ঈশ্বরের ডাইরি – ২

ঈশ্বরের ডাইরি – ২

এবার আমার লাঞ্চ টাইম! ঈশ্বর এখন লাঞ্চ করবে। মানে আমি লাঞ্চ করব। এটা আমার লেখা গল্প। তাই আমি যেখানে চাইব সেখানে লাঞ্চ টাইম হবে। না পোষালে, নিজেরা নিজেদের গল্প লিখে নাও! এখন আমি প্লাস্টিকের প্যাকেটটা খুলে হাইরাইজের মতো গজা, স্টেডিয়ামের মতো কচুরি, লেকের মতো পাতলা ছোলার ডাল আর ছোট ছোট মানুষের মতো বোঁদে খেয়ে লাঞ্চ করব। ততক্ষণে তোমরাও নিজেদের কাজ, অকাজ, পিং, প্রোফাইল হপিং, লাইক কমেন্ট, ট্যাগ শেয়ার ইত্যাদি সমস্ত বৈপ্লবিক কাজকম্ম সেরে নাও। ঈশ্বরের খাবার সময়ে তাকে বিরক্ত করতে নেই! আমায় বিরক্ত করতে নেই! আমি খাই, এই শহরকে খাই। এই শহরের কিছু মানুষজনকে বেছে বেছে খাই। আর বাকিদের অবাক হয়ে দেখি! দেখি সবাই এই সময়ে চলে ফিরে বেড়ালেও আসলে তারা এই সময়ে বেঁচে নেই কেউ। তারা বেঁচে আছে অতীতে। তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে অতীতের কোনও এক ভূত! আমি যেন তাদের সবার গলায় পুরনো বৃদ্ধ নাবিকের মতো মৃত অ্যালবেট্রস পাখিটিকে দেখতে পাই। এই যেমন, আমায় যে লম্বা লোকটা এই মাত্র খাবার দিয়ে গেল, আমি সেই লোকটার গলাতেও অ্যালবেট্রস পাখিটাকে দেখতে পেলাম! ওই দূরে দাঁড়িয়ে যে মেয়েটা অবাক হয়ে একটা অটোর দিকে তাকিয়ে আছে, তার গলাতেও দেখতে পেলাম অদৃশ্য অ্যালবেট্রস ঝুলে আছে! কিংবা ওই যে দোহারা চেহারার ছেলেটা অটোর থেকে নেমে ভাড়া মেটাচ্ছে তার গলাতেও ঝুলছে ওই অ্যালবেট্রস! সবাই অতীতে আটকে পড়ে আছে! সবাই যেন দিকভ্রান্ত, ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত! জল, চারিদিকে জল তবু তাদের পান করার মতো জল যেন নেই কোথাও! শুধু মানুষের রক্ত আছে! তাদের শিরায় স্ট্র ডুবিয়ে টেনে নেওয়ার মতো জন্তু জানোয়ার আছে! ক্ষমতার পায়ে উপুড় হয়ে পড়া হাইড্রেনের পোকা আছে! তবু কেন কে জানে, আমার বিশ্বাস একদিন সেই পাখি আসবে। অন্ধ বোষ্টম দাদুর পতাকা দেখে, আমাদের খুঁজে খুঁজে আসবে ঠিক! আমাদের নিজেদের মধ্যে থেকেই জাগিয়ে তুলবে সমস্ত মৃত অ্যালবেট্রসকে। আর তারপর সে আমাদের পৌঁছে দেবে একটা সকালবেলার দ্বীপে! কিন্তু যতক্ষণ না তা হচ্ছে, ততক্ষণ আমায় খেতে দাও তো বাপু! ফালতু ঝামেলা কোরো না! বেকার ভাট বোকো না! তার চেয়ে নেমে পড়ো গল্পে। এই শহরের আরেক দিকে এই গল্পের আরেকটা সুতোয় কী হচ্ছে সেদিকে চোখ দাও! দেখা যাক তার গলাতে ঝুলে থাকা মৃত পাখিটা প্রাণ পেয়ে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে কিনা ডাঙার কাছে!

১১ নিরমুক্তা

সিগনালে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়িটা। সামনে কাউন্টার চলছে। একশো পঞ্চাশ সেকেন্ড! বাপ রে! এতক্ষণ! ছোটবেলা থেকেই সিগনালে, স্টেশানে, লাইনে অপেক্ষা করতে গেলেই বিরক্তি লাগে মুকুর। অন্য সময়ে কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু এইসব জায়গায় অপেক্ষা করতে হলেই কেমন যেন ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ওর! মনের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা সমস্ত চঞ্চল হরিণ জেগে ওঠে এক সঙ্গে! মনে হয় কত কাজ আটকে আছে। কত কাজ এখনও বাকি! কতজন অপেক্ষা করে আছে! মনে হয়, কত কত সময় নষ্ট হয়ে গেল জীবনের থেকে! ওর এমন বিরক্তি দেখে তিজু ওকে রাগাত খুব।

বলত, ‘তোর এই স্বভাবটা আর গেল না! এদিকে বিছানা থেকে উঠবি সকাল এগারোটায়! আর রাস্তায় বেরিয়ে সব কাজ এক্ষুনি করে ফেলতে হবে! পাগলি তুই!’

‘পাগলিই তো! বেশ করব পাগলি হব!’ রাগ করত মুকু। এই একজনের ওপরই কারণ ছাড়া, মাত্রা-ছাড়া রাগ করত ও! বলত, ‘পাগলি যখন, তখন কেন আমায় বিয়ে করতে চাস? করতে হবে না বিয়ে!’

তিজু হাসত। সামান্য লম্বা কোঁকড়া চুলগুলোয় আঙুল চালিয়ে বলত, ‘সমাজসেবা করছি! পাগলি অন্য কারও কাছে গেলে কী না কী ক্ষতি করে দেবে কে জানে!’

‘অত সমাজসেবা করতে হবে না তোকে!’ আবার রাগ করত মুকু। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলত, ‘তোরা দিল্লির লোকজন এমনই হোস। ওভার গ্রোন ভিলেজ এই দিল্লি! তেমনই ফিউডাল মেন্টালিটি! ধর দেঙ্গে! কান কে নীচে বাজায়েঙ্গে! জানতা হ্যায় মেরা বাপ কৌন হ্যায়? একটা শহর উইথ মোর সারপঞ্চ দ্যান ভিলেজার্স! ইউ পিপল ইকুয়েট স্ট্রিট স্মার্টনেস উইথ ইন্টালিজেন্স! মানি উইথ সফিস্টিকেশান! গ্ল্যামার উইথ গ্রেস! রিচেস উইথ রিচনেস! তোরা সবাই হিরো! আই অ্যাম ইয়োর সেভিয়ার টাইপ! সব ফুটো কাপ্তান! করতে হবে না বিয়ে!’

হা হা করে হাসত তিজু। বলত, ‘দিল্লি ওভার গ্রোন ভিলেজ! কীসব বলছিস! এখানের বেস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিস! তাও এসব বলছিস! নমক-হারাম! জানতে পারলে না তোকে পেটাবে সবাই!’

‘তবে তো তুই বেঁচেই গেলি! আমায় পেটাবে আর তুই হাসছিস! মা ঠিক বলে, ছেলেটা জাস্ট টাইম পাস করছে!’ সামান্য কথার থেকে ইচ্ছে করেই অন্য দিকে, অন্য কথায় চলে যেত মুকু। ইচ্ছে করে তিজুকে কোনায় ঠেলে দেবার চেষ্টা করত! ও জানত সব রকম ইয়ার্কি মেনে নিতে পারত তিজু, কিন্তু ওকে ছেড়ে দেবার কথা বললে সেটা একদম নিতে পারত না ও!

‘তোর মা অমন বলেছে?’ তিজু জিজ্ঞেস করত।

‘হ্যাঁ তো! কত ভাল ভাল সম্বন্ধ আসছে জানিস তো লক্ষ্ণৌয় আমার জন্য? প্রোফেসর, এঞ্জিনিয়ার! ডাক্তার! মায়ের ডাক্তার পছন্দ! আমার না! কোথায় কখন ছুরি কাঁচি চালিয়ে দেবে কে জানে বাবা!’

তিজু কিছু না বলে মাথা নামিয়ে নিত। মুকু তাকিয়ে থাকত তিজুর দিকে। আবছা রোদে লাল হয়ে যাওয়া তিজুর মুখ দেখে কেমন একটা ভাললাগা আসত। মনে হত জড়িয়ে ধরে ওইখানেই। হাওয়ায় ওর গায়ের থেকে ভেসে আসা হালকা পারফিউমের গন্ধ কেমন যেন ধীরে ধীরে অবশ করে দিত ওকে। মনে মনে তিজুর কপালের তিলে আঙুল ছোঁয়াত ও।

কিন্তু সামনে সেটা দেখাত না। বরং বলত, ‘মা তো বলে, তুই যেন আমার পেছনে না পড়িস। যেন আমায় একা ছেড়ে দিস! মা বলে, মামা বলে, মামাতো বোন বলে। সবাই বলে! সব্বাই চায় তুই আমার থেকে দূরে চলে যাস!’

তিজু মাথা তুলে তাকাত ওর দিকে। তারপর আলতো গলায় বলত, ‘বলুক। সবাই বলুক। কিন্তু আমি কারও কথা শুনব না। কিছুতেই যাব না তোকে ছেড়ে! শুধু, তুই যদি কখনও চলে যেতে বলিস তবে, আই প্রমিস, আর খুঁজে পাবি না আমায়!’

এভাবে যে কথা রাখবে তিজু সেটা বুঝতে পারেনি মুকু! জানলা দিয়ে চারিপাশে ছড়িয়ে থাকা অনন্ত গাড়ির মিছিল আর মাথার ওপর টাঙানো ধূসর-নীলচে রঙের আকাশের দিকে তাকিয়ে মুকুর মনে হল এই বিশাল জট পাকানো শহরে কোথায় যে হারিয়ে গেল মানুষটা! এভাবে কথা রাখতে কে বলেছিল ওকে!

চিরকাল তিজু এমন। কী ভয়ঙ্কর জেদ! কী স্বার্থপর! নিজের কথা ছাড়া আর কারও কথা মনেই রাখে না। বোঝার চেষ্টাও করে না। নাহলে অমন ভাবে রাজি হয়ে যায় ডিভোর্সের জন্য! অমন একটা ঘটনার পরে যখন মুকুর পাশে দাঁড়াবার কথা ছিল ওর, তখন কিনা নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেল! ‘লস’-টা কি একার ওর ছিল? মুকুর সারা জীবনটা যে টলে গেল সেটা দেখল না! সেই দিক থেকে মুকু তো ঠিকই করেছিল ডিভোর্স চেয়ে! আর সেটা কি না ও মেনে নিল! মুকু চলে যেতে বলেছিল বলেই চলে গেল একবারে! আর পেছনে ফিরে তাকাল না!

ঘড়িটা দেখল মুকু। সোয়া চারটে বাজে। কথা বলে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে হোটেলে ফিরতে হবে ওকে। মাকে একজন ডাক্তার দেখতে আসবে। কী যে বিপদে পড়েছে ও! দীপনের কথাটা মানাই ঠিক হয়নি ওর!

আচ্ছা কেন আজও তিজুকে মন থেকে একদম ঝেড়ে ফেলতে পারে না ও! কেন এখনও মনের মধ্যে সেই আবছা রোদে কুতুব মিনারের সামনের ফাঁকা জায়গায় আজও মাথা নিচু করে বসে রয়েছে একটা ছেলে!

মাতো এটাই নিয়েই বলছিল সেদিন!

মা যে এমন করে লক্ষ্ণৌ থেকে একদম কলকাতায় চলে আসবে ভাবতে পারেনি মুকু। ওকে যখন হোটেলের রিসেপশান থেকে ফোন করে মায়ের কথা বলা হয়েছিল, মুকু তো আকাশ থেকে পড়েছিল! মা এখানে কী করছে? ওকে তো জানায়নি! কিন্তু কিছু বলেনি ও। মাকে এই বয়সেও সমঝে চলে মুকু। মা এখনও কী যে রাগী!

মা এসেছিল ওর ঘরে। হোটেলের বয়টি মায়ের ব্যাগ রেখে ঘর থেকে বেরোনোমাত্র মা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর ওপর!

মা বলেছিল, ‘কী শুরু করেছিস তুই? আবার এইসবে জড়িয়েছিস নিজেকে! আমি তো দীপনকে ফোন করব এবার। ওই জানোয়ারটার জন্য তোকে কেন ফোন করেছে ও! প্রিতম ইজ আপসেট! আমাকে ফোন করে প্রিতম বলেছে যে মুকু কীসব শুরু করেছে! সত্যি, তুই কী শুরু করেছিস? লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগে আছিস তুই! নাকি ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টে! তোর না ছুটিতে প্রিতমের কাছে যাওয়ার কথা ছিল! ওর বাবা মাও যেত। ওরা সামনের মাঘে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছে। থার্ড ফেব্রুয়ারি খুব ভাল একটা বিয়ের দিন আছে! ওরা দেখেওছে। এতসব প্ল্যান করা হয়ে গেছে! আর সেখানে তুই কলকাতায় এসে একটা বাউন্ডুলেকে খুঁজছিস!’

মুকু অবাক হয়ে গিয়েছিল! বিয়ে! সামনের মাঘে! ফেব্রুয়ারির তিন তারিখ! ও প্রিতমের কাছে গেলে সেখানে প্রিতমের বাবা মা আসত! এসব তো জানে না ও! ওকে না জানিয়ে কী করে সব ঠিক করে নিল! সেদিন যখন রাস্তায় ফোন করেছিল প্রিতম, ও তো সবটাই বলে দিয়েছিল প্রিতমকে। তখন তো প্রিতম কিছু বলেনি! আর এখন দেখছে পুরো উলটো ছবি! প্রিতম যে বলে, মুকু নিজের ইচ্ছে মতো থাকতে পারবে! নিজের ডিসিশান নিজে নিতে পারবে সেটা তাহলে শুধুমাত্র একটা ভান! আসলে ও অন্য পুরুষদের মতো সেই নিয়ন্ত্রণই করতে চায়!

ও মাকে বলেছিল, ‘তোমায় প্রিতম আসতে বলেছে এখানে? আমার ওপর নজরদারি করতে ও পাঠিয়েছে?’

‘বেশ করেছে!’ মা ভুলে গিয়েছিল এটা একটা হোটেল। আরও জোরে চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘কেন বলবে না! নিজের দিকে তাকিয়েছিস? জীবনটা তো ওই জানোয়ারটাকে বিয়ে করে নষ্ট করতে বসেছিলি! নেহাত প্রিতম এসে পড়েছে! সারা জীবন কি ভেবেছিস এভাবেই কাটবে? বয়স হবে না তোর! শরীরের এমন জোরই থাকবে? প্রিতম খুব ভাল ছেলে! ওর সঙ্গে আবার শুরু করার একটা চান্স পেয়েছিস জীবনে। আর সেটাকেও এভাবে নষ্ট করছিস! তোর বাবা কতদিন আগে মারা গিয়েছে। আমায় কিন্তু কেউ সেকেন্ড চান্স দেয়নি! আমি জীবন দেখেছি, তাই বলছি! এসব ভুলভাল কাজ বন্ধ কর। ব্যাগ গুছিয়ে কালকেই চলে যাব আমরা। তোর এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে প্রিতম যদি চলে যায়, জানবি তোর জীবন শেষ!’

মুকু কিছু বলতে পারছিল না। মাথা নিচু করে বসেছিল বিছানায়! একটা লোক চলে গেলে ওর জীবন শেষ হয়ে যাবে? কেন? এখনও কেন এমন ভাবে মানুষজন! মা, নিজে একজন মেয়ে হয়ে এভাবে কী করে ভাবতে পারে! প্রিতম আসার আগে কি ও বেঁচে ছিল না! একটা জিনিস মুকু বুঝে গিয়েছে, আমরাই অন্যদের নিজেদের জীবনে অপরিহার্য করে তুলি! আমরাই তাদের গুরুত্ব বাড়াই! মনের মধ্যে তাদের ঘিরে একটা কল্পনার পৃথিবী বানাই। আসলে সেসব কিছু থাকে না! শেষ পর্যন্ত কেউ থাকে না! সত্যি বলতে কী, প্রিতম খুব ভাল মানুষ। ডিসেন্ট! কিন্তু মুকু কোনওদিন প্রিতমের প্রেমে পড়েনি! ওকে ভাল লেগেছে! এইটুকুই। ও শুধু ভেবেছিল একটা সময় পরে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। মানুষকে বুঝে নিতে হয় যে জীবনে সব কিছু পাওয়া যায় না! তাই সম্ভাব্যটুকু দিয়েই নিজের জীবন সাজিয়ে তুলতে হয়। মনকে মানিয়ে নিতে হয়। প্রিতম হল ওর জীবনে সেই মানিয়ে নেওয়া।

তবে বুকের গভীরে তো জানে আসলে কী চায় ও! প্রিতম যখন ওকে আদর করে। ওর মধ্যে নিজেকে প্রবেশ করিয়ে প্রবল ওঠাপড়ার মাঝে ওর বুকটা কামড়ে ধরে, কাঁধে, গলায় অদৃশ্য কিছু খোঁজে, তখন কিন্তু খুব লঘু স্বরে, শ্বাসের সঙ্গে মিশে আচমকা তিজুর নামটাই বেরিয়ে আসে মুকুর! চোখেও জল চলে আসে মাঝে মাঝে! মনে হয় কোথায় যেন তিজুর বিশ্বাস ভাঙছে ও! কোথায় যেন তিজুর পিঠে ছুরি মারছে!

আর সেদিন মায়ের কথা শোনার পরে প্রিতমের ওপর কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা আসতে শুরু করেছে মুকুর! মাকে পাঠিয়েছে ওর পেছনে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য! কিন্তু নিজের সেটা বলার সাহস ছিল না! প্রিতম তো ওই রাজু নামে একজনের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়েছিল তিজুকে খুঁজে বের করার জন্য। তখনও তো একবারও বলেনি যে এমন করে মাকে ও বলেছে, বা মা আসছে!

মা চিৎকার চেঁচামেচি করে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল! মায়ের চিরকাল হাই প্রেশার। রোজ ওষুধ খেতে হয়। তাই মুকু যত দূর পারে মাকে রাগায় না। কিন্তু মা নিজেই যদি কথায় কথায় এমন করে তাহলে আর কে কী করতে পারে!

মুকু নিজে একটা সিঙ্গল রুম নিয়ে ছিল। মা আসায় ডাবল রুম করে নিয়েছিল হোটেলে বলে। ডাক্তারও মাকে বলেছিলেন, মা যেন আর উত্তেজিত না হয়।

সেদিন রাতে প্রিতম ফোন করেছিল। মুকু কিন্তু একবারও এসব নিয়ে কিছু বলেনি। খামোখা আর অশান্তি ভাল লাগছিল না। শুধু বলেছিল, রাজুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে বলে কথা দিয়েও যেতে পারেনি মা এসে যাওয়ায়! রাজু দু’দিন পরে সময় দিয়েছে! প্রিতম নিজেও আর ঘাঁটায়নি মুকুকে। মুকু যতই লুকোতে চাক, তাও কিছু একটা তো আন্দাজ করেইছিল নিশ্চিত! প্রিতম তো আর বোকা নয়! তাই খুব পাতলা কাচের আতর-শিশি ধরার মতো গলায় কথা বলেছিল।

সেদিন রাতে ঘুমোনোর আগে মা ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোকে এত বললাম তাও তুই ওকে খোঁজা বাদ দিবি না, না?’

মুকু ছোট করে বলেছিল, ‘আরেকটু চেষ্টা করে নিই! দীপনের শরীর খারাপ। হুইল চেয়ারে করে ঘোরে। ওর উপায় থাকলে আমায় বলত না!’

মা তাকিয়েছিল মুকুর দিকে। তারপর কেমন যেন আবছা গলায় বলেছিল, ‘ও আজও তোর মন থেকে সরেনি, নারে? তাহলে কেন ডিভোর্স নিলি? তোদের যা হয়, সেকি আর কারও হয়নি! যাকে মনে রাখলি এভাবে তার থেকে সরে এলি কেন মুকু?’

সব প্রশ্নের উত্তর মানুষ যদি নিজে জেনে যেত তাহলে জীবনে এমন বিপত্তি হত না! সে যে কেন প্রিয় মানুষের থেকে স্বেচ্ছায় দূরে থাকে সেটা সে নিজেও বোঝে না! নাকি বোঝে! তাহলে অভিমান, অহং পার করতে পারে না বলেই কি এভাবে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে প্রিয় মানুষের থেকে!

‘ম্যাডাম, উই হ্যাভ রিচড!’ ড্রাইভার ছেলেটির কথায় সংবিত ফিরল মুকুর। ও সামনে তাকাল। আজ হোটেল থেকে গাড়ি নিয়েছে ও। ড্রাইভার ছেলেটার বয়স অল্প। কথা শুনে মনে হচ্ছে পড়াশুনো জানে।

মুকু দেখল চারিদিক। লেক গার্ডেন্সে আগে আসেনি ও। উচ্চ মধ্যবিত্ত পাড়া এটা। কিন্তু চারিদিকে সাপের মতো আঁকাবাঁকা গলি! সামনের গলিতে একটা বড় ক্রেন দাঁড়িয়ে। তাতে উঠে একজন লোক গাছের ডাল কাটছে! পাশে একটা হলুদ রঙের লরিতে সেই কাটা ডালপালা বোঝাই করা হচ্ছে!

এই গলিতে গাড়ি ঢুকবে না। তাই ড্রাইভার ছেলেটা গাড়িটা এখানেই পথের এক পাশে পার্ক করে রেখেছে!

মুকু গাড়ি থেকে নেমে সামনে এগোল। পাশেই একটা দোকান। তার সাইনবোর্ডে বাড়ির নাম্বার আর রাস্তার নাম দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রায় এসেই গিয়েছে রাজু বলে সেই নেতাটির বাড়ি। কিন্তু লোকেশানটা ঠিক কোথায় সেটা বুঝতে পারছে না।

মুকু গলির মধ্যে ঢুকল। হলুদ লরিটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। দেখল, উলটো দিক দিয়ে একটা ছেলে আসছে।

মুকু ডাকল, ‘ভাই শুনছেন, রাজদীপ দেবের বাড়িটা কোথায়! মানে এম.এল.এ. যিনি!’

ছেলেটা বলল, ‘আরে রাজুদা?’

মুকু দেখল ছেলেটার চুল পাট করে আঁচড়ানো! পান খেয়ে দাঁতের বারোটা বাজিয়ে ফেলছে! লাল দাঁত বের করে ছেলেটা হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে।

মুকু মাথা নাড়ল।

ছেলেটা বলল, ‘ওই সামনের নীল বাড়িটা দিদি!’

মুকু ওদের কাটিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। আকাশি নীল রঙের একটা বাড়ি। সামনে কিছু লোক জড়ো হয়ে আছে। মুকু কাছে যেতেই একটা টাক মাথা লোক এগিয়ে এল ওর দিকে, ‘কাকে চাইছেন ম্যাডাম?’

মুকু দেখল লোকটাকে। মুখে কেমন একটা গ্যালগ্যালে ভাব। ওকে চোখ দিয়ে গিলছে। ও বলল, ‘রাজদীপ দেব। আসতে বলেছেন আমায়। আমি নিরমুক্তা!’

‘ও!’ লোকটা সামলাল নিজেকে। মুকু বুঝল ও যে আসবে লোকটা জানে। লোকটা বলল, ‘আপনি ভেতরে যান। একটু ওয়েট করতে হবে। আসলে দাদা একটু মানে… ব্যস্ত। আপনি যান!’

মুকু ওদের পাশ কাটিয়ে বাড়ির দিকে এগোল। রাজুর কি মেজাজ খারাপ! তবে কি ওর কাজে সাহায্য করতে পারবে না! কী করবে ও! কোথায় গেল তিজু! এভাবে লুকিয়ে আছে কেন! ওর জন্য কোথায় কোথায় আসতে হচ্ছে ওকে! কাদের সঙ্গে দেখা করতে হচ্ছে! যদি একবার দেখা হয় তিজুর সঙ্গে তবে যা শাস্তি দেবে না!

বাড়ির ভেতর পা দিল বিরক্ত মুকু। আর ঠিক তখনই আবছা ভাবে শুনল, কাছেই কোথাও যেন পাড়া কাঁপিয়ে গর্জন করে একটা মোটর বাইক চলে গেল! বিরক্তিটা আরও বাড়ল মুকুর! কারা এমন সব বিকট আওয়াজের মোটর বাইক চালায়! তাদের মাথা খারাপ নাকি?

১২ ঋত্বিজ

‘তোর মাথা কি খারাপ? এভাবে তুই সাড়ে চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছিস এখানে? পাগল? বলেছি না এভাবে রাস্তায় দাঁড়াবি না! আমার কষ্ট হয়!’ মুকু তাকাল ওর দিকে। মুকুর চোখ দুটো বাবুই পাখির মতো তিরতির করে কাঁপছে! ও বলতে গেল কিছু, কিন্তু মুকু ওকে কথা বলতে না দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওর কপালের পড়ে থাকা চুলটা সরিয়ে দিল আলতো করে! আর চমকে ঘুম ভেঙে সোজা হয়ে বসল তিজু! জানলা দিয়ে নরম আলো এসে পড়েছে ঘরে। রাস্তার অস্পষ্ট আওয়াজ পাক খাচ্ছে হাওয়ায়! পাশের একটা গাছে বসে একা কী অদ্ভুত ভাবে ডেকে যাচ্ছে একটা পাখি! এই সবের মধ্যে মুকু এসেছিল! কোথায় এসেছিল! এখানে! হ্যাঁ এখানেই তো! এই তো দাঁড়িয়েছিল পাশে। কপালে এখনও ওর স্পর্শ টের পাচ্ছে তিজু। ওর অদ্ভুত সুন্দর আঙুলগুলো তো দেখতে পাচ্ছিল এই মাত্র! তাহলে কোথায় গেল! এখন, হাওয়া, শূন্য দুপুর আর নির্জন একটা শীতকাল পড়ে আছে সামনে! কত দিন ধরে আছে এমন! কেন এখনও কলেজের সময়কার ওর অপেক্ষা করার দৃশ্য এভাবে ফিরে আসে স্বপ্নে! স্বপ্ন! যার কোনও স্পর্শ নেই! আশা নেই! হলুদ ডালের মতো উপছে পড়া রোদের মধ্যে নিজেকে আজ বড্ড একা আর অসহায় লাগছে! বুঝতে পারছে, সারা জীবন এইসব হারিয়ে যাওয়া, মিলিয়ে যাওয়া দৃশ্য নিয়েই বাঁচতে হবে ওকে! কোথায় যেন পড়েছিল, “The strongest men are the most alone.” কিন্তু উল্টোটাও কি সত্যি হয়!

সোজা হয়ে বসে ঘড়ি দেখল তিজু। আড়াইটে বাজে। এখনও পুজো সারেননি অভিনব! এক ঘন্টা তো হল। বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল! আসলে আজ বেশ ক্লান্ত আছে তিজু। কাল রাতে ঘুমোয়নি। একটা বাজে ঘটনা ঘটেছে! কাল রাতে নীপা সুইসাইড করতে গিয়েছিল। সেই কারণে ওকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল তিজুকে।

আগে হলে তিজু এসব করত না! পৃথিবীর সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখত ও। কিছুতেই নিজের বৃত্তের বাইরে গিয়ে কিছু করত না! কিন্তু মুকুর চলে যাওয়া ওকে পালটে দিয়েছে! এখনও মুকুর সেই চোখ দুটো মনে পড়ে ওর! ‘এতটা স্বার্থপর? এতটা সেলফ অ্যাবসর্বড!’ কথাগুলো বুকের মধ্যের ফাঁকা পরিত্যক্ত হলঘরে ভাসে! দেওয়ালে লেগে ঘুরে যায় অন্য দেওয়ালের দিকে। খালি মনে হয়, ও যদি এমনটা না হত তাহলে কি মুকু থেকে যেত ওর কাছে!

দীপন একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বউদি বলল আর তুই রাজি হয়ে গেলি? তুই তো ডিভোর্স নাও দিতে পারতিস!’

তিজু উত্তর দেয়নি কোনও! মুকু ওর কাছে কিছু চাইলে ও না করেনি কোনওদিন! কিন্তু এবার ‘না’ করেছিল। অনেকবার ‘না’ বলেছিল। তাতে মুকু বলেছিল, ‘আমার মন সরে গিয়েছে তোর থেকে। তুই এমন আমি জানতাম না! এতটা স্বার্থপর? এতটা সেলফ অ্যাবসর্বড! আমি থাকতে চাই না!’

মন সরে গিয়েছে! তাহলে আর লাভ কী! ওই একটা কথাই কেমন যেন অসাড় করে দিয়েছিল ওকে। ওদের যা ক্ষতি হয়েছে সেটা তো এক সঙ্গেই হয়েছে! তাহলে এমন কী করল ও! কিন্তু তারপরেই মনে হয়েছিল, বৃথা এই জিজ্ঞাসা! মনটাই তো আসল। সেটা সরে গেলে আর কিছু থাকে না! তাছাড়া সেই কলেজবেলার কথাও মনে পড়ে গিয়েছিল ওর! সেই যে কথা দিয়েছিল, কেউ বললে ও সরবে না! কিন্তু যদি মুকু ওকে চলে যেতে বলে তাহলে আর থাকবে না ও!

তিজু সরে এসেছে! কিন্তু সত্যি কি সরে এসেছে! তাহলে কেন আজও এমন আবছা ঘুমের মধ্যে এসে ওর কপালে পড়ে থাকা চুলের গোছা সরিয়ে দেয় মুকু! অমন তিরতির করে কাঁপতে থাকা বাবুই পাখির মতো তাকায়! কীসের অদৃশ্য এই বন্ধন যে সেটা কেটে আজও বেরতে পারল না ও!

জগন! জগনটাই দায়ী! কেন ও মুকুকে ফলো করছে! বারবার বারণ করেছে তিজু! কিন্তু ছেলেটা কথা শোনে না! বললেই, বলে, ‘কী করব দাদা! রিটায়ার্ড মানুষ! কাজকম্ম নেই! তাই… প্লাস বউদি বলে কথা। একা শহরে আছেন। সেফটি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!’

জগন বারবার ওর কথা বলে বলেই কি আজকাল এমন ঘনঘন মুকুর কথা মনে পড়ছে ওর! এই চুয়াল্লিশে কি আর অমন সতেরো আঠারোর মতো অস্থির হলে হয়! হয় না, জানে তিজু। কিন্তু কিছুতেই মানাতে পারছে না নিজেকে। আসলে কেউ কেউ প্রেমে পড়ে কিন্তু সেখানেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায় তাদের। কিন্তু তিজুর মতো মানুষরা প্রেমে শুধু পড়েই না সেটা নিজের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়ায়ও! আর সেটাই জগনের জন্য যেন আরও জেগে উঠছে!

এই যে জগন খবর দিল সেদিন যে মুকুর মা এসেছেন! সেটা নিয়েও কেমন একটা তেতো ভাব হয়ে আছে মনে।

কেন এসেছেন ভদ্রমহিলা সেটা জানে তিজু। এই যে মুকু ওকে খুঁজছে, সেটার জন্য এসেছেন! মুকুকে নিয়ে যেতেই এসেছেন নিশ্চয়! জীবনে কিছু জিনিস আছে যা কোনওদিন পালটায় না! এটাও তেমনই একটা ব্যাপার! সেটা জানার পর থেকে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে ওর। মুকু যে এই শহরে, এক শহরে আছে, সেটাই যেন ওর আনন্দ! কোনও লজিক নেই, তাও নিরাকার এক আনন্দ! আর সেই আনন্দটা চলে যাবে! একবার তো মনে হয়েছিল মুকুর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে নেয়! কিন্তু তারপরেই নিজেকে চড় মেরেছে মনে মনে! সব তো শেষ। মনটাই তো সরে গিয়েছে! সেখানে এসব কেন ভাবছে ও! আর কলকাতায় এসেছে কেন মনে নেই! সেটা থেকে সরে গেলে হবে? মা যা বলে গিয়েছে সেটার শেষটা জানতে হবে না!

পাশের জানলা দিয়ে আসা রোদের দিকে তাকাল তিজু। পাখিটা ডেকেই চলেছে! ওর আবার মনে পড়ল নীপার কথা! কেমন আছে মেয়েটা!

কাল রাতে আচমকা চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তিজুর! ঘর অন্ধকার ছিল। গায়ে লেপ দেওয়া ছিল। তাই প্রথমটা বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে! তারপর সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে তাকিয়েছিল বাইরের দিকে। কাচের জানলার ওপর মোটা পর্দা ঢাকা। তাও ফাঁক দিয়ে আসা রাস্তার আলোর আভা দেখে বুঝেছিল, এখনও রাত!

চিৎকারটা আসছিল নীচের থেকে। তিজু বিছানা থেকে নেমে পায়ে চটি গলিয়ে দরজা খুলে বেরিয়েছিল বাইরে। দেখেছিল আশেপাশের ফ্ল্যাটের থেকে লোকজন বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে জটলা করছে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না! বা এগোচ্ছে না! আর নীচের থেকে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা চিৎকার করে যাচ্ছে! তিজু আর অপেক্ষা না করে নেমে গিয়েছিল সিঁড়ি দিয়ে!

ওই ফ্ল্যাটটা ছোট। খুব আগোছালো! ঘরে ঢুকেই কেমন একটা গন্ধ পেয়েছিল তিজু। অ্যালকোহল। ভদ্রমহিলা কাঁদছিলেন! তিজু ওর পেছন পেছন এগিয়ে গিয়েছিল বাথরুমের দিকে।

বাথরুমের দরজাটা অর্ধেক খোলা ছিল। সেখানে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল তিজু। নীপা পড়েছিল বাথরুমের মেঝেতে! চারিদিকে চাপ চাপ রক্ত! বাঁ হাতের কবজির কাছটা কাটা! তিজু থমকে গিয়েছিল! এটা কী দেখছে ও! এটা কেন হল! ভদ্রমহিলা যে নীপার মা সেটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না ওর! কিন্তু এখন কী করবে ও! কার সঙ্গে কথা বলবে!

তিজু দ্রুত তাকিয়েছিল ভদ্রমহিলার দিকে। বলেছিল, ‘আপনার মোবাইল আছে? আমায় এক্ষুনি দিন। আমার মোবাইল নেই!’

ভদ্রমহিলা হাউস কোটের পকেট থেকে দ্রুত বের কর দিয়েছিল মোবাইলটা। মনে মনে নাম্বারটা আউড়ে নিয়ে তিজু ফোন করেছিল একটা!

দুটো রিং হতেই কলটা রিসিভ করেছিল জগন! এই রাত দুটোতেও জগন জেগে! যতটা সম্ভব ছোট করে ঘটনাটা বলেছিল ওকে।

জগন সব শুনে বলেছিল, ‘দাদা পাঁচ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। তাতে করে নিয়ে আসুন নার্সিং হোমে! আমি আসছি ওখানেই। ডোন্ট ওরি দাদা! সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।’

কুড়ি মিনিটের মধ্যে নীপাকে নিয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছে গিয়েছিল তিজু আর ভদ্রমহিলা। দেখেছিল জগন দাঁড়িয়েই আছে!

পরের আধ ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার, পুলিশ সব চলে এসেছিল। কিন্তু তিজু অবাক হয়ে দেখেছিল জগন সামলে নিয়েছে সব! এমন কী পুলিশে কেস পর্যন্ত হতে দেয়নি!

তিজু আর জগন বসেছিল ওয়েটিং লাউঞ্জে। ভদ্রমহিলার থেকে জেনেছিল পুরো ব্যাপারটা। নীপার বাবা একজন মদ্যপ মানুষ। প্রায়ই নীপাকে মারত। গালাগালি করত। আর এদিন সেটার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল খুব। ভদ্রমহিলাকে রাতে ব্যাডমিন্টনের র‌্যাকেট দিয়ে মেরেছিল লোকটা। নীপা আটকাতে গেলে ওকে মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে গায়ে মদ ঢেলে দিয়েছিল। এটা আর নিতে পারেনি মেয়েটা!

‘এটা বাবা, না জানোয়ার!’ জগন তাকিয়েছিল তিজুর দিকে, ‘বাবা এমন হয়!’

বাবা! বাবা কেমন হয়! ওর ছোটবেলায় বাবাকে বেশি পায়নি। ব্যবসায় ব্যস্ত থাকত বাবা। কিন্তু তার মধ্যেই যেটুকু পেত, তাতেই কী যে ভাল লাগত তিজুর! বাবাও খুব ভালবাসত ওকে! তাই তো বাবা যখন মারা গিয়েছিল সবচেয়ে ভেঙে পড়েছিল তিজু! কাজকম্ম বন্ধ করে মাস দুয়েক একদম নিজেকে বন্ধ করে নিয়েছিল ঘরের মধ্যে! স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কষ্ট হয়েছিল খুব! বাবা বলতেই তাই ছোটখাটো শান্ত মানুষটার মুখটাই এতদিন মনে পড়ত তিজুর! কিন্তু তারপর যে কী হল! এখন সব কেমন যেন ঘেঁটে গেছে ওর!

জগনের দিকে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল তিজু। জগন আরও কত কিছু বলছিল, কিন্তু মাথায় ঢুকছিল না একটুও! সকাল সাড়ে ছটার দিকে ডাক্তার এসে বলেছিলেন, আর ভয় নেই। বিপদ কেটে গিয়েছে।

নীপার মা জগন আর তিজুকে হাত জোড় করে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে মেয়ের কাছে চলে গিয়েছিল।

তিজু জগনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই করলি কী করে এত কিছু! তুই আসলে কে বলত!’

জগন শুধু হেসে বলেছিল, ‘আমি দাদা কেউ নই। সামান্য রিটায়ার্ড একজন মানুষ!’

‘ফির সে তু ইয়ে সব তসবিরেঁ নিকলকে রক্ষি হ্যায়? ঢোকা এখনই। ঢুকিয়ে রাখ!’ গম্ভীর গলাটা শুনে সোজা হয়ে বসল তিজু। এই তো অভিনব রাওয়াতের গলা! এতক্ষণ ধরে কী পূজা করছিলেন! এমন অসুস্থ মানুষ, তাও এভাবে এখনও পুজো আচ্চা করেন!

সামান্য সময় পড়ে কাজের ছেলেটি এসে দাঁড়াল ঘরের মধ্যে। বলল, ‘স্যার আসুন। সাহেব রেডি।’

তিজু উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটির পেছন পেছন গেল ভেতরের ঘরে। দেখল অভিনব বসে আছেন তার কাঠের বড় চেয়ারটায়। মাথায় একটা উলের টুপি। গায়ে সোয়েটার। হাঁটুর থেকে নীচটা চাদর দিয়ে ঢাকা!

‘তুমি বসে আছ এখনও?’ অভিনব সামান্য বিরক্ত গলায় বললেন!

‘হ্যাঁ স্যার। আমি তো বলেছি, কেন এসেছি আপনার কাছে! সব ছেড়ে এসেছি স্যার! আপনাকে বলতেই হবে।’ তিজু সামনে একটা নিচু চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

‘বলতেই হবে!’ অভিনব চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘আমায় কেউ জোর দিলে আমি সেই কাজ করি না!’

‘স্যার। প্লিজ। রাধুবাবু বলেছেন, আপনি জানেন সবটা। আপনি আমার ডেড এন্ড! প্লিজ!’

অভিনব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ‘কবর থেকে কিছু বের করা উচিত নয়। লেট দ্য পাস্ট রিমেন ইন দ্য পাস্ট!’

‘কিন্তু আমার কথাটা একবার ভাবুন,’ তিজু বলল, ‘নিজের জীবনে এমন একটা ঘটনা থাকলে আপনি কী করতেন স্যার!’

অভিনব মাথা নিচু করে ভাবলেন কিছু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু খেয়েছ?’

‘আমি!’ আচমকা প্রসঙ্গ বদলানোয় কেমন যেন ঘাবড়ে গেল তিজু।

‘আর কেউ কি আছে এই ঘরে!’

‘না খাইনি!’ মাথা নাড়াল তিজু, ‘খিদে পায়নি আমার!’

‘চুপ।’ অভিনব ধমক দিলেন, ‘আমি বলেছি তোমার কী পেয়েছে না পেয়েছে বলতে?’ তারপর গলা তুলে, ‘কার্তিক, কার্তিক’ বলে ডাকলেন দুবার।

কাজের ছেলেটি দৌড়ে এসে দাঁড়াল।

অভিনব বললেন, ‘এই বাবুটি উপবাস করছে। তুই কিছু খাওয়াতে পারবি একে!’

কার্তিক বলল, ‘স্যান্ডউইচ করে দিই? চিকেন স্যান্ডউইচ।’

‘কিন্তু, প্লিজ… আমার খিদে পায়নি। শুধু শুধু কষ্ট করবেন না।’ তিজু আবার প্রতিবাদ করল।

‘কার্তিক নিয়ে আয়!’ অভিনব আর কথা বাড়াতে দিলেন না।

কার্তিক ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তিজু মুখ গোঁজ করে বসে রইল।

অভিনব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল? অমন মুখ কেন?’

‘স্যার,’ তিজু বলল, ‘আমায় সবাই বলেছিল আমি যেন না আসি এই ব্যাপারে। আমি কারও কথা শুনিনি। কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছি তাকে খুঁজতে!’

‘কেন এসেছ?’ অভিনব সোজা তাকালেন তিজুর দিকে, ‘জাস্ট কৌতূহল?’

‘না স্যার,’ তিজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি একবার দেখতে চাই তাকে। কারণ আছে বলেই দেখতে চাই!’

অভিনব বললেন, ‘কমলিনী কবে মারা গেছেন?’

তিজু বলল, ‘মাস দেড়েক হয়েছে।’

‘দেড় মাস!’ অভিনব মাথা নাড়লেন। তারপর নিজের মনে বললেন, ‘ইউ ডোন্ট লুক লাইক ইওর মাদার! ইওর মাদার ওয়াজ আ স্পেশাল উওম্যান!’

‘নাইদার আই লুক লাইক মাই ফাদার, স্যার!’ তিজু চোয়াল শক্ত করল সামান্য। তারপর বলল, ‘আই মিন মাই ফস্টার ফাদার!’

অভিনব মুখ তুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন ওর দিকে।

তিজু সামলাল নিজেকে, ‘আমার বাবা খুব ভালবাসতেন আমায়! দীপনের চেয়ে আমায় ভালবাসতেন বেশি। আমিও, খুব ভালবাসতাম!’

‘তাহলে! কেন জিজ্ঞেস করছ এসব? কী হবে জেনে?’

‘আমি একবার তাকে দেখতে চাই স্যার। দেখতে চাই কেমন সেই মানুষটা! কেন সে এমন করল! কেন এভাবে পালিয়ে গেল! যদি ভালই না বাসবে তবে কেন এমনটা করল মায়ের সঙ্গে! আমার সঙ্গে! আমি তাকে এটাই জিজ্ঞেস করতে চাই। মা মৃত্যুশয্যাতেও অস্ফুটে বলছিল তার কথা! কিন্তু নামটা বলেনি! কিছুতেই বলেনি!’

‘তাহলে কী বলেছে?’ অভিনব স্থির গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

‘বলেছে, আমার বাবা আসলে সেই লোকটা! বলেছে এখনও মা চোখ বন্ধ করলে সব দেখতে পায়! আমি যখন খুব জোর করেছি কে লোকটা বলার জন্য, তখন উত্তর দিয়েছে, রাধুকাকুর কাছে গেলে আমি পথ পাব! মা নেই আর। আমার জীবনে আর কিছু নেই স্যার! আমায় প্লিজ একবার বলুন, কে সেই লোকটা! কী হয়েছিল? এখন সে কোথায়! প্লিজ স্যার বলুন আমার বাবার নাম কী!’

অভিনব চোয়াল শক্ত করে বাইরের দিকে তাকালেন। বাইরে আবছা ভাবে সেই পাখির ডাক ভেসে আসছে। জানলা দিয়ে শীতের দুর্বল রোদ এসে ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরে! নিস্তব্ধ দুপুর মিশে যাচ্ছে মনখারাপ করা বিকেলের সঙ্গে! যেন আনমনা এক নদী এসে মিশছে মনখারাপের কোনও জঙ্গলে!

অভিনব এবার তাকালেন তিজুর দিকে। তারপর বললেন, ‘সে তো মারা গিয়েছে! বহু বহু বছর আগে মারা গিয়েছে!’

১৩ স্মাহি

করিডোরে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করল স্মাহি। শরীরটা খারাপ লাগছে খুব। কাল সারারাত উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে। কী হয় কী হয় একটা ভাব। এমন পরিস্থিতিতে কোনওদিন পড়েনি স্মাহি। এভাবে যে কাল সারারাত ফ্যাক্টরির মধ্যে আটকে যেতে হবে সেটা বুঝতে পারেনি।

দীর্ঘদিন ধরে তলায় তলায় একটা ঝামেলা পাকছিল। কিন্তু সেটা যে আচমকা এভাবে ফেটে পড়বে বুঝতে পারেনি!

ও করিডোরে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। একটু আগে চোখে মুখে জল দিয়ে এসেছে। শীতকাল, তাও জল দেবার পরে ঠান্ডা লাগছে না! বরং একটু যেন ভাল লাগছে। তবে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়বে যেকোনও সময়!

ফ্যাক্টরির এক পাশে ওদের অফিস। সেখানে জনা বিশেক ছেলে মেয়ে কাজ করে। সবাই কাল আটকে পড়েছিল। স্মাহিসহ আরও ছয় জন আছে ওদের ডিপার্টমেন্টে। তারা সবাই কনফারেন্স রুমে আধ শোয়া হয়ে কাটিয়েছে!

এটা মফসসল শহর। শীতে ঠান্ডা পড়ে বেশ। কাল রাতে শীতেও কষ্ট হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ায় সেভাবে কিছু হয়নি। কারণ ক্যান্টিন চালাতে দিচ্ছে না ফ্যাক্টরি-গেটের বিক্ষোভকারীরা!

তারওপর মানসিক চাপ তো আছেই! সব মিলিয়ে শরীরটা ভাল লাগছে না।

বেশ কিছুদিন ধরেই ঝামেলা যে একটা পাকছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিল স্মাহি। মালিক পক্ষ শ্রমিকদের মাইনে দিচ্ছে না মাস দুয়েক। সেই নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছিল।

গতকাল অফিসে আসার সময় ট্রেন থেকে নেমে যখন হাঁটছিল অফিসের দিকে, আচমকা বলাই এসে ধরেছিল ওকে। মানে ঠিক ধরেনি, পাশে এসে ওর সঙ্গে হাঁটছিল। সামান্য বিরক্তই লাগছিল স্মাহির। এই ছেলেটা কেমন একটা বেহায়া টাইপের। বললেও বোঝে না যে ওকে পছন্দ নয়!

স্মাহি তাই পাত্তা দিচ্ছিল না বিশেষ!

বলাই সামান্য উশখুশ করে বলেছিল, ‘তুমি, আজ আর অফিসে ঢুকো না।’

স্মাহি বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

বলাই সামান্য গুটিয়ে গিয়েছিল যেন। তারপর বলেছিল, ‘রাগ কোরো না প্লিজ। আমি জেনেই বলছি। আজ একটা ক্যাচাল হবে। ফ্যাক্টরি গেটে বিকেলে ধরনা বসবে। আজ হেড অফিস থেকে ফাইনান্স ডিরেক্টর আসবেন তো। তাই তার সামনে দাবিদাওয়া নিয়ে একটা বড় ডেমনস্ট্রেশান দেওয়া হবে। হয়ত আরও বড় ঝামেলা হবে। তখনই ভেবেছিলাম তোমায় বলে দিই। কিন্তু সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছিল বলে আর ফোন বা মেসেজ করিনি। আর সকালে ইউনিয়ানের কাজে এত ফেঁসে গিয়েছিলাম যে সময় করে উঠতে পারিনি। আমি এখন ফ্যাক্টরি ইউনিয়ানেই যাচ্ছি। তাই তোমায় দেখে মনে হল বলে দিই!’

স্মাহি আগ্রহহীন মুখে তাকিয়েছিল বলাইয়ের দিকে। তারপর বলেছিল, ‘এত বকবক করো কেন?’

‘মানে!’ সামান্য ঘাবড়ে গিয়েছিল বলাই, ‘আমি সত্যি বলছি! অন গড! মা কালীর দিব্যি! আজ কিন্তু ঝামেলা হবে একটা। তুমি বুঝতে চাইছ না। কিন্তু দেখো হবে। এখনও টাইম আছে। ফিরে যাও আজ। নাহলে সারারাত কিন্তু আটকে থাকতে হবে ফ্যাক্টরিতে!’

স্মাহি বিরক্ত হয়েছি এবার। ছেলেটা সারাক্ষণ গায়ে পড়ে উপকার করতে চায়! এত বিরক্ত লাগে! কেউ কেউ আছে যারা, নিজেদের সীমারেখাটা বোঝে না! কোথায় থামতে হয় জানে না।

স্মাহি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন করছ এসব! এসব করে কী হয় তোমাদের!’

‘কী বলছ!’ মাথা নেড়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল বলাই।

ছেলেটা কথা বললে মুখ দিয়ে থুতু ছিটকোয় মাঝে মাঝে। ঘেন্না লাগছিল স্মাহির। ভাবছিল এর হুঁশ নেই! এভাবে থুতু ছিটিয়ে কথা বলছে!

বলাই বলেছিল, ‘কয়েক মাস মাইনে পাই না। এদিকে কাজ চলছে। মালের সাপ্লাই থেমে নেই। বিক্রিও হচ্ছে! আমাদের ঘর সংসার নেই! আন্দোলন করব না তো বাড়িতে বসে থাকব! মালিক কোটি টাকার গাড়ি চড়বে আর আমরা আঁটি চুষব?’

‘তাবলে ঝামেলা করতে হবে?’ স্মাহির বিরক্তি লাগছিল।

‘তোমরা বুঝবে না। তোমরা ম্যানেজমেন্টের লোক। ঠিক মাইনে পেয়ে যাচ্ছ! আমাদের অবস্থা দেখেছ! আমাদের বাড়ির বাচ্চাদের অবস্থা দেখেছ! আন্দোলন আমরা কি শখ করে করছি! শালা, বাদলদাটা ফালতু কোম্পানির পোষা দালাল হয়ে গিয়েছে! আমরা বুঝলেও কিছু করতে পারছিলাম না এতদিন। নেহাত এবার আদিত এল! ও এল বলেই না আজ এমন একটা মুভমেন্ট সম্ভব হবে!’

আদিত! নামটা এভাবে আচমকা এতদিন পড়ে শুনে কেমন যেন ইলেকট্রিকের শকের মতো লেগেছিল স্মাহির!

ও ঘুরে তাকিয়েছিল বলাইয়ের দিকে, ‘আদিত!’

‘হ্যাঁ!’ বলাই বলেছিল, ‘সে তুমি চিনবে না। আমাদের পার্টির ছেলে। কলকাতায় থাকে! ভাল কথা বলে। সিনসিয়ার। আগে রিপোর্টার ছিল! আমাদের কষ্টটা বোঝে! শালা ওই বুড়ো বাদলার মতো ধান্দাবাজ নয়!’

কেমন একটা করছিল স্মাহির শরীর! আদিত ওদের ফ্যাক্টরিতে আসে! মানে এত কাছে আসে ও! সেদিন লেক গার্ডেন্স স্টেশানের কাছে দেখল, তারপর আবার এখন এখানেও আসে! কী হচ্ছে কী! আদিত এত কাছে এসে ঘোরাফেরা করে আর ও জানে না! দেখাও হয়নি আগে! ওর মনে হচ্ছিল বলাইকে আরও কিছু জিজ্ঞেস করে আদিতকে নিয়ে। কিন্তু নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত করে নিয়েছিল স্মাহি! ও জানে বলাই যা কৌতূহলী ছেলে এই নিয়ে হাজার রকম প্রশ্ন করবে! তাই চুপ করে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল স্মাহি।

বলাই ঘড়ি দেখেছিল একবার, তারপর বলেছিল, ‘আমি একটু তাড়াতাড়ি যাই। তুমি আমার কথাটা শুনলে পারতে। ঝামেলায় আটকে যাবে কিন্তু। আচ্ছা, আড়াইটের আগে বেরিয়ে যেও! তাহলেও রক্ষে পাবে। নাহলে কিন্তু কপালে দুর্ভোগ আছে তোমার!’

স্মাহি আস্তে আস্তে কনফারেন্স রুমের দিকে এগোল। খিদে পেতে পেতে এখন খিদে মরে গিয়েছে! গা গুলোচ্ছে সামান্য। একটু শুতে পারলে ভাল হত! কিন্তু উপায় যে নেই সেটা ও জানে!

কাল রাতে রিতাদি ফোন করেছিল। কেন এখনও ফিরছে না জিজ্ঞেস করেছিল। সংক্ষেপে বলেছিল স্মাহি। রিতাদি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। বলেছিল সাবধানে থাকতে।

তা সাবধানেই তো আছে ও। মানে ফ্যাক্টরির চৌহদ্দির মধ্যে অফিসে তো ওরা সুরক্ষিতই! শুধু খাবার শোওয়ার যা অসুবিধে। ফাইনান্স ডিরেক্টরও আটকা পড়েছেন। কিন্তু ওঁর নিজের অফিস আর থাকার ব্যবস্থা তো আলাদা আছে। সেখানেই তিনি আছেন। শুধু কাল রাতে একবার এসেছিলেন ওদের এখানে। তারপর বলেছিলেন, ওরা যেন ভয় না পায়! সব ঠিক হয়ে যাবে!

এখন সকাল সোয়া সাতটা বাজে। কই আর ঠিক হল সব!

ফ্যাক্টরি গেটের বাইরে সিসি টিভি আছে। কিন্তু কালকেই বিক্ষোভকারীরা সেসব ভেঙে দিয়েছিল। তাই ফ্যাক্টরির উঁচু গেট টপকে বাইরে কী হচ্ছে সেটা দেখা যাচ্ছে না!

তবে সারা রাত নানান অসুবিধের মধ্যেও কোথাও যেন আবছা একটা ভাল লাগা আসছিল। মনে হচ্ছিল, হোক না গেটের অন্যদিকে। তবু কাছাকাছি তো আছে আদিত!

আজকাল নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করে স্মাহির! কী করল ও জীবনটাকে নিয়ে! একটা বাজে লোকের পাল্লায় পড়ে কী করে সব কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও! তখন কী ভূতে পেয়েছিল ওকে! দীপক কাকুকে চিনতে পারেনি!

জেঠুর কাছে আসত দীপক বেতাল। কীভাবে যেন জেঠুর সঙ্গে চেনাশুনো হয়েছিল লোকটা। লম্বা, ফর্সা, সামান্য টাক ছিল লোকটার মাথায়! দেখতে ভাল ছিল। আর কী ভাল গান গাইত!

স্মাহির মনে আছে প্রথম দিন যেদিন দীপক এসেছিল ওদের বাড়িতে সেদিন কলেজের একটা ফাংশান ছিল স্মাহির। তার জন্য সাজগোজ করে রেডি হয়ে বেরোচ্ছিল ও। জেঠুকে জানিয়ে বেরোবে বলে ঘরে ঢুকেছিল। আর সেখানেই বসেছিল দীপক। স্মাহি তাকিয়েছিল ওর দিকে। আর দেখতে পেয়েছিল এক জোড়া মুগ্ধ বাদামি চোখ! মুগ্ধতা বুঝতে মেয়েদের সময় লাগে না। ওরও লাগেনি! আর সেই চোখের মধ্যে কী যেন ছিল একটা! ভেতরে ভেতরে নড়ে গিয়েছিল স্মাহি! কেমন একটা লজ্জা আর ভাললাগা এসে স্কেচ পেনের হিজিবিজি দাগ কেটে দিয়েছিল ওর মনে। মনে হচ্ছিল লোকটা আরেকটু দেখুক ওকে। আরেকটু তাকিয়ে থাকুক।

তারপর মাঝে মাঝেই আসত দীপক। কথা বলত সবার সঙ্গে। গান গাইত। এমন কী সবার জন্য নানান রকম খাবার কিনেও আনত! আর সবার মধ্যে স্মাহিকে আলতোভাবে হলেও গুরুত্ব দিত একটু বেশি!

তারপর একদিন বৃষ্টি হল খুব! জেঠু, দাদা আর বোন কৃষ্ণনগরে গিয়ে আটকে গেল বৃষ্টিতে! বাড়িতে জেঠিমা আর স্মাহি ছিল সেদিন! আর সেদিনই এসেছিল দীপক। ভারি একটা রাবারের ওয়াটারপ্রুফ পরে এসে দাঁড়িয়েছিল ওদের বড় বাড়িটার উঠোনে! দুপুরবেলা বলে জেঠিমা ঘুমোচ্ছিল সেদিন। স্মাহি আর দীপক অমন একটা বিশাল, নির্জন, বৃষ্টি দিয়ে মোড়া বাড়িতে একাই দাঁড়িয়েছিল মুখোমুখি!

স্মাহি বলেছিল, ‘জেঠু তো নেই! জেঠিমাও ঘুমোচ্ছে! আর কেউ তো…’

ওয়াটারপ্রুফ খুলে ততক্ষণে বাড়ির দালানে এসে দাঁড়িয়েছিল দীপক। স্মাহির দিকে তাকিয়ে হেসেছিল সামান্য। তারপর মৃদু গলায় বলেছিল, ‘জানি।’

স্মাহি চোখ তুলে তাকিয়েছিল চট করে। কী ছিল সেই ফিসফিসানি স্বরের মধ্যে! সেই দুপুর আর বৃষ্টির মধ্যে! বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছমছম করে উঠেছিল স্মাহির! শ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছিল অকারণেই! অকারণেই? নাকি কারণ ছিল। এমন একটা কারণ যেটা স্মাহি নিজেকেও জানাতে ভয় পেত!

ও দম আটকে আসা স্বরে মাথা নামিয়ে কোনওমতে বলেছিল, ‘তাহলে আপনি এলেন কেন!’

দীপক সামান্য এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে। তারপর বলেছিল, ‘তুমি জানো না?’

‘আমি!’ চমকে উঠে তাকিয়েছিল স্মাহি। দেখেছিল দীপক এসে দাঁড়িয়েছে একদম সামনে! আর ও দীপকের চিবুকটা দেখেছিল সামনে থেকে! খাঁজ কাটা। নীলাভ! বুকের মধ্যে এক হাজার কাচের বাসন ভেঙে পড়েছিল ঝনঝন করে! ও বুঝতে পারছিল সব ভেসে যাচ্ছে, ধুয়ে যাচ্ছে প্রবল বৃষ্টিতে!

দীপক আলতো করে ওর কোমর ধরে একরকম উঠিয়ে নিয়েছিল কোলে! তারপর দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরেছিল ঠোঁট! জিভ দিয়ে খুঁজছিল ওর জিভ! আর গভীর জঙ্গলের মতো আফটার শেভ লোশনের গন্ধে ডুবে যেতে যেতে স্মাহি বুঝতে পারছিল তলপেটে কীসের একটা চাপ লাগছে! দীপক যখন ওর ঠোঁট থেকে ধীরে ধীরে মুখটা নামিয়ে আনছিল বুকের দিকে, স্মাহিও তখন আস্তে আস্তে নিজেকে চেপে ধরেছিল তলপেটের সেই উদ্ধত ভালবাসায়!

দীপক ওর চেয়ে বাইশ বছরের বড় ছিল। কিন্তু একান্তে নাম ধরেই ডাকত দীপককে! কীসের যে কুহক ছিল সেটা আজও বুঝতে পারে না, কিন্তু দীপক ডাকলেই চলে যেত স্মাহি! কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থাকবে বলে বাড়িতে মিথ্যে বলে গিয়ে হোটেলে দীপকের সঙ্গে থেকেছে স্মাহি। নিয়মিত ভাবে মিলিত হত ওরা! দীপক পাগলের মতো আদর করত ওকে! স্মাহি নিজেকে ছেড়ে দিত একদম। শরীরের মধ্যে যে এমন একটা স্বর্গ আছে সেটা দীপকের কাছে গেলে বুঝতে পারত ও! কেমন একটা জালে জড়িয়ে গিয়েছিল স্মাহি। অন্ধের মতো হয়ে গিয়েছিল! আর তাই তো দেখতে পায়নি আদিতকে! কাছেই তো ছিল! তাও দেখতে পায়নি! আর আজ এতদিন পড়ে সেই সকালটার কথা মনে পড়লে কষ্ট হয় স্মাহির! এই এত দূরে এসে আজ যেন স্পষ্ট দেখতে পায় আদিতকে! শুধু আদিত আর দেখতে পায় না ওকে! আদিতের হয়ত মনেও পড়ে না!

স্মাহি হাতের ঘড়িটা ধরল! কে দিয়েছে ওকে এই ঘড়ি! ওই হলুদ পালক! আদিত কি! ও যে ভাবে আদিত ওকে দেখতে পায় না, সেটা কি তাহলে ঠিক নয়! কিন্তু তাহলে আদিত আসবে না কেন সামনে! ওকে যদি সত্যি পছন্দ করে তাহলে কেন আড়ালে থাকবে! নাঃ, আদিত নিশ্চয় দেয়নি এই ঘড়ি! তাহলে কে দিল! কেন দিল!

‘কীরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস!’ সীমাদির কথায় যেন ঘোর কাটল স্মাহির। দেখল সীমাদি ওর ব্যাগটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে!

সীমাদি ওর সঙ্গেই কাজ করে। খুব ভাল মহিলা। স্মাহিকে বোনের মতোই দেখে।

সীমাদি বলল, ‘আরে পুলিশ এসেছে! ঘেরাও তুলে দিয়েছে। ফাইন্যান্স ডিরেক্টর সাহেব বলেছেন আমাদের সাবধানে পুলিশের কর্ডনের মধ্যে বেরিয়ে যেতে! চল চল দেরি করিস না!’

সীমাদি কথা শেষ করে, এক রকম ধাক্কিয়ে ওকে বের করে আনল অফিস থেকে। রোদে বেরিয়ে চোখ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকাল স্মাহি! সকালের সানগ্লাস-পরা রোদ! নরম।

গেটের বাইরে থিকথিক করছে লোকজন। ওদের দেখেই স্লোগান উঠল। কিন্তু কীসব বলছে সেদিকে কান দিল না স্মাহি। দুদিকে পুলিশ বেতের ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় হেলমেট। তাদের মধ্যে দিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত সামনে এগিয়ে গেল সামনে।

বড় রাস্তা অবধি পুলিশ এগিয়ে দিল ওদের। সামনেই রিকশা স্ট্যান্ড। স্মাহি আর কোনওদিকে না তাকিয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়ল। তারপর স্টেশানের দিকে যেতে বলে রিকশার হুডটা টেনে নিল মাথার ওপর! এখন সোজা বাড়ি গিয়ে ঘুমোবে! আর পারছে না!

‘স্মাহি স্মাহি!’ কে যেন চিৎকার করে ডাকল ওকে। চোখ খুলে তাকাল ও। বলাই! গলাটা চিনতে পেরেছে! ওফ্, কী জ্বালাতন! কাঁহাতক আর এসব ভাল লাগে! বিশেষ করে এখন!

তাও রিকশাওলাকে রিকশা দাঁড় করাতে বলল স্মাহি!

বলাই সাইকেলটা দাঁড় করাল ওর পাশে। তারপর নেমে এগিয়ে এল, ‘তুমি ঠিক আছ?’

স্মাহি বেজার মুখে একটা হাই আটকে বলল, ‘খুব ক্লান্ত। প্লিজ কিছু বলার হলে বলো!’

সামান্য থমকে গেল বলাই। বুঝতে পেরেছে এভাবে আটকানোতে স্মাহি বিরক্ত হয়েছে!

ও বলল, ‘না মানে… তুমি ঠিক আছ কীনা তাই জানতে চাইছিলাম। আসলে, কাল আমার কথা শুনলে এই দুর্ভোগ হত না তোমার! এদিকে কেস খুব বিগড়ে গেছে!’

স্মাহি তাকাল। এসব ভাল লাগছে না এখন। ছেলেটা বোঝে না কেন!

বলাই বলল, ‘আদিতের ওপর নেতারা খুব খেপে গিয়েছে এমন ঘেরাও করায়। বাদলদা থেকে কলকাতার বড় নেতারা সবাই খচে বোম! আদিত নাকি নিজেকে সামনে আনতে চেয়ে এসব করছে! জানো আমি তো শুনলাম…’

স্মাহি সোজা হয়ে বসল। আদিতের ওপর রেগে গিয়েছে নেতারা! ও তাকাল বলাইয়ের দিকে, ‘কী হয়েছে?’

বলাই এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘আদিতকে না কিছু করে দেয়! মানে বাদলদা বলল, মালটার ডানা ছাঁটতে হবে। খুব উড়ছে! ওর ওড়া বের করছি দাঁড়া! আমার তো শুনেই ভয় লাগছে! আদিতকে মেরে না দেয়!’

একটা পায়রা ছিল জেঠুর! বাদামি আর সাদা মেশানো রঙ! খুব উড়ত আকাশে। ডিগবাজি খেত! আদিত ভীষণ পছন্দ করত সেটাকে। পাখিটা যেদিন মারা গেল, আদিত খাঁচার জালে মাথা রেখে কেঁদেছিল খুব! বলেছিল, ‘আমি যা ভালবাসি তাই চলে যায় আমার থেকে! তাই নষ্ট হয়ে যায়!’

আজ আচমকা সেই কথা মনে পড়ল স্মাহির! আর দম বন্ধ হয়ে এল ওর! মনে হল, আদিতের মতো ওরও কি এমনটাই হয়! যা যা পছন্দ করে তাই কি চলে যায় ওর থেকে! অলক্ষ্যে বসে থাকা কেউ কি ওর পছন্দের সব কিছু কেড়ে নেন! তাহলে কী পড়ে থাকে ওর হাতে! শুধু মাত্র হলুদ পালক! নির্জন এক টুকরো হলুদ পালক!

১৪ নিরমুক্তা

এই রাস্তাটার কী যেন নাম! মুকু মাথা নিচু করে রাস্তার দোকানে সাইন বোর্ড দেখার চেষ্টা করল। আজ আচমকা বৃষ্টি হয়েছে! চারিদিক কেমন যেন মেঘলা আর কুয়াশায় ঢাকা! আজ সকালে নেট-এ আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখছিল, সেখানে বলছে আগামী কয়েকদিন নাকি এমন কুয়াশা থাকবে!

আজ ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখ! দেখতে দেখতে ছুটির দিনগুলো কী করে যে বেরিয়ে গেল! কিন্তু কাজের কাজ তো কিছু হয়নি! মুকু কলেজ স্ট্রিটের সেই পিসির বাড়ি ছাড়াও আরও কয়েক জায়গায় গিয়েছিল। এমন কী হালিশহর পর্যন্ত ঘুরে এসেছে তিজুদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে! কিন্তু কেউ তিজুর খবর জানে না। এমন কী একজন তো মনেও করতে পারছিল না তিজু কে!

‘এতদিন পরে ছুটি পেল আর এভাবে নষ্ট করলে!’ প্রিতম রাগ করছিল গত পরশু। বলছিল, ‘এখনও ওই স্বার্থপর লোকটা তোমার মাথা থেকে বেরোয়নি কেন ভেবে অবাক লাগছে আমার! তুমি এলে না বলে আমি ছুটি ক্যানসেল করলাম! আমার খুব খারাপ লাগছে!’

মুকু প্রিতমের এসব কথায় কোনও বাঁধা দেয়নি। বরং সময় নিয়ে ওকে শেষ করতে দিয়েছিল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘একটা লোককে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না! সেটা দেখা কি কর্তব্য নয়!’

‘কর্তব্য এক তরফা হয় না! তোমার অমন সময়ে সে কি কর্তব্য করেছিল!’ প্রিতম দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ‘আর তুমি এখন কর্তব্য দেখাচ্ছ!’

মুকুর মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল! মনে হচ্ছিল প্রিতমকে সেসব কথা বলাটাই ভুল হয়েছিল খুব! রাগটা যে পাকাচ্ছে বুঝতে পারছিল মুকু। ও জানে রাগ ওর মধ্যে একটা দেওয়াল তুলে দেয়! ওই পাড়ে থাকা মানুষটা তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে! মুকুর মনের মধ্যে অন্য একটা দরজা যেন খুলে যাচ্ছিল! নিজের কাছে যেন আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে প্রিতমকে আসলে সত্যিই ভালইবাসেনি ও! কেবল একটা ভাল লাগা আর সেটল করার লজিক-এ ভর দিয়ে এতদিন যেন নিজেকে টানছিল ও। সেই লজিকটাকেই কেমন যেন সভ্যতার প্রলেপ দিয়ে ভালবাসা বলে চালাবার চেষ্টা করছিল নিজের কাছে! কিন্তু সস্তা গিলটি করা গয়নার মতো জীবনের সামান্য ঘষা খেতেই সেই চকচকে ভাব উঠতে শুরু করেছে! মুকুর এখন মনে হচ্ছে কী করে এই সম্পর্ক থেকে বেরবে ও!

কিন্তু ভাবলেই তো আর করা যায় না! বড় হওয়ার সঙ্গে সব ভেঙে ফেলার, পালটে ফেলার ইচ্ছেগুলোকে লাগাম পরাতে হয়। তাই প্রিতমের সঙ্গে কথা বাড়ায়নি! আর কার জন্যই বা বাড়াবে! সত্যি তো কে আছে ওর! সে তো ডিভোর্স দিয়ে দিল! হ্যাঁ, মুকু খুব জোর করেছিল, সেও কয়েকবার বুঝিয়েছিল! কিন্তু তারপর তাও দিয়ে দিল তো! জোর করে একদম ধরে তো রাখল না! তাহলে কীসের আশায় ও প্রিতমকে বারণ করে দেবে!

‘কীরে চুপ কিরে আছিস কেন? এখনও রেগে আছিস!’ মা পাশের থেকে আলতো করে হাত ধরল ওর!

মুকু তাকাল। মায়ের শরীর এখন ভাল। কিন্তু তাও ফিরে যায়নি। ওর সঙ্গেই থেকে গিয়েছে! মুকু বলেছিল তুমি ফিরে যাও মা। কিন্তু মা পাত্তা দেয়নি। কেন পাত্তা দেয়নি, সেটা কাল রাতে বুঝতে পেরেছে মুকু।

ডিনার করে মুকু তখন বডি লোশন নিয়ে বসেছিল।

মা শুয়ে পড়েছিল নিজের বিছানায়। লেপের মধ্যে থেকে শুধু মাথাটাই দেখা যাচ্ছিল মায়ের।

মা বলেছিল, ‘কাল কিন্তু তোর ওইসব হাবিজাবি কাজ রাখবি না! তুই আমার সঙ্গে কাল একটা জায়গায় যাবি। বিকেলে। দরকার আছে!’

‘কীসের দরকার?’ মুকু লোশন মাখা থামিয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।

মা বলেছিল, ‘কাল প্রিতমের বাবা মা আসবে। আমাদের চায়ের নেমন্তন্ন করেছে! যাব আমরা!’

‘কী!’ মুকু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে, ‘এসব কবে হল! আর আমায় বলোনি কেন! তুমি বলোনি, প্রিতম বলেনি! কেন! আমায় বলার দরকার মনে করোনি!’

মা বলেছিল, ‘সারাক্ষণ মুখ নাড়বি না! যত টাকাই রোজগার করিস। তুই আমার মেয়ে!’

‘হ্যাঁ, মেয়ে, ক্রীতদাসী নই! আমাদের দেশে বাবা মায়েরা তো সন্তানদের ক্রীতদাস মনে করে!’ মুকু বিরক্তিতে লোশনের শিশিটার মুখ আটকে পাশের দিকে ছুড়ে দিয়েছিল।

মা লেপের মধ্যে আরও ঢুকে গিয়ে বলেছিল, ‘যা বলেছি শুনবি। ব্যাস। নিজে একটা বিয়ে করে দেখলি তো কী হল! তখনই বলেছিলাম ফালতু ছেলে! প্রিতমের সঙ্গে ব্যাপারটা আমি কিছুতেই ভাঙতে দেব না।’

ঘরের আলো নিভিয়ে চুপ করে লেপ টেনে শুয়ে পড়েছিল মুকু। কেন কে জানে চোখে জল আসছিল বারবার। মা এখনও এমন করে ভাবে! তিজুকে এখনও এতটা ঘৃণা করে! মুকুর মধ্যে থেকে আবার যেন সেই কলেজবেলার মুকু বেরিয়ে আসছিল! আবছা অন্ধকার ঘরে, লেপের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ও যেন আবার সেই ‘কুল ওয়াটার’ পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিল! তিজুর গন্ধ পাচ্ছিল! নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল ওর! কেন তিজুকে ও সরিয়ে দিল! কুয়াশা সরিয়ে নাবিকের কাছে যেভাবে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে দ্বীপ, সেভাবেই ওর সামনে যেন নিজের মনের ইচ্ছেটাও পরিষ্কার হয়ে উঠছিল! নিজে যেন বুঝতে পারছিল আসলে তিজুর প্রতি ভালবাসা কোনওদিনই মরে যায়নি। রাগ আর অভিমানের কুয়াশায় ঢাকা পড়েছিল মাত্র! কিন্তু যত আরেকটা সম্পর্কে পাকাপাকি ভাবে আটকে পড়বে মনে হচ্ছে, ততই তিজুর প্রতি যেন টান বাড়ছে মুকুর! কষ্ট বাড়ছে! যেন বুঝতে পারছে দীপনের ডাক একটা অজুহাত মাত্র, আসলে ও মনে মনে তিজুর দিকেই যেতেই চায়!

ওই ঘোলাটে অন্ধকারে যেন নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল মুকু। আর যেন কোনও আড়াল ছিল না! জীবন যেন কানে কানে ওকে বলছিল, ‘এবার, অন্তত এবার ভান বাদ দে! এবার নিজের মনের ইচ্ছেটা নিজের কাছে স্পষ্ট করে বল। রাগ, অহম আর অভিমানের ঊর্ধ্বে উঠে, এবার নিজের কাছে সত্যি হ!’

মুকু যেন বুঝতে পারছে, নিজের কাছে ‘সত্যি’ হতে পারে না বলেই মানুষের এত কষ্ট! এত মনখারাপ!

তবে, মায়ের সঙ্গে আর প্রিতমের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে আপত্তি করেনি! দেখা করবে না বললে শুধু শুধু ঝামেলা আর অশান্তি হবে! দেখাই যাক না ওঁরা কী বলেন!

নাইন্থ সিম্ফনি বেজে উঠল আবার! কে এখন ফোন করল! ব্যাগের থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল মুকু। রাজু বলে সেই লোকটার নাম্বার! বিরক্তিতে মুখটা বেঁকে গেল! প্রিতমের কীসব পরিচিত মানুষজন! সত্যি কারা মানুষের হয়ে কাজ করার নামে ভেক ধরে দেশে লুঠতরাজ করছে! সেদিন দেখা হওয়ার কথাটা আবার মনে পড়ে গেল মুকুর!

সেদিন রাজুর বাড়ির মধ্যে ঢুকে সামান্য থমকে গিয়েছিল মুকু। বাইরে যেমন লোকজন বসে, তেমন ঘরের মধ্যেও বেশ কয়েকজন বসেছিল। আর সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

‘আপনি ম্যাডাম ওই ঘরে চলে যান!’ একটা লোক ওকে সামনের দিকের একটা ঘর দেখিয়ে দিয়েছিল!

পায়ে পায়ে সেই ঘরের দিকে গিয়েছিল মুকু। জুতো খুলে আসতে হয়েছিল ঘরে ঢোকার দরজার কাছে। ঠান্ডা মার্বেলের মেঝে যেন পিন ফোটাচ্ছিল পায়ের পাতায়!

মুকু দরজায় গিয়ে নক করেছিল। ভারি কাঠের দরজা। অর্ধেকটা ঘষা কাচে ঢাকা!

দরজার ভেতর থেকে ‘আসুন’ শুনে ভেতরে ঢুকেছিল মুকু।

নরম কার্পেট মোড়া একটা বড় ঘর। একদিকে বিশাল কাচের জানলা! ভার্টিকাল ব্লাইন্ডস একপাশে জড়ো করা ছিল। খোলা জানলা দিয়ে হই হই করে রোদ ঢুকে আসছিল সেদিন।

নরম একটা চেয়ার টেনে বসে নিজেকে গুছিয়েছিল মুকু।

রাজু সামনে ঝুঁকে তাকিয়েছিল ওর দিকে, ‘প্রিতমদা বলেছে আপনার কথা বউদি। তবে কী জানেন, খুব চাপে আছি। পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলতে পারব না। কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমি নিরুপায়! তাই দ্রুত বলুন!’

মুকুর বিরক্তি লেগেছিল লোকটার কথা বলার ধরনে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বাইরে প্রকাশ করেনি! ও অল্প কথায় ব্যাপারটা গুছিয়ে বলেছিল।

রাজু সবটা শুনে চুপ করেছিল একটু। টেবলের এক পাশ থেকে একটা ছোট্ট সাদা কৌটো বের করে খুলে তার থেকে জর্দার মতো মুখে দিয়েছিল কিছু। কয়েকবার চিবিয়ে তার রস গিলে নিয়ে বলেছিল, ‘এতে আমি কী করব বুঝতে পারলাম না! আমি পুলিশ নই। গোয়েন্দা নই! আমার ক্ষমতাও নেই কিছু। প্রিতমদা আমার কাছে আপনাকে পাঠাল কেন বুঝতে পারলাম না! আপনি বলছেন পুলিশে জানালে অনেকে জেনে যাবে। ওদের বিজনেসে সমস্যা হবে। বোর্ড অব ডাইরেক্টরসে প্রবলেম হবে। কিন্তু তাতে আমি কী করব বলুন তো! পুলিশ ইনভেস্টিগেট করলে নাহয় আমি ওদের কাজটা এক্সপিডাইট করার জন্য বন্দোবস্ত করতাম! কিন্তু সেটা যখন সম্ভব নয়, তখন আমি বুঝতে পারছি না কী করব!’

রাজু কথা শেষ করে মুকুকে দেখিয়েই নিজের ঘড়িটায় চোখ রেখেছিল। এর কী অর্থ সেটা মুকুর বুঝতে অসুবিধে হয়নি! ওর রাগ হচ্ছিল খুব! কেন এখানে ওকে পাঠাল প্রিতম!

রাজু যেন বুঝতে পেরেছিল ওর মনের ভাব। তাই কিছুটা সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতেই বলেছিল, ‘আপনি ওর কোনও ছবি এনেছেন? দিয়ে যান। আমি দেখব!’

মুকু বলেছিল, ‘মোবাইলে আছে!’

‘আমায় হোয়াটস্যাপ করে দেবেন! আমি চেষ্টা করব! সরি আমায় বেরোতে হবে। তাই মানে…’

‘আমি আসছি। থ্যাঙ্কস ফর ইয়োর টাইম!’ মুকু আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে।

রাজু পেছন থেকে বলেছিল, ‘আপনি বৃথা খুঁজছেন। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি হারিয়ে যেতে চায়, কেউ তাকে আটকাতে পারে!’

মানুষ হারিয়ে যেতে চাইলে কেউ তাকে আটকাতে পারে না। তাবলে কি তাকে খোঁজা বন্ধ করে দিতে হবে!

রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল মুকু। দেখেছিল অনেক ওপর দিয়ে একটা এরোপ্লেন যাচ্ছে! আকাশের গায়ে চকের মতো করে ধোঁয়ার রেখা টেনে যাচ্ছে ছোট্ট রুপোলি আকাশযান! আচমকা নিজেকে ঠিক অমন সামান্য, ছোট্ট আর একলা লেগেছিল মুকুর! কেমন যেন চোখে জল এসে গিয়েছিল। কার ওপর এমন রাগ করে হারিয়ে গেল তিজু! ওর ওপর! দীপন কেন কিছু বলছে না কেন এমনটা করল তিজু!

রেস্টুরেন্টটা খুব সুন্দর! সাদা আর কালোয় সাজানো! একদম যেন ব্রিটিশ রাজের সময় থেকে তুলে এনে কেউ এই পূর্ণদাস রোডে বসিয়ে দিয়েছে!

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এক কোণে প্রিতমের মা আর বাবাকে দেখতে পেল মুকু। কাছের একটা বড় আলাদা ঘর আছে। প্রিতমের বাবা মা সেই ঘরে ঢোকার মুখে ডান দিকে একটা টেবলে বসে আছেন!

মুকুরা এগিয়ে গিয়ে বসল সেখানে!

মুকু বলল, ‘কাকু আপনারা এখানে! মা কাল আমায় বলল! আমি তো অবাক!’

মা মুকুর পাশে বসেছে। মুকু এমন করে বলায় মা সবার চোখের আড়ালে আলতো করে ওর হাতে একটা চিমটি কাটল! মুকু বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ও তো তেমন কিছু বলেনি! মা এমন করছে কেন!

মা বলল, ‘আরে বলবেন না। কাল রাতে শুনে ও তো তখনই জেদ ধরেছিল আপনাদের কাছে যাবে। আজকাল তো আর দিন রাতের পার্থক্য নেই! বিশেষ করে মুকুদের মতো অল্পবয়সিদের জীবনে আর কী!’

মুকু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। এভাবে মিথ্যে বলে কাকু কাকিমাকে খুশি করার কী আছে! ওর খুব অপমান লাগল।

ও বলল, ‘আসলে আমি তো কাজে এসেছি এখানে একটা। তাই…’

মা আবার বাধা দিল ওকে, ‘বাজে কাজ যত। ওসব বাদ দে। ওঁদের জন্য কী নিয়ে এসেছিস সেটা দে!’

মুকু চোয়াল শক্ত করল। এখানে আসার আগে মা ওকে হিন্দুস্থান রোডের কাছে একটা বড় জামাকাপড়ের দোকানে যেতে বাধ্য করেছিল। সেখান থেকে কাকু কাকিমার জন্য এথনিক জামাকাপড় কিনিয়েছে ওকে দিয়ে! এসব বাড়াবাড়ি একদম ভাল লাগে না মুকুর!

ও তাও হাসি মুখে এগিয়ে দিল প্যাকেটটা। প্রিতমের মা, মানে কাকিমা বাঁ হাত দিয়ে হাতটা ধরলেন ওর। তারপর ডান হাতে ব্যাগ খুলে একটা বালা বের করে পরিয়ে দিলেন মুকুর হাতে! রেস্টুরেন্টের আলোয় সোনার গায়ে বসানো ছোট ছোট হিরের মিছিল ঝলমল করে উঠল! মুকু স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল কাকু কাকিমার দিকে!

কাকিমা হেসে ওর হাতটা ধরে বললেন, ‘এটা ভেবেছিলাম সিঙ্গাপুরে প্রিতমের সামনেই দেব! কিন্তু তুমি তো সময় করতে পারলে না! তাই দিয়ে দিলাম এখানে!’

মুকু কী বলবে বুঝতে পারল না! এত দামি একটা জিনিস! কীভাবে নেবে ও!

মা বলল, ‘কী সুন্দর! কিন্তু ফেব্রুয়ারিতেই তো বিয়ে! তখন দিলেই পারতেন! আচ্ছা, কোথায় বিয়ে হবে ভেবেছেন! মানে লক্ষ্ণৌতে তো আমাদের বাড়ি ভাড়া করতে হবে!’

‘না না,’ কাকু হাত নেড়ে মাকে চুপিয়ে করিয়ে দিলেন, ‘আমরা ডেস্টিনেশান ম্যারেজ করব! রেজিস্ট্রি এখানে হবে। কিন্তু আমরা বিয়েটা দেব ইউরোপে! সাউথ অব ফ্রান্স ভাল। এখনও ভেনিউ ঠিক করিনি। কিন্তু আমাদের তাই ইচ্ছে!’

‘না না,’ মুকু আর চুপ করে থাকতে পারল না, ‘এই বয়সে আর এসব…’

‘আরে!’ কাকু হোহো করে হেসে উঠল, ‘কী আর বয়স! আর বয়সটা ফ্যাক্টর নয়! বিদেশে কেউ এভাবে ভাবেই না! একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা! আর আমার টাকা কম নাকি! প্লাস প্রিতমের রোজগারও তো জানো! কী করব এত টাকা! সঙ্গে নিয়ে তো যাব না! একটু খরচ করতে দাও মা!’

কথাটার মধ্যে এমন একটা বাচ্চা ছেলের আবদার ছিল যে মুকু হেসে ফেলল। তারপর বলতে গেল, যে এসব জাঁকজমক ওর ভাল লাগে না! আর আসলে বিয়ে হবে কীনা সেটাও ও ভেবে দেখছে! কিন্তু পারল না! আচমকা ফোনটা বেজে উঠল ব্যাগের মধ্যে! কে ফোন করল এখন!

ও ফোনটা বের করে দেখল। অচেনা নাম্বার! সামান্য দ্বিধা নিয়ে ফোনটা কানে লাগাল, ‘হ্যালো!’

‘ম্যাডাম, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। এক্ষুনি!’

‘এক্ষুনি!’ সামান্য ঘাবড়ে গেল মুকু, ‘কে বলছেন?’

‘আমি নীচেই রেস্টুরেন্টের সামনে আছি। দু মিনিট নেব! আপনার দরকারি কথাই বলব! প্লিজ যদি আসেন!’

‘কে বলছেন আপনি!’ মুকু সামনে বসা মানুষগুলো যাতে ঘাবড়ে না যায় সেই জন্য যথা সম্ভব ক্যাজুয়াল গলায় বলল কথাগুলো!

‘প্লিজ আসুন একা। আমি বাইরেই আছি। দুমিনিট!’ লোকটা কেটে দিল ফোনটা।

মুকু তাকাল হাতে ধরা মোবাইলের দিকে। কে ফোন করল ওকে! এভাবে ডাকল কেন!

‘কে রে?’ মা ভুরু কুঁচকে তাকাল, ‘এখন কাজের কথা বলব আমরা। তুই ফোনটা বন্ধ রাখ!’

মুকু উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, ‘জাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্য আমি আসছি। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড! পাঁচ মিনিট। প্রমিস!’

তারপর কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে দৌড়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে!

বাইরে মেঘ করে এসেছে আরও। চুনের জলের মতো কুয়াশা ঘন হচ্ছে ক্রমে! তার মধ্যে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখল মুকু। লোকটা বেঁটে। ভাল চেহারা। মোটা গোঁফ! নীল জ্যাকেট পরে আছে। আর একটা চিরুনি দিয়ে পাট পাট করে আঁচড়াচ্ছে নিজের লাল রঙের চুল! লোকটা ওকে দেখে দাঁত বের করে হেসে এগিয়ে এল।

মুকু তাকিয়ে রইল ওর দিকে! মনে পড়ে গিয়েছে ওর! লোকটাকে কোথায় দেখেছিল মনে পড়ে গিয়েছে! লোকটাকে ও দেখেছিল সেই পিসিমার বাড়ি থেকে বেরোবার সময়! সাইকেল ধাক্কা মেরেছিল লোকটাকে! কিন্তু কী চায় লোকটা! ওকে ফলোই বা করছে কেন!

মুকু দ্বিধা নিয়ে তাকাল লোকটার দিকে!

১৫ ঋত্বিজ

বাইকটা স্টার্ট করে জগনের দিকে তাকাল তিজু। ছেলেটা আজ ওর সঙ্গে দুপুরে খেয়েছে। তারপর বেরিয়েছিল পান কিনতে। এই সবে ফিরছে! ওকে বলেছে শিশু মঙ্গল হাসপাতালের সামনে যেন ওকে নামিয়ে দেয়! সেখানে কীসের যেন একটা কাজ আছে!

কী কাজ সেটা আর জিজ্ঞেস করেনি তিজু। ও জানে জিজ্ঞেস করলে জগন হেসে একমুখ পানের পিক নিয়ে বলবে, ‘আমি রিটায়ার্ড মানুষ দাদা। কিছু ইমপরট্যান্ট কাজ নয়! এমনি!’

এমনি! কথাটা ঠিকই বলে জগন। সত্যি সবটাই আজকাল এমনি লাগে তিজুর! ঘুম থেকে উঠে মনে হয়, কী আছে এই জীবনে! কে আছে ওর! দীপনের সংসার আছে! বিজনেস আছে! হ্যাঁ ওর শরীর ভাল নেই! কিন্তু আস্তে আস্তে উন্নতি হচ্ছে। ডাক্তার বলছে আর মাস ছয়েকের মধ্যে ও আবার হাঁটতে পারবে! ফিজিওথেরাপিতে কাজ হচ্ছে! ওর স্ত্রী, শ্বশুরমশায়, শাশুড়ি, দুই শালা, সবাই খুব সাপোর্টিভ! দীপনের জীবনে অনেকে আছে। সেখানে ওর কে আছে! মুকু ছিল! আর নেই! ছেড়ে গিয়েছে ওকে! আর মা! মা তো চলে গেল! কিন্তু যাওয়ার আগে নার্সিংহোমে যে শেষ দুটো কথা বলে গিয়েছিল সেটা একদম পালটে দিয়েছে ওর জীবন!

‘চলুন দাদা!’ জগন ব্যাক সিটে উঠে পান মুখে বলল।

‘হ্যাঁ!’ হাসল তিজু। তারপর বাইকে স্টার্ট দিল! সারা পাড়া কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল বাইক!

ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তাটা সামান্য সরু। সেটা দিয়ে বেরিয়ে ডান দিকে বাঁক নিল তিজু। অলিগলি দিয়ে গিয়ে লেক গার্ডেন্স ফ্লাই ওভারের সামনে উঠবে।

‘দাদা,’ পেছন থেকে জগন মৃদু ট্যাপ করল ওর কাঁধে, ‘এমন সাইডকার লাগানো বাইক নিলেন কেন?’

হাসল তিজু, ‘আমার ছোটবেলার ইচ্ছে ছিল এমন একটা বাইক কেনার। তাই তোকে বলেছিলাম এমন একটা জিনিস জোগাড় করে দিতে!’

‘তাই তো জিজ্ঞেস করছি!’ জগন যে কথার শেষে রাস্তায় পানের পিক ফেলল সেটা বুঝতে পারল তিজু। এই জিনিসটা পছন্দ করে না ও। আগে হলে ও বলত। কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করে না কিছু বলতে। ও একটা জিনিস দেখেছে, জীবনে কেউ কিছু শোনে না। যে যার মর্জি মতো কাজ করে। সবার সিঙ্গল পয়েন্ট এজেন্ডা হল সে নিজে! তাই আর নিজের মুখ নষ্ট করে না তিজু। বরং এমন একাকিত্বে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে! না, সেটা যে ভালবেসে করে, তা নয়! কিন্তু জীবনে ও এমন একটা জায়গায় এসে পড়েছে যে সেখানে এটাতেই ও নিরাপদ মনে করে! মানুষজন ওকে হতাশ করেছে শুধু। আর কিছু করেনি!

জগন আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল দাদা! আপনাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন থেকে আজকের আপনির মধ্যে অনেক ফারাক! কেন এমন হল দাদা? সরি আমি পারসোনাল স্পেসে ঢুকে পড়ছি! কিন্তু আমি জানতে চাই! আপনার স্ত্রী আপনাকে খুঁজতে এসেছেন শহরে! আর আপনি লুকিয়ে আছেন! কেসটা কী?’

‘স্ত্রী!’ সামান্য হাসল তিজু। পেছন দিকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, ‘স্ত্রী ছিল। এখন নেই! আর তুই এত সব জানিস, আমি কেন এসেছি সেটা খুঁজে বের করতে পারবি না!’

‘খুঁজে বের করব?’ জগন শব্দ করে হাসল, ‘আচ্ছা দাদা, আপনি এখনও ভালবাসেন বউদিকে? তাই না?’

তিজুও শব্দ করে হাসল। কিছু উত্তর দিল না। বরং পালটা প্রশ্ন করল, ‘তুই এখানে কী করিস বলতো! সত্যি করে বল!’

‘দাদা কথা কাটালে হবে না!’ জগন হাসল, ‘আমি বুঝি দাদা! আজ সকালে নীপাকে নার্সিংহোম থেকে এনে আপনি যখন স্নানে গিয়েছিলেন আমি বসে ম্যাগাজিন দেখছিলাম। আপনার প্যান্টটা চেয়ার থেকে সরিয়ে বিছানায় রাখতে গিয়েছিলাম, তখন আপনার মানিব্যাগটা পড়ে গিয়েছিল প্যান্ট থেকে! আমি সেটা তুলে রাখতে গিয়ে বউদির ছবি দেখেছি ওটায়! সরি, দাদা ইচ্ছে করে দেখিনি! মানিব্যাগটা খুলে গিয়েছিল!’

তিজু কী বলবে বুঝতে পারল না! ব্রিজের ওপর বাইকের গতি বাড়িয়ে দিল!

জগন আবার বলল, ‘কেন ডিভোর্স দিলেন দাদা? বেকার! মনে নিয়ে ঘুরছেন, কিন্তু বলছেন না! বউদি এসেছে আপনাকে খুঁজতে! আর আপনি লুকিয়ে ঘুরছেন! কেন?’

তিজু হাসল। ব্রিজ পার করে এবার বাইকটাকে দাঁড় করাল রাস্তার এক পাশে। তারপর বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে সাইডকারের ভেতরে রাখা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট তুলে নিয়ে বলল, ‘আমি ওই লোকটাকে দিয়ে আসি!’

জগন তাকাল ওর দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কেন দাদা!’

তিজু দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। কী করে ও জগনকে বলবে শেষে ছেড়ে যাওয়ার আগে মুকু বলেছিল, ‘আমার সামনে আর আসবি না!’ মুকুর কথা ও ফেলতে পারে না। আজও!

তিজু হাসল। বলল, ‘বললে তুই বুঝবি না!’

‘ট্রাই মি!’ জগন সোজাসুজি তাকাল।

তিজু মাথা নাড়ল জগনের নাছোড় মনোভাব দেখে। তারপর বলল, ‘শোন, “I loved you like a man loves a women he never touches, only writes to, keeps little photographs of.” বুঝলি কিছু?’

জগন হাসল, ‘চার্লস বুকোওস্কি! জার্মান আমেরিকান পোয়েট, নভেলিস্ট!’

তিজু অবাক হয়ে তাকাল জগনের দিকে! তারপর বলল, ‘শালা, তুই জানলি কী করে? তোকে তো কোনওদিন বই পড়তে দেখিনি! তুই কে বলতো! কী করিস তুই?’

জগন আবার পানের পিক ফেলল। তারপর হেসে বলল, ‘কী আবার করব দাদা! বাপ-দাদার খেতি আছে! সেখান থেকে টাকা পাঠায়। আমি তো রিটায়ার্ড!’

তিজু হেসে তাকাল ওর দিকে। তারপর আপন মনে মাথা নেড়ে হেঁটে গেল রাস্তার আরেক দিকে।

সেই লোকটা বসে আছে! ময়লা জামা। মাথায় জট! চোখ ঘোলাটে! ভাঙা চশমা! লোকটা সামনের বড় একটা পাথরের ওপর একটা বোর্ড রেখে তাতে কী যেন লিখছে!

তিজু গিয়ে দাঁড়াতেই মাথা তুলে তাকাল, ‘খাবার দিয়ে কী হবে? আমার লেখার জিনিস এনেছ?’

তিজু হাসল, ‘এই প্যাকেটে সব আছে!’

লোকটা প্যাকেটটা নিল। তারপর একই রকম গম্ভীর ভাবে বলল, ‘আজ কত তারিখ বলোতো!’

‘কুড়ি তারিখ! কেন!’

লোকটা হাসল, ‘শেষ হয়ে এল তো!’

‘মানে?’ তিজু অবাক হল।

লোকটা উত্তর দিল না। মাথা নামিয়ে নিল আবার! তারপর সাদা কাগজে কীসব লিখতে শুরু করল!

তিজু বুঝল আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই!

জগন নেমে গেল শিশুমঙ্গলের সামনে! শুধু যাওয়ার আগে বলল, ‘দাদা, আজ বউদি তাঁর মাকে নিয়ে পূর্ণদাশ রোডে আসবেন। দেখা করতে পারেন কিন্তু!’

তিজু আর কথা না বাড়িয়ে বাইক ছুটিয়ে দিল। অভিনব রাওয়াতের কাছে যাবে আজ। সেদিনের পর রাওয়াত আর সময় দেননি। কিন্তু আজ বলেছেন যেতে! আজ একটা হেস্তনেস্ত করবে তিজু। আর কতদিন অপেক্ষা করবে ও! যেখানে অভিনব মানুষটার নাম জানেন সেখানে কেন বলছেন না!

সেদিনটা কিছুতেই ভুলতে পারবে না তিজু। নার্সিংহোমে বসেছিল ও একা। রাতে কাউকে থাকতে বলেছিল ডাক্তার! তাই সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে একা বসেছিল ও। আসলে মা সারা জীবন ওকে বলত, ও নাকি বাবার ন্যাওটা বেশি। মায়ের দিকে নাকি নজরই নেই! তাই যেন খানিকটা সেই অপরাধ বোধ থেকেই মায়ের কাছে একা থেকে গিয়েছিল ও! যদিও ওদের অফিসের দুজন ছেলেও বাইরের রিসেপশানে বসেছিল দীপনের নির্দেশমতো!

ওদের কোম্পানি বাবা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল। এখন দীপন আর ও পার্টনার! তবে দীপনই সব দেখে! ও কতবার বলেছে দীপনকে যে ও পার্টনার থাকতে চায় না। ও তো নিজের কাজ নিয়ে সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে! ব্যবসার কাজ তো কিছুই করতে পারছে না! কিন্তু দীপন শোনে না কিছুতেই! ছেলেটা খুব ভালবাসে ওকে! বলে, ‘দাদা, তোর যেটা ভাল লাগবে সেটা কর। এসব নিয়ে ভাববি না!’ তিজু ভাবে দীপন বয়সে অনেকটা ছোট হয়েও আসলে ওই যেন বড় আর তিজু নিজে পুঁচকি এখনও!

মায়ের কেবিনের বাইরে বসে এইসব নিয়েই নানান কথা মনে আসছিল তিজুর। আর তখনই নার্স এসে বলেছিল, ‘আপনি একবার আসুন। ম্যাডাম ডাকছেন!’

মায়ের হার্ট খুব দুর্বল ছিল। ডাক্তার বলেছিলেন এখন শুধু অপেক্ষা! মা যেন স্ট্রেস না নেয়! তাই মা ডেকেছে শুনে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল তিজু! মা তো প্রায় অজ্ঞান ছিল! তাহলে! কথা বলছে!

তিজু দ্রুত দরজা ঠেলে ঢুকেছিল ঘরের মধ্যে। দেখেছিল নানান যন্ত্রের মধ্যে শুয়ে মা তাকিয়ে রয়েছে দরজার দিকে।

তিজু গিয়ে বসেছিল মায়ের পাশে রাখা একটা উঁচু টুলের ওপর। মা কষ্ট করে হাত তুলে কাছে ডেকেছিল ওকে। তিজু ঝুঁকে পড়েছিল মায়ের দিকে।

মা খুব কষ্ট করে অস্ফুটে বলেছিল, ‘বাবু, আমায় তুই ক্ষমা করে দিস!’

‘মানে!’ তিজু অবাক হয়ে গিয়েছিল।

মা ক্লান্ত গলায় বলেছিল, ‘আমার দিন শেষ। তাই তোকে বলে যাচ্ছি। তোর ছোটবেলায় একদিন কাঁদছিলাম আমি! মনে আছে তোর! সেদিন কারণটা স্পষ্ট বলিনি। আজ বলছি। তুই যাকে বাবা বলে জেনেছিস সে তোর বাবা নয়! তোর বাবা অন্যজন। বিয়ের আগে আমি কনসিভ করেছিলাম! আর…’

কী বলছে মা! তিজুর মাথা নিমেষে ঘুরে গিয়েছিল। মা এটা কী বলল! বাবা ওর বাবা নয়! মানে যে লোকটাকে ও সবচেয়ে বেশি ভালবাসল সে লোকটা ওর বাবা নয়! তাহলে ওর বাবা কে!

ও মায়ের দিকে তাকিয়েছিল।

মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ছিল সরু ধারায়! মা বলেছিল, ‘কলকাতায় রাধু আছে। রাধারমণ বসু। ও জানে… ও জানে…’

‘তুমি বল, প্লিজ মা! কী নাম তার!’ তিজু ঝুঁকে পড়েছিল আরও।

মায়ের শ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল। তাও তার মধ্যে ক্ষীণ গলায় মা বলেছিল, ‘আনোয়ার শা রোডে থাকে। আমার ডাইরিতে নাম্বার আছে রাধুর। ওর কাছে জানতে পারবি। আমার বলা বারণ! কথা দিয়েছিলাম… শুধু জানবি তোকে একদম ওর মতো দেখতে! একদম… তাই…’

‘মা… মা এটা তুমি কী বললে!’ তিজু তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।

মা চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। শুধু ওর হাত ধরে বলেছিল, ‘ক্ষমা করে দিস বাবু! ক্ষমা…’

মা আবার চুপ করে গিয়েছিল। ওর হাত থেকে খসে পড়েছিল হাত! আর তিজু বুঝতে পেরেছিল মা শেষবেলায় ওকে আরও একা করে দিয়ে গেল!

পরের দিন সকালে মা চলে গিয়েছিল সবাইকে ছেড়ে। তিজুর মনের মধ্যে কী চলছিল ও কাউকে বুঝতে দেয়নি। সব কাজ মিটিয়ে। শ্রাদ্ধ, নিয়মভঙ্গ পার করে ও সময় নিয়েছিল কয়েকটা দিন। তারপর ঠিক করেছিল খুঁজতে যাবে ও। যে লোক ওকে ছেড়ে দিয়েছে! যার নাম বলতে বারণ করে গিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করবে! ওর জীবন ছেলেখেলা করার জায়গা নাকি!

ও দীপনের কাছে গিয়েছিল এরপর।

সেদিন রবিবার ছিল। দীপন অন্যদিন হুইল চেয়ারে করে অফিস যায়। কিন্তু সেদিন ছুটি থাকায়, ওদের বড় টেরাসটায় বসে একটা পেপারব্যাক পড়ছিল।

তিজু গিয়ে সামনের চেয়ারটা টেনে বসে বলেছিল, ‘আমি তোকে একটা কথা বলতে চাই দীপু।’

দীপন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, বল না!’

‘দীপু আমি একটু বাইরে যাব।’

‘কবে? কাজ আছে?’

তিজু চোয়াল শক্ত করে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘একটা কথা বলি। মা মারা যাওয়ার আগে আমায় বলে গিয়েছিল। মানে শুধু আমায়। আর কেউ জানে না। এই তুই জানবি! বলি?’

‘বল!’ দীপু বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা ব্যাপার হয়েছে!

তিজু বলেছিল, ‘আমাদের মা এক দীপু। বাবা নয়! আমি আসলে লাভ-চাইল্ড! যদিও মায়ের বিয়ের পরে আমি পৃথিবীতে এসেছি। কিন্তু আসলে আমি বাস্টার্ড!’

‘কী বলছিস তুই? বাজে কথা খালি!’ দীপন ঝুঁকে পড়ে হাত চেপে ধরেছিল ওর, ‘এসব বলবি না। মায়ের শরীর খারাপ ছিল। কী বলতে কী বলেছে! আর সেটা তুই ধরে নিয়েছিস!’

তিজু বলেছিল, ‘মনে আছে দীপু ছোটবেলায় আমায় সবাই বলতো আমি নাকি বাড়ি ছাড়া! এমন লম্বা ফর্সা তো কেউ নেই বাড়ির! না বাবার মতো দেখতে, না মায়ের মতো! সবাই এই নিয়ে কত কী বলত আমায় বলত! এখন বুঝতে পারছি কেন বলত! মা বলেছে আমায়। আমি নাকি কার্বন কপি সেই লোকটার!’

দীপন চুপ করে বসেছিল কিছুক্ষণ। তারপর জোর দিয়ে বলেছিল, ‘হোক, তুই বাদ দে। তোকে যেতে হবে না। তুই আমার দাদা। এটাই এনাফ! ওসব ভূত মাথা থেকে তাড়া!’

‘তোর জন্য এনাফ আমার জন্য নয়!’ তিজু শান্ত করে দৃঢ় ভাবে বলেছিল।

দীপন বলেছিল, ‘তুই যাবি না কোথাও। এসব ভুলে যা। প্লিজ। যাবি না কিন্তু!’

দীপনকে খুব ভালবাসে তিজু। ছোট থেকে ওর সব কথা শুনে এসেছে। কিন্তু এই কথাটা আর শোনেনি! আসার আগে দীপনের স্ত্রী স্বপ্না খুব জোর করায় বলেছিল, কলকাতার দিকে যেতে পারে! তবে কবে সেটা বলেনি! আচমকাই চলে এসেছিল। জানত, বলতে গেলে ঠিক বাধা দেবে সবাই!

বড় বাড়িটার সামনে বাইকটা স্ট্যান্ড করিয়ে ওপরে উঠল তিজু। আজ বাইরে বেশ মেঘ আর কুয়াশা। ঠান্ডাটা অতটা নেই। সারা পথে এই বিকেলেও সবাই গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়েছে!

এই বাড়ির মধ্যেও যেন কিছুটা কুয়াশা ঢুকে পড়েছে! বেশ পাহাড়ি আবহাওয়া আজ!

লিফট দিয়ে উঠে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে যেতে খুব একটা সময় লাগল না! বেল বাজাতেই কার্তিক খুলে দিল দরজা। ওকে দেখে বলল, ‘বাবু অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য!’

মাথা নাড়ল তিজু। তারপর সরাসরি ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়ল।

এই ঘরটা বেশ অন্ধকার আজ। সব দরজা জানলা বন্ধ। শুধু টিমটিমে আলো জ্বলছে একটা। বেশ সুন্দর একটা ধূপের গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়!

ওকে দেখে অভিনব কোনও ভূমিকা না করেই বললেন, ‘তুমি মোবাইল রাখো না কেন? একটা মোবাইল রাখো। এই নাও ধরো!’ বলেই অভিনব একটা প্যাকেট ছুড়ে দিলেন ওর দিকে! বললেন, ‘সিম ভরা আছে। কানেকশান করানো আছে! রাখো!’

তিজু কোনওমতে ফোনটা লুফে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু আমি তো…’

‘চুপ! কথা শুনতে হয় বড়দের। রাখো ওটা। আমার কিছু দরকার পড়লে কী করে যোগাযোগ করব তোমার সঙ্গে? আমার ক্যান্সার হয়েছে জানো তো! কেমো নিয়ে কী অবস্থা হয়েছে দেখতেই তো পাচ্ছ! আমি আর ক’দিন! আমার কথাটা রাখো।’

তিজু মোবাইলটা পাশে রেখে বলল, ‘স্যার, আমার এসব দরকার নেই! আপনি আমায় শুধু তাঁর নামটা বলে দিন। আমার মা বলে গিয়েছে সেই আমার বাবা! রাধুকাকু বললেন আপনি জানেন। আপনি সেদিন বললেন উনি মারা গিয়েছেন! কবে মারা গিয়েছেন? আর কী নাম, সেটা প্লিজ বলে দিন!’

অভিনব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর উলের টুপি খুলে ন্যাড়া মাথায় হাত বোলালেন কিছুক্ষণ! ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আমি সেদিন যা বলেছি সেটা লিটেরারি ধরো না! সেই লোকটা সত্যি সত্যি মরে যায়নি!’

‘তাহলে!’ তিজুর পা যেন কেঁপে গেল। তবে কি নামটা জানতে পারবে আজকে! ও এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসল সামনে।

অভিনব বললেন, ‘ও বেঁচে আছে। কিন্তু যার ভালবাসার লোক তাকে বাদ দিয়ে অন্যকে বিয়ে করে নেয়, সে তো মরেই যায়, তাই না! সেই হিসেবে সে একজন মৃত মানুষ! বুঝলে!’

১৬ আদিত

লম্বা ঘোলাটে রঙের করিডোরের শেষে কেমন একটা আবছা সিঁড়ি উঠে গিয়েছে অন্ধকার অবধি! কী আছে ওই অন্ধকারের মধ্যে! মনখারাপ! অনিশ্চয়তা! নাকি অপমান! কোন দিকে এগোচ্ছে আদিতের জীবন!

আদিত ধীর পায়ে ওই টানা লম্বা বারান্দার দিকে এগোল! আজ ঠান্ডা নেই তেমন! চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে একদম! কুয়াশা নাকি ধোঁয়াশা! ওর মনটাও তো এমনই হয়ে আছে! কী করবে সামনে সেটাই যেন দেখতে পাচ্ছে না! ব্যাপারটা যে এমন হয়ে যাবে ও বুঝতে পারেনি! তারপর বাবার হার্ট অ্যাটাকটা আজকেই হল।

ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখ আজ। বাবার জন্মদিন। না সেভাবে কারওরই জন্মদিন পালন করার কোনও রীতি নেই আদিতদের! তাও আজকেই মা কেন কে জানে বাড়িতে ভাল মন্দ রান্না করেছিল একটু। পাশের বাড়ি থেকে কয়েকজনকে বলেছিল রাতে খেতে! ঘর বাড়ি গুছিয়েছিল। বাবার জন্য কিনে এনেছিল একটা পাঞ্জাবি! কিন্তু সব আয়োজন বৃথা করে দিয়ে সন্ধেবেলাতেই অমন কাণ্ডটা হল!

গোলপার্ক মোড়ের কাছে আদিত গিয়েছিল মিষ্টি কিনতে! সেখানেই মায়ের ফোনটা পায় ও! বাবা বাথরুমে পড়ে গিয়েছে! আর উঠতে পারছে না! সব কিছু ফেলে রেখে আদিত দৌড়েছিল বাড়ির দিকে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডায়াল করেছিল মাকুকে। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে! ওর একার পক্ষে সেটা তো অসুবিধে হয়ে যাবে! কিন্তু ফোন তোলেনি মাকু! রিং হয়ে হয়ে কেটে গিয়েছিল! কেন এমনটা হল! মাকু তো এমন করে না! তাহলে!

তবে মাকু না এলেও পাড়ার লোকজন সাহায্য করেছে! অ্যাম্বুলেন্স ডেকে দিয়েছে। এমন কী পাড়ার দুই দাদা তো সঙ্গেও এসেছে! আই.সি.সি.ইউ-তে ভর্তি করে সব কিছু সেরে তারপর ফিরে গিয়েছে ওরা। মাও এসেছিল। ওই পাড়ার দাদাদের সঙ্গেই মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আদিত! তারপরেও মাকুকে কয়েকবার ফোন করেছিল। কিন্তু এবার মাকুর ফোন সুইচড অফ বলছিল।

অবাক লেগেছিল আদিতের। আজ বাবার জন্মদিনে মাকুকে রাতে খেতে বলেছিল ও। বলেছিল, ‘বাদলদার কাছে ফাইলটা দিয়েই চলে আসবি। দেরি করবি না কিন্তু!’ মাকু বলেছিল কাজ সেরে বিকেলেই চলে আসবে। কিন্তু আসেনি! কী এমন হল যে এল না মাকু! আর ফোন কেন ধরছে না!

উপায় না দেখে মাকুর দাদার নাম্বারের ফোন করেছিল আদিত। কিন্তু সেখানেও খুব কিছু খবর পায়নি! শুধু জেনেছিল বিকেলে বেরিয়ে গিয়েছে মাকু। তারপর ওরা জানে না। মাকুকে নিয়ে ওর মা ছাড়া আর কেউ বিশেষ চিন্তা করে না! সবাই পাগল বলে কাটিয়ে দেয় ওকে। ওর দাদার গলাতেও সেই তাচ্ছিল্য শুনেছিল আদিত!

আসলে বাদলদাকে সামনের মিটিঙের জন্য চিঠি পাঠাতে হত। ইমেল ব্যবহার করে না মানুষটা। তাই আদিতকে বলেছিল ও যেন এসে দিয়ে যায় চিঠিটা! বলেছিল, ‘তুই নিজে এসে দিয়ে যাবি কিন্তু!’

কিন্তু আজকের ওই ছোট অনুষ্ঠানের জন্য যেতে পারেনি আদিত। মাকু নিজেই বলেছিল যাবে। তবে সেটা আর জানায়নি বাদলদাকে। শুধু একটা চিঠিই তো দেবার আছে! কিন্তু পাগলাটা ফোন ধরছে না কেন সেটাই বুঝতে পারছে না ও! বাদলদাকে কি তবে ফোন করা উচিত ছিল! আসলে বাড়ির ঝামেলায় অত কিছু মনে ছিল না আদিতের!

আদিত ধীরে ধীরে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল। আশেপাশে সামান্য কিছু মানুষজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! সবারই কেউ না কেউ এখানে ভর্তি! সবাইকেই অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে! চারিদিকে কেমন যেন মৃত্যুর থমথমে ভাব! সবাই কি ওরা আসলে প্রিয়জনের মৃত্যুর অপেক্ষাই করছে! নাকি সুস্থ হয়ে ফিরবে তার অপেক্ষা করছে সবাই! আদিত কীসের অপেক্ষা করছে! কার অপেক্ষা করছে!

ঠান্ডা সাপের মতো পড়ে আসছে সামনের করিডোর! একদম শেষ মাথায় একটা ক্যান্টিন আছে। তাতে এই রাত সাড়ে এগারোটার সময় কী পাওয়া যাবে কে জানে! কিন্তু খেতে হবে কিছু। খিদে পেয়েছে! না মন চাইছে না খেতে, কিন্তু শরীর চাইছে! বরাবর মনের কথা শুনেছে আদিত, কিন্তু এখন শরীরের কথা শুনবে!

হাসপাতালের পাশে এটা একটা দোতলা বাড়ি। পুরোনো। কেমন জঙ-ধরা জাহাজের মতো দেখতে। করিডোরটাও কেমন যেন অন্ধকার। তারপর আজ এমন হাওয়ার ওড়না জড়ানো ধোঁয়াশা, বাইরের থেকে উপছে এসে ঢেকে দিয়েছে বারান্দার সব কিছু! মনখারাপের রঙ কেমন হয় সেটা আজ যেন ভাল করে বুঝতে পারছে আদিত!

ক্যান্টিনটা বড়। কিন্তু বেশ ময়লা। কাউন্টারের কাছে টিমটিম করছে একটা বাল্‌ব। তলায় ততোধিক টিমটিমে একটা লোক বসে রয়েছে! আদিত গিয়ে দাঁড়াল ওর সামনে। লোকটা অনিচ্ছুক চোখ তুলে তাকাল! পেছনের দেওয়ালে একটা বড় মান্ধাতার আমলের কালো বোর্ড। তাতে সাদা কালি দিয়ে নানান খাবারের নাম লেখা! যদিও বেশ কিছু আর স্পষ্ট নেই! আর জায়গায় জায়গায় চক বুলিয়ে সেগুলো স্পষ্ট করার চেষ্টা করে হয়েছে! বোর্ডের ওপরে লেখা – ‘টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স সার্ভিস’!

‘কিছু পাওয়া যাবে?’ আদিত জিজ্ঞেস করল।

লোকটা সময় নিল একটু। দুর্বল ভাবে তাকাল ওর দিকে। তারপর কেমন একটা খোনা গলায় বলল, ‘এত রাতে… ওই ঘুঘনি আর পাওরুটি হবে। ডিম নেই। ফুরিয়ে গিয়েছে!’

‘তাই দিন!’ আদিত কথাটা বলে এসে বসল সামনের একটা বেঞ্চে! দূরে আরেকটা বেঞ্চে কয়েকজন লোক চা নিয়ে বসে আছে! তারা খুব নিচু স্বরে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে!

আদিত পকেটে হাত দিল। দুশো টাকা পড়ে আছে। কাল টাকা জমা দিতে হবে হাসপাতালে। সকালে ব্যাঙ্কে যেতে হবে! ছোট মামাকে ও ফোন করেছিল। মামা বলেছে ব্যাঙ্কে টাকা পাঠিয়ে দেবে কাল।

ছোট মামা নেহাত আছে! নাহলে কী যে হত! ফোন রাখার আগে ছোট মামা বলেছিল, ‘ভয় পাবি না বুড়ো। জামাইবাবু ঠিক হয়ে যাবে। আর তুই নেক্সট মাস থেকে এখানে জয়েন করছিস। সেরকমই কিন্তু আমি বলে রেখেছি! মনে থাকে যেন! ডোন্ট লুজ হার্ট!’

হ্যাঁ, কলকাতা ছেড়ে দিয়ে নয়ডায় চলে যাচ্ছে আদিত! অনেক নিজের মর্জি আর আদর্শ দেখেছে। কিন্তু আর না! সামনের সপ্তাহে রাবার ফ্যাক্টরিতে একটা মিটিং আছে। সেটা শেষ হয়ে গেলেই মোটামুটি শ্রমিকদের একটা পথ দেখানো যাবে। তারপর সব ছেড়ে ও চলে যাবে নয়ডা। অনেক হয়েছে এইসব। আর কতদিন এভাবে বাঁচবে! বাবা মাকে শান্তি আর নির্ভরতা দেওয়াও তো ওর একটা কর্তব্য! আর এখানে থাকবেই বা কেন! কে আছে ওর! যাকে দেখে, আদর্শ মেনে ও চলে এসেছিল সেই তো এমন করল ওর সঙ্গে! তা ছাড়া আগে ভেবেছিল এখানে স্মাহি আছে! কীভাবে ওকে ছেড়ে যাবে! কিন্তু পরে দেখল এভাবে বোকার মতো প্রেমের সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে বসে থাকলে বাবা মার কষ্ট বাড়বে বই কমবে না!

আদিত মাথা দু হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল। রাজুদার মুখটা ভেসে উঠল সামনে! কী করে পারল রাজুদা অমন একটা কথা বলতে! একবারও মনে আটকাল না! পুশিদির সঙ্গে ওকে শুতে হবে! পাগল হয়ে গিয়েছে নাকি! এমন কথা কেউ বলতে পারে! সেদিনের সকালটার কথা ভাবলে এখনও কেমন করছে ওর!

রাজুদা এমন করে তাকিয়েছিল ওর দিকে যে ও নড়তে পারছিল না! ওর সঙ্গে শুয়ে পুশিদি বাচ্চা নিতে চায়! নিজের কানকে বিশ্বাস করছিল না আদিত! কীসব বলছে রাজুদা!

ও শুধু অস্ফুটে বলেছিল, ‘কী বলছ তুমি!’

রাজুদা ওর হাত দুটো ধরে কাতর গলায় বলেছিল, ‘প্লিজ আদিত। পুশি বাচ্চা বাচ্চা করে পাগল হয়ে যাচ্ছে! ও ব্যালেন্স হারাচ্ছে রোজ একটু একটু করে! জানিস তো আমার কাজের স্ট্রেস কেমন! বাইরে এত স্ট্রেস আর ঘরেও যদি এমন হয়, আমি তো মরেই যাব এবার! প্লিজ ভাই, আমায় তুই বাঁচা! পুশিরও তোকে পছন্দ! ও তো নিজেই বলেছে! প্লিজ আদিত!’

পুশিদি! আদিত ভাবতেই পারছিল না। এটা কী বলছে!

রাজুদা বলেছিল, ‘আমরা তিনজনে দার্জিলিঙে চলে যাব। কেউ জানতে পারবে না। ইউ মেক হার প্রেগন্যান্ট দেয়ার! আমরা তারপর ফিরেও আসব।’

আদিতের বুকের ভেতর ঝনঝন করে ভেঙে পড়ছিল একটা গোটা শহর। রাজুদার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে!

রাজুদা এবার বলেছিল, ‘ঠিক আছে তুই পুশিকেই জিজ্ঞেস করে দেখ। ওর সঙ্গেই কথা বলে দেখ! এসো পুশি!’

আদিত চমকে গিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়েছিল। দেখেছিল কখন যেন নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে পুশি এসে দাঁড়িয়েছে! ও ভয়ে, লজ্জায় উঠে দাঁড়িয়েছিল! এসব কী হচ্ছে ওর চোখে সামনে!

রাজুদা বলেছি, ‘তোরা কথা বলে নে। আমি বাইরে যাচ্ছি!’

আদিতের যেন হাত পায়ের সঙ্গে জিভও অসাড় হয়ে গিয়েছিল। পুশিদির সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলতে হবে!

রাজুদা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। পুশিদি এসে বসেছিল ওর সামনে। আদিত বসতে পারেনি। দাঁড়িয়েই ছিল! মনে হচ্ছিল যে কোনও সময় ও মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

‘বসো!’ পুশিদি হাত ধরে বসিয়ে দিয়েছিল ওকে। যেন ছ্যাঁকা লেগেছিল আদিতের। পুশিদি বলেছিল, ‘তোমার দাদা বলেছে তো আমরা কী চাই?’

আদিত কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল।

পুশিদি বলেছিল, ‘লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই! এটাকে তুমি সেক্স হিসেবে দেখছ কেন শুধু! এটা একটা হেল্‌প হিসেবে দেখো! আমার নিজের বাচ্চা চাই আদিত! আর সেটা তোমার দাদা দিতে পারবে না! ওর শারীরিক সমস্যা আছে! তোমার নিশ্চয় নেই!’

আদিত তাও মাথা নামিয়ে রেখেছিল।

পুশিদি এগিয়ে এসে একটা আঙুল দিয়ে আদিতের থুতনি তুলে ধরেছিল, ‘তোমার কি আমায় পছন্দ নয়! মানে সেক্স করতে গেলে পছন্দ হওয়াটা তো জরুরি। নাহলে ইরেকশান আসবে না তো! আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়স হল। আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না! তুমি প্লিজ এমন স্টিফ হয়ে থেকো না। আমাকে প্লিজ হেল্‌প করো! সারাটা জীবন কী নিয়ে থাকব আমি! কাকে নিয়ে থাকব! কেউ জানবে না আদিত! কেউ না! প্লিজ।’

শেষে কথাগুলোর সময় পুশিদির গলায় কেমন যেন কান্না জড়ানো ভেঙে পড়া মানুষের স্বর শুনতে পেয়েছিল ও। কী বলবে বুঝতে পারছিল না আদিত। আচমকা পুশিদি এগিয়ে এসেছিল ওর কাছে তারপর কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই ওকে টেনে নিয়েছিল নিজের দিকে! তারপর ঠোঁটের ওপর চেপে ধরেছিল ঠোঁট! একটা হাত দিয়ে আদিতের হাতটা ধরে টেনে নিয়ে রেখেছিল নিজের বুকের ওপর! আদিত নিজের করতলে নাইটির ওপর দিয়েও বৃন্তের জেগে ওঠা টের পেয়েছিল! টের পেয়েছিল পুশিদি দাঁত দিয়ে চাপ বাড়াচ্ছে ওর ঠোঁটে! আর পুশিদির একটা হাত নেমে যাচ্ছে ওর প্যান্টের চেনের দিকে! কী হচ্ছে এসব! কেমন এমন করছে পুশিদি! সত্যি কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে!

পুশিদি প্যান্টের চেনে হাত দিয়ে টান দিয়েছিল। আর সেই টানে আদিতের ভেতরে কী যেন একটা ছিঁড়ে গিয়েছিল শব্দ করে! ও প্রাণপণে পুশিদিকে ঠেলে সরিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। তারপর আর দাঁড়ায়নি! দূরের একটা ঘরে যেন আবছাভাবে ও রাজুদাকে দেখেছিল। কিন্তু সেইদিকেও তাকায়নি! সোজা বেরিয়ে এসেছিল বাইরে! রাস্তায় এসে থরথর করে কাঁপছিল ও! ঠোঁটে তখনও যেন লেগেছিল পুশিদির জিভের স্বাদ! শ্বাসের সোঁদা গন্ধ! কেমন যেন গুলিয়ে উঠেছিল আদিতের শরীর। তারপর আচমকা রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে বমি করে দিয়েছিল ও!

এটা কী হল! আবার বমি এসেছিল। ও মাথা ধরে বসেছিল চুপ করে। তখনই একটা হাত এসে কাঁধটা ধরেছিল ওর। ও তাকিয়ে দেখেছিল সেই লম্বা, ফর্সা লোকটা! ওর দিকে একটা জলের বোতল বাড়িয়ে দিয়েছে!

সেদিনের পরে আর কয়েকদিন রাজুদার কাছে যায়নি আদিত। মুখে না বলেও ও বুঝিয়ে দিয়েছিল ও কী বলতে চাইছে!

এর মধ্যে ও রাবার ফ্যাক্টরিতে গিয়ে ঘেরাওয়ের প্ল্যান করেও এসেছিল। সবাইকে বুঝিয়েছিল, ফ্যাক্টরির ফাইন্যান্স ডিরেক্টর যেদিন আসবে সেদিন ঘেরাও করলে ওদের মনোভাব মালিকপক্ষকে ভাল করে বোঝাতে পারবে! তা হয়েওছিল ঘেরাও। সারারাত ফ্যাক্টরি ঘিরেছিল শ্রমিকরা। সকালে পুলিশ এসে সরায় ওদের। তবে ফাইন্যান্স ডিরেক্টর আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছিল ওদের সঙ্গে। মূলত আদিতই কথা বলে নিউ ইয়ারের আগেই সব টাকা মিটিয়ে দেওয়া হবে এর প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল। কিন্তু গোলমালটা বেধেছিল তারপরেই! রাজুদা নিজে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিল ওকে। না বাড়িতে নয়, পার্টি অফিসে!

এই রাজুদাকে কোনওদিন ও দেখেনি! কেমন যেন ক্ষিপ্ত, হিংস্র একটা মানুষ! মানুষ নাকি বোধহীন কোনও জন্তু! লেজ আছড়াতে আছড়াতে যেন ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল কোনও নরখাদক!

ওকে দেখেই রাজুদা চিৎকার করতে শুরু করেছিল, ‘শুয়োরের বাচ্চা কে তোকে ঘেরাও করতে বলেছিল! বাদলদার বারণও শুনিসনি! কে বলেছে ঘেরাও করতে!’

আদিত ঘাবড়ে গিয়েছিল, ‘কী বলছ রাজুদা!’

‘বাঞ্চোত, তোর চামড়া ছাড়িয়ে নেব আমি। মালিকপক্ষ ফ্যাক্টরি লক আউট করে দিলে আমি কী জবাব দেব হাই কম্যান্ডকে?’

‘কিন্তু গরিব মানুষগুলো!’ আদিত বলেছিল, ‘রাখালিয়ার ওই রেশন কার্ডগুলোও হল না! তবে কি আমরা মানুষদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুধু ভোট আদায় করে তাদের ঠকাতে এসেছি! আমরা কি জোচ্চর!’

‘শালা হারামি! তোকে…’ রাজুদা এগিয়ে এসে ঠাশ করে একটা চড় মেরেছিল ওকে, ‘ওই দিকে যাবি না আর! বুঝেছিস? জানোয়ার! আমার কাজে লাগিস না তো কোনও, আবার বুলি ফুটছে!’

আদিত চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিল রাজুদার দিকে। বুঝতে পারছিল আসল রাগটা কোন জায়গা থেকে আসছে। ও দৃঢ় গলায় বলেছিল, ‘ফ্যাক্টরির ওদের আমি কথা দিয়েছি। আমি কথা দিলে কথা রাখি রাজুদা! পালটি খাই না!’

‘আমি পালটি খাই!’ রাজুদা চোয়াল শক্ত করেছিল।

উত্তর না দিয়ে পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে আদিত দেখেছিল রাজুদার চোখে বরফের মতো ঠান্ডা, নীল দৃষ্টি!

ফোনটা হঠাৎ টিং টিং করে নড়ে উঠল পকেটের মধ্যে! এখন আবার কে। আদিত ফোনটা বের করল। অচেনা নাম্বার! এই সময়ে কে ফোন করল ওকে! ধরবে! দোনোমনো করে ফোনটা ধরল আদিত, ‘হ্যালো!’

‘আদিত শোন, ভাল করে।’ ফোনের ওপারের গলাটা কেমন সতর্ক লাগল, ‘মাকুর গুলি লেগেছে! অবস্থা খারাপ! আজ তোর যাওয়ার কথা ছিল সারেঙ্গাবাদে। কিন্তু তোর বদলে গিয়েছিল মাকু। তোকেই মারার প্ল্যান ছিল। কিন্তু ওরা ভুল করে মাকুকে গুলি করেছে! তুই সাবধানে থাকিস।’

‘কী? মাকু! কে করেছে!’ আদিতের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল নিমেষে!

‘তুই জানিস কে করেছে! নামটা তুই জানিস! সাবধান!’ কট করে কেটে গেল কলটা।

সাবধান? আদিত ঠান্ডা পাথরের মতো ফোনটা ধরে বসে রইল একা! মাকুকে গুলি করেছে! ও কি বেঁচে নেই! নাকি বেঁচে আছে! সেটা জিজ্ঞেস করল না তো! আর কে করাল এটা! মানে ও যা ভাবছে সেই করিয়েছে! এতটা নেমে গেল লোকটা! ওর বিশ্বাস, আদর্শ সব এভাবে শেষ হল! যাদের বিশ্বাস করল তারা সবাই এভাবে বিশ্বাস ভাঙল ওর!

সামনে দিয়ে যাওয়া খাবারটা দেখে গা গুলিয়ে উঠল আদিতের। কোনও কারণ ছাড়াই স্মাহির মুখটা মনে পড়ে গেল ওর! আর হঠাৎ যেন চিনতে পারল ফোনের ওপারের অজানা গলাটাকে! রাজুদার সেক্রেটারি, বিলু!

১৭ নিরমুক্তা

দিল্লিতে ওদের ফ্ল্যাটের পাশে একটা বড় শিরীষ গাছ ছিল। আর ওতে থাকত দুটো পাখি! গাছ চিনত না মুকু, তিজুই চিনিয়েছিল ওকে! আর শুধু গাছই নয়, ফুল, ফল, নক্ষত্র, পাখি সব, সব চিনিয়েছিল ওকে তিজু।

তিজু বলেছিল পাখি দুটোর নাম! মঙ্ক প্যারাকিট বা কোয়েকার প্যারট!

প্রথমবার পাখির নাম শুনে ভুরু কুঁচকে তিজুর দিকে তাকিয়েছিল মুকু, ‘বাংলা নাম কী?’

তিজু হেসে বলেছিল, ‘একজ্যাক্টলি জানি না। তবে একধরনের টিয়া পাখি! পোষ মানে খুব, কথাও বলে। কী করে এমন গাছে এসে বাসা বেঁধেছে কে জানে!’

মুকু লক্ষ রাখত ওদের। দেখতে দেখতে মা পাখিটা ডিম পাড়ল একদিন। সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হল! পাখি দুটো সেই বাচ্চাগুলোকে খাওয়াত। বাচ্চাগুলোর পাশে বসে থাকত! মুকুর কী ভাল যে লাগত ওদের দেখতে! কিন্তু তারপর হঠাৎই একদিন কী করে যেন বাচ্চা দুটোকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল চিল! জানলার থেকে মুখ দিয়ে শব্দ করে, জল ছুড়ে, এমন কী টেবলে রাখা একটা কাচের পেপার ওয়েট ছুড়ে পর্যন্ত চিলটাকে তাড়াবার চেষ্টা করেছিল মুকু। কিন্তু পারেনি!

সেদিন দুপুরে ভাল করে ঘুমতে পারেনি মুকু। খেতে পারেনি! কিছুই করতে পারেনি! শুধু যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল, ডানা ঝাপটানো একটা পাখি! মৃত্যু!

রাতে তিজু আসার পরে, ওকে সব কথা বলেছিল মুকু। আর বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল ঝরঝর করে! তিজু এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল, ‘এমন করে কেউ কাঁদে! প্রকৃতির নিজের কিছু নিয়ম আছে! আমরা তার সামনে নিরুপায়! আর এমন সময় তুই যদি এভাবে আপসেট হয়ে যাস তাহলে তোর মধ্যে বড় হচ্ছে যে আমাদের পাখিটা তার কী হবে! মা ভাল না থাকলে সন্তান ভাল থাকবে কী করে?’

তিজু সারাক্ষণ ঘিরে রাখত ওকে! বলত, ‘আমার তুই ছাড়া আর কে আছে বল! বাবা ছিল, কিন্তু সেও মারা গেল!’

‘মা?’ মুকু তাকাত তিজুর দিকে।

তিজু নিচু গলায় আলতো স্বরে বলত, ‘মা তো আছে, কিন্তু কেন জানি না মা আমায় পছন্দ করে না! মা দীপনকে ভালবাসে বেশি!’

অভিমান! তিজুর অভিমান ছিল খুব। মুখে বলত না। দেখাত না। রাগ করত না। কিন্তু একবার কিছু নিয়ে অভিমান হলে সেটার থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে দূরে সরে যেত! এটা বুঝত মুকু। কিন্তু তারপরেও কী করে যে ও অমন একটা কাজ করে ফেলল! কী করে যে ও তিজুকে অমন একটা কথা বলল সেটা ভাবলে আজও অবাক লাগে!

এখনও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে শিউরে ওঠে মুকু। তিজু অফিসের কাজে বিদেশে গিয়েছিল। ওকে দেখাশুনো করার জন্য একজন আয়া ছিল বাড়িতে। কিন্তু সেইদিনই সেই আয়ামাসি বাজারে গিয়েছিল কিছু জিনিস কেনার জন্য! আর তার জন্য অপেক্ষা না করে, একা একা বাথরুমে যেতে গিয়ে পিছল মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল মুকু! মেঝেতে পড়ে গিয়ে অদ্ভুত একটা ভোঁতা শব্দ শুনেছিল ও।

তারপরের সময়টা কেমন যেন ঘষা কাচের ওপাড়ের স্মৃতি! যেন ভোর রাতের মনে-পড়ি- পড়ি করা দুঃস্বপ্ন! যেন সেই ছোট্টবেলায় শোনা আবছা কোনও রাক্ষসের গল্প!

সেই দিনটার সব কিছু এখনও কেমন যেন আবছা! কখন আয়ামাসি এল! পায়ের কাছে পড়ে থাকা থকথকে রক্ত দেখে কে যেন চিৎকার করে উঠল! অ্যাম্বুলেন্স কখন এল! কখন একের পর এক আলো-ছায়ার করিডোর পেরিয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছল মুকু! কখন আরও সব মানুষজনের মাথা ভিড় করে এল ওকে ঘিরে! আজ আর তা স্পষ্ট মনে নেই ওর! শুধু মনে আছে নীল তোয়ালে জড়ানো একটা নিথর ছোট্ট শরীর! নরম পাখির মতো ঠান্ডা মুঠো করা একটা হাত! আর তিজুর থেমে থাকা, নির্জন একাকী একটা মুখ! আজও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে ও যেন দেখতে পায় বিশাল ডানার এক চিল এসে ডানা ঝাপটাচ্ছে ওর সামনে! আকাশ জুড়ে, জীবন জুড়ে নৃশংস চিল ডানা ঝাপটাচ্ছে! ডানা ঝাপটিয়েই যাচ্ছে!

কাউকে হারালে কেমন লাগে জীবনে এই প্রথমবার বুঝেছিল মুকু। আর জীবনে যেন প্রথমবার তিজুর আরেকটা দিকও দেখতে পেয়েছিল!

তিজু কেমন যেন একা হয়ে গিয়েছিল সেই ঘটনার পর থেকে। বাড়িতে থাকলে স্টাডিতে বসে থাকত একা। ছুটির দিনগুলোয় বেরিয়ে যেত ওকে কিছু না বলে। দীপন, ওর স্ত্রী এবং আরও নানান লোকজন আসত প্রথম প্রথম। সান্ত্বনা দিত! কিন্তু সেসব কেটে যাওয়ার পরেও তিজু কেমন যেন একা হয়ে গিয়েছিল!

মুকুর ভেতরটা ভেঙে গিয়েছিল একদম। মাঝে মাঝে ও ঝগড়া করত। তিজুকে ধরে ঝাঁকাত! এমন কী একদিন তো একটা কাঠের মূর্তি পর্যন্ত ছুড়ে মেরেছিল ওর দিকে। বলেছিল, ‘স্বার্থপর! তুই এত স্বার্থপর! নিজেরটা নিয়েই আছিস! তুই মানুষ!’

তিজু কিছু বলেনি! তাকিয়েছিল শুধু। মুকু চিৎকার করে বলেছিল, ‘তুই দোষ দিস আমায়? আমায় একা রেখে গিয়েছিলি কেন? কীসের এমন কাজ যে আমার কাছে, নিজের বাচ্চার কাছে থাকতে পারিসনি! এখন ন্যাকামো হচ্ছে! স্বার্থপর! রাক্ষস তুই! নিজেকে ছাড়া আর কিছু বুঝিস না! জানবি তোর হাতে আমার বাচ্চার রক্ত লেগে আছে!’

তিজু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলই ওর দিকে। তারপর কিছু না বলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে! একটি প্রাণহীন শিশু কেমন যেন এক সমুদ্র দূরত্ব নিয়ে এসেছিল ওদের মাঝে! তিজু ছোট্ট ডিঙির মতো ঢেউয়ের ধাক্কায় সরে গিয়েছিল দূর থেকে আরও দূরে! মুকুর মনে হয়েছিল আসলে তিজু মনে মনে দায়ী করে ওকে! ও যদি একা একা বাথরুম না যেত তাহলে হয়ত এমনটা ঘটত না – এটাই মনে করে তিজু! তাই হয়ত এমন করে ঘৃণা আর রাগে ও সরে গিয়েছিল! এই চুপ করে যাওয়া, এই অবহেলা আর সহ্য করতে পারছিল না মুকু। তাই একদিন সকালে ও তিজুকে বলেছিল, ‘তুই সরে যা আমার জীবন থেকে। দূরে চলে যা। আমি আর থাকতে পারছি না তোর সঙ্গে! আমার মন সরে গিয়েছে!’

‘কী তখন থেকে আয়নার সামনে বসে রয়েছিস!’ মায়ের কথায় মুখ ঘুরিয়ে তাকাল মুকু।

মা আবার বলল, ‘রাত এগারোটা বাজে, এখন বেরচ্ছিস! পাগল নাকি তুই? শীতের রাতে কেউ এভাবে একা বেরোয়! কে কী বলল আর তুই অমনি চললি!’

মুকু উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিল একবার! তারপর মায়ের দিকে ঘুরল। মা আবার চেষ্টা করছে জানার। এভাবে নানান কথার প্যাঁচে জানতে চাইছে কোথায় এত রাতে বেরোচ্ছে ও!

মুকু হাসল। তারপর সরাসরি বলল, ‘আমি তোমায় বলব না কোথায় যাচ্ছি!’

মা ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘সেদিন কে যে এসে তোর কানে কী মন্তর দিয়ে গেল ঈশ্বরই জানেন। তারপর থেকেই এসব শুরু করেছিস! শোন, আমি তোর মা। মুকু তোর এই ব্যাপারটা আমি জানি। তুই কিন্তু আবার ভুল করতে যাচ্ছিস! নিশ্চয় তুই ও ছেলেটার খোঁজ পেয়েছিস! তাই না! ওর কাছেই কি যাচ্ছিস? এভাবে একটা ভাল ভবিষ্যৎকে আবার দূরে ঠেলছিস! মানুষ এক ভুল কবার করে! ওর বাবা মাকে আমি কী জবাব দেব? মনে নেই ওরা তোর দিকে কেমন করে তাকিয়েছিল সেদিন!’

মুকুর মনে পড়ে গেল সেদিনের বিকেলটার কথা। অদ্ভুত দেখতে লোকটা নীল রঙের জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়েছিল। মাথার লাল চুলগুলো পাট পাট করে আঁচড়াচ্ছিল চিরুনি দিয়ে। আর ওকে দেখে দাঁত বের করে হেসে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে।

মুকু প্রথমে কী বলবে বুঝতে পারেনি। তারপর অবাক-ভাবটা কাটিয়ে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কে আপনি! আমায় কি ফলো করছেন?’

লোকটা হেসে চিরুনিটা ঢুকিয়ে রেখেছিল প্যান্টের পেছনের পকেটে। তারপর চিবোতে থাকা পানটা গালের এক পাশে জিভ দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আমার নাম জগন ম্যাডাম। ছোট্ট দুয়েকটা সেনটেন্স আপনাকে বলতে এসেছি!’

‘কে আপনি! কী দরকার আমার সঙ্গে?’ মুকু চোয়াল শক্ত লোকটার দিকে তাকিয়েছিল।

জগন বলেছিল, ‘আমি ম্যাডাম রিটায়ার্ড পারসন। মাঝে মাঝে লোকজনের হেল্‌প করি একটু। আমি জানি আপনি ঋত্বিজদাকে খুঁজতে এসেছেন! আমি শুধু একটা কথা জানতে এসেছি।’

‘আপনি জানেন!’ চমকে গিয়েছিল মুকু, ‘কী করে জানলেন!’

‘সেটা ইমপরট্যান্ট নয়। আমি জাস্ট একটা কথা জানতে এসেছি।’

‘কী কথা!’ মুকু বুঝতে পারছিল না ও রাগ করবে, না বিরক্ত হবে, নাকি ভয় পাবে!

‘আপনি কি তিজু স্যারকে এখনও ভালবাসেন?’

‘হোয়াট!’ আচমকা মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল মুকু। ভদ্রতার ধার আর ধারেনি এবার। রাগের গলায় বলেছিল, ‘কে তুমি? এসব কী প্রশ্ন! হাউ ডেয়ার ইউ আর!’

জগন হেসেছিল। তারপর বলেছিল, ‘আয়াম আ ডেয়ারিং গাই ম্যাডাম! কিন্তু আমি দাদার দিকটা জানি। কিন্তু আপনার দিকের গল্পটা কী? প্রিতমবাবুর চান্স কি দাদার চেয়ে বেশি! নাকি আপনি এখনও দাদাকে…’

মুকু থমকে গিয়েছিল। কী বলছে কী লোকটা। এসব জানল কী করে! আর তিজুর দিকটা ও জানে মানে! মানে তিজু কি এখনও…

ও জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোথায় তিজু? সবার থেকে এভাবে লুকিয়ে থাকার কোনও মানে নেই! জানলে বলো কোথায় ও!’

‘আপনার কথার উত্তর আমি দেব যদি জানি আপনার মনেও একই জিনিস থাকে দাদার জন্য। নাহলে, আমি আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যাব! তো বলুন ম্যাডাম, আপনি কি এখনও তিজুদাদাকে…’ কথাটা অসমাপ্ত রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আবার দাঁত বের করে হেসেছিল জগন।

মুকু দাঁত চেপে বলেছিল, ‘আমার পারসোনাল কথা তোমায় বলব কেন?’

জগন বলেছিল, ‘ঠিক কথা ম্যাডাম। আয়াম সরি! তবে, সামনে যার বিয়ে সে কেন আমার মতো উটকো একটা লোকের ফোন পেয়ে, সব ডিসকাশন ছেড়ে নেমে এসে এত কথা বলবে? শুধু আপনাকে বলি, দাদার ওয়ালেটে এখনও কিন্তু আপনার ছবি আছে!’

মুকু বলেছিল, ‘কোথায় আছে ও? ওর বাড়ির লোকজন খুব চিন্তিত। তুমি জানলে বলো কোথায় আছে ও! আর এভাবে চলেই বা এসেছে কেন? কী কারণ?’

জগন হেসেছিল, ‘অন্যদের কথা বাদ দিন, আপনি কি চিন্তিত? থিঙ্ক ম্যাডাম! থিঙ্ক! আর কারণটা নাহয় সামনে গিয়ে দাদার থেকেই জেনে নেবেন! বাই ফর নাউ!’ তারপর আর কিছু না বলে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে চলে গিয়েছিল!

মুকু অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কে লোকটা? কীভাবে সব কিছু জানে! আর তিজু এখনও ওর ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়! এখনও! তাহলে কেন ও যখন চলে যেতে বলেছিল তিজু খুব জোর করে আটকায়নি!

পাশের বড় রেস্টুরেন্টের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল মুকু। ওই রেস্টুরেন্টে বসে আছে ওর ভবিষ্যতের মানুষজন আর ওর সামনে দিয়ে ফুটপাথ টপকে চলে গেল যে লোকটা সে ওর অতীতকে টেনে আনল সামনে! অতীত? নাকি আজও ভীষণভাবে বর্তমান! মনের ভেতর কেমন যেন একটা নরম প্রজাপতির মতো আনন্দ উড়ছিল ওর! কোথাও কোন এক পার্সে রাখা ছোট্ট একটা ছবি এখনও এভাবে ওকে আনন্দ দিতে পারে দেখে নিজেরই অবাক লাগছিল!

মুকু রেস্টুরেন্টে ফিরে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘আমার শরীরটা ভাল নেই। এই আলোচনাটা পরে করলে হয় না!’

প্রিতমের বাবা মা প্রচণ্ড অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে!

মা আবার বলল, ‘এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না মুকু। আবার সেই জানোয়ারটার পাল্লায় পড়িস না! মনে নেই কী করে ও তোর বাচ্চাটা নষ্ট করে দিয়েছিল!’

‘কী!’ মায়ের এই শেষের কথাটায় ঘুরে তাকাল মুকু, ‘এত নোংরা কথা তুমি বলতে পারলে! এই জন্য তুমি এখানে এসেছ! আর ওই ঘটনাটা যখন ঘটেছিল ও ইউরোপে গিয়েছিল কাজে। আর তুমি এভাবে বললে! আমার সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটাকে আজ ব্যবহার করতে চাইলে আমার মনে বিষ তৈরির জন্য! ছিঃ মা!’

মা উঠে বসল আরও কিছু বলার জন্য কিন্তু তখনই মুকুর মোবাইলটা বাজল। মুকু সময় নষ্ট না করে ধরল মোবাইলটা, ‘হ্যাঁ বলো!’

‘কুড়ি মিনিটের মধ্যে দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে যে দুটো পানের দোকান আছে সেটার পাশের পেট্রোল পাম্পের সামনে আসুন। কুড়ি মিনিট। তার বেশি হলে কিন্তু হবে না। কেমন!’

মোবাইলটা কেটে কোটের পকেটে ঢুকিয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকাল মুকু।

মা এবার নেমে এসে দাঁড়াল ওর সামনে, ‘আমার ভুল হয়েছে মুকু। রাগ করিস না। কিন্তু এভাবে নিজের ভবিষ্যৎটা নষ্ট করিস না। মুকু, প্রিতমের কথা ভাব… একবার ভাব!’

মুকু আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এল হোটেলের ঘর থেকে। মা আর ও আলাদা মানুষ! মা বুঝবে না আসলে ওর মনে কে আছে!

রিসেপশানে গাড়ি বলাই আছে। লিফটটাও পেয়ে গেল ও দ্রুত!

লিফটে উঠে, গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপে ভাবল, জগন লোকটা নির্ভরযোগ্য তো? সেদিনের ওই কটা কথা আর আজকের ঘণ্টাখানেক আগের একটা দু মিনিটের ফোন কল, তাতে ওকে বিশ্বাস করে এভাবে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে!

ঘণ্টাখানেক আগে কলটা পেয়ে তো খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল মুকু।

জগন বলেছিল, ‘দেখ করবেন দাদার সঙ্গে? করতে চাইলে রেডি হয়ে থাকুন। আমি আবার ফোন করব কিছুক্ষণ পরে। দাদা জানেন না। জানলে উনি আসবেন না। কিন্তু আপনি যদি চান তাহলে দেখা করতে পারেন। দেখা করবেন?’

মুকু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমার ছবি এখনও ওর ওয়ালেটে আছে, তুমি শিয়োর?’

জগন হেসেছিল সামান্য শব্দ করে। তারপর বলেছিল, ‘আমি আবার ফোন করছি। রেডি হয়ে থাকুন!’

আজ খুব কুয়াশা! ডিসেম্বরের বাইশ তারিখ হয়ে গেল। ছুটি শেষ হয়ে এসেছে প্রায়! আজ যদি না দেখা হয় তবে কী হবে! দীপনকে কী বলবে ও! আর শুধু কি দীপন! ওর নিজের কি কিছু নেই এর মধ্যে! মুকু চোখ বন্ধ করল। দেখল বহু আগের এক রোদ ঝলমলে সকাল। কুতুব মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তিজু। বলছে, ‘বাকি দিনগুলো আমায় তোর সঙ্গে থাকতে দিবি মুকু? আমায় বিয়ে করবি?’

কুয়াশা কুয়াশা কলকাতা! তার মধ্যে দিয়ে ডুবে ভেসে গাড়িটা গিয়ে দাঁড়াল দেশপ্রিয় পার্ক মোড়ে! গাড়ি থেকে নেমে ঘড়ি দেখল মুকু। সোয়া এগারোটা বাজে। চারিদিকে যেন মেঘ নেমে এসেছে মাটিতে। তার মধ্যে ও হালকা পায়ে রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়াল অন্যদিকের সেই পেট্রোল পাম্পের সামনে!

‘এসেছেন!’

মুকু চমকে তাকাল পেছনে। কুয়াশার ওড়না সরিয়ে বেরিয়ে এল জগন। মুখে হাসি। পান চিবচ্ছে! জগন বলল, ‘ছবিটায় আপনার পেছন দিকে, কিছুটা দূরে কুতুবমিনার দেখ যাচ্ছে, জানেন! দাদা এখনও খুব ভালবাসেন আপনাকে!’

আর মুকুর বুকটা কেমন করে উঠল যেন। যেন আচমকা লক্ষ বছর পেরিয়ে ওর কাছে ভেসে এল সেই আফটার শেভের গন্ধ! যেন বুঝতে পারল এ তুচ্ছ্ব জীবনে আসলে ও কে! আসলে ও কার! বুঝতে পারল, এতদিন নিজেকেই বোকা বানিয়ে আসছিল। একটা মিথ্যেকে ও জেদের বশে, অহঙের বশে সত্যি বলে বিক্রি করছিল নিজের কাছে! আজ এই কুয়াশা মোড়া শহরের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেন বুঝতে পারল আসলে ও কোনওদিন তিজুর থেকে দূরে যায়নি। যেতে পারেনি। তাই দীপন ওকে তিজুকে খুঁজতে বলাতেই চলে এসেছে এখানে! নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা অনেক হল। এবার সত্যিটা মেনে নেওয়ার পালা। মনের মধ্যে যে কষ্টের ভার নিয়ে ও ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটাকে ফেলে দিয়ে নতুন করে বেঁচে ওঠার পালা!

‘আপনি রেডি তো?’ জগন আবছা গলায় জিজ্ঞেস করল।

মুকু উত্তর দিতে গিয়ে থমকাল। হাতে ধরা ফোনটা বাজছে। ও দেখল স্ক্রিনটা। প্রিতম! এখন! এসময় তো ও কল করে না কখনও! নির্ঘাত মা বলেছে আজকের কথা! ও চোয়াল শক্ত করল। তাকাল জগনের দিকে। দেখল জগন ভুরু তুলে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

মুকু নিজেকে সামলাল। কলটা কেটে, একদম অফ করে দিল মোবাইলটা। তারপর তাকাল কুয়াশায় আবছা হয়ে আসা জগনের দিকে। আজ সব কিছু পরিষ্কার লাগছে ওর!

মুকু বলল, ‘আমি রেডি!’

১৮ স্মাহি

ট্রেনের কামরার ভেতরের আলোটা কেমন যেন ঘোলাটে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে আজ। জানলার শাটার সব নামানো রয়েছে। তবু বাইরের ঘন কুয়াশা দরজা দিয়ে ঢুকে এসেছে কামরার ভেতরে। যেন কেউ চুনের জল স্প্রে করে দিয়েছে চারিদিকে! স্মাহি সোয়েটারের হাত দুটো টেনে হাতের পাতা ঢুকিয়ে নিয়েছে ভেতরে। মাফলারটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়েছে কানে। ঠান্ডা লাগলে আর রক্ষে নেই!

‘তুই ছেড়ে দিলি কাজটা!’ পাশের থেকে সীমা বিস্ময়ভরা গলায় জিজ্ঞেস করল ওকে।

স্মাহি মনে মনে গুনল, এই নিয়ে এগারোবার একই কথা জিজ্ঞেস করল সীমাদি। ও কিছু না বলে হাসল।

সীমাদি বলল, ‘ভাল করে ভেবে করলি তো কাজটা! এখন কী করবি?’

স্মাহি বলল, ‘আবার পড়াশুনো শুরু করব। সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেব। আর এই ফ্যাক্টরির যা অবস্থা তাতে…’

‘তা ঠিক,’ সীমাদি বলল, ‘গত পরশু শুনেছিস তো কী হয়েছে!’

স্মাহি তাকাল।

সীমাদি বলল, ‘ফ্যাক্টরির ঝামেলায় কে যেন গুলি খেয়েছে!’

‘কী!’ ছিটকে উঠল স্মাহি। ওর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল বলাইয়ের কথাটা! তবে কি রিতাদি বলেনি ওকে! কিন্তু ও তো রিতাদিকে সেদিনই বলেছিল।

বাড়িতে ফিরে সেদিন আর নিজের ঘরে ঢোকেনি স্মাহি। রিতাদের কাছে গিয়েছিল সরাসরি। তারপর বলেছিল, ‘রিতাদি ওই যে মকরন্দ বলে ছেলেটা আসে না তোমাদের কাছে, ওকে বলবে যে ওর বন্ধুর সামনে খুব বিপদ! বলবে ও যেন সাবধানে থাকে। প্লিজ রিতাদি বলবে?’

রিতাদি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে, ‘মানে? কী বলছিস?’

‘বলছি ওই মকরন্দকে ফোন করে বলো ওর বন্ধু আদিতের সামনে খুব বিপদ! আদিত যেন কয়েকদিন বাড়ি থেকে না বেরোয়! প্লিজ এটা বলো। কিন্তু আমার নাম বলবে না। বুঝলে? আমার নাম কিছুতেই বলবে না!’

রিতাদি কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর বলেছিল, ‘তুই চিনিস?’

‘প্লিজ রিতাদি ফোনে বল। আর আমার কথা বলবে না। প্লিজ। কথা দাও!’

রিতাদি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘এমন করছিস কেন? আমি বলছি। কিন্তু নিজেকে লুকিয়ে রাখছিস কেন তুই স্মাহি? এই আদিত বলে ছেলেটা কে হয় তোর?’

কে হয় ওর! আদিত কে হয় ওর! এই একটা প্রশ্ন ওর মনেও তো সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়! বুকের ভেতরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে তোলপাড় করে ওকে! ও বোঝে মানুষ সব সময় সব প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর চায় না! সে শুধু চায় প্রশ্নগুলো তাকে সারাজীবন আলতো করে ঠুকরে যাক! তাকে একটা অনিশ্চিত জায়গায় ঠেলে দিক! স্মাহির বিশ্বাস, মানুষের মনের একটা কোনা আছে যে কিনা নিশ্চিন্ত হতে ভালবাসে না। দ্বিধাতেই তার আনন্দ!

স্মাহি উত্তর দেয়নি রিতাদির কথায়। মাথা নামিয়ে নিয়েছিল।

রিতাদি বলেছিল, ‘এভাবে লুকিয়ে থেকে কী লাভ? তাকে এই কথাটা তুই নিজেই বল না!’

স্মাহির জল এসে গিয়েছিল চোখে। কী করে ও বলবে তাকে? কী করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? একদিন নিজেই তো ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিল! আজ কী করে তার সামনে দাঁড়াবে! কী করে বলবে, ধীরে ধীরে ঝিনুকের মধ্যে যেভাবে মুক্তো জমে ওঠে সেভাবে ওর মনেও মায়া জন্মেছে আদিতের জন্য! এখন স্মাহি বোঝে, সব মুক্তোর কথা এই জীবনে আর বলা হয় না মানুষের! ও শুধু রিতাদির হাত ধরে বলেছিল, ‘প্লিজ!’

স্মাহি সীমাদির দিকে আলতো করে ঘুরে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী নাম বললে না তো! আদিত?’

‘না না, আদিত নয়!’ সীমাদি মাথা নাড়াল, ‘অন্য নাম। পিকিউলিয়ার টাইপ।’

‘শিয়োর?’ স্মাহি উদ্বিগ্ন হয়ে তাকাল সীমাদির দিকে।

‘হ্যাঁ রে বাবা! তুই এসব বাদ দে! শোন ভাল করে পড়াশুনো করবি। কিন্তু থাকবি কোথায়? খরচ চালাতে অসুবিধে হবে না?’

স্মাহি হাসল। যাক আদিত নয়! ও মাথা নেড়ে না বলল শুধু। আসলে সব কথা সীমাদিকে বলা যাবে না। উপায় নেই!

সীমাদি বলল, ‘ঠিক আছে, আমি মাঝেরহাটে নেমে গেলাম। আজ কত্ত রাত হয়ে গেল! প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি আর করিস না! যাচ্ছেতাই! আর শোন, মাঝে মাঝে ফোন করিস। রাত পৌনে এগারোটা বাজে। সব কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। সাবধানে যাস। ভাল থাকিস রে।’

সীমাদি নেমে গেলে ট্রেনটা যেন আরও নির্জন হয়ে গেল। মাফলারটা শক্ত করে বেঁধে ও গুটিয়ে বসল আরও। ডিসেম্বরের আজ বাইশ তারিখ। পরশু দিন ও চলে যাবে। জেঠু আসবে নিতে!

জীবনে এমনও হয়! জটাদাদু একবার বলেছিল, ‘জানিস জীবন এমন একটা খেলা যেখানে সব শেষ না হলে কিছুই শেষ হয় না। তুই এমন মুখ করে থাকিস কেন? কষ্ট পাস কেন? জানবি জীবন তোকে পরীক্ষা করছে! সাজাচ্ছে তোকে। বর্ম নিয়ে তো আমাদের জন্ম হয় না! কিন্তু জীবন নিজেই বর্ম তৈরি করে দেয় আমাদের মনে! মন বুঝলি! মনটাই আসল। শরীর তো মাটি আর ছাই! তাই মনটা শক্ত রাখ। জানবি যে সয়, সে রয়!’

এখনও আসলে বিশ্বাস হচ্ছে না স্মাহির। সত্যি কি জেঠু এসেছিল! ওর কোনও মনের ভুল নয়তো! গত পরশু একাই ঘরে বসেছিল ও। তখনই বাইরের দরজায় একটা শব্দ হয়েছিল। আর তারপর ওর নাম ধরে ডেকেছিল কেউ! কার গলা এটা! আচমকা বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল স্মাহির গায়ে! কে ডাকছে ওর নাম ধরে! মনে হয়েছিল গত জন্মের থেকে কেউ যেন ফিরে এসেছে আবার! সত্যি এসেছে! ও উঠে দ্রুত বেরিয়ে এসেছিল বাইরে! আর দেখেছিল মানুষটাকে!

সামান্য কুঁজো হয়ে গিয়েছে জেঠু। মাথার চুলে আরও আরও তুষারপাত হয়েছে যেন। জামা কাপড়ও কেমন যেন ইস্তিরিহীন! দেখে এত কষ্ট হয়েছিল স্মাহির যে ও পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়েছিল বারান্দায়! জেঠু মুখ তুলে তাকিয়েছিল ওর দিকে। থমকে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত! তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছিল ওর সামনে। সিঁড়ি ভেঙে এক ফালি বারান্দায় উঠে তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর হাত জড়ো করে কাঁপা গলায় বলেছিল, ‘মারে, আমায় ক্ষমা করে দিবি?’

বাবা মা মারা যাওয়ার পরে এই হাত দুটো আগলে রেখেছিল ওকে। সেই হাত দুটো ওর সামনে এখন জড়ো হয়ে আছে! ও কী করবে বুঝতে পারছিল না! যেদিন ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেদিন জেঠু কিছু বলেনি! সেই কষ্টটা মনে পড়ছিল ওর! কিন্তু সেই কষ্ট ছাপিয়ে ওর মনে আসছিল গোটা একটা বড় হয়ে ওঠা! জেঠু ওর জন্য যা করেছে সেটা কী করে ভুলে যাবে ও! জেঠুর নুয়ে পড়া শরীরটা দেখে আচমকা স্মাহির মনে হয়েছিল, ও এখন বড় হয়ে গিয়েছে! আর জেঠু যেন অনাথ কোনও শিশু! অমন একটা ঘটনার পরে যে মানুষ নিজে এসে দাঁড়ায় সামনে তার জন্য কোনও খারাপলাগা পুষে রাখতে নেই মনে!

জেঠু হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিল সামনে। কেমন থরথর করে কাঁপছিল। স্মাহি দেখে বুঝেছিল মানুষটার মধ্যে ভাঙচুর হয়ে গিয়েছে অনেক! ও আর থাকতে পারেনি! এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল জেঠুকে। আর বুঝেছিল খুব রোগা আর দুর্বল হয়ে গিয়েছে জেঠু!

জেঠুও ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল! বাড়িতে কেউ ছিল না আর। শুধু ওই গরিব ইট ওঠা বাড়িই যেন দেখেছিল বহুদিন পরে বাবা আর মেয়ের এই অশ্রুস্নান! বাবা! হ্যাঁ বাবাই তো! জেঠু যা করেছে তাতে বাবার চেয়ে কম কীসে!

জেঠুকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল স্মাহি। জেঠু মাথা ঘুরিয়ে দেখেছিল ঘরের চারদিক! তারপর অস্ফুটে বলেছিল, ‘রাজকন্যা তোকে আমি এ কোথায় পাঠিয়েছিলাম! জানিস আমি দুর্বল তাই তোকে এত কষ্ট পেতে হল। আমার স্ত্রীকে কিছু বলতে পারিনি। ছেলেকে কিছু বলতে পারিনি! ভাল, মুখচোরা হয়ে থাকা মানুষদের দমিয়ে রেখে সবাই তার সুবিধে নেয়! আমায় ক্ষমা করে দিস মা! আমি তোর জন্য কিছু করতে পারিনি!’

কী বলবে বুঝতে পারছিল না স্মাহি। জেঠুর হাত ধরে মাথা নিচু করে বসেছিল ও।

জেঠু বলেছিল, ‘তোকে রক্ষা করতে পারিনি আমি। না ওই দীপকের থেকে, না আমাদের বাড়ির লোকেদের থেকে!’

‘থাক জেঠু, আর না। প্লিজ আর বোলো না! আমারও ভুল হয়েছিল! খুব ভুল হয়েছিল! জীবন সব শোধ করে দেয়!’ স্মাহি চোখ মুছে বলেছিল।

‘দীপক যে অমন শয়তান আমি বুঝতে পারিনি রে! আমি…’ জেঠুর গলা ধরে গিয়েছিল।

আর পুরোনো সব স্মৃতি যেন বিশাল জলপ্রপাতের মতো আবার আছড়ে পড়েছিল ওর সামনে। মনে পড়ে গিয়েছিল সেই সেই সকালটা যেদিন ও জানতে পেরেছিল যে ছোট্ট একটা প্রাণ এসে গিয়েছে ওর শরীরে!

কিছুদিন থেকেই নানান লক্ষণ দেখে ওর সন্দেহ হয়েছিল। তাই একটা প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট কিনে এনেছিল ও। আর সেই সকালে সবার চোখের আড়ালে তাতে পরীক্ষা করেছিল! দুটো লাল দাগ! স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল স্মাহি! এটা কী হল! এটা কী করে হল! সাধারণত তো ওরা কন্ডোম ব্যবহার করত। শুধু একদিন অসাবধানতাবশত করেনি। তাতেই কি এমনটা হল!

কী করবে ও! কাকে বলবে! ও দীপককে ফোন করেছিল উপায় না দেখে! দীপক যখন তখন ওকে ফোন করতে বারণ করত। ওর স্ত্রী নাকি সন্দেহ করবে। কিন্তু সেদিন উপায় ছিল না।

ফোনটা ধরে সবটা শুনেছিল দীপক। তারপর বলেছিল, ‘কোনও ভয় নেই। কাল আমি তোমায় ফোন করব। একটা জায়গায় নিয়ে যাব। তারা অ্যাবর্ট করে দেবে। দেখো! কিছু ভেব না!’

‘অ্যাবরশান!’ আচমকা গলা শুকিয়ে এসেছিল স্মাহির!

দীপক হেসেছিল সামান্য। বলেছিল, ‘তুমি তো জানতেই আমার জীবন। এ ছাড়া তো উপায় নেই! আমরা তো আর বিয়ে করতে পারব না! কাল আমি ফোন করব! জানি আমি যা বলছি সেটা খারাপ শোনাচ্ছে! কিন্তু বাস্তবটা বুঝতে হবে স্মাহি! কাল কথা হবে!’

কিন্তু পরেরদিন কথা হয়নি! তারপরের দিনও কথা হয়নি! তার পরের পাঁচদিনও কথা হয়নি কোনও! দীপকের ফোন অদ্ভুত ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল! কিছুতেই যোগাযোগ করা যায়নি ওর সঙ্গে!

আর উপায় না দেখে তারপরের দিন ওর বাড়ি যেখানে, সেই জায়গায় গিয়েছিল স্মাহি। কিন্তু সেখানে কাউকে পায়নি! শুনেছিল এখানে ওই নামে নাকি কেউ থাকেই না! ভয়ে, কষ্টে সেদিন থরথর করে কাঁপছিল স্মাহি। ভেবেছিল তবে কি চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেবে!

না, ঝাঁপ দেয়নি স্মাহি! বাড়িতে ফিরে, মন শক্ত করে, জেঠিমাকে সব খুলে বলেছিল! ও ভেবেছিল জেঠিমা যতই কড়া হোক না কেন, এমন অবস্থায় হয়ত বকবে, কিন্তু একটা উপায় ঠিক বের করবেই!

জেঠিমা ওর কথা শেষের আগেই আচমকা পায়ের থেকে চটি খুলে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করেছিল ওকে। মাথা ধরে ঠুকে দিয়েছিল মেঝেতে! লাথি মেরেছিল কোমরে। তারপর চুল ধরে টানতে টানতে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল দরজা! আচমকা এমন করে মার আর অপমান এসে ওকে ঝাঁঝরা করে দেওয়ায় সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল স্মাহির!

তারপরের কয়েকটা দিন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছিল সব! দাদা আর জেঠিমা ওকে নিয়ে গিয়েছিল একটা জায়গায়! সেই আধো অন্ধকার একটা ঘর! সবুজ টানা পরদা! রঙচটা লোহার বিছানা! নোনা ধরা দেওয়াল! আর ওপরের থেকে নেমে আসা একটা বড় আলো!

ওর শরীরে উপুড় হয়ে যখন সবে মাত্র জমাট বাঁধতে থাকা সন্তানকে উপড়ে ফেলা হচ্ছে ও যেন কোথাও, দূরে কোথাও একটা পাখির শব্দ শুনেছিল! কুব কুব করে কী একটা পাখি যেন ডাকছিল প্রাণপণ! ও সমস্ত মনপ্রাণ একাগ্র করে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল ওই হত্যাকাণ্ডের জায়গা থেকে! আর মনে মনে সেই পাখিটাকে অনুসরণ করছিল। কেন পাখিকে অনুসরণ করছিল ও! এই সমস্ত ক্লেদ থেকে কি উড়ে বহুদূরে কোথাও চলে যেতে চাইছিল ও! এই পৃথিবীতে কি সত্যি ক্লেদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়!

পরের কয়েকটা দিন কেমন একটা আবছায়ার মধ্যে কেটেছিল ওর! খালি মনে হচ্ছিল যদি ওই ছোট্ট প্রাণটা বেঁচে যেত তাহলে কী হত! কেমন দেখতে লাগত তাকে! মনে হয়েছিল এখন কোন আবর্জনায়? কোন অন্ধকার জায়গায় পড়ে আছে সে! হাত বাড়িয়ে কি সে ডাকছে তার মাকে!

এই ঘটনার মাঝে কি একবার এসেছিল আদিত! না মনে করতে পারছে না! আদিতকে তো ও আগেই তাড়িয়ে দিয়েছিল জীবন থেকে! শুধু মনে আছে এক রাতে দরজা খুলে গিয়েছিল ওর ঘরের। দাদা আর জেঠিমা ওকে বলেছিল, ‘তোকে এবার চলে যেতে হবে এখান থেকে। আর এই বাড়িতে তোর জায়গা নেই!’

না আর কাকুতি মিনতি করেনি স্মাহি। কয়েকদিন সময় চেয়ে নিয়েছিল শুধু। তারপর চলে এসেছিল সেই বাড়ি থেকে। আসার সময় শুধু একবার তাকিয়েছিল পেছনে ফিরে। দেখেছিল সেই বারান্দা শূন্য! জেঠু নেই! শুধু মৃতদেহের মতো পড়ে আছে এক ফালি রোদ!

সেই জেঠু বসেছিল সামনে! মাথা নিচু করে!

জেঠু এবার মাথা তুলেছিল, ‘আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি। ওই বর্ধমানের বাড়ি বেচে দিয়েছি আমি। ভাল দাম পাইনি। পার্টির লোকেরা জবরদস্তি করে নিয়েছে বাড়িটা! তোর জেঠিমাও আর নেই। তোর দাদা দুবাইতে গিয়ে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে আমার সঙ্গে। আমি আর তোর বোন আছি। আমার দীর্ঘ দিনের ইচ্ছে ছিল তোকে কাছে এনে রাখার। কিন্তু সাহস হয়নি রে মা! এবার তোর বোন বলল তোর কাছে আসতে! আমি ভিতু মানুষ! তাই বুঝতে পারছি না কী করে তোকে বলব! কী করে ক্ষমা চাইব!’

স্মাহির আবার জল এসে গিয়েছিল চোখে। ও বলেছিল, ‘আমায় কি তুমি নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে চাও?’

জেঠু তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর বলেছিল, ‘তুই কি… আমি তোকে খুব যত্ন করব দেখিস! আমরা মানে…’ জেঠু যেন কথা খুঁজছিল!

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্মাহি। তারপর বলেছিল, ‘আমি চাকরি করি জেঠু। সেটা ছাড়তে হবে যে!’

‘ছাড়বি মা?’ জেঠু তাকিয়েছিল ওর দিকে! এত দিন পরে এসে আচমকা এমন আবদার করা যে ঠিক নয় সেটা যেন জেঠুও বুঝতে পারছিল।

স্মাহি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি হলে ছাড়তে জেঠু?’

জেঠু মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘না!’

স্মাহি হেসেছিল। জেঠুর ঠান্ডা হাত দুটো ধরে বলেছিল, ‘বাইশ তারিখ আমি ছেড়ে দেব কাজ! আর তারপর চব্বিশ তারিখ তুমি আর বোন দুজনেই কিন্তু নিতে আসবে আমায়! কেমন?’

লেক গার্ডেন্স স্টেশানে নেমে ঘড়ি দেখল স্মাহি। এগারোটা দশ বাজে। শুনশান প্ল্যাটফর্ম। শুধু দূরে কয়েকটা কুকুর জটলা করছে। আর সবটাই কেমন একটা কুয়াশার মোড়কে ঢাকা! ও কাঁধের ব্যাগটাকে ভাল করে ধরল। তারপর পা বাড়াল বাড়ির দিকে। পরশু থেকে এইসব কিছু স্মৃতি হয়ে যাবে। জীবনের আরেকটা অধ্যায় শেষ হল আজ!

‘এই যে ম্যাডাম!’

আচমকা ডানদিকের একটা আধো অন্ধকার জায়গা থেকে ডাকটা ছিটকে এল! আর ছ্যাঁত করে উঠল স্মাহির বুক। দেখল পাশের থেকে দুটো ছেলে আর ঝানু আবছায়া থেকে বেরিয়ে কুয়াশা কেটে এগিয়ে আসছে ওর দিকে! জানোয়ারটা ফিরে এসেছে!

‘কী চাই?’ ভয় পেয়ে গেলেও সেটা দেখাল না স্মাহি।

‘তোকে চাইরে শালি! তোকে আজ এই ঠান্ডায় আমার চাই! অনেক ছেনালি করেছিস! আজ আমার ইঞ্জিন গরম আছে! চল, আমরা তিনজন আর তুই। চারজনে মিলে আজ ছক্কা পুট খেলব!’

কথাটা শেষ করে আচমকা ঝানু এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে টান মারতে গেল! স্মাহি সরে গেল দ্রুত। টাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে পড়ে গেল ঝানু।

‘বাঞ্চোত! রেন্ডি! আজ তুই গেছিস… আজ তোকে…’ ঝানু উঠে দাঁড়াতে গেল।

আর সময় দিল না স্মাহি। ও দেখল ওর বাড়ির দিকে যেতে হলে সামনের এই জানোয়ারগুলোকে টপকাতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। তারচেয়ে লেকের দিকটা সেফ!

ও কুয়াশার মধ্যে ডুবে গিয়ে দৌড় দিল লেকের রাস্তার দিকে।

চারিদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট! তাও ও এগোল দ্রুত! ওই তো আবছায়া লেভেল ক্রসিং। সেটা টপকে সামনের দিকে দৌড়ল ও! এখানে কেউ নেই! শুধু একটা মনখারাপ করা আলো কুয়াশার ফুটোফাটা দিয়ে ছিটকে আসছে। পেছনে ওই রাক্ষসগুলোর পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে স্মাহি। ও আরও জোরে দৌড়োবার চেষ্টা করল।

স্মাহি দেখল বাঁদিকে ব্রিজের রাস্তা নেমে আসছে। এখানে তো পুলিশ থাকে মাঝে মাঝে! কিন্তু আজ নেই! আজ কুয়াশা এসে যেন সব কিছু দখল নিয়ে নিয়েছে! পায়ের শব্দ যেন কাছে চলে এল আরও!

‘বাঁচাও… বাঁচাও…’ উপায় না দেখে এবার চিৎকার করল স্মাহি।

কোনদিকে যাবে বুঝতে না সামনের দিকেই কুয়াশা ভেদ করে এগোল স্মাহি। আর তখনই ধাক্কাটা লাগল! পড়ে গেল স্মাহি! একটা ছেলে! কুয়াশা আর হলুদ আলোর জাল কেটে জেগে উঠল একটা মুখ! স্মাহির দম বন্ধ হয়ে গেল যেন! ও দেখল ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে আদিত!

বহু আগে সেই লম্বা বারান্দায় একবার পড়ে গিয়েছিল স্মাহি। আদিত ছিল পাশেই। ও স্মাহির হাত ধরে তুলেছিল। বলেছিল, “your hand / touching mine. / this is how galaxies collide.”

আদিত তুলে দাঁড় করাল স্মাহিকে। আর আজও সহস্র কোটি আলোকবর্ষ দূরে কোন এক ছায়াপথের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ছিটকে গেল আরও অন্য কোনও এক ছায়াপথ! মহাকাশ জুড়ে ঝরে পড়ল তারাচূর্ণ! নেবুলায় নেবুলায় মাথা তুলল নতুন সৌরমণ্ডল! ফুটে উঠল গ্রহ, তারা, ধূমকেতু! আর কোথাও আবারও জন্ম নিল বহু বহু কোটি বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাণ! জন্ম নিল আরেক নীল সবুজ পৃথিবীর সম্ভাবনা!

স্মাহি তাকিয়ে রইল আদিতের দিকে। আর দেখল আদিত ধীরে ধীরে তুলে ধরল একটা পিস্তল! তারপর এগিয়ে এসে স্মাহিকে বাঁ হাত দিয়ে টেনে নিজের পেছনে, আড়ালে নিয়ে গিয়ে সামনে ঝানুদের দিকে বাড়িয়ে ধরল পিস্তল!

ঝানুরা থমকে গেল কি? নাকি পিছিয়ে পড়ল? পালিয়ে গেল নাতো! নাকি এগিয়ে এল আরও! আচ্ছা এখানে এখন আদিত কী করছে! ওর হাতে পিস্তলই বা কেন! কিন্তু কিছুই যেন বুঝতে পারল না স্মাহি। ও শুধু দেখল অন্য কোনও দূরবর্তী গ্রহে প্রাণ জন্ম নিচ্ছে আবার! জলের মধ্যে ধীরে ধীরে নড়ে উঠছে এই মহাবিশ্বের এক অনন্ত বিস্ময়! এক অশেষ জাদু!

ঝানুরা এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। কীসব বলছে যেন! আদিত পিস্তল উঁচিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে ওদের। শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে আরও শব্দে। কিন্তু আসলে কিছুই কানে আসছে না স্মাহির। ও কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে সত্যি কি এসব ঘটছে! নাকি সবটাই মিথ্যে! স্বপ্ন!

শহরে রাত্রির হাওয়া পাক খেল। কুয়াশা গাঢ় হয়ে উঠল আরও! আর স্মাহি দেখল, তার ফাটল দিয়ে স্ট্রিট লাইটের এক ফালি হলুদ আলো এসে ছিটকে পড়েছে আদিতের বাঁ হাতের ওপর! থিরথির করে কাঁপছে অদ্ভুত আলোটি! যেন কবেকার সেই হলুদ পালক!

স্মাহি বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা সমস্ত ভালবাসা নিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরল সেই পালকটি। আর এত বছর পর বুঝল জীবনে এই প্রথমবার কোনও ছায়াপথ ছড়িয়ে পড়ল ওর ভেতরে! বুঝল, এই প্রথমবার কোনও প্রাণ তৈরি হল ওর নিজস্ব গ্রহে!

১৯ আদিত

কুয়াশা! সারা জীবন জুড়ে আজ যেন কুয়াশা নেমেছে পৃথিবীতে। আজ কোনও বন্ধু নেই! কোনও আলো নেই! কিচ্ছু নেই! সব এক অন্ধকার যুদ্ধক্ষেত্র! যাকে সব থেকে বিশ্বাস করে মানুষ, সেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি আঘাত করে। যার কাছে সে তৃষ্ণার জল চায়, সেই মুখের কাছে ধরে হলাহল! এ পৃথিবী নরকের! অন্ধকারের! এ পৃথিবী প্রতিশোধের!

খারাপ করলে পৃথিবী নাকি সেই পাপ অন্যভাবে হলেও ফিরিয়ে দেয়! ‘কার্মা’ নাকি খুব কঠিন একটা জিনিস! এর হাত থেকে কেউ নাকি বাঁচতে পারে না! কিন্তু কবে কী হবে তার জন্য কি মানুষ বসে থাকবে? কবে কার্মা শাস্তি দেবে তার জন্য কতদিন অপেক্ষা করবে মানুষ!

আসলে তোমার কষ্টের হিসেব তোমাকেই নিতে হবে! তোমার বদলা নেবার ভার তোমার ওপরই আছে কেবল। সব কিছু ভাগ্য আর কার্মার ওপর ছেড়ে দিলে জানবে জীবন আবার এসে আঘাত করবে তোমায়! এই পৃথিবী এখন নরখাদকের! ক্ষমতাবান কিছু নরপিশাচ ইচ্ছেমতো সব কিছু করে যায়! তারা পায়ের তলায় পড়ে যাওয়া কাউকে লক্ষ্য করে না! তাদের লোভ, জিঘাংসা আর ক্ষমতা প্রদর্শনই হল বেঁচে থাকার লক্ষ! এরা নিজের থেকে থামবে না! এদের থামাতে হবে! অন্তত একজনকে হলেও থামাতে হবে! বাকিদের বুঝিয়ে দিতে হবে, মানুষকে যারা পশুর মতো ব্যবহার করে, তাদের শেষ পরিণতি এমন পশুর মতোই হয়! আমাদের মধ্যের সেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছেটাই আসলে হবে দোষীর ‘কার্মা’! তার নিয়তি!

সামনে কালভার্টের মতো উঁচু হয়ে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একটা চলে গিয়েছে লেক গার্ডেন্স স্টেশানের দিকে, আর অন্যটা উঠে গিয়েছে ফ্লাইওভারে!

আর আদিত যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানের রাস্তাটা চলে গেছে একটা অভিজাত ক্লাবের পাশ দিয়ে লেকের ভেতরে যাওয়ার একটা লোহার গেট অবধি! অন্যদিন এখানে গার্ড থাকে, কিন্তু আজ কেউ নেই! পুলিশের গাড়িও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না! এই আবহাওয়ার জন্যই হয়ত!

চোয়াল শক্ত করে মোবাইলে সময় দেখল আদিত। এগারোটা! কাল তেইশে ডিসেম্বর। পরশু, অর্থাৎ চব্বিশ তারিখ রাতে বিদেশে ঘুরতে চলে যাবে রাজুদা! তার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে! একদিকে মাকু আই.সি.ইউ.-তে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করবে আর অন্যদিকে যে এর জন্য দায়ী সে ‘মস্তি’ করে বেড়াবে, সেটা হয় না! জীবনে কোনওদিন কোনও নিয়ম ভাঙেনি আদিত! কিন্তু এবার ভাঙবে! রাজুদার শিক্ষা হওয়া দরকার! মানুষের জীবনের মূল্য যাদের কাছে এক ফোঁটাও নেই তাদের বেঁচে থাকার দরকারও নেই!

সেদিন বিলুর ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই মাথা কেমন করছিল! রাজুদা ওকে মারতে লোক লাগিয়েছিল! আর ওকে মারতে গিয়ে তারা ভুল করে মাকুকে গুলি করেছে! এটা কী হল! মাকু তো খুব সাধারণ ছেলে! একটু পাগলাগোছের! কিন্তু কারও ক্ষতি করে না! বরং সাহায্য করার চেষ্টা করে সবাইকে। তাকে এভাবে মেরে দিল! কেন!

পরেরদিন সকালেই রাজুদার কাছে গিয়েছিল আদিত। যার আদর্শে, যার দিকে তাকিয়ে ও চাকরি ছেড়ে এসে পলিটিক্সে যোগ দিয়েছে সে এমন কুৎসিত মানুষ সেটা তো জানত না!

বাড়িতে ঢোকার সময় ভেতরে ভেতরে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছিল ওর! মনে হচ্ছিল, এভাবে রাজুদার সামনে ওকে যেতে হবে কোনওদিন সেটা ও ভাবতেও পারেনি! কিন্তু মাকু খুব নিরীহ একটা মানুষ। তাকে মারার দায় তো নিতেই হবে রাজুদাকে!

রাজুদার বাড়িটা কেমন যেন নিস্তব্ধ ছিল সেদিন। বাইরের রোজকার ভিড়টাও কম ছিল বেশ। ওকে দেখে দু একজন সামান্য চমকেও গিয়েছিল!

বাড়ির ভেতরটা কেমন যেন ঠান্ডা আর স্যাঁতস্যাঁতে লেগেছিল। আদিত দেখেছিল রাজুদার ঘরের দরজাটা সামান্য ফাঁক করা! ও এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিয়েছিল জোরে।

‘কে?’ রাজুদার গলায় বিরক্তি ছিল স্পষ্ট!

আদিত আর উত্তর না দিয়ে সোজা দরজা ঠেলে ঢুকে গিয়েছিল ভেতরে!

‘তুই?’ রাজুদা ফোনে কথা বলছিল কারও সঙ্গে! ওকে দেখে ফোনটা নামিয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে। চোখে মুখে রাগ!

আদিত এগিয়ে গিয়ে টেবলের ওপর ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল সামনে। তারপর বলেছিল, ‘এটা কী করলে রাজুদা! মাকুকে মেরে দিলে!’

রাজুদা এবার পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর মোবাইলটা সুইচ অফ করে বলেছিল, ‘তোর দেখছি খুব সাহস বেড়ে গিয়েছে!’

‘কথা কাটিয়ো না রাজুদা! এটা তুমি কী করলে!’

‘বাঞ্চোত, সেদিনের ছেলে আমায় এসব জিজ্ঞেস করছিস!’ রাজুদা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিল ওর দিকে, ‘তোর ব্যবস্থা করছি, দাঁড়া!’

‘আমার ব্যবস্থাই তো করতে গিয়েছিলে! কিন্তু… কেন এমন করলে রাজুদা! সেই ভোটের সময় যাদের রেশন কার্ড হয়ে যাবে বলেছিলে তাদের রেশন কার্ড করে দিলে না! ফ্যাক্টরির আন্দোলনটা সাবোটাজ করলে! তারপর… তারপর…’

রাজুদা কথার মধ্যে উঠে এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে। এবার আচমকা ওর কলারটা খামচে ধরে বলেছিল, ‘তুই আমার কাছ থেকে কৈফিয়ত চাইছিস! তুই একটা ফ্যাক্টরি বন্ধ করার তালে ছিলিস না! সেটা কি ভাল কাজ!’

আদিতের গলায় কষ্ট হচ্ছিল, ও রাজুদার হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে বলেছিল, ‘তুমি… তুমি কত টাকা নিয়েছ মালিকদের থেকে? আমি কি কিছু বুঝি না! কিছু কি বুঝি না! বাদলদা আর তুমি…’

‘শালা!’ রাজুদা ওকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল মেঝেতে তারপর এগিয়ে এসে আচমকা লাথি মেরেছিল পেটে। অক্ শব্দ করে কুঁকড়ে গিয়েছিল আদিত। একটা ব্যাথা নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা শরীরে!

রাজুদা ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘তোকে ভাল একটা কথা বলেছিলাম, শুনলি না! পুশিকে কষ্ট দিলি! আর আমার কেরিয়ার নিয়েও কাঠি করছিস! গান্ডুদের পাঠিয়েছিলাম তোকে মারতে! তোর ওই ক্যালানে বন্ধুটা মাঝখান থেকে দানা খেল! কিন্তু না, এবার দেখ তোকে কী করি! তোর বাপ, মা চোদ্দ গুষ্টির যদি পেছনে না দিই তাহলে আমার নাম পালটে ফেলিস!’

আদিত উঠে বসেছিল এবার। রাজুদাকে যেন ঠিক রাজুদা লাগছিল না! বরং কেমন একটা রাক্ষসের মতো লাগছিল! মনে হচ্ছিল রাজুদার শ্বাস দিয়ে আগুন ঝরছে!

রাজুদা বলেছিল, ‘একটাই বাঁচার উপায় তোর! এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যা! আমি বিদেশ থেকে এসে যেন তোকে না দেখি এখানে!’

আদিত উঠে দাঁড়িয়েছিল। এই রাজুদাকে চিনতে পারছিল না ও। সারা শরীরে একটা চাপা রাগ ছোবল মারছিল। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি কিছু একটা করতে হবে। এই লোকটাকে এখানে থামাতে হবে, নাহলে লোকটা আরও অনেক ক্ষতি করে দেবে সবার! এটা হতে দেওয়া যায় না কিছুতেই। ও ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে!

রাজুদার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে, একটা নির্জন গলিতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল আদিত! নয়ডায় ওর চাকরি পাকা! বাবা হাসপাতালে বটে, কিন্তু তাতেও খুব কিছু আটকাবে না। ছোট মামা সেটারও একটা বন্দোবস্ত করবে বলেছে। সঙ্গে মায়ের দিকটাও দেখবে। কিন্তু তাতে তো নিজেকে বাঁচানো হল। আর বাকি মানুষদের কী হবে! মাকুর কী হবে! ও যে আই.সি.ইউ.-তে লড়াই করছে প্রতিটা শ্বাসের জন্য, তার কী হবে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কি কথা বলবে না! দেশে আইন আছে, কিন্তু সেই আইনের মাধ্যমে কি রাজুর মতো লোকেদের নাগাল পাওয়া যায়? যায় না! তাহলে? তা ছাড়া ওর তো শুধু যাওয়ার রাস্তাই আছে! ফেরার রাস্তা তো নেই!

বুকের ভেতরে কেমন একটা ছটফট করছিল ওর! মনে হচ্ছিল কী যেন একটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না! কী যেন একটা কাজ করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু সেটা হচ্ছে না! শুধু আজও হাজার হাজার মৃত পাখির পালক যেন ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে!

‘কীরে!’ আচমকা পাশের থেকে বিলুর গলা পেয়েছিল আদিত।

আদিত ঘুরে তাকিয়েছিল বিলুর দিকে। একটা হালকা সবুজ রঙের উইন্ডচিটার পরে পানের মশলা চিবোতে চিবোতে ওর দিকে তাকিয়ে ভুরু তুলে ইশারা করেছিল বিলু।

আদিত নামিয়ে নিয়েছিল মাথা। বিলু রাজুদার খাস লোক। কিছু বলতে এসেছে কি?

বিলু আরও একটু এগিয়ে এসেছিল কাছে, ‘অত ভাবছিস কেন? মালটাকে নামিয়ে দে!’

কী! চমকে উঠেছিল আদিত! বিলু ওকে মাকুর খবরটা দিয়েছিল। আর এখন এসব কী বলছে! তবে কি বিলু সরে এসেছে আদিতের থেকে!

‘অমন আতার মতো কী দেখছিস! মালটার খুব রস হয়েছে! ওকে সরিয়ে দে এই মওকায়। তোকে মালটা মারতে চেয়েছিল ভুলে যাস না। আমার কাছে খবর আছে আবার চেষ্টা করবে। আদিত, শত্রুর শেষ রাখতে নেই!’

আদিত মাথা নিচু করে নিয়েছিল। ঠিক বলেছে বিলু। রাজুদার মতো লোকজন সবার শত্রু। যে অন্যকে খুন করতে দ্বিধা করে না তার প্রতি দয়া দেখাবার কোনও মানে হয় না।

ও জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কীভাবে… মানে…’

‘টাকা আছে তোর কাছে?’ বিলু জিজ্ঞেস করেছিল।

‘কত?’

বিলু দেখে নিয়েছিল এদিক ওদিক। তারপর গলাটা সামান্য নামিয়ে বলেছিল, ‘শোন, ওয়ান শটারের দাম এক দেড় হাজারের মতো। তবে ভাল মুঙ্গেরি মাল হলে তিন চার হাজার পড়ে যাবে। সেভেন এম.এম. কিনতে চাইলে কুড়ি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার পড়বে। আর নাইন এম.এম. এর দাম মোটামুটি তিরিশ থেকে পঞ্চাশ হাজারের মতো!’

আদিত অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

বিলু বলেছিল, ‘ইলেকশান কি তোর খোল-কত্তাল বাজিয়ে হয় নাকি? রাজুদার হয়ে আমিই মাল কিনি লটে! ডিসকাউন্ট পাই! তোকেও করিয়ে দেব। পারবি?’

পারবে? ওকি পারবে সত্যি! পৃথিবী থেকে একটা নোংরা লোককে সরিয়ে দিতে পারবে কি ও! কিছুই তো পারল না আদিত। ভাল পড়াশুনো করেও সমাজের হয়ে কিছু পারল না করতে! বাবা মায়ের ভাল সন্তান হতে পারল না। এমন কী যাকে ভালবাসল তার জন্যও কিছু করতে পারল না! আচমকা ওর সামনে স্মাহির মুখটা ভেসে উঠেছিল। যেন দেখতে পেয়েছিল লম্বা বারান্দার সামনে একটা বড় পাখির খাঁচা। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন। ছোট্ট মুকুট কপাল! নাকের দুপাশে তিল! আর কী ভীষণ সুন্দর হাতের আঙুল! ওই হাত ওর কাছ থেকে এখন অনেক অনেক দূর!

একটা জীবনে ওর কিছুই করা হল না। কেবল ব্যর্থতা আর পরাজয়! এমন একটা জীবনে কিছু কি ভাল কাজ করবে না ও! একটা রাক্ষসকেও কি নিকেশ করবে না?

ও বলেছিল, ‘আমি তিন হাজার জোগাড় করতে পারব। কিন্তু কাজ হবে তো!’

বিলু ওর কাঁধে হাত দিয়েছিল, ‘মাখনের মতো হবে। চাপ নিস না।’

আজ, এই বাইশে ডিসেম্বরের আবছা কুয়াশার সন্ধেবেলা সেই বিলু ফোন করেছিল, বলেছিল রাতে, এই সময়ে, এখানে আসতে।

রাতে খাবার খেয়ে নিয়ে একটা ফুল সোয়েটার আর মাফলার জড়িয়ে আদিত যখন বেরোচ্ছিল মা এসেছিল কাছে! বলেছিল, ‘এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস? হাসপাতালে?’

আদিত শান্ত গলায় বলেছিল, ‘না, বাবা এখন ঠিক আছে। পরশু তো বাড়ি চলে আসবে। আমি অন্য একটা কাজে যাচ্ছি মা। তুমি শুয়ে পড়।’

‘সাবধানে যাস,’ মা আলতো করে হাত বুলিয়েছিল ওর মাথায়। বলেছিল, ‘কী যে করিস কে জানে! আমার চিন্তা হয়! দিনকাল ভাল নয়!’

এইজন্য, একমাত্র এই জন্যই তো ওর এই কাজটা করা দরকার! কেন দিনকাল ভাল নয়? কীসের জন্য দিনকাল এমন হয়ে গেল! কিছু মানুষ ক্ষমতা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করল বলেই তো এমন হল নাকি! সেই জঘন্য মানুষদের একজনকে অন্তত ওকে সরাতে হবে! রাজুদা তো প্রতীক মাত্র!

একটা বাইক থামার শব্দ পেল আদিত। তারপর শুনল, ‘এই যে, এসেছিস?’ কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে আলতো করে এগিয়ে এল দুটো ছায়া মূর্তি। একজনকে চিনতে পারল আদিত। বিলু।

বিলু এসে চাপা গলায় বলল, ‘নিয়ে এসেছিস তো? তিন কিন্তু! বের কর।’

নিজের অনেক কষ্টের জমানো টাকা। তবু এটা করতে হবে! আদিত টাকাটা বের করে দিল। পাশের আবছায়া লোকটা নিয়ে নিল সেটা। তারপর একটা চটে জড়ানো জিনিস তুলে দিল ওর হাতে। খশখশে গলায় বলল, ‘দাদা বলল বলে এই দামে দিলাম। সঙ্গে দশটা দানা ফিরি দিয়ে দিয়েছি! হাত সোজা রেখে কাছের থেকে টানবেন। এক সঙ্গে দুটোর বেশি চালাবেন না। গরম হয়ে গেলে মেশিন আটকে যাবে। বুঝেছেন?’

আদিত কিছু বলার আগেই বিলু এসে ওর কানের কাছে বলল, ‘কাল মালটা সন্ধেবেলা একা যোধপুর পার্কে যাবে। বুঝলি! আমি টাইমটা বলে দেব পরে।’

মাথা নাড়ল আদিত। আর ঠিক তখনই একটা হুইসল শুনল। সামনের লেক গার্ডেন্স স্টেশানে ট্রেন ঢুকেছে একটা।

‘লোকজন আসবে এবার। আমরা কাটি!’

বিলুরা আর দাঁড়াল না। বাইকে উঠে রাত্রি টুকরো টুকরো করে বেরিয়ে গেল দ্রুত! ট্রেনটাও ঘটাঘট শব্দ তুলে চলে গেল শিয়ালদার দিকে।

এদিক ওদিক দেখল আদিত। তারপর চটের মোড়কটা খুলে বের করল জিনিসটা। ঠান্ডা, ভারি একটা ধাতু! সঙ্গেই একটা প্লাস্টিকে মোড়ানো কয়েকটা বুলেট! হাত কাঁপছে আদিতের। এটা কী করতে যাচ্ছে ও! পারবে তো এটা করতে! কীভাবে করবে! একটা মানুষকে মেরে দেবে!

ও ভাল করে ধরল পিস্তলটা। হাত কাঁপলে হবে না! চট দিয়ে আবার মোড়াতে গেল জিনিসটাকে আর ঠিক তখনই শুনল শব্দটা! ‘বাঁচাও… বাঁচাও…’

একটা মেয়ের গলা! সচকিত হয়ে উঠল আদিত! কে এমন করে চিৎকার করছে এখানে! কী হয়েছে! ও দ্রুত এগোল সামনে। এখানে ব্রিজের রাস্তা আর স্টেশানের রাস্তাটা এসে মিলেছে।

ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে পায়ের শব্দ আসছে শুধু! কে আসছে এভাবে?

আরও দু পা এগোল আদিত এবং তখনই ধাক্কা লাগল একটা। আর কে যেন ছিটকে পড়ল মাটিতে! আদিত সামলাল নিজেকে। তারপর তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গে আকাশের সমস্ত নক্ষত্র ঝিলমিল করে উঠল ওর শরীরে!

স্মাহি! স্মাহি ওর সামনে! এ কি সত্যি, না রূপকথা! কী হয়েছে ওর! কী বিপদ হল! ও দ্রুত হাত ধরে তুলল স্মাহিকে! এই স্পর্শ! এই তো যথেষ্ট ঈশ্বর! এখন কী বলবে ও! কী বলতে হয় এমন সময়ে!

আচমকা পেছনের তিনজন কুয়াশার থেকে ফুটে বেরোল এবার। আর বুঝতে পারল আদিত! এই অঞ্চলের গুন্ডা এগুলো! দেখেছে আগে! কী চায় সেটাও বুঝতে পারল। আর নিমেষে ওর শরীরে এক আগ্নেয়গিরি রাগ ভর করল। ও এক হাত দিয়ে নিজের পেছনে টেনে আড়াল করল স্মাহিকে আর অন্য হাতে শূন্য পিস্তলটাই সোজা তুলে ধরল রাক্ষসগুলোর দিকে।

লোকগুলো থমকে গেল। কুয়াশার আবছায়ায় দাঁড়িয়ে আগুপিছু করতে লাগল। একজন বলল, ‘সরে যা শুয়োরের বাচ্চা! আমাদের মাল! সরে যা…’

আরেকজন বলল… কী বলল? কিছুই শুনতে পেল না আদিত। শুধু বুঝল পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে স্মাহি আলতো করে ধরেছে ওর হাতটা! সেই হাত ধরে আছে ওর হাত! বহু আগের একদিন সেই বারান্দার মতো! কিন্তু ও তো বাতিল! ওকে তো তাড়িয়ে দিয়েছিল! তাহলে কেন হাত ধরল এমন! সামনের লোকগুলো কীসব বলছে! কিন্তু কানে কিছু ঢুকছে না আদিতের। কেমন এক অদ্ভুত ভ্রমর-গুঞ্জন যেন ঘিরে রেখেছে ওকে! স্মাহির নরম হাত জড়িয়ে রয়েছে ওর হাত! কী হবে এরপর! ওই গুন্ডাদের থেকে কী করে নিস্তার পাবে ওরা! কীভাবে বাঁচবে এখান থেকে! পিস্তল তো খালি! তবে কি এভাবেই শেষ হবে সব কিছু! এভাবেই কি কিছু না বলেই সব মিলিয়ে যাবে এই কুয়াশায়! এই রাতে! এই তারাদের মাঝের অন্ধকারে! গেলে যাক! এইটুকু স্পর্শ, এইটুকু কাছে থাকাও তো সত্য! অসম্পূর্ণতাই তো জীবনের প্রকৃত সত্য!

এক হাত দিয়ে স্মাহির হাত শক্ত করে ধরল আদিত। তারপর শূন্য পিস্তল ধরে রইল সামনের দিকে! আর মনে মনে বলল, ‘ভয় নেই স্মাহি! আমি আছি! তুমি দেখো, আমি যেমন ছিলাম ঠিক তেমনই থাকব! তোমার হয়ে থাকব!’

২০ ঋত্বিজ

‘আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি!’ নীপা ওর সামনে বসে মোবাইলে খুটখাট করতে করতে তাকাল ওর দিকে!

হাসল তিজু। মেয়েটা একদম পাগলি। সারাক্ষণ ভুলভাল কথা বলে। আগে সিঁড়িতে বসে বলত এখন নার্সিংহোম থেকে আসার পরে ওর ফ্ল্যাটে এসে বলে। হাসি পায় তিজুর। এখনকার ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলো খুব পাকা! পাকা আর ওপিনিয়েনেটেড! সব কিছু নিয়ে এদের বক্তব্য আছে। সব বিষয়ে এদের মতামত আছে! তবে এটাই তো স্বাভাবিক! এটাই তো ভাল। জীবনের প্রথম দিকে এভাবেই তো ঠুকে বাজিয়ে দেখে নিতে হয় সবকিছু। খুঁজে নিতে হয় নিজের নিজের সত্যিকে! কারণ বড় হয়ে গেলে, বয়স হয়ে গেলে মানুষ তো ক্লান্ত হয়ে যায়! হতোদ্যম হয়ে যায়! তখন আর কিছুই তো করতে পারে না সে! শুধু নির্বিকার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অভ্যেস হয়ে যায় তার!

‘কী হল?’ নীপা খোঁচা মারল ওকে।

তিজু হাসল, বলল, ‘বুঝলাম, এবার বাড়ি যা! কটা বাজে দেখেছিস? পৌনে এগারোটা।’

‘তো? দেরি হোক। আমার জন্মদিনে তুমি কী দেবে আমায়? কাল তেইশে ডিসেম্বর ভুলে যাওনি তো?’

‘কী চাস তুই?’ তিজু তাকাল ওর দিকে।

‘কিস!’ খিলখিল করে হাসল নীপা, ‘লাইক ফ্রেঞ্চ কিস! তোমায় তোমার বউ ছেড়ে দিল কেন বলো তো? এমন মালকে কেউ ছেড়ে দেয়!’

তিজু চোখ বড় বড় করে তাকাল, ‘মাল!’

নীপা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ও ছেলেরাই শুধু মেয়েদের মাল বলবে, না? মেয়েরা বললেই অমনি অবাক হওয়া! এই মিডল এজেড লম্বা চওড়া লোকেদের আমার হেভি সেক্সি লাগে!’

‘আচ্ছা, চুপ কর।’ তিজু ঘড়ি দেখল। পাগলিটাকে এবার ভাগাতে হবে।

নীপা উঠে দাঁড়াল এবার, ‘আচ্ছা আচ্ছা আর ঘড়ি দেখতে হবে না। আই গেট ইট। যাচ্ছি। কিন্তু কাল কিস চাই। লাইক ডিপ ওয়ান! বুঝলে!’

‘মার খাবি,’ মিছিমিছি চোখ পাকাল তিজু, ‘যা এবার। পাগলি।’

নীপা হেসে কবজির কাছের ব্যান্ডেজটা আলতো করে ধরে বলল, ‘তোমায় কেউ কী করে ছেড়ে থাকতে পারে? আই ডোন্ট নো! আমায় তুমি পাগলি বলছ, কিন্তু সেই মেয়েটা সবচেয়ে বড় পাগলি।’

‘মানে!’

‘মানে, আই ক্যান সি ইট ইন ইয়োর আইজ! আর কতদিন এভাবে থাকবে! যাকে ভালবাস তার থেকে এমন করে সরে থেকো না! সে পাগলি বলে তুমিও এমন করবে! রাগ করে থেকো না আর! অভিমান কোরো না! একটাই জীবন! প্লিজ গো টু হার! গো ফর দে কল ইউ শেফার্ড!’ নীপা এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না!

নির্জন ঘরে দাঁড়িয়ে কেমন একটা লাগল তিজুর! নীপা কী করে বুঝল এসব! ওর মুখে কি কিছু ফুটে ওঠে! এভাবে কেন বারবার এখনও মুকুর কথা মনে পড়ে ওর! ওকে তো বলেইছিল যা বলার। এমন কী বলেছিল ওর বাচ্চার রক্ত লেগে আছে ওর হাতে! রক্ত লেগে আছে! ওর হাতে! এটা কী করে বলেছিল মুকু! খুব রাগী মেয়ে ছিল ও! খুব কষ্টে ছিল। তাই হয়ত বলে ফেলেছিল এমন একটা কথা!

যবে থেকে ও জেনেছিল মুকু প্রেগনেন্ট, তিজুর কী যে আনন্দ হয়েছিল! মনে হয়েছিল সারা পৃথিবীর সমস্ত ভাল কিছু নিয়ে ও জড়ো করে মুকুর চারিদিকে। যে মেয়েটাকে প্রথম দিন দেখেই মনে হয়েছিল ‘এ আমার!’ তার সঙ্গে ও নতুন একজনকে আনছে পৃথিবীতে! ওর নিজের রক্ত! মনে মনে কত কী যে ভেবে নিয়েছিল তিজু!

কিন্তু তারপর কী হল! অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গে যেন পড়ে গেল ও! বাচ্চাটা রইল না! মুকু কেমন হয়ে গিয়ে ওকে ছুড়ে ফেলে দিল জীবন থেকে! তারপর মৃত্যুশয্যায় মা বলে গেল এমন একটা কথা!

সবাই ছিল তিজুর। কিন্তু এখন আর কেউ নেই! মুকু বিয়ের আগে একবার বলেছিল, ‘দেখবি, তোকে ছেড়ে আমি কোনওদিন কোথাও যাব না। তোকে ছেড়ে থাকতেই পারব না!’

জীবনের এই অদ্ভুত একাকিত্বে এখন কোথায় মুকু! কার কাছে চলে গেল ও! সত্যি অন্য একজনকে বিয়ে করে নেবে!

তিজু উঠে গিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। আজ কুয়াশা খুব। কলকাতা যেন অপরিষ্কারভাবে মুছে নেওয়া কোনও ব্ল্যাকবোর্ড! সব কেমন ঘোলাটে।

অভিনব সেদিনের পরে বলেছিলেন আবার পঁচিশ তারিখ দেখা করবেন! ওঁর কেমো নিতে যাওয়া আছে মাঝখানে! খারাপ লাগছে তিজুর। একজন অসুস্থ মানুষকে এভাবে বিরক্ত করতে খারাপ লাগছে! কিন্তু এমনটা এক প্রশ্ন ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে যে নিজেকে সামলাতেও পারছে না! আর অভিনব নিজেও কিছুতেই বলছেন না যে মানুষটি কে! জোর করলে বলছেন, ‘আমি কথা দিয়েছিলাম যে নাম বলব না! কথা দিয়েছিলাম যে তাকে গোপন রাখব!’

তাও পঁচিশ তারিখ একবার চেষ্টা করবে তিজু। আর তারপর যদি না হয়… জানে না, আর কিছু ভাবতে পারছে না তিজু!

ও বাইরের দিকে তাকাল। মন ভাল নেই একটুও। আবছা শহরে একা লাগছে খুব। আচমকা মুকুর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে ভীষণ! মনে পড়ে যাচ্ছে বিয়ের অনেক আগে এমন একটা রাতের কথা! সেদিন দিল্লিতে কুয়াশা ছিল খুব! আর থাকতে না পেরে মাঝরাতে মুকুদের হোস্টেলে লুকিয়ে চলে গিয়েছিল তিজু। তখন মুকুর মায়ের জন্য ওদের মধ্যে সাময়িক একটা বিচ্ছেদ এসেছিল। মুকুই বলেছিল, তিজু যেন এখন যোগাযোগ না করে।

কিন্তু যোগাযোগ না করে কী করে থাকবে তিজু! ওর তো পাগল পাগল লাগছিল সারাক্ষণ। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি মুকুকে না পেলে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে। তাই হোস্টেলে না গিয়ে উপায় ছিল না ওর! সবার চোখ এড়িয়ে ও একতলার বারান্দায় উঠে আলতো টোকা দিয়েছিল মুকুর সিঙ্গল রুমের জানলায়। নিমেষে জানলা খুলে দিয়েছিল মুকু। তারপর ওকে দেখে দরজা খুলে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল! সেদিন সারারাত দুজনে দুজনের ভেতরে ডুবে ছিল। মুকু আদুরে গলায় ওর সঙ্গে লেপটে থেকে বলেছিল, ‘আমি আজ তোকে পাগলের মতো চাইছিলাম। আমি তোকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারছি না আর! আমাদের জীবনটা কি এভাবেই গোটা একটা অপেক্ষা হয়ে থেকে যাবে!’

শীতের রাতে মুকুর শরীরের তাপে নিজেকে জড়িয়ে নিতে নিতে ওর কানে কানে তিজু বলেছিল, ‘ “There is a place in the heart that / will never be filled/ a space/ and even during the/ best moments/and/the greatest times/ times/ we will know it/ we will know it/ more than/ ever/ there is a place in the heart that/ will never be filled/ and/ we will wait/ and/ wait/ in that space.” ’

সেই মুকুর থেকে ওকে দূরে থাকতে হয় এখন! অভিনব সত্যি বলেছেন, ভালবাসার মানুষ চলে গেলে মানুষ আর বেঁচে থাকে না!

আচমকা ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল! সামান্য বিরক্ত হয়ে পেছনে ফিরল তিজু। এই ফোনটা কেন যে ওকে অভিনব দিলেন! এসবের থেকে দূরে থাকবে বলেই তো ও নিজের ফোন নিয়ে আসেনি সঙ্গে করে!

তবু গিয়ে ফোনটা ধরল। আরে জগন! ব্যাটাকে নাম্বারটা দেওয়া ঠিক হয়নি!

‘বল।’ ফোনটা কানে লাগাল তিজু।

জগন কোনও রকম ভূমিকা না করে বলল, ‘ইন্ডিয়ান আর্মি। মেজর। ইউ.এন. পিস কিপিং ফোর্সেও ছিলেন। বিয়ে করেননি। এখন রিটায়ার্ড! অসুস্থ! নাম অভিনব রাওয়াত!’

‘আরে! কী বলছিস তুই?’ তিজু এমন আচমকা কথায় ঘাবড়ে গেল সামান্য, ‘কী হল কী! এসব বলছিস কেন?’

‘আপনি জানতেন যে অভিনব রাওয়াত আর্মিতে ছিলেন?’

‘আমি? নাতো… মানে…’ কী বলবে বুঝতে পারল না তিজু। আসলে অভিনব ওকে নিজের সম্বন্ধে কিছুই বিশেষ বলেননি। আর ও নিজেও বাবার পরিচয় জানতে চাওয়া ছাড়া আর কিছু জানতে চায়নি!

‘আমি একটা ছবি পাঠাচ্ছি আপনাকে। দেখুন। অভিনবের ছবি। ইয়াং বয়সের। দেখুন দাদা।’

বলে কট করে ফোনটা কেটে দিল জগন। আরে পাগল নাকি! ব্যাপারটা কী! কী বলছে কী ছেলেটা। কিন্তু একবার দেখা যাক কী পাঠিয়েছে! তিজু ফোনের ডেটা অন করে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেখল। একটা ছবি এসেছে। ও ক্লিক করল ছবিটায়। পুরোনো দিনের একটা রঙিন ছবি। কেমন অদ্ভুত রঙ। ইস্টম্যান কালার! একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মাথা উঁচু। হাত দুপাশে মুঠো করা। পরনে মিলিটারি পোশাক।

আচমকা হাতটা কেমন যেন অবশ হয়ে এল তিজুর! মনে হল ফোনটা পড়ে যাবে! এ কার ছবি! এ যে হুবহু ওর মতো দেখতে! স্প্লিটিং ইমেজ! হাত কাঁপছে ওর! মাথাটা কেমন যেন লাগছে! ব্যাপারটা কী! এই ছবি জগন পেল কী করে!

ও কাঁপা হাতে জগনকে ফোন করল আবার।

দুবার রিং হতেই ফোনটা ধরল জগন, ‘দাদা, আমি আপনার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। উনি বলছিলেন না প্রথমে, কিন্তু আই হ্যাভ মাই ওয়েজ! আমি সামান্য সময়ের মধ্যে যা জোগাড় করতে পারলাম, তাই পাঠালাম আপনাকে। আর আপনার জন্য জানাচ্ছি, অভিনব স্যার, কিন্তু কাল ভোরেই চলে যাচ্ছেন। আপনাকে উনি বলেননি। কিন্তু কালকেই মুম্বাই চলে যাচ্ছেন ফর ফারদার ট্রিটমেন্ট! বুঝলেন!’

‘তুই… তুই… কী করে… তুই কে জগন? সত্যি করে বল তুই কে?’

জগন হাসল, ‘আমি কেউ নই। জাস্ট আ শ্যাডো। রিটায়ার্ড! আপনি যদি অভিনব স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চান আজ এই রাতেই করতে হবে। যাকে খুঁজছেন সে কে আর নিশ্চয় বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না!’

তিজুর পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে! এটা কী পাঠাল ওকে জগন! কী করে জানল এত কিছু!

ও কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তুই যাবি আমার সঙ্গে?’

জগন হাসল, ‘আমি দেশপ্রিয় পার্ক মোড়ে যে দুটো বড় পানের দোকান আছে তার পাশের পেট্রোল পাম্পের সামনে ওয়েট করব। আপনি ডট এগারোটা কুড়িতে আসবেন! কেমন। এগারোটা কুড়ি! টাইমটা ইমপরট্যান্ট! মনে রাখবেন দাদা!’

ফোনটা কেটে কী করবে বুঝতে পারল না তিজু। মা বলেছিল বাবা ওর স্প্লিটিং ইমেজ! আর মোবাইলের ছবিটা দেখলে মনে হচ্ছে ও-ই মিলিটারি পোশাকে দাঁড়িয়ে রয়েছে! তাহলে অভিনবই কি… মানে তাই কি নিজেকে প্রকাশ করছিলেন না! মাকে কি এই কথাটাই দিয়েছিলেন! আর কাল চলে যাচ্ছেন জেনেও কি ওকে দিকভ্রান্ত করতে পঁচিশ তারিখ দেখা করতে বলেছেন! মানে উনি গোপনই রাখতে চেয়েছেন নিজেকে!

না, আর না! এখুনি যেতে হবে ওকে। জগন ঠিক বলেছে! আর সময় নেই! আজ রাতেই জিজ্ঞেস করতে হবে উনি সেই মানুষ কিনা! কেন এভাবে লুকিয়ে থাকছেন এখনও! কেন নিজের সন্তানকে সামনে পেয়েও কিছু বলছেন না! শুধু কথা দিয়েছিলেন বলে! মানে মাকে কি সত্যি ভালবেসেছিলেন উনি! ওই যে মৃত্যুর কথা বলেছিলেন তাহলে সেটা কি ওঁর নিজের অভিজ্ঞতা!

তিজু নিজেকে স্থির করল। তারপর দ্রুত ঘড়ি দেখল। এগারোটা সাত বাজে। আর সময় নেই। ও পাশে রাখা জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে গায়ে চাপিয়ে মানিব্যাগ আর মোটর বাইকের চাবিটা টেবলের ওপর থেকে তুলে নিল।

নীচে নেমে বাইকের সাইড-কারে রাখা হেলমেটটা মাথায় পরে নিল চটপট। তারপর বাইকে বসে স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে ঘড়ি দেখল তিজু। এগারোটা দশ বাজে। ও দ্রুত বাইক ছোটাল।

কুয়াশায় ডুবে থাকা শহর চিরে এগোচ্ছে ওর বাইক। আলোর লাঠি পথ দেখাচ্ছে ওকে। কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে ওর জীবন! এই ছবি কি সত্যি অভিনবের! এখন কেমোথেরাপি আর অসুখে ঝলসে যাওয়া মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না! কিন্তু এটা কি সত্যি এই মানুষটার যুবকবেলার ছবি! এটা কি সত্যি ওর বাবার ছবি!

গলি দিয়ে বেরিয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়ে লেক গার্ডেন্স ফ্লাইওভারে উঠল তিজু। ভাল করে দেখা যাচ্ছে না কিছু। ব্রিজের ওপরের হলুদ আলো কুয়াশায় মিশে হানি কেকের মতো রঙ ধরেছে!

বাইকের গতি আরও বাড়াল তিজু। ওর আর দেরি সহ্য হচ্ছে না! সত্যি জগন একটা অদ্ভুত মানুষ! কী করে এসব জেনে নিল ও! ভাবলেও অবাক লাগছে! ব্রিজটা সামনে ডান দিকে বেঁকে গিয়েছে। বাইকটা সেই দিকে ঘোরালো। তারপর দ্রুত এগিয়ে গেল সমতল রাস্তার দিকে। আর ঠিক তখনই দেখল দৃশ্যটা!

কুয়াশায় ঢাকা রাস্তায় আবছায়া কিছু শরীর! কিন্তু তার মধ্যেও একটা মেয়ে আর একটা ছেলে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না ওর। ওদের শরীরী ভাষা দেখে বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটছে! আবছা চিৎকারও শোনা যাচ্ছে! কেউ কি বিপদে পড়েছে! সর্বনাশ! এখন কী করবে ও! নিজের কাজে যাবে? নাকি এগিয়ে যাবে সাহায্য করতে! কী করা উচিত!

মোটর বাইক দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে! হেডলাইটের আলো কুয়াশা চিরে পড়ছে সামনের রাস্তায়। অবয়বগুলো স্পষ্ট হচ্ছে! আরে এটা তো সেই মেয়েটা! আর ছেলেটাকেও তো চেনে! সেই যে রাস্তায় বমি করছিল বলে ও জল দিয়েছিল একদিন! মেয়েটাকে পেছনে রেখে ছেলেটা হাতে কী একটা তুলে তাগ করেছে সামনে। আর দুটো মানুষ চিৎকার করে অশ্রাব্য ভাষায় কীসব বলছে! আরেকজন পিছিয়ে যাচ্ছে কিছু একটা আনতে। ছেলেটা আর মেয়েটা যে বিপদে পড়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না তিজুর। ও ঘড়ি দেখল। জগনের কাছে পৌঁছতে কি দেরি হয়ে যাবে? এদিকে এদের যে বিপদ! নিজের দিকটা কি দেখবে? কিন্তু এদের কিছু হয়ে গেলে সেই রক্ত কার হাতে এসে লাগবে! স্বার্থপর ঋত্বিজ কি সত্যি আজও স্বার্থপরই থাকবে?

তিজু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল! তারপর বাইকের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে ছেলেটা আর মেয়েটার পাশে গিয়ে ঘ্যাঁচ করে থামালটা গাড়িটা। এবার স্পষ্ট দেখল তিজু। সামনে দুজন গুন্ডা ধরনের লোক। আর তাদের পেছনে আরেকজন পিছিয়ে যাচ্ছে কিছু একটা আনতে!

বাইকটা অমন করে দাঁড় করাতে ছেলেটা আর মেয়েটা চমকে উঠল। তারপর মেয়েটা ওকে দেখে কাতরভাবে বল, ‘স্যার প্লিজ স্যার আমাদের বাঁচান, প্লিজ স্যার…’

তিজু নিমেষে মন স্থির করে নিল। ও বলল, ‘তাড়াতাড়ি উঠে পড় বাইকে। কুইক!’

মেয়েটা থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য তারপর ছেলেটাকে টানল হাত ধরে, ‘চলো, প্লিজ আদিত, চলো!’

আদিত পেছনে ঘুরল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ইট এসে লাগল ছেলেটার হাতে! আঃ করে চিৎকার করে উঠল আদিত! ওর হাতের থেকে কী একটা ধাতব জিনিস যেন পড়ে গেল মাটিতে! তিজু দেখল পেছনের গুন্ডা ছেলেটা ইট তুলে ছুড়ছে। ও জোর গলায় বলল, ‘বসো তাড়াতাড়ি। বসো তোমরা।’

মেয়েটা সাইডকারে লাফিয়ে বসল এবার আর ছেলেটা ওর পেছনে পিলিয়নে উঠে পড়ল। আরেকটা ইট এসে লাগল বাইকের সামনের চাকায়! তিজু দ্রুত বাইক স্টার্ট দিয়ে দিল। ইট পড়ছে সমানে। গালাগালি উড়ে আসছে বৃষ্টির মতো। তার মধ্যেই বাইক চালিয়ে দিল তিজু। শুনল একটা লোক চিৎকার করে বাইক আনতে বলছে! কিন্তু পাত্তা দিল না ও। বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিল। ওই তো লেকে ঢোকার গেটের সামনে রবীন্দ্রনাথের দাঁড়ানো মূর্তিটা! ওটা পার করে এগোতে লাগল তিজু। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল গুন্ডাগুলোর বাইক আসছে ধাওয়া করে এবার! কুয়াশার ভেতর সেই আলোটাকে কেমন মেঘ চাপা চাঁদের মতো লাগছে। আরও গতি বাড়াল তিজু। বাইকটা কতটা কাছে এল? ও আয়নায় চোখ রাখল আবার! আর দেখল কী যেন ছায়ার মতো আচমকা এসে পড়ল পেছনের বাইকটার সামনে আর বাইকের আলোটা টাল সামলাতে না পেরে কাত হয়ে গেল হঠাৎ। বিকট একটা শব্দ কাচ ভাঙার মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে! তিজু পেছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখল এবার। বাইকটা পড়ে গেছে রাস্তায়! ঝাপসা আলোটা কাত হয়ে গেছে। মিট মিট করে নিভে যাচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে!

সোজা হয়ে বসল তিজু। হাওয়া এসে লাগছে মুখে। ও না দেখেও বুঝল মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ধরে আছে ছেলেটার হাত। না দেখেও বুঝল, ছেলেটাও তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে! রাতের হাওয়া পাক খাচ্ছে কলকাতায়! এ কীসের গল্প দেখছে ও! কার গল্প দেখছে! অনেকটা কি ওর নিজের গল্প! আচ্ছা আমাদের সবার গল্পগুলোই কি কোথাও এক রকমের!

কেউ কোনও কথা বলছে না। কিন্তু কত কিছুই যে বলছে! সারা জীবন না বলতে পারা কথা কি মানুষ শুধু কথা দিয়েই বলে! কথা ছাড়াও তো মনের সব কথা এমন স্পর্শ আর এমন দৃষ্টি দিয়ে বলে দেওয়া যায়!

তিজু জানে না, সামনে কী অপেক্ষা করছে ওর জন্য! কিন্তু হঠাৎ খুব ভাল লাগছে খুব! মনে হচ্ছে এবার থেকে জীবন অন্য একটা আনন্দের দিকে বয়ে যাবে! মনে হচ্ছে জীবন এবার জীবনের দিকে বয়ে যাবে।

ও এবার পেছনের দিকে তাকাল এক পলক। দুজনে দুজনের হাত ধরে বসে রয়েছে। চোখে চোখ রেখে বসে রয়েছে! আর প্রকৃতি যেন নিজের সমস্ত ভালবাসা দিয়ে ওদের একাকী থাকার জন্য আরও ঘন কুয়াশার চাদরের আড়ালে ঢেকে দিচ্ছে চরাচর!

তিজু হাসল শব্দ করে। তারপর আরও জোরে বাইক ছুটিয়ে দিল দেশপ্রিয় পার্ক মোড়ের ওই পেট্রোল পাম্পের দিকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *