসলমানী খাবার সাবির বা সিরাজের চাঁপ? মাটন বা চিকেন?
সেগুলো চাঁব। চাঁপ নয় রে দিগগজ। অনেক বাঙালিই অবশ্য বলেন চাঁপ।
তাই?
ভটকাই অবাক হল তার প্রিয় খাবারের নাম এতদিন ভুল জানত বলে।
ওগুলো কী ফুল বল তো? এই যে গাছগুলোতে, মানে, ঝড়ে পর্যন্ত হয়েছে?
ঋজুদা আমাদের জিজ্ঞেস করল।
খুব চেনা। চেনা লাগছে কিন্তু চিনতে পারছি না।
আমি বললাম।
ভটকাইও বলল, সত্যিই খুব চেনা চেনা।
জানে না বললে ও যে আমার চেয়ে কম জানে এই কথাই প্রমাণিত হয়ে যাবে এই জন্যেই চেনে যে না, তা কবুল করল না।
ঋজুদা বলল, ঘেঁটু ফুল। এটা তো আর বিহার ওড়িশা কি মধ্যপ্রদেশ নয় রে, এই যে আমাদের বঙ্গভূমি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতে পড়িসনি ঘেঁটু ফুলের কথা? নামটা আনরোম্যান্টিক হলে কী হয়, বিভূতিভূষণের কলম, বাংলাসাহিত্যে অমর করে দিয়ে গেছে এই সাধারণ গ্রাম্য ফুলকেই।
আমি চুপ করে রইলাম।
ভাবছিলাম, আমি এই অধম রুদ্র রায়ও যে ঋজু বোসকে বাংলাসাহিত্যে অমর করে দিয়ে গেলাম এটা যেন কোনও ঘটনাই নয়!
মুখে বললাম, ঋজুদা, গাছগুলো চিনিয়ে দাও না।
আরে আমিই কি সব চিনি? ড্রাইভার ভাইকে বল, এঁরা রোজ এই পথে দিন রাত যাতায়াত করছেন, এঁরাই ভাল জানবেন। আমরা তো শহরের মানুষ, উড়ে-আসা চিড়িয়া।
তোমার নাম কী ভাই?
অভয়।
তবে আর চিন্তা কী? কোনও ভয়ই নেই আমাদের।
ড্রাইভার ভাই বললেন, না ছার। আমি ঋজুদার সব বইই পড়ছি। আপনে কত বনে বনে ঘোরেন। আমরা আর কতটুকু জানি! আপনে তো সবই জানেন।
ঋজুদা হেসে বলল, ওই আশীর্বাদটা কোরো না ভাই। অমন অভিশপ্ত যেন আমাকে কোনওদিনও হতে না হয়। তুমিও কি চাও আমিও আরেকজন সর্বজ্ঞ হই, আমিময় মুকুজ্যের মতন? সর্বজ্ঞ হওয়ার শিক্ষা আমার সাধারণ বাবা আমাকে দেননি।
তিনি আবার কিনি? আমিময় মুকুজ্যে?
ভটকাই বলল।
আমি বললাম, আছেন, আছেন। তিনি এক চিজ! পরে তোকে বলব।
বাইসন! বাইসন!
বলে, চাপা গলাতে চেঁচিয়ে উঠলেন অভয়। চাপা গলাতেও যে চ্যাঁচানো যায়, সেই প্রথম জানলাম।
একটি দলে তারা পথ পেরোল ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। সঙ্গে একটি বাচ্চাও ছিল। সবসুন্ধু আটটি। একটি আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল শিং বাগিয়ে। যতক্ষণ না পুরো দলটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সকলকে নিরাপদে রাস্তা পার করিয়ে দিয়ে সকলের শেষে সেও গেল।
ওরা চলে গেলে, ভটকাই বলল, সাদা মোজা পরে রয়েছে যে হাঁটু অবধি!
হ্যাঁ। ভগবানই মোজা পরিয়ে পাঠিয়েছেন ওদের। দু পায়ে হাঁটু অবধি সাদা মোজা, কপালেও সাদা সিঁদুর লেপা। এও বিধাতারই কারসাজি।
ঋজুদা বলল।
এই মোষগুলো, এক একটা কত কেজি করে দুধ দেবে বলো তো ঋজুদা? উরিঃ ফাদার! মাদার ডেয়ারি’ এদের ধরে নিয়ে যায় না কেন?
ঋজুদা হেসে উঠল।
তারপর বলল, এরা বুনো মোষও নয়, বাইসনও নয়।
বাইসন নয়?
ড্রাইভার সাহেব একটু অবাক হয়ে বললেন।
নয়। বাইসন, উত্তর আমেরিকার প্রাণী। তারা অনেকেই ছোট হয় এদের চেয়ে। তাদের এমন সাদা পা এবং কপালও থাকে না। এদের দেখা, শুধুমাত্র ভারতেই মেলে। পুব ভারতের নানা জঙ্গলে, দক্ষিণ ভারতের নীলগিরিতে এদের দেখা যায়। মধ্যভারতে আছে। তবে কম। এদের নাম গাউর।
কী বানান?
Gaur। এরাই হাতি গণ্ডারের পরেই সবচেয়ে বড় ভারতীয় তৃণভোজী প্রাণী। শম্বর, বারাশিঙা ইত্যাদিও বড় হয় বটে কিন্তু গাউরদের ধারে কাছে আসে না। তবে বুনো মোষও বড় হয়।
টাঁড়বারো।
ভটকাই বলল।
সেটা কী জন্তু হল?
অভয় বললেন।
ভটকাই, ঋজুদা জবাব দেবার আগেই বলল, সেটা কোনও জন্তু নয়, বুনোমোষদের দেবতা। বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক উপন্যাসে আছে। আরণ্যক কি পড়েছেন?
না।
পড়বেন পড়বেন। আরণ্যকই পড়েননি আর আপনি অরণ্যচারী! এ কী প্যারাডক্স!
শুধু অরণ্যচারীই কেন? বাংলা যাঁরা পড়তে পারেন তেমন প্রত্যেক মানুষেরই ‘আরণ্যক পড়া উচিত। সে তো উপন্যাস নয়, বনবাণী।
তা ঠিক। আমি বললাম।
ওই দ্যাখ, চিক্রাসি, আর ওইদিকে ময়নার ভিড়।
ঋজুদা বলল।
ময়না? গাছের নাম? আমি তো জানতাম পাখিরই নাম।
হ্যাঁ রে।
ময়নাগুড়ি জায়গার নাম কি এই গাছেরই জন্যে?
তা জানি না। তবে নট আনলাইকলি। এই ময়না গাছগুলোও দ্যাখ, শিমুলেরই মতন দুদিকে সমান্তরালে শাখা ছড়ায়। কাণ্ডর মূলেও শিমুলেরই মতন ভাগ ভাগ থাকে। তবে ময়নার গায়ে কিন্তু শিমুলের মতন কাঁটা থাকে না। খুব বড় বড় হয় এ গাছগুলো। থোকা থোকা ফুল ফোটে হালকা বেগুনি রঙা, মার্চ-এপ্রিলে।
এটা কী গাছ?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ড্রাইভার ভাই বললেন, এটা লাটোর।
লাটোর?
হ্যাঁ। এর শক্ত কাঠ দিয়ে ভাল তক্তা হয়।
আরে! এটা কী গাছ? চেনা চেনা লাগছে অথচ…
আমি আবারও বললাম।
পাঁচটি করে পাতা এক একটি থোকাতে?
ভটকাই বিশদ করে বলল।
এটাই তো ছাতিম।
ও হ্যাঁ। শান্তিনিকেতনের পত্তন তো এই গাছের জন্যেই। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ গ্রীষ্মে পালকি করে যেতে যেতে বীরভূমের সেই বিশ্বটাঁড় জায়গাতে ছাতিম গাছের ছায়াতে বিশ্রাম করবার জন্যে যখন থামেন, তখনই তো…
ভটকাই-ই বলল।
আঃ! তুই বড্ড কথা বলিস ভটকাই। কত গাছ অজানা অচেনা চারদিকে, চিনে নে ভাল করে।
ঋজুদা বলল।
এখানে কিন্তু ছাতিম কয় না ছার। বন-বিভাগেও ছাতিম কয় না। এর নাম ছইতান বা ছাতিয়ান।
ঠিক ঠিক। গোয়ালপাড়ার ধুবড়ি শহরেও একটি পাড়া আছে। তার নামই ছাতিয়ানতলা, ইতু পিসি, রুবী কাকিমারা থাকেন।
ফুল ফোটে ছাতিয়ান গাছে?
