2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৬০

॥ ষাট ॥

—তোমার হাত ধরলে আমার কোলে দ্যাও।

—হাত ধরবে কেন। আমি বেশ নিয়ে হাঁটতে পারছি। বলে মিনু বাচ্চাটাকে কাঁধে ফেলে নিল।

—তুমি কেবল পিছনে পড়ে যাচ্ছ।

—না, এবার ঠিক হাঁটব। দ্যাখো তোমাদের সঙ্গে কেমন হেঁটে যাচ্ছি।

আবুল বলল, মা তুমি আমার সঙ্গেও হেঁটে পারছ না।

মিনুর যেন বলার ইচ্ছা, না পারছি না বাবা, তোর সঙ্গে আমি কি করে পারি? বলে এক হাতে ছেলের চুলে বিলি কেটে আদর করল। বয়স অনুযায়ী আবুল লম্বা। শরীর এবং মুখ আন্দাজে চোখ বড়। এবং গায়ে মাংস কম বলে মুখটা সব সময় ঢল ঢল করছে। চুলগুলি বড় এবং কাঁধে এসে পড়েছে। গত ক’মাস থেকেই সবাই সংসারের প্রতি কেমন উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এটাকে উদাসীনতা বলে না। চোখ-মুখে গাম্ভীর্য, কি হবে কি হবে ভাব। আওয়ামী লীগের হয়ে সমসের কাজ করেছে। ছ’দফা দাবির জন্য সে রাত জেগে পোস্টার লিখেছে। ছ’দফা দাবি না মানলে বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য। আমরা শেষবার চেষ্টা করব অন্তত লাহোর রেজুলেসনকে সম্মান জানাতে। তারপর থেকেই মানুষটা নাওয়া-খাওয়ার কথা ভুলে গেল। সময়ই পেত না। এবং সংসারে কি হচ্ছে দেখত না। মিনু ও অন্যমনস্ক ছিল এ-সব ব্যাপারে। আবুলের চুল যে বড় হয়ে গেছে এবং চুল না কাটায় ওর মুখশ্রী যে আরও সুন্দর হয়েছে সেটা যেন আজ সকালে বের হবার আগে ধরতে পেরে অবাক হয়ে গেল মিনু। সে ডেকেছিল, আবুল আয়।

আবুল কছে এসে বলেছিল, আমাকে ডাকছ মা?

কাছে এলে ছেলের দিকে খুব নিবিষ্টভাবে তাকিয়েছিল মিনু। সে এখন আর কাঁদে না। মা বাবা এবং কিছু আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় নিহত হওয়ার খবর পাবার পর থেকেই সে কেমন কঠিন এবং স্থির ধীর। সে আবুলকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে মাথার উপর মুখ রেখে বলেছিল, আবুল তোর খুব কষ্ট হবে।

—কিসের কষ্ট মা?

—আমাদের ধরে নিয়ে গেলে তোর কষ্ট হবে।

আবুল বুঝতে না পেরে বলেছিল, কারা তোমাদের ধরবে?

সমসের পাশের ঘর থেকে শুনতে পেয়েছিল সব। যা খবর আসছে তাতে সে জেনেছে ওদের অঞ্চলেও মিলিটারি অপারেশন হবে। এবং যারাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত, তাদের হয় হত্যা করা হবে, না হয় ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। সমসের চায় না ছেলে তার ভীত হয়ে পড়ুক। সে ছেলেকে নানাভাবে সাহসী হতে শিক্ষা দিচ্ছিল। কিভাবে পিস্তল ব্যবহার করতে হয় তাও শিখিয়েছে। সে ঘরে ঢুকে চোখ টিপে দিয়েছিল। মিনু আর কিছু বলতে পারে নি। কারণ সবই উড়ো খবর। কেউ কোনও সঠিক খবর দিতে পারছে না। কত রকমের গুজব যে ক’দিন থেকে উড়ছিল!

