।। একাশি ।।
এ-ভাবেই মানুষকে কখনও কখনও ডেজার্টার হয়ে যেতে হয়। তার সব থাকে, নে চারপাশের আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠে। নানাভাবে সে নিজের ভিতর প্রকৃতির সুখমা টের পায়। অথচ পাশে পাশে থাকে শয়তানেরা। ওরা মানুষের চারপাশের রঙিন সুমা নষ্ট করে দিতে পারলে বাঁচে। মানুষ সময়ে তার থাবায় পড়ে গেলে অমানুষ হয়ে যায়।
রাতের বেলায় ওরা সবাই গোল হয়ে খেতে বসেছে। কেয়া, মুর্শেদ, জব্বার চাচা, অতীশ। মঞ্জু ওদের খেতে দিচ্ছে। রাত হয়ে গেছে অনেক। গল্প করতে করতে রাত করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া দরকার। কাল অথবা পরশু মুর্শেদকে নিয়ে সরে পড়তে হবে। খেতে বসে মুর্শেদ কোন কথাই বলতে পারছিল না। মঞ্জুকে দুপুর বেলায়ও ভেবেছে, সীমাহীন ধূর্ততায় মঞ্জু কাজ করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বিকেল থেকে সে দেখছে মেয়েটার অবসর নেই। কি ভাবে অন্তত এ-অঞ্চলটা পার করে দেওয়া যায়। কারণ মুর্শেদকে সব স্বাধীনতাকামী মানুষেরা চেনে। তাকে অনেকদিন থেকে সবাই খুঁজছে।
পরাজয়ের যখন খবর এল, এবার বন্দুকের নল নিচু করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, তখন সবাই দেখেছিল, মেজর সাব, ফল-ইনে আসে নি। মেজর সাবকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফল-ইনে সবাইকে জানানো হল কথাটা। কি-ভাবে চারপাশে হিন্দুস্থানের সামরিক অফিসারেরা জাল পেতে ফেলেছে, ঢাকার পতন অনিবার্য, তখন আর একটা মাস-কিলিঙের কি দরকার। এ-ভাবে নিরুপায় সৈনিকদের পড়ে পড়ে মার খাওয়ার চেয়ে সারেন্ডার দি আর্মস। ফল-ইনে সবাই রাজি হয়ে গেল।
এবং ফল-ইনে দেখা গেল, দু’জন অনুপস্থিত। একজন মেজর নিজে, অন্যজন মুর্শেদ। মেজরকে গভীর রাতে ঠিক পশ্চিমের আমবাগানের ভিতর পাওয়া গেল। সে বোধ হয় আত্মহত্যা করেছে। এটাই ভারতীয় সামরিক লোকেরা অনুমান করে নিল।
আসলে সেই যে মানুষেরা হাঁটে, হেঁটে যায়, চারপাশে থাকে সুষমা, সুষমার ভিতর মানুষ বড় হত হতে দেখতে পায়, যেন একজন ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো শয়তানের প্রবল হাত চোখের ওপর ঝুলছে, সে তখন কেমন বেপরোয়া হয়ে যায়, এবং সকালের দিকে দেখা গেল অর্জুন গাছের ছায়ায় হাজার হাজার মুক্তিযুদ্ধা, মার্চ করে চলে যাচ্ছে। ঢাকা চলো, এই ছিল ধ্বনি ওদের মুখে। এবং জানালায় তখন মঞ্জু। ভয়লেশহীন মুখ। জব্বার চাচা ফুল দিতে গেছে ওদের। আনন্দে পাগলের মতো গামছা ওড়াচ্ছে বাগানে। আর চিৎকার করছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। মাঝখানে রেখেছে একটা মৃতের শকট। সেখানেও ফুল দিয়ে গেছে কারা। মেজরের মৃত শকট টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অর্জুন গাছের ছায়ায় ওরা সেই মৃতের শকট রেখে অপেক্ষা করছিল। ওরা নাচ গান করছিল। আগুন জ্বেলে বন্- ফায়ারে মেতেছিল।
মঞ্জু জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছিল সব। ওরা কিছু কিছু সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছে। আবার মার্চ পাস্টের দৃশ্য। গাড়িটা চলে যাচ্ছে। মঞ্জুর মনে হল, সেখানে একজন মানুষ শুয়ে আছে, তার আকাঙ্খা তীব্র। বিদ্বেষ তার শরীরে, ইণ্ডিয়ার বিরুদ্ধে তার ঘৃণা অশেষ। এ-ভাবে তার ভিতরের সহিষ্ণুতা ক্রমে লোপ পেলে, সে বুঝতে পারে, ভিতরে আরও সব শয়তানের বাসা নানা জায়গায় তৈরি হয়ে যাচ্ছে। একজন ধার্মিক মানুষ, এ-ভাবে ক্রমে অধার্মিক হয়ে যায়। মঞ্জুর তখন দুঃখ বাড়ে। অবনীর কথা মনে হয়েছিল, অবনী ছিল ভীষণ একরোখা। সে জোরজার করে একদিন চন্দন গাছের জঙ্গলে মঞ্জুকে ফেলে দিয়েছিল, উলঙ্গ করে ফেলেছিল, এবং সেই এক ধর্ষণ। সে এভাবে মঞ্জুকে হাত করেছিল। মঞ্জুরও ছিল একটা ভাল লাগা, লোভ, শরীরের ভিতর জ্বালা, আর সেই ভীতু মানুষটাকে অহরহ কুরে কুরে খাওয়ার চেয়ে, জ্বলে পুড়ে মরে যাওয়ার ভিতর অনেক বেশি সুখ ছিল। মঞ্জু এ-ভাবে অবনীর কাছে ধরা পড়ে গেলে, বাবা বাধ্য হয়ে ওদের বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছিলেন।
নীলু বিয়ের আগের ছেলে। তাকে পৃথিবী থেকে সরানোর কি করুণ চেষ্টা অবনীর। অবনী মঞ্জুকে গর্ভবতী করে দিয়ে সাদাসিধে মানুষের মতো ঘুরে বেড়াতো। বাবার কাছে অনুপানের মাত্রা ঠিক করতে গিয়ে বলত, মঞ্জুর শরীর ভাল না কবিরাজ মশাই।
এবং অবিনাশ কবিরাজ নিজের তৈরি ওষুধ অবনীর মারফতে মঞ্জুকে খেতে দিয়েছিল। সামান্য ভ্রুণ হত্যার জন্য কি কঠিন প্রচেষ্টা। অবনী তেমনি সাদাসিধে মানুষের মতো ওষুধের বড়ি উদখলে মেড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত। ডাকত, আমি অ্যানী। এদিকে এস মঞ্জু। তোমাকে কবিরাজ মশাই ওষুধ খেতে দিয়েছে।
মঞ্জুর যেন কিছু করণীয় ছিল না। সে চুপচাপ খেয়ে যেতে থাকল। কিন্তু সে বাড়ে দিনে দিনে। চন্দ্রকলার মতো বাড়ে। অবিনাশ কবিরাজ হয়তো জীবনে দ্বিতীয়বার সর্ষেফুল দেখল, এবং বাধ্য হয়ে সে অবনীর হাত ধরে বলল, আমাকে রক্ষা কর বাবা। আমার জাত মান এখন সব তোমার হাতে।
কাজেই একটা বড় অসুখের ভিতর নীলু জন্মাল, আর একটা বড় অসুখ নিয়ে। নীলু সেই থেকে বিছানায় শুয়ে আছে। অবনী কবিরাজ পৃথিবীর তাবৎ মনুষ্যকুলের শারীরিক নিরাময়ের ওষুধ ওর ছেলের জন্য সংগ্রহ করে বেড়িয়েছে। কিন্তু কিছুতেই নিরাময় করতে পারে নি। কারণ নীলুর শরীরে গোপনে অবনী বিষ রক্তে আগেই মিশিয়ে দিয়েছে। অবনী জেনে ফেলেছিল কিছু আর করার নেই।
অতীশ এবং সবাই খুব আস্তে আস্তে খাচ্ছে। যেন খাচ্ছে না। কি ভাবছে। ওরা আজ তিন দেশের মানুষ। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মঞ্জু। ওর ভারী চশমার ভিতরে চোখ দুটো ভীষণ মস্করা করছে যেন সবাইকে।
এবং মঞ্জু ওদের দেখতে দেখতে এলোমেলো ভেবে চলেছে। মুর্শেদ এ-বাড়িতে কেন আসত, কেন অবনী কবিরাজের সঙ্গে তার এত ভাব ছিল, এও সে যেন মনে করতে পারে। সে চোখ দেখলে মানুষ চিনতে পারে। যেমন প্রথম দিনই মঞ্জু বুঝতে পেরেছিল, দূর দেশে থাকে তার বিবি। ঘর-বাড়ি, যা কিছু নিজের বলতে তার বোঝে, এখানে মুর্শেদ তেমনি কিছু যেন আবিষ্কার করে ফেলেছে। মঞ্জুর সহজ আন্তরিক ব্যবহার তাকে ভীষণভাবে বিকেল হলেই টানত। মুর্শেদের চোখ দেখে টের পেয়েছিল মঞ্জু। রাতে মুর্শেদের চোখে ঘুম থাকে না। রাতে শুয়ে সে মঞ্জুর কথা ভাবে।
মঞ্জুরও যে এ-ভাবে একটা মায়া গড়ে উঠেছিল, এই মানুষটার জন্য। কারণ মনে হয়েছিল, অবনীর চেয়ে মানুষটা বেশি আন্তরিক। অবনীর মতো জোরজার করে, ছলেবলে কৌশলে কিছু সে কখনও করতে চায় নি। শুধু দুদন্ড কথা বলতে পারলেই মুর্শেদ খুব খুশি থাকত। সে ছিল তার বিবির জন্য আন্তরিক। এই দূরদেশেও সে মঞ্জুর মধ্যে তার বিবিকে আবিষ্কার করে ফেলেছিল। মঞ্জু একসময় ঘোড়ায় চড়ে বেড়াত, মঞ্জু শহরে মানুষ, সে সবার সঙ্গে কথাবার্তায় স্বাভাবিক, এমন গ্রাম্য এক পরিবেশে এটা আশাই করা যায় না। মুর্শেদ ফল-ইনে হাজিরা দিয়ে একটা সাইকেলে বের হয়ে পড়ত। দু ক্রোশ রাস্তা ঠেঙ্গিয়ে এসেই ডাকত, কবিরাজ, নাড়ীটা দ্যাখতো। বলে সে হাত বাড়াত।
অথবা কখনও মুর্শেদ গজল গাইত। মাঠের ভিতর সে গজল শুনতে খারাপ লাগত না। তক্ষুনি অর্ডার আসবে ডিসপেনসারি থেকে, চা, কিছু খাবারও। একজন মিলিটারি মানুষের সঙ্গে অবনী বোধ হয় নিজের স্বার্থে যোগাযোগটা রক্ষা করতে চেয়েছিল। অন্যসব গ্রামের মানুষদের কাছে প্রমাণ করার ইচ্ছা সে যেন সরকার পক্ষের, এবং নিরাপত্তা বোধও কাজ করেছিল এ ব্যাপারে।
সুতরাং মঞ্জু দেখতে পাচ্ছে, সবাই যখন খাচ্ছে, তখন মুর্শেদ খেতে পারছে না। কি এক অপরাধ বোধে খাবার নাড়াচাড়া করছে। মঞ্জুর ঠোটে তখন হাসি না কটাক্ষ বোঝা যাচ্ছিল না। জব্বার চাচা হয়তো ভাবছিলেন, দেশ ভাগের সময়ে যে-সব মানুষেরা ভয়ে ভীতিতে, অথবা ধর্মাচরণে ব্যাঘাত ঘটবে বলে চলে গেল তাদের কথা। কেয়া ভাবছে, দূরদেশ থেকে একদল লোক কি করে যে ধর্মের নামে এতদিন দেশ শাসন করে গেল, শোষণ করে গেল! মুর্শেদ ভাবছে, আসলে সে কোন দেশের মানুষ, এবং অতীশ ভাবছে এই ডেজার্টার মানুষকে সে কি করে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে।
অথচ অতীশ কত কিছু ভেবে এসেছে। মঞ্জু হয়তো বলবে, আমার জন্য একটু জায়গা দ্যাখো। এখানে আর থাকা যাবে না।
মঞ্জু তখন বলল, এই মুর্শেদ! রুটি, মাংস।
আজ মাংস হয়েছে। খুব যত্ন নিয়ে রান্না করেছে মঞ্জু।
মুর্শেদ তাকাল। কিছু বলল না।
অতীশ বলল, দাও।
কেয়া বলল, আব্বাকে দাও।
জব্বার চাচা বললেন, না গো মা, আমারে দিস না।
মঞ্জু, অতীশকে আলাদা বাটিতে চার পাঁচটি হাড়-মাংস দিল। সে হাড়-মাংস খেতে ভালবাসে। কেয়াকে নরম মাংস, কেয়ার খাওয়ার কোনও আন্দাজ নেই, দেবার সময় মঞ্জু ধমক দিল, দ্যাখ খেতে পারবি, কিনা, তোর তো কি লাগবে, কি না লাগবে কিছুই বুঝে উঠতে পারিস না।
মঞ্জু মুর্শেদের কাছেও আলাদা মাংস রাখলে, মুর্শেদ বলল, না মঞ্জু। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আর দিও না।
—কেন ভয় করছে?
—ভয় করবে কেন!
—সোনাবাবুকে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না!
—না না, তা তো বলিনি।
—তুমি তো সেই থেকে মুখ গোমড়া করে রয়েছ।
—চলে যাব, তোমাদের সঙ্গে আর তো আমার জীবনেও দেখা হবে না। কেন এমন যে হয়। কেয়া বলল, মিঞা তোমাদের পাপে এমন হয়।
—এই কেয়া, কি হচ্ছে।
মুর্শেদ কেয়ার কথা কখনও ধরে না। অতীশ এটা বুঝতে পেরে মাংস চুষতে চুষতেই হাসল।—কেয়ার এত রাগ কেন।
রাগ না। দ্যাখো না, একেবারে জামাই। যেন কিছু খেতে জানে না।
মুর্শেদ কেয়ার দিকে তাকাল। মুর্শেদ, কেয়াকে দেখল, মঞ্জুকে দেখল, জব্বার চাচা, অতীশকে দেখল এই দেশে এমন সব যখন মানুষ এখনও বেঁচে আছে তখন ওর ভয় কি! সে বলল, কেয়া যদি কোনদিন এমন হয়, আমাদের তিনটে দেশের মানুষ, একটি বড় দেশের হয়ে যায়, কোনও পাপ তখন কারো মনে থাবে না। আসলে সে বুঝতে পারে, বাইরে যতই ধর্মাধর্মের ঢাক বাজুক, অন্তরে কোথায় যেন একটা কাছাকাছি থাকার স্বপ্ন সার ভিতর আছে। নানা হুজুগ সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তবে মানুষের ভিতর আছে সত্যাসত্যের পালা। সে একদিন না একদিন নিজেকে ঠিক চিনতে পারে। সে বলল, কেয়া খুব ইচ্ছে ছিল তোমাকে তোমার ভাবীর কাছে নিয়ে যাব।
কেয়া অন্যদিন হলে কি বলত, ঠিক বলা যায় না, কিন্তু আজকে এই গুমোট ভাবটা যেন হালকা করা দরকার। সে অন্যদিন এত সমীহ করে চলে যে—এ-ধরনের কথা মঞ্জুদির সামনে বলবে ভাবতেই পারে না।
সে বলল, ভাবীকে গিয়ে বলবে, এই যে, দ্যাখতো খুবসুরত মেহমান কেমন ধরে এনেছি। সাদি করে এনেছি।
জব্বার চাচা সেকেলে মানুষ। তিনি জানেন, আজকালকার মেয়েরা আগের মতো নয়। স্কুলে লেখাপড়া শিখছে। কলেজে পড়ছে। কেমন পাকা পাকা কথা। এবং তিনি যেহেতু সেকেলে মানুষ, চুপচাপ থাকতেই ভালবাসেন। মেয়েদের কথা তিনি শুনতে চান না। বিশেষ করে এই হিন্দু বাড়িতে থেকে, কেয়ার স্বভাবে কেমন একটা উগ্র ভাব এসে গেছে। যা শাসন করার মঞ্জু করে থাকে বলে, তিনি খেয়ে যেতে থাকলেন।
এমন কথায় অতীশ মুর্শেদ দু’জনেই হেসে দিল।
মঞ্জু বলল, কিরে কেয়া তোকে আর কটা ভাত দিই।
জব্বার চাচা বুঝতে পারলেন, মঞ্জু কেয়ার কথায় তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। আর মনে হল, তিনি এখানে বসে থাকলে ওদের ঠিক জমবে না। তাড়াতাড়ি খেয়ে বললেন, আমি উঠছি। তোমরা সময় নিয়া খাও।
অতীশ বলল, কেয়া তো খাচ্ছেই না। ভাত নাড়ছে শুধু।
মুর্শেদ বলল, ওর মেহমান চলে যাবে।
কেয়া বলল, মুর্শেদ মিঞা খুব খারাপ হচ্ছে।
অতীশ বলল, কি, আপনার সব রুটি তো পড়ে থাকল।
মুর্শেদ বলল, সোনাবাবু, আপনি ষষ্ঠিতলা চেনেন?
অতীশ খুব অবাক হয়ে গেল। পৃথিবীর এত জায়গা থাকতে ষষ্ঠিতলা? সে বলল, না।
—ষষ্ঠিতলা চেনেন না!
অতীশের মনে হল, সে খুব অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে বুঝি! সে বুঝতে পারছে না, যে ভাবে তাকিয়ে আছে মুর্শেদ, তাতে মনে হয়, এত অজ্ঞ মানুষ দুনিয়াতে থাকতে আছে! ষষ্ঠিতলা চেনে না। সে বলল, না সাহেব, চিনি না।
—আপনি না বিশ-বাইশ বছরের ওপর কলকাতায় আছেন?
—বিশ-বাইশ বছর ঠিক না, কম।
—তবে ষষ্ঠিতলা চিনবেন না কেন!
অতীশ কি বলবে ভেবে পেল না।
মুর্শেদ বলল, যষ্ঠিতলা, চন্ডিতলা, বাগমারী ওদিকটায় কখনও যাননি?
অতীশ বলল, বাগমারী যাইনি। তবে, নকশাল আন্দোলনে মানুষজন কোতল হয়েছে—ওদিকটাতে। কাগজে পড়েছি।
—আপনাকে আমি নিয়ে যাব।
অতীশের মনে হল সে যেন ষষ্ঠিতলা, চন্ডিতলা; খাল পোল চেনে। চুয়াল্লিশ নম্বর বাসে সে একবার লেকটাউনে যেতে এ-সব দেখেছে। কিন্তু এমন ভাবে বলা যেন, পৃথিবীর সবচেয়ে দামী এবং নামী জায়গা ষষ্ঠিতলা। তা না জানলে, পৃথিবীর আর কিছু জানা যায় না।
মুর্শেদ বলল, রহমান মিঞার কাঠের গোলায় কখনও গেছেন!
অতীশ বলল, না।
—ওখানে রহমান মিঞার কাঠের গোলাতে আমার বাবা কাজ করত, পরে ব্যবসা করত।
—আচ্ছা। আপনি এতদিন থাকলেন কলকাতায়, বলতে পারেন, উল্টোডাঙার ওদিকটায় এই খালের ধারে, দাসপাড়া গেছেন?
—না।
—কিছুই চেনেন না!
—আমি রাজবাড়িতে থাকি। কারখানায় কাজ করি। আমার পৃথিবী বলতে ঐটুকু। বলেই সে যেন হেরে যাচ্ছে, এবং এ-ভাবে ঠিক হেরে গেলে যখন সম্ভ্রম থাকে না, সে বলল, সাহেব এখানে কতদিন।
—তা অনেক দিন।
—সাহেব, গোপের-বাগের ওদিকে কি আছে বলুন।
—দড়িকান্দা।
—তারপর?
—তারপর দামোদরদি?
—তারপর?
—তারপর জানি না।
—অতীশ বলল তারপর বৈদ্যেরবাজার।
—হ্যাঁ, ভুলে গেছি।
—তারপর?
—জানি না।
—অতীশ বলল, তারপর উদ্ধবগঞ্জ।
—তা হবে।
—হাসান পীরের দরগায় গেছেন?
—না।
অতীশ বলল, তবে কি দেখলেন! একবার পাগল জ্যাঠামশাই আমাকে একা ওখানটায় ফেলে এসেছিলেন। মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বলল, যাবার আগে সব ঘুরে যাব। তোমরা সঙ্গে গেলে ভাল লাগবে। তারপর মুর্শেদের দিকে তাকিয়ে বলল, এটাতো আপনার দেশ ছিল, আপনার দেশ অথচ কিছু জানেন না।
মুর্শেদ বলল, জী, আপনি জানেন?
—হ্যাঁ, আপনার চেয়ে আমি ভাল জানি।
—ভাষা।
—কেয়া ফুটকারি কাটল, মুর্শেদ মিঞা তোমার দেশ কোনটা!
—আমার দেশ পাকিস্তান।
—সেখানে তুমি কিন্তু বাঙ্গালী মুজাহিদ।
—না।
—তুমি উর্দুভাষা জান বলে, পাঞ্জাবী।
—পাঞ্জাবীদের আলাদা ভাষা। উর্দু আমাদের শিখতে হয়। উর্দু আসলে তামাম হিন্দুস্তানের বনেদি
—সে জানি! তোমাকে আর এটা শেখাতে হবে না। তবে ঝগড়াটা কি নিয়ে মিঞা?
অতীশ দেখল ঝগড়া করবে কেয়া। মঞ্জু ওদিকে কি করছে। ওদের খাওয়া শেষ। অথচ কথা শেষ হচ্ছে না বলে কেউ উঠছে না। মঞ্জু হয়তো স্নান করতে চলে গেছে। অতীশ বুঝতে পারল, মঞ্জু আজ বার বার স্নান করছে। একটা অসুখে না পড়ে যায়। মঞ্জুর এটা বাড়াবাড়ি, এমনও মনে হয়েছে। শহরের শিক্ষা এবং শহরে বসবাস ছিল বলে মঞ্জুর পক্ষে আধুনিক হওয়া আদৌ কঠিন না। জব্বার চাচা, কেয়াকে নিজের পরিবারে আপন করে নেয়া কঠিন নয়, কিন্তু এই বার বার স্নান, এবং নিরামিষ আহার, কোথায় যেন এক বিপরীত চরিত্রের ভিতর নিয়ে যায় মঞ্জুকে। এটা তার ভাল লাগে না। এ-বয়সে মঞ্জুর এতটা বুড়ো বুড়ো ভাব ভাল লাগে না। সে বলল, এই কেয়া তোমরা আবার ঝগড়া আরম্ভ করলে।
কেয়া চুপ করে গেল তখন। অতীশ বলল, সাহেব আপনি এত সুন্দর বাংলা জানেন কি করে?
—জী, আমার বাড়ি ষষ্ঠিতলা। কলকাতায় আমার ছেলেবেলা কেটেছে।
—ষষ্ঠিতলার মানুষ!
—জী হাঁ।
—আপনি তো বাঙ্গালী!
—জী, ঠিক বাঙ্গালী না। মা বাঙ্গালী, আব্বাজান উত্তর প্রদেশের মানুষ। তাঁর কাছে দুনিয়ার সেরা জায়গা গঙ্গার পাড়ের একটা গ্রাম। আব্বাজান যদি গল্প করেন নাতি-নাতনিদের কাছে, তবে সে গ্রামটার গল্প, আখের চাষের গল্প, কলকাতার গল্প। আর কিছু যেন তাঁর জানা নেই।
অতীশ চুপ করে থাকল। আমরা এই মানুষেরা এমন একটা উপমহাদেশের মানুষেরা কেমন একটা বিশৃঙ্খলার জালে জড়িয়ে গেছি। এর থেকে উদ্ধারের পথ যেন কারো জানা নেই। সে বলল, রাত অনেক হয়েছে। এবার উঠতে হয়। না হলে, মঞ্জু এসে ঠিক ধমক লাগাবে।
মুর্শেদ বলল, কাল সবেরে আবার দেখা হবে।
সবেরে কথাটা অতীশ বুঝতে পারল না।
কেয়া বলল, সকালে।
—হ্যাঁ, তা দেখা হবে।
—আপনার কাছে তখন কলকাতার গল্প শুনব। বলেই কেমন মুর্শেদ চোখ বুজে থাকল কিছুক্ষণ যেন সে এমন একটা দেশে তখন চলে যায়, তার যা কিছু সম্বল, রাজা হবার মতো যা কিছু ছিল, সব সে সেখানে ফেলে এসেছে। সে সেখানে যে-ভাবে থেকেছে, একটা বড় রাস্তা, দু’পাশের দোকানপাট ঈদের সময় চাঁদমালা বিক্রির কথা মনে হয়েছে। অথবা সেইসব দিনে যখন শরতের পাখিরা আকাশে উড়ত, বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে, ঘুড়ি উড়ত হাজারে হাজারে, হাতে থাকত একটা লম্বা বাঁশের কঞ্চি, সে ছুটত, কঞ্চির ডগায় দুলত ডালপালা, একটা ঘুড়ি তার সুতো, আর সে—তখন তার কাছে অন্য দুনিয়া বলে কিছু থাকত না। সে আর ষষ্ঠিতলা, ষষ্ঠিতলার মাঠ, গাছপালা, কাঠের গোলা, নতুন নতুন ইমারতের গন্ধে বুঝতে পারত না, দুনিয়াতে এর চেয়ে কোন সুন্দর সুদৃশ্য জায়গা থাকতে পারে। সে সেখানে গিয়ে দুদন্ড থাকতে পারে।
মুর্শেদকে চোখ বুজে থাকতে দেখে কেয়া অতীশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। বলল, সব ওর ঢং। ওর তো সব জানেন না। মঞ্জুদি যে কি পেয়েছে ওর ভেতর, বলেই সে দেখল মঞ্জুদি আসছে। শুনে ফেলল কি না কে জানে। কেয়া জিভ কেটে বসে পড়ল। যেন সে কিছু বলেনি। সব এঁটোকাটা তুলছে থালাতে। সে সব সাফ করছে। থালাবাসন একসঙ্গে সব তুলে নিয়ে যাচ্ছে। খুব ব্যস্ত। আজেবাজে কথা বলার সময় তার নেই।
মঞ্জু স্নান করে এসেছে। ওর চুল ভিজা, এই রাতে স্নান, চুল ভিজা, কেমন মনে হল ওরা মঞ্জুকে টর্চার করছে সবাই। অতীশ বলল, এমন করলে কাল আমরা সকালেই রওনা হব মঞ্জু। তুমি যে- ভাবে শরীরের উপর অত্যাচার করছ, নির্ঘাত অসুখে পড়বে।
মঞ্জু মুর্শেদের দিকে তাকিয়ে হাসল। এত বিষণ্ণ হাসি পৃথিবীতে কেউ কখনও হেসেছে তার জানা নেই। অতীশ আর একটা কথাও বলতে পারল না। সে বাইরে বের হয়ে দেখল, তেমনি জ্যোৎস্না গাছপালায় আর জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে মনে হল, ঠিক সেই ফ্রকপরা মেয়েটি ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। সাদা জ্যোৎস্নায় ওর চুল নীল রঙের দেখাচ্ছে এবং এ-ভাবে কোনও বনভূমির ভেতরে সাদা জ্যোৎস্নায় সাদা ফ্রক গায়ে ঘোড়ায় কেউ চড়ে গেলে রহস্যময় এক পৃথিবী তৈরী হয়ে যায়। তার এক নির্জন দ্বীপের কথা মনে হয়। নারীর কথা মনে হয়। অবিরাম সমুদ্রের গর্জন কানে ভেসে আসে। অতীশ চুপচাপ সেখানে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে ভালবাসে। সে মঞ্জুকে শুনিয়ে বলল, কেয়া আমার জন্য কিন্তু জল ঘরে রেখ।
মঞ্জু বলল, কেয়া তুই মুর্শেদের মশারি ফেলে দিয়ে আয়। জল রেখে আয়। তারপর শুয়ে পড়। সোনাবাবুর ঘরে শোবার আগে আমি জল রেখে দেব।