আমি শুধোলাম।
হ্যাঁ। ফোটে বইকী! ছোট ছোট সাদা ফুল ফোটে, এপ্রিল-মে-তে।
হ্যাঁ। এপ্রিল-মেতেও একবার আসতে হবে গন্ধ বিধুর সমীরণের বাস পেতে।
আমি বললাম।
যা বলেছিস।
এটা কী গাছ ভাই?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
দেখলাম, ঋজুদার চোখ-মুখের ভাব অন্যরকম হয়ে গেছে। ঋজুদারও অচেনা এতরকম গাছ দেখে ঋজুদা অভিভূত, বিস্মিত। যে সব গাছ অচেনা, সেগুলির নাম জানবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
এটার নাম কাটুস।
কাটুস?
হ্যাঁ।
আবার ওই দেখেন ওই গাছটা, ওইটার নাম কাট্টুস।
কাট্টুস?
হ্যাঁ। বটানিকাল নাম Hystrix।
আর কাটুসের বটানিকাল নাম।
Castanopsis।
বাঃ। তুমি ভাই কতদূর পড়াশুনো করেছ? Botany নিয়ে পড়েছ না কি ভাই?
হাঃ। এতগুলান মানুষের সংসার চালাম কামনে হেই চিন্তাতেই সব চুল পাইক্কা গেল গিয়া। ক্লাস নাইনেই পড়াশুনার ইতি করছি। কুচবিহারে এক গাড়ির মেরামতির কারখানায় হেল্পার আছিলাম। তারপর হাতে-পায়ে ধইর্যা ড্রাইভারি শিখ্যা এই অবধি আসছি। তবে ইংরাজি বাংলা পড়তে তো পারিই। তাই সাহেবগো লগ্যে ঘুইরা ঘুইর্যা যেটুকু পারি শিইখ্যা লইছি। ডিগ্রির সঙ্গে শিক্ষার কী সম্পর্ক কয়েন ছার? আমি তো অশিক্ষিত ডেরাইভার।
বাঃ।
মুগ্ধ হয়ে বলল, ঋজুদা।
তারপর বলল, তোমার মতন অশিক্ষিত আমাদের দেশে আরও অনেক থাকলে দেশের উন্নতি হত। ডিগ্রির সঙ্গে শিক্ষার যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনওই সম্পর্ক নেই একথা আমিও বিশ্বাস করি।
আপনারাও য্যান কেমনধারা মানুষ।
অভয় বললেন।
কেন?
আমি বললাম।
কত সাহেব গো লইয়াই তো এইসব জঙ্গলে ডিউটি করি কিন্তু কই কারোরেই দেখি না ঘেঁটু ফুল বা ছাইতন বা কাটুস লইয়া এমন মাথা ঘামাইতে। আমাগো ফরেস্ট ডিপার্টের অনেক সাহেবদেরও দেখি না।
ভটকাই বলল, আমরা যে ভালমানুষ নই একেবারেই।
বলেই রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনীর গান গেয়ে দিল :
‘ভালো মানুষ নইরে মোরা ভালো মানুষ নই–
গুণের মধ্যে ওই আমাদের, গুণের মধ্যে ওই ॥
দেশে দেশে নিন্দে রটে, পদে পদে বিপদ ঘটে–
পুঁথির কথা কই নে মোরা, উলটো কথা কই ॥
গুণের মধ্যে ওই।
ভালো মানুষ নই রে মোরা ভালো মানুষ নই।
গান শেষ করেই ভটকাই চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়ান! দাঁড়ান অভয়দা। কাঁটাল গাছ। একটা গাছ-পাঁঠা পেড়ে নিয়ে যাই। জয়ন্তীতে যদি পাওয়া না যায়?
অভয় হেসে উঠে বললেন, ওগুলো বন কাঁটালের গাছ। এঁচড় বা কাঁটাল কিছুই ফলে না ওই সব গাছে। ও গাছের কাঠ দিয়ে ভাল আসবাব হয়, মানে ফার্নিচার।
তাই?
ভটকাই বলল।
ওগুলো কী লতা ঋজুদা?
ও। ওগুলো তো আসামী লতা। সংকোশ নদীর পাশের যমদুয়ারেও অনেক আছে। আর ওই দ্যাখ, ওই লতাটার নাম আরারিকাটা। এদের আবার তিনরকম আছে। Mimosa Himalayana…
ড্রাইভার সাহেব বললেন, তাদের নাম, আকাসিয়া পেনাল্টা আর আকাসিয়া এসেসিয়া-জংলি। বটানিকাল নাম।
বাঃ।
উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল ঋজুদা।
তারপর বলল, তুমিই আমাদের সব জায়গাতে এবার থেকে নিয়ে যাবে অভয়। তোমার রেঞ্জার সাহেবের নাম যেন কী বললে?
বিমান বিশ্বাস।
হুঁ, তাকে বলব।
এই দ্যাখ রুদ্র, আবার শিরিষ। আসলে শিরিষের পাঁচরকম আছে।
কী কী?
টাটা, হররা, সেতো, কারকুর, কালো।
শিরিষের বটানিকাল নাম কী ঋজুদা?
পাঁচ ভ্যারাইটির পাঁচ নাম।
ALBIZZIA LUCIDA, ALBIZZIA IIAMGLEI, PROCERA, PDORATISSIMA, ONS NARCINATA– পঞ্চকন্যার পাঁচ নামl
কী সব হিজবিজবিজ নামরে বাবা!
ভটকাই বলল।
আমরা কতরকম আকাসিয়া, আলবিজিয়া সব দেখেছিলাম আফ্রিকাতে, না ঋজুদা? জলের পাশে পাশে, ইয়ালো-ফিভার আকাসিয়া! মনে আছে? ন্যাবা-ধরা হলুদ।
আমি বললাম।
হ্যাঁ। ঋজুদা বলল।
ও সব তো আছে ঋজুদা সমগ্রর প্রথম খণ্ডে নয় দ্বিতীয় খণ্ডে। পড়েছি আমি। তাছাড়া পড়েছি পঞ্চম প্রবাস এবং গুগুনোম্বারের দেশেও।
আমিও পড়েছি আফ্রিকার ‘পঞ্চম প্রবাস’ আর ‘ইলমোরানদের দেশে’।
অভয় বললেন।
আমি বললাম, শেষ দুটো বইতে ঋজুদার কাহিনী তো নয়। আমার লেখাও নয়। অন্যের লেখা।
যাই বলো ঋজুদা, আমার বন্ধু রুদ্র কিন্তু তোমার কীর্তি কুকীর্তি সব লিখে তোমাকে বিখ্যাত করে দিয়েছে।
ভটকাই আমার সঙ্গে শান্তিস্থাপনের জন্যে বলল।
ঋজুদা চাপা হাসি হেসে বলল, রুদ্র তোর বন্ধু বুঝি? জানতাম না তো! বিখ্যাত কি কুখ্যাত তোরা জানিস। তবে রুদ্রর লেখার হাত যে ভাল সে কথা সকলেই বলে।
আমি দু হাতে শার্টের কলারটা তুলে দিয়ে বললাম, হুঁ হুঁ।
এ যাত্রায় আমাদের সকলেরই হাত তো খালি। বন্দুক রাইফেল পিস্তল কিছুই তো সঙ্গে আনিনি! এই বক্সা বাঘ-প্রকল্পের সীমানার মধ্যে সেসব আনাও তো বে-আইনি। জেলে যেতে হবে। কিন্তু দুটি হাতই মুক্ত বলেই নতুন অভিনেতাদের মতন দুটি হাত কোথায় রাখি, তাদের নিয়ে কী করি, এই এক সমস্যা হয়েছে।
এই দ্যাখ রে আবার লালি। এইটা দুধে লালি আর ওইটা এমনি লালি। দ্যাখ দ্যাখ, কেমন মিনিয়েচার মাকাল ফলের মতন লাল লাল গোল গোল ফুল ধরেছে লালি গাছে। দারুণ সুইট।
ভটকাই বলল।
অভয় বললেন, ওই ফলগুলো বছরের এই সময়েই পাড়া হয়। পেড়ে রেখে দেওয়া হয় বীজের জন্যে। বনের যেসব অঞ্চলে এই লালি লাগানো দরকার সেই সব অঞ্চলে এই বীজ থেকে গাছ করবেন বন-বিভাগ পরে।
ঋজুদা, এই যে, আবারও পেয়েছি।
ভটকাই চেঁচিয়ে উঠল।
কী?
আকাতরু?