তারপর মিনু জানালায় দাঁড়িয়েছিল ছেলের মাথায় হাত রেখে। কি নরম আর মসৃণ চুল আবুলের। কি ঘন আর কালো। চুলে ভারি সুন্দর তেলের গন্ধটা। ওরা সবাই তেলটা ব্যবহার করে। অথচ আবুলের মাথায় তেলের গন্ধটা যেন আলাদা। যেন আবুল তার সুন্দর নরম শরীর এবং চোখ-মুখ নিয়ে, তেলের গন্ধ নিয়ে, আলাদা মানুষ। সে কতবার কত রাতে সমসেরকে বুকের কাছে টেনে নিলে তেলের গন্ধটা পেত। সমসেরের চুল ছোট করে ছাঁটার স্বভাব। ওর মাথায় যে গন্ধটা পায়, আবুলের মাথায় তেমন গন্ধ থাকে না, আবুলের মাথার তেলের গন্ধ কেমন আশ্চর্য এক নদীর জলে ছোট ছোট কলমিলতার ঘ্রাণের মত। সে আবুলকে কিছুতেই তখন কাছছাড়া করতে পারে না। কেবল মাথায় হাত রেখে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

অথবা রাতে সমসের ফিরলে মিনু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখত নিজের মুখ। চোখে সুমা টানা এবং কপালে কাঁচপোকার টিপ। নরম পাতলা সিল্কের শাড়ী পড়ে থাকলে সমসের ভীষণভাবে মিনুকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ভালবাসে। ছেলেটা ও-ঘরে পড়ছে। একটা পর্দা এবং নীল রঙের পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে মিনু সারা সন্ধ্যাটা খাটে পা তুলে কোন সময় নজরুল আবার কখনও জীবনানন্দ পড়তে পড়তে —: রূপসী বাংলা পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে যায়। এবং মুখ তুলে তাকালেই সে সহসা দেখতে পায় সমসের এসে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

—তুমি কখন এলে?

—অনেকক্ষণ।

—তুমি আচ্ছা মানুষ। চুপচাপ চোরের মত দাঁড়িয়ে আছ।

—চোরের মত কোথায় দাঁড়ালাম!

—দাঁড়ালে না। ভয় পেয়ে চিৎকার চেঁচামিচি করলে খুব ভাল হত!

—বারে আমি যে তোমার আবৃত্তি শুনলাম। শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।

—তাই বুঝি?

—সত্যি।

—আমাকে খুব গ্যাস দেওয়া হচ্ছে সাহেবের।

—না, গ্যাস না মিনু। তোমাকে কতবার আর বলব, তোমার চোখ দেখলেই আমি বাংলাদেশের মানেটা বুঝতে পারি।

মিনু কোনও কথা বলতে পারত না তখন। উঠে বসত। আলনা থেকে বাড়িতে পরার লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবী বের করে দিত। কাছে এলেই দু’হাতে জাপ্টে ধরার স্বভাব মানুষটার। কোনও কোনও দিন দূর থেকে মিনু ছুঁড়ে দিত, কারণ মানুষটা ওর এই শরীরের জন্য পাগল, এবং কাছে গেলেই জড়িয়ে ধরবে, একাকার করে ফেলবে, পাশের ঘরে যে ছেলেটা আছে, পড়ছে, এবং যে কোনও সময় ছুটে আসতে পারে—সে এসব আদৌ ভাববে না। একেবারে ছেলেমানুষের মত চুমু খাবার জন্য কেবল আবদার করবে। এই মিনু এদিকে এস না। এই কি রে! কি হচ্ছে!

মিনুর হাঁটতে হাঁটতে ছোট ছোট ছবি চোখে ভাসছিল। ছোট ছোট ছবির ভিতর একটা মানুষকে কত সুন্দর ভাবে চেনা যায়। এবং এই মানুষই ভোটের দিনগুলিতে একবিন্দু সময় পেত না। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল। সাইকেলে কামাল সাহেবের সঙ্গে দূরে দূরে চলে গেছে। ফিরতে রাত হয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত মিনু জেগে রয়েছে জানালায়। ছেলেটা পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। শীতের দিন বলে সে-ঘরের জানালা বন্ধ করে রাখত। হালকা ঠাণ্ডায় সে একটা র‍্যাপার গায়ে জানালা খুলে অপেক্ষা করত, মিশনারি স্কুলের পথে ওর ক্রিং ক্রিং বেল কখন বাজবে। সে সেই শব্দে ধরতে পারত, সমসের ফিরছে। সদর দিয়ে ঢুকে সাইকেলটা টিনের চালাটায় রেখে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকত। ঢুকেই হাত দুটো লেপ্টে দিত মিনুর গালে।—কি ঠান্ডা দ্যাখো।

মিনু বলত, গরম পানিতে হাত-পা ধুয়ে নাও।

সমসের নড়ত না। সে দুহাত মিনুর র‍্যাপারের নিচে হাত রেখে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা হাত দুটো গরম করতে চাইত। মানুষটার এতটুকু দুষ্টুমি করার ইচ্ছা হত না। চুপচাপ হাত দুটো র‍্যাপারের নীচে। মিনু নড়ত না। ওর হাত গরম হবে না ঠিক মত, অথবা এই সামান্য সুখ সুখ খেলা ওর ভাল লাগত। শীতে মানুষটার মুখ ফ্যাকাশে। হাত-পা ধুয়ে যত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে তত সে শীত থেকে রক্ষা পাবে, অথচ মানুষটার স্বভাব, এই শীতে দাঁড়িয়ে থেকে একটু যেন কাছাকাছি থাকা। যতটুকু সময় এভাবে দাঁড়িয়ে জানালার আকাশটা দেখা যায়।

যত হাঁটছিল, যত গ্রাম ভেঙে মাঠে, মাঠ ভেঙে গ্রামে উঠে যাচ্ছিল তত মানুষটার সব রকমের ছবি চোখে ভাসছে। ওর হাতে অথবা কাঁধে বাচ্চাটা আছে, তাকে সে দিয়ে গেল, কোন নিরাপদ জায়গায় ওকে পৌঁছে দিতে হবে। হেঁটে যাবার সময় সেজন্য সে কোনও ক্লেশ অনুভব করছে না। পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। খালি পায়ে হাঁটতে হচ্ছে। চাষ করা জমি, জমিতে বড় বড় মাটির ঢেলা, খুব দ্রুত হাঁটলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পারে।

আমিনুলও দ্রুত হাঁটতে পারছে না। দ্রুত হাঁটতে না পারলে ক্রোশখানেক আর যে পথ আছে এবং সে পথে গিয়ে দাঁড়াতে না পারলে দেরী হয়ে যাবে। সে এবার কাছে গিয়ে বলল, ভাবি আমার কোলে দ্যান।

—তুমি আবার কষ্ট করবে?

—কষ্টের কি দেখলেন?

—বেশ তো ঘুমাচ্ছে। সকাল হলে ও টের পাবে আমরা ওর কেউ নই।

—কে বলেছে আমরা ওর কেউ নই? আমরা কেউ না হলে এমনভাবে কেউ নিয়ে আসে। বস্তুত এইটুকুতেই যেন কোথায় একটা মায়া ধরে গেছে। টর্চের আলোতে সে দেখেছে ছোট একটা মেয়ে, হামাগুড়ি দিতে পারে, উঠে দাঁড়াতে পারে—মুখ একফোঁটা শিশিরের মত, ভোরের বেলা ঘাসের উপর শিশির বিন্দুটি যেন! সে বুকের কাছে রেখেছে সারাক্ষণ। বুকের কাছে রাখলে কেমন মায়া বেড়ে যায়। প্রাণের কাছে অথবা হৃদয়ের এত কাছাকাছি থাকলে বোধ হয় মায়া বেড়ে যায়। আমিনুল এখনও এটা টের পাচ্ছে না। একবার বুকের কাছে তুলে নিলেই টের পাবে। এই ভেবে সে যেন ভাবল ওর জন্য সবার ভালবাসা এখন দরকার। সে এটুকু ভেবে আম্বুিলের হাতে দেবার সময় দেখল জেগে যাচ্ছে। হাত-পা তুলে ঘুম ভাঙার মত টান দিতেই সে তাড়াতাড়ি আমিনুলের কাঁধে থাবড়ে দিতে থাকল।

আমিনুল বলল, এ-সব গ্রামগুলি সব জয় বাংলার। এখানে কারো বাড়িতে ঢুকে রেখে দিলে হয় না?

—এমন কথা তো নেই। এখানে তাকে রেখে যাবার তো কথা নয়। সমসের যে অন্য কথা বলে গেলেন।

যেন কথা মত ওকে পৌঁছে দিতে না পারলে সমসেরকে অপমান করা হবে। এখানে রেখে গেলে সমসের অখুশী হতে পারে। আর এখন কেন জানি ওকে সে কোথাও রেখেও যেতে পারবে না। কপালে যা আছে হবে। সবার অদৃষ্টের সঙ্গে এই ছোট্ট মেয়েটির অদৃষ্টও বাঁধা আছে এমন সে ভাবল। এবং মিনু আরও যা ভাবল, মেয়েটি বেঁচে গেছে। ওর বাঁচা অদৃষ্ট। কেউ ওকে হয়তো মারতে পারবে না, এটা একটা শুভ ব্যাপার বলেই তার মনে হল।

আমিনুল বলল, আমরা আইসা পড়ছি। বড় অর্জুন গাছটা দ্যাখা যাইতেছে।

আবুল বলল, কোন দিকে চাচা?

—ঐ যে দ্যাখা যায় না একটা লম্বা গাছ আসমানের দিকে উইঠা গ্যাছে। দূরে জ্যোৎস্নায় আবছা মতো।

আবুল দেখল, সত্যি একটা বড় লম্বা গাছ আসমানের দিকে উঠে গেছে। এবং তার উপর অদ্ভুত এক সবুজ নক্ষত্র জ্বলছে।

মিনু তার পুত্রকে আশ্চর্য খবরটা না দিয়ে পারল না। জানো, আমাদের সোনাবাবু গাছটায় লিখে রেখে গেছে। জ্যাঠামশাই আমরা হিন্দুস্তানে চলিয়া গিয়াছি।—ইতি সোনা।

ও রাস্তায় গেলে দেখাতে পারতাম। আমরা যাচ্ছি অন্য রাস্তায়। আবুলের তখনই ঘ্যান ঘ্যান শুরু হয়ে গেল—সোনাবাবু কে? সোনাবাবু চলে গেল কেন? গাছে লিখে রেখে গেল কেন? চলিয়া গিয়াছি।

আবুল মা-র পাশে পাশে হাঁটছে। দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছে। সে কিছুতেই পেছনে পড়ে থাকবে না। সবার আগে সে যেতে চাইছে। যেতে যেতে মিনু বলল, আমি তার কি জানি। মানুষটা বেইমান- মঞ্জুদির কথা না হলে ভুলে যায়! সোনাবাবুর সঙ্গে দেখা হলে তাকে জিজ্ঞেস করো।

গাছটার নিচে মনে হল দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমিনুলই এটা প্রথম লক্ষ্য করল। এটা ভৈরবতলা ঘাট। আর কিছু দূরে ললিত সাধুর আশ্রম। এবং মাঝখানে লক্ষ্মণ সাধুর মঠ। দুটো টিনের ঘরের ফাঁকে ওরা। গঞ্জের মতো জায়গা। চালাঘরটা পার হলেই ছোট্ট একটা মসজিদ। মসজিদের গম্বুজে লাল-নীল পাথর। অন্ধকারে পাথরগুলো চকচক করছে। মসজিদের ডান দিকে পুরনো পাঁচিল। আমিনুল মিনুভাবির হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল। আবুলের পথ আগলে ফিসফিস গলায় বলল, বইসা পড়েন। মাঠে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।

ওরা তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে বসে পড়ল। একেবারে পাঁচিল ঘেঁষে। এখানে খুব জোর একজন মানুষ থাকবার কথা। অবনী আগে চলে এসে তাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কিন্তু দুজনের দাঁড়িয়ে থাকার কোন হেতু খুঁজে পেল না। পিছনে শত্রুর চর লাগতে পারে। সে ধীরে ধীরে পাঁচিলের ওপাশ থেকে মাথা তুলে দেখতে থাকল। ওরা মাঠে দাঁড়িয়ে বিড়ি অথবা সিগারেট খাচ্ছে। অন্ধকারে সিগারেটের আগুনটা জ্বলছে। এবং অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি। সে যে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। যদিও সেই এখন কমান্ডের অধিকারী, তবু কেন জানি মিনুভাবীকে তার খুব বুদ্ধিমতী মনে হয় এবং ওর পরামর্শ মত কাজ করতে পারলে অযথা রিস্ক নেওয়ার দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়।

সে আস্তে ডাকল, ভাবী।

—বল।

—কি করবেন?

—এগিয়ে গেলে হয় না?

—কিন্তু

—যদি ওরা আমাদের লোক হয়?

—আমাদের লোক তো থাকার কথা না এ-ভাবে।

—কে কোথায় থাকবে আমরা তো সব জানি না।

আমিনুল কিছুক্ষণ কি ভাবল। তারপর আরও কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, আমরা যে এখানে আইসা অপেক্ষা করমু সেটা তো জানার কথা না। কেউ জানবে না। খাড়ির মুখে সব ঠিক হইল।

মিনুর মুখটা এবার অন্ধকারেই কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এবং এতক্ষণে তার মনে হল, একমাত্র অবনীবাবু সে এবং আমিনুল জানে ওরা ভৈরবতলা ঘাট এসে অপেক্ষা করবে। আর কেউ জানে না। তবে এরা কারা?

আমিনুল ঘাবড়ে গেল। সে বলল, আপনেরা বসেন। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কোনওখানে যাইবেন না।

আমিনুল এই বলে পাঁচিলের পাশ থেকেই হামাগুড়ি দিতে থাকল। ওকে পুবদিকে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে। সে উঠে দাঁড়ালেই পাঁচিলের উপর ওর বুক-মাথা দেখা যাবে। চারপাশটা লক্ষ্য করে যাওয়া ভাল। সে পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে নিল। এবং পিছন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। এখন একজন আবার একটু সরে দাঁড়াল। ওকে কি ওরা দেখতে পেয়েছে। আমিনুল একেবারে ঘাসের ভিতর ডুবে থাকার মতো মাটির সঙ্গে মিশে আছে। কচ্ছপের মত মাঝে মাঝে গলা তুলে দেখছে। তারপর আবার দুলাফে কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। যে মানুষটা সরে দাঁড়িয়েছিল সে এখন গাছে হেলান দিয়ে গুনগুন করে কি একটা গান গাইছে। আমিনুল কান পেতে গানটা শোনার চেষ্টা করল। কিছুই বুঝতে পারছে না। হাওয়ায় গানটা ওকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এবং মনে হচ্ছে অনেকদূর থেকে কে যেন গাইছে। সুর তাল লয় খুব অস্পষ্ট। সে তবু যেন গানের সুরে বাংলাদেশের কথা খুঁজে পেল। এবং মনে হল দুটো সাইকেল গাছের কান্ডে আড়াআড়ি করে রাখা। এবং আরও কাছে গেলে সে দেখল ওদের কাঁধে রাইফেল। সে পিছনে, গাছের এ-পাশে, ওরা সামনে, গাছের অন্য পাশে। সে তবু লাফ দিয়ে উঠে রিভলবারের পয়েন্টে বলল, সজনে ফুল।

ওরা বলল, সজনে ফুল। তিন নম্বর কুটির।

আমিনুল বলল, সজনে ফুল, তিন নম্বর কুটির, তালপাতার পাখা

তারপর ওরা গলা জড়িয়ে তিনজন মিলে আলিঙ্গন করল। আমিনুল বলল, আমার নাম আমিনুল।

—আমার নাম আবেদালি।

—আমি ফিরোজ।

ওরা বলল, ভাবী কোথায়?

—আসেন আমার লগে।

আবেদালি বলল, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। খুব বিপদ।

আমিনুল কেমন সহসা পিছন ফিরে তাকাল। অন্ধকারে ওর চোখ দুটো চক চক করছে।

—অবনী নৌকায় পড়ে। ওর বাঁ কাঁধে গুলি লেগেছে। মেহের পাহারায় আছে।

আমিনুল ছুটে ভাবীকে এসে বলল, খুব বিপদ ভাবী। তাড়াতাড়ি আসেন। ওরা আমাগ লোক। ভয় নাই। সমসের ভাই অগ পাঠাইয়া দিছে। মেহের নৌকা পাহারা দিতাছে।

ওরা কারা সে জানার আর কোন উৎসাহ থাকল না। অবনীর বাঁ কাঁধে গুলি লেগেছে। সে কোথায়? আবুলের হাত ধরে, মেয়েটাকে কাঁধে ফেলে, ওদের সঙ্গে নদীর চর ভেঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকল। এখন কোনও প্রশ্ন করতে পারছে না। মিনুর মনেও নানা ধন্দ। ওদের সঙ্গে অবনীর কি ভাবে দেখা? অবনী কোথায়? ওরা কিভাবে জানল, তারা এখানে আছে? মেহের যদি পাহারায় থাকে, মেহেরের নাম সে আগেও শুনেছে। মেহের, ই, পি, আর-এর লোক। সে এক নম্বর মার্কসম্যান। এবং যারা যারা সময় মত স্বাধীনতা ঘোষণা হলে রাইফেল নিয়ে ফ্রন্টে যাবে কথা ছিল, সে জানে মেহের তাদের একজন। সেই মেহের আছে অবনীর পাশে।

