উত্তরটা খুঁজে বের করা যাক
তখন থেকে আমার বোকামি বেড়েই চলল।
মিয়াগিকে বললাম, “আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। একজনকে ফোন করতে হবে। একটু পরেই চলে আসছি,” বলে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হলাম। আমি চাইনি সে আমার ফোনালাপ শুনুক-সেজন্যই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হওয়া। কিন্তু মিয়াগিকে আমার পেছনে পেছনে আসতে দেখে খুব একটা অবাক হলাম না।
সর্বশেষ কবে যে কাউকে নিজে থেকে ফোন দিয়েছি মনে পড়ছে না। স্ক্রিনে দেখলাম, সর্বশেষ যাকে কল দিয়েছি তার নাম ভেসে উঠেছে।
ওয়াকানা।
অনেকক্ষণ ধরে একদৃষ্টিতে নামটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বাসার পেছনে গাছাপালাগুলোতে গ্রীষ্মের পোকামাকড়গুলো মনের সুখে গুঞ্জন করছে।
মোবাইলের সর্বশেষ বাটনটা চাপ দিতে কেন জানি অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ভেবে দেখলাম, ছোটবেলা থেকেই কাউকে কখনো শুধুমাত্র আড্ডা দেয়ার খাতিরে ফোন দিইনি। এর মাধ্যমে অনেক কিছুর সুযোগ হারিয়েছি ঠিকই, সেই সাথে দুনিয়ার অনেক গ্যাঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে পেরেছি। তাই আমি অনুতপ্ত নই, সন্তুষ্টও নই।
ওসবের ব্যাপারে ভাবা থামিয়ে দিলাম। কয়েক সেকেন্ডের যে শূন্যতা কাটল, এরই মধ্যে ফোন করার বাটনটা চেপে দিলাম। সে ফোন তুললেই আমি বাকিটা দেখছি। কী নিয়ে কথা বলব তা আমার ভালোমতোই জানা ছিল।
ফোনের অপর পাশ থেকে ভেসে আসা রিংটোনের শব্দ আমার স্নায়ুকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। একবার, দুইবার, তিনবার বাজল। তখন মনে পড়ল, এমনও তো হতে পারে যে অপর পাশে থাকা মানুষটা ফোন তুলতে চায় না। অনেকদিন হলো কাউকে ফোন দিই না, তাই এসব ভুলে গিয়েছিলাম। চার, পাঁচ, ছয়বার রিং হলো। ওয়াকানা বোধহয় এতটাই ব্যস্ত যে, ফোন ধরার মতো অবস্থা নেই তার। মনে মনে খানিকটা আশ্বস্তই হলাম।
আটবার রিং হতেই কট করে ফোনটা কেটে দিলাম।
ওয়াকানা হচ্ছে কলেজের এক ক্লাস জুনিয়র একটা মেয়ে। তাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে বের হতে চেয়েছিলাম। যদি সবকিছু ভালোভাবেই এগোয় তবে আমার ক্ষুদ্র এ জীবনের শেষ পর্যন্ত আমার পাশে থাকার জন্য অনুরোধ করব।
মনের ভেতরটায় নিঃসঙ্গতাবোধ খুব বেশি পরিমাণে টের পাচ্ছি। যখন নিশ্চিত হলাম যে অতি শীঘ্রই মারা যাচ্ছি আমি, তখন থেকে বেশি বেশি মানুষজনের মধ্যে থাকতে মনে চাইছে আমার। আগে কখনো এরকম মনে হয়নি আমার। আমি কারো সাথে কথা বলার জন্য অভুক্ত ছিলাম।
কলেজে ওয়াকানা ছিল একমাত্র মানুষ, যে কিনা আমার ব্যাপারে সামান্যতম হলেও আগ্রহ দেখিয়েছিল। এই বছর বসন্তের সময় পুরোনো এক বইয়ের দোকানে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। তখন সে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। সে একটা পুরোনো, ময়লা, ছিন্নভিন্ন বই মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল। আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে এমন মুখভঙ্গি করেছিলাম, ‘একটু সরে দাঁড়ান, সামনে যেতে পারছি না’। কিন্তু মেয়েটা আমার মুখভঙ্গিটা সম্পূর্ণ অন্য অর্থে নিয়েছিল। ‘লোকটা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে-কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারছি না। লোকটাকে কি আমি আগে কোথাও দেখেছি?’ কলেজে নতুন ভর্তি হলে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে এরকম ভুল অনেকেই করে থাকে।
“ইয়ে মানে, আমরা কি আগে কোথাও পরিচিত হয়েছি?” সে ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল।
“না, হইনি।” জবাব দিলাম।
“ওহ, দুঃখিত,” ওয়াকানা তার ভুল বুঝতে পেরেছিল। বিব্রত ভঙ্গিতে সে চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু পরক্ষণেই বিব্রত ভাবটা কাটিয়ে উঠে মুখ হাসি হাসি করে বলল, “তাহলে এই বইয়ের দোকানেই আমাদের প্রথম পরিচয় হলো?”
একটু অবাক হয়েছিলাম। “তা বলতে পারেন।”
“চমৎকার,” বলে সে তার হাতের পুরোনো বইটা তাকে রেখে দিল। কদিন পর কলেজ ক্যাম্পাসে তার সাথে আবার দেখা হলো। ধীরে ধীরে তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল আমার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বইপত্র আর গান নিয়ে আড্ডা দিতাম আমরা। এই আড্ডার জন্য মাঝেমধ্যে ক্লাসও ফাঁকি দিয়েছি আমরা।
“আমার বয়সী কাউকে এই প্রথম পেলাম যে কিনা আমার থেকেও অনেক বেশি বই পড়ে,” ঝকঝকে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ওয়াকানা বলেছিল।
“বইগুলো শুধু পড়েই যাচ্ছি আমি, ভেতরে কিছুই রাখতে পারছি না, “ আমি জবাব দিয়েছিলাম। “আমার মস্তিষ্কের কোনো অংশ এসব থেকে কিছুই জমা রাখতে পারে না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, বিশাল একটা স্যুপের পাত্র থেকে একটা ছোট বাটিতে স্যুপ ঢেলেই যাচ্ছি আমি। একটু স্যুপ ঢালতেই উপচে পড়ে বেশিরভাগ স্যুপ মাটিতে পড়ে যায়। তাই বই পড়ার ফলে আমার আপাতদৃষ্টিতে কোনোপ্রকার লাভই হচ্ছে না।”
“ব্যাপারটাকে তুমি এভাবে ব্যাখ্যা করলে?” কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওয়াকানা আমার দিকে তাকাল। “বই পড়ায় হয়তো সরাসরিভাবে তোমার কোনো লাভ হচ্ছে না। কিন্তু আমার ধারণা, তুমি সবকিছু ‘ভুলে’ যাবার পরেও যা যা পড়েছ, সবই তোমার মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থেকে যায়। অবচেতন ভাবেই তোমাকে ওসব সাহায্য করে থাকে।”
“কিছু ক্ষেত্রে হয়তো তোমার কথাটা সত্য। কিন্তু আমি মনে করি-নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি-যুবক বয়সে নিজের সময়টুকু শুধুমাত্র গল্পের বই পড়ে কাটানো মোটেই ভালো কোনো কাজ নয়। যাদের জীবনে কিছুই করার নেই, শুধুমাত্র তাদেরই বই পড়া উচিত।”
“তোমার জীবনে কিছুই করার নেই কুসুনোকি?” ওয়াকানা জিজ্ঞেস করল।
“নাহ। পার্ট-টাইম চাকরিটা বাদে কিছুই করি না আমি,” জবাব দিলাম।
উত্তরটা শুনে সে চওড়া একটা হাসি উপহার দিল। পিঠে খোঁচা মেরে সে বলল, “তাহলে আমি তোমাকে করার মতো একটা কাজ দিচ্ছি।” বলে আমার মোবাইলটা নিয়ে তার ইমেইল আর ফোন নম্বরটা সেভ করে দিল।
যদি আমার জানা থাকত যে, হিমেনো ইতোমধ্যে মা হয়েছে, বিয়ে করে ডিভোর্সও নিয়ে ফেলেছে, সবচেয়ে বড় কথা আমাকে ভুলে গিয়েছে-তাহলে হয়তো ওয়াকানা’র ব্যাপারে আরও বেশি আগ্রহ দেখাতাম। কিন্তু তখনো আমি হিমেনো’র সাথে করা সেই প্রতিজ্ঞার স্বপ্নে বুঁদ ছিলাম। আর কদিন পরেই আমার বিশ বছর বয়সে পা দেবার কথা। তাই ওয়াকানা’কে আর ফোন দেয়া হয়ে ওঠেনি। আর যদি সে কখনো নিজে থেকে কথাবার্তা শুরু করতে চেয়েছে, আমি কয়েকটা টেক্সট মেসেজ কিংবা কয়েক মিনিটের ফোনালাপের মধ্যেই সেটা থামিয়ে দিয়েছি। তাকে উৎসাহী করতে আমার মন সায় দেয়নি।
আসলে সারাটা জীবনই বাজে সিদ্ধান্ত নেবার ওস্তাদ ছিলাম আমি।
.
ভয়েস মেসেজ রাখতে মন চাচ্ছিল না। তাই ওয়াকানাকে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠালাম। ‘আচমকা এভাবে যোগাযোগ করার জন্য দুঃখিত, কিন্তু আগামীকাল তুমি কি আমার সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে চাও?’ মেসেজটা খুব সতর্কতার সাথে লিখলাম আমি। চাঁছাছোলাভাবে মেসেজ দিলে চলবে না, আবার আমার ব্যাপারে তার যে ধারণা তাও যেন ভেস্তে না যায়।
সাথে সাথে মেসেজের রিপ্লাই এল। মিথ্যা বলব না-হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। এই দুনিয়ায় অন্তত কেউ একজন আছে, যে আমার মতো একজনের মেসেজের রিপ্লাই দেবার কথা ভাবে।
সাধারণত মেসেজ আসার সাথে সাথে খুলে দেখার মানুষ নই আমি, কিন্তু এবার সেটা করতে মন চাইল না।
মেসেজটা খুললাম।
খোলার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম, আমি কতবড় একটা ভুল করে বসেছি।
ওয়াকানা মেসেজের রিপ্লাই দেয়নি। শুধু তাই হলে এতটা খারাপ লাগত না। কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিনে দেখলাম ভেসে উঠেছে, ‘এই ইমেইল এড্রেস এখন বন্ধ রয়েছে’।
ওয়াকানা আমাকে না জানিয়ে তার ইমেইল পাল্টে ফেলেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আমার সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার কোনো দরকার নেই তার।
অবশ্য সেটা তার মনের অজান্তের ভুলও হতে পারে। হয়তো তার সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে সে তার ভুলটা বুঝতে পেরে আমাকে কিন্তু এতকিছু করার দরকার নেই। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, সুযোগটা আমি হারিয়ে ফেলেছি।
সময় ফুরিয়ে গিয়েছে আমার।
আমি যেভাবে অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, সেটা দেখে মিয়াগি কিছু একটা বুঝতে পেরেছিল। আমার কাছাকাছি এসে সে কাঁধের ওপর উঁকি দিয়ে মেসেজটা পড়ার চেষ্টা করল।
“উত্তরটা খুঁজে বের করা যাক,” সে বলল।
“যে মেয়েটাকে আপনি ফোন দিতে চেষ্টা করলেন, আপনার জীবনের সর্বশেষ আশা সে-ই ছিল। ওয়াকানা’ই হয়তো আপনার জীবনের সর্বশেষ মানুষ, যে আপনাকে ভালোবেসেছিল। যদি তখনই তার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারতেন, তবে এতদিনে আপনাদের প্রেমিক-প্রেমিকা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। হলে হয়তো তখন আপনার জীবনের মূল্য এতটা কম হতো না—কিন্তু সেসবের জন্য দেরি হয়ে গিয়েছে। ওয়াকানা এখন আপনাকে নিয়ে আর ভাবে না। বরং তার ভালোবাসাকে আপনি অবহেলা করেছেন বলে সে আপনার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। যদি সে আপনাকে তার বর্তমান প্রেমিকের চেহারা দেখাতে পারত, তবে মনে মনে খুশি হতো অনেক।”
মিয়াগি এমন ভাবে কথাগুলো বলল, মনে হচ্ছিল আমি যেন ওখানে নেই। সে আপনমনে নিজেকে কথাগুলো শোনাচ্ছে।
“এই মুহূর্ত থেকে আপনাকে ভালোবাসতে চাইবে, এমন আর কোনো মানুষ আপনার জীবনে আসবে না। যখন কোনো মানুষ নিজের একাকিত্বকে ভোলার জন্য অন্য মানুষকে ‘ব্যবহার’ করে, সেই অন্য মানুষেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ধরে ফেলে।”
পাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে হাসিঠাট্টা, উল্লাসের শব্দ ভেসে আসছিল। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে একদল কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে আনন্দের সাথে আড্ডাবাজি করছে। তাদের জানালা থেকে যে আলো গলে বের হচ্ছিল, তা আমার ঘরের আলোর চেয়ে অনেক বেশি তীব্র, আরও উজ্জ্বল। পুরোনো ‘আমি’ হয়তো সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, কিন্তু এখন জিনিসটা আমার বুকটাকে বিদীর্ণ করে দিল।
এরকম বাজে একটা মুহূর্তে ফোন বেজে উঠল। ওয়াকানা ফোন করেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ফোনটা ধরব না। কিন্তু পরেও সে আবার ফোন করুক, সেইটা আমি চাই না। তাই ফোনটা ধরলাম।
“কিছুক্ষণ আগে আমাকে ফোন দিয়েছিলে কুসুনোকি? কী হয়েছে?” সে জিজ্ঞেস করল। আমি নিশ্চিত সে আমার সাথে আগে যেভাবে কথা বলত, এখনও সেভাবেই কথা বলছে। কিন্তু মিয়াগির কথাগুলো শোনার পর কথাগুলোর ধার টের পেলাম। কথাগুলোর মধ্যে আরও অনেকগুলো কথা উহ্য ছিল, ‘এতদিন পর আমার সাথে যোগাযোগ করে কেন বিরক্ত করছ?’
“দুঃখিত। ভুলে ফোন চলে গিয়েছে,” গলার স্বরটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম।
ওহ। অবশ্য তাতে অবাক হইনি। অন্য মানুষকে নিজ থেকে ফোন দেয়ার মতো মানুষ তুমি নও,” বলে সে হাসল। মনে হলো, তার হাসির মধ্যেও বিদ্রূপ মিশে ছিল। “এজন্যই তো তোমার সাথে আর নিজেকে জড়াতে চাইনি।”
“তা ঠিক,” বলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।
পাশের অ্যাপার্টমেন্টে উল্লাসের মাত্রা বেড়ে গেল।
.
ভেতরে যেতে মন চাইছিল না, তাই বাইরে দাঁড়িয়েই একটা সিগারেট ধরালাম। দুটো সিগারেট খতম করে হেঁটে হেঁটে নিকটবর্তী সুপারমার্কেটে পৌঁছালাম আমি। অনেক সময় নষ্ট করে ঘুরেফিরে অবশেষে সিক্স-প্যাক বিয়ার, ফ্রাইড চিকেন আর কিছু ইন্সট্যান্ট নুডুলস কাপ কিনলাম। প্রথমবারের মতো নিজের জীবন বিক্রি করে পাওয়া টাকা থেকে খরচ করলাম। যা ঘটে গেল, তা ভুলে যাওয়ার জন্য একটু নিজের জন্য খরচ করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু নিজের জন্য খরচ কীভাবে করতে হয়, তা আমার জানা নেই।
মিয়াগি একটা বাস্কেট হাতে নিয়ে ঘুরছিল। বাস্কেটের ভেতর একগাদা স্বাদহীন কিছু খাবার (নিউট্রিশন বার এর মতো) আর পানির বোতল দেখতে পেলাম। এরকম জিনিস তাকে কিনতে দেখে খুব একটা অবাক হলাম না। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সে এসব খাচ্ছে-এটা কল্পনা করতে বেগ পেতে হলো। তার মধ্যে মনুষ্যত্ববোধের অনেক ঘাটতি রয়েছে। সেজন্য যে জিনিসটা মানুষের একদম অপরিহার্য কাজ যেমন খাবার খাওয়া-সেটা তার চরিত্রের সাথে যাচ্ছিল না।
মাথার ভেতর অবশ্য ভিন্ন একটা চিন্তা খেলা করছিল আমার। আমাদের এভাবে একসাথে কেনাকাটা করতে দেখে লোকে নিশ্চয়ই আমাদের একত্রে বসবাস করা প্রেমিক-প্রেমিকা ভেবে ভুল করবে। খুব গাধার মতো চিন্তা-সেটা আমাকে বলতে হবে না। কিন্তু এই ফ্যান্টাসি কল্পনা করতে আমার ভালো লাগছিল। আমাদের পাশ কাটিয়ে যারা চলে যাচ্ছে, তারাও যেন আমাদের প্রেমিকযুগল ভাবে-সেটা মনে মনে আশা করতে লাগলাম।
সত্যি বলছি, মিয়াগি নামের এই মেয়েটার অস্তিত্বের ওপরই আমার বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক বছর ধরেই মনে মনে একটা স্বপ্ন লালন করে এসেছিলাম। সেটা হলো, সাধারণ জামাকাপড়ে একটা মেয়ের সাথে বের হয়ে খাবার আর অ্যালকোহল কিনব। এতদিন অন্যদের তা করতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি। তাই আজকে মিয়াগি আমার পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্য সাথে থাকলেও ব্যাপারটা মন্দ লাগছিল না।
এই ‘সুখ’টা সম্পূর্ণই মেকি, অন্তঃসারশূন্য। কিন্তু যে অনুভূতিটাকে আমি অনুভব করছি, সেটা তো আর মিথ্যা নয়।
মিয়াগি আমার আগে কাউন্টারে গিয়ে টাকা মিটিয়ে দিল। ব্যাগভর্তি খাবার-দাবার নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম। পাশের অ্যাপার্টমেন্টে হইহুল্লোড় এখনও চলছে। ভেতর থেকে নড়াচড়ার শব্দ দেয়াল ভেদ করে কানে এল।
সত্যিটা বলেই ফেলি, তাদের এরকম আনন্দ করতে দেখে প্রচণ্ড হিংসা হচ্ছিল। এরকম অনুভূতি আগে কখনো অনুভব করিনি আমি। আগে এরকম মানুষদের দেখলে মাথায় কেবল প্রশ্ন জাগত, এই কাজগুলোর মধ্যে কীভাবে মানুষ আনন্দ খুঁজে পায়?
কিন্তু এখন আমি আমার আসন্ন মৃত্যুর ব্যাপারে সচেতন হয়েছি। তাই বিভিন্ন ব্যাপারে আমার যেসব উদ্ভট কিংবা প্যাঁচালো চিন্তাভাবনা ছিল, সবই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
পৃথিবীর অন্যান্য মানুষদের মতোই আমি মানুষের সঙ্গ কামনা করতে শুরু করেছি।
এরকম সময়ে বেশিরভাগ মানুষই পরিবারের সঙ্গ কামনা করে, আমি ভাবলাম। তুমি যেরকম অবস্থাতেই থাক না কেন, যত ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, পরিবার সর্বদা তোমার পাশে থাকবে। তাই দিনশেষে তোমার ওখানেই ফিরে যাওয়া উচিত। অন্তত এরকম চিন্তাধারার সাথে আমি পরিচিত।
কিন্তু সকলের কাছে তাদের পরিবার উষ্ণ একটা আবাসস্থল নয়। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এই শেষ তিনমাসেও আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করব না। যা ইচ্ছে ঘটুক, এই সিদ্ধান্ত থেকে আমি পিছপা হব না। যতটুকু সময়ই বাকি থাকুক না কেন, সেটাকে আরও অসহ্য করতে আমি চাই না।
.
শৈশবকাল থেকেই আমার ছোটভাই আমার প্রাপ্য বাবা-মায়ের ভালোবাসাটা কেড়ে নিয়েছে। সে সবকিছুতে আমার থেকে ভালো ছিল। সৎ, চটপটে, লম্বা, সুদর্শন চেহারার অধিকারী ছিল সে। বারো বছর বয়স থেকে বর্তমানের উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত তার যখন প্রেমিকার প্রয়োজন হয়েছে, সে পেয়েছে। যে কলেজে সে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল সেটাও আমার থেকে হাজার গুণে ভালো। খেলাধুলায় অসাধারণ, হাইস্কুলের বেসবল টিমের হয়ে সে ন্যাশনাল টুর্নামেন্টেও পিচিং করে এসেছে। একটা ক্ষেত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে আমি ওর থেকে ভালো ছিলাম। যখন আমি সবক্ষেত্রে পিছিয়ে যেতে শুরু করলাম-তাতে বরং ওর লাভই হয়েছিল; সে আরও দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছিল।
স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা তাকে বেশি গুরুত্ব, বেশি ভালোবাসা দেয়া শুরু করেছিলেন। আমাকে ‘ব্যর্থ ছেলে’ ধরে নিয়ে সে অনুযায়ী আমার সাথে আচরণ করলেও আমার কাছে কখনো তা অযৌক্তিক লাগেনি। আসলেই তো, তুলনা করলে আমি তো আক্ষরিক অর্থেই তাদের ব্যর্থ ছেলে। তাই আমাদের সমানভাবে ভালোবাসাটা তো অযৌক্তিকই হবে। আমি যদি তাদের জায়গায় থাকতাম, আমিও তাই করতাম। যে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য, যার প্রতি ভালোবাসা ‘বিনিয়োগ’ করলে বিনিময়ে একটা ‘ফলাফল’ পাওয়া যাবে, তাকে বেশি ভালোবাসলে ভুল কোথায়?
বাড়ি ফিরে গেলে সেখানে উষ্ণ, অকৃত্রিম ভালোবাসা, আদর-যত্ন পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। এর থেকে পাশের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় নক করে তাদের পার্টিতে যোগদানের অনুরোধ করার পর সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি।
পানি গরম করতে দিয়ে আমি বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিতে থাকলাম, মাঝেমধ্যে চিকেন ফ্রাইএ কামড় দিলাম। ইনস্ট্যান্ট রামেন প্রস্তুত হতে হতে প্রায় মাতাল হয়ে গেলাম আমি। এরকম মুহূর্তগুলোর জন্য মদ হলো দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ। তবে তা পরিমাণমত খেতে হবে।
টালমাটাল হলে ঘরের যে কোণে মিয়াগি বসে ছিল, সেদিকে এগোলাম। “আমার সাথে মদ খাবে?” এতটাই নিঃসঙ্গ বোধ করছি যে, সামনে ওকে পেয়ে ওকেই প্রস্তাব দিয়ে বসলাম।
“না, ধন্যবাদ। আমি কাজ করছি,” নোটবুক থেকে চোখ না তুলেই সে জবাব দিল।
“অনেকক্ষণ ধরেই একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে-তুমি নোটবুকে কী লিখছ?”
“আমার সব পর্যবেক্ষণ। আপনার সকল কর্মকাণ্ড।”
“ওহ-আচ্ছা। তাহলে তোমাকে সাহায্য করি। আমি এখন মাতাল হয়ে গিয়েছি।”
“তা ভুল বলেননি। আপনাকে দেখেই মাতাল মনে হচ্ছে,” মিয়াগি একমত হলো।
“শুধু তাই না-আমি তোমার সাথে মদ খেতে চাইছি।”
“হ্যাঁ, আমি জানি। একটু আগেই আমাকে তা বলেছেন,” বিরক্তির সাথে মিয়াগি জবাব দিল।