জামগাছের মতন মস্ত গাছ কিন্তু পাতাগুলো পাকুড় গাছের মতন। ঋজুদা বলল। সাদা রঙা আমের বোলের মতন ফুল ফোটে মার্চ-এপ্রিল মাসে। এই গাছেদের বটানিকাল নাম হেইনি ট্রিজুগা (Heynce Trijuga), রক্স-সাহেবের দেওয়া নাম, B. Rox।
লালি গাছের ফল তো দেখলাম। ফুল কখন হয়?
ভটকাই বলল।
ফুল তো ফলের আগেই হয়। তাও কি জানো না বৎস?
আমি বললাম।
লালি গাছে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর অবধি লাল লাল ফুল ফোটে।
ফুলগুলো সুপুরির খোলার মতন খোলা দিয়ে ঢাকা থাকে।
ড্রাইভার অভয় বললেন।
তাই? একবার আসতে হবে তো সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে লালির ফুল দেখতে।
আরে! সামনে পথের মধ্যে ওটা কী?
ওটাই তো ওয়াচটাওয়ার।
ড্রাইভার অভয় বললেন।
আমরা কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ওয়াচটাওয়ারে। কংক্রিটের তৈরি গোলাকৃতি, চার-মানুষ সমান উঁচু টাওয়ার। বনের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্যে সবজে-হলদে রং করা। ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। ছোট্ট বারান্দা আছে, চেয়ার পেতে বসে বনের প্রাণী দেখবার। টাওয়ারের জনা চারেক নেপালি ফরেস্ট গার্ডও দেখলাম। তাঁরা নাকি দিনে এবং রাতেও থাকেন। সেখানেই রান্নাবান্না করে খান। একজন সাইকেল নিয়ে রাজাভাতখাওয়া গেছেন রসদ আনতে। সামনেই একটি নুনী’ বানানো হয়েছে জঙ্গল সাফ করে এবং বস্তা বস্তা নুন ফেলে। নানা তৃণভোজী জানোয়ার আসে সেই নুন চাটতে। হাতিও আসে প্রায়ই। গার্ডরাই বলল। তৃণভোজীদের পেছনে পেছনে আসে মাংসভোজীরা। কখনও-সখনও।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। দেখলাম, চারদিক থেকে চারটে কাঁচাপথ এসে যে চৌমাথাতে মিশেছে, সেখানেই এই টাওয়ার। জঙ্গলে ওয়্যারলেস ফোন আসার আগে এই টাওয়ারই হয়তো তোক মারফৎ চারদিকে খবর লেনদেন-এর ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিত। কে জানে!
টাওয়ার থেকে নেমে, সেই মোড় থেকে আমরা বাঁ দিকে ঘুরে চললাম জয়ন্তীর পথে।
ড্রাইভার ভাই বললেন, আপনারা রেঞ্জার সাহেবরে কইবেন, আপনাগো সংহাই রোডে লইয়া যাইবেন উনি।
সেটা কী ব্যাপার?
সি এক সাংঘাতিক পথ। ঘনঘোর জঙ্গলের মধ্য দিয়া যাইতে হইব। দেখনোর মতন জঙ্গল। দিনমানেও গা ছমছম করবঅনে। আর যখন জয়ন্তী থিক্যা ভুটান ঘাটে যাইবেন তখন যাইবেন পীপিং-এও। ভুটান ঘাট থিক্যা।
পীপিং মানে? বেজিং-এ?
ভটকাই অবিশ্বাসের গলাতে বলল।
না, না। পীপিং হইতাছে ভুটান আর ভারতের বর্ডার। সেইখানেই তো রাইডাক নদী পাহাড় থিক্যা সমতলে নামছে। আহা! কী ছিন-ছিনারি কী কম ছার আপনাগো! অবশ্যই যাইবেন। আপনে তো পিরথিবী ঘুইরাই আইছেন। আমাগো বক্সার জঙ্গলেও ভাল কইরা ঘুইরা যান। বক্সাও ফ্যালনা নয় আমাগো।
তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, রুদ্রবাবু যদি কলকাতা ফিরা আমাগো লইয়া কিছু ল্যাখেন তাইলে তো বইতা যা গিয়া।
লিখবেন। লিখবেন। অবশ্যই লিখবেন।
ভটকাই আমার লোকাল গার্জেনের মতন বলল, অভয় ভাইকে আশ্বস্ত করে।
.
০৭.
জয়ন্তীতে যখন আমরা গিয়ে পৌঁছলাম তখন আকাশে ঘন কালো মেঘ।
বন-বিভাগের কর্মীদের কোয়ার্টার-টোয়াটার পেরিয়ে গিয়ে যেন পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তেই গিয়ে পৌঁছলাম বলে মনে হল। ছেলেবেলাতে ডুয়ার্সের সরস্বতীপুর বাগান থেকে ভরা বর্ষায় এক গোধূলিবেলায় প্রলয়ঙ্করী তিস্তার পারে দাঁড়িয়ে আপালচাঁদ-এর জঙ্গল আর কাঠামবাড়ির রূপ, বিধুর কমলা আলোয় দেখেছিলাম। সেই ছবিটি ফিরে এল মনে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সরস্বতীপুর চা বাগান তিস্তার যে পাড়ে, সেদিকটা অবশ্য খুবই উঁচু। উল্টোদিকে নদী পাড় ভাঙছিল। ঢেউ-এর কী শব্দ আর মাটি ধ্বসার! বড় বড় মহীরুহকে তিস্তা দেশলাই-এর কাঠির মতন ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল।
জয়ন্তী বাংলোটিও উঁচু পাড়ে। নদীর খাত বেশ নীচে, তবে তিস্তার সঙ্গে আদৌ তুলনীয় নয়। তা ছাড়া, নদী এখন শুকনো। শুধু উল্টোদিকের পাড় ঘেঁষে দুটি শীর্ণ জলের ধারা বইছে। বাংলোর ঠিক বিপরীতেই উঁচু পাহাড় একটা। আকাশ ঢেকে আছে। বাংলোর পাশে নদীর উপরে বসার জায়গা আছে একটি। প্রলয়ঙ্করী বন্যাতে পি. ডাব্লু. ডি.র বাংলোটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে নদী, নিশ্চিহ্ন করে। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মস্ত শক্ত-পোক্ত লোহার ব্রিজও। যে ব্রিজ পেরিয়ে পাহাড়-জঙ্গল এবং চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে গেছিল পথ।
জয়ন্তী বাংলোর কাছাকাছি প্রায় সবই শালের গাছ। দুটি কাঠগোলাপের গাছ আছে। হাতার বাইরের পাশাপাশি ময়না গাছে র্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গোদের বাসা আছে কয়েকটি। তারা ফুরুৎ ফুরুৎ করে ওড়াউড়ি করছে। এই র্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গোরা ভীষণ ঝগড়াটে আর মারকুট্টে পাখি। এদের চেয়ে আকারে অনেক বড় পাখিও, যেমন দাঁড়কাক, ওদের ভয় পায়।
একটু পরে জয়ন্তীর রেঞ্জার বিমান বিশ্বাস দেখা করতে এলেন। বললেন, আজকের দিনটা জয়ন্তী নদীর শোভা দেখুন। কালকে আপনাদের বক্সাদুয়ারে নিয়ে যাব। সাম্রাবাড়ি হয়ে। সাম্রাবাড়িতে রেঞ্জ অফিস আছে। সেখানের রেঞ্জার গোপাল চক্রবর্তী মশাইও এসে যাবেন সকালে। আর রাতে আপনাদের সাংহাই রোডেও নিয়ে যাব। বক্সা টাইগার প্রোজেক্টের কোর এরিয়ার মধ্যে দিয়ে। চেকো হয়ে ওই পথ গিয়ে একত্রিশ নং জাতীয় সড়কে মিশেছে। রাত আটটাতে আসব। সঙ্গে গার্ড এবং আর্মসও নিয়ে আসব।
আর্মস কী হবে?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
এখানে বড় বড় বাইসন আছে। এক ঢুঁ মারলে কোথায় চলে যাবে জিপ। হাতিও আছে। তবে হাতি বা বাইসন কিছুই তো মারা যাবে না। ভয় দেখাবার জন্যে আর কী!
আর বাঘ? টাইগার প্রোজেক্টে বাঘের কথাই কেউ বলছে না। কী ব্যাপার?
এখানের বাঘেরা অসূর্যম্পশ্যা।
কারোকে দেখেও না, দেখা দেয় না। বাঘ তো ময়ূর নয় যে পেখম মেলে ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে।
ভটকাই দমে গেল। এমন জবাব পাবে আশা করেনি।
ঋজুদা বলল, কী আর্মস আনবেন?
টুয়েলভ-বোর ডাবল ব্যারেল শটগান এবং পয়েন্ট টু টু রাইফেল।
পয়েন্ট টু টু রাইফেল দিয়ে তো শুধু খরগোশ, ছোট হরিণ আর মানুষই মারা যাবে। ওসব দিয়ে হাতি আর গাউরকে কি ভয় দেখানো যাবে আদৌ?
বিশ্বাস সাহেব বললেন, গভর্নমেন্ট থেকে যা দেয়। এ তো আর আমাদের পার্সোনাল সম্পত্তি নয়।
ওঁরা চলে গেলে ঋজুদা বলল, পাকামি করবি না ভটকাই। আমরা ওঁদের অতিথি। আর গভর্নমেন্ট থেকে কেনে বলেই দিশি বন্দুক রাইফেল কেনে। বিদেশি আর্মস আনতে গেলে আলাদা ইমপোর্ট লাইসেন্স লাগবে। তা ছাড়া কত দাম?
আমরা বিদেশি কিনতেই বা যাব কেন? ইন্ডিয়ান অর্ডনান্স কোম্পানির দোনলা, পয়েন্ট বারো বোরের বন্দুক খারাপই বা কী?
আমি বললাম।
কিন্তু ইন্ডিয়ান অর্ডনান্স কোম্পানি তো পয়েন্ট থ্রি ওয়ান ফাইভ রাইফেলও বানান। তাও তো কেনা যায়। পয়েন্ট টু টু দিয়ে কি ঘণ্টা হবে?
আনডন্টেড ভটকাই বলল।
থাক সে কথা। আমরা তো শিকার করতে বা চোরা শিকারিদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে আসিনি। জাস্ট বেড়াতেই এসেছি। বন্দুক রাইফেল নিয়ে, আলোচনার এখন দরকারই বা কী?
জয়ন্তী বনবাংলোতেও বিজলী আলো আছে। তবে আমরা যখন বাংলোতে ঢুকলাম তখন লোডশেডিং ছিল। জেনারেটর চালিয়ে চৌকিদার অজয় ছেত্রী জল তুলছিল তখন। অজয়ও নেপালি। এবং অত্যন্ত পলিশড। চমৎকার বাংলা বলে। ব্যবহারও খুব ভাল। পরে জেনেছিলাম যে, বাবুর্চিও সে অত্যন্তই ভাল এবং টেবল-এ কী করে খাবার-দাবার সাজিয়ে-গুছিয়ে দিতে হয় তাও জানে।
বিকেলে যে চা খেলাম তা চমৎকার। রাজাভাতখাওয়াতেও ভাল চা খেয়েছিলাম। ভটকাইটার গরম জল পেলেই চা খাওয়া হয়। এ ব্যাপারে আমার তো বটেই, ঋজুদারও একটু খুঁতখুঁতানি আছে। চা-টা ভাল না হলে মন খারাপ হয়ে যায়।
চা খাওয়ার পরে আমরা নদীর উপরে যে বসবার জায়গাটা আছে, কাঠগোলাপ গাছ দুটোর নীচে, সেখানে গিয়ে বসলাম। ধু ধু করছে নদীর সাদা খাত। বাঁ দিকে গিয়ে একটি ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে। তারপর মূল স্রোতের খাত ডান দিকে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে গভীর বনের মধ্যে।
অন্ধকার হয়ে এল। নানা পাখি ডাকতে লাগল। আর ডাকতে লাগল গ্রেকো। মানে, তক্ষক। ট্রাক-টু-উ-উ! ট্রাক-টু-উ-উ! করে বাংলোর ফলস-সীলিংএর নীচেও আছে ওরা। নদীর ওপার থেকে একটা ডাকছে। এপারে তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট নিস্তব্ধ প্রকৃতির মধ্যে। ওরা ডাকবার আগে যেন গলা খাঁকারি দিয়ে নেয় একবার। ট্রাকটু-উ শব্দ করে ডাকে বলেই ওদের আরেক নাম টাকটু।
এত বড় তক্ষক এর আগে আর দেখিনি।
আমি বললাম।
আমিও নয়।
ঋজুদা বলল।
তারপর বলল, ইন্দোনেশিয়া আর ক্রাকাটাও দ্বীপে দেখেছিলাম অবশ্য। তবে আমাদের দেশে দেখিনি। আছে হয়তো। আমি কি আর সর্বজ্ঞ, আমিময় মুকুজ্যের মতন?
ভটকাই উত্তেজিত হয়ে বলল, দ্যাখ দ্যাখ। দাবানল।
তাই তো!
তাকিয়ে দেখলাম, বাংলোর ঠিক সামনে নদীপারে যে উঁচু পাহাড়টি উঠে গেছে তার মাথার কাছে আগুনটা লেগেছে। মালার মতন জ্বলছে সোনারঙা আগুন।
দাবানল-এর পক্ষে টু আর্লি, নয় কি?
ঋজুদা বলল।
হুঁ।
চারদিক থেকে নানারকম পাখি ডাকছিল। এখুনি রাত নেমে আসবে। সেই সব পাখির মধ্যে কিছু চেনা, কিছু অচেনা। র্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গোরা ভোর রাত থেকে ডাকাডাকি শুরু করে। সন্ধেবেলাতে তারা অত সোচ্চার নয়। চেনাদের মধ্যে বুলবুল, মিনিভেট (এখানে নাকি অ্যাশি মিনিভেটও আছে), ব্যাবলার ইত্যাদি ডাকছিল। এবং ওপার থেকে ওয়াটেলড ল্যাপউইং চমকে চমকে ডাকছিল বুকে চমক তুলে। তাদের দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই বলতে পারব না, লাল না হলুদ।
শীতকালে ভুটানঘাটের দিকে কালো গলার সারসও নামে। শীতকালে অন্য অনেক পরিযায়ী পাখিই আসে এদিকের জঙ্গল আর নদীতে।
ঋজুদা বলল।
ভটকাই যথারীতি উধাও হয়ে গেছিল রান্নাঘরের দিকে। ফিরে এসে, যেন খাদ্যদ্রব্যের প্রতি ওর কোনও ইন্টারেস্টই নেই, এমনভাবে বলল, এই নদীটি কোথা থেকে এসেছে ঋজুদা? এই জয়ন্তী নদী?
ভুটানের সীমান্তের জয়ন্তী হিলস থেকে বেরিয়ে ভারতে ঢুকেছে জয়ন্তী। তারপর এই জয়ন্তী রেঞ্জ-এরই ফাসখাওয়া আর হাতিপোতা ব্লকের সীমানা চিহ্নিত করে বয়ে গেছে হাতিপোতার হরজাই Unclassed বনের মধ্যে দিয়ে আর কার্তিকার সংরক্ষিত বনের মধ্যে দিয়ে।
কার্তিকা জায়গাটা কোথায়?
আমি বললাম।
কার্তিকা, নর্থ রায়ডাক রেঞ্জের একটি বীট।
ঋজুদা বলল।
এই বীট, রেঞ্জ এই সব কী? ফরেস্ট গার্ড? বন-বিভাগের এই সব গোলমেলে ব্যাপার-স্যাপার বোঝা দায়!
ভটকাই বলল।
কোনও গোলমাল নেই। বুঝিয়ে দেব তোকে একসময়ে। এখন বল, এখুনি যেদিক থেকে এলি সেদিকের খবরাখবর কী?
ভটকাই ধরা পড়ে গিয়ে হাসবার চেষ্টার মতন একটা ভঙ্গি করে বলল, মন্দ নয়। আমাদের জন্যে আলিপুরদুয়ার থেকে বাসে পাঁউরুটি এসেছে। মুসুরির ডালের সুপ, স্যালাড, চিকেন রোস্ট, টোস্ট, কড়কড়ে করে, আর ক্যারামেল কাস্টার্ড পুডিং। নট ব্যাড। কী বলো? এমন জঙ্গল-নদীর মধ্যে?
ব্যাড কী রে! অভাবনীয় বল! তবে আমার মন আবারও বলছে যে, বন-বিভাগ আর আমাকে এখানে আসতে বলবেন না। তোর জন্যেই পেটুক বলে আমার বদনাম হয়ে গেল!
ছাড়ো তো! পেটে খেলে পিঠে সয়! হলে হবে।
আমি চুপ করে নদীর দিকে চেয়ে ছিলাম। এখন রাত নেমে এসেছে। চাঁদও উঠেছে। ধবধবে দেখাচ্ছে মস্ত চওড়া জয়ন্তী নদীর দুধ-সাদা বালিময় বুক, দাবানলের মালা বুকে করে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পাহাড়শ্রেণীর পটভূমিতে সত্যিই দারুণ দেখাচ্ছে সেই দৃশ্য। একটু আগেই বাথরুমে চান করবার সময়ে আলো নিভিয়ে সব জানালা খুলে দিয়েছিলাম। কী অপূর্ব যে লাগছিল তা কী বলব! মনে হচ্ছিল, যেন নদীর মধ্যেই চান করছি। সামনে নদী, ডাইনে নদী। গ্রেকো ডাকছে থেকে থেকে ট্রাক-টু-উ ট্রাক-টু-উ আর মাঝে মাঝে ওয়াটেলড ল্যাপডইগ-এর ডিউ-উ-ডু-ইট। ডিউ-ঊ্য ডু-ইট ডাক যেন সেই পাহাড়-নদীর নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর, রহস্যময় করে তুলছে।
জয়ন্তী বাংলোর কাছে নদীর দিকে কোনও ঘরবাড়ি নেই তাই সেখানে নির্জনতাকে মনে হয় অসীম। শোওয়ার ঘর থেকেও দেখলাম, বিছানাতে শুয়েও মনে হয় যেন নদীতেই শুয়ে আছি। এরকম আশ্চর্য সৌন্দর্য অন্য কোনও বাংলোরই নেই। নদী এখন জানালার একেবারে পাশে চলে এসেছে, অবশ্য প্রলয়ংকরী বন্যারই জন্যে। যেন টাইগার প্রোজেক্টের ফিল্ড ডিরেক্টর এস. এস. বিস্ত সাহেবের নির্দেশেই জয়ন্তী নদী বাংলোটির পায়ে চুমু খেয়ে তাকে অক্ষত রেখে চলে গেছে গাছ পাথর মাটি এবং পি. ডব্লু. ডি.র বাংলোটিকে ভাসিয়ে নিয়ে।
একটি জিপের শব্দ শোনা গেল। জিপটা এসে ঢুকল বাংলোতেই। কল্যাণ দাস, অ্যাডিশনাল ডি. এফ. ও. এলেন আলিপুরদুয়ার থেকে ঋজুদার তত্ত্বতালাস করতে। কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে কি না তা দেখতে।
ঋজুদা বলল, একটু বেশিই আদর-যত্ন হচ্ছে। অস্বস্তিতে আছি।
দাস সাহেব নানারকম গল্প করলেন চা খেতে খেতে। চোরা কাঠ ও বন্যপ্রাণী শিকারিদের নানা ক্রিয়াকলাপ। মাঝে ডাকাতরা একটি ব্যাঙ্ক লুঠ করে এই বক্সার জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল। তাদের সঙ্গে মোকাবিলার রোমহর্ষক কাহিনী, এইসব।
দাস সাহেব উঠলেন ঘণ্টাখানেক পর। ফিরে যাবেন জঙ্গলে জঙ্গলে পুরো পথ। রাতেই পৌঁছবেন আলিপুরদুয়ারে।
ভটকাই বলল, দারুণ। না? দেখিস! আমি কমপিটিটিভ পরীক্ষাতে বসব, গ্র্যাজুয়েশনটা করেই। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসে ঢুকব। তখন দেখবি, আমার ডাঁট।
ঋজুদা বলল, এখনই তোর ডাঁট কম কী? আমরা সকলেই তো তটস্থ। এবারে চল, খাওয়া-দাওয়া করে আবার ওখানে এসে বসি রাত বারোটা অবধি। কালই তো চলে যাব ভুটানঘাটে।
সাংহাই রোডে যাবে না?
ফেরার সময়ে হবে’খন। এই নিস্তব্ধতা, এই নদীর রাতের বেলার সৌন্দর্যে মন ভরে নে। সবসময়ে দৌড়াদৌড়ি করতে নেই। শান্ত হলে তবেই না মনের মধ্যে শান্তি নামে।
ভটকাই গেয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের গান, গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে আর কোলাহল নাই।
নর্থ ভুটানঘাট-এর রেঞ্জার সুবীর বিশ্বাস সাহেব নিতে আসবেন আমাদের, ওঁর জিপ নিয়ে। কাল ব্রেকফাস্টের পরে।
ঋজুদা বলল, ভটকাই-এর গানের পরে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে।
বাঃ বেশ চলেছে কিন্তু। আমরা যেন রিলে রেস-এর রুমাল। এর হাত থেকে ও নিয়ে নিচ্ছে আমাদের। আর নিয়েই দৌড়।
ভটকাই বলল।
বললাম, বাবাঃ। কী উপমা!
.
০৮.
পরদিন লেট-ব্রেকফাস্টের পরেই রওয়ানা হওয়া হল। প্রায় দশটা নাগাদ। ব্রিজ তত বন্যায় ভেঙেই গেছে। আবার কবে নতুন করে সে ব্রিজ বানানো হবে, তা ঈশ্বর আর পি. ডব্লু. ডি.র ঈশ্বরের মতন ইঞ্জিনিয়ার এবং ঠিকাদারদেরই দয়া।
আমরা নদীর বুকে নেমে গেলাম জিপ নিয়ে, তারপর পথ কোনটা আর বিপথ কোনটা তা বোঝার কোনও উপায়ই রইল না।
জয়ন্তী নদীর শুকনো বালিময় বুকের মধ্যে মধ্যে অনেকখানি কোনাকুনি গিয়ে তারপর নদী পেরুনো হল। কিন্তু নদী কি একটা? কিছুদূর যাবার পরেই ফাসখাওয়া নদী পেরিয়ে, চুনিয়াঝোড়া নদী পেরিয়ে তুরতুরি চা বাগানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে ময়নাবাড়ি বীট অফিসে পৌঁছলাম মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে। ময়নাবাড়ি, নর্থ রায়ডাক রেঞ্জের একটি বীট। বীট অফিসার অভিজ্ঞ সুভাষচন্দ্র রায় জঙ্গলের পোকা। ময়মনসিংহ জেলাতে বাড়ি। আমাদের চা খাওয়ালেন। ভটকাই, ওরই মধ্যে আড়ালে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঋজুদার জন্যে শুঁটকি মাছের বন্দোবস্ত ফিট করে এল! এই নইলে, ঋজুদা ওকে তালেবর বলে!
সুভাষবাবু বললেন, আমার ফ্যামিলি এখানে থাকে না। তবে, শুঁটকির বন্দোবস্ত একটা হবে।
বীট অফিসের পাশেই একটি ছোট ডোবা মতন ছিল। তার পাড়ে পাড়ে রাশ রাশ টাটকা সবুজ কলমি শাক ফুটেছিল। ডোবাতে হাঁস চড়ছিল, সাদা আর বাদামিতে মেশা। স্বগতোক্তি করতে করতে। আমার ইচ্ছে হল একমুঠো শাক তুলে নিয়ে যাই। ভুটানঘাটের বাংলোতে পৌঁছে গরম ভাত দিয়ে খাওয়া যাবে। মেঘলা আকাশের নীচে সজনে গাছের ফিনফিনে পাতারা তিরতির করে কাঁপছিল। কোথায় যেন কে মুসুরির ডালে কালোজিরে শুকনো লংকা ফোড়ন দিল। গন্ধে ভরে গেল প্রলম্বিত সকাল। নীল আকাশ, চারধারে জঙ্গল, সহজ মন্থর জীবনযাত্রা। তাড়া নেই, টেনশান নেই, হাঁসের প্যাঁকপ্যাকানি, মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। দূরে মেঘ করে আসছে। মনে হয়, বৃষ্টি হবে। ভারী ভাল লাগছিল।
ওইখানেই খবর পাওয়া গেল যে দার্জিলিং থেকে কনসার্ভেটর, হিলস, এস, এস. বিস্ত সাহেব একটু আগেই বীট অফিস পেরিয়ে ভুটানঘাটের বাংলোর দিকে চলে গেছেন ঋজুদার সঙ্গে আলাপিত হতে। তারপর লাঞ্চ খেয়ে আবার ফিরে যাবেন দার্জিলিং। চিঠি এবং ফোনেই কথাবার্তা হয়েছে দুজনের এ যাবৎ, চাক্ষুষ দেখাসাক্ষাৎ হয়নি।
দেখেছ কাণ্ডটা!
ঋজুদা বলল।
তারপরই বলল, হাউ নাইস অফ হিম।
ময়নাগুড়ি বীট অফিস থেকে বাঁয়ে ঘুরেই আমরা দুদিকে গভীর জঙ্গলের মধ্যে পাউডারের মতন ধূলি-ধূসরিত পথে এগিয়ে চললাম।
জয়ন্তী থেকে রওয়ানা হবার সময় থেকে যখন এক ঘণ্টা দশ মিনিট মতন হয়েছে ঘড়িতে, তখন পথের ডান দিকে একটি দোতলা বাংলোর হাতার মধ্যে রেঞ্জার সুবীর বিশ্বাসের জিপটি ঢুকে পড়ল। দেখলাম, একটি লাল বাতি লাগানো সাদা অ্যামবাসাডর দাঁড়িয়ে আছে।
বিস্ত সাহেব ছিপছিপে, ফর্সা, ছোট্ট-খাট্ট মানুষটি। কিন্তু একজোড়া জবরদস্ত পাকানো গোঁফ আছে। ভারী অমায়িক মানুষ।
ঋজুদা আর উনি দোতলার বারান্দাতে বসে নানা বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন আর আমি আর ভটকাই ঘুরে ঘুরে বাংলো এবং বাংলোর আশপাশ দেখতে লাগলাম রেঞ্জার সুবীর বিশ্বাসের সঙ্গে। বাংলোর হাতাতে শিশু ও আম গাছ আছে দেখলাম। একটি বেঁটে-মোটা জারুল গাছ। এমন জারুল সচরাচর দেখা যায় না। জারুলেরা সচরাচর ছিপছিপে ও লম্বা হয়। তাই হঠাৎ একে দেখলে জারুল বলে চেনাই যায় না। একটি শিশু গাছের গায়ে অর্কিড হয়েছে। যে-গাছটা আমরা চিনতাম না, তা চেনালেন বীট অফিসার সুভাষবাবু। জানি না, ঋজুদারও চেনা আছে কিনা। গাছটার নাম উদাল বা ওদাল। বাংলোর পাশ দিয়ে রায়ডাক নদীর দিকে যাবার যে রাস্তাটি আছে। তারই বাঁ পাশে আছে গাছটি। সেদিকে পাম্প হাউসও আছে। সেই উদাল বা ওদাল গাছে এখন লাল লাল ফল এসেছে। ফুল ফোটে নাকি হলুদ ও বেগুনি রঙা, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। এই গাছের বটানিকাল নাম হল Streculia Villosa। বললেন, সুভাষবাবু। দেশলাই কাঠি হয় এই কাঠ থেকে। নরম কাঠ। ছাল থেকে ফাইবার বা তন্তুও হয়। আঠাও হয়। তবে তেমন সুবিধের নয়।
তারপর সুভাষবাবু বললেন, খয়ের গাছ দেখেছেন কখনও?
ভটকাইকেই কেন জিজ্ঞেস করলেন, কে জানে! ওর চেহারাটা আমার চেয়ে ভারিকি আর হাবভাব জ্যাঠার মতন বলেই বোধহয়।
ভটকাই বলল, না। লজ্জার মাথা খেয়ে।
আমার সামনে মিথ্যেটা বলে কী করে?
আমি বললাম, কেন? নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গিয়ে সেই গড়-এর নীচে তো খয়েরের জঙ্গলও ছিল রে। তুই একটা কানা।
ভটকাই, ফর আ চেঞ্জ, নিরুত্তর রইল।
খয়ের কী করে বানায়?
আমাকে ইগনোর করে ভটকাই প্রশ্ন করল।
বলব এখন পরে আপনাদের।
সুভাষবাবু বললেন।
আমি বললাম, আমি জানি।
ভটকাইয়ের জন্যে আমার লজ্জা করছিল। ঋজু বোসের ইজ্জত ঢিলে করে দিল একেবারে তার এই নতুন চেলা। ওকে বললাম, কোয়েলের কাছে বলে একটা উপন্যাস আছে, পালামৌর পটভূমিতে লেখা। পড়ে নিস। তাতে কী করে খয়ের বানানো হয় তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
ভটকাই সুভাষবাবুকে জিজ্ঞেস করল, বাবুর্চিকাম-চৌকিদারের নামটা কী?
মনবাহাদুর।
কেন?
না। একটু আলাপ করে আসি।
বুদ্ধিমান সুভাষবাবু ভটকাই-এর মুখ দেখেই যা বোঝার বুঝেছিলেন। বললেন, এই জঙ্গলে তো কিছুই পাওয়ার জো নেই। তবু আপনাদের জন্যে মুরগি আর কাতল মাছ জোগাড় করেছি। মাছ আনাতে হয়েছে সেই আলিপুরদুয়ার থেকে।
তেকাটা আর বরোলি মাছ বুঝি এ অঞ্চলে পাওয়া যায় না?
ভটকাই জিজ্ঞেস করল।
ওইসব মাছ বেশি পাওয়া যায় ডিমা, নোনাই, কালচিনি ইত্যাদিতে। জয়ন্তী বা রায়ডাকে হয়তো পাওয়া যায় কিন্তু ধরে কে এই জঙ্গলে! বাঘ যতি সাপ গাউরে ভরা যে ভীষণ জঙ্গল! থাকেই বা ক’জন মানুষ! সাপ্তাহিক হাটে মোরগা-আণ্ডা, পাঁঠা-শুয়োর ওঠে, ওই দিয়েই মুখ বদলানো আর কী!
এই সব অঞ্চলে মানুষ থাকে না?
থাকে বই কী! মাঝে মাঝে বস্তি আছে। চা বাগানে তো মেলাই মানুষ।
তারা কি সাঁওতাল?
না, সাঁওতাল নয়। এদিকের চা বাগানের কর্মীদের মধ্যে বেশিই মোদেশিয়া। তাদের ভাষার নাম সাদরী। টোটোরাও আছে। টোটোপাড়া বলে একটা বস্তিই আছে। রায়মাটাং-এর দিকে। রাভারাও আছে। মেচ আছে। এখানে বলে মেচিয়া। তবে কম। গারোরাও আছে।
সুবীরবাবু বললেন, আপনারা বুঝি Anthropology-তে ইন্টারেস্টেড?
ভটকাই Anthropology শব্দটার মানে না বুঝে apologetically বলল, শুনেছিলাম হাতিদের একটা রোগ হয়, তার নাম Anthrax।
ভটকাই-এর নির্বুদ্ধিতায়, লজ্জায় মাথা কাটা গেল আমার।
নাঃ। ঠিক করলাম ঋজুদাকে বলতেই হবে যে, ওকে নিয়ে আর কোথাওই যাওয়া নয়।
সুবীরবাবু বুঝতে পেরেছিলেন যে ভটকাই শব্দটার মানে বুঝতে পারেনি।
উনি বললেন, আমি নৃতত্ত্বের কথা বলছি।
বুঝেছি। আদিবাসীদের নৃত্যের কথা বলছেন তো!
ভটকাই আবারও স্মার্টলি কেলো করল।
আমি ধমকে বললাম, এখন চুপ কর। পরে তোর সঙ্গে আলোচনা করব।
দুপুরের খাওয়ার পরে মিতাহারী বিস্ত সাহেব চলে গেলেন তাঁর ব্যবহারে ও সৌজন্যে আমাদের মুগ্ধ করে।
আমরা এখন দোতলার বারান্দাতে বসে আছি। বাংলোর পাশেই একটি নুনী বা Salt Lick-। কুদরতি নয়, বানাওটি। আর তার ঠিক পেছনেই ভুটানের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথার কাছের কিছুটা জায়গা সাদা দেখায়, সেখান থেকে পাথর বা কোনও ধাতব পাথর বের করাতে। মনে হয়, যেন বরফ পড়েছে। বারান্দায় বসে সেই দিকে চাইলে নুনীটা দৃষ্টিপথেই পড়ে। চারটি চিতল হরিণী আর একটি শিঙাল নুন চাটতে এসেছে। জোর হাওয়া আসছে নদী থেকে। আর ঝরঝরানি আওয়াজ।
রাতে বেশ ঠাণ্ডা হবে। ভাবলাম।
ঋজুদা বলল, মনে হচ্ছে, রাতে দুটি কম্বল লাগবে জানালা-দরজা বন্ধ করেও। অথচ মাসটা মার্চ।
বললাম, রায়ডাক নদী ঘুমপাড়ানি গান গাইবে সারারাত।
রাইট।
বলে, অনেকক্ষণ বাদে ঋজুদা পাইপটা ধরাল। পাইপ খাওয়া অনেকই কমিয়ে দিয়েছে আজকাল। দুপুরের খাওয়ার পরে একটু খায়, আবার রাতের খাওয়ার পরে। ব্রেকফাস্টের পরেও খায় কখনও কখনও।
এদিকে মনে হয় একটাও তক্ষক নেই। ট্রাক টু-উ-ট্রাক-টু-উ ডাক একেবারেই শোনা যাচ্ছে না।
আমি বললাম।
আছে হয়তো। নদীর শব্দের জন্যেই হয়তো শোনা যাচ্ছে না।
খাওয়াটা বড় জোর হয়ে গেল র্যা।
ভটকাই বলল।
খেতেই তো এসেছিস তুই।
আমি বললাম।
চল, বিকেলে চা খেয়ে হাঁটতে বেরোব।
ঋজুদা বলল।
নদীতে যাব তো?
যাব। কিন্তু বাংলোর পাশের পাম্পঘরের পাশ দিয়ে নয়। সামনের পথ দিয়ে যাব।
কেন?
ওইখানে নদী খুব চওড়া।
বেশ!
তারপর কাল সকালে তোদের নিয়ে পীপিং-এ যাব। ভুটান আর পশ্চিমবাংলার সীমান্তে। বিস্ত সাহেব বলছিলেন। ভুটানের নদীটির নাম ওয়াক্কু। গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে বইছে। পীপিং-এ পৌঁছে, সমতলে পড়েই, ছড়িয়ে গেছে নদী। হাত পা শরীর সব মেলে দিয়েছে। তার নাম হয়ে গেছে সেখানে এই রায়ডাক।
রায়ডাক নাকি নদ? শুনেছি।
হবে। কিন্তু আজকাল তো ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের তফাত করা যায় না। লেখিকা বলেন না কেউই, বলেন লেখক। তাই রায়ডাক পুরুষ না নারী তা। নিয়ে বৃথা তর্ক করে কী লাভ?
গল্পে গল্পে দেখতে দেখতে বেলা পড়ে এল। কিছুক্ষণ আগে আকাশে একটু মেঘ মেঘ করেছিল। এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। মনবাহাদুর দোতলার বারান্দাতে চা নিয়ে এল। রেঞ্জার সুবীর বিশ্বাসও লাঞ্চের পরে চলে গেছিলেন তাঁর রেঞ্জ অফিসে। বলে গেছিলেন সন্ধের পর আসবেন। কল্যাণ দাস, অ্যাডিশনাল ডি. এফ. ও.ও আসবেন বলেছিলেন।
বলতে একেবারেই ভুলে গেছিলাম যে, বিস্ত সাহেব আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ সরকার, অ্যাসিস্ট্যান্ট কনসার্ভেটর এসেছিলেন। ঋজুদার ভক্ত। উনিও খাওয়া-দাওয়ার পর বিস্ত সাহেবের সঙ্গেই ফিরে গেলেন। ঋজুদার খুবই পছন্দ হয়েছে তাঁকে। বলল, ছেলেটি খুবই ব্রাইট। অনেক খোঁজ-খবর রাখে। দেখিস, জীবনে খুব উন্নতি করবে। তোরা দেখতে পাবি। তখন আমি হয়তো আর বেঁচে থাকব না। কল্যাণ দাসও অবশ্য ভাল। দুজনেই ভাল। তবে দুরকম।
চা খেয়ে আমরা বেরোলাম। তখনও বেলা ছিল। দিনে দিনেই ঘুরে আসব। সঙ্গে টর্চও নিইনি। ধূলি-ধূসরিত পথ ধরে পীপিং যাওয়ার রাস্তাতে আমরা হেঁটে এগোলাম। তারপর এক ফার্লং মতন গিয়ে সেই পথ ছেড়ে ডান দিকে যে পথটি চলে গেছে তাতে ঢুকলাম। সে পথে ট্রাকের চাকার দাগ ছিল।
ঋজুদা বলল, নদীতে ট্রাক যাওয়া-আসা করে কেন? কীরে ভটকাই?
ভটকাই বলল, পিকনিক পার্টি?
তোর মাথা! এই মার্চ মাসে কেউ পিকনিক-এ আসে! তাও আজ তো রবিবারও নয়। ভেবে বল।
মার্চ মাস হলেও ওয়েদার তো প্লেজেন্ট।
পিকনিক-এ আসতে হলে মনেরও কিছু বলার থাকে। জমাটি শীত না পড়লে, রোদে বসে আরাম না হলে, কি পিকনিক করার কথা মনে হয় কারোরই?
তাহলে? ভেবে নিয়ে ভটকাই আবার বলল, বালি আনতে গেছিল হয়তো নদীর বুকে।
বালি তো জয়ন্তী, ফাসখাওয়া, চুনিয়াঝোড়া যে-কোনও নদী থেকেই আনা যেত। এত দূরে ঠেঙিয়ে আসার দরকার কী?
তবে?
পাথর রে, পাথর। নদীর বিছানা থেকে পাথর আনতে যাওয়া-আসা করে ট্রাক।
এখানে নানা রকমের ধাতু আছে, না? ঋজুদা?
আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
নিশ্চয়ই।
ঋজুদা বলল।
কী? কী? ঋজুদা?
ডলোমাইট, লাইমস্টোন, ক্যালকারিয়াস টুফা, কপার ওর, কয়লা, আয়ন ওর আর ক্লে।
ওর কী জিনিস?
ভটকাই বলল।
ধাতু তো আলাদা থাকে না। পাথরের সঙ্গেই মেশানো থাকে। পাথর থেকে তাদের আলাদা করে তারপর তা গলিয়ে মানুষ নানা কাজে লাগায়। সেই ধাতব পাথরকেই বলে ORE বাংলায় বলে আকর।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা নদীর কাছে এসে পৌঁছলাম। এদিকে চিলৌনি, সিঁদুরে গাছ, ডেউয়া, ডুমুর এবং আকাতরু গাছ দেখা গেল। বহেড়া এবং আমলকী। যদিও হিমালয়ের পাদদেশকে বলে তেরাই, এই সব কিন্তু ভাব্বার অঞ্চল। এ অঞ্চলে জল থাকে ভূস্তরের অনেকই নীচে। গাছেদের অনেক গভীরে শিকড় নামিয়ে দিতে হয় জল পাওয়ার জন্যে। এই শিকড়দের বলে Tap Roots। সুন্দরবনের ম্যাংগ্রোভ জঙ্গলের গাছেদের শিকড়দের যেমন বলে, Aerial Roots।
একরকমের মাঝারি গাছ দেখিয়ে ঋজুদা বলল, এগুলোর নেপালি নাম কী জানিস?
কী? ঝিমুনি। দ্যাখ, পাতাগুলো দেবদারু ও লিচুপাতার মতন। আর ওই যে দ্যাখ, মেড়া গাছ। ঘন সবুজ পাতা। বেনটিক লতা, বউভোনিয়া লতা।
এই বউভোনিয়াই কি Bauhinia Vali?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ঋজুদা বলল, কার-রে-ক্ট। শেষ শব্দটির ওপর জোর দিয়ে।
তারপর বলল, এদের স্থানীয় নাম ভেড়লা।
ভেড়লা? কী নাম রে বাবা!
ভটকাই বলল।
রাইফেলবন্দুক সঙ্গে কিছুই নেই। কড়াকপিং করতে পারছে না। ভটকাই-এর মন ভাল নেই। উদাসী-উদাসী ভাব। নিনিকুমারীর বাঘ মারার অ্যাডভেঞ্চারের পরে তো মণিপুরের ইম্ফল আর নাগাল্যান্ডের কাঙ্গপোকপিতে যাওয়া হয়েছিল মৃত্যুরহস্যর কিনারা করতে। সেখানেও বন্দুক রাইফেলের দরকার ছিল না। ছিল পিস্তলের।
এবারে বনের বুকের কোরক আর মাথার উপরে পাতার সবুজ চাঁদোয়ার ছায়া পেরিয়ে আমরা নদীর পাশে এসে দাঁড়ালাম।
আঃ। অপূর্ব!
ভটকাই-ই বলল প্রথমে।
সত্যিই অপূর্ব। আমার মুখ থেকে অনবধানেই বাক্যটা বেরিয়ে এল।
ঋজুদা কিছুই না বলে, সেদিকে চেয়ে পাইপের পোড়া ছাই ঝেড়ে ফেলে পাইপে নতুন তামাক ভরতে লাগল।
তোমার এই তামাকটার গন্ধ ভারী ভাল ঋজুদা। কী তামাক?
গ্ল্যামার। চেরী র্যাভেন্ডিশ। ডাচ টোব্যাকো। হল্যান্ডে তৈরি। গত সপ্তাহে, ডিটার রাইমেনস্নাইডার ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে নিয়ে এসেছিল আমার জন্যে।
তিনি আছেন কেমন? আমাকে ডাকলে না?
আমি বললাম।
ভালই। তিন দিনের জন্যে এসেছিলেন। খুব ব্যস্ত, তাই…
বাঃ। দারুণ সুন্দর গন্ধ কিন্তু। যারা কাছে থাকে তাদের দিলখুশ হয়ে যায়।
রোদ আস্তে আস্তে পড়ে আসছে।
নদীর ওপারে ভুটান। প্রায় হাজার ফিট উঁচু খাড়া পাহাড় চলে গেছে বরাবর নদীর সমান্তরালে। আর সেই পাহাড়ের পেছনে ঢেউ-এর পর ঢেউ-এ পাহাড় মাথা তুলেছে। ক্রমশ সবুজ থেকে কালচে হয়েছে তাদের রং, কাছ থেকে যত দূরে গেছে। পাহাড়ের পায়ের কাছেই নদীর দুধলি জলধারা বেগে নীচের পাথরে হোঁচট খেতে খেতে চলকে-ছলকে বিভিন্ন রঙা পাথরের উপর দিয়ে, বিভিন্ন সমতার তল বেয়ে বেগে ধেয়ে চলেছে। আসলে, জলের তো কোনও রং নেই, অবয়বও নেই। যার বুকে যখন থাকে জল তখন তারই রঙের হয়ে যায়। যার উপর দিয়ে বয়ে যায় জল, তারই আয়তনকে সে নিজস্ব করে নেয়। তাই তার রং আর চেহারার এত হাজার রকম।
জোর শব্দ উঠছে সেই উচ্ছল জলরাশি থেকে। বিদায়ী সূর্যের নরম কমলা রোদ, সাদা নুড়িময় শুকনো নদীরেখা, দ্রুতধাবমানা জলরাশি আর তার পেছনের স্থির গম্ভীর পাহাড়শ্রেণী মিলে মিশে হু-হুঁ হাওয়ার মধ্যে এক আশ্চর্য অনড় ছবির সৃষ্টি করেছে।
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কথা বলতেও ভুলে গেলাম।
হঠাৎ ঋজুদা পাইপধরা ডান হাতটা তুলে কী যেন দেখাল দূরে।
আমরা দেখলাম, একজোড়া সাদা কালো Wood Duck ভাঁটা থেকে উজানে, পীপিং-এর দিকের ওয়াঙ্গু নদীর দিকে উড়ে যাচ্ছে, রায়ডাক নদীর বুকের উপর দিয়ে। তাদের সাদা কালো নরম কোমল ডানা-মেলা সম্ভ্রান্ত উড়াল শরীরে দিনশেষের কমলা আলো পড়ে মাখামাখি হয়ে তাদের যেন সোনার পাখি বলেই মনে হচ্ছে।
যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ চেয়ে রইলাম আমরা সকলেই।
আবার ঋজুদা বলল, ওই দ্যাখ।
বলেই, এগিয়ে চলল জলের দিকে।
আমরা অবাক হয়ে দেখলাম শিমুলের বীজ-ফাটা তুলো আলতো হয়ে ভেসে আসছে হাওয়াতে দ্রুতগতিতে। সেই জোড়া উড-ডাক যেদিকে উড়ে গেল সেই দিক থেকেই। তুলোর আঁশেরা ধীরে ধীরে উচ্চতা হারিয়ে এসে জলে পড়ছে একেক করে। আর ধাবমানা জল তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড বেগে, যেমন করে আমাদের দেশে হাজার হাজার তীর্থক্ষেত্রে প্রিয়জনের মঙ্গল কামনা করে, নদীর বুকে পুণ্যার্থীদের ভাসিয়ে দেওয়া ফুল-পাতার দোনাতে বসানো প্রদীপগুলি ভেসে যায়।
ভাবছিলাম, কে জানে! এই নির্মল কলুষহীন তীব্র হাওয়া কার বা কাদের মঙ্গল কামনা করে কোন অচিনপুরের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই অগণন বীজ-ফোঁটা শিমুলের তুলোর প্রদীপ?
ঋজুদা বলল, চল, আমরা পথ দিয়ে না গিয়ে নদীর বুক ধরেই ভুটানঘাট বাংলোতে ফিরে যাই। পাম্প হাউসের কাছে গিয়ে, জল পেরিয়ে উঠব গিয়ে বাংলোর পিছন দিয়ে। ওদিকের জলধারায় স্রোতের বেগও কম। পেরুতে অসুবিধে হবে না।
ভটকাই বলল, চলো।
এই আশ্চর্য সৌন্দর্যর মুখোমুখি হয়েই ভটকাই-এর মতন বাঁচালও সৌন্দর্যহত হয়ে একেবারেই নীরব হয়ে গেছে।
আমি বললাম, ঋজুদা।
বলেই, বালিতে দেখালাম, ডান হাতের তর্জনী দিয়ে।
একটা লেপার্ড জল খেয়ে জঙ্গলের দিকে ফিরে গেছে। তার টাটকা পায়ের দাগ বালিতে।
ভটকাই দাঁড়িয়ে পড়ে মনোযোগ সহকারে দেখল।
ঋজুদা বলল, ফিমেল।
তারপরই দেখলাম, আর একটু এগিয়েই একটি বড় বাঘ, মানে টাইগারের পায়ের দাগ। সেও জল খেয়ে জঙ্গলে ফিরে গেছে। তবে ছাপটি দিন চার-পাঁচের পুরনো। বালির উপরে রাতের শিশিরে আর দিনের রোদ-হাওয়াতে ছাঁচ ভেঙে গেছে।
বললাম, পুরুষ বাঘ। তাই না?
ঋজুদা থুতনিটা নিচু করে সায় দিল।
ঋজুদাও কথা বলছে না কোনও। এমন সৌন্দর্য মানুষকে বোবা করে দেয়। হয়তো কাঁদাতেও পারে। আমার তাই মনে হচ্ছিল ভটকাই-এর সৌন্দর্যহত মুখটির দিকে তাকিয়ে।
এবারে দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে। দিন ও রাতের মধ্যের এই ক্ষণটুকুকেই অর্যমা বলে। সিনে ক্যামেরার মিক্সিং-এর মতনই ঘটছে এই সন্ধে নামা ব্যাপারটা। নিঃশব্দে। ওপারের ভুটানের দিক থেকে হাতির বৃংহণ ভেসে এল মার্সিডিজ ট্রাকের হর্ন-এর তীক্ষ্ণ আওয়াজের মতন। হাওয়াটা ক্রমশই জোর হচ্ছে এবং ঠাণ্ডা।
নদীতে সামনেই একটি প্রপাত মতন আছে। এক কোমর সমান উঁচু হবে। জল কম, অথচ কী আওয়াজ! কী স্রোত! জুতোসুদু পা একবার ডুবিয়েই মনে হয়েছিল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে রায়ডাক আমাকে বিন্দুমাত্রও হাঁকডাক না করে। ডান দিকের প্রায়ান্ধকার জঙ্গলের মাথার উপরে একজোড়া ওয়াটেন্ড ল্যাপউইং ডাকছিল, ডিড উ্য ডু ইট? ডিড ঊ্য? ডিড উ্য ডু ইট?
চাঁদটা উঠেছে ভুটান পাহাড়ের পিঠের ওপরে কিন্তু কোনও প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের মতন পাহাড়টার অন্ধকার রোমশ পিঠ সেই আলো শুষে নিচ্ছে। টিটি পাখি দুটো নিশ্চয়ই কোনও মাংসাশী জানোয়ার দেখে থাকবে। সাবধান করছে তৃণভোজীদের। অথবা কোনও নড়াচড়া দেখেছে। হয়তো নদীর পাথর আর বালিভরা বুকে চলমান আমাদের তিনমূর্তিকে দেখেই ডাকছে, তাও হতে পারে। এমন সময়ে আমাদের পেছন থেকে একটা অদৃশ্য কোটরা হরিণ খুব জোরে ব্বাককব্বাক ধ্বক করে ভয় পাওয়া ডাক ডেকে উঠল।
ভটকাই বলল, বাঘ কি চিতা দেখেছে।
ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, রুদ্র সেই গানটা গা তো।
কোন গানটা ঋজুদা?
সেই যে, ও আমার দেশের মাটি… তুই বড় ভাল গাস গানটা!
ভটকাইও যেন নীরবে আমাকে অনুরোধ করল গানটি গাইতে।
আমি ধরলাম :
ও আমার দেশের মাটি, তোমার
’পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ী, তোমাতে
বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ॥
আমার গানের সঙ্গে সঙ্গে যেন নদীর জলের আওয়াজ আরও জোর হতে লাগল এবং গাঢ় হতে লাগল অন্ধকার।
আমরা তিনজন নুড়ির আর বালির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলাম আমাদের এই আশ্চর্য সুন্দর দেশের এক সুন্দর কোণে, এক সুন্দরতর সন্ধ্যাতে। গর্বে আমার চোখ জলে ভরে এল, আমরা এই দেশে জন্মেছি যে, এই কথা ভেবে।
কারও মুখেই কোনও কথা ছিল না।
আমরা তিনজনে….