মিনুর চোখদুটো নানা কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে। এবং বাচ্চাটাকে আমিনুলের কোলে দিয়ে দিয়েছে। সবার সঙ্গে দ্রুত ছোটার জন্য কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে নিয়েছিল। সে যে কারুর চেয়ে কম ছুটতে পারে না, এখন সেটা ওর ছুটে যাওয়া দেখে বোঝা যায়। প্রায়, দূরে ঠিক ললিত সাধুর আশ্রমের পাশে একটা আমগাছের নিচে নৌকাটা! ওরা বুঝতে পারল, নৌকার পাটাতনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে সে মেহের। ওর হাতে রাইফেল। এবং অন্ধকারেও বেয়নেট চক্‌চক্‌ করছে।

মিনু পানি ভেঙে নৌকায় উঠে গেল। ওর শাড়ি ভিজে গেছে। পায়ে পানি-কাদা। আর বাকি যারা ছিল তারাও লাফ মেরে উঠে গেছে। অবনী চিৎ হয়ে পড়ে আছে। টর্চ জ্বেলে মিনু দেখল চুল এবং ঘাড়ের নিচে জবজবে রক্ত। পাটাতনটা রক্তে ভেসে গেছে। আমিনুল নৌকা ভাসিয়ে দিল। যে সব হিজলের ডাল ছিল সেই সব ডাল অবনী আহত অবস্থায় ফেলে দিয়ে নৌকা হাল্কা করে নিয়েছিল। সে প্রায় চলে এসেছিল। সে বলল, ভাবি আর ইটুর লাইগা—। বলেই তার গলা থেকে একটা কষ্টকর আওয়াজ ফুটে বের হচ্ছে। কথাটা সে প্রকাশ করতে পারছে না। মিনুভাবির দিকে সে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।

মিনু পুঁটলি থেকে কাপড় বের করে ঘাড়ের কাছে যে চাপ চাপ রক্ত তা মুছে দিচ্ছে। মেহের ছইয়ে হেলান দিয়ে আছে। মেহের বলল, নৌকা থেকে পালাতে চাইছে ও। বলছে, ও থাকলে আমরা বিপদে পড়ে যাব। ধরা পড়ে যাব। অবনী কথা বলতে পারছে না। ওর কষ্ট হচ্ছে খুব। সে দাঁতে দাঁত চেপে কোনরকমে কষ্টটা দমন করতে চাইছে। মঞ্জু তার অপেক্ষায় সজনে গাছের নিচে যেন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে মঞ্জুর কাছে যেতেই হবে।

মিনু উবু হয়ে খুবই আস্তে বলল, আপনি কিছু বলবেন! আপনাকে পাশ ফিরিয়ে দিচ্ছি।

ওর যা কিছু সম্বল, এই যেমন ব্যাণ্ডেজ তুলো সবই পুঁটলির ভিতর রাখা আছে, তালপাতার পাখার মতই এক অদৃশ্য স্থান থেকে খুলে, সব মুছে একটা ব্যাণ্ডেজের মত করে দিল মিনু। তারপর ওকে ধরাধরি করে ছইয়ের ভিতর নিয়ে গেল। এখানে কোনও ভয় নেই। নদীর জল এখানে তত কম নয়। কচুরিপানার ভিড় নেই তেমন। শুধু মাঝে মাঝে নদীর জলে বড় বড় নাও ভেসে গেলে ওরা চুপচাপ থাকছে। এবং ওরা এবার আর একটা চৌকি, চৌকিটা পার হয়ে যেতে পারলেই মোটামুটি নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাবে। এবং হাসিমের বাড়ি, আর ওদের চারটা টিনকাঠের ঘর, ঘরের মেঝেতে সব রাখা হবে। অথবা বাড়ির পাশে কোনও গোপন জায়গায় সব লুকিয়ে ফেলা হবে। অবনীকে শুইয়ে দেওয়ার সময় মিনু কত কিছু যে ভাবছে।

আবুলের কথায় তারা সাড়াও দিচ্ছে না। রাগ হয় না! কী হয়েছে বলবেতো! তখনই মা বলল, কিছু হয় নি, তুমি এখন যাওতো এতেই সে দমে গিয়েছিল। ওর কেবল এখন আব্বার মুখটা চোখে ভাসছে। আব্বার জ্বর। আব্বা এখন কেমন আছে? সে অবনীর শিয়রে বসে মাকে বলল, মা আব্বা কেমন আছে?

