আমার একমাত্র পুরোনো বন্ধুর উদ্দেশ্যে
আমাদের পুনরায় দেখা হবার পর কী নিয়ে কথা বলেছিলাম, তা এখন মনে নেই বললেই চলে। এমনকি তার পরনে কী ছিল তাও মনে পড়ছে না এখন। এ থেকেই বোঝা যায় কতটা অস্থির হয়ে পড়েছিলাম আমি; কোনোকিছু না ভেবে শুধু কথার পর কথা বলে গিয়েছিলাম।
কী নিয়ে কথা বলেছিলাম, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং আমি কিছু একটা বলেছি আর সে তার জবাব দিয়েছে-এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সে নাকি এই উৎসব উপভোগ করতে আসেনি। সে এর কাছাকাছি একটা জায়গায় কাজ করতে এসেছিল। গাড়িটা মন্দিরের কাছাকাছি পার্ক করতেই এ উৎসব আয়োজন তার চোখে পড়েছিল। কী কাজ তা জিজ্ঞেস করায় সে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। শুধু এটুকু বলেছিল যে, তার কাজে অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়।
“আরও কথা বলতে মন চাইছে, কিন্তু সময় নেই। আগামীকাল আমাকে সকাল সকাল উঠতে হবে,” খানিকটা দূরত্ব রেখেই সে কথাগুলো বলল। আমি তাই তাকে সামনের কোনো একদিন একসাথে ড্রিংক করার অফার ছুঁড়ে দিলাম।
হিমেনো রাজি হলো। তবে ড্রিংক সে করবে না, মদ স্পর্শ করে না সে। এর চেয়ে একসাথে খাওয়াদাওয়া করলে সে রাজি আছে।
ঠিক করলাম, দুদিন পরে আমরা দেখা করব। বলে দুজন দুদিকে চলে গেলাম।
এতটাই আনন্দে মত্ত ছিলাম যে, মিয়াগির কথা আমার মনেই ছিল না। “তোমার জন্য ভালোই হলো,” সে বলল। “এরকম কিছু যে ঘটতে পারে, তা আন্দাজ করতে পারিনি।”
“আমিও না। বিশ্বাসই হচ্ছে না; আসলেই ঘটেছে এটা!”
“হ্যা…তাহলে মাঝেমধ্যে এরকম অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে থাকে।”
পরের বার যখন হিমেনোর সাথে দেখা হবে, সেদিনই হবে আসল খেলা।
ঐ দিন আসার আগেভাগেই আমাকে প্রস্তুত হতে হবে। এপার্টমেন্টে ফিরে আমার লিস্ট থেকে হিমেনোর নামটা কেটে দিলাম। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে নিতে আচমকা বললাম মিয়াগি’কে, “আমি তোমাকে একটা অদ্ভুত অনুরোধ করতে চাই।”
“আমি মদ খেতে পারব না।”
“না না। সেটা না। আগামীকালের কথা বলছি। আমি যদি হিমেনোর সাথে আড্ডা দিতে চাই, তবে আমাকে প্রস্তুত হতে হবে। এ বিষয়ে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া চলবে না। সৌভাগ্যবশত, আমার হাতে এখনও একদিন রয়েছে। আগামীকালটা আমাকে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য ব্যবহার করতে হবে। আমি চাই তুমি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে।”
“কীসের প্রস্তুতি?”
“তোমার কাছে আমার লুকানোর কিছুই নেই, তা সাফসাফ বলে দিচ্ছি। এই বিশ বছরের জীবনে আমি কখনো কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াইনি আমি। যদি এরকম অনভিজ্ঞভাবে হিমেনোর সাথে দেখা করতে যাই, তবে দেখা যাবে বেফাঁস কিছু বলে কিংবা অন্য কোনো ভাবে তাকে বিরক্ত করে ফেলব। সে সম্ভাবনাটা কমানোর জন্য আমি আগামীকাল এসবের প্র্যাকটিস করতে চাই।”
মিয়াগিকে দেখে মনে হলো সে আমার কথায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ স্থির রইল সে।
“তার মানে-আমার যদি বোঝায় কোনো ভুল না হয়, তুমি চাচ্ছ আগামীকাল আমি হিমেনোর পার্ট করি?”
“হ্যাঁ। তুমি সেটা করতে পারবে মিয়াগি?”
“আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার পরিকল্পনায় বেশ কিছু বিশাল সাইজের ত্রুটি রয়েছে।”
“যেমন আমি তোমাকে দেখতে পারব, কিন্তু অন্য কেউ তোমাকে দেখবে না?”
“একদম তাই,” সে স্বীকার করল।
“তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কে কী ভাবল তা নিয়ে আমার আসে-যায় না। এখন আমার কাছে কেবল একটা জিনিসই গুরুত্বপূর্ণ-হিমেনোর সামনে নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করা। সবাই যদি আমাকে পাগলও ভাবে, সমস্যা নেই। যদি হিমেনো আমাকে খানিকটা হলেও আগের থেকে বেশি পছন্দ করে, সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”
মিয়াগি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “হিমেনোর প্রসঙ্গ আসলেই তুমি সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ হয়ে যাও—কিন্তু আরও একটা সমস্যা আছে এ পরিকল্পনায়। তুমি তো জানোই, আমার বয়সী অন্যান্য মেয়েরা কী ভাবে না ভাবে সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। হয়তো যেটা হিমেনোর কাছে ভালো লাগে, আমার কাছে বিরক্ত লাগতে পারে; যেটা হিমেনোর কাছে বিশ্রি লাগে, সেটা হয়তো আমার কাছে ততটা খারাপ লাগে না। অনেক কিছুতেই পার্থক্য থাকতে পারে আমাদের মধ্যে। তাই আমার মধ্যে তুমি যদি আদর্শ বিশ বছর বয়েসী একটা মেয়েকে খোঁজার চেষ্টা করে থাক, তবে—”
“নিজের ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই তুমি বেশি নেগেটিভ হয়ে যাও, তাই না?” মিয়াগিকে কথাটা শেষ করতে দিলাম না। “আমার কোনো সমস্যাই নেই তাতে। তবে আমার কাছে কিন্তু তোমাকে নিতান্তই স্বাভাবিক একটা মেয়ে মনে হয়। তবে স্বাভাবিকদের তুলনায় একটু বেশিই সুন্দরী তুমি, এটাই পার্থক্য।”
“আচ্ছা তোমার যদি কোনো সমস্যা না হয়-তবে আমি রাজি আছি,” সে খানিকটা অস্বস্তির সাথে জবাব দিল।
সকাল সকাল সেলুনের একটা এপয়েন্টমেন্ট করে নিলাম। এরপর বেরিয়ে পড়লাম জামা আর জুতো কিনতে। হিমেনো’র সাথে দেখা করার সময় কোনোমতেই ছেঁড়া জিনস আর শতচ্ছিন্ন স্নিকারস পরে যাওয়া চলবে না। জামাকাপড়ের ভালো কালেকশন সমৃদ্ধ একটা দোকানে ঢুকলাম আমি। মিয়াগির উপদেশ অনুযায়ী চকলেটের মতো বাদামি রঙের চাক্কা কোম্পানির বুটজুতো কিনে ফেললাম।
“তেমন চটকদার জামা-জুতোর দরকার নেই তোমার। শুধুমাত্র দেখতে পরিষ্কার আর মানালেই চলবে।”
“এর মানে তুমি বলতে চাইছ আমার মধ্যে ওসব নেই?”
“যা ইচ্ছে ভাবতে পার।”
“ঠিক আছে। আমি যেভাবে ইচ্ছে ভাবতে পারি।”
শপিং শেষে আগেভাগেই সেলুনের দিকে পা বাড়ালাম। মিয়াগি আমাকে যা শিখিয়ে দিয়েছিল তাই বললাম আমি : “আগামীকাল একজন প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমি,” এটুকু শুনেই হেয়ার- স্টাইলিস্ট মুচকি হেসে চুল কাটতে শুরু করলেন। সেই সাথে কিছু উপদেশও জুটলো।
বাড়িয়ে বলছি না, চুল কেটে ভদ্র হবার পর আর গায়ে নতুন জামাকাপড় গায়ে দিতেই আমাকে সম্পূর্ণ নতুন একটা মানুষ মনে হতে লাগল। অযত্নে রাখা লম্বা চুল আর ওভার-সাইজ শার্টের কারণে আমাকে স্বাভাবিকের থেকেও বেশি গোমড়া দেখাত তার মানে, মনে মনে ভাবলাম আমি। সে ভাবটা আর নেই। আমাকে দেহে মনে হচ্ছে একটা পপ গানের ভিডিও থেকে লাফ দিয়ে একটা সুদর্শন, আকর্ষণীয় চেহারার যুবক বের হয়ে এসেছে।
“গতকালকের তুমি’র সাথে আজকের তুমি’র আকাশ-পাতাল পার্থক্য,” মিয়াগি স্বীকার করল।
“হ্যাঁ। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে না, এই মানুষটার জীবনের প্রতিবছরের মূল্য মাত্র দশ হাজার ইয়েন?”
“নাহ, মোটেই তা মনে হচ্ছে না। বরং তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সুন্দর একটা ভবিষ্যত তোমার সামনে অপেক্ষা করছে।”
“ধন্যবাদ। আর হ্যাঁ, তুমি যদি মাঝেমধ্যে একটু হাসো, তাহলে তোমাকেও একটা লাইব্রেরিতে থাকা ‘পরী’ বলেই মনে হবে।”
“আজকে সত্যিই অনেক খুশি লাগছে তোমাকে।”
“হুম।”
“আচ্ছা, এই ‘লাইব্রেরিতে থাকা পরী’র মানে কী?”
“এমন একটা মেয়ে, যে কিনা একই সাথে বুদ্ধিমতী আর সুন্দরী।”
“এটা তুমি হিমেনো’কেও বলবে, তাই না?”
“নাহ। তার ভালো গুণগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। আমি তোমার ব্যাপারেই মন্তব্যটা করেছি।”
সে স্থির হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আলতো করে মাথা নেড়ে ‘ধন্যবাদ’ জানাল আমাকে। “যাই হোক, আমরা কিন্তু আসলে তুচ্ছ দুজন মানুষ, যাদের কোনো দাম নেই এ জগতে।”
“খুব অদ্ভুত, তাই না?” আমি বললাম।
বড় রাস্তার পাশের একটা ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় বসে আমরা তখন আড্ডা দিচ্ছিলাম। তাই আশেপাশের মানুষজনের কাছে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে আমি আপনমনে নিজের সাথেই কথা বলছি। টের পেলাম, পাশের টেবিলে থাকা এক মধ্যবয়স্ক দম্পত্তি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলাবলি করছে।
খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে আমরা দুজন রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। ব্রিজের কাছাকাছি একটা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম, যাতে আমরা দুজন নদীকে পাশে রেখে হাঁটতে পারি। মদ খাওয়ার পর মাথাটা একটু টালমাটাল লাগছিল, তাই আমি মিয়াগির হাত ধরে সেটা দোলাতে দোলাতে হাঁটতে লাগলাম। মিয়াগির অস্বস্তি লাগলেও সে হাতটা ছুটিয়ে নিল না। যে কেউ আমাকে দেখলে ভাববে আমি অদ্ভুতভাবে হাঁটছি। তাতে কি! আমি তো আর স্বাভাবিক মানুষদের কেউ হতে পারব না। বরং তাদের থেকে উল্টো দিকে যেয়ে পাগলাটে কেউ হওয়াই আমার কাছে ভালো ঠেকছে।
“মাতলামিতে মত্ত জনাব কুসুনোকি, আমাকে হিমেনো ভেবে পটানোর চেষ্টা করো এখন,” মিয়াগি মুখ টিপে বলল। আমার হাত ধরাতে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বোঝা গেল।
আচমকা থেমে গিয়ে সরাসরি তার দিকে তাকালাম। “তোমার সাথে দেখা হওয়াটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আর সবচেয়ে বাজে মুহূর্ত ছিল তোমার চলে যাওয়াটা এখন যা তোমাকে বলতে চাইছি তা শোনার পর তোমার প্রতিক্রিয়া থেকেই নির্ধারিত হয়ে যাবে এই মুহূর্তটা নতুন’শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত’র দাবিদার কিনা।”
এরকম লম্বা একটা প্রেমবাণী যে তোমার পক্ষে এত দ্রুত বলা সম্ভব, তা ভেবেই অবাক লাগছে।”
“কী মনে হয়, হিমেনো কথাটা শোনার পর কী উত্তর দেবে?”
“হুম, ভেবে দেখি। আমি যদি হিমেনো হতাম,” মিয়াগি নিজের ঠোঁটের ওপর একটা আঙ্গুল রেখে বলল, “মনে হয়-আমি বলব, ‘কী সব যাতা বলছ?’ বলেই হেসে গড়িয়ে পড়তাম।
“আচ্ছা। আর তুমি হলে?”
“তোমার প্রশ্নটা বুঝতে পারলাম না।”
“ঠাট্টা করছি। এত ভাবতে হবে না,” হেসে ফেললাম আমি।
“তুমি কী আসলেই এরকম হাসিঠাট্টা করা মানুষ, কুসুনোকি?”
“আমার জানা নেই। আমি আসলে ‘ব্যক্তিত্ব’, ‘চরিত্র’ কিংবা ‘আচরণ’ এর মতো শব্দে বিশ্বাসী নই। পরিস্থিতি অনুযায়ী সবকিছু পাল্টাতে পারে। দিনশেষে আমার মনে হয়, মানুষ কোন কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা বেশি—সেটা দিয়েই তাদের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। প্রত্যেকের মধ্যে একটা বিশ্বাস আছে যে, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সর্বদা স্থির থাকে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় মানুষ এটাকে যতটা গুরুত্ব দেয়, ততটা গুরুত্ব পাওয়ার বৈশিষ্ট্য নয় সেটা।”
“কারো মুখ থেকে বিশেষ করে তোমার কাছ থেকে এরকম কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।”
“প্রত্যেকেই এটা কল্পনা করতে ভালোবাসে যে, ডিপ্রেশন ঘটিত ব্যাপারগুলোয় সে জগতে একলা; আর কেউ নেই তার মতো। অথচ ব্যাপারটা কিন্তু পুরোপুরি উল্টো। মোটামুটি সবাই এর সাথে পরিচিত।”
মিয়াগি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। “কথাটা ভুল বলনি।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পর আমরা কোনো চিন্তাভাবনা না করে একটা বাসে উঠে পড়লাম। যাত্রী খুব কম ছিল বাসের ভেতর। কিন্তু আমি তাদের কথা মাথায় না এনে মিয়াগিকে হিমেনো-সম্পর্কিত স্মৃতিগুলো শোনাতে থাকলাম। ওখান থেকে একজায়গা নেমে আরেকটা বাসে উঠলাম। এবার গন্তব্য একটা অবজারভেশন ডেক; এলাকার বিখ্যাত একটা ডেটিং স্পট হিসেবে নাম কুড়িয়েছে সেটা। প্রায় দশটা প্রেমিকযুগল চোখে পড়ল সেখানে; একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে, কেউ একে অপরকে চুম্বন করছে। আমি মিয়াগির সাথে কথা বলা থামালাম না। এখানের কেউই আমার কার্যকলাপে নজর দিল না। সবাই নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল।
“এ জায়গায় যখন প্রথম এসেছিলাম, হিমেনো আমার সাথে ছিল। ঐ যে প্যাঁচানো সিঁড়িটা দেখতে পাচ্ছ না? ওটার ওপরে, মানে অবজারভেশন ডেকের একদম সর্বোচ্চ স্থানটার রেলিংটার উচ্চতা আর প্রশস্ততা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের চড়ে বসার জন্য একদম উপযোগী। হিমেনো ওটার ওপরে ওঠার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রেলিংগুলোর ফাঁকে গ্যাপ খুব কম থাকায় আরেকটু হলেই সে পড়ে যেত। আমি যদি সেদিন ওকে না থামাতাম, বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। বুদ্ধিমান সাজতো সে সবসময়, অথচ এরকম ব্যাপারে সে ছিল একদমই বোকা। তার দিকে নজর রাখতে হতো সবসময়। আমি সেদিন ভয় পেয়ে তাকে টান দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। ওরকম করতে গিয়ে আমি ব্যথা পেয়েছিলাম। কিন্তু হিমেনো সেদিন সারাটা সময় আমার সাথে ভালো আচরণ করেছিল-
আমি নিজের অস্থিরতা দূর করার জন্য কথার গতি বাড়িয়ে দিলাম। মিয়াগির চোখ মুখ দেখে মনে হলো, সে কিছু একটা ঢাকার চেষ্টা করছে।
কোনো কিছু বলার জন্য অবজারভেশন ডেকটা চমৎকার একটা স্থান ছিল, কিন্তু মিয়াগি মুখ খুলল না।
হয়তো সে আমাকে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিতে চেষ্টা করছিল।
***
দিনটা অবশেষে এসেই পড়ল।
বিকেলবেলায় বেশ জোরেসোরে বৃষ্টি নেমেছিল। ছাতা হাতে থাকা মানুষ দিয়ে ভর্তি ছিল স্টেশন। আমি ওপরের জানালা দিয়ে নিচের ফাঁকা স্থানটায় তাকিয়ে রইলাম। দেখতে পেলাম, অসংখ্য রঙবেরঙের ছাতা ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে যাচ্ছিল।
পাঁচটার দিকে বইয়ের দোকানের সামনে আমাদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু দশমিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরেও হিমেনোর দেখা পেলাম না। নিজেকে বোঝালাম, অস্থির হয়ো না। বৃষ্টির কারণে সে রাস্তার জ্যামে আটকে গিয়েছে বোধহয়। আর তাছাড়া আমার মতো বেকার কোনো মানুষ সে নয়, তার কোনো কাজ পড়ে যেতেই পারে।
তা সত্ত্বেও প্রতিমিনিটে তিনবার করে ঘড়ি দেখতে লাগলাম।
বিশ মিনিট পেরিয়ে গেল। আমার কাছে মনে হতে লাগল বিশ মিনিট নয়, বরং এক-দুইঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। আমার কিংবা হিমেনোর কি জায়গাটা চিনতে কোনো ভুল হয়ে গেল কিনা, এরকম চিন্তাও মাথায় আসতে শুরু করল। কিন্তু এই স্টেশনে একটা মাত্র বইয়ের দোকান ছিল। এটা বাদে আর কোনো দোকান হতেই পারে না।
সাতাশ মিনিটের মাথায় হাল ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় দূর থেকে হিমেনো’কে দেখতে পেলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে এখানে আসছিল। ওকে দেখার আগ পর্যন্ত ভাবছিলাম, হয়তো চাপে পড়ে সে আমার থেকে দ্রুত বিদায় হবার তাগিদেই দেখা করতে রাজি হয়েছিল। তাই ওকে দেখার পর আশ্বস্ত হয়ে শরীর থেকে যেন সবটুকু শক্তি বেরিয়ে গেল।
হিমেনোর জন্য দশবছর অপেক্ষা না করে থাকলেও হয়তো আমি আজকে বলতাম, সে সৌন্দর্যের আভা ছড়াচ্ছিল। দেহের প্রতিটা ভাঁজ আর গঠন একদম নিখুঁত করে বানানো হয়েছিল। কোনোকিছুই অতিরিক্ত ছিল না তাতে, প্রত্যেকটা অঙ্গ তাদের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত ছিল।
আমি যদি ভিন্ন কোনো পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো মানুষ হতাম, আমি নিশ্চিত ওকে দেখার পর আমার বুকে ব্যথা হতে শুরু করত। সে আমার বুকে যে একটা বিশাল গর্ত তৈরি করে রেখে গিয়েছে, সেটা আমার পক্ষে পূরণ করা অসম্ভব। একটা’ সে কখনো আমার হবে না-তাহলে আমার জীবনের ষোলো আনাই মিছে, তাই না?’ এই অনুভূতিটাই টের পাচ্ছিলাম আমি।
সৌভাগ্যবশত আজ ট্রেন স্টেশনে সে ‘আমার’ সাথে দেখা করতে এসেছিল। আজকে ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ আমি। চিন্তায় মাথায় আসতেই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম।
“বৃষ্টির কারণে বাস আসতে দেরি করে ফেলেছে,” হিমেনো ব্যাখ্যা করল। “দাঁড়িয়ে রাখার জন্য দুঃখিত। এর বিনিময়ে চলো কিছু একটা—”
“সেসব পরে হবে। আজকের পরিকল্পনাটা আমারই ছিল। তাই ওসব নিয়ে ভেবো না, ঠিক আছে?”
টের পেয়েছিলাম, শুধু যে আমার বেশভূষায় পরিবর্তন এসেছে তা নয়, সেই সাথে আমার কণ্ঠস্বরও পাল্টে গিয়েছিল। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই কন্ঠস্বরটা আমার কানে ভালোই শ্রুতিমধুর ঠেকছিল।
“হুম, তাহলে ‘পরে’র কথাও ভেবে রেখেছ তাহলে?” আমার দিকে সে খানিকটা অবাক হওয়া দৃষ্টিতে তাকাল।
“হ্যাঁ। তার পরের বারের জন্যেও প্ল্যান করে রাখব।”
“যাক, এখনও তাহলে আগের মতোই সৎ রয়ে গিয়েছ,” সে খিলখিল করে হেসে ফেলল।
ঠিক এরকম ভাবে কথাবার্তা হিমেনোর পক্ষেই বলা সম্ভব, মনে মনে ভাবলাম। আচার-আচরণ একদমই পাল্টায়নি দেখছি। দশবছর বয়সেও সে ঠিক একই ভাবে ঠাট্টা করে কথা বলায় পারদর্শী ছিল।
টানেল পার হয়ে রাস্তায় বের হতেই আমি ছাতা বের করলাম। হিমেনো ঝপ করে সেটা হাতে নিয়ে আমাদের দুজনের মাঝে মেলে ধরল।
“প্রত্যেকবার তুমি ছাতা আনতে ভুলে যেতে, আর আমার ছাতাটার মধ্যে দুজনকে গুটিসুটি মেরে বাসায় ফিরতে হতো, মনে আছে?”
“মনে আছে,” বলে আমি হিমেনোর কাছ থেকে ছাতাটা কেড়ে নিলাম। তারপর সেটা আমাদের কাছাকাছি ধরলাম। “এবার উল্টোটা করতে সমস্যা নেই তো?”
“নাহ।”
এক ছাতার নিচে করে আমরা হাঁটতে লাগলাম।
“আচ্ছা, ঐদিন তুমি ওখানে কী করছিলে?” হিমেনো জিজ্ঞেস করল।
“তোমাকেই খুঁজছিলাম,” জবাব দিলাম আমি।
“মিথ্যাবাদী,” বলে আমার কাঁধে ঘুষি মেরে বসল সে।
হাসতে হাসতে বললাম, “সত্যি বলছি তো।”
মনে মনে ভাবছিলাম, যাক সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই এগোচ্ছে।
হিমেনোর প্রতি ভালোলাগাটা আমি ওকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছিলাম, আর হিমেনোও সেটার জবাব দিচ্ছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই আমার।
কিন্তু হিমেনো মনের গহীনে আসলে কী ভাবছিল, তা আমি জানতে চাইনি। তাহলে সেটার উত্তরটা জানা যাক।
রেস্তোরাঁয় ঢুকে হিমেনোর মুখোমুখি একটা সিটে বসলাম। কিন্তু কথা বলতে বলতে চরম একটা ভুল করে বসলাম আমি। অবশ্য একটু ভেবে দেখলে সেটাকে হয়তো ‘ভুল’ মনে হবে না। যদি কোনো ঘটনা বারবার ঘটানোর সুযোগ থাকত আমার কাছে, হয়তো প্রত্যেকবার আমি ঐ একই পথটাই বেছে নিতাম। আমার কাছে আর কোনো পথ ছিল না যে। আর যদি আমার সিদ্ধান্তটা ‘ভুল’ হয়ে থাকে, তবে ভুলটা আজকের নয়, বহু আগের। এই মুহূর্তে আসার আগেই ভুলটা করে এসেছি আমি।
অনেক আগে, বেশ ভেবেচিন্তে এই ভুলটা করেছিলাম।
কিন্তু যাই হোক না কেন, এই ‘ভুল’টাই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
আর এর মাধ্যমেই আমি আবিষ্কার করেছিলাম, কেন মিয়াগি আমাকে হিমেনোর সাথে দেখা করতে মানা করেছিল।
খাবার অর্ডার দেবার পর আমি হিমেনোর দিকে তাকিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা হাসি দিলাম। সেও একই ভাবে হেসে তার জবাব দিল। বরফ দেয়া জলের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সে বলল, “কুসুনোকি, এই দশবছরে তুমি কী কী করেছ তা শুনতে চাই আমি।” আমি বললাম, “না, আগে তোমারটা শুনতে চাই হিমেনো।” কিন্তু হিমেনো অনড়। “তুমিই আগে বল।”
“আসলে তেমন আহামরি কিছু ঘটেনি আমার সাথে,” বলে ব্যাখ্যা করা শুরু করলাম। মিডল স্কুল আর হাইস্কুল জীবন বেশ সাদামাটা ভাবেই কেটেছে। মিডল স্কুলের দ্বিতীয় বছর থেকে আমার রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করেছিল। যে স্মৃতিশক্তি নিয়ে আমি গর্ব করতাম, দিনের পর দিন সেটার অবনতি ঘটতে শুরু করল। এলাকার সবচেয়ে ভালো হাইস্কুলে পড়তে গেলাম। সেখানে গিয়ে তাল সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল আমার জন্য। আর এখন যে কলেজে পড়ছি সেটা অত্যন্ত সাদামাটা একটা কলেজ। আমার বাবা-মা যে এর বিরুদ্ধে ছিলেন সেটাও বললাম। নামিদামি কলেজ না হলে নাকি সেখানে পড়া বৃথাশ্রম। কিন্তু তাদের কোনোমতে রাজি করিয়ে ভর্তি ফি আদায় করে নিয়েছি। আর তাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি : বাকি সবকিছু নিজের পকেট থেকে দেব। এছাড়াও সতেরো বছর বয়স থেকে আমি যে আঁকাআঁকির জন্য পেন্সিল হাতে তুলে নিইনি, সেটাও হিমেনো’কে জানালাম।
আমার জীবনের গল্প পাঁচ মিনিটে ফুরিয়ে গেল। এর থেকে গভীরভাবে বলা যায়, এমন কোনো কিছুই আমার জীবনে ঘটেনি।
“তাহলে আঁকাআঁকি ছেড়ে দিয়েছ তুমি? খুব খারাপ লাগছে শুনে তোমার এই গুণটা আমার খুব ভালো লাগত কুসুনোকি,” হিমেনো বলল। কদিন আগে আরেকজন বন্ধুর (!) কাছ থেকে শোনা কথার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ছিল এটা। “তুমি সারাক্ষণ আঁকাআঁকি করতে,” সে কথা বলা থামায়নি। “আঁকতে গিয়ে তোমার মুখটা অনুভূতিশূন্য হয়ে যেত ঠিকই, কিন্তু প্রত্যেকটা আর্ট দেখলেই আমার দমবন্ধ হয়ে যেত। এতটাই অপূর্ব ছিল সেগুলো। আমার পক্ষে ওরকম করে আঁকা সম্ভব ছিল না, তাই তোমাকে হিংসা করতাম আমি।”
“কিন্তু তুমি এসব তখন কেন বলনি?”
“ভেতরে ভেতরে তোমার সাথে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় মত্ত ছিলাম আমি তখন। পড়ালেখা বাদে আমার কোনো কাজেই দক্ষতা ছিলাম না। তাই আমি কখনো তোমার যে পড়ালেখা করে ভালো রেজাল্ট করার পাশাপাশি আরও গুণ রয়েছে, তা স্বীকার করতে চাইনি। শোনো তোমার বোধহয় জানা নেই, কিন্তু আমি কিন্তু তোমার ঐ আর্টগুলো বাসায় নিয়ে যেতাম যাতে পরে তাকিয়ে তাকিয়ে সেটাকে আরও উপভোগ করতে পারি,” কথাগুলো বলার সময়ে তার চোখজোড়ায় দূরের কোথাও আটকে গিয়েছিল।
“আমার মধ্যেও কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ছিল। আমাদের দুজনের রেজাল্ট কাছাকাছি হলেও তুমিই সেরা ছিলে। বড়দের প্রশংসা তুমিই পেতে। আমার প্রায়ই মনে হতো একটা মানুষের একই সাথে এত মেধাবী আর সুন্দরী হতে হবে কেন!”
“সেই মেধাবী আমি যে স্কুল থেকে ঝরে পড়ব, সেটা নিশ্চয়ই ওরা কল্পনাও করতেও পারেনি,” হিমেনো খুব হালকা চালে বলল।
“ঝরে পড়া? মানে স্কুল ছেড়ে দেয়া?” অবাক হবার ভান করলাম।
“ওহ, তুমি জানতে না তাহলে।” সে হাসল। ভ্রু নাচিয়ে সে বলল, “ভেবেছিলাম ক্লাস রি-ইউনিয়ন বা এরকম কোনো অনুষ্ঠানে এসব নিয়েই একদিন তো কথা উঠবেই।”
“আমি তো ওসবে যাইনি কখনো। তুমি যে ওসবে যোগ দেবে না, তা জানা ছিল। তাই যোগ দেবার কথা মাথাতেই আসেনি।’
“ওহ-আচ্ছা। আসলে আমারও জীবন নিয়ে বলার মতো তেমন কিছুই নেই—”
হিমেনো স্কুল ছেড়ে দেবার আগ পর্যন্ত জীবন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল। মিয়াগির কাছ থেকে শোনা ‘মা হবার ঘটনা’টা সে অবশ্য তুলল না। সংক্ষেপে যা বলল তা হলো এই : ইতোমধ্যে গ্র্যাজুয়েট করে বের হওয়া এক ছেলেকে সে বিয়ে করেছিল সে, তারপর তাড়াহুড়ো করে স্কুল ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া, কিন্তু একসময় তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় অবশেষে ডিভোর্স নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছে তারা।
“আসলে আমি তখনো মানসিক দিক থেকে একটা বাচ্চাই ছিলাম,” হিমেনো খানিকটা বিব্রত ভঙ্গিতে বলল। “আমি আসলে অনেককিছু মেনে নিতে পারিনি, তাই সেখান থেকে সরেও যেতে পারিনি। কোনোকিছু আধাখেঁচড়া করে ফেলে রাখার অভ্যাস আমার কখনো ছিল না, তাই সেসব নষ্ট করে দেয়ার পথটাই বেছে নিয়েছিলাম। দশবছর বয়সে তোমাদের ছেড়ে আসার পর থেকে আমার মন-মানসিকতার কোনো ধরনের পরিবর্তন হয়নি, ঠিক দশবছর আগের মস্তিষ্কটাই রয়ে গিয়েছে বলে আমার ধারণা…হ্যাঁ, আমি মেধাবী একটা মেয়ে ছিলাম, কিন্তু সেটা দশ বছর আগের কথা। কিন্তু তার ফলে তখন থেকেই আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত রকমের অহমিকা বোধ কাজ করতে শুরু করেছিল। ‘নিজেকে পরিবর্তন করার দরকার নেই’—ঠিক এটাই মনে হতো আমার। আজও আমি সেই দশবছর আগের সেই স্বপ্নে ভাবাতুর মেয়েটা থেকে নিজেকে পাল্টাতে পারিনি। অথচ আমার আশেপাশের সবাই ইতোমধ্যে নিজেদের প্রতিনিয়ত উন্নতি করে চলেছে।”
টেবিলের ওপর রাখা নিজের হাতজোড়ার দিকে সে কষ্ট পাওয়া এক বাচ্চার মতো মুখ করে তাকিয়ে রইল।
“তোমার কী অবস্থা কুসুনোকি? বাজি ধরে বলতে পারি তুমি এই দশবছরে নিজেকে পাল্টে নিয়েছ, তাই না?” সে জিজ্ঞেস করল। ওদিকে আমার ভদ্রভাবটা টিকিয়ে রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।
“তুমিই একমাত্র নও হিমেনো,” আমি জোর দিয়ে বললাম। “আমাদের ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে আমি কোথায় যেন আটকে গিয়েছিলাম। বছরের পর বছর আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে শুধুমাত্র একটা অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছি। প্রায়ই মনে হতো, এই জগত বোধহয় বারবার আমাকে হতাশ করবার জন্য, আমাকে বারবার ভেঙে ফেলার জন্যই তৈরি হয়েছে। পুরোটা সময় আমি জীবন্মতের মতো কাটিয়েছি। আর কদিন আগে আমি-”
আমি টের পাচ্ছিলাম আমার মুখ দিয়ে কিসের কথা বের হতে যাচ্ছে। কথাটা হিমেনোকে শোনালে সে কীরকম বোধ করবে, তাও খানিকটা কল্পনা করতে পারছি। কতবড় বুদ্ধুর মতো কাজ হবে সেটা, সেটা সম্পর্কেও আমার ভালোমতোই ধারণা ছিল।
তা সত্ত্বেও নিজেকে থামাতে পারলাম না আমি।
“আমি আমার জীবনের সবখানি আয়ু বিক্রি করে দিয়েছি। প্রতিবছরের মূল্য ছিল মাত্র দশ হাজার ইয়েন,” হড়বড় করে বলে ফেললাম।
হিমেনোর চোখেমুখে বিভ্রান্তির ছাপ পড়ল, কিন্তু নিজের ভেতর থেকে বের হওয়া কথার স্রোতের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। মাথার মধ্যে জট পাকানো সবকিছু আমি এক অর্থে তার দিকে ছুঁড়েই মারলাম।
একের পর এক ঘটে যাওয়া সবকিছু তাকে খুলে বললাম।
যে দোকানে গিয়ে আমি আয়ু বিক্রি করে এসেছি সেটার কথা বললাম।
নিজের জীবনের মূল্যটাকে অনেক ভেবে রাখা আমি যে মাত্র বছর প্রতি দশ হাজার ইয়েন পেয়েছি সেটার কথা বললাম।
আমি যে আমার জীবনের মাত্র তিনমাস বাকি রেখে বাকি ত্রিশ বছর বিক্রি করে দিয়েছি সেটার কথা বললাম।
আয়ু বিক্রি করার পর থেকে আমাকে যে একজন অদৃশ্য পর্যবেক্ষক নজরবন্দী করে রেখেছে সেটার কথাও জানালাম।
বলতেই থাকলাম। ভেবেছিলাম এসব শুনে তার মনে আমার জন্য করুণা জন্ম নেবে।
“হিমেনো, তুমি তাকে হয়তো দেখতে পাচ্ছ না, কিন্তু এই যে, সে ঠিক এখানেই বসে রয়েছে,” মিয়াগির দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি। “এই যে এখানে। ওর নাম মিয়াগি। প্রথম প্রথম ওর কথাবার্তা খানিকটা কর্কশ মনে হবে। কিন্তু একটু সময় দিলেই টের পাবে, ও খুবই মিষ্টি স্বভাবের একটা—”
“শোনো কুসুনোকি,” হিমেনো আমার দিকে ক্ষমাপ্রার্থনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আশা করি কথাটা অন্য অর্থে নেবে না, কিন্তু-তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ তোমার কথাবার্তা কতটা অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে, পারছ না?”
“হ্যাঁ, আমার কথাবার্তাগুলো যে অনেক অদ্ভুত শোনাচ্ছে, আমি জানি।”
“গুড, কারণ কথাগুলো আসলেই অবিশ্বাস্য। তা সত্ত্বেও কুসুনোকিকেন জানি তোমাকে মিথ্যাবাদী ভাবতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। এমনকি তোমার হাতে যে মাত্র আর তিন মাস আয়ু আছে, আর তোমার পাশে একটা মেয়ে বসে তোমাকে পর্যবেক্ষণ করছে-সেটাকেও কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে আমার। আমরা একে অপরকে অনেকদিন ধরেই চিনি। তাই তুমি মিথ্যা বললে আমি সাথে সাথে ধরে ফেলতাম। তোমার কাহিনিটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও আমি বিশ্বাস করছি। তুমি যে আসলেই টাকার জন্য তোমার সবটুকু আয়ু বিক্রি করে দিয়েছ তা বিশ্বাস করে নিচ্ছি।”
ঐ মুহূর্তে আমার মনে কী যে আনন্দের ঢেউ খেলে গিয়েছিল তা আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না।
“কথাগুলো চেপে রাখতে আমার কষ্ট হচ্ছিল-কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমিও তোমার কাছ থেকে কিছু জিনিস লুকিয়েছি,” বলে হিমেনো কেশে গলা পরিষ্কার করল। মুখের কাছে রুমালটা ধরে উঠে দাঁড়াল সে।
“এক্সকিউজ মি। খাবার দাবার শেষে তোমার সাথে আরও আলাপ করব এ নিয়ে,” বলে সে উঠে দাঁড়াল।
বোকার মতো ধরে নিয়েছিলাম, হিমেনো বোধহয় বাথরুমে মেকআপ ঠিক করতে গিয়েছে। খাবার টেবিলে এসে গেল, আমি হিমেনোর অপেক্ষা করতে লাগলাম। কথাবার্তা আবার শুরু করতে অনেকখানি উদগ্রীব ছিলাম আমি।
হিমেনো আর ফিরে এলো না।
এত দেরি করছে কেন সে? ভয় লাগতে শুরু করল, সে মাথা ঘুরে ওখানেই পরে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে কিনা। মিয়াগি’কে বললাম, “একটু লেডিজ বাথরুমে গিয়ে দেখে আসতে পারবে? মনে হচ্ছে হিমেনোর সাথে কিছু একটা ঘটেছে।”
মিয়াগি মাথা নেড়ে উঠে চলে গেল।
কয়েকমিনিট পর সে ফিরে এসে আমাকে জানাল, হিমেনো চলে গিয়েছে।
সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে গোটা রেস্তোরাঁ খুঁজে দেখলাম। না, সে কোথাও নেই।
ফিরে এসে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া খাবারের সামনে বসে পড়লাম। মনে হচ্ছিল, শরীর থেকে সবখানি শক্তি বেরিয়ে পড়েছে। পেটের একদম গভীর থেকে ভারি আর জঘন্য কিছু একটা অনুভূতি টের পেলাম আমি। গলাটা একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, হালকা ব্যথাও করছে। আমি পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালাম। কিন্তু মনের গণ্ডগোলের কারণে চোখ দুটো ফোকাস করতে পারছিল না। ফলাফলস্বরূপ, পানি পড়ে টেবিলটা ভিজে গেল।
ধীরধীরে আমি ঠান্ডা পাস্তা গিললাম।
কিছুক্ষণ পর হিমেনোর জায়গায় মিয়াগি এসে বসল।
সে হিমেনোর জন্য অর্ডার করা পাস্তাটা গোগ্রাসে খেতে শুরু করল। “ঠান্ডা হলেও খেতে সুস্বাদু লাগছে কিন্তু,” সে বলল।
আমি মুখ খুললাম না।
প্লেট পরিষ্কার করে খাওয়ার পরেও আসলে পাস্তাটার স্বাদ কেমন ছিল, তা বুঝতে পারছিলাম না। মিয়াগিকে জিজ্ঞেস করলাম, “সত্যি করে বলো, হিমেনো কেন এখান থেকে চলে গিয়েছে?”
মিয়াগি জবাব দিল, “হয়তো সে তোমাকে পাগল ভেবেছে, তাই।”
কথাটা কিন্তু এক অর্থে ঠিক।
কিন্তু সত্যটা আরও অনেক জটিল। এবং মিয়াগির সেটা জানা ছিল।
সে সেটা লুকোনোর চেষ্টা করছে।
শুধুমাত্র আমার জন্য।
টাকা-পয়সা মিটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি, এমন সময় কে জানি আমাকে ডাকল। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ওয়েটার আমার হাতে কী যেন ধরিয়ে দিচ্ছে।
“আপনার সাথে থাকা গেস্ট আপনাকে এটা দিতে বলে গিয়েছেন।” একটা চিঠি ছিল সেটা। নোটবুক থেকে পাতা ছিঁড়ে সেটা লেখা হয়েছে।
বেশ সময় নিয়ে চিঠিটা পড়লাম আমি।
পড়া শেষে জানতে পারলাম, মিয়াগি আমাকে পুরোটা সময় ধরেই মিথ্যা বলে আসছিল।
“এ ব্যাপারে সবকিছুই তোমার জানা থাকা সত্ত্বেও তুমি আমার থেকে সবকিছু লুকিয়েছ, তাই না?”
মিয়াগি মাথা তুলল না। “হ্যাঁ। আমাকে মাফ করে দিও।”
“তোমাকে মাফ চাইতে হবে না। এ মিথ্যার কারণে অনেকদিন পর স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।”
যদি সত্যিই কাউকে ক্ষমা চাইতে হয়, তবে সেটা আমাকেই চাইতে হবে। কিন্তু নিজের ভুল স্বীকার করার মতো শক্তি আমার ছিল না।
“তার মানে আমি যদি আমার স্বাভাবিক জীবন যাপন চালিয়ে যেতাম, মিয়াগির উদ্দেশ্যটা পূরণ হতো, ঠিক না?”
“ঠিক,” মিয়াগি জবাব দিল। “মিয়াগি তোমার চোখের সামনেই কাজটা করতে চেয়েছিল।”
শুধুমাত্র আমাকে দেখিয়ে দেয়ার জন্য।
এতদিন ধরে পুষে রাখা ঘূণাটা ঝড়ে ফেলার জন্য।
চিঠিটার দিকে আবার তাকালাম।
তাতে যা লেখা ছিল-
আমার একমাত্র বন্ধুর উদ্দেশ্যে লিখছি,
সত্যি বলতে কী, তোমাকে সামনে রেখে নিজেকে মেরে ফেলার ইচ্ছে ছিল আমার।
চেয়েছিলাম অবজারভেশন ডেকটার নিচে তোমাকে অপেক্ষা করতে বলে ওপর থেকে লাফিয়ে তোমার পাশে পড়ে মারা যাব
হয়তো কখনো টের পাওনি, কিন্তু আমি সবসময় তোমাকে ঘেন্না করে এসেছি।
কখনো তুমি আমার সাহায্য প্রার্থনার জবাব দাওনি। এতকিছুর পরেও আচমকা আমার সামনে উদয় হয়েছ। আমি তোমাকে ঘেন্না করি।
পরিকল্পনা করেছিলাম, তোমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা মানুষে পরিণত হবার পর মরে যাব। শুধুমাত্র তোমাকে দেখিয়ে দেবার জন্য।
কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, এই দশ বছরে তুমি আমার থেকেও বেশি মানসিক বিকারগ্রস্ত এক মানুষে পরিণত হয়েছ।
এখন আমার প্রতিশোধের পেছনে কোনো অর্থ থাকবে না।
তাই আমি কিছু না বলেই তোমার জীবন থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি।
বিদায়।
আশা করছি, অতি শীঘ্রই তুমি যে মারা যাবে সে কথাটা সত্যি ছিল।
.
আমি আসলেই একটা বিশাল বড় একটা গাধা।
এতদিন আমি একা থেকে এসেছি যাতে কোনোদিন এরকম কিছু অনুভব করতে না হয়।
একদম শেষ পর্যন্ত ঠিক তাই করে যাওয়া উচিত ছিল আমার।
পুরোপুরি নিঃসঙ্গ থেকে তিক্তময় মৃত্যুকে বরণ করাটাই আমার জন্য শ্রেয়তর ছিল।
.
ট্রেন স্টেশনের ঠিক বাইরে অবস্থিত ব্রিজটার কাছে পৌঁছাতেই আমি হিমেনোর চিঠিটাকে ভাঁজ করে একটা প্লেন বানালাম। তারপর সেটা নদীর দিকে ছুঁড়ে মারলাম। নদীটা এর দুধারে থাকা বিল্ডিংগুলোর আলোয় চকমক করছিল। কিছুক্ষণ সময় প্লেনটা আকাশে ভেসে অবশেষে পানিকে স্পর্শ করল, তারপর স্রোতে ভেসে কোথায় যেন চলে গেল সেটা।
পকেট থেকে ভর্তি খামটা বের করলাম। এটা হিমেনো’কে দিতে চেয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমার পাশে দিয়ে হেঁটে যাওয়া প্রত্যেকটা মানুষকে একটা করে নোট হাতে ধরিয়ে দিলাম।
প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। কেউ আমার দিকে সন্দের দৃষ্টি তাকাল; কেউ কেউ চোরের মতো করে হেসে আমাকে ধন্যবাদ জানাল, তারপর দৌড় লাগাল। কয়েকজন সোজাসুজি আমাকে না করে দিল, আর কয়েকজন আরও বেশি টাকা নিতে চাইল।
“এসব এখন বন্ধ করতে পার,” মিয়াগি অধৈর্য হয়ে আমার জামার হাতা শক্ত করে ধরল।
“আমি তো কাউকে জ্বালাচ্ছি না, ঠিক না?” বলে তার হাতটা সরিয়ে দিলাম।
খুব দ্রুত খামটা খালি হয়ে গেল। তারপর পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করলাম। একদম তলানি পর্যন্ত খালি করে দিলাম সেটাও।
বিলানোর মতো আর টাকা পয়সা না থাকায়, আমি জনস্রোতের ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মানুষজন আমার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আমি যে তাদের রাস্তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া কিংবা ট্রেনের টিকিট কাটার মতো পয়সাও এখন আমার কাছে নেই। তাই হাঁটা বাদে আমার কোনো গতি ছিল না।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। মিয়াগি ব্যাগ থেকে একটা নীল রঙের ফোল্ডিং ছাতা বের করে সেটা খুলল। তখন টের পেলাম, আমার ছাতাটা রেস্তোরাঁয় ফেলে এসেছি। কিন্তু এখন ভিজতে কিংবা ভিজে ঠান্ডা বাঁধালেও আমার কোনো আসে যায় না।
“তুমি ভিজে যাবে,” বলে মিয়াগি তার ছাতাটা উঁচু করে ধরল। বোধহয় সে চাচ্ছিল আমি ছাতাটার নিচে এসে দাঁড়াই।
“দেখতেই তো পাচ্ছ, ভেজার ইচ্ছে করছে আমার,” জবাব দিলাম।
“ওহ।”
ব্যাগের ভেতর সে ছাতাটা ভাঁজ করে রেখে দিল।
আমি সামনে হাঁটতে লাগলাম, আর পেছনে মিয়াগি। দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে একসা হয়ে গেলাম।
“তোমার এভাবে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটার কোনো মানে দেখি না।” মিয়াগির উদ্দেশ্যে বললাম আমি।
“দেখতেই তো পাচ্ছো, ভেজার ইচ্ছে করছে আমার,” আমার কথাটাই ব্যঙ্গ করে পুনরাবৃত্তি করল সে।
ঠিক আছে। যা ইচ্ছে করো। আমি মাথা সামনের দিকে ফিরিয়ে নিলাম।
সামনে একটা বাস স্টপ ছিল। বৃষ্টি থেকে হালকা হলেও নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ ছিল সেখানে, তাই সেখানে আশ্রয় নিলাম। ওপরে একটা স্ট্রিট ল্যাম্প মিটমিট করে জ্বলছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, বাতিটা কোনো দৈববাণী গ্রহণ করছিল, সেজন্যই এরকম অবস্থা ওটার।
বেঞ্চে গিয়ে বসতেই ঘুম আমার দুচোখে জায়গা করে নিল। আমার শরীরের থেকে আমার মনটাই বরং ঘুমানোর জন্য বেশি কাতর ছিল।
কয়েকমিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করেছিলাম বোধহয়। গা এতটাই ভিজে গিয়েছে যে, ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে আমার শরীর। আর সেজন্যই ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেল।
মিয়াগি আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাত দুটো হাঁটুকে জড়িয়ে ধরে রেখে, শরীরের উষ্ণতা বাঁচানোর তাগিদে গুটিসুটি মেরে ঘুম দিচ্ছে সে।
তার জন্য করুণা হলো। আমার এরকম পাগলামো তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম। মিয়াগির ঘুম যাতে না ভাঙে সেদিকে নজর রাখলাম আমি। আশেপাশে খুঁজে একটা পুরোনো, জনমানবহীন কমিউনিটি সেন্টার চোখে পড়ল। ততটা পরিষ্কার ছিল না, তবে ভেতরে বিদ্যুৎ ছিল আর দরজা খোলাই ছিল।
বেঞ্চে ফিরে এসে ঘুমন্ত মিয়াগিকে কোলে তুলে নিয়ে সেন্টারে নিয়ে গেলাম।
মিয়াগির ঘুম আমার থেকেও পাতলা, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।
কিন্তু সে সারাটা পথ ঘুমানোর ভান করল, শুধুমাত্র আমার জন্য।
কমিউনিটি সেন্টারের ঘরগুলোয় পুরোনো টাটামির একটা তীব্র গন্ধ ছিল। একপাশে রাখা ছিল একস্তূপ কুশন। পরীক্ষা করে দেখলাম সেগুলোয় পোকামাকড় আছে কিনা। না পেয়ে সেগুলো এক সারিতে সাজিতে মিয়াগিকে তার ওপর শুইয়ে দিলাম। তারপর নিজের জন্য ঠিক একই ভাবে কুশন কভার সাজিয়ে তার ওপর শুয়ে পরলাম আমি। জানালার পাশে কিছু পোকামাকড়-নিরোধক কয়েল চোখে পড়ল। দেখে মনে হচ্ছে, অন্তত কয়েক যুগ আগে এটা এখানে রাখা হয়েছিল। তাই পকেট থেকে লাইটারটাকে বের করে কয়েল জ্বালিয়ে দিলাম।
বৃষ্টি ছিল আমাদের দুজনের ঘুমপাড়ানির গান।
ঘুমানোর আগে আমার প্রত্যেকদিনের করা অভ্যাসগুলো সেরে নিলাম।
প্রথমে সবচাইতে সুন্দর একটা দৃশ্যের কথা কল্পনা করে নিলাম আমি।
একদম বিন্দু থেকে নিজের জন্য একটা কল্পনার জগত বানালাম।
নিজের পছন্দমতো একটা সময়-মাঝেমধ্যে অতীত, মাঝেমধ্যে ভবিষ্যত-তারপর আমার সাথে ঘটেনি, আমি যাইনি এমন জায়গা—এসব বেছে নিয়ে সে জগতটাকে সাজালাম।
পাঁচ বছর বয়স থেকেই ঘুমোনোর আগে এরকম জগত বানিয়ে আসছি আমি।
বোধহয় এই বাচ্চাদের মতো অভ্যাসটাই আমাকে এখনও বাস্তব জগতের কোনো অংশ হওয়া থেকে বাঁধা দিচ্ছে।
কিন্তু এই কল্পনার জগতটার কারণেই আমি এই দুনিয়ার সাথে আপোষ করে টিকে রয়েছি।
.
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। মন খারাপ থাকা অবস্থায় আশাদায়ক, ভালো একটা স্বপ্ন দেখলে যেরকম ভালো লাগে, ঠিক সেরকমই লাগছিল।
এটা যদি স্বপ্ন হয়ে থাকে, তবে খুবই লজ্জাজনক স্বপ্ন হবে সেটা।
আর যদি বাস্তবেই ঘটে থাকে তবে স্বীকার করে নেয়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে-এর থেকে বেশি কিছু আশা করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
টের পেলাম, টাটামি ম্যাটগুলোর ওপর দিয়ে কেউ হাঁটছে। আমার মাথার কাছে এসে সেই মানুষটা হাঁটু ভাঁজ করে বসতেই টের পেলাম, ওটা মিয়াগি। ওর গায়ের সুগন্ধ থেকেই টের পেয়ে গিয়েছি। গ্রীষ্মের গরমেও তার গা থেকে শীতের সকালের মতো একটা ঠান্ডা, চনমনে, পরিষ্কার গন্ধ পাচ্ছিলাম।
চোখটা খুললাম না। কেন জানি না, চোখ না খোলাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হলো আমার কাছে।
ধীরে ধীরে সে তার হাতটা আমার কপালের ওপর রেখে কপালটা আলতো করে বুলিয়ে দিল।
একমিনিটেরও কম সময় ছিল সেটা, অন্তত আমার তাই ধারণা।
মনে হলো সে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। বৃষ্টির প্রবল তোড়ে কথাগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না।
ঘুমন্ত অবস্থাতেই আমি ভাবলাম, মিয়াগির এই পাশে থাকাটা আমাকে কতবার বাঁচিয়েছে? যদি সে আমার সাথে না থাকত, আমি এখন কতটা হতাশাগ্রস্ত থাকতাম?
কিন্তু এই বোধ থেকেই আমার উচিত ওর জন্য কাজকর্ম সহজ করে দেয়া, নিজেই নিজেকে বোঝালাম। এখানে সে কেবল তার কাজ করতে এসেছে। আমি তো খুব শীঘ্রই মারা যাব, সেজন্য সে আমার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। মানুষ হিসেবে আমাকে সে মমতা দেখাচ্ছে না।
এরকম বিশাল বিশাল সাইজের আশা করা থামাতে হবে আমাকে। এসব করে করে আমি শুধু শুধু আমার কষ্টের সঙ্গী করছি তাকে। এসব করে আমি শুধু তাকে অনুতপ্ত করছি।
আমার উচিত আচরণ ঠিকঠাক রেখে মরে যাওয়া। আগের দিনগুলোর মতো নিরানন্দে ভরা, আত্মকেন্দ্রীক আর অন্য কোনো মানুষের সাথে এই জীবনটা একসাথে কাটানোর স্বপ্ন না দেখার জীবনেই আমাকে ফিরে যেতে হবে। বিড়ালের মতো শান্তিতে আর নিঃশব্দে মারা যাব। চুপচাপ থেকে এটাই সিদ্ধান্ত নিলাম।
পরের দিনে সকালে প্রচণ্ড আর্দ্রতা আর গরমের মধ্যে ঘুম ভাঙল। জানালার বাইরে দেখতে পেলাম, একদল শিশুকিশোর সকালের শরীরচর্চা করছিল। মিয়াগি অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। সে এখন কুশনগুলো গুছাতে ব্যস্ত। মনে মনে গুনগুন করছে নিনা সিমোনের গান “I Wish I Knew How It Would Feel to Be Free” (স্বাধীন হলে কেমন লাগে, তা যদি জানতে পারতাম!)
আমার চোখে তখনও ঘুম লেগেছিল। কিন্তু এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
“বাড়ি ফেরা যাক,” মিয়াগি বলল।
“হ্যাঁ, চলো,” আমি জবাব দিলাম।