মিনু কিছু না জেনেই বলল, ভাল আছে। মনটা কেমন খচ করে উঠলে সে আবেদালিকে বলল, কেমন আছে ও? আবেদালি এখন নৌকা বাইছে বলে মিনুভাবী কি বলছে শুনতে পাচ্ছে না। সে বলল, ভাবি আমাকে কিছু বললেন?

—ওর শরীরে জ্বর ছিল। আসার সময় ওকে কেমন দেখে এলেন?

—ভাল। জ্বর নেই মনে হল, থাকলেও বলতে পারব না।

মিনু এই শুনে কি ভাবল, তারপর বলল—আপনারা টের পেলেন কি করে আমরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি।

—পথটা তো আমাদের জানা। কোন পথে আপনারা আলিপুরার দিকে যাচ্ছেন সে তো সমসের ভাই বলেই দিয়েছে। কিন্তু অবাক, সাইকেলে এসে দেখছি সেই ঘাসি নাওটা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। খাড়ির মুখে যাওয়া যায় না। দূরে দাঁড়িয়ে নদীর পাড়ে দেখলাম শুধু সার্চলাইট ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছে। আমরা মোগরাপাড়ার পথ ধরে সোজা নদীর পাড়ে পাড়ে টর্চ মেরে যাচ্ছি। খাড়ির মুখে সমসের ভাই যেতে বারণ করে দিয়েছে। পারে উঠে গেলে সব দেখা যাবে। কিন্তু না নৌকা, না কোনও মানুষজন। কেবল দেখছি নদীর জলে একটা ঝোপ ভেসে ভেসে চলে আসছে। খুব অবাক লাগল। টর্চ মেরে ঝোপটা দেখলাম।

লগি থেকে জল পড়ছে বলে জামা ভিজে যাচ্ছে, সে জামাটা খুলে ফেলল। এবং ঢিল মেরে ছইয়ের উপর জামাটা ফেলে রাখল, তারপর আবেদালি বলল –কি ব্যাপার ঝোপ- জঙ্গল ভেসে যায়। তারপরই দেখি একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের টর্চ যারা দেখে ঝোপের ভিতর সে লুকিয়ে পড়ল। কি করি আর। আমরা নদীর পাড়ে পাড়ে ঝোপটার সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল মেরে চললাম। বাতাসে এবং স্রোতে নৌকা ভেসে যাচ্ছে। বুঝব কি করে! বেশ লাগছিল ব্যাপারটা। এবং অন্ধকারেই মনে হল, আবার সেই মানুষ দাঁড়িয়ে হিজলের ডাল, শেওড়ার ডাল পাতা এবং ঘাস যা কিছু ছিল ঝোপের মত, টেনে টেনে ফেলে দিচ্ছে। এবং আমরা তখন হাঁকলাম, সজনে ফুল।

খুব ক্ষীণ গলায় আওয়াজ, সজনে ফুল, তিন নম্বর কুটির।

আমরা বললাম, সজনে ফুল তিন নম্বর কুটির, তালপাতার পাখা।

সে চিৎকার করে উঠল, জয়-বাংলা। আমি অবনী, তোমরা কে আছ, নৌকায় উঠে এস। আমি

আর দাঁড়াতে পারছি না।

মেহের বলল, সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল ফেলে জলে ঝাঁপ। আমি নৌকায় উঠে গেলাম। নৌকা পাড়ে নিয়ে গেলাম। সাইকেল তুলে নিলাম।

—তারপর? আবুল বড় আগ্রহে শুনছে।

ফিরোজ বলল, তারপর নৌকা ললিত সাধুর আশ্রমের পাশে রেখে অবনীর কথা মত তোমাদের খুঁজতে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

ওরা আর কি বলবে, অবনী জানে সব। এখন পাশ ফিরে শুয়ে আছে সে। রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। ব্যাণ্ডেজ ভিজে গেছে। কিন্তু সে শুনতে পাচ্ছে সেই ডাকটা ক্রমে বড় কাছে এগিয়ে আসছে। নীলু, ডাকছে, বাবা আমি যাব, তুমি আমাদের ছেড়ে কোথায় যাচ্ছ! ওদের কথা অথবা নদীর জলে ঢেউ এবং তার শব্দ কিছুই এখন তার কানে আসছে না। সে ক্রমান্বয়ে সেই শব্দের ভিতর হারিয়ে যাচ্ছে—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *